০১. নৈশ বিভাগের কর্মচারী

কাম ইজি গো ইজি

০১.

আমি লরেন্স সেফস্ কর্পোরেশনের নৈশ বিভাগের একজন কর্মচারী, রাত এগারোটার সময় আমার ছুটি। এখন এগারোটা বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। সবে ভাবছি কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে এবার কেটে পড়বো, হঠাৎ নৈশ টেলিফোনটা বেজে উঠলো। ইচ্ছা না থাকলেও এটা ধরতে হলো কেননা এটা একটা টেপরেকর্ডারে যোগ করা থাকে, ফোন বাজতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয় রেকর্ডিং শুরু হয়ে যায়। এই অদ্ভুত রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা করার কারণ, যাতে কর্মচারীরা কাজে কোনো ফাঁকি দিতে না পারে। অতএব রিসিভার তুলে নিলাম।

দূরাভাষে ঝংকৃত হলো বিরক্ত উদ্ধত কণ্ঠস্বর, কি ব্যাপার ফোন ধরতে এতো দেরী কেন?

আপনি কে কথা বলছেন?

হেনরী কুপার, অ্যাশলি আর্মস থেকে বলছি। খুব তাড়াতাড়ি এক জন লোক আমার এখানে পাঠিয়ে দিতে হবে। কেননা, সিন্দুকটা নিয়ে খুব অসুবিধায় পড়েছি।

এ কথা শুনে আমার মেজাজ একেবারে খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আজ রাতে জেনিকে সঙ্গে নিয়ে বের হবো, সে প্রোগ্রাম আর হলো না। আর এ নিয়ে এই এক মাসে তিন-তিনবার কথার খেলাপ করতে হলো ওর সঙ্গে। রাগে মুখ থেকে অপ্রিয় কথা বেরিয়ে আসছিল কিন্তু টেপটার কথা মনে করে নিজেকে সংযত করলাম।

একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম এই টেপের কথা। এক খদ্দেরকে কিছু অপ্রিয় কথা বলায় পরদিন বস আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাই এবারে যাতে সে ভুল আর না হয় তাই নিজেকে সংযত করলাম। গলার স্বরকে মোলায়েম করে জিজ্ঞেস করলাম, সিন্দুকটা নিয়ে কি অসুবিধায় পড়েছেন, যদি বলেন–

সিন্দুকের চাবিটা হারিয়ে গেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোক পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করবো কিছু ঠিক করতে পারলাম না। জেনিকে কথা দিয়েছিলাম, ওকে সোয়া এগারোটার সময় ওর বাড়ির কাছ থেকে তুলে নেবো। তারপর দুজনে মিলে একটা নতুন ক্লাবে নাচবার জন্য যাবো। এতোক্ষণে হয়তো ও সেজেগুজে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

শহরের একেবারে অন্য প্রান্তে অবস্থিত একটা বিরাট ফ্ল্যাট বাড়ি, অ্যাশলি আর্মস। এই বাড়িটিতে শহরের নামডাকওয়ালা ধনী মহাজনদের বসবাস, ওখানে গিয়ে সিন্দুক খুলে ফিরে এসে বাস ধরে জেনির বাড়ি যেতে যেতে সাড়ে বারোটা বেজে যাবে। আর জেনি ততক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করবে বলে মনে হয় না। ও আমাকে একদিন বলেছিলো, যদি আমি এইভাবে আবার কথার খেলাপ করি তবে আমার সঙ্গে ও আর কোনো সম্পর্কই রাখবে না।

মনে মনে ভাবলাম, অফিস থেকেই জেনিকে ফোন করি। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাপারে অফিসের ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তাই বাইরে থেকে জেনিকে ফোন করবো বলে ঠিক করলাম।

কোনো উপায় না থাকায় যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অফিস বন্ধ করে, যখন গ্যারেজ থেকে অফিসের ট্রাক বের করছি তখন বাইরে ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কোনো বর্ষাতি ছিল না বলে অসুবিধায় পড়লাম।

ফোন-ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। জেনির ফোন নম্বর ডায়াল করে হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। তখন বাজে এগারোটা কুড়ি। ফোন বাজামাত্র ও-প্রান্ত থেকে জেনির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। মনে হলো ও যেন সারা সন্ধ্যে বসে বসে আমার এই ফোনটার জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমার বক্তব্যটা ওকে ভালো করে বুঝিয়ে বলার আগেই ও রাগে একেবারে ফেটে পড়লো, তুমি না এলে আসবে, কোনো ক্ষতি নেই। আমি আর একজনকে চিনি, যাকে সিন্দুক সারাতে যেতে হচ্ছে না। শেট, আমি গত বারেই সাবধান করে দিয়েছিলাম, রোজ রোজ তোমার এই কথার খেলাপ আর সহ্য করতে পারছি না। এটাই আমার শেষ বার।

কিন্তু জেনি আমার আর কোনো—-। আমি আমার রিসিভারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বুঝতেই পারছিলাম অনেকক্ষণ আগেই লাইন কেটে দিয়েছে। ওকে আবার ফোন করলাম। কিন্তু বৃথা, ফোন বেজেই চললো, কিন্তু কেউ ধরলো না। মিনিট তিনেক অপেক্ষা করে ফোন নামিয়ে রাখলাম। শ্লথ পায়ে ট্রাকের দিকে এগিয়ে চললাম। এদিকে তখন খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছে। অঝোর ধারায় ঝরে চলেছে বড় বড় জলের ফোঁটা। ভারাক্রান্ত মনে ট্রাক ছুটিয়ে চললাম অ্যাশলি আর্মসের দিকে। মনে মনে লরেন্স সেফস্ কর্পোরেশনকে আর হেনরী কুপারকে যথেচ্ছ গালাগাল দিলাম।

শহরের অভিজাত অঞ্চলে বিশাল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাশলি আর্মস। ট্রাক থেকে নেমে বৃষ্টির মধ্যেই বাড়িটার দিকে এগিয়ে চললাম। সোজা এগিয়ে গেলাম দ্বাররক্ষীর ঘরের দিকে। তার কাছ থেকেই জানা গেল মিঃ কুপার চারতলায় থাকেন।

লিফটে চারতলায় পৌঁছে ফ্ল্যাটের বেল বাজালাম। দরজা খুললেন স্বয়ং হেনরী কুপার। লম্বা বিশাল চেহারার পুরুষ। ভাবভঙ্গীতে ঔদ্ধত্যের প্রকাশ সুস্পষ্ট। অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রভাবে মুখে ঈষৎ লালচে আভা। তাঁর স্ফীত উদর দেখে মনে হয় তিনি অত্যন্ত ভোজন বিলাসী। আমি দেরী করে আসায় তিনি একেবারে রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি জানতে চাইলেন, এই সামান্য রাস্তা আসতে কেন আমার এতে বিলম্ব হলো।

আমি তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলাম, বৃষ্টিতে রাস্তায় যে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে আসতে হয়েছে সেই কারণেই আসতে দেরী হয়েছে বললাম।

কুপার দ্রুতপায়ে দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিং-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। ছবিটা জনৈকা স্থূলকায় মহিলার নগ্ন-মূর্তি। দেখে রুবেনস-এর আঁকা মনে হলেও সম্ভবতঃ নকল। ছবিটাকে একপাশে সরিয়ে ধরতেই চোখে পড়লো আমাদের কোম্পানির তৈরী একটা সুপার-ডি লাক্স দেওয়াল সিন্দুক।

যখন আমি যন্ত্রপাতির ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রাখছিলাম তখন আমার নজরে পড়লো পাশের লম্বা সোফাতে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। পরনে সাদা সান্ধ্য পোশাক। পোশাকের গলার কাছটা এতো বেশী উন্মুক্ত যে মেয়েটির উদ্ধত গোলাপী স্তনের উর্ধ্বাংশ সহজেই নজরে পড়ছে। তার মাদকতায় পরিপূর্ণ রক্তিম ঠোঁটের ফাঁকে জলন্ত সিগারেট, চোখ তুলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকালো।

মেয়েটিকে দেখে আমার জেনির কথাই মনে পড়ে গেল। কারণ ওর চুলের রঙ ও পায়ের সুন্দর গড়ন অনেকটা জেনিরই মত, কিন্তু এই মেয়েটির মধ্যে এমন একটা আভিজাত্যের ছাপ লক্ষ্য করলাম যা জেনির মধ্যে নেই। এটা স্বীকার করতেই হয় যে জেনির দৈহিক গঠন চঞ্চল করে তোলে দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকাকে, ওর ব্যক্তিত্ব, ভারী নিতম্বের ছন্দোময় হিল্লোল, পুরুষের হৃদয়ে তোলে তুমুল ঝড়। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণই নিছক সস্তা চটক।

এই মেয়েটির মধ্যে সেরকম কিছু নজরে পড়লো না।

আমার চমক ভাঙলো কুপারের বাজখাই গলার আওয়াজে, এটা খুলতে তোমার কত সময় লাগবে?

প্রায় একরকম জোর করেই মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সিন্দুকের কাছে এগিয়ে গেলাম, কম্বিনেশনটা পেলে বেশী সময় লাগবে না।

তিনি একটুকরো কাগজে কম্বিনেশনটা খসখস করে লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। তারপর সোজা এগিয়ে গেলেন বিপরীত দিকের দেওয়ালে গাঁথা, ছোট একটা কাঠের আলমারির কাছে। পাল্লা সরাতেই চোখে পড়লো ভেতরের তাকে সাজানো সারি সারি মদের বোদল। একটা গেলাস টেনে নিয়ে নিজের জন্য হুইস্কি আর সোডা মেশাতে লাগলেন কুপার।

যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ শুরু করেছি এমন সময় পাশের কোনো ঘর থেকে টেলিফোনের শব্দ ভেসে এলো। ক্রি-রি-রি-রিং–

মনে হয় জ্যাক ফোন করছে, মেয়েটিকে লক্ষ্য করে কুপার বললেন, এবং দরজা খোলা রেখেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

কুপার বেরিয়ে যেতেই মেয়েটি চাপা স্বরে হিসহিস করে উঠলো, তাড়াতাড়ি হাত চালাও চাঁদ। ব্যাটা বুড়ো আজ একটা মুক্তোর নেকলেস কিনে দেবে বলেছে। ভয় হচ্ছে, এর মধ্যে বুড়ো আবার, মত না পরিবর্তন করে ফেলে।

আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। মেয়েটির কাছ থেকে এ ধরণের কথা আমি আশা করিনি। ও সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিলো। আমি ওকে আশ্বাস দিলাম, মিনিট তিনেকের বেশী সময় লাগবে না।

 কিছুক্ষণ পরেই সিন্দুকটা খুলে ফেললাম, সিন্দুকের ভেতরে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনটে তাকেই থরে থরে সাজানো একশ ডলার নোটের বাণ্ডিল। একসাথে এতো টাকা আমি জীবনে দেখিনি। সব মিলিয়ে মনে হয় পাঁচ লাখ ডলারের কম হবে না।

মেয়েটি সোফা ছেড়ে তাড়াতাড়ি সিন্দুকের সামনে এসে দাঁড়ালো, ঠিক আমার পাশে। ওর গা থেকে সেন্টের একটা উগ্র গন্ধ আমার নাকে এলো। ও আমার এতো কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে ওর বাহুর স্পর্শ অনুভব করলাম।

উফ, এতো টাকা! চাপা উত্তেজনায় মেয়েটি আমার হাত চেপে ধরলো, তারপর হাত ছেড়ে আমার চোখে চোখ রাখলো, আচ্ছা, আমরা দুজনেই যদি এটা খালি করার ব্যবস্থা করি, তাহলে কি রকম হবে?

পাশের ঘরে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম যে কুপারের কথা বলা শেষ হয়েছে।

আমি তাড়াতাড়ি সিন্দুকের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। মেয়েটিও চটপট সোফায় ফিরে গেলো।

কুপার এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। কি হলো? এখনও ওটা খুলতে পারোনি? রাগ করলেন তিনি। এক সেকেন্ড, স্যার, লকটা সরিয়ে দিলাম, এই তত খুলে গেছে। কুপার এগিয়ে এসে হাতল ঘুরিয়ে সিন্দুকের দরজাটা ইঞ্চি কয়েক ফাঁক করলেন, হুম–তুমি বরং একটা নকল-চাবির ব্যবস্থা করে দিও, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আমি সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়লাম। তারপর যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। বেরিয়ে আসার সময় সোফাতে বসে থাকা মেয়েটিকে শুভরাত্রি জানালাম। প্রত্যুত্তরে ও ঘাড় হেলালো, দরজার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে কুপার দুটো এক ডলারের নোট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি টাকাটা আমাকে দিচ্ছেন।

ট্রাক চালিয়ে আমি ফিরে চললাম অফিসে। কুপারের টাকায় ঠাসা সিন্দুকটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অফিসের সামান্য মাইনেতে আমি কোনো রকমে চালাই। আমি জানি ঐ মাইনেতে আমাকে চিরকাল এই একই ভাবে কাটাতে হবে। ভবিষ্যৎ বলে আমার কিছু নেই। মনের মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলোইচ্ছে করলে কুপারের ফ্ল্যাটে ঢুকে কতো সহজেই না হাতানো যায় ঐ টাকাগুলো! ভারী তো সিন্দুক!

বারবার মনকে বোঝালাম, এসব চিন্তা পাগলামো ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও মন থেকে চিন্তাটাকে দূর করতে পারলাম না।

পরদিন রাতে ডিউটি বদলের সময় ট্রেসি এলো আমার জায়গায়, তখনও ঐ একই সর্বনাশা চিন্তা উঁকি মারছে আমার মনের মধ্যে।

রয়কে আমি অনেকদিন ধরেই জানি। ছেলেবেলায় আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। এই সিন্দুক কোম্পানিতেই চাকরি করে। আমাদের দুজনের চেহারাতে মিল আছে, তাছাড়া আর যে ব্যাপারটায় দুজনের মধ্যে মিল আছে সেটা হলো অসীম অর্থলিপ্সা।

যে ব্যাপারটায় ওর সঙ্গে আমার অমিল সেটা হলো রয়ের জীবনে মেয়েদের কোনো স্থান নেই। উনিশ বছরে রয় বিয়ে করেছিলো কিন্তু সুখী হতে পারেনি। বছর খানেক পরেই মেয়েটি ওকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওর যে নেশাটি রয়েছে তা হলো ঘোড়া রোগ। মাইনে পেয়ে সমস্ত টাকাই উড়িয়ে দেয় ঘোড়ার পেছনে। যার জন্য সব সময় ওর পকেট খালি থাকে আর আমার থেকে ধার নেবার চেষ্টা করে।

ওকে কুপারের টাকার কথা বললাম। আমরা দুজন ছাড়া অফিসে আর কেউ নেই। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। জলের ছাট এসে আছড়ে পড়ছে জানলার শার্সির ওপর। আমার বাড়ি যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। রয়কে কুপারের ফ্ল্যাটে যাওয়া থেকে আরম্ভ করে সব বললাম। এমন কি মেয়েটার কথা বলতেও ভুললাম না।

রয়ের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, আমি জানলার কাছে এগিয়ে গেলাম। বর্ষণসিক্ত রাতের দিকে তাকালাম। বৃষ্টি তখনও অবিশ্রান্ত ভাবে ঝরে চলেছে। আমাদের মধ্যে ব্যাপারটি আলোচনা হলো।

রয় আমার দিকে তাকিয়ে বললো, পাঁচ লাখ ডলার?–তুই ঠিক জানিস?

তার চেয়ে কম বলে তো মনে হয় না,–তিনটে তাকই ভর্তি ছিলো। রয়ের চোখে দেখলাম উৎকণ্ঠার ছায়া। সে টেবিল-এ ঘুষি মেরে বললো, জানিস, মাত্র পাঁচশো ডলারের জন্য আমাকে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, যেমন করেই হোক কিছু টাকা আমাকে ব্যবস্থা করতেই হবে। শুধু সামান্য একটু হাতের কাজ

অসম্ভব কিছু নয়। আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হলো। আমি বহুদিন থেকে এই ধরনের একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। উত্তেজনায় উঠে বসলাম ডেস্কের ওপর, সুতরাং

ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখা যাক, প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা চললো। কাজটা খুবই সহজ বলে মনে হলো।

প্রথমেই আমাদের খোঁজ নেওয়া দরকার যে এই কুপার লোকটা রোজ কাটার সময় ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে যায়, আর সময়টা জানতে পারলেই আমাদের কাজ শুরু হবে,–অর্থাৎ ফ্ল্যাটে ঢুকে সিন্দুক খুলে, তাড়াতাড়ি মাল হাল্কা করা। আত্ম প্রত্যয়ের একটুকরো বাঁকা হাসিতে রয়ের ঠোঁট নেচে উঠলো, সে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললো,ঐ নকল চাবিটা নিয়ে কুপারের বাড়িতে গিয়ে দরজায় যে দারোয়ানটা থাকে, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে হবে, কথায় কথায় কুপার কখন বাড়ি থেকে বের হয় সেটা জেনে যেতে হবে। কাজটা মনে হয় খুব একটা শক্ত হবে না। ব্যাপারটা আলোচনার পর মনে হলো এর থেকে সহজ কাজ বোধ হয় আর হতে পারে না।

পর দিন রাতে নকল চাবিটা নিয়ে অ্যাশলি আমস-এ গেলাম, রয় বলেছে হাতের কাজ শেষ করেই ও অ্যাশলি আর্মসে ট্রাক নিয়ে চলে আসবে। বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

যখন অ্যাশলি আর্মস-এ পৌঁছলাম তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে। ট্রাক ছেড়ে পায়ে পায়ে দ্বার রক্ষীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি লোকটা বসে বসে একটা পকেট বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। মুখে বিরক্তির চিহ্ন।

আমাকে দেখেই চিনতে পারলো। বই বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো, মিঃ কুপারের সঙ্গে দরকার বুঝি? কিন্তু উনি তত বেরিয়ে গেছেন। আধ ঘণ্টার আগে ফিরবেন না।

আমি বললাম, কি আর করা যাবে ওনার কাছে একটা জিনিস দেবার ছিল, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।

ওর দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম, বললাম, তুমি ঠিক জানো আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই মিঃ কুপার ফিরে আসবেন?

সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কোনও দিন তাঁর দেরী হয় না। ঠিক আটটার সময় বের হন আর রাত এগারোটার সময় ফেরেন। ডিনার খেয়ে একটার সময় আবার বেরিয়ে যান। আমিও একটা বাজলেই কেটে পড়ি। এ বাড়ির প্রত্যেকের কাছেই এ বাড়ির নকল চাবি আছে। উনি শেষ রাতে ফেরেন। একটু থেমে অপেক্ষাকৃত নীচু স্বরে ও বললো, আরে তুমি বিশ্বাস করবে না দোস্ত, কতদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে টেনে তুলেছে, কি ব্যাপার? না কোন্ শালা নাকি দরজার চাবি হারিয়ে বসে আছে। এই তো গত সপ্তাহে দরজার চাবি হারিয়ে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুললো। চাবি হারানোর আর সময় খুঁজে পেলো না।

কুপার কি পাঁচটার সময়েই ফেরেন নাকি?

হাঁ, তারপর সারাদিন তো পড়ে পড়ে ঘুমোয়। একেবারে অপদার্থ।

আনন্দে আমার চোখ চক্ করে উঠলো, আমার আশা পূর্ণ হয়েছে। যতটুকু জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে।

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম লম্বা লম্বা পা ফেলে হেনরী কুপার এগিয়ে আসছেন। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক এগারোটা বাজে।

দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপনার নকল চাবিটা নিয়ে এসেছি স্যার। আমি তাকে আরো বললাম যে, আমার মনে হয় চাবিটা ঠিক হয়েছে কিনা, সেটা একবার পরখ করা দরকার, আপনি যদি বলেন–

তিনি আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করে বললেন, হ্যাঁ-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমাকে অনুসরণ করতে বলে তিনি লিফটের দিকে পা বাড়ালেন।

চারতলায় পৌঁছে কুপার তার ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে আমাকে আহ্বান জানালেন। আর আমিও তার পেছন পেছন বসবার ঘরে প্রবেশ করলাম।

হেনরী কুপার ছবিটা সরিয়ে আমাকে চাবিটা পরীক্ষা করার জন্য ইশারা করলেন। আমি চাবি ঘুরিয়ে সিন্দুক খোলার চেষ্টা করলাম। কুপার ঠিক আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার ছোট ছোট চোখ জোড়া সিন্দুকটির ওপর নিবদ্ধ।

হাতল ঘুরিয়ে টান মারতেই সিন্দুকের দরজা খুলে গেলো। চোখের সামনে আবির্ভূত হলো চোখ ধাঁধানো কুবেরের সম্পদ।

কিছুক্ষণ পরে সিন্দুক বন্ধ করে কুপারকে চাবিটা এগিয়ে দিলাম। তিনি চাবিটা নিয়ে পকেটে ঢোকালেন। এবারে আমি কুপারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লিফটে পা দিলাম। রাস্তায় নেমে বৃষ্টির বেগকে উপেক্ষা করে ক্ষিপ্রপায়ে হেঁটে চললাম। বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা পর্দা ভেদ করেও দেখা যাচ্ছিলো অদূরে দাঁড়ানো ট্রাকটাকে। ট্রাকে বসে রয় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি ট্রাকে উঠতেই রয় স্টার্ট দিয়ে ট্রাক ছুটিয়ে চললো বৃষ্টিভেজা রাস্তা ধরে, আমি এবং রয় ঠিক করলাম রবিবার দিনটাকেই কাজে লাগাবো।

দেখতে দেখতে এসে গেল সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি। রয় আগে থেকেই একটা গাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলো। রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা ও আমার বাড়িতে এলো। আমি অবশ্য তৈরী হয়েই ছিলাম। বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে রয় গাড়ি ছুটিয়ে দিলো অ্যাশলি আর্মসের দিকে। আমরা দুজনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। কেমন একটা নিঃশব্দ উৎকণ্ঠা অনুভূত হচ্ছিল। শুধু অনুভব করলাম বুকের মধ্যে অশান্ত হৃৎপিণ্ডের দাপাদাপি। বৃষ্টি পড়ার জন্য রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। ঠিক একটা বাজতে পাঁচ মিনিটের সময় আমরা অ্যাশলি আর্মসে পৌঁছলাম।

সারি সারি গাড়ি পার্ক করা রয়েছে রাস্তাটায়, একটা ক্যাডিলাক এবং একটা প্যাকার্ডের মাঝে গাড়িটা ঢুকিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করলো রয়। এবার শুরু হলো আমাদের উদগ্রীব প্রতীক্ষা। আমরা পলকহীন চোখে চেয়ে রয়েছি অ্যাশলি আর্মসের সদর দরজার দিকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর শব্দ পরিষ্কার ছন্দে শোনা যেতে লাগলো। উত্তেজনায় শরীরের প্রতিটি স্নায়ু কাঁপছে।

ঘড়িতে তখন রাত একটা। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম একজন লোক বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি রয়ের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, রয়ের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।

কুপার রাস্তায় এসেই মাথা ঝুঁকিয়ে দৌড়তে শুরু করলো। আমাদের গাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রাখা ছিলো একটা সাদা জাগুয়ার। হাত দিয়ে বৃষ্টির বেগ প্রতিহত করতে করতে জাগুয়ারটার দিকে এগিয়ে গেলে কুপার। গাড়িতে উঠেই গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টিভেজা অন্ধকার গ্রাস করলো সাদা জাগুয়ারটাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দ্বাররক্ষীকে আবার এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। তারপর চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিলো সদর দরজা। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল বাড়ির অপর প্রান্তে। সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করলো।

রয় বললো, আর দেরী করা ঠিক হবে না। আমি যন্ত্রপাতির ব্যাগটা শক্ত হাতে চেপে ধরলাম। গাড়ি থেকে নেমে আমরা বাইরে আসতেই বৃষ্টির জল একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো গায়ে, মুখে, মাথায়। সদর দরজা লক্ষ্য করে আমরা ছুটে গেলাম। আগে থেকেই আমরা সব ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার কাজ হবে তালাটা ভোলা, আর রয় চারপাশে লক্ষ্য রাখবে। কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখলেই আমাকে সতর্ক করে দেবে।

দরজার কাছে পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে পকেট থেকে চাবি ভর্তি রিংটা বের করলাম। চটপট রিংটা খুলে নিয়ে তালাটার দিকে মনোযোগ দিলাম।

এমনিতে এ ধরনের তালা খোলা আমার কাছে কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু ভয়ে আমার হাত কাঁপছিলো। তাই তালা খুলতে একটু বেশী সময়ই আমার লেগে গেলো।

অতি সন্তর্পণে দরজাটা ফাঁক করলাম, তারপর আমি আর রয় নিঃশব্দে ভেতরে পা বাড়ালাম। বেড়ালের মতো ক্ষিপ্র গতিতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চললাম।

আমরা আগে থেকেই ঠিক করে ছিলাম যে লিফট ব্যরহার করবো না। কারণ দ্বাররক্ষী যদি হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে আসে, তবে লিফটের আলো দেখে ঠিক সন্দেহ করবে।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। যখন কুপারের ফ্লাটের সামনে পৌঁছলাম তখন আমরা রীতিমতো হাঁপাচ্ছি। পকেট থেকে চাবির রিংটা বের করে একটা চাবি লাগাতেই খুলে গেলো ফ্ল্যাটের দরজা। হাতের চাপে ফাঁক হয়ে গেল দরজার পাল্লা। ঘরে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার আমাদের গ্রাস করলো। ঘরে ঢুকে প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে সজাগ রাখার চেষ্টা করলাম। কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলাম সামান্যতম শব্দ। উৎকণ্ঠায় স্নায়ু যেন ভেঙে পড়তে চাইছে।

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ডের কাছে এগিয়ে গেলাম, আলো জ্বালোম। ধবধবে মার্কারী ল্যাম্পের চোখঝলসানো আলোয় ঘর ভেসে গেলো। রয় ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। এবারে আমরা দেরী না করে অয়েল পেন্টিংটার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ছবিটা একপাশে সরাতেই সামনেই সিন্দুক। রয় তাড়া লাগালো। কম্বিনেশন নম্বরটা আমার মখস্থ ছিল। তাছাড়া সঙ্গে ছিলো সিন্দুকের নকল চাবি।কুপারের চাবিটা তৈরী করার সময় এটাও তৈরীকরিয়ে নিয়ে ছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খুলে ফেললাম সিন্দুকের দরজা।

আমরা দুজনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে হাঁকরে চেয়ে রইলাম টাকার পাহাড়ের দিকে।রয় আনন্দে বলে বসলো, তা হলে বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা তুলে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে কি বলল? সত্যিই পৃথিবীতে এর থেকে সহজ কাজ বোধ হয় আর হতে পারে না। আমার বুকের মধ্যে আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়লো। কতক্ষণ যে আমরা ঘোরের মধ্যে ছিলাম জানি না, একটা শব্দে আমাদের চমক ভেঙে গেলো। হঠাৎ একটা শব্দ কানে এলো। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালাম।

একটা চাবির অগ্রভাগ বেরিয়ে আছে চাবির ফুটো দিয়ে, চাবিটা ধীরে ধীরে ঘুরছে। আমাদের আতঙ্ক বিস্ফারিত চোখের সামনেই ক্লিককরে একটা শব্দ হলো এবং চাবিটা ফুটো থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো, আমি তখন জড় পদার্থের মতন অচল-অনড়। দেহের সমস্ত অনুভূতি যেন জমে বরফে পরিণত হয়েছে, দেখলাম রয় হঠাৎ পাগলের মতো ছুটে গেলো সুইচবোর্ড লক্ষ্য করে, আর একই সঙ্গে ঘুরতে শুরু করলো দরজার হাতলটা। অর্থাৎ কেউ বাইরে থেকে দরজা খুলছে।

রয় সুইচ অফ করার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘরের মধ্যে। পর মুহূর্তে ধীরে ধীরে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে লাগলো। বারান্দার একফালি আলো ঘরে এসে পড়লো। দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে গেলো। রয়কে অন্ধকারে দেখতে পেলাম না। শুধু দেখলাম দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে সেই আগের দিনের দেখা মেয়েটি। কিছুক্ষণ আমরা বারান্দা থেকে ঠিকরে আসা আলোয় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

পরক্ষণেই মেয়েটির তীক্ষ্ণ আর্ত চীৎকারে চমকে উঠলাম, চোর চোর!

হেনরী–ঘরে চোর ঢুকেছে–আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার পা দুটো যেন কেউ মেঝের সঙ্গে আটকে রেখেছে। দেখলাম, কুপার এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির পিছনে। এক ঝটকায় মেয়েটিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কুপার আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। চোখের দৃষ্টিতে যেন আক্রোশের লেলিহান শিখা।

আমি তখন আতঙ্কে কি করবো ঠিক করতে পারছি না।

মেয়েটি ঝড়ের বেগে সিঁড়ি লক্ষ্য করে ছুটে গেলো। ওর তীক্ষ্ণ কানফাটানো আর্তচীৎকারে গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠতে লাগলো। এবারে রয়কে আমি দেখতে পেলাম। জাগুয়ারের মতো গুঁড়ি মেরে দেওয়াল ধরে এগিয়ে চললো দরজার কাছে। কুপারের ঠিক পেছনে। কুপার রয়কে দেখতে পায়নি, সে সোজা এগিয়ে আসছিলো আমার দিকে। দু-হাত বাড়িয়ে সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই কিছু একটা ঝলসে উঠলো রয়ের হাতে। একটা জোরে শব্দ হলো। কুপারের বিশাল দেহ গোড়াকাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়লো আমার পায়ের কাছে।

লক্ষ্য করলাম, রয়ের দুহাতে, বজ্র মুষ্ঠিতে ধরা রয়েছে সেই ভারী ফুলদানিটা। অর্থাৎ হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে, ঐ ফুলদানিটাই কুপারের মাথায় বসিয়ে দিয়েছে রয়।

 আমি যেন এতক্ষণ দেখা দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে উঠলাম। এখন একটাই চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো, আমাকে পালাতে হবে। আমি আর দেরীনা করে পাগলের মতো দৌড়োতে লাগলাম। আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে চললাম। নীচ থেকে মেয়েটির গলা ফাটানো আর্তচীৎকার তখনও শোনা যাচ্ছে। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা–যে করে থোক আমাকে গাড়ির কাছে পৌঁছতে হবে।

রয়ের চাপা গলা শুনতে পেলাম, শেট, নীচে নয়–ওপরে আয়–ওপরে। ওর কথা আমার আচ্ছন্ন মনে কোনো রেখাপাত করলো না। এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে উন্মাদের মতো ছুটে চললাম।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনতলায় পৌঁছলাম। নীচের তলার সিঁড়ি লক্ষ্য করে দৌড়োতে শুরু করলাম। কিন্তু হঠাৎ পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়লাম। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে আঘাত গ্রাহ্য না করে আবার দৌড়োলাম। ছুটতে ছুটতে অবশেষে দালানে এসে উপস্থিত হলাম।

মেয়েটি তখন দ্বাররক্ষীর অফিসের কাছে দাঁড়িয়ে, দরজার হাতল ধরে টানাটানি করছে। আমার দিকে নজর পড়ায় মেয়েটি আমাকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। তারপর শুরু করলো আর্ত চীৎকার। কিছুক্ষণ পরে দ্বাররক্ষী এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপর। দুজনে জড়াজড়ি করে পড়লাম মেঝের ওপর। ওর শক্ত হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে আমি শুধু কোনরকমে পালাতে পারলেই বাঁচি।

ভয়ে মরিয়া হয়ে লোকটার চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে সজোরে ঠুকে দিলাম। তাতেও যখন কোনো ফল হলো না তখন দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলাম ওর মুখে। তারপর গায়ের জোরে লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করলাম সদর দরজা লক্ষ্য করে।

 দরজা খুলে ঠিক বাইরে পা দিচ্ছি এমন সময় বেজে উঠলো কানফাটানো এক পুলিশি-হুঁই। নিশ্চয়ই এটা দ্বাররক্ষীর কাণ্ড!

মেয়েটির বীভৎস চীৎকার, আর এই হুই-এর কানফাটানো শব্দে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো চমকে উঠলাম। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রাস্তা লক্ষ্য করে দৌড়তে লাগলাম।

বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে আর আমি সেই বৃষ্টির মধ্যে ছুটে চলেছি। কানে তখনও ভেসে আসছে সেই চীৎকার। ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ড যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

ছুটতে ছুটতে একবার পিছন ফিরে তাকালাম দেখলাম একটা ছায়ামূর্তি দৌড়ে আসছে আমার পেছন পেছন। তার মাথায় টুপি, কোটের বোতামগুলো অন্ধকারেও ঝকমক করছে পুলিশ। ভয়ে আমার শরীর অবশ হয়ে এলোমনে মনে ভাবলাম একবার গাড়িতে গিয়ে উঠতে পারলেই হলো। সামনেই আমাদের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। নতুন আশা নিয়ে প্রাণপণে গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটে চললাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেসে এলো রিভলবারের শব্দ–উঃ আমার গাল ছুঁয়ে একটা আগুনের হলকা বেরিয়ে গেলো।

মনে হলো যেন আমার গালের চামড়া পুড়ে গেল। যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলাম।

মাথা নীচু করে রাস্তার অপর প্রান্ত লক্ষ্য করে ছুটে চললাম, সেদিকটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। যদি ওখানে পৌঁছতে পারি তবে পালাবার আশা আছে।

ছুটতে ছুটতে আবার শুনতে পেলাম সেই কালান্তক রিভলভারের শব্দ–উঃ। পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড এক ধাক্কায় ভিজে রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। মনে হলো কেউ যেন একটা উত্তপ্ত লৌহশলাকা বিঁধিয়ে দিয়েছে আমার পিঠে। যন্ত্রণায় চীৎকার করতে গেলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বরই বের হলো না। নিজের অজান্তেই একটা হাত চলে গেলো পিঠে। হাত সামনে আনতেই দেখলাম হাতময় রক্ত। সেই রক্ত বৃষ্টির জলে ধুয়ে টন্ টন্ করে গড়িয়ে পড়ছে–একে একে আমার প্রতিটি অনুভূতি অবশ হয়ে আসতে লাগলো–

কানে আসতে লাগলো কয়েক জোড়া ভারী বুটের শব্দ–খট-খটখট–মনে হলো কারা যেন আমার দিকে দৌড়ে আসছে তীর বেগে।

উঃ কী ভীষণ অন্ধকার! মাগো

এরপর আর আমার কিছুই মনে নেই।

.

০২.

অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো কেউ যেন ফিসফিস করে কথা বলছে–অনেক-অনেক অনেক দূর থেকে

ক্রমশঃ চেতনা ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকে একটা অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলাম। একে একে সেই যন্ত্রণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। দুধ সাদা চার দেওয়ালে ঘেরা ঘরের মধ্যে শুয়ে আছি আমি। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে একটা মুখ। দুটো উদগ্রীব চোখ স্থির লক্ষ্যে আমার দিকে চেয়ে আছে। এক সময় সেই মুখের ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে গেলো। বুকের মধ্যে তীব্রতর হলো সেই অসহ্য যন্ত্রণা, চোখ বন্ধ হয়ে এলো। কিন্তু ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনের পর্দায় ছবির মতো একে একে ভেসে উঠতে লাগলো। মনে পড়ে গেলো পাগলের মতো সিঁড়ি ভেঙে দৌড়োনোর কথা, দ্বাররক্ষীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি, মেয়েটির বীভৎস আর্তচীৎকার, অন্ধের মতো রাস্তা লক্ষ্য করে আমার ছুটে যাওয়া–সব একে একে মনের পর্দায় ছবির মতো ফুটে উঠলো।

রাতারাতি বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে এই হলো পরিণতি। আমি আজ আহত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণাকৃতি এক পুলিশ সার্জেন্ট-একেই বলে ভাগ্য।

কিছু কিছু কথা আমার কানে আসতে লাগলো–আপনি তো বলছেন, এর আঘাত নাকি ততোটা গুরুতর নয়, তাহলে ব্যাটা নিশ্চয় মটকা মেরে পড়ে আছে। কলার ধরে তুলে এক লাথি ঝাড়লেই সুড়সুড় করে জ্ঞান ফিরে আসবে। সার্জেন্টের শ্লেষ ভরা অধৈর্য কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

না না–তাড়াহুড়ো করাটা ঠিক হবে না সার্জেন্ট, লোকটা অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। গুলিটা আর একটু বাঁদিকে ঘেঁষে গেলেই। শান্ত ভদ্র কণ্ঠস্বর, সম্ভবতঃ ডাক্তারের।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বেশ ভালোরকম বুঝতে পারছি। চোখ পিট পিট করে তাকালাম। বিছানার পাশে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম জনের চেহারা মেদবহুল, মুখে প্রশান্তির ভাব, গায়ে একটি সাদা আলখাল্লা। নিশ্চয়ই ইনি ডাক্তার। দ্বিতীয় জন ছোটখাটো পাহাড়ের মতো। ভোতা নাক পাতলা বেঁটে আর ছোট ছোট হিংস্র চোখ। পরনে তেলচিটে ময়লা পোশাক। কিন্তু তার টুপি পরার ধরণ দেখেই বুঝলাম যে এ ব্যাটা নিশ্চয়ই পুলিশের লোক।

চুপচাপ শুয়ে বুকের যন্ত্রণা সহ্য করছি। হঠাৎ রয়-এর কথা মনে পড়লো। রয় যদি ঠিকমতো সবার অলক্ষ্যে অ্যাশলি আর্মস ছেড়ে পালাতে পেরে থাকে, তবে ওর আর জড়িয়ে পড়ার কোনো ভয় নেই। কারণ কুপারের টাকা প্রথম দিন আমার চোখেই পড়েছিলো, দ্বাররক্ষীর সঙ্গে আমিই গল্প করেছিলাম। আমাকেই লোকেরা সিঁড়ি ভেঙে উন্মাদের মতো ছুটতে দেখেছে। সুতরাং মনে হয় রয়ের কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই।

এক অজানা আতঙ্ক হঠাৎ মনের মধ্যে এসে ভিড় করলো।

 কুপারের কিছু হয়নি তো? মনে পড়ে গেলো একটা ভারী ফুলদানি দিয়ে রয় এক আসুরিক শক্তি নিয়ে কুপারের মাথায় বসিয়ে দেয়।

একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে এলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখলাম এক সার্জেন্টের হিংস্র মুখ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে।

সার্জেন্টটি তার বীভৎস মুখ আমার মুখের ওপর নামিয়ে এনে বললো, ঢের হয়েছে। এবা দয়া করে মুখ খুলুন দেখি, আপনার শ্রী মুখের বাণী শোনার জন্য গত দুদিন ধরে ঠায় দাঁড়ি, আছি।নেকড়ের মত দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলো সে। শুরু হলো পুলিশের হাতে নর যন্ত্রণা।

ওদের একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল কাজটা আমি একা করিনি। তাই বিভিন্ন রকম প্র করে ভয় দেখিয়ে আমার মুখ থেকে কথা বের করতে চাইলো। ওদের কথা থেকে বুঝ পেরেছিলাম, রয়ের উপস্থিতির কোনো প্রমাণই পুলিশের হাতে নেই। এমনকি কুপারের খুনে দায়ে আমাকেই পড়তে হবে বলে ভয় দেখালেও আমি মুখ খুললাম না।

অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে ওরা ক্ষান্ত হলো। একথা বললো যে কুপার সেরে উঠেছে আমার বুঝতে কষ্ট হলো না যে কুপারের সেরে ওঠাটা ওরা ভালো চোখে দেখছে না। সার্জেন দাঁত খিঁচিয়ে আমার দিকে তাকালো, কুপার বেঁচে গেছে বলে ভেবোনা যে, তুমিও বেঁচে যাবে এ আঘাতে কুপার মারাও যেতে পারতো। তবে ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই বাছাধন, তোমার দশ বছরের ঘানি ঘোরানো কেউ আটকাতে পারবে না–হ্যায়না হাসির সঙ্গে ওর বিশাল দেহট কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।

হাসপাতাল থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো জেল হাজতে। সেখানে তিনমাস কাটানোর পর জানতে পারলাম, কুপার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।

একে একে বিচারের দিন এগিয়ে আসতে লাগলো। চিরকাল আমার এই দিনটা মনে থাকবে আদালতে এসে চারিদিকে চোখ বোলালাম। যদি কোনো পরিচিত মুখ নজরে পড়ে যায়। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়লো জেনি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়েই ও হেসে হাত নাড়লো।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমি ভাবতেই পারিনি যে জেনি এখানে আসবে আমার সঙ্গে দেখা করতে।

তারপরই চোখ পড়লো, আমার বস ফ্রাঙ্কলিনের ওপর; আর তার পাশে ভিজে বেড়ালের মতো চুপটি করে বসে আছে রয়।

রয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হলো–ওর মুখ পাণ্ডুর। মনে হলো এই তিনমাস শুধু ভেবেছে সে, ওর নাম আমি পুলিশকে জানিয়েছি কি না।

এবারে বিচারপতির দিকে চোখ পড়লো, কোটরগত অনুভূতিহীন চোখ। সারা মুখ জুড়ে এক অদ্ভুত কাঠিন্য, দেখা গেলো যে সাক্ষীর কাঠগোড়ার দিকে কুপার এগিয়ে আসছে, মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, চোখমুখ বিবর্ণ।

কুপার শপথ নিলো। তারপর সিন্দুক খোলার জন্য আমাকে ডেকে পাঠানো থেকে শুরু করেনকল চাবির কথা, ওকে আক্রমণ করার কথা–একে একে সব বলে গেলো। কিছুই বাদ দিলো না।

এরপর কাঠগোড়ায় এসে উপস্থিত হলো, কুপারের ফ্ল্যাটে দেখা সেই মেয়েটি। ওর পরণে একটা চাপা আকাশ-নীল পোশাক। আদালতের সমস্ত লোক, এমন কি বিচারপতি পর্যন্ত ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।

মেয়েটি যা বিবৃতি দিলো তার থেকে জানা গেলো যে, মেয়েটি কুপারের একটা নাইট ক্লাবে গান গায়। সেদিন একটা গানের রিহার্সাল দিতে ও কুপারের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলা, এরকম ও মাকে মধ্যেই যায়। সেদিন কুপার ফোন ধরতে পাশের ঘরে গেলে, আমি যে সিন্দুক খুলে টাকাগুলে দেখেছিলাম, সেকথার ওপর মেয়েটা একটু বেশী জোর দিল।

আমাকে খুব অবাক করে দিলো ফ্রাঙ্কলিনের সাক্ষ্য। তিনি কাঠগোড়ায় উঠে আমার প্রশংসাই করলেন। আমি যে তার কোম্পানির একজন বিশ্বাসী ও সুদক্ষ কর্মচারী, সেকথা তিনি বিচারপতিকে বার বার জানালেন।

এরপর আমার উকিল উঠে দাঁড়িয়ে আদালতের কাছে আমার জন্য করুণা ভিক্ষা করলেন অর্থাৎ এই আমার প্রথম অপরাধ, সুতরাং বিচারপতি যেন শাস্তির ব্যাপার একটু চিন্তা করে দেখেন। তার কৃপা প্রার্থনার ভঙ্গী দেখে মনে হলো, আমি দোষী সাব্যস্ত হওয়াতে তিনি বেশ আনন্দিত হয়েছেন। এরপর তিনি চেয়ারে বসে কতকগুলো কাগজপত্র ওল্টাতে লাগলেন, মনে হলো ওগুলো এর পরবর্তী মামলার কাগজপত্র। এক কথায় উকিলটি বেশ বুদ্ধিমান। আমার মামলা নিয়ে ফালতু সময় নষ্ট করে যে আর লাভ নেই, সেটা তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন।

এরপর কানে এলো বিচারপতির গম্ভীর কণ্ঠস্বর, শেট কারসন, সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি বিচার করে একথাই প্রমাণিত হচ্ছে, তুমি দোষী। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। যেহেতু এটাই তোমার প্রথম অপরাধ, সেহেতু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে লঘুদন্ড দিতে আমি আইনসঙ্গত ভাবে বাধ্য। তুমি যেভাবে মিঃ হেনরী কুপারকে আক্রমণ করেছে, তাতে তোমার হিংস্র মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানির সুনাম তুমি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছ। কারসন, যে কোম্পানিতে তোমার বাবা এবং ঠাকুরদা বিশ্বস্তভাবে কাজ করে আছেন, তুমি তাদেরই বংশধর হয়ে এই হীন কাজ করেছে, একথা ভাবতেও তারা লজ্জাবোধ করবেন।

বিচারপতির কোনো কথাই তখন আমার কানে ঢুকছে না। আমি শুধু বিচারপতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম আমার শাস্তির মেয়াদ কত বছরের? পাঁচ-দশ-না পনেরো?

সমস্ত বিচার করে আমি তোমাকে ফাওয়ার্থ বন্দীশিবিরে দশ বছরের নির্বাসনদণ্ড দিলাম। বিচারপতি উঠে দাঁড়ালেন।

আমার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে লাগলো। প্রচণ্ড ক্ষোভ আর আফশোসের রুদ্ধ কান্না সমস্ত সত্ত্বাকে ভেঙে খানখান করে দিলো।

আগামী দশটা বছরের কথা চিন্তা করে হৃদপিণ্ড আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলো। মনে হলো গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে উঠি। দোহাই হুজুর, আমাকে কুড়ি–পঁচিশ-যত বছর খুশী কারদণ্ড দিন, কিন্তু ফার্ণওয়ার্থ–ভাবতেই পারছি না।

হঠাৎ আমার মাথার মধ্যে এক অদ্ভুত চিন্তা এসে ভীড় করলোরয়ই তো এসবের জন্য দায়ী। যদি কুপারকে না মারতো তবে তো আমাকে ফার্ণওয়ার্থে যেতে হতো না। হয়তো পাঁচ বছর জেল খেটেই রেহাই পেতাম।–শুধু রয়ের জন্যই আজ আমাকে ফার্নওয়ার্থে যেতে হচ্ছে।

এখন মুক্তি পাবার একমাত্র পথ রয়ের নাম জানিয়ে দেওয়া। মনস্থির করে নিয়ে এক ঝটকায় দাঁড়ালাম। মুখ তুলতেই চোখ পড়লো রয়ের চোখে।

ফ্রাঙ্কলিনের পাশে সোজা হয়ে রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে রয়। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় ওর মুখ মৃতের মত বিবর্ণ! সমস্ত রক্ত কেউ যেন শুষে নিয়েছে।

রয়ের দিকে চেয়ে মনে পড়লো আমাদের ছেলেবেলার কথা। সেই যখন আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম–গাছ থেকে ফল পাড়তাম–মাছ ধরতাম। এমনি আরও কতো ছোট ছোট ঘটনা ছবির মত ভেসে উঠলো মনের পর্দায়।বয়ই ছিলো আমার একমাত্র বন্ধু–এবং এখনও আছে। ওর দিকে তাকিয়ে আশ্বাসের হাসি হাসলাম। বোঝাতে চাইলাম যে, তোর কোনো ভয় নেই রয়। যততক্ষণ আমি বেঁচে আছি, এতটুকু বিপদের ছোঁয়া তোর গায়ে লাগতে দেবো না। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। রয়ের দিকে চেয়ে হাত নাড়লাম। ওর মুখ ঝাপসা হয়ে এলো।

 পেছন থেকে কনস্টেবলের ধাক্কা খেলাম। ধীরে ধীরে আদালতু ছেড়ে এগিয়ে চললাম। শেষ বারের মতো জেনির দিকে তাকালাম, ও কাঁদছে, হ্যাঁ সত্যিই ও আমার জন্য কাঁদছে।

ডুকরে কেঁদে উঠলাম। জলভরা চোখে ফিরে তাকালাম রয়ের দিকে। ওর চোখেও জল। মুখে কৃতজ্ঞ হাসি। যেন মুক্ত–আমি ওকে রেহাই দিয়ে গেলাম।

স্পষ্ট দেখতে পেলাম সামনে অপেক্ষা করছে অন্ধকার ভবিতব্য আর অসীম নরক–ফানওয়ার্থ! রক্তজমানো একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে।

একটা কথা ভেবে সান্ত্বনা পেলাম যে আমার বন্ধু রয়ের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমি ওকে বাঁচবার সুযোগ দিয়েছি। নিজের বিবেকের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না বারবার মনে হতে লাগলোরয়ের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি-ও আমার বন্ধু ছিলো–আছে এবং থাকবে।

এই ফার্নওয়ার্থ বন্দীশিবির হলো জমাট দুঃস্বপ্নের কুৎসিত নরক। কাগজপত্রে এই বন্দীশিবিরের বীভৎসতা নিয়ে বহুবার লেখালেখি হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে এই শিবির বন্ধ করার জন্য। তিনি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

জার্মান সৈন্যরা নাৎসী বন্দী শিবিরের জন্য আজও বিখ্যাত। সেখানে তারা অকথ্য অমানুষিক অত্যাচারের যেসব উপায় বের করেছিলো তা শুনে আজও সাধারণ মানুষের বুক কেঁপে ওঠে কিন্তু এহেন কুখ্যাত নাৎসী বন্দীশিবিরকেও হার মানতে হয়েছিলো ফার্নওয়ার্থের কাছে। এর বীভৎসতা নাকি কল্পনা করা যায় না।

খবরের কাগজের লেখা প্রবন্ধগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে ফার্নওয়ার্থকে নরকেরও নরক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সাধারণ জেলের মতো ফার্নওয়ার্থের চারিদিকে বিশাল উঁচু পাঁচিল এবং কয়েদীদের কুঠরি আছে, একথা ভাবলে ভীষণ ভুল করা হবে। ওসবের কোনো বালাই ফার্নওয়ার্থে নেই। এখানে কয়েদখানা বলতে ধূ ধূ করছে এক বিশাল তেপান্তরের মাঠ তার মাঝে একটা ঘর। পঞ্চাশ ফুট লম্বা, দশ ফুট চওড়া। ঘরে ঢোকবার একটাই দরজা, নিরেট লোহার তৈরী। এছাড়া মোটা লোহার গরাদ বসানো একটা ছোট্ট জানলা আছে–তাও প্রায় মাটি থেকে বিশ ফুট উঁচুতে। সেটা দিয়ে খুব সামান্যই আলো আসে।

পাহারাদার হিসেবে দিনের বেলায় আছে বন্দুকবাজ প্রহরীর দল, এদের মধ্যে ছজন অশ্বারোহী। তাদের শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে দু-মাইল দূর থেকেও লক্ষ্যভেদ করা যায়। বহুদূরে দেখা যায় এক চিলতে রূপোলী রেখানদী। তার তীরে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নলখাগড়ার ঝোঁপ। এছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।

অর্থাৎ দিনের বেলা ফার্নওয়ার্থ থেকে পালাবার চেষ্টা করা আত্মহত্যারই সামিল। দিনের বেলা ফার্নওয়ার্থ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

আর রাতের প্রহরী হলো একপাল রক্তলোপ হিংস্র হাউন্ড। তাছাড়া কয়েদিরা যাতে পালাতে না পারে তাই তাদের পায়ে লাগানো থাকে ভারী লোহার শেকল।

সবকিছু জেনেও প্রথমদিন ফার্নওয়ার্থে পা দিয়েই ঠিক করলাম যেভাবেই হোক এই জীবন্ত নরক ছেড়ে আমাকে পালাতে হবে। এখানে দশ বছর থাকলে পাগল হতে বাধ্য। এই নরককুণ্ডে দশ বছর কাটানোর চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো। যে করে হোক–যেমন করে থোক আমাকে পালাতেই হবে।

দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে গেলো। সকাল হলেই প্রহরীরা এসে আমাদের মাঠে নিয়ে যায়। নাম ডাকা হয়ে গেলে পোশাক ছেড়ে খালি গায়ে আমাদের কাজে যেতে হয়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

সাতাত্তর জন বিভিন্ন চেহারার কয়েদী দল বেঁধে এগিয়ে চলেছি–আর আমাদের দু-পাশে ঘোড়ায় চড়ে চলেছে তিনজন করে প্রহরী।

এরপর চলে পাথর ভাঙার কাজ। কাঠফাটা রোদে, খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাথর ভাঙতে হয়। দূরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই ছজন ঘোড়ায় চড়া প্রহরী। এছাড়া আর যে ছজন আছে, তারা পায়চারী করে বেড়ায়। হাতে তাদের ধরা থাকে শঙ্করমাছের লেজ দিয়ে তৈরী লিকলিকে চাবুক। কারো কাজে সামান্যতম ঢিলেমি দেখলেই সেই চাবুক সপাৎ করে আছড়ে পড়তে খোলা পিঠে। চামড়া ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরে পড়ে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রমের পর শ্রান্ত ক্লান্ত আমরা রক্তাক্ত দেহে ফিরে চলি কয়েদখানার দিকে। দিনের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসতে থাকে। চারিদিকে কেমন এক ক্লান্ত অথচ স্নিগ্ধ ভাব ফুটে ওঠে। দূরের কোন গির্জা থেকে ভেসে আসে ঢং ঢং আওয়াজ। সারা রাতের কথা মনে পড়লেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। কারণ ফার্নওয়ার্থের দিনগুলো যেমন বীভৎস, তার চেয়েও ভয়াবহ এর রাতগুলো।

কয়েদখানার ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে দেওয়ালে গাঁথা লোহার জালের তৈরী শোবার তাক। একটার নীচে একটা–তার নীচে আর একটা-এইরকম অসংখ্য তাক। ঘরে টিমটিম করে জ্বালা থাকে কয়েকটা মাত্র লণ্ঠন। যার আলো কয়েদখানার পরিবেশকে ভয়াবহ করে তোলে। লোহার জালের ছায়াগুলো ঘরের নোংরা তেলচিটে দেওয়ালে কেঁপে কেঁপে উঠে একটা অমানুষিক নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে।

সাতাত্তর জন কয়েদীকে গরু-ছাগলের মতো ঢোকানো হয় সেই ঘরে। দুর্গন্ধে ভরে ওঠে গোটা ঘরটা। স্নানের অভাবে আর অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রত্যেককেই এখন পাগলের মতো দেখায়, একরাশ ধুলো ভরা মাথার চুলে জট, গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। চোখে-মুখে হতাশা।

যে যার তাকে উঠে পড়ে শোবার আশায়। প্রহরীরা এসে প্রত্যেকের পায়ে শেকল লাগিয়ে তালা এঁটে দেয়। তারপর লণ্ঠনগুলো নিয়ে চলে যায়। নিঃসীম, জমাট অন্ধকারে ঘর ভরে যায়।

তার বের করা লোহার জালের ওপরেই গা এলিয়ে দিতে হয়। এতোটুকু নড়বার কোনো উপায় নেই। কারণ প্রত্যেকের পায়ের শেকলই একটা বিরাট লম্বা শেকলের সাথে বাঁধা। এই বিরাট শেকলটা, কয়েকটা আংটার সাহায্যে সেই পঞ্চাশ ফুট লম্বা ঘরের চার দেওয়ালের গা দিয়ে আটকানো, এমনভাবে যে কেউ যদি একটুও নড়াচড়া করে তবে বড় শেকলে টান পড়ার জন্য অন্যান্য সমস্ত কয়েদীর পায়েই টান পড়ে, এবং তাদের ঘুম ভেঙে যায়। নরকেও বোধ করি এর চেয়ে আরামে থাকা যায়। ঘুমের ঘোরে কোনো কয়েদী যদি আচমকা পাশ ফেরে, তবে শেকলে টান পড়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ার জন্যে পাশের কয়েদী হিংস্রভাবে তার সঙ্গে মারামারি শুরু করে দেয়। অন্ধকারেই ভেসে আসে আর্ত চীৎকার।

এই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে বারে বারেই আমার মনের মধ্যে পালিয়ে যাবার চিন্তাটা ঘোরাফেরা করতে লাগলো।

ফার্নওয়ার্থে রক্ষীর সংখ্যা মোট বারোজন। রাত হলে ওরা সকলেই ঘরে ফিরে যায়–শুধু একজন ছাড়া। তার নাম বাইফ্লিট। ওর কাজ, কুকুরগুলোকে দেখাশোনা করা। বাইফ্লিটের চেহারায় এমন একটা আদিম হিংস্র ভাব আছে যে রক্ত লোলুপ হাউন্ডগুলো পর্যন্ত ওকে দেখলে ভয় পায়। দিনেরবেলা কুকুরগুলো একটা বড়সড় লোহার খোঁয়াড়ে বন্ধ থাকে আর ওদের খাওয়ানো হয় দিনে মাত্র একবার। যার জন্য হাউন্ডগুলো বাঘের চেয়েও হিংস্র হয়ে থাকে।

রাত আটটার সময় অন্যান্য প্রহরীরা চলে গেলে বাইফ্লিট পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় কুকুরের খোয়াড়ের দিকে। ওর হাতে তখন থাকে একটা ভারী মোটা লাঠি। সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে ও গিয়ে খুলে দেয় খোয়াড়ের দরজা। একে একে বেরিয়ে আসে হিংস্র হাউন্ডের দল।

বাইফ্লিটের চেহারা দৈত্যের মতো বিশাল। বীভৎসকুৎসিত মুখ, ইচ্ছামতো ও কুকুরগুলোকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভোর চারটের সময় কুকুরগুলোকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। খোয়াড়ে।

রাত্রে আমার ঘুম আসে না। তাই রাতের পর রাত জেগে কাটাই আর শুনি ক্ষুধার্ত সারমেয় দলের রক্ত হিম করা গর্জন। রাতে শুয়ে পালাবার কথা চিন্তা করলেই নির্মম রসভঙ্গের মতো শুনতে পাই হাউন্ডগুলোর হিংস্র গর্জন। পায়ের তালা লাগানো শেকল বা ঘরের লোহার দরজা, এ দুটোর কোনোটাই আমার কাছে সমস্যা নয়। কারণ প্রথম রাতেই আমার লোহার জাল দিয়ে। তৈরী শোবার তাক থেকে অতিকষ্টে ইঞ্চি তিনেক লম্বা একটুকরো তার ভেঙে রেখেছিলাম। আঙুল কেটে রক্ত বের হলেও মন ভরে গিয়েছিলো আনন্দে। ঐ তার এবং সামান্য সময় পেলে ফার্নওয়ার্থের যে কোনো তালাই আমি খুলে ফেলতে পারি। সিন্দুক কোম্পানি আমাকে মন ভরার মতো পয়সা না দিতে পারলেও, পৃথিবীর কঠিনতম তালা কি ভাবে খুলতে হয় সেটা শিখিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই পালাবার চিন্তাটা আরো জমাট বেঁধেছে আমার উর্বর মস্তিষ্কে। কিন্তু রাত্রিতে হাউন্ডগুলোর হিংস্র গর্জন মনটাকে দমিয়ে দেয়, পালাবার চিন্তা করতে ভয় হয়।

দিনরাত মনে হয়, কিভাবে কুকুরগুলোর একটা ব্যবস্থা করা যায়, কিন্তু কিছুই আর মাথায় আসে না।

রোজ ভোরবেলা নাম ডাকার সময়, খোঁয়াড়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অসহায় ভাবেঅধভুক্ত কুকুরগুলোর দিকে চেয়ে দেখি। আমাদের দেখেই ওরা শিকার দেখার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খোঁয়াড়ের গরাদের গায়ে।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা দৃশ্য : একটা লোক রাতের অন্ধকারে ছুটছে আর তার পেছন পেছন নিঃশব্দে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলেছে দশটা হাউন্ড। মুহূর্তের মধ্যে কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর।

দাঁতে নখে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেললো তার দেহ। ওঃ কি ভয়ানক!

ফার্নওয়ার্থে প্রায় একমাস কাটানোর পর আমাকে ঢোকানো হলো রান্নাঘরের কাজে। সেখানে আমাকে জল তুলতে হয়, বাসন মাজতে হয়, মশলা পিষতে হয়–মশলা বলতে শুধু মরিচ। প্রত্যেক কয়েদীই এই কাজটাকে ভীষণ ভয় করে। এর চেয়ে বাইরে পাথরভাঙা ওদের কাছে অনেক ভালো।

বন্দীদের জন্য যা খাবার তৈরী হয় সে আর বলার নয়। দুর্গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসে। বিশ্রী গন্ধকে চাপা দেওয়ার জন্য পাঁচক ঐ মরিচের গুড়ো ব্যবহার করে থাকে। ঐ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাকে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। একদিন এই মরিচ পিষতে পিষতেই কুকুরগুলোকে বোকা বানাবার মতলব আমার মাথায় এলো। মনে মনে ভাবলাম রান্নাঘরের কাজটা নিয়ে বেশ ভালোই হয়েছে, বেশ উৎসাহ পেলাম। এতোদিনে একটা উপায়ের মতো উপায় খুঁজে পাওয়া গেল।

পর পর কয়েকদিন রান্নাঘরের কাজ করার পর কয়েদখানায় ফেরার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে পকেটভর্তি করে মরিচের গুঁড়ো নিয়ে এলাম। পাঁচক জানতেই পারলো না। সেই মরিচকে একটা ছোট্ট পুটলি করে আমার শোবার তাকের এককোণায় লুকিয়ে রাখলাম। কারণ এই মরিচই এখন আমার প্রাণ।

এইভাবে পালাবার পথে আমি দু-ধাপ এগিয়ে গেলাম।

প্রথমতঃ দরজা খুলতে আমার অসুবিধা হবে না আর দ্বিতীয়তঃ কুকুরগুলোকে অনুসরণ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমার সঙ্গে রয়েছে মরিচ। সুতরাং এ দুটো জিনিসের সাহায্যে আমি মাঠ ছাড়িয়ে অন্ততঃদূরে নদীর কাছে পৌঁছতে পারবে। আর তারপর লুকোবার জন্যে নদীর পাড়েই তো রয়েছে ঘন নলখাগড়ার ঝোঁপ। সুতরাং ফাঁকা মাঠ পার হয়ে নদী পর্যন্ত আমাকে পৌঁছতে হবে। তারপরই ভরসা ঐ নলখাগড়া।

এসবকথা ভাবতে ভাবতেই কয়েকদিন পেরিয়ে গেলো। কোনো সমাধানেই পৌঁছতে পারলাম না। তারপর একদিন-রয়ের কাছে থেকে শেখা,কুপারের দারোয়ানকে পটানোর বুদ্ধির কথা মনে পড়লো-আর দেরী না করে পরদিন সকালে রান্নাঘরে পৌঁছেই রাধুনি ব্যাটার সঙ্গে সুযোগ বুঝে সুখদুঃখের গল্প জুড়ে দিলাম। আমি কায়দা করে জেনে নিলাম প্রহরার ব্যাপারটা। বাইফ্লিটের গতিবিধির কথা ওর থেকেই জেনে নিলাম।

প্রতিদিন রাত আটটায় অন্যান্য প্রহরীরা বাইফ্লিটের ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে ঘুমোতে চলে যায়। বাইফ্লিট কয়েদখানার দরজায় তালা দিয়ে খোঁয়াড়ে গিয়ে কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেয়। তারপর অদুরে এক কুঁড়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ভোর চারটের সময় বাইফ্লিট কুঁড়েঘর ছেড়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায়। সেখানে কুকুরগুলোর জন্যে দুটো ঝুড়িতে মাংসের ছাঁট রাখা থাকে। সেই ঝুড়ি দুটো নিয়ে বাইফ্লিট খোঁয়াড়ে যায়। কুকুরগুলোও ওকে অনুসরণ করে। খোয়াড়ের ভেতর ঢোকার পর ওদের খাওয়া শুরু হয়। শুয়ে শুয়েই শোনা যায় কুকুরগুলোর বীভৎস চীৎকার। কেউ কেঁউ শব্দ শুনলেই মনে হয় বাইফ্লিট লাঠি দিয়ে প্রয়োজন মতো মারছে। এমনি করে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সাড়ে চারটের সময় খেয়াড় বন্ধ হয়ে যায়। তার পরেই শোনা যায় বৈদ্যুতিক বাঁশীর কানফাটানো শব্দ–এটাই ছিল বাইফ্লিটের প্রতিদিনের সংকেত। এরপরই কয়েদীরা জেগে যায়। এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হয় না। ঠিক করে ফেললাম, যখনই বাইফ্লিট চারটের সময় কুকুরগুলোকে খাওয়াতে শুরু করবে, তখনই কয়েদখানার দরজা খুলে ছুট লাগাবোসোজানদীর দিকে।

হাতে সময় খুব কম পাওয়া যাবে পালাবার জন্য। তবুও তার মধ্যেই পালাতে হবে। ঠিক মতো মাথা ঠাণ্ডা রেখে যদি দৌড়োতে পারি তবে নদী পর্যন্ত পৌঁছতে মিনিট ছয়েকের বেশী লাগবে না। তারপর থেকেই কুকুরগুলোকে ধোঁকা দেবার জন্য মরিচের গুঁড়ো কাজে লাগাবো। প্রহরীরা যদি খুজতে বের হয় তবে তখনকার মতো নলখাগড়ার ঝোপে গা ঢাকা দিলেই হবে। সকলের চোখ এড়িয়ে চলার পক্ষে রাতের অন্ধকার আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করবে। এইভাবে শুধু রাতের অন্ধকারই আমাকে সাহায্য করবে রেললাইন পর্যন্ত পৌঁছতে। ফার্নওয়ার্থ থেকে রেললাইনের দূরত্ব কুড়ি মাইল। সেখানে পৌঁছতে পারলে আর কোনো ভয় নেই। যে কোনো ট্রেনে উঠে ওকল্যান্ডে নামলেই হলো। এই জেলার মধ্যে ওকল্যান্ডই সবচেয়ে বড় শহর। সেখানে লোকের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বেশী সময় লাগবে না।

আমার সামনে এখন একটা বিরাট সমস্যা রয়েছে। পায়ে লাগানো শেকলের তালা খুলতে আমার কয়েক সেকেন্ড মাত্র লাগবে। কিন্তু কয়েদখানার ভারী দরজা খোলা অতো অল্প সময়ে হবে না। ওই দরজা খোলার সময় অন্য কোন কয়েদী যদি জেগে ওঠে এবং চীৎকার শুরু করে দেয়, আর তা যদি বাইফ্লিটের কানে যায় তাহলেই সর্বনাশ হবে।

পালাবার পথে যখন এতোটা এগিয়ে এসেছি তখন এই সামান্য সমস্যার নিখুঁত কোনো সমাধান না করে এক পা-ও এগোচ্ছি না। তাতে যদি দু-একদিন দেরী হয় তো হোক।

হঠাৎ বয়েডের কথা আমার মনে পড়ে গেলো–ওকে দিয়েই কাজ হবে।

প্রত্যেক কারাগারেই এমন একজন কয়েদী থাকে যাকে অন্যান্য কয়েদীরা তার দৈহিক শক্তির জন্য ভয় পায়। এখানেও এমনি এক মস্তান আছে তার নাম জো বয়েড। বয়েড লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির বেশী হবে না, কিন্তু চওড়ায় সাধারণ মানুষের দ্বিগুণ। মুখভর্তি কাটা দাগ। সম্ভবতঃ ছুরির আঘাতেই হয়েছে। নাকটা মুষ্টি যোদ্ধাদের মতো চ্যাপ্টা। জ্বলজ্বল করছে কুতকুতে দুটো চোখ। মোট কথা বয়েডের চেহারা অনেকটা গরিলার মতো।

বয়েডের শোবার তাক আমার ঠিক নীচেই। জানতাম ওকে যদি পটিয়ে আমার সঙ্গে টানতে পারি তাহলে দরজার তালা খোলার ব্যাপারে আর অসুবিধা হবে না। তবে বয়েডকে বোঝানো একটু অসুবিধা হবে, কারণ ও কারো সঙ্গেই কথা বলে না। সবসময় নিজের মনে চুপচাপ বসে থাকে। এসব ভাবতে ভাবতে অর্ধেক রাত পার হয়ে গেলো। শুয়ে শুয়ে বয়েডের শ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর শব্দ শুনতে লাগলাম। ভাবলাম ওকে আমার মতলবের কথা জানাবো। হাজার হোক ও বন্দী তো, মুক্তির স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছা ওর নিশ্চয়ই হবে।

রাত তখন প্রায় দুটো। ঠিক করলাম বয়েডকে সব বলবো। এটুকু ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে না হলে পালানো সম্ভব হবে না।

মন ঠিক করে পায়ে লাগানো শেকলের তালা খুলে ফেললাম। উপুড় হয়ে লোহার জালের ফাঁক দিয়ে তাকালাম। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে কিছুই চোখে পড়ে না। অ্যাই বয়েড! চাপা ফিসফিস স্বরে ওকে ডাকলাম।

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো শ্বাস-প্রশ্বাসের ভারী শব্দ। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও বুঝলাম ওর সন্দেহঘন জ্বলজ্বলে চোখজোড়া আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

সে চাপা স্বরে জানতে চাইলো, কি ব্যাপার!

আমি বললাম, আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমি এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছি। তুমি কি আমার সঙ্গে আসবে?

বয়েড যেন আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলো না।

আমি বললাম, বাইফ্লিট যখন কুকুরগুলোকে খাওয়াতে শুরু করবে সেই সময়েই সুযোগ বুঝে আমরা পালাবো নদীর দিকে। সেখান থেকে রেললাইন ধরে এগিয়ে যাবো। তুমি রাজী থাকলে বলো তোমার পায়ের শেকল খুলে দিই। আমারটা আমি খুলে ফেলেছি।

বয়েড সব শুনে রাজী হলো। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে নীচে নামলাম তারপর তারের টুকরোটা দিয়ে কাজ শুরু করলাম। মিনিটখানেকের মধ্যে তালাটা খুলে ফেললাম। শেকলটা খুলে ঠং করে জালের ওপর পড়লো।

আমরা দুজনে ঠিক করলাম বাইরে বেরিয়েই একসঙ্গে নদীর দিকে ছুটবে। সেখানে পৌঁছে দুজনে দুদিকে যাবো। বাইফ্লিট সম্ভবতঃ কুকুরগুলোকে আমাদের পেছনে লেলিয়ে দেবে; কিন্তু কোনোরকমে যদি নদীটা পার হতে পারি তবে কুকুরগুলো আর আমাদের গন্ধ পাবে না।

আমরা অপেক্ষা করে থাকলাম আসন্ন মহেন্দ্রক্ষণের জন্য।

কয়েদখানার দেওয়ালে ভোরের হালকা রূপোলী আলোর আভা জানলা দিয়ে এসে পড়েছে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দরজার তালায় হাত লাগাবো। মরিচের পুটলিটা তাকের কোণা থেকে বের করে জামার ভিতর গুঁজে নিলাম। ভুলেও এর একটি কণাও আমি বয়েডকে দিচ্ছিনা। এর প্রতিটি কণাই আমার কাজে লাগবে। এই মরিচের গুঁড়োর ওপরেই আমার মরণ-বাঁচন নির্ভর করছে।

স্থির চোখে জানলার দিকে চেয়ে আছি সোনালী রোদের আশায়। কানে আসছেবয়েডের শ্বাস প্রশ্বাসের গভীর শব্দ।

কানে এলো হাউন্ডগুলোর হিংস্র গর্জন, ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো।

 ঐ–ঐ হাউন্ডগুলো বয়েডের স্বর ভয়ে কাঁপছে। বুঝলাম ও ভীষণ ভয় পেয়েছে।

আশ্চর্য! বয়েডের মতো বুনো গরিলা পর্যন্ত ঐ কুকুরগুলোকে ভয় পায়!

সময় যেন আর কাটতে চায় না। ক্রমে উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষার অবসান হলো। কয়েদখানার ছোট্ট জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঠিকরে পড়লো এক ফালি সোনালী রোদ। একসময় বুঝতে পারলাম যে আমাদের পালাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

উত্তাল হৃৎপিণ্ড আছড়ে পড়ছে বুকের খাঁচায়। আর অপেক্ষা করতে হলো না। কানে এলো কুকুরগুলোর উল্লসিত চীৎকার। অর্থাৎ বাইফ্লিট ওর কুঁড়েঘর ছেড়ে রান্নাঘরে যাচ্ছে। না–আর দেরী নয়।

দুজনে তাক থেকে মেঝেতে লাফিয়ে নামলাম। ঘর ভর্তি সব কয়েদী ঘুমে অচেতন। নিঃশব্দে আমরা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। তালাটা যতটা শক্ত ভেবেছিলাম ততোটা শক্ত নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে গেলো। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কেননা কয়েদীরা কেউ জেগে উঠলো না। বাইরে বাইফ্লিটের ধমকানির শব্দ শুনে বুঝলাম কুকুরগুলো এখন খেতে ব্যস্ত।

আস্তে আস্তে দরজা ফাঁক করে বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় পা রাখলাম। আমার পেছন পেছন বয়েড বাইরে এলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দূরে খোয়াড়ের দিকে তাকালো। ও ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে ওকে মারলাম এক ধাক্কা। বয়েড চটপট বলে সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলাম দৌড়। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাওয়ার বেগে ছুটে চললাম।

বয়েড আমার মতো জোরে দৌড়োতে পারছে না তাই ও আমার থেকে অনেক পিছনে রয়েছে। চারিদিকে ধু ধু প্রান্তর তার ওপর দিয়েই ছুটে চলেছি। লক্ষ্য দূরের নদী। নিজেকে বড়ো বেশী অসহায় মনে হতে লাগলো। জোরে দৌড়োবার চেষ্টা করছি।

হঠাৎ–ভোরের শান্ত পরিবেশের নিঃস্তব্ধ পর্দা বিদীর্ণ করে ভেসে এলো রিভলভারের শব্দ-ছুটতে ছুটতে চকিতে পেছনে তাকালাম।

বাইফ্লিট খোয়াড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা একটা ৪৫ বোরের রিভলভার।

বয়েড এঁকেবেঁকে দৌড়োচ্ছিলো। ওর ঠিক হাত পাঁচেক দুরে রিভলভারের একটা গুলি বেরিয়ে গেলো। আমি আরো জোরে ছুটতে শুরু করলাম।ছুটতে ছুটতে আর একবার পেছনে তাকালাম। বয়েড প্রায় দুশো গজ পিছিয়ে পড়েছে।

পরমুহূর্তে কানে এলো সেই বৈদ্যুতিক বাঁশির কান ফাটানো শব্দ। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই অশ্বারোহী রক্ষীরা আমাদের পেছনে ধেয়ে আসবে।

তাড়াতাড়ি নলখাগড়ার ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। তাড়াতাড়ি ঝোঁপ ভেদ করে নদীর কিনারায় পৌঁছে বাঁদিকে এগিয়ে চললাম। পাড় ধরে একশো গজ মতো গিয়ে আবার ঢুকে পড়লাম দুর্ভেদ্য নলখাগড়ার ঝোপে, লুকিয়ে পড়লাম।

কয়েক সেকেন্ড বাদে বয়েড ঝোঁপ ভেদ করে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। আমার থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ঝোঁপের মধ্যে আমাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলো না।

আমার একেবারেই ইচ্ছা নয় যে বয়েড আমার সঙ্গে আসুক। আমি পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলাম।

বয়েড নদীতে নামতে শুরু করলো। দু-একবার থেমে পিছনে তাকালো। তারপর জলে নেমে বলিষ্ঠ হাতে জল কেটে সাঁতরে এগিয়ে চললো ওপারে।

এবারে মরিচের পুটলিটা বের করে প্যান্টের গোড়ালির ভাঁজগুলো ঐ গুঁড়ো দিয়ে ভর্তি করলাম যাতে ছোটবার সময় মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ে আমার পায়ের গন্ধ ঢেকে দেয়।

ঝোঁপ ছেড়ে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চললাম। কিছুটা যাবার পর ছুটতে শুরু করলাম। একটু পরেই কানে এলো ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। ঝড়ের বেগে নদীর দিকে ছুটে আসছে প্রহরীরা। এখুনি গা ঢাকা না দিলে আর উপায় নেই। লুকোবার একটা ভালো জায়গা খুঁজতে লাগলাম।

বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে–ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে উঠেছে। ঝোঁপের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। একটু পরেই শুনতে পেলাম খস খস শব্দ। রক্ষীরা ঝোঁপ ভেদ করে নদীর দিকেই আসছে।

হঠাৎ এক প্রচণ্ড উল্লসিত চীৎকারে চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই কানে এলো জলে কারা যেন আঁপিয়ে পড়লো। মনে হলো হয়তো কোনো প্রহরী ঘোড়া নিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে যাচ্ছে।

রাইফেলের শব্দ পেলাম। আর একটি ঘোড়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কানে ভেসে এলো একাধিকবার গুলির শব্দ।-উৎকণ্ঠা আতঙ্কে মাথা গুঁজে পড়ে রইলাম।

ওরা কি তাহলে বয়েডকে দেখতে পেয়েছে?–অদম্য কৌতূহলে মাথা তুললাম। দেখি, একজন অশ্বারোহী প্রহরী ঘোড়া নিয়ে সাঁতরে ওপারে যাচ্ছে–হাতে তার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। কানে এলো কানফাটানো শব্দ–হঠাৎ দেখি বয়েড ওর লুকোনো জায়গা ছেড়ে এক লাফে নদীতে এসে পড়লো। লক্ষ্য করলাম নদীর ওপাড়ের রক্ষীটি তার ঘোড়া থেকে নেমে রাইফেল বাগিয়ে তাক করছে বয়েডকে লক্ষ্য করে। সাঁতার কাটতে থাকলেও বয়েড বোধহয় আন্দাজ করেছিলো এই আসন্ন বিপদের কথা। কারণ হঠাৎই ও জলের মধ্যে ডুব দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গর্জন-গুলির আঘাতে খানিকটা জল ছলকে উঠলো শূন্যে।

দেখলাম আর একজন প্রহরী দেরী করে ঘোড়া নিয়ে জলে নেমে পড়লো। ঘোড়াটা সাঁতরে বেশ কিছুটা এগিয়েছে এমন সময় বয়ে ভেসে উঠলো। প্রহরীটি বয়েডকে দেখতে পেয়েই ঘোড়াটাকে সেদিকে এগিয়ে নিয়ে চললো। মুহূর্তের মধ্যে বয়েড আবার ডুব দিল।

 বয়েড বোধহয় বুঝতে পারছিলো এভাবে সাঁতার কাটলে ও নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছোতে পারবে না তাই ও ডুব সাঁতার দিয়ে প্রহরীটির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। একটু পরেই দেখলাম লোকটার পেছনে ভেসে উঠেছে। মনে মনে বয়েডের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না।

প্রহরীটি বয়েডকে দেখতে পায়নি কিন্তু ওপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি ওকে দেখতে পেয়েই বিকট চীৎকার করে উঠলো, ওই যে তোর পেছনে। জলের অশ্বারোহী রক্ষীটি বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে রাইফেলের বাঁট সজোরে নামিয়ে আনলো বয়েডের মাথায়। কিন্তু বয়েড অসামান্য ক্ষিপ্রতায় মাথা সরিয়ে নিলো। লোকটার কুজি ধরে একটানে জলে নামিয়ে আনলো। জল তোলপাড় করে শুরু হলো ধস্তাধস্তি। কিন্তু লোকটা অসহায় হয়ে পড়লো বয়েডের পশু শক্তির কাছে, ভীষণভাবে জল তোলপাড় শুরু হলো।

একটু পরে বয়েড একা ভেসে উঠলো। তাড়াতাড়ি গিয়ে সাঁতরে যাওয়া ঘোড়াটাকে ধরে এমনভাবে তার আড়ালে ভেসে এগিয়ে চললো, যাতে ওপাড়ের প্রহরীটি গুলি করতে না পারে। মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি সাঁতরাবার জন্য ঘোড়াটাকে খোঁচা মারতে লাগলো। লোকটা বয়েডের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু পরমুহূর্তেই একলাফে ঘোড়ায় চাপলো। তীরের বেগে ঘোড়া সমেত নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বয়েডকে অনুসরণ করলো।

ওদিকে বয়েড ঘোড়াটাকে নিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছে মাঝে মাঝে খিস্তি দিয়ে ঘোড়াটাকে তাড়াতাড়ি যাবার জন্য ধাক্কা মারছে।

হঠাৎ বয়েড ঘোড়া ছেড়ে জলের মধ্যে ডুব দিলো। ও ডুব দেওয়া মাত্রই অনুসরণরত অশ্বারোহী প্রহরীটি সতর্ক হয়ে হাতে রাইফেল তুলে নিলো। চারিদিকে নজর রাখতে লাগলো। কোথায় বয়েড ভেসে ওঠে।

বয়েড ডুব সাঁতারে প্রহরীর দূরত্বটা ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি। ভুলক্রমে ও লোকটার পাশেই ভেসে উঠলো। মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝেড়ে বিদ্যুৎগতিতে তাকে ধরতে গেলে কিন্তু লোকটা খুব সতর্ক ছিলো। উদ্যত রাইফেলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করলো মাথায়। বয়েড চেষ্টা করেও সে আঘাত এড়াতে পারলো না। সোজা তলিয়ে গেলো। একে একে সেখানকার জল ফিকে লাল–লাল–গাঢ় লাল হয়ে উঠলো।

লোকটা ঘোড়া নিয়ে তাড়াতাড়ি পাড়ে এসে উঠলো। অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে বয়েডের ভেসে ওঠার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই বয়েডকে দেখা গেলো। ওর দেহটা উপুড় হয়ে ভাসছে–এগিয়ে চলেছে স্রোতের টানে। ভাসতে ভাসতে কিছুদূর গিয়ে দেহটা নদীর পাড়ে ঠেকে রইলো। ওদিকে অন্য প্রহরীর মৃতদেহটা ওপাড়ে ভেসে উঠেছে।

অপেক্ষমান রক্ষীটি চোখ বুলিয়ে মৃতদেহ দুটো দেখলো। তারপর ঘোড়ার পিঠে উঠে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো।

নলখাগড়ার বোপ ভেদ করে ঝড়ের বেগে ছুটে চললো। ছুটে চললো ফার্নওয়ার্থের দিকে। ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ যতক্ষণ না মিলিয়ে যায় ততোক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর খুব সাবধানে লুকোনো জায়গা ছেড়ে বাইরে এলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নদী পার হয়ে পালাতে হবে।

আমার পালানোর কথা জানার পর জেলার প্রতিটি পুলিশ আমাকে খুঁজে বেড়াবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি পুলিশ ফাঁড়িকে আমার চেহারার বিবরণ জানিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হবে নাঃ, দেরী করলে হবে না। যেমন করেই হোক একটা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে হবে।

প্যান্টের ভাঁজে ছাড়া যে অবশিষ্ট মরিচটুকু পুটলিতে ছিলো, সেটাকে ভালো করে বাঁধলাম। এর মধ্যেই সূর্য মাথার ওপর চলে এসেছে। রোদের অসহ্য উত্তাপ এখনই অনুভব করতে পারছি। আর দেরী না করে ছুটে চললাম। প্যান্টের ভাজ থেকে মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। যাক, কুকুরগুলোর জন্য আর চিন্তা নেই-অক্লান্তভাবে ছুটে চললাম।

নদীর পাড় ধরে ঘণ্টা দুই দৌড়বার পর ঠিক করলাম এবারেনদী পার হতে হবে। এখান থেকে রেললাইন প্রায় ষোলো মাইল দূরে। নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। মরিচের পুঁটলিটা ভাজ করলাম। প্যান্টের মধ্যে। তারপর কোমরের বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধলাম। এবারে নদীর শীতল জলে গা ভাসালাম।

.

০৩.

 বিকেল হয়ে গেছে। রোদের তাপ অনেকটা কমে এসেছে। একটা বিশাল গাছের ছায়ায় অবসন্ন দেহে শুয়ে আছি। সামনেই পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে তার কোল ঘেঁষে বড় রাস্তা। একজন পুলিশ অফিসার ঝড়ের গতিতে মোটর বাইক চড়ে ছুটে চলেছে। তার পেছন পেছন একটা ওয়্যারলেস ভ্যান। খুব সম্ভব আমাকেই খুঁজছে।

রেললাইন এখনও পাঁচ মাইল দূরে। অপেক্ষা না করে দৌড়োলে হয়তো অনেক আগেই ওখানে পৌঁছে যেতাম, কিন্তু দিনের বেলায় এ জায়গাটা পার হওয়া উচিত হবেনা। চারিদিকে খাঁ খাঁ করছে। অদূরে একটা গোলাবাড়ি ছাড়া লুকোবার আর কোনো জায়গাই নেই। অগত্যা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা না করলেই নয়।

এই গোলাবাড়িটা চারিদিকে বুকসমান উঁচু কাঠের বেড়ার মাঝখানে অবস্থিত। আর তার পাশেই টিনের চালা দেওয়া একটা গুমটিঘর। চারিদিকের বেড়ার এককোণে একটা কাঠের দরজা।

হঠাৎ চোখে পড়লো গোলাবাড়ি থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রথমে মেয়েটিকে ততটা গুরুত্ব দিই নি কিন্তু ওর হাতের দিকে নজর পড়তেই আমার জিভে জল এলো। অসম্ভব খিদে পেয়েছে। মেয়েটি তরমুজের ঝুড়িটা নিয়ে গুমটিঘরে ঢুকে পড়লো। একটু পরেই খালি হাতে বেরিয়ে এলো। আবার গোলাবাড়ির দিকে ফিরে চললো।

ঠিক করলাম অন্ধকারের মধ্যেই কয়েকটি তরমুজ শেষ করতে হবে। কারণ পেটে কিছু না পড়লে পথ চলা অসম্ভব।

ঘণ্টা দুই পরে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নেমে এলো চারিদিকে। বড় রাস্তায় যানবাহন চলাচল ফিকে হয়ে এলো। গোলাবাড়ির ভেতর কতকগুলো ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। অন্ধকারে কারো নজরে পড়ার ভয় নেই দেখে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে এগিয়ে চললাম। পাহাড়ী ঢালু জমি ধরে এক ছুটে গিয়ে পৌঁছলাম বড়রাস্তায়। এগিয়ে চললাম বাড়িটার দিকে। কাঠের বন্ধ দরজাটা টপকে ভেতরে নামলাম। ছুটে গিয়ে টিনের চালা দেওয়া গুমটি ঘরে আশ্রয় নিলাম। অন্ধকারেই নাকে এলো তরমুজের সুস্বাদু গন্ধ। খিদেটা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলাম, হাতে ঠেকলো তরমুজের স্তূপ। মনে হলো এরা তরমুজের চালানদার। একটা বড় দেখে তরমুজ তুলে নিয়ে দাঁত বসালাম। কয়েকটা তরমুজ খাওয়ার পর পেটের খিদে কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে তরমুজের জুপের পেছনে আশ্রয় নিলাম। শুয়ে পড়তেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো।

হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। একলাফে উঠে দাঁড়ালাম। গুমটিঘরের খোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়লো দূরের ধূসর পাহাড়। তার পেছন থেকে উঁকি মারছে ভোরের সূর্য। ভোরের বিবর্ণ আলো এসে ঠিকরে পড়েছে ঘরের ভিতরে।

একটা অজানা ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরলো। এতোক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছি কেউ আমাকে দেখে ফেলেনি তো?

আমার পরনে কয়েদীর ডোরাকাটা পোশাক। এই পোশাকে যদি দিনের বেলায় বের হই তবে নির্ঘাত ধরা পড়তে হবে। সুতরাং রাত পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই। ঘণ্টাখানেক কোনো রকমে কাটাবার পর হঠাৎ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলে উঠলো–ঘরে কেউ ঢুকেছে।

কানে এলোনড়াচড়ার শব্দ। সাবধানে মাথা তুলে উঁকি মারলাম। দেখি, আগের দিনের মেয়েটি তরমুজগুলোকে বেছে সরিয়ে রাখছে একধারে। ওর বয়স হবে সতেরো, গায়ের রঙ বাদামী। দেখতে খুব একটা সুন্দরী না হলেও কেমন যেন একটা আলগা আকর্ষণ আছে। হয়তো ওর উদ্দাম সপ্তদশী যৌবনই এর জন্য দায়ী। চটপট অভ্যস্ত হাতে মেয়েটি কাজ করে চলল। আমাকে ও দেখতে পায়নি। ঝুঁকে পড়ে বড় তরমুজগুলো ও আলাদা করে রাখছে।

মেয়েটিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে আমি মেয়েটির চোখে পড়ে গেছি। পলকের জন্য ওর হাত দুটো থেমে গেলো। মনে হলো ও ভয় পেয়ে গেছে। এখুনি কিছু করা দরকার। নয়তো বাইরে বেরিয়ে মেয়েটি যে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবে, তাতে আর সন্দেহ নেই। ওর মুখে কেমন একটা চাপা উত্তেজিত ভাব।

আড়াল থেকে বাইরে এসে বললাম, ভয় পেয়োনা।

 বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটি। ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। আতঙ্কে ওর গলা দিয়ে স্বর বের হলো না–ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার দিকে তাকিয়ে গোঁফ দাড়ির জঙ্গল দেখে মেয়েটা আরো ভয় পেয়েছে।

ভয় নেই, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবোনা।স্থির চোখে ওকে লক্ষ্য রেখে আশ্বাস দিলাম।

মেয়েটির পরনে একটা চাপা প্যান্ট, আর লাল সাদা চেক টানা শার্ট। ও দেওয়ালে হেলান দিয়ে উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগলো। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওর উন্নত স্তনদ্বয় একবার উঠছে, একবার নামছে।

খবরদার আমার কাছে এসো না। চাপা তীক্ষ্ণঋরে ও আর্তনাদ করে উঠলো।

আমি আশ্বাসের নরম সুরে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, পুলিশ আমাকে খুঁজছে-আমি– ফার্নওয়ার্থ থেকে পালিয়ে এসেছি। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে–তাছাড়া কিছু জামাকাপড় দরকার।

দেখলাম এতক্ষণে মেয়েটির ভয় অনেকটা কমে এসেছে। ও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো–আমি এখানে কেন এসেছি?

আমি জানালাম, দূর থেকে তরমুজগুলো দেখে খিদের জ্বালায় নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। খাওয়াদাওয়ার পর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম রাতের অন্ধকারে রেললাইন পর্যন্ত গিয়ে কোনো ট্রেনে উঠে পালাবো, কিন্তু পুলিশ রেললাইন পাহারা দিচ্ছে–

আমাকে বাধা দিয়ে মেয়েটি বলে উঠলো, গত রাতে রেডিওতে বলেছে; তুমি রেললাইনের দিকে যাবে বলেই পুলিশ সন্দেহ করছে। কিন্তু ফার্নওয়ার্থে যাবার মতো তুমি কি করেছিলে?

আমি মেয়েটিকে একে একে সব কথা খুলে বললাম, কিছুই গোপন করলাম না। অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ও সব কথা শুনতে লাগলো। ওর মুখে কেমন যেন করুণার ভাব ফুটে উঠলো। মমতায় ওর গভীর দুই চোখ ছলছল করে উঠলো।

সব বলতে পেরে মনটা যেন হালকা হলো।

ফার্নওয়ার্থে আমি কিছুতেই ফিরে যাবো না। তুমি যদি সাহায্য না করো, তাহলে আমার আর কোনো উপায় নেই। ওখানে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আমি আত্মহত্যা করবো।

মেয়েটি অনেকক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এলো। ফার্নওয়ার্থ সম্বন্ধে আমিও কাগজে পড়েছি। সব কথা শোনার পর তোমাকে ওখানে ফেরৎ পাঠাতে আমার বিবেকে বাধছে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।

মেয়েটি গুমটি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মুহূর্তের জন্যে দ্বিধাগ্রস্ত মনে ভয় এসে উপস্থিত হলো, ওকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? কিন্তু এছাড়াও তো আর কোনো উপায় নেই। ও যদি পুলিশে খবর দেয় তবে সেটাকে দুর্ভাগ্য বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি?

হঠাৎ দেখা গেলো মেয়েটি এগিয়ে আসছে, ডান হাতে ঝোলানো এক বালতি গরম জল, আর বাঁ-হাতে একটা তোয়ালে, সাবান, ক্ষুর আর কিছু জামা কাপড়। বালতিটা সামনে রেখে, জামাকাপড়গুলো ও আমার হাতে দিলো, হাত-পা ধুয়ে এগুলো পরে নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।

মিনিট দশ পরে ও ফিরে এলো, ততক্ষণে আমার হাত-পা ঘোয়া, দাড়ি কামানো–সব হয়ে গেছে। কয়েদীর পোষাক ছেড়ে ওর দিয়ে যাওয়া পোষাকগুলো পরে ফেলেছি, লক্ষ্য করলাম ওর হাতে খাবারের ট্রে, তাতে মাংস, ডিম সেদ্ধ আর কফি, আমার কাছে সেটাই যথেষ্ট মনে হলো।

খাওয়াদাওয়ার শেষে মেয়েটি আমার দিকে এক প্যাকেট সিগারেট এগিয়ে দিলো। সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়লাম। নিজেকে বেশ সুস্থ-সতেজ মনে হলো।

মেয়েটি আমাকে বললো, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এই তরমুজগুলো নিয়ে যাবার জন্যে একটা ছেলে ট্রাক নিয়ে আসবে, রোজ এই একই সময়ে এখানে আসে। এখানেই খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সোজা যায় ওকল্যান্ডের বাজারে। সেখানে ট্রাক রেখে টাকার তাগাদায় যায়-ও এসে যখন বাড়িতে খেতে ঢুকবেতখন তুমি গিয়ে ওর ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে পড়বে। তারপর ওকল্যান্ডে পৌঁছে, চুপিসাড়ে নেমে পড়বে।

মেয়েটির কথায় রাজি হলাম। ওকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আমার চোখে জল এসে গেলো।

একটু পরে ট্রাক এসে পৌঁছলো। চালক একটি অল্পবয়সী ছেলে, সে ট্রাক রেখে ভেতরে যেতেই গাড়ির পেছনে উঠে পড়লাম।

তারপর এক সময় ট্রাক ছেড়ে দিলো, একটু পরে দেখলাম বিকেলের রোদ তখন ঝিমিয়ে এসেছে, দূরে দেখা যাচ্ছে সেই গোলাবাড়িটা, তার দরজায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। পড়ন্ত রোদ্দুর ওর লাল সাদা ডোরা কাটা শার্টের গা থেকে ঠিকরে পড়ছে। মেয়েটি আস্তে আস্তে হাত তুলে আমাকে উদ্দেশ্য করে নাড়তে লাগলো। ট্রাক ক্ৰমশঃ এগিয়ে চললো– নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে নেমে এলো অশ্রু।

এই সুন্দর স্মৃতিটুকু একান্ত আমার করেই সযত্নে তুলে রাখবো মনের মনিকোঠায়। অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনের পথে এ স্মৃতিটুকুই হোক আমার একমাত্র সঙ্গী।

ফার্নওয়ার্থ থেকে পালাবার চারদিন পরে লিট্‌ল ক্রীকে এসে পৌঁছলাম। ওকল্যান্ড থেকে একটা মালগাড়ি ধরে প্রায় এক হাজার মাইল পার হয়ে, এসে উপস্থিত হয়েছি এই লিটু ক্রীকে।

মাথার ওপর দুপুরের চড়া রোদ। রাস্তাঘাট নির্জন। মাঝে মাঝে দু-একজন পথচারী চোখে পড়ছে।

মেয়েটি যে পাঁচ ডলার দিয়েছিলো তা থেকে অবশিষ্ট মাত্র এক ডলার। ওকল্যান্ড থেকে ট্রেনে করে এখানে আসবার পথে কিছুই পেটে পড়েনি। অদূরেই একটা স্ন্যাকবার দেখতে পেলাম। এগিয়ে গেলাম। দোকানে ঢুকে স্যান্ডউইচ আর কফি আনতে বললাম। ভাবতে লাগলাম, এরপর কোথায় যাবো।ট্রপিকা স্প্রিংসের দূরত্ব এখান থেকে প্রায় দুশ মাইল। সেখানে পৌঁছবার একমাত্র উপায় কোনো চলতি গাড়ি বা ট্রাকে আশ্রয় নেওয়া। একটি লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে একটা পেট্রোল পাম্প আছে–তার নাম পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন। এর পরের পেট্রোল পাম্পটা একেবারে পাহাড়ের ওপারে–একশো ষাট মাইল দূরে সেই কারণে এর মালিক কার্ল জেনসন নাম দিয়েছে পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন–অর্থাৎ শেষ সীমান্ত। তাছাড়া এর সঙ্গে লাগোয়া একটা রেস্তোরাঁও আছে–জেনসনই তার মালিক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানের খোলা দরজায় আবির্ভূত হলো এক বিশাল চেহারার পুরুষ। সে কাউন্টারের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। মাইক আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলো, অর্থাৎ এই কার্ল জেনসন।

জেনসন লম্বায় প্রায় সাড়ে ছ ফুট, গায়ের রঙ তামাটে, বয়স প্রায় পঞ্চান্নর কাছাকাছি হবে। মাইক কফির কাপ এগিয়ে দিলো জেনসনের দিকে, মিঃ জেনসন, এই লোকটি পাহাড় পেরিয়ে ট্রপিকা স্প্রিংসে যেতে চায়। আমি বলেছি, আপনার ওখানে যেতে,-সেখানে যদি কোনো ট্রাক ধরতে পারে; এখানে ত আর কোনো গাড়ি থামবে না।

জেনসন আমার দিকে ফিরে হাসলো, মাইক ঠিকই বলেছে ও ছাড়া তোমার উপায় নেই। তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে যেতে পারো, কিন্তু ঐ পর্যন্তই!

আমি বললাম কিন্তু আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?

জেনসন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, পাগল নাকি। এতোখানি রাস্তায় যে একজন সঙ্গী পাবো, সেটাই অনেকখানি। হঠাৎ কি মনে করে জেনসন তার পেশীবহুল হাত আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলল, আমার নাম কার্ল জেনসন।

জেনসনের হাতে হাত মেলালাম, আমি জ্যাক প্যাটমোর।

 প্রথমেই যে নামটা মনে এলো সেটাই বলে ফেললাম।

মাইককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। বাইরে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিলো। জেনসন এগিয়ে গিয়ে তার চালকের আসনে বসলো।

ট্রাকের ভেতরটা অসহ্য গরম। আমরা দুজনেই গায়ের কোট খুলে ফেললাম। জেনসন সিগারেট বের করে ধরালো। আমার দিকেও একটা এগিয়ে দিলো। তারপর স্টার্ট দিয়ে ট্রাক ছেড়ে দিলো।

শহরের বাইরে পৌঁছতেই চোখে পড়লো দিগন্ত প্রসারী মরুভূমি। চারিদিকে শুধু বালি আর বালি, মাঝের সরু পিচঢালা রাস্তা ধরে জেনসন ট্রাক ছুটিয়ে চলেছে। বহুদূরে চোখে পড়ছে। পাহাড়–তার ওপারেই ট্রপিকা স্প্রিংস। মাথার ওপরে সূর্য কিছুটা ঢলে পড়লেও গরম কমেনি।

স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে জেনসন আমার দিকে আড়চোখে তাকালো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কোথা থেকে আসছ? তুমি কোথায় কাজ করো?

আমি বললাম, আমি ওকল্যান্ড থেকে আসছি। আমাদের তালার ব্যবসা আছে। আমার বাবাও এই ব্যবসা করতেন।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে একসময় জেনসন প্রশ্ন করলো, আচ্ছা জ্যাক তুমি গাড়ির ইঞ্জিন টিঞ্জিনের ব্যাপার বোঝা?

খুব সামান্য–দু-একবার কয়েকটা গাড়ির কাজ করেছি।

জেনসন তার নীল চোখের দৃষ্টি স্থিরভাবে মেলে ধরলো আমার দিকে, জানতে চাইলো, তুমি কি ট্রপিকা স্প্রিংসে থাকবে বলে ঠিক করেছে?

হা– জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আকাশে চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা চিল।

ওখানে কোনো চাকরি নিয়ে যাচ্ছো নাকি?

এবার আমার মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো। সেটা লক্ষ্য করে জেনসন একটু বিব্রত হলো, মানে–যদি কোনো চাকরির ব্যাপার হয়, তবে আমিই তোমাকে একটা চাকরি দিতে পারি।

অবাক হয়ে আমি জেনসনের দিকে তাকালাম, আপনি আমায় চাকরি দেবেন?-কি চাকরি?

 জেনসন বললো, লোহালক্কড় সম্বন্ধে অভিজ্ঞ, গাড়ির কাজও জানে এমন একজন লোকই আমার প্রয়োজন। আমি আর আমার স্ত্রী লোলা সব কাজ সামলাতে পারি না। তোমার মতো একজন লোকই আমি খুঁজছি, তবে সপ্তাহে তিন চারদিন কিন্তু রাত্তিরে কাজ করতে হবে–অবশ্য দিনে বিশ্রাম পাবে। আমার স্ত্রী চমৎকার রান্না করে, সে তুমি খেলেই বুঝতে পারবে।

ভেবে দেখলাম গা-ঢাকা দেবার মতো এমন একটা সুযোগ ছাড়ি কেন। এই মরুভূমির দেশে পুলিশ আমার খোঁজও পাবে না।

আমি জেনসনের চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলাম যে আমি রাজি। জেনসন প্রচণ্ড খুশী হলো। অদ্ভুত ভাবে অদ্ভুত নামের এক পেট্রোল পাম্পে চাকরি পেয়ে গেলাম।

.

০৪.

 সামনের একটা উঁচু ঢিবি পার হতেই চোখে পড়লো পাহাড়ী ঢালু রাস্তা। যে দিকে তাকাই শুধু বালি আর বালি। বিকেলের চড়া রোদ বালির সমুদ্রকে করে তুলেছে উজ্জ্বল, তার গা থেকে ঠিকরে আসা সোনালী আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। দূরে বহুদূরে চোখে পড়লো একটা অস্পষ্ট বিন্দু-জেনসন আঙুল তুলে দেখালো, ওটাই আমার পেট্রোল পাম্প

পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন।

-ঘরগুলোকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাস্তার বাঁ দিকে একটা ছোট্ট বাংলো। বাংলোর উল্টোদিকে রয়েছে একটা ঘর। রাস্তা একে একে মিলিয়ে গেছে পাহাড়ের ওপিঠে

সবকটা ঘরের রঙই আকাশ নীল। জেনসন বললো, ঐ ডানদিকের ঘরটা তোমার। আর এ দিকের বাংলোটায় আমি আর লোলা থাকি।জায়গাটা এমনি নির্জন আর বিরক্তিকর, শুধু লোলা আছে বলেই সবকিছু ভুলে থাকতে পারি। এখন তুমি এসেছো–আমাদের কাজের অনেক সুবিধা হবে।

আমরা পেট্রোল পাম্পে পৌঁছে গেছি। অদূরে চোখে পড়ছে বাংলো। বাংলোর সামনে একটা বারান্দা, তার থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। একটা মেঠো পথ এগিয়ে এসেছে রাস্তা পর্যন্ত।

জায়গাটা এতো সুন্দর হতে পারে আমার ধারণা ছিল না।

গাড়ির দরজা খুলে জেনসন নেমে পড়লো, পিছন পিছন আমিও নামলাম। জেনসন আমার ঘরটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললো, জ্যাক তুমি আর দেরী করো না। হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি এদিকে তোমার খাবার ব্যবস্থা করছি। তারপর সে বালিতে ঢাকা মেঠো পথ ধরে বাংলোর দিকে এগিয়ে চললো।

আমিও ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। দরজা খুলতেই বসবার ঘর, বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো। ঘরের এককোণায় একটা টেলিভিশন সেটও রয়েছে। বসবার ঘর পার হলেই একটা ছোট্ট শোবার ঘর।

শোবার ঘরে জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে গেলাম, হাত মুখ ধুয়ে দাড়ি কামাতে শুরু করলাম। দাড়ি কামানো হয়ে গেলে আয়নায় নিজের চেহারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম খবরের কাগজে যদি আমার ছবি ছাপা হয়ে থাকে তবুও কারও পক্ষে আমাকে চেনা সম্ভব নয়।

জামাকাপড় পরে বেশ উৎফুল্ল চিত্তে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ জেনসনের বাংলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সামনে আর পেছনে তাকালে বালি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। পুলিশ হয়তো ওকল্যান্ডে বা অন্য কোনো শহরে আমার খোঁজ করবে, কিন্তু এই মরুভূমিতে নিশ্চয়ই খোঁজ করার কোনো চেষ্টাই করবে না। ঠিক করলাম যতদিন পারা যায় এখানেই থাকবো।

রাস্তা পার হয়ে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকলাম। ঘরের একপাশে সাজানো পাঁচটা টেবিল আর কতকগুলি চেয়ার। এছাড়া কাউন্টারের সামনে গোটা দশেক টুল। কাউন্টারের ওপর সাজানো সারি সারি বীয়ার ও সোডার বোতল। এক পাশে গোটা দুয়েক আচারের শিশি। তার সঙ্গে রয়েছে একগাদা কাঁচের গ্লাস, ছুরি, কাঁটা চামচ আর কাগজের রুমাল। প্রত্যেকটি জিনিষই পরিষ্কার ঝকঝক করছে। দেওয়ালের গায়ে টাঙানো একটা ফলকে ছাপা হরফে লেখা রয়েছে খাদ্যের তালিকা। কাউন্টারের পেছনে আধ ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে রান্নার সুস্বাদু গন্ধ ভেসে আসছে। ভাবছি কাউকে ডাকবো কিনা। হঠাৎ কানে এলো জেনসনের গলা, এই লোলা-শোনো, অবুঝ হয়োনা, অনেক ভেবেচিন্তে আমি জ্যাককে এখানে নিয়ে এসেছি, ও এখানে কাজ দেখাশোনা করলে, আমরা সপ্তাহে দু-চার দিন করে ওয়েন্ট ওয়ার্থে বেড়াতে যেতে পারবো।

দ্যাখো কার্ল, একটা কথা তোমাকে হাজারবার বলেছি, আজও বলছিঃ কোনো উটকো লোককে আমি এখানে রাখবো না, ব্যস।

হ্যাঁ, জানি তুমি বলেছো, কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না, একজন লোক রাখা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। ভেবে দ্যাখো তো, গতকাল রাত্রে তোমাকে কতবার উঠতে হয়েছে? বারে বারে তোমাকে উঠে এসে ঐ হতচ্ছাড়া ট্রাকগুলোকে পেট্রল দিতে হয়েছে। আমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন লোলা,জ্যাক যদি রাত্রিবেলা কাজ করে, তবে আমরা একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি। তাছাড়া দু-চারদিন দেখতে ক্ষতি কি? তারপর যদি পছন্দ না হয়, তখন জ্যাককে বারণ করে দিলেই হবে।

তুমি কি করে জানলে লোকটা বিশ্বাসী? ওকে এখানে রেখে আমরা ওয়েন্ট ওয়ার্থে যাবো, আর ও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে মনে করেছো?সিন্দুক ভেঙে টাকা হাতিয়ে সোজা কেটে পড়বে।

লোলার মনোভাবে অস্বস্তি বোধ করলাম। সে যাই হোক পরে ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু আপাততঃ সাড়া দেওয়া দরকার। কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম, দরজায় শব্দ করে ডাকলাম কেউ আছেন নাকি? রান্নাঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো।

একটু পরে দরজা খুলে জেনসন বেরিয়ে এলো, মুখে কেমন একটা অপ্রতিভ হাসি, এসো জ্যাক ঘর কেমন লাগলো? পছন্দ হয়েছে তো?

আমার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চেহারা দেখে জেনসন আশ্বস্ত হয়েছে মনে হলো। আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, পছন্দ হয়নি মানে? সত্যি মিঃ জেনসন আপনার পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এর তুলনা নেই। জেনসন সম্মতি জানালো।

তারপর সে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো আমার খাবার ব্যবস্থা করতে।

কিন্তু জেনসন রান্নাঘরে পা বাড়াতেই কানে এলো বাইরে থেকে ভেসে আসা কোনো গাড়ির হর্নের শব্দ।

ঘরের জানলা দিয়ে দেখা গেলো বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা জীর্ণ ধূলি মলিন প্যাকার্ড। চালকের নির্দেশে জেনসন গাড়িটার ট্যাঙ্কে পেট্রল ঢালতে লাগলো।

হঠাৎ পেছনে সামান্য শব্দ হতেই চমকে ফিরে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। ওর চোখের দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে সীমাহীন কৌতূহল। মেয়েটির মাথা ভর্তি একরাশ লাল চুল, কামনা মদির পুরু ঠোঁট, তিরিশ বসন্তের শরীরে ভরন্ত যৌবন। তার পান্না সবুজ টলটলে চোখ রক্তে নেশা ধরায়, মেয়েটিকে দেখার পর কোনো পুরুষের পক্ষেই ওর যৌবনের হাতছানিকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। ওর পরনে একটা সাদা গাউন ও শরীরের সঙ্গে যেন ভেজা কাপড় হয়ে লেপটে আছে।

মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে এলো। লক্ষ্য করলাম ওর গাউনের নীচে কোনো অন্তর্বাসের বালাই নেই।

অপলক দৃষ্টিতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানিনা। একসময় খেয়াল হলো জেনসন আমার পাশে দাঁড়িয়ে, এই যে লোলা, তুমি এসেছো, আলাপকরিয়ে দিই–এই জ্যাক।জ্যাক এ হচ্ছে লোলা–আমার স্ত্রী।

মেয়েটি ছোট্ট করে ঘাড় নাড়লো, গভীর সবুজ চোখে শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই।

জেনসন বললো, আর দেরী করো না লোলা, কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করো।

ভাবলেশহীন মুখে লোলা জবাব দিলো, অপেক্ষা করো, আমি আসছি। ও ফিরে চললো, চলার সময় স্পষ্ট হয়ে উঠলো ওর ভারী নিতম্বের সুডৌল রেখা। নিটোল ছন্দে হিল্লোল তুলে ও এগিয়ে চললো রান্নাঘরের দিকে।

আমার সারা মুখ তখন ঘেমে উঠেছে। একটা কাগজের রুমাল টেনে নিয়ে মুখ মুছলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে,–চোখের সামনে ভাসছে লোলার পাগল করা যৌবন।

খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর জেনসন বাইরে এলাম। আমাকে কোন্ কোন্ দিন কাজ করতে হবে সেটা তার কাছ থেকে জেনে নিয়েছি। সপ্তাহে তিনদিন আমাকে রাতে কাজ করতে হবে। গাড়ি ব্রেকডাউনের ব্যাপার হলে আমাকেই সামলাতে হবে। আর গ্যারেজ আর পাম্পের কাছটা সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।

বাইরে এসে জেনসন আমাকে দেখিয়ে দিলো কিভাবে পাম্প থেকে পেট্রোল দিতে হয়। মোবিল আর পেট্রোলের দাম কিভাবে হিসাব করতে হয়, তাও বুঝিয়ে দিলো। তারপর লোহা বোঝাই ট্রাকটা খালি করার জন্য আমাকে ডাকলো।

এর মধ্যেই সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দিনের অসহ্য গরম আর নেই। মরুভূমির ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভেসে আসছে অসংখ্য বালুকণা। গোধূলির আলোয় দূরের ধূসর পাহাড় হয়ে উঠেছে রক্তাভ। মনে হয় যেন একটা শান্ত সমাহিত ভাব নেমে এসেছে দিনের উত্তপ্ত মরুভূমিতে।

আমি আর জেনসন মিলে লোহালক্কড়গুলো একে একে নামাতে আরম্ভ করলাম। কাজ করতে করতে হঠাৎই জেনসন আমার দিকে তাকালো, লোলার ব্যবহারে কিছু মনে কোরো না জ্যাক,-ও ওইরকমই। কেউ এখানে কাজ করুক, তা ও চায় না কে জানে কেন? হয়তো সব মেয়েরাই এরকম জেনসনের মুখে চিন্তার ছায়া।

কথা বলতে বলতে একটা পুরোনো মরচে পড়া গাড়ির ইঞ্জিন ও এক হ্যাঁচকায় মাটিতে নামালো। ওর শক্তি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। অতো ভারী ইঞ্জিনটাকে এমনভাবে বয়ে নিয়ে চললো, যেন পালকের তৈরী খেলনা। গুমটি ঘরে সেটা রেখে সে ফিরে এলো। তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমাকে বললো–প্রথম প্রথম লোলা হয়ছে তোমাকে ভালো চোখে দেখবে না কিন্তু দেখো কয়েকদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। জেনসন আমাকে বলতে শুরু করলো যে, কিভাবে লোলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। সে হেসে বললো, ভাবতে অবাক লাগে-ভীষণ মজার ব্যাপার বুঝলে জ্যাক। আজ থেকে বছর দুয়েক আগের কথা। আমার প্রথমা স্ত্রী মারা যাওয়ায়, তখন একাই সব সামলাচ্ছি। মনের অবস্থা খুবই খারাপ। থেকে থেকেই বউয়ের কথা মনে পড়ছে। সমস্ত পরিবেশ যেন আমার মতই বিষয়–নিঃসঙ্গ। চুপচাপ বসে আছি, এমন সময় একটা বাস এসে দাঁড়ালো সামনের রাস্তায়। যাত্রীরা সব একে একে নেমে এলো, প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন হবে। তার মধ্যে ভোলাও ছিল।

আমি রেস্তোরাঁর কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম যাত্রীরা সব হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। একবার রানাঘর আর একবার খাওয়ার টেবিল–এই করে একেবারে হিমসিম খেয়ে যাবার অবস্থা হঠাৎ দেখি, সবুজ পোশাকে সজ্জিতা একটি সুন্দরী তরুণী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অভ্যস্ত হাতে যাত্রীদের দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে।

যখন বাস ছাড়ার সময় হলো ততক্ষণে সবাইয়ের খাওয়া হয়ে গেছে। মেয়েটি সাহায্য না করতে, কি যে করতাম তাই ভাবি! বাস ছাড়ার সময় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও আমার এখানে চাকরি করবে কিনা, মেয়েটি তো এক কথায় রাজি।বাস ছেড়ে দিলো কিন্তু ও থেকে গেলো।

তারপর থেকে দুজনে মিলে কাজ করি। বেশ ভালোভাবেই দিন কেটে যায়। কিন্তু আমাদের একসাথে থাকা নিয়ে লোকে নানা কথা বলে, তাই কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিয়ে করে ফেলি। লোলা আমার থেকে যদিও তেইশ বছরের ছোট। এমনিতে মাঝে মাঝে মান-অভিমান করে বটে কিন্তু খুব কাজের মেয়ে। এখন হয়তো কদিন একটু অভিমান করে থাকবে, কিন্তু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এমন সময় একরাশ ধুলো উড়িয়ে একটা ক্যাডিলাক এসে দাঁড়ালো। জেনসন আমাকে ওটা দেখতে বলে রেস্তোরাঁয় ফিরে গেলো। পেট্রল দিতে দিতে গাড়ির আরোহীদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলাম। কথায় কথায় জানিয়ে দিলাম এখানে রেস্তোরাঁও আছে। ইচ্ছে করলে তারা খেয়ে নিতে পারেন। কারণ এরপর ট্রপিকা স্প্রিংস পর্যন্ত রাস্তায় কোনো দোকান নেই। আমার কথায় রাজি হয়ে ওরা গাড়ি থেকে নেমে রেস্তোরাঁর দিকে এগিয়ে চললো–এইভাবে আরম্ভ হলো আমার প্রথম কর্মব্যস্ত সন্ধ্যা। গাড়ির পর গাড়ি আসতে লাগলো কাজ করে চললাম। একসময় জেনসন আমার কাজের প্রশংসা না করে থাকতে পারলো না।

এক নাগাড়ে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন কোনো গাড়ির হেডলাইট চোখে পড়লো না, তখন ফিরে চললাম খাবার ঘরে।

গিয়ে দেখি, দুজন ট্রাকচালক কাউন্টারের সামনে টুলে বসে। তাদের সামনে প্লেটে ফ্রট পাই। রান্নাঘরের ভেতর থেকে বাসনপত্র নাড়াচাড়ার শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম লোলা রান্নাঘরে।

জেনসন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, জ্যাক তুমি আর দেরী করো নাআজ রাতে আমার পালা, কাল থেকে রাত্রিতে তোমাকে কাজ করতে হবে।

আমি আর দেরী না করে রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে চললাম ঘরের দিকে। তারপর ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়লেও চোখে ঘুম নেই, অজস্র চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত। মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠছে লোলার ছবিও যেন হেঁটে চলেছে রান্নাঘরের দিকে–পরনে সেই সাদা গাউন– আমি বুঝতে পারছি লোলা পরস্ত্রী ওর কথা এভাবে আমার ভাবা উচিতনয়, কিন্তু তবুও ওর চিন্তা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।

ঘরের জানলার ঠিক পাশেই আমার শোবার খাট, অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলোটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলাম বাংলোর দিকে কিছুতেই ঘুম আসছে না।

প্রায় ঘণ্টাখানেক এভাবে শুয়ে থাকার পর একসময় বাংলোর একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। জানলার নীল পর্দা সরানো থাকায় আলোকিত ঘরটা পরিষ্কার চোখে পড়ছে, ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোলা। ওর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। একটু পরে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগলো। ওর একরাশি লাল চুল কোমরের কাছে আছড়ে পড়েছে।

আমি উত্তেজনায় উঠে বসে থাকলাম। অনুভব করলাম হৃদয় তোলপাড় করা মনের অবস্থা।

একটু পরে লোলা জানলার কাছে এসে গাউনের বোম খুলতে শুরু করলো..সাদা গাউনটা মেঝেতে খসে পড়লো। ও হাত বাড়িয়ে জানলা বন্ধ করে দিল। ঘষা কাঁচের পাল্লায় ভাসতে লাগলো ওর নগ্ন শরীরের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।

অন্ধকারে কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানিনা, একসময় খেয়াল হলো বাংলোর আলো নিভে গেছে।

অপেক্ষা না করে শুয়ে পড়লাম কিন্তু সে রাত্রে আমার চোখে আর ঘুম এলো না।