১৫. দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি

১৫.

কথাটা আমার মাথার মধ্যে যেন দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি দিয়ে পিটছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করলাম–কি বলছেন? স্পষ্ট করে বলুন!

 মানে এটাই, ভেস্তালকে খুন করা হয়েছে।দৃঢ়স্বরে মিঃ লেগো জানাল।

আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন? জানতে চাইলাম। সে কথা পরে হবে, তার আগে আপনার ডিকটেশান টেপ করা ক্যাসেট দিন। ওটা সাক্ষী হিসাবে আমার একান্ত দরকার।

আমি মৃদু হেসে বললাম–সরি মিঃ লেগো, অনেক গুলো ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠি এতে রেকর্ড করা আছে। সেগুলো এখনও টাইপ করা হয় নি। অবশ্য একান্ত দরকার পড়লে আপনি নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ভেস্তালের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি নিশ্চয়ই আমাকে দায়ী করছেন না?

প্রথম সন্দেহ স্বামীর উপরই এসে পড়ে, মৃদু হেসে মিঃ লেগো টেপটা বার করে তার উপর সই করে দিতে বলল।

তারপর মিঃ লেগো আমাকে জানাল যে, সে জানে অর্গিস আমাকে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে এই ঘরে দেখেছে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যদিও ভাল নয়।

তবুও অর্গিস সত্যি কথা বলছে এটা ভেবেই তিনি সরাসরি আমাকে দায়ী করতে পারছেন না। 

আমি এবার চালাকি করে জিজ্ঞাসা করলাম, তা আপনি কি বলেন?

লেগোর চোখ দুটো থেকে যেন আগুন ঝরে পড়তে থাকে। কঠোর দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি টাকার লোভে তোমার স্ত্রীকে খুন করেছ।

আমার শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। মৃত্যু যেন আমার গলা টিপে ধরবে এখনি। ফ্যাসফেসে গলায় বললাম, আমি ভেস্তালকে খুন করি নি।

হা তুমিই খুন করেছ। মিঃ লেগোর গলার স্বরে হুঙ্কার। রুক্ষ্ম স্বরে বলল–তোমাকে আমি খুব ভাল করে চিনি। মেয়েদের পটাতে তুমি পটু। আমি জানতাম তোমার সঙ্গে যখন ভেস্তালের পরিচয় হয়েছে, তখনই ওর বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। তুমি শেলীকে বিয়ে করনি,করেছ ওর টাকাকে।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার কথা শুনছি। একটু থেমে সে বলল–তুমি খুন করেছ, এ আমি নিশ্চিত। কিন্তু কি করে করলে বলতো?

ওর শেষ কথাটাতেই আমি মনে জোর ফিরে পেলাম। ভাবলাম, ও আমাকে ঘাবড়ে দিয়ে আসল সত্য জানতে চাইছে। আমিও সংযত থাকবার চেষ্টা করে বললাম–আমি যে খুন করেছি, তা প্রমাণ করুন আগে।

লেগো বিদ্রুপের স্বরে বলল–মিঃ উইন্টার্স, তুমি খুব বুদ্ধিমান। ভেস্তালকে তুমি খুন করেছ। তোমাকে আমি বঁড়শি দিয়ে গেঁথে তুলব। ভেঙালের খুনী কে আমি বার করবই।

তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ–আমি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিলাম।

তোমার গায়ে এখনই হাত তুলতে পারছি না আমি। কিন্তু শয়তানরা ভুল একটু অন্ততঃ করে থাকবে। তুমিও ইতিমধ্যে একটা বড় ধরনের ভুল করেছ।

মুহূর্তে আমার গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

সে বলতে থাকে–গাড়িটার সামনের ফাটা চাকাতে বালি ছিল। কিন্তু গাড়িটা যে রাস্তা ধরে গেছে, সেখানে বিন্দুমাত্র বালি ছিল না। আর ক্লিক রোডেও বালি নেই।

আমি বাজি লড়ে বলতে পারি যে, কদিন আগে যে টায়ার ফেটেছিল, তুমি সেটাই লাগিয়েছ। তখন লক্ষ্য করে দেখোনি টিউবে বালি লেগেছিল। এভাবে ধর্মের কল বাতাসেনড়ে, তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে চাকাটার একটা নাট নেই। ক্লিক রোডে সেই চাকাটার একটা নাট পড়েছিল। এবার কি মনে হচ্ছে?

লেগোর কাহিনী শুনতে শুনতে আমি ভিতর থেকে দুমড়ে যাচ্ছি। লোকটা এখনই বোধহয় সব প্রমাণ করে দিল। তবুও বাইরে থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে দাপটের সঙ্গে বললাম–বেশ, লেফটেন্যান্ট তোমার কাল্পনিক গল্পটা প্রমাণ করে দেখাও।

লেগো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দিল–মিঃ উইন্টার্স, আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না। প্রমাণ আমি করব, তবে আমার ধারণা তোমাকে এ কাজে কেউ সাহায্য করেছিল, সে কে? তুমি একই সঙ্গে দু জায়গায় রইলে কি করে সেটাই গোলমেলে।

একটু থেমে আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–তবে কি ইভ ডোলান তোমাকে এ কাজে সাহায্য করেছে?

আমার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। আমি কায়দা করে বললাম–ও করতে যাবে কেন? আমরা কেউই এ কাজ করি নি। আসলে তোমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে।

আমার কথাগুলো একবার প্রতিধ্বনিত করল লেগো–ও কেন করতে যাবে? তারপর ব্যঙ্গের সঙ্গে বলল–আচ্ছা মিঃ উইন্টার্স,তুমি কি তোমার স্ত্রীর উইলের সম্পর্কে কিছু জান?

আমি ঘাড় নেড়ে জবাব দিলাম–না।

আমি প্রশ্ন করলাম–উইলের সঙ্গে দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

লেগো বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল মিস ডোলান বেশ বড় রকমের দাও মেরেছে ভেস্তালের কাছ থেকে, আর তাই তাকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে দিল।

আমি বললাম–তার মানে?

 মানেটা এইরকম। ভেন্তাল নতুন উইল করে মিস ডোেলানকে তিন কোটি ডলার আর এই বাড়িটা দিয়ে গেছে। আর তোমাকে টাকা দিতে চাইলে নাকি তুমি নিতে চাইতে না। তাই তোমার ভাগে পড়েছে মাত্র তিরিশ হাজার ডলার।

তার কাছ থেকে এ কথা শোনার পর মনে হল যেন আমার পায়ের তলায়–মাটি নেই। আমার মুখের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করে লেগো কথাটা আবার বলল, অনেকটা যেন চিবিয়ে চিবিয়ে হ্যাঁ, মাত্র ত্রিশ হাজার ডলার পেয়েছ তুমি।

আমি জোর গলায় বললাম–তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলে বোকা বানাবার চেষ্টা করো না।

লেফটেন্যান্ট আমার মুখের অবস্থা দেখে হেসে ফেলল,আমি একটুও মিথ্যে বলছি না, তোমার স্ত্রীর উইল আমি নিজের চোখে দেখেছি।

আমি মুখের ভাব নির্বিকার রেখে হেসে বললাম–মিস ডোলান যদি অতটাকা পেয়ে থাকেন, তা তার সৌভাগ্যের কথা। আমার পক্ষে ত্রিশ হাজারই যথেষ্ট। তোমার যেমন খুশী, তেমনই ব্যাখ্যা কর।

আমার মনের ভিতরটা জ্বলে যেতে থাকে। ইভের এইজন্যই এত দর্প। ল্যারীর সঙ্গে পরামর্শ করেই সে আমাকে দিয়ে খুনটা করিয়েছে। আমার সঙ্গে ও এতবড় বেইমানী করল! ওকে এত সহজে আমি ছাড়ব না।

লেগো এবার দৃঢ়স্বরে প্রশ্ন করল–এবার বল, তোমার দলে মিস ডোলান ছিল কিনা? বল, দুজনে জুটি করে একাজটা করোনি? বল উইন্টার্স? সত্যি কথা বল!

আমিও হার মানবার পাত্র নই। মুখে হাসি এনে বললাম–তোমার স্বপ্ন, মিঃ লেগো তুমি নিজেই বারেবারে উপভোগ কর। বলছি তোআমি খুন করি নি। সারা সন্ধ্যা আমি এখানে কাটিয়েছি। অর্গিস আর ব্ল্যাকস্টেন সাক্ষী আছে।

দেখ উইন্টার্স চালাকি করবার চেষ্টা করো না। তোমরা দুজনে মিলে অর্গিস আর ব্ল্যাকস্টেনকে বোকা বানিয়েছ। মনে রেখ, ফাঁসির দড়ি তোমার গলাতেই নাচছে। তোমাকে এত সহজে আমি ছাড়ব না।কথাটা শেষ করে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লেগো।

আমি জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার হাত পা কাঁপছে। মুখে ঘাম ভর্তি হয়ে রয়েছে।

এক পেগ হুইস্কি খেয়ে ইডেন এন্ডে চলে এলাম। একটা নিরিবিলি টেবিলে বসে আগাগোড়া ব্যাপারটা ভাবতে লাগলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলাম।না, কোন ভুল আমার হয় নি। অর্গিস আর ব্ল্যাকস্টে যখন বলবে আমি বাড়িতে ছিলাম, তখন লেগো বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারবে না। জজসাহেব কেস বাতিল করে দেবে।

এবার আমাকে দেখতে হবে ডোলান কি বলে। খুন করবার আগে বলেছে–আমি তোমায় ভালবাসি। তোমাকে বিয়ে করব। আর কাজ হয়ে যাবার পরে বলছে, তুমি আমার ধারে কাছে আসবে না। আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আমার মনে হল ইভ দু–একদিনের মধ্যে পালাবে। তার আগে ওর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে দিতে হবে। নজর রাখতে হবে ওর গতিবিধির উপর। কিন্তু কি করে পাব ওর খবর? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ জোসুয়া মরগ্যানের কথা মনে হল।

সোজা রুজভেল্ট বুলেভার্ডে চলে এলাম জোসুয়ার অফিসে। লোকটির বয়স বছর পঞ্চাশ হবে, নজর দারিতে ওস্তাদ। এ কাজের জন্য ওর অনেক লোক আছে। এক হাজার ডলার দেব বললাম। সব বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে এলাম।

বাড়িতে ফিরে প্রথমে অর্গিসের সঙ্গে দেখা হল। ভেস্তাল মারা যাবার পর থেকে সে যেন আমাকে এড়িয়ে চলছিল।

সে আমার কাছে মাইনে চাইল। বাড়ির সকল চাকরবাকর–প্রত্যেকেই নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছে।

আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম।–ঠিক আছে, পনের মিনিট পরে আমার ঘরে সবাইকে আসতে বলবে।

সকলে চলে যাচ্ছে শুনে আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ইভকে কিছুটা শিক্ষা দিতে পারব। একা এই বাড়িতে আমি আর ইভ। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম–মিস ডোলান বেরিয়েছে ছটার পর ফিরবে।

চাকর–বাকরের সংখ্যা তিরিশ জনা মতন হবে। যে যার বেতন নিয়ে চলে গেল। আমি তাদের সবার ঠিকানা নিয়ে নিলাম, যদি লেগোর কোন দরকার হয়।

সবার শেষে অর্গিস এল, টাকাটা হাতে নিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–ম্যাডামকে, আপনি যেভাবে মারলেন, তার দাম আপনাকে একদিন দিতে হবে স্যার।

আমি রেগে গিয়ে মেজাজের সুরে বললাম–এই বুড়ো উল্লুক, ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেবার আগে, মুখ বুজিয়ে পালা। যা ভাগ।

আমার ধমক খেয়ে অর্গিস মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল।

বাড়িতে কেউ নেই। বিশাল বাড়িটা যেন মরে গেল। ঘড়ির টিকটিক শব্দ, আর বুকের ধক ধক শব্দ ছাড়া কোন কিছু শোনা যাচ্ছে না এতবড় বাড়িটা থেকে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম–পাঁচটা বেজে চল্লিশ মিনিট।

জানলার পাশে গিয়ে শূন্য মন নিয়ে বসেনীচের লম্বা তকতকে সিঁড়িটার দিকে চেয়ে রইলাম।

 ইভ এখনি আসবে। আর তার সঙ্গে হবে আমার শেষ বোঝাপড়া।

.

১৬.

ছটার সময় নয়,কাঁটায় কাঁটায় নটার সময় বাড়ি ঢুকলইভ। এতক্ষণ আমি কেবলি ভেবে গেছি ইভের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। সে ভেস্তালকে সহ্য করতে পারত না বলেই ঔষধ খাইয়ে অসুস্থ করে দিত। আসলে আমি ভেস্তালকে বিয়ে করবার পর ভেবে নিয়েছিল আমাকে দিয়ে সে তার ইচ্ছাটা পূর্ণ করাবে। আর এতদিন তাই সে আমার সঙ্গে অভিনয় করে নিজের কাজটা হাসিল করে নিয়েছে। আর এখন বেঁকে বসেছে। দেখা যাক বুদ্ধির দৌড় কার কতটা?

ইভ গ্যারেজে গাড়ি রেখে সদর দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি নিঃশব্দে লাউঞ্জে চলে এসে একটা সীটের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম।

ইভ সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় চারিদিক তাকাল। ও ঘরে বাঁদিকে চলে যেতেই আমি হলের দরজায় চাবি দিলাম। কান খাড়া রাখলাম।

নিজের ঘরে ঢুকে ও ঘণ্টা বাজাল।বুঝতে পারলাম এখন ও এবাড়ির মালিক!তাই ঘণ্টা বাজিয়ে সে বি–চাকরদের ডাকল।

আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা অব্যবহার্য ঘরে ঢুকে অপেক্ষা করছি।

বার বার ঘণ্টা বাজানোর পরে সে ইন্টারন্যাল ফোন তুলে ডায়াল করল ও পাশে ক্রিং ক্রিং শব্দ শোনা গেল।

এবার সে বিরক্তির সঙ্গে সিঁড়ির থামটার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে হলের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ডাক দিল–অর্গিস! কেউ সাড়া দিল না।

ওর মুখটা তখন বেশ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ও অস্থির হয়ে উঠছে। একটা ভয় ক্রমশঃ গ্রাস করছে ওকে। তার এরকম পরিণতি দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল।

ইভ হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল–এখানে কে আছ? অর্গিস তুমি–তোমরা কোথায় গেলে? সাড়া দিচ্ছ না কেন?

নিস্তব্ধ সব।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর নিজের মনে বলল–সকলেই তাহলে কি একসঙ্গে চলে গেল! না, তা তো হতে পারে না। ভয় পেয়ে গেল ইভ।

দৌড়ে গিয়ে হলের দরজাটা একটানে খোলবার চেষ্টা করল। একটুও নড়ল না দরজাটা।

ইতিমধ্যে আমি ইভের খানিকটা তফাতে এসে দাঁড়িয়েছি। কয়েক মুহূর্ত ওকে দেখলাম, তারপর হেসে বললাম–দরজাটা টানাটানি করে কোন লাভ নেই। ওটা চাবি দেওয়া।

আতঙ্কে সে প্রায় চীৎকার করে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে, তারপর দুহাত দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলল। বলল–তুমি ওরকম ভাবে আমাকে দেখছ কেন?

— তোমাকে অভিনন্দন জানাতে। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে তবুও হাসবার চেষ্টা করলাম–এরকম প্রাসাদতুল্য একটা বাড়ি,সঙ্গে তিন কোটি ডলার!কিরকম লাগছেবলতো ইভ?

মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল–আমাকে যদি কেউ ভালবেসে দান করে যায়, সেটা কি আমার দোষ?

আমি তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বললাম তুমি আর ল্যারী দুজনে মিলে তো পরিকল্পনাটা বেশ করেছ। মিষ্টি কথায় বেশ কাজ হাসিল করে এখন আমাকে কাঁচকলা দেখাচ্ছে। এটা কিন্তু খুব গুণের কথা? এখন তুমি খুব খুশী তো?

ইভ তাচ্ছিল্যের স্বরে জবাব দিল–পরিকল্পনাটা তোমারই ছিল আর যা করেছ তুমিই করেছ। –মিঃ উইন্টার্স! তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না, আমি এখনি সব গোছগাছ করে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।

আমি তার কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম–লেফটেন্যান্ট লেগো জেনে গেছে যে, আমরা দুজনে মিলে এই কাজটা করেছি।

সঙ্গে সঙ্গে ইভের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল ভয়ে। চীৎকার করে উঠলতুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলছ।

 ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তাই হোক কিন্তু লেগো ভীষণ চতুর। ফেটে যাওয়া চাকার মধ্যে তিনি বালি আবিষ্কার করেছেন, একটা হারিয়ে যাওয়া নাটক্লিক রোডে পেয়েছেন। তিনি সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করেছেন–ভেস্তালকে খুন করবার আসল পরিকল্পনাটা তোমার কিনা? কারণ তার ধারণা উইলের জন্যই তুমি খুন করেছ।

ইভ আঁতকে উঠে দু–পা পিছিয়ে গেল।তুমি, তুমি মিথ্যা বলছ।

আমি হেসে বললাম, বিশ্বাস করতে হবে না। কিন্তু মিঃ লেগো যখন প্রমাণসহ হাজির হবে, তখন সামাল দিও। তোমার ল্যারী তখন তোমার কাছে থাকবে তো? বলতে বলতে ধীর পায়ে আমি ইভের দিকে এগিয়ে গেলাম।

ইভ দুপা পিছিয়ে গিয়ে সভয়ে বলে উঠল–খবরদার আমার দিকে এগোবে না।

আমি গর্জন করে বলে উঠলাম–দাঁড়াও, তোমার এই ব্যবহারের মাসুল দিতেই হবে। একটা কাজ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

তোমার নরম সরু গলাটা আমার এই লৌহকঠিন হাত দিয়ে শুধুমাত্র একটু চাপ দেব। তারপর তুমি কেবল একটা লাশে পরিণত হবে। তুমি যাতে আর অন্য কোন পুরুষকে ধোকা না দিতে পার, সেজন্য এটুকু তো আমায় করতেই হবে।

আচমকা ইভ একটা লাফ দিয়ে দু–হাতে আমার বুকে ধাক্কা মেরে দুমদাম করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।

একটু বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওর পিছনে ছুটলাম।

ভেস্তালের পড়ার ঘরে বড় ডেস্কটার একপাশে ইভ আর এক পাশে আমি।

 ইভ গর্জন করে উঠল–আমার কাছে আসবার চেষ্টা করবে না।

আমি হেসে বললাম–তোমাকে একটু আদর করব। বলে ধীরে ধীরে তার দিকে এগোলাম।

চট করে ড্রয়ারের ভেতর থেকে ৩৮ বোরের একটা পিস্তল বার করে আমার বুক লক্ষ্য করে তাক করল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

এসো। আদর করবে এস–বিদ্রুপের সুরে বলল ইভ।

–তোমাকে আমি বোকা বানিয়েছি, ধাপ্পা দিয়েছি শে। আমি শুধুমাত্র তোমাকে দিয়ে ভেস্তালকে খুন করাবার মতলবে ছিলাম।

তোমার সঙ্গে যখন শুয়েছি, প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে ঘেন্ন করেছি। সব মুখ বুজে সহ্য করে গেছি। দামও দিতে হয়েছে তার জন্য। এখন আমি সব পেয়ে গেছি। এবার তুমি এখনি এ বাড়ি থেকে বেরোও।

আমি অবস্থা ভাল নয় বুঝে, পিছু হটলাম।তাকে শাসালাম–তোমার সুখের জীবন আমি ভেঙ্গে তছনছ করে দেব।

ইভও ভয় না পেয়ে জবাব দিল–তুমি এখান থেকে না গেলে এখনি গুলি চালাব।

আমি মৃদু হেসে বললাম–শুভরাত্রি ইভ। সারারাত ধরে একা এই বাড়িতে ভেস্তালের প্রেতাত্মার সঙ্গে আলাপ কর।

.

জ্যাকের বারে চলে এলাম। রাত বেশ অনেক হয়েছে। তিন পেগ হুইস্কি শেষ করে চতুর্থটার জন্য কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল।

শেড ডার্লিং! চমকে পিছন ফিরে তাকালাম পাশের দিকে। তার দিকে তাকাতে অনেক পুরান স্মৃতি মনে এল।

ছবির মত অনেকগুলো দৃশ্য, অনেক কথা মনে পড়ে গেল। ভেস্তালের আগে সে ছিল আমার সাথী, ভেস্তালের সঙ্গে বিয়ের আগের রাতও যার সান্নিধ্যে কাটিয়েছিলাম, সেই গ্লোরির দেখা পেলাম আজ কতদিন পরে।

প্রায় সোল মাস আমি তার কোন খবর রাখি নি।

 তাকে জিজ্ঞাসা করলাম–গ্লোরি, কি খবর তোমার, কেমন আছ?

সে আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল–মনে হচ্ছে খুশী হও নি তুমি?

আমি বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আনন্দের সঙ্গে বললাম আমি একশবার খুশী হয়েছি। তা তুমি। এখানে কেন?

গ্লোরি মুচকি হেসে জানাল–আমি ভেবেছিলাম কোন রাজকুমার আমাকে ডেকে নিতে আসবে। কিন্তু কেউ এল না, বোধহয় আর আসবেও না–তার গলায় শ্লেষের সুর।

আমি ওর গালে টোকা মেরে আদুরে সুরে বললাম–কে বলল, আসবে না? এই তো আমি এসেছি। চল, আমরা কোন নিরাপদ আশ্রয়ে যাই।

গ্লোরি আমার কথা শুনে খুব খুশী হল।বলল–আমার ফ্ল্যাটে চল। তোমার তো গাড়ি আছে?

 গাড়ি চালাতে চালাতে বললাম–তোমাকে খুব মিস করেছি। গ্লোরি–এখন কি করছ?

না, কিছু না। গ্লোরি হেসে বলল–তোমরা যখন ভেনিসে হনিমুন করছিলে, আমি তখন ফ্লোরিডাতে একজন সুন্দর বৃদ্ধের সঙ্গে দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম। বেশ ভালই কাটছিল,হঠাৎ কোথা থেকে বুড়োর স্ত্রী এসে তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

একসময়ে সে আঙুল দিয়ে স্থান নির্দেশ করে বলল বাঁ দিকে ঘোরাও। ব্যাস এখানেই গাড়ি থামাও। আমি এখানে নামছি। তুমি পিছন দিকে গাড়িটা পার্ক করো।

আমি লিফটে করে সোজা চলে গেলাম গ্লোরির ফ্ল্যাটে।

গ্লোরি আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। ঘরটা বেশ ছোট কিন্তু সাজানো গোছান। গ্লোরির ঠোঁটে মৃদু হাসি তাকে বেশ মোহময়ী করে তুলেছে। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে গ্লোরিকে। আমি আসবার আগেই ও নিজেকে অন্য পোষাকে আচ্ছাদিত করে নিয়েছিল। হলদে সিল্কের গাউনে বেশ ভালই লাগছে।

আমি তার কাছে এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে গ্লোরির কোমরটা বেড় দিয়ে ধরে আমার শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে আলতো করে ওর ঠোঁটে চুমু দিলাম।বললাম তুমি জানো আমার স্ত্রী মারা গেছে?

হ্যাঁ, খবরের কাগজ থেকে জেনেছি।বলে গ্লোরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল–তাহলে তোমার স্ত্রীর টাকার মালিক তো এখন তুমি?

সবটা নয়, ডার্লিং। বেশীর ভাগটা গেছে অন্যের দখলে। যা এখন বাদ দাও এসব কথা। তার চেয়ে বরং আমরা মহৎ কাজে লিপ্ত হই, এস।

পরদিন ব্রেকফ্রাস্টের সময় গ্লোরিকে বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছিল। ও যা উচ্চুঙ্খল জীবন–যাপন করছিল, তাতে অকালে বুড়ি হওয়া তো স্বাভাবিক।

গ্লোরি জিজ্ঞাসা করল–এতদিন কোন্ রূপসীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলে? শেড ডার্লিং! আমি তো বাপু সতীপনা করি না, তা তো তুমি জান?

আমি হেসে বললাম–হা ভেস্তালের সেক্রেটারী। কটা মাস ওর সঙ্গ পেয়ে কামোত্তেজনা মেটাবার চেষ্টায় ছিলাম। কিন্তু এখন যদিও আর কোন সম্পর্ক নেই।

গ্লোরি বলল–একসময় তুমি মেয়েগুলোকে নাচাতে, আর এই প্রথম তুমি একটা মেয়ের কাছে হেরে গেলে তাই তো?–তার কথায় ব্যঙ্গের সুর।

আমার মুখে শুকনো হাসি–তুমি দেখছি জ্যোতিষি হয়ে উঠেছে।

শেড, আমি নিজেও পুরুষদের কাছ থেকে তাক বুঝে পালাতে অভ্যস্ত ছিলাম, এখন তারা আগে পালিয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–যৌবন তো যায়, সুন্দরীও নই আমি, তবুও তুমি আমার সঙ্গ পাবার জন্য উদগ্রীব।

 জান শেড, গতরাতে তুমি ভীষণ নিষ্ঠুরের মত আমাকে পীড়ন করেছ। তোমার চাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে আমার দেহের আর ক্ষমতা ছিল না। মনটা যদিও তৃপ্ত হচ্ছিল। কিন্তু তুমি আমাকে কাল প্রায় মেরে ফেলছিলে।

আমি হাসলাম।

একটু থেমে সে আবার বলল–আচ্ছা, মেয়েটা কি খুব সুন্দরী, তবে ওর গলা শুনে মনে হল–কড়া ধাতের মেয়ে।

তার দ্বিতীয় কথাটায় আমি চমকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে গ্লোরির দিকে তাকালাম। তুমি ওর কথা শুনলে কখন?

গ্লোরি সরলভাবে উত্তর দিল–টেলিফোনে শুনেছি। মিয়ামী থেকে ফিরে মনে হল তোমার খোঁজ খবর নেওয়া দরকার।

আমার ভ্রূ দুটো কুঁচকে গেল। ইভ তো আমাকে কিছু বলেনি। চীৎকার করে বললাম তুমি কখন ফোন করেছিলে?

পরশু ফোন করেছিলাম। তখন রাত নটা কুড়ি হবে। মেয়েটি ফোন ধরেছিল। তুমি বাইরে গেছ জানিয়ে সে ফোনটা নামিয়ে রাখল। অথচ আমি তোমার গলা

ওর কথা শেষ হতে না হতেই এক লাফে গিয়ে ওকে খামচে ধরলাম। আমার কোন কথা তখন তুমি শুনতে পেয়েছিলে?

দুঃখিত শেড। কথাটা তোমাকে এতটা বিচলিত করবে ভাবিনি। সেভয় পেয়ে বলল–শেড লাগছে আমায় ছাড়।

আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম–চোপরাও। টেলিফোনে তুমি কি শুনেছিলে বল?

ও তোতলাতে তোতলাতে বলল–তুমি চিঠি ডিকটেটকরছিলে। কোনওয়ে সিমেন্ট–এরকম জাতীয় ব্যবসার কোন বিষয়ে। আর উত্তর দেবার সময় ঐ মেয়েটির গলা বেশ দৃঢ় অথচ বিচলিত শোনাচ্ছিল।

ওকে আমি ছেড়ে দিলাম। হাত–পা ঠাণ্ডা, অবশ হয়ে যাচ্ছে। কঁপছিল আমার সারা শরীর। গ্লোরি আবার বলল–শেড কি হল তোমার? আমি কোন অপরাধ করে ফেলেছি? রাগের চোটে আমার মুখের ভাষা নোংরা হয়ে গেল।কি করেছিস হারামজাদি? সেই সময় ভেস্তাল আমার হাতে খুন হচ্ছে। দাঁত কড়মড় করে গ্লোরির হতভম্ব মুখের মধ্যে এক ঘুষি লাগালাম। অতর্কিত আক্রমণে গ্লোরি মেঝেতে ছিটকে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে আমি ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে চলে এলাম।

.

১৭.

 রুজভেল্ট বুলেভার্ড জন সমাগমে মুখরিত। ভীড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে আমি একটা বুথ থেকে জোসুয়া মরগ্যানকে ফোন করলাম। তখন সকাল সাড়ে নটা হবে।

জোসুয়া মরগ্যান জানাল–মিস ইভ এখন পামবীচ হোটেলের একশ ঊনষাট নম্বর ঘরে রয়েছে। আপনি চলে যাবার পরই ও এখানে চলে আসে সঙ্গে বেশ বড় একটা সুটকেসও রয়েছে।

আমি মরগ্যানকে বললাম–আরো খবর নিতে।

এবার আমি ফোন রেখে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম পামবীচ হোটেলে। দরজায় টোকা দিতেই বাজখাই গলায় প্রশ্ন এল–কে?

প্রত্যুত্তরে গম্ভীর গলায় বললাম– টেলিগ্রাম। মিস।

সে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

আমাকে দেখে ইভ সভয়ে পিছিয়ে গেল, ভয়ে মুখখানা শক্ত কাঠ।

আমি মৃদু হেসে বললাম তোমার বোকামীর জন্য আসতে হল।

অবাক হয়ে ইভ তাকিয়ে রইল।

তুমি আমাকে বলল নি কেন যে আমার ফোন এসেছিল সেই রাতে?

তোতলাতে তোতলাতে ইভ বলল–আ–আ–আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কি বোকামীর কাজ করেছিলে তুমি? ব্ল্যাকস্টে আর অর্গিস দুজনে নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিল টেলিফোনের রিং আর তোমার উত্তর?

–তাতে কি হয়েছে? সকলেই জানে যে তুমি ব্যস্ত ছিলে আর তোমাকে বিরক্ত না করে কেউ, সেজন্যই বলেছি বাইরে গেছ।

তার কথা শুনে মনে হল যেন একটা ঘুষি মেরে মুখটা ফাটিয়ে দিই। নিজেকে সংযত করে নিয়ে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম–সকলে জানে যে আমার চিঠির ডিকটেশান গুলো ঐ মুহূর্তে টেপ হচ্ছিল, সবাই টেলিফোনের কথা শুনেছে, তাহলে তোমার টেলিফোনের কথা বলাটা নিশ্চয়ই টেপ হয়ে থাকবে। কিন্তু মিঃ লেগো টেপ শুনে দেখবে তোমার গলাটা রেকর্ড হয়নি। তখন সবাই এটা বুঝতে পারবে, রেকর্ডটা পূর্বে করা হয়েছে ও খুনটাও পূর্ব পরিকল্পিত।

ব্যাপারটা বুঝে ইভ বেশ ভয় পেয়ে গেল। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল–তাহলে এখন কি হবে?

সময় মতো যদি আমাকে বলতে, কিছু অন্ততঃ একটা ব্যবস্থা করতাম–একটু থেমে থেমে আবার বললাম–আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। এছাড়া অন্য কোন পথ নেই।

কিন্তু পালিয়ে তুমি যাবে কোথায়। পুলিশ তো অপরাধীদের খুঁজে বার করে ঠিক।

আমি তোমাকে নিয়ে যেখানে যাব, সেখানে পুলিশ আমাদের হদিশ খুঁজে পাবে না। কিন্তু আমি জানতে চাই–তুমি কি যাবে আমার

হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে যাব। ইভের চোখদুটো সাদা কাগজের মত লাগছিল।

আমি তাকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে এসে নিয়ে যাব বলে চলে গেলাম।

ফিরে এসে দেখলাম পাখী পালিয়েছে। যদিও আমার একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, অবিশ্যি সামান্য। রাগে শরীরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে।

ফোনে জোসুয়া মরগ্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম–আমার চলে যাবার পর ইভ–ল্যারী গ্রাঞ্জারকে ফোন করেছিল আর আজ দুপুর আড়াইটার সময় সমুদ্রের বাইরের কুঁড়ে ঘরে দুজনে দেখা করবে।

আমি মরগ্যানকে ওর লোজন তুলে নিতে বললাম। পারিশ্রমিকের জন্যে আমার সঙ্গে বাড়িতে যোগাযোগ করতে বললাম।

এখন বাজে সাড়ে বারোটা। আমার করণীয় কাজগুলো পর পর সাজিয়ে নিলাম।

প্রথমে আটলান্টিক হোটেলে কানেকশান চাইলাম হ্যালো, আটলান্টিক? শুনুন, মিঃ। গ্যাঞ্জারকে একটা খবর দিতে হবে

কি?

উনি এইমাত্র বেরিয়েছেন। ঠিক আছে, খবরটা লিখে নিন। উনি এলে দয়া করে জানিয়ে দেবেন।

–হ্যাঁ।

লিখে নিন–ল্যারী গ্রাঞ্জার, দেরী হয়ে গেছে, সাড়ে পাঁচটার আগে দেখা করতে যেও না–ইভ।

আচ্ছা, ধন্যবাদ।

.

১৮.

মিঃ অ্যাটর্নী, এই পর্যন্ত শুনে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি কেন আমার স্ত্রীকে খুন করলাম। আসলে, কেবলমাত্র টাকার জন্যে নয়, ইভকে পাবার জন্য আমি একাজ করলাম। ইভের প্রেম এজন্য দায়ী। বেশ বুদ্ধি করে খুনের মতলবটা ইভ আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে এ কাজে প্ররোচিত করেছে। সুতরাং ইভ হল আসল খুনী।

ইভ ভীষণ চালাক আর নোংরা মেয়ে। আমি কুঁড়ে ঘরটাতে পৌঁছোলাম, দেখলাম–ইভ ল্যারীর অপেক্ষায় তৈরী হয়েই আছে।

ইভ আমাকে দেখতে পেয়েই নাগিনীর মত ফুঁসে উঠল তবুও হাসবার চেষ্টা করে বললাম–হ্যালো ইভ। দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। আমাদের পালাবার পথ বন্ধ।

ইভ ৩৮ বোরের রিভলভারটা আমার দিকে তাক করে বলল তুমি পারবে না ঠিকই, কিন্তু আমি পালাতে পারব।

আমি তার দিকে এগোতেই সে বলল–এগিও না, তাহলে গুলি করব। আমি জানতাম যে, স্যারীর দেখা পেলে সে আমাকে গুলি করে মারবে।

আমিও মনে মনে ফন্দি আঁটছিলাম। ইভ আমার কাছ থেকে ষোল সতের ফুট দূরে। এখান থেকেঝাঁপিয়ে পড়লে ওকে আঘাত করা যাবেনা। ভেতরে ভেতরে ও অস্থির হয়ে উঠছিল ল্যারীর জন্য। সুযোগটা কাজে লাগালাম।

কই, করো গুলি–বলে ইভের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। জানলার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম–ওই যে, তোমার প্রেমিক মহাশয় এসে পড়েছে।

ইভ যেই ঘাড় ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়েছে আমি বাঘের মত ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। রিভলভারটা ঘরের কোণে ছিটকে গেল। ওর গায়ে অসম্ভব শক্তি। ওর সুন্দর গলাটা চেপে ধরতে চাইলাম।

দুহাঁটু দিয়ে ওর হাত দুটো চেপে ধরে ওর বুকে বসে ওর গলাটা টিপে ধরলাম। কোটর থেকে চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওর সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে গেল। ডান নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এল একফোঁটা রক্ত। মুহূর্তের মধ্যে নিস্পন্দ, নিথর হয়ে দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

.

সমাপ্তির আগে

শেড দেখল দূরে ফোর্ড গাড়িটা আসছে। একসময় ঘরের কাছাকাছি এসে গাড়িটার ইঞ্জিন বন্ধ হল, এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ পাচ্ছে ও। শেড রেঞ্জটাকে শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরল।

ল্যারী দরজা খুলে ঘরে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে শেড ভারী রেঞ্জটা দিয়ে আঘাত করল। মাথার ব্রহ্মতালুর উপর যেন আচমকা বজ্রপাত হল।

ল্যারী লুটিয়ে বসে পড়ল। কথা বলার শেষ চেষ্টাও তার হল না।

 শেড তাকে পরীক্ষা করে বুঝল–একদম শেষ।

শেডের এদিককার কাজটা শেষ হল। ল্যারীর পকেট হাতড়ে গাড়ির লাইসেন্স, ন্যাতানোব্যাগ, সিগারেট কেস, রুমাল, দেশলাই আর বিশ ডলারের একটা নোট পেল। সেগুলো টেবিলের উপর রেখে ল্যারীর পোষাকগুলো সে পরে নিল আর তার পোষাকগুলো ল্যারীকে পরিয়ে দিয়ে সে টেবিলের উপর থেকে জিনিসগুলো হস্তগত করল।

পালাবার শেষ চেষ্টায় সে ল্যারীর মৃতদেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে বুইক গাড়ির দরজা খুলে দেহটাকে শুইয়ে দিল পিছনের সীটে।কুঁড়েঘরে ফিরে গিয়ে টেপের চাকতি দুটো নিয়ে নিল।ইভের সটকেসের দিকে তার নজর পড়ল। খুলে তার মধ্যে দেখতে পেল ভেস্তলের গহনার বাক্স। সব শুদ্ধ নিয়ে গাড়িতে তুলল।

শেডের মুখে এবার বিজয়ীর কঠিন হাসি। সে ল্যারীর বুইকটা নিয়ে দ্রুতবেগে ধাবিত হল। হেডলাইটের বদলে ছোট লাইট দিয়েই সে রাস্তার অন্ধকার দূর করেছে।

আবার সেই ক্লিকরোড, সেই বেড়া। শেড বেড়ার কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে নিজের স্যুটকেসটা, পার্সেল আর গয়নার বাক্সটা ঘাসের মধ্যে নামিয়ে আনল। এগুলো সবই জেলা অ্যাটর্নী জন হ্যারিন্টনের কাছে পাঠাতে হবে।

এবার সে বুইক গাড়িটাকে খাদের ধারে এনে ফাঁকের মুখে গাড়ির মুখটা ঘুরিয়ে রেখে নেমে এল।

গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখে গাড়ির দরজা খুলে হাত দিয়ে ক্লাচ পেডাল চেপে ধরল। গিয়ার পাল্টে তিনের ঘরে তুলে দিল। ইঞ্জিন পুরো গতি না নেওয়া পর্যন্ত সেনাকটা পুরো টেনে রাখল। তারপর কটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ক্লাচ্ ছেড়ে দিয়ে পিছন দিকে নিজের দেহটা সরিয়ে নিল।

একটা ভীষণ ঝাঁকুনি, তারপর গাড়িটা সামনের দিকে লাফিয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির খোলা দরজাটা ঘুরে এসে শেডের কাঁধে প্রচণ্ড জোরে আছড়ে পড়ল।

ধাক্কাতে ছিটকে দুপাক গড়িয়ে গেল শেড। আর গাড়িটা সাঁ–সাঁ করে তার পাশ দিয়ে যেন উড়তে উড়তে গভীর খাদে গড়িয়ে পড়ল।

মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। খাদের অতলে। আর তখনি হঠাৎ ভয়ঙ্কর আতঙ্কে তার শরীরটা হিম হয়ে গেল। সে যে নিজেই খাদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। প্রাণের ভয়ে মরিয়া হয়ে সে ঘাস মাটিকেই মুঠো করে ধরল। মাটিতে আঙুল গুলো শক্ত করে গেঁথে দিল।

ওদিকে বুইকটা খাদের মধ্যে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে আগুন ধরে গেল। তার ধাক্কায় পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। একটা অন্ধ, দুর্দমনীয় আতঙ্কে মরিয়া হয়ে সে অন্য কিছু ধরবার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। হাতের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। দেহটা কতক্ষণ ধরে আর ঝুলে থাকবে! শেষ চেষ্টায় সেঝাঁকুনি দিয়ে দেহটা ওপরে তোলবার চেষ্টা করল। ডান হাঁটুটাও তুলতে পারল। কিন্তু তার হাতের চাপে মাটির চাবড়া আলগা হতে হতে শেষ পর্যন্ত খসে গেল। শেড হাত বাড়িয়ে আরেক জায়গা ধরবার চেষ্টা করল। কিন্তু সে সুযোগ পেল না। দেহটা অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর পথে পাড়ি দিল।