০৯. লিটন ট্যাভার্ন নাইট ক্লাব

নবম পরিচ্ছেদ

০১.

লিটন ট্যাভার্ন নাইট ক্লাব রাস্তার ঠিক মোড়ে, ভিতরে ঢোকার পথটা ঘোরানো নানা রঙের নিয়ন আলোয় সাজানো। জমকালো সাজে এক দারোয়ান বসে আছে। গাড়ি দাঁড় করানো জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দিলাম।

নাইট ক্লাবের দরজায় আসতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে তার টুপিতে হাত ঠেকাল।

একটা সাজানো ঘরে এসে ঢুকলাম। টুপি ও কোচান পোশাক পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার অনাবৃত হাঁটু দেখা যাচ্ছিল। নিতম্ব দুলিয়ে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে সাদা দাঁতগুলো বার করে হাসল। আমার মাথায় টুপি নেই দেখে তার হাসির বহর কমে গেল। বুঝলো যে আমার কাছে ডলার বকশিশ পাবার আশা নেই। শরীরের গঠনের সঙ্গে তার ও মেরিলিন মনরোর অনেক সাদৃশ্য আছে।

ছাদের ঝোলান আলোর লাল কার্পেটে মোড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাল্কা নীল আলোয় ভরা জায়গায় এলাম। সেটা একটা বার।

ঘরটা বেশ বড়, শেষের দিকে ঘোড়ার খুরের মত দেখতে একটা বার আছে। অসংখ্য টেবিল চেয়ারে শখানেক মানুষ মদ খাচ্ছিল।

তাদের একজনও বাতের পোশাকে ছিল না। মেয়েরাও ছিল বিভিন্ন ধরনের, কেউ হয়তো ব্যবসায়ীর সেক্রেটারী। অতীত উপকারের বিনিময়ে রাতে বেরিয়েছে। পেছনের সারিতে নোংরা পোশাকে কিছু যুবতী মেয়ে ছিল যাদের অনেকে পেশাদার। কিছু বয়স্ক মেয়েও ছিল যারা তাদের নাচেরসঙ্গীর আশায় ছিল। পামসিটির যে কোন নিকৃষ্ট নাইটক্লাবের লোকেরা এদের চেয়ে মার্জিত।

দুজন বারম্যান ভীড় সামলাচ্ছিল। তাদের একজনও রসনয়। লোকদুজনকে মেক্সিকো দেশীয় মনে হল।

বারের পিছনেরসকে মদ পরিবেশন করতে দেখলাম। চারপাশেজন দশেক মেয়ে ইচ্ছে করেই আমার দিকে চেয়েছিল। তাদের আহ্বানের দৃষ্টি গ্রাহ্য করলাম না।

বারের চারিদিকে ঘুরে দেখে ট্রপিক্যাল স্যুট পরা এক মোটা লোকের পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। লোকটি রাম খাচ্ছিল বলে মনে হল। তিনভাগই ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

স্কচের অর্ডার দিলাম। বারম্যান যখন মদ ঢালছিল তখন বললাম ক্যাবারে কখন শুরু হবে।

সাড়ে এগারোটায় স্যার, সে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল।

রেস্তোরাঁয় যাবার রাস্তার বাঁ দিকে।

আকাশী সবুজ রঙের পোশাক পরা এক লম্বা রোগা মেয়ে মদ নিয়ে চলে গেল। শ্যাম্পেন খাওয়ার জন্য নাকিসুরে জেদ ধরায় তার বয়স্ক সঙ্গী অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজী হল। তখন ঘড়িতে এগারোটা বেজে কুড়ি।

অত্যাধিক মদ খেয়ে মোটা নোকটা বোকার মত হেসে বলল, আপনার রোজগারের পয়সা ক্যাবারে দেখে নষ্ট করবেন না। শহরের সবচেয়ে নোংরা জোচ্চোরির জায়গা–অনেকেই একথা বলে।

মেয়ে নেই?

 হ্যাঁ, মেয়ে আছে। যদি অবশ্য তাদের মেয়ে বলা যায়।

শুনেছি সেই লেন মেয়েটা নাকি দারুণ জিনিস।

সে খানিকটা রাম এবং লাইম জুস চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, যদি মেয়েটা বাগাতে পারেন তাহলে অবশ্য খুশিই হবে। তবে তাকে বাগানো খুবই কষ্টকর। অবশ্য দুদিন সন্ধ্যায় আমি তার গান শুনেছি অতি জঘন্য গান।

তাহলে এখানকার বিশেষত্ব কি?

সে চারপাশ দেখে নিয়ে খুব কাছে এসে গলার স্বর নামিয়ে বলল, বন্ধু ভেবেই বলছি! উপর তলায় ওদের জুয়াখেলার আচ্ছা আছে। জুয়ার বাজি মারাত্মক প্রায় আকাশছোঁয়া। এসব ঠাট হচ্ছে লোক দেখানো। কথাটা খুব গোপনে রাখবেন ভাই।

আমিও তাহলে উপরটা দেখে আসতে পারি।

উপরে লোক যেতে দেওয়ার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। কারণ এ সব কিছুই তো বেআইনী। ক্লডের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন, আড্ডাটা সেই দেখাশোনা করে। ইচ্ছে করলে আমার নাম বলতে পারেন। আমার নাম ফিল ওয়েলিভার।

ধন্যবাদ। কোথায় তার দেখা পাব?

ভেতরে, বেরিয়ে যেতে যেতে বলল। আমাকে এখন যেতে হবে। বৌ-কে বলে এসেছি। আজ রাতে বেড়াতে নিয়ে যাব। পাঁচ মিনিট আগেও কথাটা মনে হয়নি। আর দেরী করা ঠিক হবে না।

আমিও ঐ পথে এগিয়ে বাঁ দিকে রেস্তোরাঁটা দেখতে পেলাম। ডিম্বাকৃতি একটা ঘর, লাল ও গোলাপী আয়না এবং নীল সাজে ঘরটা মৃদু আলোয় আলোকিত। জন ষাটেক লোক সেখানে ডিনার খাচ্ছিল। তাদের মৃদু গুঞ্জন ও সিগারেটের ধোয়ায় ঘরটা ভরে গিয়েছিল।

হেড ওয়েটার একজন খিটখিটে রোগা লোক। মাথায় কোকড়া চুল লালচে সোনালি, ব্যবসায়ী সুলভ হাসি হেসে আমার দিকে এগিয়ে এল।

আমি ক্যাবারে দেখতে চাই। তবে ডিনার চাই না।

আচ্ছা স্যার। ড্রিঙ্ক ও স্যান্ডউইচ লাগবে…?

নিশ্চয়ই। টক হুইস্কি এবং সরষে মাখান মুরগি আর রুটি নিয়ে এস।

পিছনের সারিতে ব্যান্ডের কাছে আমাকে একটা ছোট টেবিলের সামনে সে নিয়ে এল। আমি বসলাম।

ব্যান্ডের চার রকমের বাজনা ছিল : চারজন বিশালকায় নিগ্রো, একটা ট্রাম্পেট, ড্রাম, ডবল বাস এবং স্যাক্সোফোন।

একটু পরেই ওয়েটার আমার জন্যে মুরগির স্যান্ডউইচ নিয়ে এল। সরষে মাখানো রুটি শুকনো আর মুরগিটা দেখে মনে হচ্ছিল পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তার জন্ডিস হয়েছিল। স্যান্ডউইচটা ফেলে দিলাম। খারাপটক হুইস্কি অনেকবার খেয়েছি কিন্তু এত খারাপকখনও খাইনি।

প্রায় পৌনে বারোটায় চারজন মেয়ে নাচতে নাচতে ভিতরে এসে ঢুকল। মাতালদের জন্যেই তারা এসেছিল এবং নিয়মিত লোকদের ইশারা করে তারা যত হৈ হৈ করে ঢুকেছিল তার চেয়েও বেশি জোরে নাচতে নাচতে চলে গেল। সেই ভদ্রলোক ঠিকই বলেছিল, ক্যাবারে হিসাবে এটা জঘন্য।

মাঝ রাতের একটু পরেই ডলোরেস এল। হাতে মাইক্রোফোন। পরনে সোনালী রঙের পোশাক এত জোরে গায়ের উপর চেপে বসেছিল মনে হচ্ছিল যেন চামড়া। আলোর নিচে সেদাঁড়িয়েছিল, দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। দুটো ল্যাটিন আমেরিককান গান গাইল। মাইক্রোফোন ছাড়া কারও পক্ষে তার গান শোনা সম্ভব নয়। সে উদাসীনভাবে গাইছিল যেন ক্তি হয়ে। গানের শেষে অতি নগণ্য পরিমাণ করতালি তার ভাগ্যে জুটল।

সে চলে গেল। তার চোখ চকচক করছিল। তারপর সমস্ত জনতা আবার নাচতে শুরু করল।

ওয়ালেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে লিখলাম। আমার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করবেন? আশা করি আজ সকালে পায়ে বালি লাগেনি।

একটা ওয়েটারকে পাকড়াও করলাম এবং তার হাতে কাগজের টুকরো ও পাঁচ ডলারের নোট দিয়ে ব্যবস্থা করতে বললাম।

যখন দ্বিতীয়বার টক হুইস্কি খাচ্ছিলাম ওয়েটার ফিরে এল।

সে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনার সঙ্গে ড্রেসিং রুমে দেখা করবে। ঐ দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁ দিকে যাবেন সামনেই তারকা চিহ্নিত একটা দরজা দেখতে পাবেন।

তাকে ধন্যবাদ জানালাম।

 গ্লাস শেষ করে ওয়েটারের নির্দেশমত এক অদ্ভুত ধরনের গুপ্ত রাস্তা দিয়ে গেলাম।

তারকা চিহ্ন দরজায় টোকা মারতেই মহিলা কন্ঠে শুনতে পেলাম, ভেতরে আসুন।

দরজার হাতল ঘুরাতেই একটা ছোট ঘরে এসে পৌঁছালাম। ঘরে একটা আলো দেওয়া আয়না, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা কাবার্ড, মেঝেয় শতছিন্ন একটা কার্পেট।

ডলোরেস আয়নার সামনে বসে প্রসাধন করছিল। একটা লাল সিল্কের ওড়না তার শরীরের উপর দিয়ে উরু পর্যন্ত এসেছে। নাইলন মোজায় ঢাকা তার সুন্দর পা দুটো দেখা যাচ্ছিল।

ড্রেসিং টেবিলের উপর অর্ধেক খালি একটা জিনের বোতল। জিন ভর্তি একটা গেলাস পাশে।

সে আয়না দিয়ে চাইল। ভেবেছিলাম, আপনিই হবেন। জিন খাবেন?

না। ধন্যবাদ। এতক্ষণ ইস্কি খাচ্ছিলাম। আপনার জন্য মদ কিনব এটাই ধারণা ছিল।

আয়নায় বুকে একটা ব্রাশ দিয়ে কালো ভুরুর উপর থেকে পাউডারের গুড়ো ঝাড়ল। কেন?

 আপনার গান খুব ভাল লেগেছে। এক বোতল শ্যাম্পেনের সঙ্গে আরও জমত। তাছাড়া আপনার সঙ্গে একটু কথাও বলতে চেয়েছিলাম।

গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে, জানতে চাই আপনি কে?

সে এখন তিনভাগ মাতাল, তবে ঠিক কাজ না করা বা কথা না বলার মত মাতাল হয়নি।

নাম চেসটার স্কট। বাসস্থান ও কর্মস্থান শহরে।

চেসটার স্কট? কোথায় যেন নামটা শুনেছি?

 তাই বুঝি?

কোথায়…আমার গান তাহলে ভাল লেগেছে? তাহলে একটা সিগারেট দিন।

 তাকে দিয়ে নিজেও একটা ধরিয়ে নিলাম–গান সুন্দর হয়েছিল তবে ব্যাকগ্রাউন্ড ভাল ছিল না।

জানি। কিভাবে হাততালি দিচ্ছিল লক্ষ্য করেছেন? মনে হয় তাদের হাতে ফোস্কা পড়েছে।

শ্রোতারা আপনার উপযুক্ত নয়। বাজে আঢিটকেঅবশ্য জনতার যে কোনোঝামেলা পোয়াতে পারে। সমুদ্রের ধারে সকালবেলা কেন গিয়েছিলেন? ঐ সাঁতারের ঘটনার ব্যাপারে নিশ্চয়ই নয়।

জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলাম।

একজন পুলিশের লোককে বিয়ে করতে আপনি কেন রাজি হয়েছিলেন?

সে ধীরে ধীরে ভাসা চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, আমি কাকে বিয়ে করি তাতে আপনার কি?

কিছুই না। তবে আপনার মত মেয়ে পুলিশকে বিয়ে করা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছিল।

সে হেসে বলল, পুলিশের লোক হলেও সে অন্য ধরনের ছিল।

তাই বুঝি? তা বিশেষত্ব কি ছিল?

ওর টাকা ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে পর্দার পিছনে গেল। আপনার টাকাকড়ি আছে, মিঃ স্কট?

তার মাথাটা দেখতে পাচ্ছিলাম। সে তখন পরনের পোশাকটা খুলে পর্দার বাইরে ফেলে দিল।

বেশি নয়। তবে কিছু টাকাকড়ি আছে।

এই পৃথিবীতে কোনঅর্থআছে। কোন গুরুত্বআছে। এমন জিনিসহচ্ছে টাকা। নইলেকাউকে আমল দিতে নেই। অনেকেই বলে, স্বাস্থ্য আর ধর্মই হচ্ছে জীবনের পরম কাম্য, কিন্তু আমি কেবল টাকাই বুঝি। যদি টাকা না থাকে তবে কোন রকমে একটা ক্ষুর কিনে গলায় বসিয়ে দিন। একটা ভাল চাকরি পাবেননা। বেড়াবার মত জায়গায় যেতে পারবেননা। উপযুক্ত মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবেন না। টাকা না থাকলে আপনি রাস্তার মানুষ, যেখানে কদর্য জীবন যাপন করতে হয়।

পর্দার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে লাল রঙের পোশাক যাতে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ প্রকট হয়ে উঠেছিল। সে টলতে টলতে ড্রেসিং টেবিলের কাছে এল।

সে মাথায় চিরুণি চালাতে চালাতে বলল, গত দশ বছর ধরে এই কাজ করছি। আমার প্রতিভা ছিল সামান্য। আমার মাতাল দালালটা এরকমভাবে আমার কাছে আসে যে অনন্যর কাছে পাত্তা পাওয়া যায় না। ফলে আমার জীবনটা যে রকম বললাম অনেকটা সেই ধরনের। সুতরাং ঐ লালমুখো পুলিশটা যখন আমার কাছে আনাগোনা শুরু করল তখন তাকে সুযোগ দিলাম কারণ তার টাকাকড়ি ছিল। গত দশবছর ধরে অনেক নাইট ক্লাবে কাজ করেছি কিন্তু কখনও বিয়ের প্রস্তাব আসেনি। শেষে এই পুলিশটাই দিল। যদিও সে রুক্ষ নির্দয় ও ভয়ংকর প্রকৃতির, তবুও সে অন্তত বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিছুক্ষণ থেমে আবার জিন খেল। ওর টাকা ছিল, আমাকে অনেক উপহার দিয়েছে। সে ড্রয়ার থেকে একটা অত্যন্ত দামী সুন্দর অলংকার বের করে দেখাল। সে আমাকে এটা দেয় এই উদ্দেশ্যে নয় যে আমি পাওয়া মাত্র জামা-কাপড় খুলতে থাকব। সে আমাকে নরম চামড়ার কোর্ট দিয়েছিল এবং বলেছিল বিয়ের উপহার হিসেবে একটা দামী কোর্ট দেবে। পাম উপসাগরের তীরে তার একটা ভারীসুন্দর বাংলো আছে। বারান্দার সামনে বিস্তৃত সমুদ্র, ঘরগুলোও বিচিত্র : একটা ঘরের মেঝে কাঁচের এবং নিচে আলোর ব্যবস্থা আছে। সে বেঁচে থাকলে আমি তাকেই বিয়ে করতাম যদিও লোকটা ভুল রুচির সে মাথার টুপি পরেই এখানে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর পা তুলে দিত, এবং আমাকে বেবি ডল বলে ডাকত। সে জিনের শেষটুকু খেয়ে, চিরদিনের মত স্তব্ধ হয়ে গেল যখন সে এবং আর্ট গ্যালগানো…সে কাঁদতে শুরু করল, তির্যক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, মনে হচ্ছে আমি এখন মাতাল। আপনার কাছে কেন এসব কথা বলছি?

জানি না। লোকে অনেক সময় মনের কথা বলে হালকা হতে চায় তাই হবে। মৃত্যু ছাড়া তার আর কোন গতি ছিল না। তার জন্য আপনার দুঃখিত হওয়া উচিত।

তাই বুঝি? আমি নিজের জন্যেই দুঃখিত হচ্ছি? আপনার কি বৌ দরকার মিঃ স্কট?

 বলতে পারছি না।

আপনার কি দরকার?

আমি জানতে চাই, ও’ব্রায়ান কিভাবে চাপা পড়েছিল?

সে জিনের গ্লাসটা তুলে শুঁকতে লাগল, ভীষণ বাজে জিনিস। যখন গান করি আর আজ রাতের মত হাততালি পাই, তখন এই মদ খাই। ও’ব্রায়ানের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক?

কিছু নয়। আমি জানতে চাইছি, কেমন করে সে চাপা পড়েছিল?

কোন কারণ নেই। অকারণ কৌতূহল?

 কেবল কৌতূহল।

 আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

আপনার নাম কি বললেন যেন?

স্কট।

আপনি জানতে চান হ্যারি কেমন করে চাপা পড়েছিল?

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন?

পারি বলতে। জিন চুমুক দিল, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে জিনটা ঢেলে দিল। বলতে পারি। কিন্তু মিঃ স্কট, আপনার কাছে এর মূল্য কত?

সিগারেটটা ফেলে দিলাম।

টাকায় এর মূল্য কত জানতে চান।

টয়লেটের সামনে গিয়ে সে হাসল। কিন্তু সুন্দর নয়। তাকে কঠিন দেখাচ্ছিল, যেন তার শরীরটা পাথরে খোদাই করা।

হা, বলতে চাই এর আর্থিক মূল্য কত?

 চেসটার স্কট–এখন বুঝেছি আপনি কে! অসকার রস আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে।

একথা ভাবলেন কেন? ভাবলেশহীন মুখে জিজ্ঞাসা করলাম।

শুনতে পাই অনেক জিনিস সেবলল। ব্ল্যাকমেল করা আমি পছন্দ করিনা। আমার টাকা দরকার, মিঃ স্কট। আমি চেষ্টা করবো অসকার রসের হাত থেকে মুক্তি পান। কিন্তু মূল্য দিতে হবে, জোর করে নয়। মাত্র পাঁচশ, সে তুলনায় কিছুই নয়।

কি তথ্য?

আপনার কাছে পাঁচশো ডলার আছে মিঃ স্কট?

না কাছে নেই।

আজ রাতে আনতে পারেন?

তা পারি। মনে পড়ল অফিসে আটশো ডলার রেখে এসেছি। আমি ধার নিতে পারি, সোমবার ব্যাংক খুললে জমা দিয়ে দেব। কি করে বুঝলেন যে আপনার তথ্য আমার প্রয়োজনে আসবে?

একটা সিগারেট দিন।

সে সিগারেট ধরাচ্ছিল, তখন তার হাতটা আমার হাতের উপর রাখল।

তার কাছ থেকে সরে গেলাম।

অসকারের হাত থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে পারি, সে বলল।

কি করে আমাকে মুক্তি দেবেন? জিজ্ঞাসা করলাম। মনে হল আমার মাথায় পা দিয়ে সে নিজেই মুক্তি পেতে চায়।

আমি বলে দেব কখন টাকা দিতে হবে, তার আগে নয়। যখন সাপে কামড়ায় তখন তার প্রতিষেধক দরকার। অসকারের কামড় থেকে রেহাই পাবার জন্য আমি আপনাকে প্রতিষেধক দেব। যদি পাঁচশো ডলারের বিনিময়ে তিরিশ হাজার বাঁচাতে না চান তবে আপনি বোকা। আজ রাতেই কি টাকাটা দিতে পারবেন?

হ্যাঁ, দিতে পারব।

সে বলল, দুটোর পর আমি বাড়িতে থাকব। ম্যাডক্স আর্মসের দশনম্বর ঘরে আমাকে পাবেন। কোথায় আপনি জানেন?

বললাম, জানি।

টাকাটা তাহলে নিয়ে আসুন, মিঃস্কট। আমি আপনাকে প্রতিষেধক দেব। ঠিকদুটোয় আসবেন। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। ঐ মাতালদের কাছে আবার আমাকে গান করতে হবে। পরে তাহলে দেখা হবে।

তার পাশ কাটিয়ে প্যাসেজে এলাম। ফিরে তাকালাম তাকে দেখে মনে হল, সে ভয় পেয়েছে।

সেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে আমার মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিল।

.

০২.

 গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম একটা কালো রঙের গাড়ি দ্বিতীয় সারি থেকে বেরিয়ে আমার পিছু নিল।

কালো গাড়িটা আমার পিছনে পিছনে এসে অফিসের সামনে আমার গাড়িটা দাঁড় করাতে ঐ গাড়িটা যখন পাশ দিয়ে চলে গেল তখন ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন ঠেকল।

পৌনে একটা বাজে। সদর দরজার একটা চাবিআমার কাছে ছিল কিন্তু ভাবলামসদর দরজাটা খুললে অ্যালার্মটা আর বাজবে না। তাই কলিং বেলটা টিপলাম।

সে উঠে এসে শার্সির ভেতর থেকে দেখে খুলে দিল।

আশা করি তোমাকে বিছানা থেকে তুলিনি। রবিবারে কাজ করার জন্য কাগজপত্র নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছি।

ঠিক আছে মিঃ স্কট। আপনি কি অনেকক্ষণ থাকবেন?

পাঁচ মিনিট।

তাহলে আমি এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করব, আপনি চলে গেলে দরজা বন্ধ করবো। আপনি কি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন?

কিছুনা বলে এলিভেটরের দিকে গিয়ে অফিসের দরজা খুলে আলমারীখুলে ক্যাশবাক্স থেকে পাঁচশো ডলার নেওয়ার জন্য সেখানে একটা স্লিপ রেখে দিলাম।

পথে অনেক কিছু ভাবছিলাম। ডলোরেস বলছিল, রসের কামড় থেকে রক্ষা পাবার জন্য সে আমাকে প্রতিষেধক দেবে। এর অর্থ হচ্ছে। সে আমাকে এমন কতগুলো তথ্য দেবে যা দিয়ে আমি রসকে ভয় দেখাতে পারি।

পাঁচশো ডলারের নোটগুলো পকেটে রাখতে গিয়ে ভাবছিলাম যে তথ্যটা কি হতে পারে। ডলোরেসকে কতদুর বিশ্বাসকরা যায়। রসও বলেছিল তাকে শহর ছেড়ে যেতে হবে। ডলোরেসও বলেছেশহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য তার টাকার দরকার। ও’ব্রায়ানের মৃত্যুতে তাদের কোন পরিকল্পনা কি নষ্ট হতে চলেছে?

একজন সাধারণ পুলিশের কর্মচারীর পক্ষে চামড়ার কোট উপহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়াকাঁচের মেঝেওয়ালা বাংলোর মালিক হওয়ার পিছনে নিশ্চয় কোন গোপন আয়ের পথ আছে। তাহলে সে পুলিশের কাজ করে কেন?

দারোয়ানকে গুডনাইট জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

বুইকটা যেখানে ছিল সেদিকে যাবার সময় দেখলাম রাভার উল্টোদিকের দোকানে একটা লোক দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। আমি কিছু বোঝার আগেই সে ছায়ার আড়ালে চলে গেল।

বুইকে ফিরে এসে পাম সিটির কোয়ার্টারগুলোর দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে তাকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কালো গাড়িটার মত তাকে দেখে আবার মনে করতে হয়েছিল।

ম্যাডাম আর্মস হচ্ছে ম্যাডক্স অ্যাভিনিউয়ের অল্প শৌখিন পাড়াগুলোর আবাসিক অঞ্চল। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে পাথরের ইট দিয়ে কোন বাড়ি তৈরি করার পর তাতে আর হাত না দিলে যেমন দেখায় সেরকম দেখাচ্ছিল।

একটা অল্প আলোকিত দেউড়িতে এসে দাঁড়ালাম। ডান দিকে সারি সারি চিঠির বাক্স, সামনে পুরনো ধরনের একটা এলিভেটর এবং ডানদিকে একটা ঘরের বাইরে লেখা দারোয়ান।

প্রাচীর পত্র থেকে বুঝলাম দশ নম্বর ঘর হচ্ছে চারতলায়। এলিভেটার চেপে ঘড়ি দেখলাম, দুটো বাজতে তিন মিনিট বাকী।

একটি ছোট প্যাসেজে এসে দাঁড়ালাম। যার দুদিকে দরজা। বাঁদিকেই দশ নম্বর ঘর।

দরজায় গায়ে লেখা ছিল, মিস ডলোরেস লেন।

কলিং বেলটা টিপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। দরজার পেছনে চলাফেরার শব্দ পেলাম। দরজাটা ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে তলার শিকলে এসে আটকে গেল।

কে? ডলোরেস বলল।

স্কট। অন্য কে ভেবেছিলেন?

 শিকলটা ভিতরে টেনে দেওয়ার জন্য দরজাটা একবার বন্ধ হয়ে তারপরে খুলে গেল।

একটা ধূসর রঙের পোশাকের উপর সে হালকা ট্রাভেলিং কোট পরেছিল। তার মুখ গম্ভীর।

 ভিতরে আসুন। এরকম একটা নোংরা জায়গায় বাসকরলে রাত দুটোয় কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়ার আগে সাবধান হওয়া দরকার।

ঘরটা বেশ বড়, ফার্নিশড় অ্যাপার্টমেন্টে যে ধরনের আসবাবপত্র থাকা উচিত সেতুলনায় নগণ্য আসবাবপত্র। সম্ভবতঃ সে বেশ আর্থিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।

আমাকে চারপাশে চাইতে দেখে বলল, এসব দিকে তাকাবেন না। ভগবানকে ধন্যবাদ যে আজ এসব ছেড়ে যাচ্ছি। একমাত্র সুবিধা যে ঘরটা খুব সস্তা। 

একটা অর্ধেক ভেজান দরজার দিকে চেয়ে মনে হল ঘরটা শোবার ঘর। বিছানার নিচে বড় বড় স্যুটকেশ রয়েছে। সে যাবার জন্য প্রস্তুত।

সে উদ্বেগের সঙ্গে বলল। টাকা এনেছেন?

এনেছি। কিন্তু টাকা দিচ্ছিনা যতক্ষণ না জানতে পারছি আপনি যে খবর দেবেন তার জন্য টাকা দেওয়া যাবে কিনা।

দেওয়া যায়। টাকাটা একবার দেখান।

টাকাটা বার করে তাকে দেখাতেই, সে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, পাঁচশো ডলার?

হ্যাঁ।

এবার আপনাকে দেখাব আমার কাছে কি আছে। বলে সে টেবিলের একটা ড্রয়ার টেনে খুলল।

আমি এতই মূর্খ যে সব সময় ভেবেছিলাম সে একজন স্ত্রীলোক এবং তাকে যে কোন সময় বাগে আনতে পারব।

তার হাত উঠে এল ৩৮ ইঞ্চি অটোমেটিক রিভলবারে, তার মুখে ভয়ংকর ভাব, নলটার মুখ আমার দিকে তাক করা।

একটুও নড়বেন না। টেবিলের উপর টাকাটা রাখুন।

আমার জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতা কেউ বন্দুক উঁচিয়ে আমার দিকে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা বিলী। বন্দুকটা বিপজ্জনক ও মারাত্মক।

এ ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা গোয়েন্দা কাহিনীতে পড়েছি। মুখটা শুকিয়ে আসছে এবং শরীরটা ঠাণ্ডা ও হালকা মনে হচ্ছে।

ওটা বরং নামিয়ে রাখুন। গুলি বেরিয়ে আসবে।

 টেবিলে টাকা না রাখলে এখনই গুলি বেরিয়ে আসবে।

 আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য রেখে সেবা দিকে কিছুটা সরে হাত বাড়িয়ে রেডিওটা চালাল।

গুলির শব্দ শোনার মত এই তলায় কেউ নেই। নিচের তলার লোকটা কানে শুনতে পায় না সে ভাববে এটা গাড়ির ব্ল্যাংক ফায়ারিং অথবা কিছুই শুনতে পাবে না।

ভয়ানক জোর বাজনার সুরে ঘরটা ভরে উঠল, কোনো স্টেশনের গান লাউড স্পীকারের মাধ্যমে ভেসে এল।

টেবিলে টাকা রাখুন নইলে গুলি করে মারব।

বোঝা গেল সে মিথ্যা বলছে না। বুকটা কেঁপে উঠল। ট্রিগারে তার আঙ্গুল, যে কোন সময় গুলি বেরিয়ে আসবে।

প্রসাধন সত্ত্বেও সে ঘামছে।

দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ান।

 দাঁড়ালাম। ডলারের নোটগুলো নিয়ে সে তার ওভারকোটের পকেটে রাখল।

 স্বাভাবিক গলায় বললাম। বেশি দূর যেতে হবে না। পুলিশ ধরে ফেলবে।

চালাকি করবেন না। আপনি যদি পুলিশকে আমার সম্বন্ধে বলেন। আমিও তাদের আপনার সম্বন্ধে বলব। আপনার সম্বন্ধে শুধু অসকার রসই জানে না, আমিও সব জানি। আমি চোর নই। ব্ল্যাকমেলার নই। কিন্তু শহরে থেকে যেভাবেই হোক আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া আমার আর কোন পথ নেই। হঠাৎ সাহসী হবার চেষ্টা করে আমাকে বাইরে যেতে বাধা দেবেন না, তাহলেই গুলি করব। এবার ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। নড়বার চেষ্টা করবেন না।

তার চোখে একটা নিষ্ঠুর ভয়ার্ত ভাব। তার কথামত কাজ না করলেই সে গুলি করবে। পিছন ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম।

শোবার ঘরে গিয়ে তার সুটকেসটা নিয়ে যাচ্ছে।

 চলি মিঃ স্কট, আপনি অনেক উপকার করেছেন। ধাপ্পা দেওয়ার জন্য দুঃখিত, কিন্তু আপনি যদি বোকার মত ফাঁদে পা দেন তাহলে আমার দোষ কি?

দরজা বন্ধ হওয়ার ও চাবি লাগানোর শব্দ পেলাম।

দেয়াল থেকে সরে রেডিওটা বন্ধ করে দরজার দিকে যেতে গিয়ে বাইরে প্যাসেজে ডলোরেসকে ভয়ে চীৎকার করে উঠতে শুনলাম, না। আমার কাছ থেকে সরে যাও। না…খবরদার না…

বুকটা দুরদুর করে কাঁপছিল। তার গলার স্বর আতঙ্কে পূর্ণ।

 চীৎকারের পরেই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ, তারপরেই একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল।

সে আবার আর্ত চীৎকার করে উঠল তারপরেই নিস্তব্ধ।

আমি কান পেতে শুনছিলাম এলিভেটারের গ্রিল বন্ধ হওয়ার ও নিচের দিকে নামার শব্দ।

রাস্তা থেকে ইঞ্জিন স্টার্ট করে একটা গাড়ি দ্রুত চলে গেল।

একটা নিস্তব্ধতা চারিদিকে আমি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। এরপর খুব আস্তে একটা ভয়ংকর ধরনের দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ দরজার ওপাশ থেকে এল। সে শব্দে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।