১০. পালরাজ্যের ধ্বংস

দশম পরিচ্ছেদ –পালরাজ্যের ধ্বংস

রামপালের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র কুমারপাল রাজা হইলেন। রামচরিতে উক্ত হইয়াছে যে রামপালের দুই পুত্র বিত্তপাল ও রাজ্যপাল বরেন্দ্রের বিদ্রোহ দমনে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। রামপালের আর এক পুত্র মদনপাল পরে পালরাজ্যের রাজা হইয়াছিলেন। রামপালের এই চারি পুত্রের মধ্যে কে সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন, এবং কোন অধিকারে কুমারপাল পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনের আরোহণ করিয়াছিলেন তাহা সঠিক জানিবার উপায় নাই।

কুমারপালের রাজত্বকালে (আ ১১২০-১১২৫) দক্ষিণবঙ্গে বিদ্রোহ হইয়াছিল এবং তাঁহার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর বন্ধু প্রধান অমাত্য” বৈদ্যদেব নৌযুদ্ধে বিদ্রোহীগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন। ইহার কিছুদিন পরেই পূৰ্ব্বভাগে, সম্ভবত কামরূপে, তিগ্যদেব বিদ্রোহী হইয়াছিলেন এবং বৈদ্যদেব তাঁহাকে পরাজিত করিয়া সেই রাজ্যের রাজা হইয়াছিলেন। পরবর্ত্তীকালে, সম্ভবত কুমারপালের মৃত্যুর পর, বৈদ্যদেব কামরূপে স্বাধীনভাবে রাজ্য করেন। কুমারপালের পর তাঁহার পুত্র তৃতীয় গোপাল রাজা হন। তাঁহার রাজত্বকালের (আ ১১২৫-১১৪০) কোনো ঘটনাই জানা যায় না। কিন্তু পালরাজ্যের অন্তর্বিদ্রোহ সম্ভবত এই সময় আরও বিস্তৃত হয়। পূর্ব্ববঙ্গে বৰ্মণ রাজারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সুযোগ পাইয়া দক্ষিণ হইতে গঙ্গরাজগণ পালরাজ্য আক্রমণ করেন। ১১৩৫ অব্দের পূর্ব্বে অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গ মেদিনীপুর ও হুগলী জিলার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হইয়া গঙ্গাতীরবর্ত্তী মন্দার প্রদেশ পর্য্যন্ত জয় করেন। তিনি যে মিথুনপুর ও আরম্য দুর্গ অধিকার করেন তাহা সম্ভবত আধুনিক মেদিনীপুর ও আরামবাগ (হুগলী জিলা)। দাক্ষিণাত্যের চালুক্য রাজগণও পশ্চিমবঙ্গ আক্রমণ করেন এবং ইহার ফলে রাদেশের সেনরাজবংশ প্রবল হইয়া ওঠে। গাহড়বাল রাজগণও মগধ আক্রমণ করিয়া পাটনা পৰ্য্যন্ত অধিকার করেন।

তৃতীয় গোপালের মৃত্যুর পর মদনপাল যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন এইরূপে আভ্যন্তরিক বিদ্রোহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে পালরাজ্য দ্রুতবেগে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইতেছিল। মদনপাল চতুর্দিকে শত্রু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া পালরাজ্য রক্ষার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন কিন্তু সমর্থ হইলেন না। রামচরিতের একটি শ্লোক হইতে অনুমিত হয় যে তিনি অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গের সহিত যুদ্ধে কিছু সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু এই সময়ে গাহড়বালগণ আরও অগ্রসর হইয়া মুঙ্গের নগরী পৰ্য্যন্ত অধিকার করে। অনেক চেষ্টার পরও মদনপাল এই অঞ্চল শহস্ত হইতে পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু শ্রীঘই তাঁহাকে অন্যান্য শক্রর বিরুদ্ধে অগ্রসর হইতে হয়। গোবর্দ্ধন নামক এক রাজাকে তিনি পরাজিত করেন। সম্ভবত ইনি বাংলার কোনো অঞ্চলে এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। আর এক প্রবল শক্র মদনপালের বহু সৈন্য নষ্ট করিয়াছিল। মদনপাল বহু কষ্টে তাহাকে কালিন্দী নদীর তীর পর্য্যন্ত হঠাইয়া দেন। এই নদী সম্ভবত মালদহের নিকটবর্ত্তী কালিন্দী নদী। এইরূপে যে শক্ররাজা গৌড় দেশের একাংশ জয় করিয়া প্রায় পালরাজধানী পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন তিনি সম্ভবত সেনরাজ বিজয় সেন। বিজয় সেনের শিলালিপি হইতে জানা যায় যে, তিনি গৌড়রাজকে বিতাড়িত করিয়াছিলেন এবং গৌড়রাজ্যের অন্তত কিয়দংশ অধিকার করিয়াছিলেন। এই পরাজিত গৌড়রাজ যে মদনপাল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। মদনপাল আনুমানিক ১১৪০ হইতে ১১৫৫ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন।

মদনপালের রাজত্বের সমুদয় ঘটনার বিশদ বিবরণ অথবা পারম্পর্য সঠিক না জানিতে পারিলেও ইহা অনায়াসেই সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে যে তাঁহার মৃত্যুকালে দক্ষিণ, পূর্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গে তাঁহার কোনো অধিকারই ছিল না। উত্তরবঙ্গেরও সমগ্র অথবা অধিকাংশ তাঁহার হস্তচ্যুত হইয়াছিল। সুতরাং পালরাজ্য এই সময়ে মগধের মধ্যে ও পূৰ্ব্বভাগে সীমাবদ্ধ ছিল।

মদনপালের পর গোবিন্দপাল নামে এক রাজা গয়ায় রাজত্ব করেন। ইহারও পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ প্রভৃতি পদবী এবং গৌড়েশ্বর উপাধি ছিল। সম্ভবত মদনপালের মৃত্যুর পরই তিনি রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১১৬২ খৃষ্টাব্দে তাঁহার রাজ্য বিনষ্ট হয়। তিনি বৌদ্ধ ছিলেন এবং একখানি বৌদ্ধ পুঁথিতে ‘শ্রীমদগোবিন্দপালদেবানাং বিনষ্টরাজ্যে অষ্টত্রিংশৎ সম্বৎসরে’ এইরূপ কালজ্ঞাপন পদ পাওয়া যায়। অপর কয়েকখানি পুঁথিতে বিনষ্টরাজ্যের পরিবর্তে ‘গতরাজ্যে’, ‘অতীত-সম্বৎসর’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। এই সমুদয় কালজ্ঞাপক বাক্য হইতে অনুমিত হয় যে গোবিন্দপালই মগধে শেষ বৌদ্ধ রাজা, এবং এইজন্যই বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ তাঁহার মৃত্যুর পর বিধর্মী রাজার প্রবর্দ্ধমান বিজয়রাজ্যের উল্লেখ না করিয়া গোবিন্দপালের রাজ্য-ধ্বংস হইতে কাল গণনা করিতেন।

গোবিন্দপাল পালরাজবংশীয় ছিলেন কি না তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না। তাঁহার পদবী ও উপাধি, বৌদ্ধধৰ্ম্ম, ও মদনপালের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই মগধে রাজত্বের কথা বিবেচনা করিলে তিনি যে পালরাজবংশীয় ছিলেন এরূপ অনুমান সঙ্গত বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু তাহা হইলেও মদনপালের সহিত তাঁহার কী সম্বন্ধ ছিল, এবং গয়ার বাহিরে তাঁহার রাজ্য কত দূর বিস্তৃত ছিল–অর্থাৎ তাঁহার গৌড়েশ্বর উপাধি কেবলমাত্র পূৰ্বগৌরবের সূচক অথবা গৌড়রাজ্যে তাঁহার কোনোকালে কোনো প্রকার অধিকার ছিল-ইত্যাদির বিষয়ে কিছুই বলা যায় না। তবে ইহা এক প্রকার স্থির সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে যে, ১১৬২ খৃষ্টাব্দে তাঁহার রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধর্ম্মপাল, দেবপাল, মহীপাল ও রামপালের স্মৃতিবিজড়িত পালরাজ্যের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত হইয়া যায়।

কেহ কেহ পলপাল, ইন্দ্রদ্যুম্নপাল প্রভৃতি দুই-একজন পরবর্ত্তী পাল উপাধিধারী রাজার উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু ইঁহাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *