১৫. রাজ্যশাসনপদ্ধতি

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ –রাজ্যশাসনপদ্ধতি

১. প্রাচীন যুগ

গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্ব্বে বাংলার রাজ্যশাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে কোনো সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন গ্রন্থে সুহ্ম পু প্রভৃতি জাতি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উল্লেখ দেখিয়া অনুমান হয় যে আর্য্যাবর্তের অন্যান্য অংশের ন্যায় বাংলা দেশেও প্রথমে কয়েকটি বিশিষ্ট সংঘবদ্ধ জাতি বসবাস করে এবং ইহা হইতেই ক্রমে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়।

গ্রীক লেখকগণ গঙ্গরিডই রাজ্যের যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহাতে কোনো সন্দেহ থাকে না যে খৃষ্টপূৰ্ব চতুর্থ শতাব্দের পূর্ব্বেই বাংলায় রাজতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ হইয়াছিল। কারণ রাজ্যশাসনপদ্ধতি সুনিয়ন্ত্রিত ও বিশেষ শৃঙ্খলার সহিত বিধিবদ্ধ না হইলে এরূপ পরাক্রান্ত রাজ্যের উদ্ভব সম্ভবপর নহে। মহাভারতের উল্লিখিত হইয়াছে যে বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি মিলিত হইয়া বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিল এবং তাহারা বিদেশী রাজ্যের সহিতও রাজনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছিল। ইহাও বাংলা দেশে রাজনৈতিক জ্ঞানের প্রসার ও প্রভাব সূচিত করে। রাজকুমার বিজয়ের আখ্যান (পৃ. ১৪) সত্য হইলে বাংলা দেশে যে প্রজাশক্তি প্রভাবশালী ছিল তাহা স্বীকার করিতে হইবে।

মৌৰ্য্যযুগের একখানিমাত্র লিপি মহাস্থানগড়ে অর্থাৎ প্রাচীন পুণ্ড্রবর্দ্ধনে পাওয়া গিয়াছে। ইহাতে একজন মহামাত্রের উল্লেখ আছে। এই লিপির প্রকৃত মৰ্ম্ম কী তাহা লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। দুর্ভিক্ষ বা অন্য কোনো কারণবশত প্রজাগণের দুরাবস্থা হওয়ায় সরকারী ভাণ্ডার (কোষাগার) হইতে দুস্থ লোকদিগকে শস্য ও নগদ টাকা ধার দিয়া সাহায্য করার আদেশই এই লিপিতে উক্ত হইয়াছে। খুব সম্ভবত মৌর্যগণের সুপরিচিত রাজ্যশাসনপদ্ধতি বাংলা দেশেও প্রচলিত ছিল।

.

২. গুপ্তসাম্রাজ্য ও অব্যবহিত পরবর্ত্তী যুগ

বাংলা দেশ গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হইলেও ইহার এক অংশমাত্র গুপ্ত সম্রাটগণের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল। শাসনকার্য্যের সুবিধার জন্য এই অংশে বর্ত্তমান কালের ন্যায় কতকগুলি নির্দিষ্ট শাসন বিভাগ ছিল। সৰ্ব্বাপেক্ষা বড় বিভাগের নাম ছিল ভুক্তি। প্রত্যেক ভুক্তি কতকগুলি বিষয়, মণ্ডল, বীথি ও গ্রামে বিভক্ত ছিল। বঙ্গ বিভাগের পূর্ব্বে বাংলার যে অংশকে আমরা রাজসাহী বিভাগ বলিতাম মোটামুটি তাহাই ছিল পুণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তির সীমা। প্রাচীন ভুক্তি ও বর্ত্তমান বর্দ্ধমান বিভাগও মোটামুটি একই বলা যাইতে পারে। বিষয়গুলি ছিল বর্ত্তমান জিলার মতো।

গুপ্ত সম্রাট স্বয়ং ভুক্তির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিতেন-ইহার উপাধি ছিল উপরিক মহারাজ। সাধারণত উপরিক-মহারাজই অধীনস্থ বিষয়গুলির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিতেন, কিন্তু কোনো কোনো স্থলে স্বয়ং সম্রাট কর্ত্তৃক তাঁহাদের নির্বাচনের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের নানা উপাধি ছিল,–কুমারামাত্য, আযুক্তক, বিষয়পতি প্রভৃতি। ইহা ভিন্ন আরও বহুসংখ্যক কাজকর্ম্মচারীর নাম পাওয়া যায়।

ভুক্তি, বিষয়, বীথি প্রভৃতি প্রত্যেক বিভাগেরই একটি কেন্দ্র ছিল এবং সেখানে তাহাদের একটি অধিকরণ (আফিস) থাকিত। তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ কতকগুলি ভূমি বিক্রয়ের দলিল হইতে এই সমুদয় অধিকরণের কিছু কিছু বিবরণ জানিতে পাওয়া যায়। ইহার কয়েকখানিতে কোটিবর্ষ বিষয়ের অধিকরণের উল্লেখ আছে। কোটিবর্ষ নগরীর ধ্বংসাবশেষ বর্ত্তমানকালে বাণগড় নামে পরিচিত। এই নগরীর নাম অনুসারেই উক্ত বিষয়ের নামকরণ হইয়াছিল এবং এখানেই এই বিষয়ের অধিকরণ অবস্থিত ছিল। বিষয়পতি ব্যতীত এই অধিকরণের আর চারিজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। তাঁহারা নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম সার্থবাহ, প্রথম কুলিক ও প্রথম কায়স্থ। এই চারিটি পদবীর প্রকৃত অর্থ নিরূপণ করা দুরূহ। সম্ভবত প্রথম তিনটি ধনী মহাজন, বণিক ও শিল্পীগণের প্রতিনিধিস্বরূপ অধিকরণের সদস্য ছিলেন। কায়স্থ শব্দে লেখক ও এক শ্রেণীর রাজকর্ম্মচারী বুঝাইত। সেকালে ধনী মহাজন, বণিক ও শিল্পীগণের বিধিবদ্ধ সংঘ-প্রতিষ্ঠান ছিল। এই সমুদয় সংঘ-মুখ্যগণই সম্ভবত বিষয় অধিকরণের সদস্য হইতেন। ইহা হইতে সেকালের স্বায়ত্তশাসন প্রথার মূল কত দৃঢ় ছিল তাহা বুঝা যায়। প্রতি বিষয়পতি এই সমুদয় বিভিন্ন সংঘের প্রতিনিধির মিলিত হইয়া বিষয়ের কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিতেন। কী প্রণালীতে এই সমুদয় অধিকরণ জমি বিক্রয় করিত তাঁহার বিবরণ পূৰ্ব্বোক্ত তাম্রশাসনগুলি হইতে জানা যায়। প্রথমে ক্রেতা অধিকরণের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কী উদ্দেশ্যে কোনো জমি কিনিতে চান তাহা নিবেদন করিতেন। তখন অধিকরণের আদেশে পুস্তপাল নামক একজন কর্ম্মচারী ঐ জমি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া উহা বিক্রয় করা যাইতে পারে কি না এবং উহার মূল্য কত প্রভৃতি বিষয় অধিকরণের গোচর করিতেন। তারপর নির্ধারিত মূল্য দেওয়া হইলে ক্রেতা জমির অধিকার পাইতেন। কোনো কোনো স্থলে দেখা যায় যে এই জমি বিক্রয়ের কথা পার্শ্ববর্ত্তী গ্রামবাসীগণকে জানানো হইত এবং গ্রামের মহত্তর (মাতব্বর) ও কুটুম্বিগণের (গৃহস্থ) সাক্ষাতে জমি মাপিয়া তাঁহার সীমা নির্দিষ্ট করা হইত।

বাংলার যে অংশ প্রত্যক্ষভাবে গুপ্ত সম্রাটগণের শাসনাধীনে ছিল না তাহা সামন্ত মহারাজগণের অধীনে ছিল। সম্ভবত যে সমুদয় স্বাধীন রাজ্য গুপ্তগণের পদানত হইয়াছিল তাহাদের রাজারাই গুপ্তগণের অধীনস্থ সামন্তরাজরূপে পরিগণিত হইয়াছিলেন। ইঁহাদের বিভিন্ন উপাধি দেখিয়া অনুমিত হয় যে ইহারা দেশের আভ্যন্তরিক শাসন বিষয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতা পরিচালিত করিতেন। ক্রমে গুপ্তগণের প্রবর্তিত শাসনপদ্ধতি বাংলা দেশের সর্বত্র প্রচলিত হইয়াছিল। দক্ষিণ ও পূর্ব্ববঙ্গে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবার পরও ভুক্তি, বিষয়, বীথি প্রভৃতি শাসন বিভাগের ও বিষয় অধিকারের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। অবশ্য স্বাধীন রাজগণ মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করিতেন। গুপ্ত সম্রাটগণের ন্যায় ইঁহারাও বিভিন্ন শ্ৰেণীর বহুসংখক রাজকর্ম্মচারী নিযুক্ত করিতেন। গোপচন্দ্রের মল্লসারূল তাম্রশাসনে এই কর্ম্মচারীগণের একটি তালিকা পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু ইহাদের কাহার কী কাৰ্য্য বা কী পরিমাণ ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছিল অধিকাংশস্থলেই তাহা নির্ণয় করা যায় না।

.

৩. পালসাম্রাজ্য

পালবংশীয় রাজগণের চারি শতাব্দীব্যাপী রাজত্বকালে বাংলায় শাসনপ্রণালী দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। গুপ্তযুগের ন্যায় ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল প্রভৃতি সুনির্দিষ্ট শাসন বিভাগের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। পুণ্ড্রবর্দ্ধন ও বর্দ্ধমান ভুক্তি ব্যতীত বাংলায় আর একটি ভুক্তির প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। ইহার নাম দণ্ডভুক্তি। ইহা বর্ত্তমান মেদিনীপুর জিলায় অবস্থিত ছিল। এতদ্ব্যতীত উত্তর বিহারে তীর-ভুক্তি (ত্রিহুত), দক্ষিণ বিহারে শ্রীনগর-ভুক্তি এবং আসামে প্রাগজ্যোতিষ-ভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু এই সমুদয় ভুক্তি বা ইহাদের অধীনস্থিত বিষয়, মণ্ডল প্রভৃতির শাসনপ্রণালী সম্বন্ধে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

পরাক্রান্ত পাল সম্রাটগণ প্রাচীন বাংলার মহারাজ বা পরবর্ত্তীকালের ‘মহারাজাধিরাজ’ পদবীতে সন্তুষ্ট থাকেন নাই। গুপ্ত সম্রাটগণের ন্যায় তাঁহারাও পরমেশ্বর, পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ প্রভৃতি গৌরবময় উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের রাজ্য বহু বিস্তৃত হওয়ায় শাসনপ্রণালীরও তদনুরূপ পরিবর্ত্তন হইয়াছিল। এই সময় হইতেই রাজত্বের সমুদয় ব্যাপারে প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন একজন প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখ দেখিতে পাই। গর্গ নামে এক ব্রাহ্মণ ধৰ্ম্মপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন–তারপর তাঁহার বংশধরগণই নারায়ণপালের রাজ্য পৰ্য্যন্ত প্রায় একশত বৎসর যাবৎ এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই বংশীয় গুরবমিশ্রের একখানি শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে যে ম্রাট দেবপাল স্বয়ং তাঁহার মন্ত্রী দর্ভপাণির অবসরের অপেক্ষায় তাঁহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিতেন, এবং এই দর্ভপাণি ও তাঁহার পৌত্র কেদারমিশ্রর নীতিকৌশলে ও বুদ্ধিবলেই বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই সমুদয় উক্তি অতিরঞ্জিত হইলেও পালরাজ্যে প্রধানমন্ত্রীগণ যে অসাধারণ প্রভুত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। পরবর্ত্তী যুগে এইরূপ আর এক মন্ত্রীবংশের পরিচয় পাই। এই বংশীয় যোগদেব তৃতীয় বিগ্রহপালের এবং বৈদ্যদেব কুমারপালের মন্ত্রী ছিলেন। বৈদ্যদেব পরে কামরূপে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

গুপ্তযুগের ন্যায় পালরাজ্যের অধীনেও অনেক সামন্ত রাজা ছিলেন। ইহাদের মধ্যে রাজা, রাজন্যক, রাজনক, রাণক, সামন্ত ও মহাসামন্ত প্রভৃতি বহু শ্রেণীবিভাগ ছিল। কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বল হইলে এই সমুদয় সামন্তরাজগণ যে স্বাধীন রাজার ন্যায় ব্যবহার করিতেন রামপালের প্রসঙ্গে তাহা বর্ণিত হইয়াছে।

প্রাচীন ভারতে রাজগণ রাজ্যের শাসন সংরক্ষণ ব্যতীত সমাজ ও অর্থনীতি, এমনকি ধর্ম্মের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করিতেন। ধর্ম্মপাল শাস্ত্রানুসারে বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম প্রতিপালন করিতেন। তিনি নিজে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী হইলেও হিন্দু প্রজাগণকে তাঁহাদের ধর্ম্মব্যবস্থা অনুসারেই শাসন করিতেন। পালরাজগণের প্রধানমন্ত্রীগণও যে ব্রাহ্মণবংশীয় ছিলেন ইহাও সে যুগের ধর্ম্মমত বিষয়ে উদারতা প্রমাণিত করে।

পালরাজগণের তাম্রশাসনে রাজকর্ম্মচারীগণের যে সুদীর্ঘ তালিকা আছে তাহা হইতে বেশ বোঝা যায় যে, রাজ্যশাসনপ্রণালী বিধিবদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। দুঃখের বিষয় এই সমুদয় রাজকর্ম্মচারীগণের অনেকের সম্বন্ধেই আমাদের কিছু জানা নাই। তাহাদের নাম বা উপাধি হইতে যেটুকু অনুমান করা যায় তাহা ব্যতীত শাসনপ্রণালী ও বিভিন্ন কর্ম্মচারীর কর্তব্য ও ক্ষমতা সম্বন্ধে আর কিছুই জানিবার উপায় নাই। এই কর্ম্মচারীর তালিকা বিশ্লেষণ করিয়া যে সামান্য তথ্য পাওয়া যায় এখানে মাত্র তাঁহারই উল্লেখ করিতেছি।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত শাসনপ্রণালীতে দেখিতে পাই যে রাজ্যের সমুদয় শাসনকাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহের জন্য কতকগুলি নির্দিষ্ট শাসন বিভাগ ছিল এবং ইহার প্রত্যেকটির জন্য একজন অধ্যক্ষ নিযুক্ত হইতেন। পালরাজগণও মোটামুটি এই ব্যবস্থার অনুসরণ করিতেন। কয়েকটি প্রধান প্রধান শাসন বিভাগ ও তাঁহার কর্ম্মচারীগণের সম্বন্ধে যাহা জানা যায় তাহা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ হইল।

১। কেন্দ্রীয় শাসন-প্রধানমন্ত্রী এবং আরও অনেক মন্ত্রী ও অমাত্যের সাহায্যে রাজা স্বয়ং এই বিভাগ পরিচালনা করিতেন। এই সমুদয়ের মধ্যে ‘মহাসান্ধিবিগ্ৰহিক’ একজন প্রধান অমাত্য ছিলেন। অপর রাজ্যের সহিত সম্বন্ধ রক্ষা করাই ছিল তাঁহার কাজ। দূতও একজন প্রধান কর্ম্মচারী ছিলেন এবং বিদেশীয় রাজ্যের সহিত প্রত্যক্ষভাবে যোগসূত্র রক্ষা করিতেন। ‘রাজস্থানীয়’ ও ‘অঙ্গরক্ত’ নামে দুইজন অমাত্যের উল্লেখ আছে। ইহারা সম্ভবত যথাক্রমে রাজার প্রতিনিধি ও দেহরক্ষীর দলের নায়ক ছিলেন। অনেক সময়, বিশেষত রাজা বৃদ্ধ হইলে, যুবরাজ শাসন বিষয়ে পিতাকে সাহায্য করিতেন। পালরাজগণের লিপিতে ও রামচরিতে যুবরাজগণের উল্লেখ আছে।

২। রাজস্ব বিভাগ-বিভিন্ন প্রকার রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর কর্ম্মচারী নির্দিষ্ট ছিল। উৎপন্ন শস্যের উপর নানাবিধ কর ধার্য্য হইত, যথা, ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য, উপরিকর প্রভৃতি,-এবং সম্ভবত গ্রামপতি ও বিষয়পতিরাই ইহা সংগ্রহ করিতেন। ‘ষষ্ঠাধিকৃত’ নামে একজন কর্ম্মচারীর উল্লেখ আছে। মনুস্মৃতি অনুসারে কতকগুলি দ্রব্যের ষষ্ঠভাগ রাজার প্রাপ্য ছিল,-সম্ভবত উক্ত কর্ম্মচারী এই কর আদায় করিতেন। ‘চৌরোদ্ধরণিক’, ‘শৌল্কিক’, ‘দাশাপরাধিক’ ও ‘তরক’ নামক কর্ম্মচারীরা সম্ভবত যথাক্রমে, দস্যু ও তস্করের ভয় হইতে রক্ষার জন্য দেয় কর, বাণিজ্যদ্রব্যের শুল্ক, চৌৰ্যাদি অপরাধের নিমিত্ত অর্থদণ্ড এবং খেয়াঘাটেরও মাশুল আদায় করিতেন।

৩। ‘মহাক্ষপটলিক’ ও ‘জ্যেষ্ঠকায়স্থ’ সম্ভবত হিসাব ও দলিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ করিতেন।

৪। ‘ক্ষেত্রপ’ ও ‘প্রমাতৃ’ সম্ভবত জমির জরিপ বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।

৫। ‘মহাদণ্ডনায়ক’ অথবা ‘ধর্ম্মাধিকার’ বিচার বিভাগের কর্ত্তা ছিলেন।

৬। মহাপ্রতীহার’, ‘দাণ্ডিক’, ‘দাপাশিক’ ও ‘দণ্ডশক্তি সম্ভবত পুলিশ বিভাগের প্রধান কর্ম্মচারী ছিলেন।

৭। সৈনিক বিভাগ-এই বিভাগে অধ্যক্ষের উপাধি ছিল সেনাপতি অথবা মহাসেনাপতি। পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তী, উষ্ট্র ও রণতরী সৈন্যদলের এই কয়টি প্রধান বিভাগ ছিল। ইহার প্রত্যেকের জন্য একজন স্বতন্ত্র অধ্যক্ষ ছিল। এতদ্ব্যতীত ‘কোট্টপাল’ (দুর্গরক্ষক), ‘প্রান্তপাল’ (রাজ্যের সীমান্তরক্ষক) প্রভৃতি নামও পাওয়া যায়।

বাংলা দেশে, বিশেষত দক্ষিণ ও পূর্ব্ববঙ্গে, রণতরী যুদ্ধসজ্জার একটি প্রধান উপকরণ ছিল। বহু প্রাচীনকাল হইতেই বাংলার নৌবাহিনী প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল! কালিদাস রঘুবংশে ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। বাংলার প্রাচীন লিপিতেও তরীর উল্লেখ আছে। কুমারপাল ও বিজয়সেনের রাজত্বে যে নৌযুদ্ধ হইয়াছিল তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। বাংলার সামরিক হস্তীর প্রসিদ্ধিও প্রাচীনকাল হইতে প্রচলিত। ভারতের পূৰ্ব্বপ্রান্তে বহু হস্তী পাওয়া যাইত এবং এখনো যায়। কিন্তু বাংলায় উৎকৃষ্ট অশ্বের অভাব ছিল। পালরাজগণ সুদূর কামোজ হইতে যুদ্ধের অশ্ব সংগ্রহ করিতেন। ভারতের এই প্রদেশ চিরকালই অশ্বের জন্য প্রসিদ্ধ। পালরাজগণের একখানিমাত্র তাম্রশাসনে রথের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই যুগের যুদ্ধে রথের খুব ব্যবহার হইত না।

পালরাজগণের তাম্রশাসনে অমাত্যগণের তালিকার শেষে “গৌড়-মালব-খশ-হূণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট” প্রভৃতি জাতির উল্লেখ আছে। খুব সম্ভবত ভারতের এই সমুদয় জাতি হইতে পালরাজগণ সৈন্য সংগ্রহ করিতেন এবং বর্ত্তমানকালের মারহাট্টা, বেলুচি, গুর্খা রেজিমেন্টের ন্যায় ঐ সমুদয় ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় সৈন্য দ্বারা সৈন্যদল গঠিত হইত।

.

৪. সেনরাজ্য ও অন্যান্য খরাজ্য

পালরাজ্যের যে শাসনপদ্ধতি প্রচলিত হইয়াছিল তাহা মোটামুটিভাবে সেন, কাম্বোজ, চন্দ্র বর্ম্মবংশীয় রাজগণ গ্রহণ করিয়াছিলেন। অবশ্য কোনো কোনো বিষয়ে কিছু কিছু পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল।

ভুক্তি, মণ্ডল ও বিষয় ব্যতীত পাঠক, চতুর, আবৃত্তি প্রভৃতি কয়েকটি নূতন শাসনকেন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেনরাজ্য পুণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তির সীমা অনেক। বাড়িয়েছিল। বঙ্গ-বিভাগের পূর্ব্ববর্ত্তী রাজসাহী, ঢাকা ও প্রেসিডেন্সী বিভাগ এবং সম্ভবত বর্ত্তমানকালের চট্টগ্রাম বিভাগেরও কতক অংশ এই ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ ইহা উত্তরে হিমালয় হইতে দক্ষিণে সমুদ্র এবং পশ্চিমে ভাগীরথী হইতে মেঘনা অথবা তাঁহার পূৰ্ব্বভাগের প্রদেশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। অপর দিকে বর্দ্ধমান ভুক্তির সীমা কমাইয়া ইহার উত্তর অংশে কঙ্কগ্রাম নামে নূতন একটি ভুক্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

সেনবংশীয় লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার পুত্রগণ পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ ব্যতীত ‘অশ্বপতি, গজপতি, নরপতি, রাজত্রয়াধিপতি’ প্রভৃতি নূতন পদবীও গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের অনুকরণে দেববংশীয় দশরথদেবও এই সমুদয় উপাধি ব্যবহার করিতেন।

পালরাজগণের ন্যায় সেনরাজগণের তাম্রশাসনেও সামন্ত, অমাত্য প্রভৃতির সুদীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায়। কিন্তু ইহার মধ্যে কিছু কিছু নূতনত্ব আছে। সেনরাজগণের তালিকায় রাণীর নাম আছে কিন্তু পালরাজগণের একখানি তাম্রশাসনেও এই সুদীর্ঘ তালিকায় রাণীর নাম পাওয়া যায় না। চন্দ্র, বৰ্ম ও কামোজ রাজগণের তাম্ৰশাসনোক্ত তালিকায়ও রাণীর নাম পাওয়া যায়। এই যুগে রাজ্যশাসন বিষয়ে রাণীর কোনো বিশেষ ক্ষমতা ছিল, অথবা বাংলার বাহির হইতে আগত এই সমুদয় রাজবংশের আদিম বাসস্থানে রাণীর বিশেষ কোনো অধিকার ছিল বলিয়া তাঁহারা বাংলায় এই নূতন প্রথার প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন, তাহা বলা কঠিন। কাম্বোজ, বৰ্ম্ম ও সেনরাজবংশের তাম্রশাসনে পুরোহিতের নাম পাওয়া যায়। সেনরাজগণের শেষযুগে পুরোহিতের স্থানে মহাপুরোহিতের উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম্মাবলম্বী এই তিন রাজবংশের রাজ্যকালে হিন্দুধর্ম্ম ও সমাজের সহিত রাজশক্তির সম্বন্ধ যে পূৰ্ব্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ হইয়াছিল ইহা তাহাই সূচিত করে।

‘মহামুদ্ৰাধিকৃত’ ও ‘মহাসর্ব্বাধিকৃত’ নামে দুইজন নূতন উচ্চপদস্থ অমাত্যের নাম পাওয়া যায়। এই শেষোক্ত নাম হইতেই বাংলার ‘সর্ব্বাধিকারী’ পদবীর উদ্ভব হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। এইরূপ বিচার বিভাগে মহাধর্ম্মাধ্যক্ষ, রাজস্ব বিভাগে ‘হট্টপতি’ এবং সৈন্য বিভাগে ‘মহাপীলুপতি’, ‘মহাগণস্থ’ এবং ‘মহাব্যুহপতি’ প্রভৃতি আরও কয়েকটি নূতন নাম পাই।

কামোজরাজ নয়পালের তাম্রশাসনে যেভাবে অমাত্যগণের উল্লেখ আছে তাহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এই তালিকায় আছে “করণসহ অধ্যক্ষবর্গ; সৈনিক-সঙ্ মুখ্যসহ সেনাপতি; গূঢ়পুরুষসহ দূত; এবং মন্ত্রপাল”। “করণসহ অধ্যক্ষবর্গ” এই সমষ্টিসূচক শব্দ হইতে প্রমাণিত হয় যে একজন অধ্যক্ষ কয়েকজন করণ অর্থাৎ কেরাণীর সহযোগে একটি শাসন বিভাগ তদন্ত করিতেন, এবং নির্দিষ্টসংখ্যক এইরূপ কতকগুলি অধ্যক্ষের দ্বারা দেশের সমুদয় আভ্যন্তরিক শাসনের কাৰ্যনিৰ্বাহ হইত। সৈন্য বিভাগেও বিভিন্ন শ্রেণীর সৈন্যদলের সঙ্ ছিল এবং তাহাদের অধিনায়কদের সহযোগে সেনাপতি এই বিভাগের কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিতেন। পররাষ্ট্র বিভাগ স্বতন্ত্র ছিল এবং ‘দূত’, ‘গূঢ়পুরুষ’ (গুপ্তচর) গণের সহায়তায় ইহার কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিতেন। সর্বোপরি ছিলেন মন্ত্রপাল’ অর্থাৎ মন্ত্রীগণ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যে শাসনপদ্ধতির বর্ণনা আছে ইহার সহিত তাঁহার খুবই সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। চন্দ্র, বৰ্ম ও সেনরাজগণের তাম্রশাসনে অমাত্যের যে সুদীর্ঘ তালিকা আছে। তাঁহার যে “এবং অধ্যক্ষ-প্রচারোক্ত অন্যান্য কর্ম্মচারীগণ” এই উক্তি দেখিতে পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রের যে অধ্যায়ে শাসনপদ্ধতির বিবরণ আছে তাঁহার নাম ‘অধ্যক্ষপ্রচার’। এই সমুদয় কারণে এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের যে শাসনপদ্ধতি বর্ণিত আছে তাঁহার অনুকরণেই বাংলার শাসনপদ্ধতি গড়িয়া উঠিয়াছিল।

বাংলার শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে যাহা বলা হইল তাহা অতিশয় সামান্য এবং ইহা হইতে এ সম্বন্ধে স্পষ্ট বা সঠিক কোনো ধারণা করা কঠিন। কিন্তু আপাতত ইহার বেশী জানিবার উপায় নাই। তবে যেটুকু জানা গিয়াছে তাহা হইতে এরূপ সিদ্ধান্ত করা যায় যে বাংলায় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দী বা তাঁহার পূৰ্ব্ব হইতেই ধীরে ধীরে একটি বিধিবদ্ধ শাসনপ্রণালী গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং পাল ও সেনযুগে তাহা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ইহা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের শাসনপদ্ধতির অনুরূপ ছিল বলিয়াই মনে হয়। অন্তত বাংলা দেশ যে এই বিষয়ে কম অগ্রসর হইয়াছিল এরূপ মনে করিবার কোনো সঙ্গত কারণ নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *