১২. মেয়েটাকে ধর

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

০১.

মেয়েটাকে ধর।–একজন লোক উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু ততক্ষণে অ্যান কামরার দরজা খুলে ঘাসে ভরা জমির উপর লাফিয়ে পড়েছে। নীচে উপত্যকার অপ্রশস্ত নদীর পাড় ঘুরে সে রেল চলাচলের সেতুর দিকে দৌড়তে শুরু করল। সেতুর কাছাকাছি পৌঁছতেই করিডন লাফিয়ে পড়ল। গর্জে উঠল রলিন্সের রিভলভার; কিন্তু নিশানা ঠিক হলো না।

অ্যান আরো দুজন গোয়েন্দাকে দেখতে পেল। একজন রক্তে ভেজা রুমাল নিজের নাকে চেপে ধরে প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে বেরিয়ে এসে রলিন্সের কাছে দাঁড়াল।

তিনজন গোয়েন্দানদীতে ঝাঁপিয়ে পড়াকরিডনের দিকে তাকিয়ে রইল। জলে ডুবতে কিছুক্ষণ সময় নিল সে। এভাবে জলে ঝাঁপ দিতে রলিন্সের সাহসে কুলোত না।

তিনটে লোক এমনভাবে করিডনকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল যে, তাদের কয়েক গজ দুরে সেতুর পাশের প্রাচীরের উপর অ্যান যে উঠে দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করেনি।

করিডন জল থেকে মাথা তুলে প্রাচীরের উপরে নড়ানো অ্যানকে দেখতে পেল। তারপর লক্ষ্য করল জলের দিকে মেয়েটা বুলেটের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জলে পড়ে অ্যানকে ডুবে যেতে দেখল সে। অ্যান মাথা তুলতেই তার দিকে করিডন এগিয়ে গেল।

তুমি একটা বোকা। করিডন চেঁচিয়ে বলল, তোমার ঘাড় ভেঙ্গে যেতে পারত। তোমারও ভাঙ্গতে পারত। অ্যান চোখ থেকে জল সরিয়ে বলল, কিন্তু আমাদের ঘাড় ভাঙেনি

না, ঠিক আছে।

অবশ্যই–অ্যান সাঁতার কাটতে কাটতে বলল, নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে ঠিক সময়ে ট্রেন থামিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, স্বীকার করছি। কিন্তু একাজ কেন করলে বলতো? তোমায় সাবধান করেছিলাম নিজেকে আমার সঙ্গে না জড়াতে। এখন তুমি নিজেকেও ঝামেলায় জড়িয়ে ফেললে।

হেসে অ্যান বলল, ওখানে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়াই ঠিক হয়েছে।

স্রোতে শরীর ভাসিয়ে নদীর কিনারায় পৌঁছে তারা পাড়ে উঠে পড়ল। ঘাসের উপর বসে পড়ে আন হাঁপাতে লাগল।

আমরা কোথায় যাব বলতে পার?

করিডন দূরের পাহাড়টা দেখিয়ে বলল, ওই দিকে আমাদের যেতে হবে। দুনবারে পৌঁছবার পথ নাতিদীর্ঘ। পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। অনেক দূর পর্যন্ত কোন বাড়িঘর আছে বলে মনে হয় না।

পাহাড়ের ওপাশে থাকতে পারে। অ্যান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভীষণ বিশ্রী লাগছে। এই ভিজে পোশাকেই কি দুনবারের দিকে হাঁটব?

করিডন হাসল। সে বলল, ইচ্ছে হলে খুলে ফেলতে পার, আমার আপত্তি নেই। লুকোনোর মত সময় আমাদের হাতে নেই।

.

০২.

 এক সময় তারা হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পড়ল।

 তোমার কথা ভেবে খারাপ লাগছে।–করিডন হাঁটতে হাঁটতে বলল। চেয়েছিলাম তুমি যেন নিজেকে আমার সঙ্গে জড়িয়ে না ফেল।

হাসিও না। অ্যান হেসে বলল, নিজের ভালমন্দ নিজে দেখতে পারি।

এ তোমার কথা। করিডন বলল, তবে পুলিশ যদি রীটা অ্যালেনের মৃত্যুর ব্যাপারে আমাকে অপরাধী ভাবে তুমি ঝামেলায় পড়বে।

এ নিয়ে আমি ভাবছি না। তুমি ভাববে কেন? তুমি তো ভালভাবেই জান তোমাকে আমার ভাল লাগছে।

তাই নাকি?–চকিত কটাক্ষে তার দিকে তাকাল।

আমি তোমার মতনই। আমার সব চিন্তা জুড়ে তুমি আছ। আমার মত একজন সাধারণ মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছ তুমি, কি বল?

এক সময়ে মেয়েদের আমি খুব সস্তা ভাবতাম। প্রয়োজন মিটে গেলেই বাতিল করতাম। কিন্তু যুদ্ধের সময় এ অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে। অনেক মাস আমিনারীর প্রতি আসক্ত হইনি।তুমি আমার মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করলে তাই ভাল বোধ হচ্ছে না।

অ্যান কি বলবে ঠিক করতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর করিডন প্রশ্ন করল, তুমি কি কাউকে কথা দিয়েছ?

দিয়েছি। হাসল অ্যান, সে, নেভিতে আছে। মাসে একবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়।

তাহলে তো আর কথা বাড়ান ঠিক নয়।

তাই নাকি? আমরা পরস্পরকে পছন্দ করি এই আর কি?

করে যাও পছন্দ। জীবনে এসব ব্যাপার বড় ঝামেলার সৃষ্টি করে।

কি ঝামেলা সৃষ্টি করে?

অ্যানের দিকে করিডন তাকাল। সে বলল, দেখ, তোমাকে আমার ভাল লাগে। যখন কাউকে ভাল লাগে, তাকে আঘাত দেওয়া যায় না। এসব ব্যাপারে আমি অনুভূতিপ্রবণ। আমাকে উপর থেকে দেখে তোমার মনে হবে না বটে তবে আমি এই রকমই। এটা আমার চরিত্রদোষ বলতে পার।

আমাকে আঘাত দিতে চাও কেন?

তোমার দাদার পিছনে লেগে আছিবলে বলছি। ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইছি। কিন্তু এখন ভাবছি কি করব।

ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তুমি পণ্ডশ্রম করছ।

 কি বলতে চাইছ?

তোমাকে আগেই বলেছি ব্রায়ান রীটা অ্যালেনকে খুন করেনি বা গোর্ভিলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। ব্রায়ানকে আমি চিনি।

যদি তোমার ভাই না করে থাকে তাহলে কে করেছে?

আমি জানি এমন ভান করব না। তবে জানি ব্রায়ান এ কাজ করেনি। তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি না যে ও বেঁচে আছে, তবে বিশ্বাস করতে চাই। তুমি যখন প্রথম বললে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। ব্রায়ান আমার কাছে কতখানি তুমি বুঝবে না। তবে জানি ও বেঁচে নেই। একরাতে স্বপ্ন দেখলাম ও মারা গেছে-ঘুম ভেঙে গেল। চার মাস পরে মিলিটারী থেকে ওর মৃত্যুর খবর এল। এত দেরীতে সেই মৃত্যু-খবর এসেছিল যে আমার মনে কোন আঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি।

করিডন তার কাধ চাপড়ে বলল, এসব ভুলে যাও। এস হাঁটি। আমরা অযথা সময় নষ্ট করছি।

কিছুক্ষণ পরে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করতেই এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। অ্যান প্রথম ইঞ্জিনের শব্দ শুনে উপর দিকে তাকাল। দেখল একটা হেলিকপ্টার মাথার উপর উড়ছে, তাদের দিকেই আসছে।

শুয়ে পড়।–করিডন চিৎকার করে উঠল। অ্যান তার আগেই লম্বা ঘাসের মধ্যে শুয়ে পড়েছে। এখন সে তার পাশে শুয়ে পড়ল।

আমাদের ঠিক দেখে ফেলেছে।–করিডন বলল, চল, আমরা কোন রকমে বনের দিকে যাই, ওটাই একমাত্র যাবার পথ।

তারা উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় আধমাইল তফাতে মাথা তুলে দাঁড়ানো বনভূমির দিকে ছুটতে লাগল। হেলিকপ্টার তাদের মাথার উপর দিয়ে শকুনের মত উড়ে গেল।

তারা আধাআধি পথ গিয়ে পিছন থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ চিৎকার শুনতে পেল। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল কতকগুলো লোক তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে।

এস দৌড়ই, আমরা এভাবে খোলা আকাশের নীচে ধরা পড়তে চাই না।

 আমরা ধরা পড়বই।–অ্যান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

 দুজনের মোকাবিলা আমি করছি। যত দ্রুত গতিতে পার দৌড়তে থাক।

অ্যান বনের মধ্যে ঢুকে গেল। করিডন পিছনের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আড়চোখে তাকাল। দুটি সবল আর স্বাস্থ্যবান যুবক তাদের দিকে ছুটে আসছে। হঠাৎ করিড়ন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। এখন ছুটে আসা লোকদুটি আর মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে।

এই দাঁড়াও বলছি।–একজন চিৎকার করে নিজের গতি বাড়াল।

বনভূমি সামনে। অ্যানকে আর দেখা যাচ্ছে না। করিডন সহসা উঠে দাঁড়াল। লোকদুটি একেবারে কাছে এসে পড়েছে।করিডন চায় না লোকদুটি তার পিছন পিছন বনের মধ্যে ঢুকে পড়ুক। পিছনের বাকী লোকগুলো এখনো প্রায় আধমাইল দূরে আছে।

করিডন সহসা উঠে দাঁড়াল। লোকদুটি একেবারে কাছে এসে পড়েছে। সে একজনের কাঁধের পিছনে আঘাত করল। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে আর উঠল না।

দ্বিতীয়জন তার গলা টিপে রইল। সে লোকটার মুখে সজোরে এক ঘুষি মারল। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল। তারপর সে বনের মধ্যে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল। অ্যান তার একখানা হাত ধরল। দুজনে বনভূমির আরো ভেতরে ঢুকে পড়ল। অনুসরণকারীদের পায়ের শব্দ তারা শুনতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আর শোনা গেল না।

করিডন থামল। হাঁপাতে হাঁপাতে জামার হাতায় মুখ মুছে বলল, ঠিক এই রকমই চেয়েছিলাম।

এখন কি করবে? অ্যান জানতে চাইল। এত অন্ধকারে আমাদের অনুসরণ করতে পারবে না। ওরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আমাদের ভাগ্য ভাল ইতিমধ্যে আমরা কয়েক মাইল এগিয়ে যেতে পারব।

এখন হাঁটব?

বেশী জোরে হাঁটার প্রয়োজন নেই। এই রাস্তাটা ধরেই হাঁটতে থাকব। কোথাও না কোথাও ঠিক পৌঁছব।

একাদিক্রমে আধঘণ্টা হাঁটার পর তারা বনপ্রান্তে এসে পৌঁছল। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা দূরে একটা গ্রামের আলো দেখতে পেল।

ওই জায়গাটার নাম কি কে জানে।করিডন হাত তুলে গ্রামটা দেখিয়ে বলল, জানি না। এটা আমাদের রুটে পড়ছে না।

পড়া উচিৎ। কিন্তু আর এক পা এগোবার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। খুব খিদে পেয়েছে।

তারা ঘাসের উপর পাশাপাশি বসল। অ্যান খাবারের প্যাকেট খুলে সামনে রাখল। তারপর চুপচাপ খেতে লাগল। আপন আপন চিন্তায় দুজনে বিভোর হয়ে রইল। বিষণ্ণ দেখাচ্ছে করিডনকে।

অ্যান বলল, আবার চিন্তা করতে আরম্ভ করলে?

সব সময়েই চিন্তা করছি। করিডন হাসল, এই আলোচনা করতে আর ইচ্ছা করছে না।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হল।

নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একসময় অ্যান বলল, এদিকে একটা গাড়ি যাচ্ছে। নিশ্চয়ই রাস্তা আছে।

একটা গাড়ি গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছে। করিডন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। অ্যান, এস আমরা নীচে নামি। একটা লিফট পেতে পারি।

পুলিশও তো হতে পারে। ঝুঁকি নেওয়া কি এতই জরুরী?

আমরা তড়িঘড়ি করব না। শুধু যাচাই করে দেখতে চাই। এস।

তারা নামতে লাগল খাড়াই পথে। একজায়গায় মোটর গাড়িটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খারাপ হয়ে গেছে।–একসাথে নামতে নামতে করিডন বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি কথা বলে আসি। সজাগ থেক যাতে কোন ঝামেলা না হয়।

করিডন গাড়ির কাছে এল অ্যানকে ছেড়ে। ভাল করে দেখল ড্রাইভার একা। সাহায্য করতে পারি? করিডন উচ্চকণ্ঠে বলল, গাড়ির সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে।

ড্রাইভার চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে করিডনের উপর টর্চের আলো ফেলল।

সন্দেহ তুমি পারবে কিনা-লোকটি বলল, তবে যদি তুমি আমার চেয়ে ভাল মেকানিক হও তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।

এস দেখা যাক। গাড়ির ইঞ্জিনের উপর ঝুঁকে পড়ে করিডন বলল, রোগটা কি?

 বিশ্রী শব্দ করে থেমে যাচ্ছে।

পেট্রোল আছে তো?

ট্যাঙ্ক ভর্তি আছে।

সম্ভবতঃ কার্বোরেটর গোলমাল করছে। যন্ত্রপাতি কিছু আছে?

ঠিক করে দিলে খুব খুশী হব। ড্রাইভার খুশীজড়ান গলায় বলল, তুমি কোথা থেকে এলে?

বউ আর আমি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছি।করিডন গম্ভীর মুখে বলে চেঁচিয়ে ডাকল, শুনছ ডার্লিং, এখানে এসে আমাদের সাহায্য কর।

অ্যান অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল। এই হল আমার বউ। অ্যানের দিকে না তাকিয়ে করিডন বলল, বন্ধুর কার্বোরেটরে গোলমাল দেখা দিয়েছে, মনে হচ্ছে ঠিক করে দিতে পারব। শেষদিকের কথাগুলো অ্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল।

আমার স্বামীর হাতের কাজ চমৎকার।–অ্যান বলল।

ব্রেয়ার আমার নাম। সেই উপকারী সামারিটনের গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। সে প্রশংসার দৃষ্টিতে অ্যানের দিকে তাকিয়েই সজাগ হয়ে উঠল, কারণ মেয়েটার পরনের ফ্রক অনেকখানি উপরে উঠে গেছে, তার পা দুটির অনেকটা দেখা যাচ্ছে।

করিডন কার্বোরেটর খুলতে ব্যস্ত আর এদিকে ব্লেয়ার ব্যস্ত অ্যানের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টায়। করিডন কার্বোরেটর ফিট করে স্কু লাগিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেখতে বলতেই ব্রেয়ারের মন খারাপ হয়ে গেল।

তুলনা হয় না, তোমার।ব্রেয়ার বলল, তোমরা কোথায় নামবে?

আমরা যাব দুনবারে,–অ্যান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ওখানে আমাদের পৌঁছে দিতে পারবেন?

 কেন পারব না? আমি তো এডিনবরা যাচ্ছি। খুশী হব তোমাদের পৌঁছে দিতে পারলে।

তারা গাড়িতে উঠে বসল। দরজা বন্ধ করল করিডন।

.

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

০১.

 মোটর-বোটটা আঠার ফুট লম্বা ব্রুকবান-বোট, দশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন আর মোটর গাড়ির মত হ্যাঁন্ডেল লাগান আছে। বোটটা ঝোলান ছিল কংক্রিট ছাউনির মধ্যে। একটা বৈদ্যুতিক সুইচ টিপে কপিকলের সাহায্যে সেটা নীচে নামান হল।

অ্যান ব্যস্ত ইঞ্জিন পরীক্ষায়।করিডন চঞ্চল মনে দরজা দিয়ে বাইরে নজর রেখেছে। এই মুহূর্তে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল তাদের যেন কেউ নজর করছে–এই ধরনের একটা অনুভূতি মনে জাগল। অন্ধকারে চোখ রাখল। সমুদ্রের দিক থেকে ছুটে আসা শীতল বাতাস চোখে মুখে লাগল। কিন্তু তার সন্দেহ হওয়ার স্বপক্ষে কোন যুক্তি খুঁজে পেল না।

সব ঠিক আছে।–অ্যান জানাল, ডাঙ্গার দিকে ঢালু জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল, আমরা কি যাব?

হ্যাঁ-দরজার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে করিডন বলল, বাতসের বেগ বাড়ছে। যত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারি ততই ভাল। পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে?

প্রায় একঘণ্টা। দ্বীপে পৌঁছতে পারলে আর ভাবনা নেই। বাড়িতে টিনের খাবার অনেক আছে। চার সপ্তাহ চলে যাবে।

একসপ্তাহ চললেই যথেষ্ট-অন্ধকারের দিকে একবার তাকিয়ে করিডন বলল, চল আমরা যাই। অ্যান বোটের ইঞ্জিন চালিয়ে দিল। বোট চলতে শুরু করতেই সেকরিডনের কাছে এসে বলল,এখান থেকে চলে যাওয়াই উচিৎ হবে। না গেলে হয়ত-অ্যান মাঝপথে থেমে গিয়ে তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। করিডন ঘুরে দাঁড়াল। বোটের উপর মানুষের একটা ছায়া এসে পড়েছে।

কে ওখানে? করিডন কয়েক পা এগিয়ে প্রশ্ন করল।

জিনি আলোর সামনে এল। তার হাতের পিস্তল দুজনের দিকে তুলে ধরা। চোখে মুখে নিপ্রাণ অভিব্যক্তি। চোখ দুটো চকচক করছে।

আমি তোমাদের সঙ্গে যাব। রুদ্ধশ্বসে জিনি বলল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল করিডন। সে আশংকা করেছিল অন্ধকার থেকে রলিন্স বেরিয়ে আসবে বুঝি। সে বলল, এখানে এসে পৌঁছলে কি করে?

আমরা ঠিক করেছিলাম এখানে দেখা করব–জিনি নিষ্প্রণকণ্ঠে বলল, নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ফাঁকি দিতে চাওনি?

তোমার কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম-করিডন পিস্তলের দিকে লক্ষ্য রেখে বলল, জন কি অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে?

না।

তাহলে ও কোথায়?

জিনি হেসে উঠল। ভয়ার্ত সেই হাসি।করিডনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত প্রবাহিত হল। অসুস্থ বলে মনে হল জিনিকে। ঠোঁট দুটি রক্ত শূন্য।

ও মারা গেছে–সে বলল।

মারা গেছে?-করিডন এধরনের কিছু আশা করেনি, কি হয়েছিল? পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল নাকি?

জিনি অ্যানের দিকে তাকাল। ঘৃণার ছাপ সারা মুখে। সে বলল, ওকে জিজ্ঞাসা কর। ও জানে। ম্যালোরী ওকে খুন করেছে।

অ্যান রুদ্ধশ্বাসে দুপা এগিয়ে যেতেই করিডন তার হাত ধরে থামাল। সে বলল, তুমি কি বলছ? এ ধারণা তোমার হল কি করে ম্যালোরী খুন করেছে?

দেখেছি খুন করতে। জিনি কাঁপা আঙ্গুলে নিজের ঘন কালো চুলে বিলি কাটল, ম্যালোরী– আমাদের অনুসরণ করছিল।

অনুসরণ করছিল–কোথায়?

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জিনি। সহসা সে বলতে লাগল, রনলি খুন হয়েছে। আমাদের জন্য সে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। জন আহত হয়েছিল। পুলিশ আমাদের প্রায় ধরে ফেলেছিল। আমরা একটা চার্চে লুকিয়েছিলাম তারপর তার কোন কথা শোনা গেল না, শুধু ঠোঁট জোড়া নড়তে লাগল।

থামলে কেন বল, বল কি হয়েছে?

একটা ট্রেনে চড়ে বসেছিলাম। ভাগ্য ভাল বলতে হবে। ট্রেনটাদুনবার পর্যন্ত এল। মনের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল, তার প্রচণ্ড জল পিপাসা পেয়েছিল। বার বার জল খেতে চাইছিল। ওকে ছেড়ে আমি একটার পর একটা কামরায় চড়ে কিছু খাবার সন্ধান করছিলাম। হঠাৎ তার আর্তচিৎকারে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ট্রেনের কামরা থেকে শরীরের অর্ধেকটা ঝুলে পড়েছে। ম্যালোরী ওর গলা টিপে ধরেছে। আমার কিছু করবার ক্ষমতা ছিল না, আমি অনেক দূরে ছিলাম কিনা। জন রেল লাইনের উপর পড়ে গেল। লুবিসকে যেভাবে মারা হয়েছিল ওকেও সেইভাবে মারা হয়েছে। ম্যালোরীই ওকে খুন করেছে।

করিডনের শিরদাঁড়া শিহরিত হল। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বলতে চাইছম্যালোরীকে দেখছ?

হা।

ও মিথ্যে কথা বলছে।–অস্ফুট গলায় অ্যান বলল।

 চুপ কর। ওকে বলতে দাও।-জিনিকে করিডন প্রশ্ন করল, জনের মৃত্যুর পর কি হল?

ম্যালোরীকে এখন পর্যন্ত অনুসরণ করেছি। সে দ্বীপে চলে গেছে।

 দ্বীপে কিভাবে গেল? এই বোটটা ওর। এটা নিয়ে যায়নি কেন?

জিনি কপাল চুলকোতে লাগল। তাকে মনে হল দ্বিধাগ্রস্ত। সে বলল, বন্দর থেকে একটা বোট নিয়ে গেছে। হঠাৎ কয়েক পা এগিয়ে এসে কঠিন কণ্ঠে বলল, বোটে উঠে পড়, তাড়াতাড়ি কর। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ম্যালোরী দ্বীপে আছে, এবার রেহাই পাবে না।

.

০২.

 হার্মিট দ্বীপটা যত বড় হবে কল্পনা করেছিল করিডন, দ্বীপটা তার থেকেও বড়। ভেবেছিল জায়গাটা হবে পাহাড়ী আর আয়তনে বড় জোর দুশো স্কোয়ার ইয়ার্ড। এর মধ্যে একটা বাড়ি মাথা। তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু যখন মোটর বোটটা একটা গুপ্ত বন্দরে ভিড়ল, দেখল সুউচ্চ পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। অ্যানের কথাগুলো করিডনের মনে পড়ল, সে বলেছিল, দ্বীপটা সম্পর্কে যে না জানে তার পক্ষে খুব বিপজ্জনক।

কুয়াশা ঘিরে আছে দ্বীপটাকে। প্রচণ্ড বেগে হাওয়া ধাক্কা খাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। সমুদ্র-পাখী অন্ধকারে ইতস্ততঃ উড়ছে খাদ্যের অন্বেষণে।

পাহাড়ের গা কেটে সিঁড়ি তৈরীকরা হয়েছে। প্রায় দুশো ধাপ অতিক্রম করবার পর পাহাড়ের মাথায় খোলা আকাশের নীচে একটা সমতল জায়গায় এসে দাঁড়াল। অ্যানকে অনুসরণ করে অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু ঢালু রাস্তা দিয়ে ওরাহাঁটতে লাগল। জিনি হাঁটছেআর বিড় বিড় করে কিছু বলছে।

তারা সহসা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়িটা পাহাড় কেটে তৈরী করা, দুটো পাশ পাহাড়ের দেওয়ালে ঢাকা। মুখ সমুদ্রের দিকে। বাড়িটা দোতলা আর অপরিচ্ছন্ন। দেখতে কতকটা পুরোন দুর্গের মত। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি তৈরী হয়েছে পাহাড়ের বুক কেটে।

অন্ধকারে বাড়িটা ডুবে আছে। জানলাগুলো কালো আয়না যেন। অ্যান বাড়ির প্রবেশ পথের দিকে যেতে উদ্যত হতেই করিডন তার হাত ধরে থামাল।

এত ব্যস্ত হয়ো না,বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সে সাবধান করল তাকে, ব্যক্তভাবে ঢোকার প্রয়োজন নেই। যদি কেউ ভেতরে থাকে

ভেতরে কেউ নেই।–অ্যান মৃদুকণ্ঠে বলল, তুমি কি জিনির মিথ্যে কথাগুলো বিশ্বাস করেছ?

 তবু কোন সুযোগের সৃষ্টি করা উচিৎ হবে না।

আমি অত ভয় পাই না। নিজেকে ছাড়িয়ে সে বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আমরা বাইরে গেলে দরজা বন্ধ করে সীল করে যাই। যদি এসে দেখা যায় সীল ঠিক আছে তাহলে বুঝতে হবে ভেতরে কেউ নেই।

ভেতরে ঢোকার আর কোন পথ নেই?

 না। এটাই একমাত্র দরজা।

অ্যান পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজার তালা খুলল।

এখানে দাঁড়িয়ে থাক। করিডন বলল, বাড়িটা একটু ঘুরে দেখি।

এখানে কারো দেখা পাবে না।–অ্যান বলল।

আমি সুযোগের সন্ধানে আছি। সে প্রতিটি ঘরে ঢুকে চোখ বুলিয়ে বুঝল কেউ বাড়ির ভেতরে লুকিয়ে নেই। আর কারো পক্ষে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। লাউঞ্জে ফিরে এসে দেখল, ইলেকট্রিক চুল্লির পাশে অ্যান দাঁড়িয়ে আছে আর অসুস্থ শরীরে জিনি ঘরের এপাশ-ওপাশ পায়চারি করছে।

এখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। করিডন ঠিক করল। অন্ধকারের ভেতর দ্বীপটা একটু ঘুরে দেখবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হল জিনি। বিরাট আয়তন দ্বীপের। পাহাড়ের কঠিন ঢাল আর বাতাসের গতি তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে আর পিস্তল হাতে নিয়ে অন্য দুজনের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে বসেছে।

অ্যান তাকে বেডরুমে ঘুমতে যেতে বলতেই সে জানাল, লাউঞ্জে চুল্লির পাশেই থাকবে।

ও একা থাক।করিডন চাপা কণ্ঠে বলল, চল আমরা ওর কাছ থেকে সরে গিয়ে ওপরে যাই।

চারটে বেডরুম আছে লাউঞ্জের দিকে মুখ করে। অ্যানকে অনুসরণ করে করিডন একটা বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ব্রায়ান এখানেই আছে। এ ধরনের বিশ্বাস তোমার নেই নিশ্চয়ই?–অ্যান আধশোয়া হয়ে সাগ্রহে প্রশ্ন করল, জিনির মিথ্যে কথাগুলো বিশ্বাস করে বসে নেই তো?

তার দিকে তাকাল করিডন। সে বলল, আমি নিশ্চিত ওর মাথার গোলমাল হয়েছে। ওর বলা জনের গল্প কেমন যেন খাপছাড়া।

স্মরণ করে দেখ জিনি বলেছে জন আর ম্যালোরী যখন হাতাহাতি করছে তখন তার পক্ষে করবার কিছু ছিল না কিন্তু তার হাতে তে পিস্তল ছিল। গুলি ছুঁড়ে ম্যালোরীকে খুন করতে পারত। না, গল্পটা ঠিক মিলছেনা। আমরা জানি জন আহত ছিল। এই ক্ষতের কারণে তার মৃত্যু হয়ে থাকবে। কিন্তু জিনি ভেবেছে ম্যালোরীতাকে খুন করেছে কিম্বা ইচ্ছাকৃতভাবে সে মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু কেন বলছে? কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে। আমাদের চোখে কিছু যেন এড়িয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবে দেখতে চাই। এ সবের পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। করিডন উঠে গিয়ে অ্যানের সামনে দাঁড়াল, যাও শুয়ে পড় গে, অ্যান। আমি আগাগোড়া ভেবে দেখতে চাই। কোন চিন্তা করো না।

এটাই আমার কাছে স্বস্তি।–অ্যান বলল, ব্রায়ান এসব ব্যাপারে জড়িয়ে নেই।

জিনি বলছে, ব্রায়ান এই দ্বীপেই আছে। যদি তাই থাকে তাহলে আমি ওকে খুঁজে বের করবই। মনে হচ্ছে কালই হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।

ওর দেখা তুমি পাবে না।–অ্যান দৃঢ়কণ্ঠে বলল, আমি জানি পাবে না।

শুয়ে পড়গে।–করিডন নীরস কণ্ঠে বলল, ভেতরে লক করে শোবে। জিনিকে বিশ্বাস নেই। আশা করছি ওর হাত থেকে পিস্তলটা নিতে পারব। আজ রাতে আর কাজ নয়। দিনের আলো ফোঁটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

অ্যান বিদায় নিতেই করিডন ঘরে পায়চারি করতে শুরু করল।

জানলার গায়ে বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। বাতাসের গর্জন শুনতে পাচ্ছে করিডন। দ্বীপের কূলে কূলে ঢেউ ভেঙে পরবার শব্দ হচ্ছে। সকালের আগে কিছু করা যাবেনা। কিন্তু পোষাক পালটে বিছানায় আশ্রয় নেওয়ার ইচ্ছেও তার নেই।অস্বস্তি বোধ করছে সে আর বিরামহীনভাবে পাড়ে ঢেউ ভাঙার শব্দ তাকে চিন্তিত করে তুলল।

অস্থিরভাবে গায়ের কোট খুলে আর্ম-চেয়ারে বসল। শেষবার ঘুমের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। ট্রেনে ঝিমুনি এসেছিল মাত্র, কিন্তু তাকে তো আর ঘুম বলে না। চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসছে বটে, কিন্তু বিছানায় শুলে ঘুম আসবে না। সে চোখ বুজে শরীর এলিয়ে দিয়ে ম্যালোরীর কথা ভাবতে লাগল।

ম্যালোরীঃ ভাবতে লাগল করিডন, জনের বর্ণনা মত তার একটা চেহারা তৈরী হয়েছে মাত্র। কারো মতে মানুষটা ভাল, আবার কারো মতে মন্দ। এই অবান্তর চরিত্রের মানুষটা কয়েকজনকে খুন করেছে নির্দয়ভাবে। এই লোকটি সম্পর্কে রলিন্স প্রসংশা করছে। তাকেই আবার অ্যান ভালবেসেছে। জিনি আর জন তাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করে। লোকটা বিশ্বাসঘাতক, কিন্তু বন্ধুদের প্রতি বিশ্বস্ত। হয়তো এই দ্বীপে আছে, কিংবা মারা গেছে। তাকে ফ্রান্সের কোন অজানা স্থানে কবর দেওয়া হয়েছে।

করিডন উত্তেজিতভাবে চেয়ারের হাত চেপে ধরল। ঠিক যেন এক রহস্য দানা বেঁধে আছে এর পেছনে যা সে ধরতে পারছে না।

ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই করিডন উঠে বসল। হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। নয়তো কেউ যেন সুইচ অফ করে দিয়েছে। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে সাবধানে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জমাট বাঁধা অন্ধকারের বুকে দৃষ্টি রাখল। বাড়ির সব আলোই নিভে গেছে, কূলে জলের ঢেউ ভেঙে পড়বার শব্দ শুধু কানে ভেসে আসছে। তারই মধ্যে কানে এল সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর। করিডন কান পেতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে। নিচে অন্ধকার থেকে ভেসে আসা সেই কণ্ঠস্বর তার ঘাড়ের চুল খাড়া করে দিল। কোন অজানা দিক থেকে অশরীরী আর্তস্বর যেন ভেসে আসছে। ঠিক এই কণ্ঠস্বর সে ক্রিডের ফ্ল্যাটে শুনেছিল– ম্যালোরীর কণ্ঠস্বর।

করিডন নিজেকে আয়ত্বে আনার আগেই এক ঝলক আগুন ঝলকে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ। মানুষের আর্তচিৎকার শোনা গেল। জিনির কণ্ঠস্বর। সামান্য সময় পরে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়ে গেল বাড়ির ভেতরে।

অ্যান অন্ধকারের মধ্যে ছুটে করিডনের কাছে এল। কি হয়েছে? কি ঘটেছে এখানে?–ভয়ার্ত কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করল।

অ্যানকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে করিডন টর্চের আলো ফেললনীচে লাউঞ্জের উপর। ওখানে কেউ নেই। লাউঞ্জের দরজা খোলা।

জিনি?–তীক্ষকণ্ঠে ডাকল করিডন, জিনি, তুমি কোথায়?

কোন উত্তর ভেসে এল না।

মেন সুইচটা কোথায়?–অ্যানের দিকে ফিরে সে প্রশ্ন করল।

রান্নাঘরে।

এখানে দাঁড়িয়ে থাক। সে সিঁড়ি অতিক্রম করে নীচে নেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে আলো জ্বলল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে লাউঞ্জের দিকে গেল।

জিনি নেই, সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ান অ্যানকে উদ্দেশ্য করে সে বলল।

কিন্তু গুলি ছুঁড়ল কে? কি ঘটেছে বল তো? কথাগুলো বলে অ্যান তার কাছে নেমে এল। আর দরজার সামনে গিয়ে বৃষ্টি ভেজা অন্ধকারের দিকে তাকাল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।

চারিদিকে ভালো করে খোঁজ তো? অ্যান, আমি বুলেটটা খুঁজে পেতে চাই। সে নিজেই খুঁজতে শুরু করে দিল। তার সারা মুখে উত্তেজনা। শেষ পর্যন্ত বুলেটটা খুঁজে পেল অ্যান, একটা ওক কাঠের তৈরী দরজার পাল্লার গায়ে গেথে আছে। একটা ছুরির সাহায্যে বুলেটটা বের করল করিডন।

মসার পিস্তলের বুলেট।–অ্যানের দিকে তাকিয়ে সে বলল। তার মুখে জেগে উঠল সামান্য হাসি, তোমায় বলেছিলাম কি যেন আমি ধরতে পারছি না। ভেসে আসা কণ্ঠস্বর আমাকে বুদ্ধ বানিয়েছে। মনে হচ্ছে এখন ধরতে পেরেছি।

.

০৩.

 বাড়ির বাইরে উঁচু সমতল ভূমির উপর দাঁড়িয়ে করিডন সারা দ্বীপটা দেখতে পেল। দ্বীপটার যেন কিছু অংশ জলাভূমি, বাকী জায়গা পাহাড়। এই পাহাড় শেষ হয়েছে সমুদ্রের পাড়ে।

কিছুক্ষণ জমি পরীক্ষা করে করিডন ঠিক করল সুবিস্তৃত জলাভূমির দিকে যাবেনা। কেউ যদি ওদিকে যায় তাহলে সাথে সাথে তার অস্তিত্বনজরে পড়বে। পশ্চিম দিকটা ছোট বড় পাথরে ঢাকা, কারো পক্ষে সেখানে লুকিয়ে থাকা সম্ভব। এই দিকে গিয়ে খুঁজে দেখবে ঠিক করল। নদীযুক্ত সংকীর্ণ উপত্যকা অতিক্রম করে সে পশ্চিম দিকে এগোতে লাগল।

ইতিমধ্যে সে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেল। এখন প্রায় দুপুর। রোদ খাড়াভাবে গায়ে পড়ছে। তিনঘণ্টা ধরে সে হাঁটছে, সমুদ্র-পাখী ছাড়া আর কোন প্রাণী তার চোখে পড়েনি।

তাকে যাতে নীচে থেকে দেখা না যায় তাই করিডন পাহাড়ের মাথায় পৌঁছবার সময় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল।নীচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল তার ডান দিকে ছড়িয়ে আছে রৌদ্রতপ্ত বালুকাভূমি। আর বাকী জায়গা ছোট বড় পাথরে ঢাকা। আর একটু এগিয়ে সে দেখতে পেল বালুকাভূমির উপর এক ঝাক পায়ের ছাপ। কেউ বড় পদক্ষেপে হেঁটে গেছে, তাই একটা ছাপ থেকে আর একটা ছাপের দূরত্ব বেশী। পদচিহ্নগুলো উত্তর দিকে চলে গেছে, বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।

এই পদচিহ্নগুলো দেখে মনে মনে ভীত হয়ে পড়ল। এই চিহ্নগুলো সে দেখতে পাবে আশা করেনি। ম্যালোরী। তার মনে হল কেউ যেন দ্রুত পায়ে হেঁটে আড়ালে চলে গেল। সাথে সাথে সে ঘুরে দ্রুত পায়ে সরু পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে ঝোঁপ-জঙ্গল পেরিয়ে এগিয়ে গেল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। সে মনে মনে ভাবল যে চওড়া কাঁধওয়ালা লম্বা মানুষের ছায়াশরীর দেখল তা কি শুধুই তার কল্পনা? ছায়া শরীর যত তাড়াতাড়ি আবির্ভূত হয়েছিল ঠিক তত তাড়াতাড়িই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

করিডন বিন্দুমাত্র দ্বিধানাকরে পাহাড়ের মাথা থেকেনীচে সমতলভূমিতে নেমে এসে দৌড়তে শুরু করল।

করিডনের মনে হল, যে লোকটাকে সে চকিতে আড়ালে যেতে দেখেছে সে আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছে।খুব সাবধানে সে পা ফেলে এগোতে লাগল, অসাবধানে পা ফেললে পাছে কোন আলগা পাথর পায়ের আঘাতে নীচে পড়ে না যায়। এর ফলে লোকটি সজাগ হয়ে যাবে।

এইভাবে এগোতে এগোতে হার্মিটের কাছাকাছি উঁচু দুটি পাথরের মাঝখানে চলে এল। কুঁজো হয়ে পাথরের মাথায় উঠে এল সে। নীচের দিকে তাকাতেই তার নজরে পড়ল বিস্তীর্ণ জলাভূমি। এখানে তার চোখে যা পড়ল তা দেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। তার চোখমুখে ফুটে ওঠা বিস্ময় আর সতর্কতা মুছে গিয়ে তার জায়গায় ফুটে উঠল হাসি।

গজ দশেক দূরে একজন বিশালাকৃতি মানুষ আছে। তার লক্ষ্য করিডনের দিকে। লোকটি পায়ের গোড়ালিতে হাত বোলাচ্ছে। তার রোদে পোড়া লাল মুখে বিষণ্ণ অভিব্যক্তি। লোকটি চকিতে মাথা তুলে উপর দিকে তাকিয়ে দেখতে গেল, সাথে সাথে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এই যে বুড়ো শালিক–সে খুশিভরা গলায় বলল, খুব খারাপ সময় যাচ্ছে, কি বল? অনেক আগেই তোমার কাছে যাব ভাবছিলাম। এই পরিত্যক্ত দ্বীপটা একটু আগে ঘুরে দেখে এখন এখানে পৌঁছেছি।

লোকটা আর কেউ নয়, ডিটেকটিভ সার্জেন্ট রলিন্স।

.

০৪.

 হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না। করিডন উপর থেকে ধীর গতিতে নামতে নামতে বলল, কিন্তু তোমাকে দেখে খুব একটা অখুশী হইনি।

তা অবশ্য ঠিক–সতর্ক হয়ে সে বলল, আমি একবারও ভাবিনি যে তুমি আমাকে দেখে খুশী হবে। জানতাম বিস্মিত হবে, তবে খুশী হবে না।

সত্যিই তাই। করিডন বলল, আচ্ছা কয়েক মাইল দূরে সমুদ্র বেলাভূমিতে তুমিই তো একা হাঁটছিলে?

ঠিক ধরেছ। রলিন্স বলল। 

একবার ভেবেছিলাম মানুষটা অন্য কেউ,-করিডন বলল, যদিও জানি পুলিশের লোক ছাড়া অন্য কারও পদচিহ্ন অত বড় হতে পারে না। পথ চিনে এখানে কিভাবে এলে?

সেই লোকটা, জন না কি যেন নাম? আমাকে বাৎলে দিয়েছে। রলিন্স বলল, ফরাসী মেয়েটা তো এখানে, তাই না?

হ্যাঁ। তাহলে জনকে গ্রেপ্তার করেছ?

হ্যাঁ,করেছি, আমার লোকেরা ওকে রেল লাইনে পড়ে থাকা অবস্থায় পেয়েছে। সে আমাদের একটা চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়েছে।

জন ভাল আছে?

না, ভাল আছে বলতে পারব না। ফিরে গিয়ে ওকে জীবিত দেখতে পাব কি না সন্দেহ আছে। গাড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল।

জন পড়ে গিয়েছিল। কেউ ওকে ফেলে দেয়নি তো?

জন বলেছে, এই ফরাসী মেয়েটা, তাকে মাথায় আঘাত করে নীচে ফেলে দিয়েছে।

করিডন মাথা নাড়ল। সে বলল, এই রকম কিছু আশা করেছিলাম।

এ ব্যাপারে তুমি কি জান? রলিন্স প্রশ্ন করল।

পাহাড়ের উপর থেকে একটা পাথরের টুকরো নীচে গড়িয়ে পড়ল। রলিন্স উপর দিকে তাকালেও করিডন তাকাল না।

একটা দল ছিল। সে বলল, দলের সকলে ম্যালোরী নামে একজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জন কি তার নাম উল্লেখ করেছে?

করেছে– রলিন্স বলল, কিছুটা বিরক্ত মনে হল, তুমি কি করে তাকে খুঁজে বের করবার জন্য এদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছ তাও বলেছে।

সত্যিই কি ওরা তোমাকে সাড়ে সাতশো ডলার দিয়েছে?

 হাসল করিডন। সে বলল, একটু বাড়িয়ে বলেছে। তবে টাকা দিয়েছে এ কথা ঠিক।

অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে রলিন্স তার দিকে তাকাল। জন বলেছে ম্যালোরী তার দুজন সঙ্গী লুবিস আর হ্যারিসকে খুন করেছে। আরো বলেছে, ম্যালোরী রীটা অ্যালেনকেও হত্যা করেছে। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি এই ম্যালোরী নামে লোকটি বছর খানেক আগে কর্মরত অবস্থায় মারা গেছে। কোন দ্বিমত নেই এ ব্যাপারে।

ঠিক বলছ?-করিডন বলল, তুমি নিশ্চিত তো?

 যতটা নিশ্চিত হওয়া যায় আর কি? আমি রীটা অ্যালেনের মৃত্যুর ব্যাপারে আগ্রহী আর সেই ফরাসী মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাই। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সে করিডনের দিকে তাকিয়ে রইল। রীটার সম্বন্ধে কি জান বল তো? তার মৃত্যুর সময় তুমি কি সেখানে উপস্থিত ছিলে?

করিডন ঘাড় নেড়ে সায় দিল। সে বলল, তবে আমি মেয়েটাকে স্পর্শ করিনি। তার চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে ওই অবস্থায় দেখি। সে নিজে পড়ে গেছিল, নাকি তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আমি সঠিক বলতে পারব না। তবে ঘটনাটা আমাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। আমি দ্রুতবেগে পালিয়ে এসেছি।

ডাক্তারী পরীক্ষায় প্রকাশ মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়েছিল আর এই জন্যই ব্যাপারটাকে খুন বলা হচ্ছে। রলিন্স গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

প্রমাণ করা কঠিন হবে।করিডন বলল, শোন রলিন্স, তড়বড় করবে না–সেই ফরাসী মেয়েটার নিশানা অব্যর্থ আর তিন মিনিট হল সে একটা পিল আমাদের দিকে নিশানাকরে আছে। ওর অস্তিত্ব তুমি বুঝতে পারনি। আমি পেরেছি। সেআড়চোখে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল, আড়াল থেকে বেরিয়ে এস জিনি তোমার সঙ্গে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট রলিন্সের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।

একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে জিনি বেরিয়ে এল। তার হাতে একটা পিস্তল রয়েছে। তার সারা মুখে ছড়িয়ে আছে অবজ্ঞার হাসি।

তুমি ঠিক সময়ে এসে গেছ।-সেরলিন্সের দিকে তাকিয়ে বলল, এরই নাম জিনি পারসিগনী। যেমন বসে আছ তেমনি চুপচাপ বসে থাক, আর সম্ভব হলে একটা কথাও বলবেনা। জিনির সাথে আমার কিছু কথা আছে। তাই না জিনি?

আছে কি?–জিনি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল।

 জানি না আমাদের আলোচনা তুমি আড়াল থেকে শুনেছ কি না।

করিডন জিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, যদি না শুনে থাক তাহলে তোমাকে জানাচ্ছি যে আমার এই বন্ধু জনকে গ্রেপ্তার করেছেন আর জন জানিয়েছে কে তার মাথায় আঘাত করেছে। তার মানে ম্যালোরী নয়, তুমিই কাজটা করে ধাক্কা মেরে লাইনের উপর ফেলে দিয়েছ।

হ্যাঁ, ফেলেছি।সে বলল, তাতে কি হয়েছে?

 হয়েছে বৈকি। করিডন বলল, অনেক কিছু হয়েছে। একটু থেমে সে বলল, তুমি জান না। যে বছরখানেক আগে ম্যালোরী মারা গেছে?

জিনি চমকে উঠল। কপালে হাত বুলিয়ে সে বলল, না, ও বেঁচে আছে।

না, বেঁচে নেই। তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে করিডন বলল, যদি জানতে তাহলে এত ঘটনা কখনই ঘটত না, তুমিই বল, ঘটত কি? গত রাত পর্যন্ত তুমি আমায় বোকা বানিয়েছ। একটু বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ। ম্যালোরীর কণ্ঠস্বর অনুসরণ করবার চালাকি প্রথমবারে খুব কাজ দিয়েছিল। তবে পুনরাবৃত্তি করা ঠিক হয়নি। বাড়িটার সমস্ত দরজা জানলা পরীক্ষা করে দেখার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে কারও পক্ষে বাইরে থেকে ভিতরে ঢোকা মোটেই সম্ভবনয়। তারপর খুঁজে পেলাম বুলেটটা, বুঝতে অসুবিধা হল না তোমার পিস্তল থেকে সেটা ছোঁড়া হয়েছে।

মাত্র একজন মানুষ এই বাড়িতে ছিল যার পক্ষে গুলি ছোঁড়া আর তোমার নাম চাপা কণ্ঠে উচ্চারণ করা সম্ভব ছিল; সেই মানুষ তুমি। আমি দুই আর দুইয়ে যোগ করলাম আর গুণ করলাম, দেখলাম ফলাফল একই হল। যদি তুমি গতরাতে ম্যালোরীর কণ্ঠস্বরের নকল করে থাক, তাহলে ক্রিডের ফ্ল্যাটে যে কণ্ঠস্বর শুনেছি তা তোমার কণ্ঠের। এখন ভাবা প্রয়োজন কেন তুমি এই কাণ্ড করতে গেলে? তুমি কি একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে চেয়েছিলে, যাতে তোমার ইচ্ছামত ম্যালোরীর খোঁজ করতে পার?

জিনির মুখে মাংসপেশী কঠিন হল। সে কোন কথা বলল না।

আর একটা সমস্যা আমায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছিল। করিডন বলতে লাগল। কেন হ্যারিস, লুবিস আর রীটা অ্যালেন খুন হল। একটা ব্যাপার তাদের মধ্যে ছিল, সাধারণতঃ তারা তিনজনই ম্যালোরী সম্বন্ধে কিছু না কিছু জানত এমন কিছু জানত যার সাহায্যে ম্যালোরীর কাছাকাছি পৌঁছন তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। যদি ম্যালোরী মারা গিয়ে থাকে তাহলে কে তাদের খুন করল?

করিডনের স্থির দৃষ্টি জিনিকে শঙ্কিত করে তুলল। সে ভীষণভাবে হাঁপাতে লাগল আর চোখ মুখের উত্তেজনা প্রকাশ পেল।

গোর্ভিলের সঙ্গে ম্যালোরীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা রনলির মুখে শুনে বিশ্বাস করাই আমার ভুল হয়েছিল।করিডন মৃদুকণ্ঠে বলল, রনলি বিশ্বাস করত বটে, তবে ও শুনেছিল তোমার কাছে, তাই না? কিন্তু গোর্ভিল কোথায় আছে এ খবর ম্যালোরী জানায়নি গেস্টাপোদের, জানিয়েছিলে তুমি নিজে।

জিনির সারা শরীর কেঁপে উঠল, দু হাতে মুখ ঢাকল।

এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। করিডন বলল, আমি তোমায় দোষ দিচ্ছি না। জানি গেস্টাপোরাকত জঘন্য শয়তান। তারা প্রথমে তোমার উপর অত্যাচার চালায়, কিন্তু কোন কথা আদায় করতে পারেনি। তারপর অত্যাচার চালায় রনলির উপর। সে জ্ঞান হারাবার পর আবার তোমাকে ধরে, কি, সত্যি বলছি তো? এইবারে তোমার কাছ থেকে তারা কথা আদায় করে। ম্যালোরী নিজের কানে শুনেছিল গোর্ভিলের হদিশ তুমি তাদের বলে দিলে। তোমার জন্য তার কষ্টবোধ হয়েছিল, তাই নিজের কাঁধে দোষ নিল। দুর্বলকে রক্ষা করাই ছিল তার স্বভাব। রনলি জ্ঞান ফিরে পেতেই তাকে সে জানাল সে গোর্ভিলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, রনলি তার কথা অবিশ্বাস করেনি। কি ঠিক বলছি তো?

কথা বলবার চেষ্টা করল জিনি, কিন্তু গলা দিয়ে কোন কথা বেরিয়ে এল না। তার চোখ মুখের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। দেখে মনে হল এখুনি পড়ে যাবে।

এই হল সমস্ত ঘটনার প্রকৃত ছবি।করিডন তার দিকে নজর রেখে বলতে লাগল, জন তোমাকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। তুমি ভয় পেয়েছিলে পাছে সে মুখ খুলবে। সুতরাং যতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায় তা করেছ। তারপর ম্যালোরীর খোঁজে হ্যারিস আর লুবিসকে পাঠান হল, তাদের খুন করে তুমি শান্ত করলে। তুমি রীটার উপর লক্ষ্য রেখেছিলে আর তার বাড়িতে আমায় যেতে দেখেছিলে। যখন আড়াল থেকে ম্যালোরীর এই দ্বীপের কথা বলতে শুনলে, তাকেও খুন করলে।করিডন জিনির দিকে আঙুল দেখাল,তুমিই ছিলে সবকিছুর মূলে,কি বল? ম্যালোরী নয়। যা করবার প্রথম থেকে তুমিই করেছ।

জিনি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তার মুখের ভাবের পরিবর্তন ঘটতে লাগল, চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল অপ্রকৃতিস্থ।

হা–জিনি তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, পিয়েরীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করেছি। তুমি তো জান না গেস্টাপোরা আমার উপর কি ধরনের অত্যাচার চালিয়েছিল। আমি তো চাইনি ম্যালোর আমার দোষ তার নিজের কাঁধে তুলে নিক। ও একটা বুদ্ধ, তাই আমাকে ভালবেসেছিল। যেন ওর মত একজন বুদ্র ভালমন্দ আমি চিন্তা করতাম। হ্যাঁ, আমি ওদের খুন করেছি। সে একপা একপা করে পিছু হটতে লাগল, পিস্তলের নল তাদের দিকে, যে যেখানে আছ সেখানে থাক।

রলিন্স উঠে দাঁড়াতেই সে চিৎকার করে বলল, আমি ধরা দেবনা। যদি আমার দিকে এগোবার চেষ্টা কর খুন করে ফেলব।

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের উপর দিকে ছুটতে লাগল।

রলিন্স চিৎকার করে তার দিকে ছুটতে লাগল। দুজন তোক ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে জিনির পিছনে দৌড়তেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

হাডসন! ওকে ধর, রলিন্স উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, পালাতে দিও না।

কিন্তু জিনির গতির সাথে ডিটেকটিভ দুজন পেরে উঠল না।

ও বেশী দূর যেতে পারবে না। করিডন অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলল।

 ডিটেকটিভ দুজন পৌঁছবার আগেই জিনি পাহাড়ের মাথার উপর পৌঁছে গেল। পাহাড়ের ঢালে পৌঁছেও সে দৌড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পরে নীচে পড়ে যাওয়ার ভারী শব্দ তারা শুনতে পেল, যেন পাথরে পড়ে কিছু থেঁতলে গেল।

ডিটেকটিভ দুজন বর্ষাতিতে জড়ানো একটা ভারী বস্তু বালির উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে পুলিশ বোটে তুলল।রলিন্স দুহাত কোটের পকেটে ভরে উদ্বিগ্নমুখে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝেই সে একটা বড় পাথরের উপর বসা করিডনের দিকে তাকাচ্ছে। ধূমপান করতে করতে পিছন ফিরে দেখতে লাগল কর্মরত দুজন ডিটেকটিভ।

মনে হচ্ছে এবারেও তুমি জাল কাটলে। খুশি জড়ানো কণ্ঠে রলিন্স বলল, তোমার মত আর একটিও লোক দেখিনি।

আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণা ভুল রলিন্স। ধীরস্থির কণ্ঠে করিডন বলল, তোমার কাজ হচ্ছে মানুষের পিছনে লেগে থাকা আর আমার কাজ হল মানুষকে সাহায্য করতে চাওয়া।একথা তোমার জেনে রাখা প্রয়োজন।

জানি হে জানি। রলিন্স অবজ্ঞা ভরে বলল, নইলে পরে অনুশোচনা করতে হতে পারে।

আমাকে পারিশ্রমিক হিসাবে যা দিয়েছে কাজের তুলনায় খুবই সস্তা। তিক্ত কঠেকরিডন বলল, দেশের প্রতিটি খবরের কাগজে পড়তে হয়েছে, আমার উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। পুলিশের তাড়া খেতে হয়েছে, খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে আর ঈশ্বর জানেন আরো কত কি। করতে হয়েছে। এবং এখন মনে হচ্ছে তোমার সাথে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে বিবৃতি প্রদান করতে হবে আর যে জট পাকিয়ে আছে তা ছাড়াতে তোমাকে সাহায্য করতে হবে। এই কাজের দায়িত্ব নেওয়ার আগে যদি পরিণতি জানতে পারতাম তাহলে কখনও নিজেকে জড়াতাম না।

তোমাকে বেশীক্ষণ আটকে রাখব না। রলিন্স বলল, হাডসন আর সন্ডার্স জিনির স্বীকারোক্তি আগাগোড়া শুনেছে বলেই আমার ধারণা। যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত। সঙ্গে নিতে হবে এমন কিছু আছে নাকি?

করিডন ইতস্ততঃ করে বলল, না। তুমি প্রস্তুত থাকলে আমিও প্রস্তুত, সে উঠে দাঁড়াল।

 রলিন্স ধূর্তের হাসি হাসল। তোমার বোট কোথায়? নিশ্চয় তুমি এখানে সাঁতার কেটে আসনি। –সে হেসে বলল।

বোটের কথা থাক। করিডন চটপট বলল, সময় নষ্ট করবেনা। বোটটা দ্বীপের অন্যদিকে আছে।

কাউকে পাঠিয়ে দেব নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ওই যুবতীর কি হবে–যে ট্রেন থামিয়ে ছিল? রলিন্স জানতে চাইল, ও তো এখানেই আছে কি বল? তার বিরুদ্ধে পাঁচ পাউন্ড জরিমানা না দেওয়া এবং পুলিশকে বাধাদানের অভিযোগ আছে। ওকে তো এখানে ছেড়ে যেতে পারি না।

ওকে কেউ কি চেন টানতে দেখেছে? করিডন বলল, ওকে কোর্টে দাঁড় করাবার মত প্রমাণ তোমার হাতে নেই। এই ঝামেলা থেকে ওকে বাদ দাও।

তা হয় না, রলিন্স বলল, দেখা করতেই হবে ওর সাথে।

 দেখ, মেয়েটা চমৎকার। বোঝাবার চেষ্টা করল করিডন, এখানেই তার বাড়ি। বোটটা ওর নিজের। প্রয়োজন বোধ করলে ও ফিরতে পারবে। এবারের মত কর্তব্যচ্যুত না হয় হলেই রলিন্স। জান তো কাগজের লোকেরা তাকে নিয়ে কি কেচ্ছা শুরু করবে। তোমারও তো মেয়ে আছে।

রলিন্স হাসল। সে বলল, আচ্ছা, এই মেয়েটাই তো যুদ্ধের সময় ফ্রান্সে নেমেছিল?

ঠিকই ধরেছ।

ঠিক আছে। চল আমরা যাই।

লোকে বলে পুলিশরা নাকি হৃদয়হীন। করিডন দাঁত বের করে হাসল, কিন্তু কথাটা ভুল দেখছি।

বোটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রলিন্স জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে চাও না? আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আমাদের জন্য চিন্তা করো না। মাঝে মধ্যে রলিন্স বেশ রসিকতা করে।

করিডন তার দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। ওকে কেন বিদায় সম্ভাষণ জানাতে যাব? সে জিজ্ঞাসা করল, ও আমার মত নয়। বোটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, তাছাড়া নেভিতে কাজ করে এমন একজন ছেলে বন্ধু ওর আছে।

ভাগ্যবান লোকনাবিক। হাসি চেপে রলিন্স বলল, একজন নাবিককে বিয়ে করে ভালই থাকবে। তোমার জন্য হতাশা বোধ করছি। ভেবেছিলাম মহিলাদের কাছে তোমার চাহিদা

চুপ কর।– করিডন বোটে উঠল, পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি, যদি অ্যানকে শেষবারের মত দেখা যায় এই আশায়।