৭. থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁয়

০৭.

থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁয় রাত এগারোটায় পা রাখতেই ওয়েটার আমায় শীততাপে নিয়ন্ত্রিত একটি ছোট ডিনার কামরায় নিয়ে গেল। স্যান্ড্রা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ তার পরনে গাঢ় লাল রংয়ের আঁট পোশাক, মাথার চুল পেছনদিকে মুক্তো বসানো ফিতে দিয়ে বাধা। তার উগ্র সাজসজ্জার দিকে চেয়ে নিজেই উত্তেজিত বোধ করলাম।

সে মৃদু হেসে বলল, আমার পুরো নাম স্যান্ড্রা উইলিস। কিন্তু এখন আর কোন কথা নয় কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদেয় আমার পেট জ্বলছে।

প্লেটে ঝিনুক ভাজা আর ঠাণ্ডা সাদা ওয়াইন ওয়েটার এসে আমাদের টেবিলে রেখে গেল।

খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে, কিন্তু কেন?

বলছি, আগে পেট পুরে খেয়ে নিই। ওয়ালিনস্কি থাকলে আজও খাওয়া জুটত না, এমন কাজের চাপ পড়েছে। উনি ক্যাসিনোতে গেছেন তাই এখানে আসতে পারলাম।

 খাওয়ার পরে স্যান্ড্রা সিগারেট ধরিয়ে বলল, এই যাচ্ছেতাই শহরে আপনিই দেখলাম একমাত্র লোক যার সাহস আছে। শিরদাঁড়া খাড়া করে যে শয়তানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।

কি দেখে তোমার মনে হল যে আমার সাহস আছে?

ব্ল্যাক ক্যাসেটের মত একটা নোংরা জায়গা যিনি বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন, যিনি হ্যাংকের মত একটা বদমায়েশকে ভয় দেখিয়ে শহর থেকে খেদাতে পারেন তাকে সাহসী বলব না?

কি করে বুঝলে যে হ্যাংক এই শহর ছেড়ে চলে গেছে?

আধঘণ্টা আগে ও টেলিফোন করেছিল। ও জে. ডব্লিউ. অর্থাৎ ওয়ালিনস্কির সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। আমি ওর গলা শুনেই চিনতে পেরেছিলাম, বললাম যে জে. ডব্লিউ. ব্যস্ত আছেন যা বলার আমাকে বলতে পারেন। ও তখন বলল যে আপনি নাকি ওর ওপর খুব অত্যাচার চালিয়েছেন আর তার ফলেই ও বলতে বাধ্য হয়েছে যে অ্যাঞ্জেলা থরসেন টাকা খাইয়ে ওকে। অ্যাসিড ছুঁড়তে বাধ্য করেছিল। হ্যাংক এও বলল যে আপনি ওকে শহর ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিয়েছেন তাই ও চলে যাচ্ছে, কিন্তু ওর সঙ্গে টাকাকড়ি বিশেষ নেই। ওয়ালিনস্কি কি ওকে টাকা দিতে পারবেন?

সব শুনে হ্যাংককে বললাম যে ওর জন্য জাহান্নামের রাস্তা খোলা আছে সেখানে যেতে টাকাকড়ি কিছুই লাগে না। এই বলে আমি রিসিভার নামিয়ে রেখেছি। তারপর দলের লোকেদের কাছে জানলাম হ্যাংক স্মেডলি মিয়ামির দিকে রওনা হয়েছে।

চুপচাপ স্যান্ড্রার কথা শুনছিলাম। একটু দম নিয়ে সে বলল, অ্যাঞ্জেলা থরসেন সম্পর্কে ও আমায় যা যা বলেছে তা ওয়ালিনস্কিকে জানাইনি, কারণ ওঁর কাছে অ্যাঞ্জেলা খুব দামী খদ্দের। আর ওয়ালিনস্কি যদি জানতে পারে যে অ্যাসিড ছোঁড়ার মূলে অ্যাঞ্জেলা তাহলে সে ধরেই নেবে যে আপনি তাকেও ছাড়বেন না। আজ হোক কাল হোক অ্যাঞ্জেলাকে আপনি ঠিকই শায়েস্তা করবেন।

সে ত করবই। আমি অ্যাঞ্জেলাকে ছেড়ে দেব না।

এখন ডার্ক, গোটা ব্যাপারটাকে বুঝতে আমি আপনাকে সাহায্য করব।

 কেন?

আগেই বলেছি যে আমি একজন সাহসী লোক চাই। আপনি এই মাফিয়া সংগঠনটির কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না। এবার মন দিয়ে শুনুন। ওয়ালিনস্কি ফ্লোরিডায় তার মাফিয়া দলের বড়কর্তা। দলের হয়ে টাকা যোগাড় করাই তার কাজ। ফ্লোরিডায় টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। যার টাকা আছে তারই অতীতের কোনও না কোন কলঙ্কিত ইতিহাস আছে। এরকম হাজার হাজার লোককে ওরা ব্ল্যাকমেল করছে। বড় বড় দোকান, জুয়ার আচ্ছা, হোটেল সবাই মাফিয়াদের উৎপাত থেকে বাঁচবার জন্য তাদের হাতে মোটা টাকা তুলে দেয়। এই যে ওয়ালিনস্কি স্প্যানীশ বে হোটেলে থাকছেন তারও পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। সেখানকার কর্মচারীরা সব ওর কথায় ওঠাবসা করে। উনি আঙুল তুললেই সবাই হোটেল থেকে বেরিয়ে আসবে। এই এলাকা থেকে ওয়ালিনস্কি পনেরো লাখ ডলার পান। ঐ টাকার পরিমাণ যাতে না কমে সে দিকে লক্ষ্য রাখাই তার কাজ। আর এখানেই ওর ভরাডুবি ঘটবে। টাকার পরিমাণ কমলেই দল ওয়ালিনস্কিকে সরিয়ে এখানে অন্য কাউকে বসাবে। এই কারণেই উনি এই শহরে কোন ঝামেলা চান না। অ্যাঞ্জেলা থরসেনের কাছ থেকে উনি প্রত্যেক মাসে দশ হাজার ডলার পাচ্ছেন। এখন আপনি যদি ঝামেলা করেন তবে ওর মাসিক দশহাজার ডলার আয় কমে যাবে। আমি গোপনে জানতে পেরেছি যে দলের বড় কর্তারা ওঁর কাজে খুব খুশি নন। ওঁরা এই এলাকা থেকে আরও বেশী টাকা তুলতে চাইছেন। আর এখানে সবাই আপনাকে চেনে, পুলিশের সঙ্গেও আপনার দহরম মহরম আছে, তাই আপনি বেঁচে আছেন, ওরা আপনার গায়ে হাত তুলতে সাহস পাচ্ছেনা। ওঁর কাজকর্ম জানাজানি হয়ে যাক এটা ওয়ালিনস্কি চান না। আমার কথা বুঝতে পারছেন?

এসব আমায় বলে কি লাভ, স্যান্ড্রা? আমি বললাম, তুমি ওয়ালিনস্কির হয়ে কাজ করছে। তিনি তো তোমার জন্য যথেষ্ট করেছেন।

স্যান্ড্রা নিষ্ঠুর হেসে বলল, সে কথায় আসছি। উনি আপনাকে ডেকে বললেন যে আপনার বান্ধবীর মুখে হুলা আর হ্যাংক অ্যাসিড ছুঁড়েছে বলে তিনি খুব দুঃখিত, তাই না? আপনাকে উনি বেশ বুঝিয়ে দিলেন যে হুলা মিনস্কিকে খতম করে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ওয়ালিনস্কি কি পরিমাণ মিথ্যেবাদী সে সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণাই নেই। ইলা ওঁর ডানহাত, সে নিজের সাগরেদদের নিয়ে ধনীদের ব্ল্যাকমেলের ফাঁদ পেতে বেড়ায়। আমার কথা বিশ্বাস করুন, হুলা মিনস্কি এই মুহূর্তে বহাল তবিয়তে এই শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে হ্যাঁ হ্যাংক স্মেডলিকে উনি বাঁচিয়ে রাখবেন না, মিয়ামিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে খতম করে দেওয়া হবে। কাজটা হুলা নিজেই করবে। গুম, খুন করতে ওর মত ওস্তাদ লোক দুটি নেই।

 তার মানে? আমি ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলাম, যে বদমাশ ছেলে আমার বান্ধবীর মুখে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল, সে বেঁচে আছে এই কথাটাই তুমি বোঝাতে চাইছো?

ঠিক তাই।

স্যান্ড্রার কথা শুনে আমার একটা শীতল ক্রোধ মাথার দিকে উঠে গেল। হুলা মিনস্কিকে কোথায় খুঁজে পাব?

স্যান্ড্রা বলল, আপনি খুঁজে পাবেন না। ওকে কিরকম দেখতে তাই আপনার জানা নেই।

কে বলল জানা নেই? সে বেঁটেখাটো দেখতে, কাঁধ চওড়া, গায়ে একটা সাদা কোট থাকে আর মাথায় থাকে চওড়া বনাত দেওয়া টুপি।

তাতে কাজ কতদূর এগোবে? টুপি আর কোট খুলে ফেললে আপনি তাকে চিনতে পারবেন? কয়েক হাজার বেঁটে খাটো চওড়া কাধওয়ালা লোক এই শহরে চলাফেরা করে। আমি সাহায্য না করলে আপনি হাজার চেষ্টা করেও তাকে খুঁজে পাবেন না।

কিন্তু তুমি কোন স্বার্থে আমায় সাহায্য করবে বলো তো?

বিষাক্ত সাপের মত হিসহিস করে স্যান্ড্রা বলল, কারণ সে আমার বাবাকে খুন করেছিল।

কেন?

ওঁর জায়গায় ওয়ালিনস্কিকে বসানোর জন্য। আমার বাবাই ছিলেন ফ্লোরিডায় মাফিয়ার কর্তা। এখানকার কাজকর্ম তিনিই চালাতেন। আমি ছিলাম আমার বাবার সেক্রেটারী, একটা সিগারেট দিন।

স্যান্ড্রা, তোমার বাবা মাফিয়া সর্দার ছিলেন?

সিগারেট ধরিয়ে স্যান্ড্রা বলল, হ্যাঁ। বাবা খুন হবার পর তার মৃতদেহ ছুঁয়ে শপথ করেছিলাম বদলা নেবো। আর এতদিন ধরে এমন একজনকে খুঁজছি যার সাহস আছে।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে তারপর প্রশ্ন করলাম, তুমি ওয়ালিনস্কির সেক্রেটারী হয়ে গেলে?

হ্যাঁ, ওয়ালিনস্কি নিজেই যে আমার বাবাকে খুন করার হুকুম দিয়েছিলেন আর সেটা যে আমি জেনে ফেলেছি সেটা তিনি ধরতে পারেন নি। বাবাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। তার কিছুদিন পর বাবার নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি খুঁজে পাই। চিঠিটা আমাকে লেখা। তাতেই জেনেছিলাম যে ওয়ালিনস্কি তাকে সরিয়ে এখানকার দলের কর্তা হতে চাইছে। আর মিনস্কি ওঁকে খুন করার সুযোগ খুজছে। আমি পুরো তিনটি বছর আমার বাবার সেক্রেটারীর কাজ করেছি। দলের কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়ালিনস্কির চাইতে অনেক বেশী খোঁজখবর আমার জানা ছিল। আমি ওঁর সেক্রেটারীর কাজ করতে চাই শুনে ওয়ালিনস্কি খুব খুশি হলেন।

কিন্তু তুমি তা করতে গেলে কেন? ওয়ালিনস্কির অধীনে কাজ করতে তোমার একবারের জন্যও মনে ঘেন্না হল না?

বিষাক্ত হাসি হেসে সে বলল, প্রতিশোধ নেবার জন্য ডার্ক। দিনের পর দিন আমি সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছি। জানতাম একদিন সুযোগ আসবেই। এখন আপনি আর আমি দুজনেই প্রতিশোধ নিতে চাইছি। আমি চাই আমার বাবার খুনের বদলা আর আপনি চান আপনার বান্ধবীর মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার বদলা। আমাদের দুজনেরই উদ্দেশ্য এক, ডার্ক।

তাহলে কি এটাই দাঁড়াচ্ছে যে হুলা মিনস্কিকে খতম করতে পারলে ওয়ালিনস্কিকে ওপর ওয়ালারা এখান থেকে সরিয়ে দেবে?

হ্যাঁ, কিন্তু মাফিয়াদের কাজ বন্ধ হবে না। ওয়ালিনস্কির জায়গায় আর কাউকে বসানো হবে। আবার হুলার জায়গাতেও নতুন কোনও বদমাশ আসবে। সে আবার নতুন করে ব্ল্যাকমেলিংয়ের ফাঁদ পাততে শুরু করবে। মাফিয়াদের কাজকর্ম থামাতে না পারলে হুলা মিনস্কিকে আপনি আর আমি মিলে সরাতে পারব আর তার ফলে ওয়ালিনস্কি ডুববে এইটুকুই আমাদের লাভ। আমি অন্তত তাতেই খুশি হব।

স্যান্ড্রার পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। কিন্তু হাজার হলেও ও নিজে মাফিয়া দলের কর্মী, ওর বাবা ছিল এখানকার মাফিয়া সর্দার, তাই ওর সঙ্গে হাত মেলাতে মনে মনে ঘেন্না হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যদি হুলা মিনস্কিকে শেষ করতে পারি তবে সেটাই আমার লাভ।

ঠিক আছে স্যান্ড্রা তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পার। আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু আমরা কিভাবে এগোবো?

প্রথমে হুলাকে খুঁজে বের করতে হবে। ও টেলিফোনে ওয়ালিনস্কির সঙ্গে যোগাযোগ করে হুকুম নেয়। এতক্ষণে স্মেডলির কাছে থেকে ও নিশ্চয়ই সব জেনেছে কিন্তু ও যে এখনও বেঁচে আছে আর সেটা যে আপনি জানেন এটা ওর জানা নেই। এর ফলে ও অসাবধানী হবে। হুলা আর ওর পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাবে না। এখানেই আবার কোথাও নতুন কোনও থাকার জায়গা ও ঠিক জুটিয়ে নেবে।

ওকি হার্মিস ইয়াটে থাকতে পারে?

স্যান্ড্রার মুখ শক্ত হল, কঠিন গলায় বলল, হার্মিসের খোঁজ আপনাকে কে দিল?

 খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি। কার কাছে জেনেছি তা তোমার না জানলেও চলবে।

হুলা ওখানে যাবে না। ইয়াটে শুধু এখানকার লোকেরা গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। ওয়ালিনস্কি মাসের পয়লা তারিখে গিয়ে সেই টাকা হাতিয়ে মিয়ামির দিকে রওনা হয়। হুলা মিনস্কি কখনও ইয়াটে থাকতে যাবে না। ওর থাকার জন্য অনেকটা জায়গা দরকার।

ওর চেহারার বর্ণনা দিতে পার?

পারি। একসময় ওয়ালিনস্কি টেলিফোনে ওর সঙ্গে কথা বলতে জানতে চেয়েছিল ডলি কেমন আছে। হয়ত ডলি নামে মিনস্কির কোনও বান্ধবী আছে।

ডলি! নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম, মনে পড়ে গেল ডলি গিলবার্ট নামের সেই বেশ্যা। মেয়েটিকে। হ্যাংক স্মেডলির খবর তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ও চমকে উঠেছিল। ডলি যদি হুলার বান্ধবী হয় তাহলে হ্যাংক লুকিয়ে তার কাছে যেত আর হুলা তা জানতেও পারত না।

হ্যাংকের নাইট ক্লাবের তো বারোটা বেজে গেছে, তাহলে ব্ল্যাকমেলের আর প্রোটেকশানের টাকা এখন কোথায় কার কাছে জমা পড়বে বলতে পারো?

জানি না। তবে আমি খুঁজে সেটা ঠিক বের করতে পারব।

মাস শেষ হতে আর মাত্র আটদিন আছে স্যা, পয়লা তারিখে ব্ল্যাকমেলের টাকা হাতাতে মিনস্কিকে আসতেই হবে।

হা, ও আমি ঠিক খুঁজে বের করব, ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেব। আপনার নম্বর কত?

গাইডে পাবে। হ্যাঁ, আর একটা কথা স্যান্ড্রা, অ্যাঞ্জেলা থরসেনকে কেন ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে বলতে পারো?

না, তা আমার জানা নেই। সে সব খবর মিনস্কির কাছে লেখা আছে। ওয়ালিনস্কি নিজেও জানেন না। উনি শুধু টাকা চান। আর কোনও কৌতূহল নেই।

সে কি? যে সব লোক ওঁকে প্রতিমাসে লাখ লাখ ডলার দিচ্ছে তাদের গোপন পাপের খবর উনি কিছুই রাখেন না?

কেন রাখতে যাবেন বলুন তো? উনি পুরোপুরি স্থলা মিনস্কির উপর নির্ভর করেন। ওয়ালিনস্কির নিজের চোরাই মাদক ওষুধের ব্যবসা আছে। উনি তাই নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকেন। ব্ল্যাকমেলের কাজকর্মের ব্যাপার পুরোপুরি হুলার ওপর। ওয়ালিনস্কির ফেরার সময় হয়েছে এবার আমায় যেতে হবে। আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি, ডার্ক?

পারো।

এখানে আমার অ্যাকাউন্ট আছে, কাজেই আপনাকে দাম দিতে হবে না, বলতে বলতে হঠাৎ তীব্র ঘৃণা আর জিঘাংসায় স্যান্ড্রার বুজ চোখজোড়া ঝলসে উঠল, মিনস্কির দেখা পেলে তাকে খুন করবেন না যেন। ওটা আমার জন্য তুলে রাখবেন, বলে সে হাত নেড়ে বিদায় নিল।

.

রাত প্রায় একটায় থ্রী ক্র্যাব রেস্তোরাঁ থেকে বেরোলাম। আগামীকাল সকাল থেকে আমার আর কিছুই করার নেই, অগত্যা বাড়ি ফিরলাম। বিল আগেই শুয়ে পড়েছিল। তাই আমিও শুয়ে পড়লাম। বালিশে মাথা রেখে স্যান্ড্রার কথা ভাবতে ভাবতে কোনপথে এগোব তাই ভাবছিলাম। শেষকালে কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ভারী জলখাবার খেতে খেতে স্যান্ড্রার সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে সব বিলকে বললাম। সব শুনে সে বলল, এবার তাহলে কি করবে ঠিক করলে?

আগে মিনস্কি তারপর অ্যাঞ্জেলাকে টিট করব। আমার ইচ্ছে তুমি অ্যাঞ্জেলার ওপর বেশী নজর রাখ। ওর সম্পর্কে আমাদের আরও জানা দরকার। ওর সঙ্গে আঠার মত লেগে থাকো বিল, ও কি করে, কোথায় যায় সব ভালো ভাবে লক্ষ্য রাখবে। ও নিশ্চয়ই সারাদিন একা বাড়িতে বসে থাকে না। অ্যাঞ্জেলা লুকিয়ে কার সঙ্গে দেখা করে, কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, এগুলো আমার জানা দরকার।

বুঝলাম, কিন্তু তুমি এখন কি করবে?

আমি এখন যাব ডলি নামে সেই বেশ্যা মেয়েটার কাছে। হয়ত মিনস্কি এখন ওর কাছেই থাকে। ঐ বাড়ির দারোয়ানের সঙ্গে আবার কথা বলব। মিনস্কি যেখানে যাই করে বেড়াক না কেন আমি তার ওপর ঠিক নজর রাখব জেনো। ঠিক আছে বিল, তুমি তাহলে অ্যাঞ্জেলার ওপর নজর রেখো, রাতে আবার দেখা হবে। বলে বেরিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম ডলির বাড়ি। তখন বেলা এগারোটা। বাড়ির একতলায় দারোয়ান তার ঝাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আমায় দেখেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

আবার এসেছেন দেখছি। টেরি জিগলারের খোঁজ পেলেন?

না, আপাততঃ আমি আরেকজনকে খুঁজছি। বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা কোনও লোককে দেখেছো যে গায়ে সবসময় সাদা কোট আর মাথায় চওড়া বনাত দেওয়া টুপি পরে?

সে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, সারাদিনে কত লোককেই এখানে আসা যাওয়া করতে দেখি।

আমি এমন একজনের খোঁজ করছি যাকে বেঁটে খাটো গাঁট্টাগোট্টা দেখতে যে সবসময় সাদা কোট পরে আর মাথায় চওড়া বনাত দেয়া টুপি পরে।

আসে হয়ত। হয়ত আমি তাকে দেখেছি।

ওয়ালেট থেকে একটা দশ ডলারের নোট তার হাতে দিয়ে বললাম, দেখো তো মনে করতে পারা কিনা?

প্রায় ছোঁ মেরে নোটটা নিয়ে পকেটে পুরে বলল, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। লোকটা ডলির দালাল। প্রায়ই এখানে আসে, এলোমলো ভাবে ঝাট দিতে দিতে নিজের মনেই বলে, এখানে থেকে এখানকার লোকেদের সম্পর্কে খোঁজ খবর দেওয়াটা আমার পক্ষে উচিৎনয় মশায়। ওরা এটা ভাল চোখে দেখবেন না।

তুমি নিজে থেকে কিছু না বললে কেউ জানতে পারবে না।

মনে হয় ঠিকই বলেছেন।

লোকটাকে কেমন দেখতে তাই বলল।

এসব আমি বলতে পারবো না মশাই। যার কথা জানতে চাইছেন তার সঙ্গে আমার ঝামেলা হোক আমি তা চাইনা।

বুঝলাম অল্পে তার পেট ভরেনি। সে আরো টাকা চায়। আরেকটা দশ ডলারের নোট বের করে মুঠোয় রেখে তার দিকে তাকালাম।

দারোয়ান বলল, ওটা কি আমার জন্য? আপনি একটু আগে যেমন বলেছেন লোকটাকে তেমনি দেখতে। বেঁটে কাঠখোট্টা চেহারা। আমি মাত্র দুবার তাকে দেখেছি, তাতেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। ওর মুখ দেখে মনে হয় ছেলেবেলায় কেউ ওর নাক মুখ পায়ে মাড়িয়ে থেলে দিয়েছিল। চ্যাপ্টা নাক, ঢালু কপাল, এককথায় বলব যে ওর মুখ দেখলে যে কেউ ভয়ে আঁতকে উঠবে। আবার আমার হাতের মুঠোর দিকে তাকিয়ে, এটা সত্যিই আমায় দেবেন তো?

ওর চুলের রং কেমন? কালো, না লাল, না সোনালী?

তা বলতে পারবো না, যতদূর মনে হয় ও আজকালকার ক্ষ্যাপা ছোঁড়াদের মতন মাথা কামায়, আর হয়ত সেজন্যেই ও মাথায় সবসময় টুপি পরে থাকে। ওর মাথাটা ডিমের মত চাচাছোলা। লোকটা ভুরুও কামায়।

ভাবলাম এবার একটা খাঁটি খবর পেয়েছি যার ওপর ভিত্তি করে আমি এগোতে পারি। নোটটা দারোয়ানের হাতে দিয়ে বললাম। কতদিন পর পর ও এখানে আসে?

জানি না। ওপরে বেশীক্ষণ কাটানোর মত সময় আমার হাতে নেই। ও গতকাল রাতে এখানে এসেছিল। ময়লা ফেলার পাত্র হাতে নিয়ে বেরিয়েছিলাম এমন সময় ওকে ঢুকতে দেখেছিলাম। এখনও হয়ত ওর বেশ্যাটার কাছেই আছে।

ঠিক আছে পরে আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে। বলে লিফটে চড়ে ডলির অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা টিপে টিপে এগিয়ে দেখি তার সদর দরজার হাতলের সঙ্গে একটা নোটিশ ঝুলছে, তাতে লেখাঃ

বিরক্ত করবে না

বন্ধ দরজায় কান রাখতে ভেতর থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারীর গলার আওয়াজ আবছাভাবে কানে এল। মনে হল শোবার ঘরে আছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আমার গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে ঢুকে একখানা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

দু ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর নিজের ওপরেই বিরক্ত হচ্ছিলাম। অবশেষে একটা চল্লিশ নাগাদ দেখলাম ডলি ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, তার পেছনে একজন বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা লোক। ডলির পরনে কাগজের মত পাতলা একটা ইমিটেশান চিতাবাঘের চামড়ার কোট। মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা। কিন্তু ডলি সম্পর্কে আমার উৎসাহ নেই। তার সঙ্গের লোকটির ওপর আমার মনোযোগ।

ডলির সঙ্গের লোকটির মাথায় উঁচলো বনাত দেওয়া টুপি, গায়ে কালো উইন্ডচিটার, আর পরনে সাদা স্ন্যাক্স। এই লোকটিই তবে হুলা মিনস্কি। আর চাচাছোলা ঘাড় আর রগ দেখে বুঝলাম যে সে নিয়মিত মাথা কামায়, সেইসঙ্গে এও দেখলাম তার ভুরুও পরিষ্কার ভাবে কামানো। লোমহীন সেই ভয়ঙ্কর মুখের দিকে তাকালে ভয়ে গা শিউরে উঠে। তার চওড়া কাঁধ, বেঁটে খাটো পেশীবহুল দুটি পা দেখলে মনে হয় সে বুঝি মানুষ নয়, সভ্যতার এই জনারণ্যে এক হিংস্র গরিলা রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে। তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার প্রতিশোধের স্পৃহা ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল। এই লোকটিই সুজির মৃত্যুর জন্য দায়ী। সে নিজ হাতে তার সুন্দর মুখখানায় অ্যাসিড ছিটিয়ে দিয়েছিল। নিজের অজান্তেই আমার ডানহাতটা আমার বুকের সঙ্গে বাঁধা রিভলভারের বাটটা বারবার মুঠো করে ধরতে লাগল। কয়েকটা গুলিতে আমি এই শয়তানের ন্যাড়ামাথাটা ফাটিয়ে চৌচির করতে পারি কিন্তু স্যার কাছে কথা দিয়েছি, হাতে পেলেও আমি মিনস্কিকে খুন করবো না। স্যান্ড্রা নিজে সেটা করবে বাবার খুনের বদলা নিতে, তাই অতি কষ্টে নিজেকে সংযত রাখলাম।

হুলা মিনস্কি কয়েক পা এগিয়ে ফুটপাতে দাঁড় করানো একটা সবুজ রংয়ের ক্যাডিলাকের দরজা খুলে স্ট্রিয়ারিং ধরে বসল, ডলি তার পাশে বসল। জোর স্পীডে গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই আমি বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু নিলাম। অনেক রাস্তা, অনেক গলি পেরিয়ে এক ইটালিয়ান রেস্তোরাঁর সামনে মিনস্কি গাড়ি দাঁড় করালো। রেস্তোরাঁর দারোয়ান এসে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই ডলি ও হুলা দুজনে হাত ধরাধরি করে রেস্তোরাঁয় ঢুকল।

রাস্তার শেষে গাড়ি রেখে রাস্তার অন্যপ্রান্তে ফিরে এলাম। ইটালিয়ান রেস্তোরাঁর ঠিক উল্টোদিকে একটা স্যান্ডউইচ বারে ঢুকে দুটো বীফ পিকেল স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিলাম। এখান থেকে রেস্তোরাঁর দরজাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কফি খেতে খেতে পুরো এক ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম তারপর দেখলাম রেস্তোরাঁর দরজা খুলে ডলি একা বেরিয়ে এল। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ডলি সোজা উল্টোমুখে হাঁটতে লাগল। বুঝলাম সে এখন আস্তানায় ফিরে যাচ্ছে। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উল্টোদিকের রেস্তোরাঁর সামনে এলাম। সামনেই মিনস্কির সেই সবুজ ক্যাডিলাক। আড়চোখে নম্বরটা দেখে নিয়ে আমার গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আরও আধঘণ্টা পর মিনস্কি সেই ইটালিয়ান রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল। এবার একটি নতুন লোককে তার পাশে হাঁটতে দেখলাম। লোকটি লম্বা পাতলা ছিপছিপে গড়ন, মাথাভর্তি লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত এসে নেমেছে। চোখে সানগ্লাস, পরনে গলা খোলা শার্ট আর জিনস্। লোকটার মাথায় কালো টুপি, তার বনাত নামিয়ে দেবার ফলে তার মুখটা ভাল দেখা যাচ্ছে না।

সেই সবুজ ক্যাডিলাকে দুজনে চাপল। মিনস্কি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছু দূর এগোতেই আমি তার পিছু নিলাম। কিন্তু সী ভিউ অ্যাভিনিউতে ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে পড়ে আমি মিনস্কির গাড়িটাকে হারিয়ে ফেললাম। অগত্যা ফিরে এলাম সেই পুরোনো ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় নেপচুন রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেখলাম আমার চর অ্যাল বার্নি একমনে বীয়ার খাচ্ছে।

তার চোখে মুখে হাসি ফুটল আমায় দেখে। ওয়ালেট থেকে একটা কুড়ি ডলারের নোট বের করে নোংরা ভেজা শার্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে বললাম, চটপট বলে ফেলো তো অ্যাল, হলা মিনস্কির সঙ্গে একটা লম্বা পাতলা ছিপছিপে লোক ঘুরে বেড়ায়। মাথায় কালো টুপি। চোখে সানগ্লাস, মাথার চুল কাধ পর্যন্ত নেমেছে। লোকটা কে?

বিষাক্ত সাপ মিঃ ওয়ালেস। ওর নাম সল হার্মাস, জো ওয়ালিনস্কির ইয়াটটা ঐ চালায়। অর্থাৎ ঐ ইয়াটের ক্যাপ্টেন। লোকটা বিষাক্ত সাপের মত ধূর্ত আর হিংস্র। ওর কাছ থেকে যত দূরে থাকবেন ততই আপনার মঙ্গল।

ওকে কোথায় পাবো বলতে পার?

আপনি আমায় প্রাণে না মেরে রেহাই দেবেন না দেখছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, শুনুন সী ভিউ অ্যাভিনিউর শেষ বাংলোটায় মিনস্কি যখন থাকে তখন সল হামাস ওই বাংলোতে থাকে।

ধন্যবাদ অ্যাল। আমার আর কিছুর দরকার নেই। বলেই বেরিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম। সী ভিউ অ্যাভিনিউর একধারে সমুদ্রের বেলাভূমিতে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দলে দলে বালুর ওপর শুয়ে আছে। কেউ বা বিকিনি কিংবা সাঁতারের পোশাক পরে জলে ঝপাচ্ছে। খুব আস্তে গাড়ি চালাতে চালাতে আমি রাস্তার ধারের শেষ বাংলোটার দিকে একনজর তাকালাম।

বাংলোটায় গোটা ছয়েক ঘর নিশ্চয়ই আছে। বাংলোর চারিদিক ঘিরে কাঁটাতারের মজবুত বেড়া আর সদর দরজার ঠিক মুখেই দুজন ষণ্ডা চেহারার লোক সাদা ড্রিলের ট্রাউজার্স আর স্পোর্টস শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে চুইংগাম চিবোচ্ছে। তাদের দুজনেরই কোমরের বেল্টে রিভলভার ঝুলছে। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ির মুখ ঘোরালাম। ফেরার পথে আবার বাংলোর দিকে তাকাতে দেখলাম সদর দরজার পাশে একটা লোক গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার পায়ের কাছে বেশ বড়সড় একটা শিকারী কুকুর শুয়ে থাবা চাটছে। এই জাতের কুকুর দিয়ে সাধারণতঃ পুলিশ বিভাগে অপরাধীদের খুঁজে বেড়ায়। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম মিনস্কি এই মুহূর্তে বাংলোতেই আছে। তাকে ধরতে হলে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

 বেলাভূমির ধারে গাড়ি রেখে একটা টেলিফোন বুথে ঢুকলাম। স্প্যানীশ বে হোটেলের টেলিফোন নম্বর ডায়াল করে বললাম, মিস স্যান্ড্রাকে দিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্যান্ড্রর গলা ভেসে এল।

হ্যালো কে বলছেন?

এখন কথা বলা যাবে?

 যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। ওয়ালিনস্কি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকছে।

আজ কোথায় কখন দেখা করবে বলে দাও।

সন্ধ্যা ছটার সময় থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁয়, বলেই সে হঠাৎ জোর গলায় বলল। দুঃখিত, আপনি ভুল নম্বরে ফোন করছেন। বুঝলাম ওয়ালিনস্কি ঘরে ঢুকেছে। রিসিভার নামিয়ে গাড়িতে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বসে ভাবলাম। তারপর সোজা গেলাম পুলিশ হেডকোয়ারটার্সে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর টম লেপস্কি তার টেবিলে বসে কাজ করছিল। আরো দুজন ডিটেকটিভ নিজেদের টেবিলে বসে রিপোর্ট লিখছিল।

এই যে টম, ব্যস্ত নাকি?

দুচোখে ঠাণ্ডা পুলিশীচাউনীতে আমার দিকে তাকিয়ে টম বলল, কাল মাঝরাতে তুমি কোথায় ছিলে ডার্ক?

কোথায় ছিলাম জানতে চাইছে? কাল মাঝ রাতে আমি আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে গপগপ করে ইটালিয়ান খানা খেয়েছি। 

বান্ধবী? কে সে, কি নাম তার?

কিছুটা গম্ভীর ভাবেই বললাম, তুমি খুব ভালভাবেই জানো যে এসব প্রশ্ন করার এক্তিয়ার তোমার নেই। কাল মাঝরাতে কোথায় ছিলাম তাইবা তুমি জানতে চাইছো কেন?

 শোন, মিয়ামি পুলিশ জানিয়েছে আজ ভোরবেলা তারা সেখানকার বন্দরের কাছে হ্যাংক স্মেডলির লাশ জল থেকে উদ্ধার করেছে। মাথার পেছন দিকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

হ্যাংক খুন হয়েছে আঃ, কি সুসংবাদ। একটা গেছে এখন অ্যাঞ্জেলা আর হুলা মিনস্কি এই দুটো দুশমন বাকি।

হ্যাংককে কে খুন করতে পারে বলো তো?

 যেই করুক, সে তুমি নও, এটাই বলতে চাইছে তাই না, ডার্ক?

ঠিক ধরেছে, যাকগে। ঐ বাঁদরটা মরেছে সেজন্য কারও কোনও ক্ষতি হবে না। আমি কিছু খবরের জন্য তোমার কাছে এসেছি। আগে জানতে চাই সুজির মুখে যারা অ্যাসিড মেরেছিল তাদের কোন খোঁজ পেয়েছ কিনা?

দুঃখিত ডার্ক, আমরা শুধু অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি।

সল হার্মিস সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?

জো ওয়ালিনস্কির ইয়াটের ক্যাপ্টেনের কথা বলছো?

হ্যাঁ।

না, ওর বিরুদ্ধে আমার কাছে কোন অভিযোগ আসেনি, কিন্তু ওর সম্পর্কে তোমার এত কৌতূহল কেন?

টম, সুজির সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ছিল, ওর মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজে আমি ভুলব না। আমি নিজেও খোঁজখবর নিচ্ছি। সবকিছু গুছিয়ে তারপর তোমার কাছে আসব।

কিছু প্রমাণ আমাদের হাতে দাও, ডার্ক। তাহলেই আমরা কাজে নেমে যাব।

হার্মিস সম্পর্কে কতটুকু জানো?

রাজার হালে থাকে, এর বাড়ির চারপাশে গুলিভরা রিভলভার নিয়ে জো ওয়ালিনস্কির লোকেরা পাহারা দেয়। তবে ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার মত কোন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

এবার বলল হুলা মিনস্কি সম্পর্কে কতটুকু জানো?

ঐ বেজন্মার সঙ্গে সুজির মারা যাবার কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে টম, ঐ বেজন্মাটাই সুজির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল। অন্ততঃ সাক্ষীদের বর্ণনা শুনে বুঝেছি এটা তারই কাজ। ওর অ্যাপার্টমেন্টে স্মেডলিকে থাকতে দিত। ওরা দুজনে মিলেই সুজিকে শেষ করেছে।

শুধু মুখের কথায় তো হবে না, প্রমাণ চাই। উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারবে?

তেমন প্রমাণ এখনও আমার হাতে আসেনি, পেলে নিশ্চয়ই তোমায় দেব।

শোন ডার্ক। কিসের মধ্যে পা বাড়াচ্ছ সে সম্পর্কে এখনও তোমার ধারণা হয়নি। মিনস্কি লোকটা কিন্তু ভয়ানক বিপজ্জনক। জানি, সুজির মারা যাবার ব্যাপারটা তুমি ভুলতে পারছ না। তুমি যা বলছে আমি উড়িয়ে দিতে পারছি না। হয়ত অ্যাসিড ছোঁড়ার কাজটা মিনস্কি করেছিল। ও এ ধরনের কাজ করে বেড়ায়, তাহলেও বলব লোকটা ভয়ানক ধূর্ত, ওর পেছনে লেগে তুমি কিছুই করতে পারবে না, তারচেয়ে ব্যাপারটা ভুলে যাও। স্মেডলি খুন হয়েছে, তোমার কমবেশী শোধবোধ হয়ে গেছে। ভগবানের দোহাই এসব থেকে দূরে থাকো।

টম, তুমি কি জানো যে এই শহরের কয়েকশো বাসিন্দাকে প্রত্যেক মাসে ব্ল্যাকমেলের টাকা যোগাতে হয়। প্রত্যেক মাসে শুধু এই শহর থেকেই ওঠে মোট পনেরো লাখ ডলার? সেই খোঁজ রাখো? খোঁজ নেবার লোক আমার আছে। ওরা তোমায় কিছু না বললেও আমার কাছে কিছুই চাপা রাখে না। শোন, প্রত্যেক মাসের এক তারিখ যাদের ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে তারা টাকা দেয়। বড় বড় পয়সাওয়ালা লোকেরা স্মেডলিকে টাকা দিত। আর যারা ছোটখাটো তারা রাত তিনটেয় ওয়ালিনস্কির ইয়াটে গিয়ে টাকা দিয়ে আসত। স্মেডলিও যা টাকাকড়ি পেত, সব হুলা মিনস্কিকে দিত। রাত তিনটের সময় ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় দুজন লোক ছাড়া আর কেউ ঘুরে বেড়ায় না। সেই দুজন লোক হল তোমাদের দুই কনস্টেবল, ওখানে অপরাধ দমন করা যাদের কাজ। আমি তোমায় বলছি ঐ দুই পেট মোটা শুয়োরের বাচ্চাও কিন্তু মাফিয়ার কাছ থেকে টাকা খায়। আর খেয়ে চোখ বুজে ঘুরে বেড়ায়। কে ব্ল্যাকমেলের টাকা কার কাছে জমা দিচ্ছে তা জানার কোনও কৌতূহল ওদের আর নেই। ঐ দুটো কনস্টেবলকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসো। তারপর চালাক-চতুর আর ঘুষ খায় না এমন দুটো ছেলেকে ওখানে পাহারা দেবার কাজে বহাল করো, যারা ওয়ালিনস্কির ইয়াটে রাত তিনটেয় যাকে উঠতে দেখবে তাকেই জেরা করবে। আমার কথা শুনে কাজ করে দ্যাখো, ভাল ফল পাবে।

কিন্তু স্মেডলির আড্ডা তো বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন তাহলে পয়সাওয়ালার দল কোথায় টাকা জমা দেবে?

তা নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আবার নতুন আড্ডা গজিয়ে উঠবে। গজিয়ে উঠলে তোমায় খবর দেবো।

ওপরওয়ালার সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে।

আমিও তাই চাই টম। তুমি আগে ওঁর সঙ্গে কথা বল, তারপর কাজে হাত লাগাও। মাসের পয়লা তারিখ আসতে আর মাত্র সাতদিন বাকি, বলে উঠে দাঁড়ালাম।

লেপস্কি বলল, মিনস্কিকে ঘাঁটাতে যেও না। তুমি একানও। আমাদের পক্ষেও ওকে সামলানো সহজ হবে না। এই শহরে অনেক পয়সাওয়ালা লোক আছে যারা নিজেদের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবার চাইতে মাসে মাসে ব্ল্যাকমেলের টাকা জুগিয়ে যাবে। কথাটা মনে রেখো।

ভারী নতুন কথা শোনাচ্ছে যেন। যাক গে টম, তোমার লোকেরা এই ব্ল্যাকমেলের কারবার বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা সেটা বলো?

 ডার্ক, এতবড় ব্ল্যাকমেলের কারবার বন্ধ করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা জানি যে ওয়ালিনস্কি এই কারবার দেখাশোনা করে কিন্তু তাতে কিছুই আসবে যাবে না। ব্ল্যাকমেলের টাকা জোগাচ্ছে, এমন তিন চারজন লোক আমাদের কাছে এসে যদি নালিশ করে, শুধু তাহলেই আমরা কিছু করতে পারব। কিন্তু সেখানেও ভয় আছে। হয়ত তেমন তিনচারজন লোক আমরা যোগাড় করলাম। কিন্তু তারপর একদিন দেখব হ্যাংক স্মেডলির মত তাদেরও লাশ বন্দরের জলে ভাসছে। কুকর্মের সাক্ষী রাখবে না ভেবে ওয়ালিনস্কির দলের লোকেরা তাদের খুন করবে। আর তখন আমরা পড়ব মুশকিলে, কারণ ওয়ালিনস্কিকে আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোন রাস্তাই থাকবে না।

তাহলে তোমরা সব জেনেশুনেও কিছুই করছে না, তাই না?

 ঠিক বলেছো ডার্ক। আমরা কিছুই করছি না।

তাহলে অন্ততঃ ঐ ওয়াটার ফ্রন্টের কনস্টেবল দুটোকে সরাও। তাহলেও ওদের চাকে যথেষ্ট ঘা দেওয়া হবে।

দেখি, আমি ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলব।

 চলি টম, বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।

.

বিলকে দেখতে পেলাম না বাড়ি ফিরে। আন্দাজ করলাম ও অ্যাঞ্জেলা থরসেনের ওপর নজর রাখছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে গাড়ি চালিয়ে থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁয় হাজির হলাম। ছটা বাজে। ভেতরে ঢুকতেই খবর পেলাম স্যান্ড্রা আমার জন্য দোতলায় অপেক্ষা করছে। এই সময় খদ্দেরদের ভীড় বাড়বার ফলে রেস্তোরাঁয় বেশ হৈ চৈ পড়ে যায়।

দোতলার নির্দিষ্ট কেবিনে ঢুকে দেখি স্যান্ডা বসে, হাতে সিগারেট।

ডার্ক, খাবার দাবার যা আনবার তাড়াতাড়ি আনতে বলুন, ওয়ালিনস্কি বেরিয়েছে, ঠিক সাতটায় ফিরবে।

উল্টোদিকের চেয়ারে বসে স্যার দিকে তাকাতে মনে হল ও মানুষ নয় শিকারের পেছনে ছুটে বেড়ানো এক রক্ত লোলুপ বাঘিনী।

মিনস্কিকে দেখেছি স্যা। তার আজ্ঞার খোঁজও পেয়েছি।

সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, দেখেছেন? কোথায়?

সংক্ষেপে সব কথা বললাম। সল হার্মাসের সঙ্গে তার বাংলোয় গিয়ে হুলা আশ্রয় নিয়েছে তাও বললাম।

ঠিকই ধরেছেন। ঐ বাংলোটাকে আমরা সবাই খামার বাড়ি বলি। আমার বাবার পরামর্শে ওয়ালিনস্কি ওটা বানিয়েছিল। ওখানে সবসময় কড়া পাহারা থাকে। মিনস্কি যতক্ষণ ঐ বাড়ির ভেতরে থাকবে ততক্ষণ কেউ তাকে ছুঁতেও পারবে না।

খুব ভাল কথা। আমরা অপেক্ষা করব। একসময় তো ওকে বেরিয়ে আসতেই হবে, তখন আমরা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।

স্যান্ড্রা বলল, মাসের শেষদিন ওকে বেরিয়ে আসতেই হবে। তখন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। ঐ একমাত্র সুযোগ। কথা শেষ করে এক ভয়ঙ্কর হাসি হাসল যা দেখে আমি শিউরে উঠলাম। এর আগে কখনও এমন ভয়ঙ্কর হাসি আমি দেখিনি।

তুমি না দেখলেও আমি হুলাকে দেখেছি। ওকে সামনে পেলে তুমি কি করবে?

আগে ওকে জ্যান্ত পাই তারপর ভাবব। আমার বাবাকে খুন করার ফল ওকে পেতেই হবে।

কিন্তু হুলা মিনস্কিকে তো তুমি আর জালে ধরতে পারবে না। জ্যান্ত বাঘ ধরার মত ব্যাপার।

স্যান্ড্রা বলল, রাস্তা অনেক আছে। দেখি মাথা খাটিয়ে কিছু বের করা যায় কিনা। ওয়ালিনস্কি তিনদিনের জন্য নিউইয়র্ক যাবে। আপনি আগামী বৃহস্পতিবার আবার এখানে আসবেন তখন কথা হবে।

বৃহস্পতিবার অর্থাৎ মাসের পয়লা তারিখ। বেশ, তাই আসব।

খাওয়া শেষ করে স্যান্ড্রা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল, আমার কাঁধে আলতো চাপড় মেরে এক দুর্বোধ্য কঠিন নিষ্ঠুর হাসি হেসে সে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আমিও নীচে চলে এলাম।