১১. বৰ্ম্মরাজবংশ

একাদশ পরিচ্ছেদ –বৰ্ম্মরাজবংশ

একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন পালরাজশক্তি ক্রমশ দুর্বল হইয়া পড়িতেছিল তখন পূর্ব্ববঙ্গে বৰ্ম্ম-উপাধিধারী এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় একথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। ঢাকা জিলার অন্তর্গত বেলাব গ্রামে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসনই এই রাজবংশের ইতিহাসের প্রধান অবলম্বন। এই শাসনে বৰ্ম্মরাজগণের বংশপরিচয়ে প্রথমে পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী ব্রহ্মা হইতে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে অত্রি, চন্দ্র, বুধ, পুরূরবা, আয়ু নহুষ, যযাতি ও যদুর, এবং এই যদুবংশে হরির অবতার কৃষ্ণের জন্মের উল্লেখ আছে। এই হরির বান্ধব অর্থাৎ জ্ঞাতি বৰ্ম্মবংশ বৈদিক ধর্ম্মের প্রদান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং সিংহপুরে রাজত্ব করিতেন। এই বংশীয় বজ্ৰবর্ম্মা একাধারে বীর, কবি ও পণ্ডিত ছিলেন। তাঁহার পুত্র জাতবর্ম্মা বহু যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া সার্বভৌমত্ব লাভ করিয়াছিলেন। তিনি অঙ্গদেশে স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, কামরূপ জয় করিয়াছিলেন, দিব্যের ভুজবল হতশ্রী করিয়াছিলেন, এবং গোবর্দ্ধন নামক রাজাকে পরাজিত করিয়াছিলেন। প্রশস্তিকারের দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকের এই উক্তি কত দূর সত্য তাহা বলা যায় না। ঐ শ্লোকে ইহাও বলা হইয়াছে যে তিনি কর্ণের কন্যা বীরশ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। ডাহলের কলচুরিরাজ কর্ণ যে পালরাজ্য আক্রমণ করিয়া বঙ্গদেশ পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং অবশেষে পালরাজ তৃতীয় বিগ্রহপালের সহিত স্বীয় কন্যা যৌবনশ্রীর বিবাহ দিয়াছিলেন তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। সুতরাং অসম্ভব নহে যে জাতবর্ম্মা কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব ও কর্ণের অধীনস্থ সামন্তরাজরূপে তাঁহাদের সঙ্গে পালরাজ্য আক্রমণ করেন, এবং অঙ্গদেশে পালরাজ ও বরেন্দ্রে কৈবর্ত্যরাজ দিব্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। তারপর কোনো সুযোগে পূর্ব্ববঙ্গে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিয়া কামরূপ আক্রমণ করেন ও গোবর্দ্ধন নামক বঙ্গদেশীয় কোনো রাজার বিরুদ্ধে অভিযান করেন। অবশ্য এ সকলই বর্ত্তমানে অনুমান মাত্র কারণ ইহার সপক্ষে বিশিষ্ট কোনো প্রমাণ নাই। কিন্তু এইরূপ কোনো অনুমানের আশ্রয় না লইলে সিংহপুর নামক ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি জাতবৰ্ম্মা কেবলমাত্র নিজের বাহুবলে অঙ্গ, কামরূপ ও বরেন্দ্রে বিজয়াভিযান করিয়া বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এরূপ বিশ্বাস করা কঠিন।

বৰ্ম্মরাজগণের আদিম রাজ্য সিংহপুর কোথায় ছিল এ বিষয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। পঞ্জাবের একখানি শিলালিপিতে সিংহপুরের যাদব বংশসস্তৃতা জালন্ধরের এক রাণীর কথা আছে এবং হুয়েন সাংও পঞ্জাবে এক সিংহপুর রাজ্যের উল্লেখ করিয়াছেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইহাই পূর্ব্ববঙ্গের যাদববংশীয় বৰ্ম্মরাজগণের আদি বাসভূমি। কলিঙ্গেও এক সিংহপুর রাজ্য ছিল-এই স্থান বর্ত্তমানে সিঙ্গুপুর নামে পরিচিত এবং চিকাকোল ও নরাসন্নপেতার মধ্যস্থলে অবস্থিত। সিংহলদেশীয় গ্রন্থে যে বিজয়সিংহের আখ্যান আছে তাহাতে রাঢ়দেশে এক সিংহপুরের উল্লেখ আছে; ইহা সম্ভবত হুগলী জিলার অন্তর্গত সিঙ্গুর নামক গ্রামে অবস্থিত ছিল। বৰ্মগণের আদি বাসভূমি কলিঙ্গ রাঢ়ের অন্তর্গত সিংহপুরে ছিল ইহাও কেহ কেহ অনুমান করেন। কলিঙ্গের সিংহপুর রাজ্য পঞ্চম হইতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত বিদ্যমান ছিল ইহার বিশেষ প্রমাণ আছে। খুব সম্ভবত জাতবর্ম্মা এই রাজ্যেরই অধিপতি ছিলেন। কলচুরিরাজগণের প্রশস্তি অনুসারে গাঙ্গেয়দেব অঙ্গ ও উৎকলের রাজাকে পরাজিত করেন ও তৎপুত্র কর্ণ গৌড়, বঙ্গ ও কলিঙ্গে আধিপত্য করেন। সুতরাং কলিঙ্গদেশীয় জাতবর্ম্মা কলচুরিরাজগণের অধীনে অঙ্গ, গৌড় ও বঙ্গে যুদ্ধাভিযান করিয়াছিলেন এবং এই সুযোগে বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন এরূপ অনুমানই খুব স্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়।

বেলাব তাম্রশাসনে জাতবর্ম্মার পর তাঁহার পুত্র সামলবর্ম্মার উল্লেখ আছে। কিন্তু ঢাকার নিকটবর্ত্তী বজ্রযোগিনী গ্রামে এই সামলবর্ম্মার একখানি তাম্রশাসনের যে একটি খণ্ডমাত্র পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতে অনুমিত হয় যে, জাতবর্ম্মার পরে হরিবর্ম্মা রাজত্ব করেন। এই তাম্রশাসনখানির অবশিষ্ট অংশ না পাওয়া পর্য্যন্ত এ সম্বন্ধে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত করা যায় না। কিন্তু হরিবৰ্ম্মা নামে যে একজন রাজা ছিলেন তাঁহার বহু প্রমাণ আছে। দুইখানি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথি মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর পরমভট্টারক হরিবর্ম্মার রাজত্বের ১৯ ও ৩৯ সংবৎসরে লিখিত হইয়াছিল। হরিবর্ম্মার মন্ত্রী প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ভবদেব ভট্টের একখানি শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে; ইহাতেও হরিবৰ্ম্মার উল্লেখ আছে। হরিবর্ম্মার একখানি তাম্রশাসন সামন্তসার গ্রামে পাওয়া গিয়াছে। দুঃখের বিষয় অগ্নিদগ্ধ হওয়ায় এই তাম্রশাসনখানির পাঠ অনেক স্থলেই অস্পষ্ট ও দুর্বোধ। ইহাতে হরিবৰ্ম্মার পিতার নাম আছে। নগেন্দ্রনাথ বসু ইহা জ্যোতিবর্ম্মা পড়িয়াছিলেন কিন্তু নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে ইহা সম্ভবত জাতবৰ্ম্মা। এই পাঠ সত্য হইলে বলিতে হইবে যে জাতবর্ম্মার মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র হরিবৰ্ম্মা রাজত্ব করেন।

হরিবর্ম্মার রাজধানী সম্ভবত বিক্রমপুরেই ছিল এবং তিনি প্রায় অর্দ্ধশতাব্দীকাল যাবৎ রাজত্ব করেন। রামচরিতে উক্ত হইয়াছে যে হরি নামক একজন সেনানায়ক কৈবর্ত্যরাজ ভীমের পরাজয়ের পর রামপালের সহিত সুখ্যসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন, এবং প্রাকদেশীয় এক বৰ্ম্ম নরপতি স্বীয় পরিত্রাণের নিমিত্ত বিজয়ী রামপালের নিকট উপঢৌকন পাঠাইয়াছিলেন। খুব সম্ভবত উক্ত হরি ও বৰ্ম্ম নরপতি এবং হরিবর্ম্মা একই ব্যক্তি। তবে এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।

হরিবর্ম্মার পর তাঁহার পুত্র রাজা হইয়াছিলেন। কিন্তু ইঁহাদের কাহারও রাজ্যকালের বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে ইহাদের মন্ত্রী ভবদেবভট্ট একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন এবং একখানি শিলালিপি হইতে তাঁহার ও তাঁহার বংশের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলা দেশের এই প্রকার কোনো প্রাচীন ব্রাহ্মণ বংশের সঠিক বিবরণ বিশেষ দুর্লভ, সুতরাং ইহার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্রয়োজন।

রাঢ়দেশের অলঙ্কারস্বরূপ সিদ্ধল গ্রামের অধিবাসী ভবদেব নামক জনৈক ব্রাহ্মণ গৌড় রাজার নিকট হইতে হস্তিনীভট্ট গ্রাম উপহার পাইয়াছিলেন। তাঁহার পৌত্রের পৌত্র আদিদেব বঙ্গরাজের বিশেষ বিশ্বাসভাজন মহামন্ত্রী, মহাপাত্র ও সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন। তাঁহার পুত্র গোবর্দ্ধন শস্ত্র ও শাস্ত্রে তুল্য পারদর্শী ছিলেন এবং পণ্ডিতগণের সভায় ও যুদ্ধক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার পত্নী বন্দ্যঘটীয় এক ব্রাহ্মণকন্যার গর্ভে ভবদেবভট্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিদ্ধান্ত, তন্ত্র, গণিত ও ফলসংহিতায় (জ্যোতিষ) পারদর্শী ছিলেন এবং হোরাশাস্ত্রে অভিনব সিদ্ধান্ত প্রচার করিয়াছিলেন। তিনি ধর্ম্মশাস্ত্রের ও স্মৃতির নূতন ব্যাখ্যা ও মীমাংসা সম্বন্ধে বহু গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, এবং কবিকলা, সৰ্ব্ব আগম (বেদ), অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্ব্বেদ, অস্ত্রবেদ প্রভৃতি শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি রাজা হরিবর্ম্মাদেবের মন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁহার মন্ত্রশক্তির প্রভাবে ধর্ম্মবিজয়ী রাজা হরিবৰ্ম্মা দীর্ঘকাল রাজ্যসুখ ভোগ করিয়াছিলেন। প্রশস্তিকারের বর্ণনা অনুসারে ভবদেবভট্ট একজন অসাধারণ পুরুষ ছিলেন। অতিরঞ্জিত হইলেও ভবদেবের পাণ্ডিত্যের বিবরণ যে অনেকাংশে সত্য তাহাতে সন্দেহ নাই, কারণ তাঁহার মীমাংসা ও স্মৃতিবিষয়ক গ্রন্থ এখনো প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ। সংস্কৃত সাহিত্য প্রসঙ্গে পরে ইহার আলোচনা করা যাইবে। ভবদেবের বালবলভীভুজঙ্গ এই উপাধি ছিল। ইহার প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ। অনেকেই মনে করেন যে বালবলভী কোনো স্থানের নাম। কিন্তু ভীমসেন প্রণীত সুধাসাগরে এই নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে। তাহাই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। বলভী শব্দের অর্থ বাটীর সর্বোচ্চ কক্ষ। এইরূপ এক বলভীতে ব্রাহ্মণ বালকগণের পাঠশালা ছিল। ইহাদের মধ্যে গৌড়দেশীয় বালক ভবদেব বুদ্ধিমত্তায় ও বাচ্চাতুর্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল এবং অন্যান্য বালকগণ তাহাকে বিশেষ ভয় করিত। এই জন্য গুরুমহাশয় এই বালককে বালবলভীভুজঙ্গ এই উপাধি প্রদান করেন।

হরিবর্ম্মা ও তাঁহার পুত্রের পর জাতবর্ম্মার অপর পুত্র সামলবৰ্ম্মা রাজা হন। মহারাজাধিরাজ সামলবর্ম্মার রাজ্যকালের কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ জানা যায় না, কিন্তু বাংলার বৈদিক ব্রাহ্মণগণের কুলজী গ্রন্থ অনুসারে রাজা সামলবর্ম্মার আমন্ত্রণে তাঁহাদের পূৰ্বপুরুষ ১০০১ শকে বাংলা দেশে আগমন করেন। আবার কোনো কোনো কুলজী মতে রাজা হরিবর্ম্মাই বৈদিক ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন। মোটের উপর বাংলায় বৈদিক ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ম্মারাজবংশের সহিত জড়িত। কুলজীতে যে তারিখ (১০৭৯ অব্দ) আছে তাহা একেবারে ঠিক না হইলেও খুব বেশি ভুল বলা যায় না। কারণ জাতবর্ম্মা তৃতীয় বিগ্রহপালের সমসাময়িক, সুতরাং একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজত্ব করিতেন; এবং তাঁহার পুত্রদ্বয় হরিবর্ম্মা ও সামলবর্ম্মা একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমে রাজত্ব করিয়াছিলেন ইহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।

সামলবর্ম্মার পর তাঁহার পুত্র ভোজবর্ম্মা রাজত্ব করেন। তাঁহার রাজধানী বিক্রমপুর হইতে তাঁহার রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে বেলাব-তাম্রশাসন প্রদত্ত হয়। এই তাম্রশাসনে ভোজবর্ম্মা পরমবৈষ্ণব পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হইয়াছেন। সুতরাং তিনি যে একজন স্বাধীন ও পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। কিন্তু ভোজবর্ম্মার পরে এই বংশের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দের প্রথমার্ধে সেনরাজবংশীয় বিজয়সেন এই বৰ্ম্মরাজবংশের উচ্ছেদ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *