২. বরিশালের ‘পোলা’র ঢাকা আগমন

বরিশালের ‘পোলা’র ঢাকা আগমন

উপক্রমণিকা

চল্লিশের দশকের ঢাকা–এই শিরোনাম আমার মনে অনেক দিন ধরেই বেশ আলোড়ন তুলে চলেছিলো। ওই দশকের লোকজন আমাদের পরিচিত মহলে আজ একেবারেই কমে গেছেন। চল্লিশের দশকের ঢাকা, বিশেষ করে সে সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, তখনকার সক্রিয় পরিচিত প্রগতিশীল তরুণ ছাত্রদের প্রসঙ্গ, বিশিষ্ট শিক্ষকদের কথা স্মরণ করা এবং বর্তমানের তরুণদের কাছে সেসব জানানোর একটা প্রয়োজন ও গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমান অবশ্যই বর্তমানের হাতে। বর্তমানের যুবক আর তরুণরাই বর্তমানের মীমাংসাকারী শক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি। এই বর্তমান অবশ্যই নতুন। এরা চল্লিশে ছিলো না। চল্লিশে এদের জন্মই হয় নি। চল্লিশে যাদের জন্ম হয়েছে তাদের বয়সই এখন, এতো বছর পরে পঞ্চাশের ওপর। এই বয়সের ব্যক্তিরাও আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। এদের কেউ সমর অধিনায়ক, কেউ বা সেক্রেটারিয়েটের কর্মকর্তা, অনেকে রাজনৈতিক নেতা, অধ্যাপক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী। তবু এরা চল্লিশের দশককে সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ করেন নি। অথচ চল্লিশের দশকের যে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ভাবনা-ধারণা-চিন্তা, তারই ফসল, তারই সৃষ্টি এরা। কিন্তু এই চল্লিশের দশকের ঢাকার জীবন সম্পর্কে বর্তমানের একজন প্রৌঢ়ের যেমন কোন অন্তরঙ্গ ধারণা নেই, তেমনি বর্তমানের তরুণদের কাছে চল্লিশের দশক একেবারেই অতীত ইতিহাসের ব্যাপার। কেবল যে অতীত ইতিহাসের ব্যাপার তাই নয়, অজ্ঞাত এক ইতিহাস। এ ইতিহাসের ওপর গবেষণা আবশ্যক। কারণ চল্লিশের দশকের ঢাকার গুরুত্ব কেবল এ কারণে নয় যে, ওই দশকে যে ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের একটি শহর মাত্র, সমগ্র বঙ্গদেশের এবং রাজধানী কলকাতার তুলনায় মফস্বল শহর মাত্র, সেই ঢাকাই দশকের শেষে ৪৭-এর বঙ্গবিভাগের পর পরিণত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানীতে। কেবল এই কারণেই নয়। বঙ্গদেশের একটা ঐতিহাসিক বিভাগ পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে ইতিহাসের বেশ কিছুটা পর্যায় থেকেই একটা সত্য এবং তার একটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এই বৈশিষ্ট্যটি প্রধানত এই সম্প্রদায় কিংবা ঐ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য অপ্রাধান্যের বৈশিষ্ট্য। অন্তত সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর বৈশিষ্ট্য। এবং সে দিক থেকেই পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজে শিক্ষার ক্রমপ্রসারের ক্ষেত্রে কলকাতার বাইরে ঢাকা, তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, তেমনি ঢাকার শিক্ষাগত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, তার ধারা-উপধারা সমগ্র বঙ্গদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে মুসলিম সমাজের রাজনীতিতে একটা বিশিষ্ট ভূমিকা ক্রমিক গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছিল।

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে তখনকার প্রধান মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো লাহোরে। সে প্রস্তাবের শাব্দিক গঠন যাই থাক, পাকিস্তান আন্দোলন। মানে ভারতকে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে ভাগ করে মুসলমানদের জন্যে একটা ভিন্ন এবং নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পাকিস্তান প্রস্তাব থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বিস্তারিত হয়েছে। শিক্ষিত তো বটেই, শিক্ষিতদের মাধ্যমে ব্যাপকতর মুসলিম সমাজ তাতে আলোড়িত হয়েছে। সে ইতিহাসে যাচ্ছি নে। হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমান সম্প্রদায় বলে আমরা অনেক সময়ে কথা বলি। সম্প্রদায় কথাটার মধ্যে কোনো নিন্দামূলক ভাব থাকার কারণ নেই। মানুষ গোত্র, ধর্ম, সম্প্রদায়, দেশ, ভাষা ও অর্থনৈতিক শ্ৰেণী–বিভিন্নভাবে বিভক্ত। কিংবা মানুষকে এভাবে বিভক্ত বলে বিবেচনা করা যায়। মানুষের সমাজের বিকাশ, এই ক্ষুদ্রকায় পৃথিবীতেও সর্বত্র সমান এবং সমতালে হয় নি। ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে ধর্ম হিসেবে বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব থাকলেও হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম এবং তাদের বিশ্বাসীদের মধ্যকার সম্পর্ক উনবিংশ থেকে বিংশ শতকের মধ্য ভাগে নানা কার্যকারণে রাজনৈতিক তাৎপর্য গ্রহণ করে। হিন্দু-মুসলমান কথা দুটির মধ্যে একটি মানসিক আবেগের ভাব ক্রমান্বয়ে আপসহীনভাবে সঞ্চারিত হতে থাকে। বিশেষ করে মুসলমান ধর্ম বিশ্বাসীদের উচ্চ শ্রেণীগত শিক্ষিত ব্যক্তিবৃন্দ উনিশ এবং বিশের শতকে নিজেদেরকে যেমন মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিচালনকারী বলে প্রচার করতে লাগলেন, তেমনি মুসলমানরা একই ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুধর্ম বিশ্বাসীদের চাইতে একেবারে ভিন্ন এরূপ ব্যাখ্যা-বক্তব্যের ওপর জোর দিতে থাকেন। যে ভারতীয় উপমহাদেশে, নানা ধর্ম, ভাষা ও জাতির অবস্থান, বিদেশী শক্তির থেকে স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে তার অপর কোন সমাধানের স্থানে মুসলমানদের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্র স্থাপন, তথা ভারত বিভাগের ওপরই এই নেতৃবৃন্দ তথা মুসলিম লীগ জোর দিতে লাগলেন। এখান থেকেই মুসলিম লীগের আন্দোলনটি সাম্প্রদায়িক। এই আখ্যা পাকিস্তান আন্দোলন ধারার বাইরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মহলে উচ্চারিত হতে থাকে। তবু সেদিন সাম্প্রদায়িক বলেও যেমন পাকিস্তান আন্দোলনকে বাতিল করে দেয়া দেশের বৃহত্তর দল এবং জনসমষ্টির পক্ষে সম্ভব হয় নি (তার কার্যকারণের বিশ্লেষণের কথা ভিন্ন), তেমনি কেবল যে অমুসলমানরাই পাকিস্ত নি আন্দোলনকে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক বিকাশের সুস্থ কোনো পথনির্দেশক নয় বলে বিবেচনা করেছেন, তাই নয়, মুসলিম সমাজের মধ্যেও, বিশেষ করে তার বিকাশমান শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে এমন একটি অংশ চল্লিশের দশকে উদ্ভূত হচ্ছিল, যে অংশটি পাকিস্তান আন্দোলনের শক্তিকে অস্বীকার না করলেও তার সাম্প্রদায়িক আবেগে নিজেরা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে চায়নি।

মুসলিম সমাজের শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে এবং ক্রমাধিক সংখ্যায় মুসলিম সমাজের মধ্যস্তর থেকে আগত তরুণদের আধুনিক শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে ঢাকা শহর তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বের কথা আমি উল্লেখ করছি। কলকাতার সেইকালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে আমার নিজের কোন গভীর ধারণা নেই। কিন্তু ঢাকার সঙ্গে ১৯৪০ সাল থেকেই আমার একটি সচেতন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সে জন্যই চল্লিশের দশকের ঢাকার জন্য আমার মমতাবোধ, পেছন ফিরে তাকানোর একটা গভীর আগ্রহ। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে কেবল ব্যক্তিগত আবেগের দিকই নেই। পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ার পর থেকে পূর্ববঙ্গে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গে যে গণতন্ত্রিক ও বামপন্থী সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্রমপ্রকাশ ও বিকাশ দেখা গেছে, তার ভিত্তি চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে উপ্ত হয়েছিলো। এরকম ভিত্তির কথা যখন বলা হয়, তখন এটা স্বাভাবিক যে, এর মূলে কোনো একটি ব্যক্তি বা কারণকে উল্লেখ করা হয় না। চল্লিশের দশকের ঢাকায় পঞ্চাশের দশকের গণতান্ত্রিক বিকাশের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিলো বলার অর্থ, চল্লিশের দশকের ঢাকা তথা মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আবাসক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা পরিবেশ ছিল যার মধ্যে মানবতাবাদী, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে যায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। সবকিছু মিলিয়ে বলা চলে, একটি মানবতাবাদী, গণতন্ত্রী, বামপন্থী পরিবেশ। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, এটা কি সেদিনকার প্রধান ধারা ছিলো, তবে তার জবাব অবশ্যই এই হবে যে, না, এটা নিশ্চয়ই সেদিনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রধান ধারা ছিলো না। কিন্তু তার বীজ যে ছিলো, এটা তো গুরুত্বহীন নয়। বীজ বাদে বৃক্ষের বিকাশ সম্ভব নয়। এটা কোনো রূপক অর্থে নয়, একেবারে বস্তুগত অর্থেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সত্য। অবশ্য চল্লিশের দশকে দুর্বল হলেও, সেদিনও দৃশ্যমান এই বীজটিরও কিছু পূর্বভিত্তি নিশ্চয়ই ছিলো। আমার নিজের চিন্তায়, এই পূর্বভিত্তিটি স্থাপন করেছিলেন অধিকতর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বিশ ও ত্রিশের দশকের ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ, তার মুখপত্র শিখা এবং তার মুখ্য পাত্রবৃন্দ, যথা কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন, কাজী মোতাহার। হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার তরুণ কিংবা প্রৌঢ় শিক্ষক ও অধ্যাপকবৃন্দ। এই পর্যায় সম্পর্কে কিছু পরিমাণ আলাপ-আলোচনা আমাদের সাহিত্য-আলোচকবৃন্দ করেছেন। যে চল্লিশের দশকের ঢাকার কথা আমি বলতে চাই সে চল্লিশের দশকের ঢাকা অবশ্যই তার পূর্বসূরি ত্রিশের দশকের ঢাকার উত্তরসূরি।

বরিশালের ‘পোলা’র ঢাকা আগমন

কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জবানবন্দিতে যদি চল্লিশের দশকের ঢাকার কিছু স্মৃতিচারণ করতে হয় তাহলে আমাকে তো প্রথমে ঢাকায় আসতে হয়।

আমি নিজে ঢাকা এসেছিলাম চল্লিশের দশকের ঠিক সূচনাতেই। ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করার অব্যবহিত পরেই।

আমি এসেছিলাম বলাটা ঠিক নয়। বরিশালের একটি কিশোর। বরিশালের ভাষায় বরিশালের একটি পোলা এসেছিল ঢাকায়, ঢাকা কলেজ পড়তে ম্যাট্রিক পাস করার পর অবশ্যই সে বরিশালের বিএম কলেজেও পড়তে পারত। তার সহপাঠী অনেকে তাই করেছে। অনেকে কলকাতা গিয়েছে। বরিশাল থেকে তখন সকাল-বিকাল এক্সপ্রেস আর মেইল, বিলাতি আর,এস,এন–আই.জি.এন কোম্পানির বিরাট বিরাট চাকাওয়ালা স্টিমার, যেমন ফ্লোরিকান, নাগা, গারো কলকাতা রওনা হয়ে যেতো। খুলনা গিয়ে যাত্রীরা ঘাটে দাঁড়ানো রেলগাড়িতে উঠত এবং তাতে চড়ে সোজা কলকাতা। কিন্তু বরিশালের এই পোলাটি কেন কলকাতা যায় নি, সেটাও আজ খোঁজ করে বার বার ব্যাপার।

এর একটি বোধগম্য কারণ হচ্ছে আর্থিক। কলকাতা গেলে খরচ বেশি পড়বে। ঢাকায় তত পড়বে না। কিন্তু তাছাড়াও আর একটা কারণ ছিল এই যে, কিশোরের বড় ভাইও উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা না গিয়ে এসেছিলেন ঢাকাতেই, সেই বিশের দশকের শেষ দিকে, ১৯২৭ সালে। বড় ভাই মঞ্জে আলী সরদারের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি তারও বরিশালের বিএম কলেজ থেকে বিএ পাস করে এমএ পড়ার জন্য ঢাকায় আসবার কারণের মধ্যে প্রধান ছিল আর্থিক বিবেচনা। ঢাকায় হল বা হোস্টেলে অল্প খরচে থাকা যাবে। এ বিবেচনা একটি গরিব কৃষক পরিবারের সন্তানের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য দূরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা নয়।

কিন্তু আজ এতো বছর পর সেই ছেলেটির ঢাকা আসবার ছবিটির দিকে তাকাতে গিয়ে যে কথা মনে পড়ে, সেটা আর্থিক সেই বিবেচনার ব্যাপার নয়। মনে ভেসে ওঠে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ছবি। খাল-বিল-বরিশালের ছেলে হলেও এমন বড় জাহাজে চড়ে আর সে নিজের জেলার বাইরে কখনো যায় নি। রওনা করলো যখন সে ঢাকার পথে, তখন কোনো আত্মীয়জন আসে নি সেই পনের বছরের কিশোরের সঙ্গে। ঢাকাতে কোনো আত্মীয়জন থাকার মত অবস্থাই তার ছিলো না। তার বড় ভাই-ই তার মুরুব্বি আর অভিভাবক। তিনি তখন সরকারি চাকুরে। বরিশালেরই কোনো থানা শহর বা বন্দরে। তিনি তার ছোট ভাইটিকে তার পরিচিত ঢাকায় পাঠরত বয়স্ক কোনো ছাত্রের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হবার জন্য।

ঝমঝম করে বিরাট জাহাজ (সেদিনকার সেই কিশোর এর চাইতে বড় জাহাজ যথার্থই দেখে নি) বরিশাল থেকে ছেড়ে বিরাট বিরাট নদীর বুকে ঢেউ তুলে, চাঁদপুর বন্দর এবং মুঞ্জিগঞ্জে নোঙর করে, নারায়ণগঞ্জের নদীতে ঢুকে সেখানে কিছুক্ষণ থেমে তারপর আবার মীরকাদিম হয়ে সন্ধ্যার পরে যখন বুড়িগঙ্গায় ঢুকল, তখন কিশোরের চোখে পড়ল, দূরের রাস্তা দিয়ে আরো দ্রুতবেগে এক-চোখো কি একটা দৌড়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। সঙ্গী বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র কিশোরকে তার বিস্ময় আর ভয়ের ঘোর কাটিয়ে দেবার জন্য নিশ্চয়ই বলেছিল: ঐ দেখ রেলগাড়ি যায়।

রেলগাড়ি! অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কিশোরটি দূরে অদৃশ্যপ্রায় সেই অজানা কিন্তু নামেশোনা ছুটন্ত লৌহদানবের দিকে। বলত, কোন্ জেলায় রেল যায় নি?–এ প্রশ্ন কেবল সেদিনের নয়, আজকের দিনের কিশোরের কাছেও সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্ন আর তার জবাব আজও এক: সে জেলা বরিশাল।

সে যাই হোক, শান্ত বুড়িগঙ্গায় ঢেউ তুলে জাহাজ এসে ভিড়েছিলো বাদামতলি ঘাটে। সেদিনকার বাদামতলি ঘাট বা তার লাগোয়া সদরঘাটের বাকল্যান্ড বান্দ এলাকা আজকের মত সরগরম ছিলো না। বুড়িগঙ্গাও এত কৃশকায়া ছিলো না। ছিলো বেড় বড়। বরিশালের নদীর মতো না হলেও বুড়িগঙ্গা দিয়ে কোম্পানির বড় জাহাজগুলোর চলাচলে, ভিড়তে, কিংবা ছাড়তে কোনো অসুবিধে হতো না। কিন্তু সেকালের বাদামতলি ঘাটে জাহাজ ভেড়া এবং ছাড়ার সঙ্গে যে বিষয়টি কিশোরের মনে জড়িত ছিলো সে হচ্ছে তার আর একটা বিস্ময়। কোম্পানির যাত্রীজাহাজ ঘাটের সীমানায় পৌঁছুলে লম্বা ভো দেয়: ডবল সিটি মারে, যাত্রীরা বোঝে তাদের গন্তব্য প্রায় এসে গেছে। ছাড়ার সময়েও বারংবার সেই একই ভো। কিন্তু ঢাকার বাদামতলিতে রাতের অন্ধকারে জাহাজ ভিড়তো যেন চোরের মতো, ছাড়তোও প্রায় চোরের মতোই। ইঞ্জিনের আওয়াজ যেনো ভেড়ার আর ছাড়ার সময়ে কম হতো, অন্য জায়গার চাইতে। কিন্তু কেননা? রহস্যটা কিশোরের ক্রমবর্ধমান অভিজ্ঞতায় বেশিদিন রহস্য হয়ে রইল না। বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুরা বলল : আরে জানো না, বাদামতলি ঘাটের কাছেই ঢাকার নওয়াবের বাড়ি, আহসান মঞ্জিল। নওয়াবের হুকুম, সন্ধ্যার পরে স্টিমার আসা আর যাওয়ার সময় কোন হুইসল দিতে পারবে না–নওয়াবের তাতে ঘুমের ব্যাঘাত হবে। নওয়াবের হুকুম কিনা তা জানা নেই। (সেকালে ঢাকার নওয়াব পরিবার ঢাকার সমাজ জীবনের অন্যতম প্রধান। বলেই বিবেচিত হতো।) কিন্তু সেকালে বাদামতলি ঘাটে জাহাজ নোঙর করা, নোঙর উঠিয়ে ছেড়ে যাওয়ার সময়ে যে ভোঁ দিত না, একথা সত্য।

প্রৌঢ়ের কৈশোর স্মৃতি

 অপরে বৃদ্ধ বললে তেমনি উপাদেয় বোধ হয় না। প্রৌঢ় বরঞ্চ চলে। পঁয়ষট্টি প্রাসের প্রৌঢ়। তারই কিশোরকালের কিছু স্মৃতিকথা।

সাজিয়েগুছিয়ে বলার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। স্মৃতির পটে যখন যা ভেসে ওঠে, তাকেই আবার তলিয়ে যাবার আগে টেনে তোলার চেষ্টা করা ভাল। এ কোনো সাহিত্যকর্ম নয়। কাজেই সাহিত্যিক সৌকর্যের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়াও নিরর্থক।

১৯৪০ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বরিশালের সেই কিশোর পোলাটি ঢাকা এসেছিলো। বিদেশ ঢাকায়। সেদিন ঢাকায় আসার জন্য জাহাজে চড়ে জাহাজ ছাড়ার সময়ে সে ফেলে আসা বরিশাল শহরের দিকে তাকায় নি। তাকিয়েছিলো অজানা ঢাকা দেখা যায় কি না, কখন দেখা যাবে, তার দিকে। সেদিন ছিলো অজানার আকর্ষণ। লিউর অব দি আনোন্। কিন্তু আজ স্মৃতির বাহনে চড়ে সেই ৪০ সালে ফিরে গিয়ে অত সহজে বরিশাল ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এখন লিউর অব দি আনোন কোথায়? এখন জিজ্ঞাসা সেদিনের ফেলে আসা বরিশালকে কি জানা শেষ হয়েছিলো?

সেই বেল ইসলামিয়া হোস্টেল, পাশের এ. কে, স্কুলের খাবার ঘর, নামাযের সময়ে রোলকল, হোস্টেলে কড়া সুপার সাহেব : টুপি মাথায় দিয়ে খেতে বসতে হবে। তা না হলে খাওয়ার টেবিল থেকে সুপার এসে তুলে দেবেন। রাত দশটা বাজতেই হোস্টেলের লাইট নিবিয়ে দেওয়ার হুকুম। আর তারপরেই অন্ধকারে ৩৯-৪০ সালে সেই কিশোরটির গা ঢাকা দিয়ে খান কয়েক বই হাতে নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের গা ঘেঁষে, লোহার রেলিং টপকে ছবির মতো সুন্দর স্টিমার ঘাটের বুকিং অফিসের টাইম-বোর্ডটার নিচে বসে বই পড়া। আহা, যদি জানতাম, এমন জীবন আর ফিরে পাওয়া যাবে না, তাহলে ফেলে আসা কৈশোরের জীবনকে আরো গভীর করে ভালবাসতাম! পূর্ণতরভাবে বাঁচতাম।

জেলা স্কুলের হেডমাস্টার সিরাজউদ্দিন সাহেবের দস্তখত করা আমার ক্লাস টেনের একটা প্রশংসাপত্র এখন পর্যন্ত সযত্নে রাখা আছে। সবল অথচ কম্পিত হাতের সেই সইটির দিকে তাকালেই হেড স্যারের গৌরবর্ণ দেহের ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখনো ভাবতে ভয় লাগে : আপাতভাবে কি কড়া মেজাজের মানুষ। আর এমন কাঠামোর স্কুল-দালানও আমি আর কোথাও দেখি নি। সামনে-পেছনে বিরাট সিঁড়িওয়ালা একতলা দালান। মাঝখান দিয়ে লম্বা করিডোর। দুপাশে ক্লাসঘর। হেডমাস্টার সাহেব এই করিডোর দিয়ে এ-মাথা থেকে ও-মাথা হেঁটে যেতেন। তার পায়ের আওয়াজেই সব ক্লাসরুম হিম-ঠাণ্ডা হয়ে যেতো।

কিন্তু শশধর স্যার ছিলেন কী সুন্দর হাসিখুশি মেজাজের শিক্ষক। খুব সম্ভব তিনি ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক। আর অঙ্কে আমি আজীবনই কাঁচার কাঁচাই রয়ে গেলাম।

ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অঙ্কের দিন অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছি। কোনো রকম দিয়েছি। একেবারে যে ফেল করব, তা নয়। তবে কানের পাশ দিয়ে যাওয়ার। ব্যাপার। তাই উদ্বেগের অন্ত ছিলো না। পরীক্ষা শেষ হতে শশধর স্যারই সহাস্যে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিরে পাশ করবি তো? আমি সভয়ে এবং শঙ্কিতভাবে বলেছিলাম : পাশ করব না স্যার? চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশও কি পাবো না? স্যার হেসে বলেছিলেন : ঘাবড়াসনে। আমি খাতা একবার দেখে দিয়েছি। পঞ্চাশের মতো তোর থেকে যাবে।

অঙ্কে এমন কাঁচা মানুষের পৌঢ় বয়সে অঙ্কের কিছু স্মরণে আসবার কথা নয়। তবু স্মৃতিতে সে যে উঠে এলো, সেটাই মজার। আর মজার ঘটনা বলেই মনে এলো।

ম্যাট্রিকের আগে এ্যানুয়ালে, নাইন থেকে যখন টেনে উঠেছিলাম, তার ফলাফলের ওপর যেদিন পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান হয়েছিলো, সেদিন আমাকে অঙ্কের ওপরও পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো। না, ফেল করার জন্য নয়। বাংলাতে বোধ হয় নম্বর একটু ভালো উঠেছিলো আর অঙ্ক-বাংলার মিলিত নম্বরের এটা পুরস্কার ছিলো। আর তাতেই আমি এই দুবিষয়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। কিন্তু আসলে এটাও মূল কারণ ছিলো না। মূল কারণ এ্যানুয়ালে তপনের পরীক্ষা না দেওয়া। তপন ছিলো ক্লাসের হিন্দু-মুসলমান সকলের মধ্যে তুখোড় ছেলে। ওই-ই ফার্স্ট হতো। ওরই ন্যায্যত প্রাপ্য ছিল সব পুরস্কার। কিন্তু কোনো অসুখের জন্য বোধ হয় সেবার তপন এ্যানুয়াল দেয় নি। আর তাতেই খুলেছিল আমার কপাল।

কিন্তু ব্যাপারটাতে আমার আনন্দ বা গর্ববোধ হওয়ার চাইতে কৌতুক জেগেছিলো বেশি। বেশ মজার মনে হয়েছিলো। তবে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া ইংরেজি-বাংলা বই-এর বোঝায় তিনফুটি ছোট্ট কিশোরটির কাঁধ যে ভরে গিয়েছিলো, সেটা সত্য। আর তাতেই দর্শকদের মধ্যে যে কী বাহবা!

তাই বলে একেবারেই কি যোগ্য ছিলাম না? মিলাদ হতো স্কুলে। সে উপলক্ষে হযরতের জীবনের ওপর রচনা প্রতিযোগিতা হতো। আর তাতে একবার মানুষ হযরত মোহাম্মদ শিরোনামের আমার লেখাটিকে প্রথম পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো। এ পাওয়াতে হয়ত তেমন ফাঁকি ছিলো না।

আসলে মোজাম্মেলের সামনে এই ভালো হওয়া, পুরস্কার পাওয়া নিয়ে কোনো কথা বলারই উপায় ছিলো না। ইচ্ছা করলে মোজাম্মেল আমাদের অনেকের চাইতেই ভালো ফল করতে পারতো। ক্লাস এইটে বৃত্তি নিয়ে নাইনে এসে ভর্তি হয়েছে ও। কালো ছিপছিপে গড়ন। চোখে-মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ। ওর চিন্তা ভালো ফলের নয়, চিন্তা নিজের বিপ্লবী দল আর.এস.পির সাংগঠনিক প্রভাবে কোন ছেলেকে কীভাবে যোগাড় করতে পারবে সেটা। আর তাই আমাকে ঠাট্টা করে বলত : এই ভালো ছেলে! বই পড়া রাখো। এই লিফলেট কটা নিয়ে যাও। দেখো, একটু সাবধানে নিও। কেউ যেন জানে । কালই ফেরত দিও। ওর কথাবার্তায় সত্যি ভয় হতো। লাল কালিতে ছোট ছোট অক্ষরে ছাপা ইশতেহার : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে খতম করে ভারতবর্ষে শোষিত জনতার রাজ কায়েম করার জঙ্গি আওয়াজ।

একদিন দিয়েছিলো পড়তে একটা বই। তিনশ পৃষ্ঠার ওপরে তার আকার। বাংলায় বলেছিলো : প্রোসক্রাইবড় বই; বেআইনি বই। খবরদার, কেউ যেন টের না পায়। একরাতে শেষ করতে হবে। আমি তাই করেছিলাম। কোনো কষ্ট করতে হয় নি। একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কেবল যে নিষিদ্ধ বই পাঠের আকর্ষণ, তাই নয়। গ্রন্থের বিষয়বস্তুও। প্রবন্ধ নয়। গল্প। বিপ্লবী উপন্যাস।

নায়ক-নায়িকারা সমিতি করে। শ্রমিকদের মধ্যে সভা করে। ভারতবর্ষের বাইরে। রেঙ্গুনে। মান্দালয়ে। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা তাদের লক্ষ্য। নায়ককে ভালবাসে নায়িকা। কিন্তু নায়ক দুর্বল। পুলিশের আতঙ্কে সে দলের গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়। এই অপরাধে গুপ্ত দলের গোপন বিচার বসে। রায় হয় : এই গুরুতর অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু সে দণ্ড কার্যকর হতে পারে না। নায়িকা তার প্রেমিকের দণ্ডে বিমূঢ়। কিন্তু তাকে অভয় দেয় সব্যসাচী। দলের বিপ্লবী অধিনায়ক। রহস্যপুরুষ। সব্যসাচী বলেন : ভয় পাসনে বোন, ভারতী। অপূর্বর কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু অপূর্ব বিপ্লবীদলের যোগ্য নয়। ওকে তুই এই বিপদের মধ্যে আনিসনে ….।

আজ জানি এ কাহিনী হচ্ছে পথের দাবীর কাহিনী। বই-এর নাম পথের দাবী। লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এই বই তখন ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণায় নিষিদ্ধ আর বিপজ্জনক বই। এ বই কারুর হাতে পেলে অমনি তার গ্রেপ্তারের আশংকা। সশ্রম কারাদণ্ডের ভয়। আর তাই সে রাতে বইটার পুরোটা পড়েও বুঝতে পারি নিঃ কি নাম এ বইয়ের। বইয়ের পাতার মাথায় মুদ্রিত হয়েছিলো যেখানে যেখানে পথের দাবী নামটি, সবখান থেকেই সেটাকে কেটে ফেলে আপাত নির্দোষ করা হয়েছিলো পথের দাবীকে। পথের দাবী হীন পথের দাবীকে।

মোজাম্মেলের এই ছিল কারবার। তাই ওর ধমকে ক্লাসে ভালো ফল করেছি বা অনেক বই পুরস্কার পেয়েছি, একথা বলার সাহসই হতো না।

এই বই পড়া স্মৃতি যেমন মনে গেঁথে রয়েছে, তেমনি মজার স্মৃতি হিসেবে গেঁথে আছে বেল ইসলামিয়া হোস্টেলে কম্পালসরি নামাযের রোলকলের স্মৃতি।

এখন আর বেল ইসলামিয়ার সেই পুরনো মর্যাদা নেই। তার দেওয়ালেও দেখলাম, আজকাল আর চুনকাম হয় না। অথচ সেদিন শহরে বি আই হোস্টেল বা বেল ইসলামিয়া হোস্টেল ছিল জেলা স্কুল আর এ. কে স্কুলের ছাত্রদের ছাত্রাবাস। কোনো ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নামে প্রতিষ্ঠিত হোস্টেল।

এ. কে স্কুলের মৌলবী, দীর্ঘদেহী, শুশ্রুমণ্ডিত সুলতান সাহেব তার সুপারিনটেন্ডেন্ট। তাঁর গলার আওয়াজ আর দীর্ঘ চেহারার সামনে নাইন টেনের বড় সাইজের ছেলেরাও কুঁকড়ে যেতো। তাঁর রেওয়াজ ছিলো, মগরেবের আর এশার নামাযে বোর্ডিং-এর প্রত্যেক ছাত্রকে হাজির থাকতে হবে। নামাযের জমাত হবে বোর্ডিং-এর টানা বারান্দায়। আর সুপারিনটেন্ডেন্ট নিজে তার ইমামতি করবেন। মোনাজাত শেষে রেজিস্টার ধরে রোলকল। রোলকলের জবাবে লাম্বায়েক বলতে হবে। লাম্বায়েক মানে হাজির।

কিন্তু সন্ধ্যার পর ছাত্রদের দুষ্টুমি যে বাড়তে থাকতো, সুলতান সাহেব সেটা বুঝতে পারতেন। কেউ কেউ নামাযে উপস্থিত হতো না। উপস্থিত না হলে ক্লাস সেভেন থেকে টেন পর্যন্ত ওয়াক্ত প্রতি জরিমানা ছিল, যতদূর মনে পড়ে, এক আনা। আর ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বেত। আমি সাহস করে লাব্বায়েক বলি নি বা জামাতে অনুপস্থিত রয়েছি, এমন কথা মনে করতে পারছি নে। কিন্তু সহপাঠী আমিনুলকে দেখতাম বেপরোয়া। হাসি হাসি মুখ। কিন্তু নামাজে, বিশেষ করে এশার নামাজে সে হাজির হতো না। সুলতান সাহেব এর কৈফিয়ত তলব করতেন। সুপারিনটেন্টকে আমরা স্যার বলতাম না। বলতে হতো হুজুর। আমিনুলকে তলব করলে আমিনুল হাসিমুখে বলত : হুজুর, আমি তো বলেছি, আমার জরিমানাটা আগাম নিয়ে নিন….।

সুলতান সাহেব আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু শুনেছি, আমি বরিশাল থেকে আসার পরেও তিনি আমাকে স্মরণে রেখেছিলেন, তাঁর আত্মীয়জন আর অন্য ছাত্রদের কাছেও আমার কথা বলেছিলেন।

এই বরিশালেই সেই ৩৮ সালে এসেছিলেন ছবির মতো দেখতে সুন্দর, সুভাষচন্দ্র বসু। বক্তৃতা করেছিলেন বি.এম স্কুলের উল্টো দিকের বার একাডেমির মাঠে। এসেছিলেন নিশ্চয়ই। তা না হলে বার একাডেমির মাঠের পাশ দিয়ে এরপর যখনই হেঁটেছি, তখুনি সুভাষ বসুর চেহারা আমার মনের চোখে কেনো ভেসে উঠেছে বারংবার! আজ হয়ত সেই বার একাডেমিও নিচিহ্ন। বরিশাল শহরে যতগুলো হাইস্কুল ছিল, এতগুলো হাইস্কুল খুব কম জেলা শহরেই দেখা যেত।

এমনি জানা-অজানা নানা উপাদান। নানা উপাদান দিয়ে গঠিত হয় যে কোনো পদার্থ। একজন কিশোরও একটা পদার্থ। চারদিকের আলো-হাওয়া, পানি, মানুষজন, দয়া-মায়া, আঘাত, স্নেহ, সব নিয়ে যে পরিবেশ তারই মিলিত উপাদানের ফসল সে। এমনি করেই তার বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। তারপরে একদিন আবার সে যৌগিকের বিশ্লিষ্ট উপাদানে পর্যবসিত হয়।

যেমন ছিলো তেমনভাবে হয়ত নয়। নতুনভাবে নতুন উপাদানের সৃষ্টি করে পুরনো উপাদান তার ভূমিকা পালন করে। তার কতোখানি সচেতন, কতোখানি অচেতন : সে অনেক তত্ত্বের কথা। সে তত্ত্ব থাক। কিন্তু কোনো এক সময়ে যদি বসতেই হয় কোন উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছে একটা জীবন, তার হিসেব নিতে, তখন কোনো উপাদানকেই হিসেবের বাইরে রাখবার উপায় থাকে না। কাউকেই বাইরে রাখা উচিত নয়। অবশ্য সব উপাদানকে নির্দিষ্ট করাও সহজ নয়।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর স্মৃতিচারণ

 চল্লিশের দশকের ঢাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিবেশের কোনো রেখাচিত্র আমার একার পক্ষে তৈরি করা আদৌ সম্ভব নয়। আমি কেবল এর বৈশিষ্ট্য, একে জানবার প্রয়োজন আর এ বিষয়ে আমার আগ্রহের কথা উল্লেখ করেছি।

ব্যক্তিগত এই আগ্রহের কথা প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক সৈয়দ নুরুদ্দিনকে আমি বলেছিলাম। কবি সানাউল হকও এই সময়কার ছাত্র। আমার অগ্রবর্তী। তাঁর সঙ্গেও এ সম্পর্কে আলাপের প্রয়োজন রয়েছে। সংবাদ এর এককালীন সম্পাদক খায়রুল কবির এবং তার বর্তমান সম্পাদক আহমদুল কবির এঁরা দুজনও আমার অগ্রবর্তী। চল্লিশের দশকের ঢাকার কাহিনী লেখার অধিকতর উপযুক্ত পাত্র এঁরা। ঢাকা শহরের না হলেও ঢাকা জেলার এঁরা অধিবাসী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, চল্লিশের দশকেই। এবং বুদ্ধিবৃত্তি গতভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এঁরা এদের অধ্যয়নকাল থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছিলেন। চল্লিশের দশকের ঢাকার অন্তরঙ্গ পরিচয় এঁরাই জানেন। এ. কে. নাজমুল করিম আজ প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি ১৯৪১ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সমাজতাত্ত্বিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। কলেজে পড়ার সময় থেকেই দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত না হলেও, এ সম্পর্কে কৌতূহলী মন ছিল তাঁর। তাঁর সহপাঠী হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন এর কর্মী। এদের একজন ছিলেন রবি গুহ। রবি গুহ ছিলেন সর্বদা হাসিমুখ, আলাপপ্রিয়, সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যাকারী এবং ছাত্র-শিক্ষক মহলে খুব সাদরে গৃহীত ছাত্রকর্মী। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে আমার অগ্রজদের কথা স্মরণ করতেই মনে এল নাজমুল করিমের নাম। নাজমুল করিম যে সমাজতন্ত্রে দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাস করতেন, তা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে তার ছিলো বিশেষ কৌতূহল। চল্লিশের সনে না হলেও বিয়াল্লিশ সনের দিকে ঢাকার কমিউনিস্ট কর্মীরা ছাত্রদের মধ্যে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠছিলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হওয়ার পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধ সম্পর্কে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যে নীতি গ্রহণ করেছিলো, তাতে কমিউনিস্ট পার্টিকে ভারত সরকার আর নিষিদ্ধ রাখা আবশ্যক মনে করে নি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি জার্মানি-ইতালি-জাপান মিলে যে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তি তৈরি হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের নীতি ঘোষণা করেছিলো। এ নীতির ব্যাপারে ভারতের কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের ভেতরে কিংবা বাইরে ফরোয়ার্ড ব্লক, আর.এস.পি বা বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টি প্রভৃতির বিরোধিতা ছিলো। ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রখ্যাত নেতা সুভাষচন্দ্র বসু সে সময়ে ব্রিটিশ সরকারের অন্ত রীণ অবস্থা থেকে কৌশলে পালিয়ে বার্লিন হয়ে টোকিওয়েত গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাপানের সাহায্য লাভের চেষ্টা করেছিলেন। এর ফলে ভারতে যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা অধিকতর জটিল রূপ গ্রহণ করে। ঢাকাতে কমিউনিস্ট কর্মীদের এই ফ্যাসিবাদ-বিরোধী নীতি হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক এবং আর.এস.পি মহল থেকে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এর বিভিন্ন আত্মঘাতী প্রকাশ সংঘটিত হত হিন্দু ছাত্রদের হল ঢাকা হল, জগন্নাথ হল এবং হিন্দু দু মধ্যবিত্ত প্রধান তাঁতীবাজার, শাখারী বাজার, ওয়ারী ও নবাবপুর প্রভৃতি এলাকার ছাত্র মধ্যবিত্ত কর্মীদের মধ্যে। এসব বিরোধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে তেমন কোনো আলোড়ন বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত না। যুদ্ধের চরিত্রের ব্যাখ্যা-প্রতিব্যাখ্যা মুসলিম ছাত্রদের চিন্তা ও আলোচনার কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল এই যে, ঢাকা শহরের এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন হিন্দু ছাত্র এবং মধ্যবিত্ত অন্য কর্মীরা তাদের নিজেদের সমাজে তীব্র বিরোধের সম্মুখীন হলেও মুসলিম ছাত্র, বিশেষ করে তার মধ্যকার উদার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছাত্রদের কাছে বেশ সমাদর পেতে লাগল। এই ধারাতেই চল্লিশের দশকে, বিশেষ করে ৪২ থেকে ৪৫ ৪৬ সালে ছাত্র ফেডারেশনের এবং ঢাকার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের কর্মীদের সম্পর্ক তৈরি হয় এই সময়কার মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে। এবং এদের মধ্যে আমার বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে যেমন ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ.কে. নাজমুল করিম, তেমনি বাংলার হেসামুদ্দিন আহমদ, ইংরেজির এ.কে.এম আহসান, কবীর চৌধুরী, অর্থনীতির সানাউল হক এরা। সৈয়দ নুরুদ্দিন আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন কিংবা একেবারে সহপাঠী, সেটাও হিসেব করার বিষয়। সৈয়দ নুরুদ্দিনের পাঠ্য বিষয় ছিল বোধ হয় ইতিহাস। বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে প্রয়াত মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর নামও স্মরণীয়। তিনি ছিলেন এ.কে. নাজমুল করিমেরও অগ্রবর্তী। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও কমিউনিস্ট কর্মীদের একটা পরিচয় এবং হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিলো।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী চল্লিশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। ইংরেজিতে অনার্স এবং এম.এ. উভয় পরীক্ষাতে তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেছিলেন। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ছোট। ভাই মুনীর চৌধুরী। এককালে যখন জঙ্গি এবং বামপন্থী রাজনীতিতে মুসলিম মধ্যবিত্ত কোনো মেয়ে বা ছাত্রীর সক্রিয়তা একেবারে অচিন্তনীয় ছিল, বিশেষ করে ঢাকায়, তখন পাকিস্তানের গোড়ার দিকে কবীর চৌধুরীর ছোট বোন নাদেরা বেগমের রাজনৈতিক উৎসাহ এবং কর্ম ছাত্রছাত্রী মহলে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর একটি পারিবারিক অন্তরঙ্গ নাম মানিক। বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অগ্রজপ্রতিম হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে পড়বার সময় থেকে তাঁকে মানিক ভাই বলে সম্বোধন করেছি। এই চল্লিশের দশকের ঢাকার কথা মনে করে সেদিন, ১৭ জুন ৮৩, তাঁর বাসায় গিয়ে বললাম, আপনি কিছু বলুন আমাকে, সেদিনের কথা যা মনে আছে।

কবীর চৌধুরী সহাস্যে বললেন : সেদিনের সঙ্গে আজকের কালের ব্যবধান তো কম নয়। ঘটনা এবং চরিত্রের স্মৃতিও তো প্রায় বিলুপ্ত।

আমি বললাম : আপনি কি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়েই ঢাকা এসেছিলেন?

কবীর চৌধুরী বললেন : না, আমি বেশ কিছু আগেই ঢাকা এসেছিলাম।

কবীর চৌধুরী ঢাকাতে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেছেন ১৯৩৮ সালে। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। ১৯৪০ সালে। তারপর আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মচারি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনকার ছবিটা স্মরণ করে কবীর চৌধুরী বললেন : ছাত্রসংখ্যা তো তখন কত কম! ধরো, সেই ১৯৪০-এর কথা। আমি অনার্স দিয়েছিলাম ৪৩-এ। তখন আমরা মাত্র জনাবিশেক ছাত্র ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে। মেয়ে ছাত্র চারজন।

আমি বললাম : মেয়েদের মধ্যে মুসলমান ছাত্রী ছিল কি একটিও?

মানিক ভাই বললেন : না, আমাদের ইংরেজিতে আদৌ নয়। কিন্তু বিজ্ঞানে ছিলেন মেহের, যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, পরবর্তীকালে।

দু একটা কথা। খণ্ডচিত্র। আজ বেশি কিছু মনে পড়ে না। কেবল রমনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত রোমান্টিক পরিবেশ বাদে মনে পড়ার মতো হয়তো কিছু নেইও। তবু সেদিনকার পটভূমিতে তার একটি ভূমিকা ছিলো, যা পরবর্তীকালকে প্রভাবিত করেছে। এই প্রসঙ্গে কবীর চৌধুরী বললেন : সাম্প্রদায়িকতা চারদিকে বিস্তারিত হচ্ছিল, একথা সত্য। কিন্তু ১৯৪২-এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের মনে পড়ে না।

’৪২ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে একটা সংঘাত ঘটেছিলো। এর সূত্রপাত হয়েছিলো কার্জন হলে ছাত্রীদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সলিমুল্লাহ হলের কিছু ছাত্রের আচরণ নিয়ে, হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদের ফলে। পরের দিন এর বিস্তার ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস এবং অফিস বিল্ডিং অর্থাৎ এখনকার বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বিল্ডিং-এ। এ ভবনের দোতলার একদিকে ছিল ফজলুল হক হল অর্থাৎ মুসলিম ছাত্রদের বাসস্থান। ভবনের পুবদিকে ছিল ক্লাসঘর, ছাত্রীদের কমনরুম আর শিক্ষকদেরও বসার ঘর। নিচে ছিল লাইব্রেরি। এই দিনের সংঘাতের সময়টাতেই নাজির আহমদ নামের একজন মুসলমান ছাত্র আকস্মিকভাবে ছুরিকাহত হন এবং ঐদিনই বিকেলে মিটফোর্ড হাসপাতালে তিনি মারা যান। আমি তখন মাত্র আই.এ. পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি। নাজির আহমদের। স্মরণে পরবর্তীকালে নাজিরাবাজার এলাকায় একটা পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিল মুসলিম ছাত্রবৃন্দ, যার নাম দেয়া হয়েছিলো শহীদ নাজির লাইব্রেরি।

আমি কবীর চৌধুরী সাহেবকে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু এ ঘটনা সত্ত্বেও হিন্দু মুসলমান ছাত্রদের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে আপনার কি কিছু মনে পড়ে?

কবীর চৌধুরী সাহেব বললেন : এ ঘটনাকে বলতে পারি সেদিনকার আবহাওয়ার একটি ব্যতিক্রম। কারণ আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কেবল হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে নয়। শিক্ষকদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু সমাজের। আমাদের ইংরেজিতে ড. মাহমুদ হাসান ব্যতীত সেদিন কোনো মুসলমান অধ্যাপক ছিলেন না। আমার ছাত্র জীবনের শেষদিকে, আমার মনে পড়ে, প্রয়াত ফজলুর রহমান সাহেব এসে ইংরেজি বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে তিনি কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তানের জনশিক্ষা পরিচালক অর্থাৎ ডি.পি.আই হয়েছিলেন। অকালে তিনি মারা গেছেন। হিন্দু শিক্ষকদের বাড়িতে গিয়ে আমাদের গল্প করা, ক্লাস করা–এটা ছিল সেদিনকার সেই পরিবেশের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন যেমন মন্মথ ঘোষ, তেমনি পি.কে. গুহ, অমলেন্দু বোস আর এস.এন রায়। এঁদের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, ছাত্রদের এত আন্তরিক, অমায়িক সম্পর্ক ছিলো যে, সে কথা আজ একেবারে অকল্পনীয় বলে মনে হয়। আমাদের সে সম্পর্কটা ছিলো, বলা চলে, একেবারে পারিবারিক ব্যাপার। অধ্যাপক জুনারকরের পরিবারের কথা মনে পড়ে। এই পরিবারের সঙ্গে মুনীরের সম্পর্ক তো পরবর্তীকালে খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো। এইসব শিক্ষক এত স্নেহপরায়ণ ছিলেন, ছাত্রদের সঙ্গে এঁদের ব্যবহার এত খোলামেলা ছিলো যে, সে কথা ভাবতেই আজ মনে একটা আবেগের সঞ্চার হয়।

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নিজের বিভাগের অন্য মুসলিম ছাত্রদের কথাও স্মরণ করলেন। বললেন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনও কৃতী ছাত্র ছিলেন। ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন। কিন্তু আমার এক বছর কিংবা দুবছর আগে। অবশ্য সৈয়দ আলী আহসান আমার সহপাঠী। আমাদের সময়ে অনার্সে প্রথম শ্রেণী আমি একাই পেয়েছিলাম। ১৯৪৩-এ। কিন্তু এম.এ-তে আমরা প্রথম শ্রেণী লাভ করেছিলাম পাঁচজন। সে একটা রেকর্ড বিশেষ। এদের মধ্যে আমি ছাড়া ছিলেন আজিজুল হক (কিছুদিন আগে তিনি উপদেষ্টা তথা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন)। আজিজুল হক নানা ক্ষেত্রে তখন থেকেই খুব এ্যাকটিভ ছিলেন। খুব ভাল ডিবেট করতেন। তাছাড়া ছিলেন প্রণব গুহ। প্রণব গুহ পরে ভারতীয় ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন এবং আমাদের এখানে একবার ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবেও এসেছিলেন। প্রণব ছিলেন অধ্যাপক মন্মথ ঘোষের আত্মীয়। মন্মথ বাবু ছিলেন আমাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কৃতী অধ্যাপক। ইংরেজির কৃতী ছাত্রদের স্মরণ করে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এ.কে.এম আহসান সাহেবের কথাও বললেন। এ.কে.এম. আহসান আমার কিছুটা পরবর্তী–হয়ত এক বছর পরে এসেছিলেন ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু সেদিনও সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনাকে তার মধ্যে একটা তীব্র অতৃপ্তি আর জ্বালার আভাস থাকতো বলে আমার মনে পড়ে।

এই প্রসঙ্গে কবীর চৌধুরী সাহেব হঠাৎ তার একজন সহপাঠীর নাম এবং তাঁর অকাল মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বললেন : দেখ, হঠাৎ আমার রউফের কথা মনে পড়েছে। কত মেধাবী ছাত্র ছিলো সে। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হয়েছিলো। উত্তরবঙ্গে বোধ হয় বাড়ি ছিলো। যক্ষ্মাতে মারা গিয়েছিলো পরে, অকালে। কিন্তু ওর কথায় একটি ব্যাপার মনে পড়ে। বাংলা বিভাগে সম্ভবত উমা বলে একটি মেয়ে ছিলো। এই মেয়েটির সঙ্গে রউফের বেশ একটি প্রণয় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।

কথাটায় কিছুটা চমকিত হওয়ার ব্যাপার আছে। আজ আন্তঃসম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রীতি-প্রণয়ের কথা, এমন কি আন্তঃসম্প্রদায়িক পরিণয়ও আর কোনো চমক সৃষ্টি করে না, সমাজে কোন তরঙ্গ তোলে না। কিন্তু একদিন, এবং সেই ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে এমন ঘটনা যেমন বিরল, তেমনি সাংঘাতিকই ছিলো। সমাজের মধ্যে এমন সম্পর্কের উপলক্ষে মর্মান্তিক বিরোধেরও সৃষ্টি হয়েছে, মারাত্মক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রউফের সঙ্গে উমার সম্পর্ক তেমন কোনো বিসম্বাদের সৃষ্টি করেছিল বলে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মরণ করলেন না। বরঞ্চ সেই উমাকে স্মরণ করে বললেন : আজও রউফের প্রতি ওর আকর্ষণের প্রগাঢ়তা এবং সাহসের কথা মনে হলে আমার আনন্দ হয়। সেদিন হিন্দু-মুসলমান সব মেয়েরই বাইরে যাতায়াত ছিল সীমাবদ্ধ। মুসলমান মেয়েরা তো বদ্ধ ঘোড়ার গাড়িতে ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে পায়ে হেঁটে বা উন্মুক্ত গাড়িতে আসতেই পারত না। হিন্দু মেয়েদের সীমাবদ্ধতা অতখানি ছিলো না। কিন্তু উমা শাড়ি ছেড়ে সেলোয়ার-কামিজ আর বোরখা পরে মুসলমান মেয়ে সেজে রউফের সঙ্গে রমনার লেকের কাছে এসে যে আলাপ করার সাহস দেখাত, সে চিত্রটি আমি ভুলতে পারি নি।

কাহিনীটি আমারও ভালো লাগে।

তারপরেই কবীর চৌধুরী সাহেব বললেন : তবে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে সেইকালে সাম্প্রদায়িকতা তীব্রভাবে না থাকলেও একটা পোত্রবোধ যে ছিলো, সেটি আমি স্মরণ করতে পারি। এবং সেটি আজ বেশ কৌতুকজনক বোধ হয়।

আমি বললাম : এর কোনো ঘটনা আপনার স্মৃতিতে আসে?

কবীর চৌধুরী বললেন; সে এক মজার ঘটনা। আমাদের বিভাগের একটি খ্রিস্টান ছাত্রীর সঙ্গে আমার কিছুটা পরিচয় এবং আলাপ-বিনিময় ছিল। আর সেকালে এটিও ছিলো চোখে পড়ার বিষয়। এ নিয়েই চলত জল্পনা-কল্পনা। একদিন দেখলাম, সলিমুল্লাহ হলের সহপাঠী কিছু ছাত্র এসে আমাকে খুব তমিজ করে বললেন : কবীর সাহেব, আপনার একটা ব্যাপারে আমরা খুব উদ্বিগ্ন। (সেকালে সহপাঠী সহপাঠীকে আপনি করে বলত, বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে এই রেওয়াজটি ছিল)। আমি বললাম, কি ব্যাপার? তারা বললেন, এই যে আপনি আমাদের সমাজের বাইরের একটি মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করছেন, আপনার মত একটি মুসলমান ভালো ছাত্র, এটি ঠিক নয়।

ঘটনাটি বলে কবীর চৌধুরী বললেন, এতে তেমন কিছু ঘটে নি। তবে এই যে এঁরা বললেন, মুসলমান সমাজের আমি ভালো ছাত্র, অপর সমাজের কারুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে পারব না, এটিতে সেদিনকার মুসলিম ছাত্রদের একটি গোত্রবোধের প্রকাশ দেখা যায়।

ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি প্রসঙ্গে কবীর চৌধুরী সাহেব সেদিনের কথা স্মরণ করে বললেন, মুনীর তো ঢাকা এসেছিল আমার পরে। আমি যখন আসি তখন মুনীর আলীগড়ে পড়ে। তবে ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যে আমি সেদিন সাম্প্রদায়িকতার চাইতে মানবিক একটি বোধেরই প্রকাশ দেখতাম। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে এবং শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে যে চল্লিশের দশকে ক্রমান্বয়ে প্রবেশ করছিলো এবং নানা মহল থেকে প্রবেশ করানো হচ্ছিল, সে কথাও ঠিক। কিন্তু এখানে যেটি উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে এই যে, এমন অবস্থায়ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে এমন কিছু ছাত্র ছিলো যারা সাম্প্রদায়িক হওয়ার চাইতে বামপন্থী রাজনীতির দিকে অধিক আকর্ষিত হয়েছে। নিজের কথা বলতে গিয়ে কবীর চৌধুরী বললেন, আমি সেদিন রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে কোন সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। কিন্তু তবু সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সেদিনকার ঢাকার বামপন্থী গুণীদের মধ্যে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত (কবি), রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী–এঁরা যে ক্রমান্বয়ে আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছিলেন এবং আমরা যে তাদের দিকে এগুচ্ছিলাম, এ ভাবটি তো আমার আজো মনে জাগে। কারণ, ৪৭-এর পূর্ববর্তী সময়ে একদিকে কংগ্রেস, আর একদিকে মুসলিম লীগ : এর বাইরে প্রগতিশীল বামপন্থী চিন্তাসম্পন্ন একটা ধারা ছিলো।

তারপর আমাকে জিগ্যেস করলেন : তোমার মনে পড়ে, রায় সাহেব বাজারের সেই দালানটির কথা, যার তেতলাতেই বোধ হয় প্রগতি লেখক সঙ্রে অফিস ছিলো?

আমি বললাম, হ্যাঁ, সেই দালানটি এখনো আছে। যেখানে এখন একটা ওভারব্রিজ উঠেছে তার পূর্বপাড়ের গোড়াতে। এই গলিটির নাম জি. ঘোষের গলি। এবং এক সময়ে এই গলির মুখের প্রথম তেতলা বাড়িটির দোতলাতে ছিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্রে অফিস। পরে এর নিচের তলায় প্রগতিশীল বইপত্রের একটি দোকানও খোলা হয়েছিলো।

কবীর চৌধুরী বললেন, আমি খুব বেশি হয়ত যাতায়াত করি নি সেদিন প্রগতি লেখক সঙ্রে সেই অফিসে। তবু আমার যোগ নিশ্চয়ই কিছুটা ছিল। তাই সেদিনের কথা মনে হতে আজ এই কবি-সাহিত্যিকদের কথা মনে ভেসে উঠছে।

কবীর চৌধুরী এম.এ পাস করে (৪৫ সালে সরকারি চাকরি গ্রহণ। করেছিলেন। খাদ্য বিভাগে। মুসলিম ছাত্রদের ওপর বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রী ভাবনার ক্রমপ্রসারের উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বললেন, আমি তখন রাজবাড়িতে সরকারি চাকরি করি। রাজবাড়ির একটা ঘটনা কিন্তু এখনো মনে পড়ে।

আমি বললাম : কি ঘটনা, বলুন।

কবীর চৌধুরী বললেন, আমার মনে আছে, রেল শ্রমিকদের সংগঠক ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু এসেছেন রাজবাড়িতে রেল শ্রমিকদের এক সম্মেলনে। জ্যোতি বসু তখনি কলকাতার প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা। রাজবাড়িতে তিনি বক্তৃতা করবেন শ্রমিকদের সম্মেলনে। আমার মত চাকরিজীবীর সেই সম্মেলনের কাছে যাওয়া সেদিন খুব নিরাপদ ব্যাপার ছিলো না। আমার মনে যেমন শঙ্কা ছিলো, তেমনি আকর্ষণও ছিলো। আমার এখনো কৌতুকের সঙ্গে মনে পড়ে যে, সেই আকর্ষণ এবং আশঙ্কা নিয়ে আমি রাত্রির অন্ধকারে আমার এক বন্ধুকে সাথে করে গায়ে-মাথায় কাপড় জড়িয়ে প্রায় আত্মগোপনের ভাব নিয়ে সেদিন জ্যোতি বসুর বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম।

***

‘চল্লিশের দশকের ঢাকা’ নামের লেখাটি প্রসঙ্গে সংবাদ-এর বিদগ্ধ পাঠকজনদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পাওয়া গেছে। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সহপাঠী জনাব বোরহানউদ্দিন আহমদ ইতোমধ্যে সংবাদ-এ তাঁর ছাত্রজীবনের কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। জনাব সিরাজুল ইসলামের একটি চিঠিও প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহীর নওগাঁ থেকে জনাব আতাউল হক সিদ্দিকী অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তার সহপাঠী কৃতী ছাত্র আবদুর রউফ এবং তার সঙ্গে এক হিন্দু সম্প্রদায়ের ছাত্রীর যে প্রণয়-প্রীতির কথা উল্লেখ করেছিলেন তার সূত্র ধরে একটি দীর্ঘ রচনা সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পদককে পাঠিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও তিনি এ সম্পর্কে জানিয়েছেন। তাঁর এই লেখাটিতে তিনি উল্লিখিত তরুণ ছাত্র আবদুর রউফের শিক্ষাগত জীবন এবং তার সঙ্গে এক হিন্দু তরুণীর প্রণয়ের বিষয়টিকে বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। জনাব আতাউল হক সিদ্দিকী অকাল প্রয়াত রউফের ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে এ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে তিনি তাঁর রচনাটি তৈরি করেছেন। জনাব সিদ্দিকী বলেছেন, রউফের বাড়িও ছিল নওগাঁতে।

তিনি রউফের ছাত্রজীবনের কৃতিত্বের অধিকতর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন : ১৯৩৮ সালে ঢাকা সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে রউফ ঢাকা বোর্ডের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন এবং বাংলাতেও তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পার্বতীচরণ মেডাল নামে সাধারণ মেধার স্বর্ণপদকের অতিরিক্ত আর একটি স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন এবং তখনকার দিনে শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাদপদ বাংলার মুসলমান সমাজের মধ্য থেকে রউফের মত একজন মুসলিম ছাত্রের ঐ রকম কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের একটা আলাদা গৌরব ছিল–জনাব সিদ্দিকীর এ মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ এবং যথার্থ। পত্ৰলেখকের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী অর্ধশতাব্দী পূর্বের সেই ঢাকার সমাজে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং সংঘাতের পরিবেশে দুই সম্প্রদায়ের দুই তরুণ-তরুণী রউফ এবং উমার প্রণয়, পরিণয়ের প্রস্তাব অবধি নাকি পৌঁছেছিলো। কিন্তু পুরুসিতে আক্রান্ত রউফের আকস্মিক প্রয়াণে তাদের সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হতে পারে নি। ছাত্রীটির প্রকৃত নাম নাকি ছিল জয়ন্তী মজুমদার। ডাকনাম ছিলো উমা। এই বিষাদময় কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করেছেন পত্ৰলেখক জনাব সিদ্দিকী। সেকালের আবহাওয়াতে এই প্রণয় কাহিনীটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু তার বিস্তারিত বিবরণের তেমন প্রয়োজন হয়ত আজ নেই।

কলেজ নয় তো রাজপ্রাসাদ

কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জবানবন্দিতে যদি চল্লিশের দশকের ঢাকার কিছু স্মৃতিচারণ করতে হয় তাহলে আমাকে তো প্রথমে ঢাকাতে আসতে হয়।

আমি নিজে ঢাকা এসেছিলাম চল্লিশের দশকের ঠিক শুরুতেই। ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করার অব্যবহিত পরেই।

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট সরকারি কলেজে আই.এ.- তে ভর্তি হয়ে গেলাম। কত সহজে, একবাক্যে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন ব্যাপারটা এমনিই ছিলো। যারা ভর্তি হতে চাইত, যারা আগের পরীক্ষা পাস করে এসেছে তাদের জন্য ভর্তি হওয়া কোন সমস্যা ছিলো না। আজ সেদিনের কথা শায়েস্তা খাঁর আমলের চাল-ডালের মতোই শোনায়। চাল-ডালের কথা তুলছিনে। কিন্তু লেখাপড়ার ব্যাপারে সেদিনটি শায়েস্তা খাঁর আমলের ব্যাপারই ছিল। স্কুল কলেজই ভর্তির জন্য ছাত্র খুঁজে বেড়াত। কোনো স্কুল বা কলেজ কত ভালো, তার প্রসপেকটাস বার করতো।

ঢাকা শহরে তখন প্রধান কলেজ ছিলো ঢাকা কলেজ আর জগন্নাথ কলেজ। আরো কলেজ ছিলো। কিন্তু এ দুটিই পুরানো এবং পরিচিত।

ঢাকা কলেজে আই.এ.-তে আমার বিষয় ছিলো ইংরেজি, বাংলা এবং তার সাথে ইতিহাস, মানে পৃথিবীর ইতিহাস, লজিক এবং সিভিকস ও ইকনমিকস।

ঢাকা কলেজ কথাটি মনে করতেই আমার চোখে ভেসে ওঠে প্রাসাদের মত সেই দালানটি, যেটি ১৯০৫ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের পরে পূর্ববঙ্গ এবং আসাম নিয়ে গঠিত প্রদেশের লাট সাহেবের ভবন হিসেবে তৈরি হয়েছিলো। অনেকটা কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর প্যাটার্নে তৈরি। সাদা ঝকঝকে বাড়ি। উঠতে রাজকীয় সিঁড়ি। মার্বেল পাথরের। তারপরে দোতলায় যাবার সিঁড়ি। ফটো নেওয়ার মতো। উপরে উঠে বাঁদিকে কাঠের মেঝে, বিরাট হলঘর। পরে শুনেছি এটি নাকি সাহেবদের বলরুম বা নাচঘর ছিলো। মোট কথা কোনো ঘরই ছাত্রদের ক্লাস করার জন্য তৈরি নয়। তাই জীবনকালের ভাগ্য যে এমন দালানে ঢোকার অধিকার পেল বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রামের এক ছাওয়াল। দিনকালই বদলে যাচ্ছিল। তা না হলে, এমন হয়? প্রাসাদের মধ্যে কৃষকের সন্তানের প্রবেশ ঘটে?

রাস্তার একদিকে এই দালান। বর্তমানে পুরানো হাইকোর্ট নামে পরিচিত। আর একদিকে কার্জন হল। মাঝখানের এই রাস্তাটি সেদিন থেকেই আছে। এর তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। তা না হলে সেদিনের ঢাকা আর অপরিবর্তিত নেই। এমন কি শহরের মধ্যকার দোলাইখালও আজ রাস্তা হয়ে গেছে এবং ঢাকার রেলস্টেশন বলতেই যে ফুলবাড়িয়াকে বোঝাত সে এখন এই ’৮৩ সালে ঢাকা থেকে যাতায়াতকারী বাসের প্রধান কেন্দ্র। রেল লাইন আর বিদ্যমান নেই। পুরানো সেই রেললাইনকেই তেজগাঁ থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত রাস্তা করা হয়েছে।

পরিবর্তিত ঢাকায় হাঁটতে কিংবা রিকশা করে যাতায়াতেও ঢাকাকে যেমন অপরিচিত তেমনি নিজেকে বিদেশি বলে বোধ হয়।

১৯৪০ সালেও নিজেকে ঢাকাতে বিদেশি বলে মনে হয়েছিলো। বিদেশি কিশোর হিসেবেই সেদিন শান্ত ঠাণ্ডা রমনার নাম না জানা এ-রাস্তা, ও-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করেছি সলিমুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিং অর্থাৎ বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ঢাকা কলেজ আর কার্জন হলের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা পূর্বদিকে গিয়ে কোথায় যে মোড় নিয়েছিলো, কোন মাঠে বা বাগানে তা আর এখন স্মরণ করতে পারছিনে। অথচ মন চায় পুরনো দিনে ফিরে যেতে, পুরানো রাস্তায় হাঁটতে। পুরানো বাড়ি আজ বিধ্বস্ত, পুরানো মাঠ আজ সরকারি- বেসরকারি বাড়িতে রূপান্তরিত। এমন অবস্থায় পুরানো জীবনকে স্মরণ করার উপায় কি? তাই অসহায় বোধ। করি পুরানো জীবনকে স্মরণ করার চেষ্টায়। ঢাকার সেই ৪০-এর দশকের কোনো পুরানো মানচিত্র আছে কিনা আমার জানা নেই। না থাকাই সম্ভব। থাকলে সেখানে রাস্তাঘাটের নাম দেখেও হয়তো পুরানো কথা কিছু স্মরণ করতে পারতাম। বস্তুর সঙ্গে স্মৃতি জড়িত থাকে, ঘটনার, এমন কি ভাব ভাবনারও। সেই বস্তুর বাস্তব পরিবর্তনে পুরানো ঘটনাকে স্মরণে আনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ঢাকায় এসে প্রথম রাতটি কাটিয়েছিলাম নওয়াব মনজিলের ন্যায় গঠিত বিরাট সলিমুল্লাহ হলে। এ কথাটি স্মরণ হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক যে ছাত্রটির হাতে জিম্বা করে দিয়েছিলেন আমাকে আমার অভিভাবক বড় ভাই, সে ছাত্রটিই আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। সেকালে যেমন তার বাইরের সৌকর্য ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তেমনি ভেতরের বাগানটিও ছিল ছবির মতো সাজানো, মনোহারী। তার চারপাশে কোথাও এমন মনোহর গম্বুজওয়ালা দালান আর ছিলো না। এখান থেকে জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে এগিয়ে কার্জন হল অবধি এলেই মাত্র আমাদের ঢাকা কলেজের সাদা গম্বুজওয়ালা বাড়ির সাক্ষাৎ মিলতো।

আজো এই দালানের পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে মনে ইচ্ছা জাগে একবার ভেতরে যাই, দেখি আমাদের সেই ক্লাস রুমগুলো এখন কেমন আছে। কিন্তু এমন ইচ্ছা পূরণ করার উপায় নেই। এ ভবন এখন নিষিদ্ধ এবং সংরক্ষিত এলাকা। সরকারের কোনো গোপন বিভাগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে দালানটিকে জাতীয় জাদুঘর হিসেবে বিবেচনা করে তাকে যেমন আবিকৃত রাখার চেষ্টা করার আবশ্যক, তেমনি তাকে আজকের যুগের শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, প্রবীণ-প্রবীণার দর্শনের জন্য প্রবেশযোগ্য করাও আবশ্যক। এই ভবনের বিভিন্ন ঘরেই পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের বিকাশ ও বিবর্তনের নানা উপাদান সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হওয়া উচিত। নতুন যাদুঘর ভবন বিশাল বটে, কিন্তু পুরানো এই ভবনটির মত ইতিহাসের সাক্ষাৎ সাক্ষ্য সে এখনো হয়ে ওঠে নি।

ঢাকা কলেজের কথা বলতে কেবল কলেজ ভবনই যে মনের মধ্যে ভেসে উঠছে, তা নয়। এখানে কলেজের আর একটি ভবনের কথাও বলতে হয়। সেটি ঢাকা কলেজের ছাত্রদের থাকার ভবন। ভবনটি কার্জন হলের দক্ষিণ-পূর্বে লাল ইটের ভবন। এটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মূল ভবন বলে পরিচিত। এর মূল কাঠামোটি এখনো অপরিবর্তিত। কিন্তু দোতলার সঙ্গে আর একটি তলা যুক্ত করা হয়েছে। সামনের মাঠেও নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। তবে বৃহৎ আকারের পুকুরটি এবং তারই দুই পাড়ের বড় বাধানো ঘাট এখনো আছে। এই পুকুরের পশ্চিম পাড়ে সেকালে ছিলো ঢাকা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস। থাকতো প্রধানত হিন্দু সমাজেরই ছাত্রবৃন্দ। এখন সে ছাত্রাবাসের নাম দেওয়া হয়েছে শহীদুল্লাহ হল : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল।

কাজেই যেটি এখন ফজলুল হক হল, সে ভবনটি আসলে ঢাকা কলেজেরই ছাত্রাবাস। এই ভবনটির সঙ্গে আমার ছাত্রজীবন, বলা চলে ৪০ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়, এম. এ. পর্যন্ত জড়িত ছিলো। কারণ দ্বিতীয় মহাদ্ধের কালে ঢাকা কলেজের ভবনটি যেমন তখন ব্রিটিশ ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনের সৈনিকদের একটা হাসপাতালে পর্যবসিত হয়েছিলো, ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসও অন্যত্র অপসারিত হয়েছিলো। যুদ্ধের সময়ে ইউনিভার্সিটির মূল আর্টস বিল্ডিং-এর একাংশও সামরিক হাসপাতালে পরিণত হয়েছিলো এবং তখনি বোধ হয় এই ভবনের দোতলাতে অবস্থিত ফজলুল হক হলকে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাস তথা বর্তমান ফজলুল হক হল ভবনে নিয়ে আসা হয়।

কিন্তু ভবনসমূহের এমন প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনার দক্ষ লোক আমি নই। তবু ভবনের মধ্যকার মানুষজন, তার ভাবনাচিন্তার কথা বলতে গেলে ভবনের কথাই আগে আসে।

একটা কথা বলা ভাল। সেদিন এটাকে তেমন বেমানান মনে হয় নি। কিন্তু আজ কথাটা ভাবতে গিয়ে একটু বিস্ময় বোধ হচ্ছে। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের হোস্টেলের কথা বলেছি। কিন্তু ছাত্রীদের সন্ধান কি? আসলে এখনো ঢাকা কলেজ বোধ হয় কেবল মাত্র ছাত্রদেরই কলেজ, যদিও শিক্ষক বা অধ্যাপকরা কেবল অধ্যাপকই নন, অধ্যাপিকাও বটে। কিন্তু সেদিনও ঢাকা কলেজে কোনো ছাত্রী পাড়তো না। জগন্নাথ কলেজেও নয়। ছাত্রীদের ইডেন কলেজ শহরের এ মাথাতেই ছিলো না। ছিল ওয়াইজঘাট নামে সদরঘাটের কাছে যে এলাকা আছে সেখানে। মোট কথা মেয়েদের সঙ্গে সেই ইন্টারমিডিয়েট স্টেজেও আমাদের কোনো যোগাযোগই ছিলো না।

প্রবীণ অগ্রজ সাহিত্যিক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষদের স্মৃতিচারণে দেখছি যে, তাঁরা অনেকে ঢাকা কলেজে পড়েছেন এবং ঢাকা কলেজে প্রখ্যাত সাহিত্যিক কাজি আবদুল ওদুদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তাঁর সাহিত্য আলোচনা শুনেছেন। কিন্তু আমার সে সৌভাগ্য হয় নি। হয়ত কাজি আবদুল ওদুদ ৪০-এর পূর্বেই ঢাকা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ বা অপর কোথাও বদলি হয়ে গিয়েছিলেন।

’৪০ থেকে ’৪২ সালের কলেজজীবনে আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে প্রয়াত ডক্টর মমতাজউদ্দিন আহমদের নাম। তিনি তখন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। তাছাড়া আমার নিজের শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজির জালালউদ্দিন আহমদ, পি.কে.রায় (সঠিক মনে করতে পারছিনে নামটি), ইতিহাসের পূর্ণেন্দু চক্রবর্তী। (আহা! কি নিরীহ কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষক। শুনেছি পরবর্তীকালে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন)। সিভিকস ও ইকনমিকস-এর অধ্যাপক জনাব শফিকুর রহমান, লজিকের জনাব ফজলুর রহমান-এঁরা ছিলেন। শফিকুর রহমান সাহেব এবং ফজলুর রহমান সাহেব এখনো জীবিত আছেন। এবং উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক কার্যাদির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছেন। এটি আনন্দের কথা। জালালউদ্দিন সাহেব খুব রসিক মেজাজের মানুষ ছিলেন। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে সেদিনও আমরা ছেলেরা নানা রস-রসিকতা করতাম। তাকে অনুকরণ করে কথা বলতাম। জালাল সাহেব পরবর্তীকালে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি এখন প্রয়াত।

দুবছরের সেই কিশোরকালের কলেজ জীবনে বড় রকমের কোনো ঘটনা স্মৃতিতে নেই। যে একটির কথা স্মরণে আছে তা একটু বিস্তারিতভাবে পরে বলব। কিন্তু তার চেয়ে হালকা ধরনের নিজের যে আচরণের কথা মনে পড়ছে তারই একটু উল্লেখ এখানে করা যায়। বিজ্ঞানে সেদিন কারা ছাত্র ছিলেন, তা আজ জানিনে। কারণ আমি ছিলাম আই.এ. তথা কলা শাখার ছাত্র। কলা এবং বিজ্ঞান, এ দুটিই প্রধান শাখা ছিলো। বাণিজ্য শাখা তখনও চালু হয়েছে কিনা স্মরণ নেই। কলা শাখায়, বিশেষ করে আমার ক্লাসে সহপাঠী হিসেবে আমি পেয়েছিলাম সৈয়দ আলী আশরাফকে। সৈয়দ আলী আশরাফ সৈয়দ আলী আহসানের অনুজ। সৈয়দ আলী আশরাফ ছিলেন যেমন মেধাবী তেমনি সিরিয়াস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এইচ.এল.দের ছেলে অজিত দেও আমার সহপাঠি ছিলো। আমার সহপাঠী ছিলেন কামালউদ্দিনও। ইনি পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স এবং এম.এ পড়েছেন এবং এখন ব্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। নাসিরউদ্দিনও আমার তখনকার বন্ধু; নাসিরউদ্দিন আহমদ। ডাক বিভাগ এবং যোগাযোগ বিভাগের উচ্চতর দায়িত্ব পালন করে হয়ত এতদিনে অবসর নিয়েছেন। নাসিরের ছোট ভাই ছিলো গিয়াসউদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের তরুণ অধ্যাপক, ৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়ে নিজের সতেজ স্বাদেশিক জীবনবোধের অপরাজেয়তাকে প্রমাণ করে গেছেন। তাদের পরিবারেও যেমন, আমিও তেমনি গিয়াসকে তার কিশোরকালে ডাকতাম বাচ্চু বলে। নাসিরের বাবা ১৯৪১-৪২-এ চাঁদপুর মহকুমার প্রধান ছিলেন। জনাব আবদুল গফুর। উদার হৃদয়ের মানুষ। নাসির নিয়ে গিয়েছিলো আমাকে। তাদের সেই বাসায়। আর সেখানেই কিশোর বাচ্চুকে পেয়েছিলাম আমার অনুরাগী স্নেহভাজন হিসেবে। ৪২-এর কথা বলতে এমনিভাবে ৭১-এর শহীদ বাচ্চুও স্মৃতির পাতায় স্মৃতি হিসেবে জ্বলে ওঠে। আমার আর একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আবদুল মতিন। এককালে সাংবাদিক ছিলেন। এখন বিলেত প্রবাসী। ইনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু হোস্টেলে আমার সঙ্গী ছিলেন। হোস্টেলে সঙ্গী ছিলেন কামালও। তাছাড়া ইতিহাসের আর একজন মেধাবী ছাত্রের নাম আজ স্মরণ হচ্ছে। ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন মোজাহেরউদ্দিন আহমদ। মেধাবী এবং ব্যতিক্রমী জীবনবোধ আর আচরণের এক তরুণ ছাত্র ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে ইতিহাসে এম.এ পাস করেছেন। আইন শাস্ত্রেও কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি নিয়েছেন। মুন্সেফ থেকে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা এবং অধ্যক্ষ করেছেন। কিন্তু সংসার বা চাকরি, কোথাও যেন কোনো স্থিতি পান নি তিনি। এবং মানাতে পারেন নি পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে। সে পরিবেশে তিনি এককালে যেমন সাম্প্রদায়িক মনোভাবের তীব্রতা দেখেছেন, তেমনি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিধাবাদ এবং দুর্নীতি তার আপসহীন মনকে বিচলিত করেছে। তিনি অকালে মারা গেছেন। বন্ধুবর আবুল কাসেম ছিলেন দরাজমন, মেজাজ এবং চিন্তার কিশোর। কূপমণ্ডুকতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতেন সেই তাঁর কলেজের ছাত্রজীবন থেকে এবং কারুর মধ্যে এমন সঙ্গীর্ণতার পরিচয় পেলে তাকে স্পষ্ট ভাষায় সমালোচনা করতে কাসেম ছিলেন দ্বিধাহীন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটিও বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। সরকারি কলেজে ভুগোলের অধ্যাপনা করেছেন। ইংরেজি সাহিত্যেও ডিগ্রি নিয়েছেন। এখনো তিনি তাঁর সেদিনকার সরস মেজাজ এবং ভঙ্গি নিয়ে বেঁচে আছেন।

কলেজের মধ্যে রাজনৈতিক হৈ-হাঙ্গামা সেকালে তেমন ঘটে নি। তখনো রমনা শান্ত। ৪০, ৪১, ৪২-বিশেষ করে যুদ্ধ বাধার পূর্ব পর্যন্ত সেকালের কিশোর ছাত্রদের জীবন তরঙ্গবিহীন অলস-আনন্দঘন অধ্যয়নের জীবন। শিক্ষকরা ক্লাস করতেন রীতিমত। বরঞ্চ সেই রীতিমত ক্লাসের মধ্যে দুএক সময়ে ক্লাস না করাতেই মন আনন্দ পেতো। (এখন রীতি হচ্ছে ক্লাস না হওয়ার। ক্লাস হওয়াটাই রীতির ব্যতিক্রম।) ক্লাসে আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে নির্দোষ দুষ্টামিতে আনন্দ পেতাম। জালাল সাহেবের বেপরোয়া ঢাকাইয়া উচ্চারণের ইংরেজি বক্তৃতাতে আমরা বেশ আমোদ বোধ করতাম। শফিকুর রহমান সাহেব সিভিকস্ আর ইকনমিকস্ পড়াতেন। নিরীহ এবং সিরিয়াস অধ্যাপক। হয়ত ছাত্রদের সঙ্গে রস-রসিকতার যোগাযোগ কম ছিল। আর তাই তাঁর কোনো ভঙ্গি নিয়ে ছাত্ররা তাঁকে জ্বালাতন করার চেষ্টা করতো। তাঁর আলোচনা রীতিকে আমরা একটা রঙ্গ করে প্রকাশ করে নিজেদের মধ্যে তিনি ক্লাসে আসার আগে বলতাম: চ্যাপম্যান ওপাইনস, সেলিগম্যান কনকুডস এ্যান্ড শফিকুর রহমান জয়েনস: এটা সেকালের দুষ্টু কিশোর আমাদের মস্তিষ্কের সৃষ্টি। শফিকুর রহমান সাহেব হয়ত তার বক্তৃতায় অথরিটির উদ্ধৃতি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করতেন। তার প্রতি তার ছাত্রদের সরস সমালোচনা। কিন্তু এমন সমালোচনা তার কানে কখনো গেছে বলে আমি মনে করিনে।

মমতাজউদ্দিন সাহেব নিজে দর্শন শাস্ত্রের বিলেত-ফেরত অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক কলেজে দর্শন পড়াবার তো কোন জায়গা ছিলো না। লজিকের ক্লাস নিয়েছেন, এমনও মনে পড়ে না। কিন্তু ইংরেজির ক্লাস নেওয়াটাই বোধ হয় অধ্যক্ষকে অধিক মানায়। তাই তিনি আমাদের দুএকটা ইংরেজি ক্লাস নিয়েছিলেন। তার একটা ক্লাসে তিনি এসথেটিক ব্যাপারটির সংজ্ঞাদানের চেষ্টা করে তাঁর নিজস্ব কিছুটা তোতলানো ভঙ্গিতে এবং বিশিষ্ট উচ্চারণে যে বিব্রত হয়ে উঠছিলেন, সেটি আজ ৪৩ বছর পরেও মনে ভেসে উঠছে। ইউ আনডারস্ট্যান্ড, এসথেটিকস্ মিনস্ সে উচ্চারণটি কানে বাজলেও তাকে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেদিনকার তাঁর বিব্রতকর অবস্থায় দুষ্ট ছাত্র হিসেবে আমোদ বোধ করলেও আজ তাঁর জন্য মমতাবোধ হচ্ছে। মমতাজউদ্দিন সাহেবই পরবর্তীকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন ও বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন মমতাজউদ্দিন কলাভবন বলে অভিহিত হচ্ছে।

কিন্তু তিনি বেশ স্নেহপরায়ণ ছিলেন। কলেজের পেছনে মাঠের মধ্যে একতলা বাড়িটিতে প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে তাঁর বাস ছিলো। আমরা সেবার হোস্টেলে কি নিয়ে যেন হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছিলাম। তখন রেডিওর যুগের। সবে সূচনা। হয়ত আমাদের দাবি ছিলো হোস্টেলের কমনরুমে একটি রেডিও কেনো বসানো হচ্ছে না। কিংবা হয়ত অভিযোগ ছিলো ডাইনিংহলের ডাল এত পাতলা হয় কেন? আমরা ঘোষণা করে দিলাম আমরা আর ভাত খাবো না। দুপুর গড়িয়ে যায়, আমরা ভাই খাইনে। অবশ্য নিজের নিজের ঘরে বসে কেক, বিস্কুট খেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় নি। আমাদের ক্ষোভ বোধ হয় বেশি ছিলো হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট আঁদরেল মানুষ ওয়ালীউল্লাহ। সাহেবের বিরুদ্ধে। ওয়ালীউল্লাহ সাহেব অবশ্য মুসলমান ছাত্রদের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। হিন্দু-মুসলমান ছাত্ররা আমরা একই দালানে থাকতাম। পশ্চিম দিকের ভাগটা বোধ হয় হিন্দু ছেলেদের ছিলো। পূর্বদিকের ভাগটা মুসলমান ছেলেদের। তিনটা দালান। একটার সঙ্গে আর একটা যোগ করা। উত্তরের অর্ধেক বোধ হয় হিন্দু ছেলেদের। অর্ধেক মুসলমান ছেলেদের। এরও আগে হয়ত হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি ছিলো। ৪০-এর দিকে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। সে যা হোক, হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের দুটো ভিন্ন হোস্টেল ছিলো, এমন আমার মনে পড়ে না। হিন্দু ছাত্রদের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন বোধ হয় বিজ্ঞানের অধ্যাপক নির্মল সেন। আমাদের একজন এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তাঁর নাম জনাব কফিলউদ্দিন। ওয়ালীউল্লাহ সাহেব এবং কফিলউদ্দিন সাহেব–এঁরা দুজনেই আজ প্রয়াত! যে হাঙ্গার স্ট্রাইকের কথা বলছিলাম তার স্মৃতিতে দেখছি, মমতাজউদ্দিন সাহেব যখন শুনলেন আমরা বেলা দুটো পর্যন্ত খাচ্ছিনে, তখনি তিনি ছুটে এলেন আমাদের রাগ ভাঙাতে। নিজে ছেলেদের পিঠে হাত দিয়ে আদর করে ডাইনিং হলে নিয়ে গেলেন এবং নিজে তাদের সঙ্গে বসে খেলেন এবং ভরসা দিলেন, ডাইনিং হলের খাওয়ার তিনি উন্নতির ব্যবস্থা করবেন।

শিবরাত্রির ফুল সিরিয়াল

 ’৪০-৪২ সালের কথা। ঢাকা কলেজের ক্লাসের স্মৃতি যতো না মনে পড়ে তার চেয়ে বেশি মনে পড়ে হোস্টেলের। সহপাঠী নূরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন অন্ত রঙ্গ বন্ধু। আর ছিলেন লুৎফুল করিম। এরা কজন কেবল যে কলেজের সহপাঠী ছিলেন তাই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য বিষয়ের বিভিন্নতা হলেও এঁদের অনেককেই আমি একই ভবনে, অর্থাৎ ঢাকা কলেজের হোস্টেল ভবন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্রাবাস ফজলুল হক হলে রূপান্তরিত হলো, তখন হলের সঙ্গী হিসেবেও পেয়েছিলাম। নূরুল ইসলাম চৌধুরী সম্প্রতি বাংলাদেশের ফরেন সারভিস থেকে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণ করেছেন। প্রয়াত অধ্যাপক এ কে নাজমুল করিমের কনিষ্ঠ ভাই লুৎফুল করিমও সরকারের প্রশাসন বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু সেই ’৪১-৪২ সালের ইন্টারমিডিয়েট হোস্টেলের স্মৃতির মধ্যে আর যে ঘটনাটি ভাসছে সেটিকে কিছুটা রাজনৈতিক ঘটনা বলা চলে। এই ঘটনাটির উৎসও বোধ হয় হোস্টেলের জাঁদরেল সুপারিনটেনডেন্ট ওয়ালীউল্লাহ সাহেব। সাংঘাতিক কড়া মানুষ ছিলেন। হোস্টেলে নিয়ম করেছিলেন, রাত নটা বাজতেই লোহার সদর গেট বন্ধ করে দিবেন। এরপরে কেউ বাইরে থেকে এলে তাকে গেট বইতে নাম লিখতে হবে এবং তার এমন বিলম্বের জন্য পরের দিন সুপারিনটেনডেন্টের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। রাত দশটার পরে। হোস্টেলের মেইন সুইচ অফ করে দেবার হুকুম দিতেন। দশটার পরে সবাইকে ঘুমাতে হবে। সিনেমা যাওয়া বারণ ছিল। অথচ এমন সমস্ত নিয়ম নিষেধ আমরা মান্য করার চাইতে ভঙ্গই হয়ত বেশি করতাম। বিলম্বে ফিরলে গেটের খাতায় নাম লেখার বদলে গেটের উঁচু শিক বেয়ে তা টপকে ভেতরে ঢোকার পন্থাই ছেলেরা অধিক গ্রহণ করতো। একবার ব্যাপারটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিলো।

সে রাতটা ছিল শিবরাত্রি। হিন্দু পর্বের দিন। এমন পর্বে ঢাকায় তখন যে কয়টি সিনেমা ঘর ছিলো তাদের মধ্যে বিশিষ্টরা বিশেষ আকর্ষণীয় ছবির প্রদর্শনী করতো। এই শিবরাত্রির তারিখেও ঢাকার অন্যতম সিনেমা হল মুকুলে (এর বর্তমান নাম আজাদ, ঢাকা কোর্টের বিপরীতে) এই রাতে তিন তিনটা পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখবার আকর্ষণ ছিলো। এমন আকর্ষণে আকৃষ্ট না হওয়া কঠিন ব্যাপার। ভক্ত, অনুরক্ত ইত্যাদি মিলে আমার প্রায় একটি দল বা উপদলের মতো গড়ে উঠেছিলো। এরা একজোটে হাঁটতো, চলতো, গল্প করতো। এদের নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয় হতো সাহিত্য বা কোনো উল্লেখযোগ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ঘটনা। নিজেদের ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করার জন্য হাতে লেখা ম্যাগাজিনও আমরা সেদিন তৈরি করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম : পাগলা ঝোরা। এ নামের কি অর্থ, তা আমি আজো জানিনে। হয়ত বা উৎফুল্ল নিৰ্ব্বর। এই দলের প্রায় স্বনির্বাচিত নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আর সেজন্যই বোধ হয় আমার নামের প্রধান দুই অংশকে বাদ দিয়ে বন্ধুরা নামের অপ্রধান অংশকে প্রধান করে সরদার বলে আমাকে সম্বোধন করতো। শিবরাত্রির ফুল সিরিয়ালে যাবার গোপন ব্যবস্থার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। সন্ধ্যার পরেই ডাইনিংহল থেকে খেয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা রওনা দিলাম রমনা হোস্টেল থেকে মুকুল বাবর। ভরসা ছিল, ছবি দেখতে দেখতে তো ভোর হয়ে যাবে। তখন ফিরে এলে গেট খোলাই পাওয়া যাবে এবং ওয়ালীউল্লাহ সাহেব টেরও পাবেন না। তিন তিনটে। ছবি। একটির বোধ হয় নাম ছিলো দেশের মাটি। আর দুটির নাম মনে নেই। তবে ঠিকই, সারারাত্রি ছবি দেখেছিলাম। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছবি মানে প্রত্যেকটার দৈর্ঘ্য কমসে কম আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। ছবি যখন শেষ হলো তখন ভোর হয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু সারারাত ধরে এমন অদ্ভুত আনন্দ ভোগের নেশায় ছসাতজনের সেই দলের সকলেরই চোখ রাঙা আর টুলটুলু, মাথার চুল বেপাট, উস্কখুস্ক। কারুর মুখেই তেমন কোনো কথা নেই। আধ বোজা চোখে নির্জন ঠাণ্ডা রাস্তা দিয়ে মুকুল থেকে সারাটা পথ হেঁটে এলাম। মনে কোনো ভয় ছিলো না। ভেবেছিলাম, এত সকালে ওয়ালীউল্লাহ সাহেব জানতেও পারবেন না। কিন্তু প্রবাদে যা আছে বাস্তবে তা সত্য বৈ মিথ্যা হয় না। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত্রি হয়। আমাদেরও তাই হলো। হোস্টেলের কাছে প্রায় এসে গেছি। এখনো রাস্তার পাশের গেটে পৌঁছি নি। হঠাৎ শুনলাম হাঁক এলো : এই তোমরা সবাই কোত্থেকে এলে, এত ভোরে? ঐ হাঁকের চোটে আমাদের সকলের তন্দ্রা টুটে গেল। চোখের পাতা পুরো খুলতেই দেখি সামনেই ব্যাঘ্র স্বয়ং, সুপারিনটেণডেন্ট ওয়ালীউল্লাহ সাহেব। কিন্তু যেটা মারাত্মক হয়েছিলো, সে হচ্ছে এই দলের মধ্যে জবাবদানকারী একজনের সত্যবাদিতা। সে মুখে আর কোনো জবাব না পেয়ে অক্লেশে বলে ফেলল : স্যার, সিনেমায় গেছিলাম।

বিস্ময় আর আতঙ্কভরা প্রশ্ন এলো আবার : সিনেমায়? সারারাত? ডিড ইউ টেক পারমিশন?

জবাব এলো : স্যার সরদার বলেছে, পারমিশন পাওয়া গেছে …

কিন্তু সত্যি কি সরদার বলেছিলো, পারমিশন পাওয়া গেছে? সরদারের একথা সেদিনও মনে পড়ে নি, আজো মনে পড়ছে না। তাই বলে, তা নিয়ে বাদপ্রতিবাদের প্রশ্ন ওঠে না। যে বিপদ এসেছে, তার আশঙ্কা তো ছিলই।

: সি ইন মাই অফিস, আমার অফিসে সবাই দেখা করো।…

যা হোক, বিস্তারিত সংলাপ উল্লেখ করে লাভ নেই। ওয়ালীউল্লাহ সাহেব শোকজ করলেন আমাদের সবাইকেই; শোকজ কেন তোমাদের স্টাইপেন্ড কেটে দেওয়া হবে না এবং লুফুল করিমকে (এবং আরো একজনকে বোধ হয়) হোস্টেল থেকে বহিস্কৃত করা হবে না? লুৎফুল করিম ছিলো নাজমুল করিমের ছোট ভাই। নাজমুল করিম ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়েন। আমরা ঢাকা ইন্টার হোসেটল থেকে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে গিয়ে গল্প করি। তারও একটি ভক্ত এবং গুণমুগ্ধ সহপাঠীর দল ছিলো। লুঙ্কুল করিমের ওপর খড়গহস্ত হওয়ার কারণ বোধ হয় ওর ত্যাড়াবাকা জওয়াব। লুৎফুল করিম সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবকে হয়ত তেমন মান্য করতো না এবং এই অপরাধের ব্যাপারে তাকে কিছু একটা বলে থাকবে।

এবং এই বহিষ্কারের আদেশ থেকেই ব্যাপারটা কিছুটা রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়াল। আমরা যুক্ত হয়ে পড়লাম আমাদের কলেজের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়, এমন কি বৃহত্তরভাবে দেশের মধ্যে প্রবাহিত রাজনৈতিক ধারা-উপধারার সঙ্গে। ১৯৪০-এর পরবর্তীকাল। যুদ্ধ বেধে গেছে ইউরোপে। সে যুদ্ধ ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে বিশ্বের চারদিকে। ৪২-এর গোড়াতে এশিয়াতে যুদ্ধ চলছে। জাপান এগুচ্ছে চীনের দিকে এবং বর্মার দিকে। ভারতবর্ষে প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠছে। প্রধান ধারার বাইরে মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ জিন্নাহ সাহেবের নেতৃত্বে দাবি তুলেছে পাকিস্তানের। ৪০-এর মার্চে লাহোরে পাশ হয়েছে পাকিস্তান প্রস্তাব। মুসলিম সমাজের ছাত্রদের মধ্যেও পাকিস্তান আন্দোলন সাড়া জাগাচ্ছে। মুসলিম ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান এই আন্দোলন সমর্থন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান ছাত্রগণ বোধ হয় এই প্রথম দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক মঞ্চের ঘটনা-দুর্ঘটনা, দাবি প্রতি-দাবির প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে। তারা আন্দোলিত হচ্ছে তার দ্বারা।

বঙ্গদেশ এবং তার রাজধানী কলকাতায় তখন এই রাজনীতিই নানা জটিলতা লাভ করছে। বঙ্গদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। তিনি এতদিন মুসলিমদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে তার বিরোধিতা ঘটেছে। তিনি মুসলিম লীগের বাইরের শক্তি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে সঙ্গী করে কলকাতায় আইন পরিষদে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এই মন্ত্রিসভাকেই মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এবং অনুসারীগণ নিন্দাসূচকভাবে হক-শ্যামা বা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা বলে অভিহিত করছে। এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ঢাকার নওয়াব হাবিবুল্লাহ। পুরাতন ঢাকা তথা ঢাকার স্থানীয় মুসলিম সমাজের ওপর নওয়াব পরিবারের তখনো বিপুল প্রভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্ররা প্রধানত ঢাকার বাইরে থেকে আগত। তাদের বাস ছাত্রাবাসগুলোতে। মোট কথা বৃহত্তর ক্ষেত্রে যেমন, ঢাকাতেও তেমনি হক সাহেবের মন্ত্রিসভার পক্ষের, বিপক্ষের একটি রাজনৈতিক শক্তি সংগঠিত হয়ে ওঠে।

ঢাকা কলেজের হোস্টেলে আমাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত করলেন তারা তখন জরুরিভাবে আবেদন করল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হক সাহেবের কাছে। হয়ত এটা তাদের কৌশলগত একটা ব্যাপার ছিলো। তারা বলল, যেহেতু তারা হকপন্থী সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে এরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। হক সাহেব। নাকি কলেজ কর্তৃপক্ষকে এই দণ্ড অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আমাদের হোস্টেলের ব্যাপারটি সাংঘাতিক কিছু অবশ্যই ছিলো না। কিন্তু ক্রমান্বয়ে যে আমরা যুক্ত হয়ে পড়ছিলাম বৃহত্তর রাজনৈতিক ধারা-প্রতিধারার সঙ্গে, সেটি উল্লেখ করা আবশ্যক।

এমনি সময়ে শোনা গেল হক মন্ত্রিসভার নেতৃবর্গ ঢাকা আসবেন আগামী অত তারিখে। ঢাকায় এপক্ষ, ওপক্ষের যেন সাজসাজ রব পড়ে গেল। মুসলমান ছাত্রদের প্রধান অংশ হক সাহেবের বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, মুসলিম লীগ হক সাহেবের বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং তখন পাকিস্তান আন্দোলনই মুসলমান সমাজের প্রধান আন্দোলন। মুসলিম ছাত্ররা সংগঠিত হলো, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে হক সাহেবের মন্ত্রিসভার নেতারা যখন নামবেন তখন তাঁদের বিরুদ্ধে কালো পতাকা প্রদর্শন করে তাদের বিরোধিতা করা হবে। শহরের মহল্লা সরদারগণ নওয়াববাড়ির নেতৃত্বে সংগঠিত হলো ঢাকা রেলস্টেশনে হক মন্ত্রিসভার সদস্যদের সংবর্ধনা জানাবার জন্য। খুব সম্ভব এই সদস্যদের মধ্যে নওয়াব হাবিবুল্লাহ মাত্র সেদিন কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। আর কেউ নয়। তবু সেদিন স্টেশনে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়েছিলো।

ঘটনার আগে থেকে ঢাকা কলেজের আমাদের হোস্টেলেও এই সংবর্ধনা প্রতি-সংবর্ধনার ঢেউ এসে লাগছিলো। একদিন দেখলাম হঠাৎ কয়েকটি ছাত্র এসে আমাদের কয়েকজনকে বলল, আগামী অত তারিখে স্টেশনে যেতে হবে হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রদর্শনে। তারা এমনটি করেছিলো আমাদের হকপন্থী ভেবেই। একথা ঠিক যে, দেশের রাজনীতির ব্যাপারটা আমরা তত বুঝতাম না। এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেদিন আমরা হক মন্ত্রিসভার সমর্থক কিংবা বিরোধী হিসেবে দাঁড়াই নি। কিন্তু হোস্টেলের মধ্যে আমাদের নিয়ে ইতোপূর্বে যে ব্যাপার ঘটেছিলো তাতে হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার আমাদের উপায় ছিলো না। আমরা বললাম: প্রতিবাদে যাবো, কি যাবো না, সে আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের ব্যাপার। একথায় আমাদের হোস্টেলের প্রতিপক্ষ দল রুষ্ট হলো।

তাদের এই রোষের প্রকাশ ঐ মুহূর্তে না ঘটলেও ঘটলো সংবর্ধনা প্রতি সংবর্ধনার সন্ধ্যায়। কারণ ঐ দিন সলিমুল্লাহ এবং ফজলুল হক হলের হক বিরোধী যে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাতে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে গিয়েছিলো তারা তাদের চাইতে দলে ভারি হক-নওয়াবের সমর্থনকারী মহল্লার লোকদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলো। তাদের কালো পতাকা প্রদর্শন তত কার্যকর হয় নি। স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। এবং এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাল তারা ঐ সন্ধ্যায় ফজলুল হক হল এবং সলিমুল্লাহ হলের যেসব ছাত্রকে তারা হক সমর্থক বলে মনে করল তাদের বিছানাপত্র ওলটপালট এবং ফেলে দেয়ার মাধ্যমে। ফজলুল হক হলে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো নাজমুল করিম। তার বিছানাপত্র তাঁর প্রতিপক্ষীয়রা ওপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলো। এই আক্রমণ আমাদের হোস্টেলেও বিস্তারিত হলো।

কয়েক মাস পরেই আমার আই.এ. ফাইনাল পরীক্ষা। এমন সময়ে হোস্টেলের আবহাওয়া এই সব ঘটনায় পড়াশুনার জন্য প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াল। আমি অবশেষে হোস্টেল ত্যাগ করে আমার বড় ভাই সাহেবের বাসায় চলে যাই। তিনি তখন বরিশাল জেলার নলছিটিতে সাবরেজিস্টার হিসেবে চাকরিরত। সেখানে তার বাসায় বসে পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমার বড় ভাই হোস্টেলের ঘটনার বিবরণ শুনে আমার ওপর খুব সন্তুষ্ট হলেন না। তাঁর মন্তব্য হলো : তোমরা হচ্ছ কওমের দুশমন। তোমরা হুমায়ুন কবীরের মতোই ক্ষতিকারণ শক্তি। বড় ভাই আমার মুরুব্বি। তাঁর সামনে মুখ তুলে কখনো কথা বলিনে। সেদিনও কিছু বলি নি। কিন্তু একটু মজা লাগছিল, তিনি যে আমাকে হুমায়ুন কবীরের নামের সঙ্গে যুক্ত করে আঘাত করছেন, তাই দেখে। কারণ হুমায়ুন কবীরকে আমি ততটা খারাপ কিছু মনে করতাম না। সাংঘাতিক বিদ্বান বলে যেমন তিনি পরিচিত ছিলেন, তেমনি তাকে জাতীয়তাবাদী বলে আমি প্রশংসা করতাম।

লাস্টবেঞ্চের আমি

সে যাহোক, মাস দুই পরে পরীক্ষা দিতে যখন ঢাকায় নিজের হোস্টেলে ফিরে এলাম তখন দেখলাম হোস্টেলের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেছে। এমন কি যারা সেদিন সক্রিয়ভাবে আমার বিরুদ্ধতা করেছিলো তাদের মধ্যেও কোনো কোনো সহপাঠী এসে বলল: সেদিন উত্তেজনার মধ্যে তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। তুমি সেটা মনে রেখো না।

শান্ত পরিস্থিতিতেই পরীক্ষা শেষ হলো। সে পরীক্ষা ছিলো ঢাকা বোর্ডের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। ঢাকা বোর্ড তখন ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঢাকা শহরের বাইরের সমগ্র বঙ্গের সব স্কুল-কলেজই ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে।

আমার পরীক্ষার সিট পড়েছিলো জগন্নাথ কলেজে। কেন্দ্রের কথা মনে পড়লো এই কারণে যে, সেদিন আমি বোধ হয় লজিক পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। সেদিন দেখলাম আমি কিছু লেখার পর থেকেই একজন অধ্যাপক, যিনি পাহারা দিচ্ছিলেন হলে, আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার লেখা দেখতে লাগলেন। অল্পক্ষণ পরেই যদি তিনি চলে যেতেন তাহলে ঘটনাটি মনে দাগ কাটতো না। কিন্তু তিনি প্রায় সারা সময়টাই আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন বলে মনে পড়ছে। যেন আমি নকল-টকল করতে না পারি, তার বিরুদ্ধে পাহারা। ব্যাপারটাতে প্রথমে আমি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের লেখায় মগ্ন হয়ে গেলাম। তখন বাংলা বাদে সব বিষয়ের প্রশ্নের জবাবই আমারা ইংরেজিতে দিতাম। যে-অধ্যাপক আমাকে সারাক্ষণ পাহারা দিলেন তিনি যে আমার জবাবদানের দ্রুততায় এবং জবাবের মানে বেশ সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন তাই যেন বুঝিয়ে গেলেন একেবারে শেষ ঘণ্টা পড়ার সময়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে।

পরীক্ষা দিয়ে আবার চলে এলাম বড় ভাইয়ের কাছে। বড় ভাই জিগ্যেস করলেন : কেমন হবে তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট। জিজ্ঞাসার মধ্যেও একটু খোঁচা ছিলো। ভাবটা এমন যে, পড়ার চাইতে অপড়ার কাজেই তো জুটে গেছ। কাজেই কি আর ফল করবে। আমি ছোট কথায় বললাম। পাস নিশ্চয় করব।

তিনি বললেন : আর কিছু নয়?

আমি বললাম : পরীক্ষায় পাস করা ছাড়া আর কি করা যায়?

যা হোক, ছোট-বড়র এমন সংলাপ আর বেশি এগোয় নি।

কিন্তু আমার জবাবে কোনো ক্ষোভ ছিলো না। আসলেই পরীক্ষার ফলাফলে আমার কোনো চিন্তা ছিলো না। একে তো ম্যাট্রিকে স্কুলে দেখেছিলাম মোজাম্মেলকে, যে পরীক্ষায় ভাল ফল করাকেই খারাপ মনে করতো। (মোজাম্মেলের একালের পরিচয় অনেকে জানেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক, এককালের রাজনৈতিক দল আর.এস.পির নেতৃস্থানীয় কর্মী এবং ১৯৬৫ সালে কায়রোতে পিআইএ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত। মোজাম্মেল হক আমার স্কুল সহপাঠী এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু)। তাছাড়া একবার যখন ম্যাট্রিকের অঙ্কের বাধা পার হতে পেরেছি কোনো প্রকারে, টায়ে টায়ে, তখন বই পড়াতে আমায় আর আটকায় কে? আর বই পড়ার মত সোজা কাজ আর কি আছে? অন্তত বই পড়া যে তামাক সাজাবার চাইতে সোজা, সে কথাটা আমি জীবনের পাঁচ ছবছর বয়সেই বুঝেছিলাম, বাবা যখন বাড়িতে মেহমান কেউ এলে ডাক দিয়ে বলতেন, করিম তামাক নিয়ে আয়। আর তখন সে হুকুমে হুঁকা জোগাড় করতে হতো, হুঁকার কল্কেতে তামাকের দলা পুরতে হতো এবং সেই তামাকে উনুন থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার তুলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে হুঁকার মাথায় বসিয়ে মজলিশে নিয়ে হাজির করতে হতো। সে এক কঠিন পরীক্ষা। সে কঠিন পরীক্ষায় বিনা বকাবকুনিতে পাস খুব কমই করেছি। তখনি বুঝেছিলাম এর চাইতে কত সহজ কোরানের বাণীর সুললিত কাব্যিক অনুবাদ পড়া, আর তা পড়ে মা, বোন, চাচা, চাচীকে শোনানো। কত আকর্ষণীয় হাসান-হোসেনের করুণ কাহিনী পড়া, বিষাদ-সিন্ধু থেকে। আহা ইমাম হোসেনের জীবনের শেষ মুহূর্তটি কি করুণ, কি নিদারুণ। সীমার ইমাম হোসেনে বক্ষে চাপিয়া বসিয়াছে। সে হোসেনের কণ্ঠে খঞ্জর চালাইতেছে। কিন্তু খঞ্জর হোসেনের কণ্ঠ ভেদ করিতেছে না। ইমাম হোসেন বলিলেন: ভাই সীমার এ জায়গায় তুমি কিছু করিতে পারিবে না। এ জায়গায় হযরত মুহম্মদ মোস্তফা, আমার নানাজান আমাকে চুম্বন করিয়াছিলেন। আর ফোরাত নদীর তীরে এক ফোঁটা পানি না পেয়ে ইমাম হোসেনের পরিবার-পরিজন বিশেষ করে শিশুদের কি করুণ মৃত্যু। পড়তে পড়তে সত্যি গলা ধরে আসত, চোখে পানি জমত। বাড়ির চাচা, চাচী, বড় ভাই, এরা কেবল ডেকে ডেকে আদর করে বলতেন : করিম তুইতো সুন্দর পড়িস। পড়তো আবার সেই জায়গাটি।

তাই পরীক্ষার ভয় নয়, পড়ার আনন্দই আমাকে আনন্দিত করতো। এই পরীক্ষা পাসের সুযোগেই যখন গ্রামের কৃষক পরিবারের একটি ছেলে আমার পক্ষে ঢাকা কলেজের প্রাসাদ আর হোস্টেলের পাকা ভবনকে নিজের বাড়িতে পরিণত করা সম্ভব হলো তখন আমার চেতন-অবচেতনে আর আনন্দের সীমা রইল না। কলেজ আর হোস্টেল এবং তার শিক্ষকবৃন্দ, সহপাঠী বন্ধুরা হোস্টেলের ওয়ালীউল্লাহ সাহেব, এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট কফিল উদ্দিন সাহেব এঁরা হয়ে দাঁড়ালেন আমার এই বৃহত্তর এবং নতুন পরিবারের আত্মীয়বর্গ। ক্লাস এইট কিংবা নাইন থেকে হোস্টেল জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমি তাই কোনদিনই কলেজ আর হোস্টেল জীবনকে বৈরী বলে ভাবতে পারি নি। এত যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঢাকার বুকে বয়ে গেল, কোনোদিন তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে কোথাও যেতে মন চায় নি। ঢাকার মধ্যে থেকেই ঢাকাকে উপভোগ করার একটি বোধ ছিল মনে।

কয়েক মাস পরে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো। তার খবর পেলাম বড় ভাইয়ের চাকরিস্থানের বাসায় বসে। ঢাকা থেকে আমি তখন দূরে। নিরুদ্বিগ্ন আমার নামে বড় ভাইয়ের কেয়ার অবে হঠাৎ একদিন একটি টেলিগ্রাম এলো ঢাকা থেকে। পাঠিয়েছেন ইউনিভার্সিটির অনার্স ক্লাসের ছাত্র নাজমুল করিম। তাঁর সঙ্গে ইতোমধ্যে সম্পর্কটি আমার অগ্রজ-অনুজের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। টেলিগ্রামে তিনি আমার পরীক্ষার ফল জানিয়েছেন। বুঝলাম আমার পরীক্ষার ফলের ব্যাপারে আমার চাইতে তাঁরই আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিলো অধিক। সে টেলিগ্রামের মর্ম আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ছিলো: কেবল আমার বড় ভাইয়ের জন্য নয়। আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ছিলো খোদ আমার জন্যও। টেলিগ্রাম করেছেন নাজমুল করিম : ইউ হ্যাভ স্টুড সেকেন্ড ইন দি বোর্ড। হারটি কনগ্রেচুলেশনস: তুমি বোর্ডে সেকেন্ড হয়েছ। আমার অভিনন্দনও নিও। নাজমুল করিম কোনোদিন আমাকে তুমি বলে ডাকেন নি। বলেছেন, আপনি। অথচ আমি তার বয়োকনিষ্ঠ এবং অনুজপ্রতিম। কিন্তু সেকালে সহপাঠীও সহপাঠীকে খুব ঘনিষ্ঠ না হলে আপনি বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু আপনি বললেও আমার জন্য নাজমুল করিমের স্নেহ ছিলো অপার। তিনি আজ অকালে প্রয়াত। সেদিনের এই স্মৃতিতে স্বাভাবিকভাবে আমার মনে একটি আবেগের সৃষ্টি হচ্ছে।

টেলিগ্রাম পেয়ে বড় ভাইয়ের আনন্দ আর ধরে না। তিনি অমনি তাঁর পাড়া-প্রতিবেশীকে খবর দিলেন, যেন আমি মস্ত একটা কাজ করেছি। বিকেলে মসজিদে মিলাদেরও আয়োজন করলেন।

তার কয়েকদিন পরে ঢাকায় পাঠাবার সময়ে হুকুম দিলেন : ইংরেজিতে কিন্তু অনার্স নিবে।

এ হুকুম তিনি করতে পারেন। কি আশ্চর্য অক্লেশে ইংরেজি লিখতে পারেন তিনি। নিজে অনার্স পড়তে পারেন নি। বরিশালের বি.এম কলেজ থেকে বি.এ পাস করে এম.এ পড়তে এসেছিলেন ইংরেজিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, ১৯২৭ সালে। কিন্তু সাংসারিক দৈন্যের কারণে একটি চাকরির সুযোগ পেলে সেই পড়া আর শেষ করতে পারেন নি। অথচ পুরোনো সকল শিক্ষক আর সহপাঠীদের কাছেই তার প্রশংসা শুনেছিঃ আহ! মৌজে আলী! খুব ভালো ছেলে ছিলো সে। তাই বড় ভাইয়ের হুকুম ছিলো ইংরেজিতে অনার্স নিতে। আমি প্রথমে ইংরেজিতেই অনার্স নিয়েছিলাম। পরে তাকে বাদ দিয়ে দর্শন। কিন্তু সে কাহিনী পরে বলা যাবে। পরীক্ষায় ভাল ফল করলে ব্যাপারটা যে কেবল ব্যক্তিগত এবং পরিবারগত নয়, সেটা ব্যক্তি এবং পরিবারকে ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠান, এমনকি বৃহত্তরভাবে সম্প্রদায়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে, কিংবা সেদিন সেরূপ দাঁড়াতে সেটা বুঝলাম, এই মহাকাণ্ড সেকেণ্ড হওয়ার ব্যাপারটির প্রতিক্রিয়া দেখে, ঢাকা ফিরে এসে। কলেজে যেতে ইংরেজি অধ্যাপক পি.কে রায় গর্বের সঙ্গে হাত ধরে অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন অধ্যক্ষ এবং অপর অধ্যাপকদের : দেখুন, আমিই একে হদিস করেছিলাম। আমি জানতাম ও ভাল করবে। ও আমাদের কলেজের নাম রেখেছে। কথাটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখলে কিছুটা সত্য বটে। সেকালে লেখাপড়া আর পরীক্ষাতে সত্যেন ভদ্রের অধ্যক্ষতায় জগন্নাথ কলেজই ছিল প্রধান। পরীক্ষায় জগন্নাথ কলেজই ফাস্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতো। কিন্তু ৪২ সালের পরীক্ষায় ঢাকা কলেজ কলা শাখায় সেকেন্ড পেপাস্ট দখল করেছে, এটা কি কম কথা। এ প্রায় ফুটবলের কম্পিটিশনের ব্যাপার : কলেজে কলেজে। কলেজের দল জিতলো তো কলেজের নাম। ব্যাপারটাতে আমার বেশ মজাই লাগছিলো। কিছুটা অজাতশত্রুরই ব্যাপার ছিলো একটু। সবাই খুশি হলো। এমন কি আশরাফও, সৈয়দ আলী আশরাফ। আসলে অধিক ভালো ছাত্র আশরাফ আর অজিত দে-ই ছিলো। আশরাফ ইংরেজিতে কত দক্ষ। পারিবারিক পরিবেশও উচ্চশিক্ষা আর সাহিত্যের। সৈয়দ আলী আহসানের অনুজ। অজিত দেও ইতিহাসে কত ভালো নম্বর পেত ক্লাসে আর কলেজের পরীক্ষায়। ওরা ক্লাসে বসত ফাস্ট বেঞ্চে। একেবারে অধ্যাপকের চোখের সামনে। আর আমি বসতাম পেছনে, অধ্যাপকদের চোখ এড়িয়ে, যেখানে বসে পাশের বন্ধুর সঙ্গে একটু খুনসুটি করতে পারি আর স্যারকে দুএকটা বেয়াড়া প্রশ্ন করতে পারি। (এটা বুঝতে পারছি, এ সমস্ত গোপন কথা এই বয়সে, বিশেষ করে মাস্টারি করার অবস্থায়, নিজের ছেলেমেয়ে আর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে প্রকাশ করা বুদ্ধির কাজ নয়। তবু কথার টানে কথা আসছে, স্মৃতির টানে স্মৃতি। বাস্তব বিবেচনাবোধ আর থাকছে কোথায়?)। সবচেয়ে খুশি হলো দেখলাম লাস্ট বেঞ্চের হাসিখুশি মেজাজের সুঠামদেহী কামালউদ্দিন। ওরই বেশি টান ছিলো আমার উপর। ওর ডাক নাম ছিলো। ঠাণ্ডা। ওই-ই অনেক সময়ে কিছুটা সামনের বেঞ্চ থেকে টেনে আমাকে একেবারে পেছনের বেঞ্চে নিয়ে যেতো। আপনি সম্বোধন করতো না। তুমিও না। করত তুই বলে। বলত: তোর জায়গা সামনে নয়। সামনে। বসবে গুড বয়েজরা। তুই বসবি আমাদের কাছে আর দেখে দিবি আমাদের খাতা। তুই পড়া নিবি আমাদের। ব্যাপারটা প্রায় তাই ছিলো। কামাল, ওরা যে লেখাপড়ায় খারাপ ছিলো তা নয়। ওরা সমগ্র জীবনটাকে অধিকতর স্বাভাবিকভাবে নিতো। আমি যখনি পারতাম আন্তরিকভাবে ওদের সাহায্য করতাম। বিশেষ করে সেই কামালউদ্দিনের চেহারা আর কথা এত বছর পরেও মনে ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে একটা বেদনাবোধের সঙ্গে। কামালউদ্দিন নাকি মারা গেছেন। একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি তখন আমার পরবর্তী জীবনে, এক পর্যায়ের রাজবন্দিত্ব শেষ করে বেরিয়েছি, পাকিস্ত নি আমলে। ঘটনাচক্রে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হয়েছি, ১৯৫৫ সালে। এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন পথে দেখা কামালউদ্দিনের সঙ্গে। দেখা মাত্র একেবারে জোর করে রিকশায় উঠিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে মার কাছে হাজির করে বলল: দেখ মা, কাকে নিয়ে এসেছি। আমার কলেজের বন্ধু, সরদার…..। কামালের বাবা তখন মারা গেছেন। কিন্তু সেদিন অমনি করে ধরে নিয়ে মার কাছে হাজির করে যে পরিচয় আমার সে দিয়েছিলো এবং মা স্নেহযত্নে যেভাবে আপ্যায়িত করেছিলেন এবং তাতে কামালউদ্দিনের আন্ত রিকতার যে প্রকাশটি ঘটেছিলো, তাতে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।

কেবল কলেজের নয়, নাজমুল করিম, দেখলাম, তার দলের একটি ছেলের এমন ভাল ফলকে তার প্রতিপক্ষীয়দের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত করলেন। দেখ, আমার ছেলেরাই ভালো করে, তারা খারাপ করে না। হোস্টেলের এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট কফিলউদ্দিন সাহেব সত্যই আন্ত রিকভাবে আমাদের, অর্থাৎ কেবল আমার ফলে নয়, আমাদের দুষ্টু দলটির লুৎফুল করিম, আবুল কাসেম, মোজাহার–সকলের রেজাল্টেই খুশি হলেন। সুপারিনটেনডেন্ট ওয়ালীউল্লাহ সাহেব আমাদের ওপর একটু খাপ্লাই ছিলেন। আমাদের প্রতি তাঁর সব আচরণ কফিল উদ্দিন সাহেবের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো না। তাই আমাদের জন্য কফিল উদ্দিন সাহেবের যথার্থই একটি মানসিক সহানুভূতি ছিলো।

ঢাকা কলেজের স্মৃতির কথা এখানে শেষ করতে গিয়ে নিজের মনে কেবল একটি বোধই জাগছে। যে কলেজ একদিন আমার অপরিচিত এবং বিস্ময়ের জগৎ বলে বোধ হতো, সে কলেজ, তার হোস্টেল এবং পরিবেশ আর একদিন যথার্থই আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ঢাকাতে তখনো কলেজের পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে কলেজের সঙ্গে কোনো বিচ্ছেদবোধ জাগত না। কারণ ঢাকাতেই ইউনিভার্সিটি। আর আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে যে অনভিজাত তথা কমনারের হল অর্থাৎ ফজলুল হক হলে জায়গা নিলাম সে ফজলুল হক হলও আমার অপরিচিত ছিলো না। সে পরিচয়ের সূত্র ছিলেন নাজমুল করিম এবং তাঁর অপর সহপাঠীরা। এবং তার সহপাঠীদের অন্যতম ছিলেন রবি গুহ।

সিনেমা বিশারদ

এই স্মৃতিচারণের একটি জায়গায় সে যুগে সারারাত জেগে সিনেমা দেখার পাপের কথা যখন আজকের নিজের ছেলেপিলের কাছে একবার বলেই। ফেলেছি তখন সেকালে কত সিনেমা দেখেছি তার একটি লিস্টিই দিয়ে দিই। তালিকাটি পেলাম ছেঁড়াখোঁড়া প্রায় ৪৫ বছর পুরোনো একটি খাতার পৃষ্ঠায়। এ লিস্টি দেখে আমার নিজের তো এখন গর্বই হয়। আর কিছু না হোক, সেদিনকার একজন সিনেমা এক্সপার্ট বলে তো নিজেকে দাবি করতে পারি। কিন্তু তার চাইতেও মূল্যবান কথা, রক্ষিত এই লিস্টি থেকে বাংলা ছায়াছবির সেই কৈশোরকালের চিন্তা-ভাবনা, আকর্ষণ রুচির কিছু শিরোনাম একালের মানুষ পেতে পারে। সেজন্যই তালিকাটির এই উদ্ধৃতি। সেকালে যে দুএকটি ইংরেজি ছবি আসত তার নামও দেখছি খাতাটিতে মেলে। তাই তাও তুলে দেয়া হলো। সংখ্যাগতভাবে প্রায় সেঞ্চুরি। সংখ্যার ক্রম না দিয়ে কেবল শিরোনামগুলো দিচ্ছি; মুক্তি, চণ্ডিদাস, বিদ্যাপতি, দিদি, অভিনয়, টারজানকি বেটি, খনা, অভিজ্ঞান, অচ্ছুৎ কন্যা, রিক্তা, দেবদাস, গৃহদাহ, পুকার, সাপুড়ে, গোরা, পরপারে, পায়ের ধুলো, পথের শেষে, বড়দিদি, রজত জয়ন্তী, অধিকার, অভিনেত্রী, শুকতারা, জীবন-মরণ, দুশমন, যখের ধন, সাথী, পথভুলে, ঘরকি রানী, ডাক্তার, তরুণী, কলঙ্ক ভঞ্জন, মাদার ইন্ডিয়া, দি লায়ন হ্যাঁজ উইংস, লাইফ অব এমিল জোলা, দি ম্যান দে কুড নট হ্যাং, ক্রিমিন্যাল অব দি এয়ার, টাইফুন, শাপমুক্তি, দেশের মাটি, হাতেখড়ি, শর্মিষ্ঠা, দেবযানী, সোনার সংসার, রেবেকা, স্বামী-স্ত্রী, ভালবাসা ও মায়ামৃগ, শিবরাত্রি, পুনর্মিলন, পরিচয়, খাজাঞ্চী, বিজয়িনী, গ্রহের ফের, চাণক্য, অমরগীতি সার্জেন্ট ম্যাডেন, দি বিস্ট অব বারলিন, পথিক, ঠিকাদার, পরশমণি, রমা, কয়েদী, জেইলর, রাজকুমারের নির্বাসন, দি রেইনস কেইম, দি কোর্ট ড্যান্সার, রাজনৰ্তকী, মায়ের প্রাণ, উত্তরায়ন, আজাদ, পড়শী, প্রতিরোধ, অভয়ের বিয়ে, স্কুল ডেজ অব টম ব্রাউন, গ্রেট কম্যান্ডমেন্ট, কঙ্কণ, জীবন প্রভাত, দি বার্থ অব এ বেবী, নন্দিনী, বন্দী, শেষ উত্তর, দি ডিফিট অব দি জারমানস নিয়ার মস্কো, প্রিয় বান্ধবী, ভীষ্ম, বন্ধন।

এবার গুনে দেখুন! না! প্রায় ৪৫ বছর আগেকার জীবনের এদিক-ওদিকে দৃষ্টিক্ষেপকারী সেই কিশোর ছাত্রটিকে আমার খুব যে খারাপ লাগছে, এমন বলতে পারিনে। বরঞ্চ একটু মমতা জাগছে এবং কৃতজ্ঞতাও। অন্তত তার খাতায় সিনেমা দেখার ‘পাপের’ এই সাক্ষ্যটি তুলে রাখার জন্য।

সোমেনের হত্যাকাণ্ড এবং সেকালের এক কিশোর মনের প্রতিক্রিয়া

একালের প্রগতিশীল তরুণ সাহিত্যকর্মীদের কাছে সোমেনকে পরিচিত করার দায়বদ্ধতা থেকে আমি কিছু যে না লিখেছি, তা নয়। কিন্তু সেকালের কথা আমার স্মৃতিতে তত সজাগ নেই। সে এখন ঝাপসা হয়ে গেছে। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ, অসামান্য সম্ভাবনার আকর, রেলশ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, তরুণ লেখক সোমেন চন্দ একটি শ্রমিক মিছিল পরিচালনাকালে প্রতিপক্ষীয়দের দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। আমি তখন আই.এ পরীক্ষা পাস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটির দরজায় মাত্র পা রেখেছি। প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সাথে তখনো হয়ত হৃদ্যতা ততো তৈরি হয় নি। সোমেনের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনাই হয়তো চুম্বকের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীদের আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিলো প্রগতি লেখক সঙ্রে অনুষ্ঠানে, আলোচনায়, ক্রিয়াকর্মে। আমার ভাগ্য যে, আমিও সে আহ্বানের বাইরে সেদিন থাকতে পারি নি। কিন্তু ঘটনা হিসেবে তার কোনো স্মৃতিকে টেনে তুলতে পারছিনে। আকস্মিকভাবে দেখলাম, কলকাতা থেকে এ যুগে, ১৯৭৩ সালে দিলীপ মজুমদারের সম্পাদনায় দুটি খণ্ডে সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সমগ্র নামে যে সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়েছে তার একটির মধ্যে সেকালে সোমেনের গল্পসংগ্রহ সঙ্কেত-এর ওপর আমার একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। প্রবন্ধটির পুনর্মুদ্রণের ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন : প্রতিরোধ পত্রিকায় (১৩৫০ : ১৯৪৩ : সোমেন স্মৃতি সংখ্যা) সরদার ফজলুল করিম সঙ্কেত নামে যে প্রবন্ধটি রচনা করেন সেই প্রবন্ধেও সোমেনের সঙ্কেত ও অন্যান্য গল্প সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি এই কারণে উল্লেখযোগ্য, এতে একজন সমসাময়িক মুসলিম লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত। অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রেমিক কমিউনিস্ট সোমেনকে তাঁরাও চিনতে পেরেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন তাঁকে।

সেকালের একটি কিশোরের প্রতিক্রিয়ার স্মারক হিসেবে লেখাটির খানিকটা গুরুত্ব এখনো আছে বলেই সম্পাদক পুনর্মুদ্রিত করেছেন। লেখাটির সাহিত্যিক গুণাগুণের কথা নয়। সেই ইতিহাসের আভাস হিসেবে লেখাটিকে এখানেও প্রকাশ করা যায়।

১৯৪২ সালের মার্চ মাসে সোমেন চন্দ যখন নিহত হয়, আমাদের মুসলমান ছাত্র সমাজের বৃহত্তর অংশ তখন নিজেদের নেতৃবৃন্দের মান অপমানের পরিমাণ নির্ধারণ লইয়া ব্যস্ত। কোনো বিশিষ্ট নেতাকে পুষ্পমাল্য প্রদান বা অপর কাহাকেও কালো পতাকা প্রদর্শন, ইহাই ছিলো আমাদের রাজনীতির তখনকার বৈশিষ্ট্য। আমাদের সেই চেতনাহীন অবস্থাতে সোমেন চন্দের মৃত্যুকে আমরা হয়তো ঠিকভাবে দেখিতে পারি নাই। এমনি সময়ে শুনিয়াছিলাম সোমেনের মৃত্যুর কথা। ঢাকা শহরের চির পুরাতন দাঙ্গা ব্যতীত সেইদিন তাহাকে কিছু ভাবিতে পারি নাই। কিন্তু তথাপি সেই অবস্থাতেও পরিচিত-অপরিচিত কাহারো কাহারো মুখে সোমেন চন্দের মৃত্যুসংবাদের সাথে বক্ৰহাসি দেখিয়া সন্দেহ জাগিয়াছিলো।

তাহার পরে বাহিরের আলোবাতাসে আসিলাম-বক্ৰহাসি সেদিন কাহারা হাসিয়াছিলো, কেননা হাসিয়াছিলো পরিষ্কার বুঝিতে পারিলাম। সোমেনের কাহিনী তো পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন নহে। জীবনের কল্যাণের বিরোধী গুণ্ডার দল অনেক সোমেনকে হত্যা করিয়াছে–কিন্তু তাই বলিয়া জীবনের জয়কে ওরা রোধ করিতে পারে নাই। সেদিনও কাপুরুষ ফ্যাসিস্ত গুণ্ডার দল সোমেনকে হত্যা করিয়া সোমেনের জীবনের আদর্শকে নষ্ট করিতে পারে নাই। তাই আজ যদি দিনের আলোতে তাদের কারুকে দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে জোরগলায় বলিতাম : সোমেনের সঙ্কেতধ্বনি স্পষ্টতর হইয়া উঠিয়াছে–তোদের দিন শেষ হইয়াছে। দুঃখের বিষয়, দিনের আলোয় আজ আর উহারা বাহির হয় না–পৃথিবীর জনগণের অগ্রগতির প্রতিটি শক্তিতরঙ্গ ওদের বুকে শেল হানিয়াছে–চোরা গর্তে উহারা আত্মরক্ষার পথ খুঁজিয়াছে। তাই আজকাল নিশাচরের বেশে ওদের দুর্বল ছোবল ওদের বিলোপের আভাস দেয়।

সোমেন চন্দ যখন মারা যায় তখন তাহাকে চিনিতাম না–চিনিবার পর্যায়ে তখন ছিলাম না। সোমেনকে চিনিলাম তাহার সঙ্কেত ও অন্যান্য গল্প প্রকাশ হইবার পরে। বইখানা হাতে লইতে প্রথমে সঙ্কোচ ছিলো যথেষ্ট অবহেলাও সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের বাজার বাংলা গল্প উপন্যাসে ভরিয়া। গিয়াছে–এত বই! কত আর পড়া যায়? আর নিছক একই সুরের বিভিন্ন দুর্বল প্রকাশ। তাই সোমেনের সঙ্কেত হাতে আসার পরেও অনেকদিন যাবৎ অপঠিত হইয়া পড়িয়াছিলো।

তাহার পর সত্যই সঙ্কেত একদিন পড়িতে আরম্ভ করিলাম। রাত্রিশেষ সঙ্কেতের প্রথম গল্প। বৈঞ্চবদের আখড়ার কাহিনী। পড়িতে আরম্ভ করিয়া তেমন ভাল লাগিল না। পড়িতে পড়িতে কিছুদূর যাইতে একখানে টের পাইলাম, নিজের অজ্ঞাতে ভাল লাগিতে আরম্ভ করিয়াছে। সোমনে একস্থানে চাঁদিনী রাতের বর্ণনা করিতেছে। … আজ এতোক্ষণে মাত্র চাঁদ উঠিয়াছে। বনানী কথা বলিতে শুরু করিয়াছে। পায়ে হাঁটা সাদা পথ টুকরা জ্যোৎস্নায় মনোরম। সৌন্দর্য আহরণের নেশায় চোখ বুজিয়া আসে–পা ফেলা মন্থর-দেহ শিথিল… দেখিলাম আমার অবহেলায় ভাঙন ধরিয়াছে। মনে মনে ভাবিলাম কয়েকটি মাত্র লাইনে বেশ তো বর্ণনাটি দিয়াছে। পিছনের পাতা উল্টাইয়া সোমেনের জন্ম-মৃত্যুর তারিখটা দেখিতে ইচ্ছা হইলো। দেখিলাম জীবনের পরিধি মাত্র বাইশ বছর। চমক লাগিল। এ গল্প তাহা হইলে নিশ্চয়ই ষোল সতের বছর বয়সে লেখা। আহা, লেখাটার যদি তারিখ থাকিত। গল্পটা শেষ করিলাম। কাহিনীর তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নাই, কিন্তু সংযত হাতের প্রকাশ-ক্ষমতা যেভাবে গল্পটার শেষের দিকে এক জায়গায় সোমেন গাঢ় সন্ধ্যার নিস্তব্ধতার বর্ণনা দিয়াছে–… বাহিরে অন্ধকার আরো গাঢ়তায় চাপিয়া আসিয়াছে। একটানা ঝিঁঝিপোকার শব্দ। কিছুদূরে কামার বাড়ির লোহা কিবার আওয়াজ…চমৎকার লাগিল। লাইন তিনটি পড়িতে যাইয়া আমাদের গ্রামের বাড়ির বিশিষ্ট একটা জায়গার কথা মনে পড়িল, যেখানটায় দাঁড়াইয়া সন্ধ্যার সময়ে কামার বাড়ির লোহা ঠোকার শব্দ ঠিক শোনা যায়। তিন লাইনে সোমেন সব ছবিটা আঁকিয়া দিল! আজ আবার লাইন তিনটার পানে চাহিয়া সোমেনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, যে সম্ভাবনাকে গুণ্ডা পশুর দল বর্বরভাবে হত্যা করিল, সেই সম্ভাবনার ছবিকে স্পষ্ট দেখিতে পাই। দ্বিতীয় গল্প স্বপ্ন ও রাত্রি। শেষ এর সুরেই লেখা–কিন্তু এখানে গল্পটির মধ্যে উপমা শক্তির নতুনত্বের যেমন খবর পাইলাম, তেমনি তাহার দরকার মত কাহিনীর মধ্যে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টির অদ্ভুত হাতেরও স্পর্শ অনুভব করিলাম। এই গল্পে একখানে সোমেন রাত্রিকে বলিয়াছে সাপের দেহের মত পিচ্ছিল নিস্তব্ধ। এবার বইখানা দরদের সহিত জোর করিয়া ধরিলাম-সোমেন গতানুগতিক নয়, সোমেন নতুন পথের যাত্রী।

তাহার পরে একটি রাত। প্রায় এক নিশ্বাসে শেষ করিয়া কেবল খুঁজিতে লাগিলাম যদি গল্পটার রচনার তারিখটা পাইত পারি–যদি আগের দুইটা গল্পের সাথে এই গল্পের সময়ের ব্যবধানটা ও অবস্থা নিরূপণ করিতে পারি। সেদিন পারি নাই। আজো জানি না সোমেন রাত্রি শেষ ও স্বপ্ন কবে লিখিয়াছিলো–ইহার পরে তাহার মনে ভাবের বন্যা কিভাবে বহিয়াছিলো। সঠিক জানিতে পারি নাই। কিন্তু আভাস পাইয়াছি। শ্রীযুক্ত নির্মল ঘোষকে লিখিত সোমেনের যে কখানি চিঠিপত্র প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার একখানে ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে সোমেন এই বলিয়া লিখিল : গ্রামের অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর, এমন কী যা কেন্দ্র করে শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে অনেকেই কতগুলো Sweet উপন্যাস রচনা করেছেন, বৈষ্ণবদের সেই আখড়ার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত আমি। কিন্তু ওসব পুরানো হয়ে গেছে–এখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার। বছরখানেক আগে সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কোনোই পথ খুঁজে পেতাম না–এখন কতকটা পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। ১৮ বছর বয়সে সে এই চিঠি লিখিয়াছিলো। কাজেই এরও দুই এক বছর আগে হয়ত লিখিয়াছিলো স্বপ্ন ও রাত্রি শেষ। তাই আজ কেবল সোমেন সম্বন্ধে মনে হয়, জীবনের গতি কত সবল ও দ্রুত হইলে ঐ সময়ে এই বয়সে, এই দৃষ্টিভঙ্গি রূপ পাইতে পারে। … গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে সুকুমার। সাম্যবাদে বিশ্বাসী সে–তার কর্মীও। ঘরে শুধু বৃদ্ধা মা। ঘরের অভাব অভিযোগ কত স্পষ্ট–কিন্তু সুকুমারের কর্মে বাধা নাই–সুকুমারের কাছে কতো লোক যে আসে তার ইয়ত্তা নেই। সারাদিন ডাকাডাকি লেগেই আছে। সর্বদা যারা আসে তাদের মধ্যে গ্লাস ওয়ার্কসের সামসুর একজন…। বৃদ্ধা মা ছেলের কাজকর্ম দেখিয়া চোখের জল ফেলেন–কিন্তু ছেলের জন্য তৃপ্তি ও তাদের অনুভূতি তাহার মনকেও ভরিয়া তোলে। … এই সুকুমারের জীবন কাহিনী–বিশেষ করিয়া তাহার একটি রাতের কথা, যে রাত্রিতে পুলিশ আসিয়া সুকুমারের বাড়ি ঘেরাও করিল। তাই সোমেন শুধু নতুন পথের যাত্রীই ছিলো না–সে ছিলো নতুন দিনের অগ্রদূত–আমাদের দেশে তার প্রথম বীর সৈনিক। ইহার পরের গল্প তিনটি সঙ্কেত, দাঙ্গা, ইঁদুর।

‘এক রাত্রি’তে যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনের সাক্ষাৎ পাইলাম; শেষের এই গল্প তিনটি তাহারই উন্নততর ও পূর্ণতর প্রকাশরূপ হইয়া রহিয়াছে। সঙ্কেত ও দুর দুইটিই বড় গল্প। ইঁদুর সম্বন্ধে আজ আর কিছু বলিবার অপেক্ষা রাখে না। দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকবৃন্দ অসঙ্কোচে শিল্পের উচ্চাসন প্রদান করিয়াছেন। সোমেনের শক্তির প্রমাণের ইহার পরে আর প্রয়োজন হয় না। ইঁদুর ইংরেজিতে অনূদিত হইয়া আজ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্য ক্ষেত্রে আন্তঃপ্রাদেশিক গল্পে পরিণত হইয়াছে। ঢাকার সোমেন আজ শুধু বাংলার সোমেন নয়–সে আজ ভারতের সোমেন। ইঁদুর গল্পের প্রথম পাঠে। আমার মনে যে তৃপ্তির শিহরণ জাগিয়াছিলো, তাহাকে প্রকাশ করিয়া বলিবার ক্ষমতা আমার জন্মায় নাই। তাহার কতকগুলি জায়গা ভুলিতে পারি না–কেবল পড়িতে ভাল লাগে। গরিব মধ্যবিত্ত পরিবার। সোমেনের নায়ক গরিব মা-বাপের মধ্যে সন্ধ্যার পূর্বে মান-অভিমান হইয়াছিলো! গভীররাত্রে ইঁদুরের উৎপাতের মধ্যে তাহাদের মান ভাঙনের পালা আরম্ভ হইয়াছে। সোমেনের নায়ক এইখানকায় বলিতেছে: বাবা মাকে ডাকলেন নাম ধরে। ভারি চমৎকার মনে হলো–মনে মনে বাবাকে আমার বয়স ফিরিয়ে দিলাম–আর আমার প্রতি ভালবাসা কামনা করতে লাগলাম তার কাছ থেকে…। কিন্তু এই স্থানটি! সোমেনের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সংযত নায়কের মনের অবস্থার কি অভিনব প্রকাশ: মনে মনে বাবাকে আমার বয়স ফিরিয়ে দিলাম …। সোমেনও ছিলো গরিব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। মধ্যবিত্ত পরিবারের দুঃখময় কাহিনী সেই দুঃখের সংসারেও নব জীবনের যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হইতেছে, তাহার এমনি সরস মধুর সাহিত্যিক প্রকাশ আর কি কোথাও পাইয়াছি? তারপর সেইখানটা, সোমেনের নায়ক (এটি সোমেন নিজে?) রেল ইউনিয়ন হইতে ফিরিয়া আসিতেছে–মজুর, ইয়াসিন, সুরেন–সোমেনের আপন-জনের মধ্য হইতে সোমেনের নায়ক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিতেছে আমি ফিরে এলাম। সাম্যবাদের গর্ব–তার ইস্পাতের মতো আশা তার সোনার মতো ফসল বুকে করে আমি ফিরে এলাম…..।

সঙ্কেত গল্পটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করা প্রয়োজন। সঙ্কেত-এ সোমেনের সাহিত্যিক শক্তির কতখানি প্রকাশ হইয়াছে তাহাই একমাত্র বিচার্য নহে। কিন্তু সেদিক দিয়া বলিতে গেলেও গ্রামের অধিবাসী ও তাহাদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তাহার জ্ঞানের পরিচয় ও তাহার সাহিত্যিক প্রকাশ সঙ্কেতে আছে। কিন্তু সঙ্কেতের অপর যে দিকটা, সে আমাদের দেশের সর্বহারা মজুর ও কিষাণদের জাগরণের সঙ্কেতধ্বনির প্রকাশ। … কোন মিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট করিয়াছে। মিলের মালিক তাহাদের ধর্মঘট শক্তিহীন করিয়া দিবার জন্য দূর গ্রাম হইতে লোভ দেখাইয়া কৃষকদের লাইয়া আসিয়াছে। নতুন সংগৃহীত শ্রমিকগণ মিলের মধ্যে ঢুকিতে যাইতে কলের ধর্মঘটি মজুরগণের নেতা তাহাদের বুঝাইয়া বলিতেছে যে, যেন তাহারা তাহাদেরই ভাইদের মুখের ভাত কাড়িয়া না লয়-দুঃখ-দুর্দশা তাহাদের উভয়েরই সমান–উভয়ের উপরই শোষণ সমানভাবে চলিয়াছে–মিলের ম্যানেজার হতভম্ব হইয়াছে কি করিতে সে কি করিল? শ্রমিকের শক্তি সে আরো জোরালো করিয়া দিলো। সোমেনের সঙ্কেত, কৃষক মজুরের একতাবদ্ধতার যে সঙ্কেত আমরা আমাদের দেশে পাইতেছি তাহারই প্রকাশ।

দাঙ্গা সম্বন্ধে কোনো বিশেষণই বোধ হয় যোগ্য হইবে না। ঢাকা শহরের ১৯৪০-৪১ সালের দাঙ্গার সময়ে প্রায়ই ঢাকাতে ছিলাম। সোমেনের দাঙ্গা পড়িয়া শেষ করিয়া আবার সেই অবস্থা হুবহু মনে পড়িল-সেই আল্লাহু আকবার বন্দেমাতরম-এর মুহুর্মুহু ধ্বনি–বাড়িকে বাড়ি পোড়াইবার সেই অমানুষিক দৃশ্য। সোমেনের এই গল্প সেই সময়ে হয়তো কোথাও প্রকাশ হয় নাই–হয়তো এই বইতেই ইহার প্রথম প্রকাশ-নচেৎ দেশের সেই দুর্দিনে বাংলার সাহিত্যিক জগৎ ঢাকার অবস্থা সম্বন্ধে নিছক নিস্তব্ধ! প্রতিবাদের শব্দ কাহারো লেখনী হইতে তখন বাহির হয় নাই–কোনো সমাজেরই নানা হিন্দু, না মুসলমান। হয়তো একমাত্র সোমেনের হাত হইতে বাহির হইয়াছিলো সমবেদনা ও প্রতিবাদের এই তীবাণ। দাঙ্গার একটা স্থান-সোমেনের নায়ক অশোক দাঙ্গার বিরোধিতা করে, তাহাতে তাহার ছোট ভাই অজয় ক্ষেপা: অজু কর্কশ স্বরে বললে, তোমরা তো বলবেই–আবার মৃদু স্বরে-তোমরা হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়। নায়ক অশোক জবাব দিল: আমরা ইহুদির বাচ্চা নারে? তাহার পর আর একস্থানে–মাটির দিকে চেয়ে অশোক মনে মনে বললে, আগামী নূতন সভ্যতার যারা বীজ, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি যোগ দিয়েছি–তাদের সুখ-দুঃখ আমারও সুখ-দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানর সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সেজন্য আমার গর্বের সীমা নেই। আমি জানি আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে-প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মেলাবে। আমি আজ থেকে দ্বিগুণ কর্তব্যপরায়ণ হলাম–আমার কোনো ভয় নেই। পড়িয়া ভাবিলাম দেশকে, তাহার জনগণকে কতখানি দরদ দিয়া ভালবাসিলে লেখক এমনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সৈনিক হইতে পারে–তাহাদেরই জন্য শহীদ হইতে পারে। আর আমাদের দেশের যাহারা সাহিত্যের পবিত্র প্রাসাদে বসিয়া মনে করেন, দেশের জনগণের সমস্যা লইয়া সাহিত্য সৃষ্টি হয় না–দেশের সমস্যাকে সাহিত্যে রূপ দেওয়া মানে প্রোপাগান্ডা করা, তাহারা অন্ততপক্ষে সোমেনের দাঙ্গা পড়িয়া দেখিতে পারেন।

টর্লার ও রালফ ফক্সের জীবনী পড়িয়া সোমেন একদিন লিখিয়াছিলো : ফক্স সবচেয়ে গৌরবজনকভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে–কিন্তু যদি আরো কিছুকাল বেঁচে থাকত! আজ সোমেনের স্মৃতিবার্ষিকী উদযাপন করিতে যাইয়া তাহার নিজের কথাই তাহার সম্বন্ধে কেবল বলিতে ইচ্ছা করে; কিন্তু যদি আরো কিছুকাল বেচে থাকত! তবু সোমেন আজ নাই। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা হতাশ হইব না। সোমেনের মৃত্যুদিনে মুষ্টিবদ্ধ হাতে আমরা আজ এই প্রতিজ্ঞা লইব, যেন তাহার আদর্শের বীজ লক্ষ কোটি হইয়া আমাদের মধ্যে ছড়াইয়া পড়ে; জীবনের যে ইঙ্গিত সোমেন তাহার জীবনে পাইয়াছিলো–আজ যাহার সুস্পষ্ট আভাস সোমেনের ও হাজার লক্ষ জনগণের রক্তের মধ্যে দিয়ে আমাদের দৃষ্টিপথে ভাসিয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রতিষ্ঠা যেন আমরা করিতে পারি–কেননা একমাত্র তাহার প্রতিষ্ঠাতেই হইবে সোমেনের জীবনের নব প্রতিষ্ঠা।

‘দি রুটস’

গাছের শক্তি শেকড়ে। মাটির কত গভীরে তার শেকড় গেল তাতে। কথাটা মনে পড়েছে, আমার বাসা থেকে নিউমার্কেটের পথে যে দুটো গাছ দেখেছিলাম। কয়েকদিন আগেও, সামান্য ঝড়ের আঘাতে তাদের পড়ে যেতে দেখে। ঝড়ের পরেও রাস্তায় গাছ দুটো শুয়ে ছিলো। গোড়ার দিকে চাইতে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আরে! এর যে শেকড়ই নেই। এ দাঁড়িয়ে ছিলো কি করে এতদিন! এটাই বিস্ময়। বৃহৎ বৃক্ষ যেগুলো, যেগুলো বড় ঝড়েও পড়ে না, তার ডালপালা ভাঙলেও সে যে আমূল উল্টে যায় না, তার কারণ তার শেকড়ের গভীরতা। স্বর্ণলতার কথা অবশ্য আলাদা। স্বর্ণলতা, সোনার মতো রং। তাই বোধ হয় স্বর্ণলতা। আমরা গ্রামে থাকতে বলতাম, শূন্যলতা। শূন্যলতা অবশ্য গাছ নয়, লতা। কিন্তু যথার্থই শূন্য। শেকড়বিহীন। ওর বাঁচন ও বৃদ্ধি অন্য গাছকে শোষণ করে। কিন্তু তবু তারও বিপদ আছে। যাকে শোষণ করে এমন সোনর রং, সে যদি উল্টে যায়, তবে তারও শেষ। এমন কি, সে যদি ঝেড়ে ফেলে দেয় নিজের গা থেকে এমন পরভোজীকে তবু তার শেষ।

মানুষের বেলায় কি ব্যাপারটা আলাদা? না। তা নয়। মানুষেরও শক্তি তার শেকড়ে। ব্যক্তি বা জাতি যেভাবেই দেখিনে কেননা, শক্তি তার শেকড়ে। কত গভীরে সে প্রবিষ্ট হয়েছে, তার ওপর। মানুষের শেকড়ের মাটি কেবল আক্ষরিক অর্থে মাটি নয়। মানুষের শেকড়ের মাটি তার অভিজ্ঞতা, তার ইতিহাস, তার অতীত। যার অভিজ্ঞতা নাই, ইতিহাস নাই, অতীত নাই, সে শেকড়হীন, প্রায় শূন্যলতার মতো। যে মানুষ, ব্যক্তি বা জাতি হিসেবে ঋদ্ধ হতে চায়, কিংবা যদি সে পতিত হয় সঙ্কটে, তবে তার উচিত অন্বেষণ করা তার শেকড়ের। দেখা, কত দূর গেছে সে শেকড়। আর এই চেষ্টাতেই তার। শেকড় গভীর থেকে গভীরে চলে যেতে বাধ্য। নিজের আত্মবিশ্বাসে সঙ্কটের সমাধানের অস্থিরতায় জিজ্ঞাসা যদি জাগে, সন্ধান করো তোমার শেকড়ের।

আমিও তো জানিনে আমার শেকড় কোথায়? কি দিয়ে তৈরি হয়েছি আমি। চল্লিশ সালে যে কিশোরটি এসেছিলো একেবারে বিদেশ এক ঢাকায়, তারও তো কিছু শেকড় ছিলো তখনো। কিছু পূর্বকাহিনী। কিছু মালমশলা, পরিবেশ। সুতোর টানে তাও আসে। তাকেও আনতে হয়। জানতে হয়। সেই বোধ থেকে এতদিন পরে গেলাম নিজের বড় ভাইয়ের কাছে, যিনি বেঁচে আছেন এখনো। একদিন ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস হতো না। কিন্তু স্নেহশ্রদ্ধায় দুজনে প্রায় বন্ধুর মতো। গেলাম তার কাছে পুরনো দিনের কিছু কথা জানতে। আমার ভাল লেগেছিলো তার সঙ্গে সেদিনের এই আলাপটি, মাত্র অল্পক্ষণের। সেই সাক্ষাতের রোজনামচাটিই বরঞ্চ তুলে দিই।

১৩.৭.৮৩ : গুলশানের কাছেই বনানী। ছোট ছেলে তিতুকে সঙ্গে করে গুলশানে বড় বোনের কাছে বিদায় নিয়ে বনানী এলাম। বনানীতে বড় ভাই একটি ছোট বাড়ি করেছেন। চাকরিজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি অবসর নিয়েছেন। সেও অনেক বছর হয়ে গেছে। সাবরেজিস্ট্রার এবং পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। উভয় পদমর্যাদায় বিভিন্ন স্থানে, পূর্ববঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরেও কিছুকাল নানা দায়িত্ব সততা এবং শ্রমের সঙ্গে পালন করেছেন। চাকরিজীবনে তাঁর সতোর নানা ঘটনা পরিচিতজনদের কাছে প্রবাদ কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। চাকরির কোনো এক স্থলে প্রতিবেশী কোনো এক সহকর্মীর কাছ থেকে নাকি সেলাইকরণের জন্য সুই এনেছিলেন একটি, ধার করে। বদলির সময়ে ভুলে ফেরত দেওয়া হয় নি ধার করা সেই সুই। তাতেই মনে শান্তি আসে না। খামে করে চিঠি লিখলেন সহকর্মীকে নতুন জায়গা থেকে এবং খামের মধ্যে ধার করা সেই সুচটি পাঠিয়ে দিলেন সহকর্মীকে। আমাদের কাছে অতিরিক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে একেবারে ফরজ। নিজের চোখে দেখেছি, প্রৌঢ় বয়সে যখন বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছেন, একটি জেলা মিউনিসিপ্যালিটি শাসনের। তখন সেই শহরের টাউন হলেন বিদ্যুতায়নের সাজ-সরঞ্জামে যেন না কোন দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়, তাই নিজে দূর ঢাকা শহরে এসে হেঁটে হেঁটে দোকানে দোকানে ঘুরে বালু, তার, সুইচ, কাঠি, বকস্ দর দস্তুর করে ক্রয় করেছেন। সে সব বাক্সবন্দী করেছেন। কুলির মাথায় চাপিয়ে লঞ্চে উঠিয়ে নিজে নিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে তদারক করে টাউন হলের ইলেকট্রিকের কাজ সমাধা করেছেন। সাবরেজিস্ট্রার যখন ছিলেন, তখন দুপয়সা উপরি আয়ের কর্মচারিরা অসুবিধায় পড়ত তাঁর অফিসে। তিনি অফিসে নোটিশ টানিয়ে দিতেন, সরকারি নিয়মের বাইরে কেউ কিছু দাবি করলে দলিল করার জন্য আগত ব্যক্তিগণ যেন সরাসরি তাঁর কাছে অভিযোগ করেন। অথচ রেজিস্ট্রি অফিসের সুপরিচিত রেওয়াজ ছিলো (এবং আজো আছে) কেনা-বেচার দলিলের ব্যাপারে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত কর্মচারিগণ উপরি গ্রহণ করে।

এই কথা বলতে আমার আকস্মিকভাবেই মনে পড়ে গেল আমার একেবারে শিশুকালের কথা। আমার বড় ভাই তখনো নিজের সংসার করেন নি। চাকরিজীবন হয়ত মাত্র শুরু করেছেন। আমি হয়ত বাল্যশিক্ষা শেষ করেছি। শ্রেণী হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণী বলা চলে। মিয়াভাই (বড় ভাইকে আমরা মিয়াভাই ডাকতাম) তখন বরিশাল জেলার পিরোজপুরের মধ্যকার নাজিরপুরের সাবরেজিস্টার। ডাকবাংলো ধরনের লাল টালির ঘরটি আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি। সামনে অদূরে নদী বয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পেডাল অর্থাৎ চাকাওয়ালা স্টিমার। যাত্রী কিংবা মালটানা স্টিমার। আমি বলতাম জাহাজ। সামনের নদীর বুক দিয়ে এই জাহাজ যাতায়াত করে। নাজিরপুর স্টেশন পৌঁছার আগে গম্ভীর গলায় দীর্ঘ ভোঁ করে দুবার আওয়াজ দিতো। অফিস বাংলোর সামনে বড়ো মাঠ। পাশে একটা জোকভরতি পুকুর। তারও একটু পরে আর একটা রিজার্ভ পুকুর। এই পুকুরের পানি সবাই খায়। গোছল করা, কাপড় কাঁচা এতে নিষিদ্ধ। আর একটু দূর নদীর পারে পোস্টঅফিস। তারও পরে পুলিশের থানার দালান। নদীর ওপারে হাট। হাটের পারেই স্টিমার ভিড়ে এবং ওখান থেকে মোড় ঘুরে ফিরে চলে যায়। আহা! কি সুন্দর ছবি। মনে হয়, সেই জায়গাটিতে, সেই বয়সটিতে আমার বড় ভাইয়ের কাঁধে চড়ে চলে যাই। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়। কাঁধে চড়ার কথাটা আক্ষরিকভাবেই সত্য। সেবার হয়ত ১৯৩০ কিংসা ১৯৩১-এ মিয়াভাই এসেছিলেন ছুটিতে বাড়িতে। ছুটি শেষে রওনা হলেন সন্ধ্যার সময়ে আমাদের গ্রাম আটিপাড়া ছেড়ে উজিরপুরের দিকে। হেঁটে যাবেন উজিরপুর। সঙ্গে ছিলো তার অফিসের চাপরাসি, ফজল মিয়া। মিয়াভাইয়ের এই এক গুণ। যেখানেই কাজ করেছেন, অফিসের কেরানি, কর্মচারি, নিমপদের পিয়ন–সবাইকে আত্মীয়ের মতো আপন করে নিয়েছেন। একবার কারুর সঙ্গে দায়িত্বের ক্ষেত্রে পরিচয় ঘটেছে তো সারাজীবন সে পরিচয় সজীব রয়েছে। আঘাত বা শত্রুতামূলক সম্পর্ক কারুর সঙ্গে তাঁর তৈরি হয়েছে, এমন ঘটনা তিনি কখনো বলেন নি। উজিরপুর আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে তিন কিংবা চার মাইল। ওখান থেকে নদীপথে যেতে হবে বানরীপাড়া। বানরীপাড়াতে স্টিমার পাওয়া যাবে সকালে। সেই স্টিমার যাচে হুলার হাট হয়ে নাজিরপুর, মিয়াভাইয়ের যেখানে চাকরি স্থান। আমি তখন বোধ হয় ভাইদের মধ্যে সবচাইতে ছোট এবং স্নেহের। বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার মুহূর্তে বায়না ধরলাম, আমিও যাব বড় ভাইয়ের সঙ্গে। নানা নিরোধ। মা বলেন, তুই কোথায় যাবি? আমি বলি না, আমি যাব। নাছোড়বান্দা। স্নেহপরায়ণ বড় ভাই বলেন: ঠিক আছে, ও যাক। উজিরপুর পর্যন্ত। ওখান থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেব বাড়ির লোকের সঙ্গে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আমাকে উজিরপুর থেকেও ফেরত পাঠানো গেলো না। শেষপর্যন্ত ঠিক হল মিয়াভাই আমাকে সঙ্গেই নিবেন। হয়তো সেদিন তার প্রশ্ন ছিলো কিরে, তুই পারবি, আমার সঙ্গে থাকতে? এ প্রশ্নের কি জবাব দিয়েছিলাম। আজ আর তা স্মরণে নেই। কিন্তু ফেরত যে পাঠাতে পারলেন না তাতেই জবাবটি যে ছিলো দৃঢ় এবং নাছোড়বান্দা ধরনের তাতে সন্দেহ নেই। সেই রাত্রির কথা আজো মনে ভেসে ওঠে। বড় ভাইয়ের ইচ্ছা ছিলো, উজিরপুর থেকে নৌকা করে বানরীপাড়া যাবেন। কিন্তু নৌকোর কোন মাঝি রাজি হলো না। বলল, নৌকো করে গিয়ে সকালে স্টিমার ধরিয়ে দেওয়া যাবে না।

উজিরপুর থেকে বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা বিদায় নিলেন। এবার উজিরপুর থেকে হাঁটাপথে রওনা হলাম আমরা তিনজন। মিয়াভাই, তাঁর চাপরাসি ফজল মিয়া এবং আমি। তিনজন বলে কোন লাভ নেই। আসলে দুজন। পাঁচ বছরের শিশুকে ঐ রাতে দশ-বার মাইল পথ হাঁটিয়ে নেওয়া যাবে কি করে? কিছুদূর না যেতে শক্ত সবল ফজল মিয়া আমাকে অক্লেশে তার কাঁধে তুলে নিলেন। অন্ধকার পথে হেঁটে ঐ পথে মিয়াভাই কিংবা তাঁর চাপরাসিও যে কখন বানরীপাড়া গিয়েছিলেন তা মনে হয় না। কারণ, কোনো এক পথ ধরে ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরে দেখা গেল, যে-নদীর পার থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেই নদীর পারেই তারা আবার ফিরে এসেছেন। কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে আবার হাঁটা শুরু হলো। রাত তখন দুপুর পেরিয়ে হয়ত একটা কিংবা দুটা বেজে গেছে। কত পথ বাকি তাই বা কে জানে। এবার হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লেন তাঁরা দিগন্তবিস্তারী নির্জন মাঠে। এদিকে-ওদিকে আঁকড়ামাথা তালগাছ সেই রাত্রির বুকে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরবাড়ির নাম-নিশানা কোনো দিকে নেই। এরকম মাঠ উজিরপুরের মতো ঘনবসতি এলাকায় থাকতে পারে, তা আমি কোনোদিন কল্পনা করতে পারি নি। পরবর্তীকালেও এই মাঠের রূপটি আমাকে আকর্ষিত করেছে। এই মাঠের নাম নাকি হুলুদপুরের মাঠ। সারারাত ধরে এই হলুদপুরের মাঠে এ ভুল ও ভুল করে চলতে চলতে একেবারে ভোরবেলা যে বানরীপাড়া এসে পৌঁছেছিলাম এবং চাকাওয়ালা যে স্টিমারটি ঘাটে ছিলো সেটি যে ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম করে তার সিঁড়ির একটি তক্তা উঠিয়েও ফেলেছিলো এবং আমাকে কাঁধে করে আমার ভাই এবং তাঁর চাপরাসি উধ্বশ্বাসে গিয়ে সেই স্টিমারটিতে উঠেছিলেন–সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্যটি আজকের সাতান্ন বছরের জীবনের কত শত বিপদ-আপদের স্মৃতি-বিস্মৃতি ঘটনার মধ্যেও জ্বলজ্বল করে ভাসছে। স্মৃতির এই ব্যাপারটিও বিস্ময়কর। কোনটি যে স্মৃতিতে থাকে, ভেসে ওঠে এবং কোনটি যে থাকে না, তলিয়ে যায়–সে এক অজানিত রহস্য।

এমনি করে সেদিন বড় ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে এসেছিলাম তার কার্যস্থল নাজিরপুরে। মিয়াভাইয়ের সঙ্গে শিশু ও কিশোরকালের তাই আমার নানা স্মৃতি। আসলে ভাই হলেও তিনিই ছিলেন আমার এবং অপর সকল ছোট ভাইবোনের নিকট পিতার মতো। তাঁর বয়োকনিষ্ঠ সকলের পড়াশুনার দায় দায়িত্ব তিনিই বহন করেছেন। বাবা-মার কাছে তিনি ছিলেন ভরসার এবং গর্বের ধন। গ্রামের লোকেরা বাবা-মাকে ডাকতো মৌজালীর (মৌজে আলী) বাবা কিংবা মা বলে। বাবা-মা তাঁদের ছেলেকে ডাকতেন মনু বলে। কথার টানে সে ডাক শোনাত মউন্না বলে।

আজ তিনি সংসারী তো বটেই। প্রবীণ। চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা মোটামুটি স্থিত হয়েছে আপন আপন সংসারে এবং অবস্থানে। বড় ছেলে ইংরেজির অধ্যাপক। এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। মেয়েরাও শিক্ষিত এবং সংসারী। একটি ছেলে ৭১ সালে জীবন বীমায় চাকরি করত। ৭১-এর আগে কোনো রাজনীতি করতে বলে শুনি নি। কিন্তু ৭১ সালে জড়িত হয়ে পড়েছিলো যুদ্ধের সঙ্গে এবং ৭১-এর শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনো জায়গাতে কোনো কর্মসূচি সম্পন্ন করতে সেই যে, গেলো, আর কিন্তু এলো না। মা-বাবা বহুদিন ভেবেছিলেন, ছেলে তাদের বেঁচে আছে, ফিরে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া যুবকের ন্যায় সেও আর ফিরে আসে নি। ছেলেটির নাম ছিল হুমায়ুন। পুরো নাম আহমদ নিয়াজ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওর একটি ছবি জীবন বীমা কর্পোরেশনের গুলিস্তানের অফিসে এখনো টাঙ্গানো দেখা যায়। তাতে বোঝা যায়, ছেলেটি তার সহকর্মীদের মনেও দাগ কেটেছিলো।

বড় ভাইয়ের জীবনে এই এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কোনোদিন রাজনীতি করেন নি। আমার নিজের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় ক্ষুব্ধ ছিলেন আমার ওপর। ১৯৪৮ সালে হঠাৎ একদিন আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষকতার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিষিদ্ধ রাজনীতিক জীবনে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলাম, সেদিন সেই মুহূর্তে পুলিশের লোক অন্বেষণ করে আমাকে না পেলেও বড় ভাই ঠিকই আমাকে বের করেছিলেন ঢাকার শহরতলির একটি এলাকাতে। দেখা হতেই বলেছিলেন : তুমি বোকার বোকা তো বটেই। এখন দেখছি পাগল। বিলেত যাওয়ার চান্স পেলে। তাও গেলে না। (কথাটা মিথ্যা নয়।) এখন হাতের চাকরিতে ইস্তফা দিলে। এ সবের অর্থ কি? বড় ভাইয়ের এরকম প্রশ্নের মোকাবেলা আমাকে আগেও করতে হয়েছে। এবং এসব ক্ষেত্রে আমার কৌশলটি কিছুটা ব্যতিক্রমী ধরনের ছিলো। আমার নীতিটি ছিলো: মুরুব্বিজনের সঙ্গে তর্ক করবে না এবং নিজের বিবেকের সিদ্ধান্তে বিচলিত হবে না। আর এই নীতিতে সেদিনও আমি মিয়াভাইয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিই নি। শুনেছি, তিনি তখনি ছুটে গিয়েছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান ড. বিনয় রায়ের কাছে। ড. বিনয় রায় আমার নাম ধরে আমার ভাইকে বলেছিলেন : ওকে তো আমরা চিনি। ওতো আমাদের একান্ত স্নেহের ছাত্র। কিন্তু ওর সিদ্ধান্ত থেকে তো ওকে ফেরানো যাবে না। তা না। হলে এখনো যদি ও ফিরে আসে, আমরা ওকে আবার সাদরে নিয়ে নেবো।

অধ্যাপক বিনয় রায়ের কথা মিথ্যা নয়। আমার প্রতি এ শিক্ষকদের ছিলো অপার স্নেহ। দর্শনের প্রখ্যাত শিক্ষক, অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের, অধ্যাপক বিনয় রায়ের, অধ্যাপক ক্ষিরোদ মুখার্জি বা কেসি মুখাজির এবং অধ্যাপক রাকেশ রঞ্জন শর্মার স্নেহ। হিন্দু শিক্ষকই তখন সংখ্যায় অধিক ছিলেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালেও। আমাদের দর্শন বিভাগে মুসলিম শিক্ষক ছিলেন হাদি সাহেব। আব্দুল হাদি তালুকদার। এবং পরবর্তীকালে গোলাম জিলানী, উর্দুভাষী। বোধ হয় লাহোরের। ইনি পড়াতেন মুসলিম দর্শন।

বিনয়বাবুর স্মৃতিটি উল্লেখ করা আবশ্যক। ১৯৪৬ সালে আমি যখন এম.এ পাস করি তখন দর্শন বিভাগের তিনি অধ্যক্ষ। হরিদাস ভট্টাচার্য তখন। অবসর নিয়ে চলে গেছেন, কলকাতায়। এম.এ পাসের পরে কোনো আনুষ্ঠানিকতা করে যে আমাকে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হতে হয়েছিলো, তা আদৌ মনে পড়ে না। আসলে কেবল আমাদের বিভাগ নয়, তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টিই ছিল ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটি ছোট পরিবারের ন্যায়। আমাদের বিভাগের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অধিকতর সত্য। দর্শনের অনার্সে এম.এতে গুটি পাঁচ-ছয় ছাত্রছাত্রী। শিক্ষকদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিলো সন্ত নের সম্পর্ক। তাঁদের নিজেদের বাড়ি আর ছাত্রদের ক্লাস, এর মধ্যে কোনো ভেদরেখা ছিলো বলে মনে পড়ে না। হরিদাস বাবু বা বিনয়বাবুর ক্ষেত্রে একথা খুবই সত্য। হরিদাস বাবু ছিলেন সারা ভারতব্যাপী বিখ্যাত বাগী, দার্শনিক। কলকাতা, লখনৌ, বেনারস, দিল্লি, বোম্বে, লাহোর-সকল জ্ঞানকেন্দ্রে তার অবাধ যাতায়াত, অহরহ ডাক।

বিনয়বাবুর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের স্মৃতি আমার মনে অমলিন হয়ে ভাসছে। সেটিই আমার শেষ সাক্ষাৎ। (বিনয়বাবু ছিলেন ইংরেজির অধ্যক্ষ এস.এন রায়ের ছোট ভাই। এস,এন রায় ছিলেন সেকালের ইডেন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সুজাতা রায়ের স্বামী। আসলে স্বামী-স্ত্রী হওয়ার পূর্বেও এঁরা একই পরিবারের লোক ছিলেন। আমাদের সামাজিক ভাষায় হয়ত খালাত-মামাত ভাইবোন। হিন্দু সমাজে এত নিকট আত্মীয়ের মধ্যে নাকি সেকালে বিয়ের সম্পর্ক হতো না। কিন্তু এস,এন রায়-সুজাতা রায় সে সংস্কারকে ভেঙে ছিলেন।

১৯৪৬-৪৭ সাল। কিংবা তারও কিছু পর ১৯৪৮-এর মধ্যভাগ। তখন বিনয়বাবু ছিলেন দর্শন বিভাগের প্রধান। তার মারফতেই বয়োকনিষ্ঠ বা জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়োগ-তথা তাদের সকল আবেদন-নিবেদন : বিদেশ যাওয়ার বৃত্তির দরখাস্ত বা ছুটির প্রার্থনা। আমি তখন বিভাগের একজন তরুণ শিক্ষক। বিনয়বাবু জানতেন, আমার কিছু এদিক-ওদিক চলাচল আছে। পড়াশুনার বাইরে : এই কনফারেন্সে যাওয়া, ঐ মিটিং করা, করোনেশন পার্কে বক্তৃতা দেওয়া, রাজনৈতিক পত্রিকা বিক্রি করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদস্থ পিয়ন বা চাপরাসিদের ছেলেমেয়েদের নাইট স্কুল চালানো, এমন কি তাদের নিয়ে বেয়ারার সমিতি গঠন করা। এসব কিছুকে আমার ছাত্রাবস্থা থেকেই আমার শিক্ষকরা প্রশ্রয় এবং স্নেহের চোখে দেখতেন। মোট কথা, কেবল বই পড়তে ছেলেটি যে ব্যস্ত থাকে না, আবার এটা-ওটা করেও ছেলেটি বেশ ভাল ফল করে পরীক্ষাতে, এটি আমার অধ্যাপক-শিক্ষকদের বেশ আমোদিত করতো। সে যা হোক, ’৪৭-৪৮-এ আমি যখন দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করছি, তখন দেশ বিভাগ তথা পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকার রাজনীতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে জটিল হয়ে উঠছিলো। পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার বামপন্থী রাজনীতিকদের বিষয়ে তাদের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে তীক্ষ্ণ করে তুলছিলো। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করা থেকে ধর-পাকড়ও শুরু হয়েছিলো। তখনো বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট কর্মীদের অধিকাংশ হিন্দু সমাজভুক্ত। তাঁরাই অধিক পরিমাণে গ্রেফতার হচ্ছিলেন। কিন্তু সরকারের আই.বি তথা গুপ্তচর বিভাগ খোঁজ করছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এমন ধরনের কর্মী আছে কিনা। শিক্ষকদের মধ্যে মুসলিম তরুণ শিক্ষক হিসেবে স্বাভাবিকভাবে এক্ষেত্রে আমি এই বিভাগের নজরে পড়েছিলাম। তাদের এ দৃষ্টি হয়ত আমার ওপর পড়েছিলো বিভাগের পূর্বে, সেই ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ এবং ’৪৫-৪৬ সালের সারাদেশব্যাপী ছাত্র এবং শ্রমিক আন্দোলনের আলোড়নের কালেই: নৌবিদ্রোহ, রশিদ আলী দিবস, ঢাকার ছাত্রদের দাঙ্গাবিরোধী শান্তি মিছিল হিসেবে ইতিহাসে যে ঘটনাগুলো পরিচিত হয়ে আছে, তার মধ্যেই। কিন্তু বিভাগের পূর্বে আমার ওপর তাদের দৃষ্টি ততো খর হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু দেশ বিভাগের পরে আমি এমন কর্মীদের মধ্যে প্রায় অন্যতম হয়ে দাঁড়ালাম। পাকে প্রকারে আমি নোটিশ পেলাম: আমাকে তারা অন্বেষণ করছে। এমন অবস্থায় প্রকাশ্য চাকরিরত হয়ে বেশিদিন বাইরে থাকা যাবে না, সংগঠনের এই বিবেচনা থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো: তুমি চাকরি ছেড়ে আত্মগোপন করবে। সিদ্ধান্তটি কার্যকর করতে আমার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আসে নি। সাংসারিক কোনো দায়-দায়িত্ব আমি কোনোদিন পালন করি নি। একমাত্র আকর্ষণ জন্মেছিলো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। বেশ লাগছিলো ছাত্র–প্রায় আমার শিক্ষকের মতো বক্তৃতা দিতে। কেমন করে যে সেদিন ছাত্রছাত্রীদের কাছে গুরুগম্ভীর কথা বলতাম, তা স্মরণ করতে পারছিনে। তবে গোবেচারী আমার প্রতি ছেলেমেয়েদেরও কিছুটা আকর্ষণ যেন তৈরি হচ্ছিলো। তার একটা কারণ বোধ হয় এই যে, এই স্যারটির যেমন অ-স্যারমূলক নানা আচার-আচরণের কথা শোনা যায়, তেমনি আবার ব্যতিক্রমহীনভাবে তাকে নির্দিষ্ট সময়ে তার ক্লাসটিতেও পাওয়া। যায় আর সেখানে তাকে সাগ্রহে পাঠ্য কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যাতে নিবদ্ধ হতেও দেখা যায়। আর এ কারণেই একদিন আমি তাদের সতর্ক করে দিয়েই বললাম : আমি আর তোমাদের ক্লাস নেব না।

তারা বলল : কেন স্যার, কেন স্যার?

আমি বললাম : আমার জীবনে অ-শিক্ষক কিছু দায়দায়িত্ব আছে। সেটি পালন করে শিক্ষকতার পুরো দায়িত্ব পালনে আমি ব্যর্থ হবো। কিন্তু দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবো না জেনেও চাকরিতে বহাল থাকব, এমন কথা আমি ভাবতে পারিনে। সেদিনকার সেই পরিবেশে ছেলেমেয়েদের কাছে আমার এমন কথা নিশ্চয়ই বেশ রহস্যের সৃষ্টি করেছিলো, কিন্তু কথাটা সঠিকই ছিলো।

দুদিন পরে আমি একটুকরা কাগজ নিয়ে অধ্যাপক বিনয় রায়ের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমার সাক্ষাৎশিক্ষক এবং বিভাগের প্রধান, যিনি আমাকে ঘরের ছেলের মতো স্নেহ করতেন, তিনি ভেবেছিলেন, কাগজটিতে আমার কোনো আবেদন আছে, কোনো পদোন্নতির, বা বিদেশ গমনের জন্যে বৃত্তির। আমার হাতের কাগজটিতে আবেদন অবশ্যই একটি ছিলো। কিন্তু পদোন্নতির নয়, অব্যাহতির: স্যার, আই বেগ টুবি রিলিভড় অব মাই ডিউটিস এস এ টিচার ইন দি ডিপার্টমেন্ট: স্যার, বিভাগের শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি দিবেন। সোজা কথায়, পদত্যাগ। বিনয়বাবু আমার হাত থেকে সেই কাগজটুকু নিয়ে বেশ কয়েক মিনিট একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন বাক্যটির মর্ম তিনি অনুধাবন করতে পারছেন না। এবং যথার্থই তিনি আমাকে রাগের স্বরে জিগ্যেস করলেন : এসবের অর্থ কি? তুমি কি পাগল হয়েছো? আর ইউ ম্যাড? বিনয়বাবুর বিস্মিত হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিলো না। তখনকার হিন্দু সমাজের মধ্যবিত্ত কত ছেলে রাজবন্দী হিসেবে জেলে গেছে, এমন কি ফাঁসিতেও ঝুলেছে। আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছে, আত্মগোপন করেছে। বিনয়বাবু, এস.এন রায়, পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, হরিদাস বাবু। এঁদের কাছে। এমন ব্যাপার বিস্ময়কর কিছু ছিলো না। সেকালে তাদের কাছে চমক ছিলো : একটি মুসলমান ছাত্রের এমন বিপথে পা বাড়ানোর। সেদিন মুসলমান সমাজে এমন ঘটনা তাঁদের সমাজের ছেলেদের ন্যায় সচরাচর ছিলো না। মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের প্রেক্ষিতে এ ছিলো ব্যতিক্রম।

বিনয়বাবু তারপরে আবার বললেন : তোমার এ রেজিগনেশন লেটার আমি ছিঁড়ে ফেলব। এমন পাগলামি তুমি করো না।

আমি বললাম : স্যার আপনি তো আমাকে জানেন। ব্যাপারটাতে একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এটা তো আর পাল্টানো যাবে না।

শুধুমাত্র এই কথা কয়টিই। আর কিছু নয়। আর তারপরেই আমার স্বভাবসুলভ সলজ্জ নিঃশব্দতা ব্যতীত আর কোনো জবাব ছিলো না আমার। আরো কয়েক মুহূর্ত বোধ হয় পার হয়েছিলো। তারপরের ঘটনাটি আজ মনে। করতে আমার চোখে পানি আসছে। কিন্তু সেদিন যে কিভাবে ঘটনাটিকে অতিক্রম করে এসেছিলাম, তা আর স্মরণ করতে পারিনে। আমার শিক্ষক ড. বিনয় রায়, বিভাগের প্রধান, আমাকে হঠাৎ বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন : তোমার মত পাগল ছেলে আমি আর পাই নি। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি ….।

বিনয়বাবু আজ হয়ত বেঁচে নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনকার সেই পারিবারিক পরিমণ্ডলে শত দ্বন্দ্ব দাঙ্গা, অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধার ক্রমপ্রসার সত্ত্বেও এমন স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক যে ছিলো, তার কথা আজ যথাসম্ভব লিপিবদ্ধ করা, ব্যক্তিগত আবেগ থেকে স্মৃতিচারণের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হচ্ছে। সেই বোধ থেকেই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করার এই দুর্বল চেষ্টা।

এক কিশোরের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি

ধারাবাহিকভাবে স্মৃতিচারণের চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। আত্মজীবনী লেখার মতো বড়লোকও আমি নই। তবু চল্লিশের দশকের ঢাকার কথা বলার কিছুটা দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য নিজের মনের আলো আঁধারিতে হাতড়ে বেড়াবার চেষ্টা করছি নিরন্তর। হঠাৎ হঠাৎ কোনো একটা উদ্দীপক বা স্টিমুলাসে তার কোনো কোনো জায়গা যেন আকস্মিকভাবে দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। কিছুটা পরিমাণে দেখা যায়। চিত্রবৎ ভেসে ওঠে ১৯৪০, ৪১, ৪২, ৪৩-এর জীবন, তার কোনো ঘটনা, কোনো চরিত্র। তারপরেই। আবার হয়ত অন্ধকার। এ প্রায়, অতীত নিয়ে কানামাছির খেলা: এই চুঁই, এই পাই: এই পাইনে…

খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পেয়ে গেলাম কয়েকটি হাতে লেখা খাতা। বয়স হয়েছে তার চল্লিশ বছরের ওপর। তারিখ আছে কোনো কোনোটির গায়ে ১৯৪০-৪১ সালের। একটি কিশোরের খাতা। প্রায়ই ছিন্ন। আবার কোথাও কিছুটা ধারাবাহিকতা আছে। একটি কিশোর ছাত্রের খাতা। কিশোর তো বটেই। মাত্র ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেছে। পনের বছরও পুরো হয় নি ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়ে। যে লেখক বর্তমানে এই ভূমিকাটি লিখছে তার নামের সঙ্গে এই কিশোরের নামের অবশ্যই মিল আছে। কিন্তু তাই বলে সেই খাতার মধ্যে যে দুই-একটি সাহিত্যচর্চামূলক লেখার আভাস পাওয়া গেল, সে লেখা বর্তমানের এই লেখকের, এমন কথা বলা অর্থহীন। তার মানে এই নয় যে, বর্তমানে প্রৌঢ় বয়সের এই লেখক সেই কিশোরের চাইতে উচ্চতর স্তরের কোনো লেখক, তাই একটি কিশোরের রচনাকে নিজের বলতে তার সঙ্কোচ। ব্যাপারটি তা নয়। বরঞ্চ সেই কিশোরের কাঁচা হাতের লেখার মধ্যে, শব্দের বানানে ভুল এবং ভাষা ব্যবহারের সাধু চলতির মিশ্রণ সত্ত্বেও যে অকৃত্রিম আবেগের পরিচয় আছে, সেটি বর্তমানের এই তিত-পোড়া প্রৌঢ়ের জীবনে বা। তার লেখায় নেই। তাই সে কিশোরের আবেগময় লেখার মালিকানা দাবি করার হক বর্তমানের একই নামধারী এই লেখকের নেই।

সেই কিশোরের এই লেখার একটিও সেদিন কোনো সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত হয় নি। অপর কোনো লেখা হয়ত ঢাকা কলেজের ম্যাগাজিনে কিংবা মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক সওগাতে প্রকাশিত হয়ে থাকবে।

কিন্তু অপ্রকাশিত এই পাণ্ডুলিপির একটি রচনা আমার কাছে আজ একটু তাৎপর্যপূর্ণ বলে বোধ হচ্ছে। লেখাটি গল্প। রচনার কাল ১৯৪১-এর শেষে কিংবা ৪২। খাতার বিভিন্ন চিহ্ন থেকে এমন অনুমানই করতে হয়।

দাঙ্গার শহর, ঢাকা শহর। এই দাঙ্গার পটভূমিতে একটি মুসলমান ডাক্তার ছেলে এবং দাঙ্গায় সদ্য নিহত একটি হিন্দু যুবকের অসহায় বোনকে নিয়ে কিশোর লেখক তার গল্পটি তৈরি করেছে। গল্পটিকে আমি নিচে তুলে দিচ্ছি। সেদিনের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে একটি মুসলিম কিশোর ছাত্র তার সাহিত্যচর্চার চেষ্টায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ভালবাসা তথা হৃদয়গত ঐক্যের সূত্রটিকে যে মূল্যবান বলে মনে করেছিলো, এই ঘটনাটি সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত প্রবাহিত সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান-পতনের প্রেক্ষাপটে অবশ্যই একটি সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য বহন করে। এবং সে কারণেই সেই কিশোরের এই কাঁচা লেখাটি অভিজ্ঞ-পক্ষ এই প্রৌঢ়ের ভাল লেগেছে।

ভূমিকার এই কথাটি বলে আমি গল্পটি তুলে দিচ্ছি। পাণ্ডুলিপিতে গল্পটির কোনো নাম পাওয়া যায় নি। হয়ত কিশোরের এটি খসড়ামাত্র ছিলো। একে মার্জিত করা হয় নি। কিন্তু আজ একে মার্জিত করে কোনো লাভ নেই। সেটি উচিতও নয়। এবং এর নামকরণেও কোনো প্রয়োজন নেই। পাণ্ডুলিপিতে লেখকের নাম ছিলো না। খাতার উপর তার নিজের নামটি লেখা ছিলো। এবং দ্বিতীয়বার কোনো ব্যাখ্যা না করে বলছি; সে লেখক এই লেখক নয়। কিন্তু তার নাম এবং বর্তমান লেখকের নামের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। লেখার পুরোটি পাওয়া যায় নি। যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে শরতী প্রভাব সহজেই ধরা পড়ে। সে যাক, লেখাটির সাহিত্যিক মূল্য বড় নয়। বড় তার কালগত বৈশিষ্ট্য।

***

দাদা, তুমি আমায় ছেড়ে চলে যেও না, যেও না।

অমল আর সুরমা। দুই ভাইবোন। আত্মীয় বান্ধব বলিতে তখন আর কেহই অবশিষ্ট ছিলো না। মানুষের বাঁচিবার উপায় কম। কিন্তু মরণের পথের অল্পতা নাই। মরণের পথ অসংখ্য। মরণের পথের প্রশস্ততা সত্ত্বেও অমল আর সুরমা এতদিন বাঁচিয়াই ছিলো। পূর্ববঙ্গেরই ওরা মানুষ। বাবা ছিলেন জমিদার। অমল কিন্ত গ্রামের জমিদারি বাদ দিয়া পূর্ববাংলারই ঢাকা শহরে বোন সুরমাকে লইয়া বাড়ি করিয়া বাস করিতেছিলো। যখনকার কথা বলিতেছি, অমল তখন বি.এ. পড়ে, বোন সুরমা ম্যাট্রিক।

অমল আর সুরমা। এদের একের বাঁচার জন্য দায়ি অপরে। অমল সুরমার শুধু বড় ভাইই নয়। ছেলেবেলা হইতে অমল সুরমার ভারপ্রাপ্ত। বোন সুরমার একাধারে সে বড় ভাই, মাতা-পিতার মত রক্ষণকারী সব। সুরমার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বই অমলের বাঁচার একমাত্র প্রয়োজন।

ঢাকার ১৯৩৯ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা-হাঙ্গামার কালে অমল পাইল এক ভীষণ আঘাত। হাসপাতালে অমলকে স্থানান্তরিত করা হইল। কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপ হইতে লাগিল। সুরমার সম্মুখে সমস্ত পৃথিবী ঘুরিতে লাগিল। হাসপাতালে মুমূর্ষ ভাইয়ের শয্যাপার্শ্বে বসিয়া অঝোরে সে অশ্রু ত্যাগ করিতে লাগিল। সুরমার চক্ষুর সম্মুখে তাহার সমস্ত ভবিষ্যৎ লেপিয়া-মুছিয়া একাকার হইয়া গেল। অমল তাহাকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে। অথচ অমলের এই চলিয়া যাওয়া সুরমার নিকট যে ভবিষ্যতে কি একটা ভয়াবহ আলোড়ন, একটা ভূমিকম্প আনিয়া উপস্থিত করিবে সে কথা সুরমা ভুলিয়া গিয়াছে। তাহার মনে হইতে লাগিল, অমল তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে পারে না। অন্তরের নিগূঢ় ক্রন্দন ধ্বনি মুহূর্তে মুহূর্তে সুরমার মুখে প্রকাশ পাইতেছিলো: দাদা, তুমি যেও না…

অমল? নির্বানোন্মুখ প্রদীপ। সুরমার কথা কানে প্রবেশ করিতেই জ্বলিয়া ওঠে। কিন্তু কথা বাহির হয় না। কোমরের পাশের ক্ষতটার ব্যাণ্ডেজ আবার রক্তে ভিজিয়া উঠিয়াছে। মরণপথের যাত্রীর শেষ নিশ্বাস পড়িতে নিমেষমাত্র বাকি। অমল হঠাৎ একটি অস্বাভাবিক চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, সুরমা, এই প্রকাণ্ড বিশ্বটায় এমন একটা মানুষও কি নেই যার হাতে তোর ভার আমি ন্যস্ত করে যেতে পারি, নেই?

এতক্ষণ পর্যন্ত হাসপাতালের বারন্দায় একটি মুসলমান ডাক্তার ছেলে রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিলো। ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত সে। গত রাত্রি বারটা হইতে কত মানুষকেই তো সে ভর্তি করিয়াছে এই ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে। কতজনের শেষ নিশ্বাস তো এরই মধ্যে বাহির হইয়া গিয়াছে। আর একটা কেস এই অমল বাবু। তারও হয়ত আর বেশি বিলম্ব নাই। অথচ অমল চলিয়া যাইবার পরে ঐ পার্শ্বে উপবিষ্ট মেয়েটির অবস্থা এই দাঙ্গা-হাঙ্গামারকালে কিরূপ নিঃসহায় হইয়াই যে দাঁড়াইবে, সে কথা কি সে এতক্ষণে কম বুঝিতে পারিয়াছে? দাদার মৃত্যু নিশ্চিত জানিয়াও যে বলিতে পারে, তুমি যেও না, সে যে কতটা আশ্রয়হীন, সমস্ত পৃথিবীটায় যে তাহার কোথাও মাথা পুঁজিবার এতটুকু স্থানও নাই, সে কি তাহার বুঝিতে বাকি রহিয়াছে? অথচ কিইবা সে করিতে পারে? আজিজ রেলিং-এ ভর দিয়া দূরে রাঙা আকাশটার পানে নির্মিমেষে চাহিয়া থাকিয়া ভাবিতে লাগিল, মানুষে মানুষে এই যে হানাহানি, এই যে লহুর স্রোত দিনরাত বিচারহীনভাবে বহিয়া চলিয়াছে, এর শেষ কোথায়? আজ ভাইয়ের পাশে উপবিষ্ট ঐ নিঃসহায় মেয়েটির আতাঁরব, তার বুকফাটা ক্ৰন্দন কি এই নিষ্ঠুর নির্দয় পশুগুলিকে অভিশাপ দেয় না? আর এই যে বছরে বছরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, এর নিবারণই বা কিসে?

আজিজ ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে পড়ে। ওর এই ডাক্তারি পড়ার পেছনেও বেশ একটু গল্পের মতো আছে।

বছর দুই পূর্বে আজিজ যখন স্কলারশিপ লইয়া আই.এ পাস করিল তখন সবাই ভাবিয়াছিলো, আজিজ বি.এ পড়িতে আরম্ভ করিবে। কিন্তু আসলে তা হইল না। পরীক্ষা দিয়া ও বাড়ি যায়। গ্রামে তখন বসন্ত দুর্দম বেগে বহিয়া চলিয়াছে। প্রতিদিন লোক মরিতে লাগিল। মাটি দিবার কেহ নাই। প্রতিষেধক কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করিবার জন্য উপদশ দিতে কোনো লোক নাই। দিনের পর দিন গ্রাম উজাড় হইয়া চলিল। রোগ চড়াইতে ছড়াইতে ক্রমে আজিজদের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। ছোট ভাইটি ওর যেদিন ওরই সম্মুখে শত শুশ্রূষা সত্ত্বেও ওষুধ না লইয়া মরিয়া গেল, সেদিন ওর সমস্ত চিত্ত আলোড়িত হইয়া নিজের বিদ্যাশিক্ষার উপর একটা ধিক্কার আসিল। পরীক্ষার পরে আজিজ ভবিয়াছিলো, পিতার সম্মতি লইয়া সে বি.এ পড়িতে আরম্ভ করিবে। কিন্তু পিতার সম্মতি দেওয়ার সময়ও অতিবাহিত হইয়া গেল। তিনিও তাঁহার ছোট্ট ছেলেটিকে অনুসরণ করিলেন। আজিজের মা ছিলো না। বাপ আর ভাইকে কবরগাহে রাখিয়া আসিবার কালে মনে মনে আজিজ এই প্রতিজ্ঞা। করিয়া লইল যে তাহার ভ্রাতার এবং পিতার আত্মার কল্যাণের জন্য সে ডাক্তারি পড়িবে। রোগে শোকে সে সমস্ত গরিবকে সেবা করিবে। গরিবেরই আর্শীবাদের অশ্রু লইয়া সে বাঁচিয়া থাকিবে।

দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া আজিজ তাহার পিছনের ইতিহাসটাকেই উল্টাইতেছিলো। নিঃসহায় আজ ঐ মেয়েটির মতো সেও একদিন এমনিভাবে সহায় সম্বলহীন হইয়াছিলো। কিন্তু তবুও তো কত তফাৎ। এ যে দুর্বল।

দূরে শহরের মধ্যে বন্দেমাতরম আর আল্লাহ আকবরের চাপা ধ্বনি ভাসিয়া আসিল। একটা বাড়িতে এইমাত্র আগুন দেওয়া হইল। তাহার লেলিহান শিখা সন্ধ্যার আকাশটাকে আরো ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছে। আজিজের মুখে একটু ম্লান হাসি ফুটিয়া উঠিল, ধর্মের নামে এরা কত অনাচার কত অত্যাচারই না করিতে পারে। তবুও মনে করে, ইহারা ইহাদের স্বর্গের পথ পরিষ্কার করিতেছে।

হাসি মিলাইয়া যাইতেই ভিতরে অমলের চিৎকারে আজিজের মুখে কালো ছায়া নামিয়া আসিল। অমল তখন বলিতেছিলো, সুরমা, বোন আমার, মানুষ নাই। কার হাতে তোকে সঁপে দিই…।

অমলের কথা ভালমতো শেষ হইতে পারিল না। মাঝপথে থামিয়া পড়িল। সুরমা চিৎকার করিয়া উঠিল, ওগো কে আছ? দাদা আমার কেমন করছে।

আজিজ তাড়াতাড়ি আসিয়া বিছানার পাশে দাঁড়াইয়া অমলের হাতের নাড়ি ধরিল। সুরমা বলিয়া উঠিল, ডাক্তার সাহেব, দেখুনতো দাদা আমার। সুরমার কথা থামিয়া গেল। ডাক্তারের চক্ষে জল।

কি ডাক্তার, দাদা আমার নাই? বলিয়া সুরমা অমলের বুকের উপর লুটাইয়া পড়িয়া ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। ডাক্তার রুমাল দিয়া চক্ষু মুছিয়া বাহির হইয়া আসিল। এ দৃশ্য সহ্য করা তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়া দাঁড়াইল। চক্ষু বাঁধ মানিল না। বারবার ভিজিয়া উঠিতে লাগিল।

আজিজ ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারি মন ওর ছিলো না। একবার ডিসেকটিং রুমে আজিজ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলো। জ্ঞান হইবার পরে সার্জন আসিয়া হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ইউ শুড নট হ্যাভ কাম টু দিস ডিপার্টমেন্ট মাই বয়। এ ভেরি টেন্ডার হার্ট ইউ পুজেজ।

রাত্রি তখন নয়টা বাজিয়া গিয়াছে। সুরমা এখনো ভাইয়ের বুক আঁকড়াইয়া পড়িয়া আছে। আজিজ আসিয়া ডাক দিল, সুরমা দেবী, একটু উঠুন। সুরমা উঠিায়া চাহিল আজিজের পানে। শান্ত সমাহিত সে চাহনি। কত বড় ব্যথা সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে ঐ চক্ষুর কোটরে। আজিজ নিজের দৃষ্টি নামাইয়া বলিল রাত নয়টা বেজে গেছে। এরপরে সকার করানো অসম্ভব হবে। কাকেও পাওয়া যাবে না। এখন কয়েকটি বিশ্বাসী লোক যোগাড় করতে পেরেছি। আপনি একটু আমার প্রাইভেট রুমটায় যেয়ে অপেক্ষা করুন। আমি ফিরে এসে যা হোক একটা ব্যবস্থা করব।

আজিজের নতদৃষ্টির উপর একদৃষ্টে সুরমা চাহিয়া রহিল। সে দৃষ্টি তাহার বিস্ময়ের। আজিজ কে? আজিজ ডাক্তার। হাসপাতালের ডাক্তার। সে কোথায় যাইবে? কেননা যাইবে? কাহার জন্য যাইবে? ইহা কিছুই সুরমা বুঝিতে পারিল না। ভাইকে তাহার সৎকার করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতে ডাক্তারের কি? সুরমার মুখ দিয়া বিস্ময়ের সহিত বাহির হইলো, আপনি কোথায় যাইবেন?

ডাক্তার ম্লান হাসিয়া বলিল, আমি না গেলে তো সকার করা সম্ভব হবে না। আর যার তার হাতে তো আমি এ মৃতদেহকে ছেড়ে দিতে পারিনে। ডোমের নিকট আমি এঁকে দিতে পারব না। তাছাড়া নেবার পথে লাশের উপর আবার আক্রমণ হতে পারে। কাজেই আমার না গেলেই নয়। আপনি কিছু ভয় করবেন না। আমার ঘরে একটা ইজি চেয়ার আছে। সেখানে যেয়ে আপনি একটু বিশ্রাম করুন।

তাহার ভাইয়ের শেষ গতি করিতে আজিজ যাইবে? এত দয়া তাহার? সুরমার চক্ষে জল আসিয়া পড়িল।

আজিজ বলিল, আপনি যান সুরমা দেবী। আপনি ঘরে গেলে পরে আমি দাদার দেহটা তুলব।

আবার সুরমার মাথা যেন কেমন হইয়া গেলো। কিছুক্ষণ পূর্বে এই দেহটাই ছিলো তাহার একমাত্র ভরসাস্থল। এই দেহেরই আত্মা কিছুক্ষণ পূর্ব পর্যন্তও ভবিষ্যৎ নিয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলো। আর এখন কিনা তাহাকে ধরিয়া রাখিবার জোও তাহার নাই। সুরমা আবার অমলের পা জড়াইয়া লুটাইয়া পড়িল। আজিজের চক্ষু ছাপিয়া কান্না আসিল। কিছুক্ষণ পরে আজিজ আবার ডাকিল, সুরমা, সুরমা দেবী, উঠুন।

সুরমা উঠিয়া বলিল, চলুন।

সুরমাকে ঘরের মধ্যে রাখিয়া আজিজ অমলের মৃতদেহকে লইয়া কয়েকজন সাথী সঙ্গে করিয়া শ্মশানের উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া পড়িল। দূরে বন্দেমাতরমের সাথে সাথে আর একটি বাড়ি জ্বলিয়া উঠিল।

আজিজ চলিয়া যাইবার পরে হঠাৎ সুরমার একটা কথা মনে পড়িল, মৃতদেহের উপর পথে আক্রমণ চলিতে পারে। ভাবিতেই সুরমা শিহরিয়া উঠিল। তাহার ডাক্তারের কথা মনে পড়িল। যদি ডাক্তারও তেমনি করিয়া আঘাত পায়, যদি ডাক্তারও আর ফিরিয়া না আসে। দাদাকে সে ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। দাদা তাহার চলিয়া গিয়াছে। তাহার পরে ডাক্তার একমাত্র আশ্রয়স্থল হইয়া আসিয়া দেখা দিল তাহার ভাইয়ের মৃত্যু সময়ে। নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া সে তাহার দাদার মৃতদেহের সঙ্কার করিতে গেল। কিন্তু যদি? সুরমা আর ভাবিতে পারিল না। নিজের মনে মনে বারবার সে আবৃত্তি করিতে লাগিল, না না, ডাক্তারের বচিতে হইবেই। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই অপরিচিত ডাক্তার ছেলেটি যে তাহার কত বড় আত্মীয়, কতদূর নির্ভরস্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা ভাবিয়া এত বড় বিপদের মধ্যেও সুরমার বিস্ময়বোধ হইল।

রাত্রি বারটা পার হইয়া গিয়াছে। আজিজ তখনো অমলের দেহ সৎকার করিয়া ফিরিয়া আসিতে পারে নাই। সুরমার চিন্তা ক্রমশই বাড়িতে লাগিল। সুরমার পাশের ঘরে ইমারজেন্সির কেসের রুগীদের কাতরুক্তি শোনা যাইতেছে। দূরে একটা হল্লার সাথে সুরমা চমকিয়া উঠিল। কি একটা অশুভের সম্ভাবনায় সুরমার মন শঙ্কিত হইয়া উঠিল।

রাত্রি একটার কালে আজিজ ফিরিয়া আসিল। চিতার আগুনের হষ্কার জন্য তখনো আজিজের মুখ লাল। আজিজ ফিরিয়া আসিতেই সুরমা ব্যাকুল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ডাক্তার আপনি ফিরে এসেছেন? কোনো বিপদ হয় নি তো?

ডাক্তার একটু হাসিয়া বলিল–না, সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু হয় নি। কিন্তু আমি চিন্তিত হয়েছিলুম আপনার জন্যে।

: আপনার মুখ অত লাল কেন?

: আগুনের তাপে বোধ হয়। কিন্তু সুরমা দেবী আপনি তো পরিশ্রান্ত। আপনার বিশ্রামের জন্য আমি কি বন্দোবস্ত করতে পারি? যে ঝড় এইমাত্র আপনার ওপর দিয়ে বয়ে গেল সে ঝড়ের প্রাবল্যই আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে কত বড় হয়ে এর আঘাত লেগেছে আপনার ওপরে। কিন্তু কিইবা সাধ্য আছে আমাদের এর বিরুদ্ধে? আচ্ছা সুরমা দেবী, আপনাদের বাসায় কোনো চাকর আছে?

: না, একটা চাকর ছিলো। সেও আজ দুদিন পর্যন্ত আসে না।

: আচ্ছা সে ব্যবস্থা হবে। আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি ইজি চেয়ারটায় একটু বিশ্রাম করে নিন। আমার ওয়ার্ডে আরো প্রায় গোটা বারো কেস এসে জমা হয়েছে। তাদের এ্যাডমিশন করে নিতে নিতে প্রায় সকাল হয়ে যাবে। দেখি তখন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি কি না। আমার ডিউটিও তখন শেষ হয়ে যাবে। বলিয়া আজিজ সুরমাকে একটু বিশ্রাম করিতে অনুরোধ করিয়া ডিউটিতে চলিয়া গেলো।

ডাক্তার ফিরিয়া আসিয়াছে। এতক্ষণে সুরমা একটু নিশ্চিন্তে নিজের জীবনটা লইয়া আলোচনা করিবার অবসর পাইল। সুরমা ভাবিয়া পাইল না মানুষের জীবনটা এত দ্রুত পরিবর্তিত হইয়া যায় কেমন করিয়া। তাহা না হইলে গত পরশু যে নিজের জীবন সম্বন্ধে, তাহার দাদার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কত কিছুর কল্পনাই না করিয়াছিলো। আর আজ সে সমস্ত কিরূপভাবে এক নিমেষের ফুৎকারে সব অন্ধকারে লীন হইয়া গেল। সে সমস্তকে আর দ্বিতীয়বার কল্পনা করিবার পথও তাহার রহিল না। ভাবিতে ভাবিতে সুরমা। ইজি চেয়ারে হেলান দিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।

রাত্রি প্রায় প্রভাত হইয়া আসিয়াছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চিৎকার ধ্বনি আর শুনিতে পাওয়া যাইতেছে না। দূরে কতগুলি বড় বড় কাপড়ের দোকান পুড়িয়া শেষ হইতেছিলো। তাহার মৃদু আলোকরশ্মি কিঞ্চিৎ ধুমের সহিত আকাশের দিকে কুণ্ডলী পাকাইয়া উঠিতে উঠিতে সেখানের আকাশটাকে একটু গাঢ়তর করিয়া তুলিতেছিলো। আজিজের ডিউটি শেষ হইয়া আসিয়াছিলো। হাসপাতালের গাড়িটার ব্যবস্থা করিয়া সুরমার দুয়ারে আসিয়া আজিজ ডাক দিল : সুরমা দেবী।

সুরমার তন্দ্রা ভাঙিয়া গেল। কবাট খুলিয়া বলিল, আপনার ডিউটি শেষ হলো?

: হ্যাঁ, আপাতত শেষ হয়েছে। একটা গাড়ির ব্যবস্থাও করতে পেরেছি। শহরের দাঙ্গাটা এখন একটু শান্ত আছে। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

ডাক্তারের নির্দেশমত সুরমা আসিয়া গাড়িতে উঠিল। আজিজ ড্রাইভারকে রাস্তার কথা বলিয়া গাড়িতে উঠিল।

সুরমা এতক্ষণে অনেকখানি স্বাভাবিক হইয়া উঠিতে পারিয়াছিলো। অমল থাকিতে সুরমা একটা দিনও ভাবিতে পারে নাই যে, দাদার অনুপস্থিতিতে তাহার নিজের কোনো অস্তিত্ব থাকিতে পারে। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুরমার অনেকখানি জ্ঞান, অনেকখানি অভিজ্ঞতা হইয়া গিয়াছে। দাদার মতো স্নেহ, দাদার মতো উদার হৃদয় যে আর কাহারো থাকিতে পারে সে কথাটাও সুরমা এই অল্পক্ষণের মধ্যেই বুঝিতে পারিল। গাড়িতে সম্মুখে ঐ ড্রাইভারের পাশে বসা ঐ যে ডাক্তার ছেলেটি, ভিন জাতি, ভিন ধর্ম, অথচ কত উদার। তাহার হৃদয়, কত কোমল তাহার অন্তর। একথা কি সে এই একটি রাত্রির মধ্যে কম বুঝিতে পারিয়াছে? এর মধ্যেই তো সে সুরমার দাদার অভাব কতটা পূরণ করিয়া দিয়াছে। দাদার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জানিয়াও সুরমা যখন দাদার পাশে বসিয়া তাহাকে ধরিয়া রাখিবার জন্য আকুলভাবে চেষ্টা করিতেছিলো, তখন তাহার সম্মুখে তাহার ভবিষ্যতটা কত ভয়াবহ হইয়াই না দেখা দিয়াছিলো। আর সত্যই তো, আজ এই আত্মীয়-স্বজনহীন দাঙ্গা-হাঙ্গামার। শহরে তাহার ভাইয়ের অন্তিম গতির কে ব্যবস্থা করিত। হাসপাতালের কর্মকর্তারা যদি তাহার মৃতদেহকে ডোমের হাতেই তুলিয়া দিতেন তাহা হইলেই বা সে কি করিতে পারিত। এই হাঙ্গামা মাথায় লইয়া কে তাহাকে বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতো। অথচ বেচারির না হইয়াছে একটু ঘুম না একটু বিশ্রাম। সারাটা পথ সুরমার চিত্ত ব্যাপিয়া আজিজের কথাই দোল খাইতে লাগিল। তাহার অন্তর আজিজের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায় অকৃত্রিম সহানুভূতিতে ভরিয়া উঠিল।

বাসায় নামিয়া আজিজ বলিল, সারারাত্রি আপনি একটুকুও চক্ষু বন্ধ করতে পারেন নি, সে আমি বুঝি। আর যে বিপদ এইমাত্র বয়ে গেল তার পরে একটুও বিশ্রাম করা যে কত দুঃসাধ্য সে কথা ডাক্তার হলেও আমার চেয়ে বেশি কে জানে? আপনি দেরি করবেন না। এখনি স্নানাদি সেরে নিন। আমি এই গাড়িতেই যাচ্ছি। কিছু খাবার যদি কোথাও পাই, দেখি। আর একটি বামুনকে চেষ্টা করে যদি পাই তো আমি এখনি নিয়ে আসব।….

সুরমা ভারি গলায় বলিল, আমি যদি ঘুমোতে না পেরে থাকি, আপনি যে একটু জিরোতেও পান নি। সেও তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি। না, ডাক্তার সাহেব, আপনি যা করেছেন, কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে সে অমূল্যদানকে আমি মূল্য দিতে চাই না। কিন্তু আপনিও আর দৌড়াদৌড়ি করতে পারবেন না।

একটু থামিয়া আবার বলিল, আর বামুন ঠাকুরের জন্যও এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমি নিজের হাতেই সব আপাতত করে নিতে পারব। আর আপনি। কোথায় পাবেন বামুন ঠাকুর। কে আসবে এই দাঙ্গার কালে নিজের প্রাণটুকু হারাতে। বৃথা চেষ্টা করবেন না। ওর চেয়ে আপনি দেরি না করে হাত-মুখ ধুয়ে নিন। চা বোধ হয় কিছু আছে। বিনা দুধে আমিই সত্বর যোগাড় করে আনছি। বলিয়া সুরমা আজিজকে কথার অবসর না দিয়া বাহির হইয়া গেল।

আজিজের সেবার একান্ততায় সুরমার হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিলো। এই সেবার একাগ্রতাই সুরমাকে তাহার এতবড় বিপদের মধ্যেও সান্ত্বনা আর ভরসা দিয়াছিলো। কিছুটা পরিমাণে সে তাহার নিজের দুঃখও এরই জন্য ভুলিতে পারিয়াছিলো।

আজিজ একটা চেয়ার টানিয়া লইয়া বসিয়া পড়িল। রাত্রি জাগিবার অভ্যাস তাহার আছে। কিন্তু ঘুমে ক্লান্ত না হইলেও অনেকগুলি অনেক প্রকার চিন্তা আসিয়া তাহার প্রাণশক্তিকে নিস্তেজ করিয়া ফেলিয়াছিলো। একটি আত্মীয় নাই, বান্ধব নাই, একটি বামুন ঠাকুর পর্যন্ত নাই। একা নির্বান্ধবভাবে কেমন করিয়া সুরমা থাকিবে। এই চিন্তাটাই তাহাকে বড় করিয়া পাইয়া বসিল। আজিজ বুঝিতে পারিয়াছে, এই বিপদের সময়ে আজিজের ওপর কতখানি নির্ভর করিয়া আছে সুরমা। কিন্তু সেই বা কি করিতে পারিবে। ক্ষণিকের দেখা। একে স্থায়ী করে রাখার বিপদও কি কম। হাসপাতালের ডাক্তার সে। এই দাঙ্গার কালে এই সাহায্যকে হিন্দু-মুসলমান, কেহই কি ভাল চক্ষুতে দেখিতে পারিবে? অথচ কোন হৃদয়েই বা সে সুরমাকে সম্পূর্ণ বিপন্ন। করিয়া ফেলিয়া চলিয়া যাইবে। এই সমস্ত চিন্তা আসিয়া আজিজকে উদ্বস্ত করিয়া তুলিতেছিলো। আজিজ নিজেকে মহা সমস্যায় দেখিতে পাইল।

স্নান করিয়া চায়ের ব্যবস্থা সারিয়া সুরমা চায়ের সরঞ্জাম লইয়া ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। পায়ের শব্দে আজিজ চক্ষু মেলিয়া চাহিল। ডাক্তার আজিজের চক্ষে একটা মস্ত বড় আর্ট এক্ষণে ধরা পড়িল। সবুজ সাধারণ একখানা শাড়ি পরনে সুরমার। অবিন্যস্ত চুলের কয়েকটি আসিয়া কপোলের দুই পাশ দিয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছিলো। অনিন্দ্যসুন্দর মুখে গত রাত্রির বিপদের ছায়া পড়িয়া তাহাকে আরো গম্ভীর, সুন্দর ও শান্ত করিয়া তুলিয়াছিলো। আজিজ বিস্ময়ে মুগ্ধ-প্রায় চাহিয়া রহিল।

সুরমা ঘরে পা দিয়াই বলিল, খুব ঘুম পাচ্ছে বুঝি? পাবেই তো। ঘুমের তো আর দোষ নয়। এক নিমেষের জন্য কি চক্ষের পাতা বন্ধ করতে পেরেছিলেন? কিন্তু এখনো মুখ পোননি যে? যান। আমার চা হয়ে গেছে?

আজিজ সুবোধ ছেলেটির মতো আদেশ পালন করিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিয়া বলিল, যাই। আবার প্রশ্ন জাগিল, এতো বিপদের মধ্যে এতো যে স্বাভাবিক, সে কাহার জন্য, কাহাকে আশ্রয় করিয়া?

চা ঢালিতে ঢালিতে সুরমা বলিল, আজকেও আপনার নাইট ডিউটি আছে নাকি?

: না, আজ আর নাই।

: আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ঐ রুগীদের আতধ্বনির মধ্যে থেকে কাজ করতে আপনার অসহ্য বোধ হয় না?

আজিজ বুঝিল, সুরমা নিজের দুঃখ ভুলিয়া স্বাভাবিক হইতে চাহিতেছে।

আজিজ বলিল, যতক্ষণ হাসপাতালে থাকি ততক্ষণ আমার হুঁশ থাকে না, আমি কোথায় আছি। কোনো দিনই আমি হাসপাতালে বসে নরমাল কনডিশনে থাকতে পারিনে। কি একটা ভাব, একটা ইনসপিরেশন আমাকে রুগীদের …।

***

এখানে এসে পাণ্ডুলিপির দুটি পৃষ্ঠা পাওয়া গেলো না। ছিঁড়ে গেছে। তারপরে আরো কয়েকটি পৃষ্ঠা আছে। গল্পের নায়ক-নায়িকা পরস্পরের প্রীতিতে আবদ্ধ হচ্ছে। তবু তাদের দ্বিধা আছে। দ্বন্দ্ব আছে। একের মনে প্রশ্ন: এর শেষ কোথায়? অপরের মনের প্রশ্ন: ভিনজাতের এই যে লোকটি প্রতিদিন। যে তাহাকে বিপদের আরম্ভ হইতে আলিয়া রাখিতেছে, তাহার বিপদের আরম্ভ হইতে সে যে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে অসংখ্য বিপদের মধ্যে টানিয়া লইয়া তাহাকে বিপদের আগুনের হল্কা হইতে আড়াল করিয়া রাখিল, তাহার কি কোন দাম নাই?…

তারপরে আবার ছিঁড়ে গেছে কিশোর লেখকের সেই পাণ্ডুলিপি। কেমন করে লেখক গল্পটিকে শেষ করেছিলো, তা আজ আর জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সেটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কয়টি পৃষ্ঠা পাওয়া গেল এই পাণ্ডুলিপির, তাতে অন্তত চল্লিশ বছর পূর্বের ঢাকা শহরের অধ্যয়নরত মুসলিম সমাজভুক্ত একটি কিশোরের মনের কিছু আভাস পাওয়া গেল। হয়ত এর মূল্য। আছে কিছু, চল্লিশ বছর পরের প্রবহমান জীবনের নতুন কারিগরদের কাছে। কোনো কিছুই শূন্যের ওপর তৈরি হয় না। আর তাই কিছু তৈরির সময়ে তার ভেতরে সন্ধান আবশ্যক তার জমির, সে জমির নরম, শক্ত, গভীর, অগভীর উপাদানের।…. ২০.৭.৮৩

আবে আইজ আর থাউককা

ঈদের পরদিন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এসেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাসায়, সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। এখন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে কাছে পেলে আমি জিল্লুর বলে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বোধনে ডেকে থাকি।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বেশ কয়েক বছর যাবৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ইংরেজির অধ্যাপক। বাংলাদেশের তিনি একজন সুপরিচিত কবি, প্রবন্ধকার এবং চিন্তাশীল সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তার আলাপআলোচনা কিংবা বক্তৃতাতেও বেশ একটি চারুশীলতার পরিচয় ফুটে ওঠে। পোশাক-পরিচ্ছদে অনাড়ম্বর, কিন্তু সুপরিপাটি। যে কারুর সঙ্গে আলাপে দুপ্রাপ্যরূপে ভদ্র, সুজন।

আমাকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। তারও আগে তাঁর স্ত্রী আমার স্ত্রীকে চিনতেন। তখন অবশ্য এঁরা কেউ কারুর স্ত্রী হন নি। জিরের স্ত্রী শিক্ষাজীবনে আমার স্ত্রীর কিছু বয়োকনিষ্ঠ বলে আমার স্ত্রী তাঁকে নাম ধরে ডাকেন। এঁদের সাক্ষাৎ ঘটেছিলো যখন এরা ইউনিভার্সিটিতে বি.এ এবং এম.এ পড়েন, তখন।

জিল্লুর আমাকে জানেন জেলখাটা লোক বলে। পঞ্চাশের দশকে জেলখাটা মুসলমান বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের একটা ভিন্নতর সম্মান ছিলো উন্মুক্ত মুসলমান বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তাবিদদের কাছে।

পঞ্চাশের দশকেরও বোধ হয় পরের কথা। আমি ছিলাম রাজশাহী জেলে বন্দী। হয়ত ৬০-৬১-র দিকে। আমার স্ত্রী ঢাকা থেকে আমাকে পাঠাতে চেয়েছিলেন কিছু খাবার-দাবার, টুকিটাকি। জিল্লুর তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির অধ্যাপক। জিল্লুর আগ্রহ করে তা সংগ্রহ করে। আমার জেলখানাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এ কাজটি আমার প্রতি তাঁর একটি সশ্রদ্ধ প্রীতিরই পরিচয়। তারপরে আমার নিজের বর্তমানে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার পর্যায়ে প্রায়ই আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে কোনো আলোচনার বৈঠকে কিংবা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে। কিন্তু সম্প্রতি এই পরিচয়টিকে অধিকতর ঘনিষ্ঠ করে তুলল আমাদের উভয়ের উত্তর-পুরুষগণ : তথা আমার মেয়ে এবং তার মেজ ছেলেটি। তারা উভয়ই চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত। ছেলেটি (শাকিল) মাত্র মেডিক্যাল কলেজের শেষ পরীক্ষা পাস করেছে। আমার মেয়েটি শেষ বর্ষে উঠেছে। তাদের নিজেদের জগতের বক্তৃতা, বিতর্ক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের পারস্পরিক পরিচয়। উভয়েরই সরল এবং সাহাস্য সামাজিকতার একটি গুণ আছে এবং কিছুদিন পরে উভয়েই সরলভাবে তাদের বাবা-মার কাছে বলল : তারা দুজনে সাংসারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। ছেলে, মেয়ে, কোনো পক্ষের বাবা-মারই এতে আনন্দ বই আপত্তির কোনো কারণ ছিলো না। এ ক্ষেত্রে জিল্লুরের মন্ত ব্যটি ছিলো সরস। বলেছিলেন : যা দিনকাল! ছেলে যে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করেছে, এতেই তো বাবা-মা কৃতজ্ঞ।

কাজেই জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সামাজিক আত্মীয়তার ক্ষেত্রে আজ আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ। গতকাল কিছুক্ষণ বসেছিলেন। কেমন আছেন কথার পরেই আমি বললাম : চল্লিশের দশকের ঢাকা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? আপনি কবে এসেছিলেন ঢাকা? জিল্লুর প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝলেন। সম্প্রতি চল্লিশের দশকের ঢাকা আমাকে প্রায় ভূতের মতো পেয়ে বসেছে। এর ওপর একটি লেখা এবারকার ঈদসংখ্যা সংবাদ-এ দিয়েছি। সবটা বেরোয় নি। তবু কিছুটা বেরিয়েছে। তাতে চল্লিশের দশকের ঢাকার কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য উদঘাটনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই একই সংখ্যায় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর নিজেরও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সমস্যার ওপর একটি লেখা বেরিয়েছে। একই সংখ্যায় একই পৃষ্ঠায় রাজশাহীর অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার আর এক একুশে ফেব্রুয়ারি নামে তেভাগা আন্দোলনের প্রসঙ্গ নিয়ে একটি লেখা বেরিয়েছে। এ লেখাটিও ভাল। পুরোন যে ঘটনা ও আন্দোলনে মহৎ ঐতিহ্যের সম্ভাব রয়েছে তাকে এ যুগের তরুণ ও সমাজকর্মীদের কাছে তুলে ধরার যে প্রয়োজনের কথা আমি চল্লিশের দশকের ঢাকার সূচনাতে উল্লেখ করেছি, সেই বোধ থেকেই সনৎও তেভাগার অবিস্মরণীয় কিছু ঘটনাকে আবার স্মরণ করেছেন এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রখ্যাত কৃষকনেতা আবদুল্লাহ রসুল তেভাগার কাহিনী নিয়ে যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার আলোচনা প্রসঙ্গেই ব্যাপারটি এসেছে।

জিল্লুরের কাছে আমার প্রশ্নে জিল্লুর বললেন : একে তো ছেলে আমি যশোরের এবং কলকাতার সাথে চলাচলের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক ছিলো সকাল-বিকালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তায় আমার শৈশব যদি বা কেটেছে যশোরে, কৈশোর কেটেছে জলপাইগুড়িতে, আব্বার সঙ্গে। আরো যখন একটু বড় হলাম, আই.এ পড়ার সময় এল, তখন গেলাম স্বাভাবিকভাবে কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে। ঢাকাতে তো আমি আসি নি। কিংবা সঠিকভাবে বলতে গেলে এসেছি ভাঙ্গাভাঙ্গির পরেই মাত্র, ’৪৭-এ।

আমি বললাম : তবু কলকাতা থেকে ঢাকাকে সেকালে কি চোখে দেখতেন?

জিল্লুর বললেন : ঢাকার প্রধান পরিচয় ছিলো আমাদের কাছে দাঙ্গার শহর বলে। তাই ভীতিজনক।

আমি বললাম : অথচ ৪৬-এ সাম্প্রদায়িক গণহত্যা হলো কলকাতাতে। তার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকাতেও শুরু হয়ে যেতে পারত নরমেধযজ্ঞ। কিন্তু তা যে হলো না, সে স্মৃতি আমার সচেতন গৌরবের স্মৃতি। ১৬ আগস্টের খবরে আমরাও কেঁপে উঠেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার প্রগতিশীল অংশটি। আমি তখন এম.এ পড়ি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে বেশ কিছুটা জড়িত হয়েছি। আমরা ১৭ কিংবা ১৮ আগস্ট ঢাকাতে বের করেছিলাম হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি রক্ষার শাস্তি মিছিল। সে মিছিলটি স্মরণীয় ছিলো। তার উদ্যোগ এসেছিলো বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী মহল থেকে। ঢাকার মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মীবৃন্দ যাঁরা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও যুক্ত ছিলেন এই মিছিলে। এ কারণে শাহ আজিজুর রহমান, ফরিদ আহমদ এদের মতো সেদিনকার মুসলিম ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের পক্ষে এ শান্তি মিছিলের বাইরে থাকা সম্ভব হয় নি।

শাহ আজিজের কথা উঠতে জিল্লুর বললেন, ঐ প্রেসিডেন্সিতে পড়ার কালে মুসলিম লীগ এবং শাহ আজিজের রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ আমারও একটু ঘটেছিলো। ৪৬ সালে ফরিদপুরের নির্বাচনে ভলান্টিয়ারি করেছি বলে আমারও মনে পড়ে। সেটার নেতৃত্ব শাহ আজিজই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমাদের, মোহন মিয়াকে জেতাতে হবে। মোহন মিয়াই মুসলিম লীগের আসল প্রার্থী। বাদশাহ মিয়া নন। বাদশাহ মিয়াকে সমর্থন যোগাচ্ছেন জনাব সোহরাওয়ার্দী।

জিল্লুরও যে রাজনীতির কাছাকাছি কিছুটা ছিলেন তা শুনে আমার আনন্দ হলো। শাহ আজিজকে আমি ৪২-৪৩ সাল থেকে দেখেছি। ৪৬ সালে আমার মনে হয়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। ইংরেজিতে। অবশ্য এর আগে আলীগড়ও হয়ে এসেছেন। তুখোড় বক্তা ছিলেন : ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে। অবশ্য কারুর মধ্যে এতো বেশি দক্ষতা থাকলে স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে অহমিকা আর দক্ষতার সুবিধাজনক ক্রয় বিক্রয় ইত্যাদি প্রবণতারও প্রকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে শাহ সাহেব কোনো ব্যতিক্রম ছিলেন বলে আমার স্মৃতিতে তেমন কোনো ঘটনা নেই। শাহ সাহেবের সঙ্গে বহুদিন ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ ঘটে নি। সাম্প্রতিকালে তিনি রাজপুরুষ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সরকারি নেতার স্থানেও অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

নিজের বন্ধু-বান্ধব কেউ এমন হলে তখনি আমার বেশি করে সঙ্কোচ জাগে। ব্যবধানটা তখনি বৃদ্ধি পায়। অথচ এটা ঠিক যে, চল্লিশের দশকের ঢাকার কর্মকাণ্ডে, এর প্রতি-ধারার অন্যতম নেতা হিসেবে শাহ আজিজুর রহমানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো।

দাঙ্গার শহর ঢাকা। একথা ঠিক। ক্রনিক দাঙ্গা। তবু তো ঢাকা থেকে পালালাম না কোথাও। এমন মনে পড়ে না, ঢাকাতে দাঙ্গা লেছে এবং সে কারণে হোস্টেল থেকে গাটরি-বোঁচকা বেঁধে ঢাকা ত্যাগ করে নিজ বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছি। না, তেমন কোনোদিন হয় নি। ঢাকার দাঙ্গা আমাদের সেকালের ম্যালেরিয়ার মতো আমরা সহ্য করেছি। তা নিয়ে জীবনযাপন করেছি। মহামারী আকারে ঢাকায় কখনো দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নি। গণহত্যা ঘটে নি। দাঙ্গা বাধলে তার শিকার অবশ্য নিরীহ পথচারীরা হয়েছে। যারা গ্রাম থেকে হঠাৎ শহরে এসেছে। কোনটা প্রধানত হিন্দুপাড়া, কোনটা। মুসলমান পাড়া, তা যার জানা নেই। ঢাকার মানুষ দাঙ্গায় নিহত হয়ত কমই হয়েছে। দাঙ্গা বেধেছে মহররম বা জন্মাষ্টমী উপলক্ষে। কিংবা ভারতের অপর কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় যদি কেউ নিহত হয়েছে তবেই বুঝতাম দাঙ্গা বেধেছে। দাঙ্গার এমন সংবাদে শহরটা বিভিন্ন জায়গাতে দুভাগে আপসে ভাগ হয়ে যেতো। যেমন ধরা যাক, ঢাকার মধ্যকার মূল সড়ক নওয়াবপুরের কথা। ঢাকা রেলস্টেশন থেকে নওয়াবপুর ছিলো হিন্দু এলাকা। কিন্তু নওয়াবপুর রোড যেই রায় সাহেবের বাজারের পুল পৌঁছত, অমনি শুরু হত মুসলিম এলাকা। সদরঘাট থেকে তখন আমি মুসলমান যদি রমনা আসতে চাইতাম তবে রায় সাহেবের বাজার পর্যন্ত এসে ঘোড়ার গাড়ির খেয়া ধরতাম। ইংলিশ রোড আর নাজিমুদ্দীন রোড বরাবর এই খেয়া চলত। যেন মাঝখানে একটা নদী বা খাল বিশেষ। ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানরা শেয়ারে যাত্রী নিয়ে ইংলিশ রোডের বিপজ্জনক এলাকা পার করে ফুলবাড়িয়া নাজিমুদ্দীন রোডে আমাদের পৌঁছে দিত।

দাঙ্গার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি দেখা দিতো ঢাকার বিখ্যাত দুটি পর্বের সময়ে। এদের একটি ছিলো জন্মাষ্টমীর মিছিল। জন্মাষ্টমী মানে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন : ভাদ্র মাসে পর্বটি অনুষ্ঠিত হতো। হিন্দু সম্প্রদায়ের। আর একটি ছিলো মহররমের মিছিল। হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর মিছিলের উদ্যোগ নিত হিন্দু মধ্যবিত্ত তরুণরা এবং শাঁখারী পট্টি বা নওয়াবপুরের স্থানীয় অধিবাসীরা। এই মিছিল হয়ত শুরু হতে সদরঘাট বা তারও পূর্বের লালকুঠি, লোহারপুল ইত্যাদি এলাকা থেকে। বহু চলন্ত মঞ্চে নানা রঙ্গ-তামাশা মঞ্চস্থ হতো। এই সব চলন্ত মঞ্চ আস্তে আস্তে অগ্রসর হত নওয়াবপুর রোডের মধ্য দিয়ে। দুপাশে রাস্তায় এবং বাড়ির বারান্দা ও ছাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মিছিল দেখত। দূর-দূর গ্রাম থেকে শিশু কিশোর বৃদ্ধ বৃদ্ধারা আসত। জন্মাষ্টমীর মিছিল দেখা একটা পুণ্যের কাজ বলে তারা মনে করত। মহররমের মিছিলও তাই। তাজিয়া বেরুত। হায় হাসান, হায় হোসেন করে শোক মিছিল বেরুত। আজকাল জন্মাষ্টমীর মিছিল একেবারে বিলুপ্ত। মহররমের মিছিলেরও সেই শান আছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে দুটো জিনিস আমার স্মৃতিতে ভাসে। একটি হচ্ছে, চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে এই দুটি মিছিলের উপলক্ষ এলেই আমরা অর্থাৎ বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহল উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতাম, পাছে না এই উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেধে যায় এবং যাতে তা না বাধে তার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হতো। এমন কমিটি গঠনের মূল উদ্যোগ আসত সেদিনকার ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। তারাই গায়ে পড়ে, উদ্যোগ নিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের যৌথ মিটিং করতেন। এমন মিটিং অনেক সময়ে নওয়াব বাড়িতে কিংবা ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ঢাকা বিভাগের কমিশনারের অফিসেও অনুষ্ঠিত হতো। যখন উত্তেজনা বেড়ে যেত তখন শান্তি কমিটি এবং সরকারি প্রশাসন উভয়ই যৌথভাবে ব্যবস্থা নিয়েছে কিভাবে শান্তি রক্ষা করা যায়। নওয়াবপুর পুল যেন ছিল দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত। সরকারি ফৌজ নওয়াবপুর পুলের ওপর একদল উত্তরমুখো অর্থাৎ হিন্দু এলাকার দিকে আর একদল দক্ষিণমুখো অর্থাৎ মুসলিম এলাকার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এমন দৃশ্য চোখ বুজলে আমি এখনো দেখতে পাই।

ঠিকই, উত্তেজনা রাজনৈতিক কারণে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ধর্মীয় মিছিল ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করছিলো। জন্মাষ্টমীর চলন্ত রঙ্গমঞ্চে হয়ত বা জিন্নাহ সাহেবকে নিয়ে কৌতুক করা হচ্ছে কিংবা অপর কোনো রাজনৈতিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। তারই পাল্টা মহররমের সময়ে মহররমের মিছিলে মুসলিম লীগ অর্থাৎ মুসলমানদের প্রধান রাজনৈতিক ধারা যে-সব নেতাকে হেয় করতে চাইত তাদের মূর্তি বা কুশপুত্তলিকা দাঁড় করিয়ে মঞ্চ তৈরি করে তা চালিয়ে নিতো। জিন্নাহ সাহেবকে যেমন হিন্দু সমাজ পছন্দ করতো না, তেমনি মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক গোড়াপন্থীগণ কংগ্রেসের অন্যতম মুসলিম নেতা মওলানা আজাদকে পছন্দ করতো না। তারা তাঁকে মনে করতো কওমের বিশ্বাসঘাতক বা গাদ্দার বলে। আর তাই মহররমের মিছিলে চলন্ত মঞ্চে তাঁকে বিচার করার একটি ব্যঙ্গ অনুষ্ঠানের কথা আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে।

এসবই ছিলো রাজনৈতিক দাহ্য পদার্থ। আর তাই চল্লিশের দশকের গোড়াতে ঢাকাতে এই দুটি মিছিল দেখার যদি আগ্রহ ছিল আমার মনে, পরবর্তীকালে একজন সচেতন কর্মী হিসেবে এই দুটি মিছিলের সময় হলেই উদ্বেগে আশঙ্কায় মন ভরে উঠতো।

যে শান্তি রক্ষার প্রচেষ্টার কথা বলেছি তা সেদিন হয়তো ভয়ানক কিছু ছিলো না। এ সব সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা যে না ঘটেছে, তা নয়। তবু জন্মাষ্টমী আর মহররমে যে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটত ঢাকায়, তাতে অশুভ শক্তির বাইরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি এবং সহনশীলতা এবং আনন্দভোগের মনোভাবটি প্রধান না হলে ১৯৪৬-এর আগস্টে কলকাতায় যা ঘটেছে তা ঢাকায় প্রতিবছর অন্তত দুবার করে ঘটতে পারতো। তেমন যে ঘটে নি, তার কারণ নিয়ে আমাদের তরুণ গবেষকদের কি একটু গবেষণা করা উচিত নয়?

এই প্রসঙ্গে দাঙ্গার ক্ষেত্রেও ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের রসবোধের যে বৈশিষ্ট্য এককালে সুপরিচিত ছিলো, তার উল্লেখ করা যায়।

আগামসিহ্ লেন মুসলমান পাড়া। বেচারাম দেউড়ী হিন্দুপাড়া। দাঙ্গা চলছে। দাঙ্গার আবহাওয়া। দাঙ্গা কেবল ছুরি দিয়ে হয় না। আগামসিহর ইট পড়ছে বেচারাম দেউড়ীর টিনের চালে। বেচারাম দেউড়ীর ইট আগামসিহতে। বিরামহীনভাবে ইটের উত্তর প্রত্যুত্তর চলতে চলতে রাত দশটা পার হয়েছে। ঘুমের সময় এসে গেছে। তখন আগামসিহ্ ঢাকাইয়া ভাষায় ডাক দিয়ে বলছে : আবে, আইজ আর থাউকা, ঘুমা। আবার কাইলকা ছুরু করিছ। বেচারাম দেউড়ী জবাব দিচ্ছে : ঠিক আছে।….

অগ্রজপ্রতিমকে স্মরণ করি

 প্রয়াত অধ্যাপক এ কে নাজমুল করিমের লেখা ফায়ুনকরা। কিন্তু নাজমুল করিম লেখক হিসেবে স্পষ্টভাবে নিজের নাম ব্যবহার করেন নি। লেখকের নাম লিখেছেন, ইবনে রশিদ, অর্থাৎ রশীদের পুত্র। নাজমুল করিমের পিতা ছিলেন শিক্ষাবিদ আবদুর রশিদ। কুমিল্লা জেলার মানুষ। নাজমুল করিম তাঁর বাবা, মা, দাদা, নানা, পূর্ব-পুরুষদের জীবনের, তাদের সময়কার সমাজের ঘটনা, কাহিনী, কিংবদন্তি, সংস্কার–এই বইতে বর্ণনা করেছেন তৃতীয় পুরুষ হিসেবে। এর মধ্যে ভেসে উঠেছে পূর্ববঙ্গের একটি গ্রামের একটি মুসলিম পরিবারের ক্রমবিকাশের কাহিনী। লেখকের লেখার ধরনটি প্রাঞ্জল। কথা ছোট ছোট সহজ বাক্যে আবদ্ধ। তাঁর বিবৃত কাহিনীতে উনিশের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকের গ্রামীণ সমাজচিত্রেরও আভাস পাওয়া যায়।

এই ‘ফাল্গুনকরা’র প্রকাশকাল দেখা যায় ১৯৫৮ সাল। নাজমুল করিমের একটি সমাজতাত্ত্বিক তথা সমাজের বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর ফাল্গুনকরা বইতে বেশ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যদি তাঁর জীবনের পরবর্তীকালের কর্মকাণ্ড এবং তার ফলের কথা বাংলাতে প্রকাশ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান প্রভূতভাবে উপকৃত হতো। নাজমুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মহাবিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য একজন মিশনারির ঐকান্তিকতা, উদ্যোগ ও পরিশ্রম নিয়ে কাজ করেছেন। এজন্য বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানের অগণিত ছাত্র-শিক্ষক তাঁর গুণমুগ্ধ এবং ভক্ত। তাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন।

নাজমুল করিমের সঙ্গে আমার নিজের সম্পর্ক ছিলো পারস্পরিক স্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক। নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই অসময়ে এবং আকস্মিকভাবে তাঁকে তাঁর জীবনের প্রিয় প্রতিষ্ঠান এবং কর্মপ্রবাহকে পরিত্যাগ করে যেতে হয়েছে। ফারুনকরা-তে যে জ্যেষ্ঠ ভাই সম্পর্কে তিনি এত বিস্ত রিত লিখেছেন এবং নিজেকে নেপথ্যে রেখেছেন, তিনি শুনেছি আজো সৌভাগ্যবশত জীবিত এবং কর্মক্ষম রয়েছেন। এটি নাজমুল করিমের পরিবারবর্গের নিকট যেমন আনন্দের, তেমনি নাজমুল করিম, যিনি তাঁর পরিবারের অন্যতম গর্ব এবং গৌরবের পাত্র তাঁর এই অকাল বিয়োগ তাঁদের নিকট এক দুঃসহ আঘাত-স্বরূপ।

নাজমুল করিমকে স্মরণ করতে চাইলে আমার নিজের মন চলে যায় দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর আগের কালে। সে সময়টা আমার যেমন কিশোরকাল, তেমনি নাজমুল করিমেরও তরুণকাল। ১৯৪০-৪১ সাল আজকের চুরাশি সাল থেকে চুয়াল্লিশ বছর পেছনের কাল। মহাকালের পরিমাপে এটি ক্ষণকালও নয়। তথাপি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এই সময়টাতেই আমাদের দেশ ও সমাজের এত বিচিত্র পরিবর্তন এত দ্রুত সংঘটিত হয়েছে যে চুরাশি থেকে পেছন ফিরে তাকালে সেই চল্লিশের ঢাকার পরিবেশ ও জীবনকে এক ছায়াঘেরা, নির্ঘ রোমান্টিক জীবনের যুগ বলে মনে হয়।

আমি নিজে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বরিশাল থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৪০-এর মধ্যভাগে। ঢাকা কলেজ তখন ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের চিহ্নধারাক কার্জন হলের অপর পারে লাভবনে স্থাপিত। কেবল যে আমি, তা নয়। সেদিন যে পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষক বা মধ্যবিত্ত সমাজের কিশোর ও তরুণরা ক্রমেই অধিক সংখ্যায় ঢাকায় আসতে শুরু করেছিলো এবং এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের প্রাসাদোপম ভবনরাজিতে প্রবেশ করছিলো, এ ঘটনাও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে পরিবর্তনের এক স্মারক।

ঢাকা কলেজে আমি নাজমুল করিমের সাক্ষাৎ পাই নি। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই লুৎফুল করিমের আমি সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। আমুদে মানুষ লুৎফুল করিম ছিলো আমার সহপাঠী। ঢাকা কলেজের হোস্টেল তথা তার ছাত্রদের আবাসিক ভবন, বর্তমানে ফজলুল হক হলে, লুৎফুল করিমসহ আমাদের সমদৃষ্টি এবং মেজাজের একটি কিশোর দল গড়ে উঠেছিলো। এরা এক সাথে উঠত, বসত, জোট করে বই পড়ত, সাহিত্যের মটিং করতো, হাতে লেখা সাহিত্যপত্র প্রকাশ করত। এদের মধ্যে ছিলো আবুল কাসেম, নাসিরউদ্দিন আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল মতিন, এ এইচ এম কামালউদ্দিন। এঁরা সকলেই পরবর্তী জীবনে শিক্ষা, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠা এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিন্তু সেদিনের কথা স্মরণ করলে আজকের সমস্যাপীড়িত আমাদের কোনো মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। ভেসে ওঠে সেদিনের জীবনোচ্ছল কয়েকটি তরুণের মুখ।

নাজমুল করিম তখন হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ক্লাসের ছাত্র। তিনি থাকতেন আজকের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ভবন এবং সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দোতলার একটা দিকে। সেই ভবনেই তখন ফজলুল হক হল ছাত্রাবাসের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।

কেমন করে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিলো, তা আজ স্মরণে নেই। কিন্তু ১৯৪২ সালে আই.এ পাস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পূর্বে যে ঘটনায় আমরা স্নেহ-শ্রদ্ধা এবং হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম, সে ঘটনা বিস্মৃত হই নি। বলা চলে সে এক রাজনৈতিক ঘটনা।

নিস্তরঙ্গ ঢাকার বুকেও তখন ছোটবড় ঢেউ জাগতে শুরু করেছিলো। ১৯৪০ সালে ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়ে উঠছিলো। তার ঢেউ ঢাকার ছাত্রদের মধ্যে প্রধানত এসে আঘাত করতে কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির হিন্দু-তরুণ তরুণীদের মধ্যে। তারা ধর্মঘট আহ্বান করতো। মিছিল বের করতো। তারাই পুলিশের লাঠিপেটা খেত। মুসলমান ছাত্ররা তার যে বিরোধিতা করতো, তা নয়। কিন্তু গভীরভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে সেই দৈনন্দিন আন্দোলনে যে তারা জড়িত হতো না, সে কথাও সত্য। কিন্তু সাধারণভাবে কিংবা সামগ্রিকভাবে মুসলিম ছাত্ররা এতে জড়িত না হলেও ইংরেজ সরকার বিরোধী এরূপ জঙ্গী ছাত্র আন্দোলন মুসলমান সমাজের ছাত্রদের মধ্যে কারো কারো মনকে যে আলোড়িত করে তুলত না, তাদের মনেও যে প্রশ্নের উদ্রেক করত না, এমনও নয়। এরই প্রভাবে সেকালে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যেও, ক্ষুদ্র হলেও, একটা জাতীয়তাবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি হতে থাকে।

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মুসলিম লীগ সম্মেলনে গৃহীত হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবে ঢাকার মুসলমান ছাত্রসমাজ সেই আন্দোলনের আকর্ষণে আলোড়িত হয়ে ওঠে। কিন্তু ৪২-৪৩ সালে মুসলমান সমাজের রাজনীতিও অখণ্ড ছিলো না। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধের ফলে বাংলাদেশের কৃষক ও মধ্যবিত্ত সমাজের অবিসংবাদিত নেতা এ.কে. ফজলুল হক আইন পরিষদে ভিন্ন দল গঠন করেছেন এবং আইন পরিষদে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে মিলিত হয়ে মন্ত্রিপরিষদও গঠন করেছেন। হক সাহেবের সঙ্গে রয়েছে ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ। মুসলিম সমাজের এই বিভেদে ক্ষুব্ধ হয়ে লীগপন্থী ছাত্র এবং তরুণরা নিন্দাসূচক ভাষায় এই মন্ত্রিসভাকে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা বলে অভিহিত করছে। এমনি অবস্থায় হক সাহেবর ঢাকা আসার কথা ঘোষিত হলো। নবাব হাবিবুল্লাহর তখন ঢাকার বাইরে না হলেও ঢাকার স্থানীয় মুসলমান অধিবাসীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা। কেননা তিনি ঢাকার নবাব। আর ঢাকার নবাব তখনো ঢাকার মুসলমানদের সমাজ নমাজের প্রধান পুরুষ। কিন্তু সে প্রভাব রেললাইনের দক্ষিণ পাড়েই সীমাবদ্ধ। ঢাকার রেললাইন ছিলো সেদিন মুসলিম সমাজের ক্ষেত্রে, অন্তত নতুন পুরাতনের বিভক্তি লাইন। রেলাইনের উত্তর পাড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর তার ছাত্রাবাস সলিমুললাহ এবং ফজলুল হক হলে অবস্থান করে মুসলমান ছাত্রবৃন্দ। এদের সকলেই, বলা চলে, অ-ঢাকাবাসী তথা বহিরাগত।

কিন্তু যে কারণে একথার উত্থাপন সেটি হচ্ছে এই যে, নতুন পুরানের দ্বন্দ্ব যে সর্বদা সহজভাবে প্রকাশ পেত, তা নয়। নতুন ঢাকার সকল মুসলমান ছাত্রই যে সেদিন মুসলিম লীগ এবং মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃত্বে চলত, এমন নয়। তারই প্রকাশ ঘটলো ৪২-এর গোড়ার দিকে, হক সাহেবের ঢাকা আগমনকে কেন্দ্র করে।

হক সাহেব ঢাকা আসবেন। সবেমাত্র তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। কাজেই ঢাকার অধিবাসীদের তরফ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা জানাবার আয়োজন। হলো। এই সংবর্ধনা নিয়েই ঢাকার মুসলিম ছাত্রসমাজ যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। এক দল অভিহিত হল প্রো-হক বা হক সমর্থক বলে, অপর দল এ্যান্টি হক বা হক-বিরোধী বলে।

ফজলুল হক হলে নিশ্চয়ই প্রো-হকদের নেতৃস্থানীয় ছিলেন এ.কে, নাজমুল করিম। নাজমুল করিম তার কলেজ জীবন থেকেই কলেজের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন, আলোচনা, বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করে। এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর অনুরক্ত একটি দল স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়েছিলো। এ দলটির বৈশিষ্ট্য ছিলো, এ দলের ছাত্ররা চিন্তা এবং বুদ্ধিতে তীক্ষ্ম, মতবাদে সমাজতাত্ত্বিক, অসাম্প্রদায়িক এবং খানিকটা সমাজবাদীও। সংবর্ধনা নিয়ে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে প্রো-হক ও এ্যান্টি হকদের মধ্যে সংঘর্ষও ঘটেছিলো। প্রো-হকদের প্রধান জমায়েত ছিলো ঢাকার স্থানীয় অধিবাসী, যারা কুট্টি নামে সাধারণত অভিহিত হতেন এবং এ কারণে স্টেশনে প্রো-হক পক্ষই ছিলো প্রধান এবং এ্যান্টি হক ছাত্ররা হয়েছিলো পরাজিত। কিন্তু পর্যদস্ত দল অর্থাৎ মুসলিম ছাত্রাবাসের রাজনৈতিক ছাত্রদের অধিকাংশের দল প্রতিশোধ নিল হলে ফিরে এসে প্রো-হকদের ওপরে। নাজমুল করিমের বিছানাপত্র তারা তছনছ করল, ফেলে দিল উপর থেকে নিচে। ফজলুল হক হলের এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমার নিজের জানা নেই। কিন্তু ঢাকা কলেজের হোস্টেলের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যেও যে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া পড়েছিলো তা আমি সাক্ষাভাবেই জেনেছিলাম। কলেজ ছাত্রাবাসের আমার দলটিও ঘটনাক্রমে প্রো-হক বলে বাকি ছাত্রদের দ্বারা অভিহিত হলো এবং এই ছাত্রাবাসের মুসলিম লীগপন্থী ক্ষুব্ধ ছাত্ররা স্টেশন থেকে ফিরে এসে আমাদের ওপরও রূঢ় আচরণে আঘাত হানার চেষ্টা করল। আমাদের মধ্যে নাজমুল করিমের অনুজ লুণ্ডুল করিম ছিলো অধিক পরিমাণে খোলামুখ। খাওয়ার ঘরে যাওয়ার সময়ে আক্রমণ হল তার ওপর। দৈহিকভাবে আঘাত আমার ওপর না এলেও হোস্টেলের পরিবেশ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে বেশ গরম এবং পড়াশোনার প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াল। এমনি অবস্থাতে হোস্টেল ছেড়ে আমি বরিশালে নলছিটি শহরে আমার চাকরিরত বড় ভাইয়ের কাছে গিয়ে আই.এ পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। এ ঘটনা স্মরণে পড়ছে এই জন্য যে, মাস দুই পরে আই.এ পরীক্ষা দিয়ে আবার বরিশাল গিয়ে অপেক্ষা করছি পরীক্ষার ফলের জন্য। তখন একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে নাজমুল করিমই আমার ভাইয়ের ঠিকানায় টেলিগ্রাম করে আনন্দের সঙ্গে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আমি ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষাতেই আই.এ-তে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছি, এতে আমার চাইতে তাঁরই আনন্দ এবং গর্ব ছিলো বেশি।

এর পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাজমুল করিমের অধিকতর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটিতেও নাজমুল করিমকে কেন্দ্র করে একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গ্রুপ তৈরি হয়েছিলো। এরা যে কেবল মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ছিলো তা নয়। নাজমুল করিমের সহপাঠী ছিলেন রবি গুহ। তিনি ছিলেন সমাজতন্ত্রবাদী এবং কমিউনিস্ট। তাঁদের মতাবলম্বী ছাত্রদলের নাম ছিলো ছাত্র ফেডারেশন। রবি গুহ এবং তাঁর অপর বন্ধুরা, যাদের মধ্যে ছিলেন মদন বসাক, অনিল বসাক, দেবপ্রসাদ মুখার্জি এবং হেসামুদ্দিন আহমদ-এঁরা সকলেই ছিলেন কমিউনিস্ট কর্মী। ৪২ কিংবা ৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিলো, যাতে প্রাণ হারিয়েছিলো মুসলিম ছাত্রনেতা নাজির আহমদ, সে দাঙ্গার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন নাজমুল করিম, হেসামুদ্দিন (বাহাদুর), রবি গুহ এবং তাঁর অপর বন্ধুরা। এবং দাঙ্গাবিরোধী মনোভাবের কারণে তারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ছাত্রদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিতও হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রী মনোভাবাপন্ন গ্রুপের সঙ্গে পরবর্তীকালে এসে যুক্ত হয়েছিলো মুনীর চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী ক্রমান্বয়ে তার বাকশৈলী, তীক্ষ্মধার বুদ্ধি এবং পরিহাসপ্রিয়তার সেদিনকার ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্রমনি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আমি নিজে ছিলাম দর্শন বিভাগের ছাত্র। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ত অধিকতর তৈরি হয়েছিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেরই ছাত্র এবং শিক্ষকবৃন্দের সঙ্গে। নাজমুল করিম, রবি গুহ, দেবপ্রসাদ মুখার্জি-এঁরা ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ডি. এন. ব্যানার্জি, এ.কে সেন এবং আবদুর রাজ্জাক–এঁরা ছিলেন যেমন নাজমুল করিম, রবি গুহের প্রিয় শিক্ষক, তেমনি আমারও বস্তুত নাজমুল করিম-রবি গুহের মাধ্যমেই আমি পরিচিত হয়েছিলাম এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সঙ্গে। আমার অনার্সের অনুষঙ্গী বিষয়েরও একটি ছিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান। নাজমুল করিম তাঁর পরবর্তী জীবনের শিক্ষকতা ও গবেষণার জীবনে এঁদের কথা, বিশেষ করে অজিতকুমার সেনের কথা, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। নিজের একখানি গ্রন্থের উপক্রমণিকাতে বলেছেন : আমার সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার অনুপ্রেরণাদাতা হচ্ছেন অজিতকুমার সেন। অজিত সেন যথার্থই একজন বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন। আচার-আচরণে তিনি ছিলেন অভিজাত। শুভ্র ধুতি এবং পাঞ্জাবি ছাড়া অপর কোনো পরিধানে তাঁকে কখনো দেখেছি, এমন কথা স্মরণ করতে পারিনে। কথা বলতেন ধীর উচ্চারণে এবং বাংলায়। কেবল যে ব্যক্তিগত আলাপে বাংলা ব্যবহার করতেন, তা নয়। ক্লাসে আলোচনা করতেন বাংলায়। আমাদের টিউটোরিয়াল খাতা সংশোধন করে তার পাশে মন্তব্য করতেন বাংলায় এবং বিভাগে নিজের চাকরিগত ছুটি বা অন্য কোনো প্রয়োজনের বিষয়ে বিভাগীয় প্রধান বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সম্বোধন করে চিঠিপত্র রচনা করতেন বাংলায়। সুন্দর হস্তাক্ষরে তৈরি তার সেসব মন্তব্য বা যোগাযোগপত্রে কোনো কৃত্রিমতা ছিলো না। বরঞ্চ তাঁর নিজের আচার-আচরণের সরল ও সতেজ ভাবটি সেদিনকার। ইংরেজি বচন-বাচন, পোশাক-আশাক পরিবেশকেই করত ব্যঙ্গ। নাজমুল করিম-রবি গুহের সঙ্গেই আমার যাতায়াত শুরু হয়েছিলো অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বাসায়। সেকালে আমরা যে শ্রেণীকক্ষেই কেবল আমাদের শিক্ষকদের আলোচনা শুনতাম, তা নয়। সেদিনকার সেই রোমান্টিক পরিবেশকে যে উপাদানটি আরো গাঢ় এবং ঘন করে তুলতে তা শিক্ষক ও ছাত্রদের পারস্পারিক নৈকট্য ও সাহচর্য। ব্যাপারটি হয়ত ব্যাপকভাবে ঘটতো না। কিন্তু বুদ্ধিমান, লেখাপড়ায় আগ্রহী ছাত্রদের জন্য খ্যাতিমান শিক্ষকদের কেবল দরজা নয়, তাঁদের বাসগৃহের কক্ষও ছিলো অবারিত। অনার্স এবং এম.এ-তে ছাত্রসংখ্যা অবশ্য তখনো কম ছিলো। এবং এদের মধ্যে যারা মেধাবী ছিলো তারা জ্ঞানের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সময়-অসময় নির্বিশেষে চলে যেত শিক্ষকদের রমনার নীলক্ষেতের সড়কের এপাশে-ওপাশের ভবনগুলোতে। আমার নিজের অনার্সের শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্য যেমন ছিলেন দর্শন বিভাগের প্রধান, তেমনি ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। নিজে থাকতেন যে ভবনটিতে, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের রাস্তার বিপরীতে, সেটি আজ বিলুপ্ত। তার জায়গাতে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে শিক্ষকদের বহুতল আবাসিক ভবন। কিন্তু সেদিন হরিদাস বাবুর ভবনের সামনে ছিলো একটি পুকুরও। এবং তাতে ছিলো বাঁধানো ঘাট। তাঁর এই ভবনটিতে তিনি আমাদের ডেকে নিতেন অনেক সময়ে ক্লাসের অসমাপ্ত আলোচনা সমাপ্ত করার জন্য। বলতেন, চলো বাসায় যেতে যেতে কথা বলি। কিংবা বলতেন, কাল সকালে এসো বাসায়। তখন আলোচনাটা শেষ করে দেবো। রাজ্জাক স্যারের বাসার ছিলো ভিন্ন আকর্ষণ। আপ্যায়ন তো বটেই। সহৃদয়, সমৃদ্ধ আপ্যায়ন। ছুটির দিনে সকাল না হতেই আমাদের মনে একটা টান উঠত। হয়ত নাজমুল করিম। বলতেন, তাঁর স্মিত মুখে, কি সরদার যাবেন নাকি আজ রাজ্জাক স্যারের বাসায়? এমন আহ্বানে না বলার কোনো ব্যাপার থাকতো না। রাজ্জাক স্যার নিজে যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতেন, তা নয়। কিন্তু তাঁকে প্রশ্ন করতে আমাদের ভালো লাগত। প্রশ্ন করলেই তিনি আনন্দিত হতেন এবং যে-কোনো বিষয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের কেবল যে দরাজ মনে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা দ্বারা সাহায্য করতেন, তাই নয়, তাঁর নিজের গ্রন্থ-সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার থেকে অকৃপণভাবে বই দিয়ে তাঁর ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। এমন যাতায়াতের কথায় স্মৃতিতে এখনো ভেসে ওঠে তাঁর জেলখানার দিকে যাওয়ার রাস্তার পূর্বপাশের একটি ছোট ঘরের দৃশ্য। একখানি তক্তপোশে নামমাত্র চাদর বালিশ তার শয্যা। কাঠের চৌকিখানার কোনো একটি পা হয়তো-বা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঘরে আর যা কিছুর অভাব থাকুক, রাজ্জাক স্যারের ঘরে বইয়ের কোনো অভাব ছিলো না। এমন পরিবেশেই তৈরি হয়েছিলেন নাজমুল করিম। তৈরি হয়ে উঠেছিলাম সেদিন আমরা।

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢাকা হল আর জগন্নাথ হলের ছাত্ররাই তাদের বার্ষিক পত্রিকার নাম দিত বাংলা শতদল আর বাসন্তিকা। এবং তাদের তৈরিও করত সাহিত্য পত্রিকার সম্ভার ও সৌকর্য দিয়ে। তুলনাতে মুসলিম ছাত্রাবাস দুটির বার্ষিক পত্রিকার চেহারা ছিলো দো-আঁশলা তথা দোভাষী। এ মাথায় বাংলা তো, ও মাথায় ইংরেজি। তাছাড়া আকারে প্রকারে তাদের মনে হতো চপল এবং সামান্য। এই ট্রাভিশনে ভাঙন ধরাবারও চেষ্টা করেছিলাম আমরা, মানে নাজমুল করিম ও তার সঙ্গীসাথীরা। আমরা ফজলুল হক হলের বার্ষিকীর নামকরণ করেছিলাম কেবল হল বার্ষিকী বা হল এ্যানুয়ালের পরিবর্তে কলাপী। ইংরেজিতে কোনো রচনা গ্রহণ করা হয় নি এতে। বাংলাতে যাঁদের লেখা ছিলো তাতে, আমার নিজের একটি লেখা ছাড়া, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আহমদ শরীফ, মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, সানাউল হক, নাজমুল করিম, সৈয়দ নুরুদ্দিন, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সেরাজুন নূর, মনিরউদ্দিন ইউসুফ, আলীম আল রাজি, আবদুস শুকুর–এঁরা। এঁদের বাংলা রচনায় কলাপীর প্রথম সংখ্যাটিই হয়ে উঠেছিলো সেদিনকার মুসলিম ছাত্রদের সাংস্কৃতিক পরিবেশে এক ব্যতিক্রম সৃষ্টিকারী প্রকাশনা। যথার্থই ব্যতিক্রমী। কারণ আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে চলে আসার পরে সাহিত্যিক এই উদ্যোগের অনুসরণে কলাপীর দ্বিতীয় সংখ্যাও আর প্রকাশিত হয় নি। কেবল হলের এই উদ্যোগ নয়। নাজমুল করিম, আহমদুল কবির, সানাউল হক, এ.কে.এম. আহসান–উচ্চতর ক্লাসের অন্য প্রগতিশীল ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মুখপত্ররূপে সেদিন অর্থাৎ ৪৪ কিংবা ৪৫ সালে যে সাহিত্যপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিলো সেটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র হিসেবে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতার প্রগতিশীল সাহিত্যিক মহলে রীতিমত বিস্ময়ের সঞ্চার করেছিলো।

হয়ত বা এই সাহিত্যপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিলো নাজমুল করিমের সেই লেখাটি যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ভূগোল ও ভগবান। সেই লেখাটিতেই প্রকাশ পেয়েছিলো নাজমুল করিমের সমাজ বিশ্লেষণমূলক সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটি। প্রবন্ধটি হয়ত বা তাঁর পারিবারিক বইপত্রের মধ্যে আজো পাওয়া যাবে। অন্যত্র পাওয়া যায় নি। আমি উদ্ধার করতে পারি নি। কিন্তু পারিবারিক সূত্রে পাওয়া গেলে, লেখাটি পুনর্বার মুদ্রণের উপযুক্ত। লেখাটি যে দীর্ঘ ছিলো, এমন নয়। কিন্তু লেখাটির পরিবেশনায় সাবলীলতা এবং রসবোধে পরিচয় ছিলো। তাছাড়া তার প্রতিপাদ্যটি ছিলো সমাজতাত্ত্বিক। লেখার গোড়াতেই প্রশ্নটি ছিলো, ভগবান ভূগোল সৃষ্টি করেছেন, না ভূগোল ভগবানকে সৃষ্টি করেছে? নাজমুল করিম প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করলেন : দূর উত্তরের শীতের জগতের এস্কিমোদের দেশ শাপল্যাণ্ডের গল্প। খৃস্টান ধর্মপ্রচারকারী এক যাজক গিয়েছেন এস্কিমোদের মধ্যে খ্রিস্টানধর্ম প্রচারের জন্য। ধর্মের পিতার কাছে সরল, নিরীহ, শীতার্তদের নানা প্রশ্ন, ঈশ্বরের স্বর্গে কি কি দ্রব্য পাওয়া যায়? খুরমা, খেজুর, মেওয়া, বাদাম, পেস্তা, শরবত : এসব পাওয়া যাবে মৃত্যুর পরে স্বর্গে গেলে। এবং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলে স্বর্গে যাওয়া তোমাদের নিশ্চিতই ঘটবে। ধর্মীয় পিতার এত ওয়াদাতেও শীতার্ত এস্কিমোদের মন ভরে না। তবু তাদের প্রশ্ন থাকে, ঈশ্বরের স্বর্গে অপর যা কিছুই পাওয়া যাক না যাক, তাদের প্রিয় সীল মাছকে পাওয়া যাবে কি না? নাজমুল করিম এ গল্প নিশ্চয়ই শুনেছেন। তাঁর প্রিয় অধ্যাপক অজিতকুমার সেনের কাছ থেকে। অজিতকুমার সেন তাঁর প্রিয় ছাত্রদের শুনিয়েছেন সমাজতাত্ত্বিক সেই গ্রন্থের করা যেখানে উদ্ধৃত আছে সমাজতত্ত্বের এমন তাৎপর্যপূর্ণ সব গল্প। নাজমুল করিম তার প্রবন্ধে লিখেছেন, ধর্ম প্রচারক খ্রিস্টীয় পাদ্রী এস্কিমোদের আর সব প্রশ্নের জবাব ঠিকই দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার স্বর্গে সীল মাছ পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চিত জবাব তিনি সরল এস্কিমোদের দিতে পারেন নি। এস্কিমোদের জন্যও তাই এমন ধর্মের আকর্ষণ প্রবল হয়ে ওঠে নি। কারণ, যে স্বর্গে সীল মাছ নেই, সে স্বর্গ দিয়ে এস্কিমোরা কি করবে। নিবন্ধের বক্তব্য তাই, ভূগোলই ভগবানকে তৈরি করেছে। তাই কোনো এলাকার স্বর্গে ঠাণ্ডা শরবতের নহর প্রবাহিত হয়, কোনো এলাকার স্বর্গে সীল মাছ থাকার প্রশ্ন আসে।

আমাদের ফজলুল হক হলের ১৩৫১ তথা ১৯৪৪ সালের বার্ষিকীটির নামকরণ করেছিলাম আমরা কলাপী। সে কথা আমি ওপরে বলেছি। এই সংখ্যায় নাজমুল করিমের একটি রচনা প্রকাশিত হয়। লেখাটির নাম অবকাশ ও সভ্যতা। নাজমুল করিম হয়ত তখন এম.এ ক্লাসের শেষ পর্বের ছাত্র। এই লেখাটিতে তরুণ নাজমুল করিমের সমাজবাদ সমর্থনকারী মনোভাবের একটি সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। ৪০ বছর আগের কথা। লেখাটিকে ৪০ বছর পরে আবার পাঠ করে আমার ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে, মানুষের যৌবনের সৃষ্টিই তার আবেগে, আন্তরিকতায় শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। নাজমুল করিমের প্রবীণ বয়সে এই লেখাটির কথা তাঁর নিজের মুখে আর শুনেছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো লেখাটিকে জীবনের নানা টানাপড়েনে এবং ঘটনা-দুর্ঘটনায় পোড়-খাওয়া অধ্যাপক নাজমুল করিম কিশোরকালের কাঁচা রচনা বলে গণ্য করেছেন। একে নিজের বলে আর গর্ব বা দাবি করেন নি হয়ত এমন আশঙ্কায়, পাছে এই ডান বামের টানাটানি আর দ্বন্দ্বের যুগে তাকে কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু আজ যদি নাজমুল করিমের দীর্ঘদিনের শিক্ষাদানের দীক্ষায় দীক্ষিত তরুণরা তার গবেষণামূলক অপর রচনায় মুগ্ধ হন তবে তাদের যুবক নাজমুল করিমের এই রচনার কথাটিও জানতে হয়। লেখাটি নাজমুল করিম শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতি দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া থেকে এসে বলেছেন, সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম ফসল ফলছে অবকাশের ক্ষেত্রে। এই সূচনা থেকে নাজমুল করিম তার নাতিদীর্ঘ রচনাটিতে মানুষের সমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারাটি বর্ণনা করেছেন, কি করে মানুষ আদিম শিকার আর পশুচারণের যুগ থেকে শুরু করে কৃষি যুগের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে উৎপাদনের পদ্ধতি উন্নত করে করে ধনবাদী সমাজে এসে পৌঁছেছে। এককালে মানুষের যেখানে অন্নচিন্তা বাদে কোন প্রকার চিন্তার এবং সৃষ্টির অবকাশ ছিলো না, সেকানে মানুষের হাতে আজ সৃষ্টির যেমন নানা উপাদান, তেমনি সৃষ্টির সেই উপাদান মানুষকে সমৃদ্ধি দিয়েছে, দিয়েছে অন্নচিন্তা বাদেও অন্যতর চিন্তা তথা শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা তৈরির অবকাশ। কিন্তু এখনো কি পৃথিবীর সর্বত্র সর্বানুষের হাতে এসেছে অবকাশের সেই সুযোগ? ধনিক সমাজে এ অবকাশ ধনবানের হাতে। কিন্তু অবকাশভোগী এই ধনবান একেবারে শ্রম-বিচ্ছিন্ন। নাজমুল করিম আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করেছেন যে, এই সনাতনী ধারার ব্যতিক্রম এসেছে মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে নতুনতম সমাজব্যবস্থায়, তথা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সমাজব্যবস্থায়।

ফাল্গুনকরার পরে নাজমুল করিমের আত্মজীবনীমূলক আর কোনো রচনা প্রকাশিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তাঁর নিজের বিবর্তন ও বিকাশ তথা তাঁর পরিবারের পরবর্তী বিকাশেও তিনি বিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন। বিষয়টি তাঁর প্রিয় ছিলো। নাজমুল করিম আমার অগ্রজপ্রতিম ছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি ফুলার রোডের তার নিজ বাসা থেকে হেঁটে আমার বাসায় চলে আসতেন। এবং তখন আমরা বর্তমানের চাইতে অধিকতর আবেগে চলে যেতাম সেদিনকার অতীতে। নানা কথায় স্মরণ করতাম চল্লিশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোকে, যে দিনগুলোতেই পরবর্তীকালে বিকশিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার আন্দোলনের বীজ কিছু উপ্ত হয়েছিলো। নাজমুল করিম আমাকে দেখতে দিয়েছিলেন একখানি। পাণ্ডুলিপি। আমি দেখে তা ফেরত দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম সেই আত্মজীবনীমূলক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করার। সে পাণ্ডুলিপির বর্তমান পরিস্থিতি আমি জানিনে। নাজমুল করিমের প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থের মধ্যে চেঞ্জিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া এ্যান্ড পাকিস্তান বিশেষ পরিচিত।

অগ্রজপ্রতিম নাজমুল করিমের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনাকালীন ক্রিয়াকর্ম এবং বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়ে আমি অজ্ঞ। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার প্রত্যাবর্তন করি শিক্ষকতা নিয়ে, ৭১-এর পরবর্তী পর্যায়ে, তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর নিজের প্রাতিষ্ঠানিক-সামাজিক অবস্থান ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অপর সকলে যে সবসময়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, কিংবা পছন্দ করেছেন, এমন নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এ.কে. নাজমুল করিম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানমূলক জ্ঞানচর্চার ও গবেষণার আগ্রহ এবং আবহ সৃষ্টির উদ্যোগী পুরুষ এবং পথিকৃৎ এ বিষয়ে কারুরই কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের সকল প্রয়াস, প্রকল্পে তাই নাজমুল করিম অনাগতদিনেও অনিবার্য এক স্মরণীয় নাম হয়ে বিরাজ করবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমার শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্য

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষাট বছরপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার অর্থাৎ ১৯৮১-তে কিছু কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে। কোনো কোনো উৎসব বা আলোচনার সঙ্গে হীরক জয়ন্তী কথাটি যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টিকে তেমন অনুপ্রেরণাদায়ক করে তোলার চেষ্টা নজরে পড়ে না। কয়েক মাস আগে এ বছরটির উদ্বোধন করেছিলেন উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সংলগ্ন মাঠে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ছাত্রাবাসগুলোর পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো। আকাশে পারাবত ওড়ানো হয়েছিলো। একটি গেট তৈরি করা হয়েছিলো। পতাকাগুলো এবং প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলরদের উৎকীর্ণ বাণীসহ ফেস্টুনগুলো রোদে-বৃষ্টিতে বিবর্ণ হয়ে আজো দণ্ডের ওপর উড়ছে। ছাত্রছাত্রী মহলে এর কোনো উৎসাহজনক। প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট উদ্যোগ নিয়েছেন হলের ষাট বছর পূরণকে স্মরণ করার জন্য একখানি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করার।

জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রভোস্টদের মধ্যে ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য ছিলেন অন্যতম। হরিদাসবাবু আমার সাক্ষাৎ এবং স্মরণীয় শিক্ষক। আমি দর্শন বিভাগ থেকেই বিএ এবং এম.এ পাস করেছিলাম। সে কথা জেনেই জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট বন্ধুবর ডক্টর রঙ্গলাল সেন বারংবার অনুরোধ করেছিলেন হরিদাসবাবুর ওপর একটি প্রবন্ধ তৈরি করে দিতে। হরিদাসবাবু সেই আমলে ক্ষুদ্রায়তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন, তেমনি অখণ্ড ভারত-উপমহাদেশের বিদ্বজ্জনমধ্যে দার্শনিক এবং বাগ্মী। হিসেবে বিশেষ খ্যাতিমান ছিলেন। সেদিন অন্যান্য বিভাগ যেমন, দর্শন বিভাগের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও ছিলো কয়েকজনে মাত্র সীমাবদ্ধ। সেটা একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। তার ফলেই এ রকম গুণী অধ্যাপকদের নৈকট্যে আসা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো। কিন্তু হরিদাসবাবুর দার্শনিক মতামত বা তাঁর জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করার মতো তথ্য এবং গ্রন্থ পাওয়া এখন দুষ্কর। তবু জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের অনুরোধটি আমাকে আকর্ষণ করেছিলো। হরিদাসবাবুর দর্শনের আলোচনা না হোক, তার একটি আলেখ্য তৈরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে খোঁজ করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে তাঁর অধ্যাপনার চাকরিকালীন ব্যক্তিগত নথিটি পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গেল অবশ্য, কিন্তু সবটা নয়। কেবল তার ঢাকা আগমন থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু হরিদাসবাবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। তবু তাঁর ব্যক্তিগত নথির এই অংশটির চিঠিপত্র, আলাপ-আলোচনা ও তথ্যাদির ভিত্তিতে আমি একটি লেখা তৈরি করে জগন্নাথ হলের প্রভোস্টকে দিয়েছি। তারা সেটি হয়তো তাদের স্মারকগ্রন্থে প্রকাশ করবেন। লেখাটি সম্পর্কে দর্শন বিভাগের কয়েকজন সাথীকে বলেছিলাম। আশা করেছিলাম, দর্শন বিভাগ যদি এই হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে দর্শন বিভাগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য–এই নামে একটি আলোলাচনার আয়োজন করে, তাহলে সে সুযোগে দর্শন বিভাগের পুরাতন শিক্ষকদের কথা বিভাগের পুরাতন ছাত্ররা স্মরণ করতে পারবেন। তখন হরিদাস বাবু সম্পর্কেও আলাপ উঠবে এবং আমার না জানা আরো কিছু খবর আমি জানতে পারব। কিন্তু দেখলাম, দর্শন বিভাগ বিষয়টিতে তেমন আগ্রহ বোধ করছে না। কিন্তু বিভাগের অধ্যাপক জহুরুল হক সাহেব বিষয়টি, বিশেষ করে আমার প্রবন্ধটির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখালেন। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে অধ্যাপক সাইয়েদ আবদুল হাই সাহেবের বাসায় কয়েকদিন আগে এই প্রবন্ধটি শুনবার জন্য একটি ঘরোয়া আসরের আয়োজন করেছিলেন। হাই সাহেব খুবই সামাজিক এবং অতিথিপরায়ণ প্রতিবেশী। আমার ফ্ল্যাটের বিপরীত ফ্ল্যাটে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ আছেন। জহুরুল হক সাহেব খবর দেওয়াতে প্রবীণ অধ্যাপক এবং ত্রিশের গোড়াতেই হরিদাসবাবুর ছাত্র দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ আসরটিতে এসেছিলেন। তাছাড়া ছিলেন দর্শন বিভাগের জহুরুল হক সাহেব ব্যতীত মিসেস আখতার ইমাম, অধ্যাপক আবদুল মতিন, হাসনা বেগম, কাজি নূরুল ইসলাম এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক আবদুল বারি।

আমার প্রবন্ধটি সকলে বেশ আগ্রহ সহকারে শুনলেন। এবং কেবল একটি নথির ভিত্তিতে করা হলেও এটি যে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হয়েছে, সেটা তারা বললেন। উপস্থিত এঁদের মধ্যে আজরফ সাহেব, হাই সাহেব এবং মিসেস আখতার ইমাম হরিদাসবাবুকে সাক্ষাত্তাবে পেয়েছেন। এঁরা সকলেই তার ছাত্রছাত্রী। আমি এজন্যই এদের কাছে প্রবন্ধটি পাঠ করে শোনাতে চেয়েছি। এঁদের স্মৃতিচারণে লেখাটিকে আমি আর একটু ভাল করতে পারব। আজরফ সাহেবের বয়স প্রায় সত্তর হলেও তিনি দর্শন ও সাহিত্যচর্চাতে এখনো বেশ সক্রিয়। নানা সভা-সমিতিতে তিনি আলোচনা করেন এবং পত্র-পত্রিকাতে ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য বিষয়ে প্রবন্ধাদি প্রকাশ করেন। হরিদাসবাবু সম্পর্কে তাঁর সপ্রশংস উক্তি এবং স্মৃতিচারণ আমাদের সকলকেই বেশ আনন্দ দিয়েছে। তিনি হরিদাসবাবুর আলোচনা ও বক্তৃতাদানের বেশ কিছু নমুনা এখনো হুবহু উদ্ধৃত করে শোনাতে পারেন। আমাদের শোনালেনও। আমার প্রবন্ধটিতে যেমন, এ দিনের শ্রোতা এবং আলোচকদের স্মৃতিচারণেও তেমনি, হরিদাসবাবু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হলেও তিনি যে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ছাত্রছাত্রীকে অকৃপণভাবে স্নেহ করতেন এবং জ্ঞানদানের ক্ষেত্রে তিনি যে স্মরণীয়ভাবে উদার এবং তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্য একাগ্র ছিলেন, সেই চিত্রটিই প্রকাশ পেয়েছে। আজরফ সাহেব বললেন, একদিন আমি এবং আর এক সহপাঠী, দুজনে বাসায় গিয়ে বললাম, স্যার, হেগেলকে বুঝিনে। তিনি তখন ধুতি পরে, গলাবন্ধ কোট আর চাদর কাঁধে এবং লাঠি হাতে বেরুচ্ছেন আর এক অধ্যাপকের বাড়ি যাবেন বলে। সেই ত্রিশের দশকে শান্ত, ছায়াচ্ছন্ন নীলক্ষেতের পরিমণ্ডলে। কিন্তু সে অজুহাতে আমাদের ফিরিয়ে দিলেন না। বললেন, চলো, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আলাপ করি। এবং রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর অনবদ্য ভাষায় যে আলাপ তিনি করলেন তা সেদিনকার কিশোর আমাদের মনে হেগেলের জটিলতাকে যেমন বিরাটভাবে পরিষ্কার করে দিয়েছিলো, তেমনি আমাদের মনের ওপর একটা স্থায়ী ছাপও কেটে দিয়েছিলো। অধ্যাপক দেওয়ান মুহম্মদ আজরফের এ বর্ণনা যথার্থ। হরিদাসবাবুর এই বৈশিষ্ট্যটি আমার মনকেও সেদিন মুগ্ধ করেছিলো। দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানের নানা কঠিন তত্ত্ব ভাষা ও ব্যাখ্যার গুণে তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে প্রাঞ্জল করে তুলতে পারতেন হরিদাস ভট্টাচার্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো তাঁর সেই সম্মোহনী বিনয়সূচক উক্তি, আরে, আমিও কি বুঝি এসব তত্ত্ব? এই, তোমাদের সঙ্গে একটু আলোচনা করা, আর কি? একদিকে রাশভারী ব্যক্তিত্বময় চরিত্র। আবার অন্যদিকে একেবারে আনুষ্ঠানিকতাবিহীন। ক্লাসে তার কক্ষে তার টেবিলের তিনপাশ ঘিরে আমরা বসেছি গুটিকতক ছাত্রছাত্রী। তিনি পড়াচ্ছেন, মানে আলোচনা করছেন। আলোচনা করতে করতে সময় ফুরিয়ে এল। অন্য কোনো ক্লাস বা কাজ রয়েছে হরিদাসবাবুর। তিনি তাই বললেন, এখন এ পর্যন্ত রইল। কাল সকালে এসো তোমরা, আমার বাসায়। তখন বাকিটুকু সেরে। দেবো। এমনি করে সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে এই শিক্ষকবৃন্দ একেবারে সেই প্রাচীনকালের ভারতের আশ্রম-প্রায় করে তুলেছিলেন। সেদিনকার ক্রমাধিক পরিমাণে অসঙ্গতিপূর্ণ দেশ এবং সমাজে এও ছিলো আর এক অসঙ্গতি। মাঝে-মাঝেই শহরে দাঙ্গা ঘটত। সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু তখনো, আমার অধ্যয়নকালেও, চল্লিশের দশকে, সংখ্যায় হিন্দু ছাত্রছাত্রীই বেশি। মুসলমান ছাত্রী তো কুল্লে ডজনখানেক। রমনা নতুন শহর। রেললাইনের দক্ষিণ পাড়ে পুরনো শহর। রমনা যদি বা মুক্ত, কিছুটা উদার, ঢাকা রক্ষণশীল। মুসলমান ছাত্রী যারা ঢাকা থেকে আসত, তারা আসত বদ্ধ দরোজা-ঘঘাড়ারগড়িতে। রেললাইন পেরুলেই মাত্র গাড়ির দরজা আর মাথার ঘোমটা ফেলে দিতে সাহস পেত। কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটি অভিহিত হত মক্কা ইউনিভার্সিটি বলে। তবু মক্কা ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের বেশির ভাগ তখনো হিন্দু। দাঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও যে দুএক সময় না হয়েছে তা নয়। পাকিস্তান আন্দোলনে যত জোর বাড়ছিলো, দাঙ্গার প্রকোপ ততো বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। সম্প্রদায়গত উভয় দিকের জঙ্গীবাজদের কারণে। চারদিকের আবহাওয়া ক্রমান্বয়েই অসহিষ্ণু আর আতঙ্কজনক হয়ে পড়ছিলো। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের তরুণ ছাত্রছাত্রীকে স্নেহ করতেন। কে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত সে বিবেচনা তাঁদের ছিলো না। আমার প্রবন্ধটি পাঠের উপলক্ষে মিসেস আখতার ইমামও সে কথা বললেন। তিনি নানা পারিবারিক অসুবিধার মধ্যে এসেছিলেন দর্শনে এম.এ পড়তে। মিসেস ইমামও প্রবন্ধটি শুনে বললেন, আমাকেও তিনি নিজের মেয়ের মতোই দেখতেন।

আমি নিজে যে খুব বিশিষ্ট ছাত্র ছিলাম, এমনও নয়। তবে একটু বেলাইনের বটে। যত না রীতিমাফিক পড়াশোনা করতাম, তার চাইতে একটু রাস্তার বাইর দিয়ে হাঁটতাম। রাজনীতি আর ছাত্র আন্দোলনের বৃহৎ দুটি ধারা, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগপন্থী ধারা, তখন বেশ প্রবল। আমি কোনো ছাত্র নেতা ছিলাম না। তবু যে ভাল করে পড়াশোনা না করে, বিশ্ববিদ্যালয়েরই অল্প বেতনের কর্মচারিদের সঙ্গে মিশতাম, তাদের পাড়ায় গিয়ে নানা রকম কথা বলতাম, তারা আদাব জানাত, নিজেদের লোক বলে মনে করত, এটি হরিদদাসবাবুর দৃষ্টি এড়ায় নি। আমি এ ভয়েই হরিদাসবাবুর কাছে ততো ভিড়তে সাহস পেতাম না। পাছে ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন আর মনোবিজ্ঞানের কঠিন কোনো প্রশ্ন করে আমাকে বিপাকে ফেলেন। কিন্তু না, তেমন কোনোদিন করেন নি। মনে হতো যেন বেলাইনের এই চলার জন্যই আমার প্রতি তাঁর স্নেহ আর কৌতুকমিশ্রিত একটা প্রশ্রয় ছিলো। কখনো কোনো সম্মেলনের কারণে দুদিন ক্লাসে উপস্থিত না হয়ে তৃতীয় দিনে হাজির হলে বলে উঠতেন, কি দেশোদ্ধার হলো! একবার হরিদাসবাবু নিয়ে গেলেন বিভাগের আমাদের সবাইকে সঙ্গে করে লখনৌতে। দর্শন সম্মেলনে। সে সম্মেলনে বোধ হয় তিনি সভাপতি ছিলেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আমাদের সকলকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সঙ্গে। আলাপআলোচনায় রাজনীতির কথা উঠলে রাজনীতিতে আমাদের কিছুটা সংস্রবকে একেবারে নিন্দা করলেন না। বললেন, শ্লোগানও অহেতুক নয়। তারও প্রয়োজন আছে। আমি কাছে যাই নি তেমন। কিছুটা দূর থেকে লক্ষ্য করেছি হরিদাসবাবুকে। কিশোর মনের বিস্ময় আর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে। কিন্তু আজ তাঁকে স্মরণ করতে মনে বেশ আবেগেরও সৃষ্টি হচ্ছে। মনে আছে, কখনো কলকাতা, দিল্লি, বম্বে থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বিভাগ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে এলে আমাকে ডেকে বলতেন, এ বইটি বেশ ভালো। তোমার ভালো লাগবে। তুমি আগে পড়ো, তারপরে আমি লাইব্রেরিতে জমা দেব। অনার্স পরীক্ষার ফলের ওপর কিছু বই প্রাইজ পাওয়ার ভাগ্য হলো। হরিদাসবাবু বললেন, কি হে মার্কসিস্ট! কি বই কিনবে? আমি সলজ্জভাবে বললাম, ঐ মার্কসিস্ট বই স্যার। প্রশ্রয় দিয়ে বললেন, আমাকে লিস্ট দিও। এখানে কোথায় পাবে? আমি কলকাতা কিংবা বম্বে যাব। নিয়ে আসব তোমার জন্য।…

… কিন্তু একাল সেকাল নয়। একালের তরুণদের সেকালের এই স্মৃতিচারণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। এবং একালের আমিও আর সেকালের শিক্ষক নই। তাই আফশোস আর অভিযোগের দিকে গিয়ে লাভ নেই। তবু একালের মন্দ-ভালো, যা বৈশিষ্ট্য তাতে সেকালের অবদান নিশ্চয়ই আছে। সেকালের ওপরই একালের আগমন। সে সত্যটি স্মরণ করার জন্যই এসব কথার উল্লেখ … ২০.৩.৮১

***

হরিদাসবাবুকে ব্যক্তিগতভাবে স্মরণ করতে গেলেই আমার যে ভবনটির কথা মনে পড়ে সেটি আজ আর নেই। বর্তমানে যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র তার ঠিক বিপরীতে একটি দোতলা দালান ছিলো। এটিই ছিলো জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের ভবন। ভবনটি সম্প্রতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার জায়গাতে শিক্ষকদের একটি বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে।

খুব যে দীর্ঘ ছিলেন, এমন নয়। কিন্তু গায়ের রঙটি ছিলো খুবই ফরসা। গায়ের রঙ-এর মতোই ধবধবে সাদা ধুতি-চাদর পরতেন। স্যুট-টাইতে কখনো দেখি নি। গলাবন্ধ যে কোট পরতে দেখতাম তাকে আজকালকার ভাষায় বলা চলে চীনা কোট।

হরিদাস ভট্টাচার্যের বাড়ি কোথায়, তাঁর অধ্যয়ন জীবনের কৃতিত্ব কি ছিলো, কি ছিলো না, তা আমি কিছুই জানতাম না। ১৯৪২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়, মানে বর্তমানের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনে বি.এ পড়তে এলাম তখন প্রথম চোটে আমি দর্শন শাস্ত্রে ভর্তির আবেদনও করি নি। আবেদন করেছিলাম ইংরেজি সাহিত্যে। কিন্তু মাঝখানে করিডোর আর দুপাশে ক্লাসরুম। এই ভবনের করিডোর দিয়ে যাওয়াতে যে শিক্ষক-বক্তার দর্শন, জ্ঞান, সত্য-মিথ্যার ওপর দরাজ গলার আলোচনা আর যে-কোনো ছাত্রের মতো আমাকেও চমকিত এবং আকির্ষত করেছিলো–সে গলা ছিল হরিদাস ভট্টাচার্যের। আর সেই আকর্ষণেই ইংরেজি সাহিত্য পরিত্যাগ করে দর্শন শাস্ত্রে ভর্তি হবার আবেদনপত্র নিয়ে একদিন হাজির হয়েছিলাম অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী সেই বাগী হরিদাস ভট্টচার্যের সামনে। এখনও মনে ভেসে উঠছে, আমার সাক্ষাৎকারটি ঘটেছিলো দর্শন বিভাগের প্রধানের দপ্তরে নয়, ঘটেছিলো জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের দপ্তরে। আমার আবেদনটি হাতে নিয়ে আই.এ পরীক্ষার নম্বরাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করে যে কথাটি বলেছিলেন, সেটি এখনো কানে বাজছে, ফিলসফি পড়তে এসেছ? কিন্তু টিকবে তো? এ এক কঠিন প্রশ্ন। এর সরাসরি কোনো জবাব নেই। মুখচোরা গোবেচারী আমি সেদিন তাঁকে কি জবাব দিয়েছিলাম, কিসে তিনি খুশি হয়েছিলেন, তা আজ মনে নেই। তবে সেদিন অচেতনভাবে বুঝেছিলাম, একটি কিশোর ছাত্র বা ছাত্রীকে কেবল যে জ্ঞানের একটি শাখাই অপর শাখা থেকে কম কিংবা বেশি আকর্ষণ করে, তাই নয়। কোনো বিভাগের প্রতি কম কিংবা বেশি আকর্ষণ করে তার কোনো বিশেষ শিক্ষকও। ব্যাপারটি আজ বিরাট আকারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে হয়তো ততো জোরের সঙ্গে বলা যায় না; কিন্তু সেদিনকার সেই আশ্রয় কিংবা পরিবার প্রায়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনেকখানি সত্য ছিলো। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, দার্শনিক হরিদাস ভট্টাচার্য, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপক এস.এন রায়, গণিতের এস.এন বসু, অর্থনীতির এইচ এল দে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডি এন বানার্জী, এ কে সেন, অবণীভূষণ রুদ্র, আবদুর রাজ্জাক, বাংলার মোহিতলাল মজুমদার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জসীমউদ্দীন প্রমুখ।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবী বিখ্যাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি প্রশংসাবাক্য প্রচারিত ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। অক্সফোর্ডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কি, আমার জানা নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে যে তখনকার ভারত উপমহাদেশের জ্ঞানী গুণীদের মধ্যে বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটেছিলো তাতে সন্দেহ নেই। আর ছাত্র হিসেবে সেটিই ছিলো আমাদের গর্ব এবং গৌরবের বিষয়। তা না হলে কলকাতা বা লখনৌ বা কাশী বা আগ্রা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অজপাড়াগাঁ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাঁড়াবার উপায় ছিলো না।

কিন্তু যে কথা আজ এই হীরক জয়ন্তীতে ভাবতে গিয়ে চমৎকৃত হতে হয়, সেটি হচ্ছে, সমাবেশের এই ঘটনাটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে নি। এমন নয় যে হরিদাস ভট্টাচার্য, সত্যেন বসু, রমেশ মজুমদার, এফ রহমান এরা কোথাও বেকার বসেছিলেন, আর চাকরি খালির বিজ্ঞাপন দেখে তারা কলকাতাকে ছেড়ে ঢাকাতে দৌড়ে এসেছিলেন। তাঁদেরকে খুঁজে পেতে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। আর তার প্রতিষ্ঠানগত কৃতিত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালের সাংগঠনিক কমিটির হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজেপত্রে যে ব্যক্তির ঐকান্তিক আগ্রহ, পরিশ্রম ও চেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় তিনি না বাঙালি, না ভারতীয় এবং না হিন্দু, না মুসলমান। তিনি ইংরেজ–পি জে হারটগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য। তিনিও বেকার ছিলেন না। হয়ত ছিলেন ভারতীয় শিক্ষা সারভিস বা আই.ই.এস-এর অভিজ্ঞ এবং উচ্চতর সদস্য। কিন্তু ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি, তার সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, আইন-সকল বিভাগের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক অন্বেষণের যে প্রচেষ্টা হারটগ সাহেব চালিয়েছিলেন, সেটি তাঁকে একজন যথার্থ কর্মী, জ্ঞানী, এবং উদ্যোগী সংগঠক হিসেবে প্রমাণিত করে। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত সেই গোড়াকার সকল প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মধ্যে যারা ছিলেন, পি জে হারটগ এবং তার অন্য সহকর্মীদের পরিচয় বিবরণী সংগ্রহ করে প্রকাশ করা।

শুধু বিজ্ঞাপনের জবাবে আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে নিয়োগপত্র দেয়ার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনকার সংগঠন, বিশেষ করে ভাইস চ্যান্সেলর হারটা সাহেবের কাজ সীমাবদ্ধ ছিলো না। হরিদাসবাবুর ব্যক্তিগত নথির কিছুটা মাত্র এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরতান কাগজপত্রের মধ্যে রক্ষিত আছে। তা নাড়াচাড়া করতে গিয়েই দেখলাম, ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসেও কলকাতা শহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের ক্যাম্প অফিস চালু রয়েছে। আর সেখান থেকে ২৯ জানুয়ারি (১৯২১) তারিখে হারটা সাহেব হরিদাস ভট্টাচার্যকে তাঁর কলকাতার ৩৬ নম্বর আমহারস্ট রোডের ঠিকানায় ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়ে লিখছেন :

Dear Mr. Bhattacharyya, I am authorized by His Excellency the chancellor to offer you the post of Reader in philosophy in the University of Dacca at an initial salary of Rs. 500/- per mensem rising by annual increments of Rs. 50/- per mensem of a maximum which has not yet been fixed, but which I hope will be fixed shortly. I should be glad to hear from you at your early convenience that you will accept the post. It will be necessary for you to join the University not later that 13th June in order to complete the arrangements preparatory to the beginning of the session on July the 1st ….

হরিদাস ভট্টাচার্য তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলসফি এ্যান্ড একসপেরিমেন্টাল সাইকোলজির লেকচারার। তিনি অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদের জন্যই একটি আবেদন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হারটা সাহেবের এই পত্রের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, রিডার-এর পদ গ্রহণেও তাঁর আপত্তি নেই। হরিদাসবাবুর বাংলা হস্তাক্ষরের সাক্ষাৎ পাওয়া ভার। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত নথিতে শুরু থেকে, অর্থাৎ ১৯২১-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত রক্ষিত নথিতে (১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সময়ের নথির খোঁজ আমি পাই নি। তাঁর নিজের অত্যাশ্চর্য ইংরেজি হস্তাক্ষর এবং ইংরেজিতে লেখা সাবলীল পত্রাদির কোনো অভাব নেই।

ভাইস চ্যান্সেলর হারটগ সাহেবের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি যে পত্র লিখেছিলেন তাতে স্যার আশুতোষ মুখার্জির উল্লেখ দেখা যায় : But before putting into your hands the formal letter of acceptance I think I ought to see the President to the Post-Graduate Department, Sir Ashutosh Mukherjee. I wish you could have told him that you wanted me just as he did to Dr. Urquhart. It is always so very delicate to touch upon the subject of resignation and departure before one with whom I am on cordial terms and who during the last month made me a paper-setter in B.A. philosophy (Pass and Honours) unasked.

স্যার হারটগের পক্ষে এমন অনুরোধ রক্ষা করার তেমন কোনো বাধ্যতা ছিলো না। কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত নথিতে রক্ষিত পত্রাদির মধ্য দিয়েও বোঝা যায় স্যার হারটগ (পদবিসহ যার নাম ছিলো Sir P.J. Hartog Kt. CIE LLD, M.A, B.Sc) যথার্থই দ্র এবং দক্ষ সংগঠক ছিলেন। হরিদাসবাবুর সঙ্কোচের কারণটি তিনি বুঝেছিলেন এবং যথার্থই স্যার আশুতোষকে হরিদাসবাবু সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন।

এরপরে স্যার হারটগকে যে দীর্ঘ পত্ৰ হরিদাসবাবু লিখেছিলেন তাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে তিনি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন কিনা সে প্রসঙ্গটি বেশ উল্লেখযোগ্য :

… (2) The facility for research and freedom in teaching. It has been hinted to me that the freedom and leisure for study that I enjoy here may be denied me there. Personally I do not put much credence in these statements but I should like to be assured that I shall not be unnecessarily dictated to by the professor or by anybody else in matters of study and teaching. There must certainly be consultation and mutual arrangement and agreement but that should be all. I have already told you that here I am absolutely free to teach as I like and have to report only at the end of the year what and how much I have taught. I have never abused that privilege, in fact, both at Scottish Churches College and at the University. I have taken extra classes on my own initiative, and I shall justify your confidence in me on that point there too….

চাকরিতে স্থায়ী হতে কত দিন লাগবে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের কি সুযোগ পাওয়া যাবে, থাকার ব্যবস্থা কি হবে প্রভৃতি সব বিষয়েই তিনি ভি.সি-র কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন এবং এতদিন পরে একজন গবেষককে যা চমৎকৃত করবে সে হচ্ছে ভি.সি স্যার হারটগও বিস্তারিতভাবে হরিদাস ভট্টাচার্যের সকল প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন।

৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯২১ তারিখে স্যার হারটগ হরিদাসবাবুকে লিখলেন :

Dear Mr. Bhattacharyya, Many thanks for your letter of February 7. As you will learn from my letter no. 89/C dated the 7th February, 1921, I have already written to Sir Ashutosh Mukherji in regard to your appointment. I now deal with your various queries: (1) with a record like your own I anticipate that confirmation after the Probationary period would be merely normal. However I will put your points before the Chancellor; (2) The University will enter into a written contract with you and will be obliged to carry out the obligations of the contract. This is required under the Dacca University Act.

(3) One of the main objects of the University is to provide every facility for research and freedom in teaching. If you will consult the Dacca University Act, you will see what a large space the teachers will occupy in the management of the University. The post of Reader would be one of dignity and importance and your letter seems to me to indicate the exact spirit in which the department should be conducted. Mutual arrangement and agreement are of course necessary, but you ought certainly not be hampered in any way in your teaching…..

হরিদাসবাবু নিজে স্যার হারটগকে যে চিঠি লিখেছিলেন তার গোড়াতেই দেখা যায়, তিনি ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তেমনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে, খুব সম্ভব ১৯১৭ সাল পর্যন্ত স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হরিদাসবাবুর নথিতে কোনো আবেদনপত্র এবং তার সঙ্গে তাঁর জীবনের কোনো বৃত্তান্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু স্যার হারটগের সঙ্গে এই পত্রালাপের উল্লেখে মনে হয়, হরিদাসবাবুর জন্ম হয়ত ১৮৯০ কি ৯১ সালে। হরিদাসবাবু শিক্ষাগতভাবে ছিলেন এম.এ.বি.এল। অর্থাৎ এম.এ পাস করে হয়ত তিনি দুবছর ল পড়েছিলেন এবং আনুমানিক হিসেবে ১৫ বছরে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ১৯০৫-এর দিকে এম.এ পাস করেছেন। তারপরে ল শেষ করে হয়ত স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনার চাকরি গ্রহণ করেন।

হরিদাসবাবু কলকাতায় বসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদানের পত্র পাঠান এবং দর্শন বিভাগে আর কোন উপযুক্ত সহকর্মীকে গ্রহণ করা যায় এবং মনোবিজ্ঞানের গবেষণাগারের জন্য কি যন্ত্রপাতি কিংবা দর্শনের জন্য কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ করা যায় তার প্রচেষ্টাতে নিজেকে অবিলম্বে নিযুক্ত করেন।

হরিদাসবাবু তখন তরুণ অধ্যাপক। কিন্তু স্যার আশুতোষের মতই স্যার হারটগও যে নির্বাচনে ভুল করেন নি তা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়ার দিকের যে কোন দলিলপত্র বা প্রকাশনা ওল্টালেই বোঝা যায়। নিজের দাবিদাওয়া আদায়ের ব্যাপারে হরিদাসবাবু যে দার্শনিক রকমের নিরীসক্ত ছিলেন, তা নয়। তিনি তাঁর প্রাপ্য আদায় করতে জানতেন। কিন্তু তাঁর পত্রালাপ বা দাবি উত্থাপনের মধ্যে যুক্তির জোর এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রকাশের চিহ্ন স্পষ্ট। বস্তুত প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালেই কেবল দর্শন বিভাগের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অরডিন্যান্স ও রেগুলেশনসমূহ সুবিন্যস্ত করার দায়িত্ব পড়ে হরিদাসবাবুর ওপর। ১৯২৪ সালের একটি পত্রে দেখা যায়, হরিদাসবাবু ভাইস চ্যান্সেলরের নিকট একটি দাবি জানিয়েছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অরডিন্যান্সসমূহ সম্পাদনাতে তাঁর যে কষ্টকর পরিশ্রম করতে হয়েছে সেজন্য তাঁর কিছু প্রাপ্য হওয়া উচিত। এবং পরবর্তী সময়ে একসিকিউটিভ কাউন্সিল হরিদাসবাবুকে এ পরিশ্রমের জন্য পাঁচশ টাকার একটি সম্মানী প্রস্তাব করে মঞ্জুর করে।

হরিদাসবাবু দর্শন বিভাগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। কিন্তু গোড়াতে তিনি দর্শন বিভাগের হেড ছিলেন না। হেড ছিলেন অধ্যাপক জি.এইচ, ল্যাংলী এবং তিনি যখন ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে ছুটিতে যান তখন মাত্র হরিদাসবাবু বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন।

এই সময়কার চিঠিপত্র পাঠ করতে গিয়ে একটি বিষয়ে আমার বেশ আমোদ লেগেছে। ঢাকায় আসার পূর্বে হরিদাসবাবু ভিসি হারটগ সাহেবকে চিঠিতে ঢাকার মশার আতঙ্কের কথা উল্লেখ করেছিলেন। হারটা সাহেব তার জবাবে লিখেছিলেন : I am told that although there are mosquitoes in Ramna, there is no malaria and many people who have lived here for years had never had an attack. The situation is open and healthy. অর্থাৎ ঢাকার মশা তোমাকে কামড়াবে বটে কিন্তু ম্যালেরিয়ার রুগী করবে না। ঢাকার মশা ভদ্র এবং রসিক। সে গুণ। তার এখনো আছে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের নিবাসস্থল ভাটপাড়ার টিকিধারী তরুণ ব্রাহ্মণ অধ্যাপক হারটগ সাহেবের এই অভয়তে ঢাকা এসেছিলেন। তাছাড়া হারটগ সাহেবের আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত ব্যক্তিগত পত্রালাপ এবং ঢাকাতে আগমনে ইচ্ছুক একজন তরুণ শিক্ষকের সকল সঙ্কোচ কাটিয়ে দেবার প্রয়াসও নিশ্চয়ই কম আকর্ষণীয় ছিলো না।

কিন্তু বাদুড়ের উৎপাতের কথা তরুণ অধ্যাপক বাইরে থেকে আঁচ করতে পারেন নি। আজকের ঢাকাবাসীরা যদিও মশাকে ভালোভাবেই চেনেন তবে বানর আর বাদুড়কে তারা তেমন জানেন না। কিন্তু হরিদাসবাবু খুবই বিব্রত হয়েছিলেন বাদুড়ের উৎপাতে, যখন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিকটবর্তী চামেরী হাউস ভবনটি থাকার জন্য দেওয়া হয়। এই চামেরী হাউস থেকে ১৯২৪ সনের দিকে হরিদাসবাবু ভিসিকে লিখলেন :

My dear Sir, I am afraid; I shall have to think seriously of vacating University Quarters next session. The unbearable stench of bats excreta returned with the summer heat in spite of last years renovation of the ceiling cloth and the P.W.D. people practically told me that they would be unable to drive the bats away.

এ রকম ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা উল্লেখ করে কোনো শিক্ষক আজকের দিনের একজন ভিসিকে পত্র দিলে তিনি তার জবাব ব্যক্তিগতভাবে এবং লিখিতভাবে দেবেন কিনা এবং কি জবাব দেবেন তা আমি নিশ্চিত জানিনে। তবে হারটগ সাহেব অবিলম্বে কেবল যে হরিদাসবাবুকে জবাব দিয়ে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন তাই নয়, তিনি নিজে পি.ডব্লিউ ডির ইঞ্জিনিয়ারকে চিঠি লিখে বললেন :

My dear Stein, Mr. Haridas Bhattacharyya who lives in the Chummery tells me that the stench of the bats in the house is so unbearable that he wishes to leave it. Is it not possible to keep the bats out of the house? At one time they used to come into this house but since wire-netting has been put in the holes through which the electric wires pass. they have been kept out completely. I know that the Chummer is differently constructed, but it is difficult to believe that it is impossible to keep bats from entering above the ceiling cloth.

হরিদাসবাবু কেবল যে বিভাগের অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন, ল্যাংলী সাহেবের পরে দর্শন বিভাগের প্রধান হয়েছেন, তাই নয়। একাধিকবার তিনি ডেপুটি রেজিস্টার বা রেজিস্টারের দায়িত্বও পালন করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, সেদিনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে হরিদাসবাবু একজন। প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের কিছুকালের মধ্যে পরিগণিত হয়েছিলেন।

হরিদাস ভট্টাচার্য, এম.এ, বি.এল, পি.আর.এস, দর্শন সাগর। পি.আর.এস বা প্রেমাদ রায়চাঁদ স্কলার তো আমাদের নিকট আতঙ্কজনক ব্যাপার ছিলো। যিনি এই বৃত্তির অধিকারী হন তিনি অবশ্যই মহাপণ্ডিত। তার ওপর দর্শন সাগর! এবং অপ্রতিরোধ্য এক ব্যক্তিত্ব। এসবই সেই কিশোরকালের আমাকে চল্লিশের দশকে মুগ্ধ করেছিলো। বৃহত্তর বিশ্ব, কোলকাতাতে লেখাপড়া করতে না যাওয়ার জন্য আমার কোনো আফসোস ছিলো না। কিন্তু হরিদাসবাবুর টিকি এবং উপবীত বা পৈতা পৈতা অবশ্য বার থেকে দেখা যেতো না) আমাকে বিস্মিত করেছিলো। দর্শন বলতে তো জিজ্ঞাসা আর সংশয়কে বোঝায়। হরিদাসবাবুর দরাজ বক্তৃতাতেও দর্শনের এই অর্থই আমি উপলব্ধি করেছিলাম। তাহলে এই জিজ্ঞাসা এবং সংশয়ের সঙ্গে দার্শনিক হরিদাসবাবুর টিকি এবং পৈতার সঙ্গতি কোথায়? এ প্রশ্ন সেদিনও আমার মনে জেগেছিলো। কিন্তু এমন প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি। অসঙ্গতি কেবল এ ক্ষেত্রে নয়। অসঙ্গতি এখানেও যে, হরিদাসবাবু বাড়ির বাইরে অপর কারুর পাক করা অন্ন গ্রহণ করতেন না। শুনেছি বাইরে কোথাও গেলে তিনি নিজেই রান্না করে খেতেন। একেই বোধ হয় বলে স্বপাক ব্রাহ্মণ। কিন্তু এই হরিদাসবাবুর বাড়িতে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত অধ্যাপক হুমায়ুন কবির যখনি ঢাকা এসেছেন কোনো পরীক্ষা কার্য ব্যপদেশে, তখন তাঁর স্থান হয়েছে। অপর কোথাও তাঁকে তিনি থাকতে দেন নি। এও কম বিষ্ময়ের ব্যাপার ছিলো না আমাদের কাছে। আসলে হরিদাসবাবু শুধু দর্শনের ছাত্র এবং অধ্যাপক ছিলেন না। ছিলেন মনোবিজ্ঞানেরও। আর তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, যে ব্যক্তিকে তোমরা বইরে থেকে আস্ত কিংবা অখণ্ড দেখ, সে আসলে আস্ত কিংবা অখণ্ড কোনো সত্তা নয়। নানা খণ্ডিত, পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্বের অর্থাৎ বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আচরণ, সংস্কারের টুকরো নিয়ে বাহ্যত অখণ্ড ব্যক্তির সৃষ্টি। এই পরস্পর বিরোধী সত্তাতেই ব্যক্তির মধ্যকার অসঙ্গতি আর দ্বন্দ্ব। এটা যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সত্য। কেবল এই পরস্পরবিরোধী সত্তাগুলো যখন এমন তীব্রতাপ্রাপ্ত হয় যে ব্যক্তির সর্বমোট নিয়ন্ত্রণটা নষ্ট হয়ে যায়, তখনি আমরা এমন ব্যক্তিকে এ্যাবনরম্যাল বা মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করি। এমন শিক্ষা এবং সত্যকেই বোধ হয় হরিদাসবাবু সচেতনে নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। তাই তাঁর ব্যক্তিগত নথি ওল্টাতে ওল্টাতে যখন দেখলাম, কলকাতায় বালিগঞ্জে তৈরি নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ছুটির আবেদন করে ৫-১১-৩১ তারিখে তিনি লিখেছেন।

… The earliest possible date is the 11th instant. The only other date is 20th instant. The astrologers consulted have vetoed these two dates after consulting my horoscope and in the matter I am absolutely in their hands. তখন আর বিস্মিত হই নি। জ্যোতিষীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা আমার কুষ্টি দেখে বলেছে ১১ কিংবা ২০ তারিখে গৃহপ্রবেশ করা চলবে না। এ ব্যাপারে আমি একেবারেই তাদের হাতে বন্দী। দর্শন সাগর হরিদাস ভট্টাচার্য এমন সত্য স্বীকারে কোনো অস্বস্তি বোধ করেন না। কারণ, ব্যক্তি তো অখণ্ড সত্তা নয়, খণ্ডিত সত্তাসমূহেরই সমন্বিত প্রকাশ।

হরিদাসবাবু বাগ্মী হিসেবে সেদিনকার সারা-ভারতেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষাতে বিরামহীনভাবে বক্তৃতাদানের অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে যেমন ছাত্র, সহকর্মী এবং দেশবাসী সকলের নিকট প্রিয়। করেছিলো, তেমনি বোধ হয় সে কারণেই রীতিসিদ্ধ গবেষণাকর্মে বা একাধিক গ্রন্থ রচনাতে তিনি নিবন্ধ থাকতে পারেন নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সেদিনকার সমাজের নানা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে তিনি ব্যাপৃত রয়েছেন। এক সময়ে তিনি বালিগঞ্জ ব্যাঙ্ক নামক একটি ব্যাঙ্কের অন্যতম ডাইরেক্টর নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের বাইরে বলে তিনি তা গ্রহণ করেন নি।

হরিদাসবাবু একবার লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন সেখানে ফিলসফির প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য। তাঁর নথিতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ল্যাংলী সাহেব হরিদাসবাবুর যোগ্যতার প্রশংসা করে তাঁর সে আবেদন লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠিয়েছিলেন, এ তথ্য পাওয়া যায়। এটা ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা।

হরিদাসবাবুর ব্যক্তিগত নথিতে তাঁর সম্পর্কে ভারতের বিখ্যাত দার্শনিক আচার্য ব্রজেন্দ্র নাথ শীলের একটি প্রশংসাপত্র রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর হরিদাসবাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে এই প্রশংসাপত্রের একটি কপি পাঠিয়েছিলেন এবং এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন।

On perusing certain portions of my scientific work, The Evolution of individuality and of my philosophical work, The Principle of Activism, Dr. Brojendra Nath Seal under whom I had the honour of serving in the Philosophy Department of the Calcutta University for about three years has sent a certificate …

স্যার ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের প্রশংসাপত্র পাওয়া একজন ছাত্র কিংবা শিক্ষকের পক্ষে অবশ্যই গর্বের বিষয়। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল তখন মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। সেখান থেকে ৭ আগস্ট ১৯২২ তারিখে তিনি হরিদাসবাবুকে নিমোক্ত প্রশংসাপত্রটি পাঠিয়েছিলেন :

Mysore
7th August, 1922.
I have known Professors Haridas Bhattacharyya for the last eight years in various capacities and I have had ample opportunities of judging his personal worth, his mental calibre and his attainments in philosophy. He has a full mind, a rapid sweep of thought which does not however miss the significant details in the ensemble and a marked gift of lucid and interesting exposition. He has studied with great profit the foundations of recent philosophical thought in physical and biological sciences and kept himself abreast of the modern developments of experimental and comparative psychology. I have no hesitation in stating that alike by his metaphysical acumen and his strenuous thinking, by his clearness of ideas, his knowledge of the principles and methods of physical and biological sciences and his gift of exposition he is exceptionally fitted to occupy the chair of professor of Philosophy in any Indian University.
—Brojendra Nath Seal
Vice Chancellor,
Mysore University

হরিদাসবাবুর বৃহৎ আকারের গ্রন্থের মধ্যে সমধিক প্রসিদ্ধ হয়ে আছে তার Foundations of Living Faiths। এছাড়া ১৯২৭ সনের ২৯ এপ্রিল তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে হরিদাসবাবুর শিক্ষাগত অভিজ্ঞতার যে বিবরণ দেন তাতে নিমোক্ত কথা কটি অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়:

(1) Teaching Experience: that Mr. Bhattacharyya was professor of Philosophy in the Scottish Churches College, Calcutta and Lecrtuer in Philosophy and Experimental Psychology, Calcutta University before entering the service of the Dacca University in 1921 …. হরিদাস বাবুর নথির মধ্যে Inferiority Complex নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধের কপি রক্ষিত হতে দেখা যায়। ঐ প্রবন্ধটি ব্যক্তির হীনম্মন্যতা বোধ, তার প্রকাশ প্রভৃতির ওপর মনোহর ইংরেজিতে লিখিত একটি আকর্ষণীয় রচনা। প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিলো ১৯২৭ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সাইকোলজি সেকশনে এবং ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকার জানুয়ারি ১৯২৭ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। লেখাটির প্রাঞ্জল-উপস্থাপনায় যথার্থই মুগ্ধ হতে হয়। আমাদের দর্শন বিভাগ তাঁদের কোনো মুখপত্র বা বার্ষিক প্রকাশনায় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পত্রিকায় আজো লেখাটি হরিদাসবাবুর নথি থেকে উদ্ধার করে পুনর্মুদ্রণ করলে আমাদের ছাত্রছাত্রী এবং পাঠকসাধারণ একটি সুন্দর রচনা পাঠে উপকৃত বোধ করবেন।

Foundations Of Living Faiths-এর প্রথম খণ্ডের একটি কপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে এখনো রক্ষিত আছে। এর দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিলো কিনা তা আমার জানা নেই। এ গ্রন্থের প্রকাশক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশকাল ১৯৩৮। গ্রন্থখানির নাম পৃষ্ঠাটি ছিলো নিম্নরূপ। এই নাম পৃষ্ঠায় তিনি যে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট সে কথারও উল্লেখ দেখা যায় :

STEPHANOS NIRMALENDU GHOSH LECTURES
 THE FOUNDATIONS OF LIVING FAITHS
(An Introduction to Comprative Religion)
by
HARIDAS BHATTACHARYYA
 Provost, Jagannath Hall
 and Head of the Department of Philosopohy
University of Dacca
First Volume
 Published by the University of Calcutta
1938

গ্রন্থখানি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তার পিতার নামে। উৎসর্গ বাক্যটিতেই হরিদাসবাবুর পিতার নাম পাওয়া যায় :

“To the sacred memory of my father, Pandit Ramprasanna Sruti Ratna Battacharyya whose life has ever been to mean ideal and an inspiration”

এই গ্রন্থ মূলত ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি বক্তৃতামালার ভিত্তিতে রচিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত স্টিফানোস নির্মলেন্দু ঘোষ লেকচার্স সেকালের একটি মর্যাদাবান বক্তৃতা ছিলো। এ. বক্তৃতাদানের আহ্বান যখন ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের নিকট আসে তখন তাঁর বয়স হয়ত ৪২ বছর। কিন্তু সে বয়সের জন্যও এমন গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাদানের আহ্বান একটি সম্মানের বিষয় ছিলো। এই বক্তৃতাদানের জন্য তাকে সম্মানী দেওয়া হয়েছিলো ৯০০০ টাকা, আজকের মূল্যমান হিসেব করলে নিশ্চয়ই এটিকে লক্ষ টাকা বলে উল্লেখ করা যায়।

Foundations of Living Faiths বা জীবন্ত ধর্মসমূহের ভিত্তি। বিষয়টি হরিদাসবাবুর বিশ্বাস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে অবশ্যই সঙ্গতিপূর্ণ ছিলো। আগ্রহী গবেষক বা পাঠক এই গ্রন্থখানার সঙ্গে প্রাথমিকভাবেও পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলে একদিকে যেমন মুগ্ধ হবেন হরিদাসবাবুর সকল ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের বিস্তার এবং গভীরতা দেখে, তেমনি চমৎকৃত হবেন একজন গোঁড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা তাঁর উদারতা এবং পারদর্শিতা দেখে।

‘স্টিফানোস বক্তৃতা’ দানকে হরিদাসবাবু নিজেও বিশেষ সম্মানের বিষয় বলে বিবেচনা করেছিলেন। সেই বোধেরই প্রকাশ দেখা যায় তার এই গ্রন্থের প্রিফেস-এর মধ্যে।

I am much flattered to think that the distinction of a fairly orthodox Brahimn being appointed to a christain endowment during the regime of a Muslim Vice-Chancellor should have falten first on me. By a curious coincidence I had the unique privilege of being born in one of the greatest strongholds of Sanskrit learning and Hindu orthodoxy in Bengal, of being educated in one of the oldest Missionary colleges of Calcutta and of spending the greater part of my teaching career at one of the most important centres of Muslim Culture in India. … (P. Viii, Foundations of Living Faiths.)

এই প্রিফেস-এর মধ্যেই ধর্ম সম্পর্কে তাঁর নিজের অভিমতের উল্লেখ করতে গিয়ে হরিদাসবাবু বলেছেন :

… I have also made no secret of my belief that most, if not all, religions fight ignorance half heartedly for fear lest a widespread culture should mean the disowning of all spiritual obligations and a gradual loss of influence of those new in spiritual power over the uneducated masses. I have not subscribed, however, to the view that religion as a distinctive attitude towards life and reality is ultimately destined to pass away with the growth of education and the development of industry….. (ঐ P. IX)

প্রিফেস-এর এই মন্তব্যটিও উল্লেখযোগ্য যে বক্তৃতাগুলো তিনি লিখিতভাবে পাঠ করেন নি, উপস্থিত বক্তৃতা হিসেবে দিয়েছেন। …. Following my usual practice, I delivered the entire series of lectures extempore in order to be better able to adjust my discourse to the actual audience of the day… (ঐ P. IX)। এও তার স্বভাবসুলভ। আমার ছাত্রজীবনের এমন কোনো দিনকে স্মরণ করতে পারিনে যেদিন হরিদাসবাবু তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত বাগ্মিতা বাদ দিয়ে লিখিত কোন কিছু আমাদের পাঠ করে শুনিয়েছেন।

ইসলাম ধর্মকে সুবিস্তারিতভাবে যে তিনি আলোচনা করেছেন তার এই গ্রন্থে তার পরিচয় পাওয়া যায় এ থেকে যে গড ইন ইসলাম এই শিরোনামের প্রায় ৬৫ পৃষ্ঠাব্যাপী অধ্যায়তে। তিনি ইসলাম-পূর্ব যুগের শক্তিসমূহ থেকে শুরু করে ইসলামের রহস্যবাদ ও হিন্দু সর্বেশ্বরবাদ শিরোনামে বিভিন্ন উপ অধ্যায়সমূহে যে আলোচনা করেছেন সে উপ-অধ্যায়গুলোর সংখ্যা হচ্ছে চৌষট্টিটি। এই উপ-অধ্যায়গুলোর আকার যে বৃহৎ, তা নয়। কিন্তু এতে ইসলাম ধর্মের এবং মুসলিম দর্শনের যে সমস্যাসমূহের তিনি আলোচনা করেছেন তার মাঝেই তার জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় মেলে। হরিদাসবাবুর আলোচিত সমস্যাগুলোর মধ্যে।

Pre-Islamic Religious Forces, The Quranic Revelation, The Last Prophet, Christ and Muhammad as rival Prophets, Muhammads miracles, Islam as the universal religion, The Nature of Islamic Toleration, The Quran and the Bible, The Quranic view of God, The Mutazilite view of God, The ninety nine names of Allah, Divine Will and Human Destiny, Human Freedom, Divine Forgiveness, Divine Mercy, The orthodox and Mutazilite views, Al-Asharis opinion, Islmaic mysticims, Islamic mysticism and Hindu Polytheism প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়। এ গ্রন্থটিকেও পুর্নমুদ্রিত আকারে বাংলাদেশের আজকের ছাত্র, শিক্ষক এবং পাঠক-সাধারণের কাছে পৌঁছাবার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার দর্শন বিভাগের পালন করা উচিত। হরিদাসবাবুর ব্যক্তিগত নথিটি তাঁর মনোহর হস্তাক্ষরে লিখিত নানা মন্তব্য, স্লিপ, পত্র, স্মারক ইত্যাদিতে পূর্ণ। হয়ত হস্তাক্ষর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো তাঁর ছুটির আবেদনে। তার সংখ্যাধিক্যে এই নথিটির পাঠকের মনে হতে পারে যে হরিদাসবাবু অসংখ্যবার ছুটি নিয়েছেন। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। কিন্তু অসংখ্য এই ছুটির আবেদনের যে বৈশিষ্ট্যটি আমাকে বিমোহিত করেছে সে হচ্ছে তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা এবং দায়িত্ব পালনে নিয়মনিষ্ঠা। নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে না পারলে অবশ্যই পদাধিকারীকে নিয়মমাফিক সকারণ ছুটির আবেদন করতে হবে এবং ছুটি এ্যালাউ করতে হবে। ফ্রেঞ্চ লিভ বলে ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি শব্দগতভাবে আমরা যতো না ব্যবহার করি, কার্যগতভাবে তার অধিক যে। তাকে ব্যবহার করি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু হরিদাসবাবু নিশ্চয়ই ফ্রেঞ্চ লিভ ব্যাপারটি সম্পর্কে চরিত্রগতভাবে জ্ঞাত ছিলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিসও হয়ত হরিদাসবাবুর এমন নিয়মনিষ্ঠায় কিছুটা বিব্রত হয়েছিলো। তাই হরিদাসবাবুর যখন একদিনের ছুটির আবেদন। করে একটি দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন তখন দেখা গেল রেজিস্ট্রার সাহেবের অফিসে এক সহকারী হরিদাসবাবুকে লিখে পাঠাচ্ছেন : V.c, says that you do not really require the leave. কিন্তু এর উত্তরে হরিদাসবাবু লিখে পাঠালেন : I was obliged to cut two classes from 10-30 to 12-30. So formal leave would still be required. এই মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায় আর একটি চিঠিতে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে তিনি চিঠি লিখে বলেছেন : (১.৩.৩৫) :

Dear Mr. Vice-Chancellor,
As I was detained too long at the Court to be able to take my class, I pray that duty leave for this day only be granted to me…

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিস্মৃত তথ্য হিসেবে এখানে একটি কথা বলা যায়। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠানগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ, সে সিন্ডিকেটে বা ভিসি যিনিই হোন, তিনি নিয়োগকারী, এমপ্লয়ার এবং শিক্ষক হচ্ছেন এমপ্লয়ী। সেদিন অর্থাৎ বিশের বা ত্রিশের দশকে অন্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কি ছিলো তা জানিনে। কিন্তু শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি ইউ আর এ্যাপয়েন্টেড বলে কোনো নিয়োগপত্র দিতেন না।

শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয় এরা উভয় ছিলো দুটি পক্ষ, সমপক্ষ। তাদের মধ্যে চুক্তি হতো। উভয়পক্ষের জন্য চুক্তির শর্ত উল্লেখ থাকত। এবং উল্লেখ থাকত যে, একে পক্ষ চুক্তির কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে অপর পক্ষ তার প্রতিবিধানের কি পথ গ্রহণ করতে পারবে। আজো অবশ্য পক্ষ দুটি। তবু সেদিন চুক্তির পদ্ধতিতে আজকের প্রভু-ভৃত্যের দিকটি এত প্রকট হয়ে চোখকে বিদ্ধ করতো না।

একেবারে গোড়াতে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এমন চুক্তিপত্রও শিক্ষকদের জন্য তৈরি হয়েছিলো না। ভাইস চ্যান্সেলরের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। ১৯২৩ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উভয় পক্ষে চুক্তিপত্র সম্পাদিত হতে শুরু করে এবং এরূপ চুক্তিপত্রে মাহিনার শর্তে যে গোড়াকার প্রতিশ্রুতির পরিবর্তন ঘটেছিলো তার আভাস পাওয়া যায় হরিদাসবাবু ১৯২৩ সালে রেজিস্টারকে যে প্রতিবাদপত্র লিখেছিলেন, তা থেকে। হরিদাসবাবুর নিকট প্রেরিত চুক্তিপত্রের গোড়াতে ছিলো :

Where as the Executive Coucil of the Dacca University in exercise of the powers conferred on them by the Dacca University Act have engaged the party of the first part (Mr. Haridas Bhattachayya) to serve as a Reader in Philosophy in the University of Dacca till he attains the age of fifty and subject to the conditions and agreements herein contained….

3. That from the first of July nineteen hundred and twentyfour the University will pay him, so long as he shall remain in the said service and actually perform his duties, a salary at the rate of Rupees 700/- Seven hundred (fixed) per mensem.

‘৭০০’ টাকা নির্দিষ্ট মাহিনার এই শর্তের প্রতিবাদে হরিদাসবাবু রেজিস্টারকে লিখেছিলেন : (১৮.১২.১৯২৩)

This is the first official intimation that I have received from the university that the maximum has been reduc from Rs 1200/- to Rs 700/- in the case of Readers… … … Taking all the facts together the matter comes to this that intead of a maximum of 1200/- pay and 120—-as P.F. contribution of the University I am being offered now practically half of what was in the original offer and this inspite of the fact that I wanted a definite assurance from the Vice-Chancellor that the maximum offered would not be varied from ….

আমার স্মরণমতে হরিদাসবাবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিডার হিসেবেই অবসর গ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে। অর্থাৎ তখন তার বয়স হয়েছিলো ৫২ বছর। (সে হিসেবেও হরিদাসবাবুর জন্ম সাল নির্দিষ্ট করা যায় ১৮৯০ সাল।) এই দীর্ঘ সময়ে অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পঁচিশ বছর কার্যকালে তার মাহিনার সেই নির্দিষ্ট ৭০০ টাকার কোনো পরিবর্তন ঘটেছিলো কিনা, আমার জানা নেই।

বাংলাদেশের যেমন রাজনীতি আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও তেমনি রাজনীতি আছে। ইংরেজিতে আমরা বলি ইউনিভার্সিটি পলিটিক্স। এটি নিশ্চয়ই কোনো আধুনিক উপাদান নয়। এটি সেকালেও ছিলো। তবে একালের মত হয়তো সেকালে এত প্রকট বা পোশাক-আশাকবিহীন ছিলো না।

এই রাজনীতির আভাসই পাওয়া যায় হরিদাসবাবুর জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের একসিকিউটিভ কাউন্সিলের ১০.২.১৯৩৭ তারিখের কার্যবিবরণী থেকে।

হরিদাসবাবু ১৯৩৫ সালে কলা অনুষদের ডীন নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৩৭ সালে অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হলে জগন্নাথ হলের জন্য নতুন প্রভোস্ট নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। ড, রমেশচন্দ্র মজুমদার এতদিন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। সেকালে হলের প্রভোস্ট পদও স্থায়ী চাকরি বলে গণ্য হতো এবং সেই হিসেবেই প্রভোস্ট নিযুক্ত হতেন।

উল্লিখিত তারিখে একসিকিউটিভ কাউন্সিলে বিষয়টিকে আলোচ্য বিষয় করা হয়। সভার কার্যবিবরণীটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে সেকালের বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিকস-এর পরিচায়ক হিসেবে। বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উদ্যোগী এবং কর্মীপুরুষ হরিদাস ভট্টাচার্য যে অজাতশত্রু ছিলেন, এমন মনে করা যায় না। তবে তাঁর গুণগ্রাহীরও অভাব ছিলো না। তাই দেখা যায়, সে সভার শুরুতে হরিদাস ভট্টাচার্যকে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট পদে নিয়োগের প্রস্ত বি উত্থাপন করেন ড. এন.এম. বসু এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কিন্তু এ প্রস্ত বের বিরোধিতা আসে জনাব এস.এ. সেলিম এবং সুলতান উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে।

তারা কয়েকটি নামের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করে সেই কমিটির কাছে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনার জন্য প্রেরণ করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু যাঁদের নিয়ে এই কমিটি গঠনের প্রস্তাব হয় তাঁর মধ্যে পি.এন. রায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে কমিটি গঠনের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায় এবং মূল প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া হয় :

Original motion was put to vote and carried, eight members voting for it and three members against. Messrs Fazlur Rahman, Sultan uddin Ahmed and S.A. Salim voted against the motion.

এই সভারই শেষে অবশ্য ফজলুর রহমান এবং সেলিম সাহেবও হরিদাসবাবুর প্রভোস্ট নিয়োগে সম্মত হয়েছিলেন।

একসিকিউটিভ কাউন্সিলের এই প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার হরিদাসবাবুর নিকট ১০.২.৩৭ তারিখে প্রেরণ করে লিখেছিলেন :

Dear Sir,
I am directed to communicate to you the following resolution of the Executive Council adopted at its meeting 10th February, 1937 :

That Mr. H. D. Bhattacharyya, M.A.B.L Head of the Department of Philosophy, be appointed Provost of the Jahannath Hall on an allowance of Rs. 150/- per mensem and free quarters for a period of two years in the first instance, with effect from the 11th February, 1937 and that with approved service the appointment may be renewed up to the end of the session in which he will attain the age of 55 years.

১৯৪৫ সালে হরিদাসবাবুর চুক্তি মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের রীডার হিসেবে অবসরগ্রহণ করে কলকাতা চলে যান। পঞ্চান্ন বছর তখন তার বয়স। সে বয়স কর্মক্ষম থাকার বয়স।

হরিদাস ভট্টাচার্যের জন্য অবসর গ্রহণের বয়স ছিলো না। হরিদাসবাবু কি তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য কোনো আবেদন বা চেষ্টা করেছিলেন? সেদিনকার গোবেচারী ছাত্র আমার তা জানা নেই। হরিদাসবাবুর ব্যক্তিগত নথিটিও ৩৭ সালের পর থেকে নিরুদ্দিষ্ট। হয়তো চেয়েছিলেন, কিংবা ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আবহাওয়ার তিক্ততায় তার ভরসা পান নি। যেমন ভরসা পান নি বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনিও তাঁর পঞ্চান্ন বছর বয়সের পূর্তি বা তার পূর্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছিলেন, কারণ আচার আচরণে যথার্থ দার্শনিক অধ্যাপক বসু তাঁর চারপাশে গুঞ্জন শুনছিলেন। সে গুঞ্জনের প্রধান উৎস ছিলেন করিৎকর্মা মুসলমান রাজনীতিক জনাব ফজলুর রহমান। তিনিই সরবে দাবি তুলেছিলেন, আমাদের একজন মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানী আবশ্যক। সত্যেন্দ্রনাথ বসু হিন্দু। অবশ্য অধ্যাপক বসুকে আরো কিছুদিন রাখারও যে প্রচেষ্টা চলে নি তা নয়। কিন্তু অধ্যাপক বসু চান। নি তাঁকে নিয়ে এপক্ষে-ওপক্ষে টানা-হাচড়া হোক। তাই তেমন প্রচেষ্টার উদ্যোক্তাদেরও নিবৃত্ত করে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন।

হরিদাস ভট্টাচার্যের আলেখ্য একটি প্রবন্ধে উপস্থিত করা সম্ভব নয়। এ কেবল তাঁকে স্মরণ করার প্রয়াস। হরিদাসবাবু ব্রাহ্মণ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে সেই কালের একটি কৌতৃকজনক তথ্যের কথা উল্লেখ করা যায়। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ধর্ম হিসেবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান বলে তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯২১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কার্যবিবরণীতে ছাত্রদের, বিশেষ করে হিন্দু ছাত্রদের কেবল হিন্দু বলে শ্রেণীভুক্ত করা হয় নি। তাদেরকে ব্রাহ্মণ এবং অ-ব্রাহ্মণ বলেও ভাগ করা হয়েছে। এই তথ্যটি কালের নির্দেশক হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ।

হরিদাসবাবু সম্পর্কে এই আলোচনাটি ব্যক্তিগত একটি বিষয়ের উল্লেখে শেষ করা যায়। হরিদাস ভট্টাচার্য আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ছাত্র ছিলেন। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল অকৃপণভাবে তাঁর পরিশ্রমী, ধীমান ছাত্র হরিদাস ভট্টাচার্যের জন্য প্রশংসাপত্র দিয়েছেন। অধ্যয়ন শেষে শিক্ষক তথা বিভাগীয় প্রধানের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করা ছাত্রদের পক্ষে একটি বোধ্য প্রয়াস। হরিদাসবাবু সম্পর্কে তার ছাত্র হিসেবে আমার এই স্মৃতিটি আনন্দের এবং অনুপ্রেরণার যে, তিনি ঢাকা থেকে চলে যাবার পরেও ১৯৪৭ সালে তাঁর কলকাতার বাড়ি থেকে নিজের টাইপ মেসিনটিতে নিজের হাতে টাইপ করে তাঁর সেই পরিচিত এইচ ডি, ভট্টাচারিয়ার স্বাক্ষরে আমাকে একটি প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন। সে প্রশংসাপত্র পেয়ে আমি যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছি, তেমনি তার প্রশংসাবাচক উক্তির উপযুক্ত নই বলে বিব্রত বোধ করেছি। এমন প্রশংসাপত্র ব্যবহার বা বিক্রি করে কোনো জাগতিক উন্নতি লাভ করতে আমি সঙ্কোচ বোধ করেছি। কিন্তু প্রশংসাপত্রটি তার মূল কাগজ খণ্ডটিতে রক্ষা করতে পেরে বিশেষ আনন্দ লাভ করেছি। এ প্রশংসাপত্র টিকিধারী ব্রাহ্মণ দার্শনিক অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য যে তাঁর স্নেহভাজন একটি কিশোর ছাত্রের প্রশংসায় তারই শিক্ষক আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মতোই অকৃপণ এবং উদার ছিলেন সেই সাক্ষ্যই বহন করছে আমার নিজের কোনো কৃতিত্বের স্বাক্ষর নয়। ইতিহাসের বিষয় বলেই তার কয়েকটি ছত্র এখানে উদ্ধৃত করা গেল :

Apart from his intellectual briliance, Mr. Sardar has been a steadying froce in the Department. Genial by temperament and social to a fault, Mr. Sardar has proved a cementing froce among various sections of students, belonging to different halls of the university and I can testify from personal knowledge to his popularity as a student of the university. He was also noted for his social service and his sympathy for the poor and the needy. His teachers are all praise for him and justifiably so.

দুই পৃষ্ঠাব্যাপী এমন প্রশংসাপত্রের পুরো উদ্ধৃতিতে প্রায় চল্লিশ বছর পরে আজো আমি সঙ্কুচিত। তবে এতে মনোবিজ্ঞানী হরিদাস ভট্টাচার্যের এমন। প্রত্যয়টিও ধরা পড়ে যে, তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রশংসা করেই মাত্র স্নেহভাজনকে প্রশংসার যোগ্য হওয়ার প্রয়াসে উদ্বুদ্ধ করা যায়।

হরিদাস ভট্টাচার্য আজ বেঁচে নেই। কবে তিনি প্রয়াত হয়েছেন, তার তারিখ বিনা অনুসন্ধানে বার করা ঢাকায় তাঁর পুরাতন ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। ১৯৫৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হরিদাস ভট্টাচার্যের মৃত্যুর তারিখটি সেদিনের পাকিস্তানভূক্ত ঢাকার কোনো কাগজে সংবাদ হয়েছিলো কি না, আমার জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দর্শন বিভাগ প্রতিষ্ঠানগতভাবে তার প্রতিষ্ঠাকালের অন্যতম সংগঠক শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্যকে স্মরণ করেছিলো কিনা সেটিও আমার অজ্ঞাত। জগন্নাথ হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রঙ্গলাল সেন অনুসন্ধান করে জানিয়েছেন, তখনকার ঢাক-জগন্নাথ হলের যুক্ত ছাত্রাবাসের প্রভোস্ট এবং ছাত্রগণ একটি শোকসভায় মিলিত হয়ে হরিদাস ভট্টাচার্যকে সেদিন স্মরণ করেছিলেন। ইতিহাসকে বিস্মরণের প্রবাহে তারা সেদিন অন্তত একটি ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, হরিদাসবাবুর একজন ছাত্র হিসেবে এজন্য জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নিকট আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।

মিস. এ. জি. স্টকের স্মৃতিকথা

শুনলাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের এক সময়কার ইংরেজ অধ্যাপিকা মিস এ.জি, স্টক কয়েকদিনের জন্য আবার ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন। আমি নিজে তাঁর নিকট পরিচিত নই। তাহলে আমি গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতাম। ইংরেজি বিভাগ থেকে, শুনেছি, একটি সংবর্ধনা জানানো হবে। তাতে জোর করে উপস্থিত হওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু সেটি বড় কথা নয়। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় অপরিচয় বড় নয়।

মিস স্টকের নামের সঙ্গে আমি সেই ৪৭ সালের দিকেই পরিচিত হয়েছিলাম। অবশ্য তিনি যখন ভারত বিভাগের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এসে যোগ দেন, তখন একদিকে যেমন আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে, তেমনি অপরদিকে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে। পুলিশের দৃষ্টি আমার ওপর পড়তে শুরু করেছে। এর ফলেই ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি আমি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাই। আর তারপরে ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে গ্রেফতার হওয়া থেকে আমার দীর্ঘ বন্দীজীবনের শুরু হয়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মিস স্টকের সাহচর্যে আসা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।

কিন্তু যে সাহচর্য আমি সাক্ষাৎভাবে লাভ করি নি সেটিই পেয়েছিলাম আজ থেকে বছরখানেক আগে তাঁর ঢাকার স্মৃতিচারণমূলক নাইনটি ফরটি সেভেন টু ফিফটিওয়ান মেমেয়ের অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি শিরোনামে বইখানি যখন পড়ি। তার এই স্মৃতিচারণের মধ্যে মিস স্টক একজন দরদী ও জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে কেবল প্রকাশিত হন নি, তিনি পূর্ব বাংলার সে সময়কার ছাত্র শিক্ষক-মধ্যবিত্তের প্রগতিশীল ভাষা-সংস্কৃতির আন্দোলনের একজন অকৃত্রিম সুহৃদ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন।

বইখানা প্রথমে যখন পড়ি তখন আমার খুবই ভাল লেগেছিলো। এর প্রধান কারণ, ১৯৪৭-৫১-এই সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে জানার আমারও একটি আগ্রহ আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি ছাত্র ছিলাম। কিছুকাল এর শিক্ষকও ছিলাম। আজ আবার এর সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে জড়িত হয়েছি। অধ্যাপিকা মিস স্টকের সরস ও সুন্দর অর্থময় উক্তিপূর্ণ স্মৃতিচারণ আমাকে সেই সময়কার জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় ঋদ্ধ এবং সে কারণে এই স্মৃতিচারণ পাঠে একটা আনন্দ ও কৃতজ্ঞতাবোধ আমার মনকে পূর্ণ করে তুলেছিলো। রোজনামচার আকারে লিখিত এ স্মৃতিচারণে অধ্যাপিকা স্টক তাঁর সেই বিলেত থেকে ঢাকা এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি গ্রহণ করা। থেকে ১৯৫১ সালের শেষে পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান সরকারের নির্বোধ আচরণের ফলে ক্রমাধিক পরিমাণে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক হত্যা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ঢাকা ত্যাগের সময় পর্যন্ত তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। কেমন করে ধীরে ধীরে তিনি পরিচিত হয়েছেন পূর্ববঙ্গের জীবনের সঙ্গে। তার আবহাওয়া-রাস্তাঘাট-মানুষের সঙ্গে। কেমন করে হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে তাঁর বিশ্বস্ত বাবুর্চি আবদুল থেকে ছাত্র, শিক্ষক সম্প্রদায়ের। বুদ্ধিমান, সমাজসচেতন চরিত্রসমূহের সঙ্গে। মুনীর চৌধুরী, সারওয়ার মুর্শিদ, জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, ড. পি সি চক্রবর্তী, কবি জসিমউদ্দীন, ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হাসান এঁরা সবাই অন্তরঙ্গ রেখাচিত্র হিসেবে তাঁর রোজনামচায় ফুটে উঠেছেন। রচনার সমগ্রটিতে একজন দরদী সুহৃদের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। অধ্যাপিকা মিস স্টকের এ রচনা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সালের হলেও এটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিনি যে একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন সেটি তিনি কখনো বিস্মৃত হন নি। তাঁর সেই অকৃত্রিম সম্পর্কের টানেই তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার ঢাকা এসেছিলেন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। তখনি তিনি এই পাণ্ডুলিপিটি ঢাকার গ্রীন বুক হাউজের রুচিবান প্রকাশক মাহমুদ সাহেবের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। গ্রন্থে লেখিকা তাঁর মূল রচনার পরবর্তীকালের ঘটনাবলির আভাসও তার ভূমিকাতে দিয়েছেন। সে ভূমিকায় তিনি লিখেছেন :

…I had reached the language riot of nineteeen fortyeight when the war brokeout in march 1971 and the present came horryfyingly to life on secreen, radio and the newsprint smothering memories. It was months before I learnt anything of the fate of my friends lyotirmony guha thakurta was killed in the presence of his students, Munir Chowdhury, with his gallantry and gaiety was a body among many bodies in the brickfield…..

আমার স্মৃতিচারণে আমি ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে যখন পৌঁছি তখন ১৯৭১-এর মার্চে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এবার অতীতকে আচ্ছন্ন করে মর্মান্তিক বর্তমান আমার সামনে এসে হাজির হলো। ছবিতে দৃষ্ট সে দৃশ্য, বেতারে শ্রুত আর কাহিনী আর নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত তার বিবরণ আমার অতীতের স্মৃতিকে একেবারে রুদ্ধ করে দিল। কিন্তু বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে আমি জানতে পারলাম না আমার সেদিনের বন্ধুদের কার ভাগ্যে কি ঘটেছে। অবশেষে জানলাম জ্যোর্তিময় গুহঠাকুর তাকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর ছাত্রদেরই সামনে। সদাহাস্য মুনীর চৌধুরী একটা ইটের ভাটিখানায় বহু মৃতদেহের একটি মৃতদেহে পর্যবসিত হয়েছেন….

মিস এ জি স্টকের এই স্মৃতিচারণ একখানি মূল্যবান গ্রন্থ। সাহিত্যপত্র এবং সাহিত্যিক মহলে বইখানির আলোচনা হওয়া উচিত। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের যেমন এ একটি উত্তম সৃষ্টি, তেমনি পূর্ববাংলার ১৯৪৭-৫১ সময়কালের জীবন ও নানা চরিত্রের অন্তরঙ্গ আলেখ্যে এ গ্রন্থ অনন্য। বাংলা অনুবাদে মিস স্টকের প্রকাশ মাধুর্য হয়ত রক্ষিত হবে না, তবু ১৯৪৭ থেকে ৫১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের একখানি অনুপ্রেরণাদায়ক অন্তরঙ্গ ইতিহাস হিসেবে এর অনুবাদ হওয়া প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়।

সানাউল হক : চল্লিশের দশকের অন্যতম সাথী

প্রায় ১২ বছর আগে, ’৮১ সালের জানুয়ারি মাসের এক রাতে আকস্মিকভাবে টেলিভিশনের আওয়াজে শুনেছিলাম সৈয়দ নুরুদ্দিনের প্রয়াণের কথা। ১২ বছর পরে ৯৩-এর ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে টেলিভিশনের শেষ সংবাদ পাঠিকার কণ্ঠে খবর পেয়ে চমকে উঠলাম : আমাদের চল্লিশের দশকের অন্যতম সুহৃদ, সাথী, কবি সানাউল হকও চলে গেছেন।

সানাউল হক অসুস্থ ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম তখনো তিনি আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক জীবনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলছিলেন। বাংলা একাডেমির তিনি সভাপতি ছিলেন। বোধ হয় একুশের এক বক্তৃতায় তিনি অপ্রত্যাশিত সাহসী বক্তব্য উপস্থিত করে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন। আমার নিজের সাংসারিক জীবনের নানা সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতার কারণে মনের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সানাউলের কাছে গিয়ে বসতে পারি নি। অথচ নিজের মনে তার সঙ্গে কখনো আমার অন্তরের কথা বন্ধ হয় নি।

সানাউল, নুরুদ্দিন : দুজন বোধ হয় একই বয়সের ছিলেন। বয়সে আমার জ্যেষ্ঠ। কিন্তু সম্পর্কে আমাদের পরস্পরের মধ্যে কখনো বয়সের কোনো প্রশ্ন আসে নি। আসলে আমরা সেদিন, সেই রূপকথার যুগে, জানতামই না আমাদের কার বয়স কত। আমরা কেই কারুর চাইতে ছোট কিংবা বড় ছিলাম না। সকলেই সকলের সমান। নুরুদ্দিন তো বটেই, সানাউল হকের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিলো পরস্পরের তুমি সম্পর্ক। কেমন করে। আমরা সেদিনই, এই পূর্ববঙ্গের উত্তর-পশ্চিম পূর্বদক্ষিণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্রমে এসে মিলিত হয়েছিলাম তার কোনো হদিস আজ। চেষ্টা করেও আমি বার করতে পারছিনে। জল যেমন নিঃশব্দে জলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়, নদী যেমন পূর্ণতার টানে সাগরে মেশে, আমরাও সেদিন জল আর নদীর মতো নিজেদের অজান্তেই পরস্পরের অন্বেষণে ছিলাম এবং সেই অম্বেষণে পরস্পরকে লাভ করেছিলাম। আর তাতেই তৈরি হয়ে উঠেছিলো নতুন জীবন ও স্বপ্নের বোধে উদ্বুদ্ধ সুহৃদ ও সাথীর একটি গোত্র। সেই গোত্রের পরস্পরের মধ্যকার ঘনিষ্ঠতা আর হৃদ্যতার কথা একালের। তরুণ-তরুণী, এমন কি বয়স্কদেরও বুঝিয়ে বলা, লিখে জানানো একেবারে অসম্ভব। আর তাই আমি যখন সানাউলের বাড়িতে গিয়েছি, কিংবা টলস্টয়ের। জন্মের ১৫০ তম বার্ষিকীতে একই মঞ্চে যে যার ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি, তখন আমাদের পারস্পরিক দৃষ্টিতে যে প্রীতি ও স্মৃতির আবেগ উদ্ভাসিত হতো, তা অপর কারুর পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব হতো না।

পূর্ববঙ্গের এমন অঞ্চল আছে যে অঞ্চলের দুই সুহৃদ একান্তভাবে পরস্পর সংলাপে রত হলে অপর অঞ্চলের মানুষের পক্ষে তার মর্মার্থ অনুধাবন করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। তেমনি আমাদের অবস্থা হতো যখন সানাউল, নুরুদ্দিন, মতিন, মুনীর, কামাল, নুরুল ইসলাম, বাহাদুর একালেও মিলিত হতাম এবং একে অপরকে প্রীতির আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতাম। তখন একালের পারিপার্শ্বিক যেন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। তাদের চোখে ভেসে উঠত জিজ্ঞাসা, এরা কারা, এদের এমন গভীর প্রেম আর প্রীতির রহস্য কি?

নুরুদ্দিন চলে যাওয়ার পরের দিনও আমার এই কথাগুলো মনে হয়েছিলো। আজ ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সানাউলের জানাজায় শরিক হয়ে মসজিদ থেকে নেমে আনমনে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে কথাগুলোই মনে। পড়ছে। ক্রমান্বয়ে একটা সঙ্গীহীনতার অসহায়তা যে বৃদ্ধি না পাচ্ছে, তা নয়। যথার্থই ক্রমান্বয়ে সঙ্গীহীন হয়ে পড়ার একটা অসহায় এবং অনিবার্যতার বোধ মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

না, দিনক্ষণ মনে করতে পারছিনে। আনন্দে বিষাদে সঙ্কটে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ফললুল হক হলের বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে, যুদ্ধের মধ্যে লাভ করা আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের সৈনিকদের মধ্যে সাম্যবাদী আদর্শের কমরেডদের সঙ্গে সাহিত্যের আসরে, কিংবা তাদের উদ্যোগে ক্যান্টনমেন্টের সেনাছাউনিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে সংগঠিত বিতর্কে আমরা কে কি বলেছি তা স্মরণ করতে পারছিনে। এমন কি ৪৬ সালের কলকাতার। গণহত্যার খবরে উদ্বেগে অস্থির হয়ে আমরা কেমন করে ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে চক-ইসলামপুর-পাটুয়াটুলি-নবাবপুরের মধ্য দিয়ে যে শান্তি মিছিল সংগঠিত করেছিলাম, তাতে সানাউল আমার সামনে কিংবা পেছনে ছিলো তা কেমন করে বলব? কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক সমগ্র উদ্যোগ ও আয়োজনে যে সানাউল থাকত, থাকত, মুনীর, নুরুদ্দিন, মতিন : এতে কোনো সন্দেহ নেই।

একটা কথা ভাবতে আমার অবাক লাগে। কোনো বর্তমানই সদস্যা ও সঙ্কটমুক্ত নয়। তাই কোনো বর্তমানের মানুষই নিজেকে নিশ্চিন্ত আর সুখী বোধ করতে পারে না। কিন্তু চল্লিশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে তার সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জীবনে লালিত পালিত হচ্ছিলাম যে আমরা, তারা রাজনৈতিক সঙ্গটে উদ্বিগ্ন ও চিহ্নিত হলেও, নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ আমরা নিজেদের সেই জীবনকে মনে করতাম ভাগ্যবান জীবন। মানুষের মুক্তির তত্ত্বের সন্ধান লাভে আমরা ভাগ্যবান ছিলাম। সোমেনকে লাভ করার আমাদের ভাগ্য হয়েছিলো। আশ্রম-সম বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে আমাদের তথা সানাউলের, নুরুদ্দিনের, মুনীরের, মতিনের, নাজমুল করিমের, মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর, আমার ভাগ্য হয়েছিলো বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন বসুকে লাভ করার, ভাগ্য হয়েছিলো জ্ঞানতাপস ড. শহীদুল্লাহর স্নেহ সাহচর্যে ধন্য হওয়ার, ভাগ্য হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমগ্র বঙ্গদেশ এবং ভারতের প্রগতিপন্থী চিন্তাধারার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়ার। এ কেবল স্মৃতির কথা নয়। এ আমাদের সকলেরই। সেইকালেরই সচেতন বোধের ব্যাপার ছিলো।

আর সে কারণেই অসুস্থ শরীরে সানাউলের মন যখন ভেঙে পড়ল, যখন তার একটি প্রকাশিত কবিতার প্রধান অনুরণন ছিলো, আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি, তখন সে কবিতা পাঠ করে বন্ধুবর মতিনের মতো আমার মনও বেদনায় ভরে উঠেছিলো। একথা জানতাম, সেই অসুস্থ অবস্থায় সানাউল হকের কাছে গিয়ে সান্ত্বনা বা আশার কথা বলা নিরর্থক ছিলো। তবু সানাউল তথা আমরা, সেই চল্লিশের দশকের সুহৃদরা, সাথীরা তাদের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কি নিঃশেষ আর ব্যর্থ হয়ে গেছি? শরীর দুর্বল হলে অনিবার্যভাবে মনও আমাদের দুর্বল হয়ে পড়ে। তবু সেই অসুস্থ শরীরের হাহাকার এবং আফসোস কি একদিনকার আশাবাদী তরুণ সানাউলদের নিষ্ঠা, আদর্শ ও স্বপ্নের অবদানকে মিথ্যে করে দিতে পারে? যদি আমার সাধ্য থাকত তবে আমি সেই কবিতাটি পাঠ করার পরে সানাউলকে গিয়ে বলতাম, না, তুমি নিঃশেষ হয়ে যাও নি, তুমি ব্যর্থ হয়ে যাও নি। তুমি মানেই আমরা, আমরা মানেই তুমি। আমি নিজে সেদিন সানাউলের কাছে যেতে পারি নি। এই না পারার অক্ষমতার দুঃখই আজ সানাউলের মৃত্যুর খবর হঠাৎ ৪ তারিখে শুনে আমার মনে বড় হয়ে বাজল।

এই রোজনামচাটি শেষ করার মুহূর্তে হাসনাতের কাছ থেকে ১৯৯০ সালে নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে প্রকাশিত সানাউল হকের তারুণ্যের দিনলিপি ও অন্যান্য বইখানা পেলাম। বইখানাকে সানাউল উৎসর্গ করেছেন একালের মননশীল সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল হাসনাত ও সংস্কৃতিবান কর্মী আফজাল হোসেনকে। এই উৎসর্গটিতে কবি সানাউল হকের প্রিয়জনদের জন্য স্নেহ ও মমতার একটি অনাবিল প্রকাশ ঘটেছে।

আমার আফসোস, সানাউলের জীবনকালে এই গ্রন্থখানির আমি খবর রাখতে পারি নি। তার ছেলেবেলার কাহিনী বেরিয়েছিলো, তা আমি জানতাম। কিন্তু সানাউল তার সেই চল্লিশের দশকের তারুণ্যে, কলেজে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে, দিনের পর দিন জীবনের নানাদিকের ওপর তার চিন্তাপূর্ণ মন নিয়ে সুন্দর কাব্যময় গদ্যে দিনলিপি রচনা করে যে ভবিষ্যৎকালের জন্য রক্ষা করেছেন, তা আমি জানতাম না। তাঁর এ দিনলিপি সমগ্র বাংলাসাহিত্যে একটি মূল্যবান ও তাৎপর্যময় সংযোজন বিশেষ। সানাউলের এই দিনলিপি নিয়ে উপযুক্তভাবে কি ঢাকার সাহিত্যিক মহল আলোচনা করেছেন? আমি তেমন আলোচনা সম্পর্কে জ্ঞাত নই।

আমি এখনো সানাউলের দিনলিপি পাঠ শেষ করতে পারি নি। তবু তার মধ্যে থেকে ১০ বৈশাখ ১৩৫০ তথা ১৯৪৩ সালে লিখিত এবং ২৪.৭.১৯৪৩ তারিখে লিখিত দুটি দিনলিপির পাঠ মুহূর্তে আমার এই পৌঢ়ত্ব থেকে ৫০ বছর হেঁটে ফেলে আমাকে পৌঁছে দিল একেবারে কিশোর তারুণ্যে।

বৈশাখ দশ, ১৩৫০, সাতগাঁও

ভারতের কথা ভাবলে দুঃখ হয়। বর্তমান শতকে এমন বহুধাবিভক্ত আর দুর্দশাগ্রস্ত দেশ হয়তো একটিও নেই। পৃথিবীর আর সব দেশ যখন নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধির প্রয়োগে নব নব সম্ভাবনাকে রূপ দিচ্ছে তাদের কর্মে ও চিন্ত য়ি, ভারত তখন পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান, এই দোটানায় পড়ে পড়ে দিন দিন নির্জীব ও শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। তার অখণ্ডত্বের ও দ্বিখণ্ডত্বের মধ্যে দর কষাকষি হচ্ছে বিস্তর, অথচ যাকে নিয়ে এ তোলপাড় তার দিকে নজর নেই কারো–এ যেনো মার্কামারা থান কাপড়ের মতো। তাকে হেঁটেকেটে টুকরো করলেও যা, আস্ত রেখে ফরাশ পাতলেও তা। যে ব্যবহার করবে, তার রুচিতেই নির্ধারিত হবে সব কিছু, যাকে ব্যবহার করা তার জো হুজুর করা ছাড়া যেনো নিস্তার নেই। ধর্ম ও সংস্কার তীক্ষ্ণ কাঁচির মতো হাঁ করে আছে কার হাতে শিকার পড়বে, শুধু এই ভাবনা। জিন্না ও সাভারকর, দুই ভিন্ন স্বার্থের প্রধান ভূমিকায়। অভিনয় করছেন। একজন কথার তুবড়িতে আর একনজকে উড়িয়ে দেন–দলের লোক চেঁচিয়ে বলে, শাবাশ নওজোয়ান জিতে রাহো। সাগর পাড়ের মুরুব্বিরা আশ্বস্ত হয়ে, একের অগোচরে অন্যকে উৎসাহ দেন।

আবার ২৪.৭.৪৩ তারিখের দিনলিপিতে সানাউল আমাদের নিয়ে যান। সেকালের প্রতিক্রিয়া ও রক্ষণশীল শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সানাউল ও তার কমরেডদের সাহসী উদ্যম উৎসাহ, প্রয়াস-প্রচেষ্টার জমিনটিতে।

২৪.৭.১৯৪৩

আমাদের হলের জনৈক বিলাতফেরত উচ্চশিক্ষিত (?) হাউজ টিউটর আমাদের কমরেড রবিগুহ ও প্রত্যক্ষ দত্তের হলের প্রবেশাধিকার নিয়ে যে তুমুল হৈ হৈ করে আমাকে ধমকালেন, তা শালীনতা, ভদ্রতা ও ভব্যতার বাইরে। তার কথাগুলো এতো জ্বালামীয় যে তা শুনে আমি বিস্ময়ে হতবাক হতে বাধ্য হলাম। মানুষের চরমতম নিচাশয়তার পরিচয় জীবনে আমি বহুবার দেখেছি, কিন্তু তাতে মনে এতোটা বাজে নি। কিন্তু আজ যখন হিন্দু-মুসলমান উভয়ের শিক্ষাদান-কর্তব্যে নিযুক্ত এই শিক্ষক এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুটি ছাত্রের হলের আগমন নিয়ে এমন কাণ্ড বাধালেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাগার। সম্বন্ধে আমি ঘোর সন্দিহান হয়ে উঠতে বাধ্য হলাম। আমাদের আজ বুঝিয়ে বলতে হবে যে, শুধু বিধর্মী হলেই মানুষ মানুষের শত্রু নয়, অন্যপক্ষে এক ধর্মাবলম্বী মানুষই পরস্পরের বন্ধু নয়।

সানাউলের সংযত রুচিপূর্ণ বাকভঙ্গিটি চোখের সামনে আজ ভেসে উঠছে। আমি যেন আমার সদ্যপ্রাপ্ত তার তারুণ্যের দিনলিপি নিয়ে তাঁকে অবাক করে দেওয়ার জন্য রহস্য করে বলছি, দেখতো, এই লেখকটিকে তুমি কি চিনতে পারো?

সানাউল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনন্দপূর্ণ আবেগে অসুস্থ শরীরেও হেসে ওঠার চেষ্টা করে বলছেন, আরে সরদার! এ বই তুমি কোথায় পেলে? তোমাকে দেব বলে ভেবেছি। কিন্তু দেওয়া তো হয় নি।…

আমি সানাউলকে বলছি, তাতে আমার কোনো অভিমান নেই। তোমার এ বই নিয়ে আমাদের অবশ্যই আলোচনা করতে হবে…..।

আমার আফসোস এজন্য আরো যে, সানাউল বেঁচে থাকার সময়ে আমি তাঁর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্ত বিরতিবিহীন-এর উৎসর্গপত্রটি দেখি নি যেখানে তিনি তাঁর চল্লিশের দশকের সতীর্থদের উল্লেখ করে বলেছেন :

কবীর চৌধুরী
ওয়াদুদুল হক
সরদার ফজলুল করিম
 চল্লিশের দশকের সহমর্মিতার বন্ধুত্রয়

৭.২.৯৩

ওজনের বেলা করিও না হেলা

ওজনের বেলা করিও না হেলা,
 মাপকাঠি তব রাখিও সমান…

 শুধু এই বয়াতটিই আমার মনে আছে। সেই ছোটকাল থেকে। তখন আরো বয়াত আমার মুখস্থ ছিলো। কোরানের সুরা আর রহমান-এর বোধ হয় একখানি কাব্যিক অনুবাদ মিয়াভাই সাহেব এনে দিয়েছিলেন। সে বইয়ের সবটাই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। বাড়ির সকলে ডেকে ডেকে আমাকে বলতেন, তুমি পড়োত একটু সেই বইখানা। কিন্তু বড় হয়ে, সব ভুলে গেছি তার পদ। কেবল মনে আছে এই দুটি ছত্র। ওজনের বেলা করিও না হেলা, মাপকাঠি তব রাখিও সমান। কথাটি সুন্দর। মনকে উদ্বুদ্ধ করে। ওজনের বেলা সতর্ক থেকো। দেখো, যেন সেখানে কোনো এদিক-ওদিক না হয়। যার যা প্রাপ্য তাকে তা ঠিকমতো দিবে।

জীবনের জন্য এ এক মৌলিক নির্দেশ। আর এই নির্দেশ পালনেই আমাদের যত ব্যর্থতা। মিয়াভাই সাহেব নিশ্চয়ই আজো জানেন, কোরানের এই কবিতার অনুবাদের অনুবাদক কে? এ বই কি এখন পাওয়া যায়! গতকালের (১৩.৭.৮৩) সাক্ষাতে তাঁকে প্রশ্নটি করেছিলাম। আমার প্রশ্নে মিয়াভাই খুশি হলেন। বললেন, মীর ফজলে আলী অনুবাদ করেছিলেন। কেবল সুরা আর রহমান নয়। আরো বেশ কিছু সুরা। তাই নিয়ে বই বার করেছিলেন। নাম কোরানকণিকা। বইখানি এখন আবার ছাপা হয়েছে। ইসলামী বইয়ের দোকানে তুমি পাবে। আমারও বোধ হয় আছে একখানা। কোথায় আছে ঠিক নেই। পেলে তোমাকে আমি দিয়ে দেবো।

বইখানাকে খোঁজ করে দেখতে হবে, পাই কিনা। বইখানি আবার আমার পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে।

বরিশাল শহর থেকে আট মাইল পশ্চিমে রহমতপুর। রহমতপুরে আমার বড় ভাই সাবরেজিস্ট্রার ছিলেন। ১৯৩৪-৩৫ সালের কথা। জমিদারবাড়ির কাছে হাই স্কুল। বেশির ভাগ ছেলেই হিন্দু। মুসলমান কম। হেডমাস্টার উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ পুরুষ ছিলেন। সেকালের হেডমাস্টাররা সবাই প্রায় বড় ছিলেন। আজকাল তেমন বড় হেডমাস্টার খুব পাওয়া যায় না।

কিন্তু রহমতপুর স্কুলকে আমার যে কারণে স্মরণ হয় তার একটি: যে বাড়িটিতে আমরা থাকতাম সেই বাড়িটির কারণে। আর দ্বিতীয়টি আমার ক্লাসের বন্ধু কানাইয়ের কারণে। গ্রামের মধ্যে আমাদের সেই বাড়িটি, অর্থাৎ বড় ভাই-এর অফিস-কাম-বাসা বাড়িটি ছিলো সুন্দর দোতলা দালান। সেকালে এমন বড় দোতলা দালান হিন্দু পাড়া ব্যতীত কোনো মুসলমান পাড়া বা বাড়িতে ছিলো না। কিন্তু এই বাড়িটি ছিলো বরিশালের ওয়াহাব খান সাহেবের বাবার। ওয়াহাব খান বরিশালের উকিল ছিলেন। আরো পরবর্তীকালে তিনি হক সাহেবের দলের নেতা ছিলেন এবং ১৯৫৬-৫৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের স্পিকার হয়েছিলেন। তাঁদের বাড়িটি, আমি যেকালের কথা বলছি, সেকালে প্রায় পোডড়াবাড়ি হয়েছিলো। কারণ এ রকম কথা শুনেছিলাম যে, পারিবারিক কোনো বিবাদের কারণে ওয়াহাব সাহেবদের কোনো নিকটজন এই বাড়িতে নিহত হয়েছিলেন। সামনে বাঁধানো ঘাটের বড় পুকুর। পেছনে আম-সুপারির বড় বাগান। পেছনে আর একটি বাঁধানো ঘাটের পুকুর। মেয়েদের জন্য। চারদিকে দেয়ালঘেরা। মোটকথা, জমিদারের এক বাগানবাড়ি-প্রায়। বাড়ির সামনে পাকা দোতলা মসজিদ।

কিন্তু মারাত্মক ঐ ঘটনার পর থেকে বাড়িটি খালি পড়েছিলো। ওয়াহাব খান সাহেবের পরিবার-পরিজন গ্রাম ছেড়ে ৭/৮ মাইল দূরে বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে উঠে গেলেন। পরে সরকারের তরফ থেকে বাড়িটিতে রেজিস্ট্রেশন অফিস বসানো হলো। দোতলা দালানের নিচতলাতে অফিস। ওপরের তলাতে সাবরেজিস্ট্রারের বাসা। এ বাড়িটা কেবল পোড়ো এবং ভূতুড়ে ছিলো না। সত্যি এতে ভূত ছিলো। কোনো সাবরেজিস্ট্রার এখানে বদলি হয়ে আসতে চাইতেন না। এলেও বেশিদিন থাকতেন না। আমার বড় ভাই ধার্মিক পরহেজগার মানুষ। ভূতে বিশ্বাস করেন না। বাড়ির বদনাম সত্ত্বেও তিনি আগ্রহ করে বদলি হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি এসে ভূত তাড়িয়েছিলেন।

একদিন রাতে, দোতলাতে আমি এবং আমার বোন ঘুমাতাম যে ঘরে এবং যে ঘরের পাশে বড় ভাই থাকতেন, সেই ঘরের সামনে বারান্দায় একটি ভূতকে চক্রবন্দী করা হয়েছিলো। চকের রেখা দিয়ে, ভূত আমাদের পড়শি যে যুবকটির ওপর ভর করেছিলো, সেই যুবকটির চারদিকে মন্ত্রপূত খড়ির রেখার চক্র কেটে তাকে আটক করে এক জবরদস্ত দরবেশ তাকে জেরা করছিলো। জেরায় সে নানা অদ্ভুত কথা বলেছিলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত দরবেশের দাবড়ানিতে তাকে কথা দিতে হয়েছিলো যে, সে আমাদের এই বাড়ির চারপাশে আর থাকবে না। তার যাওয়ার চিহ্ন হিসেবে দক্ষিণ পাশের আমগাছের একটা ডাল সে ভেঙে দিয়ে যাবে। সেদিন এই পুরো অনুষ্ঠানটির পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে কিশোর মনে যতো না ভয় বা বিশ্বাস জন্মেছিলো, তার চাইতে বেশি কৌতুক আর কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিলো।

কিন্তু রহমতপুরকে মনে রাখার বা মনে পড়ার এটা বড় কারণ নয়। রহমতপুরের হিন্দু একটি পরিবারের এক পুত্র-শোকাতুরা মা, যে আমার ধর্মভক্ত বড় ভাইকে একেবারে সন্তানের মতো গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই পরিবারের আম-তেঁতুলের আচারে আমার এবং আমার সহপাঠিনী মেজ বোনের যে অবাধ অধিকার ছিলো, স্নেহ-প্রীতি-ভালবাসা-ভরা সেই স্মৃতি আমাকে রহমতপুরকে ভুলতে দেয় না।

এবং আমাকে ভুলতে দেয় না আমার অন্তরঙ্গ কিশোর বন্ধু কানাই। এক কিশোরের আর এক কিশোর বন্ধু। কানাইয়ের পুরো নাম ছিলো ফণীভূষণ কাঞ্জিলাল। কানাইদের হিন্দুপাড়াটি ছিলো আমাদের রেজিস্ট্রি অফিসের বাসার মুসলমান পাড়ার একেবারে পার্শ্ববর্তী। কিন্তু কানাই সম্পর্কে আমার স্মৃতির মধ্যে একটি বেদনার ভাব আছে। কানাই যখন স্কুলে আসত তখন ওর কাছে ওদের গরিব মধ্যবিত্ত পরিবারের দুঃখের কাহিনী শুনতাম। কিন্তু কেবল দুঃখের নয়, গর্বেরও। কানাই গর্ব করে বলত, জানিস আজ আমার ডেটিনিউ দাদার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। ডেটিনিউ, রাজবন্দী, ইন্টারনড, অন্তরীণাবদ্ধ রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই শব্দগুলো সেই কিশোর বয়সে আমি কানাইয়ের কাছ থেকেই শুনেছিলাম। কানাইয়ের এক ভাই ব্রিটিশ সরকার দ্বারা কোথাও ইন্টারন্ড বা রাজনৈতিকভাবে অন্তরীণবন্দী ছিলো। কানাইয়ের কাছ থেকে একথা শুনে আমার দুঃখ হতো। কানাইয়ের পরিবারটিকে আর পঁচটি পরিবার থেকে ভিন্ন মনে হতো। সেদিনও আমি জানি নি, আজো। জানিনে কানাইয়ের দাদার বয়স কত ছিলো, কোন দলের সে কর্মী ছিলো এবং কবে সে মুক্তি পেয়েছিলো। কিন্তু সেই নিষিদ্ধ রাজনীতির রেমান্টিক একটি আকর্ষণ যে আমার সেই কিশোর বয়সের জীবনেই অনুপ্রবেশ করেছিলো, সে কথাটির উল্লেখ করতে হয়।

আমি ক্লাস সিক্সের পরেই রহমতপুর থেকে চলে আসি। কারণ আমার বড় ভাই তার পরেই রহমতপুর থেকে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ বরিশালের গলাচিপাতে।

কানাইয়ের মা আমাকে কোনোদিন সঙ্কোচ করেন নি। মুসলমান বলে পর মনে করেন নি। ছেলের বন্ধু। ছেলে সাথে করে নিয়ে গেলেই ঘরে তুলে পুজোর নাড়, মুড়কি, মোয়া বার করে দিয়েছেন। আমার কোনো সঙ্কোচ, আপত্তি মানেন নি। আমাকে খেতে হয়েছে।

জীবনের স্রোতে কানাই কোথায় ভেসে গেছে, তা আমি জানিনে। একদিন যে হিন্দু পাড়াগুলো সাজানোগোছানো ছোট ছোট শহরের মতো ছিলো, আজ সেগুলো পোড়ামাটির ভিটে। ঘরবাড়ির সব উৎসাদিত। ইট-কাঠ-টিনের চিহ্নমাত্র নেই। কোনোদিন যে এমন পাড়া সুন্দর লোকালয় ছিলো, তা বোঝাও সহজ নয়।

আসলে মানুষের জীবনে, সামাজিক রাজনৈতিক আলোড়নে এক একটা লোকবসতি যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, সে কথা আমি আমার কিশোরকালের পরিচিত হিন্দু বন্ধু এবং পরিচিতজনদের বাসের জায়গাগুলো স্মৃতির টানে আবার দেখতে না গেলে এত মর্মান্তিকভাবে বুঝতেই পারতাম না।

 ১৪.৭.১৯৮৩

আমার মিয়াভাই

’৮৩ সালের জুলাই মাস। তখনো আমার বড় ভাই, যাকে আমি মিয়াভাই বলে সম্বোধন করতাম, তিনি বেঁচে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের রোজনামচা হিসেবে নিচের লেখাটি তুলে দিচ্ছি।

গুলশান বড় ভাগ্নের বাড়ি থেকে বনানী। মাইলখানেক পথ। ছোট ছেলে তিতুকে সাথে করে মিয়াভাই সাহেবের বনানীর বাড়িটিতে এলাম ঈদের আগের দিন : ১১ জুলাই, ৮৩। মিয়াভাই সাহেবের দেখা পাবো কি পাবো না, এই এক চিন্তা ছিলো। আজকাল প্রায়ই তিনি তবলিগে যান। তাঁর ভাষায় জামাতের দাওয়াতে যেতে হয়। ৪০ দিন ৪৫ দিন বাসার বাইরে থাকেন। মসজিদে মসজিদে। সঙ্গে দলের আরো মুসল্লি, মোয়াল্লাম থাকেন। খাবারের চিন্তা করেন না। যে যেখানে যা দেয়, তাই খান। সাধারণ কিছু জামাকাপড় সাথে রাখেন। আর কিছু নয়। সবার সঙ্গে নরম হয়ে কথা বলেন। এই তবলিগের মসজিদ আছে কাকরাইলে। বছরে একবার টঙ্গীতে আন্তর্জাতিক জামাত হয়। লক্ষ লক্ষ লোক তাতে জমায়েত হয়। সুশৃঙ্খলভাবে তাদের খাওয়া-দাওয়া, ধোয়া-মোছার কাছ পরিচালিত হয়। বড় ভাবী আজ আর নেই। দুবছর আগে তিনি মারা যান। কিন্তু তিনি থাকতেও মিয়াভাই এভাবে তবলিগে বার হয়ে যেতেন। আমাদের ধর্মের পুনরুত্থান জাতীয় একটা ব্যাপার চলছে। জাতীয় আন্তর্জাতিক নানা শক্তি এতে যোগান দিচ্ছে। আমার বড় ভাই সরল মানুষ। ধর্মপ্রাণ তো বটেই। ধর্মের আচার-আচরণ সেই তাঁর শৈশব জীবন থেকেই পালন করে এসেছেন। যুবক বয়স থেকে মুখে দাড়ি রেখেছেন। সেও ধর্মীয় নিয়ম বলেই। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারে, বিশেষ করে ছোট ভাই আমার সঙ্গে তাঁর বিনয় ব্যবহার আমাকে বিস্মিত করে দিয়েছে। আমার অভিভাবক হিসেবে ছোটকালে তম্বি করেছেন। পড়াশোনায় অবহেলা দেখলে দণ্ড দিয়েছেন। এমন কি বড় হয়ে কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার যখন কিছুটা সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও ঘটনাতে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপার ঘটে, তখনো তিনি আমার ওপর রাগ করেছেন, কড়া নসিহত করেছেন। কিন্তু সবসময়ই স্নেহ বোধ করেছেন। দীর্ঘদিন যখন কারাগারে ছিলাম তখন দুএক সময়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে জেলখানায় গিয়ে আমাকে দেখে এসেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাঁর এই তবলিগের দিকটি নজরে পড়েছে। এখন আর আমার সঙ্গে কখনো রাগ করে কথা বলেন না। এখনো নসিহত করেন। কিন্তু সে এক মিশনারি বা ধর্মপ্রচারকারীর বিনয় মনোভাব থেকে। আজো যখন দেখা হলো এবং জানলেন, রোযা রাখি নি, তখন বললেন রোযা রাখতে পার নি বুঝি। কিন্তু নামাযটা আদায় করো। তুমি তো কত জান। কিন্তু একথা তো মানবে যে, দুনিয়ার শেষ থাকলেও আখেরাতের শেষ নেই। সেই আখেরাতে আমাদের সকলেরই তো জবাব দিতে হবে।

আজ আমি মিয়াভাই সাহেবের সঙ্গে একটা উদ্দেশ্য নিয়েই দেখা করতে এসেছি। তাঁর বয়স হয়েছে। এখন তিনি বৃদ্ধ। অবশ্য এই বয়সেও তিনি যেরূপ চলাচলতি করেন, তাতে আমাদের অবাক হতে হয়। হাঁটতে পারলে রিকশা নেবেন না। দূরের পথে ভিড়ের মধ্যেও বাসে যাবেন। গ্রামের সঙ্গে আমাদের যেখানে নিশ্চিদ্র বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেখানে তিনি এখনো গ্রামের বাড়িতে যান। নিজেদের বাড়িতে সকল জ্ঞাতি ভাই কিংবা ভাইয়ের ছেলেদের সাংসারিক অবস্থা খারাপ। যে-বাড়িতে এককালে উঠোনে ধানের স্তূপ জমে উঠত, সেখানে অনেক ঘরেরই রোজকার খাবার জোটে না। যারা একটু লেখাপড়া শিখেছি তারা তাদের ছেলেমেয়েসহ প্রবাসী হয়েছি, শহরবাসী হয়েছি। কিন্তু মিয়াভাই ব্যতিক্রম। তিনি গ্রামে যান। বাড়িতে নিজের আগ্রহে বাবা-মার কবর দুটিকে বাঁধাই করেছেন। নিজে নানাভাবে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে টিনের মসজিদখানিকে পাকা দালানে পরিণত করেছেন। বাড়ির দরজাতে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেছেন। তার জন্য পাকা দালানও উঠিয়েছেন। একবার হজ করে এসেছেন। গ্রামে সকলে চেনে। ডেপুটি সাহেব নামেই তিনি পরিচিত। এই মাদ্রাসার এ্যাফিলিয়েশন, তার জন্য অর্থ সাহায্য ইত্যাদি সংগ্রহে সর্বক্ষণই ব্যস্ত থাকেন। এই ব্যস্ততার কারণেই মনে অপর কোনো চিন্তা প্রবেশ করতে পারে না। তাই বয়সের তুলনাতে তিনি ভাল আছেন এবং একথা ভাবতে আমার বেশ ভালো লাগে।

তিনি যখন ধর্মের কথা তুলে আমাকে নসিহত করেন তখন আজো আমি নীরবে নতমস্তক হয়ে থাকি। তিনি মুরুব্বি মানুষ। তার সঙ্গে তর্ক চলে না। তা ছাড়া ধর্ম নিয়ে আদপেই কোনো তর্ক চলে না। আজো যখন তিনি আমার মঙ্গলের জন্য নামায-রোযা পালনের কথা বললেন, তখন আমি স্মিতমুখে চুপ করে রইলাম। তারপরে বললাম, মিয়াভাই, আপনার এখন বয়স কত?

আমার প্রশ্নটিতে তিনি একটু চকিত হলেন। হয়ত বুঝলেন, আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে চাচ্ছি। তাই হাসিমুখে বললেন, তা ৭৯ চলছে….

তাঁর বয়স হয়েছে জানতাম। কিন্তু তিনি যে ৭৯ বছরের মানুষ এটি আমি কোনোদিন ভাবতে পারি নি। এখনো তাঁর শরীরের ঋজুতা সে কথা বিশ্বাসে আনতে দিতে চায় না। বললেন, ১৯০৫-এ জন্ম। তারপর হিসেব করে দেখ। ১৯২৩-এ ম্যাট্রিক পাস করলাম। বি.এম স্কুল থেকে। ১৯২৫-এ আই.এ পাস করলাম আর ১৯২৭-এ বি.এ পাস করে ঢাকা এলাম এম.এ পড়তে।

আমি বললাম আপনি ইংরেজিতে এম.এ নিলেন। এত সুন্দর আপনার ইংরেজির হাত। কিন্তু শেষ করলেন না কেন?

নতুন করে জানা নয়। যথার্থই আমি এসব কথা জানতাম না। আজ দেখছি, এ তথ্যগুলোর একটা তাৎপর্য আছে। আমার ভাইয়ের লেখাপড়া তথা সেদিনকার হাইস্কুলে পড়া মানে একটি মুসলিম গরিব কৃষক পরিবারে প্রথমবারের মতো আধুনিককালের শিক্ষার প্রবেশ ঘটা। সেই পরিবারের এই ছেলেটি কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেছে। আই.এ এবং বি.এ পাস করে ঢাকা এসেছে এম.এ পড়তে, এটার মধ্যে একটা সামাজিক রূপান্তরের আভাস আছে। শুধু একজন ব্যক্তির জীবনযাপন নয়। যুগ পরিবর্তিত হচ্ছিল, একথা সত্য। তাই এই শতকের গোড়ার দিক থেকেই মধ্যবিত্ত এবং গরিব ঘরের কৃষকের ছেলেও শুধু মক্তব নয়, হাইস্কুল আর কলেজে আসছিলো, উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য।

মিয়াভাই সাহেব তার এই পাসের কথায় দুঃখ করে বললেন, কলেজে তো আমাকে সকল প্রফেসররা অসম্ভব স্নেহ করতেন। সলিল চৌধুরী, তিনি পরীক্ষার পরে আমার খাতা দেখে বলেছিলেন, ইওরস ইজ দি বেস্ট। তবু তো রেজাল্ট ভালো হলো না। এক নম্বরের জন্য সেকেন্ড ক্লাস পেলাম না। অথচ প্রফেসরদের কাছে শুনেছিলাম আমার খাতায় হাই সেকেন্ড ক্লাস উঠেছে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এর কারণ কি?

 মিয়াভাই বললেন, কারণ, মুসলমান ছেলে ভালো কেন করবে?

মিয়াভাইয়ের এমন অভিযোগের কথাতেও বিস্ময়বোধ ছিলো। আমি বললাম, কিন্তু আপনার গুণের কারণে হিন্দু শিক্ষকরা তো আপনাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন।

একথা তিনি স্বীকার করলেন। মনে করে বললেন, বি.এম স্কুলের হেডমাস্টার অমৃতলাল দাশগুপ্ত, নিজের ছেলের চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন আমাকে।

ধর্মপরায়ণ মিয়াভাইয়ের এই আর একটি দিক। একদিকে যেমন হিন্দুরা মুসলমানদের ছোট ভেবেছে, তাদের হেয় জ্ঞান করেছে, এ অভিযোগ তিনি বিভিন্ন সময়েই করেছেন এবং এর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, তেমনি এরূপ ধর্মপরায়ণ, আচার-আচরণ লেবাসে মুসল্লি মুসলমান একজন তরুণের যে হিন্দু অভিভাবক থাকতে পারে তা কল্পনাই করা যায় না। অথচ আমার ছোটকালের রহমতপুরের সে ছবি তো আমি আজো ভুলতে পারি নি।

১৯৩৩-এর দিকে মিয়াভাই বদলি হয়ে এলেন রহমতপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সাবরেজিস্টার হিসেবে, নাজিরপুর থেকে।

রহমতপুর ছিলো একটি হিন্দু-প্রধান এলাকা। রহমতপুর বাজার বসত সে এলাকার জমিদারবাড়ির দরজায়। তার কাছের স্কুলে আমি এবং আমার বড় বোন একসঙ্গে পড়তাম। তখন আমার ক্লাস ফাইভ এবং সিক্স। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ সন পর্যন্ত বোধ হয় বড় ভাই ছিলেন রহমতপুরে।

এই রহমতপুরের জমিদারবাড়ির এক জমিদারের নাম ছিলো বোধ হয় কালু বাবু। কালু বাবুর স্ত্রী আমার বড় ভাইকে নিজের ছেলে বলে ডাকতেন। এই বাড়িতে আমাদের যাতায়াত কেবল যে অবাধ ছিলো, তাই নয়। এদের কোনো অনুষ্ঠান আমাদের বাদে হতো না।

এই বাড়ির কথা মনে হলেই আমার চোখে যে ছবিটি ভেসে ওঠে সে। হচ্ছে: কালু বাবুর বাড়িতে মিয়াভাই বেড়াতে গেছেন। সন্ধ্যায় পুজার ঘণ্টা বাজছে এক ঘরে। এদিকে মগরেবের নামাযেরও সময় হয়েছে। মিয়াভাই তার মাকে বললেন, মা একখানা ধোয়া কাপড় দিন। আমি পাশের ঘরে নামাযটা আদায় করে নিই। মা স্নেহে এবং আগ্রহে বোয়া কাপড় বার করে দিয়েছেন। তার মুসলমান পুত্র একঘরে মগরেবের নামায পড়ছে এবং আর একঘরে সন্ধ্যা আহ্নিকের আয়োজন হচ্ছে। এ এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। আমার কিশোর মনকে ঘটনাটির এই সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতির দিকটি সেদিনও অভিভূত করেছিলো।

কিন্তু একথা ঠিক যে ত্রিশের এবং চল্লিশের দশকে সাম্প্রদায়িক দ্বেষই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমন প্রীতির সম্পর্ক বিরল হয়ে আসছিলো। কিন্তু মিয়াভাই সাহেব একদিকে যেমন কোনোদিন হিন্দু সমাজের যারা তাকে স্নেহপ্রীতি দিয়েছেন তাদের কথা ভুলতে পারেন নি, তেমনি সমাজে সাধারণভাবে যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিলো এবং সাধারণভাবে হিন্দু-প্রধানরা যে মুসলমান। সমাজ, এমন কি তার বিকাশমান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত অংশকেও বৈরী দৃষ্টিতে দেখতেন, সেই অনুভবটি নিজের মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন নি।

তাই নিজের বি.এ পরীক্ষার ফলাফলে এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবটি যে কাজ করেছিলো সে সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাপারটি খুবই সম্ভব বলে আমারও মনে হলো। যখন বললাম, কিন্তু হিন্দু অধ্যাপকরা তো আপনাকে ভালো ছেলে বলে জানতেন, তখন তিনি বললেন, আমার কলেজের প্রফেসররা জানলে কি হবে। তখন তো খাতার ওপর পরীক্ষার্থীর নাম লেখা থাকতো। আর তা থেকেই ধরা যেত কোন খাতা হিন্দু-ছাত্রের এবং কোন খাতা মুসলমান ছাত্রের। আর এ কারণেই মুসলমান ছাত্রের পক্ষে সেদিন ভাল করা ছিলো প্রায় অসম্ভব।

সেকালের কথা ভালো করে আমি জানিনে। কিন্তু মিয়াভাইয়ের এ ব্যাখ্যায় যুক্তি আছে।

সে যা হোক। তবু তিনি ঢাকায় পড়তে এসেছিলেন এম.এ, ইংরেজিতে। ইংরেজিতে তাঁর দক্ষতা ছিলো এবং এখনো আছে। এখনো তিনি যেমন দ্রুতগতিতে সুন্দর শব্দরাজি দিয়ে ইংরেজিতে নিজের মনের ভাব, বিশেষ করে লিখিতভাবে প্রকাশ করেন, তাতে আমার মনে বিস্ময় আর ঈর্ষার সঞ্চার হয়। আহা, আমি যদি এমন করে ইংরেজিতে লিখতে পারতাম!

ঢাকায় এসে তিনি ইংরেজির অধ্যাপক এস এন রায়ের স্নেহ পেয়েছিলেন। ড. হাসানও তাঁকে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু গরিব কৃষকের ঘর থেকে একেবারে নিজের উদ্যোগে যে ছেলেটি স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলো সে যখন ১৯২৮ কিংবা ২৯-এর দিকে একটি চাকরির সুযোগ পেল তখন আর সে চাকরিকে গ্রহণ না করার দুঃসাহস দেখাতে পারল না। কারণ তার ওপর নির্ভর করছে গরিব বাবা, মা, ছোট ভাই আর বোনেরা।

আমি একটু সমাজতাত্ত্বিক ভাব থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু এম. এ পড়ার জন্য কলকাতা না গিয়ে ঢাকা কেন এলেন? বরিশাল থেকে তো কলকাতা যেতে পারতেন।

মিয়াভাই বললেন, ১৯২১ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি তৈরি হলো। তারপর থেকে পূর্ববঙ্গের আমাদের কাছে, বিশেষ করে অর্থের দিক থেকে যারা কম সচ্ছল, তাদের ঢাকা আসার দিকেই বেশি ঝোঁক ছিলো। আমিও সে কারণেই ঢাকাতে পড়তে এসেছিলাম।

মিয়াভাইয়ের কাছ থেকে আরো অনেক কথা জানার আছে। কিন্তু এদিনের সাক্ষাতে অন্য কথা আর তুললাম না। মিয়াভাই সাহেবের কাছে আমরা যারা ছোট ভাইবোন, তাদের ঋণের শেষ নেই। একথা সচেতনভাবে আমি সবসময়ই মনে করেছি। এখন তাঁর নিজেরই বৃহৎ সংসার। তাঁর সন্তানরাও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নানা পথঘাট ঘুরে আমিও সংসার জীবনে থিতু হয়ে বসেছি। আমারও ছেলেমেয়ে আছে। সংসারের দায়দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব পালনের আর্থিক অক্ষমতা জীবনের সমস্যাকে বোজকে রোজ কঠিনতর করে তুলছে। মিয়াভাই সাহেবের ঋণের কোনো পরিশোধ হতে পারে না। তিনি সেদিন না পড়ালে আমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসে পৌঁছাও সম্ভব হতো না। কিন্তু এ ঋণের কথা মুখে প্রকাশ করা যায় না। শব্দের কৃত্রিমতায় তা লঘু হয়ে দেখা দেয়। আজো তার কাছে কৃতজ্ঞতার কথা মুখে বললাম না। কিন্তু উঠে আসার সময়ে তিনি যেন মনে কিসের ভার অনুভব করে বললেন, তোমাদের কারুর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ জানেন, আমি সারা জীবন আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি….

আমি বললাম, আমাদের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ থাকা যে কত স্বাভাবিক তা আমি জানি। তবু যে আপনি কোনো অভিযোগ রাখছেন না, সেও আপনার গুন, আমাদের নয়।….

মিয়াভাই সাহেবকে সালাম করে ছোট ছেলেকে সাথে করে চলে এলাম।

তার যে এদিন দেখা পেয়েছিলাম, আর অতীত নিয়ে একটু আলাপ করতে পেরেছিলাম, তাতে নিজের মনটা আনন্দে বেশ ভরে উঠেছিলো।

গ্রামে নির্বাসন : পিতামাতার কাছে প্রত্যাবর্তন

সে এক পাগলামিই বটে। ৪৬ সালে এম.এ পাস শেষ হলো। সেকালের ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর একালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আকাশ-পাতাল পৃথক। আমার জীবনের এ এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। প্রাচীনকালের জ্ঞানের আশ্রমের কথা শুনেছি। গুরুগৃহে, গুরুর সাহচর্যে, নৈকট্যে শিষ্যের বাস। শিষ্যের সাধনা। চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনে প্রায় তাই ছিলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে আমি আমার নিজের বাড়িতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিলাম। গুরুদের নৈকট্য পেয়েছি। তাঁদের স্নেহ এবং সাহচর্যে ধন্য হয়েছি।

দর্শনের ছাত্র। দর্শন বিভাগে সর্বমোট ৫টি কিংবা ৬টি ছাত্রছাত্রী। ছাত্রী বোধ হয় অনার্সে ছিলো দুটি। একটির নাম ছিলো ঊষা পৈত। ওদের বাসা ছিলো পুরোন ঢাকার পাতলা খান গলিতে। এখানেই বাসা ছিলো সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স এবং এম.এ-র অন্যতম জনপ্রিয় কমিউনিস্ট ছাত্রকর্মী রবি শুহের। রবিগুহ আর নাজমুল করিম, এরা। আমার বয়োজ্যেষ্ঠ। ইউনিভার্সিটির ভাষার সিনিয়র। কিন্তু আমাদের এই তিনজনের ক্ষেত্রে কোনো বয়োজ্যষ্ঠতা বা বয়োকনিষ্ঠতার ব্যাপার ছিলো না। আমরা পরস্পরের নিকট ছিলাম আত্মীয়সম। রবি গুহকে আমি নাম ধরে আপনি বলে সম্বোধন করতাম। কিন্তু সে আপনিতে সমীহের চাইতে প্রীতি ও শ্রদ্ধা ছিলো অধিক। রবি গুহও আমাকে তুমি-র বদলে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু সে আপনি স্নেহ মমতায় তুমিরও অধিক ছিলো। রবি ইউনিভার্সিটির হলে থাকতেন না। থাকতেন বাসায়। ঐ পাতলা খান লেনেই বোধ হয়। তার দিদি এবং ভগ্নিপতির সঙ্গে। তাঁদের সে বাসাও আমার নিজের বাসায় পরিণত হয়েছিলো। তাঁদের কোনো পারিবারিক আতিথেয়তা ও অনুষ্ঠান আমাকে বাদ দিয়ে হতে পারতো না।

অনার্স এবং এম.এ-তে যে ভালো ফল হলো, এতে আমার চাইতে নাজমুল করিম আর রবি গুহের আনন্দই অধিক। আমি যতো বলি, স্যাররা খাতির করে নম্বর দিয়েছেন। আমি এর যোগ্য নই। তারা ততো বলেন, এরকম খাতির স্যাররা আমাদের কেন করেন না?

অনার্স আর এম.এ-তে ভাইভা পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়ে আসতে মূল পরীক্ষক প্রখ্যাত দার্শনিক হরিদাস ভট্টাচার্য কাঁধে স্নেহের হাত রেখে বললেন, ভালো করেছ। এখন কি করবে? আমি সবিনয়ে হেসে বললাম, মাস্টারি করা ছাড়া আর কি করব স্যার? তিনি তখন বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন। দর্শন বিভাগের হেড তখন ড. বিনয় রায়। বিনয় রায় ইংরেজি বিভাগের তখনকার হেড এস.এন. রায়ের ছোট ভাই ছিলেন। উভয়েরই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সহাস্য স্নেহপূর্ণ ব্যবহার ইউনিভার্সিটির সর্বমহলে পরিচিত ছিলো।

চাকরির দরখাস্তের ভিত্তিতে নয়। বিনয়বাবু বললেন, ফজলুল করিম, কাল থেকে তুমি ক্লাস নিতে শুরু করো।

তখনো ছাত্রদের সংখ্যা কম। ক্লাস নিতে গেলে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক হিসেবে গণ্য করার চাইতে তাদের সঙ্গেই পাঠরত আর একটি ছাত্র বলেই বিবেচনা করেছে বেশি। ভাবতে আজ মজা লাগছে।

ভালোই লাগছিলো এই মাস্টারি। ৪৭-এর শেষ আর ৪৮-এর প্রথমে। কিন্তু দেশে সামাজিক, রাজনৈতিকহ সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পাকিস্তান হয়ে গেছে। ভারত বিভক্ত হয়েছে। আগে যা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ দাঙ্গা। হিসেবে সংঘটিত হয়েছে, তা এখন ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের রূপ গ্রহণ করেছে। ৪৬-এর ১৬ আগস্ট হলো ক্যালকাটা কিলিং। তার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালি, বিহারের হত্যাকাণ্ড। ৪৭-এর বিভাগের কালে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। ফলে সাধারণ মানুষের অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতা। লক্ষ লক্ষ নরনারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার এপার থেকে ওপার গমন।

এর আঘাত ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেও এসে লাগল। দাঙ্গার আকারে নয়। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত প্রখ্যাত শিক্ষকদের ঢাকা থেকে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে গমন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন শিক্ষকদের তখন অভাব। একটা দায়িত্ববোধ থেকেই দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম। কিন্তু চাকরির বাইরে রাজনৈতিক একটা দায়িত্ব বহন এবং আদেশ পালনেরও একটা ব্যাপার ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। কমিউনিস্ট সংগঠনের আমি একজন অনুগত কর্মী। সে সংগঠনেও সামাজিকভাবে দেশত্যাগের আঘাতে কর্মীর অভাবে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সংগঠন তাই বলল, তোমার অধ্যাপনার চাকরি ছাড়তে হবে। তার প্রধান কারণ, গুপ্ত পুলিশের দৃষ্টির খরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মীশূন্য মাঠে আমি তাদের কাছে পূর্বের মতো আর ফেলনা রইলাম না। আমাকে তারা অন্বেষণ করে বেড়াতে শুরু করল।

পার্টি বললো তুমি চাকরি ছাড় এবং আত্মগোপন কর। আমি তাই করলাম। কোনো অসুবিধা হলো না সিদ্ধান্ত গ্রহণে। আমার বিভাগের হেড বিনয়বাবুকে গিয়ে দরখাস্ত দিয়ে বললাম, স্যার, আমি আর চাকরি করব না।

তিনি প্রথমে অবাক হলেন। ব্যাপারটার আকস্মিকতায়। বিশ্বাস করতে চাইলেন না। রাগ করে বললেন, তোমার পদত্যাগপত্র আমি ছিঁড়ে ফেলে দেব।

আমি বললাম, স্যার, আপনি তো আমাকে নিজের সন্তানের মতো জানেন। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। একে তো আর বদল করা যাবে না।

স্যার আমাকে চার বছর ধরে দেখে আসছেন। তার বাসায় আমার যাতায়াত ছিলো অবাধ। আমাকে তিনি আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাঁর স্নেহ-সম্ভাষণ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আত্মগোপনে চলে গেলাম।

চাকরি থেকে পদত্যাগ করার কথা শুধু বিভাগে আলোচ্য বিষয় হলো না। সরকারি মহলেও আলোচিত হলো। আমার সেই ৪৮ সনের চাকরির নথি খুললে এখনো তার মধ্যে রেজিস্টারের কাছে লেখা স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশ বিভাগের কর্তাদের কৈফিয়ত তলবমূলক বার্তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কেন ফজলুল করিম সরদার চাকরি ছেড়েছে এবং তার আস্তানা, অধিষ্ঠান, হোয়েয়ারঅ্যাবাউটস কোথায়, তা সরকারকে অবগত করা হোক।

 আসলে আমার আস্তানা-অধিষ্ঠানের কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। দুর্বল সংগঠন। আমি পাতলা আর কৃশ দেহের ক্ষুদ্রকায় জীব হলেও আমার নামটা ভারি ছিলো। সে নামকে হেঁটে ফেলেও রেহাই পাওয়া দায় হয়ে উঠলো। নাম পাল্টালাম। নামের শরীর থেকে ভারি অংশ সরদারকে বিদায় করলাম। ওজনে হালকা হল বটে, তবু নিঃশঙ্ক হওয়া গেল না। শহরে নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব। পার্টি দেখল, আমি তাদের বিদ্যমান অবস্থায় সম্পদের চাইতে বোঝা বেশি। কোথায় রাখবে আমাকে।

অবশেষে বলল, ঢাকা জেলার মনোহরদি-চালাকচর এলাকায় কৃষকদের মধ্যে আমাদের কিছু প্রভাব আছে। তুমি সেখানে গিয়ে থাকো। কৃষকদের মধ্যে থাকবে। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করবে।

তাই সই। আমাকে কোনো কর্মী-বন্ধু পৌঁছে দিলেন চালাকচরে। চালাকচরে তখনো আন্দামানের নির্বাসন-ফেরত বিখ্যাত কৃষক নেতা অন্নদা পাল হয়তো ছিলেন। এলাকার প্রবাদপুরুষ। চালাকচর, পীরপুর, শরীফপুর, মনোহরদি, পোরাদিয়া, হাতিরদিয়া, এই নামগুলো এখনো মনে ভেসে উঠছে। কারণ এই গ্রামগুলোতে ৪৮-৪৯ সালে প্রায় এক বছর আমি আত্মগোপন করেছিলাম। পীরপুরের প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক আখতারুজ্জামানের হাসিমুখ চেহারাটি এখনো চোখের সামনে অমলিন। তাঁর এলাকার সম্মানিত শিক্ষক এবং গ্রামীণ নেতা। কমিউনিস্ট সংগঠনের একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি আমাকে স্বনামেই জানতেন। কিন্তু তিনি অন্য লোকের কাছে আমাকে ভিন্ন নামে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আখতারুজ্জামান হয়তো আজ আর বেঁচে নেই। পীরপুরের পাশেই ছিলো শরীফপুর। শরীফপুর ছিলো প্রধানত পানের বরজ বা পানচাষীদের এলাকা। হরেন সিং, সুরেশ সিং, এরূপ নাম মনে ভেসে উঠছে। তাদের বাড়িঘর ছিলো গ্রামের অন্য, বিশেষ করে মুসলিম-প্রধান এলাকা থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট। ঘরের সঙ্গে ঘর লাগানো। উঁচু দাওয়া। সুন্দর নিকোনো, ধোয়া-মোছা উঠোন। টিনের ঘরই বেশি। প্রত্যেক বাড়ির পাশে পানের বাগান বা বরজ। বাঁশ আর পাটকাঠি দিয়ে পানের লতার সাড়ি দেওয়া মাচান। কী সুন্দর পরিচ্ছন্নতায় রক্ষণাবেক্ষণ। তাঁরা যেদিন তোলাপান বিক্রির জন্য হাঁটে যেত সেদিন সকালে পানের বরজে ঢুকে আমিও পানলতা থেকে কচি পান তুলে এনে তাদের সাহায্য করতাম।….

এমন আত্মগোপনের জীবনে ঘটনার আধিক্য ছিলো না। তাই ঘটনার কোনো স্মৃতি নেই। তবু এই একটা বছর গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবনযাপনই একটা ঘটনা হিসেবে আমার জীবনে অমোচনীয় এক আনন্দকর স্মৃতির পলি রেখে গেছে। গরিব কৃষকের এলাকা। জৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কাজের অভাবে গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরের অর্ধাহারে-অনাহারে সঙ্কট বৃদ্ধি পেত। কিন্তু এলাকায় কাঁঠাল হতো প্রচুর। প্রত্যেক বাড়িতেই কাঁঠাল গাছ ছিলো। আমি অনেক সময়ে ভাতের বদলে কাঁঠাল খেয়ে দিন কাটিয়েছি। ভাত পেলে ভাতের সঙ্গে কোনো ডাল-তরকারি নয়। একটি শুটটি-পুটি পাটকাঠির মুখে আগুন ধরিয়ে তাকে পুড়িয়ে ভাতের সঙ্গে মেখে খেয়েছি …..

হিন্দু পান কৃষকদের বাড়িতে হিন্দু নাম নিয়ে থেকেছি। আখতারুজ্জামানই নিয়ে গেছেন এলাকাতে। আমাকে অশোক কিংবা আশীষ নাম দিয়ে অন্দরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরা তাঁদের দূরসম্পর্কীয় দেবর কিংবা মাসতুতো, পিসতুতো ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

সেই একটি বছরের এমন প্রাপ্ত জীবনকে আমি একটা সৌভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। সেই কবে শিশু বয়সে আমার অভিভাবক বড় ভাইয়ের কাঁধে চড়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম। প্রায় পঁচিশ বছর পরে আবার যেন আমার সেই নিজগ্রামে প্রত্যাবর্তন ঘটল, বাবা, মা, চাচা-চাচী, ভাইবোনের কাছে প্রত্যাবর্তন।

সেই জীবনের স্মৃতি এখনো টানে, এই প্রৌঢ় বয়সে। ইচ্ছে হয় আবার ফিরে যাই সেই চালাকচর, পীরপুর, শরীফপুর, পোড়াদিয়া, হাতিরদিয়া আর মনোহরদিতে।….

২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯ : চল্লিশের দশকের শেষ

শতকই বলি, আর দশকই বলি, এগুলো প্রচলিত, তবু কৃত্রিম হিসাব। সময়ের হিসাব। সময়ের গতি এবং তার এরূপ শুরু, শেষের হিসাব সবার জীবনে এক নয়। মহাকবি শেকসপীয়র নাকি বলেছিলেন, প্রেমিকের জন্য সময়ের গতি একরকম, আর ফাঁসির আসামীর জন্য আর এক রকম। প্রেমিকের প্রতীক্ষার মুহূর্ত ঘন্টাতেও শেষ হয় না। ফাঁসির আসামীর ঘণ্টা মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়।

চল্লিশের দশকের ঢাকায় আমার যা একটু বোধ-বুদ্ধির বিকাশ, তার শেষ হয়ে গেল আকস্মিকভাবে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে। ৫০ পর্যন্ত আর আমি অপেক্ষা করতে পারলাম না।

যথার্থই কি ২৫ ডিসেম্বর ৪৯? ২৫ ডিসেম্বর অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু সেটি আমার জীবনেও যে একটি পর্যায়ন্তরের সূচনা ঘটাবে তা সেদিন বুঝি নি।

আসলে তারিখটা ২৫ ছিলো কিনা তা যাচাই করার জন্য আমার বন্ধু, প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক দৈনিক সংবাদ-এ কর্মরত সন্তোষ গুপ্তের কাছে গেলাম। সন্তোষ গুপ্তকে আমি প্রীতির সম্বোধনে শুধু সন্তোষ বলে ডাকি। তুমি বলি। সন্তোষ আমাকে আপনি বলে। সে বয়সের কারণে কিনা জানিনে। কিন্তু সন্তোষের সঙ্গে সেই ৪৯ সালে একদিনের যে পরিচয় ঘটেছিলো, সেটিই আজীবনের পরিচয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু আমার কাছে সন্তে ষের এক পরিচয় অনন্য এক স্মৃতিধর হিসেবে। কম্পুটারের যুগ আসার পূর্ব থেকে সন্তোষের মস্তিষ্ক কম্পুটারে পরিণত হয়েছিলো নিশ্চয়ই। স্মৃতি, তথ্য, সংখ্যা আর তারিখের কম্পুটার। সে কিছুই বিস্মৃত হয় না। এবং তার স্মৃতির ওপর নির্ভর করেই সে ইতিহাসের মোকাবেলা করতে পারে। তার সে পরিচয় সাম্প্রতিককালেও আমরা পাচ্ছি। সন্তোষের বয়স কত, এটি তাঁকে জিগ্যেস করতে হবে। দেখতে আমার চাইতেও পাতলা-দুবলা। বিরামহীনভাবে সিগারেট পান করে। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলি, তোমাকে না সিগারেট খেতে নিষেধ করেছি। সে তার কাব্যিক চরণ উচ্চারণ করে বলে, আয়ু নয়। তো, বায়ু সিগারেটের ধূম্রের সঙ্গে সে যদি উড়ে যায়, তো যাক না। তাতে আফসোস কি?

আমি তাঁকে বলি, কম্পুটার সন্তোষ। সেদিন খোঁজ করে সাক্ষাৎ করে বললাম, সন্তোষ, তুমি-আমি সেই ৪৯ সালে কোন তারিখে এ্যারেস্ট হয়েছিলাম?

সন্তোষ নিশ্চিন্তে বলে দিল, ২৫ ডিসেম্বর, দুপুরে খাওয়ার পরে।

 : কে কে সেদিন তোমার বাসা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলাম?

: আপনি, আমি, আমার মা, বারি সাহেব, রানু চ্যাটার্জি … আর যেন কে?

 : জ্ঞানদা, জ্ঞান চক্রবর্তী কি সেদিন গ্রেফতার হয়েছিলেন?

সন্তোষ বলল : না। জ্ঞানদা বোধ হয় তার আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন।….

যাক, বোঝা গেল, সন্তোষ সন্দেহের ঊর্ধ্বে। আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম সন্তোষের বাসা থেকে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে।

ঘটনার স্মৃতি নয়। স্মৃতির পলি। স্মরণের কাঠি দিয়ে তাই নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। আজো এতদিন পরে। পুরো চুয়াল্লিশ বছর পরে। সন্তোষ দিনরাত কলাম লেখা নিয়ে ব্যস্ত। তার সময় নেই এসব নিয়ে আলাপ করার। গল্প করার। চেপে ধরলে বলে, আর কি হবে বাল্যকালের বালখিল্য সেসব ব্যাপারকে খুঁটিয়ে তুলে?

একথা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে সন্তোষ বলতে পারে। সে বলে, সেকালের আদর্শ, বিশ্বাস-নির্যাতন ভোগ, ত্যাগ সবই ছিলো ভুল।

এজন্য সন্তোষের ওপর আমার কোনো মান-অভিমান নেই। সন্তোষের বর্তমানে সব্যসাচীর কলম এবং কলাম্ন আছে। আমার যে ৪৪ বছর আগের স্মৃতির পলি বাদে আর কিছু নেই। আরো পাঁচ বছর যদি বাঁচতে হয়, তবে আমি বাঁচি কি নিয়ে।

তাই বাল্যকালের বালখিল্যতায় আমার আফসোস নয়, রোমাঞ্চ লাগে। এ রোমাঞ্চের কথা অপরকে লিখে বা বলে বোঝানো মুশকিল।

সন্তোষের বাসা। ঢাকার তাঁতিবাজারে। পুরনো একতলা একটি দালানে। ঢাকা কোর্টের পেছনের পশ্চিম দিকের এলাকা। বাসা নয়, তাকে আমরা জানতাম ডেন বলে। নিষিদ্ধ প্রায় গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অভিযানের টেকনিক্যাল শব্দ ডেন। শব্দটা ভয়ঙ্কর। অর্থ : গুহা, গহ্বর ইত্যাদি। শুধু শব্দটা ভয়ঙ্কর নয়। ব্যাপারটাই ভয়ঙ্কর ছিলো। কত যে ভয়ঙ্কর তা নিরীহ সদ্য এম.এ পাস করা, রোমান্টিকতার আবেগে আবিষ্ট, হাতের মোয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষকতার চাকরিতে রিজাইন দেওয়া আমি বুঝতাম না। আসলে আমাদের সে জীবনে ভয় শব্দটার অর্থই আমি বুঝতাম না। রাতের অন্ধকারে নিমস্বরে আশ্রয়দাতার বিভিন্ন বাড়িতে আলোচনা বসেছে। দেশের অবস্থা নিয়ে জেলা কমিটির মিটিং বসেছে। ডাকাতির প্রোগ্রাম নয়। পরিস্থিতি নাজুক। সে বিষয়ে আলোচনা। ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়ে গেছে অনেক কমরেড। যারা আছি, দায়িত্ব বহন করতে হবে তাদের। জনতার মধ্যে থাকতে হবে। বিবেক বুদ্ধি মত যা পারি সেটুকুই করতে হবে। বলতে হবে, বর্তমানই শেষ নয়। মৃত্যুর পরেও জীবন থাকে। থাকবে। দেশ থাকবে। ইতিহাস থাকবে। ইতিহাস তৈরি হবে। ইতিহাস আমাদের পক্ষে। সমাজ বদলাবে। বিপ্লব অনিবার্য। বিপ্লব মানুষের জীবনে, সমাজের জীবনে সংঘটিত হবে।

আমার তো মনে হয় কথাগুলো সাংঘাতিক কোনো খারাপ কথা নয়। ভয়ঙ্কর কথা নয়। কিন্তু সেদিনের এবং এদিনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা তাকে তাই মনে করে। কেউ এ রকম কথা ভাবছে, বা বলছে, মনে মনে কিংবা কানে। কানে, এমন আভাস পেলেই তাকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নিরাপদ জেলখানাতে আবদ্ধ করেছে।

কাজেই এমন যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার তাতে সন্তোষ কিভাবে জড়িত হয়েছিলো, একথাটা আজো আমার জানা হয় নি। আর তা জানাও যাবে না। সন্তোষ আর তা বলবে না।

অথচ যথার্থই কী ভয়ঙ্কর, কী বিপজ্জনক! বিধবা মা। আমরা ডাকতাম মাসিমা বলে। তাঁকে নিয়ে বাসা করেছে। নিজে চাকরি করে পূর্ববঙ্গের কারা প্রধান তথা ইনপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস্-এর অফিসে তারই গোপন সহকারী। কনফিডেনস্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট। অফিস ঢাকা জেলেরই ভেতরে। আর তাঁতিবাজারের বাসায় কমিউনিস্ট ডেন। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। সেখানে রাতের অন্ধকারে আসেন কমিউনিস্ট নেতা ফণী গুহ, অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী, আবদুল বারি, রওশন শেখ, মনু মিয়া এরা। আসেন সংগঠনের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে। রাতের আঁধারে আসেন। দিনের বেলা থাকতে হলেও অন্ধকারেই থাকেন। আবার আঁধার হলে যার যেখানে যাওয়ার চলে যান সেখানে। সন্তোষের বাসায় ছিলেন কৃষকনেতা অজিত চ্যাটার্জির স্ত্রী রানু চ্যাটার্জিও।

এই ডেনের বিষয়ে আর একটু জিজ্ঞেস করতে সন্তোষ স্বল্পতম দৈর্ঘ্যের দুএকটি বাক্যে বলল, আসলে ডেনটা আরো আগে তুলে দেওয়া উচিত ছিলো। আমার বাসায় ঢোকার মুখেই কিছুদিন আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন ফণী গুই। কাজেই বাড়িটার ওপর সরকারের আই.বি তথা গুপ্ত পুলিশের ওয়াচ অবশ্যই ছিলো। কিন্তু পার্টি প্রয়োজনীয় সময়ে উপযুক্ত ডিসিশন নিতে পারে নি।

আমি এত সবের কিছুই জানতাম না। আমি ছিলাম নির্বাসনে। ঢাকা জেলার মনোহরদি থানার চালাকচর-পীরপুর-শরীফপুর অঞ্চলে আত্মগুপ্ত অবস্থায়। আমার চাকরিতে রিজাইন করে আন্ডারগ্রাউন্ড চলে যাওয়ার পর থেকেই হয়ত বা ৪৮ সালের মধ্য কিংবা শেষ দিক থেকেই। সেখানে আমার চলছিল ভালোই। জালের মধ্যে মাছের যেমন। কাঁঠাল আর শুঁটকি-পুঁটির পোড়া খেয়ে।

কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ছোট্ট খামে হুকুম গেল : তোমাকে ২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় আসতে হবে সাংগঠনিক আলোচনার জন্য। কোরিয়ার গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে। তুমি রেডি থেকো।

আমি রেডি ছিলাম। আর কোরিয়ার আমাকে রাতের আঁধারে প্রায় চোখ বাঁধার মতো করে অপরিচিত একটি এলাকার অপরিচিত একটি বাড়িতে নিয়ে এসে রেখে গেল। সেখানেই আলোচনাটি বসেছিলো। সকালের সেশন শেষ হয়েছে। হয়ত পাঁচ-ছ জনের বৈঠক। দুপুরে বিরাম। খাওয়া-দাওয়ার জন্য। উচ্চকণ্ঠে কোনো কথা নয়। হাসিও নয়। কাশিও নয়। এবাড়িতে কোনো লোক আছে, তা কেউ আন্দাজ করবে কি করে?

কিন্তু যাদের শ্বাপদ-চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল নিরীহ কেসেমের লোকগুলোকে, তারা ঠিকই আন্দাজ পেয়েছিলো।

তাই দুপুরের শেষে, অন্ধকারের অপেক্ষা না করেই তারা আক্রমণ করল। বাড়িটা ঘিরে ফেলল। পেছনের দরজায় দমাদম আঘাত পড়ল। আমাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না, কি ঘটতে যাচ্ছে।

বিকেল বোধ হয় চারটে। পালাবার কোনো পথ নেই। তবু একটা দরজা দিয়ে দেয়াল টপকে পাশের বাড়িতে পড়লাম। সাথে তখন আর কে যেন ছিলো। চারপাশের বাড়ির ছাদেই মানুষজন উঠে গেছে। তারা হয়ত ভাবছে, পুলিশ ডাকাত ধরছে। আমরা এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করতেই চারদিকে থেকে শব্দ উঠছে ঐ যায়, ঐ যায়। এখন ভাবতে মজাই লাগছে। কিন্তু সেদিন?

পুলিশ সন্তোষের পায়ে হাত তুলেছিলো। হয়ত লাঠি মেরেছিলো। মাসিমা সহ্য করতে পারেন নি। চুলোর পাশ থেকে লাকড়ি তুলে তিনিও তাগ করেছিলেন পুলিশের দিকে।

মিনিট পনেরোর মধ্যে অপারেশন শেষ। সন্তোষ, মাসিমা, রানু চ্যাটার্জিসহ আমাদের সবাইকে ধরে একটা জায়গায় জড়ো করে নিয়ে এলো পাশের কোতোয়ালী থানায়। বসিয়ে রাখল এক গারদে। কিছু পরে দেখলাম আই বি মানে গুপ্ত পুলিশ নানা জায়গা থেকে খবর পেয়ে ছুটে আসছে। সবাইকে দেখছে। কার কি নাম, জেনে নিচ্ছে। আমার নাম শুনে অবাক হলো। চেহারার দিকে চেয়ে পছন্দ হলো না। ক্ষুদ্র দেহে ভারি নাম। এই নামের পেছনে তারা এখানে ওখানে এতদিন ছুটে বেড়িয়েছে। জেরার সময়ে আপ্যায়ন যে আরো কিছু না জুটেছিলো তা নয়। কিন্তু সে কথা স্মরণ করে কি হবে? রাতটা থানায়। রাখল। পরের দিন পাঠিয়ে দিল ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। জেলের গেটে নাম-পরিচয় লিখে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো নানা জনকে নানা জায়গাতে। আমার সঙ্গে ছিলেন বোধ হয় সন্তোষ আর রেলশ্রমিক নেতা বারি সাহেব।

জেলখানার অফিস থেকে ভেতরে এসকর্ট করে নিয়ে গিয়েছিলো নিরাপত্তা বন্দীদের খবরদারি করতো যে জাঁদরেল জমাদার, সেই নাজির জমাদার। গোড়াতে ছিলো বোধ হয় বিহারি। কিন্তু বাংলাদেশে থাকতে থাকতে বাংলা-বিহারিতে পরিণত হয়ে গেছিলো। দশাসই চেহারা। ভারি আওয়াজ। নিয়ে গেল আমাদের ফাঁসির সেল তথা খুপরিতে। আট ডিগ্রিতে। পাশাপাশি আটটা খুপরি। সামনে পাশে উঁচু দেয়াল। ফাঁসির ডিগ্রিতে ঢোকাতে ঢোকাতে নাজির জমাদার আওয়াজ দিল, যাইয়ে হিয়াছে আর যানে নেহি সাকতা। এখান থেকে আর বেরুতে হবে না। সেদিনের পরিবেশে হুঙ্কারটা মিথ্যে ছিলো না।

আমি এখনো জানিনে, সেই সেকালে, আমাদের গ্রেফতারের খবর অন্তত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ২৬ ডিসেম্বর কিংবা তার কাছাকাছি কোনো তারিখে কিভাবে উঠেছিলো।….।

কথা শুরু করেছিলাম চল্লিশের দশক নিয়ে। সেই ৪০ সালে বরিশালের একটি নিরীহ পোলা কিশোর বালকের ঢাকা আগমনের কথা বলে।

সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগী একজন কর্মী আবদুল মোতালেব আমাকে দিয়ে জন্ম থেকে অর্থাৎ ২৫ থেকে ৯৩ পর্যন্ত জীবনের কাহিনীর একটি আউটলাইন বারবার অনুরোধ করে বলিয়ে তাঁর শব্দগ্রাহক যন্ত্রে ধরে রাখলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটা অনুভূতি জেগেছিলো। তাঁকে বলেছিলাম, আমার জীবনের আবার কথা কি? তবু বলতে গিয়ে দেখলাম কথা কথাকে টেনে তুলছে। ঘটনা ঘটনাকে। তার পরিমাণে নিজেই একটু বিস্মিত হয়ে গেলাম। দ্বিধায়-সঙ্কোচে পূর্ণ সেই পোলার মনে জমা কথার পরিমাণ আজ দেখছি খুব কম নয়। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নয়। কোনো ঘটনার বিস্তারিত স্মৃতি নেই।

আজ এখানেও এই নতুন পর্যায়ের কোনো বিস্তারিত বিবরণ নয়। এ প্রসঙ্গের উত্থাপন কেবল এই কতা বলতে যে, চল্লিশের দশকের যবনিকা ঘটল আমার জীবনে সেই ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সাল।

এরপরের পর্যায় জেলের পর্যায়। রাজবন্দীর পর্যায়। এই পর্যায়ের দৈর্ঘ্য কয়েক কিস্তিতে প্রায় এগারো বছর। এই এগারো বছরেই বাইরের পৃথিবীতে, পূর্ববঙ্গের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে কত পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রথম পর্যায়ে বন্দী ছিলাম ৪৯ থেকে ৫৫ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত।

এই প্রথম পর্যায়েই ঘটেছিলো ঢাকা জেলের প্রায় একশ রাজবন্দীর দীর্ঘ ৫৮ দিনের অনশন সংগ্রাম। জেলের ভেতর মানবেতর অবস্থা থেকে রাজবন্দীদের একটু মানুষের মতো মর্যাদা আদায় করার সংগ্রাম। এই অনশন ধর্মঘটের মাঝখানেই আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম। আর গ্রেফতার হওয়ার পরদিন থেকে অনশন সংগ্রাম আমরাও শুরু করেছিলাম। অন্য বন্ধুদের যদি ৫৮ দিন হয়েছিলো তো মাঝখান থেকে আমাদের অর্থাৎ আমার, সন্তোষ, বারি সাহেব, এদের অন্তত ৩৩ দিন অনশন হয়েছিলো। কিন্তু তার মর্মান্তিক কাহিনী সংক্ষেপে বলা যায় না। অপর দুএকটি উপলক্ষে কিছু স্মৃতির টুকরোতে হয়ত এর আভাস দেবার চেষ্টা করেছি।

এই অনশনের দশ দিনের দিন ঘটেছিলো বন্দী, কুষ্টিয়ার শ্রমিক নেতা শিবেন রায়ের হত্যাকাণ্ড। ফোর্সড় ফিডিং বা জোর করে নাকের মধ্যে নল ঢুকিয়ে দুধ বা জলীয় কিছু ঢেলে দেওয়ার সময়ে শ্বাস বন্ধ করে হত্যা করার। মর্মান্তিক ঘটনা।

আমার আফসোস পূর্ববঙ্গের রাজবন্দীদের বছরের পর বছর বন্দিদশার কাহিনী, তাদের নির্যাতনভোগ, নিহত হওয়া এবং সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাতেও নিজেদের রাজনৈতিক মনোবল রক্ষার অবিশ্বাস্য চেষ্টার কাহিনী আজ পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে রচিত হয় নি। এবং সে কাহিনী বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এবং তার প্রগতিশীল সংগ্রামী কর্মীদের কাছে অজ্ঞাত। অথচ কারাগারের অন্তরালে সেদিনের শত শত কমিউনিস্ট রাজবন্দীর মরণপণ সংগ্রাম কারাগারের বাইরের রাজনৈতিক জীবনকে অনুপ্রাণিত করে জঙ্গী ও সংগ্রামী করে তুলেছিলো। আবার বাইরের সংগ্রামী জীবনের বিস্তার ও বিকাশ কারাগারের ভেতরের মুমূর্ষ রাজবন্দীদের জীবনকে আশার আলো দিয়ে সঞ্জীবিত করে তুলেছিলো।

অনশন ধর্মঘটের বিস্তার ঘটেছিলো রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে এবং সিলেটের জেলেও। সিলেটের জেলে ৫০ সালে স্থানান্তরিত হয়ে জেনেছিলাম সিলেট জেলের সাথীদের ওপর প্রৌঢ়, প্রবীণ আর কিশোর বন্দীদের ওপর অবিশ্বাস্য অত্যাচারের কথা।

এই ’৫০ সালেই ঘটেছিলো রাজশাহীর রাজবন্দীদের ওপর ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ডে নির্বিচার গুলিবর্ষণ। আর তাতে নিহত হয়েছিলেন সাতজন রাজবন্দী, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র আন্দোলনের নেতা হানিফ শেখ, বিজন সেন, সুধীনধর, কম্পম সিং, আনোয়ার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন এবং হানিফ শেখ, বিজন সেন, সুধীনধর, কম্পম সিং, আনোয়ার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন এবং সুখেন ভট্টাচার্য। আহত হয়েছিলেন আরো অনেকে।

এই ’৪৯-৫০ সালেই সাঁওতাল আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ইলামিত্র এবং সাঁওতাল কর্মীরা গ্রেফতার হয়ে এসেছিলেন। গ্রেফতারের মুহূর্ত থেকে থানার হাজতে ইলা মিত্রের ওপর সংঘটিত হয়েছিলো অবিশ্বাস্য পাশবিক নির্যাতন। সংখ্যাহীন সাঁওতাল বন্দী থানায় এবং জেলখানায় অত্যচারিত হয়ে নিহত। হয়েছিলেন।…..

দশকের হিসেব হয়ত কালের বুকে সামান্য সময়ের হিসেব। তবু এই সামান্য সময়ের অসামান্য ঘটনাসমূহই রচনা করেছিলো পূর্ববঙ্গের সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী বিবর্তন ও বিকাশের ভিত্তিভূমি।

২৪.৯.১৯৯৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *