৪. পিকাডিলি হোটেলের লবিতে

পিকাডিলি হোটেলের লবিতে ওয়েসলির সঙ্গে মিলিত হবার পর থেকেই জুলি খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। ওয়েসলির সঙ্গে দেখা হবার আগে অবধি বিকেলটা ওর ভালই কেটেছিল। ওর সবচেয়ে ভাল পোশাকটা পরেছিল। থিও ওর পিছু নিতে পারেনি, সেজন্যে মনে উত্তেজনা ছিল। বাস থেকে নেমে মুখ লুকিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার মধ্যেও উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ওয়েসলি অন্ধের ভান করছে জুলি তা জানত। আর যেভাবে মানুষ ওয়েসলির দিকে তাকাচ্ছিল, পথ ছেড়ে দিচ্ছিল সাহায্য করতে চাইছিল, তাতে জুলি বেজায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছিল।

ওর মনে হচ্ছিল ঈশ্বর সহসা ক্রুদ্ধ হয়ে ওয়েসলিকে শিক্ষা দেবার জন্যে সত্যিই অন্ধ করে দেবেন। ওয়েসলির পক্ষে এরকম আচরণ অনুচিত।

ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করলে জুলির অস্বস্তিটা টের পেয়ে ওয়েসলি হেসে বলল, বেচারা জুলি! তুমি নিশ্চয় বিব্রত বোধ করছে। ভেব না অভ্যেস হয়ে যাবে।

জুলি রেগে গিয়ে বলল, কিন্তু এরকম আচরণ করাটা অন্যায় হচ্ছে।

ওয়েসলি সহসা শানিত গলায় বলল, অভিনয় যখন করতে হয়, তখন নিখুঁত হওয়া চাই। আমাদের যদি সম্পর্ক রাখতেই হয়, তবে আমি যেরকম, সেটাই তোমায় মেনে নিতে হবে।

ডিউক স্ট্রীটে এস্টেট এজেন্ট ফাউলার অ্যান্ড ফ্রিবডির অফিসের সামনে ট্যাক্সি থামলো।

ওয়েসলি তার কি দরকার বলতে মিঃ ফাউলার চমকিত হয়ে জুলির দিকে তাকালেন। ওঁর চোখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হল ও রেগে গেল। উনি বার্কলে স্কোয়ার আর ভিগো স্ট্রীটে দুটো ফ্ল্যাটের বর্ণনা দিলেন।

ট্যাক্সি নিয়ে ওরা দুটো জায়গাই গেল। জুলির ভিগো স্ট্রাটের ফ্ল্যাটটাই বেশি ভাল লাগল। শোবার ঘরে গাঢ় নীল ছাতে রুপোলি তারা আঁকা। গোলাপী কাঁচের আয়না দিয়ে একদিকের দেওয়ালের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঢাকা।

 জুলি উত্তেজিত হয়ে ছোটাছুটি করে শোবার ঘর, বাথরুমটা দেখে মহাখুশী। ওয়েসলি ওকে দেখছিলেন। ওঁর চাউনিতে বিদ্রূপ ফুটে উঠলো।

জুলি বলল, এটা চমৎকার। বার্কলে স্কোয়ারের ওই আদ্যিকালের ফ্ল্যাটের চেয়ে এটা অনেক ভাল।

ওয়েসলি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, তুমি খুশী হলেই হলো, কিন্তু আমার মনে হয় এ জায়গাটা খেলল। খারাপ মেয়েমানুষদের জায়গা।

জুলি লাল হয়ে গিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, সে আমি জানি না। এ জায়গাটা আমার চাই।

–বেশ, তোমার যখন ভাল লেগেছে তাহলে এটাই নাও।

–হ্যাঁ, আমি এটাই চাই। মনে মনে ভাবল, ওয়েসলির যদি জায়গাটা পছন্দ না হয়, তিনি না এলেই হলো।

ওরা যখন এজেন্টের অফিস থেকে বেরুল, ওয়েসলি ওর হাতে সামনের দরজার চাবি দিলেন।

চাবিটা নিয়ে ধন্যবাদও দিল না জুলি। ওর রাগ তখনো পড়েনি।

ওয়েসলি বললেন, এখন বোধহয় তোমায় কিছু পোশাক কিনে দিতে হবে। এখন আর তোমার জীবন সেই ব্রিজ কাফে, হ্যারি গ্লেব, ব্ল্যাক মার্কেটে জড়িয়ে নেই। বুঝেছ? না বোঝনি।

তাই হবে। জুলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল। সেই পুরোন দলের কারোর সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হবেনা তার। জুলি যে পুলিশকে সব বলে দিয়েছে, আজ হোক কাল হোক সে কথা ছড়িয়ে পড়বেই। একবার জানাজানি হয়ে গেলে আর কেউ জুলিকে পাত্তা দেবে না।

ওয়েসলি ওর জন্যে জমকালো নয় তবে চমৎকার কাটছাঁটের সব পোশাক কিনলেন। সে পোশাক পড়ে দোকানের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জুলি দেখল তাকে বেশ অভিজাত আর স্মার্ট দেখাচ্ছে। দোকানের লোকটি বেরিয়ে যেতে ওয়েসলি ওর দিকে মুগ্ধ চোখে চাইতে জুলি খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল।

তবে যখন ওয়েসলি ওকে একটা মিল্ক কোট কিনে দিলেন, তখন ওর আনন্দ আর বাঁধ মানে না। তখনি জুলি ওয়েসলির সব রকম খুঁতখুঁতুনি ক্ষমা করে দিল।

ওয়েসলি বললেন, এখন আমি কারখানায় যাচ্ছি। আশা করি তোমার বিকেলটা ভালই কাটবে।

 মিল্ক কোটটা পেয়ে জুলি বেজায় আনন্দিত। ও ওয়েসলিকে কিছু প্রতিদান দিতে চাইল।

ওয়েসলিকে চোখের ইশারায় আমন্ত্রণ জানিয়ে জুলি বলল, হাওয়ার্ড, তুমি কি আমার ফ্ল্যাটে ফিরতে চাও?

চমকে, অসহজ ও অস্বস্তির হাসি হেসে, ওর হাতে আদর করে ওয়েসলি বলল, এখন নয় জুলি, আমাকে কাজের জায়গায় ফিরতে হবে।

তাড়াতাড়ি ওয়েসলি একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসল। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। জুলি সেদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ক্রুদ্ধ জুলি ভাবল, নাকউঁচু, অহঙ্কারী লোক কোথাকার! ঠিক আছে আমাকে না চাইলে আমার বয়েই গেল। পরে যদি ওর ইচ্ছে হয়, আমার ইচ্ছে হবে না।

যে সাদা পোশাকের ডিকেটটিভটি পরম ধৈর্যে ওদের সারা বিকেল অনুসরণ করেছে ওয়েসলিকে চলে যেতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সারা বিকেলটা বেজায় হয়রানি গেছে। এখন হেড অফিসে গিয়ে রিপোর্ট দিতে হবে।

জুলির পেছন পেছন যেতে যেতে ওর মনে হল, এ আবার কি নতুন খেলা শুরু হল। মনে হচ্ছে, ওয়েসলি ওকে নতুন বাসায় তুলছেন? জুলি তাড়াতাড়ি হাঁটছিল। ওর সুডোল পা দুটো দেখতে দেখতে ও ভাবল ওয়েসলিকেও তো দোষ দেওয়া যায় না, অন্ধ হলে কি হবে মাল ভাল পেয়েছে।

জুলি বোঝেনি ওকে কেউ অনুসরণ করছে। ও পিকাডিলির দিকে যেতে লাগল। পুরো সন্ধ্যাটা ওর সামনে। ওর এখন আনন্দ করতে ইচ্ছে হলো।

.

মিসেস ফ্রেঞ্চের অফিস থেকে বেরিয়ে হার্লেকুইন ক্লাবে এসেছে হ্যারি গ্লেব। এখন ওর একটু মদ দরকার। চুরির বিষয় সমস্ত খুঁটিনাটি ব্যবস্থা শেষ হল।

সিঁড়ি দিয়ে ক্লাবেউঠতে উঠতে হ্যারি ভাবল, শুধুই মনে হচ্ছে বিপদ হবে। যা এটাই শেষ, আর একাজ অন্ততঃ কিছুকাল করবো না। যথেষ্ট হয়েছে।

লাউঞ্জে ঢুকে দারোয়ানের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে সোজা বারে ঢুকে গেল। সাড়ে চারটে বেজে ক-মিনিট হয়েছে। দুজন বেশ্যা টুলে বসে হুইস্কি খাচ্ছে।

হ্যারিকে দেখে, বেশ্যা দুটোর সঙ্গে কথা বলে ক্লান্ত বারম্যান খুশিতে চিকমিকিয়ে উঠল। কিন্তু হ্যারির কথা বলার মেজাজ নেই। ও ডবল হুইস্কি নিয়ে জানলার ধারের একটা টেবিলে একা এসে কল।

সারারাত ধরে হ্যারি জুলির কথা ভেবেছে। রাতে না ঘুমলে ওর শরীর খারাপ হয়।

আগামীকাল আমাদের কাজ হাসিল হবে। তারপর জুলির মন ফেরাবার চেষ্টা করব। ওকে । যদি এই কাজে না জড়াতাম, তাহলে ওকে নিয়ে কোন ঝামেলাই হতো না।

হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে হ্যারি চিন্তা করতে লাগল, মিসেস ফ্রেঞ্চের পক্ষে জুলিকে ফ্ল্যাটে রেখে এস বলা খুব সোজা। সেটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে জুলিকে নিয়ে আমি যদি কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকি কিংবা দেশ ছেড়ে পালাই দুজনে, সেটাই ঠিক কাজ হবে।

কিন্তু জুলি কি আমার সঙ্গে আসতে রাজী হবে?

হঠাৎ ওর মনে পড়ল আজ বিকেলটা জুলি যদি ছুটি পায়। কি করছে ও? ও নিশ্চয় ওয়েস্ট এন্ডে গোমড়া মুখে দোকান দেখে বেড়াচ্ছে।

দেখি, ওকে একটু খুঁজে দেখি। হয়তো বুঝিয়ে বললে বুঝবে।

 বারম্যানের দিকে মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়ে ও ক্লাব থেকে বেরিয়ে পিকাডিলি পৌঁছে পার্ক লেনের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলো। হাইড পার্ক অব্দি গিয়ে ও বার্কলে হোটেলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে ও হঠাৎ জুলিকে দেখল, জুলি চটপট হেঁটে পিকাডিলির দিকে যাচ্ছে।

একেই বলে ভাগ্যি। জুলিকে দেখতে পেয়ে হ্যারির বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ফুলে ফুলে উঠছে।

ট্রাফিক আলোর সঙ্কেতে গাড়িগুলো গতি কমাতেই ও রাস্তা পেরিয়ে জুলির পেছনে ছুটল। সাদা পোষাকের ডিটেকটিভটা হ্যারিকে ওর পেছনে আসতে দেখে ভাবল এ আবার কোত্থেকে এল, কি চায়? একটু পিছিয়ে ও হ্যারিকে এগিয়ে যেতে দিল।

হ্যারি তখন এতই ব্যস্ত, যে ডিটেকটিভকে, ও দেখতেই পেলনা। জুলি রাস্তা পেরোবে বলে দাঁড়িয়ে আছে, তখন হ্যারি এসে ওকে ধরে ফেলল।

টুপি তুলে বলল, হ্যালো আমি একটু কথা বলতে চাই। আমাদের প্ল্যান বদলে গেছে।

জুলি রেগে গিয়ে বলল, আমি কথা বলতে চাই না, চলে যাও।

হ্যারি ওর হাত ধরে বলল, কাজের কথা। গোয়ার্তুমি কোর না। কোণেই একটা ক্লাব আছে। ওখানে বসে কথা বললে কেউ দেখতে পাবে না।

জুলি ইতস্ততঃ করলো। ভাবলো, প্ল্যান যদি সত্যিই বদল হয়ে যায়, তবে ওয়েসলিকে তা জানাতে হবে।

–ঠিক আছে। রেগেই বলল। রিজেন্ট স্ট্রীট ধরে ওরা এগোল।

জুলি ভাবল হ্যারির সঙ্গে দেখা হয়ে ওর সন্ধ্যেটা মাটি হল। ভেবেছিল একটা সিনেমা দেখে পার্কওয়েতে ফিরবে।

হার্লেকুইন ক্লাব এখন খালি। ওরা ঢুকল। হ্যারি জানতে চাইল জুলি কি খাবে।

–কিছু না। তোমার কাছ থেকে কিছুই চাই না আমি। জুলির সংক্ষিপ্ত জবাব।

 হ্যারি ডবল হুইস্কির অর্ডার দিল।

 জুলির মুখোমুখি বসেও জিজ্ঞেস করল, জুলি তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপর এখনো রেগে নেই? এ ঝামেলার কাজটায় জড়িয়ে পড়ে, এখন তো আর পেছতে পারব না?

জুলি অধৈর্য হলে উঠল।

বলেছো কাজের কথা বলতে চাও, কি বলার আছে বল, আমাকে যেতে হবে।

 হ্যারি এতক্ষণে জুলির শীতল চাহনি, অচেনা চাহনি ভাল করে দেখল। দেখে হ্যারি বুঝল জুলি আর ওকে ভালবাসে না। ও কেমন চুপসে গেল।

 ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত গলায় বলল, কাজটা হলে তোমাকে ওখানে রেখে আসাটা আমার ভাল লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে ও ব্যবস্থাটা নিরাপদ নয়। তার চেয়ে তুমি আমার সঙ্গে চলে এসো চুরির পর। কোথাও গা ঢাকা দেব আমরা। তারপর জাহাজে চড়ে আমেরিকা পালার।

জুলি এমনভাবে ওর দিকে তাকাল, যেন হ্যারি পাগল হয়ে গেছে।

ধারালো গলায় জুলি বলল, ওখানে যেতে আমি ভয় পাই না। তবে কাল রাতেই তো আমি তোমাকে বলে দিয়েছি যে তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না আমি।

হ্যারি একটু সামনে ঝুঁকে বলল, দেখ জুলি, আমি স্বীকার করছি, আমিই এ ফাঁদে তোমায় ফেলেছি। আমি শুধু খানিকটা টাকা চাই। তারপরই আমি সোজা রাস্তায় চলব, ভাল হয়ে যাবো। সত্যি বলছি জুলি, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারছি না।

হ্যারির কথাগুলো নয়, যে ভঙ্গীতে ও কথাগুলো বলল, তাতে জুলির মনে গভীর ভাবে একটা ধাক্কা লাগলো।

না। চেঁচিয়ে উঠল জুলি। তোমার সঙ্গে আমি জীবনেও যাব না। কিন্তু হ্যারি আমি তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। সময় থাকতে সরে যাও। আমি জানি একাজ করে পার পাবেনা তুমি। দোহাই তোমার একাজ কোর না।

হ্যারি ওকে বাধা দেবার আগেই ও লাফিয়ে দরজার দিকে ছুটল।

 হ্যারি একমিনিট মূঢ়ের মত তাকিয়ে থেকে, তারপর চেয়ারটাকে লাথি দিয়ে পেছনে ঠেলে জুলির পেছনে ছুটল। সিঁড়িতে জুলিকে ধরে ফেলল।

জুলি? কি বলছ তুমি? কি জান?

ও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে হ্যারি ওকে আরো শক্ত করে ধরে ওর চোখে চোখ রাখল।

ওকে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি নিশ্চয় বলে দাওনি সব। বলে দিয়েছ? পুলিশকে বলে দিয়েছ?

না। আমি ভয় পাচ্ছি শুধু। এ কাজ বেজায় বিপদের। আমার শুধু মনে হচ্ছে একাজ সফল হবে না। জুলি কথাগুলো বলে গেল।

হ্যারির সন্দিগ্ধ চোখ দুটো ওর মুখে কি যেন খুঁজেই চলেছে।

 জুলি বলল, যেতে দাও আমায়। শুনছ? যেতে দাও আমাকে ছেড়ে দাও।

 সিঁড়ির নিচ থেকে একটা কঠিন কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কি মিস? লোকটা কি আপনাকে জ্বালাতন করছে?

ওরা নিচের দিকে চেয়ে দেখল বিশালাকার একটা লোক কপালটাকা টুপি আর বর্ষাতি পরে ওদের দিকে চেয়ে আছে। হ্যারি দেখেই চিনতে পারলো ও সেভিল–রো পুলিশ ফাঁড়ির সাদা পোশাকি ডিটেকটিভ। ও তাড়াতাড়ি জুলিকে ছেড়ে দিল।

–ঠিক আছে। বলে ও সিঁড়ি দিয়ে নেমে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামলো

 ডিটেকটিভ হ্যারিকে বলল, একটু খেয়াল রেখো ভায়া। নইলে আমার সঙ্গে তোমাকে একটু বেড়াতে যেতে হবে।

হ্যারি বলল, খেয়াল থাকবে।

 হ্যারি ক্লাবে ফিরে গেল।

.

হ্যারি যখন জুলিকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করছিল যে ও তাকে ভালবাসে, মিসেস ফ্রেঞ্চ তখন থিওর সঙ্গে চুরির বিষয়ে শেষ খুঁটিনাটি আলোচনা করে নিচ্ছিলেন। জানলার পাশের চেয়ারে বসেছিলেন উনি।

ওঁর মুখোমুখি ইজিচেয়ারে গা ঢেলে পড়েছিল থিও।

মিসেস ফ্রেঞ্চ ব্যবস্থা করে ফেলেছেন চুরির জন্যে কোন্ গাড়ি ব্যবহার করা হবে। সহসা দুজনের মাঝে একটা নীরবতা। শীতল চাউনিতে বাইরের দিকে চেয়ে মিসেস ফ্রেঞ্চ যেন কি ভাবছেন।

হঠাৎ মুখ না ফিরিয়েই মিসেস ফ্রেঞ্চ বললেন, আর কিছু নেই তো?

 থিও হাসলো।

ঐ যে মেয়েটা জুলি কি যেন পদবী ওর! বলে ধুলোমাখা জুতার দিকে চিন্তাকুল চোখে চেয়ে বলল, হ্যারি ওতে মজেছে।

মিসেস ফ্রেঞ্চ স্বগতচিন্তা করছেন, কে জানে ও আবার সব ফাঁস করে দেবে না তো? মাথা পিছু আট হাজার টাকা করে পড়বে। ও যদি কথা বলে…।

থিও ধারালো গলায় বলল, আবার ঐ কথাগুলো বলবে না কি? বলেছি আমি ওকে ঠিক করে দেব। আমি…।

থিও কি যেন ভেবে আবার বলল, এখন হ্যারি ওর প্রেমে মজেছে, আমার অন্যের সাহায্য দরকার।

–কি ধরনের সাহায্য?

থিও ওয়েস্টকোটের বোম খুলে হাত ঢুকিয়ে পাঁজরা চুলকোতে চুলকোতে বলল, আমার মনে হয়, হ্যারি কাজ হাসিল করে, লিফটে ফারগুলো আমাকে নামিয়ে দিয়ে তারপর মেয়েটাকে বেঁধেহেঁদে, গয়নাগুলো নিয়ে ও সামনের সিঁড়ি দিয়ে নামলো। আমি ফারগুলো গাড়িতে রাখলাম। গাড়ি কিন্তু চালাবে ডানা। মানে তিনজনের হাতে কাজটা হবে।

মিসেস ফ্রেঞ্চ সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে বললেন, এতে ডানাকে জড়াতে চাই না আমি। তুমি তো আগেও গাড়ি চালিয়েছো?

থিও ওঁর দিকে তাকিয়ে রেগে বলল, কি হয়েছে তোমার? ঐ মেয়েটাকে আমাকে দেখতে হবে না? বলে আবার পাঁজরা চুলকোতে লাগল।

–কেমন করে দেখবে?

চাকরদের লিফটে আমি উঠে আসবো। হ্যারি বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। তারপর মেয়েটার বাঁধন খুলে আলমারীতে ঢুকিয়ে দেব। পুলিশ ভাববে ও চুরি করতে গিয়ে আটকা পড়ে মারা গেছে।

মিসেস ফ্রেঞ্চ বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন।

–সে ত খুন হবে থিও। কথাটা কেমন আনমনে বললেন মিসেস ফ্রেঞ্চ।

থিও নাক সিঁটকাল। নোংরা নখ দিয়ে নাক খুটল।

দুর্ঘটনা। যাই হোক না কেন, দেখে দুর্ঘটনাই মনে হবে।

 মিসেস ফ্রেঞ্চ বললেন, আমি বলছি না আইডিয়াটা খারাপ। আর ও যে মুখ খুলবে না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আমি খুনে মত দেব না থিও।

থিও কথাটাকে কোন আমলই দিল না। মোচোনো টুপিটার ভেতর থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে সব থেকে কম নোংরা সিগারেটটা বেছে নিয়ে ধরালো।

নাক দিয়ে লম্বা ধোয়া ছেড়ে থিও বলল, পয়সার খানিকটা আমি খরচ করতে চাই। তুমি যা বলেছিলে–ও যদি মুখ খোলে, তবে খরচ করার সময়ই পাব না। তুমিও না, ডানাও না।

–হ্যারিও না।

–হ্যারির কি হয়, তা নিয়ে মাথা ঘামাবো না। আমি ওকে দেখিয়ে দিতে।

–আমি এসব কথা শুনতে চাই না। তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত।

 –আমি লজ্জিত। থিও আবার পাঁজরা চুলকোতে শুরু করলো।

 দীর্ঘ বিরতির পর মিসেস ফ্রেঞ্চ বললেন, ও অবশ্য আমেরিকা চলে যাবে।

থিও মুখ বাঁকালো।

–হ্যারির কথা ভুলতে পারছে না। হচ্ছে মেয়েটার কথা।

মিসেস ফ্রেঞ্চ মাথা নাড়ালেন।

–আমি ওর কথা শুনতে চাই না। খুনে আমার মত নেই।

থিও মিসেস ফ্রেঞ্চের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল। তারপর অনায়াসে বলে উঠলো, বলছি না, জিনিষটা দুর্ঘটনা! আবার চুলকোতে লাগল।

মিসেস ফ্রেঞ্চ বললেন, আমি আর ও নিয়ে কথা বলতে চাই না। তুমি হ্যারি আর ডানার চেয়ে বেশি পাবে। আরো পনেরোশো।

থিওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

দু–হাজারই করে দাও ওটা। পয়সা উঠে যাবে।

পনেরো শ। হ্যারিকে তো আমাকেই বুঝিয়ে বলতে হবে।

–না। কাজ হাসিল হলে তবে টাকা ভাগ হবে। তখন ও আপত্তি করতে পারবে না। তখন তো সব খতম।

বেশ দু–হাজার।

 –ডানা গাড়ি চালাবে তো? থিও–জিজ্ঞেস করলো।

জানি না কেন তুমি গাড়ি চালাতে চাইছে না। তবে তুমি যদি বল যে চালাতে পারবে না, তবে ডানা চালাবে।

–কেন কথা ঘোরাচ্ছে। আমরা তো সাক্ষী রেখে কাজ করছি না। তুমি কি চাও না আমি কাজটা করি?

–আমি তো বলেছি মেয়েটার মুখ বন্ধ রাখার এটাই একমাত্র পথ। কিন্তু আমি এও বলেছি খুন আমি সমর্থন করি না। একথা যা এখন।

–আমি দু–হাজার উপরি পাচ্ছি, ডানা গাড়ি চালাচ্ছে।

 মিসেস ফ্রেঞ্চ মাথা নাড়লেন।

–ঠিক আছে। ছেড়ে দাও। ও নিয়ে আমিই ভেবে দেখব।

 থিও বেরিয়ে গেল। মিসেস ফ্রেঞ্চ অনেকক্ষণ জানলার বাইরে চেয়ে রইলেন। ডানা ঘরে এসে ঢুকল।

থিও চলে গেছে? একা বসে আছো?

 মিসেস ফ্রেঞ্চ হু বললেন।

–সব ঠিকঠাক হয়ে গেল? ডানা সপ্রশ্ন চোখে তাকাল।

 –সব।

 ডানা মার টেবিলের কোণে বসে হাঁটুর ওপর যেখানে গার্টার চেপে বসেছে, সেখানকার লাল জায়গাটা ঘষতে ঘষতে বলল, ঐ হল্যান্ড মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।

মিসেস ফ্রেঞ্চ ডানার দিকে না তাকিয়েই বলল, তোমাকে ওর কথা ভাবতে হবে না। তোমায় গাড়ি চালাতে হবে।

ডানার ভুরু কুঁচকে গেল।

–কেন? থিও চালাবে এরকমই কথা ছিল না?

মিসেস ফ্রেঞ্চ উঠে দাঁড়ালেন।

–থিও বলছে তার চেয়েও জরুরী কাজ ওর আছে। আমি জানি না ওকে কি করতে হবে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি, আমি চাই না যে তুমি কিছু জিজ্ঞেস কর।

–ডানা একমুহূর্ত ফ্যাকাশে মুখে মার দিকে চেয়ে রইল।

–মা, তুমি নিশ্চয় বলছ না?

–চুপ কর। মিসেস ফ্রেঞ্চ আবার জানলার দিকে মুখ ফেরালেন।

.

পরদিন বিকেলে ওয়েসলির আসার কথা শুনে ডসন কনস্টেবলকে মাথা নেড়ে ওয়েসলিকে ভেতরে আনতে বলল।

ওয়েসলি ঘরে ঢুকতেই ডসন চেয়ার পিছিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার ঠিক পাশেই চেয়ার আছে মিঃ ওয়েসলি। তারপর কনস্টেবলকে ইশারা করতে চেয়ারটা ওয়েসলির হাঁটুর পেছনে ঠেকাল, ওয়েসলি বসল।

ওয়েসলি বললেন, তাহলে আজ সন্ধ্যায় ওদের ধরবার জন্যে আপনি প্রস্তুত থাকছেন। ভাবলাম শেষ অবধি যদি কিছু করার থাকে, জেনে যাই।

–সব ঠিক আছে, ডসন বলল, ওয়েসলি চিন্তাকুল মুখে চাইল, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, কোন চিন্তা নেই।

ডসন মনে মনে ভাবল, এই লোকটা হল্যান্ড মেয়েটার মধ্যে কি দেখেছে? মেয়েটা দেখতে ভাল, সে আমি বলবই, কিন্তু মেয়েটার মধ্যে আর কিছু তো নেই। কিন্তু এ লোকটার তো প্রচুর পয়সা, শিক্ষাদীক্ষা, রুচি আভিজাত্য আছে। ওদের দুজনের মধ্যে কোন মিলই নেই। তবে ব্যাপারটা কি?

সেই সাদা পোশাকী ডিটেকটিভটির কথা শুনেই ওর কৌতূহল হয়েছিল। ক্লেগ জুলির পিছু নিয়ে বুঝেছিল ওদের দুজনের মধ্যে একটা ব্যাপার ঘনিয়ে উঠেছে।

ওয়েসলি ইতস্ততঃ করে বললেন, তাহলে আপনারা সব হাতের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছেন। আমি স্ত্রীকে নিয়ে থিয়েটারে যাচ্ছি। একমাত্র থিয়েটারে গেলেই আমি আমার স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে পারবো। তবে আমি খুবই উদ্বিগ্ন আছি, দেখবেন আজ রাতে যা ঘটতে চলেছে তার বিন্দুমাত্রও যেন উনি টের না পান। তাহলে সব গোলমাল হয়ে যাবে। একটু থেমে অধীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন ওয়েসলি, আপনি মনে করেন জুলির কোন ক্ষতি হবে না, তাই তো?

না। জুলি বলেছে ওদের প্ল্যান, চুরির পর ওকে বেঁধে রাখা। যাই হোক, আমরা কাছাকাছিই থাকবো। উনি যেন শুধু চেঁচান।

–আপনার পুলিশ ঠিক কোন্ জায়গায় থাকবে?

হলে দুজন, পেছনের গলিতে দুজন, আর ফ্ল্যাটের ঠিক বাইরে সিঁড়ির মুখে দুজন, ছাতে দুজন। ওরা যেই বাড়িতে ঢুকবে আমরা কোন ঝুঁকি না নিয়ে বাড়িটা ঘিরে ফেলবো।

ওয়েসলি মাথা নাড়লেন।

 উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে সব ঠিকই আছে। আমরা হিপোডড্রাম থিয়েটারে যাচ্ছি, মনে হয় না আমাকে আপনাদের দরকার হবে। তবুও আটটা চল্লিশে ইনটারভ্যালের সময় আমি আপনাকে ফোন করব। তাতে হবে তো?

হওয়া উচিত। তাহলে চিন্তার কিছু কারণ থাকবে না।

ধন্যবাদ। আপনার নিশ্চয় অনেক কাজ, আর দেরী করাবো না আপনাকে। ওয়েসলি হাত বাড়ালেন।

ডসন হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ব্যস্ত তত থাকতে হবেই স্যার। তবে এ কাজটা আমাদের পক্ষে বেশ ভাল। সব সময়ে আমরা ভেতর থেকে এমন খবর পাই না, বুঝলেন?

–দেখনে, আপনাদের হাত ফসকে ওরা যেন না পালায়।

–সে ভয় নেই। আপনি নিশ্চিত থাকুন।

–আপনারা বোধহয় মিস হল্যান্ডকে সাক্ষী দেওয়াতে চাইবেন। যদি তা পারেন–সাক্ষী না দিতে হয় তবে খুশী হবো। ওর বিষয়ে যত কম প্রচার হয় ততই ভাল। সেটা কি খুব প্রয়োজন হবে?

ডসন ভাবল, এই কি ওঁর আসার উদ্দেশ্য? মুখে বলল, যদি ধরতে পারি তাহলে মনে হয় না ওকে দরকার হবে। অবশ্য আপনাকে দরকার হবে।

–তা ঠিক আছে। দেখুন আপনারা তো জানেনই মেয়েটা ভাল পরিবেশ থেকে আসেনি। আমি চাই ও যাতে নতুন জীবন শুরু করতে পারে। দলটা ধরা পড়ায় ওর হাত আছে চাউর হয়ে গেলে ওর পুরনো পরিচিতরা ওকে বিপদে ফেলতে পারে।

–তা পারে। বাধ্য না হলে ওকে আমরা ডাকব না স্যার।

 ওয়েসলি মাথা নাড়লেন।

 উনি নড়বার কোন লক্ষণ দেখালেন না। একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, ভালো। ইন্সপেক্টর, মিস হল্যান্ডের বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে। আপনি নিশ্চয় আমার কথা বুঝতে পারছেন। এ সব চুকেবুকে গেলে আমি ওর দায়িত্ব নেব। তাই বলছিলাম, সামান্য জানাজানি হলেও লজ্জায় পড়তে হবে।

ডসন লজ্জিত হয়ে বললেন, এ বিষয়ে আমার কি বা বলার থাকতে পারে?

ওয়েসলি হেসে বললেন, তা আমি জানি। এ-সব মিটে গেলে আমি ওর দায়িত্ব নেব, আমি দেখব ও যেন আর কোন ঝামেলায় নিজেকে না জড়ায়।

ডসন নিরুত্তাপ গলায় বলল, ও ঝামেলায় না জড়ালে আমাদেরও খোঁজ নেওয়ার দরকার পড়বে না। এসব কথা আমাকে বলার দরকার ছিল না, স্যার।

–কিন্তু ইন্সপেক্টর, আমি চেয়েছিলাম আপনি প্রকৃত ঘটনাটা জানুন। আশা করি, ভবিষ্যতে আমায় কোন ডিটেকটিভ অনুসরণ করবে না। যদি করে আমি ব্যবস্থা নেব। ওয়েসলি কঠিন গলায় বললেন।

ডসন মুখ চমকে ভাবল, ধরে ফেলেছে। নিশ্চয়ই হতভাগা মেয়েটা ক্লেগকে দেখে ফেলেছে। আর সেজন্যই এত খুলে মেলে সব বলতে এসেছে।

ডসন ধীরে নিচু গলায় বলল, ওটা একটা দুর্ঘটনা মনে করে মাপ করে দিন। আমরা মিস হল্যান্ডকে পাহারা দিচ্ছিলাম, হঠাৎই একটা অহেতুক ব্যাপার এসে গেল।

তাই মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে যদি আপনার লোক আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে, তাকে চলে যেতে বলবেন।

–আজ সন্ধ্যার পর আশা করি মিস হল্যান্ডকে আর পাহারা দেবার দরকার পড়বেনা। ডসন বলল।

–নিশ্চয়ই না। ওয়েসলি হাসলেন, আজ সন্ধ্যায় কোন্ সময়ে ফোন করবো আপনাকে? আপনার লোক কি আমায় ট্যাক্সি পর্যন্ত নিয়ে যাবে?

–ওয়সলি বেরিয়ে গেলেন।

 ডসন ভাবতে লাগল, এ-সব লোককে আমি চট করে ঘাঁটাতে চাই না। ওঁর ডাক নরম, কামড় সাংঘাতিক। ওয়েসলির ট্যাক্সিটা চলে যেতে দেখে ভাবল, তবে লোকটা ভাল, হিম্মত আছে। ভি, সি পেয়েছে, এদিকে অন্ধ। যদি মেয়েটাকে নিয়ে মজা পায় তো পাক না।

ও আবার কাজ করতে টেবিলে ফিরে এলো।

.

জুলি ঘরে পায়চারি করছিল। দরজায় মৃদু করাঘাত শুনে ও চমকে উঠলো। ওয়েসলি সান্ধ্য পোষাকে ঢুকল।

দরজা বন্ধ করে উনি হাসলেন।

–ভয় পেয়েছ জুলি? বুকে হাতুড়ি পিটছে?

জুলি কাতরভাবে মাথা নাড়াল।

উনি ভরসা দিলেন, এখনি সব চুকে যাবে। আমি সঙ্গে থাকতে পারলে ভাল হত, কিন্তু এ কাজটা তোমার একাই করতে হবে।

জুলি বলে ফেলল, আমার…আমার শুধু হ্যারির কথা মনে হচ্ছে। কাল ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ও আমাকে ওর সঙ্গে আমেরিকা নিয়ে যেতে চাইল। বলছিল ও আমায় সত্যিই ভালবাসে। আমিও দেখলাম সে কথা সত্যি।

ওয়েসলির মুখে কোন কথা ফুটল না।

ধীরে ধীরে বললেন, তাই বুঝি? পুলিশ ওকে ধরবে তোমার খারাপ লাগছে? কিন্তু গ্লেবের মত লোক তোমাকে কোনদিন সুখী করতে পারবে না। আজ বা কাল ও নিজেকে ঝামেলায় জড়াবেই আর ওর সঙ্গে তুমিও ফাসবে। তোমার এখন নিজের কথা ভাবতেই হবে।

জানি। কিন্তু যে আমাকে ভালবাসে তার সঙ্গে এরকম করাটা নীচতা। এখন মনে হচ্ছে যদি ওকে সাবধান করে দিতে পারতাম…যদি থিও না থাকত…।

ওয়েসলি কথা এড়িয়ে বললেন, এই নাও এটা। দেখ এতে মনটা একটু হালকা হয় কিনা। মুখ ফিরিয়ে জুলি দেখল ওঁর প্রসারিত হাতে একটা চেকবই।

এটা তোমার। আড়াইশো পাউন্ড জমা দিয়ে তোমার নামে ব্যাঙ্কে একটা খাতা খুলেছি। প্রতি তিনমাসে আড়াইশো পাউন্ড করে জমা দেব আমি। কাল ব্যাঙ্কে গিয়ে সইটা করে আসবে। তারপর তুমি টাকা তুলতে পারবে।

জুলি চিরকালের আকাঙ্খিত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের চেকবই পেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে বলল, আমার জন্যে? আড়াইশো পাউন্ড?

–আমি তো তোমায় বলেছি বছরে হাজার পাউন্ড দেব। এই তার শুরু।

–ও। আসলে এটা তুমি দিচ্ছে যাতে আমি মুখ বন্ধ রাখি। তুমি আমায় পছন্দ করো না।

ওয়েসলি আস্তে আস্তে বললেন, তোমার চুপ থাকার গুরুত্ব অনেকখানি। সেজন্য আমি তোমায় টাকা, পোষাক, বাড়ি, আনন্দ যা চাও দেব। কিছুতেই মুখ খুলল না।

–খুলব না। জুলি বলল, চেকবইটা হাতে চেপে ধরল।

আর হ্যারির প্রতি যদি এখন দুর্বলতা দেখাও তো পরে অনুশোচনা করতে হবে। একটু থেমে উনি বললেন, জুলি, এখন আমায় যেতে হবে। ভয় পেও না। শেষ অবধি সামলে নিতে পারবে তো?

জুলি মনে জোর এনে ভাবল, আমাকে পারতেই হবে। হ্যারিই একদিন আমাকে বলেছিল, টাকা মানে ক্ষমতা। টাকা কোথা থেকে, যেমনভাবে পেলাম, ভাবতে চাই না। যে কদিন বাঁচব ফুর্তি করে নেব। তারপর তো কবরের পোকা…।

এ তো হ্যারিরই জীবনদর্শন। আজ যদি জুলির অবস্থায় হ্যারি পড়তে ও ইতস্ততঃ করত না।

–হ্যাঁ আমি পারবো। জুলি বলল।

ওয়েসলি চলে যেতেই ওর হাত পা ভয়ে কাঁপতে লাগল। হাতের মুঠো শক্ত, ঘড়ির কাটার দিকে চেয়ে বসে আছে। আর চল্লিশ মিনিট বাকি হ্যারি আসতে। জুলির স্নায়ুগুলো পাকিয়ে ধরতে লাগল।

এই একই উত্তেজনা পার্কের গাছের ছায়ায় অন্ধকারে হ্যারি আর থিওর মধ্যেও। আলোকোজ্জ্বল ফটকটা ওরা লক্ষ্য রাখছিল।

হ্যারি উত্তেজনায় অস্থির হয়ে একবার এ পায়ে, আর একবার ওপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর ঘনঘন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।

থিওর কিছুই হয়নি। ও একটা হাত পকেটে পুরে, টুপিটা মাথার পেছন দিকে হেলিয়ে গাছে হেলান দিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে।

হ্যারি সহসা বলল, কটা বাজে?

–সাতটা বিশ। থিও ঘড়ির উজ্জ্বল কাঁটা দুটো দেখে, হ্যারির দিকে ঘেন্নার চোখে তাকাল।

–ওদের তো বেরিয়ে যাওয়া উচিত। ওরা কি চলে গেছে?

না, হতে পারে না। তাড়াহুড়ো করছ কেন? আটটার আগে তো আমরা কিছু করতে পারছি না।

হ্যারি বিড়বিড় করে বলল, বুড়ি কেন ডানাকে এর মধ্যে টানল, জানিনা। কাজটা তোআমাদের দুজনের দ্বারাই হয়ে যেত।

অন্ধকারে থিও প্রেতের মত হাসল।

বলল, ঠিকই করেছে। গলিতে অনেকক্ষণ গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ দেখে ফেলতে পারতো। এই ভাল হয়েছে। আমায় কেউ দেখতে পাবে না। আমি পেছনে যাব, ফারগুলো নেব, ডানা গাড়ি নিয়ে আসবে, ফারগুলো ভেতরে রাখবো, ও চলে যাবে গাড়ি নিয়ে। এ তত ভাল বুদ্ধির কাজ।

হ্যারি আপত্তি জানাল। পরিকল্পনার পরিবর্তন ওর মনপুতঃ হয়নি।

–ঐ যে যাচ্ছে। থিও আঙুল তুলে দেখাল।

 ওরা দেখল ব্লানশ আর ওয়েসলি ট্যাক্সিতে উঠল। গাড়ি চলে গেল।

হ্যারি সিগারেট ধরাল। বলল, খেল শুরু হল। আমি ওখানে যেতে চাই। অপেক্ষা করে করে শরীরে ব্যথা ধরে গেল।

থিও চেঁচিয়ে বলল, ভয় পেয়েছো?

চুপ কর বাঁদর। হ্যারি গর্জাল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে থিও ঘড়ি দেখে বলল, আমার যাবার সময় হলো। পাঁচ মিনিট বাদে তুমি এসো। জেলে দেখা হবে। বলে, ঘষটে ঘষটে ও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

হ্যারি আঙুল মটকে ভাবল, জেলে দেখা হবে। এ ধরনের বদরসিকতা?

হ্যারি এখন জুলির কথা ভাবছে। ও ঠিক করেছে কাজ হাসিল করার পর জুলির হাজার আপত্তি সত্ত্বেও ও জুলিকে সঙ্গে নিয়ে বেরোবে।

থিও এতক্ষণে বাড়ির পেছনের গলিতে পৌঁছে গেছে ধরে নিয়ে হ্যারি কলার তুলে এগোল। ধীর পায়ে পার্কের ঘাসের সীমানা পেরিয়ে পার্কওয়ের দিকে এগোল। বুক ধড়াস ধড়াস করছে, গলা শুকিয়ে গেছে।

ডিটেকটিভ ডসন আর দুজন সাদা–পোশাকী ডিটেকটিভ ওকে নজরে রেখেছিল।

 বিশাল লবিতে ঢুকে ও দারোয়ানের আফিসে গেল।

–মিসেস গ্রেগরির ফ্ল্যাট খুঁজছি। বলতে পারেন কোথায়?

জুলি ওকে বলেছিল ওপরতলার ফ্ল্যাটটা মিসেস গ্রেগরীর। হ্যারি খবরটা স্মৃতিপটে লিখে রেখেছিল।

মিসেস গ্রেগরী?

–হ্যাঁ স্যার।

 –ওপরে। ডানদিকের লিফটা নিন। জানি না উনি আছে কিনা, দেখব ফোন করে?

উনি জানেন আমি আসব। হ্যারি তাড়াতাড়ি লিফটের কাছে গিয়ে বোতাম টিপল।

অপেক্ষা করতে করতে ওর একটা আতঙ্কের অনুভূতি হলো, মনে হল ওর ওপর কেউ যেন নজর রেখেছে।

ওর ঘাম ঝড়তে লাগল। রুমাল দিয়ে মুছল।

ওপরতলায় পৌঁছে ঝট্‌ করে লবিটা দেখে নিল। জনশূন্য ভো ভো। দারোয়ান অফিসে ফিরে গেছে।

লিফট থেকে বেরিয়ে ও দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ওয়েসলির ফ্ল্যাট যে তলায় সেখানে পৌঁছাল। নির্জন বারান্দাটা দেখে ও বেল টিপল।

চূড়ান্ত যন্ত্রণায় দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত দেরী হল জুলির দরজা খুলতে।

ওর দিকে চাইল জুলি, ভয়ে ওর মুখ সাদা, চোখ বিস্ফারিত।

–সব ঠিক আছে জুলি? হ্যারি তড়িঘড়ি ভাব দেখাল, চল যাই।

কিন্তু জুলি হাঁ করে চেয়ে রইল। হ্যারি ওভারকোট পরেছে, কালো সিলকের স্কার্ফে চিবুক জড়ানো।

–হ্যারি, একাজ কোর না। জুলি পিছিয়ে গেল।

হ্যারি ঠেলে ওকে জুলির শোবার ঘরে নিয়ে গেল।

হ্যারি নিজে অস্থির হয়েও ওকে বলল, ঠাণ্ডা হও, তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। ঢুকব আর বেরোব। বুঝলে, যত তাড়াতাড়ি পার, আলমারীটা খোল।

ভয়ে সিঁটিয়ে রইল জুলি। ওর মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে পুলিশ এসে পড়বে। ও নড়তেই পারল না, মরার মত চেয়ে রইল।

হ্যারি বলল, তাড়াতাড়ি কর। দোহাই তোমার কথা বোল না। হতচ্ছাড়া আলমারীটা খোল। হ্যারি অস্থির হয়ে জুলিকে ঝাঁকাল।

–কিন্তু হ্যারি–জুলি ডুকরে উঠল।

হ্যারি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো, বেরোলে তবে কথা হবে। খোল এটা! লেপটাকা দেওয়ালের দিকে ও ঠেলে জুলিকে নিয়ে গেল, অ্যালার্ম বন্ধ কর। বিছানার পাশে একটা ঘণ্টা আছে, বন্ধ কর।

হঠাৎ জুলির মনে হল, হ্যারি যদি ফার না নেয়, তাহলে পুলিশ ওকে ধরতে পারবে না। ও দিব্যি বলতে পারবে, হ্যারি ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

হ্যারি শোন, তুমি কিছু নিও না। আমি তোমার সঙ্গে যাব, তুমি যদি এখন চলে যাও।

 হ্যারি ঝট করে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ওর শিরা, স্নায়ু, সব ছিঁড়ে যাচ্ছে।

হ্যারি চেঁচিয়ে উঠলো, ঐ হাঙ্গামার অ্যালার্ম বন্ধ কর। কথা বোল না।

–কিন্তু হ্যারি তুমি বুঝছো না কেন? … জুলির কথার মাঝখানে চাপা গলায় হ্যারি দিব্যি গেলে জুলির হাত চেপে ধরে জুলির মুখে ঠাস করে একটা চড় মারলো।

রেগে গিয়ে হ্যারি বলল, আলমারী খোল। মাথা ঠাণ্ডা করো গাধা।

 জুলি বুঝল যে ভয় পেয়েছে বলেই হ্যারি ওকে মেরেছে।

জুলিকে ভালবাসে বলেও যদি ও চড় মারতে পারে, তাহলে ওর ভালোবাসার মূল্যটা কি?

–ঠিক আছে। তারপর বোল না, আমি তোমায় সাবধান করি নি। রিক্ত গলায় জুলি বলল।

হ্যারি দেখল দশ মিনিট হলো ও ঢুকেছে। এখনো আলমারি খোলা হলো না।

তাড়াতাড়ি কর। রুদ্ধশ্বাসে, আতঙ্কে হ্যারি বলল, বেরিয়ে পালাতে হবে।

 জুলি যন্ত্রচালিতের মত বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করল। বাথরুমে গিয়ে দ্বিতীয় অ্যালার্মটাও বন্ধ করলো। হ্যারি, ওকে তাড়া লাগাল।

কি করছে তা না বুঝেই জুলি আলমারীটা খুলল। ইস্পাতের দরজা খুলল, ফোটো ইলেকট্রিক সেলের আলোটা জুলি বন্ধ করতেই হ্যারি ঝাঁপিয়ে পড়ে ফারগুলো পাঁজা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জুলি শুনতে পেল ও রান্নাঘরের দেওয়াল সরাচ্ছে বোম টিপে, চাকরদের লিফটটা ওখানে। হঠাৎ জুলির মনে হল ও যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে। চেয়ারটা ধরে নিজেকে সামলালো।

হ্যারি আবার এসে আরেক পাঁজা করে বেরিয়ে গেল। তড়িতের মত ছোটাছুটি করছে ও। জুলির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। জুলিরও কিছু করার নেই। ও ভাবছে এক মুহূর্তেই পুলিশ আসবে আর হ্যারির খেলাও শেষ হবে।

তারপর হঠাৎই বন্দুকের গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ মর্মভেদী আর্তনাদে সারা ফ্ল্যাটটা হা হা করে ধ্বনিত হয়ে উঠলো।

জুলি দরজায় এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে উঁকি মারলো।

জুলি দেখল, দরজার গজখানেক ভেতরে হ্যারি দাঁড়িয়ে আর ওর পায়ের কাছে কি যেন একটা, হ্যারির চোখ সেদিকে। হ্যারির জন্যে জিনিষটা জুলি দেখতে পাচ্ছে না। কাছেই একটা অটোমেটিক পিস্তল পড়ে আছে, নল দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

–হ্যারি! জুলি আর্তনাদ করলো।

 হ্যারি যেন আঁতকে উঠে সামনের দরজাটা বন্ধ করলো। ও নড়তেই জুলি দেখল, মেঝেতে পুতুলের মতো একটা শরীর পড়ে আছে। বিস্ফারিত চোখে জুলি দেখল শরীরটা ব্লানশের।

ব্লানশের মুখের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ওর উজ্জ্বল চুল ঘিরে রক্তবলয় রচনা করেছে দেখে জুলি আর্তনাদ করলো।

সামনের দরজায় ভীষণ আঘাতের শব্দ। ক্যাচ ক্যাচ করে উঠলো, খুলল না।

জুলি শিউরে পিছিয়ে এল।

দুহাতে হ্যারিকে ঠেকাতে চেষ্টা করল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি ওকে গুলি করেছ, সরে যাও হ্যারি।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি বিশ্বাস কর, আমি গুলি করি নি। আমি রান্নাঘরে ছিলাম। জীবনে বন্দুক সঙ্গে রাখি না জুলি। তোমাকে পুলিশের কাছে বলতে হবে, আমি…আমি একাজ করিনি।

তারপর সামনের দরজা খুলে তিনজন পুলিশ অফিসার তেড়ে এল।

হ্যারি জুলিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক পা নড়ার আগেই ওরা হ্যারিকে ধরে ফেলল। অনেকগুলো হাত ওর ধস্তাধস্তির চেষ্টা ব্যর্থ করল।

তারপর সব অন্ধকার। জুলি যেন কোন খাদের গহন অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

থিও যখন চাকরদের লিফট চালিয়ে ওপরে উঠছিল তখন ও গুলির আওয়াজ শুনতে পেল। তখনি ও পলকা ব্রেকটা কষে থামায়। লিফট তখনি থৈমে যায়। হ্যারি লিফটে ঢোকার জায়গাটা খুলে রেখেছিল। সেই খোলা দরজার একটু নিচে থিওর লিফটা থামে। মুখটা বের করে রান্নাঘরের ছাদটা দেখতে পায়।

জুলির উন্মত্ত, ভীত আর্তনাদ, ফ্ল্যাটের সদর দরজা ভাঙার আওয়াজ পেল। ও বুঝল কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে।

লিফটের ভেতরে দড়ির যে অংশটা আছে, সেটা টেনে লিফটা নামানো যায় বহু কষ্টে। থিওর দড়ি টেনে টেনে লিফট ওপরে তুলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তবু ঐভাবে উঠল, কেননা জুলির মুখ বন্ধ করা প্রয়োজন।

এখন ওপরে পৌঁছবার একটু আগেই গোলমাল বাঁধল।

সহসা ও শুনতে পেল হ্যারির শঙ্কিত আওয়াজ। আমি একাজ করিনি, ওটা আমার বন্দুক নয়, আমি শপথ করে বলছি।

থিওর মুখ কঠিন হয়ে উঠল।

ও ভাবল তবে কেউ গুলি খেয়েছে। কেউ দেখে ফেলার আগেই অত্যধিক ব্যস্ত হয়ে দড়িটা টানার আগেই ব্রেক আলগা করলো, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল গতিতে লিফটা নামতে লাগলো। থিও ব্রেকটা প্রাণপণে আঁচড়ে ধরে বসে রইল। কিন্তু পেছনের গলির ডিটেকটিভ দুজন দেখল অন্ধকারের ভেতর থেকে লিফটা নীচে আছড়ে পড়লো আর থিও ভয়ে ঝাঁকিয়ে উঠলো।

ছুটে গিয়ে থিওর পাণ্ডুর মুখে টর্চ ফেলল। যখন ওরা থিওকে ছুঁল থিও এমন আর্ত চীৎকার করে উঠল, যে দুজনে চমকে পিছিয়ে গেল।

লম্বা লোকটি বলল। ঠিক আছে, মাথা ঠাণ্ডা কর। আমরা অ্যাম্বুলেন্স আনছি।

অন্য লোকটিকে প্যাসেজ ধরে ছুটে যেতে দেখে থিও বলল, কোথায় যাচ্ছো?

–ডসনকে ডাকতে, অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিতে।

থিওর মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে গেল, ডসন বুড়োটা আমাকে দেখতে পারে না, ও নিশ্চয় বেজায় খুশী হবে। ও হাঁপিয়ে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করল। বলল, আমায় ছুঁয়ো না, পিঠটা ভেঙ্গে গেছে। না ছুঁলে তবু একরকম।

ডিটেকটিভটা ওর পাশে থেবড়ে বসে বলল, একটু শান্ত হও, আমরা তোমায় ঠিক টেনে তুলব।

থিও মুখ বেঁকাল।

বলল, শেষ অব্দি কাগজে নাম বেরুচ্ছে। আমার ব্যাগে একটা ফোটো আছে, প্রেসকে দিও, আমার বাবা কাগজে আমার ছবি দেখে চমকে যাবে। প্রথম পাতায় বেরুবে তো?

–হ্যাঁ। ডিটেকটিভটির মুখ কুঁচকে গেল।

–তাহলে তাড়াতাড়ি ওটা বের করে নাও। ওরা তোমায় পয়সা দেবে সেজন্যে। তুমি না নিলে ডসন নেবে। থিও জোর দিয়ে বলল।

–এইটে? ওর ব্যাগ থেকে ফোটোটা বের করে ডিটেকটিভটি ওকে দেখাল।

হ্যাঁ। প্রেসকে দিও।

এক মিনিট চুপ করে শুয়ে রইল ও। তারপর বলল, গুলির কারবারটা কি হলো এক্ষুনি?

–জানি না। গ্লেবের কাছে তো বন্দুক ছিল না, ছিল?

থিও চুপ করে থাকল। ও ভাবল ও মরে গেলেও হ্যারির মারের দাম উসুল করে তবে মরবে। তবে গুলির ব্যাপারটা ভাল করে জেনে তবেই থিও মুখ খুলবে।

–ডসন আসার আগে আমি কিছু বলব না। ওকে তাড়াতাড়ি আনো। আমি পটল তুলব।

না না, তুমি বেঁচে দশ বছর জেল খাটবে। ডিটেকটিভ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। অন্ধকার থেকে ডসন বেরিয়ে এলো। থিওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল।

সাদা, যন্ত্রণা কাতর মুখটার দিকে তাকিয়ে ডসন বলল, হ্যালো, এবার সত্যিই প্যাঁচে পড়েছ, পড়নি?

থিও চোখ খুলল।

 বলল, আমাকে যতক্ষণ না ঘুচ্ছো আমি ঠিক থাকবে। অ্যাম্বুলেন্স আসছে?

ডসন বলল, হ্যাঁ। থিও এই বন্দুকটা আগে দেখেছ? একটা অটোমেটিক পিস্তলের ওপর টর্চ ফেলে ওকে দেখাল।

থিও জিজ্ঞেস করল, হ্যারি গুলি ছুঁড়ছিল? কাউকে মেরেছে?

জানি না। এটা ওর বন্দুক কিনা তার ওপর সব নির্ভর করছে।

থিও চোখ বুজল, খুলল।

–ওর বন্দুক। কাকে মেরেছে?

–ঠিক বলছো?

নিশ্চয় ঠিক বলছি। আমি ওকে বন্দুক আনতে বারণ করেছিলাম, ও শুনল না। বলল যে কেউ কোনরকম বাধা দিলেই তাকে ও মারবে।

জবানবন্দী সই করবে?

থিও ঘষা কাঁচের মত চোখদুটো চেয়ে মাথা নাড়ল।

তাড়াতাড়ি কর, নইলে পটল তুলব। থিও যন্ত্রণাকাতর ভাবে বলল।

 ডসন নোট বইয়ে সব লিখে নিচ্ছিল। অনেক কষ্টে থিওকে দিয়ে সই করালো।

অ্যাম্বুলেন্স যখন পৌঁছাল থিও মারা গেছে।

.

ডসন যখন পার্কওয়ের লবিতে আবার ঢুকল, তখন একজন বলিষ্ঠ চেহারার ডিটেকটিভের সঙ্গে হাতকড়া লাগিয়ে হ্যারিকে লিফটে করে নামানো হচ্ছে। আরেজন ডিটেকটিভ ওর পেছনে আসছে।

অটোমেটিক পিস্তল হাতে ডসনকে দেখেই মরিয়া কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, আমি এ কাজ করিনি ডসন। ওটা আমার পিস্তল নয়। তুমি জান আমার কোনদিন বন্দুক কিংবা পিস্তল ছিল না। আমি এরকম কাজ করবই না। দোহাই তোমার ডসন, আমাকে খুনের দায়ে ধর না। আমি একাজ করি নি।

ডসনের নীল চোখ হ্যারির আগাপাশতলা দেখে নিল।

ডসন প্রায় ধমক দিয়ে বলল, আমাকে ধাপ্পা দিও না গ্লেব। তোমার দোস্ত থিও সব ফাস করে দিয়েছে। আমার কাছে ওর সই করা জবানবন্দীতে লেখা আছে এ পিস্তল তোমার। তুমি বড্ড চালাক হয়েছে গ্লেব, এটাই তোমার শেষ খেলা।

হ্যারি চীৎকার করে উঠল, মিথ্যে কথা বলেছে ও, ওকে এখানে আন, ইঁদুরটাকে দিয়ে আমি সত্যি কথা বলাবো। নিয়ে এস ওকে।

ডসন রুক্ষ গলায় বলল, ও মারা গেছে। ডিটেকটিভকে নির্দেশ দিল, ওকে নিয়ে যাও।

হ্যারি চেঁচিয়ে উঠল, মরে গেছে? তারপর ও ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। দুজন ডিটেকটিভের প্রবল চেষ্টায় ওকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল।

খবরের কাগজের সাংবাদিকরা ধস্তাধস্তি করে হ্যারির ফোটো তুলতে লাগলো। অন্ধকার বিদীর্ণ করে গাড়িটা যখন জোরে চলে যাচ্ছে তখনও হ্যারির কাতর কণ্ঠের প্রতিবাদ শোনা যেতে লাগলো।

ডসনের সহকারী গারসন এগিয়ে এল।

নীচু গলায় বলল, মিঃ ওয়েসলি এসেছেন। উনি ওপরে গেছেন।

ডসন মাথা নাড়ল।

ডসন বলল, আমি জানতে চাই, মহিলা পুলিশের কর্ডন ভেঙে কি করে ঢুকলো? কেন এভাবে ফিরে এল?

গারসন বলল, আমি মিঃ ওয়েসলিকে কোন প্রশ্ন করি নি। ওঁকে ধাতস্থ হতে একটু সময় দিলাম। আপনি ওঁকে প্রশ্ন করবেন না আমি?

ডসন বলল, আমি যাচ্ছি। আমরা বাড়িটা ঘিরে রেখেছিলাম, জানতাম গ্লেবের মতলব কি, তবু দিব্যি গ্লেব মহিলাকে খুন করলো। মহিলা সমাজে সুপরিচিত বটে। একবার কাগজগুলোকে খবরটা পেতে দাও। এখনি ওরা জানতে চাইছে, চুরিটা হবার আগেই পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হলো কেমন করে। হল্যান্ড মেয়েটার খবর কি?

ওপরে ডাক্তার ওকে দেখছে।

ডসন লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলল, থিওটা পিঠ ভেঙে মরেছে। জ্যাকসন মড়া আগলাচ্ছে।

ওরা লিফটে ওপরে উঠলো।

ডসন ফট্‌ করে জিজ্ঞেস করলো, ওয়েসলি কিভাবে নিলেন?

–একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। উনি যখন ঢোকেন তখন মৃতদেহ নিয়ে খুব গণ্ডগোল হচ্ছে। মৃতদেহটা সরানো হয়নি, উনি তার ওপরেই পা তুলে দিয়েছিলেন বলতে গেলে। আমি ওঁর কাছে। যেতে উনি মৃতদেহটা ছোঁয়ামাত্র ভয়ানক রকমের ধাক্কা খেলেন।

ডসন বলল, মনে হয় না দুজনের মধ্যে আর কোন ভালবাসা টিকে ছিল। ওয়েসলি হল্যান্ডকে রাখতে চাইছিলেন। যতদূর শুনেছি, ব্লানশ ওয়েসলিও বেশ দুশ্চরিত্রা ছিলেন। সে যাই হোক, বউয়ের মৃতদেহের গায়ে হোঁচট খাওয়াতে নিশ্চয়ই মজা নেই। কি বল?

ডসন সদর দরজা দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকল।

পুলিশ ফোটোগ্রাফাররা ছবি নিচ্ছে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা হলে কাজ করছে।

ডসন সোজা ওয়েসলির কাছে গেল। হাতদুটো কোলের ওপর ভাজ করে বসেছিলেন।

–ডসন, বড় দুঃখের ঘটনা। আমি খুবই দুঃখিত হয়েছি। ওয়েসলি নিস্তেজ গলায় বললেন।

–হ্যাঁ। আমার লোকরা ওর আসা ঠেকাতে পারলো না। কাউকে ঢুকতে বারণ করবে, এ নির্দেশ ওদের দেওয়া হয়নি। কেউ বেরোতে গেলে বাধা দেবে এই কথা ছিল। আমার লোকেরা ওঁকে দেখেন নি আসতে। যদি ওঁর পরিচয় জানতো, তবে ওঁকে বাধা দিতো। কেন ফিরে এলেন উনি?

–ওয়েসলি হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, আমরা ঝগড়া করেছিলাম। আমার অন্ধত্বের কারণে এবং নানা কারণে আমাদের তেমন বনিবনা ছিল না। উনি খুব মদ খেতেন। থিয়েটারে যাবার আগে উনি খানিকটা মদ খেয়েছিলেন। গাড়িতে আমাদের ভীষণ ঝগড়া শুরু হলো। আমি যখন ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছি, তখন উনি নেমে চলে গেলেন। থিয়েটারে ঢোকার আগে উনি চলে গেলেন আমি বুঝিনি।

আপনি নিশ্চয় বুঝবেন একটা ভীড়, ঠেলাঠেলির মধ্যে একটা অন্ধ লোককে একা ছেড়ে গেলে তার কি অবস্থা হয়। ভাবলাম হয়তো বাথরুমে, নয়তো বারে গেছেন। কিন্তু পর্দা উঠে যাওয়ার পরও উনি না আসাতে ভাবলাম উনি আর থিয়েটার দেখতে চান না, হয়তো ক্লাবে চলে গেছেন। সহসা মনে হল, উনি হয়তো বাড়ি ফিরে গেছেন। তখন বেজায় উদ্বেগ হল। ট্যাক্সি করে এখানে পৌঁছে শুনলাম উনি…ও…।

কিন্তু কেমন করে ঢুকলেন উনি? কেউ ওঁকে ঢুকতে দেখেন নি। সেটা বলতে পারেন? ডসন জিজ্ঞেস করল।

–মনে হয়, গ্যারেজের দরজায় উনি ট্যাক্সি থামিয়েছিলেন। এ বাড়ির গ্যারেজ মাটির তলায়, দরজা আলাদা। উনি হয়তো গ্যারেজ থেকে সটান আমাদের ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলেন। উনি অনেক সময়ই তাই করতেন।

–কিন্তু গ্লেব ঢোকার পর কোন ট্যাক্সিকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি।

–হয়তো হেঁটে এসেছে। আমি ঠিক বলতে পারছি না।

 ডসন ওঁর দিকে তাকাল।

 বললেন, তা হতে পারে। তবে খোঁজ নিতে হবে, গ্যারেজে ওকে কেউ দেখেছে কিনা। যা যে একাজ করেছে, তাকে আমরা ধরেছি, সে পালাতে পারবে না।

ওয়েসলি আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন।

–যদি আমাকে আর দরকার না থাকে, তবে এই মর্মান্তিক আঘাতের কারণে আমি কি একটু একলা থাকতে পারি?

নিশ্চয়ই। আমরা আপনাকে বিরক্ত না করারই চেষ্টা করব। আর কিছু করতে পারি কি?

–গেরিজকে…আমার সেক্রেটারীকে যদি দেখেন, আমার কাছে আসতে বলবেন।

বলবো। ডসন দরজার দিকে এগোল।

–ওয়েসলি সতর্ক প্রশ্ন করলেন, মিস হল্যান্ড ঠিক আছে তো?

–হ্যা…একটু ভেঙে পড়েছে, তবে ঠিক আছে। আমি ওর কাছেই যাচ্ছি।

 –ও কি কিছু দেখেছে?

–তাই জানতে যাচ্ছি।

–তাই বলুন। ধন্যবাদ।

ডসন একটু দাঁড়িয়ে কি ভেবে বসার ঘরে গারসনের কাছে গেল। ওকে ডসন বলল, বাড়ির নিচে গ্যারেজে মিসেস ওয়েসলিকে কেউ আসতে দেখেছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখো। ওদিকে আমাদের কোন পাহারা ছিল না। ওয়েসলির সন্দেহ মহিলা ওখান দিয়ে ঢুকেছেন।

–হ্যাঁ স্যার।

হল্যান্ড মেয়েটা কোথায়?

–নিজের ঘরে। এই প্যাসেজের শেষ ঘর স্যার।

ডসন ভারি পা ফেলে হেঁটে গিয়ে দরজায় টোকা মারল।

জুলি বিছানায় শুয়েছিল। মুখখানা অশ্রুভেজা। ডসনকে দেখে রক্তশূন্য হয়ে গেল।

সময় নষ্ট না করে ডসন জিজ্ঞেস করল, যখন গুলিটা চলে তুমি কোথায় ছিলে?

মিসেস ওয়েসলির ঘরে।

–কি হল ব্যাপারটা?

আ..আমি কিছু জানি না.আমি কিছু..দেখিনি।

ডসন ওর দিকে ভালভাবে চেয়ে বলল, দেখ বাছা, ফ্ল্যাটে তুমি আর গ্লেব ছিলে। তুমি সব খোলসা করে বলল। নইলে বিপদে পড়বে।

–কিন্তু আমি কিছু জানি না। জুলি উঠে বসল। আমি কিছু দেখি নি।

–শুনেছ তো কিছু? না শোন নি?

মিসেস ওয়েসলিকে চেঁচাতে শুনেছি। তারপরই গুলির শব্দ শুনে ছুটে যেতে.দেখলাম হ্যারি ঝুঁকে মিসেস ওয়েসলিকে দেখছে। ও তখনই রান্নাঘর থেকে এসেছে।

–শুধু এই দেখেছ। ওকে হ্যারি গুলি করেছে দেখনি?

–কিন্তু ও গুলি করেনি। ও রান্নাঘরে ছিল। ও একাজ করতে পারে না। ওর কাছে পিস্তল ছিল না। জুলি বলল।

 ডসন রুক্ষ গলায় বলল, ওকে বাঁচাবার চেষ্টা কোর না। তাতে কাজ হবে না। ও না করলে, তুমি করেছে। ফ্ল্যাটে তো শুধু তুমি আর গ্লেবই ছিলে।

ভয় পেয়ে জুলি বলল, না! আমি করিনি।

ডসন ভয়াল হাসি হাসল। বলল, আমি বলছি না তুমি করেছে, তবে তোমায় এটা বোঝাতে চাইছি, মিথ্যে বললে বিপদে পড়বে।

জুলি হাতের মুঠি শক্ত করে বলল, কিন্তু আমি একেবারে নিশ্চিত যে হ্যারি একাজ করেনি, করতে পারে না। সদর ভোলা ছিল। সেখান থেকে কেউ গুলি করতে পারে।

–অদৃশ্য মানুষ? সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠলে বানামলে সিঁড়ির দুদিকে আমার লোক ছিল, ওরা দেখতে পেত। ওরা কাউকে দেখেনি।

জুলি ওর দিকে চেয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল।

 ডসন জিজ্ঞেস করলো, পিস্তলটা কি গ্লেবের হাতে ছিল?

না। মিসেস ওয়েসলির পাশে মেঝেতে, দরজার ঠিক পাশে পড়েছিল।

–ঠিক আছে। যাক, তুমি বেঁচে গেলে। থিও মরে গেছে। গ্লেব ধরা পড়েছে। ফ্রেঞ্চদের খুজছি। হুঁশিয়ার থেকো।

দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে এসে বলল, মনে রেখো তোমাকে সাক্ষী দিতে হবে। এখন থেকে মামলা ওঠা অবধি সাবধানে থেকো। বুঝলে?

জুলির ঘর থেকে বেরোবার সময় গারসনের সঙ্গে ডসনের দেখা হল।

গারসন বলল, গ্যারেজে কেউ ছিল না স্যার। কাজের লোকেরা সাতটায় চলে গেছে।

ডসন ভুরু কুঁচকে বলল, যে ট্যাক্সিটায় এসেছিল, সেটার খোঁজ কর। যেভাবে ফিরে এসেছিলেন, তারমধ্যে কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল আছে। আমার মনে হচ্ছে, এদিক থেকে তদন্ত করলে খানিকটা ফল পাওয়া যাবে।

গারসন চমকে তাকাল।

কিন্তু, গ্লেবই ওকে খুন করেছে এতে কোন সন্দেহই নেই। আছে কি?

 ডসন তিক্ত গন্যায় বলল, মামলা শেষ না হওয়া অবধি সন্দেহ থেকে যায়। খানিকটা খাটুনির ভয়ে কেসটা হাত ফসকে যাবে, সেটা আমি চাই না। গ্লেবকে যখন এতদিন পর ধরেছি, তখন জাল ফসকে মাছ বেরোতে দিচ্ছি না। খোঁজ নাও, মিঃ ওয়েসলির কাছ থেকে যাবার পর মিসেস ওয়েসলি কি করেছেন?

–হ্যাঁ স্যার।

কেউ লক্ষ্য করলনা, ওয়েসলির স্টাডির দরজাটাইঞ্চিখানেক খুলে গেল। গারন চলে যেতে নীরবে বন্ধ হয়ে গেল।

.

 পুলিশ চলে যেতে ফ্ল্যাটটিতে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা ফিরে এল। জুলির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডসন গম্ভীর গলায় ওর লোকদের নির্দেশ দিচ্ছে জুলি শুনতে পাচ্ছে। জুলি ভাবল, ডসন আবার ওর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু ডসন শুধু ওয়েসলির সঙ্গে দেখা করে, ভারী পায়ের শব্দ করে চলে গেল।

তারপর গেরিজেরও চলে যাবার আওয়াজ পেল। জুলি আস্তে আস্তে উঠে কার্পেটে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখতে লাগল।

সারা ফ্ল্যাটে এখন শূন্য গীর্জার নীরবতা।

প্যাসেজে আসতে ও ভয় পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ব্লানশ যে কোন মুহূর্তে ওর সামনে এসে দাঁড়াকেন।

এ ফ্ল্যাটে আর এক মিনিটও থাকার কথা ভাবতে পারছে না ও। ভিগো স্ট্রীটের চাবি আছে ওর কাছে। এই ভয়াবহ পরিবেশ ছেড়ে ওখানেই চলে যাবে ঠিক করলো জুলি। ব্যাগ গোছাতে শুরু করল।

ব্যাগ গোছানোর পর কিছু ভুলে গেল কিনা ও দেখছিল। হঠাৎ প্যাসেজে পায়ের শব্দ শুনে ওর মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল।

ব্লানশ?

অসম্ভব উনি মারা গেছেন।

অপেক্ষা করলো জুলি। আবার কান পাতল। ইঁদুর দেওয়ালের কাঠ আঁচড়ালে যতটুকু শব্দ হয়, তার চেয়ে জোর নয় আওয়াজটা। ও দরজাটা একচুল ফাঁক করে উঁকি মারলো।

দেখল, ফ্যাকাশে, অভিব্যক্তিহীন মুখে সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওয়েসলি কার্পেটের ভিজে দাগটা দেখছেন। তারপর ঐ জায়গাটায় পা বুলিয়ে স্বাগত বললেন, ও বেঁচে থাকার যোগ্য ছিল না।

জুলির অসুস্থতা অনুভব হলো এখন। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে ও চোখ বুজল।

 কখন ওয়েসলি ঘরে ঢুকেছেন ও শুনতে পায় নি। যখন উনি কথা বললেন ও চমকে, ছিটকে, লাফিয়ে উঠল।

ওয়েসলি মৃদু কণ্ঠে বললেন, ঘাবড়ে দিতে চাই নি। দরজায় টোকা দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু অতটা মাথায় আসেনি।

জুলি চুপ করে রইল।

ওয়েসলি আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন। জুলির দিকে না তাকিয়েই বললেন, এখন সব কি নীরব, শান্ত না? পুলিশের মুখে শুনলাম, তুমি ঠিকই আছে। তুমি নিশ্চয় ভীষণ ঘা খেয়েছে তাই না?

 জুলি কি বলবে ভেবে পেল না।

–ডসন কি রকম অদ্ভুত রকমের আচরণ করছিল। তাই না? এবার একটু দাঁড়িয়ে জুলির দিকে তাকালেন। আবার পায়চারি করতে করতে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলেন। বললেন, ও যেন কি সন্দেহ করছিল। ব্লানশ কেমন করে ফ্ল্যাটে ঢুকলো, তাতে কি এসে যায়? ডসন কেন তাই নিয়ে রহস্য করছে?

–আমি জানি না।

–গ্লেব ওকে গুলি করেছে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। ডসনের মতলব কি আমি বুঝতে পারছি না।

জুলি বলে উঠল, হ্যারি গুলি করেনি। আমি জানি।

ওয়েসলি সতর্ক দৃষ্টিতে ঘুরে দাঁড়ালেন।

–কি বলতে চাইছ জুলি?

–হ্যারি ও কাজ করে নি। আমি জানি ও করেনি।

তুমি কি করে এত নিশ্চিত হচ্ছো?

 আমি জানি ও খারাপ। কিন্তু ও কোনদিন সঙ্গে বন্দুক রাখতো না। একবার আমার সামনে মিসেস ফ্রেঞ্চ ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ওর কাছে বন্দুক আছে কিনা। ও তখন বলেছিল, ও কখনন বন্দুক রাখেনি, রাখবেও না। তখন ও সত্যি কথা বলেছিল। আজ রাতে ও যখন বলল ও ব্লানশকে গুলি করে নি তখনো ও সত্যিই বলেছিল।

ওয়েসলি সামান্য কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি পুলিশকে একথা বলেছো?

–ডসন আমার কথা বিশ্বাস করে নি। ও বলেছে, ফ্ল্যাটে শুধু আমি আর হ্যারি ছিলাম। হ্যারি না করলে আমি খুন করেছি।

–মূর্খ! ওয়েসলি রেগে গিয়ে বলল, ও নিশ্চয় একথা বিশ্বাস করে নি।

না। ও আমায় ভয় দেখাতে চাইছিল। কিন্তু হ্যারি খুন করতে পারে না। আমি ডসনকে বললাম সদর খোলা ছিল।

–কি বললে, কি বলতে চাইছ তুমি?

–সদর খোলা ছিল। ব্লানশ ঢোকার পর দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।

 ওয়েসলি জুলির কবজি ধরে টেনে এনে, ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, দরজা খোলার সঙ্গে খুনের কি সম্পর্ক আছে? কি ইঙ্গিত করছে তুমি?

ওঁর জ্বলন্ত দৃষ্টি দেখে জুলি স্থির, নির্বাক হয়ে গেল।

জবাব দাও জুলি!

–আমি শুধু বললাম, প্যাসেজ থেকে কেউ ওঁকে গুলি করে থাকতে পারে।

জুলি বিরক্ত হয়ে কবজি ছাড়ানোর চেষ্টা করল। দোহাই তোমার ছেড়ে দাও। আমার ব্যথা লাগছে।

কিছুক্ষণ ওকে ধরে থেকে তারপর ওয়েসলি ওকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ফেরালেন।

দুঃখিত। ডসন এর জবাবে কি বলল?

 জুলি বসে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, অদৃশ্য মানুষের কথা কি যেন বলল। বলল, কেউ উঠলে বা নামলে সেটা পুলিশের নজরে পড়তো।

–অদৃশ্য মানুষ? ডসন এই কথা বলল?

ওয়েসলির চাউনি জ্বরো রুগীর মত। কিন্তু সহসা.উনি খুব স্বাভাবিক ভাবে হাসলেন, জুলি তুমি সাহায্য করতে চেয়েছিলে। কিন্তু ভেবে দেখ ওকে দরজা দিয়ে কেউ গুলি করতে পারে না। পুলিশ যদি ওখানে পাহারায় থাকে তবে কারোর পক্ষে সম্ভব ওখান থেকে গুলি করা?

জুলি ওঁর ভাবভঙ্গী দেখে অবাক হয়ে বলল, না, হয়ত না। কিন্তু আমি নিশ্চিত হ্যারি ও কাজ করে নি।

–গ্লেবের ওপর তোমার এ বিশ্বাস বড়ই দুঃখের। হাজার হলেও ও একটা চোর। তোমার ওপর ও কোন দয়া দেখায় নি। ব্লশকে ও যে গুলি করেনি, তার কোন প্রামাণই নেই তোমার কাছে। তুমি কি ওকে ভালবাস?

না, আমি ওকে ভালবাসি না। কিন্তু তবু বলব ও একাজ করেনি।

–এটা একটা যুক্তিগ্রাহ্য কথা হলো না। জুরি তোমার এ কথায় কান দেবে না। যাক, দেখা যাক কি হয়।

জুলি বিস্ফারিত চোখে বলল, ওকে কি ফাঁসি দেবে ওরা?

জানি না। ও কথা এখন না ভাবাই ভালো। ওকে তো এখনো আদালতেই ভোলা হয় নি। ওয়েসলি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, এখানে আর একরাতও থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। তুমি পারবে জুলি?

–না।

–তাহলে, চলো নতুন ফ্ল্যাটে যাই আমরা।

ওঁর সঙ্গে থাকার কথা ভেবে জুলি শিউরে উঠল, ভাবল, এখন থেকেই বোধহয় ওদের নতুন সম্পর্ক শুরু হবে।

কিছুদিন আমি একলা থাকতে পারলে হোত। আমি কি ওখানে একা যেতে পারি না?

–সে অসম্ভব! ওঁর গলায় ধার। তুমি ভুলে যেতে পারো আমার সঙ্গে কোনদিন আলাপ হয়েছিল।

জুলি ওর দিকে কঠিন মুখে চাইল। ও ধারালো গলায় বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছো কেন আমি যাতে মুখ না খুলি, তার জন্যেই তুমি আমাকে এসব দিয়েছে? এখন আমার যা ইচ্ছে তাই করবো। আমি তোমার ঐ ফ্ল্যাট চাই না।

ওয়েসলি হাসলেন।

মৃদুস্বরে বললেন, একেবারে পাল্টে গেছ না জুলি? তুমি এখন যাকে ইচ্ছে বলতে পার আমি দেখতে পাই। আমার অন্ধত্বের ভান শুধু ব্লানশের জন্যে। এখন আর কিছু এসে যায় না। হয়তো ভবিষ্যতে তোমাকে বিশদ ভাবে সব বলব, এখন নয়। আর কয়েক সপ্তাহ আমি অন্ধের ভান করে যাবো। তারপর দৃষ্টি ফিরে পাবো। যদি তুমি বলে বেড়াতে চাও, বোলল। কিন্তু তুমি ফ্ল্যাট, টাকা কিছুই পাবে না। ঠিকভাবে চললে তোমার সবকিছুই থাকবে।

জুলি বুঝে উঠতে পারলো না উনি ধাপ্পা দিচ্ছেন, নাকি ধাপ্পা নয়। এই অনিশ্চয়তা ওকে খেপিয়ে তুলল। ও যে কোন শর্তে ফ্ল্যাট বা টাকা আঁকড়ে পড়ে থাকতে রাজি।

–বেশ, তাহলে তুমিও চলো। ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল।

 ওয়েসলি নতুন সুরে, উদ্বেল হয়ে বললেন, ভাল। চল, তাহলে নতুন করে জীবন শুরু করি দুজনে। আমি কথা দিচ্ছি ওখানে তোমায় আনন্দে ভরিয়ে রাখবো। আমি ব্যাগে কয়েকটা জিনিষ ভরে আসছি, তুমিও তৈরী হও। দেরী কোর না। কেমন?

জুলি গোছানো শেষ করল। ওয়েসলি এসে ব্যাগটা নিল।

চল। কাল গেরিজকে পাঠিয়ে দেব, ও গোছগাছ শেষ করে দেবে।

দুজনে প্যাসেজ ধরে এগোতে এগোতে কার্পেটে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখে কুঁচকে গেল। ওয়েসলি এগিয়ে লিফটের বোতাম টিপলেন।

লিফটের দরজাটা খুলে গেল। ওয়েসলি বললেন, এখান থেকে চলে যেতে ভাল লাগছে। চিরটাকাল এ জায়গাটা আমার অপছন্দ ছিল।

লিফটটা যখন নামছে, লিফটের মেঝেতে কোণের দিকে একটা জিনিষ জুলির চোখে পড়ল। ওয়েসলিও সেটা সেই মুহূর্তেই দেখলেন। দেখেই চট করে ওটা তুলে পকেটে পুরলেন। জুলি সবই লক্ষ্য করল। ওদের প্রথম সাক্ষাতের দিনে, ওঁর হাতে পরিয়ে দেওয়া সেই লিউকোপ্লাস্টের টুপিটা।

উনি ওটা লুকিয়ে ফেললেন বলে জুলি একটু বিস্মিত হল। জুলি দেখল ওঁর মুখে কিছু একটা মনের ভাব চেপে রাখার অদ্ভুত উত্তেজনার চিহ্ন। ও নিশ্চিত জানলো কালো চশমার আড়ালে চোখ দুটোতে ভয় জেগে উঠেছে।

তখন ও ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ব্যাপারটা ওর মনে একটা দাগ কেটে রইল। পরে ওর এ ঘটনার কথা মনে হয়েছে।

.

হ্যারি গ্লেব যখন কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল তখন ওয়েস্ট আদালতে তোক গিজগিজ করছে। হ্যারির দিকে অতগুলো তীক্ষ্ণ চোখের নির্মম কৌতূহলের দৃষ্টি হ্যারিকে স্তম্ভিত করলো ও ভীষণভাবে নাড়া দিল। ও সঙ্কুচিত চাহনিতে একবার তাকিয়েই ম্যাজিস্ট্রেটের মাথার ওপরের দেওয়ালটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

গ্রেপ্তার হবার পর হ্যারির মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ওর ফাঁপা অহমিকার বদলে আজ, ওর চোখে বন্য, ভীত, সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। হাত কাঁপছে। এখন ও ফাঁদে পড়া ভিতু একটা জন্তু, ওর নাকে মৃত্যুর গন্ধ আসছে।

এক সপ্তাহের জেল হাজতের হুকুম হওয়ার আগে ও ডসনের সাক্ষাতে শুনেছে, যে মিসেস ফ্রেঞ্চ আর ওঁর মেয়ে ডানা ওঁর হাত ফসকে সেই যে পালিয়ে গেছে, আর ধরা পড়ে নি। কোর্টের চারিদিকে তাকিয়ে ও বুঝলো ডসনের কথাটা কতখানি সত্যি কেননা ওর থেকে ক-গজ দুরেই ডানা বিপদ স্বীকার করেও হ্যারিকে দেখতে এসেছে। থিও মরে গেছে। হ্যারি ভাবল ও সবকিছু ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে গেছে। এখন ওর নিজেকে মনে হল অক্ষম, পরিত্যক্ত।

ডানা জানত ওর বিপদের সম্ভাবনা বেশি নয়। পুলিশের কাছে ওর তেমন বিশদ বিবরণ নেই। তবু সাবধানতাবশতঃ ও একটা চশমা পড়েছে, আঁটো টুপিতে ঢেকে নিয়েছে তামাটে চুল।

ডানার মনে হলো হ্যারিকে প্রেতের মতো দেখাচ্ছে। সজোরে কাঠগড়ার রেলিং চেপে ধরে ও কম্পিত গলায় উকিলের সাহায্য চাইল। ডানার বুক ফেটে যেতে লাগল কেননা ও অনেকদিন ধরে হ্যারিকে ভালবেসে এসেছে।

ডসন যখন অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদ বাড়িয়ে দিতে বলল, ম্যাজিস্ট্রেট তাতে সায় দিলেন। ডসন বলল হপ্তা ফুরোবার আগেই ও আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের আশা রাখে। হ্যারিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময়, ডানাকে ও দেখতে পেল। ডানা ওর দিকে তাকিয়ে উৎসাহের হাসি হাসলো।

ভীড় ঠেলে বেরোবার সময় ডানা ভাবল, ওরা হ্যারিকে ফাঁসি দিতে পারে না। ও খুন করেনি। থিওর কাছে বন্দুক ছিল, থিওই খুন করেছে। যেমন করে তোক হ্যারিকে এই জাল কেটে বের করতেই হবে কিন্তু কিভাবে?

চিন্তায় ডুবেও রাস্তা চলছিল। মনের গভীরে ও বুঝতে পারছিল হ্যারির জন্যে ও কিছুই করতে পারবে না।

ডানা যখন নিজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছে, ইন্সপেক্টর ডসন তখন আফিসে পৌঁছে দেখল গারক্ষন বসে আছে।

গারসনের প্রশ্নের জবাবে ডসন বলল, এক হপ্তার হাজত হলো। তারমধ্যে ওদের ধরতে হবে। কোন খবর আছে?

মিসেস ফ্রেঞ্চ আর ডানার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। নিশ্চয় কোথাও ভালমতো গা ঢাকা দিয়েছে।

ডসন ঘোত করে শব্দ করলো।

মিসেস ওয়েসলির সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের কোন খোঁজ পেলে, যে ট্যাক্সি ওকে থিয়েটার থেকে বাড়ি এনেছিল।

মনে হচ্ছে উনি ট্যাক্সিতে যাননি। কোন ড্রাইভারই ওকে ওয়েসলির বাড়িতে এনেছে বলে খোঁজ দিতে পারছে না। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার স্যার, একজন ড্রাইভারের পক্ষে একজন অন্ধলোককে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

–যাক্, ও এখন ছেড়ে দাও, মিসেস ওয়েসলির গতিবিধির কোন খোঁজ পেলে?

–তেমন কিছু পাইনি স্যার। থিয়েটারের দারোয়ান দেখেছে উনি ট্যাক্সি থেকে নেমে থিয়েটারে ঢুকলেন, ওয়েসলি ভাড়া মেটাচ্ছেন। থিয়েটারে বহুবার অভিনয়ের সুবাদে দারোয়ান ওঁকে ভালই চিনত। উনি বারে চলে গেলেন। দারোয়ান ওয়েসলিকে ঢোকার দরজা দেখিয়ে বলে দেয় মিসেস ওয়েসলি বারে গেছেন। ওয়েসলি শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। উনি ঢুকে গেলেন।

–কেন শুনতে পেলেন না, আমি জানি না। উনি তো কালা নন?

মিসেস ওয়েসলি বারে গেলেন। বারের মেয়েটার মনে হচ্ছিল ওঁর মেজাজ খারাপ আছে, বলতে গেলে কোন কথাই হয়নি ওঁর সঙ্গে। ওঁর এই আচরণে মেয়েটি খুশী হয় নি। তারপর উনি তিনটে ব্র্যান্ডি খান। প্রথম ঘণ্টা পড়ার মিনিটখানেক আগে বার থেকে বেরিয়ে যান। দারোয়ানটি অবাক হয়ে যায়। উনি পিকাডিলি সার্কাসের দিকে চলে যান। ফ্ল্যাটে গিয়ে না পৌঁছনো অবধি কেউ ওঁকে দেখেন নি।

হয়ত আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে গেছেন উনি। ট্যাক্সি পাওয়া অত সোজা নয় আজকাল।

–তাই মনে হয় স্যার। উনি যদি বেরিয়েই ট্রেন পেয়ে থাকেন তবে অবশ্য যে সময়ে পৌঁছেছেন, তা সম্ভব।

–ওয়েসলির কথা বলল। তার জবানবন্দীর সঙ্গে যা ঘটেছিল, তার মিল হচ্ছে কি রকম?

–ঠিকই মিলছে স্যার, তবে দুটো কথা। একটা হচ্ছে, দারোয়ানটি ওঁকে বলে মিসেস ওয়েসলি বারে কিন্তু উনি বলেছেন উনি জানতেন না মহিলা কোথায় গেছেন। অবশ্য এমন হতে পারে, উনি ওঁর কথা শোনেন নি। কিন্তু পর্দা উঠে যাবার পর উনি যখন থিয়েটার থেকে বেরোন, দারোয়ান একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে চায়। এখানে আমার একটু গোলমাল লাগছে। উনি জবানবন্দীতে বলেছেন, আমার মনে হল উনি এখানে ফিরে আসতে পারেন, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ট্যাক্সি পেতে আমাকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। অবশেষে একজন দয়াপরবশ হয়ে আমাকে ট্যাক্সি ডেকে দেয়।

হা, বেশ ভালই গোলমেলে। দারোয়ান যদি ট্যাক্সি ডেকে দিতে চায়, উনি যদি ভয়ই পেয়ে গিয়ে থাকেন, তবে দারোয়ানকে ট্যাক্সি ডাকতে দিলেন না কেন? উনি তো জানতেন উনি নিজে নিজে ট্যাক্সি ধরতে পারবেননা। আমি আবার ওনার সঙ্গে কথা বলে দেখব। এখন উনি সেই হল্যান্ড মেয়েটির সঙ্গে ভিগো স্ট্রীটের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন।

গারসন হাসলো।

মেয়েটি তো দেখতে বেশ খাসা স্যার। একটি মেয়ের যদি সুন্দর মুখ আর ভালো শরীর থাকে, তবে ফুর্তিবাজরা তার মগজে কি আছে কি নেই তা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না কেউ আজকাল।

–যে অন্ধ তার আবার সুন্দর মুখের মূল্য কি?

 গারসন চোখ পিটপিট করলো।

–হ্যাঁ, তা তো বটেই স্যার। আমি সে কথা ভেবে দেখি নি স্যার। না ঠিকই বলেছেন। তবে ব্যাপারটা কি?

–ওদের ওপর আমি নজর রাখার ব্যবস্থা করেছি। ওয়েসলি ঐ মেয়েটার পেছনে টাকা ঢেলে যাচ্ছেন। নাইট ক্লাব, থিয়েটার, মদের পার্টি, রেস্টুরেন্ট, নাচের আসর, রেস সর্বত্র দেখা যাচ্ছে ওরা একসঙ্গে যাচ্ছেন। উনি কারখানাতেও যাচ্ছেন না। আমি জানতে চাই আসল ব্যাপারটা কি?

ব্লাকমেইল?

–মনে হয় না। ব্ল্যাকমেইল হলে মেয়েটা সবসময় ওর সঙ্গে সব জায়গায় ঘুরবে কেন? ব্লকমেইলারও নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাইবে। জুলিকে ঠিক সে টাইপের মেয়ে বলে মনে হয় না।

–হয়ত ওরা প্রেমে পড়েছে স্যার।

–হয়তো। জানি না। যাই হোক গারসন, তুমি দেখ ফ্রেঞ্চরা কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। ওদের পেছনে লেগে থাকো। ট্যাক্সি ড্রাইভারের খোঁজ করে চলল। এখনও সময় আছে, হয়তো একজন কিংবা দুজন এগিয়ে এসে যোগাযোগ করবে। আমি এদিকে ওয়েসলির সঙ্গে কথা বলবো।

গারসন চলে গেলে ডসন ঘড়ি দেখলেন, তিনটে বেজে কয়েক মিনিট। ভাবলেন পাঁচটার পর ওয়েসলির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। উনি বাড়িতে না থাকলে জুলির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে।

.

ওয়েস্ট এন্ডে বেনটন একা একটা ছোট অথচ আরামপ্রদ ফ্ল্যাটে দিব্যি থাকেন। পুরোনো ফ্যাশনের বাড়িটায় তিনটে ফ্ল্যাট, তিনটেই অবিবাহিত একলা মানুষের জন্যে।

রবিবারে সকাল নটায়, অন্যান্য দিন সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট দিয়ে যায়। বেনটন সকাল সাড়ে সাতটায় উঠে সবকিছু সেরে সকাল নটায় কারখানায় চলে যায়।

ওর ব্রেকফাস্ট হলে জোলো দুধের সঙ্গে কর্নফ্লেক্স, মাখন, টোস্ট, কড়া কফি। কখনো এর ব্যতিক্রম হয় না। খাওয়া হয়ে গেলে ট্রের-ওপরে পড়ে থাকা আঁটা মোড়কের খবরের কাগজ নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে পড়তে শুরু করে।

ব্লশের মৃত্যুর পরের দিন অভ্যাস মত স্নান করেছে, দাড়ি কামিয়েছে, প্রাতঃরাশ খেয়েছে। মনে তখন দুটো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, ব্লানশ আর টাকা।

ব্লানশকে ও বহুবার স্টেজে দেখেছে দূর থেকে, মুগ্ধ হয়েছে। তবে প্রথম ভাল করে দেখে বেনটন, বিয়ের সময়ে। ওয়েসলি বিয়ের কথা ওকে আগে কিছুই বলেনি। অনেক বছর ওরা দুজনে ছিল কারখানার অংশীদার। একদিন ওয়েসলি-বেনটন এয়ারক্রাফট ফ্যাকটরি ছিল একটি ছোট, পরীক্ষামূলক, কল্পনামাত্র। দুজনের এক প্রচেষ্টায় আজ সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে চারশো একর জুড়ে মেশিনের দোকান, রানওয়ে আর হ্যাঙারের জঙ্গল। উদ্যোগটা ওয়েসলির তবে বেনটনের অবদানও কম নয়।

এই চুপচাপ, ফ্যাকাশে লোকটার সংগঠন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। প্রায় বছর আগে একদিন ওয়েসলি বেনটনের অফিসে ঢুকে ওঁর বিয়ের খবর জানালেন। বেনটন অভিনন্দন জানালো এবং মনে মনে কৌতূহল হল বউ দেখবে বলে। ভাবলো, দুনিয়ার কোন্ মেয়ে ঐ নাক উঁচু ওয়েসলিকে বিয়ে করছে! হয়তো কোন ঘোড়ামুখো মেয়ে। কিন্তু ওয়েসলি যখন ওকে ব্লানশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন ও প্রবল ধাক্কা খেল মনে।

বেনটন ছিল দুশ্চরিত্র। স্কুলে পড়ার সময় বেনটন একটা অত্যন্ত নোংরা কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ে। সর্বসমক্ষে স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়। নেশাখোরদের আফিমের মত, বেনটনের কাছে মেয়েরাও তেমনিই প্রয়োজনীয় ছিল।

ব্লানশকে কাছ থেকে দেখার পর ব্লানশ ওকে কাত করে ফেলল। ওর সঙ্গ কদিন পেতে না পেতেই ক্লানশের মদির, জাব আকর্ষণ বেনটনের ভেতরে থাবা বসালো। এ শুধু ক্ষণিকের মোহ নয়, সুন্দরী মেয়ের প্রতি সামান্য কামনা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি, গভীর প্রেমের অনুভূতি।

–ওয়েসলি যখন রয়্যাল এয়ারফোর্সে নাম লেখালেন, বেনটন তার অনুপস্থিতির সদ্বব্যহার করতে ইতস্ততঃ করলো না। ব্লানশের ততদিনে প্রচুর মদ খেয়ে শরীরে ও মনে পচন ধরে গেল। মদ বেনটনকে কাবু করতে পারলো না।

বেনটন অবাক হয়ে গেল যে ব্লানশের প্রতি ওর মোহ, ওর অনুভূতি এমনই প্রবল হয়েছে যে একবার ঘনিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সঙ্গ-তৃষ্ণায় টান ধরছে। টাকা থাকলে ও ব্লানশকে বিয়ে করত। ব্লানশ ওকে টাকাপয়সার সুব্যবস্থা করতে বললো।

এক বিকৃত যৌনকামনা ক্রমশঃ এক অদ্ভুত ধরনের গভীর প্রেমে দাঁড়াল। বেনটনের কোন বন্ধুবান্ধব ছিল না। ওর মধ্যে কি যেন ছিল, পুরুষরা ওকে অবিশ্বাস করতো। ব্লানশই ছিল ওর একমাত্র সঙ্গী।

কাগজ খুলে ব্লানশের ছবি আর খুনের খবরটা পড়ে বেনটন মড়ার মতো স্থানু হয়ে বসে রইল।

কাগজটা আঁকড়ে, চোখ বুজে নিশ্চল বসে রইল বহুক্ষণ। ওর মন যেন পঙ্গু হয়ে গেল। যখন একটু নড়তে পারলো সাইডবোর্ডের কাছে গিয়ে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি ঢেলে খেয়ে ফেলে আবার গ্লাস ভরে ফেলল। ও আবার খবরটা পড়লো আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

পরে ও ওয়েসলির ফ্ল্যাটে ফোন করলো, কিন্তু কোন উত্তর পেল না। কারখানায় ফোন করে জানতে পারলো ওয়েসলি তখনো পৌঁছননি। কিছুই করার ছিল না ওর। ঠোঁট কামড়াতে লাগল।

একঘণ্টা বাদে ওয়েসলি ফোন করে কাঠ কাঠ, ভাবলেশহীন গলায় বলল, আমি কিছুদি কারখানায় আসব না, তুমি আশা করি চালিয়ে নিতে পারবে। জরুরী কাজ কিছু নেই, তোমার আমাকে দরকার পড়লে ক্লাবে খোঁজ কোর।

ওয়েসলি হঠাৎ সব দায় দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন দেখে বেনটন স্তম্ভিত হয়ে গেল। ব্লানশের মৃত্যুতে ও কি আঘাত পেয়েছে।

বেনটন ভেবেছিল কোন ছুতো দেখিয়ে ক-দিনের ছুটি নেবে। কিন্তু তা সম্ভব হল না।

হ্যারি গ্লেব যখন ওয়েস্ট লন্ডন আদালতে হাজিরা দিল, বেনটন সেদিন হাজির ছিল। হ্যারির মুখে যন্ত্রণা আর ভয় দেখে ও খানিকটা স্বস্তি পেল।

সেদিনই সন্ধ্যায় ও জারমিন স্ট্রীটে সেগেত্তির রেস্টুরেন্টে গেল।

সেগেত্তি ওর দিকে আসতে ও বলল, আমার বাঁধা টেবিল। ওর কটা চোখে বিষাক্ত চাহনি, বলল, আমি বেশিক্ষণ থাকব না।

সেগেত্তি বলল, অবশ্যই মিঃ বেনটন, ফাঁকা টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে নীচু গলায় বলল, বেচারি ম্যাডাম! ওঁর অভাব আমাদের বড় মনে হবে। কি ভয়ানক, পৈশাচিক ব্যাপার।

বেনটন বসলো।

ও সেঁকা সামন মাছের ফরমাশ দিয়েও খেল না। ব্লানশের প্রিয় ব্র্যান্ডি নিল এক বোতল। বোতলের ব্র্যান্ডি দ্রুত কমতে লাগল, আর ও চিন্তায় ডুবে গেল। খেয়ালও করল না যে অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ ওর দিকে তাকিয়ে। টের পেল বেশ নেশা ধরেছে, পরোয়া করল না। ভেতরের তিক্ত, কঠিন প্রতিরোধটা ব্র্যান্ডির প্রভাবে আলগা হলো।

হঠাৎ ও ওয়েসলি আর জুলিকে ঢুকতে দেখল। জুলিকে চিনতে পারলো না। শুধু দেখলো একটা মেয়ে, পরনে আগুনরঙা সান্ধ্য পোষাক, উজ্জ্বল কাঁধ অবধি নামানো। গলায় ঝমকে হীরের হার। মেয়েটির দিকে কোন মনোযোগ না দিয়েই ও শুধু ওয়েসলিকে দেখতে লাগল। ও নিজেকেই প্রশ্ন করলো, ওয়েসলি কি করে এটা পারলেন? স্ত্রীনৃশংসভাবে খুন হবার পাঁচদিনের মাথায় উনি রেস্টুরেন্টে একটা মেয়েকে নিয়ে আসতে পারলেন কিভাবে? এইজন্যই কি উনি কারখানায় যাচ্ছেন না? এই মেয়েটির সঙ্গে বসবাস করছেন? মেয়েটি কে?

হঠাৎই ও রক্তরঙা চোখ দুটো জুলির দিকে ফেরালো। কোথায় দেখেছে ওকে? সহসা আড়ষ্ট হয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লো ও। জুলি! ব্লশের চাকরানী! চোখ মুছে আবার তাকালো। গাউনটা ওর চেনা। গাউনটা পরে জুলিকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না বটে কিন্তু ও যে জুলিই তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না।

ঐ গাউনটা ব্লানশ বিয়ের দিন পরেছিল। গাউনটা বেনটনের মনে ওদের প্রতিটি প্রেমের স্মৃতি জাগিয়ে তুলল। ঐ হীরে, ঐ গাউন, এসব তো ব্লানশের! ওয়েসলি ওর চাকরানীকে ব্লানশের জিনিষ দিয়ে সাজিয়ে ওর প্রতি চরম অবমাননা করেছে। ওর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। উঠে দাঁড়ালো ও। শ্বাসরোধকারী পৈশাচিক ক্রোধে জ্বলে উঠল।

বেনটন অস্পষ্ট ভাবে বুঝল, কেউ ওর একটা হাত ধরেছে, মোলায়েম গলায় ওর অসুস্থ লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করছে। নোংরা গালাগালি করে ও হাতটা ছুঁড়ে ফেলল। তারপর আড়ষ্ট পায়ে, জ্বলন্ত চোখে ওয়েসলির টেবিলের কাছে গেল।

চেয়ারে বসে রেস্টুরেন্টের সব লোক দেখতে লাগল, বেনটন ওয়েসলির টেবিলের সামনে থামলো। জুলির দিকে কম্পিত আঙুল তুললো।

ভাঙা, উন্মত্ত গলায় ও চেঁচিয়ে উঠলো, ঐ নোংরা কুত্তীটাকে তোমার স্ত্রীর পোষাক খুলে ফেলতে বলো। জুলির দিকে তাকিয়ে বলল, কোন আস্পর্ধায় পরেছিস তুই? ঝি কোথাকার?

ওর হাতটা হীরের নেকলেশটা ছিনিয়ে নিতে গেল কিন্তু জুলি ওর হাতটা মেরে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। ওয়েসলি লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। পাশের টেবিলে এক হোমরা-চোমড়া আর্মি অফিসার বসেছিল। সে সামনে লাফিয়ে পড়ে বেনটনের মুখে উল্টো হাতের একটা চড় মেরে ওকে ছিটকে ফেলে দিলো।

অফিসারটি উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, মাতাল, শুয়োর কোথাকার!

দুজন ওয়েটার ছুটে এল। ওরা বেনটনের হাত ধরলো। মনে মনে হাত মোচড়াতে মোচড়াতে সেগেত্তি ওদের ইশারা করল, বেনটনকে নিয়ে যেতে।

বেনটন ক্ষ্যাপার মত ধস্তাধস্তি করতে করতে বলতে লাগল, আমায় ছেড়ে দাও। হাত সরাও! ওরা বেনটনকে দরজার দিকে টানতে লাগল। তারপর ওর গলা কান্নায় ভেঙে পড়ল, ও ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।

সেই কান্নার দমকে সবাই হিম হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে, বকতে বকতে, দুজন ওয়েটারের সঙ্গে ও বেরিয়ে গেল। কাঁচের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

.