১২. আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন

১২.

রয় সম্বন্ধে আমার গত রাতের আশঙ্কা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, পরদিন সকালেই সেটা বুঝতে পারলাম। কারণ আমার চোখে পড়লো ওর ব্যবহার আগের মতোই হাসিখুশী ও উজ্জ্বল।

প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যেবেলা আমরা তাস নিয়ে বসলাম। নিজেদের মধ্যে হার জিত নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কিও করলাম। নানা রকম ব্যাপার নিয়ে আলোচনাও করলাম। রয় আবার ওর হাসিখুশী মেজাজ ফিরে পাওয়ায় অনেকটা স্বস্তিবোধ করলাম। এছাড়া নিশ্চিন্ত হওয়ার আরও অনেক কারণ ছিল যেমন–আমার প্রতি লোলার ব্যবহার আবার ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠেছে। সারাদিনে লোলা আমার সঙ্গে বার দুয়েক কথা বলেছে, যদিও ব্যবসা সংক্রান্ত। তবুও আমি খুব খুশী।

রাত প্রায় দশটার সময় লোলা বারান্দায় এসে আমাদের খেলা দেখতে লাগলো। আমরা ওকে দেখে ডাকলাম। কিন্তু ও এলোনা, শুতে চলে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো যে ওয়েন্টওয়ার্থে গিয়ে আগামীকাল কিছু কেনাকাটা করার আছে। আমাদের দুজনের মধ্যে কেউ একজন সঙ্গে গেলে ভালো হয়।

আমি একটু অবাক হলাম। কারণ, এ পর্যন্ত কেনাকাটার ব্যাপারগুলো লোলা একাই সেরেছে। তাই আজ ওর এই অনুরোধে মনের মধ্যে সন্দেহের দোলা লাগলো। এর পেছনে কি লোলার কোন উদ্দেশ্য আছে?

রয় আমাকে জানালো যে আমার যদি কোনো অপত্তি না থাকে তাহলে ও লোলার সঙ্গে ওয়েন্টওয়ার্থে যেতে চায়। কারণ ওরও কিছু কেনাকাটা আছে।

আমি মনে মনে চমকে রয়-এর দিকে তাকালাম। মুখে বললাম, ঠিক আছে যাবি তো যা না। তবে দুপুরের আগেই ফিরে আসার চেষ্টা করিস। নাহলে আমি একা সবকিছু সামলাতে পারবো না।

আমি কিন্তু সকাল আটটায় যাবো। বিদায় জানিয়ে লোলা বাংলোয় ফিরে গেলো।

লোলার সঙ্গে রয়-এর যাওয়াটাকে আমি কিছুতেই সহজভাবে মেনে নিতে পারছি না। কারণ আমি নিশ্চিত, সুযোগ পেলেই লোলা ওর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করবে। তার ওপর এখান থেকে ওয়েন্টওয়ার্থে যাবার কুড়ি মাইল রাস্তা লোলা চুপচাপ বসে কাটাবে বলে তো মনে হয় না।

রয় জানালো যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে কিছু কেনাকাটি করেই ফিরে আসবে।

পরদিন সকালে দেখলাম রয় আর লোলা মার্কারি নিয়ে রওনা হচ্ছে। ওরা চলে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গতাবোধ আমাকে আঁকড়ে ধরলো। মনের কোণায় ঘুরতে লাগলো একই সন্দেহ, একই আশংকা।

এসব চিন্তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য স্টেশন ওয়াগনের ইঞ্জিন নিয়ে কাজে লেগে গেলাম।

এই সময় হঠাৎ দেখলাম, একটা বড় ট্রাক তেল নেবার পাম্পগুলোর কাছে এসে দাঁড়ালো। ট্রাকে সার বেঁধে সাজানো বড় বড় কাঠের প্যাকিং বাক্স। ট্রাকচালক একজন মোটাসোটা বয়স্ক– লোক। মাথায় সোনালী চুলের কোথাও কোথাও শুভ্রতার আভাস। মাথায় একটা স্টেটসন হ্যাট।

ট্যাঙ্কে তেল দিচ্ছি, ড্রাইভারটা হঠাৎ ট্রাক থেকে নেমে এলো। একটা ময়লা রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে লোকটা কৌতূহল ভরে আমার দিকে তাকালো। তুমি বোধহয় এখানে নতুন এসেছে, তাই না?–তা জেনসন গেলো কোথায়?

আমি লক্ষ্য করলাম, জেনসনের মতো এ লোকটাও সুইডেনের অধিবাসী। সুতরাং এ যদি জেনসনের বন্ধুও হয়, তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। সেই কারণে খুব সাবধানে ওকে জেনসনের অ্যারিজোনায় যাওয়ার গল্পটা শোনালাম।

আমার গল্পটা শুনে লোকটির মুখের রেখা কঠিন হয়ে উঠলো, চোখ দুটো হয়ে উঠলো সংকীর্ণ।

জেনসন কোনদিন এ জায়গা ছেড়ে গেছে বলে তো মনে পড়ে না। জানো গত বিশ বছর ধরে আমি এ রাস্তায় নিয়মিত যাতায়াত করি। যতবারই গেছি কার্লের সঙ্গে প্রতিবারই আমার দেখা হয়েছে–অ্যারিজোনায় নতুন পেট্রলপাম্প খুলে ওর যে কি সুবিধা হবে কে জানে!-তাহলে কি ও আর এখানে ফিরবে না।

হ্যাঁ, ফিরবেন। এখানকার সবকিছু গোছগাছ করার জন্য তাকে একবার আসতে হবে।

পেট্রল ট্যাঙ্কের ঢাকনা লাগাচ্ছি। লোকটা হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রশ্ন করলো, তুমি কি কার্লের বউ এর পরিচিত কেউ?

না, আমি এখানে চাকরি করি। কিন্তু কেন বলুন তো?

না-বলছিলাম–জেনসনের বউ-এর স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো নয়। যখন প্রথম মেয়েটাকে দেখলাম যে জেনসনকে বিয়ে করে এখানে বসে আছে–তখন ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম।

মেয়েটাকে আমি আগে থেকেই চিনি। লোকটি একটি সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, বছর পাঁচেক আগেকার কথা। তখন মেয়েটা কারসন সিটিতে থাকতো। ফ্রাঙ্ক ফিনি নামে একটা লোককে ও বিয়ে করেছিলো। ফিনি একটা গাড়ির কারখানা দেখাশোনা করতে, আর সেই সঙ্গে একটা স্ন্যাক-বারের ম্যানেজারও ছিলো। জানো, শেষ পর্যন্ত কি হল?

–একদিন ফিনিকে স্ন্যাক বারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো। ওর ডান হাতে ধরা ছিলো একটা রিভলবার। আর মাথাটা ফেটে চুরমার হয়ে সারা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছিলো। লোলার বক্তব্য ও নাকি ওপরের ঘরে কাজেই ব্যস্ত ছিলো। এমন সময় নীচের তলা থেকে রিভলবারের বিকট শব্দ ওর কানে আসে। তারপর ও নীচে এসে দেখে ফিনি মরে পড়ে আছে। কাউন্টারের ওপর। যে ক্যাশবাক্স ছিলো তা থেকে প্রায় দু-হাজার ডলার অদৃশ্য হয়েছে। পুলিশের ধারণা সেই টাকাগুলো লোলাই নিয়েছে। অথচ তার বিপক্ষে কোনো প্রমাণ দাখিল করা গেলো না।

একজন অফিসার সন্দেহ করলো লোলাই হয়তো ফিনিকে গুলি করেছে। কারণ ওরা নাকি প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া করতো। কিন্তু সেটাও পুলিশ প্রমাণ করতে পারলো না।

এ ঘটনার কিছুদিন পরে লোলা কারসন সিটি ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেলো। তাহলেই বুঝে দেখো, যখন দেখলাম ও এখানে এসে জেনসনের মতো একজন ভালো লোককে বিয়ে করে বসেছে তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ অবাক হলাম।

এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে লোকটার কথা শুনছিলাম। কারণ লোলার অতীত ইতিহাস আমার কাছে অমূল্য। চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললাম, আশ্চর্য, আমি তো কিছুই জানতাম না। যাই হোক। আমি লোকটাকে বললাম, আমি যতদূর জানি, মিঃ জেনসন মিসেস জেনসনকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন। আপনার এই কথাগুলো মিঃ জেনসনের কানে গেলে তিনি হয়তো খুব অসন্তুষ্ট হবেন। অতএব এ নিয়ে আর বেশী আলোচনা না করাই ভালো।

জেনসন তাহলে ওর বউকে নিয়ে সুখে আছে বলছো?

লোকটা যেন আমার কথা বিশ্বাসই করতে পারছে না।

কথা শেষ করে লোকটা তেলের দাম বাবদ কয়েকটা নোট আমার দিকে এগিয়ে ধরলো, আর বললো, আমি যেন জেনসনের কাছে এই সমস্ত কথা না বলি।

লোকটি ট্রাকে উঠে পূর্ণ গতিতে ট্রাক ছুটিয়ে দিলো।

লোকটির কথাগুলো আমাকে বেশ আতঙ্কগ্রস্ত করলো। ছুটন্ত ট্রাকটার দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।

মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বয়ে চললো। তাহলে লোলা আগেও একবার বিয়ে করেছে। ওর স্বামী মারা গেছে রিভলবারের গুলিতে। আর সেই সঙ্গে অদৃশ্য হয়েছে দু হাজার ডলার। এ কথা ভাবতেই হৃৎপিণ্ডটা কে যেন খামচে ধরলো।

জেনসনও তো মারা গেছে রিভলবারের গুলিতে। আর আমি যদি সিন্দুকের দরজা বন্ধ করে না দিতাম তাহলে অদৃশ্য হত ঐ একলাখ ডলার।

এই ঘটনা দুটোর মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে! সন্দেহ-আতঙ্কের সুতোয় মনটা দুলতে লাগলো পেন্ডুলামের মতো।

ঐ ট্রাক ড্রাইভারটার কথা যদি সত্যি হয়, তবেকারসন সিটির পুলিশ লোলাকে শুধু টাকা চুরির জন্যই সন্দেহ করেনি ফিনিকে খুন করার জন্যও সন্দেহ করেছে। তার মানে–লোলা কি জেনসনকে খুন করেছে?

মনকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম সেই ভয়াবহ রাতের দৃশ্যে। সবকিছু আবার যেন আমার চোখের সামনে নিখুঁতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, লোলা রিভলবার উচিয়ে বসবার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় ওর বুক উঠছে নামছে। তারপরই শুনতে পেলাম লোলার সেই অবিশ্বাস্য কর্কশ শাসানি। মনে পড়লো, জেনসনের উঠে দাঁড়ানোর কথা। রাগে চোখমুখ লাল করে ও লোলার দিকে এগোতে গেলো। সঙ্গে সঙ্গেই আবার যেন শুনতে পেলাম সিন্দুকের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ-লোলার সেই হিংস্র দৃষ্টি বন্দুকের বিকট আওয়াজ!

এতোদিন ধরে ভেবে এসেছি সিন্দুকের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে লোলা চমকে ওঠায়, ট্রিগারে আচমকা চাপ পড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। আর তাতেই জেনসন মারা গেছে। এক আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এখন ঐ লোকটার কথা শোনার পর আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম।

প্রথম স্বামীকে খুনের ব্যাপারে পুলিশ লোলাকে সন্দেহ করেছিলো তাহলে কি জেনসনকে লোলা নৃশংসভাবে খুন করেছে।

 কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে আকস্মিক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ব্যাপারটা যদি সত্যিই খুন হয়, তাহলে ও তো অনায়াসেই খুনের দায়টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারতো। তারপর হঠাৎ একটা বিচিত্র সম্ভাবনা আমার সমস্ত চিন্তাশক্তি পরিবর্তন করে দিলো। হৃৎপিণ্ডের গতি স্তব্ধ হয়ে এলো।

সেদিন লোলা যখন রিভলবার হাতে ঘরে এসে ঢোকে, তখন সিন্দুকের দরজা খোলাই ছিলো। তাহলে কি লোলার উদ্দেশ্য ছিলো জেনসনের পর আমাকে গুলি করে সিন্দুকের টাকা গুছিয়ে নেওয়া? হয়তো আগে থেকেই সবকিছু প্ল্যান করে রেখেছিলো। লোলার গুলিতে আমি আর জেনসন মারা গেলে পর, ও হয়তো টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলে পুলিশে খবর দিতো। তারপর পুলিশ এলে ফ্র্যাঙ্ক ফিনির সময় যে রকম গল্প শুনিয়েছিলো, এবারও সেরকম কিছু একটা শোনাতো।

লোলার এই নিখুঁত প্ল্যান বানচাল হয়ে যাওয়ার একটাই যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। তা হলো জেনসনকে গুলি করা মাত্রই আমি সিন্দুকের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সেই মুহূর্তেই লোলা বুঝতে পেরেছিলো, ও যদি আমাকে তখন গুলি করে, তবে সিন্দুক চিরকাল বন্ধই থেকে যাবে। কারণ আমি ছাড়া সিন্দুক খোলার লোক এই জায়গায় আর নেই। তাই সঙ্গে সঙ্গে ও এমন অভিনয় করেছে, যেন আচমকা গুলি বেরিয়ে জেনসন মারা গেছে। তারপরই লোলা যখন বুঝতে পারলো, ব্ল্যাকমেল করে আমাকে দিয়ে সিন্দুক খোলানো যাবে না, তখন ও অন্য রাস্তা ধরলো। এমন ভাব দেখালো যেন ও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ওর ফাঁদে আমি পা দিইনি।

আর যখনই ও বুঝতে পেরেছে যে এই পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এ সিন্দুক খোলার লোক আর আমি একা নই, তখনই আমার প্রতি ওর ব্যবহার রূঢ় হয়ে উঠেছে। যেহেতু রয়ও এখন সিন্দুক খুলতে জানে। তাই লোলা এখন রয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করছে।

আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে, জেনসনের ৪৫ বর্তমানে লোলার কাছে, একথা ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে গেলো। অর্থাৎ আমার এবং রয়ের–দুজনেরই জীবন বিপন্ন। লোলা হয়তো রয়কে যাহোক করে রাজী করিয়ে সিন্দুক খোলাবে। তারপর নির্বিকার চিত্তে ওকে খুন করবে। হয়তো আমাকেও আর জীবিত রাখবে না। পুলিশকেও সেই একই গল্প শোনাবে।

নাঃ,এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন। লোলার চোখের রক্তলোলুপ হিংস্র দৃষ্টি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

লোলাকে জব্দ করার একটা মাত্র উপায় আছে তা হলো সিন্দুক থেকে সমস্ত টাকা অন্য কোথাও সরিয়ে সিন্দুক খোলা রেখে দেওয়া। কিন্তু ঐ টাকাগুলো লুকিয়ে রাখার জন্য আমাকে প্রথমেই ভালো দেখে একটা জায়গা খুঁজতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করে ফেললাম যে টাকাগুলো সিন্দুক থেকে নিয়ে জেনসনের মৃত দেহের সঙ্গেই কবর দেবো।

বারান্দা ছেড়ে বাংলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ট্রাক ওয়েন্টওয়ার্থের রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। তার পেছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা পুরোনো প্যাকার্ড গাড়ি। প্যাকার্ডের ড্রাইভার অত্যন্ত খিটখিটে স্বরে জানালো, তার গাড়ি এখুনি ঠিক করে দিতে হবে না হলে ট্রপিকা ম্প্রিংসে পৌঁছতে তার দেরী হয়ে যাবে। ঐ ঝরঝরে প্যাকার্ডের পেছনে আমার সময় নষ্ট হতে লাগলো, দুপুরবেলা রয় আর লোলা যখন ওয়েন্টওয়ার্থ থেকে ফিরে এলো, তখনও আমি ঐ হতচ্ছাড়া প্যাকার্ডের সঙ্গে রেঞ্চ নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছি।

এইভাবে তিন দিন তিন রাত কেটে গেলো। কিন্তু এর মধ্যে একবারও সিন্দুকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলাম না।

লোলা সবসময় আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলো। ও আজকাল আমার সঙ্গে কথা বলে ঠিকই, কিন্তু ওর নিস্পৃহ ব্যবহার সব সময় আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অতীতের অন্তরঙ্গতার সূত্র ছিঁড়ে গিয়ে আমাদের মাঝখানে গড়ে উঠেছে এক সুদৃঢ় দ্বন্দ্বের পাঁচিল।

প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও এই অস্বস্তিকর পরিবেশকে আমি মেনে নিলাম। এবং কিছু দিনের মধ্যে অনুভব করলাম লোলাকে স্পর্শ করতেও আমার প্রচণ্ড অনীহা। লোলার প্রতি একে একে আমার ঘৃণা জন্মাতে শুরু করলো।

সবসময় ওকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলাম। এক এক সময় মনে হয়েছে রয়কে সব কথা খুলে বলি। কিন্তু পরক্ষণেই কি মনে করে আবার চুপ করে গেছি।

রয় যদি জানতে পারে যে সিন্দুকে এক লাখ ডলার আছে তবে ওর বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এবং ওকে ঠেকিয়ে রাখা খুব অসুবিধা হবে। সুতরাং মুখ বন্ধ করে দিন কাটাতে লাগলাম।

এই কঠিন সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হলো রয় ও লোলার অনুপস্থিতি। তাই বসে বসে দিন গুনতে লাগলাম কবে লোলা রয়-এর সঙ্গে ওয়েন্টওয়ার্থে যাবে আমাকে এই পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এ রেখে যাবে সম্পূর্ণ একা।

প্রায় সপ্তাহখানেক পরে এসে গেলো সেই প্রতীক্ষিত সুযোগ। একদিন সন্ধ্যায় খাবার ঘরে আমি আর রয় কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় লোলা ঘরে এসে ঢুকলো, ওয়েন্টওয়ার্থে ব্রিজিত বার্দোর একটা ভালো ছবি এসেছে। আজ রাতে আমি দেখতে যাবো তোমরা কেউ যাবে?

রয় বললো যে সে মারপিটের ছবি ছাড়া দেখে না।

আমি ভেবে দেখলাম, এই সুযোগ। এখন যদি কোনরকমে রয়কে লোলার সঙ্গে যেতে রাজী করাতে পারি তবে আমার উদ্দেশ্য সফল হবে। কারণ, ওয়েন্টওয়ার্থে সিনেমা দেখে ফিরতে ফিরতে ওদের রাত তিনটে হয়ে যাবে। আর ঐ সময়টাকেই আমি কাজে লাগাবো।

আর রয়কে বললাম ছবিতে মারপিট না হয় নাই থাকলো, ব্রিজিত বার্দোকে তো দেখতে পাবি।

রয় অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো। ও হয়তো ভেবেছিলো, আমিই লোলার সঙ্গে যাবো।

রয় ইতস্ততঃ করে জবাব দিলো ভাবছিলাম আজ একটু তাস খেলবো।

 কিন্তু এই কুড়ি মাইল গাড়ি চালিয়ে লোলা একেবারে একা ওয়েন্টওয়ার্থে যাবেতাই বলছিলাম

লক্ষ্য করলাম লোলা একদৃষ্টে আমাকে দেখছে। ও হঠাৎ বলে উঠলো, ঠিক আছে তোমাদের যখন যাবার ইচ্ছা নেই, তখন আমি একাই যাবো।

রয় লোলার দিকে আড়চোখে চেয়ে হাসলো, আচ্ছা তোমার কথাই থাক। চলো কি ছবি দেখাতে নিয়ে যাবে

রয় আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে মাথা নোওয়ালো। লোলা প্রত্যুত্তরে হেসে বাংলোর দিকে পা বাড়ালো।

সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই লোলা সেজেগুজে বাংলো থেকে বেরিয়ে এলো। ওর পরনে একটা দুধ সাদা পোশাক। আগে কোনদিন ওকে এ পোশাকে দেখিনি।

লোলা যেন আজ প্রাণ ভরে সেজেছে। ওর রূপযৌবনের সমস্ত ছলাকলা প্রকট করে ও এগিয়ে চললো মার্কারির দিকে। ওর ভাবগতিক দেখে বুকের মধ্যে বেজে উঠলো বিপদের সংকেত।

লোলা ওর স্বভাবসিদ্ধ ছন্দে এগিয়ে গিয়ে রয়ের পাশে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রয় আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।

শেট, আমি কিন্তু যেতে চাইনি। তুই বললি বলে তাই

লোলাকে আড়াল করে চোখ টিপলো রয়।

রয়ের মন্তব্য আমার কানে বাজলো। কারণ ওর চরিত্রের সঙ্গে এ ধরনের কথা ঠিক খাপ খায় না–কিন্তু ওর কথা আমি গায়েই মাখলাম না। মিষ্টি করে জবাব দিলাম, আশাকরি সময়টা তোর ভালোই কাটবে।

আমি ভালোভাবেই জানি যদি একবার সিন্দুকের টাকাটা পরিকল্পনামতো লুকিয়ে ফেলতে পারি, তবে লোলা আর রয় দুজনেই থাকবে আমার বুড়ো আঙুলের তলায় সম্পূর্ণ আমার আজ্ঞাধীন।

ওদের গাড়ি ছেড়ে দেবার পর কয়েক মুহূর্ত আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বাংলোর দিকে চললাম।

বাংলোর কাছে পৌঁছেই লক্ষ্য করলাম সদর দরজা বন্ধ। বুঝলাম লোলা দরজায় তালা দিয়ে গেছে। সুতরাং গুমটিঘরের দিকে চললাম একটুকরো তারের সন্ধানে।

তারের মাথাটা সামান্য বেঁকিয়ে চাবির ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। একটু চেষ্টাতেই খুলে গেলো বাংলোর দরজা। তারপর হাঁটু গেড়ে সিন্দুকের কাছে বসলাম, খুলে ফেললাম সিন্দুকের দরজা। সিন্দুকের দরজা খোলামাত্রই নির্মম রসভঙ্গের মতো কানে এলো কোনো গাড়ির হর্নের শব্দ। জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখি পাম্পের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা হলদে ক্যাডিলাক।

অতএব কম্বিনেশন ডায়াল ঘুরিয়ে সিন্দুক বন্ধ করে বাইরে এলাম। কিছুটা হতাশ হয়েই গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম–

সেই যে গাড়ি আসতে শুরু করলো ব্যস–সিন্দুক সিন্দুকের জায়গায় পড়ে রইলো, আর আমি অক্লান্ত ভাবে খেটে চললাম।

প্রায় বারোটা নাগাদ গাড়ি চলাচল একেবারে কমে এলো। নিশ্চিন্ত হয়ে উঠেদাঁড়ালাম। বাংলোর দিকে এগিয়ে যাবো এমন সময় চোখে পড়লো দূরাগত কোনো গাড়ির হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো। একটু বিরক্ত হয়ে পাম্পের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

গাড়িটা একটা পুরোনো মডেলের বুইক। গাড়ির আরোহী দুজনের একজন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার দিকে তাকালো।

লোকটার বয়স প্রায় আমার মতো। মাথায় কালো টুপি, পরনে কালো জামা, আর একটা সাদা টাই।

তার স্থূলকায় সঙ্গীকে দেখে মেক্সিকোর অধিবাসী বলেই মনে হলো, তার গায়ের রঙ রোদে পোড়া–তামাটে। ঠোঁটের ওপর লম্বা টানা গোঁফ।

কেন জানিনা লোক দুটোকে দেখে মনে মনে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করলাম। ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে উঠলো, সাবধান-সাবধান!

এতদিন পরে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন সত্যিই বড় নির্জন এবং এখানে আমি সম্পূর্ণ একা!

মোটা লোকটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছিলো। কিন্তু তার সঙ্গী গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলো। হয়তো দেখলো আমি ছাড়া আর কেউ এখানে আছে কিনা। পাম্পের গা থেকে তেল দেবার পাইপটা নিলাম, ক লিটার দেবো?

মোটা নোকটা নির্বিকার সুরে জবাব দিলোদশ লিটার।

ট্যাঙ্কে তেল ঢালতে ঢালতে সাদা টাই পরা লোকটার দিকে আড়চোখে তাকালাম। সে তখন গাড়ি ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক চাইছে, যেন কার খোঁজ করছে।

হঠাৎ আমার সন্দেহ হলো এই লোক দুটো হয়ত রেস্তোরাঁর ক্যাশ লুঠ করতে এসেছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই অন্য একটা চিন্তা আমার মনে এলো। যদি ওরা বাংলোয় গিয়ে সিন্দুকটা খুঁজে পায়।

সাদা টাইপরা লোকটা কোট থেকে একটা পিন খুলে নিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগলো। অনুভব করলাম ওর ক্ষুদে ক্ষুদে চোখজোড়া আমার ওপরেই নিবদ্ধ। মনে মনে ভয় পেলাম।

কি হে, তুমি এখানকার মালিক নাকি? হালকা সুরে আচমকা প্রশ্ন করলো সাদা টাই পরা লোকটি, একা থাকে না বউ ছেলেমেয়ে আছে?

আমি এখানে চাকরি করি। পাম্পের মিটারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে জবাব দিলাম, মালিক এবং তার একজন কর্মচারী একটু বাইরে গেছেন। এখনি এসে পড়বেন। ওঁদের আসার সময় অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে।

আমি তেল দেওয়া শেষ করে বালতি থেকে ভিজে স্পঞ্জটা তুলে নিলাম। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন মুছতে লাগলাম।

লোকটা চুপচাপ পিন দিয়ে মাড়ি খোঁচাতে লাগলো।

আমি কাজ করতে থাকলেও আমার দৃষ্টি কিন্তু সবসময় লোক দুটোর গতিবিধির দিকে।

লোকদুটো আমার কাছে জানতে চাইলে যে খাওয়ার মতো কি কি আছে?

এতো রাতে তো স্যান্ডউইচ ছাড়া কিছুই নেই। আড়চোখে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট অর্থাৎ লোলাদের ফিরতে এখনো ঘণ্টা আড়াই বাকি। সুতরাং এ লোকদুটোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। উপায়হীন হয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। খাবার ঘরে ঢুকে ওরা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল।

মোটা লোকটা আমাকে অতিক্রম করে কাউন্টার পার হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। রান্নাঘরের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি মারলো। কিন্তু একটু পরে ফিরে এসে সাদাটাইকে উদ্দেশ্য – করে মাথা নেড়ে জানালো, রান্নাঘরে কেউ নেই।

ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝলাম, আমি বিপদে পড়েছি।

সাদা টাই পায়ে পায়ে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলো। টেলিফোন ডায়ালের ওপর আঙুলের টোকা মারলো।

লোকটা টেলিফোনের রিসিভারটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলো। রিসিভারটা তার ছিঁড়ে দেওয়াল থেকে আলগা হয়ে বেরিয়ে এলো। সাদা টাই সরীসৃপের মতো স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের ভাব লক্ষ্য করতে লাগলো। যাও ফ্রায়েড চিকেনের ব্যবস্থা করোগিয়ে। সল, তুমি ওর সঙ্গে যাও–ওর দিকে নজর রাখো।

রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। কানে এলো অনুসরণরত সলের গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। ফ্রাইং প্যানে মুরগী চাপিয়ে সলকে প্রশ্ন করলাম, কি ব্যাপার–তোমরা এখানে কি চাও?

ভয় পেয়োনা, দোস্ত।সল এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর বসলো।ওর পাঁচ আঙুল রিভলবারের বাঁটের গায়ে খেলে বেড়াতে লাগলো। চুপচাপ কাজ করে যাও।

আমার বুকের কাপুনি হঠাৎ বেড়ে গেলো ঠোঁট শুকিয়ে আসতে লাগলো।

এমন সময় সাদা টাই রান্নাঘরে এসে ঢুকলো। ওর হাতে একপ্লেট স্যান্ডউইচ। সম্ভবতঃ খাবার ঘরের আলমারি থেকে তুলে নিয়েছে।

সাদা টাইয়ের মুখ স্যান্ডউইচে ঠাসা-খোকার দিকে লক্ষ্য রেখো। দেখো যেন উল্টোপাল্টা কিছু করেনা বসে। আমি একবার চারপাশটা ঘুরে দেখে আসি। কথা শেষ করে সাদা-টাই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

সল প্লেট থেকে একজোড়া স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলো,এডি এমনিতে খুব ভালো লোক। তবে রিভলবারের ট্রিগার দেখলেই ওর ভীষণ টিপতে ইচ্ছা করে। সুতরাং ওর সঙ্গে বুঝেশুনে ব্যবহার কোরো নয়তো

মনে মনে ভাবলাম সলকে কায়দা করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। ওর ওই থলথলে চেহারা নিয়ে ও আমার সঙ্গে যুঝে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। সুতরাং একবার যদি ওকে কাবু করে ফেলতে পারি তবে এডির সঙ্গে আমার লড়াই হবে সমানে সমানে।

ভেবে দেখলাম, যদি সাহস করে সল আর এডির মোকাবিলা করতে পারি তবে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীরয় ও লোলা ফিরে আসার আগেই সিন্দুকের টাকাটা সরিয়ে ফেলতে পারবো। সল হঠাৎ প্রশ্ন করলো, ক্যাশে টাকা-পয়সা কি রকম আছে?

আজ বিকেলেই ব্যাঙ্কে সব টাকা জমা দেওয়া হয়ে গেছে।

দুটো খালি প্লেট নিয়ে টেবিলে রাখলাম। উত্তেজনায় শাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠলো। এই মোটাটাকে ঢিট করতে হলে এটাই উপযুক্ত সময়।

–শোন ভায়া আমাদের মালের দরকার। চট্‌পট ছাড়ার ব্যবস্থা করো। এডির সঙ্গে প্যাঁচ খেলার চেষ্টা করলে তার ফল ভালো হবে না।

সল ধীরেসুস্থে টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো।শিকারীর চোখেআমাকে লক্ষ্য করতে লাগলো। আমি আর দেরী না করে ফ্রাইং প্যানের গরম মুরগীগুলো সজোরে ছুঁড়ে দিলাম ওর মুখে। এক বিকট চীৎকার করে সল টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। গরম তেল ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। ভাজা মুরগীর কিছু অংশ ওর টুপির ওপর, আর বাকীটা ওর কোটের গায়ে লেগে মেঝেতে ছিটকে পড়লো।

সল একহাতে মুখ চাপা দিয়ে অন্য হাতে কোমর থেকে রিভলবারটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। আর দেরী না করে ফ্রাইং প্যানটা ঘুরিয়ে সপাটে বসিয়ে দিলাম ওর মুখে। সেই আঘাতে সল আরো কয়েক পা পিছিয়ে কোনোরকমে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। ওর এক হাত তখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে ৪৫ রিভলবারের বাট।

ফ্রাইং প্যানের আর এক আঘাতেই সল মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা চাপা গোঙানি।

সলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ওর পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে বিনা দ্বিধায় ৪৫-এর বাঁট দিয়ে সজোরে ওর মাথায় আঘাত করলাম।

এবার ও চোখ উল্টে, হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়লো। ওর বন্দুকটা শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

হঠাৎ খাবার ঘরের দরজা খোলার মৃদু শব্দ হলো। আমি আর সময় নষ্ট না করে বিদ্যুৎবেগে ছুটলাম আলোর সুইচ লক্ষ্য করে। সুইচ অফ করতেই একরাশ অন্ধকারে ভরে গেলো ছোট্ট রান্নাঘরটা। বুঝলাম এডি যদিও পেশাদার খুনে তবুও আশার কথা আমি নিরস্ত্র নই।

সুতরাং রিভলবার বাগিয়ে ধরে অন্ধকার রান্নাঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে রইলাম।

.

১৩.

সল!

অন্ধকারে ভেসে এলো এডির সতর্ক ফিসফিসে কণ্ঠস্বর, খুব সাবধানে হাল্কা পায়ে রান্নাঘরের খিড়কি দরজার কাছে গেলাম। আমার যেটুকু আশা ভরসা তা ঐ ৪৫ রিভলবারটার জন্য। যদিও জীবনে কোনদিন আমি পিস্তল ব্যবহার করিনি।

এমনু সময় খাবার ঘরের আলোটা হঠাৎ নিভে গেলো। কানে এলো কাঠের পাটাতনে পা ফেলার খসখস শব্দ।

খিড়কির দরজায় হাত রেখে ধীরে ধীরে চাপ দিলাম।

দরজা খুলতেই কানে এলো সলের চাপা গোঙানি, এবং সঙ্গে ওর নড়াচড়ার শব্দ। নাঃ সলের মাথাটা দেখছি লোহার তৈরী। ভেবেছিলাম, অন্ততঃ ঘণ্টাখানেক ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে; আর সেই সময়ে এডির সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়া শেষ হবে। কিন্তু এখন দেখছি সমূহ বিপদ।

খিড়কি দরজা পুরোটা খুলতেই অনুভব করলাম মরুভূমির উত্তপ্ত বাতাসের ঝাঁপটা। ভেবে দেখলাম বাইরে বের হতে পারলে এডির সঙ্গে মোকাবিলা করতে আমার অনেক সুবিধা হবে। সেই কারণে ৪৫ টা রান্নাঘরের দরজার দিকে কোনোরকমে তাক করে পায়ে পায়ে পেছোতে লাগলাম।

হঠাৎ চোখে পড়লো বিদ্যুৎ ঝলকের মতো নীল আগুনের রেখা–আর তার পরমুহূর্তেই রিভলবারের কান ফাটানো বীভৎস শব্দ। একটা গরম সীসের টুকরো আমার রগ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর ঘেমে উঠলো।

এক লাফে তিনটে সিঁড়ি পার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বালির ওপর। মুহূর্তের মধ্যে আত্মগোপন করলাম অন্ধকারের মধ্যে

এডির লক্ষ্য যে এতোটা নির্ভুল তা আশা করিনি।

চারিদিকের বরফ শীতল নিস্তব্ধতা পরিবেশকে আরো ভয়াবহ করে তুললো। পরিস্থিতি যেন আমাকে বারবার জানিয়ে দিচ্ছে যে আমি একা। এই বিপদের মুহূর্তে কেউ এগিয়ে আসবে না আমাকে সাহায্য করতে। সম্পূর্ণ নিজের ওপরেই আমাকে নির্ভর করতে হবে।

সামনের পাম্পগুলো চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যে ভাবে হোক আমাকে বাংলোয় পৌঁছতে হবে।

 রেস্তোরাঁর দেওয়াল ঘেঁষে পায়ে পায়ে পেছোতে লাগলাম। এমন সময় নরম স্বরে কেউ বলে উঠলো, ওহে খোকা, পিস্তল ফেলে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসো। শুধু শুধু কেন নিজের বিপদ ডেকেআনছে?

অন্ধকারের মধ্যে ঠিক বুঝতে পারলাম না কিন্তু এডির সাদা টাইয়ের ঝিলিক মুহূর্তের জন্য চোখে পড়তেই গুলি করার একটা দুর্দম ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসলো। কিন্তু পরক্ষণেই সে নির্বুদ্ধিতার পরিণতির কথা চিন্তা করে নিরস্ত হলাম।

ভীষণ ভয় পেলেও স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি আমি তখনও হারাইনি। তাই যখন আরো একবার কানে এলো এডির নেশা ধরানো হাল্কা স্বর, আমি যেমন বসে ছিলাম, তেমনি রইলাম। কিন্তু আমার মনে হলো এডির কণ্ঠস্বর যেন আরো অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছে। রুদ্ধশ্বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এডি যদি কোনো রকমে একবার বুঝতে পারে আমি কোথায় লুকিয়ে আছি, তাহলে আমাকে খুন করতে ও এতোটুকু দ্বিধা করবে না।

খুব সাবধানে বালিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। বুকে হেঁটে এগোতে যেতেই পায়ে ঠেকলো একটা পাথরের টুকরো। অতি সাবধানে ওটা তুলে নিয়ে বিপরীত দিক লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলাম। পাথরটা রেস্তোরাঁর দেওয়ালে গিয়ে সশব্দে আঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধানো নীল আলো, আর পিস্তলের বিকট গর্জন

পিস্তলের আলোটা ঝলসে উঠছে ঠিক খিড়কি দরজার কাছ থেকে। কিন্তু আমি রিভলবার তুলতে গিয়েই থমকে গেলাম। কারণ এডি আমাকে গুলি করার পরমুহূর্তেই সিঁড়ির পেছনে বালির ওপর লাফ দিলো। বুঝতে পারলাম এডি সিঁড়ির ধাপের আড়ালে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই সংকটময় মুহূর্তে হঠাৎই এডিকে দেখতে পেলাম।

সন্তর্পণে একটু একটু করে রিভলবার শক্ত করে ধরে এডির ঝাপসা সাদা টাইয়ের ওপর তাক করলাম। অস্থির–ভয়ার্ত আঙুল ট্রিগারের ওপর ক্রমশঃ চেপে বসতে লাগলো

কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে রিভলবার নামিয়ে নিলাম। আর সেটাই হলো আমার চরম নির্বুদ্ধিতা। কারণ রিভলবার নামানোর এই সামান্য নড়াচড়া এডির শিকারী দৃষ্টিবে ফাঁকি দিতে পারলো না।

আগুনের ঝলক আর রিভলবারের গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বুকে অনুভব করলাম এক প্রচণ্ড ধাক্কা। সারা শরীর কেঁপে উঠলো। কিন্তু কোনো যন্ত্রণাই অনুভব করলাম না। শুধু মনে হলো, আমার মস্তিষ্কের ভেতর কেউ যেন একটা সুইচ অফ করে দিয়েছে, আর তারই ফলস্বরূপ নির্বাপিত হয়েছে আমার শক্তির উৎস, শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হয়েছে অকেজো।

বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়তেই অনুভব করলাম উষ্ণ উত্তাপ। রিভলবারটা হাত থেকে খসে বালির ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছুঁচলো জুতোর অগ্রভাগ সপাটে এসে আছড়ে পড়লো আমার পাঁজরে।

মনে হলো একটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কাছে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তার উত্তাপে আমার ভেতরটা পর্যন্ত পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। রক্ত সমুদ্রের বিশাল ঢেউ যেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসতে লাগলো

পরে রয়ের কাছে ঘটনা শুনেছিলাম ওয়েন্টওয়ার্থ থেকে ফিরে এসে ওরা লক্ষ্য করে পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা। তাই দেখে রয়ের মনে কেমন যেন সন্দেহ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বালির ওপর আমাকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। লোলা এবং রয় দুজনে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসে তারপরই আমার জ্ঞান ফিরে আসে।

জ্ঞান ফিরলে দেখি রয় আমার দেহের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। ওর মুখ সাদা, হাত পা থর থর করে কাঁপছে। রয়ের ঠিক পেছনেই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে লোলা। উত্তেজনায় ওর মুখের রেখা কঠিন–চোখের তারায় কৌতূহল।

আমাকে চোখ মেলতে দেখেই লোলা রয়কে পাশ কাটিয়ে ঝুঁকে পড়লো আমার মুখের ওপরকাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলে কি হয়েছিলো, শেট? কে তোমার এ অবস্থা করেছে?

আমার কথা বলার কোনো শক্তি নেই। আমি ভেসে চললাম অন্ধকারের রাজ্যে। একরাশ কালো অন্ধকার যেন উন্মত্ত আক্রোশে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। মনে হলো, এই বোধহয় শেষ অন্ধকার জীবনের ওপিঠ, মৃত্যু। কিন্তু আশ্চর্য, এই মৃত্যুভয় আমার মনে আশঙ্কার পরিবর্তে এনে দিলো এক বিচিত্র প্রশান্তি। চেতনার সীমারেখা পার হতেই যন্ত্রণার রেশ ক্রমশঃ ফিকে হয়ে মিলিয়ে গেলো। জমাট অন্ধকারের বিশাল টুকরো এসে আশ্রয় নিলো দু চোখের পাতায়

কিছুক্ষণ পর চোখ মেলেই দেখি রয় আমার পাশেই বসে আছে। চোখের চিন্তাকুল দৃষ্টি আমার মুখের ওপর নিবদ্ধ। কিন্তু লোলাকে কোথাও দেখলাম না। সম্ভবতঃ ও বাংলোয় ফিরে গেছে। রয় আমাকে প্রশ্ন করলো, এখন কেমন আছিস?

ভালোই।

মনে হলো, এই একটা শব্দ উচ্চারণ করতেই শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়েছে। শরীর দুর্বল হলেও আমার চিন্তাশক্তি কিন্তু আচ্ছন্ন হয়নি। এমন সময় জানলা দিয়ে ভেসে এলো হর্নের তীক্ষ্ণ শব্দ। রয় উঠে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ এক মৃদুশব্দে চমকে চোখ মেলোম। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দেখি, লোলা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে।

শেট, কারা তোমাকে গুলি করেছে?

দুজন লোক; ওদের কাছে রিভলবার ছিল, অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিলাম। অতিকষ্টে চোখ ফিরিয়ে লোলার দিকে তাকালাম। ওকে আর আগের লোলা বলে চেনা যায় না। চোখের কোণে কালি পড়েছে। এই ক দিনে লোলার বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। ওর মুখ যেন কাগজের মতো সাদা।

ওরা কি সিন্দুকের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো?

 বললাম–না।

লোলার ফ্যাকাশে মুখে লোভ উল্কণ্ঠার ছায়া।–কি করে সিন্দুক খুলতে হয় আমাকে বলে দাও শেট, চুপ করে থেকো না।

আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো সেই অন্ধকার; আমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলোসবকিছুর সামনে কে যেন হঠাৎ টেনে দিলো এক কালো পর্দা

জীবন মৃত্যুর অনিশ্চয়তার দোলায় কেটে গেলো তিনটে দিন, সব কিছু ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।

রয় যদি জীবনপণ করে এভাবে আমার সেবা না করতো, তাহলে হয়তো এই তিনটে সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্যও আমার হতো না। এক সেকেন্ডের জন্যেও চোখের পাতা এক করেনি রয়।

রয়ের কাছে শুনেছি মাঝে মাঝে নাকি আমার অবস্থা চরমে উঠেছিল।

প্রায় সাতদিন পর ফিরে পেলাম কথা বলার শক্তি। তখন রয়ের সঙ্গে এডি এবং সলের ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। শুনলাম এডি নাকি ক্যাশবাক্স আর পেট্রল বিক্রির টাকা-সব কিছুই নিয়ে গেছে।

রয় আমাকে বললো তোর কোন ভয় নেই শেট, তুই এবারে ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠবি।

আটদিন আটরাত আমি অসহায়ভাবে বিছানায় পড়েছিলাম। কিন্তু লোলা একবারের জন্যও আমার কাছে আসেনি। জানি না, এই কদিনে রয়ের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একদিন রয় আমার কাছে জানতে চাইলো, শেট, সত্যি করে বলতো জেনসনের আসলে কি হয়েছে?

আমিও মনে মনে ভাবছিলাম যে করেই হোক রয়কে সমস্ত ঘটনা জানানো ভীষণ প্রয়োজনীয়। তাই ওকে সত্যি কথাই বললাম, লোলা কার্লকে খুন করেছে–আর আমি বোকার মতো লোলার কথায় রাজী হয়ে সেই মৃতদেহটা কবর দিয়েছি।

ওকে আরও বললাম, লোলার প্রথম স্বামীর কথা এবং সেই স্বামীকেও লোলা নৃশংশভাবে খুন করেছে। তুই সাবধানে থাকিস, রয়, লোলার রক্তে মিশে আছে খুন করার নেশা। প্রয়োজন হলে তোকেও খুন করতে ওর একটুও হাত কাঁপবে না।

সব শুনে রয়ের চোখে ফিরে এলো নির্বিকার শূন্যদৃষ্টি। রয় কোনো কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো। মনে মনে ভাবলাম, যাক্রয়কে যে আগে থাকতে সাবধান করে দিতে পেরেছি তাতেই আমার সান্ত্বনা।কিন্তু তখনও বুঝিনি, আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে; সাবধান করার আর প্রয়োজন নেই। কারণ পরদিন রাতেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম।

সেদিন রাত প্রায় এগারোটা বাজতেই দেখি, লোলা বাংলোয় ফিরে চলেছে। তার একটু পরেই নিভে গেলো বাংলোর আলো। রাত প্রায় বারোটা নাগাদ রয় রেস্তোরাঁর আলো নিভিয়ে ঘরে আমাকে উঁকি মেরে দেখলো। তারপর শুনতে পেলাম দরজা বন্ধ করার মৃদু শব্দ।বুঝতে পারলাম, রয় ঘর ছেড়ে চলে গেছে।

সব কিছু জেনেশুনেও মনে প্রাণে চাইলাম আমার অনুমান যেন মিথ্যে হয়। রয় সম্বন্ধে আমার ধারণা যেন এই অসুস্থ চিন্তায় কলঙ্কিত না হয়। কিন্তু আমি জানি এ মিথ্যা স্তোক দিয়ে লাভ নেই। কারণ, বাস্তবকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার কেন এ পৃথিবীতে কারোর নেই। জানলা দিয়ে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরেই রয় অন্ধকারে এগিয়ে চলল।

অন্ধকারে শুয়ে নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হতে লাগলো, ঈর্ষার বদলে অনুভব করলাম আতঙ্কের অস্তিত্ব। লোলা একবার যখন রয়কে কজা করেছে তখন ওকে দিয়ে সিন্দুক ভোলাবেই। তারপর ও রয়কে খুন করবে।-না, এ বিষয়ে এতোটুকু সন্দেহ আমার নেই।রয়ের ঘরে আমাকেও লোলার শিকার হতে হবে। তারপর টাকাগুলো জায়গা মতো লুকিয়ে ফেলে খবর দেবে সেই শেরিফকে। লোলার স্বরূপ আমি জানি; ওর আসাধ্য কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।

রাত প্রায় দুটো নাগাদ রয় বাংলোর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। দরজা বন্ধ করে ঘরের দিকে আসতে লাগলো, নিঃশব্দে বসবার ঘরে এসে ঢুকলো রয়। একই সঙ্গে আমিও হাত বাড়ালাম আলোর সুইচের দিকে।

আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ও স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

আমি রয়কে ডাকলাম, আয় এখানে এসে আমার পাশে বস, তোর সঙ্গে জরুরী কথা আছে। রয় ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসলো। লোলা তোকে শেষ পর্যন্ত তাহলে ফাঁদে ফেলেছে?ই, রয় কোনো জবাব দিলোনা। আমি ওকে জানিয়ে দিলাম যে,আমার কথায় যদি তুই সাবধান না হোস তবে তোর কবর তুই নিজেই খুঁড়বি মনে রাখিস। আমি ওকে জেনসনের সিন্দুকের কথা সব কিছুই বলে দিলাম। বললাম, জেনসনের সিন্দুকে এমন একটা জিনিস আছে যেটানাহলে লোলার চলবেনা।আর সেটা পাওয়ার জন্য হেন কাজ নেই যে লোলা করতে রাজীনয়। এমন কি খুন করতেও ওর বিবেকে বাধবে না। এ জিনিসটার জন্যই ও জেনসনকে খুন করেছে। ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়েও সিন্দুক খোলাতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি।আর এখন যেই তোকে হাতের কাছে পেয়েছে, অমনিওরকাজ শুরু হয়ে গেছে। লোলা জানে তুই সিন্দুক খুলতে জানিস; তাই তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করছে। তোকে দিয়ে যে করে থোক সিন্দুক খুলিয়ে ও তোকে খুন করবে।

কথা বলার পরিশ্রমে আমার সারা শরীর ঘেমে উঠলো। বুকের যন্ত্রণায় মনে হলো নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসবে।কিন্তু ওরঅভিব্যক্তিহীনমুখেনিস্পৃহতার মুখোস।শুধু চোখের তারায় ঈষৎকালো ছায়া।অধৈর্য হয়ে ওপ্রশ্নকরলে তোর কিমাথাখারাপহয়ে গেছে?সিন্দুকেকিএমনআছে যে লোলার সেটা না হলে চলবেনা?সিন্দুকে যে এক লাখ ডলার আছে; সে কথা বলার মতো বুদ্ধিভ্রংশ তখনও আমার হয়নি। তাই একটা বিশ্বাসযোগ্য কাল্পনিকগল্প ওকে শুনিয়ে দিলাম।রয় ঘাড়ে হাত বুলিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালো; শেট, তুই, কি এগুলো সব বানিয়ে বলছিস, না সত্যি?

এর এক বর্ণও মিথ্যা নয়, রয়। সেদিন জেনসনকে গুলি করার পর লোলা আমাকেও খুন করতো। কিন্তু ও দ্বিতীয়বার ট্রিগার টেপার আগেই আমি সিন্দুকের দরজাটা বন্ধ করে দিই। ও জানতে আমার সাহায্য ছাড়া ওর পক্ষে সিন্দুক খোলা অসম্ভব; তাই এতোদিন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ও জানে, এখন আর আমার প্রয়োজন নেই, সিন্দুকটা তুই কিছুতেই খুলিস না, রয়–আমার কথা শোন! জেনসন মারা যাবার পর পাঁচটা সপ্তাহ আমরা চুপচাপ, একা একা কাটিয়েছি, তারপর একদিন রাতে লোলা আমার ঘরে এসে উপস্থিত হলো– তারপর যা হবার তাই হলো;ঠিক তের বেলা যেমনটা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, তার আগে সেরকম কোনো চেষ্টাই আমি করিনি।

হাঁফাতে হাঁফাতে কোনো রকমে কথা শেষ করলাম। অনুভব করলাম মেরুদণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গায়ের ঘামের শীতল স্রোত।

রয় আমার অবস্থা বুঝে আমার কাছে এগিয়ে এলো, কি হলো তোর?–নে, চুপচাপ শুয়ে পড়। একে তোর শরীর ভালো নয়, তার ওপর শুধু শুধু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিস।

আমি রয়ের হাত চেপে ধরলাম, যদি তুই সিন্দুকটা খুলিস, তাহলে আমরা কেউই লোলার হাত থেকে রেহাই পাবো না। আমি তোকে বারবার করে বলে রাখছি রয়-সিন্দুক খোলা মানে নিজেদের মৃত্যুকে ডেকে আনা!

আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। কিন্তু তুই মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিস, শেট। লোলা সিন্দুক খোলার ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেনি।

আমি ক্লান্ত দেহে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। অবসাদে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।

আমার কর্তব্য আমি পালন করেছি। রয়কে খোলাখুলি সব বলে দিয়ে সাবধান করে দিয়েছি। এখন বাকীটা ভাগ্যে যা আছে ঘটবে। তবে মনে হয় এবারের যুদ্ধে লোলা পরাজিত হবে। কিন্তু সে আশা কুহকিনী!

সে রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত রয় আমার পাশেই বসে রইলো। পরদিন সকাল দশটায় ঘুম ভাঙলো। নিজেকে বেশ সতেজ বলে মনে হলো। মাথাটা যেন আগের থেকে হালকা ঠেকলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা এখনো আমার হয়নি।

জানলার ধারে শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগলাম বাইরের কর্মচাঞ্চল্য। লোলা আর রয় অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে চলেছে। রেস্তোরাঁ খদ্দেরদের ভিড়ে জমজমাট।

প্রায় রাত দশটার সময় রয় এলো আমার ঘরে, হাতে স্যুপ এর বাটি।

 হঠাৎ রয়ের চোখে কেমন অস্বস্তির ভাব লক্ষ্য করলাম। ও আমাকে বললো, একটু আগে খাবার সময় লোলা সিন্দুকের কথা বলেছে। জিজ্ঞেস করেছে, একটা লরেন্স সিন্দুক আমি খুলতে পারবো কি না!

আমি ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম। লোলা তাহলে তোকে সিন্দুকের কথা বলেছে?

হা। তারপর আমি বললাম যে সিন্দুকটা না দেখা পর্যন্ত আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।

আমার বুকের ভেতর তখন শুরু হয়ে গেছে তুমুল আলোড়ন।

তোকে আবার বলছি রয়, সিন্দুকটা যতোক্ষণ বন্ধ আছে, ততোক্ষণ আমরা নিরাপদ। কিন্তু

জানি তুই কি বলবি। আমাকে হাত তুলে বাধা দিয়ে রয় বললো, এতই যদি তোর ভয় তাহলে জেনসনের সেই রিভলবারটা আমাকে দে না কেন?

আমি বললাম যে রিভলবারটা আমার কাছে আর নেই। ওটা লোলা হাতিয়েছে।

রয় ভীষণভাবে চমকে উঠলো। কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। লোলা আমাকে বলেছে রিভলবারটা ওয়েন্টওয়ার্থের রাস্তায় পুঁতে ফেলেছে; কিন্তু আমার ধারণা অন্যরকম।

রয় চিন্তিত মুখে বসে রইলো। এরপর এ ব্যাপারে আমাদের আর কথা হলো না।

পরবর্তী চারটে দিন সাধারণ ভাবে কেটে গেলো। রয় আমাকে বলেছে, লোলা এখনও ওকে সিন্দুক খোলার কথা বলেনি। জানি না, সত্যি কি মিথ্যা।

আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও বিছানা ছেড়ে নামার শক্তি এখনও আমার হয়নি। তবে সান্তনার কথা, রয় আজকাল আর বাংলোতে শুতে যায় না। আমার মনে হয় রয়ের এই হঠাৎ উদাসীনতার কারণ সম্ভবতঃ লোলার প্রতি ওর প্রচ্ছন্ন আতঙ্ক। অর্থাৎ আমার কথা.ওর মনে রেখাপাত করেছে। লোলা যে দু-দুটো খুন করেছে সে বিষয়ে রয়ের মনে আর কোনো সংশয় নেই।

বেশ কয়েকদিন পরে রাত তিনটের সময় আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি,বাংলোয় বসবার ঘরে আলো জ্বলছে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। বার কয়েক ঢোক গিলে রয়ের নাম ধরে আস্তে আস্তে ডাকলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না। অর্থাৎ রয় এখন বাংলোর বসবার ঘরে; এখানে ওর সঙ্গে রয়েছে লোলা, আর সেই অভিশপ্ত সিন্দুক।

মনে হলো এখনই বিছানা ছেড়ে ছুটে যাই বাংলোয়; কিন্তু জানি, আমার এই অসুস্থ দেহ নিয়ে তা কখনই সম্ভব নয়। সুতরাং চুপচাপ বসবার ঘরের আলোকিত জানলার দিকে চেয়ে গুনতে গেলাম হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।

রাত প্রায় চারটের সময় বাংলোর আলো নিভে গেলো। একটু পরেই রয় বাংলো থেকে বেরিয়ে আমার ঘরের দিকে হেঁটে আসতে লাগলো।

একটু পরে আমার ঘরের দরজা খুলে গেলো। রয়ের গলা ভেসে এলো। –আলো জ্বালাস না। লোলা দেখতে পাবে।

এতোক্ষণ কি করছিলি বাংলোয়?

লোলা আমাকে সিন্দুকটা দেখিয়ে খুলতে বলেছিলো। আমি বললাম এটা খুব পুরোনো আমলের, আমার পক্ষে খোলা সম্ভব নয়।

আমার বুক ভেদ করে বেরিয়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস।

 সিন্দুকে কি আছে, কেন ও সিন্দুক খুলতে চায় সে বিষয়ে তাকে কিছু বলেছে? আমার উদগ্র কৌতুহল আর বাধ মানতে চাইছে না। অশান্ত তরঙ্গের মতোই মনের ভেতরে আছড়ে পড়ছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রয় বললো, সিন্দুকে নাকি প্রচুর টাকা আছে। সিন্দুক খুললে লোলা আমাকেও সে টাকার ভাগ দেবে। রয় আমার কাছে জানতে চাইলো সিন্দুকে সত্যিই টাকা আছে কি না।

এক্ষেত্রে ওকে সত্যি কথা বলা মানে সর্বনাশ ডেকে আনা। সুতরাং বাধ্য হয়েই বললাম, আছে তবে মাত্র তিনশো ডলার। জেনসন দুঃসময়ের সঞ্চয় হিসাবে ঐ টাকা সিন্দুকে জমিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু লোলার লোভ ঐ তিনশো ডলারের জন্য নয়, ও চায় সেই স্বীকারোক্তি লেখা কাগজটা।

কিন্তু ও যে বললো, সিন্দুকে প্রায় এক লাখ ডলার আছে?

রয়ের মুখে বিস্ময়ের ছায়া।

লোলা তোকে মিথ্যে কথা বলেছে, তোকে দিয়ে সিন্দুকটা খোলানোর জন্য ও এই টাকার টোপ ফেলেছে।

রয় চিন্তান্বিত ভাবে জবাব দিলো, তাই যদি হয় তাহলে লোলাকে হতাশ হতে হবে। শেষের দিকে ওর গলার স্বর কঠিন মনে হলো।

পরদিন সকালে শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েছিলাম। দেখছিলাম পাম্পের কাছে কর্মব্যস্ত রয়কে। এমন সময় দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে লোলা। লোলাকে দেখে যেন চেনাই যায়না। মুখের রেখা কঠিন। গাল ভেঙে চোয়ালের হাড় হয়ে উঠেছে প্রকট। চোখের কোলে কালি পড়েছে।

লোলা ওর অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর সবকিছু অচেনা লাগলেও লোলার এই সাপিনী সবুজ চোখ আমার অনেকদিনের চেনা।

কর্কশ কাঁপা গলায় লোলা বলে উঠলো, কি করে, সিন্দুক খুলতে হয় আমাকে বলে দাও।

যদি না বলো তবে এখনি আমি পুলিশে খবর দেবো। আর তোমাকে আবার ফিরে যেতে হবে সেই ফার্নওয়ার্থে।

আমি ভয় না পেয়ে বললাম, তবে আর দেরী করছো কেন? যাও পুলিশে খবর দাও। কিন্তু ঐ একলাখ ডলার এর আশা আর করোনা! তাছাড়া পুলিশকে আমিও বলে দেবো, জেনসনের মৃতদেহ কোথায় লুকোনো আছে। ভেবো না, পুলিশ আমার কথা অবিশ্বাস করবে আর তোমার কথায় সায় দেবে। কারণ তুমিও তো আর ধোয়া তুলসী পাতাটি নও। ওদের যদি জানিয়ে দিই ফ্র্যাঙ্ক ফিনির কথা তাহলে তোমাকে আর রক্ষা পেতে হবে না।

আমার কথাগুলো শুনে লোলা ভীষণভাবে চমকে উঠলো। ওর শরীরটা পলকে যেন পাথর হয়ে গেলো। অন্ধ আতঙ্কের নিবিড় ছায়া কেঁপে উঠলো ওর সবুজ চোখে।

ফ্র্যাঙ্ক সম্বন্ধে তুমি কি জানো? আগুনঝরা চোখে জানতে চাইলো লোলা।

আর কিছু না জানলেও তুমি যে ওকে খুন করেছে তা জানি। মিথ্যা রাগ দেখিয়ে লাভ হবে না লোলা। আমরা দুজনেই এমন ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছি। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, বাকী দিন কটা আমাদের এইভাবেই একসঙ্গে কাটাতে হবে। এছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। সেই সঙ্গে আর একটা কথা মনে রেখো, জেনসনের সিন্দুকটা যেমন আছে তেমনিই থাকবে। রয়কে আমি তোমার সম্বন্ধে সব কথা বলেছি, সাবধান করে দিয়েছি। তাছাড়া সিন্দুক কি করে খুলতে হয়, তাও ও জানে না। সুতরাং শুধু শুধুই তুমি রয়ের পেছনে সময় আর বুদ্ধি খরচা করছে।

অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোলা। তারপর এক সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

এই পরাজয়কে সাময়িক ভাবে মেনে নিলেও লোলা আমাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। আহত নাগিনীর মতোই ও হয়ে উঠেছে প্রতিহিংসাপরায়ণ। সতর্ক না থাকলে যে কোনো মুহূর্তেই লোলা চরম আঘাত হানতে পারে।

মানসিক অস্বস্তি ও উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে এর পরের দুটো দিন নির্বিঘ্নেই কেটে গেল। কিন্তু তৃতীয় দিনের দিন রয় হঠাৎ আমাকে এসে বললো, লোলা ওয়েন্টওয়ার্থে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠলো বিপদের সঙ্কেত। আমি রয়ের দিকে সন্দেহভরা চোখে তাকালাম। তার মানে ও তোকে এখানে একা রেখে যাচ্ছে?

রয় বললো, ও আমাকে সিনেমায় যাবার জন্য বলেছিলো কিন্তু আমি রাজী হইনি। কেননা তোকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে আমার মন চাইলো না।

নিজেকে ছলনা করার চেষ্টা করিস না, রয়। তুই ভালো ভাবেই জানিস, লোলা সিনেমায় যাচ্ছে না। তোর সামনে টোপ ফেলে তোকে সেটা গিলবার একটা সুযোগ দিচ্ছে। লোলা এতোদিনে বুঝে গেছে, এই দুনিয়াতে তোর কাছে টাকাই সব। সুতরাং তোর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ও তোকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে। লোলা জানে, ও সিনেমায় যাওয়া মাত্রই তুই সিন্দুক খুলতে চেষ্টা করবি। তাই ও সিনেমায় যাওয়ার ছল করে কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থাকবে। তারপর হঠাৎ ফিরে এসে খোলা সিন্দুক সমেত তোকে হাতেনাতে ধরে ফেলবে। বুঝতেই পারছিস, তোকে বোকা বানিয়ে কার্যোদ্ধার করার এই একটা মাত্র পথ খোলা আছে।

তোকে তো বলেছি শেট, সিন্দুক আমি খুলছি না।

ভালো কথা, তবে লোলা সিনেমায় যাওয়ার পর যেন কথাটা তোর মনে থাকে।

রাত দশটার পরে লোলা মার্কারির দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিল। আর রয় রেস্তোরাঁর কাছ থেকে ওকে লক্ষ্য করল চাঁদেরআলোয় দেখা গেলো উত্তেজনায় ওর মুখ কঠিন। স্থির দুই চোখে তাকিয়ে আছে মার্কারির মিলিয়ে যাওয়া লাল আলোর দিকে।

রয় রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরের আকাশের দিকে। আসন্ন কোনো দুর্ঘটনার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে রইলাম। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলাম, জীবন পথের শেষ মাইলস্টোনের পাশে পরিশ্রান্ত দেহে অবসন্ন মনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওপারের চির শান্তির জগৎ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

সময় যেন আর কাটতেই চায় না। ঘড়ির কাটা শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলেছে। ঘণ্টাখানেক পর লক্ষ্য করলাম, হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা ট্রাক এদিকে এগিয়ে আসছে। ট্রাকটা ধীরে ধীরে পাম্পের কাছে এসে থামলো।

রয় গাড়ির শব্দ পেয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলো। ট্রাকের ট্যাঙ্কে তেল ঢালতে ঢালতে ড্রাইভারের সঙ্গে দু-একটা কথাও বললো। তারপর তেলের দাম মিটিয়ে লোকটা ট্রাক ছেড়ে দিলো।

বুঝতে পারলাম, এই সেই সংকটময় মুহূর্ত। রয়ের দ্বিধাগ্রস্ত মন এই মুহূর্তেই চরম সিদ্ধান্ত নেবে। হঠাৎ গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।

রয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল।

ওর অসীম অর্থলিপ্সা লোলার প্রলোভনকে এড়াতে পারলো না। বুঝতে পারলাম যে রয় টোপ গিলেছে। ও এখন অভিশপ্ত সিন্দুক খুলতে যাচ্ছে।

বাংলোর দরজার কাছে পৌঁছে রয় একটু থামলো। তারপর পেছনে এক পলক নজর বুলিয়েই বাংলোয় ঢুকে পড়লো। একটু পরে আবার বাইরে বেরিয়ে এলো। বাংলোর দরজায় দাঁড়িয়ে ওয়েন্টওয়ার্থের আঁকাবাঁকা রাস্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে আবার বালোয় গিয়ে ঢুকলো। রয়ের এই অতিরিক্ত সাবধানতায় আমার হাসি পেলো। লোলাকে ও এখনও ঠিকমতো চিনতে পারেনি।রয়ের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতেই লোলা ফিরে আসবে। এব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

একটু পরেই বাংলোর বসবার ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। সিন্দুক খুলতে রয়ের হয়তো মিনিট চারেক লাগবে। তারপরই বুঝতে পারবে যে লোলার কথাই সত্যি। দেখবে সিন্দুকে সাজানো রয়েছে একলাখ ডলার। না, এখন আর ওকে বাধা দেওয়া সম্ভব নয়। আমার যথাসাধ্য আমি করেছি। কিন্তু এই তাসের জুয়ায় শেষ পর্যন্ত আমি লোলার কাছে হেরে গেছি।

আমার অনুমানই ঠিক। একটু পরেই দেখলাম যে চুপিচুপি লোলা বাংলোর দিকে এগিয়ে আসছে।

রয় রেস্তোরাঁয় ঢুকবার পরই ও হয়তো গাড়ি থামিয়েছে পাহাড়ী রাস্তায়। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে অতি সন্তর্পণে ফিরে এসেছে পয়েন্ট অফ নো রিটার্নএ।

লোলার দক্ষতার প্রশংসা করতেই হবে। কারণ আমি সারাক্ষণই চেয়েছিলাম বাইরের রাস্তায়। কিন্তু ওকে ফিরে আসতে বা গাড়ি থামাতে আমিও দেখিনি।

কিন্তু ঐ তো লোলা বেড়ালের মতো নিঃশব্দ চরণে এগিয়ে চলেছে বাংলোর দিকে।

চাঁদের আলোতে আলোকিত বালির উঠোনটুকু পার হওয়ার সময় দেখলাম ওর সবুজ পোশাক। জেনসনকে খুন করার সময় ওর পরনে এই একই পোশাক ছিলো। হয়তো এই সবুজের আড়ালেই লুকিয়ে আছে রয়ের মৃত্যুসংকেত।

শেষ পর্যন্ত তাহলে লোলার ফাঁদে ধরা পড়লো রয়। আমি যেন দেখতে পেলাম খোলা সিন্দুকটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে রয়। ও হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে থরে থরে সাজানো এক লাখ ডলারের দিকে। ঐ অবস্থায় বসবার ঘরে দরজা খোলার শব্দ ওর কানে ঢুকবেনা। এবং লোলা ওকে খুন করবে। এ ব্যাপারে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।

রয় এখনও জানে না মৃত্যু গুঁড়ি মেরে ওর দিকে এগিয়ে চলেছে।

আর সহ্য করতে না পেরে গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসলাম। টলতে টলতে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে, মাথাটা অসম্ভব ভারী ঠেকলো। দরজার হাতলে ভর দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম। বুকের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। মনের মধ্যে তখন একই চিন্তা, যে ভাবে হোক বাংলোয় গিয়ে রয়কে বাঁচাতে হবে।

কোনো রকমে দরজা খুলে বসবার ঘরে এলাম। বুকের কাছটা কেমন যেন উষ্ণ ভিজে ভিজে ঠেকলো। বুঝতে পারলাম পুরোনো ক্ষত থেকে আবার রক্তস্রাব শুরু হয়েছে। কিন্তু সে সব গ্রাহ্য না করে অন্ধকারে পা বাড়ালাম। কিন্তু লোলাকে বাইরে কোথাও দেখলাম না। তাহলে কি?– টলতে টলতে বাংলোর দিকে এগিয়ে চললাম। আমার বুক, পেট তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সর্পিল রেখায় তখন গা বেয়ে এগিয়ে চলেছে রক্তের উষ্ণ ধারা। কিন্তু আমি না থেমে এগিয়ে চললাম।

বাংলোর কাছে পৌঁছতেই কানে এলো রিভলবারের চাপা গম্ভীর শব্দ। হৃৎপিণ্ড ডিগবাজি খেয়ে আছড়ে পড়লো বুকের ভেতর। থর থর করে কাঁপতে লাগলাম। সেই সঙ্গে কানে এলো গুরুভার কিছু পতনের শব্দ। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এক ধাক্কায় খুলে ফেললাম বাংলোর ভেজানো দরজা। টলতে টলতে বসার ঘরে ঢুকলাম

দেখলাম রয় দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। ওর হাতের মুঠোয় জেনসনের ৪৫ রিভলবারটা। সিন্দুকের দরজা হাট করে খোলা। পরিষ্কার নজরে পড়ছে থরে থরে সাজানো নোটের বান্ডিলগুলো। রয়ের পায়ের কাছে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে লোলা।ওর কপালে গভীর ক্ষত। লোলা যে বেঁচে নেই, এ কথাটা বুঝতে আমার দেরী হলো না।

আমি আর রয় পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম। ওর মুখ রক্তহীন, পাণ্ডুর।নাকের ওপরে জমে ওঠা ঘামের ফোঁটা ঘরের উজ্জ্বল আলোয় চক্করছে। আমি কোনোরকমে একটা চেয়ারে গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম। বুকের ব্যাভেজের কাছটায় কেমন যেন একটা কালচে ভাব।

রয় হতবাক হয়ে লোলার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইল।

 রয় আমাদের পালাতে হবে। বুকের রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ দু হাতে চেপে ধরলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িটাকে বাংলোর কাছে নিয়ে আয়! পুলিশ এসে গেলে আমরা বিপদের মধ্যে পড়ে যাবো। নে টাকাগুলো চটপটু গুছিয়ে নে! এখনও পালাবার সময় আছে

রয় আচ্ছন্ন স্বরে বললো, লোলা ঘরে ঢুকতেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর কাছ থেকে রিভলবারটা কেড়ে নিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ওকে খুন করতে চাইনি।

আর দেরী না করে রয় সিন্দুকের কাছে এগিয়ে গিয়ে টেবিলক্লথটা টেনে নিয়ে নোটের বান্ডিলগুলো তার ওপর রাখতে লাগলো।

রয় আমার ব্যান্ডেজটা একটু ঠিক করে দে; আর কোটটা নিয়ে এসে আমার গায়ে জড়িয়ে দে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

রয় আমার মুখের দিকে ফিরে তাকালো। ওর মুখে এমন একটা অদ্ভুত ভাব, যা আমি আগে কোনোদিন দেখিনি।

টাকাগুলো টেবিলক্লথ-এ বেঁধে উঠে দাঁড়ালো। কর্কশ লোভাতুর স্বরে বলে উঠলল, তুই আর কতদিন বাঁচবি বলে তোর মনে হয় শেট? এখন আর তোর কোনো দাম নেই। তুই চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছিস! আর আমি এই টাকা নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারবো, নতুনভাবে বাঁচতে পারবো। গাড়িতে তোকে জায়গা দিতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত, শেট। তুই কি ভাবছিস তোর দাম এই একলাখ ডলারের চেয়েও বেশী?

রয় টাকার পুঁটলিটা আমার চোখের সামনে বারকয়েক ঝাঁকালো। তুই তো সেদিন বলেছিলি, তোকে আমি দু-দুবার বাঁচিয়ে তোর সব ঋণ আমি শোধ করে দিয়েছি, তাই তো? অতএব এবারে আমি চললাম। পরে আবার বলিস না যেন, রয় নিষ্ঠুর অকৃতজ্ঞ।

হঠাৎ আমার উত্তেজিত মন ভীষণ শান্তহয়ে পড়লো। রয়কে একটুও বাধা দেবার চেষ্টা করলাম না। জানলা দিয়ে দেখলাম, মার্কারির হেডলাইট জ্বলে উঠলো। তারপর গাড়িটা মোড় নিয়ে ছুটে চললো পাহাড়ে দিকে। যে পাহাড়ের ওপারেই রয়েছে আমার কল্পনার আশ্রয়স্থল ট্রপিকা ম্প্রিংস।

চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিলাম, মাথাটা ভীষণ ঝিঁঝিম্ করছে। সামনে পড়ে রয়েছে লোলার মৃতদেহ।

শরীরের সব শক্তি মিলিয়ে গিয়ে চোখে নেমে আসছে নিঃসীম অন্ধকার। জানি, আজ নয়– কাল, কেউ না কেউ আসবে এই পয়েন্ট অফ নো রিটার্নএ দেখতেই পাবে এই ঘরের আলো। ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না, লোলাকে আমি খুন করিনি! জেনসনের মৃতদেহ খুঁজে পেলেও ওরা আমাকেই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করবে। রয় ৰা লোলা কাউকেই ওরা সন্দেহ করবে না।

বুকভরা আশা নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় রইলাম। আসুক সেই চির অন্ধকার, আমার কপালে এঁকে দিক মৃত্যুর স্নেহ চুম্বন। সেই হবে আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

হঠাৎ মনের মধ্যে এসে ভীড় করলো হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্মৃতি। জীবনে এই প্রথম মনে পড়লো মায়ের কথা, মনে পড়লো আমাদের ছোট্ট বাড়িটার কথা

কিন্তু রয়ের কথা মনে পড়তেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো। অতীতের স্মৃতির টুকরো ছবিগুলো হঠাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো নিদারুণ বাস্তবের কঠিন আঘাতে। ছেলেবেলার রয় আর আজকের রয়, এই দুয়ের মাঝে বিশাল ব্যবধান-আমার চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করে দিলো। বুকের যন্ত্রণাটা আরো বেড়ে গেলো

–শুনতে পাচ্ছি মৃত্যুর হালকা পদধ্বনি–সে আসছে নিঃশব্দ চরণে–সে আসছে।