৬. অ্যাপার্টমেন্টে এসে

০৬.

রাত এগারোটায় অ্যাপার্টমেন্টে এসে পৌঁছলাম। কলিংবেল বাজাতে বিল দরজা খুলে দিল। দেখলাম ও নিজের মালপত্র সব নিয়ে এসেছে।

ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে জোশ স্মেডলির কাছ থেকে যা যা জানতে পেরেছি সব বললাম।

মাফিয়াদের হুমকিতে ভয় পেয়েই মিসেস থরসেন তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। টেরির কোন খোঁজ পেলাম না। এখন হাতের সামনে পাচ্ছি শুধু হ্যাংককে। বোমা বানানোর জন্য নগদ পাঁচশ ডলার আমি আলি হাসানকে দিয়ে এসেছি।

হ্যাংকের বারোটা বাজিয়ে দেব এটুকু জেনো। বোমা মেরে আমি ওরনাইট ক্লাব গুঁড়িয়ে দেব। ওর গাড়িটা তছনছকরবতারপর ওর বাড়িটাও ভেঙ্গে দেব। ওর জীবনের সবটুকু শাস্তি আমি ছিনিয়ে নেব। এখন একটা কথা আমাদের দুজনকেই মনে রাখতে হবে যে আমি ওর পেছনে লেগেছি এটা যেন হ্যাংক টের না পায়। ও টের পেলে ওর মাফিয়া দোস্তদের আমাদের পেছনে লেলিয়ে দেবে। তাহলে আমরা সত্যিই মুশকিলে পড়ে যাব। কথাটা মনে রেখে বিল।

আমার কথাটা তার মনে ধরেছে মনে হল। আমার মাথায় একটা মতলব এল। রান্নাঘরে ঢুকে অনেক খুঁজে এক টুকরো কার্ডবোর্ড পেলাম। ফেন্ট পেন দিয়ে তাতে গোটা গোটা হরফে লিখলামঃ

কালোদের এখানে কেউ চায় না
ক্লু ক্লুক্স ক্ল্যান

 বিলকে কার্ডবোর্ডের টুকরোটা দেখিয়ে বললাম, এটা ওদেরনাইট ক্লাবের দরজায় ঝুলিয়ে দেব। তাহলে ধরে নেবে যে আমিনই। কালোদের যারা দেখতে পারেনা সেই ক্লু কুক্স ক্ল্যানের গুন্ডারাই ওর পেছনে লেগেছে। ওর গাড়ি ভেঙ্গে চুরে সেখানেও ওদের নাম লিখে আসব। তাহলে আমাদের আর সন্দেহ করতে পারবে না।

বিল বলল, বুঝতে পেরেছি।

তবে এটাও ঠিক যে মাফিয়াদের চোখে ধুলো দিয়ে বেশিদিন গা বাঁচিয়ে থাকতে পারব না। আজ হোক কাল হোক ওরা আমায় জানতে পারবে তখন ওরা আমায় মারবার তালে থাকবে। সেজন্যে আমাদের তৈরী থাকতে হবে। একবার খেলায় নামলে এরপর আমাদের গা ঢাকা দিতে হবে। দেবার মত আমার জায়গা জানা আছে। সেখানে কিছুদিন থাকতে হবে। কেমন বিল, রাজি আছো তো?

তুমি রাজি থাকলে আমার আর বলবার কিছু নেই।

তাহলে তুমি অন্ততঃ এই বোমার ব্যাপারটা থেকে তফাতে থাকো, বিল। এটা আমায় একা করতে দাও।

একদম নয়। তুমি যখন যেখানে যাবে আমিও ছায়ার মত সেখানে গিয়ে হাজির হব।

তোমাকে আমার দরকার নেই। এটা একজনের কাজ।

যে কোন কাজ দুজন হাত লাগালে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায়, বলে বিল তার শোবার ঘরে ঢুকল। বাথরুমে স্নান সেরে আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আমার পাশে রাখা বালিশের ওপর হাত রাখলাম। সুজি এই বালিশের ওপর মাথা রেখে আমায় আদরে আদরে ভরিয়ে তুলেছে, কত রঙীন স্বপ্নে বিভোর হয়েছে। পরমুহূর্তে কান্নার একটা বীভৎস দৃশ্য ফুটে উঠল। সুজির মুখে কেউ অ্যাসিড ছুঁড়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে রাস্তার ওপর ছোটাছুটি করছে। দুহাত মুখে ঢাকা থাকায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। সেই সময় এক বিশাল দৈত্যের মত ট্রাক ব্রেক কষতে না পেরে ওর ঘাড়ে এসে পড়ল। তার নরম শরীর নিমেষে পিষে গেল। সেই দৃশ্য কল্পনা করায় আমার রাতের ঘুম বিদায় নিল। সারারাত জেগে একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে সেই অতীতের দিনগুলোর কথা ভাবতে লাগলাম।

সারারাত জেগে ক্লান্ত হয়ে ভোরের দিকে মাত্র একঘণ্টা ঘুমোলাম। কিন্তু তারই মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখলাম একটা বিশাল গরিলার সঙ্গে আমি লড়াই করছি। গরিলার মুখোমুখি হতেই দেখলাম সেটা হ্যাংক। তার গায়ে গরিলার চামড়া। তারবীভৎসমুখটা আমার কাছে এগিয়ে আসতেই ভয়াল আতঙ্কে জেগে উঠলাম। সারা গা ঘামে ভিজে গেছে দেখলাম। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দাড়ি কামালাম, তারপর স্নান সেরে বেরোবার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম।

বাইরে এসে দেখি বিল টোস্টে জ্যাম মাখিয়ে দুজনের ব্রেকফাস্ট তৈরী করেছে সঙ্গে দুকাপ কফি। দুজনে চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সারলাম।

আর চুপ করে থাকতে পারলনা বিল। তাহলে হ্যাংককে টিট করার পর কি করবে ভেবেছ?

 জানি না বিল, এই ব্যাপারটা শেষ না করে কিছুই ভাবতে পারছি না।

বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার নিজের করার মত কি কিছুই নেই?

অধৈর্য ভাবে বললাম, ভগবান জানেন। তুমি নিজের ইচ্ছায় আমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তোমায় আমার সঙ্গেই থাকতে হবে।

ঠিক আছে। আমি বাইরেটা একবার দেখেঅব। লাঞ্চ না হয় আজ এখানেই খাব। কি করবে ফল?

রাত হওয়া পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করব। তোমার যা ইচ্ছে হয় কয়রা।

 গাড়িটা নিতে পারি?

নিশ্চয়ই। আমি এখানেই থাকব। রাত তিনটেয় ওর গুদামের ঝাঁপ পড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত আমায় অপেক্ষা করতে হবে।

অত ভেবো না ডার্ক। ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেবার চেষ্টা করো। বলে বিল চলে গেল।

এটো কাপপ্লেট ধুয়ে টেবিলটা সাফ করলাম। বড় ফোঁড়া পাকা ধরলে যেমন যন্ত্রণা হয় আমি ভেতরে ভেতরে তেমন যন্ত্রণা অনুভব করছি। ফোঁড়াটার নাম হ্যাংক স্মেডলি। সিগারেট খেতে খেতে সুজির কথা ভাবতে ভাবতে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। দুপুর একটা নাগাদ বিল ফিরে এল।

দুটো স্টেক কিনে এনেছি, বলে সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। আমার কিন্তু খাবারের কোন উৎসাহ নেই।

দুটো প্লেটে দুটো স্টেক এনে বিল টেবিলে রাখল। আমরা বাদামী পাউরুটি দিয়ে সেগুলো শেষ করলাম।

বিল বলল, আমি ওয়াটার ফ্রন্টে গেছিলাম। রাত আড়াইটেয় হ্যাংকের নাইট ক্লাব ভেঙ্গে যায়। সবাই যে যার বাড়ি চলে যায়। আমরা যখন ওখানে পৌঁছাবো তখন ধারে কাছে কেউ থাকছে না।

চমৎকার কাজ করেছে বিল, আধ খাওয়া স্টেকটা সরিয়ে রেখে বললাম। চমৎকার। তাহলে দুটো নাগাদ ওখানে গিয়ে কাজ করতে হবে। আমায় ভেতরে যেতে হবে তার ওপর ওয়াটার ফ্রন্টের কনস্টেবল দুজনের যাতে নজরে না পড়ি সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বিল জোর গলায় বলল, আমরা ওখানে যাব ডার্ক।

যাবার যখন সত্যিই ইচ্ছে তখন চলল। তোমার কাজে লাগবে।

ডার্ক তোমার মাথায় নিশ্চয়ই সব জট পাকিয়ে আছে। তাই না?

এই কালো বেজন্মাটাকে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত সুস্থির হতে পারছি না। ওকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু ওকে আমি খুন করব না, ওকে এমন শিক্ষা দেব যার কথা ও জীবনে ভুলবে না।

জানি সেকথা, তুমি আগেও আমায় বলেছো। তুমি বোমা মেরেব্ল্যাক ক্যাসেট উড়িয়ে দেবে। খুব ভাল কথা কিন্তু হ্যাংককে শায়েস্তা করার পর কি করবে?

সে নিয়ে ভাববার মত যথেষ্ট সময় আছে। এখন বেরোচ্ছি। পরে দেখা হবে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই আমি হেঁটে সোজা পুলিশ হেডকোয়ারটার্সে গেলাম। ডেস্ক সার্জেন্ট চার্লি ট্যানার আমার পরিচিত। তাকে বললাম যে সার্জেন্ট জো বিগলারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

চার্লি বলল, আমি সব শুনেছি ডার্ক। সত্যিই আমি দুঃখিত। সোজা ওপরে চলে যান। জো ঐখানেই আছে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে জো আমার সঙ্গে করমর্দন করলো। বুঝলাম ও সহানুভূতি জানাতে চাইছে। কিন্তু এই সহানুভূতি আমার ভেতরের জ্বালাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিল।

কোনও খবর আছে জো?

আছে। কিন্তু তেমন বিশেষ কিছুনয়। একজন সাক্ষী যে গোটাব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছে ও গাড়িটারনম্বরও নিয়েছিল। আমরা সেইনম্বর ধরে খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম ওটা চোরাই গাড়ি। দুটো লোকেরই হাতে দস্তানা ছিল। কাজেই গাড়ির ভেতর আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায় নি। গাড়ি যে চালাচ্ছিল সে কালো এটুকুই শুধু জেনেছি। তবে আমরা এখনও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।

ড্রাইভার কালো ছিল এ সম্পর্কে তোমাদের সাক্ষী নিশ্চিত?

 হ্যাঁ, সে শপথ করে তাই বলেছে।

তোমরা যথেষ্ট করেছ। যাক, আর তোমার সময় নষ্ট করবো না বলেই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে এলাম। এতক্ষণে আমিও নিশ্চিত হলাম যে হ্যাংক ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত।

হাঁটতে হাঁটতে ওয়াটার ফ্রন্টে এলাম। বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। হ্যাংক নিশ্চয়ই তার নাইট ক্লাবের নরকগুলজারের জন্য তৈরী হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আমি ওয়ালিনস্কির ইয়াটটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। অনেক টুরিস্টকে দেখলাম প্ল্যাস্টিকের মাকিন্টস গায়ে জড়িয়ে আমার মতই সেই দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের ভীড়ে মিশে গেলাম।

ইয়াটের ডেকের ওপর লু গেরান্ডা পায়চারী করছে আর মাঝে মাঝে টুরিস্টদের লক্ষ্য করে গালি গালাজ করছে। মনে মনে বললাম হ্যাংককে শায়েস্তা করার পর এই ইয়াটটা ডুবিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। একটা ছোট মাইন হলেই হবে। আলি হাসান সেটা যোগাড় করে দেবে। মোটা টাকা দিলে ও সবকিছুই দিতে পারবে।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এসে দেখি বিল বেরিয়েছে। হাতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। ভাবতে লাগলাম আজ রাতে আমার আঘাত হানার পালা। পাল্টা আঘাত।

বিল রাত আটটায় ফিরল। তার এক হাতে একটা ব্যাগ আরেক হাতে একটা প্লাস্টিকের থলে।

ব্যাগ আর থলে নামিয়ে বিল বলল, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে। আগে খেয়ে নিই, বলেই ও রান্নাঘরে ঢুকল। আমারও খিদে পেয়েছে। তবে সে খিদেটা পেটে নয় সর্বশরীরে। বদলা নেবার খিদেয় আমি জ্বলছি।

বিল দুটো প্লেটে নরম হ্যামবার্গার এনে টেবিলে রেখে বলল, চলে এসো ডার্ক, ভেবে ভেবে মাথাটা খারাপ কোর না।

হ্যামবার্গার মুখে পুরে বললাম, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

বাইরে ঘুরছিলাম। শোন ডার্ক, আগে চলো হ্যাংককে শায়েস্তা করি তাহলে হয়তো তোমার মাথাটা ঠাণ্ডা হবে।

তোমার ব্যাগে কি আছে?

বাঃ! হ্যাংকের নাইট ক্লাবে ঢুকতে হবে না? ওখানকার কাজ সেরে ওর গাড়িটা ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দিতে হবে না ব্যাগের ভেতর সেইসব সরঞ্জাম আছে।

হ্যামবার্গার শেষ করে বললাম, বিগলারের সঙ্গে কথা বলেছি। পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি বটে কিন্তু একজন সাক্ষী ওরা খুঁজে বার করেছে। সে লোকটা বলছে যে গাড়ির ড্রাইভার কালো ছিল।

সে আমরা কম বেশি সবাই জানি, বলে বিল রান্নাঘরে গিয়ে আরও দুটো হ্যামবার্গার নিয়ে এল। দেখি আটটা পঁয়ত্রিশ বাজে। সময় কিভাবে কেটে যায়।

খাওয়া শেষ হলে সিগারেট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে বসলাম।

নটা নাগাদ বিলকে বললাম বিল, আগে চলো বোমাটা যোগাড় করি।

আমি তো একপায়ে খাঁড়া আছি। আমার হাতে এখন কোন কাজ নেই।

বিলকে গাড়িতে বসিয়ে হাসানের পুরোনো মালের দোকানে গেলাম। হাসান আমাকে দেখেই এগিয়ে এল।

চাপা গলায় বললাম, ওটা তৈরী করা হয়ে গেছে?

হা মিঃ জো। চমৎকার মাল বানিয়েছি। ঝেড়ে আরাম পাবেন। আপনার প্রত্যেকটা ডলার উসুল হয়ে যাবে।

তাহলে ওটা নিয়ে আসুন। আপনার দাম আমি দিয়ে দিচ্ছি।

এক্ষুণি আনছি মিঃ জো। ভাল করে শুনুন, ওটার মাথায় একটা সুইচ আছে সেটাকে ডানদিকে ঘুরিয়ে দিলেই দশ মিনিটের মধ্যেই পুরো মালটা ফেটে যাবে। যতক্ষণ সুইচ না ধরছেন ততক্ষণ কোন ভয়ও নেই। সুইচ ঘুরিয়ে ওটা ফেলে দিতেও পারেন।

একটু আড়ালে গিয়ে বাকি টাকাটা হাসানকে দিলাম। সে সেগুলো গুণে কোমরে গুজল, তারপর স্টলের ভেতর থেকে একটা ছোট প্ল্যাস্টিকের থলে এনে আমাকে দিল। এই নিন। মাথার সুইচটা ডানদিকে ঘুরিয়ে দিয়েই দূরে সরে যাবেন। দশমিনিটের ভেতর ভীষণ জোরে আওয়াজ হবে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও হবে।

আমার আর একটা জিনিস দরকার। একটা মাল আমার দরকার যা একশো ফিট লম্বা একটা ইয়াটকে ডুবিয়ে দিতে পারে। আপনার হাতে তেমন কিছু আছে?

এতে একটু বেশি খরচ পড়বে মিঃ জো। আমি ব্যবস্থা করতে পারি কিন্তু আমার একজন মেরিন সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলে সব বন্দোবস্ত করতে হবে। লোকটা একটু বেশি দর হাঁকে।

আপনি যোগাড় করতে পারবেন কিনা তাই বলুন?

টাকা পেলে সবকিছুই যোগাড় করা যাবে।

পরে আপনার সঙ্গে দেখা করব। বলে আমি থলে হাতে করে গাড়িতে উঠলাম। পেছনের সীটে থলেটা রেখে স্টার্ট দিতেই বিল বলল, ঐ বুঝি সেই মাল?

হ্যাঁ, এবার বাড়ি গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।

 মাঝপথে ফাটবে না তো?

আরে না, সেই ভয় নেই।

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে বিলকে বললাম এখনও পাঁচঘণ্টা সময় আছে। একটু কফি খেয়ে নেওয়া যাক।

নিশ্চয়ই, বলে বিল রান্নাঘরে ঢুকল।

কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এল দুকাপ কফি নিয়ে। আমার সামনে একটা কাপ রেখে বলল, আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি, বেরোবার আগে ডেকো কিন্তু।

ঘাড় নেড়ে আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম। রাত পৌনে দুটোয় বিলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললাম, ওঠো, সময় হয়েছে। আর দেরী করে লাভ নেই।

বোমা সমেত প্ল্যাস্টিকের থলে আর ক্লু কুক্স লেখা নোটিশটা সঙ্গে নিয়ে বিল আর আমি গাড়ি চালিয়ে ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় এসে হাজির হলাম। বৃষ্টি পড়ছে, ধারে কাছে লোকজন নেই। টুরিস্টরাও বহুক্ষণ আগে হোটেলে ফিরে গেছে। সেই কনস্টেবল দুটোকেও দেখতে পাচ্ছিনা। ব্ল্যাক ক্যাসেট নাইট ক্লাবের একশো গজ দূরে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে পা টিপে টিপেনাইট ক্লাবের পেছনের দিকে এগোলাম। একটা জানলা খোলা দেখে ভেতরে উঁকি দিলাম। এটা রান্নাঘর। ভেতরে একটা কালো তার নোংরা অ্যাপ্রন খুলে রাখছে। আর একটা মনের সুখে একটা হট ডগ চিবোচ্ছে। আমি ফিরে এসে গাড়িতে ঢুকলাম।

যাক ভেতরে ঢোকার কোন অসুবিধে হবে না। পেছনে রান্নাঘরে একটা জানলা আছে।

রাত আড়াইটে নাগাদ ক্লাবের সব আলো নিভে গেল। হৈ-হৈ করতে করতে প্রায় গোটা ত্রিশেক কালো ছেলে মেয়ে নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাঁটতে লাগল।

আরও আধঘণ্টা বাদে হ্যাংক স্মেডলি তার বিশাল গরিলার মত শরীরটা নিয়ে নাইট ক্লাব থেকে বেরোল। তার পাশে আরও একজন লোক সে কিন্তু কালো নয়। তার গায়ের রং বেশ সাদা। দূর থেকে ঠিক বোঝা গেল না। লোকটার গায়ে সাদা রংয়ের জ্যাকেট আর মাথায় চওড়া কান ঢাকা দেওয়া টুপি। হ্যাংক নিজের হাতে নাইট ক্লাবের দরজায় তালা লাগাল তারপর সাদা লোকটিকে নিয়ে সামনে দাঁড় করানো ওসমোবাইলের দরজা খুলে ভেতরে বসল। তারপর গাড়ি চালিয়ে নিমেষের মধ্যে তারা অদৃশ্য হল।

 বিল বলল, টুপিপরা লোকটা কে বলো তো? ওর গায়ের রং সাদা কিন্তু হ্যাংকের নাইটক্লাবে তো সাদাদের ঢোকার নিয়ম নেই।

আমার জেনেও কোনও দরকার নেই বিল। চলে এসো, নষ্ট করার মত আর এক মুহূর্তও সময় নেই আমার।

বিলের হাতে একটা বড় কাঁচভাঙ্গা রবারের হাতুড়ী। নাইট ক্লাবের পিছনে গিয়ে সেই হাতুড়ীর এক ঘা রান্নাঘরের জানলার পাল্লায় মারতেই একখানা কাঁচ ভেঙ্গে পড়ল। সেই ভাঙ্গা পাল্লার ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে সে ছিটকিনি খুলে ফেলল। তারপর খোলা জানালাপথে দুজনে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আমার সঙ্গে একটা জোরালো টর্চলাইট ছিল। সেটা জ্বালিয়ে বিলকে বললাম, আমি বোমাটার ব্যবস্থা করছি। তুমি ক্লু কু ক্ল্যান লেখা নোটিসটা নিয়ে সদর দরজায় এঁটে দিয়ে এসো।

বিল সদর দরজায় এগোল, আমি রিভলবার বের করে পাতি পাতি করে খুঁজে দেখলাম ভেতরে কেউ আছে কিনা। তারপর বারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোমার সুইচটা ডানদিকে ঘুরিয়ে সেটা একটা টেবিলের ওপর রাখলাম। তারপর দ্রুতপায়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে টপকে দৌড়িয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। বিল আগেই গাড়িতে বসেছিল, আমায় দেখেই বলল, ডার্ক আমরা ঠিক দূরত্বে আছি তো?  তাই তো মনে হচ্ছে। দাঁড়াও, দৃশ্যটা কেমন জমে আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।

স্টিয়ারিং হুইল চেপে ধরে ঘাড় ফিরিয়েনাইট ক্লাবের দিকে তাকালাম। আর মনে মনে সেকেণ্ড গুনতে লাগলাম। সুজির মৃত্যুর বদলা নেবার এই হল প্রথম ধাপ। এক…দুই……তিন…চার…

দশ মিনিট একসময় পেরিয়ে গেল। কিছুই হল না। বিল বিরক্ত হয়ে বলল, ধ্যাৎ ওটা বোমা না কচু। একগাদা পয়সা নিয়ে তোমার হাতে একটা বাচ্চাদের খেলনা ধরিয়ে দিয়েছে।

দাঁড়াও চুপ! এত অধৈর্য হয়ো না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড শব্দ করে বোমাটা ফাটল। তার ধাক্কায় আমাদের গাড়িটাও কেঁপে উঠলো।

নাইট ক্লাবের সামনের জানলাগুলো ভেঙ্গে ছিটকে পড়ল ওয়াটার ফ্রন্টের রাস্তার ওপর। ছাদখানাও ভেঙ্গে খসে পড়ল। আরও শব্দে নাইট ক্লাবের ভেতরের দেওয়ালের কড়ি বরগা সব খসে পড়তে লাগল।

আমার চাওয়ার চাইতেও কিছুটা বেশিই ঘটল। এবার দমকল পুলিশ সব ছুটে আসবে। আর দাঁড়ানো উচিত নয়। ভেবে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলাম।

বিল বলল, নাঃ, বোমাটা সত্যিই ভাল জাতের। ব্ল্যাক নাইট ক্লাবের ব্যবসার বারোটা বাজল। এবার কি করবে?

হ্যাংকের গাড়ি কোন্ গ্যারেজে থাকে জানো?

নিশ্চয়ই।

তাহলে চলো এবার ওর গাড়িটা ভেঙ্গে দিয়ে আসি।

বিলের নির্দেশমত সীগ্রোভ রোডে পৌঁছে মাটির নীচে একটা গ্যারেজে ঢুকলাম। দুজনের হাতেই দুটো বড় হাতুড়ী। কেউ কোথাও নেই দেখে দুজনে একসঙ্গে হ্যাংকের ওসমোবাইল গাড়িটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি গাড়িটার জানালার দরজার কাঁচ ভেঙ্গে গুঁড়ো করলাম, আর বিল মোটর ও ইঞ্জিন ভাঙ্গল।

তারপর চারটে টায়ার ছুরি দিয়ে ফাঁসিয়ে গাড়ির দরজার গায়ে লিখে দিলাম। কে কে কেক কুক্স ক্যান।

এবার ফিরে এসে গাড়িতে বসে স্টার্ট দিতেই বিল বলল, কি এবার মন ভরেছে?

হ্যাঁ, আজ একটু শান্তিতে ঘুমোত পারব। ধন্যবাদ বিল।

.

সুজি মারা যাবার পর সত্যিই এই প্রথম আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাড়ি কামিয়ে স্নান সারতে সারতে সোয়া এগারটা বেজে গেল।

বিল দুটো ডিম সেদ্ধ শেষ করে আরেকটা মুখে পুরতে পুরতে বলল, যাক, একটাআপদ বিদেয় হয়েছে।

তাইতো মনে হচ্ছে। হ্যাংক গাড়িটা ড্রাইভ করেছিল ঠিকই কিন্তু সুজির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল অন্য লোক। সে ব্যাটাকে শায়েস্তা করতে হবে।

খাওয়া শেষ করে বিলকে নিয়ে ওয়াটার ফ্রন্টে এলাম। ব্ল্যাক ক্যাসেটের একশোগজের ভেতর পুলিশের কর্ডন, চারপাশে লোকের ভীড়। ব্ল্যাক ক্যাসেট নাইট ক্লাবের দিকে তাকিয়ে নিজেই চমকে উঠলাম। দেখে মনে হয় বোমারু বিমান থেকে তার ওপর বোমা ফেলেছে। একপাশে একখানা দেওয়াল ছাড়া আর কোনও চিহ্ন নেই। দমকলের লোকেরা জঞ্জাল পরিষ্কার করছে। ভীড়ের ভেতর হঠাৎ চোখে পড়ল ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর টম লেপস্কি দমকলের একজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলছে। বিলকে গাড়িতে রেখে আমি লেপস্কির দিকে এগিয়ে গেলাম।

যে দুটো কনস্টেবল পাহারা দেয় একজন এগোতেই আমি লেপস্কির নাম ধরে ডাকলাম, অ্যাই টম! লেপস্কি আমার গলা শুনেই ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে হাত নাড়তেই কনস্টেবল সরে গেল।

লেপস্কি নাইট ক্লাবের ভাঙ্গা দরজাটার দিকে ইঙ্গিত করে, দেখ কাণ্ড, এমন কাণ্ড এর আগে কখনও এখানে ঘটে নি।

ভেতরের খুশি ভাব গোপন রেখে বললাম, বোমা মেরে মনে হয় কেউ এটা করেছে।

লেপস্কি মুচকি হেসে বলল, ঠিক তাই। শালাদের বড় বাড় বেড়েছিল। একটু উচিত শিক্ষা পাওয়া দরকার ছিল, যেই করে থাকুক কাজের কাজ করেছে।

ভুরু কুঁচকে বললাম, আমারও তাই মনে হচ্ছে। আড়চোখে দেখলাম লেপস্কি তীক্ষ্ণচোখে আমাকে বোঝবার চেষ্ঠা করছে।

লেপস্কি বলল, দরজায় ক্লু ক্লুক্স ক্ল্যানের একটা নোটিশ আঁটা ছিল। কিন্তু ওটা যে পুলিশকে ধোঁকা দেবার জন্য তা বুঝতে আমার বাকি নেই। আসলে এমন কেউ বোমাটা মেরেছে হ্যাংক স্মেডলির ওপর যার চাপা রাগ ছিল।

হয়তো তোমার কথাই ঠিক। স্মেডলির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?

নিশ্চয়ই তাছাড়া শুধু এটাই নয়। সে ব্যাটা হ্যাংকের গাড়িখানাও ভেঙ্গে গুড়ো করে দিয়েছে। স্মেডলির শুধু পাগল হতে বাকি। বারবার আমাদের দপ্তরে গিয়ে চিৎকার করে বলছে, আমি জানতে চাই আপনারা আসল লোককে ধরবেন কিনা। আমরা আমাদের কাজ ঠিকই করে যাব। তবে ওর কথায় কিছু আসবে যাবেনা। এটা ওর পাওনা ছিল। লেপস্কি আমার দিকে পুলিশি চোখে তাকিয়ে, ডার্ক, শুনলাম তুমি এজেন্সীর চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছো?

হ্যাঁ, সুজির ব্যাপারটার পর কাজে মন লাগাতে পারছিলাম না। হয়তো কিছুদিন পর আবার কাজে লাগব। আমার চাকরীটা ওখানে ঠিকই থাকবে। তা বলো টম, সুজির ব্যাপারে তোমাদের তদন্ত কতদূর এগোল?

তদন্ত এখনও চলছে। আমরা আরেকজন সাক্ষীকে খুঁজে বের করেছি। যে ব্যাটা সুজির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল তার চেহারার বর্ণনা আমরা সেই সাক্ষীর কাছে পেয়েছি। তবে খুব একটা পরিষ্কার নয়। লোকটার নাকি চওড়া কাধ, গায়ে সাদা জ্যাকেট আর মাথায় বনাত দেয়া একটা টুপি ছিল। এই রকম বর্ণনার লোককে আমরা খুঁজছি।

মনে পড়ল গতকাল রাতে এইরকম বর্ণনা অনুযায়ী একটা লোককে হ্যাংকের পাশে হাঁটতে দেখেছিলাম। ওরা নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে একসঙ্গে গাড়িতে উঠেছিল।

এখনও লেপস্কি তীক্ষ্ণচোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে চোখ পড়তেই সে বলল, শোন ডার্ক, হ্যাংকের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আমরা আর এখানে ঝামেলা করতে চাই না। এখানে, বোমা ফাটার খবর কিন্তু রেডিওতে বলা হয়েছে। জানো তত বড়লোকেরা বোমাকে ভীষণ ভয় পায়। সামনের মাসে এখানকার হোটেলগুলোতে যাদের আসবার কথা ছিল তারা সবাই বুকিং ক্যানসেল করেছে। আমরা এখানে আর কোন বোমাবাজি চাই না। ডার্ক আমি কি বলতে চাইছি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?

আমায় এসব কথা বলে কি লাভ টম? যে বোমা ছুঁড়েছে তাকে ধরে বোঝাও গে। দেখো সে তোমার কথা শোনে কিনা।

তোমার যা খুশি করতে পার ডার্ক। সে তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি বলে রাখছি যে আর একটা বোমা ফাটলে আমরা কিন্তু বসে থাকব না। সে লোকটাকে ঠিক পাকড়াও করব। আর একবার ধরতে পারলে কম সে কম পনেরো বছরের জন্য জেলের ঘানিতে জুড়ে তবে ছাড়ব।

এসব তুমি তাকেই বলো গিয়ে, আমায় খামোক শোনাচ্ছো কেন? চলি আবার দেখা হবে। বলে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেলাম।

বিলকে আর কিছুক্ষণ গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে সোজা গিয়ে নেপন সরাইখানায় ঢুকলাম। দুজন গগলস চোখে টুরিস্ট অ্যাল বার্নির ছবি তুলছিল। ছবি তোলা হতে তার হাতে দশ ডলারের একটা নোট গুঁজে দিয়ে তারা চলে গেল। আমি এবার গিয়ে বার্নির মুখোমুখি বসলাম।

কেমন আমদানি হচ্ছে অ্যাল? টুরিস্টদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি আসছে?

তা তো আসছে মিঃ ওয়ালেস। আগামী মাসে আরও কিছু টুরিস্ট আসবে। হ্যাংক স্মেডলির কারবারের তো বারোটা বেজেছে শুনেছেন নিশ্চয়ই। ব্যাটার এটা পাওনা ছিল।

অ্যাল, চওড়া কাধ, সাদা জ্যাকেট গায়ে, মাথায় চওড়া বনাত দেওয়া টুপি আছে এমন কাউকে তুমি চেনো?

বার্নি ভুরু কুঁচকে বলল, নুলা মিনস্কি। খুব সাবধান মিঃ ওয়ালেস। ওর ধারে কাছে ঘেঁষবেন না।

লোকটা কে?

বার্নি ভয়ে গলা নামিয়ে বলল, ও ওয়ালিনস্কির পোষা গুণ্ডাদের মধ্যে একজন। বিষাক্ত সাপের মত ভয়ঙ্কর।

ওকে কোথায় খুঁজে পাব?

এখানে এলে ও হ্যাংক স্মেডলির সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। মাসের পয়লা তারিখে ও মাফিয়ার টাকা আদায় করতে এখানে আসে।

ধন্যবাদ অ্যাল। বলে বার্নির কাঁধে একটা চাপড় মেরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। বিল, পুলিশ কিন্তু বুঝতে পেরেছে যে বোমাটা আমিই ছুঁড়েছি। লেপস্কি আমায় হুঁশিয়ার করেও দিল কিন্তু ওদের হাতে কোন প্রমাণ নেই।

বিল সীটে গা এগিয়ে বলল, হুম। নুলা মিনস্কিকে নিয়ে কি করবে?

সত্যি বলছি বিল, ওকে প্রাণে মারব না। কিন্তু এমন বেধড়ক ধোলাই দেব যাতে কোমরের নীচ থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত একখানা হাড়ও আস্ত না থাকে। আমার হাতে মার খেলে ওকে বাকি জীবনটা হুইল চেয়ারে বসে কাটাতে হবে। বলতে বলতে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলাম।

কবে ঠ্যাঙ্গাচ্ছ ওকে?

আজ রাতে। সাতটা নাগাদ আমরা হ্যাংকের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে হানা দেব।

 ওদের দুজনকে একসঙ্গে সামলানো কিন্তু আমাদের পক্ষে মুশকিল হবে।

ঠিক আছে। আমরাও ওদের মুশকিলে ফেলব।

বিল বলল, তুমি মিনস্কিকে প্যাদাবে আমি প্যাদাব হ্যাংককে। ঐ শালার ওপর আমার রাগ জমেছে। আমার হাতদুটো নিসপিস করছে।

ভাল বুদ্ধি বাতলেছ বিল।

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে বিল অস্থিরভাবে এ ঘর সে ঘর করতে লাগল। আমি সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে বসলাম।

টেলিফোন বাজতেই আমি রিসিভার তুলে ধরলাম।

মিঃ ওয়ালেস? যুবতীর গলা ভেসে এল।

ঠিক ধরেছেন। আপনি কে?

আমি মিঃ ওয়ালিনস্কির সেক্রেটারী। মিঃ ওয়ালিনস্কি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। দয়া করে আজ বিকেল পাঁচটায় স্প্যানীশ বে হোটেলে আসুন। আমি আপনার জন্য লবীতে অপেক্ষা করব তারপর আপনাকে নিয়ে মিঃ ওয়ালিনস্কির স্যুটে যাব।

উত্তর দেবার আগেই লাইন কেটে গেল। রিসিভার নামিয়ে বিলকে সব বললাম।

বিল শুনে শিস দিয়ে উঠল। আমরা জানি যে পূর্ব উপকূলের এই এলাকায় স্প্যানীশ বে হোটেল হল সবচাইতে সেরা এবং বিলাস ও ব্যয়বহুল হোটেল।

বিল বলল, তা তুমি কি সত্যিই যাবে ওখানে?

হ্যাঁ আমি যাচ্ছি।

আমি স্প্যানীশ বে হোটেলে ঢুকলাম বিকেল পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট আগে। চারপাশে বিলাসের নানারকম আয়োজন ছড়ানো। তার মাঝখানে বড়লোক যাত্রীরা আসা যাওয়া করছে। রিসেপশান ডেস্কের পাশেই স্যান্ড্রা অপেক্ষা করছিল। লম্বা পাতলা ছিপছিপে চেহারা, পিঠ পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, সবুজ চোখের মণিতে দুর্বার জীবন যাপনের ছায়া। সে চোখে চোখ রাখলে যে কোন পুরুষের শরীর উত্তেজনা আর আতঙ্কে শিউরে উঠবে। স্যান্ড্রার পরনে একটা সাদা শর্ট কোট আর মানান সই শার্ট। এমন একটি যুবতীর দাম নিঃসন্দেহে কয়েক কোটি ডলার।

যুবতী এগিয়ে এসে বলল, মিঃ ওয়ালেস? আমার নাম স্যান্ড্রা। পদবী জেনে আপনার প্রয়োজন নেই। সবাই আমায় স্যান্ড্রা বলেই জানে।

পরিচিত হয়ে সুখী হলাম, বলে আড়চোখে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম। স্যান্ডার উদ্ধত দুটি স্তন, সরু চাপা কোমর, চওড়া নিতম্ব আর একজোড়া লম্বা পা যে কোন পুরুষকেই আকৃষ্ট করবে। এক কথায় সে মোহিনী।

মিঃ ওয়ালিনস্কি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান মিঃ ওয়ালেস। ওর সঙ্গে কথা বলতে হুঁশিয়ার। উনি কি সাংঘাতিক টাইপের লোক তা সামনে থেকে কথা না বললে বুঝতে পারবেন না।

আমায় নিয়ে স্যান্ড্রা লিফটে উঠল। সাততলায় পৌঁছে লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে চাবি দিয়ে একটা স্যুটের দরজা খুলতে খুলতে সে আবার বলল, খুব হুঁশিয়ার। দরজা খুলে আমায় ভেতরে যাবার ইঙ্গিত করল। আমি ভেতরে পা রাখতেই সে গলা চড়িয়ে বলল, মিঃ ওয়ালিনস্কি, মিঃ ওয়ালেস আসছেন। বলে আমার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আবার বলছি মিঃ ওয়ালেস! হুঁশিয়ার! যান, সোজা এগিয়ে যান। উনি ব্যালকনিতে অপেক্ষা করছেন।

ব্যালকনিতে পা রাখতেই হতাশ হলাম। শুনেছিলাম ওয়ালিনস্কি এক নামজাদা মাফিয়া দলের সর্দার। তার ওপর ব্ল্যাকমেলার। ভেবেছিলাম তার চেহারাটাও হবে দেখবার মত।

কিন্তু আদৌ তা নয়। যেসব বেঁটে মোটা ব্যবসায়ীরা এখানে বেড়াতে আসে ওয়ালিনস্কি ঠিক তাদেরই মত দেখতে। গায়ের রং কিছুটা তামাটে। মাথায় টাক। পরনে নীল রংয়ের স্যুট। গোল মুখ, নাকখানা বেজায় ছোট। পাতলা ঠোঁট। কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্য। তার গোটা চেহারাকে আর সবার চাইতে আলাদা করেছে সেহল তার ফ্যাকাশেনীল চোখ জোড়া। সে দিকে তাকালে তার মনোভাব বোঝা যায় না।

আপনি এসে ভালই করেছেন মিঃ ওয়ালেস। বলতে বলতে সে হাত বাড়িয়ে দিল। একটু ইতস্ততঃ করে তার হাতে হাত মেলালাম।

বসুন, দেখে তো মনে হচ্ছে আরও বৃষ্টি হবে, এখানেই বসা যাক। বলে সেব্যালকনির একপাশে রাখা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করল। মাঝখানে ছোট একটা টেবিল। আমার মুখোমুখি সে বসল।

আমি বসতে বসতে বুঝলাম যে সে তার ধূসর নীল চোখ দিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে দেখছে।

চায়ের সময় এখনও হয়নি। একটু কফি চলবে?

না, ধন্যবাদ।

তাহলে চা-ই খান।

 বেশ। তাহলে কাজের কথাটা শুরু করা যাক। সময় নষ্ট করা আমাদের উচিত নয়।

জো ওয়ালিনস্কি বলল, মিস সুজি লংয়ের মৃত্যুর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মিঃ ওয়ালেস, বিশ্বাস করুন এই নিষ্ঠুর কাজটা আমায় পুরোপুরি না জানিয়ে করা হয়েছে। অবশ্য কাজটা যে করেছে সে আমারই অধীনস্থ লোক। লোকটার মনে দয়ামায়া বলে কিছু ছিল না। টাকার জন্য সে সব কিছু করতে পারত। ব্যাপারটার জন্য ওর কাছে যখন আমি কৈফিয়ত চাইলাম তখন ও বলল যে, ঐ কাজটার জন্য ও পাঁচ হাজার ডলার পেয়েছিল। আর এও বলল যে হ্যাংক স্মেডলি একজনের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ওকে দিয়েছিল, আর যে টাকাটা দিয়েছিল হ্যাংককে কাজটা সেই করতে বলেছিল। আমার নোকটা জানত না সে লোকটি কে। আমি একটু চাপ দিতেই সে বলেছিল এটা নিছক বদলা নেওয়ার একটা ব্যাপার।

আমার মন চলে গিয়েছিল কয়েকদিন আগে ব্যাঙ্কে সেই ঘটনার দৃশ্যে যখন অ্যাঞ্জেলা থরসেন চলে যাবার আগে বলেছিল এর ফল আপনাকে পেতে হবে। হাড়ে হাড়ে পেতে হবে বলে শাসাচ্ছিল। সুজির মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার জন্য তাহলে কি অ্যাঞ্জেলাই হ্যাংককে লাগিয়েছিল? তাকে পাঁচহাজার ডলার দিয়েছিল?

ওয়ালিনস্কি বলল, মিঃ ওয়ালেস! আপনি স্মেডলির হিসেব চুকিয়ে দিয়ে ওর পাওনা পুরো বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমিও তেমনি লোকটিকে তার পাওনা হিসেব পুরোপুরি বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার দলের অন্যান্য লোকেরাই তার ব্যবস্থা করেছে। আমার দলের লোকেরা গোলমাল বা ঝামেলা জিইয়ে রাখে না। পুরোপুরি শেষ করে দেয়। এ লোকটিরও তাই করা হয়েছে। স্মেডলিকে আমি আর দলে রাখছিনা। আপনি চাইলে ওকেও জানে খতম করে দিতে পারি। বলুন, আপনি তাতে খুশি হবেন?

তার মানে, আপনি ইঙ্গিত করলেই আপনার দলের লোকেরা হ্যাংককে শেষ করে ফেলবে?

সোজা কথায় তাই বোঝয় মিঃ ওয়ালেস। কিন্তু সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আপনি রাজি কিনা একবার বলুন।

তাহলে ওকে বরং বাঁচিয়ে রাখুন।

আপনি সত্যিই মহান মিঃ ওয়ালেস। আপনি সত্যিই দয়ার শরীর নিয়ে আছেন। ওরা দুজনে মিলে আমার প্রেমিকার অমন দশা করলে আমি কিন্তু ক্ষমা করতে পারতাম না।

ওকে বাঁচতে দিন। আমি ওর পুরোপুরি বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব।

 সে তো একশোবার।

তার কথা শেষ হতেই স্যান্ড্রা ট্রেতে কফির পট আর কাপ সাজিয়ে নিয়ে এল। দুধ ছাড়া কালো কফি। কফি রেখে চলে যেতে আমি আড়চোখে তার দেহে মনে দোলা দেওয়া শরীরের দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম ওয়ালিনস্কি তীক্ষ্ণচোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই রসিয়ে রসিয়ে বলল, ও খুব কাজের মেয়ে। ওর বাবা একসময় আমার হয়ে কাজ করত। সে মারা যাবার পর ওকে আমার সেক্রেটারী করে রেখেছি। এখন আর ওকে ছাড়া আমার চলে না।

ওয়ালিনস্কি কফির কাপে চুমুক দিল। আমি চুপ করে রইলাম।

তাহলে কাজের কথায় আসা যাক মিঃ ওয়ালেস। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন। আমি আপনাকে খুশি করতে চাই। আমার দলের সে লোকটি আর বেঁচে নেই। স্মেডলিকে নিয়ে আপনি কি করবেন না করবেন তা পুরোপুরি আপনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। এখন ব্যাপার হল, আপনি যে স্মেডলির নাইট ক্লাব বোমা মেরে ভেঙ্গে দিয়ে তাড়াতাড়ি বদলা নিয়েছেন তা আমার বুঝতে বাকি নেই। এই শান্ত শহরে কোথাও একবার বোমা ফাটলে ধনী লোকেরা সহজে পা দিতে চায় না। আমি নিজেও এখানে আর বোমাবাজী চাই না। আমি বড়লোকদের নিয়ে এখানে কাজ করি। আরও বোমাবাজি হলে ওরা অন্য কোথাও চলে যাবে। তার ফলে আমার ব্যবসার ভয়ানক ক্ষতি হবে। আপনি বুদ্ধিমান লোক। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। কিন্তু একই সঙ্গে হয় তো আবার নতুন করে ঝামেলা পাকাবার ব্যাপারে আমি আপনাকে বলব দয়া করে এমন কাজটি করবেন না।

ওয়ালিনস্কির হাসি দেখে মনে হল একটা র‍্যাটেল সাপ হাসছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন মিঃ ওয়ালেস, যে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে আমার দলের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে আছে। কাজেই এই শহরে আর ঝামেলা পাকাবেন না। আপনাকে এটাই উপদেশ দিচ্ছি। যদি করেন তাহলে কিন্তু পরে অনুতাপ করতে হবে। কি বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

আপনার কথা আমার কানে গেছে। বলে উঠে দাঁড়িয়ে একবারও পেছনে না তাকিয়ে স্যুটের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্যান্ড্রা সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। দরজার হাতলে হাত রেখে ও আমার চোখে চোখ রাখল। এই রকম চেহারার মেয়ে আমি আগে কখনও দেখিনি। ওর চেহারাকে কোন কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না। কিন্তু সুজির মত ভালবাসা ওকে তেমনভাবে দেওয়া যায় না। ও আর সব মেয়ের চাইতে আলাদা। ওর সবুজ দুটি চোখে আকর্ষণ আর বিপদের ছায়া সমানভাবে ফুটে উঠেছে। স্যান্ড্রা দরজার হাতল টেনে পাল্লা খুলতেই আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেরোবার মুহূর্তে আমার কানে ও ফিসফিস করে বলল, আজ রাত ঠিক এগারোটায় থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁয় আসবেন, কথা আছে।

ওর কথায় বিশ্বাস হল না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে ও মুখের ওপর দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিল।

.

বেলা দুটোয় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলাম। বিল আমার টেবিলে বসে থরসেন ফাইলের পাতা উল্টে যাচ্ছিল। আমি ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসলাম। বিল গ্লাস হাতে নিয়ে আমার মুখোমুখি বসল। ওয়ালিনস্কির সঙ্গে আমার যা কথাবার্তা হয়েছে সব ওকে খুলে বললাম।

বিল, মাফিয়ার কাজ নয়। আমার যতদূর ধারণা হ্যাংক আর মিনস্কি পাঁচহাজার ডলার পেয়ে এটা করেছে। মিনস্কিকে খুন করে এমন কোথাও ওরা পুঁতে রেখেছে যা কেউ খুঁজে পাবে না। আমাদের ওকে নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন বাকি রইল হ্যাংক… ।

হ্যাঁ, ঐ শালাকে প্যাদানো বাকি আছে।

 শোন বিল, আমরা ওর সঙ্গে দেখা করব। অ্যাসিড ছুঁড়তে কে ওকে টাকা দিয়েছিল সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। মনে হচ্ছে অ্যাঞ্জেলা থরসেনই ওটা করিয়েছে। তবু আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই। ও যদি বলে যে অ্যাঞ্জেলাই কাজটা করিয়েছে, তখন না হয় ওর ব্যবস্থা করা যাবে।

বিল ঘাড় নাড়ল। হু, কিন্তু ঐ গরিলাকে দিয়ে আমরা কথা বলাবো কিভাবে?

তুমি ব্লো-টর্চ দিয়ে কখনও কাজ করেছে?

ওঃ বুঝেছি, আমরা ওর গায়ে হ্যাঁকা দিয়ে কথা বের করে নেব। তাই তো? বিল গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ওয়ালিনস্কিকে তোমার কেমন লাগল ডার্ক?

ভয়ঙ্কর লোক, বিষাক্ত সাপের মত বিপজ্জনক। ওর মত লোককে একদম ঘাঁটানো উচিত নয়। বলে আমি স্যান্ড্রার কথাও বিলকে জানালাম। বললাম যে আজ রাত ঠিক এগারোটায় সে আমায় দেখা করতে বলেছে।

তুমি কি সত্যিই ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবে না কি?

নিশ্চয়ই, কেন যাব না? ভালো কথা, থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁটা কোথায় বল তো?

বিলের নখদর্পণে হোটেল রেস্তোরাঁর খবর। সে বলল, ওটা তো ওয়াটার ফ্রন্টে, ভাল রেস্তোরাঁ। তবে সব মালেরই দাম একটু বেশী নেয়। সলি জোয়েলের ঠেকের পাশেই, এবার মনে পড়েছে?

মনে পড়েছে। যাকগে বিল, এবার দেখো একটা ব্লো-টর্চ যোগাড় করতে পার কিনা। আমি টেলিফোনে হ্যাংকের সঙ্গে কথা বলছি।

বাড়ির দারোয়ানের কাছে নিশ্চয়ই থাকবে। বিল বাইরে বেরোলো। আমি আলমারী খুলে দুটো হাতকড়া বের করলাম। বাক্স থেকে রিভলবারটা বের করে দেখলাম গুলি আছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে পকেটে পুরলাম। তারপর টেলি গাইড খুলে হ্যাংকের নম্বর বের করলাম।

বার কয়েক ডায়াল ঘোরানোর পর হ্যাংক রিসিভার তুলল, ঘোঁত ঘোত করে বলে উঠল, কে ফোন করছ?

মিঃ স্মেডলি? আমি বললাম, পুলিশ হেডকোয়ারটার্স থেকে ফোন করছি।

অ্যাঁ? হ্যাঁ তারপর বলুন, আমার নাইট ক্লাবে যে শুয়োরের বাচ্চা বোমা মেরেছে তাকে খুঁজে বের করেছেন?

ঐ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই মিঃ স্মেডলি, বেশী নয় কয়েকটা কথা। আমরা গোয়েন্দাদের আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি কেমন?

ঠিক আছে, কিন্তু যা করার তাড়াতাড়ি করুন। আমি একঘণ্টার ভেতরে বেরিয়ে পড়ব। বলে হ্যাংক রিসিভার রাখল।

বিল ব্লো-টর্চ হাতে নিয়ে ফিরে এল, হাসতে হাসতে বলল, জিনিসটা নতুন আছে হে, কাজও ভাল দেবে।

ঠিক আছে, আমি বললাম। এবার চলল তাহলে যাওয়া যাক।

 শোন ডার্ক, বিল বলল, এই গরিলাটাকে কিন্তু আমি একা শায়েস্তা করব।

তোমার পাঞ্চ দুটো কাজে লাগাবার জন্যে একদম ছটফটিয়ে মরছ তাই না? হেসে বললাম, চলো সুযোগ তুমি পাবে।

দশ মিনিটে সীগ্রোভ রোডে এসে পৌঁছলাম। শেষ তলায় উঠে বিল বলল, এবার যা করার তা আমি করব।

তাই করো, বলে রিভলবার নিয়ে আমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম, বিলকলিং বেল টিপল। কয়েক সেকেন্ডের পর হ্যাংক বেরিয়ে এলো। খালি গা, একটা আঁটো জিনসের ট্রাউজার্স পরনে। কটমট করে দুচোখ পাকিয়ে ও বিলের দিকে তাকাতে আমি ওর পা থেকে মাথা একপলক দেখে নিলাম। হ্যাংক শুধু স্বাস্থ্যবান নয়, তার শরীর পুরোপুরি পেশাদার বক্সারদের মত।

আপনারা কি পুলিশের লোক? বলেই হ্যাংক বিল আর আমাকে চিনতে পারলো, গরিলার মত ঘোঁতঘোঁত করে বলে উঠল, এবার তোমাদের চিনেছি। তোমরা সেদিন আমার নাইট ক্লাবে একলক্ষ ডলারের গল্প শোনাতে গিয়েছিলে না? ভাল চাও তো কেটে পড়, নয়ত তোমাদের মাংসের কাবাব বানিয়ে ছাড়ব।

হ্যাংক কি বলল বিল ঠিক শুনতে পেলোনা। নীচু হয়ে ঘাড় ঝোকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিল তার ডান হাতে লাগানো পাঞ্চ দিয়ে হ্যাংকের বাঁ দিকের চোয়ালে এক আঘাত হানল। দুচোখ উল্টে হ্যাংক ধুপ করে গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর।

এবার আমাদের পালা, বিল বলল, ডার্ক এবার হাতের সুখ করে নাও।

 দুজনে হ্যাংকের বিশাল লাশখানা ভেতরে এনে মেঝের ওপর শুইয়ে রাখলাম। হ্যাংকের জ্ঞান ফেরেনি, এই ফাঁকে তার হাতদুটো পেছনদিকে নিয়ে হাতকড়া তার দুপায়ের গোড়ালীতে এঁটে দিলাম। থাকুক এইভাবে শুয়ে। বিল উঠে গিয়ে সদর দরজাটা ভেজিয়ে ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিল।

আমি বললাম, সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই, চোখে মুখে জল ছিটিয়ে শালার জ্ঞান ফেরাও।

বিল কোন কথা না বলে আধ বালতি জল এনে হ্যাংকের মাথায় ঢেলে দিল তারপর ব্লো টর্চ জ্বালিয়ে তার তাপ বাড়াতে লাগল।

জলের ছোঁয়ায় হ্যাংকের জ্ঞান আসতেই মাথা ঝাঁকিয়ে বসতে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার পাঁজরে খুব জোরে একটা লাথি কলাম। উঠে সে টের পেল যে তার দুহাত আর দুপায়ে হাতকড়া পরানো হয়েছে। হ্যাংক উঠে বসতেই আমি ডান পা দিয়ে ওর কপালে চাপ দিলাম, ও সঙ্গে সঙ্গে চিৎ হয়ে পড়ল মেঝের ওপর। ফাঁদে পড়া বন্দী বনবেড়ালের মত আমার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে লাগল।

 আমার প্রেমিকার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার জন্য কে তোমায় পাঁচহাজার ডলার দিয়েছিল? আমি প্রশ্ন করলাম।

উত্তর না দিয়ে হ্যাংক হাতকড়া দুটো খোলার জন্য চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু খোলা হলনা। এই হাতকড়া বেশী ছটফট করলে আরো জোরে এঁটে বসে।

তুমি কি বলছে আমার মাথায় ঢুকছে না, ও বিড় বিড় করে বলল।

আমি বিলের দিকে তাকালাম। বিল ওকে এবার ছ্যাঁকা দাও, নয়ত মুখ খুলবে না।

আমি তাই চাইছি, বলে বিল পাম্প করে ব্লো–টর্চের তাপ বাড়ালো। তারপর হ্যাংকের খোলা বুকের ওপর বাগিয়ে ধরল। তাতে হ্যাংকের বুকের সব লোম পুড়ে যেতে লাগল। হ্যাংক চেঁচিয়ে উঠল, তখন আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে ভয়।

ওটা সরিয়ে নাও। হ্যাংক চেঁচিয়ে উঠল, আমি কথা দিচ্ছি বলব।

লোকটা কে? তার পাশে বসে আমি জানতে চাইলাম।

 অ্যাঞ্জি, বলেই হ্যাংক চেঁচিয়ে উঠল, দোহাই ওটা সরিয়ে নাও।

সব খুলে বলল, আমি ধমকে উঠলাম, একদম গোড়া থেকে। বিল আগুনের শিখাটা বুক থেকে সরিয়ে মুখের সামনে নিয়ে আসতেই হ্যাংক চেঁচিয়ে উঠল।

সব খুলে বলো বলছি। আমি এবার গলা চড়ালাম।

অ্যাঞ্জি আমার কাছে এসেছিল। ঐ একলাখ ডলার পেতে বাগড়া দিয়েছিলে বলে ও দারুণ চটে গিয়েছিল। মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার মতলবটা ওরই মাথা থেকে বেরিয়েছিল। সত্যিই ওর মাথা তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ও পাঁচ হাজার ডলারের লোভ দেখাতে আমি হুলাকে ডেকে ব্যবস্থা করতে বললাম। তবে তোমার প্রেমিকাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা আমার ছিল না বিশ্বাস করো। ভেবেছিলাম মুখের এক পর্দা তুলে নিলেই হবে। ও যে দৌড়োতে গিয়ে ট্রাকের নীচে পড়বে তা ভাবতে পারিনি। বিশ্বাস করো।

টাকাটা পেয়েছিলে? আমি ঘৃণাভরা সুরে জানতে চাইলাম।

নিশ্চয়ই, অ্যাঞ্জিও টাকা দেবে বলে কথা দিলে ঠিক দেয়। আমি অর্ধেক নিয়েছি, হুলা বাকি অর্ধেক নিয়েছে।

হুলা কোথায়?

 জানিনা, কাল রাতে ওর ডাক এসেছিল। বলল কাজ আছে, বেরোচ্ছি। তারপর ও ফেরেনি।

হুলা কোথায় গেছে জানো?

না। হ্যাংক আঁতকে বলল, হুলাকে কোন প্রশ্ন করি না। ও কোথায় গেছে আমি জানি না।

ভাবলাম হ্যাংককে বলি যে ওয়ালিনস্কি হলাকে খতম করে দিয়েছে, কিন্তু কি ভেবে চুপ করে গেলাম।

এবার অ্যাঞ্জির প্রসঙ্গে আসা যাক, আমি বললাম, অ্যাঞ্জেলা থরসেন প্রত্যেক মাসে তোমায় দশহাজার টাকা দেয় তাই না?

হ্যাংক অস্বীকারের ভঙ্গি করতেই বিল তার মুখের কাছে ব্লো-টর্চের আগুনটা নিয়ে এল। ছটফটিয়ে হ্যাংক বলল : ঐ টাকা ও আমায় দেয় না, কাজটা কি ভাবে হয় শোন বলছি। হুলা নানা ধরনের কাজে নাইট ক্লাবটাকে ব্যবহার করে, আর তার বদলে প্রত্যেক হপ্তায় ও আমায় পাঁচশো ডলার দেয়। আমি এতেই খুশি থাকি। অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হুলা নিজেই। ও শুধু আমায় থাকতে দেয়। এর বাইরে আমি কিছুই জানিনা, বিশ্বাস করো।

বলে যাও, থেমোনা, আমি বললাম। বিল হ্যাংককে আগুনের ছ্যাকা দিতেই ও তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল।

হ্যাংক কঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার কি দোষ। সবাই আমার নাইট ক্লাবে এসে আমার হাতে একটা করে খাম ধরিয়ে দিয়ে যায়। অ্যাঞ্জিও একটা ওয়ালেট দেয়, তাতে টাকা ভর্তি থাকে। আমি সে সব একটা থলেতে পুরে রাখি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখ হুলা যখন আসে তখন ঐ থলেটা আমি দিই। ব্যস, তারপর আমি আর কিছু জানি না।

অ্যাঞ্জেলাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে কেন?

আমি জানিনা, শপথ করে বলছি আমি এর বিন্দুবিসর্গ কিছু জানি না। হুলাই ঘুরে ঘুরে লোকের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী বের করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। অ্যাঞ্জিও হুলার পাল্লায় পড়েছে। ব্যাপারটা কি আমি জানি না। কিন্তু সেটা এমনই ব্যাপার যে তাকে প্রত্যেক মাসে এতগুলো টাকা দিতে হয়। অ্যাঞ্জির মাথার ঠিক নেই। ওর মাথা বরাবরই খারাপ। সেই ছেলেবেলা থেকেই।

মনে হল হ্যাংক সত্যি কথাই বলছে। হুলার মত একটা নিষ্ঠুর পশুর মত লোক ওর মত এক মোটামাথার লোককে কিছুই বলবে না এটাই স্বাভাবিক।

সব জানার পর হ্যাংককে আমার ভীষণ ঘেন্না করতে লাগল। ঘেন্না করল এই ঘর আর তার ভেতরের আবহাওয়া।

ঠিক আছে বিল। এবার ওর হাতকড়া দুটো খুলে দাও। রিভলবার হাতে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই ফাঁকে বিল ব্লো-টর্চ নিভিয়ে হ্যাংকের হাত আর পায়ের হাতকড়া খুলে দিল। হ্যাংক উঠে বসে কব্জি দুটো রগড়াতে রগড়াতে আমার দিকে তাকাল।

মন দিয়ে শোন হ্যাংক। এই শহরে তোমার আর হলার মনিবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। হুলা এখন কবরের নীচে। ওর সঙ্গে এ জীবনে আর তোমার দেখা হবে না। আমিও এ জীবনে আর তোমার মুখ দেখতে চাই না। তোমায় বারোঘণ্টা সময় দিলাম, তারমধ্যে তুমি এ শহর ছেড়ে চলে যাবে। তারপরেও যদি তোমাকে দেখি তাহলে তোমার দুই হাঁটু তাক করে আমি দুটো গুলি ছুঁড়ব। তারপর তুমি জীবনে আর হাঁটতে পারবে না। যাও, আমার কথা বুঝতে পেরেছে?

ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে হ্যাংক বিড়বিড় করে বলল, আমার যাবার কোন জায়গা নেই। আমার কাছে টাকাকড়িও কিছু নেই।

হ্যাংক, আমি কিন্তু এই শেষবার তোমাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি। বারো ঘণ্টার পর তোমাকে এই শহরে দেখলে তোমার ঠ্যাং দুটো আর আস্ত থাকবে না। কথা শেষ করে আমি বিলকে বললাম, চলে এসো বিল। এই শুয়োরের বাচ্চার গায়ের গন্ধে আমার বমি পাচ্ছে। লিফটে চেপে আমরা নীচে নেমে এলাম। বাইরে সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল। তারই ভেতর হেঁটে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।