২. দ্বিতীয় অঙ্ক

দ্বিতীয় অঙ্ক

পরদিন। একই সময়। একই জায়গা।

[মঞ্চের ঠিক মাঝখানে, সামনের দিকে, এস্ট্রাগনের বুটজোড়া, গোড়ালি গায়ে গায়ে লাগানো, আঙুলের দিকটা দু-পাশে ছড়ানো। লাকির টুপি একই জায়গায়।

গাছের তিন-চারটা পাতা আছে।

ভ্লাডিমিরের উত্তেজিত প্রবেশ। থামে, অনেকক্ষণ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ পাগলের মতো মঞ্চে ঘোরাফিরা করতে থাকে। জুতোর সামনে দাঁড়ায়, একপাটি হাতে তুলে নেয়, পরীক্ষা করে দেখে, গন্ধ শোঁকে, বিতৃষ্ণায় চোখমুখ কোঁচকায়, সন্তর্পণে নামিয়ে রাখে। আসে, যায়। একেবারে ডান প্রান্তে গিয়ে থামে, হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে সুদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। আসে, যায়। একেবারে বাঁ প্রান্তে গিয়ে থামে, আগের মতো করে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করে]

ভ্লাডিমির : এক কুকুর এক–

[খুব উঁচু পর্দায় আরম্ভ করেছে বুঝতে পেরে থামে, গলা পরিষ্কার করে, আবার শুরু করে]

এক কুকুর এক রান্নাঘরে ঢুকল
তারপর করল চুরি এক টুকরো রুটি।
বাবুর্চি খুন্তি দিয়ে তাকে পেটাল বেদম
কুকুরের দফা করল সে রফা।৷

রাজ্যের কুকুর তখন দৌড়ে এল সেখানে
খুড়ল এই কুকুরের জন্য একটি কবর–

[থামে, চিন্তা করে, তারপর আবার শুরু করে]

রাজ্যের কুকুর তখন দৌড়ে এল সেখানে
খুঁড়ল ওই কুকুরের জন্য একটি কবর
আর লিখল কবর ফলকে এই কথা
অন্য সব কুকুর যেন পড়তে পারে

এক কুকুর এক রান্নাঘরে ঢুকল
তারপর করল চুরি এক টুকরো রুটি।
বাবুর্চি খুন্তি দিয়ে তাকে পেটাল বেদম
কুকুরের দফা করল সে রফা।।

রাজ্যের কুকুর তখন দৌড়ে এল সেখানে
খুঁড়ল ওই কুকুরের জন্য একটি কবর—

[থামে, চিন্তা করে, তারপর আবার শুরু করে]

রাজ্যের কুকুর তখন দৌড়ে এল সেখানে
কুকুরের জন্য একটি কবর…

[থামে, চিন্তা করে, তারপর আস্তে আস্তে কোমল কন্ঠে]

খুঁড়ল ওই কুকুরের জন্য একটি কবর…

[এক মুহূর্ত নীরব নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরই পাগলের মতো মঞ্চে ঘোরাফিরা করে। গাছের সমনে দাঁড়ায়, আসে আর যায়, জুতোর সামনে দাঁড়ায়, আসে আর যায়, একেবারে ডান প্রান্তে গিয়ে থামে, দূরে তাকিয়ে থাকে, একেবারে বাঁয়ে যায়, দূরে তাকিয়ে থাকে। ডান দিক থেকে এস্ট্রাগনের প্রবেশ, নগ্ন পদযুগল, মাথা অনাবৃত। আস্তে আস্তে মঞ্চ পার হয়। ভ্লাডিমির ঘুরে দাঁড়ায়, তাকে দেখে]

ভ্লাডিমির : আবার তুমি! [এস্ট্রাগন থামে, কিন্তু মাথা তোলে না। ভ্লাডিমির তার দিকে যায়] এখানে এসো, তোমাকে আলিঙ্গন করব।

এস্ট্রাগন : ছুঁয়ো না আমাকে।

[ভ্লাডিমির : থমকে দাঁড়ায়, বেদনাহত]

ভ্লাডিমির : তুমি চাও যে আমি চলে যাই? [চুপ করে থাকে একটুক্ষণ] গোগো! [চুপচাপ। ভ্লাডিমির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করে] তোমাকে কি ওরা মেরেছে? [চুপচাপ] গোগো! [এস্ট্রাগন নিরুত্তর, মাথা নিচু] কোথায় রাত কাটালে তুমি?

এস্ট্রাগন : ছুঁয়ো না আমাকে! প্রশ্ন কোরো না! কথা বোলো না আমার সঙ্গে! আমার কাছে থাকো!

ভ্লাডিমির : আমি কি কখনো তোমাকে ছেড়ে গেছি?

এস্ট্রাগন : তুমি আমাকে চলে যেতে দিয়েছিল।

ভ্লাডিমির : আমার দিকে তাকাও। {এস্ট্রাগন মুখ তোলে না। প্রচণ্ড জোরে]

তাকাও আমার দিকে।

[এস্ট্রাগন মুখ তোলে। অনেকক্ষণ ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ আলিঙ্গন করে, একে অন্যের পিঠ চাপড়ায়। আলিঙ্গন শেষ হয়। এস্ট্রাগন সমর্থনশূন্য হয়ে প্রায় পড়ে যায়]

এস্ট্রাগন : কী দিন গেল!

ভ্লাডিমির : কারা মেরেছে তোমাকে? আমাকে বলো।

এস্ট্রাগন : আরেকটা দিন কাটল।

ভ্লাডিমির : এখনো কাটেনি।

এস্ট্রাগন : আর যাই ঘটুক না কেন আমার জন্য কেটে গেছে। [নীরবতা] আমি তোমাকে গান গাইতে শুনেছি।

ভ্লাডিমির : ঠিক, মনে পড়ছে আমার।

এস্ট্রাগন : তাই শেষ করেছে আমাকে। মনে মনে বলেছি, ও একেবারে একা, ভেবেছি আমি চিরকালের মতো চলে গেছি আর তাই গান করছে।

ভ্লাডিমির : মনের উপর কি কারু পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে! আজ সারা দিন আমার মনে হয়েছে আমি প্রচণ্ড ফর্মে আছি। [চুপ করে থাকে একটুক্ষণ] রাতে একবারও উঠিনি!

এস্ট্রাগন : [বিষণ্ণ] দেখলে তো, আমি না থাকলে তোমার হিসিও ভালো হয়।

ভ্লাডিমির : আমি তোমার অভাব বোধ করেছি খুব…আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে সুখীও হয়েছি। অদ্ভুত ব্যাপার না?

এস্ট্রাগন : [স্তম্ভিত] সুখী?

ভ্লাডিমির : ওটা বোধহয় যথার্থ শব্দ হল না।

এস্ট্রাগন : আর এখন?।

ভ্লাডিমির : এখন?…[উল্লসিত] আবার তুমি এসেছ…[উদাসীন] আবার আমরা

একসঙ্গে…[তমসাচ্ছন্ন] আবার আমি এখানে।

এস্ট্রাগন : দেখলে, আমি সঙ্গে থাকলেই তোমার খারাপ লাগে। আমারও একা একাই ভালো লাগে।

ভ্লাডিমির : [বিরক্ত] তাহলে সব সময় হামাগুড়ি দিতে দিতে আবার ফিরে আসো কেন?

এস্ট্রাগন : জানি না।

ভ্লাডিমির : না, কিন্তু আমি জানি। তার কারণ কেমন করে নিজেকে রক্ষা করতে হয় তা তুমি জানো না। আমি থাকলে ওদের তোমাকে মারতে দিতাম না কখনো।

এস্ট্রাগন : তুমি ওদের বাধা দিতে পারতে না।

ভ্লাডিমির : কেন পারতাম না?

এস্ট্রাগন : ওরা সংখ্যায় ছিল দশজন।

ভ্লাডিমির : না, মানে ওরা তোমাকে পিটুনি দেবার আগে, তুমি যা করেছিলে সেটা করার আগেই আমি তোমাকে থামিয়ে দিতাম।

এস্ট্রাগন : আমি কিছুই করিনি। প্লাডিমির : তাহলে ওরা তোমাকে মারল কেন?

এস্ট্রাগন : জানি না।

ভ্লাডিমির : না, না, গোগো। সত্যি কথা হল এই যে অনেক জিনিস তোমার চোখ এড়িয়ে যায় যা আমার চোখ এড়াতে পারে না। তুমি নিজেই এটা বুঝতে পারো।

এস্ট্রাগন : বলছি আমি কিছুই করিনি।

ভ্লাডিমির : হয়ত করেনি। কিন্তু যদি বেঁচে থাকতে চাও তবে করার পদ্ধতিটা, বুঝলে, পদ্ধতিটাই মূল্যবান।

এস্ট্রাগন : আমি কিছুই করিনি।

ভ্লাডিমির : তুমি বুঝতে পারছ না, নইলে তুমিও নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে খুশি হয়েছ।

এস্ট্রাগন : কীসের জন্য খুশি হব?

ভ্লাডিমির : আবার আমার কাছে ফিরে আসতে পেরেছ বলে।

এস্ট্রাগন : তোমার তাই মনে হয়?

ভ্লাডিমির : বলো, সত্যি না হলেও বলো।

এস্ট্রাগন : কী বলতে হবে আমাকে?

ভ্লাডিমির : বলো, আমি সুখী হয়েছি।

এস্ট্রাগন : আমি সুখী হয়েছি।

ভ্লাডিমির : আমিও।

এস্ট্রাগন : আমিও।

ভ্লাডিমির : আমরা সুখী।

এস্ট্রাগন : আমরা সুখী। [নীরবতা] আমরা তো সুখী, এবার কী করব?

ভ্লাডিমির : গডোর জন্য অপেক্ষা করব। [এস্ট্রাগন ঝাঁকিয়ে ওঠে। নীরবতা] কালকের পর থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে।

এস্ট্রাগন : আর উনি যদি না আসেন?

ভ্লাডিমির : [এক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে থাকবার পর] সে তখন দেখা যাবে। চুপচাপ বলছিলাম যে কালকের পর থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে।

এস্ট্রাগন : সবকিছু থেকেই ঝরছে।

ভ্লাডিমির : গাছটার দিকে দেখো।

এস্ট্রাগন : কখনোই এক পুঁজ নয়, এই এখানে তো তারপর মুহূর্তেই অন্য কোনোখান থেকে।

ভ্লাডিমির : গাছটা, গাছটার দিকে দেখো।

[এস্ট্রাগন : গাছের দিকে তাকায়]

এস্ট্রাগন : কাল, এখানে গাছটা ছিল না?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ, অবশ্যই ছিল। তোমার মনে পড়ছে না? ওখান থেকে আমরা গলায় দড়ি দিয়ে প্রায় ঝুলে পড়ছিলাম। কিন্তু তুমি রাজি হওনি। মনে নেই?

এস্ট্রাগন : স্বপ্ন দেখছ তুমি।

ভ্লাডিমির : এ কি সম্ভব যে তুমি এর মধ্যেই ভুলে গেছ?

এস্ট্রাগন : আমি ওই রকমই। হয় তক্ষুনি ভুলে যাই, নয়ত জীবনে ভুলি না।

ভ্লাডিমির : আর পোজো এবং লাকি, তাদের কথাও ভুলে গেছ?

এস্ট্রাগন : পোজো এবং লাকি?

ভ্লাডিমির : সব ভুলে গেছে।

এস্ট্রাগন : একটা উন্মাদের কথা মনে পড়ছে, লাথি মেরে আমার পায়ের চামড়া তুলে দিয়েছিল, তারপর ভাঁড়ামি করেছে।

ভ্লাডিমির : ওই তো লাকি।

এস্ট্রাগন : মনে পড়ছে। কিন্তু কখন ঘটেছে ওসব?

ভ্লাডিমির : আর ওর রক্ষক, তার কথা মনে নেই?

এস্ট্রাগন : আমাকে একটা হাড় দিয়েছিল।

ভ্লাডিমির : ওই তো পোজো।

এস্ট্রাগন : আর তুমি বলছ, এই সবই গতকালের ঘটনা?

ভ্লাডিমির : এই সবই গতকালের ঘটনা।

এস্ট্রাগন : এবং এইখানে, এখন আমরা যেখানে?

ভ্লাডিমির : তোমার ধারণা কোথায়? তুমি জায়গাটা চিনতে পারছ না?

এস্ট্রাগন : [হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে] চিনব! চিনবার কী আছে? চিরটা কাল আমার এই জঘন্য জীবনে আমি শুধু কাদার ভেতর কিলবিল করেছি। আর তুমি আমার কাছে সিনারির গল্প করছ। [উন্মাদের মতো চারি দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে] এই আবর্জনার স্তূপের দিকে তাকিয়ে দেখো একবার। আমি কোনো দিন এখান থেকে এক পা-ও নড়িনি।

ভ্লাডিমির : শান্ত হও! শান্ত হও!

এস্ট্রাগন : তুমি আর তোমার দৃশ্যাবলি! কেঁচোর কথা বলো বরং আমাকে!

ভ্লাডিমির : তবু তুমি নিশ্চয়ই এ কথা বলবে না যে এই জায়গার ইঙ্গিতে দেখায়] সঙ্গে…[ইতস্তত করে] এই ধরো, মাকোন অঞ্চলের কোনো সাদৃশ্য আছে? এদের মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে সে কথা তুমি অস্বীকার করতে পারো না।

এস্ট্রাগন : মাকোন অঞ্চল! মাকোন অঞ্চলের কথা কে তোমাকে বলেছে?

ভ্লাডিমির : কিন্তু তুমি নিজেই তো ছিলে মাকোন অঞ্চলে।

এস্ট্রাগন : না, আমি কোনো দিন মাকোন অঞ্চলে থাকিনি। তোমাকে বলছি, আমার কেন্নোর জীবন। কেন্নোর মতো চিরকাল আমি এখানেই কাটিয়েছি। এইখানে! এই কাকোন অঞ্চলে।

ভ্লাডিমির : কিন্তু আমি শপথ করে বলতে পারি আমরা দুজন একত্রে ওখানে ছিলাম। একজনের ক্ষেতে আঙ্গুর তুলেছি আমরা, লোকটির নাম….[আঙুল মটকায়]…লোকটির নাম মনে করতে পারছি না, জায়গাটা হল গিয়ে…[আঙুল মটকায়]…জায়গাটার নাম মনে করতে পারছি না… তোমার মনে নেই?

এস্ট্রাগন : [একটু শান্ত] তা সম্ভব। আমি কিছু লক্ষ করিনি।

[নীরবতা ভ্লাডিমির দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে]

ভ্লাডিমির : তোমার সঙ্গে চলা বড়ো শক্ত, গোগো।

এস্ট্রাগন : আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।

ভ্লাডিমির : সব সময়ই ও কথা বলো তুমি, তারপর সুড়সুড় করে আবার ফিরে আসো।

এস্ট্রাগন : আমাকে মেরে ফেললেই সব চাইতে ভালো হয়, অন্যদের মতো।

ভ্লাডিমির : কোন অন্যদের মতো?

এস্ট্রাগন : লক্ষ লক্ষ অন্যদের মতো।

ভ্লাডিমির : [ভারিক্কি ভঙ্গিতে] সবাইকে নিজের নিজের বোঝা বইতে হবে। [দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে] যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মৃত্যু হয়। [দ্বিতীয় চিন্তার পর] এবং সবাই তাকে ভুলে যায়।

এস্ট্রাগন : কিন্তু যেহেতু আমরা নীরব থাকতে অসমর্থ, অতএব ইতিমধ্যে একটু শান্তভাবে আলাপ করার চেষ্টা করা যাক।

ভ্লাডিমির : ঠিক বলেছ, আমরা অফুরন্ত।

এস্ট্রাগন : যেন চিন্তা করতে না হয় সেজন্য।

ভ্লাডিমির : সে অজুহাত আমাদের আছে।

এস্ট্রাগন : যেন আমাদের শুনতে না হয় সেজন্য।

ভ্লাডিমির : যুক্তি আছে আমাদের।

এস্ট্রাগন : সমস্ত মৃত কণ্ঠস্বরগুলি।

ভ্লাডিমির : পাখার মতো শব্দ করে তারা।

এস্ট্রাগন : পাতার মতো।

ভ্লাডিমির : বালির মতো।

এস্ট্রাগন : পাতার মতো।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : ওরা সবাই, একসঙ্গে কথা বলে।

এস্ট্রাগন : প্রত্যেকে নিজের নিজের সঙ্গে।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : ওরা ফিসফিস করে।

এস্ট্রাগন : শন শন করে।

ভ্লাডিমির : গুনগুন করে।

এস্ট্রাগন : শনশন করে।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : কী বলে ওরা?

এস্ট্রাগন : তাদের জীবনের কথা।

ভ্লাডিমির : বেঁচে থেকে তাদের তৃপ্তি হয়নি।

এস্ট্রাগন : তা নিয়ে তাদের কথা বলতে হবে।

ভ্লাডিমির : মরে গিয়ে তাদের তৃপ্তি হয়নি।

এস্ট্রাগন : তা যথেষ্ট নয়।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : পালকের মতো শব্দ করে তারা।

এস্ট্রাগন : পাতার মতো।

ভ্লাডিমির : ছাইয়ের মতো।

এস্ট্রাগন : পাতার মতো।

[দীর্ঘ নীরবতা]

ভ্লাডিমির : কিছু বলো?

এস্ট্রাগন : চেষ্টা করছি।

[দীর্ঘ নীরবতা]

ভ্লাডিমির : [যন্ত্রণাক্লিষ্ট] একটা যা কিছু বলো!

এস্ট্রাগন : এখন কী করি আমরা?

ভ্লাডিমির : গডোর জন্য অপেক্ষা।

এস্ট্রাগন : ওহ!

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : এ অসহ্য!

এস্ট্রাগন : একটা গান করো।

ভ্লাডিমির : না, না। [চিন্তা করে] আবার বোধহয় গোড়া থেকে শুরু করতে পারি।

এস্ট্রাগন : তা সহজ হওয়া উচিত।

ভ্লাডিমির : শুরুটাই কঠিন।

এস্ট্রাগন : যেকোনো জায়গা থেকে তুমি শুরু করতে পারো।

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে স্থির করতে হবে তো।

এস্ট্রাগন : সত্যি।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : একটু সাহায্য করো!

এস্ট্রাগন : চেষ্টা করছি।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : খুঁজলে পর শোনা যায়।

এস্ট্রাগন : যায়।

ভ্লাডিমির : সেটা পাওয়া থেকে রক্ষা করে।

এস্ট্রাগন : করে। ভ্লাডিমির : চিন্তা করা থেকে রক্ষা করে।

এস্ট্রাগন : তবু চিন্তা তুমি করোই।

ভ্লাডিমির : না, না, অসম্ভব।

এস্ট্রাগন : এই তো! এসো, পরস্পরের কথার প্রতিবাদ করা যাক।

ভ্লাডিমির : অসম্ভব।

এস্ট্রাগন : তাই মনে হয় তোমার?

ভ্লাডিমির : আর আমাদের চিন্তা করবার বিপদের সম্মুখীন হতে হবে না।

এস্ট্রাগন : তাহলে অভিযোগ করছি কী জন্য?

ভ্লাডিমির : চিন্তা করাটাই সবচাইতে খারাপ ব্যাপার নয়।

এস্ট্রাগন : হয়ত নয়। কিন্তু সে ব্যাপারটা তো রয়েইছে।

ভ্লাডিমির : কোন ব্যাপারটা?

এস্ট্রাগন : বাঃ। এসো, পরস্পরকে প্রশ্ন করা যাক।

ভ্লাডিমির : কী বলতে চাও তুমি, অন্তত সে ব্যাপারটা তো রয়েছে?

এস্ট্রাগন : অন্তত অতটুকু কম দুঃখ।

ভ্লাডিমির : ঠিক।

এস্ট্রাগন : তারপর? যদি দাক্ষিণ্য লাভের জন্য ধন্যবাদ দিই?

ভ্লাডিমির : চিন্তাভাবনা যে করেছি তাই ভয়ংকর!

এস্ট্রাগন : কিন্তু ওসব কি আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে কখনো?

ভ্লাডিমির : এইসব মৃতদেহ এল কোথা থেকে?

এস্ট্রাগন : এই কঙ্কালগুলি?

ভ্লাডিমির : আমাকে বলো সে কথা?

এস্ট্রাগন : ঠিক।

ভ্লাডিমির : কিছু চিন্তাভাবনা আমরা নিশ্চয়ই করেছি।

এস্ট্রাগন : একেবারে গোড়াতে।

ভ্লাডিমির : শব-ঘর! শব-ঘর!

এস্ট্রাগন : তোমাকে দেখতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

ভ্লাডিমির : না দেখে তোমার উপায় নেই।

এস্ট্রাগন : ঠিক।

ভ্লাডিমির : যতই তুমি চেষ্টা করো না কেন।

এস্ট্রাগন : কী বললে?

ভ্লাডিমির : যতই তুমি চেষ্টা করো না কেন।

এস্ট্রাগন : আমাদের দৃঢ়চিত্তে প্রকৃতির পানে চোখ ফেরানো উচিত।

ভ্লাডিমির : আমরা সে চেষ্টা করে দেখেছি।

এস্ট্রাগন : ঠিক।

ভ্লাডিমির : ওহ, আমি জানি সেটাই সবচাইতে খারাপ ব্যাপার নয়।

এস্ট্রাগন : কী?

ভ্লাডিমির : চিন্তাভাবনা করে ফেলাটা।

এস্ট্রাগন : স্পষ্টতই।

ভ্লাডিমির : তবে না করলেও পারতাম।

এস্ট্রাগন : Que Voulez-vouz?

ভ্লাডিমির : কী বললে?

এস্ট্রাগন : Que Voulez-vouz?

ভ্লাডিমির : আহ্! Que Voulez-vouz?

একজ্যাকটলি।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : এটা খুব মন্দ হয়নি।

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ, কিন্তু এখন আবার অন্য কিছু একটা খুঁজে বার করতে হবে।

এস্ট্রাগন : দাঁড়াও, দেখি।

[মাথার টুপি খোলে, গভীরভাবে চিন্তা করে]

ভ্লাডিমির : দাঁড়াও, দেখি।

[মাথায় টুপি খোলে, গভীরভাবে চিন্তা করে। দীর্ঘ নীরবতা] আহ্।

[ওরা টুপি পরে, তৃপ্তির ভঙ্গি করে]

এস্ট্রাগন : তারপর?

ভ্লাডিমির : আমি বলছিলাম কি, ওখান থেকে আমরা অগ্রসর হতে পারি।

এস্ট্রাগন : কখন তুমি কী বলছিলে?

ভ্লাডিমির : একেবারে গোড়াতে।

এস্ট্রাগন : কীসের গোড়াতে?

ভ্লাডিমির : আজ বিকেলে…আমি বলছিলাম…আমি বলছিলাম…

এস্ট্রাগন : আমি ঐতিহাসিক নই।

ভ্লাডিমির : দাঁড়াও…আমরা কোলাকুলি করেছিলাম…সুখী হয়েছিলাম…সুখী…এখন যখন সুখী এরপর কী করি…অপেক্ষা করে থাকা… অপেক্ষা…দাঁড়াও, মনে করি…মনে পড়ছে…অপেক্ষা করে থাকা…এখন যখন সুখী…দাঁড়াও…আহ! গাছটা!

এস্ট্রাগন : গাছটা?

ভ্লাডিমির : মনে পড়ছে না তোমার?

এস্ট্রাগন : আমি ক্লান্ত।

ভ্লাডিমির : ওদিকে তাকাও।

[ওরা গাছের দিকে দেখে]

এস্ট্রাগন : আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

ভ্লাডিমির : কিন্তু কাল বিকেলে এটা ছিল সম্পূর্ণ কালো আর নিষ্পত্র। আর এখন পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে।

এস্ট্রাগন : পাতা?

ভ্লাডিমির : এক রাতের মধ্যে।

এস্ট্রাগন : নিশ্চয়ই বসন্তের কীর্তি।

ভ্লাডিমির : কিন্তু এক রাতের মধ্যে।

এস্ট্রাগন : আমি তোমাকে বলছি আমরা গতকাল এখানে ছিলাম না। ওটা তোমার আরেকটা দুঃস্বপ্ন।

ভ্লাডিমির : তাহলে আপনার মতে কাল বিকেলে আমরা কোথায় ছিলাম?

এস্ট্রাগন : আমি কী জানি? অন্য কোনো প্রকোষ্ঠে। শূন্যস্থানের কোনো ঘাটতি পড়েনি।

ভ্লাডিমির : আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তম। আমরা কাল বিকেলে এখানে ছিলাম না। কাল বিকেলে আমরা কী করেছি?

এস্ট্রাগন : করেছি?

ভ্লাডিমির : চেষ্টা করে মনে করো।

এস্ট্রাগন : করেছি…বোধহয় বকবক করেছি।

ভ্লাডিমির : [আত্মসংবরণ করে] কী নিয়ে?

এস্ট্রাগন : ওহ…এটা ওটা নিয়ে। আমার মনে হয় বিশেষ কোনো কিছু নিয়ে নয়। [দৃঢ়তার সঙ্গে] হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে, কাল বিকেলে আমরা বকবক করেছি বিশেষ কোনো কিছু নিয়ে নয়। আজ অর্ধ-শতাব্দী ধরে তাই চলেছে।

ভ্লাডিমির : তোমার কোনো ঘটনা, কোনো পরিস্থিতির কথাই মনে পড়ছে না?

এস্ট্রাগন : ক্লিান্ত আমাকে কষ্ট দিও না, ডিডি।

ভ্লাডিমির : সূর্য। চাঁদ। তোমার মনে নেই?

এস্ট্রাগন : ছিল নিশ্চয়ই। যেমন থাকে।

ভ্লাডিমির : অসাধারণ কিছুই তুমি লক্ষ করোনি?

এস্ট্রাগন : হায়!

ভ্লাডিমির : আর পোজো? আর লাকি?

এস্ট্রাগন : পোজো?

ভ্লাডিমির : হাড়।

এস্ট্রাগন : মাছের কাঁটার মতো।

ভ্লাডিমির : ওগুলি পোজো তোমাকে দিয়েছিল।

এস্ট্রাগন : আমি জানি না।

ভ্লাডিমির : আর লাথি।

এস্ট্রাগন : ঠিক, কে একজন আমাকে লাথি মেরেছিল।

ভ্লাডিমির : লাকি।

এস্ট্রাগন : এ সবই কালকের ব্যাপার?

ভ্লাডিমির : তোমার পা দেখাও।

এস্ট্রাগন : কোনটা?

ভ্লাডিমির : দুটোই। প্যান্ট তোলো [এস্ট্রাগন ভ্লাডিমিরকে একটা পা দেয়, টলমল করে। ভ্লাডিমির পা নেয়। দুজনেই টলমল করে] প্যান্ট তোলো।

এস্ট্রাগন : পারছি না।

[ভ্লাডিমির : ওর প্যান্ট ওঠায়, পা দেখে ছেড়ে দেয়। এস্ট্রাগন প্রায় পড়ে যায়]

ভ্লাডিমির : অন্যটা। [এস্ট্রাগন একই পা এগিয়ে দেয়] অন্যটা, শুয়ার! [এস্ট্রাগন

অন্য পা দেয়। জয়োল্লাসের সঙ্গে] এই তো আঘাতের চিহ্ন! ঘা হতে শুরু করেছে!

এস্ট্রাগন : এতে হলটা কী?

ভ্লাডিমির : [পা ছেড়ে দিয়ে] তোমার জুতো কোথায়?

এস্ট্রাগন : নিশ্চয় ফেলে দিয়েছি।

ডিমির কখন?

এস্ট্রাগন : জানি না।

ভ্লাডিমির : কেন?

এস্ট্রাগন : [ক্ষিপ্ত হয়ে] আমি জানি না কেন আমি জানি না।

ভ্লাডিমির : না, আমি বলছিলাম ফেলে দিয়েছ কেন?

এস্ট্রাগন : ক্ষিপ্ত] কারণ ব্যথা পাচ্ছিলাম খুব।

ভ্লাডিমির : [জয়োল্লাসের সঙ্গে, জুতোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে] ওই যে ওখানে!

[এস্ট্রাগনের জুতোর দিকে দেখে] কাল যেখানে রেখেছিলে ঠিক সেইখানেই আছে!

[এস্ট্রাগন জুতোর দিকে এগিয়ে যায়, খুব মন দিয়ে পরীক্ষা করে]

এস্ট্রাগন : এগুলি আমার নয়।

ভ্লাডিমির : [স্তম্ভিত] তোমার নয়!

এস্ট্রাগন : আমার জুতো ছিল কালো। এগুলি লাল।

ভ্লাডিমির : তুমি ঠিক জানো তোমার জুতো কালো ছিল?

এস্ট্রাগন : ইয়ে, একটু ধূসরমতো ছিল।

ভ্লাডিমির : আর এগুলি লাল? দেখাও।

এস্ট্রাগন : [একটা জুতো তুলে] ইয়ে এগুলি একটু সবুজমতো।

ভ্লাডিমির : দেখাও। [এস্ট্রাগন জুতোটা ওর হাতে দেয়। ভ্লাডিমির ভালো করে। দেখে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে] যত্তসব–

এস্ট্রাগন : দেখলে তো, যত্তসব–

ভ্লাডিমির : ওহ্, বুঝেছি। হ্যাঁ, কী হয়েছে আমি বুঝতে পেরেছি।

এস্ট্রাগন : যত্তসব–

ভ্লাডিমির খুব সোজা! কেউ একজন এসেছিল। তোমারটা নিয়ে তারটা রেখে গেছে।

এস্ট্রাগন : কেন?

ভ্লাডিমির : তারটা খুব টাইট হত, তাই তোমারটা নিয়ে গেছে।

এস্ট্রাগন : কিন্তু আমার তো খুব টাইট হত।

ভ্লাডিমির : তোমার জন্যে, তার জন্যে নয়।

এস্ট্রাগন : [মর্মোদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টার পর] আমি ক্লান্ত! [চুপচাপ] চলো, যাওয়া যাক।

ভ্লাডিমির : আমরা যেতে পারি না।

এস্ট্রাগন : কেন পারি না?

ভ্লাডিমির : গডোর জন্য অপেক্ষা করছি আমরা।

এস্ট্রাগন : আহ! চুপচাপ। হতাশ ভঙ্গিতে কী করব আমরা! কী করব!

ভ্লাডিমির : কিছু করবার নেই আমাদের।

এস্ট্রাগন : কিন্তু আমি যে আর পারছি না এভাবে!

ভ্লাডিমির : একটা মূলা খাবে?

এস্ট্রাগন : আর কিছু নেই?

ভ্লাডিমির : মূলা আর ওলকপি আছে।

এস্ট্রাগন : গাজর নেই?

ভ্লাডিমির : না। তা ছাড়া তুমি গাজর নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করো।

এস্ট্রাগন : তাহলে মূলাই দাও।

[ভ্লাডিমির পকেট হাতড়ায়, ওলকপি ছাড়া কিছু পায় না, অবশেষে একটা মূলা বার করে আনে, এস্ট্রাগনকে দেয়, সে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে, গন্ধ শোঁকে] এই তো কালো!

ভ্লাডিমির : মূলা।

এস্ট্রাগন : কিন্তু তুমি জানো আমি শুধু লালগুলি পছন্দ করি।

ভ্লাডিমির : তাহলে তোমার এটার দরকার নেই?

এস্ট্রাগন : আমি লালগুলি পছন্দ করি।

ভ্লাডিমির : তবে ওটা আমাকে ফিরিয়ে দাও।

[এস্ট্রাগন ফিরিয়ে দেয় সেটা]

এস্ট্রাগন : যাই, একটা গাজর নিয়ে আসি।

[সে নড়ে না]

ভ্লাডিমির : এটা সত্যি তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে পড়ছে।

এস্ট্রাগন : যথেষ্ট নয়।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : ওগুলি একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি?

এস্ট্রাগন : আমি সবকিছু চেষ্টা করে দেখেছি।

ভ্লাডিমির : না, আমি ওই জুতোজোড়ার কথা বলছিলাম।

এস্ট্রাগন : সেটা কি ভালো কাজ হবে?

ভ্লাডিমির : সময়টা কাটত। [এস্ট্রাগন ইতস্তত করে] আমি বলছি, ওর ফলে একটা কাজ করা হবে।

এস্ট্রাগন : একটু বিশ্রাম।

ভ্লাডিমির : একটু চিত্তবিনোদন।

এস্ট্রাগন : একটু বিশ্রাম।

ভ্লাডিমির : চেষ্টা করে দেখো।

এস্ট্রাগন : তুমি আমাকে সাহায্য করবে?

ভ্লাডিমির : অবশ্যই।

এস্ট্রাগন : আমরা দুজনে মিলে নেহাৎ একটা খারাপ করছি না, ডিডি, কী বলো?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ হ্যাঁ। এসো, আগে বাঁ পা।

এস্ট্রাগন : আমরা টিকে আছি, সে ধারণা জন্মাবার মতো একটা না একটা কিছু আমরা সব সময় পেয়েই যাই, না ডিডি?

ভ্লাডিমির : [অসহিষ্ণু কণ্ঠে] হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা ম্যাজিশিয়ান। কিন্তু ভুলে যাবার আগে সিদ্ধান্তটা আমাদের কাজে পরিণত করা দরকার। [একটা জুতো হাতে তুলে নেয়] এসো, তোমার পা-টা দাও [এস্ট্রাগন পা উঁচু করে] অন্যটা, শুয়ার! [এস্ট্রাগন অন্য পা তোলে] আরো উঁচু! [জড়াজড়ি করে টলমল পায়ে দুজনে মঞ্চের উপর ঘোরে। ভ্লাডিমির অবশেষে ওর পায়ে জুতোটা পরাতে সক্ষম হয়] হেঁটে দেখো। [এস্ট্রাগন হাঁটে] কী?

এস্ট্রাগন : ফিট করেছে।

ভ্লাডিমির : [পকেট থেকে ফিতা বার করে] দাঁড়াও, ফিতা লাগিয়ে দিই।

এস্ট্রাগন : [তীব্র কণ্ঠে] না, না, ফিতা না, ফিতা না!

ভ্লাডিমির : পরে দুঃখ করবে। দেখি এবার অন্য পা-টা। [পূর্বের মতো] কী?

এস্ট্রাগন : [অনিচ্ছুক গলায়] এটাও ফিট করেছে।

ভ্লাডিমির : ব্যথা লাগছে না?

এস্ট্রাগন : এখন পর্যন্ত না।

ভ্লাডিমির : তাহলে রেখে দিতে পারো।

এস্ট্রাগন : বেশি বড়ো।

ভ্লাডিমির : হয়ত একদিন মোজা পেয়ে যাবে তুমি।

এস্ট্রাগন : ঠিক।

ভ্লাডিমির : তাহলে রাখছ।

এস্ট্রাগন : ব্যস, জুতো নিয়ে যথেষ্ট হয়েছে।

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ, কিন্তু–

এস্ট্রাগন : [তীব্র কণ্ঠে] ব্যস! [নীরবতা] এবার একটু বসতে পারি। [কোথায় বসবে তাকিয়ে দেখে, তারপর ঢিবির উপর গিয়ে বসে]

ভ্লাডিমির : কাল বিকেলে তুমি ওইখানে গিয়েই বসেছিলে।

এস্ট্রাগন : শুধু যদি ঘুমুতে পারতাম।

ভ্লাডিমির : কাল তুমি ঘুমিয়েছিলে।

এস্ট্রাগন : আমি চেষ্টা করব।

[গর্ভস্থ ভ্রূণের ভঙ্গিতে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে দেয়]

ভ্লাডিমির : দাঁড়াও। [এস্ট্রাগনের কাছে গিয়ে তার পাশে বসে, উঁচু গলায় গান গাইতে আরম্ভ করে]

বাই বাই বাই বাই
বাই বাই বাই বাই
বাই বাই বাই বাই
বাই বাই…..

[এস্ট্রাগন ঘুমিয়ে পড়ে। ভিমির সন্তর্পণে উঠে দাঁড়ায়, নিজের কোট খুলে এস্ট্রাগনের পিঠের উপর বিছিয়ে দেয়, তারপর নিজের শরীর গরম রাখার জন্য হাত দুটো জোরে নাড়তে নাড়তে পায়চারি করতে থাকে। এস্ট্রাগন হঠাৎ চমকে জেগে ওঠে, লাফ দেয়, অস্থিরভাবে এদিক ওদিক দেখে। ভ্লাডিমির ওর কাছে ছুটে আসে, দু বাহু দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে]

এই যে…এই যে…এই যে…এই যে ডিডি এখানে…ভয় নেই কোনো…

এস্ট্রাগন : আহ!

ভ্লাডিমির : এই তো…এই তো…এই তো সব চুকে গেছে।

এস্ট্রাগন : আমি পড়ে যাচ্ছিলাম।

ভ্লাডিমির : সব শেষ হয়ে গেছে, সব।

এস্ট্রাগন : আমি ছিলাম একেবারে চূড়ায়।

ভ্লাডিমির : চলো, একটু হাঁটি আমরা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

[এস্ট্রাগনকে জড়িয়ে ধরে সে পায়চারি করে। একসময় এস্ট্রাগন আর হাঁটতে অস্বীকৃতি জানায়]

এস্ট্রাগন : ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে। আমি ক্লান্ত।

ভ্লাডিমির : তুমি ওইখানে থাকবে, ওই রকমভাবে? কিছু না করে?

এস্ট্রাগন : হ্যাঁ।

ভ্লাডিমির : বেশ, তোমার যা খুশি তাই করো।

[এস্ট্রাগনকে ছেড়ে দেয়, নিজের কোট তুলে নিয়ে গায়ে পরে]

এস্ট্রাগন : চলো যাওয়া যাক।

ডিমির : যেতে আমরা পারি না।

এস্ট্রাগন : কেন না?

ভ্লাডিমির : আমরা গডোর জন্য অপেক্ষা করছি।

এস্ট্রাগন : আহ্! [ভ্লাডিমির পায়চারি করে] একটু স্থির হয়ে থাকতে পারো না?

ভ্লাডিমির : আমার শীত করছে।

এস্ট্রাগন : আমরা বেশি আগে এসে পড়েছি।

ভ্লাডিমির : সব সময়ই তো ঠিক রাত নামবার মুহূর্তে হয়।

এস্ট্রাগন : কিন্তু রাত তো নামে না।

ভ্লাডিমির : হঠাৎ নামবে, কালকের মতো।

এস্ট্রাগন : তাহলে রাত হবে।

ভ্লাডিমির : এবং আমরা যেতে পারব।

এস্ট্রাগন : তারপর আবার দিন হবে। [চুপচাপ। হতাশ কণ্ঠে] কী করব, আমরা কী করব?

ভ্লাডিমির : [দাঁড়িয়ে পড়ে, হিংস্র গলায়] তোমার প্যানপ্যানানি বন্ধ করবে! তোমার কাঁদুনি আর সহ্য হয় না আমার।

এস্ট্রাগন : আমি যাচ্ছি।

ভ্লাডিমির : [লাকির টুপিটা দেখতে পায়] আ রে!

এস্ট্রাগন : বিদায়।

ভ্লাডিমির : লাকির টুপি! [সেদিকে এগিয়ে যায়] এক ঘণ্টা ধরে এখানে আছি অথচ এতক্ষণ একবারও চোখে পড়েনি। [ভীষণ খুশি] চমৎকার!

এস্ট্রাগন : আর তুমি আমাকে কখনো দেখবে না।

ভ্লাডিমির : আমি জানতাম ঠিক জায়গা এটা। এবার আমাদের সব দুঃখকষ্টের অবসান হবে। [টুপিটা তুলে নেয়, মন দিয়ে দেখে, সোজা করে] খুব সুন্দর ছিল একসময়। [নিজের টুপির বদলে এটা পরে, নিজেরটা এস্ট্রাগনের হাতে দেয়] নাও।

এস্ট্রাগন : কী?

ভ্লাডিমির : এটা ধরো।

[এস্ট্রাগন ভ্লাডিমিরের টুপি হাতে নেয়। ভ্লাডিমির লাকির টুপি নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। এস্ট্রাগন নিজের টুপির বদলে জুডিমিরেরটা তার মাথায় পরে, নিজেরটা ভ্লাডিমিরকে দেয়। ভ্লাডিমির এস্ট্রাগনের টুপি নেয়। এস্ট্রাগন ভ্লাডিমিরের টুপি নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। ভ্লাডিমির : লাকির টুপির বদলে এস্ট্রাগনেরটা নিজের মাথায় পরে, লাকিরটা এস্ট্রাগনকে দেয়। এস্ট্রাগন লাকির টুপি নেয়। ভ্লাডিমির এস্ট্রাগনের টুপি নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। এস্ট্রাগন ভ্লাডিমিরের টুপির বদলে লাকির টুপি নিজের মাথায় পরে, নিজেরটা ভ্লাডিমিরকে দেয়। ভ্লাডিমির তার টুপি নেয়। এস্ট্রাগন লাকির টুপি নিজের মাথায় দেয়। এস্ট্রাগন এস্ট্রাগনের টুপির বদলে লাকির টুপি পরে এবং এস্ট্রাগনেরটা এস্ট্রাগনকে দেয়। এস্ট্রাগন তার টুপি নেয়। ভ্লাডিমির তার টুপি নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। এস্ট্রাগন লাকির টুপির বদলে নিজের টুপি পরে এবং লাকিরটা ভ্লাডিমিরকে দেয়। ভ্লাডিমির লাকির টুপি নেয়। এস্ট্রাগন তার টুপি নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। ভ্লাডিমির নিজের টুপির বদলে লাকির টুপি পরে এবং নিজেরটা এস্ট্রাগনকে দেয়। এস্ট্রাগন ভ্লাডিমিরের টুপি নেয়। ভ্লাডিমির লাকির টুপি নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। এস্ট্রাগ ভ্লাডিমিরের টুপি ভ্লাডিমিরকে ফেরত দেয়, ভ্লাডিমির সেটা হাতে নেয়, আবার এস্ট্রাগনকে ফিরিয়ে দেয়, সে হাতে নেয়, আবার জাড়িমিরের কাছে ফেরত দেয়, সে হাতে নেয়, তারপর মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়]

কী রকম ফিট করেছে আমাকে?

এস্ট্রাগন : আমি কী জানি তার?

ভ্লাডিমির : না, মানে আমাকে এটা পরে কী রকম দেখাচ্ছে?

[খুব ছিনালি ভঙ্গি করে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে]

 এস্ট্রাগন : জঘন্য।

ভ্লাডিমির : কিন্তু সচরাচরের চাইতে বেশি নয়?

এস্ট্রাগন : বেশিও নয়, কমও নয়।

ভ্লাডিমির : তাহলে এটা আমি রেখে দিতে পারি। আমারটা খারাপ লাগত। [একটুক্ষণ চুপ করে থাকে] কী করে প্রকাশ করব? ওটা কুটুকুট করত। [লাকির টুপিটা মাথা থেকে নামায়, উঁকি মেরে ভেতরটা দেখে, নাড়ে, চাঁদিতে চাপড় মারে, আবার মাথায় দেয়]

এস্ট্রাগন : আমি চললাম।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : খেলবে না?

এস্ট্রাগন : কী খেলব?

ভ্লাডিমির : আমরা পোজো-লাকি খেলতে পারি।

এস্ট্রাগন : কোনো দিন নাম শুনিনি।

ভ্লাডিমির : আমি লাকি হব, তুমি পোজো।

[বোঝার ভারে নুয়ে পড়া লাকির অনুকরণ করে। এস্ট্রাগন স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে]

এস্ট্রাগন : কী করতে হবে আমাকে?

ভ্লাডিমির : গালাগাল করো আমাকে।

এস্ট্রাগন : [বেশ ভেবেচিন্তে] দুষ্টু!

ভ্লাডিমির : আরো কড়া!

এস্ট্রাগন : গোনে কক্কাস! স্পিরোকিট!

[ভ্লাডিমির দেহকে প্রায় দু-ভাজে ভেঙে দুলতে থাকে সামনে পেছনে]

ভ্লাডিমির : আমাকে চিন্তা করতে বলল।

এস্ট্রাগন : কী?

ভ্লাডিমির : বল, চিন্তা কর, শুয়ার।

এস্ট্রাগন : চিন্তা কর, শুয়ার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : পারছি না আমি!

এস্ট্রাগন : ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে।

ভ্লাডিমির : আমাকে নাচতে বলল।

এস্ট্রাগন : আমি চললাম।

ভ্লাডিমির : নাচ, শুয়ার। [সে দেহ বাঁকায়, আঁকুপাঁকু করে। এস্ট্রাগন হঠাৎ দ্রুত বা দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়] পারছি না। [মুখ তুলে এস্ট্রাগনকে দেখতে পায় না] গোগো! [পাগলের মতো মঞ্চে ঘোরে। এস্ট্রাগন হাঁফাতে হাঁফাতে প্রবেশ করে, বাঁ দিক দিয়ে দ্রুত পায়ে ভ্লাডিমিরের দিকে যায়, তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে] এই যে, আবার এলে তুমি অবশেষে!

এস্ট্রাগন : আমি অভিশপ্ত!

ভ্লাডিমির : কোথায় ছিলে তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি চিরদিনের মতো চলে গেলে।

এস্ট্রাগন : ওরা আসছে!

ভ্লাডিমির : কারা?

এস্ট্রাগন : জানি না।

ভ্লাডিমির : ক-জন?

এস্ট্রাগন : জানি না।

ভ্লাডিমির : [জয়োল্লাসের সঙ্গে] গডো! অবশেষে! গোগো, গডো আসছেন। এবার রক্ষা পেলাম আমরা! চলে যাই, ওঁর সঙ্গে দেখা করি গিয়ে। [এস্ট্রাগনকে উইংসের দিকে টেনে নিয়ে চলে। এস্ট্রাগন বাধা দেয়, নিজেকে মুক্ত করে, ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়] গোগো! ফিরে এসো! [ভ্লাডিমির একেবারে বাঁ প্রান্তে ছুটে যায়, দিগন্তের পানে চোখ বুলায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। এস্ট্রাগন ডান দিক দিয়ে প্রবেশ করে, দ্রুত জুডিমিরের দিকে এগিয়ে যায়, তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে] এই যে, তুমি আবার এলে, আবার!

এস্ট্রাগন : আমি জাহান্নামে!

ভ্লাডিমির : কোথায় গিয়েছিলে?

এস্ট্রাগন : সেখানেও ওরা আসছে!

ভ্লাডিমির : আমাদের ঘিরে ফেলেছে! [এস্ট্রাগন পিছন দিকে ছুটে যায়] পাগল! ওদিকে পালাবার কোনো পথ নেই। [এস্ট্রাগনকে বাহু বেষ্টনে আবদ্ধ করে সামনের দিকে টেনে নিয়ে আসে। সামনের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়] ওই দিকে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না! পালাও তুমি! জলদি করো! [এস্ট্রাগনকে প্রেক্ষাগৃহের দিকে ঠেলে দেয়। এস্ট্রাগন আতঙ্কে শিউরে পিছনে সরে আসো যাবে না? [প্রেক্ষাগৃহের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখো, এটা অবশ্য বুঝতে পারি। দাঁড়াও, একটা উপায় বার করতে দাও। [চিন্তা করে] তোমার একমাত্র ভরসা হচ্ছে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

এস্ট্রাগন : কোথায় যাব?

ভ্লাডিমির : ওই গাছের পিছনে। [এস্ট্রাগন ইতস্তত করে] জলদি করো। গাছটার পিছনে। [এস্ট্রাগন গাছের পিছনে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে, উপলব্ধি করে যে তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে আসে] এই গাছ নিঃসন্দেহে আমাদের সামান্যতম কাজে আসবে না।

এস্ট্রাগন : [অপেক্ষাকৃত শান্ত] আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। মাপ করো। আর কখনো এমন হবে না। বলে কী করতে হবে আমাকে।

ভ্লাডিমির : কিছুই করতে হবে না।

এস্ট্রাগন : তুমি ওখানে গিয়ে দাঁড়াও। [ভ্লাডিমিরকে একেবারে ডান প্রান্তে নিয়ে যায়, মঞ্চের দিকে পিঠ করে সেখানে দাঁড় করিয়ে দেয়] ব্যস, নোড়ো না। আর পাহারা দাও। [ভ্লাডিমির হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে তী দৃষ্টিতে দিগন্তের পানে খুঁটিয়ে দেখে। এস্ট্রাগন দৌড়ে গিয়ে একেবারে বাঁ প্রান্তে এসে একই অবস্থান গ্রহণ করে। মাথা ঘুরিয়ে তারা দুজন পরস্পরের দিকে তাকায়] আনন্দময় অতীত দিনের মতো আবার সেই পিঠাপিঠি! [মুহূর্তের জন্য পরস্পরের দিকে তারা তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার প্রহরায় মনোনিবেশ করে। দীর্ঘ নীরবতা] কিছু আসতে দেখছ তুমি?

ভ্লাডিমির : [মাথা ঘুরিয়ে] কী?

এস্ট্রাগন : [আরেকটু গলা তুলে] কিছু আসতে দেখছ তুমি?

ভ্লাডিমির : না।

এস্ট্রাগন : আমিও না।

[আবার প্রহরায় নিযুক্ত। নীরবতা]

ভ্লাডিমির : নিশ্চয়ই অলৌকিক কোনো দর্শন লাভ করেছ তুমি।

এস্ট্রাগন : মাথা ঘুরিয়ে কী?

ভ্লাডিমির : [আরেকটু গলা তুলে] নিশ্চয়ই অলৌকিক কোনো দর্শন লাভ করেছ তুমি!

এস্ট্রাগন : চিৎকার করবার প্রয়োজন নেই।

[আবার প্রহরায় নিযুক্ত। নীরবতা]

ভ্লাডিমির ও এস্ট্রাগন : [একই সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে] তুমি কি—

ভ্লাডিমির : ওহ্, পাৰ্ডন!

এস্ট্রাগন : বলে ফেলো।

ভ্লাডিমির : না, না, তোমার পরে।

এস্ট্রাগন : না, না, তুমি আগে।

ভ্লাডিমির : আমি তোমাকে বাধা দিয়েছি।

এস্ট্রাগন : ঠিক উল্টো।

[পরস্পরের দিকে তারা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়]

ভ্লাডিমির : শারাফতের শিম্পাজি!

এস্ট্রাগন : সৌজন্যের শুয়োর!

ভ্লাডিমির : বলছি তোমার কথাটা শেষ করো!

এস্ট্রাগন : তোমার নিজেরটা শেষ করো!

ভ্লাডিমির : পাঁঠা!

এস্ট্রাগন : চমৎকার! এসো, পরস্পরকে গালাগাল করা যাক।

[দুজনেই ঘুরে দাঁড়ায়, দূরে সরে যায়, পরস্পরের দিকে মুখ করে আবার ঘুরে দাঁড়ায়]

ভ্লাডিমির : পাঁঠা।

এস্ট্রাগন : উকুন!

ভ্লাডিমির : গর্ভস্রাব।

এস্ট্রাগন : মরপিয়ন!

ভ্লাডিমির : ড্রেনের ছুঁচো।

এস্ট্রাগন : সহকারী পাদরি।

ভ্লাডিমির : শুশুক।

এস্ট্রাগন : [চরম আঘাত হানার সুরে] স্‌-সমালোচক।

ভ্লাডিমির : ওহ্!

[মুষড়ে পড়ে, পরাজিত, মুখ ঘুরিয়ে নেয়]

এস্ট্রাগন : এসো, এবার ভাব করে ফেলি।

ভ্লাডিমির : গোগো!

এস্ট্রাগন : ডিডি!

ভ্লাডিমির : হাত বাড়াও!

এস্ট্রাগন : এই নাও!

ভ্লাডিমির : বাহুপাশে এসো!

এস্ট্রাগন : বাহুপাশে?

ভ্লাডিমির : বুকে।

এস্ট্রাগন : কেয়া বাত!

[পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। সরে আসে। নীরবতা]

ভ্লাডিমির : ফুর্তির মধ্যে থাকলে কী দ্রুত যে সময় কেটে যায়।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : এবার আমরা কী করব?

ভ্লাডিমির : অপেক্ষা করতে থাকার সময়টুকুতে।

এস্ট্রাগন : অপেক্ষা করতে থাকার সময়টুকুতে।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : আমরা আমাদের ব্যায়ামগুলি করতে পারি।

এস্ট্রাগন : আমাদের মুভমেন্টগুলি।

ভ্লাডিমির : আমাদের এলিভেশনগুলি।

এস্ট্রাগন : আমাদের রিলাক্সেশনগুলি।

ভ্লাডিমির : আমাদের এলাঙ্গেশনগুলি

এস্ট্রাগন : আমাদের রিলাক্সেশনগুলি।

ভ্লাডিমির : গরম করে তোলার জন্য।

এস্ট্রাগন : ঠাণ্ডা করে দেবার জন্য।

ভ্লাডিমির : কেয়া বাত! চালাও।

[ভ্লাডিমির প্রথমে এক পায়ে তারপর অন্য পায়ে লাফায়। এস্ট্রাগন তার অনুকরণ করে]

এস্ট্রাগন : থেমে অনেক হয়েছে। আমি ক্লান্ত।

ভ্লাডিমির : [থেমে] আমরা ফর্মে নেই। একটু জোরে জোরে নিশ্বাস নিলে কেমন হয়?

এস্ট্রাগন : নিশ্বাস নিতে নিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।

ভ্লাডিমির : ঠিক বলেছ তুমি। [একটুক্ষণ চুপচাপ] চলো, গাছ হওয়া যাক। ব্যালান্সের জন্য।

এস্ট্রাগন : তোমার কি মনে হয় ঈশ্বর আমাকে দেখছেন?

ভ্লাডিমির : তোমাকে চোখ বন্ধ করতে হবে।

এস্ট্রাগন : [থেমে, মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে, প্রাণপণে চিৎকার করে বলে ওঠে] ঈশ্বর, দয়া করো আমাকে!

ভ্লাডিমির : [বিরক্ত হয়ে] আর আমাকে?

এস্ট্রাগন : আমাকে! আমাকে! দয়া করো! আমাকে!

[পোজো এবং লাকির প্রবেশ। পোজো অন্ধ। লাকির পিঠে আগের মতোই মালপত্র। দড়িও আছে, তবে অনেক খাটো, পোজো যেন সহজে অনুগমন করতে পারে। লাকির মাথায় অন্য একটি টুপি। ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগনকে দেখতে পেয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। পোজো চলতে থাকে, ওর গায়ে এসে ধাক্কা খায়]

ভ্লাডিমির : গোগো!

পোজো : [লাকিকে জড়িয়ে ধরে, লাকি টলমল করে] কী হল? কী হল?

[লাকি পড়ে যায়, সব মালপত্র পড়ে যায়, পোজোকে নিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে। হত্ৰবিচ্ছিন্ন মালপত্রের মধ্যে ওরা অসহায়ের মতো পড়ে থাকে]

এস্ট্রাগন : গডো এলেন কি?

ভ্লাডিমির : অবশেষে! [স্তূপের দিকে এগিয়ে যায়] অবশেষে সাহায্যকারী দল এসে পৌঁছাল?

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : গডো কি?

ভ্লাডিমির : আমরা মুষড়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে সাফল্যের সঙ্গে আমরা বিকেলটা পার করে দিতে পারব।

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : শুনতে পাচ্ছ?

ভ্লাডিমির : আর আমরা নিঃসঙ্গ নই, রাত্রির জন্য প্রতীক্ষারত, গডোর জন্য প্রতীক্ষারত, প্রতীক্ষা…রত…। সারা বিকেল আমরা একা একা ঘুরেছি। এখন তার অবসান ঘটেছে। আগামীকাল ইতিমধ্যে এসে গেছে।

পোজো : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : এর মধ্যেই আবার সময়ের স্রোত বইতে আরম্ভ করেছে। সূর্য উঠবে, চাঁদ উঠবে, আর আমরা এখান থেকে…চলে যাব।

পোজো : দয়া করে।

ভ্লাডিমির : বেচারা পোজো!

এস্ট্রাগন : আমি ঠিক জানতাম উনি।

ভ্লাডিমির : কে?

এস্ট্রাগন : গডো।

ভ্লাডিমির : কিন্তু ও তো গডো নয়।

এস্ট্রাগন : তবে কে ও?

ভ্লাডিমির : পোজো।

পোজো : এই যে এখানে। এখানে! আমাকে একটু তুলে ধরো!

ভ্লাডিমির : ও উঠতে পারছে না।

এস্ট্রাগন : চলো যাই।

ভ্লাডিমির : যেতে আমরা পারি না।

এস্ট্রাগন : কেন না?

ভ্লাডিমির : আমরা গভোর জন্য অপেক্ষা করছি।

এস্ট্রাগন : আহ্‌।

ভ্লাডিমির : হয়ত তোমার জন্য ওর কাছে আরেকটা হাড় আছে।

এস্ট্রাগন : হাড়?

ভ্লাডিমির : মুরগির। তোমার মনে নেই?

এস্ট্রাগন : সেই লোক?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ।

এস্ট্রাগন : জিজ্ঞেস করো।

ভ্লাডিমির : আগে বোধহয় আমাদের ওকে সাহায্য করা উচিত।

এস্ট্রাগন : কী করতে?

ভ্লাডিমির : উঠে দাঁড়াতে।

এস্ট্রাগন : ও উঠতে পারছে না।

ভ্লাডিমির : সে উঠতে চায়।

এস্ট্রাগন : তবে উঠুক।

ভ্লাডিমির : পারছে না।

এস্ট্রাগন : কেন?

ভ্লাডিমির : আমি জানি না।

পোজো : [আঁকুপাঁকু করে, গোঙায়, মাটির উপর ঘুষি মারে]

এস্ট্রাগন : আগে আমাদের ওর কাছে হাড়টা চাওয়া উচিত। না দিলে ওকে ওখানেই ফেলে রেখে চলে যাব।

ভ্লাডিমির : তুমি বলতে চাও ওকে এখন আমরা বাগে পেয়েছি?

এস্ট্রাগন : হ্যাঁ।

ভ্লাডিমির :। এবং আমাদের সাহায্য কতিপয় শর্তসাপেক্ষে করা উচিত।

এস্ট্রাগন : কী?

ভ্লাডিমির : বেশ বুদ্ধিসম্মত বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা ভয় আছে।

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : কী?

ভ্লাডিমির : লাকিটা হঠাৎ আবার তেড়ে উঠতে পারে। তাহলে আমরা গেছি!

এস্ট্রাগন : লাকি?

ভ্লাডিমির : কাল যে তোমার পিছু লেগেছিল।

এস্ট্রাগন : বলছি কাল ওরা দশজন ছিল।

ভ্লাডিমির : না, তার আগে, যে তোমাকে লাথি মেরেছিল।

এস্ট্রাগন : ও এখানে আছে নাকি?

ভ্লাডিমির : সশরীরে। জলজ্যান্ত। [লাকির দিকে ইঙ্গিত করে] আপাতত অসাড়, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে ক্ষেপে উঠতে পারে।

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : আর আমরা দুজন মিলে যদি এখন ওকে বেদম পিটুনি দিই?

ভ্লাডিমির : অর্থাৎ যদি ঘুমের মধ্যে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি?

এস্ট্রাগন : হ্যাঁ।

ভ্লাডিমির : কথাটা ভালোই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি তা করতে পারব? ও কি সত্যিই ঘুমুচ্ছে? [একটুক্ষণ চুপ করে থাকে] না, সবচাইতে ভালো হবে যদি আমরা পোজোর সাহায্যের আহ্বানের সুযোগ গ্রহণ করি–

পোজো : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : ওকে সাহায্য করলে–

এস্ট্রাগন : আমরা সাহায্য করব ওকে?

ভ্লাডিমির : কিছু সুস্পষ্ট প্রতিদানের প্রত্যাশায়।

এস্ট্রাগন : আর সে যদি–

ভ্লাডিমির : আঃ, বাজে তর্কে সময় নষ্ট করে কাজ নেই! [চুপচাপ তীব্র কণ্ঠে] চলো, সুযোগ থাকতে একটা কিছু করি! এমন তো নয় যে রোজ আমাদের দরকার পড়ে। অবশ্য এখনো ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দরকার পড়েনি। অন্যদের দিয়েও সমানভাবে এই প্রয়োজন মিটতে পারত, হয়ত আমাদের চাইতে ভালোভাবেই। সাহায্যের জন্য ওই আবেদন, যা আমাদের কানে তীব্রভাবে এখনো বাজছে, তা সমস্ত মানবজাতির উদ্দেশে উচ্চারিত। কিন্তু এই স্থানে মহাকালের এই মূহূর্তে আমরাই সমগ্র মানবজাতি। আমরা তাই চাই বা না চাই। দেরি হয়ে যাবার আগে, চলো, এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করি আমরা! নিষ্ঠুর নিয়তি আমাদের যে ক্লেদাক্ত প্রাণীতে পরিণত করেছে, এসো, অন্তত একবারের মতো হলেও তার মহৎ রূপটি আমরা প্রদর্শন করি। কী বলো তুমি? [এস্ট্রাগন কিছু বলে না] অবশ্য এ কথা সত্য যে বুকের উপর দু-হাত ন্যস্ত করে আমরা যখন কোনো বিষয়ের গুণাগুণ বিচার করি তখনো আমরা আমাদের প্রজাতি সম্পর্কে কম গৌরবের নিদর্শন দিই না। বাঘ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে তার স্বজাতির সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, নয়ত সংগোপনে অরণ্যের গভীরে পালিয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন তা নয়। আমরা এখানে কী করছি সেইটেই প্রশ্ন। এবং আমাদের সৌভাগ্য এইখানে যে উত্তরটা আমাদের জানা। হ্যাঁ, এই বিশাল অনিশ্চয়তার মধ্যে একটি জিনিসই সুস্পষ্ট। আমরা অপেক্ষা করে আছি গডো আসবেন–

এস্ট্রাগন : আহ্‌!

এস্ট্রাগন : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : অথবা রাত্রি নামবে। [একটু চুপ করে থাকে] আমরা আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করেছি, ব্যস, এই পর্যন্ত। আমরা সেইন্ট নই, কিন্তু আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আমরা রক্ষা করেছি। কজন লোক এইটুকু বলতে পারে বলো?

এস্ট্রাগন : লক্ষ কোটি?

ভ্লাডিমির : তাই মনে হয় তোমার?

এস্ট্রাগন : আমি জানি না।

ভ্লাডিমির : তোমার কথা ঠিক হতেও পারে।

এস্ট্রাগন : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : আমি শুধু এইটুকু জানি যে এই পরিস্থিতিতে সময় বড়ো দীর্ঘ মনে হয় এবং ফাঁকি দিয়ে সময়টা কাটিয়ে দেবার জন্য আমাদের এমন সব কাণ্ডকারখানা করতে হয় যা প্রথম দৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হলেও পরে শুধুই গতানুগতিক অভ্যাসে পরিণত হয়। তুমি বলতে পারো যে আমাদের যুক্তি যেন দিশেহারা না হয় তাই এই ব্যবস্থা। নিঃসন্দেহে। কিন্তু তা কি ইতিমধ্যে রাত্রির সীমাহীন অতল গহ্বরে দীর্ঘকাল ধরে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়নি? আমি মাঝে মাঝে সে কথাই ভাবি। তুমি আমার যুক্তি অনুসরণ করতে পারছ?

এস্ট্রাগন : [একবারের মতো অন্তত অতিসংক্ষিপ্ত আপ্ত বাক্যের ঢঙে] আমরা সবাই ভূমিষ্ঠ হই উন্মাদরূপে। কেউ কেউ তাই থেকে যাই।

পোজো : বাঁচাও! অর্থ দেব তোমাদের!

এস্ট্রাগন : কত?

পোজো : এক শ ফ্রাঙ্ক!

এস্ট্রাগন : উঁহু, যথেষ্ট নয়।

ভ্লাডিমির : আমি অতটা বলব না।

এস্ট্রাগন : তুমি ওটাই যথেষ্ট মনে করো?

ভ্লাডিমির : না, যখন এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হই তখনই আমার মগজে কিছু ঘাটতি ছিল আমি জোর দিয়ে অতটা বলতে রাজি নই। কিন্তু প্রশ্ন তা নয়।

পোজা : দু শ!

ভ্লাডিমির : আমরা অপেক্ষা করি। আমরা বোরড হই। [দু হাত তুলে] না, প্রতিবাদ কোরো না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে উই আর বোরড টু ডেথ। উত্তম। মনটা বিক্ষিপ্ত করার মতো কিছু একটার সাক্ষাৎ পেলাম আমরা আর তখন কী করি? সুযোগটা হেলায় হারাই। এসো! কাজে লেগে যাই! [স্তূপের দিকে এগিয়ে যায়, চলতে গিয়ে থেমে পড়ে] দেখতে দেখতে সবকিছু অপসৃত হবে, আর তখন আবার আমরা নিঃসঙ্গ পড়ে থাকব নীরঞ্জ শূন্যতার মধ্যে।

[চিন্তামগ্ন]

পোজো : দু শ!

ভ্লাডিমির : আমরা আসছি।

[পোজোকে টেনে তোলার চেষ্টা করে, পারে না, আবার চেষ্টা করে, হোঁচট খায়, নিজে পড়ে যায়, উঠতে চেষ্টা করে, পারে না]

এস্ট্রাগন : কী হল তোমাদের সবার?

ভ্লাডিমির : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : আমি চললাম।

ভ্লাডিমির : আমাকে ফেলে যেও না! ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।

পোজো : আমি কোথায়?

ভ্লাডিমির : গোগো!

পোজো : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : চললাম।

ভ্লাডিমির : আগে আমাকে ধরে তোলো। তারপর দুজনেই একসঙ্গে যাব।

এস্ট্রাগন : কথা দিচ্ছ?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি।

এস্ট্রাগন : আর আমরা কখনো ফিরে আসব না?

ভ্লাডিমির : আর কখনো না।

এস্ট্রাগন : আমরা পিরিনিসে চলে যাব।

ভ্লাডিমির : যেখানে তুমি যেতে চাও।

এস্ট্রাগন : আমি চিরটা কাল পিরিনিসে ঘুরে বেড়াতে চেয়েছি।

ভ্লাডিমির : সেখানেই তুমি ঘুরে বেড়াবে।

এস্ট্রাগন : [বিতৃষ্ণায় সিঁটিয়ে গিয়ে] কে পাদ দিল?

ভ্লাডিমির : পোজো।

পোজো : এইখানে! এইখানে! দয়া করো!

এস্ট্রাগন : ন্যক্কারজনক!

ভ্লাডিমির : জলদি করো! দাও, তোমার হাত দাও।

এস্ট্রাগন : আমি চললাম। [একটু চুপ করে থাকে। তারপর আরেকটু উচ্চ কণ্ঠে] আমি চললাম।

ভ্লাডিমির : বেশ। মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত নিজের চেষ্টাতেই আমি উঠে দাঁড়াব। চেষ্টা করে, পারে না] কাল পূর্ণ হলেই। ইন দি ফুলনেস অব টাইম।

এস্ট্রাগন : কী হলো তোমার?

ভ্লাডিমির : জাহান্নামে যাও।

এস্ট্রাগন : তুমি কি ওখানেই থাকছ নাকি?

ভ্লাডিমির : আপাতত।

এস্ট্রাগন : চলো, চলো, উঠে পড়ো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে।

ভ্লাডিমির : আমার জন্য ভেবো না।

এস্ট্রাগন : চলো, ডিডি, গোঁয়ার্তুমি কোরো না।

[হাত বাড়িয়ে দেয়, ভ্লাডিমির ক্ষিপ্র তৎপরতায় হাত আঁকড়ে ধরে]

ভ্লাডিমির : টানো এবার।

[এস্ট্রাগন টানে, হোঁচট খায়, নিজেই পড়ে যায়। দীর্ঘ নীরবতা]

পোজো : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : আমরা পৌঁছে গেছি।

পোজো : তোমরা কে?

ভ্লাডিমির : আমরা মানুষ।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : মধুরা মা ধরিত্রী!

ভ্লাডিমির : তুমি উঠতে পারবে?

এস্ট্রাগন : জানি না।

ভ্লাডিমির : চেষ্টা করে দেখো।

এস্ট্রাগন : এখন না, এখন না।

[নীরবতা]

পোজো : কী হয়েছে?

ভ্লাডিমির : [তীব্র কণ্ঠে] এই, এই, চুপ করবে তুমি! জঞ্জাল কোথাকার! নিজের কথা ছাড়া আর কোনো চিন্তা নেই ওর।

এস্ট্রাগন : একটু চোখ বুজলে কেমন হয়?

ভ্লাডিমির : কথা শুনলে ওর? কী হয়েছে সেটা জানতে চান উনি।

এস্ট্রাগন : ওর কথা বাদ দাও। ঘুমাও।

[নীরবতা]

পোজো : দয়া করো! দয়া করো!

এস্ট্রাগন : [চমকে উঠে] কী হল?

ভ্লাডিমির : তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?

এস্ট্রাগন : তাই তো মনে হচ্ছে।

ভ্লাডিমির : এই হারামজাদা পোজোটা আবার শুরু করেছে।

এস্ট্রাগন : বন্ধ করাও যে করে পারো। বীচিতে লাথি মারো।

ভ্লাডিমির : [পোজোকে আঘাত করে] বন্ধ করবি? ছুঁচোর বাচ্চা।

[পোজো ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে, ওর হাত ছাড়িয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে দূরে সরে যায়, থামে, অন্ধের মতো বাতাসে হাত ছেড়ে, সাহায্যের জন্য চিৎকার করে। ভ্লাডিমির কনুইর ওপর ভর দিয়ে পোজোর পলায়ন দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে] গেছে! [পোজো লুটিয়ে পড়ে] পড়ে গেছে!

এস্ট্রাগন : এখন কী করব আমরা?

ভ্লাডিমির : হামাগুড়ি দিতে দিতে আমি বোধহয় ওর কাছে পৌঁছাতে পারব।

এস্ট্রাগন : আমাকে ছেড়ে যেও না তুমি!

ভ্লাডিমির : ওকে ডাকতেও পারি।

এস্ট্রাগন : তাই ডাকো।

ভ্লাডিমির : পোজো! নীরবতা পোজো! [নীরবতা] কোনো জবাব নেই।

এস্ট্রাগন : দুজনে।

এস্ট্রাগন ও ভ্লাডিমির : পোজো! পোজো!

ভ্লাডিমির : নড়ে উঠেছে।

এস্ট্রাগন : তুমি ঠিক জানো ওর নাম পোজো?

ভ্লাডিমির : [আতঙ্কিত] মি. পোজো! ফিরে আসুন। আমরা মারব না আপনাকে!

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : অন্য নামে ডেকে দেখলে পারি।

ভ্লাডিমির : আমার মনে হয় মরে যাচ্ছে।

এস্ট্রাগন : সে বেশ মজাই হবে।

ভ্লাডিমির : কী বেশ মজাই হবে?

এস্ট্রাগন : ভিন্ন ভিন্ন নামে ওকে ডেকে দেখলে। সময়টা কেটে যেত। তা ছাড়া একসময় না একসময় ঠিক নামটা লেগে যেতে বাধ্য।

ভ্লাডিমির : আমি তোমাকে বলছি ওর নাম পোজো।

এস্ট্রাগন : এখনই দেখা যাবে। চিন্তা করে হাবিল! হাবিল!

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : প্রথমবারেই লেগে গেছে।

ভ্লাডিমির : নাঃ, আমি ক্লান্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছি।

এস্ট্রাগন : বোধহয় অন্যটার নাম কাবিল। কাবিল! কাবিল!

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : সমস্ত মানবতা ও। [নীরবতা] ওই ছোট্ট মেঘের টুকরোটার দিকে দেখো।

ভ্লাডিমির : চোখ তুলে কোথায়?

এস্ট্রাগন : ওইখানে। একেবারে উপর দিকে।

ভ্লাডিমির : আচ্ছা? [চুপচাপ] ওর মধ্যে এমন কী সাংঘাতিক বিস্ময়কর দেখলে? [নীরবতা]

এস্ট্রাগন : চলো, অন্য কিছু নেয়া যাক। আপত্তি আছে?

ভ্লাডিমির : আমিও সে কথাই বলতে যাচ্ছিলাম।

এস্ট্রাগন : কিন্তু কী নেব?

ভ্লাডিমির : আহ!,

এস্ট্রাগন : প্রথমে উঠে দাঁড়ানো যাক তো।

ভ্লাডিমির : চেষ্টা করে দেখতে দোষ নেই।

[ওরা উঠে দাঁড়ায়]

এস্ট্রাগন : ছেলেখেলা।

ভ্লাডিমির : স্রেফ ইচ্ছাশক্তির প্রশ্ন।

এস্ট্রাগন : এবার?

পোজো : বাঁচাও!

এস্ট্রাগন : চলো, যাওয়া যাক।

ভ্লাডিমির : যেতে আমরা পারি না।

এস্ট্রাগন : কেন পারি না?

ভ্লাডিমির : আমরা গডোর জন্য অপেক্ষা করছি।

এস্ট্রাগন : আহ্ হতাশার সঙ্গে কী করব, কী করব আমরা!

পোজো : বাঁচাও!

ভ্লাডিমির : ওকে সাহায্য করলে কেমন হয়?

এস্ট্রাগন : ও কী চায়?

ভ্লাডিমির : উঠতে চায়?

এস্ট্রাগন : তবে উঠছে না কেন?

ভ্লাডিমির : ও চায় আমরা যেন ওকে উঠতে সাহায্য করি।

এস্ট্রাগন : তাহলে আমরা করছি না কেন? দাঁড়িয়ে আছি কী জন্য?

[ওরা পোজোকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে, ওর বাহু ছেড়ে দেয়, ও পড়ে যায়]

ভ্লাডিমির : ওকে আমাদের ধরে থাকতে হবে।

[ওরা আবার ওকে ধরে তোলে। পোজোর শরীর ভেঙে পড়ে, ওদের ঘাড়ের উপর দিয়ে তার দু হাত প্রসারিত] একটু ভালো বোধ করছ?

পোজো : তোমরা কে?

এস্ট্রাগন : তুমি আমাদের চিনতে পারছ না?

ভ্লাডিমির : আমি অন্ধ।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : বোধহয় ও ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।

ভ্লাডিমির : কবে থেকে?

পোজো : কী চমৎকার দৃষ্টিশক্তি ছিল আমার–কিন্তু তোমরা কি বন্ধু?

এস্ট্রাগন : শিব্দ করে হেসে ওঠে। উনি জানতে চাইছেন আমরা বন্ধু কি না!

ভ্লাডিমির : না, উনি জানতে চান ওর বন্ধু কি না।

এস্ট্রাগন : তুমি কী বলো?

ভ্লাডিমির : ওকে সাহায্য করে আমরা তার প্রমাণ দিয়েছি।

এস্ট্রাগন : ঠিক। ওর বন্ধু না হলে কি আমরা ওকে সাহায্য করতাম?

ভ্লাডিমির : সম্ভবত।

এস্ট্রাগন : সত্য।

ভ্লাডিমির : এখন এ নিয়ে আর সূক্ষ্ম বিতর্কে গিয়ে কাজ নেই।

পোজো : তোমরা ডাকাত নও তো?

এস্ট্রাগন : ডাকাত? আমাদের কি ডাকাতের মতো দেখায়?

ভ্লাডিমির : ড্যাম ইট, দেখতে পাও না লোকটা অন্ধ!

এস্ট্রাগন : ড্যাম ইট, তাই তো? একটু থামে] ও তাই বলছে বটে।

পোজো : আমাকে ছেড়ে যেও না!

ভ্লাডিমির : সে প্রশ্নই ওঠে না।

এস্ট্রাগন : আপাতত।

পোজো : কটা বেজেছে এখন?

ভ্লাডিমির : [আকাশ পর্যবেক্ষণ করে] সাতটা…আটটা…

এস্ট্রাগন : এখন বছরের কোন সময় সেটা তার উপর নির্ভর করে।

পোজো : এখন কি বিকেল?

[নীরবতা। ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন : খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সূর্যাস্ত দেখে]

এস্ট্রাগন : উঠছে।

ডিমির : অসম্ভব।

এস্ট্রাগন : বোধহয় ঊষালগ্ন।

ভ্লাডিমির : বুন্ধুর মতো কোরো না। ওদিকটা তো পশ্চিম।

এস্ট্রাগন : কেমন করে জানলে?

পোজো : [বেদনার্ত] এখন কি বিকেল?

ভ্লাডিমির : যাই হোক, ওটা নড়েনি।

এস্ট্রাগন : আমি বলছি ওটা উঠছে।

পোজো : তোমরা আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?

এস্ট্রাগন : সুযোগ তো দাও।

ভ্লাডিমির : [আশ্বস্ত করার সুরে] এখন বিকেল, হুজুর, বিকেল। রাত্রি সন্নিকট। আমার এই বন্ধু আমাকে সে সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলতে চেয়েছিল এবং স্বীকার করি, মুহূর্তের জন্য আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি খামোখাই এই দীর্ঘকাল পার হয়ে আসিনি, এবং আপনাকে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে জানাচ্ছি যে খেলা প্রায় খতম হয়ে এসেছে। [একটু থামে] এখন কেমন লাগছে?

এস্ট্রাগন : আর কতক্ষণ আমাদের ওকে এইভাবে বয়ে বেড়াতে হবে? [প্রায় ছেড়ে দেয় তাকে, পড়ার উপক্রম হতেই আবার ধরে ফেলে] আমরা কারইয়াটিড না!

ভ্লাডিমির : যদি ঠিক শুনে থাকি তাহলে তুমি বলছিলে যে এককালে তোমার দৃষ্টিশক্তি খুব ভালো ছিল।

পোজো : চমৎকার! চমৎকার, চমৎকার! দৃষ্টিশক্তি!

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : বিরক্ত কণ্ঠে বিশদ কর! বিশদ কর!

ভ্লাডিমির : ওকে জ্বালিও না। দেখছ না ও পুরনো সুখের দিনের কথা ভাবছে? একটু থামে মেমোরিয়া প্রিটেরিটোরাম বোনোরাম–সে নিশ্চয়ই খুব বিচ্ছিরি হবে।

এস্ট্রাগন : আমাদের জানার কথা নয়।

ভ্লাডিমির : আর অকস্মাৎ তোমার উপর এই দুর্যোগ নেমে এল?

পোজো : সত্যি চমৎকার।

ভ্লাডিমির : আমি জিজ্ঞেস করছি ঘটনাটা অকস্মাৎ ঘটেছিল কি না।

পোজো : এক সুপ্রভাতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে আমি দেখলাম আমি ভাগ্যদেবীর মতো অন্ধ হয়ে গেছি! [একটু চুপ করে থাকে] মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় আমি কি এখনো ঘুমিয়ে আছি।

ভ্লাডিমির : কখন ঘটেছিল ব্যাপারটা?

পোজো : জানি না।

ওয়েটিং ফর গডো

ভ্লাডিমির : কিন্তু গতকালকের আগে নয়–

পোজো : জিজ্ঞেস কোরো না আমাকে! অন্ধের কোনো সময়জ্ঞান নেই। সময়ের ঘটনাবলিও তার কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন থাকে।

ভ্লাডিমির : কী কাণ্ড! আমি খুব ভাবতাম যে তার উল্টোটাই বুঝি সত্যি।

এস্ট্রাগন : আমি চললাম।

পোজো : আমরা কোথায়?

ভ্লাডিমির : বলতে পারব না।

এস্ট্রাগন : বোর্ড নামে যে জায়গাটা পরিচিত এটা কোনোক্রমে সেটা নয়ত?

ভ্লাডিমির : তার নামও শুনিনি কোনো দিন।

পোজো : জায়গাটা দেখতে কেমন?

ভ্লাডিমির : [চারদিকে দেখে] অবর্ণনীয়। ইটস লাইক নাথিং। কোথাও কিচ্ছু নেই। একটা গাছ আছে।

পোজো : তাহলে বোর্ড নয়।

এস্ট্রাগন : [ক্লান্ত, ভেঙে পড়ে] ডাইভার্সান বটে!

পোজো : আমার চাকরটা কোথায়?

ভ্লাডিমির : আছে কাছেপিঠে কোথাও।

পোজো : ডাকলে সাড়া দেয় না কেন?

ভ্লাডিমির : জানি না। মনে হয় ঘুমুচ্ছে। হয়ত মরে গেছে।

পোজো : ঠিক ঘটেছিলটা কী?

এস্ট্রাগন : একদম ঠিক ঠিক!

ভ্লাডিমির : তোমাদের দুজনের পা হড়কে গিয়েছিল। [একটু থামে] তারপর পড়ে গিয়েছিলে।

পোজো : যাও, ও ব্যথা পেয়েছে কি না দেখো।

ভ্লাডিমির : তোমাকে ফেলে রেখে আমরা যেতে পারি না।

পোজো : তোমাদের দুজনের যাবার দরকার নেই।

এস্ট্রাগন : [এস্ট্রাগনের উদ্দেশ্যে] তুমি যাও।

এস্ট্রাগন : আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তারপরে? কক্ষনো না।

পোজো : হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার বন্ধু যাক। যা গন্ধ ওর গায়ে। [নীরবতা] অপেক্ষা করছ কী জন্য?

ভ্লাডিমির : অপেক্ষা করছ কী জন্য?

এস্ট্রাগন : আমি গডোর জন্য অপেক্ষা করছি।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : ঠিক কী করতে হবে ওকে?

পোজো : ইয়ে, প্রথমে দড়িটা ধরে টানতে হবে, যত জোরে ওর খুশি, শুধু দেখতে হবে যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে না যায়। তাতে কাজ না হলে লাথি মারতে থাকবে, মুখে, অণ্ডকোষে।

ভ্লাডিমির : [এস্ট্রাগনের উদ্দেশে] দেখছ, তোমার ভয়ের কিছুই নেই। বরং প্রতিশোধ নেবার একটা সুযোগ পাচ্ছ তুমি।

এস্ট্রাগন : আর ও যদি আত্মরক্ষা করতে শুরু করে?

পোজো : না, না, ও কখনো আত্মরক্ষার চেষ্টা করে না।

ভ্লাডিমির : আমি ছুটে যাব তোমার সাহায্যে।

এস্ট্রাগন : এক মুহূর্তের জন্যও আমার উপর থেকে তোমার চোখ সরিও না।

[লাকির দিকে এগিয়ে যায়]

ভ্লাডিমির : আগে ভালো করে দেখে নিও বেঁচে আছে কি না। মরে গিয়ে থাকলে খামোখা তোমার কষ্ট করার কোনো মানে নেই।

এস্ট্রাগন : [লাকির উপর নিচু হয়ে ঝুঁকে] নিশ্বাস পড়ছে।

ভ্লাডিমির : তাহলে লাগাও।

[হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে এস্ট্রাগন লাকিকে লাথি মারতে শুরু করে, সঙ্গে প্রচণ্ড গালাগাল। কিন্তু নিজের পায়েই ব্যথা পেয়ে গোঙাতে আরম্ভ করে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে সরে আসে লাকির কাছ থেকে। লাকি নড়ে ওঠে]

এস্ট্রাগন : ব্যাটা জানোয়ার কাঁহাকা!

[টিবির উপর বসে, জুতো খুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু একটু পরেই সে চেষ্টা বাদ দিয়ে হাঁটুতে বাহু ন্যস্ত করে তার উপর মাথা গুঁজে ঘুমোবার আয়োজন করে]

পোজো : আবার কী হল?

ভ্লাডিমির : আমার বন্ধুর চোট লেগেছে।

পোজো : আর লাকি?

ভ্লাডিমির : তাহলে সে-ই?

পোজো : কী?

ভ্লাডিমির : তাহলে সে-ই?

পোজো : কী?

ভ্লাডিমির : ও লাকি?

পোজো : কী বলছ বুঝতে পারছি না।

ভ্লাডিমির : আর তুমি পোজো।

পোজো : অবশ্যই আমি পোজো।

ভ্লাডিমির : কালকের সেই লোক?

পোজা : কালকের?

ভ্লাডিমির : কাল আমাদের দেখা হয়েছিল। [একটু চুপ করে থাকে] তোমার মনে নেই?

পোজো : গতকাল কারু সঙ্গে দেখা হবার কথা আমার মনে নেই। কিন্তু

আজ যে কারু সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে এ কথাও আগামী কাল আমার মনে থাকবে না। কাজেই এ ব্যাপারে আমার কাছ থেকে কিছু জানার আশা কোরো না।

ভ্লাডিমির : কিন্তু…

পোজো : যথেষ্ট হয়েছে। ওঠ শুয়ার!

ভ্লাডিমির : তুমি মেলাতে ওকে বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলে। আমাদের সঙ্গে কথা বলেছ তুমি। ও নেচেছিল, চিন্তা করেছিল। তোমার দৃষ্টিশক্তি ছিল।

পোজো : বেশ। এবার যেতে দাও। [ভ্লাডিমির সরে যায়]

[লাকি উঠে দাঁড়ায়, মালপত্র তুলে নেয়]

ভ্লাডিমির : এখন কোথায় যাবে?

পোজো : চলো। [লাকি মালপত্রসহ পোজোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়] চাবুক! [লাকি সব জিনিসপত্র নামিয়ে রাখে, চাবুক খোঁজে, পায়, পোজোর হাতে দেয়, আবার সব জিনিসপত্র তুলে নেয়] দড়ি! [লাকি সব জিনিসপত্র নামিয়ে রাখে, দড়ির প্রান্ত পোজোর হাতে দেয়, সব জিনিসপত্র আবার তুলে নেয়]

ভ্লাডিমির : ওই ব্যাগের মধ্যে কী আছে?

পোজো : বালি। [দড়ি ধরে টানে] চল।

ভ্লাডিমির : আরেকটু থাকো!

পোজো : আমি চললাম।

ভ্লাডিমির : কাছেপিঠে সাহায্য করার মতো কেউ নেই এমন জায়গায় যখন পড়ে যাও তখন কী করো?

পোজো : উঠতে না পারা পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকি। তারপর আবার চলতে শুরু করি। চল।

ভ্লাডিমির : যাবার আগে ওকে একটা গান গাইতে বলো।

পোজো : কাকে?

ভ্লাডিমির : লাকিকে।

পোজো : গান গাইতে?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ। কিংবা চিন্তা করতে। কিংবা আবৃত্তি করতে।

পোজো : কিন্তু ও তো বোবা।

ভ্লাডিমির : বোবা!

পোজো : বোবা। গোঙাতে পর্যন্ত পারে না ও।

ভ্লাডিমির : বোবা। কখন থেকে?

পোজো : [হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে] তোমার এই অভিশপ্ত সময়ের কথা বলে তুমি আর কত যন্ত্রণা দেবে আমাকে! অসহ্য! কখন! কখন! একদিন, তাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়, যেকোনো দিনের মতো একদিন, একদিন আমরা বধির হয়ে যাব, একদিন আমরা জন্মগ্রহণ করেছিলাম, একদিন আমরা মরব, সেই একই দিন, একই ক্ষণ, তাই কি যথেষ্ট নয় তোমার জন্য? [অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে] কবরের উপরে তারা জন্ম দেয়, মুহূর্তের জন্য আলো ঝলমল করে, তারপর আবার রাত্রি। [দড়িতে টান দেয়] চল।

[পোজো এবং লাকির প্রস্থান। ভ্লাডিমির মঞ্চের প্রান্ত পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করে, তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। পতনের শব্দ এবং ভ্লাডিমিরের অঙ্গভঙ্গি থেকে বোঝা যায় আবার ওরা পড়ে গেছে। নীরবতা। ভ্লাডিমির এস্ট্রাগনের দিকে এগিয়ে যায়, এক মুহূর্ত তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখে, তারপর তাকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দেয়]

এস্ট্রাগন : [উদভ্রান্তের মতো হাত-পা ছোঁড়ে, অসম্বদ্ধ শব্দাবলি উচ্চারণ করে। অবশেষে] কেন তুমি কখনো আমাকে ঘুমাতে দাও না?

ভ্লাডিমির : বড্ড একা একা লাগছিল আমার।

এস্ট্রাগন : আমি স্বপ্ন দেখছিলাম আমি সুখী।

ভ্লাডিমির : ওতে কিছুটা সময় কাটল।

এস্ট্রাগন : স্বপ্ন দেখলাম–

ভ্লাডিমির : তীব্র কণ্ঠে বলো না! [নীরবতা] আমি ভাবছি ও কি সত্যিই অন্ধ।

এস্ট্রাগন : অন্ধ? কে?

ভ্লাডিমির : পোজো।

এস্ট্রাগন : অন্ধ?

ডিমির : বলল তো অন্ধ।

এস্ট্রাগন : তাতে হলটা কী?

ভ্লাডিমির : আমার মনে হচ্ছে ও দেখতে পাচ্ছিল।

এস্ট্রাগন : স্বপ্ন দেখছ তুমি। [একটু থামে] চলো, যাওয়া যাক। না, যেতে আমরা পারি না। আহ্! [একটু থামে] তুমি কি জানো যে ওটা উনি ছিলেন না?

ভ্লাডিমির : কে?

এস্ট্রাগন : গডো।

ভ্লাডিমির : কিন্তু কে?

এস্ট্রাগন : পোজা।

ভ্লাডিমির : অসম্ভব। [একটু কম নিশ্চিত] অসম্ভব। [আরো কম নিশ্চিত] অসম্ভব।

এস্ট্রাগন : এখন বোধহয় উঠতে পারি। [কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়ায়] আউ! ডিডি!

ভ্লাডিমির : আর আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

এস্ট্রাগন : আমার পা! [বসে পড়ে, পা থেকে জুতো খোলার চেষ্টা করে] আমাকে একটু সাহায্য করো!

ভ্লাডিমির : অন্যরা যখন কষ্ট পাচ্ছিল আমি কি তখন ঘুমাচ্ছিলাম? আমি কি এখনো ঘুমন্ত? কাল যখন আমি জেগে উঠব, কিংবা ভাবব জেগে উঠেছি, তখন আজকের কথা কী বলব? যে বন্ধুবর এস্ট্রাগনের সঙ্গে এইখানে, রাত নেমে না আসা পর্যন্ত, আমি গডোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম? যে, পোজো তার বাহককে নিয়ে এই পথে গিয়েছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে? হয়ত। কিন্তু ওইসবের মধ্যে কতটুকু সত্য থাকবে?

[এস্ট্রাগন জুতো খোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আবার তন্দ্রায় দুলে পড়ে। ভ্লাডিমির তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে]

ও কিছু জানবে না। কী রকম পিটুনি খেয়েছে সেই কথা বলবে আমাকে, আর আমি তাকে গাজর দেব। [একটু থামে] কবরের উপরে, আর কঠিন জন্ম। গর্তের মধ্যে, ধীরেসুস্থে, গোরখোদক ছুরি ধরে। সময় আছে আমাদের বুড়ো হবার। সারা আকাশ আমাদের ক্রন্দনে পূর্ণ। [কান পেতে শোনে] কিন্তু সময় সবকিছুকে অসাড় করে দেয়। [আবার এস্ট্রাগনের দিকে তাকায়] আমার দিকেও একজন কেউ তাকাচ্ছে, আমার সম্পর্কেও একজন কেউ বলছে, ও ঘুমাচ্ছে, ও কিছুই জানে না, ঘুমাক ও। [একটু থামে] আর আমি পারি না! [একটু চুপ করে থাকে] কী বলেছি আমি? [উদ্ভান্তের মতো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে, তারপর একেবারে বাঁ ধারে এসে দাঁড়ায়, চিন্তা করে। ডান দিক দিয়ে বালকের প্রবেশ। দাঁড়িয়ে পড়ে। নীরবতা]

বালক : মিস্টার… ভ্লাডিমির : ঘুরে দাঁড়ায়] মিস্টার এলবার্ট…

ভ্লাডিমির : আবার শুরু হল। [একটু চুপ করে থাকে] তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?

বালক : না, স্যার।

ভ্লাডিমির : গতকাল তুমি আসোনি?

[নীরবতা]

বালক: না, স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : এই তোমার প্রথমবার?

বালক : হ্যাঁ, স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : মিস্টার গডোর কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছ?

বালক : হ্যাঁ, স্যার।

ভ্লাডিমির : তিনি আজ বিকেলে আসবেন না?

বালক : না, স্যার।

ভ্লাডিমির : কিন্তু কাল আসবেন।

বালক : হ্যাঁ, স্যার।

ভ্লাডিমির : অতি অবশ্য?

বালক : হ্যাঁ, স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : আর কারু সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?

বালক : না, স্যার।

ভ্লাডিমির : দুজন…[ইতস্তত করে] মানুষের সঙ্গে?

বালক : আমি কাউকে দেখিনি, স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : তিনি কী করেন? মি, গডো? নীরবতা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

বালক : হ্যাঁ, স্যার।

ভ্লাডিমির : তবে?

বালক : তিনি কিছুই করেন না, স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : তোমার ভাই কেমন আছে?

এস্ট্রাগন : অসুস্থ, স্যার।

ভ্লাডিমির : কাল বোধহয় সে-ই এসেছিল।

বালক : জানি না স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : [নিচু গলায়] তার কি দাড়ি আছে? মি. গডোর?

বালক : হ্যাঁ, স্যার।

ভ্লাডিমির : সাদা, না…[ইতস্তত করে] না কালো?

বালক : আমার মনে হয় সাদা, স্যার।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : আমাদের দয়া করো যিশু!

[নীরবতা]

বালক : মিস্টার গডোকে কী বলব, স্যার?

ভ্লাডিমির : তাঁকে বোলো….[ইতস্তত করে] তাঁকে বোলো যে তুমি আমার সাক্ষাৎ পেয়েছ, আর….[ইতস্তত করে]…আর তুমি আমার সাক্ষাৎ পেয়েছ। [চুপ করে থাকে একটুক্ষণ। ভ্লাডিমির এগিয়ে আসে, বালকটি পিছিয়ে যায়। ভ্লাডিমির দাঁড়ায়, বালকটি দাঁড়ায়। হঠাৎ ভীষণ তীব্র কণ্ঠে] তুমি ঠিক জানো যে তুমি আমাকে দেখেছ কাল? আবার এসে বলবে না যে তুমি আমাকে কোনো দিন দেখোনি! [নীরবতা ভ্লাডিমির হঠাৎ লাফ দিয়ে এগিয়ে আসে, বালকটি তাকে এড়িয়ে দৌড়ে মঞ্চ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়। নীরবতা। সূর্য ডোবে, চাঁদ ওঠে। প্রথম অঙ্কের অনুরূপ। ভ্লাডিমির মাথা নিচু করে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এস্ট্রাগন জেগে ওঠে, জুতোজোড়া খুলে ফেলে, দু-হাতে দু-পাটি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সামনে এগিয়ে আসে, ঠিক মাঝখানে জুতো দুটি নামিয়ে রাখে, তারপর ভ্লাডিমিরের দিকে এগিয়ে যায়]

এস্ট্রাগন : কী হয়েছে তোমার?

ভ্লাডিমির : কিছু না।

এস্ট্রাগন : আমি চললাম।

ভ্লাডিমির : আমিও।

এস্ট্রাগন : আমি কি অনেকক্ষণ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি?

ভ্লাডিমির : জানি না।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : কোথায় যাব আমরা?

ভ্লাডিমির : বেশি দূরে না।

এস্ট্রাগন : ওঃ হ্যাঁ, চলো, এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাই।

ভ্লাডিমির : তা আমরা পারি না।

এস্ট্রাগন : না কেন?

ভ্লাডিমির : কাল আমাদের এইখানে ফিরে আসতে হবে।

এস্ট্রাগন : কী জন্যে?

ভ্লাডিমির : গডোর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

এস্ট্রাগন : আহ্‌। [নীরবতা] উনি আসেননি?

ভ্লাডিমির : না।

এস্ট্রাগন : এবং এখন আর সময় নেই?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ, এখন রাত।

এস্ট্রাগন : আর আমরা যদি তাকে ছেড়ে দিই? [একটু থামে] তাঁকে যদি আমরা ছেড়ে দিই?

ভ্লাডিমির : তিনি আমাদের শাস্তি দেবেন। [নীরবতা। সে গা দিকে তাকায়] সবকিছু মৃত, শুধু গাছটি ছাড়া।

এস্ট্রাগন : [গাছটার দিকে তাকিয়ে] কী ওটা?

ভ্লাডিমির : গাছ।

এস্ট্রাগন : হ্যাঁ, কিন্তু কী জাতের?

ভ্লাডিমির : জানি না। উইলো।

[এস্ট্রাগন : ভ্লাডিমিয়কে গাছটার দিকে টেনে নিয়ে যায়। ওরা দুজন তার সামনে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নীরবতা]

এস্ট্রাগন : আমরা গলায় ফাঁস লাগিয়ে স্কুলে পড়ি না কেন?

ভ্লাডিমির : কী দিয়ে?

এস্ট্রাগন : তোমার কাছে একটু দড়ি নেই?

ভ্লাডিমির : না।

এস্ট্রাগন : তবে হল না।

[নীরবতা]

ভ্লাডিমির : চলো যাই।

এস্ট্রাগন : দাঁড়াও, আমার বেল্ট।

ভ্লাডিমির : খাটো হবে।

এস্ট্রাগন : তুমি আমার পা ধরে ঝুলে পড়তে পারো।

ভ্লাডিমির : আর আমার পা ধরে কে ঝুলবে?

এস্ট্রাগন : ঠিক।

ভ্লাডিমির : তবু দেখাও। [যে দড়ি দিয়ে তার প্যান্ট বাঁধা এস্ট্রাগন তা ঢিলা করে। অতিরিক্ত ঢোলা প্যান্টটি হড়হড় করে পায়ের গোড়ালি অবধি নেমে আসে। ওরা দড়িটার দিকে তাকায়] কোনো রকমে কাজ চলতে পারে। কি যথেষ্ট মজবুত তো?

এস্ট্রাগন : এখনই দেখা যাবে। ধরো।

[দুজনে দড়ির দু-ত ধরে টানে। দড়িটা ছিঁড়ে যায়। ওরা প্রায় প্রপাতধরণীতল]

ভ্লাডিমির : নট ওয়ার্থ এ কার্স।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : তুমি বলছ কাল আবার এখানে ফিরে আসতে হবে?

ভ্লাডিমির : হ্যাঁ।

এস্ট্রাগন : তখন একটা ভালো দড়ি দিয়ে নিয়ে আসা যাবে।

ভ্লাডিমির হ্যাঁ।

[নীরবতা]

এস্ট্রাগন : ভিডি।

ভ্লাডিমির : হুঁ।

এস্ট্রাগন : আর আমি পারছি না।

ভ্লাডিমির : তুমি ভাবছ তাই।

এস্ট্রাগন : যদি আলাদা হয়ে যাই আমরা? তাহলে বোধহয় আমাদের দুজনের পক্ষেই ভালো হত।

ভ্লাডিমির : কাল আমরা গলায় ফাঁস দেব। এিকটুক্ষণ চুপ করে থাকে। যদি গডো না আসেন।

এস্ট্রাগন : আর যদি আসেন?

ভ্লাডিমির : তাহলে আমরা রক্ষা পাব। [ভ্লাডিমির টুপিটা (লাকির) মাথা থেকে খোলে, উঁকি মেরে তার ভেতরটা দেখে, হাত দিয়ে ভালো করে ভেতরটা হাতড়ায়, নাড়ে, চাঁদিতে চাপড় মারে, আবার মাথায় চাপায়]

এস্ট্রাগন : কী? চলব এখন?

ভ্লাডিমির : প্যান্টটা তোলো।

এস্ট্রাগন : কী?

ভ্লাডিমির : তোমার প্যান্টটা তোলো।

ওয়েটিং ফর গডো

এস্ট্রাগন : আমার প্যান্টটা খুলে ফেলতে বলছ?

ভ্লাডিমির : তোমার প্যান্টটা তোলো।

এস্ট্রাগন : [প্যান্ট যে নিচে পড়ে গেছে তা উপলব্ধি করে] ঠিক। [প্যান্ট তোলে]

ভ্লাডিমির : কী? চলব এখন?

এস্ট্রাগন : হ্যাঁ, চলে যাই।

[কেউ নড়ে না]

যবনিকা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *