৪. প্যারিসে বৈকালিক কনফারেন্স

ঊনত্রিশে মে, শুক্রবার :

পরেরদিন সকালবেলা। প্যারিসে বৈকালিক কনফারেন্সের জন্যে চারজন নিরাপত্তা প্রধান মিলিত হয়েছে। ঠিক তখনই মার্টেলের লঞ্চ কোনস্ট্যানজ লেকের পূর্বদিকে তীরভূমিতে একটা দুরুহ অবতরণের জায়গার দিকে এগিয়ে চলেছে।

উইন্ড সার্ফার এগজিকিউসান স্কোয়াডের প্রধান ওয়ার্নার হেগেন হাত পা বাঁধা অবস্থায় অসহায়ভাবে লঞ্চের নীচে পড়েছিল।

মুখটা বাঁধা। একটা কাপড় দিয়ে চোখ দুটোও বাঁধা। তা সত্ত্বেও ও ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, মুখে সুর্যের উত্তাপ অনুভব করতে পারছিল।

মার্টেল প্রস্তুতি নিল। ক্লেয়ারও ওকে সাহায্য করছিল। কুয়াশা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

সামনেই তীরভূমিতে পাথরের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সামনে ভাঙা কাঠের সিঁড়ি।

–শব্দটা বন্ধ করে দাও। ক্লেয়ার বলে উঠল, এ জায়গাটা আমি চিনি। এখানেই আমি মিউনিখ থেকে যখন ওয়ার্নার এসেছিল দেখা করেছিলাম। এ সামনের গাছগুলোর তলায় আগের রাতে একটা গাড়ি ভাড়া করে এসেছিলাম। ওখান থেকেই কাছাকাছি স্টেশনে গিয়ে লিন্ডা পৌঁছানো যায়।

–আমি তো গাড়ি…।

কি বলছো। ক্লেয়ার সামান্য কঠিন হয়ে বলল, জায়গাটা ঢালু, সমস্যাটা বুঝেছো তো মার্টেল?

বুঝেছি। সমস্যাটা যখন আমার…

–কিন্তু, আমরা কোথায় ড্রাইভ দেবো বুঝতে পারছি না।

–সেই সোনালী চুলের যুবকটাকে সেখানে অভিনন্দন জানাবো…।

-ওয়ার্নার হেগেনকে বয়ে নিয়ে এসে ও গাড়ির মেঝেতে ফেলে দিলো। জানলা দিয়ে বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তারপর একটু বিশ্রাম নিতে লাগলো। দূরে একটা ওয়াটার মিলের ধ্বংসাবশেষ।

ক্লেয়ারের বর্ণনা মতে সবই ঠিকঠাক। এখানে মিলের উদ্দেশ্য কি কে জানে। কিন্তু বেশ কিছু ঘুরন্ত হুইল দেখা যাচ্ছে।

মার্টেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল, ব্লেডগুলো বেশ ধারালো।

–হুঁ, ও নিশ্চিত বলে উঠল, এটা কাজ করবে…।

—কি কাজ করবে?

–পুরোনো চীনা ওয়াটার টর্চার-এর আমার নতুন ব্যাখ্যা। সোনালী যুবক…।

ওরা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। জার্মানটাকে বয়ে নিয়ে আসতে দুজনকেই পরিশ্রম করতে হলো। আর এগোনোর আগে মার্টেল ক্লেয়ারকে মুখোশটা পরে নিতে বলল।

মুখোশটা পড়ে নিয়ে ক্লেয়ার মার্টেলের কাছে গেল সাহায্যের জন্যে। মার্টেল তখন প্লাটফরমের হুইলটার দিকে তাকিয়েছিল। হুইলের যে অংশটা ঘুরে যাচ্ছিল সেখানে হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে একটা ব্লেডের সঙ্গে আটকে দিলো। মাথাটা এমনভাবে রাখা হল জলের মধ্যে অর্ধেকটা রইল। দেহটা ওপরদিকে। কাজটা শেষ করতে লাগল দশ মিনিট। ওর বাঁধা চোখ দুটো খুলে দেওয়া হলে সামনে মার্টেলকে দেখে ওর চোখ বিস্ফারিত হল। ক্লেয়ারের আঙুলগুলো ওর মুখের ওপর।

মুখে মুখোশ পরে, মার্টেলের জ্যাকেট পরে, হাতে পিস্তল নিয়ে ক্লেয়ারকে নৃশংস খুনীর মতো লাগছিল।

এরপরে হুইলটা জলের নীচে চলে যেতে হেগেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই কঠিন পরীক্ষায়। উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

চাকাটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথাটাও ঘুরতে লাগলো। ও এবারে জ্ঞান হারাতে পারে।

 মার্টেল নদীর তীরের দিকে এলো। হুইলটা একইভাবে ঘুরে চলেছে। আকাশটা ধূসর।

আমরা এখন কথা বলতে পারি। ও আস্তে আস্তে ডুবছে। মার্টেল বলল।

ডুবুক। কঠিন স্বরে বললো, মুখোশটা মুখ থেকে খুলে ফেলে বলল, চার্লসকে যারা নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল ও তাদেরই একজন…।

মার্টেল ওর দিকে তাকাতেই বলল, ওকে ছাড়বে কখন?

–যতক্ষণ না ওর প্রতিরোধ শক্তি ভেঙে যাচ্ছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ও সব কথা বলছে। আমার এখনও আশা অনেক কিছুই…।

এদিকে হেগেনের অবস্থা অচৈতন্যের পর্যায়ে এসে গেছে। ক্লেয়ার মুখোশ পরে নিলে তারপর দুজনে প্লাটফরমের দিকে চলল।

মার্টেল ওর পায়ের বাঁধন কেটে ওকে তীরে নিয়ে এল। আস্তে আস্তে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। ক্লেয়ার বন্দুক তাক করে বসে।

খানিক বাদে মার্টেলের প্রশ্ন, তুমি কে বলতো?

রেইনহার্ড দিয়েত্রিচের ভাইপো…।

–তোমার নাম?

–ওয়ার্নার হেগেন। তুমি তো জানো…।

 –আমার প্রশ্নের শুধু ঠিক ঠিক জবাব দিয়ে যাও।

এরপর মার্টেল আবার জিজ্ঞেস করল, অপারেশন ক্রোকোডাইল ডেলটার দিন কবে ঠিক করা?

–তেসরা জুন। নির্বাচনের আগের দিন। ও থামল। আস্তে আস্তে ও ধাতস্থ হয়ে উঠছিল। ক্লেয়ার ওর দিকে পিস্তল তুলে ধরে রইল।

মার্টেলের দিকে তাকিয়ে হেগেন বলল, তুমি ওকে একটু থামাও। উত্তর তো দিচ্ছি। এই খারাপ ব্যাপারটা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই। কোথাও একটা গোলমাল…।

–তুমি বলছ তেসরা জুন। কিন্তু তুমি আরো কিছু…।

মার্টেলের কথার মাঝখানে হেগেন বলে উঠল, জায়গাটা হলো সামিট এক্সপ্রেস যখন ব্যাভেরিয়া অতিক্রম করবে।

সবই আমরা জানি। মার্টেল বলল, ওয়ার্নার লন্ডনের খবর। মার্টেল সিগারেট টেনে বলল, আমি ব্যাপারটা তোমার কাছে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম।

হেগেন বিস্মিত হয়ে বললো, তুমি সব জানো?

–হ্যাঁ, আর যা জানো বলল। সামিট এক্সপ্রেসে কি ঘটবে?

–চারজন পশ্চিমী নেতার মধ্যে একজন খুন হবে।

 মার্টেল নিস্পৃহ অভিব্যক্তিতে জিজ্ঞেস করল, লক্ষ্যটা কে?

লক্ষ্যটা কে সত্যিই জানিনা। ঈশ্বরই জানেন…।

হেগেন আতঙ্কে বলে উঠলে মার্টেল জিগ্যেস করল, তুমি এসব জানলে কিভাবে?

কারণ আমি দিয়েত্রিচের ভাইপো।

 মার্টেল জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে বলেছো কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে? কি সেই গণ্ডগোল?

–আমি নিশ্চিত নই।

-আমি কিন্তু জবাব চাই। কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল মার্টেল।

-আমার কাকা সম্ভবতঃ সামনের নির্বাচনে ব্যাভেরিয়াতে ফিরে আসছে। কারণ জনগণ আমাদের চায়। ওদের ভয় বলশেভিক উফলারকে।

ওর মুখের ভাব খানিকটা বিব্রত। আবার বললো, কিন্তু যত তাড়াতাড়িই মিলিশিয়াদের জন্যে অস্ত্রশস্ত্র, পোষাক এসব করতে যাবো, বি.এ. ডি খুঁজে তা বের করত, সম্ভবতঃ কেউ খবর দিচ্ছে…।

মার্টেল জিজ্ঞেস করলো, ঐ নেতাকে কে খুন করবে?

হেগেন আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু কষ্ট হচ্ছিল, তারপর বলল, আমি ঠিক জানিনা। তবে ওদের নিরাপত্তা প্রধানের চারজনের মধ্যে একজন…।

শুনেই মার্টেলের কেমন যেন মনে হচ্ছিল। স্বাভাবিক হয়ে সেই সুযোগে হেগেন ক্লেয়ারের মুখে সজোরে একটা ঘুষি মারতে ও ছিটকে পড়েও পিস্তলটা তাক করে রইল। লোকটাকে এখনও বাঁচিয়ে রাখা দরকার। এবারে ওর মাথাটা মিলটার দিকে এগিয়ে যেতে সজোরে একটা পাথরে ধাক্কা খেল। আর্তনাদ করে উঠলো। মিলের ধাতব ব্লেড ওর মাথার একপাশে লাগতেই ও নির্জীব হয়ে গেল। মাথাটা জলের ভেতর। রক্তে জল লাল হয়ে উঠল।

ক্লেয়ার হেগেনের কাছে গিয়ে মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা করবার পর মার্টেলকে বলল, মারা গেছে। আমরা এখন কি করব?

–ওকে নিয়ে যেতে হবে। এখনই স্টোলার আর ডরনারের সঙ্গে দেখা করা দরকার। টুইডকে ফোন করতে হবে।

লিন্ডাউ পুলিশ স্টেশনে ওরা পৌঁছলো। বর্ষাতি ঢাকা দেওয়া মৃতদেহটা গাড়ির পেছনে।

ডরনার জানালো, এরিখ স্টোলার তোমাকে একটা খবর জানাতে বলেছে। নিরাপত্তা বিষয়ক কনফারেন্সে ও প্যারিসে গেছে। আমি হেগেনের ব্যাপারে সমস্ত কিছু করবো। ওকে মিউনিখ মর্গে নিয়ে যেতে বলেছে। লন্ডনে ফোনের ব্যাপারে…।

ডরনার ওদের গাড়িতে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। জার্মান ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলো। ওদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা ওরই হাতে।

ডরনারের কথামতো লন্ডনে ফোন করল। টুইডের কণ্ঠস্বর শুনে মার্টেল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলার আগেই টুইড প্রাথমিক ব্যাপারগুলো সেরে নিলো।

…অপারেশন ক্রোকোডাইল। কেইথ, তুমি ঠিক এখন মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ জার্মানীর ম্যাপটা দেখ। কেপকোন্ট্যানজকে ভাল করে লক্ষ্য করো, দেখবে জায়গাটা কুমীরের মতো…তাইনা?

-হ্যাঁ। ঠিক। ব্যাভেরিয়াই কর্মকাণ্ডের উৎসস্থল। রেইনহার্ডের ভাইপো হেগেনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অবশ্য ও এখন শেষ।

চারজন ভি. আই. পির একজন খুন হবে সামিট এক্সপ্রেসের মধ্যে। সব ঠিকঠাক। শুনতে পাচ্ছো।

–হুঁ। ওদের নাম্বার দাও। ফোন নাম্বার, লক্ষ্য বস্তু…।

–সেই ইনফরমার তা বলতে পারেনি।

যাই হোক, আমাদের সাবধান হতে হবে। এ ব্যাপারটা আমি পেয়েছি। খুনির পরিচয়? মার্টেল ওর প্রশ্নে থতমত খেলো৷ টুইড ওর সম্পর্কে কি ভাবছে? ডরনার সুইচ বোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে, সুতরাং শোনার মত কেউ নেই।

ব্যাপারটা আমি বুঝেছি। হেগেনের খবর ঠিকই। আমার জাজমেন্টকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো।

–আচ্ছা।

-হ্যাঁ, চারজন সিকিউরিটির একজন সম্ভবতঃ খুনী। ভি. আই. পি-দের ওরাই গার্ড দেবে। কিন্তু না…।

–ঠিক আছে।

–আমার বিচারকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো।

 –আচ্ছা।

 টুইডের কাজ সময়ের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলে। এরপরে ও ক্যাবে চড়ে পার্ক ক্রিসেন্টে যাওয়ার উদ্যোগ করতে লাগল। এদিকে উচ্চাকাঙ্খী মনোভাবের হাওয়ার্ড সিকিউরিটি মিটিং কোথায় হচ্ছে কাউকে কিছু না বলে প্যারিসে চলে গেছে। হাওয়ার্ড চারজনের মধ্যে একজন। সুতরাং সন্দেহ…।

নাঃ, টুইড সমস্ত নিয়মনীতি মেনেই কাজ করে। ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হেনরীক্র্যাফোর্ড-এর সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু ফরেন অফিসে বন্ধুকেই আগে ফোন করা দরকার।

খুব জরুরী। টুইড বলল, আমি একটা সিগন্যাল পাঠাচ্ছি। দু-ঘণ্টার মধ্যে ওটা রাষ্ট্রদূতের কাছে অবশ্যই পৌঁছবে।

–অ্যামবাসীতে ফোন করে আগে জেনে নাও ও আছে কি নেই। ও সঙ্গে সঙ্গে অ্যামবাসীতে ফোন করলো। রাষ্ট্রদূত অফিসেই ছিল। জানালো কোনরকম সমস্যা নেই। সিগন্যালটা আসা অবধি ওর নিশ্চয়ইক্র্যাফোর্ডকে সহানুভূতিশীল মনে হলো। টুইড ফরেন অফিসে যোগাযোগ করার জন্যে ক্যাবে গিয়ে ঢুকল।

–আমি স্যার ক্র্যাফোর্ড-এর সঙ্গে কথা বলেছি। আরাম চেয়ারে বসতে বসতে ও বলে উঠলো ঘরের মধ্যে অন্য একজন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু খবরটা কি?

–ঠিক হয়েছে ডিউটি থেকে অপদার্থ ক্লার্কটিকে বিছিন্ন করতে হবে। তুমি কিছু মনে করবেনা নিশ্চয়ই।

টুইড বিনীতভাবে ঢুকতে গেলো। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।বাইরে থেকে ঢুকলে সে প্রাইভেট ফোর্ড ব্যবহার করে। টুইড একেবারে নিশ্চুপ। চশমাটা ঠিক করতে লাগলো আর এগোতে লাগল।

–আমার সঙ্গে এসো। বলে উঠল।

 দশ মিনিট পরে সিগন্যাল প্যারিসে যাত্রা করল। এবারে টুইডের পার্ক ক্রিসেন্টে যাওয়া দরকার। ক্যাবে উঠে বসলো।

দিনটা অত্যন্ত বর্ণময়। রাষ্ট্রদূত নিজেও বিষয়বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এরপর রাষ্ট্রদূত নিজে কনফারেন্স রুমে হাওয়ার্ডকে খবরটা জানাবার উদ্যোগ নিলো। এর পরে হাওয়ার্ড তিনজন সিকিউরিটি চীফকে খবরটা জানাতে বাধ্য হবে।

–আমার ধারণা আমি যদি থাকতাম তাহলে, খবর পড়ার সময় ওদের অভিব্যক্তি দেখতে পেতাম।

চ্যারিং ক্রস রোডে ঢোকার মুখে, টুইড বলে উঠল, একজনের অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই বদলে যেতো।

চারজনের মধ্যে যে কোন একজন…।

টুইড ম্যাকনেইলকে সবকিছু বুঝিয়ে বলল। ওরা দুজন রিজেন্ট পার্কে ঢুকছে। জায়গাটা আলোকিত। টুইডের পায়ের নীচে ঘাস। সবকিছু ঠিকঠাক, এখন সমস্যা সময়ের। এটার সমাধান করতেই হবে।

–ও’মিয়েরা, স্টোলার, আর ফ্ল্যান্ড্রেস।

–-হাওয়ার্ডের কথাটা ভুলে যেওনা।

–আমি ঠিক খুঁজছি? ম্যাকনেইল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো।

একটা গ্যাপ। টুইড একটা সবুজ গাছের নীচে থামল।

জীবনের গ্যাপ রেকর্ড চারজন বিশ্বস্ত লোকের মধ্যে একজন। ও নিশ্চয়ই লোহার পর্দার আড়ালে চলে যাবে। আমি নিশ্চিত, অনেকদিন আগে থেকেই লোকটা…।

–হাওয়ার্ডের ব্যাপারটা একবার পরখ…।

-তোমার একটা কাজ আছে। সেন্ট্রাল রেজিস্টার ফাইলগুলো দেখবার একটা যুক্তি দেখাতে হবে। আমি চিন্তা করছি…।

হঠাৎ টুইডের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। বললো, ম্যাকনেইল মজার ব্যাপার। একটা কু পাওয়া গেছে। যদি…।

–হাওয়ার্ড-এর থেকে টিম ও’মিয়েরা কোন অংশে কমনয়। এক বছরই কেবল ও প্রেসিডেন্ট সিক্রেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিল।

সেজন্য আমাকে ওয়াশিংটন যেতে হবে, যদি সীট পাই। আমি জানি ওখানে কেউ আমাকে সাহায্য করবে না। ও ও’মিয়েরাকে পছন্দ করেনা। একটা ছোট ব্যাপার অনেক সময় দরজা খুলে দেয়।

–হাওয়ার্ড জানতে চাইবে, ও সতর্ক করে দিলো। এছাড়াও কনফোর্ড-এর টিকিট-এর খরচের ব্যাপারটা হিসাবে থাকবে।

না, না হবেনা। আমার নিজের পয়সা দিয়েই টিকিট কিনেছি। আমার কাকার কিছু সম্পত্তি আছে। হাওয়ার্ড ফিরে আসার আগেই আমার কাজ হয়ে যাবে। ওকে বলবে আমার হাঁপানিটা : বেড়েছে। সেজন্যে আমি ডেভেন কটেজে গেছি।

ও চেষ্ট করবে যোগাযোগের..। কিন্তু, আমবাসাডারের পাঠানো সিগন্যাল টুইড ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো। চারিদিকে তাকিয়ে তারপর বলল, আমার কোন সন্দেহ নেই যখন ও ফিরে আসবে, তখন ওর প্রথম কাজের ব্যাপারটা আমার অফিসে পৌঁছে গেছে। কটেজের ব্যাপারটা আসলে ধোঁকা।

কথা শেষ হলে ওর অভিব্যক্তিটা কেমন কঠিন লাগলো। বললো আবার, ও ভাববে হয়ত, কয়েকদিনের জন্যে ওকে আমি পাশ কাটাচ্ছি। কিন্তু ও মোটেই ভাববে না যে, আমি অ্যাটলান্টিক পেরিয়ে কোথাও গেছি।

ম্যাকনেইল সামনের দিকে তাকালো।

ঘুরে তাকিও না। ম্যাসন আমাদের ঠিক পেছনে। সঙ্গে আবার একটা কুকুর…।

টুইড চশমাটা খুললো। পরিষ্কার করে লোকটাকে একবার দেখল। ওর চশমার কাঁচে ভেসে উঠল পাতলা ডেপুটির প্রতিমূর্তি যাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে সম্প্রতি নিয়োগ করা হয়েছে। একটা গাছের তলায় ও থামলো।

–আমি তো কুকুরের চেয়ে মানুষ বেশি পছন্দ করি। টুইড চশমাটা পড়ে নিয়ে সামনের দিকে এগোলো। বললো, লিস্টে ওর নামটাও সোজা করো। যদি কেউ গুরুত্বপূর্ণ গরমিল খুঁজে পায়, তাহলে তুমি…।

মাঝপথেই থেমে গেল ও।

রাতের জন্য একটা ঘর রিজার্ভ করে রেখেছে। হোটেলটা বড়ই। ফ্রান্সের অভিজাত হোটেলই বলা যায়। অতিথিদের জন্যে ও অপেক্ষা করছে। পার্ক ক্রিসেন্টে একটা কল করলো।নাইট ডিউটির অপারেটরটা ছিল।

টুইডের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই, একটু আবেগের সঙ্গে ও বললো।

–এক মিনিট স্যার। আমি একেবারে ওর অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে নিচ্ছি।

হাওয়ার্ড ঘড়িটা একবার দেখল। দশটা পঁয়তাল্লিশ। ও নিজেও খানিকটা ডিসটার্বড়।টুইড পার্ক ক্রিসেন্টের মধ্যে রয়েছে। বিল্ডিং একেবারেই ফাঁকা। ফোন করবার পরেই ব্যাপারটা ও অনুভব করতে পারলো। তারপরেই ও প্রান্ত থেকে ম্যাকনেইলের কণ্ঠস্বর শুনে ও সতর্ক করে দিলো এটা প্রকাশ্য ফোন।

–আমি আমার হোটেলের ঘর থেকে ফোন করছি। টুইডের সঙ্গে আমার জরুরী দরকার…।

–আমি বলতে ভয় পাচ্ছি যে টুইড ভীষণ অসুস্থ। অবশ্য এমন কিছু সিরিয়াস ব্যাপার নয়। হাঁপানির আক্রমণ। কয়েকদিনের জন্য ও একটু দেশে গেছে।

–তাহলে ওকে ফোনে পাওয়া সম্ভব নয়?

–এখন হবেনা বলেই মনে হচ্ছে। আবার কখন পাওয়া যাবে তোমাকে?

বলা মুস্কিল। আচ্ছা শুভরাত্রি। কঠিন মুখে ফোনটা রেখে বিছানায় বসে রইল চুপচাপ খানিকক্ষণ। ওর ভবিষ্যতের গতিবিধি আগে থাকতে জানানো ওর ভীষণ অপছন্দ।

এদিকে পার্ক ক্রিসেন্ট অফিসে ফোনটা রেখেই মিস ম্যাকনেইল নিজের মনেই মৃদু হাসল। একটা ব্যাপারে ও নিশ্চিত যে শেষ প্রশ্নটা করবার আগেই হাওয়ার্ড লাইনটা ছেড়ে দিয়েছিল। ওর সামনে রাখা ডোসিয়ারটা পরীক্ষার জন্যে আবার ফিরে এলো। ওটার মধ্যে একটা লাল তারা রয়েছে। ক্লারিফিকেশানটা সত্যিই উঁচুদরের। কভারের ওপর নামটা লেখা আছে। ফ্রেডেরিক অ্যান্টনী হাওয়ার্ড।

ওদিকে প্যারিসে হাওয়ার্ড অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারী করছিল। মাঝে মাঝেই ঘরের দরজায় কে যেন টোকা মারছে। টোকার সংকেত দেখেই বুঝতে পারছে, ও অ্যালেন ফ্ল্যান্ডেস। সিগন্যালের উত্তরে ফ্ল্যান্ড্রেস ওকে যে ৭.৬৫ এম, এম.-এর যে পিস্তলটা ব্যবহার করতে দিয়েছিল সেটা বের করে পকেটে গুঁজে রাখলো। তারপর দরজা খুলতেই কোডে একটা কথা বলে উঠল।

ও ঘরের মধ্যে ঢুকে কথা বলে খানিকটা মৃদু হাসলো। ওর কালো তীক্ষ্ণ চোখ ঘরের সর্বত্রই ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

-কে চেজ? হাওয়ার্ড জানতে চাইল।

–বেনেয়ট। ওরা প্যারিসের সমস্ত জায়গাতেই ভাল খাবার পরিবেশন করে। শেষ পরিবেশন ছিল রাত নটায়। কিন্তু আমার ব্যাপারে লে প্যাট্রন ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে। ওখানে অবশ্য পুলিশ আছে। তুমি প্রস্তুত। ভাল…।

ফ্ল্যান্ড্রেস বলে উঠল, লন্ডন থেকে আমি টেলেক্স করেছিলাম। কার্লোসকে সকালে পিকাডিলীতে দেখা গেছে যে ব্যাপারে তুমি বিরক্ত হয়েছিলে? তুমি অবাক নয়? কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে? সকালে তুমি লন্ডনে ছিলে তো?

এরপর ওরা পরস্পর টেলেক্স এর ব্যাপারে আলোচনা করলো। এখন ও মোটামুটি বুঝেছে যে কিছু একটা ব্যাপার ইংরেজটাকে বিব্রত করছে। কোথাও যেন একটা গোপনীয়তা…।

***

শনিবার, তিরিশে মে :

ওয়াশিংটন ডিসি, ক্লিন্ট লুমিস… ওয়ার্নারের মৃতদেহের পোষাক থেকে যে নোটবুক পাওয়া গেছে তাতে আর বেশি এগোনো যায়না।

কনকেডি যখন সঠিক সময়ে ডালাস বিমান বন্দরে নামলো তখন টুইড জনতার মাঝখান দিয়ে নামতে লাগল। চশমাটা খোলা অবস্থায় মুখটা অনেকটাই বদলে গেছে।

টুইড ক্লিন্ট লুমিসকে নিয়ে সোজা একটা নীলচে সেডানে উঠে বসলো। লুমিস সবদিক দিয়েই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।

রোদ ঝলমলে দিন। কিছু মামুলি কথাবার্তার পর লুমিস বললো, তুমি ওকে রিপোর্টটা দেবে, সে যাতে বোঝে তুমি কাজটা করে যাচ্ছো। লুমিস খানিক বাদে আবার বলে উঠল, বিমানবন্দরে আমাদের কেউ অনুসরণ করেনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। লুমিসের অনেক কিছু ব্যাপার টুইডের ভাল লাগে। সবেগে চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে সমস্ত কিছু দেখতে দেখতে টুইড বলে উঠলো, আমাদের পেছনে একটা সবুজ গাড়ি আসছে। আমরা কি…।

লুমিস দেখে নিল তার পেছনে দুটো গাড়ি। ডালাস থেকেই গাড়ি দুটো ওদের পেছনে আসছে। লুমিস খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লে টুইডই ওকে সাহস দিলো। খানিকটা বাদেই ট্রাকটা হুড়মুড়িয়ে প্রায় ওদের ওপরে এসে পড়লো। লুমিস চীৎকার করে উঠলো। আলো…।

রাবারের একটা আর্তনাদ। টুইড ততক্ষণে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। আলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আবার দ্বিতীয় আর্তনাদ। এয়ার ব্রেক জ্যাম হয়ে গেছে।

আমরা প্রায় মারা পড়েছিলাম।

টুইড আয়না দিয়ে দেখল গাড়ি এগোচ্ছে। আর কোন বাধা আপাততঃ নেই।

মিটিং এর জায়গাটা অদ্ভুত। পটোম্যাক নদীর ওপরে বয়াতে বাঁধা একটা পাওয়ার ক্রুজার। টুইড প্রথমে সাইনপোস্ট দেখে পরে লুমিসের সহযোগিতায় রাস্তার পূর্বদিক ধরে এগোচ্ছিল। অবশেষে পৌঁছানোর পর ওকে নদীবক্ষে যেতে হবে।

-ওটা তোমার নাকি? ক্রুজারটার দিকে আঙুল দেখিয়ে টুইড জিজ্ঞেস করল।

–হুঁ, ওটা আমার নিরাপত্তা বলতে পারো…।

টুইড আশ্চর্য হয়ে ভাবল ওয়াশিংটনে ওর সদর দপ্তরেই অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। ক্লিন্ট লুমিস সি. আই. এর অবসরপ্রাপ্ত। তবুও যেন কেমন নার্ভাস-প্রকৃতির। একটা বিচিত্র নৌকোয় চেপে ক্রুজারের দিকে দুজনে এগিয়ে চললো। ক্রুজারে একটা কুকুর আছে। কোন অনুপ্রবেশকারীকেই রেয়াৎ করে না। টুইড জিগ্যেস করল, এই কুকুরটা?

–ও নদীতে সাঁতার কাটতে পারে। লুমিসের মুখে বেশ স্বস্তির ভাব। বসার পর ও আবার বলতে শুরু করল, ওয়াডলো বিস্ফোরকের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। যে কারণে ওকে আমরা ডেকে দেখতে যাই। কোন অনুপ্রবেশকারীই ক্রুজারে থাকতে পারেনা। ওয়াডলো মারা যেতে পারে কিংবা কোনো লোকের দেহ পড়ে থাকতে পারে যার গলাটা ফালা ফালা হয়ে গেছে। ঠিক আছে?

টুইড একটু ভয়ে শিউরে উঠে খানিকটা বিয়ার গলাধঃকরণ করলো আর কম্পিত স্বরে বললো, ঠিক আছে।

কথা প্রসঙ্গে টিম, ও’মিয়েরার কথা উঠল। ও বলল, ঐ টিম যখন অপারেশন ডিরেক্টর ছিল তখন আমাকে ও কোম্পানী থেকে বের করে দিয়ে সিক্রেট সার্ভিসের বস হয়ে বসে।

–কিন্তু মিয়েরা এরকম কেন করেছিল?

কারণ, আমি জানি আফগানিস্তানের অস্ত্রশস্ত্রের বরাদ্দ বাবদ দুশো হাজার ডলার ও আত্মসাৎ করেছিল।

মিউনিকের অ্যাপার্টমেন্টে ম্যানফ্রেড একটা পরবর্তী কালের ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছিল। কথাবার্তা প্রথমটা সবই কোডে হয়। কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, টুইড জানে যে লক্ষ্যবস্তু নির্দিষ্ট।

–লক্ষ্যবস্তু কি ও চিনতে পেরেছে?

ম্যানফ্রেড বিব্রত গলায় জিজ্ঞেস করল।

 কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, না, একমাত্র একজনই। তুমি নিশ্চয়ই অ্যাকশন নিতে পারো।

–জানাবার জন্যে ধন্যবাদ। আমাকে আবার আগামীকাল এইসময়ে ফোন কারো। ম্যানফ্রেড রিসিভার রেখে দিয়ে ভাবল, যে ওর সঙ্গে কথা বলেছে তার কণ্ঠস্বরে কোন অস্বস্তি ছিলনা। একটা নোটবুক খুলে লন্ডনের একটা নাম্বারে ও ডায়াল ঘোরাল।

টুইড-এর ওয়াশিংটনে যাবার আগের দিন উপরোক্ত ঘটনা ঘটলো। ঐদিনই সন্ধ্যেবেলা চারজন নিরাপত্তা প্রধান প্যারিসের মুরেট বিল্ডিং-এ একটা কনফারেন্সে মিলিত হলো।

***

টুইড-এর মনে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। ও একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলোনা যে, ক্লিস্ট লুমিসের মানসিক রোগ আছে কিনা, তা না হলে ও সর্বত্রই ওর শত্রু দেখছে!

ওর আরো একটা কথা মনে পড়ল, ডালাস বিমানবন্দরে আসার সময় দুটো গাড়িতে চারজন ওদের অনুসরণ করেছিল।

চার্লস ওয়ার্নার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার কাছে এসেছিল ও’মিয়েরার ব্যাপারে ও খুবই আগ্রহী। তুমি স্টেশনে এসেছ আমার সঙ্গে কথা বলতে? ব্যাপারটা একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছেনা।

বিশ্বাস কর, যখন ও’মিয়েরা সি. আই. এ-র অপারেশান ডিরেকটর ছিল তখন তোমার অবসরের ব্যাপারটা ঐ দেখেছিল। একটু নরম ভঙ্গীতে টুইড বলল।

একটু থেমে আবার বলল, ল্যাংলেতে ডিউটি করার পর ও পশ্চিম বার্লিনে বেশ কবছর ছিল? সত্যি?

–ঠিকই বলেছে। কিন্তু টুইড…।

–আমাকে বিশ্বাস করো। ও ওর কণ্ঠস্বরকে যথাসময়ে নরম করে লুমিসকে বোঝানোর বা একটা ব্যাপার মনোনিবেশ করানোর চেষ্টা করছিল।

-তুমি বলছো ওর পশ্চিম বার্লিনের রেকর্ড তুমি পরীক্ষা করে দেখেছে। ও জার্মান বলতে পারে?

-খুব ভাল বলতে পারে।

 লুমিসের মাধ্যমে টুইড জানতে পারলো ও’মিয়েরা ছদ্মবেশে পূর্ব বার্লিনে লু কারসন নামে এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। টুইড কথার ফাঁকে লুমিসের দিকে একইভাবে তাকিয়ে ছিল। লুমিস একবার বলে উঠলো, শয়তানটা আমাকে মোটেই পছন্দ করেনা।

টুইড শান্তভাবে বসে রইল, লুমিস উঠে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শান্ত-জলরাশির ওপর দিয়ে ধীরগতিতে নৌকো এগিয়ে চলেছে।

লুমিস আবার কথা বলা শুরু করল, পশ্চিম বার্লিনের এই বিশেষ ইউনিটের ঐ দুজন পূর্ব জার্মানীর এসপিয়নেজ সেটআপের ওপরে নজর রেখেছিল। কার্লোস-এর রিপোর্টেই ব্যাপারটা জানা যায়।

-তাই নাকি?

আমাদের কোড চেনার একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল। সে ভাবেই জানতাম লু কারসনের মাধ্যমে ও’মিয়েরার সংকেত আসে।

টুইডের চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক রহস্যময় জাল…।

পরের দিন ঠিক সময়েই ম্যানফ্রেড দ্বিতীয় বারের লং-ডিসট্যান্স ফোন করলো। ম্যানফ্রেডই কথা বলা আরম্ভ করলো, ভাববার কিছু নেই। টুইড ওয়াশিংটনেই আছে।

শয়তান। তুমি কেমন করে জানলে?

–আমার লোক সবজায়গাতেই আছে। যাই হোক সমস্যা একটাই। কাজের ব্যাপার।

–তুমি কি টুইডের সঙ্গে যোগাযোগ…।

না। তাহলে ব্যাপারটা ভেস্তে যাবে। ক্রোকোডাইল ঠিক সময় এগোবে। আমি…।

 ম্যানফ্রেড নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগল। ভাবল, টুইডকে হত্যা করার কাজটা ভীষণ শক্ত। কোথায় যেন লোকটার একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। খানিকক্ষণ চিন্তা করার পর ও ওয়াশিংটনে যোগাযোগের জন্যে ফোনটা আবার তুলে নিল।

***

একত্রিশে মে, রবিবার

 টুইড সারা রাত ওয়েসিস-এ কাটালো। লুমিসকে বেশ খানিকটা নার্ভাস বলে মনে হচ্ছিল।

লুমিস ক্রুজারটাকে বয়াতে বাঁধতে বাঁধতে বলল, একভাবে অনেকদিন এক জায়গায় থাকা নিরাপদ নয়। রাতের অন্ধকারে সব সময় সঙ্গে কোন আলো ছাড়া ঘোরাফেরা করবে।

ব্যাপারটা বেআইনী নয়? নৌকোয় কোন আলো নেই? টুইড জানতে চাইলো।

জীবন মরণের প্রশ্নে…।

এরপরে ওরা পুরানো কিছু কথাবার্তায় ফিরে গেল। ডালাসে পৌঁছবার পরে টুইডের লক্ষণীয় দুটো ঘটনা ঘটেছে।

ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। ডেকে সুটকেশ হাতে ও দাঁড়িয়েছিল। আস্তে আস্তে চলেছে ওটা।

লুমিসকে একবার বললো ও, তোমার ফিল্ড গ্লাসটা আমাকে একবার দাও তো।

লুমিস দিতে টুইড ওটা চোখে লাগিয়ে ফোকাসটা ঠিকমত এ্যাডজাস্ট করে তট রেখার দিকে তাকালো। তারপর লুমিসকে ওটা দিয়ে দিল।

লুমিস জিজ্ঞেস করলো, কেউ নজর রাখছে?

–গাছের ওপর দুজন। একজনের হাতে টেলিলেন্স ক্যামেরা…।

তখন ওরা দুজনে ডিঙিতে নামলো৷ সিঁড়ির ওপর কুকুর ওয়ালডো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই সময়ে একটা হেলিকপ্টার চেসাসিক বে থেকে চ্যানেলের মাঝামাঝি উড়ে আসছে। ওটা যেই অতিক্রম করে গেল, টুইড গলাটা বাড়িয়ে দিল যাতে মেশিনটা দেখা যায়।

লুমিস ডিঙিটাকে তটরেখার দিকে নিয়ে চলেছে। টুইড একভাবে হেলিকপ্টারের দিকে তাকিয়েছিল। সূর্যের আলোর ঝলকানিতে হেলিকপ্টারের কেবিনটা একেবারেই দেখা যাচ্ছিল না।

ডালাসে টুইড গাড়ি থেকে নেমেই সোজা বিল্ডিং-এর ভেতরে ঢুকে গেল। লুমিস গাড়ি নিয়ে ফিরে যেতে, টুইডের লুমিসের মুখে শোনা ও’মিয়েরার কার্যকলাপের কথা মনে পড়ছিল।

খানিক বাদে টুইড চোখ বুঝল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল জানে না।

পার্ক ক্রিসেন্টে অবশেষে যখন টুইড পৌঁছালো, ম্যাকনেইলের চোখ দেখেই বুঝল গুরুতর একটা কিছু ঘটেছে।

***

একত্রিশে মে, রবিবার

 ডালাসে একা ফিরে আসার পথে ক্লিন্ট লুমিস অনেক জায়গায় গাড়িটাকে থামিয়েছিল। সমুদ্র উপকূলের সব কিছু ওর জানা।

রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। মিস ডিঙিতে উঠে মোটরে স্টার্ট দিলো। সামনেই ক্রুজার ওয়েসিস দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ হেলিকপ্টারের আওয়াজে ওর টুইডের কথা মনে পড়ল।

ওয়াডলো লুমিসকে দেখে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে একবার চীৎকার করে উঠলো।

লুইস ডিঙিটা বেঁধে ক্রুজারে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ওর লক্ষ্য পড়ল ঠিক একই রকমের আর একটা ক্রুজার ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

ও সতর্ক হবার চেষ্টা করল।

ওয়াডলো কেমন অস্বাভাবিক ভঙ্গীতে গরগর শব্দ করতে আরম্ভ করলো।

–কি ব্যাপার ওয়াডলো…?

বলেই ওয়াডলো যেদিকে তাকিয়ে ছিল লুমিসও সেদিকে তাকালো। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো। ক্রুজারটা সম্ভবতঃ ওদের পাশ দিয়েই বেরিয়ে যাবে কিন্তু লুমিস ওটার ডেকের ওপরে কাউকে দেখতে না পেয়ে দ্রুত কেবিনের দিকে দৌড়লো।

সি. আই. এর প্রাক্তন লোক হিসেবে ও একটা ছোট অস্ত্রাগার ভরে রেখেছে। সেটা খুললল, একটা মেশিন পিস্তল দেখতে পেলো। ডাবল ব্যারেলের শর্টগান আর তিনটে হ্যান্ডগানও আছে। ও শর্টগানটা বের করলো।

ক্রুজারটা ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল। লুমিস ওটা নিয়ে ডেকে দাঁড়িয়ে রইল। সম্ভবতঃ হুইলের কাছে কেউ যেন বসে আছে। ও ক্রুজারের গায়ে ওয়েসিসনামটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো।

ওয়াডলো তখনও মুখ দিয়ে গরগর করে যাচ্ছে। চারিদিকে শুধুই জল ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনা।

ও একটু নীচু হল, শর্টগানটা চোখের আড়ালে। যদি ওদিক থেকে কেউ কিছু ছেড়ে তাহলে ও সমস্যায় পড়বে। আবার এটাও হতে পারে হয়ত স্বাভাবিকভাবেই ক্রুজারটা পাশ দিয়ে চলে যেতে পারে।

ও কি সজোরে চীৎকার করে জানতে চাইবে?

ও খানিকটা হিংস্র হয়ে পড়লো। সামনে ওয়াডলো রয়েছে। 

লুমিস আগে দেখতে পায়নি, একটা টাস্ক পুরোপুরি তৈরী। ক্রুজারটা ওয়েসিসের একেবারে কাছাকাছি। ডেকের ওপর গ্রেনেড ও মিসাইলগুলো ঠিক জায়গায় ফিট করা আছে।

–হে যীশু…।

 তারপরেই একজন একেবারে ওয়াডলোর কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে তার মাংসগুলোও টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।

 লুমিস এই দেখে একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।

 উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, শুয়োরের বাচ্চা।

বলে শটগান সামনের দিকে ধরে ট্রিগার টিপতে যাবে ঠিক সেই সময়ে একটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। পেছনের পাটা ওর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অতিকষ্টে নামতে গিয়ে ঠিক সেই সময়ে আরো একটা গ্রেনেড এসে কেবিনের সামনে পড়ল। কেবিনটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। লুমিসের অবস্থা আরো শোচনীয় বলা যায় দেহটা একেবারে ছিন্নভিন্ন।

এরকম পরপর দশটা বিস্ফোরণ ঘটলো। তারপর একটা হুক দিয়ে ওয়েসিসকে আটকালো। প্রত্যেকের গায়েই ফগম্যান স্যুট। একজনের হাতে সাব মেশিনগান।

এদিকে একটা লোক কয়েকমিনিট জাহাজটা সার্চ করল। ভেতরে কেউ নেই। লুমিস তখন মৃত। ও নিশ্চিত হয়ে আবার ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করলো।

ওপরে তখন একটা হেলিকপ্টারের পাইলট রেডিওতে বলে যাচ্ছিল, শেষ করে দেওয়া হয়েছে।

হেলিকপ্টারের গন্তব্য ওয়াশিংটনের দিকে।

***

একত্রিশে মে, রবিবার

বি. এন. ডি-র হেড কোয়ার্টার যেটা জার্মান ফেডারাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস আবিষ্কার করেছে সেটা হচ্ছে পূলাখ। জায়গাটা মিউনিক থেকে ছয় মাইল দক্ষিণে। এরিখ স্টোলারের নার্ভ সেন্টার এর চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা। ভেতরের দেওয়ালে বৈদ্যুতিক বেড়া লাগানো। স্টোলার রসিকতা করে বার্লিনের দেওয়াল নাম দিয়েছে। এই মুহূর্তে মার্টেলের সঙ্গে বসে ও কফি খাচ্ছিল।

টুইড লন্ডনে ফিরে আসার জন্যে একটা পাঁচের ফ্লাইট ধরলো।

স্টোলারের অফিসের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ হলো মার্টেল আছে। বাইরে সশস্ত্র প্রহরী।

–আমি চার বছর ওয়াইস বাডেনে ছিলাম। তারপর বি. এন. ডি-তে এসেছি। এক সময় আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম পূর্ব জার্মানীতে। স্টোলার জানালো, তারপর ব্যাভেরিয়াতে বছর কয়েক হল বসবাস করছে। এরই মধ্যে নয়া-নাজী আর বামপন্থীদের মধ্যেকার লড়াই শোচনীয় আকার ধারণ করেছে।

মার্টেল জানালো, স্টেটের নির্বাচন হলেই ব্যাপারটা মিটে যাবে।

স্টোলার বলল, যদি ল্যাংগারের মডারেট পার্টি জেতে তাহলে হয়ত মিটবে। সমস্যা আসলে দিয়েত্রিচের পার্টি এবং ডেলটার অস্ত্রশস্ত্রের আবিষ্কার। এর ফলেইটফলার-এর বামদল জিতে যেতে পারে। ও তো আবার ব্যাভেরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র করার পক্ষপাতী। ফেডারাল রিপাবলিক থেকে পৃথক হয়ে যাবে।

এরকম আলোচনা হতে থাকল ওদের দুজনের মধ্যে।

এরপরে সামিট এক্সপ্রেসের কথা উঠল। ওতে পাশ্চাত্যের সব বড় নেতারা থাকছে। স্টোলারের দায়িত্ব হচ্ছে স্ট্যালবার্গ থেকে সলিজবার্গ। স্টোলার মাৰ্টেলকে বলে উঠল, মিউনিখে যাবার সময় ক্লেয়ার হফারকে পাওয়া যাবে কিনা। এরকম আলোচনায় কিছুক্ষণ কাটলো।

একসময়ে পার্ক ক্রিসেন্টের নাম্বারে ডায়াল করলো। খানিক বাদে ওপ্রান্তে ম্যাকনেইলের গলা শোনা গেল। ও ওকে চার প্রধানের ছবি দেবার কথা বললো।

ও প্রান্তে ম্যাকনেইল বলে উঠল,টুইড এখন বাইরে।ও একটা খবর দিতে বলেছে। আগামীকাল প্রথম ফ্লাইটে ওকে নাকি হিথরো বিমানবন্দরে যেতে বলেছে।

মার্টেলের কাছে ও ফ্লাইট নাম্বার চাইল। মিস্হফারের একটা পাসপোর্ট ছবি দিয়ে ওকে বললো তাড়াতাড়ি ব্যাভেরিয়াতে যেতে।

***

প্যারিসের এক উষ্ণ রবিবার। হাওয়ার্ড সামিট এক্সপ্রেসের ব্যাপার নিয়ে অ্যালেন ফ্ল্যান্ড্রেস আর ও’মিয়েরার সাথে আরো কিছু আলোচনার জন্য অপেক্ষা করছিল। নিরাপত্তার ব্যাপারটা আরো জোরদার করা দরকার। গেয়াফে ইস্ট থেকে ট্রেন ছাড়বে জুনের দুতারিখে। আর মাত্র তিন দিন বাকি আছে।

আলোচনার শেষে হাওয়ার্ড লন্ডনের ফ্লাইট ধরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সময় জানতে পারলো ও’মিয়েরাও লন্ডনে যাবে। খানিকক্ষণ থেকে ও কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। সামনেই কেতাদুরস্ত এক মহিলা কাগজ পড়ছিল। বাইরে যেতেই ফ্ল্যান্ড্রেস ওকে পথ দেখিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। গাড়িতে ঢুকতেই ও’মিয়েরাকে মনে পড়ল। বুঝল হাওয়ার্ডকে এখানে বাধ্য করে আনা হয়েছে। গাড়ি ছাড়তেই সেই মহিলাও পেছনে একটা ক্যাবে চড়ে বসলো।

সবাই নিশ্চুপ। হাওয়ার্ড দেখলো অ্যালেন হুইলের পেছনেই বসে আছে। চোখের সামনের আয়নায় দেখতে পেল কেউ ওদের অনুসরণ করছে। দ্যাগলে এসে অ্যালেন ওকে বিদায় জানালো। হাওয়ার্ড চারদিকে তাকাতেই দেখল অদূরেই দুজন তোক তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে সুটকেশ হাতে সেই মহিলা দ্রুত চলে গেল।

কোথাও যেন কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।

***

মিউনিখের হাউপ্টব্যানহফ। ব্যাভেরিয়ার সেই রাজধানী যেখানে চার্লস ওয়ার্নার এসেছিল। মার্টেল আর ক্লেয়ার স্টোলারকে বলল শহরের মাঝখানের হোটেলটায় ওদের নামিয়ে দিতে। যে মুহূর্তে ও নামিয়ে চলে গেল সেই মুহূর্তেই মার্টেল কুলিকে বলল ওরা এই হোটেলে থাকবে না।

খানিকটা এগিয়ে একটা ক্যাবেউঠে হাউপ্টব্যানহফের কাছাকাছি একটা জায়গার ঠিকানা দিল। দুজনে খানিকটা পৃথক বসেছে। স্টেশনে নেমে ক্লেয়ার মার্টেলের পেছন পেছন চলল। ক্লেয়ারের হ্যান্ডব্যাগে লুকোনো পিস্তল। দুজনে স্টেশনে জিনিষপত্র জমা রাখলো। এবার মার্টেলের খোঁজ করার পালা কেন ওয়ার্নার এখানে এসেছিল। ক্লেয়ার ওর পেছনেই চলতে লাগল। চারিদিকে ওদের এখন মাকড়সার জাল।

এডুইন ভিনজ। দুবার ভুল করে দিয়েত্রিচের কাছে ধমক খেয়েছিল। গ্রসকে যখন মার্টেল হত্যা করলো তুমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে…।

ধমকানির জবাবে ভিনজের বলার কিছুই ছিলনা। দু-দুবার মাৰ্টেলকে বাগে পেয়েও কিছু করতে পারেনি। দিয়েত্রিচের হুকুম.যেমন করে হোক ওকে মারতে হবে, না হলে খবর যেখানে পৌঁছোবার পৌঁছে যাবে।

হাউপ্টব্যানহফ জায়গাটা চীৎকার, চেঁচামেচিতে একেবারে নরকের মতো। মার্টেল জনতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললো।

 চারিদিকে শুধু ভীড়, যাত্রীদের ব্যস্ততা, ঘোষকের চীঙ্কার সব মিলিয়ে একটা গতিময় জীবন।

ক্লেয়ার মার্টেলের পেছনে। ব্যাগের নীচে লুকোনো পিস্তল। হঠাৎ ওর যাকে নজরে পড়ল সে হল স্বয়ং এডুইন ভিনজ।

ক্লেয়ার নিশ্চিত ভিনজ ওকে চিনতে পারেনি। ব্যাগ থেকে কালো চশমাটা বের করে পড়ে নিলো।

মার্টেল অন্যদিকে অন্যকিছু দেখছিল। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ও অনুভব করছিল যেন চারিদিক থেকে অনেকে ওকে ঘিরে ধরেছে। দূরে একজনের পকেটে দেখল ডেলটা ব্যাজ। জুরিখ থেকে মিউনিখ এক্সপ্রেসটা এসে যেখানে থামবে লোকটা সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে।

মার্টেল সামনের টাইম বোর্ড দেখার ভান করে,লোকটাকে দেখতে লাগল। আর একজন পকেটে ডেলটা চিহ্নিত লোক ওর কাছে এসে দাঁড়ালো। ক্লেয়ার ইতিমধ্যে মার্টেলের কাছে এসে সন্তর্পণে সতর্ক করে দিলো যে, এডুইন ভিনজ এখানেই আছে। মার্টেলের ওপর নজর রেখেছে। বাকি দুজন কাফেতে ঢুকলো।

মার্টেলও ক্লেয়ারকে সাবধান করে দিল যে জায়গাটা ডেলটার লোকেরা ঘিরে রেখেছে। এরপর ক্লেয়ারের কাছ থেকে মার্টেল চলে যেতে ও ট্রেনটাইম লিখে নিল। মার্টেল গিয়ে ঢুকল ঐ ক্যাফেটেরিয়ায়।

একটা বসার টেবিলে বসে ও কফির অর্ডার দিলো। টেবিলটার সামনে একটা বন্ধ দরজা। কিছুটা দূরে ডেলটার লোকদুটো কথাবার্তায় ব্যস্ত। আগের লোকটা পরের লোকটাকে একটা খাম দিতে ও পকেটে পুরে নিলো।

মার্টেল যেন একটা ফাঁদের মধ্যে ঢুকল।

ঠিক বেরোবার মুখে ওরা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা বন্ধ করে। পাঁচজনের চেহারাই ষণ্ডা মার্কা। তাদের একজন মার্টেলের টেবিলে এসে বসে একটা নোটবুক আর পেনসিল টেবিলের ওপর রাখলো। পেনসিলটার একটা বোতাম টিপতেই একটা উঁচ বেরিয়ে এলো। মার্টেল এতক্ষণ একটা পাত্রে মাথা নীচু করে কি যেন দেখছিল। সঁচটা বার হতে মার্টেল পাত্রের তরলটা ওর চোখের ওপরে ছুঁড়ে দিল আর লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল থেকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ বাতাসে ভেসে গেল।

মার্টেল লাফিয়ে উঠে টেবিলটা সামনের দিকে ঠেলে দিল, তারপরে চেয়ারটা সামনের দিকে ছুঁড়ে দিলে। দরজার মুখের লোকগুলো অস্বাভাবিক আতঙ্কে পালাতে পারলে বাঁচে।

–এই দিকে পালাও।

 মার্টেল দেখল দরজার সামনে ক্লেয়ার দাঁড়িয়ে পর পর তিনবার গুলি করলো। অবশ্য সবগুলোই মাথার ওপর দিয়ে গেছে।

 মার্টেল দৌড়ে গিয়ে সামনের লোকটার মাথায় আঘাত করল। ক্লেয়ার পিস্তল লুকিয়ে ফেলেছে। মার্টেল ক্লেয়ারের হাত ধরে এগোতে লাগল। ওদের পেছনে তখন সবাই ভয়ে আতঙ্কিত। সবাই পালাতে চায়। ইউব্যানসিস্টেম একটা স্বয়ংক্রিয়, জটিল ব্যবস্থা। ওরা এই সিস্টেমে দ্রুত বেরিয়ে এসে ট্রেনে এসে বসল।

মার্টেল আর ক্লেয়ার পাশাপাশি বসল। মার্টেল নিশ্চিত যে কেউ ওদের অনুসরণ করছে না। সার্টেল ওকে জানালো ওরা সোজা ফ্লাউসেনে যাবে। এখন রাস্তার ধারে ছোটখাটো হোটেলে ওঠা যাক। ব্যাগ-ট্যাগ পরে আনা যাবে।

***

ওয়াশিংটন থেকে রবিবারের ফ্লাইট হিথরোতে এসে পৌঁছবে রাত নটায়। পার্ক ক্রিসেন্টে ইডের ক্যাব ছিল। ম্যাকনেইল অফিসেই অপেক্ষারত।

-খবরটা সবে টেলেক্সে এসেছে।

 ম্যাকনেইল টুইডের রিসিভ করার খবর জানে কিনা জানে না। ও খবরটা জিজ্ঞেস করতেই ব্যাকনেইল জানালো, তোমার বন্ধু ক্লিন্ট লুমিস খুন হয়েছে।

টেলেক্সটা হাতে নিয়ে টুইড পরপর তিনবার সংকেতটা পড়ল। ম্যাকনেইলের হাতে নোটবুক।

টেলেক্সের সংকেতটা হল

প্রাক্তন সি. আই. এ এজেন্ট ক্লিন্ট লুমিস আজ আততায়ীর দ্বারা নিহত হয়েছে ক্রুজার ওয়েসিসেই আর একটা ক্রুজার-গ্রেনেডের আঘাতে নিহত লুমিসের কুকুরও নিহত–এস. বি. মাই. সি. আই. এর সহযোগিতায় তদন্ত চালাচ্ছে।

টুইডের হেলিকপ্টারের কথা মনে পড়ল। চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

ম্যাকনেইল জিজ্ঞেস করল, মার্টেলের কোন খবর আছে কিনা?

টুইড জানালো যে, ব্যাভেরিয়া থেকে ও ফোন করেছিল। কাল সকালে এসে পৌঁছবার কথা। জিহররাতে সাজানো হোটেল বুক করা হয়ে গেছে। ম্যাকনেইলকে ওর সমস্ত ব্যবস্থা করতে বললো। টুইড সামনের খোলা জানলায় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। চিন্তাশূন্য মন। সামিট এক্সপ্রেস আর মাত্র দুদিন বাকি।

মাঝরাতে মিউনিখের অ্যাপার্টমেন্টে ম্যানফ্রেড যখন ঘুমোচ্ছিল,তখনই ওয়াশিংটন থেকে খবর এসে পৌঁছালো।

আলো জ্বালিয়ে গ্লাভসহাতে তুলতেই এক মার্কিনীকণ্ঠস্বর সংক্ষেপেখবরটা জানালো। লুমিস সংবাদদাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্রোকোডাইলকে থামানো সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে আরো বড় খুন।

***

পয়লা জুন; সোমবার

 টুইড বলে উঠলো, আমরা আজ আর মঙ্গলবারে খানিকটা বিশ্রাম পাবো। আগামীকাল রাতে সামিট এক্সপ্রেস প্যারিস থেকে ভিয়েনার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে।

মার্টেল চিন্তিত মুখে জবাব দিলো, এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের আইডেন্টিফাই-এর কাজটা সেরে ফেলতে হবে। সিকিউরিটির প্রধানের ফোনটা গুপ্তচর…।

লন্ডন বিমানবন্দরের হোটেলে ম্যাকনেইল তিনটে শোবার ঘর ভাড়া নিলো। প্রত্যেকটা পৃথক থামে। টুইড সমস্ত ঘরগুলো ভালো করে দেখে নিল। মার্টেল সবে মাত্র মিউনিখ থেকে ফিরেছে। এরা মাঝের ঘরটাতেই আপাততঃ থাকবার ব্যবস্থা করেছে। লুমিসের হত্যা প্রসঙ্গে ওদের মধ্যে আলোচনা হত যখন সিকিউরিদিকে উঠেছিল।

ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত যখন সিকিউরিটি কনফারেন্সে লুমিস হত্যার ব্যাপারটা শোনাচ্ছিল তখন নাকি চারজন নিরাপত্তা প্রধানের একজন চমকে উঠেছিল।

এদিকে অ্যালেন ফ্ল্যান্ড্রেস-এর সমস্ত অতীত একটা ফাইলে রাখা। মিয়েরারও তাই। এদিকে জুরিখ স্টোলারও দুবছর অজ্ঞাতবাসে ছিল। এই সব চমকপ্রদ সংবাদ সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এছাড়া হাওয়ার্ড আছে। মার্টেলের বক্তব্য আসল নোক দীর্ঘকাল ধরে এইরকম কাজে নিযুক্ত রয়েছে। মার্টেলের মতে হাওয়ার্ডের বিষয়টা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

খানিকবাদে টুইড ব্রিফকেস থেকে একটা ফাইলের ফটোকপি মার্টেলের হাতে দিল। ফ্রেডারিক অ্যান্টনী হাওয়ার্ডের নাম ওপরেই লেখা। টুইড জানালো এটা পাওয়ার জন্যে ম্যাকনেইলকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। ওই সব সংগ্রহ করেছে। ফাইলের বারো পাতায় এসে ও থামলো। লেখা আছে বেশ কয়েক বছর আগে হাওয়ার্ড প্যারিস দূতাবাসে ইনটেলিজেন্স অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিল। এর মধ্যে দুসপ্তাহ অসুখের জন্যে ছুটি নিয়ে ও ভিয়েনাতে ছিল।

মেডিক্যাল রিপোর্টও আছে। সমস্তটা ভালভাবে শেষ করে মার্টেল ওটা টুইডকে দিলো৷ এরপরে টুইড ওকে একটা খাম দিলো। ওর মধ্যে চারটে উজ্জ্বল ছবির প্রিন্ট ছিল। ফ্ল্যান্ড্রেস, ও’মিয়েরা, হাওয়ার্ড আর স্টোলার। মার্টেল খামটা পকেটে রেখে দিলো। তারপর জানালো, সময় আর বেশি নেই এখন চারজন নিরাপত্তা প্রধানের ওপরেই চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ব্যাপারটা কড়া ভাবে ধরতে হবে। চারজনকেই এক কথা বলতে হবে। মার্টেল নিজে স্টোলারকে বলবে আর টুইড হাওয়ার্ড, অ্যালেন আর ও’মিয়েরার ভার নেবে। কথাটা হলো একটা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, একজন পাশ্চাত্য নেতাকে এক্সপ্রেসেই খুন করা হবে। খুনী চারজন নিরাপত্তা প্রধানেরই একজন।

পকেট থেকে প্ল্যাস্টিকে মোড়া একটা কার্ড বের করে টুইড ওর হাতে দিলো। মার্টেল দেখল ও যখন ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারীকরছিল, তখনকার ছবি। টুইড ওকে জানালো কাল রাতে সামিট এক্সপ্রেস গেয়ার-দ্য-ইস্ট ছাড়ার আগে ওদের দেখা হতে পারে কিনা। কার্ডটা দেখালে কেউই ওকে আটকাতে পারবেনা।

মার্টেল জিজ্ঞেস করলো, ও এই কার্ড কোথায় পেলো? টুইড জানালো, কার্ডটা পাওয়া গেছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। ওকে বলেছে যে চারজন নিরাপত্তা প্রধানের মধ্যে একজন খুনী। ব্যাপারটা শুনে প্রধানমন্ত্রী মশাই বেশ চিন্তিত। কথা হতে হতে ক্লেয়ারের একটা পাশপোর্ট ছবিও মার্টেলের হাতে দিলো। ক্লেয়ার না থাকলে মার্টেল হয়তো শেষ হয়ে যেতো। চোখ বুজেই ওকে বিশ্বাস করা যায়। মার্টেলের কার্ডের মতো ক্লেয়ারেরও একটা কার্ড তৈরী হলো। বলা বাহুল্য, যে পেনে সইটা হলো সেটাও প্রধানমন্ত্রীরই পেন। টুইড হাসলো, তারপর আবার জানালো যে, একটা ব্যাপার আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হলো আমরা যাবার আগেই ম্যানফ্রেড…।

–তাহলে কিভাবে এগোনো উচিত? টুইড বলল, ও সামাদের কাছে আসল খুনীকে চাপা দেবার চেষ্টা করতে পারে। ও জানে যে ব্যাপারটা আমরা জানি। ও চেষ্টা করবে ভুল লোককে যাতে আমরা সন্দেহ করি। সুতরাং–হ্যাঁ। আমরা চারজন নিরাপত্তা প্রধানের প্রত্যেককেই বলব যে তোমাদের মধ্যেই একজন দোষী ব্যক্তি রয়েছে।

***

ম্যানফ্রেড-এর জানানো মিটিং-এর জায়গায় যাবার জন্যে রেইনহার্ড দিয়েত্রিচ ও অ্যাপার্টমেন্টের তলা থেকে মার্সিডিস গাড়িটা বের করল। এখনও অনেকটা সময় আছে।

মিটিং-এর জায়গাটা বেশ অদ্ভুত। সব দিকে ফাঁকা একটা গুপ্ত গ্যারেজ। ম্যানফ্রেড যে গাড়িটার মধ্যে বসেছিল সেটা মিথ্যে নাম আর ঠিকানায় কেনা। কাগজপত্র সবই জাল। দিয়েত্রিচ এল। ওর গাড়ির জোরালো আলোয় ম্যানফ্রেডের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলোটা নিভতে ও দেখল কালো পোষাকে, গগলস পরা একজন আলোটা নিভিয়ে জানলা দিয়ে এদিকেই চেয়ে আছে। ম্যানফ্রেডের কাছে এগিয়ে এল। সহাস্যে অভিনন্দন জানিয়ে ও বলল, তুমি যদি নির্বাচনে হেরে যাও, তাহলে তোমার পরিকল্পনা মতে এগোও। তোমার লোকেরা সবাই ইউনিফরম পড়ে প্রস্তুত। মিউনিখে মার্চ করো, হিটফলারের উনিশশো তেইশের মার্চ যেরকম রিপাবলিক তৈরীহয়েছিল, ঠিক সেরকম তুমিও মিউনিখে কর।

–কিন্তু হিটলার তো সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত ল্যান্ডবার্গ-এর জেলে ওকে…। দিয়েত্রিচ বলে উঠল।

নতুন অস্ত্রের জায়গাটা কোথায়?ম্যানফ্রেড বলে উঠলো, আমরা একেবারে শেষ সময়ে…। তুমি এখন জায়গাটাকে সুরক্ষিত রাখতে সশস্ত্র প্রহরী লাগাও…।

বলে ম্যানফ্রেড দ্রুত গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে অর্থাৎ দুমিনিট পর দিয়েত্রিচও যাবার জন্যে তৈরী হলো।

***

মিউনিখ বিমান বন্দরে ফিরে এসে মার্টেল শহরের একপ্রান্তে একটা ক্যাব নিলো। খানিকটা গিয়ে ক্যারটা ছেড়ে দিয়ে চারশো গজের মতো হেঁটে ক্লসেন হোটেলে পৌঁছালো। ক্লেয়ার-এর কোন বিপদ হয়নি। মার্টেল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

ক্লেয়ার বলল, তুমি ছিলেনা যখন আমি হাউস্টব্যানহফেই বেশি সময় কাটিয়েছি। মার্টেল অবশ্য কাজটাকে সমর্থন করলো না। কারণ চিহ্নিত হয়ে যাবার বিপদ ছিল। অবশ্য ক্লেয়ার জানালো যে, ও বেশ সতর্কই ছিল। মার্টেল দুঃখ প্রকাশ করে বললো, আগামীকাল রাতে সামিট এক্সপ্রেস প্যারিস ছাড়বে। এখনও পর্যন্ত আসল লোককে ধরা যায়নি।

ওদের মধ্যে পরবর্তী কার্যক্রমের নানা বিষয়ে আলোচনা হতে লাগলো। সমস্ত বিষয়টার ওপরে একটা ধোঁয়াশার জাল তৈরী হয়েছে। মার্টেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ক্লেয়ারের চোখ এড়ালো না।

ক্লেয়ার বলল, জুরিখ হচ্ছেডেলটার চলমান হেডকোয়ার্টার। সেজন্যই স্টোলার ওদের আসল ঘাঁটি খুঁজে পায়নি। দিয়েত্রিচের জায়গাটা একেবারে দূর্গম। হেড-কোয়ার্টারের উপযুক্ত জায়গাও বটে। সবরকম সুযোগ-সুবিধে আছে। সবসময়ে ভিড়, সুতরাং দুজন বা আরও বেশি লোকের মিটিং-এ কোনও অসুবিধেই নেই। দূতেরা ট্রেনে করে এসে খবর দেয় আবার অন্য ট্রেনে চলে যায়। ওরা কেউই আসলে মিউনিখে যায়না। দুএকটা মিটিং যদি দেখা যায় তাহলে বোঝা যাবে। অনেক নিরাপদ জায়গা এখানে। কাফে, সিনেমা এরকম অনেক। মার্টেল এবার ওয়ার্নার-এর গতিবিধির ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ও ক্লেয়ারকে বলল, তুমি কি বলতে চাইছে, দিয়েছি এখানে, একটা বিশেষ ফোর্স পাঠাচ্ছে। সম্ভবতঃ এখানে হোটেলে জায়গা নেবে। এছাড়া ওদের লক্ষ্য থাকবে টিভি, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের জায়গাগুলো।

–হ্যাঁ। এটাই আমার অনুমান।

মার্টেল অধৈর্য ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। এক সময় বলে উঠলো, আমাদের এখন স্টোলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। সম্ভাব্য খুনী।

ক্লেয়ার ওর দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরের মধ্যে সাময়িক নীরবতা বিরাজ করতে লাগলো।

***

টুইড শান্তভাবে বললো, অ্যালেন, ভিয়েনার উদ্দেশ্যে যে সামিট এক্সপ্রেস আগামীকাল রাতে ছেড়েছে, তাতে আমরা জানি, চারজন যাত্রীর মধ্যে একজন খুনের লক্ষ্য।

ফ্ল্যান্ড্রেস বলে উঠল, আমাদেরও তাই অনুমান। সেন্ট হর্ন, একটা ছোটখাট রেস্তোরাঁয় ওরা খেতে খেতে আলোচনা করছিল। জায়গাটা নিরিবিলি।

টুইড বললো, ফ্ল্যান্ড্রেস আমাদের বন্ধুত্ব অনেক দিনের, এই বন্ধুত্বের বিশ্বাসে আমি তোমাকে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।

ফ্ল্যান্ড্রেস খেতে খেতে পুরোনো দিনের গল্প আরম্ভ করলো। সেই উনিশশো তিপান্ন সালে ও সেনাবাহিনী ছেড়ে অন্য কাজে যোগ দেয়। এই ধরনের অনেক কথা। কথায় কথায় জানিয়ে দিল হাওয়ার্ডকে ওর পছন্দ নয়,কারণ ওনাকি অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলনয়। ফ্লানড্রেস ওর জীবনের অদ্ভুত সব দুর্ঘটনার কথা জানালো। ও প্রথমে মিলিটারী ইনটেলিজেন্সীতে চাকরী পায়। তার দু সপ্তাহ পরে ও কমিশনড র্যাংকে চলে যায়, ওর ওপরওয়ালার দুর্ঘটনার ফলে। তারপর ও জেনারেল ডুমার স্টাফে ইনটেলিজেন্স অফিসার হয় এবং ব্যাভেরিয়াতে আসে। তারপর ওখান থেকে প্যারিসে ফিরে আসে। একমাত্র সম্বল ছিল জেনারেল ডুমার রেকমেন্ডেশন। ডিন. এন. টি-কে দেখাতে ওরা আবার ওকে নিয়ে নেয়।

এরকম কথা বলার পরে ফ্ল্যান্ড্রেস একসময় থামলো।

টুইড রেস্তোরাঁর চারদিকটা একবার তাকিয়ে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বললো, একজন মৃত লোকের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া গেছে। লোকটা কে জানতে চেওনা। তবে আমার বিশ্বাস ও সত্যি কথাই বলেছে এবং সত্যি যে বলেছে সেটা আমি প্রমাণ করতেও পারবো না। ওর বক্তব্য, পাশ্চাত্যের যে চারজন নেতাকে চারজন নিরাপত্তা প্রধান নিয়ে আসছে সামিট এক্সপ্রেসে, তাদেরই মধ্যে একজন পাশ্চাত্যের একজন নেতাকে খুন করবে…।

ফ্ল্যান্ড্রেস শোনামাত্র বলে উঠল, সত্যিই এ তো ভীষণ ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। কোন সূত্র পাওয়া গেছে সে কে…?

না। টুইড জানালো।

–তাহলে তো তোমরা আমাকেও সন্দেহ করতে পারো? তোমার কাকে সন্দেহ হয়? এ ব্যাপারে কোন অনুসন্ধান করেছে কি?

ফ্ল্যান্ড্রেস লোকটা বড় বিচিত্র ধরনের। পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা প্রধানদের মধ্যে সম্ভবতঃ সবচেয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন।

টুইড বললো, গত কয়েকদিন কথাটা আমি কাউকে বলিনি, এমনকি হাওয়ার্ডকেও নয়, তোমাকেই প্রথম। কারণ আমি তো সরকারীভাবে সামিট কনফারেন্সের সঙ্গে যুক্ত নই…।

ফ্ল্যান্ড্রেস শুনে বললো, যে ব্যাপারটা ভেবে আমার ভয়ে ঘুম আসছেনা, সেটা হলো ট্রেন গেয়ার দ্য ইস্ট থেকে রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ-এ ছাড়বে। জার্মানীর সীমান্ত যখন অতিক্রম করবে, তখন সমস্ত জায়গা অন্ধকার।

ফ্ল্যান্ড্রেস ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ট্রেনটা সাধারণ ট্রেন হলেও ভি. আই. পি যাত্রীদের জন্যে কিছু কোচ সংরক্ষিত, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব কড়া, এছাড়া ওদের নিজস্ব রেস্তোরাঁ।

টুইড বললো, ট্রেনটা মিউনিখে যাবার আগে ছজায়গায় থামবে। ওখানে মানে মিউনিখে চ্যান্সেলার ল্যাংগার থাকবেন। ফ্ল্যান্ড্রেস একটা হতাশার ভঙ্গিমা করল। ওর চোখে কিসের যেন প্রশ্ন উঁকি মারছে। টুইড ওকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করছিল। তাহলে সন্দেহের তালিকায় কে? কে?…।

***

স্টোলারের হেডকোয়ার্টার। সোমবার, সন্ধ্যেবেলা। অপারেটরের কাছে একটা সাংকেতিক নামে ফোন এসেছে। বি. এন. ডি-র প্রধান দুচোখে আশার-আলো নিয়ে নিজের অফিসে বসেছিল। এরিখ স্টোলার রিসিভার হাতে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এলো, অস্ত্রের বৃহত্তম গুদামে ডেলটার লোকেরা পাহারা দিচ্ছে..।

একটু থেমে বললো, যতক্ষণ না গুদাম সম্পূর্ণ তৈরী হয়… তোমারা আগামীকাল করো রেইড, অর্থাৎ নির্বাচনের আগের দিন। গুদামটা…।

রেইনহার্ড দিয়েত্রিচ ওকে গোপন গ্যারেজে যে খবরটা দিয়েছিল, ম্যানফ্রেড সেটা স্টোলারকে জানিয়ে রিসিভার রেখে দিল।

***

দোসরা জুন, মঙ্গলবার :

যুক্তরাষ্ট্র ব্যাভেরিয়া! টফলার… আগের রাত থেকেই ব্যানার আর পোস্টারে সর্বত্র ছেয়ে গেছে। ছোট ছোট বিমানগুলো থেকে আকাশপথে ঐ একই লেখার লিফলেট ফেলা হচ্ছিল। ব্যাভেরিয়ার নির্বাচনের দুদিন আগে, ডেলটার প্রতীক পকেটে লাগানো, টুপী আর বাদামী শার্ট পরা ডেলটার লোকেরা সারা শহরের সব জায়গায় মার্চ করে বেড়াচ্ছিল। সব জায়গায় চরম বিশৃঙ্খলা।

এদিকে টফলারের লোকেরাও সাদা পোষাকে সজ্জিত হয়ে ব্যানার সহযোগে পথ পরিক্রমা করে বেড়াচ্ছে। ওরা ডেলটার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। সামনের সারিতে মেয়েরা ফুল হাতে সারবেঁধে চলেছে আর এই মেয়েদের জন্যে পুলিশও কোনও অ্যাকশন নিতে পারছে না। মিউনিখ শহর মোটর সাইকেলে ছেয়ে গেছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অফিসের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে এরিখ স্টোলার। ওর অভিব্যক্তি ভয়ানক আকার নিয়েছে।

 ও বললো, ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর একটা কাজ। আগামীকাল ডেলটার অস্ত্রগুদাম সীজ করা।

ঠিক সেই সময় ক্লেয়ার ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, তোমারই ইনফরমার আবার…।

–ফ্রাঞ্জ আবার ফোন করেছিল।

–তাই নাকি?

স্টোলার এক ধরনের ভঙ্গীমা করে বললো, ফ্রাঞ্জ আমার ইনফরমারের কোড নাম। আমি ওকে ঠিকমত জানিনা, কিন্তু ওর কাছ থেকে সমস্ত খবর পাওয়া যায়।

মার্টেল বললো, একদিকে সামিট এক্সপ্রেস, অন্যদিকে অস্ত্রের গুদাম। সময়টা দারুণ বেছেছে। ওয়ার্নার হেগেন মরার আগে একটা বিপজ্জনক কথা বলে তবেই মরেছে।

স্টোলার কৌতূহল প্রকাশ করায় ও বললো, আমি আর ক্লেয়ার দুজনেই বিশ্বাস করি কথাটা, তা হলো ট্রেনে চারজন নেতার একজনকে যে খুন করবে সে চারজন নিরাপত্তা প্রধানদের মধ্যেই একজন…।

বড় ঘরটার মধ্যে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছিল, উত্তেজনা বাড়ছিল। ক্লেয়ার চুপচাপ দাঁড়িয়ে। স্টোলার কফিতে চুমুক দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্টোলার আর মার্টেল পরস্পরের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন উভয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে। স্টোলারের মুখ ক্রমশ বিবর্ণ হতে শুরু করেছে।

মার্টেল সেটা লক্ষ্য করে বললো, আমার কাজ হচ্ছে চারজনের মধ্যে একজনকে ঠিকমত চিহ্নিত; করা। চারজন হচ্ছে ও’মিয়েরা, ফ্ল্যান্ড্রেস, হাওয়ার্ড ও তুমি। আজ রাতে ট্রেন প্যারিস ছাড়ছে।

একটু থেমে মাৰ্টেল আবার বললো, হেগেনের কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য।

স্টোলারের তখন এমন অবস্থা যে সামনে যে কাউকেই অসহ্য মনে হচ্ছিল তার। সে একটু একা থাকতে চাইছিল। মার্টেল সেটা বুঝল।

***

ক্লেয়ার বলল, তুমি স্টোলারকে ঐরকম কথা কেন বললে? ও তো আমাদের সাহায্য করছে।

 ক্লসন হোটেলের ঘরে মার্টেল বিছানায় আর ক্লেয়ার অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। এক সময় ও মার্টেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, টুইড আর আমি ওর সঙ্গে লন্ডন বিমানবন্দরে যোগাযোগ করেছিলাম। এখন তো ভালো…। আর এখন…।

–এখন ওরা পরস্পরকে নজরে রাখবে।

ক্লেয়ারে বলল, তুমি নিজেকে স্টোলারের শত্রু বানিয়ে ফেললে।

 মার্টেল বলল, ও দোষী হলে তবেই…।

***

প্যারিস থেকে টুইড আসছে। ওরা দুজন অফিসে বসে ওর অপেক্ষাতেই। ম্যাকনেইল দুচোখ বঁজে ভাবছে, একটা বড় সমস্যা সামনে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

টিম ও’মিয়েরা –হাওয়ার্ড পরিচয় করিয়ে দিল। টুইডের সঙ্গে করমর্দন না করে ও শুধু তাকিয়ে রইল।

যখন ক্লিন্ট লুমিসের ক্রুজারে ছিলে তখনই কেউ ছবিটা তুলেছে।

টুইড ওর হাত থেকে ফটোগ্রাফটা নিয়ে দেখলো। সূর্যের দিকে টুইড তাকিয়ে আছে, ছবিটা এইরকম। ল্যাংগলের সি. আই. এ ল্যাবরেটরীতে অত্যন্ত চতুরভাবে ছবিটা করা হয়েছে।

—ভালো হয়েছে? হাওয়ার্ড বলে উঠল।

-এটা তুমি কি করে পেলে? ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।

 টুইড ও’মিয়েরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো। টুইডের প্রশ্নটা শুনে হাওয়ার্ডের মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ হয়ে গেল।

হে ঈশ্বর, তুমি কি…।

না। টুইড বেশ কঠিন স্বরেই জবাব দিলো।

আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে তুমিই আক্ষেপ…।

ফটো তোলার ব্যাপারটা আমি জানি, বলে ও’মিয়েরার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে, কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি এ ছবি কোথা থেকে পেলে?

ল্যাংগলেতে একজন দূতের কাছ থেকে পাওয়া…।

ও’মিয়েরা টুইডের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো।

টেলিফটো লেন্সে ছবিটা তুলে তারপর ওটাকে বাড়ানো হয়েছে। টুইড ধীরে ধীরে বলে উঠলো, সমস্ত কিছুই ম্যানফ্রেডের চালাকি। লুমিস আর আমাকে ও ডালাস থেকে অনুসরণ করেছিল। সমস্ত ব্যাপারটা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।

খানিক পরে টুইড, হাওয়ার্ড আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ড্রয়ার খুলে তিনটে জিনিস বের  করে টেবিলের ওপর রাখলো। একটা ৩৮ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন স্পেশাল, কালো রঙের একটা ব্যারেট, আর একজোড়া বড় আকারের সানগ্লাস এর সঙ্গে একটা কালচে নীল উইন্ড চিটার।

–প্রশ্নটা খুবই ইন্টারেস্টিং, টুইড বলে উঠলো, গত শুক্রবার সকালে লন্ডনে কে ছিল, যখন ম্যানফ্রেড কার্লোস পিকাডিলিতে ছিল?

আমরা সিকিউরিটি মিটিং-এ প্যারিসে ছিলাম। তারপর আমি মধ্যাহ্নের প্লেন ধরি।ও’মিয়েরা বলে উঠলো।

–আমি সকাল দশটার ফ্লাইটে…।

অন্য আমেরিকানদের মতো ও দ্রুত বলে থেমে গেল। টুইড প্রথমে ওদের দুজনের দিকে তাকালো, তারপর বললো, এতেই তোমাদের নির্দোষ বলা যায় না। সকালনটা নাগাদ পিকাডিলিতে একজন পুলিশ এক বন্দুকধারীকে দেখে। তারপরে সেখানে টেগারে জিনিস পাওয়া যায়। অস্টিন রীডা। এখন আমার প্রশ্ন এই রহস্যময় ব্যক্তিটি কে? যে এত তাড়াতাড়ি লন্ডনে সাক্ষাৎ করতে এসে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল?

হঠাৎ দরজাটা খুলতেই টুইড থেমে গেল। ঘরে ঢুকলো হাওয়ার্ডের ডেপুটি ম্যাসন।

টুইড বললো, ঘরে ঢোকার আগে তোমার অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল। আমরা এখন একটু ব্যস্ত আছি।

-কিন্তু আমি তো আমন্ত্রিত…।

–তবু বলছি তুমি এখন যাও। টুইড ওর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো স্পষ্টভাবে বললো। ম্যাসন হাওয়ার্ডের দিকে তাকালো, হাওয়ার্ড জানলার দিকে তাকিয়ে, ঘর নিস্তব্ধ। ম্যাসন দেখল, টুইড একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে। ম্যাসন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা। টুইড এবারে নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, যাক, পিকাডীলির ঘটনায় আসা যাক। আমার অনুরোধে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ ঐ আইটেমগুলো বিশ্লেষণ করার জন্যে ফরেনসিকে দিয়েছিল। ম্যানুফ্যাকচারের কোন লেবেল নেই। বিশ্লেষণের রিপোর্ট, ব্যারেটটা গায়নার। উইন্ডচিটার আর গগলসটা হচ্ছে ভেনেজুয়েলার। বন্দুকের ব্যাপারটা জানা যায়নি। এতে কি কিছু বোঝা যাচ্ছে?

দক্ষিণ আমেরিকা। ও’মিয়েরা বলে উঠলো, আবার কার্লোস?

টুইড বলল, আমরা অনেক স্পষ্ট সংকেত পাচ্ছি, কিন্তু আমি এখন সংকেত খুঁজছি যেটা স্পষ্ট নয়।

হাওয়ার্ড ভুরু কুঁচকে বললো, কি বলতে চাইছ তুমি। তাছাড়া সামিট এক্সপ্রেসের সঙ্গে এসবের কি সম্পর্ক?

–আসলে প্রশ্নটা সময় নির্বাচনের। টুইড ও’মিয়েরার দিকে তাকালো। বলল তোমার একটু ইতিহাস জানা দরকার। সেই উনিশশো উনিশে যখন জার্মানীর পতন হচ্ছে তখন সোভিয়েট রিপাবলিক ব্যাভেরিয়াতে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। এটাই হচ্ছে অপারেশন ক্রোকোডাইলের আগের ঘটনা। সৌভাগ্যবশতঃ তথাকথিত জনতার গভর্নমেন্ট অবশিষ্ট জার্মান সৈন্য আর ফ্রেইপদের দ্বারাই ধ্বংস হয়েছিল। এবারে ম্যাপটা দেখ…।

টুইড একটা ম্যাপ খুললো। লেক কোল্সট্যাঞ্জ-এর আকারটা একেবারে কুমীরের মতো। এটাই ওদের চক্রান্তের কেন্দ্রস্থল, ব্যাভেরিয়াই ওদের লক্ষ্য। ওদের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ গভর্নমেন্ট করা। টফলারের সঙ্গে কমিউনিস্টদের যোগাযোগ আছে। কোসট্যানঞ্জ উপকূলেও ব্যাভেরিয়ার একটা ছোট্ট অংশ আছে। আমার কাছে যা রিপোর্ট আছে তাতে ওখানে চেকোশ্লোভাকিয়ার একটা গোপন মোটর টরপেডো বোটের ফ্যাক্টরী…।

–কিন্তু চেকদের কোন সীমারেখা নেই।

বুঝলাম। টফলার যখন ক্ষমতা পাবে তখন টর্পেডো বোট স্থলপথে এসে লেকে কোল্সট্যানঞ্জে পৌঁছবে। কয়েকটা মাত্র রাইন ডেলটাকে জব্দ করার জন্যে যথেষ্ট। এমনকি পরে অস্ট্রিয়া থেকে ভোরালবার্গ রাজ্যকেও হাতে পাবে।

ব্যাপারটা তো খুবই উদ্বেগের…। ও’মিয়েরার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

 টুইড বলল, ফেডারেল রিপাবলিকের থেকে ব্যাভেরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস এতে পশ্চিম জার্মানীর এক তৃতীয়াংশ সোভিয়েটের প্রভাবাধীনে চলে যাবে। সমস্ত পরিকল্পনা ম্যানফ্রেডের। সুতরাং ক্রোকোডাইল…।

ও’মিয়েরা বলে উঠলো, তুমি কি নাটক করছে।

 সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার্ড বলল, না ও ঠিকই বলেছে।

 টুইডের ভুরু কুঁচকে গেল হাওয়ার্ডের কথায়।

হাওয়ার্ড আবার বলে উঠলো, রাজনৈতিক কারণে ফেডেরাল রিপাবলিক থেকে যদি ব্যাভেরিয়া বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে সোভিয়েটের দখলে পশ্চিম ইউরোপে ক্রেমলিনে ঢোকার চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।

কিছুটা চুপ করে হাওয়ার্ড টুইডের কাছে জানতে চাইল, এবারে বলল তোমার খবরের উৎসটা কি?

টুইড বলল, ওয়ার্নার হেগেন। রেইনহার্ড দিয়েত্রিচের ভাইপো। ওরই কাছ থেকে খবর পাওয়া গেছে যে সিকিউরিটি চীফের চারজনের একজন খুনী…।

হাওয়ার্ডের মুখে একটা অস্বস্তির ভাব লক্ষ্য করা গেল। ডেস্কের চারদিকে পায়চারী করতে করতে বলল, এর জন্যে তোমার চাকরী যেতে পারে জানো?

-যদি আমি ভুল করি তাহলে তুমি তা করতে পারো। আর আমার কাজ যদি ঠিক হয়, তাহলে আমি তোমার কাছে জবাবদিহি…।

ও’মিয়েরা ক্রোধে ফেটে পড়ল। বলল, প্রথমে ক্লিন্ট লুমিসকে হত্যা করার ব্যাপারে জড়িয়ে ছিল, তারপর এখন সব পাগলামী কথাবার্তা।

টুইড ওদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে উঠলো, ফ্ল্যান্ড্রেস কিন্তু ব্যাপারটাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই নিয়েছে। আমি ওর সঙ্গে প্যারিসে মাত্র একবারই দেখা করেছিলাম।

হাওয়ার্ড উত্তেজনায় কম্পিত হাতজোড়া পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। টুইড তীক্ষ্ণভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, সামিট এক্সপ্রেসের নিরাপত্তার ব্যাপারে তোমার কোন অধিকার নেই। তোমার বিবৃতি ঠিক নয়। কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে…।

ও’মিয়েরা উন্মাদের মতো চীৎকার করে উঠলো, ওয়াশিংটনের কানে এসব যাবে। একজন সিনিয়ার ব্রিটিশ এজেন্ট তার নিরাপত্তা প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে চমৎকার।

আমি বলেছি চারজনের মধ্যে একজন। টুইড কঠিন চোখে বলে উঠলো, আগে থেকেই সব ঘটছে। এটা মনে রেখো চ্যান্সেলার উইলি ব্রানটটের ঘনিষ্ঠ লোক গন্টার জিলামো সোভিয়েট প্ল্যান্ট বাতিল করে দিয়েছিল।

–তাতে ব্রানট-এর ক্ষতিই হয়েছে।

একটু চুপ করে থেকে ও হাওয়ার্ডের দিকে তাকালো, অনেক বছর আগে থেকেই খুনী নিযুক্ত হয়েছে। ট্রেন আজ রাতে। অতএব প্রচণ্ডভাবে সতর্ক থাকলেই সবার মঙ্গল…।

***

দোসরা জুন, মঙ্গলবার :

 নাম : অ্যালেন ডোমিনেকো ফ্ল্যান্ড্রেস।

জাতি : ফরাসী

জন্ম তারিখ : ঊনিশশ আঠেরোই জানুয়ারি।

 জন্মস্থান : স্ট্রাসবার্গ।

টুইড তার অফিসে বসে, ম্যাকনেইলের দেওয়া ফাইলটায় চোখ বোলাতে বোলাতে চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল।

ফ্ল্যানড্রেসের অতীত ইতিহাস সম্বলিত আছে এই ফাইলে।

ক্যারিয়ার রেকর্ড? ইংল্যান্ড থেকে পালিয়েছিল ঊনিশশ চুয়াল্লিশ এর এপ্রিলে। যুক্ত ফরাসী বাহিনীর লেফটান্যান্ট হয়েছিল। জার্মান ভাষায় দক্ষতার জন্যে পরে মিলিটারী ইনটেলিজেন্সে নিযুক্ত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হবার পরে জেনারেল ডুমার স্টাফ হিসেবে ওকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ফ্রান্স অধিকৃত ভোরালবার্গ আর টেরেলে।

এরপরে উনিশশ তিপান্ন তে আবার ফ্রান্সে ফিরে আসে। সবশেষে ঊনিশশ আশি সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতির স্পেশ্যাল গার্ড ইউনিট-এর সিক্রেট সার্ভিস-এর ইনচার্জ-এর দায়িত্ব গ্রহণ করে।

টুইড পুরো ফাইলটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ম্যাকনেইলকে জিজ্ঞেস করলো, ওর বিবাহিত জীবন?

স্মৃতি হাতড়ে ম্যাকনেইল বলল, লিলির টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারের এক মেয়ে লুসিল ডুর্যান্ডকে ও বিয়ে করে।

টুইড বলে উঠলো, ক্লু যে কোথায় পাওয়া যায়…।

–ওর সাতজন মিসট্রেস, যতদূর জানি। ম্যাকনেইল বলল।

এরপর আলোচ্য ব্যক্তির নাম হচ্ছে ও’মিয়েরা। ফাইল দেখে টুইড বলল, এটা তো আরো বড় মনে হচ্ছে। টেনে নিল ওটাকে। পড়তে লাগল,

নাম : টিমসি প্যাট্রিক ও’মিয়েরা।

জাতি : মার্কিনী।

জন্মতারিখ : উনিশশ ত্রিশ সালের সেরা রা আগস্ট।

 জন্মস্থান : নিউইয়র্ক সিটি।

ক্যারিয়ার রেকর্ড : উনিশশ ষাট থেকে ঊনিশশ পয়ষট্টি পর্যন্ত ল্যাংগলেতে সি. আই. এ র ক্রিপটো অ্যানালিসিস সেকশানের সঙ্গে যুক্ত। উনিশশ পঁয়ষট্টি থেকে উনিশশ বাহাত্তর অবধি ওখানেই যুক্ত ছিল। পরে উনিশশ বাহাত্তর থেকে উনিশশ চুয়াত্তর অবধি পশ্চিম বার্লিন স্টেশনে কন্ট্রোলার ক্লিন্ট লুমিসের সঙ্গে কাজ করেছিল। দুজনের ইউনিট। অন্য জুনিয়ার মেম্বার লুজা কারসন। বার্লিনে আঠারো বছরের এক জার্মান মহিলার প্রেমে পড়ে, নাম ক্লারা বেক। এরপরে ইউনাইটেড স্টেটসে ফিরে ল্যাংগলেতে–অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে উন্নীত হয়। সবশেষে সিক্রেট সার্ভিসে…।

টুইড হঠাৎ থামল বিয়ে করেনি?

–হ্যাঁ। ম্যাকনেইল একটা হলদে রঙের ফাইল এগিয়ে বলল, বিয়ে হয়েছিল ন্যানসি মার্গারেট চেজ, শিক্ষিকার সঙ্গে। ওর বাবা ফিলাডেলফিয়ার একজন ব্যাংকার। নোকটা একটাই বিয়ে করেছিল। এখন ওর সেনেটে দাঁড়াবার ইচ্ছে।

ম্যাকনেইল জানতে চাইল, ও ও’মিয়েরা আর হাওয়ার্ডের ওপরে এত উত্তেজিত হলো কেন?

টুইড সহাস্যে বলে উঠলো, এটা আমার খেলার সবে শুরু। আর আমার সহযোগী মার্টেল তো আছেই।

***

মার্টেল স্টোলারকে বলল, আমি রেইনহার্ড দিয়েত্রিচকে ফোন করতে যাচ্ছি। মিউনিখের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ওদের কথা হচ্ছিল। স্টোলার খানিকটা অবাক হয়ে বলল, তুমি পাগল হয়ে গেছ।

মার্টেল ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। আমার ধারণা ভি ডেলটার সঙ্গেই গুপ্তচক্র গড়ে তুলছে যা দিয়েত্রিচের অজানা। এই চক্রটা সরাসরি পূর্ব জার্মানদের মাধ্যমে চালানো হচ্ছে। এর অর্থ সোভিয়েট নিয়ন্ত্রিত। আমার কাজ দিয়েত্রিচের মনে সন্দেহ জাগানো। তাহলে শেষমুহূর্তে অন্তত অপারেশন ক্রোকোডাইল ভেস্তে যাবে। সামিট এক্সপ্রেস আজ রাতে ছাড়ছে। সুতরাং এই সুযোগ…।

স্টোলার নির্বাক হয়ে মার্কেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাৰ্টেলকে চারবার আঘাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবারেই ডেলটার প্রতীক এমনকি ওয়ার্নারের মৃতদেহেও তা পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা খুবই কাঁচা…।

মার্টেল জানালো যে ও বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে ব্যাপারটা দিয়েত্রিচকে জানাবে।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে অপর প্রান্ত থেকে টুইডের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ওদের সতর্ক কথাবার্তা স্টোলার টেপ করে যাচ্ছিল।

কথাবার্তার সারাংশ হলো, কেইথের জন্যে একজন দূত কিছু গোপন রেকর্ড নিয়ে যাচ্ছে, যা ওর কাজে লাগবে। ওরই সহযোগী দূত মিউনিখ বিমানবন্দরে পৌঁছবে।

স্টোলার মার্টেলের পদক্ষেপ একবারেই বুঝছিল না। দিয়েত্রিচের ডেরায় ও পৌঁছতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা নির্মম ভাবে ভয়ঙ্কর।

এদিকে স্টোলারকেও আজ রাতে জরুরী বন-এ যাওয়া দরকার…।

***

মার্টেল আর ক্লেয়ার বাড়িতে বসেছিল। ক্লেয়ার বলল, স্টোলারের অফিসে কি হচ্ছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে হয়, কোড সংকেত বিনিময়।

মার্টেল বললো, যাই হোক স্টোলার-কে একটু বিষয় মনে হল। টুইড আজ সন্ধ্যেতে একটা দূত পাঠাচ্ছে। দেখা যাক কি হয়।

***

গাড়ি দ্রুত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে…।

কখন ব্রিটিশ রিপোর্টার ফিলিপ জনসন আমার সঙ্গে দেখা করবে দিয়েত্রিচ? তুমি কেন রাজি হলে?

ম্যানফ্রেড কথাগুলো বলে রিসিভারটা শক্ত করে ধরে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো।

খানিকক্ষণ নীরব থাকার পর দিয়েত্রিচ বলে উঠলো খুব ধীরে ধীরে, কারণ আমি নিশ্চিত, সে হচ্ছে কেইথ মার্টেল যে আমার ভাইপোকে খুন করেছে।

একটু থেমে দিয়েত্রিচ আবার বলল, আমি সব খোঁজখবর এর মধ্যে নিয়েছি। আসল ফিলিপ জন্ এখন প্যারিসে।

সাবধানে এগিয়ে।

–বটেই তো। দিয়েত্রিচের কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য।

***