৯. তৃতীয় ঘর

০৯.

দানাগুয়ে ঘরে ঢুকে দু-পা পিছিয়ে আসেন। দ্বিধান্বিত দেখায় তাকে। তারপর চলে যান আমার পাশ দিয়ে। প্রথম ঘরের মত এ ঘরের শেষপ্রান্তেও রঙিন পর্দা। সেই পর্দা সরিয়ে ঢুকে যান। অর্থাৎ, ওটা তৃতীয় ঘর।

ঘুরে ঘুরে মূর্তি দেখতে থাকি। বুড়ি ঠিক নজর রাখে। মূর্তি দেখার অভিনয় করে পায়ে পায়ে ঘরের শেষপ্রান্তে এসে থামি। পর্দার ফাঁক দিয়ে এখান থেকে পাশের ঘর সহজেই দেখা যায়। পর্দা সরিয়ে দানাগুয়ে ঢোকেন। মুখে অপরাধী ভাব নিয়ে এ পায়ে প্রথম ঘরের দিকে চলে যান। মিস ম্যাডক্স তখনো তাকিয়ে আছে। হাসি অন্তর্হিত। চোখে সন্দেহ।

আমি ম্যাচ ফোল্ডার দেখাই। দুরু দুরু করে বুক। ধরা পড়ে যাবো নাতো? মর্গটের জিনিস, সেটা একপলক দেখে অভিজ্ঞা ম্যাডক্স পর্দা সরিয়ে আমায় ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত দেয়।

ধন্যবাদ। এতক্ষণ নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলাম যাতে আমায় কেউ লক্ষ্য না করে। তার শূন্য শীতল দৃষ্টি বলে দিল, ভীষণ বোকার মত কথা বলে ফেলেছি।

পর্দার পরদরজা। মধ্যেভঁই হয়ে পড়ে আছে একরাশ ব্যবহৃতম্যাচ ফোল্ডার। একটাতুলে দেখি, ভেতরের পাতা ছেঁড়া। প্রত্যেকটির পিছনের সাঁটা লেবেল ছেঁড়া, মাথাগুলো পোড়ানো। জানি আর নিস্তার নেই। সামনের ঘরেঅবধারিতমৃত্যু ওৎপেতে আছে। কিংবাতুমুলগণ্ডগোল। এবার ধরা পড়ার সময়। হঠাৎ খেয়াল হয়, আরে, মাঝের ঘর থেকে তো ম্যাডক্স আমায় দেখতে পাচ্ছেন না।

অবিকল দানাগুয়ের মত মুখ করে বেরিয়ে এসে ত্রস্ত পায়ে স্কুল থেকে পথে নামি। পার্কিংলট থেকে গাড়ি ছোটাই ফ্র্যাঙ্কলিন আর্মস অভিমুখে। পকেট থেকে ম্যাচ ফোল্ডার বের করে মর্গটের ব্যাগে রাখি। কিছুক্ষণের মধ্যে তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাই। রিসেপশন ক্লার্ককে নাম বলতে সে বারে গিয়ে বসতে বলে। উনি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছে। বারে বসে থাকি।

দশ মিনিটও কাটে না, মর্গট আসে। পরনে সাঁতারের পোষাক ঢেকেছে বিচকোট, পায়ে স্যান্ডেল।

বসতে বসতে তিনি বলেন–বেশীক্ষণ বসবো না, লিউ। এক জায়গায় লাঞ্চের ডেট আছে। ব্যাগ এনেছো?

ব্যাগ টেবিলে রাখলাম। এর জন্য পুরস্কার পাওনা রইল।

চোখে কামনার ছটা–খুশি মনে দেবো। ধন্যবাদ লিউ। আমি এত বেখেয়ালী..বলতে বলতে টেবিল থেকে ব্যাগটা বিচব্যাগে ভরে নেন।

–এক মিনিট দাঁড়াও। ব্যাগটা খুলে দেখলে না কিছু খোয়া গেছে কিনা?

অবাক দৃষ্টিতে মর্গট বলেন–কি খোয়া যাবে?

–তোমার ব্যাগে একটা ম্যাচ ফোল্ডার আছে।

 –তাই নাকি? ম্যাচ ফোল্ডার! এতে তোমার কৌতূহল কেন?

 প্রায় বড় ব্যাগ, তার ভিতর ছোট ব্যাগ খুলে মর্গট ফোল্ডারটা তুলে বলেন–এটাই তো?

–হ্যাঁ, কোত্থেকে পেলে?

জানি না। ওটা ব্যাগে আছে তাই জানি না। লিউ এত কৌতূহল কেন?

কারণ আছে। এটা সিপ্পির ব্যাগ থেকে পেয়েছি এবং আমার হোটেল রুম থেকে চুরি গেছে। পরিবর্তে এক নকল ফোল্ডার রেখে যায় চোর। এখন দেখছি তোমার ব্যাগে এটা।

–এটা তুমি কোথায় পেয়েছ?

–বোধহয় গতরাতে ক্লাব থেকে এনেছি। কাল ডিনার খেয়েছি সেখানে। ও হা হা, মনে পড়েছে। আমি লাইটার নিতে ভুলে গেছিলাম। লাইটার নিতে না ভুললে কখনই দেশলাই বা ম্যাচ ফোল্ডার ব্যবহার করি না। টুপি রাখার ট্রে থেকেই বোধহয় ওটা নিয়েছি।

কাদের সাথে ডিনার সেরেছো?

–পার্টি ছিল। সাকুল্যে পাঁচজন ছিলাম। আমি, ব্রিজিৎ, থ্রিসবি, দানাগুয়েনামের এক ভদ্রলোক, বন্ধু ভোরিস ও যার সঙ্গে প্রায় টেনিস খেলি সেই হ্যারি লুকাস।

মর্গট, এই ম্যাচ ফোল্ডার আমি চাই। লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিনকে দেখাবো।

–কিন্তু লিউ, আমি পুলিশের ব্যাপারে জড়াতে চাইনা। তাহলে ড্যাডির কানে উঠবে কথাটা।

 –চিন্তার কারণ নেই। তোমাকে জড়াবার ক্ষমতা তোমার বাবাকে এড়িয়ে র‍্যানকিনের নেই।

মর্গট ফোল্ডার দেন। বলেন–প্লিজ, আমায় জড়িওনা। যদি খবরের কাগজে প্রকাশ পায়…। তার হাতে মৃদু চাপড় মেরে বলি–ভেবো না।

তুমি কি এখন থ্রিসবির কাছে যাচ্ছ? তাকে পাবে কোথায়? মাউন্টেন রোড ধরে পাঁচমাইল গিয়ে সাইন পোস্ট দেখবে দি ক্রিস্ট। ঐখানে পাবে হোয়াইট চ্যাটিড। আচ্ছা, শীঘ্রই দেখা হবে লিউ। ও কে।

হোয়াইট চ্যাটিউ? নীল, টালির সারিবদ্ধ বাড়ি। কাঠের গেট। গায়ে বাড়ির নাম। গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে গেলাম, কলিংবেলে হাত রাখতে যাবো, ভেজানো দরজা থেকে ভেসে আসে সংলাপ–পুরুষ কণ্ঠ–বেশ, তুমি ড্রিঙ্ক না করলে আমিই করি। খানিক নীরবতা।

নারীকণ্ঠ–ঈশ্বরের দোহাই। এখনই শুরু করো না জ্যাকুইস। তোমার সাথে কথা আছে।

পুরুষকণ্ঠ–আরে সেজন্যই তো মদ খেতে হবে। না হলে তোমার প্রলাপ হজম করবো কি করে?

নারী–তুমি একটা শয়তান। কুৎসিত শোনায় নারীকণ্ঠ। আমি নিঃশব্দে দরজার আড়ালে দাঁড়াই। ভেজানো দরজার ফাঁকে দৃশ্যমান বেশ বড় ঘর। ছত্রিশ–সাঁইত্রিশ বছরের অপূর্ব এক রমনী লাউঞ্জিং চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। হ্যাঁ চেনা যায়। ইনিই ব্রিজিৎ ক্রিডি। প্রাক্তন অভিনেত্রী, লী ক্রিডির স্ত্রী।

চোখে পড়ে থ্রিসবিকে। সুঠাম, রোদজ্বলা চামড়া, কালো ঝাকড়া চুল, নীল চোখ, গোঁফযুক্ত মুখটি চৌকস। পরনে লাল সর্টস্ ও স্যান্ডেল। ডানহাতে মদভর্তি গ্লাস। ঠোঁটে সিগারেট। প্রশ্ন করে ব্রিজিৎ–কোথায় ছিলে কাল রাতে?

কতবার বলবো এখানে ছিলাম। টিভিতে মারপিট দেখছিলাম।

 না। তুমি তা করোনি। আমি ক্লাব থেকে ফোন করে কোন সাড়া পাইনি।

–আমি সব সময় ফোন ধরি না। ব্রিজিৎ ডার্লিং, আমি চাই না কেউ বিরক্ত করুক। তাই রিং শুনেও ধরিনি।

সহসা উঠে দাঁড়ান ব্রিজিৎ। চোখে আগুন–মিথ্যে কথা, তুমি ছিলে না এখানে। আমি এসে দেখেছি তুমি নেই। আলো নেভানো এমনকি গ্যারাজে গাড়ি নেই। তোমার এত সাহস, মিথ্যে বলো? কি করছিলে?

থ্রিসবির মুখ থেকে প্লেবয়ের হাসি উধাও। কঠোর হিংস্রতা ফুটে ওঠে–সেজন্য ছুটে এসেছো? কত সস্তা করে ফেলেছে নিজেকে তুমি! প্রথমত একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগালে আমার ওপর নজর রাখতে। সে মারা গেলে নিজেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ? যথেষ্ট হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ।

বীভৎস চিৎকার করে ওঠে ব্রিজিৎ–মেয়েটা কে?

সিগারেট নিভিয়ে থ্রিসবি বলেন–যথেষ্ট হয়েছে আজ। তুমি চাইলে আমি আর সম্পর্ক রাখব না। এখানেই শেষ হোক।

–সে কি মর্গট? তার সাথে শুরু করেছে?

মর্গট তোমার থেকে দশ বছরের ছোট। যুবতী ও ঢের বেশী সুন্দরী। তবে দেখছি তোমরা দুজনেই মাদকাসক্ত, অতিরিক্ত যৌন পিপাসু ও বিরক্তিকর। যাগে এবার তুমি আসবে, আমার লাঞ্চের নিমন্ত্রণ আছে।

মেয়েটা মর্গটি, তাইনা? সে এখনো ভালোবাসে তোমায়? সে ঠিক করেছে তোমাকে ছিনিয়ে নেবে আমার কাছ থেকে? উত্তেজিত ও রাগমিশ্রিত গলা কাপে ব্রিজিতের।

দ্যাখো সিন ক্রিয়েট করোনা। তুমি কি যাবে এখন?

 কাল কোন মাগীর সঙ্গে কাটিয়েছ না জেনো যাবো না।

–বেশ, শোন তবে। মেয়েটা একদম তাজা। সোনালীচুল, সদ্য যুবতী। রাস্তায় একা হাঁটছিল, আলাপ হয়ে গেল। তার সাথেই রাত কাটিয়েছি।

লম্পট! কুত্তির বাচ্চা–ব্রিজিতের মুখে রক্ত ছায়। রাগে কণ্ঠ কাপে মিথ্যে কথা। মাগীটা মর্গট

–তুমি না গেলে আমি যাচ্ছি। পরে বোলনা যে আমি প্রাক্তন প্রেমিকাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। থ্রিসবিকে দেখা যায় না। বোতলের ছিপি খোলার শব্দ। ব্রিজিৎবলেন–একসাথে আমরা অনেক এনজয় করেছি। আজ যে যার পথ দেখার সময় এসেছে। ঠিক আছে, আলাদা হয়ে যাবো। তবে তুমি ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই আমার থেকে কিছু ডলার ধার নিয়েছিলে। মনে পড়ে? , ঠিক তেরো হাজার ডলার।

চাইতে পারো, আমাকে জবরদস্তি করতে চাইলে কোর্টে কেস করো। মনে হয় তোমার স্বামী এ বিষয়ে তোমায় যথেষ্ট সাহায্য করবেন। তিনি আমায় এত টাকা দিয়েছ শুনলে তোমায় নির্ঘাৎ ডিভোর্স করবেন।

ব্রিজিৎ চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করেন–তোমার সাথে কোনদিন আমার কিছু হয়েছিল তা ভুলে যাবো। তোমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

চেয়ারে ঘুরে বসেন থ্রিসবি–উঁহু, অতটা কঠোর হোয়োনা। দেখো, তুমি যৌন অতৃপ্ত রমনী। আমি তোমার খিদে মিটিয়েছি। তার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। ভেবে দেখো ব্রিজিৎ, বিচ্ছেদের সময় তিক্ততা রেখো না। আমার মত অনেক সুন্দর চেহারার যুবক পাবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অক্লেশে আমায় ভুলে যাবে। আর ক–খ–নো দেখা হবে না আমাদের?

চোখ জ্বলে ওঠে ব্রিজিতের। টেবিল থেকে তুলে নেন কিটব্যাগ। বেশ তাই হোক। ব্রিজিতের হাসিতে নির্মম কৌতুক ঝরে। শিরদাঁড়া কাঁপানো হিমবাহ–তোমায় খুন করছি জ্যাকুইস। আমি তোমায় না পেলে, আর কাউকে পেতে দেবোনা। ব্যাগের ভেতর থেকে, ব্রিজিতের হাতে উঠে আসে পয়েন্ট আটত্রিশের স্বয়ংক্রিয় রিভলভার। থ্রিসবির দিকে নিশানা।

.

১০.

 ধীরে উঠে দাঁড়ান ব্রিজিৎ। বন্দুক হাতে যেন বিকিনী পরিহিতা বাঘিনী। পাথুরে মুখ। বন্দুকের রূপালী ট্রিগারে আঙুল। নিচুস্বরে বললেন–হ্যাঁ, জ্যাকুইস, আমাকে ঢের জ্বালিয়েছে। এবার সেই যন্ত্রণার কিছু ভাগ নাও।

ঠোঁটে জিভ বোলান থ্রিসবি–ব্রিজিৎ বন্দুক নামাও। এসো আমরা আলোচনায় বসি।

বড় দেরী হয়ে গেছে জ্যাকুইস। ঢের ক্ষমা করেছি। আর না, লম্পট, ভীতুর ডিম।

ঠিক এসময়ে নিঃশব্দে ঘরে পা রাখি। থ্রিসবি আমাকে দেখতে পায়। ব্রিজিতের পেছনে এসে দাঁড়াই। বন্দুক তুলেছেন ব্রিজিৎ। লাফিয়ে পড়ি। তার হাত সজোরে নিচে নামিয়ে দিতে, লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট কার্পেট গর্ত করে জানলা দিয়ে ছুটে যায়। হাত মুচড়ে বন্দুক ছিনিয়ে নিই। অবাক চোখে ব্রিজিৎ তাকান। তার ভয়ার্ত মুখে চামড়া ঝুলে পড়ে। কিছুক্ষণ ওই ভাবে চেয়ে থেকে, টেবিল থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে নিষ্ক্রান্ত হন। বাইরে গাড়ির স্টার্ট নেবার শব্দ।

বন্দুক টেবিলে রেখে হাত মুছি রুমালে। স্তব্ধতা যেন ভারী পাথর। থ্রিসবি দেখছেন আমাকে। নরম সুরে বলি, উনি খুন করতে গেলে বড়জোর আপনার পায়ে একটা গুলি লাগত।

সম্বিৎ ফিরে পান প্রিসবি। তখনো ভয়ার্ত দু–চোখ, কোনরকমে উচ্চারণ করেন, নিউরোটিক মাগী! বন্দুক পেল কোথায়? তা আপনি উদয় হলেন কোত্থেকে?

ট্রেড কার্ড দিই। থ্রিসবি চোখ বুলিয়ে নেন, দ্য স্টার এজেন্সি, আরে। এই এজেন্সির একজন, আচমকা থেমে মুখ ঘোরান। চোখে ভয়, হতাশা, বিহ্বলতার সংমিশ্রণ।

–ঠিক, সিপ্পি আমার পার্টনার ছিলেন।

–আমার ওপর নজরদারীর জন্য নিযুক্ত হন?

না। দুর্ঘটনার পর আমি এসেছি। আপনার সাথে কথা বলতে চাই।

 রুমালে মুখ মোছেন থ্রিসবি। শূন্য গ্লাস নিয়ে বার টেবিলে যান–মদ চলবে?

চলতে পারে, ধন্যবাদ।

 দু–গ্লাসে মদ ঢেলে, এক গ্লাস আমায় দেন। সিগারেট ধরিয়ে এক বুক ঘোয়া টেনে বলেন বলুন, কি জানতে চান?

–ব্রিজিৎ কি আপনার ওপর নজর রাখতে সিপ্পিকে নিয়োগ করেন?

 থ্রিসবি দ্বিধান্বিত–পুলিশ কেসে জড়াবো নাতো?

–হ্যাঁ, সিপ্পিকে ও ভাড়া করেছিল।

–কেন?

—-ওর ধারণা, আমি ওর সৎমেয়ে মর্গটের সাথে প্রেম চালাচ্ছি।

আমি গ্লাসে চুমুক দিই, সিগারেট ধরাই, তবে কার সাথে আপনার প্রেম চলছে?

–সেটা বলার মত নাকি। সা্ধারণ এক মেয়ে।

সিপ্পি কি সে কথা ব্রিজিৎকে জানিয়েছিলেন?

–হা জানিয়েছিলেন। তাই ব্রিজিৎ মেয়েটারকাছে গিয়ে তাকে ঈশ্বরের ভয় দেখায়। পাপের পথ থেকে সরে দাঁড়াতে বলে।

–ব্রিজিং কি সফল হয়েছিলেন?

–বোধ হয়। মেয়েটাকে আর দেখতে পাই না।

 –তারপর কি হল?

–ব্রিজিৎ আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে, বচসা হয়। গত পরশু ঠিক করি, অনেক হয়েছে। এবার সম্পর্ক চুকিয়ে দেবো। বাকীটা তো দেখলেন।

আচ্ছা মিস্টার থ্রিসবি, সিপ্পি যাকে ফলো করছিলেন, আপনার সেই প্রেমিকার নাম কি থেলমা কাজিন?

মুহূর্তে মুখ–চোখের অদ্ভুত পরিবর্তন হল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, দেখুন, পুলিশী জেরা করবেন না, সে এক সাধারণ মেয়ে।

–অনেক কথাই বললেন, বলুন না, মেয়েটা থেলমা কাজিন?

–হ্যাঁ হ্যাঁ সেই, এবার খুশি তো?

–কি করে আলাপ হল?

–পটারী প্লেসে ব্রিজিৎ কেনাকাটা করতে নিয়ে গিয়েছিল। তখনই টের পাই মেয়েটা আমার প্রেমে পড়ে গেছে।

কি করে বুঝলেন আপনাদের ওপর সিপ্পি নজর রাখছেন?

থেলমা বলেছিল। সে তার কর্মস্থানে আমায় ডেকে জানিয়েছিল, আমার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে তাকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বুঝতে পাচ্ছিলাম, থেলমা না ছাড়লে ব্রিজিৎ শায়েস্তা করবে আমায়।

–খুন করেছে?

মনে হয় খুনী সিপ্পিকে নয়, থেলমাকে খুন করতে গেছিল। সম্ভবতঃ থেলমাকে বাঁচাতে  গিয়ে সিপ্পি খুন হয়।

–তাহলে ব্রিজিৎ জোড়া খুনের আসামী?

আমি তা বলিনি, ব্রিজিৎ আইসপিক দিয়ে সিপ্পিকে খুন করছে–তা আমি বা আপনি কেউই। দেখিনি।

–ব্রিজিৎ ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে খুন করাতে পারে। যেমন হার্জ?

 থ্রিসবি চমকে ওঠেন। করতে পারে, আমার বোধহয় এ শহরে থাকা নিরাপদ নয়। তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে।

আমি ঠোঁটে দ্বিতীয় সিগারেট রেখে পকেট থেকে ম্যাচ ফোল্ডার নিয়ে এমনভাবে ধরাই যাতে ওটা থ্রিসবির চোখে পড়ে। বলি–হার্জ সম্বন্ধে কি জানেন? ওর প্রতিক্রিয়া দেখার মত। ফোল্ডার থেকে ওর দৃষ্টি সরে না। আমি নিশ্চিন্তে সিগারেট ধরিয়ে ওর ইতস্ততঃ ভাব দেখে প্রশ্ন করি–কি ব্যাপার?

না মানে, আপনি মাসকেটিয়ার্স ক্লাবের মেম্বার জানতাম না।

মেম্বার নই। এটা একজনের কাছে থেকে নিয়েছি।

–ওঃ, একটু বেরুবো। লাঞ্চের ডেট আছে। উঠে দাঁড়ান তিনি।

 –আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। হার্জ সম্বন্ধে কি জানেন?

–লী ক্রিডির ভাড়াটে গুণ্ডা, ওর সম্বন্ধে প্রশ্ন করছেন কেন? যাক ঠিক সময়ে এসে বাঁচিয়েছেন। ধন্যবাদ।

–আচ্ছা পরে দেখা হবে।

অত্যন্ত শ্লথ গতিতে ফিরলাম সেন্ট রাফাইল সিটিতে। এক ড্রাগ স্টোর্সের সামণে গাড়ি থামাই, সিধে বুথে গিয়ে ফোন করি ক্রিডির বাড়ি। কিছুক্ষণ বিচিত্র যন্ত্র শব্দ। সেক্রেটারীর গলা ভেসে আসে, বলিমিসেস ক্রিডির সাথে দেখা করতে চাই। আজ সকালে ওনার সাথে দেখা হয়েছিল। ওনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে। জিজ্ঞাসা করুন, উনি কখন দেখা করতে পারবেন।

–আপনার নাম?

–নামটা জরুরী নয়, যা বললাম তাই বলুন।

–প্লিজ, ধরুন এক মিনিট।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর সেক্রেটারির গলা–তিনটের সময় দেখা করতে পারেন।

–বেশ, যাবো আমি, বলে রিসিভার নাবাই। ঘড়িতে দেখি তিনটে বাজতে তিন মিনিট বাকী। পার্কিং লটে গাড়ি থামাতে কানে ধাক্কা দেয় পরিচিত কণ্ঠস্বর–মিস্টার ব্রান্ডন? এভাবে পুরোনো দোস্তকে এড়িয়ে যেতে হয় বুঝি?

–দেখি সেই বাটলার ফাল্টনের চেনা মুখ। সংক্ষেপে বলি মিসেস ক্রিডির সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

মনে হয় তিনি এখনি এসে পড়বেন। আমি ভেতর থেকে খোঁজ নিয়ে আসছি।

এক মিনিটের মধ্যে ফেরেন তরুণী। ঘরে ঢুকে দেখি ছবির মত জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ক্রিডি। পরনে হলুদ স্ন্যাক্স, সাদা সার্ট। দৃষ্টি গোলাপ বাগানে প্রসারিত।

হলিউডের ফিল্মের মত স্লো মোশানে ফেরেন সতর্ক চোখে। বুঝি সেলুলয়েডে ধরে রাখা ফ্রেম।

সামনের চেয়ার টেনে বসে পড়ি।

–আপনাকে বসতে বলিনি, হলিউডীয় চিত্রার্পিতের ভঙ্গি ব্রিজিতের।

বলেননি, কিন্তু আমি ক্লান্ত। সারাদিন ধকল গেছে বড়। নিন, আপনার বন্দুক ফেরৎ দিতে এসেছি।

পকেট থেকে পয়েন্ট আটত্রিশের পিস্তল বের করে, ম্যাগাজিন খুলে এগিয়ে দিই।

পিস্তল তুলে নিয়ে ব্রিজিৎ বলেন কি ভেবেছেন। ব্ল্যাকমেল করবেন আমাকে?

–আলবাৎ ব্ল্যাক মেইল করতে পারি আপনাকে। উনিশশো আটচল্লিশ–এর অস্কার বিজয়িনীর অভিনয় ছেড়ে আমার কথা চুপচাপ শুনুন।

ওহ, ঠিক আছে। কত টাকা চাই আপনার?

–আমাকে আপনার বয়ফ্রেণ্ড ভাববেন না মিসেস ক্রিডি, যে টাকার ধান্দায় ঘোরে। আমি কিছু খবরাখবর চাই।

কি খবর?

অন্য কারোর ওপর নজর রাখার জন্য কি সিপ্পিকে ভাড়া করেছিলেন?

না।

–আপনি কি জানেন সম্প্রতি থেলমা কাজিন নামে একটি মেয়ের সাথে থ্রিসবি প্রেম করছেন?

–না। ওরকম কোনো নাম শুনিনি, চিনিও না।

–থ্রিসবি আমায় যা বলেছেন তা লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিনকে জানালে আপনার আপত্তি নেই বোধ হয়।

–আপনি যা খুশি করতে পারেন? তবে সাবধান, আমাকে বিপদে ফেলতে গেলে আপনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। ভাববেন না। তা আমি পারিনা, আপনার বকবক আর শুনতে চাই না। এবার কেটে পড়ুন।

এবার শেষ অস্ত্র সামনে রাখি। ম্যাচ ফোল্ডার….এটা কি আপনার?

— থ্রিসবির মত কোন প্রতিক্রিয়া ফোটে না ব্রিজিতের মুখে বুঝতে পাচ্ছি না কি বলতে চান? এখন চলে যাওয়া উচিত আপনার। ব্রিজিত উঠে বেল টেপেন। দরজা খুলে ঢোকেন সেক্রেটারী। যেতে যেতে বলি–আবার দেখা হতে পারে।

বাইরের ঘরে পা দিতেই দেখতে পাই দুরের চেয়ারে হিল্টন বসে আছেন। বলেন মিসেস ক্রিডির সাথে কথা বলা শেষ হলে মিস্টার ক্রিডি আপনাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন।

–বেশ, দেখা যাক, চলুন।

মিস্টার ক্রিডির ঘরে দরজা খুলে হিল্টন অনুচ্চ স্বরে বলেন–স্যার, মিস্টার ব্রান্ডন এসেছে।

আমি ঘরে ঢুকতে ক্রিডি বলেন–আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হল?

–এজন্য ডেকেছিলেন? তাহলে আমি যাই।

কয়েক মুহূর্ত আমায় জরিপ করেন ক্রিডি। টেবিল থেকে কাগজকাটা ছুরি চোখের সামনে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলেন–আপনাদের এজেন্সি সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি, শুনেছি বিত্তবান আপনারা। লাভজনক ব্যবসা ভালই চলছে এবং মূলধন তিন হাজার ডলার। উঠতি ব্যবসা কিনতে আমি পছন্দ করি। আপনাদের ব্যবসা কিনতে আমি প্রস্তুত। দশ হাজার ডলার দিচ্ছি। সুনাম আর ওই, কি যেন বললেন, হ্যাঁ, ব্যক্তিত্বের জন্য।

মনে মনে ভাবি, বিক্রি করলে সিপ্পি হত্যারহস্যের তদন্ত ধামা চাপা পড়ে যাবে, আমি তদন্ত চালাবই। কেনা যাবে না আমায়।

–আর দ্বিধা করবেন না। আপনার পার্টনার সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছি। অত্যন্ত বাজে লোক। তার সাথে আর কিছুদিন কাজ করলে আপনার কারবার ডকে উঠতো। লোকটা মেয়েবাজ। আদৌ ভাল গোয়েন্দা ছিল না। ওর জন্য সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করবেন না, আমি পঞ্চাশ হাজার ডলার দেবো।

–আমি বিক্রি হব না।

 –একলাখ ডলার?

না?

–দেড় লাখ?

বাদ দিন। নিজেকে বড় সস্তা করে ফেলছেন। আমাকে কেনার ধান্দা ছাড়ুন এবং আপনার ঐ ডলার সর্বস্ব মানসিকতা বাদ দিন। ফিরবো বলে দরজায় পা রাখতে বুঝি পিছনে ফেলে আসা নিস্তব্ধতা কি যন্ত্রণাদায়ক।

.

১১.

 মাঝ দুপুরে টেলিফোন বেজে ওঠে।

–হ্যালো?

–কে লিউ? মর্গটের গলা। জানো, ম্যাচ ফোল্ডারটা জ্যাকুইসের।

কি করে বলছো?

 –মনে পড়ল, ও আমার টেবিলের বিপরীতে বসেছিল। আমার লাইটার কাজ করছিল না। ও পকেট থেকে তার ম্যাচফোডার বের করে। টেবিলে সিগারেট–এর প্যাকেট ও ম্যাচ ফোল্ডার ফেলে জেরিসের সঙ্গে নাচে যোগ দেয়। সিগারেট ধরাতে গিয়ে আমি সেই ম্যাচ ফোল্ডার নিই ও পরে অন্যমনস্ক হয়ে সেটা ব্যাগে ভরে নিই। হলফ করে বলতে পারি টেবিলের ওপর ওকে ম্যাচ ফোল্ডার রাখতে দেখেছি। লিউ, জ্যাকুইসের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?

–ব্রিজিৎ সেখানে ছিলেন। তিনি যখন থ্রিসবিকে গুলি করতে যান সেই নাটকীয় মুহূর্তে আমার প্রবেশ। আমার হস্তক্ষেপে থ্রিসবি বুলেট বিদ্ধ হননি।

–বোধহয় ব্রিজিৎ মেজাজ হারিয়েছিল। কি ভাবছে লিউ, পুলিশকে জানাবে নাতো?

না। তুমি কি জান ওনার বন্দুক আছে?

–না।

 –সিপ্পির খুনের ব্যাপারে ব্রিজিতের হাত আছে বলে মনে হয়?

–এখন ভাবতে পারছি না কিছু।

 –কি করবে?

থ্রিসবিকে ফের ধরতে হবে। তুমি জানো ওর বাড়িতে চাকর আছে?

–হ্যাঁ, ফিলিপিন নামে একজন আছে। সকালে আসে, রাত আটটায় কাজ সেরে চলে যায়।

আবার কখন তোমার সাথে দেখা হবে মর্গট? রাত সাড়ে দশটায় চলে এসো। ইতিমধ্যে থ্রিসবির বাড়ি ঘুরে এসে তোমায় জানাবো নতুন কি খবর পেলাম।

–বেশ, যাবো। সাবধান লিউ। বাড়ির খুব কাছে গেলে জ্যাকুইস পালিয়ে যাবে। আমার কথা মনে রেখো, লোকটা হিং ও ভয়ঙ্কর।

.

 পিস্তলের সেফটি ক্যাচ তুলে দিই। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলি, কে ওখানে?

উত্তর নেই। বারন্দার কোণে হাঁটু গেড়ে বসা মানুষটির নাড়াচাড়ার কোন শব্দ নেই। পা কাঁপতে থাকে। অন্যমনস্ক হাত থেকে একটা বুলেট দরজা ফুড়ে ছুটে যায়। হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে। চীৎকার করে বলি–দাঁড়াও! নড়ো না! এক পা নড়লেই খতম করে দেব।

ডান হাতে পিস্তল উচিয়ে, বাঁ হাতে লাইটার জ্বালাই। সেই স্বালোক বলে দেয় কোণের লোকটা নড়ছে না। কালো–খাটো মানুষটার চোখ বোজা। হাঁ মুখের কটি দাঁত দৃশ্যমান। আমার অভিজ্ঞতায় বুঝি মানুষটি মৃত। নিষ্প্রভ হতে শুরু করেছে লাইটারের আলো। আমি নিচে সিঁড়ি  থেকেফাসলাইট কুড়িয়ে আনি। এই মৃত লোকটিই বোধহয় থ্রিসবির চাকর। কেউ তার বুকে গুলি করেছে। মৃতের মাথাটা ঘোরাই। ঠাণ্ডা চামড়া। চামড়ার নিচে শক্ত পেশী পরীক্ষা করে বুঝি এর মৃত্যু হয়েছে কয়েকঘন্টা আগে।

কালো বেড়ালটা আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। ল্যাজ নেড়ে জুলজুল করে তাকায়। হাঁটতে থাকে অতি ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে পিছু ফিরে দেখে। আমি বেড়ালটাকে অনুসরণ করতে থাকি।

মৃত চাকর ফিলিপিনোকে পাশ কাটিয়ে একটা দরজার সামনে থামে বেড়ালটা। রুদ্ধ দরজায় পা দিয়ে আঁচড় কাটে।

আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় মৃদু চাপ দিই। খুলে যায় ভেজানো দরজা। অন্ধকার আর নিঝুম স্তব্ধতা। বেড়ালটা কান খাড়া, খাড় কাৎ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার মুখ শুকিয়ে যায়, হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে, পা যেন গেঁথে যায় মাটিতে।

ঘরের মধ্যে ফ্ল্যাসলাইটের তীব্র আলোয় উদ্ভাসিত হয় মেঝে, খাটের পায়া। লাফ দিয়ে কালো বেড়ালটা খাটের ওপর ওঠে।

থ্রিসবি পড়ে আছেন বিছানায়। পরনে লাল সর্টস সাদা জামা। পায়ে স্যান্ডাল। রক্তে বিছানা ভেসে যাচ্ছে। পিছন থেকে থ্রিসবিকে ছুরি মেরেছে আততায়ী।

ফোন করি ক্রিডির বাড়িতে, বেশ কিছুক্ষণ বাদে অপর প্রান্ত সরব হয়দুঃখিত মিস্টার ব্রান্ডন। মিসেস ক্রিডি আপনার সাথে কথা বলতে রাজি নন।

–দেখুন, মিসেস ক্রিডিকে দিন। তাকে আমার সঙ্গে কথা বলার কষ্ট করতে হবে না।

অনেক্ষণ পর মিসেস ক্রিডির গলা পাই–ফের যদি ঝামেলা করতে চান, আমি স্বামীকে গিয়ে বলবো।

খুব ভালো। তিনিও পছন্দ করবেন। আপনি বরং এখনি তাকে বলুন। কেন না, আপনি এখনি যে ঝামেলায় জড়াতে যাচ্ছেন যাতে আমার হাত নেই। প্রিসবি খুন হয়ে তার বিছানায় পড়ে আছে। আর আপনার পয়েন্ট থার্টি এইট পিস্তল মৃতদেহের কাছে পাওয়া গেছে।

মিথ্যে কথা।

–বেশ তাই ভাবলে গ্যাট হয়ে বসে থাকুন যতক্ষণ না আইনের জালে জড়িয়ে পড়েন। আমি খবর দিচ্ছি পুলিশকে।

ভীত শাসরুদ্ধ কণ্ঠে ব্রিজিৎ বলেন–সত্যি মারা গেছে?

পুরোপুরি। আজ পাঁচটা থেকে ছটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?

 –এখানে নিজের ঘরে।

 –কেউ দেখেছে আপনাকে?

না, আমি একা ছিলাম।

 –আপনার সেক্রেটারী?

চলে গিয়েছিল।

 –আপনাকে যে পিস্তলটা দিয়েছিলাম সেটা কোথায়?

বেডরুমের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি।

–আপনার জন্য করছি কেন জানি না। তবে পিস্তলটা অকুস্থল থেকে সরিয়ে নিয়েছি। মনে হয়, কেউ আপনাকে থ্রিসবির খুনী সাজাতে চাইছে। পিস্তল সরালেও থ্রিসবির গায়ে বিদ্ধ বুলেট থেকে পিস্তলের হদিস করতে পারে পুলিশ। যদিও তা করবেনা খুব সম্ভব। এখন বসে বসে ডাকুন ঠাকুরকে। ব্রিজিতের উত্তরের অপেক্ষা না করে রিসিভার নামিয়ে রাখি।

ঠিক সোয়া দশটায় বাংলোয় ফিরে আসি। পাম গাছের আড়ালে কনভার্টেবল ক্যাডিলাক, একপলক সেদিকে তাকিয়ে বাংলোর ফটকে তালা খুলি। অন্ধকারে সন্তর্পণে স্যুইচ টিপে আলো জ্বালি। কান সজাগ, হাতে উত্তোলিত বন্দুক, কোথাও কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ অন্ধকার থেকে ভেসে আসে মর্গটের কণ্ঠস্বর।

.

১২.

 গাড়ি থেকে নেমে লেফটেন্যান্ট চেঁচিয়ে ওঠেন–আপনার সঙ্গে কথা আছে ব্রান্ডন। ভেতরে আসছি আমরা।

র‍্যানকিন ভেতরে ঢুকে বলেন–স্বেচ্ছায় আসবেন, না জোর করতে হবে? আপনি এইমাত্র থ্রিসবির বাড়ি থেকে এসেছেন, বলুন, যাননি?

আমি পুলিশের গাড়িতে পিছনের সীটে বসি। 

বন্দুক দিন…হঠাৎ র‍্যানকিন বলেন।

–আমার কাছে নেই। তৎক্ষণাৎ র‍্যানকিন গাড়ি থামাতে বলে প্রশ্ন করেন–কোথায়?

বাংলোয়।

বাংলোর সামনে গাড়ি থামে। ক্যানডিকে যথাসম্ভব আড়াল করে ড্রয়ার খুলি। ক্যানডি বুকে আমার পয়েন্ট থার্টি এইট বন্দুক তুলে বলেন–এটা?

–হ্যাঁ।

ড্রয়ারে তাকিয়ে শিউরে উঠি। ব্রিজিতের বন্দুক উধাও।

স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকি। টের পাই, ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে, আমার কাছে বন্দুক নেই। র‍্যানকিন আমারটা নিয়েছে আর ব্রিজিতেরটা দিয়েছে হেল্পলকে। হেলের কথাগুলো কানে বাজে–যে কেউ যে কোনো জায়গায় আপনাকে খতম করে দিতে পারে। আপনি খুন হয়ে যেতে পারেন, কেউ সেজন্য দায়ী হবে না।

কেউ বেডরুমে সন্তর্পণে হাঁটছে। মিহি কিন্তু স্পষ্টই পদশব্দ শোনা যায়। সুইচ টিপে আলো নেভাই। কে যেন এ ঘরের দরজায় চাপ দেয়..ক্যাচ শব্দ ওঠে। পান্না ফাঁক হয়। আর তখনই ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠি–ওখানে কে আছে দাঁড়াও, নইলে খুপড়ি উড়িয়ে দেবো।

বলেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি, যাতে আততায়ীর গুলি মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়।

–লিউ? …ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন মর্গট।

উঠে আলো জ্বেলে দিই। দরজায় মর্গট। মুখে আতঙ্ক, পরণে কাঁচের মত স্বচ্ছ রাত পোশাক। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। যেন এই ধুলিমলিন পৃথিবীর কেউ নয়।

–ওহ লিউ। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছে। প্রাণ খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড়।

–আর তুমি যা করেছে তাতে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত, এখানে কি করছিলে মর্গট?

–ফিরে এলাম। তোমার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ডার্লিং…কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলাম। অন্ধকারে অপেক্ষা করছিলাম। পুলিশ এলো, চলে গেলো। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা বলে ঘরে এসে তোমার প্রতীক্ষায় রইলাম।

তোমায় ফেলে যেতে হয়েছিল বলে দুঃখিত। ওঃ যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তাতে ভাবলাম অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে।

দুঃখিত, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে উঠে আলো নিভতে দেখলাম। ভাবলাম তুমি হতে পারে। কিন্তু যদি তুমি না হও? ভেবে, তোমায় ডাকতে ভয় পেলাম, তাই দরজার আড়াল থেকে শুনছিলাম। তারপর তুমি যেরকম চিৎকার করে উঠলে।

আস্তে বলি–বিছানায় যাও, ঠাণ্ডা লাগবে।

সর্বাঙ্গে গভীর আশ্লেষী আমন্ত্রণ জানিয়ে মর্গট বলেন–ঠাণ্ডা লাগবেনা। আমি বিছানায় তো যাবো, তুমি?

দাঁড়াও আগে স্নান সারি, তারপর আসছি তোমার কাছে।

জামা কাপড়মুক্ত হয়ে বাথরুমে ঢুকি। দরজা ভেজিয়ে সাওয়ার খুলে দিই। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। দশ সেকেন্ড ঐভাবে থাকার পর খুব সন্তর্পণে এক ইঞ্চি দরজা ফাঁক করে বেডরুমের উদ্দেশ্যে চোখ রাখি।

আশ্চর্য। বিছানায় মর্গট নেই। যে চেয়ারে জামাকাপড় রেখেছি তার পাশে দাঁড়িয়ে আমার ট্রাউজারের হিপ পকেট থেকে ম্যাচ–ফোল্ডার বের করে নিলেন। মুখে ভীতি ও মুক্তির মিশ্রণ দেখে ভারী বিশ্রী লাগে।

সাওয়ার বন্ধ করে বেডরুমে ঢুকি। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মর্গট। চোখ বিস্ফারিত। বুকে আটকে আছে দমকা বাতাস।

বিছানার কাছে গিয়ে মর্গটের মাথায় সুস্পষ্ট ছাপসহ বালিশ মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলি। বিছানার ওপর বালিশ চাপা হলুদ হাতলের (আইস পিক) বরফ খোঁচানো ছুরি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।

মর্গট পাথরের মত নিশ্চল, হাতে ফোল্ডার, চোখে শঙ্কা।

–এ দিয়ে কার্যসিদ্ধি হবে ভেবেছো মর্গট? সত্যি কি ভেবেছো তুমি তৃতীয়বারও সফল হবে? আমার প্রশ্নাঘাতে থরথর কাপে ঠোঁট। কোনো শব্দ উচ্চারিত হয় না। ছুরিটা হাতে নিই। সুচের মত ভীষণ আর ব্লেডের মতো ধারালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমেল প্রবাহ বয়ে যায়। টের পাই মৃত্যুর কত কাছ থেকে বেঁচে ফিরলাম। চোখে চোখ রেখে বলি–অভিনেত্রী তুমি অদ্বিতীয়া হলেও একজন তৃতীয় শ্রেণীর মিথ্যুক তুমি।

মর্গট মাথা নাড়েন। বলতে থাকেন তুমি বুঝবেনা। ও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল। আমার কাছ থেকে ম্যাচ–ফোল্ডার চুরি করেছিল আর তার ফেরতের বিনিময়ে আমায় চেয়েছিল। দেহদানে জোর করেছিল। আত্মরক্ষার জন্য তাকে আমি খুন করি।

–মর্গট এ গল্পটা আগের চেয়ে ভাল। সিপ্পি মোটেই ব্ল্যাক মেইল করেন নি। তার অনেক ত্রুটি হলেও তিনি নীচ নন এত। ব্যাপারটা আরো জটিল। অনুমান করতে পারি কি ঘটেছিল।

কিছুক্ষণ পরে মাথা নাড়েন মর্গট, চোখের জলে ভাসে…হা ড্যাড কোন উপায় ছিল না।

ক্রিডির চোয়াল শক্ত হয়–উপায় ছিল না মানে?

কর্ডেজ সম্বন্ধে ও পুলিশকে সব বলতে যাচ্ছিল। তা আমি করতে দিইনি।

 –কেন? তুমি কি বলতে চাও, তুমি মাদকাসক্ত–তাই কি?

মনে হয়।

হঠাৎ সেখানে ক্রিডির আবির্ভাব হয়। কপাল থেকে চশমা খুলে তিনি মুছে দেখেন।

শোনো মর্গট, ক্রিডি বলতে থাকেন–তোমায় এখনি সেন্ট রাফাইল ছাড়তে হবে। মানিব্যাগ খুলে পেটমোটা টাকার বান্ডিল মেয়ের কোলে ছুঁড়ে দিয়ে বলেন রাখো, চলে যাও। ব্রান্ডনের গাড়ি নিয়ে যাও। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাসির কাছে চলে যাও। বুঝলে?

দৌড়ে বাংলো বাইরে আসি। পামগাছের ছায়ায় রাখা ক্রিডির কালো ক্যাডিলাকে উঠেইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে ধাওয়া করি আমার গাড়ির পেছনে।

বিপজ্জনক দ্রুততায় গাড়ি চালাচ্ছেন মর্গট। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ। অবিশ্বাস্য ঝড়ের গতিতে মর্গটের গাড়ি ছুটে যায়। পুলিশ তো থ। বাঁশি বাজাতেও ভুলে যায়।

মাউন্টেন রোডে পড়েছি আমরা। আচমকা বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা এক মাতাল গাড়ি মর্গটের গাড়িকে পাশ দিয়ে ধাক্কা মেরে আমার দিকে ছুটে আসে। ব্রেক না চেপে স্টিয়ারিং ঘোরাই। এক চুলের জন্য বেঁচে যাই।

গাড়িশুদ্ধ মর্গট ডিগবাজি খেয়ে গড়াতে থাকে। টায়ারে ঘষা লেগে বুইকের পেছনে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। রাস্তার বাঁকে গাড়ি থামে।

যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হল। পুলিশের যে খুনে গাড়ি আমাকে ধাক্কা দেবার জন্য পথে নেমেছিল এবং শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটলো, ঘটনাচক্রে সেই গাড়ির স্টিয়ারিং ছিল মর্গটের হাতে। গাঢ় অন্ধকারে গাড়ির চালককে ওদের পক্ষে ঠাওর করা সম্ভব হয়নি। জানি এই স্বেচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার পেছনে মাপকাঠি নেড়েছেন ক্রিডি। তিনি জানতেন আমার গাড়ি দেখা মাত্র পুলিশের গাড়ি ধাক্কা দিয়ে তা পিষে ফেলবে। তাই মর্গটকে সেই গাড়ি নিয়ে মাউন্টেন রোড ধরে যেতে নির্দেশ দেন। আর এভাবেই তিনি নিঃশব্দে, রাতের আঁধারে সাক্ষ্যহীন, প্রচারহীন পোয়া পুলিশী গুণ্ডা দিয়ে নিজে নষ্ট, অপদার্থ–মাদকাসক্ত ও খুনী মেয়েকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন। ক্যাডিলাক থামিয়ে নামলাম। আর করার কিছু নেই। পুলিশের গাড়ির একটানা সাইরেন বাজছে কাছে। আমরা ফিরতে থাকি।