০২. গেবলসে এসে পৌঁছলাম

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

০১.

গেবলসে এসে পৌঁছলাম আটটার কিছু পরে। গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবছিলাম আর একবার দেখা পাব কিনা। মেয়েটির চিন্তায় আমাকে দুর্বল করে তুলল, বুকের ভেতর নেচে উঠল।

বাগান ও সুইমিং পুলের ফ্লাডলাইট নেভানো থাকলেও চাঁদের আলোয় পরিবেশটা বেশ সুন্দর লাগছিল।

উপরে উঠে বেল বাজালাম। ওয়াটকিনস কিছু পরে দরজা খুলে বলল, শুভসন্ধ্যা স্যার।

আমি তার পাশ দিয়ে হলঘরে এসে বললাম, মিঃ আইকেন কেমন আছেন?

বেশ ভালই বলব। সম্ভবতঃ আজ রাতে তিনি একটু নার্ভাস ছিলেন। মনে হয় আজ বেশিক্ষণ না থাকাই ভাল।

যত শীঘ্র পারি চলে যাব।

তাহলে ভাল হয়, স্যার।

আমরা এলিভেটরে চাপলাম। বুড়ো মানুষটা জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।

আইকেন বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন, দাঁতের ফাঁকে সিগার। তার দুই হাঁটুর ফাঁকে হিসাব নিকাশের কয়েকটা কাগজ, পাশে একটা প্যাড ও পেন্সিল পড়েছিল। তার ঠোঁট দুটো ছিল একটু বাঁকা ও চোখের পাতা দুটো ভারী, আগের রাতের মত অত ভালো আজ দেখাচ্ছিল না।

বিরক্তস্বরে তিনি বললেন, ভিতরে এস, স্কট।

ইজিচেয়ারে বসে বললাম, পা কেমন আছে?

ভালই আছি। হ্যাঁমিলটন ফোন করেছিল। সে বলল তুমি মিটিং-এ ভাল কাজ দেখিয়েছ।

তিনি ভেবে থাকলে আমি খুব আনন্দিত। টেম্পলম্যানকে খুব ভালভাবে সামলাতে পারিনি। আমাকে বেশ ভুগিয়েছেন।

ঠিক মতই সামলেছ হ্যাঁমিলটন আমাকে বলেছে। বোকা গাড়ি নিয়ে ভেগেছিল, মিটিং-এর মিনিট পেয়েছ? হেসে আইকেন বললেন।

তার হাতে সেগুলো তুলে দিলাম।

ততক্ষণ আমি পড়ি তুমি কিছু পান কর, আমাকেও একটু দেবে। দেয়ালের পাশে একটা টেবিলের উপর বোতল ও গ্লাস রাখা সেদিকে হাত দেখালেন। আমাকে হুইস্কি দাও। হ্যাঁ, যা বলছি, গ্লাসে কিছু হুইস্কি ঢাল।

তার গলার স্বর আমাকে সতর্ক করে দিল যে কোন তর্ক করা ঠিক হবে না। আমি দুটো গ্লাসে পানীয় ঢালোম। তাকে একটা গ্লাস দিলাম। তিনি সেদিকে চাইলেন এবং সেই মুহূর্তে তাকে বেশ বদমেজাজী অনিষ্টকর ব্যক্তির মত দেখাচ্ছিল।

আমি যে বললাম কিছু হুইস্কি ঢাল! শুনতে পাও নি?

টেবিলে গিয়ে গ্লাসে আরও হুইস্কি ঢালোম এবং তার কাছে নিয়ে এলাম। তিনি গ্লাসটা নিয়ে পুরোটা গিলে নিলেন গ্লাসটা আমার হাতে দিয়ে, আর একবার তৈরি করে নিয়ে এসে পাশে বস।

আর এক গ্লাস তৈরি করে এনে পাশে বসলাম।

 দুজনে পরস্পরের দিকে চাইলাম। হঠাৎ তিনি দাঁত চেপে বললেন, কিছু মনে কর না। স্কট, যদি পা ভাঙো কিছুটা অসহায় হয়ে পড়বে। আমাকে অসুস্থ মানুষ হিসেবে দেখানোর জন্য বাড়িতে একটা ষড়যন্ত্র চলেছে। সারাদিন অপেক্ষা করছিলাম, তুমি এসে আমাকে পানীয় দেবে।

আমারও ভাবা উচিত ছিলো যে আপনি যা পেতে চাইছেন তা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ জিনিস।

তুমি ও তাই ভাব? বিচারের ভার আমাকে দাও। মিনিটটা হাতে তুলে নিল। ইচ্ছে করলে ধূমপান করতে পার।

একটা সিগারেট ধরালাম, কিছু স্কচ পান করলাম। মিনিটটা পড়তে তার প্রায় দশ মিনিট লাগল, পরে কাগজগুলো হাঁটুর উপর ছুঁড়ে ফেলে আর একবার তিনি পান করলেন।

আরম্ভটা বেশ ভাল। বরং তার চেয়েও বেশী। আমি নিজে এর চেয়ে ভাল কাজ দেখাতে পারতাম না। এইভাবেই কাজ করে যাও। নিউইয়র্কের চাকরী তোমারই হবে।

সত্যিই প্রশংসা।

এখন দেখা যাক ওরা আমাদের যে সব সুযোগ দিয়েছে সে সবের কিভাবে সদ্ব্যবহার করা যায়। তোমার কি ধারণা বল?

আগেই ভেবেছিলাম তিনি এ প্রশ্ন করতে পারেন সেইজন্য অফিস থেকে আসার আগে বিভিন্ন বিভাগের প্রধানের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, তাই তৈরিই ছিলাম।

আধঘণ্টা ধরে বলে চললাম, তিনি শুনছিলেন আর মাঝে মাঝে হুইস্কিতে চুমুক দিচ্ছিলেন। যখন বলা হয়ে গেল, তিনি বললেন মন্দ নয়। আমি তোমাকে আরও ভালভাবে কাজ করতে শেখাব।

এবার আমার শোনার পালা এবং আমাকে কিছু শেখাবার প্রচেষ্টা। তিনি আমার ধারণাগুলিকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় আমার ভুল বুঝলাম। আমার যুক্তিগুলো ছিল আরও ব্যয়সাপেক্ষ। তার যুক্তিতে খরচের প্রায় দশ শতাংশ সাশ্রয় হবে। বুঝতে পারলাম তিনি আমার চেয়ে অনেক বড় ব্যবসায়ী।

নটা বেজে গেছে দেখে মনে পড়ল ওয়াটকিনস আগেই আমাকে জানিয়েছিল। আলাপ আলোচনা অল্পক্ষণ করার জন্য।

কাগজগুলো ব্রিফকেসে গুছোতে গুছোতে বললাম, ঠিক আছে স্যার। সব দেখে রাখব। এবার আমি বিদায় নেব। দশটায় আমার কাজ আছে।

তুমি মিথ্যেবাদী স্কট। ঐ বোকা বুড়ো ওয়াটকিনসের কথা শুনে তুমি যেতে চাইছ। ঠিক আছে তুমি বিদায় হও। কাল আটটায় একবার দেখা করবে। কোন মেয়ের সঙ্গে জানাশোনা আছে স্কট?

চমকে কিছু কাগজ মেঝেয় পড়ে গেল। সেগুলো কুড়োতে কুড়োতে বললাম, যদি সেই অর্থে বলেন তবে বিশেষ ভাবে কারো সঙ্গে নেই।

আমি ঠিক তা বলছি না। পুরুষের প্রতি মুহূর্তে নারীর প্রয়োজন হয়। কখনও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে না তবে তাদের ব্যবহার করবে। সেই উদ্দেশ্যেই তারা অফিসে আছে। আমি চাই না তুমি সবসময় কাজ কর। মাঝে মাঝে আমোদ ফুর্তি করো। মেয়েরা যে আমোদ ফুর্তির একটা উপকরণ এটা বুঝতে তোমার বেশী সময় লেগেছে। তবে তোমাকে যাতে তারা গাঁথতে না পারে সেদিকে দেখবে। যদি তাকে গাঁথতে দাও তবে তুমি খতম।

হ্যাঁ, স্যার। আগামী কাল আটটায় আসব।

এই সপ্তাহের শেষটা তুমি ছুটি নাও। আগামী শুক্রবার রাতে আর তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। সোমবার সকালে একটা ফোন করবে। আজ মঙ্গলবার, সপ্তাহের শেষটার জন্যে একটা প্ল্যান করে ফেল, স্কট। আমি চাই তুমি কিছু বিশ্রাম নাও। গলফ খেলতে পার?

হ্যাঁ, পারি।

যদি খুব সিরিয়াসলি না নাও তবে এটাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল খেলা। গলফ অনেকটা একটা মেয়ের মত। যদি কোনটাকে সিরিয়াসলি নাও ও তাকে সুযোগ দাও তোমাকে গেঁথে ফেলবে। ব্যস, তুমি খতম। কি রকম খেলতে পার?

বললাম, সবচেয়ে ভাল দিনগুলোতে বাহাত্তর বার মেরেছি।

তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমাকে প্রথমবার দেখলেন, বাঃ তুমি তো ভাল খেলো।

তা হওয়া উচিত। পাঁচ বছর বয়স থেকে খেলছি। আমার বাবা গল পাগল ছিলেন। এমন কি মাকেও খেলাতেন।

আগামীকাল রাত আটটায় আসব বলে দরজার দিকে চাইলাম।

তাই করবে, স্কট। সপ্তাহের শেষটা গলফ খেলার ব্যবস্থা করবে। রাতের জন্য একটা সুন্দরী মেয়ে খোঁজ করে নেবে। জীবনে আমোদ–প্রমোদের সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে গলফ ও মেয়ে।

বাইরে আসার পর বেশ আনন্দ হচ্ছিল। তার পাগলামির জন্য কেমন যেন বিস্বাদ লাগছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটা মনে দুলে উঠলো, এলিভেটর ছেড়ে সিঁড়ির মুখটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

নিচের চাতালটায় তাকিয়ে দেখলাম জায়গাটা বেশ অন্ধকার, মনে হল তখন নটা বেজে দশ, এই সময়ে সে তার শোবার ঘরে থাকবে এটা আশা করা যায় না।

এলিভেটর চেপে নিচে হলঘরে এসে দেখলাম ওয়াটকিনস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বললাম, মনে হয় না মিঃ আইকেন আজ ভাল আছেন।

তার অল্প জ্বর হয়েছে স্যার। ভেবেছিলাম এটা হবে।

 হ্যাঁ। আমি আবার কাল রাতে আসব।

আমার বিশ্বাস, মিঃ আইকেন আপনার আশায় পথ চেয়ে থাকেন।

শুভরাত্রি জানিয়ে গ্রীষ্মের চাঁদের আলোয় ভরা রাতে বেরিয়ে এলাম।

ক্যাডিলাক গাড়িটার দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে বাড়িটার উপর দিকে চাইলাম। শুধুমাত্র মিঃ আইকেনের ঘরে আলো জ্বলছে আর সব অন্ধকার। আশ্চর্য, মেয়েটা কি বাইরে গেছে, নাকি বাড়ির পেছন দিকে কোথাও আছে?

সারাদিন ধরে তাকে আর একবার দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু মনে হল, মিসেস হেপল অথবা ওয়াটকিনস কোন এক অন্ধকার জানলা থেকে আমাকে লক্ষ্য করছে। এভাবে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এটা নয়। গাড়িটার দরজা খুলে পেছনের সীটে ব্রিফকেসটা রেখে ড্রাইভিং হুইলের নীচে গিয়ে বসলাম।

মেয়েটা সেখানে বসেছিল, হাতদুটো মুঠো করে কোলের উপর রাখা। অন্ধকার হলেও আমি তার মাথার আকারটা বুঝতে পারছিলাম। মাথাটা একদিকে হেলিয়ে সে আমার দিকে চেয়েছিল। সে ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না। অন্য কেউ হলে আমার হৃদপিণ্ডটা হয়ত এভাবে নেচে উঠত না।

প্রায় পাঁচ সেকেন্ড আমি তার দিকে তার মৃদু গন্ধ ও নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সেই পাঁচ সেকেন্ডে যেন আমার সবকিছু আবছা হয়ে এল।

জীবনের এই মুহূর্তকে আর কোনদিনই ভুলব না।

.

০২.

 সে বলল, হ্যালো আপনাকে অবাক করে দিয়েছি। ভাবতে পারিনি এত শীঘ্র বেরিয়ে আসবেন।

হ্যাঁ, তা কিছুটা, আশা করিনি…।

সে হেসে, এটা আপনার গাড়ি?

হ্যাঁ।

খুব সুন্দর গাড়ি। গাড়ির ব্যাপারে আমি পাগল। যখন এটা দেখলাম ঠিক তখনই ভেতরে আসি। রোজারের বেন্টলির চেয়ে এটা আমার বেশী পছন্দ। আর এটাই বেশী জোরে চলে, তাই না?

হ্যাঁ, বেশ জোরে চলে।

সীটের গদিতে হেলান দিয়ে মেয়েটা বসা, চাঁদের আলোয় তার মুখের পাশটা দেখা যাচ্ছিল, অপরূপ সুন্দরী দেখতে।

রোজার আপনার কথা আমাকে বলেছে। সে বলে আপনি তার নতুন পার্টনার হবেন।

এখনও ঠিক হয়নি।

আমার অবাক হবার ভাবটা তখনো যাচ্ছিল না। সে কথা বলে যাচ্ছিল যেন সারা জীবন ধরে আমার চেনা।

সে বলল, সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। আপনার কি নিউইয়র্কে থাকতে ভাল লাগবে?

খুব বেশি।

আমার ইচ্ছা এখানে থাকার। আপনার কি মনে হয় না, পাম শহর দারুণ বিশ্রী?

মনে হয়, আপনার বয়সে এরকম লাগতে পারে।

সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, মনে হচ্ছে আপনি যেন বুড়িয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এখনও বোধ হয় ত্রিশ হয়নি, তাই না?

একত্রিশ।

 আপনি ভীষণ চালাক।

রোজার বলল আপনি ব্যবসায়ে বিশ হাজার ডলার খাটাবেন। আপনার বয়স মাত্র একত্রিশ হলে আপনি এত টাকা পেলেন কোথা থেকে?

আমার বাবা বেশি অংশটা রেখে গেছে, বাকীটা আমার জমানো। আপনি কি সমস্ত টাকাই রোজারের ব্যবসায়ে খাটাতে চান?

আপনার খুব আগ্রহ দেখছি।

হ্যাঁ কিছুটা, মানুষ যে ভাবে টাকা রোজগার করে তাতে আমার চিরদিনই আগ্রহ আছে। একটা মেয়ের ধনী হওয়ার একমাত্র পথ বিয়ে করা। পুরুষেরা বাইরে গিয়ে টাকা রোজগার করতে পারে। অবশ্য আপনি ভাগ্যবান যে আপনার বাবা আপনার জন্য অনেক কিছু রেখে গিয়েছিলেন, তাই না?

আমারও অনুমান ঠিক তাই। সে উঠে বসল ও এগিয়ে গিয়ে ড্যাস বোর্ডে হাত রাখল।

গাড়িটা আমার খুব পছন্দ। আমাকে চালাতে শেখাকেন?

শেখাবার কিছুই নেই। এটার ড্রাইভ আটোমেটিক, স্টাটারে পায়ের চাপ দিলেই আপনা থেকেই চলবে।

বিশাস হবে কিনা জানি না। আমি কখনও গাড়ি চালাই নি। রোজারের চারটে গাড়ি আছে : কিন্তু একটাও আমাকে ছুঁতে দেবে না।

কেন?

সে অদ্ভুত ধরনের। কেথাও যেতে হলে আমাকে সাইকেলে যেতে হয়। সাংঘাতিক তাই না? তার ওজর হচ্ছে আমি চালাতে পারি না। যদি শিখি, তবে চারটের একটা গাড়ি তাকে দিতেই হবে। আপনি আমাকে শেখাবেন?

হ্যাঁ, যদি আপনি চান তবে তাই হবে।

যে কোন জিনিসের চেয়ে পৃথিবীতে এইটাই আমি সবচেয়ে বেশি করে চাই। আপনি কি এখনই আমাকে শেখাবেন, না আপনার কিছু করার আছে?

আপনি বলতে চান এখনই?

হ্যাঁ, যদি আপনি সময় দিতে পারেন।

ঠিক আছে, আমরা তাহলে স্থান পরিবর্তন করব। আমি গাড়ি থেকে বেরোতে যেতেই সে আমার কোটের হাতা ধরে থামাল। তার আঙ্গুলের ছোঁয়ায় রক্তের উষ্ণ ষোত আমার মেরুদণ্ডের ভেতরে বয়ে গেল।

এখানে নয়। ওরা আমাদের দেখে রোজারকে বলে দেবে। এমন কোথাও যাওয়া যাক যেখানে কেউ দেখতে পাবে না।

ওরা? আপনি কাদের বোঝাতে চাইছেন?

 মিসেস হেপল ও ওয়াটকিনস। মিসেস হেপলকে আপনি দেখেছেন?

হা।

আমার ভাল লাগে না। সে নীচ স্বভাবের মেয়ে। আপনার কি মনে হয়?

ঠিক জানি না। কেবল কাল রাতে দেখেছি। তার সঙ্গে কথা বলিনি।

সে আমাকে সহ্য করতে পারেনা। আমাকে বিপদে ফেলতে চায়। রোজারতার কথা শুনে চলে।

বিপদের সংকেত দেখতে পেলাম। আপনি গাড়ি চালাতে শিখুন মিঃ আইকেন যদি সেটা পছন্দ না করেন……?

সে তার হাত আমার বাহুতে রাখাতে থামতে হল।

আপনি যে ওদের মত তাকে ভয় করেন একথা বলবেন না। তাহলে ড্রাইভিং শেখার জন্য আমাকে অন্য কারও সাহায্য নিতে হবে।

আমি তাকে ঠিক ভয় করি তা নয়, তবে এমন কিছু করতে চাই না যা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

 সে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে, আমার ইচ্ছার কি তবে কোন অর্থ, নেই?

আমি আপনাকে গাড়ি চালাতে শেখাব। বলে গিয়ার লিভারকে পজিশনে রাখলাম ও গ্যাস পেডালে পা দিয়ে চাপ দিলাম। বন্দুক থেকে বেরিয়ে আসা বুলেটের মত গাড়িটা দুটল।

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে জোরে গাড়ি চালালাম, স্পীড মিটারের কাঁটা প্রায় নব্বই-এর ঘরে। পরে একটা ছোট রাস্তার দিকে ঘুরলাম ও গাড়ি থামালাম।

 বাবা! সে চিৎকার করে উঠল। আপনি সত্যিই জোরে গাড়ি চালাতে পারেন। আমি এত জোরে কখনই চালাই নি।

বাইরে বেরিয়ে এসে বললাম, ঐ দিকে সরে যান। যেখানে বসে আছেন ওখান থেকে কোনদিনই গাড়ি চালাতে পারবেন না।

সে ওপাশে সরে গেলে আমি ভিতরে ঢুকে তার জায়গায় বসলাম।

দেখুন খুব সোজা, এটা হচ্ছে গীয়ার লিভার। এটাকে একটা নটের নিচে আনতে হবে। পরে ডান পা দিয়ে অ্যাকসিলেটরে চাপ দিন। যখন গাড়ি থামাতে চান তখন অ্যাকসিলেটর থেকে পা সরিয়ে নিন ও বাঁ দিকের বড় পেডালটায় চাপ দিন। ওটা হচ্ছে ব্রেক। পেয়েছেন?

বাঃ, বেশ সোজা। সে বলল এবং একবারের চেষ্টাতেই গিয়ার লিভারটা নামিয়ে অ্যাকসিলেটরটা পা দিয়ে চেপে ধরল।

পাগলের মত গাড়িটা ছুটে চলল। কি ভাবে গাড়ি নিয়ে যেতে হয় তার কোন ধারণাই নেই। কোথায় ছুটে চলেছে সে একবারও লক্ষ্য করল না।

আমি এতই বিহ্বল হয়েছিলাম যে কিছুই করতে পারলাম না।

সে সময় খুব ছুটে ঘাসের ধারে এসে পড়লাম ও দূরের চাকাগুলো মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছিল। পরে রাস্তায় এসে উঠলাম।

গাড়িটা বাগানের বেড়ার দিকে ছুটছিল; আমি স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে গাড়িটা সোজা চলালাম।

পা সরিয়ে নিন অ্যাকসিলেটর থেকে! চীৎকার করে পা সরিয়ে দিলাম, তার পর ব্রেকে চাপ দিতেই গাড়িটা থেমে গেল।

কয়েক সেকেণ্ড ছিল ভয়ংকর। একটুর জন্য শেষ হয়ে যেতাম।

 তার দিকে চাইলাম ইঞ্জিন বন্ধ করে।

গাড়িতে চাঁদের আলো এসে পড়ছিল তাই তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। চঞ্চল হয় নি বরং হাসছিল। তাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল যে আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল।

এখন একটু বিশ্রাম নিন, আমি বললাম। আত্মহত্যার এ এক পথ। জোরে চাপ দেবেন না…।

জানি অধৈর্য্য হয়ে সে বলল, আমাকে বলতে হবে না, খুব জোরে চাপ দিয়েছিলাম। আর একবার চেষ্টা করা যাক।

লক্ষ্য রাখবেন যখন গাড়ি ছুটবে রাস্তার দিকে।

 সে হেসে উঠল ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে।

অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি, সে বলল। ভাবতেই পারিনি যে এটার এত ক্ষমতা আছে।

খুব আস্তে চালান। অ্যাকসিলেটরে আস্তে চাপ দিন, বলে ইঞ্জিন চালু করলাম।

 হ্যাঁ, জানি।

গিয়ার ঠিক রেখে আমরা ঘণ্টায় কুড়ি কিঃ মিঃ বেগে চললাম। এবারও বোঝা গেল কোন অভিজ্ঞতা নেই।

আপনি যদি সবই করেন তবে কি করে শিখব বুঝতে পারছি না, বলে হাতটা সরিয়ে দিল।

বললাম মিঃ আইকেন কি কখনও আপনাকে গাড়ি চালানো শেখান নি?

 রোজার? সে হেসে উঠল, না, না, তার কোন ধৈৰ্য্যই নেই।

বেশ জোরে চালাচ্ছেন অথচ রাস্তার দিকে নজর দিচ্ছেন না। আর একবার চালান যাক।

এবার ঘন্টায় পনের মাইল বেগে রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল।

আমি বললাম, ঠিক এই ভাবে চলুন তাহলে, বেশ ভাল লাগবে।

সেই সময় উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ির হেডলাইটকে খুব জোরে এগিয়ে আসতে দেখলাম।

ডান দিকে এগিয়ে যান। আস্তে চালান, রাস্তার দিকে লক্ষ্য রাখুন।

খুব তাড়াতাড়ি বাঁক নিতে গাড়িটা অনেক দূর এগিয়ে গেল এবং দুরের চাকাগুলো রাস্তার পাশের ঘাসের উপর এসে পড়ল। স্থির জানতাম যে এবার সে ঘাসের উপর থেকে গাড়িটাকে রাস্তায় আনার চেষ্টা করবে। ফলে হয়তো উল্টো দিকের গাড়িটা পথের উপর এসে পড়বে। আমি ব্রেক কষতেই গাড়িটা থেমে গেল। অন্য গাড়িটা জোর শব্দ তুলে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল।

অধৈর্য হয়ে সে বলল, আমার ইচ্ছা যা কিছু করার আমাকেই করতে দিন। আমি নিজেই সামলাতাম।

তা বটে, এটাই কিন্তু আমার একমাত্র গাড়ি।

সে হেসে বলল, বেশ মজা। ভালই লাগছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি গাড়ি চালান শিখে যাব। রোজার যদি তার একটা গাড়িও আমাকে ব্যবহার করতে না দেয় তবে আপনারটা আমাকে দেবেন কি?

একা চালাবার আগে আপনাকে অনেক কিছু শিখতে হবে।

 যখন পারব তখন গাড়িটা দেবেন তো?

ঠিক আছে, তবে সময় নিয়ে অসুবিধা হবে। প্রতিদিনই কাজের সময় এটা লাগে।

যখন আমার দরকার হবে তখন আপনি বাসেও যেতে পারেন।

ভাববার কথা। আমি বাস পাগল নই। তাছাড়া কাজের সময় প্রায়ই আমার গাড়িটার দরকার হয়।

মাঝে মাঝে খুব প্রয়োজনে ট্যাক্সি নিতে পারেন। পারেন

না? মনে হয় তা পারি।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি গাড়িটা আমাকে দিতে চান না। এটাই আসল কথা। তাই না?

না, তা নয়। আমার ভয় আপনি কোন কিছুতে ধাক্কা মারবেন বা কেউ আপনাকে ধাক্কা মারবে। একা চালাবার আগে আপনার অনেক প্র্যাকটিসের দরকার। আপনি একা কোথায় যেতে চান?

বিশেষ কোন জায়গায় নয়, আমি শুধু চালাতে চাই। সব সময়ই আমার জোরে চালাতে ইচ্ছা করে।

ঠিক আছে। যখন একা গাড়ি চালাতে পারবেন তখন ধার নিতে পারেন।

আপনি কি সত্যিই বলছেন?

 হ্যাঁ, তাই বোঝাতে চাইছি।

যখন ইচ্ছা তখনই পেতে পারি? আমার কাজ হচ্ছে টেলিফোনে আপনাকে বলে দেওয়া কখন আমার চাই। তাহলেই আপনি পাঠিয়ে দেবেন।

হ্যাঁ, এইটুকুই আপনাকে করতে হবে।

 সত্যি?

 হ্যাঁ, সত্যি।

সে অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে আমার হাতের ওপর ওর হাত বুলোতে বুলোতে বলল, যত মানুষ দেখেছি আপনিই সবচেয়ে ভাল।

আমি অবশ্য তা বলবনা। যদি গাড়ি চান পেতে পারেন। এখন আর একবার দেখা যাক আগের চেয়ে ভাল ভাবে এটাকে কায়দায় আনতে পারেন কি না?

হ্যাঁ। বলে সে ইঞ্জিন চালু করল।

এবারে সে সত্যিই ভাল চালাচ্ছিল, দুটো গাড়ি গাঁ গাঁ করতে করতে উল্টো দিকে ছুটে গেল, তখনও সে গাড়িটা ঠিকমত সোজাভাবেই চালিয়ে নিল।

এবার শিখে ফেলেছি। এখন অনেক কিছু বুঝতে পারছি।

প্রয়োজন হলে যাতে হইলটা ধরতে পারি তাই তার দিকে একটু সরে বসলাম। পা ব্রেকের কাছে এগিয়ে আনলাম। সে সোজা পথেই গাড়িটা চালাল এবং গাড়ির গতিও বাড়িয়ে দিল। স্পীডোমিটারের কাটা আশির ঘরে গেল।

আস্তে আস্তে চালান। খুব জোরে যাচ্ছেন কিন্তু।

কি চমৎকার। আমি এই ভাবেই চালাতে চেয়েছি। কি গাড়ি! কি সুন্দর!

 এবারে আস্তে চালান।

চোখ ঝলসানো আলো জ্বালিয়ে একটা আলো অন্ধকার থেকে আমাদের দিকে এল। আমরা তখন রাস্তার ঠিক মাঝখানে। আমি ব্রেকে পায়ের চাপ দিলাম।

ডান দিকে যান। সে খুব তাড়াতাড়ি ডানদিকে চালিয়ে নিল। যদি ব্রেকে চাপ দিতাম আমরা তবে ঘাসের উপর এসে পরতাম ও গাড়িটা উল্টে যেত। অন্য গাড়িটা জোরে হর্ণ বাজাতে বাজাতে আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ক্যাডিলাকটা থামালাম।

এটা করার কি প্রয়োজন ছিল? আমি বেশ যাচ্ছিলাম।

তা যাচ্ছিলেন, এক রাতে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আপনার এখন প্রয়োজন প্র্যাকটিস। সেটাও আজ রাতে করবেন? এবার আমি চালাব।

ঠিক আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে–সর্বনাশ! এবার ফেরা দরকার। রোজার ভাববে আমি কোথায়?

আমার মনে একটু তিক্ত ও কটু অনুভূতি জাগল।

আপনি কি জোরে গাড়ি চালাবেন? বেশ জোরে?

 অ্যাকসিলেটরে জোরে চাপ দিলাম। ক্যাডিলাকটা ঘণ্টায় নব্বই মাইল বেগে ছুটল।

এগারটা বাজতে কুড়ি মিনিটের সময় আমরা গেবলসে পৌঁছলাম।

গাড়ি থামতে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আপনি বেশ জোরে গাড়ি চালাতে পারেন। সত্যিই ভাল পারেন। আমার বেশ লাগছিল, কখন আমি দ্বিতীয়বার শিখব?

একটু ইতস্ততঃ করে বললাম। দেখুন আমি আপনাকে বিপদে ফেলতে চাই না। আপনার স্বামী সত্যিই চান না যে আপনি গাড়ি চালান…।

সে তার ঠাণ্ডা আঙ্গুলগুলো আমার মনিবন্ধে রাখল

রোজার কখনও জানবে না। কি করে জানবে?

তার স্পর্শ পেয়ে সব যেন গুলিয়ে ফেললাম ও অসংযমী হয়ে উঠলাম।

আগামী কাল রাত আটটায় আমি এখানে থাকব। নটার পরেই শুরু করা যাবে।

আমি গাড়িতে অপেক্ষা করব। বুঝতে পারবেন না কত আনন্দ আমার হয়েছে। প্রায়ই এত বিরক্ত লাগে কিন্তু আজকের সন্ধ্যা যে এত সুন্দরভাবে ও উত্তেজনার সঙ্গে কাটিয়েছি, কোনদিনও কাটাইনি। সত্যিই ভাল লাগছিল। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

চাঁদের আলোয় বোঝা যাচ্ছিল যে সে লেবুরং-এর স্ন্যাক ও নীল রংএর সোয়েটার পরেছিল সোয়েটারের নীচের গড়ন আমার দম বন্ধ করে আনল।

আমার নাম লুসিলি। মনে থাকবে তো?

 বললাম যে মনে থাকবে।

সে হেসে বলল, তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। শুভ রাত্রি।

 হাত নাড়িয়ে বাড়ি যাবার রাস্তায় এগিয়ে গেল। যতক্ষণ না অদৃশ্য হল ততক্ষণ চেয়েছিলাম

সে যেন এখন আমার রক্তে ভাইরাসের মতই ভয়ংকর ও বিপদজনক। সে রাতে তো বলাবাহুল্য ঘুম হয়নি। মনটা যখন আগুনে তখন ঘুম আসবে কি করে? মনে হল, পরের সাক্ষাতের সময়টা বুঝি একশো বছরের দুরত্ব।