৪৫. সাঙসু ঋতুর রোদ

৪৫.

উপত্যকায়, বনের মাথায়, পাহাড়ের চূড়ায় সাঙসু ঋতুর রোদ জ্বলছে। স্বচ্ছ নীলাকাশে ধূসর রঙের কয়েকটি বিন্দু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ওগুলো মরশুমি পাখি। গুটসুঙ, আউ আর ইবাতঙ পাখিরা বাতাসে সাঁতার কাটছে। সাঙসু ঋতুতে নাগা পাহাড়ের আকাশে এই সব পাখি দেখা যায়।

একটু আগেই পেছনের উতরাই বেয়ে নেমে গিয়েছেন গাইডিলিও। নাগা পাহাড়ের দিগদিগন্তে, গ্রামে-জনপদে, চড়াই-উতরাই-মালভূমি-উপত্যকায় সরল, বন্য মানুষের প্রাণে প্রাণে স্বাধীনতার প্রখর আকাঙ্ক্ষাটি বীজ-ফসলের মতো বুনে চলেছেন তিনি। লোটা, রেঙমা, সাঙটাম, আওলানা মানুষ, নানা জাতি, গোত্র, বংশ, কুল, নানা ভাষা-উপভাষার এই বিরাট বিস্তীর্ণ পাহাড়ী জগৎকে একটি শপথের মালায় গেঁথে ক্রমাগত ছুটছেন। সেই শপথের নাম স্বাধীনতা।

টোঘুটুঘোটা পাতার চাল, চারপাশে আও আও বাঁশের দেওয়াল, নিচে খাসেম কাঠের

পাটাতন। নতুন ঘরখানায় দু’দিন ছিলেন গাইডিলিও। ঘরটার সামনে পাহাড়ী মানুষের জটলাটা এখনও স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।

একটু পরেই বুড়ো খাপেগা, সেঙাই এবং অন্যান্য জোয়ান ছেলেরা গাইডিলিওকে পথ দেখিয়ে দিয়ে ফিরে এল।

সারুয়ামারু ভীরু, কাঁপা গলায় বলল, কী হবে সদ্দার?

কিসের কী? নিরোম ভুরু দুটো কুঁচকে বুড়ো খাপেগা তাকাল।

হুই যে বললাম, সায়েব্রা আসছে। হু, কোহিমার সেই বড় ফাদার রয়েছে সামনে। সালুয়ালাঙ বস্তির সদ্দার রয়েছে। মণিপুরী পুলিশের হাতে বন্দুক রয়েছে। দূর থেকে একবার তাক করলে জানে লোপাট হয়ে যাব। কী হবে সদ্দার? সারুয়ামারুর পিঙ্গল চোখের মণিতে ভয়ের ছায়া। গলার স্বরটা কাঁপছে, আমার ভয় করছে সদ্দার।

বর্শার বাজুতে ঝকানি দিল বুড়ো খাপেগা। দুটো ঘোলাটে পিচুটিভরা নোংরা চোখ দপ করে জ্বলে উঠল। ভাঙা, ক্ষয়া শেষ দাঁত কটা কড়মড় শব্দে বাজল। খাপেগা হুমকে উঠল, ভয় করছে! ইজা হুবতা! তোকে আমিই সাবাড় করব। তুইনা পাহাড়ী জোয়ান! হুই শরদের। বস্তি থেকে আমাদের বস্তিতে না বলে কয়ে, না জানিয়ে শুনিয়ে ওরা এসে ঢুকবে, তা হবে না। লড়াই বাধাতেই হবে। তা নইলে আমাদের ইজ্জত থাকবে না। কোনিয়াকরা সাঙটামরা গায়ে থুতু দেবে।

এর মধ্যে মেয়ে-পুরুষেরা উঠে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে বুড়ো খাপেগাকে। মাথা নেড়ে নেড়ে তারা সায় দিল, হু-হু, ঠিক বলেছিস সদ্দার। আমাদের বস্তির ইজ্জত আছেনা? না বলে কয়ে শয়তানেরা বস্তিতে ঢুকবে, জান থাকতে তা আমরা হতে দেব না। হু-হু।

সকলকে ঠেলে গুতিয়ে একটা অর্ধনগ্ন যুবতী সামনের দিকে এগিয়ে এল। সে হল সারুয়ামারুর বউ জামাতসু। রুক্ষ, ঘন চুলের ফাঁকে ফাঁকে আরেলা ফুল গোঁজা।সগোল মসৃণ। স্তন দু’টি টস টস করছে, কিছুদিনের মধ্যে সন্তানের জন্য প্রাণরস আসবে। সুধায় ভরে যাবে। চোখের কোলে কালো দাগ পড়েছে, মাজা এবং পেট স্ফীত হয়ে উঠেছে, নিটোল উরুর পাতলা চামড়ার তলায় লাল রক্তের বেগবান ধারাগুলি উত্তেজনায় ছোটাছুটি করছে। মাতৃত্ব দেখিয়ে বেড়ায় সে। খুব সম্ভব, এই দেখানোর মধ্যে অতি স্পষ্ট এক গৌরব বোধ রয়েছে।

অলস ভঙ্গিতে মাথার ওপর হাত দুটো তুলে হাই তুলল জামাতসু। চোখের ঘনপক্ষ্ম পাতাদু’টি সন্তান ধারণের গর্বে বুজে বুজে আসছে। অপরিসীম ক্লান্ত গলায় সে বলল, এই সদ্দার, আসল কথাটা ভুলে মেরে দিলি, দেখছি।

কী আবার ভুললাম রে কুকুরের বাচ্চা? বিরক্ত চোখে তাকাল বুড়ো সর্দার।

খুব যে খিস্তি দিচ্ছিস! হুই মেহেলী যে বিয়ের আগেই সেঙাইকে দেখল, তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে না? তোর আক্কেল নেই? তুই এখনও বেঁচে রয়েছিস! তুই থাকতে বস্তিতে পাপ ঢুকবে? আনিজার গোেসা এসে পড়বে? তা হতে পারে না।

প্রবলভাবে ঘাড়খানা ঝাঁকিয়ে বুড়ো খাপেগা বলল, হু, হতে পারে না। আমি এখনও বেঁচে আছি। মেহেলীর শয়তানীর কথা ভুলিনি রে জামাতসু। আগে হুই সায়েব আর সালুয়ালাঙ বক্তির শয়তানগুলোকে সাবাড় করি। তারপর মেহেলী মাগীর চামড়া উপড়ে ফেলব। আমি যদ্দিন বেঁচে আছি তদ্দিন বস্তিতে পাপ হতে দেব না।

বুড়ো খাপেগা। কেলুরি গ্রামের নিষ্ঠুর ক্ষমাহীন অতীতের জীবন্ত মূর্তি। এই পাহাড়ের অমোঘ রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, পাপপুণ্যের বোধ এবং নিরবধি কালের সমস্ত সামাজিক অনুশাসনের নিয়ামক।

কিছুক্ষণ পর আচমকা চিৎকার করে উঠল বুড়ো খাপেগা, হো-য়া-য়া-য়া-য়া, হো-য়া-য়া-য়া-য়া–বস্তির জোয়ানেরা, তোরা সবাই মোরাঙ থেকে তীরধনুক বর্শাদা-কুড়াল নিয়ে যা।

খবদ্দার, হুই শয়তানের বাচ্চারা যেন আমাদের বস্তিতে ঢুকতে না পারে।

অসংখ্য গলা থেকে একটা ভীষণ উত্তেজিত হুঙ্কার সাঙসু ঋতুর বাতাস চিরে ফেঁড়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুন্যে মিলিয়ে গেল, হো-য়া-য়া-য়া, হো-য়া-য়া-য়া–

হাতিয়ারের খোঁজে মোরাঙের দিকে ছুটে গেল জোয়ান ছেলেরা। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ওঙলে আর সেঙাই। বুড়ো খাপেগা বলল, আমরা হুই টিজু নদীর দিকে যাচ্ছি। তোরা দুজনে মাগীগুলোকে নিয়ে জোহেরি কেসুঙে যা। মেয়েদের ইজ্জত তোরা রাখবি। তাদের ইজ্জত নষ্ট হলে টেটসে আনিজা তোদের পাহাড় থেকে খাদে ফেলে মারবে। খবদ্দার ওঙলে, খুব সাবধান সেঙাই। |||||||||| হু-হু, তুই ঘাবড়াসনি সদ্দার। শয়তানেরা আমাদের বস্তির মেয়েদের গায়ে হাত তুললে জান নিয়ে ফিরতে হবে না। সেঙাই বলল। তার চোখজোড়া খ্যাপা বাঘের মতো ধকধক করছে।

ওঙলের দিকে ঘুরে সে আবার বলল, এই ওঙলে, মেয়েদের ডাক।

হো-য়া-য়া-য়া-য়া–

হো-য়া-য়া-য়া-য়া–

মোরাঙের দিক থেকে জোয়ানদের চিৎকার ভেসে আসছে। ওঙলে আর সেঙাই মেয়েদের নিয়ে ডান দিকের টিলাটা পেরিয়ে জোহেরি কেসুঙের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সাঙসু ঋতুর উজ্জ্বল দিনটির ওপর অশুভ ছায়া এসে পড়েছে। ছোট্ট পাহাড়ী গ্রামটার বিনাশকামী আত্মার ভেতর থেকে একটা আদিম হিংস্র সত্তা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। বর্শার মুখে মুখে তাজা উষ্ণ রক্তের ফোয়ারা ছুটবে, কুড়ালের ঘা লেগে লেগে মানুষের মুণ্ডু ধড় থেকে খসে পড়বে–পাহাড়ী বন্য মানুষের বিচারে এর চেয়ে অমোঘ সত্য আর কী আছে? এখানে বেঁচে থাকাটাই সাঙ্ঘাতিক তাজ্জবের ব্যাপার। সব সময় মৃত্যু এবং হত্যার জন্য এখানে উত্তেজক প্রস্তুতি।

জোহেরি কেসুঙের দিকে যেতে যেতে সেঙাই বলল, রানী গাইডিলিও খুনখারাপি করতে বারণ করে গেছে। সায়েবরা মারলেও আমরা যেন না মারি। কিন্তু সদ্দার বোধ হয় সে কথা শুনবে না। দলবল নিয়ে সে তো টিজু নদীর দিকে ছুটল। কী হবে বল তো ওঙলে? আমরা কি রানীর কথাটা মানব না?

দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওঙলে চেঁচিয়ে উঠল, আহে ভু টেলো! ওরা মারবে আর আমরা বুঝি পড়ে পড়ে মার খাব! হুই সব আবদার এই পাহাড়ে চলবে না। হু-হু, তোর কী হয়েছে, বল তো সেঙাই? একটু থেমে আবার, খুনটুন না করলে কিসের পাহাড়ী জোয়ান! মনে থাকে যেন, বস্তির মেয়েদের ইজ্জত সদ্দার আমাদের হাতে ছেড়ে গেছে। ওদের ইজ্জত বাঁচাতেই হবে। সেঙাইকে সতর্ক করে দিল ওঙলে।

হু-হু, ঠিক বলেছিস। বস্তির ইজ্জত, মাগীদের ইজ্জত, সব রাখতেই হবে। হুই সায়েবরা আসছে। কোহিমায় ওরা আমাকে মেরেছিল। সালুয়ালাঙের শত্তুররা আসছে, ওরা আমার ঠাকুরদার মুণ্ডু কেটে নিয়েছিল। সব কটাকে আজ বর্শার মাথায় গেঁথে রাখব। প্রতিহিংসায় চোখজোড়া জ্বলতে লাগল সেঙাইর-এর।

সকলকে চমকে দিয়ে বিকট গলায় আমোদের হাসি হাসল ওঙলে। বলল, এই তো পাহাড়ী মরদের মতো কথা বেরিয়েছে। মাঝে মাঝে খামোকা এমন করিস কেন বল তো? খুনোখুনির ব্যাপারে এত ভাবিস কেন? আমরা হলাম পাহাড়ী, এত ভাবাভাবি করলে আমাদের চলে! মনে যা আসে তাই আমরা করি। সুন্দরী মাগী দেখলে, তার সঙ্গে পিরিত জমাতে ইচ্ছে হলে তাকে আমরা ছিনিয়ে আনি। আচেনা মানুষ বস্তিতে দেখলে এফোঁড় ওফোড় করে ফেলি। বুনো মোষ কোপাই, বাঘ মারি। আগুনে শুয়োর ঝলসে রোহি মধু দিয়ে খাই আর ভোঁস ভোস করে ঘুমোই। এত ভাবাভাবি আমাদের ধাতে সয় না রে সেঙাই। অত ভাবতে গেলে মরেই যাবি। বলতে বলতে মেয়েদের তাড়া দিতে লাগল ওঙলে, এই মাগীরা, চল চল। পা চালা। সায়েবরা এসে পড়লে গতর দুলিয়ে চলা বেরিয়ে যাবে।

একটি মেয়ে পিছিয়ে পড়ছিল। তার দিকে তাকিয়ে ওঙলে বলল, কি রে ইখুজা, অত পেছনে আছিস কেন? সায়েব ভাতার করবার মতলব বুঝি?

ইখুজা একগাদা অশ্রাব্য, অকথ্য খিস্তি দিল। গালাগালিটা গায়ে মাখল না ওঙলে। হো হো করে হেসে উঠল।

দ্রুত পা ফেলে ফেলে জোহেরি কেসুঙের রুক্ষ পাথুরে উঠোনটায় এসে পড়ল সকলে। বিরাট এক খণ্ড পাথর উঠোনের ডান পাশ ঘিরে জোরি বংশের বাড়িটার দিকে উঠে গিয়েছে।

ওঙলে আবার বলল, এই মেয়েরা, ঘরে ঢোক। আমরা বাইরে আছি।

কেলুরি গ্রামের সব কটা জোয়ানী, কিশোরী, বুড়ি এবং বউ বাচ্চা সেঙাইদের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

আর বাইরে দু টুকরো বড় পাথরের ওপর জাঁকিয়ে বসল সেঙাই এবং ওঙলে। তাদের থাবায় দুটো লম্বা খারে বর্শা। রোদ পড়ে ধারাল ফলা দুটো ঝকমক করছে। দুজনের। ইন্দ্রিয়গুলো ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে রয়েছে। সতর্ক চোখে তারা এধারে ওধারে নজর রাখতে লাগল।

ওঙলে বলল, খুব সাবধান সেঙাই।

সেঙাই সামনের দিকে ঝুঁকে বর্শার ফলার ধার পরখ করতে করতে বলল, আমি ঠিক আছি। তুই সাবধান হ টেফঙের বাচ্চা, চারদিকে নজর রাখ।

একটু চুপচাপ। অস্বস্তিকর নীরবতা চারপাশ থেকে ঘনিয়ে এল। একবার কোথায় যেন আউ পাখি ককিয়ে উঠল। এ ছাড়া শব্দ নেই। অসহ্য গুমোট। ঝড়ো বাতাস এসে ওক বনে আজ বোধ হয় আর মাথা কোটাকুটি করবে না।

খানিক পর ওঙলে বলল, এতকাল সদ্দারের মুখে খালি লড়াইর কথা শুনেছি। দু-একটা মাথা কাটা ছাড়া তেমন লড়াই দেখিওনি, করিওনি। আজ বড় মজা লাগছে রে সেঙাই। শব্দুরদের মুণ্ডু কেটে আগেকার মানুষদের মতো মোরাঙের সামনে গেঁথে রাখব। মোরাঙের দেওয়াল রক্ত দিয়ে চিত্তির করব। ভারি ফুত্তি হচ্ছে। তোর হচ্ছে না সেঙাই?

হু-হু। দুচোখ তুলে সেঙাই বলল, আমি কিন্তু অন্য কথা ভাবছি ওঙলে।

আবার কী ভাবছিস? ভাবনার ব্যারামে ধরেছে তোকে। বল, কী ভাবছিস? তামাটে চারকোনা মুখে বিরক্ত ভ্রুকুটি ফুটে বেরুল ওঙলের।

ঠিকই বলেছিস। ভাবনার ব্যারামেই আমাকে ধরেছে। একটু থেমে মাথার চুল খামচা মেরে ধরে সেঙাই বলল, শোন ওঙলে, ভাবছি এরপর কী হবে?

কিসের পর কী হবে?

হুই যে সদ্দার বলল, সায়েব আর সালুয়ালাঙ বস্তির শয়তানগুলোকে খতম করে মেহেলীর চামড়া উপড়ে ফেলবে। কী হবে বল দিকি? সেঙাই-এর মুখখানা বড়ই বিমর্ষ দেখাল।

ইজা হুতা! বউর চামড়ার কথা এখন থেকে ভাবতে শুরু করেছিস? মেহেলীর চামড়ার চেয়ে বস্তির ইজ্জত অনেক ওপরে। সেটা আগে বাঁচাতে হবে। সে কথা ভুলিস না সেঙাই। বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে সেঙাই-এর দুকাঁধ ধরে ঝকানি দিল ওঙলে।

কিছু একটা জবাব দিত সেঙাই, কিন্তু তার আগেই টিজু নদীর দিক থেকে সামনের উপত্যকা বেয়ে একটা তুমুল হল্লার রেশ ছুটে এল, হো-য়া-য়া-য়া-য়া–সঙ্গে সঙ্গে এক আঁক অপরিচিত এবং ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা গেল, বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌-বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–

আউ-উ-উ-উ–আউ-উ-উ-উ–জোয়ানদের তীক্ষ্ণ এবং অস্বাভাবিক গলার আর্তনাদ ভেসে এল।

ওঙলে শিউরে উঠল, সেঙাই চমকে উঠল। তারপর দুটো পাহাড়ী জোয়ানের শিরায় শিরায় রক্ত ফেনিয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অজানা, অপরিসীম আতঙ্কে বুক ছমছম করছে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল ওঙলে এবং সেঙাই।

বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌-বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–

আ-উ-উ-উ-উ–আ-উ-উ-উ-উ–

অপরিচিত সাআতিক ওই শব্দগুলো, পাহাড়ী জোয়ানদের আর্তনাদ, সব মিলিয়ে কী এক অশুভ সংকেত চারপাশ থেকে যেন চেপে ধরছে। সাঙসু ঋতুর উজ্জ্বল দিন, ঝলমলে রোদ, গুহাগোপন জলপ্রপাতের শব্দ–এই মুহূর্তে সব যেন থেমে যাচ্ছে, সব উজ্জ্বলতা নিভে আসছে।

ভেতরের ঘর থেকে জামাতসু বাইরে বেরিয়ে এল। তার পেছন পেছন এল মেহেলী। কাঁপা কাঁপা গলায় জামাতসু বললে, হুই সব কিসের শব্দ রে সেঙাই?

কী জানি। এমন ধরনের শব্দ কোনদিন শুনিনি।

মেহেলী বলল, আমার বড্ড ভয় করছে সেঙাই। জোয়ান ছেলেরা অমন করে ককাচ্ছে কেন রে?

ঠিক বুঝতে পারছি না।ভীরু, ভাঙা গলায় সেঙাই বলতে লাগল, তুই ঘরে যা মেহেলী। এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস, সদ্দার টের পেলে আর রেহাই নেই। যা যা–

ঘরের ভেতর আমার ভয় করছে।

দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কুৎসিত মুখভঙ্গি করল ওঙলে। খেঁকিয়ে খেঁকিয়ে বলতে লাগল, ভয় করছে! তা হলে পাহাড়ী মাগী হয়েছিস কেন? ভয় করছে, না পিরিতের জ্বালায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিস? বাইরে আমরা বসে আছি না? আমাদের না মেরে তোদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে? যা যা, ঘরে ঢোক। পনেরো দিন পর তেলেঙ্গা সু মাসে তোদর বিয়ে। বুর সইছেনা শয়তান দুটোর। ঠিক বলেছে সদ্দার, চামড়া উপড়ে নেবে তোর। যা যা, ঘরে ঢোক।

তাড়িয়ে তাড়িয়ে জামাতসু আর মেহেলীকে আবার ঘরে ঢুকিয়ে দিল ওঙলে।

বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–

আকাশে বাতাসে সাঙসু ঋতুর পাখিরা ছড়িয়ে পড়েছে। বনের মাথা থেকে অসংখ্য পাখির ঝাঁক–আউ, গুটসুঙ, ইবাতঙ–ডানা মেলে উড়ে পালাচ্ছে। ওই অনভ্যস্ত, ভয়ানক শব্দগুলো কনভূমিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। দাঁতাল শুয়োরেরা দল বেঁধে ঘোঁত ঘোত করতে করতে ছুটছে। বুনো মোষ, সম্বর, চিতা বাঘ, নীলচে রঙের পাহাড়ী সাপ, সব ঊর্ধ্বশ্বাসে দিগ্বিদিকে পালাচ্ছে। দক্ষিণ পাহাড়ের খাদ পেরিয়ে অঙ্গামীদের জঙ্গলের দিকে ছুটেছে একদল চিতি হরিণ। এই পাহাড়ী বনের পশুজগৎ, তাদের এতকালের সাজানো সংসার ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে যাচ্ছে।

জোহেরি কেসুঙের উঠোন থেকে সেঙাই এবং ওঙলে দেখতে লাগল, কেমন করে পাখি পশু-সাপ-পতঙ্গ ঝাঁক বেঁধে পালাচ্ছে।

ওঙলে বলল, নিঘাত খুনোখুনি বেধেছে রে সেঙাই। লড়াইটা বেশ জমেছে মনে হচ্ছে।

কী করে বুঝলি?

