২০. পিতা-পুত্র

পিতা-পুত্র

মনোয়ারা বেগম রোজ রাতে মরিয়মের গলায় কার যেন কান্না শোনেন। শব্দটা আসে বোজা কুয়াটার তল থেকে। কী আছে ওখানে, কেন টলটলে পানির কুয়াটা এভাবে মাটি দিয়ে বুজিয়ে ফেলা হলো–স্বামীকে বারবার জিগ্যেস করেও এর কোনো সদুত্তর পান না। তার সান্ত্বনা যে, মেরি যেখানেই থাকুক, বেঁচে আছে। কান্নার আওয়াজটা হয়তো তার কল্পনা। এত বড় একটা যুদ্ধ গেল, কত শত মানুষ মারা গেছে, কত শত স্বজনহারা কণ্ঠের ক্রন্দন, বাতাস কি এর কণামাত্রও ধরে রাখেনি! তার ভেতরটাও তো নিরালে কাঁদে। সময় সময় নিজের কান্নার শব্দে তিনি চমকে ওঠেন। এক মা ছাড়া দুনিয়ার কেউ এর আওয়াজ পায় না। ছেলেটা তার কোথায় গেল। কুয়াটা মন্টুর কবর নয় তো, যা তার কাছে গোপন রাখা হচ্ছে? মনোয়ারা বেগমের পীড়াপীড়িতে মন্টুর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি পুনরায় ছাপা হয় পত্রিকায়।

বিজ্ঞাপনটা পড়ে যে কালবিলম্ব করেনি, কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে পুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে, সে মন্টুর সহযোদ্ধা সরফরাজ হোসেন। ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার। সময় মন্টু বলেছিল, যদি কখনো দরকার হয়, ফুলতলি গাঁয়ের সন্ধানে তাকে গ্রামাঞ্চলে যেতে হবে না, ঢাকা শহরে খুঁজলেই চলবে। সেইমতো সরফরাজ একটা নদী পার হয়। নদীর পাড়েই কুমারদের আবাস। সেখানে ঘূর্ণায়মান চাকার ওপর তাল তাল। মাটি নানান তৈজসপত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। কুম্ভকারের আঙুলের ফাঁকে হাতি, ঘোড়া, টেপা পুতুল। পইন থেকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বের হচ্ছে অবিশ্বাস্য সব জন্তু-জানোয়ার। ভাঙা হাঁড়িকুড়ি আর স্তূপীকৃত ভাঙা ফুলের টবের পাশ দিয়ে সরফরাজকে পথ চিনিয়ে। নিয়ে চলে মন্টু। অদূরের ট্যানারির সে গন্ধ শুঁকে মন্টুরই নাক দিয়ে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে ওর কথামতো বাঁশঝাড়টা দেখতে পায় না। এমনকি বাড়ির ভেতর থেকে। মেরিবু’র যে বেরিয়ে আসার কথা, সে না-এসে আসেন মন্টুর বাবা-মা। তাদের পেছন পেছন ঘরে ঢোকার পর সরফরাজকে ছেড়ে মন্টু পালিয়ে যায়। সে একা এখন কী করবে। তার সামনে উদগ্রীব দুজন মানুষ। দেশের বিজয় নিয়ে তারা এমন মেতেছিল যে, সহযোদ্ধার মৃত্যুসংবাদটিও সময়মতো পরিবারকে জানানোর দায়িত্ববোধ করেনি। সে নিজের ওপর বিরক্ত হয়। হাতের মুঠোতে ভরা খবরের কাগজের টুকরাটার মতো গলার ভেতর মৃত্যুসংবাদটা দলা পাকাতে থাকে। মন্টুর মা সে কিছু বলার আগে কাঁদতে শুরু করেন। বাবা একদম চুপ। ঝড় আসার আগ মুহূর্তে আকাশটা যেমন থমথম করে, বাতাস যেমন বন্ধ হয়ে যায়, সেরকম তার অবস্থা। অতীতকালের রাজা বাদশারা দূরদূরান্ত থেকে যে মৃত্যুখবর বয়ে আনত, তার গর্দান ফেলে দিত।

সরফরাজ গর্দানসহ মন্টুদের বাড়ি থেকে যখন বের হয়, তখনো দিন শেষ হওয়ার অনেকটা সময় বাকি। কিন্তু সে আর দেরি করে না। মন্টু এত দিন যেন বেঁচেই ছিল। তার মৃত্যু হলো আজ, যখন তার বাবা-মা খবরটা জানতে পারলেন। সরফরাজ জোরে জোরে পা চালায়। কারণ ভাঙা হাঁড়িকুড়ি, ফুলের টব, অবিশ্বাস্য সব জন্তুজানোয়ারের পাশ দিয়ে, ট্যানারির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তাকে এখন একা ফিরতে হবে।

সেই রাতে মনোয়ারা বেগম নিজের কান্নার শব্দ শুনতে পান না। তবে কুয়ার মাটিচাপা ক্রন্দনটা গুমরে গুমরে ওপরে উঠে সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তাতে পড়শিদের ঘুম ভেঙে যায়। তারা রাতের প্রহরে প্রহরে যে ছেলেটার মায়ের বিলাপ শোনে, সে যুদ্ধের আগে কালো কালিতে দেয়ালে শ্লোগান লিখত। তার হস্তাক্ষর ছিল ছাপার অক্ষরের মতো সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন। মিলিটারির ভয়ে চুনকাম করে তারা সেসব ঢেকে দিয়েছে। আজ তার মৃত্যুসংবাদ এসেছে। ঘুমভাঙা মানুষদের নিজের হাতে মুছে ফেলা সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন সারবাঁধা সব অক্ষর মনে পড়ে। কিন্তু স্লোগানের কথাগুলো স্মরণ হয় না।

পরদিন তিক্ততা ভুলে গোলাম মোস্তফা সপরিবারে ছুটে আসেন। গ্রাম থেকে আনানো হয় ছোট দুটি মেয়ে রত্না আর ছন্দাকে। তারা মনোয়ারা বেগমকে সারা দিন জড়িয়ে ধরে রইল দুধের শিশুর মতো। যে বাড়িতে বড় বোনের পাহারাদারির জন্য মন্টুকে পাঠানো হয়েছিল, সেখানে তার কুলখানির আয়োজন হয়। মেরির নাম একবারও উচ্চারিত হয় না। গোলাম মোস্তফা শুধু বললেন, ছেলেমেয়ে দুজনের নামেই কোরান খতম হোক। কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মনোয়ারা বেগম। মেয়ে তো বেঁচে আছে, তার ভাই কী নিষ্ঠুর! তিরিশ জন মাওলানা কুয়ার বুনো ঘাসের ওপর বদনির পানি ঢেলে অজু করে, সাদা চাদরের চারদিকে গোল হয়ে বসেন পবিত্র কোরানপাঠে। তবে দিনকাল ভালো নয় বলে কাজটা এত দ্রুততার সঙ্গে তারা শেষ করেন যে, মনে হলো, এক দরজা দিয়ে ঢুকে আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাদের পবিত্র গুঞ্জন আতর-আগরবাতির সুগন্ধি ধোঁয়ায় পরকালের ভীতিসঞ্চার করে খানিকক্ষণ ভেসে থাকল।

ঢাকার পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে সরফরাজের আগমনের দিনটা মন্টুর মৃত্যুদিন বলে সাব্যস্ত হলো। কারণ কবে কোথায় সে মারা গেছে, ছেলেটি এক-দু’বার বললেও কফিলউদ্দিন আহমেদ বা মনোয়ারা বেগমের অবস্থা ছিল না তা মনে রাখার। এ ছাড়া সংবাদবাহক নিজের ঠিকানা না-দিয়েই যে পথে এসেছিল, সেই পথেই ফিরে গেছে। তার নির্গমনের চতুর্থ দিনে বাড়িতে মিলাদ পড়ানো হয়, সঙ্গে কাঙালিভোজ। যে দেয়ালে যুদ্ধের আগে মন্টু সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে স্লোগান লিখেছিল, তার কিনার ঘেঁষে ফকির-মিসকিনরা কলাপাতা পেতে খেতে বসেছে। মহিষের মাংস আর লাউয়ের তরকারিতে ভাত মেখে যতবার তারা মুখ উঁচু করে লোকমা তোলে, ততবারই চুনকাম করা একটা সাদা দেয়াল তাদের দৃষ্টি রোধ করে দাঁড়ায়। কারো কারো তাতে অস্বস্তি হয়। তারা রাস্তায় ঝোল ফেলতে ফেলতে একবার এপাশে আসে, আরেকবার ওপাশে যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, তারা তো এখনো ভিখিরি। কাঙালিভোজে ভালোমন্দ খেতে এসেছে। মানুষের এত অভাব-অভিযোগ থাকতে খালি থাকে নাকি শহরের উঁচু-লম্বা দেয়াল! তবে অল্প কদিনের মধ্যেই সেসব আর সাদা থাকবে না। ভিক্ষুকদের দাবিদাওয়াসহ অন্য রকম অভিযোগ আর ভর্ৎসনায় ভরে যাবে। লিখবে মন্টুর বদলে আরেকজন–সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে, যে এখন তারই বয়সি।

কফিলউদ্দিন আহমেদ পকেট উজাড় করে টাকা খরচ করেছেন। একমাত্র ছেলে, যে সবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিল, তার জন্য সামনে অনেক খরচাপাতির ব্যাপার ছিল। সেই তুলনায় শত শত কাঙালিভোজ বা পঞ্চাশ-একশ মাওলানা খাওয়ানো কিছুই নয়। তা ছাড়া ছেলেই যখন নেই, কার জন্য ঘরবাড়ি, জমিজমা আর ধনসম্পদ। গোলাম মোস্তফা পরামর্শ দেন, ‘দুলাভাই, বাসাটা ভাড়া দিয়া দেন।’ আগে ঢাকা ছিল প্রাদেশিক রাজধানী, এখন সারা দেশের প্রাণকেন্দ্র। সাহায্য করতে এসে এর ওপর বিদেশিদেরও নজর পড়েছে। হু-হুঁ করে ধানচালের দামের মতো বাড়িভাড়াও বাড়বে। ঢাকার মাটি বিকোবে সোনার দরে। কিন্তু মেরি? নামটা উহ্য থাকলেও সবার মাথায় সে নড়াচড়া করে। এ ব্যাপারেও গোলাম মোস্তফার বক্তব্য আছে। মেয়েটা এবার নিজের পায়ে দাঁড়াক। মানুষ জন্মায় যেমন নিঃস্ব আর একা, কেউ চাক-না-চাক যুদ্ধ তাকে সেই অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে। তেইশ বছর বয়সে সে একবার মরে আবার জন্ম নিয়েছে। দ্বিতীয়বার জন্মদানের ভাগিদার তার বাবা-মা নয়। মন্টুর কুলখানিতে মেরির নামেও কোরান খতম হয়েছে। ধরা যাক, এই পাতকুয়াটাই তার কবর। মা-বাবা ওখানে মেয়ের গোর দিয়েছেন। সব চুকেবুকে গেছে। এখন এই নতুন জীবনের দায় তার নিজের, না হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। গোলাম মোস্তফা নগণ্য মানুষ। জীবনে লেখাপড়ার ধার ধারেন নাই। তবু সাহস করে শিক্ষিত ভাগনির ভাঙাচোরা জীবনটা গড়ে দিতে চেয়েছিলেন। খোদা যা করে, মানুষের ভালোর জন্যই করে। দুলাভাই, একবার আমার কথা ভাবেন দেখি! একদিকে নিজের ছেলে, আরেক দিকে মায়ের তুল্য বড় বোনের মেয়ে। আমি কার স্বার্থ দেখলাম, নাকি দেখলাম না? কফিলউদ্দিন আহমেদ তার জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে উশখুশ করেন। শোকের বাড়িতে পুরোনো কথা তুলে আর অপমান করা কেন! গোলাম মোস্তফা নাছোড়বান্দা। সুযোগের তিনি কখনো হাতছাড়া করেন না। ছেলেটার যদি খুঁত থাকে, মেয়েটারও আছে, ঠিক কি না। এত যে বুঝলেন দুলাভাই, বলেন দেখি কার খুঁত বেশি–আপনার মেয়ের, না আমার ছেলের?

শ্যালকের মুখের দিকে কফিলউদ্দিন আহমেদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। খোদা দিন দিয়েছে, যা খুশি বলুক। এসব কথা সহ্য হয় না মনোয়ারা বেগমের। তিনি জায়নামাজ হাতে পাশের ঘরে চলে যান। তাতে গোলাম মোস্তফার যেন হুশ হয়। তিনি সযত্নে কথার মোড় ঘোরান। খোদা যা করে বান্দার ভালোর জন্যই করে। হঠাৎ খুশির চোটে জোরে একটা চাপড় মারেন কফিলউদ্দিন আহমেদের উরুতে, ‘দুলাভাই, রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা ক’দিন পরই দেখবেন এক ঘাটে জল খাচ্ছে। অবস্থা যত খারাপ ভাবছেন অত খারাপ না। মনে মনে যতই আপনার-আমার শত্রুতা থাক, মুসলমান মুসলমান মাত্র ভাই-ভাইই তো! আর পাক-ভারতও দুইটা দেশ–হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান। মাঝখানে বাংলাদেশটা ফাউ। আইজ আছে কাইল নাই।’

গোলাম মোস্তফার বাঁচালতার কারণ বিলম্বে হলেও জানা গেল। আসন্ন বকরি ঈদে তিনি যাচ্ছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে মোবারকবাদ জানাতে। সরকারের খুব কাছের একজন এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন লড়াইটা বোঝলেন দুলাভাই, হিন্দুস্থানে আর পাকিস্তানে নাই, তামান দুনিয়াই জড়াই গেছে। খোদার কিরা–এক্কেবারে ভিতরের খবর। গোলাম মোস্তফার মুখ আর কফিলউদ্দিন আহমেদের কান এক জায়গায় চলে আসে। তার কথা শোনা না গেলেও বিষয়টা হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যেই এখন দুটি দল–একদল ভারত আর রাশিয়াপন্থি, আরেক দল আমেরিকাপন্থি। দুই পন্থিরা সংখ্যায় সমান সমান। মাঝখানে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধু। আজন্ম ভারতের শত্রু গোলাম মোস্তফা আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে আমেরিকার পক্ষেই এবার ফাইট দেবেন। তার কাজকর্ম শুরু হবে পবিত্র ঈদুল আজহার পরদিন থেকে।

কফিলউদ্দিন আহমেদ মাঝরাতে জেগে ওঠেন প্রচণ্ড এক হাহাকার নিয়ে। স্বপ্নটা কী ছিল মনে নেই। তবে সত্য যা, তিনি পুত্রহীন এবং এ অবস্থায় একদিন দুনিয়া থেকে তাকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু কেন। কার ক্ষতি করেছেন যে, এত বড় সাজাটা তাকে মাথা পেতে নিতে হবে? দিনের বেলায় তিনি যে নিজহাতে মিলাদের মিষ্টি বেঁটেছেন, পকেটের টাকা গুনে গুনে তুলে দিয়েছেন মওলানাদের হাতে, সেসব ছিল লৌকিকতা, যা কেবল দিনেই সম্ভব। মধ্যরাতে তার চিত্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মৃতপুত্রের আত্মার মাগফেরাত না চেয়ে তিনি চান একটি জীবন্ত পুত্র–যে তার কবরে একদিন মাটি ফেলবে, যখন তিনি থাকবেন না তার রক্ত প্রবাহিত হবে যার ধমনিতে, যে তার নাক দিয়ে দম নিয়ে তারই ফুসফুসে বায়ু সঞ্চালন করবে, যখন তার নাক এমনকি ফুসফুসও থাকবে না। কফিলউদ্দিন আহমেদের একটি পুত্রসন্তান চাই-ই চাই। সেই মতো পরিপূর্ণ তেজ নিয়ে তিনি অগ্রসর হন। মন আর দেহ দুই-ই প্রস্তুত। কিন্তু তার আরোহণ আরেকটা ক্রোধের জন্ম দেয়। স্ত্রী যে আর রজস্বলা হন না, রাতের কুহক এমন যে, তা ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে ভুল পথে চালিত করেছিল। কাজটা ক্ষমাহীন। শোকার্ত একজন মায়ের জন্য নির্যাতনতুল্য। পুত্রপ্রত্যাশী পিতার বেলায় অপূরণীয় ব্যর্থতা, যা তাকে আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এভাবে একটা ক্রোধ থেকে আরেকটা ক্রোধ-রাতের সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়ে চলল। মনোয়ারা বেগম দুঃখে-অপমানে কাঁদতে কাঁদতে দেখলেন, লোকটাকে ঘর ছেড়ে ছায়ার মতো বেরিয়ে যেতে। তার এক হাতে শাবল আরেক হাতে একটা টুকরি।

ডুবন্ত চাঁদের আলোয় কফিলউদ্দিন আহমেদ মাটি খুঁড়ছেন। ষাটোর্ধ্ব পেশি শাবলের সঙ্গে ওঠানামা করছে স্বাভাবিকের চেয়ে ক্ষিপ্রগতিতে। তালহীন। এ বেতাল অবস্থাটা বিছানা থেকে তার সঙ্গ নিয়েছে। কাকভোরে বাড়ির চারকোনায় বড় বড় চারটি গর্ত তৈরি হয়। তা থেকে বেরোয় পবিত্র চারটি বোতল, যা টুটাফাটা। তিনি সেসব আছড়ে-আছড়ে গুঁড়ো করে টুকরিতে ভরেন। এবার দ্বিতীয় অভিযান। স্থান পাতকুয়া। দিনের আলোয় ঘামে ভেজা মানুষটি বিকট আকার ধারণ করে। মনোয়ারা বেগম ছোট মেয়ে দুটিকে নিয়ে বাধা দেন। কাজ হয় না। তাদের চেঁচামেচিতে পড়শি একজন বেরিয়ে আসে। সে জানায়, কুয়া খোঁড়ার এখতিয়ার কফিলউদ্দিন আহমেদের নেই। যদিও তার নিজের জায়গায় নিজস্ব খরচে তৈরি এই পাতকুয়া। যারা কুয়াটা বন্ধ করেছে, সরকারের অনুমতি নিয়ে তারাই কেবল খুঁড়তে পারবে। তা ছাড়া পাড়ার মুরুব্বি হাজি সাহেব মন্টুর কুলখানির রাতেই ফিরে এসেছেন। এসব কাজে এখন। থেকে তার পারমিশন আবশ্যক।

হাজি সাহেবের নাম শুনে কফিলউদ্দিন আহমেদ শাবল ছেড়ে দেন। কাঁচ-ভাঙায় ভর্তি টুকরিটা উল্টে পড়ে। শিশুর মতো ভীত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। যাদের লুকিয়ে থাকার কথা, তারা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে! যেন গর্ত থেকে সাপ। মন্টুর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর হাজি সাহেব আর বিলম্ব করেননি। পথের কাঁটা চিরতরে সরে গেছে। এই সুবর্ণ সুযোগ। এবার তাহলে গোলাম মোস্তফার মতো আমেরিকাপন্থি হয়ে তিনি ফাইট করবেন? কী হলো দেশটার? যুদ্ধ তাহলে শেষ হয়নি! পুত্রকামনায় গত রাতে যে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, তিনি যুদ্ধে হারানো মৃত সন্তানদের জন্য চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। রত্না-ছন্দা বিচলিত। মন্টুর কুলখানির রাতে হাজি সাহেবের ফিরে আসার সম্পর্ক তারা বুঝতে পারে না। এ বাড়ির ইতিহাসও তাদের অজানা। তাই বোতল আর পাতকুয়া রহস্যজনক মনে হয়। এসব রহস্যের প্রদর্শনী কেবল একটি আদর্শ জাদুঘরেই হওয়া সম্ভব। তবু বাবা-মায়ের সঙ্গে ফুলতলি গায়ে ফেরার আগে, ছোট ছোট হাতে মাটি দিয়ে তারা গর্ত চারটি ভরে দেয়। আর কুয়ার বুনো ঘাস সাফ করে তাতে একটা হাস্নাহেনার চারা রোপণ করে। বুদ্ধিটা যমজদের নিজস্ব। হাস্নাহেনা ফুলের সুবাসে রাতের বেলা সাপ আসবে। তাদের একমাত্র ভাই যুদ্ধে মারা গেছে। বড় বোন ঘরত্যাগী। যমজদের বড় হওয়া পর্যন্ত বাড়িটা পাহারা দেবে মন্ত্রপড়া বোতলের পরিবর্তে বিষধর সর্পকুল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *