২১. বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী

একবিংশ পরিচ্ছেদ – বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী

ভারতবাসীরা পূর্ব্ব এশিয়ায় ও পূর্ব্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যে বিপুল বাণিজ্য-ব্যবসায়, বহু-সংখ্যক রাজ্য ও উপনিবেশ স্থাপন, এবং হিন্দু-সভ্যতার বহুল প্রচার করিয়াছিল, তাঁহার মধ্যে বাঙ্গালীর কৃতিত্ব কম ছিল না। এরূপ মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। স্থলপথে ভারতবর্ষ হইতে ঐ সমুদয় দেশে যাইতে হইলে, বঙ্গদেশের মধ্য দিয়াই যাইতে হইত। আৰ্য্যাবৰ্ত্ত হইতে যাহারা জলপথে যাইতেন, তাঁহারও তাম্রলিপ্তি বন্দরেই জাহাজে উঠিতেন। এই সমুদয় কারণে এবং বঙ্গদেশের লোকেরা সৰ্ব্বাপেক্ষা নিকটে থাকায়, তাহাদের পক্ষেই এরূপ যাতায়াতের সুবিধা বেশী ছিল।

এই সিদ্ধান্ত কেবল অনুমানমূলক নহে। ইহার প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ব্রহ্মদেশের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প যে প্রধানত বাঙ্গালীরই সৃষ্টি, পণ্ডিতেরা তাহা একবাক্যে স্বীকার করেন। প্রাচীন ব্রহ্মদেশের এক অঞ্চল গৌড় নামে অভিহিত হইত। মালয় উপদ্বীপের এক শিলালিপি হইতে রক্তমৃত্তিকাবাসী বুদ্ধগুপ্ত নামক এক মহানাবিকের কথা জানা যায়; পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, এই রক্তমৃত্তিকা বা রাঙ্গামাটি বাংলায় অবস্থিত ছিল। শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজগণের গুরু ছিলেন একজন বাঙ্গালী, এবং যবদ্বীপে ও পার্শ্ববর্ত্তী অন্যান্য দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রচার ও প্রসারে বাংলার যথেষ্ট প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। শৈলেন্দ্ররাজগণের সহিত পালসম্রাট দেবপালের যে সৌখ্য ছিল, তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। যবদ্বীপের কতকগুলি মূর্ত্তিতে উৎকীর্ণ লিপি তকালে বাংলা দেশে প্রচলিত অক্ষরে লিখিত। কাম্বোডিয়ার একখানি সংস্কৃত লিপিতে প্রাচীন গৌড়ীয় রীতির ছাপ এতই স্পষ্ট যে, কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে ইহার রচয়িতা হয় বাঙালি ছিলেন, নচেৎ বহুকাল বঙ্গদেশে থাকিয়া তথাকার সাহিত্যের অভিজ্ঞ হইয়াছিলেন। এই সমুদয় আলোচনা করিলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, এশিয়ার পূর্ব্বখণ্ডে ভারতীয় রাজ্য ও সভ্যতা বিস্তারে বাঙ্গালীর প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।

সিংহল-দ্বীপ বাঙ্গালী রাজকুমার বিজয় ও তাঁহার সঙ্গীগণ জয় করিয়াছিলেন, এই কাহিনী সিংহলদেশীয় গ্রন্থে সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু ইহা কতদূর ঐতিহাসিক সত্য, তাহা বলা যায় না।

দুর্গম হিমালয়গিরি পার হইয়া বহু বৌদ্ধ আচাৰ্য ও পণ্ডিত তিব্বতে গিয়া তথাকার ধর্ম্মসংস্কারে সহায়তা করিয়াছিলেন। তিব্বতদেশীয় গ্রন্থে তাঁহাদের জীবনী ও বিস্তৃত বিবরণ আছে। ইহাদের মধ্যে যাঁহারা বাঙ্গালী ছিলেন বলিয়া মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে, তাহাদের কয়েকজনের বিবরণ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিতেছি।

অষ্টম শতাব্দে তিব্বতের রাজা খৃস্রং-লদে-বসান গৌড়দেশীয় আচাৰ্য শান্তি রক্ষিতকে (অথবা শাস্ত্ররক্ষিত) তিব্বতে নিমন্ত্রণ করেন। শান্তিরক্ষিত নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি রাজনিমন্ত্রণে দুইবার তিব্বতে গমন করেন এবং তথাকার বৌদ্ধধর্ম্ম সংস্কার করেন। তাঁহার ভগ্নীপতি বৌদ্ধ আচার্য্য পদ্মসম্ভবও রাজনিমন্ত্রণে তিব্বতে গিয়া তাঁহার সাহায্য করেন। তিব্বতের রাজা হঁহাদের উপর খুব প্রসন্ন হন। তিনি মগধের ওদন্তপুরী বিহারের অনুকরণে রাজধানী লাসায় বসম য়া নামক একটি বিহার নির্মাণ করেন এবং শান্তিরক্ষিতকে ইহার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। শান্তিরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব তিব্বতের বিখ্যাত লামা সম্প্রদায়ের প্রবর্ত্তন করেন এবং অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁহারা তিব্বতীয় ভিক্ষুকগণকে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রকৃত তথ্যগুলি যথাযথ শিক্ষা দিয়া তাঁহাদিগের দ্বারা দেশের নানা স্থানে ধর্ম্ম প্রচার করান। শান্তিরক্ষিত ১৩ বৎসর উক্ত অধ্যক্ষের পদে ছিলেন। পরে তাঁহারই পরামর্শে তাঁহার শিষ্য কমলশীলকে তিব্বতের রাজা আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু কমলশীল তিব্বত পৌঁছিবার পূর্ব্বেই শান্তিরক্ষিতের মৃত্যু হয়। ইহার পূর্ব্বেই পদ্মসম্ভব তিব্বত ত্যাগ করিয়া অন্যান্য দেশে গিয়া বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার করেন। কমলশীল তিব্বতে গুরুর আরব্ধ কাৰ্য্য সম্পন্ন করেন।

যে সকল বাঙ্গালী বৌদ্ধ আচার্য তিব্বতে গিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সমধিক প্রসিদ্ধ। ইনি অতীশ নামেও সুপরিচিত এবং এখনো তিব্বতে তাঁহার স্মৃতি পূজিত হয়। তিব্বতীয় গ্রন্থে তাঁহার জীবনী সম্বন্ধে অনেক তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। আমরা সংক্ষেপে তাঁহার বিবরণ দিতেছি।

বঙ্গল (বাংলা) দেশে বিক্রমণিপুরের গৌড়ের রাজবংশে ৯৮০ অব্দে দীপঙ্করের জন্ম হয়। বাল্যকালে তাঁহার নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। তাঁহার পিতার নাম কল্যাণশ্রী এবং মাতার নাম প্রভাবতী। তিনি প্রথমে জেরি ও পরে রাহুলগুপ্তের নিকট নানা বিদ্যা অধ্যয়ন করেন। উনিশ বৎসর বয়সে তিনি ওদন্তপুরী বিহারে বৌদ্ধ-সম্ভের আচাৰ্য্য শীলরক্ষিতের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং গুরু তাঁহাকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এই নাম দেন। এই সময় সুবর্ণদ্বীপের প্রধান ধর্ম্মাচাৰ্য্য চন্দ্রকীৰ্ত্তি বৌদ্ধজগতে বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার নিকট শিক্ষা লাভ করিবার মানসে দীপঙ্কর একখানি বাণিজ্য-জাহাজে কয়েক মাস সমুদ্রযাত্রা করিয়া সুবর্ণদ্বীপে উপস্থিত হন। সেখানে বারো বৎসর অধ্যয়ন করিয়া দীপঙ্কর সিংহল ভ্রমণ করিয়া মগধে গমন করেন। রাজা মহীপাল তাঁহাকে বিক্রমশীল বিহারে নিমন্ত্রণ করেন, এবং রাজা নয়পাল তাঁহাকে ইহার প্রধান আচাৰ্য্য পদে নিযুক্ত করেন। এই সময় তিব্বতের রাজা য়ে শেষ-হোড বৌদ্ধধর্ম্ম সংস্কার করিবার জন্য ভারতবর্ষ হইতে কয়েকজন আচার্য্য নিয়া যাইবার জন্য দুইজন রাজকর্ম্মচারী প্রেরণ করেন। ইহারা নানা দেশ ঘুরিয়া বিক্রমশীল বিহারে উপস্থিত হইলেন এবং ক্রমে জানিতে পারিলেন যে, দীপঙ্করই মগধের বৌদ্ধ আচাৰ্য্যদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু তিনি তিব্বতে যাইতে রাজী হইবেন না জানিয়া, তাঁহারা তিব্বতে ফিরিয়া গিয়া রাজার নিকট সমুদয় নিবেদন করিলেন। রাজা য়ে-শেষ-হোড় দীপঙ্করকে নিমন্ত্রণ করিবার জন্য মূল্যবান উপঢৌকনসহ কয়েকটি দূত পাঠাইলেন। দূতমুখে তিব্বতের রাজার প্রস্তাব শুনিয়া দীপঙ্কর যাইতে অস্বীকার করিয়া বলিলেন যে, তাঁহার স্বর্ণের কোনো প্রয়োজন নাই এবং খ্যাতি-প্রতিপত্তির জন্যও তিনি লালায়িত নহেন। রাজদূতগণ তিব্বতে প্রত্যাগমন করিবার অল্পকাল পরেই য়ে-শেষ-হেড এক সীমান্ত রাজার হস্তে বন্দী হইলেন। শত্ৰুকারাগারে তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে তিনি দীপঙ্করকে তিব্বতে যাইবার জন্য পুনরায় করুণ মিনতি জানাইয়া এক পত্র লেখেন। তিব্বতের নতুন রাজা চ্যান-চুর এই পত্রসহ কয়েকজন রাজদূত দীপঙ্করের নিকট প্রেরণ করেন। দীপঙ্কর ধর্ম্মপ্রাণ রাজার শোচনীয় মৃত্যুতে ব্যথিত হইয়া তাঁহার অন্তিম অনুরোধ পালনপূর্ব্বক তিব্বত গমনে স্বীকৃত হইলেন। নেপালের মধ্য দিয়া তিব্বতের সীমান্তে পৌঁছিলে রাজার সৈন্যদল তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিল। মানসসরোবরে এক সপ্তাহ কাটাইয়া তিনি সদলবলে থোলিং মঠে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে রাজধানীতে পৌঁছিলে রাজা স্বয়ং মহাসমারোহে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলেন। অতঃপর তিব্বতের নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া তিনি বিশুদ্ধ মহাযান ধর্ম্ম প্রচার করেন এবং তথাকার বৌদ্ধধর্ম্মের সংস্কার করেন। তিনি তেরো বৎসর তিব্বতে থাকিয়া প্রায় দুইশতখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। ১০৫৩ অব্দে ৭৩ বৎসর বয়সে তিব্বতেই তাঁহার মৃত্যু হয়।

কেবল বিদেশে নহে, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশেও অনেক বাঙ্গালী জ্ঞানবীর ও কর্ম্মবীর যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছেন। বাংলার বাহিরে নালন্দা ও বিক্রমশীল এই দুই প্রসিদ্ধ বৌদ্ধবিহারে অনেক বাঙ্গালী আচাৰ্য খ্যাতি লাভ করিয়াছেন ও সর্বাধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করিয়াছেন। চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাং যখন নালন্দায় যান, তখন বাংলার ব্রাহ্মণ-রাজবংশীয় শীলভদ্র এই মহাবিহারের প্রধান আচাৰ্য্য ও অধ্যক্ষ ছিলেন। হুয়েন সাংয়ের বিবরণ হইতে শীলভদ্রের জীবনী সম্বন্ধে অনেক কথা জানিতে পারা যায়। শীলভদ্র ভারতের নানা স্থানে ঘুরিয়া বৌদ্ধধর্ম্মে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি নালন্দায় ভিক্ষুপ্রবর ধর্ম্মপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁহার নিকট দীক্ষা লাভ করেন। তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দূরদেশেও বিস্তৃত হইয়াছিল। এই সময় দাক্ষিণাত্যের একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মগধে আসিয়া ধর্ম্মপালকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেন। শীলভদ্রের বয়স তখন মাত্র ৩০ বৎসর, কিন্তু ধর্ম্মপাল তাঁহাকেই ব্রাহ্মণের সহিত তর্ক করিতে আদেশ দিলেন। শীলভদ্র ব্রাহ্মণকে পরাজিত করিলেন। মগধের রাজা ইহাতে সন্তুষ্ট হইয়া শীলভদ্রকে একটি নগরের রাজস্ব উপহার দিলেন। ভিক্ষুর ধনলোভ উচিত নহে-এই যুক্তি দেখাইয়া শীলভদ্র প্রথমে ইহা প্রত্যাখ্যান করিলেন, কিন্তু রাজার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তিনি এই দান গ্রহণ করিলেন এবং ইহার দ্বারা একটি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করিলেন। কালক্রমে হুয়েন সাং ৬৩৭ অব্দে নালন্দায় গমন করেন। তখন এখানে ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ হাজার এবং বৌদ্ধগণের আঠারোটি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন। ধর্ম্মশাস্ত্র ব্যতীত বেদ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, ও সাংখ্য, প্রভৃতি এখানে অধীত হইত। হুয়েন সাং বলেন যে, এক শীলভদ্রই একা এই সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন এবং সংঘবাসীগণ তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁহার নাম উচ্চারণ না করিয়া তাহাকে ‘ধর্ম্মনিধি’ বলিয়া অভিহিত করিতেন। হুয়েন সাং চীনদেশ হইতে আসিয়াছেন শুনিয়া, শীলভদ্র তাঁহাকে সাদরে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন এবং যোগশাস্ত্র শিক্ষা দেন। আ ৬৫৪ অব্দে শীলভদ্রের মৃত্যু হয়।

শীলভদ্র ব্যতীত আরও দুইজন বাঙ্গালী-শান্তিরক্ষিত ও চন্দ্রগোমিন-নালন্দার আচাৰ্যপদ লাভ করিয়াছিলেন। শান্তিরক্ষিতের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। চন্দ্রগোমিন বরেন্দ্রে এক ক্ষত্রিয়বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, জ্যোতিষ, আয়ুর্ব্বেদ, সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্পকলায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং আচাৰ্য অশোকের নিকট বৌদ্ধধর্ম্মে দীক্ষা লাভ করেন। তিনি প্রথমে দাক্ষিণাত্য ও সিংহল-দ্বীপে বাস করেন এবং চান্দ্র-ব্যাকরণ নামে একখানি ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেন। তিনি নালন্দায় গমন করিলে, প্রথমে তথাকার আচাৰ্য্যগণ তাঁহার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন নাই। কিন্তু নালন্দার প্রধান আচাৰ্য্য চন্দ্রকীৰ্ত্তি তাঁহার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হন। তিনি নালন্দায় একটি শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করেন। ইহার সম্মুখভাগে তিনখানি রথ ছিল। ইহার একখানিতে চন্দ্রগোমিন আর একখানিতে মঞ্জুশ্রীর মূর্ত্তি, এবং তৃতীয়খানিতে স্বয়ং চন্দ্রকীর্তি ছিলেন। ইহার পর হইতে নালন্দায় চন্দ্রগোমিনের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বাড়িয়া যায় এবং যোগাচার-মতবাদ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্ক করিয়া তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

নালন্দার ন্যায় বিক্রমশীল বিহারেও অনেক বাঙ্গালী আচাৰ্য্য ছিলেন। দীপঙ্করের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। অভয়াকরগুপ্ত এই মহাবিহারের সর্বাধ্যক্ষের পদ লাভ করিয়াছিলেন এবং তিনি এখনো তিব্বতে একজন পঞ্ছেন-রিণপোছে অর্থাৎ রাজগুণালঙ্কৃত লামারূপে পূজিত হন। গৌড় নগরীর নিকটে তাঁহার জন্ম হয় এবং তিনি বৌদ্ধ পণ্ডিতরূপে খ্যাতিলাভ করেন। তিনি প্রথমে রামপালের রাজপ্রাসাদে বৌদ্ধ আচাৰ্য নিযুক্ত হন এবং ওদন্তপুরী বিহারের মহাযান সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব লাভ করেন। কালক্রমে তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রধান আচার্য পদে নিযুক্ত হন। ঐ বিহারে তখন তিন হাজার ভিক্ষু বাস করিতেন। তিনি তিব্বতে গিয়াছিলেন কি না সঠিক বলা যায় না, কিন্তু বহু গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিরেন। রামপালের রাজ্যাবসানের পূর্ব্বেই তাঁহার মৃত্যু হয়। তাঁহার সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তিনি দিবসের প্রথম দুইভাগে শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করিতেন, তৃতীয় ভাগে ধৰ্ম্মব্যাখ্যা করিতেন এবং তারপর দ্বিপ্রহর রাত্রি পর্য্যন্ত হিমবন শ্মশানে দেবার্চনা করিয়া শয়ন করিতেন। সুখবতী নগরীর বহু ক্ষুধিত ভিক্ষুককে তিনি অন্নদান করেন। চরসিংহ নগরের এক চণ্ডাল রাজা একশত নরবলী দিবার সংকল্প করেন, কিন্তু তাঁহার অনুরোধে প্রতিনিবৃত্ত হন। একবার একদল ‘তুরুষ্ক’ ভারতবর্ষ আক্রমণ করিলে তিনি কয়েকটি ধর্ম্মানুষ্ঠান করেন এবং তাঁহার ফলে তুরুষ্কেরা ভারতবর্ষ ছাড়িয়া যাইতে বাধ্য হয়। অবশ্য এই গল্পগুলি কত দূর সত্য বলা কঠিন।

তিব্বতীয় লামা তারনাথ জেরি নামক আর একজন বাঙ্গালী আচার্যের কিছু বিবরণ দিয়াছেন। জেরির পিতা ব্রাহ্মণ আচাৰ্য্য গর্ভপাদ বরেন্দ্রের রাজা সনাতনের গুরু ছিলেন। বরেন্দ্রেই জেতারির জন্ম হয়। অল্প বয়সেই জ্ঞাতিগণ কর্ত্তৃক বিতাড়িত হইয়া জেরি বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করেন, এবং বৌদ্ধশাস্ত্রে, বিশেষত অভিধর্ম্মপিটকে, বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। রাজা মহাপাল (মহীপাল?) তাহাকে বিক্রমশীল বিহারের পণ্ডিত-এই গৌরবময় পদসূচক একখানি মানপত্র দান করেন। তিনি বহুদিন এই বিহারের আচাৰ্য্য ছিলেন এবং তাঁহার দুই ছাত্র রত্নাকরশান্তি ও দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পরে এই মহাবিহারের সাধ্যক্ষ পদ লাভ করিয়াছিলেন। তারনাথের মতে তিনি একশত গ্রন্থ রচনা করেন। ইহার অনেকগুলিই তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল।

দীপঙ্করের আর একজন অধ্যাপক জ্ঞানশ্রীও বাঙ্গালী ছিলেন। তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারের দ্বারপণ্ডিত ছিলেন। কাশ্মীরে জ্ঞানশ্রীদ্র নামে এক বৌদ্ধ আচার্য্যের খ্যাতি আছে, তিনি ও এই জ্ঞানশ্রী সম্ভবত একই ব্যক্তি। তিনি বহু গ্রন্থ লিখিয়াছেন এবং তিব্বতীয় ভাষায় ইহার অনেকগুলির অনুবাদ হইয়াছিল।

বৌদ্ধ আচাৰ্য ব্যতীত বাংলার অনেক শৈব গুরুও বাংলার বাহিরে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। দক্ষিণরাঢ়া নিবাসী উমাপতিদেব (অপর নাম জ্ঞানশিব দেব) চোলদেশে বসবাস করেন এবং স্বামিদেবর এই নামে পরিচিত হইয়া রাজা-প্রজা উভয়েরই শ্রদ্ধা ও সম্মানভাজন হন। এই সময়ে চোলরাজ দ্বিতীয় রাজাধিরাজের (১১৬৩-১১৯০) একজন সামন্তরাজা সিংহলদেশীয় সৈন্যের আক্রমণে ভীত হইয়া উমাপতিদেবের শরণাপন্ন হন। উমাপতিদেব ২৮ দিন শিবের আরাধনা করেন এবং তাঁহার ফলে সিংহলীয় সৈন্য চোলরাজ্য ত্যাগ করিয়া পলাইয়া যায়। কৃতজ্ঞ সামন্তরাজা উমাপতিদেবকে একখানি গ্রাম দান করেন এবং উমাপতি ইহার রাজস্ব তাঁহার আত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করিয়া দেন।

জব্বলপুরের নিকটবর্ত্তী প্রাচীন ডাহলমণ্ডলে গোলকীমঠ নামে এক বিখ্যাতি শৈব প্রতিষ্ঠান ছিল। কলচুরিরাজ প্রথম যুবরাজ (আ ৯২৫ অব্দ) এই মঠের অধ্যক্ষকে তিন লক্ষ গ্রাম দান করেন। ইহার আয় হইতে মঠের ব্যয় নির্বাহ হইত। বাঙ্গালী বিশ্বেশ্বরশম্ভু ত্রয়োদশ শতাব্দের মধ্যভাগে এই মঠের অধ্যক্ষপদ লাভ করেন। দক্ষিণ রাঢ়ার অন্তর্গত পূৰ্ব্বগ্রামে তাঁহার জন্ম হয়। বেদে অগাধ পাণ্ডিত্যহেতু তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। চোল ও মালবরাজ তাঁহার শিষ্য ছিলেন এবং কাকতীয়রাজ গণপতি ও ত্রিপুরীর কলচুরিরাজ তাঁহার নিকট দীক্ষাগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি মন্ত্রশিষ্য রাজা গণপতির রাজ্যে বাস করিতেন। গণপতি এবং তাঁহার কন্যা ও উত্তরাধিকারিণী রুদ্রাম্বা তাঁহাকে দুইখানি গ্রাম দান করেন। বিশ্বেশ্বরশম্ভু এই দুইখানি গ্রাম একত্র করিয়া বিশ্বেশ্বর-গোলকী নামে অভিহিত করেন এবং তথায় মন্দির, মঠ, বিদ্যালয়, অন্নছত্র, মাতৃশালা ও আরোগ্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই গ্রামে ৬০টি দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ-পরিবার বসতি করান এবং তাঁহাদের ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত ভূমিদান করেন। অবশিষ্ট ভূমি তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। একভাগ শিবমন্দির, আর একভাগ বিদ্যালয় ও শৈবমঠ, এবং তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয়-নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট হয়। বিদ্যালয়ের জন্য আটজন অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনজন ঋক, যজু ও সাম এই তিন বেদ পড়াইতেন, আর বাকি পাঁচজন সাহিত্য, ন্যায় ও আগম শাস্ত্রের অধ্যাপনা করিতেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির জন্যও যথোচিত কর্ম্মচারী ও সেবক প্রভৃতি নিযুক্ত হয়। গ্রামের লোকের জন্য একঘর করিয়া স্বর্ণকার, কৰ্ম্মকার, শিলাকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, স্থপতি, নাপিত প্রভৃতি স্থাপিত করা হয়। বিশ্বেশ্বরশঙ্কু জন্মভূতি পূৰ্ব্বগ্রাম হইতে কয়েকজন ব্রাহ্মণ আনাইয়া গ্রামের আয়-ব্যয় পরীক্ষা ও হিসাবরক্ষকের কাৰ্য্যে নিযুক্ত করেন। গ্রামের বিবিধ প্রতিষ্ঠানগুলি যাহাতে ভবিষ্যতে উপযুক্তরূপে পরিচালিত হয়, তাঁহার জন্য তিনি অনেক বিধিব্যবস্থা করেন। বিশ্বেশ্বরশম্ভু আরও বহু সৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করেন এবং বিভিন্ন স্থানে মঠ, মন্দির ও শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার ব্যয় নির্বাহের জন্য উপযুক্ত জমি দান করেন। বিশ্বেশ্বর নামে তিনি একটি নগরী স্থাপন করেন। শিলালিপিতে এই সমুদয়ের যে সবিস্তার উল্লেখ আছে, তাহা পাঠ করিলে প্রাচীন যুগের বাঙ্গালীর জীবনযাত্রা, সমাজের প্রতি কর্তব্য এবং ধর্ম্মসংস্কার প্রভৃতির আদর্শ আমাদের নিকট উজ্জ্বল হইয়া ওঠে।

বাঙ্গালী বৎস-ভার্গব গোত্রীয় ব্রাহ্মণ বসাবণ হরিয়াণ (পঞ্জাবের হিসার জিলার অন্তর্গত হরিয়ান) প্রদেশের সিংহপল্লী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র ঈশানশিব সংসার ত্যাগ করিয়া বোদামযুতের (যুক্ত প্রদেশের বাউন) শৈব-মঠে বাস করেন। কালক্রমে তিনি এই মঠের অধ্যক্ষ হন এবং একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়দেশীয় অবিঘ্নাকর কৃষ্ণগিরি পাহাড়ে (বম্বের অন্ত গত কাহ্নেরি) ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য একটি গুহা খনন করান। তিনি ৮৫৩ অব্দে একশত দ্রম্ম দান করেন। এই গচ্ছিত অর্থের সুদ হইতে উক্ত গুহা বিহারবাসী ভিক্ষুগণকে বস্ত্র দিবার ব্যবস্থা করা হয়।

কয়েকজন বাঙ্গালী পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের জন্য বাংলার বাহিরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। শক্তিস্বামী নামে একজন বাঙ্গালী কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্যের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁহার পুত্র কল্যাণস্বামী যাজ্ঞবন্ধ্যের তুল্য বলিয়া কথিত হইয়াছেন। কল্যাণস্বামীর পৌত্র জয়ন্ত একজন কবি ও বাগ্মী ছিলেন এবং বেদ-বেদাঙ্গাদি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, তিনি ও ন্যায়মঞ্জরী-প্রণেতা জয়ন্তভট্ট একই ব্যক্তি। এই জয়ন্তের পুত্র অভিনন্দন কাদম্বরী-কথাসার গ্রন্থ রচনা করেন। ইহাতে বাণভট্ট-প্রণীত কাদম্বরীর সারমর্ম কবিতায় বর্ণিত হইয়াছে। ভট্টকোশল-গ্রাম-নিবাসী বাঙ্গালী লক্ষ্মীধর একজন সুপরিচিত কবি ছিলেন। তিনি মালবে গমন করেন এবং পরমাররাজ ভোজের (১০০০-১০৪৫) সভা অলঙ্কৃত করেন। তিনি চক্রপাণি-বিজয় নামক একখানি কাব্য প্রণয়ন করেন। দক্ষিণ রাঢ়ার অন্তর্গত নবগ্রাম-নিবাসী হলায়ূধও মালবে বাসস্থাপন করেন। তাঁহার রচিত ৬৪টি শ্লোক মান্ধাতা (প্রাচীন মাহিম্মতী?) নগরের এক মন্দিরগাত্রে উত্তীর্ণ হয় (১০৬৩ অব্দ)। মদন নামে আর একজন বিখ্যাত বাঙ্গালী কবি বাল্যকালে মালবে গিয়া তাঁহার কবিত্বশক্তির জন্য বাল-সরস্বতী উপাধি প্রাপ্ত হন এবং পরমাররাজ অর্জুন বর্ম্মার (১২১০-১২১৮) গুরুপদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি পারিজাতমঞ্জরী’ নামক কাব্য রচনা করেন। চন্দ্রেরাজ পরমর্দির সভায় বাঙ্গালী গদাধর ও তাঁহার দুই পুত্র দেবর ও ধৰ্মধর এই তিন কবি বাস করিতেন। রামচন্দ্ৰ কবিভারতী নামে আর একজন বাঙ্গালী সুদূর সিংহলদ্বীপে প্রতিপত্তি লাভ করেন। বীরবতী গ্রামে তাঁহার জন্ম হয় এবং অল্পবয়সেই তিনি তর্ক, ব্যাকরণ, শ্রুতি, স্মৃতি, মহাকাব্য, আগম, অলঙ্কার, ছন্দ, জ্যোতিষ ও নাটক প্রভৃতিতে পারদর্শী হন। রাজা দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজ্যকালে (১২২৫-৬০) তিনি সিংহলে গমন করিয়া বৌদ্ধ আচার্য্য রাহুলের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৌদ্ধধর্ম্মে দীক্ষা লাভ করেন। রাজা পরাক্রমবাহু তাহাকে ‘বৌদ্ধগমচক্রবর্ত্তী এই সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেন। রামচন্দ্র ভক্তিশতক, বৃত্তমালা ও বৃত্তরত্নাকর-পঞ্জিকা এই তিনখানি গ্রন্থ রচনা করেন। শেষোক্ত গ্রন্থের রচনাকাল ১২৪৫ অব্দ।

গৌড়দেশীয় করণ-কায়স্থগণ সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান ও লিপি-কুশলতার জন্য আৰ্য্যাবর্তের সর্বত্র বিখ্যাত ছিলেন ও প্রাচীন লিপি উৎকীর্ণ করিবার জন্য নিযুক্ত হইতেন। চন্দ্রে, চাহমন ও কলচুরি রাজগণের অনেক লিপি হঁহাদের দ্বারা উৎকীর্ণ হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন বিহার ও যুক্তপ্রদেশের কয়েকখানি লিপির লেখকও বাঙ্গালী ছিলেন।

এতক্ষণ আমরা কেবল ধর্ম্মাচাৰ্য, কবি ও পণ্ডিত সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। কিন্তু ক্ষত্রিয়োচিত কার্য্যেও অনেক বাঙ্গালী বাংলার বাহিরে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। গদাধর বরেন্দ্রের অন্তর্গত তড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৩৯-৯৬৮) ও খোট্টিগের অধীনে কার্তিকেয়-তপোবন নামক ভূখণ্ডের অধিপতি হন। মাদ্রাজ-প্রদেশের অন্তর্গত বেলারী জিলার কোলগলুগ্রামে তাঁহার রাজধানী ছিল। তিনি এই স্থানে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করিয়া ব্ৰহ্ম, বিষ্ণু, শিব, পাৰ্ব্বতী, কার্তিক, গণেশ ও সূৰ্য্য প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্ত্তি স্থাপন এবং কুপ-তড়াগাদি খনন করেন। একখানি প্রস্তরলিপিতে তিনি গৌড় চূড়ামণি, বরেন্দ্রীর দ্যোতকারী এবং মুনি ও দুর্ভিক্ষমল্ল (দুর্ভিক্ষের দমনকারী) বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। ১১৯১ অব্দে উত্তীর্ণ একখানি লিপিতে গৌড়বংশীয় রাজা অনেকমল্লের উল্লেখ আছে। তিনি গাঢ়ওয়াল অঞ্চলে রাজত্ব করিতেন এবং কেদারভূমি ও তন্নিকটবর্ত্তী প্রদেশ জয় করেন। সপ্তম শতাব্দীতে শক্তি নামক ভরদ্বাজ-বংশীয় একজন বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ দৰ্বাভিসারের অধিপতি হন। এই স্থান পঞ্জাবের চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদীর মধ্যস্থলে পার্ব্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। তাঁহার পৌত্র শক্তিস্বামী কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের মন্ত্রী হইয়াছিলেন। বাঙ্গালী লক্ষ্মীধরের পুত্র গদাধর চন্দেল্লরাজগণের মরমর্দির (১১৬৭-১২০২) সান্ধিবিগ্ৰহিক পদ লাভ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মীধর নামে আর একজন বাঙ্গালী ও তাঁহার বংশধরগণ সাত পুরুষ যাবৎ চন্দেল্লরাজগণের অধীনে কর্ম্ম করেন। ইহার মধ্যে তিনজন-যশঃপাল, গোকুল ও জগদ্ধর-রাজমন্ত্রীর পদ লাভ করিয়াছিলেন। দেড়শত বৎসরের অধিককাল (আ ১১০০-১২৫০) এই বাঙ্গালী পরিবার চন্দেল্লরাজ্যে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত থাকিয়া। বাঙ্গালীর শাসনকার্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। পঞ্চম শতাব্দের একখানি লিপি হইতে জানা যায় যে, ‘গৌরী’ দেশের এক ক্ষত্রিয় রাজপুতানার উদয়পুরে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। এই গৌর সম্ভবত গৌড় দেশ এবং এই রাজপরিবার সম্ভবত বাঙ্গালী ছিলেন।

চাহমানরাজ তৃতীয় পৃথ্বীরাজের নাম ইতিহাসে সুপরিচিত। মুহম্মদ ঘোরীকে প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করিয়া পরে দ্বিতীয় যুদ্ধে কিরূপে তিনি পরাজিত ও নিহত হন, মুসলমান ঐতিহাসিকগণ তাহা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু হম্মীর মহাকাব্যে এই যুদ্ধের অন্য রকম বিবরণ পাওয়া যায় এবং এই প্রসঙ্গে উদয়রাজ নামক একজন বাঙ্গালী বীরের কীর্তি উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে। উদয়রাজ পৃথ্বীরাজের সেনাপতি ছিলেন। পৃথ্বীরাজ ঘোরীর সহিত বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেন। কিন্তু একবার ঘোরী পৃথ্বীরাজের রাজ্য আক্রমণ করিয়া দিল্লী অধিকার করেন। পৃথ্বীরাজ উদয়রাজকে সসৈন্যে অগ্রসর হইতে আদেশ করিয়া নিজে অল্প সৈন্য লইয়া শত্রুর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন এবং পরাজিত ও বন্দী হন। উদয়রাজ সসৈন্যে উপস্থিত হইলে, ঘোরী তাঁহার সহিত যুদ্ধ না করিয়া বন্দী পৃথ্বীরাজসহ দিল্লীর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। গৌড়বীর প্রভুর পরাজয়েও হতাশ না হইয়া দিল্লী আক্রমণ করেন এবং এক মাসকাল যুদ্ধ করেন। ঘোরীর অমাত্যগণ উদয়রাজের পরাক্রমে ভীত হইয়া শান্তি স্থাপনের নিমিত্ত পৃথ্বীরাজকে মুক্তি দিবার পরামর্শ দিলেন। ঘোরী তাহা না শুনিয়া পৃথ্বীরাজকে বধ করিলেন। প্রভুর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া উদয়রাজ দিল্লী অধিকার করিবার জন্য প্রাণপণে শেষ চেষ্টা করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। হম্মীর-মহাকাব্যের এই কাহিনী কত দূর বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন, কিন্তু উদয়রাজের বীরত্বকাহিনী একেবারে নিছক কল্পনা, এরূপ অনুমান করাও সঙ্গত নহে। হিন্দু যুগের অবসানে একজন গৌড়ীয় বীর সুদূর পশ্চিমে তুরষ্কসেনার সহিত সংগ্রামে আত্মবিসৰ্জন করিয়া প্রভুভক্তির চরম প্রমাণ দিয়াছিল, বিদেশীয় কবির এই কল্পনাও বাঙ্গালীর পক্ষে কম শ্লাঘার বিষয় নহে।

বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী কিরূপ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করিয়াছিল, তাঁহার যে কয়েকটি মাত্র দৃষ্টান্ত আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানিতে পারিয়াছি, তাহাই লিপিবদ্ধ হইল। কালসমুদ্রে এইরূপ আর কত বিষ্মকর কাহিনী ও কীর্তিগাথা বিলীন হইয়াছে কে বলিতে পারে? পঞ্জাবের পার্ব্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত সুকেত, কেওস্থল, কাষ্টওয়ার ও মণ্ডী এই কয়টি রাজ্যের রাজগণ বাংলার গৌড়-রাজবংশ-সদ্ভূত, এইরূপ একটি বদ্ধমূল সংস্কার দীর্ঘকাল যাবৎ ঐ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। কাষ্টওয়ার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কাহনপাল সম্বন্ধে প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে, তিনি গৌড়ের রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং কতিপয় অনুচরসহ উক্ত পার্ব্বত্য অঞ্চলে গমন করিয়া একটি রাজ্য স্থাপন করেন। পালবংশীয় সম্রাটগণ এই প্রদেশে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, এবং পরবর্ত্তীকালে তাঁদের অথবা সেনরাজগণের বংশের কেহ এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিতে পারেন। সুতরাং পূর্ব্বোক্ত জনশ্রুতি একেবারে অমূলক বা অসম্ভব বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। তবে বিশ্বস্ত প্রমাণ না পাইলে, ইহা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়াও গ্রহণ করা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *