৯. তবুও সংশয়

০৯.

তবুও সংশয়

মিয়ামির অফিস থেকে চিঠি এলো। আমি ওখানে একটা চাকরি পেয়েছি। মাইনেটা যদিও ভালো নয় তবুও ঠিক করলাম আমি চাকরিটা নেবো।

বাড়ি ফিরে আমি ম্যাকলিনকে ফোন করে বললাম, গিভার ঠিকানাটা দিতে। ম্যাকলিনের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে কয়েকঘন্টা আগে ও নিউইয়র্ক চলে গেছে। কোনো ঠিকানা দিয়ে যায়নি তবে কোন চিঠি দিলে ম্যাকলিন পাঠিয়ে দেবে। 

মনের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগল, আমাকে কিছু না বলেই সে চলে গেল! বোধহয় খবরের কাগজের লোকেদের এড়াতে চায়, আমার খবর পেলে নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবে।

বাড়ি ফিরে আমি ওকে চিঠি লিখলাম। আমি লিখলাম যে আমি মিয়ামিতে যাচ্ছি। আমার ওখানকার ঠিকানা দিলাম। নতুন কাজটার কথাও লিখলাম। আমি চাই যে ও আমার কাছে আসুক, দুজনে নতুন জীবন শুরু করবো। আমি লিখলাম যে, আমার আশা আছে যখন আমি ডেলানির মৃত্যুর জন্য আর দায়ীনই এখন ও নিশ্চয় আমাকে আবার ভালোবাসতে পারবে। মিয়ামিতে উত্তর দিতে বলে চিঠি শেষ করলাম।

মিয়ামিতে চটপট গুছিয়ে বসলাম আমি, দুঘরওয়ালা একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি, পরিশ্রম হচ্ছে খুব। কিন্তু জীবনে কোনো আনন্দ নেই কারণ গিল্ডার কোনো চিঠি পাইনি।

যতবার পিওন আসতো, ওর চিঠি আসছে মনে করে দৌড়ে যেতাম, কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরতে হতো।

তিনমাস পরে আমি বুঝতে পারলাম যে আমি ওকে হারিয়েছি। সেই মুহূর্তে আমি যা করেছি তার জন্য আমার সত্যিকারের দুঃখ হলো। আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম, যাকে ভালবাসি তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা বড় কষ্টদায়ক।

বছরখানেক পর ধীরে ধীরে সেই যন্ত্রণাটা কমে এলো। আমার অফিসে উন্নতি হয়েছে।

পনেরো মাস পরে আমার ওপরওয়ালা আমাকে ডেকে বললেন, নিউইয়র্কে একটা ব্রাঞ্চ খোলার দায়িত্ব আমি নিতে পারবো কি না। আমি রাজী হয়ে গেলাম। এ সুযোগ আমি ছাড়লাম না। মাসের শেষে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিউইয়র্কের প্লেনে উঠলাম।

গিল্ডার কথা বারে বারে মনে হচ্ছে। এতোদিনে আমি গিল্ডার কাছাকাছি এসেছি। ওর সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে আমি ওকে আবার বিয়ে করার কথা বলে দেখবো।

এক খরিদ্দার আমার কাছ থেকে প্রায়ই এল. পি. রেকর্ড কিনতেন। একদিন একটা রেডিওগ্রাম তৈরী করাতে চাইলেন তিনি। লোকটির নাম হেনরি ফুলার। সত্তরের মতো বয়স হবে। খুব বড়লোক।

আমি বললাম, আমি সবচেয়ে ভালোটাই বানিয়ে দিতে পারি। তবে ঘরটা দেখলে আমার সুবিধা হবে, কি ধরনের অ্যাকাউন্টস দরকার তা বোঝা যাবে।

তাই আসুন, আজ বিকেলে আসতে পারেন, আমি থাকবো না, আমার স্ত্রীকে বলে রাখবো।

ব্যয়বহুল কিছু তৈরী করার আগে আমাদের নিয়ম, খরিদ্দার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া, খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে, ফুলারের চল্লিশ লক্ষ ডলার আছে। বিরাট বাড়ি। তিনবার বিয়ে করেছেন। তৃতীয় বিয়েটা মাত্ৰ ছমাস আগে। বাড়িটার ছাদের ওপর সুন্দর বাগান আছে, ওখান থেকে শহরটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়।

ফুলারের বাড়িতে দেখলাম যে সর্বত্র অর্থের বিলাসিতা ছড়ান।

গিল্ডা এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। আমাকে দেখেই সে চমকে উঠলো। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে, কব্জিতে মোটা সোনার চুড়ি তাতে দামী পাথর। কোথাও কোনো ত্রুটি নেই।

এখানে কি চাই তোমার?

 গিল্ডা। আমি সর্বত্র তোমাকে খুঁজেছি। তুমি চিঠি দাওনি কেন? আমি অপেক্ষা করে ছিলাম…

ওর চোখে অবহেলা দেখে থেমে গেলাম।

কি চাই এখানে? গিল্ডা জানতে চাইলো।

আমি রেডিওগ্রামের ব্যাপারে এসেছি। কিন্তু তুমি এখানে? তুমি কি ওঁর সেক্রেটারি নাকি?

না, আমি ওঁর স্ত্রী।

তুমি ফুলারের স্ত্রী? ওই বৃদ্ধকে বিয়ে করেছে তুমি। আমি বিশ্বাস করি না।

আমি এখন মিসেস হেনরি ফুলার, তুমি এখন আমার কাছে কেউ নও। দয়া করে কথাটা মনে রেখো। ও আরও বললো যে, যদি ভেবে থাকো যে আমায় ব্ল্যাকমেল করবে তবে ভুল করছে। সেরকম চেষ্ঠা করতে যেও না। তোমার জন্য আমাকে আসামী হতে হয়েছিল, এ জন্য কোনদিন তোমাকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না। এখন বেরিয়ে যাও।

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বুকের মধ্যে যন্ত্রণা হতে থাকলো। কিন্তু তোমার স্বামী আমায় ডেকেছিলেন রেডিওগ্রাম তৈরী করার জন্য। আমি বললাম।

সে আমি তাকে বুঝিয়ে বলবো। এখন বেরোও। কথও আসবে না এখানে।

আচ্ছা, আমি আর আসবো না। তোমাকে সুখী দেখে আমি খুশী হয়েছি। আর দেরী না করে আমি লিফটে নেমে এলাম। কিছু ভাবতে পারছি না আয়।

তিন সপ্তাহ বাদে আমি কাগজে ফুলারের মৃত্যুসংবাদ পড়লাম। ছাদের বাগান থেকে পড়ে ওঁর ঘাড় ভেঙে গিয়েছিল।

.

আমার ভেতরে কি যেন মনে হতে লাগলো, তদন্তের সময় আমি গেলাম। আদালত লোকে ভর্তি। বসতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম ম্যাডক্স এসেছে।

একটু পরেই দেখা গেল গিল্ডা জর্জ ম্যাকলিনের সঙ্গে এসে ঢুকেছে। কালো পোষাকে ওকে ভালোই লাগছিল। একটু বিবর্ণ, হাতে একটা রুমাল।

সাক্ষ্য থেকে জানা গেল ফুলারের বাড়িতে একটা পার্টি ছিল। অতিথিরা সকলেই বিরাট ধনী। ফুলার সারাক্ষণই হুইস্কি আর শ্যাম্পেন খেয়েছেন, পা টলছিল তার। খুব গরম পড়েছিল, সবাই ডিনার সেরে ছাদের বাগানে গিয়েছিল।

ওখান থেকে গোটা ত্রিশেক ধাপ নেমেই একটা টেরেস। সবাই ওখানে গিয়ে শহরের আলো দেখছিলো। ফুলার আর গিল্ডা ওপরের ধাপেই দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎফুলার পড়ে যান, গিল্ডা ধরার চেষ্টা করেছিল, পারে নি।

সবাই দৌড়ে এসে দেখতে পেয়েছিল ফুলার মারা গিয়েছেন।

ম্যাডক্স আমার পাশেই বসেছিলো, আমার কানে কানে বললো, ঐ ধাক্কাটার দাম চল্লিশ লক্ষ ডলার। ফুলারের মত বৃদ্ধ মাতাল ওর কাছে তো খেলনা একটা।

ব্যাপারটা নিয়ে গোলমাল হবার কিছু ছিল না। প্রত্যেকেই দুর্ঘটনাটা দেখেছে। ফুলার যে মাতাল ছিলেন এটার ওপর কোনো জোর দিলেন না করোনার। উনি বললেন, ফুলারের বোধহয় মাথা ঘুরে গিয়েছিল। টাল সামলাতে পারেন নি। গিল্ডার জন্য উনি সমবেদনা জানালেন। প্রত্যেকে দুঃখ প্রকাশ করে বেরিয়ে গেল।

গিল্ডা প্রথমেই বের হলো, ওর চোখে রুমাল চাপা ছিল। আমাকে ও দেখতে পায়নি। ম্যাকলিন একটু ইতস্ততঃ করে ওর হাতটা ধরলো।

ম্যাডক্স বললো, খুন করে পালানো যায় কে বললো? যাই হোক, কোন টাকা বের করে নিতে পারেনি, অন্তত আমার কাছ থেকে। বুড়োটার অবশ্য ইনসিওর ছিল না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা ট্যাক্সি ধরলো ম্যাডক্স।

আমি রাস্তায় নেমে দেখতে পেলাম নীল ক্যাডিলাকটায় উঠে গিল্ডা আর ম্যাকলিন চলে যাচ্ছে। গিল্ডা ম্যাকলিনের দিকেই উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে।

দোকানে ফিরে যেতে যেতে আমার কেন জানিনা হঠাৎ ডেলানির কয়েকটা কথা মনে পড়লো, যে কথা উনি অনেকদিন আগেই আমায় বলেছিলেন : আপনি জানেন আমার স্ত্রী কি চায়? সে টাকার জন্য পাগল, টাকা ছাড়া সে আর কিছুই ভাবতে পারে না।

আমি রাস্তার দিকে এক মনে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

 ও-ই কি ডেলানিকে বিষ দিয়েছিল? ও-ই কি ফুলারকে সিঁড়ির নিচে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল? ম্যাডক্স কি ঠিক বলছে?

আমার মনে পড়ে গেলো ওর সুন্দর ফরগেট-মি-নট চোখ দুটো, মনে পড়ে গেল আমার হাতের মধ্যে ওর নরম শরীরটার কথা।

না, আর ভাবতে পারছি না আমি। ও এরকম করতে পারে না, –এ হতে পারে না।

আমি ওকে ভালোবাসি। যাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবাসবো জীবনে কোনদিন যাকে ভুলতে পারবোনা, তার সম্বন্ধে এ ধরনের কথা বিশ্বাস করা যায় না যা আমার পক্ষে খুবই কষ্টদায়ক হবে না।