সদ্দার বলেছে, আমাদের পাহাড়ে যখন লড়াই জমে ওঠে, হই-হল্লায় বন থেকে বাঘ শুয়োর-সাপ বেরিয়ে আসে। ভারি মজাদার ব্যাপার, কিন্তু আমার বড় আপশোশ হচ্ছে।

কেন? সেঙাই-এর চোখদুটোয় কৌতূহল।

আপশোশ হবে না! তুই বড় বোকা সেঙাই। আমরা জোয়ান মরদ, আমাদের বস্তির সঙ্গে অমন খাসা লড়াই বেধেছে, সবাই বর্শা হাঁকাচ্ছে। আর এখানে বসে আমরা মাগীদের পাহারা দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত একটা কোপ ঝাড়তে পারলাম না। হাতটা যা নিশপিশ করছে! ইজা হুবতা! উত্তেজনায় নিজের হাত কামড়াতে লাগল ওঙলে। তামাটে মুখটা ঝকমক করছে তার।

হু-হু, ঠিক বলেছিস। সেঙাই মাথা নেড়ে সায় দিল।

বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–শব্দগুলো অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে।

কেলুরি গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে পাটকিলে রঙের যে ন্যাড়া টিলাটা রয়েছে, আচমকা তার পাশ থেকে ভাঙা গলার আর্ত চিৎকার ভেসে এল, খো-কু-ঙ-ঙ-গা-আ-আ—

আর্তনাদটা শুনে ভীষণভাবে চমকে উঠল সেঙাই এবং ওঙলে। কান খাড়া করে ভাবতে লাগল, ভুল শুনছে না তো। নাঃ, কোনো ভুল নেই। সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে অন্তরাত্মা থরথর কাঁপতে শুরু করল। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল দুজনে। ওই চিৎকারের মধ্যে একটা অনিবার্য ইঙ্গিত রয়েছে। কেলুরি গ্রামের বাধা চুরমার হয়েছে। তাদের প্রতিরোধ তছনছ করে সাহেবরা ছুটে আসছে, তাদের সঙ্গে আসছে সালুয়ালাঙের শয়তানেরা। কেলুরি গ্রামের বীরত্ব, গর্ব, দুঃসাহসের গৌরব এবং দম্ভ ভেঙেচুরে একটা অপঘাত ধাওয়া করে আসছে যেন। আর উপায় নেই।

খো-কু-ঙ-ঙ-গা-আ-আ—পাহাড়ী যুদ্ধের পরিচিত সংকেত। লড়াইয়ে হেরে গ্রামের দিকে পালিয়ে আসার সময় জোয়ান ছেলেরা এমন শব্দ করে।

কেলুরি গ্রামের জোয়ানেরা হেরে পালিয়ে আসছে।

খো-কু-ঙ-ঙ-গা-আ-আ—ছোট পাহাড়ী গ্রামটা ঘিরে কাতর কান্নার শব্দ পাকিয়ে পাকিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।

জোহেরি কেসুঙের উঠোনে ভয়ে আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে ওঙলে ও সেঙাই। একসময় ফিসফিস, সন্ত্রস্ত গলায় ওঙলে বলল, কি রে সেঙাই, আমরা তা হলে হেরে গেলাম। সেবারও হেরেছিলাম, সালুয়ালাঙ বস্তির শয়তানেরা তোর ঠাকুরদার মুণ্ডু কেটে নিয়ে গিয়েছিল। আর এবার হারলাম সায়েবদের কাছে।

তাই তো দেখছি। আবছা গলায় সেঙাই বলল।

খো-কু-ঙ-ঙ-গা-আ-আ—

ঘরের মধ্যে বুড়ি-ছুঁড়ি-বউ-বাচ্চা তুমুল চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। কান্না, চিৎকার, অশ্রাব্য গালাগালি–সরু মোটা ঘড়ঘড়ে এবং তীক্ষ্ণ গলার মিশ্র শব্দ দলা পাকিয়ে একাকার হয়ে বাঁশের দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। মেয়েরা ভয় পেয়েছে ভীষণ, মারাত্মক ভয়।

ভেতর থেকে মেহেলী বলল, এই সেঙাই, বস্তির জোয়ানরা যে পালিয়ে আসছে! কী হবে?

সেঙাই এবং ওঙলে কেউ জবাব দিল না। হতবাক, দাঁড়িয়ে রইল দুজনে।

আচমকা দক্ষিণ প্রান্তের সেই পাটকিলে ন্যাড়া টিলাটার পাশ থেকে পিঙলেই আর খোখিকেসারি বংশের দুটো জোয়ান ছেলে-ফামুসা এবং যাসেমু উঠে এল। তাদের সমস্ত দেহে তাজা রক্তের ছোপ লেগে রয়েছে। তিনজনে সাঁ করে সামনের একটা ছোট ভাঁজ পেরিয়ে মোরাঙের দিকে ছুটে পালাল।

সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, এই পিঙলেই, এই ফানুসা, এই যাসেমু, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? এই শয়তানের বাচ্চারা–

একজনও উত্তর দিল না, মুহূর্তে ওরা মোরাঙের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

পিঙলেইদের দিকে তাকিয়ে ছিল ওঙলেও। মুখ ফিরিয়ে সে ফুঁসে উঠল, দেখছিস সেঙাই, ওদের গায়ে কী রক্ত! নির্ঘাত সায়েবরা মেরেছে। এর বদলা

আরো কিছু হয়তো বলত ওঙলে। বিশ্রী মুখভঙ্গি করে খানিকটা চেঁচামেচি করত, গালাগালিতে সাঙসু ঋতুর দিনটাকে কদর্য করে তুলত। লাল লাল, অসমান দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠত, কিন্তু তার আগেই পাটকিলে টিলাটার পাশ থেকে দুটো ভয়ঙ্কর মুখ উঁকি দিল। পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি এবং পুলিশ সুপার বসওয়েল। দুটো মুখই কী হিংস্র না দেখাচ্ছে এখন। স্নেহ মায়া করুণা নামে মিগ্ধ সুকুমার বৃত্তিগুলির কোনো চিহ্নই নেই সে-মুখে।

চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে, যাচাই করে, বিপদের আশঙ্কা নেই বুঝে, বুকে হেঁটে হেঁটে টিলার মাথায় উঠে এল বসওয়েল এবং ম্যাকেঞ্জি। তাদের পেছন পেছন এল একদল মণিপুরী

বিহারী-অসমীয়া পুলিশ। এল জনকতক সাদা মানুষ। সকলের হাতেই রাইফেল এবং রিভলভার। ট্রিগারের ওপর তর্জনীগুলো নির্মমভাবে চেপে রয়েছে। সকলের সঙ্গে উঠে এল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। তার পাশে সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার। এসেছে মেহেলীর বাপ সাঞ্চামখাবা। এসেছে নানকোয়া গ্রামের রাঙসুঙ এবং তার ছেলে মেজিচিজুঙ। কতদিন হল একশোটা খারে বর্শা তারা বউপণ দিয়ে গিয়েছে মেহেলীর বাপকে। এই পাহাড়ের মেহেলী নামে সেরা মেয়েটিকে তাদের চাই। সকলের পেছনে নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের সব কটা জোয়ান ছেলে লম্বা লম্বা বর্শা বাগিয়ে এসেছে।

চাপা বীভৎস গলায় বসওয়েল বলল, খুব সাবধান, এই হিলি বিস্টগুলো কিন্তু মারাত্মক। কখন কোথা থেকে যে বিষমাখা তীর ছুঁড়ে বসবে, তার ঠিক নেই। বি কেয়ারপুল, চারদিকে নজর রাখ। অবশ্য গ্রেট ওয়ার ফেরত লোক আমি, আমাকে ঘায়েল করা অত সহজ নয়। বিশাল মাংসল মুখখানায় আত্মপ্রসাদ এবং দম্ভের হাসি নেচে বেড়াতে লাগল বসওয়েলের। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই গর্জে উঠল বসওয়েল, এক ঘন্টা ধরে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। পাহাড়ী বিস্টগুলো মরল, জখম হল, কিন্তু গাইডিলিও কোথায়? কোথায় সেই শয়তানী? আই মাস্ট র‍্যানস্যাক দা এনটায়ার ভিলেজ। ডাইনিটাকে ধরতেই হবে। আচ্ছা ফাদার, এই সর্দারটা ভুল খবর দেয়নি তো? আমি আবার ওদের ভাষা পুরোপুরি বুঝি না। একটু থেমে বলল, আমার এক-একসময় সন্দেহ হয়, গাইডিলিও বলে কেউ আছে কিনা। একটা মিরেজের পেছনে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি বোধ হয়। উঃ, হরিবল! গ্রেট ওয়ারের লোক আমি। জীবনে অনেক আজব অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু আপনাদের এই নাগা পাহাড়ে টু চেজ দিস হিল উইচ আমি হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি ফাদার। হয়রান হয়ে পড়েছি। এত পাহাড়ী মানুষ মরল, জখম হল, কিন্তু শয়তানীটাকে বাগেই পাচ্ছি না। আপনার সর্দারকে জিগ্যেস করুন, গাইডিলিও কোথায়?

বসওয়েলের কথাগুলোতে ম্যাকেঞ্জির মনে কী প্রতিক্রিয়া হল, আদৌ হয়েছে কিনা, মুখ দেখে তা বুঝবার উপায় নেই। বসওয়েলের দিকে তাকিয়ে কপাল বুক বাহু ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে ক্রস আঁকল। ঠোঁটে সূক্ষ্ম, নির্লিপ্ত হাসিটুকু লেগেই রয়েছে। একটু পর মুখ ঘুরিয়ে শান্ত গলায়, নির্ভুল উচ্চারণে পাহাড়ী ভাষায় বলতে লাগল, কি হে সর্দার, তুমি ঠিক জানো তো, এই কেলুরি গ্রামে গাইডিলিও এসেছিল?

হু-হু– পালকের মুকুট নেড়ে সালুয়ালাঙের সর্দার বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি। দু’দিন এই বস্তিতে ছিল গাইডিলিও। রাত্তির বেলা লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছি, ডাইনিটা আর কোথাও পালায় কিনা।

গ্রামের মধ্যে কাউকেই তো দেখছি না। সব গেল কোথায়?

বন্দুকের আওয়াজ শুনে নির্ঘাত জঙ্গলে ভেগেছে। দেখলি না, শয়তানের বাচ্চারা আমাদের ফুঁড়তে গিয়েছিল। গুলি খেয়ে কটা পড়তেই বাকিগুলো জঙ্গলে পালাল। সালুয়ালা গ্রামের সর্দার ক্ষয়া, হলদে ছোপধরা দাঁত বার করে আমোদের হাসি হাসল। বলল, হু-হু, টেফঙের বাচ্চারা বন্দুকের সঙ্গে লড়াই করতে এসেছে বর্শা দিয়ে! থুঃ থুঃ–রুক্ষ টিলাটার মাথায় একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল সর্দার। আবার শুরু করল, ফাদার, তুই আমাদের মেহেলীটাকে এনে দে। নইলে বস্তির ইজ্জত আর থাকছে না। অঙ্গামীরা ধান বদল করছে না; সাঙটামরা কোদাল, মাটির হাঁড়ি কি উল্কির রং দিচ্ছে না। মাগীটাকে ছিনিয়ে দে আমাদের। এই দ্যাখ না, নানকোয়া বস্তির রাঙসুঙ এসেছে। ওর ছেলে মেজিচিজুঙের সঙ্গে মেহেলীর বিয়ে দেবে। এই জন্যে একশোটা খারে বর্শা বউপণ দিয়ে গেছে। মেহেলীকে মেজিচিজুঙের সঙ্গে বিয়ে না দিলে নানকোয়া বস্তির সঙ্গে আমাদের লড়াই বেধে যাবে।

বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির ঠোঁটে হাসিটুকু আগের মতোই আটকে রয়েছে। মোটা মোটা, রোমশ আঙুলের নিচে জপমালাটা থামল না। স্নিগ্ধ, মধুর গলায় সে বলল,

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। মেহেলীকে তোমরা ঠিক পাবে, কিন্তু গাইডিলিওকে তো আমাদের চাই।

হু-হু। সালুয়ালাঙের সর্দার সায় দিল।

তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। গ্রামের ভেতর চল। খুঁজে বার করতে হবে তোমাদের মেহেলী আর আমাদের গাইডিলিওকে। আমরা এই বস্তির কিছুই চিনি না। কোথায় কী আছে, জানি না। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চল।

হু-হু, চল ফাদার। আমি তো আছি, এ বস্তির সব কিছু চিনি। অনেক দিন আগে আমাদের সালুয়ালাঙ আর এই কেলুরি মিলিয়ে একটা মস্ত বড় বস্তি ছিল। তার নাম কুরগুলাঙ। ছোটবেলায় কতবার এসেছি এই বস্তিতে। চল ফাদার, চল–আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি।

বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি বসওয়েলের দিকে তাকাল। বলল, চলুন পুলিশ সুপার, ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে।

চলুন। চওড়া ঘাড়খানা ঘুরিয়ে চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভরাট গমগমে গলায় বসওয়েল বলল, টুপস, খুব সাবধান। পাহাড়ীগুলোকে দেখামাত্র গুলি করবে। গাইডিলিওকে না পেলে এই পাহাড়ের সবাইকে আমি খুন করব। দেখি, পাই কিনা। আর ইয়াস, ওই ঘরে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবে। পাহাড়ী কুত্তীটা কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে, আমিও দেখব।

ভারী ভারী পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে এল পুলিশ সুপার বসওয়েল। তার পাশে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। পেছন পেছন ইউরোপীয় সার্জেন্টদের দল, অসমীয়া-বিহারী-মণিপুরী পুলিশের আঁক। তাদের পেছনে নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেরাও এগিয়ে আসছে।

বেয়নেট, রাইফেল ও রিভলবারের নল এবং বর্শার মাথায় মাথায় ধারাল রোদ জ্বলছে। শক্ত পাথুরে টিলায় বুটের শব্দ হচ্ছে। খট, খট, খট, খট।

জোহেরি কেসুঙের উঠোন থেকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে সেঙাই আর ওঙলে।

সেঙাই বলল, রামখোর বাচ্চারা যে বক্তির মধ্যে ঢুকে পড়ল রে ওঙলে!

দাঁতে দাঁত ঘষে অস্ফুট শব্দ করল ওঙলে। বলল, তাই তো দেখছি।

আচমকা জোহেরি কেসুঙের মধ্যে চিৎকার করে উঠল মেহেলী। বাঁশের দেওয়ালের ফাঁকে চোখ রেখে সে সাহেব-পুলিশ বর্শা বন্দুক, সব দেখে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর নির্জীব গলায় মেহেলী বলল, এই সেঙাই, আমাদের সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে সর্দার এসেছে, বাপ এসেছে। বাঘ-মানুষ মেজিচিজুঙ এসেছে। হুই শয়তানটাই তো আমাকে বিয়ে করতে চায়। ওরা যে আমাকে খতম করে ফেলবে।

এত মানুষ, সাহেব, নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের অসংখ্য জোয়ান, মণিপুরী অসমীয়া বিহারী পুলিশ, তাদের বর্শা বন্দুককুড়াল দেখতে দেখতে খুবই ভয় পেয়েছে সেঙাই। বুকের মধ্যে শ্বাস আটকে আটকে আসছে। চোখের তারা দুটো অসাড় হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় মেহেলীর কথাগুলো কানে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া ঘটে গেল। স্কুল পৌরুষবোধে সাঙ্ঘাতিক ঘা লেগেছে। চোখজোড়া জ্বলে উঠল। চড়া, তীক্ষ্ণ গলায় সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, চুপ কর মাগী। আমি আছি না? আমার হাতে এই বর্শা থাকতে কেউ তোকে ছুঁতে পারবে না। এফোঁড়-ওফোড় করে ফেলব।

হঠাৎ কালচে মাড়িসমেত দু’পাটি দাঁত বার করে, বিকট শব্দ করে হাসতে লাগল ওঙলে। হাসির দমকে তার বলিষ্ঠ পেশল দেহটা কাঁপছে, ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। আবার টান টান খাড়া হয়ে যাচ্ছে। ওঙলে বলল, ভালোই হল সেঙাই, খুব ভালো। হুই সায়েবরা, হুই সালুয়ালাঙের শয়তানেরা আসায় মেজাজটা খাসা হয়ে গেল।

কেন?

কেন আবার?হাসি থামিয়ে উত্তেজিত গলায় ওঙলে আবার বলতে লাগল, তুই আমাদের বক্তির সেরা জোয়ান আর মেহেলী হল সালুয়ালাঙ বস্তির সেরা মেয়ে। তোদের বিয়েতে কম করে তিন কুড়ি মাথা ধড় থেকে না নামলে জুত হয়! একটু থেমে কপাল-ভুরু কুঁচকে বলল, রামখোর বাচ্চারা কেমন করে বস্তির ভেতর ঢুকল বল তো সেঙাই?

আমরা হেরে গেছি। নইলে ওরা ঢুকবে কেমন করে? সদ্দারটার দেখা নেই। সেটা হয়; মরেছে, নয় তো জঙ্গলে পালিয়েছে। হুই যে শুনলি না খো কু-ঙ-গা-আ-আ-। হেরে। গেলেই তো জোয়ানেরা অমন করে চেঁচায়।

একটু আগে শব্দ করে আমুদে হাসি হাসছিল ওঙলে। এখন তাকে বিষয় এবং সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। মাথা নেড়ে সে বলল, ঠিক বলেছিস সেঙাই। আমরা হেরেই গেছি।

আচমকা উত্তর দিকের আকাশে লকলকে আগুন দেখা দিল। প্রথম উত্তর, তারপর দক্ষিণ, তারও পর পশ্চিম দিকের আকাশ ঘিরে ক্রমে ক্রমে লেলিহান আগুন সমস্ত গ্রামটাকে ঘিরে ধরতে লাগল।

টিলায় টিলায়, মস্ত মস্ত পাথরের খাঁজে, চড়াই এবং উতরাইতে কেলুরি গ্রামের ঘরবাড়িগুলো ছড়ানো ছিটানো। ছোট ছোট ঘর। আতামারি পাতার ছাউনি, ওক কাঠের পাটাতন, চারপাশে আস্ত আস্ত বাঁশের দেওয়াল। ঘরের চালে চালে আগুনের ফণা নেচে বেড়াচ্ছে। বাঁশের গাঁটগুলো ফাটছে। ফটফট শব্দ হচ্ছে। আতামারি পাতার চাল পুড়ে পুড়ে উৎকট গন্ধ বেরুচ্ছে। ঘরপোড়া ছাই উড়ে উড়ে যাচ্ছে। উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমছোট্ট পাহাড়ী গ্রামটার তিন দিক থেকে কান্না-চিৎকার-আর্তনাদের শব্দ পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে, আ-উ-উ-উ-উ, আ-উ-উ-উ-উ, আ-উ-উ-উ-উ। মাঝে মাঝে বুম্‌-ম্‌-ম্‌ বুম্‌-ম্‌-ম্‌ আওয়াজ হচ্ছে। হল্লা এবং শোরগোলের মিশ্র শব্দ ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর তাণ্ডব।

আর টিলায় টিলায়, চড়াই-এর মাথায় মাথায় ভারী পা ফেলে ছোটাছুটি করছে পুলিশ সুপার বসওয়েল। মাথার চুল উড়ছে, রিভলবার বাগিয়ে উন্মাদের মতো অট্টহাসি হাসছে সে। মনে হয়, বসওয়েলের ঘাড়ে প্রেতাত্মা ভর করেছে। বাঁশের গাঁট ফাটার শব্দ, হল্লা-চিৎকার গোঙানির শব্দ, গুলির শব্দ, সব ছাপিয়ে তার উন্মত্ত গলা পর্দায় পর্দায় চড়ছে, গাইডিলিও ড্যামনড় উইচ, ডার্টি উম্যান। কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারিস, আমি একবার দেখব।

বসওয়েলের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। বিডসের ওপর আঙুলগুলো পরম নির্বিকার। কপালের একটি রেখাও স্থানচ্যুত হয়নি। এমনকি ঠোঁটের সেই হাসিটুকু পর্যন্ত অবিচল।

পুব দিকে জোহেরি বংশের এই বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে গ্রামপোড়া আগুন দেখছিল সেঙাই

আর ওঙলে। দেখতে দেখতে অপরিসীম আতঙ্কে বিহ্বল এবং আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল।

হঠাৎ ঘরের মধ্যে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ উঠল, আগুন আগুন। এই সেঙাই এই ওঙলে, হুই পশ্চিম দিকেই তো আমাদের ঘর! সব পুড়ে বুঝি ছারখার হল।

একজন বলল, পাঁচ খুদি ধান আর জোয়ার রেখে এসেছি। পরশু রাত্তিরে টাটকা রোহি মধু বানিয়েছি। সব পুড়ে গেলে তেলেঙ্গা সু মাসটা চলবে কেমন করে?

আর-একটি গলা শোনা গেল, বাচ্চা ছেলেটাকে শুইয়ে রেখে এসেছি ঘরের মধ্যে। নির্ঘাত পুড়ে মরছে। ইজ্জত দিয়ে কী হবে? আমার বাচ্চা চাই।

ঘরের ভেতর থেকে উল্কার মতো বাইরে বেরিয়ে এলে একটি অর্ধনগ্ন নারীদেহ; চক্ষের পলকে সামনের বড় টিলার আড়ালে অদৃশ্য হল।

নারীকন্ঠের চিৎকার তুমুল হয়ে উঠেছে। উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম, খোখিকেসারি বংশ, জোরি বংশ, গুসেরি, সোচারি, লোহেরিনানা বংশের ঘরবাড়ি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে নিরুপায়, অসহায় আক্রোশে ফুলতে লাগল সেঙাই এবং ওঙলে।

.

পুব দিকের খাড়া চড়াই বেয়ে সেঙাইদের কাছাকাছি এসে পড়ল বুড়ি বেঙসানু, ফাসাও আর নজলি। দিনকয়েক আগে তিন পাহাড়ের ওপারে কোনিয়াকদের গ্রাম ফচিমাঙে কুটুম বাড়ি গিয়েছিল তারা। অনেকখানি উঁচুনিচু দুর্গম পাহাড়ী পথ ভেঙে এসেছে। রীতিমতো হাঁপাতে শুরু করল বুড়ি বেঙসানু। জিভ বেরিয়ে পড়েছে। জীর্ণ, শুকনো স্তন দুটো ঘন ঘন নিশ্বাসের তালে তালে উঠছে, নামছে। বেঙসানু বলল, তার গলায় ভীত কৌতূহলের সুর, এই সেঙাই, এই ওঙলে, ব্যাপার কী? চড়াই ডিঙিয়ে আসতে আসতে আগুন নজরে পড়ল। তাই দেখে ছুটতে লাগলাম। এখন তো জঙ্গল পোড়াবার সময় নয়। তা হলে বস্তিতে আগুন ধরেছেনাকি?

আগুন ধরে নি। সায়েবরা ধরিয়ে দিয়েছে।

সায়েবরা ধরিয়ে দিয়েছে। ইজা হুতা! শয়তানদের খুঁড়ে ফেল সেঙাই। কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে সাবাড় কর ওঙলে। উত্তেজনায়, রাগে বুড়ি বেঙসানুর গলার স্বয় কয়েক পর্দা চড়ে ভয়ানক শোনাতে লাগল। নিশ্বাস দ্রুততর হল তার। বুকটা আরো জোরে তোলপাড় হচ্ছে। ঘোলাটে চোখের অস্পষ্ট তারা দুটো লাল হয়ে উঠল।

তার আর উপায় নেই ঠাকুমা। কিছু করতে পারলে কি আর এখানে দাঁড়িয়ে আছি? একটু থেমে লম্বা দম নিয়ে সেঙাই বলতে লাগল, আমরা হেরে গেছি সায়েবদের কাছে। সদ্দার জোয়ান ছোকরাদের নিয়ে সায়েবদের রুখতে গিয়েছিল। সবাইকে সাবাড় করে সায়েরা বস্তিতে ঢুকেছে। একটু আগে পিঙলেই, ফামুসা আর যাসেমু মোরাঙের দিকে ছুটে পালাল। ওদের গা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছিল।

আহে ভু টেলো! আনিজা তোদের ঘাড় মুচড়ে রক্ত খাক।দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বুড়ি বেঙসানু খেঁকিয়ে উঠল, শয়তানের বাচ্চারা, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস! বস্তির সবাই লড়াই করে মরল, আর তোরা এখানে জানের ডরে লুকিয়ে রয়েছিস! থুঃ থুঃএকদলা থুতু সেঙাই এবং ওঙলের মুখে ছুঁড়ে মারল বুড়ি বেঙসানু।

বেঙসানুর সাড়া পেয়ে ঘর থেকে মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে। চারপাশ থেকে বুড়ি বেঙসানু, ওঙলে এবং সেঙাইকে ঘিরে ধরেছে। সকলের মুখচোখে আতঙ্কের ছায়া।

বেঙসানু আবার খেঁকিয়ে উঠল, কেলুরি বস্তির ইজ্জত তোরা ডুবিয়ে দিলি।

সেঙাই বলল, সদ্দারই তো আমাদের এখানে থাকতে বলেছে। লড়াই করতে যাব কেমন করে?

কেন থাকতে বলেছে এখানে?

কেন আবার? বস্তির মাগীদের ইজ্জত বাঁচাবার জন্যে।

.

৪৬.

টিলার ফাঁক থেকে, পাথরের খাঁজ থেকে, উঁচুনিচু উতরাই-এর আশপাশ থেকে আগুন জিভ মেলছে আকাশের দিকে। মোরাঙ পুড়ছে, চাল-দেওয়াল-পাটাতন পুড়ছে, গাছের আগায় কুমারী মেয়েদের শোওয়ার ঘরগুলি পুড়ছে। পাহাড়ী মানুষগুলো তাদের অস্ফুট মনের কামনা বাসনা দিয়ে, অফুরন্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা দিয়ে ঘর বানিয়েছিল। সব পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সংসার ভেঙে তছনছ হচ্ছে।

বসওয়েলের মনের বৃত্তিগুলির মধ্যে বিনাশকামিতাই বুঝি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্ট। মহাযুদ্ধ-ফেরত বসওয়েল। নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস এবং তাণ্ডবের মতো উত্তেজক নেশা তার কাছে আর কিছু নেই। তার বন্দুকের গুলি যখন মানুষের পাঁজর ভেদ করে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটায়, তার নির্দেশে মানুষের সাজানো-গোছানো গ্রাম-জনপদ যখন পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, নিরাশ্রয় পশুর মতো সচকিত সন্ত্রস্ত হয়ে চারিদিকে মানুষ যখন পালাতে থাকে, তখন অবর্ণনীয় উল্লাসে বসওয়েলের মন ভরে যায়। ধ্বংস করার প্রবৃত্তিটা তার মনে এত প্রবল, এত সযত্নে লালিত হয়েছে যে অন্যান্য সুকুমার বৃত্তিগুলি মোটেই পুষ্টিলাভ করেনি।

চারপাশে আগুন এবং ধ্বংস। দু-চারটে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহও এপাশে ওপাশে পড়ে আছে। নেশাটা মোটামুটি মন্দ জমেনি। রাক্ষসের মতো টিলায় টিলায় দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। বসওয়েল। তার প্রচণ্ড অট্টহাসি পাথরে পাথরে ঘা লেগে উৎকট এবং ভীষণ শোনাচ্ছে, হাঃ হাঃহাঃ। উন্মত্তের মতো হেসে চলেছে সে। আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কি ফাদার, ঘরে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলাম। কিন্তু কোথায়, গাইডিলিও কোথায়? পুলিশরা দু-চারটেকে গুলি করে মেরেছে, বাকি পাহাড়ীগুলো কোথায় যে ভাগল! পেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঠিক খবর আদায় করতাম। ওই হেডম্যানটাকে জিগ্যেস করুন ব্যাপারটা কী।

পেছনে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সমানে মালা জপছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। কটা চোখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। কিছু একটা জবাব সে দিত। কিন্তু তার আগেই সালুয়ালা গ্রামের সর্দার চিৎকার করে উঠল, হুই, হুই যে সেঙাই। হুই যে মেহেলী। ইজা হুবতা!

চক্ষের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। টিলার মাথা থেকে বিরাট খারে বর্শাটা আকাশের দিকে তুলে ধরল সালুয়ালা গ্রামের সর্দার। তার পরেই নিচের উতরাইতে লাফিয়ে পড়ল। তার পেছন পেছন অসংখ্য পাহাড়ী জোয়ানও লাফ দিল। তাদের হাতের থাবায় ঝকমকে বর্শা, মাথায় আউ পাখির পালকের মুকুট, কোমর থেকে জানু পর্যন্ত ডোরাকাটা পী মুঙ কাপড়। পেশীপুষ্ট তামাটে দেহগুলো উতরাই বেয়ে ঢলের মতো নেমে গেল। তাদের সঙ্গে নামল একটানা ভীষণ, ভয়ঙ্কর গর্জন, হো-য়া-য়া-আ-আ, হো-য়া-য়া-আ-আ-আ–

ঘটনাটা এত দ্রুত এবং আকস্মিকভাবে ঘটল যে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি বিমূঢ়ের মতো হতবাক দাঁড়িয়ে রইল। এমনকি বসওয়েলের অট্টহাসিও থেমে গেল।

কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকার পর ম্যাকেঞ্জি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল, কুইক মিস্টার বসওয়েল, ওদের মধ্যে খুনখারাপি বাধলে আমাদের উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি চলুন।

পেছন দিকে তাকিয়ে বসওয়েল হুঙ্কার ছাড়ল, টুপস, কুইক মার্চ, ডাউন দ্য হিল। সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিক নির্দেশ করল, কুইক

টিলার ওপর থেকে প্রথমে লাফ দিল বসওয়েল। তার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকেঞ্জি, মণিপুরী বিহারী-অসমীয়া পুলিশের ঝক এবং ইউরোপীয় সার্জেন্টের দল। ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যাবার আগেই তাদের জোহেরি কেঙে পৌঁছুতে হবে। যেমন করে হোক।

ওদিকে জোহেরি কেসুঙের সামনে পাটকিলে রঙের বিরাট টিলাটার তলায় এসে থমকে দাঁড়াল সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার। তার পেছনে নানকোয়া গ্রামের রাঙসুঙ, তার ছেলে মেজিচিজুঙ এবং মেহেলীর বাপ সাঞ্চামখাবা। আর সবার পেছনে দুই গ্রামের পাহাড়ী জোয়ানেরা।

দূর থেকে বুড়ি বেঙসানুরা সালুয়ালা গ্রামের সর্দারদের ছুটে আসতে দেখেছিল। মুহূর্তে মেয়ে বউরা ঘরের দেওয়াল থেকে তীর-ধনুক কুড়াল এবং বাঁকা খারে বর্শা নিয়ে সেঙাই আর ওঙলের পাশে এসে দাঁড়াল। আদিম মানুষ এবং আদিম মানুষী। সকলের হাতে মৃত্যুমুখ অস্ত্র ঝকমক করছে। এমন সব ভয়ঙ্কর মুহূর্তে অর্ধনগ্ন পাহাড়ী মেয়েরা পুরুষের পাশে অন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। হত্যা এবং মৃত্যু সমান অংশে বাঁটোয়ারা করে নেয়।

টিলার ভাঁজে একটা ক্রুদ্ধ হিংস্রতা যুঁসছে। গর্জে চলেছে একটানা।

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

দীর্ঘ বাঁকানো খারে বর্শার ফলা। আকাশের দিকে সেটাকে বাগিয়ে সেঙাই চিৎকার করে উঠল, শয়তানের বাচ্চারা, খবদ্দার। না বলে বস্তিতে ঢুকেছিস! ওপরে উঠলে সাবাড় করে ফেলব। জানের মায়া থাকলে ভেগে পড়।

ঝাকড়া মাথা ঝাঁকিয়ে সালুয়ালাঙের সর্দার গর্জে উঠল, ভাগব! তোর ভয়ে ভাগব নাকি রে রামখোর ছা? সেবার টিজু নদী থেকে তোর ঠাকুদ্দার মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছিলাম। এবার তোদের ঘর থেকেই বর্শার মাথায় তোর মুণ্ডুটা গেঁথে নিয়ে যাব।

সেঙাই-এর ঠিক পাশেই মস্ত বড় একটা কুড়াল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহেলী। চোখের পাতা কোঁচকানো, তারা দুটো জ্বলছে। স্তনে, চুলে, উরুতে, সুডৌল গলায় সাঙসু ঋতুর রোদ চিকচিক করছে। মেহেলী তীক্ষ্ণ, টানা গলায় বলল, ভেগে পড় সদ্দার। নইলে ঘাড়ের ওপর তোর মাথা থাকবে না। যা, ভাগ।

সালুয়ালাঙের সর্দারের পাশ থেকে সাঞ্চামখাবা খেঁকিয়ে উঠল, এই মেহেলী, এই মাগী, টেফঙের বাচ্চা, শিগগির নেমে আয়। সেই গদা সু মাসে নানকোয়া বস্তির রাঙসুঙের কাছ থেকে বউপণ নিয়েছি। আর তুই কিনা এই বস্তিতে এসে সেঙাই শয়তানটার সঙ্গে পিরিত জমিয়েছিস! শিগগির আয়। বস্তিতে নিয়ে দুঠ্যাঙ ধরে ফেড়ে ফেলব, গায়ের ছাল উপড়ে নেব। তারপর তেলেঙ্গা সু মাসে মেজিচিজুঙের সঙ্গে বিয়ে দেব।

তীব্র, ধারাল গলায় মেহেলী চিৎকার করে উঠল, মেজিচিজুঙের সঙ্গে আমার বিয়ে দিবি। কক্ষনো না। তেলেঙ্গা সু মাসে সেঙাইর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। তুই ওদের নিয়ে বস্তিতে ফিরে যা বাপ, নইলে খুনোখুনি হবে।

টেমে নটুঙ! খুনোখুনি হবে! খুনোখুনিতে কি সাঞ্চামখাবা ভয় পায়! আমার বুকে পাহাড়ী রক্ত নেই! কলিজায় তাগদ নেই? হু-হুক্রুর চোখে তাকাল সাঞ্চামখাবা। বলল, তোদের দুটোকেই আজ ছুঁড়ে নিয়ে যাব। বলতে বলতে খাড়া পাহাড়ী টিলার গা বেয়ে বেয়ে ওপর দিকে উঠতে লাগল সে।

হোয়া–আ-আ-আ—

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

জোয়ানদের গলা থেকে উত্তেজিত, ভয়ানক শব্দটা পাক খেয়ে খেয়ে আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

সালুয়ালা গ্রামের সর্দার বলল, এই শয়তানের বাচ্চা সেঙাই, একদিন তোর ঠাকুদ্দার রক্ত দিয়ে আমাদের মোরাঙের দেওয়ালে চিত্তির করেছিলাম; আজ তোর রক্ত দিয়ে

সর্দারের কথা শেষ হবার আগেই ব্যাপারটা ঘটল। মস্ত বড় এক খণ্ড পাথর তুলে নিল বুড়ি বেঙসানু। মাংসহীন লিকলিকে হাতে দেহের সবটুকু শক্তি একত্র করে ছুঁড়ে মারল। নির্ভুল লক্ষ্য। পাথরের খণ্ডটা সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দারের মাথায় গিয়ে পড়ল। চড়াত করে একটা শব্দ হল। খুলি ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল সালয়ালা গ্রামের সর্দার, আ-উ-উ-উ-উ-মেরে ফেলল আমাকে। শয়তানের বাচ্চাটা আমাকে খতম করল। ওদের ছুঁড়ে ফেল, সাবাড় কর। টিলার গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে গিয়ে পড়ল সে।

হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটা উঠে এসেছিল সাঞ্চামখাবা। হঠাৎ থমকে গেল। আর জোহেরি কেসুঙের উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাঙা কর্কশ গলায় একটানা অশ্রাব্য গালাগালিতে দুপুরটাকে ভরিয়ে তুলল বুড়ি বেঙসানু। সমানে গজগজ করতে লাগল, আমার সোয়ামীর মুণ্ডু নিয়েছিলি। তার শোধ তুললাম। এগিয়ে আয়, আরো কটাকে সাবাড় করি।

সর্দারকে পাথরের ঘা খেয়ে নিচে পড়তে দেখে জোয়ান ছেলেরা বেশ দমে গিয়েছিল; টিলা বেয়ে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে তারা। হতভম্ব ভাবটা কেটে যাবার পর সকলে সমস্বরে শোরগোল করে উঠল হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ, হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ টিলাটা বেয়ে বেয়ে আবার সকলে জোহেরি বংশের বাড়িটার দিকে উঠতে লাগল।

সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, খুব হুঁশিয়ার শয়তানেরা। আর এগুবি না। মায়ের ছানা মায়ের কাছে ফিরে যা। যারা বিয়ে করেছিস, বউর কাছে ভাগ। নইলে রেহাই দেব না কাউকে।

আমাদের সদ্দারকে মেরেছিস। বিশটা মাথা নিয়ে শোধ তুলব। নিচে থেকে সাঞ্চামখাবা গর্জে উঠল, মেহেলীকে এতদিন বস্তিতে আটকে পিরিত করেছিস, সেই জন্যে তোর মাথাটা নেব সবার আগে।

রাঙসুঙের ছেলে মেজিচিজুঙ হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত এগুতে শুরু করল। টিলাটার মাথায় জোহেরি কেসুঙের উঠোনে মেহেলী নামে এক রমণীয় পাহাড়ী যুবতী দাঁড়িয়ে আছে। তার উজ্জ্বল তামাভ দেহে, সুঠাম চিকণ মাজায়, নির্ভাজ উরুতে, মসৃণ চামড়ায়, নিটোল গলায় অফুরন্ত স্বাস্থ্য এবং যৌবন বিচ্ছুরিত হয়ে রয়েছে। এর আগে কোনদিনই মেহেলীকে দেখেনি মেজিচিজুঙ। তার বাপ রাঙসুঙ মেহেলীর সঙ্গে তার বিয়ের জন্য বউপণ দিয়ে এসেছিল। এটুকুই তার জানা। মেহেলীকে দেখতে দেখতে মেজিচিজুঙের চাপা কুতকুতে চোখজোড়ায় বিস্ময় ফুটল। মনে মনে সে স্থির করে ফেলল, যেমন করে হোক, যত রক্তপাতই ঘটুক, মেহেলীকে তার চাই। ধমনীতে রক্তের কণাগুলো ঝনঝন করে বাজতে লাগল তার। নিশ্বাস ঘন হল। কামনাতুর নিষ্পলক চোখে মেহেলীর দিকে তাকিয়ে পিঠ বেঁকিয়ে আরো দ্রুত টিলা বাইতে লাগল মেজিচিজুঙ।

সেঙাই এবং ওঙল তাক করার জন্য বর্শা মাথার ওপর তুলে ধরেছিল। কিছু একটা ঘটে যেত, রুক্ষ টিলার গা বেয়ে তাজা টকটকে রক্তের ঢল নামতে পারত, কিন্তু তার আগেই বসওয়েল আর ম্যাকেঞ্জি দলবল নিয়ে এসে পড়ল।

চমকে উঠল ম্যাকেঞ্জি। কোহিমায় এত মার খেয়েও সেঙাই মরেনি। নিমেষে চমকটা ঝেড়ে ফেলে সে চেঁচিয়ে উঠল, এই সেঙাই, থামো থামো, বর্শা ছুড়ো না–

টিলার গায়ে জোয়ান ছেলেরা আবার থমকে গেল।

সেঙাই হুমকে উঠল, বর্শা ছুড়ব না! সবার আগে তোকে খুন করব শয়তানের বাচ্চা। আয়, এদিকে আয় একবার। কেলুরি বস্তিতে সদ্দারি ফলাতে এসেছিস! হুই সব এখানে চলবে না।

বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না ম্যাকেঞ্জি। ঠোঁটে আটকানো সেই হাসিটা অতি দ্রুত সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। সস্নেহ সুরে বলল, আমি বুড়ো মানুষ, টিলা বেয়ে উঠতে পারব না। তুমিই নেমে এসো। অনেক কথা আছে। অনেক কাপড় আর টাকা এনেছি তোমাকে দেব বলে।

সেঙাই সমানে চেঁচাতে লাগল, তুই একটা আস্ত টেফঙের বাচ্চা। টাকা চাই না, তোর কাপড়ে মুতে দি। ওপরে আয়, তোকে খুঁড়ি। কোহিমায় মেরেছিলি, তার বদলা নেব। তোকে আজ ফুড়বই।

মনে মনে শঙ্কিত হল ম্যাকেঞ্জি। এই পাহাড়ী মানুষগুলোকে বিশ্বাস নেই। গোঁ যখন ধরেছে তখন সেঙাই যে খুব নিরীহ ধরনের কিছু করবে, এমন ভরসা হচ্ছে না। বুকটা ধক করে উঠল, চোখের কোণটা সামান্য কোঁচকানো। কিন্তু হাসিটা তেমনই সারা মুখে ছড়িয়ে রইল। মোলায়েম গলায় বলল, আমি কি তোমাদের মেরেছি? আসান্যুরা মেরেছে।

ইজা হুবুতা! দাঁত খিঁচিয়ে চেঁচাল সেঙাই, রানী আমাদের বলেছে, তোরা, সায়েব শয়তানেরা বলিস বলেই আসান্যুরা আমাদের মারে। আয় টেফঙের বাচ্চা, তোর মুণ্ডু নিয়ে আজ মোরাঙের সামনে গেঁথে রাখব।

একটু একটু করে ম্যাকেঞ্জির মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। কপালে মাকড়সার জালের মতো অসংখ্য জটিল রেখা ফুটে বেরিয়েছে। অনেক, অনেককাল আগে ব্রেটনব্রুকশায়ারের এক সাঙ্ঘাতিক আউট লর ছায়া এসে পড়েছে দুটো কটা চোখের মণিতে। সারপ্লিসের কোনো কোটরে অদৃশ্য হয়েছে বাদামি রঙের জপমালাটা। আশ্চর্য শান্ত এবং নিস্পৃহ সুরে ম্যাকেঞ্জি বলতে লাগল, দেখছ তো সেঙাই, তোমাদের গ্রামে আসা আর পুলিশরা কেমন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বর্শা-তীর-ধনুক দিয়ে তোমরা আমাদের রুখতে গিয়েছিলে। পুলিশের বন্দুকের গুলিতে গোটাকয়েক সাবাড় হতে, বাকি সকলে জঙ্গলে পালাল। বুঝতেই পারছ, বর্শা কুড়াল দিয়ে বন্দুকের সঙ্গে তোমরা লড়তে পারবে না। ভালোয় ভালোয় বলছি, গাইডিলিওকে বার করে দাও।নইলে আসান্যুরা তোমাদের–একটা ভয়ানক ইঙ্গিত দিয়ে সেঙাইর দিকে তাকাল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি।

সেঙাই বলল, রানী চলে গেছে বস্তি থেকে।

কোথায় গেছে?

তা আমরা জানি না।

তোমাদের কতবার বলেছি, ওই গাইডিলিওটার সঙ্গে মিশবে না, ওকে বস্তিতে ঢুকতে দেবে না। গাইডিলিও হল ডাইনি, রক্ত চুষে সবাইকে সাবাড় করবে।

ভীষণ উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল সেঙাই, মিছে কথা, মিছে কথা। গাইডিলিও হল রানী। তোরা, তোরা ডাইনি। কোহিমায় যখন গিয়েছিলাম তোরা আমাকে মেরেছিলি। হুই রানী আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। গাইডিলিওকে ডাইনি বললি, এখুনি তোকে সাবাড় করব।

অত্যন্ত আচমকা, মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। সেঙাইর থাবা থেকে বর্শাটা সাঁ করে ছুটে গেল। বাঁকা খারে বর্শার ফলা ম্যাকেঞ্জির কণ্ঠায় গেঁথে গেল।

ওহ ক্রাইস্ট, মারডার মারডার। মিস্টার বসওয়েল, সেভ মি, সেভ মি। ওহ-হ-হ–প্রাণফাটা আর্তনাদ করে উঠল ম্যাকেঞ্জি। ফিনকি দিয়ে তাজা রক্তের ফোয়ারা সারা সারপ্লিসটাকে লাল করে দিতে লাগল।

প্রথমে বিচলিত এবং হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল বসওয়েল। জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, মহাযুদ্ধের ধ্বংস এবং নির্বিচার হত্যা তার চোখের সামনে ঘটেছে। কোনোদিনই সামান্য রক্তপাতে সে অধীর হয়ে পড়ে না। স্নায়ুমণ্ডলীর জোর তার অসাধারণ। কিন্তু এমন একটা ঘটনা তার জীবনে যতটা অভিনব, তার চেয়ে অনেক বেশি আকস্মিক এবং উন্মাদনাকর। মস্তিষ্কের সমস্ত বুদ্ধি এবং বিনাশকামী মনের অন্যান্য অপুষ্ট অনুভূতিগুলি দিয়ে কিছুতেই বসওয়েল বুঝে উঠতে পারছে না, কেমন করে একটা পাহাড়ী জোয়ান বন্দুক এবং রিভলবার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বর্শা ছুঁড়তে পারে! এ যেন তাকেই, তার মারাত্মক জবরদস্ত অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। সূক্ষ্ম এবং সাঙঘাতিক এক খোঁচা লাগল বসওয়েলের দম্ভে।

ঢালু উতরাই। ধারাল রুক্ষ পাথর। সেখানে লুটিয়ে পড়েছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। বিরাট, মেদপুষ্ট দেহটা থরথর কাঁপছে। ম্যাকেঞ্জির তাজা মিশনারি রক্ত এই কেলুরি গ্রামের, এই অ্যাডোলেট্রির পাহাড়ী জগৎকে স্নান করাচ্ছে। আর এক ক্রাইস্ট! এতক্ষণ আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করছিল ম্যাকেঞ্জি। এবার গলাটা ক্ষীণ হয়ে আসছে। গোঁ গোঁ শব্দে গোঙাচ্ছে, থেমে থেমে অনেকক্ষণ পর পর বলছে, মিস্টার বসওয়েল, মারডার মারডার। আমাকে মেরে ফেলল। ওহ ক্রাইস্ট, আমি আর বাঁচব না।

টিলার গায়ে নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেরা এবং তাদের পেছনে অসমীয়া-বিহারী-মণিপুরী পুলিশের ঝাক নিশ্চল, স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। ওত পেতে সুযোগের অপেক্ষা করছে।

বসওয়েলের রুক্ষ কর্কশ মনে এই মুহূর্তে কেমন করে যেন অদ্ভুত এক উপমার জন্ম হল। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িই এক-একটা দুর্গ। ওপরের ওই বাড়িটা আদিম মানুষের শেষ দুর্গ। দুটো পাহাড়ী জোয়ান এবং অসংখ্য অর্ধনগ্ন মেয়েমানুষ বর্শা কুড়াল-তীর-ধনুক বাগিয়ে দুৰ্গটাকে পাহারা দিচ্ছে। আর তারা, সভ্য জগতের মানুষ, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত, আদিম বর্বরদের শেষ দুর্গ দখল করতে এসেছে। সভ্য জগতের সঙ্গে আদিম জগতের লড়াই। মনে মনে নিজের রসবোধে মুগ্ধ হয়ে গেল বসওয়েল। একটু হাসল। মোহিত হয়ে হাসলেও তাকে কী ভয়ঙ্করই না দেখায়!

কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, তার পরেই রক্তে রক্তে গ্রেট ওয়ার নেচে উঠল যেন। চোখের সামনে দিয়ে হুস হুস করে মিছিলের মতো সরে সরে যেতে লাগল হত্যা, রক্ত, আর্তনাদ, ফ্লাইং ফাইটার আর অ্যান্টি এয়ারক্রাফটের গর্জন এবং অসংখ্য ওয়ারফ্রন্ট।

হা, ওয়ারফ্রন্টই বটে। ওই ওপরের বাড়িটা এই গ্রামের লাস্ট ফ্রন্টিয়ার। লাস্ট সিটাডেল। চোখের কপিশ মণিদুটো ধকধককরে জ্বলে উঠল বসওয়েলের। এই নাগাপাহাড়ে এমন একটা ওয়ারফ্রন্ট তারই জন্য অপেক্ষা করছিল, আগেভাগে কি তা জানত বসওয়েল? প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল বসওয়েল, ফায়ার–

সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের মুখগুলো থেকে নীলচে আগুনের সঙ্গে গুলি এবং গর্জন ছুটল, বুম্‌-ম্‌-ম্‌–, বু-ম্‌-ম্‌-ম্‌–

জোহেরি কেসুঙের চত্বরে গোটাকয়েক নারীদেহ লুটিয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ মরণকাতর গলায় ককিয়ে উঠল ওরা, আ-উ-উ-উ, আ-উ-উ-উ, আ-উ-উ-উ–

একটা গুলি সেঙাই-এর কবজি ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। হাত থেকে বর্শাটা খসে পড়েছে। কপালের দু’পাশে সমস্ত রগগুলো একসঙ্গে লাফাচ্ছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সেঙাই, সব ঝাপসা হয়ে আসছে। টলতে টলতে পড়ে গেল সে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মেহেলী, সে-ও পাশে বসে পড়েছে। চোখ দুটো তার জ্বলছে। হাউ হাউ করে চেঁচাতে চেঁচাতে, কাঁদতে কাঁদতে সে বলছে, তোকে ওরা মারল সেঙাই, তোকে ওরা খুঁড়ে ফেলল! উরুর ওপর সেঙাইর মাথাটা তুলে নিল মেহেলী।

টিলার গায়ে একটা ভীষণতা দাপাদাপি করছে। একটা অট্টহাসি আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে। বসওয়েল চিৎকার করছে, গ্রেট ওয়ার ফেরত লোক আমি। হিলি প্যাগানদের লাস্ট ফোর্টরেস আমার দখলে। আই হ্যাভ কঙ্কারড, আই অ্যাম ডিক্লেয়ার্ড ভিক্টর। হাঃ-হাঃ-হাঃ–স্পিয়াব দিয়ে বন্দুকের সঙ্গে লড়াই করতে এসেছে শয়তানগুলো!

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

নানকোয়া এবং সালুয়ালাঙের জোয়ানগুলো এতক্ষণ টিলার গায়ে ওত পেতে ছিল। এবার সমস্ত কেলরি গ্রাম এবং চারপাশের বনভূমি চমকে দিয়ে চিৎকার করে উঠল। তারপর দ্রুত চড়াই বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

তাজা পাহাড়ী রক্তে জোহেরি কেসুঙের চত্বরটা ভিজে গিয়েছে। রক্তের মধ্যে নারীদেহগুলি থরথর কাঁপছে। কেলুরি গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা বর্শা হাতে সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

সকলের আগে আগে ছুটে এল বসওয়েল। কেলুরি গ্রামের লাস্ট ওয়ারফ্রন্টে তার পা পড়ল।

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—

টিলার গা বেয়ে একটা উন্মাদ ঝড় উঠে আসছে।

জোহেরি কেসুঙের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল বুড়ি বেঙসানু। সাপের জিভের মতো লিকলিকে পিঙ্গল রঙের চুল উড়ছে। ভুরুতে লোম নেই। হলদে ছানিপড়া চোখে ঘোলাটে তারাদুটো ধকধক করছে। উলঙ্গ শুকনো দেহ, হাড়গুলো উৎকটভাবে চামড়া ছুঁড়ে বেরিয়েছে। বুকের দু’পাশে একজোড়া স্তন ঝুলছে। পাটকিলে রঙের মাড়ি দেখা যাচ্ছে। নোংরা ক্ষয়া দাঁতের পাটি ফাঁক হয়ে রয়েছে। গালের পাশ দিয়ে জিভ বেরিয়ে পড়েছে। উত্তেজনায় শুকনো বুকটা ফুলছে যুঁসছে উঠছে নামছে। হাতের মুঠিতে মস্ত এক কুড়াল। রাগে আক্রোশে দাঁতগুলো আপনা থেকেই ঘষে ঘষে শব্দ হচ্ছে। বুড়ি বেঙসানু সামনের দিকে আরো অনেকটা এগিয়ে এল। তীক্ষ্ণ আর ভাঙা গলায় গর্জে উঠল, ইজা হুতা! রামখোর বাচ্চারা, আমাদের বস্তির এতগুলো মানুষকে খুঁড়লি! আমার নাতি হুই সেঙাইকে খুঁড়লি! আজ তোদের সব কটার ঘাড় থেকে মুণ্ডু খসাব। হু-হু, আমার ছেলে সিজিটো শয়তানটা ছিল সায়েবচাটা। ওটা বলত, সায়েবদের গায়ের রং হুন্টসিঙ পাখির পালকের মতো সাদা। নির্ঘাত তোরা সেই সায়েব। এই কেলুরি বস্তি থেকে তোদের আর জান নিয়ে ফিরতে হবে না। দম নেবার জন্য একটু থামল বেঙসানু। তারপর আবার চিৎকার শুরু করল, আহে ভু টেলো। মর মর। সালুয়ালাঙ বস্তির শয়তানগুলো এসেছিস। তোরা আমার সোয়ামীর জান নিয়েছিলি, তোদেরও রহাই দেব না। আপোটিয়া।

একটা অপঘাত ছুটে আসছে। টিলা বেয়ে উঠে আসতে আসতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বসওয়েল। চওড়া, বিশাল বুকটার মধ্যে হৃৎপিণ্ড দুরুদুরু করে উঠল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, ধমনীর ওপর এক ঝলক রক্ত উছলে পড়ল। গলাটা কেঁপে গেল বসওয়েলের, উইচ, শুয়োরলি আ উইচ। ওহ ক্রাইস্ট! হাউ হরিবল! হাউ ডেঞ্জারাস!

বুড়ি বেঙসানু নামে পাহাড়ী বিভীষিকাটা ছুটতে ছুটতে টিলার শেষ মাথায় এসে পড়ল। একটানা চেঁচাতে চেঁচাতে বলল, আমি এখনও বেঁচে রয়েছি। দেখি কী করে জোহেরি বংশের ইজ্জত নষ্ট করিস! আয়, বেজন্ম না হলে এগিয়ে আয়। আজ তোদের একটাকেও ফিরতে দেব না। আমরা জানে খতম হয়ে গেলেও বস্তির ইজ্জতে হাত দিতে দেব না। আয় সায়েব শয়তানেরা। আমার ছেলে হুই সিজিটোটাকে কোহিমায় নিয়ে তোরা তার মাথা খেয়েছিস। সে আর আমার কাছে আসে না। আমার নাতি হুই সেঙাইটাকে তোরা ফুড়লি! আয় সালয়ালাঙের কুত্তারা। তোরা আমাদের তিনপুরুষের শর। তোদেরও সাবাড় করব। টেমে নটুঙ!

নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ সুপার বসওয়েল। তার পেছনে থমকে রয়েছে নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের অসংখ্য জোয়ান।

বসওয়েল ভাবছিল, পাহাড়ী ইজ্জত, গ্রাম-সমাজ এবং নারীর মর্যাদাবোধ এখানে কী উগ্র! কী সাঙ্ঘাতিক! টিলার মাথায় একটি শুকনো নীরস নারীদেহে সেই ইজ্জত এবং মর্যাদাবোধ দাবাগ্নির মতো জ্বলছে।

ওপাশ থেকে সালুয়ালা গ্রামের সর্দার চিৎকার করে উঠল, ডাইনি ডাইনি, নির্ঘাত ডাইনি। সায়েব, ওকে ছুঁড়ে ফেল, মেরে ফেল। নইলে ও সবাইকে সাবাড় করে ফেলবে।

পাহাড়ীদের ভাষা ঠিকমতো বোঝে না বসওয়েল। কিন্তু সালুয়ালাঙের সর্দারের চিৎকারে নিষ্ক্রিয় ভাবটা নিমেষে ঘুচে গেল। বুড়ি বেঙসানু সোঁ সোঁ করে ছুটে আসছে। কর্তব্য স্থির করে ফেলল বসওয়েল। কেলুরি গ্রামের লাস্ট ওয়ারফ্রন্ট তাকে দখল করতেই হবে। শিরায় শিরায় রক্তের কণিকাগুলি আগ্নেয় ধাতুস্রোতের মতো ছুটতে ছুটতে ধমনীতে ঘা দিতে লাগল। কোমর থেকে রিভলভারটা টেনে বাগিয়ে ধরল বসওয়েল। ট্রিগারের ওপর মোটা রোমশ তর্জনীটা চেপে বসল। পুরু পুরু ঠোঁট দুটো হিংস্র ভঙ্গিতে বেঁকে গেল।

আরো, আরো অনেকটা এগিয়ে এসেছে বুড়ি বেঙসানু।

উইচ, স্টপ! বসওয়েল গর্জে উঠল। গর্জনের রেশটা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ল। তারপরেই রিভালভারের নলের মুখ দিয়ে খানিকটা নীল আগুন ছুটে গেল, বুম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌–

বেঙসানুর দুটো জীর্ণ স্তনের নিচে এবং বুকে চোখা চোখা হাড় প্রকট হয়ে রয়েছে। হাড় এবং চামড়ার খাঁচার মধ্যে ছোট্ট হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করে বাজছে। সেই হৃৎপিণ্ডটা কুঁড়ে রিভালভারের নীল আগুন বেরিয়ে গেল।

আ-উ-উ-উ-কাতর শব্দ করে টিলার ওপর লুটিয়ে পড়ল বেঙসানু।

হাঃ-হাঃ-হাঃ–ভয়াল অট্টহাসি বাজল বসওয়েলের গলায়, এনি ফারদার রেজিস্টান্স, ওয়াইল্ড বিস্টস? হাঃ-হাঃ-হাঃ

ঠাকুমা, ঠাকুমা–কাতর গলায় বার দুই গুঙিয়ে উঠল সেঙাই। শরীর এবং মন থেকে

চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো আপনা থেকেই বুজে বুজে আসছে। মেহেলীর উরুতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল সেঙাই। অসহ্য যন্ত্রণায় শিরা-স্নায়ু-হাড়-মাংস সব যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে। কবজির হাড়টা বুঝি চুরমারই হয়ে গিয়েছে। ফিসফিস, আবছা গলায় সেঙাই। ডাকল, মেহেলী–

কী বলছিস সেঙাই? দ্রুত মুখটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে মেহেলী জিগ্যেস করল।

আমার বর্শাটা একবার দে তো।

কেন?

শয়তানদের ফুঁড়ব।

তুই পারবি না সেঙাই। আমার কোলে চুপ করে শুয়ে থাক। দেখছিস না, কত রক্ত পড়েছে তোর?

পারব, খুব পারব। গোঙাতে গোঙাতে নির্জীব হয়ে পড়ল সেঙাই। আর কথা বলল না, বলতে পারল না।

চোখের পাতাদুটো দুখণ্ড পাথরের মতো ভারী হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না সেঙাই। উজ্জ্বল তামাটে মুখখানা ফ্যাকাসে, নীরক্ত হয়ে গিয়েছে।

মেহেলী নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেঙাই-এর দিকে। কেলুরি গ্রামের দুর্দান্ত জোয়ান তার উরু দুটোর মধ্যে এখন নির্জীব হয়ে পড়ে রয়েছে। তবে কি সেঙাই মরে গেল? আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠল। সেঙাইর দুকাধ ধরে প্রবল ঝকানি দিল মেহেলী। সমস্ত দেহে যন্ত্রণা জ্বালা এবং আতঙ্কের ভঙ্গি ফুটিয়ে তীব্র, অতি তীব্র, অতি তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, সেঙাই, সেঙাই–

কোনো জবাব দিল না সেঙাই।

মেহেলী আবার ডাকল। ভীত, উত্তেজিত স্বরটাকে অনেক উঁচুতে তুলে সমানে চেঁচাতে লাগল, সেঙাই–সেঙাই–

অনেকক্ষণ পর আবছা গলায় সেঙাই বলল, কী?

তুই খতম হয়ে গেলি?

হু—হু–

সেঙাই, এই সেঙাই—

আবার থেমে গিয়েছে সেঙাই। সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

শিরায় শিরায় তীব্র বেগে রক্তের ধারা ছোটাছুটি করছে মেহেলীর। জখমী ময়ালীর মতো তার চোখজোড়া জ্বলছে। হিংস্র, বলিষ্ঠ, বুনো জোয়ানী সে। আরণ্যক প্রকৃতির ক্রুরতা, ভীষণতা এবং দুর্বার জীবনবেগের মধ্যে সে মানুষ হয়েছে। হত্যা, প্রতিহিংসা, চরম আক্রোশ এবং প্রচণ্ড ক্রোধ–আদিম জীবনের স্কুল এবং অতি স্পষ্ট প্রবণতাগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে ও নিজের জৈবিক প্রয়োজনের তাড়নায় জোগাড় করে নিয়েছে মেহেলী।

দুই উরুর মাঝখানে মাথা রেখে অসাড় পড়ে রয়েছে সেঙাই। সাহেবরা তাকে খুঁড়েছে। তাজা ঘন রক্তে সমস্ত দেহ মাখামাখি। সেঙাই-এর রক্ত তার উরুতে এবং হাতে লেগে রয়েছে। মেহেলী কি জানত, সেঙাই নামে শত্রুপক্ষের অনাত্মীয়, স্বল্পজানা জোয়ানটাকে কেউ ফুঁড়লে কি মারলে তার কষ্ট হয়, ভয়ানক সাঙ্ঘাতিক রাগ হয়, দুচোখ জ্বালা করতে থাকে।

পাতলা চামড়ার নিচে চাপবাঁধা মাংসপিণ্ড এবং শিরা-উপশিরায় কী যেন সমানে ফুঁসছে। স্নায়ুতে স্নায়ুতে একটা শ্বাপদ যেন অবিরাম হুঙ্কার ছাড়ছে। আবার চেঁচিয়ে উঠল মেহেলী, তোকে ওরা মারল সেঙাই! হুই শয়তানের বাচ্চারা খুঁড়ল!

দেহটা অল্প অল্প কাঁপছে। বড় বড় শ্বাস পড়ছে। চোখের পাতা দুটো সামান্য ফাঁক হয়েছে। নির্জীব, প্রায় শোনা যায় না, এমন গলায় সেঙাই বলল, হু-হু–

আমি হুই টেফঙের বাচ্চাদের সাবাড় করব। তুই আমার পিরিতের জোয়ান। পনেরো দিন পর তেলেঙ্গা সু মাসে তোর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। তুই আমার সোয়ামী হবি। আর তোকে ওরা ফুড়ল! একটাকেও আজ রেহাই দেব না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল মেহেলী। শরীরটা কাঁপছে, নড়ছে, ঝকানি খেয়ে দুলে দুলে উঠছে। হাউ হাউ কান্নাটা বিকট শব্দ করে বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।

পাহাড়ী মানুষের শোক প্রকাশের রীতিই আলাদা। এরা প্রবল শব্দ করে কাঁদে, চেঁচায়। সেই সঙ্গে শোকের কারণের বিপক্ষে অভিযোগ করে, আক্রোশ জানায় এবং প্রতিহিংসা নেবার। চেষ্টা করে। শোকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিমূঢ়, বিহ্বল হয়ে প্রতিশোধপ্রবণ বন্য প্রকৃতির কথা ভোলে না।

একটু পর আবার ডাকল মেহেলী, ওরা সবাইকে মারল। তোর ঠাকুমাকে মারল। বস্তির ঘরে ঘরে আগুন ধরাল। তোকেও খতম করল। কী হবে সেঙাই? আমাদের কি বিয়ে হবে না?

চোখের পাতা দুটো বুজে আসছে আবার। তবু সব যন্ত্রণা ঝেড়েকুড়ে শরীরটাকে দুমড়ে বেঁকিয়ে উঠে বসতে চাইল সেঙাই। পারল না। কাঁধে চাপ দিয়ে তাকে আবার শুইয়ে দিল মেহেলী।

ক্ষীণ গলায় সেঙাই বলল, নির্ঘাত তোর আর আমার বিয়ে হবে।

হঠাৎ জোহেরি কেসুঙটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত গলায় চিৎকার করে উঠল মেহেলী, সেঙাই সেঙাই, হুই শয়তানের বাচ্চারা উঠে আসছে। সামনে একটা আনিজা। আমার বড্ড ভয় করছে।

টিলা বেয়ে বেয়ে এতক্ষণে জোহেরি কেসুঙের কঠিন চত্বরে চলে এসেছে পুলিশ সুপার বসওয়েল। কী এক ব্যভিচারের জন্য নাকে পচন লেগেছিল; একটি হাড় খেসারত দিয়ে নাকটাকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য দুটো বড় গর্ত হয়ে রয়েছে। বীভৎস মুখখানায় একটা কদর্য হাসি ছুটে বেড়াচ্ছে। কেলুরি গ্রামের লাস্ট সিটাডেল, লাস্ট ফ্রন্টিয়ারে উদ্ধত ভঙ্গিতে পা ফেলে, পকেট থেকে আইভরি পাইপ বার করে, সুগন্ধি তামাক পুরতে লাগল বসওয়েল। তারপর লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করল।

বসওয়েলের পেছন পেছন উঠে এসেছে মেহেলীর বাপ সাঞ্চামাখাবা, রাঙসুঙ এবং মেজিচিজুঙ। আর এসেছে সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার, অসংখ্য জোয়ান ছেলে ও পুলিশের দল।

রক্তাক্ত নারীদেহগুলো চারদিকে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে। বুড়ি বেঙসানুর উলঙ্গ শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছে। পাটকিলে রঙের পাথুরে ধুলো রক্তে ভিজে থকথকে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

ভয়ানক গলায় আবার হেসে উঠল বসওয়েল, ওয়ারফ্রন্ট! এহ, উই ইনভেড অ্যান্ড কঙ্কার। এহ্, হোয়াট আ জয়! হাঃ-হাঃ-হাঃ–বসওয়েলের তামাটে চুলগুলো বুনো বাতাসে উড়ছে। বড় বড় দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভ বেরিয়ে পড়েছে। উল্লাসের আতিশয্য ঘটলে বসওয়েল ঘন ঘন ঠোঁট চাটে। মোটা তামাক-পোড়া ঠোঁট দুটো চেটে সে হুঙ্কার ছাড়ল, আগুন লাগাও–

এক ঝক শিকারি কুকুরের মতো জনকতক পুলিশ জোহেরি বংশের বাড়িটার দিকে ছুটে গেল। আতামারি পাতার চাল, চারপাশে আস্ত আস্ত বাঁশের দেওয়াল, কাঠের পাটাতন শুকিয়ে আগুনের জন্য যেন উন্মুখ হয়ে রয়েছে। চক্ষের পলকে ঘরের চালে আগুন নেচে উঠল। বাঁশের গাঁটফাটা ফট ফট আওয়াজ হতে লাগল।

মেহেলীর উরুর ওপর থেকে হাতের ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল সেঙাই। রাগ, আক্রোশ, রোষ–মনের আদিম বৃত্তিগুলো চেতনার মধ্যে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। অশক্ত দুর্বল দেহ। রক্ত ঝরে ঝরে শরীরটা সাঙ্ঘাতিক কাহিল হয়ে পড়েছে। গোঙাতে গোঙাতে সেঙাই বলল, আহে ভু টেলো! শয়তানেরা আমাদের ঘরটা পুড়িয়ে দিল। আমাদের বংশের ইজ্জত সাবাড় করল। খুঁড়েই ফেলব সব কটাকে।

নিষ্পলক তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল মেহেলী। একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে। হঠাৎ তার দৃষ্টিটা সামনের দিকে গিয়ে পড়ল। নানকোয়া ও সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেরা তার দিকে এগিয়ে আসছে। সবার আগে আগে আসছে তার বাপ সাঞ্চামখাবা। এমনকি বুড়ো সর্দার ফাটা মাথা নিয়ে উঠে পড়েছে, এখন টিলা বাইছে।

গলা ফাটিয়ে মেহেলী আর্তনাদ করে উঠল, সেঙাই, এই সেঙাই—

উঁ–

শয়তানেরা আমাকে কেড়ে নিতে আসছে।

বর্শাটা আমার বাঁ হাতে দে দেখি একবার। ফিস ফিস, অবশ গলায় সেঙাই বলল, তোর গায়ে একবার হাত দিয়ে দেখুক–

ইজা হুবুতা! সাঞ্চামখাবা খেঁকিয়ে উঠল, টেঙের বাচ্চার পিরিত দ্যাখ। সেই কবে রাঙসুঙের কাছ থেকে পণের বর্শা বাগিয়েছি আর ছুঁড়িটা এখানে এসে শত্তুরদের ছোঁড়াটার সঙ্গে কেমন পিরিত জমিয়ে বসেছে দ্যাখ।

এতহুণে টিলার মাথায় উঠে এসে সাঞ্চামখাবার পাশে দাঁড়িয়েছে সালুয়ালাঙের বুড়ো সর্দার। বেঙসানুর পাথরের ঘা লেগে মাথা ফেটে গিয়েছে। ঘন রক্তের ধারা কপাল, খসখসে চোখের পাতা এবং শুকনো তোবড়ানো গালের ওপর জমাট বেঁধে রয়েছে।

সাঞ্চামখাবা বলল, তুই একবার বল সদ্দার, মাগী আর মরদটাকে বর্শার ডগায় ফুঁড়ে বস্তিতে নিয়ে যাই।

সাঞ্চামখাবার কথায় কান দিল না সর্দার। বিকট মুখভঙ্গি করে সমানে চেঁচাতে লাগল, শয়তানীটার জন্যে সকলে আমাদের ঘেন্না করছে। যেই এ-খবর চাউর হয়েছে অমনি অঙ্গামীরা ধান বদল করছে না, কোনিয়াকরা হাঁড়ি-শাবল-কোদাল দিচ্ছে না। মাগীর জন্যে আমাদের অত নামকরা বস্তির ইজ্জত আর রইল না। আহে থুঙকু সালো!

একটু থেমে, ঘড়ঘড়ে গলায় কেশে, সর্দার গলাটা আরো চড়াল, বস্তিতে নিয়ে মাগী তোর ছাল উপড়ে নেব। শত্রুরদের বস্তিতে তোকে মারব না, আনিজার গোসা হবে।

পাখির পালকের মুকুটটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সাঞ্চামখাবা বলল, উঠে আয় মেহেলী, উঠে আয়।

না না, আমি যাব না।

যাবি না? খেঁকিয়ে উঠে রক্তচোখে তাকাল সাঞ্চামখাবা।

না। ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করতে লাগল মেহেলী। মাথার সঙ্গে সমস্ত শরীরটা নাড়াতে লাগল, না না, যাব না। সেঙাইকে ছেড়ে কিছুতেই যাব না।

যাবি না! কেন যাবি না? অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিশাল খারে বর্শার ফলাটা আকাশের দিকে বাগিয়ে আরো সামনে এগিয়ে এল সাঞ্চামখাবা। বুনো মোষের মতো ফোঁস ফেস করতে করতে বলল, বেশি ফ্যাকর ফ্যাকর করবি না মাগী। সিধে কথায় না উঠে এলে বর্শায় গেঁথে টানতে টানতে বস্তিতে নিয়ে যাব। শয়তানী, তোর জন্যে বংশের ইজ্জত রইল না। অঙ্গামীরা, কোনিয়াকরা, চারপাশের বস্তির লোকেরা আমাদের দেখলেই গায়ে থুতু দিচ্ছে। উঠে আয়, উঠে আয় বলছি।

টেমে নটুঙ! আমি তো বললাম, যাব না। আর পনেরো দিন পর তেলেঙ্গা সু মাসে আমার বিয়ে হবে। সেঙাই আমার সোয়ামী হবে। সেঙাইকে ছেড়ে যাব না। তুই চলে যা বাপ, নইলে সেঙাই তোকে সাবাড় করে ফেলবে। বলতে বলতে সেঙাই-এর মুখের দিকে তাকাল মেহেলী। তার উজ্জ্বল তামাটে মুখখানা, স্বাস্থ্যপুষ্ট পেশল দেহটা এখন বড়ই কাহিল দেখাচ্ছে।

এই পাহাড়ী পৃথিবীর ক্রোধ বড় ভয়ঙ্কর এবং সর্বনাশা। তার প্রকাশও আকস্মিক। কখন কোন কথায়, কোন ঘটনায় এই বন্য আদিম মানুষগুলো জ্বলে উঠবে, আগে থেকে তার হদিস মেলে না। কিন্তু অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এখন খেপে উঠল সাঞ্চামখাবা। দাঁত খিঁচিয়ে বলতে লাগল, সোয়ামী! শব্দুরদের হুই সেঙাই শয়তানটা তোর সোয়ামী হবে! আপোটিয়া। হোক আনিজার গোসা, আজ তোকে আর হুই সেঙাইটাকে এখানেই খতম করে বস্তিতে ফিরব। খারে বর্শাটা মাথায় ওপর তুলে লক্ষ্য ঠিক করতে লাগল সাঞ্চামখাবা।

হা-আ-আ-আ–বর্শাটা ছুঁড়ে মারার ঠিক আগেই চেঁচাতে চেঁচাতে জোরি বংশের বাড়ি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ল জামাতসু। ছুটতে ছুটতে মেহেলীকে আড়াল করে দু হাত তুলে একটানা চিৎকার করতে লাগল।

সাঞ্চামখাবার হাতে বর্শাটা কেঁপে গেল।

উত্তেজনায়, আশঙ্কায় এবং লাফিয়ে এতটা পথ ছুটে আসার ধকলে সমস্ত দেহ থরথর কাঁপছে সারুয়ামারুর বউ জামাতসুর। জামাতসু গর্ভিণী। কয়েকদিনের মধ্যেই এই পাহাড়ে একটা বাচ্চার জন্ম দেবে। স্ফীত উদর, ভারী পাছা। স্তন দুটো টসটস করছে। তার আলস্যভরা চোখ থেকে এখন আগুনের হলকা ছুটছে। নিজের রক্তমাংস দিয়ে মাতৃকুক্ষিতে একটি প্রাণ। সযত্নে লালন করছে, এই পাহাড়কে একটা তাজা সজীব জীবন উপহার দেবে, সেই গৌরবে এবং দেমাকে গর্ভ হবার পর থেকেই সমস্ত গ্রামটায় কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সে হেঁটে বেড়াত। এখনকার জামাতসুর সঙ্গে সেই গর্ভধারণের গর্বে ভরপুর জামাতসুর কত তফাত!

জামাতসু হুমকে উঠল, শয়তানের বাচ্চারা, মেহেলীকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিস! সালুয়ালাঙ বস্তির সেরা মেয়েটার সঙ্গে এই কেলুরি বস্তির সেরা মরদটার বিয়ে হবে। তোদের তা সইছে না কেন রে রামখোরা? যা যা, হুই পাহাড়ের মাথা থেকে খাদে লাফিয়ে মর গিয়ে। টেটসে আনিজা তোদের ঘাড় মুচড়ে রক্ত খাক। নিজেরা লড়াই করে মেহেলীকে কেড়ে নিতে পারিস না, সঙ্গে করে আবার সায়েবদের এনেছিস! মুরোদ কত! প্রচণ্ড রাগে জামাতসু ফঁসে ফুঁসে উঠতে লাগল।

জোহেরি বংশের বাড়ি পুড়ছে। বাঁশের গাঁটগুলো শব্দ করে ফাটছে। টিলার মাথায় দাপাদাপি করতে করতে বসওয়েল অট্টহাসি হাসছে, হাঃ হাঃ হাঃ–হোয়ের ইজ গাইডিলিও? এই পাহাড়ের মাথায় মাথায় আমি আগুন লাগিয়ে দেব। দেখি কত দিন, ইয়াস, হাউ লঙ দ্যাট মিংক্স গাইডিলিওটা লুকিয়ে থাকতে পারে! হাঃ-হাঃ-হাঃ–

বিকট গলায় হাসতে হাসতে বসওয়েল মাথা ঘুরিয়ে এদিকে তাকাল। কিছুটা কৌতুকে এবং অভাবনীয় উল্লাসে তার চোখজোড়া জ্বলে উঠল। হাঁ করা মুখ থেকে বিস্ময়ের একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল, এঃ–

তারপরেই বসওয়েল চেঁচিয়ে উঠল, এহ, হোয়াট আ ফান! পাহাড়ীটা বর্শা দিয়ে তাক করছে। সামনে মাগীটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। লিভিং টার্গেট! হাউ ইন্টারেস্টিং! হোয়াট আ ফান!

জোহেরি কেসুঙের পাশ থেকে এলোপাথাড়ি পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বসওয়েল ছুটে এল। এই নাগা পাহাড়ে, এই বুনো প্যাগানদের দেশে তার জন্য এমন একটা বিস্ময়কর, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল, আগে কি কখনও তা কল্পনা করতে পেরেছিল সে? একটা পাহাড়ী মানুষ বর্শা দিয়ে চোখের সামনে জীবন্ত একটি মেয়েকে খুঁড়বে। কী মজা!

সেঙাইর মাথাটা উরুর ওপর রেখে দুহাত দিয়ে চেপে বিহ্বল হয়ে বসে রয়েছে মেহেলী। খানিক আগে জামাতসুই বুড়ো খাপেগাকে বলেছিল, মেহেলী আর সেঙাই বিয়ের আগে পরস্পরকে দেখেছে। পাহাড়ী প্রথা অনুযায়ী বিয়ের আগে ভাবী বর-বউর দেখাসাক্ষাৎ এবং কথা বলার কারণে যে অপরাধ হয়েছে তার ক্ষমা নেই। সেই মারাত্মক পাপাঁচরণের কথা জানাবার সঙ্গে সঙ্গে কঠিন কর্তব্যও বুড়ো খাপেগাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল জামাতসু। মেহেলীকে শাস্তি দিতে হবে। ভীষণ, নিষ্ঠুর শাস্তি।

তাজ্জবের ব্যাপার, সেই গর্ভিণী জামাতসুই এখন সাঞ্চামখাবার উদ্যত বর্শার সামনে মেহেলীর নিশ্চিত মৃত্যুকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। হতভম্ব হয়ে বসে থাকা ছাড়া মেহেলী কী-ই বা করতে পারে?

সাঞ্চামখাবা গর্জে উঠল, এই মাগী, ভাগ এখান থেকে।

আমি কেন ভাগব? তুই ভাগ শয়তানের বাচ্চা। আমাদের বস্তি থেকে তোরা সবাই ভাগ।

গর্ভবতী নারীকে আঘাত করা এই পাহাড়ের নীতিবিরুদ্ধ কাজ। এমন অপকর্ম কেউ করে বসলে তার শাস্তি হল মৃত্যু।

বর্শাটা মাথার ওপর থেকে নামিয়ে খ্যাপা বাঘের মতো ফুঁসতে লাগল সাঞ্চামখাবা। এই মাগী, বর্শার সামনে থেকে সরে বাচ্চা বিয়োতে যা।

কিছুতেই যাব না রে ধাড়ি টেফঙ। আমি জ্যান্ত থাকতে মেহেলীকে খুঁড়তে দেব না। তেলাঙ্গা সু মাসে মেহেলী সেঙাই-এর বউ হবে। তাকে কিনা ফুঁড়তে এসেছিস শয়তান! ইজা হুবুতা। জামাতসু খেঁকিয়ে উঠল।

নিরুপায় আক্রোশে সাঞ্চামখাবা চেঁচাতে লাগল, মেহেলী হবে মেজিচিজুঙের বউ। মেজিচিজুঙের বাপ রাঙসুঙের কাছ থেকে আমি বউপণ নিয়েছি। একটু দম নিয়ে আবার ফোসানি শুরু হল, আর মেহেলীর সঙ্গে বিয়ে হবে কিনা সেঙাই-এর! সরে যা মাগী। নইলে–

ভয়ানক ইঙ্গিত দিয়ে সাঞ্চামখাবা থেমে গেল।

লাফাতে লাফাতে সাঞ্চামখাবার পাশে এসে দাঁড়াল বসওয়েল। একসঙ্গে হাত-পা-মাথা নেড়ে প্রচুর উৎসাহ দিতে লাগল সাঞ্চামখাবাকে, ইয়াস, জাস্ট থ্রো দা স্পিয়ার। অ্যামুজিঙ ইমপালসিভ গেম, আই সী। থ্রো–

সাদা ধবধবে সাহেবটা বিজাতীয়, দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বিমূঢ়ের মতো বসওয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সাঞ্চামখাবা।

আশ্চর্য! খাড়া টিলাটা বেয়ে কখন যে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি ওপরে উঠে এসেছে, কারো খেয়াল ছিল না। কণ্ঠার হাড়ের ফাঁকে লম্বা বাঁকা বর্শার ফলা গেঁথে গিয়েছিল। সেটাকে টেনে খুলে ফেলেছে সে। সাদা সারপ্লিসটা রক্তে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। মিশনারির প্রাণ, বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির জীবন, না না, অনেককাল আগের আবছা অতীতের নেপথ্যে ব্রেটনব্রুকশায়ারের এক ভয়ঙ্কর আউট লর প্রাণ বড় কঠিন। নাগা পাহাড়ের একটা বর্শার ফলা সেই প্রাণকে চিরকালের জন্য থামিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট নয়।

সাঞ্চামখাবাকে সমানে উৎসাহ দিয়ে চলেছে বসওয়েল, ছোড় ছোড়, বেশ তাক করে বর্শাটা ছোড় দিকি। দেরি কোরো না।

পাশ থেকে ম্যাকেঞ্জি বলল, না না মিস্টার বসওয়েল, বর্শা ও ছুঁড়তে পারে না।

হোয়াই? ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক বিস্ময়ে বসওয়েল বলল, আই সী, আপনি বেঁচে আছেন! আমি মনে করেছিলাম, মারা গেছেন।

ম্যাকেঞ্জি অদ্ভুত হাসল। সে হাসিতে ক্ষোভ জ্বালা আত্মপ্রসাদ আর দম্ভ সূক্ষ্মভাবে মিশে রয়েছে। স্থূল মানসিক বৃত্তির মানুষ বসওয়েল। তার পক্ষে ম্যাকেঞ্জির হাসির কারণগুলি বিশ্লেষণ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এমন চেষ্টাও সে করল না।

ম্যাকেঞ্জি বলতে লাগল, মিশনারির জীবন, বিশেষ করে আমার মতো মিশনারির প্রাণ এই নাগা পাহাড়ের একটা বর্শার ঘায়েই যদি শেষ হয়ে যায় তা হলে এখানে ব্রিটিশ রুল কদিন টিকবে বলতে পারেন মিস্টার বসওয়েল? একটু থেমে, যাক, যে কথা বলেছিলাম। স্পিয়ার ও ছুড়বে না।

কেন, কেন? হোয়াই? অনেকটা কাছাকাছি এগিয়ে এল বসওয়েল। তার মুখেচোখে ঔৎসুক্য ফুটে বেরিয়েছে।

ওদের প্রথা আছে, গর্ভিণী মেয়েদের গায়ে কেউ আঘাত করে না। তা সে যত শক্রই হোক। এই রীতি ওরা কিছুতেই অমান্য করবে না।

পাহাড়ী বিস্টগুলোর আবার নিয়ম টিয়ম আছে নাকি? স্ট্রেঞ্জ!

স্ট্রেঞ্জ বলে কিছু নেই মিস্টার বসওয়েল। পৃথিবীর সব জায়গাতেই নিয়ম রয়েছে। সব দেশের সব সমাজই তাদের নিজের নিজের প্রথা অনুযায়ী চলছে। এই নাগাদেরও নিজস্ব আইনকানুন, সামাজিক রীতিনীতি, আচার বিচার, শাসন শাস্তি থাকাই তো স্বাভাবিক।

আশ্চর্য! আমার ধারণা ছিল প্রিমিটিভ বর্বরদের সামাজিক বোধই নেই, সুশৃঙ্খল রীতিনীতি তো দূরের কথা।

মৃদু হেসে ম্যাকেঞ্জি বলল, এদের সামাজিক বোধ, আচার বিচার, আমাদের সভ্য মানুষদের চেয়ে অনেক সময় ভালো এবং শ্রেয় ছাড়া মন্দ নয়। সেসব কথা পরে হবে। বিকেল হয়ে আসছে। ঝপ করে রাত্রি নামবে। এখনই এই গ্রাম থেকে আমাদের চলে যাওয়া দরকার। রাত্রি হলে কোথায় কী ঘটে যাবে! জন্তু-জানোয়ার আছে। তা ছাড়া, বন্দুকের ভয়ে পাহাড়ীগুলো জঙ্গলে পালিয়েছে। অন্ধকারে হঠাৎ অ্যাটাক করে বসলে বেঘোরে মারা পড়তে হবে। সমস্ত গ্রাম তো জ্বালালাম, গুলি চালালাম, তছনছ করে খুঁজলাম কিন্তু গাইডিলিওকে পাওয়া গেল না। শয়তানীটা নিশ্চয়ই আমাদের গন্ধ পেয়েই পালিয়েছে। চলুন, ওই সালুয়ালা গ্রামেই ফিরে যাই। ওরা আমাদের নুন খেয়েছে। কখনই বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। ওদের কাছে নিরাপদে থাকা যাবে। কাল সকালে কোহিমা ফিরব।

ঠিক আছে।

সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার ছুটে এল ম্যাকেঞ্জির কাছে। আজ বিশেষ রকমের সাজসজ্জা করেছে সে। শত্রুপক্ষের গ্রাম কেলুরিতে অভিযান চালাবে। তাই আরি পী কাপড় পরেছিল। সেই কাপড়ে চিতাবাঘের মাথা, মানুষের কঙ্কাল, বুনো মোষের শিঙ এবং অজগরের মাথা আঁকা রয়েছে। মাথার মুকুটে হরিণের শিঙ ও ইবাতঙ পাখির পালক গুঁজেছিল। পায়ে বাঘের হাড় বাঁকিয়ে গোল করে পরেছে। কবজিতে হাতির চামড়ার পটি। দাঁতাল শুয়োরের অনেকগুলো দাঁত গলায় ঝুলিয়েছে, ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে। মাথার তামাটে চুলগুলো সাপের চামড়ার ছিলা দিয়ে আঁটো করে বাঁধা। গা থেকে মিশ্র, উগ্র দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। এক থাবায় বিরাট সুচেন্যু, আর এক থাবায় লম্বা বর্শা। সর্দার বলল,হু-হু– ফাদার, হুই যে মেহেলীটা বসে রয়েছে। ওটার কোলে সেঙাই শয়তান শুয়ে আছে। তুই একবার বল, আমরা মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে যাই।

যাও, নিয়ে যাও তোমাদের মেহেলীকে। সালুয়ালাঙের সর্দারের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলল, কি সর্দার, খুশি তো?

হু-হু—

তোমরা তোমাদের মেহেলীকে পেলে। আমরা কিন্তু গাইডিলিওকে পেলুম না।

কী করব ফাদার, আমি তো ঠিক খবরই দিয়েছিলাম। ডাইনিটা যে এমন করে ভাগবে, কী করে জানব?

ঠিক আছে। এবার না হয় ভেগেছে। কতবার আর ভাগবে ডাইনিটা! তোমরা তাকে তাকে থাকবে। খবর পেলেই কোহিমায় চলে যাবে। গাইডিলিও ডাইনিটাকে ধরতেই হবে।

হু-হু, গাইডিলিও ডাইনির খবর পেলেই তোকে বলে আসব কোহিমায়। তোর নিমক খেয়েছি, টাকা কাপড় নিয়েছি। নিমকহারামি করব না।

মনে থাকে যেন। মেহেলীকে নিয়ে তোমাদের গ্রামে চল। ম্যাকেঞ্জির গলাটা বড়ই উদার শোনাল। নির্বিকার ভঙ্গিতে নির্দেশ দিয়ে বসল সে।

আর সাঁ করে ঘরে দাঁড়াল সালুয়ালা গ্রামের সর্দার। তার কুতকুতে ঘোলাটে চোখজোড়া নানাকোয়া ও সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেদের মুখের ওপর দিয়ে সরে সরে যেতে লাগল। ধারাল সুচেনুটা নামিয়ে রেখে ডান হাত দিয়ে বুকের ওপর গোটা কয়েক চাপড় বসিয়ে দিল সে। তারপর চিৎকার করে উঠল, যা জোয়ানের বাচ্চারা, হুই মেহেলী মাগীকে ছিনিয়ে আমাদের বস্তিতে নিয়ে যা।

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—

আকাশ-ফাটানো শোরগোল শুরু হল।

তারপরেই জনকয়েক জোয়ান ছেলে মেহেলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জামাতসু বাধা দিতে এগিয়ে এসেছিল। তাকে ধাক্কা মেরে, গুতিয়ে এক পাশে ফেলে দিয়েছে একটা জোয়ান। দুহাতের কঠিন বাঁধনে সেঙাইকে জড়িয়ে, তার বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে মেহেলী। নিমেষে সেঙাই-এর বুক থেকে মেহেলীকে ছিনিয়ে কাঁধের ওপর তুলে নিল জোয়ানেরা। উতরাই বেয়ে তারা ছুটল টিজু নদীর দিকে। একটা ভয়ঙ্কর পাহাড়ী ঝড় যেন ছুটে চলেছে।

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—

হোয়া-য়া য়া-আ-আ—

তুমুল উল্লসিত চিৎকার আকাশের দিকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগল।

প্রাণ-ফাটা আর্তনাদ করে উঠল মেহেলী। সে আর্তনাদে ছয় আকাশ, ছয় পাহাড় এবং বন ঝরনা-প্রপাত দিয়ে ঘেরা এই নাগা পাহাড়ের হৃৎপিণ্ডটা যেন শিউরে উঠল। মেহেলীর আর্তনাদ জোয়ানদের সঙ্গে সঙ্গে যেন ছুটে চলেছে, আ-উ-উ-উ-উ—আমি যাব না। শয়তানের বাচ্চারা, আনিজা ঘাড় মটকে তোদের রক্ত খাবে, খাদে ফেলে মারবে। আ-উ-উ-উ-উ–

হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

হো-য়া-য়া-য়া-য়া-য়া-আ-আ–

নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের জোয়ানদের উল্লসিত হল্লা দু’পাশের পাহাড়ে আছাড় খেতে খেতে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

টিজু নদীর দিকে মেহেলীর আর্তনাদ মিলিয়ে গেল। জোহেরি কেসুঙের পাথুরে উঠোন থেকে নির্জীব চোখে সেদিকে তাকিয়ে ছিল সেঙাই। কবজি ফুঁড়ে অনেক রক্ত ঝরেছে। অসহ্য যন্ত্রণার পর শরীরের বোধগুলি যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। হাত-পায়ের জোড়গুলো খুলে খুলে যাচ্ছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সেঙাই। তবু সে পাহাড়ী মানুষ। এদের আদিম দুর্দান্ত প্রকৃতি কবজির ক্ষত-মুখ দিয়ে খানিকটা রক্তপাতের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। শিরায় শিরায় হাড়-মেদ রক্তে যে বন্য হিংস্র প্রাণ প্রবল গতিবেগে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে, সেটা এই মুহূর্তে উত্তেজনায় আক্রোশে প্রতিহিংসায় ফুঁসে ফুঁসে উঠতে লাগল। কোনোরকমে কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসল সেঙাই। মাথা টলছে, শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। যন্ত্রণা এবং রাগে মুখখানা বিকৃত দেখাচ্ছে। বাঁ হাত বাড়িয়ে পাশের বর্শাটাকে তুলে নিল সে, তারপর শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সাঞ্চামখাবার দিকে ছুঁড়ে মারল। দুর্বল, অশক্ত দেহ। বর্শাটা সাঞ্চামখাবার ধারে কাছে পৌঁছল না।

সাঞ্চামখাবা বিকট শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ইজা হুবতা! দ্যাখ দ্যাখ, সেঙাই। শয়তানটা বর্শা ছুড়ছে। কী তাগদ, আমার গায়ে ছোঁয়াতেই পারল না, আবার কুঁড়বার মতলব? বিড়বিড় করে অশ্রাব্য গালাগালি করতে করতে লুটিয়ে পড়ল সেঙাই। বসে থাকতে পারছে সে, কিন্তু চোখজোড়া জ্বলছে।

সাঞ্চামখাবা আঙুল বাড়িয়ে সেঙাইকে দেখিয়ে লাফাতে লাগল। হাসতে হাসতে চেঁচাল, রামখোর বাচ্চাটা বর্শা ছুঁড়েই কাত হয়ে পড়েছে। হিঃ হিঃ হিঃকী জোয়ান রে!

ডান হাতের কবজি কুঁড়ে একটা গুলি বেরিয়ে গিয়েছে। সেই রক্তাক্ত, চূর্ণ, বিচূর্ণ শক্তিহীন হাতটার দিকে তাকিয়ে সেঙাই ককিয়ে উঠল, আ-উ-উ-উ-উ–আ-উ-উ-উ-উ—

.

বসওয়েল বলল, সমস্ত গ্রাম ঢুঁড়েও তো গাইডিলিওকে পাওয়া গেল না। এবার কী করা দরকার ফাদার?

ম্যাকেঞ্জি বলল, আপাতত আমরা ওই সালুয়ালা গ্রামে যাব। তার আগে সেঙাইটাকে বেঁধে নেওয়া দরকার। ওর সঙ্গে গাইডিলিওর নিশ্চয়ই যোগাযোগ রয়েছে। ওটার কাছ থেকে অনেক খবর পাওয়া যাবে, মনে হচ্ছে।

আর ইউ সুয়োর?

নিশ্চয়ই। আমার কথা বর্ণে বর্ণে মিলিয়ে নেবেন।

কী করে বুঝলেন সেঙাই-এর সঙ্গে গাইডিলিওর যোগাযোগ রয়েছে?

এটা কিন্তু পুলিশ সুপারের মতো কথা হল না মিস্টার বসওয়েল। গাইডিলিও এই গ্রামে ছিল। এ ব্যাপারে আমার এতটুকু সন্দেহ নেই। তা ছাড়া সেঙাই নিজেই তো বলেছে, কোহিমায় ও যখন গিয়েছিল, আমরা ওকে ঠেঙিয়েছি, গাইডিলিও ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবেই বুঝুন, আমরা স্বাভাবিক নিয়মেই সন্দেহ করতে পারি, গাইডিলিওর সঙ্গে এই গ্রাম আর সেঙাই-এর নিবিড় যোগ আছে। সন্দেহ যখন হয়েছে, একেবারে শেষ পর্যন্ত দেখাই যাক না। সেঙাইকে খুঁচিয়ে, পিটিয়ে কিংবা ভালো কথা বলে এই হিল অ্যাজিটেশনের খবর জোগাড় করতেই হবে। শান্ত, দৃঢ় গলায় কথাগুলো বলে বিডস জপতে লাগল ম্যাকেঞ্জি।

শ্রদ্ধায় সম্ভ্রমে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল বসওয়েল। এবার ফিসফিস করে বলল, আমি অতটা তলিয়ে দেখিনি। আপনি সত্যিই আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। তারপরেই ডান দিকে ঘুরে বসওয়েল হুঙ্কার ছাড়ল, চ্যাটার্জি, ওই শুয়ারের বাচ্চা সেঙাইটাকে আমাদের সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা কর।

শিকারি কুকুরের মতো টিলার শেষ প্রান্তে ছুটে গেল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। কোমরের বেল্টটাকে সামলাতে সামলাতে মণিপুরী পুলিশগুলোর দিকে তাকিয়ে চেঁচাল, ওটাকে কাঁধে তুলে নাও।

কয়েকটি মণিপুরী পুলিশ সেঙাই-এর রক্তাক্ত দেহটার দিকে এগিয়ে গেল।

এতক্ষণ একেপাশে দাঁড়িয়ে সাহেব আর পুলিশের ভাবগতিক লক্ষ করছিল জামাতসু। সেঙাইকে কাঁধের ওপর তোলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশগুলোর ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলতে লাগল, না না, আমাদের বস্তির সেঙাইকে তোরা ফুঁড়েছিস। ওকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেব না, কিছুতেই না।

ধারাল দাঁত এবং তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে কামড়ে আঁচড়ে পুলিশদের জামা ছিঁড়ে ফেলল জামাতসু। গা-হাত কেটে ফেঁড়ে একাকার করে দিতে লাগল। পুলিশগুলো আকস্মিক আক্রমণে বিহ্বল এবং হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল। ওপাশ থেকে বসওয়েল দৌড়ে এল। বিরাট থাবায় জামাতসুর চুলের গোছা শক্ত করে ধরে পুলিশদের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, ওম্যান, ডোন্ট ডু সো।

পিঙ্গল চোখ দুটো রক্তাভ হয়ে উঠেছে জামাতসুর। বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে। রাগে উত্তেজনায় সমস্ত দেহ দুলছে, কাঁপছে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। পুলিশ সুপার বসওয়েলের চোখেমুখে কী এক ছায়া দেখে জামাতসু হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ইজা বুতা! চেঁচাতে চেঁচাতেই বসওয়েলের বুকের ওপর লাফিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল।

চুলের গোছা ধরাই ছিল। এক টানে জামাতসুকে বুক থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দাঁতে দাঁত পিষল বসওয়েল। চোখ দুটো জ্বলছে। চিবিয়ে চিবিয়ে নির্মম গলায় সে বলল, ওম্যান, ইউ আর প্রেগনান্ট। পাহাড়ী রীতিতে তোমার গায়ে হাত তুলতে বাধে। বাট আই অ্যাম ব্রিটিশার, নো হিল বিস্ট। তুমি আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছ। আমার জ্ঞানে এবং বিচারে এ রীতিমতো অপরাধ। অ্যান্ড ফর দ্যাট–বলতে বলতেই গর্ভিণী জামাতসুর স্ফীত পেটে ভারী বুটের প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দিল।

আর্তনাদ করে পাথুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জামাতসু, আ-উ-উ-উ-উ–

সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরী পুলিশদের কাঁধের ওপর থেকে সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, শয়তানের বাচ্চা জামাতসুকে খতম করে ফেলল। ওটাকে সাবাড় কর।

বসওয়েলকে সাবাড় করবার মতো সবল, শক্তিমান একটা পাহাড়ী জোয়ানও আশেপাশে নেই।

রক্তের সমুদ্রে ছটফট করছে জামাতসু। গড়াগড়ি দিতে দিতে তার দেহটা কখনও ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে, পরক্ষণেই টান টান হচ্ছে। খানিক পর একেবারেই থেমে গেল জামাতসু, পুরোপুরি নিস্পন্দ হয়ে গেল।

আর বসওয়েল উন্মাদ গলায় অট্টহাসি হাসছে, হাঃ-হাঃ-হাঃ–

ওপাশ থেকে সালুয়ালাঙের সর্দার গর্জে উঠল, ইজা বু! শয়তানের বাচ্চা সায়েব, তুই পোয়াতি মাগীকে খতম করলি! আমাদের ওপর আনিজার গোসা হবে না? বলেই বর্শা তুলে তাক করল।

ম্যাকেঞ্জি চিৎকার করে উঠল, বর্শা ছুড়ো না সর্দার, খবরদার। সায়েব তো ভালোই করেছে। তোমাদের শত্রুকে খতম করেছে।

আহে ভু টেলো! শর বলে পোয়াতি মাগীকে সাবাড় করবে! এ পাপ সইব না। শয়তানের বাচ্চাটাকে ছুঁড়বই। বর্শাটা ছোঁড়ার উদ্যোগ করল সালুয়ালাঙের সর্দার।

কিন্তু তার আগেই বসওয়েলের রিভলভার থেকে এক ঝলক নীল আগুন ছুটে গেল, বু-ম্‌-ম্‌-ম্‌–

পাঁজরে হাত চেপে বিকৃত আর্তনাদ করে দুমড়ে মুচড়ে পাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সালুয়ালাঙের সর্দার।

নানকোয়া আর সালয়ালা গ্রামের জোয়ানরা মেহেলীকে নিয়ে অনেক আগেই টিজু নদীর দিকে চলে গিয়েছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল মেহেলীর বাপ সাঞ্চামখাবা, রাঙসুঙ এবং মেজিচিজুঙ। কেউ কিছু করার বা বলার আগে তিনজনে লাফ দিয়ে টিলার মাথা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ল। সেখান থেকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বসওয়েল আবার অমানুষিক অট্টহাসি জুড়ে দিল, হাঃ-হাঃ-হাঃ–আমাকে বর্শা হাঁকাতে চায় পাহাড়ী কুত্তাটা! গ্রেট ওয়ার–

থামুন। ভয়ানক গলায় ধমক দিল ম্যাকেঞ্জি, কী সর্বনাশটা করলেন বলুন দিকি?

বসওয়েলের হাসি থেমে গিয়েছে। কঠিন গলায় টেনে টেনে সে বলল, কী সর্বনাশ করলাম?

পাহাড়ীটাকে ছুঁড়ে আমাদের ইন্টারেস্টের দিক থেকে কত ক্ষতি হল জানেন? কুঞ্চিত চোখে তাকিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলতে লাগল, ওর কাছ থেকে গাইডিলিওর খবর পাওয়া যেত। একে তো সমস্ত নাগা পাহাড়টা আমাদের ওপর খেপে রয়েছে। ভালোভাবে প্ৰিচ করতে পারছি না। তার ওপর লয়াল পাহাড়ীদের খুন করলে উপায় থাকবে? একটু ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে কাজ করতে হয়।

রিভলভারের মাথায় আঙুল ঠুকতে ঠুকতে বোকা বোকা মুখ করে বসওয়েল বলল, কিন্তু শয়তানটা যে বর্শা ছুড়ত!

ছুড়ত না। আমি ছুঁড়তে দিতাম না। যদি ছুড়ত আপনি মরতেন। ওকে মেরে হয়তো আপনার প্রাণ বাঁচল, কিন্তু ওটা বেঁচে থাকলে গাইডিলিওকে তাড়াতাড়ি ধরা যেত, নাগা পাহাড়ে ব্রিটিশ রুল আরো জাঁকিয়ে বসত। যাক, এমন ভুল আর কক্ষনো করবেন না মিস্টার বসওয়েল। সবসময় খুনখারাপিতে কাজ হয় না। এই তো সেঙাই আমাকে বর্শা দিয়ে জখম করল। আমি ওকে মারলাম? না, ওকে মারবই না। ওর কাছ থেকে গাইডিলিওর খবর আদায় করতে হবে না?

নিচের দিকে মাথাটা ঝুলিয়ে অল্প অল্প নাড়তে লাগল বসওয়েল। ম্যাকেঞ্জির প্রতি শ্রদ্ধার মাত্রাটা হঠাৎ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে সে বলল, আমি অতটা তলিয়ে দেখিনি।

দুর্বোধ্য হাসি হাসল ম্যাকেঞ্জি। সেই সঙ্গে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বলল, মানুষ মাত্রেরই ভুলচুক হয় মিস্টার বসওয়েল। যা হবার হয়ে গেছে। এখনই কোহিমা ফিরতে হবে। সালুয়ালাঙে তো যাবার উপায় নেই। পাহাড়ী তিনটে ছুটে পালাল। মেরেছিলেন যখন, ওই কটাকেও যদি শেষ করতেন। যাক, নির্ঘাত ওরা তোক ডেকে আনবে। ওরা এসে পড়ার আগেই আমাদের সরে পড়তে হবে। কুইক।

.

৪৭.

সমস্ত রাত বেহুশ হয়ে ছিল সেঙাই। যখন জ্ঞান ফিরল, কোহিমা পাহাড়ের আকাশ থেকে সাঙসু ঋতুর তাপহীন বিকেলটা নিভে আসতে শুরু করেছে। আকাশ সাঁতার ক্লান্ত পাখিদের ঝক কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেঙাই চোখ মেলল। চোখজোড়া টকটকে লাল। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। সব ঝাপসা, ছায়া ছায়া। অনেকক্ষণ পর ঘোরটা সামান্য কেটে গেলে শিউরে উঠল। বুকের মধ্যে ভীতি, শঙ্কা এবং উত্তেজনা কিলবিল করে ছুটতে লাগল যেন।

কোহিমা থেকে ডিমাপুরের দিকে পুলিশ ভ্যানটা সাঁ সাঁ ছুটছে। মাঝখানে সেঙাই শুয়ে রয়েছে। আশেপাশে জনকয়েক পাহাড়ী জোয়ান হাঁটু গুঁজে দলা পাকিয়ে বসে আছে। লোহার বেড়ি দিয়ে তাদের হাত-পা বাঁধা। কারো মাথার খুলি ফাটা, কারো উরু ভেদ করে গুলি বেরিয়ে গিয়েছে। কারো আবার ধারাল বেয়নেটের খোঁচা লেগে খাবলা-খাবলা মাংস উঠে গিয়েছে। পাহাড়ী জোয়ানগুলির শরীরে জমাট বাঁধা রক্ত।

ঘোর ঘোর দৃষ্টিটা সকলের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল সেঙাই। চেনাজানা একজনও বেরুল না। তাদের কেলুরি গ্রামের একটা মানুষও নেই পুলিশ ভ্যানটার মধ্যে।

এবার নিজের ডান হাতের কবজিটার দিকে তাকাল সেঙাই। তাকিয়েই চমকে উঠল। ক্ষতমুখে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে রয়েছে। কাধ পর্যন্ত সমস্ত হাতখানা অস্বাভাবিক ফুলেছে। ক্ষতমুখ থেকে লালচে বিষাক্ত রস ঝরছে। অসহ্য যন্ত্রণায় দেহ থেকে হাতখানা যেন খসে পড়বে। নির্জীব গলায় সেঙাই আর্তনাদ করে উঠল, আ-উ-উ-উ-উ, আ-উ-উ-উ-উ—

জনকতক পুলিশ জোয়ানগুলোকে ঘিরে বসেছে। তাদের হাতে রাইফেল, রাইফেলের মাথায় বেয়নেটের শাণিত ফলাগুলো কী হিংস্র!

সামনের দিকে উবু হয়ে বসেছে বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। তার পাশে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। ম্যাকেঞ্জির কণ্ঠায় সেঙাই-এর বর্শা গেঁথে গিয়েছিল। এখন সেখানে মোেটাসোটা বিরাট এক ব্যান্ডেজ।

তার-আঁটা জানলার ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল সেঙাই। কিছুদিন আগে সারুয়ামারুর সঙ্গে এই কোহিমা পাহাড়ে এসেছিল, সে স্মৃতিটা এখনও টাটকা।

ডিমাপুরগামী এই পথটার পাশে বিকিকিনি, লেনদেনের বাজার বসিয়েছে সমতলের বাসিন্দারা। সারুয়ামারু এখানে নিয়ে এসেছিল তাকে। মাথোলালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেঙাই-এর। মাধোলাল! অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প বলত সে। আসাদের সর্দার গান্ধির গল্প, রানী গাইডিলিরও গল্প। ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ের ওপারে অজানা দেশের বিচিত্র সব মানুষের, তাদের বিস্ময়কর জীবনযাত্রা, রীতিনীতি এবং আচার আচরণের গল্প বলত। রহস্যময় দুর্বোধ্য নেশায় সেঙাই বুঁদ হয়ে থাকত।

হঠাৎ দৃষ্টিটা চমকে উঠল সেঙাই-এর। ডেমাপুরগামী সড়কের সেই বাজারটার চিহ্নমাত্র নেই। সমতলের বাসিন্দারা, তাদের চাল-ডাল-নুন, তেল-হেরিকেন থেকে শুরু করে নানা মনিহারী পণ্যসম্ভার কি এক ভোজবাজিতে উধাও হয়েছে। মাধোলালের সেই দোকানটা, বাঁশের মাচান, টিনের চাল, কাঠের দেওয়াল ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে রয়েছে। শুধু মাথোলালের দোকানই নয়, সমতলের বাসিন্দাদের এই বাণিজ্যমেলাকে দলে পিষে ভেঙে মুচড়ে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।

বিড়বিড় গলায় সেঙাই বলল, মাধোলাল, মাধোলাল–

আঁকাবাঁকা পথটা ধরে, কখনও টিলার ওপর দিয়ে, কখনও পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে নিবিড় বনভূমি চিরে চিরে এগিয়ে চলেছে পুলিশ ভ্যানটা। কখনও সড়কটা দোল খেয়ে সামনের দিকে নেমে গিয়েছে, আবার খাড়া চড়াই বেয়ে ওপরের দিকে উঠেছে। চোখের সামনে থেকে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে জলপ্রপাত, ঘন বন, ঝরনা, টিলা, খাদ।

বাইরে থেকে দৃষ্টিটাকে ভ্যানের মধ্যে নিয়ে এল সেঙাই। ধারাল কটা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ম্যাকেঞ্জি। নির্বিকার ভঙ্গিতে বিডস জপে চলেছে।

বাঁ হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল সেঙাই। কিন্তু যন্ত্রণায় সমস্ত শরীরটা যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। সামান্য ঝাঁকানি লেগে মনে হল, ডান হাতটা বুঝি ছিঁড়ে পড়বে। আধাআধি উঠেই আবার শুয়ে পড়ল সেঙাই।

ম্যাকেঞ্জি বলল, কি সেঙাই, ঘুম ভাঙল?

প্রথমে জবাব দিল না সেঙাই। একটু পর দুর্বল গলায় গর্জে উঠল, ইজা হুবতা! এই শয়তানের বাচ্চা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

বিচিত্র এক হাসির মহিমায় মুখখানা ভরে গেল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির। আশ্চর্য শান্ত গলায় সে বলল, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি সালুয়ালাঙ বস্তিতে। তোমার সঙ্গে যে আজ মেহেলীর বিয়ে হবে।

সব মিছে কথা। সালুয়ালাঙ তো আমাদের কেলুরি বস্তির পাশে। আর এটা তো কোহিমা শহরের পথ। বলে একটু দম নিয়ে সেঙাই ফের বলল, সালুয়ালাঙের সদ্দারকে সাবাড় করেছিস। তাদের বস্তিতে গেলে তোদের খতম করবে।

বিন্দুমাত্র ভাবান্তর ঘটল না ম্যাকেঞ্জির। মুখের হাসিটা স্থানচ্যুত হল না। অস্ফুট গলায় স্বগত ভঙ্গিতে বলতে লাগল সে, নাড়িজ্ঞান একেবারে টনটনে। শয়তানটা ঠিক টের পেয়েছে এটা সালুয়ালাঙে যাবার পথ নয়।

সেঙাই চেঁচাল, আহে ভু টেলো! তোদের খুব ফুটানি হয়েছে। আমাকে ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস সেই কথাটা বল না টেফঙের বাচ্চা। দাঁড়া, হাতটা একটু ভালো হতে দে। তোদের সব সদ্দারি বর্শা হাঁকড়ে লোপাট করব। একবার বর্শা দিয়ে তোর গলা কুঁড়েছিলাম, তখন তুই মরিসনি। এবার তোকে নিঘাত খুন করব।

মুখের একটা রেখাও বিকৃত হল না ম্যাকেঞ্জির। জপমালার গায়ে আঙুলগুলো এতটুকু বিচলিত হল না। ধীর, শান্ত গলায় সে বলল, আমাকে খুন করতে চাইছ সেঙাই? খুব ভালো, খুব ভালো। কিন্তু হাতটা জখম হয়ে রয়েছে। এখন তো পেরে উঠবে না। ওষুধ দিয়ে হাতটা সারিয়ে একটা বর্শা দেবখন। তখন আমাকে ছুঁড়ো। তার আগে একটা কথা জিগ্যেস করি। ঠিক ঠিক জবাব দাও দিকি। বলতে বলতে মুখখানা কানের কাছে নামিয়ে আনল ম্যাকেঞ্জি। বলল, মেহেলীর জন্যে মনটা খুব খারাপ লাগছে, তাই না সেঙাই?

হু-হু– সেঙাই মাথা নাড়ল।

সত্যিই তো, মন খারাপ হবার কথাই। কিন্তু উপায় কী? মুখখানায় একটা খাঁটি জাতের বিমর্ষ ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল ম্যাকেঞ্জি।

আচমকা দুর্বল দেহের অবশিষ্ট শক্তি কোমরে একত্র করে উঠে বসল সেঙাই। হাউ হাউ করে ডুকরে উঠল, তুই আমাকে মেহেলীর কাছে দিয়ে আয় সায়েব।

মেহেলীর কাছে যেতে চাইছ?

হু-হু—

মেহেলীর কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে আর একজনের কাছে নিয়ে যাবে। যদি তার কাছে নিয়ে যেতে পার তা হলে মেহেলীর সঙ্গে তেলেঙ্গা সু মাসেই তোমার বিয়ে দেব। বলতে বলতে চোখ দুটো তীক্ষ্ণ করে সেঙাই-এর মুখের ভাবভঙ্গি লক্ষ করতে লাগল ম্যাকেঞ্জি।

কে সে? কার কাছে তোকে নিয়ে যাব?

ম্যাকেঞ্জির মুখে স্বৰ্গীয় হাসি ফুটল, তোমাদের ওই রানী গাইডিলিওর কাছে। আমার বড় ব্যারাম হয়েছে। সে ছুঁয়ে দিলে সেরে যাবে।

সন্দিগ্ধ চোখে ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকিয়ে সেঙাই বলল, তুই তো রানীকে ডাইনি বলিস। তার কাছে যে আবার ব্যারাম সারাতে চাইছিস!

তোমাকে রাগাবার জন্যে বলি। ওসব কথা থাক, তুমি আমাকে রানীর কাছে নিয়ে চল।

রানীকে কোথায় পাব? সে আমাদের বস্তি থেকে চলে গেছে।

তবে মেহেলীকেই বা আমি কোথায় পাব? সে তো নাগা পাহাড় থেকে ভেগেছে।

সেঙাই হুমকে উঠল, ইজা হুবতা! তোকে বর্শা দিয়ে ফুড়ব। তুই আমাকে বস্তিতে রেখে আয়।

বস্তিতে ফিরতে চাও? ঠিক আছে, আট বছর পর ফিরো। কেমন? ম্যাকেঞ্জির কণ্ঠ বড় স্নেহময় শোনাল।

আট বছর! আট বছর আমি কোথায় থাকব?

শিলং পাহাড়ে।

শিলং পাহাড়ে যাব না, কিছুতেই না। সেঙাই ফুঁসে উঠল।

কী মুশকিল! সেখানে তোমার জন্যে একখানা ঘর তৈরি করে রেখেছি যে। না গেলে কি চলে? বিরক্ত হতে হতে নিজেকে সামলে নিয়ে, হেসে ফেলল ম্যাকেঞ্জি।

শিলং! নামটা এর আগেও বারকয়েক শুনেছে সেঙাই। মাথোলাল, সারুয়ামারু এবং তার বাপ সিজিটো তাকে বলেছে। ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ের ওপারে কোথায় শিলং নামের অদ্ভুত রহস্যময় দেশটা রয়েছে, অতশত খবর জানে না সেঙাই। শিলং তার অস্ফুট মনটাকে দুর্বোধ্য আকর্ষণে হয়তো টেনেছে। আগে ওই জায়গাটার জন্য কিছুটা কৌতূহলও তার হয়ে থাকবে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে শিলং সম্বন্ধে তার কোনো মোহ নেই, কৌতূহল থাকলেও উবে গিয়েছে।

অপরিণত মন দিয়ে সেঙাই অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে, মাধোলাল, সারুয়ামারু কি তার বাপ সিজিটোর শিলংয়ের সঙ্গে ম্যাকেঞ্জির শিলংয়ের বিন্দুমাত্র মিল নেই। ম্যাকেঞ্জির শিলংয়ের সঙ্গে দুর্বোধ্য বিভীষিকা এবং আশঙ্কা যেন জড়িয়ে রয়েছে। সেখানে গেলে সে আর বাঁচবে না। নির্ঘাত মরে যাবে। আনিজার গোসা এসে পড়বে। শিলং পাহাড়ে সে যাবে না, কিছুতেই না। মেহেলীকে ছেড়ে, নিজেদের বন্ধুবান্ধব প্রিয়জন, কেলুরি গ্রামের চারপাশের নদী, বনভূমি, ফসলের খেত এবং শিকারের সঙ্গী, সবার ওপর অভ্যস্ত বন্য জীবন ছেড়ে অজানা শিলং পাহাড়ে আটটা বছর কাটাতে হবে! ভাবতেও মনটা অসাড় হয়ে আসে।

নাগাপাহাড় তাকে সব দিয়েছে। আলো বাতাস দিয়েছে, ঝরনার জল দিয়েছে, স্বাস্থ্য-খাদ্য আয় দিয়েছে। মা বাপ-ভাই-বোন, পিরিতের জোয়ানী থেকে শুরু করে নগদা উৎসব, ফসল বোনার উৎসব, জঙ্গল কাটার উৎসব, শিকারের জন্য হিংস্র জানোয়ার, পাহাড়ী আরণ্যক মানুষের বেঁচে থাকার মতো প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণই দিয়েছে। না না, চিরকালের চেনা জগৎ ছেড়ে সে কোথায়ও যাবে না।

সেঙাই চিৎকার করে উঠল, আমি যাব না, কিছুতেই যাব না শিলং পাহাড়ে। আমাকে ছেড়ে দে সায়েব, বস্তিতে ফিরে যাই।

ম্যাকেঞ্জি কিছুই বলল না। শুধু সেই অপার্থিব হাসিটুকু সমস্ত মুখে স্থির করে রাখল।

পাহাড়ী সড়ক বেয়ে পুলিশ ভ্যানটা ডিমাপুরের দিকে ছুটে চলেছে। সেই সঙ্গে ছুটছে। সেঙাই-এর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, আমি যাব না শিলং পাহাড়ে। যাব না। নানা-না।

কিছুক্ষণ পর অস্থিরতা খানিকটা কাটলে সামনের একটা জোয়ানের দিকে তাকাল সেঙাই। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে। সেঙাই ডাকল, এই, তুই কে?

জোয়ানটা মাথা তুলল। চোখের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে যেন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে।

সেঙাই আবার বলল, তুই কে?

আমি লেঙড়ি আও। ফচিমাঙ বস্তিতে আমাদের ঘর।

এবার ওপাশের অন্য একটা জোয়ানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সেঙাই জিগ্যেস করল, তুই কে? তোদের কোন বস্তি?

আমি ইয়ালুলুক। আমাদের বস্তি হল জুনোবট।

একটি একটি করে প্রতিটি জোয়ানের নাম-ধাম-গোত্রবংশের খবর নিল সেঙাই। কেউ কোনিয়াক, কেউ আও, কেউ সাঙটাম, কেউ রেঙমা–নাগা পাহাড়ের দিগদিগন্ত থেকে, নানা গ্রাম-জনপদ থেকে, এইসব পাহাড়ী ছেলেদের তুলে নিয়ে এসেছে ম্যাকেঞ্জিরা।

সেঙাই বলল, সায়েব শয়তানের বাচ্চারা তোদের ধরে আনল কেন রে?

জোয়ানেরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, কেন আবার? রানী গাইডিলিও আমাদের বস্তিতে গিয়েছিল। কত কথা বলেছে রানী। বলেছে, ছয় আকাশ আর ছয় পাহাড়ের ওধারে কোন এক ভিন দেশ থেকে সায়েব শয়তানরা এসেছে সদ্দারি ফেলাতে। বলেছে, আমাদের পাহাড় থেকে রামখোর বাচ্চাদের ভাগিয়ে দিতে হবে। আমরা রানীর কথামতো কাজ করলাম। সায়েবদের কাছ থেকে নিমক নিই না, যীশু-মেরী বলি না, বুকে কাঁধেকপালে আঙুল ঠেকাই না। কেন রানীর কথা শুনব না? ওর ছোঁয়ায় ব্যারাম সারে, আনিজার গোসা চলে যায়। ওর কথা নিঘ্‌ঘাত শুনব।

হু-হু নিঘ্‌ঘাত শুনবি। সেঙাই সায় দিল, তারপর কী হল বল দিকি।

তারপর হুই শয়তানেরা রানীর খোঁজে বস্তিতে বস্তিতে যেতে লাগল। আমরা তাদের রুখলাম। তুইই বল, জান থাকতে আমরা রানীকে ধরিয়ে দিতে পারি?

না না, কক্ষনো না।

রানীকে আমরা ধরতে দিলাম না। রাগে সায়েবরা আমাদের বস্তি জ্বালিয়ে দিল, গুলি করে অনেককে ফুঁড়ল। এখন আমাদের কজনকে জখম করে শিলং পাহাড়ে নিয়ে চলেছে।

আচমকা সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, হুই শিলং পাহাড়ে আমরা যাব না। যাব না।

সেঙাই-এর সঙ্গে সঙ্গে অন্য জোয়ানেরা চিৎকার করতে লাগল, আমরা যাব না, যাব না।

বিশাল গোঁফে চাড়া দিয়ে বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি হুমকে উঠল, চুপ, চুপ কুত্তার বাচ্চারা।

গালাগালিটা নির্ভেজাল মাতৃভাষাতেই দিল বৈকুণ্ঠ।

সেঙাই-এর কাছাকাছি বসে জপমালা জপছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। এই শোরগোল, চিৎকার এবং তর্জন-গর্জনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নিজের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল টেনে একান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে সে।

.

৪৮.

মণিপুর রোড স্টেশন।

সকালবেলা রেলের কামরায় পাহাড়ী জোয়ানগুলোকে ঠেসে ঠেসে ভরে, পুলিশদের নিরঙ্কুশ হেফাজতে এবং রাইফেল বেয়নেটের জিম্মায় রেখে কোহিমার দিকে ফিরে গেল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি।

সেঙাইদের সঙ্গে গেল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি।

বিস্মিত, বিহ্বল হয়ে রেলগাড়ি দেখল সেঙাই। অন্য ছেলেরাও দেখল। এর আগে তারা রেলগাড়ি দেখেনি। ভীতি, উৎকণ্ঠা এবং প্রবল ঔৎসুক্যের মিশ্র অনুভূতিতে চুপচাপ বসে রইল সকলে।

একসময় ঝকর ঝকর শব্দ করে ট্রেন ছুটতে শুরু করল। জানালার ফাঁক দিয়ে পাহাড়ী বুনো দেশ ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমতলের বাসিন্দাদের নানা ধরনের, বিচিত্র আকারের সব ঘরবাড়ি মিলিয়ে যেতে লাগল। পাশে পাশে টেলিগ্রাফের তার।(ওগুলো যে টেলিগ্রাফের তার, আট বছর পরে তা জেনেছিল সেঙাই)। রাঙ্গা পাহাড়, ডিফু, লামডিঙ, চাপার মুখনানা স্টেশন।(স্টেশন এবং স্টেশনগুলোর নামও আট বছর পরেই জেনেছিল সেঙাই। আট বছরে স্টেশনের নাম এবং টেলিগ্রাফের তারই শুধু নয়, আরো অনেক বিস্ময়কর বস্তু এবং মানুষ দেখেছিল সেঙাই! অসংখ্য ব্যাপার বুঝেছিল। জীবনের অনেক মৌল সমস্যা তাকে নাড়া দিয়েছিল। সে-সব অনেক পরের কথা। যখাসময়ে বলা যাবে)। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের বিরাম। নানা চেহারার মানুষের জটলা। এক একটা স্টেশন আসে। শুরু হয় হইচই, চিৎকার, যাত্রীদের ওঠানামা। তারপর আবার দৌড়।

পাহাড়ী বুনো মানুষ সেঙাই-এর অস্ফুট মনটা বিস্ময়ে ঝুঁদ হয়ে গেল। অবাক, নিষ্পলক চোখে সে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়ের জন্য চলমান বনজঙ্গল, সমতলের দেশ, এ দেশের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে কবজির যন্ত্রণা, মেহেলী, কেলুরি গ্রাম, গাইডিলিও, এবং অতীতের সব কথাই যেন ভুলে গেল সেঙাই।

শিলং পাহাড়ে যেতে চাইছিল না সেঙাই। চিৎকার করেছিল, রাগে ফেটে পড়েছিল। এখন শিলং যাওয়ার পথটা এবং রেলগাড়ির একটানা ঝকানি মোটামুটি মন্দ লাগছে না। নাগা পাহাড়ের বাইরে এমন একটি সুন্দর দেশ যে ছিল তা কি আগে জানত সেঙাই?

জানালার সামনে পাহাড়ী জোয়ানেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

একজন বলল, এটাই বুঝি আসান্যুদের দেশ?

হু-হু– সেঙাই মাথা ঝাঁকায়।

দেশটা ভালো, খুব ভালো।

হু-হু, দেখছিস আমাদের ঘরের চেয়ে আসাদের ঘরগুলো অনেক ভালো।

হু-হু, ঠিক বলেছিস। সকলে সায় দিল।

সেঙাই বলল, শিলং থেকে বস্তিতে ফিরে এইরকম ঘর বানাব।

কে, তোর ঘর নেই? বিয়ে হয়নি?

বেশ ভুলে ছিল সেঙাই, আবার মেহেলীর কথা মনে পড়ল। চোখজোড়া জ্বলে উঠল তার। সে ফুঁসে ওঠে, টেমে নটুঙ! বিয়ে আর হল কই? মোরাঙ থেকে বেরুতেই পারলাম না। বিয়ে করার আগেই তো শয়তানের বাচ্চারা মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আমাকে ছুঁড়ল। টেফরা ঘর বানাতে দিল না।

হঠাৎ হাউ হাউ করে সেঙাই কেঁদে উঠল।

কত সাধ ছিল তার, অপরিণত মনে কত স্বপ্নই না ঠাসা ছিল। সমস্ত চেতনা জুড়ে স্পষ্ট অস্পষ্ট কত কামনাই না ছিল। বিয়ের পর মেহেলীকে নিয়ে ঘর বেঁধে থাকবে। জোরি বংশের বাড়িটার পাশে সর্দার তাকে ঘর তোলার জায়গা দিয়েছিল। বিয়ের সময় ফসলের, জন্মমৃত্যুর, বনপাহাড়ের আনিজাদের নামে সাদা শুয়োর বলি দেবে। গ্রামের সবাইকে ভোজ খাওয়াবে। নিজের ধরনে মনে মনে স্থূল ভোগ এবং উপভোগের জগৎ বানিয়ে নিয়েছিল সেঙাই। কিন্তু সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে গেল। তাকে সাহেবরা চালান করছে শিলং-এ, মেহেলী যে কোথায়, কতদূরে, তার হদিস কেই বা দেবে এখন?

সেঙাই কাঁদছে। চুল ছিঁড়ে আশেপাশের জোয়ানদের আঁচড়ে কামড়ে শব্দ করে চেঁচাচ্ছে।

আদিম মানুষের কামনার প্রকাশ যেমন সাঙ্ঘাতিক, তার নৈরাশ্যও তেমনই মারাত্মক।

সেঙাই-এর বিচিত্র ধ্বনিময় কান্না মুহূর্তে অন্যান্য জোয়ানদের স্পর্শ করল। তারাও সমস্বরে কান্না জুড়ে দিল।

গাড়ির দোলানিতে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জির। দুটো দিন পাহাড়ীদের গ্রামে হানা দিয়ে কি ধকলটাই না গিয়েছে! তন্দ্রার ব্যাঘাত ঘটায় দাঁত খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বৈকুণ্ঠ, থাম জানোয়ারের বাচ্চারা।

.

ট্রেনের চাকার নিচে রেলের লাইন ফুরিয়ে এল। গুয়াহাটি স্টেশন। সেখান থেকে আবার পুলিশ-ভ্যানে শিলং পাহাড়। মাঝে ডিমাপুরের পথের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী সড়ক। সেই সড়ক ধরে যেতে যেতে রাত্রি নামল।

হিম হিম বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ঠকঠক করে হাড় কাঁপে। খাদের পাশে কমলাবন আবছা হয়ে গেল। ঘন ঝোঁপ, নিবিড় অরণ্য, বুনো লতাপাতার জটিল বাঁধনে জড়ানো টিলাগুলো এখন অস্পষ্ট।

একসময় শিলং শহরে এসে ঢুকল পুলিশ-ভ্যান। পাইনপাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের কান্না বাজছে। সোঁ সোঁ দীর্ঘশ্বাস উঠছে। তারের জাল বসানো জানালার মধ্য দিয়ে বাইরে তাকাল সেঙাই।

দু’পাশ থেকে ঝলমলে আলোগুলো ছিটকে যাচ্ছে। সরে সরে যাচ্ছে দোকান পসার, বিচিত্র চেহারার মানুষ, বিচিত্রতর বেশভূষা।

ভ্যানটা ছুটছে, তার শ্রান্ত হৃৎপিণ্ডের একটানা ঘসঘস শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই সেটা বিরাট এক ফটকের মধ্যে ঢুকে গেল।

রেলের ঝকানি, ভ্যানের দোলানি এবং দু’দিনের অবিশ্রান্ত ধকলে শরীরটা যেন কেমন করে উঠল। কাঁধ থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত সমস্ত ডান দিকটা ফুলে রয়েছে। অসহ্য টাটানি শুরু হয়েছে। সেঙাই-এর মনে হল, ডান দিকটা খসে পড়বে। একটা যন্ত্রণার থাবা ক্রমাগত মাংস শিরা-উপশিরাগুলোকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধরেছে যেন। এই দু’দিন খানিকটা ঝলসানো মাংস, একচোঙা রোহি মধু আর একপিণ্ড গলা ভাত ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। হঠাৎ ভ্যানের মধ্যে পিত্তবমি করে ভাসিয়ে দিল সে। তার পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। এই শিলং পাহাড়, হুস হুস করে ছুটে যাওয়া আলোকিত বাড়িঘর আর পাইনবন তার চেতনা থেকে মুছে গেল।

যখন জ্ঞান ফিরল, চারিদিকে ছায়া ছায়া, ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকার। একটা মুখ তার মুখের কাছে ঝুঁকে রয়েছে। একপাশে তেলের লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে। ঘোর ঘোর, সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেঙাই চমকে উঠল। উঠে বসতে চাইল। কিন্তু তার আগেই দুহাতের সস্নেহ চাপে আবার শুয়ে পড়ল সে।

আশ্চর্য! মানুষটা কথা বলছে না। তবু স্ফুটনোম্মুখ মনের সমস্তটুকু বোধ দিয়ে সেঙাই বুঝতে পারল, এর দিক থেকে বিপদ-আপদের কোনো সম্ভাবনা নেই। আচ্ছন্ন এবং বিহ্বল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল।

চোখ থেকে আচ্ছন্নতা কেটে গেল একটু পরেই। সেঙাই দেখল, মানুষটা তার মতো নাগা নয়, সমতলের বাসিন্দা। অথচ তাদের ভাষাটা কী সুন্দর রপ্ত করেছে। মানুষটা বলল, তুমি নিশ্চয়ই নাগা পাহাড় থেকে এসেছ। কী নাম তোমার?

হু-হু, আমি নাগা। কেলুরি বস্তিতে আমাদের ঘর, আমাদের বংশ হল জোহেরি, আমার নাম সেঙাই। একটু থেমে সেঙাই আবার বলল, তুই কে?

আমি? আমার নাম বসন্ত সেন। মুখখানা আরো ঝুঁকিয়ে দিলেন বসন্ত। বললেন, তুমি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলে। এখন কেমন লাগছে?

বসন্তর কথার উত্তর দিল না সেঙাই। ফিসফিস করে বলল, তুই তো আসা। আমাদের পাহাড়ীদের কথা কী করে শিখলি?

স্নিগ্ধ হেসে বসন্ত বললেন, অনেকদিন আমি নাগা পাহাড়ে ছিলাম। কোহিমা, ডিমাপুর, মোককচঙ, ওখা, তুয়েন সাঙ–তোমাদের পাহাড়ের সব জায়গায় ঘুরেছি। ঘুরতে ঘুরতে তোমাদের কথা শিখে ফেলেছি। একটু ছেদ, আবার শুরু হল, তুমি এই জেলখানায় এলে কেন?

জেলখানা কী?

যেখানে মানুষকে আটক করে রাখা হয়।

আটকে রাখবে কেন?

দোষ করলে, কাউকে মারলে ধরলে, খুনখারাপি করলে, চুরি করলে আটকে রাখে। তুমি কী করেছিলে?

সেঙাই সোৎসাহে বলতে শুরু করল, আমাদের পাহাড়ে একটা রানী আছে, তার নাম গাইডিলিও। রানী বলত, নাগা পাহাড়ে সায়েবরা সদ্দারি করতে এসেছে। আমরা শয়তানদের সদ্দারি মানব না।

ঠিক, ঠিক কথা। আগ্রহে চোখ দুটো ঝকমক করতে লাগল বসন্তর। আরো একটু এগিয়ে ঘন হয়ে বসে বললেন, তারপর?

ভাবলাম, রানীর কথামতো আমরা কাজ করব। সায়েবদের সদ্দারি মানব না, ফাদারদের নিমক কাপড় নেব না, যীশু-মেরী বলব না, ক্রন্স আঁকব না। সায়েবরা রেগে রানীকে খুঁজতে এল আমাদের বস্তিতে। আমরা রুখতে গেলাম। শয়তানের বাচ্চারা আমাদের বস্তি জ্বালিয়ে। দিল। বন্দুক দিয়ে ফুঁড়ল। তারপর বেঁধে নিয়ে এল এখানে। এই দ্যাখ, আমার কী হাল করেছে! ফুঁসতে ফুঁসতে ডান হাতখানা দেখাল, আমাদের বস্তির জামাতসুর পেটে বাচ্চা ছিল, তাকে পেটে লাথি মেরে শয়তানেরা খতম করেছে। আমার ঠাকুমার বুক ফুঁড়ে সাবাড় করেছে। মেহেলীকে কেড়ে নিয়ে গেছে। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসন্তকে আঁচড়াতে কামড়াতে লাগল সেঙাই।

পাহাড়ী মানুষের আক্রোশ এবং যন্ত্রণা প্রকাশের রীতি জানতেন বসন্ত। তাই বিচলিত হলেন না। অন্যমনস্কের মতো বললেন, মেহেলী কে?

আমার পিরিতের জোয়ানী। পনেরো দিন পরে আমার সঙ্গে মেহেলীর বিয়ের কথা ছিল। রামখোর বাচ্চারা ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। সেঙাই কাঁদতে লাগল।

সেঙাই-এর কান্না বসন্তকে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তিনি ভাবছিলেন অন্য কথা। শান্ত, স্নিগ্ধ মানুষটির প্রাণ টগবগ করে ফুটছিল। তিনি ভাবছিলেন, আসমুদ্রহিমাচল বিশাল বিপুল এই দেশ, তার আত্মা, মনুষ্যত্ব এবং আকাঙ্ক্ষার মধ্যে স্বাধীনতা নামে যে প্রখর চেতনার জন্ম হয়েছে, তা থেকে এই দেশের একটি মানুষও বিচ্ছিন্ন হয়ে নেই। স্বাধীনতার স্বপ্নে অরণ্যচারী, গুহাবাসী, আদিবাসী, উপজাতি–প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

বসন্ত ভাবছিলেন, এই চেতনাকে গুলি মেরে দাবিয়ে রাখা যাবে না। অন্যায় অবিচার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করার দিন শেষ হয়েছে। দেশে নতুন চেনা এসেছে নতুন উপলব্ধির আলো ছড়িয়ে পড়েছে।

জেলখানায় বসে বাইরের খবর ঠিকমতো পাওয়া যায় না। যা আসে তা ছাড়া ছাড়া, টুকরো টুকরো। সেগুলো থেকে ধারাবাহিক ছবি ধরা যায় না। কল্পনা দিয়ে ফাঁক ভরাট করতে হয়।

অনেক সময় উৎকণ্ঠায় আশঙ্কায় সংশয়ে দৃঢ় কঠোর আশাবাদী মন আকীর্ণ হয়ে থাকে। দেশ কি ঠিক পথে চলেছে? কোন মত এবং পথে সিদ্ধি? সন্ত্রাসবাদ না অহিংস সত্যাগ্রহ? নানা চিন্তা, নানা জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে জটলা পাকায়। এক-এক সময় সন্দেহ জাগলে বড় দুর্বল হয়ে পড়েন বসন্ত। নৈরাশ্য আসে। কিন্তু আজ সেঙাইকে দেখতে দেখতে উত্তর পূর্ব ভারতের বন্য আদিম জোয়ানটির মধ্যে সমগ্র দেশের আকাঙ্ক্ষার স্পন্দন শুনে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, না না, স্বাধীনতা আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অসম্ভব। আমরা দেখব, শয়তানেরা আর কত অত্যাচার করতে পারে।

সেঙাই বলল, তুই কী বলছিস, কিছুই যে বুঝতে পারছি না রে ধাড়ি টেঙ।

তন্ময় হয়ে ছিলেন বসন্ত। একটু চমকে উঠলেন। উত্তেজনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই বিভ্রান্তির পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে দ্বিতীয় রিপু। মুহূর্তের জন্য সত্যাগ্রহীর অনুশাসনগুলি ভুলে গিয়েছিলেন, আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। সত্যাগ্রহের পথ বড় দুর্গম। ছয় রিপু এবং পঞ্চেন্দ্রিয় দমন। করে এ পথে হাঁটার অধিকার পাওয়া যায়।

সেঙাইকে দেখে মাত্রাছাড়া, বেপরোয়া উত্তেজনা হয়েছিল। রাগের বশে সত্যাগ্রহীর পক্ষে অশোভন কটুক্তিও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আজ আর সেজন্য বিশেষ অনুশোচনা হচ্ছে না।

উত্তর পূর্ব সীমান্তে অরণ্য-আদিম পাহাড়ী দেশেও যে নতুন জীবনবোধ জেগেছে সে খবর। এনেছে সেঙাই।

অপরিসীম আশায়, উদ্দীপনায় এবং আনন্দে সমস্ত হৃদয় ভরে গেল বসন্তর। .

.

৪৯.

শিলং শহরের ওপর রাত্রি ঘন হচ্ছে। ছোট্ট সেলের মোটা গরাদের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বসন্ত। গাঢ় ধোঁয়ারঙের কুয়াশার স্তরগুলি পাহাড়ের চূড়া ঢেকে রেখেছে। পাইনের পাতায় পাতায় বাতাসের একটানা সোঁ সোঁ শব্দ। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের আওয়াজ ছাড়া পাহাড়ী রাত্রি কী নিঃসাড়, কী ভীষণ নিস্তব্ধ!

অবশ্য থেকে থেকে নিঝুম রাতের আত্মা বিদীর্ণ করে আর্তনাদ উঠছে। উচ্চ, তীক্ষ্ণ এবং প্রাণফাটা কান্না একটু একটু কমে গোঙানির রূপ নিয়ে থেমে আসছে, ইয়া আল্লাহ-হ্‌-হ্‌–

পাশের সেলে মুসলমান কয়েদিটা কয়েক রাত্রি ধরে সমানে কাঁদছে। নিজেও ঘুমোয় না, আশেপাশের কাউকে ঘুমোতেও দেয় না। কদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না, কারো সঙ্গে কথা বলছে না। সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো দূরের পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, আর রাত্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে মাত্র দু’টি শব্দ করে কাঁদে, ইয়া আল্লাহ-হ্‌-হ্‌–

দিন পাঁচেক আগে রায় বেরিয়েছে, জরু হত্যার অপরাধে ফাঁসি হবে লোকটার। দিন কুড়ি পরেই বুঝি ফাঁসির দিন স্থির হয়েছে।

এখন বুক চাপড়ে কাঁদছে সে, হতভাগাটা বোধ হয় পাগল হয়ে যাবে।

বসন্ত ভাবছিলেন। নানা চিন্তা, অসংখ্য ঘটনা মনের মধ্যে একাকার হয়ে, বলা যায়, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। করাত ধরেই তার সমানে মনে হচ্ছে, জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানে কী দুর্বিষহ যন্ত্রণাই না লোকটার মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।

হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিল লোকটা।

অনেকক্ষণ পর বসন্তর ভাবনা অন্য একটি খাত বেয়ে ছুটতে লাগল। নিজের জীবনের কথা মনে পড়ল। কত বার যে পাশের সেলের কয়েদিটার মতো জীবন এবং মৃত্যুর সীমান্তে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে, বাঁচার প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং মৃত্যুর আতঙ্কে উন্মাদ হতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

প্রতি মুহূর্তে মত-পথ-বিশ্বাস-আস্থা হারানো এবং প্রাপ্তির মধ্যে কখনও মনে হয়েছে, শেষ হয়ে গেলেন। পরক্ষণে নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছেন।

বসন্ত ভাবছিলেন।

সাত হাত লম্বা, সাড়ে পাঁচ হাত চওড়া ছোট সেলের মধ্যে ওঠাবসা ছাড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করার উপায় নেই। এক পা এগুলেই পায়ের নিচে জমি ফুরিয়ে যায়। দেওয়ালে কপাল ঠুকে যায়। বসে বসে চিন্তা করা, অর্থাৎ মনকে সক্রিয় এবং সঞ্চালিত করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। তাই বসন্ত ভাবেন।

হঠাৎ একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল।

বছর তিনেক আগের কথা। সন্ত্রাসবাদে তখন অসীম আস্থা বসন্তর। সে সময় তার ধারণা, রক্তক্ষয় ছাড়া স্বাধীনতা অসম্ভব।

সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কাটিহারে গিয়েছিলেন তিনি। কিষেণগঞ্জ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেরিয়েছিলেন সফরে। পথে কাটিহার স্টেশন পড়বে।

স্টেশন থেকে খানিক দূরে বাঁশবনে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিলেন বসন্ত, পাশে দশ জন সঙ্গী। হাতে হাত-বোমা।

নিঝুম ঘুটঘুটে রাত। পাল্লা দিয়ে ঝিঁঝির দল একটানা বিলাপ করে চলেছে। কোথায় ব্যাঙ ডাকল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। জোনাকির সবুজ আলো জ্বলছে নিভছে, নিভছে জ্বলছে। হঠাৎ দমকা বাতাস হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল বাঁশবনে, মটমট শব্দ হল। এগারোটি রুদ্ধশ্বাস মানুষ চকিত হয়ে উঠল।

ট্রেনটা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে একচক্ষু সিগন্যাল পোস্টটা পেছনে ফেলে বাঁশঝোঁপের কাছাকাছি এসে পড়ল।

মনে আছে, প্রচণ্ড উত্তেজনায় মেরুদণ্ড হঠাৎ টান টান হয়ে গিয়েছে। হৃৎপিণ্ডটা শব্দ করে থেমে গেল। হাত থেকে নিজের অজান্তে বোমাটা ছুটে গিয়েছিল। একটা ভয়ঙ্কর শব্দ, তারপর পর পর আরো দশটা। চক্ষের পলকে তাণ্ডব ঘটে গেল। আর্তনাদ, চিৎকার, ঘস্স্স্ করে ট্রেন থামার শব্দ। তারপর কী হয়েছিল, মনে নেই। শূন্য রুক্ষ মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে মনে হয়েছিল, একটা অস্বাভাবিক আতঙ্ক অন্ধকারে বিরাট রোমশ হাত বাড়িয়ে পিছু পিছু ছুটে আসছে।

পরের দিন খবরের কাগজে বসন্ত পড়েছিলেন, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মারা যাননি। দেহাতি কয়েকটি শিশু এবং নারী হতাহত হয়েছে।

চারিদিকে পুলিশের খানাতল্লাশ শুরু হল। হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশ আসামীদের ধরবেই।

বেগতিক দেখে দাদারা পাঞ্জাবে শারোয়ান সিংয়ের আস্তানায় চলে যেতে বললেন। এক বছর পাঞ্জাবে লুকিয়ে ছিলেন বসন্ত।

এই এক বছরের প্রতিটি মুহূর্ত তিলে তিলে মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তিনি। নিরীহ শিশু এবং নারীদের হত্যাকারী হিসাবে মনে হয়েছে নিজেকে। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়াত। পাশের মুসলমান কয়েদিটির মতো কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। কেমন এক আতঙ্ক সারাক্ষণ শ্বাসনালীটাকে চেপে ধরে থাকত। পৃথিবীতে এত বাতাস, তবু মনে হত, নিশ্বাস নেবার মতো পর্যাপ্ত নয়। এত অফুরন্ত আলো, তবু মনে হত, সব অন্ধকার। রাতে চোখ দুটো ঘুমে বুজে এলেই চারপাশে শিশু এবং নারীর আর্তনাদ শুরু হত। চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে বসতেন বসন্ত। অসহ্য, অসহ্য।

আত্মপীড়নের মাত্রাটা যখন চরমে উঠত, তখন নিজের রায় নিজেই ঠিক করে ফেলতেন বসন্ত। হ্যাঁ, ফাঁসিই হওয়া উচিত তার। এক-এক সময় মনে হত, পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাবেন।

এমন করে সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী মনটা একদিন মরে গেল। নতুন ভাবনার পুঞ্জ পুঞ্জ আলো এসে পড়ল তার চিন্তায়। মেল ডাকাতি, দু-একটা খুনখারাপি কিংবা খণ্ড খণ্ড সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দেশের এবং দেশের মানুষের কোনো মৌলিক পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এই সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভীতি এবং আতঙ্ক। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় সন্ত্রাসবাদীকে। আত্মগোপন করে থাকতে হয়। নিজের অজান্তেই বোমা-পিস্তলের। রোমান্সের সঙ্গে মনের মধ্যে অপরাধবোধ লুকিয়ে থাকে। রোমান্সের জলুস নিভলে সেই বোধটা মাথা চাড়া দেয়। তখন অবস্থা মারাত্মক হয়ে ওঠে। বসন্ত ভাবলেন, এ পথে গন্তব্যে পৌঁছুনো সম্ভব হবে না।

দ্বিধায় যখন মন দুলছিল তখন পায়ের সামনে আরেকটা পথ পাওয়া গেল। সে পথ অহিংস সত্যাগ্রহের। অসহযোগের। সত্যাগ্রহ করেই এক বছর শিলং জেলে আটক রয়েছেন বসন্ত। এ পথে অপরাধীর মতো লুকিয়ে চুরিয়ে বেড়াতে হয় না। সগৌরবে মাথা উঁচু করে চলা যায়।

সত্যাগ্রহে দীক্ষা নিয়ে নতুন জন্মলাভ হয়েছিল বসন্তর।

আজকের অনেক পরিণত বসন্ত সেন ভাবেন, দেহই শুধু বাঁচন এবং মরণশীল নয়, মনও।

আচমকা পাশের সেলে সেই গোঙানি শোনা গেল, হা আল্লাহ-হ-হ–এবার গলার আওয়াজ তেমন উচ্চ কিংবা তীক্ষ্ণ নয়। কেমন যেন নির্জীব। বোধ হয়, হতাশার শেষ সীমায় এসে পড়েছে লোকটা।

কম্বল মুড়ি দিয়ে সেঙাই শুয়ে ছিল। মুখ বাড়িয়ে বলল, কে কাঁদে রে?

বসন্ত জবাব দিলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *