১৪. পরদিন কলেজ ছুটির পর

১৪.

পরদিন কলেজ ছুটির পর একটা ট্যাক্সি করে বিমলেশকে বাড়ি নিয়ে এল সুবর্ণা। অবশ্য দেবীকেও তার স্কুল থেকে তুলে এনেছে।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাড়ির একটা কাজে সকালেই হরেনকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। রাত ন’টার আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই। রাজীব সম্পর্কে আগেই তাকে সব জানিয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। তবু বিমলেশের সঙ্গে রাজীবের দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সে জানুক, সুবর্ণা তা একেবারেই চায় না। একতলায় বিমলেশকে বসিয়ে বলল, প্লিজ, তুমি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। দু-একটা কাজ সেরে আমি ওকে নিয়ে আসছি।

দেবীকে সঙ্গে করে দোতলায় চলে গেল সুবর্ণা। ওপরে বাইরের কাউকে নিয়ে যাবার আগে সংগ্রামনারায়ণকে জানাতে হয়। বিমলেশের কথা বললে হাজার রকমের কৈফিয়ত দিতে হত। আসলে একজন প্রাক্তন উগ্রপন্থীর সঙ্গে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদীর সাক্ষাৎকারটা সংগ্রামনারায়ণের চোখের সামনে ঘটুক, এটা কোনও ক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়।

আজ কলেজে বেরুবার সময় বিমলেশের কথাটা মাথায় রেখে মায়াকে বেশি করে খাবার আর বড় ফ্লাস্ক বোঝাই করে কফি করে রাখতে বলেছিল সুবর্ণা । ওপরে এসে দ্রুত শাড়িটাড়ি পালটে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে, সংগ্রামনারায়ণ আর দেবীর খাওয়ার ব্যবস্থা করে, ট্রেতে তিনজনের মতো খাবার, জলের গেলাস আর কফির ফ্লাস্কটা সাজিয়ে নিয়ে রাজীবকে বলল, বিমলেশ এসেছে।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

একতলায়।

সঙ্গে আর কেউ নেই তো?

না।

চলুন—

রাজীব সারাক্ষণ তার পিস্তলটা কাছেই রাখে। সেটা পকেটে পুরে সুবর্ণার সঙ্গে নিচে নেমে এল।

ওদের দেখে বিমলেশ উঠে দাঁড়িয়েছিল। টেবলে ট্রে নামিয়ে রেখে সুবর্ণা দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিল।

নমস্কারের পর্ব চুকলে রাজীবরা বসে পড়ে। বিমলেশ বলে, আপনার কথা সুবর্ণার কাছে শোনার পর থেকে আলাপ করার খুব ইচ্ছা হয়েছিল। আপনি যে আপত্তি করেননি, সে জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

রাজীব উত্তর দিল না; একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। সুবর্ণা বলা সত্ত্বেও বিমলেশ কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেটাই যেন মেপে নিতে চাইছে সে।

সুবর্ণা এই সময় বলে ওঠে, খেতে খেতে গল্প করা যাক। দু’জনকে খাবারের প্লেট দিয়ে নিজেও একটা তুলে নিল সে।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়ার পর রাজীব বলল, বিমলেশবাবু, মিসেস সিংহের ওপর আমার খানিকটা আস্থা হয়েছে বলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছি। আপনাকে উনি বিশ্বাস করেন। আশা করি আপনি তার মর্যাদা রাখবেন।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছিল বিমলেশ। হেসে হেসে বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নেই।

রাজীব বলল, এবার বলুন আমার মতো মারাত্মক একটা লোকের সঙ্গে আলাপ করার শখ হল কেন?

আপনাকে সুবর্ণা বলেনি?

সেভাবে কিছু বলেন নি। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

বিমলেশ বলল, এক সময়, ধরুন চব্বিশ পঁচিশ বছর আগে, উগ্রপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমার এবং আমার মতো হাজার হাজার যুবকের বিশ্বাস ছিল, আমর্ড রেভোলিউশন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থা বদলানো যাবে না।

রাজীব বলল, আপনাদের আন্দোলনের কথা আমি জানি। সেই সময় সমস্ত দেশ এর ধাক্কায় তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ। স্বাধীন ভারতে এটা ছিল নতুন ধরনের মুভমেন্ট।

কিন্তু—

বলুন–

আন্দোলনটা থেমে গেল কেন?

থামে নি তো। তীব্রতা হয়তো কমে গেছে কিন্তু সারা ভারতবর্ষের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন এখনও ওটা চলছে। অবশ্য নানা কারণে আমার মতো অনেকেই আর অ্যাক্টিভলি জড়িত নেই।

রাজীব উত্তর দিল না।

বিমলেশ বলতে লাগল, সোশাল সিস্টেম একদিন দু’দিনে বদলানো যায় না। আন্দোলনটা হল অন্তহীন একটা প্রসেস। আমাদের প্রসঙ্গ থাক, আপনার কথা। শুনতে চাই।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, আমার কী কথা?

দেখুন, আমরা ভারতবর্ষের মধ্যে থেকেই এখানকার সমাজ ব্যবস্থা পালটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাগজে যেটুকু পড়েছি কিংবা অন্যান্য সোর্স থেকে যা জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে, আপনারা ইন্ডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান।

আপনার কথার নিশ্চয়ই উত্তর দেবো। তার আগে ইন্ডিয়া ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিন।

বিমলেশ বলল, কোটি কোটি মানুষের বিশাল এক দেশ। আ সভারেন, ইনডিপেনডেন্ট কান্ট্রি।

রাজীব বলল, এ তো ক্লাস ফোরের পাঠ্য বইতে পাওয়া যাবে। আপনার মতো অত্যন্ত শিক্ষিত, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে এক সময় যুক্ত মানুষের কাছ থেকে এত সরল উত্তর আশা করিনি।

রাজীব ঠিক কী জানতে চাইছে, বুঝতে না পেরে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে বিমলেশ।

একটু ভেবে রাজীব এবার বলল, স্টুডেন্ট লাইফ থেকে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় পার্মানেন্টলি ভর করে আছে। বলতে পারেন, ওটা আমাকে হন্ট করে বেড়াচ্ছে। দেশ নিয়ে যাঁরা ভাবেন–পলিটিশিয়ান, এডুকেশনিস্ট, সোশাল সায়েন্টিস্ট, এমন অনেককে জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কারও কাছ থেকেই পরিষ্কার উত্তর পাইনি। সবাই গোঁজামিল দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। বাট আই অ্যাম নট রিয়ালি স্যাটিসফায়েড। প্রশ্নটা আপনাকে কি করতে পারি?

বিমলেশ বলল, বেশ তো, করুন না। উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয়ই দেবো।

রাজীব বলল, ইন্ডিয়াননেস, মানে ভারতীয়ত্ব বস্তুটা আসলে কী?

বিমলেশ লক্ষ করল, গলার স্বরে চাপা বিদ্রূপ মিশিয়ে বস্তু’ শব্দটা উচ্চারণ করেছে রাজীব। বলার ভঙ্গিটা খট করে কানে লাগল তার। ধীরে ধীরে বলল, হাজার হাজার বছর ধরে নানা ধরনের মানুষের তৈরি কালচার, জীবনদর্শন, আমাদের ইতিহাস, আমাদের সিভিলাইজেশন–সব মিলিয়ে–

তাকে শেষ করতে দিল না রাজীব। তার আগেই অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠল, ছেলেবেলা থেকে এসব শুনতে শুনতে কান পচে গেছে বিমলেশবাবু। বিবিধের মাঝে মহান মিলন, ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান সত্ত্বেও ঐক্যের অটুট বন্ধন–এই বস্তাপচা বুলিগুলো দশ বছরের বাচ্চাও জানে। আমি আপনার কাছে অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলাম।

বিমলেশ কী বলবে ভেবে পেল না; তাকে খানিকটা দিশেহারার মতো দেখাচ্ছিল।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রাজীব। পেছনে দুই হাত রেখে অস্থিরভাবে হল-ঘরে মিনিট খানেক পায়চারি করার পর ফিরে এসে আবার বসল। তারপর নিজের মতো করে বলতে লাগল, বিমলেশবাবু, ইংরেজরা আসার আগে কী ছিল ইন্ডিয়া? বিশাল ভৌগোলিক বাউন্ডারির ভেতরে ছোট বড় কাউন্টলেস নাম্বার অফ স্টেটস। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক নেই। যুদ্ধ, শত্রুতা লেগেই থাকত। ব্রিটিশ রুল চালু হওয়ায় ইন্ডিয়া যে একটা নেশন সেটা বোঝা গেল–নানা ল্যাংগুয়েজ, নানা রিলিজিওন, নানা ফুড হ্যাবিট, নানা সোশাল প্যাটার্ন সত্ত্বেও। তখন হিন্দু মুসলিম শিখ, সবার সামনে একটা লক্ষ্য ছিল–স্বাধীনতা। মুক্তির জন্য সারা দেশ সেই বোধ হয় প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের পর ইংরেজরা যখন যাই যাই করছে তখন কী দেখলাম আমরা? কমিউনালিজম দাঁত নখ বার করে ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে। ফর্টি

সেভেনে টু নেশন থিয়োরির ধাক্কায় ইন্ডিয়া দু ভাগ হয়ে গেল। এক নেশন ভেঙে দু’টো নেশল হল। জওহরলালরা অবশ্য জানালেন, আমাদের ভাগে যেটুকু পড়েছে সেটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সেটা নিশ্চয়ই খুব বড় ব্যাপার।

বিমলেশ বলল, এসব ভারতবর্ষের সবাই জানে। আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।

একটু ধৈর্য ধরুন। আমি যা বলতে চাই, সেখানে পৌঁছুবার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। স্বাধীনতার পর সেকুরালিজমের আদর্শ কতটুকু টিকে আছে? রিলিজিয়াস ফান্ডামেন্টালিজম কীভাবে বাড়ছে, নিশ্চয়ই আপনি জানেন। সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রাদেশিকতা, জাতপাতের সমস্যা। বম্বে প্রেসিডেন্সি দু’ভাগ হয়ে হল মহারাষ্ট্র আর গুজরাট, মাদ্রাজ ভেঙে হল অন্ধ্র আর। তামিলনাড়ু, নর্থ-ইস্ট এখন সাত টুকরো, যদিও তাদের বলা হয় সেভেন সিস্টার্স। তা হলে স্বাধীনতার পর আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, জাতপাতের সমস্যা–সব মিলিয়ে পিপলের মধ্যে ডিভিসন কিন্তু হয়েই চলেছে। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান বাঙালি বিহারী তামিল বা মারাঠি, ব্রাহ্মণ রাজপুত ক্ষত্রিয় বা যাদব–এসবের বাইরে কেউ আর কিছু ভাবতে চায় না। এর মধ্যে ভারতীয়ত্বটা কোথায় বলতে পারেন?

বিমলেশ আর সুবর্ণা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। বিমলেশ বলল, হ্যাঁ, এগুলো ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার। দেশের মানুষের মধ্যে এই বিভাজন নেশন হিসেবে আমাদের চরম ক্ষতি করছে।

রাজীব বলল, আরেকটা মারাত্মক দিক লক্ষ করছেন?

কী?

ইন্ডিয়ার কয়েকটা অঞ্চল হাইলি ডেভলাপড। সে সব জায়গায় বিপুল ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে; দেশের বেশির ভাগ ওয়েলথ ওখানে জমা হচ্ছে। বাকি জায়গাগুলো আন্ডার-ডেভলাপড। সেখানে কোনওরকম ইনভেস্টমেন্ট নেই। হলেও খুব সামান্য। বিশেষ করে ইস্টার্ন আর নর্থ-ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখুন, এ দু’টো অঞ্চল কীভাবে পিছিয়ে পড়ছে। আর্থিক সচ্ছলতা সব জায়গায় যদি সমানভাবে না আসে, ক্ষোভ জমা হতে হতে বিস্ফোরণের চেহারা নেয়। নিচ্ছেও। যারা হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে তাদের কিছু কিছু ঘুষ অবশ্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা হবে কেন?

বিমলেশ উত্তর দিল না।

রাজীব বলতে লাগল, এবার নিজের কথা বলা যাক। আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে স্বাধীনতার পর কতটুকু ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে? প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তাছাড়া সাঙ্ঘাতিক একটা সমস্যা হল, আমাদের এথনিক আইডেনটিটি অত্যন্ত বিপন্ন।

বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, কীরকম?

রাজীব বলল, আপনারা তো জানেনই নর্থ-ইস্টে কী বিপুল পরিমাণে ন্যাচারাল রিসোর্সের্স রয়েছে–টি, ফরেস্ট, পেট্রোলিয়াম। ইংরেজরা তো লুট করেছেই। তারপরও এক্সপ্লয়টেশন চলছে। ব্রিটিশ আমলে ইন্ডিয়ার নানা জায়গা থেকে হাজার হাজার লোক চাকরি বাকরি নিয়ে ওখানে সেটল করেছিল। পার্টিশনের পর এসেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এখন চলছে ইনফিলট্রেশন। রোজ কত ফ্যামিলি যে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়ছে তার হিসেব নেই। এর রেজাল্ট কী হতে পারে ভাবতে পারেন?

কী?

রাজীব জানাল, আর কিছুদিন এরকম চললে তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। তাদের জাতি-পরিচয়, সংস্কৃতি, ভাষা, বাইরের মানুষের চাপে ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা তারা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারে না।

বিমলেশ বলল, এর সমাধান কি দিল্লির সঙ্গে আলোচনা করে হতে পারে না?

রাজীব বলল, আলোচনা, অ্যাকর্ড, কত কিছুই তো হল। খবরের কাগজে সেসব আপনারা পড়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে?

সমস্যাটা এত জটিল আর বিরাট এবং দীর্ঘকালের যে তার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হওয়া কি সম্ভব? ধৈর্য তো ধরতে হবে।

ধৈর্য ধরতে ধরতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর দেরি করলে আমরা সন্স অফ দা সয়েল, পুরোপুরি শেষ হয়ে যাব।

বিমলেশ সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, এই জন্যেই কি হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছেন?

রাজীব এক পলক তাকাল শুধু; উত্তর দিল না।

বিমলেশ এবার বলল, আপনাদের যা মুভমেন্ট, গভর্নমেন্ট সেটা কোনওভাবেই মেনে নেবে না। তারা কড়া—

রাজীব হাত তুলে উত্তেজিত সুরে বলল, মিলিটারি অ্যাকসনের কথা বলছেন তো? প্রতি মুহূর্তে সেটা টের পাচ্ছি। কত যুবক মারা গেছে ভাবতে পারবেন না।

হ্যাঁ, প্রচুর প্রাণহানি, রক্তক্ষয়–’

দিস ইজ ইনএভিটেবল বিমলেশবাবু।

বিমলেশ বলল, একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করছে–’

রাজীব জিজ্ঞেস করল, কী?

শুধু নর্থ-ইস্টেই না, ইন্ডিয়ার আরও কয়েক জায়গায় সেসেসানিস্ট মুভমেন্ট চলছে। ধরুন ছোট ছোট কয়েকটা অংশ আলাদা হয়ে বেরিয়ে গেল। ইনডিপেনডেন্ট স্টেট হিসেবে সেগুলো টিকে থাকা কি সম্ভব?

রাজীব বলল, আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের কাছে এই ধরনের ওয়র্থলেস প্রশ্ন আশা করিনি। ইওরোপ, সাউথ আমেরিকা, কি কাছাকাছি মিডল ইস্টের ছোট স্টেটগুলোর কথা ভুলে গেছেন? এই সেদিন সোভিয়েট রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে কতকগুলো নেশন তৈরি হল? তারা টিকে নেই?

আবার দুই জার্মানি তো এক হয়ে গেছে। তার পেছনে অন্য কারণ ছিল। ওদের ধর্ম এক, ভাষা এক। সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের পর জোর করে জার্মানিকে দু’ভাগ করা হয়েছিল। প্রবল জাতীয় আবেগ ওদের রিইউনাইট করেছে।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর বিমলেশ বলল, বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিটান্সি তা হলে চলতেই থাকবে? রাজীব এই প্রথম একটু হাসল। বলল, আপনি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন দেখছিঃ বিরাট বিরাট একান্নবর্তী পরিবারও সুখের জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে যায়। এটাকে সেভাবে ভাবতে অসুবিধা কোথায়?

বিমলেশ বলল, আপনার কাছে এবার একটা বিষয়ে জানতে চাইব।

বলুন কী জানতে চান—

শুনলে আপনি নিশ্চয়ই রেগে যাবেন। তবু ঝুঁকি নিয়েই প্রশ্নটা করছি।

চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল রাজীবের। বলল, আগে শুনি। রাগের কথা তো পরে–

বিমলেশ বলে, কাগজে প্রায়ই দেখি, আমাদের দেশে যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হচ্ছে তার সবগুলোই বিদেশি রাষ্ট্রের উসকানিতে। ইন্ডিয়াকে দুর্বল করার এ এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এমনকি ডেসট্রাক্টিভ অ্যাক্টিভিটির জন্য মিলিটান্টদের বাইরে নিয়ে ট্রেনিংও দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র স্মাগল করে ঢোকানো হচ্ছে দেশের ভেতর। এ বিষয়ে আপনি কি কিছু বলবেন?

মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে রাজীবের। সে বলে, আপনি বোধহয় ঘুরিয়ে জানতে চাইছেন, আমরা বিদেশি রাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে এখানে কাজ করছি কি না? খুব সংক্ষেপে বলছি–না। এর বেশি আর কিছু এখন আর জানতে চাইবেন না। ভবিষ্যতে যদি কখনও দেখা হয়, সে সম্ভাবনা নেই বললেই হয়–আপনার সঙ্গে ডিটেলে আলোচনা করা যাবে। শুধু একটাই অনুরোধ–

বিমলেশ দু চোখে অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

রাজীব থামেনি, ভাসা ভাসা কিছু ইনফরমেশনের ভিত্তিতে নয়, আমাদের সমস্যাগুলো গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন। বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, আচ্ছা নমস্কার।

বিমলেশ আর সুবর্ণাও উঠে পড়ে। রাজীব বুঝিয়ে দিয়েছে সে আর কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।

.

১৫.

সেই যে বিমলেশ এসেছিল তার দু’দিন পর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল।

কাল জেল থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েরা মুক্তি পেয়ে বিকেলের দিকে সোজা এখানে চলে আসবে। রাজীব শেষ পর্যন্ত আপত্তি করেনি, সংগ্রামনারায়ণের অনুমতিও পাওয়া গেছে।

একতলার ঘরগুলো খুলিয়ে ধুলো ময়লা সাফ করার জন্য সকাল থেকেই লোক লাগানো হয়েছে। সুবর্ণা আজ আর কলেজে যাবে না, দেবীকেও স্কুলে পাঠাবে না। মোট বারোজন মহিলা আসছে। সুষ্ঠুভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে যে বাড়তি লেপ-তোষক বালিশ-টালিশ আছে তাতে কুলোবে না। ডেকরেটরদের কাছ থেকে কয়েক সেট বিছানা ভাড়া করা দরকার। অবশ্য খাওয়ানোর দায়িত্ব তাদের নয়। নারী বিকাশ কেন্দ্র থেকে সে বন্দোবস্ত করা হবে। কাল ভোরে মনোরমাদি রান্নার লোকের সঙ্গে চাল ডাল মাছ আনাজ তেল নুন, যা যা প্রয়োজন সব পাঠিয়ে দেবেন। নিজে তখন আসবেন না, আসবেন সেই বিকেলবেলায় মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে।

সকাল থেকে নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে একতলায় এসে খোঁজ খবর নিয়ে গেছে সুবর্ণা। যদিও হরেনকে লাগিয়ে রেখেছে, তবু নিজের চোখে না দেখলে যেন স্বস্তি হচ্ছিল না।

অঘটনটা ঘটল দুপুরবেলায়। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে তখন তার ঘরে খাওয়াচ্ছিল সুবর্ণা। একধারে সোফায় বসে বই পড়ছিল রাজীব। হঠাৎ সংগ্রামনারায়ণের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বৌমা–বৌমা, তাড়াতাড়ি একবার এখানে এসো। তো–

রাজীব এবং সুবর্ণা দু’জনেই চমকে ওঠে। সুবর্ণা হাতের প্লেটটা খাটের পাশের সাইড টেবলে নামিয়ে রেখে একরকম দৌড়েই সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে আসে।

সংগ্রামনারায়ণ খাটের মাঝখানে বসে ছিলেন। তাঁর হাতে একটা খবরের কাগজ। সেটা সুবর্ণার দিকে বাড়িয়ে একটা ছবিতে আঙুল রেখে বললেন, লুক হিয়ার–এ কে?

কাগজটা কয়েকদিন আগের দৈনিক দিনকাল’-এর সেই কপি, যার প্রথম পাতায় রাজীবের ছবিসুদ্ধ বিরাট রিপোর্ট বেরিয়েছিল। রাজীবের ছবিতে এখন দাড়ি নেই, হোয়াইট ইংক দিয়ে সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে।

পায়ের তলায় শ্বেত পাথরের মসৃণ মেঝে দুলে উঠল সুবর্ণার। মনে হল মাথার ভেতর আগুনের চাকার মতো কিছু একটা ঘুরে যাচ্ছে।

সংগ্রামনারায়ণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, একে চিনতে পারছ?

হোয়াইট ইংক লাগানোর পর রাজীবের এখনকার নিখুঁত কামানো মুখটা বেরিয়ে পড়েছে। নির্জীব স্বরে কিছু বলতে চেষ্টা করল সুবর্ণা, তার একটা শব্দও বোঝা গেল না।

সংগ্রামনারায়ণ আবার বললেন, এই তোমার আত্মীয়-বৌদির পিসতুতো ভাই? প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল, লোকটার সঙ্গে তোমাদের কোনওরকম সম্পর্ক নেই। জোর করে এখানে ঢুকে পড়েছে। একটু থেমে কী ভেবে বললেন, বৌমা, একটা সত্যি কথা বল তো, লোকটা তোমাকে ভয় দেখিয়ে আমাদের সবাইকে কি হোস্টেজ করে রেখেছে?

সংগ্রামনারায়ণ দাম্ভিক, রুক্ষ, রগচটা হলেও খুবই চতুর। তার ইন্দ্রিয়গুলো ভীষণ প্রখর। তাঁর চোখে ধুলো দিয়ে কিছু হওয়ার উপায় নেই। হোয়াইট ইংক লাগিয়ে রাজীবের আসল মুখটা যে তিনি বার করে ফেলবেন, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সুবর্ণা। নিজের অজান্তেই মাথাটা খুব আস্তে হেলিয়ে দেয় সে।

সাঙ্ঘাতিক হার্ট অ্যাটাকের কারণে তার যে উত্তেজিত হওয়া বারণ, স্নায়ুমণ্ডলীকে সব সময় যে শান্ত রাখা উচিত, সে সব আর মনে থাকে না সংগ্রামনারায়ণের। লাফ দিয়ে খাট থেকে নিচে নামতে নামতে গর্জে ওঠেন, রাসকেলের এত বড় সাহস, থ্রেটনিং দিয়ে প্যালেসে ঢুকে আছে। আমি ওকে লাথি মেরে–

ভয়ে শ্বাস যেন আটকে যায় সুবর্ণার। হাত বাড়িয়ে সংগ্রামনারায়ণের একটা হাত ধরে ফেলে সে, বাবা, যাবেন না, যাবেন না। ও যে কী ডেঞ্জারাস লোক আপনার ধারণা নেই।

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে সংগ্রামনারায়ণ বলেন, অনেক ডেঞ্জারাস লোক আমার দেখা আছে–’ তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরের দিকে দৌড়ে যান।

আতঙ্কিত সুবর্ণার চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। তবু তারই মধ্যে সংগ্রামনারায়ণের পেছন পেছন সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে।

ইউ স্কাউন্ড্রেল–শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে গলার শির ছিঁড়ে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে ওঠেন সংগ্রামনারায়ণ, তোমার এত বড় স্পর্ধা যে–শরীরের সব রক্ত যেন তার মুখে উঠে এসেছে। চোখ দু’টো বুঝিবা ফেটে পড়বে। গালের কষ বেয়ে ফেনার মতো কিছু বেরিয়ে আসছে।

সংগ্রামনারায়ণ চেঁচাতে চেঁচাতে রাজীবের ওপর প্রায় আঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন; সুবর্ণা পেছন থেকে প্রাণপণ শক্তিতে দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভীত, দুর্বল গলায় বলে, বাবা শান্ত হোন, শান্ত হোন, আপনার ঘরে চলুন—

কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না সংগ্রামনারায়ণ। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন।

এদিকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে রাজীব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। দুই চোখের ভেতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছে ভীতিকর এক হিংস্রতা। একটা হাত মুঠো পাকানো। আরেকটা হাত ট্রাউজারের পকেটে। সে তীব্র, চাপা গলায় বলল, স্টপ মিস্টার সিংহ, স্টপ–

হইচই শুনে কিচেনের দিক থেকে মায়া ছুটে এসেছিল। চোখের ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল সুবর্ণা।

হুমকি সত্ত্বেও সংগ্রামনারায়ণ কিন্তু থামেননি। তাঁর মাথায় যেন হিস্টিরিয়া ভর করেছে। কণ্ঠস্বর আরও উঁচুতে তুলে তিনি বলে যাচ্ছিলেন, খুনি হোক, ডাকু হোক-রাজবাড়িতে যে শেলটার নেয় তার ক্ষতি আমরা করি না। তোমাকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেবো না। তবে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না। নাউ গেট আউট–’

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই পিস্তল বের করে সংগ্রামনারায়ণের বুকের দিকে তাক করল রাজীব। খুব ঠান্ডা গলায় বলল, আই রিপিট–স্টপ।

প্রতিক্রিয়া হল ভয়ানক। সংগ্রামনারায়ণ যতটা ক্রুদ্ধ আর উত্তেজিত হয়েছিলেন; এখন ঠিক ততটাই আতঙ্কিত। পিস্তলের দিকে তাকিয়ে তার চোখের তারা দু’টো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। মুহূর্তে সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল। গোঙানির মতো অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে আওয়াজ করে তিনি মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, সুবর্ণা পড়তে দিল না। মূৰ্ছিত সংগ্রামনারায়ণকে কোনওরকমে ধরে রাখল। রাজীবকে বলল, এ আপনি কী করলেন?

পিস্তলটা পকেটে পুরে রাজীব বলল, ওটা না দেখালে ভদ্রলোক যেভাবে চেঁচাচ্ছিলেন, একতলা থেকে লোকজন ছুটে আসত। আমাকে কত রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে হত, ভেবে দেখুন। চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে সাহায্য করছি।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ ধন্দ-লাগা, বিহ্বল মানুষের মতো তাকিয়ে ছিলেন। তার অসাড় মস্তিষ্কে দৃশ্যটা হয়তো সামান্য ধাক্কা দিয়ে থাকবে। কিছু বলতে চাইলেন, গলা দিয়ে স্বর বেরুল না। ঠোঁট দু’টো অল্প নড়ল শুধু। রাজীব আর সুবর্ণা ধরাধরি করে সংগ্রামনারায়ণকে তার ঘরে এনে শুইয়ে দিল।

তিন-চার মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড বিপর্যয় ঘটে গেছে যেন। দিশেহারার মতো সুবর্ণা বলল, এখন আমি কী করি বলুন তো? বাবার বোধ হয় আরেকটা অ্যাটাক হয়ে গেল। ডাক্তারকে এখনই খবর দিতে হবে। কাল থেকে অতগুলো মহিলা এসে থাকবে। আমি যে কী করব!

রাজীব বলল, হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মায়াকে বলুন জল দিয়ে যেতে। যদি দেখি জ্ঞান ফিরছে না তখন ডাক্তার ডাকবেন। । সুবর্ণা দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে জলের জগ নিয়ে এল। তার হাত থেকে। সেটা নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে লাগল রাজীব। মিনিট পাঁচেক পর চোখ মেলে ঘোর-লাগা মানুষের মতো তাকালেন সংগ্রামনারায়ণ। এই প্রকাণ্ড বেডরুমের কোনও কিছুই যেন তার কাছে পরিষ্কার নয়। সব ঝাপসা, ঘোলাটে। ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে এল। চারপাশের দৃশ্যগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। খাটের এক ধারে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুবর্ণা। আরেক ধারে সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে দেখতে পেলেন। সে অনেকখানি ঝুঁকে তাকে লক্ষ করছে। আবার সেই আতঙ্কটা তার চোখে মুখে ফিরে এল। ভয়ার্ত স্বরে বললেন, আমি-–আমি–’

সংগ্রামনারায়ণের একটা হাত ধরে খুব সহৃদয় ভঙ্গিতে রাজীব বলল, আপনারা আমাকে শেলটার দিয়েছেন। আমি আপনাদের কোনওরকম ক্ষতি করব না। দয়া করে চুপচাপ থাকুন। আমার কথা কাউকে বলবেন না। একটু থেমে বলল, জানি, আপনাদের ভীষণ বিপদে ফেলেছি। কিন্তু খুব বেশিদিন না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাব।

সংগ্রামনারায়ণ তাকিয়ে রইলেন শুধু; কিছু বললেন না।

সুবর্ণা অবাক হয়ে রাজীবকে দেখছিল। খানিক আগের সেই হিংস্রতা আর নেই। তার ভেতর থেকে একজন হৃদয়বান, সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ যেন বেরিয়ে এসেছে।

সংগ্রামনারায়ণের বালিশের পাশে সবসময় একটা ভাঁজ-করা ধবধবে তোয়ালে থাকে। সেটা তুলে নিয়ে রাজীব সযত্নে তার ভেজা চুল, মুখ মুছিয়ে দিয়ে পাশে বসে বলল, বুকে কি পেইন হচ্ছে?

যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে পিস্তল তাক করেছিল সে যে কয়েক মিনিটের ভেতর এতটা বদলে যেতে পারে, এমন অভাবনীয় দৃশ্য নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সংগ্রামনারায়ণ। বিহ্বলভাবে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন–যন্ত্রণা হচ্ছে না।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, অন্য কোনওরকম অস্বস্তি?

নিচু গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, না।

রাজীব সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি আশঙ্কা করছিলেন তেমন কোনও সিম্পটম দেখা যাচ্ছে না। আপাতত ডাক্তার ডাকার দরকার নেই।

সুবর্ণা চুপ করে রইল।

রাজীব বলল, আমি ওঁর কাছে বসছি। আপনার দাদাশ্বশুরের খাওয়া শেষ হয়নি; তাকে খাইয়ে আসুন।

সুবর্ণা দ্বিধান্বিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাজীবের হাতে সংগ্রামনারায়ণকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারে না।

রাজীব তার মনোভাব আন্দাজ করে নিয়ে বলে, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান। আমার কোম্পানি ওঁর খারাপ লাগবে না।

সুবর্ণা খানিকটা নিরুপায় হয়েই যেন দু’জনের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যায়। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে ফের ভাতের প্লেট তুলে নিয়ে তাকে দ্রুত খাইয়ে, মুখটুখ ধুইয়ে রাজীবদের কাছে ফিরে যায়। আসলে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা বোধ করছিল সে। যদিও সংগ্রামনারায়ণ অজ্ঞান হওয়ার পর শুশ্রূষা করে তাঁকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলেছে রাজীব, তবু একা ঘরে একজন ভয়াবহ সশস্ত্র উগ্রপন্থীর সঙ্গ তার কতটা ভাল লাগছে, ভাবতে পারছিল না সুবর্ণা। সংগ্রামনারায়ণের ঘরে পা দিয়ে সে দারুণ অবাক হয়ে যায়।

রাজীব একটা চেয়ার খাটের কাছে টেনে নিয়ে বসে বসে কথা বলছিল। সংগ্রামনারায়ণ এখন আর শুয়ে নেই; খাটের মাঝখানে রাজীবের দিকে মুখ করে বসে আছেন। তার চোখে মুখে আতঙ্ক বা বিহ্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। খুব স্বাভাবিক আর সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে।

রাজীব বলছিল, মিসেস সিংহ, মানে আপনার পুত্রবধুর কাছে শুনেছি ইন্ডিপেনডেন্সের পর নেটিভ স্টেটগুলো যখন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে ঢুকে গেল আপনারা তা মেনে নিতে পারেননি।

সংগ্রামনারায়ণের দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, তোমার হৃৎপিণ্ড যদি কেউ উপড়ে নেয়, তুমি সেটা মেনে নেবে? জওহরলাল প্যাটেলরা জোর করে আমাদের স্টেট ছিনিয়ে নিল। ছিলাম স্বাধীন রাজা, একটা রাজ্যের সর্বময় অধীশ্বর। এখন আমাদের স্টেটাসটা কী? রিকশাওলা, ঠেলাওলা, রাস্তার হকার, কেরানি–এদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা কোথায়? রাজবংশের মর্যাদা, স্বাধীনতা, গৌরব, সর্বস্ব গেছে। রাস্তার ধুলোয় আমাদের মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষোভ নয় রাজীব, যতদিন বেঁচে থাকব আমার রাগ যাবে না।

একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—

কী?

ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা, হায়দ্রাবাদের নিজাম তো অ্যাকসেসন মেনে নিতে চাননি। তারা আপত্তি করেছিলেন। আপনারাও করতে পারতেন।

ত্রিবাঙ্কুর, হায়দ্রাবাদ অত বড় স্টেট। তারাই কিছু করতে পারল না। প্রতাপপুরের মতো ছোট রাজ্য কী আর করতে পারে।

একটু চিন্তা করে রাজীব বলল, ইন্ডিয়ায় তিনশ’র মতো নেটিভ স্টেট ছিল। সবাই জয়েন্টলি রুখে দাঁড়ালে অ্যাকসেসন কি হতে পারত?

হঠাৎ ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন সংগ্রামনারায়ণ। নির্জীব সুরে বললেন, সকলে ইউনাইটেড আর হতে পারল কোথায়? বেশির ভাগ স্টেটই তো ইন্ডিয়ার পেটের ভেতর ঢুকে যাবার জন্যে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। জওহরলালদের গুড বুকে থাকার জন্যে সে যে কী র‍্যাটরেস বলে বোঝাতে পারব না। দু-একটা স্টেটের যাও আপত্তি ছিল, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, আর অন্য পলিটিক্যাল পার্টির ওয়ার্কাররা এমন তুলকালাম কাণ্ড বাধাল যে কিছুই করা গেল না। সর্বগ্রাসী এক হতাশা যেন সংগ্রামনারায়ণের ওপর ভর করে।

সুবর্ণা ঘরে ঢুকে চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ রাজীবের চোখ এসে পড়ে তার ওপর। বলে, কতক্ষণ এসেছেন?

সুবর্ণা বলে, এই মিনিট পাঁচেক।

ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?

আপনাদের কথা শুনছিলাম। রাজীব সামান্য হেসে বলল, তখন টেনান নিয়ে এ ঘর থেকে গেলেন। জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার কোম্পানি আপনার শ্বশুরমশাইয়ের খুব খারাপ লাগছে না।

সুবর্ণা উত্তর দিল না। রাজীব নামে এই সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা ম্যাজিক আছে, নইলে সংগ্রামনারায়ণের মতো সন্দিগ্ধ, সর্বক্ষণ ক্ষিপ্ত একটি মানুষকে কী করে বশ করল?

রাজীব বলল, মিসেস সিংহ, আপনাদের বাড়ির ডেইলি রুটিন আমার জানা হয়ে গেছে। আপনার শ্বশুরমশাইয়ের লাঞ্চের সময় হয়েছে। প্লিজ মায়াকে বলুন, ওঁর আর আমার ভাত যেন এখানে দিয়ে যায়। মিস্টার সিংহর সঙ্গে গল্প করতে খুব ভাল লাগছে।

সংগ্রামনারায়ণও সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এখানেই দিতে বল।

সুবর্ণা চলে যায়। মায়া নয়, নিজেই সংগ্রামনারায়ণদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছের পাত্রগুলো যখন সে সাজিয়ে দিচ্ছে সেই সময় সংগ্রামনারায়ণ বলছিলেন, কাগজে তোমাদের মিলিটান্ট অ্যাক্টিভিটির কথা অনেক পড়েছি। এজাক্টলি তোমরা কী চাও?

রাজীব বলল, আমরা এক্সপ্লয়টেড হচ্ছি; এটা বন্ধ করতে চাই। আমাদের এথনিক আইডেনটিটি ধ্বংস হতে বসেছে; সেটা কিছুতেই হতে দেবো না।

তোমরা কি ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হতে চাও?

এই প্রশ্নটা সেদিন বিমলেশও করেছিল। খাদ্যবস্তুগুলো সাজাতে সাজাতে চকিতে একবার মুখ তুলে রাজীবের দিকে তাকায় সুবর্ণা।

রাজীব বলল, মিস্টার সিংহ, আপনারা নিজেদের আইডেনটিটি যে কোনও কারণেই তোক হারিয়েছেন। আমরা হারাতে চাই না। এর জন্যে যতদূর যেতে হয় যাব। তারপর দেখা যাক–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *