০৯. অনুরাধার ডায়েরি

অনুরাধার ডায়েরি

মন্টুর হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ মরিয়ম দেখে ‘৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, পত্রিকার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির পাতায়। সে তখন নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তখন সিনেটর কেনেডিকে যে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল, তার সচিত্র প্রতিবেদনের নিচে একগুচ্ছ ছবিসহ নিখোঁজ বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হয়। তাতে মন্টুর স্কুলজীবনের সাদা-কালো ফটোগ্রাফ। নিচে লেখা সাইফুদ্দিন আহমেদ মন্টু। বয়স বিশ। এর আগে মরিয়ম হাসপাতালের বেডে দৈনিক পত্রিকা নাড়াচাড়া করলেও পড়ে দেখেনি কখনো। অক্ষরগুলো মনে হতো পরস্পর জড়াজড়ি করা, এক লাইন আরেক লাইনের পিঠে চড়ে সিটি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে, যার সঙ্গে মরিয়মের কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন দেশের মানুষের হাসি-কান্না, পুনর্মিলনী তাকে স্পর্শ করে না। শহিদ পরিবারের ফ্যামিলি ফটোগ্রাফগুলো বেজায় ক্লান্তিকর। বিদেশি স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার খবরাখবর সে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে খাটের তলায়। ধ্বংসস্তূপের ওপর এত হাঁকডাক আয়োজন অন্য কারোর জন্য, এর শরিক নয় সে।

সেদিন মন্টুর নিখোঁজ-সংবাদ পত্রিকায় দেখামাত্র, মরিয়ম তা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে। তবে বুঝতে খানিকটা দেরি হয়। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি ক্রমে বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় সে ফের চেনা আলোকচিত্রটির দিকে তাকায়–মন্টুর তেলসিক্ত চুল পরিপাটি আঁচড়ানো, কপালটা ভেজা ভেজা, যেন আঙুল দিয়ে ছুঁলেই তেলের আঠায়। তর্জনী আটকে যাবে। ফুলতলি গায়ের ধূলি-বালি থেকে শহরে উপড়ে আনা কিশোরের দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখজোড়ায় ক্যামেরার প্রথম ফ্লাশ বিস্ময় ফোঁটাতে পারেনি। ঠোঁট দুটি আঁটসাঁট–এক বুক অভিমান প্রাণপণে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। কিছুতেই বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না–স্টুডিওর লোকটার বারবার এক্স-রে মেশিন অপারেটরের মতো ‘দম ছাড়ো, বি ইজি’ বলার পরও। সেদিন স্টুডিও থেকে বেরিয়ে মরিয়ম ভাইয়ের ওপর খুব চোটপাট করে, ‘তুই একটা গাঁইয়্যা ভূত। এই ছবি দেখলে শহরের স্কুলে ভর্তি নেবে? শুধু শুধু কতগুলি টাকা খরচ!’

‘যারা আজও ফেরেনি’ শিরোনামের সচিত্র খবরের মাঝখানে ‘দম ছাড়ো, বি ইজি’ নির্দেশ অমান্যকারী মন্টুর সেই ফটোগ্রাফ–খবরের কাগজের প্রতিদিনের নিখোঁজের তালিকার আজ জায়গা করে নিয়েছে। মরিয়মের সামনে থেকে কাগজের অক্ষরগুলো জড়াজড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়ায়, এক লাইন আরেক লাইনের পিঠ থেকে নেমে পড়ে, সিটি বাজানো বন্ধ হয়ে দেয়। একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মন্টু বাড়ি থেকে উধাও। ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার সময় একটা হাতচিঠি পাঠিয়েছিল। তারপর আর খবর নেই। বাবা-মা, ছোট দুই বোন অধীর আগ্রহে তার অপেক্ষা করছে। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি মন্টুর খোঁজ পেলে, তাকে নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। পিতা কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়।

এটি হারিয়ে যাওয়া মন্টুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ঠিকানা। সেখানে বাবা-মা, ছোট দুই যমজ বোন রত্না-ছন্দা বাস করে। তারা বেঁচে আছে। মন্টু গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে উধাও। মরিয়ম কোথাও নেই। তার জন্য বাবা-মা, ছোট দুই বোন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে না। করলেও বিজ্ঞাপনে তার উল্লেখ নেই। কিন্তু সে তো বেঁচে আছে এবং ডাক্তারের কথামতো দ্রুত সেরে উঠছে! পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে বারবার তার ঠিকানা চাওয়া হচ্ছিল, যদি আপনজনেরা এসে নিয়ে যায়। কেউ কেউ নিরাময় লাভের পর ইতিমধ্যে নিজের বাড়িঘরে ফিরে গেছে। যদিও সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য। ঠিকানা চাইতে এলে মরিয়ম পিঠ ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে, টুঁ শব্দটি করে না। বিজ্ঞাপনটা পড়ার পর তার মনে একটাই প্রশ্ন, মন্টু নিখোঁজ! স্বাধীনতার দু’মাস পর নিখোঁজ কেউ ফিরে আসে? মন্টু আসবে?

মরিয়মের সামনে থেকে হাসপাতালের সাদা দেয়ালটা সরে দাঁড়ায়। চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে প্রায়ান্ধকার একটি কক্ষ। সেখানে টিমটিমে আলোর বালুবের নিচে ভাগ্যগণনা করছেন একজন কৃশ, খর্বাকৃতির লোক। স্বরটা অসম্ভব ভারী। যেন তার নয়, অন্য কারো কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে—’হাতের তালুতে দীর্ঘ আয়ুরেখা নিয়ে অসময়ে চিরদিনের মতো কেউ হারিয়ে যেতে পারে না, যদি না প্রতিজ্ঞার বরখেলাপ হয়।’ ‘জ্যোতিষশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, এশিয়া বিখ্যাত হস্তরেখাবিশারদ প্রফেসর কিউ এম তালুকদার’-এর চলটা ওঠা সঁতসেঁতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে মন্টু। প্রফেসরের পাথরের আংটি পরা বিশাল থাবায় পাখির ছানার মতো তার কচি হাতটা তিরতির করে কাঁপছে। মরিয়ম অদূরে। আবেদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। গলির ভেতরের তস্যগলিতে সে একা আসতে পারবে না বলে ভাইকে সঙ্গে এনেছে। মন্টুর হাত দেখানো ছিল ফাউ। তাই ছোটবেলায় মরিয়ম যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিল, প্রফেসরের প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে সেদিন মনে পড়েনি। আজ পড়ছে।

মেরির সাত আর মন্টুর পাঁচ বছর বয়স তখন। আব্বা-আম্মার বিছানা থেকে সদ্য তাদের চালান দেওয়া হয়েছে পাশের ঘরে। সেখানে ভাই-বোনের জন্য পাশাপাশি দুটি বিছানা। তখন মন্টুর বড় কোনো অসুখ নয়, সামান্য জ্বরই হয়েছিল। ফুলতলি বাজারের হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধে সারছিল না। ভাইয়ের জন্য বোন অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন আল্লার কাছে মানত করেছিল, মন্টু সুস্থ হলে ছাপরা মসজিদে চার আনার মোমবাতি দেবে। আজ দেবে, কাল দেবে করে কোনোদিন যা আর দেওয়াই হয়নি। ভাই সুস্থ হওয়ার পর আগের মতোই সেই ঝগড়াঝাটি মারামারি। একজন মেরে পালালে, মার খায় যে, সে অভিশাপ দেয়—’কুষ্ঠ হইয়্যা মরবি তুই।’ বড় হওয়ার পর মেরি-মন্টু একে-অন্যের মরণ চায়নি ঠিকই, তবে দীর্ঘায়ু কামনা করে খোদার দরবারে ফরিয়াদও জানায়নি। হয়তো জানাত, যদি তারা বাঁচতে বাঁচতে একদিন বৃদ্ধ হতো। সে সময়টা আসার বহু আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

মন্টু আজ নিখোঁজ। মেরি হাসপাতালের বেডে। তাকে বাবা-মার অস্বীকৃতিটাও মনে খুব বাজে। যদিও কেন্দ্রের রেজিস্ট্রেশনের দিন থেকে সে তাদের লাগাতার অস্বীকার করে এসেছে, নিজের পরিচয়টাও ঠিকভাবে কেসহিস্ট্রিতে লিখতে দেয়নি। তবে দুটি বিষয়ে ফারাক বিস্তর–বাবা-মা অস্বীকার করছে সন্তান আর সে আড়াল করেছে নিজের পূর্বপরিচয়, যে পরিচয়ে বাস্তবিকই সে আর বাঁচবে না। নির্যাতন ক্যাম্পের দেয়ালের কিনারে যে মেয়েটি আড়ি পেতে বসত, যার নাম অনুরাধা সরকার, এটি ছিল তার ভবিষ্যদ্বাণী। হাতের রেখা না দেখেই অনুরাধা ভবিষ্যৎ বলে। দিতে পারত।

তারা তখন হলরুমের মতো লম্বা একটি ঘরে বন্দি। জায়গাটা কোথায় মরিয়ম জানে না। কারণ চোখ বেঁধে তাদের ওখানে আনা হয়েছে, কয়েকবার বের করেও নিয়ে গেছে চোখ-বাঁধা অবস্থায়। প্রথম দিনেই মরিয়ম দেখেছে, ঘরের জানালা পেরেক। ঠুকে বন্ধ করা। প্রধান ফটক বাদে সব কটা দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝোলানো। বিশাল ঘরে বাতির ব্যবস্থা নেই। যেটুকু আলো আসে ভেন্টিলেটর দিয়ে। ঘরে কয়েকটা ভূগ্রস্ত মেয়ে কম্বল গায়ে নড়াচড়া করে। তাদের আলাদা কোনো চেহারা নেই, পরিচয় নেই, নাম নেই।

‘ধরো আমার নাম অনুরাধা সরকার’–দেয়ালে আড়ি-পাতা মেয়েটি একদিন মরিয়মকে ফিসফিস করে বলে। মরিয়ম তার চোখ দুটি কাছ থেকে দেখে অবাক হয়। মাইনাস ফাইভ চশমার পরকলার অভাবে তার যে মাছের মতো ঘোলা চোখ-কথাটা বলে মরিয়মের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে অনুরাধা সরকার। তাকে তখন আরো অদ্ভুত দেখায়। পাকসেনারা বিএম কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রীটিকে বইয়ের জগৎ থেকে উপড়ে এনে ফেলেছিল চার দেয়ালের মাঝখানে। প্রথম দিনের ধস্তাধস্তির ফলে। চশমাটা ভেঙে যায়। থাকলে কী হতো? এখানে তো এর কোনো কার্যকারিতাই নেই। তবে কাগজ-কলম বরাদ্দ থাকলে, অনুরাধা তাকে বলে, সে আনা ফ্রাংকের মতো। বন্দিজীবনের ডায়েরি লিখত।

যেদিন হলঘরের সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটিকে দরজার বাইরে গুলি করে হত্যা করে মিলিটারিরা, অনুরাধা দেয়ালের কিনার থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে মরিয়মকে। সঁতসেঁতে দেয়াল। গত কদিন ধরে মেয়েটির কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ছিল। যক্ষ্মা হয়েছিল বোধ হয়। তা বলে গুলি করে মেরে ফেলবে! হলঘরের মেয়েরা যখন নড়াচড়া করতেও ভয় পাচ্ছিল, দেয়ালে আড়িপাতার খেলা শুরু হয়ে যায় অনুরাধার। তারপর শুরু হবে অদৃশ্য খাতার পাতায় ডায়েরি লেখা। মরিয়ম এগিয়ে যেতে অনুরাধা। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দেয়ালে কান পাতো, মেরি। কি, শুনতে পাচ্ছ কিছু?’ মরিয়ম মাথা। নাড়ে। ‘শক্ত করে চেপে ধরো। পাবা। আরেক হাত রাখো ওই কানটায়। কী শুনতেছ?’ মরিয়ম ঠোঁটে তর্জনী চেপে তাকে চুপ থাকতে বলে। অনেকক্ষণ পর শোনে, রিমঝিম বৃষ্টির সুরেলা আওয়াজ। সে হয়তো অসম্ভব কিছু শোনার প্রত্যাশা করেছিল, তাই মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘এহ বৃষ্টি!’

‘হ্যাঁ বৃষ্টি।’ অনুরাধার চোখের কোণ দুটি সরু, কপালে গভীর কুঞ্চন। মরিয়ম কান খাড়া করে। অদৃশ্য খাতার পাতায় অনুরাধা কলম ছাড়া ডায়েরি লেখে-বর্ষাকাল এসে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিল, সৈন্যরা জল-কাদায় নড়তে-চড়তে পারবে না। বৃষ্টির ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকবে। তাদের অনুমান ভুল। সর্বাংশেই ভুল। স্পিডবোটে চড়ে সৈন্যরা এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে গাঁয়ের মেয়েতে হলঘরটা ভরে উঠবে। এখন আমরা যদি হই পাঁচ, মাস শেষে দশ হব।

সত্যি সত্যি তা-ই হয়েছিল। নতুন মেয়েগুলোর একজনের নাম ছিল শোভা রানী। ঘোর বর্ষায় বাড়ির পেছনের জঙ্গলে সে ধরা পড়ে। শোভা রানীর বিয়ে হয়েছে। ছয় মাসও হয়নি। এর মধ্যে সে স্বামী হারিয়েছে। সুযোগ পেলেই গড়গড়িয়ে নিজের অত্যাচারের কাহিনি বলত আর হাপুস নয়নে কাঁদত। সেদিন জঙ্গল থেকে ধরে এনে। বাড়ির আঙিনায় দুজন সৈন্য তাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাস্থলের অদূরেই ছিল কুমড়োর মাচা। যা শোভা রানীর স্বামীর পারিবারিক সম্পত্তি। যুদ্ধ শুরুর আগে সে মাটি কুপিয়ে নিজহাতে বীজ বুনেছিল। আর্মির ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর সময়ও গাছের গোড়ার আগাছা সাফ করেছে, পুকুর থেকে কলসি ভরে পানি এনে ঢেলেছে। স্বামী বিমল দাসকে সঙ্গে নিয়ে একটা একটা করে লকলকে ডগা সযত্নে তুলে দিয়েছে কাঁচা বাঁশের মাচায়। কুমড়ো-লতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। অজস্র হলদে ফুল ফুটিয়ে ফল। ফলাল। তখন চোর নেই চুরি করার। নিজেরা যে কুমড়ো পেড়ে স্বস্তিতে রান্না করে। একবেলা সবাই মিলে খাবে, সেই সুযোগও মিলিটারি আর রাজাকাররা তাদের দেয়নি। অথচ সেদিন একজন সৈন্য মাচার বড় কুমড়োটার বোঁটা ছিঁড়ে তাকে ধর্ষণের পারিশ্রমিক দিতে চায়। শোভা রানী ঘেন্নায় নেয় না। শাস্তিস্বরূপ উঠানের ঘাস-কাদায়। মাখামাখি তার রক্তাক্ত শরীরটা ক্যাম্পে চালান করে। এর আগে স্বামীকে গুলি করে মারে সেই মাচাটার নিচে। শোভা রানীর বৃদ্ধা শাশুড়ি সুরবালা তখন মুখ-বাঁধা অবস্থায় গলাকাটা মুরগির মতো দাওয়ার ওপর দাপাদাপি করছিলেন।

আস্তে আস্তে দিনগুলো আরো কঠিন হচ্ছে। গণধর্ষণের ফলে জবা নামের হাসিখুশি মেয়েটি সবার চোখের সামনেই মারা গেল। শেষ সৈন্যটি শরীরে থাকতেই ওর দম বেরিয়ে যায়। দিন গিয়ে রাত নামে, ডেডবডি সরাতে কেউ আসে না। কম্বলের নিচে পচে উঠছে তাদের রাতদিনের সঙ্গী, ফুলের মতো মেয়ে জবার শরীর। এরকম সময় অনুরাধা অদৃশ্য খাতার পাতায় ডায়েরি লিখছে–হানাদারদের সামনে দৃশ্যত এখন কোনো শত্রু নেই। যারা আছে, তারা পাটখেতের আড়াল থেকে রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়, পাকা সড়কে বা জলপথে অ্যামবুশ রচনা করে। অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে সৈন্যরা তাই কাণ্ডজ্ঞানরহিত, দিশাহারা। এভাবে ভয় পেতে পেতে মনোবল হারিয়ে ফেললে তাদের দিয়ে আর যুদ্ধ হবে না। বাড়ির কথা মনে পড়বে–গলফ ক্লাব, টেনিস বল, ঘি আর টেংরি কাবাবের সেই সুখী, নিরাপদ, ভোগবিলাসের জীবন। কর্তারা তাই লাগাম খুলে দিয়েছেন–যে যত পারো খুন-ধর্ষণ লুণ্ঠন করো। এ কাজগুলো হচ্ছে ফুয়েল-পেট্রোলের মতো, যা যুদ্ধ চালু রাখে, এর গতি বাড়ায়। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে…অনুরাধা কথার মাঝখানে খেই হারিয়ে ফেলে। আচমকা বর্তমান সময়টা ছুটতে ছুটতে আটকে যায় ধূসর অ্যালবামের পাতায়। যেখানে কতগুলো সাদা-কালো ছবি, যা ভবিষ্যতের মানুষ পাতা উল্টিয়ে দেখছে, বিশেষত আজকের মতো কোনো এক বৃষ্টির দিনে।

যুদ্ধের পর এই ঘরগুলোতে একদল অনুসন্ধানকারী হয়তো তল্লাশি চালাবে। কিন্তু লুঙ্গি-গেঞ্জির ছেঁড়া টুকরা, হাড়গোড় এসব দেখে প্রথম বুঝতে পারবে না বন্দিরা নারী, পুরুষ ছিল। নিজের জট পাকানো চুল মুখের কাছে টেনে এনে অনুরাধার সেদিনের ভবিষ্যদ্বাণী–‘এই চুল তখন সাক্ষী দেবে।’

হয়েছিলও তাই। ভূগর্ভস্থ বাংকার আর ব্যারাকগুলোতে স্বাধীনতার পর রাশি রাশি লম্বা চুল আবিষ্কৃত হয়। মাদার তেরেসা ঢাকা সেনানিবাসে পৌঁছে গিয়েছিলেন ডিসেম্বর কি জানুয়ারিতে। তার মাথায় ছিল ভ্রুণহত্যার খ্রিষ্টীয় পাপ আর অনাগত শিশুদের দত্তক বানিয়ে বিদেশে পাঠানোর পাঁয়তারা। সেখানে মাদার কোনো মেয়ে দেখতে পাননি। গোছা গোছা লম্বা চুল, ঘেঁড়া পেটিকোট আর কিছু টুকিটাকি আবর্জনা দেখে সেইবার তাকে কলকাতায় ফিরে যেতে হয়েছিল।

অনুরাধা আরেক দিন আড়িপাতা বাদ দিয়ে মরিয়মকে উদ্ভট একটা প্রস্তাব দেয়, ‘চলো দেয়ালের গন্ধ শুকি। কানের বদলে নাক! কেন? মরিয়ম বেঁকে বসে। তখন ঘরের আরেক প্রান্ত থেকে ছুটে আসে শোভা রানী। অনাহারক্লিষ্ট দুর্বল শরীর, ঘন ঘন দম নেয়-হাঁপায়। দেয়ালে নাক ঘষে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, ‘অ্যাঁ রাম, কুমড়োর গন্ধ!’ শোভা রানী তখন গর্ভবতী। বলেই চাক চাক কুমড়ার টুকরা হড়হড় করে বমি করে দেয়। যদিও গত এক মাসের মেন্যুতে এক দিনও মিষ্টি কুমড়োর ঘাট ছিল না। শোভা রানীর পর মরিয়মের পালা। সে দেয়ালের ঘ্রাণ শোঁকে–ভেজা ইট-সিমেন্টের বালি বালি গন্ধ। ‘নাকটা চেপে ধরো!’ অনুরাধা উচ্ছ্বসিত, ‘কি, পাচ্ছ তো? আহা ধোঁয়া ধোঁয়া শিশিরের গায়ে জড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের মিষ্টি সৌরভ!’ বমির ওপর থেকে। শোভা রানী ক্লান্ত স্বরে বিড়বিড় করে, ‘মা দুর্গা কৈলাস ছেড়ে অচিরেই আসছেন।’ ইন্দিরা গান্ধীর চেহারাটা তার মনে আসে না।

শরৎ এসে গেছে, তারপর হেমন্ত। তাদের আর কতকাল এভাবে বাঁচতে হবে? অনুরাধা বলে, ‘মনোবল হারালে সৈন্যরা যেমন যুদ্ধ করতে পারে না, আমরাও তেমন বাঁচতে পারব না।’

মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুক্তির দিকে তাকায়। যার এত বাঁচার শখ ছিল, সে আজ বেঁচে আছে না মারা গেছে? কত আশা ছিল মেয়েটার! ভবিষ্যৎ নিয়ে কত কথা! মুক্তি নড়েচড়ে বসে। তখন সময়টাই ছিল অন্যরকম। সে এক আশাবাদের যুগ-জটিলতাবর্জিত আর একরৈখিক। যেমন এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা, এক স্লোগান। জয়বাংলা স্লোগান দেওয়ার বিনিময়ে মানুষ মরতে প্রস্তুত ছিল। তারা বিশ্বাস করত, রক্ত দিয়ে যে-কোনো অর্জনই সম্ভব। রক্তের আরাধনায় গীতিকার-গায়কেরাও মেতে ওঠেন–রক্তে যদি ফোটে জীবনের ফুল/ ফুটুক না ফুটুক না ফুটুক না। সেই বেহিসেবি আশাবাদের কালে অনুরাধার অমরত্বে বিশ্বাস ছিল।

অনুরাধা চেয়েছিল, কীভাবে তারা নির্যাতিত হলো, কারা তাদের নির্যাতন করল, কেন নির্যাতন করল–ভবিষ্যতের মানুষ সেসব জানুক, তাদের কথা মনে রাখুক। মুক্তিদের গবেষণার প্রকল্পে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের একটি সম্ভাব্য ছক, যা অনুরাধার মাথায় ছিল না। কারণ সময়টা ছিল ১৯৭১। মেয়েদের পক্ষ থেকে বিচারের দাবি উঠতে আরো দু’দশক লেগে যায় এবং তা বিস্তার লাভ করে পৃথিবীর আরেক ভূখণ্ডে। সেখানকার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পঁয়তাল্লিশ বছর পরে। অভিযোগকারীরা কমফোর্ট উইমেন, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোরপূর্বক সৈন্যদের যৌনসেবায় নিয়োজিত ছিল। যুদ্ধশেষে এ মেয়েরা যেন দুর্গন্ধময় পচা মাছ-সমাজ-পরিবারে জায়গা পায়নি। সে আরেক কাহিনি–পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তের, সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের, ঈশ্বরের প্রতিভূ সূর্যবংশীয় সম্রাট হিরোহিতোর আর তার সাম্রাজ্য বিস্তারের।

সম্রাট হিরোহিতোর যুদ্ধ ১৯৩২-এ মাঞ্চুরিয়ায় শুরু হয়ে, শেষ হয় ১৩ বছর পর ১৯৪৫ সালে বার্মায়, বর্তমান মিয়ানমারে। জাপানি সৈন্যরা নিয়তির মতো গোটা পথ বয়ে নিয়ে বেড়ায় কমফোর্ট স্টেশনসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বন্দি নারীদের। তারা তাদের বেঁধে-বেড়ে খাওয়ায়, নোংরা কাপড় কেচে দেয়, স্ত্রী বা গেইশাদের মতো যৌনসুখ বিলায়। বিনিময়ে রাজকীয় সেনারা সেসব মেয়েদের যৌনাঙ্গে তলোয়ার চালায়, স্তন কেটে নেয়, স্তন থেকে দাঁত দিয়ে বোঁটা উপড়ে ফেলে, গর্ভপাত করায়, শরীরে গনোরিয়া-সিফিলিসের জীবাণু ছড়ায়, গুলি করে, সাবমেরিনে তুলে গভীর সমুদ্রে ডুবিয়ে মারে। ’৪৫-এর আগস্ট মাসে তিন দিন আগে-পরে বোমা পড়ে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে। সম্রাট হিরোহিতো যুদ্ধে হেরে যান। ১৫ আগস্ট অনুগত সুনাগরিকদের উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেন তিনি, ‘আমি এখন থেকে আর ঈশ্বর নই, আমি মানুষ। মানুষ! জাপানিরা নাগাসাকি-হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে বলে নয়, যুদ্ধে হেরে গেছে বলে নয়, সেদিন গণকান্নায় ভেঙে পড়ে তাদের এত কালের আরাধ্য। ঈশ্বরকে হারিয়ে। সেই ঈশ্বর ’৯১ সাল থেকে ক্রমাগত আসামির কাঠগড়ায়। কমফোর্ট নারীরা তাকে রাজকীয় কবর থেকে তুলে এনেছে। মানুষরূপী ঈশ্বর ধর্ষণের হোতা, কমফোর্ট স্টেশনের প্রতিষ্ঠাতা। উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ-জেনারেলসহ তার বিচার হোক, সে ক্ষমা চাক, ক্ষতিপূরণ দিক। ’৩২ থেকে ৪৫-এর নির্যাতনের জন্য তো বটেই, যুদ্ধ পরবর্তী নারীর আমৃত্যু ক্ষয়ক্ষতির মাসুলও তাকে গুনতে হবে।

মুক্তির মুখে যুদ্ধাপরাধের বিচারের গল্প শুনতে শুনতে বহু বছর পর মরিয়মের মনে পড়ে একজন মেয়ের কথা, যার নাম শ্যামলী-শ্যামলী রহমান। মুক্তিযুদ্ধের পর শ্যামলী রহমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের অপেক্ষা করেনি, নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছিল। অথচ সে ছিল মরিয়মের জানামতে একমাত্র নারী, যুদ্ধাবস্থায় হলঘর থেকে জীবিত ছাড়া পাওয়ার সৌভাগ্য যার হয়েছে। এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি টাল খায় অনুরাধা। অমরত্বের ঊর্ধ্বলোক থেকে সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। আর তখন থেকেই ভাবতে শুরু করে, সব যুদ্ধই একদিন শেষ হয়, এই যুদ্ধও হবে। কিন্তু তারা পূর্বপরিচয়ে আগের ঠিকানায় ফিরে যেতে পারবে না, তাদের জায়গা হবে দেশ বিদেশের বেশ্যালয়ে।

যুদ্ধের কয়েক বছর পর শ্যামলীর সঙ্গে মরিয়মের ফের দেখা পাকিস্তান। দূতাবাসের সামনে। সে মরচে ধরা কিচেন নাইফ কোমরে গুঁজে দিনেদুপুরে ঘুরঘুর করছে। পায়ে পোয়াতির মতো পানি নেমে গেছে, পরনে ময়লা শাড়ি, চুল মাথার ওপর উঁই করে বাঁধা, মুখে মদের গন্ধ। মরিয়মকে দেখামাত্র হাত ধরে টানতে টানতে রাস্তার ওপাশে নিয়ে শাড়ির কুঁচি সরিয়ে সে ছুরিটা দেখায়–যা দিয়ে মানুষ খুন করবে।

কাকে?

পাকিস্তানি আর্মি অফিসার শাহাদতকে, কারণ প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও লোকটা শ্যামলীকে বিয়ে করেনি। মাঝখান থেকে তার ছোট ছেলে বুলু মারা যায়, বিনা চিকিৎসায়, অবহেলায়।

কত কথা ডুবে ডুবে রয়েছে, কত শত নির্যাতন! বলতে চাইলেও পুরোটা মুখ ফুটে বলা যায় না। বা কথা তো গাছের পাতা, একবার খসে পড়লে ডালে ফেরত যাবে। কেঁচো খুঁড়তে হয়তো সাপ বেরিয়ে পড়বে। ‘কিন্তু’ মুক্তি তাকে জিগ্যেস করে, ‘যদি এমন হয় যে আপনারা সে সময়ের কয়েকজন একসঙ্গে বসলেন, বাইরের কেউ আশপাশে থাকল না, তখন কি বলা সম্ভব?’

সম্ভব কি না মরিয়ম জানে না। তবে মুক্তির কথা শুনে তার মুখে হাসি ফোটে। অনুরাধা নিজের কানে এ উদ্ভট প্রস্তাবটা শুনলে বইয়ের ভাষায় নাম দিত–নির্যাতিতের কনফারেন্স।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *