ব্লাড শেডেড ডার্কনেস

ব্লাড শেডেড ডার্কনেস

আমার বোধগম্য হয় না জিম শর্টহার্ডস কি ভাবে ব্যক্তিগত সচিবের পদ পেয়েছিল। বছর কয়েক সে এই পদে অধিষ্ঠিত ছিল ও ব্যাঙ্কে কিছু টাকা পয়সাও জমিয়েছিল।

শর্টহার্ডস বুঝেছিল তার মনিব যখন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে তখন নিশ্চয়ই একটা বিশেষ কাজ আছে। কারণ মনিবের মাথায় হঠাৎ হঠাৎ খেয়াল চাপে। এই খেয়ালিপনারই ডাক এটা।

শর্টহার্ডসকে মনিব বললে, যদিও তোমার সাহস ও মনের জোর সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই তবুও আন্দাজ করতে পারি তুমি একজন সাহসী মানুষ। উত্তরে শর্টহার্ডর্সবলল যে ভয় ভীতি কমই আছে তবে এই সাহসটা কিসের, দৈহিক নির্যাতনের কিনা, এবং তার উত্তরে জানল, কতকটা তাই। সে তার পারিশ্রমিক বৃদ্ধির কথা চিন্তা করে বলল সব বিপদকেই সে অগ্রাহ্য করে যদি বিবেকের সায় পায়। কিন্তু মনে হচ্ছে কোন গোয়েন্দা সুলভ কাজের ভার পাচ্ছি।

কাজটা বেশ গোপনীয় বলে সাইড বোথাম অর্থাৎ তার মনিব আস্তে কথা বলতে বললেন। এবং পুরোন পার্টনার জোয়েল গার্ডির চিঠি তুলে ধরলেন এবং বললেন এর কথা তুমি শুনেছ।

শর্টহার্ডস এ বিষয়ে অবগত। সে জানে কোম্পানি শিকাগোর বাজারে গার্ডি অ্যান্ড সাইড বোথামের পরিচিতি আছে। যেমনি অকস্মাৎ তারা ধনী হয়েছিল সেরকম অকস্মাৎ ভাবেই হারিয়ে যায়। তারা দুজন পার্টনার ছিল। একে অপরের মৃত্যু কামনা করত। এবং আর একটা বিষয় দুজনেই দুজনের দুর্বলতার খবরাখবর রাখত। সাইড বোথাম তাকে বোঝালেন এটা ব্ল্যাকমেলিং-এর ব্যাপার। গার্ভির সই করা গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি কাগজ সাইড বোথামের কাছে আছে আর ঐ কাগজগুলি পরস্পরের কাছে বেশ মূল্যবান। এবং অধিকারও সমান। সেই কাগজগুলো থেকে গার্ভি তার নিজের সইগুলি কেটে দিতে ইচ্ছুক। সেই কাগজগুলি তোমার হাতে পাঠাবো তুমি সইগুলি কাটিয়ে কাগজগুলি আমাকে ফেরৎ দেবে।

গার্ভি সাইড বোথামের উপর যে প্রচণ্ড চাপ দিয়েছে শর্টহার্ডসের অগোচরেরইল না। সাইড বোথাম শর্টহার্ডসকে কাগজগুলি পড়তে বারণ করলেন। পৃষ্ঠার শেষে সইগুলি শুধু কাটিয়ে নিতে হবে। কিন্তু কাগজগুলি তার হাতে যেন না যায়।

শর্টহার্ডসের কাছে কাজটা খুব মুশকিলের বলে মনে হলো না। মোট কথা মিঃ গার্ভির কাছে কাগজগুলো সই কাটিয়ে ফেরৎ আনা।

বিগত কুড়ি বছরে গার্ভির সঙ্গে সাইড বোথামের দেখা হয়নি। তবে কিছু কিছু গুজব তার কর্ণগোচর হয়েছে যে সে কেমিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করে। মাঝে মাঝে সে পাগলামি করে থাকে তবে মারধোর করবে বলে মনে হয়না। তবে সাবধান থেক এবং একটি পিস্তল দিলেন। শর্টহার্ডস সেটা ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে রাখল এবং বেরিয়ে গেল।

গার্ভির বাসস্থান স্টেশন থেকে ছ–মাইল দূরত্বে। জায়গাটা নোংরা। রুক্ষ আবহাওয়া। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তুষার ছাওয়া। মাঝে মাঝে দু–একটা গোল বাড়ি। গার্ভি ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসল। গারোয়ান নীরবতাই ভালোবাসে। অগত্যা শর্টহার্ডস নিজের চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে রইল তার ফেরার গাড়ি সাতটা পনেরতে কিন্তু গাড়োয়ান তাকে পৌঁছে দিতে রাজী না হওয়ায় তাকে পায়ে হেঁটেই ফিরতে হবে। অগত্যা কাজ সেরেই ব্রুকলিন থেকে রওনা দেবে। আসল দলিলটার মত দেখতে এক বান্ডিল কাগজ সে নিয়ে এসেছে। উদ্দেশ্য নকল দলিল দিয়ে আসল দলিলটা ফেরৎ আনা। গাড়োয়ান মিঃ গার্ভির গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে বাড়িটা তাকে দেখিয়ে দিল। ভাঙা গেটের সামনে গাড়িটাকে আনতে বলায় গাড়োয়ান রাজি হলো না। কেননা সে ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। পয়সা পেয়েই গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

শর্টহার্ডস গেট পেরিয়ে এগিয়ে চললো। প্রাণহীন একটা বাড়ি। একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না। কখনোবাড়িটা সাদা ছিল। এখন একদম জরাজীর্ণ, বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ বাড়িটায় প্রবেশ করুক এটা সে চায়না। শুধু বৃষ্টির আওয়াজ হচ্ছে। শর্টহার্ডস দরজার হাতল খুঁজে পেল না। তাই লাঠি দিয়ে দরজায় ঘা দিল। সেই ঘায়ের আওয়াজ শুধু প্রতিধ্বনিত হলো। দুঃসাহসী শর্টহার্ডসচমকে উঠল। একটা বাতাসবয়ে গেল। কারো কোন পায়ের শব্দ পাওয়া গেলনা। পরপর কয়েক বার ধাক্কা দেওয়ার পরও দরজা খুলল না। অগত্যা শর্টহার্ডস দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ এই ভাবে কেটে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে গেল। সে দেখতে পেল দরজার ওপারে হলঘরে কোন আলো নেই। অস্পষ্ট ভাবে একজোড়া চোখ দেখা গেল। অতঃপর জিজ্ঞাসা করল তাকে, মিঃ গার্ভি এখানে থাকেন নাকি? আমি মিঃ সাইড বোথামের ব্যক্তিগত সচিব। এবং লোকটির হাতে একটি কার্ড দিল এবং বলতে বলল যে সে মিঃ সাইড বোথামকে যে কাজের জন্য তিনি লিখেছিলেন সেই কাজের জন্য এসেছে সে। তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটি কার্ড। নিয়ে চলে গেল।

কয়েক মিনিট পরে দরজাটা খুলে গেলে প্রবেশ করল সে। লোকটির হাতে একটি মাত্র কম্পমান আলো। তাইতেই শর্টহার্ডস দেখল লোকটি ইহুদি। লোকটি মাঝ বয়সী। বেঁটে চকচকে চোখ। সে পা পর্যন্ত একটি কালো আলখাল্লা পরে আছে। এবং বাড়িটির সাথে লোকটি বেশ মানানসই।

রুক্ষ স্বরে লোকটি জানালো–মিঃ গার্ভি এখুনি আসবেন। একটি বেশ আলোকিত ঘরে লোকটি শর্টহার্ডসকে নিয়ে গেল। ঘরটি বেশ সুসজ্জিত। বই ভর্তি দেওয়াল আলমারি। ঘরের মাঝখানে রয়েছে মেহগনি কাঠের চেয়ার ঘেরা ডেস্ক। ফায়ার-প্লেসে বেশ আগুন জ্বলছে। এই ঘরে এসে শর্টহার্ডসের মন উৎসাহিত হয়ে উঠল।

সে দেখল ইহুদিটি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

শর্টহার্ডস বলল যে সেকম সময় হাতে নিয়ে এসেছে। মিঃ গার্ভি যেন তাকে বসিয়েনা রাখেন।

লোকটি নিঃশব্দে চলে গেল। ডেস্কের টেবিল ল্যাম্পটা স্পর্শ করে শর্টহার্ডস বুঝল একটু আগেও এই আলোটা জ্বলছিল কেননা সেটা গরম ছিল। শর্টহার্ডসের কেমন যেন মনে হল তাকে কেউ এ ঘরে অন্তরীক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। কারো যেন উপস্থিতি এই ঘরের মধ্যে অনুভব হল। পনের মিনিট পর বইয়ের আলমারির দরজা খুলে মিঃ গার্ভি এলেন।

শর্টহার্ডসের ধারণা ছিল মিঃ গার্ভি হয়ত তৃষ্ণার প্রতিমূর্তি। কিন্তু তার ধারণা ভুল। মিঃ গার্ভি একজন সুন্দর সুপুরুষ বয়স্ক ভদ্রলোক। শর্টহার্ডসকে বসিয়ে রাখার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। মিহি গলায় কথা বললেও তার মুখে হাসির বিন্দু মাত্রও নেই। তিনি বললেন, রসায়নের একটি সমস্যায় মগ্ন থাকার জন্য তিনি আসতে দেরী করেছেন। কাজটি শেষ করে তবেই আসতে পারলেন। এবং শর্টহার্ডসকে বসতে বলতে শর্টহার্ডস ওভার কোটটা খুলে বসল। সে বুঝতে পারল ভদ্রলোক মিথ্যা কথা বললেন, কিন্তু কারণটা তার বোধগম্য হলো না। ফায়ার-প্লেসের উল্টোদিকের চেয়ারে তিনি বসলেন। গার্ভিকে দেখে শর্টহাউসের অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। সে তার হাতের কাগজগুলি দেখিয়ে তাকে সই করে দিতে বলায় গার্ভি জানালেন তার পরীক্ষাগারে কিছু কাগজ পরীক্ষা করে দেখার আছে। এবং ঘর থেকে তখন বেরিয়ে গেলেন। নিরুপায় হয়ে শর্টহার্ডর্স বসে রইল।

প্রায় কুড়ি মিনিট পরে গার্ভি ফিরে এলেন। তখন শর্টহার্ডসের ফেরার গাড়ির আর কয়েক মিনিট মাত্র বাকি।

বিলম্বের জন্য পুনরায় গাড়ি দুঃখ প্রকাশ করলেন। এবং শর্টহার্ডসের জন্য কি করতে পারেন তা জিজ্ঞাসা করলেন। এবং বললেন, এ ধরনের কাজে সাবধানতার প্রয়োজন। তাছাড়া শর্টহার্ডস নিশ্চয়ই জানেন তার পুরোন পার্টনারের মাথায় যখন নেই।

শর্টহার্ডস বুঝল তিনি তাকে লক্ষ্য করছেন। কিন্তু শর্টহার্ডস নিরুত্তর রইল। সতর্কতার সঙ্গে গার্ভি উক্তি করলেন, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজেই সাবধানের মার নেই। তিনি জানতে চাইলেন যে শর্টহার্ডস-এর সাইড বোথামকে সামাল দিতে কি ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। তিনি জানতে চাইলেন সাইড বোথামের মধ্যে এখনও তার প্রতি কোন বিদ্বেষ আগের মত আছে কিনা? শর্টহার্ডস কোন উত্তর না দিয়ে দলিলটা গাভির দিকে এগিয়ে দিল। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবার জন্য।

গার্ভি আবার বললেন, সাইড বোথাম তাকে মারধোর করে কিনা? উত্তরে শর্টহার্ডর্স জানালো না একদম না।

তিনি বললেন, ভালোই। এবার কাজটা শেষ করে ডিনার হোক। কথা বলেই নিজের সইটা কেটে নিয়ে আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন, কুড়ি বছর আগে এই সইটা করেছিলাম।

সুযোগ পেয়ে আসল দলিলটা পকেটে রেখে দিল শর্টহার্ডস। আর ব্যাগে রাখল নকলটা। আর ঠিক তখনই গার্ভি তার দিকে ফিরলে সে বলল পকেটে কাগজগুলো রেখে দিলাম। উত্তরে গার্ভি বলল, ঠিক আছে ওগুলো দিয়ে আমি কি করব? মনে হল এই দলিল পাল্টানোটা তিনি দেখেননি। শর্টহার্ডসকে ওভার কোটটা গায়ে দিতে দেখে তিনি বললেন, নিউইয়র্ক নিশ্চয়ই শর্টহার্ডস আজ যাবে না?

শর্টহার্ডস বলল, একটু চেষ্টা করলে সাতটা পনেরর গাড়ি ধরতে পারবো। গার্ভি বললেন, অনেকক্ষণ ছটা বেজে গেছে। ঐ গাড়িটা পাওয়া সম্ভবনা। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম আজ এখানেই থাকবে তুমি। দেওয়ালের ঘড়িটা হাতের ঘড়িটার সাথে মিলিয়ে দেখল দেওয়াল ঘড়িটা আধ ঘণ্টা পিছিয়ে আছে। হয়তো ইচ্ছে করেই ঘড়িটা পিছিয়ে রাখা হয়েছে। অগত্যা এই অন্ধকারে ছমাইল পথ হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় কখনই ভেবে বলল আপনার এখানেই থেকে যেতে হবে রাতটা।

উত্তরে গার্ভি বললেন এখানে বড় একটা লোকের দেখা পাওয়া যায় না। আপনি থাকছেন শুনে খুশী হলাম। আর বাইরে ঝড়ও হচ্ছে। গার্ভির মুখের আন্তরিকতা দেখে শর্টহার্ডস-এর ভয় কেটে গেল। ওভার কোটটা খুলে দুজনে আগুনের সামনে গিয়ে বসল।

শর্টহার্ডসকে গার্ভি বললেন, আপনার মনে যে সংশয় হচ্ছে তা আমি জানি। সাইড বোথাম নিজেকে ছাড়া সকলকেই পাগল বলে। সেআমার সম্বন্ধে আপনার মনে নিশ্চয়ই ভুল ধারনা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখনও কি সেই ধারণাই পোষণ করে?

গাঢ়ভাবে চিন্তা করে শর্টহার্ডর্স বলল, যে কোন মানুষেরই ভুল হতে পারে তবে কয়েকটি বিষয়ে সকলকেই ভেবে-চিন্তে কথা বলা উচিত।

খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পর গার্ভি উঠে দাঁড়ালেন শোওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। এবং বললেন আমার ইচ্ছে আপনি ভাল ধারণা নিয়ে যান। তাই আপনার রাতটা যাতে আরামে কাটে সেটার বন্দোবস্ত করি। যাওয়ার আগে গাড়ি দরজাটা বন্ধ করে গেলেন। শর্টহার্ডসের গার্ডির সঙ্গে কথাবার্তা বলে মনে হলনা গার্ভি কোন অস্বাভাবিক মানুষ। বরং তার সম্বন্ধে ভুল ধারণার জন্য তার কুণ্ঠাবোধ হল। মনে হল সাইডবোথামের সাবধান বাণীর কোন মানে হয়না। খালি পেটে ছ-মাইল রাস্তা হেঁটে যাওয়ার চেয়ে রাত্তিরটা আরামে ঘুমানো বরং ভাল। গার্ভি ফিরে এসে একটু হুইস্কি খাওয়ার প্রস্তাব করলেন, বললেন খেলে খিদে বাড়বে। শর্টহার্ডসও রাজি হয়ে গেল।

গেলাস নামিয়ে রাখার সময় গার্ভির দিকে নজর পড়ায় তার কণ্ঠস্বরে আশ্চর্য সুর শুনে শিউরে উঠল শর্টহাউস। এক প্রকার আশ্চর্য আলো তার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে তার মুখময় কঠিনতার প্রলেপ পড়ল এবং এটা তার স্নায়ুর উপরে বেশ চাপ দিল। একটা ধোঁয়াটে ভাব তার চোখের সামনে নেমে এলো আর তারই সঙ্গে মনে হল যেন বন্য জর মত তাকিয়ে আছে। একটু আগের সূক্ষর ধারণাটা উবে গেল। কিন্তু আতঙ্কিত শর্টহার্ডস হাসিমুখেই বলল, হুইস্কিটা বেশ সুন্দর।

শর্টহার্ডসের কথা শুনে গার্ডি খুশী হলেন এবং কিভাবে এটা সংগ্রহ করা হয়েছে তা বলতে লাগলেন। ঠিক তখনই মা বলল ডিনার তৈরী।

অন্ধকার পথ দিয়ে খাবার ঘরে যেতে হবে। সেখানেও একটি মাত্র আলো জ্বলছে। গৃহকর্তার জন্যে শুধু স্যুপ কিন্তু তার জন্যে খাবার সরঞ্জাম সাজানো।

গার্ভি বললেন যে তিনি সারাদিনে একবার খান। সে যেন ভালভাবে খাওয়া-দাওয়া করে।

মার্ক্স নামক ইহুদি ভৃত্যটির উপস্থিতি শর্টহার্ডসের একদম ভাল লাগছিল না। তবু সে যখন স্যুপের বাটিটি তার সামনে রাখল তখন শর্টহার্ডস সেটি কোনরকমে পান করল। সে দেখল গার্ভি তাকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে।

শর্টহার্ডস আরো খানিকটা স্যুপ খেতে খেতে গৃহকর্তার দিকে নজর রাখছিল। দেখল ক্রমে তার মুখে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। দ্রুত তার নড়াচড়া লক্ষ্য করল, চোখ বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। গলার স্বরও কাঁপছিল। বেশ নার্ভাস লাগছিল।

গার্ভি বললেন, আপনার সঙ্গে খেতে বসলে ভাল লাগত কিন্তু একটি বিশেষ জিনিস ছাড়া আমি খাই না।

শর্টহার্ডসের এই বিশেষ জিনিস খাওয়া নিয়ে মনে মনে কৌতূহলী হলেও মুখে সে কিছুই বলল না। কিন্তু দেখল গৃহকর্তা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এবং সেটা দেখে মনে মনে ভাবল হেঁটে স্টেশনে চলে গেলেই বরং ভাল হত।

গার্ভি বললেন, আপনি দেখছি মার্ক্স-এর সামনে কথা বলেন না। সেটা অবশ্য ভালই। মানুষ ও ভালোই কিন্তু একটা বাজে অভ্যেস ওর আছে।

শর্টহার্ডস বলল, সেটা কি পানদোষ?

গার্ভি উত্তর দিলেন, আরও খারাপ দোষ। শর্টহার্ডস বলল, দোষ সব ভৃত্যেরই থাকে।

গার্ভি বললেন, আপনি যদি ভয় না পান তবে আস্তে আস্তে বলি। বলে তিনি বলতে লাগলেন, কেননা শর্টহার্ডস জানিয়েছে সে ভয় পায়না।

গার্ভি বললেন আমিই মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যাই শুনে শর্টহার্ডস নিরুত্তর থাকল, কিন্তু তার হৃদযন্ত্র ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গার্ভি বলতে থাকলেন, গর্তের ভিতরে আশ্রয় নেওয়ার ওর একটা ঝোঁক আছে।

শুনে শর্টহার্ডস অবাক হয়ে গেল বলল, কি গর্ত?

সেইসব গর্তে নেমে যায় এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকে, ডেকে সাড়া পাওয়া যায়না। কী যে করে জানিনা।

আশ্চর্য! শর্টহার্ডস প্রশ্ন করল সেখানে সে কি করে হাওয়া বদলায়?

 তিনি বললেন আমার কথা, তাই জানি কি ভাবে শয়তানটা গর্তে থাকে।

শর্টহাউস-এর প্রশ্ন, কোনদিন ওকে অনুসরণ করে দেখা হয়েছে কিনা।

গার্ভি বললেন– না। সেই গর্তে দুজনে যাওয়া যায় না বলেই মার্ক নিশ্চিন্ত। তার কোন ভয় নেই। শর্টহার্ডসের মন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল। ভয়ে কথা আটকে গেল। চোখের পলক পড়ল না। দেহমন সব মনে হল সাড়হীন হয়ে গেছে। সে দেখল, গার্ভির মুখে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিশ্রীকুৎসিত প্রাণীর ছায়া।

আবার একটু পরেই সেই ছায়া সরে গেল। মনের কুয়াশাও অপসারিত হল। যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে গার্ভি বলল অনেকদিন এই সব ব্যাপার নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। তার বুক ধড়ফড় করছিল। মনে হচ্ছিল বুকের উপরে কিছু একটা ভারি বস্তু চাপা রয়েছে।

গার্ভি বললেন, তার এসব ব্যাপার নিয়েই কৌতূহল। এসব নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন।

পায়ের শব্দ দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলে গার্ভির মুখ উত্তেজনায় ভরে গেল। টেবিল শক্ত করে ধরে বললেন আমার খাবার আসছে। তার মুখ এক বন্য জন্তুর মত হয়ে গেল। নেকড়ের মত চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করল শর্টহার্ডস। ওপরের ঠোঁটের জায়গায় চচ্চকে দাঁত বেরিয়ে এলো। সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল।

দরজা খুলে মার্ক্স খাবার ভর্তি একটা ডিসগার্ভির সামনেরাখতেই শর্টহার্ডস দেখল সেটা থেকে সদ্য নিহত প্রাণীর তাপের ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সেই মাংস তুলে গার্ভি খেতে লাগলেন। তার ঠোঁট ও চোয়াল রক্তে ভরে গেছে। শর্টহার্ডস আর সহ্য করতে পারল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। আতঙ্কিত হয়ে শর্টহার্ডস এই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল।

একসময় গার্ভি স্বাভাবিক ভাবে তাকে বললেন–আপনি এ খাবার নিশ্চয়ই খেতেন না। আপনার খাওয়া আশাকরি পরিতৃপ্তি সহকারেই হয়েছে। মার্ক্স এখুনি আসবে। সে গর্তের মধ্যে চলে গেছে কিংবা আমাদের কথা শুনেছে নিশ্চয়ই।

শর্টহাউস প্রশ্ন করল গার্ভির কাছে মার্ক্স-এর আসার কোন নির্দিষ্ট সময় আছে কিনা।

উত্তরে তিনি বললে অন্যদিন সে চলে গেলেও আজ সে চলে যায়নি। কেননা তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

গর্ত বলতে গার্ভি কি বলছেন শর্টহার্ডস তা বুঝতে পারল না। গর্ত মানে কি মদ রাখার কুঠুরি সে দেখল, মার্ক্স জল ও তোয়ালে নিয়ে এলে পশুর আদর খাওয়ার কায়দায় গার্ভি মুখ এগিয়ে দিলেন। গার্ডি এবার শর্টহার্ডসকে লাইব্রেরিতে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। এবং শর্টহার্ডস তার পিছু পিছু এগিয়ে চলল। গার্ভি তৎক্ষণাৎবলেন ব্যাগে কি কাঁচা মাংস আছে যে ওটা সবসময় আপনার সঙ্গ নিচ্ছে।

শর্টহার্ডস জানে ব্যাগের মধ্যে কি আছে তা জানতে পারলে গার্ভি তার উপর হামলা করবে, তাই সহজ সুরে বলল না ওর মধ্যে কাগজপত্রই আছে। কিন্তু গার্ভি নিঃসন্দেহ হতে পারলেন না ব্যাগটা পর্যবেক্ষণ করে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। গার্ভি সেই সময় শর্টহার্ডসের হাত এমন জোরের সঙ্গে চেপে ধরেছিল যে তার হাতটা বেশ ব্যথা করতে লাগল। এবং ব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেল গার্ভি তখনই তার দিকে ফিরে দাঁড়ালো। কিন্তু অবিলম্বেই শর্টহার্ডস নিজেকে সামলে নিয়ে তার দিকে কঠোর ভাবে তাকিয়ে রইল।

ফায়ার-প্লেসের সামনে দুজনে গিয়ে বসে কফি খেতে লাগল। এবং এই গনগনে আগুনের তাপটা তার কাছে বেশ আরামদায়ক লাগল। কফি ও চুরুট খেতে খেতে সে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলল।

খানিকক্ষণ বসে থাকার পর গার্ভি বললেন তাকে মাংস খেতে দেখে শর্টহার্ডসের নিশ্চয়ই অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু তিনি নিরুপায়। দিনে মাত্র একবার। এছাড়া তিনি আর কিছুই খাননা শর্টহার্ডস এই কথার জের টানতে চাইছিলেন না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে আমিষ বা নিরামিষ খাবারের গুন সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করলেন। কিন্তু গার্ভির তাতে কোন উৎসাহ ছিল না।

তার কথা শেষ হতেই গার্ভি বললেন খিদে পেলে নিজেকে তার সামলানো মুশকিল। তখন কাঁচা মাংস চাই-ই তার। সে যে প্রাণীই জুটুক না কেন। তিনি বললেন বছর খানেক আগে মার্ক্স এর অনুপস্থিতিতে এমন খিদে পেয়েছিল তার যে তিনি নিজেকেই কামড়াতে থাকতেন। একসময় খিদে অসহ্য হয়ে উঠতেই ঠিক সেই মুহূর্তেই পোষা কুকুরটা সোফার তলা থেকে বেরোতেই তার খিদের সমস্যা মিটিয়ে ফেললেন। মার্ক্সকে তিনি অনেক বার কামড়েছেন তবে মার্ক্সের গা খুব তেতো। তিনি বললেন হয়তো বা সেই জন্যই মার্ক্স গর্তের মধ্যে ঢুকে যায়।

এসব কথা বলার পর বিকট ভাবে তিনি হাসতে লাগলেন। অগ্নিস্থানে শর্টহার্ডস শিক দিয়ে আগুনটাকে একটু খুঁচিয়ে দিল এমনভাবে মনেহয় জীবনটা তার এর উপরেই নির্ভরশীল। যাইহোক শর্টহার্ডস গার্ভির কাছ থেকে শুতে যাওয়ার অনুমতি চাইল তাকে তার বিশ্রামের ঘরটা দেখিয়ে দিতে বলল কেননা সে বড়ই ক্লান্ত। গার্ভি সম্মত হয়ে টেবিলের মোমবাতিটা জ্বালিয়ে বললেন মার্ক্স এখন গর্তে চলে গেছে তাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা সুন্দর ঘরে শর্টহার্ডসের শোওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন। ঘরটা ভাল করে দেখার পর শর্টহার্ডসের বেশ পছন্দ হয়ে গেল। বিছানার পায়ের কাছেদুটো মোমবাতি ছিল সেদুটো গার্ভি জ্বেলে দিলেন। গনগনে আগুন রয়েছে। ঘরের বিপরীতে দরজার মত দুটো জানালা খোলা। ঘরে কয়েকটি ছবিও আছে দোর গোড়ায় গার্ভি দাঁড়িয়ে বললেন আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস সবই এখানে আছে, তাও যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে ঘণ্টা বাজাবেন। মার্ক্স শুনতে না পেলেও গবেষণাগার থেকে আমি শুনতে পাব। আমি ওখানে সারারাত কাজ করি। এই কথা বলার পর তিনি প্রস্থান করলেন। আর তখনই এক আশ্চর্য কাণ্ড করল শর্টহার্ডস। পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে জানলার দিকে ধরে আধ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল তারপরেই পিস্তলটা দরজার চাবির গর্তের মুখে ঢুকিয়ে ধরে থাকল খানিকক্ষণ। তার পরেই চলা ফেরার আওয়াজ হল দরজার বাইরে। এবং ক্রমশঃ আওয়াজটা পিছু হটতে লাগল। শর্টহার্ডস নিজের মনেই যা ভেবেছিল ঠিক তাই। হাঁটু পেতে দরজার চাবির ফুটোয় চোখ লাগিয়ে বসেছিল। ফুটো দিয়ে বন্দুকের নল দেখে পিছু হটে চলে গেল। ক্ৰমশঃ পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। দরজাবন্ধ করার সময় শর্টহার্ডসের নজরে পড়ল চাবির ফুটোর উপরে আর একটা চাবির গর্ত তখনই সেটা কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দিল। এবং ভাল ভাবে সবটা পরীক্ষা করে সন্দেহ হবার মত কিছুই সে দেখতে পেলনা। ঘরের ভিতর কেউ কোথাও লুকিয়ে নেই দেখে নিশ্চিন্ত বোধ করল।

ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল গরাদহীন জানলার নীচে একটা বারান্দা। নীচে থেকে সেটা প্রায় কুড়ি ফুট উঁচুতে। বেশ বড়সড় বিছানাটা আরামপ্রদ। ফায়ার প্লেসের পাশে দুটো হাতলওয়ালা চেয়ার। কিন্তু ক্লান্ত শর্টহার্ডস ঠিক করল শোবেনা। সে সতর্কতা মেনে চলবে। একটি চেয়ারে বসে সে উপলব্ধি করল কেউ যেন তার প্রতি নজর রাখছে। কিন্তু কি ভাবে তাকে আঘাত করবে বুঝতে না পেরে নিজের মনের ওপর জোর খাটাতে চেষ্টা করল। ভয়কে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে চলল। নিস্তব্ধ রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের দাপটও কমে আসতে লাগল। মাঝে মাঝে জানলায় তুষারের ঝাপটা এসে লাগতে লাগল। বোঝা গেল দুর্যোগ এখনো শেষ হয়নি।

ক্রমে তার নিদ্রা আসছে আর বর্তমানে যে আতঙ্ক তাকে ঘিরে রয়েছে তা শিথিল হয়ে আসছে। তবে এই পরিবর্তনটা তার গোচরে আসছেন। তার মনে হচ্ছে বিপদ সম্বন্ধে সে অবগতই আছে। শর্টহার্ডস মনে জোর আনবার চেষ্টা করছে।

জোর করে মনের কোণে জেগে থাকা কুৎসিত দৃশ্যগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। আর ঘুম ক্রমশঃ আঁকড়ে ধরছে তাকে। গনগনে আগুন আর বিছানা তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতে আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। ঠিক ঘুমিয়ে পড়বার আগেই সে বিপদের সংকেত পেল। মনে হল কে যেন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে। লাফ দিয়ে শর্টহার্ডস উঠে পড়ল আর এক লাফে দরজার চাবির গর্ত আড়াল যাতে না হয় এমন ভাবে ঘরের বিপরীত কোণে গিয়ে দাঁড়ালো।

ধীর পায়ে সাবধানের সঙ্গে যে আসছিল সে মনে হল দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে শর্টহার্ডস পকেট থেকে পিস্তল বার করে সতর্ক হয়ে দাঁড়ালো ঠিক তখনই পায়ের আওয়াজ একেবারে থেমে গেল। বোঝা গেল লোকটা দরজার কাছে থেমে গেছে। চাবির গর্ত দিয়ে ঘরের ভিতর লক্ষ্য করছে। শর্টহার্ডসভীতু প্রকৃতির নয় যথেষ্ট মনোবল আছে ওর। কিন্তু এই রহস্যজনক ঘটনায় সে একটু চিন্তিত হয়েছে মাত্র। তার মনে হচ্ছে পশুভাবাপন্ন গার্ভি ওইহুদি ভৃত্যটির সম্মুখীন হওয়ার থেকে একপাল নেকড়ের সঙ্গে দেখা হওয়া ভাল। শর্টহার্ডস দেখল কি একটা জিনিস দরজা ছুঁয়ে এগিয়ে এল। শর্টহার্ডস শিহরিত হল। সে ঘামতে লাগল। শক্ত হাতে পিস্তুলটা চেপে ধরল। দরজা খুললেই ঐ ব্যক্তি তার পিস্তলের সামনে পড়বে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি জানে দরজা ভিতর থেকে চাবি বন্ধ করা। কাজেই দরজা খোলা মুশকিল। সঙ্গে সঙ্গে চাবির গর্তে গোঁজা কাগজ মাটিতে পড়ে গেল। যেটা দিয়ে সে কাগজের টুকরোটাকে ফেলেছিল সেটা শর্টহার্ডসের নজরে পড়ল।

বুঝতে কষ্ট হলোনা বাইরে থেকে কোন ব্যক্তি ঐ গর্ত দিয়ে ভেতরে নজর রাখছে। সঙ্গে সঙ্গে শর্টহার্ডসের মনে হল প্রতিশোধ নেবার সেই ইচ্ছেয় গর্তের পাশে সজোরে হাত ঠুকলো। সেই শব্দ মনে হয় দরজার পাশে থাকা ব্যক্তির কানে সজোরে আওয়াজ সৃষ্টি করেছে। সে ভয় পেয়েছে বোঝা গেল। তখনই দরজার কাছে কেউ আছে সে বুঝল। আর ভয় পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে গেলল। তবে এবার দুজন এসেছিল। গর্তের মধ্যেকাগজটা গুঁজে দিয়ে অগ্নিস্থানের দিকে শর্টহার্ডস ফিরে আসতে গিয়ে চোখ পড়ল জানলার উপরে। সেখানে একটা সাদামুখ। বরফের জন্যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ভালো করে দেখবার আগেই মুখটা সরে গেল। বুঝতে পারল শর্টহার্ডস দু-দিক দিয়েই তার উপর নজর রাখা হচ্ছে। যেন তেমন কোন ঘটনাই হয়নি এমনভাবেশর্টহার্ডস আগুনটা উসকে দিয়ে জানলার কাছে গেল এবং দৃঢ় ভাবে জানলাটা খুলে বারান্দায় গেল সে। কিছুক্ষণ আগে মনে হচ্ছিল ঝড় বুঝি থেমে গেছে কিন্তু বারান্দায় এসে বুঝল তার ধারণা ভুল। ঝড়ের ঝাপটা এসে ঘরের মোমবাতি নিভিয়ে দিল। বৃষ্টি এসে মুখময় ভিজিয়ে দিল। গাঢ় অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পেলনা। শর্টহার্ডস গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল।

খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে হল এখানে কেউ নেই। ক্রমে তার চোখে অন্ধকার ধাতস্থ হয়ে গেল। তখন সে অন্য জানলা দিয়ে আলোর রেখা দেখতে পেল। সেই জানলার কাছে পৌঁছবার জন্যে যেখানে বারান্দায় সে দাঁড়াল সেখানে শটহার্ডসের গায়ে একটা আলোর টুকরো ওর গায়ের উপর পড়ে থাকায় নীচের থেকে তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ওপর থেকে যে শর্টহার্ডসকে দেখা যায় তা শর্টহার্ডসভাবতে পারেনি। খেয়াল হতেই দেখল তার মাথার ওপরে কী যেন একটা নড়াচড়া করছে। দেখল একটা মোটা কালো দড়ি কে যেন উপর থেকে টেনে তুলে নিল। শর্টহার্ডস যেন মাথায় রক্তচাপ অনুভব করল। শর্টহার্ডসের মনে হল ঘরের সব জায়গাতেই যেন অনেক ইহুদির কুৎসিত ছায়া তার দিকে চেয়ে রয়েছে। শটহার্ডসের দৃষ্টি পড়ামাত্র তারা সরে যাচ্ছে। কিন্তু অনুভব করছে সে এখন দুর্বলতা প্রকাশ করলেই তারা আবার এগিয়ে আসবে। কেননা তার মনে হয় তার অজ্ঞাতসারেই একটা ষড়যন্ত্র চলছে। তাই সে সদা জাগ্রত থাকল। এবং ঘুমকে এড়ানো মুশকিল হয়ে গেল। এই কারণেই সে পেনসিল দিয়ে ঘরের ফার্নিচারের ছবি আঁকতে লাগল ও নকল করা শুরু করল প্রতিটি ছবির। বেশ ভালভাবেই এ বিষয়টি তাকে মুগ্ধ করায় ঘুম চলে গেল। এবং দেখল প্রত্যেকটি ছবি খুব সুন্দর ভাবে আঁকা।

আলোর স্বল্পতার জন্য সে এখন অগ্নিস্থানের ছবিগুলোই আঁকতে লাগল। আর বারবার জানলার দিকে নজর দিচ্ছিল। কিন্তু সেই মুখটি আর দেখা গেলনা। মাঝে মাঝেই দরজায় গিয়ে কান পেতে ও কোন আওয়াজ পেলোনা। এবার সেআক্রমণের ভয় থেকে নিশ্চিন্ত হল। বারান্দায় গিয়ে দেখল উপরের জানলার খড়খড়িগুলো বন্ধু। তুষার ঝড় বইছে। বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে চলে এলো। বেশ কয়েক ঘণ্টা এইরকম করেই কেটে গেল। আগুনটা নিভে গেছে। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। দুটো মাথা স্কেচ করতে করতে ক্লান্তি বোধ করল সে। রাত প্রায় তিনটের সময় উঠে দাঁড়ালো সে। এবং সে নির্ভয়ে ঐ পোশাকেই ব্যাগটা পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্ত হয়েই। হঠাৎ তার মনে হল কে যেন তাকে স্পর্শ করেছে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে সে নিশ্চিত হয়ে দেখল, না কোটের পকেটে কাগজগুলো ঠিকই আছে। কিন্তু শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো ঘরের মধ্যে পরিবর্তন দেখে। ঘরের জানলাটা ভিতর থেকে বন্ধ কিন্তু দরজাটা ভিতর থেকেই ভোলা এবং বারান্দায় পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। সে পিস্তলটা বার করে বিছানার থেকে নেমে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গেই পায়ের শব্দও থেমে গেল। সে আগন্তুকের জন্য অপেক্ষা করে থাকল, সে ঘরে প্রবেশ করল।

আর লুকোচুরির অবকাশ নেই। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে দেখতে না পেয়ে মোমবাতির আলো জ্বাললো। মনে মনেশর্টহার্ডস ভেবেছিল এখনই সেআঘাত পাবেকিন্তু তা হলোনা। আলো জ্বেলে কাউকে দেখতে পেলোনা। কেবল দেখল ব্যাগটা নেই। শর্টহার্ডসের আর ঘুম হলোনা। রাত এখন চারটে। ভোর হতে আরও তিন চার ঘন্টা বাকি। অগত্যা সে আবার ছবি আঁকতে লাগল। নতুন করে আবার লোকটির মাথা আঁকায় মন দিল সে। কিন্তু বার বার সে ব্যর্থ হতে লাগল। এরকম কেন হচ্ছে পরিষ্কার সেবুঝতে পারলনা। মনেহল চোখ দুটোই তার কারণ। পেন্সিল নিয়ে ছবিটার দিকে এগিয়ে গেল নাক আর চোখের দূরত্বের আন্দাজ করতে।

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখল চোখের পাতা দুটো বন্ধ হয়ে গেছে, আরো আশ্চর্য হয়ে সে দেখল তার সামনেই আবার চোখের পাতা দুটো খুলে গেল। এবং তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বুঝতে কষ্ট হলো না ছবির চোখ দুটো কেটে ফেলে দিয়ে সেখানে জীবন্ত মানুষের চোখ চেয়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার ভয় দূরীভূত হয়ে ক্রোধের জন্ম নিল। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে ছবিটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই চোখদুটো সরে গিয়ে ছবিটা পড়ে গেল মাটিতে। শর্টহার্ডস বাঁ হাতে একটা পা টেনে নিয়ে এসে ডান হাতে পিস্তল উচিয়ে ধরল। টেনে এনে লোকটাকে দেখল সেইহুদি চাকরটা। শর্টহার্ডসের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। সেই সময় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে গার্ভি এসে দুজনের মধ্যিখানে দাঁড়ালো এবং চিৎকার করে উঠলেন ওকে মারবেন না। গার্ভি মার্ক্সকে ধরে কুকুরের মত ঝাঁকাতে লাগলেন, এইটাই তোর গর্ত? তোকে সারারাত ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি আমি। এইবার তোকে ঠিক ধরেছি। বলতে বলতে গার্ভি উপরের ঠোঁট তুলে দাঁত বার করলেন। মাও তাই দেখে ভীষণ চিৎকার আরম্ভ করল, আর নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল।

শর্টহার্ডসের সামনে যেন একটা অধ্যায় শেষ হল। তৎক্ষণাৎ গার্ভির মুখে সেই ছায়াটাও দেখা গেল। এখুনি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখে মার্ক্স পিস্তল সামনে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। শর্টহার্ডস দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে দেখল মার্ক্সকে গার্ভি তখনও ঝাঁকিয়ে চলেছেন। ততক্ষণে শর্টহার্ডস সিঁড়ির ধাপে এসে পড়েছে। প্রচণ্ড রাগে পশুর মত মুখ গার্ডি আর মার্ক্স ভয়ে আতঙ্কিত। কিন্তু এবার দুজনেই শর্টহার্ডসের দিকে ধেয়ে এলেন রাগে। সেই মুহূর্তেই শর্টহার্ডস তাদের মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। দৌড়ে সিঁড়ির নীচে ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। আর মার্ক্স ও গার্ভি তাকে অনুসরণ করে ধাওয়া করে গেল। সুযোগ বুঝে শর্টহার্ডস সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে ওদের অগোচরে শোওয়ার ঘর অতিক্রম করে জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নরম বালির উপর। এবং দৌড়তে দৌড়তে ওদের চিৎকার শুনতে পেল। কয়েক ঘন্টা পরে বাড়ি পৌঁছে জানল সাইড বোথাম তার মাইনে বাড়িয়ে কোট ও শার্টও নতুন করে বানিয়ে দিতে চেয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *