১৩. পাল ও সেনরাজগণের কাল-নির্ণয়

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ –পাল ও সেনরাজগণের কাল-নির্ণয়

পাল ও সেনরাজগণের কাল-নির্ণয় লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা এ স্থলে সম্ভবপর নহে। তবে যে প্রণালীতে এই গ্রন্থে এই সমুদয় কাল-নির্ণয় করা হইয়াছে তাঁহার সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন।

পালরাজগণের মধ্যে কেবলমাত্র প্রথম মহীপালের সারনাথ লিপিতে একটি নির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ আছে-১০৮৩ সম্বৎ অর্থাৎ ১০২৬ খৃষ্টাব্দ। মহীপাল এই তারিখে রাজত্ব করিতেন ইহা ধরিয়া লইয়া, তাঁহার পূর্ব্ব ও পরবর্ত্তী রাজগণের মোট রাজত্বকাল যত দূর জানা আছে তাঁহার সাহায্যে মোটামুটিভাবে পালরাজগণের কাল নির্ণয় করা যায়। তারপর পালরাজগণের সমসাময়িক অন্যান্য যে সমুদয় ভারতীয় রাজগণের তারিখ সঠিক জানা আছে, তাঁহার সাহায্যে এই কাল নির্ণয় আরও একটু সংকীর্ণভাবে করা সম্ভবপর। ধর্ম্মপাল রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের, মহীপাল রাজেন্দ্ৰচোলের এবং নয়পাল কলচুরি কর্ণের সমসাময়িক ছিলেন ইহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে, এবং সৌভাগ্যের বিষয় এই সমুদয় বিদেশী রাজগণের তারিখও সঠিকভাবে জানিবার উপায় আছে। এই সমুদয় আলোচনাপূর্ব্বক পালরাজগণের নিম্নলিখিত কাল নির্ণয় করা হইয়াছে।

রাজার নাম –মোট জানা রাজত্বকাল –রাজ্যলারে আনুমানিক অব্দ

১। গোপাল (১ম)  –X –৭৫০

২। ধর্ম্মপাল  –৩২ –৭৭০

৩। দেবপাল –৩৯ (অথবা ৩৫) –৮১০

৪। বিগ্রহপাল অথবা (১ম) শূরপাল – ৩ –৮১০

৫। নারায়ণপাল – ৫৪ –৮৫৪

৬। রাজ্যপাল – ৩২ –৯০৮

৭। গোপাল (২য়)  –১৭ –৯৪০

৮। বিগ্রহপাল (২য়) –২৬ (?) –৯৬০

৯। মহীপাল (১ম) – ৪৮ –৯৮৮

১০। নয়পাল – ১৫ –১০৩৮

১১। বিগ্রহপাল (৩য়) – X –১০৫৫

১২। মহীপাল (২য়) – X -১০৭০

১৩। শূরপাল (২য়) — X –১০৭৫

১৪। রামপাল –৪২ –১০৭৭

১৫। কুমারপাল –X –১১২০

১৬। গোপাল (৩য়) –১৪ –১১২৫

১৭। মদনপাল –১৪ –১১৪০

১৮। গোবিন্দপাল –৪ –১১৫৫

সেনরাজগণের কাল নির্ণয় বিষয়ে দুইটি মূল্যবান উপাদান আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় ইহারা পরস্পরবিরোধী। প্রথমত লক্ষ্মণ সংবৎ (ল সং) নামে একটি অব্দ প্রাচীনকাল হইতে অদ্যাবধি মিথিলায় প্রচলিত আছে। ১১০৭ হইতে ১১১৯ অব্দের মধ্যে কোনো সময়ে ইহার প্রথম বৎসর গণনা আরম্ভ করা হয়। সাধারণত কোনো রাজার রাজ্যপ্রাপ্তির সময় হইতেই তাঁহার নামে অব্দ প্রচলিত হয়। সুতরাং লক্ষ্মণ সংবতের আরম্ভকালে অর্থাৎ ১১০৭ হইতে ১১১৯ অব্দের মধ্যে লক্ষ্মণসেন রাজ্য লাভ করেন অনেকে এই মত গ্রহণ করিয়াছেন।

অপরপক্ষে বল্লালসেন রচিত দানসাগর ও অদ্ভুতসাগরের বহুসংখ্যক পুঁথির উপসংহারে স্পষ্ট লিখিত আছে যে ১০৮১ (অথবা) ১০৮২ শাকে (১১৫৯-৬০ অব্দে) বল্লালসেনের রাজ্যারম্ভ, ১০৯১ শাকে (১১৬৯ অব্দ) দানসাগরের রচনাকাল এবং ১০৮৯ (অথবা ১০৯০) শাকে (১১৬৭-৬৮ অব্দ) অদ্ভুতসাগর গ্রন্থের রচনা আরম্ভ হয়। কোনো কোনো পুঁথিতে এই সময়জ্ঞাপক শ্লোকগুলি না থাকায় কেহ কেহ এইগুলির উপর আস্থা স্থাপন করেন না। কিন্তু এযাবৎ যত পুঁথি আবিষ্কৃত হইয়াছে তাঁহার প্রায় সকলগুলিতেই এই সমুদয় শ্লোক পাওয়া যায়, যে দুই একখানি পুঁথিতে এই সমুদয় শ্লোক নাই সে পুঁথিতেও গ্রন্থমধ্যে নানা স্থানে উহার কোনো কোনো তারিখের উল্লেখ আছে। রাজা টোডরমলু অদ্ভুতসাগরের পুঁথিতে এই তারিখের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন যে বল্লালসেন ১১৬০-৬১ অব্দে রাজত্ব করিতেন।

এই সমুদয় তারিখের সমর্থক আর একটি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। লক্ষ্মণসেনের সভাকবি শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থের পুঁথিতে যে পুস্পিকা আছে তাহা হইতে জানা যায় যে, ১১২৭ শাকে (=১২০৫ অব্দে) লক্ষ্মণসেনের ‘রসৈক-বিংশ’ রাজ্য সম্বৎসরে এই গ্রন্থ রচিত হয়। রসৈক-বিংশ পদের অর্থ ২৭ (রস= ৬+১+২০)। এইরূপ পদের প্রয়োগ একটু অদ্ভুত বলিয়া কেহ কেহ এই পদটিকে রাজ্যৈকবিংশ’ এইরূপ পাঠ করিয়া ১২০৫ অব্দে লক্ষ্মণসেনের একবিংশতি বৎসর রাজ্যকাল এইরূপ অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন। সে যাহা হইক ১২০৫ অব্দে যে লক্ষ্মণসেন রাজত্ব করিতেন সদুক্তিকর্ণামৃত হইতে তাহা প্রমাণিত হয় এবং এই সিদ্ধান্ত বল্লালসেনের কালজ্ঞাপক পূৰ্ব্বোক্ত শ্লোকগুলির সম্পূর্ণ সমর্থন করে। এই সমুদয়ের উপর নির্ভর করিয়া এই গ্রন্থে সেনরাজগণের নিম্নলিখিতরূপ কাল নির্ণয় করা হইয়াছে এবং পণ্ডিতগণ প্রায় সকলেই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন।

রাজার নামমোট জানা রাজত্বকালরাজ্যলাভের আনুমানিক অব্দ
বিজয়সেন৬২ (৩২)১০৯৫ (১১২৫?)
বল্লালসেন১১১১৫৮
লক্ষ্মণসেন২৭১১৭৯
বিশ্বরূপসেন১৪১২০৬
কেশবসেন১২২৫

বিজয়সেনের বারাকপুর লিপির তারিখ কেহ ৩২ এবং কেহ ৬২ পাঠ করিয়াছেন। এই দুই ভিন্ন পাঠ গ্রহণ করিলে তাঁহার রাজ্যারম্ভকাল কিরূপ বিভিন্ন হইবে তাহা উপরে বন্ধনীযুক্ত সংখ্যা দ্বারা দেখানো হইয়াছে।

প্রশ্ন উঠিতে পারে যে লক্ষ্মণসেন যদি ১১৭৯ অব্দে রাজ্যলাভ করিয়া থাকেন তবে ১১০৭ হইতে ১১১৯ অব্দের মধ্যে তাঁহার নামযুক্ত লক্ষ্মণ সংবৎ আরম্ভ হইল কিরূপে? এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া সম্ভবপর নহে। তবে এ বিষয়ে কয়েকটি কথা স্মরণ রাখা আবশ্যক। প্রথমত লক্ষ্মণসেনের রাজ্যারম্ভকাল হইতে কোনো অব্দের প্রতিষ্ঠা হইলে বঙ্গদেশে তাঁহার প্রচলন হইত এবং তাঁহার পুত্রদ্বয় বিশ্বরূপসেন এবং কেশবসেনের তাম্রশাসনে তাঁহাদের রাজ্যাঙ্কের পরিবর্তে এই অব্দেরই ব্যবহার হইত, এইরূপ অনুমান সম্পূর্ণ সঙ্গত। দ্বিতীয়ত লক্ষ্মণ সংবতের ব্যবহারের পূর্ব্বে মগধের তিনটি প্রাচীন লিপিতে নিম্নলিখিতরূপে তারিখ দেওয়া হইয়াছে।

১। শ্রীমল্লখণসেনস্যাতীতরাজ্যে সং ৫১

২। শ্রীমল্ললক্ষ্মণসেনদেবপাদানামতীতরাজ্যে সং ৭৪

৩। লক্ষ্মণসেনস্যাতীতরাজ্যে সং ৮৩

পালবংশীয় (অথবা পাল-উপাধিধারী) শেষ রাজা গোবিন্দপালের নাম সংযুক্ত এইরূপ তারিখ একখানি শিলালিপি ও কয়েকখানি পুঁথিতে পাওয়া যায় যথা :

১। শ্রীগোবিন্দপালদেবগতরাজ্যে চতুর্দ্দশসম্বৎসরে

২। শ্রীমদৃগোবিন্দপালদেবানাং বিনষ্টরাজ্যে অষ্টত্রিংশৎসম্বৎ

এই সমুদয় পদের প্রকৃত ব্যাখ্যা সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু এই সমুদয় তারিখ যে গোবিন্দপাল ও লক্ষ্মণসেনের রাজ্য শেষ হইতে গণনা আরম্ভ হইয়াছে তাহাই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। সাধারণত কোনো রাজার রাজ্যকালে কোনো লিপি বা পুঁথি লিখিত হইলে তাঁহার ‘প্রবর্দ্ধমান-বিজয়রাজ্য-সংবৎসরে’ দিয়া তারিখ দেওয়া হইত। কিন্তু বৌদ্ধ পাল বংশ ধ্বংস হইলে বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষুগণ নবাগত হিন্দু রাজার প্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যের পরিবর্তে বৌদ্ধ রাজবংশের ধ্বংস হইতেই তারিখ গণনা করিতেন, এবং মগধ মুসলমান বিজেতার পদানত হইলে মগধবাসীগণ মুসলমান রাজার প্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যের পরিবর্তে শেষ হিন্দুরাজা লক্ষ্মণসেনের রাজ্যশেষ হইতে তারিখ গণনা করিতেন-ইহাই উক্ত তারিখযুক্ত পদগুলি হইতে অনুমান হয়। সুতরাং প্রথমে লক্ষ্মণসেনের রাজ্যধ্বংস হইতেই একটি অব্দের গণনা আরম্ভ হয়। বাংলায় প্রচলিত বলালি সন ও পরগণাতি সনও ঐ অব্দ বলিয়াই অনুমিত হয়। কারণ এ উভয়ই ১২০০ খৃষ্টাব্দের দুই-এক বৎসর আগে বা পরে আরম্ভ হইয়াছে।

এই অব্দ কিছুকাল প্রচলিত থাকিবার পর সম্ভবত মিথিলায় লক্ষ্মণসেনের রাজ্যধ্বংসের পরিবর্তে তাঁহার জন্ম হইতে এক অব্দ গণনার রীতি প্রবর্তিত হয় এবং এই জন্মতারিখ হইতে গণনা করিয়া লক্ষ্মণ সংবৎ প্রচলিত হয়। মীনহাজুদ্দিন লিখিয়াছেন যে বখতিয়ারের আক্রমণকালে লক্ষ্মণসেনের বয়স প্রায় ৮০ বৎসর হইয়াছিল। এই উক্তি অনুসারে আ ১১১৯ অব্দে লক্ষ্মণসেনের জন্ম হইয়াছিল। লক্ষ্মণ সংবতের সহিত শকাব্দ ও সংবতের তারিখ দেওয়া আছে এরূপ বহু দৃষ্টান্ত আলোচনা করিয়া দেখা গিয়াছে যে ‘লসং’-এর আরম্ভকাল ১১০৭ হইতে ১১১৯ অব্দের মধ্যে বিভিন্ন বৎসরে পড়ে। বর্ত্তমানকালে মিথিলায় যে পঞ্জিকা প্রচলিত আছে তদানুসারে লসং ১১০৮ অব্দে আরম্ভ হইয়াছিল। এই প্রকার বৈষম্যের কারণ কী তাহা জানা যায় নাই। সম্ভবত যখন লক্ষ্মণসেনের মৃত্যুর শতাধিক বর্ষ পরে তাঁহার জন্মতারিখ হইতে লসং গণনা আরম্ভ হয় তখন মিথিলায় এই তারিখটি সঠিক জানা ছিল না এবং এ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত ছিল। সেই জন্যই লসং’ এর বিভিন্ন আরম্ভকালের মধ্যে অনধিক বারো বৎসরের প্রভেদ হইয়াছে। অবশ্য এ সকলই অনুমান মাত্র। লসং-এর প্রকৃত আরম্ভকাল এবং ইহা কোন ঘটনার স্মৃতি বহন করিতেছে তাহা সঠিক জানিবার উপায় নাই। তবে ইহা এক প্রকার স্থির যে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশকে-যখন হইতে ‘লসং’-এর প্রথম বৎসর গণনা করা হয়-লক্ষ্মণসেন রাজ্য লাভ করেন নাই, সুতরাং লক্ষ্মণসেনের রাজসিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে বা সেই ঘটনা চিরস্মরণীয় করিবার জন্য লক্ষ্মণ সংবতের প্রচলন হইয়াছিল এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নহে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *