৫. নিউইয়র্ক সান

০৫.

নিউইয়র্ক সান-এর বিশেষ প্রতিনিধি বার্তা সম্পাদকের অফিসে ঢুকে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। হেনরি ম্যাথিসন হাতের নীল পেন্সিল নামিয়ে বার্ডিকের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাল। এখন বার্লিকের মেক্সিকোয় থাকার কথা, কেননা ম্যাথিসনই ওকে পর্যটনের ব্যবসায়িক দিকটা বাড়াবার জন্য কয়েকটা রম্যরচনা লিখতে পাঠিয়েছিল। অবশ্য বার্ডিক এ ব্যাপারে খুবই নিরুৎসাহ ছিল।

তুমি ফিরে এলে যে বার্ডিক? আমি তো বলিনি। বার্ডিক হাসল। বার্ডিক লম্বা, বোগা, চুল ভুরু সব সাদা। বয়স তিরিশ হবে। সান–এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বার্ডিক। বার্ডিক জানে সান এর তাকে দরকার তাই খানিক সুবিধে নেয় তবে লেখাগুলো ঠিক সময় মতই দেয়।

সেই টুরিস্টদের ওপর গুলভরা কাহিনীর কথা যদি বল সব করে দিয়েছি আমি। চার্লি দেখছে লেখাগুলো। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, হেনরি। সান–এর এতে ভালো হবে।

ম্যাথিসন একটা সিগারেট ধরাল আর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বার্ডিককে দেখতে লাগল।

বলতে পার দশ দিন আগে মেক্সিকো শহরে কার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে? বার্ডিক বিনা অনুমতিতেই ম্যাথিসনের সিগারেট প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে ধরাল।

বল, এটা তো ধাঁধা নয় যে উত্তর দেব।

ভ্যাল কেড, ফটোগ্রাফার। বার্ডিক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওর কথার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইল।

ম্যাথিসন ভাবলেশহীন মুখে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছিল।

কেডকে মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ, মনে আছে বইকি। কোন্ মেয়ের থেকে ঘা খেয়ে বোতল ধরে দ্য গ্যলের ছবি তোলার ব্যাপারে সব ভণ্ডল করে। ওর এজেন্টের প্রচুর অর্থদণ্ড হয়। ওরকম একটা মাতালের সম্পর্কে আমার ভাবার কি দরকার।

কেন না সে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফার। বার্ডিক গভীরভাবে বলল।

মেক্সিকো থেকে শুধু এই কথা বলার জন্য তুমি এসেছ এড? আশ্চর্য।

আমি কেডের সঙ্গে কাজ করতে চাই।

 ম্যাথিসন হাঁ করে বার্ভিকের দিকে চেয়ে রইল।

 মানে, আবার বল তো কথাটা।

আমি আর কেড একসঙ্গে কাজ করলে সান–এর চেহারাটাই পালটে যাবে। আর আমি তুমি দুজনেই বুঝি সান–এর উন্নতি হওয়া এখন খুবই দরকার।

তুমিও কি কেডের সঙ্গে বোতল টোতল ধরেছ নাকি?

হেনরি, আমি সত্যি বলছি। তুমি যদি এ প্রস্তাবে রাজি না হও আমি টাইমসের সঙ্গে কথা বলব। নয়তো ট্রিবিউনকে বলব। আমি নিশ্চিত কেড আর আমি একসঙ্গে কাজ করলে ফাটাফাটি ব্যাপার হবে।

লোকটা আস্ত মাতাল। ওর সব শেষ হয়ে গিয়েছে। কিসে তোমার কেডের ওপর এত বিশাস জন্মাল?

কেন তোমার কি মনে হয় না কেড আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। ও একজন জাত ফটোগ্রাফার।

আরে আমি পাড় মাতালদের চিনি। নেশা ওদের কেড়ে নেয়।

আরে একটা ঝুঁকি নিতে কি? কেড তার আগের অবস্থায় যদি ফিরে যেতে পারে তাতে আমাদেরই লাভ হবে।

ম্যাথিসন সিগারেটের ছাই ফেলে বলল, তুমি কি কেডের সঙ্গে কথা বলেছ?

 নিশ্চয়ই।

শুনেছিলাম ও কোন্ একটা ইন্ডিয়ানের কুঁড়েয় পড়ে আছে। শুনেছিলাম এক পেসোয় দিন চালাত আর এক বোতল টেকুইলা খেত। ঠিক তো?

এটা পুরনো খবর। ইন্ডিয়ানদের কুঁড়ে থেকে ওয়াল্ডের এজেন্ট ক্রিল ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিন সপ্তাহ হাসপাতালে ওকে একফোঁটা মদও খেতে দেওয়া হয় নি।

ক্রিল আমার কাছে এসে অনুরোধ করে কেডের ব্যাপারে কিছু করার জন্য। আমি, কেডকে দেখতে চাই, আমার ওর সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগে। ওর তোলা ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবি মনে আছে? অসাধারণ, অপূর্ব। কেড আবার উঠে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত। তুমি তো জান একসময় সব খবরের কাগজ কেডকে নেবার চেষ্টা করেছে। আমার বিশ্বাস আমি আর ও যদি একসঙ্গে কাজ করি আর তুমি যদি ওর পেছনে থাক, ও আবার আগের মতন কাজ করবে। এবং তাতে সান উৎকর্ষতার একটা বিশেষ মাত্রায় পৌঁছতে পারবে।

আমার বিশ্বাস হয় না ও মদ পুরোপুরি ছাড়তে পারবে।

বার্ডিক অধীর হয়ে বলল, বিশ্বাস কর ম্যাথিসন এক সপ্তাহ হল ও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কোকোকোলা ছাড়া আর কিছুই খায় নি। আর এখানেই আছে কেড।

ম্যাথিসন অবাক হয়ে বলল, এখানে?

বার্ডিক বলল, কী করব বল ম্যাথিসন। নইলে আমরা টাইমসে যাব।

 ম্যাথিসন ভাবতে লাগল। মনে হচ্ছে তুমি একেবারে পণ করে বসে আছ।

 হ্যাঁ। কেডের সঙ্গে আমি কাজ করতে চাই। তাহলে একটা অসাধারণ কীর্তি গড়ব আমরা।

কী রকমভাবে কাজ করবে?

রবিবারের ছটা পাতাই আমার চাই। আমরাই লেখা ও ছবির বিষয় ঠিক করব, মানে আমরা তিনজন।

কেডের রঙিন ছবি ছাপাব আমরা। আমি এরকম ভেবেছি। দুরকম একেবারে বিপরীত জিনিসকে তুলনায় ফেলে আলোচনা হবে। কেড বৈপরীত্য দারুণ ফোঁটাতে পারে। যেমন সবল আর দুর্বল মানুষ, যেমন বৃদ্ধ আর তরুণ যেমন অত্যাচারী আর অত্যাচারিত।

ম্যাথিসনের বার্ডিকের প্রস্তাব মনে মনে ভাল লেগেছে কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না।

খরচ কেমন হবে?

কেডের কথা ভাবছ। এখন কেডকে হপ্তায় তিনশো ডলার দিলেই চলবে! আগেকার কেডকে ভাবলে এটা আমাদের খুবই সস্তায় দাও মারা হবে।

হু…তোমার কি মনে হয় আমরা ওকে ছ বছরের কনট্রাক্টে রাজী করাতে পারব?

মানে, অতদিনের কনট্র্যাক্ট কেন? ধর দুবছর। দ্বিতীয় বছরেহপ্তায় একে ৫০০ ডলার দিতে হবে।

ম্যাথিসন বিরক্ত হয়ে বলল, মনে হয় তুমি কেডের এজেন্ট হয়েছ।

বার্ডিক বিনীত ভাবে হেসে বলল, না আমি শুধু দেখছি কেড যাতে না ঠকে। ওর গুণের প্রতি শ্রদ্ধা আছে আমার।

ম্যাথিসন বলল, আমি কথা বলি আগে ওর সঙ্গে।

.

বার্ডিক খুবই উদ্বিগ্ন ভাবে বারে অপেক্ষা করছিল। একঘণ্টা বাদে কেড সেখানে ঢুকল।

এই চারমাসে কেড অনেক বদলে গিয়েছে। রোগা হয়ে গিয়েছে, কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে পাকা চুল দেখা দিচ্ছে। মেক্সিকোর রোদে পুড়ে পুড়ে ওর গায়ের রং ইন্ডিয়ানদের মতন বাদামি হয়ে গেছে। তবে ওকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে। কেমন একটা উদাসীন দৃষ্টি। তবুও বার্ডিক যখন ওর দিকে তাকাল কেড খুশীর হাসি হাসল।

বার্ডিকের পাশের টুলটায় বসে বলল, ধন্যবাদ বার্ডিক। দুবছরের কন্ট্রাক্ট সই করে এলাম।

বার্ডিক ওর কাঁধে হালকা ঘুষি মেরে বলল, এবার আমরা ওদের দেখিয়ে দেব ভ্যাল। আমরা একটা ফাটাফাটি কাণ্ড করব।

সত্যিই হল তাই। সান পত্রিকার এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরু হল। অন্যান্য পত্রিকার থেকে সানএর নাম ছড়িয়ে পড়ল। সংবাদপত্রের কর্মজীবনে যে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর কাজের চাপ থাকে তাতে কেডের পক্ষে ভাল হয়েছে। মদের অভ্যাস প্রায় চলে গেছে কেডের। শুধু কাজ আর কাজ। বার্ডিকের মত সমব্যথী বন্ধু পাওয়াতে একাকীত্বও অনেক ঘুচেছে। সান–এর অফিসের কাছেই বার্ভিকের ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাটেরই একটা ঘরে কেড থাকে। দুজনে আপন মনে কাজ করে, সময় কেটে যায়।

বহুসময় ঘুমের আগে একা ঘরে জুয়ানার কথা মনে পড়ে যায় কেডের। জুয়ানা এখন প্রায় স্মৃতি। সেই স্মৃতিতে বেদনা অনেক কম। কিন্তু কে জানে এই মুহূর্তে যদি জুয়ানা ঘরে ঢোকে আর কেডকে জড়িয়ে ধরে, কেড সব ভুলে যাবে। স্পেনে ষাঁড়ের লড়াইয়ের সিজন শেষ। জুয়ানা নিশ্চয়ই মেক্সিকোয় ফিরে এসেছে। হয়তো ডিয়াজের সঙ্গেও সম্পর্ক শেষ করেছে জুয়ানা অন্য কারও সাথে রয়েছে। জুয়ানা এখনও তার স্ত্রী। কিন্তু ওকে ডিভোর্স করার কথা ভাবতেও পারে না কেড।

কয়েকমাস কেটে গেছে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় কেডের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। বার্ডিক বিরক্তস্বরে বলল, বাজতে দাও। কিন্তু সেই টেলিফোনটার মধ্যে যেন একটা অমোঘ নিয়তির ডাক ছিল। কেড ফোনটা তুলল। ম্যাথিসন কথা বলছে।

শোন ভ্যাল, একটা দারুণ ব্যাপার অথচ একটা ফটোগ্রাফারও হাতের কাছে নেই। দুটোই শহরের বাইরে। কেড বলল, কি হয়েছে হেনরি?

বুড়ো ফ্রিডল্যান্ডার গুলি খেয়েছে। আমরা সবার আগে ওখানে পৌঁছতে চাই। তুমি কি ওখানে যাবে ভ্যাল?

কেড প্রত্যাখ্যান করতে পারত। কিন্তু তার মনে পড়ল ম্যাথিসনই তাকে আবার উঠে দাঁড়াবার সুযোগ দিয়েছে। তার ঋণ শোধ করার এটাই সুযোগ।

আমি যাচ্ছি হেনরি। আমার ওপর ছেড়ে দাও।

খুব ভাল। তুমি ঠিকানা জানো ত?

 জানি।

কেড তাড়াতাড়ি টাই আর জ্যাকেট পরে ক্যামেরা নিয়ে ছুটল।

জোলাস ফ্রিডল্যান্ডার কবি, নাট্যকার, শিল্পী, সঙ্গীতকার। লোকটার শিল্পজগতে বিশাল নাম। লোকটার সমকামী বলে দুর্নাম আছে। ওর সঙ্গে সবসময় একটি পেলব, ক্ষীণতনু সুদর্শন একজন। তরুণ থাকেই। সেই তরুণ আবার বদলে যায় আবার আরেকজন তার জায়গায় আসে।

কিন্তু ফ্রিডল্যান্ডার মানেই জবর খবর। ওর ব্যাপার স্যাপার সবসময়েই সংবাদপত্রের জোর খবর। ছাতের ওপর ফ্রিডল্যান্ডারের অপূর্ব ফ্ল্যাট। ওর বাড়ির দিকে পড়ি কি মরি করে গাড়ি চালাতে চালাতে কেড বুঝল হেনরির তার কাছে সাহায্য চাইবার অধিকার আছে। ফ্রিডল্যান্ডারের। গুলিতে আহত হবার খবর আগে ছাপানো যে কোন বার্তা সম্পাদকের কাছে একটা স্বপ্ন।

গাড়িটা কোনরকমে পার্ক করে কেড ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়ি টপকে উঠতে লাগল। ফ্রিডল্যান্ডারের সদর দরজার সামনে একজন বিশালকায় লালমুখো পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। কেডকে দেখে চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি কে? কোথায় গটগট করে চলে যাচ্ছ?

লেফটেন্যান্ট টাকার আছেন?

থাকলে তোমার কি?

তাকে গিয়ে বল নিউইয়র্ক সান–এর কেড ভেতরে যেতে চায়। আর চোখ পাকিও না তোমাকে একটা ষাঁড়ের মতন দেখাচ্ছে। পুলিশটি একটু ইতস্ততঃ করে ভেতরে গেল। কেডও ওর পেছন পেছন ঢুকল। লেফটেন্যান্ট টাকার ছোটখাট মানুষ, মুখটা কঠিন। সুসজ্জিত লবিতে দাঁড়িয়ে তিনি একজন ডিটেকটিভের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কেড ও পুলিশটিকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি বিরক্তিভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি কে?

নিউইয়র্ক সান–এর কেড। ম্যাথিসন আমাকে পাঠিয়েছে। কি হয়েছে?

ম্যাথিসন টাকারের সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। টাকার কেডের হাত ঝাঁকিয়ে বলল, আলাপ করে খুশী হলাম।

কি ব্যাপার যদি বলেন?

 টাকার বিতৃষ্ণার সঙ্গে বলল, বুড়ো বদমাশটা এবার বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নতুন নঙ্গী আনার আগে আগের সঙ্গীটিকে ছাঁটাই করতে ভুলে গেছে। ফলে ঝগড়াঝাটি, ছেলেটি গুলি করেছে ওকে।

মারা গেছে?

আরে না না, সেই সৌভাগ্য কি হবে। ও ভেতরেই হিরো হয়ে বসে আছে।

 ছেলেটির নাম কি?

জেরি মার্শাল। ছেলেটা ভালই। বুড়ো শয়তানটাই ওকে নষ্ট করেছে।

ওর ছবি তুলতে চাই।

নিশ্চয়ই। আগে আমি সেরে আসি, তারপর তুমি যেও।

কেড ক্যামেরা বার করল। তারপর ফ্ল্যাশগান এঁটে নিয়ে দরজা ঠেলে একাট বিশাল লাউঞ্জে ঢুকল। সাদায় কালোয় সাজানো ঘরটা। দেয়ালে ফ্রিডল্যান্ডারের আঁকা প্রাচীর চিত্র।

একটা উঁচু বেদীর ওপর জেব্রার চামড়া ঢাকা আরাম কেদারায় জোলাস ফ্রিডল্যান্ডার শুয়ে ছিল। একজন বয়স্ক চাকর সামনে দাঁড়িয়ে। একজন ডাক্তার ফ্রিডল্যান্ডারের মাংসল হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধছিল।

কেড বেদীতে উঠে জিগ্যেস করল, এখন কেমন বোধ করছেন?

স্থূলদেই মানুষটি মুখ বিকৃত করে বলল চলে যাও। কোন্ সাহসে এখানে ঢুকেছ। আমি ছবি তুলতে দেব না। আমার শরীর খুব খারাপ।

আমি ভ্যাল কেড।

 পরিচারকটি কেড়কে বাধা দিতে আসছিল, ফ্রিডল্যান্ডার তাকে হাত নাড়িয়ে মানা করল।

তুমিই কেড? সত্যি? তোমায় চিনতে পারছি বটে। খুবই অবাক এবং খুশী হয়েছি। তুমি একজন মহৎ শিল্পী..অবশ্য তোমার ক্ষেত্রে। এখানে কেন?

কেড বলল, মিঃ ফ্রিডল্যান্ডার এই গুলি চালানোর কথা চাপা থাকবে না। আপনি চান না পৃথিবীর সব কাগজে আপনার ফটো বেয়োক। আপনি আমাকে চেনেন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ছবিগুলো খুবই উঁচু দরের হবে।

ফ্রিডল্যান্ডার হাসার চেষ্টা করল। তার যন্ত্রণা করছিল কিন্তু ভয়ানক খুশী হয়েছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাই তুমি ছবি তোল। শোন আর কোন ফটোগ্রাফারকে এখানে ঢুকতে দেবে না।

তরুণ ডাক্তারটি বলার চেষ্টা করল, প্লিজ মিস্টার ফ্রিডল্যান্ডার আপনি এত উত্তেজিত হবেন না।

ফ্রিডল্যান্ডার বলল, যাওতো, আমি হাতুড়েদের কথা শুনি না।

ছবি তুলতে তুলতে কেড বলল, কি করে ব্যাপারটা ঘটল মিঃ ফ্রিডল্যান্ডার?

বুড়োটার মুখ বিকৃত হয়ে গেল। কেড ঠিক এই অভিব্যক্তিই চাইছিল। কেড ছবি তুলতেই লাগল ওদিকে ফ্রিডল্যান্ডার চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ছোকরা বদ্ধ পাগল। কিছুনা ব্যাপারটা, আমার এক তরুণ বন্ধুর সঙ্গে হিংসা হিংসি আর কি। জেরি হিংসের চোটে আমাকে যা তা বলতে লাগল। কিন্তু আমি অন্যের ধমকিতে চলি না। শেষে জেরি এই বন্দুকটা দিয়ে আমাকে গুলি করে বসল। আমি এর জন্য প্রস্তুতই ছিলাম না।

ফ্রিডল্যান্ডার–এর মুখ বিবর্ণ সাদা হয়ে যাচ্ছিল। কেড মোম ছবিটি তুলল। ডাক্তার কেডকে ইশারা করল শেষ করতে।

ধন্যবাদ মিঃ ফ্রিডল্যান্ডার। কেড বেরিয়ে গেল। বুড়োকে দেখে মনে হল অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু পাকা অভিনেতা একেবারে। দুর্বলভাবে হাত নাড়ল কেডকে। সদর দরজার বাইরে অনেক গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। কেড সাবধান হল। প্রেসের লোকেরা এসে গিয়েছে। কেড টাকারকে জেরি মার্শালের কথা বলল। যাও, দশ মিনিটের বেশি নয় কিন্তু। আমি ওই বদরগুলোকে সামলে আসি।

কেড ঘরে ঢুকে দেখল দুজন ডিটেকটিভ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। জেরি মার্শালের বয়স তেইশ বছর। লম্বা, ফ্যাকাসে চুল ও ভুরু, মুখশ্রী ভাল। চোখ নীল। কেডের হাতে ক্যামেরা দেখেই জেরি আড়ষ্ট হয়ে গেলো। বিদ্বেষের দৃষ্টিতে কেডের দিকে তাকাল। কেড ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে বলল, আমি ভ্যাল কেড। তুমি রাজী হলেই আমি তোমার ছবি তুলব জেরি। আজ পৃথিবীর সব সংবাদপত্রে তোমার খবর হেডলাইনে বেরোচ্ছে তুমি তা থামাতে পারবে না। বাইরে প্রেসের লোকেরা গিজগিজ করছে। তুমি ওদের এড়াতে পারবে না। তবে তুমি যদি আমাকে তোমার ছবি তুলতে দাও আমি কথা দিচ্ছি আমার কাগজের অফিস থেকে আমি তোমার জন্য একজন ভাল অ্যাটর্নি নিয়োগ করিয়ে দেব। সেই তোমার কেস দেখবে। এ ছাড়া আরও যদি তোমার জন্য কিছু করতে পারি আমাকে বলতে পার।

জেরি এবার একটু সহজ হল, বলল, আমি আপনার নাম জানি, কে না জানে? ঠিক আছে আমি আপনার শতে রাজী।

জেরি তো আর ফ্রিডল্যান্ডারের মতন আত্মসচেতন নয়, তাই সহজেই ওর মুখের আসল অভিব্যক্তি তোলা যায়। ছবি তোলা হয়ে গেলে একজন ডিটেকটিভ বলল, একে এখনি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে হবে মিস্টার কেড। আপনার হয়ে গেছে তো?

হ্যাঁ, তারপর জেরিকে কেড বলল, আজ রাতেই একজন উকিল যাবে তোমার কাছে, সবচাইতে ভাল উকিল। আর কিছু করতে পারি?

মার্শাল একটু আমতা আমতা করে বলল, আমার বোনকে খবর দিতে পারেন দয়া করে।

কেড বলল, নিশ্চয়। আজ রাতেই দেখা করব আমি। ওর ঠিকানা? জেরি মার্শাল ওর নামের একটা কার্ড বার করে তার পেছনে ওর বোনের ঠিকানা লিখে দিল।

তারপর আবেগ প্রাণপণে দমন করার চেষ্টা করতে করতে বলল, একটু সইয়ে বলবেন মিঃ কেড। আমাদের মধ্যে খুব ভাব, ও খুবই দুঃখ পাবে।

কেড কার্ডটা নিয়ে বলল, আমার ওপর আস্থা রাখ। বিশেষ কিছু বলতে হবে?

 বলবেন বুড়ো হতচ্ছাড়াটাকে আমি খুন করতে পারলে খুশী হতাম।

ঠিক আছে।

ফ্রিডল্যান্ডারের ঘরের বাইরে চেঁচামেচি চলছে। হঠাৎ পরিচারকটি বেরিয়ে আসতে ওর হাত চেপে কেড বলল, পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবার কোন রাস্তা আছে?

লোকটা বলল, ওদিকে চাকর জমাদারদের লিফট আছে।

পাঁচমিনিটের মধ্যে বেরিয়ে কেড জোরে গাড়ি চালিয়েছে নিউইয়র্ক সান–এর অফিসের দিকে।

অফিসে গিয়ে দেখল ম্যাথিসন অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। কেড টেবিলে ফিলমের কার্টিজ নামিয়ে রাখল।

হেনরি শুধু আমরাই ছবি তুলেছি। ছবি ভাল হয়েছে।

 ফ্রিডল্যান্ডার আর যে ছেলেটি গুলি করেছে জেরি মার্শাল দুজনের ছবি তুলেছি।

ম্যাথিসন সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন তুলে ফটো এডিটরকে ছুটে আসতে বলল।

ম্যাথিসন রিসিভার নামিয়ে রাখতেই কেড বলল, ছেলেটির সঙ্গে আমি একটা শর্ত করেছি। তুমি ওর জন্য একজন ভালো অ্যাটর্নি ঠিক করবে। আমার ধারণা আমার ছবির জন্য ও খালাস পেয়ে যেতে পারে।

কি বলতে চাইছ?

আগে ছবিগুলো দেখই।

 আমি বেনস্টাইনকে বলছি। এ ধরনের কেসে ও খুবই সফল।

শোন কেনস্টাইন যেন আজ রাতেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা করে। বলেই কেড সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে লাগল।

ছেলেটার বোন ভিকি মার্শাল ট্রিমন্ট অ্যাভেনিউতে একটা ফ্ল্যাটে থাকে।

কেড জানতো না নিয়তি তার সঙ্গে আবার এক অদ্ভুত খেলা খেলছে। জানে না আজকের এই সাক্ষাৎকার ওকে একদিন ইস্টনভিল নামে একটা শহরে পৌঁছে দেবে।

ফ্রিডল্যান্ডারের আহত হবার খবর যতই চমকপ্রদ হোক বার্ডিক এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ও শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখছিল। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। ম্যাথিসনের ফোন।

এড, এখনি চলে এসো। এক্ষুনি তোমাকে আমার চাই।

আস্তে হেনরি। এখন আমি অফ ডিউটি। আর ফ্রিডল্যান্ডার, শোন…

থামাও তোমার বকুনি। ম্যাথিসন অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে বলল, এড। আমরা একটা আশ্চর্য জিনিস পেয়েছি যা আমার ডেস্কের ওপর পড়ে আছে। এটা পেলে তুমি ফোর্ট নক্সের সমস্ত সোনাও চাইবে না। ও বাব্বা! আমাদের কেড ফ্রিডল্যান্ডারের যা একখানা ছবি তুলেছে, দেখলে সারা দুনিয়াতে সাড়া পড়ে যাবে। এ ছবির মতন ছবি তুমি আর দেখ নি। কেড মনে করে এই ছবির জোরেই ছেলেটা খালাস পেয়ে যাবে। আমিও নিশ্চিত। বেনস্টাইন এখানে আসছে। তুমি লেখার দিকটা দেখ…

বার্ডিক উত্তেজিত হয়ে বসে পড়ল। বল কি হেনরি, কেডের ছবির জোরে…

 আরে তাহলে আর কি বলছি। ছবিটা একবার দেখ শুধু..

 আমি তোমাকে কি বলেছিলাম হেনরি, তুমি কেডের সম্বন্ধে যা বলেছিলে…

 ঠিক আছে বাবা, আমি প্রতিটা কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। এবার দয়া করে এখানে এস।

শোন হেনরি, নিউজের ছবি তোলার কথা নয় কেডের। তুমি ওকে এজন্য আলাদা করে টাকা দেবে। এ ছবির কপিরাইট শুধু কেডের। সারা দুনিয়ায় নিশ্চয় এ ছবি ছাপা হবে…

আরে তুমি আমাকে কি মনে কর। আমি কি একটা চোর নাকি?

কোনরকমে জামা গলিয়ে বেরোবার উপক্রম করতেই দরজায় বেল বাজল। কেড আর একটা লম্বা মতন রুপোলী চুল আর ভুরুওয়ালা মেয়ে ঘরে ঢুকল।

কেড ক্যামেরা নামিয়ে বলল, এড, ইনি ভিকি মার্শাল। এর ভাই ফ্রিডল্যান্ডারের হাতে গুলি করেছে। রিপোর্টারদের উৎপাত এড়াতে আজ রাতে ইনি এখানে থাকবেন।

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কেড বলল, এখানে আপনাকে কেড খোঁজ করার কথা ভাববে না, মিস মার্শাল। আপনি বৃথা দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার ধারণা আপনার ভাইকে আমরা খালাস করতে পারব। আমি এখন সান–এর অফিসে যাচ্ছি। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফিরব।

মেয়েটি আকস্মিক বেদনার আঘাতে তখনও মুহ্যমান হয়ে আছে। তার নীল চোখ দুটো বিষণ্ণ, ঠোঁট কাঁপছে।

কেড নরম গলায় বলল, আপনি বসুন। বৃথা দুশ্চিন্তা করবেন না। এড, তুমি কি আসছ?

নিশ্চয়। হেনরি হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে।

লিফটে নামতে নামতে কেড বলল, মেয়েটি অসম্ভব আঘাত পেয়েছে। ভাইকে খুবই ভালবাসে।

বার্ডিক বলল, কি মেয়ে! কি চেহারা! কি করে জান?

মনে হয় ফ্যাশন আর্টিস্ট। ভাইয়ের কাছে যেতে চাইছিল, আমিই সরিয়ে আনলাম।

দশ মিনিট বাদে ওরা ম্যাথিসনের অফিসে ঢুকল। জোয়েল কেনস্টাইন ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। বিখ্যাত ফৌজদারী আইনজীবী বেনস্টাইন। বেটে, মোটা আর একরোখা। উনি কেডের তোলা ফ্রিডল্যান্ডের ছবিটা দেখছিলেন মন দিয়ে। বললেন, ফ্রিডল্যান্ড এই ছবিটা কি করে তুলতে দিল?

বার্ডিক ছবি দেখেশিস দিয়ে উঠল। তুমি বুড়োটার মুখোশ একদম টেনে ছিঁড়ে ফেলেছ ভ্যাল। ওর মুখটা দেখেই মনে হচ্ছে পাপ আর অনাচারের একটা মূর্তিমান ছবি। মুখের প্রতিটি বলিরেখা স্পষ্টভাবে প্রকট। কেমন আক্রোশে ঠোঁটটা কুঁচকে আছে। কি কুৎসিত!

কেড খুব আস্তে বলল, আমরা এ ছবিটা ছাপব না। ফ্রিডল্যান্ডারের সঙ্গে একটা বোঝাপোড়া করব এ ছবিটা নিয়ে।

ম্যাথিসন ফেটে পড়ল, না আমরা এ ছবি ছাপবই। কি বাজে বকছ তুমি?

কেড ম্যাথিসনের দিকে তাকাল। অন্য ছবিগুলি আমি বিনাপয়সায় দিয়ে দিচ্ছি হেনরি। কিন্তু এ ছবিটা আমি না বলা অবধি তুমি ব্যবহার করতে পারবে না।

টেবিলে একটা ঘুষি মেরে ম্যাথিসন বলল, আমি এ ছবি ছেপে দিলে তুমি কি করতে পার?

বার্ডিক বলল, নিশ্চয়ই পারে। কপিরাইটের কেসে ফেলে দিতে পারে সানকে।

কেড বের্নস্টাইনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এ ছবিটা ফ্রিল্যান্ডারকে দেখিয়ে ব্যাপারকে জলদি মিটমাট করতে পারি। ফ্রিডল্যান্ডার যদি বলে এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা তাহলে জেরি মার্শাল ছাড়া পেয়ে যায়।

বের্নস্টাইন একটু ভেবে বললেন, ভাল প্রস্তাব। বলে ছবিটা ব্রিফকেসে পুরলেন। আমি যাচ্ছি।

এক মিনিট…এই। ম্যাথিসন প্রায় পাগলের মতন টেবিল চাপড়াতে লাগল।

 ততক্ষণে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেছে, ম্যাথিসনের দিকে তাকালেনও না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপরে ম্যাথিসন বলল, ভ্যাল তুমি জান যে দুনিয়ার সমস্ত কাগজে তুমি এ ছবি বিক্রী করতে পারতে। মোটা টাকাও পেতে। তুমি এরকম করলে কেন?

কিছু না। কোন কোন সময়ে টাকা তুচ্ছ হয়ে যায়। আমি চাই ছেলেটা খালাস পাক।

কেডের দিকে তাকিয়ে বার্ডিকের হঠাৎ মনে হল মার্শালের বোন খুব প্রভাবিত করেছে। কেডকে, তাই যেন মনে হয়।

একঘণ্টাবাদে কেনস্টাইন ফোন করলেন। ম্যাথিসন ফোন ধরল। উনি বললেন কাজ হয়েছে। আমি পুলিশ হেড কোয়ার্টারসে যাচ্ছি। ফ্রিডল্যান্ডার রাজী হয়েছে। বন্দুকটা ভাগ্যিস ফ্রিডল্যান্ডারের। এটাই বলা হবে যে মার্শাল বন্দুকটায় গুলি ভরা আছে জানত না। দেরাজ খুলে বন্দুকটা তুলতেই গুলি ছুটে যায়।

সবাই বুঝবে এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা।

কিন্তু প্রমাণ ত করতে পারবে না। কেনস্টাইন বললেন। ম্যাথিসন ফ্রিডল্যান্ডার আর মার্শালের বাকি ছবিগুলো দেখছিল। যাক অন্তত এগুলি ও একাই ছাপাতে পারবে। তবে একটা সাংঘাতিক সম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেল।

বের্নস্টাইন হেসে বললেন, কেড একটা লোক বটে। আমার তো ফ্রিডল্যান্ডারকে ব্ল্যাকমেল করার কথা মনেও আসেনি।

হু। মাথিন মুখ বিকৃত করে বলল।

জেরি মার্শাল যখন ছাড়া পেল তখন কেড আর বার্ডিক পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের বাইরে অপেক্ষা করছে। জেরি বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টাররা ওকে ঘিরে ধরল। সমানে ক্যামেরার ফ্ল্যাশবাতি জ্বলছে। কোনরকমে একটা পুলিশ জেরিকে কেডের গাড়িতে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। কেড সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

মার্শাল অভিভূত ভাবে বলল, মিঃ কেড, আপনি আমার জন্য যা করেছেন, কেনস্টাইন আমাকে সব বলেছেন। বিনিময়ে আমি আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন…

কেড বলল, তোমার বোনের কাছে তোনার ঋণ আরো অনেক বেশি জেরি। এ কথাটা মনে রেখ। তোমার বোন খুবই ভাল মেয়ে।

বার্ডিক মনে মনে হাসল। বার্ডিক জুয়ানার সব কথাই জানত। ওর মনে হল ভিকি মার্শালের সঙ্গে কেডের একটা সম্পর্ক হলে কেড জুয়ানাকে একেবারে ভুলে যেতে পারবে। আর পারবে নিজেকে সর্বনাশ থেকে বাঁচাতে।

কেড ওদের বাড়ির বাইরে গাড়ি থামাল। তারপর মার্শালকে বলল, যাও, ওপরে যাও। আমরা একটু বেড়িয়ে আসছি। আর কোন ঝামেলায় জড়িও না যেন। আমরা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঘুমোতে চাই।

মার্শাল বলল, কিন্তু মিঃ কেড ভিকি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাইবে।

কেড মাথা নাড়াল, ধন্যবাদের দরকার নেই। বলে গাড়ি ছেড়ে দিল।

বার্ডিক সিগারেট ধরাল, ভাল মেয়ে।

কেড বলল, হ্যাঁ।

বার্ডিক আড়চোখে কেডকে দেখতে লাগল। অনেকদিন পরে কেডের মুখে ও বেদনার ছাপটা দেখতে পেল না। ওকে কেমন খুব স্বস্তি পেয়েছে মনে হল।

পরদিন সকালে ওরা হলিউড গেল। বিস্মৃত চিত্রতারকাদের নিয়ে একটা লেখা বেরোবে, সেজন্য যাওয়া। ম্যাথিসন জানত কেড অপূর্ব সব ছবি তুলবে।

ফিরে এসে কেড ওর চিঠিপত্রের মধ্যে ভিকি মার্শালের একটা চিঠি পেল।

 প্রিয় মিঃ কেড,

জেরির জন্য আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে সামনে থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। একটু কি দেখা হওয়া সম্ভব? প্রায় সন্ধ্যায় আমি বাড়িতেই থাকি।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় কেড ভিকি মার্শালের বাড়িতে গেল। ভিকি মেয়েটি নম্র সহানুভূতিশীল স্বভাবের। এবং অবশ্যই শিল্পী মন আছে ওর মধ্যে। ঠিক এরকম একজন সঙ্গীই কেড চেয়েছিল। কিন্তু আশা করে নি।

প্রায় রাত দুটো অবধি ওরা গল্প করল। ভিকি জানাল জেরি কানাডায় চলে গেছে। ভ্যাঙ্কুভারে জেরির বন্ধুর একটা খেলার ক্লাব আছে। ও জেরিকে ওর পার্টনার হওয়ার জন্য অনেকদিনই পীড়াপীড়ি করছিল। ওর নিজের ভাই সমকামী, ভিকির কাছে এ আঘাত সাংঘাতিক। ওরা যদিও দুজন দুজনকে খুব ভালবাসে, কিন্তু ওদের ছাড়াছাড়ি হওয়াটাই ভাল।

ভিকি কেডকে বলল ও কেডের একজন মস্ত ফ্যান। কেডের ইদানীংকার কিছু ছবি নিয়েও বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা করল। কেড মুগ্ধই হল।

কেড উঠে পড়বার আগে বলল, কাল আমরা কোথাও যেতে পারি না, শহরের বাইরে? আপনার কি সময় হবে?

ভিকি জানাল তার অনেক কাজ বাকী রয়েছে। সে কেডকে আগামীকাল ডিনার খেতে আসতে বলল।

বেশ, আমরা না হয় বাইরেই খাব কোথায়।

কেন আমার রান্না খেতে আপনি ভয় পাচ্ছেন?

কেডের হঠাৎ জুয়ানার কথা মনে পড়ল। ওর মুখে এমন একটা বেদনা ফুটে উঠল যে বুদ্ধিমতী ভিকি তাড়াতাড়ি বলল, বেশ আমরা বাইরেই খাব।

না, আমি এখানেই আসব।

তারপর দশদিন ধরে ও রোজই ভিকির ফ্ল্যাটে এল। এই দশ দিনেই ও বুঝল ভিকিকে ও ধীরে ধীরে ভালবেসে ফেলেছে।

ও ভিকিকে সবই বলল। জুয়ানার কথা, দুঃস্বপ্নের মতন সেই দিনগুলি, ওর রেডইন্ডিয়ানদের কুঁড়েয় পড়ে থাকা..সব। ভালবাসার কথা ওরা উচ্চারণ করেনি কিন্তু কেডও বুঝেছেভিকিও তাকে ভালবেসেছে। কিন্তু জুয়ানার অশুভ স্মৃতি তার কাছে এখনও মলিন হয়নি, বড় জীবন্ত তার প্রভাব। কেড ভাবছিল সে কি আর কোন নতুন সম্পর্ক শুরু করতে পারবে।

তারপর কেড আর বার্ডিক নতুন কাজ নিয়ে প্যারিসে চলে গেল। প্যারিসে আমেরিকান পর্যটকদের নিয়ে একটা বেশ লেখা হতে পারে।

কেডও একটু স্বস্তি পেল। কিছুদিন নিজের মনটাকে ভাল করে যাচাই করে নেওয়ার জন্য ভিকির থেকে একটু দূরে সরাই ভাল। আটদিন বাদে ফিরতে ফিরতে প্লেনে বসে ও মনস্থির করল সেডিভোর্স নেবে। আর ভিকিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। বাডিককে না জানিয়ে ও একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলল।

শুনল ডিভোর্স পেতে ওর কোন অসুবিধেই হবে না। শুধু মেক্সিকো শহরে তাকে দুসপ্তাহ থাকতে হবে। মেক্সিকোর বিবাহবিচ্ছেদ খুব তাড়াতাড়ি আর সহজে হয়। উকিলই কেডকে ওঁর মেক্সিকান প্রতিনিধির ঠিকানা দিলেন। কেড ম্যাথিসনকে বলল সে দুসপ্তাহ ছুটি চায়। ম্যাথিসন আপত্তি করল। বার্ডিককে ও বলল বিবাহ বিচ্ছেদ করতেই ও মেক্সিকো যাচ্ছে। বার্ডিক খুশী মনে ওকে শুভকামনা জানাল।

যাবার আগের দিন ও সন্ধ্যাবেলাটা ভিকির সঙ্গে কাটাল। কিন্তু কিছুই বলল না। যতক্ষণ না ওসত্যিই জেনেছে ও মুক্তি পেয়েছে ভিকিকে ও মনের কথা জানাবেইনা। শুধু বলল একটা জরুরী কাজে ও দুসপ্তাহের জন্য মেক্সিকো যাচ্ছে।

.

০৬.

 এল প্রাভো হোটেলের লবির দেওয়ালে বিভেরার আঁকা পঞ্চাশ ফুট লম্বা প্রাচীর চিত্র। রবিবার বিকেলের একটি সময় আমেরিকান টুরিস্টরা হাঁ করে তাই দেখছিল। কেড লবিতে ঢুকল সে সময়। একা একা সে লাঞ্চ খেয়ে নিয়েছে। আজ রবিবার, কি করে যে সময় কাটাবে ভাবছিল কেড। মেক্সিকান উকিলরা ওকে পরামর্শ দিয়েছে কেড যেন ওদের সাথে আরো আলোচনা করে। জুয়ানার ব্যাভিচারের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেছে, সব প্রমাণ খুঁটিয়ে দেখেছে। এক কথা বলতে বলতে কেডের বিরক্তি ধরে গেছে।

একটা পেপারব্যাক বই কিনে বিকেল অবধি আলামেদা গার্ডেনে সময় কাটাবে ভেবে একটা বইয়ের দোকানে গেল কেড।

সিনর কেড।

ঘুরে দাঁড়িয়ে কেড ক্রিল অ্যাডোলফোর আনন্দে ঝলমলে মুখটা দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আর নিঃসঙ্গ বলে মনে হল না কেডের। করমর্দন করতে করতে ক্রিলের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি বলে কেডের একটু খারাপ লাগল। কেড ইচ্ছে করেই ক্রিলের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেনি। কেডের দুঃসহ অতীতের সঙ্গে ক্রিল খুবই জড়িত ছিল। কেড সব ভুলতে চাইছিল। তবে এখন ক্রিলকে দেখে তার মন খুশীতে ভরে গেল।

ক্রিল আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলেছে, এ একটা বিশেষ মুহূর্ত সিনর। আমি তো জানতামই না আপনি এখানে এসেছেন। কি চমৎকার চেহারা হয়েছে আপনার। আপনাকে দেখে এত ভাল লাগছে।

কেড বলল, আমরা দুজনেই খুশী হয়েছি। চল কিছু খাওয়া যাক। তোমার সময় আছে তো?

আপনার জন্য সময় নেই। ক্রিল বলল।

ক্রিল কেডের সঙ্গে একটা স্বাল্পালোকিত বারে ঢুকল।

আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি আপনি ভাল আছেন। নিউইয়র্ক সান–এ আপনার অসাধারণ ছবি দেখেছি। আমি খুবই সাধারণ এবং অশিক্ষিত। হয়তো আমার পক্ষে এটা ঔদ্ধত্য হবে বলা যে আপনার ছবি আমার মনকে ভীষণ নাড়া দেয়।

ক্রিলের স্থূল হাতটায় চাপ দিল কেড। তারপর নিজের জন্য কোকাকোলা আর ক্রীলের জন্য কফি অর্ডার দিল। তারপর আবেগ সামলে বলল, অ্যাডোলফো, প্লিজ আমাকে সিনর বল না। আমাকে ভ্যাল বলেই ডেক। আর তুমি অজ্ঞ, অশিক্ষিত এ সব বাজে কথা বোলল না।

আনন্দে উচ্ছ্বাসে ক্রিল প্রায় নেচে ফেলে আর কি।

এবার বল, এখানে এসেছ কেন?

একটুও দ্বিধা না করে কেড ভিকির কথা খুলে বলল।

বলল, অ্যাডোলফো, ভিকির সঙ্গে তোমার আলাপ করতেই হবে। জুয়ানার মধ্যে যা নেই, ওর মধ্যে আছে। আমি জুয়ানার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এসেছি। জুয়ানার সঙ্গে আমার যা হয়েছিল তা নিছক পাগলামো বলতে পার। এখন আমি সবই বুঝতে পারছি।

জুয়ানা তোমার উপযুক্ত নয়, কেড। ও বোঝে শুধু টাকা। ও ব্যাধিগ্রস্ত।

 কেড ইততঃ করে বলল, জুয়ানার কি হল শেষ পর্যন্ত?

 জুয়ানা এখন এখানে।

গলার মধ্যে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে তোলে কেডের। মাথা নীচু করে বলল, এখন ডিয়াজের সঙ্গেই আছে?

না ও ডিয়াজকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। ওরা যখন স্পেন থেকে ফিরল তখনই ওদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। আজ বিকেলে আমি ডিয়াজের ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই দেখতে যাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে এটাই ওর শেষ লড়াই।

শেষ লড়াই মানে?

ডিয়াজকে আমি দেখেছি, কেড। ও এখন একটা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয়। জুয়ানা ওর সাহস নিঃশেষ করে দিয়েছে। ওকে দেখলে তোমার দুঃখ হবে। গত রবিবার দর্শকরা ওর দিকে বোতল ছুঁড়ে মেরেছে। তুমি ভাবতে পার?

কিন্তু অ্যাডোলফো কেন? কেড বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল।

ক্রিল মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, একটা রেডইন্ডিয়ানের কুঁড়ে ঘরের কথা তোমার মনে পড়ে…তা–ও জানতে চাও কেন?

কেড দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, সত্যি আমরা পুরুষরা সত্যিই নির্বোধ।

 জুয়ানাকে ভালবাসা মানে মৃত্যুকে ভালবাসা।

দ্বিতীয়বার কেড এই তুলনাটা শুনল। বলল, জুয়ানা কী করছে এখন?

চ্যাপুলটেপেক পার্কে তুমি একসময়ে যে বাড়ি ভাড়া করেছিলে ওখানেই থাকে এখন। ওর সঙ্গে এখন কেড নেই। ডিয়াজ জুয়ানাকে অনেক দামী দামী উপহার দিয়েছিলো তাতেই… তাছাড়া ও সানপাবলে নাইট ক্লাবে রোজ রাতেই যায়। ওখানে ধনী আমেরিকানদের আড্ডা। দিব্যি আরামেই আছে ও।

কেডের চোখের সামনে জুয়ানার প্রায় অলৌকিক চেহারাটা ভেসে উঠল। ওর দীর্ঘ এলায়িত কালো চুল একটা বর্মের মন ওর শরীরকে ঢেকে রাখে। জুয়ানার মতন তাকে কেড আর অত উন্মত্ত করতে পারবে না।

কেড জোর করে জুয়ানার ছবিটা মন থেকে মুছে ফেলল।

 অ্যাডোলফো আমি ডিয়াজের লড়াই দেখতে চাই।

বেশ। আজকাল ডিয়াজের লড়াইয়ে আর ভীড় হয় না। শুধু ওর অনিবার্য পরিণতি দেখার আশায় অনেক শকুন ওখানে ভীড় করে।

তবে তুমি কেন যেতে চাও অ্যাডোলফো।

আমার জীবনের একটা অধ্যায় তোমার, জুয়ানার আর ডিয়াজের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে কেড। ওর জন্য আমার টায়ার খোয়া যায়। যে ঘটনা গোড়া থেকে দেখেছি তার শেষটাও আমি দেখতে চাই।

গোল ময়দানে বালি ছড়ানো। মাঠটা লালরঙের তার দিয়ে ঘেরা। বেড়াতারের ঠিক পাশের সীটটায় ক্রিল আর কেড গিয়ে বসে পড়ল। সত্যিই অনেক সীট খালি আছে। তবে ভীড় হয়েছে।

কেড ক্ল্যানোকোকে দেখতে পেল। ভুরু কুঁচকে রেজিনো তরোয়াল অনুশীলন করছে।

কেডকে ওর দিকে তাকাতে দেখে ক্রিল বলল, হ্যাঁ, রেজিনো এখনও ডিয়াজের সঙ্গে আছে। ডিয়াজের সত্যিই বিশ্বস্ত অনুচর ও।

গত রবিবার দর্শকরা যখন ডিয়াজকে বোতল ছুঁড়ে মারছিল, রেজিনো কাঁদছিল।

চারদিকে রোদ ঝকমক করছে। পরনে রুপোলি কালো পোষাক, পেট্রোকে দেখেই চিনতে পারল কেড। দুপাশে দুজন মাতাদের। ওদের পেছনে আরো লোক। সবচেয়ে পিছনে ঘোড়ার পিঠে সহযোদ্ধারা।

ডানহাত দুলিয়ে ওরা বালির ওপর দিয়ে সমান তালে হেঁটে এল। কেড ভেতরে ভেতরে একটা অসুস্থ উত্তেজনা বোধ করল। সে ডিয়াজের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল। ক্রিল ঠিকই বলেছে। আজকের ডিয়াজ আগের ডিয়াজের ধ্বংসাবশেষ মাত্র। তার সেই বাজপাখির মন ধারালো মুখ কেমন ঝুলে পড়েছে, আগের মতন নিষ্ঠুর লাগছে না ওকে। ওর চোখ অস্থিরভাবে ঘুরছে। জিল বলল প্রথম যাড়টার সঙ্গে ও লড়বে।

ডিয়াজ এগিয়ে গিয়ে ক্ল্যানাকোকে ওর আংরাখা দিল।

ডিয়াজ হঠাৎ কেডকে দেখতে পেল। মুখ ফিরিয়ে ও ক্ল্যানোকোকে কী বলল। ক্ল্যানাকেও কেডের দিকে তাকাতে লাগল। দুজনে মিলে কেডের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে লাগল। এসময় ষাঁড়টা ঝড়ের বেগে মাঠটায় ঢুকে পড়ল। তারপর শিং বাগিয়ে চারিদিকে ছুটতে লাগল। ষাঁড়টা যখনই কোন আংরাখা দেখতে পেল তার দিকে তেড়ে গেল।

ওঃ কি প্রকাণ্ড বাঁড়টা। ক্রিল বলে উঠল।

ডিয়াজ ষাঁড়টাকে দেখতে লাগল। ক্ল্যানোকো রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে রেগেমেগে ডিয়াজকে কি যেন বলল। ডিয়াজ বলল, চুপ কর। আমাকে বোতলটা দাও। ক্ল্যানোকো বিরক্তিভরা মুখে একটা চোঙ্গার মতন মুখওয়ালা সোরাই দিল। ডিয়াজ চকচকিয়ে তা খেয়ে খেয়ে সোরাইটা ফেরত দিল।

ক্রিল বলল, সবাই ভাবছে ওটা জল, আসলে ওটা টেকুইলা।

মাঠে তখন ভীষণ হইচই। ষাঁড়টা একটা ঘোড়াকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। ডিয়াজ সরাসরি কেডের দিকে তাকাল, আবার দেখা হল তাহলে। তোমার জন্যই আমি এই ষাঁড়টাকে মারব। তবে আমি তোমাকে করুণা করি। ডিয়াজের কথাগুলো কেড ঠিকই শুনতে পেল।

গুডলাক, কেড আস্তে বলল। ডিয়াজকে দেখে কেডের করুণা হল। তারপর বেঁটে চৌকো মানুষটা ষাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। মাঠের বাকি সবাই চলে গেছে। এখন ডিয়াজ আর ষাঁড়টা মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য তৈরী।

ডিয়াজ হাঁটতে হাঁটতে দুবার হোঁচট খেল। জনতা রুদ্ধশ্বাস হয়ে ডিয়াজকে দেখছে। কেড দেখল ক্যাননকো অন্য দুজন মাতাদেরকে কি যেন বলল। তারপর আংরাখা হাতে ওরাও ডিয়াজের পেছন পেছন ছুটল। অধচক্রাকারে ডিয়াজকে ঘিরে আগলাতে আগলাতে ওরা চলল।

ডিয়াজ ষাঁড়টার তিরিশগজ দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে আসা মাতাদোরদের স্প্যানিশ ভাষায় গালাগাল দিল। ওদের হাত নেড়ে চলে যেতে বলল। কেড দেখল দর্শকদের সীট আর মাঠ ঘেরা রেলিঙের মাঝ দিয়ে ক্ল্যানোকা পাগলের মতন ষড়টার দিকে ছুটছে।

 ক্রিল বলল, আরে বোকাটা করছে কী, এতে ডিয়াজ আরও ঘাবড়ে যাবে।

এবার ডিয়াজ ষাঁড়টার পনের গজের মধ্যে দাঁড়িয়ে। তারপর আংরাখাটা খুলে ষাঁড়ের দিকে দোলাতে লাগল। ততক্ষণে ক্ল্যানোকো ষাঁড়টার পেছনে রেলিং বেয়ে নামবার চেষ্টা করছে। লেজ সোজা করে ষাঁড়টা আক্রমণ করল। এক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। একটা প্রায় পৃথিবী কাঁপানো শব্দ হল, কেড দেখল ডিয়াজ ছিটকে শূন্যে উঠে গেল আর তারপর চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ল বালির ওপর। এবার ষাঁড়টা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এগিয়ে এল। অন্যরা দৌড়ে আসছে। ডিয়াজ উঠতে চেষ্টা করল। কিন্তু ষাঁড়টার গতি এত ক্ষিপ্র যে ক্ল্যানোকো কিছুই করতে পারল না। বা শিং দিয়ে ষাঁড়টা ডিয়াজের বুক চিড়ে ওকে রেলিঙের সঙ্গে গেঁথে ফেলল। তারপর আবার শিং বেঁধাল।

ক্ল্যানোকো আর্তনাদ করতে করতে ষড়টার সিং ধরে ওরনাকে ঘুষি মারতে লাগল। দর্শকদের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে কেডও পাগলের মতন চেঁচাচ্ছিল। ক্ল্যানোকোকে এবার মাটিতে আছড়ে ফেলে ষাঁড়টা অন্য একজন পলায়মান মাতাদোরের পেছনে ছুটতে লাগল। যাবার সময় ক্ষুর দিয়ে ক্ল্যানোকোর মুখটা থেতলে দিয়ে গেল। তিনজন চাকর এসে ডিয়াজকে তুলে নিয়ে মাঠ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। একজন ক্ল্যানোকোকে দাঁড় করিয়ে দিল। ক্ল্যানোকোর মুখ দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছিল।

কেডের বমি পাচ্ছিল, সে কোনরকমে বলল, চল যাওয়া যাক। গেটের বাইরে দিয়ে যেতে যেতে কেড উদভ্রান্তের মতন বলল, ডিয়াজের আঘাত খুব গুরুতর মনে হয় তোমার?

ক্রিল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ডিয়াজ নিশ্চয়ই এতক্ষণে মারা গিয়েছে। ওর পাঁজরার হাড় চুরচুর হয়ে গেছে ষড়টার শিঙের ঘায়ে।

কেড খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছে। বলল, আমাকে হোটেলে নিয়ে চল আঁডোলফো। আমি এ শহর থেকে চলে যেতে চাই। আমার ঘেন্না ধরে গেছে এখানে।

ক্রিল অগুনতি গাড়ির ভীড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ওর পন্টিয়াকের কাছে পৌঁছে বলল, ডিয়াজ নিজেই নিয়তি ডেকে এনেছে। ক্রিল হোটেলের বাইরে গাড়ি থামাতে কেড বলল, নিজে কদিনের মধ্যে আমি চলে যাব। তোমায় খবর দেব। হোটেলে ঢুকেই কেড ট্রাভেস্তাল এজেন্সীর অফিসে গিয়ে তার পরদিনই নিউইয়র্ক যাবার প্লেনে টিকিট বুক করল। লিফট ওপরে চলে এলে কেড চাবি দিয়ে নিজের ঘর খুলল। সন্ধ্যার দীর্ঘ প্রহরগুলো সে কি করে কাটাবে ভেবে তার মন ভারি হয়ে গেল। দরজা বন্ধ করল কেড, আর তারপরই পাথর হয়ে গেল। জানালার দিকে পিঠ ফিরিয়ে জুয়ানা দাঁড়িয়ে আছে। একটা সাধাসিধে পোষাক পরে আছে। চারিদিক দিয়ে রোদের আভা ওকে ঘিরে ধরেছে।

তোমার মতন কেড হয় না, হতে পারে না। আমি ফিরে এসেছি কারণ আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমায় কত ভালবাসি। বলেই জুয়ানা দুহাত কেডের দিকে বাড়িয়ে দিল। তুমি কি আমাকে চাও, তাহলেনাও আমাকে। পরদিন সকালে কেড নিউইয়র্কে যাবার সীট ক্যানসেল করল। জুয়ানা বিছানার ওপর এলিয়ে শুয়ে আছে। সারারাত ওরা পাগলের মতন কথা বলেছে, হেসেছে, ভালবেসেছে। জুয়ানা কেডকে বলল, তোমাকে হারিয়ে বুঝেছি তুমি আমার কতখানি জুড়ে আছ। আমি একা ছিলাম এই জন্যই কুবুদ্ধি আমায় পেয়ে বসেছিল। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে কক্ষনো এমন হত না।

জুয়ানা কেডকে কী ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছে, সবই মনে পড়েছে কেডের। কিন্তু ও সে নিয়ে আর ভাবল না। ও বুঝেছে জুয়ানা যত নিষ্ঠুরতাই করুক না কেন, জুয়ানা তার সর্বস্ব। জুয়ানা তাকে ডাকলে সে তাকে কিছুতেই ফেরাতে পারবে না। এ যেন ভয়ংকর এক নিয়তির নির্দেশ।

আমরা পুরনো কথা আর মনে করবনা জুয়ানা। তুমি আমার স্ত্রী। আমরা নতুন করে আমাদের বিবাহিত জীবন শুরু করব। আমরা নিউইয়র্কে ফিরে যাব। কোথাও একটা ছোট ফ্ল্যাট খুঁজে নেব। আমরা খুব সুখী হব।

জুয়ানা কেডের হাত বোলাতে বোলাতে বলল, নিউইয়র্ক? আমার মনে হয় না ডার্লিং নিউইয়র্কে আমার থাকতে ভাল লাগবে। আমরা তো সেই বাড়িটাতেই থাকতে পারি।

নিউইয়র্কে আমার সান–এর সঙ্গে কনট্রাক্ট আছে। আমাকে ওখানেই কাজ করতে হবে।

কনট্রাক্ট? তার মানে?

আমি একটা কাগজে কাজ করি।

ওরা ভাল টাকা দেয় তোমাকে?

না।

তবে তুমি ওখানে কাজ কর কেন?

 সে তুমি বুঝবে না। এখনও দেড়বছর ওদের সঙ্গে আমায় কাজ করতে হবে।

 জুয়ানা বলল, ওরা কত দেয় তোমায়?

হপ্তায় তিনশো ডলার, হতাশায় ডুবে যেতে যেতে কেড ভাবল অ্যাডোলফো ঠিকই বলে, জুয়ানা বোঝে কেবল শরীর আর টাকা।

টাকা তোমার কাছে খুব দামী না?

জানিনা। টাকা থাকা ভাল, তবে সেটা এমন কিছু একটা ব্যাপার নয়। তারপর হেসে জুয়ানা বলল কেড আমি কত কম টাকায় তোমার সংসার চালিয়েছি বল? নিজের হাতে রান্না করেছি।

হ্যাঁ।

তোমার কি মনে হয় সপ্তাহে তিনশো ডলারে আমরা চালাতে পারব?

নিশ্চয়। হাজার হাজার লোক–এর চেয়ে অনেক কমে সংসার চালায়।

তবে চল আমরা নিউইয়র্কে যাই।

কেড উকীলদের জানাল সে বিবাহ বিচ্ছেদ চায় না। এ বিষয়েও জুয়ানার সঙ্গেও কথা বলল। জুয়ানা বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে পার না। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার। তুমি আমার স্বামী, তাই জন্যেই তো তোমার কাছে ফিরে এসেছি।

জুয়ানার মুখ দু হাত দিয়ে তুলে ধরে কেড বলল, তুমি আমার স্ত্রী তাই তো তোমাকে ক্ষমা করতে পারছি।

জুয়ানা বলল, চল আমরা বাড়ী যাই। এই মাসের শেষ অব্দি ভাড়া দেওয়া আছে।

ওর সেই ওদের আগেকার বাড়ীতে ফিরে গেল। গ্যারাজে নতুন লাল থান্ডারবার্ডটা চোখে পড়ল কেডের।

জুয়ানা যেন কিছুই নয় এভাবে বলল, তোমার আমার অনেক পছন্দ ছিল। এটা পেড্রো আমাকে দেয়। ওকে তো ক্ষতিপূরণ দিতেই হত।

কেড বুকের কষ্টটা জোর করে সরিয়ে দিল। ঘরে ঢুকে জুয়ানা বলল, তোমায় একটু টেকুইলা এনে দি?

কেড বলল, না আমি আর মদ খাই না।

কেন?

কেড বলল, মদ খেলে আমার শরীরের ক্ষতি হবে।

জুয়ানা যেন একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর ভেতরে গিয়ে কেড স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে ওর। গাড়িটা দেখে ও বিচলিত হয়ে পড়েছে। ওদের শোবার ঘরে জুয়ানা আর ডিয়াজ প্রেম করত, এই ভেবে ওর যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে। অথচ ও এত অসহায় যে জুয়ানাকে অস্বীকার করার তার ক্ষমতা নেই। এ সম্পর্ক স্থায়ী হবে না, কেড মর্মে মর্মে বুঝছিল। জুয়ানা যেমন শরীর আর টাকা ছাড়তে পারে না সেও জুয়ানাকে না ভালবেসে থাকতে পারে না। তবুও তো ক্ষণিকের জন্যও জুয়ানাকে চোখ ভরে দেখতে পাবে। জুয়ানা যদি ওকে ছেড়ে দেয় ও নিজেকে আর ধ্বংস করবে না। বড় কষ্ট পেয়েছে সে, আর সে নিজের জীবন নষ্ট করবে না।

দশদিন স্বপ্নের মতন কেটে গেল। এই দশদিন সে নিমেষের জন্য চোখের আড়াল করেনি জুয়ানাকে। একদিন বাগানে বসে জুয়ানা বলল, সোনা তুমি সুখী হয়েছ তো?

কেড বলল, কেন একথা বলছে?

জুয়ানা বলল, কত বদলে গেছ তুমি। কত গম্ভীর। কেমন যেন উদাসীন লাগে তমাকে। তুমি আবার কাজ শুরু করবে না?

হ্যাঁ, সেই কথাই বলছি তোমাকে। আমি নিউইয়র্কে ফিরব তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।

নিউইয়র্কে কোথায় থাকব আমরা? আমাদের বাড়ীতে বাগান থাকবে না?

না।

 জুয়ানার পরনে বিকিনি। সে পায়ের ওপর পা তুলে বসল। কেডের মনে হল জুয়ানা যেন সৌন্দর্যের জীবন্ত প্রতিমা।

আমার মনে হয় তুমি আগে ফ্ল্যাটটা জোগাড় কর তারপর না হয় আমি যাব। দেখ আমি কেমন হিসেবী হয়ে গেছি।

না, তুমি আমার সঙ্গে যাবে জুয়ানা।

 বেশ তো, তুমি যা বলবে ডার্লিং। কবে রওনা হব?

আগামী বৃহস্পতিবার।

তাহলে বুধবার বিকেলেই আমরা গাড়ি চালিয়ে চলে যাব নিউইয়র্ক।

কেড জুয়ানাকে লক্ষ্য করছিল, বলল, নিউইয়র্কে তোমার গাড়ি লাগবে না জুয়ানা। ওখানে পার্ক করবার জায়গা নেই। গাড়িটা আমরা বেচে দিয়ে যাব।

জুয়ানার চোখদুটো রাগে জ্বলে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই বলল, ঠিক আছে।

রাতে কেড বার্ডিককে টেলিফোন করল।

 বৃহস্পতিবার ফিরবো এড। গিয়েই কাজ ধরব।

 বার্ডিক বলল, বেশ তাই হোক। একটা খবর দেবে তো। আমি চিন্তায় মরি। ভাল আছ তো?

 খুব। দেখা হলে সব বলব।

ঠিক আছে, একটা কাজ তোমার জন্য ঠিক করেই রেখেছি।

কি কাজ?

 হ্যারি ওয়েস্টনের ডিজাইন করা পোষাকে একটা নতুন গানের নাটক শুরু হচ্ছে। শুধু আমরাই এই খবরটা ছাপার ভার পেয়েছি। শুক্রবার বিকেলে শুরু হচ্ছে।

ঠিক আছে। আমি পৌঁছে যাব কেড টেলিফোন ছেড়ে দিল। তারপর ক্রিলের সঙ্গে কথা বলল কেড।

অ্যাডোলফো আমি আর জুয়ানা একসঙ্গে আবার থাকব, ঠিক করলাম। বৃহস্পতিবার আমরা নিউইয়র্ক যাচ্ছি। গ্যারেজে ওর গাড়িটা রেখে দিচ্ছি। বেচে দিতে পারবে?

বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর ক্রিল বলল, কী বললে, আমি ঠিক শুনেছি? তুমি আর জুয়ানা। আবার বলতো?

ঠিক ঠিক আছে। অত উত্তেজিত হয়ো না। আমি যা করেছি ভেবেচিন্তেই করেছি। গাড়িটার ব্যবস্থা করতে পারবে তো?

ক্রিল তখনও স্তম্ভিত হয়ে আছে। কোন রকমে বলল, ঠিক আছে।

ধন্যবাদ, কেড তাড়াতাড়ি ফোন নামিয়ে রাখল।

বুধবার রাতে বাক্স গোছতে গোছাতে হঠাৎ জুয়ানা দু হাতে মাথা টিপে বিছানার ওপর বসে পড়ে।

কেড দৌড়ে ওর কাছে গেল, কি হল সোনা?

জুয়ানা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। মুখ ব্যথায় শক্ত হয়ে উঠেছে। অনেক কষ্টে জুয়ানা বলল, এই সময় প্রতিমাসে আমার এই নরকযন্ত্রণা। যাও যাও আমাকে একা থাকতে দাও।

কেড বলল, আমি ডাক্তার ডাকছি।

বোকার মতন কথা বোল না। মেয়েদের এরকম হয়। তুমি থোকা নাকি? আমাকে একা থাকতে দাও, ব্যস্।

নিচে গিয়ে কেড অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগল। তারপর বাগানে গেল। শেষে থাকতে না পেরে আবার উপরে গেল। জুয়ানা তখনও শুয়ে আছে। মুখ একেবারে চকের মতন সাদা। কেডকে দেখে বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে বলল, কি হল, বললাম না আমাকে একা থাকতে দাও। এরকম হয় আমার। দু একদিন যন্ত্রণা থাকে তারপরেই ঠিক হয়ে যাব আমি।

কেড তবু বলল, কাল যেতে পারবে তো?

যেতে বাধ্য হলে যাব। এখন তো যাও। জুয়ানা বলল।

কেড বলল, বাধ্য হলে যেতে হবেনা। পরেও গেলে হবে। আমি কি কিছু করতে পারি তোমার জন্য?

না, কিছু না। কাল নাগাদ ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু পরদিন স্বাভাবিকভাবেই জুয়ানা ঠিক হল না। এত সাদা রক্তশূন্য লাগছিল ওকে যে কেড জুয়ানাকে নিয়ে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিল। তবু কেন জানিনা মনে হল, ঠিক যাওয়ার সময়েই জুয়ানার অসুখটা হল যেন সাজানো ব্যাপার একটা।

কেড জানে জুয়ানাকে অবিশ্বাস করা উচিৎ। তবু যতদিন পারবে ও জুয়ানাকে নিজের দখলে রেখে দেবে।

বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কেড জুয়ানাকে বলল, আমি যাচ্ছি। এক ঘণ্টার মধ্যে রওনা দেব। মনে হচ্ছে যেতে পারবেনা না?

তুমি জোর করলে আমি যাব। ব্যথা সহজ করব আমি।

না, না শুয়ে থাক তুমি।

 নীচে গিয়ে ক্রিলকে ফোন করল কেড, অ্যাডোলফো খুব তাড়াতাড়ি এখানে আসতে পারবে? তোমাকে আমার ভীষণ দরকার।

দশ মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি।

যেমন কথা, দশ মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির ক্রিল। ওর সারা মুখে উদ্বেগ।

কেড ওকে নিয়ে বসবার ঘরে গেল, আমার একটা উপকার করবে ভাই আর কাউকে আমি বিশাস করি না।

বেশ তুমি যা বলবে, করব। কিন্তু জুয়ানার ব্যাপারটা কি? আমি তো তোমাকে সাবধান…

জানি। শোনো আগামী তিনদিন তোমার কোন জরুরি কাজ আছে।

না।

আমি চাই তুমি এ বাড়িতে থাক। তুমি জুয়ানার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। জুয়ানা ভাল হলে তুমি ওকে নিউইয়র্কের প্লেনে বসিয়ে দেবে।

আমি ভাল করে বুঝলাম না।

আমার আর জুয়ানার একসঙ্গে নিউইয়র্কে যাবার কথা ছিল আজ। জুয়ানা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এটা ওর ধাপ্পাও হতে পারে। হয়তো আমার থেকে ও ভাগবার সুযোগ খুঁজছে।

ক্রিল একেবারে বিচলিত হয়ে পড়ল, আমি বুঝতে পারছি না, ও যদি চলে যেতে চায় ওকে যেতে দিচ্ছ না কেন। ওরকম একটা মেয়েমানুষ দিয়ে তোমার কি হবে?

আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না অ্যাডোলফো। ও যে আমায় চায় আমি নিশ্চিত জানি। হয়তো আমাকে ভালবাসে। কিন্তু ওর কাছে টাকার আকর্ষণ সাংঘাতিক। ধরে নাও না একটা যুদ্ধে নেমেছি আমি। দেখি না জয়ী হতে পারি কি না।

তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

 হ্যাঁ। তুমি আমার অতি বিশ্বাসী বন্ধু। তুমি আমার জন্য এটুকু করবে?

নিশ্চয়। ওকে আমি নিউইয়র্কের প্লেনে তুলে দেবই, কথা দিচ্ছি।

কেড ওপরে গিয়ে জুয়ানাকে বলল ক্রিল তোমার দেখাশোনা করবে। তুমি সুস্থ হলে ও। তোমায় নিউইয়র্কের প্লেনে তুলে দিয়ে আসবে।

আমার ওপর তোমার একটুও বিশ্বাস নেই না?

না। কিন্তু আমি তোমায় ভালবাসি, আমি তোমাকে ঘরে রাখতে চাই।

 হঠাৎ হাসল জুয়ানা, হাত দুটো বাড়িয়ে বলল, আমি যে তোমায় কী ভালবাসি। এরকম ভালবাসা পাওয়া যে কোন মেয়ের ভাগ্যি। আর কেড আমার জন্য এত কষ্ট করেনি।

জুয়ানা আবেগে থরথর করে কাঁপছিল।

আমরা দুজনে মিলে একটা চমৎকার জীবন গড়ে তুলতে পারি জুয়ানা।

নিশ্চয়ই আমরা তা করব।

 ব্যাগ হাতে কেড নীচে নেমে এল। ক্রিল নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনে দুজনের হাত ঝাঁকাল।

 তোমার জন্য আমি কি করতে পারি অ্যাডোলফো? কেড বলল।

ক্রিল মৃদু হেসে বলল, সময় নিশ্চয়ই আসবে। বন্ধুত্বের মানেই তো হল পরস্পরের কাজে লাগা।

বিদায় অ্যাডোলফো। প্রতিদিন সন্ধ্যা আটটায় আমি ফোন করব। ওর ওপর নজর রেখ।

নিশ্চয়ই কিন্তু এরকম করে তুমি কতদিন চলতে পারবে। তোমার তো সুখ আসবে না।

আমি সুখ কিনতে চাইছি অ্যাডোলফো। আচ্ছা চলি।

বার্ডিক এয়ারপোর্টে এসেছিল। রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বার্ডিককে জুয়ানার কথা বলার চেষ্টা করল কেড। বার্ডিক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার ভ্যাল। তবে আমি মনে করেছিলাম তুমি ভিকির ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস। ঠিক আছে তুমি যা ভাল বুঝেছ করেছ। কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে বার্ডিক বলল, ভগবান করুন তুমি যা করছ তা ভেবেচিন্তে যেন কর।

কেড ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলল, জুয়ানা আমার স্ত্রী এড। বিয়ে ব্যাপারটা আমার কাছে চিরস্থায়ী ব্যাপার। বার্ডিক কাঁধ ঝাঁকাল।

আমার কাছে কোন কিছুই চিরস্থায়ীনয়। আমি হচ্ছি সিনিক। শোন আমি ওয়েস্টনের ডিজাইন শো নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করতে চাই।

এরপর কাজের কথা বলতে বলতে ওরা নিউইয়র্ক সা-এর অফিসে পৌঁছে গেল। সেই থেকে। এমন ভাবে কাজে জড়িয়ে পড়ল কেড যে জুয়ানার খবরই নিতে পারল না। শহরে একটা বারে ওয়েস্টন, বার্ডিক আর নাটকের দুই প্রধান অভিনেতার সঙ্গে মঞ্চসজ্জা নিয়ে আলোচনা করতে, করতে হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল কেডের। সাতটা পঞ্চাশ বাজে। তখনি ও কাছের একটা টেলিফোন বুথ থেকে মেক্সিকোতে টেলিফোন করল।

ক্রিল বলল জুয়ানা এখনও সুস্থ হয়নি। গাড়ির খদ্দের পেয়েছে একটা। ভালই দাম দেবে।

জুয়ানার সঙ্গে কথা বলা যাবে?

 ঘুমোচ্ছ। পাঁচ মিনিট আগেও দেখেছি।

 তবে কি ওর সত্যিই অসুখ করেছে?

বলতে পারছি না। ও ওপরে শুয়ে আছে, আমি নীচে বাগানে আছি। চিন্তা কোর না। কাল আবার ফোন কোর।

ওকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নিউইয়র্কে পাঠাও।

কথা দিয়েছি তো। আমার সাধ্যমতন করব।

ফোন ছেড়ে দিয়ে এই প্রথম নিজেকে খুব হাল্কা লাগল কেডের। পরের দিন সারাদিনটা কেটে গেল ব্যস্ততায়। সন্ধ্যার শুরুটা ফিল্ম ডেভেস্তালপ করেই কাটিয়ে দিল কেড। কখন ফোন করবে ভেতরে ভেতের ছটফট করছিল। আটটার সময়ে অন্যদের হাতে প্রিন্ট করবার ভার দিয়ে ও একটা ফাঁকা অফিস কামরায় গিয়ে মেক্সিকোয় ফোন লাগাল। টেলিফোনের কানেকশনের জন্য অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কেড। অপারেটর জানাল কেড ধরছে না।

কেড আড়ষ্ট হয়ে গেল।

 কিন্তু আমি জানি বাড়িতে লোক আছে। আরেকটু দেখুন না। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা ও অস্বস্তিতে কেড টালমাটাল হতে লাগল। অপারেটর জানাল কোন জবাব নেই। হয়তো ক্রিল জুয়ানাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেছে। তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে ফোন করল কেড। এয়ারপোর্ট থেকে জানাল ঘণ্টা দুয়েক বাদে মেক্সিকোর একটা প্লেন আসছে। নিশ্চয়ই ওই প্লেনে আসছে জুয়ানা। কিন্তু অ্যাডোলফো খবর দেবে তো একটা।

একঘণ্টা বাদে ছবিগুলো ম্যাথিসনকে পাঠিয়ে আবার ক্রিলকে ফোন করল কেড। এবারও অপারেটর জানাল কোন উত্তর নেই। এয়ারপোর্টে ফোন করে জানল মেক্সিকো থেকে সবচেয়ে শেষে যে প্লেন এসেছে তাতে জুয়ানা নামের কেড নেই।

এ সময় বার্ডিক ঘরে ঢুকল। কেডের মুখ দেখে চমকে বার্ডিক বলল, কি হয়েছে?

কেড বলল, জুয়ানার কাছ থেকে কোন খবর পাচ্ছি না। ওকে ছেড়ে আসা আমার উচিৎ হয়নি। চুলোয় যাক সব। চল বেরোই, একটু মদ খাই।

থাম, তুমি আবার এসব শুরু করতে পারবে না। চল বাড়ি চল।

কেড একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, চল বাড়িই চল।

পরদিন ভোর ছটায় কেড আবার ফোন করল। এবারও কোন জবাব নেই। এয়ারপোর্টে ফোন করল কেড। সকাল সাড়ে নটায় মেক্সিকো যাবার একটা প্লেন আছে। সামান্য জিনিস ব্যাগে পুরে কেড ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল। তার মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছে যেন। তবু নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল কেড। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ট্যাক্সি নিয়ে পার্কের সেই বাড়িটাতে পৌঁছল কেড। নেমেই দেখল গ্যারাজ ভোলা থান্ডারবার্ড নেই। সদর দরজা হাঁকরে খোলা। কেড প্রায় পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল। দরজা জানলা সব হা হা করছে। একটা ভয়ংকর সর্বনাশের আঁচ পাচ্ছে কেড। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ও ওপরে শোবার ঘরে গেল। শোবার ঘরের দরজার পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কেড। তার বুকের হৃৎপিণ্ডটা সমানে লাফাচ্ছে। শেষে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ল।

ক্রিল বিছানায় পড়ে আছে। পরনে সাদা গোলাপী ডোরাকাটা পায়জামা। ডান হাতে একটা ২২ রিভলভার আঁকড়ে ধরে আছে ক্রিল। বিছানায় রক্ত গড়িয়ে শুকিয়ে ডেলা হয়ে আছে। কপালে রগের ওপর একটা ছোট কাল গর্ত। কেড বুঝল ক্রিল কিভাবে মরেছে। বাতাসে তখন জুয়ানার সেই বিশেষ এসেন্স ভাসছে। সেদিনই অনেক রাতে নিউইয়র্কে ফিরে এল কেড। বার্ডিক খুবই দুশ্চিন্তা করছিল। কেডকে দেখেই বার্ডিক বুঝল কেড প্রচুর মদ খেয়েছে।

যাক। অদ্ভুত হেসে কেড বলল, সব চুকে গেল।

বার্ডিক কেডের মদ খাওয়া দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। কিন্তু সে কথা না বলে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

কেড আবার অদ্ভুতভাবে হাসল, জুয়ানা ভেগেছে এড। নিজের সব জিনিস গুছিয়ে নিয়ে, থান্ডারবার্ড নিয়ে কেটে পড়েছে। হয়তো আমারই দোষ। আমি বড্ড কড়াকড়ি করছিলাম। গাড়িটা নিয়ে ওকে জবরদস্তি না করলে ও নিউইয়র্কে নিশ্চয়ই আসত। কিন্তু ওর এক প্রেমিকের গাড়ি বলে আমি সহ্য করতে পারিনি। আর তাছাড়া আমি কম রোজগার করি বলে ও ভয়ও পেয়েছিলো।

কিন্তু তুমি তো বলেছিলে ক্রিল ওর দেখাশোনা করছে। ও কি বলল।

কেড প্রায় পাগলের মতন হাসল এবার। তাই দেখে বার্ডিক ভয় পেয়ে গেল।

অতি কর্কশ, বিতৃষ্ণায় ভরা কন্ঠে কেড বলল, নিশ্চয়ই। দেখাশোনার কথাই তো ছিল। আশ্চর্য, আমি ভেবেছিলাম আমি ক্রিলকে বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু আমি একটা গাধা। তুমি ভাবতে পার ক্রিল জুয়ানার সঙ্গে শুয়েছে?

বার্ডিক জোরে নিশ্বাস টানল। কি বলছ ভ্যাল? ক্রিলকে আমি ভাল লোক বলে জানতাম।

ঠিকই বলছি। আমাদের বিছানায় শুয়েছিল ক্ৰিল। মূর্খ বেজন্মাটা গুলি করে আত্মহত্যা করেছে।

তারপর চোখ ঢেকে বলল, উঃ আমি ভাবতে পারছি না। জুয়ানার ওপর জবরদস্তি করে, তারপর আমার মুখোমুখি হবার সাহসে কুলোয়নি। হোঁৎকা, একটা নির্বোধ একটা বেশ্যার বাচ্চা…

হা ভগবান। অসম্ভব আঘাত পেল বার্ডিক। ও তাড়াতাড়ি জানলার কাছে গিয়ে আকাশ দেখতে লাগল।

কেডের গলা কাঁপছিল, ক্রিল কথা দিয়েছিল ও জুয়ানাকে প্লেনে তুলে দেবে। বলেছিল আমি যেন ওকে বিশ্বাস করি। আমি হলফ করে বলতে পারি আমি মেক্সিকো ছাড়ার আগেই ও আমাদের বিছানায় গিয়ে জুয়ানাকে পাকড়াও করে। পাজী, হতচ্ছাড়া নরকে যেন ও ঝলসে মরে।

চুপ কর। এবার রাগে ফেটে পড়ল বার্ডিক। তুমি মাতলামি করছ। যা ঘটেছে তোমারই দোষে। তুমিই ক্রিলকে মারলে। ক্রীলের মতন সরল লোককে ঐ রকম একটা মেয়েছেলের খপ্পরে কেড ফেলে আসে? এই মেয়েছেলেটা তোমাকে কতবার বোকা বানিয়েছে? ওই অ্যাডোলফোকে ওর সাথে শুতে বাধ্য করেছে, লোভ দেখিয়েছে। কি করে তোমার মনে হল অ্যাডোলফোর মনের জোর তোমার থেকে বেশী? তুমি যদি পুরুষ হও অ্যাডোলফো পুরুষনয়? ও কি মহাপুরুষ নাকি?

ও তুমি ক্ৰীলের পক্ষে বলছ। আমি ওকে বিশ্বাস করেছিলাম। পাজী, হোকা, চর্বির গোলা একটা….

বার্ডিক রাগে চীৎকার করে উঠল, তোমার কথা শুনে আমার বমি পাচ্ছে। অ্যাডোলফোকে ওর সত্যিই ভাল লাগত। খুবই নিরীহ আবেগপ্রবণ ভদ্রলোক। অ্যাডোলফোর মৃত্যুর জন্য যে কেড পুরোপুরি দায়ী জানে বার্ডিক। ওই বদমাশ মেয়েছেলেটার জন্য তুমি সেবার নিজেকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলে…তাও শিক্ষা হয়নি তোমার। কি কুৎসিত অপদার্থ নোংরা বেশ্যা মেয়েমানুষ একটা। এখন আবার ঢং করে বোতল ধরেছ। তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ। একটা হ্যাংলা ব্যক্তিত্বহীন মেয়েছেলেবাজ। এ পর্যন্ত একথা তোমার মুখের ওপর কেড বলেনি। কিন্তু আমি বলছি। অ্যাডোলফোকে তুমিই মেরেছ। তোমার গুণ আছে তো কি? অ্যাডোলফোর তবু অনেক এলেম ছিল। জুয়ানা ওই বেশ্যাটা ওকে ফাঁসিয়েছে। ও আমাকে অব্দি ফাসাত। অ্যাডোলফো বুঝেছিল। কিন্তু তোমার জন্য নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তোমার দোষ ষোলআনা–বেচারা তোমাদের এই বেহায়াপনার জন্য নিজের জানটাও খোয়াল।

কেড উঠে দাঁড়াল। আমি ম্যাথিসনকে বলছি, আমার সম্বন্ধে তোমার মনোভাব যখন এরকম, তোমার সঙ্গে আমি আর কাজ করব না…।

মনোভাব? তোমার সম্পর্কে আবার কি মনোভাব থাকবে। তুমি একটা বেহায়া ফালতু লোক। তুমি একটা সত্যিকারের অপদার্থ, গলা কাঁপছিল বার্ভিকের। বলল, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। আমি ফিরবার আগেই তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমি জানি তুমি এখন মদ খেতেই থাকবে। আমি এসব বরদাস্ত করব না। জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড় এখনই। মদ খাও, মাতলামি কর, আত্মহত্যা কর। আমার কিছু এসে যায় না। যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলে তুমি। ভিকিকে বিয়ে করতে পারতে তুমি, তা না করে ওই নর্দমার বেশ্যাটার পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগলে। সেও জাহান্নামে যাক। তুমিও জাহান্নামে যাও।

বলে দরজা ধড়াস করে বন্ধ করে বার্ডিক বাইরে বেরিয়ে গেল।

এরপর পর পর তিন দিন কেডের আর কোন পাত্তাই নেই। বার্ডিক আগেই ম্যাথিসনকে সব জানিয়ে দিয়েছিল। তবুও ম্যাথিসন খুবই ধৈর্যসহকারে কেডের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বার্ডিককে ইংলন্ডে পাঠিয়ে দিল সাধারণ নির্বাচনের ওপর একটা লেখা লিখতে।

বার্ডিক গভীর ক্ষোভে ম্যাথিসনকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে। হয়তো সারাজীবনই ও মাতাল থেকে যাবে। আমি জানি না তুমি ওর সঙ্গে কী করবে তবে ওর সঙ্গে কাজ করে নিজের বদনাম করতে চাই না আমি। ম্যাথিসন শুধু কাঁধ ঝাঁকাল!

বার্ডিককে বলল, ঠিক আছে এড। আমি ওর সাথে কথা বলব এখন। ও ফটোগ্রাফার হিসেবে দারুণ। তুমি আর কেড মিলে কাগজের বিক্রি সাতাশ পারসেন্ট বাড়িয়ে দিয়েছিলে। সেটা কম কথা নয়। তুমি লন্ডনে যাও।

চারদিনের দিন কেড ম্যাথিসনের সঙ্গে দেখা করতে এল। প্রচুর মদ খেয়েছে। তবে বেসামাল হয়নি। বলল আবার কাজ করতে চায়। ম্যাথিসন বলল ও ওকে প্রস রিপোর্টিং–এর কাজ দিতে চায়। কেড তাতেই রাজী হল। এক সর্বনাশা বিভীষিকার মধ্যে তিন সপ্তাহ কাটল। কেডের দ্বিতীয় আত্মহনন। তারপরই ইস্টনভিলের খবর এল।