২. সাঁতরে চলেছি কুয়াশার সাগরে

ভালো কি একটু? আমার অনুভব নারকীয়, বলতে পারলাম না ওর প্রত্যাশা ভরা চোখে তাকিয়ে। চোখ বুজলাম ঠোঁটে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করে। আর এক অনুভূতি চোখ বোজার পরেই–আলোর কাঁপুনি পাতার আড়ালে–যেন সাঁতরে চলেছি কুয়াশার সাগরে–কিসের ভাবনা? সে স্রোতে ছেড়ে দিলাম নিজেকে। একবারই ত মরে মানুষ।

যেন থমকে গেছে সময়। বাড়ছে আধার–চলে গেলাম নৈঃশব্দের আর কুয়াশার রাজ্যে রইলাম সেই অবস্থায় অনেক–অনেকক্ষণ। আলোর কাঁপুনি আবার শুরু–আমি শুয়ে বিছানায় আমার হাতটাছুঁলো চাদরের প্রান্ত। আমার সামনে সরে আসতে বুঝলাম চোখে আলো, মনে পড়লো পাশে পর্দা, এই ব্যবস্থা তো থাকে মুমূর্ষদের বিছানা ঘিরেই। তাকাতে টুপিটা ঠেলে দেওয়া মাথার পেছনদিকে, মুখে আঁকিবুকি কঠিন রেখার।

খড়কে চুষছে দাঁত খোঁচার। বিরক্তির স্বাক্ষর মাংসল মুখে পুলিস চিহ্নিত সারা অঙ্গে। হাওয়া খেতে লাগলো টুপিটা হাতে নিয়ে আমাকে চোখ মেলতে দেখে, আমার কি ভাগ্যি লিখে দিয়েছিলাম খরচার খাতায় আমি তো তোমাকে। সেবিকা বেরলো পর্দার আড়াল থেকে না–এটি তন্বী নয় সেই মেদবহুল।

বলুন ত কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে যেন ভেসে আসা অনেকদূর থেকে নিজের কানেই আমার কথা। বলবেন না কথা–শুয়ে থাকুন চুপচাপ–ধমকে উঠলো সেবিকা। ঘুমোবে। ধূর শুনতে হবেওর কাছে সব–নার্স কেটে পড়ুনতোআপনি–বিড়বিড় করে উঠলো আইনের খুঁটি, ভাইটি, তুমি বলতে চাও তো কথা, না?

আবার আমার চোখ বুজে এলো সার্জেন্ট সাহেব। এবার সেই সাদা কুর্তাকে চোখ মেলতে দেখলাম, কেমন আছি আমি? ডাক্তার দেখালেন মশাই আপনি ভেস্তালকি। ভালো করে তাকালাম, আমার ওকে ভালো লাগলো। কোথায় আমি?

চেষ্টা করলাম মাথা তুলতে, কিন্তু ভারী বড্ড–অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো আপনার একটা, তা, সেরে উঠেছেন ও কিছু না–ঢুকলো পুলিস সাহেব, এখন কথাবলা যাবে তো ওর সঙ্গে? প্রশ্ন দু–একটা। ঘটাবো না কোনো অস্বস্তি ভালো নয় ওর আঘাতটা, তাড়াতাড়ি করুন– সরে দাঁড়ালো ডাক্তার। পেনসিল হাতে, এগিয়ে বসলো সার্জেন্ট। মেলা নোটবইটা। কি ভাই তোমার নাম? বোলো না যেন উল্টোপাল্টা, আমার সব জানা দরকার

জন ফারার ঠিকানা? নেই কিছু বলছে শয়ন হট্টমন্দিরে? ও হাসলো দাঁতের ফাঁকে।

বলা যায় বাউণ্ডুলেও–চেষ্টা করলাম আমিও হাসবার। লোকটা প্রার্থনার ভঙ্গিতে কড়িকাঠের দিকে তাকালো একটা ফুঁ দিয়েও নিলো, আচ্ছা বেশ। তা ঘরণী, বাপ-মা, বা অন্য কেউ তাদের। পাত্তা নেই কেউ। আমিও চোখ তুললাম কড়িকাঠে। পুলিস সাহেব এবার ফিরলো ডাক্তারের দিকে। আপনাকে বললাম তো আমার নাড়ি ধরলো ডাক্তার, উনি এখনো আসেন নি কথা বলার অবস্থায়

আরে দাঁড়ান দাঁড়ান–পুলিস বাবাজী বলে উঠলো পেনসিল চিবোতে চিবোতে, সবকিছু তো আমাকে জানতে হবে।

এবার সে ঘুরলো আমার দিকে, কেউ নেই তোমার ওয়ারিসন, এই তো? ঠিক আছে ভাই তা, কে ঐ মহিলটি–পাওয়া গেলে তোমাকে যার সঙ্গে? এবার মনের চোখে ভেসে উঠলো। একটা ছবি। কামার্ত একটা মুখচ্ছবি আর কালো কালো চুল একরাশ

ডেলা বলে ডাককেন আমাকে ও বলেছিলো। বলেনি পদবী কিছু? জানিনা–একটা অদ্ভুত শব্দ করলো পুলিস সাহেবনাকে বলা যায় আর্তনাদও। কেমন আছে ও? খুব বেশী কি আঘাত? প্রশ্ন করলাম।

চিন্তা করবেন না ভালোই আছে–ও মুখ খোলার আগেই ডাক্তার বলে উঠলো। তিনি ওর স্বামী? কে আবার সেটি? পুলিস আমার দিকে তাকালো ছানাবড়া চোখে, যেন আমাকে ভূতে পেয়েছে। বসেছিলেন পেছনে, পল ওর নামও বলেছিলো তিনি কেমন আছেন?

ওর জন্যেও আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা–এবারও ডাক্তারই কথা বললো পুলিসসাহেব মাথা নাড়লো কপালে হাত রেখে। জানতে পারি কি করে ঘটলো ব্যাপারটা? তার গলায় আশার সুর ধ্বনিত হলো না তেমন। এদের তো বলা যাবেনা পেটেল্লির খবর। আমি ভুলে যেতে চাইলাম গাড়ির ব্যাপারটা চোখ বুজে।

না, গেলোনা তো ভোলা। বললাম, বেশ কিছুক্ষণ পরে, বেশ জোরেই একটা গাড়ি আসছিলো সামনের দিক থেকে। শালারা যেন দেখতেই পাচ্ছিলো না আমাদের–ও, মানে–ডেলা চেষ্টা করছিলো সরে যাবার, কিন্তু পারলো না–গাড়িটা হুমড়ি খেয়ে পড়লো প্রায় আমাদের ওপর। কি হয়েছে ও শালাদের? লম্বা নিঃশ্বাস গলায় একটা, সার্জেন্ট আমাকে মাপলো আপাদমস্তক।

 থাক চাদু ওসব কথা–আসা যাক কাজের কথায়। বাউণ্ডুলে তুমি তো–তা বাবাজী, ঘুরছিলে কেন বুইক চড়ে? ভূত দেখার পালা এবার আমার। বুইক নয় গাড়িটা বেন্টলে। মেয়েটাই চালাচ্ছিলো। ওর পাশে আমি বসেছিলাম–পেছনে স্বামী, উঠলাম হাঁফিয়ে। যাঃ এ যে শ্রাদ্ধ ভূতের বাপের।

টুপি সরিয়ে চাদি ঘষে নিলো রুমাল দিয়ে। জোরে টেনে দিলো টুপিটা বাপু শোনো–তুমিই গাড়িটা চালাচ্ছিলে মেয়েটা বসে ছিলো পেছনে–কেউ ছিলো না ভাতার–মাতার–সে আঙুলটা মেলে দিলো আমার দিকে ঝুঁকে। আর বুইক ছিলো গাড়িটা।

এবার আমি খেপে গেলাম, দূর মশাই আপনি ভুল করছেন–মুঠোয় ধরলাম বিছানার চাদরটা, মেয়েটাই গাড়ি চালাচ্ছিলো বলছি তো–বেন্টলে গাড়ি কালো রঙের। অন্যদিক থেকে এসে ধাক্কা দেয় একটা গাড়ি–চেপে ধরুন ড্রাইভারটাকে, বলবে সেই শালাই। মামা নোট বইটা নাচালো। আমার নাকের ওপর, গাড়ি ছিলো না অন্য কোন।

আচ্ছা, তোমার কি হয়েছে বলতো? কি আছে লুকোবার, অ্যাঁ?

থামুন তো এবার অনেক হয়েছে

 রুক্ষ গলা পেলাম ডাক্তারের। চিৎকার করে দরকার নেই বের করার ওর কানের পোকা। ভালো না ওর অবস্থা–সার্জেন্ট, একলা ওকে থাকতে দিন, লুকোইনি আমি কিছুই–চেষ্টা করলাম উঠে বসতে। পারলাম না। আবার ঝলসে উঠলো মাথার আলো–ছিটকে পড়লাম আঁধারে। সারা ঘর ভরে গেছে দিনের আলোয় যখন জ্ঞান হলো। পর্দাটা সরে গেছে পায়ের দিকে, শুধু রয়েছে পাশের দুটো।

চোখে পড়ছে সামনের খাটটা বেড়েছে কোলাহল। বুঝলাম আমাকে আনা হয়েছে ওয়ার্ডে। নজর করলাম ভালো করে কেউ নেই। মনে হচ্ছে অনেক সুস্থ, যন্ত্রণাটাও গেছে মাথার–যদিও শুকোয়নি ঘাটা। তুললাম হাতদুটো, উঠলো অনায়াসে। ভাবতে শুরু করলাম সার্জেন্টের কথাগুলি–অস্বস্তি বাড়লো ভাবনায়।

গাড়ি ছিলো না অন্য কোন। ও বলছে, স্বামীও না, বুইক গাড়ি। আর আমিই ছিলাম স্টিয়ারিঙে–লোকটা তাহলে কি বলতে চাইছিলো? নাকি আমি দর্শন করেছি স্বপ্নে হয়তো কুয়াশারই ফসল লোকটা হাতাইনা, হয়তো আমাকে গুলিয়ে ফেলে। অন্য কারুর সঙ্গে। ডাক্তার বেরোল পর্দার আড়াল থেকে, মুখে একগাল হাসি।

ভালোই তো আছে দেখে মনে হচ্ছে–তা আছিতাকিয়ে নিলাম একমুহূর্ত ডাক্তারের চোখে। আচ্ছা, বলুন তো এখানে কতদিন আছি?

সে চোখ বুলিয়ে নিলো খাটের পায়ায় লটকানো কাগজটায়। এখানে ভর্তি করা হয়েছে আপনাকে ৬ই সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে এগারোটার সময়। বারো তারিখ আজছদিন হলো,

সেপ্টেম্বর?

হ্যাঁ–তাই তো। কেন? বিস্ময় ডাক্তারের চোখে। কি করে হবে সেপ্টেম্বর, বলুন জুলাই।

লড়াইয়ের দিনটা ছিলো উনত্রিশে–আর দুর্ঘটনাটা ঘটে সেই রাতেই, জানি না তো তা–তবে ৬ই সেপ্টেম্বর আপনার ভর্তির তারিখটা আমি স্থির নিশ্চিন্ত এসম্পর্কে, উই আমাকে খুঁজে পাবার আগে বলছেন আমি অজ্ঞান হয়ে ছিলাম এক মাস ধরে?

হাসি ফুটলো ডাক্তারের ঠোঁটে, না, তা নয়–আপনাকে তো পাওয়া যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। সেখানে আওয়াজ শুনে ছুটে যায় পুলিসের এক টহলদার কনস্টেবল–অবশ্য সে বলতে পারেনা কি করে কি হলো তবে সে হাজির হয়েছিলো ঘটনার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই। ওরা এখানে আনে আপনাকে তার ঘন্টা খানেক পরে। চেটে নিলাম ঠোঁট জিভ দিয়ে ডাক্তার ঠাট্টা করছেন? ডাক্তারসলে বিছানার এই কোণে, না, তবেমাথা খারাপ করার তো কিছু নেই এই নিয়ে আপনার। এ অবস্থা চলবে আপনার এখন বেশ কিছুদিন, মনে হবেসব এলোমলো ঘটনা–দিনক্ষণ অতীত। তারপর, ক্রমে ঠিক হয়ে যাবে সব। স্বাভাবিক হয়ে আসবে স্মৃতিশক্তি। সে একটু থেমে বললো, একটা কথা আর, জ্বালাতে দেবেন না বেশী খোচড়গুলোকে। আমি বলেদিয়েছি ওদের। ওরা সাহায্য চায় আপনার–ওরা এটা উপলব্ধি করেছে যে স্বেচ্ছাকৃতনয় আপনার ভুলগুলো। আপনার শুধু বিশ্রাম চাই এখন পূর্ণ বিশ্রাম।

আর কি শুধু সময়ের ব্যাপার–উদার ডাক্তার মানুষটা অনেক করেছে আমার জন্য, কৃতজ্ঞ আমি। কিন্তু এতে ছেদ পড়ছেনা তো আমার ভাবনার। জানি আমি তো, আমার লড়াইয়ের দিনটা ছিলো উনত্রিশে জুলাই মিয়ামির ছোঁড়াটার সঙ্গে আর সংঘর্ষটা ঘটেছিলো সেই রাতেই। ঘটনার হেরফের হবেনা তাতেও যাই বলুক। ডাক্তার আর তর্ক করে লাভ নেই এব্যাপারে। একটা উপকার করবেন আমার? নিশ্চয়, বলুন। ডেলা–মানে এখানে নিশ্চয় আছে সেই মেয়েটাও, ওকেই করুন না জিজ্ঞাসা–সে আপনাকে খুলে বলতে পারবে উনত্রিশে জুলাইয়ের ব্যাপারটা। জিজ্ঞাসা করতে পারেন ওর স্বামীকেও, সেও বলবে একই কথা।

মুখের হাসি তরুণ ডাক্তারের মিলিয়ে গেলো, আচ্ছা, ধরা যাক এ ব্যাপারটাই–স্বামীর ব্যাপারটা ওর ওই-এরকম পাওয়াই যায়নি তো। গাড়িতে ছিলেন ওই মহিলাটি আর আপনি আওয়াজ উঠলো বুকে টিকটিক, বেশ তো বললাম খানিক পরে মানলাম–গাড়িতে ছিলো না আর কেউ। তাহলে জিজ্ঞাসা করুন ওই ডেলাকে আপনারা এটা তো মানছেন ও ছিলো জিজ্ঞাসা করুন ওকে যান

কষ্ট হচ্ছিলো বলতে একসঙ্গে অনেক কথা। ডাক্তার হাত চালিয়ে দিলো তার মসৃণ কালে চুলে। নিঃশেষে মিলিয়ে গেছে ঠোঁটের হাসি, এটা আপনাকে জানাতাম না দুদিন আগে হলে–কারণ অবস্থা ছিলো না আপনার শোনার মতো। এখন বলি–ঘাড় মটকে গিয়েছিলো মহিলাটির। পাওয়া যায় যখন আপনাকে, বেঁচে নেই উনি তখন পুলিস লেফটেনান্ট বিল রিস্কিন এলো বিকেলে। সন্দেহ থেকে যেতো ওর পদমর্যাদা সম্পর্কে নার্স পরিচয় করিয়ে না দিলে।

বিষাদের ছোঁয়া কেমন একটা উত্তর চল্লিশের ছোট খাটো মানুষটার মুখে, নিরীহ একজোড়া চোখ শুড়ওলা চশমার ফাঁকে। রিস্কিন নিঃশব্দ পায়ে ঢুকলো টুপি হাতে নিয়ে। লোকটা কথা বলে অত্যন্ত নরম গলায়।

আমার উদ্বেগ বাড়লো কারণ ঘুম পাড়িয়ে গিয়েছিলো আমাকে মোটা সার্জেন্টটা হৈ–হুঁঙ্কার করে। কিন্তু এ তো রিস্কিন বসলো আমার বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে। নজরে পড়লো ওর জুতো আর সাদা মোজা পায়ের ওপর পা–চাপিয়ে বসতে। সে নাচাতে লাগলো সরু পাটা।

ভাই কেমন আছো? রিস্কিন প্রশ্ন করলো মোলায়েম গলায়।

ভালোই আছি বললাম। সেই সঙ্গে আবার মুঠোয় নিলাম চাদরের কোণাটা। সন্দেহ করছি ওকে–ঘেমে গেছি, শুধু ওকে কেন সবাইকে।

আচ্ছা, বিকৃতমস্তিষ্ক ভাবছে কি ওরা আমাকে? কে জানে। তুমি বিপর্যস্ত ডাক্তার বলেছিলো কিন্তু কেন তা হবে। তোমার আগে অনেকেই পেয়েছে তোত মাথায় চোট, স্মৃতিভ্রংশও হয়েছে তাদের সাময়িক। এখন আমার ওপর ওসব ছেড়ে দিয়ে একটু হাল্কা হওতো চিন্তা ভাবনার ব্যাপারটায়। লেফটেনান্ট সাহেব পা নাচিয়ে চললো।

তাহলে এই রকম দাঁড়াচ্ছে ঘটনাটা–মারা গেছে মেয়েটা। তাহলে সে পালিয়েছে। তোমাকে যদি কেউ মেরেও থাকে। আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের শিক্ষা দেওয়া এই লোকটাকে এবং তার দলবলকে খুঁজে বের করার কাজটা সহজ হবে তোমার সাহায্য পেয়ে, আর তুমিও চাও তাই তো–তাই না? চাই, বললাম।

রিস্কিন চোখে চোখ রাখলো আমার। আচ্ছা তুমি ভবঘুরে কি সত্যি?

হু গাড়ি চালাতে দিয়েছিলো মেয়েটা তোমাকে?

দিলাম না জবাব। ওরা বুঝলাম না কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে আমার গাড়ি চালানোর ব্যাপারটায়। আমার ঘাড়ে কি চাপাতে চেষ্টা করছে ডেলার মৃত্যুর ব্যাপারটা? আবার বাড়লো অস্বস্তি। প্রশ্নটা পুনরুচ্চারণ করলো রিস্কিন তার স্বভাবশান্ত গলায়, সে মুখে হাসি ফোঁটালো আমাকে সাহস যোগাতে।

চালাচ্ছিলাম না আমি গাড়ি। বললাম গলা তুলে। মেয়েটাই চালাচ্ছিলো–পাশে ছিলাম আমি ওর স্বামী পেছনে ছিলো আর একথাকতবার বলতে হবে আপনাদের? ভেবেছিলাম এবার খেপে যাবে রিস্কিন। কিন্তু…না সে শুধু একটু হেলালো মাথাটা আরো স্পষ্ট হলো মুখে বিষাদের অভিব্যক্তিটুকু ভাই, আমি দুঃখিত–কোনো কারণ নেই তোমার উত্তেজিত হবার। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে আমার মনে হচ্ছে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে। হয়েইছে তো! ঐ সার্জেন্ট ভদ্রলোকটা আপনাদের যেতে দাও–ভাই যেতে দাও ওর কথা। ওতো শুধু লোক খেপাতে শিখেছে গলা হাঁকড়ে–দোষ লাইনের।

কিন্তু ওসব কিছুই আমি।

কথাটা রিস্কিন শেষ করলো হাসি দিয়ে। কিন্তু, থেকেই গেলো সন্দেহের রেশ–তবুও ভালো। লাগছে ওকে। কোত্থেকে তুললো বল তো তোমাকে মেয়েটা? হেঁটে চলেছিলে তুমিনাকি দিতে চাইলো লিফটব্যাপারটা কি হলো?

না। অনুমান ভুল আপনাদের। আমাকে বলতে দেবেন দয়া করে সব গোড়া থেকে? হ্যাঁ, চাইছি তো ঠিক তাই–ই… রিস্কিন নোটবই বের করে ফেললো দ্রুতহাতে পকেট থেকে। ভাই কিছু কিছু নোট করবো আপত্তি না থাকলে মনে থাকে না সব কথা–বয়েস হচ্ছে তো–সে লেখার আসল ব্যাপারটাও বোঝালো চোখ মটকে। সব খুলে বললাম। বড়লোক হবার স্বপ্ন, পিটসবার্গের কৈশোর কাহিনী, কি করে এলাম পেলোট্রায়।

বললাম চোয়াল ভাঙার গল্প ম্যাক্রেডীর বললাম লুকোচুরির কথাটাও পেট্টেল্লির সঙ্গে। জানাতে ভুললাম না সে কথাও। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো ডেলা। সবিস্তারে বললাম পেপি–বেনোর উপাখ্যানও। সবশেষে বললাম ব্র্যান্টের প্রস্তাবিত গাড়ি আর টাকার কথাটাও। অনেক সময় গেলো কাহিনী শোনাতে–শেষে ফিসফিসানিতে নেমে এলোগ। তবু স্বস্তি পেলাম ভেবে সব বলতে পেরেছি। একটা কথাও বলেনি রিস্কিন সমস্ত সময়টা। কি সব লিখলো নোটবইতে সময় সময়। শেষে বললে কান চুলকে নিয়ে, যাক জানা গেলো তো সবই–তুমি ভাই একটা ঘুম দাও এবার শুয়ে, খুব পরিশ্রম গেছে।

পরিশ্রম যাচ্ছে আমারও, আর ঘুম কেড়েই নিয়েছে তো কর্তারাচলি তাহলে রিস্কিন উঠে দাঁড়ালো, আবার দেখা হবে দু–একদিনের মধ্যে। শোনা যাবে কিছু মনে পড়ে যায় তো এর মধ্যে কিছু–আর আমার বলার কিছু নেই, গা এলিয়ে দিলাম নিশ্চিন্তে। আচ্ছা, চলি তাহলে শুয়ে পড়, রিস্কিন ওয়ার্ড থেকে বেরোলো বেড়ালের পায়ে। কেটে গেলো দুটো দিন। বোধ করছি ভালো অনেকটা খুশী ডাক্তারও।

উঠতে পারবেন আপনি দিন দুয়েকের মধ্যেই হাসলাম, অন্য কোনোখানে তো আমার ভাবনা। রিস্কিন তো এ কদিন ঘুম দিচ্ছে না নাকে তেল দিয়ে। কে জানে এবার সে উদয় হবে কি মূর্তিতে! ডাক্তার কেমন হয় একটু ঘুরে দেখলে শহরটা? এত কথা শুনেছি যে লিঙ্কন বীচ সম্পর্কে। এটা লিঙ্কন বীচ কে বললো আপনাকে? এতো মিয়ামি, বিস্ময় ডাক্তারের কথায়– মিয়ামি। ওর দিকে তাকালাম অবিশ্বাসের চোখে। কিন্তু একটা হাসপাতাল আছেনা লিঙ্কন বীচে? আছে হুইস্কি প্রায় আমাদের এটার মতোই ভালো হাসপাতালই–তাহলে ওরা ভর্তি করালো না কেন আমাকে ওখানে? আসার দরকার ছিলো না কিছু দুশো মাইল দূরে মিয়ামিতে।

মাইল সত্তরেক হবে–দুশো নয়–শান্তস্বরে বললো ডাক্তার। এখানে আপনাকে আনা হয়েছে লিঙ্কন বীচ থেকে মিয়ামির কাছাকাছি ছিলেন বলেই বাড়লো উত্তেজনা, কিন্তু পেলোট্রার শহরতলীতে লিঙ্কন বীচের রাস্তায় আমরা তো দুর্ঘটনার সময়

বারণ করেছি না আপনাকে ভাবতে।

ডাক্তার বললো কপট গাম্ভীর্যের গলায়। ঠিক হয়ে যাবে সব–বিশ্রাম নিনতো কটা দিন।

আবার দুর্ভাবনা শুরু হলো একা শুয়ে থাকতে থাকতে। গোলমাল হয়ে গেলো নাকি সবকিছু।

ঝাঁকিয়ে নিলাম মাথাটা শক্ত রাখতে হবেনার্ভ। নইলে পাঠিয়ে দেবেহয়তো পাগলা গারদে। ওদের ব্যবস্থা মেনে নিলাম। ঘরটা সত্যিই সুন্দর বসে বসে দেখতে পাবো দিনভর সমুদ্রের ঢেউ ভাঙা। কিন্তু সায় দিলো না মন। মনে হলো আমাকে এখানে আনা হয়েছে কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই জানা দরকার…কি সেটা? প্রায় ছটা বিকেল। জলের ঢেউ গুনছি বিছানায় বসে।

ঢুকলো রিস্কিন–ব্রাদার কি খবর? আছো কেমন? ভালো বলে ফেললাম কোনো ভূমিকা না করেই। আচ্ছা, ওরা কেন আমাকে ঢোকালো এ ঘরে?

রিস্কিন ধীর পায়ে এগিয়ে এলো বিছানার দিকে, খরচ কত জানো এ ঘরে থাকার? জানি, আর জিজ্ঞেস করছি জানি বলেই তো–রিস্কিন বসলো চেয়ার টেনে, বললো গলা নামিয়ে, আমি যে যাতায়াত করছি সেটা রুগীদের জানতে দিতে চান না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ভালো তো ডাক্তার লোকটা–তাই খারাপ লাগবে ভেবে তোমার কাছে ব্যাপারটা

রিস্কিন মুছে নিলো মুখটা রুমাল দিয়ে। ওর নিরীহ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। নিঃশ্বাস নিলাম একটা লম্বা।

রিস্কিন সাহেব কি জানেন মনেই হয়নি ওটা আমার। আমার ধারণা সরানো হয়েছে আমাকে মানসিক অস্থিরতা বাড়ছে ভেবেই রিস্কিন বের করলো সিগারেটের প্যাকেট পকেট থেকে। একটা খাবেনাকি? সিগারেটটা নিলাম হাত বাড়িয়ে। ভাই ওসব একদম ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে আজে বাজে চিন্তা– হালকা গলায় রিস্কিন বললো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা, হাতকড়া আমার হাতেই পরাবে আবার এ ব্যাপারটা দেখলে নার্সা।

তবে, এ জন্যেই তো আছে ওরা, কি বলো, রিস্কিন মুখে নির্মল হাসি ফোঁটালো। আমিও বের করলাম দাঁত, আজ মনে হচ্ছে অনেক ভালো। তবে বড় খারাপ মনটা–আমি ছিলাম আপনার অপেক্ষাতে–লম্বা টান দিলাম সিগারেটে। ব্যস্ত ছিলাম একটু। রিস্কিন অনেকক্ষণ দেখলো সিগারেটের আগুনটা।

তোমাকে চমকে দিবো একটা খবর দিয়ে–পারবে তো সহ্য করতে?

হয়তো পারবো, ব্যাপার কি? গাড়িটা ছিলো না বেন্টলে, বুইক ছিলো। পাওয়া যায় তোমাকে চালকের আসনে। পেছনে ছিলো মহিলাটি, তাকে বের করতে হয় গাড়ির দরজা কেটে। গাড়িতে আর কেউ ছিল না। আমি সেই জায়গায় নিজে ঘুরেছি, দেখেছি ছবিগুলো, দেখেছি বুইকটাও। প্রথম দেখতে পায় যে কনস্টেবলটা আমার কথা হয়েছে তার সঙ্গেও–আমি ওর কথা নিঃশব্দে শুনেছি। বলতে পারলাম না মুখের ওপর এটা যে ও মিথ্যা কথা বলছে।

নিঃশেষে মিলিয়ে গেছে সমস্ত রক্ত আমার মুখের বুঝতে পারছি, মাটিতে পড়ে গেলো সিগারেটটা হাত থেকে।

রিস্কিন সেটা ঝুঁকে তুলেছিলো। আরে, হোলো কি? চমক আছেবললাম তো তোমাকে হলো কি! তাকাচ্ছো যে অমন ভাবে? আপনি মিথ্যা কথা বলছেন–আপনি! বলে উঠলাম স্বাভাবিক গলায়। আহা–কেন চটছো? এসো, যদি আর কিছু বেরোয় একটু আলোচনা করা যাক ব্যাপারটা নিয়ে–উন্মাদ হয়ে যাবো এবার সত্যিই মনে হলো আমার। ভাবলাম দৌড়ে পালাই খাট থেকে নেমে, দু চোখ যায় যেদিকে..সমস্ত ব্যাপারটাই বিশ্বাস করতে হচ্ছে রিস্কিন মিথ্যে না বললেও। কানে এলো ওর শান্ত গলা, ব্যাপারটা ঘটেছিলো উনত্রিশে জুলাই তাইনা? তুমি বলেছিলে। এদিকে দ্যাখো, যে তারিখে তোমাকে পাওয়া গেলো সে তারিখটা হলো ৬ই সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনার পর। পরিষ্কার তার উল্লেখ আছে বলস্টে। একই কথা লেখা হাসপাতালের খাতাতেও, তাহলে? কি বলবে এবার? কিছুই না, এখনও তাই বলছি আগেও যা বলেছি–সেটা হচ্ছে উনত্রিশে জুলাই লড়াইয়ের দিনটা ছিলো মিয়ামির ছোকরার সঙ্গে আমার লড়াইয়ের, আর অ্যাকসিডেন্টটা হয় লড়াইয়ের পর–যাক, কিন্তু খবর পেলাম আমি তোএকটু হদিস পেয়েছি আমি এ ব্যাপারে আমার মনে হয়।

 কথাও হয়েছে এ নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে, ঠিক পথেই আমি চলেছি ওর মতে। অবশ্য শক্ত হতে পারে ব্যাপারটা গ্রহণ করা তোমার পক্ষে। শোন–আরো কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতে তোমার, ডাক্তারের ধারণা। মানুষের মনে উদ্ভট চিন্তা ঢোকে মাথায় আঘাত পেলে। এখন মেনেনাও আমি যা বলছিদুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে। সহজ হয়ে আসবেব্যাপারটা অনেক, দুজনের কাছেই।

বুলিয়ে নিলাম জিভ শুকনো ঠোঁটে। বলুন, একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো রাস্তায় পেলোট্রার বাইরে প্রচণ্ড গতিতে সংঘর্ষটা হয়েছিলো ধাবমান পরস্পরমুখী দুটো গাড়ির মধ্যে। উল্টে গিয়েছিলো দুটো গাড়িই। ওঁরই একটায় আগুন ধরে যায় বেন্টলে গাড়িটায়– রিস্কিন নতুন করে সিগারেট ধরালো, জনি ফারার বলে একজন মুষ্টিক গাড়িটা চালাচ্ছিলোমারা গেছে সে। চেঁচিয়ে উঠলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার–বললাম হাত দিয়ে নিজের বুকে, জনি ফারার–আমিই ফারার–সস্নেহে রিস্কিন হাত রাখলো আমার পিঠে। জট ছাড়াবো দুজনে বসে বলেছি তো ভাই, সুযোগ দাও আমাকে একটু, শোনো শেষ পর্যন্ত কি বলতে চাইছি—এগিয়ে দিলাম মাথার বালিশ, আমার শরীর কাঁপছে আতঙ্কে।

কাগজে ছাপা হয়েছে দুর্ঘটনার পূর্ণ বিবরণ–ওরা লিখেছে সবই। দেখাবো, দেখতে চাও? রিস্কিন তাকালো জানলার বাইরে লম্বা টান দিয়ে সিগারেটে, পরে ঘুরলো আমার দিকে। নিশ্চয় পড়ে থাকবে তোমার চোখে খবরটা, হয়ে থাকতে পারে মানসিক প্রতিক্রিয়াও। ভাবতে শুরু করে দিলে নিজেকে ফারার বলে, তুমিও অ্যাকসিডেন্টে পড়ে সপ্তাহ পাঁচেক পরে। নিশ্চিত হলে জ্ঞান হওয়ার পর বুঝলে, তুমিই ফায়ার! এই বিভ্রান্তি থাকবে তোমার মনে আরও কিছুদিন, তাই মত ডাক্তারেরওরিস্কিন সিগারেটটা পিষলো ভালো করে পায়ের তলায় ফেলে, শুধু বিশ্রাম এখন, আর ভুলে যেতে হবে এটা–যে তুমি ফারার। ছিলে না তুমি গাড়ির গ্যাড়াকলে। ঊনত্রিশে জুলাইয়ের–মুষ্টিযোদ্ধা নও তুমি।

তুমি অংশ নাওনি কোনো লড়াইয়ে কুঁচকে তাকালাম রিস্কিনের দিকে। আমি বিশ্বাস করছি না আপনার এসব ভূতুড়ে গল্প। আপনার কি মনে হয়? মুহূর্তের জন্যেও নয়। ফারার আমি–লড়াই হয়েছিলো আমারই মিয়ামির ছোঁড়াটার সঙ্গে আর আমিই লাগিয়েছি ওর দাঁতকপাটি–এই হাতেই আমার–রিস্কিনের নাকের সামনেহাতটা মেলে ধরলাম। আর আমার হাতে লোকও আছে শুনুন। এ সব প্রমাণ করাব, তারা থাকে পেলোট্রাতেই। কাফে চালায় টম রোশ আর তার স্ত্রী অ্যালিস। তাদের নিয়ে আসুন–হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে রোশনামটা। কথা হয়েছে তার সঙ্গেও কথা হয়েছে ও ছাড়া ওর স্ত্রী অ্যালিস আর সলি ব্র্যান্ট বলে একজন লোকের সঙ্গেও। তারা সনাক্ত করেছে মৃতদেহ। কাগজে পড়েছে বলেই বোধহয় ওদের সম্পর্কে…

দাঁড়ান–খামচে ধরলাম ওর হাতটা।

 বললেন সনাক্ত করেছে। কার মৃতদেহ?

কেন ফারারের–এই দ্যাখোরিস্কিন পকেট থেকে বের করে বাড়িয়ে ধরলো ভাজ করা কাগজ, সব আছে এতেই

হ্যাঁ। আছে সবই, সবই রিনি যা বলছে। শুধু ব্যাপার একটা ছাড়া। বেন্টলে গাড়িটা আমি নাকি চুরি করেছিলাম কাগজে বলছে। আর দায়ীকরেনিনাকি মালিক। ফেলে দিলাম ছুঁড়ে কাগজটা, রীতিমত এবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বলে চললো রিস্কিন।

চেষ্টা করেছি খুঁজে বের করতে বেন্টলে গাড়িটা, কিন্তু নম্বরটা জাল। পাওয়া গেছে বুইকটা ওটা কার! পেয়েছেন? কথাগুলো ছাড়লাম একদমে। রিস্কিন হাসলো, তোমার জনরিককা তোমার নাম ঠিকানা–৩৯৪৫, ৪নং অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্র্যাঞ্চবুলেভার্ড, লিনবীচ–মিথ্যে মিথ্যে কথা–মিথ্যে কথা নয় করা হয়েছে সনাক্ত তোমাকে–কে? শুনি কে করেছে সনাক্ত? বলে উঠলাম অধৈর্য গলায়।

এক সম্পর্কের ভাই তোমার। আর এই কেবিনে তুমি তার দৌলতে। ও এই ব্যবস্থা করেছে তোমার খবর পাওয়া মাত্র–ভাই নেই কোনো আমার আর রিককা নামও আমার নয়বসিয়ে দিলাম একটা ঘুষি। আপনি বকছেন আবোল–তাবোলনা। রিস্কিনের গলা তেমনি শান্ত, ও দেখে গেছে তোমাকে গতকাল রাতে, তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে। সে সেই সময়ই দিয়ে গেছে তোমার পরিচয়ও। তাই বলছে গাড়ির রেজিস্ট্রি খাতাও। মাথায় শুরু হয়ে গেছে অসহ্য যন্ত্রণা, বললাম কোনো রকমে, বিশ্বাস করি না আমি এর এক বর্ণও–আমি ফারার–ছেড়ে দিলাম বালিশে মাথা। রিস্কিন একটু কান চুলকে নিলো আমার মুখে দিকে তাকিয়ে। এখন উত্তেজনার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর তার চোখেমুখে। কিন্তু ঠোঁটে রেখেছে উদার হাসিটুকু–যে অভিব্যক্তি দেখা যায় কথা বলার সময় অপ্রকৃতিস্থ মানুষের সঙ্গে। রিস্কিন মুখ খুললে বেশ কিছুক্ষণ পরে। এক কাজ করা যাক তাহলে আমার মনে হয় হয়তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে ওর সঙ্গে দেখা হলে।

জনি একটা ঝড় বয়ে গেলো তোমার ওপর দিয়ে ডাক্তারের ধারণা তুমি–সান্ত্বনা দিতে পারবো আমি তোমার এই অবস্থায়। আমি এসেছি সেজন্যেই–আবার মনটা কেঁপে উঠলো অজানা আতঙ্কে। এমন কিছু ছিলো যা সাবধান করে দিলো আমার মনকে লোকটার হাসি মুখের আড়ালে।

কথা বলতে চাই না আমি আপনার সঙ্গে–রিককা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, আমার নাকে পৌঁছলো সে নিঃশ্বাসের ঢেউ। ঝলসে উঠলো আংটি বাইরে থেকে আসা সূর্যের আলোয়, কিন্তু একবার ভাবো জিনির কথা–দেখতে চায় ও তোমাকে, জনি–আচ্ছা শেষ নেই কি এর! আমার হাত চলে গেলো চাদরের প্রান্তে। সেটা খামচে ধরলাম। বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন।

কোন দরকার নেই এখানে আপনার, আসুন আপনি। ভুলে গেলে জিনিকে? ওকে তুমি বিয়ে করতে চেয়েছিলে। রিককা ঝুঁকে পড়লো আমার মুখের ওপর।

জানো কি বলে ডাকে ও লোকটাকে দপ্তরের সবাই–শেয়ালে রিস্কিন! রিককা হাসলে খ্যাক খ্যাক করে। করছে দেখছি খুব ভাই বেরাদার। অবছে ও সাহায্য করবে তোমাকে? না, লোকটা মাড়াবে না সে ধারই–খুনের গ্যাড়াকলে ফাসাবে কথা বের করে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে। কিছুই বুঝছি না মাথামুণ্ড। একেবারে মেরি গেছি ঠাণ্ডা।

কয়েদখানার বাইরে আছে এখনো তুমি আমার জন্যেই রিস্কিন শুধু বের করার অপেক্ষায় রয়েছে খুনের মোটিভ। আমি বলে দিতে পারতাম ওকে সবই। শুধু একটা কারণে মুখ বন্ধ রেখেছি, একটা চুক্তি করবো বলে তোমাতে আমাতে–শুনতে চাই না আমি কিছু, বেরোও তুমি–মেয়েটা কে ওরা জানে নালোকষ্টা নির্বিকার বলে চললো, তুমি ডুববে ফাস করে দিলে। অবশ্য, আমি এটা চাই না ওরা জানুক–কিন্তু হয়েই যায় যদি জানাজানি, আমি মোকাবিলা করি এসবের সেভাবেই।

যা খুশি করো আমার কেউ ভাই নেই, তাছাড়া কখনো এর আগে তোমায় দেখিনি, কেমন? রিককা পূরণ করে দিলো আমার পদ, কিন্তু ভালো হবে কি জানিয়ে দেওয়াটা রিস্কিনকে যে আমি তোমার ভাইনই–তোমার ঘাড়ে তিন–তিনটে খুনের ঝামেলা, যথেষ্ট নয় কি একটাই? সেই হাসির বিস্তার তার ঠোঁটে। দেখা দিলে সরষে ফুলের প্রাচুর্য আবার আমার চোখে কি করবো যা অবস্থা মাথার গুলিয়ে ফেলছে অন্য কারোর সঙ্গে আমাকে বললাম কোনোরকমে। আমার নাম রিককা নয় জন ফারার। আমার কোন সম্পর্ক নেই তোমার সঙ্গে

 নিয়ে নিলাম একটা ঢোঁক, এখন বিদেয় হবে কি দয়া করে? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে একসঙ্গে কথা বলে। জানি। আমি জানি যে তুমি জন ফারার। বাইসনারকে আর পল ওয়াদমকেতুমি সাবাড় করেছো এও জানি, আর–ওর ঠোঁটে একফালি দুষ্টুমির হাসি খেললো, খতম করেছো তুমিই মেয়েটাকেও। অবশ্য ব্যাপারটা অ্যাকসিডেন্ট বলে চালিয়ে দেওয়া যেতো, বন্দুকটা না পাওয়া গেলে, কিন্তু বন্দুকে ছাপ পাওয়া গেছে ওর আঙুলের–ওর চোখে তাকিয়ে একটু ঝুঁকে, বললাম ফিসফিসিয়ে, এসব আসছে কোত্থেকে রিককা–ফিকার ব্যাপার? তুমিই রিককা রিস্কিনের ধারণা, কপালে বোলালো লোকটা মোটা আঙুল, আর সুযোগ নেবো আমরা যতক্ষণ পরিবর্তন না ঘটছে ওর ভাবনার–তুমিই ফারার ও জানবে যে মুহূর্তে–শুনতে পারছি না আর কিছু চাইও না। ঢেকে ফেললাম মুখ হাত দিয়ে।

বিশ্বাস করতে পারছে না তাহলে আমাকে, এই ত? বেশ প্রশ্ন করো তুমি নিজেকেই–এই মাথা ব্যাথা কেন তোমার জন্য আমার–ভাবো সেটা। তুমি বেরিয়ে যেতে পারো যখন খুশি এখান থেকে, তাতে যায় আসে না আমার কিছু, আমি শুধু তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি ওই মেয়েটার কথা, ও ভাবছে তোমার জন্যও বসে আছে তোমার পথ চেয়ে–সে আরো নামালো গলা।

আমাকে দিয়ে দাও টাকাটা। বলল, কোথায় রেখেছে টাকাটা?

জানি না–আর, বলব না জানলেও। বেরোও তুমি এখন দিলাম গলা চড়িয়ে। ওর মুখটা হয়ে গেলো হিংস্রতার মুখোেশ, প্রতিমূর্তি যেন দানরে।

বোকা কোথাকার! ওর গলা কাঁপছে। ভাবছে, আমি বিশ্বাস করি তোমার এই স্মৃতি বিলুপ্তির অভিনয়। তুমি এমন অবস্থায় পড়বেনা বললে কোথায় রেখেছে, না জন্মালেই ভালো ছিলো তখন মনে হবে। কি, রেখেছো কোথায়? বলছি বেরোও–খামচে ধরলাম বিছানার চাদর। বন্ধ হলো হাঁটু বাজানো, রিককা উঠে দাঁড়ালো। মুখে বিস্তৃত হলো অর্থহীন নির্বোধ হাসিটুকু। চলি–তুমি তো খেলতে চাইছে এই ভাবেই? ঠিক আছে তাহলে জানিয়ে দিই ব্যাপারটা রিস্কিনকেও চোখ রাখলো হাত ঘড়িতে। ব্যবস্থা হয়ে যাবে কয়েদে পোরার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই; রেহাই থাকলেও একটা খুনের। জুটবে না তিনটের রেহাই, কি বলো? রিককা ফিরে দাঁড়ালো নিঃশব্দে দরজা পর্যন্ত গিয়ে। কি করবে? দরজা দেখিয়ে দিলাম বুড়ো আঙুলের ইশারায় শরীরী রিককা যেমন ঢুকেছিলো বেরিয়ে গেলো তেমনি। একজন সেবিকাঢুকলোমন তৈরীকরার আগেই এসবের বিশ্লেষণ করার।

সেবিকা আলমারির দিকে হাত বাড়ালো।

ডাক্তার বলছিলো ছেড়ে দেবে শীগগিরই তাই–আচ্ছা, ঘুমাবার চেষ্টা করি এবার একটু।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিলাম সুন্দর ফুলগুলো বিছানাতে উঠে বসলাম ও বেরোতেই। পালাতে হবে এখান থেকে দূরে কোথাও রিককা আর ওই রিস্কিনের কাছ থেকে। আমার মনে হচ্ছে দুটো জিনিষ এক, হয় ওরা আমাকে গুলিয়ে ফেলছে অন্য কারুর সঙ্গে না হয় আমাকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছে ওদের একজন বা দুজন। দেখলাম ঘড়ি, ছটা বেজে কুড়ি।

বেরোতে হবে সিঁড়ি ধরেই। ফিরলাম। ঘরে ফিরে দাঁড়ালাম জানলার সামনে। ঘরটা সাত তলায়। তাকালামনীচে, মানুষের ভীড় অসংখ্য সূর্যস্নানরত না হবেনা এখান দিয়েও ফিরে এলাম গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার বাইরে। সন্তর্পণে ডাক দিলাম, ফিরতে হতে পারে বিছানায় যে কোনো মুহূর্তে। একজন চালক আর সেবিকা এগিয়ে আসছে একটা ট্রলি ঠেলে। ফিরে তাকালাম টেবিল ঘড়ির দিকে–দশ মিনিট বাকি সাতটা বাজতে। হাতে সময় বিশ মিনিট, কাজ সারতে হবে এর ভিতর। দাঁড়িয়ে আছি দরজায়, চিন্তার জট মাথায়।

কানে এলো ট্রলি চালকের কথা। ওকে নামাবো কথা বলে ডাক্তারের সঙ্গে। ফেলে এসেছি মর্গের কাগজটা। এটা না ভুলে বসে থাকো কোনদিন নিজের মাথা আছে–তাহলে কিন্তু বিপদ আছে। বললো ঠোঁট উল্টে সেবিকাটা। দ্রুত সরে গেলো সেবিকা চালক তার দিকে হাত বাড়াতে। নীচে নামতে শুরু করলো সেবিকা।

পেছন পেছন চালক। বাইরে পা দিলাম এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে। ঝুঁকে রেলিং ধরে সিপাই দুটো, চোখ নীচের দিকে–সেবিকার বোধহয় অবয়ব। ওরা পেছন ফিরে রয়েছে আমার দিকে। পেয়ে গেছি আমার পথ। উল্টোদিকের ঘরের সামনে দাঁড়ালাম বারান্দা দিয়ে হেঁটে। ঘরে ঢুকে পড়লাম দরজার হাতল ঠেলে। পাথর হয়ে গেলাম ট্রলির দিকে চোখ পড়তেই–মৃতদেহ স্ত্রীলোকের… আচ্ছাদিত সাদা চাদরে। বাড়ছে উত্তজনা…মুখের ওপর ভালো করে টেনে দিলাম চাদর।

এখন কি করা যায়। সরাতে হবে একে কিন্তু কোথায়? চোখ বুলিয়ে নিলাম ঘরের চারপাশে, না, চোখে পড়ছে না সেরকম কোনো জায়গা। তাহলে? নজরে পড়লো একটা দরজা কোণের দিকে, প্রায় সেদিকে দৌড়ে গেলাম–ঘরের হাতল ঘুরিয়ে দিলাম।

কলঘর। কলঘরের দিকে ট্রলি ঠেলে নিয়ে চললাম দ্রুতপায়ে ফিরে, নামিয়ে দিলাম স্নানের টবে ট্রলি থেকে তুলে মৃতার হিমশীতল দেহটা। শীতল অনুভূতি হলো একটা নিজের শরীরেও। ঘুরে উঠলো মাথাটা। দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত কলঘরের দরজা ধরে। আগের জায়গায় ফিরে এলাম ট্রলি চালিয়ে। চাদরটা আপাদমস্তক টেনে দিলাম নিজের শরীরটাকে তার ওপর ছেড়ে দিয়ে। শুরু হলো প্রতীক্ষা। কাঁপুনিও, মাথার যন্ত্রণার সঙ্গে।

ধরা পড়ে যাবো না তো এখান থেকে বেরোবার আগেই! ফিরে যাবো নিজের ঘরে? সময় আছে এখনও…ঘরের দরজাটা খুলে গেলো দোদুল্যমান ভাবনার মধ্যেই…রুদ্ধ হয়ে এলো নিঃশ্বাস…শুনছি নিজের হৃৎস্পন্দন..শুরু করলো ট্রলি চলতে…কান দিয়ে পড়ে রইলাম। চালকের মৃদুস্বর শিস…গাড়ি চললো বারান্দা দিয়ে যেন অনন্তকাল এক একটা মুহূর্ত। কথার টুকরো কানে এলো। ওতে কি আছে?

মড়া মেয়ে মানুষের গলা পেলাম চালকের। দুশশালা বোধহয় জ্যান্ত মানুষ বাড়ি ফেরে না হাসপাতাল থেকে উকবরওলাদের কাছ থেকে যে কমিশন খায় ডাক্তার সাহেবরা। হু–হয়েছিলো কি? রোগটার যেন কি নামটা বলেছিলো নাকি যে পেরিটোনাইটিস গাড়ি চড়লো লিফটে। নেমে চললাম নীচে। চালক হালকা মেজাজে শিস দিয়ে চলেছে।

আওয়াজ উঠলো দরজা খোলার, নড়ে উঠলো ট্রলি। আই জো– ভেসে এলো বামাকণ্ঠ।

 কি গো সোনা– থেমে গেলো ট্রলি।

আবার মরলো কে?

মিসেস এনিসমোর ওই চুয়াল্লিশ নম্বরের চালক গলা নামিয়ে দিলো।

তোমাকে কিন্তু আজ দারুণ দেখাচ্ছে এক মিনিট ছেড়ে দিয়ে আসি এটাকে চালক গাড়ি, ঠেলে দিলে ঝোলানো দরজার ফাঁকে–গাড়িটা থমকে দাঁড়ালো দেওয়ালে একটা ধাক্কা খেয়ে। চিৎকার করে উঠেছিলাম প্রায় যন্ত্রণায়। নৈঃশব্দ কয়েক মুহূর্ত। উঠে বসলাম চাদর সরিয়ে লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেতেই। অন্ধকার বন্ধ একচিলতে আলো আসছে দরজার ফাঁক দিয়ে–ট্রলির সারি সারা ঘর জুড়ে। বাতাসে শীতল ঘ্রাণ। নেমে পড়লাম, এবারও প্রায় ভুলেছিলাম টুপিটা। ওটাকে চাপিয়ে দিলাম মাথায়। মুখ বাড়ালাম দরজার বাইরে চোখে অন্ধকার সয়ে আসতেই, ফুরিয়ে এসেছে দিনের আলো। দেখতে পাচ্ছি দূরে গেট, আশেপাশে কেউ নেই। নেবে গেলাম রাস্তায়–যাবো কোথায়, জানি না কি করবো। পয়সা নেই পকেটে, রুমাল পর্যন্ত না একটা–কিন্তু, আমার তো ভাবনা নয় তা নিয়ে…দূরে সরে যেতে তো পারছিরিস্কিনের কাছ থেকে রিককার সংস্পর্শ থেকে…হাসপাতাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে চাঁদের পীতাঙ্ক আলো মিয়ামির সৈকত জুড়ে।

একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে বালিয়াড়িতে নেভানো আলোগুলো। পাশে দুটো মানুষ বদলাচ্ছে পোষাক। একটি মেয়ে আর একটি পুরুষ মানার্থী সম্ভবত। শুনতে পাচ্ছি ওদের কথা কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে কি বলছে। জনহীন সারা সৈকত।

লুকিয়ে বসে আছি আমি গড়ান গাছের আড়ালে ঝাড়া তিনটে ঘণ্টা, ওরা এলো এমন সময়। গাড়ির কাছে চলে গেলাম আমি দ্রুত পায়ে, ওরা দৌড়ে জলে নামতেই। লোকটার কোটটা পড়ে চালকের আসনে–কোটটা তুলে নিলাম হাত বাড়িয়ে।

চামড়ার ব্যাগ টাকার ভারে স্ফীত কলেবর। টাকা অনেক! না, নিলাম না সব–মুড়ে ফেলে দিলাম পকেটে দেড়শো ডলার তুলে নিয়ে ফিরে গেলাম গাছের আড়ালে আবার ব্যাগটা যথাস্থানে রেখে। মনটা থেমে থাকেনি তো, শরীর নিশ্চল থাকলেও তিনঘণ্টা। মিয়ামিতে বসে থাকবো না আমি নিশ্চয় ভাবছে রিস্কিন হাঁটার অভ্যেস আছে আমার ও জানে। এতক্ষণে সাড়া উঠেছে কাছেই চেকপোষ্টগুলোতে। তাহলে–আপাতত থেকে যেতে হবে মিয়ামিতেই। গা ঢাকা দিতে হবে খুঁজে নিয়ে একটা শান্ত ছোট্ট হোটেল। একটা ঘর দখল নিতে হবে গল্প ফেঁদে। অপেক্ষায় রয়েছি বাক্স প্যাটরার।

কিন্তু দৈহিক অবস্থা নেই আমার খোঁজাখুজি করার মতো। মানসিক তো নয়ই। বেড়ে চলেছে মাথার যন্ত্রণাও আর এতক্ষণে আমার চেহারার বর্ণনা চলে গেছে সব ফাঁড়িতে। শহর তোলপাড় করছে আমার খোঁজে, রিককাও। খুলে ফেলেছি ব্যান্ডেজ, এখন কিছু স্বস্তি পাচ্ছি টুপিটা পরে। একদিকে রেস্তোরাঁর ভীড় আর দোকান পসরা সারা তল্লাট জুড়ে আর একদিকে পোতাশ্রয়, সামনে সমুদ্র।

দেখেশুনে একটা হোটেলে ঢুকলাম আলো জ্বালিয়ে দিলো ঘরে ঢুকে বেয়ারা ছোরাটা। বারান্দার ওই কোণে বাথরুমটাও দেখালো আঙুল বাড়িয়ে, খুলবেন না ঝরনাটা। খারাপ হয়ে গেছে ওটা।

ছোট্ট ঘর। একপাশে খাট, একটি চেয়ার আর টেবিল। এক কোণে আয়নাও আছে। জীর্ণ কার্পেট মোড়া মেঝেয়। কি বলো বাকিংহাম প্রাসাদ? ঠাট্টা করলাম।

স্যার তার চেয়ে বড়ই হবে একটু। ছোকরা জবাব দিলো অম্লান বদনে। বেয়ারাটা আমার দিকে তাকালো প্রত্যাশার চোখে টেবিলের ওপর চাবিটা রেখে। ওর হাতে গুঁজে দিলাম একটা ডলার, ছোকরা একটা ঢোঁক গিলে ফেললো বিস্ময়ে, স্যার আর কিছু চাই? রাত তো পড়ে আছে। মানে ওদের ফোনের নম্বরগুলো আমার কাছে আছে। ছোঁড়াটা চোখের একটা ভঙ্গি করলো।

এখন কেটে পড়ো তুমি দিলাম নম্বরের চিরকুট পকেট থেকে বের করার আগেই। স্যার আমাকে ডাকবেন মন চাইলে–ম্যাডক্স আমার নাম।

আমাকে নীচেই পাবেন। শুধু উত্তরে তাকালাম মুখ তুলে দরজাটার দিকে। ম্যাডক্স বেরিয়ে গেলো ম্লানমুখে। একপাশে টুপিটা ছুঁড়ে দিলাম লোকটা বেরোনোমাত্র। কষ্ট হচ্ছে চোখ তুলে রাখতে এত শ্রান্ত হয়েছি যে।

মোলামেয় না বিছানাটা। কিন্তু তবু বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমার, এতে শরীর ছেড়ে দিতে। কিছুক্ষণ বসে রইলাম হাই তুলে শূন্য মনে। হঠাৎ মনে পড়লো আমার চিরকালীন অভ্যেস টুপির মধ্যে একটা দশ ডলারের নোট রাখার, কাজে লাগতে দুর্দিনে। ভাবলাম সে অভ্যেস থাকা সম্ভব হয়তো এই টুপির মালিকেরও।

লাইনিংয়ের ফাঁকে ডলারটি রেখে দিলাম টুপিটা হাতে নিয়ে। পেনসিলে কটা কথা লেখা? জন ফারার সি বোর্ড এয়ার লাইন রেলওয়ে, গ্রেটার মিয়ামি। বর্ণনা লেখা নীচের মালের; স্যুটকেস একটা। ঘুম চলে গেছে চোখ থেকে–আমারই এই জামা-প্যান্ট–টুপি। খুঁজলাম রসিদের তারিখটা রয়েছে সেটাও ৬ই সেপ্টেম্বর। সময়ও দেওয়া ছটা বেজে পাঁচমিনিট। আমি যেন ভূতুড়ে পরিবেশে বসে নাস্তিকের চোখ নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলাম কার্পেটে চোখ রেখে। নেই কোনো সন্দেহ উধাও হয়ে গেছে আমার স্মৃতিপট থেকে পঁয়তাল্লিশটা দিন।

আর ঐ সময়টুকুর মধ্যে বিশ্বাস করলে, রিককার কথা বিশ্বাস করলে, তিন তিনটে খুন আমার হাতে হয়েছে। একটি নারী আর দুটো পুরুষ। হয়তো সত্যি নয় রিককার কথা কিন্তু ওই দিন গুলিতে কি ঘটেছে তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রকৃতিস্থ অবস্থায়–একটা খতিয়ান মিলবে ভাগ্য প্রসন্ন হলে। মাথায় চোট পেয়ে ছিলাম বেন্টলে থেকে ছিটকে পড়ে। সেই মুহূর্ত থেকে আমার মন থেমে ছিলো হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পাওয়া পর্যন্ত।

হাতে নাড়াচাড়া করছি কাগজটা, হয়তো রহস্য লুকিয়ে আছে আমার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো এই সুটকেসের মধ্যেই। আমার নাম লেখা রসিদে, সুতরাং স্যুটকেসও আমার। কিন্তু আমার তো জানা নেই কোথায় এয়ার লাইনের অফিস। অথচ আজ এখনই আমার চাই স্যুটকেসটা আমি স্থির হতে পারছি না ওটা না পাওয়া পর্যন্ত, আমার স্বস্তি নেই। হাত বাড়ালাম বেলটার দিকে। ওপরে পাঠিয়ে দিতে বললাম ম্যাডক্সকে। সিগারেট চাই আমার, নির্দেশ দিলাম টাকমাথাকে। রিসিভার নামিয়ে দিলাম টেকো বিড়বিড় করে কথা শুরু করতেই। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো ম্যাডক্স মিনিট, দুয়েকের মধ্যে। হাঁপাচ্ছে, স্যার মত পালটেছেন–চকচক করছে তার চোখদুটো, স্যার আপনার। কি পছন্দ। ওর নাকের সামনে হাত বাড়িয়ে দিলাম।

সিগারেট? উত্তরে বাড়িয়ে দিলো দ্রুতহাতে প্যাকেট বের করে। অল্পবয়সী মেয়ে–হ্যাট খোকা ভুলে যাও এসব একমুখ ধোয়া ছেড়ে দিলাম সিগারেটে আগুন দিয়ে। মেলে ধরলাম ওর চকচকে চোখের ওপর দুটো দশ ডলারের নোট।

রোজগার করতে চাও এগুলো? এবার ছেলেটার চোখদুটো যেন বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। কি করতে হবে বলুন। এগিয়ে দিলাম রসিদ, আনতে হবে এটা–এই–স্যার এখন? যদি চাও টাকাটা। ম্যাডক্স চোখ বুলিয়ে নিলো রসিদটায়। ক্রসবি তো আপনার নাম। ওর চোখে ছোঁয়া লাগলে সন্দেহের। ঢুকিয়ে দিলাম পকেটে নোট দুখানা মুড়ে। ম্যাডক্স জিভ কাটলো, না না স্যার, ও ব্যাপারটা ভুলে যান তাহলে ব্যবস্থা করো ওটা আনার–ম্যাডক্স ছিটকে বেরিয়ে গেলো বন্দুকের গুলির মতো। স্মৃতিরোমান্থনে মগ্ন হলাম অপেক্ষার মুহূর্তগুলোতে। একটা বুইক কনভার্টিবল আমি চালাচ্ছিলাম ৬ই সেপ্টেম্বরের রাতে। জন রিককা গাড়ির মালিক। মিয়ামি থেকে গাড়িটা চলছিলো পঁচাত্তর মাইল দূরত্বের রাস্তায়। একটা মেয়ে ছিলো আমার সঙ্গে বলতে পারবো না সে ডেলা কিনা। ওই লোকটা ব্যাপারটা জানে–য়ে পরিচয় দিলো রিককা বলে।

কিন্তু সম্পূর্ণ এ ব্যাপারে অজ্ঞ রিস্কিন। ঘটেছিলো একটা দুর্ঘটনা–আমি যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম গাড়ির ওপর আপাতদৃষ্টিতে তা বোঝা যাচ্ছে। কারণ খবর নেই কোনো গাড়ির প্রতিপক্ষের। মারা যায় মেয়েটি, পুলিসের লোক আমাকে উদ্ধার করে অচৈতন্য অবস্থায়। ছিলো নাকি একটা বন্দুকের ব্যাপারও।

তাতে নাকি পাওয়া গেছে মেয়েটির আঙুলের ছাপও। রিস্কিনের বিশ্বাস দুর্ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত যে কোনো কারণেই হোক। মুখটামুছে নিলাম হাতের চেটোয়। এটা বের করতে হবে যে মেয়েটা কে এবং বন্দুক কেন ছিল তার হাতে।

কেন গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলাম, সে ব্যাপারটাও বের করতে হবে। আমার নাকি লিঙ্কন বীচের ফ্র্যাঙ্কলিন বুলেভার্ডে ডেরা আছে রিস্কিন বলেছিলো। লিঙ্কন বীচে ডেলা আর তার স্বামী যাচ্ছিলো মনে পড়লো–সঙ্গী করতে চেয়েছিলো আমাকে তাহলে লিঙ্কন বীচে হারানো দিনগুলো কেটেছে এই দেড় মাস সময়ের মধ্যে। শুধু তাই নয়–ওই সময় টুকুর মধ্যে হয়ে গিয়েছিলো আমার একটা পাকা আস্তানাও। দামী স্যুট ছিলো আমার পরনে, মালিকও নাকি হয়েছিলাম দামী বুইক গাড়ির কাজেই মালিকও হয়েছিলাম অনেক টাকার। কিন্তু কি করে তা সম্ভব হলে ওই সময়ের মধ্যে মনে পড়লো রিককার কথা–লোকটা সরবরাহ করেছে অনেক অস্বচ্ছ তথ্য। আমার বাগদত্তা নাকি জিনি বলে একটা মেয়ে। আচ্ছা, তার দেখা পেয়েছিলাম কোথায়? সে এখনই বা কোথায়?

বলেছিলো লোকটা বাইসনার আর ওয়ার্দমকে তুমি মেরেছে কে ওরা?

 কোথায় লুকিয়েছো টাকাটা? টাকা কিসের? তুমি যা খুশি করতে পারো এখান থেকে বেরিয়ে–ভাববে ওই! ও কে? আর কেন ওভাবতে যাবে আমার জন্যে? শূন্য মনে সিগারেট টেনে চললাম কড়িকাঠে চোখ রেখে। শেষ নেই যেন এ প্রশ্নের কিন্তু উত্তর?

উত্তর কে দেবে? বার বার মনে হচ্ছে একটা কথাই এ সমস্ত ছাপিয়ে চলতে পারবো না এক পাও টাকা ছাড়া। হাতে আছে শ খানেক ডলার–বেশী সময় লাগবে না তা ফুরোতে। আর ফুরোলেই ত্যাগ করতে হবে আমাকে মিয়ামির মায়া–মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে হবে। ছেদ পড়লো ভাবনায় পায়ের শব্দে।

উঠে বসলাম টুপিটা মাথায় চাপিয়ে। ম্যাডক্স সশব্দে মাটিতে নামালো একটা বড় চামড়ার স্যুটকেস। স্যার এই নিন, শালা ভারী প্রায় মনখানেক–দেখেনিলাম ভালো করে সুটকেসটা– মনে হোল না এই স্যুটকেসটা কোনদিন দেখেছি। একটা লেবেল সাঁটা হাতলে–লেখা আমার নাম, হাতের লেখা আমারই! চেষ্টা করলাম তালাদুটো খোলার। নাড়ানো গেলোনা। মজবুত তালা, ভারী, সময় লাগবে ভেঙে ফেলতে। স্যার শক্তই মনে হচ্ছে জিনিষটা, ম্যাডক্স আমাকে লক্ষ্য করছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে হ্যাঁ, কিন্তু হারিয়ে তো বসে আছি চাবিটা, তোমাদের আছে– ড্রাইভার? আবার সন্দেহের ছায়া নামলো ওর চোখে, অগ্রাহ্য করে আমি তা লক্ষ্য করলাম। ভাঙ্গ বেন না তালা, একটা যন্ত্র আছে আমার কাছে।

সেটা আনো– আবার ম্যাডক্স ছিটকে বেরোলো। বসে রইলাম একদৃষ্টে তাকিয়ে সুটকেসটার দিকে, মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ভয় আর উত্তেজনায়। এই স্যুটকেসের ডালা তুলে ধরার সঙ্গে কোনো হদিশ কি মিলবে হারানো দিনগুলোর?

আমি কি কিনেছিলাম এটা? চুরির মালনাকি? ম্যাডক্স হুমড়ি খেয়ে পড়লোটকেসটার ওপর। তালা লাফিয়ে উঠলো একটা ধাতব বস্তু ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই।

স্যার, সোজা কাজ–কিন্তু জানতে হয়–বিজ্ঞের ভঙ্গিতে ম্যাডক্স হাত ঝেড়ে নিয়ে বললো। ওর হাতে তুলে দিলাম দুটো দশ ডলারের নোট। আচ্ছা, তাহলে কাল দেখা হবে–আমি ব্যাকুল ওকে তাড়াবার জন্য। ম্যাডক্স সুটকেসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো প্রত্যাশার চোখে, তারপর দ্বিধাভরা গলায় বললে দরজার দিকে সরে গিয়ে, তাহলে দরকার নেই অপর কোনো–যেতে পারি আমি?

হ্যাঁ ম্যাডক্স খিল তুলে দিলাম ও দরজা পেরোতেই। তালা খুলে দিলাম এক ঝটকায় বিছানায় ফিরে গিয়ে–ভাবিনি কি দেখব। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি যা দেখলাম–প্রতি ইঞ্চি জুড়ে টাকা সুটকেসের–হা–হাজার হাজার ডলার–চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে তাকিয়ে থাকতে থাকতে…বিছানায় সাজালাম একে একে বের করে আনকোরা নোটের বান্ডিলগুলো কাঁপা হাতে। সোয়া লাখ ডলার–কেন টাকার জন্য মাথা খুড়ছিলো রিককা সেদিন, এখন বুঝলাম।

ঘুরে উঠলো মাথাটা, ধরে ফেললাম খাটের রেল–আসছে হাঁটু ভেঙে–পড়ে গেলাম মাটিতে। কিন্তু চোখ সরাতে পারলাম না টাকার ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যেও। খুনের মোটিভ। তাহলে কি আমি তিনটে খুন করেছি কোন উদ্দেশ্য নিয়েই?

রিস্কিনের হাতে স্যুটকেস তুলে দিতাম কোন অভিযোগ না থাকলে আমার বিরুদ্ধে। কিন্তু, রিস্কিন তো সোজা হাতকড়া লাগিয়ে দেবে আমার হাতে আমার ঘাড়ে খুনের ব্যাপারটা চাপিয়ে দিয়ে। ওরা আমাকে তো খুঁজে বেড়াচ্ছে সেজন্যেই! জানা দরকার ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত, আর টাকা চাই সেজন্যেও। টাকাআছে আমার, খরচও করবোযখন মনস্থির একবার করা গেল, জলবৎ হয়ে গেলে বাকি ব্যাপারটাও হাত করলাম টাকা দিয়ে ম্যাডঅকে, একশো দিতে হলো ম্যাডক্সকে টেকো সন্তুষ্ট হলো পঞ্চাশ নিয়েই। ওরা পেয়ে গিয়েছিলো আমার পরিচয়–আমার ছবি ছাপা হয়ে গিয়েছিলো খবরের কাগজে। খবরটা হচ্ছে এই লোকটাকে খোঁজা হচ্ছে একটি অজ্ঞাতনামা স্ত্রীলোককে খুনের অপরাধে। হোমিসাইড (নরহত্যা) বিভাগের লেফটেনান্ট বিল রিস্কিনকে জানান কোনো সূত্র দেবার থাকলে বা এর পরিচয় কারো জানা থাকলে।

লিঙ্কন বীচের মাইল পঞ্চাশেক আগে কমিয়ে দিলাম গাড়ির গতি–কোথাও হবে জায়গাটা এখানেই। চোখে পড়লো সামনে একটা টিবি, ঝোঁপও ছায়া ছায়া, থামিয়ে দিলাম গাড়ি। পাঁচের ঘরে ঘড়ির কাটা–ফোঁটার দেরী নেই ভোরের আলো, দিনের আলোয় দিক–বিদিক ভরে যাবে মিনিট কয়েকের মধ্যেই। নিভিয়ে দিলাম হেডলাইট।

নেমে পড়লাম গাড়ি সরিয়ে দিয়ে রাস্তার এক পাশে। বসেরইলাম স্টিয়ারিংয়ে সিগারেট ধরিয়ে, বাড়ছে উত্তেজনা। করতে হবে অপেক্ষা, খুঁটিয়েদেখতে হবে সবদিক দিনের আলোয়। ফুটলো দিনের আলো, ছেড়ে দিলাম গাড়ি, থামালাম বেশ কিছু এগিয়ে। ওপড়ানো গাছ একপাশে চাকার স্পষ্ট দাগ হেঁচড়ানো ঘাসে। তেমনি আছে সবই–মোছেনি ষাট দিনেও। এগিয়ে গেলাম আরো। গাড়ি থামালাম একটা ঝোঁপের আড়ালে, চলবে না কোনো ঝুঁকি নেওয়া। কোনো গাড়ি রাখা মানে বিপদ ডেকে আনা দুর্ঘটনার জায়গায়। ফিরলাম হেঁটে। হাত রেখে পকেটে বন্দুকের গায়। খাড়া রেখেছি চোখ কান। না, আশেপাশে কেউ নেই। জমি পরীক্ষা করলাম আধ ঘন্টা ধরে, চোখে পড়লো না আর কিছুই। বোঝা গেল পুলিস এসেছে, জানতাম নিয়েও গেছে কিছু পেয়ে থাকলে, আমি কিছু পাবো না, কিন্তু মনে পড়ে যাবে এমন কোনো ব্যাপার, যা আমার অর্ধপ্রাপ্ত রহস্যের কিনারা করবে।

ঘেমে উঠলাম–বাড়ছে অস্বস্তি…স্বপ্ন দেখছি কি আমি? নাকি সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে কোনো ভূমিকা ছিলো ওই বিশালাকায়া আর সিংহের? পরে–চিত্র ফুটলো একটা পরিষ্কার অনেক পরে…একটা ছোট্ট বাড়ি সৈকতে, সাজানো আরাম কেদারা বারান্দায়…বসে আছি কান পেতে রেডিওর কাছে। শুনতে পাচ্ছি বাজনার রেশ–সমঝদার না হয়েও বলতে পারি রাগাশ্রয়ী বাজনার এটা বিঠোফেনের ঐক্যতান বাদন এক তন্বীকে দেখেছি পীতাস সাঁতার পোষাকে এগিয়ে আসছে ঘরের ভেতর থেকে বন্ধ করতে বলছে রেডিও….সে বর্জন করতে রাজি সাঁতার পোষাক বাজনা থামালে…তার আকর্ষণ কি কম বাজনার চেয়ে? না…। সে একটা চড় কষালো আমার গালে আমার নেতিবাচক উত্তরে। একই ছবি বারবার কিন্তু অর্থহীন। একটা সেগারেট ধরালাম ছিন্নমূল গাছের ওপর বসে–মনে করবার চেষ্টা করছি সমস্ত ব্যাপারটা যদিও ঝোঁপের পরিবেশে চোখ নিবদ্ধ। একটা গাড়ি ছুটে এসেছিলো উল্টোদিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে কানে বাজছে মেয়েটার আর্তনাদ ও আমাদের গাড়ির ওপর ভেঙ্গে পড়ার শব্দের সঙ্গে…

মনে পড়ছে ড্যাশবোর্ডটা আঁকড়ে ধরেছিলাম বেন্টলে উল্টে যাবার মুহূর্তে। ফেলেছিলাম চোখ বুজে..আলোর ঝলকানি একটা চোখ ধাঁধানো…অন্ধকার তারপর…একটা ছবিও ভেসে উঠলো ছোট্ট কুটিরের…কুটিরটা সৈকতের মুখোমুখি। স্পষ্ট হয়ে উঠলো এবার…ভাঙা শার্সি সামনে টিনের ছাদ। একটা ফাটল সদর দরজাতে–আগে ছিলো না তো এটা।

এটা তাহলে দুর্ঘটনার পর হয়েছে, তাই–ই। লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আবিষ্কারে উল্লসিত হয়ে। দেখতে লাগলাম চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে। সৈকতমুখী পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে পামবনের ভিতর দিকে। সে পথে চালিয়ে দিলাম দ্রুতপায়ে–যেন চেনা পথ। আমি এ পথে হেঁটেছি এর আগে। সামনে সাগর বালিয়াড়ি ঝোঁপ থেকে। চোখ বোলালাম দুপাশে, কোথাও নেই কুটিরের চিহ্ন। মন পাল্টালাম হাঁটতে শুরু করে ডানদিকের রাস্তা ধরে ঘুরলাম বাঁ দিকে। নিজের ঘরে অন্ধের মতো যেন আমার অবস্থা। হয়ে চলেছি স্বভাব–প্রবৃত্তিতাড়িত–সেখানে পৌঁছবোই জানি। কুটিরটা চোখে পড়লো বালিয়াড়ি ধরে মিনিট দশেক হাঁটতেই–যে ছবি এঁকেছি মনের মনিকোটরে সবই মিলছে–ফাটল ধরা শার্সি, টিনের ছাদ, ঠিক তেমনি। বর্ষীয়ান এক পুরুষ ধূমপানরত কুটিরের দরজায়।

বেশভূষা মলিন, তার দৃষ্টি আমার দিকেই। সে চমকিত হলো ভালো করে আমাকে নজর করে, সতর্কও একটু। সুপ্রভাত, জায়গা বড় নির্জন–আপনাদের এদিকটা, তাই না? বলে বসলাম কাছাকাছিহতে। মানুষটা তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ রেখাবহুল মুখে। আসছেন কোথা থেকে? গাড়ি চালিয়ে এলাম সারারাত–একটু বিশ্রাম নিতে চাই হাত পা ছড়িয়ে পাওয়া যাবে কফি, মানে–পয়সা দিয়ে?

করেছি খানিক আগেই–পাবেন। আনছি–আপনি বসুন। বসে পড়লাম কাঠের প্যাকিং বাক্সে, দেখেছি একে আগে। খানিক পরে লোকটা বেরিয়ে এলো ধূমায়িত দু বাটি কফি নিয়ে। অনুভব করলাম কফির বাটিতে চুমুক দিতে দিতে। ও আমার দিকে তাকিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে। মজার ব্যাপার এর আগে দেখেছি আপনাকে? লোকটা বললো মৃদুস্বরে।

দেখেছো আমার ভাইকে–মিথ্যে কথা বললাম কথা বের করবার জন্যে। মনে পড়ছে, কাছেই একটা গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটেছিলো ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে? ও চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত, না, না কিছুই জানি না ওসবেরও বলছে মিথ্যে কথা। আহত হয়েছিলো আমার ভাই–সে হারিয়ে ফেলেছে স্মরণশক্তি। আসলে বুঝতে পারছি না কি ঘটেছিলো।

জানা যায় কিনা কিছু বললাম ওর চোখে চোখ রেখে। আমি জানি না কিছু বলছি তো ঐ ব্যাপারে, বললো কথাগুলো কেটে কেটে। শেষ হয়েছে আপনার খাওয়া?

বেরোতে হবে আমাকে। কয়েকটা নোট বের করলাম পকেট হাতড়ে ছড়িয়ে দিলাম হাঁটুর ওপর গুনে গুনে একশোটা ডলার–তাসের কায়দায়।

তাহলে নষ্ট করবো না তোমার সময়–তাই বলছিলাম তবে আমি খবর সংগ্রহ করবো না শুধু হাতে।

আমাকে বারণ করেছিলো মুখ খুলতে ওই মেয়েটা লোকটার চোখদুটো জ্বলে উঠলো প্রাপ্তির আশায়। তবে আপনার ভাই বলছেন যখন আপনি। টাকাটা বাড়িয়ে দিলাম হাতে।

 আমার হাত কাঁপছে। বাড়ছে হৃৎস্পন্দন। ব্যাপারটা কি হয়েছিলো ভাই? এসেছিলো আপনার ভাই আর ওই মহিলা। ও বললো মাথায় নাকি চোট পেয়েছে আপনার ভাই, আর চুরি গেছেনাকি গাড়িটাও।

মিথ্যে কথা বলছে পরে বুঝলাম, কারণ জানলাম, হয়েছিলো একটা অ্যাকসিডেন্ট এবং ধরে যায় গাড়িতে আগুন। গাড়িতে পাওয়া যায় একটা লোকের মৃতদেহও। আচ্ছা আচ্ছা তা চেহারা কেমন ওই মেয়েটির? ময়লারটা, তবে জেন্না আছে চেহারায়, খাণ্ডারনি মেয়ে, দাদা–লোকটা হেসে উঠলো, মনেহয় যাদের দেখে প্রথম দর্শনেই–আছে মালকড়ি–ডেলা! ভাই বলে যাও। মনেহলো অবস্থা বেশ খারাপই আপনার ভাইটির–সে অভিনয় করছে পরে বুঝলাম। আর চেষ্টা করছে ধোকা দেবার আমাকে মেয়েটাও পরিষ্কার করে নিলো গলা একটু কেশে, মেয়েটা একজনকে ডাকতে বললো আমাকে একটা ফোননম্বর দিয়ে। প্রায় আধমাইল দূর হবে এখান থেকে ফোনের বুথা। লোকটাকে ডাকলাম নম্বর ধরে, বললো সে আসছে।

কি মনে হলো ফিরে জানলায় উঁকি দিলাম দরজায় না গিয়ে কথা বলছে মেয়েটার সঙ্গে তোমার ভাই। ঘরে ঢুকলাম ঘুরে গিয়ে পড়ে আছে লোকটা চোখ বুজে–অজ্ঞান।

বললাম না কোনোকথা, কারণ আবার জট পাকিয়ে গেছে সবকিছুই। বেরিয়ে গেলো আচমকা মুখ দিয়ে, তোমার মনে আছে নম্বরটা? হ্যাঁ আছে। নম্বরটা ভুলিনি মনে রাখা সহজ বলেই–লিন বীচ ৪৪৪৪। মনে পড়ে কাকে ডেকেছিলো?

হ্যাঁ, নিক রাইসনার। মনে হচ্ছে নামটা তাই বলেই যেন শিরদাঁড়া বেয়ে মাকড়সার পা উঠলো। আচ্ছা, কি বলেছিলো মহিলাটি? লোকটা চুলকে নিলো মাথাটা রিককা কে এক –অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে নাকি তার–ওদের যেন নিয়ে যায় রাইসনার এসে। তুমি দেখেছিলে রাইসনারকে? না, শুয়ে পড়েছিলাম আমি। প্রশ্ন করলাম আরো অনেক, কিন্তু জানা গেলো না আর এমন কিছু যা লাগবে আমার কাজে।

লিনবীচের চৌরঙ্গীসুটকেসটা ঢুকিয়ে দিয়ে গাড়ির পেছনে গাড়ি চালিয়ে দিলামরুজভেল্ট বুলেভার্ডের দিকে। ভীড় শুরু হয়ে গেছে মানুষের, রাস্তার দুপাশে–পরনে সাঁতারের পোষাক অধিকাংশরই। প্রায় বিবস্ত্র মেয়েদের দু–একজন, কিন্তু উদাসীন।

গাড়ি ভিড়িয়ে দিয়ে নেমে পড়লাম। একটা বড় প্যাকার্ড গাড়ির পেছনে। ৪৪৪৪নম্বর চাইলাম টেলিফোন বুথে ঢুকে। একটা মেয়ের গলা পাওয়া গেল কিছুক্ষণ বেজে চলার পর। নমস্কার, বলছি লিঙ্কন বীচ ক্যাসিনো থেকে করতে পারি কি সাহায্য?

দিন নিক রাইসনারকে–কথাগুলো ছেড়ে দিলাম, বিকৃত গলায়। কি বললেন নামটা? নিক রাইসনার। আবার গলা পেলাম সামান্য নিস্তব্ধতার পর। উনি তো এখন নেই আমাদের সঙ্গে, কে বলছেন আপনি? শুকনো ঠোঁট বোলালাম শুকনো জিভ দিয়ে। বন্ধু বলছি আমি তার এই শহরে সবে এসেছি। আচ্ছা, ওকে পেতে পারি কোথায়? তাৎক্ষণিক উত্তর এলো বিব্রত গলায়, দুঃখিত। পাবেন না তো ওকে মারা গেছেন উনি। মারা গেছেন, বিস্ময় আনলাম গলায়। জানতাম নাতো কবে? তিরিশে জুলাই। সৈকত থেকে নিয়ে আসার পরের দিন। আমার হাড়ে কাপুনি লাগলো আবার। হয়েছিলো কি? প্রস্তুত ছিলাম না তারজন্য। এবার মেয়েটা যা বললো।

লাইনটা ধরুন তো একটু —

ছাড়বেন না–আরে শুনুন। বসে গেছে আমার গলা। সাড়া নেই আর অনেকক্ষণ। শুরু করলাম ঘামতে। শব্দ হলো একটা খুট করে। কে বলছেন কথা? গলা ভারী–রিককা! রইলাম চুপ করে, কানে নিয়ে রিসিভার। ওঠা–নামা করছে ওর ভারী নিঃশ্বাস।

আমার শীতল স্রোত নামানো মেরুদণ্ড বেয়ে। কে, জনি নাকি? ওর গলা পেলাম আবার। নিরুত্তর আমি। নামাতে পারছি না রিসিভার। সম্মোহিত হয়ে পড়েছি ওর নিঃশ্বাস আর ভারী গলায়।

হুঙ্কার দিয়ে উঠলো একটা কর্কশ গলা পরমুহূর্তে। অপারেটর–শীগগির, আমাকে জানান কলটা কোথাকার।

.