৩. পেড্রো ডিয়াজ

০৩.

পেড্রো ডিয়াজ ছোটখাট আঁটসাট চেহারা। চৌকো ঘাড়, শক্ত শরীরটা যেন ইস্পাত আর কংক্রিটে তৈরী। শরীর থেকে পাশব শক্তি এবং অমানুষিক ক্ষমতা যেন ঠিকরে পড়ছে। মেক্সিকান হিসেবে ওর গায়ের রং রীতিমতো কালো। মুখ চোখ যেন কাটা কাটা। ডিয়াজ রীতিমতো সুদর্শন আর অহংকারী পুরুষ।

কেড যখন ওর বিরাট সুসজ্জিত হোটেল রুমে ঢুকল ডিয়াজ ওর দিকে পেছন ফিরে জানলা দিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে পাঁচিলের দিকে নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যায় কেড আসবে বলে ও ইচ্ছে করেই এই পোজে দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই দাঁড়িয়ে রেজিনো ক্ল্যানোকো। ডিয়াজের খাপ ঢাকা চারটে তরোয়াল আর যুদ্ধ করবার আকাঙ্খা নাড়াচাড়া করছে। ক্ল্যানোকো ডিয়াজের তরোয়াল দেখাশোনা করে।

রেজিনো ক্ল্যানোকো ছোটোখাটো, পাতলা সুদর্শন এক তরুণ কিন্তু ওর আপাত সুশ্রী মুখের আড়ালে একটা শয়তানী যেন খেলা করছে। ওর চোখগুলি চঞ্চল, সন্দেহে ভরা। ওর ভাবভঙ্গী ঠিক একজন খুঁতখুঁতে সন্ধিগ্ধ স্ত্রীলোকের মতন। ক্রিল আগে থেকেই ওর সম্পর্কে কেডকে সাবধান করে দিয়েছে।

ও ডিয়াজকে খুশী রাখে। কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব বিপজ্জনক। ডিয়াজ ওর কাছে দেবতুল্য। তবে এ নিয়ে কোন কেচ্ছা হয়নি। সবাই জানে ডিয়াজ মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতে ওস্তাদ। যাঁড়ের মতন শক্তি ডিয়াজের।

একজন বিশাল চেহারার বেশ হাসিখুশি মানুষ চেয়ারে বসে কড়া চুরোট খাচ্ছিল। ইয়া ভুড়ি আর ইয়া গোঁফ ওর। ও হচ্ছে রেনাদো, ষাঁড়ের লড়াইয়ের ম্যানেজার। বলল, কেডের মতন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আলোক চিত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে সে রীতিমতো গর্বিত ও আনন্দিত। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্প্যানিশে কেড ওকে ধন্যবাদ দিল।

তার পর কেড ডিয়াজের কাছে গেল। ডিয়াজ এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে যেন ও হচ্ছে সম্রাট দয়া করে দর্শন দিচ্ছে মাত্র। তবে কেডের একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে, ও খুব তাড়াতাড়ি প্রতিরোধ জয় করতে পারে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডিয়াজ বেশ সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠল, হাসিও ফুটল ওর মুখে। কেড বুঝল ডিয়াজ তোষামোদ প্রিয়। কেড নির্লজ্জ ভাবে ওকে চাটুকারী করতে লাগল।

ক্রিল এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল, এখন ও কেডের ক্যামেরাপত্ৰ বার করতে শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কেড ছবি তুলতে শুরু করল। সর্বদাই ও কিছু ফিলম নষ্ট হবে ধরে নেয়। ও জানে ও যার ছবি তুলছে সে কোন না কোন সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়বেই আর তখনই ওর ক্যামেরায় তার স্বরূপটা ধরা পড়বে। প্রায় সত্তরটা ছবি তোলার পর যে ছবিটি সে আকাঙ্খ করছিল সেটি তুলতে পারল।

ততক্ষণে ডিয়াজ ছবি তোলার জন্য খুবই আগ্রহী হয়ে পড়েছে। ডিয়াজ, যেমন ভাবে বলেছে কেড সম্মতি জানিয়েছে। শুধু অপেক্ষা করছে অসাধারণ সেই ছবিটার জন্য। তখন তীব্র বিদ্বেষে ক্ল্যানোকা কেডের দিকে তাকিয়েছিল। ওর চোখ দেখলেই বোঝা যায় জীবনে ব্যর্থ, এবং অন্যের সাফল্য সে সহ্য করতে পারছে না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্কভাবে ক্ল্যানোকা তরোয়ালগুলোর ওপর হাত রাখল, চেয়ারের গায়ে দাঁড় করানো ছিল তলোয়ারগুলো। হঠাৎ ঝনঝন করে মাটিতে পড়ে গেল। বিদ্যুৎবেগে ডিয়াজ ঘুরে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠল। তার চোখ ক্রোধে নিষ্ঠুরতায় জ্বলে উঠেছে।

আনাড়ি উজবুক। তুমি কি দু মিনিটও চুপ করে থাকতে পার না?

সঙ্গে সঙ্গে শার্টার টিপল কেড, ও জানে এইজন্য সে প্রতীক্ষা করে ছিল যদিও এর পরে আরও গোটা কুড়ি ছবিও তুলল। ফোটো ভোলা হয়ে গেলে ডিয়াজ কেমন দুঃখিত ভাবে বলল, আপনারা আমার লড়াই দেখতে আসছেন তো?

নিশ্চয়। কেড ক্রিলকে ইশারা করল ক্যামেরা গোটাতে।

আপনার জীবনে এ এক বিরাট অভিজ্ঞতা হবে। আপনি আপনার নাতিনাতনীদেরও এই গল্প বলতে পারবেন, যে বিখ্যাত ডিয়াজকে আপনি ষাঁড় মারতে দেখেছে।

ভাবলেশহীন মুখে কেড বলল, সে খুবই সম্মানিত বোধ করছে নিজেকে। ডিয়াজকে কথা দিল ফটোর এক কপি ওর কাছে পাঠাবে। তারপর করমর্দন করে রেদোর সঙ্গে হাত ঝাঁকাল।

.

লড়াইয়ের গোল ময়দানের দিকে যেতে যেতে ক্রিল বলল ও নির্বোধ বটে কিন্তু ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াইয়ে খুব মজবুত, অসম্ভব সাহসও আছে লোকটার। যার সাহস বলেই আছে তার অনেক দোষ ক্ষমা করা যায়। আজ বিকেলে আপনি ওর আসল চেহারা দেখবেন। বছর খানেকের মধ্যেই ও ভস্কা হয়ে যাবে। তবে মেয়েদের বড় উৎপাত ওর জীবনে। দুটো লড়াইয়ে মজবুতি দেখাতে গিয়ে মানুষ সাধারণতঃ হেরে যায়।

কেড ক্রিলের কথা মন দিয়ে শুনছিল না। সে শুধু জুয়ানার কথা ভাবছিল। জুয়ানা সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেছে। ও বলেছে ষাঁড়ের লড়াই ওর কাছে ক্লান্তিকর একঘেয়ে লাগে। এছাড়া বাড়িটাকেও ঠিকঠাক করতে হবে। লড়াই শেষ হলে কেডকে সোজানতুন বাড়িতে যেতে বলেছে, ওখানেই সে কেডের জন্য অপেক্ষা করবে।

ডিয়াজ এক বিশালাকার ষাঁড়ের সঙ্গে যুজছে। ষাঁড়টা অত্যন্ত শক্তিশালী, দ্রুতগতি আর সাহসী। ক্রিল বলছিল আজকাল ভালো ষাঁড় পাওয়াই যায় না। যারা ষাঁড় প্রজন্ম করায় ও পালে তারা তেমন ভাল ষাঁড় পাঠায় না আজকাল। এখন যে সব ষাঁড় আসে, তারা ছোট, ফুর্তিবাজ কিন্তু তেমন সাহসী নয়।

ষাঁড়ের লড়াইয়ের কলাকৌশল কেড কিছুই বোঝে না। তবে এটুকু বুঝেছে এক অনন্য অসাধারণ যোদ্ধা আর প্রতিপক্ষে এক বলবান চমৎকার একটা ষাঁড়ের এ লড়াই ক্রীড়া হিসেবে অনন্যসাধারণ। সে তার সমস্ত নৈপুণ্য প্রয়োগ করে তিনশো ছবি তুলেছে। ক্রিলও ঠিক দক্ষ বন্দুকবাজের মতন একটার পর একটা ক্যামেরা ওকে যুগিয়ে যাচ্ছিল।

ষাঁড়টিকে হত্যার দৃশ্য বহুদিন কেডের স্মৃতিতে আঁকা থাকবে। তখনি বোঝা গেছে কি পাশবিক শক্তি ধরে ওই ডিয়াজ। পেশীবহুল বার সবটুকু শক্তি দিয়ে ও তোয়ালটা ঢুকিয়ে দিল ষাঁড়ের শরীরে। আমূল বিধে গেছে তবোয়ালটা। ষাঁড়ের শরীর বালিতে গড়িয়ে পড়বার আগেই মৃত্যু ঘটে গেছে ষাঁড়টার।

এরপর ডিয়াজ উদ্ধত ভঙ্গীতে রাজার মতন মাঠের চারিদিকে হাঁটল আর দর্শকদের উল্লাস ধ্বনি শুনে মাথা নাড়ল।

ক্রিল আগেই একটা ফটোগ্রাফির দোকানের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিল। সোজা ওরা চলে গেল সেখানে।

দু ঘন্টা বাদে ডার্করুম থেকে বেরিয়ে এল কেড, হাতে এক গোছা ভিজে প্রিন্ট।

ক্রিল আর দোকানের মালিক বীয়ার খেতে খেতে কথা বলছিল। কেডকে দেখে ওরা উঠে দাঁড়াল।

এগুলো চলবে, ঠিক আছে। কেড কাউন্টারের উপর প্রিন্টগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল।

দোকানের টেকো মালিকটার ষাঁড়ের লড়াই বেজায় অপছন্দ। কিন্তু প্রিন্টগুলো দেখতে ও শিস দিয়ে নিশ্বাস টানল। হ্যাঁ, আমি ছবিতে স্পষ্ট দেখতে পারছি ষাঁড়ের লড়াইয়ের আসল চেহারা।

এবার উদ্বেগের সঙ্গে ক্রিল বলল, ডিয়াজ খুশী হবেনা সিনর!

ওর ভাবায় কি আসে যায়? কেড প্রিন্টগুলো তুলে একটা বড় খামে ভরল। চল, বাড়ি যাই।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ক্রিল বলল, ডিয়াজ লোকটা সাংঘাতিক। তার ওপর ধনী, জনপ্রিয়। ছবি দেখে ও মোটেই খুশী হবেনা। আমার কেমন মনে হচ্ছে ছবিতে ওর ষাঁড় মারার ব্যাপারটা অসম্ভব অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। ..

জিনিসটা অকিঞ্চিৎকরই, কেড খুশী হয়ে বলল।

কিন্তু ডিয়াজ আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে।

কে আমাকে বিপদে ফেলবে এসব যদি ভাবতাম তাহলে আজ টিকে থাকতে পারতাম না।

জানি সিনর, জানি, তবুও আপনাকে সাবধান না করে পারছি না।

 ধন্যবাদ। পরে দেখা যাবে কি হয়।

 ক্রিল ওর ভারী কাধটা ঝাঁকাল। তার মুখে অস্বস্তি আর হতাশা।

 বুঝেছি সিনর, ডিয়াজের মতনই আপনার সাহস।

বেশ, এবার চুপ কর আর তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও।

 বাড়িটা দেখে খুবই অবাক আর খুশী হল কেড।

একটা বড় হল, দুটো শোবার ঘর, দুটো বাথরুম, একটা রান্নাঘর একটা এতবড় গ্যারাজ আছে যে তাতে দুটো গাড়ি রাখা যায়। বাগানে ফুল ফুটে আলো হয়ে আছে, একটা ছোট ফোয়ারা আছে আর কয়েকটা সুন্দর গাছ। বাড়ির ফার্নিচারও আধুনিক সৌখিন। জুয়ানার প্রত্যাশাদীপ্ত উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে কেড অভিভূত হয়ে বলল, তুমি জানো ডার্লিং বাড়িটা আমার কি পছন্দ হয়েছে। তোমার জন্য আমি এই প্রথম নিজের বাড়ি বলতে যা বোঝায় তাই পেলাম।

জুয়ানা কেডকে জড়িয়ে ধরল। এটা আমার আর তোমার বাড়ি। আর কেড আমাদের মধ্যে আসবে না।

সেই রাতে জুয়ানার অনেক পীড়াপিড়িতেও কেড ওকে রাঁধতে দিল না। দুজনে কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে এল। তারপর জুয়ানাকে ডিয়াজের ছবিগুলো দেখাল। জুয়ানা প্রথমে কিছুই বলেনি। ডিয়াজ ক্ল্যানোকোর ওপর চাঁচাচ্ছে এই ছবিটা দেখে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল বিস্ময়ে। অন্যসব ছবি সরিয়ে এই ছবিটার ডিয়াজের নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি সে মন দিয়ে দেখতে লাগল।

ডিয়াজকে সত্যিই এরকম দেখতে?

মুখোশটা খসেনা পড়া অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। হ্যাঁ, এ হচ্ছে পেড্রো ডিয়াজ। নিষ্ঠুর, নির্বোধ এই হচ্ছে ওর আসল চেহারা।

জুয়ানার কালো চোখে অস্বস্তি ফুটে উঠল। তোমাকে দিয়ে বাবা আমার কোন ছবি তোলার না। তারপর হেসে বলল, না এমনি ঠাট্টা করছি। তবে ডিয়াজ এই ছবি দেখে খুশী হবে না। চল, আমরা শুতে যাই। নতুন বাড়িতে এই আমাদের প্রথম রাত।

তুমি লড়াইয়ের ছবি দেখলে না?

জানি তুমি যে ছবিই তোল, অসাধারণ হয়। চল শুতে যাই। নাকি যেতে চাও না? জুয়ানার হাসিতে আমন্ত্রণ ফুটে উঠল।

পরদিন সকালে কফি খেতে খেতে কেড জিজ্ঞেস করল জুয়ানা গাড়ি চালাতে পারে কিনা?

নিশ্চয়। কেন?

এখানে তোমার একটা গাড়ি দরকার হবে। আমি খোঁজ নিচ্ছি একটা ভাল সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির।

উল্লাসে আনন্দে জুয়ানা নেচে উঠল।

বরাবর একটা গাড়ির সাধ ছিল আমার।

কিন্তু এত টাকা আছে কি আমাদের। এই বাড়ি…

–ও নিয়ে তুমি ভেব না। এখন আমি বেরোচ্ছি। চারটের মধ্যে ফিরে আসব। যদি দরকার হয় ওলসোদার ফটোর দোকানে খোঁজ কর, আমি সেখানেই থাকব। ছবিগুলো এনলার্জ করতে হবে। আজ রাতের প্লেনেই ওগুলো পাঠাতে হবে। আমি না আসা অব্দি…।

নিশ্চয়। আমি বাড়ির কাজ করব। আজ রাতে এমন চমৎকার ডিনার রাঁধব যে তুমি আমাকে বাহবা দেবেই।

কেড মানিব্যাগ খুলে পাঁচশো পেসোর নোটের তাড়া টেবিলে রাখল।

আরো দরকার হলে বোল। এ তোমারই টাকা জুয়ানা, যা খুশী করো। একটা পোষাক কিনে নিও ইচ্ছে হলে। আমার যা আছে আমরা ভাগ করে নেব।

কেড ছুটে বেরিয়ে গেল। ক্রিল পন্টিয়াক নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। এত সুখ কেড জীবনে আর পায় নি। মনে হচ্ছে তার যা কিছু আছে সব বিলিয়ে দিলে তার প্রেম সার্থক হয়।

গাড়িতে কেড ক্রিলকে বলল, তোমার সাহায্য চাই ক্রিল।

 প্রথমে চাই একটা গাড়ি। থান্ডারবার্ডের বাজার দর কি এখন?

 ক্রিল সমীহ করার ভঙ্গীতে বলল, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে সিনর। আমার বন্ধুর গাড়ির ব্যবসা আছে।

বিকেল তিনটের মধ্যে চাই কিন্তু।

নিশ্চয় পেয়ে যাবেন।

বেশ আরেকটা কথা শোন। আমি একটা হীরের ব্রেসলেট কিনতে চাই।

ক্রীলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। প্রায় একটা ট্যাক্সিকে মেরে বসল।

 ক্রিল এবার টোক গিলে বলল হীরে? হীরে কিনতে যে অনেক টাকা লাগে সিনর

টাকার কথা রাখ। হীরের ব্যবস্থা করতে পারবে তো?

এ শহরে টাকা ফেললে কীসের না ব্যবস্থা করা যায়। আমার একটি বন্ধু হীরের খোঁজখবর রাখে। আমি ব্যবস্থা করে দেব।

ফটোর দোকানের সামনে গাড়ি রাখল ক্রিল।

গাড়ি আর ব্রেসলেট নিয়ে তিনটের সময় এখানে চলে এস।

নিশ্চয় সিনর। ক্রিল টুপি তুলে সম্মান জানাল।

তুমি খুব ভালো অ্যাডোলফো।

ক্রিল বলল, মাদাম খুবই রূপসী। কিন্তু আমি হলাম সাধারণ সাদামাটা লোক। আপনার কাজে লাগতে পারছি বলে আমি খুবই খুশী। কিন্তু কি জানেন, সোনাও ব্যবহার করতে করতে ক্ষয়ে যায়।

কেড হেসে দোকানে ঢুকল। টমাস ওলমোদা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। আড়াইটের মধ্যে প্রিন্ট শেষ করে স্যাম ওয়াল্ডকে পাঠাবার জন্য ফোটোগুলো প্যাকেটে ভরে ফেলল কেড। পেড্রো ডিয়াজের জন্য যে ছবিগুলো ডিয়াজকে ভাল দেখিয়েছে সেইগুলো বেছে বেছে আলাদা একটা প্যাকেটে ভরল। ওলমোদা বলল ওর সহকারী একটা ছেলেকে দিয়ে হোটেল ডি টেরোতে ছবিগুলো পাঠিয়ে দেবে।

ক্রীলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কেড সকালের কাগজটা তুলে নিল।

কাগজের প্রথম পাতায় একটা ছবি। তার নীচে লেখা, বিখ্যাত জাহাজ স্বত্বাধিকারী ম্যানুয়েল ব্যারেডা গতকাল সকালে মারা গিয়েছেন। সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাকের পর অ্যাকাপুলকোয় একটি সম্ভ্রান্ত হোটেলে সিনর ব্যারেডা ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভ করছিলেন। তিনি…।

কেডের হাত থেকে খবরের কাগজটা পড়ে গেল মাটিতে। সমস্ত শরীরটা যেন ওর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যদি কেড ব্যারেডার কাছ থেকে জুয়ানাকে না কেড়ে নিতে সিনর ব্যারেডা নিশ্চয় বেঁচে থাকতেন। কেডই ওঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী। কেড তাড়াতাড়ি ফোন করল জুয়ানাকে।

কাগজ দেখেছ আজকের? কেড প্রশ্ন করল।

সোনা, কাগজ দেখার সময় কোথায় আমার। কেন?

কাল সকালে সিনর ব্যারেডা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গিয়েছেন।

একটু থেমে জুয়ানা বলল, মারা গেছে? দাঁড়াও উনোনে কি যেন পুড়ছে। তুমি…

 কেড চীৎকার করে বলল, শুনছ, উনি মারা গেছেন। আমরাই ওকে মেরেছি।

কিন্তু ডার্লিং ওর বয়েস হয়েছিল, অসুখে ভুগছিল। আমরা কোথায় ওকে মারলাম। তুমি যেন বড্ড বিচলিত হয়ে পড়েছ?

তোমার কিছু হচ্ছে না, জুয়ানা?

আমার খারাপ লাগছে ঠিকই, কিন্তু….।

ওর সঙ্গে আমাদের এরকম করা ঠিক হয় নি জুয়ানা।

জুয়ানা সংক্ষেপে বলল, একদিন না একদিন ওকে মরতেই হত। এই নিয়ে মন খারাপ কর না। আমি যাই নইলে এমন চমৎকার ডিনারটা নষ্ট হবে।

কেড বিমর্ষ হয়ে পড়ল। ভাবছে আমারও তো ঠিক এরকমই মৃত্যু ঘটতে পারে। কাল, পরশু অথবা একবছর বাদে জুয়ানার জীবনে যদি অন্য কোন পুরুষের আবির্ভাব ঘটে! জুয়ানা আমাকে ছুঁড়ে ফেলে সেই পুরুষের জীবনে প্রবেশ করবে। সঙ্গে সঙ্গে একটা শ্বাসরোধকারী ভয় কেডকে একদম অবশ করে দিল। না না সে জুয়ানাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কেডের ভালবাসা যেমন উন্মও জুয়ানারও তাই। তাহলে এখন তাদের বিয়ে করে ফেলতে বাধা কোথায়?

চারটের একটু পরে কেড একটা ঝকমকে লাল থান্ডারবার্ড চালিয়ে বাড়ি এল।

ছটার একটু পরে ওরা বাগানের দোলনায় পাশাপাশি বসেছিল। জুয়ানা যেরকম দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালিয়েছে তা দেখে কেড অবাক হয়ে গেছে। গাড়ি আর হীরের ব্রেসলেট দেখে জুয়ানা এত খুশী হয়েছে যে আনন্দে কেঁদে ফেলেছে। আর কেডকে পুরস্কার দিয়েছে অনেক।

দশটার সময় মোমের আলোয় ডিনার খেতে বসেছিল কেড আর জুয়ানা। জুয়ানা হাসতে হাসতে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে মেক্সিকানদের উৎসবে যা যা রান্না হয় তা করে ফেলেছে।

খাওয়া শেষ হলে জুয়ানা উৎসুক চোখে কেডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন রেধেছি বল তো? তোমার ভাল লেগেছে। মোমের আলোয় ওর হীরের ব্রেসলেট ঝকমক করছিল।

কেড মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, জুয়ানা তুমি যা কর তা সুন্দর হতে বাধ্য। তুমি সৌন্দর্যের প্রতিমা।

জুয়ানা আনন্দে লাফিয়ে বলল, চল আমরা এখন পিরামিড অফ দি মুনে যাব। এমন চাঁদের আলোয় পিরামিড দেখাটা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা।

খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে ওরা আধঘণ্টার মধ্যে সান জুয়ান টিওটিহুয়াকানে চলে এল। সে এক মহান দৃশ্য। কুড়ি মাইল জুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে।

মেক্সিকো উপত্যকার প্রাচীনতম কীর্তি পিরামিড অফ দি মুনের পায়ের কাছে একটি নতজানু স্ত্রীলোকের মূর্তি আছে। লোকে বলে ওটা জলদেবীর মূর্তি। তারই পাশে দাঁড়িয়ে কেড জুয়ানাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। এই কথা বলার জন্য এমন রোমান্টিক আর নাটকীয় পরিবেশ আর হয় না। কেড জানে এল তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, তার সমস্ত ভবিষ্যতের সুখ নির্ভর করছে জুয়ানার একটা হ্যাঁ বলার উপর। সে দুরুদুরু বক্ষে জুয়ানার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। জুয়ানা কেড়ের হাত ধরে বলল, তুমি তোমার মন ভাল করে বুঝে একথা আমায় বলছো তো? আমাকে কেড কোনদিন স্ত্রী হতে বলে নি। আমিও তো তাই চাই। তুমি কি সত্যিই তাই চাও? তুমি যদি আমাকে না বিয়ে কর আমি তবুও তোমাকে ভালবাসবই। তুমি তোমার মন ঠিক জান?

কেড বিয়ে করতেই চায়, সে শিশুর মতন বিয়ের পবিত্রতাতে বিশ্বাস করে। সে মনে করে একমাত্র বিয়ে হলেই জুয়ানার সাথে তার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক হওয়া সম্ভব। বিয়ে হলে জুয়ানা কিছুতেই তাকে ছেড়ে চলে যাবে না।

ওই সপ্তাহের শেষেই ওরা বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলল। কেড নিজেকে খুব নিশ্চিত হালকা অনুভব করল। ওরা কেড আর ব্যারের কথা উল্লেখ করে নি। কিন্তু ব্যারের কথা মনে পড়তেই কেডের খুব অস্বস্তি হয়েছে। জুয়ানা বিয়েতে কোন আড়ম্বর চায় না। শুধু কোজুমিলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে চায়। জুয়ানা বলল ওর দিকের সাক্ষী হবে একটি মেয়ে। কেড অ্যাডোলফো ক্রিলকে ওর সাক্ষী হতে অনুরোধ করল। মোটা মেক্সিকানটি তো এ সম্মানে অভিভূত হয়ে পড়ল। কেডের সুখশান্তি কামনা করতে করতে ও কেঁদেই ফেলল।

কেডের সুখের যেন শেষ নেই। জুয়ানা শুধু ভাল রাঁধতেই জানে না সে অত্যন্ত নিপুণভাবে সংসার চালাতে পারে একদিনেই কেড তা বুঝে গেল।

পরদিন সকালেই বিয়ে। ওরা মধুচন্দ্রিমাতে যাওয়ার জন্য গোছগাছ করছিল। এমন সময় নিউইয়র্ক থেকে ওয়াল্ডের টেলিফোন এল।

সবাই ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবি দেখে একেবারে অভিভূত। বলতে দ্বিধা নেই ভ্যাল এ যাবৎ যত ছবি তুলেছ, এ একেবারে সবার সেরা। এখন কি করছ? ফিরে আসছ? তাহলে কাজের ব্যবস্থা করে রাখব।

কাল সকালে আমি বিয়ে করছি, কেড ভাবল স্যাম ওয়ার্ল্ডের মুখটা যদি ও একবার দেখতে পারত।

আরে আরে, ওয়াল্ড চেঁচিয়ে উঠল। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। যা তুমি ঠাট্টা করছ।

কেড ওকে ভালভাবে বুঝিয়ে বলল সে সত্যিই বিয়ে করছে।

যাক শুনে আমার একটু কষ্ট হচ্ছে। তবে তোমায় অভিনন্দন জানাচ্ছি। কি করছ তা জেনে বুঝে এগোচ্ছ তো?

ওদের মধুচন্দ্রিমা তেমন জমলনা। আসলে আমেরিকান টুরিস্টরা জুয়ানার দিকে এতো মনযোগ দিচ্ছিল যে কেড রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে উঠল। জুয়ানা খুব কৌতুক অনুভব করছিল কিন্তু কেডের বিরক্তি বাড়ছিল। নাচ–ঘরেও কেড জুয়ানাকে কাছে পাচ্ছিল না। সমানে কেড না কেড জুয়ানাকে নাচের সঙ্গী হতে অনুরোধ করছিল। শেষমেষ এমন অবস্থা হল যে কেড বলল দিনের বেশীর ভাগ সময়টা ওরা ব্যালকনিতে লাউঞ্জ চেয়ারে শুয়ে কাটাবে। তাতে আবার জুয়ানার আপত্তি। অবশেষে দশদিন না যেতেই ওরা মধুচন্দ্রিমা বাদ দিয়ে মেক্সিকোয় ফিরে আসবে ঠিক করল।

কেড দেখল বিয়ে জিনিসটা যদিও খুব চমৎকার কিন্তু ও আর আগের মতন স্বাধীন নেই। আগে ও রাস্তায় রাস্তায় ওর ফটোগ্রাফির জন্য নতুন বিষয় খুঁজে বেড়াত। কোন চিত্তাকর্ষক মুখ, নতুন দৃষ্টিকোণ, কোন আলোর খেলা। কিন্তু জুয়ানা ওর সঙ্গে থাকে বলে ও কিছুতে মনযোগ দিতে পারে না। জুয়ানা হাঁটতে ভালবাসে না। ও ওর থান্ডারবার্ড ছাড়তেই চায় না। কেড ওকে যতই বোঝাক যে ঘণ্টায় আশি মাইল বেগে গাড়ি ছোটালে ওর ভবিষ্যতে নতুন নতুন ছবি তোলা খুবই কঠিন হবে, জুয়ানা তার কথায় কর্ণপাত করে না। তাই ফিরে আসবার পাঁচদিন বাদে কেড স্থির করল সে এবার নতুন কাজে হাত দেবে। স্যাম ওয়াল্ডকে ফোন করল কেড।

ফোন ধরেই ওধার থেকে চেঁচিয়ে উঠল স্যাম, কি ভায়া! তোমার ফোনের জন্যই বসে আছি। কেমন কাটল হনিমুন।

কেড বলল, ভালই কেটেছে।

 এখনও কি নেশার মধ্যেই আছে।

 কেডের এসব তামাসা ভাল লাগল না। ও বলল, কোন কাজের কথা আছে? আমি তৈরী।

একটা কাজ আছে তুমি করতে পার। বিশেষ টাকাপয়সা দেবে না। তিনশো ডলার আর অন্যান্য খরচাপাতি, তবে তোমার টাকাপয়সার যা হাল, তিনশো ডলার তোমার কাজেই লাগবে।

এ কথার মানে কি?

তুমি আমায় ভাবনায় ফেলেছে ভ্যাল। তোমার ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আমার কাছে এসেছিল। তোমার অ্যাকাউন্টে চার হাজার ডলার ঘাটতি পড়েছে। আমি বললাম কিছু বন্ড বিক্রী করতে, কিন্তু তোমার জন্য আর কিছু নেই।

কেড উদ্বিগ্ন হল। ও টাকাপয়সার ব্যাপারে বরাবরই অসাবধান। এনিয়ে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে ওর খিটিমিটি লেগেই থাকত। শেষে ওয়াল্ডই বলে কয়ে তার অ্যাকাউন্ট দেখাশোনার ভার নেয়।

ওয়াল্ড বলেছিল সবচেয়ে ভাল হয় যদি কেড কয়েকটা বন্ড কিনে রাখতে পারে আর অ্যাকাউন্টে খরচ খরচার জন্য এক হাজার ডলার রাখে। হাজার ডলার ফুরিয়ে গেলে ও একটা বন্ড বেচতে পারে। আবার ছবি বেচে আর একটা বন্ড কিনতে পারে। তাছাড়া টাকায় টাকা আসবে। কেড রাজী হয়েছিল!

ওয়াল্ড বলল, এক মাস আগেও তোমার চল্লিশ হাজার বন্ড ছিল। এরমধ্যেই সব বেচে খেয়েছো?

কেড ঘন ঘন মাথায় আঙুল চালাতে লাগল। অনেকদিন ধরে ওর একটা অভ্যাস চেকের পেছনে লিখে দেওয়া, অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলে, বন্ড বিক্রী করুন। কে জানে ওর অজস্র বন্ড আছে, তাই অত হিসেব রাখত না। একটু ভয়ে ভয়ে ইদানীং ও যা খরচা করেছে তার একটা মোটামুটি হিসেব করল। থান্ডারবার্ড গাড়িটা কিনেছে। হীরের ব্রেসলেট কিনেছে। বাড়ির একমাসের ভাড়া আগাম দিয়েছে। জুয়ানাকে সিল্কের স্টোল কিনে দিয়েছে। দশ দিন ধরে কোজুমেলের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করেছে। তবুও চল্লিশ হাজার ডলার খরচ হয়ে গেল?

ফোন ধরে আছ না ছেড়ে দিয়েছ? ওয়ান্ড অধীর ভাবে জিজ্ঞেস করল।

একমিনিট চুপ কর। আমি ভাবতে চেষ্টা করছি।

সত্যিই তো যা খরচ করেছে তাত চল্লিশ হাজার ডলার হয়ই। খুব ধাক্কা খেল কেড, সে ঘামতে শুরু করল।

স্যাম, ওরা কি ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবিগুলোর টাকা দিয়েছে? তিনহাজার ডলার দেবার কথা ছিল…

দিয়েছে এবং তুমি দশদিন আগেই তা খরচা করে ফেলেছ। কি হচ্ছে বল তো, ঈশ্বরের দোহাই কি হচ্ছে আমায় বলবে।

তুমি বললে না চার হাজার ঘাটতি পড়েছে?

হা। এখন শোন…।

এক মিনিট ধর…

কেড কাগজে হিসেব করতে শুরু করল। কোজুমেলে ও গাড়ি আর মোটরবোট ভাড়া করেছিল। জলের নীচে সাঁতার দেবার জন্য স্বচ্ছন্দে ডুবুরীর পোষাক ভাড়া করা চলত, কিন্তু কেড তা কিনেছে। তা ছাড়া জুয়ানা একটা রুপোর টি–সেট চেয়েছিল তাও কিনে দিয়েছে কেড। ইস জুয়ানাকে নিরস্ত করা উচিত ছিল কেডের। রুপোর টি–সেট ও কি ব্যবহার করবে?

কেড বলল, স্যাম, তুমি কিছু স্টক বিক্রী কর। ব্যাঙ্কের ওভার ড্রাফট মেটাতে, আমার খরচ চালাতে এখন হাজার দশেক ডলার ব্যাঙ্কে থাকা দরকার। করবে তো?

আরে বাজার খুব মন্দা যে। এখন বেচার সময় নয়, কেনার সময়।

 যা হয় বেচ। আমার দশ হাজার ডলার চাই।

 বেশ। তোমার কি স্টক আছে দেখব, যা পারি করব।

কেডের মনটা একটু হালকা হল।

এখন কাজের কথা শোন। বোস্টনের আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম মেক্সিকোর চিফেন–ইজো আর উক্সমলের ধ্বংসস্তূপের একসেট নতুন ফটো চায়। আমি আমার পুরনো ছবিগুলোর কপি আর প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠিয়ে দেব। ওরা তোমার হাতে ভোলা ছবি চায়। কি বল?

এই তো য়ুকাতান থেকে ফিরলাম।

সেটা কি আমার দোষ। তুমি তো আমায় জানাওনি তুমি কোথায় যাচ্ছ?

তিনশো ডলার আর খরচখরচা দেবে?

 হ্যাঁ। কিন্তু দুজনের যাওয়া আসার খরচা দিতে পারব না। যদি বউকে নিয়ে যেতে হয় ওর ভাড়া তোমাকে দিতে হবে। কাজটার এক সপ্তাহ মতো সময় লাগবে।

এক সপ্তাহের কাজ করে তিনশো ডলার। গোল্লায় যাক ওরা।

 ভ্যাল, অপরিণতের মত কথা বোল না। এ টাকাটা তোমার দরকার।

ওয়ান্ড ওকে এভাবে কোনদিনও কথা বলেনি। একটু ইতস্ততঃ করে কেড বলল, ঠিক আছে। ছবি দিলেই টাকা সঙ্গে সঙ্গে পাব তো?

নিশ্চয়। আচ্ছা, ফোন রাখছি এখন। কেড রান্নাঘরে গিয়ে দেখল জুয়ানা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত।

 বলল, ওয়ান্ডের সঙ্গে কথা বলছিলাম। একটা কাজ ঠিক হয়েছে। মেরিডায় ফিরে যেতে হবে।

 জুয়ানা ভ্রূ কোঁচকাল।

 কাজটা কি করতেই হবে?

 আরে কাজ তো, হাজার হলেও।

 কখন?

 এই সপ্তাহের শেষাশেষি।

 ঠিক আছে। আমাদের ফিরতে দেরি হবে না তো?

না মানে আমি একাই যাচ্ছি। কাজটা জটিল, ঝামেলার ব্যাপার। আমাকে মন দিতে হবে ভালো করে।

জুয়ানা অবাক হয়ে বলল, তার মানে তুমি আমায় নিয়ে যেতে চাও না? ।

না তা নয়। আমার কাজের ধরণটা এরকম। এক সপ্তাহ আমি থাকব না, তুমি কি করবে ডার্লিং?

আমি তোমার সঙ্গে গেলেই ভালো হত। দিনের বেলায় তুমি না হয় কাজ করতে রাতের বেলা তো আমরা একসঙ্গে থাকতে পারতাম।

কেড একটু ইতস্ততঃ করে বলল, ওরা আমার একার খরচ দিচ্ছে।

 জুয়ানার কালো চোখ হঠাৎ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল।

কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমাদের অনেক টাকা আছে।

আছে। তা বলেই কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে খরচ করতে হবে নাকি। আমার এখন একটু টানাটানি যাচ্ছে, তবে দুমাসের মধ্যেই আমি রয়্যালটি পাব। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি তোমার খুব খরচ করিয়ে দিচ্ছি না?

দেখ তুমি ঘর সামলাও, আমি টাকাপয়সার ব্যাপার দেখবো। দু মাস বাদে আমরা আবার বেড়াতে যাব।

আবার টেলিফোন বেজে উঠল। কেড ছুটে গিয়ে ফোন ধরল, তোমার স্টকের হিসেব দেখলাম। এখন বেচলে তিরিশ পার্সেন্ট লস দিচ্ছ তুমি?

চুলোয় যাক। ব্যাঙ্ককে বলা যাক লোন দিতে।

আরে তুমি কি খবরের কাগজে পড় না। লোনের ব্যাপারে এখন দারুণ কড়াকড়ি চলছে। লোন পাবে না।

কেডের অসম্ভব বিরক্তি বোধ হল। এমনিতেই টাকার জন্য মাথা ঘামাতে ওর চিরকাল খারাপ

বেশ। নিজেদের মধ্যে তিরিশ পার্সেন্ট লোকসানে কি এসে যায় বল? বিক্রী করে দাও তুমি। আমার টাকার দরকার।

অত টাকার কি দরকার তোমার। ওভারড্রাফটের টাকাটা মিটিয়ে দাও আর ব্যাঙ্কে দু হাজার ডলার রেখে চালাও না যতদিন না রয়্যালটি পাও?

দাও এ ছাই স্টক বিক্রী করে। আমি অত টেনেটুনে চালাতে পারছি না। কেড ফোন ছেড়ে দিল।

এখন টাকার টান পড়েছে বলে কেড খরচের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে হয়ে উঠল। থান্ডারবার্ডের জন্য পেট্রোল, রেফ্রিজারেটর মেরামতি, এক ডজন হোয়াইট হর্স হুইস্কির বিল, সব জমা পড়ছে। বেপরোয়া ভাবে এক শিশি জয় এসেন্স কিনেছিল? এখন আফশোষ হচ্ছে। ওলমোদো বিল পাঠিয়েছে ওর ডার্করুম ভাড়া করার জন্য। জুয়ানার চার জোড়া জুতোর বিল। জীবনে এই প্রথম হিসেব করতে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল কেডের। টাকা এত দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে ও রীতিমতো ভয় পেয়ে যাচ্ছিল।

জুয়ানা গাড়ি চালিয়ে কেডকে মেরিডা যাবার প্লেনে তুলে দিল। কেডের বিষণ্ণতার ছোঁয়াচ তারও লেগেছে। প্রায় কথা না বলেই এরা সারা পথটা এসেছে। এয়ারপোর্টের কাছে আসতে কেড বলল, আমি না থাকলে তুমি কি করবে ডার্লিং।

যা হয় করে সময় কাটাব। তোমার সঙ্গে গেলেই ভাল করতাম। আমার খুব মন খারাপ লাগবে।

কেড বলল, রোজ সন্ধ্যায় তোমায় ফোন করব। আজ রাত আটটায় ফোন করব।

 যুক্সমালে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় কেড ক্রিলের টেলিফোন পেল।

ওখানে পৌঁছে কেড ভাবল টাকাপয়সা নিয়ে এত উতলা না হলেই সে পারত। জুয়ানার জন্য ওর খুবই মন খারাপ করছে। সন্ধ্যার পর ধ্বংসস্তূপের ছবি তোলার মতন আলো থাকে না। তাই সন্ধ্যাবেলাগুলোতে ওর নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে। আগের সন্ধ্যায় ও জুয়ানার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে এক ঘণ্টা। আজও ফোন করতেই যাচ্ছিল, এমন সময় ক্রীলের ফোন এল।

আপনাকে জানানো দরকার সিনর, আজ সকালে আপনার ষাড়ের লড়াইয়ের ছবিশুদ্ধ ম্যাগাজিনগুলো পৌঁছেছে।

তাতে কি হল? কেড অধীর হয়ে ঘড়ি দেখল। জুয়ানা তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে।

এখানে সবাই খুব চটে গেছে। আমি তো আপনাকে বলেছিলাম ডিয়াজ এখানে খুবই জনপ্রিয়। সবাই খেপে আছে।

তা আমাকে কি করতে হবে? মাথা চাপড়ে কাঁদতে হবে?

আমার মনে হল আপনাকে আমার জানানো দরকার যে আজ বিকেলে কেড আমার গাড়ির চারটে টায়ার কেটে দিয়েছে। এমন কেড করেছে যে জানে আপনাকে আমি ছবিগুলো তুলতে সাহায্য করেছি?

কেড সচকিত হয়ে উঠল। আমি দুঃখিত অ্যাডাফো? তুমি জান কে এ কাজ করেছে।

আমার মনে হয় ক্ল্যানোকো। আমি তো আপনাকে বলেছিলাম ও ডিয়াজকে দেবতা মনে করে?

আমি খুবই দুঃখিত। তুমি নতুন টায়ার কিনে নাও। আমার নামে বিল করো।

না, না, তা বলছি না আমি। আমি শুধু আপনাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি সিনর। আপনার ওরা ক্ষতি করবে আমার ধারণা। আপনি সাবধানে থাকবেন।

গোল্লায় যাক ওরা। আমায় কিছু করলে ওদের মাথা ভেঙ্গে দেব আমি। শোন তুমি টায়ার কেন, আমার নামে বিল পাঠাও।

অনেক ধন্যবাদ সিনর, তবে সাবধান সিনর। ভালই হয়েছে আপনি এখন এখানে নেই। আপনি ফিরে আসতে আসতে এদের রোষ অনেকটা কমে যাবে।

হঠাৎ জুয়ানার কথা মনে হল কেডের।

আমার স্ত্রীর কিছু হবে না তো অ্যাডোলফো? কেড সাংঘাতিক ঘাবড়ে ফোনের রিসিভারটা আঁকড়ে ধরল।

ক্রিল হাসল। না সিনর, সিনোরা কেড একদমই নিরাপদ, কেন না উনি নিজেকে বাঁচাতে পারেন। তার ওপর উনি মেক্সিকান, তার উপর অপূর্ব সুন্দরী।

কেড স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ঠিক বলছ তো?

ঠিক না জানলে আমি আপনাকে একথা বলতামই না। কিন্তু আপনি সাবধানে থাকবেন, সিনর, আপনার জন্য আমার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

হ্যাঁ, আমি সতর্ক থাকব, তোমায় কথা দিচ্ছি। ও ফোন ছেড়ে দিল।

সিগারেট ধরিয়ে ও জুয়ানাকে ফোন করল। জুয়ানা ফোন ধরল একটু দেরী করে।

ক্রিলের কথাগুলো কেড জুয়ানাকে বলল। নিজের কথা ভাবছি না আমি, কিন্তু তুমি একলা আছ। বড় চিন্তা হচ্ছে।

আমার জন্য চিন্তা কর না। আমি রেনাদোর সঙ্গে কথা বলব। ও বদমাসটাকে উচিৎ শিক্ষা দেবে। তোমার খবর কি বল? কেড হঠাৎ উত্তেজনায় টানটান হয়ে উঠল। ও যেন শুনল একজন পুরুষ কি বলে উঠল। ডার্লিং তুমি কথা বলছ না কেন? জুয়ানা বলল। কেড কান পেতে আবার শোনার চেষ্টা করল। না, এবার কোন আওয়াজ ভেসে এল না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ এখানকার কাজ ঠিকই চলছে। তোমার ঘরে কি কেড আছে জুয়ানা?

আমার এখানে না তো, একথা জিজ্ঞেস করছো কেন?

মনে হল একটা লোক তোমার সঙ্গে কথা বলল।

জুয়ানা হেসে উঠল, ও তো রেডিও। একটা নাটক শুনছিলাম। এখনি রেডিওটা বন্ধ করে দিলাম।

কেড জোরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

তুমি কি করছ একা একা? জুয়ানা অনেকক্ষণ বকরবকর করল, তারপর বলল, না তোমার আর পয়সা নষ্ট করা উচিৎ হবে না। গুডনাইট ডার্লিং।

নীচে রেস্টুরেন্টে যেতে যেতে কেড উপলব্ধি করল জুয়ানা তার কতখানি জুড়ে আছে। কী নিঃসঙ্গ কী একাকী যে লাগছে নিজেকে। ওয়েটারকে বলতে ওয়েটার কেডকে একটা খবরের কাগজ এনে দিল। খেতে খেতে কে কাগজ পড়তে লাগল। খাওয়া যখন শেষ হয়ে এসেছে ও রেডিও আর টেলিভিশনের প্রোগ্রাম পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে গেল কেড, হাত থেমে গেল তার। আজ মেক্সিকো রেডিয়োতে কোন নাটকের প্রোগ্রামই নেই! কেডের মন : ঈর্ষায় জ্বলে উঠল। এখন ও নিশ্চিত যে পুরুষ কণ্ঠই সে শুনতে পেয়েছিল জুয়ানার ঘরে। এর মধ্যেই জুয়ানা ওর সাথে প্রবঞ্চনা করতে শুরু করেছে? মনের অস্থির যন্ত্রণা থামাতে ও প্রাণপণে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল সবটাই তার কল্পনা। কেড ছিল না জুয়ানার ঘরে। কিন্তু জুয়ানা কেন প্রোগ্রাম নিয়ে মিছে কথা বলল! ঘরে ফিরে এসেই ও জুয়ানার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। তখন দশটা বাজে। অপারেটর মেয়েটি বলল, ওদিক থেকে কেড ফোন ধরছে না। কেড ওকে আবার চেষ্টা করতে বলল। আর অসহ্য রাগে যন্ত্রণায় ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। ওয়েটারকে বলল এক বোতল টেকুইলা, বরফ ও লেবু আনতে। কত কি তার মনে আসতে লাগল, এখন নিশ্চয়ই জুয়ানা তার পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে রয়েছে। যত ভাবছে তত মাথা পাগল পাগল লাগছে তার।

মাঝরাত পেরিয়ে গেল। টেকুইলার বোতল অর্ধেক খালি কেড প্রায় পুরো মাতাল। অপারেটর মেয়েটিকে কিছুক্ষণ পরপরই বলছে কি হচ্ছে ওদিকে। বারোটা পয়তাল্লিশ মিনিটে ফোন বেজে উঠল। কেড টলতে টলতে রিসিভার ধরল, কোন চুলোয় গিয়েছিলে? তীব্র ক্রোধে কে বলে উঠল। অপর প্রান্তে জুয়ানা হ্যালো বলতেই।

তুমি কথা বলছ। কি মজা। এইমাত্র তোমার কথা ভাবছিলাম।

কোথায় গিয়েছিলে? কৈড় প্রায় চেঁচাতে লাগল।

খোঁজ করেছিলে নাকি। আনা এসেছিল, আমরা সিনেমায় গিয়েছিলাম। আনা সেই বিয়ের সাক্ষী মেয়েটা।

মিথ্যে কথা বল না। তুমি কোন পুরুষের সঙ্গে বেরিয়েছিলে…কে?

জুয়ানা নিশ্বাস টানল জোরে। ভ্যাল তুমি কি মদ খাচ্ছ নাকি?

 তাতে তোমার কি? বল ওই পুরুষটা কে।

কোন পুরুষই আসেনি। আমি আনার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। বিশ্বাস না হয় আনাকে ফোন কর। ওর ফোন নম্বর দিচ্ছি তোমাকে।

আমি আসছি। কাল একটা হেস্তনেস্ত করব। কেড দুম করে ফোন নামিয়ে রাখল। কম্পিত হাতে কেড গ্লাসে দু ইঞ্চি টেকুইলা ভরে খেয়ে নিল এক ঢোকে। তারপর থরথর করে কাঁপতে লাগল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তারপরই হাতের গ্লাস হাত থেকে পিছলে গেল আর ও বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল কেডের মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ও পরপর চারটে অ্যাসপিরিনের বড়ি খেল। কিন্তু মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতেই লাগল। তারপরে ঠাণ্ডা জল খেয়ে পরপর তিন পেয়ালা কফি খেল। এবার একটু স্থির হয়ে চিন্তা করতে লাগল সে কি করবে। জুয়ানা মিথ্যে কথা বলেছে তার কোন সন্দেহই নেই। ওর মনে হল এক্ষুণি ও জুয়ানার কাছে ছুটে গিয়ে কৈফিয়ৎ চায় কেন জুয়ানা তাকে মিথ্যে বলল, মিউজিয়ামের কাজ চুলোয় যাক। মনের শান্তির কাছে তিনশো ডলার কি? কিছুই না। সে তাড়াতাড়ি হোটেলের বিল মিটিয়ে দিল আর প্রায় ছুটে এয়ারপোর্টে চলে এল। মাঝপথে কাজটা ছেড়ে দিলে স্যাম ওয়াল্ড কি বলবে তাকে? ভেবে উদ্বিগ্ন হল কেড। হঠাৎ তার মনে হল কাজটা শেষ না করায় সে প্লেনের যাওয়া আসার ভাড়া আর হোটেল বিলের টাকাও পাবে না। ইস্ এই সময় এত বাজে খরচা হয়ে গেল। মনটা তেতো হয়ে গেল। জুয়ানা ওর জন্যেই বসে ছিল। মুখ সাদা, মনে হয় সারারাত ঘুমায় নি। কেড রুক্ষ গলায় বলল, একটা ফয়সালা হয়ে যাক। আমি তোমার ঘরে স্পষ্ট একটা পুরুষের গলা পেয়েছি। কাল রাতে রেডিয়োতে কোন নাটকের প্রোগ্রামও ছিল না। এতেই প্রমাণ হয় তুমি মিথ্যেবাদী।

জুয়ানা ওর দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে বলল, জানই যদি আমি মিথ্যেবাদী তাহলে ফিরে এলে কেন?

কেডের মনে ভয় আঁকড়ে ধরল।

ফিরে এলাম কেন? কী বলছ তুমি। আমি তোমার স্বামী, আমি তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চাই?

 কোন কৈফিয়ৎ দেব না আমি। আমি নাটক শুনছিলাম, তার জন্য কৈফিয়ৎ দেব কেন?

মিথ্যে কথা। কোন নাটক শুনছিলে তুমি? নাটকের নাম কি?

জুয়ানা উদ্ধত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল। ওর কালো চোখে আগুন ঝরতে লাগল।

নাটকটা ছিল য়ু কানট টেক ইট উইথয়ু। নিউ অরলিয়েনস থেকে শর্টওয়েভে শোনা যাচ্ছিল। ক্রিলকে বল, তোমাকে খবর দিয়ে দেবে। তুমি অসম্ভব নির্বোধ, সন্দিগ্ধচিত্ত আর নিষ্ঠুর। আমি তোমায় ভালবাসি না।

কেডের ভয়ে দম বন্ধ হয়ে গেল। জুয়ানাকে সে যেতে দিতে পারে না। কেড উত্ৰান্ত ভাবে জুয়ানা, জুয়ানা ডাকতে ডাকতে ওর পেছন পেছন ছুটতে লাগল।

.

০৪.

 জুয়ানার মন ফেরাতে রাত হয়ে গেছে। এক ঘণ্টারও বেশি সময় বন্ধ শোবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাকুতি মিনতি করেছে কেড। বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছে।

আমি মিথ্যেবাদী। তুমি আমায় বিশ্বাস কর না, আমায় ভালবাস না। জুয়ানা রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছে।

অনেক অনুনয় বিনয় করে প্রায় নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করার পর জুয়ানার মন একটু নরম হল।

জান আমি কাল সারারাত ঘুমাই নি। তুমি আমাকে ভীষণ আঘাত করেছ। তুমি খারাপ, খুব খারাপ।

বিশ্বাস কর আর কখনও এরকম হবে না। শেষমেষ জুয়ানা কেডের বাহুতে ধরা দিয়েছে। কেড হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আবার ওরা নেই রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। আবার কেড শ্যাম্পেনের অর্ডার দিল। খরচের কথা খেয়াল করলই না। তার তো ডাইনার্স ক্লাবের কার্ড আছে। পরে দেখা যাবে। ঘুমিয়ে পড়বার আগে কেড ঠিক করল জুয়ানার মন পেতে ও ওকে একটা উপহার দেবে। একটা ওমেগা স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি। এখনো কিছু স্টক বাকি আছে তার। তিন মাসের মধ্যে রয়্যালটির টাকাও পেয়ে যাবে।

পরদিন ক্রিলকে কেড ফোন করে বলল একটা ঘড়ি দেখতে। ক্রিল বলল বিকেলের মধ্যেই ও ঘড়ি পৌঁছে দেবে। তারপর কেড ভয়ে ভয়ে স্যাম ওয়ান্ডকে ফোন করল।

স্যাম আমি য়ুকাতানে যাচ্ছি না। তোমাকে ছবিগুলি ফেরত পাঠাচ্ছি। মানে যাওয়া আসার পরিশ্রম আর খরচা উঠবে না স্যাম। আর কোন কাজের কথা থাকলে বল।

ওয়াল্ড বিরক্ত হল, আমি ওদের বলেছিলাম তুমি রাজী আছ…।

 অন্য কোন কাজের খবর স্যাম?

 ঠিক এখনি কিছু হাতে নেই তবে হ্যারি জ্যাকসনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। ও তোমার ষাড়ের লড়াইয়ের ছবিগুলো দেখে একদম পাগল হয়ে গেছে। ও লাইফম্যাগাজিনের সঙ্গে কথা বলেছে। নিউ অরলিয়নসের ডিক্সি র‍্যান্ডের ওপর একটা প্রবন্ধ লেখার কথা হয়েছে। যদি ডিলটা হয়, তোমাকে ছবি তুলতে হবে। কাজটায় ভাল টাকা থাকবে ভ্যাল, কাল তোমায় সঠিক জানাব।

বেশ। আরেকটা কথা আরো কিছুস্টক বেচে দাও আমার। আমার পাঁচ হাজার ডলার দরকার।

দোহাই তোমার। তোমাকে তো বলেছি…

স্যাম মনে রেখ টাকাটা আমার।

জানি এটা তোমার টাকা কিন্তু তোমার অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে তোমার ভ্যাল? তোমার একুশ হাজার ডলারের স্টক আছে এখন বেচলে মোটে ১৫ হাজার ডলার পাবে।

রয়্যালটি তো পাব?

শোন ভ্যাল….

 পাঁচ হাজার ডলার আমার চাই। বলে ফোন রেখে দিল কেড।

ঘড়িটি ঠিক সময়ে এল। অপূর্ব অপরূপ ঘড়িটি, আগাগোড়া হীরে বসানো। কেড জানে এটা পেলে জুয়ানা যেমন খুশী হবে আর কিছুতে নয়। তাই–ই হল। সেই রাতে কেডের ভাগ্য খুবই প্রসন্ন হল। দুজনের মধ্যে ভালবাসা যেন উপচে পড়ছিল।

স্যাম ওয়াল্ড তারপর দিন সকালে ফোন করে বলল, নিউ অরলিয়নসের কাজটা ঠিক হয়ে গেছে। আর সে কেডের স্টক চল্লিশ পার্সেন্ট লোকসান দিয়ে বেচে দিয়েছে। স্যাম আরও বলল, শুক্রবার জ্যাকসন নিউ অরলিয়নসের ফনটেন র মোটর হোটেলে থাকবে। এটা সিন্ডিকেটের কাজ। তুমি হয়তো নয় হাজার ডলার পর্যন্ত পেতে পারো! শুনে যারপরনাই আনন্দ হল কেডের। আমি ঠিক পৌঁছে সব–স্যাম, ধন্যবাদ।

ও জুয়ানাকে ছুটে গিয়ে বলল ওরা শুক্রবার নিউ অরলিয়নসে যাচ্ছে। জুয়ানাও খুব খুশী হল। তারপরেই কেড ফ্রিলকে বলল ট্রেনে সীট রিজার্ভ করতে। আর হোটেলে একটা বড় ঘর বুক করতে। ডিনারের পর কেড বলল চল একটু গাড়িতে ঘুরে আসি। জুয়ানাতে থান্ডারবার্ড চালানোর একটা সুযোগ পেলেই হয়। ও লাফিয়ে উঠল।

একসঙ্গে বেরিয়ে ওরা গ্যারেজের কাছে এল। এবং অকস্মাৎ গ্যারেজের কাছে একটা গাছের ঝোঁপ থেকে একটা বিরাট ছায়ামূর্তি এসে ঘিরে ধরল তাদের।

দেখো, সাবধান, জুয়ানা তার ভারী হাতব্যাগটা একটা লোকের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করল।

ঘটনার আকস্মিকতায় কেড নিজেকে সামলাতে না সামলাতেই দুজন বেঁটে মেক্সিকান ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কেড লাথি মারার চেষ্টা করল। সজোরে একটা ঘুষি পড়ল ওর মুখে। সমানে গালাগালি দিয়ে ওরা কেডকে চড় ঘুষি লাথি মারতে লাগল।

জুয়ানার আর্তনাদ ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। কেড বহুকষ্টে ঠেলেঠুলে ওঠবার চেষ্টা করতেই আরেকটা ছায়ামূর্তি তেড়ে এল ওর দিকে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেনা দাঁড়াতেই ও আবার পড়ে গেল। আবার হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠার চেষ্টা করতেই ও সভয়ে দেখল একটা লোহার ডাণ্ডা পড়ছে ওর মাথায়। কেড হাত তুলে নিজেকে বাঁচাতে গেল, কিন্তু দেরী হয়ে গেছে। কেড চারিদিকে আগুনের হঙ্কা দেখল তার পর চৈতন্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল। চেনা হারাবার আগে কেড নিজের গলার গোঙানি শুনতে পেল মনে হল যেন তার মাথা দুটুকরো হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে সে জুয়ানার খোঁজ করছিল।

জুয়ানা, ক্রিল আর স্যাম ওয়ার্ল্ড হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিল। জোসে পিন্টো নামে তরুণ মেক্সিকান ডাক্তারটি সেই সময়ে ঘরে এল। ওয়াল্ড নিউইয়র্ক থেকে ছুটে এসেছে। ওয়াল্ড লম্বা, মোটা আর অসম্ভব উদ্যম আর প্রাণশক্তি ওর। বছর চল্লিশ বয়স। জুয়ানার সৌন্দর্য ওকে এতটুকু টলাতে পারেনি। জুয়ানা আক্রমণের ব্যাপারে তেমন কিছুই বলতে পারেনি। বলেছে ওরা পাঁচজন ছিল। জুয়ানার মাথায় ওরা কম্বল চেপে ধরেছিল তাই জুয়ানা কিছুই দেখতে পারেনি। জুয়ানার আর্তনাদ শুনেই প্রতিবেশীরা পুলিশকে ফোন করে। মেক্সিকানরা খুব উদাসীন বিশেষ করে সংকটের সময়ে। যথারীতি যখন পুলিশ এল আততায়ীরা তখন পালিয়ে গেছে। ওরা এসে দেখল গ্যারাজে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, থান্ডারবার্ড ততক্ষণে পুড়ে একটা ধ্বংসস্তূপ, কেড জীবন মৃত্যুর মাঝখানে। ওকে তখনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনদিন পর স্থির হয় অপারেশন হবে।

ওরা উদ্বিগ্ন চোখে পিন্টোর দিকে তাকাল। ডাক্তারটি বলল, খুব সামলে নিয়েছেন উনি। ওর মাথার খুলির হাড় ভেঙ্গেছে তবে আশা করি জোড়া লেগে যাবে। আমরা আশা করছি মাসখানেকের মধ্যেই উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।

আমি দেখতে পারি ওকে? জুয়ানা জিজ্ঞেস করল। কালকের আগে নয়। পরে একটা কাফেতে ঢুকে জুয়ানা ওয়ান্ডের সাথে কথাবার্তা বলছিল। হাতের নখ খুটতে খুটতে বলল ও, দৈনিক খরচা লাগবে। আরো অনেক রকম খরচা আছে। আমার একটা নতুন গাড়ির দরকার…

ওয়াল্ড শীতল চোখে জুয়ানার দিকে তাকাল। ওর এখন তেমন টাকা নেই। কাণ্ডজ্ঞানহীন মাতালের মতন ইদানীং ও টাকা উড়িয়েছে। তারপর জুয়ানার হাতের হীরের রিস্টওয়াচটার দিকে তাকিয়ে বলল, টাকার দরকার থাকলে এটা বিক্রী করুন। ইনস্যুরেন্স কোম্পানী গাড়ির টাকা দেবে। যে কটা টাকা আছে কেড হাসপাতাল থেকে বেরোলে ওর কাজে লাগবে।

জুয়ানার চোখ কঠিন হল। রাগে দাঁড়িয়ে উঠে জুয়ানা বলল, কেড সব সময় বলেছে আপনি ওর বন্ধু। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। ও কখনোই চাইত না আমি ঘড়িটা বেচে দিই। কক্ষনো না। 

ওয়াল্ড অবজ্ঞার দৃষ্টিতে জুয়ানার দিকে তাকাল। ওয়ান্ডের কাছে জুয়ানা একটা সুন্দরী বেশ্যা মাত্র।

আমি ওর প্রকৃত বন্ধু বলেই বলছি ওই ঘড়ি আর যা দামী দামী উপহার আছে সব বেচে দিতে। ওর যে কটা টাকা আছে আমি তা আগলে রাখছি মহোদয়া। আপনি তার কানাকড়িও পাবেন না।

সুগঠিত কাধ দুটি আঁকিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাগে গরগর করতে করতে জুয়ানা বেরিয়ে গেল।

 পরদিন সর্বপ্রথম ওয়াল্ডই কেডকে দেখতে গেল।

ছোট সাদা ঘরটায় ঢুকেই কেডের মুখ দেখে ওয়াল্ড বুঝল কেড অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্তু।

 কেড বলল, এসেছ ভাল করেছ স্যাম। জুয়ানার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

 কাল হয়েছিল। উনি ভালই আছেন।

কেড আগ্রহভরা চোখ তুলে বলল, আমাকে কখন দেখতে আসবে বলল কিছু?

বলেন নি বটে, তবে মনে হয় আজ আসবেন। তোমার কেমন লাগছে এখন?

কেড মুখ বিকৃত করে বলল, ব্যাপারটা একটা অভিশাপের মতন হল স্যাম। তার মানে নিউ অরলিয়ান্সের কাজটা হাতছাড়া হয়ে গেল।

জ্যাকসন অপেক্ষা করতে পারল না। ও লুকাসকে কাজটা দিয়ে দিল।

কেড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তারপর একটু ভেবে ওয়াল্ডকে বলল, জানি না জুয়ানার হাতে কেমন টাকাপয়সা আছে। চাইলে কিছু দিও ওকে।

উনি চালিয়ে নেবেনখন। তোমার বাকি স্টক কটা রাখা দরকার। তুমি যখন হাসপাতাল থেকে বেরোবে, তোমার টাকা লাগবে।

তা হয়তো ঠিক…ঠিক আছে আমি ওর সাথে কথা বলব।

ঘটনাটা কি হয়েছিল বলত?

আমার তোলা ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবিগুলো ওরা পছন্দ করেনি। অ্যাডালফো সাবধান করে দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমি কান দিইনি। গাড়িটা গেছে, তাই না?

হা।

একটা নতুন গাড়ির দরকার হবে ওর।

ইনস্যুরেন্স কোম্পানী সেটা দেখবে এখন। ওর জন্য ভেবনা। উনি নিজেকে দেখতে জানেন। শোন ভ্যাল, আমাকে নিউইয়র্কে ফিরতে হবে। বলে যাচ্ছি, যখনই তুমি সুস্থ হবে তোমার জন্য একগাদা কাজ ঠিক করে রাখব। তুমি ভালভাবে সেরে ওঠ, আমি এদিকটা দেখছি।

ওয়াল্ড চলে যাবার পর কেড চোখ বুজে থাকল। মাথায় খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে। ওয়াল্ডের আগে জুয়ানা কেন তাকে দেখতে এল না? জুয়ানা এল বিকেলের দিকে।

তোমাকে দেখে এত ভাল লাগছে। কেমন আছ? খুব যন্ত্রণা হচ্ছে? জুয়ানা জিজ্ঞেস করল।

আমি ঠিক আছি। তোমার খবর কি? আমার জন্য মন কেমন করছে কি?

 নিশ্চয়ই। হাসল জুয়ানা, তারপর বলল, এত কিছু সামলাতে হচ্ছে আমাকে কি বলব। ইনস্যুরেন্সের লোকেরা গাড়ি নিয়ে ঝামেলা করছে। বলছে ইচ্ছে করে টাকা পাবার জন্য আমরা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি। একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলতে হল। তিনি মনে করেননা ওরা টাকা দেবে। বাড়িওয়ালা বাড়িটা ইনসিওর করে রাখে নি। ও টাকা চাইছে।

কেডের মাথা যন্ত্রণায় দপদপ করছে। ও জোর করে হাসি টেনে আনল।

ওসব নিয়ে ভেব না ডার্লিং। আমি সেরে উঠে সব ব্যবস্থা করব।

কিন্তু আমার যে গাড়ি নেই। ট্যাক্সিও পাওয়া যায় না। আমরা একটা গাড়ি কিনতে পারি?

নিশ্চয় নিশ্চয়। ব্যাঙ্কে কত আছ জানিনা তবে কুলিয়ে যাবে। ওই ড্রয়ারে আমার চেকবুক আছে। আমি ব্ল্যাঙ্ক চেক সই করে দিচ্ছি। তবে সবটা যেন তুলে নিও না সোনা।

জুয়ানার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চেকবুক আর কলম নিয়ে তক্ষুণি কেডের কাছে এল।

ক্রিলকে বোল, ও সস্তায় ব্যবস্থা করে দেবে। যতদিন না সেরে উঠি একটু হুঁশিয়ার হয়ে খরচ করতে হবে।

আমার এক বন্ধুর গাড়ির ব্যবসা আছে। ক্রিকে আর বিরক্ত করব না। তারপর ঘড়ি দেখে জুয়ানা বলল ডাক্তার আমাকে কয়েকমিনিট থাকতে বলেছে। তোমাকে আর বিরক্ত করবনা। কাল যদি নাও আসি চিন্তা কর না কেমন। আমি যখনই পারব আসব।

কেডের মাথার যন্ত্রণা এত বেড়ে গেছে ওর মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল, ঘামছিল দরদর করে। বলল, একমিনিট জুয়ানা, তুমি রেনাদোর সঙ্গে কথা বলেছিলে, ক্ল্যানোকোই তো ব্যাপারটা ঘটিয়েছে, তাই না?

জানি না। যে কেড হতে পারে। ওই ফটোগুলো নিয়ে অনেকেই ক্ষেপে আছে।

 কিন্তু বেনাদোর সঙ্গে কথা বলেছিলে?

জুয়ানা কেডের দিকে না তাকিয়ে বলল, এই..মানে ভুলে গিয়েছিলাম। তবে অন্য কেড হতে পারে। আচ্ছা এখন চলি ডার্লিং। তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ। বলে চলে গেল।

জুয়ানা চলে যাবার পর খুবই বিচলিত হয়ে পড়ল কেড। ডাঃ পিন্টো ওকে দেখে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন এ কদিন কেড ওর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। না, শুনুন আপনার ভালর জন্য বলছি। আপনাকে এখন ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন।

কেড বলল, আমার স্ত্রীকে টেলিফোন করে বলবেন যদি আমাকে দেখতে না–ই পায়, এতটা পথ আসবার দরকার নেই।

ঠিক আছে, আমি টেলিফোন করব।

ঘুমের ওষুধ খাওয়ার আগে জুয়ানা যে এককাড়ি সমস্যার কথা বলেছিল মনে পড়ল কেডের। সেরে উঠে মহা ঝঞ্ঝাটে পড়বে ও। মনে মনে প্রার্থনা করল, জুয়ানা যেন ব্যাঙ্কের সব টাকা না তুলে নেয়। তারপরেই মনে পড়ল জুয়ানার হাতঘড়ির দাম দেওয়া বাকি এখনও। গ্যারেজের ব্যাপারটা একটা ঝামেলা হয়ে রইল। বাড়িওয়ালাকেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কেডের হঠাৎ মনে হল তার আগেকার নিশ্চিন্ত আরামের জীবন যেন চিরতরে শেষ হয়ে গেছে।

এক সপ্তাহ কেটে গেল। কেডকে বেশিরভাগ সময়েই ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ওর মাথার যন্ত্রণা এখন অনেক কম। বুঝতে পারছে ক্রমশঃ ও শক্তি ফিরে পাচ্ছে। সবচেয়ে শক্তি দিয়েছে ওকে জুয়ানার রোজ সকালে পাঠানো একতোড়া ফুল। ফুলের সঙ্গে সবসময়েই একটা কার্ড থাকে। তাতে লেখা থাকে, আমার ভালবাসা নাও, জুয়ানা। কেড আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। আটদিনের দিন কেড ডাঃ পিন্টোকে জিগ্যেস করল সে জুয়ানাকে দেখতে পারে কিনা। ডাক্তার মাথা নাড়ল, না, এখন আপনার কাছে কোন লোক না আসাই ভাল। আপনার স্ত্রী আপনাকে বিব্রত করবে বলছি না। কিন্তু তারও তো নিজের সমস্যা থাকতে পারে। এখানে শুয়ে আপনি কি বা করতে পারেন। এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার হাড় জোড়া লেগে যাবে। দেখবেন তারপর আপনি কি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

ওকে একটু জানিয়ে দেবেন দয়া করে।

ডাঃ পিন্টো মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। বলে দেব।

দ্বিতীয় সপ্তাহ যেদিন শেষ হল কেড জানলার ধারে ইজিচেয়ারে বসেছিল। বেশ ভাল লাগছিল শরীর। জুয়ানার সঙ্গে দেখা করার জন্য ও অধীর হয়ে গিয়েছিল। ডাঃ পিন্টো যখন ওকে দেখতে এলেন কেড সেই কথাই ওকে বলল। ডাঃ পিন্টো ভাবলেশহীন মুখে বললেন, ঠিক আছে, আমি ফোন করব? কাল বিকেলে আসতে বলব, কেমন?

আজ বিকেলে। কেড জোর দিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারি না এই ঘরে টেলিফোন নেই। কেন।

পিন্টো বললেন, এখানে আমরা মাথার আঘাতের চিকিৎসা করি সিনর। তাই রোগীদের ঘরে টেলিফোন থাকে না।

আর কতদিন এখানে থাকতে হবে আমাকে?

 আর এক সপ্তাহ। তারপরও মাঝে মাঝে চেকআপের জন্য আপনাকে এখানে আসতে হবে।

এতে তো খরচ হচ্ছে প্রচুর। তাছাড়া ডক্টর আমাকে কাজও শুরু করতে হবে।

 করবেন তবে এক সপ্তাহ বাদে।

কেড জুয়ানার কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখল। আজ সকালেও একজোড়া কারনেশন ফুল এসেছে কেডের কাছে।

কেড হঠাৎ শিশুর মতন হেসে বলল, আচ্ছা বলুনতো, আমার স্ত্রীর এত খরচা করার দরকারটা কি। এসব বন্ধ করতেই হবে ওকে।

ডঃ পিন্টো কেডের দিকে তাকালেন না। আমাকে যেতে হবে সিনর। বলে বেরিয়ে গেলেন।

কেড ডঃ পিন্টোর যাওয়ার দিকে অস্বস্তি ভরা চোখে তাকাল। লোকটা যেন কী রকম।

বেলা তিনটে থেকেই কেড অধীর আগ্রহে জানালার পাশে বসে রইল। কতদিন বাদে সে জুয়ানাকে দেখতে পাবে ভেবে তার বুকে আনন্দের শিহরণ হচ্ছিল। সে জুয়ানার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ, পিরামিড অফ দি মুনের নীচে তার বিয়ের প্রস্তাব, তাদের হনিমুন সবকিছুর কথা ভাবছিল। বড় অভাব ছিল তার জীবনে স্নেহ ভালবাসার। জুয়ানা তাকে ভরিয়ে দিয়েছে। জুয়ানা সঙ্গে থাকলে সে ভবিষ্যতকে ভয় করে না। সে আবার ঠিক টাকা রোজগার করবে। তাদের জীবন আবার সুখে আনন্দে ভরে যাবে।

দরজায় টোকা পড়ল।

এসো ডার্লিং। উত্তেজনায় কেড়ের বুক ধকধক করতে লাগল। এক্ষুণি সে জুয়ানাকে দেখতে পাবে।

দরজা খুলে অ্যাডোলফো ক্রিল ঘরে ঢুকল। উসকোখুসকো চেহারা বরাবরকার মন। ময়লা পোষাক। দরজায় দাঁড়িয়ে ঘামছে আর ইতস্ততঃ করছে।

হ্যালো আডোলফো, তুমি আসবে তা ভাবি নি। কি করছ এখানে? ক্রিল চোখ তুলে তাকাল।

 কেড দেখল ফ্রীলের চোখ ছলছল করছে। কেড অধীরভাবে বলল, আমি জুয়ানার জন্য অপেক্ষা করছি, ক্রিল। তুমি বরঞ্চ কাল এসো।

উনি আসবেন না সিনর কেড।

কেড ওর দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এই একটা কথায় ওর হৃদয়ের স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেছে।  

মানে ওর কি অসুখ করেছে?

না না।

 তবে কি হয়েছে? বোকার মতন দাঁড়িয়ে থেক না। জুয়ানা আসবে না কেন?

উনি এখানে নেই, সিনয়। ক্রিল ঢোক গিলে বলল।

কি যা তা বলছ, আজ সকালেও আমি ওর পাঠানো ফুল পেয়েছি।

 ক্রিল জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এখানে নেই তো কোথায় গেছে?

 উনি স্পেনে, সিনর।

কেড চেঁচিয়ে বলল, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি? স্পেনে ও করছেটা কি?

 ক্রিল ঠোঁট কামড়ে বলল, স্পেনে ষাঁড়ের লড়াইয়ের মরসুম শুরু হয়েছে।

কেড প্রাণপণে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করল। ওর কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। একটা ভয়ের স্রোত পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগল।

ষাঁড়ের লড়াইতে জুয়ানার কি? তুমি কি বলতে চাইছ জুয়ানা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে?

ক্রিল ইতস্ততঃ করে মাথা নাড়ল।

কেড পনেরটা কার্ড তুলে ক্রিলকে দেখিয়ে বলল, মিথ্যে বলছ তুমি। পাগল হয়ে গেছ তুমি। আজ সকালেও আমাকে ফুল পাঠিয়েছে।

আমি পাঠিয়েছি সিনর। ক্ৰীল মাথা নীচু করে বলল। আপনার সঙ্গে এরকম মিথ্যাচার করেছি। বলে খুবই খারাপ লেগেছে আমার। কিন্তু ডাক্তার বলেছিলেন এসময় আপনাকে কোন খারাপ খবর দেওয়া চলবে না।

তুমি…তুমি পাঠিয়েছে?

হ্যাঁ সিনর। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ভাল করে তোলা। কার্ডগুলো আমার হাতে লেখা। আমি ভেবেছিলাম সিনরার হাতের লেখা হয়তো আপনি চেনেন না।

কেডের গলা কাঁপতে লাগল। সে হিসহিস স্বরে বলল, কিন্তু আমি তো পনেরটা কার্ড পেয়েছি। ও কবে গেল?

আপনি এখানে যেদিন আসেন তার পরের দিনই।

কেড চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুধু টাকার জন্যই তাহলে জুয়ানা তার কাছে এসেছিল। তার সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল যেন।

বলো আরও বলো। কেড রাগে দুঃখে অভিমানে প্রায় বুজে যাওয়া গলায় বলল। আরো তো বলার আছে না? সহসা তার কাছে সব কিছু দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয়ে গেল।

হ্যাঁ। পেড্রো ডিয়াজ। দুঃস্বপ্নের মতন এ ভয়ংকর সত্য কিছুতেই মিথ্যে হতে পারে না।

পেড্রো ডিয়াজ।

ধন্যবাদ অ্যাডোলফো। তুমি দয়া করে এখান থেকে চলে যাও। আমায় একা থাকতে দাও।

ক্রিল বলার চেষ্টা করল সে কতটা মর্মাহত। কিন্তু কেডের স্তম্ভিত যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখে জল এসে গেল। মোটা মানুষটি তার ময়লা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

ক্রিল আগে থেকেই ডাক্তারকে সাবধান করে দিয়েছিল। উনি রুগী দেখে তাড়াতাড়ি কেডের ঘরে এলেন।

এসে দেখেন কেড পোষাক পরে টরে জ্যাকেট গায়ে গলাচ্ছেন ওর মুখ সাদা চোখ টকটকে লাল। কেড পকেটে ওর জিনিসপত্র ভরতে লাগল।

কি করছেন টা কি? পিন্টো চেঁচিয়ে বলল, পোষাক পরে আপনার বেরনোর অবস্থা নয় এখন। যান শুয়ে পড়ুন।

চুপ করুন। আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে কি কাগজপত্রে সই করতে হবে বলুন।

সিনর কেড, আমি সবই শুনেছি। আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকের মতন কাজ করাটা আপনাকে মানায় না। আপনি সেরে ওঠেননি এখনও।

আমার আপনার সহানুভূতি চাই না। আমার এজেন্টকে হাসপাতালের হিসেবটা পাঠিয়ে দেবেন। আমাকে ছেড়ে দিন।

কেডের চোখ মুখের মরিয়া ভাব দেখে ডঃ পিন্টো বুঝলেন কেডের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। উনি শান্তভাবে বললেন, সিনর কেড আপনি খুবই ঝুঁকি নিচ্ছেন। তবে আমি আপনাকে বাধা দিতে পারি না। দয়া করে দরকারী ফর্মগুলো না আনা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

কেড বলল, আমি পনের মিনিট সময় দিচ্ছি আপনাকে। এরপর আমি বেরিয়ে যাব।

কেড হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। শারীরিক দুর্বলতা আর স্নায়ুর উত্তেজনায় তার পা কাঁপছিল।

ক্রিল বাইরে ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল। ডঃ পিন্টোর ফোন পাবার পরই সে উদ্ধশ্বাসে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে।

আমি হাজির সিনর। কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে?

কেডের ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথা। চোখ কোটরাগত, তাতে আবার কেমন বন্য দৃষ্টি। মুখ খড়ির। মতন সাদা। পথচারীরা সবাই ওর দিকে একবার করে তাকাচ্ছিল।

কেড হিংস্রভাবে বলল, আমায় নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। আমার টাকা নেই আর। আমাকে নিংড়ালেও আর টাকা বেরোবে না।

ক্রিল নরম গলায় বলল, আমি শুধু জিগ্যেস করছি তোমায় কোথায় নিয়ে যাব বন্ধু।

কেড দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্রীলের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি দুঃখিত। কিছু মনে কর না। আমায় বাড়ি নিয়ে চল।

বাড়ির কাছে গিয়ে কেড অনেকক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে রইল। তারপর পা টেনে টেনে বাড়িতে ঢুকল। ক্রিল আধঘণ্টা অপেক্ষা করে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।

কেড আধ গ্লাস টেকুইলা হাতে লাউঞ্জ চেয়ারে বসেছিল।

এগুলো কী ক্রি। টেবিলে সযত্নে সাজানো কার্ডগুলির দিকে দেখিয়ে কেড বলল।

 ক্রিল ওদিকে তাকাতেই তার চোখ বিতৃষ্ণায় কুঁচকে গেল।

ওগুলো জিনিস বাঁধা দেবার দোকানের টিকিট।

কেড চেয়ারে হেলান দিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে বলল, জুয়ানা দেখছি বাড়ি ঝেটিয়ে সব নিয়ে গেছে। আমার ক্যামেরাটা পর্যন্ত নেই। কেড গভীর দুঃখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

ক্রিল ততক্ষণে একটা ভোবড়ানো খাম বার করে হিসাব টুকতে বসেছে।

কত? কেড জিগ্যেস করল।

 আট হাজার পেসো সিনর।

কেড কাঁধ ঝাঁকাল। কী আর এসে যায় এতে। তুমি এখন যাও, কেড উদাস গলায় বলল। কাল ইচ্ছে করলে এস।

ক্রিল উঠে দাঁড়াল। আমি সাহসে বিশ্বাস করি সিনর। আমার মনে হয় আপনার মতন সাহসী লোক আবার ইচ্ছে করলেই উঠে দাঁড়াতে পারে। আমি আপনাকে বলেছিলাম একজন সাহসী লোকের অনেক দোষই ক্ষমা করা যায়। আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না।

ওর দিকে না তাকিয়েই কেড বলল, তুমি নির্বোধ। এখন আমার জন্য ভাবনা করার আর কোন অর্থই নেই।

আমরা কথা বলতে পারি সিনর। কথা বললে অনেক সময় মনের ভার লাঘব হয়।

বেরোও তুমি, বেরোও। তোমার মতন একটা চর্বির গোলা আমাকে নিয়ে বিলাপ করবে তাই চাই নাকি আমি? তুমি যাও এখন।

আমি বুঝতে পারছি সিনর, ক্রীলের মুখে কোন ভাবান্তর হল না।

কেড মুখ বিকৃত করে বলল, তুমি কিছুক্ষণ আগেই আমাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছিলে।

 আমি যাকে বন্ধু বলে মনে করি, সেও আমায় বন্ধু ভাববে না আমি তো আশা করি না সিনর।

আঃ বেরোও এখন তুমি।

 ক্রিল কেডের দিকে তাকিয়ে বলল দয়া করে টেকুইলা সাবধানে খাবেন। মারাত্মক নেশা হয় এটায়।

জ্ঞান দিওনা, যাও এখান থেকে।

অত্যন্ত বিমর্ষভাবে ক্রিল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আধঘণ্টা বাদে ক্রিল স্যাম ওয়ান্ডকে ফোন করল। ওয়াল্ড বলল, দ্যাখ অ্যাডোলফো, তুমি কি করতে পার। একটা মেয়ে ল্যাং মেরেছে বলে কেড যদি অধঃপাতে যেতে চায়, তবে ওর মরণই ঘনাবে। কেডের সমস্যা নিয়ে আমায় বিরক্ত কর না। আমার নিজের অনেক কাজ আছে। ও ঠিকই আবার উঠে দাঁড়াবে। একটা বেশ্যার জন্য আর কতদিন শোক করবে।

উনি একজন সত্যিকারের মানুষ সিনর? একজন সাহসী মানুষ। আপনি এখানে একবার আসতে পারেন?

আমাকে জ্বালিও না। বলে ওয়াল্ড ফোন ছেড়ে দিল।

ক্রিল নিজের বাড়িতে গিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। সময় অপচয় নিয়ে মেক্সিকানরা ভাবে না। ক্রিল সমানে ভাবল কেড একজন অসাধারণ মানুষ। ওর জন্য তার কিছু করা দরকার।

সন্ধ্যাবেলায় ও দ্বিধাগ্রস্তুভাবে কেডের বাড়িতে আবার এল। বাড়িটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সামনের দরজা খোলাই ছেল। ক্রিল তাড়াতাড়ি ঢুকে আলো জ্বালল। দেখল কেড উপুড় হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। আর মেঝেতে টেকুইলার খালি বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনেক কষ্টে ক্রিল কেডের অচৈতন্য দেহটাকে সোফায় তুলে শুইয়ে দিল। গলার টাই আলগা করে দিল। বন্ধকী জিনিসের টিকিটগুলো নিজের পকেটে পুরল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে বুঝল কেড এখন ঘুমোবে। তার এখানে থাকার দরকার নেই। খুব অনিচ্ছায় ক্রিল আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তার বুকটা ভারি হয়ে উঠেছে।

পরদিন সকালে কেড কাতরাতে কাতরাতে জেগে উঠল। তার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মুখ শুকনো। জোর করে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, তার হাত পা সব কাঁপছে। হঠাৎ চারিদিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। টেবিলের ওপর তার বই ব্যবহৃত প্যান আম ব্যাগটা। কম্পিত হাতে ব্যাগটা খুলে ওর ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতি দেখতে পেল। মিনোলটা তুলে নিতেই দরজা ঠেলে ক্রিল কফি, পেয়ালা, প্লেট চিনির পট ট্রেতে করে নিয়ে ঢুকল।

গুড মর্নিং সিনর।

ক্যামেরার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে কেড বলল, তুমিই এটা ছাড়িয়ে আনলে?

হ্যাঁ, সিনর। ক্রিল কফি ঢালল। এখন কেমন বোধ করছেন?

 টাকা কোত্থেকে এল।

মনে করুন না এটা একটা সামান্য ধার, শোধ দেবার দরকার নেই। আমার টায়ার নষ্ট হয়ে গেলে আপনিই তো আমাকে টায়ার কিনে দিয়েছিলেন, আমিও আপনার ক্যামেরাটা ফিরিয়ে আনলাম। ব্যস শোধবোধ হয়ে গেল।

ধন্যবাদ, অ্যাডেলফো। কেড বলল।

 ক্রিল কফির পেয়ালা কেডের দিকে ঠেলে বলল, আমার মনে হচ্ছে সিনর আপনার এবাড়িতে থাকতে আর ভাল লাগবেনা। আমার ফ্ল্যাটে একটাবাড়তি ঘর আছে। ঘরটা তেমন নয় তবে আপনি কিছুদিন ব্যবহার করতে পারেন।

— কেড তাড়াতাড়ি বলল, আমার মানুষজনের সঙ্গ আর ভাল লাগছে না ক্রিল। ধন্যবাদ, আমি অন্য কোথায় একটা ঘর দেখে নেব।

ঘরটার ঢোকার দরজা আলাদা। আপনাকে কেড বিরক্ত করবে না, আপনাকে কথা দিচ্ছি।

কেড যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে ক্রিল। ধন্যবাদ। কিন্তু শুধু কয়েকদিনের জন্যে।

নিশ্চয়। আপনি কফি খান, আমি আপনার জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছি।

তিন ঘণ্টা বাদে ক্রিল স্যাম ওয়াল্ডকে টেলিফোন করল। সব বলে বলল, ওর এখনি কোন কাজ শুরু করা দরকার সিনর। শুধু টাকার জন্য নয়, ওকে আবার কাজে ফিরে আসতে হবে।

বেশ অ্যাডোলফো। দেখি কি করতে পারি। কাজ করার মত শরীরের অবস্থা আছে তো?

মনে তো হয়।

 ক্রিল অশান্ত মনে কেডের খোঁজখবরে গেল। ওর পরিচারিকা মারিয়াকে ও কেডকে দেখাশোনা করতে বলেছিল। মারিয়া খবর দিল কেড আসবার পরে একজন ছোকরা এসে তিন বোতল টেকুইলা দিয়ে গেছে। কেডের দরজার বাইরে ও খাবার রেখে এসেছিল। কেড তা ছোঁয়নি। পরদিন সকালে ক্রিল খবরের কাগজ দেবার ছুঁতো করে কেডের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল।

কী? কী? কেড তীক্ষ্ণ গলায় বলল।

খবরের কাগজ নিয়ে এসেছি সিনর।

আমি কাগজ চাই না। আমাকে জ্বালিও না।

মানে আর কিছু চাই আপনার। সিগারেট?

 দোহাই তোমার, আমাকে একলা থাকতে দাও।

ক্রিল হতাশ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। বিকেলে কেডের বাড়ি গিয়ে দেখল চিঠিপত্র এসেছে। সেগুলি নিয়ে ও কেডের দরজায় ধাক্কা দিল।

আপনার চিঠি সিনর।

দরজা খুলে গেল। কেড মাথার ব্যান্ডেজ খোলেনি। দাড়ি কামায় নি। ক্রিল বুঝল কেড প্রচুর মদ খেয়েছে। ক্রীলের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল, আমাকে দাও। তারপর চিঠিপত্রগুলো একরকম ছিনিয়ে নিয়ে মরিয়া হয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। ক্রিল বুঝল কেড নিশ্চয় জুয়ানার চিঠি আশা করছে।

আমায় একলা থাকতে দাও। কেড ক্রিলকে প্রায় ঠেলে দরজার বাইরে বার করে দিল। বেশির ভাগ চিঠিই বিল। ইনস্যুরেন্স কোম্পানী একটা চিঠিতে জুয়ানাকে তিন হাজার ডলার দেবে বলেছে। ডাইনার্স ক্লাব ছশো ডলারের বিল পাঠিয়েছে।

কেড চিঠিগুলো মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর টেকুইলার বোতলটা নিয়ে গ্লাসে মদ ঢালতে লাগল। কেড বুঝল সে নিজেকে ধ্বংস করছে। কিন্তু তার যন্ত্রণা কমাবার আর কোন উপায়ই নেই। এমন সময় হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। চমকে উঠে একটু ইতস্ততঃ করে ও ফোনটা ধরল। ও প্রান্তে ওয়ান্ডের গলা।

কেমন আছ ভ্যাল? একদিনের একটা কাজ আছে। করতে পারবে?

কেড অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল, হ্যালো স্যাম। আমি খুব ভাল আছি। দেখ, এখনি একগাদা বিল এসেছে। এগুলো তোমাকে মেটাতে হবে।

ঠিক আছে। ওগুলো আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। কী, কাজটা করতে পারবে?

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। কাজটা কী

কাল জেনারেল দি গ্যল মেক্সিকো পৌঁছেছেন। ফ্রান্সে শুধু তোমার তোলা ছবিই ছাপা হবে। বিরাট ব্যাপার। প্যারিস ম্যাচ..জুর দ্য ফ্রান্স.সমস্ত কাগজ। কাজগুলোকর তোমায় আর ধারের জন্য ভাবতে হবে না। অ্যাডেলফো সব ব্যবস্থা করে দেবে। তুমি শুধু ছবি তুলবে।

নিশ্চয় তুলব…তুলতে পারব। তার মাথা সমানে কামড়াচ্ছে।

.

কেডের ফটোগ্রাফার জীবনে কলঙ্কময় অধ্যায়ের শুরু এখানে থেকেই। ক্রিলই সব ঠিক করে দিল। পাশ জোগাড় করল। দ্য গ্যলের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঠিক করল। কেডকে ওর প্রাসাদে নিয়ে গেল সময় হাতে করে। কেড এত টেকুইলা গিলেছে যে ভালো ছবি তোলা সম্ভব নয় এ অবস্থায়।

নিজের ছবি প্রিন্ট করার ক্ষমতা নেই কেডের। ও টমাস ওলমোদাকে সে ভার দিল। কেড। আর ক্রিল দুজনেই ওলমোদর অফিসে গেল প্রিন্ট দেখতে। দুজনের মনেই আশঙ্কা খেলা করছে। ওলমোদার মুখ দেখে কেড বুঝল সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। একটা ভয়ের শীতল প্রবাহ তার পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে নামতে লাগল।

ওলমোদা বিভ্রান্ত ভাবে বলল, এ ছবিগুলো তো কোন কাজেই আসবে না সিনর। সব আউট অফ ফোকাস।

স্যাম ওয়াল্ড খবরটা জানামাত্ৰ ক্ষেপে গিয়ে চেঁচাতে লাগল। তুমি ক্যামেরার দোষ দিচ্ছ। ভ্যাল। এটা তোমার পরীক্ষা করা উচিৎ ছিল না। প্যারিস ম্যাচকে এখন কি জবাবদিহি দেব। আমি জীবনে এরকম অবস্থায় পড়িনি।

কেড আমতা আমতা করে সমানে মিথ্যে বলতে লাগল, জীবনে একবার তো এরকম হতেই পারে, স্যাম। ক্যামেরার প্রি–সেটটা কাজ করছিল না। …বিশ্বাস কর আমি একদম বোকা হয়ে গেছি।

শোন ভ্যাল, তুমি আমার নাম ডুবিয়েছ। তুমি এরকম বেইমানী করতে পারলে আমার সঙ্গে

আঃ চুপ কর। কেড চীৎকার করে উঠল, যা হবার হয়েছে, আমাকে অন্য কাজ দাও। আমার হাত খালি সম্পূর্ণ। একটা কিছু ব্যবস্থা কর।

আরেকবার এরকম কর, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। তোমার আর কি, কৈফিয়ৎ তো আমাকেই দিতে হয়। তুমি আমার কত ক্ষতি করেছ জান না।

আঃ, খ্যাচখ্যাচ কর না। আমার অন্য কাজ চাই। কেড টেকুইলার গ্লাসে চুমুক দিল।

পরে খবর পাবে। বলে ওয়াল্ড দুম করে ফোনটা নামিয়ে রাখল।

দুদিন পরে ওয়াল্ড লিখিত হিসেব পাঠাল। সমস্ত বিল মিটিয়ে দিয়েছে, ডাঃ পিন্টো আর হাসপাতালের সব প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়েছে। আর কোন শেয়ার বা স্টক নেই, একদম পরিষ্কার। তার ওপরে ওর এক বছরের রয়্যালটির টাকার মধ্যে ছ মাসের টাকাই ধার শোধ করতে চলে গেছে। কেড বুঝল ওর মূল্য এখন এক কানাকড়িও নয়। তার উপর ক্রীলের থেকে ও এ পর্যন্ত ৭০০ ডলার ধার করেছে, ওয়াল্ড ওর কাছে পায় ছশো ডলার।

টেকুইলা খেলে মন একদম অসাড় হয়ে যায়। এই–ই ভাল। কেড প্রাণপণে টেকুইলা গিলতে থাকল। এই সময় ক্যালিফোর্নিয়ার নতুন কাগজ লুকনাউ–এর হয়ে ডিউক অব এডিনবরার মেক্সিকো আগমনের ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দিল ওয়ান্ড।

ওর থেকে ভালো কিছু বাগাতে পারলে না? এডিনবরা কি সোজা ব্যাপার নাকি? সিন্ডিকেট থেকে এ ছবি তুললে ঠিক হত।

 সিন্ডিকেটও ছবি তুলছে। ওরা লুকাসকে নিয়েছে। তোমার বদনাম ছড়িয়ে গেছে ভ্যাল। তুমি নিজের সর্বনাশ করছ। হ্যাঁ তবে এবার আমার ঠিকঠাক ছবি চাই। মনে রেখো।

ছবিগুলো তুলতে কেডের যা শারীরিক আর মানসিক পরিশ্রম হল বলার নয়। প্রিন্টগুলো ওলমোদা নীরবে কেডের হাতে তুলে দিল।

কেড বুঝতে পারল ছবিগুলো অত্যন্ত সাধারণ মানের, এতে অনন্য সাধারণ কেডকে কেড খুঁজে পাবে না।

পরদিন বিকেলে ওয়ান্ডের টেলিফোন এল। কেড তখন তার বিশ্বস্ত বন্ধু টেকুইলার গ্লাস হাতে, নিয়ে বিছানায় শুয়েছিল। ও বুঝেছে ওয়াল্ড গালাগালি করবে। কিন্তু ওয়াল্ড যা বলল তা তীরের মতন তার বুকে গিয়ে বিধল। ওয়াল্ড আস্তে আস্তে বলল, শোন ভ্যাল, আমার মনে হয় তুমি এখনও সুস্থ হও নি। তোমার ছবিগুলো একটা তৃতীয় শ্রেণীর ফটোগ্রাফারও তুলতে পারত।

মাত্র ছশো ডলারের বিনিময়ে ওরা কী আশা করে।

যাক গে ভ্যাল, পয়সা ওরা দিয়েছে কিন্তু প্রশংসা করেছে লুকাসের ছবিগুলির। আমি আমার বদনাম নিয়েও ভাবছি। আমি তোমাকে ছশো ডলার পাঠাচ্ছি। আমার কমিশন নিচ্ছি না। সাবধানে চললে এতে তোমার দুমাস চলে যাবে। পরিশ্রম কম কর, বিশ্রাম নাও। যখন তুমি সত্যিই সুস্থ হবে তোমার জন্য কাজকর্ম দেখবক্ষণ।

এত বছর বাদে কি অনায়াসে ওয়াল্ড ওকে ছেটে দিল–এ যে অবিশ্বাস্য। কেড টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। ঠিক আছে। ওয়াল্ডই তো একমাত্র এজেন্ট নয়। সে দেখিয়ে দেবে ওকে। জানলা দিয়ে আছড়ে পড়ছে গাড়ি চলাচলের আওয়াজ। কেডের মাথা দপদপ করছে একটা ঢেউ যেন তার মধ্যে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপতে কাঁপতে ও দু হাতে নিজের মুখ ঢাকল। চরম হতাশায় ওর শরীর বেঁকে বেঁকে গেল, ভেতর থেকে দমকের ওপর দমক কান্না বেরিয়ে এল।