০৫.  স্বর্গধামের পতন

 স্বর্গধামের পতন

এপ্রিলের মাঝামাঝি মরিয়মদের নতুন দলটা পদ্মা পার হয়ে পাকা সড়ক, বৈদ্যুতিক তার, টেলিফোনের পিলার অনেক অনেক পেছনে ফেলে এক প্রত্যন্ত গাঁয়ের পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ি ঢোকার মুখে টিনের পাতে খড়ি দিয়ে লেখা-স্বর্গধাম। স্বর্গধামে ঘর প্রচুর, মানুষ নেই। দরজাগুলো হাট করে খোলা। তখনো উঠানের রোদে কাপড় মেলা রয়েছে। চুলার আগুনটাও নেভানো হয়নি। বাড়ির বাসিন্দাদের পালিয়ে যাওয়ার পর, বাড়িটা লুট হওয়ার আগে তারা ওখানে পৌঁছায়। পরিত্যক্ত মালামালের মালিক হয়ে বসে। বাড়ির সুবিধা-অসুবিধাগুলো গভীরভাবে নিরিখ করে। উঠানের কোনের তুলসীমঞ্চ, বাঁশঝাড়ের তলায় শীতলা ঠাকুর দেখে বোঝে যে, বাড়ির লোকগুলো ভারতে চলে গেছে এবং আপাতত ফিরছে না। তারা তুলসীগাছ উপড়ে ফেলে আর শীতলা ঠাকুরকে ভোগের ঝুনা নারকেলসমেত জঙ্গলের ভেতর ঠেলে দেয়। এখন কারো বোঝার সাধ্য নেই যে, বাড়িটা হিন্দুর। তাতে তারা নিরাপদ বোধ করে। ততক্ষণে পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে এক দঙ্গল মুরগি। সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে ছানাপোনা। বাড়িতে ঢুকেই প্রাপ্তবয়স্ক মুরগিগুলো কুড়কুড়িয়ে ডিম পাড়ার জায়গা খোঁজে। একটিমাত্র মোরগ গলা ফুলিয়ে উঠান, বারান্দা, রান্নাঘর মুরগিদের দাবড়িয়ে বেড়ায়। গোয়ালঘরে লাল ও সাদা গাই দুটি হাম্বা রবে ডেকে ওঠে।

পরিত্যক্ত বাড়ি, রান্নার চুলা, তারে মেলা কাপড়, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা মোরগ-মুরগি আর গোয়ালের গরু-বাছুর দেখে উদ্বাস্তুদের ফের সংসারী হতে ইচ্ছে করে। জোড়াতালি দিয়ে পরিবার রচিত হয়। যা থেকে মরিয়ম বাদ পড়ে যায়। নিজেরা পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমন বিষয় বলতে থাকে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ভয়–যা রাতদিনের যে-কোনো প্রহরে জানান না দিয়ে হতে পারে।

মিসেস আলাউদ্দিন স্বামীর মৃতদেহ ঢাকায় ফেলে এসেছেন। তিনি এখন বিধবা, দুটি কন্যাসন্তানসহ। আট বছরের যমজ শিশু দুটি জানে না তাদের বাবা-মা কোথায়। তারা তিন-চার দিন হয় দলে আশ্রয় নিয়েছে। এদের পরিচয় এখন এতিম। নিঃসন্তান আতিক দম্পতি যমজদের পালক নিলেও প্রকারান্তরে চাকরের মতো খাটাচ্ছেন। মলিনা গুপ্তের স্বামী, দেওর, পুত্র, শ্বশুরসহ পরিবারের ১১ জন পুরুষ লাইন করিয়ে পাকসেনারা হত্যা করেছে। লাইনটি ছিল দৈর্ঘ্যে বাঁকা, উচ্চতায় অসমান। ব্যাটন মেরে, ভয় দেখিয়ে, একজনের জায়গায় আরেকজনকে টেনে এনে সৈন্যরা তা সোজা আর সমান করতে পারেনি। ব্রাশফায়ারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত লাইনটা পূর্বাবস্থায় থেকে যায়। সৈন্যরা একে অবাধ্যতা মনে করে ফেরার সময় ঘর-বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মলিনা কোমরের বটুয়ায় স্ত্রীধন আর দু’হাতে দুটি সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। ডাকাত বা মিলিটারির হাতে কে কখন তাকে সোপর্দ করে, এই ভয়েই সন্ত্রস্ত। মনটা তার এখানে নেই, সীমান্তের ওপারে। দাদা-বউদির কৃষ্ণনগরের বাড়িতে বৈধব্যের বেশে ফেরত যাবেন, না সল্টলেকের শরণার্থী ক্যাম্পে উঠবেন–এ নিয়ে খানিকটা সময় ভাবনা-চিন্তা করেন। বাকি সময় নিজের মেয়ে দুটিকে মুরগির মতো ডানার নিচে লুকিয়ে আপনমনে কথা বলেন। একটা বাঁকা ও অসমান লাইনের ধাঁধা তার কিছুতেই ঘোচে না।

ইঞ্জিনিয়ার তৈয়ব ওয়াপদার বড় অফিসার। বারংবার রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি যে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন না, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী স্বপ্ন মনে করে, তা মেরির জন্য। নাম শুনে মনে হয় মেয়েটা খ্রিষ্টান, আবার মুসলমানও হতে পারে। তবে স্বভাবে ছেনাল। ওর স্বামীকে কুপথে টানছে। সাতকুলের সব ফেলে তাদের সঙ্গে ভিড়েছে পুরুষ ধরার জন্য। অন্তঃসত্ত্বা স্বপ্ন, যার সন্তান মাতৃগর্ভে খুন হবে, তিনি দলের আরেকজন সধবাকে ডেকে বলেন, ‘আতিক ভাবি, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করছেন তো মরছেন। ওরা চাইলে মেয়েটারে বাইর কইরা দিতে পারে না স্বর্গধাম থেকে! আলাউদ্দিন ভাবির আর ভাবনা কী। মাথা থাকলেই না মাথাব্যথা। তবে ওনার নৈতিক দিকটা খুব স্ট্রং। বেশ্যা সন্দেহে মেরির সঙ্গে ওঠবোস বন্ধ করে দিয়েছেন।’

মরিয়ম পুরোনো ভুক্তভোগী। আড়াল তার জীবনে ভীষণ প্রয়োজন। খানিকটা ফাঁক পেলেই ওরা ঢুকে পড়বে তার অতীতে। তখন সামান্য যে আশ্রয় যা খুব বড়ও নয়, ছোটও নয়, অনেকটা কবরের মাপের–যে পরিধিতে এখন সে মিসেস আলাউদ্দিন ও তার সন্তানদের পাশে শুয়ে আছে, তাও হারাবে। আহার নিয়ে ভাবনা নেই স্বর্গধামে। এখানে কেউ কারোর খাচ্ছে না। এখানকার গাই দুধ দেয়। ফলের ভারে বাগানের গাছগুলো সেজদার ভঙ্গিতে নুয়ে থাকে। মুরগির ডিম সমান ভাগে ভাগ হয়। দু’দিন ধরে মরিয়ম লক্ষ করছে, খাওয়ার সময় কেউ তাকে ডাকছে না। কাঁসার থালায় প্রসাদ আসে যমজদের হাত দিয়ে। সে দেবী না ডাইনি? এই যে সবার মতো আলাউদ্দিন ভাবিও দিনের বেলায় তাকে এড়িয়ে চলেন, পারত কথা বলেন না, এখন। তিনি অন্ধকার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন। রাত কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। স্বর্গধামের পালঙ্ক দুটি দুই জোড়া দম্পতির দখলে। সেখানে সুখ আর আনন্দের ঝড় বইছে। মাস দেড়েক আগে স্বামী বেঁচে থাকাবস্থায় যেসবে মিসেস আলাউদ্দিনের অংশীদার ছিল, এখন ওসব জিনিস দরজা-জানালা ভেদ করে তাকে তিরবিদ্ধ করে। এরকম সময় তিনি মরিয়মকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। জোরে জোরে দু-চারটা কথা বলে তিরগুলোর গতিমুখ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চান। দিনে যে শত্রু, রাতে সে মিত্র। এ সময় মেরিকে ডাকতে মিসেস আলাউদ্দিনের সংকোচ হয়, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে, আবার মায়াও হয় মেয়েটার জন্য। দিনে বড় অবিচার করেছেন। কোথায় বাবা-মা, আপনজন। তার তো তবু দুটি সন্তান রয়েছে। দিনের আলোয় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। মিসেস আলাউদ্দিনের এসব ভাবনা কেবল রাতের বেলার–যখন তিনি একা শরশয্যায়, যখন দিনের মিত্ররা বন্ধ দরজার ওপাশে শত্রুতে রূপান্তরিত হয়।

স্বর্গধামের মানুষগুলো ভুলে যায়, যদিও গরু দুটি বালতি ভরে দুধ দেয়, মুরগি ডিম পাড়ে, গাছ ফল ফলায়–এখন যুদ্ধের সময়। স্বর্গধাম আসলে মায়া, তাদের যুদ্ধ তাড়িত মনের কল্পনা, অথবা স্বপ্ন, ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যা মিলিয়ে যাবে। যদি সত্যিও হয়, মর্তে স্বর্গসুখ বেশিক্ষণ টেকে না। মরিয়ম দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তাতেও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নগুলো দিনে দিনে বড় হয়। তার গোপন অতীত সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বিস্ফোরণ ঘটায় আচমকা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রমিজ শেখ স্বর্গধামে হাজির হয়। তারপর যা ঘটতে থাকে, প্রকারান্তরে তা মরিয়মের জীবনে। আগেই ঘটেছিল।

রমিজ শেখের আগমনে অন্তঃসত্ত্বা স্বপ্ন সবচেয়ে বেশি খুশি। কারণ স্বামীর ওপর তার ভরসা নেই। প্রসবের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন মানুষটা স্ত্রীর প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছেন। একই ঘটনায় মলিনা গুপ্তের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন। রমিজ শেখের আগমনের রাতেই কোমরের বটুয়ায় স্ত্রীধন বেঁধে মেয়ে দুটিকে নিয়ে তিনি স্বর্গধাম ছেড়ে চলে যান। মিসেস আলাউদ্দিন আর আতিক ভাবি রমিজ শেখকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান। তারা তা করেন স্বপ্নর মতো একই কারণে। তাদের নিজেদের গর্ভজাত বা পালক সন্তান রয়েছে। অথচ এত বড় দলটায় কর্মক্ষম পুরুষ মাত্র দুজন। তাদের আবার স্বর্গধামের আরাম-আয়েশে থেকে গায়ে পোকা পড়ার উপক্রম। আতিক মিয়া আর তৈয়ব সাহেবের অবস্থা দেখে মেয়েরা ভুলতে বসেছিল, পাকসেনার বিরুদ্ধে। এ দেশের পুরুষেরা বন-বাদাড়ে থেকে লড়াই করছে। স্বাধীন বাংলা যতই জাহির। করুক, রেডিওটা তো যন্ত্র। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। বন্দুকধারী রমিজ শেখ রক্ত-মাংসের মানুষ। কখন, কোন দিক থেকে বিপদ চলে আসে–তখন চওড়া কাঁধের, খর্বাকৃতির, অভিব্যক্তিহীন, গেঁয়ো লোকটা সব সামাল দেবে।

এদিকে তৈয়ব সাহেব, আতিক মিয়া মেয়েদের আদেখলাপনায় বিরক্ত। রমিজ শেখ তাদের সৌভাগ্যে ভাগ বসাতে এসেছে, যা পুরুষ হিসেবে দুজন স্বর্গধামে একচেটিয়া ভোগ করছিল। মরিয়মের প্রতি তাদের আকর্ষণ দলের কারো অজানা নয়। এ নিয়ে আড়ালে-আবডালে প্রতিযোগিতাও চলে দুজনের। সেটি প্রকট হয় তাস পেটানোর সময়। খেলার যে নিয়ম-একজন হারলে আরেকজনের জিত হবে, তা তারা ভঙ্গ করে। প্রত্যহ চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে তাস গোটাতে হয়। মরিয়ম মরিয়মের জায়গায়। বিবাহিত পুরুষ হিসেবে তাকে বাগে আনার পথে বাধা বিস্তর, যা রমিজ শেখের নেই। লোকটা গোঁয়ার, বন্য প্রকৃতির, সারা দিন রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। এমন জিনিস হাতে থাকলে আজকের দিনে আর কিছু লাগে! যে যা খুশি করতে পারে। অবিবাহিত যুবতীসহ স্বর্গধামের পুরো কর্তৃত্ব তার হাতে চলে গেলে আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেব বুঝতে পারেন না, তারা তখন কী করবেন। মিলিটারির আক্রমণের চেয়ে এই বিপদটাই দুজনের বড় মনে হয়।

রমিজ শেখের পক্ষে-বিপক্ষে স্বর্গধাম বিভক্ত হয়ে গেলে মরিয়ম ফাঁপরে পড়ে। ভাবে, এই লোকটা তার শত্রু না মিত্র? স্বর্গধামের লোকজনের ব্যাপারে তার মনে কোনো সংশয় নেই। যুদ্ধের আগের ফুলতলি গাঁয়ের মানুষদের সঙ্গে এদের বদলে ফেলা যায়-কুটি আঁকা, তিরস্কার আর ঘৃণায় বাঁকানো মুখের অভিব্যক্তিসমেত। এই বাকা মুখগুলো যেন মৃত্যুঞ্জয়। মাঝখান থেকে মন্টু হারিয়ে যায়, আবেদের খোঁজ থাকে না, কফিলউদ্দিনের পরিবার ক্রমাগত ছোট হতে থাকে, গোলাম মোস্তফা তীরে বসে রোদ পোহান, হাজি সাহেব দেশপ্রেমিক বনে যান, রমিজ শেখ পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলার ভেতর তালগোল পাকিয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

পাকিস্তানি জনগণের বাঙালি-অবাঙালি বিভক্তির সময়টার পাক্কা দশ বছর রমিজ শেখ জেলখানায় ছিল। কী নিয়ে যুদ্ধটা বেধেছে, কে কাকে কেন মারছে–মার্চ এপ্রিলের পর মে মাস, এখনো তার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার নয়। রাজনীতির জ্ঞানগম্যি তার যতটুকু, তাও হাজি সাহেবের কাছ থেকে। তাই উত্তেজিত হলে এখনো পাকিস্তান। জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। জয় বাংলা বলার সময় তোতলায়। যেখানে গলা টিপে মানুষ খুন সম্ভব, অস্ত্রশস্ত্র তার বাহুল্য লাগে। তবে কাঁধের রাইফেলটা সে হাতছাড়া করে না। জিনিসটার বাড়তি শক্তিতে সে মুগ্ধ। এর মসৃণ বাঁটে সময়-অসময় হাত বোলায়, রোজ তেল পালিশ করে। সে দেশপ্রেমিক জনগণ বলতে বোঝে শান্তি কমিটির লোকদের। তার জানামতে, তাদের কাজ শুধু মেয়ে ও মুরগি সরবরাহ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের খেদমত করা। হাজি সাহেব একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকা ফিরে তিনি শান্তি কমিটির মেম্বার হয়েছেন। রমিজ শেখকেও সঙ্গে রেখেছিলেন। একেক দিন একেক মহল্লায় জাল ফেলার মতো মেয়ে আর মুরগি ধরার নির্দেশ ছিল তার ওপর। এখন শহরে জিনিস দুটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

স্বর্গধামে মোরগ-মুরগির স্বাধীন বিচরণ আর মেয়েদের সংখ্যাধিক্য রমিজ শেখকে নতুন করে ভাবনায় ফেলে। তাকে যদি দেশপ্রেমিক হতেই হয়, সে এখানকার ছোট বড় মেয়েসহ মুরগির ছানা-পোনা আর্মির হাতে তুলে দেবে। কিন্তু মেরিকে নয়। মেয়েটাকে পোড়া মরিচের ধোয়া দিয়ে বাঁচিয়েছে সে। ওর বাকি জীবন তার হাতে। আর এজন্যই হাজির জাল ছিঁড়ে পথ হাতড়ে হাতড়ে স্বর্গধামে তার আগমন।

রমিজ শেখের অতীত না জানলেও তার কিছু ত্রুটি আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেবের নজর এড়ায় না। তারা মুক্তিফৌজের অপেক্ষায় থাকেন। লুঙ্গিপরা একদল লোক খালি পায়ে স্টেনগান কাঁধে কোনো একদিন স্বর্গধামের দরজার কড়া নাড়বে, রাতের মতো আশ্রয় আর ভাত চাইবে। আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেব স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নির্দেশমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বটে, তার আগে তাদের কানে তুলে দেবেন রমিজ শেখের আড়ষ্ট জিবের তোতলানো জয় বাংলা স্লোগান আর আঙুল দিয়ে দেখাবেন মসৃণ বাঁটের একটি বন্দুক, যা যুদ্ধের বাজারে শত্ৰু না মেরে বেগার বয়ে বেড়ানো হচ্ছে।

দিন যায়, রাত আসে। ভাত আর আশ্রয় চেয়ে দরজায় কাউকে কড়া নাড়তে শোনা যায় না। এর পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের পরস্পরের কাছে লেখা একটা সাংকেতিক চিঠি ভুল করে স্বর্গধামে চলে আসে। চিঠির দুটি লাইন তাদের কলজেয় জোর কামড় বসায়–এতগুলি মুরগি আর ডিম পাঠালাম কোনো কাজেই লাগাচ্ছ না, ব্যাপার কী?…আমি আবারও বলছি বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেই থেকে দুজন ভয়ে অস্থির। রমিজ শেখকে তাদের মনে হয় ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা, যে গোপনে তাদের বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালি করছে। আর নিজেদের তারা ভাবতে শুরু করেন, মুরগির ডিম ভালো কাজে না-লাগিয়ে, খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে এমন এক নতুন ধরনের বিশ্বাসঘাতক–যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

বাকি থাকে মেয়েরা। যারা সংখ্যাগুরু এবং রমিজ শেখের ধামাধরা। স্বর্গধাম বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতন। উত্তাল সাগরে ছোট্ট একটি ছিপ নৌকায় চেপে লোকটা যেন হাজির হয়েছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে একটা বন্দুক, একজোড়া লৌহবর্ণের কাঁধ, বেপরোয়া মনোভাব। মেয়েরা তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে ভূষিত করেছে। আর বীরের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দ্বিগুণ খাবারদাবার, উত্তম বিছানা।

যা ভাবনার কথা অথচ কেউ ভাবে না, কিছুদিন পর তা ঘটে। স্বর্গধামে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ফলশূন্য গাছগুলো ডালপালাসমেত মাথা তুলতে শুরু করে। গাভির ওলান শুকিয়ে যায়। মুরগিরা থলে শূন্য হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ডিম পাড়ার পর নিয়মমতো তা দিয়ে বাচ্চা ফোঁটাতে না পেরে খুব হতাশ। শূন্য খাঁচা দেখলে খেপে ওঠে। ডিমপাড়ায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাউন্ডুলেপনা জুড়ে দেয়। এই পরিস্থিতির প্রথম শিকার হয় মরিয়ম। মেয়েরা তার খাবার বন্ধ করে দেয়। তাতে পুরুষ দুজনেরও হাত থাকে। কারণ মরিয়মের প্রতি তাদের ব্যর্থ অনুরাগ তত দিনে ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়া মেয়েদের হাতে রেখে হলেও স্বর্গধামের কর্তৃত্ব বজায় রাখায় তারা বদ্ধপরিকর।

প্রথম প্রথম নিজের পাতের খাবার মরিয়মকে দিয়ে খেলেও রমিজ শেখ এ অন্যায় বরদাস্ত করে না। মেয়েটি না খেয়ে মরবে তার চোখের সামনে, যাকে সে নিজ হাতে জীবন দান করেছে! স্বর্গধামে প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়। মেয়েরা অবস্থান পরিবর্তন করে এবং পুরুষদের সহযোগিতায় রমিজ শেখকে বীরের আসন থেকে ফেলে দেয়। তারা জনে জনে বলে বেড়ায়, মরিয়ম আর রমিজ শেখ লটঘট করছে, যা বিয়ের আগে করা ঠিক নয়–এ ব্যভিচার।

রটনাটির সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের প্রশ্নই ওঠে না। কেউ এর প্রমাণও চায় না। যুদ্ধের দিন। আইন নেই, আদালত বসে না। এর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে স্বর্গধাম থেকে বহিষ্কার।

রমিজ শেখের পাতের খাবার ভাগ করে খেতে খেতে মরিয়ম অনুভব করে, তাকে বুক পেতে রক্ষা করছে রমিজ শেখ। লোকটা তার মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বামী-বন্ধু-যে কোনো কিছুই হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। চোখের সামনে আবেদ, মন্টু, কফিলউদ্দিন পরিবার, কলেজের বান্ধবী কেউ নেই যে মরিয়মের পাশে রমিজ শেখকে দেখে ভিরমি খাবে। সে জেলপালানো খুনের আসামি। দশ বছর কয়েদ খেটেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে রমিজ শেখের পরিচয় কী হবে-মরিয়ম জানে না। এখন দরকার শুধু দুই বেলা খাবার, মাথা গোঁজার ঠাই, নিরাপদ আশ্রয়, যা এই লোকটাই তাকে দিতে পারে।

স্বর্গের নিষিদ্ধ ফল খেতে রমিজ শেখকে প্ররোচিত করে মরিয়ম। বলে যে, এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন ভারতে শরণার্থী। স্বর্গধামের মতো পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজলেই পাওয়া সম্ভব। সেখানে তাদের অপমান করার কেউ থাকবে না।

রমিজ শেখ মরিয়মের কথা ফেলতে পারে না। মেয়েটার বিদ্যাবুদ্ধি অনেক। সে নিজে পড়েছে–অ-তে অজগর, আ-তে আম, ওই অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে। তা বলে দুজন অকর্মা পুরুষ আর এক দঙ্গল মেয়ের ভয়ে পালাতে হবে! যা হোক কথাটা যে বলছে, সে তার নিজের লোক। হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রমিজ শেখ বিনা যুদ্ধে স্বর্গধামের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়।

স্বর্গধাম থেকে বেরিয়ে আসে আদম আর হাওয়া অগ্নিদগ্ধ, খুনাখুনির বিপজ্জনক এক পৃথিবীতে। সঙ্গে নেয় পেছনে ফেলে আসা আবাসের অনুরূপ একটি বাড়ির স্বপ্ন। সেখানে তারা হবে একমাত্র নর-নারী। তাদের দেখতে আকাশের ফালি চাঁদ দূর থেকে উঁকি দেয়। পরক্ষণে ভয় পেয়ে মেঘের আড়ালে লুকোয়। আকাশের বুক ফেটে গুমগুম আওয়াজ ওঠে। ছাই ছাই গাছের পাতা প্রবল ত্রাসে কাঁপতে থাকে। খারাপ কিছুর আশঙ্কা ব্যতিরেকেই দুজন অজানার উদ্দেশে যাত্রা করে।

তখনো রাত শেষ হয়নি। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কর্দমাক্ত রাস্তায় দু’ফাইল করে একদল সৈন্য স্বর্গধামের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের ভুতুড়ে ছায়া পড়েছে রাস্তার পাশের জলাশয়ে। যুদ্ধের এখন তৃতীয় মাস। উদ্যোগ-আয়োজনে তাদের খামতি নেই। খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-মার্চের তালে তালে শেষরাতের পৃথিবী ঘুমের ভেতর চমকে চমকে ওঠে। তাতে ভোরের গান গাওয়া পাখির তাল ভঙ্গ হয়।

স্বর্গের দুয়ারে কোনো পাহারা ছিল না। মরিয়ম আর রমিজ শেখ যে পথ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সৈন্যরা তার ঠিক উল্টো দিক থেকে আসে। স্বর্গধাম শূন্য। লোকজন বুটের আওয়াজ পেয়ে পালিয়েছে। বাউন্ডুলে মুরগিগুলো রাতে খোয়াড়ে না-ঢুকে গাছে উঠে বসেছিল। ওখান থেকে স্বপ্নার প্রসববেদনার কাতরানি শোনা যায়। তার জন্য ধাই আসে না। আতিক ভাবি, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করছেন তো মরছেন’-কথাটা। কদিন আগে যে বলেছিল, তার জীবনে তা সত্য হয়ে ওঠে। সৈন্যরা প্রতিটি ঘরে। তল্লাশি চালায়। সদ্য ত্যাগ করা উষ্ণ বিছানা-বালিশ রাগে লন্ডভন্ড করে। তবে কোনো গুলি ছোড়ে না। বেয়নেট দিয়ে স্বপ্নর উঁচু পেটটা চিরে দেয়। গোয়ালঘরে তখনো গাই দুটি বাঁধা। তারা এদের আঘাত করে না। শুধু দড়ি খুলে হিড়হিড় করে বাইরে নিয়ে আসে। অপারেশনের লাভের তালিকায়-বাছুরসহ দুটি গরু (জীবিত), একজন নারী ও একটি শিশু (মৃত)। তারা তাতে সন্তুষ্ট হয় না। স্বর্গধামের ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর গরম আঁচে গাছের ডালে বসা মুরগিগুলো কককক ডাকতে শুরু করে। তাদের গায়ে গায়ে ঠ্যালাঠেলি অন্ধকারে দেখা যায় না। সৈন্যরা সন্ত্রস্ত–যেন এক দল মুক্তিফৌজ এলএমজি কক করে অটোতে নিয়ে বাগিয়ে ধরেছে। তারা ঝটপট মাটিতে। শুয়ে, সেই অবস্থায় পজিশন নেয়। প্রথম দফায় বুলেটগুলো মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। কককক আওয়াজ বাড়তে শুরু করলে সৈন্যরা গাছের ডাল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বাউন্ডুলে মুরগিগুলো সারেন্ডার করে না। থলে শূন্য হালকা শরীর নিয়ে উড়তে শুরু থাকে। সৈন্যরা নাছোড়, কককক আওয়াজ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত টানা গুলি চালিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *