৪. জরুরী কাজের কথা

জনি কি হলো? জিনি আমার দিকে তাকালো উৎকণ্ঠার চোখে। কিছু না। ফিরতে হবে আমাকে মনে পড়ে গেলো একটা জরুরী কাজের কথা। বলতে পারলাম না এর বেশী কিছু। স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যেন আটটা ঘন্টা কেটে গেলো।

পৌঁছে দিই চলল তোমাকে লাগবেনা দশ মিনিটও। গাড়িতে চড়ে বসলাম স্বপ্লেখিতের মত। শুকিয়ে গেছে গলা, বুকে ঘা চলছে হাতুড়ির…বুঝলো জিনি–একটা গোলমাল হয়েছে কোথাও কোনো, কিন্তু প্রশ্ন করলো না কোন।

গাড়ি চালিয়ে গেল দ্রুত হাতে ক্যাসিনোর গেটে পৌঁছে দিলো সাত মিনিটেই–হ্যাঁ, সাত মিনিট পাকা, কারণ আমার চোখ এঁটে বসেছিলো, ঘড়িতে। বেরোলাম গাড়ি থেকে কাঁপছেহাঁটু। আবার বাস্তব রূপ নিলো রাইসনার ডেলা আর সিংহের গর্জন। রুমাল বোলালাম, ঘাম ভেজা মুখে।

জিনি ধন্যবাদ, কথাগুলো বললাম ভাঙাগলায় কোনোরকমে। বলতে চেয়েছি আরো কিছু। ঠিক করতে চেয়েছি একটা তারিখও, জানাতে চেয়েছি ও কতো সুন্দর, কিন্তু আমার গলা দিয়ে বেরোলো কোনো কথাই–জনি কি হয়েছে? বিপদ কিছু নয়তো কোনো? জিনি প্রশ্ন করল। উদ্বিগ্ন।

না, ঠিক আছে–দেখা হবে আবার। ফিরলাম, জিনি গাড়িতে বসে তেমনি ভয়াতুর দৃষ্টি মেলে।

 পাহারাদার কাঁচ বসানো চোখে গেট খুলে দিলো গাড়িটা আর তার আরোহিনীকে ঠাণ্ডা চোখে মেপে নিয়ে। ক্যাসিনোর দিকে হেঁটে চললাম আলো ঝলমল রাস্তায়। নিঃশব্দ পায়ে ঢুকলাম কুটিরের দরজা ঠেলে। রেডিও চলছে পুরোদমে আলো জ্বলছে ঘরের সব কটাই। ডেলা শুয়ে ডিভানে।

সিগারেট টেনে চলেছে মাথার পেছনে হাত রেখে। ঘোরালাম চোখ। আরে কোথায় সে? নেই রাইসনারের দেহটাবুকে শুরু হলো হাতুড়ির পিটুনি। কোথায় ও? ওইখানে–ডেলা আঙুল বাড়ালোকলঘরের দিকে। তা এতক্ষণ ছিলে কোথায় তুমি? কাটাচ্ছিলাম সময়। এসেছিলো কেউ?

একটা কাজ দিয়েছিলাম তোমাকে তাই না? ডেলার চাপারাগের গলা। করেছি তো চেষ্টা ফোন এসেছেতিনবার। দরজা ধাক্কাতেও শুরু করেছিলোলুই হতভাগা তো বলা যায় কি এটাকে চেষ্টা? বারণ করেছিলাম তো ওদের বিরক্ত করতে।

রাস্তায় কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় যদি–এখানেই থাকছি আমি, এখনো পর্যন্ত প্রমাণ দিতে পারোনি তুমি যে কাজের লোক। এগিয়ে পড় চাঁদবদন, ওকে খুন করেছে তুমিই তো? ঘরের সমস্ত আলোগুলো যেন নিভে গেলো চোখের ওপর থেকে।

আরে শোনো–এই ব্যাপারে তুমিও তো আছে। হাতিয়েছে ওর বন্দুকটা। ওকে যদি খুঁজতে থাকে ওরা– গেলাম থেমে। টোকা পড়লো দরজায়। বেশ জোরেই। মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম আমরা দুজনে। শব্দ হলো আবার, আছে নাকি মিসেস ওয়াদাম।

হেমের গলা অধৈর্য। আবার ভয় বাড়লো মনের গভীরে, গেছি পাথর হয়ে। ডিভান থেকে উঠে পড়লো ডেলা, বললো গলা তুলে, হেম সাহেব এক মিনিট কিন্তু ভয়ের ছায়া ওর চোখে, ফিসফিসিয়ে বললো কলঘরের দিকে হাত বাড়িয়ে, ঢুকে পড়, যেন সাড়া না পায় কোনো! অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম কলঘরের দরজা খুলে। হেমের গলা পেলাম কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর, মিসেস ওয়ার্দাম দুঃখিত বিরক্ত করার জন্য আপনাকে। বোধহয় শুনেছেন, পাওয়া যাচ্ছে না। রাইসনারকে।

 ফেরেনি নাকি এখনোবসুন মিঃ হেমনা। ভারী বুটের আওয়াজ পেলাম কার্পেটে। খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন মিস ডোয়েরিং, ফোন করে ছিলেন আমাকে–একবার ঘুরেই যাই তাই ভাবলাম–কিন্তু আপনি কি মনেকরছেন কোনোকারণ আছে? মজা মারার আমেজ ডেলার গলায়। বসে আছে বে স্ট্রীটে গিয়ে দেখুন হয়তো। জানতে পারলাম বেরোয়নি ক্যাসিনোর এলাকা থেকে। মনে হলো না ডেলা কানে নিলো বলে ওর কথা। খাবেন একটু কিছু? বুকে ঝড় আমি দাঁড়িয়ে আছি দরজায় কান লাগিয়ে।

না, ধন্যবাদ ডিউটিতে আছি এখন তো, কাজেই–অফিসারোচিত হেমের গলা। ও খুব কৃতজ্ঞবোধ করবে আপনি সঙ্গদান করেছেন শুনলে রাইসনারের নিঃসঙ্গ সেক্রেটারীকে–ডেলার গলা রিনরিনিয়ে উঠলো। কিন্তু মিসেস ওয়ার্দাম ব্যাপারটা গোলমেলে–শুনেছি রাইসনার সারা দুপুর ছিলো আপনার এখানে। হ্যাঁ, ছিলোই তো। নিক বেরিয়েছে সন্ধ্যে নাগাদ, বললো যাচ্ছে সাঁতার কাটতে তাকে কেউ দেখেনি তো ওদিকেও। হেম বললো একটু থেমে।

আলোচনা করছিলেন কি ব্যবসার কথা আপনারা? ঘরে নীরবতানামলো আবার। হেমের দিকে তাকিয়ে ডেলা, অনুমান করলাম, ক্যাপটেন বিশ্বাস করা যায় আপনাকে আমার মনে হয় কথা আছে, বসুন–লড়াই শুরু দুজনের ইচ্ছাশক্তির, এবার বোধহয়, নীরব তাই দুজনেই। আওয়াজ হলো ক্যাচ করে কিছুক্ষণ পরে, জয় হলো ডেলার বুঝলাম, ক্যাপটেন একটু খান, আমার পছন্দ নয় একা খাওয়া। হেম চোখ ফেরালো স্কচের খালি গ্লাসটার দিকে।

শুরু করেছেন আমি আসার আগেই মনে হচ্ছে। আপনার যে সুনাম আছে বুদ্ধিমান পুলিস সাহেব বলে সেটা মিথ্যে নয়। ডেলা ফোয়ারা ছোটালো হাসির। ই, এড়ায় না বড় কোনো কিছু আমার চোখে। শান্ত মনে হলো হেম কিঞ্চিৎ। উঠলো গ্লাসের আওয়াজ, ডেলা বোধহয় সোড়া ঢাললো। মনে হচ্ছে এক নম্বরী জিনিষ আপনার বোতল দেখে।

যাক কি বলছিলেন যেন বিশ্বাসের ব্যাপারটা? আপনার জানার আগ্রহ হতে পারে এখানে হঠাৎ হাজির হয়েছি কেন আমি আর রিককা। শুনুন খাতাপত্র পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছে পল আমাদের। পল রিককাকে পাঠিয়েছে ক্যাসিনোর উদ্ধৃত্ত টাকা নিক জুয়োর পেছনে লাগাচ্ছে জেনেই, তাড়াবার জন্য ওকে। তা, মানে মানে সরে পড়েছে নিক তো দেখছি নিজেই। ডেলা সাবাস! অভিনয় করছে বেড়ে! অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভাবলাম। কত টাকা গেছে? বলেন কি! বলা শক্ত সেটা এখুনি; হতে পারে হাজার দশেক। দেখা শেষ হয়নি তো কাগজ পত্র, তবে–সব স্বীকার করেছে ও নিজে। চাবিগুলোও দিয়ে দিয়েছে ঝামেলা না বাড়িয়ে। আমি ওকে সরে যাবার বারো ঘণ্টা সময় দিয়েছি। ভাবিনি এর মধ্যে আপনাকে টেনে আনবে ওই বোকা মেয়েটা

হু! এই তাহলে ব্যাপারটা? ধুত্তোর! হেম অনিচ্ছার গলায় প্রশ্ন করলো একটুক্ষণ পরে, তা, এখন কি করার আছে কিছু আমার? বোধহয় না!

আপনার কি মনে হয় ও কোথায় গেছে? পারছি না বলতে। গিয়ে থাকবে সমুদ্রের দিকেই। ওকে তো দেখেনি পাহারাদারগুলো, বলছেন, ব্যাপার মজার। সঙ্গে নেয়নি দেখছি আর কিছুই তো–আমি দেখে এসেছি ওর ঘরটাও রইলাম রুদ্ধশ্বাস হয়ে–ডেলা কি করবে এবার?

ওর কিছু জিনিষপত্র থাকে জোয়ের ওখানে। আর, একদিন এটা হবে নিক তো জানতোই কিন্তু চালু ছিলো লোকটা, অসুবিধা হতে পারে ব্যবসায় ও না থাকায় হেম বললো চিন্তাকুল গলায়। অসুবিধা হবে না কোনো আপনার–আছি তো আমি আর রিককা

ওয়ার্দামের মতও কি তাই? হ্যাঁ, ক্যাপটেন অনেক করেছেন, এখনো করছেন আপনি আমাদের জন্য, পলের ধারণা। কথাও হয়েছে এনিয়ে তার নিকের সঙ্গে–কিন্তু ঝগড়া বাধিয়েছে নিকই। ডেলা হেসে উঠলো আবার উচ্চকণ্ঠে। যাক, আপদ বিদায় হয়েছে। আমরা বাড়িয়ে দিচ্ছি সপ্তাহে আড়াই শোকরে আপনার দক্ষিণা। ছমাস আগে থেকে টাকার হিসেব হবে। আপনি টাকাটা পাবেন কালকেই।

হঠাৎ যেন হেম খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, ই বেশ বেশ। সকলেরই তো দরকার টাকার। মিসেস ওয়ার্দাম কি বলেন? মনে হচ্ছে ভালোই চালাতে পারবো আপনাদের সঙ্গে। তা, কোথায় রিককা সাহেব? আমার নিশ্বাস রুদ্ধ হলে আবার।

হাজির হয়েছে বে স্ট্রীটে গিয়ে সেই হয়তো। পারছি না বলতে ঠিক। কথা হবে, আসুন না কাল। আসবো–আওয়াজ উঠলো ক্যাচ–হেম বোধহয় উঠে পড়লো, কথা বলতে হবে মিস ডায়েরিংয়ের সঙ্গে। খুঁজে মরছে ওরা তো। বলতে পারেন, তবে না ভাঙাই ভালো আসলে কি হয়েছে।

ঠিক তা চাইছি না আমি এখুনি। বলবেন–গেছে যেন বাইরে কোথায়। আসছেন তো কাল? চেয়ার ঠেলে ডেলা উঠলো। নিশ্চয়ই গুড নাইট। কালই আপনাদের সঙ্গে শুরু করা যাবে কাজ–কার্পেটে আওয়াজ পেলাম জুতোর, ব্যাঙ্কে খোঁজ করবো কাল তাহলে, কি বলেন? হ্যাঁ, আগেই চলে যাবো আমরা অবশ্য। কল্পনা করলাম ডেলার হাসিটা। ক্যাপটেন গুড নাইট। শব্দ পেলাম দরজা বন্ধ করার।

অপেক্ষা করছি আমরা দুজনে দরজায় ডেলা, আর এই আঁধারে আমি রাইসনারের লাশ পড়ে আমার পেছনে কোথাও। আওয়াজ এলো গাড়ির স্টার্টারের, মিলিয়েও গেলো ক্রমে। ডেলা ঠেলে দিলো কলঘরের দরজাটা, সামলানো গেছে এখনকার মতো। বেরিয়ে এসো– বেরিয়ে এলাম আস্তে। চোখ ঘোরালাম ভেলার দিকে, লক্ষ্য করলাম সেই বিজয়িনীর দৃষ্টি ওর চোখে আলোটা সরে আসতে।

দেখেছি যা আগেও রাস্তা পরিষ্কারজনি বেরিয়ে পড়। রাইসনার শেষ বিদায় নিতে গিয়েছিলো তার প্রাণাধিক বন্ধুদের কাছে ওরা জানবে। কাছে গিয়েছিলো একটু বেশী। নাও চলো–চোখ ফেরালাম কলঘরের অন্ধকারে ঘাড়ের পাশ দিয়ে। কেমন অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে রাতের এই প্রহরে বয়ে নিয়ে যাওয়া এই লোকটাকে কাঁধে করে। কিন্তু উপায় নেই।

বাইরেই আছে আমার গাড়িটা। ডেলা বলে উঠলো নরম গলায়, ওকে নিয়ে যাও গাড়িতে ফেলে। ক্যাসিনোর পেছনের রাস্তা দিয়ে। দেখে এসেছো তো গুহা। বেশী লাগবেনা পাঁচ মিনিটের, নাও বেরোও। ভালো হতো গাড়িটা তুমি চালালে, চেষ্টা করলাম মৃদুস্বরে বলার। এক পাও নড়ছি না আমি এখান থেকে, তোমাকে কাজটা একাই সারতে হবেযদি টাকার ভাগ পেতে চাও। তোমারই সম্পূর্ণ দায়িত্ব যদি তুমি ভুল করো তো তার–ওকে মেরেছো তুমি, তোমার শেষ কাজও। কলঘরে ঢুকলাম ধীর পায়ে। ওকে দেখলাম আলোটা জ্বলতেই রাইসনার সেই চিৎ হয়ে পড়ে তোয়ালে মাথার নীচে।

অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ওর শরীরে হাত দেবার আগে। লোকটা ভারী শক্ত কাঠ হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ালাম লাশ কাঁধে ফেলে, মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছে দর দর করে, কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে। কলঘরের বাইরে পা দিতেই রাইসনারকে নিয়ে, ডেলা সদর দরজাটা খুলে দিলো ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে।

রাইসনার-এর দেহটা দিলাম সিংহদের।

.

চলছে গাড়িচাপা পড়ে রইলো সিংহগর্জনে ইঞ্জিনের শব্দ। বাড়িয়ে দিলাম গতি আস্তে..নজরে পড়লো ডেলার কুটির কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। আলো জ্বলছে। হেঁটে এগোলাম গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে কুটিরের দরজায় ডেলা। গর্জন শুনতে পাচ্ছি এখান থেকেও। হুইস্কির বোতল তুলে নিলাম ওর পাশ দিয়ে ঢুকে।

ডেলা ফিরে দাঁড়ালো দরজা বন্ধ করে। কোটরে ঢুকে গেছে ওর চোখদুটো। দেখতে পায়নি তো ওরা তোমাকে? নাড়লাম মাথা। হয়ে নাও চাঙ্গা, হেম হাজির হতে পারে যে কোনো মুহূর্তে আরে ধুর, থামাও তো কপচানি।

খেঁকিয়ে উঠলাম, করতে তো হয়নি তোমাকে কাজটা। ন ঘণ্টা থাকতে হয়েছিলো আগলে বসে। ডেলা এগিয়ে এলো স্কচটা একচুমুকে নামিয়ে দিয়ে আবার ঢালতেই। জল দিয়ে এসো তো মুখে–চোখে কলঘরে গিয়ে। কেলেঙ্কারি হবে হেম দেখলে। কলঘরে ঢুকে গেলাম ওর দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে। সমস্ত পরিষ্কার করেছে ডেলা। দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। নিজেকে মনে হচ্ছে শ্মশান ফেরত মানুষ। ঘামে জব জব করছে সারা মুখ, চুল এসে পড়েছে চোখের ওপর, বীভৎস। বেসিনে মুখ নামিয়ে দিলাম ঠাণ্ডা জল ছেড়ে দিয়ে। চুলে চিরুনি চালিয়ে দিলাম তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে। এখনো কাঁপছে হাতটা। দেখি ডেলা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে দরজার দিকে ফিরতেই। প্রশ্ন করলো চোখে চোখ পড়তেই। ওকে জনি? বিশ্বাস করতে পারছি না নিজের কানকে।

কি বললে? কে ওই মেয়েটা? কাজচলেছে চিরুনির কিন্তু জমে গেছে ভেতরটা। বলছো কার কথা? গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম যতটা সম্ভব। তোমাকে নাকি একটা মেয়ে পৌঁছে দিয়ে গেলো পাহারার লোক বললো। কে মেয়েটা এবার সোজা তাকালাম ওর চোখে।

জানবো কি করে! হারিয়ে ফেলেছিলাম রাস্তা বলেইছি ত। যাচ্ছিলো দেরি হয়ে, তাড়া ছিলো ফেরার। লিফট নিলাম ওকে থামিয়ে। নেওয়া হয়নি ওর পরিচয়টাও, হয়েছেটা কি তাতে? না, ভাবছিলাম স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে ডেলা তাকিয়ে আছে, –লিফট নিতে ওস্তাদ তুমি তো আবার, তাই না? ও ফিরে চললো বসার ঘরে।

কলঘর থেকে আমিও বেরোলাম। একসঙ্গে গাঁথা হয়ে গেলো কিন্তু আমাদের জগৎ এখন থেকে ভালো নাও বাসি আমরা যদি পরস্পরকে, মুশকিল ছাড়াছাড়ি হওয়া। বুঝতে পারছো? ডেলা বলে চললো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে। একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার আমাদের মধ্যে। অনুপ্রবেশ চলবে না কোনো নারীর আমাদের জীবনে। একই কথা বলেছিলাম পলকেও পারবো না ঠকতে। এখান থেকে সরে যেতে হবে তোমার মাথায়ও যদি ওই ভূত চেপে থাকে তাহলে। খোলাই রাস্তা তো, তুলে দেওয়া হেমের হাতে–ফোন বেজে উঠলো আমি কিছু বলার আগেই। ডেলা রিসিভার তুলে নিলো লীলায়িত ভঙ্গিতে এগিয়ে।

হ্যালো? দেখতে লাগলাম ওকে। অন্যদিক থেকে কানে এলো একটা উত্তেজিত গলার কচকচি অনেকক্ষণ ধরে। পরেবললো ডেলা, শুনতে পাচ্ছি আমি গর্জন! বলুন তোকি ক্লেলেঙ্কারি। খাঁচার কাছে যেতে লোকটা সবসময় বারণ করেছে পল কতবার, অ্যাঁ? হ্যাঁ আছে, ফিরলো এই তো না–না–এ ঝামেলায় যাচ্ছি না আমরা যা করার করুন আপনি। না, আর এদিকে আসতে দেবেন না কাগজের লোকগুলোকে–ঠিক আছে, দেখা হবে কালই ক্যাপটেন ধন্যবাদ। ডেলা হাসলো মোহিনী হাসি তাহলে ছাড়ছি গুড নাইট, ও নামিয়ে দিল রিসিভার। মুচকি হাসলো আমার দিকে ফিরে, ঠিক আছে সব, তাই হলো যা চেয়েছিলাম, হেম লোকটা কাজের।

কি বলল এর মধ্যে নেই আমরা বাবা! ডেলা সরে এলো আমার দিকে, ঢালোনা সখা আর একটু সেলিব্রেট করি। বাড়িয়ে ধরলাম হুইস্কি ঢেলে। ডেলা বললো গ্লাসটা নিতে নিতে, এইতো এখন নিশ্চিন্ত আমরা। হয়ে গেলাম বড়লোক শুরু সবে জীবনের। জনি, বুঝতে পারছো? বলতে পারলাম না, বললাম না কিছুই।

ডেলা চুমুক দিলো হুইস্কিতে ওর দৃষ্টি আমার দিকেই। খিল তুলে দিলো গ্লাস নামিয়ে হাসিমুখে দরজার দিকে এগিয়ে। আমাদের বিরক্ত করবে না আর কেউ আমি আর তুমি শুধু। ওদিকে ব্যস্ত ওরা সবাই এই আনন্দক্ষণটা ধরে রাখি এসো আমরা দেখিয়ে দাও তুমি কত ভালবাসো আমাকে। ডেলা দাঁড়ালো আমার গা ঘেঁষে। আমার ঘৃণ্য মনেহলো ওকে। আমার জীবনে আর কখনো হয়নি এমন ঘৃণাবোধ। যেভাবে পেতে চেয়েছিলো পেয়েছে ও আমাকে। একটা কথাই যথেষ্ট ওর মুখ থেকে। আমি গাড্ডায়। আমাকে চলতে হবে ওর কথামতই, নইলে–থাকবে না কোনো নারী। মনে পড়লো জিনির কথা। টাকা আছে আমাদের, বলে চললো ডেলা, এটা পরম লগ্ন আমার জীবনের তোমারও নিশ্চয়তাই না? কি, জনি বিশ্বাস হচ্ছে না? বললাম নির্লিপ্ত গলায়, হচ্ছে। ডেলা তার নরম হাতে জড়িয়ে ধরলো আমার গলা।

আমি তাকিয়ে রইলাম ওর অতলান্ত কালো হরিণ চোখের দিকে। ও মৃদুস্বরে বললো, কেমন লাগছে লক্ষপতি হতে? ভালোই লাগছে বললাম। নামিয়ে দিলাম ওর ঠোঁটে ঠোঁট। জড়িয়ে ধরলাম। তারপর ডিভানের দিকে চললাম আস্তে তুলে নিয়ে। আমার ওপর কর্তৃত্বকরেছেও এতক্ষণ পর্যন্ত, কিন্তু চালু হতে হবে আমাকেও, অন্তত বাঁচাতে হবে পৈতৃকপ্রাণটা, ধরতে হবে ধৈর্য। ওর চোখে চোখ রেখে হাসলাম, ওকে ডিভানে শুইয়ে দিয়ে।

এখুনি শেষ করে দেওয়া যায় ওর পাখীর মত নরম গলাটা টিপে–কিন্তু না, ওকে সরাতে হবে অন্য উপায়ে।

এ কথা বিশ্বাস করে নি ডেলা আমাকে গাড়িতে চাপিয়েছে অপরিচিত একটা মেয়ে। ফলে হতে পারলাম না ক্যাসিনোর সহ পরিচালক। আমাকে কাজ করে যেতে হলো ওর সহকারী হয়ে। আমি মেনে নিয়েছি এ অবস্থা, ভুলিনি এটা বুঝিয়ে দিতেও ওকে প্রকাশ্যে।

আমি বিশ্বাস করি নি ডেলাকেও। ও সিন্দুকের চাবিগুলো হাতিয়েছে রাইসারের লাশ আগলাবার ছুতো করে। আমাকে বলেনি সংযোগের সংখ্যাগুলোও। অলিখিত চুক্তি আমাদের মধ্যে : আধা–আধি বখরা উদ্ধৃত্ত টাকার। সোয়া লাখ করে।

এখনো পাইনি টাকাটা। টাকাটা চাইতে ডেলার কাছে ও বলেছিলো, জনি, ব্যবসায় নেমেছি আমরা এখন ও টাকায় চলবে না হাত দেওয়া।

গোটা ক্যাসিনোর মালিকানা অনেক বেশি লাভজনক, নয় কি? থোক টাকা পাওয়ার চেয়ে। অন্য খাতে বইছে কিন্তু আমার ভাবনা। এখান থেকে সরে যাবো জিনিকে নিয়ে ওই টাকাটা পেলে। আমার কোনো স্বপ্নই বাস্তবে রূপ নেবে না ডেলার দেওয়া সপ্তাহাভিক একশো ডলারে। এখন তো বেশি টাকার দরকার নেই তোমার। ডেলা হাই তুলছিলো ডিভানে প্রায় বিবস্ত্রাবস্থায় শুয়ে।

তুমি তোমার ভাগ পাবে, এখুনিনয় তবে। ব্যবসায় খাটছে ধরেনাও টাকাটা। অবস্থা বুঝি আমি বাজারের, অজানা সেটা তোমার। অপেক্ষা করো আরকটা দিন। আমি বিশ্বাস করিনি একথা অবশ্য, ডেলা নিজেওকরেনি সম্ভবত। চাইলেই পাবে তোমার যখন যা দরকার। ঠোঁটে ডেলার কুহক হাসি। লক্ষ্মীটি তোমাকে দেখতে চাই আমি সুখী–সুখী তো না কি তুমি? হাসি ফোঁটালাম বহুকষ্টে মুখে। সুখী আমি বললাম।

ঘৃণা জমেছে মনে প্রচণ্ড প্রবোধ দিলাম নিজেকে, একদিন সময় আসবে…শুধু অপেক্ষা সুযোগের। কিন্তু তা হলো না ডেলা যেমনটা চেয়েছিলো। কেউ মেনে নিতে পারলো না মেয়ে মানুষের খবরদারি। বেঁকে বসলো আবাসিকরাও, কর্মচারীরা তোনয়ই। ডেলা জাকিয়ে অফিসঘরে বসতে লাগলো রোজ সকালে। চালালো হাঁক–ডাকও কিন্তু পেলো না তেমন পাত্তা। একদিন উপস্থিত হলো ধূমকেতুর মত ইস্পাত সম্রাট গলয়ে হ্যারিস ব্রাউন। তখন দপ্তরে ছিলাম আমিও। ডেলা স্বাগত জানালো মিষ্টি হেসে ব্রাউন ঢুকতেই, কিন্তু মনে হলো না ওর দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। প্রশ্নবান ছুঁড়লেন সোজা তাকিয়ে আমার দিকে। অ্যাই রিককা তো আপনিই তাই না? হা, দাঁড়ালাম উঠে, গরম জল নেই আজ সকাল থেকেই আমার ওখানে, আপনারা কি শুরু করেছেন? আগুনের টুকরো ওর চোখদুটো, ডেলা এগোলো হাসিমুখে। সাহায্য করতে পারি আমি হয়তো আপনাকে।

ওর দিকে ঘুরে তাকালেন ব্রাউন, নাকচ করে দিলেন ডেলার বক্তব্য হাতের আন্দোলনে, দেখুন আমি মেয়েদের কাজের ব্যাপারে কোনো কথা বলি না বিশেষ করে তরুণীদের সঙ্গে। রিককা তো ইনিই? সরে যান আপনি একেই বলছি যা বলার। ডেলার আর পথ রইলোনা দুপা পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া। আমি করে দিলাম জলের ব্যবস্থা–আশ্বাস দিলাম উনি সপরিবারে আমার কুটির দখল করতে পারেন এ ধরনের ঘটনা আর ঘটলে। ব্রাউন বেরোলেন দিকবিদিক কাঁপিয়ে ঘোঁৎ ঘোৎ শব্দে। ছড়িয়ে পড়লো খবরটা অন্যেরাও তাদের অসুবিধার ফিরিক্তি নিয়ে আমার কাছেই আসতে লাগলো। বুদ্ধিমতী ডেলা। আমার ওপর ছেড়ে দিলো দপ্তরের কাজগুলো, জনি তুমিই চালাও–তুমিই এখন ক্যাসিনোর মালিক। অবশ্য আমার কাছেই রাখছিচাবিগুলো। জানিও টাকার দরকার হলে। ওর হাতেই রইলো বে স্ট্রীটের কর্তৃত্বও। ভয় করতে শুরু করলো ওরাও ডেলাকে। ডেলা হাজিরা দিতে লাগলো সেখানে সপ্তাহে তিনদিন করে সন্ধ্যেয়। সুবিধেই হলো আমার এতে। আমি জিনির মধুর সঙ্গ পেতে লাগলাম ওই দিন গুলোতে।

ভালো লেগেছে জিনিকে। হৃদয় দিয়ে ফেলেছি ওকে। যদিও জানি ওকে পাওয়ার ঝুঁকি অনেক। ওকে পেতে হবে। মনে ছিলো ডেলার সাবধান বাণী–কিন্তু আমি বদ্ধপরিকর আমার প্রেমপর্ব চালিয়ে যেতে। জিনিকে একটা চিঠি দিয়ে ছিলাম ওর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের পর, তাতে দুঃখপ্রকাশ করেছিলাম আচমকা বিদায় নেবার জন্য ওর কাছ থেকে ওই রকম? সেদিন মনটা অস্বস্তিতে ভরে গিয়েছিলো বোধহয় অনেকটা সময় রোদে বসে থাকার দরুণই। পড়েছিলাম অসুস্থ হয়ে সামলে উঠেছি এখন মোটামুটি। কবে আসবো, ক্ষমা চাইতে যাবো তোমার কাছে। ভাড়া করে ফেললাম একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট ফ্রাঙ্কলিন বুলেভার্ডে চিঠি ছেড়ে দিয়েই। ঠিকানাটাও ওকে দিয়ে দিলাম। সপ্তাহে একশো ডলার আর খাওয়া–দাওয়া, আমার মন্দ চলবে না। অবশ্য থাকছেও না হাতে কিছু। মাঝে মধ্যে বসছিজুয়োর টেবিলেও। পাচ্ছিও কিছু কিছু। পিটসবার্গ অফিস থেকে লিঙ্কনীচে বদলি হয়েছি আমি জিনি জানালোদায়িত্ব নিয়ে এখানেনতুন অফিস খোলার। চালিয়ে গেলাম কাজের ভান, বিশ্বাস করলো জিনি সবই।

খারাপ লাগছিলো ওর কাছে মিথ্যের বেসাতি করতে কিন্তু ছিলো না কোনো উপায়, কারণ ভালবেসে ফেলেছি জিনিকে। জীবন–সঙ্গিনী করতে চাই আমার ওকে। কিন্তু টাকা চাই তার আগে, আর মুক্তি।

আরও ব্যাপারটা সহজ হতো যদি যেমন তেমন কিছু একটা হতো জিনির চাকরিটা। কিন্তু ওকে নিয়ে সরে যেতে পারছি না আমার হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকাতে। ফেলেছি ভুল করে–বোধহয় জিনি আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে এখন বুঝেছি আমি ফকির হলেও কিন্তু ধরা পড়ে এ সব তো দেরিতে। ডেলা বে স্ট্রীটে পাড়ি জমাতে যে সব দিনে, আমি বেরিয়ে পড়তাম বুইকে চেপে জিনির সঙ্গসুখের সন্ধানে। কথা হতো ফোনে–ফ্ল্যাটে সোজা চলে আসতে জিনি, কখনো ওকে তুলে নিতাম আমি। দুটিতে ডুবে যেতাম গানে বাজনায়।

দুজনে খেলতাম দাবা। খেলা শিখেছিলাম জিনির কাছেই। মাঝে মধ্যে চলে যেতাম রণের ওখানেও। ওখানে সময় কাটতে নিরাপদে, কারণ হাজির হবে না সেখানে ডেলা কখনোই। কেউ ক্যাসিনোরও। ভালবাসে আমাকে জিনিও–কিন্তু এগিয়ে আসছে বেরিয়ে পড়ার সময় ওর তো–

দুশ্চিন্তা বাড়লো দুজনেরই জনি বলল তো কি করবো। জিনি বললো ফ্ল্যাটের এক নিভৃত সন্ধ্যায়। কবে হবে আমাদের বিয়েটা এই পর্যায়ে পৌঁছেছি আমরা এগারো দিনে। আমিও মাথা খুঁড়ে মরছি এই সমস্যা সমাধানের জন্য। আমাকে দুটো কাজ করতে হবে জিনিকে আমার জীবনে জড়াবার আগে। হাতে রাখা দরকার অনেক টাকা, প্রথম কাজ, থাকার জায়গা ঠিক করা দ্বিতীয় কাজ। আমাদের পাত্তা পাবে না যেখানে ডেলা এমন জায়গা এখানে যখন টেনে আনে ডেলা আমাকে আশ্বাস দিলো সোয়া লাখের। পালন করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে আমার কাজ–কিন্তু প্রতিশ্রুতি রাখেনি ডেলা তার। আমার অর্জিত অর্থ ওই টাকাটা–আমার বিবেচনায় সুপ্রতিষ্ঠিত তাতে আমার অধিকার। পেতে হবে আমাকে টাকাটা। কিন্তু আমাকে জানতে হবে তার আগে সিন্দুকের সংযোগের সংখ্যাগুলো। রাস্তা নেই প্রতীক্ষায় থাকা ছাড়া। মোটামুটি ঠিক হয়েছে একটা জায়গা বিবাহোত্তর অজ্ঞাতবাসের। কিউবা। হ্যাঁ আমরা যাবো কিউবায়।

বিমানের টিকিট কাটবো টাকাটা হাতে আসা মাত্র। কখনো আসবেনা ডেলার মাথায় কিউবার কথা। করার কিছু থাকবেনা। আর এলেও। তাই, কবে বিয়েটা হতে পারে জিনি যখন প্রশ্ন রাখলো; আমার তৈরীই ছিলো আংশিক উত্তর।

জানালাম আমাদের মিলন সম্ভব হবে মাস দেড়েকের মধ্যেই। বললাম, আমাকে হাভানাতে ম্যানেজারের পদটি দেওয়া হবে যদি এখানকার কাজ মোটামুটি সন্তোষজনক হয় তাহলে। অফিসের কর্তা জানিয়েছে আমাদের। জিনি বেশ হবে, পেয়ে যাবো আমাদের যা চাহিদা কাজ করতে হবে না তোমাকেও আর। জিনি তোমার কেমন লাগবে কিউবায় থাকতে? জিনির উত্তর নীড় বাঁধতে পারে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে সে, আমি সঙ্গে থাকলে। দুশ্চিন্তাও বেড়েছিলো মিথ্যাভাষণে কোনোদিন যদি জানতে পারে জিনি প্রকৃত অর্থ..কিন্তু আমার টাকা নিয়ে বেশি মানসিক অস্থিরতা তার চেয়েও…কবে সরে যেতে পারবো আমার ভাগের টাকা বের করে সিন্দুক খুলে প্রতিদিন বসতাম কর্মচারীদের সঙ্গে ক্যাসিনোর দপ্তরে, শোনা হোত তাদের অভাব অভিযোগ, বিবেচনাও করা হতো প্রস্তাব থাকলে। এদের কখনো ডাকেনি পল বা রাইসনার এরা খুশীহতো তাই ডাকলে।

একটা ক্ষেত্রও হলো হেলিকপটার অবতরণের লিঙ্কন বীচে। উড়ো–ট্যাকসি চলাচল শুরু হলো মিয়ামি আর লিঙ্কন বীচের মধ্যে। মিয়ামি চলে যাচ্ছে একঘেয়েমি কাটাতে বীচের মানুষ, আবার বীচে আসছে মিয়ামির মানুষও–বেড়ে চললো ক্যাসিনোর আয় টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনও চালু হলো ক্যাসিনোর কার্যকলাপের। অনুষ্ঠানও শুরু হলো ক্যাবারে নৃত্য আর বাদ্যবৃন্দের। বুদ্ধির তারিফ করলো ডেলা আমার। জনি, দারুণ তোমার এই আইডিয়াটা, জবাব নেই–হু, করে ফ্যালো পুরস্কারের ব্যবস্থাটাও যখন স্বীকার করছে। হাসলাম, আচ্ছা দিয়ে দাও না ওই টাকাটা, বলেছে যেটা দেবে। কাজে লাগাবো ওটা–মুক্তোঝরা হাসি ফোঁটালো ডেলা ঠোঁটে, জনি ধৈর্য ধরো একটু তুমি পাবে টাকা। বুঝলাম মাঠে মারা গেলো এবারের আবেদনও, কবে? ডেলা একটা বেলেল্লা ভঙ্গি করলো, বলছি কাছে এসো, এই পর্যায় সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ওর অভিনয়ের… প্রেমের পালা শুরু করা অঙ্গুলি হেলনে…কিন্তু যেতে হবে করে–দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এই মেয়ে মানুষটাকে জিনির কাছ থেকে। ডেলা জানবে আমি ওর প্রেমে পাগল যতদিন আমি বাঁচবো ততদিনই। শুয়ে শুয়ে ভেবেছিকুটিরের বিছানায় অন্ধকারে আমার মনের পটে বার বার ভেসে উঠেছে একটা মানুষের মুখ…রাইসনার।

লক্ষ্মীসোনা, দিচ্ছি বিবেকের তাড়নায়–ক্যাসিনোর জন্য তুমি অনেক করেছে। পাকা অভিনেত্রী মেয়ে–মানুষ! জিনি মিয়ামি যাবার জন্য প্রস্তুত হলো তার সৈকতবাস ছেড়ে দিন পনেরো পর। কি ওয়েস্ট চলে যাবে সেখানকার কাজে মিয়ামির কাজ সেরে। অবশ্য ঠিক হয়নি যাত্রার দিন। পাঁচ সপ্তাহ কেটে গেছে রাইসনারের মৃত্যুর পর সব দিব্যি চলছে। রেহাই মিলেছে খুনের, লুকোচুরিও চলেছে ডেলার সঙ্গে। ভালবেসেছি জিনিকে–পাখানা মেলে দিয়েছে সেও তার হৃদয়ের।

লস এঞ্জেলস থেকে হাজির হলো এসে আসল রিককা এমনি এক দিনে।

জানতাম আমরা রিককা আসবে–তাই প্রস্তুতিও ছিলো মানসিক ভাবে। তারবার্তা এসেছে লেভিনস্কীর কাছ থেকে কিছুদিন আগে, সেখানে পল পৌঁছায়নি। নিশ্চয় খবর গেছে রিককার কাছেও। ফেরত ডাকে পলের শরীর ভালো নয় লেভিনস্কীকে জানানো হলো, সে বিশ্রাম নিচ্ছে লন্ডনে। রাইসনারের নামেই তার গেলো। সময় নেবার জন্য এসবই। রিককার ট্রাঙ্ক আশা করছিলাম লস্ এঞ্জেলস থেকে, কিন্তু হয়তো উঁকি দিয়ে থাকবে কোনো সন্দেহ লোকটার মনে তাই, সে হাজির হলো সশরীরেই, বিনা নোটিসেই, একরকম।

আঁকিবুকি কাটছিলাম সাঁতার দীঘির একটা নতুন পরিকল্পনা নিয়ে। ভাবছিলাম কেমন দাঁড়াবে আলোগুলোকে দীঘির চারপাশে মেঝেয় বসাবার ব্যবস্থা করলে ওপরের আলোগুলোকে তুলে দিয়ে। সময়টা বারোটার কিছু পরই হবে–ভিড় বাড়ছে লাঞ্চের –লোকও বাড়ছে বারের। টের পাইনি ওর ঢোকা। নিঃশব্দে চলাফেরাই নাকি তার বৈশিষ্ট্য পরে জেনেছি। লোকটাকে নজরে পড়লো চোখ তুলতেই দাঁড়িয়ে সামান্য দূরে।

চমকে উঠলাম। ওকে চিনলাম কোনো মিল না পেলেও আমার কল্পনার সঙ্গে ওর চেহারার। ওর চেহারাটা বেশ ভারীই হবে আমার ধারণায় ছিলো, কিন্তু বিশাল ভূঁড়ি, বেঁটে, মোটা একটালোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে। মাথায় টাক পড়ার পূর্বাবস্থা পাতলা চুল কয়েক গাছা ছড়িয়ে। এক মুহূর্তে বলে দেওয়া যায় লোকটা মদ্যপ মাংসল মুখটা দেখে।

একজোড়া প্রাণহীন চোখ সাপের মত, তৈরী যেন কাঁচের। অর্থহীন হাসি মুখে একটা, যে হাসি ঠোঁট থেকে কখনোই মিলোয় না।

বিস্তৃত হলো হাসিটা, জ্যাক রিককা আমি, কোথায় নিক? আমার পা চলে গেলো টেবিলের তলায় একটা বোতামে, সঙ্কেত বেজে উঠলো ডেলার ঘরে। শুধু এটা ব্যবহার করার কথা রিককার আগমনের সাবধানবানী হিসেবেই। ছেড়ে দিলাম চেয়ারে পিঠ, এক নিভৃত কোণে বসলাম অম্লান রইলো মুখের হাসি, অপরিবর্তিত মুখভাবেও–রিককা টেনে নিয়ে বসলো চেয়ারের পেছনে মোটা আঙুল ছুঁইয়ে। মানে, বলছেন মায়া কাটিয়েছে ইহলোকের? গন্ধ পাচ্ছি ওর নিশ্বাসের ওর অনুমান ঠিকই মাথা হেলিয়ে জানালাম। হু, ব্যাপার গোলমেলে তা, জানতে পারি আপনি কে? সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম ড্রয়ার খুলে। ৪৫ কোলট অটোমেটিকটা রয়েছে আধখোলা ড্রয়ারের এক কোণে…শুধু ঘোড়া টিপে দেওয়া হাতের মুঠোয় নিয়ে বিপদ দেখা দিলে–পাকা করা আছে সব ব্যবস্থাই রিককার অভ্যর্থনার। আমি? কোম্পানী চালাচ্ছি আমি। হু, –আচ্ছা।

তো, কে দিলো এ গুরুভারের দায়িত্ব আপনাকে? ড্রয়ারে স্থির রিককার সর্পচক্ষু। কিন্তু সেখান থেকে অটোমেটিক চোখ চলে না সে যেখানে বসে আছে। তবে সে যে আন্দাজ করেনি কিছু তার মানে এই নয়। ফিরলাম ডেলার কণ্ঠস্বরে। আমি দিয়েছি, ও দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তাই বুঝি? রিককা বলল মাথা না ঘুরিয়েই–তার চোখ নিবদ্ধ আমার ওপরই, তা, কোথায় পল? ডেলা তার মুখোমুখি এগিয়ে এলো ধীর পায়ে জ্যাক কেমন আছো? দেখা নেই অনেকদিন, খবরাখবর কি। লস এঞ্জেলসের? রিককা চাপিয়ে দিলো পায়ের ওপর পা, বুকে জড় করলো হাত দুটো। মনে হচ্ছে লোকটা বিপদজনক। তার জানার কথা নয় ডেলা এখানে রয়েছে, অজানা রাইসনারের মৃত্যুসংবাদও, কিন্তু বুঝলাম তার মুখোভাবের পরিবর্তন আসার পক্ষে যথেষ্ট নয় এ খবরগুলোর কোনোটাই।

সে উত্তর দিয়ে গেলো নির্বিকার ডেলার প্রশ্নের, আছি ভালোই। হ্যাঁ, দেখা অনেকদিন পরে, খবর ভালোই লস এঞ্জেলসের। কিন্তু দেখছিনা যে পলকে। মারা গেছে। ডেলাও কথাগুলো ছেড়ে দিলো নির্বিকার গলায়। সেই হাসি মুখে, ভাবান্তর নেই কোন। স্বাস্থ্যের জায়গা তো লিঙ্কন বীচ তা এখানে–যাকগে একদিন তো মরতে হতোই। কি হয়েছিলো? ঠাণ্ডা লেগেছিলোনাকি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দুনিয়া থেকে? মারা গেছে গাড়ির দুর্ঘটনায়। আর তারপর ক্যাসিনোর : মালকানী সেজে বসেছো একটা ছোকরা জোগাড় করে?

পা নাচাতে লাগলো রিককা। হ্যাঁ, ঠিক তাই–ডেলার বরফঠাণ্ডা গলা, আর তাতে করার কিছুই নেই তোমার। রিককার হাসি সুস্পষ্ট হলো, ডেলা স্মার্ট মেয়ে তুমি বরাবরই। তা, ব্যাপারটা আর কেউ কি জানে তোমরা দুজন ছাড়া? না, জানবে জানার সময় হলেরিককা ফুটবল মাথা নাড়লো ভালো। তা কে ইনি? সে মোটা আঙুল বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। ও জনি, ওকে এখানে জনি রিককা বলে জানে সকলে–বেশ, বেশ–একেই আমি বলে ধরেই নিয়েছিলো নিক তাহলে–কথা বললাম না আমরা কোনো। তা, ভায়া গেড়ে বসেছে ভালো জায়গাতেই। হ্যাঁ, আর সেদিকেও লক্ষ্য আছে আমার যাতে অন্য কেউ গিয়ে বসতে না পারে তাকালাম রিককার চোখে। তার ঠোঁট থেকে হাসি মেলালো না। ডেলা কোমর ঠেকিয়ে বসলো টেবিলে।

সিগারেট ধরাল। দ্যাখো জ্যাক কথা বলি খোলাখুলি মারা গেছে পল। রাইসনারওরইলাম জনি, লেভিনস্কী, তুমি আর আমি। লেভিনস্কী যেমন আছে থাক প্যারিসের ব্যাপারটা নিয়ে। লস এঞ্জেসল আছে তোমার। আমরা থাকবো লিঙ্কন বীচ নিয়ে–পা দেব না কেউ কারো ল্যাজে।

হু, ব্যাপারটা সাজানো হয়েছে দেখছি বেশ নিখুঁত ভাবে। তা, মনে করছে কাজ করতে পারবে বলে এ ছোকরা, ঠিকমত? হাতটা এগিয়ে নিলাম একটু ড্রয়ারের দিকে, মনে হচ্ছে গোলমালের সূত্রপাতকারী সংলাপ। জ্যাক আমি নিশ্চিন্ত সে বিষয়, ওর এলেম আছে এ সব ব্যাপারে বলতে পারো পলের মতোই–চমকে উঠলাম। মনে হলো সত্যি কথাই বলছে যেন ওর বলার ধরনে। রিককা মাথা নাড়লো আমার দিকে চেয়ে, ঠিক আছে। আমার পছন্দ চালু লোকই–আর ভালোই চালাচ্ছো তো তোমরা দুজনে ডেলা যেন অভয় পেলো একটু কিন্তু সতর্ক আমি। তোমার আপত্তি আছে এখানে যদি দিন দুয়েক থাকি? দেখতাম ঘুরে ফিরে একটু হ্যাঁ–হ্যাঁ থাকো না–আমাদের ভালোই লাগবে, ডেলা লুফে নিলো প্রস্তাবটা। খাওয়া যাক চলো একটু, শুকিয়ে গেছে গলাটা। ডেলা তাকালো আমার দিকে, আসছোনাকি জনি? ব্যস্ত আছি একটু, আসছি দেড়টা নাগাদ—

ঠিক আছে। উঠে দাঁড়ালো রিককা। উঁকি দিলো ড্রয়ার বন্ধ করার মুহূর্তে, বাঃ, আমার তো পছন্দ এরকম লোকই–যে বাঁচাতে জানে নিজেকে। পরে মোলকাত হবে, আচ্ছা দোস্ত। ডেলা বেরোলো রিককা দরজা খুলে ধরতে।

দেখে যাচ্ছি আমি। সশব্দে ড্রয়ার ঠেলে দিলাম আমি দরজা বন্ধ হতেই। চপ চপ করছে ঘামে মুখ, গতি বাড়ছে হৃৎস্পন্দনের বাঘের মুখে যাওয়া এ লোকটাকে বিশ্বাস করা মানেই। বলতে পারে বেশ গুছিয়েই কথাবার্তা–খালি হাতে ফেরার মানুষনা এধরনের চিজগুলো–মাথায় বসে রইলো চিন্তার কুণ্ডলী পাকিয়ে। পরে উঠে দাঁড়ালাম জানলার কাছে–চোখে পড়ছে একটা অংশ বাইরে গাড়িবারান্দার। হেঁটে চলেছে ওরা পাশাপাশি। সেই হাসি রিককার ঠোঁটে। বলছে কথাও।

ঠিক। রিককা ফিরলো ডেলার দিকে, নিক কি হাত দিয়েছিলো সত্যিই উদ্ধৃত্ত টাকায়–না কি শুধু সন্দেহ করেছিলো পল? দিয়েছিলো তবে, সরাতে পেরেছে খুব সামান্য–জবাব দিলো ডেলা। অংশটা বিরাট। উদ্ধৃত্ত টাকার ডবল টাকা আমার ওখানকার। রিককা বললো। ডেলা, কঠিন গলায় বললোকয়েক সেকেন্ডনীরবতার পর, হ্যাঁ। তবে আমাদের দরকার এর প্রতি পাই পয়সাই। রিককা আমার দিকে ফিরলো। ওর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় পাঠিয়ে দেওয়া যায় লস এঞ্জেলসে এই টাকার একটা অংশ মানে, আর কি কথার কথা। এটা করতো পল থাকলে সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতে জানতো এক জায়গার টাকা অন্যখানে খাটিয়ে। টেবিলে নামিয়ে দিলাম ছুরি–কাঁটা আমার। চলে গেছে ক্ষিদে। কিন্তু কোনো বিকার নেই ডেলার সে খেয়ে চলেছে যেন কানে যায়নি কিছুই।

একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলো রিককার হাসিটা রবারের মুখোশ যেন মুখটা! আমার আদৌ ভালো লাগলো না ওর ওই মুখভাব। তোমাদের ব্যাপার অবশ্য এটা–রিককার ঠোঁটে ফিরে এলো হাসি। জ্যাক বললাম তো তোমাকে, এখানে লাগছে এর প্রতিটি পয়সা।

ডেলা কথাগুলো বলে গেলো মুখ না তুলেই। লাগছে হয়তো–শেষ করলো রিককা খাওয়া। বেয়ারা সরিয়ে নিয়ে গেলো বাসন। রিককা বলে যেতে লাগলো লস এঞ্জেলসের ক্যাসিনো সম্বন্ধে। মনে হলো ফঁড়া কাটলো এখনকার মত, কিন্তু তাহলে রিককা আবার এ প্রসঙ্গ তুলবে যদি আমি ভুল না করে থাকি, টাকা হাতাবার চেষ্টা চালাবে। জানি না কতদূর যেতে পারবে। কিন্তু শেষ না দেখে ছাড়বে না। সাঁতার দীঘির আলোক ব্যবস্থা সম্পর্কে রিককাকে বোঝাচ্ছি ব্র্যান্ডির গ্লাস হাতে নিয়ে। বারান্দায় বসে কফি শেষ করে আমার পেছনে কিছু দেখে চোখ তুললো রিককা আর ডেলা, ফিরলাম আমি। দাঁড়িয়েছে এসে একটা মেয়ে। ওকে চিনতে পারিনি প্রথমটায়, মনে পড়লো পরে–জর্জিয়া হ্যারিস ব্রাউন মেয়েটা।

মাতাল, টলছে। আর আমাদের দেখা হয়নি সৈকতে সেই দিনটির পর। আমার অস্বস্তি হলো, আজ ওকে দেখে। জর্জিয়া শুধোলো আমার কাঁধে একটা হাত রেখে, চিনতে পারো কিগো পিয়ারী? ও আমার দিকে তাকালো রক্তবর্ণ চোখে, পরনে স্ন্যাস। দাঁড়ালাম উঠে, রিককাও উঠলো। আমার দিকে ডেলার চোখ।

ইঁদুরের দিকে তাকায় বেড়াল যেমন করে। বিপদের সঙ্কেত, বললাম আড়ষ্ট গলায় কিছু বলবে? হ্যাগো, এসেছি তো সেজন্যেই। জর্জিয়া পড়ে যেতে যেতে সামলালো আমার কোটের কোণ ধরে। তুমি চেনোই মিসেস ওয়ার্দামকে। জ্যাক রিককা ইনিই। পরিচয় করিয়ে দিই রিককা–মিস জর্জিয়া হ্যারিস ব্রাউন। অভিবাদনকরলো রিককা একটু ঝুঁকে। ওর দিকে তাকালো না ফিরেও জর্জিয়া। তুমিই রিককা, আমি তো জানতাম…। হ্যাঁ, ভাই হয় ও আমার সম্পর্কের বাবার দিকের। ভাবতে অবাক লাগে আবার বাপ আছে তোমার মত পোকা জাতীয় জীবের। কিছুক্ষণ হাওয়ায় ভাসলোকথাগুলো–কেউই কিছু বললাম না আমি আর রিককা। সিগারেট ধরালো ডেলা একটা। কথা বলছেন যে, কিগো বেজন্মা! বুঝলাম, রিককা আমাকে দেখছে গভীর মনোযোগর দৃষ্টিতে। ফ্যাকাসে মেরে গেছে ডেলার মুখ। সে বসে আছে নিশ্চল। আমার দাস। আমাকেই সামলাতে হবে। তুমি কি চাও বললাম। এখন শুধু দর্শক নয় রিককা আর ডেলা, মজা দেখার জন্য অনেকেই জুটে গেছে।

আমার দিকে টান করে দাঁড়ালো জর্জিয়া তার ভরা বুকদুটো নিয়ে লাম্পট্যের হাসি ফোঁটালো রঞ্জনী মাখা ঠোঁটে, ওর চোখে পাপের ছায়া, জানতে চাইছি সে কে, যে মাগীটাকে নিয়ে ঘুরছে। কে বল তো লালচুলো সুন্দরীটা? যাকে নিয়ে শোও ফ্র্যাঙ্কলিন বুলে ভার্ডের ডেরায়, কথা বলল যার কানে কানে বলের কামরায়, ও কে? দপদপ করে উঠলো মাথার শিরা। দমে গেলাম পরক্ষণেইমামলো সেই শীতল অনুভব। আমার বোলোনা কোন কথা মুখ দিয়ে। এবার কানে এলো রিককার রসিকতা, জনির ও, মায়ের দিকের ছুটকি কেটে পড় তো এখন ভরে গেছে চোখ জলে। নাক লাল বিকট গন্ধ মুখে। পারছে না কিছুই। বুঝতে না? কাটো। কে হেসে উঠলো দর্শকদের মধ্যে। জর্জিয়া হঠাৎ চুপসে গেলো ফোঁটা বেলুনের মত, দৌড়ে চলে গেলো নিজের ঘরের দিকে এলোমেলো পায়ে। দরকার ছিলো ওকে তাড়ানোর, দুঃখিত জনি কথা বলার জন্য কথার মধ্যে–রিককা বললে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে।

 ধন্যবাদ। তাছাড়া ও ছিলো না প্রকৃতিস্থও। বললো চোখাচোখি হতেই ডেলার সঙ্গে, ব্যাপারটা কি রলের, জনি, নাকি ঠিক হবে না জিজ্ঞাসা করা; হাসি ওর ঠোঁটে, বরফশীতল চোখ দুটো। কি বললাম শুনলেই তো, প্রকৃতিস্থা নয় মেয়েটা রিককা বলে উঠলো সান্ত্বনার গলায়, আরে আরে এরকম অনেক আছে। আমাদের লস এঞ্জেলসেও পাত্তাই দিতে নেই ওদের। মাথা পাগলের দল উঠে পড়লো ডেলা, বে স্ট্রীটে যাচ্ছি আমি আর জ্যাককথা হবে পরে–ডেলা গাড়ির দিকে নেমে গেলো আমার দিকে না তাকিয়েই। রিককা হাত রাখলো আমার কাঁধে। সবই আজব চীজ মেয়েগুলো ব্যতিক্রম নয় এও তার, চলি–এ যেন কথা বলছে রাইসনার! নেমে গেলো রিককাও–তার ঠোঁটে আকণ্ঠ হাসি। বসে আছি টেবিলে ব্যস্ত মনে। হাতে জ্বলছে সিগারেট। দেখতে পাচ্ছি দেওয়ালের লিখন। আর নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না ডেলাকে ফাঁকি দিতে পারবো বলে।

চালু মেয়েটা বড্ড–ও জিনির সমস্ত খবরই বের করে ফেলবেআজ রাতের মধ্যেই। আবিষ্কৃত হবে অভিসার কক্ষও ফ্র্যাঙ্কলিন বুলেভার্ডের। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠবে রলের নিভৃত কামরাও। তবে হেমের হাতে তুলে দেবে না ডেলা আমাকে বরং আমাকে টাইট দেবার চেষ্টা করবে রিককার সঙ্গে এক জোট হয়ে।

খেলা ফুরিয়েছে আমার এবার সরে পড়তে হবে মানে মানে সিকটার দিকে তাকালাম চেয়ার ঘুরিয়ে। তাড়া তাড়া নোট সাজানো আছে ওই ভারী ইস্পাত দরজার পেছনে, আমার প্রাপ্য যার একটা বড় অংশই। কিন্তু সম্ভবনয়। কোই পরোয়া নেই যদি টাকাটা পেয়ে যাই তো। কিন্তু সিন্দুকের দরজা তো চিচিং ফাঁক হচ্ছে না সংযোগের কায়দা ছাড়া। আশার স্বপ্ন বুনে চলেছি এতদিন ধরে শুধু। স্বপ্নে দেখা দেবে সংযোগের নম্বরগুলো। আর, মাত্র তিনটে ঘণ্টা সময় আজ আমার হাতে–চার ঘণ্টা হতে পারে হয়তো করতে হবে এর মধ্যেই। কার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে নম্বরগুলো ডেলার কাছ থেকে যখন পাচ্ছি না? লুই? জানে কি ও লোকটা? হয়তো তুলে নিলাম ফোনের রিসিভার।

লুই, বলছি রিককা, হয়েছে এক ফ্যাসাদ। অফিসে এসেছেন মিঃ ভ্যান এটিং–এখুনি ভাঙাতে চাইছেন একটা চেক; বেরিয়েছেন তো মিসেস, ওয়াদাম–জানেন কি সিন্দুকের সংযোগ নম্বরগুলো? মনে হলো, ভালোই বললাম–ব্যবসায়িক সুর রয়েছে গলায়। গলায় রয়েছে ব্যক্ততার আভাস। জানি না তো মিঃ রিককা আমি দুঃখিত। লোকটা জানা থাকলে নিশ্চয় বলতো, গলার সুরে মনে হলো। ও। এখন কি করি তাহলে? ক্ষেপে উঠেছেন তো ভদ্রলোক! যোগাযোগ করুন না মিসেস ওয়ার্দামের সঙ্গে, পেয়ে যাবেন বে স্ট্রীটে। করেছি চেষ্টা। ওখানে নেই উনি। আচ্ছা, হাজার তিনেক ডলার হবে না আপনার ওখানে, না? না, স্যার নেই অত টাকা। লুই, ঠিক আছে। দুঃখিত বিরক্ত করার জন্য–দেখি কিভাবে সাহায্য করা যায় মিঃ এটিংকে–লুইয়ের গলা পেলাম রিসিভার নামিয়ে রাখার মুহূর্তে হয়তো বলতে পারতেন, মিস ডোয়েরিং থাকলে মিস ডোয়েরিং, আমার দৃষ্টি চলে গেলো সামনে দেওয়ালের দিকে।

ডোয়েরিং রাইসনারের সেক্রেটারী? চাকরি থেকে বরখাস্ত করে ওকে ডেলা, হেমকে ডাকার জন্য। হাত টনটন করছে এখন রিসিভারটা এতো জোরে চেপে ধরেছি যে, জানেন কি সিন্দুকের ব্যাপারটা উনি? , শুনেছি তো জানেন বলেই উনিই তো টাকা বের করতেন রাইসনার সাহেব না থাকলে। কিন্তু এখন তো নেই তিনি, লুই, ও ঠিক আছে ছাড়ছি। লাইন ছেড়ে দিলাম প্রমাণ করার জন্য আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই এ ব্যাপারে। কয়েক মুহূর্ত ভাবলাম লাইন ছেড়ে, তারপর সুপারভাইজারকে ডাকলাম ফোন তুলে, রিককা বলছি–ঠিকানা জানা আছেমিস ডোয়েরিংয়ের? মহিলাটি বললো লাইন ধরে রাখতে, অনন্ত সময় মনে হচ্ছে এক একটা মিনিট যেন। ২৪৭–সি কোরাল বুলেভার্ড গলা এলো সুপারভাইজারের। আছৈ ফোন? আছে স্যার। লিঙ্কন বীচ, ১৮৫৭৭। ধন্যবাদ, ছেড়ে দিলাম লাইন।

শুকোবার সময় নিলাম মুখের ঘাম। এবার নম্বর চাইলাম ডোয়েরিংয়ের, আমার পরিচিত হবার সুযোগ হয়নি এই মহিলাটির সঙ্গে, শুধু দুএকবার চোখাচোখি হয়েছে। রিং হলো, লাইনে ভেসে এলো নারীকণ্ঠ, হ্যালো? মিস ডায়েরিং? হুঁ, কে বলছেন? রিককা, একটু দরকার আছে আপনার সঙ্গে। আসতে পারি মিনিট পনেরোর মধ্যে, আপত্তি আছে? ডোয়েরিং জিজ্ঞেস করলো একটু চুপ করে থেকেবলুন তো কি ব্যাপার? আপনাকে বিরক্ত করতে যাবো কেন আর ফোনে বলতে পারলে। আসবো? দরকার দেখা করা। মনে করেন যদি তাই। ছাড়ছি ধন্যবাদ। লিফটে হাজির হলাম দপ্তর থেকে বেরিয়ে।

লবি ছেড়ে গাড়ি বারান্দায় একতলায় নেমে। কথা বললো কে যেন–দেখালামই না লোকটাকে, সোজা চলেছি। বসলাম বুইকে চেপে সোজা গেটে। গেট খুলে গেলো আজ সঙ্গে সঙ্গেই। কাঁটা সত্তরের ঘরে তুলে দিলাম। সদর রাস্তায় পড়ে। নামলাম গাড়ি থামিয়ে ২৪৭-এর সামনে বাড়িটা অনেকগুলো ফ্ল্যাট নিয়ে। উঠে গেলাম সোজা পাঁচতলায় লিফটে করে। বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেল টিপে দিলাম নম্বর আঁটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। খুলে গেলো দরজা মুহূর্তে–দরজা খুললো ডোয়েরিং, আসুন মিঃ রিককা। আসুন ভিতরে। একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলাম ওর পেছন পেছন। একটা টেবিল আর রেডিও সেট দুটো আরাম কেদারা একটি সেটি। ওর পাশে সেটিতে বসলাম। দেখলাম দুজন দুজনকে, ভাবছি শুরু করবো কিভাবে। কথা বের করা শক্ত হবে না ওর কাছ থেকে। আমার মনে হলো, কিছু পেলেন কাজকর্ম? না, একটা দেবেন নাকি? ডোয়েরিং পা চাপালে পায়ের ওপর।

চোখে পড়লো হাঁটুর যে অনাবৃত অংশটুকু তাতে আকর্ষণের বস্তু হতে পারতো জিনির সঙ্গে পরিচয় না হলে।

কিন্তু তাকালাম না আজ। একটা সিন্দুক আছে রাইসনারের দপ্তরে, আমার দরকার সেটার সংযোগনম্বরগুলো। আপনি নাকি জানেন লুই বলেছিলো–কথাগুলোবলে দিলাম বিনা ভূমিকায় এক নিশ্বাসে। মিঃ রিককা সময় নষ্ট করতে আসেন নি আপনি নিশ্চয়? ভাবলেন কি করে সেটা বলে দেবো চাইবা মাত্র? আমি এসেছি আশা করে–আর জিজ্ঞেস করলেন না তো আপনি, কেন চাইছি–ভোয়েরিং একটা খোঁচা দিলো আমার বুকে সরু আঙুলে, আপনি এতো দেরি করলেন কেন আমি তো ভাবছিলাম। কারণ জানতাম যে আপনি আসবেন। আপনি মাথা চাপড়াবার লোক নন সিন্দুক সামনে রেখে, আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম। তো, করতে চান কিসিন্দুক ফাঁক করতে ডেলার মাথায় বাড়ি দিয়ে? তাহলে শুনুন ডেলা আমাকে কিছু টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো একটা কাজের বিনিময়ে, কিন্তু এখন শুরু করেছে অন্য কাহানী। ফুটে যাবো ভাবছি আমার প্রাপ্য টাকাগুলো নিয়ে। কিন্তু, ভাবলেন কি করে আমি আপনাকে সাহায্য করবো? ডোয়েরিং ভ্রূ নাচালো। বললামই তো ভেবে আসিনি করবেনই আমার দিকে একটু সরে এলো ডোয়েরিং, আহা কেন গো বলছো এত গাছাড়া কথা? সব বলবো। আমি বলবো। আমার শক্ত সমর্থ মানুষই পছন্দ বুঝলে?

ওর ঠোঁটে ঠোঁট নামিয়ে দিলাম আমিও তাল বুঝে। ও সরিয়ে দিলো আমাকে আলতো হাতে ঠেলে খানিক পরে। উম–মনে হচ্ছে ভালোই খেলতে পারবে একটু ধৈর্য ধরলে হাত চালিয়ে দিলাম চুলে। তাকালাম তাকের ঘড়িটার দিকে ঠোঁট থেকে রঞ্জনীর দাগ মুছে নিয়ে, পাঁচটা বেজে পাঁচ। কিছু নেই তাড়াহুড়োর, ওকে আশ্বাস দিলাম তবে পেতেই হবে টাকাটা আমাকে। ডোয়েরিং মুখে প্রলেপ দিলো পাউডারের, পালাতে পারবে টাকাটা নিয়ে? চেষ্টা করবো কি করে? হাঁটা দেবে বান্ডিলগুলো বগলের তলায় ফেলে। গাড়িতে করে বেরোবো স্যুটকেসে ফেলে। বাড়িয়ে দিলো বুড়ো আঙুল জানলার দিকে, তার চেয়ে অনেক নিরাপদ ওই পাঁচতলার জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়াও–আঃ, ছাড়ো তো মজা, তুমি কত চাও? মনে হচ্ছে কি সেরকম ক্ষ্যাপা আমাকে? না। আমি ছোঁবো না ও টাকা– ডোয়েরিং হাসলো শব্দ করে।

মোট পঁচিশ মিনিট সময় গেলো ক্যাসিনোয় ফিরতে। ডেলা ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম গেটের সবুজ চোখো পাহারাদারটাকে। বুঝলাম তাতে ফেরেনি লোকটা বিড়বিড়িয়ে যা বললো। ক্যাসিনোর পেছন দিকে চলে গেলাম দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে। মাটি থেকে বিশ ফুট উঁচুতে আমার দপ্তরটা। দেয়াল ঘেরা বাগান পেছনে শুধু। তাকালাম আশেপাশে নেই কেউ কোথাও। নীচে স্যুটকেসটা রাখলাম জানলা বরাবর। ক্যাসিনোর গাড়িবারান্দায় নিয়ে এলাম গাড়িতে ফিরে সেটা চালিয়ে। ওপরে উঠতে লাগলাম একসঙ্গে তিনটে করে সিঁড়ি টপকে। কথা বলার চেষ্টা করলো পথে পরিচিত অনেকে, সবাইকে এড়িয়ে গেলাম মুখে হাসির ভাব রেখে। ডেলা ক্রমে সবই জানবে স্যুটকেসের কথা ছাড়া। শুধু জানবে আমার সঙ্গে ছিলো একটা ব্রাউন পেপারের মোড়ক। খিল তুলে দিলাম ঘরে ঢুকে। আংটা নামিয়ে দিলাম জানলার কাছে গিয়ে বাঁধা শক্ত দড়িতে। আংটা গাঁথলে প্রথমবারেই স্যুটকেসে। সেটাকে টেনে তুললাম হড় হড় করে। নষ্ট করা চলবে না একটা মুহূর্তও। সিন্দুকের কাজ শুরু করে দিলাম সংযোগের সংখ্যাগুলো নিয়ে।

ঘড়িতে ছটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। ঘোরানো হলো শেষ সংখ্যাটাও–অপেক্ষা করলাম নিশ্বাস বন্ধ করে। তারপর সিন্দুকের দরজা খুলে গেলো হাতল ধরে টানতেই। তাকালাম একটু পিছিয়ে গিয়ে। শুধু ব্যান্ডিলের সারি দুটো তাক ভরে…বাণ্ডিল! এক শো ডলারের বাণ্ডিলগুলো ভরতে শুরু করে দিলাম স্যুটকেস খুলে সন্তর্পণে। স্যুটকেস ভরে গেলো আড়াইশো টা বান্ডিলে…সব আমারই। আরো অনেক টাকা সিন্দুকে…কিন্তু আমার তো না ও টাকা।

বন্ধ করে দিলাম সিন্দুক। তিনখানা নোট বের করে রাখলাম স্যুটকেসে তালা মারার আগে। জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম নোটগুলো ভাজ করে। সেটা পকেটে ফেলে দিলাম স্যুটকেসে চাবি মেরে। ভালো করে টেনে দিলাম সিন্দুকের দরজাটা, ঠিক আছে। একবার ঘষে দিলাম সিন্দুকের হাতলটা রুমাল দিয়ে। উঠে দাঁড়ালাম–ঘামে ভিজে গেছে, সারা পিঠ, ভিজে ন্যাকড়া শার্টের কলার। স্যুটকেসটা ফেলে দিলাম জানলার কাছে গিয়ে বাইরে একবার তাকিয়ে। নীচে দড়ি ধরে নেমে গেলাম জানলার খাঁজে কাঁটা আটকে দিয়ে। মাটিতে পা দিয়ে কাটা শুদ্ধ খুলে গেলো দড়িটা বার কয়েক ঝাঁকাতে। সেটা ফেলে দিলাম দড়ি পেঁচিয়ে ঝোঁপের মধ্যে। দ্রুতপায়ে মাঠ পেরিয়ে গেলাম স্যুটকেস হাতে নিয়ে। ট্রাক চালক তার হাত ঝেড়ে মাল তোলার কাজ শেষ করে যাত্রার প্রস্তুতি নেবার মুহূর্তে হাজির হলাম। ওর সামনে নামিয়ে দিলাম স্যুটকেস পৌঁছে গেলাম ঠিক সময়ই।

ভায়া! বললাম হাঁফাতে হাঁফাতে। আমাকে একবার মাপলো লোকটা আপাদমস্তক। সে উদাসীন হাসি ফোঁটালো মুখে একটা, পাঠাচ্ছেন কোথায়? বলছি ভাই দিতে পারো একটা লেবেল। লেবেল পেলাম। সব লিখে দিলাম পরিষ্কার করে : জন ফারার মিবোর্ড এয়ারলাইন রেলওয়ে। গ্রেটার মিয়ামি। চালক স্যুটকেসে সেঁটে দিলো চিরকুটে চোখ বুলিয়ে। চালকের আসনে উঠে গেলো আমাকে একটা রসিদ ধরিয়ে দিয়ে। এটা রাখো, দুঃখিত তোমাকে আটকাবার জন্য। ব্যাটা প্রায় ভিরমি খায় আর কি দশ ডলারের নোটখানা হাতে নিয়ে, স্যার আমি পৌঁছে দেবো ঠিকঠিক আপনার জন্য অপেক্ষা করবো–হেলিয়ে দিলাম মাথাটা মৃদু হেসে। দেখলাম দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান গাড়িটা। চলে গেলো এতগুলো টাকা, আমি নেই তার ধারে কাছেও। মাথা আছে ডোয়েরিং মেয়েটার। দেখবার লোভ সামলাতে পারতো না সুটকেসটা দেখা মাত্র তার ভিতর কি আছে পাহারাদার দুটো–ওই সবুজে চোখোটা বিশেষ করে। টুপির লাইনিংয়ে ঢুকিয়ে দিলাম রসিদটা একটা সরু ফিতেয় মুড়ে। আড়াই লক্ষ ডলার এই ছোট্ট কাগজটার দাম।

কাজ এগিয়ে চলেছে আশাতীত ভাবে বেরিয়ে গেলো টাকা। এবার বেরোতে হবে আমাকেও। ৪৫ কোল্ট অটোমেটিকের কথা মনে পড়লো, টেবিলের ড্রয়ারে রাখা, নিতে হবে ওটা সঙ্গে। ক্যাসিনোর দপ্তরে পৌঁছলাম মিনিট দুয়েকের মধ্যে, ঘরে ঢুকতেই থমকে গেলাম দরজা ঠেলে। আমার টেবিলের পাশে বসে ডেলা আর রিককা আমার বন্দুকটা রিককার হাতে তাক করা আমার দিকেই…জনি এসো কানে এলো ডেলার কিশোরী কণ্ঠস্বর। দামী কার্পেটের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে গেলাম দরজা ভেজিয়ে দিয়ে। ফিরে আসার জন্য অভিশাপ দিলাম মনে মনে নিজেকে। ডেলা বলে উঠলো টেবিলের দিকে এগোতেই, তোমার আর বসা চলবেনা ওখানে;পরিচয় করিয়ে দিই আমার নতুন অংশীদারের সঙ্গে। সে রিককাকে দেখিয়ে দিলো পেলব হাতবাড়িয়ে।

হু, জমেছে, দেখছি নাটক বেশ–তা, এটা খেললো কার বুদ্ধিতে? তোমার না রিককা সাহেবের? আর আমার দিকেই বা উচিয়ে রেখেছে কেন বন্দুকের নলটা? কারুরই নয় বুদ্ধিটা আমাদের বলতে পারো জর্জিয়ার! ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেই তোমারধীরে আস্তে সিগারেট ধরালাম প্যাকেট বের করে, উঠে এলো হাতে স্যুটকেসের চাবিটাও।

আমার হাঁড়ির খবর নিতে বেরিয়েছিলো ডেলা। তবু বললাম, এ সব মজা না মারলেই কি নয় রিককার সামনে? মনে হয় না এটা ভালো লাগছে ওর কাছে–হাসির জোয়ার বইলো রিককার ভোতা মুখে হা–হা, ডেলা তো গুলি করতে বলেছিলো তোমাকে দেখামাত্র, অনেক কষ্টে বুঝিয়ে আমি–তাহলে দোস্ত এখানে তুমিই থাকো–নির্বিকার ভাব দেখাবার চেষ্টা করলাম সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে। চোখ দুটোকে বিস্ফারিত করলো ডেলা সামনে ঝুঁকে, তুমি একথা অস্বীকার করতে পার ফ্র্যাঙ্কলিন বুলেভার্ডে ফ্ল্যাট নিয়েছো? আর লদকালদকি করছো ওই মাগীটার সঙ্গে, সেটা? না। করি না। তো, এ ব্যাপারে কি করতে চাও? বললাম শান্তকণ্ঠে। ডেলা গুম হয়ে গেলো চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে। চুপচাপ আমরাও।

শেষে বলে উঠলো রিককা, তাহলে চলে যাওয়া যাক নাটকের শেষ দৃশ্যে–দরকার কি বৃথা সময় নষ্ট করার একে নিয়ে–ফেটে পড়বে ডেলা এবার ভেবেছিলাম। কিন্তু ওর আশ্চর্য নিয়ন্ত্রিত গলা পেলাম। হ্যাঁ, তাই যাবো। জনি সাবধান করেছি তো বারবার তোমাকে–চলবেনা মেয়েবাজি। পরিষ্কার মনে আছে আমার কি বলেছিলে–আশ্চর্য শান্ত আমার গলাও। তাহলে তোমাকে ভোগ করতে হবে তার ফলও–তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি এখান থেকে। তোমাকে ফিরে যেতে হবে নামহীন তৃতীয় শ্রেণীর মুস্টিকের জীবনে কেমন বুঝছো? বাঁচলাম। ভেবেছিলাম গালে স্পর্শ পড়বে ডেলার হাতের। তাকিয়ে নিলাম আড়চোখে সিন্দুকটার দিকে। এরা এখনো পায় নি মাল গ্যাড়ানোর। খবর। দাঁড়াও, সমাধান করে ফেললে তো হবেনা এত সহজে ব্যাপারটার কিছু টাকা পাবো আমি কথা ছিলো–সেটা চাই– ডেলা আমার দিকে তাকালো চোখে একরাশ ঘৃণা নিয়ে। একটা চুক্তি হয়েছিলো অলিখিত আমাদের মধ্যে মনে আছে, তোমার জীবনে অন্য কোনো নারী থাকবে না? বেইমানী করেছ তুমি–তোমার টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। দ্যাখো এখন ওই টাকার উপযুক্ত কি না তোমার প্রেয়সী।

উঠে দাঁড়ালাম সারামুখে ক্ষিপ্ততার মুখোশ নিয়ে। রিককা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বোসো! বসলাম, দিতে চাও, দাও আমাকে তাড়িয়ে–কিন্তু আমার চাই টাকাটা! তোমাকে বেরোতে হবে এক কাপড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় বলা আছে গেটে ওদের–কেড়ে রাখবে সঙ্গে ঝুলি থাকলেও। হেঁটে যাবে। রাস্তা সোজা। তোমার তো আছেই হাঁটার অভ্যেস। পদযাত্রা শুরু করো–তুমি পার পাবেনা শেষ করলামনাকথা। আমার সর্বশরীর কাঁপছেরাগে। অভিনয় করছি মারাত্মক। রিককাও উঠে দাঁড়ালো আশঙ্কা করে ডেলার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি–আরো কাছে সরে এলো বন্দুকের নলটা। সব টেবিলে রাখো পকেটে যা আছে! ফতোয়া জারী করলো ডেলা। দ্যাখো চেষ্টা করেই–দেখি হিম্মত কেমন তোমাদের যেতে হবে না অতদূর–পায়ে গুলি করবো ও যা বলছেতাই করনাহলে। শেষে বেরোতে হবে হামাগুড়ি দিয়ে–মনে পড়লো একশো ডলারের নোট তিনটের কথা জুতোর মধ্যে, পকেট দুটো উল্টে দিলাম মুখটা অবিকৃত রাখার চেষ্টা করে, দেখে নেবো তোমাকেও–বললাম রিককার উদ্দেশ্যে। ঠোঁটের ফাঁকে রিককা হাসলো। শেষ হলো তল্লাশী। নিশ্চিন্ত হলাম চাবিগুলো চেয়ারে পড়ে থাকায় নইলে হারামজাদীটার ওগুলো দেখলেই মনে পড়ে যেতো সিন্দুকের কথা। অস্বক্তি বাড়াচ্ছে টুপির মধ্যে রসিদটাও। ঠিক আছে, এবার যেতে পারো তুমি। ডেলা কুৎসিত হাসি ফোঁটালো মুখে একটা। সরে পড় তাড়াতাড়ি খবর পাঠিয়েছি বেনো আর পেপিকে, এসে পড়লো বলে ওরা। গাড্ডায় পড়লে আবার, মুণ্ডু চিবোবে ওরা তোমার প্রিয়তম

লুই দরজা ঠেলে ঢুকলো আমি কিছু বলার আগেই। রিককা ওকে দেখে পেছনে লুকিয়ে ফেললো বন্দুকটা। কি চাই? ঢোকা যায় না দরজায় সাড়া দিয়ে? কৈফিয়ৎ তলব করলো ডেলা। ভয় ফুটে উঠলো লুইয়ের চোখেমুখে মিঃ রিককা একা আছেন আমি ভেবেছিলাম–উনি একা নেই দেখছেই তো, কি চাই কি? মেরে গেলাম ঠাণ্ডা। জানি কেন এসেছে লুই। জানতে এসেছে আমি খুলতে পেরেছি কিনা সিন্দুক। লুই কথা বলো তুমি চলে যাচ্ছি আমি। তোমার নতুন মনিব ওই মোটা লোটা ডেলা চেঁচিয়ে উঠলো দরজা খোলার মুহূর্তে ওর পাশ কাটিয়ে, দাঁড়াও। আর দাঁড়িয়েছে! এখুনি তত বেড়াল বেরিয়ে পড়বে ঝোলা থেকে। সরে যেতে হবে। নষ্ট করা যাবে না মুহূর্ত। বুইকে চড়ে বসলাম দ্রুতপায়ে বেরিয়ে। গাড়ি ছিটকে এগোলো। নামিয়ে দিলাম গাড়ির কাঁচ। যখন আমি গেটের কাছাকাছি–ষাটের ঘর ছুঁয়েছে কাঁটা। সেই পাহারাদার দুটোই গেটে, বন্দুক সবুজ চোখোর হাতে। ওরা নিশ্চয় নির্দেশ পেয়ে গেছে আমাকে থামাবার কিন্তু থামা তো চলবে না আমার। মজবুদ, বড় গেট দুটো, আছে অসুবিধেও–সেটা একটা তালাতেই বন্ধ হয় আর বাইরের দিকে খোলে।

জানি ওরা আমাকে রুখবার চেষ্টা করবে না গাড়ির এই গতিতে, করলোও না। ক্ষিপ্র পায়ে সরে দাঁড়ালো ওদের ওপর পড়ার মুহূর্তেনীচের দিকে মাথাটা নামিয়ে দিলাম শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে। গাড়ি সামনের লোহার পাত গেটে আছড়ে পড়লো। গাড়ি টলে উঠলো, গাড়ি সোজা করলাম অ্যাকসিলারেটারে চাপ দিয়ে। আওয়াজ হলো বন্দুকের–কিন্তু বেপরোয়া আমি গাড়ি রাস্তায় পড়লো। আশীর ঘরে এক লাফে উঠলো স্পিডোমিটারেরকাটা। এবার ওরা নড়াচড়া করুক। মিয়ামি হাইওয়ের বাঁক পেলাম মাইল দুয়েক চালিয়ে। কমাতে হলো গতি, তা হোক। কমিনিট সময় লাগবে ওদের বেরোতেও। আর, এ রাস্তায় ওরা জোরে গাড়ি চালাতে পারবে না আমার চেয়ে। হারাতে পেরেছি ডেলাকে–গান গাইতে ইচ্ছে করছেআমার চেঁচিয়ে। বেরোতেও পেরেছি। টাকা পেয়েছি। ও চালু, আমি আরো চালু…আমি কিউবা পৌঁছে যাবো ও কাজ শুরু করার আগে। আমার মনটা ঘুড়ির মতো উড়ছে। রাস্তা পাল্টালাম মাইল পঞ্চাশেক টেনে গাড়ি চালাবার পর। গাড়িটা বুইক কাজেই নজরে পড়বে দূর থেকে। সে ভয় কম এ রাস্তায়। ভরতে হবে গাড়িতে তেলও। মনে পড়লো জিনির কথা–সে রয়েছে মিয়ামিতে এক বান্ধবীর সঙ্গে। টেলিফোন নম্বরটাও আছে। ওকে ডাকবো পরের পাম্পে গাড়ি থামিয়ে।

নিয়ে নেবো তেলটা করে ফেলতে হবে প্লেনের ব্যবস্থাটা আজ রাতেই। জিনিকে রাজি করাতে হবে আমার সঙ্গে কিউবা যেতে পেট্রোল পাম্পে হাজির হলাম আরও মাইল দুয়েক চালাবার পর। বেরিয়ে এলো এক ছাগল দাড়ি বৃদ্ধ গাড়ি থামাতে। ভরে দাও–আর, তোমাদের টেলিফোন আছে? আছে স্যার, ভেতরে। বৃদ্ধ বাড়িয়ে দিলো আঙুল। মনে পড়ে গেলো জুতোর মধ্যে লুকানো টাকাগুলোর কথা। সেগুলো বের করে নিলাম, আমার কাছে নোট নেই–ভাঙানো যাবে এটা? যাবে স্যার। ফোন করুন আপনি, ভাঙিয়ে দিচ্ছি আমি–নিভে এসেছে দিনের আলো। ডায়াল করলাম জিনির নম্বর। প্রায়নটা ঘড়িতে। বাইরে তেল ভরছে ছাগল দাড়ি। টেবিলে পড়ে ক্যামেল সিগারেটের প্যাকেট। ধরালাম একটা তুলে নিয়ে। হ্যালো? ভেসে এলো চাপা কণ্ঠ। জিনির গলা নয়। আছে মিস ল্যাভেরিক না, বেরিয়েছে ফিরবে এখুনি–মনে মনে খিস্তি দিলাম, ঠিক আছে, ফোন করছি আমি পরে।

ছেড়ে দিলাম। তাকালাম বাইরে প্রায় শেষ বৃদ্ধের তেল ভরার কাজ। হাত তুলে জানালো চোখে চোখ পড়তেই, স্যার হয়ে গেছে। ফোন করতে হবে আবার চেঞ্জটা দেখি। ভাঙানো হলো নোট। সিগারেটও কিনলাম এক প্যাকেট। জিনিকে পেলাম মিনিট এগারো পরে, জনি? সোনা, কি খবর? জিনি শোনো, সুখবর আছে–আমি পেয়ে গেছি কাজটা হা–খবরটা এলো এইমাত্র…কাজ শুরু হবে কাল থেকে হাভানাতে। হাভানার প্লেন ভাড়া করে ফেলল এয়ারপোর্টে যোগাযোগ করে–হ্যাঁ, বেরিয়ে পড়তে হবে ঘন্টাচারেকের মধ্যেই…সঙ্গে তুমিও নিশ্চয়ই যাচ্ছো? ভাড়া করবো প্লেন? জিনি হাসলো, আরে, মেলা টাকা লাগে তাতে যেলটারীর টিকিট ফিকিট কিছু..আহা, ভাবতে হবে না টাকার কথা…এখন অনেক টাকা আমার কাছে…জিনি যাবে তো আমার সঙ্গে তুমি? আজ রাতেই? কিন্তু অনেক কিছু তো আছে গোছগাছ করার–হা, করা শক্ত, কিন্তু আমাকে একাই যেতে হবে তোমাকে সঙ্গে না পেলে জনি বোলো না ওরকম করে, –গুছিয়ে নিচ্ছি আমি। লক্ষ্মীমেয়ে, আমরা বিয়ে করছি পৌঁছেই। কেমন, আমি আসছি? নামিয়ে দিলাম রিসিভার।

সেখানে আর এক নাটক বাইরে বেরোতেই–বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে কাঁপছে মাথার ওপর হাত তুলে…আমার থেমে গেলো হৃৎস্পন্দন–আলো আঁধারিতে নজরে পড়লো ডেলার ছায়া শরীর, ওর হাতে বন্দুক–সেই বীভৎসহাসি ঠোঁটে, জনি কি খবর? বুঝলাম এক নজর তাকিয়েই ওর চোখের দিকে।

আমার লাশ পড়বে এক পা নড়লেই। ওঠো গাড়িতে বেড়াতে বেরোবো দুজনে একটু। করলাম না দ্বিধা, করলে অবধারিত মৃত্যু। চড়ে বসলাম বুইকের স্টিয়ারিংয়ে পেছনে বসলো ডেলা, জলদি মিয়ামি চলল! গাড়ি চালিয়ে দিলাম গিয়ার পাল্টে স্টার্টারে পা দিয়ে। গৌরাঙ্গ স্ট্যাচু বৃদ্ধ তখনো। ডেলা মুখ খুললো মাইল খানিক রানীরবতায় কাটিয়ে। কোথায় টাকাটা? ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি গাড়ির আলোয় মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চাঁদের আলোর মত। সেই দৃষ্টি চোখে–জীবনে খুঁজে পাবে না তুমি সে জায়গা–পাবো মিয়ামিতে অপেক্ষা করছে তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য পেপিআর বেনো। তোমাকে কথা বলাবেওরাইখুন করবে–তারপর। তোমার ভালোই লাগবে মরতে। গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি নিঃশব্দে–কিছুই বলার নেই, ভাবনা আছে, শুধু ভাবনা। ভেবেছিলে বিয়ে করতে পারবে ওই মেয়েমানুষটাকে। তাই না? ডেলা বিষোদগার করলো, ওকেও তুলবো পেপি আর বেনোকে তোলার পর…তোমার মুখও খুলবে চাঙড়া দুটো ওর ওপর কাজ শুরু করলেই। মজা টের পাওয়াবো হাড়ে হাড়ে। সরল হয়ে গেলো ব্যাপারটা–তাহলে বিমান বন্দরের কথা শুনেছে ডেলা আমার শুরু হয়ে গেলো অন্য ভাবনাগরান গাছের ঝোঁপ রাস্তার দুপাশে…জিনি বিদায়–উচ্চারণ করলাম কথাগুলো মনে মনে।

একমাত্র একটাই রাস্তা…কল্পনায় ভেসে উঠলো জিনির মুখটা, চোখ দুটো বড় টলটলে, ওর চুলের গোছা তামাটে… স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিলাম প্রচণ্ড বেগে…চাপ দিলাম অ্যাকসিলারেটারে সর্বশক্তি দিয়ে গাড়ি লাফিয়ে উঠলো…জানি না কোনদিকে চলেছি আয়নায় চোখ…মুখ দেখছি ডেলার আবার আওড়ালাম মনে মনে, নাও, এবার গুলি করো–এইযদি শেষ পর্ব হয় আমার জীবনে। তাহলে আমার সঙ্গে তুমিও আছে। চলবে না তোমার নোংরা থাবার স্পর্শ জিনির শরীরে–মৃত্যু ভয়ের ছায়া ডেলার চোখে আর্তনাদ উঠলো একটা বিলাপের তীক্ষ্ণগলায়। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো বন্দুকটা কোলে ফেলে দিয়ে। গাড়িটা ধাক্কা লাগলো একটা গাছে, আর একটা গাছে সেখান থেকে পিছলে। আঁকড়ে আছি আমি স্টিয়ারিং আর দেখতে পাচ্ছি না ডেলার মুখটা…উল্টে গেলো আস্তে গাড়িটা। হবার যা হলো…ভয় নেই আর–ভাবলাম শুধু ভাবছি জিনির কথা এমন সময় কি যেন পড়লো প্রচণ্ড শব্দে মাথার ওপর…শুধু কানে আসছে শব্দগুলোকথা বব শালা টেনেদাঁড় করিয়ে দিলো আমার কোটের কোণ ধরে একটা শক্ত হাত। চোখ খুলতে পারলাম কষ্ট করে সামনে ভেসে উঠলো বেনোর মাংসল মুখটা। ঘুষি মারতে গেলাম হাত উঠিয়ে। উঠলোনা হাত। আমার মুখে মারলো হাতের উল্টো পিঠে বেনো একটা খিস্তি দিয়ে। পড়ে গেলাম বিছানার ওপর। হারিয়ে ফেলেছি চৈতন্য। একটা গম্ভীর গলা পেলাম তার মধ্যেই। উল্লুক কোথাকার, মেরো না ওভাবে! কথা বের করতে হবে ওর কাছ থেকে–কথা ঢুকলো কিনা কে জানে বেনোর কানে, আবার পেলাম ওর বিষটালা গলা কথা বল আই শালা ছিঁড়ে ফেলবো কান নাহলে–চারদিকে তাকালাম চোখ খুলে, পড়ে আছি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নিজের ফ্ল্যাটে ফ্র্যাঙ্কনিল বুলেভার্ডে।

বিছানায় বসে বেনো। রিককা দাঁড়িয়ে পায়ের কাছে। পড়ে রইলাম অনেকক্ষণ হতবুদ্ধি…সব। হয়ে যাচ্ছে এলোমেলো ক্ৰমে মনে পড়ছে জিনির কথা–সে এই ফ্ল্যাটেই আছে কি? ওর চোখে ভয়ের প্রতিফলন দেখেছিলাম দরজা খোলার সময়।

কোথায় ও? প্রশ্ন করলাম ক্ষীণকণ্ঠে। দাঁত বের করে রিককা হাসলো, আছে, আছে পাশের ঘরেই। জনি খেলতে পারলে না খেলাটা জমিয়ে–আমার দরকার ছিলো মেয়েটাকেও। আর, আমাকে সোজা এনে ফেললে সেখানে। চেষ্টা করলাম হাত মুক্ত করতে, কিন্তু কবজিতে আরো এঁটে বসলো দড়িটা। বেনোর দিকে ফিরলো রিককা, নিয়ে এসো এখানে মেয়েটাকে। শুরু করতে হবেকাজ, বেরিয়ে গেলো বেনো। রিককাআমার দিকে তাকিয়ে রইলো তার সাপের চোখে। জিনিকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে একটু পরেই বেনো ঢুকলো বাঁধা ওরমুখ। পেছনে বাঁধা হাত দুটো। বিস্ফারিত চোখে তাকালো জিনি আমার দিকে। আর একবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম হাতের বাঁধন ছাড়াবার, কি করেছে ওরা তোমার? রিককার কাছ থেকে উত্তর এলো, এখনো করা হয়নি তেমন কিছু।

কিন্তু করতে হবে তুমি মুখ না খুললে–চেঁচিয়ে উঠলাম ক্ষিপ্তের মত। ছেড়ে দাও ওকে বলছি সব। ছেড়ে দাও ওকে-এরমধ্যেও নেই। আমাকে পাগল করেছেজিনিরঅবস্থা। মেদবহুল শরীরটা ছেড়ে দিলো রিককা একটা চেয়ারে। ব্যাপারটা সেই সময় আমার হাতে ছিলো, যখন প্রথম তোমাকে সুযোগ দিই আমি। এখন, সব চলে গেছে আমার হাতের বাইরে। দাবি করেছে পেটেল্লি তোমাকে।

টাকাটা চাই আমি শুধু তার হাতে তুলে দেবো তোমাকে মাল পেয়েই। রিককা তার মোটা ঠোঁটটা টানলো হাত দিয়ে, ভেবে দুঃখ পাচ্ছি ওর হাতে তুলে দিতে হবে। তোমার সঙ্গে ওই মহিলাটিকেও। সুবিধে হবে না তাতে বিশেষ। ছেড়ে দাও ওকে, নইলে সেখানেই থাকবে টাকাটা যেখানে আছে–তোমার বাপও খুঁজে পাবে না তা আর তা এমন জায়গায় আছে তোমাকে কথা বলাবার অস্ত্র আছে আমার হাতে। কি বললাম শুনলেই তো ছেড়ে দাও ওকে, নয়তে ছাড়তে হবে টাকার আশা–রিককা একটা ভঙ্গি করলো তার থলথলে কাঁধের উপায় নেই–সব কিছু চলে গেছে আমার আওতার বাইরে। জেনে ফেলেছে অনেক কিছু মেয়েটা। ব্যবস্থা করছে বেনো তোমার–বাদ যাবে না। মেয়েটা–

বরফ মেরে গেলাম। ভয়াবহ ইঙ্গিত রিককার চোখে। শুধু বলতে পারলাম কোনো রকমে। কথা দিচ্ছি আমি খুলবে না ও মুখ।

ছেড়ে দাও ওকে। আড়মোড়া ভাঙলো রিককা। দাঁড়াও বলে নিই একটা কথা–তোমাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি যখন আমার দায়িত্বে রয়েছে এ ব্যাপারটার সবই; হয় শারীরিক কার্যকলাপ চালাতে হবে ওর ওপর তোমাকে কথা বলাতে, নয়তো বুলেটের গুলি তোমার মাথায়, তোমার কোনটা পছন্দ? বলল, বলে ফেলো তাড়াতাড়ি। অধৈর্য হয়ে পড়ছে বেনো। বেনো টান মারলো জিনির ছেঁড়া স্কার্ট ধরে…নেমে এলো জামাটা..বুঝলাম নিস্তার নেই আমার তবু, ওর মৃত্যু কামনাই শ্রেয় মনে হলো আমার বেনোর হাতে ওর শ্লীলতাহানির চেয়ে। আচ্ছা, সব বলছি আমি ওকে বারণ কর জিনির গায়ে হাত দিতে–তাকাতে পারছি না জিনির চোখে। হাতে হাত ঘষলো রিককা আহ্বাদে। এইতো দেখছি পথে এসেছে–সোনার চাঁদ বলতো টাকাটা কোথায় রেখেছে?

মিয়ামি সেফ ডিপোজিট ভন্টে।

হু, করেছে দেখছি বিবেচনার কাজই, চলে গেলো মনটা ভল্টে। ২২ বোরের বন্দুকটা রয়েছে স্যুটকেসে! সারা শরীরে উত্তেজনার একটা তরঙ্গ বয়ে গেলো–রিষ্কার ব্যবস্থা করতে হবে ওই বন্দুকটা দিয়ে।

লিখে দাও একটা চিঠি ওদের, যে–রিককা থেমে গেলো আমার নেতিবাচক ঘাড় হেলানোয়। অত বুন্ধু ভাবলে কি করে আমাকে–টাকাটা বের করতে পারছেনা আমি সঙ্গে না থাকলে। আমার নির্দেশ ঢুকতে পারবেনা ভন্টে অন্য কেউ। কি ভাবলো রিককা মাথা নীচু করে, তারপর বেনোকে ইশারা করলো মাথা তুলে, আরে নিয়ে যাও মেয়েটাকে আসছে না কেন পেপিটা? সে জানে না আমরা এখানে কতবার বলতে হবে একথাটা। তাকে বের করো খুঁজে। দরকার আছে। যেখানে আছে থাকনা–নিজেই সারাবার চেষ্টা করো এ ব্যাপারটা–তোমাকে যেতে বললাম ওকে নিয়ে। রিককা কানে নিলোনা বেনোর কথা। বেনো প্রায় দরজার কাছে ঠেলে নিয়ে গেলো জিনিকে একটা প্রচণ্ড গুতো দিলো হাঁটু দিয়ে ওর নিতম্বে। জিনি বাইরে পড়লো মুখ থুবড়ে। যদি তোমাকে হাতে পাই আমি কখনো। আন্দোলিত করলাম দড়ি বাঁধা হাতটা বেনোর দিকে।

সেঁতো হাসি হাসলো রিককা, বেরাদার তোমারই তো দোষ, নারীর মর্যাদা আশা করা বৃথা বেনোর মত একটা জানোয়ারের কাছে; তোমার উচিত ছিলো বোঝা, শয়তানটা তাকালো দরজার দিকে মুখটা বিকৃত করে। বেনোর ওপরই পড়বে তোমার দায়িত্ব কাটা বের করার পর। তাড়াতাড়িই সারতে পারে কাজগুলো ও শালা। তবে তোমার কাছে ঋণী থেকে গেলাম আমি একটা ব্যাপারে, আমি তোমার কাজে কৃতজ্ঞ, ডেলা মাগীটাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। আমি এখন ক্যাসিনোর মালিক। রিককার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম বলে চললো রিককা, আর শোনো–পিয়াজীকরার কোনো চেষ্টা করোনা ভল্টে ঢুকে, বুঝলে? ক্যাসিনোর সম্পত্তি টাকাটা। আমার কাছে প্রমাণও আছে। আমার সঙ্গে হেমও আছে। চলে গেলে পাশের ঘরে গলাও পেলাম বেনোর সঙ্গে শলাপরামর্শের। চেষ্টা করতে লাগলাম হাত দুটো মুক্ত করার, কিন্তু রিককা ফিরে এলো তার মধ্যেই, বলে এলাম বেনোকে মেয়েটার ব্যবস্থা করবে আমি সময় মত না ফিরলে, কাজেই চলবে না ঝুটঝামেলা।

রিককা খুলে দিলো আমার পায়ের বাঁধন, নাও চলো–বেনোকে দেখতে পেলাম দরজার দিকে মুখ ফেরাতেই, ভোতা মুখো অটোমেটিক হাতে ধরে আছে আমার দিকেই। রিককা ক্ৰমে পকেট থেকে তার বন্দুক বের করলো আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে। আমি শুরু করলাম হাঁটতে।

আমার পেছনে রিককা। নীচে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। বাইরে দাঁড়িয়ে গাঢ় নীল প্যাকার্ডটা। চালাও তুমি, পেছনেবসছি আমি। দরকার কাজটা তাড়াতাড়ি। কে জানে কতক্ষণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে বেনো শালা, খাসা মেয়েটা তো। রিককা সেঁতো হাসি হাসলো। গাড়ি চালিয়ে গেলাম সারাটা রাস্তা মুখ বুজে। বেশ কিছুটা সময় লেগে গেলো৷ পৌঁছতেই ছুটে এলো পাহারাদার। জমা দিয়ে গেছি একটা স্যুটকেস আজ সকালে…এসেছি সেটা নিতে…জানেনই তো সব আপনি গেলেই হবে মিঃ ইভশ্যামের কাছে। শুরু করলাম চলতে। পায়ে পায়ে রিককা। ইভশ্যাম বিস্মিত হলো আমাদের দেখে, কিন্তু তার কোনো পরিবর্তন ঘটলো না মুখভাবের। অভিবাদন করলো সামান্য ঝুঁকে।

হঠাৎ বাইরে থেকে এসে পড়েছেন আমার অংশীদার, দেখিয়ে দিলাম রিককাকে, দিন দুয়েকের জন্য দরকার সুটকেসটা। নিশ্চয় স্যার, আপনাদের সঙ্গে ওপরে যাবো কি আমি? হবে না তার দরকার, চিনে গেছি আমি তো। রসিদ করে রাখছি আমি, এলেই পাবেন। ধন্যবাদ। আমরা এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে। পাঁচ তলায় উঠতে লাগলো লিফট।

ভালোই তো এখানকার ব্যবসাপত্তর। বলে উঠলো শুয়োরের বাচ্চাটা, চালু করলে মন্দ হয় না ক্যাসিনোতে এরকম একটা কিছু। নিরুত্তর আমি। বেরিয়ে এগোলাম লিফট থামলে, রিককা চলেছেগা সেঁটে। এগিয়ে এলো পাহারার লোক। চাবিটা দেখি ছেচল্লিশনম্বরের। লোকটা একমুহূর্ত তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, নিয়ে এলো পরে চাবিটা। আমরা দাঁড়ালাম ছেচল্লিশনম্বরের সামনে। টাকাটা পাওয়া তো অসম্ভব হতো তোমার সাহায্য ছাড়া, জনি, তুমি সত্যিই বুদ্ধিমান লোক। ঘরে ঢুকলাম দরজা ঠেলে। বাঃ ঘরটা তোবড়ো। উঁকি দিলো ঘরে রিককা, অপেক্ষা করছি আমি বাইরে। বার করে আনো টাকাটা। কিন্তু ওকে তো বন্ধ ঘরে চাই আমি। সিন্দুক খুলবে না দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাইরেই থাকো তাহলে। রিককা সন্তর্পণে বন্দুকটা পকেট থেকে বের করলো বারান্দার দুপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে।

ভেতরে যেতে হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমারও চোখে চোখে রাখা দরকার তোমাকে। কিন্তু জনি সাবধান–চেষ্টা করলে কোনোরকম ফল্স দেবার। আমার হাত একটুও কাপবে না এই নোংরা লোকটাকে খুন করতে। এই কীটটার জীবনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান আমার আর জিনির জীবন। আর এই ইস্পাত মোড়া ঘরের বাইরে যাবে না ২২ বোরের গুলির শব্দ। বানান করে ঘোরাতে লাগলাম সংযোগের অক্ষরগুলো সিন্দুকের সামনে ঝুঁকে। সশব্দে দরজা খুলে গেলো শেষ অক্ষরটির সঙ্গে সঙ্গেই…শান্ত আমি…শুধু ভাবছি জিনি আর বেনোর কথা…চলবে না এতটুকু ভুল করা। দাঁড়াও সরে একটু ছবি তোলার একটা ব্যাপার আছেসিন্দুকের ভেতর স্বয়ংক্রিয়। দেখছি সব কিছুই ভেবে রেখেছে এশালারা তোত। সন্দেহের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই রিককার গলায়, এখানেই আছে কি টাকাটা? মনে হয় তাই তো। বললাম স্যুটকেসটা টেনে বের করে। জায়গা কম ঘরে, কাজেই বাক্সের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছে না ও আমার পাশে এসে।

তুলে দিলাম স্যুটকেসের ঢাকনা। টেবিলে রাখতে লাগলাম একে একে বের করে নোটর বান্ডিলগুলো। আত্মপ্রসাদের হাসি রিককার ঠোঁটে। হাসিতে কেমন তেল তেলে ভাব। হাতে তুলে নিলাম ২২ বোর বন্দুকটা তাক করলাম ওর পেট লক্ষ্য করে ডালার ভিতর দিয়েই। অস্ত্র ছোট্ট–অন্য ব্যবস্থা নিতে হয় এতে জীবনহানি না হলে। ধীরে ধীরে এগিয়ে নিলাম হাতটা। চোখে চোখ ওরটিপে দিলাম ঘোড়া…শব্দ হলো একটা খুট করে যেন শুকনোকাঠি ভাঙার শব্দ…হেলে পড়তে লাগলো রিককা পেছনে, অব্যক্ত যন্ত্রণার স্বাক্ষর মুখে…সে মাংসল হাতে পেট চেপে ধরে পড়তে লাগলো …বন্দুক ছিটকে পড়লো রিককার হাত থেকে…ডালাটার ওপর মুখ থুবড়ে পড়লো। ওর মাথায় একটা বাড়ি দিলাম বন্দুকটা দিয়ে প্রচণ্ডশক্তিতে। ক্যাসিনোর মালিক, জ্যাক রিককা, লুটিয়ে পড়লো। ঘামে চপ চপ করছে আমার সারা শরীর, ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। পেট চেপে ধরে রিককা লুটোপুটি খাচ্ছে, অঝোরে রক্ত ঝরছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে এবার তুলে নিলাম ওর বন্দুক ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লাম নলটা নাকের ওপর ধরে…পরস্পরের দিকে দুজনে তাকিয়ে আছি…রিককার দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে আসছে..সে উঠলো গর্জন করে, বুঝলাম এখনো জ্ঞান হারায়নি। সর্বশক্তি দিয়ে কপালের মাঝখানে বন্দুকের বাঁট বসিয়ে দিলাম। গর্ত হয়ে গেলো মুহূর্তে ফেটে গিয়ে–বন্ধ হয়ে গেলো রিককার হাত-পা ছোঁড়া শক্ত হয়ে একপাশে হেলে পড়লো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলাম ওর মুখের সামনে। সোজা হয়ে দাঁড়ালাম তারপর ঘাম মুছে। বান্ডিলগুলো স্যুটকেসে ভরে নিলাম ২২ বোর পকেটে ফেলে দিয়ে। পাহারাদারকে এগিয়ে আসতে দেখলাম বাইরে বেরিয়ে দরজায় চাবি এঁটে দিতেই। হেঁটে গেলাম দ্রুতপায়ে ওর দিকে। বাইরে যাচ্ছি আমি। উনি দেখছেন কাগজপত্র সময় লাগবে একটু। বিরক্ত কোরো না ওঁকে বুঝলে? স্যার ঠিক আছে। ওর কাছেই রইলো চাবি…তোমাকে দিয়ে যাবেন বেরোবার সময়। তোমাদের বন্ধ হয় কটায়? স্যার। দেখলাম ঘড়ি পৌনে বারটা এখন হাতে সময় আছে আড়াই ঘণ্টার ওপর, মনে হয় হয়ে যাবে ওর মধ্যেই। এগিয়ে গেলাম লিটের দিকে। ইভশ্যাম অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। ওপরে কাজ করছে আমার অংশীদার বন্ধুটি বলে এসেছি পাহারাদার লোকটাকে। স্যার ঠিক আছে। সঙ্গে নিচ্ছি সুটকেসটা, করতে হবে কিছু সইটই? ইভশ্যাম এগিয়ে দিলো দুটো কাগজ। করে দিলাম সই। ফিরছিদিন দুয়েকের মধ্যেই। স্যার আসবেন। সে ভুললো না ঝুঁকে অভিবাদন করতে রাজকীয় কায়দায়। রিককার গাড়ির দরজা খুলে দিলো পাহারার লোক। স্টিয়ারিংয়ে বসে গেলাম গাড়ির পেছনে স্যুটকেস রাখতে বলে। গাড়ি দ্রুতগতিতে ছেড়ে দিলাম দরজা বন্ধ হতেই–ফ্র্যাঙ্কলিন বুলেভার্ড গন্তব্য। গাড়িটা থামালাম বুলেভার্ডের সমান্তরাল একটা রাস্তায় জায়গাটা আমার ফ্ল্যাটের পেছন দিকে। স্যুটকেসটা ঢুকিয়ে দিয়ে গাড়ির পেছনে মাল রাখার বুটে গাছে গাছে এগোতে লাগলাম ঝোঁপঝাড় ফুলের বাগান পেরিয়ে। একটা দড়ি টানা লিফট ফ্ল্যাটের পেছনে। ব্যবস্থা মুদি মশলা তোলার জন্য। বেছে নিলাম এই রাস্তাই চমকে দিতে হবে বেনোকে।

ও শালা নিশ্চয়ই আছে এখনো বাইরের ঘরে। ফ্ল্যাটে ঢুকতে হবে ওর অজান্তে। তারপর না, করবোনা গুলি। অন্য উপায়ে বুদ্ধি ভাজছি ওপর দিকে মুখ করে বেরিয়ে এলো একটা সাদা বিড়াল ঝোঁপের ভিতর থেকে। মার্জার সুন্দরী মুখ ঘষতে লাগলো আমার পায়ে।

এটাকে আমি আগে দেখেছি, পোষ্য জীবটি দারওয়ানের। জিনির হাতে খাবারও খেয়েছে মাজে মধ্যে। এখন আমার যা মনের অবস্থা, তাতে ফুরসত নেই ওটার দিকে নজর দেবার, একটা মৃদু ঠেলা দিলাম পা দিয়ে। বাঘের মাসীনড়লো না। পায়ে পায়ে চললো বেড়ালটাও ঝোঁপের ফাঁকে এগোতে এগোতে। চড়ে বসলাম লিফটে আমার কোলে উঠলো লাফিয়ে বেড়ালটাও। খেলে গেলো। — একটা বদবুদ্ধি মাথায়…একটা বিভ্রান্তির ঝড় তোলা যেতে পারে এটাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে…ওটাকে আঁকড়ে ধরলাম। শুরু করলাম উঠতে লিফট ঊর্ধ্বগামী হলো ক্যাচ ক্যাচ শব্দে। বেশ হাঁফিয়ে উঠলাম চতুর্থতলায় পৌঁছতে। থামতে হলো দম নেওয়ার জন্য। শুরু করলাম পূর্ণ্যাত্ৰা মিনিট খানেক বিশ্রামের পর। লিফট থামালাম আমার রান্না ঘর বরাবর। কিছুক্ষণ হাত মালিশ করলাম দড়ি ছেড়ে দিয়ে। লাফিয়ে পড়লাম রান্নাঘরের জানলার ভেতর একটু সুস্থ হতেই আমার দিকে তাকালো খাবার টেবিলের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে বেড়ালটাকে মাটিতে নামিয়ে দিতে। এককোণে সরিয়ে দিলাম জুতো খুলে। সেটা একটু ফাঁক করলাম দরজার দিকে এগিয়ে…অপেক্ষা করলাম কয়েক সেকেন্ড…না আওয়াজ নেই কোন…কাটলো কিছুক্ষণ।

ভেজিয়ে দিলাম দরজা। দুটো কাঁচের প্লেট বের করলাম অতি সন্তর্পণে কাবার্ড থেকে বেড়ালটাকে বগলদাবা করে। শূন্যে ছেড়ে দিলাম প্লেট দুটো এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে। সেগুলো ভেঙ্গে খান খান হলো মরা জাগানো শব্দে। সরে গেলাম দরজার আড়ালে। চললে অপেক্ষা…শুধু কানে বেড়ালের ঘরঘরানি আর আমার নিশ্বাসের শব্দ। কাটলো বেশ কিছুক্ষণ। ভাবনা হলো, শব্দ কি শুনতে পায়নি বেনোফাঁক হয়ে গেলো দরজাটা সেই মুহূর্তেই…মাটিতে নামিয়ে দিলাম বেড়ালটাকে…প্রতিটি পেশীউত্তেজনা কঠিন আমার শরীরের…ফাঁকবাড়লোদরজার… স্থিরদাঁড়িয়ে বেড়ালটাও দরজার দিকেই দৃষ্টি। বেড়াল ঢুকেছে দুঃশালা! বেনোর গলা।

বন্ধ করে দিলাম নিশ্বাস, বেজন্মাটা ঘরে ঢুকুক কিন্তু না, ও দাঁড়িয়ে রইলো বাইরেই। দ্রুত ওঠানামা করছে বেনোর নিঃশ্বাস।

অ্যাই ঢুকেছিস কি করে এখানে? আয় এদিকে আয়। বাঘের মাসির কিন্তু পছন্দ হলো না লোকটাকে, সে ফুঁসে চলেছে বেনোর দিকে। এবার ঘরে ঢুকতে হলে বেনোকে। সে পায়ে পায়ে এগোতে লাগলো ডানহাতে বন্দুক ধরে, আমার আর বেনোর মধ্যে ফুট তিনেক দূরত্ব…সাবধান করে দিলো ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়…বিপদ সামনে। বেনো ঘুরলল, ঘুষি চালালাম সঙ্গে সঙ্গে। মার লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। দ্রুত চালনায় ঘুষিটা কাঁধের ওপর পড়লো, চোয়ালে না পড়ে। তবু, সেই ঘুষিটা ছিলো মোটামুটি ভারীওজনের। বেনোআছড়ে পড়লো দেয়ালে। সে চেষ্টা করলো উঠে দাঁড়াতে। রাগে অন্ধ আমার দিকে ঘোড়ালো বন্দুকের নলটাও…। ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম এক রদ্দা মারলাম বন্দুকশুদ্ধ হাতে–ওকে ঠেলে দিলাম এক লাথিতে, বেনো আবার গিয়ে পড়লে দেয়ালে। এবার আরো কাছে ওর মাংসল মুখটা।

বেনো হাত বাড়ালো আমার টুটির দিকে, ঘুষি জমালাম ওর মাথার পাশে আমিও। একই সঙ্গে দূরে ছুঁড়ে দিলাম হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে। হাতটা আস্তে ডুবিয়ে দিলাম ওর ঘাড়ের নরম মাংসে; ক্রমে চেপে বসতে লাগলো আঙুলগুলো ওর কণ্ঠনালীতে… ওর রক্ত জমে মীলাভ হতে লাগলো চাপ বাড়তে শুরু হতেই–নির্মমভাবে ঝাঁকাতে লাগলাম দেয়ালে চেপে ধরে…বেরিয়ে এলো বেনোর চোখ ঠেলে…বেনো নেতিয়ে পড়লো মাটিতে…অদৃশ্য হয়ে গেছে চোখের তারা। ওর কাছ থেকে সরে এলাম–যন্ত্রণা হচ্ছে হাতে, বুকে ঘা পড়ছে হাতুড়ির হাত রাখলাম ওর চোখের পাতায় ঝুঁকে পড়েনা, স্থির কাঁপুনি নেই। সাড়া নেই ধমনীতেও সিগারেট ধরালাম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, কেঁপে উঠলো হাতটা..বেড়েছে যন্ত্রণাও। একে একে সবাই চলে গেলো। বেনো, রিককা, ডেলা, আর এই রাইসনার, অথচ আমার মনের কোণে একবিন্দু করুণা নেই এদের কারোর জন্য। আমাকেই মরতে হতো এদের না মারলে বেনোর মুখে নাকটা ছোঁয়ালো বেড়ালটা লঘুপায়ে এগিয়ে একবার তার নাকটা ঘষলো থাবা বের করে। পায়ের তলায় পিষে দিলাম সিগারেটে গোটা দুই তিন দ্রুত টান দিয়ে বাকি এখনো অনেক কিছু।

জুতো গলিয়ে দিলাম পায়ে, বাইরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম বেনোর বন্দুকটা পকেটে ফেলে। জিনি পড়ে রয়েছে আরাম কেদারায়। পেছনে টেনে বাঁধা হাত দুটো। কাপড় গোঁজা মুখে। মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে চেতনা নেই। ওকে বাঁধনমুক্ত করলাম দ্রুতহাতে। মৃদুস্বরে ডাকলাম মুখের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে, জিনি সোনা! আওয়াজ পেলাম একটা স্পষ্ট গোঙানির। আমি এসেছি জিনি। ..

ওঠো, আমাদের চলে যেতে হবে এখান থেকে। আস্তে পেছনে হেলালো মাথাটা, চোখের পাতা খুললো সামান্য কাপুনির পর! জিনি চিনতে পারলে আমাকে–জিনি আমার গাল ছুঁলো নরম হাতে, তুমি জনি, তুমি কোথায়–ও বলে উঠলো ভাঙাগলায়, অপেক্ষা করেছি আমি, অনেক অনেকক্ষণ ধরে..ফিরবে বলে তুমি…দেরি হয়ে গেলো কত।

জিনি ভেঙে পড়লো কান্নায়! জিনি সব বলবো তোমাকে, এসো আগে বেরোনো যাক এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে এ শহর ছেড়ে। গাড়ি দাঁড়িয়ে বাইরে। আমরা কোথায় যাবো? উঠে বসলো জিনি, হাত দিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করলো স্কার্টের ছেঁড়া অংশ। ঠিক করা যাবে সেটা যেতে যেতে, তাড়া আছে–চলল। কেঁপে উঠলো জিনি, কই সেই বিশ্রী লোকটা, সেই লোকটা বেঁটে ভয়ঙ্কর চেহারার? জনি ও লোকটা কে? ওকে টেনে তুললাম, চলেছে কাঁপুনি, পড়েই যেতো আমি না ধরলে। 

জিনি ভয় নেই আর–চল আমি ব্যবস্থা করেছি ওর। না, জিনি সরিয়ে দিতে চাইলে আমাকে ঠেলে, মানে কি এসবের, আমি তোমার সঙ্গে যাবো না, না জানা পর্যন্ত আর যাবোই বা কেন–জনি পুলিস ডাকো তুমি। আসুক ওরা পালাবো কেন আমরা? জিনি বলে চলল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত গলায়। জিনি বুঝতে পারছে না তুমি চেষ্টা করলাম গলা স্বাভাবিক রাখার, আমাদের পথ আরো সমস্যাসঙ্কুল করে তোলা এক একটা মুহূর্ত চলে যাওয়া মানে–আমরা যেতে পারছি না পুলিসের কাছে। এর মধ্যে আছেক্যাপটেন হেমও, পালাতে হবে আমাদের! ভয়ের ছায়ানামলো। জিনির চোখে। জনি টাকার ব্যাপারটা কি–ওরা বলছিলো কোন টাকার কথা?

সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছানো টাকার কথাটা ওকে বলা মানেই, হয়তো বলতে পারবো পরে কোনদিন, তবে এখনি নয়। বললাম তাড়াতাড়ি, ওরা ভুল করেছে আমাকে অন্য কেউ বলে চলোত এখন, সব বলবো গাড়িতে বসে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো জিনি, আমাকে খালি খালি জিজ্ঞেস করছিলো ওই লোকটা টাকার কথা, বলছিলো তুমি নাকি টাকা চুরি করেছে ক্যাসিনো থেকে। ওঠো তো এখন, মিথ্যা কথা বলেছে। তাহলে জনি সাহায্য করো আমাকে, হাঁটতে পারবো না বোধহয় আমি। ফেললাম স্বস্তির নিঃশ্বাস, হাঁটবে না তুমি মোটেই, আমি কাঁধে তুলে নিচ্ছি। তোমাকে। জিনি আমার কণ্ঠলগ্না হলো, জনি ভয় হচ্ছিলো আমার বড়, কোথায় যে ছিলে তুমি এতদিন। লক্ষ্মীটি তুমি দেখো ঠিক হয়ে যাবে সব। সব ভুলে যাবে–একটা সপ্তাহ শুধু। এগিয়ে খুললাম সদর দরজাটা। বাইরে দাঁড়িয়ে হেম–৪৫ অটোমেটিক হাতে।

আমাকে ঘরের মধ্যে ফিরিয়ে আনলো বন্দুকের নল দিয়ে ঠেলে…যেন বরফের টুকরো ওর চোখদুটো। জিনিকে নামিয়ে দিলাম আরাম কেদারায়। হেম আমার মাথার বরাবর বন্দুক তুলে ধরলো পা দিয়ে ঠেলে দরজা বন্ধ করে। মাথার ওপর তুলে দিলাম হাত দুটো। ধরতে পেরেছি তোমাকে শেষ পর্যন্ত;বলে যেতে পেরেছে তোমার নামটা রিককা অবশ্য মরবার আগে। ফারার তুমি কাজকর্ম শুরু করেছে পাগলা কুকুরের মতো। অস্ফুট শব্দ বের করলো জিনি মুখ দিয়ে একটা, ও ভয় পেয়েছে। শোনো51 হেম থামিয়ে দিলো আমি মুখ খুলতে, তুমি খুন করেছে রাইসনারকে, আমার হাতে সে প্রমাণও আছে। তুমিই খতম করেছে ওয়ার্দামের মেয়েমানুষটাকে আর নিজের মুখেই বলে গেলো রিককা তা–খুন অনেকগুলো…হেমের গলা পাল্টে গেলো, এখন দাঁড়াও দেয়ালে পিঠ রেখে। আমি পড়তে পারছি ওর চোখের ভাষা–তাও জানি কি করবে। আমাকে ওর নিয়ে যাবার সাহস নেই কাঠগড়া পর্যন্ত। কারণ আমি জানি ওর কীর্তিকলাপের কাহিনী। গুলি করা ওর একমাত্র রাস্তা। প্রমাণ হবে সে গুলি করতে বাধ্য হয় আমি পালাবার চেষ্টা করলে। ফিরলাম জিনির দিকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা ভয়বিহ্বল দৃষ্টিতে, এক বিন্দু রক্ত নেই সারা মুখে। হেম জিনির দিকে তাকালো আমার চোখ অনুসরণ করে, দাঁড়াও। তুমিও ওর পাশে উঠে দাঁড়াও, দলে তুমিও আছো! যেতে হবে জিনিকেও, হেম কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখবে না আমার মৃত্যুর। হেম দাঁড়াও, আমরা একটা চুক্তি করি। আমি আর নেই ও লাইনে। কিন্তু তুমি রাজী হবে শুনলে। আমি বলে যেতে লাগলাম দ্রুত, ক্যাসিনোর উদ্ধৃত্ত টাকাগুলি আমার কাছে আছে–আড়াই লাখ ডলার। থমকে গেলো হেম। ও থমকাবে জানতাম। পুলিস পুজবের জ্বলে উঠলো চোখ দুটো, চেষ্টা কোরো না আমাকে ধাপ্পা দেবার ফারার, তুমি পার পাবে না এ সব বলে। বুঝলাম হেম টোপ গিলেছে। কর্কশ গলায় কথাগুলো বললেও। ছেড়ে দাও আমাদের বখরা হবে আধাআধি সোয়া লাখ করে। কোথায় আছে টাকাটা কোনোদিনই পাত্তা পাবে না আমি না দেখিয়ে দিলে, এমন জায়গায় আছে। ভাগ নাও তোমার আর আমাদের পালাবার সময় দাও তিন ঘণ্টা। কি ভাবছো। ওকে বললাম নিরুত্তর দেখে। কোনো চুক্তি হচ্ছে না টাকাটা চোখে না দেখা পর্যন্ত। দেখবে দেখতে পাবে নিশ্চয়, কিন্তু সময় দিতে হবে ওই তিন ঘণ্টার। ওর ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি খেলে গেলো গোঁফের ফাঁকে, ফারার আমি নেবো সমস্তটাই–শেষ হয়ে গেছে তোমার কথা। তবে, এক ঘণ্টা তোমাকে সুযোগ দেবো পালাবার। না! হেম শোনো, আমি তোমাকে দুলাখ দেবো, পেতেই হবে আমাকে কিছু আর ওই সময়টুকু পালাবার। তাহলে টাকাটা বের করার কষ্টটুকু স্বীকার করবো দুজনকেই গুলি করে হেম হাসলো। কি মহিমা টাকার! নাও কি করবে করে ফেলল এবার। শুরু করলাম সময় নিতে। আমি অর্ধেক টাকা ছাড়তে রাজি জিনি আর আমার মুক্তির বিনিময়ে, কিন্তু কোনো প্রশ্নই ওঠে না সবটা ছাড়বার। অনেক কেচ্ছা করতে হয়েছে আমাকে টাকাটা পেতে।

না, পারিনা ছাড়তে। উপায়ই আছে এখন একটা, মেরে বেরোনো ওকে অন্যমনস্ক করে। আচ্ছা পাঁচ হাজার নিতে দাও আমাকে অন্ততঃ। বললাম মরিয়া হয়ে, চলতে হবে তো আমাকে। হুঁ, হেম বললো দাঁত মেলেই তা কোথায় টাকাটা?

নিয়ে এসো তো টাকাটা জিনি ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম গাড়ির চাবিটা। তাড়াতাড়ি করো– ফ্ল্যাটের পেছনেই আছে গাড়ি। জিনি কুঁকড়ে গেলো অসহায় পশুর মতো আমার দিকে তাকালো… সে দৃষ্টিতে সেই অপার্থিব শিহরণ নামলো আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।

ঘামে ভিজে গেছে আমার সারা শরীর। করলাম শেষ চেষ্টা, আসতেই হবে টাকাটা তোমাকে নিয়ে–দেখছে না এ লোকটা মেরে ফেলবে আমাদের দুজনকেই টাকা না পেলে, এখান থেকে বেবোও চাবিটা নিয়ে! না না, থাক, যেতে না চায় তো ও, যদি তাই করি, আমার যা করার কথা। হেম একটু তুললো বন্দুকটা। ঠিক সেই মুহূর্তে সাদা বিড়ালটা বেরিয়ে এলো রান্নাঘরের দরজা দিয়ে। এবার কঠিন হলো আমার মুখের পেশীগুলো, তাহলে যেতে দাও আমাকেই…আমার সব জিনিই, ফিরে আসবো আমি, হেম, বিশ্বাস করো..আড়াই লাখ নয় কোনো মেয়েমানুষের মূল্যই, চলো, সবাই যাই আমরা–বেড়ালটা মুখ ঘষলো হেমের পায়ে। হেম ওটাকে ঢুকতে দেখেনি, ফলে সে চমকে উঠলো…মুখ নামালো একটা খিস্তি দিয়ে, পরম মুহূর্ত এই তো! ছিলাম তো এর অপেক্ষাতেই…হেমের বন্দুকশুদ্ধ হাতটা ধরে ফেললাম লাফিয়ে ডানহাতে, ওর গলায় বাঁ হাতটা, বেরিয়ে গেলো গুলি–কাঁপিয়ে জানলা দরজা।

হেম আমাকে জড়িয়ে ধরলো একটু পিছিয়ে, পড়ে গেলাম দুজনেই, আমি ওপরে। বন্দুক ছিনিয়ে নিলাম ওর হাত থেকে ঘুষি মেরে, আবার আওয়াজ হলো গুলির। আমাদের লড়াই চললো মিনিট খানিক, কি তারও বেশি, জানোয়ারের লড়াই, লড়িয়ে লোক হেম, তার আয়ত্তে লাইনের সব কায়দা কানুনই।

গড়াগড়ি খাচ্ছি আমরা, তছনছ করে আসবাবপত্র..ঘুষি চলছে, হাঁটুর কসরতও। মুশকিল হয়ে পড়েছে ওকে ধরে রাখা…আস্তে আস্তে নিঙড়োতে শুরু করলাম গলায় আঙুল বসিয়ে, আমার গলা ধরেছে হেমও আমার বন্ধ হয়ে আসছে দম…মুখে ঘুষি মারলাম প্রচণ্ড শক্তিতে ভেসে গেলল ওর নাক। হেম পড়ে গেলো চিৎ হয়ে। মেঝেয় ঠুকতে লাগলাম ওর মাথাটা। শিথিল হয়ে এলো ওর হাতের মুঠো দাঁড়িয়ে পড়লাম লাফিয়ে…চোখের পলকে হেমও উঠে পড়লো। মুখটা একটা রক্তাক্ত মুখোশ। রক্ত গড়াচ্ছে নাক বেয়ে…ওকে আর কাছে আসতে দিলে চলবে না, কাজ সারতে হবে দূর থেকেই, একজন মুষ্টিক আমি যে, একথা ভুলে গেছে হেম বোধহয়। হাত বাড়িয়ে সে ছুটে এলো আমার কোমর ধরার জন্য, আহ্বান মল্লযুদ্ধের।

কিন্তু শিক্ষা হয়ে গেছে আমার, ওর রক্তাক্ত মুখে ডান হাতে মারলাম একপাশে সরে গিয়ে বেশ জোরেই। হেম বাঘের বাচ্চা, আবার তেড়ে এলো একমুহূর্ত থেমে এবার আমার ভুল হলো না আর, ওর হাত পড়তেই আমার কোটের কোণে, বাঁ হাতে হুক জমালাম হেমের রক্ত মাখা মুখের দিকে হেসে তাকিয়ে…যে মারে ফেটেছিলো ম্যাকক্ৰেডীর চোয়াল। এই একই মারে ওয়ালার মাটি নিয়েছিলো, এই মারেই শেষ করে ছিলাম মিয়ামির সেই ছোঁড়াটারও খেল…পুলিস ক্যাপটেন হেম এবারের শিকার। জিনির দিকে ফিরলাম দম নিয়ে, কিন্তু সে কোথায়? নেই! দৌড়ে গেলাম বারান্দায়। হাটখোলা সদর দরজা, ফিরে এলাম। ছুটে গেলাম জানলার দিকে বৈঠকখানায় ঢুকে দৌড়োচ্ছে জিনি, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে চলেছে গেটের দিকে।

টলছে, উঠে আবার ছুটছে পড়ে যেতে যেতে, হাত চাপা দিয়ে মুখে। শরীর বের করে ঝুঁকলাম জানলার বাইরে, জিনি শোনো আমি আসছি দাঁড়াও–অপেক্ষা করো। তাকালো না ঘুরেও…কে জানে কানে গেছে কিনা আমার কথা…জিনি চললো ছুটেই। আমার দৃষ্টি চলে গেলো ওর মাথার ওপর দিকে। গাড়ি এসে থামলো দুটো পুলিসের। গাড়ি থেকে নেমে এগোতে লাগলো ফ্ল্যাটের দিকে জনা দুয়েক সিপাই প্রায় ওদের ঘাড়ের ওপর পড়ছিলো জিনি দৌড়ে।

ওকে ধরে ফেললে সিপাইদের একজন। আরও কতজন সিপাই নামলো দ্বিতীয় গাড়ি থেকে…আমি সরে যাবার চেষ্টা করলাম পুলিসের লোকগুলো চোখ তুলতেই কিন্তু আমাকে দেখে ফেলেছে ওরা তার মধ্যেই…একটা টোক আটকাল গলায় একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জিনিকে দেখতে গিয়েই তো…শেষবারের মত দেখছি ওকে হয়তো…রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলাম চোখ ফিরিয়ে নিয়ে। পড়ে আছে বেনোভসনার প্রলেপ নিয়ে তার হিমশীতল চোখে। জানলার বাইরে দড়ির লিফটে চড়ে বসলাম ওর নিশ্চল শরীরটা ডিঙিয়ে। আমি পেছনের গেটের দিকে ছুটে চললাম শেওলাধরা রাস্তা দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরে। না, আমাকে লক্ষ্য করেনি কেউ। অপেক্ষমান প্যাকার্ডে উঠে বসলাম একটানে গেট খুলে। বাঁশীর আওয়াজ কানে এলো গাড়ি চলতে শুরু করতেই–না।

আমার দ্রুতগামী গাড়ি আছে। কিন্তু আমি যাবো কোথায়? চারিদিকে এখুনি বেজে উঠবে বিপদের সঙ্কেত…আমাকে খুঁজে ফিরবে প্রতিটি পুলিসের গাড়ি তাহলে? কে আমাকে লুকোবে ওদের হাত থেকে? মনে পড়লো বেস্ট্রীটের লিবটি ইন-এর জো এলমোরের কথা; আশ্রয় মিলতে পারে টাকার বিনিময়ে ওর কাছে পৌঁছোতে পারলে। গাড়ি ঘোরালাম বে স্ট্রীটের দিকে। এক সিপাইয়ের সামনে পড়ে গেলাম লিঙ্কন বীচের প্রধান সড়কের সমান্তরাল লিঙ্কন অ্যাভিনিউয়ের। মাঝামাঝি পড়তেই। আমাকে থামতে বললো লোকটা হাতের ইশারায়, পায়ের চাপ বাড়ালাম আমি অ্যাকসিলারেটারে। গাড়ি এগোলো ঝোঁক নিয়ে। সাহসবলিহারি সিপাইজীর, এক হাতে লাঠি আর অন্যহাতে বন্দুক, নেমে পড়লো রাস্তায়! থমকে দাঁড়ালো রাস্তার দুপাশের মানুষ, কিন্তু পারলো না–আমার মাথা লক্ষ্য করে লাঠিটা ছুঁড়ে দিলো আমাকে রুখতে না পেরে। নামিয়ে নিলাম মাথা লাঠিটা আবার বাইরেই পড়লো গাড়ির কাছে একটা গর্ত করে দিয়ে। আওয়াজও পেলাম পেছনে গুলির, ক্ষতবিক্ষত হলো গাড়ির বডি আর একটা রাস্তায় পড়লাম কিছুদূর এগিয়ে। বেশি দূর যাওয়া যাবে না গুলির দাগ আর ভাঙা কাঁচ নিয়ে আমাকে দেখতে শুরু করেছে রাস্তার মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখে পড়লো গাড়ি রাখার জায়গা সামনে অল্প দূরে, গাড়ি দাঁড়িয়ে সারি সারি।

আস্তে আস্তে সবার পেছনে গাড়িটা ঢুকিয়ে দিলাম। সাদা পোষাকের একজন কর্মী এগিয়ে এলো নেমে গাড়ির পেছনে মাল রাখার জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢাকনিটা তুলে দিতেই। স্যার গাড়ির কি হয়েছে? তার চোখ গুলির দাগে। পাগলা এক ব্যাটার কীর্তি ওই আর কি! যাক একটু লক্ষ্য রেখো–আমি ফিরছি কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি বিরাশি শিক্কার ঘুষি জমিয়ে দিলাম ওর মুখে লোকটা অবার মুখ খোলার আগেই। লোকটা পড়লো মুখ থুবড়ে, বেচারা! চারপাশে তাকালাম মাথা তুলে! না, দেখতে পায়নি কেউ। অল্পদূরে দাঁড়িয়ে আরো জনা দুতিন সাদা পোষাকের কর্মচারী, তারা মত্ত গল্পে। পাঁচিলের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেলাম সুটকেস হাতে নিয়ে।

সুটকেসটা বড্ড ভারী লাগছে–বোধহয় এটা মনে হচ্ছে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বলেই। আমার জীবনের মোড় ফেরাতে পারি এটাকায় এখনো। কিন্তু টাকাটা ছাড়া একটা উঁচু ঢিবির ওপর উঠলাম দেয়ালের পাশ দিয়ে। নজরে পড়লো দুটো পুলিসের গাড়ি রাস্তার দিকে চোখ ফেরাতে এদিকেই এগিয়ে আসছে বুলেভার্ডের ধার ঘেঁষে।

একটা কয়েক গজ তফাতে। আশ্রয় দরকার এখুনি একটা আর কোনো সম্ভবনাই নেই লিবার্টি ইন–এ পৌঁছোনোর। লিঙ্কন হোটেল রাস্তার উল্টোদিকে–সে দাঁড়িয়ে তার চল্লিশতলা আকাশ ভেদী উচ্চতা নিয়ে। এগোলাম রাস্তা পেরিয়ে, আনার্থীর ভিড়ে এক দল মেদের পাহাড় লোক। একটা একপাশে। স্নানের পোষাক পরনে যুবতী অন্যপাশে। স্নানার্থিনী আমাকে মাপলো কৌতূহলের চোখে। হোটেলের উদ্দেশ্যে জনতা চলেছে, জনস্রোতে আমিও মিশে গেলাম সেই সুযোগে…পেছনে ফিরে তাকালাম. ঘূর্ণায়মান দরজার মধ্যে গলে গিয়ে এবং নিজেকে অভিশাপ দিলাম সঙ্গে সঙ্গেই–আমাকে দেখে ফেলেছে সিপাইদের একজন।

লোকটা থমকে গেলো এক মুহূর্ত, তারপর পা বাড়িয়ে দিলো দ্রুতপায়ে হোটেলের দিকে। লিফটে উঠে পড়লাম দ্রুতপায়ে। লবি পেরিয়ে। আমি নির্বিকার গলায় বলে দিলাম এগারোতলা। লিফট চালক আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সিপাইটাকে দেখতে পেলাম লিট চলতে শুরু করতেই সে বেরিয়ে এলো ঘোরানো দরজা দিয়ে, জেট চালিত রকেটের মত ছিটকে।

সারা হোটেল ভরে যাবে পুলিসে আর কয়েক মিনিটের মধ্যে। লিফট থামলো ষষ্ঠ তলায়। কেউ চড়লো না, দুজন বোলো। আমি মেয়েটা আর চালক, তখন শুধু লিফটে। চালক আমার দিকে ফিরলো, মেয়েটাকে অপাঙ্গে লেহন করে একবার, স্যার, কোন ঘর আপনার? এসেছি। একজনের কাছে। স্যার কাজ করে ফেলেছেন বেআইনী, নামটা লেখানো উচিৎ ছিলো নীচে অনুসন্ধানের দপ্তরে। একটু বোধহয় দেরি হয়ে গেলো, তাই না? চেষ্টা করলাম হাসবার। একদৃষ্টে তাকিয়ে যুবতী আমার দিকে। আমি তাকাতে, টেনে দিলো জামাটা একটু। মেয়েটাকে মনে হচ্ছে। লাইনের…। স্যার নীচে নামতে হবে আপনাকে। মেয়েটার বুকে কিন্তু চালকের দৃষ্টি। নামবো ঠিক আছে। লিফট থামলো তেইশ তলায়। মেয়েটা বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলো বারান্দা দিয়ে…অলস মন্থর পায়ে। ওর নিতম্বের আন্দোলন লক্ষ্য করছি বিমোহিত দৃষ্টিতে আমি আর চালক। চালক ছোকরার কাঁধে হাত ঠেকালাম মেয়েটা অদৃশ্য হতেই, চোয়ালে একটা ঘুষি মারলাম সর্বশক্তি দিয়ে ও মুখ ফেরাতেই–মাথাটা প্রায় নেমে যাবার উপক্রম হলো ওর কাধ থেকে মারটা এতটা জোড়ে পড়লো যে, ছেলেটা সশব্দে পড়ে গেলো টুল থেকে। মেয়েটার পেছনে ধাওয়া করলাম দ্রুতপায়ে বেরিয়ে স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে। মেয়েটাকে ধরলাম তার ঘরের সামনে, দরজা খুলছে চাবি ঘুরিয়ে। সে ঢুকে পড়লো ঘরে আমার দিকে নজর পড়তেই। ৪৫ বোরের বন্দুকটা ওর কাঁধে ঠেকালাম দরজা বন্ধ করার মুহূর্তে, আলতো হাতে। কোনো শব্দ করবেনা মুখ দিয়ে। ঢুকে দরজা বন্ধ করে। দিলাম পা দিয়ে ঠেলে। আপনি কি চান? তন্বী বলে উঠলো প্রায় বিকৃত গলায়। কথা আছে বোসো। বের করে ধরালাম সিগারেট। ভয় নেই তোমার, পেছনে লেগেছে পুলিসের খোঁচড়গুলো। আমি এখানে থাকছি ওরা কেটে না পড়া পর্যন্ত। তাকে দেখাচ্ছে খুশী খুশী, নিতম্বিনী বসলো। বাইরে তাকালাম ডানদিকে স্যুটকেসটা নামিয়ে দিয়ে।

মনে হচ্ছে এখান থেকে সেটা অনেক দূর যে জায়গায় পৌঁছতে পারলে পালাতে পারি। ভিড়ও বাড়ছে হোটেলের বাইরে–সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে আসছে গোটা তিনেক পুলিসের গাড়িও…ওরা তোমার ঘরে তল্লাসীতে আসবে আর মিনিট দশেকের মধ্যেই। আমার ঘাড়ে খুনের দায় চার চারটে, আমার হাত কাঁপবে না আর একটা বাড়াতে। কিন্তু তোমার কাছে ফেলনা নয় নিশ্চয়ই তোমার জীবনটা। তুমি আমাকে দেখনি, ওদের বলতে হবে; গুলি ছুটবে কোনো গোলমাল হলেই বুঝলে? মেয়েটা কুঁকড়ে গেলো ভয়ে, আমার দিকে তাকালো বিস্ফারিত চোখে। আমার দুঃখ হচ্ছে ওর জন্য, কিন্তু কোনো পথ নেই আমার তো আর। পড়েছি যে গ্যাড়াকলে। ভিড় বাড়ছে বাইরেও, পুলিসের গাড়িও জমেছে মানুষও হাজার তিনেকের কম নয়… তাদের সংখ্যা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তেই পায়ের শব্দ উঠলো বারান্দায়…হাঁটতে পারে না নিঃশব্দ পায়ে ও শালারা তো…মনে হচ্ছে অনেক গুলোই হবে…একপাল মোষ! তল্লাসীচলেছে ঘরে ঘরে…এখন বাকিটা নির্ভর করছে এ মেয়েটার ওপর। আমি গেছি ও ফাঁসিয়ে দিলে, শান দিলাম গলাটায়।

এসে পড়বে ওরা এখুনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে কি করতে হবে। ওর মাথা লক্ষ্য করে তুললাম বন্দুকের নলটা। মেয়েটা বসে রইলো মোমের পুতুল হয়ে। মুছে গেছে মুখের সমস্ত রঙ…তাকিয়ে রইলো বোবা চোখে আমার দিকে। টোকা পড়লো দরজায়। নিঃশব্দে পার হয়ে গেলো একটা দীর্ঘ মুহূর্ত। জোরে আবার টোকা।

ফিসফিসিয়ে বললাম যাও, ও নড়বে না যদিও জানি। সত্যি হলো আমার আশঙ্কাই, মেয়েটা মাটিতে পড়লো একটা বিলম্বিত আর্তনাদ করে; হারিয়েছে চেতনা। জলদি খোল–  

পেলাম একটা মোটা গলা। ভবিষ্যৎ নেই আমার আর কোন। হেমের হাতেই যাওয়া ওদের হাতে পড়া মানেই আর তারপর, না, পথ নেই বাঁচার। কোনো কিছু ভাবছি না আমি। ঘুরপাক খাচ্ছে টাকাগুলোকে কেন্দ্র করে আমার ভাবনা…ভোগ করতে না পারি আমি যদি এ টাকা, তাহলে করতে দেবোনা কাউকেও..আবার কণ্ঠস্বর দরজার বাইরে। ফারার খোলো, আমরা জেনেছি তুমি ওখানে ফিরে গেলাম জানলায়। সারা বাড়ি জুড়ে জানলার নীচে কার্নিশ।

মুখ বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। কার্নিশ একটা ফুলের বাগানে শেষ হয়েছে ডাইনে ফুট ত্রিশেক গিয়ে। গুলি খাবার ভয় থাকছে না ওখানে পৌঁছতে পারলে। চোখ ফেরালাম নীচের দিকে শুধু মাথা আর মাথা সৈকত জুড়ে–দৃষ্টি ঊর্ধ্বমুখী সব মানুষের। নিবদ্ধ আমার জানলার দিকেই।

মাথাটা ঝিম করে উঠলো স্বল্পপরিসর কার্নিশটা আবার চোখে পড়তে, কিন্তু প্রাণে বাঁচবোনা ওখানে না নামতে পারলে। চাপ বাড়ছে দরজায়–ভেঙে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে। পা তুলে দিলাম জানলার ওপর। স্যুটকেসটা নিয়ে নিলাম কার্নিশে নেমে। গুঞ্জন উঠলোনীচে, কিন্তু আমি তাকাতে পারছি না আর নীচের দিকে। দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড হাতুড়ির আওয়াজ বুকে। কাঁপছে হাঁটু। ও জায়গায় হাঁটা যথেষ্ট বিপদজনক, স্যুটকেস ছাড়াই। আর হাতে করে ওটা…পায়ে পায়ে এগোতে লাগলাম দেয়ালে পিঠ রেখে। কায়দায় হাঁটছি সার্কাসে দড়ি হাঁটিয়েদের। আমাকে পৌঁছোতে হবে ওই ফুলের আস্তানায়। পার হয়ে চলেছি জানলার পরে জানলা, ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছি না ভেতরে উঁকি দিতে একটা লোক জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলো শেষ জানলার কাছাকাছি পৌঁছাতে। নিঃশ্বাস নিচ্ছি দাঁতের ফাঁকে। থেমে গেলাম–লোকটা আমাকে দেখতে লাগলো হাঁ করে। সন্তর্পণে পকেট থেকে বের করে নিলাম বেনোর বন্দুকটা। ককিয়ে উঠলো লোকটা পড়ে; সারে যে আরে, উঠে এসো আমার এখানে।

 সরে যাও জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে।

তুলে ধরলাম বন্দুকের নল। লোকটা সরে গেলো একটা অস্ফুট শব্দ করে..নীচের ভিড়ে গুঞ্জন উঠলো আবার–এগোতে লাগলাম, পৌঁছে যাবো আর ফুট বিশেক যেতে পারলেই। সুরু করলাম দ্রুত এগোতে, চেঁচিয়ে উঠলো. পেছনে কে যেন…সাহস নেই ফিরে তাকাবার… চলতে থাকলাম…পিঠে গুলি খাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে প্রতি মুহূর্তেই…পৌঁছলাম অবশেষে। দম নিলাম একটা পাথর আঁকড়ে ধরে। এ ভাবেই কিছুক্ষণ কাটলো…চোখ তুললাম আস্তে, মুখের মিছিল রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িগুলোর জানলায়। কার্নিশে নামিয়ে দিলাম সুটকেস। পাথর ধরে আস্তে ওপর দিকে উঠতে চেষ্টা করছি সামনের কোন বাড়ি থেকে একটা হুঙ্কার ভেসে এলো, মাতাল কোথাকার, কি করছো কি? আর একবার সোচ্চার হলো জনতার গুঞ্জন। মোটামুটি তো পেলাম একটা পা রাখার জায়গা। এবার কোনোরকমে একদম দাঁড়াবার জায়গা পাবো ওই কংক্রীটের গাঁথুনি পার হতে পারলে স্যুটকেসটা নিয়ে, গাঁথুনিতে চাপালাম ডান পা–টা। কিন্তু অসম্ভব হয়ে পড়লো ভারসাম্য রাখা। পিছিয়ে আসতে হলো। স্যুটকেসের ভারে ফুরিয়ে এসেছে দমও। হাতটা শূন্যে উঠে রইলো তিন–চার সেকেন্ড…বাড়তে শুরু করেছে আশ পাশের চীৎকার..শেষ পর্যন্ত কোনোরকমে ঢুকতে পারলাম ফাঁকটার মধ্যে, নিজেও বুঝতে পারছি না কি করে তা হলো।

কিছুটা জায়গা বেড়েছে, বোধ করছি একটু নিশ্চিত, ভেঙে পড়তে চাইছে সারা শরীর অবসাদে পারছি না দাঁড়াতে। বসে পড়লাম স্যুটকেস ধরে পিঠ ঢুকিয়ে সাঁকোর মধ্যে, সামনে পা দুটো শূন্যে এই প্রথম নীচের দিকে চোখ ছেড়ে দিলাম কার্ণিশে নামার পর, শুধু মাথা আর মাথা যতটুকু চোখে পড়ছেরুজভেল্ট বুলেভার্ডে আর ওসান বুলেভার্ডের এই উচ্চতা থেকে মনে হচ্ছে একটা চিকচিকে কার্পেট। চোখে পড়ছে পুলিসের লোকগুলোকেও ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে ভিড় নিয়ন্ত্রণের। দাঁড়িয়ে গেছে গাড়ির সার…মাইল জুড়ে। মানুষ এগিয়ে আসছে হোটেলের দিকে গাড়ি ছেড়ে। আরো বাড়বে পুলিসের তৎপরতা আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বাঁধা পড়বো অক্টোপাসের বাঁধনে, চলে যাচ্ছে সময়। আড়াই লক্ষ ডলার আমার পাশের স্যুটকেসে কড়কড়ে নোট আর নীচে মানুষ দু পাঁচ হাজার, আমার চিন্তায় শুধু। পরের কাজটুকু অনেক সহজ হয়ে গেলো এই মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গেই। তুলে নিলাম একটা একশো ডলারের বাণ্ডিল সুটকেস খুলে। বাণ্ডিলটা শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম রবারের চাকতিটা টান মেরে খুলে–নোটগুলো নীচের দিকে নামতে লাগলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, নড়ে উঠলোজনতা, উৎকণ্ঠার শেষ সীমায় পৌঁছেছে ওরা নিশ্চয়ই একজন লাফিয়ে উঠলো নোটগুলো ওদের কাছাকাছিনামতেই, ধরবার জন্য নোটটা। ওদের মাঝে কি জুড়ে দিয়েছি এবার মানুষগুলো জানলে…

গর্জন উঠলো একটা সে গর্জনে কেঁপে উঠলো সারা পরিবেশটা–প্রথম নোটটা ধরার জন্য কে একজন লাফিয়ে উঠলো রাস্তার উল্টোদিকের একটা জানলায়। কে একজন বলে উঠলো রাস্তার উল্টোদিকের একটা জানলায়, আরে লোকটা ফেলে দিচ্ছে টাকা! মুখগুলো একে একে মিলিয়ে গেলো সামনে চলতে লাগল ধাক্কাধাক্কি। এক অভিনব খেলায় আমিও মেতে উঠলাম। নীচের মানবসমুদ্রে বাণ্ডিল খুলছি আর ছড়িয়ে দিচ্ছি। রাখতে পেরেছি আমার প্রতিজ্ঞা; একটা চমক সৃষ্টি করবো খরচের ব্যাপারে, অনেক টাকা হাতে পেলে…আমার বহুদিনের সাধ পালন করেছি, আজ। কি আনন্দ! রোমাঞ্চ অভূতপূর্ব! আমি দুনিয়ার সর্বশক্তিমান মানুষ এই মুহূর্তে। নীচের এই দৃশ্য স্নান করে দিয়েছে আমার সমস্ত কল্পনাকে লড়াই করছে মানুষে মানুষে, মাড়িয়ে চলেছে একে অপরকে। এক অপূর্ব দৃশ্য চীৎকার আর আঁচড়া–আঁচড়ির। মেতে উঠেছে খেলায় পুলিসেরাও

আন্দোলিত হচ্ছে লাঠি শুধু ছোঁবার জন্য টাকা বাতাসে দিকবিদিকে নোট ছড়িয়ে পড়ছে, লড়াই চলেছে সৈকতেও। কখানা নোট ধরতে ধরতে একটা মেয়ে তার স্কার্টে আঁজলা করে সেটাকে রাখল। ছিড়ে ফালা ফালা করে দিলো তার দিদিমার বয়সী এক বৃদ্ধা! আর এক দৃশ্য, একটা পুরুষকে ঠেঙিয়ে চলেছে চারজন মহিলা তাদের হাতব্যাগ দিয়ে…

কখানা নোট হাতের মুঠোয়। এক মহিলাকে এক সিপাই ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য লড়াই চালাচ্ছে–ওদের মধ্যে ছেড়ে দিলাম শেষ বাণ্ডিলটাও, দেখতে লাগলাম বসে ভারী হয়ে আসছে নিশ্বাস। ঘামে চপচপ করছে সারা শরীর। আবার আমার জীবনে ফিরে আসে যদি এই দশটা মিনিট সময়টুকু বরণ করবো সানন্দে। কিন্তু আমার কাছে আর টাকা নেই। ও টাকায় কিছু করা যাবে না, ডেলা ঠিকই বলেছিলো…টাকা নিঃশেষ হলো রোদে বরফ গলে যাওয়ার মত…যেন আমার কাছে ছিলোনা এটাকা কোনদিনই। পরম মুহূর্ত অতিক্রান্ত আমার জীবনের। তার পুনরাবৃত্তি হবেনা আর কোনদিনই। তাকালাম নীচে আমার দিকে আর কেউ তাকাচ্ছে না। ওরা আমাকে ভুলে গেছে টাকার উন্মাদনায়। সময় ফুরিয়ে এলো আমারও। এবার পৌঁছতে চেষ্টা করবে আমার কাছে পুলিসের লোকগুলো। দুটো রাস্তা এখন আমার সামনে; শূন্যে লাফিয়ে ওদের ফাঁকি দেওয়া, না হয় আত্মসমর্পণ।

একই তো অবস্থা হবে দ্বিধা নেই আমার কোনো..এখুনি করে দিতে পারি জীবনের শেষ। আমাকে তা পীড়া দিচ্ছে জিনির চোখে যে অবিশ্বাস দেখেছি, আমার ভালোবাসা নিখাদ ওকে বিশ্বাস করাতে হবে। আমার এই একটা কর্তব্যই থেকে গেলো পৃথিবীতে; সে কতখানি জুড়ে ছিলো আমার জীবনের, ওকে জানান। সে জানুক আমার কাহিনী…জানুক কেমন করে হারিয়ে যায় একজন নির্দোষ, সাঁতারু ঘূর্ণিজলে পড়ে, ওর হোক অনুশোচনা..অন্তত একবারের জন্যেও ভাবুক আমি গ্যাস চেম্বারে ঢোকার পর। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে খারাপ বলে হেম আমাকে যতটা, ততো খারাপ নই আমি মানুষটা। সত্য উদঘাটিত হওয়া দরকার জিনির কাছে। আত্মসমর্পণ করবো আমি। অন্তত আমি লিখে যেতে পারবো আমার কাহিনী বিচারকের সামনে হাজির হওয়ার আগে। উঠে দাঁড়ালাম সন্তর্পণে…ফিরে তাকালামকার্নিশের দিকে একটা সিপাই জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে আমার থেকে কয়েক গজ দূরে–একদৃষ্টে তাকিয়ে আমার দিকে। সে জানলার বাইরে বেরিয়ে পড়তেই, এখন তার ওপরই তো ন্যও আমাকে বার পবিত্র দায়িত্ব–দোস্ত ওখানেই থাকো–বললাম নরম গলায়, হাতের ইশারা করে, তোমাদের কাছে আমিই আসছি, নীচের জনসমুদ্রের উত্তাল গর্জন কানে এলো, ওর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য মিল আছে এ শব্দের সঙ্গে গুহার সিংহ গর্জনের। রাইসনারকে কাছে পাওয়ার মুহূর্তে তারাও হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিলো। একটা জায়গায় শুধু তফাৎ। আমি জানি আমার ভাগ্যে কি ঘটবে–কিন্তু জানতো না রাইসনার!!