০২. বাঙ্গালী জাতি

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ –বাঙ্গালী জাতি

১. বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তি

সর্বপ্রথম কোন সময়ে বাংলা দেশে মানুষের বসতি আরম্ভ হয়, তাহা জানিবার কোনো উপায় নাই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদি যুগের মানব প্রস্তরনিৰ্মিত যে সমুদয় অস্ত্র ব্যবহার করিত, তাহাই তাহাদের অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ ও পরিচয়। সাধারণত এই প্রস্তরগুলি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। সর্বপ্রাচীন মানুষ প্রথমে যে সমুদয় পাষাণ-অস্ত্র ব্যবহার করিত, তাঁহার গঠনে বিশেষ কোনো কৌশল বা পারিপাট্য ছিল না, পরবর্ত্তী যুগে এই অস্ত্র সকল পালিস ও সুগঠিত হয়। এই দুই যুগকে যথাক্রমে প্রত্নপ্রস্তর ও নব্য প্রস্তর যুগ বলা যায়। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের সভ্যতা বৃদ্ধির আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। তাহারা অগ্নি উৎপাদন করিতে জানিত, মাটি পোড়াইয়া বাসন নির্মাণ করিত এবং রন্ধনপ্রণালীতেও অভ্যস্ত ছিল। এই যুগের বহুদিন পরে মানুষ ধাতুর আবিষ্কার করে। মানুষ প্রথমে সাধারণত তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রের ব্যবহার করিত বলিয়া এই তৃতীয় যুগকে তাম্রযুগ বলা হয়। ইহার পরবর্ত্তী যুগে লৌহ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে মানুষ ক্রমে উন্নততর সভ্যতার অধিকারী হয়।

বাংলা দেশেও আদিম মানবসভ্যতার এইরূপ বিবর্ত্তন হইয়াছিল। কারণ এখানেও-প্রধানত পূর্ব্ব ও পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে-প্রত্ন ও নব্য প্রস্তর এবং তাম্রযুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়াছে। বাংলা দেশের মধ্যভাগ অপেক্ষাকৃত পরবর্ত্তী যুগে পলিমাটিতে গঠিত হইয়াছিল। প্রস্তর ও তাম্রযুগে সম্ভবত বাংলার পার্ব্বত্য সীমান্ত প্রদেশেই মানুষ বসবাস করিতক্রমে তাহারা দেশের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

বৈদিক ধর্ম্মাবলম্বী আৰ্য্যগণ যখন পঞ্চনদে বসতি স্থাপন করেন তখন তাঁহার বহুদিন পরেও বাংলা দেশের সহিত তাঁহাদের কোনো ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না। বৈদিক সূত্রে বাংলার কোনো উল্লেখ নাই। ঐতয়ের ব্রাহ্মণে অনাৰ্য্য ও দস্যু বলিয়া যে সমুদয় জাতির উল্লেখ আছে, তাঁহার মধ্যে পুরে নাম দেখিতে পাওয়া যায়। এই পুণ্ড জাতি উত্তরবঙ্গে বাস করিত, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গদেশের নিন্দাসূচক উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষভাগে রচিত বৌধায়ন ধৰ্ম্মসূত্রেও পুণ্ডু ও বঙ্গদেশ বৈদিক কৃষ্টি ও সভ্যতার বহির্ভূত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে এবং এই দুই দেশে স্বল্পকালের জন্য বাস করিলেও আৰ্যগণের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে এইরূপ বিধান আছে।

এই সমুদয় উক্তি হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে বাংলার আদিম অধিবাসীগণ আর্য্যজাতির বংশসম্ভূত নহেন। বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করিয়া পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে আর্য্যগণ এদেশে আসিবার পূর্ব্বে বিভিন্ন জাতি এদেশে বসবাস করিত। নৃতত্ত্ববিদগণও বর্ত্তমান বাঙ্গালীর দৈহিক গঠন পরীক্ষার ফলে এই সিদ্ধান্তই সমর্থন করিয়াছেন।

কিন্তু বাংলার অধিবাসী এই সমুদয় অনাৰ্যজাতির শ্রেণীবিভাগ ও ইতিহাস সম্বন্ধে সুধীগণ একমত নহেন। তাঁহাদের বিভিন্ন মতবাদের বিস্তৃত আলোচনা না করিয়া সংক্ষেপে এ সম্বন্ধে কিছু বলিলেই যথেষ্ট হইবে।

বাংলা দেশে কোল, শবর, পুলিন্দ, হাঁড়ি, ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় অন্ত্যজ জাতি দেখা যায়, ইহারাই বাংলার আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এবং বাহিরেও এই-জাতীয় লোক দেখিতে পাওয়া যায়। ভাষার মূলগত ঐক্য হইতে সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে এই সমুদয় জাতিই একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর বংশধর। এই মানবগোষ্ঠীকে ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অষ্ট্রিক’ এই সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু কেহ কেহ ইহাদিগকে ‘নিষাদ জাতি’ এই আখ্যা দিয়াছেন। ভারতবর্ষের বাহিরের পূর্ব্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় এই জাতির সংখ্যা এখনো খুব বেশী।

নিষাদ জাতির পরে আরও কয়েকটি জাতি এদেশে আগমন করে। ইহাদের একটির ভাষা দ্রাবিড় এবং আর একটির ভাষা ব্ৰহ্ম-তিব্বতীয়। ইহাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না।

এই সমুদয় জাতিকে পরাভূত করিয়া বাংলা দেশে যাঁহারা বাস স্থাপন করেন, এবং যাহাদের বংশধরেরাই প্রধানত বর্ত্তমানে বাংলার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য কায়স্থ প্রভৃতি সমুদয় বর্ণভুক্ত হিন্দুর পূর্ব্বপুরুষ, তাঁহারা যে বৈদিক আর্য্যগণ হইতে ভিন্নজাতীয় ছিলেন, এ বিষয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে কোনো মতভেদ নাই। রিজলী সাহেবের মতে, মোঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে প্রাচীণ বাঙ্গালী জাতির উদ্ভব হইয়াছিল। কিন্তু এই মত এখন পরিত্যক্ত হইয়াছে। কোনো কোনো মোঙ্গোলীয় পার্ব্বত্য জাতি বাংলায় উত্তর ও পূর্ব্ব সীমান্তে বাস স্থাপন করিয়াছে কিন্তু এতদ্ব্যতীত প্রাচীন বাঙ্গালী জাতিতে যে মোঙ্গোলীয় রক্ত নাই, ইহা একপ্রকার সর্ব্ববাদীসম্মত। আর দ্রাবিড় নামে কোনো পৃথক জাতির অস্তিত্বই পণ্ডিতগণ এখন স্বীকার করেন না।

মস্তিষ্কের গঠনপ্রণালী হইতেই নৃতত্ত্ববিদগণ মানুষের জাতি নির্ণয় করিয়া থাকেন। মস্তিষ্কের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত অনুসারে যে সমুদয় শ্রেণীবিভাগ কল্পিত হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে প্রধান দুইটির নাম ‘দীর্ঘ-শির’ (Dolichocephalic) ও ‘প্রশস্ত-শির’ (Brachycephalic) বৈদিক আর্য্যগণ যে যে প্রদেশে প্রাধান্য স্থাপন করিয়াছিলেন, সেখানকার সকল শ্রেণীর হিন্দুগণ দীর্ঘ-শির। কিন্তু বাংলার সকল শ্ৰেণীর হিন্দুগণই প্রশস্ত-শির। কেহ কেহ অনুমান করেন যে পামির ও টাকলামাকান অঞ্চলের অধিবাসী হোমো-আলপাইনাস নামে অভিহিত একজাতীয় লোকই বাঙ্গালীর আদিপুরুষ। ইহাদের ভাষা আৰ্যজাতীয় হইলেও ইহারা বৈদিক ধর্ম্মাবলম্বী আৰ্য্যগণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু সকলে এই মত গ্রহণ করেন নাই।

মস্তিষ্কের গঠনপ্রণালী হইতে নৃতত্ত্ববিদগণ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে বাঙ্গালী একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট জাতি। এমনকি বাংলা দেশের ব্রাহ্মণের সহিত ভারতের অপর কোনো প্রদেশের ব্রাহ্মণের অপেক্ষা বাংলার কায়স্থ, সদোপ, কৈবৰ্ত্ত প্রভৃতির সহিত সম্বন্ধ অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ।

বাংলার প্রাচীন নিষাদ জাতি প্রধানত কৃষিকাৰ্য্য দ্বারা জীবনযাপন করিত এবং গ্রামে বাস করিত। তাহারা নব্য প্রস্তর যুগের লোক হইলেও ক্রমে তাম্র ও লৌহের ব্যবহার শিক্ষা করিয়াছিল। সমতল ভূমিতে এবং পাহাড়ের গায়ে স্তরে স্তরে ধান্য উৎপাদন প্রণালী তাহারাই উদ্ভাবন করে। কলা, নারিকেল, পান, সুপারি, লাউ, বেগুন প্রভৃতি সজি এবং সম্ভবত আদা ও হলুদের চাষও তাহারা করিত। তাহারা গরু চড়াইত না এবং দুধ পান করিত না, কিন্তু মুরগী পালিত এবং হাতীকে পোষ মানাইত। কুড়ি হিসাবে গণনা করা এবং চন্দ্রের হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে তিথি দ্বারা দিন-রাত্রির মাপ তাহারাই এদেশে প্রচলিত করে।

নিষাদ জাতির পরে দ্রাবিড়ভাষাভাষি ও আপলাইন শ্রেণীভুক্ত এক জাতি বাংলা দেশে বাস ও বাঙ্গালী জাতির সৃষ্টি করে। পরবর্ত্তীকালে তাহারা নবাগত আৰ্যগণের সহিত এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে তাহাদের পৃথক সত্তা ও সভ্যতা সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা করা কঠিন। কিন্তু আৰ্য্য উপনিবেশের পূর্ব্বে ভারতবর্ষের সভ্যতা কিরূপ ছিল, তাঁহার আলোচনা করিলে এই বাঙ্গালী জাতির সভ্যতা সম্বন্ধে কয়েকটি মোটামুটি সিদ্ধান্ত করা যায়। বর্ত্তমানকালে প্রচলিত হিন্দু ধর্ম্মের কয়েকটি বিশিষ্ট অঙ্গ-যেমন কৰ্ম্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস, বৈদিক হোম ও যাগযজ্ঞের বিরোধী পূজাপ্রণালী, শিব, শক্তি ও বিষ্ণু প্রভৃতি দেব-দেবীর আরাধনা এবং পুরাণবর্ণিত অনেক কথা ও কাহিনী-তাহাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। অনেক লৌকিক ব্রত, আচার, অনুষ্ঠান, বিবাহ-ক্রিয়ায় হলুদ, সিন্দুর প্রভৃতির ব্যবহার, নৌকা নিৰ্মাণ ও অন্যান্য অনেক গ্রাম্য শিল্প এবং ধুতি শাড়ি প্রভৃতি বিশিষ্ট পরিচ্ছদ প্রভৃতিও এই যুগের সভ্যতার অঙ্গ বলিয়াই মনে হয়। মোটের উপর আৰ্যজাতির সংস্পর্শে আসিবার পূর্ব্বেই যে বর্ত্তমান বাঙ্গালী জাতির উদ্ভব হইয়াছিল এবং তাহারা একটি উচ্চাঙ্গ ও বিশিষ্ট সভ্যতার অধিকারী ছিল এই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায়।

.

২. আৰ্য প্রভাব

বৈদিক যুগের শেষভাবে অথবা তাঁহার অব্যবহিত পরেই বাংলা দেশে আৰ্য্য উপনিবেশ ও আৰ্য সভ্যতা বিস্তারের পরিচয় পাওয়া যায়। বৈদিক ধৰ্ম্মসূত্রে বাংলা দেশ আৰ্য্যাবর্তের বাহিরে বলিয়া গণ্য হইলেও মানবধর্ম্মশাস্ত্রে ইহা আৰ্য্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত এবং পুণ্ড জাতি পতিত ক্ষত্রিয় বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। মহাভারতে কিন্তু পুণ্ডু ও বঙ্গ এই উভয় জাতিই ‘সুজাত’ ক্ষত্রিয় বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। জৈন উপাঙ্গ পশ্লবণা (প্রজ্ঞাপন) গ্রন্থে আৰ্যজাতির তালিকায় বঙ্গ এবং রাঢ়ের উল্লেখ আছে। মহাভারতের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে করতোয়া নদীর তীর ও গঙ্গা-সাগরসঙ্গম পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। রামায়ণেও সমৃদ্ধ জনপদগুলির তালিকায় বঙ্গের উল্লেখ আছে।

পুরাণ ও মহাভারতে বর্ণিত আছে যে দীর্ঘতমা নামে এক বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি যযাতির বংশজাত পূৰ্ব্বদেশের রাজা মহাধাৰ্মিক পণ্ডিতপ্রবর সংগ্রামে অজেয় বলির আশ্রয় লাভ করেন এবং তাঁহার অনুরোধে তাঁহার রাণী সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচটি পুত্র উৎপাদন করেন। ইহাদের নাম অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড, সুহ্ম ও বঙ্গ। তাহাদের বংশধরেরা ও তাঁহাদের বাসস্থানও ঐ ঐ নামে পরিচিত। অঙ্গ বর্ত্তমান ভাগলপুর, এবং কলিঙ্গ উড়িষ্যা ও তাঁহার দক্ষিণবর্ত্তী ভূভাগ। পু, সুহ্ম ও বঙ্গ যথাক্রমে বাংলার উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ও পূৰ্ব্বভাগ। সুতরাং এই পৌরাণিক কাহিনী মতে উল্লিখিত প্রদেশগুলির অধিবাসীরা একজাতীয় এবং আৰ্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মিশ্রণে সমুদ্ভূত। এই কাহিনী ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না কিন্তু ইহা মহাভারত ও পুরাণের যুগে বাংলা দেশে আর্য্যজাতির বিশিষ্ট প্রভাব সূচিত করে।

অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলা দেশেও উন্নত সভ্য অধিবাসীর সঙ্গে সঙ্গে আদিম অসভ্য জাতিও বাস করিত। মহাভারতে বাংলার সমুদ্রতীরবর্ত্তী লোকদিগকে ম্লেচ্ছ এবং ভাগবতপুরাণে সুহ্মগণকে পাপাশয় বলা হইয়াছে। আচারাঙ্গ সূত্র নামক প্রাচীন জৈন গ্রন্থেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার উল্লেখ আছে। তখন রাঢ় দেশ বজ্রভূমি ও সুহ্মভূমি এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর পথহীন এই দুই প্রদেশে ভ্রমণ করিবার সময় এখানকার লোকেরা তাঁহাকে প্রহার করে এবং তাহাদের ‘চুঁ চুঁ’ শব্দে উত্তেজিত হইয়া কুকুরগুলিও তাঁহাকে কামড়ায়। জৈন সন্ন্যাসীগণ অতিশয় খারাপ খাদ্য খাইয়া কোনোমতে বজ্রভূমিতে বাস করেন। কুকুর ঠেকাইবার জন্য সর্বদাই তাঁহারা একটি দীর্ঘ দণ্ড সঙ্গে রাখিতেন। জৈন গ্রন্থকার দুঃখ করিয়া লিখিয়াছেন যে রাঢ়দেশে ভ্রমণ অতিশয় কষ্টকর।

আৰ্য্যগণের উপনিবেশের ফলে আৰ্য্যগণের ভাষা, ধর্ম্ম, সামাজিক প্রথা ও সভ্যতার অন্যান্য অঙ্গ বাংলা দেশে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল। প্রাচীন অনাৰ্য্যভাষা লুপ্ত হইল, বৈদিক ও পৌরাণিক এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম্ম প্রচারিত হইল, বর্ণাশ্রমের নিয়ম অনুসারে সমাজ গঠিত হইল-এককথায় সভ্যতার দিক দিয়াও বাংলা দেশ আর্য্যাবর্তের অংশরূপে পরিণত হইল। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যে যখন কোনো প্রবল উন্নত সভ্য জাতি ও দুর্বল অনুন্নত জাতি পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন এই শেষোক্ত জাতি নিজের সত্তা হারাইয়া একেবারে প্রথমোক্ত জাতির মধ্যে মিশিয়া যায়। তবে পুরাতন ভাষা, ধর্ম্ম ও আচার-অনুষ্ঠান একেবারে বিলুপ্ত হয় না-নূতনের মধ্য দিয়া পরিবর্তিত আকারে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা দেশেও এই নীতির অন্যথা হয় নাই। বাংলার প্রাচীন অনাৰ্য্য জাতি সর্বপ্রকারে আৰ্যসমাজে মিশিয়া গিয়াছে। কিন্তু বাঙ্গালীর ‘খোকা-খুকি’ ডাক, বাঙ্গালী মেয়ের শাড়ি-সিন্দুর ও পান-হলুদ ব্যবহার, বাঙ্গালীর কালী-মনসা পূজা ও শিবের গাজন, বাংলার বালাম চাউল প্রভৃতি আজও সেই অনাৰ্য্য যুগের স্মৃতি বহন করিতেছে। ঠিক কোন সময়ে আৰ্য প্রভাব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা সঠিক নির্ণয় করা যায় না। তবে অনুমান হয় যে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দে বা তাঁহার পূর্ব্বেই যুদ্ধযাত্রা, বাণিজ্য ও ধর্ম্ম প্রচার প্রভৃতি উপলক্ষে ক্রমশ বহুসংখ্যক আৰ্য্য এদেশে আগমন ও বসবাস করিতে আরম্ভ করেন। গুপ্ত সম্রাটগণ এদেশে রাজ্য স্থাপন করার ফলে যে আৰ্য্য প্রভাব বাংলায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বঙ্গদেশে গুপ্তযুগের, অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দের যে কয়খানি তাম্রশাসন ও শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে বেশ বুঝা যায় যে আৰ্যগণের ধর্ম্ম ও সামাজিক রীতিনীতি এই সময় বাংলায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। ধর্ম্ম ও সমাজ প্রসঙ্গে পরবর্ত্তী কয়েকটি পরিচ্ছেদে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাইবে। কিন্তু এই যুগে আর্য্য প্রভাবের আরও যে কয়েকটি পরিচয় পাওয়া যায়, নিম্নে তাহা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাইতেছে।

উপরোক্ত তাম্রশাসন ও শিলালিপিতে শহর ও গ্রামবাসী বহুসংখ্যক বাঙ্গালীর নাম পাওয়া যায়। এই নামগুলি সাধারণত কেবলমাত্র একটি শব্দে গঠিত-যেমন দুর্লভ, গরুড়, বন্ধুমিত্র, ধৃতিপাল, চিরাতদত্ত প্রভৃতি। এই সমুদয় নামের শেষে চট্ট, বর্ম্মণ, পাল, মিত্র, দত্ত, নন্দী, দাস, ভদ্র, দেব, সেন, ঘোষ, কুণ্ড প্রভৃতি বর্ত্তমানে বাংলায় ব্যবহৃত অনেক পদবী দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলি তখন যে নামের অংশমাত্র ছিল অথবা বংশানুক্রমিক পদবীরূপে ব্যবহৃত হইত, তাহা নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু মোটের উপর এই নামগুলি যে আৰ্য প্রভাবের পরিচায়ক, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

বাংলার গ্রাম ও নগরীর নামেও যথেষ্ট আৰ্য্য প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। পুণ্ড্রবর্দ্ধন, কোটিবর্ষ, পঞ্চনগরী, চণ্ডগ্রাম, কৰ্ম্মান্তবাসক, স্বচ্ছন্দপাটক, শীলকুণ্ডু, নব্যাবকাশিকা, পলাশবৃন্দকে প্রভৃতি বিশুদ্ধ আৰ্য্য নাম। অনাৰ্য্য নামকে সংস্কৃতে রূপান্তরিত করা হইয়াছে এরূপ বহু দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়-যথা খাড়াপাড়া, গোষাট পুঞ্জক প্রভৃতি। প্রাচীন অনাৰ্য্য নামেরও অভাব নাই যেমন ডোঙ্গা, কণামোটিকা ইত্যাদি। এই সমুদয় জনপদ-নামের আলোচনা করিলেও স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্য্য সভ্যতা বাঙ্গালীর সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *