১. স্টেশন থেকে এস্কালেটরে

প্য ইন দ্য বটল

হ্যারি গ্লেব, নিউ বন্ড স্ট্রীটের স্টেশন থেকে এস্কালেটরে উঠে এল। বৃষ্টি পড়ছে ঝম ঝম্‌ করে। ফুটপাত জলে ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টির জল হুড়হুড়িয়ে নর্দমায় ঢুকছে। হতাশ হ্যারি গেটে দাঁড়িয়ে বিরক্তিতে রাতের আকাশের দিকে চাইল। আকাশের চেহারা অপ্রসন্ন, কালো মেঘে ঢাকা।

হ্যারি রেগে গিয়ে ভাবল, আমার পোড়া কপাল! ট্যাক্সি পাবার কোন আশাই নেই। জাহান্নামে যা সব। আমাকে হেঁটেই যেতে হবে দেখছি। দেরী হলে বুড়ী মাগী রেগে লাল হয়ে যাবে। শার্টটা সরিয়ে কবজিতে সোনার ঘড়ি দেখে ভাবল, ঘড়ি যদি ঠিক সময় দেয়, তবে আমার দেরী হয়ে গেছে।

একটু ইতস্ততঃ করে হ্যারি কোটের কলার তুলে ভিজে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিচু গলায় খিস্তি করতে লাগল। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে মাথা বাঁচাতে মাথাটা নিচু করে চলতে লাগল।

 টুপির কানা বেয়ে বৃষ্টি পড়ছে, পায়ে এসে পড়ছে বৃষ্টির ছাঁট। তাড়াতাড়ি হাঁটতে হাঁটতে হ্যারি বিড়বিড় করল, হতচ্ছাড়া দিনটার বজ্জাতি এবার কানায় কানায় পূর্ণ হলো। সিগারেটের ব্যাপারটা ঝুল খেল, হতভাগা কুকুরটা রেসে চারনম্বরে এল, চল্লিশ শিলিং একেবারে জলে গেল, আর তারপর এখন এই হাড় জ্বালানো বৃষ্টি!

বহুদিনের অভ্যাসমতো হ্যারি পথের আলো থেকে গা বাঁচিয়ে ছায়ায় ছায়ায় হাঁটছিল। নিউ বন্ড স্ট্রীটের মাঝামাঝি এসেই ও সামনের লোকটার ইম্পাতের বোতাম দেখে বুঝল এ নিশ্চয়ই পুলিশের লোক। তখনি ও রাস্তা পেরিয়ে গেল।

ঘাড়টাকে কুঁচকে ও এমনভাবে উঁচু করল যেন এখুনি একটা ভারী থাবা ওর ঘাড়ে এসে পড়বে। মনে মনে ভাবল, ওয়েস্ট এন্ড এখন ভীড়ে ঠাসা। ওঃ! লোকটা ষাঁড়ের মতো পেল্লায় জোয়ান, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছে না, স্রেফ জাক দেখাচ্ছে। এটাকে কয়লাখনিতে নামিয়ে দিলে বরং কাজ দেবে ঢের বেশী।

পুলিশটার থেকে শতখানেক দুরে এসে ও আবার রাস্তা পেরিয়ে মে ফেয়ার স্ট্রীটে ঢুকল। কয়েক গজ হেঁটে ও পেছন ফিরে চাইল। যখন পুরোপুরি বুঝল কেউ ওকে লক্ষ্য করছেনা ও কোথায় যাচ্ছে, তখন একটা পুরোন বইয়ের দোকানের পাশের দরজা দিয়ে ও একটা ঢাকা বারান্দায় ঢুকল। জায়গাটা আলো–আঁধারি।

পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ছাতা বগলে একটা মেয়ে নামছিল। ভুরু আর চুল সাদা, পরনে চামড়ার জ্যাকেট, ফ্লানেলের প্যান্ট। হ্যারিকে দেখে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। চড়া রঙ মাখা মুখখানা ঝলমল করে উঠল।

–আমায় দেখতে আসছিলে সোনা?

–প্রাণ থাকতে নয়। আমার টাকা খরচের অনেক রাস্তা আছে। হ্যারি খ্যাক করে উঠল। তারপর মেয়েটির ঠোঁট কুঁচকে যেতে দেখে একটু নরম গলায় বলল, ফ্যান, আজ বাতি–টাতি সব নিভিয়ে দাও। আজ পথে কোন খদ্দের নেই। এই অসম্ভব বৃষ্টিতে পথে পুলিশ ছাড়া কেউ নেই।

–তুমি তো আছে! মেয়েটি টোপ ফেলে বলল।

 হ্যারির খারাপ লাগল। ওয়েস্ট এন্ডের সব বেশ্যার সঙ্গে ওর চেনাজানা আছে। হ্যারি জানে ফ্যান বুড়িয়ে যাচ্ছে, ওর সময়টা খারাপ যাচ্ছে, এখন ওর লাইনের অবস্থাটা এমন যে পারলে ওর গলা কাটে।

টুপি থেকে জল ঝেড়ে ফেলে হ্যারি বলল, দুঃখিত ফ্যান! এখন আমি ব্যস্ত আছি, কাজ আছে! কেউ ওপরে গেছে কি?

–বের্নস্টাইন, আর, আর সেই ছুঁচোটা, থিও। শুয়োরের বাচ্চা আমায় আধ ডলার দিতে চাচ্ছিল।

হ্যারি হাসি চাপল।

–থিওর কথা নিয়ে ভেব না। কেউ ভাবে না। চিরকাল ও বদ রসিকতা করে।

 মেয়েটির চোখ রাগে জ্বলে উঠল।

–একদিন এমন টাইট দেব বুঝবে। অনেক পকের পোকা দেখেছি আমি, কিন্তু ও ছুঁচোটা আমায় যে সব কথা বলে, গা গুলিয়ে ওঠে একেবারে।

হ্যারি আলগোছে বলল, আমার তো ওর মুখ দেখলেই গা গুলোয়। আচ্ছা ফ্যান, চলি।

–কাজ শেষ হলে এসো আমার কাছে। ভালো জমবে, সত্যি বলছি।

 হ্যারি শিউরে উঠল।

–যাব খন একদিন, তবে আজ রাতে নয়। আমি ডানাদের বাড়ি পৌঁছব আজ। নাও, দেখি হাতের মুঠোটা?

ওর হাতে দু–পাউন্ডের নোট গুঁজে দিয়ে হ্যারি বলল, যা হয় একটা কিনে নিও।

মেয়েটি লোপ আগ্রহে নোট দুটো নিল।

ধন্যবাদ হ্যারি। তুমি বড় ভালো ছেলে।

–জানি। হ্যারি হাসল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবল, বেচারা! রদ্দি হয়ে গেছে একেবারে। মোটা বুড়ি! বলে কিনা জমবে ভালো, হেঃ!

সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটি দরজার সামনে দাঁড়াল হ্যারি। দরজায় লেখা–

মিসেস ফ্রেঞ্চ,
পরিচারক, পরিচারিকা সরবরাহ প্রতিষ্ঠান,
ভিতরে অনুসন্ধান করুন।

 ঠিক এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তারপর রেলিং দিয়ে ঝুঁকে দেখল ফ্যান বৃষ্টির মধ্যে ছাতা খুলে পথে নেমে এগিয়ে গেল। মাথা নেড়ে কাধ ঝাঁকিয়ে হ্যারি দরজায় টোকা মারল।

ঘরে আলো জ্বলে উঠল। একটা মেয়ে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল।

–এই যে! আমি যথারীতি দেরী করে এসেছি। হালকা মেজাজে হ্যারি বলল।

–এস হ্যারি। ওরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

করতে দাও।

মেয়েটিকে বুকে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে চুমো খেল। মেয়েটির ঠোঁট দুটো নরম, ওর ঠোঁটের সঙ্গে গলে মিশে গেল।

–এত কড়া দেখাচ্ছে কেন তোমায়? আঁ? গত রাতের পরেও?

রাতের কথা বোল না। মেয়েটি হেসে বলল, আজ সকালে যা মাথা ধরেছিল না।

 হ্যারি ভাবল, যেমন হীরের মতো কঠিন আর সুন্দর, তেমনি চড়া দামও বটে।

চল হ্যারি, ওরা অপেক্ষা করছে। আর মাকে তো তুমি জানই।

 সুন্দর আঙুলে ও হ্যারির মুখে আদরের ছোঁয়াচ বোলাল।

ওর কোমর জড়িয়ে ধরল হ্যারি।

–তোমার মা কি চায়? কয়েক হপ্তা দেখা না হওয়ার কারণে এখন আর আমার দেখা করতে কোন ইচ্ছে নেই। তোমার মার সঙ্গে দেখা হওয়া মানেই ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়া।

–বোকামি কোর না হ্যারি। এস, আঃ আবার ও রকম করছ? সত্যি, তোমার হাত একটু সামলাও এবার।

হ্যারি মুচকি হেসে মেয়েটির পেছন পেছন অফিস কামরা পেরিয়ে ভেতরের ঘরে এলো। একটা বড় টেবিল, তার ওপর একটা টেবিলল্যাম্প। আর কোন আলোনা জ্বলায় এবং সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরটা আলো–আঁধারি।

মিসেস ফ্রেঞ্চ টেবিলে বসে আছেন। সিডনি বের্নস্টইন আর থিও ওঁর মুখোমুখি বসে। হ্যারি ঢুকতেই সবাই ওর দিকে তাকাল।

 মিসেস ফ্রেঞ্চ ধারালো গলায় বললেন, তোমার দশমিনিট দেরি হয়েছে।

মহিলা মোটা থলথলে, গায়ের রং পাংশুটে হলদে। চোখ দুটো শানিত, চঞ্চকে। কানে দুটো দুল ঝুলছে। টেবিলল্যাম্পের আলোয় দুল দুটো ঝিমিক্‌ করছে।

হ্যারি দিব্যি বেপরোয়া চালে বলল, উপায় ছিল না। কান পেতে শোন বাইরে কোন ঝন্ঝ করে বৃষ্টি পড়ছে। ট্যাক্সি পেলাম না, হেঁটে আসতে হলো।

ও ওভারকোটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল চেয়ারে, এই যে সিড! কেমন চলছে বলো? ও কে? অন্ধকারে নখ কামড়াচ্ছে? আমাদের থিও না? কি হে থিও, ছুলি, ব্রণ সব কেমন আছে?

জাহান্নামে যাও! থিও অন্ধকার থেকে খেঁকিয়ে উঠল।

হ্যারি খোলা গলায় হাসল। তারপর বলল, যাকে বলে গোপাল ছেলে। এবার টেবিলে হাত রেখে মিসেস ফেঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে এবার তো আমি সশরীরে হাজির। না আসার চেয়ে দেরীতে আসাও ভালো। কি, ব্যাপার কি?

ডানা অধৈর্য হয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বলে ফেল মা। আমি শুতে যেতে চাই।

বস হ্যারি।

কাছের একটা চেয়ারে বসতে বললেন মিসেস ফ্রেঞ্চ, অনেকদিন হয়ে গেল। এখন একসঙ্গে একটা কারবার করতে হয়।

হ্যারি বসল।

–তাই না কি? জানি না।

এক প্যাকেট প্লেয়ার্স সিগারেট বের করে হ্যারি একটা ধরিয়ে বের্নস্টাইনকে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, পুলিশ তো পিছু লেগেই আছে। দেখেছ কাল রাতে প্যারিকে কিভাবে ধরল? বেচারা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কি বেরোয়নি অমনি ধরে নিয়ে গেল। পুলিশ এখন দারুণ ক্ষেপে আছে। আরে বাবা পুলিশকে নিকেস করেছ কি মরেছ। জানি না কেস করতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা।

 মিসেস ফ্রেঞ্চ অধীর হয়ে উঠলেন।

প্যারি একটা ন্যাকা। সব সময় তালে থাকে। কিন্তু এ কেসটা ভালো হ্যারি। আঁটঘাট বাঁধা, কোন ঝক্কি নেই।

সিগারেটের প্যাকেটটার দিকে থিওর ময়লা হাতটা এগোতে দেখে হ্যারি ছোঁ মেরে প্যাকেটটা উঠিয়ে নিল।

খেঁকিয়ে বলল, না, তুমি ধান্দা কোর না। যাও কিনে খাও গে।

থিও চাপা গলায় ওকে একটা গালাগাল দিল।

মিসেস ফ্রেঞ্চ খেঁকিয়ে উঠে বললেন, চুপ কর! কথা বলছি।

হ্যারি নরম হেসে বলল, বল! কি বলছো বল তো?

–ওয়েসলিদের ফার কোট চুরি করতে রাজী আছে?

হ্যারি কেমন যেন শক্ত হয়ে উঠল। নাক দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।

–আরে ব্বাপ। দাঁড়াও একমিনিট। তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছো? পাঁচ বছর হাজত ঘোরাতে চাও?

বের্নস্টাইন ক্রুদ্ধ গলায় ফুঁসে বলল, আমিও তাই বলছি।

লোকটা ছোটখাটো, সুটকো। মুখটা বাঁদরের মতো বাদামী কোঁচকানো। হাত আর কবজি গোছ গোছ কালো রুক্ষ লোমে ঢাকা। সার্টের কলারের ওপর দিয়ে ঘাড়ের লোম দেখা যাচ্ছে। ও বলল, একটু বুঝে শুনে বলবে তো? ইটের দেওয়ালে মাথা ঠুকে কোন লাভ আছে? ওয়েসলিদের পশমের পোষাক চুরি! মাথা খারাপ?

মিসেস ফ্রেঞ্চের চোখ কঠিন হয়ে উঠল।

আমরা যদি চুরি করি, ভাগ নেবার বেলায় তখন তো নেবে?

বের্নস্টাইন মাথা হেলাল।

–হ্যাঁ। কিন্তু ওগুলো পাবার কোন চেষ্টাই নেই তোমাদের। মাথাটা ঠাণ্ডা করে ভাবছ না কেন?

হ্যারি বলল, তুমি কি সত্যিই বলছো? আমাদের কিভাবে লড়তে হবে জানো?

জানি। মিসেস ফ্রেঞ্চ সিগারেটের ছাই ফেললেন মেঝেতে। বললেন, কাজটা সহজ নয় তবে করা যেতে পারে।

বের্নস্টাইন ওর লোমশ হাতটা মুঠো করে টেবিলে ঝুঁকে বলল, আমি বলছি, না! চারটে পার্টি চেষ্টা করেছে। তাদের অবস্থাটা কি হয়েছে ভেবে দেখ। একাজে ভয়ানক বিপদের ঝকি আছে।

হ্যারি মুখ গোঁজ করে বলল, ঠিকই বলছে ও। কেসটা হাসিল করতে পারলে একখানা কেসের মতো কেস হবে। কিন্তু বুঝতে পারছি না, আমরা পারব কিনা!

মিসেস ফ্রেঞ্চ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তুমি হাঁদার মতো কথা বোল না। তোমরা যা শুনেছ তার বাইরে কিছু জানই না। তোমরা এটা জানকি যে, চারটে হাবা ফার চুরি করতে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ খোঁজ নেয়নি আলমারীটা ভোলার কায়দা কি? ওরা মাথা খাটায়নি কেন না ওদের মগজে ঘিলু বলে পদার্থই নেই।

বের্নস্টাইন সামনে ঝুঁকে বলল, ভুল করছ। ফ্রাঙ্ক খুব খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়েছিল। চারমাস ধরে খোঁজ–খবর নিয়েই গিয়েছিল। আলমারী খুলতে যাবার আগেই মামার হাতে ফেঁসে গেল। এবার কি বলবে বল?

অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। ওদের থেকে বোঝা যাচ্ছে আলমারীতে এমন একটা ঘণ্টা ফিট করা আছে যে আলমারীতে হাত পড়লেই ওটা বাজতে থাকবে। এই খোঁজটা নেওয়াই আমাদের প্রথম কাজ হবে।

হ্যারি জিজ্ঞেস করল, কাজটা করা হবে কিভাবে?

মিসেস ওয়েসলির একটি পরিচারিকা দরকার। অন্য সব এজেন্সিতে খবর নিয়ে–টিয়ে আমার কাছে এসেছেন। আমিও এই সুযোগটার জন্যেই বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছি।

এতক্ষণে হ্যারির গলায় আগ্রহ ফুটে উঠল, এই সুযোগে আমরা আমাদের চেনা লোক ফিট করব? মতলবটা ভালই, তাতে কাজ হলেও হতে পারে।

কাজ হবে। ওখানে যদি একটা চালাক চতুর, চৌখস মেয়েকে ঢোকানো যায়, সে সমস্ত খবর, আলমারীর নকশা বের করে আনবে। যদি খবর আনে, তুমি কাজ করবে?

হ্যারি মাথা চুলকে বলল, করতে পারি।

হঠাৎ ওর প্যারির কথা মনে পড়ল। পরশু রাতে ওরা দুজনে বিলিয়ার্ড খেলছিল, প্যারি এখন জেলে। ওয়েসলিদের ফার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে পাঁচবছর সশ্রম কারাদণ্ড হবে।

একথা মনে হতেই হ্যারি শিউরে উঠল আর বলল, কাজটা সোজানয়, সময় থাকতে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি, থিও কি সঙ্গে থাকছে?

নখ কামড়ানো থামিয়ে থিও বলল, নিশ্চয়, আমি তোমার মত ভীতু নই।

হ্যারি গলার স্বরটা যথাসম্ভব নরম রেখেই বলল, বাঁদরের বাচ্চা, একদিন আমি তোমার ঐ ব্রণগুলো থেতলে দেব। সেই সঙ্গে তোমার মুখটাও থেতো করব।

মিসেস ফ্রেঞ্চ ওদের কথার মধ্যে বলে উঠলেন, আমরা একটা মেয়ে না পেলে কিছুই করতে পারব না, হ্যারি তোমার সন্ধানে কোন মেয়ের খোঁজ আছে নাকি?

হ্যারি চোখের কোণা দিয়ে তেরছা ভাবে ডানার দিকে তাকাল, আমি তো অনেক মেয়েকেই চিনি, কিন্তু ঠিক কি রকম মেয়ে চাও তার ওপর নির্ভর করছে সব।

মিসেস ফ্রেঞ্চ তড়িঘড়ি বললেন, এই চালাক-চতুর, বয়স কম, দেখতে ভাল, চটপট টাকা পেলে খুশী হবে, এরকম একটা মেয়ে পেলে ভাল হয়। প্রশংসাপত্র, সাটিফিকেট আমি যোগাড় করে দেব।

হ্যারি চেয়ারটা পেছনে হেলিয়ে ওপর দিকে চেয়ে রইল। একটু ভেবে বলল, আছে একটা মেয়ে। বেশ চালাক–চতুর, নাম জুলি হল্যান্ড। ব্রিজ কাফেতে স্যাম হিউয়ার্টের কাছে কাজ করে। সিড তো ওকে দেখেছে। কি সিড, ওকে দিয়ে কাজ চলবে?

বের্নস্টাইন কাঁধ ঝাঁকাল। মুখে বিরক্তির ভাব।

–জানি না। চলতে পারে, তবে ঐ বদমেজাজী, খেকি কুত্তিটাকে মেজাজ সামলে চলতে হবে।

হ্যারি হেসে উঠল।

–সিড রেগে আছে। সেদিনও মেয়েটার পেছনে একটা চিমটি কাটাতে ও অমনি সিডের বদনে একখানা থাপ্পড় কষিয়েছিল।

আরে বাপরে! হাসতে হাসতে আমার বেল্ট ছিঁড়ে যাচ্ছিল আর কি! সিডের কথায় কান দিও না। আমার মনে হয় ওকে দিয়েই চলবে। বেশ ভালই দেখতে, হাঁদা নয়। হিউয়ার্ট ওকে বেশ পছন্দ করে। তবে ওকে খুব হুঁশিয়ার থাকতে হয়।

মিসেস ফ্রেঞ্চ জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশের খাতায় নাম নেই তো?

না না, ও হাঙ্গামা এড়িয়েই চলে, তবে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, ও বেশ বড় দাও মারার তালে আছে। প্রচুর উচ্চাশা আছে মেয়েটার। ঐ ঘেঁতিয়ে ঘেঁতিয়ে হপ্তায় ক পাউন্ড কামাই করার চেয়ে মোটা টাকা কামানোর ধান্দায় বড় ঝুঁকি নিতেও রাজী হতে পারে।

–ওর কাছে আমরা কিছু ভাঙবনা। তাতে খুব বিপদ। পুলিশ ঠিক আঁচ করবে কাজটা ভেতর থেকে হয়েছে। তাতে ওকে ধরবে। আমাদের এটা নিশ্চিত হতে হবে যে কাজ হাসিল হবার পর, কেস বিগড়ে গেলে ও যেন মুখ না খোলে।

থিও এগিয়ে বসল। ওর মুখে আলো পড়ল।

ও মেয়ে খুঁজে বার করুক। মুখ যাতে না খোলে সে দায়িত্ব আমার।

মিসেস ফ্রেঞ্চ খেঁকিয়ে উঠলেন। মেয়েটাকে আমার চাই। মেয়েটা তোমায় পছন্দ করে হ্যারি?

হ্যারি হাসল।

–ঘেন্না করে বলতে পারব না। তবে একটা কথা কি, জানতে চেয়ো না, কেন মেয়েরা আমাকে দেখলেই গলে পড়ে।

ডানা ওর পায়ে লাথি মারল। হ্যারি তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে চোখ টিপে বলল, এখানে যারা আছে তাদের কথা আমি বলছিনা। তবে এ মেয়েটা আমার দিকে কেমন ভিজে ভিজে চোখে তাকায়। যা বুঝতে হয় বুঝে নাও।

মিসেস ফ্রেঞ্চ বললেন, তাহলে তুমি ওকে ম্যানেজ করে এখন খেলাও। তারপর ওর মন যদি তোমার ওপর পড়ে থাকে তবে ও মুখ খুলবে না।

ডানা রেগে গিয়ে বলল, যেমন তুমি তেমনি তোমার ঐ হতভাগা মেয়েগুলো। সাবালক হও, বুঝলে?

 হ্যারি ওর হাতে আদর করে বলল, দিব্যি চলে যাচ্ছে তো? তুমি তো জানো, ওদের কোন মূল্যই নেই আমার কাছে।

থিও বিশ্রীভাবে খেঁকিয়ে বলল, যাও না, দুজনে গিয়ে গলা ধরাধরি করে কাঁদো গে। তোমাদের দেখলে আমার বমি পায়।

হ্যারি রেগে বলল, এক ঘুষিতে এই হোঁদলটাকে আমি ছাতু বানাচ্ছি, দাঁড়াও।

মিসেস ফ্রেঞ্চ রেগেমেগে থিওর দিকে তাকিয়ে হ্যারিকে বললেন, তুমি মেয়েটাকে এক হপ্তার মধ্যে আমার কাছে নিয়ে এসে হ্যারি। ওকে না পেলে আমাদের কিছুই হবে না। পারবে?

দাঁড়াও; এক মিনিট সবুর কর। আমি কাজটা করব বলে কোন কথা দিইনি। আগে শুনি আমার ভাগ্যে কি থাকছে? পড়তায় না পোষালে আমি নেই।

মিসেস ফ্রেঞ্চ এ কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। পেনসিল আর কাগজের প্যাড টেনে। নিলেন তিনি।

ফারগুলো তিরিশ হাজার পাউন্ড ইনসিওর করা। ধর আমরা সতের হাজারই পেলাম?

বের্নস্টাইনের দিকে তিনি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন।

 আরও বললেন, তোমার ভাগে আট হাজারের কম পড়বে না হ্যারি, বেশীও পড়তে পারে।

–মার দিয়া! এই তো কথার মতো কথা বলেছে, আট হাজার পেলে–। হ্যারি সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। চোখ দুটো চকচক করে উঠল।

–যতসব পাগলামী!

জানালার শার্সিতে বৃষ্টি ঝাপটাচ্ছে। বর্ষাতি মুড়ে আরামে যে পুলিশটি মে ফেয়ার স্ট্রীট ধরে হাঁটছে, সে জানলেই না যে কয়েক গজ দুরে ডাকাতির একটা পরিকল্পনা হচ্ছে। ডাকাতিতে ওর কোন আগ্রহই নেই। ও তখন ভাবছিল, সেদিন যে বাঁধাকপির চারাগুলো ও পুতেছে, সেগুলো বৃষ্টি পেলে বেশ বেড়ে উঠবে।

খোঁজ করলে দেখা যাবে কিংস স্ট্রীট, ফুলহ্যাম প্যালেস রোড আর হ্যামারস্মিথ ব্রিজ রোডের ইট, পাথর ও নোংরা জানলার জটিল অরণ্যের ভেতর নানা রকমের কাফে, রেস্টুরেন্ট আর ক্লাব দিব্যি গা ঢাকা দিয়ে টিকে আছে।

ভাবতে অবাক লাগে এরকম হাড়-হাভাতে চেহারার কাফেগুলো চলে কি করে? হ্যামারস্মিথ ব্রডওয়ে থেকে দোকানদার আর লোকজনদের যে জনস্রোত বেরোয় তাদের কে, কে এসব রেস্টুরেন্টে খেতে আসে?

কিন্তু এই বিশেষ কাফে আর রেস্টুরেন্টগুলো জেগে ওঠে রাতে আর ভোরে। এগুলোতে রাত এগারটার পর ভীড় উপচে পড়ে। একদল ক্রুর ও ভীষণ চেহারার নরনারী চা বা কফি নিয়ে বসে নিচু গলায় কথা বলে। যতবার দরজা খোলে তারা সন্দিগ্ধ চোখে মুখ তোলে, চেনা লোক দেখলে নিশ্চিন্ত হয়।

সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যারা এখানে ইঁদুরের মতো গা ঢাকা দিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যায় তারা এসে ঝট করে এক পেয়ালা কফি খেয়ে চারদিকের হালচাল বুঝে নিয়ে আবার ওয়েস্ট এন্ড পালায়। ছোট-খাট গ্যাংগুলো নতুন চুরির খবরাখবর নিয়ে এখানে আলোচনা করে।

লন্ডনের অপরাধ জগতের সবচেয়ে নোংরা উচ্ছিষ্টরা, ফুলমার্কা সমকামীর দল মুখে রং মেখে, পায়ে চটি, গায়ে রঙিন সোয়েটার পরে এইসব জায়গায় ভিড় করে।

ব্রিজ কাফে এই অঞ্চলের রেস্টুরেন্ট রাজ্যের বাদশা। মালিকের নাম স্যাম হিউয়ার্ট। মোটা লোকটা, মুখের চেহারা চোয়াড়ে বয়স ধরা যায় না।

লন্ডনে বোমা পড়ার সময় হিউয়ার্ট আগ বাড়িয়ে জলের দরে কাফেটা কেনে। ও তখনি জানত ঐ অঞ্চলে মস্তানদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা করার একটা জায়গার দরকার একদিন পড়বেই। সেখানে ওরা কে শহরে আছে, কে নেই, কে দামী সিল্কের মোজা, ফারকোট সবচেয়ে চড়া দামে কিনতে রাজী আছে, সব খবর মস্তানদের জানতে হবে।

ছমাস আগে হিউয়ার্টের অফিসে জুলি হল্যান্ড নামে একটি মেয়ে আসে। কাছাকাছি একটা সত্তার লাইব্রেরীতে কাজ করতে করতে খবর পায় স্যামের ওখানে একটা কাজ খালি আছে।

মেয়েটি ওকে আস্তে বলল, হয়ত আমি কাজে লাগব। কি কাজ করছি তা নিয়ে ঝামেলা পাকাই না।

মেয়েটির ফ্যাকাশে মুখে গাঢ় বাদামী চুল ঢেউ খেলে ছড়িয়ে পড়েছে, দেখে হিউয়ার্টের ভালো লেগেছিল। জুলির সতর্ক দুটো চোখ ছাড়াও স্যামের ভাল লেগেছিল ওর শরীরটি। কামুকের মন দিয়ে ও কল্পনা করে দেখেছিল পোক ছাড়া জুলির শরীর একেবারে মনমাতানো হবে।

কেন যে মেয়েটিকে আগে ও দেখেনি! জুলি যদি লাইব্রেরীতেই কাজ করে তবে স্যামের আগেই দেখা উচিত ছিল।

নিজেকে নিজেই বলেছিল, পাঁচ বছর আগে হলে জুলি স্যামের চোখে পড়তই।

 স্যাম যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ মেয়েদের কথাই ভাবে। ভীরু মানুষের মনের অবচেতন মনে যেমন মৃত্যু চিন্তা জেগে ওঠে স্যামের মনেও মেয়েদের কথা তেমনি অমোঘ ভাবেই জেগে ওঠে।

ইদানিং অত বেশী করে মেয়েদের কথা ভাবে না, যখন খেয়াল হয় যে, মেয়েদের কথা তো ভাবছি না? তখন মেয়েদের মুখ মনে ভেসে ওঠে। ও নিজের মনে সক্ষোভে বলে ওঠে, এ আর কিছুই নয়, বয়সের লক্ষণ।

কামনার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল স্যাম। এ মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াতেই স্যামের মনে কামনা জাগিয়ে তুলল। জুলি একটা সোয়েটার পরেছে, তাতে বুক দুটো ঠেলে উঠেছে। আঁটো স্কার্ট। স্যামের চোখে পড়ার মত জুলির প্রতিটা শরীরের রেখা। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক এমনভাবে লাগিয়েছে যে ঠোঁট দুটো চৌকো মনে হয়। নরম মোমের মতো ঠোঁট দুটো দেখেই স্যামের নিঃশ্বাস আঁটকে গেল।

জুলি স্যামের জরা কবলিত মনে কামনা জাগাবার জন্যেই যে ইচ্ছে করে এই ধরনের পোষাক পরেছে, তা জানলে স্যাম বিরক্ত হতো। এক খোশমেজাজী মস্তান ছোকরা জুলিকে এই কাজের খবরটা দেয়। স্যাম একটা চালাক-চতুর মেয়ে খুঁজছে, যে গাবিয়ে না বেড়িয়ে মুখ এটে থাকবে, তাতেই হবে। মস্তানটি বলেছিল মাঝে-সাজে চটকা চটকিতে জুলির আপত্তি না থাকলে স্যামকে ওর খারাপ লাগবে না।

মস্তানটি বলেছিল, ও বুড়ো হচ্ছে, বুড়োরা কি রকম হয় তা তো জানই। আলুভাতে মার্কা ব্যবহার করে। ও তুমি ঠিক ম্যানেজ করতে পারবে।

জুলি কি জানত না ওই অঞ্চলের কাফেগুলো কি রকম? ব্রিজ কাফেও সেই জাতেরই, তবে হিউয়ার্ট রীতিমত ভাল পয়সা দেবে, সেটাই আসল কথা।

মস্তানটি বলেছিল, হপ্তায় ছ পাউন্ড দেবে, তবে মাঝে মধ্যে যদি ওকে পায়ে চিমটি কাটতে দাও, তবে ওকে → মেরে সাত পাউন্ড পেতে পার হপ্তায়।

সাত–পা–উ–ড! তখনি ও কাজটা বাগাবে বলে ঠিক করে। হিউয়ার্ট যদি ঘিনঘিনে লোক হয় তো কি আর করা যাবে? জুলিরও কিছু এসে যায় না তাতে, ওরকম খামচা খামচি ওর অভ্যেস হয়ে গেছে। হপ্তায় সাত পাউন্ড! এ যে কুবেরের ধন!

জুলির বয়স বাইশ। ওর মা বাবা অসম্ভব গরীব। এর মধ্যে কুড়িটা বছর কেটেছে দুঃসহ দারিদ্রে। কখনো কুড়িয়ে, বাড়িয়ে, কখনও চুরি করে পেট চলত। জুলির মনে পড়ে ওর পেটের খিদে কখনো যেত না।

অতীতের কথা যত দূর জুলির মনে পড়ে ওর জীবনটা ছিল হতাশায় ভরা, অন্যদিকে ওর মনে হত ও যেন ফাঁদে পড়া জন্তু। মনে হত ওর অনেক টাকা থাকলে ভালো ভালো জিনিষ কিনতে পারত ও, সব কিছু থেকে ও বঞ্চিত হচ্ছে। জীবনের সুখ-আরামের উপকরণ পাবার জন্যে ও তখন মরিয়া হয়ে নিজেই সব যোগাড় করতে লাগল।

প্রথমে বন্ধুর কাছ থেকে চকোলেট, রুটিওয়ালার দোকান থেকে মিষ্টি রুটি, নিজের বোনের মাথার রিবন, পাশের বাড়ির ছেলের কাঠের লাট্ট এইসব ছোট ছোট জিনিষ চুরি করত।

চুরি খুব হুঁশিয়ার হয়েই করত, কেউ ওকে সন্দেহ করত না। পরে লোভ বেড়ে যেতে বারো বছরের জন্মদিন উপলক্ষে ও উলওয়ার্টের দোকানের জড়োয়া গয়নার বিভাগ থেকে চুরি করল এবং ধরা পড়ল।

ম্যাজিস্ট্রেট খুবই দয়া দেখালেন। জুলির পারিবারিক রিপোর্ট পড়ে, ছোটদের মন বুঝে জুলিকে ডেকে পাঠালেন। বেদম ভয় পেয়ে যায় জুলি। ওঁর উপদেশের সারমর্ম বোঝাতে সেই যে বাঁদর আর বোতলের গল্প উনি বলেছিলেন, সেটা জুলির আজও মনে আছে।

উনি জিজ্ঞেস করলেন, জুলি, তুমি কি জান ব্রেজিলে কেমন করে বাঁদর ধরে?

 জুলি বলল, জানে না।

উনি বললেন, আমি বলি তুমি শোন। ব্লেজিলের লোকেরা বোতলে বাদাম পুরে বোতলটা গাছের গায়ে বেঁধে রাখে। বাঁদর হাত ঢুকিয়ে বাদামটা ধরে, কিন্তু বোতলের সরু মুখ দিয়ে বাদামসুদ্ধ থাবাটা বের করতে পারেনা। তুমি হয়তো ভাবছো বাদামটা ছেড়ে দিলেই তো মুঠোটা খুলে হাতটা বের করে পালিয়ে যেতে পারে বাঁদরটা। কিন্তু লোভী বাঁদর তা করে না। এবং ধরা পড়ে। গল্পটা মনে রেখো জুলি। লোভ জিনিষটা সর্বনাশা। বেড়েই চলে এবং একদিন না একদিন ধরা পড়বেই।

ম্যাজিস্ট্রেট ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

আর কোনদিন ও চুরি করেনি।

কিন্তু যতই বড় হতে থাকল ক্রমশঃ ওর টাকাপয়সার ওপর আকর্ষণ বাড়তেই থাকল। ইতিমধ্যে ওর বাবা-মা লন্ডনে বোমা পড়ার সময়ে মারা গেলে ও একখানা খুপরি ফ্ল্যাটে স্বাধীনভাবে জীবনযাত্রা শুরু করল। সহসা ও একদিন আবিষ্কার করল এখন ও যখন ইচ্ছে, যত ইচ্ছে রাতের পর রাত বাইরে কাটাতে পারে। কেননা ওর মধ্যে এখন পুরুষকে আকর্ষণ করার মত কিছু সম্পদ লুকিয়ে আছে।

কিছুদিনের মধ্যেই ও নিজের এই মোহিনী শক্তির কথা জেনে গিয়েছিল। সামান্য অছিলায় পুরুষেরা ওর শরীরে হাত রাখলে ও চটে যেত। বাস কন্ডাক্টর ওকে হাত ধরে নামাতে গেলে ও বিরক্ত হতো। বুড়োরা ওর হাত ধরে রাস্তা পার করে দিতে চাইলে ও খেপে উঠত। অন্ধকার সিনেমা হলে কোন পুরুষ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে পয়সা খোঁজার অছিলায় ওর পায়ে হাত বোলালে ও চটে উঠত।

কিছুদিনের মধ্যে ও এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এখন স্বাধীনতা পাবার পর ও ভাবল এই আকর্ষণটুকুকে পুঁজি করে তুলতে পারা যায় না?

যুদ্ধ আর আমেরিকান সৈন্যদলই ওকে এই সুযোগ এনে দিল। ইস্ট এন্ড থেকে যেসব ছুকরীরা এসে ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে ফুর্তি করে, ও তাদের দলে ভিড়ল।

সৈন্যগুলো পিকাডিলিতে ঘোরাঘুরি করলে ঐ ছুকরিলো হিঃ হিঃ করে হাসে আর ওরা তা উপভোগ করে। সতেরো বছরের জুলি এমন একটা বড় ঘরের মেয়ের মতো আদব কায়দা রপ্ত করল যে ওকে দেখে মনে হত আলাদা জাতের মেয়ে।

অফিসাররাই ওকে পছন্দ করল বেশী। এখন আর ওকে ছোট্ট খুপরি ঘরে দেখাই যায় না। এই ভাবে নিজের চারপাশে একটা কঠিন পাঁচিল গড়ে উঠল। কয়েকটা সম্পত্তি–একটা দৃঢ়কঠিন ব্যক্তিত্ব, এক আলমারীঝলমলে পোষাক, পুরুষদের যৌন আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত করার অভিজ্ঞতা আর পোস্টাফিসে পঞ্চাশ পাউন্ড জমে উঠল।

এইভাবে কিছুদিন ভালই কাটল। কিন্তু যুদ্ধ ফুরোতেই সৈন্যরা দেশে ফিরে গেল। ওর হাতে টান পড়তেই শুরু হল ছল–চাতুরীর খেলা। কাপড়ের কুপন, খাবার, টাকা সব কিছুর জন্যই চাতুরীর আশ্রয় নিতে হলো অবিরাম। ভাগ্য জোরে লাইব্রেরীর কাজটা জুটল মাইনে হপ্তায় দশ শিলিং।

জীবনটা এখন শুধু ছলচাতুরি আর কৌশল হয়ে উঠল। জুলির মনে হল জীবনে বেপরোয়া খুঁকি না নিলে দিন মন্দাই যাবে। ওর মনে হল, সৎপথে থেকে কষ্ট কর, নয় অসৎপথে গিয়ে মজা লোট সামনে এখন দুটো রাস্তা খোলা। মাঝামাঝি সন্তোষজনক কোন পথই নেই।

ও জানত ব্রিজ কাফে জায়গাটা বদমাশদের আড্ডাখানা। কিন্তু ওখানে পয়সা মেলে, মোদ্দা কথা পয়সা। দশ শিলিং–এ হপ্তা চালাতে চালাতে জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে।

তরুণ মস্তানটি বলেছিল, হিউয়ার্টের ওখানে কাজ করলে তুমি শহরের ভি. আই. পি-দের দেখতে পাবে, পাশার দান ঠিক ঠিক ফেলতে পারলে জন্মে অভাব হবে না। এত সুন্দর চেহারা তোমার, এটাকে কাজে লাগিয়ে মজা লোট। এই লাইব্রেরীতে কাজ করে নিশ্চয়ই মজা পাও না, তাই না?

হপ্তায় সাত পাউন্ড! ও তখনি মন ঠিক করে ফেলেছিল। কাফেটার প্রচুর বদনাম থাকা সত্ত্বেও ও দিব্যি সামলাতে পারবে। হিউয়ার্ট যদি রাজী থাকে ও এখনি ওর কাছে কাজ করবে।

জুলিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে হিউয়ার্ট ওকে কাজে বহাল করবে বলে ঠিক করেছিল।

হিউয়ার্ট বলেছিল, দুটো কাজ খালি আছে। একটা দিনের বেলায়, খানিকটা ঝাড়পোছ করা, রাতের জন্য স্যান্ডউইচ বানানো…তেমন খাটাখাটনি নেই আর আহামরি তেমন কোন কাজও নয়। মাইনে হপ্তায় তিন পাউন্ড।

–আর অন্যটা?

 জুলি প্রশ্নটা করেছিল বটে, কিন্তু ও তখনই ঠিক করে ফেলেছিল যে দ্বিতীয় কাজটাই ও নেবে।

হিউয়ার্ট চোখ টিপে বলেছিল, অন্য কাজটা তোমার পছন্দ হতে পারে। যে মেয়ের উচ্চাশা আছে যে মেয়ে মুখ বুজে থাকতে জানে তার মনের মত কাজ।

–তাতে কি মিলবে?

–হপ্তায় সাত পাউন্ড। টাকার হিসেব রাখবে, যে যা বলবে, মনে রাখবে। কাজটা রাতে– সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত মুখবন্ধ রাখতে হবে মানে মুখে কুলুপ এঁটে রাখা, বুঝলে।

জুলি বলল, আমি কথা বলি না।

বলে অবশ্য খুব একটা লাভ হবে না। অন্তত এ পাড়ায় তো নয়ই। আমার একটি মেয়ের। কথা মনে আছে, তোমার থেকে বয়সে ছোট হবে, কি একটা কথা শুনে ফেলেছিল, কথাও বলেছিল তা নিয়ে। ওসবে মাথা না দিলেই পারত মেয়েটি। তারপর চোরাগলিতে ওর দেহটা পাওয়া গেল। চেহারা যা তা হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং গাবিয়ে বেড়ানোর এই পুরস্কার। বুঝলে?

–আমাকে ভয় দেখিও না। আমি কালকের মেয়ে নই। জুলি ইম্পাতে শাণিত গলায় বলে উঠল।

হিউয়ার্ট ওর দিকে চেয়ে হাসল।

যা বলেছ। যে মুহূর্তে তোমায় দেখেছি তখনই বুঝেছি তোমার মত ধারালো মেয়েই আমার দরকার। এখন শোন, খদ্দেরদের কাজটি করে দিও বুঝলে? খবর রাখা এবং সময় হলে ঝটপট সেটা সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়াই এ কাজের একটা দরকারী অঙ্গ। কোন খবরই লিখে রাখা চলবে না। মনে রাখতে হবে। এক রাতে কুড়িটা খবরও আসতে পারে।

হিউয়ার্ট আরো বলে যেতে লাগল, যেমন ধর, তুমি জ্যাক স্মিথের খোঁজে একটা ফোন পেলে। তোমায় জানতে হবে জ্যাক স্মিথ কে? সে এখানে আছে কি নেই? যদি না থাকে তবে তা জানিয়ে দেবে এবং খবরটা জেনে নেবে। স্মিথ আসার সঙ্গে সঙ্গে খবরটা যেন তার কাছে পৌঁছে দিতে পারো। আর ও ছাড়া আর কারো কানে না যায়, সে দায়িত্ব তোমার। আর সবসময় হুঁশিয়ার থাকতে হবে বুঝলে? তবে তুমি পারবে।

জুলিকে ইতস্ততঃকরতে দেখে হিউয়ার্ট বলল, তুমি আগ বাড়িয়ে কোন কিছু জানতেই চাইবে না, যদি কিছুই না জান তো তোমার বিপদের ভয় থাকবে না। তাই না! মুফতে পয়সা কামাবার সহজ রাস্তা এটা। আমি দেখেছি খদ্দেরদের কেউ কেউ খবর পৌঁছে দিলে এক পাউন্ড, নয়তো দু–পাউন্ড দেবে তোমায়। আর শোন তোমাকে আমার ভাল লেগেছে, আমি তোমায় আট পাউন্ড দেব। এর চেয়ে বেশী আর কি করতে পারি বল? ছেলেরা তোমার মত ফুটফুটে; স্মার্ট, সরেস মাল দেখলে খেপে যাবে। ভেবে দেখ। প্রতি শুক্রবার করকরে নতুন আটটা এক পাউন্ডের নোট তুমি পাবে। ভেবে দেখ, কত জোড়া সিকের মোজা কিনতে পারবে তুমি?

–অ্যাঁ!

জুলি তাড়াহুড়ো করে কাজে লাগবার আগে কাজটার সম্বন্ধে আরো জানতে চেয়েছিল।

হিউয়ার্ট বলেছিল, তুমি ওখানেই ভুল করছ। কিছু জানতে চাইবে না তুমি, ঠিক আমার মত। এ শহরের অন্ধকার পাতালের পুরুষ ও মেয়েরা এখানে এসে কখনো খবর রেখে যায় কখনন বা দু–একটা প্যাকেট। আমি খেতে দিই। একটু–আধটু কাজ করে দিই। কিন্তু আমি কখনো প্রশ্ন করি না। অনেক সময় এখানে টিকটিকিরা আসে। ওরা এটা সেটা খবর জানতে চায় আমি কিছুই জানি না, তাই বলতেও পারিনা। তুমিও কিছু জানবে না, তোমাকেও ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করলে, তুমিও কিছু বলতে পারবে না। একেই বলে বুদ্ধির ধার।

জুলি চমকে উঠে বলেছিল, এখানে পুলিশ আসে? এটা আমার ভাল লাগছে না।

হিউয়ার্ট অধৈর্য হয়ে হাত নেড়েছিল এবং বলেছিল, তুমিও জান, আমিও জানি। পুলিশ সর্বত্র নাক গলিয়ে বেড়ায়। ওদের চাকরীটাই এই। তুমি যেখানেই কাজ কর কিছুই এসে যাবে না, কেন না পুলিশ সেখানে যাবেই। আজ হোক, কাল হোক, যাবেই। তাতে কার কি এসে গেল? আমরা তো লোককে সার্ভিস দেওয়া ছাড়া কোন অন্যায় করছি না।

আমাদের খদ্দেররা যদি ফন্দিবাজি করে তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। তাছাড়া তুমি ভাবছো কি? তোমায় আমি আট পাউন্ড দিচ্ছি। কাজটাতো পঞ্চাশ শিলিং-এর। পঞ্চাশ শিলিং ফললে ডজন ডজন মেয়ে আমি পেতে পারি। কিন্তু আমি আট পাউন্ড দিচ্ছি, কেননা পুলিশ প্রশ্ন করতে পারে। অবশ্য করবেই যে তা বলছি না, তবে করতে পারে। আমি জানি কোন মেয়েই পুলিশের সংস্পর্শে যেতে চায় না। তাই আমি মাইনেটা একটু বেশীই দিচ্ছি।

এসব কথা জুলির বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। বিশেষ করে টাকার অঙ্কটা তো চমৎকার। এ সুযোগ একবার হাতছাড়া করলে, জন্মেও জুলি হয়তো এমন সুযোগ আর পাবে না।

জুলি সবকিছু ভেবেচিন্তে বলেছিল, বেশ। আমি কাজটা নেব।

কাজটা যে কি সহজ, কিছুদিন কাজ করে ও অবাক হয়ে গেল। রাত এগারোটার আগে কাফেয় ভিড় জমে না। তারপর বাঁধা খদ্দেররা আসতে থাকে। সিগারেটের ধোঁয়া আর কথাবার্তার গুঞ্জনে ঘরটা ভরে ওঠে।

ক্যাশ ডেস্কের সামনে কাঁচ দিয়ে ঘেরা জায়গাটায় বসে জুলির মনে হয়েছে এ একেবারে প্রথম সিটে বসে থিয়েটার দেখার মতো ব্যাপার। জুলির মনে হয় না এই ঘরটার সঙ্গে ওর কোন যোগাযোগ আছে। ওর নিজেকে মনে হয় যেন অদৃশ্য, কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে না। অদৃশ্য এক দর্শক গোপন জানলা খুলে একটা অদ্ভুত, উত্তেজক নাটক দেখছে।

 দাঁতে চুরুট চেপে ধরে, কড়ে আঙুলে একটা মস্ত ঝলমলে হীরে বসানো আংটি পরে হিউয়ার্ট ওকে প্রথম রাতটা সব বলে কয়ে দিচ্ছিল। ঘরের লোকজনগুলোকে চিনিয়ে দিচ্ছিল। জুলির কানের কাছে মৃদু, একটানা স্বরে বলে যাচ্ছিল, বাদামী রঙের কোট পরে ঐ ব্যাটার নাম সিড বের্নস্টাইন। চিনে রাখ। গিডিয়ন রোডে ওর একটা ফারের দোকান আছে। সভায় ফার কিনতে গেলে সিডের কাছে গিয়ে আমার নাম বললে ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। ওর সঙ্গে যে কথা বলছে ওর ধরন-ধারণ আর ব্যবহার খুব মার্জিত। তাই সবাই ওকে ডিউক বলে ডাকে। কখনো দেখবে না ও প্লেটে চা ঢেলে খাচ্ছে। ও কি করে জানতে চেয়ো না।

হিউয়ার্ট বলেই চলল, ও হলো পাগসি। ওই যে ছাইরঙা স্যুটপরা লোকটা দেখছে ও রেসের বড়বাবু। কুকুরকে আফিম খাওয়াতে ওর মতো–হিউয়ার্ট তাড়াতাড়ি নিজের জিভকে সামলে নিল, যাকগে, ও পাগসি, এইটুকু মনে রেখে বাকীটা ভুলে যেও। আর ওদিকে যে হতভাগা সিগারেট ধরাচ্ছে ও গোলডস্যাক। ও ব্যাটার মাথাটা বেজায় সাফ। দু বছর আগে যখন আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, পকেটে তিরিশ শিলিংও ছিল না। আর এখন ও দশ হাজার পাউন্ডের চেক কেটে দিতে পারে, ভাতে হাত পড়ে না। ও হচ্ছে বাজী ধরতে ওস্তাদ।

জুলি-বের্নস্টাইন, পাগসি আর অন্যদের চিনে ফেলল। পাগসি আর ডিউক ওর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একবার, ও কয়েকটা কথা শুনতে পেল।

পাগসি বলছিল, আমি ভাগাভাগিতে নেই। হয় পঁচিশ হাজার নয়তো ফক্কা। তুমি ঠিক পারবে। ভাবছ কেন?

ডিউকের গলায় সংশয়, আমার পক্ষে গেলা কঠিন। কি বললে? সবগুলোই প্লেয়ার্স?

–হ্যাঁ।

 ঠিক সেই সময়ে পাগসি জুলিকে দেখে চোখ টিপেছিল।

জুলি মনে মনে ভেবেছিল, পঁচিশ হাজার প্লেয়ার্স সিগারেটে ওদের কি পড়তা থাকবে? পরদিন কাগজে দেখেছিল, হাউন্ডসভিচের একটা গুদাম থেকে পঁচিশ হাজার সিগারেট চুরি হয়ে গেছে। দুয়ে দুয়ে যোগ করতে ওর অসুবিধা হয়নি।

কাফের জীবনে বৈচিত্র্য যত, উত্তেজনাও তত। জুলি সবসময় টেলিফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকত। যে সব খবর আসত ও তার কোন মানে বুঝতো না।

–পাগসিকে বল গ্রে-হাউন্ডকে ভাল দেখাচ্ছে। বুঝেছ? গ্রে-হাউন্ডকে ভাল দেখাচ্ছে।

মিঃ গোলডস্মিথকে বল আমায় ফোন করতে। বারোটার সময় বয় ব্লু।

–মিঃ বের্নস্টাইনের জন্যে খবর আছে। বাঁধা সময়, বাঁধা জায়গা। সি. ও. ডি।

 এই সাঙ্কেতিক খবরগুলো জুলির গোলমেলে লাগত, অসম্ভব আকর্ষণ বোধ করত ও। এইভাবে খবর পেয়ে পাগসি, বের্নস্টাইন, স্মিথরা পয়সা করছিল।

পুরুষের সঙ্গ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ওর। একা একা সিনেমা দেখতে ভাল লাগে না। প্রয়োজন এমন একটি পুরুষের যে মিষ্টি কথা বলবে, উপহার কিনে দেবে। যাকে ইচ্ছে হলে জুলি দাক্ষিণ্য দেখাবে।

কাফেতে যে সব পুরুষরা আসে তারা জুলির দিকে মন দেবার ফুরসত্ব পায় না, পয়সা কামাতে তারা এত ব্যস্ত। হিউয়ার্টকে সহজেই গাঁথা যায়, কিন্তু ও বেজায় বুড়ো। প্রথম প্রথম ও জ্বালাত কিন্তু জুলি শিখে নিল ওকে বাগ মানাতে। সারা সন্ধ্যা জুলি ক্যাশ ডেস্কের খোপে বসে থাকে, হিউয়ার্ট ওকে চটকাঁচটকির সুযোগ পায় না। ঢোকবার বেরোবার সময়টাতেও ও অন্য কর্মীদের সঙ্গে যায় আসে। হিউয়ার্টকে খুশী রাখার জন্যে জুলি ছিটেফোঁটা করুণা বিতরণ করে। আর মস্তানটির কথানুযায়ী হিউয়ার্ট সামান্যতেই খুশী হয়।

জুলি ওর সমবয়সী একটি সঙ্গী চাইছিল, যে শুধু ওর শরীরটাকেই চাইবে না, যার সঙ্গে ওর মনেরও মিল হবে।

ঠিক তিনমাস ঐ কাফেতে কাজ করার পরই একদিন সেখানে উদয় হল হ্যারি গ্লেব। হ্যারির ব্যক্তিত্ব দেখে জুলি এক প্রবল আকর্ষণ অনুভব করল। ওর হাসি মাখা প্রাণোচ্ছল চেহারা চোখে পড়ার মত, ওর আত্মবিশ্বাস অপরিসীম, ওর পোষাক চোখ ধাঁধানো। জুলি তো একেবারে মুগ্ধ।

হ্যারির একমাথা গাঢ় বাদামী ঢেউ খেলানো চুল, সরু গোঁফের রেখা, সবুজ গভীর চোখ দুদম কৌতুকে জ্বলজ্বল করছে। যদিও ও কড়া, নীতিজ্ঞানের বালাই নেই, ছেঁদো স্বভাবের। অহঙ্কারী আর স্বার্থপরও বটে, তবু ওকে পছন্দ না করে পারা যায় না।

হ্যারি সবসময়ে হাসিখুশি, ঠাট্টা ওর ঠোঁটের ডগায়। সবসময়ে ও এক পাউন্ড ধার দিতে রাজি, একটা মুদ্রায় টোকা মেরে দশ পাউন্ড বাজি ধরতে পারে। বাজি ফেলে মদ খেতে ও ওস্তাদ। ওয়েস্ট এন্ডের বেশ্যাদের, রংবাজ ছোকরাদের, ধাপ্পাবাজদের সবাইকে ও চেনে আর সবাই ওকে পছন্দ করে। ও লন্ডনের এক চালু মস্তান।

জুলির মনে হল ও যেন একেবারে সিনেমার পর্দা থেকে উঠে এসেছে। কাফেতে আর যাঁরা আসে তাদের সঙ্গে ওর তুলনা করতে গিয়ে মনে হল ট্রেনে ওর পাশে যে মোটা বুড়োটা বসে তার সঙ্গে ক্লার্কসেরলের তুলনা করছে।

তবে জুলি চালাক মেয়ে। ও হ্যারিকে বুঝতেই দিল না যে হ্যারিকে ওর মনে ধরেছে। নিজের আকর্ষণীশক্তির বিষয়ে ওর ভালই ধারণা আছে। ও জানত আজ না হয় কাল হ্যারিই প্রথম আসবে ওর সঙ্গে ভাব করতে।

সে সময়ে হ্যারি কেনস্টাইনের সঙ্গে কি একটা কারবার করত যার জন্যে বাধ্য হয়ে ও ব্রিজ কাফেতে আসত। ব্রিজ কাফে ওর ভাল লাগত না, হিউয়ার্টকেও নয়।

একদিন ক্যাশ ডেস্কের সামনে জুলিকে ওর চট করে চোখে পড়ল। সন্ধ্যায় জুলি ওর কাঁচের খুপরি থেকে বেরিয়ে ডিউককে একটা খবর পৌঁছতে যাচ্ছে, হ্যারি ওর নিটোল চেহারা দেখেই উত্তাপ অনুভব করল। সে প্রথম ওকে সামনাসামনি দেখে একটা লম্বা শিস দিল।

জুলির দিকে বুড়ো আঙুলটা হেলিয়ে ও বের্নস্টাইনকে জিজ্ঞেস করল, বারুদ! স্যাম জোটাল কোথা থেকে?

বের্নস্টাইন বেরিয়ে যাবার পর হ্যারি ক্যাশডেস্কের কাছে গিয়ে জুলির সঙ্গে ফস্টিনষ্টি শুরু করল।

এই সুযোগটার জন্যেই জুলি পরম ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ও মনের আগ্রহ হারিকে বুঝতে দিল না বরংহ্যারি ঘনিষ্ঠ হতে গেলে মৃদু ধমক দিল। হ্যারির মুখে ওর খোসামোদ শুনে খুব ঠাণ্ডা ও মোলায়েম ব্যবহার করল।

হ্যারির প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ, চুম্বকের প্রতি লোহার পেরেকের মতো। মেয়েরা ওকে এড়াতে পারে না। জুলির ব্যবহারে হ্যারি রীতিমত অবাক হল। হ্যারির মতে, মেয়েরা প্যানপ্যানে আর ঘ্যানঘ্যানে জীব। কিন্তু এ মেয়েটি যে একেবারে আলাদা প্রকৃতির হ্যারি তা বলে দিতে পারে।

জুলি মেয়েটি এমনিতে বেশ। ওর চোখের দৃষ্টিতে একটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ দেখে হ্যারির ভেতর পর্যন্ত বিড়বিড় করে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে, ও হ্যারির মতলব ধরে ফেলেছে। হ্যারিকে বিশেষ আমল দিতে রাজী নয়, তা সে যতই তোষামোদ আর মিষ্টি ব্যবহার করুক না কেন।

হ্যারি একজোড়া সিল্কের মোজা, একবাক্স চকোলেট নিয়ে ঘুরে ঘুরেই আসছে জুলির কাছে কথা বলতে। হ্যারিকে নিরাপদ দূরত্বে রাখবার জন্যে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ দিয়ে জুলি যে দেওয়ালটা তৈরী করেছে, সেটা ভাঙবার জন্যে হ্যারি বন্ধুর জুলিকে ওর সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্যে অনুরোধ করেছে। জুলি রাজী হয়নি। আবার হ্যারি ওকে ছেড়ে চলে যাক সে ঝুঁকিও জুলি নিতে চায়নি। পুরুষদের সম্বন্ধে ওর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। ও জানে হ্যারিকে ও যত ঝুলিয়ে রাখবে তত ওর কামনা বেড়ে যাবে আর তারপর যখন জুলি ধরা দেবে তখনো ওর কামনার আগুন সহজে নিভবে না।

.

মিসেস ফ্রেঞ্চ যখন জিজ্ঞেস করল ওদের সাহায্য করবে এমন কোন মেয়ের খবর হ্যারি রাখে কিনা, তখন হ্যারির জুলির কথা মনে এসেছে। ওর মনে হয়েছে জুলি টাকা চায়, জুলির বুদ্ধি আছে। বেপরোয়া সুযোগ এলে ছিনিয়ে নেবার অপেক্ষায় আছে জুলি।

তবে জুলি হ্যারির সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের প্রসঙ্গটা সমানে এড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যারি ঠিক করেছে জুলির প্রতিরোধ ভাঙতে হলে ওকে কাজের প্রস্তাবটা দিতে হবে। আর কাজের প্রস্তাবটা দেবার আগে ওর কাফের চাকরীটা চলে গেলে সবচেয়ে ভাল হবে। যতদিন চাকরী থাকবে, বাঁধা মাইনে পাবে ততদিন ও স্বাধীন। আর ওর যদি নীতিজ্ঞান প্রবল হয়, তবে হ্যারির প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

হ্যারি স্বাধীনচেতা মেয়েদের ভয় পায়। জুলি স্বাধীন বলেই ওদের মধ্যে এই আড়াল, হ্যারি সেটা নিশ্চিত।

তাহলে হ্যারির প্রথম কাজই হবে ওর কাফেতে চাকরীটা খাওয়া। কিন্তু কিভাবে! হিউয়ার্টের কাছে তো জুলি ভালই কাজ করছে, ওকে চাকরী থেকে হটিয়ে দেবার মতো কোন কারণই ঘটেনি এ পর্যন্ত। তাহলে কি করা যায়। মাথা ঘামিয়েও ও কিছু বের করতে পারল না।

হ্যারি নিজেকে প্রবোধ দিল, যাক যা হয় একটা উপায় ঠিক হয়ে যাবে। হলও তাই। সবসময়ই হয় তাই-ই। তবে ও যা ভেবেছিল সে ভাবে নয়।

.

মিসেস ফ্রেঞ্চের ওখানে মিটিং হয়ে যাবার দুদিন পরে জুলির টেবিলের টেলিফোন বেজে উঠল। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় একটি মেয়ে বলল, ওখানে কি মিঃ হ্যারি গ্লেব আছেন?

জুলির মেরুদণ্ড শিরশির করে উঠল। ও তিন দিন হ্যারিকে দেখেনি, তবে কি ওর সঙ্গে বড্ড রুক্ষ ব্যবহার করে ফেলেছে বলে ও বাধ্য হয়ে অন্য কোন মেয়ের কাছে গেছে?

না আমার মনে হয় উনি কাফেতে নেই, জুলি বলল। মনে মনে ভাবল কে এই মেয়েটি।

–আপনি ঠিক বলছেন? অসম্ভব জরুরী দরকার। আপনি প্লিজ একটু দেখবেন উনি আছেন কিনা। উনি বলেছিলেন ওখানে থাকবেন।

জুলি চমকিত হল। মেয়েটির গলায় হিস্টিরিয়া।

অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে হিউয়ার্ট লক্ষ্য করল ঘন তামাকের ধোয়ার ভেতর চোখ বুলিয়ে জুলি চারিদিকে যেন কাকে খুঁজছে।

–কি হয়েছে? হিউয়ার্ট জুলিকে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

একটি মেয়ে মিঃ গ্লেবের খোঁজ করছেন। মনে হল মেয়েটি বেজায় উদ্বিগ্ন।

 হিউয়ার্ট বাঁকা হাসি হেসে বলল, গ্লেবের বান্ধবীরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়েই থাকে। বোকাগুলোর ওটাই স্বাভাবিক মনের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। হ্যারি এখানে নেই।

জুলি ফোনে মুখ রেখে বলল, দুঃখিত, আমরা ওকে আজ রাতে দেখিনি।

এক মুহূর্ত নীরব থাকার পর মেয়েটি বলল, উনি আসবেন, এলে আমাকে ফোন করতে বলবেন। নম্বরটা নিন দয়া করে।

জুলি নম্বরটা মুখস্থ করে নিল। বলল, হ্যারি আসার সঙ্গে সঙ্গেই খবরটা ও দেবে। তারপর ফোন নামিয়ে রাখল।

হিউয়ার্ট মুখ বেঁকিয়ে গজগজ করতে করতে বলল, ও এখানে না আসুক, এটাই আমি চাই, ওর দ্বারা কারোর কোনদিন ভাল হয়নি।

কয়েক মিনিট পরে কাফেতে হ্যারিকে ঢুকতে দেখে জুলি ওকে হাত নেড়ে ডাকল।

হ্যারি এগিয়ে এসে বলল, হ্যালো! তুমি নিশ্চয় বলছ না, অন্ততঃ একবার তুমি আমায় দেখে খুশী হয়েছ?

 কয়েক মিনিট আগে ফোনে একটা খবর এসেছে। একটি মেয়ে জরুরী দরকার বলে ফোন করতে বলেছে। রিভার সাইড ৫৮৮৪৫ নম্বর।

হ্যারির মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে হঠাৎ ওর মুখ কঠিন হয়ে উঠল।

–ফোনটা ব্যবহার করতে পারি?

হ্যারিকে ভালো লেগেছে জুলির। এখন ও আর ফাজলামোনা করে গম্ভীর, কঠিন আর ভয়ঙ্কর চিন্তিত হয়ে উঠল। জুলি লক্ষ্য করল হ্যারির ডায়াল ঘোরাতে হাত কাঁপছে।

–ডানা?

 জুলি ছাড়া হ্যারির কথা এঘরে কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

–হ্যারি কথা বলছি। কি হয়েছে?

হ্যারি উত্তরটা শুনল। জুলি দেখল হ্যারির হাতটা রিসিভারের ওপর শক্ত হয়ে চেপে বসেছে।

কতক্ষণ আগে? ঠিক আছে। চেপে বসে থাক। ঠিক আছে। চুপ কর, বোক না। সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আচ্ছা চলি।

ও টেলিফোন রেখে দিল।

জুলি ওকে চোখ দিয়ে বিধে বলল, কি কেউ ধরে ফেলেছে তোমায়?

–হ্যাঁ।

 হ্যারি ওকে এক লহমা ভাল করে দেখল।

আমায় একটু সাহায্য করতে পারো? ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যারি জুলির কোলের ওপর সাদা কাগজে মোড়া একটা ছোট প্যাকেট ফেলে দিয়ে বলল, কাল অবধি এটাকে সামলে রেখ, কেমন? লুকিয়ে রেখ। যদি তোমার কাছে কেউ খোঁজ নিতে আসে আমি তোমায় কিছু দিয়েছি কিনা, তুমি একটা কথাও বলল না। কেমন? 

জুলি হেসে বলল, আর কারোর জন্যে এ কাজ করতাম না। তোমার জন্যে করব।

লক্ষ্মী মেয়ে। কাল আমার সঙ্গে একটু বেরোতে পারবে? আমি তোমায় লাঞ্চ খাওয়াবো।

কাল নয়। কাল আমার সময় হবে না। কথাটা আদৌ সত্যি নয়। তারপর একটু থেমে বলল, পরদিন হতে পারে। তুমি কাল রাতে আসবে?

নিশ্চয়ই তুমি ওটা সামলে রেখো। চলি।

দরজার দিকে এগিয়ে গেল হ্যারি। দরজা খুলতেই আচমকা ও দাঁড়িয়ে পড়ল, এক পা পিছিয়ে এল।

বিশাল চেহারা, গায়ে বর্ষাতি, কপালে টুপি নামানো, দুটি লোক কাফেতে ঢুকল। পুলিশ! এটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে জুলির হাত-পা অবশ হয়ে যেতে লাগল, ওর মনে হল ও তলিয়ে ডুবে যাচ্ছে। ওর আগেই বোঝা উচিত ছিল, এই জন্যেই হ্যারি প্যাকেটটা হাত বদল করল।

হ্যারি পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে সহজ, স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, হাসছে। কাফের অন্যান্য নারী-পুরুষরাও ওদের দেখছে, কেউ নড়ছে না, কথাও বলছে না। নিজেদের যেন রবার দিয়ে মুছে ফেলেছে সবকিছু থেকে, এমনই নৈর্ব্যক্তিক মুখভঙ্গি ওদের।

ডিটেকটিভ ডসনের মুখ চেনে জুলি। সে হিউয়ার্টের অফিসের দিকে ঘাড় হেলাতেই হ্যারি কাঁধ ঝাঁকিয়ে এদিকে হেঁটে জুলির দিকে না তাকিয়েই চলে গেল।

 পুলিশগুলো যেই চোখের আড়াল হল, অমনি যত মেয়ে পুরুষ সবাই হুড়োহুড়ি করে দরজার দিকে ছুটে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কাফেটা খালি হয়ে গেল।

জুলি ঘাবড়ে গিয়ে প্যাকেটটা ব্যাগে ভরতে যাচ্ছিল কিন্তু তা না করে জনশূন্য কাফের দিকে তাকিয়ে নিয়ে স্কার্টটা তুলে কোমরের বাঁধন ঠেলে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে নিল। ব্যাগে রাখল না কারণ ওরা প্রথমেই ব্যাগটা খুঁজবে।

হিউয়ার্টের অফিসে বেশীক্ষণ থাকল না পুলিশ। ওরা হ্যারির সঙ্গে বেরিয়ে এল। পেছনে হিউয়ার্ট। ওর মুখে চাপা রাগ।

কমবয়সী অফিসারটি হ্যারিকে নিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর একসঙ্গে বেরিয়ে গেল ওরা।

হিউয়ার্ট আর ডসন কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর ওরা জুলির কাছে এল। ডসন টুপিটা তুলে ধরল। ওর বিশ্বাস ভদ্র ব্যবহার করলে প্রতিদান পাওয়া যায়।

ইভিনিং মিস। আপনি কি ঐ গ্নেব ছোকরাকে চেনেন?

জুলি ওদের দিকে উদ্যত দৃষ্টিতে চাইল।

না চিনি না। যদি চিনিও তাতে আপনার কি?

–ও এখনি আপনার সঙ্গে কথা বলছিল না?

 সিগারেট কিনছিল।

 ডসন ওর দিকে সোজাসুজি চাইল। জুলি চোখ ফিরিয়ে নিল।

কিনছিল বুঝি? কিন্তু আমি যখন ওকে সার্চ করলাম, প্যাকেট দেখলামনা তো? কি ব্যাপার বলুন তো?

জুলির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভুল হয়েছে, মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। ও চুপ করে রইল।

আপনাকে ও কিছু রাখতে দেয়নি? ডসন সোজাসুজি প্রশ্ন রাখল।

 জুলি বুঝতে পারল ওর মেরুদণ্ড শিরশিরিয়ে একটা ঠাণ্ডা প্রবাহ উঠে আসছে, কিন্তু ও জোর করে ডসনের চোখে চোখ রেখে বলল, –না দেয়নি।

–আপনার ব্যাগটা দেখতে দেলে?

জুলি জ্বলে ওঠার ভান করে বলল, আমার ব্যাগ দেখার কোন অধিকার নেই আপনার। তবে দেখলে যদি খুশী হন তো দেখুন।

ব্যাগটা ডসনের দিকে ঠেলে দিল। ডসন ওটা দুলো না পর্যন্ত। বলল–ঠিক আছে মিস। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।

হিউয়ার্টের দিকে চেয়ে ডসন বলল, চললাম স্যাম। আবার দেখা হবে।

ফাকা কাফেটার দিকে চোখ বুলিয়ে ডসন মৃদু হেসে বলল, তোমার কারবারে বোধহয় লোকসান ঘটালাম। মনে হচ্ছে তোমার খদ্দেররা একটুতেই ঘাবড়ে যায়!

কঠিন চোখে হিউয়ার্ট বলল, আচ্ছা।

ডসন জুলির দিকে টুপিটা তুলে ধরে বলল, –গ্লেবের মতো মেয়েদের তাড়াতাড়ি ফাসাতে পারে, এমন কোন ছেলে আছে বলে আমার জানা নেই। হয়তো অন্য কেউও থাকতে পারে, তবে তাতে আমার সন্দেহ আছে। গুডনাইট।

ও চলে যেতে হিউয়ার্ট জুলির দিকে বিশ্রী চোখে চাইল। কড়া গলায় বলল, –মতলব কি? কি শয়তানী করছ তুমি?

জুলি অবাক হয়ে ভুরু তুলে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, তুমি কি বলছে?

বন্ধ হলে পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে। বলে হিউয়ার্ট ধড়াস করে দরজা বন্ধ করে অফিসে গিয়ে ঢুকল।

গুদামঘরের ফাটা আয়নাটা দেখে জুলি মাথায় টুপি পরছিল, হিউয়ার্ট ঢুকল। কাফেতে এখন শুধু ওরা দুজন।

হিউয়ার্ট ওর স্বভাবসিদ্ধ ভোমির সঙ্গে বলল, গ্লেব তোমায় কি রাখতে দিয়েছিল?

হিউয়ার্টের রুক্ষ গলা আর ঠাণ্ডা অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেখে জুলি হুঁশিয়ার হল।

–খিঁচিয়ে বলল, ডসনকে কি বললাম, তা তো শুনেছে, শোননি? আমায় কিছুই দেয়নি ও।

 –ডসনকে যা বলেছে তা শুনেছি ঠিকই।

আরো কাছে এসে হিউয়ার্ট বলল, মিথ্যে কথা যদি বলতে না পারো তো চুপ করে থেক। ডসন ঠিকই বুঝেছে তুমি একটা ধান্দা পাকাতে চাইছ। গ্লেব তোমাকে যে আংটিগুলো দিয়েছে, তা যদি ডসন বুঝতে নাও পারে, তবে তোমাদের মধ্যে যে একটা ব্যাপার চলছে তা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে।

আংটিগুলো? জুলি টের পেল ওর চামড়ার রং ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

ভয় পেয়ে বলল, আ-আমি জানি না তুমি কি বলছ।

ওর চোখে ভয় দেখে হিউয়ার্ট একটু নরম হলো। ও জুলিকে স্নেহ করে, ফালতু ঝুট ঝামেলা পাকাতে চায়না ওর সঙ্গে। বলল, দেখ বাছা, এতদিন নিজেকে তুমি দিব্যি চালাক চতুর বলেই প্রতিপন্ন করে এসেছ। এখন বোকা হয়ে যাচ্ছ। আমাদের আওতার বাইরে গ্লেবের কারবার। আমরা ওর কারবার থেকে ফুটো পয়সাটিও পাই না। আমরা ওর জন্যে কিছু করিনা, ও-ও আমাদের জন্যে কিছু করে না, বুঝলে? ঠিক আছে তুমি জানতে না। আমার তোমাকে সমঝে দেওয়া উচিত ছিল। আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। ভেব না দোষ দিচ্ছি। গ্লেব বড় বেশী পাখোয়াজ।

–বলছি ও আমায় কিছু দেয়নি।

জুলির বুক ধড়াস ধড়াস করছে। ও যদি স্বীকার করে যে হ্যারির কাছ থেকে চোরাই আংটি নিয়েছে, তবে ও একেবারে হিউয়ার্টের হাতের মুঠোয় চলে যাবে। কি বোকামী আর কাঁচা কাজই না হয়ে গেছে প্যাকেটটা নিয়ে। ওর বোঝা উচিৎ ছিল ওতে চোরাই মাল আছে। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল ওর।

হিউয়ার্ট ওকে নজর করল। আর ওর পাতলা ধারালো মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো।

–শোন, আজ সন্ধ্যেবেলা একজন ধনী মহিলা দু-সেকেন্ড, বেশী নয় ঠিক দু সেকেন্ড ওর ড্রেসিং টেবিলে হাজার পাউন্ড দামের তিনটে হীরের আংটি রেখে একটু আড়ালে গিয়েছিলেন। ব্যাস! আংটিগুলো বেমালুম হাওয়া। এই হচ্ছে গ্লেব। ঠিক দু-সেকেন্ডে কাম ফতে! অসম্ভব দ্রুত গতিতে কাজ সারে, আর সবার শোবার ঘর হচ্ছে ওর বিচরণক্ষেত্র। এই হলো ওর লাইন! ডসন আর আমি ওকে খুব ভালই চিনি।

চুরিটা করেই ও সরাসরি এখানে চলে এসেছিল। আমার ধারণা মেয়েটার ফোন এসেছিল ওকে সতর্ক করার জন্যে। আর ও তখনই মাল তোমার কাছে পাচার করে। নিজের নোংরা চামড়া বাঁচাতে ও যাকে তাকে ফাঁসাতে পারে। এখন শোন জুলি, গ্লেব একেবারে গোখরো সাপ। ওর জন্যে এখানে পুলিস ঢাকায় আমি ওকে পছন্দ করি না। ওর কথা ভাবতে আমি প্রস্তুত নই, এখন আমি আংটিগুলো চাই।

জুলি ওর টুপি আর কোট খুলে নিয়ে সাঁ করে দরজার দিকে এগোল কিন্তু হিউয়ার্ট ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

ওর চোখে একটা কুৎসিত দৃষ্টি জ্বলে উঠল।

–এক মিনিট দাঁড়াও জুলি।

–আংটির কথা কিছু জানি না আমি। মিঃ হিউয়ার্ট দয়া করে আমাকে যেতে দিন। আমি বাড়ি যেতে চাই।

এখনো নয়। জুলি, আমি খুব ধৈর্য দেখাচ্ছি, কেন না আমি তোমায় পছন্দ করি। কিন্তু ঐ লোকটার জন্যে তুমি গবেটের মত ব্যবহার করছ। এখানে কি চলে না চলে আমার সব নজরে আছে। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলেছ, নানারকম কায়দা করছ, আমি সব লক্ষ্য করেছি। ওকে গাঁথতে চেষ্টা করেছে, তাই না! খুব সাবধান। গ্লেব মেয়েদের সর্বনাশ ছাড়া কোনদিন ভাল করেনি। ওর মত নেংটি ইঁদুর কেন, তুমি অনেক ছোকরা পাবে। গ্লেব মেয়েমানুষের অভিসন্ধি জানে, আর তাতেই ও মাস্টার।

ওঃ। কোন সাহসে তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলো? সরে দাঁড়াও, পথ ছাড়ো বলছি। জুলি খেপে চেঁচিয়ে উঠল।

হিউয়ার্টের আর ধৈর্য থাকল না। ও বলে উঠল, তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি, আংটিগুলো আমাকে না দিয়ে তুমি এখান থেকে নড়তে পারবে না। আমায় যদি জোর করে কেড়ে নিতে বাধ্য কর, তবে আমি তোমায় ছাঁটাই করব।

–তুমি এগুলো পাচ্ছ না। আমি তোমার পচা কাজও চাই না। আমি এরকম কাজ অনেক অনেক পেতে পারি। তোমায় ভয় পাই না। বুড়ো শয়তান কোথাকার।

জুলির ছোট্ট সাদা মুখ কঠিন, ওর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবভঙ্গী, মুঠো পাকানো হাত দেখে হিউয়ার্টের মন প্রশংসায় ভরে উঠল। ও হাসিতে ফেটে পড়ল।

চল জুলি। বোকামি কোর না। তোমার যথেষ্ট হিম্মত আছে। তুমি আর আমি দিব্যি চালিয়ে দিতে পারব। আংটিগুলো দিয়ে দাও, আমি এই ঝুটঝামেলা ভুলতে চাই।

বলছি যে তুমি কি বলছ আমার মাথায় ঢুকছে না। বারবার বলছি আমার কাছে আংটি নেই আর থাকলেও সেগুলো আমি তোমাকে দিচ্ছি না।

জুলি খেঁকিয়ে উঠে ছুট লাগাল। কিন্তু হিউয়ার্ট ওকে ধরে ফেলল। একহাতে ওর কব্জি ধরে, অন্য হাতে জুলির গায়ে হাত বুলিয়ে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জুলি বলল, আমায় ছেড়ে দাও নইলে আমি পাড়া মাথায় করব বলে দিচ্ছি।

–চেঁচাও না, চেঁচাও। হিউয়ার্ট হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, যদি পুলিস আসে তো বলব গ্লেব তোমায় আংটিগুলো দিয়েছে। তখন তুমিই ফাসবে। বেশী কায়দা কোর না। চুপ করে দাঁড়াও। আমি জানি ওগুলো তোমার কাছেই আছে।

ও আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে প্যাকেটটা কোথায় আছে টের পেল।

–আহঃ! এই তো। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। ও রকম করে কোন লাভ হবে না।

জুলি ধস্তাধস্তি করতে লাগল, লাথি ছুঁড়তে লাগল। হিউয়ার্টের গোদা গোদা পায়ে জুতোর ঠোক্কর মেরেও ওর দুটো হাত ছাড়াতে পারল না। এরপর হিউয়ার্ট যখন ওর স্কার্ট টেনে তুলতে শুরু করেছে, জুলি রেগে তীক্ষ্ণ কানফাটা চিৎকার করে উঠল।

দরজা খুলে হ্যারি ঢুকে বলল, আমি তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হচ্ছি স্যাম! যা করছ তা আধাআধি করলে তোমার দু-মাস জেল হতে পারে।

হিউয়ার্ট, হ্যারিকে দেখে ছিটকে জুলিকে ছেড়ে দিল। হ্যারি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর টুপিটা কায়দা করে হেলিয়ে নামানো, হাত দুটো প্যান্টের পকেটে, দু-চোখে উদ্ধত বিদ্রূপ।

–কেমন করে ঢুকলে? হিউয়ার্টের গলা রীতিমত ক্ষীণ।

 হ্যারির চোখের চাউনি আর পকেটে ঢোকানো মুঠো পাকানো হাত দুটো দেখে ও কিসের ভয়ে যেন সিঁটকে গেল।

জুলি টলতে টলতে হোঁচট খেয়ে হিউয়ার্টের কাছ থেকে ছিটকে সরে এলো। ওর চোখ দুটো রাগে জ্বলছে, মুখ সাদা।

–পচা শুয়োর কোথাকার! আমার গায়ে হাত দাও এতবড় আস্পর্ধা।

 হ্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সব তোমার দোষ। এই বুড়োটাকে মেরে টের পাইয়ে দাও কত ধানে কত চাল।

হ্যারি দু-চোখে প্রশংসা নিয়ে জুলির দিকে তাকাল। মেয়েদের চটতে দেখতে, বিশেষ করে জুলিকে ধানীলঙ্কার মতো চিড়বিড় করতে দেখে ও খুব খুশী।

একটু মুচকি হেসে হ্যারি বলল, এই বুড়োটার জন্যে সব রাগ খরচ করে ফেলো না সোনা। তুমি নিশ্চয়ই চাও না আমি একটা বুড়ো লোককে মেরে হাত নোংরা করি। চাও? চল আমার সঙ্গে বাড়ি। কেন, ও তো তোমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি।

জুলি ঘর ফাটিয়ে চেঁচাল, ওর নোংরা থাবা দিয়ে আমায় চটকাবার উচিৎ শিক্ষা আমি দেবই।

চার পাউন্ড ওজনের মধু ভর্তি একটা বোতল তুলে নিয়ে জুলি হিউয়ার্টের দিকে ছুঁড়ে মারল। ওর বুকের মধ্যিখানে বোতলটা লাগল, হিউয়ার্ট টলতে টলতে পিছু হটে গেল। ও আরেকটা কিছু ছোঁড়ার জন্যে খুঁজছিল কিন্তু হ্যারির হাসির চোটে দম আটকাবার জোগাড় হল। হ্যারি ওকে শক্ত করে ধরে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে এলো। চেঁচিয়ে বলল, দরজা বন্ধ করে দাও স্যাম। ওকে আমি বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারব না। ও তোমায় নির্ঘাত খুন করবে।

ধড়াস করে দরজা বন্ধ হলো, চাবি ঘুরল।

 জুলি রাগের চোটে হ্যারির হাত ছাড়িয়ে দরজায় আঘাত করতে লাগল।

–আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও, নোংরা বুড়ো ছাগল কোথাকার। তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার শেষ হয়নি। তোমায় আমি শেষ করব হতভাগা।

দরজার ফাঁক দিয়ে হিউয়ার্ট চেঁচিয়ে বলল, বেরিয়ে যাও তুমি। তোমায় আমি ছেড়ে দিলাম, বুঝলে! তোমার মুখ পর্যন্ত দেখতে চাই না। ভাগো নইলে, পুলিশ ডাকব।

জুলি পালটা চেঁচাল, আমি তোমাকে ধরাব আমার গায়ে হাত দেবার জন্যে। ভেবনা, পার পাবে তুমি, ভেবো না মোটেই।

জুলি রাগে ভেতরে ঢুকতে দাওশেষ করব হতভাগতম। তোমায় আমি হে

হ্যারি বলল, চল জুলি। যেতে দাও বুড়োটাকে। যথেষ্ট ভয় খাইয়েছে, ও আর কোন ঝামেলা করবে না।

জুলি হিউয়ার্টকে ছেড়ে হ্যারিকে নিয়ে পড়ল।

আমার কাজটা খেলে তুমি। তোমার পক্ষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করাটা সোজা। কিন্তু আমি এখন করবটা কি?

হ্যারি ভাবল, আমি বলেছিলাম যা হয় কিছু একটা ঘটবে, কিন্তু এতো দেখছি আরো ভাল হলো।

জুলি একটু ঠাণ্ডা হয়ে বলল, তুমি কি ব্যবস্থা করবে শুনি?

জুলি এখন উপলব্ধি করছে যে কাফেতে কাজ না করার মানেটা না খেয়ে মরা। হপ্তায় বারো পাউন্ডের কাজ পাওয়া অসম্ভব। ও হ্যারির ওপর চেঁচিয়ে উঠল, জাহান্নামে যাও তুমি। তোমাকে জীবনে দেখতে না পেলেই ভাল হতো। যদি তোমায় সাহায্য করতে না যেতাম।

মাথা গরম কোর না। চল কথাবার্তা বলে দেখি। আমার গাড়ি বাইরে আছে। আমি তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

কি যে করবে, কিছুই বুঝতে না পেরে হ্যারির সঙ্গেই চলল। ও একলা হলে হিউয়ার্টের কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে নিত। কিন্তু হ্যারি ওকে কনুইয়ের ধাক্কায় হিউয়ার্টের কাছ থেকে ভাগিয়ে এনেছে। ওকে ফিরে যেতে দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর।

পথের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্রাইসলার গাড়ি। জুলি দেখল নাম্বার প্লেটের জায়গায় ভাড়াটে গাড়ির নম্বর।

হ্যারি বলল, কোন ভাবনা-চিন্তা না করে সোজা গাড়িতে ওঠো, থাক কোথায়?

–এটা তোমার গাড়ি। জুলি একেবারে বিমূঢ়।

নিশ্চয়ই। নম্বর প্লেটটার কোন মানে নেই। ওর একমাত্র মানে হল আমি গাড়িটা চালু রাখতে পারি, কোত্থেকে পেট্রল পেলে জিজ্ঞেস করে পুলিশ আমায় উত্যক্ত করে না।

গাড়িটা লম্বা, ঝকঝকে বনেট, হেডলাইট ভাল করে দেখল জুলি, মনে মনে ভাবল এমন একখানা গাড়ি রাখতে পারে, তাহলে হয়তো ওর বেশ টাকা-পয়সা আছে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই আছে। দেখি ওর ঘাড় ভেঙে আমি কি আদায় করতে পারি।

–স্বপ্ন দেখ না রাজকুমারী! জাগো। কোথায় থাকো তুমি? বলে হ্যারি ওকে ঠেলে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিল।

ফুলহ্যাম প্যালেস রোড, বলল জুলি, চওড়ানরম গদিতে চেপে বসল আরাম করে। জুলির পাশে হ্যারি উঠে বসল, স্টার্টারে পা রাখল।

–ঘর নিয়ে থাকো? হ্যারির প্রশ্ন।

–ছোট ফ্ল্যাট।

কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে আছো?

না, তুমি বড় বেশী জানতে চাও, তাই না?

–হ্যাঁ, পরের ব্যাপারে নাক গলানো আমার স্বভাব। একটু হাসল হ্যারি। জনশূন্য পথ দিয়ে ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলল। যতক্ষণ না জুলির বাড়ির গেটে গিয়ে গাড়িটা থামল ওরা আর একটি কথাও বলল না।

তারপর হ্যারি জিজ্ঞেস করল, এই বাড়ি? চল ভেতরে যাই। এক কাপ চা পেলে ভাল হতো।

জুলি খ্যাক করে বলল, তুমি ভেতরে আসবে না, কোনো চা-টা পাবে না। যদি আংটিগুলো ফেরৎ চাও তোমাকে রীতিমত দাম দিতে হবে।

হ্যারি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে চাইল। ওর ঠোঁটের হাসি কিন্তু ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠল।

–কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলতে পারবো : না। লক্ষ্মী মেয়ে শোন, আমাকে ভেতরে যেতে বলল।

–এত রাতে পুরুষ মানুষকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে ঢোকানো আমার অভ্যেস নেই। আংটিগুলোর জন্যে আমার পঞ্চাশ পাউন্ড চাই, নইলে ওগুলো তুমি পাচ্ছে না।

হ্যারি চাপা শিস দিল।

–অত নিষ্ঠুর হয়ো না সোনামনি। পঞ্চাশ পাউন্ড! ঐ নচ্ছার জিনিসগুলোর আসল দামই অতো নাকি?

–ওগুলোর দাম দশ হাজার পাউন্ড, তা তুমি ভাল করেই জানো। কাল সকালে টাকা নিয়ে আসলে ভাল। নইলে আমি আংটি বেচে দেব।

গাড়ির দরজা হ্যাঁচকা টানে খুলে নেমে জুলি প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে গিয়ে দরজা খুলল বাড়ির।

জুলি!

–কাল সকাল পর্যন্ত দেখব। তার মধ্যে এলে ভাল। নইলে তারপর তুমি ওগুলোর দেখা পাচ্ছে না। সগর্বে ঘোষণা করে জুলি দুম করে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল।

.

হ্যারি কাছেই অপেক্ষা করছিল। একতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। ও একটু হেসে গাড়ি চালিয়ে কাছাকাছি গেল। এ পাড়ায় কাছেই একটা গ্যারেজ সারারাত খোলা থাকে। ও সেখানে গাড়িটা রেখে জুলির বাড়ি অবধি হেঁটে এলো। তখন রাত তিনটে বেজে গেছে। ও রাস্তার এদিক-ওদিক দেখে নিল। একটা বেড়াল চোখে পড়ল শুধু। তারপর সহজ অভ্যস্থতায় লোহার রেলিং টপকে পাইপ বেয়ে জুলির জানলা ঠেলে ঘরে ঢুকে জানলা বন্ধ করে দিল। অসম্ভব দ্রুত ওর চলাফেরা তেমনি নিঃশব্দে। সবশুদ্ধ কয়েক সেকেন্ডও লাগল না।

পর্দা সরিয়ে দেখল ঘরটা বড়, আসবাব মলিন, তেমন আরামদায়ক নয়। বিছানার পাশে টেবিলল্যাম্প। দেওয়াল ঢাকা কাগজ আর আসবাবের নিষ্প্রভ চেহারার ওপর বাড়িটার গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়েছে।

ঘরটার ওপাশে আধখোলা দরজার ও প্রান্ত থেকে জল পড়ার শব্দ শুনে বুঝল ওটা স্নানের ঘর। জুলি শোবার জন্যে তৈরি হতে হতে গুণগুণ করে গান করছে। টুপি আর কোট খুলে একটা ইজিচেয়ারে বসে হ্যারি সিগারেট ধরাল।

কয়েক মিনিট বাদে সবুজ রাতের পোষাক পরে জুলি ঘরে ঢুকল। শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট। হ্যারিকে বসে থাকতে দেখে ও প্রথমে থমকে দাঁড়াল। তারপর ওর মুখ সাদা থেকে লাল হয়ে গেল।

হ্যারি হালকাভাবে বলল, এই যে, আমায় মনে পড়ছে? বস, এই বিছানার ওপর। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

বিপন্ন চোখে জুলি চার দিকে চাইতে চাইতে ড্রেসিং টেবিলে ওর চোখ আটকে গেল। ও ছুটে গেল সেদিকে, কিন্তু তার আগেই হ্যারি সেখানে গিয়ে ওর ব্যাগের নিচ থেকে দুটো হীরের আংটি তুলে নিল।

রেখে দাও, জুলি ক্রুদ্ধ চাপা গলায় বলল।

 হ্যারি ওগুলো পকেটে পুরে নরম গলায় বলল, দুঃখিত সোনা। ওগুলো ছেলেখেলার জিনিষ নয়, ভয়ানক দরকারী জিনিষ। আমি কথা বলতে চাই জুলি। এসো, ভাব করি। আমায় এক কাপ চা খাওয়াও।

শয়তান? জুলি রাগে ফেটে পড়ল। বলল, আমি তোমার জন্যে এত হ্যাপা পোয়ালাম আর আমাকেই এক পয়সা দিতে চাচ্ছ না? পচা বদমাশ!

–কে বলল আমি তোমায় কিছু দিচ্ছি না? তুমি কাজ চাও, তাই না? বেশ আমি তোমার জন্যে একখানা দারুণ কাজ দেখে রেখেছি। সত্যি বলছি। ধাপ্পা নয়।

–কি রকম কাজ?

–আগে আমায় একটু চা খাওয়াও। মুখ থেকে বিরক্তি মুছে ফেল। বিশ্বাস কর জুলি, আমি চা না খেয়ে কথা বলতে পারছি না।

জুলি নরম হলো ওর কথা শুনে। বলল, তোমায় নিয়ে পারা যায় না হ্যারি। চা করিয়েই তবে ছাড়বে। দেরী হবে না বেশি।

জুলি চা করতে লাগল আর হ্যারি সিগারেটটা শেষ করে ভাবতে লাগল, আমি ওকে চমৎকার ম্যানেজ করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি যা বলব ও তাই করবে।

জুলি ট্রে করে চা নিয়ে এল। টেবিলে ট্রে রেখে চা ঢেলে হ্যারিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলল, কাজের কথা কি বলছিলে? তুমি আমায় পঞ্চাশ পাউন্ড দেবে, ওটা ভুলে যেও না।

স্যাম তোমায় কি দিচ্ছিল?

–হপ্তায় বারো পাউন্ড।

–চট করে তুমি অত টাকার কাজ পাচ্ছো না যদি না–হ্যারি একটু ভেবে নিয়ে বলল, কি কাজ করছ তা নিয়ে বেশী খুঁতখুঁত কর আর…খানিকটা ঝুঁকি নিতে রাজী থাক।

–তোমার এ কথার মানে?

যা বললাম! স্যামের কাছে কদ্দিন ছিলে? ছমাস।

–তার আগে?

–একটা সম্ভার লাইব্রেরীতে।

তার আগে?

 তার আগে আমি একটা কারখানায় কাজ করতাম। বলতে বলতে জুলির ভুরু কুঁচকে গেল।

–তাহলে পয়সার মুখ দেখেছো সবে এই ছমাস?

–হ্যাঁ। পয়সার মুখ, আমার যদি সাধ্যি থাকে, আমি দেখেই চলতে চাই। জুলি আরও কঠিন গলায় বলল, এর আগে আমি জীবনটা উপভোগ করতেই পারিনি। তোমার কী মনে হয় তুমি আমায় একটা ভালো কাজ দেখে দিতে পারবে?

 আমি জানি, পারব।

কি কাজ?

 হ্যারি চা খেতে খেতে জুলিকে ভাল করে দেখতে লাগল। আর ওকে নীরব থাকতে দেখে জুলি বলল, তুমি আমার জন্যে কাজ ঠিক করেছ বলে আমি বিশ্বাসই করি না। গুল দেবার আর জায়গা পাওনি। যদি দাও, পস্তাবে। আমি ডসনের সঙ্গে দেখা করে আংটিগুলোর কথা বলে দিতে পারি। কেউ আমার মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না।

হ্যারির হাত থেকে পেয়ালাটা পড়ে যাবার যোগাড় হল। জুলি কথাগুলো ঠাট্টা করে বললেও ঠিক ঠাট্টা হিসেবে নেওয়া যাচ্ছে না। জুলি হয়তো ওকে ভড়কে দিচ্ছে, কিন্তু হ্যারির মনে হল, না, জুলি ভেবেচিন্তেই বলেছে।

এক মিনিট জুলি! কি বলছ ভেবে দেখ। সাবধান, পুলিশকে যে মেয়ে কথা লাগায় তাকে একটা বিচ্ছিরি, কুৎসিত নামে ডাকা হয়, বুঝলে?

কথার ঘায়ে আমি মূর্ছা যাব না। জুলি পালটা জবাব দিল। মাথা ঝাঁকাল, কাজের কথা কি বলছো?

হ্যারি হুঁশিয়ার হয়ে, নিজেকে সামলে বলতে লাগল, এক মহিলার পরিচারিকার কাজ, মোটা টাকার কাজ। আমার এক বান্ধবী বাড়ির কাজের লোকজন দেবার এজেন্সী চালান একটা। তিনি তোমায় কাজটা পাইয়ে দিতে পারেন।

জুলি শক্ত আর আড়ষ্ট হয়ে গেল। হ্যারির দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তুমি বলতে চাও কি? আমি বাড়ির ঝিয়ের কাজ করব?

না জুলি। শোন, রেগে যেও না। চাট ছোঁড়ার জন্যে মুখিয়েই আছ তুমি। টাকাটা যদি মোটা হয়, তাহলে কি কাজ না কাজ ও সব নিয়ে ভাবছ কেন? বাড়ির কাজে দোষ কি? হাজার হলেও তুমি তো কাফেতে কাজ করেছে। অত পিটপিটিনি তোমার নেই। আছে? কাজটা খুব ভাল। চমৎকার ফ্ল্যাটে থাকবে, ভাল খাবে, ছুটি পাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা মোটা টাকা পাবে।

বাড়ির ঝি…, জুলি উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল। হ্যারি ওর রাতের পোষাক পরা শরীরটা দেখতে দেখতে টের পেল ওর মন যেন ক্রমশই কাজের প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

–না, আমি পারবনা। হিউয়ার্ট আমাকে হপ্তায় বারো পাউন্ড দিত। তার কমে আমি চালাতে পারব না, চলবে না। বাড়ির ঝি-এর মাইনে তার ধারে কাছেও নয়, ওরা বেশী পায় না।

হ্যারি মুচকি হেসে বলল, এ বাড়ির কাজে পায়। এ কাজটা স্পেশাল কাজ। হপ্তায় পনেরো পাউন্ড মাইনে, কাজ ফুরোলে পঞ্চাশ পাউন্ড বোনাস। কি বল, ভালো নয়!

জুলি পায়চারি করতে করতে ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু কেউ তা দেবে না।

–ঠিক আছে শোন, খোঁচাখুঁচি করে এর বেশী কিছু জানতে চেওনা। হ্যারির গলা ধারালো হয়ে উঠল, আমি চাই ফোকটে কিছু পয়সা কর। কি করে তা জানতে চেও না। যা বললাম আশা করি বোঝার মত বুদ্ধি তোমার আছে।

–তাই বল। নিমেষে জুলির সন্দেহ হল, বলল কোনো জোচ্চুরি কারবার, তাই বলল।

বলতে পারো…তবে তুমি যদি না জান ব্যাপারটা কি, তাহলে তোমার কোন বিপদ নেই। বুঝলে?

জুলি ভাবল, সেই পুরনো যুক্তি। হ্যারি অবশ্য ঠিকই বলছে। হিউয়ার্টও এই একই যুক্তি দেখিয়ে বলেছিল, কিছু দেখ না, কিছু শুনো না, তাহলে তোমার কোন বিপদের ভয় নেই, দিব্যি চালিয়ে নেবে। এই নিয়ম মেনে তা চালিয়ে নিয়েছিলও বটে।

হ্যারি বলল, তোমায় শুধু একটি বিশেষ বাড়িতে মাসখানেক কাজ করতে হবে। ওখানে হপ্তায় তিন পাউন্ড পাবে। আমি দেখব যাতে তুমি আরো বারো পাউন্ড পাও। কাজটা হয়ে গেলে পঞ্চাশ পাউন্ড বোনাস পাবে। কথা পাকা করবার জন্যে এখনি আমি তোমায় দশ পাউন্ড দিতে পারি।

কিন্তু হ্যারি…আমি একটু ভেবে দেখতে চাই।

–ঠিক আছে কালই বোল। এখন চেপে যাও। হপ্তায় পনের পাউন্ড, কাজ ফুরোলে পঞ্চাশ পাউন্ড বোনাস, একেবারে ফুঃ করে উড়িয়ে দেবার মত নয় কথাটা।

জুলির মনে হঠাৎ একটা কেমন সন্দেহ জেগে উঠল, বলল, তুমি ঠাট্টা করছে না তো? তারপর দেখব তুমি এখান থেকে হাঁটা দিলে আর আমি গাড্ডায় পড়ে রইলাম। আমি কালকের মেয়ে নই। তোমার সঙ্গে আমার যদি আর দেখা না হয়, তাহলে আমার কি হবে?

হ্যারি চেয়ার ছেড়ে বিছানায় ওর পাশে এসে বসল। ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, কানে কানে একটা কথা শোন। ও জুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, আজ রাতে আমি তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি না, বুঝলে?

জুলি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

না, না, ওসবের মধ্যে আমি নেই। না বেরোও তুমি। বরঞ্চ পরে দেখা হবে সেই ভাল।

হ্যারি হো হো করে হেসে উঠল।

নিজের মন জান না, তাই না? প্রথমে আমায় থাকতে বলছ, তারপর তাড়িয়ে দিচ্ছো। আচ্ছা তোমার মন আমিই ঠিক করে দিচ্ছি।

জুলি তাড়াতাড়ি ড্রেসিং গাউনটা টানতে গেল, কিন্তু হ্যারি ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। জুলি নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে ফিসফিসিয়ে বলল, না! থাম হ্যারি, না…।

হ্যারির ঠোঁট জুলির ঠোঁটের ওপর নেমে এল। এক মুহূর্ত ধস্তাধস্তি হল, তারপর দু-হাতে হ্যারির গলা জড়িয়ে ধরল।

জাহান্নামে যাও! জুলি ওর কানে কানে বলল, আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধর আমাকে।

.

জীর্ণ পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে। পথে একজন গোয়ালা তার ঘোড়াকে কানফাটানো আওয়াজে বেজায় ধমকে চেঁচিয়ে উঠল, তারপর দুধের বোতলের ঝঝনানি আওয়াজ। আরেকটু দুরে ডাকপিওন কারো বাড়িতে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে।

জুলি একটু নড়চড়ে শরীর টানটান করে হাই তুলে খেয়াল করল বাথরুমের দিক থেকে জল পড়ার শব্দ আসছে। চাদরের তলায় পা দুটোকে ছড়িয়ে দিয়ে জুলি পরম তৃপ্তিতে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ঘুম ঘুম জড়ানো গলায় জুলি বলল, সব পেয়েছে তো হ্যারি?

–আমি এখনি চা চাই। বিছানা ছেড়ে ওঠনি এখনো?

–এই উঠছি। জুলি আবার পাশ ফিরে শুয়ে চিবুক অবধি চাদরটা টেনে নিল।

–বটে! হ্যারি দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। জুলির মনে হল তোয়ালে জড়িয়ে ওকে মুষ্ঠিযোদ্ধার মত লাগছে। রোদেপোড়া পেশল, কঠিন শরীর ওর। হ্যারি বলল, ওঠো শিগগীর, নইলে বিছানা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জুলি বলল, এই উঠছি, উঠছি। এখনো নটা বাজেনি।

হ্যারি বাথরুমে ঢুকে গেল, বলল, সকালে আমার অনেক কাজ আছে।

রান্নাঘরে ঢুকে জুলি কেটলি বসাল। মনে মনে ভাবল, অবাক কাণ্ড বটে! মনে হচ্ছে ও যেন আমার সঙ্গে সারাজীবন রয়েছে। ও যেন আমার জীবনের একটা অংশ। দোষ শুধু নিজের কথা উঠলে এড়িয়ে যায়। এমনটি না হলেই ভাল হত।

রাতে ও গল্প করতে করতে কতভাবে জানতে চেষ্টা করেছে হ্যারির দৈনন্দিন জীবনটা কেমন, ও কি করে, ও কি ভাবে, কিন্তু প্রতিবারই ঠাট্টা তামাশার দেওয়ালে ঠোক্কর খেতে হয়েছে ওকে। প্রতিটা সিরিয়াস কথাকেই তামাশা করে কথার প্রসঙ্গ বদলাতে চেয়েছে।

জুলির চা নিয়ে আসার আগেই হ্যারির পোষাক পরা হয়ে গেছে।

–হ্যারি…ঐ আংটিগুলো…আমার চিন্তা হচ্ছে। তুমি ওরকম একটা কাজ করে পার পাবে না বেশীদিন। জেনে রেখো।

ওর হাত থেকে চায়ের পেয়ালা নিয়ে হ্যারি শুধু হেসেছে।

–দোহাই তোমার, আমার জন্যে ভাবতে শুরু কর না। যদি চিন্তা করতেই হয়, নিজেকে নিয়ে চিন্তা কর।

কিন্তু আমি তোমায় নিয়ে চিন্তা করি যে?

দেখ, এ দুনিয়ায় আমার মেয়াদ অল্পদিনের, ভাগ্যে থাকলে বড়জোর চল্লিশ বছর। চল্লিশটা বছর আবার সময় নাকি? কিসসু না। তারপর কবরের অন্ধকার, ঠাণ্ডা পোকার খাবার হওয়া। তার চেয়ে যদ্দিন জীবন আছে স্ফুর্তি করে নিই।

দশ বছর যদি জেলেই কাটাতে হয়, তবে পয়সা নিয়ে লাভটা কি? আসলে হ্যারি আর জুলি দুজনের জীবনদর্শনই এক রকম। তাই হ্যারির থেকে একটা সন্তোষজনক উত্তর পাবার আশায় জুলি এই প্রশ্নটা করল।

চালাক হতেও জানতে হয়। তিনবছর আমি জেল এড়িয়ে চলেছি, এখনও চলব।

 জুলি আবার ওকে খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দিল, আমি না থাকলে তুমি ইতিমধ্যে জেলে ঢুকে যেতে।

–বিশ্বাস, ইচ্ছে হলে কোর। কেউ না কেউ আমার ঠিক জুটে যায়। শুনলে অবাক হয়ে যাবে, তুমি আংটিগুলো না রাখলে আমি যেমন করে হোক ওগুলো পাচার করতামই। এরকম আগেও অনেকবার হয়েছে।

জুলি একটু বিরক্ত ও ক্ষুণ্ণ হল। ও ভাবতে চাইছিল যে, নিজেকে ও রীতিমত বিপদগ্রস্ত করে হ্যারিকে জেলের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। খচ্‌ করে জিজ্ঞেস করল, যে মেয়ে তোমায় সাহায্য করে, তার সঙ্গে সবসময়েই প্রেম কর না কি তুমি? হয়ত তোমার ধারণায় এটাই পুরস্কার?

হ্যারি হেসে বলল, ভারি রগুড়ে মেয়ে তুমি। কার সঙ্গে প্রেম করছি, সে বিষয়ে আমার খুতখুঁতুনি আছে। টের পাবে একদিন।

জুলি এখন হ্যারিকে এমন অন্তরঙ্গ ভাবে পেয়েছে, তেমনি করে অন্য কোন মেয়েও পেয়েছে, এই চিন্তাটা ওকে যন্ত্রণা দিতে থাকল।

জুলি এটা জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলো না। বললো, হ্যারি…ডানা মেয়েটা কে? তোমায় ফোন করেছিল?

হ্যারির তড়িঘড়ি জবাব, আমার মা। ভারী ভাল, কি যেন কথাটা, মরা হাতি লাখ টাকা, না কি যেন? যা হোক, তোমার ওকে খুব ভাল লাগবে।

জুলি পা ঠুকে বলল, তোমার এসব ন্যাকা ঢং ছাড়ো। বলল, কে ডানা! আমি জানতে চাই। হ্যারি জুলির মুখ লক্ষ্য করল, তারপর হাসল।

–খুঁচিও না জুলি। ডানা আমার পরিচিত একটা মেয়ে। মাথা খারাপ করার মতো কিছু নেই। তোমার অর্ধেক রূপও ওর নেই। আর আমার কাছে ওর কোন মূল্যও নেই।

–ও কেমন করে জানল, পুলিশ তোমায় খুঁজছে? জুলি প্রশ্ন করল।

–মন্ত্র জানে। নখদর্পণে ডসনকে দেখেছিল।

–ভাড়ামি থামাবে? আমাকে সত্যি কথা বলবে কিনা? জুলি রেগে গেল।

–দেখ, নিজের চরকায় তেল দিয়ে যাও। হ্যারি হাসল, কিন্তু জুলি লক্ষ্য করল ওর চোখের দৃষ্টি অতর্কিতে কঠিন হয়ে উঠেছে।

দুজনে দুজনের চোখে চোখে চেয়ে রইল। জুলির চোখই আগে নেমে এলো। ও দেখল হ্যারিকে পীড়াপীড়ি করাই বৃথা। ও এবার চাল পালটালো।

জুলি হেসে বলল, কেশ, রহস্য করতে চাও তো কর। জুলির গলার সব কৌতূহল যেন এক মুহূর্তে নিভে গেছে। বলল, আরেকটু চা নেবে?

হ্যারি পেয়ালা এগিয়ে দিল। আর একটা সিগারেট ধরাল, ঘড়ি দেখে বলল, আর এক মুহূর্তে আমাকে বেরোতে হবে।

জুলি ভাবতে থাকল এই মুহূর্তে হ্যারি ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, আর হয়ত কোনদিনও দেখা হবে না।

চা ঢালতে ঢালতে জুলি জিজ্ঞেস করল, কোথায় থাক তুমি হ্যারি?

দশনম্বর ডাউনিং স্ট্রীট। ওপরে একটা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে দিব্যি আরামে থাকি। একটাই বাটলার আমার আর প্রধানমন্ত্রীর কাজ করে।

উদ্বেগে, ক্রোধে জুলি অস্থির হয়ে উঠল। ও ভাবলো একে ঘাঁটিয়ে কোন লাভ নেই। হ্যারির এই ফাজলামি ফচকেমির আড়ালের ব্যক্তিত্বটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। জুলিকে ওরকম নেই আঁকড়ে হলে চলবে না। যখন দুজনে দুজনকে ভালভাবে চিনবে তখন হয়ত হ্যারি ওকে বিশ্বাস করবে।

জুলি হালকা গলায় বলল, তুমি গম্ভীর হতে পারো না হ্যারি?

–গম্ভীর হতে যাবো কেন? খাও, পিও, মৌজ করো, প্রেম করো। আগামীকালই হয়ত কবরের পোকারা তোমায় কুরে কুরে খাবে। গম্ভীর হওয়ার সময় আমার নেই। স্ফুর্তি করতেই চব্বিশ ঘণ্টা লেগে যায়।

–তবে আমি জানতেও পারবো না তুমি কোথায় থাকো? জুলি ভাবল মেয়েটা ওর সঙ্গে থাকে, তাই হ্যারি আমায় ঠিকানা বলছে না।

–একেক সময় তোমার বুদ্ধিতে ধার খোলে জুলি।

–বেশ, রহস্যই করো। জুলি রেগে মুখ ফেরালো।

 উত্তরে হ্যারি বলল, আমার বিষয়ে যত কম জানবে ততই মঙ্গল।

কোটটা তুলে নিয়ে ও বলল, আচ্ছা, আমি চলি। কাজের কথা কি ভাবলে জুলি?

জুলি অনিচ্ছুক গলায় বলল, ঠিক আছে। ভাবলাম কাজটা করব। আমায় শুধু পরিচারিকার কাজ করতে হবে, আর কিছু নয়।

হ্যারি বলল, শুধু তাই। তবে চোখ, কান খোলা রাখতে হবে।

জুলি তখনি বুঝল একটা চুরি হবে। ওকে বাড়ির খবরাখবরের জন্যে রাখা হবে। ও এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল। ওকে ইতস্ততঃ করতে দেখে হ্যারি পকেট থেকে পাঁচ পাউন্ডের নোট বার করল। বলল, আমি কথা দিয়েছিলাম আগাম কিছু দেব। নাও, পকেটে রাখে।

আর ইতস্ততঃ করল না জুলি। যে বিষয়ে ও জানে না কিছু, তা নিয়ে বিপদে পড়তে পারে না। আর নিজেকে যথেষ্ট সামলে চলতেও পারে ও। টাকা নিল ও।

আমায় কি করতে হবে?

হ্যারি ওকে একটা কার্ড দিল। বলল, এই ঠিকানায় মিসেস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে দেখা করে আমার নাম করে বলবে আমি পাঠিয়েছি। তিনি সব জানেন। উনি সব তোমাকে বুঝিয়ে বলে দেবেন, কি করতে হবে। ও. কে?

–কোন ভয় নেই তো? আমার কোন বিপদ হবে না তো?

–কিসসু না। হ্যারি বলল, তোমায় শুধু পরিচারিকার কাজ করতে হবে। ব্যস। সোজা তাই না?

ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে জুলি বলল, আর চোখ কান খোলা রাখতে হবে।

হ্যারি হাসল, যা বলেছো। আচ্ছা, জুলি, আবার দেখা হবে।

–আবার কবে দেখা হবে?

–শিগগীর। এখন আমার অনেক কাজ আছে। পরে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

–পুরুষ-মানুষের মতোই কথা। যা চাইলে পেয়ে গেলে, ব্যস্, ঠাণ্ডা মেরে গেলে! জুলিকে কাছে টেনে নিয়ে হ্যারি চুমো খেল।

–যদি আমাকে খুব দরকার হয়, মিসেস ফ্রেঞ্চকে একটা খবর দিও। দু-একদিন বাইরে যেতে পারি, উনি জানেন কোথায় খোঁজ করলে আমায় পাবেন। ঠিক আছে?

ওর দিকে চেয়ে জুলি বলল, ঠিক তত থাকতেই হবে।

ওকে আবার জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে হ্যারি বাইরে বেরিয়ে গেল।

জানালায় দাঁড়িয়ে জুলি ভাবল, চুরির ছক কষা হচ্ছে। আমাকে ভেতরের খবর জোগাড় করে দিতে হবে। যাকগে, টাকাটা ভালো। আসল চুরির সঙ্গে তো আমার কোন যোগ নেই, তাহলে আমার বিপদ হতে পারে না।

হাতের নোট দুটোর দিকে চেয়ে ও হাসল, টাকাটা জব্বর।

.