৩০. ঘরের মধ্যে গ্যাসের আলো

৩০.

ঘরের মধ্যে একটা মণিপুরী পুলিশ গ্যাসের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে। গ্যাসজ্বলা তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

বসওয়েল তাকাল ম্যাকেঞ্জির দিকে। বলল, কী মনে হয় ফাদার?

কিসের কথা বলছে? দুচোখে কৌতূহল নিয়ে ম্যাকেঞ্জি তাকাল।

এই যে ব্যাপারটা। দেখলেন তো, প্লেনসম্যানদের পাহাড়ীরা দেখতে পারে না। চ্যাটার্জির কথাগুলো নিশ্চয়ই শুনেছেন। বলে একটু থামল বসওয়েল। তারপর বিরাট মুখখানা ম্যাকেঞ্জির কানের কাছে নিয়ে এল, খবরদার, ভুল করেও পাহাড়ীদের গায়ে আমাদের ব্রিটিশারদের হাত ভোলা চলবে না। যদি ঠেঙাতে হয়, তবে প্লেনসম্যানদের দিয়েই এই অপ্রিয় কাজটি করাতে হবে।

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ম্যাকেঞ্জি। কিছুই যেন ধরতে পারছে না সে। বসওয়েল বলল, বুঝতে পারলেন না তো ফাদার? এটা ডিপ্লোম্যাসি। পোলিটিকস। প্লেনসম্যানদের সঙ্গে ওই হিলি হিদেনগুলোর ইউনিয়ন হলেই মুশকিল। রাজ্যপাট মাথায় উঠে যাবে। সবসময় প্লেনস আর হিলসের মধ্যে একটা ফিউড বাধিয়ে রাখতে হবে।

ব্রিলিয়ান্ট! সত্যি, এটা আমার মাথায় স্ট্রাইক করেনি তো। ম্যাকেঞ্জির গলা বিস্ময়ে কাঁপতে লাগল।

আইভরি পাইপের মধ্যে সুরভিত তামাক পুরতে লাগল বসওয়েল। অখণ্ড মনোযোগে, নির্বিকার গাম্ভীর্যে ম্যাকেঞ্জির বিস্ময়টা উপভোগ করছে সে। শুধু একটি আত্মপ্রসাদের হাসি তার সারা মুখে অদ্ভুতভাবে ফুটে রইল।

হঠাৎ ম্যাকেঞ্জি বলল, বড় মুশকিল হয়েছে পিয়ার্সনকে নিয়ে। তলে তলে ও এই পাহাড়ীদের সিমপ্যাথাইজ করে। প্রিচিঙের বিরুদ্ধে কথা বলে–বুঝলেন মিস্টার বসওয়েল।

আপনি আগেও বলেছেন। আচ্ছা পরে এই ব্যাপারটা ভাবা যাবে। আত্মপ্রসাদের যে হাসিটা এতক্ষণ ফুটে ছিল বসওয়েলের মুখে, সেটা শ্লেটের লেখার মতো মুছে গেল। গম্ভীর, থমথমে গলায় বলল, একটু ওয়াচ–

আরো কিছু বলত বসওয়েল, তার আগেই জন তিনেক নাগা সর্দার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। হাতের থাবায় বর্শা, মাথায় মোষের শিঙের মুকুট, সারা গায়ে দড়ির লেপ জড়ানো, গলায় সাপের হাড়ের মালা।

বসওয়েল গদগদ ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানাল, এসো সর্দারেরা, তারপর খবর কী?

তিনজনেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, না না, আমরা পারব না। এই দ্যাখ, গাইডিলিওকে ডাইনি বলতে গিয়েছিলাম সিকুয়ামাক বস্তিতে। আমাদের বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছে।

একজন পিঠ দেখাল। একজন হাত। আর একজন কণ্ঠার কাছের নরম জায়গা। বর্শার ফলায় তিনজন ক্ষতবিক্ষত হয়ে এসেছে। টোঘুটুঘোটাঙ ফুলের মতো থাকা থোকা রক্ত জমে রয়েছে আঘাতের জায়গাগুলোতে।

এই নে তোর টাকা। গাইডিলিওকে ডাইনি বলতে গিয়ে শেষে জান দেব নাকি? বক্তির লোকেরা সব খেপে গেছে। তিনজনেই কোমরের তলার গোপন থলে থেকে একরাশ কাঁচা টাকা ঝনঝন করে ওক কাঠের পাটাতনে ছুঁড়ে দিল।

নিচের কদাকার দাঁতের পাটিটার ওপর ওপরের পাটিটা নেমে এল বসওয়েলের। চোয়াল কঠিন হল। তামাটে ভুরু বেঁকে গেল। চোখ দুটো দাবাগ্নির মতো ধকধক করে জ্বলছে।

আচমকা পাশের ঘরে পাহাড়-ফাটানো আর্তনাদ উঠল, আউ—উ–উ–

ছোট দারোগা বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জির দলন-মলন শুরু হয়েছে। এই হল আদিপর্ব। চমকে উঠল তিন পাহাড়ী সর্দার, কী হল রে সাহেব? কাকে মারছে?

বসওয়েলের দুচোখে একটা কুটিল ছায়া খেলে গেল। কপালের ওপর কয়েকটা জটিল রেখার হাবিজাবি ফুটে উঠল। বিশাল এবং ভয়ানক মুখখানা তিনটি সর্দারের মধ্যে নামিয়ে আনল সে। ফিসফিস গলায় বলল, আসান্যুরা পাহাড়ীদের মারছে।

কেন? গর্জে উঠল পাহাড়ী সর্দারেরা, একেবারে সাবাড় করে ফেলব শয়তানদের।

আরে চুপ, চুপ। বেশি চেঁচামেচি কোরো না। আসান্যুরা ভারি শয়তান। বন্দুক আছে ওদের। গুলি মেরে খতম করে ফেলবে। অপরিসীম ভয়ের ভঙ্গি করে বসওয়েল বলল।

বন্দুকের মহিমা সম্বন্ধে অতিমাত্রার সচেতন এই পাহাড়ী সর্দারেরা। কয়েকদিন আগেই তারা দেখেছে, কেমন করে একটা মণিপুরী পুলিশ বড় বড় দুটো ময়াল সাপকে গুলি মেরে খতম করেছে। অতএব, পুরোপুরি নিভে গেল তিনজন বন্য মানুষ। রুদ্ধ গলায় তারা বলল,

তুই হুই আসান্যুদের ভাগিয়ে দে। নইলে ওরা বন্দুক দিয়ে আমাদের মারবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ভাগিয়ে দেব। তা হলে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

যা বলেছি–ওই গাইডিলিওর নামে বস্তিতে বস্তিতে ডাইনি বলে আসবে।

বসওয়েলের কথা শেষ হবার আগেই পাশের ঘরের আর্তনাদটা তুমুল হয়ে উঠল। কিল, চড় আর ঘুষির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে ব্যাটনের ঘা পড়ছে। মাঝখানে ইটের পাতলা দেওয়াল। সেটা যেন আঘাতের আওয়াজ আর আর্তনাদে এক নিমেষে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে।

এ-ঘরে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে তিনটি পাহাড়ী সর্দার, আসান্যুরা মারছে কেন?

গাইডিলিওকে ওই পাহাড়ীরা ডাইনি বলেনি, তাই মারছে। শিগগির টাকা নিয়ে বস্তিতে বস্তিতে গাইডিলিওর নামে ডাইনি বলে এসো। নইলে আসান্যুরা রেহাই দেবে না। ওরা কিন্তু আনিজার মতো শয়তান। এবার বেতের কেদারা থেকে পাহাড়ী সর্দারদের মধ্যে উঠে এল বসওয়েল। অন্তরঙ্গ গলায় বলল, আরো টাকা দেব।

কাজ হল। কাঠের পাটাতন থেকে টাকাগুলো তুলে ফের কোমরের গোপন থলিতে চালান করে দিল সর্দারেরা। তারপর উঠতে উঠতে বলল, আমরা এবার যাই। তুই কিন্তু হুই বন্দুকওলা আসান্যুদের পাহাড় থেকে ভাগিয়ে দিবি। নইলে আমাদের মেরে ফেলবে।

নিজের কৃতিত্বে প্রায় লাফিয়ে উঠল বসওয়েল, নিশ্চয়ই। ব্রাদার-ইন-লদের সব ভাগিয়ে দেব পাহাড় থেকে। তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না।

বাইরে অজগরের দেহের মতো কোহিমার আঁকাবাঁকা পথ। সেই পথে রাত্রির ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তিন পাহাড়ী সর্দার। শয়তানের তিনটি শিকার।

তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। কোহিমার পাহাড়ে রাত্রি এখন গম্ভীর হয়েছে, নিবিড় হয়ে নামছে অন্ধকার।

গ্যাসের আলোটা জ্বলছে, থেকে থেকে দমকা বাতাসে কাঁপছে। কটু দুর্গন্ধ আরো উগ্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

তিনটি পাহাড়ী সর্দার অনেকক্ষণ আগে মিলিয়ে গিয়েছে কোহিমার পথে। পাদ্রী ম্যাকেঞ্জিও বিদায় জানিয়ে চার্চে চলে গিয়েছে। ঘরের মধ্যে একটি মানুষও আর নেই। সামনের টেবলটার ওপর মাথা রেখে বসে রয়েছে বসওয়েল। একেবারেই নিশ্চল, একেবারেই নিথর সমাধিস্থ। এতক্ষণ পাশের ঘরে পাহাড়ী দুটোর অবিরাম চিৎকার আর আঘাতের শব্দ সুন্দর সিমফোনির মতো মনে হচ্ছিল বসওয়েলের। নেশার মতো মনোরম এক আনন্দে সেই সিমফোনি তার সারাটা চেনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

এখন আর পাশের ঘর থেকে দেওয়াল ভেদ করে একটু শব্দও আসছে না এদিকে। শুধু গ্যাসের আলোর চারপাশে একটা খারিমা পতঙ্গ চক্রাকারে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে।

স্যার—

খাটসঙ কাঠের টেবল থেকে মাথা তুলল বসওয়েল। সামনেই ছোট দারোগা বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি।

কী ব্যাপার?

স্যার, যা বলেছিলেন সব ঠিক ঠিক করেছি। একটুও এদিক ওদিক হয়নি। নিজের কৃতিত্বে অদ্ভুত এক ধরনের হিংস্র আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল যেন বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি, স্যার, পাহাড়ী দুটোকে টাটকা দাওয়াই দিয়েছি। একটা তো আধ-মরাই ছিল। আর একটাকে আমাদের ব্রিজলাল আর সাধু তেওয়ারী বেশ বানিয়েছে।

ভেরি গুড।

স্যার, আমার প্রমোশন–চ্যাটার্জির সগুম্ফ মুণ্ডটা বিগলিত হয়ে ঝুলে পড়ল নিচের দিকে। সমানে হাত কচলাতে লাগল সে।

ঠিক সময়েই হবে। ভাবনার কিছু নেই। এখন তুমি যাও–

দরজার দিকে একটা পা বাড়িয়ে অ্যাবাউট টার্নের ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল বৈকুণ্ঠ, স্যার, একটা কথা–

ভুরু কুঁচকে গেল বসওয়েলের। বিরক্ত মুখে জিগ্যেস করল, কী হল আবার?

একবার চোখ তুলেই সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিল বৈকুণ্ঠ। হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ঠোঁটের কাছে উঠে এল তার। কণ্ঠনলীটা কেউ যেন কঠিন থাবায় চেপে ধরেছে, স্যার, পাহাড়ী দুটো এতক্ষণ গোঙাচ্ছিল, এখন আর শব্দ করছে না। ব্রিজলালটা বড় গোঁয়ার, ব্যাটন দিয়ে একটু বেশিই মার দিয়ে ফেলেছে।

 ইজ ইট! কুটিটা এবার তীক্ষ্ণ হয়েছে বসওয়েলের। এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল সে, তারপর বলল, ডোন্ট ওরি। যাও, পাহাড়ী দুটোকে পথে ফেলে দিয়ে এস। শিক্ষাটা ভালো করেই হোক।

পাশের ঘরে চলে গেল বৈকুণ্ঠ।

আর কোমরের পেছনে আঙুলে আঙুলে ফাঁস পরিয়ে মটকাতে মটকাতে বসওয়েল বিড়বিড় করে বলল, আচ্ছা, সব দেখা যাবে। গাইডিলিও, গ্যান্ডি–স্টরচারের গুঁতোয় পাহাড়ীদের মন থেকে ওই নাম দুটো আমি উপড়ে ফেলে দেব। তবে আমার খাঁটি ব্রিটিশ বার্থ। একটা অশ্রাব্য এবং কুৎসিত শপথ আবৃত্তি করল পুলিশ সুপার বসওয়েল। অখ্রিস্টানসুলভ প্রতিজ্ঞা।

.

৩১.

দক্ষিণ দিকের পথটা পাকে পাকে পাহাড় বেয়ে মাও-এর দিকে চলে গিয়েছে। মাও ডিঙিয়ে, অনেক পাহাড়চূড়া আর ঘন বন পেরিয়ে গেলে পৌঁছনো যাবে মণিপুরে, ইম্ফলে। আর বাঁ দিকে সেই পথই দোল খেয়ে উঠে গিয়েছে কোহিমায়। কোহিমার পাহাড় ছুঁয়ে ডিমাপুরের দিকে। তারপর মণিপুর রোড স্টেশনে গিয়ে থেমেছে।

পথের পাশে নিবিড় বনের ভেতর টিলার চূড়ায় একটি ছোট্ট ঘর। বাঁশের দেওয়াল, ওপরে টোঘুটুঘোটাঙ পাতার চাল, ওক কাঠের পাটাতন।

পাটাতনের ফাঁকে ফাঁকে গোটাতিনেক পে কাঠের মশাল জ্বলছে। স্নিগ্ধ আলো। সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে একটি নারীমূর্তির ওপর। সামনের বাঁশের মাচানে স্থির হয়ে বসে রয়েছে। সেই মূর্তি। বড় কপাল, টানা টানা লম্বাটে চোখে দুখণ্ড নীলা যেন জ্বলছে। গলাটা ঘিরে এক পাঁজ মোটা কার্পাস তুলো জড়ানো। সারা দেহে মণিপুরী মেয়েদের মতো ঢোলা পোশাক। আশ্চর্য উজ্জ্বল মুখখানা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে যেন। মনে হয়, এই মুখ থেকে কণা কণা আগুন সংগ্রহ করে ওই পে কাঠের মশাল তিনটে জ্বলছে। বিচিত্র এই নারীমূর্তি। এ মুখের সঙ্গে কোহিমার আকাশে সন্ধ্যাতারাটির কোনো মিল নেই। এ মুখের সঙ্গে পাহাড়ী ভূমিকম্পের যেন আশ্চর্য সঙ্গতি রয়েছে, মিল আছে আকাশ থেকে হঠাৎ খসে যাওয়া একটা উল্কার সঙ্গে। রানী গাইডিলিও।

পাশাপাশি বাঁশের আরো কয়েকটি মাচান। নারীমূর্তির চারপাশে সেই মাচানগুলো সাজানো। সেগুলোর ওপর বসে রয়েছে কয়েকটি যুবক। সমস্ত দেহে কেতাদুরস্ত সাহেবি পোশাক।

গাইডিলিও বললেন, আপনি তো কলকাতা থেকে এলেন, সেখানকার অবস্থা কেমন?

একেবারে সামনের মাচানে বসে রয়েছে যে যুবকটি তার নাম লিকোক্যুঙবা। সে বলল, অবস্থা সাঙ্ঘাতিক। গান্ধিজির নামে সারা দেশ মেতে উঠেছে। আমাদের মেডিকেল কলেজের ছেলেরা ছাড়াও অন্য সব কলেজের ছেলেরা, স্কুল আর ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা, কেউ বাদ যায় নি। স্ট্রাইক হচ্ছে, নন-কো-অপারেশনের ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছে। আজব শহর কলকাতা, আন্দোলনের নামে একেবারে খেপে উঠেছে।

তারপর?

আমি নিজে গান্ধিজির বক্তৃতা শুনেছি। ব্রিটিশাররা ভারত না ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। শুধু কলকাতায় নয়, বোম্বাই পাঞ্জাব গুজরাট–সমস্ত ভারতবর্ষ একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে।

ঠিক। রানী গাইডিলিওর দুচোখে নীলা জ্বলছে। কিন্তু কণ্ঠ কি শান্ত, কি গম্ভীর, আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমাদের এই পাহাড় থেকে সাহেবদের হটিয়ে দিতে হবে। ওরা এসে জোর করে খ্রিস্টান করছে, আমাদের ধর্ম নষ্ট করছে। সমতলের বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া বাধিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ে এসব চলবে না।

ঠিক, ঠিক কথা। ঘরের বাকি সবাই একসঙ্গে সায় দিল, আমাদের নাগা পাহাড়ে একটা সাহেবকেও থাকতে দেব না।

গাইডিলিও বললেন, দু-চারজনের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। তা ছাড়া খুনখারাপি করে ওদের আমরা তাড়াব না। আমাদের পথ হবে গান্ধিজির মতো অহিংস। এর জন্যে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে সব মানুষকে বোঝাতে হবে। সকলকে এক করতে হবে।

ঠিক, ঠিক।

আপনারাও তো শিলং-গৌহাটির ছাত্র। সেসব জায়গার খবর কী? বাঁ পাশের যুবকদের দিকে তাকালেন গাইডিলিও।

গোপীনাথ বরদলৈ, রোহিণী চৌধুরির লিডারশিপে নন-কো-অপারেশন শুরু হয়েছে। একটি যুবক বলল।

দেখুন, আমাদেরও, মানে পাহাড়ী মানুষদের সংগঠন করতে হবে। সাহেবরা, পাদ্রীরা অনেককে টাকাপয়সা দিয়ে বশ করে ফেলেছে। সে যা হোক, আমাদের অনেক অসুবিধা। গ্রামের পাহাড়ীরা যারা কোনোদিন শহর দেখেনি, যেখানে এখনও মাথা কাটার দল রয়েছে, তাদেরও বোঝাতে হবে। তার জন্যে আপনাদেরই সব দায়িত্ব নিতে হবে।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

লিকোক্যুঙবা বলল, আমি লোহটা নাগা। আমাদের গ্রামে ফিরে গিয়ে সাহেবদের মতলবের কথা বলব। গান্ধিজির কথা বলব। গ্রামের লোকেরা বড় সরল, ওদের বুঝিয়ে দিলে ঠিকই বুঝবে।

আর একজন বলল, আমি অঙ্গামী নাগা, আমাদের গ্রামেও এ কথা বলব। ডান দিক থেকে আর একটি কণ্ঠ ফুটে বেরুল, আমি সাঙটাম, আমাদের পাহাড়ও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে না। কালই আমি রওনা হব।

আমরাও, আমরাও–বাকি সকলে জানিয়ে দিল, তাদেরও এতে সায় আছে।

আও, সাঙটাম, কোনিয়াক, অঙ্গামী, রেঙমা, লোহটা, সেমা। নাগা পাহাড়ের দিগদিগন্ত থেকে উদ্দীপ্ত তারুণ্য এই টোঘুটুঘোটাঙ পাতার ঘরে এসে সমবেত হয়েছে। কেউ কলকাতা থেকে, কেউ শিলং-গৌহাটি থেকে এক অপূর্ব প্রতিজ্ঞার অগ্নিকণা বুকে ধরে নিয়ে এসেছে, ধরে এনেছে এক বীর্যবান শপথ। সেই শপথের নাম গান্ধিজি। সেই প্রতিজ্ঞার নাম অসহযোগ। সেই শপথকে নাগা পাহাড়ের গুহায়-অরণ্যে, মালভূমি আর উপত্যকায় বনাগ্নির মতো ছড়িয়ে দেবে তারা।

আচমকা টোঘুটুঘোটাঙ পাতার ঘরখানায় এসে ঢুকল জনকয়েক কিম্ভুত মূর্তি। কার্পাস দড়ির লেপ দিয়ে সমস্ত দেহ জড়ানো। মাথার সামনে ঘোমটার মতো ঢাকনা। তারা পাহাড়ী গ্রামের সর্দার। হাতের লম্বা লম্বা বর্শার ফলায় মশালের আলো ঝকমক করে উঠল।

সর্দারেরা চেঁচামেচি করে উঠল। তাদের একজন বলল, বুঝলি রানী, হুই শয়তান ফাদারেরা আর পুলিশেরা আমাদের টাকা দিতে চায়। বস্তিতে বস্তিতে তোকে ডাইনি বলতে বলে। তা আমরা কেন বেইমানি করব! আমার ছেলে তোর ছোঁয়ায় ভালো হল। কী ব্যারাম যে হয়েছিল! তামুন্যু (চিকিৎসক) বলেছিল, আনিজাতে পেয়েছে। খাদেই ফেলে দিতুম, তুই বাঁচিয়ে দিয়েছিস।

আর-একটি গলা শোনা গেল, বলে কিনা তুই ডাইনি। ভাবলাম, বর্শা দিয়ে একেবারে এফোঁড়-ওফোড় করে ফেলি।

না, না–প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন গাইডিলিও, কক্ষনো মারামারি করবে না। ওরা মারলেও মারবে না।

কী বলছিস তুই! মারলে তার শোধ নেব না! এ কেমন তাজ্জবের কথা! অসহায় গলায় একটি সর্দার বলল।

না। সুকুমার একটি মুখ। সেই মুখের চারপাশে অপরূপ এক জ্যোতির্বলয়। সুঠাম মুখখানার আড়ালে কোথায় যেন একটা বজ্র লুকিয়ে রয়েছে। মণিপুরী পোশাকের আড়ালে ছোট্ট একটি প্রাণকণা টগবগ করে ফুটছে যেন গাইডিলিওর, আমি সব বুঝি, সব জানি। তবুও ওদের গায়ে আমরা হাত তুলব না। খুনোখুনি আমাদের পথ নয়। আর শোন, বস্তির লোকদের বলে দেবে, ফাদারেরা ক্রস আঁকতে বললে, যেন না আঁকে। তা হলে আমাদের আনিজার গোসা হবে। আর ওই সাহেবদের কাছ থেকে কোনো কিছু যেন মাগনা না নেয়।

কেন?

ওরা ঘুষ দেয়। তারপর আমাদের মনটাকে কিনে ফেলে। আমাদের ভিখিরি বানায়। একটু একটু করে খ্রিস্টান করে ওদের রাজ্য বড় করে। শাণিত বল্লমের মতো গলাটা ঝকমক করে উঠল গাইডিলিওর, খাসিয়াদের করেছে, মিকিরদের করেছে, গারোদের করেছে, এখন এসেছে। আমাদের এই নাগা পাহাড়ে।

পেন্য কাঠের মশাল থেকে স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘনপক্ষ্ম চোখে। পার্বতী কুমারী। বছর ষোল বয়স; এখনও গাইডিলিওর দেহ থেকে কৈশোর একেবারে মুছে যায় নি। উদ্ভিন্ন যৌবন। দৃষ্টি যেন ধাঁধিয়ে যায়। বার বার তার দিকে তাকিয়ে তরুণ ছেলেরা দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অবাক চোখে সর্দারেরা তাকিয়ে রয়েছে রানী গাইডিলিওর দিকে। তার একটু আগের কথাগুলো তারা ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। অত্যন্ত দুর্বোধ্য এবং রহস্যময় মনে হচ্ছে। তারা বলল, তুই কী যে বলছিস রানী, কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

গাইডিলিও বললেন, বুঝতে পারছ না? আচ্ছা বুঝিয়ে দিচ্ছি। তোমরা ফাদারের কাছ থেকে নিমক নাও। তার বদলে হরিণের ছাল, বাঘের দাঁত, বুনো মোষের শিঙ দাও?

না। তার বদলে কিছুই নেয় না ফাদারেরা।

মাগনা নাও কেন নিমক?

মাগনা কোথায়? ওরা যা বলে তাই করি। ক্রস আঁকি, যীশু-মেরীর নাম করি।

ওসব করবে না। ওসব ওদের ধর্ম, ওদের গেন্না। তাতে আমাদের আনিজারা রাগ করবে। বুঝলে?

ওদের গেন্না আমাদের দিয়ে করাচ্ছে? একেবারে কুঁড়ে ফেলব না! এবার আমাদের বস্তিতে ঢুকলে সাবাড় করে ফেলব।উত্তেজনায় চোখের তারা যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে সর্দারদের, এমন মনে হয়।

না, খবরদার মারবে না। বস্তিতে গিয়ে বলবে, কেউ যেন ওই ক্রস আঁকা আর যীশু-মেরীর নামের বদলে নিমক কাপড়-টাকা না নেয়। ওরা অনেক, অনেক দূর থেকে আমাদের দেশে এসেছে। এসেই একেবারে সর্দার হয়ে বসেছে।

না। হুই সব হবে না।

ঠিক বলেছ। এমনি থাকতে চাও, থাকো। সর্দারি করতে গেলে ভাগতে হবে। এখন এমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে যে ভাগাতেই হবে। বলে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন গাইডিলিও। তারপর বললেন, শোন সর্দারেরা, দরকার হলে তোমাদের বস্তিতে যাব। থাকবার বন্দোবস্ত করবে তো?

তুই যাবি! তুই গেলে নতুন ঘর করে দেব। নাচ দেখাব, গান শোনাব। আর বস্তির যত ব্যারামী মানুষ আছে তাদের একবার খালি ছুঁয়ে দিবি। সব রোগ চলে যাবে। তুই যাবি তো? সর্দারেরা হইচই করে উঠল।

যাব, যাব। সুন্দর শান্ত হাসিতে মুখখানা ভরে গেল রানী গাইডিলিওর।

হঠাৎ সামনের মাচান থেকে লিকোক্যুঙবা বলল, কী ব্যাপার, ওদের বস্তিতে যাবেন নাকি?

কখন কাদের বস্তিতে যেতে হয়, তার ঠিক আছে? ব্রিটিশদের তাড়াবার জন্যে আন্দোলন হবে। তারা কি সহজে ছেড়ে দেবে? আটক করবে, আন্দোলনকে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা করবে।

তা ঠিক।

পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে দেশের মানুষদের যদি ব্রিটিশদের মতলব, মিশনারিদের কাজকর্ম সম্বন্ধে খানিকটা বুঝিয়ে দিতে পারি, কাজ হবে। ধরুন আমি, আপনি কি আরো পাঁচজন হয়তো ধরা পড়লাম। সেই সঙ্গে কি স্বাধীনতা আন্দোলন মরে যাবে? তা হয় না। আমরাও সমস্ত ভারতেরই একটা অংশ। স্বাধীনতার জন্যে সবাই যখন অহিংসা দিয়ে লড়াই করছে তখন আমাদের এই নাগা পাহাড় পিছিয়ে থাকবে কেন?

ঠিক, ঠিক। সকলে মাথা নাড়ল।

টঘুটুঘোটাঙ পাতায় ছাওয়া ছোট্ট এই ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে এখনও গাইডিলিওর কথাগুলি অদ্ভুত রেশের মতো ছড়িয়ে রয়েছে।

বৈদেহী কয়েকটি শব্দ, অথচ কি শরীরময়। দেহেমনে কথাগুলোর ছোঁয়া পর্যন্ত যেন পাচ্ছে তরুণ ছেলেরা।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর কেউ কিছু বলার আগেই ঘটল ঘটনাটা।

পাঁচ ছজন পাহাড়ী দুটো অচেতন মানুষকে পাটাতনের ওপর এনে শুইয়ে দিল।

বাইরের উপত্যকায় আর বনে, মাও-এর দিকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পথে নসু কেহেঙ মাসের রাত্রি ঘন হয়ে নামছে। আকাশে বিবর্ণ তারাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে একটা অস্পষ্ট আঁচড়ের মতো ফুটে বেরিয়েছে ছায়াপথটা। ফুটে বেরিয়েছে আনিজা উইখু।

গাইডিলিও তাকালেন আগন্তুক পাহাড়ীদের দিকে। বললেন, কী ব্যাপার জদোনাঙ দাদা? এরা কারা?

জদোনাঙ বলল, জানি না, কোহিমার পথে পড়ে ছিল। মানুষ দুটো ঠাণ্ডায় একেবারে হিম হয়ে গেছে। আর জ্ঞানও নেই।

বাঁশের মাচান থেকে নিচের পাটাতন নেমে এলেন গাইডিলিও, পাটাতনে কেন? মাচানে বিছানা করে শুইয়ে দাও। আমি সেঁক দেবার ব্যবস্থা করি।

পেন্যু কাঠের মশালের আলো এসে পড়েছে নরদেহ দুটোর ওপর। থোকা থোকা রক্ত জমাট হয়ে রয়েছে সমস্ত দেহে। আর রয়েছে ভয়ানক সব ক্ষতচিহ্ন।

অপলক চোখে তাকিয়ে আছে গাইডিলিও। এতক্ষণ যে চোখ জোড়া তার জ্বলছিল এখন সে দুটো থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরতে শুরু করেছে। ঝাপসা গলায় তিনি বললেন, নিশ্চয় এদের কেউ মেরেছে।

জলদানাঙ মাথা নাড়ল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। মানুষ দুটো ওই কোহিমা থানার কাছে পড়ে ছিল। অন্ধকারে পায়ে ঠেকতে তুলে নিয়ে এলাম।

.

৩২.

নসু কেহেঙ মাসের প্রথম দিকে সিঁড়িখেতে জোয়ার বুনে এসেছিল জোয়ান ছেলেমেয়েরা। তামাটে অঙ্কুরে অঙ্কুরে ভরে গিয়েছিল পাহাড়ী উপত্যকা। সেই অঙ্কুর এখন ডাগর হয়েছে। সবুজ লাবণ্যে ঝলমল করে উঠেছে পাহাড়িয়া সিঁড়িখেত। খেতের ফসল-ঘরগুলো আকাশের দিকে মাথা তুলে সারাদিন রোদ ঠেকায়। জোয়ারের চারাগুলো দিনে দিনে বেড়ে ঋতুমতী হবে। তারপর সারা দেহে শস্যের জ্বণ জন্মাবে। তার অনেক আগেই পাহাড়ী মানুষেরা জঙ্গল কাটতে যাবে। গাছপালা পুড়িয়ে তৈরি হবে পাথুরে মাটির সার। সারালো মাটি চৌরস করে বীজধান বোনা হবে।

কেলুরি গ্রামে জঙ্গলকাটার তোড়জোড় চলছে। চলছে ধান বোনার প্রাথমিক প্রস্তুতি। কয়েক দিন পর থেকেই একরাশ গেন্না শুরু। ধারাবাহিক, একটানা। মেথি গিল্ডা কেই নে গেন্না। টসি চি কেতসা গেন্না। টেসে গা গেন্না। এমনি অনেক। গেন্না হল উৎসবের একটা বড় অঙ্গ।

বুড়ি বেঙসানু সিঁড়িখেত পেরিয়ে মালভূমিতে গিয়েছিল সকালবেলায়। বড় একটা মৌচাক কেটে এইমাত্র গ্রামে ফিরল সে। সরাসরি ঘরে এসে গোটা দুই বর্শা নিয়ে আবার বেরুল।

জোরি কেসুঙ থেকে তাকে দেখতে পেয়ে ফাসাও আর নজলি সাঁ সাঁ করে ছুটে এল। দুজন দু’দিক থেকে ঘিরে ধরল বুড়ি বেঙাসানুকে, ঠাকুমা, বড় খিদে পেয়েছে, খেতে দে।

খিদে পেয়েছে? আমি কী করব? তোদের বাপ আছে, মা আছে, দাদা আছে, তাদের কাছে। যা।দাঁত খিঁচিয়ে একটা কদাকার মুখভঙ্গি করল বেঙসানু, হুই শয়তানের বাচ্চা সেঙাইটা সেই যে কোহিমা গেল, আর ফিরবার নাম নেই। সিজিটোটা গিয়েও আর ফেরেনি। সেঙাইও ফিরল না। খেতে জোয়ার বোনেনি। খাবি কী?

তা আমরা কি জানি! খিদে পেয়েছে। বায়না শুরু করে দিল ফাসাও আর নজলি।

গায়ে কি আমার জোয়ান কালের তাগদ আছে? তা থাকলে নয় শিকার-টিকার করে নিয়ে আসতাম। খাবি কী? আমার হাত-পা ঝলসে খা।

কেমন লাগবে তোর মাংস?ফাসাও আর নজলির মুখেচোখে সবিস্ময় কৌতূহল।

আরে শয়তানের বাচ্চারা, আমার মাংস গিলতে চাইছিস! বুড়ি বেঙসানুর ঝাপসা চোখ দুটোর ওপর নকল শঙ্কা ঘনিয়ে এল। একটু পর আবার বলতে শুরু করল সে, তোরা বাইরের ঘরে গিয়ে বোস, আমি খাপেগা সদ্দারের বাড়ি থেকে চাল নিয়ে আসি। আর যদি পাই একটু মাংস।

তাড়াতাড়ি আসবি। খিদেতে পেট কামড়াচ্ছে।

ফাসাও আর নজলি নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেল। আর বেঙসানু তিনটে বড় বড় টিলা ডিঙিয়ে এল বুড়ো খাপেগার বাড়ি।

একখানা বাদামি রঙের পাথরের ওপর বসে রয়েছে বুড়ো খাপেগা। বাঁশের সরু চোঙায় তামাক পুড়ছে। তরিবত করে সেই চোঙার ফোকরে মুখ রেখে দীর্ঘ টান দিয়ে চলেছে সে। তামাকের মৌতাতে চোখদুটো বেশ ঢুলুঢুলু হয়ে উঠেছে।

বুড়ো খাপেগা এবার সরব হয়ে উঠল, আয় বেঙসানু, তারপর খবর কী বল?

খবর আবার কী, ঘরে এক দানা খাবার নেই। আমার এত বয়েস হয়েছে কোত্থেকে কী জোগাড় করব, বল? হুই সিজিটো আর সেঙাইর মা মাগীটা তো কোহিমা গেল। তারপর আজ কদিন হল সেঙাইও গেছে। একটারও ফিরবার নাম নেই। ফাসাও রয়েছে, নজলি রয়েছে। ওদের তো কিছু দিতে হবে খেতে।

হু-হু। তা তো ঠিকই। সংক্ষিপ্ত জবাব। মৌজ করে সমানে তামাক টেনে চলল বুড়ো খাপেগা।

তাই তোর কাছে এলাম।

বিরক্তি এবং সন্দেহে মুখচোখ কুঁচকে গেল বুড়ো খাপেগার। বলল, আমার কাছে কেন?

বেঙুসানু বলে, কেন আবার, আমাকে খানিকটা মাংস আর চাল দে। নইলে কি না খেয়ে মরব?

চাল! মাংস! কোথায় পাব? আমার নেই ওসব। তা ছাড়া চাল-মাংস তুই নিবি কি, আমাকেই বরং দিয়ে যাবি। ভস ভস করে একরাশ তামাকের ধোঁয়া ছাড়ল বুড়ো খাপেগা। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় তার মুখটা ঢেকে গেল।

আমি দেব? কেন? তেরছা নজরে তাকাল বুড়ি বেঙসানু।

তোর নাতির বউকে খাওয়াচ্ছি। সেই খাওয়ার দামটা দেবে কে?

আমার নাতির বউ! সে আবার কে? বিস্ময়ে বুড়ি বেঙসানুর গলা অদ্ভুত শোনায়, সেঙাইর বিয়ে হল কবে?

হু-হু, সেঙাইর বউ। হুই পোকরি বংশের মেয়ে। নাম হল মেহেলী। বিয়ে এখনও হয়নি। কোহিমা থেকে সেঙাই ফিরলেই হবে। সেই বউর খোরাকি দিয়ে যাবি এখন থেকে।

ইজা রিহুগু! কদর্য একটা খিস্তি আউড়ে বুড়ি বেঙসানু বলল, আমার ঘরে এক দানা খাবার নেই। তার ওপর নাতির বউকে খাওয়াব! এখনও বিয়েই হয়নি যার সঙ্গে!

এতক্ষণ গভীর সংযমের পরীক্ষা দিয়েছে বুড়ো খাপেগা। এবার সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, তোর নাতি জোয়ান ঘুড়িটাকে নিয়ে মজা মারবে, আর আমি বুঝি খাইয়ে পরিয়ে তাকে পুষব? তার তাজা শরীর পাহারা দেব? মাগনা ওসব হবে না।

তার আমি কি জানি। সেঙাই এলে তার কাছে চাল মাংস চাইবি। তার বউ হবে, সে বুঝবে। সে তার বউকে খাওয়াবার আর পুষবার ভাবনা ভাববে। তুই আমাকে চাল দে, মাংস দে। ফাসাও আর নজলিটা না খেয়ে রয়েছে। শেষ দিকে কথাগুলো বড়ই করুণ শোনাল বুড়ি বেঙসানুর।

চাল নিবি! মাংস নিবি! তার দাম এনেছিস?,

হু-হু– পাশ থেকে জঙগুপি কাপড়ের একটা বোঁচকা সামনে টেনে এনে খুলে ফেলল বেঙসানু। সদ্যকাটা একটা মৌচাক আর দুটো বর্শা।বর্শার ফলা রোদের আলোয় ঝকমক করে উঠল।

আচমকা ঘটে গেল ঘটনাটা। বাদামি রঙের পাথরখানা থেকে মৌচাক আর বর্শার ফলা দুটোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বুড়ো খাপেগা। সেগুলো তুলে নিয়ে সাঁ করে সামনের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল মুহূর্তে।

প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় থ মেরে গিয়েছিল বুড়ি বেঙসানু। বোকা বোকা চোখে দেখছিল, কেমন করে বুড়ো খাপেগার দেহটা বিদ্যুৎগতিতে সামনের ঘরখানায় অদৃশ্য হল। মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। তারপরই বুড়ি বেঙসানু একটানা খিস্তি আওড়াতে শুরু করল, সাসুমেচু! ওরে শুয়োরের বাচ্চা, আমার বর্শা আর মৌচাক নিলি যে? এখুনি ফিরিয়ে দে। নইলে রেনজু আনিজা তোর গুষ্টিকে পাহাড় থেকে খাদে ফেলে সাবাড় করবে। মর, মর তুই। তোর ঘাড় মুচড়ে রক্ত খাব। নে রিহুগু!

বাইরের ঘরে ঢোকার পথটা একখানা অতিকায় পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে বুড়ো খাপেগা। এবার সেই নিরাপদ এলাকা থেকে সমানে সে জবাব দিতে লাগল, টেমে নটুঙ! যা, যা এবার। তোর নাতির বউকে পুষছি, তার দাম নিলাম।

গালাগালিতে দুপক্ষই সমান ওস্তাদ। কেউ কারো চাইতে কম যায় না। খিস্তিখেউড়ে পাহাড়ী দুপুরটা কুৎসিত হয়ে উঠল।

চারপাশের কেসুঙগুলো থেকে মজা দেখতে সবাই এসে জমায়েত হয়েছে; গোল করে ঘিরে ধরেছে বুড়ো খাপেগার ছোট্ট বাড়িটাকে। ফিসফিস গলায় বলছে, সদ্দারটা একটা সাসুমেচু (অত্যন্ত লোভী মানুষ)।

আমার মৌচাক আর বর্শা দে। আমি মেহেলীর সঙ্গে সেঙাইর বিয়ে দেব না। তার খাবারও দেব না।

পাটের ফেঁসোর মতো এক মাথা রুক্ষ চুল ছিঁড়ে, কদর্য খিস্তিগুলো নানা অঙ্গভঙ্গি করে আউড়ে, অনেক শাপশাপান্ত করে, শ্রান্ত হয়ে পড়ল বুড়ি বেঙসানু। এতক্ষণ ঘোলাটে চোখদুটো তার দপদপ করে জ্বলছিল, ক্ষয়ে যাওয়া শেষ কটা দাঁত কড়মড় শব্দ করছিল। জীর্ণ শুকনো বুকটা থরথর করে কাঁপছিল। এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল বুড়ি বেঙসানু, তোর গুষ্টি সব খতম হবে। ফাসাও আর নজলি খায়নি এখনও।

কিন্তু সে কান্নায় কোনো ফলই হল না। এক মুঠো চাল কি দু খণ্ড মাংস দেওয়া দূরে থাক, মুখ বাড়িয়ে একবার উঁকিও দিল না বুড়ো খাপেগা। বেঙসানুর কান্না তাকে টলাতে পারে নি, তার কঠোর কঠিন মনটাকে এতটুকু গলাতে পারেনি। বন্ধ ঘরে চুপচাপ বসে রয়েছে বুড়ো খাপেগা। একটুও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না তার।

অনেকক্ষণ পর বিড়বিড় করে বকতে বকতে আর হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনটে টিলা পেরিয়ে নিজেদের কেসুঙে ফিরে এল বুড়ি বেঙসানু। দুপুরের রোদে তখন বিকেলের আমেজ লেগেছে।

কেঁদে কেঁদে দুটো চোখ জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে আবছা দৃষ্টিতে বেঙসানু এক রূপবতী যুবতাঁকে দেখতে পেল। উজ্জ্বল তামাটে দেহ। মসৃণ, সুঠাম উরুতে একটি ভঁজের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সামনে এক ফালি ঘাসের জমিতে বসে রয়েছে মেয়েটা। তাকে দু’দিক থেকে ঘিরে ধরেছে ফাসাও আর নজলি। ঝরনার শব্দের মতো কলকল হাসি আর গল্পে মেতে রয়েছে তিনজনে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বুড়ি বেঙসানু। কে মেয়েটা? আগে কোনোদিন একে তো দেখেনি। কোত্থেকে, কোন পাহাড় না বন থেকে, কি আকাশ ছুঁড়ে এই সুন্দর মেয়েটা তাদের কেসুঙে এসে পড়েছে! ভেবে ভেবে থই পায় না বুড়ি বেঙসানু।

হঠাৎ মেয়েটা তাকাল বুড়ি বেঙসানুর দিকে। উঠে দাঁড়াল সে, তারপর ছুটতে ছুটতে একটা বেতের ঝোড়া নিয়ে তার কাছে চলে এল। বলল, এই যে ঠাকুমা, চাল আর মাংস এনেছি।

লাল লাল একরাশ চাল আর একখণ্ড শুয়োরের মাংস সমেত বেতের ঝোড়াটা সামনে। বাড়িয়ে দিল মেয়েটা।

একটা ভোজবাজি যেন। অবিশ্বাস্য এবং দুর্বোধ্য। এই ঢলে-পড়া দুপুরে স্বপ্ন দেখছে নাকি বুড়ি বেঙসানু? হাত বাড়িয়ে ঝোড়াটা নিতে ভুলে গেল সে।

ইতিমধ্যে ফাসাও আর নজলি ঘাসের জমিটা থেকে উঠে এসেছে।

মেয়েটা বলল, আমি সদ্দারের পেছনের ঘর থেকে তোকে দেখেছি, তোর কথা শুনেছি। তাই এই চাল আর মাংস নিয়ে এলাম। এগুলো নে।

কে তুই?

আমি মেহেলী। একটু থামল মেহেলী। ইতিউতি তাকিয়ে আবার বলল, আমি এবার যাই।

অসীম কৃতজ্ঞতায় মনটা বিগলিত হয়ে গিয়েছিল বুড়ি বেঙসানুর। কিন্তু মেয়েটার নাম শুনেই স্নায়ুগুলো রাগে উত্তেজনায় টগবগ করে উঠল। মেহেলী! পোকরি বংশের মেয়ে, যে বংশ তার আঠারো বছরের যৌবনকে ফালা ফালা করে সাবাড় করেছে, তার জীবনকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে চিরকালের মতো, তার সোয়ামী জেভেথাঙ ওই পোকরি বংশের মেয়ে নিতিৎসুকে ছিনিয়ে আনতে গিয়ে লড়াই বাধিয়ে খতম হয়ে গিয়েছে। সেই বংশের উত্তরকাল। মেহেলী। অনেকখানি সংশয় পুঞ্জীভূত হল মনে। অস্ফুট চেতনার ওপর দিয়ে কুটিল একটি সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে এল। এই মেহেলীকে নিয়ে পোকরি আর জোহরি বংশে নতুন আত্মীয়তা, না নতুন এক খণ্ডযুদ্ধের সূচনা? কিন্তু মেয়েটার মুখখানা কি সুন্দর! কি আশ্চর্য নির্দোষ! স্নিগ্ধ লাবণ্যে ঝলমল করছে সারা দেহ। এই মেয়েই সেঙাইর লাগোয়া লেন্য, পিরিতের জোয়ানী। সেঙাইর কামনার মানুষী। মোরাঙের নারীহীন শয্যায় সেঙাইর মনে এই মেয়েই একটি সুখস্বাদ স্বপ্নের সঞ্চার করে রাখে! এই মেয়েকে না ভালোবাসা যেন অপরাধের। হঠাৎ সব সংশয়, সব সন্দেহ জলের লেখার মতো মুছে গেল বুড়ি বেঙসানুর চেনা থেকে। প্রসন্ন উদারতায় মনটা ভরে উঠল।

মেহেলী–পোকরি বংশের মেয়ে। সালুয়ালা গ্রামের মেয়ে। বিচিত্র রহস্যময়ী। সে কেমন করে এল কেলুরি বস্তিতে! কিসের প্রেরণায়? এতক্ষণ তন্ময় হয়ে অনেক কিছু ভাবছিল বুড়ি বেঙসানু। এবার সচেতন হয়ে তাকাল সে। আশ্চর্য, কখন যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে মেহেলী। এ কি, ফাসাও আর নজলিও নেই।

চারিদিকে তাকাল বুড়ি বেঙসানু। তিনটে ছেলেমেয়ের একটাকেও কোথাও খুঁজে বার। করতে পারল না সে। আচমকা কেসুঙের পেছন দিক থেকে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল। চমকে ঘুরে তাকাল বুড়ি বেঙসানু। তার চোখদুটো খুশিতে মোলায়েম হল। মেহেলী, ফাসাও এবং নজলি বিশাল খাসেম গাছটার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। গুটি গুটি পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল বেঙসানু।

মেহেলী উঠে দাঁড়াল, আমি যাই।

যাবি কেন?

তুই তো আমাকে সেঙাইর বউ করবি না; তবে আর থেকে কী করব? চলেই যাই।

কৌতুকের আভাস ফুটে বেরুল বেঙসানুর চোখেমুখে। বলল, গোসা হয়েছে? তুই কেমন করে জানলি, তোকে সেঙাইর বউ করব না?

আমি সদ্দারের ভেতরের ঘর থেকে সব শুনেছি।

হু-হু। কাঁকড়ার দাঁড়ার মাতা শীর্ণ দুটো হাতের আঁজলে পরম মমতায় মেহেলীর মুখখানা তুলে ধরল বুড়ি বেঙসানু, তোকে ছাড়া আর কাউকে সেঙাইর পাশে মানায় না। তোকে তো আগে দেখিনি, দেখলে কি ওকথা বলতাম?

সারাটা দেহে আনন্দর শিহরন খেলে গেল মেহেলীর। খুশি খুশি মুখে তাকিয়ে রইল পাহাড়ী মেয়ে। নির্বাক, একেবারেই চুপচাপ।

বুড়ি বেঙসানু বলল, তুই যে এ বস্তিতে চলে এলি মেহেলী! আমরা তো তোদের শত্রু।

হাসিমুখে মেহেলী বলল, তোর নাতিকে দেখে মন মজেছে। শত্রুতার কথা ভুলে গেছি। আমার বাপ টেমি খামকোয়ান্নর (বাঘমানুষ) সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চায়। সেঙাই ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করব না। তাই নদী পেরিয়ে পালিয়ে এসেছি। তোদের সদ্দারকে ধরমবাপ ডেকে তার বাড়িতে রয়েছি।

অকপট স্বীকারোক্তি। মনোরম একখানা মুখ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেহেলীর দিকে তাকিয়ে রইল বুড়ি বেঙসানু।

মেহেলী বলল, সেঙাই কোহিমা থেকে কবে ফিরবে ঠাকুমা?

কী জানি। খিঁচিয়ে উঠতে গিয়েও পারল না বুড়ি বেঙসানু। পোকরি বংশের মেয়েটা যেন জাদু করেছে তাকে। কোমল গলায় বলল, বুঝেছি

কী বুঝেছিস?

সেঙাইকে ছাড়া সোয়াস্তি পাস না, ঘুম হয় না। লজ্জা কি, বয়েসকালে আমাদেরও হত না। বুড়ি বেঙসানু মেহেলীকে দেখতে দেখতে তার যৌবনকালকে আস্বাদ করল যেন। গাঢ় গলায় বলল, ভয় নেই, সেঙাই ফিরলে জোড় বেঁধে দেব তোদের।

.

৩৩.

দু’দিন পর চোখ মেলল সেঙাই। টকটকে লাল চোখ। সেই চোখের মণিতে ছায়া পড়ল এক অপরূপ নারীমুখের। অনেকটা সময় নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। বিস্ময়ে কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছে সে। কথা বলতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে।

অপরিচিত নারীমুখ। পরম মমতায় আর লাবণ্যে সে মুখ মাখামাখি হয়ে রয়েছে। মুখখানা আরো কাছাকাছি ঝুঁকে এল। বলল, এখন কেমন লাগছে?

দু’দিন একেবারে বেহুশ পড়ে ছিল সেঙাই। এর মধ্যে কখন কোথায় কী ঘটেছে, তা সে জানে না। সব কেমন একটা অসত্য স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। একটা অবাস্তব বিভ্রমের মতো আচ্ছন্ন চেতনার ওপর দিয়ে ছায়াছবির মিছিল সরে গেল সেঙাইর। মাথোলাল, গান্ধিজির লড়াই, পাদ্রীসাহেব, সেই চার্চ, বেয়নেট নিয়ে পুলিশের ঝাঁপিয়ে পড়া। তারপরেও একটু হুঁশ ছিল তার। সারুয়ামারুর সঙ্গে কাদের যেন খানিকটা হাতাহাতি, হুমকি, চেঁচামেচি, গর্জন। তারও পর কারা যেন কোহিমার রুক্ষ, শক্ত এবং ধারাল পথের ওপর দিয়ে তাদের একটা ঘরে নিয়ে। গেল। আসান্যুরা (সমতলের লোক) এল। একটা লোকের বিরাট একজোড়া গোঁফ। আরো কয়েকটা নোক এসেছিল অদ্ভুত এক ধরনের লাঠি নিয়ে এর আগে ব্যাটন দেখে নি সেঙাই)। গুফো লোকটা কী একটা বলবার সঙ্গে সঙ্গে তার পিঠের ওপর সেই লাঠির ঘা পড়তে লাগল একটার পর একটা, অনেক। মনে হচ্ছিল, হাড়গুলো গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা। তারপর আর জ্ঞান ছিল না। ছবিগুলোর মধ্যে কোনো মিল নেই, কোনো ধারাবাহিকতা নেই। সব টুকরো টুকরো, অসংলগ্ন।

চেতনার ওপর ওই সব ভয়ানক ছায়াছবির সঙ্গে এই মমতাময় মুখখানার কোনো সঙ্গতিই খুঁজে বার করতে পারল না সেঙাই। নির্মিমেষ তাকিয়েই রইল। কেমন করে সে পাদ্রী, সমতলের বাসিন্দা, মারধর এবং আতঙ্ককর পরিবেশ থেকে এই করুণাময়ীর কাছে এল,বুঝেই উঠতে পারছে না সেঙাই। এ তার ধারণার বাইরে। আবছা সন্ধ্যার এই ছায়াছায়া অন্ধকারে কি একটা অবিশ্বাস্য স্বপ্ন দেখছে সে?

নারীমুখটি আরো অনেকটা ঝুঁকে এল, নাম কী তোমার?

সেঙাই। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল সেঙাই। মাচানের বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, সারুয়ামারু কোথায়? সে তো আমার সঙ্গেই ছিল।

এই তো। পাশের মাচানে একটা ক্ষীণ স্বর শোনা গেল, একেবারে নড়তে পারছি না রে সেঙাই। শয়তানের বাচ্চারা মারের চোটে হাড় পাঁজরা চুর চুর করে দিয়েছে। কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসল সারুয়ামারু।

সেঙাই বলল, শয়তানেরা মারাত্মক। ইজা হুবুতা।

একটুক্ষণ চুপচাপ।

আচমকা সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, আমরা এখানে কেমন করে এলাম রে সারুয়ামারু?

রানী গাইডিলিওর লোকেরা নিয়ে এসেছে। আমাদের নাকি হুই পুলিশরা কোহিমার রাস্তায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। একেবারে হুঁশ ছিল না, এমন মার দিয়েছিল রামখোর ছায়েরা। একটু থামল সারুয়ামারু। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে রীতিমতো হাঁপানি ধরে গিয়েছে। ফুসফুস ভরে হুস হুস করে বারকয়েক বাতাস টেনে আবার বলতে শুরু করল সে, রানী গাইডিলিও না থাকলে কোহিমার পাহাড়ে মরেই থাকতাম আমরা।

রানী গাইডিলিও! কে? কই! বিস্ময়ে গলাটা কাঁপা কাঁপা শোনাতে লাগল সেঙাই-এর।

হুই যে। সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সারুয়ামারু।

সেই নারীমুখ–দু’দিন পরে চোখ মেলে যাকে প্রথম দেখেছে সেঙাই। এক অপরূপ জ্যোতি সেই মুখের চারপাশে স্থির হয়ে রয়েছে। রানী গাইডিলিও। এঁকে নিয়ে এক অদ্ভুত, বিস্ময়কর গল্প বলেছিল মাধোলাল। রানী গাইডিলিও। এঁকে নিয়ে পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে তার বচসা হয়েছিল। ধারাল বিরাট বর্শা ছুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার কবজি। সেই গাইডিলিও, যাঁর ছোঁয়ায় দেহ থেকে মৃত্যু পলাতক হয়, জরা ফেরারি হয়। সেই গাইডিলিও, হাত বাড়িয়ে এখন তাকে ছোঁয়া পর্যন্ত যায়। বিস্ময়ে, অদ্ভুত ধরনের ভয়ে, নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেঙাই। তার কপিশ চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।

একসময় অস্ফুট গলায় চিৎকার করে উঠল সেঙাই, তুই রানী গাইডিলিও!

নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলেন গাইডিলিও। শুধু একটি প্রসন্ন হাসি একটু একটু করে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল তার।

সারুয়ামারু তৎপর হয়ে উঠেছে, হুই যে তোকে বলেছিলাম, রানী গাইডিলিও ছুঁয়ে দিলে সব রোগ সেরে যায়। দ্যাখ, গেল কিনা? সায়েবের লোকেরা আমাদের মেরে তো বেহুঁশ করে দিয়েছিল। কোহিমার পাহাড়ে পচে পচে মরে যেতাম। রানীর লোকেরা আমাদের তুলে নিয়ে এল। রানী ছুঁয়ে দিল। সব রোগ চলে গেল। তাই না? আমার তো কালই জ্ঞান ফিরেছে। তুই তখন ব্যথার ঘোরে বিড়বিড় করে কী যেন বকছিস। ভাবলাম আনিজাতে পেয়েছে।

তারপর? আতঙ্কে শ্বাসনলীটা যেন চেপে এল সেঙাইর। মনের ওপর খোনকের মুখখানা ভেসে উঠল। সালয়ালা গ্রামের তামুন্যু (চিকিৎসক) ব্যারামের ঘোরে বিড়বিড় করার জন্য খাদে ফেলে দিয়েছিল খোনকেকে। গ্রামে থাকলে তার বরাতেও খোকের মতো অপঘাত ছিল। ভয়ে আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল সেঙাই, তারপর কী হল সারুয়ামারু?

হুই রানী গাইডিলিও তোকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, আমাকে বাঁচিয়েছে। সব আনিজা ভেগে গেছে।

অসীম কৃতজ্ঞতায় পাহাড়ী জোয়ান সেঙাই-এর মনটা ভরে গেল। আবার তাকাল সে রানী গাইডিলিওর মুখের দিকে। আচমকা সেই মুখের ওপর আর একজনের ছায়া পড়ল। মেহেলীও একদিন তাকে সালুয়ালা গ্রামের অতল খাদ থেকে উদ্ধার করেছিল( নিশ্চিত অপমৃত্যুর হাত থেকে তুলে এনে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সেঙাই ভাবতে লাগল। তার ভাবনাটা সুষ্ঠু শৃঙ্খলাবদ্ধ না হলেও, এলোমেলো হলেও, মোটামুটি এইরকম। মেহেলী আর গাইডিলিও। দুজনের মধ্যে এক জায়গায় মিল রয়েছে। সে মিলটি সেবার, মমতার। দুজনেই তাকে বাঁচিয়েছে। এ ছাড়া আপাতত অন্য কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মেহেলীর সুন্দর তামাটে শরীর সারাদেহের কামনাকে দাবানলের মতো জ্বালিয়ে তোলে। আর গাইডিলিওর এই কমনীয় মুখখানার দিকে তাকালে রিপুর ফণারা টলে পড়ে। এতকাল ভয়, বিস্ময়, রোষ এবং প্রতিহিংসা ছাড়া অন্য কোনো বোধ জাগত না সেঙাইর মনে। এখন, এই মুহূর্তে গাইডিলিওকে দেখতে দেখতে স্থূল, অতি স্পষ্ট আদিম কতকগুলি অনুভূতির সঙ্গে সভ্য জগতের একটা অদ্ভুত অনুভূতি মিশে গেল। তার নাম সম্ভ্রম। পাহাড়ী মানুষ সেঙাইর অস্ফুট চেতনা সম্ভ্রমের এক অনুভূতিতে ভরে গেল। এমনটা এর আগে আর কোনোদিনই হয়। নি তার।

মেহেলী আর গাইডিলিও। মেহেলী যেন দু’টি বাহুর মধ্যে দেহের ভোগ এবং উপভোগের জন্য একপিণ্ড কোমল সুস্বাদু নারীমাংস। গাইডিলিও ধরাছোঁয়ার মধ্যে থেকেও অনেক দূরের। তার দিকে হাত বাড়ানো যায় না। অশুচি মন তার উপস্থিতিতে অবশ, আড়ষ্ট হয়ে যায়।

আচমকা সেঙাই বলল, তুই নাকি সায়েবদের সঙ্গে লড়াই করবি?

চমকে উঠলেন রানী গাইডিলিও, কে বললে তোমাদের?

মাথোলাল। হুই যে কোহিমাতে তার দোকান রয়েছে। সেঙাই বলতে লাগল, মাধোলালের কাছে তোর আর গান্ধিজির কথা জেনে এসেছিলাম। ফাদার আমাদের কাছ থেকে সেসব শুনে নিল। মাধোলাল তোর আর গান্ধিজির কথা বলতে বারণ করে দিয়েছিল। হুই ফাদার শুনে নিয়ে আমাদের বেইমান বানাল। বিশ্বাসঘাতক করল। উত্তেজনায় সেঙাইর চোখ দুটো ঝকমক করতে লাগল।

স্মিতমুখে তাকালেন রানী গাইডিলিও, আমি সব শুনেছি সারুয়ামারুর কাছে। ওরা এমনই, মানুষকে বেইমান বানায়। মানুষের বিশ্বাসকে, মনুষ্যত্বকে কয়েকটা টাকা দিয়ে কিনে নিতে চায়।

আধফোঁটা বুদ্ধি, অপরিণত বন্য মন। রানী গাইডিলিওর ভাষার জটিলতা ঠিক বুঝতে পারল না সেঙাই এবং সারুয়ামারু। তবু ওই কথাগুলো দুটো পাহাড়ী মানুষকে তুমুলভাবে নাড়া দিল।

গাইডিলিও বলে চলেছে তখনও, আমরা পাহাড়ী মানুষ, ওরা আমাদের ধর্ম নষ্ট করছে। টাকা-পয়সা কাপড়ের ঘুষ দিয়ে পাপের পথে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের কথামতো না চললে মারছে।

গাইডিলিওর কথাগুলো স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ল সেঙাই-এর। আঁকড়া মাথাখানা প্রবলবেগে নাড়িয়ে সে বলল, হু, তুই ঠিক বলেছিস। আমাদেরও টাকা দিতে চেয়েছিল হুই ফাদারটা। তুই লড়াই বাধিয়ে দে রানী। আমাদের বস্তি থেকে বর্শা নিয়ে আসব, জোয়ান ছেলেদের ডেকে আনব। পাহাড় থেকে শয়তানের বাচ্চাদের খুঁড়ে কুঁড়ে খাদে ফেলে দেব। শয়তানেরা আমাদের পাহাড়ে এসে আমাদেরই মারে। এই দ্যাখ।

তড়িৎগতিতে কোমরের কাপড়টা সামান্য সরিয়ে দেখাল সেঙাই। সেখানে একটা বিশাল ক্ষত। দিন দুই আগে সেই মণিপুরী পুলিশটা বেয়োনেটের আধ হাত ফলা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই বীরকীর্তি দগদগে ঘা হয়ে গিয়েছে। সেঙাই এখনও থামেনি, হুই মণিপুরী আর আসা (সমতলের লোক), দু দলকেই খেদিয়ে দিবি। ওরাই মেরেছে আমাদের।

চকিত হয়ে উঠলেন গাইডিলিও। বললেন, সব দোষ ওই সাহেবদের। ওরা বলেছে, তাই আসান্যুরা তোমাদের মেরেছে। সাহেবরাই হল আসল শয়তান। ওদের সঙ্গেই আমাদের লড়াই হবে।

কবে? কবে? রীতিমতো উৎসাহিত হয় উঠল সেঙাই, কবে লড়াই বাধবে?

বেধে গেছে। গান্ধিজি বাধিয়ে দিয়েছেন। আমাদের পাহাড়েও বোধ হয় বেধেছে কাল থেকে।

লড়াই বেধেছে? কটা মরেছে?

একজনও নয়। এ লড়াইতে মারামারি হয় না। আমরা মারি না, মারবও না। কিন্তু সাহেবরা আমাদের ধরে নিয়ে আটক করে রাখবে, মারবে। রানী গাইডিলিওর কোমল সুকুমার দেহটা পাথরের মতো কঠিন এবং ভীষণ হয়ে উঠেছে। একটু আগে যে চোখ দুটো স্নেহে মমতায় কোমল ছিল, এখন তা জ্বলছে। গাইডিলিও বললেন, এই লড়াইতে তোমাদেরও আসতে হবে সেঙাই।

মাধোলাল বলেছিল, গান্ধিজির লোকেরা নাকি মার খাচ্ছে, কিন্তু মার দিচ্ছে না। এ কেমন লড়াই! তুইও একথা বলছিস। আমরা পাহাড়ী মানুষ। লড়াই হবে, অথচ মানুষ মরবে না, এমন কথা তো সদ্দার বলেনি কোনোদিন। তবে কি তুই গান্ধিজির লোক?

আমরা সবাই গান্ধিজির লোক। বলে একটু থামলেন গাইডিলিও। দেখতে লাগলেন তার কথাগুলো দুটো সহজ পাহাড়ী মানুষের ওপর কী প্রতিক্রিয়া করছে। তারপর বললেন, গান্ধিজিই বলেছেন, এ লড়াইতে সাহেবদের আমরা মারব না। আর যদি খাই, মার খেয়ে খেয়েই আমরা জিতে যাব।

এই কথা মাথোলালও বলেছিল। অদ্ভুত এই সংগ্রাম। বর্শা নেই, তীরধনুক নেই। নিরীহ দেহটিকে সাহেবদের হাতিয়ারের সামনে অসহায়ভাবে তুলে ধরতে হবে। বন্য মন ঠিক সায় দেয় না। পাহাড়ী হৃদয় ঠিক প্রেরণা পাচ্ছে না। অথচ গাইডিলিও বলছেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদ জানাবার মতো দুঃসাহস নেই সেঙাই-এর। মাথোলালের কাছে গান্ধিজির আজব লড়াইর গল্প শুনে মনটা অবিশ্বাসে ভরে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে রানী গাইডিলিওর কথা শুনতে শুনতে একটা কিনারাহীন অথই সমস্যার মধ্যে হাবুডুবু খেতে লাগল সেঙাই। গাইডিলিওর এই যুদ্ধকে অবিশ্বাস করার মতো সাহস পর্যন্ত নেই তার।

গাইডিলিও বললেন, আমাদের এই লড়াইতে তোমরাও আসবে তো সেঙাই? আমাদের সঙ্গে মিলে মিশে সাহেবদের বি(দ্ধে (খে দাঁড়াবে?

সারুয়ামারু কুণ্ঠিত গলায় বলল, একবার সদ্দারকে জিগ্যেস করে নিই।

সদ্দারকে জিগ্যেস করে নিই? টেমে নটুঙ! হঠাৎ ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠল সেঙাই, সদ্দার তোকে কোহিমার পথ থেকে তুলে নিয়ে বাঁচিয়েছিল?

না না।

রানী আমাদের বাঁচিয়েছে। রানী আমাদের যা বলবে, তাই করব। বেহুশ হয়ে যখন ছিলাম, তখন আমাকে আনিজাতে ধরেছিল। বস্তিতে থাকলে খোনকের মতো নির্ঘাত আমাকে খাদে ফেলে দিত তামুন্যু। দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে গাইডিলিওর মুখের ওপর এনে ফেলল সেঙাই। একটু আগের উত্তেজনা কেটে গিয়েছে। সে বলল, তুই আমাদের বাঁচিয়েছিস। তুই যা বলবি তাই করব। মরতে বললে মরব।

মমতায় মুখখানা স্নিগ্ধ দেখাল গাইডিলিওর। বললেন, এই দেখ এত কথা বললাম, আসল কথাই জানা হয়নি। তোমরা কোন বস্তির লোক?

কেলুরি বস্তির।

দরকার হলে তোমাদের বস্তিতে যাব। থাকতে দেবে তো?সরল মানুষ সেঙাই-এর মধ্যে একটা নিশ্চিত বিশ্বাসের ভিত্তি খুঁজে পেয়েছে গাইডিলিও। তাকে বিশ্বাস করা যায়। তার ওপর আস্থা রাখা চলে।

হু-হু–প্রচণ্ড উৎসাহে মাচান থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল সেঙাই, তোর জন্যে নতুন ঘর বানিয়ে দেব।

একথা বেশি চাউর কোরো না।

হু-হু। তুই যখন বলছিস

বাইরের আকাশে ঝাপসা ভাবটা আর নেই। টুঘুটুঘোটাঙ পাতায় ছাওয়া এই ঘরখানার চার পাশ থেকে রাশি রাশি রোমশ থাবার মতো নেমে আসছে অন্ধকার। ভয়াল সন্ধ্যা, ভয়ালতর পাহাড়ী রাত্রি। চারিদিকে গহন বন। অগুনতি খাসেম আর ভেরাপাঙ গাছ। আতামারী লতার। বাঁধনে বাঁধনে জটিল হয়ে বন কখনও উঠেছে সুউচ্চ টিলায়। কখনও ঢেউ-এর মতো দোল খেয়ে নেমেছে উপত্যকার দিকে। ভয়ানক গলায় চেঁচিয়ে উঠছে আউ পাখির ঝাঁক। কঁ কঁ শব্দে ককিয়ে উঠছে খারিমা পতঙ্গের দল। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সর সর করে চলেছে পাহাড়ী অজগর। খাটসঙ গাছের শাখায় শাখায় লাফিয়ে চলেছে বানরেরা। চিতাবাঘ আর ডোরাদার বাঘেরা দল পাকিয়ে গর্জাচ্ছে। পাখি-পতঙ্গ-সরীসৃপ সবাই এখন নীড়মুখি। বিশৃঙ্খল পাহাড়ী অরণ্যের সংসারেও সবাই নিয়মের শাসনে বাঁধা। সে নিয়ম গুহায় কি নীড়ে, গাছের ফোকরে কি শাখায়, একটি নিভৃত আশ্রয়ে ফিরে যাবার চিরন্তন নিয়ম।

ঘরের মধ্যে একটা পেন্য কাঠের মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে গাইডিলিও। সামনের প্রবেশ পথে অন্য একজন ঝুলিয়ে দিয়েছে বাঁশে বাঁশে ফঁস পরানো একটা ছিদ্রহীন ঝাঁপ।

নাগা পাহাড় গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছে। সামনে মাও-গামী পথের আঁকাবাঁকা রেখা। চারপাশে আদিম হিংসা, অরণ্যের বিভীষিকা। তার মধ্যে টুঘুটুঘোটাঙ পাতায় ছাওয়া ছোট্ট একটি ঘরে পেন্য কাঠের মশালে একবিন্দু আলো। আলো নয়, ও যেন নাগাপাহাড়ের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সব অন্ধকার থেকে সে আলোকে দেহ-মন-আত্মা আর প্রতিজ্ঞা দিয়ে পাহারা দিয়ে রাখছে একটি প্রাণ। সে প্রাণের নাম গাইডিলিও। এই মশালের শিখাঁটিকে নাগা পাহাড়ের উপত্যকা আর মালভূমিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিতে হবে। টঘুটুঘোটাঙ পাতায়-ছাওয়া ঘরখানায় তারই নিভৃত প্রস্তুতি।

ঝাঁপের ওপর একটা ঝড় এসে যেন আছড়ে পড়ল হঠাৎ। চমকে উঠলেন গাইডিলিও। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কে?

আমি লিকোব্যুঙবা। শিগগির ঝাঁপ খুলুন।

তাড়াতাড়ি মাচান থেকে পাটাতনে নামলেন গাইডিলিও। ঝপটা খুলতে খুলতে বললেন, আসুন, আসুন।

ঘরের মধ্যে এসে ঘন ঘন কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল লিকোক্যুঙবা। বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। পুলিশ জানতে পেরেছে আপনি এখানে আছে।

গাইডিলিও চকিত দৃষ্টিতে তাকালেন লিকোব্যুঙবার দিকে। সমস্ত মুখখানা রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। সাদা জামাটা রক্তে ভিজে গিয়েছে। কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে এখনও তাজা রক্ত বেরুচ্ছে। আর্তনাদ করে উঠলেন গাইডিলিও, এ কী হয়েছে! একেবারে খুন করে ফেলেছে, দেখছি!

লিকোক্যুঙবা হাসল। দু’পাটি চকচকে দাঁত পেন্য কাঠের স্নিগ্ধ আলোতে ঝকমক করতে লাগল, কোহিমা থানার সামনে আজ জাতীয় পতাকা তোলা হচ্ছিল। পুলিশ লাঠি আর বেয়নেট চালিয়েছে। এগুলো তারই চিহ্ন। যাক ওসব। এখনই এ-ঘর ছেড়ে আপনাকে চলে যেতে হবে। অঙ্গামীদের গ্রামে লুকিয়ে থাকার একটা ব্যবস্থা করেছি।

কিন্তু আপনার মাথায় এত বড় আঘাত একটু ইতস্তত করলেন গাইডিলিও।

অঙ্গামীদের গ্রামে গিয়ে সব ব্যবস্থা হবে। থানার সামনে অনেককে অ্যারেস্ট করেছে। পুলিশ এদিকে আসছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

এ আস্তানার খবর পুলিশ কী করে পেল?

যে সব সদ্দাররা এখানে আসে তাদের মধ্যে কেউ পুলিশের চর রয়েছে। সেই আমাদের এই উপকারটুকু করেছে। সে যাই হোক, এক্ষুনি আমাদের এ আস্তানা ছাড়তে হবে। আপনার অ্যারেস্ট হওয়া কিছুতেই চলবে না। তা হলে নাগা পাহাড়ের স্বাধীনতা আন্দোলন একেবারে নিভে যাবে। সমস্ত ভারতবর্ষ স্বরাজের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। আমাদের এই নাগা পাহাড় পিছিয়ে থাকলে কিছুতেই চলবে না। আশ্চর্য এক কাঠিন্য নেমে এসেছে লিকোব্যুঙবার কণ্ঠে। চোখমুখ ধারাল বর্শার ফলার মতো ঝকঝক করছে। সে বলতে লাগল, সমতলের জন্যে। রয়েছে গান্ধিজির নেতৃত্ব। আমাদের পাহাড়ী মানুষেরা আপনাকে দেবীর মতো মানে। আপনি জীবিত থাকতে দেশের লোক শয়তানের শিকার হয়ে থাকবে? একটু একটু করে আমাদের ধর্ম নষ্ট হবে? সরল মানুষগুলো শঠ হবে? টাকা খেয়ে বিশ্বাসঘাতক হবে? বেইমান হবে? না না, এত বড় অন্যায় সহ্য করা অসম্ভব।

ঠিক। বারুদের ওপর মশালের শিখা এসে লাগল। দপ করে জ্বলে উঠলেন গাইডিলিও, ঠিক কথা। রক্ত দেখে আমার যেন কেমন লাগছিল। রক্তের পথ তো আমাদের পথ নয়। সে যাক, আমি যাব।

লিকোক্যুঙবা হাসল। বিচিত্র হাসি। সে হাসির মধ্যে একটি দাউদাউ জ্বলা প্রাণের প্রতিচ্ছায়া পড়ল, আঘাতের বদলে আমরা আঘাত হানি না। পিকেটিং-এ একটি পাহাড়ী মানুষও সাহেবদের গায়ে হাত তোলেনি। আমরা হাত তুলব না বলে তো ওরা ছাড়বে না। ওরা এ আন্দোলনকে মেরে ধরে যেমন করে হোক, থামাবার চেষ্টা করবে। একটু থামল লিকোক্যুঙবা। কী যেন ভাবল একবার। তার রক্তাক্ত মুখখানার ওপর কয়েকটা রেখা আড়াআড়ি ফুটে বেরুল। ফের সে বলল, আজ শুনলাম, গান্ধিজিকে নাকি অ্যারেস্ট করবে।

কী বললেন? গান্ধিজিকে আটক করবে! প্রায় চিৎকার করে উঠলেন গাইডিলিও।

হ্যাঁ, তাই শুনেছিলাম। এবার চলুন। পেছনের খাদে অঙ্গামী সর্দার তার লোকজন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লিকোক্যুঙবা অধীর হয়ে উঠল, এবার আমাদের কাজ শুরু হল। অনেক দায়িত্ব, অনেক সমস্যা, অনেক অনেক কাজ।

বিস্মিত চোখে সেঙাইরা তাকিয়ে ছিল গাইডিলিও আর লিকোক্যুঙবার দিকে। পাহাড়ী ভাষায় তারা কথা বলছে। সব কটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছে সেঙাই। কিন্তু সেই কথাগুলো নিঙড়ে একটি উত্তেজনা ছাড়া বিশেষ কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারেনি। যত দুর্বোধ্যই হোক, তার একটি অর্থ সে খুঁজে পেয়েছে। সে অর্থ রক্তের অক্ষরে আঁকা রয়েছে লিকোক্যুঙবার কপালে। লড়াই বেধেছে, মারামারি হচ্ছে।

সেঙাই বলল, কাদের সঙ্গে লড়াই বেধেছে রে? অমন করে ওকে কে মারল?

সাহেবদের সঙ্গে। গাইডিলিও তাকালেন সেঙাই-এর দিকে। বললেন, সেঙাই, আমাদের চলে যেতে হবে এক্ষুনি। ওই দেখ, সাহেবরা ওঁকে মেরেছে। আমাদের ধরতে আসছে।

পালাতে হবে! কেন? আমরা পাহাড়ি মরদ না? চেঁচিয়ে উঠল সেঙাই, আসুক সায়েবরা। আমাকে মেরেছে, তোর লোককে মেরেছে। তিনটে মাথা রেখে দেব।

না না। পাগলামি করো না। ওদের বন্দুক আছে, গুলি করে মারবে।

পাশের মাচান থেকে সারুয়ামারু আলোকদান করল। বন্দুকের মহিমা সম্বন্ধে সে অতিমাত্রায় সচেতন, অনেক দূর থেকে তাক করে বন্দুক দিয়ে আমাদের সাবাড় করবে ওরা। অত দূরে বর্শা ছুড়লেও লাগবে না। তার চেয়ে পালাই চল। আমাদের বস্তিতে কি পাহাড়ে জুতমতো একবার পেলে কুঁড়ে খাসেম গাছের মগডালে ঝুলিয়ে রাখব সায়েবদের।

শিউরে উঠলেন গাইডিলিও। বললেন, খবরদার, কেউ সাহেবদের মারবে না। ওরা মারুক। মারতে মারতে ওরাই একদিন কাহিল হয়ে পড়বে। কত মারবে? আমরা এখন চলে যাচ্ছি। তোমরা বস্তিতে ফিরে যেতে পারবে তো? তোমাদের শরীর খারাপ। কিন্তু এ-ঘর না ছাড়লে সাহেবরা তোমাদের ধরে ফেলবে।

পারব, খুব পারব। খাদে একবার পড়ে গিয়েছিলাম। হাড়গোড় চুরচুর হয়ে ভেঙে গিয়েছিল। তার পরদিন সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে আমি ভেগে এলাম না? সগৌরবে নিজের কৃতিত্বের কথা বলল সেঙাই।

কেন খাদে পড়ে গিয়েছিল? সালুয়ালাঙ বক্তি কোনটা? এসব কৌতূহল প্রকাশের সময় নেই গাইডিলিওর। বেয়নেট বাগিয়ে বুনো মোষের আঁকের মতো ছুটে আসছে পুলিশ। কিছুতেই ধরা দেওয়া চলবে না। এখনই পালিয়ে যেতে হবে। নাগা পাহাড়ের একটি নিভৃত প্রাণকোষে স্বাধীনতার প্রথম আকাঙ্ক্ষার যে অঙ্কুরটি জন্ম নিয়েছে তাকে কোনোমতেই দলিত পিষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। সযত্নে লালন করে নাগা পাহাড়ের দিকে দিকে তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দিতে হবে। সে আকাঙ্ক্ষাকে অগ্নিবীজের মতো নাগাদের প্রাণে প্রাণে ছিটিয়ে দিতে হবে।

গাইডিলিও বললেন, তবে চল। আর দেরি করার সময় নেই।বলতে বলতে পেন্যু কাঠের মশালটা পাটাতন থেকে তুলে নিলেন।

একসময় চারজনে বাইরে এসে দাঁড়াল। গাইডিলিও আবার বললেন, তোমাদের বস্তির নাম তো কেলুরি। দরকার হলে সেখানে যাব। এবার তোমরা সামনের পথে যাও। আমরা পেছনের খাদে নামব।

হু-হু, আমাদের বস্তিতে যাবি। সদ্দার খুব খুশি হবে। আমরা গানবাজনা শোনাব, নাচ দেখাব। তুই আমাদের জান বাঁচিয়েছিস। তোকে সম্বরের মাংস খাওয়াব।

আচ্ছা, আচ্ছা। মধুর হাসিতে মুখখানা ভরে গেল গাইডিলিওর। একটু পরেই সেঙাই আর সারুয়ামারু মাও-গামী পথের দিকে পা বাড়িয়ে দিল। আর একটি পেন্যু কাঠের মশাল আকাবাঁকা পাহাড়ী পথে উতরাই বেয়ে নিচের খাদে নামতে লাগল। কবে নাগা পাহাড়ের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা হয়ে গাইডিলিওর হাতের ওই ক্ষুদ্র অগ্নিবিন্দুটি দিকে দিকে বনবহ্নির মতো ছড়িয়ে পড়বে? প্রাণে প্রাণে একটি আগ্নেয় প্রতিজ্ঞার দাবানল ছড়াবে? কবে, কত কাল, কত দিন-মাস-বছর পেরিয়ে সেই পরম শুভময় মুহূর্ত?

.

৩৪.

বুড়ো খাপেগার কেসুঙে কেলুরি গ্রামের সব মেয়েপুরুষ জমায়েত হয়েছে। নানা বংশের প্রাচীন মানুষেরা এসেছে। বাহারি সাজে সেজে এসেছে কুমারী মেয়েরা। কোমরের খাঁজ থেকে নিটোল জানু পর্যন্ত কামেরু সু কাপড়। বাঁশের চাচারি দিয়ে আঁটো করে বাঁধা চুল। মাথার দু’পাশে আউ পাখির পালক এবং আতামারি ফুল গোঁজা। গলায় হাতির দাঁতের আরুখা হার। গোল নরম হাতে বাদামি হাড়ের বালা। জীবন্ত পাহাড়ী কাব্য সব। তাদের বাহার কত! অফুরন্ত যৌবনের ফুর্তিতে সবাই যেন টগবগিয়ে ফুটছে। এসেছে জোয়ান ছেলেরা। মাথায় মোষের শিঙের মুকুট। পরনে জঙগুপি কাপড়। আর এসেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। চুল উঁচু করে বেঁধে টুকটুকে খাসেম ফুল গেঁথে দেওয়া হয়েছে। তারা খাপেগার কেসুঙের চারপাশে লালকুঁটি মুরগির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কেসুঙের ঠিক পেছনেই ঘন বনের ফাঁকে একটা জলপ্রপাত। পাহাড়ের উঁচু চুড়া থেকে প্রবল উচ্ছ্বাসে জলধারা নিচের খাদে আছড়ে পড়ছে। নিঝুম বনভূমি সেই গর্জনে আর প্রতিধ্বনিতে ভরে গিয়েছে। দুপুরের রোদ মাছের আঁশের মতো ঝকঝকে। সেই রোদ প্রপাতের জলে মাখামাখি হয়ে রুপোলি মায়া সৃষ্টি করেছে।

প্রপাতের গমগমে আওয়াজ ছাপিয়ে বুড়ো খাপেগার কেসুঙে উল্লসিত হল্লা হচ্ছে।

ও সদ্দার, মোষের মাংস খাব।

না না, সাদা শুয়োরের কাবাব খাব।

ও সদ্দার, রোহি মধু দে।

একখণ্ড পাথরে বসে ক্ষয়ে-আসা ভাঙা দাঁতের ফাঁকে কঁচা তামাকপাতা রেখে ঝিমুচ্ছিল। বুড়ো খাপেগা। নেশার মৌতাতে চোখজোড়া বুজে আসছিল। চেঁচামেচিতে তার মেজাজ বিগড়ে গেল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, রোহি মধু গিলবে, সাদা শুয়োরের কাবাব খাবে শয়তানের বাচ্চারা! এখন পর্যন্ত বুড়ি বেঙসানুটা এল না বউপণের বর্শা নিয়ে। ইদিকে ভোজ গিলবার জন্যে চেঁচিয়ে টেফঙেরা পাহাড় ফাটাচ্ছে। এখন আমি কী করি? বেঙসানুটার গলা টিপে এখানে নিয়ে আসব না কি?

কয়েকটা গলা ফিসফিস করে ফুটে উঠেই বাতাসে মিলিয়ে গেল।

সদ্দারটা একটা আস্ত সাচুমেচু (অত্যন্ত লোভী মানুষ)।

জনকয়েক অস্ফুট শব্দ করে সায় দিল, হু-হু—

শত্তুরদের মেয়েটাকে নিজের ধরম-মেয়ে বানিয়ে শয়তানটা বউপণ বাগাচ্ছে।

এখন যদি সেঙাই থাকত্ত মজাটা জমত ভাল। ছোঁড়াটা আজও ফিরল না কোহিমা থেকে।

আচমকা জোয়ান-জোয়ানীরা খুশির গলায় হল্লা করে উঠল, হুই তো, হুই তো সেঙাইর ঠাকুমা আসছে।

কই? কই? সকলকে ধাক্কা মেরে, গুতিয়ে, মেয়েপুরুষের জটলা লণ্ডভণ্ড করে সামনের দিকে এগিয়ে এল বুড়ো খাপেগা। তার লোলুপ চোখজোড়া জ্বলছে।

সামনের বড় টিলাটা পেছনে রেখে খাপেগার কেসুঙে চলে এল বুড়ি বেঙসানু। তার কাখে। এক রাশ খারে বর্শা। বেঙসানুর সঙ্গে নাতি-নাতনি দুটোও রয়েছে। ফাসাও এবং নজলি। তাদের পেছন পেছন এসেছে ওঙলে। তার কাঁধে খানকয়েক আধুনিক গড়নের বর্শা। বুড়ি বেঙসানু একা একা এত বর্শার বোঝা নিয়ে আসতে পারবে না। তাই সকাল বেলা ওঙলেকে বেঙসানুর কাছে পাঠিয়েছিল খাপেগা।

বর্শাগুলোর দিকে তাকিয়ে ঘোলাটে চোখজোড়া জ্বলতে লাগল খাপেগার। গদগদ গলায় বলল, আয়, আয় বেঙসানু। কী খাবি বল–হোরি মধু, না শুয়োরের কাবাব? না ঝলসানো হরিণের মাংস?

না না, অত খাতিরের দরকার নেই। বউপণ এনেছি। তাই নিয়ে নে। তুই তো একটা সাচুমেচু। পরের মেয়েকে কয়েক দিন পুষে তার যৌবনের দর হেঁকেছিস দশটা খারে বর্শা। কী আর করি, মেয়েটাকে দেখে চোখ মজেছে, মেয়েটার গুণ দেখে মন নরম হয়েছে। কী আর করি! নির্লোম ভুরু দুটো কুঁচকে বেঙসানু তাকাল।

হু-হু–সমানে মাথা দুলিয়ে চলেছে বুড়ো খাপগো, সেসব আমি জানি বেঙসানু।

কেসুঙের চারপাশে উল্লসিত হল্লা হচ্ছে, ভোজ দে, রোহি মধু দে–

ও সদ্দার, শুয়োরের কাবাব দে–

থাম শয়তানের বাচ্চারা–খেঁকিয়ে উঠতে গিয়ে ভাঙা ক্ষয়া দাঁত বার করে হেসে ফেলল বুড়ো খাপেগা, আজ যদি সেঙাইটা থাকত! ওর বিয়ে, অথচ ছোঁড়াটা জানতেই পারল না।

তেরছা চোখে খাপেগাকে দেখতে দেখতে বেঙসানু বলল, তা হলে কোহিমা থেকে সেঙাইটা ফিরলেই বউপণ নিস। আজ থাক।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল খাপেগা। খোশামুদির সুরে বলল, হু-হু, কী যে বলিস বেঙাসান, সেঙাই আসার আগেই বউপণের ল্যাঠা চুকিয়ে রাখ। এলেই বিয়ে হবে।

কুৎসিত মুখভঙ্গি করে বেঙসানু চেঁচাল, বউপণ বাগাবার জন্যে তর আর সইছেনা শয়তানের।

খাপেগা মাথা নাড়ল, হু-হু—

একটুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর বুড়ি বেঙসানুর কোঁচকানো মুখখানায় রহস্যময় হাসি ফুটল, শয়তানটা এসে একেবারে তাজ্জব বনে যাবে। মেহেলী তার বউ হবে। খুশিতে টেফঙটা আবার সাবাড় না হয়ে যায়! সে যাক, তেলেঙ্গা সু মাসেই ছোঁড়াছুঁড়ির বিয়ে দিয়ে দেব।

হিঃ হিঃ হিঃ–অমানুষিক গলায় হেসে ফেলল বুড়ো খাপেগা।

হু-হু, অনেক বেলা হয়েছে। দুপুর পেরিয়ে গেল। এবার তা হলে বউপণের বর্শাগুলো হিসেব করে গুনে নে।

হু-হু। মাথা ঝাঁকাল বুড়ো খাপেগা। তার দুটো ঘোলাটে চোখ লোভে খুশিতে জ্বলজ্বল করতে লাগল। কোনোদিনই কি সে ভেবেছিল, সালুয়ালা গ্রামের শত্রুপক্ষের মেয়েটা নগদ এতগুলো খারে বর্শার বউপণ নিয়ে তার ঘরে আসবে? ভাবল, সালুয়ালাঙের সঙ্গে তিন পুরুষের শত্রুতাটা এবার মিটিয়ে ফেলবে কিনা।

রূপকথার মতো অপরূপ। কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি বিস্ময়কর। বুড়ো খাপেগার কেসুঙের ঠিক পেছনেই বিশাল একাট টিলা। তার গায়ে ইতস্তত ছড়ানো গোটা কয়েক খাসেম গাছ, আতামারী লতা আর রিলুক কাটার ঝাড়। হঠাৎ দুর্গম কাটাবন কুঁড়ে দুটো মানুষ বেরিয়ে এল। সেঙাই আর সারুয়ামারু! সরাসরি বুড়ো খাপেগার কেসুঙের সামনে এবড়োখেবড়ো চত্বরটায় এসে দাঁড়াল।

প্রচণ্ড বিস্ময়ে প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল গ্রামের মানুষগুলো। বিস্ময়ের ঘোরটা কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা তুমুল শোরগোল শুরু হল।

সেঙাই এসেছে, সেঙাই এসেছে।

সারুয়ামারু এসেছে, সারুয়ামারু এসেছে।

কী মজা! কী মজা!

বুড়ি বেঙসানুর চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করছে। তড়িৎবেগে কালো পাথরখানা থেকে লাফিয়ে উঠে ছুটে এল সে। দুটো শীর্ণ হাত দিয়ে সেঙাইর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, এতদিন কোহিমাতে কী করলি রে সেঙাই? এই দ্যাখ, তোর বউপণ দিতে এসেছি খাপেগাকে। তোর বাপ সেই সিজিটো শয়তানটা কই? তোর মা মাগী মরেছে নাকি?

প্রথম যখন জীবনের কিছু কিছু স্থূল রহস্য একটু আধটু বুঝতে শিখল সিজিটো, নিজের শরীরটার একটা উৎকট দাবি সম্বন্ধে স্পষ্ট এবং প্রবল আলোড়ন জাগল মনে, ঠিক তখনই মোরাঙের নারীহীন বিছানায় তাকে শুতে পাঠিয়েছিল বুড়ি বেঙসানু। আর সেদিন থেকেই তার সঙ্গে সম্পর্কটা শিথিল হয়ে গিয়েছে তার।

সিজিটো কেমন এক ধরনের বিচিত্র মানুষ। এই পাহাড়, এই উপত্যকা, এই বুনো মালভূমি থেকে পালিয়ে নিরালায় বসে বসে কী যেন ভাবত। তার চোখ কেলুরি বস্তি ডিঙিয়ে, ছয় আকাশ আর ছয় পাহাড় পেরিয়ে অহরহ কী খুঁজে বেড়াত, তার হদিস পেত না বুড়ি বেঙসানু।

কিন্তু যেদিন কোহিমা গিয়ে পাদ্রী সাহেবদের মন্ত্র কানে নিয়ে সিজিটো বস্তিতে ফিরে এল, সেদিন থেকেই ব্যবধান আরো বাড়ল। কী বুদ্ধিই যে দিল পাদ্রীরা! ঘন ঘন শহরে যেত সিজিটো। এত বদলে গেল যে, সমস্ত বোধবুদ্ধি এবং অসংখ্য বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে তার নাগাল পেত না বেঙসানু। বেঙসানুর কাছে সিজিটো দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট, ধরাছোঁয়া যায় না এমন এক রহস্য হয়েই রইল। সহজ মানুষ বেঙসানু তার বুনো মন দিয়ে শহুরে সিজিটোর পরিবর্তনের মাপ নিতে হিমসিম খেয়ে সে চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা বিস্ময় ছিল। যেদিন সারুয়ামারুর বউ জামাতসুর বিছানায় উঠে নিজের পাহাড়ী রক্তের আদিমতার প্রমাণ দিল সিজিটো, সেদিন জামাতসুর ইজ্জতের দাম দিতে দিতে বেঙসানুর মনে হয়েছিল সিজিটো দুর্বোধ্য নয়, অস্পষ্ট নয়। সে তারই ছেলে, বড়ই আপনার, অত্যন্ত কাছের মানুষ একটুও বদলায়নি। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত সিজিটো দূরেই রয়ে গেল। পরের বউয়ের ইজ্জত নিয়ে এই পাহাড়ের চিরাচরিত রীতিকে অপমান করে একটা ভীরু কুত্তার মতো কোথায় পালিয়ে গেল শয়তানটা!

প্রবল বিতৃষ্ণায় সামান্য খোঁজখবর নিয়েই সিজিটোর প্রসঙ্গ হেঁটে দিল বুড়ি বেঙসানু। বলল, তোর বউপণ দিতে এসেছি সেঙাই।

বউপণ দিতে এসেছিস! দপ করে জ্বলে উঠল সেঙাই, মেহেলী ছাড়া অন্য কোনো মাগীকে আমি বিয়ে করব না। সে হল আমার পিরীতের জোয়ানী। খবরদার।

বিয়ে করবি না? তোকে করতেই হবে। মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে রঙ্গ করতে লগল বেঙসানু।

আমি করব না, সিধে কথা। বেশি ফ্যাকর ফ্যাকর করবি না ঠাকুমা। বর্শা দিয়ে সাবাড় করে ফেলব। হু-হু। হুমকে উঠল সেঙাই। ফোঁস ফোঁস করে বারকয়েক শব্দ করল।

সারুয়ামারু একপাশে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে বলল, এটা কেমন কথা! মেহেলীর সঙ্গে সেঙাইর পিরিত–এই পাহাড়ের সবাই সে খবর জানে। সেঙাই কোহিমা গিয়ে ফাদারকেও বলে এসেছে। অন্য মাগীর সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া চলবে না।

চলবে তো। নির্বিকার গলায় বেঙসানু বলল।

খবদ্দার। গর্জে উঠল সেঙাই।

কিছু একটা ঘটে যেত–ভয়ঙ্কর কিছু। তাজা পাহাড়ী রক্ত বুড়ো খাপেগার কেসুঙটা রাঙিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তার আগেই কেলুরি গ্রামের মানুষগুলো আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। এতক্ষণ তারা চুপচাপ বসে বুড়ি বেঙসানু এবং সেঙাইর রং-তামাশা উপভোগ করছিল।

কেসুঙ-কাঁপানো হল্লা। কেলরি গ্রামের কুমারী জোয়ানীরা আর জোয়ান ছেলেরা সমস্বরে বলল, মেহেলীর সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে রে সেঙাই। তোর ঠাকুমা মশকরা করছে।

মেহেলীর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে! নিজের গলাটা নিজের কানেই কেমন বেখাপ্পা শোনাল সেঙাই-এর। কেমন যেন অবিশ্বাস্য।

হু-হু– খুশি গলায় সকলে সায় দিল, সেই জন্যেই তো বউপণ নিচ্ছে সদ্দার।

এক টুকরো কুটিল সন্দেহে সেঙাই-এর মনটা কালো হয়ে গেল। বলল, মেহেলী তো সালুয়ালাঙ বস্তির মেয়ে। তার জন্যে আমাদের বস্তির সদ্দার কেন বউপণ নেবে? বউপণ নেবে তো মেহেলীর বাপ।

তুই জানিস না, যেদিন তুই কোহিমা চলে গেলি সেদিনই, মেহেলী আমাদের বস্তিতে পালিয়ে এসেছে। কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এল ওঙলে। কেমন করে মেহেলী এ গ্রামে এল, কেমন করে বুড়ো খাপেগার সঙ্গে ধরমবাপ সম্পর্ক পাতাল, তারপর সেঙাইর প্রতীক্ষায় দিনের পর দিন কেমন করে কাটাচ্ছে, তার নিখুঁত, সরস এবং আদ্যোপান্ত বিবরণ দিল।

বিস্ময়ে আর আনন্দে চোখের মণি ঝিকমিক করে উঠল সেঙাইর। এই মুহূর্তে তার অস্ফুট চেতনায় সমস্ত পাহাড়ী পৃথিবীটা আশ্চর্য সুন্দর হয়ে গিয়েছে। বড় ভালো লাগছে দুপুরশেষের গেরুয়া রোদ। কুমারী জোয়ানীদের ফুলসাজ ভালো লাগছে। ভালো লাগছে ওঙলেকে। এমনকি এই বিশেষ মুহূর্তটির জাদুতে বুড়ো খাপেগা আর বেঙসানুর ভাঙা, বাঁকা, কদাকার মুখ দুটোও সুন্দর দেখাচ্ছে। সমস্ত দেহের পেশীগুলিকে এবং তাজা রঙদার মনটাকে আলোড়িত করে সুখের শিহরন খেলে যেতে লাগল সেঙাই-এর।

আবিষ্ট গলায় সেঙাই বলল, বলিস কী! মেহেলী কোথায়?

জবাবটা এবার আর ওঙলে দিল না। সামনে এগিয়ে এল বুড়ো খাপেগা। ফোকলা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কি রে শয়তানের বাচ্চা, ইজা হুকুতা! খুশিতে যে ডগমগ! পছন্দের মাগীকে পাবি। বিয়ের কথা শুনে তো ফোঁস করে উঠেছিলি।

অন্য দিকে বিন্দুমাত্র ক্রুক্ষেপ নেই সেঙাই-এর। নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্যে তার মনোযোগ স্থির হয়ে রয়েছে। সে বলল, মেহেলী কোথায়? তাকে দেখব।

মেহেলী ভেতরের ঘরে মাচানে শুয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে এখন দেখা হবে না তোর।

কেন আমার বউর সঙ্গে দেখা হবে না?

বিয়ে না হতেই বউ!কুৎসিত মুখভঙ্গি করল বুড়ো খাপেগা, মেহেলী এখনও তোর বউ হয়নি। ও এখন আমার ধরম-মেয়ে। এখন ওর সঙ্গে দেখা হবে না, সিধে কথা।

হু-হু। অসহ্য হৃদয়াবেগকে দু’টি শব্দের মধ্যে মুক্তি দিল সেঙাই, আচ্ছা।

কেসুঙের বাইরে কর্কশ পাথুরে চত্বর থেকে একটা বড় চেনা চেনা গলার স্বর ভেসে। আসছে। সে স্বরে দুনিয়ার সব সুস্বাদ, সব আনন্দ যেন মেশানো।

ভেতরের ঘরে বাঁশের মাচানে রোগের তাড়সে শুয়ে রয়েছে মেহেলী। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দু’টি কানের মধ্যে জড়ো হয়ে সেঙাই-এর গলার স্বরটাকে যেন শুষে নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেঙাই কোহিমা থেকে ফিরে এসেছে। শত্রুপরে এই জোয়ানটার জন্য গ্রাম ছেড়েছে সে। বাপ-মা প্রিয়জন-পরিজন সবাইকে ছেড়ে এই গ্রামে পালিয়ে এসেছে। কত প্রতীক্ষা করেছে। সে, সেঙাই-এর ভাবনায় কত দিনরাত্রি পার করে দিয়েছে।

সেঙাই। নামটা যেন তার বুকে ধুকধুক করে বাজতে শুরু করল। এই কর্কশ এবং নিঃসঙ্গ বাঁশের মাচান থেকে ছুটে সেঙাই-এর বুকে নিজের তাজা যুবতী দেহটাকে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তার উপায় নেই। তামুন্যুর নিষেধ, মাচান থেকে কিছুতেই ওঠা চলবে না। কী এক উদ্ভট রোগ হয়েছে। গায়ের চামড়ায় অসহ্য তাপ, হাত রাখলে যেন পুড়ে যায়। তামুন্যুর নির্দেশে ভাত-মাংস খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে।

সেঙাই-এর কাছে যাবার প্রবল তাড়নায় ছটফট করছে মেহেলী। শিরায় শিরায় যেন রক্ত ফুটছে। হতাশায় এবং অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় ফোঁস ফোঁস করতে লাগল সে। ভাবল, এই ভেতরের ঘর, বাঁশের দেওয়াল আর বাইরের ঘর পেরিয়ে যে রুক্ষ পাথুরে চত্বর, সেখানে বসে রয়েছে সেঙাই। তার গলা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কত সামনে, অথচ কত দূরে সেঙাই। তাকে ধরাছোঁয়ার কোনো উপায়ই নেই।

একসময় বউপণ দেওয়া-নেওয়ার পালা শেষ হল। বাঁশের পানপাত্রে রোহিমধু, কাঠের বাসনে শুয়োরের মাংসের কাবাব সাজিয়ে সকলকে খেতে দিল খাপেগা।

একমাত্র ভাইপো ওঙলে ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই বুড়ো খাপেগার। তাই এই দুর্ভোগ। সকালবেলা বসে বসে নিজের হাতে কাবাব বানাতে হয়েছে। অবশ্য সারুয়ামারুর বউ জামাতসু এবং গ্রামের কটি মেয়ে সাহায্য করতে এসেছিল।

তারিয়ে তারিয়ে রোহিমধু খেতে খেতে কে যেন বলল, পছন্দের মাগী তো বউ হল তোর, কি রে সেঙাই? একটা মাথা কাটা গেল না, রক্ত ঝরল না পাহাড়ে। সোয়দ পাচ্ছি না এ বিয়েতে। কেমন যেন নিমকছাড়া!

হু-হু–মাথা ঝাঁকাল বুড়ো খাপেগা, বিয়ের আমোদে ঢিলে দিলে চলবে না। কখন যে সালুয়ালাঙ বক্তির শররা বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তার কি কিছু ঠিক আছে? ওরাও তো পাহাড়ী, ওদের মেয়েকে আমাদের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি। সহজে কি ছাড়বে? লড়াই একটা বাধবে বলে মনে হচ্ছে।

হু-হু, আমাদেরও তৈরি থাকতে হবে। অনেকগুলো গলায় একই ঘোষণা।

বুড়ো খাপেগা বলল, তারপর কোহিমায় কী হল সেঙাই, সে গল্প বল।

সেঙাই-এর মন গন্ধমাতাল মৌমাছির মতো একটা মনোহর মুখের চারপাশে পাক খাচ্ছিল। সে মুখ মেহেলীর। অন্য কোনো দিকে, কোনো গল্পে, কোনো কথায় তার আকর্ষণ নেই। তার সমস্ত মনোযোগ, সকল উৎসাহ একটি মুখকে দেখার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। ওই মুখটায় কত সুখ। কত কুহক। অন্যমনস্কের মতো সেঙাই বলল, কোহিমার কথা অনেক, মোরাঙে বসে রত্তিরে বলব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *