৩০. তালাশ

তালাশ

‘মেরি আফা, কতা কচ্চো না দি, আমারে তুমি কই নিয়ে যাচ্ছ?’

মরিয়ম কুয়াশার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসে। তারপর টুকিকে যা বলে, তা শোনা না গেলেও, শ্রোতার মুখ দেখে বোঝা যায়, তাতে তার অমত নেই। শুধু এক টুকরো দীর্ঘশ্বাস ভোরের বাতাসে ঝুলে থাকে। মরিয়মের স্বপ্নের নৌকাটা রাত থাকতেই সেজেগুজে তৈরি ছিল। তারা মালামাল নিয়ে উঠে বসতে মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়। পালে হাওয়া লেগেছে। গলুইয়ে বসে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে দাঁড় টানছে মাঝি। মরিয়ম নির্বাক। যেন কাফনের কাপড় পরা মুর্দা। রুটা তার দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। টুকির বুকে উথাল-পাতাল জলের ঢেউ। দরিয়া কেমন–সে জানে না। পরপারেরই-বা স্বরূপ কী। নদীতীরে সারি সারি ইটের ভাটা, চিমনি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। এত দালানকোঠা বানায় কেন মানুষ? অদূরের ভাসন্ত ডকইয়ার্ডটা যেন দৈত্য। অপর পাড়ে অগণিত জাহাজের কঙ্কাল। লুঙ্গি-গামছা শুকোতে দেওয়া হয়েছে জাহাজের কপাটহীন দরজা-জানালায়, মরচে ধরা ভাঙা রেলিংয়ে। গরু-বাছুর নাওয়ানোর দৃশ্য আর স্নানের পর বউ-ঝিদের কলসি কাঁখে ছপছপ শব্দে ঘরে ফেরা–সেই কোন কালের! স্কুলের ড্রয়িং খাতার ছবিগুলো মরিয়মের মনের পর্দায় ভেসে উঠে তলিয়ে যায়। টুকি ভাবে, দিন শেষে মোরগ-মুরগিদের আধার খাওয়ালেও চলে, না খাওয়ালেও চলে। লাভ-লোকসানের তো ব্যাপার নেই। দু’পাড়ের যত আয়োজন–সবই তো পেছনে ফেলে চলে যাওয়ার জন্য। তবু মাছরাঙা পাখি ঠোঁটে মাছ গেঁথে পানি ছুঁয়ে উড়াল দিলে তার মুখে হাসি ফোটে। প্রতিযোগী সাঁতারুদের মনে মনে হাততালি দিয়ে সে স্বাগত জানায়। জনহীন চরের জল-কাদায় বকের হুটোপুটি দেখতে দেখতে তাদের দুজনেরই শৈশবের কথা মনে পড়ে। মেরি আফা, ছোড থাকতে আমার শখ ছিল জাউল্লার বউ হওনের। মনের দুঃখে আমি একবার পাখি হইতেও চাইছিলাম। মরিয়ম শখের হদিশ পায় না। বড় হলে ডাক্তার হব, গরিব লোকের কাছ থেকে ভিজিট নেব না–পরীক্ষার খাতায় বছরের পর বছর বাংলা আর ইংরেজিতে এই লিখে গেছে। বউ হওয়ার কথা ভাবতে-না-ভাবতে জসিমুল হক, আবেদ জাহাঙ্গীর সিনে চলে আসে। তারপর তো যুদ্ধ। নিজের পছন্দ বা বাছবিচার বলে কিছু থাকল না। পেছনে সরে সরে যাওয়া ঘর-বাড়িতে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠলে, টুকির বুকে ফের উথাল-পাতাল ঢেউ ভাঙে। ঘরের চালে তুলে দেওয়া হয়েছে শিম লাউ-কুমড়োর লতা। তাতে নানা বর্ণের ফুল ফুটেছে। জায়গায় জায়গায় সোনালি খড়ের স্তূপ। বাচ্চারা হাতমুখ ধুয়ে কেরোসিনের বাতির নিচে পড়তে বসবে। রাতের বাতাস কেটে কেটে কোথাকার পাখি কোথায় চলে যায়। টুকির না-হওয়া সংসারের ছবি মুছে দিয়ে দূরের কালো আকাশটা শুধু প্রহরীর মতো তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে। তার বিশাল বুকে অজস্র তারার স্রোত।

ঈশান কোণে মেঘের পর মেঘ জমেছে–মাঝি বলে, ‘তুফান উঠবো মনে অয়।’ আরেক দিন দাঁড় টানতে টানতে সে বলে, ‘পানি কেমুন ভার ভার ঠেহে, লক্ষণ ভালো নয়।’ মাঝি ছয় দিনের রোজ বুঝে নিয়ে নির্জন এক বালুচরে নেমে যায়। যাওয়ার সময় তারার আলোয় মরিয়ম তার চেহারায় দেখে, একাত্তরের পদ্মা পারাপারের সেই মাঝির মুখ। তবে এ মাঝি নৌকা থেকে নামতে নামতে গুনগুনিয়ে গায় হালের একটি জনপ্রিয় গান, যা আগের মাঝির গাওয়ার কথা নয়–আমার একটা নদী ছিল, জানলো না তো কেউ…

সপ্তম দিনে টুকি ও মরিয়ম মানুষের ভবিষ্যদ্বাণীর সংকীর্ণ সীমানা অতিক্রম করে যায়। আর তখনই দেখে, অনুরাধা দূরের এক বেলাভূমি থেকে সাদা রুমাল নেড়ে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুর্দার গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে মরিয়ম এখন বেশ উৎফুল্ল। আরেকটু এগোলে হয়তো রমিজ শেখ ও মন্টুর দেখা পাওয়া যাবে। এদিকে তরতর করে চালকহীন নৌকাটা পৌঁছে গেছে অনুরাধার নিকটে। শূন্যে ঝুলে থাকা একটা বরফ-শীতল হাত মরিয়ম ধরতেই গলুই বেয়ে অনুরাধা পাটাতনে উঠে আসে। তার পরও একজন আরেকজনের হাত ছাড়ে না। ইশ্‌, কত দিন পর দেখা! পানিতে ভাসতে ভাসতে অনুরাধার সারা গায় শ্যাওলা পড়ে গেছে। তবে তাদের দুটি হাতই এখন বেশ উষ্ণ। অনুরাধাও প্রাণবন্ত সেই কিশোরী। মরিয়ম নিজেকে নিজে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে পেটিকোট-ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরে টুকি বেগম, চৌধুরীবাড়ির কাজের মেয়ে, বন্দি হওয়ার বয়সে ফিরে গেছে। শাড়ির আঁচলটা মুঠো করে ধরা তার মুখের ওপর। পৃথিবীর আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। টুকির চোখে পেছনে ফেলে আসা সেই স্থলভূমি, যা রক্তিম দিগন্তে মাথার চুলের মতো ভাসছে। অনুরাধা সেদিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘কী সুন্দর আমাদের দেশটা!’

টুকির মুখ থেকে আঁচল সরে যায়–যে দেশের জন্য আমরা শরীরের রক্ত দিছিলাম।

1 Comment
Collapse Comments

ইশ! এতো সুন্দর! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক রকমের বই পড়েছি কিন্তু এই বইটা আসলেও ব্যতিক্রম আর ব্যাপক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *