০৯. সকালের সোনা রোদ

.

০৯.

সকালের সোনা রোদ সরাসরি চোখে এসে পড়তেই ঘুম ভাঙলো। শরীরে এক বিচিত্র অবসাদ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছটা বেজে কুড়ি মিনিট। লোলা যে কখন চলে গেছে জানিনা, কিন্তু ওর সেন্টের নেশা ধরানো মিষ্টি গন্ধ এখনও বিছানায় মিশে রয়েছে।

বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গেলাম। দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে জামাকাপড় পরে নিলাম। আজ সকালে লোলার মনোভাব কি রকম আছে জানার জন্য আর দেরী না করে রেস্তোরাঁর দিকে পা বাড়ালাম।

রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো কর্মরত লোলাকে। ও কাজ করার সাদা গাউনটা পরে ডিমের ওমলেট করতে ব্যস্ত। পায়ের শব্দে ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, ও হুজুরের ঘুম তাহলে ভেঙেছে! আমি তো ভাবছিলাম, আজ সারাটা দিন বুঝি পড়ে পড়ে ঘুমোবে!

ধীরে ধীরে ওর পেছনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, কাছে টেনে নিলাম, মুখ ডুবিয়ে দিলাম ওর আগুন রঙা চুলের বন্যায়।

লোলা মুখ সরিয়ে নেবার জন্য একটুও ব্যস্ত হলো না। বরং নিজেকে এলিয়ে দিলো আমার গায়ে, কাল রাতের জন্য তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপর রাগ করেছে?

ওকে কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড় করালাম, হেসে বললাম, তাহলে আরো একবার আমাকে রাগ করতে দাও।

এক ঝটকায় ওকে আমার বুকে টেনে নিলাম, ঠোঁট নামিয়ে আনলাম ওর ঠোঁটের ওপর। অনুভব করলাম ওর হৃৎস্পন্দন, ওর যৌবনের উষ্ণস্পর্শ। লোলার আঙুল খেলা করে বেড়াতে লাগলো আমার চুলে

একসময় আমার বাঁধন ছাড়িয়ে ও প্রাতঃরাশের আয়োজন করতে লাগলো। একটা চেয়ারে বসে লক্ষ্য করছিলাম ওকে। কি রকম সুপটু হাতে ও একটার পর একটা কাজ করে চলেছে।

প্রাতঃরাশ তৈরী শেষ করে লোলা খাবারের প্লেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। তারপর আমার মুখোমুখি বসে একটা সিগারেট ধরালো। ওর চোখের দৃষ্টি আজ আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত–সম্পূর্ণ নতুন।

শেট, প্রথম থেকেই তোমার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি। কিন্তু কাল রাতেই আমার মত পরিবর্তন হয়েছে। ভেবে দেখলাম, কার্ল মারা যাবার পর আমরা যেভাবে এতোদিন কাটিয়েছি তার কোনো অর্থ হয় না; বিশেষতঃ–তুমি, যখন একজন সুপুরুষ আর-কোনো মেয়ের জীবনে তোমার মতো পুরুষের সঙ্গলাভনিঃসন্দেহে একটা অভিজ্ঞতা। তুমি বরং তোমার জিনিসপত্র নিয়ে বাংলোয় চলে এসো–এখন আর আলাদা থেকে লাভ কি?

ঠিকই বলেছো–তুমি তো জানো, প্রথমদিন থেকেই তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাছাড়া গত রাতের পর আলাদা থাকা কি আমার সাধ্যে কুলোবে? লোলা মিষ্টি হেসে লজ্জায় মুখ নামালো।

বাইরে থেকে ট্রাকের শব্দ ভেসে এলো। লোলা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

খাওয়া শেষ হতেই আমার মন সক্রিয় হয়ে উঠলো। লোলা অভিনয় করছেনা তো! কে বলতে পারে ক্রুর সাপিনীর এ এক নতুন অভিসন্ধি।

কিন্তু অবচেতন মনে একটা ক্ষীণ আশা উঁকি মারছিলোর হয়তো ও সত্যিই আমাকে ভালোবাসে।

লোলা রান্নাঘরে ফিরে এলো। চোখে মুখে সামান্য পরিশ্রান্ত ভাব, কিন্তু ঠোঁটে মোহিনী হাসি। ও আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, রিক্সের কথা কিছু ভেবেছো? ও তো রাত্রিতে আবার আসবে–

ওর জন্যে আমি একটুও ভাবছি না। কিছু টাকা দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে–ও আর আসবে না। রিক্সকে সামলানোর ভার আমার।

গত কয়েকদিনের অসহ্য আবহাওয়া বর্তমানে অনেকটা সহনীয় হয়ে উঠেছে। মরুভূমির হাওয়ায় আগের মতোই অনুভূত হচ্ছে শীতল আমেজ। পয়েন্ট অফ নো রিটার্নআবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে।

সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও,দুএক মুহূর্তের অবসরে রান্নাঘরে গিয়ে লোলার উষ্ণ সান্নিধ্য অনুভব করছি। প্রতিবারই ওকে আগের চেয়েও বেশী আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে। কাজের মাঝে ওকে ব্যস্ত করার জন্য অনেক কপট অনুযোগ শুনতে হয়েছে। কিন্তু কোনবারই আমাকে ও ফিরিয়ে দেয়নি। তবুও কেন জানিনা, ও যে অভিনয় করছে, এ ধারণাটা আমার মনে আরও বদ্ধমূল হয়েছে।

সন্ধ্যে সাতটার সময় যানবাহন চলাচল একেবারে কমে এলো। সুতরাং একটুও সময় নষ্ট না করে রান্নাঘরে গেলাম।

লোলা আমাকে দেখেই বললো, কি চাই?

কোনো জবাব না দিয়ে ওকে আমার বুকের মধ্যে টেনে নিলাম, ও আমার বাঁধন ছাড়িয়ে মুক্ত, হবার চেষ্টা করলেও পেরে উঠলো না। যেন একটা তুলতুলে নরম পালকে ঢাকা পাখি তার ছোট্ট ডানা ঝটপট করছে।

আমি ওকে জাপটে ধরে রইলাম। দেখি তুমি কেমন করে ছাড়াও আমাদের এই একান্ত ব্যস্ততার মুহূর্তে একটা হাল্কা শব্দ কানে এলো, রান্নাঘরের দরজা খোলার শব্দ।

চমকে উঠে এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে।

আমরা দুজনেই দরজার দিকে তাকিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিক্স। ও হাসছে, কুৎসিত মুখের চেহারা হয়ে উঠেছে। ভয়ালকুটিল।

আমাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই লক্ষ্য করেছে। আমরা জানতাম রিক্স ঠিক এই সময়েই আসবে তবুও জেনেশুনেও কি বোকার মতো কাজ করেছি।

লোলার দিকে চেয়ে দেখলাম ও কিন্তু এতোটুকু বিচলিত হয়নি। মুখ ভাবলেশহীন চোখের ভাষায় এক নীরব প্রশ্ন।

মনের অপরাধবোধ সম্ভবতঃ প্রতিফলিত হয়েছিলো আমার মুখের দর্পণে। কারণ রিক্স কৌতূহলভরে একবার আমাকে দেখলে তারপর লোলার দিকে ফিরে তাকালো, তোমাদের বিরক্ত করার কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিলো না। বলেছিলাম এই সময়ে আসবো তাই এসেছি।

মনে হলো আমার ঠোঁট দুটো কেউ যেন সেলাই করে দিয়েছে।চুপচাপদাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছি। 

লোলা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো, এ সময়ে কি দরকার জর্জ?

রিক্সের ক্ষুদে চোখজোড়া আমাদের মুখের ওপর ঘুরে বেড়াতে লাগলো। আমি যে এ সময়ে এখানে আসবো বলেনি ও? আঙুল দিয়ে আমাকে দেখালো।

লোলা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।

কার্লের কোনো খবর পেয়েছো? আমার পেনসনের কাগজে ওর সই প্রয়োজন।

না এখনও পাইনি। হয়তো ওখানে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তুমি তো এক কাজ করতে পারো; কোনো উকিল বা ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে দিয়ে তোমার কাগজে সই করাতে পারো।

রিক্স বললো, তা সম্ভব নয় কেননা কার্লেরসইনা হলে ওরা টাকা আটকে দেবে। আমার তাহলে চলবে কি করে?

লোলা কাধ বাঁকালো, কি আর করা যাবে, কার্ল তো নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা দিয়ে যায়নি। ও না ফেরা পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

লোলার নির্বিকার দৃষ্টির কাছে রিক্স যেন অস্বস্তি বোধ করলো। যে কথাগুলো বলবে সেগুলো হয়তো মনে মনে একবার ভেবে নিলো।

রিক্স বললো, তাহলে অ্যারিজোনা পুলিশকে লিখে জানানোই ভালো। কারণ পেনসনের কাগজে কার্লের সই না হলে আমার চলবে না।

লোলা জানালো যে, ইচ্ছে হলে তাই করো, তাতে আমার কিছু যাবে আসবে না। তবে কার্ল অ্যারিজোনায় হয়তো না-ও থাকতে পারে। একবার কোলোরাজে যাবে বলেছিলো।–তা এ নিয়ে এতো ঝামেলা করবার কি আছে, জর্জ? আমার মনে হয় কোনো ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে দিলেই সে সই করে দেবে।

–অবশ্য যদি তোমার টাকার খুব প্রয়োজন থাকে তোবলো দু-পাঁচ ডলার না হয় ধারই দেওয়া যাবে।

লোলা এতো সহজ আর স্বাভাবিক ভাবে ধারের প্রসঙ্গ তোলায়, রিক্স সন্দেহ করার কোনো সুযোগ পেলো না।

লোলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো একটু পরেই ফিরে এলো হাতে তিনটে পাঁচ ডলার এর নোট নিয়ে। লোলা তিনটে নোট নিয়ে রিক্সের হাতে গুঁজে দিলো, নাও, ধরো। এই শেষ, এর চেয়ে বেশী আমার কাছ থেকে আর পাবে না, অতএব, শুধু শুধু আর এসো না। তোমাকে টাকা দিয়েছি শুনলে কার্ল হয়তো রাগ করবে।

রিক্স তাড়াতাড়ি টাকাগুলো পকেটে ভরে ফেললল, লোলা, তুমি বড় নির্দয়। ও দাঁত বের করে হাসলো, আমি যে তোমার স্বামী দেবতা নই, সেজন্য নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে করি।

আমি আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই কার্ল ওর ভুল বুঝতে পারবে। তারপর চোখের জলে বুক ভাসাবে, রিক্স শেয়ালের মতো খিক খিক করে হেসে উঠলো।

লোলা চীৎকার করে উঠলো, কার্লের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না।

রিক্স ওর চোখ জোড়া আমার মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিলো। তারপর লোলার দিকে তাকিয়ে বললো, একটু সাবধানে থেকো। কার্ল হয়ত এতখানি বাড়াবাড়ি পছন্দ করবে না।

লোলা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো, একে এক লাথি মেরে বাইরে বের করে দাও, জ্যাক, অনেক সময় ধরে ওর বকবকানি সহ্য করেছি।

আমি রিক্সের দিকে এগিয়ে যেতেই ও ঘুরে দৌড় লাগালো। ওর গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকলাম। তারপর লোলা টেবিলের কাছে গিয়ে আবার কাজে মন দিলো।

লোলা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমায় কিছু ভাবতে হবে না, রিক্সকে আমি সামলাবো।

একদিন দুদিন করে দুসপ্তাহ কেটে গেলো, রিক্স আর এলোনা। কিন্তু রিক্স না এলেও জেনসনের অনুপস্থিতির জন্য প্রায় একশো জন লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে। দু-একজন সামান্য সন্দেহ প্রকাশ করলেও, অ্যারিজোনায় যাওয়ার গল্পটা মোটামুটি সকলেই বিশ্বাস করেছে। কয়েক জন একটু অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থেকেছে।

প্রতিদিন রাতে একটার সময় রেস্তোরাঁ বন্ধ করে আমি আর লোলা শুতে যাই বাংলোয়। মাঝে মধ্যে জেনসনের কথা ভেবে অস্বস্তি হয়। ওরই বিছানায় ওরই বৌকে নিয়ে শুয়ে আছি। কিন্তু লোলার দুনির্বার আকর্ষণের কাছে এসব চিন্তা ধুয়ে মুছে বিলীন হয়ে যায়। ওকে সোহাগে আদরে জড়িয়ে চুমোয় চুমোয় অস্থির করে তুলি। সমস্ত পৃথিবী কেন্দ্রীভূত হয় আমাদের একান্ত অস্তিত্বে

একসময় পূর্ণ পরিতৃপ্তির অবসাদ নিয়ে ক্লান্ত দেহে দুজনে পাশাপাশি শুয়ে থাকি। জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় মায়াময় পরিবেশে আরো একবার মনে পড়ে কবরে শুয়ে থাকা জেনসনের কথা। তখন নিজেকে ভীষণ অপরাধী বলে মনে হয়। কিন্তু লোলাকে কখনই অপরাধ বোধের স্বীকার হতে দেখিনি। বরং ওকে দেখে মনে হয় কার্ল জেনসন নামে ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষটি ওর স্মৃতিভাণ্ডার থেকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে কার্ল-এর অস্তিত্ব ওর কাছে নেহাতই অবাস্তব।

তবে এই দুটো সপ্তাহে একটা জিনিসই উপলব্ধি করেছি যে, লোলাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। যেভাবে আমরা দিনের পর দিন কাটিয়েছি, তাতে হয়তো এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। যদিও লোলাকে দেখার প্রথম দিন থেকেই অনুভব করেছিলাম ওর প্রতি অনিবার্য দুর্দম আকর্ষণ। কিন্তু এও মনে হয়েছিলো–সেটা নিতান্তই নারীর যৌবনের প্রতি পুরুষের যে চিরন্তন লিপ্সা, তারই তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এখন দেখছি তা নয়। কামনা-বাসনার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেও আমাদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এতোটুকুও কমেনি। বরং লোলাকে ঘিরে সুখীসংসারের সুখস্বপ্ন দেখি। তাছাড়া ওকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি আমার সন্দেহ সতর্ক ভাবটা অনিবার্যভাবে ক্রমশই ফিকে হয়ে এসেছে।

কখনো কখনো আচ্ছন্ন মনকে বিবেকের কষাঘাতে সচেতন করেছি। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর যৌবনের সাজানো ডালিতে নিজের সত্তাকে সমর্পণ করেছি।

লোলা কিন্তু একবারের জন্যও টাকার কথা তোলেনি। সিন্দুকের কথা যেন ও একেবারে ভুলেই গেছে। ওর প্রতি আমার বিশ্বাস অনেকটা বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে লোলাও আমাকে সমানভাবে ভালোবাসে।

একদিন এক মিষ্টি সকালে আমরা বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছি জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে পাহাড়ের সারি, ভোরের সিঁদুর রাঙা সূর্য হঠাৎ লোলা প্রশ্ন করলো, আচ্ছা শেট, কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন লোক রাখলে কেমন হয়? আমরা বেশ মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে ওয়েন্টওয়ার্থে বেড়াতে যেতে পারি

প্রস্তাবটা লোভনীয় হলেও বিপদজনক। আলস্যে আড়মোড়া ভেঙে ওর দিকে তাকালাম, তা হয় না লোলা। ওয়েন্টওয়ার্থে আমরা একসঙ্গে বেড়াতে গেলে, লোকে নানা ধরনের কথা বলবে।না, এখনও আমাদের মাস দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। জেনসন যে আর ফিরছে না, সে গল্পটা রটিয়ে দেওয়ার পর লোক রাখার কথা ভাবা যাবে।

লোলা আমার চোখে চোখ রেখে বললো, ঠিক আছে, তোমার কথাই থাক; আর কিছুদিন না হয় অপেক্ষাই করা যাবে। হঠাৎ কি মনে পড়ায় আবার বললো, শেট তুমি আজ ওয়েন্টওয়ার্থে যেতে পারবে। অনেক জিনিসপত্র কেনার আছে।

আচমকা এক সন্দেহের ঝাঁপটায় সচেতন হয়ে উঠলাম আমি। আমাকে সরানোর জন্য এটা কি লোলার কোনো নতুন মতলব? হয়তো আমাকে ওয়েন্টওয়ার্থে পাঠিয়ে ট্রপিকা স্প্রিংসে ফোন করে কোনো সিন্দুক সারানোর লোক ডেকে আনবে–তাকে দিয়ে সিন্দুক খোলাবে তারপর আমি ওয়েন্টওয়ার্থ থেকে ফিরতে ফিরতে টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।

আমি লোলার দিকে ফিরে তাকালাম। ওর মুখে এক নির্বিকার ভাব। আমি ওকে বললাম বোধহয় ঠিক হবে না, লোলা। ওখানে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে–কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে। তার চেয়ে বরং তুমি যাও, আমি এদিকটা দেখাশোনা করবো। সেটাই মনে হয় নিরাপদ হবে।

লোলার মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। ও পায়ে পায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো আমার দিকে তাকিয়ে বললো, শেট সত্যিই কি ওয়েন্টওয়ার্থে যাওয়া তোমার পক্ষে বিপজ্জনক হবে?

–তা জানিনা। তবে, আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছি না।

 –তাহলে না যাওয়াই ভালো। তোমার ভালোমন্দ কিছু একটা হোক তা আমি চাইনা।

–শুনে সুখী হলাম।

–ঠাট্টা নয় শেট, সত্যি বলছি। তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

আমি আনন্দ আর ধরে রাখতে পারলামনা। বিছানা থেকে নেমে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, সত্যি? এতোদিন তোমার মুখ থেকে শুধু এই কথাটাই শুনতে চেয়েছি লোলা।

ও আমার বুকে আঙুল দিয়ে দাগ কাটছিলো, হেসে বললো, হ্যাঁ, সত্যি। জীবনে কোনো পুরুষকে নিয়ে সুখী হবো তা ভাবিনি। কিন্তু তুমি সব কিছু পাল্টে দিয়েছে। এ জায়গায় থাকতে আমার আর ভালো লাগছে না, শেট–আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। সারাটা দিন শুধু কাজ আর কাজ। কোথাও যে একটু বেড়াতে যাবো তারও কোনো পথ নেই।

আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো লোলা, এখানে থাকতে কি আমারও ভালো লাগছে? কিন্তু এখুনি এজায়গাটা ছেড়ে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে, তাছাড়া জায়গাটা যে বিক্রী করে দেবো তারও তো উপায় নেই।

লোলা আমার বাহুর বাঁধন খুলে সরে দাঁড়ালো, তারপর বললো, অনেক কাজ পড়ে আছে। ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, লোলা আমাকে ভালোবাসে, ও নিজের মুখে বলেছে। আজ আমার আনন্দের দিন। আমি এই মুহূর্ত থেকে ওকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। আমি লোলাকে জানিয়ে দিলাম যে ঝামেলা মিটে গেলে আমি ওকে বিয়ে করবো। তখন আর না বললে শুনছি না।

লোলা হেসে বললো, না বলতে আমার বয়ে গেছে। কিন্তু কার্ল যে মৃত সেটা তো প্রমাণ করতে হবে!

সেটা প্রমাণ করতে গেলে বিপদ-আছে। যে কোনো উপায়ে হোক আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কিভাবে, সেটা পরে ভাবা যাবেখন। যদি একবার এখান থেকে পালাতে পারি তবে আর চিন্তা নেই।

–আচ্ছা, ফ্লোরিডায় আমাদের একটা পেট্রলপাম্প খুললে কেমন হয়?

ভালোই হবে। তার মানে সিন্দুকের টাকাগুলো কাজে লাগানো যাবে, কি বলে?

এতোদিন পরে এই প্রথম ও টাকার কথা উচ্চারণ করলো। খুব সহজভাবে কথাটা বললেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকলাম। কিন্তু কোনোরকম অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লো না। আমি ওর কথা সমর্থন করলাম।

আমরা দুজনে আলোচনা করলাম যে, এই জায়গাটা আগে আমাদের বিক্রী করতে হবে, যেভাবেই হোক।

এমন সময় বাইরে ট্রাকের শব্দ পেলাম। বাইরে বেরিয়ে এলাম। আর তারপরই কাজে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে লোলার সঙ্গে কথা বলারই কোনো সুযোগ পেলাম না।

হঠাৎ দেখি অপরূপ সাজে সেজে লোলা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ও আমাকে বলে গেলো যে, ও বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে; দুপুরের দিকে ফিরবে।

আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হাতের কাজ সেরে রেস্তোরাঁয় গেলাম। লোলা টাকার উল্লেখ করায় বেশ খুশীই হয়েছি। ওর সম্বন্ধে যেটুকু অবিশ্বাস আমার মনের মধ্যে ছিলো, সেটা মন থেকে মুছে গেছে। কিন্তু এই পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এর হাত থেকে কি ভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেকথাই বারে বারে ভাবতে লাগলাম। কিন্তু ভাবতে ভাবতে দেখছি সমস্যাটা যেন একে একে জটিল হয়ে উঠছে। একসময় মনে হলো আর ভেবে কোনো লাভ নেই, কেননা এখন আমাদের অবস্থা মাকড়সার জালে আটকানো মাছির মতো। মুক্তির কোনো পথই আমাদের সামনে খোলা নেই।

নিরাপদে থাকতে হলে সারাটা জীবন আমাদের এখানেই কাটাতে হবে।

হঠাৎ গাড়ির শব্দে তাকিয়ে দেখি রিক্স তার ঝরঝরে গাড়ি থেকে নেমে গুমটি ঘরের দিকে আসছে। পেছন পেছন এগিয়ে আসছে ওর কুকুরটা।

এতোদিন পরে রিক্সকে দেখে চমকে উঠলাম। মনে পড়ে গেলো গুমটি ঘরেই পোঁতা রয়েছে জেনসনের দেহ। একমুহূর্ত দেরী না করে ছুটলাম গুমটি ঘরের দিকে। বুকের ভেতর যেন দামামা বাজতে শুরু করেছে।

গিয়ে দেখি গুমটি ঘরে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিক্স মাঝে মাঝে যন্ত্রপাতিগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছে। কুকুরটাও যেন ওর পায়ে পায়ে লেগে রয়েছে। আমাকে দেখেই কুকুরটা কুঁকড়ে গেলো।

রুক্ষস্বরে রিক্স-কে জিজ্ঞেস করলাম তার কি চাই। রিক্স থমকে দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে এক লাথিতে সরিয়ে দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, কার্ল কোনো খবর-টবর দিয়েছে?

না।

 লোলা কোথায় জানতে চাইলে তাকে বললাম যে তিনি ওয়েন্টওয়ার্থ গেছেন।

হঠাৎ দেখি রিক্সের কুকুরটা উৎসুক হয়ে কাজ করবার টেবিলটার দিকে তাকালো। তারপর ছোটো ছোটো পা ফেলে এগিয়ে চললো জেনসনের কবরের দিকে। সীমাহীন আগ্রহে ওখানকার মাটি শুঁকতে লাগলো। মাঝে মাঝে পা দিয়ে আঁচড়াতে চেষ্টা করলো।

বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। রিক্স কুকুরটাকে লক্ষ্য না করেই বললো, আমার কিছু টাকার দরকার। পেনসনের টাকা এখনও পাইনি।

আমার সমস্ত মন তখন পড়ে আছে কুকুরটার দিকে। কুকুরটা তখন মাটি আঁচড়াতে শুরু করেছে।

রিক্স হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে কুকুরটাকে দেখলো। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি কি এখানে কিছু পুঁতেছো?

কেমন যেন শীত শীত করতে লাগলো সারা মুখে ফুটে উঠলো বিন্দু বিন্দু ঘাম– কোনোরকমে মুখে হাত বোলালাম, কিচ্ছু পুঁতিনি!- যাও, যাও, এখন কেটে পড়ো!

আমার কথা কানে না তুলে রিক্স ধীরে ধীরে গর্তটার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ওর শকুন চোখজোড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গর্তটা পর্যবেক্ষণ করছে।

দেখে মনে হচ্ছে গর্তটা আগে কেউ খুঁড়েছে। অধৈর্য হাতের এক ধাক্কায় রিক্স কুকুরটাকে সরিয়ে দিলো, আপন মনেই বলে উঠলো কার্ল হয়তো ওর জমানো টাকা এখানেই লুকিয়ে রেখেছে।

আমার হাত-পা যেন ভয়ে পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চাইলো। রিক্সের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম। আমার মুখের ভাবে রিক্স ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালো।

আমি চীৎকার করে উঠলাম, বেরোও! আর কোনদিন এখানে আসার চেষ্টা করলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেব! ওকে তাড়িয়ে নিয়ে চললাম, গাড়িতে উঠে সোজা কেটে পড়ো।

পেছোতে পেছোতে রিক্স ওর গাড়ির কাছে পৌঁছলো। গাড়ির দরজায় হাত রেখে ও হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো, আড়চোখে ঘৃণাভরা চাউনি নিয়ে তাকালো আমার দিকে, আচ্ছা, তুমি তাহলে সোজা কথার মানুষ নও! ওর গলায় যেন বিষ ঝরে পড়লো, শেষ পর্যন্ত পুলিশেই খবর দিতে হবে দেখছি। ওদের বলবো কার্লের খোঁজ করতে। নয়তো, তুমি আর ঐ বেশ্যাটা যেভাবে গা ঘষাঘষি শুরু করেছে

অন্ধক্রোধে রিক্সের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম, আমার ডান হাতের ঘুষি সপাটে গিয়ে আছড়ে পড়লো ওর চোয়ালে। রিক্স ছিটকে গিয়ে বালির ওপর পড়লো। রিক্স ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো। টলতে টলতে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে বলে গেলো, ও পুলিশে যাচ্ছে।

আমি বুঝতে পারলাম একটা ভীষণ ভুল করে ফেলেছি। রিক্সকে মারা আমার উচিত হয়নি। যাবার সময় রিক্স-এর আগুন ঝরা চোখের দৃষ্টি কিছুতেই ভোলা যাচ্ছিল না।

রিক্স-আতঙ্ক মনের মধ্যে আরো চেপে বসলো। ধীরে ধীরে গুমটি ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। টেবিলটা সরিয়ে মাটি দিয়ে গর্তটা ভরাট করে একগাদা পুরনো লোহালক্কড় এনে ওর ওপরে জমা করলাম। কারণ কুকুরটা আবার এসে জায়গাটা আঁচড়াক, তা আমি চাই না। আধঘণ্টা বাদে কাজ শেষে খাবার ঘরে গেলাম।

রিক্স যে এবার পুলিশে যাবে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কি করবো ভেবে ভেবে কোনো পথ পেলাম না।

হঠাৎ জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি একটা জরাজীর্ণ লিংকন গাড়ি পাম্পের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এলাম।

গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসে থাকা লোকটিকে যেন চেনা চেনা ঠেকলো। সে গাড়ি থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সামনে আসতেই তাকে চিনতে পারলাম। মুহূর্তে স্তব্ধ হলো হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন–কিন্তু পরক্ষণেই ছুটে চললো পাগলা ঘোড়ার মতো উদ্দাম গতিতে

আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমার বন্ধুরয় ট্রেসি।

.

১০.

 আমি ও রয় উভয়ে উভয়কে চিনতে পারলাম। এই হঠাৎ দেখার বিস্ময়কে ওর চোখ যেন মেনে নিতে পারছে না। ওর মুখ রক্তহীন বিবর্ণ।

কিছুক্ষণ পর ওর মুখের বিবর্ণ ভাবটা কেটে গিয়ে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য; ঠোঁটের কোণায় ফিরে এলো সেই অতি পরিচিত হাসি। ও ছুটে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

আমাদের কারোর-ই তখন আর কথা বলার শক্তি নেই। এক প্রচণ্ড আনন্দ-উল্লাসের অনুভূতি যেন কণ্ঠরোধ করলো।

একসময় আমাকে ছেড়ে দিয়ে রয় সোজা হয়ে দাঁড়ালো, শেট। তুই-তুই এখানে? আমি কি ভুল দেখছি?

ঠিক সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম রয়কে আমি কতটা ভালোবাসি। এতেদিনে ওর অনুপস্থিতিতে আমার বুকটা যেন খালি ছিলো। এখন বুঝতে পারছি রয় আমার জীবনে কতখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে। ওকে কাছে পেয়ে সাময়িকভাবে লোলার কথাও ভুলে গেলাম। ওর কাঁধে এক চাপড় মেরে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কপট তিরস্কারের সুরে বললাম, শালা, সিন্দুকের বাচ্চা! কোথায় ছিলি এতোদিন?

রয় অস্পষ্ট স্বরে বললো কিন্তু শেট তুই এখানে কি করছিস?আমি তো ভেবেছিলাম তুই কোনো শহরে কেটে পড়েছিস!

পুলিশও তাই ভাবছে। কথা বলতে বলতে আনন্দে আমার চোখ সজল হয়ে উঠলো। ওর হাত ধরে আমি ওকে রেস্তোরাঁয় টেনে নিয়ে চললাম। খাবার ঘরে ঢুকে কাউন্টারের কাছে দুটো টুল নিয়ে আমরা বসলাম। রয় ঘরটার চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলো। দুটো গেলাসে হুইস্কি আর সোডা মিশিয়ে রয়ের দিকে একটা এগিয়ে দিলাম। অন্যটায় নিজে চুমুক দিয়ে ভাবলাম রয়কে এখনি সব বলাটা ঠিক হবে না। তাই ও যখন জানতে চাইলে আমি এখানে কি করছি। তখন সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে একটা জবাব দিলাম, আমি এখানে চাকরি করছি। তাছাড়া গা-ঢাকা দেবার পক্ষে জায়গাটা বেশ নিরাপদ।

রয় আমার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো, ফার্নওয়ার্থ থেকে তোর পালানোর কথা আমি কাগজে পড়েছি। তোর সাহসের প্রশংসা করি। এই কমাস শুধু তোর কথাই ভেবেছি। কোনোদিন ভাবতেই পারিনি, তোর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে।

ওর দিকে চেয়ে হাসলাম, সেটা আমিও ভাবিনি।

রয় হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে আমার হাত চেপে ধরলো, শেট, তোকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো জানি না। তুই আমার জন্যে যা করেছিস তার তুলনা হয় না। তোকে যখন ওরা ধরলল, আমি তো ভাবলাম তুই বোধহয় আমার কথা বলেই দিবি। কিন্তু না শেট, তুই-ই আমার বন্ধুর মতো । বন্ধু।

সে যাকগে–এখন কি করছিস বল্? আর এখানেই বা কেমন করে এলি?

এখন আমাকে সেলসম্যান হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে, শেট। অর্থাৎ লরেন্স কোম্পানি এখন কোনোরকমে আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। ফ্রাঙ্কলিন থেকে আরম্ভ করে সব বড়কর্তারাই সন্দেহ করছে কুপারের ব্যাপারটায় তোর সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম। আর তার ওপর কে আবার বলে বসেছে পাঁচশো ডলারের দেনায় আমি নাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

একদিন ফ্রাঙ্কলিন আমায় ডেকে বললো, আমার আর সিন্দুক টিক সারানোর দরকার নেই। তার চেয়ে যে সব খদ্দেরের পুরানো লরেন্স সিন্দুক আছে, তাদের ধরে ধরে নতুন সিন্দুক গছানোর কাজটা আমি নাকি ভালোই পিরবো। এবং তাতে নাকি আমার অভিজ্ঞতাও বাড়বে। তারপরেই আমার হাতে খদ্দেরদের নামের ইয়া বড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিলো আর কিছু উপদেশও দিয়ে দিলো।

রয় পকেট থেকে একটা লম্বা কাগজের টুকরো বের করলো–এই তোপয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-মালিক : কার্ল জেনসন।

এখন আমার কাজ হলো মিঃ জেনসনকে পটিয়ে একটা নতুন সিন্দুক গছানো–আচ্ছা, এই জেনসন লোকটা কে, তোর বস?

বাইরে থেকে একটা ক্যাডিলাকের হর্ন কানে আসায় উঠে বাইরে এলাম।

রয়ের কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য রেহাই পেয়ে মনে মনে খুশীই হলাম। ওকেকতোটা কি বলবো না বলবো, সেটা ভাববার কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। ক্যাডিলাক গাড়িটায় তেল ভরতে ভরতে চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম

অনেক চিন্তা ভাবনা করে স্থির করলাম রয়কে সব কিছু বলা ঠিক হবে না। বিশেষ করে জেনসনের খুনের কথা। লোলাই বুঝবে। তার চেয়ে বরং সবাইকে যে গল্পটা বলেছি ওকেও সেটা বলবো। সেটাই নিরাপদ হবে বলে মনে হয়।

কাজ শেষ করে যখন রেস্তোরাঁয় ফিরে এলাম তখন রয় সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করছিলো। আমি গিয়ে ওকে জানিয়ে দিলাম যে, মিঃ জেনসন এখানে নেই : ব্যবসার কাজে অ্যারিজোনা গেছেন। কবে ফিরবেন কিছুই বলে যান নি।

রয় এ কথা শুনে হতাশায় ধপ করে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। তাহলে এতোদূর এসে কোনো লাভ হলো না? তা তুই একবার মিসেস জেনসনকে বলে দেখ না, তিনি হয়তো নতুন সিন্দুক অর্ডার দিতে পারেন ।

আমি ওকে বললাম যে এখানে কোনো আশাই নেই। কেননা মিঃ জেনসনের কথা ছাড়া এখানে কেউ এক পাও চলে না। তোর কপাল খারাপ কি আর করা যাবে।

রয় খুব হতাশ হয়ে পড়লো। রয় বললো যে, সিন্দুকের কাজ ছাড়া তো আর কোনো কাজই আমি জানি না। তাছাড়া বয়সও তো প্রায় পঁয়তিরিশ হলো, এই বয়সে নতুন চাকরি কেই বা দেবে? কথা বলতে বলতে ঘড়ি দেখলাম, একটা বাজে। ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। আমি রয়কে জানালাম কি কি রান্না করেছি। এমন সময় দুজন ট্রাক ড্রাইভার এসে খাবারের অর্ডার দিলো।

কাজ করতে করতে মাঝে মধ্যেই জানলা দিয়ে বাইরে দেখছি, লোলা এলো কিনা। এততক্ষণে তো লোলা ফিরে আসার কথা। কেন এতো দেরী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। হঠাৎ দেখলাম দূরের। বালিয়াড়ির পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে আসছে লোলার মার্কারি।

খাবারের প্লেটটা এনে রয়ের সামনে রাখলাম, মিসেস জেনসন আসছেন। তারপর গলার স্বরকে অপেক্ষাকৃত নীচু করলাম। এখানে আমার নাম শেট কারসন নয়-জ্যাক প্যাটমোর। যেন ভুল না হয়।

রয় সেই ছেলেবেলা থেকে আমাকে শেট নামে ডেকে অভ্যস্ত। তাই জ্যাক প্যাটমোর বললেও, ও হয়তো ভুল করে শেট নামেই আমাকে ডেকে বসবে। আর তা শুনে লোলা যদি অবাক না হয়, তাহলে ও ভাববে লোলা আমার আসল পরিচয় জেনেও আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছে। এবং এতে রয় নির্ঘাত সন্দেহ করে বসবে। হয়তো বুঝতে পারবে যে জেনসনের উধাও হওয়ার পেছনে আমাদের হাত আছে।

এই সমস্ত ভেবেই ওকে ঐ নামটা বললাম।

রয় ঘাড় নেড়ে জানালো, নিশ্চিন্ত থাকুন মিঃ জ্যাক প্যাটমোর। আমার কোনো ভুল হবে না।

লোলা এসে জানালো যে, ওর ফিরতে একটু দেরীহয়ে গেলো। সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা? রোদে একটানা গাড়ি চালানোর ফলে ওর মুখ হয়ে গেছে রক্তাভ।

আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে ওর গালে ছোট্ট করে চুমু খেলাম। বললাম, সব কিছু ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হয় নি। আমি ওকে আরও জানালাম যে আমার এক ছেলেবেলাকার বন্ধু আজ হঠাৎ এখানে এসে হাজির হয়েছে। কার্লের সঙ্গে ওর কিছু ব্যবসার কথাবার্তা ছিলো। ওকে আমি বলেছি যে কার্ল অ্যারিজোনা থেকে মাস দুয়েকের আগে আর ফিরছে না।

লোলা যেন চমকে উঠলো, তোমার বন্ধু? কিন্তু ও যদি পুলিশে তোমার কথা

আমি লোলাকে জানালাম যে, সে ধরনের ভয়ের কোনো কারণ নেই। ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

একসময় খাবার ঘর থেকে কাউন্টারের ওপর অধৈর্যভাবে টোকা মারার শব্দ কানে এলো।

 খাবার ঘরে গিয়ে দেখলাম, কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মোটাসোটা বয়স্ক লোক ও পরনে ফিকে বাদামী রঙের স্যুট। সারা মুখে একটা পরিশ্রান্ত ভাব। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়লো পাম্পের কাছে দাঁড়ানো একটা যাত্রীবাহী বাস। মোটা লোকটির কথামতো যাত্রীরা একে একে বাস থেকে নেমে আসতে লাগলো।

কাউন্টারের কাছে ফিরে আসতে না আসতেই খাবার ঘর খদ্দেরে ভরে গেলো, আরম্ভ হয়ে গেলো কাজ আর কাজ। এর মধ্যেও আবার গোটা কয়েক ট্রাক তেল নেবার জন্য অনবরত হর্ন দিতে লাগলো।

রয়ের তখন খাওয়া-দাওয়া শেষ। ও আমার অবস্থা দেখে আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো, আমি সাহায্য করলে তোর আপত্তি আছে? যদি বলিস তবে বাইরে গিয়ে ট্রাকগুলোতে পেট্রল দিই।

তাহলে তো আমার অনেক সুবিধা হয়। খুচরো পয়সা ভরা থলেটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম, পাম্পের মিটারেই দাম লেখা আছে দেখতে পাবি; কোনো অসুবিধা হবে না। থলেটা নিয়ে ও পাম্পের দিকে চললো।

প্রায় ঘণ্টা দুই পরে কাজের চাপ কিছুটা হাল্কা হয়ে এলো। এতোক্ষণ কাজের ভিড়ের মধ্যে রয়ের কথা মনেই ছিলো না। খেয়াল হতে জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম পাম্পের কাছে এখনও তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। রয় একমনে তাদের উইন্ডস্ক্রীন পরিষ্কার করছে।

লোলা যে কখন রান্নাঘর ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল নেই আমার ও রয়কে একদৃষ্টে দেখতে লাগলো। একসময় আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন করলো, শেট, এ লোকটা কে? তোমার সেই বন্ধু নাকি?

হ্যাঁ, আমার বন্ধু রয় ট্রেসি। কাজের চাপ দেখে নিজে থেকেই আমাকে সাহায্য করতে চাইলো। বেশ ভালোই কাজ করছে কি বলল?

হু–লোলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিলো, যা শুনে চোখ ফেরাতে গিয়েও থমকে গেলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোলাকে দেখতে লাগলাম। ও কিন্তু তখনও জানলা দিয়ে রয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ ওর সবুজ চোখ কোনো এক কুটিল চিন্তায় কুঁচকে উঠলো।.

তোমার বন্ধু কি এখানে কাজ করবে বলেছে শেট? তাহলে ওকে রাখলে কেমন হয়? তুমিই তো বলেছিলে আমাদের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী প্রয়োজন।

ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম আমিও তোমাকে ঠিক এই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম লোলা। রয় আমার ভাইয়ের মতো আর খুবই বিশ্বাসী।

-ওকে তো আগেই বলেছি যে, জেনসন এখানে নেই। এখন জানিয়ে দিলেই হবে, কার্ল অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে কেটে পড়েছে। ও কোনো সন্দেহই করবে না।

কিন্তু রয় কি এই নির্জন জায়গায় থাকতে চাইবে?

লোলার কাঁধে হাত রেখে হাসলাম, তবে একটা কথা বলতে পারি লোলা–তোমার দিকে রয় কখনই হাত বাড়াবেনা। উনিশ বছর বয়সে ওর বউ পালানোর পর থেকে, ও কোনো মেয়েকেই সহ্য করতে পারে না।

ওই রয় আসছে। এলে ওকে জিজ্ঞেস করবে থাকবে কিনা। রয়কে আসতে দেখে চাপা স্বরে লোলা বললো।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রয় খাবার ঘরে এসে ঢুকলো। লোলাকে দেখেই ও থমকে দাঁড়ালো; অবাক। হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। অন্য কেউ লোলার দিকে এভাবে চেয়ে থাকলে হয়তো অস্বস্তি বোধ করতাম। কিন্তু রয়কে যেহেতু আমি চিনি তাই হাসতে হাসতে লোলার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিলাম। রয়, ইনিই মিসেস জেনসন-লোলা, এ আমার বন্ধু রয় ট্রেসি।

লোলা রয়ের দিকে চেয়ে হাসলো, সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।

-ও কিছু নয়, রয় হেসে লোলার হাসি ফিরিয়ে দিলো, সত্যি মিসেস জেনসন, এই জায়গাটা ভারী চমৎকার!

আমি এই সুযোগে রয়কে বললাম, তাহলে এখানে থেকেই যানা। সুযোগ বুঝে রয়কে বললাম, রাস্তার ওপরে একটা ঘর আছে, ওখানে থাকতে পারিস। আর সপ্তাহে চল্লিশ ডলার করে মাইনে পাবি।–কি রে রাজি?

রয় আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে লোলার দিকে তাকালো; মুখের ধূর্ত হাসিটাকে আরও ধূর্ত করলো, আপনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে আর আপত্তি করার কি আছে মিসেস জেনসন?

আমি লোলাকে বললাম, ভালো করে ওর আদর যত্ন করো-সেই স্কুল থেকে ও আমার বন্ধু; শুধু বন্ধু কেন, একেবারে ভাইয়ের মতো।

এমন সময় একটা ফোর্ড স্টেশন ওয়াগন একরাশ ধুলো উড়িয়ে পাম্পের কাছে এসে থামলো আমরা সবাই মিলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

রাত দশটার সময় গাড়ি-ট্রাকের ভিড় কমলে আমরা খেতে বসলাম। ডিনার টেবিলের একদিকে আমি আর লোলা। আমাদের মুখোমুখি টেবিলের অপর দিকে রয় বসেছে। রয়ের উপস্থিতি আমার কাছে কিছুটা অস্বস্তির কারণ হলেও লোলাকে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো নতুন চাকরিতে ঢুকে রয় এর আনন্দ আর ধরে না। সমানে কথা বলে যাচ্ছে।

জায়গাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে শেট! কে ভেবেছিলো বল, এভাবে হুট করে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা লোভনীয় চাকরি পেয়ে যাবো। ঘুরে ঘুরে সিন্দুক বেচার চেয়ে এখানে চাকরি করা অনেক ভালো।

লোলা খেতে খেতে থমকে তাকালো রয়ের দিকে, তুমি বুঝি সিন্দুক কোম্পানিতে চাকরি করতে?

রয় বললো, আপনার কাছে গোপন করে লাভ নেই মিসেস জেনসন, এই সিন্দুকের লাইনে আমাদের চেয়ে অর্থাৎ আমার আর শেটের চেয়ে ভালো কারিগর আর নেই। আমি আর শেট একই দিনে, একই কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলাম। অবশ্য ও আমার চেয়ে অনেক ভালো কারিগর, তবে সিন্দুক খোলার ব্যাপারে ওর চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশী। আর ওকে নিয়ে অসুবিধা হলো, ও একটু বেশী সাধুপুরুষ। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার দিন থেকে আজ পর্যন্ত ও শুধু আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেই গেছে। সব সময় আমি ওকে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি, আর শেষ পর্যন্ত ও-ই আমাকে বাঁচিয়েছে।

রয় হঠাৎ গম্ভীর মুখে বললো, কিন্তু মিঃ জেনসন ফিরে এসে আমাকে দেখলে কি ভাববেন? ও লোলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, মিসেস জেনসন, চাকরীটা স্থায়ী হলে ভালো হয়।

কার্ল ফিরবে বলে আমার মনে হয় না। লোলার বিষণ্ণ স্বর শোনা গেলো। আর যদিও বা ফিরে আসে, তোমাকে দেখলে আনন্দ পাবে। আমি কাউকে এখনও বলিনি। চিঠিতে কার্ল পরিষ্কার করে না লিখলেও আমার মনে হয় ও আর ফিরবে না। অ্যারিজোনায় গিয়ে কার্ল আর একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছে, যাকে ওর আমার চেয়ে অনেক বেশী ভালো লেগেছে। কথা শেষ করে লোলা চুপ করে রইলো।

রয় সব শুনে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করলো, আমি দুঃখিত মিসেস জেনসন

লোলা হেসে বললো, এতে দুঃখিত হওয়ার কি আছে–ও হাত রাখলো আমার হাতে, এখন আমি আর শেট কার্ল যে শেটকে এখানে রেখে গেছে তাতেই আমি খুশী। আর আমি কিছু চাই না।

রয় আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে মাথা নাড়লো, শেট, তোর ভাগ্য সত্যিই অসাধারণ।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, চল্ তোর ঘর দেখিয়ে দিই। রয়কে নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। চাঁদের আলোয় ভেজা বালির রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার ওপারে পৌঁছে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম।

রয় ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একেবারে অবাক হয়ে গেলো। এ যে সাংঘাতিক কাণ্ড দেখছি! টেলিভিশন পর্যন্ত রয়েছে। তারপর ও ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা জেনসনের বাংলোর দিকে তাকালো, তুই কি ওখানে থাকিস?

হ্যাঁ, তাছাড়া আর কোথায় থাকবো?

রয় ওর মালপত্রের ব্যাগটা একটা চেয়ারে নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরালো। রয়কে দেখে মনে হলো, ব্যাপার-স্যাপার দেখে ওর সন্দেহ হচ্ছে। যেভাবে হোক ওকে বিশ্বাস করাতেই হবে, না হলে আসল ব্যাপারটা ও ধরে ফেলবে।

ওর সন্দেহাতুর চোখ আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর একসময় আমাকে বললো, তুই যে ঝামেলায় জড়িয়ে আছিস সেকথা লোলা জানে?

আমি উত্তর দিতে কয়েক মুহূর্ত দেরী করলেও ঠিক করলাম, লোলা যে আমার সম্বন্ধে সবই জানে একথা রয়কে জানাতে কোনো বাধা নেই। হাজার হলেও ও আমার ছেলেবেলাকার বন্ধু। তাই সম্মতি জানিয়ে জবাব দিলাম, হ্যাঁ, বলেছি।

আমার উত্তরে রয় একটুও অবাক হলো না। হয়তো এই উত্তরই ও আশা করেছিলো।

রয় একমনে ওর ব্যাগ খালি করে জিনিসপত্রগুলো বিছানার ওপর ছড়িয়ে রাখতে লাগলো। –এ জায়গাটাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে তুই রাজা হয়ে যাবি।–সপ্তাহে কি রকম আমদানি হয় শেট?

জেনসন মারা যাবার পর থেকে সাপ্তাহিক আয় একেবারে কমে গেছে। কারণ ওর পুরনো লোহালক্কড়ের ব্যবসা থেকেই একটা মোটা টাকা আসতো আর এই লোহালক্কড়ের ব্যাপারে আমি আর লোলা সমান পণ্ডিত। তাই কার্ল মারা যাবার পরই লোহালক্কড়ের ব্যবসা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমানে আমাদের ভরসা রেস্তোরাঁ, পেট্রল এবং গাড়ি মেরামত। কিন্তু হলে কি হবে যা আশা করেছিলাম, আয়পত্তর তার চেয়ে অনেক কম, সপ্তাহে মাত্র শদুয়েক ডলার কোন প্রকারে লাভ হয়। সেটাকাটা আমি আর লোলা ভাগাভাগি করে নিই। জেনসন মারা যাবার পর, ওর সিন্দুকে আমার জমানো টাকা ঠিক যেমন ছিল তেমনই আছে? ওতে আর হাত দিইনি। প্রতি সপ্তাহে আমার ভাগের একশো ডলার ঐ সিন্দুকেই জমিয়ে রাখি।

কিরে শেট, বললি না তো আমদানি কেমন হয়?

রয়ের কথায় আমার চমক ভাঙালো। ভাবনা চিন্তা ছেড়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, তুই যতো ভাবছিস ততো নয়। এই শ দুয়েক ডলার আসে আর কি!

রয় জানালো যে ঠিকমতো কায়দা করতে পারলে, এই ধরনের একটা জায়গাকে কাজে লাগিয়ে মোটা টাকা আমদানি করা যায়।

তুই কি এই নির্জন জায়গায় চিরজীবন পড়ে থাকতে চাস, শেট? ছেলেবেলা থেকেই আমরা সবসময় ভেবেছি কি করে বড়লোক হবো, দুটো পয়সার মুখ দেখবো!–তাই তো বললাম, এ জায়গাটা কাজে লাগাতে পারলে তুই রাজা হয়ে যাবি। রয় এসে আমার মুখোমুখি বসলো।

আমি জানতে চাইলাম কাজটা কি ধরনের?

এই ধর, মেক্সিকো ছেড়ে যারা পালাতে চায়, তাদের হেলিকপ্টারে করে এখানে নিয়ে আসা যায়;–এ জায়গাটা তাদের ভালোই লাগবে। আর আমরাও মাথাপিছু দুশা ডলার করে পাবো।

রয়, তুই যদি মাস দুয়েক ফার্নওয়ার্থে থাকতিস, তবে আর এ-ধরনের কথা বলতিস না। ওকে আমি শান্ত স্বরে বললাম।

রয় মাথার চুলে হাত চালিয়ে নির্লজ্জের মতো হাসলো। কিছুটা অস্বস্তি ভরেই বললো, সে কথা ঠিক শেট। তোর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু বড়লোক হওয়ার আশা আমি ছাড়তে পারবো না। আজ হোক কাল যোক বেশ কিছু টাকা আমার চাই-ই চাই।

আমিও ওকে জানিয়ে দিলাম, বেশ কিছু টাকা যে সে এখান থেকে পাবে না এটা নিশ্চিত।

রয় উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ড্রয়ার খুলে কতকগুলো শার্ট প্যান্ট তাতে রাখলো। তারপর মুখ ফিরিয়ে তাকালো আমার দিকে, শেট, সত্যিই কি তোর আর বড়লোক হওয়ার সাধ নেই?

না, রয়-ফার্নওয়ার্থের দাওয়াই খেয়ে সে ইচ্ছা আমার মিটে গেছে। তুই খেলে তোরও যেতো!

শুনেছি ওরা নাকি কয়েদীদের প্রতি খুব নৃশংস ব্যবহার করে–গোটাকয়েক রুমাল বিছানা থেকে তুলে ও দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুললো। কিন্তু সেগুলো রাখতে গিয়েই তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো রয়, আরে! এটা কি?

ওর কথার সুরে চমকে উঠলাম। অশান্ত হৃৎপিণ্ড যেন ধাক্কা খেলো এক অদৃশ্য কাঁচের দেওয়ালে, কিসের কথা বলছিস?দুরু দুরু বুকে প্রশ্ন করলাম। আমার আশঙ্কা মিথ্যে নয়। রয় ৪৫ বোরের রিভলবারটা ততক্ষণে ড্রয়ার থেকে বের করে ফেলেছে; যে রিভলবারের গুলিতে জেনসন প্রাণ দিয়েছে।

আমার চোখের সামনে যেন গোটা পৃথিবীটা দুলে উঠলো। মাথার প্রতিটি চিন্তার কোষ ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কি উত্তর দেবো কিছুই ঠিক করতে পারলাম না।

আমার মনেও নেই যে সেই ঘটনার পর রিভলবারটা লোলার কাছ থেকে নিয়ে, পরে কখন ঐ ড্রয়ারটায় রেখে দিয়েছিলাম। এতোদিন ধরে ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন কি বলবো ওকে?

হঠাৎ ইচ্ছে হলো একলাফে রয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবারটা কেড়ে নিই, কিন্তু অনেক কষ্টে সে ইচ্ছা দমন করে কোনোরকমে জবাব দিলাম, ও, ওটা? ওটা জেনসনের রিভলবার। ও চলে যাবার পর একদিন ঐ রিভলবারটা পেয়ে এই ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। যতোটা সম্ভব সহজ হবার চেষ্টা করলাম।

রয় নিষ্পলক চোখে রিভলবারটার দিকে তাকিয়ে ছিল। গুলি ভরার সিলিন্ডাউটা ও আঙুল দিয়ে ঘোরালো৷ রিভলবারের নলটা নাকের কাছে এনে শুকলো, খুব সম্প্রতি এটা থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে দেখছি। আত্মগতভাবে শেষ কথাগুলো বলে রয় ওর অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে মারলো আমার চোখে, জানতে চাইলে এই গুলিতে কে মারা গেছে?

বহু কষ্টে ওর চোখে চোখ রাখলাম। অপরাধবোধের ছায়াকে মুখের আয়না থেকে সরিয়ে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, কেউ মারা যায়নি, রয়। জেনসন এটা দিয়ে চিল শিকার করতো। হয়ত গুলি করার পর রিভলবারটা পরিষ্কার করতে ভুলে গেছে।

৪৫ রিভলবার দিয়ে কেউ যে পাখী স্বীকার করে, তা তো জানতাম না!

 রয় রিভলবারটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো, তাহলে জেনসনের টিপ আছে বলতে হবে।

এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে রিভলবারটা তুলে নিয়ে পকেটে রাখলাম, যাকগে অনেক দেরী হয়ে গেলো–আমি চলি।

রয় হঠাৎ প্রশ্ন করলো আজ রাতে কে জাগছে শেট?

আমি। কিন্তু কাল রাতে তোর ডিউটি।

 দরজার দিকে পা বাড়ালাম, হঠাৎ রয় ডাকতে পিছন ফিরে তাকালাম।

কি বলছিস, বল!

৪৫ টা পরিষ্কার করে রাখিস। যে বন্দুকে বারুদের গন্ধ লেগে থাকে, সে বন্দুককে কখনো বিশ্বাস নেই!

ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম, ঠিকই বলেছিস, আচ্ছা-গুড নাইট!

ঘর ছেড়ে বাইরে আসতেই লক্ষ্য করলাম রেস্তোরাঁয় কোনো আলো নেই; কিন্তু বাংলোয় লোলার ঘরে আলো জ্বলছে। সুতরাং বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলাম।

লোলা বিছানায় বসে মোেজা খুলছিলো। পরনে সাদা অন্তর্বাস ও নাইলনের প্যান্টিস।

আমি ঘরে ঢুকতেই ও ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে একবার দেখলো।

লোলা আমাকে বললো, শেট তোমার বন্ধুকে আমার ভালো লেগেছে।

তা ভালো, কারণ, রয় আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে টেবিলের একেবারে ওপরের ড্রয়ারটায় রাখলাম। লোলা আমার দিকে পিছন ফিরে থাকায় কিছু দেখতে পেলো না। ঠিক করলাম, কালই রিভলবারটা পরিষ্কার করে রাখবো।

ড্রয়ার বন্ধ করে লোলাকে বললাম, আমরা তিনজনে এক সঙ্গে থাকলে, দিনগুলো বেশ ভালোই কাটবে। তবে একটা কথা কি জানো, রয় মেয়েদের ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও কৌতূহলী নয়। মাঝে মাঝে ভারী অবাক লাগে, সেই যে একবার উনিশ বছর বয়েসে ওর বউ পালালো-ব্যস,ঐ শেষ! তারপর থেকে রয়কে কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে দেখিনি।

লোলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অবশিষ্ট জামাকাপড় ছেড়ে রাত্রিবাস পরতে লাগলো, শেট পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ নেই, যে মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না–সেটা শুধু নির্ভর করে কি রকম মেয়ে তার ওপর। লোলার কথায় যে একটা ঔদ্ধত্যের সুর লুকিয়ে আছে সেটা

আমার কান এড়ালো না।

লোলা, রয়কে আমি তিরিশ বছর জানি। আজ পর্যন্ত মাত্র একটি মেয়ের প্রতিই ও আকৃষ্ট হয়েছিলো, সে ওর বউ। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই সে সব আকর্ষণ ধুয়ে-মুছে মিলিয়ে গেছে।

লোলা বিছানায় শুয়ে পড়লো, হাই তুলতে তুলতে বললো, তুমি একটা বাজলেই চলে এসো কেমন?

হ্যাঁ, ঝুঁকে পড়ে ওকে চুমু খেলাম। বললাম, চুপ করে ঘুমোও ফিরে এসে তোমাকে আর জাগাবো না।

সেই ভালো আমার ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। তারপর আমার দিকে চেয়ে হেসে বললো, সকালে তোমার কোন অসুবিধা হয় নি তো?

রিক্সের কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। রয়কে নিয়ে আনন্দে এতো মেতেছিলাম যে ব্যাপারটা মনে ছিলো না।

লোলা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

আমি বললাম, রিক্স আজ এসেছিলো। ওর গায়ে হাত তুলতে আমাকে বাধ্য করেছে। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।

লোলা উত্তেজনায় আমার হাত চেপে ধরলো, আমাকে সব খুলে বলল। রিক্স কি করেছিলো?

ওকে সমস্ত কথা বললাম, লোলার সবুজ চোখজোড়া উত্তেজনায় বিস্ফরিত। সারা শরীর চাবুকের মতো টানটান।

লোলা বললো, শেটরিক্স পুলিশে যাবে না। আর গেলেও পুলিশ ওর কথা বিশ্বাস করবে না। ওরা রিক্সকে ভালোভাবেই চেনে। কিন্তু তুমি ওকে মারতে গেলে কেন? যাক্ ও নিয়ে আর চিন্তা করোনা। পুলিশের কাছে গেলে ওরা রিক্সকে সোজাসুজি তাড়িয়ে দেবে।

লোলার কপালে চুমু খেয়ে বললাম, শুয়ে পড়োকাজ সেরে আমি ফিরে আসছি।

আমি বাংলো ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

.

১১.

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ খাবার সময় রয়কে রিক্সের কথা জানালাম। ওর কাছ থেকে সাবধানে থাকিস। যখন তখন হুটহাট করে এখানে ঢুকে পড়ে। এই তো কালই এসেছিলো–একেবারে অসহ্য; কাল তো রাগের মাথায় ব্যাটাকে মারধোর দিয়েছি। তারপর ও বলেছে পুলিশে খবর দেবে।

রয় চমকে মুখ তুলে তাকালো, পুলিশ! তার মানে?

 রিক্স একদিন আমাকে আর লোলাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে। জেনসন যে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে লটকে পড়েছে, সে খবর ও জানে না। তাই এখন ও কার্লকে খুঁজে বের করতে চায় ওর পেনসনের কাগজে কি সব সইয়ের ঝামেলা আছে। তাছাড়া রিক্স আমাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরালো রয়-তাহলে লোলা ওকে বলছে না কেন, জেনসন আর ফিরবে না?

হয়তো সেটা রিক্সকে বলার প্রয়োজন নেই আর বললেও রিক্স সে কথা বিশ্বাস করবে না।

 রয় চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়লো।

আমি রয়কে বললাম, যা বলছিলাম, আমরা যখন থাকবো না, তখন যদি রিক্স এখানে আসে সোজা তাড়িয়ে দিবি। এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যেতে দিবি না বুঝলি?

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, যাকগে–আয়, ঘরটা পরিষ্কার করে ফেলা যাক। প্রত্যেকদিন সকালে লোলাই পরিষ্কার করে; কিন্তু, এখন তুই এসেছিস

রয়ের দিকে চেয়ে হাসলাম তাই লোলা এখনও ঘুমোচ্ছে

খাবার ঘর পরিষ্কার করতে করতে রয়কে জানালাম ফার্নওয়ার্থ থেকে আমার পালানোর ইতিহাস। ঝাট দেওয়া বন্ধ করে রয় একমনে শুনতে লাগলো। ওর মুখ দেখে মনে হলো এই  অবিশ্বাস্য গল্প ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

আমার কথা শেষ হতেই ও আমাকে জাপটে ধরে বললো, তোর সাহস আছে বলতে হবে। কি করে পালালি! একবার ভয়ও করলো না?

আমি বললাম, ফার্নওয়ার্থ থেকে পালানোর জন্যে কুকুর কেন, বাঘের মুখোমুখি হতেও কোনো কয়েদী পিছপা হবে না।

ফার্নওয়ার্থে ফেরার থেকে আমার মৃত্যুও অনেক ভালো বলে আমি মনে করি।

হঠাৎ জানলা দিয়ে বাংলোর দরজায় চোখ পড়তেই লোলাকে দেখলাম ও রেস্তোরাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে সেই চোলি আর একটা খাটো প্যান্ট। মাথায় একরাশ তাম্রাভ চুল একটা সবুজ ফিতে দিয়ে অগোছালো ভাবে বাঁধা।

ওকে দেখামাত্রই কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলাম। কারণ সেদিন বারণ করার পর থেকে লোলা এই পোশাকে আর বাইরে বের হয় না। তাহলে আজ কেন? ও বুঝেছি পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এ যেই একজন অপরিচিত পুরুষের আগমন ঘটেছে অমনি লোলা ওর ভরা যৌবনের পসরা সাজিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আড়চোখে রয়কে দেখলাম। ও কাজ করতে করতে থমকালো, চোখ তুলে তাকালো লোলার দিকে। ও তখন দরজার গায়ে হেলান দিয়ে স্থির চোখে রয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

লোলা আজ যেন আরও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রয়ের চোখের সামনে নিজেকে অনেক বেশী লোভনীয় করে তুলেছে।

কিন্তু রয়ের মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন হলো না। ও শূন্য দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দিলো।

লোলা চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার কাছে পৌঁছে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে রয়কে দেখলো। রয় তখনও সেই একইভাবে কাজ করে চলেছে আর আপন মনেই হালকা সুরে শিস দিচ্ছে। রয় লোলার দিকে পেছন ফিরে থাকায় ওর মুখের ভাব দেখতে পেলো না। কিন্তু লোলা রান্নাঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করতেই ও মুখ ফিরিয়ে একবার রান্নাঘরের দিকে তাকালো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো, শালা রমনীর মনঃ দেবান জানন্তি, কুত মনুষ্যাঃ! কোনদিন কোনো মেয়েকে সন্তুষ্ট হতে দেখলাম না।

আমারই দোষ। হেসে রয়কে বললাম, আমিই তোর কথা ওকে বলেছি। বলেছি যে মেয়েদের সম্বন্ধে তুই এতোটুকু কৌতূহলী নয়। একথা শুনে লোলা তো কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। বলে এ নাকি হতেই পারে না।

রয় হেসে জবাব দিলো এবার বোধহয় বিশ্বাস করবে।

এমন সময় বাইরে থেকে একটা ট্রাকের শব্দ পাওয়া গেলো। রয় বললো, তুই থাক, আমিই যাচ্ছি।

ও বেরিয়ে যেতেই রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

 লোলা মুখ গোমড়া করে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এর মধ্যেই ও কাজ করার গাউনটা পরে ফেলেছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বললো, শেট আজ রাতে আমরা সিনেমায় যাবো। রয় এখানে দেখাশোনা করবে, কোনো অসুবিধা হবে না।

আমি একটু ইতস্ততঃ করে বললাম, আমাদের দুজনের একসঙ্গে ওয়েন্টওয়ার্থে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? লোলা, আমার মনে হয় আরও কিছুদিন আমাদের অপেক্ষা করা ভালো।

লোলার মুখের ভাব কঠিন দেখালো চট করে ঘুরে আমার দিকে তাকালো।

না, বলছিলাম–জেনসন যে অ্যারিজোনায় গিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে ভিড়ে গেছে, সে গল্পটা তো কেউ জানে না–তাই ভাবছিলাম, লোকে আগে গল্পটা শুনুক। তারপর আমরা একসঙ্গে যেখানে-সেখানে ঘুরবো, কারোর কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু তার আগে আমাদের দুজনের

আমার কথা শেষ হতে না হতেই লোলা রাগ করে বলে উঠলো, ওসব বাজে কথা আমি শুনতে চাই না। আজ রাতে আমি সিনেমায় যাবো আর তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।

ঠিক আছে এত করে যখন বলছো,যাবো।বারোটার শো তো, কেউ যে আমাদের দেখে ফেলবে সে সম্ভাবনা কম।

দেখে ফেললেই বা আমাদের তাতে বয়েই গেলো। লোলার কণ্ঠস্বর অধৈর্য।

কিন্তু তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছে। লোলা, কার্লকে আমরা এইখানেই কবর দিয়েছি। যদি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিস এখানে আসে তাহলে

লোলা ব্যাঙ্গের সুরে বললো তার মানে বাকী জীবনটা আমাকে পুলিশের ভয়েই কাটাতে হবে; এই তুমি বলতে চাও?

এমন সময় রয় এসে রান্নাঘরে ঢুকলো।

রয়কে দেখেই লোলা বললো, রয় আমি আর শেট রাতে সিনেমায় যাচ্ছি। তুমি একা সব সামলাতে পারবে তো?

রয় একটু অবাক হলেও মুখে সে কথা প্রকাশ করলো না। বললো যে তার কোনো অসুবিধা হবে না।

লোলা ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার তার কাজে মন দিলো।

রয় আমাকে লক্ষ্য করে বললো, শেট এক মিনিট একটু বাইরে আয়। গাড়িটার সবকটা প্লাগই খারাপ হয়ে গেছে। একটু দেখ, ঠিক করতে পারিস কিনা। আমি ওকে বললাম, এবারে গাড়ির কাজকর্ম একটু আধটু শেখ, না হলে অসুবিধায় পড়তে হবে।

রয় রান্নাঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ওর পেছন পেছন আমিও চললাম। কিন্তু রান্নাঘরের দরজা খুলেই ও দাঁড়িয়ে পড়লো। ব্যাপারটা আচমকা ঘটে যাওয়ায় নিজেকে সামলাবার সময় পেলাম না। সোজা গিয়ে ওর গায়ে ধাক্কা খেলাম।

রয়ের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালাম, আর জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটাকে। গাড়ির আরোহী দুজনের পরনেই কালো স্যুট আর স্টেটসন হ্যাট। দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত মোটাসোটা লোকটি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তার কোটের ওপর বুকের কাছে লাগানো রয়েছে একটা রূপোর তারা। প্রখর সূর্যের আলো সেই তারার গায়ে ঠিকরে পড়ছে।

গাড়ি থেকে নামার সময় লোকটার কোটটা একটু ফাঁক হতেই চোখে পড়লো তার কোমরের বেল্টে আঁটা ৪৫ রিভলবার।

রয় চাপাস্বরে ফিসফিস করে বললো, পুলিশ!

ততক্ষণে আমিও বেশ বুঝতে পেরেছি। মেরুদণ্ড দিয়ে একটা বরফ শীতল স্রোত নেমে গেলো। পুলিশ কেন? তাহলে কি

পাগলের মতো লোলার দিকে ফিরে তাকালাম। অদ্ভুত মনে হলেও এক আশ্চর্য ভয়ার্ত অনুভূতি আমার মনকে ছেয়ে ফেললো। মনে হলো এই আসন্ন বিপদ থেকে একমাত্র লোলাই আমাকে রক্ষা করতে পারে।

যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি লোলার কাছে এগিয়ে গেলাম। লোলা, শেরিফ এখানে আসছে।

লোলা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বললো, কোনো ভয় নেই শেট, শেরিফের সঙ্গে আমিই কথা বলছি। লোলার ব্যবহারে খুব অবাক হয়ে গেলাম। ও এতো শান্ত, সহজ ও নির্বিকারভাবে কথাগুলো বললো যে বিশ্বাসই হতে চায় না।

অবশ্য লোলার থেকে ভয়টা আমারই বেশী কারণ ফার্নওয়ার্থ থেকে আমিই পালিয়ে এসেছি।

আতঙ্কে আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। আমাকে এবংরয়কে পাশ কাটিয়ে লোলা ঘরে গেলো। সঙ্গে সঙ্গেই কানে এলো লোলার অকম্পিত কণ্ঠস্বর, কি ব্যাপার, শেরিফ? হঠাৎ কি মনে করে?

আমি ও রয় দেওয়ালে কান পেতে শুনতে লাগলাম ওদের কণ্ঠস্বর, কথাবার্তা। কানে এলো শেরিফের সুস্পষ্ট ভরাট কণ্ঠস্বর, মিঃ জেনসনকে একটু ডেকে দিন কয়েকটা কথা আছে।

কার্ল তো এখানে নেই, বাইরে গেছে, লোলার স্বর অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিক। কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম শেরিফের মুখোমুখি লোলা দাঁড়িয়ে, ওর সবুজ চোখে শূন্য নিষ্পাপ দৃষ্টি। মনে হলো লোলাকে কায়দা করা এতো সহজ নয়। তবুও কেন জানিনা শেরিফকে দেখার পর থেকে কিছুতেই সহজ হতে পারছি না।

মিঃ জেনসন এখানে নেই? লোলার কথায় শেরিফ যথেষ্ট অবাক হয়েছে বলে মনে হলো, আশ্চর্য ব্যাপার মিঃ জেনসন কোনদিন এই জায়গা ছেড়ে গেছে বলে তো আমার মনে পড়ে না। আচ্ছা কোথায় গেছে বলতে পারেন?

লোলার কথায় ফুটে উঠলো অবহেলার সুর, কি জানি কোথায় গেছে! বলে তো গিয়েছিলো কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি করবে। হয়তো অ্যারিজোনা কিংবা কোলোরাডো আছে–ঠিক বলতে পারবো না। ও তো গিয়ে পর্যন্ত একটা চিঠিও দেয়নি।

কবে ফিরবে কিছু বলে গেছে? একটু পরেই শোনা গেলো।

 লোলার স্পষ্ট শীতল উত্তর, আমার তো মনে হয় কার্ল আর ফিরবে না।

শেরিফ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শেরিফ একটু দ্বিধাগ্রস্ত স্বরেবলছেন, ও তাইনাকি? কিন্তু মিসেস জেনসন, আপনি কি করে বুঝলেন, মিঃ জেনসন আপনাকে

শেরিফকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে লোলা বলে উঠলো কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে, এ ঘটনা তো আজ নতুন নয়। লোলার কণ্ঠস্বর এবার ধারালো হয়ে উঠল কিন্তু এসবে আপনার কি প্রয়োজন বলুন তো, শেরিফ? কার্ল কি করলো না করলো, সে আমি বুঝবো; আপনি এতে নাক গলাচ্ছেন কেন?

 শেরিফের গলার স্বর শোনা গেলো। আমি দুঃখিত, মিসেস জেনসন। মিঃ জেনসন যে আপনার সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করতে পারেন তা আমার মাথায়ও আসেনি।

না, এতে কার্লের খুব একটা দোষ নেই, দোষ আমার। কারণ ওর মতো বয়স্ক লোককে বিয়ে করে আমি খুব ভুল করেছি। বিয়ের পর থেকেই ওর সঙ্গে আমার বনিবনা হতো না। এতদিন যে আমরা কি করে একসঙ্গে কাটালাম ভাবতেই অবাক লাগে–তবে কার্ল আমাকে এ জায়গাটা দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেনা হলে, আমাকে হয়তো না খেয়েই মরতে হতো। কিন্তু কালের সঙ্গে আপনার কি দরকার তা তো বললেন না, শেরিফ! অবশ্য আমাকে বলতে যদি আপনার অসুবিধা না থাকে।

শেরিফ বললেন, আপনার এখানে জ্যাক প্যাটমোর নামে একটা লোক কাজ করে শুনলাম ভয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। চারিদিকে একটা হাতিয়ারের সন্ধানে চোখ বোলালাম, মাংস কাটার ছুরিটা টেবিলের ওপরই পড়ে ছিলো। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ওটা তুলে নিলাম।

রয় আমাকে ছুরিটা তুলতে দেখেই ইশারায় বারণ করলো। দেখলাম, বিপদের আশঙ্কায় ওর মুখ সাদা হয়ে গেছে। আমার মুখের ভাবে ও বোধ হয় বুঝতে পারলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি কিছুতেই ধরা দেবো না। কিন্তু শেরিফের রিভলবারের কথা চিন্তা করেই ও আমাকে নিরস্ত করতে চাইলো, কিন্তু একবারও আমারকথা বুঝলোনা।বুঝতে পারলোনা, ফার্ণওয়ার্থের চেয়ে যে কোনো মৃত্যু আমার কাছে শ্রেয়।

এবার লোলার উত্তর শুনতে পেলাম, প্যাটমোর?হ্যাঁ,ও এখানে কাজ করে। কার্ল যাবার আগে ওকে এখানে চাকরিতে ঢুকিয়ে ছিলো। আর আমার কাজের সাহায্যের জন্যে একজন তোক তো এমনিতেই দরকার, তাই ওকে আর ছাড়াইনি।

ও–আচ্ছা, ওকে একবার ডাকুন তো, ওর সঙ্গে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

তা বেশ তো–দেখুন, ও বোধ হয় গুমটিঘরে রয়েছে লোলার স্বর অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্বাভাবিক, সম্ভবতঃ আমাদের শোনবার জন্যই।রয় নিঃশব্দে আমার কাছে এগিয়ে এলো। ফিসফিস করে বললো, তুই এখানে থাক, আমি দেখছি। মনে রাখিস, জ্যাক প্যাটমোর–শেট নয়।

ও রান্নাঘরের খিড়কি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

হঠাৎ লোলার স্বর শোনা গেলো, রিক্স কি প্যাটমোরের নামে আপনাকে কিছু বলেছে, শেরিফ?

হা–কেন বলুন তো?

কি বলেছে? প্যাটমোর ওকে মেরেছে? কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শেরিফের জবাব কানে এলো-হ্যাঁ,এই প্যাটমোর লোকটা নাকি অকারণেই ওকে মেরেছে। তাছাড়া প্যাটমোরের স্বভাব চরিত্রও খুব

তাহলে আসল কারণটা রিক্স আপনাকে বলেনি দেখছি। প্যাটমোর কেন ওকে মেরেছে জানেন? রিক্স আমাকে বেশ্যা বলেছেবলে। লোলার কণ্ঠে অভিমানের সুর, প্যাটমোরের জায়গায় যদি আপনি হতেন তবে আপনিও রিক্সকে মারতেন, তাই না?

শেরিফ বললেন, আসল কথা কি জানেন, রিক্সের কথা আমি যে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছি, তা নয়–এমন সময় খাবার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম। পরক্ষণেই তোমার নামই জ্যাক  প্যাটমোর?

হা-কি হয়েছে?

দরজার গায়ে কান পেতে একাগ্র চিত্তে শুনতে লাগলাম ওদের কথোপকথন, এরপর শেরিফ রয়কে কি প্রশ্ন করবেন কে জানে।

কিন্তু শেরিফের পক্ষে কেবলমাত্র রিক্সের বর্ণনা শুনে রয়কে চিনে ফেলা অত্যন্ত কঠিন হবে। কারণ বর্তমানে গোঁফ রাখার ফলে, আমার এবং রয়ের চেহারা প্রায় একই রকম দাঁড়িয়েছে। সুতরাং রয়কে প্যাটমোর বলে ভুল করা শেরিফের পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক।

শেরিফ গম্ভীর স্বরে রয়কে প্রশ্ন করলেন, রিক্স বলছিলো,তুমিনাকি কাল ওকে মেরেছো-সত্যি নাকি?

লোলা অত্যন্ত চতুরভাবে রয়কে ঘটনার সূত্র ধরিয়ে দিলো। শেরিফের কথা শেষ হতে না হতেই ও বলে উঠলো, এইমাত্র শেরিফকে বলছিলাম, রিক্স আমাকে বেশ্যা বলে গালাগাল দিয়েছে, বলেই তুমি ওকে মেরেছে!

হ্যাঁ, মেরেছি! রয় হালকা স্বরেই জবাব দিলো, এবং আর একটা কথা আপনাকে বলে রাখি শেরিফ-রিক্স যদি আবার এখানে কোনদিন আসে, তাহলে শুধু যে ওকে মারবো তা নয়, পা দুটো একেবারে ভেঙেই দেবো।

শেরিফ হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন, এখানে চাকরিতে ঢোকার আগে তুমি কোথায় থাকতে, প্যাটমোর!

রয় বেশ ব্যঙ্গের সুরেই উত্তর দিলো, ওকভিল, ক্যালিফোর্নিয়া। শুনুন শেরিফ, আমাদের গ্রামে কোনো ভদ্রঘরের মেয়েকে রিক্সের মতো কোনো ছুঁচো যদি গালাগালি দেয় তবে আমরা তা সহ্য করি না। যদি মনে করেন, আপনি আমার হাতের ছাপ নিতে পারেন

হয়েছে, তোমাকে আর বেশী চালাক সাজতে হবেনা। বিরক্ত স্বরে শেরিফ রয়কে বাধা দিলেন, এ অঞ্চলে কোনো নতুন লোক এলে, তার সম্বন্ধে আমার খবর রাখা প্রয়োজন বলেই জিজ্ঞেস করছি।

 লোলা হঠাৎ অযাচিতভাবে বলে উঠলো লোহালক্কড়ের ব্যবসার মাধ্যমে কার্লের সঙ্গে প্যাটমোরের পরিচয় হয়। তারপর কালই ওকে এখানে নিয়ে আসে।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর শেরিফ উত্তর দিলেন, সবই মানলাম, কিন্তু প্যাটমোর, তুমি একটু সাবধানে থেকো, একটা ঘুষি খরচা করার আগে দশবার ভেবে দেখবে, বুঝলে?

রয় একটু রুক্ষ স্বরে জবাব দিলো, আপনি তাহলে রিক্সকেও বলে দেবেন–কোন কথা বলার আগে যেন একশোবার ভাবে।

ঠিক আছে, রিক্সকে আমি সাবধান করে দেবো।

লোলা বিরক্ত স্বরে বললো, ওকে আরও বলবেন, এদিকে যেন আর না আসে। জর্জ সব সময়েই কেবল টাকার জন্য আমাকে জ্বালাতন করে।

হ্যাঁ, আমি জানি, মিঃ জেনসনও আমাকে অনেকবার এই কথা বলে ছিলেন। রিক্স নাকি টাকার জন্য দিনরাত তাকে জ্বালাতন করে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শেরিফের সহানুভূতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর কানে এলো, মিঃ জেনসন আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন শুনে আমি আন্তরিক দুঃখিত। একটু কাশলেন শেরিফ, আশা করি অল্পদিনের মধ্যেই মিঃ জেনসন তার ভুল বুঝতে পারবেন।

কিন্তু লোলার নিস্পৃহ স্বর শেরিফকে নিরাশ করলো, সে নিয়ে আপনি আর ভেবে কি করবেন। কাল যদি আমাকে ছেড়ে সুখে থাকতে পারে, আমিও পারবো।

সে তো খুব ভালো কথা। কিন্তু শেরিফের কথার সুরে তা মনে হলো না, তবে মিঃ জেনসন যে এ জায়গা ছেড়ে চলে যাবেন ভাবতেই পারিনি–শুনেছি এখানেই নাকি তাঁর জন্ম হয়েছিলো।

এতোক্ষণ ধরে শেরিফের কথা শুনে লোলা বোধ হয় বিরক্ত হয়ে উঠছিলো, তাই শেরিফের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বললো, অনেক দিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হলো, শেরিফ। সময় সুবিধা পেলেই এদিকে চলে আসবেন–

শেরিফও বললেন, আপনার কোনো প্রয়োজন পড়লেই আমাকে খবর দেবেন। মিসেস জেনসন-কোনো দ্বিধা করবেন না।

ধন্যবাদ।

শেরিফ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

এতক্ষণ পরে ভয় ও উত্তেজনা কেটে গিয়ে অনেকটা স্বস্তি পেলাম। একটু পরেই লোলা আর রয় রান্নাঘরে এসে ঢুকলো।

তুই আমাকে বাঁচিয়েছিস। আনন্দে রয়ের হাত চেপে ধরলাম তুই না থাকলে আজ কি যে হোত

তুমি মিছিমিছি ভয় করছিলে, লোলা অধৈর্যভাবে বলে উঠলো; তোমাকে তো বলেছিলাম, শেরিফকে আমিই সামলাবোE

রয় আমার পক্ষ নিয়ে উত্তর দিলো, তা হোক, আমি যদি শেট হতাম, তবে আমিও ভয় পেতাম। তাছাড়া শেটের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিলো।

রয় দরজার দিকে পা বাড়ালো।

আমি ওকে বললাম, সত্যি রয় তোর জন্যই আজ এই বিপদের হাত থেকে

রয় থমকে ঘুরে তাকালো, তুই এমনভাবে বলছিস, যেন তুই আমার জন্য কোনদিন কিছু করিসনি।–আরে শালা, কৃতজ্ঞতা বোধ বলেও তো কিছু একটা আছে।

ও চলে যেতেই লোলার কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওকে লক্ষ্য করলাম, তারপর বললাম, আজ রাতে আমার আর সিনেমায় যাওয়া হবে না, লোলা।

লোলা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে ফিরে তাকালো, তার মানে?

 আমি আজ আর ওয়েন্টওয়ার্থে যাবো না।

কেন?

বুঝতেই তো পারছ। শেরিফ যদি হঠাৎ আমাদের দেখে ফেলেন, তবে? ওর নির্বুদ্ধিতায় আমার ভীষণ রাগ হলো, শেরিফ এখন জানেন রয়ই প্যাটমোর। তাহলে তার সঙ্গে দেখা হলে আমার পরিচয় কি দেবো?

লোলা বললো, ঐ পেটমোটা শেরিফটার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে তুমি ওয়েন্টওয়ার্থে যাবে না? এর কোনো মানে হয়?

তুমি বুঝতে পারছে না–শেরিফের মাথায় যদি একবার ঢোকে, এখানে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, তাহলে বিপর্যয়ের আর কিছু বাকি থাকবে না।

গলার স্বর নীচু করে লোলাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, মনে করো যদি ও জেনসনের দেহ খুঁজে পায়? তখন তুমি কি করবে? পারবে এমন নিশ্চিন্ত থাকতে? আমি জানি তুমি পারবে না। কারণ জেনসনকে তুমিই গুলি করেছে।

তাই বুঝি? তোমার ঐ শেরিফ সেটা প্রমাণ করতে পারবে?

অবাক চোখে লোলার দিকে চেয়ে রইলাম। মনে মনে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করলাম। লোলা বলে কি?

যাক এসব কথা বাদ দাও আমরা দুজনেই যখন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি, তখন দুজনকেই সাবধানে থাকতে হবে। তুমি চাইলেও কোনো ঝুঁকি আর নিতে পারবো না।

লোলা নিস্পৃহ ভাবে বললো, আমি তাহলে একাই যাবো। ওর কথার মধ্যে একটা চাপা অভিমান লক্ষ্য করলাম। মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো। ওর সবুজ চোখ দুটো যেন পাথরে খোদাই করা–বরফের মতো শীতল, নিপ্রাণ।

শেট আজ রাতে বাংলোয় আমি একা থাকতে চাই। তুমি রয়ের ঘরে থেকো।

শোনো লোলা

আমি কি বলেছি, তা আশা করি বুঝতে পেরেছো? তুমি হয়তো ভুলে গেছো, আমিই এ জায়গাটার মালিক–তুমি নও। রয়ের সঙ্গে তোমার যখন এতই বন্ধুত্ব তো যাও–ওর কাছে গিয়ে রাত কাটাও।

লোলার চোখের তারায় অতলান্ত ঘৃণার ছায়া। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বিশ্বাসই হতে চাইলো না, লোলা আমাকে এই কথাগুলো বলছে।

রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। সশব্দে বন্ধ করে দিলাম ঘরের দরজা।

লোলার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতার সেই দিনই শেষ হলো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, রয়ের সদা হাস্যময় উপস্থিতি, আমাকে ভুলিয়ে দিলো এই বিচ্ছেদের কথা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে যখনই বাংলোয় গেছি অনুভব করেছি জেনসনের অশরীরী উপস্থিতি। লোলার মোহময়ী সান্নিধ্য আর তত ভালো লাগেনি। জেনসনের বিছানায় শোওয়ামাত্রই মনে হয়েছে, যেন অনধিকার প্রবেশ করেছি। কিন্তু পরক্ষণেই লোলার উষ্ণ আলিঙ্গনে পারিপার্শ্বিক পৃথিবী লুপ্ত হয়েছে মনের আকাশ থেকে।

তবু রোজ রাতে বাংলোয় ঢুকবার সময় কখনোকখনো মনে হয়েছে ফিরে যাই।সুতরাং লোলার সিদ্ধান্ত একরকম আমাকে খুশিই করলো। জিনিসপত্র সব বাংলো থেকে সরিয়ে রয়ের ঘরে নিয়ে তুললাম। রয় আমার অবস্থা দেখে ঠাট্টা করতে ছাড়লো না।

সারাটা দিন লোলা মুখ গোমড়া করে থাকলো। আমার সঙ্গে একটা কথাও বললো না। বেলা দশটার সময় ও গাড়ি নিয়ে ওয়েন্টওয়ার্থে চলে গেলো। লোলা চলে যাওয়ার পর বাংলো থেকে আমার অবশিষ্ট জিনিসপত্রগুলো নিয়ে এলাম। কাজ করতে করতে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি। ভেবেছি, দু-এক দিনেই লোলা ওর ভুল বুঝতে পারবে–আমার কাছে আবার ফিরে আসবে।

রয় বাইরে একটা গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাংলোয় আমি একাই ছিলাম। হঠাৎ ৪৫ রিভলবারটার কথা মনে পড়ায় ড্রয়ারের কাছে গেলাম। একেবারে ওপরের ড্রয়ারটা খুলতেই চমকে উঠলাম। চোখের সামনে যেন একটা কালো পর্দা নেমে এলো।

মনে মনে ভাবলাম একমাত্র লোলা ছাড়া ওটা কেই বা নেবে! সুতরাং সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। যেন রিভলবারটার ওপরেই নির্ভর করছে আমার জীবনমরণ!

সারা বাংলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ওটার কোনো সন্ধান পেলাম না। রিভলবারটা যেন সম্পূর্ণ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু রিভলবারটায় লোলার কি প্রয়োজন বুঝতে পারলাম না। নিতান্তই উদ্দেশ্যহীন ভাবেই কি ও ৪৫টা সরিয়েছে। বাকি দিনটুকু এই রিভলবারের চিন্তাতেই কেটে গেলো। কাজ করতে করতেও খালি ভেবেছি ৪৫ টার কথা। খুঁজেছি, ওটাকে সরানোর কোনো যুক্তিসঙ্গ ত কারণ–কিন্তু সবই বৃথা। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে লোলার ঘৃণাভরা কুটিল চোখ। মনে হয়েছে, আমাদের অন্তরঙ্গতার দিনগুলো সব মিথ্যে স্বপ্ন। লোলা আমার সঙ্গে অভিনয় করে আমাকে বোকা বানিয়েছে।

রাত একটা পর্যন্ত রয়ের সঙ্গে বাইরেই কাটালাম। কিন্তু লোলার ফিরবার কোনো লক্ষণই দেখা গেলো না। অবশেষে কিছুটা হতাশ হয়েই রয়কে নিয়ে ঘরে ফিরে চললাম।

আমার বিছানা ঠিক জানলার পাশে। রাত প্রায় তিনটের সময় একটা গাড়ির শব্দ কানে আসায় জানলা দিয়ে উঁকি মারলাম। দেখি, লোলার মার্কারি বাইরে বালির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর লোলা বাংলোর দিকে চলেছে। ইচ্ছে হলো এক্ষুনি গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি, রিভলবারটার কথা কিন্তু রাতে আর না গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে লোলা যখন খাবার ঘরে এলো, তখন এগারোটা বাজে। লোলাকে একা পেয়েই জানতে চাইলাম রিভলবারটা কোথায়!

লোলা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, ওটা আমি লুকিয়ে ফেলেছি।

কোথায়?

ওয়েন্টওয়ার্থ যাবার পথে রাস্তায় পুঁতে ফেলেছি। কেন তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে?

কেন? পুঁতে ফেলেছো কেন?

 তোমার তো কারণটা বোঝা উচিত শেট, পুলিশ যদি রিভলবারটা খুঁজে পেতো, তাহলে কি আমাকে ছেড়ে দিতো মনে করেছো? ওরা সহজেই বুঝতে পারতো, ঐ রিভলবারের গুলিতেই কার্ল মারা গেছে তাই না?

লোলার কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত হলেও তবুও কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে। বারে বারে মনে হচ্ছে ও যেন মিথ্যে বলছে। লোলা আমাকে আরো জানালো যে, ও এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে চায়। এবং এখানকার দেখাশোনার ভার ও আমার ওপরে দিয়ে যেতে চায়।

আমি সব শুনে ওকে বললাম, তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছো লোলা, এখানকার প্রতিটি পুলিশ ফাঁড়িতে আমার চেহারার বিবরণ–এমন কি ফটো পর্যন্ত রয়েছে। তুমি চলে গেলে আমার পক্ষে নিরাপদে থাকা অসম্ভব। সুতরাং এ জায়গা ছেড়ে যাওয়া তোমার হবে না।

লোলার চোখ হায়নার মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো, কার্লের সিন্দুক তোমাকে খুলতেই হবে শেটকারণ আমার টাকা আমি চাই। টাকা পেলেই আমি এ সপ্তাহের শেষে পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন ছেড়ে চলে যাবো। দেখা যাক কে আমাকে বাধা দেয়।

আমি ওকে বললাম, ওসবে কোনো লাভ হবে না। এ জায়গা তুমি তিনটে কারণে ত্যাগ করতে পারবে না।

প্রথমতঃ, এখানে সব সময় আমাকে আত্মগোপন করে থাকতে হবে। তুমি যদি চলে যাও তাহলে সবাই মনে করবে রয় একাই এ জায়গা দেখাশোনা করছে। আর তাতে শেরিফ যদি সন্দেহ করে বসে, তবে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। তারপর শেরিফ এসে আমাকে দেখলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে।

দ্বিতীয়তঃ জেনসনের মৃতদেহ আশেপাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ যদি খোঁড়াখুঁড়ি করে মৃতদেহ খুঁজে পায় তবে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তোমাকে জেলে গিয়ে ঘানি ঘোরাতে হবে। কারণ কার্লকে গুলি যখন তুমিই করেছে, তার ফলও তোমাকেই ভোগ করতে হবে। আর তৃতীয়তঃ সিন্দুক আমি খুলছি না–এবং টাকাও তুমি পাবে না। কারণ, টাকা পেয়ে গেলেই তুমি আমার বিপদ ডেকে আনবে। হয়তো পুলিশকে বলবে, জেনসনকে আমিই খুন করেছি। কিন্তু এ কথাটা তুমি যাতে পুলিশকে না বলতে পারো সেদিকে আমি বিশেষ যত্ন নেবো, বুঝেছো?

আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার উত্তরের প্রতিটি শব্দ মিছরির ছুরির মতো লোলার গায়ে কেটে বসেছে। দেখলাম লোলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখে অন্ধকারের ছায়া, মুখে কষ্টকৃত প্রশান্তির ভাব। আমার দিকে তাকিয়ে ও বললো, তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। অধৈর্য হওয়ার মতো ছেলেমানুষ আমি নই। এ জায়গা ছেড়ে আমি চলে যাবোই। আর যখন যাবে তখন তোমার হয়তো দুঃখ হবে তোমার পরিণতির কথা ভেবে। হয়তো মনে হবে, আমাকে এখন যেতে দিলেই তুমি ভালো করতে

তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো লোলা? তবে শোনো রয় যে কার্লের সিন্দুক খুলতে পারবে না, তা নয়। কিন্তু ভুলক্রমেও ওকে দিয়ে সিন্দুক খোলানোর কথা চিন্তা করো না। কারণ, রয় যদি সিন্দুক খুলে দেখে ওতে কি আছে, তবে সমস্ত টাকা ও-ই নিয়ে নেবে। এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। ভেবো না ও তোমার যৌবনের মায়াজালে ধরা দেবে। তা যদি হতো তবে আমি রয়কে এখানে চাকরি দিতাম না। ওকে আমি ছেলেবেলা থেকেই চিনি। মেয়েদের উপস্থিতিই রয়ের কাছে অসহ্য এবং বিরক্তিকর। তুমিও তো কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছো, কোনো লাভ হয়েছে কি? রয়ের জীবনে সবচেয়ে প্রথমে যার স্থান, তা হলো টাকা। সিন্দুক খুলে টাকাগুলো দেখলেই তোমাকে খুন করবে। তারপর সমস্ত টাকা নিয়ে চলে যাবে। ও টাকা তুমি আর কোনোদিন পাবে না। সুতরাং তোমার যদি এতোই টাকার প্রয়োজন থাকে, তবে যাও-রয়কে সিন্দুক খুলতে বল।

 কথা শেষ করে বাইরে পা বাড়ালাম। লোলা তখনও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

বাইরে এসেই রয়-এর সঙ্গে দেখা। মনে মনে ভাবলাম সত্যিই কি রয়কে বিশ্বাস করা চলে! ও যদি এততদিনকার সংযম ভুলে লোলার যৌবনের ফাঁদে পা দেয়। কিন্তু ওর নির্বিকার, কঠোর ভাব আমাকে আশ্বস্ত করলো। মনে হলো রয়কে আমি বিশ্বাস করতে পারি।

আমি রয়কে বললাম, আমার কি মনে হয় জানিস, এবার লোলা হয়তো তোর সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করবে। তোকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম। দেখিস, সাবধানে থাকিস।

এবার মনে হলো, রয়কে সিন্দুকের কথা বলে দিই। কিন্তু মনে হলো রয় যদি একবার জানতে পারে সিন্দুকে কি আছে, তবে ওর পক্ষে স্থির থাকা মুস্কিল হবে। হয়তো সিন্দুক খোলার জন্য আমাকেই চাপ দেবে। আর যাই করি, সিন্দুক আমি খুলছি না।

রয় আপন মনেই মাথা নাড়লো, ওঃ, মেয়েদের পক্ষে সবই সম্ভব।

পর পর তিনটে দিন লোলা একাই কাটালো। আমার সঙ্গে কথাবার্তা একেবারেই বন্ধ করে দিলো। তাতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি, কারণ রয়ই হলো আমার সর্বক্ষণের সাথী।

রোজ রাতে বাইরের উঠোনে আমরা তাস খেলে সময় কাটাতাম। মাঝে মাঝে প্রয়োজন হলে খেলা ছেড়ে উঠে গিয়ে গাড়িতে তেল মোবিল দিয়ে আসতাম।

খেলতে খেলতে ও প্রায় টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করতো,বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো।

আমি ওকে অনেক বোঝাতাম বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন, টাকার লোভ ইত্যাদি ত্যাগ করতে। কিন্তু ওর মাথায় সেই একই চিন্তা ঘুরে বেড়াতে।

সেদিন লক্ষ্য করলাম খেলার প্রতি ওর একেবারেই মন নেই। হঠাৎ ও টেবিলের ওপর তাস ছড়িয়ে দিয়ে বলল, আজ আর খেলবো না খুব ক্লান্ত লাগছে। যাই শুয়ে পড়ি।

আজ রাতে কাজ করবার দায়িত্ব আমার। গাড়ির ভিড় কমলে আমরা এক সঙ্গেই শুতে যাই। কিন্তু আজ এই প্রথম রয় একা শুতে যাচ্ছে।

রয় বিদায় নিয়ে চলে গেলো। চুপচাপ বসে লক্ষ্য করতে লাগলাম। একটু পরেই ওর ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। চোখ ফিরিয়ে দেখি, বাংলোয় লোলার ঘরে তখনও আলো জ্বলছে।

দুটো আলোকিত জানলা আমার কাছে বয়ে নিয়ে এলো এক অনুচ্চারিত ইঙ্গিত। মনে হলো রয় হঠাৎ যেন আমার বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমি এখানে বড় একা।