০৩. প্রাচীন ইতিহাস

তৃতীয় পরিচ্ছেদ –প্রাচীন ইতিহাস

গুপ্তযুগের পূর্ব্বে প্রাচীন বাংলার কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস সঙ্কলন করার উপাদান এখন পর্য্যন্ত আমরা পাই নাই। ভারতীয় ও বিদেশীয় সাহিত্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত উক্তি হইতে আমরা ইহার সম্বন্ধে কিছু কিছু সংবাদ পাই, কিন্তু কেবলমাত্র এইগুলির সাহায্যে সন তারিখ ও ঘটনাসম্বলিত কোনো ইতিহাস রচনা সম্ভবপর নহে।

সিংহলদেশীয় মহাবংশ নামক পালি গ্রন্থে নিম্নলিখিত আখ্যানটি পাওয়া যায়।

বঙ্গদেশের রাজা কলিঙ্গের রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁহাদের কন্যা মগধ যাইবার পথে লাঢ় (রাঢ়) দেশে এক সিংহ কর্ত্তৃক অপহৃত হন এবং ঐ সিংহের গুহায় তাঁহার সীহবাহু (সিংহবাহু) নামে এক পুত্র ও সীহসীবলী নামে এক কন্যা জন্মে। পুত্রকন্যাসহ তিনি পলাইয়া আসিয়া বঙ্গদেশের সেনাপতিকে বিবাহ করেন। কালক্রমে বঙ্গরাজ্যের মৃত্যু হইলে অপুত্রক রাজার মন্ত্রীগণ সীহবাহুকেই রাজা হইতে অনুরোধ করেন কিন্তু তিনি তাঁহার মাতার স্বামীকে রাজপদে বরণ করিয়া রাঢ়দেশে গমন করেন। এখানে তিনি সীহপুর নামক নগর প্রতিষ্ঠা করিয়া রাজ্য স্থাপন করেন এবং সীহসীবলীকে বিবাহ করেন। তাঁহার বহু পুত্র জন্মে। তাহাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম ছিল বিজয়।

বিজয় কুসঙ্গীদের সঙ্গে মিশিয়া রাজ্যে নানারকম অত্যাচার করিত। রাজা তাঁহার চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা করিলেন কিন্তু কোনো ফল হইল না। অবশেষে বিজয় ও তাঁহার সাত শত সঙ্গীর মাথা অর্ধেক মুড়াইয়া স্ত্রী-পুত্রসহ এক জাহাজে চড়াইয়া তিনি তাহাদিগকে সমুদ্রে ভাসাইয়া দিলেন। তাহারা লঙ্কাদ্বীপে পৌঁছিল।

ভগবান বুদ্ধের নির্বাণলাভের অব্যবহিত পূর্ব্বে এই ঘটনা ঘটে। ভবিষ্যতে লঙ্কাদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্ধের আদেশে শত্রু (ইন্দ্র) বিজয়কে রক্ষা করিবার ভার নিলেন। বিজয় লঙ্কাদ্বীপের যক্ষগণকে পরাস্ত করিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর বঙ্গদেশ হইতে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডুবাসুদেব লঙ্কার রাজা হন। এইরূপে লঙ্কাদ্বীপে বাঙ্গালী রাজবংশ পুরুষানুক্রমে রাজত্ব করে। সিংহবাহুর নাম অনুসারে লঙ্কাদ্বীপের নাম হইল সিংহল।

এই কাহিনী ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। বুদ্ধের জীবনকালে বাঙ্গালীরা সমুদ্র পার হইয়া সুদূর সিংহল অথবা লঙ্কাদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিল, ইহার অন্য কোনো প্রমাণ নাই। সুতরাং সহস্র বৎসর পরে রচিত মহাবংশের অলৌকিক ঘটনাপূর্ণ কাহিনী বিশ্বাস করা কঠিন। বঙ্গদেশের সহিত লঙ্কাদ্বীপের কোনো রাজনৈতিক সম্বন্ধ থাকা বিচিত্র নহে। কিন্তু তাহা কবে কী আকারে স্থাপিত হইয়াছিল, তাহা সঠিক জানিবার কোনো উপায় নাই।

মহাভারতে বাংলা দেশের কয়েকটি রাজ্যের কথা আছে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত রাজগণের মধ্যে বঙ্গরাজ সমুদ্রসেনের পুত্র ‘প্রতাপবান’ চন্দ্রসেন, পৌণ্ড্ররাজ বাসুদেব এবং তাম্রলিপ্তির রাজার উল্লেখ আছে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানকালে শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার নিকট ভারতবর্ষের তদানীন্তন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে বঙ্গ, পুণ্ডু ও কিরাতদেশের অধিপতি পৌণ্ড্রক বাসুদেব বলসমন্বিত ও লোকবিশ্রুত এবং সম্রাট জরাসন্ধের অনুগত। জরাসন্ধের মৃত্যুর পর কর্ণকলিঙ্গ, অঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ডু ও বঙ্গদেশ এক যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে আনয়ন করেন। ভীমসেন দিগ্বিজয় উপলক্ষে কৌশিকী নদের তীরবর্ত্তী প্রদেশের রাজা এবং পৌণ্ড্রক বাসুদেব এই দুই মহাবীরকে পরাজিত করিয়া বঙ্গরাজ সমুদ্রসেন ও চন্দ্রসেনকে পরাভূত করেন এবং সুহ্ম তাম্রলিপ্তি, কৰ্বট প্রভৃতি রাজ্য ও সমুদ্রতীরবর্ত্তী ম্লেচ্ছগণকে জয় করেন। পৌণ্ড্রক বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের হস্তে নিহত হন এবং বঙ্গ ও পুণ্ড উভয় দেশই পাণ্ডবগণের অধীনতা স্বীকার করে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বঙ্গরাজ দুর্যোধনের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অতুল সাহস ও পরাক্রমের পরিচয় দেন।

এই সমুদয় আখ্যান হইতে অনুমিত হয় যে মহাভারত রচনার যুগে-এমনকি তাঁহার পূর্ব্ব হইতেই-বাংলা দেশ অনেকগুলি খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল। কখনো কখনো কোনো পরাক্রান্ত রাজা ইহার দুই-তিনটি একত্র করিয়া বিশাল রাজ্য স্থাপন করিতেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশের সহিত ও বাংলার রাজগণের রাজনৈতিক সম্বন্ধ ছিল এবং তাঁহাদের শৌর্য্য ও বীর্যের খ্যাতি বাংলার বাহিরেও বিস্তৃত ছিল।

অঙ্গরাজ কর্ণের অধীনে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ ভাগ মিলিয়া একটি বিশাল রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল-মহাভারতের এই উক্তি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য তাহা বলা কঠিন। কিন্তু খৃ. পূ. ৩২৭ অব্দে যখন আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন, তখন যে বাংলা দেশে এইরূপ একটি পরাক্রান্ত রাজ্য ছিল, সমসাময়িক গ্রিক লেখকগণের বর্ণনা হইতে তাহা স্পষ্ট বোঝা যায়। গ্রীকগণ গণ্ডরিডাই অথবা গঙ্গরিডই নামে যে এক পরাক্রান্ত জাতির উল্লেখ করিয়াছেন, তাহারা যে বঙ্গদেশের অধিবাসী, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কোনো কোনো লেখক গঙ্গা নদীকে এই দেশের পূর্ধ্বসীমা এবং কেহ কেহ ইহার পশ্চিম সীমারূপে বর্ণনা করিয়াছেন। প্লিনি বলেন যে, গঙ্গা নদীর শেষভাগ এই রাজ্যের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়াছে। এই সমুদয় উক্তি হইতে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে গঙ্গা নদীর যে দুইটি স্রোত এখন ভাগীরথী ও পদ্মা বলিয়া পরিচিত, এই উভয়ের মধ্যবর্ত্তী প্রদেশে গঙ্গরিডই জাতির বাসস্থান ছিল।

এই গঙ্গরিডই জাতি সম্বন্ধে একজন গ্রীক লিখিছেন : ভারতবর্ষে বহু জাতির বাস। তন্মধ্যে গঙ্গরিডই জাতিই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ (অথবা সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রভাবশালী)। ইহাদের চারি সহস্র বৃহত্যায় সুসজ্জিত রণহস্তী আছে, এই জন্যই অপর কোনো রাজা এই দেশ জয় করিতে পারেন নাই। স্বয়ং আলেকজাণ্ডারও এই সমুদয় হস্তীর বিবরণ শুনিয়া এই জাতিকে পরাস্ত করিবার দুরাশা ত্যাগ করেন।

গ্রীকগণ প্রাসিয়য় নামক আর এক জাতির উল্লেখ করেন। ইহাদের রাজধানীর নাম পালিবোথরা (পাটলিপুত্র-বর্ত্তমান পাটনা) এবং ইহারা গঙ্গরিডই দেশের পশ্চিমে বাস করিত। এই দুই জাতির পরস্পর সম্বন্ধ কী ছিল, গ্রীক লেখকগণ সে সম্বন্ধে বিভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছেন। অধিকাংশ প্রাচীন লেখকই বলিয়াছেন যে এই দুইটি জাতি গঙ্গরিডইর রাজার অধীনে ছিল এবং তাঁহার রাজ্য পাঞ্জাবের অন্তর্গত বিপাশা নদীর তীর হইতে ভারতষের পূর্ব্ব সীমান্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্লুতর্ক একস্থলে এই দুই জাতিকে গঙ্গরিডই রাজার অধীন এবং আর একস্থলে দুই জাতির পৃথক রাজার উল্লেখ করিয়াছেন।

অধিকাংশ গ্রীক লেখকের উক্তির উপর নির্ভর করিয়া মোটের উপর এই সিদ্ধান্ত করা অসমীচীন হইবে না যে, যে সময়ে আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন, সেই সময়ে বাংলার রাজ মগধাদি দেশ জয় করিয়া পাঞ্জাব পৰ্য্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন। গ্রীক ও লাতিন লেখকগণ এই রাজার যে নাম ও বিবরণ দিয়াছেন, তাহাতে অনেকেই অনুমান করেন যে ইনি পাটলিপুত্রের নন্দবংশীয় কোনো রাজা। ইহা সত্য হইলেও পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তের বিরোধী নহে। কারণ নন্দরাজা বাংলা হইতে গিয়া পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থাপন করিবেন, ইহা অসম্ভব নহে। পরবর্ত্তীকালে বাঙ্গালী পালরাজগণও তাহাই করিয়াছিলেন। পুরাণে নন্দরাজবংশ শূদ্র বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। ইহাও পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তের সপক্ষে। কারণ বাংলা দেশ বহুকাল পর্য্যন্ত আৰ্য সভ্যতার বহির্ভূত ছিল এবং ইহার অধিবাসী আৰ্য্য ধর্ম্মশাস্ত্র অনুসারে শূদ্র বলিয়া বিবেচিত হইবেন ইহাই খুব স্বাভাবিক। অবশ্য নন্দরাজা বাঙ্গালী ছিলেন, ইহা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এই সময় যে বাংলার রাজাই সমধিক শক্তিশালী ছিলেন, প্রাচীন গ্রীক লেখকগণের উক্তি হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়-এবং যখন ইহার অব্যবহিত পরেই শূদ্র নন্দরাজকে আর্য্যাবর্তের সাৰ্বভৌম রাজারূপে দেখিতে পাই, তখন তিনিই যে এই বাঙ্গালী রাজা এরূপ মত গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। অন্যথা স্বীকার করিতে হয় যে সহসা প্রবল গঙ্গরিডই রাজত্বের লোপ হইয়া নন্দরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইল। আলেকজাণ্ডারের ভারতে অবস্থানকালেই এই গুরুতর পরিবর্ত্তন হয়, অথচ সমসাময়িক লেখকগণ ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিলেন না অথবা জানিয়াও উল্লেখ করিলেন না এরূপ অনুমান করা কঠিন।

যদি পাটলিপুত্রের নন্দরাজ ও যবন লেখকগণ বর্ণিত গঙ্গরিডইর রাজা অভিন্ন বলিয়া ধরা যায়-তাহা হইলে খৃষ্টপূর্ব্ব চতুর্থ শতাব্দী বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবময় যুগ বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। এই মতবাদ গ্রহণ না করিলেও ৩২৭ খ্র. পূ. বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। কারণ, বঙ্গ ও মগধ এই যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনা ও আর্য্যাবর্তে তাঁহার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা একটি মহৎ কীর্তি। অঙ্গাধিপ কর্ণ সম্ভবত যাহার সূচনা করেন এবং সহস্রাধিক বৎসর পরে শশাঙ্ক ও ধর্ম্মপালের অধীনে যাহার পুনরাবৃত্তি হয়, মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্ব্বে অজ্ঞাতনামা বাংলা দেশের এক রাজা বাহুবলে সেই অপূৰ্ব্ব কীৰ্ত্তি অর্জন করিয়া বিশ্ববিজয়ী যবনবীর আলেকজাণ্ডারের বিস্ময় সম্ভ্রম ও আশঙ্কার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় বিদেশীয় লেখকগণের কয়েকটি সম্ভমসূচক উক্তি ব্যতীত ইহার পরবর্ত্তী যুগের বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে আর কিছুই জানা যায় না। বাংলার এই অন্ধকারময় যুগে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন, গ্রীক শক পুতুব কুষাণ প্রভৃতি বিদেশী জাতির আক্রমণ, দাক্ষিণাত্যে শাতবাহন রাজ্যের অভ্যুদয় এবং আর্য্যাবর্তে বহু খণ্ডাজ্যের উদ্ভব হয়। বাংলা দেশ সম্ভবত মৌৰ্য্য রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং হয়ত কুষাণ রাজও ইহার কিয়দংশ অধিকার করিয়াছিলেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো সংবাদ জানা যায় না। আলেকজাণ্ডারের অভিযানের চারি পাঁচশত বৎসর পরে লিখিত পেরিপ্লাস গ্রন্থ ও টলেমীর বিবরণ হইতে আমরা জানিতে পারি যে খৃষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে বাংলায় স্বাধীন গঙ্গরিডই রাজ্য বেশ প্রবল ছিল এবং গঙ্গাতীরবর্ত্তী গঙ্গে নামক নগরী ইহার রাজধানী ছিল। এই গঙ্গে নগরী একটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল, এবং বাংলার সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় এখান হইতে সুদূর পশ্চিম দেশে রপ্তানি হইত। এই সংবাদটুকু ছাড়া খৃষ্টজন্মের পূর্ব্বে ও পরের তিন শত-মোট ছয় শত বৎসরের বাংলার ইতিহাস নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। বিদেশীয় ঐতিহাসিকগণ যে গঙ্গরিডই জাতির সাম্রাজ্য ও ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হইয়া তাহাদিগকে ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, মহাকবি ভার্জিল যে জাতির শৌর্য-বীর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন এবং পঞ্চ শতাধিক বৎসর যাঁহারা বাংলা দেশে রাজত্ব করিয়াছেন-এদেশীয় পুরাণ বা অন্য কোনো গ্রন্থে সে জাতির কোনোই উল্লেখ নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *