৯. ঘণ্টা কয়েক বিশ্রামের পর

০৯.

 একইভাবে পরবর্তী দুটো দিন কেটে গেলো। প্রতিদিন খুব ভোরে ব্লেক আর জিপো ক্যারাভ্যানে চলে যায়। আর কিটসন কেবিনে ফিরে আসে। ঘণ্টা কয়েক বিশ্রামের পর সেআর জিনি কেবিনের বাইরে বেরিয়ে পড়ে–তাদের দৈনন্দিন অভিনয় পর্বকে বাস্তবানুগ করে তুলতে তারা হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ায় হ্রদের ধারে। নৌকো করে ভেসে বেড়ায় হ্রদের নীল জলে। অথবা সাঁতারে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়।

ট্রাকের দরজার পেছনে জিপো সারাটা দিন লেগে থাকে। আর সেই সময়টা ব্লেক খবরের কাগজ পড়েই কাটিয়ে দেয়।

ব্লেকের মনে দৈনন্দিন খবরগুলো রীতিমত আশার উদ্রেক করলো। কারণ পুলিসও সৈন্যবাহিনীর লোকেরা উধাও ট্রাকটাকে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অবশ্য তারা অনুসন্ধানে এখনও ক্ষান্তহয় নি। কিন্তু কাগজওয়ালাদের কাছে পুলিসের বক্তব্যে হতাশার সুরটাই প্রকট হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, ট্রাকটাকে অন্য কোনো গাড়িতে উঠিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

দুশো সৈনিক ও পুলিস মিলে ফক্স উডকে চিরুনির মত আঁচড়ে দেখছে ট্রাকের হদিস পাওয়ার আশায়। তাছাড়া রাস্তায় রাস্তায় শ্যেনচক্ষু মেলে উড়ন্ত হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে।

সৈন্যবাহিনীরা আজ হোক কাল যোক ট্রাকটা খুঁজে বের করবেই। কারণ ট্রাকটা যেভাবে অদৃশ্য হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত হয়ে আছে তা বস্তুগতভাবে সম্পূর্ণ অসম্ভব।

পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী যে হারে পরিশ্রম করে চলেছে, সেই একইভাবে ব্লেক ও জিপো পরিশ্রম করে চলেছে–ক্যারাভ্যানের ভেতর, লোকচক্ষুর আড়ালে।

 জিপোর সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে গত দুদিন ধরে।

সে সারাদিন ক্যারাভ্যানের বদ্ধ আবহাওয়ায়, অসহ্য গরমে ধৈর্য ধরে কাজ করেছে। মাঝে মাঝে জিপো বিরক্তিভরে ট্রাকের তালাকে অভিসম্পাত করেছে। কিন্তু কম্বিনেশনের দ্বিতীয় নম্বরটা তার অজ্ঞাতই থেকে গেছে।

খবরের কাগজ পড়া আর জিপোর কার্যকলাপ লক্ষ্য করা ছাড়া ব্লেকের আর কোনো কাজই ছিলো না। ক্যারাভ্যানের প্রচণ্ড গরম, তালা খোলার সমস্যা ইত্যাদি চিন্তায় ব্লেকের স্নায়ুমণ্ডলী একেবারেই ভারাক্রান্ত, তারওপর জিনি আর কিটসনের কথা মনে হতেই সে ক্রোধে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এখানে তারা গলদঘর্ম হচ্ছে আর কিটসন জিনিকে নিয়ে মজা লুটছে।

এ কদিনে কিটসন জিনির মনের ওপর একটা ছাপ রাখতে পেরেছে বলেই ব্লেকের ধারণা কারণ তিন–তিনটে দিন পেয়ে কোনো মানুষই সুযোগ হাতছাড়া করবে না। ব্লেক বারো ঘণ্টা সময় যদি পেতো, তাহলে ঐসময়ে জিনি তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে। এর মধ্যে জিনি আর কিটসনের ভাবনা তার মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তুললো।

তৃতীয় দিন ছটা নাগাদ জিপো ভেঙে পড়লো। অপরাহ্নের সূর্য পর্বত শ্রেণীর আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছে। সেই সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো জিপো।

তিনদিন এই পরিবেশে জিপো কাজ করে গেছে। এই মুহূর্তে সে উপলব্ধি করলো, সে পরাস্ত হয়েছে। অনেক কিছু করেও দ্বিতীয় নম্বরটা মেলেনি। কারণ জিপোর তীক্ষ্ণ কানেনম্বর মেলার ধাতব শব্দটা ধরা পড়ে নি। অর্থাৎ চাকতিটা সতর্ক হাতে ঘোরাতে পারেনি। অর্থাৎ দক্ষ হাতজোড়া গর্বের বস্তু ছিলো, কিন্তু চাকতিকে তেমন ঘোরাতে পারেনি।

না, আমার দ্বারা সম্ভব নয়! হঠাৎই চিৎকার করে উঠেছে জিপো। ট্রাকের দরজার গায়ে অবসন্নভাবে গা এলিয়ে। এ তালা খোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এড! এভাবে বেগার খেটে কোন লাভ নেই। বিশ বছর ধরে চেষ্টা করলেও আমি এ ট্রাকের দরজা খুলতে পারবোনা। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে পাগল হয়ে যাবো।

অপ্রকৃতিস্থ কণ্ঠস্বরে জিপোর অবস্থা দেখে ব্লেক চঞ্চল হয়ে রিভলবার নিয়ে জিপোর দিকে এগিয়ে গেলো।

জিপোর পাঁজরে রিভলবারের নলটা চেপে ধরে ব্লেক, থামো। যদি এই ট্রাকের তালা তুমি না খোলো, তাহলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলবো।

অসহায়ভাবে জিপো কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার স্থূল দেহ কান্নায় কেঁপে উঠতে লাগলো।

তাই করো। আমাকে খুন করো। তুমি কি ভেবেছ মরতে আমি ভয় পাই? কিন্তু এই শালার ট্রাকের তালা তুমি আমাকে খুলতে বোলো না। তার চেয়ে আমাকে মেরেই ফেলল, আমি আর পারছি না।

ব্লেক রিভলবারের নল দিয়ে নৃশংসভাবে জিপোকে আঘাত করলো–সরাসরি মুখের ওপর। জিপো মেঝেতে ছিটকে পড়লো। তার গাল কেটে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগলো। ট্রাকের পাশেই অবসন্নভাবে সে পড়ে রইলো যন্ত্রণায় চোখ দুটো বোজা।

জিপো রক্তাক্ত বীভৎস মুখে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো আতঙ্কে আর্তনাদ করলো, মেরে ফেলল, শেষ করে দাও আমাকে। আমি এসব আর সহ্য করতে পারছি না।

থাম বলছি, শালা কুত্তীর বাচ্চা। নয়তো গলা টিপে তোকে শেষ করে দেবো। ব্লেক মরিয়া হয়ে চিৎকার করলো। জিপোর অবস্থা দেখে সে চিন্তিত। সত্যিই যদি জিপো শাসনের বাইরে চলে যায়। তাহলে তাদের সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। তাছাড়া চেঁচামেচির শব্দ বাইরে লোকের কানেও যেতে পারে।

জিপো আবার কান্নাভেজা স্বরে আকুতি জানালো, আমি আবারও বলছি, এড, আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। এ তালা আমি খুলতে পারবোনা।

ঠিক তখানি ক্যারাভ্যানের দরজায় কে যেন টোকা মারলো, একবার..দুবার। ব্লেকের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো, কে এলো এই অসময়ে?

জিনি আর কিটসনকে সে বুইক নিয়ে শহরের দিকে যেতে দেখেছে কিছু কেনাকাটা করতে। না, বর্তমান আগন্তুক যে ওদের দুজনের কেউ নয়, সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। তাহলে…?

জিপো আবার তার গোঙানি শুরু করতেই ব্রেক হাত চেপে ধরে হিংস্র ফিসফিস স্বরে ধমকে উঠলো। চুপ করো! ক্যারাভ্যানের দরজায় কেউ এসেছে।

আতঙ্কে জিপো কুঁকড়ে চুপ হয়ে গেলো।

 দুজন নিশ্চল, শুধু কান খাড়া করে পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় রইলো।

টোকা মারার শব্দ আবার শোনা গেলো।

ব্লেক হাতের ইশারায় জিপোকে তার জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। তারপর রিভলবার চেপে ধরে পা টিপে টিপে পর্দা ঢাকা জানলায় গিয়ে অতি সন্তর্পণে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলো।

ক্যারাভ্যানের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে।

সংশয়াপন্ন দৃষ্টিতে ক্যারাভ্যানের দরজায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই টোকা মেরে চলেছে সে। তার হাতে একটা খেলনা পিস্তল, দরজার দিকে তাক করা।

ক্রুরদৃষ্টিতে ব্লেক ছেলেটাকে লক্ষ্য করতে লাগলো।

ছেলেটার পরনে সূতীর প্যান্ট, আর সাদালাল ডোরাকাটা একটা জামা। পায়ে কিছুই নেই। মাথায় একটা ভাঙাচোরা শোলার টুপি। কৌতূহলভরা স্থির চোখে ছেলেটা ক্যারাভ্যানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তারপর ছেলেটা দরজার আরো কাছে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে জানলার চৌকাঠ চেপে ধরলো। সে শরীরটাকে জানলা পর্যন্ত তুলতে চেষ্টা করলো ক্যারাভ্যানের ভেতরটা দেখার আশায়।

ব্লেককে ভয়ার্ত ও হিংস্র দেখে, বিপদের আশংকায় জিপো এগিয়ে এলো। সে ছেলেটাকে দেখেই যেন আঁতকে উঠলো। তার হাত সজোরে আঁকড়ে ধরলো ব্লেকের রিভলবার ধরা হাতটা।

জিপো ফিসফিসিয়ে, না! একটা বাচ্চাকে তুমি গুলি করতে যাচ্ছো? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?

ব্লেক প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছেলেটাকে উঠতে না পেরে মাটিতে নেমে পড়তে দেখে সে হাফ ছেড়ে বাঁচলল।

ছেলেটা হঠাৎ ঘুরে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে হ্রদের কিনারা ধরে হাঁটতে লাগলো।

ব্লেক উদগ্রীব স্বরে, তোমার কি মনে হয় ও আমাদের কথা শুনতে পেয়েছে?

কি জানি।

ওঃ, আমি তো ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। জিপো তুমি এখানে এসে একটু বিশ্রাম নাও, আমি বরং তালাটা ভোলার চেষ্টা করি।

অবিশ্বাস্য বিরক্তিতে জিপো মুখ বিকৃত করে, তুমি খুলবে তালা? খবরদার ঐ তালায় তুমি হাত দেবেনা। কাজের কাজ কিছুই পারবেনা। উন্টে যে নম্বরটা মিলিয়েছি সেটাকে ও নষ্ট করে দেবে।

ব্লেকরাগে চেঁচিয়ে উঠলো, তুমিও খুলবেনা। আমাকেও খুলতে দেবেনা, তাহলে তালাটা খুলবে

তুমি কি এখনও বুঝতে পারছ না, এড? এ তালা আমরা কোনদিনই খুলতে পারবোনা। গত তিন দিন ধরে ঘন্টার পর ঘণ্টা একটানা পরিশ্রম করেছি। কিন্তু তাতে লাভ কি হলো? শুধু একটা নম্বর মিললো এখনও আমাকে পাঁচটা নম্বর খুঁজে বের করতে হবে। আমি ততদিনে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো।

এই গরমে আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভবনয়ই। অতএব আমাকে বিদায় দাও, এড। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, আর নয়। এই অমানুষিক পরিশ্রমের মূল্য, টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।

আঃ, থামো। তুমি কি সব আবোল তাবোল বকছ!

 কিন্তু ব্লেক বুঝলো যে জিপোর কথায় যুক্তি আছে। এই উত্তপ্ত পরিবেশে তিন–চার সপ্তাহ কাটানোর কথা চিন্তা করা যায় না।

হতাশ হয়ে জিপো যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে নিরাশ চোখে কম্বিনেশন চাকতিটার দিকে চেয়ে রইলো।

 ব্লেক বললো, দরজাটাকে কেটে ফেলা যায় না?

এই ক্যারাভ্যানে বসে? অসম্ভব। লোকেরা বাইরে থেকে অ্যাসিটিলিন টর্চের আলো দেখতে পাবে। তাছাড়া কি রকম গরম হবে একবার ভেবে দেখেছে? আর ক্যারাভ্যানে আগুন লাগবার ভয় তো আছেই।

আচ্ছা, ক্যারাভ্যানটাকে যদি পাহাড়ের ওপর নিয়ে যাওয়া যায়? ফ্র্যাঙ্ক বলছিলো, প্রয়োজন হলে ক্যারাভ্যানটাকে আমরা পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাবো। মনে হচ্ছে এখন এ ছাড়া আর উপায় নেই। সেখানে তুমি ক্যারাভ্যানের দরজা খোলা রেখেই নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবে। কি বলল?

জিপো রুমাল বের করে ক্ষতস্থানে চেপে ধরলো, আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। অর্থনয়। এবার আমি বাড়ি ফিরতে চাই। এ হতচ্ছাড়া তালাকে কেউই শায়েস্তা করতে পারবেনা।

ব্রেক শ্লেষের সুরে, ঠিক আছে। ওদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক। কিন্তু তোমার সাহস গেলো কোথায়? এই ট্রাকের ভেতরে রয়েছে দশ লক্ষ ডলার। একবার ভালো করে ভেবে দেখো, জিপো।

জিপোর গলা উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলো, ঢের ভেবে দেখেছি। দশ লাখ কেন, দশ কোটি হলেও এর মধ্যে আমি আর নেই। বার বার তো বলছি, তুমি কি সহজ কথাও বোঝা না?

নামো, অনেক হয়েছে। আগে ওদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে দেখি।

ওদিকে জিনি আর কিটসন কেনাকাটা করে বুইক চালিয়ে ফিরছে। ওরা জানে না ক্যারাভ্যানের নাটকের কথা।

স্থানীয় দোকান থেকে খাবার জিনিসপত্র কেনায় যে বিপদের সম্ভাবনা আছে, সেটা জিনি বুঝতে পেরেছিলো কারণ দোকানদার খাবারের পরিমাণ দেখেই বুঝবে এ খাবার স্বামী–স্ত্রীর প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। তখন হয়তো ব্লেকও জিপোর উপস্থিতি সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। তাই ওরা ঠিক করেছিলো, রোজকার কেনাকাটা ওরা শহরে গিয়েই নিশ্চিন্তে সেরে আসবে।

কিটসন ও জিনি গত দুদিন ধরে পরস্পরকে সঙ্গদান করেছে এবং মনের কাছাকাছি এসেছে।

নিজের অংশের টাকা পাওয়ার পরও কিটসনের সঙ্গিনী হবে কিনা, এ নিয়ে জিনি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছে। ও জানে কিটসন ওকে ভালবাসে। ক্রমে জিনিও কিটসনকে ভালবাসতে লেগেছে। কারণ ব্লেকের মতো কিটসনের ব্যবহার রুক্ষ বা অভদ্র নয়। বরং কিটসনের সান্নিধ্য ওকে দেয় নিরাপত্তার ইঙ্গিত।

ফন হ্রদ অভিমুখে ওরা গাড়ি ছুটিয়ে চলেছে। জিনি থেকে থেকেই আড়চোখে কিটসনকে দেখছে। ওর হঠাৎই ভীষণ ইচ্ছে হলো আলেক্সকে সব কথা খুলে বলে, যেকথা সে বারবারই জানতে চেয়েছে, কিন্তু জবাব পায় নি।

আলেক্স… ।

জিনির দিকে এক পলক তাকিয়ে কিটসন সামনের রাস্তায় চোখ রাখলো।

 কি ব্যাপার? কিছু বলবে?

হা–একদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে কি করে এই ট্রাকের খবর আমি পেলাম, তাইতো?

 হা।

তুমি কি এখনও তা জানতে চাও, আলেক্স?

আমতা আমতা করে কিটসন জবাব দিলো, না–মানে আমার এমনিই মনে হয়েছিলো। তাছাড়া তোমারব্যক্তিগতব্যাপারেআমারনাক গলানোউচিত হয়নি। …কিন্তু এখন আবার তোমার একথা মনে হলো কেন?

তুমি আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করেছে আলেক্স। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমার কাছে অসহ্য বিরক্তিকর হয়ে উঠতো। কিন্তু তোমার মার্জিত ভদ্ৰব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই আমার সবকথাআমি তোমাকে খুলে বলতে চাই। …আলেক্স, এরআগে আমি অন্য কোনোদলের হয়ে কখনো কাজ করিনি

কিটসন মাথা নাড়লো, আমি তো কখনো তা ভাবিনি।

তুমি ভাবোনি। কিন্তু মরগ্যান ভাবতো। সে ভাবত, আমি অন্য কোনো দলের কাছ থেকে ট্রাক লুঠের মতলবটা চুরি করে বেশি বখরার লোভে তোমাদের দলে এসে যোগ দিয়েছি। সে মুখে কখনোনা। কিছু প্রকাশ না করলেও আমি জানতাম মরগ্যান আমাকে কি ভাবছে।

কিটসন অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে বসলো। কারণ সে জানে জিনির ধারণা বর্ণে বর্ণে সত্যি। সত্যিই মরগ্যান তাই ভাবতো।

কি জানি। হতে পারে। তবে আমি কখনো ভাবিনি। তুমি আগে অন্য দলের হয়ে কাজ করেছে?

আমি ঐ ট্রাক এবং দশ লক্ষ ডলারের কথা জানতে পারি আমার বাবার কাছে। আমার বাবা ছিলেন রিসার্চ স্টেশনের প্রহরী।

কিটসন জিনির দিকে ফিরে, তাই না কি? তবে তো সবই তোমার জানা থাকার কথা।

মনে কোরো না আমি নিজেকে সতীসাধ্বী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। আমার মায়ের স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো ছিলো না। তার কিছু কিছু–দোষ আমিও যে পাইনি তা নয়। আমার বয়স দশ বছর যখন, মা তখন বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। মা সর্বদাই আমাকে বলতো, টাকা ছাড়া দুনিয়া ফাঁকা।

কিটসন গাড়ির গতি কমিয়ে একমনে জিনির কথা শুনছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় গোলাকা ররক্তাক্ত সূর্য যেন শেষবারের মতো খুশীর আবীর ওদের মনে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

আগ্রহের সুরে কিটসন, শোনো, জিনি। তুমি আর আমি একাজ ছেড়ে দেবো। কি, রাজি? আমরা .. মেক্সিকোয় চলে যাবো। এখনো বাঁচার সময় আছে, জিনি। একবার ভেবে দেখো

না। এখন আর হয় না। টমাস ও ডার্কসনকে খুন করার আগে একথা ভাবা উচিত ছিলো। ভাবা উচিত ছিলো মরগ্যান মারা যাবার আগে। এখন এর শেষ দেখা ছাড়া আমার উপায় নেই, আলেক্স। কিন্তু ইচ্ছে হলেতুমি ছেড়ে দিতে পারো। তুমি ছেড়ে দিলে আমি অন্তত খুশী হবো। আমার জন্য তুমি ভেবো না। আমার মনে হয় দশ লাখ ডলার পাওয়ার আশা এখনো নিঃশেষিত হয় নি। তাছাড়া, আমি এখন চরম সীমায় এসে পৌঁছেছি। এর চেয়ে বেশি ক্ষতি আমার আর কিই বা হবে? কিন্তু তুমি ছেড়ে দাও, আলেক্স। তুমি কেন এর মধ্যে এলে? তুমি তো মন থেকে এ কাজে সায় দাও নি। আমি জানি তুমি কেন আমাদের হয়ে ভোট দিলে, আলেক্স?

একমাত্র তোমার জন্য। যবে থেকে তোমাকে দেখেছি, আমি আমার মন–প্রাণ সব হারিয়ে বসে আছি।

আলেক্স। আমি দুঃখিত। …দুঃখিত।

আচ্ছা জিনি, টাকাটা পাওয়ার পর আমরা পরস্পরের সঙ্গী হলে কেমন হয়? একদৃষ্টে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো কিটসন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, জিনি। তোমার আগে কোনোদিন এমন করে ভালো লাগেনি।

কি জানি…হয়তো তাই। যে কোনো জটিলতাকে আমি ভয় করি। তুমি যদি আমাকে কয়েকদিন সময় দাও, তাহলে ভাল হয়। কিটসনের আনন্দ আর বাঁধ মানতে চাইছে না।

তার মানে তার মানে, তুমি…

 হ্যাঁ, আলেক্স কিটসনের হাত হাতে বোলালো জিনি, আমাকে ভাববার সময় দাও।

 খুশীতে তার মন ধরে না, জিনি যে তার প্রস্তাবে সম্মত হবে ভাবতে পারেনি।

একেবারে নির্জন হ্রদের কাছটা। সুতরাং ব্লেক ও জিপোর বাইরে আসার কোনো ভয় নেই।

ক্যারাভ্যান থেকে দুজন বেরোলো, কিটসন বুঝলো কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। দেখলো তার ডান গালে লম্বা ক্ষত; এবং অল্প রক্ত বেরোচ্ছে।

কিটসন জানতে চাইলে, জিপো জবাব দিলো না। কেবিনে ঢুকে ধপ করে বসে পড়লো।

বিষণ্ণমুখে ব্লেক সোফায় গিয়ে বসলো। চোখে কুৎসিত দ্যুতি। হাত বাড়িয়ে হুইস্কির গেলাসতুলে নিলো সে। কিছুটা খাওয়ার পর গা এলিয়ে দিলো সোফায়।

ক্যারাভ্যানের কাছে একটা বাচ্চা ছেলে ঘুরঘুর করছিলো, ব্লেক কিটসনকে বললো। কিটসন কেবিনের দরজা বন্ধ করে তালা এঁটে দিচ্ছে, ছোঁড়াটা ভেতরটাও দেখবার চেষ্টা করছিলো।

প্রশ্ন করলো জিনি, কিন্তু ট্রাকের তালার কি হলো?

কিছু হয় নি। জিনির দিকে তাকিয়ে বলে চললো সে, দ্বিতীয় কম্বিনেশন নম্বরটা মেলার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া জিপোও প্রকৃতিস্থ নেই।

প্রকৃতিস্থ? জিপো চিৎকার করে উঠলো। আমি এসব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাচ্ছি! এতালা খোলা আমার কর্ম নয়! তোমার কানে ঢুকেছে? আমি এর মধ্যে নেই!

জবাব দিলো জিনি, এখন আর তা হয় না, জিপো। ..কিন্তু ব্যাপারটা কি খুলে বলো তো?

এই প্রচণ্ড গরমে ক্যারাভ্যানের ভেতরে কাজ করা সাধ্যনয়। কি যে গরম তা তুমি বুঝতে পারবে না। তিনদিন ধরে ঐ তালার পেছনে লেগে আছি, কিন্তু কোনো ফল হয় নি। সুতরাং এর পিছনে আমি আর নেই।

ফ্রাঙ্ককে তুমি বলেছিলে তালাটা খুলতে মাসখানেক লাগবে। কিন্তু তিনদিনের চেষ্টায় তুমি হাল ছেড়ে দিতে চাও?

যাকগে, ওকে ঘাঁটিয়ো না। জিনিকে বললো ব্লেক, সকাল থেকে একই কথা নিয়ে বকরবকর করে আমি হন্যে হয়ে গেছি। তবে সত্যি ক্যারাভ্যানের ভেতর বীভৎস গরম–ঐ গরমে কাজ করা যায় না। মনে হয় শেষ পর্যন্ত হয়তো ফ্র্যাঙ্কের কথামতো আমাদের পাহাড়ের দিকে যেতে হবে। ঐ নির্জন জায়গায় ক্যারাভ্যানের পেছনটা খোলা রেখেই কাজ করতে পারবো। নইলে এভাবে কাজ করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

চিন্তিত মনে জিনি বললো, কিন্তু পাহাড়ের ওপরে ওঠাতে বিপদের সম্ভাবনাও প্রচুর। এখানে কয়েক শো ক্যারাভ্যানের মধ্যে অতি সহজেই আমরা গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারি, কিন্তু ঐ নির্জন পাহাড়ী এলাকায় আমাদের সন্দেহ করতে বাধ্য।

অধৈর্যভাবে ব্লেক বললো, কিন্তু সে ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আমাদের আর তো উপায় নেই। জিপো যদি একান্তই ঐ তালা খুলতে না পারে, তাহলে বাধ্য হয়েই আমাদের হয়তো অ্যাসিটিলিন টর্চ ব্যবহার করতে হবে এবং সেটা এই ফন হ্রদ এলাকায় বসে করা সম্ভব নয়।

কিটসন অস্বস্তিভরে বললো, পুলিশ এখনো প্রতিটি রাস্তায় টহল দিচ্ছে। রাস্তায় তারা আমাদের বাধাদিতে পারে এড । তাছাড়া আরো একটা অসুবিধে আছে। বুইকটা অলোভরী ক্যারাভ্যানটাকে নিয়ে। পাহাড়ী রাস্তায় উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ। ঢালু তো আছেই তার ওপর এবড়ো থেবড়ো–কিছুদিন আগে রাস্তার কিছু অংশ ঝড়ে ভেঙ্গে গেছে বলে শুনেছি।

আমাদের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই, আলেক্স। এঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। আগামীকাল দুপুরে—যদি আমরা রওনা হই তাহলে সন্ধ্যে নাগাদ আমরা পাহাড়ী রাস্তায় পৌঁছে যাবে। কিন্তু আমাদের একটা তাঁবু ও কিছু খাবারের প্রয়োজন। অর্থাৎ জিপো ট্রাকের তালা না খোলা পর্যন্ত আমাদের বেশ কষ্ট করেই দিন কাটাতে হবে।

জিপো ভয়ঙ্কর স্বরে, আমি থাকছিনা, এড। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো ব্লেক, এমন সময় দরজায় টোকা মারার শব্দ শোনা গেলো।

উৎকণ্ঠাময় নিস্তব্ধতার পর রিভলবার উঁচিয়ে ধরে ব্লেক আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।

বিবর্ণমুখে জিপো সামনে ঝুঁকে কিছু দেখতে চেষ্টা করলো।

চাপা উত্তেজিত স্বরে ফিসফিসিয়ে জিনি, লুকিয়ে পড়ো। যাও, শীগগির তোমরা শোবার ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ো। 

জিপোর হাত ধরে টেনে ব্লেক শোবার ঘরে নিয়ে গেল। কিটসন দুরুদুরু বুকে কেবিনের দরজা খুললো।

ফ্রেড ব্র্যাডফোর্ড দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে।

এই যে, মিঃ হ্যারিসন। অসময়ে বিরক্ত করলাম বলে মাপ চাইছি। মিসেস হ্যারিসন কোথায়? রান্নাঘরে বুঝি?

কিটসন দরজাটা পুরোপুরি আগলে দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?

 সামান্যই। চলুন, ভেতরে গিয়ে বসি। বেশিক্ষণ আপনাকে আটকাবো না।

জিনি কিটসনকে ইতস্ততঃ করতে দেখে এগিয়ে এসে, আরে মিঃ ব্র্যাডফোর্ড যে! হঠাৎ কি মনে করে? …আসুন–ভেতরে আসুন। হেসে ব্র্যাডফোর্ডকে অভ্যর্থনা জানালো জিনি।

ঘরে এসে ঢুকলো ব্র্যাডফোর্ড। তাকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো। 

কি খাবেন? হুইস্কি না জিন?

ধন্যবাদ। এখনই ঠিক ভালো লাগছেনা। ব্রাডফোর্ড বসলো। শুধু–শুধু আপনাদের দেরি করাবো না, মিঃ হ্যারিসন। আমার ছেলে বিকেলে হ্রদের কাছে ঘোরাফেরা করছিলো। ও বলছে, আপনাদের ক্যারাভ্যানের ভেতরে নাকি দুজন লোক ছিল। সে তাকালো জিনির দিকে। ব্র্যাডফোর্ডের কথার কি উত্তর দেবে ভেবে পেলোনা।

জিনি জবাব দিলো, হাসলো ব্র্যাডফোর্ডের দিকে চেয়ে, তারা পরিচিত লোক, মিঃ ব্র্যাডফোর্ড। আমরা বলেছিলাম; ছুটি কাটানোর জন্য ক্যারাভ্যানটা তাদের ব্যবহার করতে দেবো। হয়তো আমরা যখন বাইরে ছিলাম, তখন হয়তো এসেছিলো ক্যারাভ্যানটা ঘুরেফিরে দেখতে।

সংশয়ের ছায়াটা মিলিয়ে গেলো ব্রাডফোর্ডের। আমি তাই বলছিলাম, কিন্তু কে শোনেকার কথা! ও ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বলছে, লোক দুটো চিৎকার করে বিশ্রীভাবে ঝগড়া করছিলো। বাচ্চা তো, তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ও ভেবেছে কোনো ডাকাত–টাকাত হবে।

হাসলো জিনি, না, ডাকাত না হলেও ঐ দুজনের স্বভাব–চরিত্র তেমন ভালো নয়। আমি তোওদের একটুও বিশ্বাস করিনা। দিনরাতই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে! … কিন্তু বেড়াতে যাবার সময় দুজনেই হরিহর আত্মা!

কিন্তু আমার ছেলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। তাই ভাবলাম ব্যাপারটা জানিয়েই যাই। বলা যায় না কীহয়ে যায়; জানেন, এই হ্রদে বেশ কয়েকবার ডাকাতি হয়েছে! যখন পরিচিত লোক বলছেন, তখন আর…

চিন্তার কিছু নেই।

না, না, ব্যস্ত হবেন না। ভুরু কোচকালো ব্র্যাডফোর্ড, যাক, আপনাদের সময় নষ্ট করবোনা, মিসেস হ্যারিসন, এখন চলি। বাচ্চা ছেলে তো, সবকিছুতেই রহস্যের গন্ধ পায়। এই যে কাগজে ট্রাক লোপাটের খবর দিয়েছে, সেটা পড়ে কি ভাবছে জানেন? বলছে, ট্রাকটা কোথায় লুকানো আছে তা ও ধরে ফেলেছে। ট্রাকটাকে নাকি লুঠেরা ক্যারাভ্যানে লুকিয়ে রেখেছে..বুঝুন কাণ্ড! হাঃহাঃহাঃ।

এই কথা শুনে কিটসনের মাথায় যেন বাজ পড়লো। সে চটপট টান হয়ে দাঁড়ালো।

সে বলে উঠলো, এমন ধারণা তার কেমন করে হলো? তবে মিঃ ব্র্যাডফোর্ড, আপনার ছেলের কল্পনাশক্তির তুলনা নেই!

তা সত্যি বলেছে। ও আমাকে বলছে, পুলিশের কাছে গিয়ে জানাতে। ও ভাবছে, যদি ট্রাকটাকে কোনো ক্যারাভ্যানের ভেতরে লুকানো অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে পুরস্কারের টাকাটা সেই পাবে। কাগজে দেখেছেন, পুরস্কারের টাকাটা বাড়িয়ে পাঁচ হাজার করে দেওয়া হয়েছে! নাঃ, টাকার পরিমাণটা নেহাত কম নয়।

জিনি বললো, পুরস্কারের টাকাটা পুলিশ ওকে দেবে বলে তো মনে হয় না। আপনার কি মনেহয়? । শেষে বাচ্চা ছেলে বলে ঠকাবে না তো?

ব্র্যাডফোর্ড ইতস্ততঃ করে বললো হা তা বলতে পারেন। আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। পুলিশে খবর দেওয়া উচিত হবে কিনা। তবে ছোঁড়াটা কিছু না কিছুর সন্ধান পেয়েছেই। অবশ্য পুলিস এসব কথাকে বিশেষ পাত্তা দেবেনা।

আপনারও তো একটা ক্যারাভ্যান আছে, মিঃব্রা ডফোর্ড, তাইনা? পুলিশ যদি ট্রাক লুটের ব্যাপারে আপনাকেই সন্দেহ করে বসে, তবে আমি কিন্তু অবাক হবো না। শেষে হয়তো আপনার ক্যারাভ্যান নিয়েই ওরা টানাটানি করবে। …জানেন, একবার আমার বাবারও অমনি হয়েছিলো। তিনি কতগুলো মুক্তো পেয়ে থানায় জমা দিতে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কিছু পুরস্কার পাওয়া যাবে, কিন্তু পুলিশ। উল্টে তাকেই গ্রেপ্তার করলো। তারপর মাসখানেক কোর্টকাছারি করার পর তিনি ছাড়া পান। তারপর থেকে বাবা ভুলেও কোনদিন পুরস্কারের কথা উচ্চারণও করেন নি।

 ব্র্যাডফোর্ড বিস্ফারিত চোখে, বলেন কি? আমি তো এদিকটা একেবারেই ভাবি নি। না ম্যাডাম, আমি আর ওর মধ্যে নেই। ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। শখ করে জেলে যাওয়ার সাধ আমার নেই।

উঠে দাঁড়ালো ব্র্যাডফোর্ড।

জিনি হেসে, এই বোধহয় আমাদের শেষ দেখা, মিঃ ব্র্যাডফোর্ড। কারণ কালই আমরা চলে যাচ্ছি।

তাই নাকি! কেন, ফন হ্রদ বুঝি আপনাদের ভালো লাগলো না। আমার কিন্তু জায়গাটা বেশ লাগে–খোলামেলা, সুন্দর ।

না, আমাদেরও ভালোই লেগেছে, তবে আরো অনেক জায়গায় তো বেড়াবার কথা আছে, তাই। এবারে আমরা যাবো স্ট্যাগ হ্রদের দিকে। তারপর ডিয়ার হ্রদে বেড়াতে যাবো।

তাহলে তো আপনাদের বিরাট পরিকল্পনা রয়েছে দেখছি। যা আপনাদের দিনগুলি সুখেকাটুক কামনা করি। জিনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দরজার কাছে গিয়েও কথা বলছে। তখন তো কিটসন অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

ব্র্যাডফোর্ড মিনিটদশেকপরে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। জিনিদরজাবন্ধকরেতালা এঁটে দিলো। তাহলে আর দ্বিতীয় কোনো চিন্তার অবকাশ নেই। আমাদের চলে যেতেই হবে।

চিন্তিত মুখে কিটসন, হা, তাছাড়া উপায় নেই। কিন্তু তুমি যেভাবে ব্র্যাডফোর্ডকে বোকা বানালে, সত্যি তোমার তুলনা নেই।

ব্লেক শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। থাক, থাক—অনেক হয়েছে। অত বেশি উচ্ছ্বাসের দরকার নেই, আলেক্স। ও বোধ হয় আমাদের গলা শুনতে পেয়েছিলো। তাহলে কালই আমরা রওনা দিচ্ছি। নইলে ওই ছোঁড়াটা আর কোন গণ্ডগোল বাধিয়ে বসতে পারে। আলেক্স, তুমি বরং ক্যারাভ্যানে গিয়ে থাকো। বলা যায় না, ঐ হতচ্ছাড়া ছোঁড়াটা হয়তো রাতের অন্ধকারে এসে ক্যারাভ্যানের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে।

সম্মতি জানিয়ে কিটসন দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো।

নির্লিপ্তসুরে জিপো বললো, আগামীকাল আমি বাড়ি যাচ্ছি। বুঝেছো? অনেক সহ্য করেছি..আর নয়। আমি শুতে চললাম।

জিপো শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

ব্লেক ক্রোধভরে, কালই শালাকে ঢিট করবো। তখন থেকে ওর বকবকানি শুনে আমি হদ্দ হয়ে গেছি।

রাতের খাবার তৈরীকরতে জিনি রান্নাঘরে চলে গেল।

ব্লেক রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, ব্র্যাডফোর্ডকে তুমি বেশ কায়দা করে বোকা বানিয়েছে। জিনি–তোমার বুদ্ধি আছে। …কিন্তু আমার প্রস্তাব সম্বন্ধে তুমি কিছু ভেবেছো? আপত্তির তো কিছু নেই–তুমি রাজি তো?

জিনি ব্লেকের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো, তুমি যদি পৃথিবীর শেষপুরুষও হও, তবুও তোমার সম্পর্কে আমি কৌতূহলী হবো না।

আচ্ছা সময় এলেই দেখা যাবে, হাসতে হাসতে ব্লেক আরামকেদারায় গিয়ে বসলো।

কিটসন পরদিন খুব ভোরে গাড়ি নিয়ে শহরের দিকে গেলো। জিনি ক্যারাভ্যানের পাহারায় রইলো। ব্লেক ও জিপো তখন কেবিনে।

জিপোর মানসিক অবস্থা এতোই চরমে পৌঁছেছে যে শেষ পর্যন্ত কিটসন ও ব্লেক তাকে খাটের সঙ্গে বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে দিতে বাধ্য হয়েছে।

জিপোকে বাঁধা হয়ে গেলে ব্লেক ইশারা করেছে কিটসনকে, তুমি যাও। ওকে আমি দেখছি। কি করে ওর মত বদলাতে হয় দেখছি। ফিরে এসেই হয়তো শুনবে জিপো রাজী।

জিপোকে ঐ ভাবে ছেড়ে যেতে কিটসনের কষ্ট হলেও জিপোর সাহায্য ছাড়া তো ট্রাকের তালা খোলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর জিপো বেহেড হয়ে পড়ায়, ওকে সামলানোর দায়িত্ব ব্লেকনিয়েছে।

কিটসন শহরে গিয়ে একটা বড়সড় তাবুও প্রচুর খাবার কিনলো। কারণ পাহাড়ী অঞ্চলে গেলে রোজকার কেনাকাটা করা যেমন অসম্ভব তেমনি বিপজ্জনক।

 কিটসন ফিরে এলে জিনি তার কাছে এগিয়ে এলো।

কিটসন বললো, কোনো গণ্ডগোল হয়নি তো?

না। কিন্তু তুমি ফিরে আসাতে আমি খুশী হয়েছি। তখন থেকে ঐ ছেলেটার কথাই ভাবছি। যতো তাড়াতাড়ি সরে পড়তে পারি ততোই ভালো।

দুজনে কেবিনে এসে ঢুকলো।

জিপো আরাম কেদারায় বসে, মুখ শুকনো। কোটরগত চোখে কালি। ব্লেক উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছে হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

সব ঠিকমতো হয়েছে?

 হা–জিনিষপত্র সবই ঠিকমত কিনেছি।

জিপোর মত বদলেছে?

গম্ভীর ভাবে কিটসনের প্রশ্নের জবাব দিলো ব্লেক, ওর সঙ্গে আমার খোলাখুলি কথা হয়েছে, ও ট্রাকের তালা খুলতে রাজী হয়েছে।

জিপো প্রতিবাদ করলো, তোমরা আমাকে দিয়ে গায়ের জোরে কাজ করিয়ে নিতে চাইছো। এর ফল ভালো হবে না। একথা আগেও বলেছি–এখনও বলছি। আলেক্স, তুমি আমার বন্ধু ছিলে। হু বন্ধুই বটে। তুমি আমার কাছে আর এসো না। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ।

 কিটসন ব্লেকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কি হয়েছে? ব্যাপার কি, এড?

ওর সঙ্গে একটু খারাপ ব্যবহার করতে হয়েছে। ও আমাদের ট্রাকের তালা খোলার ব্যবস্থা না করলে যে ভীষণ বিপদে পড়বে সেটা ওকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি।

জিপো চাপা স্বরে কিটসনকে বোঝাতে চাইলো, এডবলছে ট্রাকের তালা না খুললেও আমার হাত ভেঙ্গে দেবে। হাত ছাড়া কোনো মানুষ বাঁচতে পারে?

কিটসন কিছু বলতে যাচ্ছিলো ব্লেক মাথা নেড়ে ইশারা করতেই চুপ হয়ে গেলো।

 চলো, যাওয়া যাক। দেখো তো, বাইরে কেউ আছে কি না।

 কিটসন ও জিনি বাইরে এসে দেখলো সামনা সামনি কেউ নেই তবে হ্রদে নৌকোর আনাগোনা।

কিটসন ক্যারাভ্যানটা বুইকের সঙ্গে জুড়িয়ে কেবিনের দরজার সামনে চালিয়ে নিয়ে এলো। গাড়ি ঘুরিয়ে ক্যারাভ্যানের পেছনের দরজা কেবিনের মুখোমুখি রাখলো।

এড, তোমরা প্রস্তুত?

কিটসন ক্যারাভ্যানের দরজা খুলতেই ব্লেক আর জিপো চটপট ঢুকে পড়লো ভেতরে। কিটসন। দরজা বন্ধ করে দিলো।

কিটসন জিনির হাতে মানিব্যাগটা দিয়ে, আমি এখানেই আছি। তুমি বরং হিসেব পত্তরটা চুকিয়ে এসো।

কিটসন ক্যারাভ্যানের গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে জিনির ফেরার অপেক্ষায় রইলো। কিটসন ভাবছে–এখন তারা যাবে সম্পূর্ণ খোলা জায়গায়–যেখানে নেই অজস্র ক্যারাভ্যানের আড়াল। এ যেন বিপদকে ডেকে আনা। কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায়ও নেই।

এই যে, শুনুন।

কিটসন চমকে দেখলো একটা বাচ্চা ছেলে তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে। পরনে সুতীর প্যান্ট। সাদা ডোরাকাটা জামা। মাথায় একটা শোলার টুপি।

কি ব্যাপার

 আমার বাবা আপনাকে চেনে। আমি ফ্রেড ব্র্যাডফোর্ড, জুনিয়র।

 তাই নাকি?

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে। তারপর ক্যারাভ্যানের দিকে।

এটা আপনার?

হা।

ছেলেটা গম্ভীরভাবে বললো, এটার চেয়ে আমাদেরটা অনেক ভাল।

কিটসন এই সময়ে মনেপ্রাণে জিনিকে চাইলো, কি করছে এতক্ষণ জিনি।

এবার ছেলেটা উবু হয়ে মাটিতে ঝুঁকে পড়লো। ঘাড় কাত করে ক্যারাভ্যানের তলাটা দেখতে চেষ্টা করলো।

ওরেব্বাপ! আপনাদের ক্যারাভ্যানের তলাটা দেখি লোহার চাদরে মোড়া। এত লোহা দিয়েছেন কেন? শুধু শুধু এটার ওজন বাড়ছে, তাই না?

কি জানি, জানি না। যখন এটা কিনেছি, এরকমই ছিলো।

বাবা বলছিলো, গতকাল আপনাদের দুজন বন্ধু এর মধ্যে ছিলো, সত্যি?

হা।

কিন্তু ওদের মধ্যে একটা গোলমাল আছে।

না তো

 হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে কিছু একটা হয়েছিলো, নয়তো ওরকমভাবে ঝগড়া করছিলো কেন?

 ওরা সবসময়ই ওরকম ঝগড়া করে –ও কিছু নয়।

 ছেলেটা কয়েক পা পিছিয়ে ক্যারাভ্যানকে ভালো করে দেখতে লাগলো।

এর ভেতরটা আমাকে একবার দেখতে দেবেন?

কিটসনের স্বর ঈষৎ উত্তপ্ত, ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। কারণ চাবিটা আমার স্ত্রীর কাছে।

আমার বাবা কিন্তু মাকে কখখনো চাবি রাখতে দেয় না। মা সবসময় চাবি হারিয়ে ফেলে।

আমার স্ত্রী চাবি–টাবি খুব সাবধানে রাখে। কখনো হারায় না।

ছেলেটা আবার মাটিতে উবু হয়ে বসে সবুজ ঘাসগুলো দুহাতে ছিঁড়তে লাগলো।

 আপনার বন্ধুরা কি এখনো এর মধ্যেই আছে?

না

তাহলে কোথায় আছে?

বাড়িতে।

 বাড়ি কোথায়?

সেন্ট লরেন্স

তারা তাহলে একসঙ্গেই থাকে?

হা।

কিন্তু ওরা যেরকম বিশ্রীভাবে ঝগড়া করছিলো, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

 বললাম তো, ও কিছুনয়। ওরা সবসময়েই অমনি ঝগড়া করে।

মাথা থেকে টুপিটা খুলে ছেলেটা হাতে নিলো। তারপর সেটাকে ঘাস দিয়ে ভর্তি করলো।

ওদের একজন আর একজনকে কিছু করতে না পারার জন্য গালাগাল দিচ্ছিলো। কি বলছিলো জানেন?

উঁহু

ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো, এখুনি একটা মারপিট বাধিয়ে বসবে—

 ওদের নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। ওদের বন্ধুত্ব অনেকদিনের–অতো সহজে ভাঙবার নয়।

টুপিটায় ঘাস ভর্তি হয়ে গেলে সেটা চেপে মাথায় বসিয়ে দিলো।

হু, শোনো খোকা। তুমি এবার বাড়ি যাও। তোমার বাবা হয়ত তোমাকে খুঁজে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

না, আমি বাবাকে বলেই এসেছি। বলেছি, আমি চুরি যাওয়া ট্রাকটা খুঁজতে বেরোচ্ছি–ঐ যে, যেটা প্রচুর টাকাসুদ্ধ উধাও হয়ে গেছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে বাবা আমার খোঁজ করবে না। আপনি কাগজে ঐ ট্রাক লুঠের খবরটা পড়েছেন?

হ্যাঁ, পড়েছি।

জানেন, আমি কি ভাবছি?

হা–তোমার বাবা আমাকে বলেছে।

বাবার বলা উচিত হয়নি। এভাবে শহরসুদ্ধ লোককে বললে আমি পুরস্কারের টাকাটা পাব কি করে?

সামনের রাস্তা ধরে জিনিকে আসতে দেখলে কিটসন।

ছোট ব্র্যাডফোর্ড বলে চললো, যেকরেই হোক পুরস্কারের টাকাটা আমার চাই। পাঁচ হাজার ডলার। টাকাটা পেলে কি করবো জানেন?

কিটসন মাথা নাড়লল, না তো

বাবাকে আমি ওর একটা পয়সাও দিচ্ছি না–আমি আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছি।

জিনি এলে কিটসন বললো, এই হচ্ছে ব্র্যাডফোর্ড, জুনিয়র।

হেসে জিনি, কেমন আছো?

ছেলেটা পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপনার কাছে কি ক্যারাভ্যানের চাবিটা আছে? ইনি আমাকে বলেছেন, ভেতরটা আমাকে দেখতে দেবেন।

জিনি ও কিটসন পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময় করলো।

আমি দুঃখিত। চাবিটা আমি স্যুটকেসে ভরে ফেলেছি। এখন বের করা খুব মুশকিল।

আপনি নিশ্চয়ই চাবিটা হারিয়ে ফেলেছেন। ঠিক আছে, আমি তাহলে চলি। বাবা বলেছিলো, আপনারা নাকি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন?

হা।

এখুনি?

হা।

আচ্ছা বিদায়। বলে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ছেলেটা শিস দিতে দিতে এগিয়ে চলল।

তোমার কি মনে হয়? ঠিক আছে, চলো। আর দেরি না করে রওনা হওয়া যাক।

 ওরা বুইকে উঠে বসলো।

ওদের গাড়ি ছেড়ে দিতেই ঝোঁপের আড়াল থেকে ছোট ব্র্যাডফোর্ড বেরিয়ে বুইক ও ক্যারাভ্যানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর পকেট থেকে একটা ময়লা নোটবই বের করে পেন্সিল দিয়ে বুইকের লাইসেন্স নম্বরটা নোটবইয়ের পাতায় লিখে নিলো।

.

১০.

 ছটি রাস্তায় ভাগ করা চওড়া বড় সড়কটা এমনিতেই গাড়ির ভিড়ে জমজমাট তার ওপর বেশ কয়েকটা গাড়ি তাদের পেছনে একটা করে ক্যারাভ্যান টেনে নিয়ে চলেছে।

উড়ন্ত হোডার প্লেন থেকে থেকেই মাথার ওপর নেমে আসছে–উড়ে চলেছে প্রধান সড়ক ধরে—যেন চলমান যন্ত্রযানদের প্রত্যেকটিকে সে পরখ করে দেখছে। এবং পরখ করার প্রতিটি মুহূর্তেই কিটসনের বুক দুরুদুরু করে উঠছে।

পুলিশের দল মাঝে মাঝে দু একটা বড়সড় ট্রাকের ঢাকনা খুলে অনুসন্ধান করছে। কিন্তু একটা ক্যারাভ্যানকে ওরা সন্দেহবশে থামালো না হয়তো তাদের ধারণা, অতো ভারী ট্রাকটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ক্যারাভ্যানের মতো হালকা জিনিসের পক্ষে সম্ভব নয়।

তবু ঐ পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ঠিক তিরিশ মাইল বেগে গাড়ি চালানো কঠিন বই কি? কিটসন দুঃসাহসের সঙ্গে গাড়ি চালাতে লাগলো।

ওরা দীর্ঘ ছ ঘণ্টা গাড়ি ছুটিয়ে চললো।

রাস্তায় যখনই তাদের কোনো পুলিসের গাড়িবা মোটরবাইক চোখে পড়েছে, তখনই ওরা আতঙ্কে সিঁটিয়ে উঠেছে।

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ওরা পাহাড়ী রাস্তায় পৌঁছলো।

অন্ধকার নেমে এসেছে, ততক্ষণে কিটসন বিপরীতমুখী বাঁকের প্রথম সারি অনায়াসেই পার হয়ে গেছে।

পথ যতই যেতে লাগলো, গাড়ি চালানো ততই দুরূহ হতে লাগলো। কিটসন জানে, বাঁকের দূরত্ব অনুমানে সামান্যতম ভুলচুক হলেই ক্যারাভ্যান সমেত অতল খাদে গড়িয়ে পড়তে হবে।

কিটসন অনুভব করলো, ক্যারাভ্যানও ট্রাকের পিছুটান বুইকের গতিকে ক্রমশঃ শ্লথ করে তুলছে। অ্যাকসিলারেটরের কাছে তেমন আশা পাচ্ছেনা কিটসন, সে চিন্তিত হয়ে পড়লো। কারণ কিটসন জানে আরো কুড়ি মাইল সেই রুক্ষ্ম ও খাড়াই রাস্তা আরো বিপজ্জনক।

তাপমাত্রা যন্ত্রের দিকে দেখলো কিটসন। চক্রের নির্দেশক ক্ৰমশঃ স্বাভাবিক থেকে উত্তপ্ত অংশের দিকে এগোচ্ছে।

কিটসন জিনিকে জানালো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটা গরম হয়ে পড়বে। ট্রাক ও ক্যারাভ্যানের ওজনের জন্যেই এই অবস্থা হচ্ছে। আমাদের সামনের কুড়ি মাইল রাস্তা মোটামুটি এইরকম–তারপরেই শুরু হবে আসল বিপদ।

কেন, এর চেয়েও খারাপ রাস্তা?

 খারাপ? সেই রাস্তার তুলনায় এ রাস্তা তো বেতপাথরেবাঁধানো। গত সপ্তাহের এক প্রচণ্ড ঝড়ে সেই রাস্তা একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এই রাস্তাটা কেউ কখনো ব্যবহার করেনা। সকলেই ডুকার্সের সুড়ঙ্গ পথটা ধরে যাতায়াত করে।

আরো তিনচার মাইল যাবার পর তাপমাত্রা নির্দেশক ফুটনাঙ্কের ঘরে এসে থামলো। অগত্যা বাধ্য হয়েই কিটসন একসময় রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করালো।

গাড়িটা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা হোক–তারপর আবার চালানো যাবে। কিটসন গাড়ি থেকে নেমে গোটা কয়েকবড় বড় পাথরের টুকরো দিয়ে গাড়ির চাকা আটকে দিলো। জিনি হাতল ঘুরিয়ে ক্যারাভ্যানের দরজা খুলে দিলো।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ব্লেক বললো, কি হলো। থামলে কেন?

 ইঞ্জিন ভীষণ গরম হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা না হলে গাড়ি চালানো যাবেনা।

ব্লেক ক্যারাভ্যান থেকে নেমে বুক ভরে শ্বাস নিলো, হু, আমরা তাহলে অনেকটা পথই এসে পড়েছি। ওপরে পৌঁছতে আর কত বাকি?

প্রায় ষোলো মাইল। খারাপ রাস্তা এখনো সবটাই বাকি।

নির্বিঘ্নে শেষটুকু পার হওয়া যাবে তো?

কি জানি। এই ক্যারাভ্যান ও ট্রাকের ওজন নেহাত কম নয়। শুধু ক্যারাভ্যানটাকে টেনে তোলাই সমস্যা তারপর ট্রাক তো রয়েছেই।

জিনি বললো, এক কাজ করা যাক। ট্রাকটা বের করে চালিয়ে নিয়ে চলো। এখন যথেষ্ট রাত হয়েছে। সুতরাং বিপদের ভয় নেই।

কিটসন জিনির প্রস্তাবে সায় দিয়ে, ট্রাকটাকে ওপরে তোলার এটাই একমাত্র পথ। এবং এ কাজটাও যে খুব একটা সহজ হবে তা নয়।

তাই করা যাক তাহলে কিন্তু কেউ যদি আমাদের দেখে ফেলে তাহলে সর্বনাশের কিছু বাকি থাকবে না।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে জিপো এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো। এবার বললো, কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়? আর কত দূর?

পাহাড়ের একেবারে ওপরে একটা হ্রদ আছে–আর আছে ঘন জঙ্গল। আমরা যদি সেখানে পৌঁছতে পারি, তাহলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, কিটসন বললো।

ব্লেক জিপোকে লক্ষ্য করে খেঁকিয়ে উঠলো, কিন্তু ট্রাকটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে গেলে প্রথমে ব্যাটারির তার দুটোকে আবার লাগিয়ে নাও, জিপো। ভূতের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে একটু কাজের কাজ করো। চটপট করে ব্যাটারির তার দুটোকে লাগাও।

একটা শাবলের সাহায্যে ট্রাকেরবনেট ভেঙে যখন ওরা ব্যাটারীর তার লাগালো, ততক্ষণে বুইকের ইঞ্জিন অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

ব্লেক বললো, বুইকের সঙ্গে ট্রাকটাকে আরো কিছুক্ষণ টেনে নিলে কেমন হয়?

কিটসন বললো, সেটা না করলেই ভালো হয়। কারণ রাস্তার খাড়াই ক্ৰমশঃই বাড়ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর বুইকের ইঞ্জিন আবার গরম হয়ে উঠবে।

ব্লেক কাধ ঝাঁকিয়ে ট্রাকের ভেতরে গিয়ে ইঞ্জিন চালু করে ট্রাকটাকে পেছিয়ে আনতে লাগলো ক্যারাভ্যানের পাটাতন বেয়ে।

সে কিটসনকে বললো, তোমরা আগে আগে বুইক নিয়ে চলো। জিপো আর আমি ট্রাক নিয়ে তোমাদের অনুসরণ করছি। আমি ট্রাকের হেডলাইট জ্বালছি না। তোমাদের গাড়ির পেছনের লাল আলো দেখেই আমি পথ চিনতে পারবো।

কিটসন বুইকে গিয়ে জিনির পাশে বসে ইঞ্জিন চালু করতেই জিনি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ট্রাকটাকে দেখতে চেষ্টা করলো।

ট্রাকের ওজনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বুইকটা সহজ গতিতে চড়াই রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলো।

কিটসন বললো, ওরা ঠিকমতো অনুসরণ করছে তো?

হ্যাঁ। কিন্তু একটু আস্তে চালাও, বাঁক নেওয়ার সময় ওরা বেশ পিছিয়ে পড়ছে।

মিনিট কুড়ি পর ওরা সেই বিধ্বংস অংশের কাছে পৌঁছলো।

হেডলাইট জ্বালিয়ে কিটসন গাড়ি থামালো, তুমি গাড়িতেই থাকো। আমি সামনে গিয়ে রাস্তার অবস্থাটা দেখছি।

ট্রাকের কাছে গিয়ে কিটসন ব্লেককে জানালো সে সামনের রাস্তাটা পরীক্ষা করতে যাচ্ছে।

ওরা বুইকের হেডলাইটের আলোয় দেখলো রাস্তাটা সোজা হয়ে ওপরে উঠে গেছে প্রায় লম্বভাবে। বড় বড় পাথর নুড়ি সব রাস্তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

অবিশ্বাসের সুরে ব্লেক বললো, আরে সর্বনাশ। আমাদের এই রাস্তা বেয়ে উঠতে হবে?

কিটসন মাথা নাড়লো। হ্যাঁ, কাজটা যে কঠিন তাতে সন্দেহ নেই–তবে অসম্ভব নয়। প্রথমে ঐ বড় বড় পাথরগুলো আমাদের সরাতে হবে।

সে গিয়ে ঐ পাথরগুলো ধাক্কা মেরে গড়িয়ে দিতে লাগলো রাস্তার ধারে। সব পাথরগুলো সরাতে ওদের তিনজনের প্রায় আধঘণ্টা লাগলো।

কিটসন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, যাক, মনে হয় এতেই কাজ হবে। এই পর্যন্ত আসতে পারলেই বাকিটা আমরা সহজেই পার হতে পারবো।

ওরা তিনজনে ঢাল বেয়ে নেমে চললোলা দাঁড়িয়ে থাকা বুইকের কাছে।

খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাবে। কিটসন বললো ব্লেককে, আর গাড়িকে প্রথম গীয়ারে রাখবে। হেডলাইট জ্বালাতে ভুলো না যেন। আর একমুহূর্তের জন্যও থামাবেনা। যদি থামো, তাহলে চাকায় জোর পাবেনা।

ঠিক আছে বিরক্ত হয়ে উঠলো ব্লেক, কি করে চালাতে হয় তোমায় শেখাতে হবে না, তুমি তোমার খেয়াল রেখো, আমি আমারটা দেখবো।

ঠিক আছে; এখন বকবক না করে কাজ শুরু করো। কিটসনকে চেঁচিয়ে উঠলো ব্লেক।

 কিটসন এগিয়ে গেলো বুইকের দিকে। উঠে বসলো গাড়িতে।

প্রয়োজনের তুলনায় বুইকের শক্তির কমতি নেই। কিন্তু পেছনে বাধা ক্যারাভ্যানের খালি হলেও সে শক্তি হ্রাসের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আর পেছনের চাকা দুটো বিদ্যুৎবেগে ঘুরতে লাগলো। সেইসঙ্গে পাথরের টুকরো, শুকনো মাটি ছিটকে পড়তে লাগলো দু–পাশে।

জিনি ঝুঁকে বসেছিলো–দৃষ্টি রাস্তার দিকে। পথে বড় পাথর পড়লেই জিনি কিটসনকে সাবধান করে দিচ্ছে।

বুইকের গতি কমে গেছে। স্টিয়ারিং শক্ত হাতে চেপে অভিসম্পাত করছে কিটসন। আর অনুভব করছেগাড়ির প্রচণ্ডকাপুনি। এইভাবে সেইসরুরাস্তায় একবার ডানদিকে, একবারবাঁদিককরেদক্ষতার সঙ্গে রাস্তার ধার বাঁচিয়ে বুইক নিয়ে এগিয়ে চললো।

রেডিয়েটরের জল কমায়, গাড়ির ভেতরটাও গরম হয়ে উঠেছে।

হেডলাইটের আলোয় চোখে পড়লো স্বাভাবিক রাস্তা।

ওঃ, আর একটু! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো জিনি। আমরা প্রায় এসে গেছি!

গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করালো কিটসন।

যাক, আমরা তাহলে শেষ পর্যন্ত পেরেছি। কিটসন সাফল্যের হাসি হাসলো, ওফ, আমি তো ভাবলাম বোধহয় হয়ে গেলো।

তোমার কৃতিত্ব আছে, আলেক্স। এমনভাবে গাড়ি চালানো সোজা ব্যাপার নয়!

এইভাবে আধ ঘণ্টা ধরে চললো ট্রাক চালানোর কাজ। কিটসনহ্যাঁচকা মেরে একটু একটু করে এগোয় আর ব্লেক ও জিপো এসে পাথরের সাহায্যে ট্রাকের পতন রোধ করে।

অবশেষে ওরা বুইকের পঞ্চাশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেলো। কিন্তু সবাই ক্লান্তহয়ে পড়েছে। তাই ব্লেক বিরতির প্রস্তাব করলো।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কিটসনের মনে হলো ট্রাকের ইঞ্জিন যথেষ্ট ঠাণ্ডা হয়েছে, তখন ব্লেককে ডাকলো, উঠে বসলো ট্রাকে।

দশ মিনিট পরে ট্রাকটাকে দেখা গেলো বুইকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।

এখন এটাকে ক্যারাভ্যানে ভরে ফেলা যেতে পারে। কিটসন বললো, বুইকের যখন টানতে অসুবিধা হবে না তখন ট্রাকটাকে আড়ালে রাখাই ভালো।

সে ট্রাকটাকে চালিয়ে ঢুকিয়ে দিলো ক্যারাভ্যানের ভেতরে। ব্লেক আর জিপোও একই সঙ্গে ক্যারাভ্যানে আশ্রয় নিলো।

ক্যারাভ্যানের দরজা বন্ধ করে কিটসন বুইকের কাছে এগিয়ে গেলো। স্টিয়ারিং ধরে বসলো চালকের আসনে জিনির পাশে।

তোমার দক্ষতায় আমি অবাক আলেক্স। তুমি না থাকলে এ রাস্তা পার হতে পারতাম না।

জিনি ঝুঁকে এলো, ওর উষ্ণ ঠোঁট আলতোভাবে কিটসনের গাল স্পর্শ করলো।

.

ব্লেকের ঘুম ভাঙলো তাবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা সূর্যের আলোতে। চোখ খুলে ওপরের ঢালু ক্যাম্বিসের ছাদের দিকে তাকিয়েই কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল সে কোথায় আছে ভাবতে।

ব্লেক চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো সারা শরীরে ক্লান্তির অবসাদ। ভুরু কুঁচকে সে পরিস্থিতি অনুমান করার চেষ্টা করলো।

অন্ততঃপক্ষে লুকোবার জন্য একটা ভালো জায়গা পেয়েছে ওরা। যদি কপাল ভালো থাকে জিপো ট্রাক না খোলা পর্যন্ত ওরা বেশ নিরাপদেই এখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে।

একটা ঝরনা রয়েছে কাছাকাছি জলের অভাব নেই। তাছাড়া ঘন জঙ্গলে তাদের আড়াল করে রেখেছে। উড়ন্ত কোনো বায়ুযান যে তাদের দেখবে সে সম্ভাবনাও কম। আর প্রায় পাঁচশো গজ দূরে রয়েছে বড় রাস্তা থেকে।

এই বিধ্বস্ত রাস্তা বেয়ে যে ট্রাকটাকে আনা সম্ভব এটা কেউ বিশ্বাসই করবে না। তাই ট্রাকের খোঁজে এখানে কেউ আসার সম্ভাবনা কম।

জিপো যদি এমনিতে তালা খুলতে না পারে, তাহলে বাধ্য হয়েই তাদের অ্যাসিটিলিন টর্চ ব্যবহার করতে হবে।

ব্লেক চোখ খুলে দেখলো ঘড়িতে ছটা পাঁচ বাজে। এবার মাথা তুলে শুয়ে থাকা জিনির দিকে দেখলো। একটা কোটকে ভাজ করে মাথায় দিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ ও।

জিনি ও ব্লেকের মাঝখানে কিটসন শুয়েছে–গভীর ঘুমে অসাড়।

তাবুর ভেতরে জায়গা কম হলেও ওরা কোনোরকমে শুয়েছে। কারণ বাইরে অসহ্য ঠাণ্ডা।

 এবার সে জিপোর দিকে চোখ ফেরালো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ব্লেক লাফ দিয়ে উঠে বসলো।

তাবুতে জিপো নেই।

ব্লেক ভাবলো হয়ত জিপো বাইরে প্রাতঃরাশ তৈরী করছে। কিন্তু তাকে নিশ্চিত হতে হবে। তাই কিটসনকে পা দিয়ে এক ধাক্কা দিলো। কিটসনের ঘুম ভাঙতেই, শীগগির ওঠো। জিপো এর মধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমাদের আজ প্রচুর কাজ।

কিটসন হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলো। তার অবস্থান তাবুর চেয়ে কাছাকাছি হওয়ায় সেই প্রথম হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এলো।

কিটসনের পরেই ব্লেক বাইরে এলো। ইতিমধ্যে জিনির ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো।

কিটসন চারপাশে তাকিয়ে, বললো, জিপো কোথায়?

 ব্লেক দুহাতে মুখ আড়াল করে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করলো, জিপো–ও–ও

কিটস ও ব্লেক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। ব্লেক বললো, হতভাগাটা আমাদের ছেড়ে সরে পড়েছে। মনে হয় পালিয়েছে। ওর ওপর আমাদের নজর রাখা উচিত ছিলো।

তাবু থেকে জিনি বেরিয়ে, কি হয়েছে?

 জিপো পালিয়েছে।

তাহলেও বেশীদূর যেতে পারেনি। কারণ মিনিট কুড়ি আগেও আমি ওকে ঘুমোতে দেখেছি।

ভয়ঙ্কর স্বরে ব্লেক বললো, যে করে হোক ওকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। জিপোকে ছাড়া আমরা অথৈ জলে পড়বো। ওর মাথার ঠিক নেই। নইলে কুড়ি মাইল পাহাড়ী রাস্তা পায়ে হেঁটে কেউ পালাবার চেষ্টা করে। বড় রাস্তায় পৌঁছতে ওর দশ ঘন্টা লেগে যাবে।

কিটসন ও ব্লেক ছুটতে লাগলো।

ঘাসজমির শেষ প্রান্তে গিয়ে তারা থামলো। নীচের দিকে তাকালো। পাহাড়ে গাঢ় রঙের পটভূমিকায় রাস্তাটাকে সাদা সুতোর মতো দেখাচ্ছে।

কিটসন ব্লেকের হাত ধরে আঙুল তুলে দেখালো, ঐ যে জিপো যাচ্ছে।

 ব্লেক নীচের দিকে প্রায় দু মাইল নীচের রাস্তায় একটা ছোট্ট সচল বস্তু দেখলো–জিপো।

ওকে এখনো ধরা যাবে। একবার ধরতে পারলে ওকে পালানোর ঠেলাটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবো। চলো, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

কিটসন বললো, না। রাস্তাটা অসম্ভব সরু। ওকে ধরতে পারলেও গাড়ি ঘুরিয়ে আনা অসম্ভব। তার চেয়ে চলো পাহাড়ের দিক দিয়ে নামতে থাকি। তাহলে দু মাইল রাস্তা আমরা একমাইল হেঁটেই পৌঁছে যাবে।

কিটস নামতে শুরু করলো পাহাড়ের গা বেয়ে। কখনো লাফিয়ে, কখনো বুকে হেঁটে খাড়াই পাহাড় বেয়ে সে ধীরে ধীরে নামতে লাগলো।

জিপোকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ব্লেক কিটসনের পাশে এসে দাঁড়ালো।

কিটসন আঙুল তুলে জিপোকে দেখালো, ঐ যে যাচ্ছে।

ব্রেক দাঁত খিঁচিয়ে রিভলবার উচিয়ে ধরলো।

 কিটসন ব্লেকের কব্জি চেপে ধরলো, কি, করছে কি? এখন জিগোই আমাদের ট্রাক খোলার একমাত্র ভরসা। আর ওকেই তুমি খুন করতে চাইছো?

ব্লেক হিংস্রভাবে এক ঝাঁকুনি দিয়ে রিভলবারটা খাপে খুঁজে আবার খাড়াই বেয়ে নামতে শুরু করলো।

হঠাৎ কিটসনের চোখ পড়লো জিপোর ওপর, ও ধমকে দাঁড়িয়েছে। চোখ তুলে পাহাড়ের দিকে তাকালো জিপো। একটু দাঁড়িয়ে তারপর সে ছুটতে লাগলো।

কিটসন ব্লেককে বললো, ও আমাদের দেখে ফেলেছে। তারপর গলা চড়িয়ে চিৎকার করলো, জিপো ফিরে এসো

জিপো কিন্তু মরিয়া হয়ে ছুটে চললো। ওর পা যেন সীসের মতো ভারী লাগছে। তার পালানোর এই প্রয়াস যে নির্বুদ্ধিতারই ফলশ্রুতি তা সে উপলব্ধি করলো এবার।

তাঁবুতে সকালে যখন জিপোর ঘুম ভেঙ্গেছে, তখন ব্লেক, কিটসন, জিনি তিনজনেই গভীর ঘুমে মগ্ন। ওদের ঘুমোতে দেখে পালাবার চিন্তাটা হঠাৎই তার মাথায় চাড়া দিলো।

তিনজনকে না জাগিয়ে অতি সন্তর্পণে গায়ের চাদর সরিয়ে জিপো উঠে বসেছে। হামাগুড়ি দিয়ে অতি কষ্টে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

কুড়ি মাইল পাহাড়ী রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। তখন ঘড়িতে পৌনে ছটা। সুতরাং জিপোর মনে হয়েছে, কম করে সাতটা আটটার আগে ওদের ঘুম ভাঙবে না। তার মানে সে পালাবার জন্য দেড় দুই ঘণ্টা সময় পাবে।

সুতরাং সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই জিপো রওনা দিয়েছে। দ্রুতপায়ে ঢালু রাস্তা ধরে চলতে শুরু করেছে।

আধ ঘণ্টায় সে প্রায় দু মাইল পথ এসেছে। হঠাৎ ওপর থেকে ভেসে এসেছে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ।

চমকে মুখ তুলে তাকাতেই কিটসন ও ব্লেককে দেখেছে।

ওদের দেখেই জিপোর হাত–পা সিটকে গেছে।

 সে শুনতে পেলো কিটসনের চিৎকার, জিপো! থামো! ফিরে এসো।

কয়েক শ গজ অন্ধের মতো দৌড়নোর পর জিপো বুঝতে পেরেছে, এভাবে–সে ওদের সঙ্গে পারবে না। তাই পেছন ফিরে দেখলো, ব্লেক তখনও পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে। কিটসন তার পেছনে গোড়ালিতে ভর দিয়ে সরসর করে নেমে আসছে।

ফাঁদে পড়া ভয়ার্ত শিকারের মতো রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের ঢালের দিকে জিপো ছুটে চললো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জিপো মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়ল। হাত দিয়ে পতনজনিত আঘাত রোধ করলো সে। কিন্তু ওর ভারী শরীরটা পাহাড়ের রুক্ষ্ম, অসমতল গা বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

জিপোর আহত দেহটা রাস্তায় এসে থামলো। কোনোরকমে সে উঠে দাঁড়ালো। ঘাড় ফিরিয়ে ওপর দিকে তাকালো।

না, এখান থেকে কিটসন বা ব্লেক কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা বড় বড় ঝুলন্ত পাথরগুলোই জিপোও ওদের মাঝে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দেখতে না পেলেও ওদের পায়ের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে।

উন্মত্তের মতো জিপো চারিদিকে তাকালো। একটা আশ্রয় তার দরকার, ওরা এসে পড়বে।

সামনেই ডান দিকে বিস্তৃত ঘন বুনন গাছের ঝোঁপ–ঠিক পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে। ঝোঁপ লক্ষ্য করে জিপো তীরবেগে দৌড়লো। ঝোঁপের উচ্চতা বেশীনয়–জিপোর উরু পর্যন্ত। তারই মধ্যে সে ছুটতে লাগলো। কাটা ঝোপে লেগে তার প্যান্ট ছিঁড়ে গেলোপা কেটে রক্ত বেরোতে লাগলো। ঝোঁপের মাঝামাঝি গিয়ে জিপো উপুড় হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঝোঁপের ডালপালা আবার তাদের জায়গায়, ফিরে এলো। নিষ্পাপ জিপোকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন নিরাপত্তার চাদরে ভয়ার্ত জিপোকে আগলে রাখতে চাইছে।

কিটসনই প্রথম রাস্তায় এসে পৌঁছলো। কিন্তু সামনে পেছনে তাকিয়ে জিপোকে না দেখতে পেয়ে সে ভীষণ অবাক হলো।

একটা অশ্রাব্য কটুক্তি করে হাঁপাতে হাঁপাতে ব্লেক তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

 কোথায় গেলো ও?

 মনে হয় কোথায় ও লুকিয়ে পড়েছে।

দুজনেই সামনের ঝোঁপের দিকে তাকালো, ঐ কাটাঝোঁপই একমাত্র লুকোবার জায়গা।

ব্লেক বললো, শালা ওখানেই লুকিয়েছে। চেঁচিয়ে বললো, জিপো, বাইরে বেরিয়ে এসো। আমরা জানি তুমি ওখানেই লুকিয়ে আছে।

জিপো আতঙ্কে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ করে অনড় হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

ব্লেক বললো, চলো, ওকে ধরে বাইরে টেনে আনি। তুমি ওপাশ দিয়ে ভেতরে ঢোক, আমি সামনে দিয়ে ঢুকছি।

ব্লেক দুহাতে কাটাগাছ সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। এইভাবে গজ দশেক যাওয়ার পর ব্লেক বুঝলো পরিশ্রম ও সময় নষ্ট করে তার পক্ষে জিপোকে বের করা অসম্ভব। কারণ গোটা এলাকাটাই ঘন ঝোপে ঠাসা। সুতরাং এর মধ্যে জিপোর অবস্থান নির্ণয় করা অসম্ভব।

ওদিকে কিটসনও একই সময়ে অবস্থাটা উপলব্ধি করলো এবং একরাশ বুনো ঝোঁপের মধ্যে থমকে দাঁড়ালো।

 ওরা দুজন পরস্পরের দিকে তাকালো। ব্লেক চিৎকার করলো জিপো, এই শেষবারের মতো তোমাকে বলছি। যদি এক্ষুনি বেরিয়ে না আসো তাহলে তোমাকে এমন মার মারবো, কোনদিন ভুলবে না, বেরিয়ে এসো বলছি।

জিপো ব্লেকের স্বরে ক্রোধ ও হতাশার আভাস পেয়ে নিশ্চিন্ত হলে, সে বুঝলো যদি সে সাহস করে নিশ্চলভাবে পড়ে থাকতে পারে, তাহলে তার সাফল্যলাভের সম্ভাবনা যথেষ্ট। শুধু একটু সাহস…আর কিছু নয়।

হতাশ হলেও সামনের দিকে আরো কয়েক পা ব্লেক এগিয়ে গেলো। জিপো শুনতে পেলো ঝোঁপঝাড় ঠেলে তার এগিয়ে আসার শব্দ–কিন্তু সে চলেছে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত দিকে। কিটসনের অবস্থাও তথৈবচ–সেও ব্লেকের মতোই মূল নিশানা এড়িয়ে চলেছে।

দাঁতে দাঁত চেপে জিপো অপেক্ষা করতে লাগলো।

বেশ কয়েক মিনিট পর কিটসন ও ব্লেকের পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেলো, তখন জিপো বেবোনো মনস্থ করলো।

কারণ ওরা যদি এইভাবে পুরো এলাকাটা তন্ন তন্ন করে, তাহলে লুকোনো জায়গা ছেড়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলাই তার পক্ষে নিরাপদ।

সুতরাং খুব সতর্কভাবে বেলে মাটির ওপর বুক ঘষটে, কাটাগাছগুলো না নড়িয়ে সে তার স্কুল দেহ নিয়ে এগিয়ে চললো। কারণ কাঁটা ঝোঁপের সামান্য আন্দোলনই কিটসন ও ব্লেককে তার অবস্থিতির কথা জানিয়ে দেবে।

এইভাবে তিরিশ চল্লিশ গজ যাওয়ার পর জিপো নিশ্চিন্ত বোধ করলো। কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার আগেই সে সাপটাকে দেখতে পেলো।

নিজেকে সামনে এগোবার জন্যে সবে ডান হাতটা সামনে বাড়িয়েছে। এমন সময় দেখে সাপটা তার আঙুল থেকে ইঞ্চি দুয়েক দূরেই কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। চ্যাপ্টা বাঁকানো ফণাটা শুনে স্থির।

জিপোর সারা শরীর যেন পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে পড়লো, সমস্ত চেতনা হয়ে গেলো আচ্ছন্ন। পাথরের মূর্তির মতো অনড় হয়ে পড়ে রইলো সে। হৃদপিণ্ডের দুর্দম গতি বুঝি তার কণ্ঠনালী রোধ করছে।

সাপটাও নিশ্চলভাবে ফণা তুলে প্রতীক্ষায় রইলো।

কয়েকটা যন্ত্রণাময় মুহূর্তের পর জিপো দাঁতে দাঁত চেপে, মরিয়া হয়ে বি ডান হাতটা ফিরিয়ে আনলো।

এবং সেই মুহূর্তেই সাপটা তার হাতে ছোবল মারলো।

জিপো অমানুষিক যন্ত্রণায় উন্মাদের মতো সঙ্গে সঙ্গে অপার্থিব চিৎকার করে উঠে অন্ধের মতো ঝোঁপঝাড় ভেদ করে দৌড়তে লাগলো।

ব্লেকও কিটসন ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার অনুসন্ধান করতে যাবে, এমন সময় শুনতে পেলো জিপোর আর্তনাদ।

ওরা দেখলো জিপো রক্ত জমানো আর্তনাদে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে উন্মাদের মতো ছুটে চলেছে

শালা একেবারে পাগল হয়ে গেছে, বলেই ব্লেকও জিপোর পেছন পেছন ছুটতে শুরু করলো ঝোঁপঝাড় ঠেলে কিটসনও তাকে অনুসরণ করলো।

জিপো ঝোঁপঝাড় ছাড়িয়ে পাহাড়ের খাড়াই ঢালের দিকে ছুটে চললো। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো মাত্রই জিপো ভারসাম্য হারিয়ে পিছলে পড়লো। পাহাড়ের গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে অসহায়ভাবে নেমে চলল।

ব্লেককে পেছনে ফেলে কিটসনই আগে পৌঁছলে জিপোর কাছে। নিচের রাস্তার কাছে একটা বড় পাথরের গায়ে পিঠ দিয়ে সে পড়েছিল। কিটসন জিপোর ওপর ঝুঁকে, জিপো! কোনো ভয় নেই। ব্লেক তোমাকে কিছু করবে না। কিন্তু তোমার হয়েছে কি?

কিটসন জিপোর কালসিটে পড়া মুখ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।

জিপো কোনরকমে বললো, একটা সাপ…

ব্লেক পড়িমড়ি করে এসে পৌঁছলো। জিপোকে দেখেই সে রাগে ফেটে পড়লো, শালা ভীতু কোথাকার। তোকে আমি খুন করে ফেলবো।

ব্লেক এক প্রচণ্ড লাথি চালাতে গেলো কিন্তু কিটসন বাঁ হাতে সে আঘাত রোধ করে, থাক, এসব পরে হবে। দেখতে পাচ্ছে না। জিপোর কি অবস্থা হয়েছে।

জিপো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতটা তুলে কিটসনকে দেখিয়ে, সাপ…একটা সাপ…

কিটসন দেখলো, জিপোররক্তিমহাতটাঅস্বাভাবিকফুলেউঠেছে সমস্তরক্ত এসেজমাহয়েছে তার হাতে। সে জিপোর স্ফীত হাতের ওপর আঙুল ছোঁয়াতেই সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করলো।

কিটসন জিপোর পাশে পা ছড়িয়ে বসে, কি হয়েছে, জিপো?

জিপো শাসকষ্টে হাঁপিয়ে, সাপ…একটা সাপ…আমাকে ছোবল…মেরেছে…।

কিটসন দেখতে পেলো জিপোর হাতের উপর পাশাপাশি দুটো তীক্ষ্ণ দাঁতের দাগ। সুতরাং ওকে আশ্বাস দিয়ে, ভয় নেই, জিপো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করছি।

আমাকে…আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো। আমি আমার ভাইয়ের মতো…সাপের কামড়ে…মারা যেতে চাই না…আলেক্স…।

কিটসন রুমাল বের করে সেটাকে দড়ির মতো পাকিয়ে শক্ত করে জিপোর কব্জিতে বেঁধে দিলো।

ব্লেক উত্তেজিত ভাবে, তার মানে ওকে সাপে কামড়েছে? তাহলে তাহলে আমরা ট্রাকের ডালা খুলবো কি করে?

পকেট থেকে একটা–ছুরি বের করে তার ফলা খুলে ধরলো।

 জিপো, এতে তোমার একটু ব্যথা লাগবে কিন্তু কিছুটা আরাম পাবে। এ ছাড়া এখন আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

ছুরির ধারালো অগ্রভাগ জিপোর উত্তপ্ত, স্ফীত হাতে বসিয়ে দিলো সে। খানিকটা লম্বা করে চিরে দিলো।

জিপো চিৎকার করে বাঁ হাতে কিটসনকে আঘাত করলো।

ওর হাতের ক্ষত থেকে ধীরে ধীরে রক্ত বেরোতে লাগলো। একইভাবে শক্ত হাতে কিটসন জিপোর কব্জি ধরে রইলো। হাতে চাপ দিয়ে ক্ষত মুখ দিয়ে বিষটা বের করার চেষ্টা করলো। জিপোর বিবর্ণ মুখ দেখে মনে হলো জিপো যেন আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে।

আলেক্স–তুমি আমার…সত্যিকারের বন্ধু। তোমার সঙ্গে সেদিন যে দুর্ব্যবহার করেছি, সে সব চলে যেও। আমাকে–আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলল…

ভয় পেয়োনা জিপো। আমি সব ব্যবস্থা করছি। দাঁড়াও, আগে বুইকটা নিয়ে আসি।

ব্লেক খেঁকিয়ে উঠলো। কি–কি বললে?

গাড়িতে করে আমি জিপোকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ওর অবস্থাটা একবার দেখো। বাঁচে কি না বাঁচে ঠিক নেই। বলেই কিটসন পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করলো।

ব্লেক তীব্রভাবে, কিটসন!

আবার কি হলো?

 ফিরে এসো এখানে। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? দেখো উপরে! একটা উড়োজাহাজ চক্রাকারে পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি গাড়িটা আড়াল থেকে বাইরে আনলেই ওরা সেটা দেখতে পাবে। তারপর পুলিস এসে এ জায়গাটা গরুখোঁড়া করে আমাদের বের করবে।

তাতে কি হয়েছে? একটা মানুষকে তো আর বসে বসে মরতে দেওয়া যায় না। জিপোকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে না গেলে ওর বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেটা বুঝতে পারছে না

গাড়িটা তুমি লুকোনো জায়গা থেকে বাইরে আনতে পারবে না, ব্যস।

হাসপাতাল এখান থেকে কম করে তিরিশ মাইল দূরে। এতোটা রাস্তা আমি জিপোকে কাধে করে নিতে পারবো কি?

ব্লেক খেঁকিয়ে উঠলো, তাতে আমার বয়েই গেলো। মোটমাট গাড়িটা তুমি দিনের আলোয় রাস্তায় বের করবে না। জিপোকে এখন ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। উপায় কি?

নিকুচি করেছে তোমার উপদেশের, বলেই কিটসন পাহাড়ে উঠতে শুরু করলো।

কিটসন।

ব্লেকের শাসানির সুরে কিটসন ঘুরে দেখলে ব্লেকের হাতে তার দিকে লক্ষ্য করে রিভলবার রয়েছে।

ব্লেক নিপ্রাণ স্বরে, এখানে ফিরে এসো।

দেরি হলে জিপো মারা পড়বে এড। তুমি সেটা দেখছো না?

ব্লেক ভয়ঙ্কর স্বরে শাসিয়ে বললো, তুমি আগে এখানে ফিরে এসো। গাড়ি বের করার কথা ভুলে যাও। জলদি এসো, আমি আর দ্বিতীয়বার বলবো না।

কিটসন ধীরে ধীরে নেমে এলো। সে ভাবলো এতোদিনে তাহলে সময় এসেছে। আজই একটা ফয়সালা হয়ে যাক। তবে ওর ডান হাতের দিকে নজর রাখতে হবে। এই আমাদের চুড়ান্ত ফয়সালা। সে কিছুতেই জিগ্বেকে অসহায় ভাবে মরতে দেবে না।

কিটসন সহজভাবে এগিয়ে এলো, কিন্তু আমাদের কিছু একটা করা উচিত। এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে জিপোকে আমরা মরতে দিতে পারি না। ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নেওয়া দরকার।

ওর দিকে তাকিয়ে দেখো, গর্দভ কোথাকার। যতক্ষণে তুমি গিয়ে গাড়ি এনে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, ততক্ষণে ও মারা যাবে।

কিন্তু তাই বলে, চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। সে আড়চোখে দেখলো, ব্লেক রিভলবারটা সামান্য নামিয়ে নিলো।

পলকের মধ্যে বিদ্যুৎবেগে ব্রেকের কব্জির ওপর কিটসনের হাত নেমে এলো।

ব্রেকের হাত থেকে রিভলবারটা ঝোঁপের মধ্যে ছিটকে পড়লো। এক লাফেপিছিয়ে কিটসনের মুখোমুখি সে দাঁড়ালো।

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপরদাঁত বের করে নিঃশব্দে ব্লেক হেসে উঠলো।

ব্লেক হালকা স্বরে, তাহলে তাই হোক। তুমিই যখন আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে আনলে তখন আমি আর কী করতে পারি। তোমাকে ঢিট করার ইচ্ছেটা আমার বরাবরের। সুতরাং সুযোগ যখন পেয়েছি আজ তোমাকে সমঝে দেবো লড়াই কাকে বলে। শালা

কিটসন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে অপেক্ষা করতে লাগলো।

কিটসন মুখ লক্ষ্য করে একটা ঘুষি চালালো। ব্রেক চকিতে মাথা সরিয়ে নিলো আর ঘুষিটা কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। সে চট করে বসে পড়লো। কিটসনের ডান হাতের আড়াল কাটিয়ে তার বজ্রমুষ্টি সশব্দে প্রতিদ্বন্দ্বীর পাজরে আছড়ে পড়লো। আকস্মিক আঘাতে কিটসনের দম যেন বন্ধ হয়ে এলো। সে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।

ব্লেক এগিয়ে আসতেই কিটসনের বাঁ–হাতি ঘুষি তার মাথায় আঘাত করলো। ব্লেকের শরীর টলে পড়লো।

একই সঙ্গে দুজন এগিয়ে আসতেই ওরা অন্ধ লক্ষ্যে ঘুষি চালাতে লাগলো। কয়েকটা গায়ে মুখে আঘাতও করলো। এইভাবে সাবধানী ভঙ্গিমায় ওদের প্রতিদ্বন্দিতা চললো।

ব্রেক হিংস্রভাবে কিটসনের বুক লক্ষ্য করে সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুষিটা মারলো।

কিটসন জোরালো ঘুষির নিরেট আঘাত সইতে পারলো না। আস্তে আস্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

ব্লেক হিংস্রভাবে এগিয়ে এসে আর একখানা ঘুষি কিটসনের ঘাড়ে বসিয়ে দিলো। কিটসন মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লো।

ব্লেক পিছিয়ে দাঁড়ালো।

কিটসন হাতে ও হাঁটুতে ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে বসলো। দেখলো, ব্রেক তার দিকে আবার এগিয়ে আসছে সঙ্গে সঙ্গে সে ব্লেকের হাঁটু লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলো। দু হাতে ব্লেকের পা দুটো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো সে।

ব্লেক কিটসনকে নিয়েই মাটিতে আছড়ে পড়লো। কয়েক মুহূর্ত ওরা দুজনেই শিথিল ভঙ্গিতেহাত–পাএলিয়ে পড়েরইল। তারপর কিটসনআচ্ছন্নভাবে ব্লেকেরগলাটিপতে গেলে ব্লেকের ঘুষিতে কিটসনের হাত আলগা হয়ে গেলো। ব্লেক গড়িয়ে তার আওতার বাইরে চলে এলো।

একমুহূর্ত ধরে ওদের ধস্তাধস্তি চললো। ব্লেক প্রাণপণেকিটসনেরবাঁধন ছাড়াতে চেষ্টা করলো, কিটসনও মরিয়া হয়ে ব্লেকের হাত ধরলো।

ব্লেক নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বাঁ–হাতে ক্ষিপ্র ঘুষি চালালো। কিটসন কোনোরকমে ঘুষিটাকে এড়িয়ে তার পাঁজরে খুঁষি বসিয়ে দিলো, ব্লেক যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলো।

কিটসন সাফল্যের আশায় এগিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুষি চালালো ব্লেকের মাথা লক্ষ্য করে।

ব্লেক অস্ফুট শব্দ করে পিছালো।

এবার কিটসনের বাঁ–হাতি ঘঁষি তার মাথায় পড়তেই ব্লেক চোখে অন্ধকার দেখলো। দু হাত শূন্যে তুলে ব্লেক আরো কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।

কিটসন তার চোয়ালে সংঘর্ষ অনুভব করলো। তারপরেই তার মস্তিষ্কে খেত তপ্ত কিছুর বিস্ফোরণ ঘটলো। কিটসন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। পাথরের টুকরোর আঘাতে তার মুখ কেটে গেলো, যন্ত্রণায় চাপা আর্তনাদ করে চিত হয়ে গড়িয়ে পড়লো। তারপর আপ্রাণ চেষ্টার পর মাথা তুলে দেখলল।

ব্লেক জিপোর দেহের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে।

 কিটসন টলতে টলতে উঠে ব্লেকের কাছে এগিয়ে গেলো।

ব্লেকের শীতল নির্বিকার স্বর, ও মারা গেছে। শেষ পর্যন্ত হতভাগাটা আমাদের এভাবে বোকা বানালো।

জিপোর পাশে কিটসন হাঁটু গেড়ে বসে ওর শীতল হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতে।

প্রশান্তির ছাপ জিপোর মুখমণ্ডলে। ক্ষুদে ক্ষুদে কালো চোখ জোড়া পরম নিশ্চিন্ততায় নীলাকাশে নিবদ্ধ।

কিটসন শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে ভাবলো, জিপোর মৃত্যুর পর ট্রাকের তালা খোলার ক্ষীণতম আশাও নেই। দশ লক্ষ ডলার এখন মরীচিকা! হাতের মুঠোয় পৃথিবী। ই, তাই ই বটে। মরগ্যান প্রথমেই করেছে চরম গলদ, আজ যদি ফ্র্যাঙ্ক থাকতো, তবে সে তার ভুলের নিষ্ঠুর পরিণতি দেখতে।

ব্লেক কিটসনকে ডাকলো, চলে এসো, ও মারা গেছে। ওর জন্য আমাদের আর কিছুই করার নেই।

মৃত জিপোর মুখে তাকিয়ে চুপচাপ তার হাত ধরে কিটসন যেন শেষ সান্ত্বনা দিতে চাইলো।

ব্লেক কাঁধ ঝাঁকিয়ে দীর্ঘ পথ ধরে লুকানো ট্রাকের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো।

.

১১.

 ফ্রেড ব্র্যাডফোর্ড হ্রদের কাছেই বসে ছিলো। একমনে খবরের কাগজ পড়ছিলো। এমন সময় দুজন লোককে সামনের সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো।

সবেমাত্র প্রাতঃরাশ সেরে ব্র্যাডফোর্ড একটু বিশ্রাম করছিলো। একটু আগেই তার স্ত্রী ও ছেলে হ্রদের দিকে বেড়াতে গেছে। সে একটু পরে যাবে। এমন সময় আগন্তুক দুজনকে দেখে ব্র্যাডফোর্ড অবাক হলো।

একজনের পরনে সৈন্যবাহিনীর মেজরের পোশাক, দ্বিতীয় জনের পরনে সস্তা ছাই রঙের স্যুট, মাথায় টুপি।

মেজরের চেহারা বেঁটেখাটো। তামাটে, লম্বা মুখ, ঠোঁটের ওপর টানা মিলিটারী মার্কা গোঁফ। নীল চোখে অন্তর্ভেদী কঠিন দৃষ্টি।

মেজরের সঙ্গী যথেষ্ট লম্বা, ভারী রক্তিম মুখমণ্ডল যেন পাথর খোদাই করে বসানো। চোখমুখে তীক্ষ্ণতা, এই দ্বিতীয় ব্যক্তি হয়তো কোনো সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার হবে।

সামনে এসে মেজর ব্র্যাডফোর্ড?

ব্র্যাডফোর্ড উঠে দাঁড়ালো। হ্যাঁ, কিন্তু…কি ব্যাপার বলুন তো?

ফ্রেড ব্র্যাডফোর্ড, জুনিয়র?

না, সে আমার ছেলে কিন্তু ওর সঙ্গে আপনাদের কি দরকার?

আমি মেজর ডিলেনি, ফিল্ড সিকিউরিটি। আর ইনি হলেন লেফটেন্যান্ট কুপার, সিটি পুলিশ। আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে খুশী হলাম। কিন্তু আপনারা কি আমার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চান?

হ্যাঁ, কোথায় সে?

ও তার মার সঙ্গে হ্রদের ধারে বেড়াতে গেছে। কিন্তু কি হয়েছে বলুন তো?

ডিলেনি তাকে আশ্বাস দিলো, চিন্তা করার কিছুই নেই; মিঃ ব্র্যাডফোর্ড। আমরা শুধু ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

এমন সময় জুনিয়র ব্র্যাডফোর্ড শিস দিতে দিতে এসে হাজির। কিন্তু বাবার সামনে দুজনকে দেখে শিস দেওয়া বন্ধ করে সতর্ক হয়ে গেল।

ব্র্যাডফোর্ড বললো, ঐ যে, ও এসে গেছে। এই–জুনিয়র, এদিকে এস। তোমার মা কোথায়? তাকে যে দেখছি না।

মা হ্রদের ধারে বসে আড্ডা দিচ্ছে।

ডিলেনিই প্রথম প্রশ্ন করলো, তুমিই কি ফ্রেড ব্যাডফোর্ড, জুনিয়র?

ঠিকই ধরেছেন।

পকেট থেকে একটা খাম বের করে দেখিয়ে এটা কি তোমার লেখা? এই চিঠিটা? ছেলের আঁকাবাঁকা হাতের লেখা ব্র্যাডফোর্ড চিনতে পারলো কিন্তু কি লিখেছে বুঝতে পারলো না।

হা–আমারই লেখা।

 সে মাটিতে উবু হয়ে বসে শতছিন্ন শোলার টুপিতে ঘাস ভরলো।

 অবাক হয়ে ব্র্যাডফোর্ড বললো, আমার ছেলে আপনাদের চিঠি দিয়েছে?

হ্যাঁ, সে পুলিশ সদরে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, লুকোনো ট্রাকটার হদিশ সে জানে।

জুনিয়র। একি করেছো তুমি! তুমি ভালোভাবেই জানো, লুকোনো ট্রাকের হদিস তুমি জানো না। তবে কেন…

ছেলেটা বাবার দিকে একবার অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে আবার টুপিতে ঘাস ভরার কাজে মন দিলো। এবার ঘাসভর্তি টুপিটা তার মাথায় ভালো করে চেপে বসালো। তারপর গম্ভীরভাবে উঠে দাঁড়ালো।

সে নিজের মনে বলে চললো, এভাবে টুপিটা পড়া ছাড়া উপায় নেই। নইলে সব ঘাস পড়ে যেতো। এতে আমার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের আবিষ্কার।

 ডিলেনি ও কুপার পরস্পরের দিকে তাকালো। তারপর ডিলেনিই আদর মাখানো সুরে, ট্রাকটা কোথায় আছে, খোকা? ছেলেটা টুপিটা আরো টেনেটুনে শক্ত করে মাথায় বসিয়ে গম্ভীর সুরে বললো, ট্রাকটা কোথায় লুকোনো আছে, আমি জানি।

সে তো খুব ভালো কথা। কিন্তু কোথায় আছে ওটা?

 জুনিয়র ব্র্যাডফোর্ড স্থির। অপ্রতিভ চোখে মেজরের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু পুরস্কারের কি হবে?

ব্র্যাডফোর্ড অস্বস্তিভরে, শোনো জুনিয়র, তুমি ট্রাকের কোনো খবরই জানোনা। তাহলে এদের শুধু শুধু সময় নষ্ট করছো কেন? এতে তুমি নিজেই বিপদে পড়বে

ছেলেটা শান্তস্বরে জবাব দিলো, ট্রাকটা কোথায় আছে সেটা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু পুরস্কারের টাকাটা হাতে না আসা পর্যন্ত একটা কথাও আমি বলছি না।

ডিলেনির স্বর তীক্ষ্ণ হলো, শোনো থোকা, যদি সত্যি সত্যিই ট্রাকের খবর তোমার জানা থাকে তো চটপট বলে ফেলো। তোমার বাবা ঠিকই বলেছেন, আমাদের সময় নষ্ট করার মতলব থাকলে তুমি ভীষণ বিপদে পড়বে।

সরাসরি ছেলেটা জবাব দিলো, ট্রাকটা একটা ক্যারাভ্যানের ভেতরে লুকোনো আছে।

ব্র্যাডফোর্ড অধৈর্য হয়ে, ওঃ, আবার সেই একই কথা। ও ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সঙ্গে হাজারবার আলোচনা করেছি। যেমন আমিও জানি, তেমন তুমিও জানো যে….

ডিলোনি বাধা দিলো, একমিনিট মিঃ ব্র্যাডফোর্ড; যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কথা বলার সুযোগটা আমাকেই দিন। খোকা, তুমি বুঝলে কি করে যে ট্রাকটা একটা ক্যারাভ্যানের ভেতর লুকোনো আছে?

জুনিয়র বললো, আমি নিজের চোখে দেখেছি। ক্যারাভ্যানটা যাতে ট্রাকের ওজন বইতে পারে, সে জন্যে ওরা ক্যারাভ্যানের তলায় দুটো চওড়া ইস্পাতের পাত লাগিয়েছে।

ওরা? তার মানে কারা?

যারা ট্রাকটা চুরি করেছে। আমি তাদের কথাই বলছি।

তার মানে তুমি ট্রাকটাকে নিজের চোখে দেখেছো?

ছেলেটা মাথা নাড়লো এবং চিন্তিত মুখে টুপিটা খুলে নিলো।

প্রথম প্রথম এটা বেশ ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ঘাস গুলো গরম হয়ে যায়। নাঃ, আবার নতুন করে ঘাস ভরতে হবে দেখছি।

সুতরাং আবার সে তার স্ব–আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে মন দিলো।

ডিলেনির কণ্ঠস্বর উত্তেজিত, ট্রাকটাকে তুমি কোথায় দেখেছো?

মেজরের কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে ছেলেটা মুঠো মুঠো ঘাস ছিঁড়ে টুপিতে ভরতে লাগলো। আমার কথা তোমার কানে গেছে?

কি বললেন?

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি ট্রাকটা কোথায় রয়েছে?

 ঘাস ভরতে ভরতেই ছেলেটা বললো, আমার বাবা বলছিলো, পুলিশ না কি আমাকে পুরস্কারের টাকাটা দেবে না। নিজেরাই ওটা মেরে দেবে।

ব্র্যাডফোর্ডের দিকে কুপার কটমট করে তাকালো। ব্র্যাডফোর্ড অস্বক্তিভরে ছেলেকে তিরস্কার করলো। আমি মোটেই ওকথা তোমাকে বলিনি। এভাবে কথা বলার জন্যে তোমার লজ্জা হওয়া উচিত!

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা শিস দেওয়ার মতো বিচিত্র শব্দ করলো। তারপর বললো, কি মিথ্যেবাদী। তুমিই তো বললে ট্রাকটা একটা ক্যারাভ্যানে লুকোনো আছে একথা পুলিশকে জানালে ওরা ভাববে আমরাই সেটা চুরি করেছি। তারপর বললে না, সব পুলিশই এক–একনম্বরের চোর

ব্র্যাডফোর্ডের দিকে চেয়ে ডিলেনি একটা অস্পষ্ট শব্দ করলো, হুম–

কুপার গর্জন করে উঠলো, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার বাবা কি বলেছে না বলেছে বাদ দাও। ট্রাকটা কোথায় দেখেছে সে কথাই আগে বলল।

অত্যন্ত সতর্কভাবে ছেলেটা টুপির ওপর ঝুঁকে মাথাটা ভেতরে গুজে দিয়ে শক্ত করে এঁটে দিলো।

ছেলেটা সরাসরি লেফটেন্যান্টের চোখে তাকিয়ে, পুরস্কারের টাকাটা না পাওয়া পর্যন্ত আমি আর কিছুই বলবো না।

কুপারের মুখভাব কঠিন হলো। তাই নাকি, আচ্ছা, দেখা যাবে। তোমরা দুজন আগে থানায় চলো। তারপর দেখবো। যদি দেখি যে এতোক্ষণ ধরে তুমি শুধু আমাদের সময় নষ্ট করেছ, তাহলে…

কুপারকে হাত দিয়ে ডিলেনি সরিয়ে, দেখি সরো, আমাকে কথা বলতে দাও। শোনোখোকা, ট্রাকটা খুঁজে বার করার ব্যাপারে যে পুলিশকে খবর দিতে সাহায্য করবে, সেই–ই পাবে পুরস্কারের টাকাটা। এর মধ্যে পক্ষপাতিত্বের কোনো প্রশ্নই নেই। তোমার দেওয়া খবর যদি আমাদের ট্রাকটা খুঁজতে সাহায্য করে তবেই তুমি পুরস্কারের টাকাটা পাবে। এতে অবিশ্বাসের কি আছে?

সত্যি বলছেন?

মেজর ঘাড় নাড়ালো, সত্যি বলছি।

পুরস্কারের টাকাটা আমার বাবাকে দেবেন না তো? আমার হাতেই দেবেন?

 হ্যাঁ তোমাকেই দেবো।

পাঁচ হাজার ডলার?

হা–ছেলেটা কিছুক্ষণ চিন্তা করে।

 ঠিক বলছেন তো? ট্রাকের খবর দিলে টাকাটা আপনি আমাকেই দেবেন?

মেজরের মুখে আকর্ণ বিস্তৃত আন্তরিক হাসি, আমি ঠাট্টা করছি না, খোকা। সৈন্যবাহিনীর লোকেরা কখনো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয় না। তাদের কথার দাম আছে।

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর জুনিয়র ব্র্যাডফোর্ড মনস্থির করে বললো, আচ্ছা, তাহলে বলছি। ওরা মোট চারজন আছে তিনজন পুরুষ, একজন মেয়ে। তিনজনের মধ্যে দুজন সারাদিন ধরে ক্যারাভ্যানের ভেতরেই থাকতো। শুধু রাত্রি হলেই বাইরে বেরোতো। একদিন রাতে আমি ওদের দুজনকে ক্যারাভ্যান ছেড়ে বেরোতে দেখেছি। ওদের গাড়ির নম্বরও আমার কাছে রয়েছে। ওরা বলছিলো, এর পর স্ট্যাগ হ্রদের দিকে বেড়াতে যাবে কিন্তু সব মিথ্যে কথা। আমি দেখেছি ওরা স্ট্যাগ হ্রদে যাবার রাস্তায় না গিয়ে বড় রাস্তার দিকে গেছে। ক্যারাভ্যানটার রঙ সাদা, কিন্তু ছাদটা নীল রঙের! ছেলেটা নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে ডিলেনির দিকে এগিয়ে দিলে, ওদের গাড়ির নম্বরটা এই কাগজেই লেখা আছে।

ডিলেনি পাতাটা সযতে পকেটে রাখতে রাখতে, কিন্তু ট্রাকটা যে ক্যারাভ্যানে আছে, সেটা জানলে কি করে?

ওদের দুজন যখন ভোরবেলা ক্যারাভ্যানে ঢুকছিলো, তখনই আমি দেখেছি। ট্রাকটা দেখবার জন্যেই তো আমি অতো ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিলাম

কিন্তু ওটাই যে হারানো ট্রাক সেটা তুমি বুঝলে কি করে?

হারানো ট্রাকের বিবরণ আমি খবরের কাগজে পড়েছি। ওই ট্রাকটাই সেই হারানো ট্রাক, স্পষ্ট দেখেছি।

ওরা এ জায়গা ছেড়ে কখন রওনা হয়েছে?

 কাল দুপুরে। ওরা যখন যায় তখন আমি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম। স্ট্যাগ হ্রদের রাস্তার দিকে ওরা যায় নি। গেছে পাহাড়ী এলাকার দিকে।

ডিলেনি কঠিন ভাবে, ওঃ, তাহলে তো অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। তুমি তোমার বাবাকে বলে আমাদের সদরে ফোন করতে পারতে!

বলেছিলাম বাবাকে। কিন্তু বাবা নিজেও ফোন করবে না, আমাকেও করতে দেবে না। তাই শেষ পর্যন্ত চিঠিই দিতে হলো। বাবা খালি বলছিলো, সব পুলিশের লোকই এক নম্বরের চোর।

কুপার এবং ডিলেনি একই সঙ্গে ফিরে তাকালোব্র্যাডফোর্ডের দিকে। কটমট করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো।

ব্র্যাডফোর্ড ঢোঁক গিললো। নীচু স্বরে জবাব দিলো, আমি এমনি ঠাট্টা করছিলাম। ওর ধারণাকে অপরিণত মস্তিষ্কের কল্পনা ভেবে…..

থাক, হয়েছে। রূঢ় স্বরে ব্র্যাডফোর্ডকে থামিয়ে দিলো ডিলেনি। ফিরলো জুনিয়রের দিকে, ওই লোকগুলোর চেহারার বর্ণনা তুমি দিতে পারবে, খোকা?

নিশ্চয়ই বললো সে, এবং কিটসন, জিনি, জিপো ও ব্লেকের নিখুঁত শারীরিক বর্ণনা গড়গড় করে বলে গেলো।

কুপার ওদের চেহারার বর্ণনা টুকে নিলো।

এই তো লক্ষ্মী ছেলে। ডিলেনি উৎসাহভরা সুরে বলে উঠলো, তুমি একটা কাজের মতো কাজ করেছ। যদি ট্রাকটা আমরা খুঁজে পাই, তাহলে তুমি যাতে পুরস্কারের টাকাটা পাও সেজন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো।

নিশ্চিন্ত থাকুন; ট্রাক আপনারা খুঁজে পাবেনই। মাথা থেকে টুপিটা খুলে ঝেড়ে–ঝেড়ে ঘাসগুলো ফেলে দিলো ছেলেটা, উঁহু, এই কায়দাটা তেমন জুতসই নয়। বড্ড তাড়াতাড়ি এটা গরম হয়ে যাচ্ছে।

কুপার দাঁত বের করে হাসলো, এক কাজ করো, ঘাসের বদলে বরফ দিয়ে দেখো কাজ হবে। জুনিয়রের মুখে হতাশা নেমে এলো।

নিতান্তই অবাস্তব। গভীর স্বরে বললো সে, বরফ গলে যাবে না?

 ডিলেনি ওর কাঁধ চাপড়ে দিলো, আমি একটা পথ বাতলাতে পারি, তোমার টুপির ওপরটা কেটে ফেলল। তাহলে স্বাধীনভাবে হাওয়া চলাচল করতে পারবে, মাথাও ঠাণ্ডা থাকবে। তাছাড়া, কে বলতে পারে যে আগামী যুগে এটাই একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়াবে না!

ছেলেটা কিছুক্ষণ প্রস্তাবটা ভেবে দেখলো, তারপর মাথা নাড়লল, এটার মধ্যে বেশ নতুনত্ব আছে। দেখি, চেষ্টা করে দেখতে হবে। হয়তো এ থেকে বেশ কিছুটাকাও জমিয়ে ফেলতে পারি

গাড়ির দিকে ফিরে যেতে যেতে ডিলেনি বললো, পাহাড়ের ওপরে…. একমাত্র ঐ জায়গাটাই আমরা এখনো খুঁজতে বাকি রেখেছি। ওখানে ওরা থাকলেও থাকতে পারে।

অসম্ভব। কুপার দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো, আমার যদি একবারও মনে হতো যে ওরা ওখানে লুকিয়েছে, তাহলে এতোদিনে ও জায়গাটাকে তুলোধোননা করে ছাড়তাম। কারণ ঐ রাস্তা বেয়ে কারো পক্ষেই ওপরে ওঠা সম্ভব নয়–ভারী ট্রাক নিয়ে তো দুরের কথা! কয়েক সপ্তাহ আগে এক প্রচণ্ড ঝড়ে এ রাস্তার কিছুটা অংশ একেবারে ধুয়ে–মুছে গেছে। .

কিন্তু একমাত্র ঐ পাহাড়ী এলাকা ছাড়া আর কোনো জায়গাই তো আমরা খুঁজতে বাকি রাখিনি। …..হোক অসম্ভব, তবু আমি একবার খুঁজে দেখতে চাই। হয়তো ভাগ্যের জোরে ওরা ট্রাক নিয়েই ও রাস্তাটা উৎরে গেছে।

গাড়িতে উঠে কুপার ইঞ্জিন চালু করলো।

তুমি পুরস্কারের জন্য সত্যি–সত্যিই ঐ বাচ্চাটার নাম সুপারিশ করবে নাকি? সে প্রশ্ন করলো।

কুপারের পাশে ডিলেনি আয়েস করে বসলো। তার চোখে দুরাভিসারী শূন্যদৃষ্টি, একটা দশ বছরের বাচ্চা ছেলে পাঁচ হাজার ডলার নিয়ে কি করবে বলতে পারো? মাঝখান থেকে ওর গেছে বাপটা ঐ টাকাগুলো পকেটস্থ করবে। কুপারের দিকে ফিরে তাকালো ডিলেনি, মুখে দুয়ে হাসি, পুরস্কারের টাকাটা কে পাবে সেটা আমরা ভালোভাবেই জানি, তাই না? পুরস্কারের শর্তে স্পষ্টই লেখা আছে, যে বা যারা ট্রাকটা খুঁজে বার করবে টাকাটা তারাই পাবে। আমার ধারণা তুমি আর আমিই সেটা খুঁজে বের করতে চলেছি; অতএব…

কুপার সশব্দে হাঁপ ছাড়লল, ওঃ, তুমি যেভাবে ঐ বাচ্চাটাকে বোঝাচ্ছিলে, আমি তো ভাবলাম বুঝি সত্যি–সত্যি…

ডিলেনি জানালো, বাচ্চাদের পেট থেকে কিভাবে কথা বার করতে হয় তা আমার জানা, ওদের সঙ্গে কথা বলার সময় একাগ্র এবং আন্তরিক হতে হবে, নইলে ওরা তোমার কোনো কথাই বিশ্বাস করবে না। …তাছাড়া, তুমি তো জানো, আমি বরাবরই একাগ্র এবং বিশ্বস্তভাবে কাজ করতে ভালোবাসি। উঁচু গলায় হেসে উঠলো সে।

.

কিটসন যখন তাঁবুতে ফিরলো তখন নটা বেজে গেছে। জিপোর বেলচাটা কাঁধে ফেলে শ্লথ ভঙ্গীতে এগিয়ে এলো। গায়ের জামা ঘামে ভেজা।

গাছের ছায়ায় একটা পাথরের ওপর বসে ছিলো জিনি। মুখ ফ্যাকাশে, সবুজ চোখে জল।

ব্লেক ট্রাকটাকে ক্যারাভ্যানের বাইরে বের করেছে। ট্রাকের দরজার গায়ে কান পেতে সে ডান হাতে কম্বিনেশন চাকতিটা ঘুরিয়ে চলেছে। অত্যন্ত সর্তক ভঙ্গীতে, ধীরে ধীরে সে চাকতিটা ঘোরাচ্ছে সম্ভবতঃ জিপোর পদ্ধতি অনুসরণ করতে চাইছে।

কিটসন বেলচাটা লাগিয়ে জিনির দিকে এগিয়ে গেলো। ওর পায়ের কাছে মাটিতে বসলো, কাঁপা হাতে সিগারেট ধরালো।

জিনি হাত রাখলো কিটসনের কাঁধে।

ওঃ, কি ভাবেই না বেচারা মারা গেলো : জিনির হাতের ওপর হাত রাখলো কিটসন, কিন্তু ওর জন্য আমাদের কিছুই করার ছিলোনা। জিপো যখন মারা যায়, আমি আর ঐ ছুঁচোটা মারামারিতে মত্ত। অবশ্য এমনিতেই ওকে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না, তার আগেই ও মারা যেতো।

ওসব নিয়ে আর ভেবো না, আলেক্স।

তারপর ওর দেহটা কবর দেওয়া–জিপো বড় ভালো লোক ছিলো, জিনি। ওর কথা শোনা উচিত ছিলো। এ কাজে জিপো হাত দিতে চায়নি। আমাকেও নিরস্ত করার জন্য কম চেষ্টা ও করেনি। এখন ভাবছি; ওর কথা শুনলেই ভালো হতো।

হা।

ও বলেছিলো, এ কাজের ফল কোনোদিনই ভালো হবে না; সেটা যে কতো বড় সত্যি কথা, তা আজ আমি বুঝতে পারছি। চলো জিনি–আমরা এখান থেকে চলে যাই; তুমি আর আমি। অন্ধকার হলেই আমরা রওনা হবো।

তাই চলো। এ সবই আমার দোষ, আলেক্স, এর জন্য নিজেকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবো না। এতো সবের মূলে একমাত্র আমি। তুমি যখন জিপোকে কবর দিতে গেলে, তখন থেকে খালি ভাবছি। এখন বুঝতে পারছি খুব ভুল করেছি আমি। কতো অন্যায়, এখন ট্রাক যদি খোলাও হয়, তবু একটাও টাকা ছোঁবো না।

তাহলে তুমি আসতে রাজী? জিনির দিকে না তাকিয়ে কিটসন বললো, আমরা নতুন করে জীবন শুরু করবো, জিনি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?

তুমি চাইলে আমার আপত্তি নেই! ও জবাব দিলো, কিন্তু পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে সত্যিই কি আমরা পালাতে পারবো? আজ না হয় কাল আমাদের ধরে ফেলবেই।

কিটসন সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললো।

কে জানে, হয়তো পারতেও পারি। একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? আমরা বুইকটা নিয়ে সোজা মেক্সিকো সীমান্তের দিকে রওনা দেবো। পুলিশ আমাদের চেহারার বিবরণ জানে না। যদি আমরা মেক্সিকোয় পৌঁছতে পারি….

এই কিটসন! এদিকে এসো! ব্লেক ডেকে উঠলো, কি হচ্ছে ওখানে বসে? এখানে এসে কাজে হাত লাগাও, আমাকে সাহায্য করো।

কিটসন উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে চললো ট্রাকের দিকে।

তুমি অ্যাসিটিলিন টর্চ ব্যবহার করতে জানো? ব্লেক প্রশ্ন করলো। তার মুখমণ্ডল কঠিন, যেন পাথরে খোদাই করা। চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

 না, জানি না।

তাহলে এখন থেকেই শিখতে শুরু করো, এই হতচ্ছাড়া বাক্সটা আমাদের তালা গলিয়ে খুলতে হবে। এসো, সিলিণ্ডারগুলো ঠিক করে ধরো।

ও আমার দ্বারা হবে না। কিটসন জবাব দিলো!

ব্লেক তার দিকে তাকালো, তার মানে? এই ট্রাকটা আমাদের যে খুলতেই হবে, তাই না?

ওতে আমার উৎসাহ নেই। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, আর নয়। তোমার দরকার থাকে তুমি ভোলো। যদি খুলতে পার, সমস্ত টাকাই তোমার। কেউই ভাগ বসাতে যাবে না। আমি এই ঝামেলায় আর থাকতে চাই না।

ব্লেক বললো, শালা ভীতুর ডিম। বুঝতে পারছে না, এটা আমার পক্ষে একা সামলানো সম্ভব নয়। ফালতু না বকে এসে আমাকে সাহায্য করো।

অন্ধকার হলেই এখান থেকে আমি ও জিনি চলে যাচ্ছি। তুমি তোমার খুশিমতো পথ বেছে নাও। কিন্তু আমরা চলে যাচ্ছি, নিশ্চিত জেনো।

ব্লেক খেঁকিয়ে উঠলো। ও–তাই বুঝি? তোমরা দুজন…ও শেষ পর্যন্ত জিনিকেও কজা করেছো? কিন্তু তাই বলে দশ লক্ষ ডলারকে পায়ে ঠেলে চলে যাবে এ কেমন কথা। তোমার নিশ্চয়ই মাথার কোনো ঠিক নেই। তাহলে তোমরা এক দীর্ঘ পদযাত্রার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো।

আমরা বুইকটা নিয়ে যাচ্ছি।

সে তো তুমি ভাবছো। কিন্তু বুইকটা আমার কাজে লাগবে। আর আমি যাবার জন্য প্রস্তুতও নই। আর কিছু করি না করি, এই ট্রাকের তালা আমি খুলবোই। ভেবো না, তোমার মতো কোনো ডরপোক ভেড়ুয়া বা তার পেয়ারের তওয়ায়েফ আমাকে রুখতে পারবে। সোজা কেটে পড়ো, আমি বাধা দেবো না। তবে বুইক নয়, শ্রীচরণ ভরসা করেই বিদেয় হও। গাড়ি আমি ছাড়ছি না।

ব্লেক আড়চোখে দেখলো জিনি উঠে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ব্লেক একা–তার প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক। তাছাড়া, জিনির কাছে হয়তো রিভলবারও আছে।

শান্ত স্বরে কিটসন বললো, আজ রাতেই আমরা চলে যাচ্ছি। এবং গাড়ি নিয়েই যাচ্ছি। তুমি ইচ্ছে করলে বড় রাস্তা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আসতে পারো। কিন্তু তারপরে তোমাকে নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

ইতস্ততঃ করে ব্লেক জিনির দিকে তাকালো। নিশ্চলভাবে ও দাঁড়িয়ে ডান হাত শরীরের আড়ালে নামালো।

ব্লেক ভাবলো–এখন সে যদি ঠিকমতো প্যাঁচ না কষতে পারে তাহলে ওরা দুজনে তাকে খুন করবে। সে কিটসনকে লক্ষ্য করে বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি যা বলছে তাই হবে। তাহলে সন্ধ্যে পর্যন্ত আমরা ট্রাকটা খোলার চেষ্টা করতে পারি হয়তো খুলে যেতেও পারে। এসো, সিলিণ্ডারগুলো ধরো কাজের সাহায্য করে।

ঠিক আছে। কিন্তু তাতে কিছু লাভ হবে বলে মনে হয় না।

এক পলক জিনিকে দেখলে ব্লেক, দেখাই যাক না। তোমার বড় বেশী উপদেশ দেওয়ার স্বভাব, আলেক্স। এসো, কাজে হাত লাগাও।

কিটসন ক্যারাভ্যানের দিকে পা বাড়াতেই ব্লেক কিটসনের পেটে রিভলবার চেপে ধরলো।

ব্লেক জিনিকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠলো, রিভলবারটা ফেলে দাও নইলে তোমার হবু বরের পেট ফুটো করে ছাড়বো।

জিনির হাত থেকে রিভলবার খসে পড়লো, ব্লেক দুজনকে রিভলবারের আওতায় রেখে পিছিয়ে জিনিকে বললো, সরে যাও রিভলবারের কাছ থেকে।

জিনি কিটসনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

ব্লেক জিনির রিভলবারটা তুলে হ্রদের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

এবারে শোনো। এই ট্রাকটা আমরা খুলবোই। ট্রাক না খোলা পর্যন্ত এ জায়গা ছেড়ে আমরা নড়ছি না। তোমরা এ টাকা না চাইতে পারো। কিন্তু আমি চাই। আলেক্স যাও। ভেতরে গিয়ে সিলিণ্ডারগুলো বের করো।

কিটসন ক্যারাভ্যানের দিকে পা বাড়িয়ে বললো, এ কাজ আমার একার সম্ভব নয়। গাড়িতে এগুলো ভোলার সময় জিপো আমাকে সাহায্য করেছিলো। তুমি অন্য দিকটা না ধরলে হবে না।

ব্লেক রিভলবার খাপে ঢুকিয়ে, কোনোরকম চালাকির চেষ্টা করো না, আলেক্স, ফল খারাপই হবে।

কিটসন সিলিণ্ডারের এক প্রান্ত ধরে টানলো। ব্লেক অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজের কাধ পাতলো। তারপর দুজনে অতি সাবধানে এক পা এক পা করে বাইরে এলো।

 কিটসন বাইরে এসেই আচমকা সিলিন্ডারের এক প্রান্ত কাঁধ থেকে ফেলে দিলো। সিলিন্ডারের প্রান্তটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে পলো। এই অতর্কিত আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে ব্লেক ছিটকে পড়লো।

কিটসন ডান হাতি ঘুষিতে ব্লেকের ঘাড়ে সজোরে আঘাত করলো–সে চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।

ব্লেক রিভলবার বের করার চেষ্টা করলো কিন্তু কিটসনের শরীরের তেরো স্টোন ওজন তার ওপর চেপে বসলো।

বন্যজন্তুর মতো ওরা যুঝে গেলো। একসময় ব্লেক হাঁটু ভাজ করে কিটসনের বুকে আঘাত করলো–ছিটকে ফেলে দিয়ে রিভলবার বের করতেই কিটসন ঝাঁপিয়ে পড়লে তার ওপর।

ব্লেকের রিভলবার ধৃত হাত আঁকড়ে ধরে কিটসন সপাটে ব্লেকের মুখে আঘাত করলো। একটা অস্ফুট আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে রিভলবারটা ব্লেকের হাত থেকে খসে পড়লো।

কিটসন রিভলবার কুঁড়িয়ে উঁচিয়ে ধরেছে ব্লেকের দিকে।

ব্লেক নৃশংস স্বরে, এর বদলা আমি নেবোই।

তোমার বদলা নেবার দিন চলে গেছে, এড।

সহসা সৈন্যবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একটা ছোট বায়ুন হাওয়ার ঝাপটায় ঘাসের শীষগুলোকে কাঁপিয়ে দিয়ে উপত্যকা অভিমুখে উড়ে গেলো।

ব্রেক চাপা স্বরে বললো, ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে। এখুনি ওরা উঠে আসবে এই পাহাড়ে, আমাদের পিছু নেবে।

ওরা তিনজন নিশ্চলভাবেদাঁড়িয়ে দেখলো বহুদূরে একটা ছোট বৃত্তাকার পথে বাঁক নিয়ে প্লেনটা আবার তাদের দিকে ফিরে আসছে।

চিৎকার করে বললো ব্লেক, শীগগির লুকিয়ে পড়ো। বলেই অন্ধের মতো সামনের জঙ্গলের দিকে দৌড়লো।

কিটসনও জিনিজঙ্গলের অন্য দিকে ছুটলো। ইতিমধ্যেই প্লেনটা তাদের মাথার ওপর এসে গেছে। ওরা স্পষ্ট দেখতে পেলো, খোলা ককপিট দিয়ে দুজন লোক খুঁকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

জিনি ও কিটসন পরস্পরের দিকে তাকালো।

ব্লেক চেঁচিয়ে, লুকিয়ে পড়ো, গর্দভ কোথাকার। বোকার মতন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না।

কিটসন বললো, জিনি, ওরা আমাদের দেখেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।

হ্যাঁ। আমি তো আগেই বলেছিলাম। ওরা আমাদের ধরে ফেলবেই।

 কিটসন শরীরকে যথাসম্ভব মাটিতে মিশিয়ে রাস্তা পার হলো। উপত্যকার কোল ঘেঁষে বেয়ে ওঠা রাস্তায় ক্ষীণ সাদা পটভূমিতে তার নজরে পড়লো বিপদের যান্ত্রিক রূপ।

প্রায় মাইল দশেক নীচে তিনটে গাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ছুটে আসছে। কিটসন জিনির কাছে ছুটে এলো, ওরা আসছে।

ব্লেক আড়াল থেকে বেরিয়ে, ওদের দেখা যাচ্ছে?

হা। যেভাবে ওরা গাড়ি ছুটিয়ে আসছে তাতে ওদের পৌঁছতে মিনিট দশেকের বেশী লাগবে না।

ব্লেক কাঁপা স্বরে, এখনো পালাবার সুযোগ আছে। শীগগির বুইকটা নিয়ে এসো। আমরা যদি একেবারে পাহাড়ের মাথায় চড়তে পারি। তাহলে এখনো বাঁচবার উপায় আছে।

কিটসন বললো, এখান থেকে মাইলখানেক ওপরে রাস্তা একেবারে ধসে গেছে। আমাদের হয়তো পাহাড় বেয়েই উঠতে হবে…

ব্রেক ক্যারাভ্যান থেকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটা নিয়ে এলো, আমি প্রাণ থাকতে ওদের হাতে ধরা দিচ্ছি না। কারণ বিদ্যুৎ–চেয়ার আমার পছন্দ না।

কিটসন বুইকের দরজা খুলতেই জিনি তার পাশে উঠে বসলো। জিনির শরীর কাঁপছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবো।

ব্লেক গাড়িতে উঠতেই কিটসন গাড়িটাকে চালিয়ে ঘাস জমি পেরিয়ে রাস্তায় নিয়ে এলো।

 তিনজনে একবার দুরে দাঁড়ানো ট্রাকটাকে ফিরে দেখলো।

ব্লেক নৃশংস স্বরে বলল, ওই শালারা বলেছিল এটাই পৃথিবীর নিরাপদতম ট্রাক। এখন দেখছি কথাটা কেবল প্রচারের জন্য নয়।

কিটসন ঝড়ের গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে চললো। চোখের দৃষ্টি সামনের রাস্তায় নিবদ্ধ। প্রচণ্ড গতিবেগের জন্য রাস্তার বাঁকে গাড়ির চাকা পিছলে যেতে লাগলো।

কিন্তু পাহাড়ী রাস্তায় আবার উঠতে শুরু করা মাত্রই সামরিক বাহিনীর উড়োজাহাজটা চঞ্চল হাউন্ডের মতো তাদের মাথার ওপরে ঘুরতে লাগলো।

ব্লেক খিঁচিয়ে উঠলো, ওই ব্যাটাকে যদি একবার নাগালের মধ্যে পাই। বলে ব্লেক শক্ত হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটা আঁকড়ে ধরলো।

দুর থেকে ভেসে আসা পুলিশ সাইরেনের একটানা কাতর আর্তনাদ ওরা শুনতে পেলো।

জিনি ভয়ে কেঁপে উঠলো।

গাড়ি সচল রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো কিটসনের। কারণ রাস্তাটা শত গর্ত এবং আলগা পাথরে কন্টকিত।

ওদের বাঁ দিকে খাড়া পাহাড়, যেন একটা গ্রানাইট পাথরের দেওয়াল। আর ডান পাশে অতল খাদ। নীচের উপত্যকা এখান থেকে একটা বোতামের মতো দেখাচ্ছে।

কিটসন গাড়ির গতিটা কমিয়ে আনলো, এভাবে আমরা আর বেশীদূর যেতে পারবোনা। আর একটু পরেই আমরা সেই বিধ্বস্ত অংশের মুখোমুখি হব।

কিটসন পরের বাঁকে মোড় নিতেই ব্রেক কষলো। বুইক থমকে দাঁড়ালো।

অসংখ্য পাথর, বুনো ঝোঁপরাস্তার ঠিক মাঝখানে রয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে বুইককে নিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই।

ব্লেক স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটা নিয়ে অন্যদিকে না তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে, ছুটে গিয়ে পাথর ঝোপে–ঢাকা ঢিবিটা বেয়ে উঠতে লাগলো।

কিটন তাকিয়ে দেখলো ওপরে অনেক ওপরে পাহাড়ের শুভ্র তুষারাবৃত চূড়া দেখা যাচ্ছে। জিনির হাত ধরে বললো, জিনি, আমরা ওই পথ বেয়ে ওপরে উঠবো। ওখানে হয়তো লুকোবার যথেষ্ট জায়গা থাকতে পারে। তাছাড়া ব্লেকের সঙ্গে গেলে আমাদের বাঁচবার আশাই থাকবে না।

জিনি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো, ও আমি পারবোনা, আলেক্স। তুমি একাই যাও।

কিটসন জিনিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললো।

গেলে আমরা দুজনে একসঙ্গেই যাবো। বলে সে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে উঠতে লাগলো। প্রথম একশো গজ সহজেই উঠলো, জিনিরও তেমন অসুবিধে হলো না। থেকে থেকেই কিটসন থমকে পেছন ফিরে জিনিকে উঠতে সাহায্য করছে। হাত বাড়িয়ে ওপরে টেনে তুলছে।

ক্ৰমশঃ ওদের আরোহণের গতি কমে এলো এবং সাইরেনের শব্দও আগের চেয়ে অনেক তীব্র।

পাহাড়ের বন্ধুর তলের পটভূমিতে ওরা নিজেদের বড় অসহায় বোধ করলো। কিন্তু পঞ্চাশ গজ ওপরে গেলেই ওরা বিশাল পাথরের আড়ালে সহজেই আত্মগোপন করতে পারবে। কিটসন জিনিকে বারেবারেই তাড়া দিতে লাগলো।

জিনির ডান হাত একসময় আতঙ্কে পিছলে গেলো। কিন্তু কিটসন ওকে আঁকড়ে ধরে নিরাপদ আশ্রয়ে টেনে তুললো।

অবশেষে ওরা পাথরগুলোর আড়ালে গিয়ে পৌঁছলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই এসে থামলো কতকগুলো গাড়ি ওদের ঠিক নীচেই।

ওরা নীচের রাস্তায় উঁকি মারলো কিন্তু রাস্তার একটা অংশ সামনের একটা ঝুলন্ত বিশাল পাথর আড়াল করে রেখেছে। কিটসন ডানদিকে দেখলে ব্লেক পাগলের মতো ছুটছে আর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। সামনের বাঁকে মোড় ঘুরতেই কিটসন তাকে আর দেখতে পেলো না।

কিটসন ওপরে তাকালো, সম্ভবতঃ বাঁচবার আশায়।

তাদের কাছ থেকে আরো অনেকটা ওপরে ছোট ঝোঁপঝাড়ের পর্দায় ঢাকা একটা চওড়া পাথরের আড়াল দেখে কিটসন ভাবলো, যদি ঐ পাথরের আড়ালে পৌঁছতে পারে তাহলে পুলিশের অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে ও জিনি পরম নিশ্চিন্তে আত্মগোপন করে থাকতে পারবে।

সে হাত বাড়িয়ে জিনির বাহু স্পর্শ করলো, এখন ওপরে উঠতে পারবে তো?

হ্যাঁ, চলো।

সামান্য কাছে সরে এলো জিনি। কিটসনের দেহে ওর উষ্ণ ঠোঁট জোড়ার মাধ্যমে অনুভূতি সঞ্চালিত হল।

আমি দুঃখিত, আলেক্স। এ সমস্তই আমার দোষে হয়েছে।

উঁহু, আমি তো নিজের ইচ্ছেতেই ফ্র্যাঙ্কের কথায় রাজী হয়েছিলাম। তবে দুঃখ এই, আমরা শেষ পর্যন্ত জিততে পারলাম না।

নীচে উত্তেজিত লোকজনের কথোপকথন ওদের কানে এলো।

 কিটসন ফিসফিসিয়ে, ওরা নিশ্চয়ই বুইকটা খুঁজে পেয়েছে? চলো, এগোনো যাক।

আবার ওরা পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো।

জিনি ভাবলো, কিটসন যদি পদে পদে ওকে সাহায্য না করতো, তাহলে এই খাড়াই পাহাড় বেয়ে ওঠা কোনোমতেই সম্ভব হতো না।

জিনি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। ওপরের একটা ছোট ছুঁচলো পাথরকে দুহাতে আঁকড়ে একটা গাছের শেকড়ে পা রেখে ও হাঁপাতে লাগলো, দু চোখ বোজা।

আমি আর পারছি না, আলেক্স। আর এক পাও ওঠার সামর্থ্য আমার নেই। তুমি একাই ওপরে উঠে যাও। আমার জন্য সময় নষ্ট কোরো না।

আর মাত্র ফুট খানেক ওপরেই রয়েছে সেই পাথরের আড়ালটা।

তারপর জিনির দিকে চোখ নামাতেই সে দেখলো, দূরে বহুদূরে বিস্তীর্ণ উপত্যকায় অতল গভীরতার হাতছানি।

একটা ছোট্ট কাটাঝোঁপের শেকড়কে অবলম্বন করে কিটসন ঝুলতে লাগলো। ভয়ে সে চোখ বুজলো।

জিনি কিটসনের অবস্থা দেখে চমকে উঠলো।

আলেক্স!

কোনো ভয় নেই। হঠাৎ কিরকম মাথা ঘুরে গেলো। তুমি নীচের দিকে তাকিও না জিনি। এক মিনিট–আমাকে একটু সামলে নেবার সময় দাও।

মসৃণ দেওয়ালের গায়ে লেপটে থাকা দুটো নিঃসঙ্গ মাছির মতো ওরা স্থির হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপরই আবার উঠতে শুরু করলো। পা রাখবার একটা জুতসই প্রশস্ত জায়গা খুঁজে পেতে তার দেরি হলো না।

দেখি, হাত ধরো। …এবার আস্তে আস্তে ওঠবার চেষ্টা করা। ভয়ের কিছু নেই, আমি তো ধরে আছি। 

না, আলেক্স। এতে করেও তুমি আমাকে টেনে তুলতে পারবে না, আমি তার আগেই হয়তো নীচে….

কিটসনের অধৈর্য সুর, যা বলছি করো। হাতটা বাড়িয়ে দাও।

ও আলেক্স। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি আর এভাবে ঝুলে থাকতে পারছি না। আমার হাতের বাঁধন হয়তো খুলে যাবে–

ওর হাতের বাঁধন আলগা হতেই কিটসন জিনির কব্জি চেপে ধরলো। জিনির আর্ত চিৎকার মিলিয়ে গেলো। ওর দু বাহুর শেষ প্রান্তে অসহায়ভাবে ঝুলতে লাগলো জিনি।

কিটসন জিনির শরীরের সমস্ত ওজন নিজের হাতে নিয়ে ঝুলে রইলো।

কিটসন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, জিনি! সাবধান! আমি পাহাড়ের গা ঘেঁষে তোমাকে ধরে থাকছি, তুমি পাথরের খাঁজে টাজে পা রাখবার চেষ্টা করো। তারপর তোমাকে সহজেই টেনে তুলতে পারবো। কোনো ভয় নেই। শুধু আমাকে একটু সাহায্য করো।

একটু পরেই কিটসন অনুভব করলো জিনির ওজন নেই–অর্থাৎ ও কোনো অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে।

কিটসন জিনির দিকে তাকিয়ে, ঠিক আছে–একটু অপেক্ষা করো।

দীর্ঘ এক মিনিট পর কিটসন বললো, আচ্ছা এবার এসো। বলে সে ওকে টেনে তুলতে শুরু করলো।

চওড়া পাথরটায় পৌঁছেই জিনি অবসন্নভাবে কিটসনের পাশে বসে পড়লো।

 ওরা তখন গুলির শব্দ শুনতে পেলো। জিনি ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।

গুলির শব্দটা এসেছে নীচের থেকে ওদের ডান পাশ থেকে

কিটসন অতি সাবধানে ঝুঁকে দেখলে বুইকটা এবং তার কাছাকাছি দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ি তিনটে নীচের রাস্তায় রয়েছে।

রাস্তার অবরোধের ঠিক পেছনেই অতি সন্তর্পণে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে দশজন সৈনিক ও তিনজন পুলিশ অফিসার।

সেখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটা বাঁকের আড়ালে রয়েছে ব্লেক। দুটো ছোট ছোট গোলাকার পাথরকে সে আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে সামনে রেখেছে। তার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে ব্লেকের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের নল।

ব্লেকের থেকে আরো পঞ্চাশ গজ দূরে একটা জীপদাঁড়িয়ে পাশেই তিনজন সৈনিক–ব্লেকের আড়ালে।

জীপটা নিশ্চয়ই পাহাড়ের অপর দিক দিয়ে উঠে এসেছে এবং ব্লেককে ফাঁদে ফেলেছে। ব্লেককে অনুসরণ না করে সে মনে স্বস্তি পেলো।

ব্লেকের সোজাসুজি একজন সৈনিক মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। তার মাথার একটা ক্ষত থেকে রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে।

বাঁকটার কাছে এসে সৈনিকের দল থামলো–ব্লেকের দৃষ্টির আড়ালে। ব্লেকের কাছ থেকে ওদের দূরত্ব মাত্র কুড়ি ফুট।

একজন বেঁটে খাটো মেজর তার সোনালী চুলে ঢাকা মাথাটা অতি সাবধানে সামনে উঁকি মারলো। কিন্তু মৃত সৈনিকটাকে দেখামাত্রই ব্যস্তসমস্তভাবে সে মাথাটা ভেতরে টেনে নিলো।

সে চিৎকার করে উঠলো, আমরা জানি, তুমি ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে। অতএব মাথার ওপর হাত তুলে বাইরে বেরিয়ে এসো। চুপচাপ বেরিয়ে এসে ধরা দাও।

জিনি আস্তে আস্তে কিটসনের পাশে এসে নীচে তাকালো।

মেজর চিৎকার করলো। তুমি নিজেই বেরিয়ে আসবে, না আমরা গিয়ে তোমাকে টেনে বার করবো?

ব্লেক নৃশংস, আতঙ্কিত স্বরে, আয় শালা, আমাকে ধরবি আয়। আয়–তারপর দেখ, কেমন দাওয়াইটা তোদের দিই।

মেজর একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে কি যেন বলে আর একজন সৈনিকের কাছে এগিয়ে গেলো। তার সঙ্গে আলোচনার পর সৈনিকটি তার রাইফেল আর একজন সহকর্মীর হাতে তুলে দিলো। তারপর পকেট থেকে ক্ষুদ্রাকৃতি কি একটা হাতে নিয়ে সন্তর্পণে এগোতে লাগলো।

কিটসন রুদ্ধশ্বাসে সব লক্ষ্য করে চললো।

 রাস্তার বাঁকের কাছে পৌঁছেই সৈনিকটি থামলো।

 মেজর আবার চিৎকার করলো, এই তোমার শেষ সুযোগ। এখনো বাইরে বেরিয়ে এসো।

 ব্লেক একটা অশ্রাব্য খিস্তি করে উঠলো।

মেজর বললেন, ঠিক আছে, তাহলে তাই হোক।

সৈনিকটি সেই ছোট্ট জিনিসটাকে ছুঁড়ে দিলো। ওটা পাক খেতে খেতে নীচে পড়তে লাগলো।

 জিনি কিটসনের কাঁধে মুখ ঢাকলো।

 কিটসন চিৎকার করে ব্লেককে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো। তাহলে ওরা আমাদের উপস্থিতি জেনে যাবে।

ব্লেক যে পাথর দুটোর আড়ালে ছিলো, গ্রেনেডটা ঠিক তার সামনে গিয়ে পড়লো।

কিটসন দু হাতে মুখ ঢাকলো। গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দটা অস্বাভাবিক তীব্র শোনালো। ছোট ছোট আলগা পাথরগুলো গড়িয়ে পড়ার শব্দ কিটসনের কানে এলো।

এক হাতে জিনিকে আঁকড়ে ধরে সে আস্তে আস্তে ভেতরে সরে এলো।

কিটসনকে দু হাতে জাপটে ধরে জিনি থর থর করে কাঁপছে।

হঠাৎ একজন চিৎকার করলো, এখানে তো মাত্র একজন। আর দুজন তাহলে গেলো কোথায়? মেয়েটাও তো এখানে নেই!

কিটসনের চঞ্চল আঙুল তখন জিনির চুলে বিলি কেটে, ভয় পেয়ো না। ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না। এই পাথরের আড়ালে আমাদের খোঁজ করার কথা ওদের মাথায় আসবে না।

তখনই শুনতে পেলো কোনো বায়ুযান উড়ে আসার শব্দ।

কিটসন জানতো, ওপর থেকে নজর ফেললে তাদের খুঁজে পেতে সময় লাগবে না। কারণ মসৃণ পর্বতপৃষ্ঠে তাদের শরীর দুটো মিনারের মতোই প্রকট।

জিনি প্রাণপণে চেষ্টা করলো নিজের শরীরটা কিটসনের শরীরে মিশিয়ে ফেলতে। যেন কোনো আতঙ্কিত পশু দিশেহারা হয়ে তার গর্তে ঢোকবার চেষ্টা করছে।

কিটসন আতঙ্কিত চোখে সম্মোহিতের মতো বায়ুযানটির দিকে চেয়ে রইলো।

প্লেনটা ওদের ঠিক ওপর দিয়েই উড়ে গেলো। ওপরে চোখ রাখতেই কিটসন দেখলো, প্লেন চালক জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাদের দিকেই দেখছে।

কিটসন যেন মানসচক্ষে দেখতে পেলো, প্লেনচালক তার বেতারযন্ত্রে খবর পাঠাচ্ছে। নীচের রাস্তায় দাঁড়ানো লোকগুলোকে জানিয়ে দিচ্ছে পলাতকদের সন্ধান সে পেয়ে গেছে।

জিনির মুখটা আলতো করে তুলে ধরে কিটসন বললো, জিনি, আমার কথা শোন। ব্লেক ঠিকই বলেছিলো। কারণ এখন দেখছি মরণ কারাগারে যাবার ইচ্ছে আমারও নেই। কিন্তু তোমার এখনো বাঁচবার সুযোগ আছে। তোমাকে ওরা দশ বছরের বেশীকারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেনা। তোমার বয়েস অনেক কম। দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে যাবে। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে তুমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। তুমি বরং এখানেই থাকো পুলিশের লোক এসে তোমাকে নামিয়ে নিয়ে যাবে।

আর তুমি?

আমি এখান থেকে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেবো। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এ পৃথিবী ছেড়ে নিষ্ক্রমণের পথ। আমি কিছুতেই মরণ কামরায় পা রাখতে পারবো না।

আমরা একসঙ্গেই যাবো, আলেক্স। এতে আমি ভয় করি না। কিন্তু দশবছরের নিঃসঙ্গ জীবনকে আমি ভয় পাই। আমরা একসঙ্গেই যাবো।

হঠাৎই কোনো স্বরবর্ধক যন্ত্রে একটা কর্কশ আদেশ ভেসে এলো। এই তোমাদের দুজনকে বলছি। নীচে নেমে এসো। আমরা জানি তোমরা পাথরের ওপরেই লুকিয়ে রয়েছে। আমরা রক্তপাত চাই না বলেই বলছি, চুপচাপ নেমে এসো।

তুমি থাকো, জিনি

না। তা হয় না।

সামনে ঝুঁকে কিটসন জিনিকে সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরে আবেগ ভরে চুমু খেলো। জিনি, মনে আছে ফ্র্যাঙ্ক কি বলেছিলো? হাতের মুঠোয় পৃথিবী। কে জানে, আমাদের সেই ইচ্ছার বাস্তব রূপ বোধ হয় এই পরিণতি, হয়তো সে ইচ্ছাপূরণ এই পৃথিবীতে সম্ভব নয়। তার জন্য রয়েছে অন্য পৃথিবী যে পৃথিবীর সন্ধানে আমরা চলেছি।

ওরা দুজনে হাত ধরাধরি করে উঠে দাঁড়ালো।

ওরা নীচের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো পুলিশ ও সৈনিকদের দিকে তাকালো। তাদের রাইফেলের নল ঊর্ধ্বমুখী।

কিটসন চিৎকার করে উঠলো, ঠিক আছে। আমরা আসছি।

সে জিনির দিকে তাকালো, তুমি কি প্রস্তুত?

 জিনি আরো শক্ত করে কিটসনকে আঁকড়ে ধরলো, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো, আলেক্স। আমি প্রস্তুত।

নীচের দাঁড়ানো লোকগুলো দেখলো, ওরা মসৃণ পাথরের আশ্রয় ছেড়ে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিলো। পাহাড়ের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে, এলোপাথাড়িভাবে সত্যি সত্যিই ওরা দুশো ফুট নীচের রাস্তায় নেমে আসতে লাগলো।