১. সেই সে কাল কিছু স্মৃতি কিছু কথা

সেই সে কাল কিছু স্মৃতি কিছু কথা

সম্বোধন:

 আজকের এই অনুষ্ঠানের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য, অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আরিফা রহমান এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ।

স্নেহভাজন অনুজাপ্রতিম নাজমা জেসমিন চৌধুরীর আজকের এই স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে যোগদানে আমার মানসিক অনুভূতিটি আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশের অতীত।

আমি সাধারণ। আমি দুর্বল, অযোগ্য এবং দরিদ্র।

আমি জানি, মৃত্যুর মধ্যে আমাদের বাস। তবু আমি মৃত্যুকে স্বীকার করিনে। শহীদ কথাটি আমার কাছে পবিত্র। আমার স্বপ্নের মনুষ্য সমাজ তৈরির সংগ্রামে জীবনদানকারী সৈনিককে আমি বলি শহীদ। আমাদের নাজমা সেই সংগ্রামের এক মহৎ সৈনিক। জীবনদানকারী সৈনিক মহৎ জীবন তৈরির সংগ্রামে জীবনদানকারী নাজমাকে আমি শহীদ বলে গণ্য করি। জীবনসংগ্রামের সব শহীদকে আমি জানিনে। আমার জানা-অজানা সকল শহীদের দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত বোধ করি। নাজমা আমার অনুজপ্রতিম। কিন্তু নাজমা আমার চাইতে অনেক বড়। নাজমাকে আমার জানতে হবে। নাজমা স্মৃতি সংসদের আজকের আহ্বানে আমার সকল অযোগ্যতা সত্ত্বেও আমি তাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে যোগ দিতে এসেছি এক দায়িত্ব পালনের বোধ থেকে।

আপনারা নাজমার উপর একটি স্মারকগ্রন্থ তৈরি করেছেন। এমন মহৎ স্মারকগ্রন্থও আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। এটি পাঠ করতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছে। চোখের পাতা অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। আনন্দে, গর্বে ও গৌরবে। তখন আর নিজেকে অশক্ত এবং দরিদ্র বলে মনে হয়নি। মনে হয় না। এ গ্রন্থখানিকে কি আমাদের সকলের জন্য অবশ্যপাঠ্য করা যায় না? এ কথা আমি আজ যেমন বলছি, আগামীতেও তেমনি বলব।

প্রীতিভাজন সিরাজ বলেছেন : আপনি এবার কিছু বলুন। নাজমা বলেছেন : স্যার, আপনি কিছু বলুন। নাজমার এমন সম্বোধন তার প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্বোধন।

আমার নিজের সঙ্কোচ কাটিয়ে আমি তাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছি। বলেছি : আমি কি বলব? আমি তোমাকে কি দেব? তোমার দানেই আমি ধন্য। আমরা ধন্য।

আপনি আপনার জীবনের কথা বলুন। আপনার অনুভূতির কথা।

এ প্রায় তার হুকুম। এমন সুন্দর করে সে হুকুম করতে পারে! এ দৃশ্য ভাবতে আমি আবেগে আপুত হই। যারা জীবন দিয়ে আমাদের জীবিত রাখছে তাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ কোথায়? আমার দরিদ্র জীবনে আজ যেভাবে নাজমাকে পেলাম, এমন প্রাপ্তি আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। এই প্রাপ্তিতে আজ আমি নিজেকে শক্তিমান মনে করছি। সমস্ত রকম হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে, জীবনের অপরাজেয়তার স্বপ্নে এবং বিশ্বাসে আমি উজ্জীবিত বোধ করছি। এই বোধটুকুর জন্য আমি অনুজা নাজমার কাছে ঋণী।

নাজমাকে প্রত্যক্ষ রেখে যে কথা কয়টি আমি বলার চেষ্টা করছি তা এই : এ কোনো আত্মজীবনী নয়। আত্মজীবনী’ কথার মধ্যে হয়তো কিছু অহংবোধের ব্যাপার থাকে। তাই আত্মজীবনী বলার আমার সাহস নেই। কিন্তু জীবন তো, যে জীবন পাঁচটা মানুষকে দেখেছে, পাঁচটা কালকে দেখেছে, তার কথা বলার দায়িত্ব তো সে অস্বীকার করতে পারে না।

১৯২৫ থেকে আজকের এই ২০০০ পেরিয়ে প্রায় ২০০১ এর সামনে দাঁড়িয়ে। আমার দরিদ্র পিতা-মাতার দান করা জীবন দিয়ে যে নতুন মানুষের স্বপ্ন দেখতে দেখতে এই পথটা আমি হেঁটে এসেছি, সেই নতুন মানুষের কল্পনাতীত এক প্রতীক আমাদের নাজমা। তার যে এমন করে সাক্ষাৎ পেলাম, সেজন্য আমি আমার জনক-জননীর কাছে অসীমভাবে কৃতজ্ঞ : কৃতজ্ঞ আমাকে জীবন দেওয়ার জন্যে। তাদের কাছে তাই আমার ঋণের শেষ নেই। এর কোনো পরিশোধ নেই। কিন্তু একে অস্বীকার করার সাধ্য নেই। পাপ বলে যদি কিছু থাকে তবে সেটাই হবে আমার পাপ। জনক-জননীর দান করা জীবনের ঋণকে অস্বীকার করার পাপ।

তাই এ পথ চলতে চলতে ডাইনে-বাঁয়ে যা আমি দেখেছি, জীবন-পথের অপেক্ষমান সারিতে নাজমাকে সে কথা বলার দায়ে আমি দায়বদ্ধ।

***

একদিন জীবনের মিছিলে যোগ দিয়েছি, আওয়াজ তুলেছি, পথের সাথী, পথের সংগ্রামী কমরেডদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আওয়াজ তুলেছি : ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বিপ্লব জিন্দাবাদ।

বিপ্লব কি আসবে? সব প্রতিকূলতা এবং দানবীয় শক্তিকে পরাজিত করে বিপ্লব কি আসবে?

হ্যাঁ বিপ্লব আসবে। আমার বোধ : বিপ্লব এসেছে। বিপ্লবের মধ্যে আমরা বাস করছি।

প্রতিকূলতায় হতাশ হওয়া নয়। দানবীয় শক্তির প্রকাশে শঙ্কির হওয়া নয়। দানবীয় শক্তি, তথা মৃত্যুর মুখের ব্যাদান : জীবনের শক্তির বিকাশে আতঙ্কিত প্রতিকূলতার প্রকাশ : এই প্রত্যয়ে আত্মপ্রত্যয়ী আমাদের হতে হবে। এই বোধ তো আমরা আহরণ করেছি যেমন নাজমার কাছ থেকে, তেমনি সংখ্যাহীন আমাদের সংগ্রামী সাথীদের জীবন থেকে। নির্যাতিত মানুষের এমন সংগ্রামী ঐতিহ্যের বোধ হচ্ছে আমাদের শক্তির উৎস।

আদি থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত যুগের সংগ্রামী মানুষের মহৎ ঐতিহ্যের আমরা একমাত্র উত্তরাধিকারী : আজকের পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষ। নির্যাতিত সংগ্রামী মানুষ। যে নির্যাতনকারী, সে কোনো মহৎ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। সকল মহৎ সংগ্রামের মহৎ ঐতিহ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছে নির্যাতিত, নিপীড়িত সংগ্রামী মানুষ।

তাই নিকটভাবে আমাদের দেশ ও মাতৃভূমিতে, সংখ্যাহীন ঘটনার মধ্য দিয়ে এই বৈপ্লবিক শক্তির প্রকাশকে যেমন আমরা দেখতে পাই, তেমনি বিশ্বব্যাপী তার প্রকাশও আমাদের কাছে আর অদৃশ্য এবং অ-দৃষ্ট নয়।

ওরা বলে : আমাদের স্বপ্ন, তথা একটা নতুন মনুষ্য সমাজের স্বপ্ন আমাদের মিথ্যা এবং মৃত।

আমার বোধ: তাহলে তোমরা এত আতঙ্কিত কেন? একদিন যদি মার্কস এঙ্গেলস্ বলেছিলেন : The Spectre of Communism is haunting Europe, তা হলে আমরা আজ প্রত্যক্ষভাবে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি : the Spectre at the ghost of dead Communism is haunting the exploiting classes of the entire world.

স্নেহভাজন নাজমা, আমি পারি তোমাকে আমার এই অতিক্রান্ত পথের দু একটি মজার কাহিনীর কথা বলতে। তোমার অসহনীয় কষ্টের কথা স্মরণ করে আমার চোখের পাতা কেঁপে উঠছে। তোমার কষ্টের উপশমের জন্যে দেখো সহস্র বার কেমন উদ্বেগে অস্থির হচ্ছি। কিন্তু তুমি সত্যি জেনো, আমাদের বহমান জীবন এবং সমগ্র পৃথিবীতে এমন সব সংখ্যাহীন ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, নতুন মানুষের নতুন কাহিনী তৈরি হচ্ছে, তোমার কষ্টকে লাঘব করার জন্য। তুমি আমার বলা এই কাহিনীর কথা শুনে নিজের মনে মজা পাবে, তুমি নিজের কষ্টকে ভুলে যাবে, যেমন তুমি যথার্থই তোমার নিজের কষ্টকে হাসিমুখে বিস্মৃত হয়ে তোমার নিকট-দূরের সব সাথীর মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছ। তোমার মতো এমন জীবনের সাক্ষাৎ আমি খুব কমই পেয়েছি।

***

আমি তোমাকে কয়েকটা গল্প কিংবা বলতে পারো গল্পের অংশ বলছি। গল্পের আগে পরে ভেবে তো লাভ নেই। গল্প গল্পই। আগেরটাও গল্প। পরেরটাও গল্প। যেমন ধরো আমার এক রাতে পথের দাবী পড়ার গল্প।

পথের দাবী : শরৎবাবুর পথের দাবী। নিষিদ্ধ পথের দাবী। শরৎবাবু কখন লিখেছিলেন এ উপন্যাস আমি এ মুহূর্তে বলতে পারব না। কিন্তু আমি যখন পড়ি তখন আমি কিশোর : ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্র। বরিশাল জেলা স্কুলে। সে ১৯৩৮-৩৯ সালের কথা। নাজমা, বিস্ময়ের ব্যাপার। তুমি জীবনে এসেছিলে : ১৯৪০ সালে। ১৯৪০ সালে আমি সেকালের ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেছিলাম। কিন্তু সে কথা বড় কথা নয়। এখন দেখছি বড় কথা : তুমি ১৯৪০ সালে জন্মেছিলে। আর আজ আমি তোমাকে সম্বোধন করে কথা। বলছি। কী বিস্ময়কর আমাদের জীবন! কী বিস্ময়কর মানুষের জীবন!

পথের দাবী দিয়েছিল আমাকে আমার সহপাঠী অন্তরঙ্গ কিশোর বন্ধু মোজাম্মেল হক। [পরবর্তীকালে সে নিহত হয়েছে, ১৯৬৪ কি ৬৫ সালে মিশরের মরুভূমিতে পিআইএ বিমানের এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মোজাম্মেল আমার কাছে স্মরণীয়। কেবল আমার কৈশোরের বন্ধু বলে নয়। সমাজগত পশ্চাৎপদতা-অগ্রগামীতার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের একটি কিশোর ছাত্র বলে, যে সেই ১৯৩৯-৪০ এ ছিল সারা ভারত বিপ্লবী দল RSPI এর সক্রিয় এক রাজনীতিক কর্মী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত শক্তিসমূহের একটির মাঝে নিজেকে একাত্ম করা এক কর্মী হিসেবে সে আমাকে বিপ্লবের লাল-নীল ইস্তেহার দিত। আমাকে ভালো পড়ুয়া ছাত্র বলে ব্যঙ্গ করত। অথচ নিজে বৃত্তিধারী মেধাবী ছাত্র ছিল। আমাকে পথের দাবী দিয়ে এক রাতের মধ্যে গোপনে তা পাঠ করার হুকুম দিয়ে বলেছিল : খবরদার! এই বইয়ের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। তা হলেই তোমাকে জেলে যেতে হবে।

সে এক রোমান্টিক আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। বরিশাল শহরের একটি বাসাবাড়ি। এ শহরে ইলেকট্রিক লাইট তখনো আসেনি। রাস্তায় রাতে ঝুলানো গ্যাসের বাতি জ্বলে। একটি কিশোর, মুরব্বীর ভয়ে হ্যারিকেনের দুদিকে কাগজের ঢাকনা দিয়ে পড়ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের রোমাঞ্চকর এক কাহিনী। ভারতী, অপূর্ব, সব্যসাচীর কাহিনী। ঘটনাস্থল সুদূর বার্মার রেঙ্গুন শহরের অন্ধকার কাঠের ঘর, গাছপালাঘেরা শহরতলীর নদী। নায়িকা ভারতীয় বরিশালের মেয়ে। কেমন করে এলো সুদূর রেঙ্গুনে সেটি বড় কথা নয়। একটি গুপ্ত দল। যে দল স্বাধীনতার কথা বলে, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে, স্বাধীন করতে চায় ভারতকে। ব্রিটিশ সরকারের চর অনুচর সর্বত্র, কলকাতা, রেঙ্গুন, সুমাত্রায়। নিষিদ্ধ এই গুপ্ত সমিতির আসল নায়ক সব্যসাচী। তার পিস্তল চলে দুই হাতে। তার যাতায়াত রহস্যজনক। পুলিশ ও তাদের অনুচরেরা শত চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারে না।

কিন্তু সে কাহিনীর বিস্তারিত থাক। কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে, এ কাহিনী। এই কিশোরের দেহমনকে সে রাত্রিতে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল। তার চোখেও স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়েছিল। পথের দাবীর প্রতিটি পৃষ্ঠার উপরের কোণা কায়দা করে কাটা। এই কোণাতেই মুদ্রিত ছিল পথের দাবী দুটি শব্দ। ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা, সর্বত্র এই বই নিষিদ্ধ। এই বই কতখানি উপন্যাস হয়েছিল কিংবা হয়েছিল না তা নিয়ে তর্ক ছিল কবিগুরু ও শরৎচন্দ্রের মধ্যে। কিন্তু আমার মনে শিহরণ বাদে কোনো সন্দেহ ছিল না। কোনো তর্ক ছিল না। সেজন্য আজো সেই কিশোর তার বার্ধক্যে লজ্জা বোধ করে না। কারণ একালেও তার সাথী রয়েছে। বৃদ্ধ জ্যোতিবাবুর পরিচিতি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন অশীতিপর এই বিপ্লবী। ঢাকায় এসে তিনিও তাঁর কৈশোরের স্মৃতিচারণ করে বললেন : আমি স্বদেশী রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলাম পথের দাবী পাঠ করে।

কেবল যে রোমাঞ্চকর নিষিদ্ধ বিপ্লবী বই-এর পাঠ তাই নয়। কিশোরের জীবন-নদী দিয়ে জীবনতরী এগিয়ে চলে। আহা সেকালটি ছিল সোনার কাল। স্বপ্নের কাল। বরিশালের বিশাল কীর্তনখোলায় কত বড় বড় জাহাজ : নাগা, গারো, ফ্লোরিকান, অস্ট্রিচ। ঢাকা-বরিশাল, বরিশাল-খুলনা যাতায়াত করে R.S.N.I.G.N. কোম্পানির স্টিমার : মেইল এ্যান্ড এক্সপ্রেস। স্টিমার নয়, যথার্থই জাহাজ। প্রত্যেকটির দুই পাশে তাদের কি বিরাটাকার চাকা। সেই চাকা পেডালের টানে থরথর করে জাহাজ চলে নদীর বুকে বিরাট আকারের ঢেউ তুলে। সে ঢেউ-এর আঘাতে ইলিশধরার ডিঙ্গিগুলো উথালপাথাল হাবুডুবু খায়। সেই জাহাজে চড়ে কিশোর আসে অজানা এক শহরে। নাম তার ঢাকা।…

এ কাহিনী এই কিশোরের যৌবন পেরিয়ে প্রবীণ বয়সেও কলমের কালিতে অবর্ণনীয়।

১৯৪১, ৪২, ৪৩, ৪৫ এর কথা। ২০০০ সাল থেকে ৬০ বছর আগের কথা। গরিবের বাচ্চা হলে কি হবে। বিড়ালের জান বটে। তাই মরেও মরে না। মরল না ৭৫ বছরে এসেও। ঠ্যাং ভাঙলো, তবু মরলো না তো। মরলে। পরে এই বাংলাদেশের কিছু আসত যেত না। যা যেত এবং যার যেত সে এই বিড়াল তপস্বীর। সে না পেত এ কালের নাজমার দেখা। না পেত নাজমার অনিরুদ্ধ আহ্বানে হাজির হয়েছে যে দীপবাহকেরা : তাদের সাক্ষাৎ।

আহা! যদি ফিরে যাওয়া যেত সেই জীবনে : জীবনের এই অভিজ্ঞতা এবং ভালবাসা নিয়ে, তা হলে আবার সে ভর্তি হত বরিশালের সেই জেলা স্কুলে। ক্লাস নাইনে, আবার পরীক্ষা দিত ম্যাট্রিকে : শশধর স্যারকে পেয়ে অঙ্কে ভীত কিশোর সলজ্জভাবে প্রশ্ন করত : স্যার একেবারেই পাস করবো না? স্যার মিষ্টি হেসে পিঠে হাত বুলিয়ে বলতেন : তোর খাতা এক বার দেখে দিয়েছি। ৪৯ কি ৫০ তুই পেয়ে যাবি।

তাতেই সে খুশি। একেবারে ফেল তো নয়।

আসলে এ এক অদ্ভুত ছেলে। জীবনে এ্যাম্বিশন কাকে বলে তা সে জানাল না। সেকালের বরিশাল : নজরুল নাকি বলেছিলেন : বাংলার ভেনিস। ঘাটে ভেড়া জাহাজ। ছবির মতো সুন্দর টিকেটঘর। দক্ষিণে সাগরদাড়ি পর্যন্ত চলে গেছে দুই পাশে ঝাউ আর দেবদারুর মাথায় পাতার বহর নিয়ে, সমুদ্র থেকে ভেসে আসা বাতাসের ঢেউএ আন্দোলিত পাতার শা শা শব্দ তুলে।

না, ফিরে যাওয়া যায় না। কিন্তু তাকানো তো যায়। আর তাকালেই সে দেখতে পায়, অতিক্রান্ত পথের এপাশ ওপাশ থেকে কত পত্রপুস্প সে তুলে তুলে তার জীবনের কাঁধের থলেকে ভর্তি করেছে। এর যা কিছু মূল্য সে কেবল তার নিজের কাছে। তাতেই সে সার্থকবোধ করে। এবং সেই সার্থকতার পরিশেষের চিহ্ন আজকে এই মুহূর্তে এই কাহিনী বলতে পারার সৌভাগ্য। এতে কোনো অহংকার নেই, সঙ্কোচ ব্যতীত। কোনো দম্ভ কিংবা আত্মম্ভরিতা নয়।

আদৌ আমি মুখ খুলতে চাইনি। যদি নাজমা এসে ডাক দিয়ে না বলত : স্যার আপনি কিছু বলুন।

: আমি কি বলব?

: আপনার জীবনের কথা বলুন। আপনার অনুভূতির কথা।

সেই হুকুমেই বলার এই ব্যর্থ চেষ্টা। নাজমার হুকুমকে অমান্য করার শক্তি আমার নেই। তেমন করলে আমার জীবনের অপদার্থতা এবং অসার্থকতার আর শেষ থাকবে না।…

তবু এই এখন, পেছনের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছি। স্মৃতির পটে ছবির টুকরা এই ভেসে ওঠে তো, এই ডুবে যায়।

কিন্তু পাকা ডুবুরী বলব প্রীতিভাজন অধ্যাপক মনসুর মুসাকে, তার সহকর্মী এবং আমার স্নেহভাজন শিশির ভট্টাচাৰ্য্যকে, আমার বন্ধু অধ্যাপক আবদুল হাইকে। তারা নাজমার দোহাই দিয়ে আমাকে তাদের শ্রদ্ধা ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে ডেকে এনেছেন। আমার যথার্থই শূন্য কুম্ভ বাজিয়ে তার ভেতর থেকে শব্দ আহরণ করেছেন : শব্দগ্রাহক যন্ত্রে আমার অর্ধোচ্চারিত শব্দকে ধারণ করেছেন, আবার সেই শব্দ বাজিয়ে আমার সঙ্গে আমাকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। তারা যথার্থই আমাকে আমার চেয়ে অধিক জানেন। তাদের দেওয়া পরিচয়ের মধ্য দিয়ে যেন নিজেকে আবার একটু একটু করে চিনতে পারছি। এবং এজন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। নিভন্ত দীপের সলতে যেন একটু জ্বলে উঠছে। সাথীরা বলছেন : এটুকুই যথেষ্ট। তোমার দীপ থেকে আমাদের হাতের শিখাকে জ্বালিয়ে নিতে দাও।

আহা, এমন মিনতির কি কোনো কিছুর সাথে তুলনা হয়! দীপ বলে : একটু ত্বরা করো। না হলে যে নিভে যাবে। তেমন হলে তো আমার সব জীবনটাই ব্যর্থ বলে বোধ হবে। নিঃশেষিতপ্রায় তেলটুকুতে সলতে যদি জ্বলে আরো একটি মুহূর্ত, তবে তা থেকে জ্বালিয়ে নাও তোমাদের জীবনের আলো এবং সেই আলোর নিশান হাতে এগিয়ে যাও জীবনের পথে, সমুখের পানে : নতুন মনুষ্যসমাজ তৈরির নূতনতর স্বপ্ন নিয়ে। মা তৈ! চরৈবেতি। এগিয়ে চলো।

নাজমা, তোমার কাছে আমার আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : নিভে যাবার মুহূর্তটিতে তোমার দেওয়া স্বপ্নের সার্থকতার এই বোধের জন্য…

২. মানুষের জন্ম কবে?

আমি বলি, মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তার সত্যিকার জন্মদিন। একটু উলটাপালটা কথা বলে মনে হতে পারে। শেখ মুজিবের জন্ম হচ্ছে শেখ মুজিবের মৃত্যুর দিনে। মৃত্যুর পর কোনো ব্যক্তির পুরো পোর্ট্রেটটা আমার সামনে আসে। যেভাবেই মরুক না কেন একজন ব্যক্তি, অসুখেবিসুখে কিংবা কোনো আন্দোলনে বা কোনো যুদ্ধে। মরার পর জন্ম থেকে শুরু হওয়া সার্কিটটা তখন কমপ্লিট হয়। কাজেই আমরা যে জন্মদিবস পালন করি কেউ পঞ্চাশে, কেউ চল্লিশে বা ষাটে–এটা খুব একটা যথার্থ নয়। তখনো পর্যন্ত পুরো পোর্ট্রেটটা আমার সামনে নেই।

আমার সার্কিটও কমপ্লিট হয়নি এখনো, তবে এখন এই পঁচাত্তর বছর বয়সে আমি পেছন দিকে একবার তাকাতে পারি। লুক ব্যাক। স্মৃতি আমার বেশ ভালোই আছে যদিও ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে নেই।

বর্তমান বাংলাদেশে জিজ্ঞাসু যে প্রজন্ম তাকে আমি কী দিতে পারি? আমি বড় পণ্ডিত নই, বড় প্রফেসরও নই, বড় গবেষক নই। তারা বড় বড় সমস্ত প্রবন্ধ লেখেন জীবনে গতি, জীবনের পরিবর্তন, পরিবর্তনের ধারা, ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে। এসব আমি তেমন কিছুই জানি না। এমন আমি, কী দিতে পারি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে? আমি দিতে পারি আমার জীবনটাকে। শিশুকাল থেকে যেসব অসাধারণ মানুষ আমি দেখেছি তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি নতুন প্রজন্মকে।

টীকা : আলোচনার এই অংশটির বর্তমান রূপে উপস্থাপনার প্রধান কৃতিত্ব ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মনসুর মুসা এবং তাঁর সহযোগী শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য্যের। তারা দুজনে আমার অনীহা ও অক্ষমতার মোকাবেলায় একটি শব্দগ্রহক যন্ত্রে বেশ কয়েকদিন যাবৎ আমার মুখের এলোমেলো, গুরুচণ্ডালী কথাকে একটি গ্রাহ্য তথা দ্ররূপ দেবার চেষ্টা। করেন। এমন কাজের যেমন অবর্ণনীয় পরিশ্রম, তেমনি এর নানা সীমাবদ্ধতা। কিন্তু তাদের আন্তরিকতার কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া আমার উপায় থাকেনি।

৩. শৈশব ও স্কুলজীবন

আমার জন্ম ১৯২৫ সালে বরিশালের আঁটিপাড়া গ্রামে। ভাইবোনদের মধ্যে আমি চতুর্থ। কৃষক পরিবারের ছেলে আমি। আমাদের পরিবারকে মধ্যবিত্ত পরিবার বলা চলে না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত বললে ঠিক হয়। বছরের খোরাক হয় কিংবা কিছু কম পড়ে। বাজারে গিয়ে তরিতরকারি বিক্রি করেছি ছোটবেলায়। বাবা কৃষিকাজ করতেন। মনে আছে বাবা বলছেন, তুই লাঙলটা ধর বা মইয়ে। একটু ওঠ, আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আমি যে কৃষিকাজ তেমনভাবে করেছি তা বলবো না। কিন্তু কৃষিকাজে বাবাকে সাহায্য করেছি। বাবা আমাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন। মেঝ ভাইকে তিনি সঙ্গে পাননি। মেঝ ভাই একটু আউট অব লাইন হয়ে যান স্কুলজীবন থেকেই। কিন্তু আমি ছিলাম অনুগত সঙ্গী, বড় ভাইয়ের যেমন, তেমনি বাবার। খুব বাধ্য ছেলে ছিলাম আমি। ছোটবেলায় খুব নামাজ পড়তাম, আযান দিতাম।

মা প্রতিদিন রান্নার বরাদ্দ চাল থেকে এক মুঠো চাল একটা ভাণ্ডে উঠিয়ে রাখতেন। এ চালটা থেকে ফকির-মিসকিনদের দান করা হত। দানের জন্যে এই এক মুঠি চাল উঠিয়ে রাখা আমাদের দেশের অনেক পুরোনো রীতি। আমার মা-বাবা নিরক্ষর এবং একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। তাঁদের মতো লোকের কথা ছিল না আমাকে স্কুলে পাঠানোর। কিন্তু তারা আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। সেজন্য আমি এই মাটির মানুষগুলোর কাছে ঋণী এবং এই দেশের মাটির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা ভক্তি জেগে আছে।

আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এলাকারই লোক ছিলেন। তখন আজকালকার মতো এক জায়গার শিক্ষক অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হওয়ার ব্যাপারটা ছিল না। শিক্ষকেরা একদিকে যেমন স্কুলে শিক্ষাদান করতেন, তেমনি তারা মাঠে কৃষিকাজেও নিযুক্ত থাকতেন। একটা কথা মনে পড়ে যে, শিক্ষকেরা খুব যত্ন করে পড়াতেন আমাদের। পাঠশালায় একজন শিক্ষকের কথা বিস্মৃত হতে পারি না কিছুতেই। তাঁর নাম লেহাজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি একজন পঙ্গু মানুষ। তিনি আমাদের দূর-সম্পর্কে আত্মীয়ও ছিলেন। আমার মামা। অনেক দূর থেকে এসে পড়াতেন তিনি আমাদের। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি কলম দিয়ে এই মামা হাতে ধরে আমাদের বর্ণমালা লিখতে শেখাতেন তালপাতায়। কাঠকয়লা গুঁড়ো করে পানিতে মিশিয়ে তৈরি হত কালি। সেই কালিতে কঞ্চির কলম ডুবিয়ে সিদ্ধ করা তালপাতার উপর বড় বড় করে অ, আ, ই ইত্যাদি অক্ষর লিখে দিতেন আর আমাদের সেই সব অক্ষরের উপর লিখে লিখে হাত মকশো করতে হত। এই ছিল তখনকার দিনে লিখতে শেখার সিস্টেম। এখন আর এসব পাওয়া যাবে না।

লেহাজ মামার স্মৃতিটা মনের মধ্যে গেঁথে আছে এই জন্যে যে, একজন সাধারণ মানুষ সৎভাবে বাঁচার জন্যে কীভাবে সংগ্রামী হয় অর্থাৎ সৎভাবে জীবনযাপন করা যে একটা সংগ্রাম–এটা আমি শিখি লেহাজ মামাকে দেখে। তাকে দেখে আমি প্রথম অনুপ্রাণিত হই। বড় ভাই পরে চাকরিবাকরি পেয়ে এই মামাকে খুব সাহায্য করেছেন।

আটিপাড়া গ্রামে একটা বোর্ড স্কুল ছিল। সেই স্কুলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে থাকব হয়তো। যখন আমি পড়তে শিখলাম তখন সবাইকে বই পড়ে শুনাতাম। মনে পড়ে, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু পড়ে শুনিয়েছি বাড়ির লোকদের। শুনে বাড়ির লোকজন বেশ প্রশংসা করত।

১৯২৯ সালে বড় ভাই বা আমার মিয়াভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম. এ. পড়তে আসেন ঢাকায়। বাবা মা তাঁর নাম রেখেছিলেন মউজে আলী। ওটা তিনি বোধ হয় পরে একটু সংস্কার করে নিজের নাম রেখেছিলেন মঞ্জে আলী। তিনি বরিশাল বি এম কলেজের ছাত্র ছিলেন। বড় ভাই ধার্মিক ছিলেন, দাড়ি রাখতেন। কিন্তু তাঁর ব্যবহার এত ভালো ছিল, এত সামাজিক ছিলেন তিনি যে হিন্দু সমাজের লোকজনও খুব ভালবাসত তাঁকে, বিশেষত বরিশালের দত্ত পরিবার, অশ্বিনী কুমার দত্তের পরিবার তাকে খুবই স্নেহ করত। মুসলমানরা তখন চাকরিতে অগ্রাধিকার পেত। সুতরাং বড় ভাই এম. এ. প্রথম। পর্ব শেষ করেই সাবরেজিস্ট্রারের চাকরি নিলেন। এম. এ.র পড়াটা তিনি কমপ্লিট করেননি। বড় ভাই অনেক সামাজিক কাজ করতেন। যেখানেই যেতেন স্কুল, মসজিদ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতেন। খুব জনপ্রিয় ও সৎলোক ছিলেন তিনি।

বড় ভাই বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং পেয়েছেন যেমন, নাজিরপুর, রহমতপুর, নলছিটি। নিজের সংসার তৈরি করার আগে তিনি আমাকে নিয়ে তার কর্মস্থলে গিয়েছেন। এসব জায়গায় যাওয়ার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আমার। আমি তখন এত ছোট যে হেঁটে সব জায়গায় যাওয়ার শক্তি আমার ছিল না। তিনি আমাকে কোনো কর্মচারীর কাঁধে তুলে দিয়েছেন, হয়তোবা তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। সেসব জায়গায় ভালো নদী ছিল তখন। বড় বড় জাহাজ চলত সেসব নদীতে। নিজের গ্রামের সঙ্গে আমি সম্পর্কহীন নই। গ্রামের সাথে সম্পর্ক ছিল আমার কিন্তু দূরত্ব সৃষ্টি হয় ১৯৩৪/৩৫ সালে যখন বড় ভাই চাকরি পেলেন। চাকরি পেয়ে তিনি এলেন নাজিরপুরে*। [* ওফাজ উদ্দীন আহমদ] সাথে করে তিনি আমাকেও নিয়ে এলেন। উনি আমাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন অবশ্য আমার কান্নাকাটিতেই। মা বা অন্যরা খুব একটা রাজি ছিল না আমাকে আসতে দিতে।

এর কিছুদিন পর বড় ভাই গলাচিপায় পোস্টিং পেলেন। সেখানে গলাচিপা স্কুলে আমি সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণী সমাপ্ত করি। স্কুলটা বড় ভাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং পরে স্কুলটাকে তিনি উচ্চবিদ্যালয়ে পরিণত করেন। গলাচিপা থেকে বড় ভাই ট্রান্সফার হন ভোলা মহকুমার দক্ষিণে বোরহানউদ্দিনে। এ সময়ে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বরিশালে। বরিশাল এ কে স্কুলে আমার বড় ভগ্নিপতি* [*মঞ্জে আলী সরদার (১৯১০-১৯৯১)] শিক্ষকতা করতেন। তিনি আমাকে নিজের স্কুলে না নিয়ে ভর্তি করতে চাইলেন বরিশাল জেলা স্কুলে। বরিশালে অনেকগুলো স্কুল ছিল তখন। আমি জেলা স্কুলে ভর্তি-পরীক্ষা দিলাম। প্রশংসাই পেলাম পরীক্ষায়। হেডমাস্টার সাহেব*[ সিরাজ উদ্দিন আহমেদ] বললেন : না, ইংরেজি বাক্য তো শুদ্ধ করে লিখতে পারে। আমি ভাইদের মধ্যে লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম। ব্রিলিয়ান্ট বলা চলে না আমাকে, মোটামুটি ভালো।

বরিশাল জেলা স্কুলে আমি ভর্তি হলাম ক্লাস নাইনে। এখানে আমি বন্ধু হিসেবে পেলাম মোজাম্মেল হককে। পরবর্তী কালে কায়রোতে পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের বিমান দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। অনেকে মারা গিয়েছিল এই দুর্ঘটনায়, মোনায়েম খানের ছেলেও নিহতদের মধ্যে ছিল। এই মোজাম্মেল। হকই আমাকে পলিটিক্যাল বা রাজনীতি-সচেতন করেছে। মোজাম্মেল ছিল বরিশালের রিভলিউশনারী সোসালিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা আর এস পি আই। এর সদস্য। বরিশালের রাজনৈতিক জীবন বেশ সমৃদ্ধ ছিল। সেখানে নলিনী দাশের মতো বড় বড় নেতারা ছিলেন। নলিনী দাশ আন্দামান সেলুলার জেলে রাজবন্দি ছিলেন। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। আমাদের বাড়িতেও গেছেন তিনি। এই নলিনী দাশকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় গ্রামের লোকজন জবাই করতে চেয়েছিল। তিনি গ্রামের লোকজনকে বললেন, “আমাকে জবাই করে তোমাদের কি লাভ? এর চেয়ে আমাকে বরং পুলিশে দিয়ে দাও। তোমরা পুরস্কার পাবে। গ্রামের লোক ভাবল, সত্যি কথাই তো! জবাই করার চাইতে পুলিশে দিয়ে দেওয়া যাক। এভাবে তাঁর জীবন রক্ষা পায়।

R.S.P.I নানা ইস্তেহার বের করত। মোজাম্মেল একদিন আমাকে একটি বই দিয়ে বলল, এই বইটি তুমি নেবে। এটি এক রাতের মধ্যে পড়ে শেষ করতে হবে। কেউ যেন না দেখে। সাধারণত বইয়ের নাম উপরে লেখা থাকে। এই বইটির উপরে নামের জায়গাটুকু কাটা ছিল। বইটি হচ্ছে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী। সাংঘাতিক বই। কবিগুরু নাকি বলেছিলেন, এটা কি একটা উপন্যাস হল? শরৎচন্দ্র জবাব দিয়েছিলেন, যা হয়েছে তাতো হয়েছে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, আমি রাজনীতিতে এসেছি পথের দাবী পড়ে। পথের দাবী পড়ে রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়। যারা পলিটিক্যাল লোক তাদের এখনো বইটি ভালো লাগার কথা। পথের দাবীর যে নায়িকা, ভারতী তার নাম, সে হচ্ছে বরিশালের ভারতী। শরৎ বাবুর রেঙ্গুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। পথের দাবীর নায়িকা ভারতীকে তিনি রেঙ্গুন নিয়ে গেছেন। সেখানে হাবাগোবা একটি বাঙালি কেরানি ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। রেঙ্গুনে একটি বিপ্লবী সংগঠন আছে। সংগঠনটি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে। আরেকটি চরিত্র আছে সব্যসাচী। সে দুই হাতে পিস্তল ছুঁড়তে পারে। পুলিশ তাকে ধরার জন্যে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। একদিন পুলিশ খবর পেল যে আজ সব্যসাচী জাহাজে আসবে। পুলিশ ঘিরে ফেলল জাহাজ ঘাট। এমন একজনকে পাওয়া গেল যার পকেটে আছে গাঁজার কলকে। পুলিশ তখন তাকে জিগ্যেস করে, তুমি কি গাঁজা খাও? সব্যসাচী উত্তর দেয়, না আমি খাই না, তবে কলকেটা সাথে রাখি, যদি কেউ খায়! সংলাপগুলো খুব চমৎকার। এই পথের দাবী পড়ে আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়।

বরিশাল জেলা স্কুল থেকে আমি ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করি। জেলাভিত্তিক স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। ম্যাট্রিকে পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে আমি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি উচ্চতর ক্লাসের বন্ধুদের বইটই পড়তাম। আমি ঐ সময়েই সিভিকস ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, এই ১৯৪০ সালেই লাহোর প্রস্তাব পাশ হয়। অবশ্য লাহোর প্রস্তাব পাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যে বিরাট কোনো আলোড়ন উঠেছিল এমন নয়।

বরিশালে হিন্দু ছাত্ররাই ছিল বেশি সক্রিয়। তারাই মেধাবী। মাঝে মাঝে যে ধর্মঘট হয় তাতে হিন্দু ছাত্ররাই যোগ দেয়, পুলিশের অত্যাচার তাদের উপরই বেশি হয়। মুসলমান ছাত্ররা খুব একটা সক্রিয় ছিল না। তার মধ্যে মোজাম্মেল হক ছিল ব্যতিক্রম। আমি আর এস পির সদস্য ছিলাম না। তবে আমি মোজাম্মেলের বন্ধু ছিলাম।

ম্যাট্রিক পাশ করার পর বড় ভাই আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কলকাতায়ও অবশ্য আমি পড়তে যেতে পারতাম। সে সময় অনেক জাহাজ ছিল যেগুলো বরিশাল থেকে কলকাতায় যাতায়াত করত। দুটি ভালো সার্ভিস ছিল জাহাজের। ঐসব জাহাজের দুই-একটি এখনো আছে : অস্ট্রিচ, লেপচা। অনেক জাহাজের নাম মুখস্থ আছে আমার : ফ্লোরিকান, নাগা, গারো ইত্যাদি। এসব জাহাজের দুই পাশে দুটি প্যাডেলের মতো ছিল। মাঝখানে বড় একটা মেশিনঘর। একপাশে কয়লা রাখা থাকত। ফায়ারম্যান কয়লা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিত মেশিনে। জাহাজের এই ফায়ারম্যান নিয়ে আমি একটি গল্প। লিখেছিলাম। ফায়ারম্যান গল্পটি কলকাতার মোহাম্মদীতে ছাপা হয়েছিল।

৪. ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ

 ঢাকায় এসে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হলাম আইএতে। তখন ভর্তির ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি ছিল না। থাকলেও আমি তো ছাত্র মোটামুটি ভালো ছিলাম। সুতরাং ভর্তি হতে বেগ পেতে হত না। মেডিকেল কলেজের মূল বিল্ডিং যেটি এখন, সেটি তখন দোতলা ছিল। তখন এটি ছিল এ্যাডমিনিসট্রেটিভ বিল্ডিং। পরে এটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়। কার্জন হলও বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ ছিল। কার্জন হলের বিপরীত দিকের বিল্ডিংটি ছিল তখন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে এটি তৈরি হয়। সেখানে শুধু আই এ, আই এস সি এবং আই কম পড়ানো হত।

ঢাকায় তখন তিনটি মাত্র কলেজ ছিল : জগন্নাথ কলেজ, গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ আর সলিমুল্লাহ কলেজ। জগন্নাথ কলেজে হিন্দু ছেলেদের সংখ্যা ছিল বেশি। ভালো ফল তারাই করত। যেটা এখন ফজলুল হক হল, সেটা ছিল ইন্টারমিডিয়েট কলেজের হোস্টেল। আমি এখানে থাকতাম। এর একদিকে হিন্দু ছেলেরা থাকত, অন্যদিকে মুসলিম ছেলেরা। কখনো মারামারি হয়নি তাদের মধ্যে। দায়িত্বে নিয়োজিত সুপারিন্টেডেন্ট শিক্ষক দুজনেই খুব ভালো ছিলেন।

ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ে আমার পেছনে একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়। যাকে বলা যায় জাতীয়তাবাদী অর্থাৎ নন-মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের সাথে আমাদের কোনো প্রকার হৃদ্যতা ছিল না। এ সময়ে আমি পার্ল বাকের গুড আর্থ উপন্যাসটি পড়ি এক রাতে। এরও একটা অবদান আছে আমার চরিত্র গঠনে। এ সময়ে মোজাম্মেল হকের সাথে আমার যোগাযোগ কমে যায়। সে থাকে বরিশালে, আমি ঢাকায়। তবে তাদের সংগঠন ঢাকায়ও ছিল। মোজাম্মেল ঢাকায় এলে আমার সাথে দেখা করত।

আমি কোনো ছাত্র আন্দোলন করিনি, তথাপি আমি সংশ্লিষ্ট ছিলাম এর সাথে। কমিউনিস্টরা চেষ্টা করত মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে ঢোকার। ঢাকায় আসার পরপরই ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্ট যে গ্রুপটা, তারা আমাকে পিক আপ করল। আমি একা নই, সৈয়দ নুরুদ্দীন, সানাউল হক এরাও ছিলেন আমার সঙ্গে। ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে আমাদের সঙ্গে আরো ছিলেন নাজমুল করিমের ছোটভাই লুফুল করিম, মো. আবুল কাসেম। যিনি ভূগোল আর ইংরেজি উভয় বিষয়ে এম. এ.। এখন তেজগা কলেজের অধ্যাপক। এবং হিসামুদ্দিন–তিনি অবশ্য একটু সিনিয়র আমাদের চেয়ে। সম্প্রতি প্রয়াত।

ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আমি যতটা না কমিউনিস্ট, তার চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদী ছিলাম। আমি আর আমার গ্রুপের বন্ধুরা মিলে তখন হাতে লেখা পত্রিকা বের করেছি। আমি হলে কিংবা হোস্টেলে গিয়ে নিজে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দাঁড় করিয়েছি। আমি ভেবেছি আমার বন্ধুরা কেমন করে তাদের অবসর সময় কাটাবে। তারা এসে আমার ঘর থেকে নিজেরা বই নিয়ে গেছে। নাম লিখে রেখে গেছে-আমি বই নিলাম। আবার সেই বই ফেরত দিয়ে গেছে পড়া হয়ে গেলে। সারারাত জেগে আমরা তখন পার্ল বাকের গুড আর্থ পড়েছি বা পড়েছি শরৎচন্দ্রের পথের দাবী।

উভয় বাংলার সব কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে ছিল। কিন্তু ঢাকা শহরের কলেজগুলো ছিল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এন্ড ইন্টারমিডিয়েট এ্যাডুকেশনের আন্ডারে। ঢাকা বোর্ড ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিডার অর্থাৎ এখান থেকে ছাত্ররা বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। ঢাকা বোর্ডে ইন্টারমিডিয়েটে আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। কোনো মুসলমান ছাত্র এ রকম রেজাল্ট করেনি এর আগে। সাধারণত জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররাই তখন প্রথম দ্বিতীয় স্থান অধিকার করত। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের এসব স্থানে দেখা যেত না। মুসলমান ছাত্রদের তো নয়ই। আমি অবশ্য প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার জন্যে লেখাপড়া করতাম না কখনো। ভালো ছাত্রদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। আমার সম্পর্ক ছিল ব্যাকবেঞ্চারদের সাথে। পেছন থেকে এসে তারা আমাকে টেনে নিয়ে যেত তাদের কাছে। বলত, তোর জায়গা তো এখানে না। এখানে বসবে সৈয়দ আলী আশরাফ সৈয়দ আলী আহসানের ভাই)। ওরা তো গুড বয়। তুই তো গুড বয় না। তুই ব্যাড বয়। তুই আমাদের সাথে থাকবি। আর আমাদের পড়াবি তুই। ক্লাসের এ মাথা থেকে ও মাথা সবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আমি কোনো ছুটিতে আমার নিজের বাড়িতে যেতাম না। বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম। নাসিরুদ্দীনের সাথে চলে যেতাম তার বাবার কাছে চাঁদপুরে। তিনি তখন ওখানকার এস ডি ও। নাসিরুদ্দীন, গিয়াসুদ্দীন আর রশিদুদ্দীন এরা তিন ভাই ছিল। রশিদুদ্দীন এখন ঢাকার একজন বড় সার্জন। জহুরা মার্কেটে বসেন। তাদের ছোট বোন ফরিদা বানু বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। কিংবা যেতাম নূরুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ি রাজশাহীতে। বাড়ির ওপর কোনো টান ছিল না আমার। বাড়ির লোকরা অবশ্য খবর পেত যে তাদের করিম খুব পরিচিত, তাকে সবাই খুব ভালবাসে।

ইন্টারমিডিয়েটে দ্বিতীয় হওয়ার পর আমার ইংরেজির অধ্যাপক আমাকে সাথে করে ক্লাসে ক্লাসে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। সবাইকে বলেছিলেন, দেখো, একে কিন্তু আমি আবিষ্কার করেছি। আমার এক শিক্ষক ছিলেন পি সি চক্রবর্তী। তিনি দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন। তাঁকে স্মরণে পড়ে। কী সুন্দর। লোক! গলাবন্ধ কোট পরতেন, ময়মনসিংহের টানা-টানা ভাষায় কথা বলতেন। আমি একদিন গিয়ে রসিকতা করে বললাম, স্যার আমি এত কম নম্বর পাইছি কেন? অজিত (অজিত দে, এইচ এল দের ছেলে) এত বেশি নম্বর পাইল কেন? উনি তখন আমাকে বললেন, তুমি কি মুখস্থ কর?” আমি বললাম, না স্যার আমি মুখস্থ করতে পারি না। উনি উত্তর দিলেন, মুখস্থ কর। মুখস্থ না করিলে ভালো নম্বর পাইবা না। ভালো ভালো বই মুখস্থ করলে ঐ সব বাক্য লেখার সময় মাথায় আসে–এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। তিনি ইন্টারমিডিয়েটে আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। ৪২ এর দিকে দাঙ্গায় তিনি নিহত হন। দাঙ্গা মানে ছুরি মারামারি আরকি। প্রায়ই হত এ রকম ঢাকা শহরে। লোকজন দলে দলে লাঠিসোটা নিয়ে বের হয়ে দাঙ্গা শুরু করত, তা কিন্তু নয়।

৫. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

 যুদ্ধের খবর আমরা নিয়মিতই পেতাম। তখনো রেডিও তেমনভাবে চালু হয়নি, মাত্র চালু হয়েছে। ছাত্ররা দাবি করছে হোস্টেলে একটি করে রেডিও পাবার জন্যে। পত্রিকাগুলো যেমন, আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, এ্যাডভান্স (ইত্তেহাদ বোধ হয় আর একটু পরে হয়েছে) ইত্যাদি কলকাতা থেকে সকাল বেলায় রওয়ানা হত। কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস। গোয়ালন্দ থেকে কানেকটিং স্টিমার সার্ভিস ছিল নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। বিকেল চারটা-পাঁচটার মধ্যে পত্রিকা নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে যেত। তারপর নারায়ণগঞ্জ থেকে আবার ট্রেনে করে ঢাকায় আসত। সুতরাং যুদ্ধের প্রায় তাজা খবরই আমরা পেতাম।

একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, ঢাকা আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। এই ব্যাপারটা আমার মনে করতে ভালো লাগে। ঢাকায় যখন আমি তরুণদের সঙ্গে কথা বলি তখন আমি এ সময়টার কথা বলি তাদের। বলি এ জন্যে যে, মুসলমান সমাজের মধ্যে এসব কথা বলার মতো পুরোনো লোক আর নেই। হিন্দু যাঁরা ছিলেন তাঁরা অনেকেই নিহত হয়েছেন বা ওপারে চলে গিয়েছেন। সেজন্যে বর্তমান প্রজন্মকে আমি এটা জানানোর চেষ্টা করি যে আমাদের একটা সুন্দর সময় ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো মনে করে যে, আমাদের সময়ে শুধু দাঙ্গাই হয়েছে। না, আমাদের সময়ে শুধু দাসাই হয়নি। দাঙ্গা অবশ্যই এখানে হয়েছে, কিন্তু এর বাইরে অন্য অনেক কিছুই করেছি আমরা।

ঢাকা ছিল যুদ্ধের সময়ে একটি পশ্চাৎ ঘাটি। এখন যেখানে ক্যান্টনমেন্ট সেখানে পুরো জায়গাটায় সৈন্যরা ছড়িয়ে ছিল। ধরা যাক, কোনো সৈন্য ফ্রন্টে গেল। সেখানে যুদ্ধে আহত হওয়ার পর এসব সৈন্যকে চিকিৎসার জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হত ঢাকায়। এখন যেটা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল তখন সে বিল্ডিংটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিল্ডিং-এর পুরোটা এবং সলিমুল্লাহ হল মিলিটারিরা দখল করে নেয়। শুধু ফজলুল হক হলটা তারা দখল করেনি।

এই সব সৈন্যদের মধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ক্যাডাররা ছিলেন। অনেকের নাম এখনো মনে করতে পারি। এক মিলিটারি অফিসারের নাম ছিল রাপাপোর্ট। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। নামকরা অধ্যাপক। কিন্তু তখন যুদ্ধে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক বলে তাকেও যুদ্ধ করতে আসতে হয়েছে এশিয়ায়। স্প্রিঙ্গার নামে একজন যুব কমিউনিস্ট ক্যাডার ছিলেন। আরেক জন ব্রিটিশ কমিউনিস্টের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। হয়তো বা ক্লাইভ ব্র্যানসন। বার্মা ফ্রন্টে তিনি মারা গেছেন। তিনি কবি ছিলেন। তাঁর লেখা কবিতা আছে, কবিতা অনুবাদও করা হয়েছে।

সাধারণ সৈন্যরা ঢাকায় এসেই নিষিদ্ধ পল্লীর খোঁজ করত। ইসলামপুর বা আশপাশের এলাকায় মিলিটারি এ্যাডমিনিসট্রেশন আউট অব বাউন্ড লেখা বোর্ড টাঙিয়ে দিত। আউট অব বাউন্ড ফর দি আর্মি। আমি পারসনেরা এখানে যেতে পারত না। তবুও যেত অবশ্য অনেকেই। যেত এবং ধরাও পড়ত। কিন্তু স্প্রিঙ্গার, রাপাপোর্টের মতো সৈন্যরা, মানে কমিউনিস্টরা খুঁজত, ভালো মানুষ কোথায় আছে। ভালো মানুষ পাবার একটি জায়গা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন হল বা হোস্টেল থেকে তারা লোকজন খুঁজে খুঁজে বের করত। কমিউনিস্টদের একটি সিম্বল তো ছিলই : মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত। এটা একটা আন্তর্জাতিক সিম্বল ছিল তখন। এর মানে আমিও একজন। আমি তোমাদেরই লোক।

এ সময়টার খুব সুন্দর সুন্দর স্মৃতি আছে আমার। ফজলুল হক হল আর ঢাকা হলের মাঝখানে যে পুকুরটা এবং তার যে বাঁধানো সিঁড়ি, ওখানে আমরা আড্ডা মারতাম সৈন্যদের সাথে। আড্ডাটা আমাদের অজান্তেই ইন্টারন্যাশনাল হয়ে যেত। চীনে তখন যুদ্ধ চলছে কুওমিনটাং এর সঙ্গে কমিউনিস্টদের চুং কিং ছিল তখন চীন সরকারের হেড কোয়ার্টার। একজন বিমান-সেনা হয়তো সকালে বিমানে করে উড়ে গিয়ে যুদ্ধ করে এসেছে চীনে। সেই সৈন্যই হয়তো বিকাল বেলা চা খেতে খেতে আমাদের সঙ্গে গল্প করছে সেই পুকুরঘাটে : ডু ইউ নো আই ফ্লিউ টুডে টু চুং কিং? সে চুং কিং এয়ারপোর্টে নেমেছে, সেখানেও কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছে। মাও সে তুং বা অন্যদের নাম উচ্চারণ করেছে। ওখানকার কমিউনিস্টরা হয়তো তখন তাকে বলেছে, ডোন্ট টক, ডেঞ্জারাস! এভাবেই আমাদের কিছুটা আন্তর্জাতিকীকরণ হয়ে গিয়েছিল।

যুদ্ধ চলছে তখন। ১৯৪২ সালের কথা। আমরা তখন ফজলুল হক হলে থাকি। ফজলুল হক হলের করিডোরের সিঁড়িঘরে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল আলোচনা হত। সানাউল হক, সৈয়দ নুরুদ্দীন এঁরা সে আলোচনায় আমার সঙ্গী ছিলেন। পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভিন্ন আলোচনা করতাম আমরা। এখন। যেটা গুলিস্তান সিনেমা হল তখন সেটার নাম ছিল গুলিস্তান বিল্ডিং। এই গুলিস্ত নি বিল্ডিং-এ ডি এন ফা বলে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। ডি এন ফার বিপরীতে একটি সিনেমা হল ছিল। হলটির নাম ছিল ব্রিটানিকা। সে যুগে ঢাকার একমাত্র ইংলিশ সিনেমা হল। সৈন্যরা আমাদের নিয়ে যেত সেই রেস্টুরেন্টে। শত শত সৈন্য নয়, কিছু কিছু আরকি! বেশি বেশি খাবারের অর্ডার দিত। অত খাবার খাওয়া যেত না। বাকি খাবার সৈন্যরা আমাদের পকেটে ঢুকিয়ে দিত। আমরা রাজি হতাম না। কিন্তু তারা বলত, ইউ নিড ইট, ইউ নিড ইট।

এই সখ্য থেকে একবার একটা ঘটনা ঘটল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সামনে এখন যে ওভার ব্রিজটা আছে তার পাশে জি ঘোষের লেন বলে একটা লেন আছে। সেখানে একটি বাসায় থাকত কয়েকজন কমিউনিস্ট। বাসাটির নাম দিয়েছিল তারা কমিউন। কমিউন হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে সবাই একসাথে থাকে, এক সাথে খায়। আলাদা কোনো ব্যাপার নেই। আমেরিকান সৈন্যরা একবার দেখতে চাইল, আমরা কীভাবে পাঁচ আঙুল ব্যবহার করে খাই। সৈন্যরা বলল তারাও চামচ ব্যবহার না করে হাত দিয়ে খাবে। কমিউনে দাওয়াত করা হল সেই সব সৈন্যদের। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন চলছে যখন, তখন হঠাৎ কোথা থেকে মিলিটারি পুলিশ এসে ঐ সৈন্যদের ধরে নিয়ে গেল। তাদের শাস্তি কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছিল। মিলিটারি কর্তৃপক্ষ পছন্দ করত না সৈন্যরা সাধারণ লোকজনের সাথে, বিশেষ করে কমিউনিস্টদের সাথে মিশুক। তবুও সখ্যটা তো ছিলই। মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে পরিচয় দেওয়া, বিদায় নেওয়া, স্যালুট দেওয়া, একে অপরকে কমরেড বলা, এসব এখন আর দেখা যায় না, কিন্তু তখন বেশ ছিল।

একবার অধ্যাপক রাপাপোর্ট এসে আমাদের বললেন, হোয়েয়ার ইজ ইয়োর বোস? বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের নাম তিনি শুনেছেন। কতখানি শুনেছেন আমি জানি না। কিন্তু তিনি এসে অধ্যাপক বোসের খোঁজ করলেন এবং জানালেন যে বোসের সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। আমরা তাঁকে নিয়ে গেলাম অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে। তিনি তখন বসতেন কার্জন হলের পশ্চিম সাইডের একটা ঘরে। ঘরটা এখন আছে। সত্যেন বোস একটা রোমান্টিক ক্যারেক্টার। চেহারাটাই রোমান্টিক ছিল তাঁর। দিন দুনিয়া বোঝেন না তিনি। সাম্প্রদায়িক কোনো ভাব তার মনে ছিল না। মুসলমান ছেলেদের কাছে আসতে তিনি কোনো দ্বিধা করতেন না। ছেলেরা বলত, অন্য কেউ কষ্মনাল হতে পারে, সত্যেন বোস কিছুতেই কমনাল হতে পারেন না। কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, তার লেখা পড়ে সত্যেন বোস সবাইকে ডেকে বলেছিলেন, দেখো দেখো, আমার ছেলে এ রকম বাংলা লিখেছে। তোমরা কেউ কি এ রকম বাংলা লিখতে পারো? তখন তিনি কলকাতায় খয়রা প্রফেসর।

সত্যেন বোস সব সময় কাজে ডুবে থাকতেন। কেউ গিয়ে না ডাকলে তিনি তার ল্যাবরেটরি থেকে বাসায় খেতে আসতেন না। খাওয়ার কথা মনেই থাকত না তার অনেক গল্প আছে তার সম্পর্কে। সত্যেন বোস একবার মেয়েকে নিয়ে মুকুল সিনেমায় গেছেন ছবি দেখতে। টিকেট কিনতে গিয়ে দেখলেন যে মানিব্যাগটা তার পকেটে নেই। মানিব্যাগ ফেলে গিয়েছেন তিনি বাড়িতে। তিনি মেয়েকে বললেন, মা তুই এখানে বোস। আমি বাড়ি থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে আসি। এখন যেখানে খন্দকার মোকররম হোসেন লাইব্রেরিটা, সেখানে একটা চাইনিজ প্যাটার্নের বাড়িতে তিনি থাকতেন। তখন যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়ি ফিরে এসে টেবিলের উপর থেকে নিজের মানিব্যাগটা নিতে যাবেন, এমন সময় টেবিলের উপরে পড়ে থাকা একটি আনসলভড প্রব্লেমের দিকে নজর গেল তার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে গেল সেটা সমাধান করতে। মেয়েকে যে সিনেমা হলে বসিয়ে রেখে এসেছেন তা তিনি ভুলেই গিয়েছেন। অনেকক্ষণ পর গাড়োয়ান সাহস করে বলল, হুজুর, আপনি যাবেন না? আপনার মেয়েকে আপনি সিনেমা হলে বসিয়ে রেখে এসেছেন। তখন তার খেয়াল হল। ও, তাই তো! মেয়েকে সিনেমা হলে রেখে এসেছি, চলো চলো। সিনেমা হলের কর্মচারীরা অবশ্য তাঁর মেয়েকে আগেই সিটে বসিয়ে দিয়েছিল। সত্যেন বোস যাবার পর তারা বলল, সিনেমা তো এখনি শেষ হয়ে যাবে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। এ রকম মনভোলা লোক ছিলেন সত্যেন বোস।

৬. কমিউনিস্ট পার্টির নীতি পরিবর্তন

 ১৯৪১ সালের আগে কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ-ভারতে বেআইনি ছিল। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আক্রান্ত হল তখন কমিউনিস্ট পার্টি আইনসঙ্গত হল। আগে কমিউনিস্টদের নীতি ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। কিন্তু হিটলার যখন রাশিয়া আক্রমণ করল তখন তারা নীতি পাল্টাতে বাধ্য হল। কমিউনিস্টরা দেখল, যুদ্ধের চরিত্র বদলে গেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিই পালটে গেছে তখন। ফ্রান্স ততদিনে দখল হয়ে গেছে। যে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড সোভিয়েত রাশিয়াকে তার জন্মকালে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে, এক সময় দখল করারও চেষ্টা করেছে, তারা এখন রাশিয়ার মিত্রশক্তি। সুতরাং আগে যেটা ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন সেটা হয়ে গেছে পিপলস্ ওয়ার। কমিউনিস্টরা ভাবল, পিপলের যেটা আসল দুর্গ সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই যদি হিটলারের হাতে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাবো। সুতরাং তারা তখনকার মতো ব্রিটিশদের বিরোধিতা করা থেকে বিরত রইল, কারণ আমেরিকান আর ব্রিটিশরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগী শক্তি বা এ্যালাইড ফোর্স। আন্তর্জাতিকভাবেই কমিউনিস্টেরা ঘোষণা করল যে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা আপাতত স্থগিত থাকবে। তাদের বর্তমান রাজনীতি হবে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী। ভারতবর্ষে জেলখানাতেই কমিউনিস্টরা তাদের নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিল।

এ অবস্থায় স্বাধীনতা আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী অংশ মনে করল, কমিউনিস্টরা হচ্ছে ব্রিটিশের দালাল। তারা ভাবছে, ব্রিটিশদের এখনি তাড়াতে হবে। যারা তা করবে না তারা সবাই ব্রিটিশদের দালাল। পি সি যযাশী সে সময়ের একজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা। পি সি যোশীর মতো বড় বড় কমিউনিস্ট নেতারা শুধু যে সংগ্রামের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন সে সময় তা নয়, তারা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনকে একেবারে খারিজ করে দিলেন না।

সোমেন চন্দ* [*সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ভারতের প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা রণেন সেনের স্মৃতিকথা; পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য]

কমিউনিস্টদের সঙ্গে কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড, E.S.P.I ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সংঘাতের পরিণতিতে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ সোমেন চন্দ খুন হয়। সোমেন চন্দ একটা সম্ভাবনাময় তরুণ সাহিত্যিক। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। সে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলের ছাত্র ছিল আবার সাথে সাথে ফুলবাড়িয়া স্টেশনের ওয়ার্কশপের শ্রমিক কর্মীও ছিল। কর্মী শুধু নয়, সবার অত্যন্ত প্রিয় কর্মী ছিল সে।

সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে একটি এ্যান্টিফ্যাসিস্ট কনফারেন্স হচ্ছিল ঢাকার এক্রামপুরে। এই কনফারেন্সে বঙ্কিম মুখার্জী ও অন্যান্য সমস্ত নেতা কলকাতা থেকে এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সোমেন তার সঙ্গী বন্ধুদের নিয়ে মিছিল করে যাচ্ছিল সেই কনফারেন্সের দিকে। এর আগে নিশ্চয়ই কিছু গণ্ডগোল হয়েছে ঐ কনফারেন্সের মঞ্চে; বিরুদ্ধপক্ষ মঞ্চ দখল করার চেষ্টা করে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা ফিরে গিয়ে সোমেনের মিছিলকে আক্রমণ করল। মিছিলের অন্য সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সোমেনকে তুলে একটা গলির ভিতর নিয়ে যায় তারা এবং সেখানে ছুরি মেরে ওর চোখ-টোখ উপড়ে ফেলে। কে সোমেনকে খুন করেছে তা জানা যায়নি। আর এসপি স্বীকার করতে চায়নি। কিন্তু অন্যেরা মানে কমিউনিস্টরা বলে, তাকে ফরোয়ার্ড ব্লক, আর এস পি এই সমস্ত অর্থাৎ কংগ্রেসের বামপন্থী অংশের কর্মীরা সোমেন চন্দকে খুন করেছিল। ফরোয়ার্ড ব্লক তখন কংগ্রেসের অন্তর্গত অন্য সব পার্টির মতোই ছিল।

এটা খুব সাংঘাতিক একটা ঘটনা সে সময়ের। গোপাল হালদার, মনোরঞ্জন ভট্টাচাৰ্য্য এরা সবাই অর্থাৎ এমন কেউ ছিল না যে এ ঘটনায় মর্মাহত না হয়েছিল। আমার তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলছে। এই ঘটনাটি আমি সরাসরি দেখিনি, তবে পরে যখন শুনেছি সোমেনের এই আত্মাহুতির কথা তখন খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করেছি। পরবর্তীকালে যখন প্রগতি লেখক সজ্ঞে যাতায়াত করেছি, যখন সোমেন চন্দ দিবস পালন করেছি, তখন এ সমস্ত কাহিনী এসেছে। প্রগতি লেখক সঙ্ সোমেন চন্দের একটি গল্প সংকলন প্রকাশ করেছিল। অশোক মিত্র আই সি এস সোমেন চন্দের একটি গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর মধ্যে একটি গল্পের নাম ইঁদুর (mice)। এই ইঁদুর গল্পে এক মধ্যবিত্ত যুবক তার পারিবারিক কাহিনী বলছে। এই কাহিনীর মধ্যেও এসে যাচ্ছে জীবনের বিভিন্ন দিক এবং দাঙ্গ। সোমেন কিংবা তার গল্পের নায়ক রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখছে রাস্তার উপর রক্তের স্তূপ জমে আছে। কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে কে বা কারা মেরে ফেলেছে। ছেলেটি ভাবছে, এই রক্ত কবে নিঃশেষ হবে।

৭. মুসলিম ছাত্রদের মেরুকরণ

 গঙ্গাধর অধিকারী জি অধিকারী এ সময়ে একটি পুস্তিকা লেখেন : পাকিস্তান এন্ড দি কোশ্চেন অব সেলফ ডিটারমিনিশেন অব দি মাইনরিটিস। অর্থাৎ মুসলমানেরাই একমাত্র মাইনরিটি নয়, আরো মাইনরিটি আছে ভারতে। ভারতবর্ষে একটা পাকিস্তান নয়, দৃশটা পাকিস্তান দরকার। পাকিস্তানপন্থীরা তখন আবুল কালাম আজাদ, হুমায়ুন কবির প্রমুখ জাতীয়তাবাদীদের গালাগালি করছে মুসলিম কমিউনিটির বিদ্রোহী হিসেবে। হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সটারনাল পরীক্ষক হিসেবে আসতেন, দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি পরীক্ষা নিতেন।

মুসলিম লীগের আবুল হাশেম সাহেব এসেছিলেন একটি জাতীয়তাবাদী পরিবার থেকে। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একটা বিশেষ ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন। তাঁর ব্যাখ্যাটা কিছু পরিমাণে সোসালিস্ট। সুতরাং মুসলিম লীগের মধ্যে দুটি উপবিভাগ দাঁড়িয়ে গেল। একটি দল ডানপন্থী আর একটি দল। প্রগতিবাদী। মুসলিমদের মধ্যে যারা প্রগতিবাদী, কমিউনিস্ট পার্টি তাদের পক্ষ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল। পার্টি থেকে সদস্যদের কাছে গোপন নির্দেশ আসত, অমুক প্রগতিবাদী, তুমি ওর কাছাকাছি থেকো। যদি কোনো ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে তবে তাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু যোগাযোগ হয়। হিসাম উদ্দীন আহমদ যিনি পরবর্তীকালে বগুড়া কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন, এখন তো তার আমার চেয়ে বেশি বয়স হয়ে গেছে, ওঁরও এ ধরনের স্মৃতি থাকবে। রবি শুহেরও আছে এসব স্মৃতি। রবি গুহ তার লেখায় নাজমুল করিমের খুব প্রশংসা করেছেন। রবি গুহের সপ্রশংস সব চিঠি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নাজমুল করিম স্মারক গ্রন্থে পাওয়া যাবে। এ সব সূত্র একটির সাথে অন্যটি জোড়া দিলে আপনারা একটি ডেভেলপমেন্ট পাবেন তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির। তখন আপনারা দেখবেন, মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়ের একমাত্র মুসলিম দল হিসেবে ডেভেলপ করেনি। আবুল হাশেমও খাঁটি মুসলিম লীগার ছিলেন না। ছাত্র ফেডারেশন ছিল কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন।

ঢাকা কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থানগত দূরত্ব বেশি ছিল না। তেমন আলাদাও ছিল না এ দুটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আমাদের পরিচয় ছিল। যাতায়াতটাও ছিল। একই রাস্তা তো। আমার বন্ধুবান্ধব, যেমন নাজমুল করিমের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। নাজমুল করিমের এক বন্ধু রবি গুহ। রবি গুহ, নাজমুল করিম আর আমি খুবই মার্কড ছিলাম। মুসলিম লীগ যখন থেকে সংগঠিত হতে শুরু করল তখন থেকেই আমরা তিনজন হয়ে দাঁড়ালাম তাদের অর্থাৎ পাকিস্তানি পক্ষের আক্রমণের লক্ষ্য। মুসলিম লীগের মধ্যে খুব গোঁড়া যারা যেমন, শাহ আজিজুর রহমান কিংবা সালেক বলে একজন ছিল, দে মেইড আস দেয়ার টার্গেট অব এ্যাটাক। আমাদের তারা বলত হকপন্থী অর্থাৎ আমরা শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের সমর্থক।

এ সময়ে একটি ঘটনা ঘটেছিল। যে সময়ের কথা বলছি তখন ফজলুল হক সাহেব মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সাথে মিলিত হয়ে একটা সরকার গঠন করেছেন। এই সরকারের পেছনে ঢাকার নবাব বাড়ির সমর্থন ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ এবং ঢাকার সরদাররা ছিল শ্যামা-হক সরকারের সমর্থক। ফজলুল হক সাহেব একবার ঠিক করলেন যে তিনি ঢাকায় আসবেন। এটা শুনে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট হোস্টেল, ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ হল : ইত্যাদিতে যেসব মুসলিম লীগের ছেলেরা থাকত তারা ঠিক করল হক সাহেবকে তারা বিরূপ সংবর্ধনা দেবে। ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ওরা ঐভাবে অরগানাইজড হল। আর এদিকে নবাব হাবিবুল্লাহ এবং তাঁর অনুগামীরাও অর্থাৎ ঢাকা সিটির যত সরদার, যত স্থানীয় লোক ছিল সবাই একজোট হল। আমরা যারা নিরীহ, মানে আমি সরদার ফজলুল করিম, মোহাম্মদ কাসেম যে এখন তেজগাঁও কলেজের অধ্যাপক, নাজমুল করিমের ছোটভাই লুৎফুল করিম অর্থাৎ আমরা প্রগতিবাদীরা এই দ্বিতীয় গ্রুপটির সঙ্গে থাকব বলে স্থির করলাম।

আমি আমার গ্রুপের মুখপাত্রের মতো ছিলাম, একটু লিডারগিরি করতাম। লিডারশিপ অবশ্য শুরু হয় আরো অনেক আগে থেকে। একবার আমার গ্রুপের সব ছেলে মিলে সারারাত মুকুল সিনেমায় গিয়ে সিনেমা দেখেছি, ভালো ভালো সব সিনেমা মুক্তি, দেশের মাটি ইত্যাদি। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট এর জন্যে আমাদের শাস্তি দিয়েছেন। ছেলেদের যখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাদের বলেছে যে তোমাদের পারমিশন আছে সিনেমা। দেখার? ছেলেরা তখন উত্তর দিয়েছে, সরদার বলেছে। আমাকেই সরদার বানিয়েছে তারা। এই সরদারিটা আমি ভালোই এনজয় করেছি। সাময়িক পত্রিকা, হাতে লেখা ম্যাগাজিন এসব বের করেছি। আমাদের গ্রুপটা ছিল জাতীয়তাবাদী এবং হকপন্থী। একবার আমাদের গ্রুপের কিছু ছেলেকে সুপারিনটেনডেন্ট হল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তখন হক সাহেবের মন্ত্রীসভা ক্ষমতায়। আমরা হক সাহেবের কাছে পিটিশান পাঠিয়ে দিলাম এই মর্মে যে, আমরা হক-পন্থী বলে অর্থাৎ আমরা আপনাকে সাপোর্ট করি বলে আমাদের এমন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ রকম সব ব্যাপার-স্যাপার ছিল তখন।

একদিন আমরা যখন ইন্টারমিডিয়েট কলেজের হোস্টেলে বসে কথা বলছি তখন মুসলিম লীগের গ্রুপটা এসে আমাদের বলল, অমুক তারিখে আমরা ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে ডেমনেস্ট্রেশন দিতে যাবো। তোমরা সেদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমি আমাদের গ্রুপের মুখপাত্র হিসেবে তাদের বললাম, আমরা যাব কি যাব না, তার সিদ্ধান্ত আমরা নেবো। তোমাদের মতামত আমরা শুনলাম, ঠিক আছে। এটা শুনে ওরা খুব ক্ষেপে গেল আমাদের উপর।

হক সাহেব আসেননি সেবার, নবাব হাবিবুল্লাহ এসেছিলেন কলকাতা থেকে। একটা মারামারি হয়েছিল সেদিন দুই পক্ষের মধ্যে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমের সামনে, যেখানে এসে রেলগাড়ির কম্পার্টমেন্টগুলো দাঁড়াত সেখানে। ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট হোস্টেলের মুসলিম লীগপন্থী ছেলেরা সবাই ফুলবাড়িয়া স্টেশনে লুকিয়ে ছিল এই ভেবে যে হক সাহেব বা নবাব হাবিবুল্লাহ যেই ট্রেনে করে এসে প্ল্যাটফর্মে নামবে অমনি তারা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু মুসলিম লীগারদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি সেদিন। নবাববাড়ির পক্ষের লোকেরা অর্থাৎ সব সরদার আর স্থানীয় লোকেরা মিলে বেদম পিটালো মুসলিম লীগপন্থীদের। পিটুনি খেয়ে ওরা নিজ নিজ হলে ফিরে গিয়ে ওরা আবার সেখানে যাদের যাদের হকপন্থী বলে মনে করত তাদের উপর হামলা করল। নাজমুল করিমের বিছানাপত্র সব উপর থেকে নিচে ফেলে দিল, ডাইনিং হলে আমার খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। যদি আমি ডাইনিং-এ খেতে আসি তবে আমাকে চোখা বাশ দিয়ে খুঁচিয়ে মারবেটারবে বলে হুমকি দিল। আমার কলেজে যাওয়াও বোধ হয় বন্ধ করে দেয় তারা। আমার তখন ফাইনাল পরীক্ষা। আমি হোস্টেল ছেড়ে আমার বড় ভাইয়ের কাছে চলে গেলাম।

আমার বড় ভাই মঞ্জে আলী তখন ঝালকাঠির কাছে নলছিটির সাবরেজিস্ট্রার। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক মনোভাবের ছিলেন। হুমায়ুন কবীরের প্রশংসা তিনি কখনো করেননি। তিনি বরং জিন্না সাহেবের প্রশংসা করতেন। তবুও বড় ভাই যখন ঢাকায় আসতেন তখন তিনি এটা। দেখে মোহিত হতেন যে, ছেলেপিলেরা তাঁর ভাইয়ের বেশ প্রশংসা করে। ওরা বলত, ও! আপনি সরদারের ভাই! বলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করত। এটা তাঁর খুব ভালো লাগত। কিন্তু ইতোমধ্যে ঢাকার ঘটনাটা তাঁর কানে গেছে এবং আমার সম্পর্কে তিনি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা শুরু করেছেন। আমাকে দেখে বড় ভাই একটু এ্যাগ্রেসিভ টোনে বললেন, তুমি দুই কলম ইংরেজি শিইখ্যা খুব মাতব্বর অইয়া গেছে, হুমায়ুন কবিরের দলে যোগ দিছো! হুমায়ুন কবির তখন বিখ্যাত। বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন তিনি, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছেন, শ্রমিক আন্দোলনের হুমায়ুন কবিরের বিরোধী পক্ষ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জ্যোতি বসু।

১৯৪১-৪২ সালে মুসলিম লীগ ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। পাকিস্তান আন্দোলন দানা বাঁধছে। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যে মুসলিম লীগ খুব জোরদার হয়ে গেল এমন নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মজহারুল হক আর ফজলুর রহমান–এই দুজনে পাকিস্তান নামে একটি বাংলা পত্রিকা বের করতেন এ সময়। ফজলুর রহমান সাহেবের সাথে আমি ৫৫/৫৬ সালে পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির সদস্য ছিলাম। সেটা অবশ্য আরো পরের কথা।

যেখানে কংগ্রেসের স্লোগান ছিল কুইট ইন্ডিয়া, সেখানে মুসলিম লীগ ধ্বনি তুলল ডিভাইড এ্যন্ড কুইট। ১৯৪২-এ কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন জঙ্গি রূপ নিল। ব্রিটিশ সরকার সবাইকে গ্রেপ্তার করে ফেলল। মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইত্যাদি সব বড় বড় কংগ্রেস নেতাকে হায়দ্রাবাদের একটা প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল। এদিকে বঙ্গদেশে মেদিনীপুর, তমলুক ইত্যাদি জায়গায় স্বাধীন সরকার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। জনগণ টেলিগ্রাফের খুঁটি ইত্যাদি উপড়ে ফেলছে। মহিলা নেতা মাতঙ্গিনী হাজরার কথা পাবেন আপনারা ইতিহাসে। আন্দোলন সাংঘাতিক জঙ্গি হয়ে উঠেছে। উত্তাল চল্লিশ বলে একটা বইয়ে এসব আন্দোলনের কথা লেখা আছে।

৮. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৪২ সালে ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, কেন আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম? প্রধানত আমার মুরুব্বী ছিলেন আমার বড় ভাই। বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স পার্ট ওয়ান করেছেন। আগেই বলেছি, কৃষক পরিবারের ছেলে ছিলাম। অভিভাবকেরা ভাবলেন, কলকাতায় খরচ চালানো কঠিন হবে। বড় ভাইয়ের শিক্ষকেরা সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেমন ধরুন, এস এন রায়। বড় ভাই তাদের কাছে চিঠি লিখে দিতেন–স্যার, আমি আমার ছোট ভাইকে পাঠালাম। আপনি একটু দেখবেন। এই প্যাট্রোনাইজেশনটা তিনি নিজে এখানে যোগাড় করতে পারতেন। সুতরাং আমার ঢাকা আসাই স্থির হল। কলকাতায় কোন রকম ইনস্টিটিউশনাল পরিচয় আমাদের ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে প্রথমে কিছুদিন ইংরেজি বিভাগে ছিলাম। বক্তৃতা শুনলাম কিছুদিন। দেখলাম, কোন্ টিচার কী রকম বক্তৃতা দেন। এখন যেটা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল সেখানে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হত। সব ক্লাসের পাশ দিয়ে ঘুরতাম। করিডোর দিয়ে গেলে এপাশে-ওপাশে বিভিন্ন ক্লাস দেখতে পেতাম। দর্শনের হরিদাস ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শুনে খুব ভালো লাগল। সাংঘাতিক বক্তৃতা। সত্য কী, মিথ্যা কী–এসব নিয়ে তিনি সেদিন আলোচনা করছিলেন। হরিদাস বাবুর কাছে গিয়ে বললাম, স্যার আমি দর্শনে ভর্তি হবো। চলে এলাম দর্শনে। এতে অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমল না, বরং বাড়ল।

কবি জসীম উদ্‌দীন সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। আমি দর্শনের বাইরে অন্য ক্লাসও করতাম। দেখতাম, জসীম উদ্‌দীন স্যারকে ছেলেরা টালাইতেছে। টালাইতেছে মানে ছেলেরা তাকে একটু tease করছে। বা তার সাথে পরিহাস করছে। জসীম উদ্‌দীন স্যার ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না। মাহমুদ হাসান সাহেব তখন সম্ভবত ভি সি। তিনি একদিন করিডোর দিয়ে যেতে যেতে জসীম উদ্‌দীন স্যারের বক্তৃতা শুনে থমকে দাঁড়ালেন এবং ক্লাসে ঢুকে স্যারকে বললেন, মি. জসীম উদ্দীন, ইউ বেটার নট গিভ লেকচার ইন ইংলিশ। শিক রাদার বেঙ্গলি!

তখনকার কিছু ছেলে একটু ইয়ার্কিবাজ ছিল। পলিটিক্যাল সায়েন্সের এক তরুণ পাশ করা শিক্ষক হয়তো ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছেন। ক্লাসে ছেলেরা সেই স্যারকে বলছে, স্যার আপনি বরং বাংলাতেই বলেন। সেই স্যার যখন বাংলায় বলা শুরু করলেন তখন একটু পরে তারা আবার আব্দার করা শুরু করল, না স্যার ইংরেজিই ভালো। স্যার এবার ইংরেজিতে বলতে লাগলেন। পরে এক সময় ছাত্ররা আবার বলল, স্যার আপনি এবার সংস্কৃতে বলুন। কোনো কোনো স্যার সোজা মানুষ ছিলেন বলেই ছেলেরা তাদের এ রকম টালাইতে পারত। কথাটা বললাম এ কারণে যে হরিদাস ভট্টাচাৰ্য্য বা এস,এন, রায়ের মতো অধ্যাপকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করা সম্ভব ছিল না। এ সব বড় বড় অধ্যাপকদের বাগ্মীতার কাছে ছেলেরা দাঁড়াতেই পারত না।

হাদী সাহেব ছিলেন দর্শনের শিক্ষক। তিনি হাউস টিউটর ছিলেন। তাঁর ইংরেজি বক্তৃতা আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছি রেডিওতে পড়ার জন্যে। তিনি আমাকে তাঁর বক্তৃতার ইংরেজি কপি দিয়ে বলতেন, ফজলুল করিম, আপনি দেখেন তো কিছু করতে পারেন কিনা। স্যার আমার লেখা পড়ে খুব প্রশংসা করলেন। আমাকে বললেন : আপনি লিখেছেন তো ভালো। কিন্তু আমি পড়লে কেউ কি বলবে যে ওটা আমার লেখা?

শিক্ষকরা তখন ছাত্রদের খুব দেখাশোনা করতেন। তখন ছাত্র তো খুবই কম। আমাদের দর্শন বিভাগে ছাত্র ছিল পাঁচ কি ছয় জন। তখন অনার্স ছিল তিন বছরের, এম. এ. এক বছরের। ১৯৪৫ এ আমি অনার্স শেষ করি। ১৯৪৫ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষ হল। ঐ যে টি এইচ খান এখনো যার নাম পাওয়া যায় বিএনপির লগে সেই টি এইচ খান আমার ক্লাসফ্রেন্ড। মিসেস আখতার ইমামও আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিলেন। উনি আমার কথা খুব মনে করেন। উনি আমাকে বলেন, আপনি আমাকে লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছেন।

আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সে সময়ে, অর্থাৎ ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দাঙ্গা হয়। সেদিনকার দাঙ্গার কারণটা ছিল এ রকম : কার্জন হলে হিন্দু ছাত্ররা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছিল। সব ছেলেমেয়েরাই গেছে সেখানে, হিন্দু ছাত্ররা যেমন গেছে, মুসলমান ছাত্ররাও গেছে। বোধ হয় মুসলমান ছেলেদের মধ্যে কেউ ইয়ার্কি করার জন্যে কিছু ফুল বা পাতা বা এ রকমের কিছু দোতলার ব্যালকনি থেকে হিন্দু মেয়েদের গায়ে। ছুঁড়ে দিয়েছিল। ঐ এরিয়াটা ছিল হিন্দু ছেলেদের। পাশেই ঢাকা হল। হিন্দু ছেলেরা এতে অফেন্স নেয় এবং মুসলমান ছেলেদের মধ্যে কয়েকজনকে মারধর করে। পরদিন যখন ক্লাস শুরু হয়, তখন মুসলমান ছাত্ররা একত্র হয়ে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে। সেই সময় একটা মারামারি হয়। মারামারির মধ্যে নাজির আহমদ নামে এক ছাত্র ছুরিকাহত হয়। নাজির আহমদের নামে একটি লাইব্রেরি আছে কোথাও। তখন মিডফোর্ড ছিল একমাত্র হাসপাতাল। নাজির আহমদকে মিটফোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্তও দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি হয়তো আমার ভাইয়ের কাছে চলে যাই। এটা একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো হয়েছিল। সব মুসলমান ছাত্রই যে এতে অংশ নিয়েছিল তা নয় তবুও মনে পড়ে ঢাকা হলের ছেলেরা ধেয়ে আসছে আর্টস বিল্ডি-এর দিকে, আর্টস বিল্ডি-এর ছেলেরা পিছিয়ে যাচ্ছে। এ রকম ছোটখাটো দাঙ্গা বা ছুরি মারামারি প্রায়ই হত ঢাকা শহরে। তবে লোকজন যে দলে দলে লাঠিসোটা নিয়ে বের হয়ে দাঙ্গা শুরু করত তা কিন্তু নয়।

৯. ’৪৩-এর মনন্তর

১৯৪৩ সালটি মনে রাখা দরকার। ১৯৪৩ মানেই হচ্ছে বাংলা ১৩৫০।১৩৫০ সালে হয়েছিল সেই নিদারুণ দুর্ভিক্ষ যার নাম ৪৩-এর মন্বন্তর। এই দুর্ভিক্ষটা আমাদের প্রভাবিত করে। এতে যত না কংগ্রেস কর্মী, ফরওয়ার্ড ব্লক, R.S.PI এরা বেরিয়ে আসে, তার চেয়ে বেশি বের হয়ে আসে কমিউনিস্ট কর্মী। যেমন পি সি যোশী, একজন দক্ষ কমিউনিস্ট নেতা। তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপরে বই লিখেছিলেন হু লিভস্ ইফ বেঙ্গল ডাইস?।

আমি তখন সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল–এ সমস্ত নিয়ে পড়াশুনো করছি। একদিন আমার কমরেড এসে বলছে, তুমি কী এত লেখাপড়া করো? হেগেল তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? তোমার মা-বোনেরা যেখানে মারা যাচ্ছে সেখানে তুমি হেগেল পড়ে কী করবে? আমি নিজেও নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এই পাঠ দিয়ে আমি কোথায় যাব? আমাকে ওরা বলছে, তুমি নয়াবাজারে গিয়ে লঙ্গরখানায় ডিউটি দাও। সেখানে গিয়ে দেখ তোমার মা-বোনেরা এসে হাজির হয়েছে। তাদের তুমি খাবার বিতরণ করে দাও। তুমি সেখানে থাকলে অন্যায়-অত্যাচার কম হবে। ঐ দেখ একটা মেয়েকে ধরে পিটাচ্ছে। সুতরাং আমি আমার হেগেলের কাছে থাকতে পারলাম না। পরদিন আমাকে যেতে হল নয়াবাজারে সিরাজদৌল্লা পার্কে। ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় আমি বন্ধুদের সঙ্গে গ্রামেও গিয়েছি রিলিফের কাজে।

এক ঝাণ্ডায় তিন পতাকা

কমিউনিস্টরা লঙ্গরখানা খোলে এবং আরো বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় দুর্ভিক্ষ দূর করার জন্যে। দুর্ভিক্ষে ভূমিকা রাখার কারণে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের প্রধান তিনটি পার্টির একটিতে পরিণত হয়। ১৯৪৫-৪৬-এ নৌবাহিনীর সৈন্যরা যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখন তাদের জাহাজের মাস্তুলের উপর তারা তিনটি ঝাণ্ডা বা পতাকা টাঙিয়ে দেয়। একটি হচ্ছে কংগ্রেসের পতাকা, একটি মুসলিম লীগের পতাকা, একটি কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা। কলকাতা শহরে আশি দিনব্যাপী একটি ট্রাম ধর্মঘট হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। মোহাম্মদ ইসমাইল এই ট্রাম ধর্মঘটের একজন নেতা। এই ধর্মঘট ছিল ব্রিটিশ কোম্পানি ক্যালকাটা ট্রামওয়েজের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বর কোম্পানি। পুরো ট্রাম ব্যবস্থাকে আশি দিন পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা হয়। অবশেষে ট্রাম কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটীদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিছু দাবি তো অবশ্যই মেনেছিল। ট্রাম আবার চালু করার আগে দুই-তিন দিন ধরে লাইন। পরিষ্কার করতে হয়েছিল; মরচে ধরে গিয়েছিল ট্রাম লাইনে। গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে বই লিখেছেন। তারাশঙ্করও লিখেছেন এ বিষয়ে। এভাবে কমিউনিস্ট পার্টি একটা পিপলস পার্টি হিসেবে গড়ে ওঠে।

ফজলুল হক হল থেকে কলাপী নামে একটি পত্রিকা বের করতাম আমরা। নূরুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি পরে রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন এই ম্যাগাজিনের সম্পাদক। ঐ কলাপী-তে ১৩৫০ নামে আমার একটা লেখা আছে। লেখাটা অনেকটা মাসিক ডায়েরির মতো। ১৩৫০ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মাসে দুর্ভিক্ষের ডেভেলপমেন্টটা এতে পাওয়া যায়।

১০. প্রগতিবাদী মুসলিম গ্রুপ

আমাকে দেখতে হবে এ্যাজ এ সেপারেট এ্যান্ড আইসোলেটেড এলিমেন্ট ফ্রম দি মেইন-মুসলিম কারেন্ট। ৪৬-এর নির্বাচনে, এমনকি সিলেটের উপর যখন। গণভোট হয় তখন মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন এরা সবাই অংশগ্রহণ করেছে। আমি বা আমার গ্রুপের কেউ কিন্তু তা করেনি। ঢাকাতে আমরা ছিলাম আবুল হাশেম সাহেবের কমিউনিস্ট গ্রুপের অনুগামী সমর্থক। এই আবুল হাশেম সাহেব বদরুদ্দীন উমরের বাবা। শামসুদ্দীন ছিল কমিউনিস্ট, একেবারে কমিউনিস্ট পার্টির লোক। তখন মুনীর চৌধুরীও আমাদের পাশে এসে গেছে।

মুনীর চৌধুরী

মুনীর চৌধুরী আলিগড়ের ছাত্র ছিলেন* [প্রফেসর আনিসুজ্জামান বলেছেন : মুনীর আসলে ১৯৪৩ সালেই ঢাকায় এসে ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হন।], ১৯৪৬ এ ঢাকায় এসে ইংরেজি বিভাগে ঢুকলেন। তার বাবাও ছিলেন ইংরেজির লোক। আলিগড় যাওয়ার কারণে একাডেমিক্যালি সে হয়তো একটু জুনিয়র হয়ে গেছে আমার তুলনায়। আমি যখন এম. এ. দিচ্ছি সে হয়তো তখন অনার্স দিচ্ছে। মুনীর চৌধুরী। সাহিত্যিক ছিলেন। ঢাকায় কারা কারা সাহিত্যিক তা খুঁজে বের করাই ছিল। আমেরিকান সৈন্যদের একটা কাজ। মুনীরকে তারা খুব পছন্দ করত। রণেশ দাশগুপ্ত বা সত্যেন সেন কীভাবে সাহিত্যিক হয়ে উঠল তা বলা মুস্কিল। তবে তারা সাহিত্যিক হয়ে গেলেন এটা হচ্ছে আসল কথা। মুনীর পরবর্তীকালে জেলেও গিয়েছিল। রণেশ দাশগুপ্ত তাকে কবর নাটক লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সেটা অবশ্য ভাষা আন্দোলনের পরের ঘটনা।

মুনীরের একটা পরিষ্কার পোর্ট্রেট আমাদের সামনে থাকা দরকার। মুনীর ছিল একটা সাংঘাতিক হিউমারিস্ট। আমাদের সঙ্গে যেমন, তেমনি নিজের পরিবারের মধ্যেও। খুব রসিক লোক ছিল সে। আমাদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলত বাপ-মার সাথেও ঠিক সেভাবে মজা করে কথা বলত। মুনীর ছিল মাস্টার স্পিকার, মাস্টার ডিবেটার। ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, জগন্নাথ হল এবং সলিমুল্লাহ হল–এই চারটা হলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে মুনীর জড়িত থাকত। যে কোনো সাহিত্যিক ডিবেটে মুনীর একেবারে মাস্টার। ওর একটা সাইকেল ছিল। যদি একই দিনে তিনটা হলে ডিবেট থাকত তবে একটা হলে ডিবেট উইন করে আর একটা হলে যেত। আমরা সচেতনভাবে ভালবাসতাম তাকে। মুনীরের একটা বাক্য আছে তার আত্মজীবনীতে আমি যদি সরদারদের না চিনতাম তা হলে আমার জীবন কি হত আমি জানি না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মুনীরের নাম দিয়েছিলাম king of words অর্থাৎ শব্দের রাজা। গোঁড়া মুসলিম ছাত্ররা ওকে কমিউনিস্ট বলে মনে করত। কিন্তু মুনীর ওদের সঙ্গে খুব মজা করত। যদি কখনো কোনো জঙ্গিবাদী মুসলিম ছাত্র ওকে একটা কথা বলত, মুনীর অমনি ঠাট্টা করে তাকে উত্তর দিত, আপনারা যা কইছেন তার উপরে আর কথা হয়? তখন ছেলেরা তার কথা বুঝতে না পেরে একে অপরকে জিজ্ঞেস করত, মুনীর কি আমাদের পক্ষে কইল, না বিপক্ষে কইল? হি ওয়াজ সো কিউট। কাউকে সে ভয় পেত না।

মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে মোজাম্মেলের মতো ছেলেরা ব্যতিক্রম। মোজাম্মেল হক, আবদুল খালেক, নাজমুল করিম, সরদার ফজলুল করিম এরা সবাই ব্যতিক্রম। আবুল হাশেম সাহেব পরবর্তীকালে এভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন : কমরেড সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী এরা সবাই আমাদের মোগলটুলীর মুসলিম লীগ অফিসে এসে আমাকে একেবারে আক্রমণই করে বসলেন এই বলে, যে আপনাকে এই কথাটার ব্যাখ্যা দিতে হবে। আমি যখন ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করলাম তন সরদার ফজলুল করিম বললেন : আপনি উপমা দিবেন না। অর্থাৎ আমি যে মেসেল দিয়ে কথা বলতাম এটা তারা পছন্দ করতেন না। আমার সামনে তারা দাঁড়াতে পারতেন না। এসব কথা তাজউদ্দীনের ডায়েরির মধ্যেই পাওয়া যাবে।

যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি, আমি তখনো ছিল। আর্মিতে অনেক ভালো এলিমেন্ট ছিল। ওরা প্রগ্রেসিভ স্টুডেন্টদেরকে বাছাই করে ব্রিটিশ যে খারাপ এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যে যুক্তিযুক্ত–এ কথা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ডিবেট করত। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ওরা আমাদের নিয়ে যেত। ডিবেট হত সেখানে, কোনো মারামারির কোনো ব্যাপার নয়, একদল থাকত ব্রিটিশের পক্ষে, আর এক দল ইন্ডিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে। ডিবেট হত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লিটন হলেও। লিটন হলে ছোট্ট একটি অডিটোরিয়াম ছিল। এসবের বেশ সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো স্মৃতি আমার আছে।

১১. প্রগতি লেখক সংঘ

ঢাকা শহরে প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। এর সাথে আমার সম্পর্ক বাড়তে থাকে। প্রগতি লেখক সংঘের একজন অরগানাইজারও ছিলাম আমি। লেখক তেমনভাবে ছিলাম না অবশ্য, কিন্তু আমি এর ভলান্টিয়ার, অনুগত ছিলাম। প্রগতি লেখক সংঘের ক্রান্তি নামে একটি পত্রিকা ছিল। সোমেন চন্দের ওপর একটি সংখ্যা বের করে ক্রান্তি পত্রিকা। এতে আমার একটি লেখা ছিল ১৯৪৫-এর তারিখ দেওয়া। কলকাতার সোমেন। চন্দ রচনাসমগ্র সঙ্কলনের সম্পাদক একটি নোট দেন আমার লেখাটির নিচে : এই লেখা থেকে প্রমাণ হয় সোমেন চন্দ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও অপরিচিত ছিলেন না, বিচ্ছিন্ন ছিলেন না তাদের কাছ থেকে।

এ ছাড়া যুদ্ধের সময় সোভিয়েত সাহিত্য যা আসত তার অনুবাদ করা আমার একটা হবি হয়ে দাঁড়ায়। সুন্দর সুন্দর সব গল্প। আমি নিকোলাই তিখনভের একটি গল্প অনুবাদ করেছিলাম। গল্পটির নাম একটি শিশুর জন্ম। যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে গল্প। যুদ্ধ চলছে, বোমা এসে পড়ছে। এমনি সময়ে একজন মা মারা যেতে যেতে সন্তান প্রসব করছে রাস্তায়। জীবন ও মৃত্যু যে একসঙ্গে চলে এবং সোভিয়েতরা যে জীবন দিয়ে লড়াই করছে-এটা সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় এই গল্পটিতে।

আমার পার্সোনাল দৃষ্টিটা অন্য কোনো কিছুর দ্বারা রুদ্ধ হতে পারেনি। জওহর লাল নেহেরুর  গ্লিম্পসেস অব দি ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি বইটা আমি বহুবার পড়েছি। আমি ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করি এখনো, আচ্ছা নেহেরু যদি প্রধানমন্ত্রী না হতেন, তা হলেও কি তার নাম থাকতো? মুসলমান ছেলেরা তো নেহেরুকে চিনেই না। যারা চিনে তারা বলে, হ্যাঁ থাকতো, তার ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ইত্যাদি বই তাঁকে একইভাবে বিখ্যাত করে রাখতো। আমি বলি, আর একটি বই আছে নেহেরুর : কন্যার কাছে পিতার পত্র। জেল থেকে কন্যা ইন্দিরাকে যেসব পত্র লিখেছেন নেহেরু সেগুলো সঙ্কলিত হয়েছে। এই বইয়ে। পত্রের মাধ্যমে ইন্দিরাকে রাজনীতিবিদ করে তুলছেন নেহেরু। বইটি যে আমি কতবার কিনেছি আর কতবার হারিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অমৃত দত্ত, সরলানন্দ সেন (মাও সে তুঙের। জীবনী-লেখক) ও অন্যান্যেরা নিয়মিত একটা পাক্ষিক সভায় মিলিত হতেন ঢাকা কোর্টের কাছে একটি বিল্ডিং-এ। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ছিল আবার অচ্যুত গোস্বামীর বাসাও ছিল। সেখানে আমরা মাঝে মাঝে যেতাম। আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে সৈয়দ নুরুদ্দীন, মুনীর চৌধুরী, সানাউল হক, আবদুল মতিন এদের মিটিং-এ নিয়ে যাওয়া। সবাই আমার খুব প্রশংসা করত এই বলে যে আমি খুব বাধ্য ইত্যাদি।

১৯৪৪-৪৫ সালে ক্রমান্বয়ে আমি প্রগতি লেখক সঙ্রে একজন স্বেচ্ছাসেবকে পরিণত হলাম। প্রগতি লেখক সংঘ থেকেই অজিত গুহের সাথে আমার আলাপ। ওয়ারীতে তিনি থাকতেন হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির উলটোদিকের একটা বাড়িতে। বাড়িটার নাম ছিল টয়। নীল রঙের সিরামিক দিয়ে লেখা ছিল বাড়ির নামটা। কিছুদিন আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে। অজিত গুহ জগন্নাথ কলেজের প্রফেসর ছিলেন। কামরুল ভাই অজিত গুহের বাড়িতে পড়ে থাকতেন। আমাদের খুব খাওয়াতেন তিনি। এই যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, আমি তো মনে করি নূরুল হুদা ইজ এ ক্রিয়েশন অব অজিত গুহ। তিনি কতখানি অজিত দার কথা স্মৃতিতে রেখেছেন জানি না। এই যে আলতাফ মাহমুদ, আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা মাহমুদ বা তার শালা, ওর নামটা ভুলে গেছি–এদের সবাইকে অজিত গুহ পালন করতেন নিজের সন্তানের মতো।

১৯৪৫ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি তখন ফজলুল হক হলের ছাত্র। ছাত্ররা ঠিক করল তারা নির্বাচন করবে। হলের স্টুডেন্ট ইলেকশান। প্রত্যেক হলে হয়। আমি ছিলাম একটু গুঁড়ি গুডি টাইপের। কর্মচারীদের মধ্যে আমি আর রবি গুহের খুব জনপ্রিয়তা ছিল। তাদের ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যায় পড়াতাম আমরা। কর্মচারীরা আমাদের খুবই ভক্তি করত, সালাম দিত। শিক্ষকরা ঠাট্টা করে বলতেন, কর্মচারীরা দেখি আমাদের চেয়ে তোমাদেরই সালাম বেশি দেয়, কী ব্যাপার! পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেয়ারার্স ইউনিয়ন হয়েছিল। পরবর্তী কালে শেখ মুজিবুর রহমানও এর সাথে জড়িত হয়েছিলেন।

১৯৪৫ বা ৪৬-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জার্নাল বের হয়েছিল বাংলায়। আগে পত্রিকাটি ছিল বাই-লিঙ্গুয়াল, আমরাই প্রথম বাংলা চালু করি। বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় আমার। প্রবন্ধটার নাম ছিল : সাহিত্যের সমস্যাটা কি? প্রবন্ধটির কথা অনেকে বলেন, বিশেষ করে মুস্তাফা নূরুল ইসলাম এই প্রবন্ধটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। মুনীরও বলত। প্রবন্ধের বিষয় ছিল : সাহিত্যের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক থাকবে কি থাকবে না। সেখানে এই আইডিয়াটি দেবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, রাজনীতি যদি মানুষের জন্যে হয়, তবে রাজনীতিকে অবশ্যই সাহিত্যের জন্যে হতে হবে। লেখাটি কলকাতায় আহসান হাবীব সাহেবের চোখে পড়ে। তিনি তখন সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন। আহসান হাবীব সাহেব তখন আমাকে চেনেনও না। তিনি সওগাতে রিপ্রিন্ট করেন লেখাটি। আমার নানা কথা বইয়ে প্রবন্ধটি আছে।

এভাবে কিছু প্রগতিবাদী উপাদান দানা বেঁধে উঠছিল। পুরোপুরি তারা কমিউনিস্ট–এ কথা বলা যাবে না। তারা প্রো-কমিউনিস্ট। যেমন, এ কে এম আহসান একজন প্রো-কমিউনিস্ট। এমনকি কবির চৌধুরীকেও পুরোপুরি কমিউনিস্ট বলা যাবে না। তিনি লিখেছেন, একবার জ্যোতি বসু এসেছেন বক্তৃতা দিতে। ইচ্ছে হচ্ছে, জ্যোতি বসুর বক্তৃতা শুনতে যেতে কিন্তু তখন তিনি সরকারি চাকরি করেন, সম্ভবত ফুড ডিপার্টমেন্টে। সুতরাং কেমন করে যাবেন? অবশেষে মাথায় ঘোমটা দিয়ে, মানে মাথা ঢেকে বক্তৃতা শুনে এলেন।

১২. এ্যামবিশন কাকে বলে?

১৯৪৫ বা ৪৬-এ একটি অফার আসে আমার কাছে বিলাত যাবার জন্যে। একটা স্কলারশিপ ছিল রিজার্ভড ফর মুসলিমস। আমাকে বলা হল কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং-এ এসে তুমি ইন্টারভিউতে এ্যাটেন্ড কর।

ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে আমি কলকাতায় যাই। কলকাতায় গিয়ে আমি রাইটার্স বিল্ডিং-এ না গিয়ে প্রথমে গেলাম কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। ৮নং ডেকার্স লেনে, এটাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার। সেখানে মুজাফফর আহমেদ (যাকে আমরা কাকাবাবু বলতাম), নৃপেন চক্রবর্তী (যিনি পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, আমার খুব প্রিয় তোক আর কি!)। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি তো বিলেত যাচ্ছি। আমি ফিলসফিতে এম.এ. ও অনার্সে প্রথম শ্রেণী পেয়েছি, আমি মুসলিম। স্কলারশিপটা ফিলসফির জন্যে রিজার্ভড় এবং মুসলমানদের জন্যে রিজার্ভড। সুতরাং স্কলারশিপটা আমারই ছিল।

আমার আশ্চর্য লাগে, উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকটা আমার মধ্যে একেবারে খালি রয়ে গেছে। বিলেত যাব, পাস করে আসব–এসব নিয়ে ভাবতাম না। আমি যেই বললাম, আমি বিলেত যাবো, ওঁরা শুনে হাসতে হাসতে ঠাট্টার ছলে বললেন, আপনি বিলেত যাবেন আমরা আর এখানে বসে ভেরেণ্ডা ভাজবো? আমি বললাম, আমাকে কি করতে হবে? ওঁরা বললেন, কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন। কি করতে হবে বুঝেন না? তো কাঁথা-কম্বল নিয়ে পরদিন আমি পার্টি অফিসে যাইনি কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।

ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন সাহেব (সম্ভবত তখন ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট) ছিলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের অন্যতম সদস্য। তিনি আমার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন। কলকাতা থেকে ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সরদার কেন আপনি গেলেন না? হোয়াই ডিড ইউ নট গো? আমি বললাম, না স্যার আমি দেশ ছেড়ে যেতে আগ্রহী নই। এটা একটা ঘটনা। মাহমুদ হোসেন সাহেব আশ্চর্য হয়েছিলেন। নিশ্চিত স্কলারশিপ পেয়েও বিলাত যেতে চায় না–এ কেমন ছেলে! বলে রাখা ভালো যে, এই ড. মাহমুদ হোসেন ভারতের এক সময়ের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের ছোট ভাই।

১৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের কোর্স ছিল তিন বৎসরের আর এম.এ, কোর্স ছিল এক বৎসরের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু এ দুটি কোর্স দুই বৎসরের ছিল। সিলেবাস থেকে শুরু করে সব দিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বতন্ত্র ছিল। অনেকটা প্রাচীনকালের তপোবনের আদলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে স্বর্ণযুগের কথা এখনকার শিক্ষকেরা জানেন না বা জানলেও স্মরণ করতে চান না। আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্কলনে আপনারা সেসব গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর কিছুটা আভাস পাবেন।

১৯৪৬-এ আমি এম. এ. পাস করি। আমি অনার্স ও এম. এ. তে প্রথম শ্ৰেণী পেয়েছিলাম। হরিদাস ভট্টাচাৰ্য্য তখন অবসর নিয়েছেন। তারপর এস এন রায়ের ভাই বিনয় রায় বিভাগীয় প্রধান। তিনি আমাকে বললেন, তুমিকাল থেকে ক্লাস নেবে। আমি পরদিন থেকে ক্লাস নিতে শুরু করলাম দর্শন বিভাগে। প্রথম দিনের ক্লাসের কথা তেমন মনে নেই তবে তখনো আই ওয়াজ মোর এ স্টুডেন্ট দ্যান এ টিচার। ছাত্ররা সেভাবেই আমাকে গ্রহণ করেছিল।

দর্শন বিভাগের প্রথম দিকের ছাত্রদের কথা আমার মনে নেই তবে ছাত্রীদের একজনের নাম মনে আছে। তার নাম ছিল ঊষা পৈত। পরবর্তী কালে আমাকে সংসারী করলেন আমাদের শফিফের (সাপ্তাহিক যায় যায় দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান) বাবা প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান সাহেব। জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি। সাইদুর রহমান সাহেব সোজা। আমাকে ইন্টারভিউতে নিয়ে গেলেন আমার ভাবী শ্বশুর পরিবারে। তিনি যখন হবু কনেকে জিগ্যেস করলেন, কি মেয়ে, একে চিন? তখন কনে জবাব দিল, ইনি তো আমাদের স্যার ছিলেন। দ্যাট ওয়াজ ইন্টারেস্টিং!

১৪. মুসলিম লীগের জঙ্গি গ্রুপ

এদিকে মুসলিম লীগ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে শাহ আজিজুর রহমান, এস এম সুলতানের নেতৃত্বে মুসলিম ডানপন্থীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। ছাত্রদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ডানপন্থীরা তখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, ছাত্রদের মধ্যে বাম মনোভাবাপন্ন করা আছে। মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, নাজমুল করিম, তার ভাই লুৎফুল করিম, আবুল কাসেম, আবদুল মতিন (যিনি পরবর্তীতে জেনেভায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন) কে তারা প্রথমত পয়েন্ট আউট করার চেষ্টা করে। মুসলিম লীগের মধ্যে যারা একটু জঙ্গি মনোভাবাপন্ন তারা একটা কাউন্সিল দাঁড় করিয়েছিল। এই কাউন্সিলটা পরিচিত ছিল ফ্যাসিস্ট কাউন্সিল হিসেবে। ১৯৪৫-৪৬ সালে এরা আমাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তখন আমি ফজলুল হক হলে থাকি টিচার হিসেবে।

১৯৪৫-৪৬ সালে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে স্পষ্টত দুটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেল। একটা গ্রুপকে কমিউনিস্ট বলা হচ্ছে। তারা কিন্তু নিজেদের বলছে, জাতীয়তাবাদী বা হক-পন্থী। হক-পন্থী হিসেবে আমি আক্রান্ত হয়েছি। আমি একাই যে আক্রান্ত হয়েছি তা নয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের বড় ছেলে সফিয়ুল্লাহ তখন কমিউনিস্ট। শহীদুল্লাহ সাহেব একজন ডেমোক্রাট। পরিবারের ভিতরেও তিনি ডেমোক্রাট। সফিয়ুল্লাহ তখন আন্ডার গ্রাউন্ডে কাজ করছে। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সরকার, মানে তখনকার সমস্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ–এরা সবাই শহীদুল্লাহ সাহেবকে গিয়ে বলেছে, কনট্রোল ইয়োর সান। শুনে শহীদুল্লাহ সাহেব তার স্বভাবসুলভ নাকী সুরে উত্তর দিয়েছেন, অ্যাঁ হাউ কেন আই ডু ইট? সে এখন বড় হয়েছে, তার ডিসিশন সে নেবে।

শহীদুল্লাহ সাহেব ছেলেকে ভর্ৎসনা করেননি। যখন পুলিশ কিংবা ব্রিটিশ সরকার তাঁর ছেলেকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছে তখন তিনি এই ভাবটাই দেখিয়েছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব থাকতেন এখনকার সাইন্স এ্যানেক্সের পাশে চাইনিজ ধরনের একটি বাড়িতে। এটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি হলের প্রভোস্টের কোয়ার্টার। সফিয়ুল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টি করত বলে মুসলিম লীগাররা শহীদুল্লাহ সাহেবের কোয়ার্টারে গিয়ে তাঁকেও অপমান করেছিল।

সেই সুন্দর মুখ : মতি

 ফ্যাসিস্ট গ্রুপটা একবার জঙ্গিভাবে আক্রমণ করল মুনীরকে। তাকে তার রুম থেকে বার করে দিল। মুনীর চৌধুরীর বিছানাপত্র তারা পুড়িয়ে দিল, বইপত্র তছনছ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মুনীরের এক খালাতো ভাই ছিল রফিকুল ইসলাম। তার ডাক নাম মতি। সে জগন্নাথ কলেজে বিজ্ঞান পড়ত। এখন আর নাই সে, কিছুদিন আগে সে মারা গেছে। এই রফিকুল ইসলাম আমাদের পরিচিত অর্থনীতির টিচার এম এম আকাশের বাবা। মুনীরের ঘরটায় যেদিন ভাংচুর করা হয় তার পরদিন দেখা গেল উল্টাপালটা সব বিছানাপত্র আর বইয়ের স্তূপের মধ্যে বসে মতি একটা বই পড়ছে। বিরোধী পক্ষ তো ঘরটার উপর নজর রাখছিল, কারা সে ঘরে আসে তারা দেখবে। তারা যখন দেখল মুনীরের ঘর খোলা এবং মতি বইয়ের তূপের উপর বসে মনোযাগ দিয়ে একটা। বই পড়ছে তখন তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করছেন এখানে?

মতি ছেলেটা খুব হাসিখুশি আর বুদ্ধিমান ছিল। সে উত্তর দিল আমি একটা বই পড়ছিলাম। কি বই–প্রশ্ন করাতে মতি জানাল, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভলগা থেকে গঙ্গা। জঙ্গি গ্রুপের ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, এই বই আপনি আগে পড়েন নাই? মতি উত্তর দিল, হ্যাঁ আগেও পড়েছি। তবে আজ আবার কি পড়ছেন? আজ বর্বর যুগটা একটু ভালোভাবে পড়ে দেখছিলাম। এত সুন্দরভাবে স্মার্টলি উত্তরটা দিল মতি।

এতে বোঝা যায়, ছাত্রদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট গ্রুপটা বা ডানপন্থীরাই একমাত্র গ্রুপ ছিল না। এর কালচারাল রিফলেকশানটা আপনারা ঐ সময়কার বিভিন্ন ম্যাগাজিনে পাবেন। টিচারদের কাছে আমি, মুনীর এরাই ছিলাম সাংঘাতিকভাবে ফেভারিট। তখন ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন এ. জি, স্টক। আগে ছিলেন ইহুদি একজন, এ্যান্ডারসন না কি যেন নাম ছিল তাঁর। এরা সবাই পছন্দ করতেন আমাদের।

নাজমুল করিম আর রবি গুহ পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র। তারা আবদুর রাজ্জাক সাহেবকে পিক আপ করেন জ্ঞানী লোক হিসেবে। রাজ্জাক সাহেব ক্লাসের মধ্যে যা আলোচনা করেন, তার অধিক আলোচনা করেন ক্লাসের বাইরে। বাড়িতে গেলে তিনি ছাত্রদের খাওয়ান। আমাদের তিন জনেরই প্রধান আকর্ষণ ছিল ছুটির দিনে রাজ্জাক স্যারের বাসায় যাওয়া, নানান কথা বলা, নানান বই নিয়ে আলোচনা করা। সেই হিসেবে ১৯৪৪-৪৫ সালেই তাঁর সাথে আমার পরিচয়।

১৫. কমিউনিস্ট পার্টি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ভারতবিভাগ

কমিউনিস্ট পার্টিকে আমি একটি পরিবারের মতো দেখতাম। মেম্বাররা ছিল ভাইয়ের মতো। যেমন, রবি গুহ কিছুই আমাকে ছাড়া খেতো না; পূজার প্রসাদও আমাকে দিয়ে, তারপর খেতো। কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার কেউ হতে চাইত না। ভাবতো, আমি মেম্বার হওয়ার উপযুক্ত নই। পার্টি মেম্বার করতে চায় কিন্তু কর্মীরা মেম্বার হতে চায় না–এ রকম ছিল অবস্থা। উচ্চ ধারণা ছিল সবার কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে। সমাজ বদলাতে চাই আমরা, সে জন্য কষ্ট করতে হবে, যদি না পারি তা করতে, তবে মেম্বার হবো কি করে? আমি নিজেকে পার্টির মেম্বার হিসেবে কোনোদিন দেখিনি। আমি মেম্বারশিপ ফি দিলাম, তারা আমার কাছ থেকে ফি নিল–এটা কখনো হয়নি। আমি ছিলাম ঘরের ছেলে। আমার সম্পর্কে তেমন কোনো প্রশ্নও কখনো ওঠেনি।

এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। একবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে একজন কমরেডকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের পর কমরেডের এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করে, এখন কি করবি? বহিস্কৃত কমরেড উত্তর দেয়, কি আর করবো, বাইরে থেকেই কাজ করবো। অর্থাৎ এরা এ্যান্টি কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কিছু করার কথা চিন্তাও করতে পারত না। আদর্শ, অঙ্গীকার, স্বপ্ন এসব কিছু মিলিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনটা একটা ফ্যামিলি জাতীয় ব্যাপার ছিল। কীভাবে, কোথা থেকে ফান্ড আসত তা আমরা জানতাম না। কিন্তু পার্টির পত্রিকা স্বাধীনতা আমরা বিক্রি করতাম। আমি বিক্রি করেছি, মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী বিক্রি করেছেন। চার পয়সা দাম ছিল এর চার পৃষ্ঠার পত্রিকা। হিন্দু, মুসলিমসহ সবার মধ্যে একটি একটি ইউনিটি গড়ার স্বপ্ন দেখত কমিউনিস্ট পার্টি। তারা ভাবত, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য ছাড়া তো আমরা কিছুই করতে পারব না। কমিউনিস্ট নেতা পি সি যোশী, শ্রী রাজা গোপালচারী, গান্ধীজি আর জিন্নার মধ্যে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। এভাবে কমিউনিস্ট পার্টি পিপলস্ পার্টি হিসেবে পরিচিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি এমন একটি পার্টি যেটি জনগণের কাছাকাছি থাকে।

৪৭ সাল এগিয়ে আসছে। ৪৫-৪৬ এ ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে কথা হচ্ছে। জিন্না সাহেব আর গান্ধীজির মধ্যে টানাপড়েন চলছে। আবুল হাশেম সাহেবের গ্রুপ আর সুভাষ বোসের ভাই শরৎ বসু মিলে একটু চেষ্টাও করছে। যেন ডিভিশনটা বন্ধ করা যায়, কেননা হাশেম সাহেব হচ্ছেন বর্ধমানের বিখ্যাত একটি জাতীয়তাবাদী পরিবারের লোক।

ঢাকার কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, ঢাকা তো বরাবরই তৎকালীন ইতিহাসে দাঙ্গার শহর হিসেবে অপখ্যাত ছিল। দাঙ্গার আবহাওয়া শুরু হয়ে। গেছে তখন। সব সময় একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আতঙ্কে আমরা আতঙ্কিত থাকতাম। দাঙ্গার সময় কমিউনিস্ট এলিমেন্টদের কাজ ছিল শান্তির দিকে খেয়াল রাখা, শান্তিমিছিল বের করা। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল ছিল তারা এতে যোগ দিত। ফরিদ আহমেদ, শাহ আজিজুর রহমানও শান্তি মিছিলে যেত বলে মনে পড়ছে।

তখন জঙ্গি গ্রুপটা নানা এ্যাকশানে যাচ্ছিল। রায় সাহেবের বাজার আর নবাবপুর-এর মাঝখানে ছিল একটা খাল। সেই খালের উপর ছিল নবাবপুর ব্রিজ। নবাবপুর ব্রিজের কাছে নবাবপুর মসজিদটা এখনো আছে কিন্তু নবাবপুর ব্রিজটা এখন আর নেই। এই ব্রিজের দুই পাশে ছিল হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের মতো ব্যাপার। নবাবপুর সাইডটা হচ্ছে হিন্দুস্তান আর রায় সাহেবের বাজারটা হচ্ছে পাকিস্তান। ওটা একটা সাংঘাতিক পয়েন্ট ছিল। আর্মড ফোর্স যখন আসত তখন একটা সাইড দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়াত আর একটা সাইড উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়াত।

১৯৪৭ এ ব্রিটিশরা চলে গেল। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ইন্ডিয়া স্বাধীন হয়ে গেল। ঠিক হল, পাকিস্তান আর ইন্ডিয়া কমনওয়েলথের। মধ্যে থাকবে। রানী কমনওয়েলথের প্রধান। এ ছাড়া রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন। ১৪ আগস্টে মিছিল একটা নিশ্চয়ই বের হয়েছিল। তাতে কংগ্রেসও জয়েন করেছিল। কিন্তু তাদের তেমন উৎসাহ ছিল বলে মনে হয় না। আমরাও যে খুব উৎসাহের সঙ্গে এতে যোগ দিয়েছি তা নয়। তবে আমরা সব সময় লক্ষ রেখেছি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাতে না শুরু হয়। নবাববাড়িতে মিটিং হয়েছে। নবাববাড়ি যেহেতু প্রো-হক ছিল সেহেতু ওরা আমাদের সাহায্য করেছে।

পাকিস্তান হবার পর বেশিরভাগ হিন্দু টিচার ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছেন ঢাকা থেকে। আবহাওয়াটা খারাপ হয়ে উঠছে। অপশন দেওয়া হচ্ছে। কোথায় থাকবেন? এখানে না ওখানে? ওখানকার মুসলমান কর্মচারীদেরও অপশন দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশটা সাংঘাতিকভাবে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অনেক হিন্দু টিচার চলে গেলেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ বিখ্যাত হিন্দু শিক্ষক যেমন ডি এন ব্যানার্জী, অমিয় চক্রবর্তী, এঁরা প্রায় সবাই কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছিলেন। দেশভাগ হওয়ার পর এঁরা খুব ফ্লাইটেন্ড হলেন। একটা অপশান দেওয়ার ব্যাপার দাঁড়াল : আপনারা এখানে থাকবেন, নাকি ওখানে? অনেকে চলে গেলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের একটা সঙ্কট দেখা দেয়। রাজ্জাক সাহেবের স্মৃতিকথার মধ্যে এ ব্যাপারটি আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বালীন উপাচার্য মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব যখন শিক্ষক সংগ্রহের জন্যে বিলাত যান তখন রাজ্জাক সাহেব বিলাতে। রাজ্জাক সাহেব তাঁকে বলেছিলেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে টিচার দিচ্ছি। রাজ্জাক সাহেব তখন লাস্কির সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করলেন। লাস্কির তিনি ছাত্র এবং সহকর্মী ছিলেন। লাস্কি*[* হারল্ড লাস্কি : দ্রষ্টব্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা : ২য় মুদ্রণ, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০২; পৃ.৮৮] তাঁর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন।

১৬. আমাদের সভা আক্রান্ত হল

৪৭-এর শেষে বা ৪৮ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। তখন পাকিস্তান হয়ে গেছে। সদর ঘাটের বাধটা যেখানে, তার পূর্ব দিকে একটা পার্ক ছিল। পার্কটার নাম ছিল লেডিজ পার্ক। ঐ লেডিজ পার্ক ছিল একটা মিটিং প্লেস। মাঝে মাঝে সভা হত ওখানে। ওখানে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় অবস্থার উপরে আলোচনা করার জন্যে একদিন একটি মিটিং আহ্বান করে। ঐ সভায় সরদার ফজলুল করিম ওয়াজ টু প্রিসাইড ওভার দি মিটিং এ্যান্ড মুনীর চৌধুরী ওয়াজ টু স্পিক। অন্য কমিউনিস্ট নেতা যারাই থাকুন না কেন–এই দুই জনই ছিল প্রধান।

আমরা মিটিং শুরু করতে যাবো, তখন দি মিটিং ওয়াজ এ্যাটাকড বাই শাহ আজিজুর রহমান গ্রুপ। সুলতান হোসেন খানও আক্রমণকারী গ্রুপের ছিলেন। এই জঙ্গি গ্রুপটা আমাদের মিটিং ভেঙে দিল। লাঠিপেটা করল আমাদের। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আমাদের দৌড়ে পালিয়ে আসতে হল। পালিয়ে আমরা আশ্রয় নিলাম এখন যেটা বার লাইব্রেরি তার উত্তর দিকের একটা দোতলা বিল্ডিং-এ। এটা ছিল ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। আমি আর মুনীর ওখানে আশ্রয় নিলাম। শাহ আজিজেরা ওখানে গিয়েও কিছু ইট-পাটকেল ছুঁড়ল আমাদের দিকে। তারপর তারা চলে গেল।

আর একটা ঘটনা ঘটেছিল এ সময় রথখোলায়। নবাবপুরের মাঝামাঝি জায়গায় রথখোলা নামে একটা জায়গা ছিল। এখন ট্রাফিক পুলিশ যেখানে দাঁড়ায় সে জায়গাটা। সেখানে কলকাতার ন্যাশনাল বুক এজেন্সির একটা শাখা খোলা হয়েছিল। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি কমিউনিস্ট প্রকাশনা বিক্রি করত। কাকাবাবু মানে মুজাফফর আহমেদ এই ঢাকা শাখাঁটির উদ্বোধন করেন। এই সময়ে এই শাখাটার উপরেও হামলা হয়। বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। এটাও একটা ঘটনা।

১৭. অধ্যাপনায় ইস্তফা

১৯৪৭ পর্যন্ত কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন অন্যরা। বড় বড় নেতারা ছিলেন অনেকে যাদের নাম আপনাদের কাছে বলে লাভ নেই কিছু। আপনারা চিনবেন না, মনেও রাখতে পারবেন না। পুলিশের চোখ ছিল তাদের দিকে। আমি তো কেউই ছিলাম না। আমি খাইদাই, সংস্কৃতি করে বেড়াই। মিছিলে প্রসেশানে যাই। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল এটা জানা যে, মুসলমানদের মধ্যে কারা কারা কমিউনিস্ট। কারণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো সাধারণ মুসলমানেরা করবে না। সুতরাং খুঁজে বের করতে হবে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী কারা। বেশিরভাগ হিন্দু কর্মী ভারতে চলে গেছে, অনেকেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কারা কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করে বা কারা কারা কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত তা জানতে হবে! মুসলমান অফিসারেরা তো চেনে না মুসলমানদের মধ্যে কারা কারা কমিউনিস্ট। তাই গভর্ণমেন্টে হিন্দু অফিসারদের অনুরোধ করে বলল, তোমরা আরো কটা দিন থেকে যাও পাকিস্তানে। তোমরা ভারতে যাবার আগে আমাদের চিনিয়ে দিয়ে যাও, মুসলমানদের মধ্যে কারা কারা কমিউনিস্ট। এভাবেই আমাদের নাম প্রথম পুলিশের খাতায় আসে।

তখন পার্টি একদিন আমাকে বলে, তুমি তো চাকরি করে কাজ করতে পারবে না। পুলিশ তোমাকে খোঁজ করছে। চাকরি ছেড়ে দাও। আমি তো বাধ্য কর্মী। একদিন বিভাগীয় প্রধানের কাছে একটি দরখাস্ত দিলাম। দরখাস্ত খুলে তিনি অবাক হলেন। ওটা ছিল আমার পদত্যাগপত্র। উনি বললেন, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ইট? আমি বললাম, স্যার একটা ডিসিশন হয়ে গেছে। এটা আর বদলানো যাবে না। আমি যেমন সহজে শিক্ষক হয়েছিলাম তেমনি সহজে শিক্ষকতার কাজ ছেড়েও দিয়েছিলাম। অন্যান্য শিক্ষকেরা তাতে অবাকই হয়েছিলেন একটু। হরিদাস বাবু বলেছিলেন, আই হ্যাভ নেভার সিন এ বয় লাইক হিম। মানে এ ছেলে একটু অন্য পথে হাঁটে।

আমি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে পার্টির কাজে চলে এলাম। আমি একটা গোবেচারি ছেলে, কমিউনিস্ট নেতারা আমার মতন একটা মুসলমান ক্যাডার পেয়েছে এটা তাদের জন্যে আনন্দের ব্যাপার। ইউনিভার্সিটির হিন্দু প্রফেসর যারা তাদের তো একটা পারিবারিক ট্র্যাডিশন আছে আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়ার। কিন্তু একটা মুসলমান ছেলে এ রকমভাবে হাতের চাকরি ছেড়ে দিল এটা অমুসলমান টিচারদের যতটা টাচ করেছে মুসলমান টিচারদের ততটা করে নাই। বলা যায় যে, ব্যাপারটা মুসলমান টিচারদের আদৌ টাচ করে নাই, কিন্তু হিন্দু টিচারদের সাংঘাতিকভাবে টাচ করেছে।

আমার রেজিগনেশন দেওয়ার এই খবরটা যে গভর্ণমেন্টের কাছে পৌঁছেছিল তার প্রমাণ আছে। আমার যে পার্সোনাল ফাইল তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আছে। সেখানে আমি দেখেছি যে তকালীন গভর্নমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে এক্সপ্ল্যানেশান চেয়েছে : হোয়াই সরদার ফজলুল করিম হ্যাঁজ রিজাইনড? তার ঠিকানা এখন কোথায়, তোমরা আমাদের জানাও।

জীবিকার সমস্যা কখনোই ছিল না আমার। ছাত্রাবস্থায় স্কলারশিপ পেতাম। তা দিয়ে চলতাম। মাস্টার যতদিন ছিলাম ততদিন মাইনে পেতাম। বোনের বাড়িতে থাকতাম, খেতাম। যা লাগবে বড় ভাই-ই দিতেন। পরীক্ষার আগে তিনি আমাকে দোয়া করে যাবার জন্যে ঢাকায় আসতেন। কখনো জিজ্ঞেস করতেন, তোমার কিছু লাগবে না? আমি রসিকতা করে জবাব দিতাম, যা লাগবে তা তো তৈরি করছি। পড়াশুনো করছি, আর কি করব? জামাকাপড়ের খুব একটা চাহিদা আমার কখনো ছিল না।

চাকরি ছাড়ার খবরটা বড় ভাই পরিবারের কাছে পৌঁছিয়েছিলেন। আমার চাকরি ছেড়ে দেবার খবর শুনে বাবা আর বড় ভাই ঢাকায় এলেন আমাকে খুঁজতে। বাবা তখন বুড়ো হয়েছেন। বড় ভাইয়ের চাকরি আছে, তবুও তিনি এসেছেন। বড় ভাই আমার হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট বিনয় বাবুর কাছে গিয়ে। বললেন, দেখেন তো আমার ভাইটা কেমন হয়ে গেল! ও কি করছে না করছে, আপনি ওর সম্পর্কে একটু চিন্তা করেন, একটু বলেন ওকে। তখন বিনয় বাবু উত্তর দিলেন, দেখেন, ও আমার ছেলের চাইতে বেশি। ওর রেজিগনেশন লেটার, ওটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আপনারা তো ওকে ফিরাতে পারবেন না।

বাবা আর বড় ভাই সিদ্ধেশ্বরী এলাকার এক বাসায় পেল আমাকে। যেখানে এখন মৌচাক মার্কেট, সে জায়গাটা তখন জঙ্গলের মতো ছিল। ওখানে আমার এক ছোট ভগ্নিপতি থাকত। ফরেস্ট অফিসে কাজ করত সে। ও আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। বনজঙ্গলের মতো ছিল বলে জায়গাটা সেফ ছিল, ওখান থেকে আমি আমার পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম। বাবা তখন বৃদ্ধ মানুষ। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই একটা পাগল। তুই এগুলো কি আরম্ভ করেছিস? তোকে আজ আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। বাড়ি যেতে হবে।

আমি ধরা পড়ে গেলাম। বড় ভাই আর বাবার হাতে আমি ধরা পড়ে গেলাম। আমার তখন মনে একটাই প্রশ্ন, এই বন্ধন থেকে আমি কীভাবে মুক্তি পাবো? আমার বাবা আর বড় ভাইয়ের হাত থেকে আমি কীভাবে মুক্তি পাবো? আমি তখন অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন মাগরেবের নামায শুরু হবে এবং বাবা আর বড় ভাই কখন নামায পড়তে যাবেন। আমি ঠিক করলাম, সেই সময়টাতেই আমি পালাব।

আমি জানতাম, তারা যদি আমাকে জোর করে বাদামতলীর ঘাটে স্টিমারে নিয়ে ওঠায়ও, তবুও তো ওঁরা আমাকে বরিশালে নিয়ে যেতে পারবেন না। স্টিমারঘাটে ইন্টেলিজেন্স আছে, পুলিশ আছে। তারা আমাকে ফলো করছে। যে মুহূর্তে ওরা আমাকে জাহাজে ওঠাবে সঙ্গে সঙ্গে তো জাহাজ ছেড়ে দেবে না। জাহাজে এজেন্ট আছে, আই বি আছে, ওয়াচার আছে। তারা তো সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পয়েন্ট আউট করবে : এই যে, সেই লোক যাচ্ছে। সরদার ফজলুল করিম যাচ্ছে। এখন জাহাজে আছে। ওরা আমাকে ধরে ফেলবে। যে স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে আমার বাবা আর ভাই আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, তাতে বড় রকমের আঘাত আসবে। এটা সম্ভব হবে না। আর পুলিশ এ্যাডমিনিস্ট্রেশানের পক্ষ থেকে আমাকে ফলো করার এত সব ব্যাপার বাবা আর বড় ভাই চিন্তাও করতে পারতেন না। ওঁরা ভাবছিলেন, ও পাগল হয়ে গেছে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। পাগলটাকে আমরা নিয়ে যাই। বাবা সেই প্রথম ঢাকায় এসেছেন। বাবাকে বড় ভাই নিয়ে এসেছেন শুধু আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন বলে। আমি আমার শেল্টার থেকে পালালাম, কোথায় গিয়েছিলাম, আজ এতদিন পরে আর বলতে পারছি না, হয়তো কোনো বন্ধুর বাসায় হবে। আজ এতদিন পরে মনে হচ্ছে, আমি সেদিন ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। যদি আমি সেদিন না পালাতাম তবে নট ইন ১৯৪৯, আই উড হ্যাভ বিন এ্যারেস্টেড ইন ১৯৪৮।

আপনাদের কাছে মনে হবে, মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি ছেলে কমিউনিস্ট হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটিকে দেখি এভাবে : একটি জীবন নানান উপাদানের সমন্বয়ে আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। আমার গ্রামের প্রাশেই ছিল হিন্দুপাড়া। হিন্দুপাড়াগুলো যেন কেমন-কেমন ছিল, আলাদা একেবারে। টাউনের মতো মনে হত সেখানে গেলে। সেখানে আমার হিন্দু বন্ধুবান্ধব ছিল। সেখানে আমি বন্ধুদের সাথে একসাথে খেয়েছি। মা দুই থালায় আমাদের ভাত দিয়েছে। একই জায়গায় একই আসনে।

১৮. হিন্দু মায়ের মুসলমান ছেলে

একটা ঘটনার কথা বলি। আমার বড় ভাই মঞ্জে আলী তখন রহমতপুরে সাবরেজিস্ট্রার। সাবরেজিস্ট্রার একজন বড় অফিসার। তা ছাড়া বড় ভাই খুব সামাজিক লোক ছিলেন। সবার বাড়িতে যেতেন। এক হিন্দু জমিদার ছিলেন রহমতপুরে। সেই জমিদারের প্রাপ্তবয়স্ক বড় ছেলে অকালে মারা গিয়েছিল। আমার বড় ভাইয়ের যাতায়াত ছিল সেই বাড়িতে। বড় ভাই একদিন সে বাড়িতে গেলে পরে সেই জমিদারের বৃদ্ধা স্ত্রী কেঁদে ফেলেন। বড় ভাইকে দেখে তাঁর নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। তখন বড় ভাই তাকে প্রবোধ দেন এই বলে, আপনি কাঁদেন কেন! আমিই তো আপনার বড় ছেলে। শুনে ভদ্রমহিলা শোক ভুলে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তুই-ই আমার ছেলে। এটা একটা ঘটনা। একজন মুসলমান বলছে এক হিন্দু মহিলাকে : মা, আমি আপনার ছেলে। বড় ভাই তখন দাড়ি রাখেন।

একদিন বড় ভাই আর আমি মাগরিবের নামাযের সময় গেছি সে বাড়িতে। সময়টা হিন্দুদের সন্ধ্যাফিকেরও সময়। আমার বড় ভাই মহিলাকে বললেন, মা, আপনার বোয়া কাপড়টা দিন তো। কাপড়খানা বিছিয়ে আমি নামাযটা পড়ে নিই। এক ঘরে সন্ধ্যাহ্নিকের কাঁসর-ঘণ্টা বাজছে আর তার পাশের ঘরে বড় ভাই নামায পড়ছেন! আমি বলতে চাই, এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটা উপাদান, এই যে সমন্বয়-বন্ধুত্ব কিংবা আত্মীয়তা। তিনি মুসলমান হয়ে এক হিন্দু মহিলার কাপড়ের উপর নামায পড়ছেন, পাশে কাঁসর ঘণ্টা বাজছে।

এ ঘটনার কথা আমি যখন লিখি ১৯৭২ সালের দিকে তখন লেখাটা বড় ভাইয়ের* [*বড় ভাই : মন্ত্রে আলী সরদার : জীবনকালে উচ্চপদে সরকারি কর্মচারী ছিলেন : জন্ম আনু : ১৯০৬, মৃত্যু : ১৯৯১। এই বড় ভাই-এর একটি যুবক সন্তান হমায়ুন ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করে। কেবল আমার বড় ভাই-এর ছেলে নয়, আমার মেজ বোনের একটি ছেলেও নিহত হয়েছে ২৫ মার্চের পরে বোধ হয় এপ্রিল মাসে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে লঞ্চে, পাকিস্তান বাহিনীর বিমান আক্রমণে, ওর নাম ছিল জাহাঙ্গীর।] নজরে পড়ে। হয়তো কেউ লেখাটার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, করিম তুমি কী সব লেখো, আমাকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারো না?। তিনি না পারেন স্বীকার করতে, না পারেন অস্বীকার করতে। তিনি বিব্রত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি তো আর পলিটিশিয়ান না যে ঘটনাটা বেমালুম অস্বীকার করবেন। তার অনেক হিন্দু শিক্ষক ছিলেন, অনেক ভালো হিন্দু শিক্ষক, তাদের তিনি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। আমাকে তিনি গৌরবের সঙ্গে তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমাকে তিনি ভালবাসতেন এই জন্যে যে ভাইদের মধ্যে অন্তত একটাকে পাওয়া গেছে।

১৯. ভাষা আন্দোলন

 ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস এ্যাক্ট অনুসারে ভারত ও পাকিস্তানে একটি করে কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি গঠন করা হয়েছিল। ইন্ডিয়াতে বছর এক-দুইয়ের মধ্যে কনস্টিটিউশান তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু পাকিস্তানে তখনো আলোচনা চলছে। পাকিস্তান তো একটা পাকিস্তান না। লাহোর রিজলিউশানে একাধিক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। মূল প্রস্তাবটা ছিল এ রকম : হোয়েয়ার মুসলিমস আর মেজরিটি দোজ প্রভিন্সেস উইল বি কনস্টিটিউটেড এ্যাজ অটোনোমাস এ্যান্ড সোভরিন স্টেটস। কিন্তু ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হওয়ার পর জিন্নাহ সাহেব বললেন, লাহোর রিজলিউশানে একটা ভুল আছে। স্টেটস কথাটা টাইপের ভুল, কথাটা আসলে হবে স্টেট। সুতরাং ডিসেম্বর মাসেই এটা এ্যামেন্ড করে ফেলা হয় : স্টেটস এর বদলে স্টেট। হাশেম সাহেব তখন এর বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু তাকে বসিয়ে দেওয়া হয়।

এ রকম ঘটনা তখন অনেক ঘটছিল। ভাষার ব্যাপারে বারবার উর্দুর উপর জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল : উর্দু শ্যাল বি দি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা অব পাকিস্তান, স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। করাচীতে ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লিতে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছিল। তখন ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে করাচীতে বৈঠক হচ্ছে। মূলনীতি কমিটির বৈঠক হচ্ছে। ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপালস্ ফর দি কনস্টিটিউশান কি কি হবে সেসব নিয়ে আলোচনা চলছে। এ্যাসেমব্লি সদস্যরা। কোন্ কোন্ ভাষায় বক্তৃতা দিতে পারবে তা এ্যাসেমব্লির রুলস এ্যান্ড রেগুলেশনের মধ্যে লেখা থাকে। সেখানে লেখা ছিল, মেম্বারস মে স্পিক ইন উর্দু এ্যান্ড ইন ইংলিশ।

কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লিতে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের মধ্যে তখন নেতৃস্থানীয় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায় এরা সব। এ্যাসেমব্লির এক সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম বাংলা ভাষার প্রশ্নটি তুলেছিলেন। ধীরেন দত্ত কুমিল্লা কোর্টের এক জন বড় উকিল ছিলেন। তিনি এ্যাসেমব্লির প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে বললেন, স্যার আই হ্যাভ এন হাম্বল সাবমিশন। পাকিস্তানের মানি অর্ডার ফর্মে যদি শুধু উর্দু আর ইংরেজি ব্যবহার করা হয় তবে ইস্ট বেঙ্গলের কৃষকেরা কীভাবে এই ফর্ম ব্যবহার করবে? ধরা যাক্, কৃষকের ছেলে স্কুলে পড়ে। সেই ছেলে বাবার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছে। বাবা তাকে মানি অর্ডার করবে। এই কৃষক ফাদার কীভাবে মানি অর্ডার ফর্মটা ব্যবহার করতে পারবে? এসব কথা অবশ্য সবই ইংরেজিতেই হচ্ছিল। মানিঅর্ডারের ব্যাকগ্রাউন্ডটা দিয়ে তিনি বললেন, আই হাম্বলি সাবমিট, ইন দি রিজলিউশান, দি মেম্বারর্স মে শিক আইদার উর্দু অর ইংলিশ অর বেঙ্গলি। দ্যাট ওয়াজ দি সাবমিশন অব ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইন ১৯৪৮। কিন্তু তার সেই বিনীত দাবিটাকে দমন করা হল। লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে* [*ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ১৯৭১, ২৫ মার্চের পরবর্তীতে কুমিল্লার নিজ বাড়ি থেকে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বারা গ্রেপ্তার হয়ে সেনানিবাসে নির্মমভাবে নিহত হন। তাই ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ : এ কথা ইতিহাসগতভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে।] ভয় দেখাল এই বলে যে তুমি প্রভিন্সিয়ালিজম প্ৰিচ করছে, এটা চলবে না। এসব কথা ইতিহাসে আছে।

’৪৮ এর মার্চ মাসেই মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলেন এবং রেসকোর্সে বক্তৃতা দিলেন। গরমের দিন ছিল তখন। পশ্চিম দিকে যেখানে এখন টিএসসি, সেখানে রেসকোর্সে ঢোকার একটা গেট আছে। ঐখানে মঞ্চ তৈরি করা হয়। পাশেই ছিল কালীমন্দির, রমনা কালীমন্দির যেটা পাকবাহিনী ৭১ সালে ভেঙে ফেলে। পাশে মা আনন্দময়ীর আশ্রমও ছিল। আমরা নিজেরা ভিজিট করেছি সে আশ্রম, বসেছি সেখানে। এ আশ্রমটা অবশ্য আগে থেকেই উঠে গিয়েছিল। হতে পারে মা আনন্দময়ী ঢাকা থেকে চলে গিয়েছেন বলে। কালীমন্দিরটা কিন্তু তখন ছিল।

সে সময় আমি ঢাকাতে দুইটা মিটিং-এ এ্যাটেন্ড করি। এর মধ্যে একটা হচ্ছে রেসকোর্সের সেই মিটিংটা। মুহম্মদ আলী জিন্নাহর কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে : চুপ করো, বৈঠ যাও, খামস্ সে সুনো। খুব বড় মিটিং ছিল সেটা এবং খুবই অরগানাইজড। তখনকার দিনের মুসলিম পপুলেশন বা ছাত্রদের মধ্যে কায়েদে আজম খুবই পপুলার টার্ম। ইট ওয়াজ হিজ ফার্স্ট ভিজিট ইন ঢাকা। দেশ তখন মুসলিম লীগের আমেজে আচ্ছন্ন। ছাত্ররা তখন ইনসপায়ারড বাই পার্টিশান এ্যান্ড ইনটেলিজেন্স অব জিন্নাহ। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সাথে মোকাবিলা করার কারিশমা ইত্যাদি ব্যাপারের জন্যে জিন্নাহ তাদের কাছে তখনো মহান নেতা। কাজেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তি বা ডিসইনমেন্ট, যাকে আমরা বলি, সেটা তখনো শুরু হয়নি। সেদিন সম্ভবত ১৬ মার্চ, ১৯৪৮। কিন্তু আমার *মনে আছে জিন্নাহ সাহেবের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ছাত্ররা ধর্মঘট আহ্বান করে ১১ মার্চে-এটা আমার মনে আছে। তা হলে জিন্নাহ সাহেব সম্ভবত ৮ মার্চ তারিখে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। [*স্মৃতির কথা ঠিক না হতে পারে, অনেক সুহৃদ বলেছেন জিন্নাহ সাহেব এসেছিলেন ১১ মার্চের পরে।]

জিন্নাহ সাহেবের সব কথা তো আমার মনে নাই। রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন : উর্দু এ্যান্ড উর্দু এলোন শ্যাল বি দি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। তিনি আরো বলেছিলেন, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে, একে বাঁচাতে হবে, রিকনস্ট্রাক্ট করতে হবে। এ্যান্ড আই ওয়ার্ন ইউ দ্যাট দেয়ার আর ফিফথ কলামিস্ট এমাংস্ট ইউ। কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না ইত্যাদি। যে কথাটা এখনো কানে বাজছে সেটা হচ্ছে, এ্যাজ ফার এ্যাজ ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ কনসার্নড় উর্দু এ্যান্ড উর্দু এলোন শ্যাল বিদি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান।

কমিউনিস্টদের ব্যাপারটা ওখানে উপস্থিত হাজার হাজার ছাত্রদের যতটা না উত্তেজিত করেছে তার চাইতে দশ গুণ বেশি উত্তেজিত করেছে কায়েদে আজম এর ভাষাসংক্রান্ত ঐ মন্তব্যটা। ছাত্রদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হয় সাংঘাতিক। জিন্নাহ সাহেবকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যে ছাত্ররা ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ হল… এ সমস্ত জায়গাতে গেট বানিয়েছিল। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই সব গেট তারা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে ফেলল।

২০. ‘নো, নো, নো’!

এর একদিন পর কার্জন হলে স্পেশাল কনভোকেশনের আয়োজন করা হয়। সেই কনভোকেশনে জিন্নাহ সাহেব নিজ হাতে ডিগ্রির সার্টিফিকেট দেবেন–এমন কথা ছিল। সেই ডিগ্রির সার্টিফিকেট তিনি ডিস্ট্রিবিউট করেন তার বক্তৃতার আগে কিংবা পরে। আমি তখনো পর্যন্ত আমার সার্টিফিকেট নিইনি। কার্জন হলের অনুষ্ঠানে প্রথমে ছিল শিক্ষকদের বসার জায়গা, তার পেছনে ছিল ছাত্ররা। আমি ইচ্ছে করলে শিক্ষকদের সঙ্গে বসতে পারতাম। শিক্ষকেরা তাদের জায়গা থেকেই ডিগ্রি আনতে স্টেজে যাবে। আমি সেখানে। বসিনি। তা ছাড়া ডিগ্রি নিতে হলে আগে থেকে রেজিস্ট্রারের সাথে যোগাযোগ করে ফর্ম পূরণ করতে হত। সেসব কিছুই আমি করিনি।

জিন্নাহ সাহেব তার স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ল্যাঙ্গুয়েজে ইংরেজিতে ভাষণ দিলেন। রেসকোর্সেও ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছিলেন, মাঝে মাঝে যখন শব্দ হয়েছে বা গণ্ডগোল হয়েছে, তখন উর্দুতে দুই-একটা কথা বলেছেন। কার্জন হলে তিনি উর্দুতে কিছুই বলেননি, তার প্রয়োজনও হয়নি। জিন্নাহ সাহেব যখন রাষ্ট্রভাষার কথায় এলেন তখন তিনি রেসকোর্সের কথাটাই রিপিট করলেন। আই টেল ইউ, এ্যাজ ফার এ্যাজ ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ কনসার্নড় উর্দু এ্যান্ড উর্দু এলোন শ্যাল বি দি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। এ সময়ে ছাত্ররা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে তিনটা আওয়াজ বের হয়েছিল।নো, নো, নো। জাস্ট তিনটা শব্দ। কোনো গোলমাল নয়, হৈচৈ নয়। এই তিনটা শব্দই শুধু ছাত্ররা উচ্চারণ করেছিল পিছনের সারি থেকে। এই তিনটা আওয়াজ সে সময়কার রেডিও রেকর্ডিং-এ নিশ্চয়ই ছিল। পরে হয়তো মুছে ফেলা হয়েছিল। জিন্নাহ সাহেব হেজিটেড ফর এ সেকেন্ড এ্যান্ড স্টপড, বাট দেন হি কনটিনিউড হিজ ওউন স্পিচ এজ হি ওয়ান্টেড টু।

জিন্নাহ সাহেবকে এস্কর্ট করে কার্জন হলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারা কারা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, তা এতদিন পরে আর মনে নেই। তবে একটা কথা মনে আছে, জিন্নাহ সাহেবকে যখন এস্কর্ট করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন কার্জন হলের পিছন দিকের গেটটা ব্যবহার করা হয়েছিল। সামনের গেট দিয়ে তাকে বের করা হয়নি।

জিন্নাহ সাহেব ১১ই মার্চের আগেই চলে গেছেন কিনা আমি জানি না কিন্তু জিন্নাহ সাহেবের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ১১ মার্চ তারিখে যে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল তা ইতিহাসে আছে। আমি নিজেও পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। কেননা পুলিশ তখনো পর্যন্ত আমার পিছনে লাগে নাই। আমি তখন শিক্ষকতা ছেড়ে এসেছি। বিভিন্ন সভা সমিতিতে যাচ্ছি। নিজেকে ওপেন রেখেছি।

পাকিস্তান হওয়ার পর ইডেন কলেজের বিল্ডিংটা সরকার দখল করেছে। সেটাই তখন সেক্রেটারিয়েট। মিনিস্টাররা সেখানে অফিস করা শুরু করেছিল। ইডেন কলেজটা তখন চলে গেছে ওয়াইজ ঘাটে এখন যেখানে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী সেখানে। মনে পড়ছে, কার্জন হলের পাশ দিয়ে যে রাস্ত টিা একেবারে সেক্রেটারিয়েটে চলে গেছে, আমরা ছাত্ররা সব মিছিল করে সে। রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। তোহাও পিকেটিং-এ পার্টিসিপেট করেছিল। ১১ মার্চের পিকেটিং-এর সময় তোহাকে সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিল।* [*স্মৃতি বলছে পুরোনো জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে পিকেটিং-এ তাজউদ্দীন আহমদের পাশে তোহা এবং আমি : আমরা দুজনেই ছিলাম।]

একটা ঘটনা আমার মনে আছে যে, ছাত্ররা সেক্রেটারিয়েট থেকে একজন মিনিস্টারকে বের করে এনেছিল। তিনি এডুকেশন মিনিস্টার বা অন্য কোনো মিনিস্টার হবেন। কোন মিনিস্টার তিনি ছিলেন তা মনে নেই তবে এটা মনে আছে যে তার বাড়ি ছিল পিরোজপুরে। ছাত্ররা তাকে ধরে এনে একটা বাক্সের উপর উঠিয়ে দিয়ে বলেছে, আপনি এখন বলেন। তখন ঐ লোক ভয় পেয়ে বলেছে, বাবারা তোমরা শোনো। বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ দি বেস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি বাংলা ভাষাকে সাপোর্ট করি। ছেলেরা তখন সেই মিনিস্টারের কাছে দাবি জানিয়েছিল : আপনাদের রিজলিউশন নিতে হবে, বাংলাকে পাকিস্তানের ওয়ান অব দি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজেস অব পাকিস্তান ঘোষণা করতে হবে।

এখনো মনে পড়ছে, পিকেটিং করার সময় আমি তাজউদ্দীন আহমদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি মেইন পোস্ট অফিসের সামনে। মেইন পোস্ট অফিসটা ছিল এখন যেখানে টি এন্ড টি অফিস সেখানে। তখন তো আর এলাকাটা এখনকার মতো ছিল না, আরো ছোট ছিল। পশ্চিম পাশে যে এক্সটেনশন সেটাই ছিল মেইন বিল্ডিং। পাশে একদিকে ছিল খেলার মাঠ। এখন আপনারা আর রিকলেক্ট করতে পারবেন না, অন্তত আমি যেভাবে পারি সেভাবে পারবেন না। এর একপাশে ছিল ব্রিটানিকা সিনেমা যেখানে ইংরেজি ছবি দেখানো হত, আর এক সাইডে ছিল নবাবদের একটা বড় রেস্টুরেন্ট : ডিয়েনফা।

এ সময় থেকে মুসলমান ছাত্রদের মোহমুক্তি শুরু হল। সবার অবশ্য হল না মোহমুক্তি। ছাত্রলীগ গ্রুপিং ছিল, শাহ আজীজ গ্রুপ ছিল, তোয়াহাদের গ্রুপ ছিল। আমি মুসলিম লীগের কেউ ছিলাম না। কিন্তু তোয়াহা ওয়াজ প্রমিনেন্ট মুসলিম লীগ লীডার। তাজউদ্দীন ওয়াজ প্রমিনেন্ট মুসলিম লীগ লীডার অব ইস্ট বেঙ্গল। কামরুদ্দীন আহমদ ছিলেন। তিনি অবশ্য স্টুডেন্ট ছিলেন না। কিন্তু তার স্টুডেন্ট সাপোর্টাররা ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৪৮ সালের মার্চ-এই কয়েক মাসেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তি হয়ে গেল ছাত্রদের। এই মোহমুক্তিটা একটা এ্যাগ্রেসিভ রূপ নিল ১৯৫২ সালে। এটা ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ সময় নানান জনে নানান কথা বলছেন। মুসলিম লীগের মিনিস্টার ফজলুর রহমান সাহেব এ্যাডভোকেটেড : বেঙ্গলি শুড বি রিটেন ইন অ্যারাবিক হরফ, ইন এ্যারাবিক লেটার্স। ১৯৪৮-এর মোহমুক্তিটাই ম্যাচিউর করল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে।

আমরা সাধারণত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করি। তা কিন্তু নয়। ভাষা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল আরো আগে, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের আগে। ভাষা নিয়ে যখন প্রাদেশিক পরিষদে আলাপ আলোচনা শুরু হয় তখন এই মোহমুক্তির ঘটনা কিছুটা ঘটতে শুরু করে। আগেই বলেছি, পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব দিয়েই ভাষা আন্দোলনের শুরু। সে জন্যে আমি মনে করি এবং অনেকেই এটা বলেছেন যে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ বা সৈনিক যদি আমরা কাউকে বলতে চাই তবে বলা উচিত, তিনি হচ্ছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি হচ্ছেন পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের প্রথম উপস্থাপক। ৭১ সালে তিনি যেভাবে নির্মমভাবে নিহত হলেন পাক আর্মীর দ্বারা, তাতে তিনি তাঁর জীবনের যে আদর্শ ছিল সে আদর্শের জন্যে সম্পূর্ণ মূল্য দিয়ে গেলেন–এটা বলতে গিয়ে আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি।

২১. আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন

’৪৮-এর মাঝামাঝি থেকেই আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে। আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রথম দিকে আমি শহরেই ছিলাম। আন্ডারগ্রাউন্ড মানে কারো সঙ্গে গোপনে কনটাক্ট করা, কোনো কমরেডের সঙ্গে দেখা করা, সন্দেহকারীকে ধোকা দেওয়া কিংবা তারা আমার সঙ্গে কনটাক্ট করে বলল : অমুক জায়গায় অমুককে পাওয়া যাবে।

তখনো হলে আমার সিট ছিল টিচার হিসেবে। আমি নিজেকে টিচার বা লিডার বলে মনে করতাম না। আমি এখনো স্টুডেন্ট–এই চিন্তাই আমার মাথায় ছিল। এ সময় ফজলুল হক হলে আমার একটা সিট ছিল। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী সাহেবও তখন ফজলুল হক হলে থাকতেন। ফজলুল হক হলের ইস্ট উইঙের একেবারে সাউদার্ন বুকে ছিল তাঁর সিট। সুতরাং হলে আমি একা নই : কিন্তু মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে কেউ এ্যাটাক করছে না। জঙ্গি গ্রুপটা মনে করছে, সরদার ফজলুল করিম কমিউনিজমের বীজ ছড়াচ্ছে।

মুসলিম লীগের ছেলেরা এসে আমাকে হল থেকে বের করে দিল। তোয়াহা সাহেবের এক চাচা খয়ের ছিল ঐ জঙ্গি গ্রুপের একজন লিডার। খয়েরের নাম এখনো পাওয়া যেতে পারে ইতিহাস ঘাঁটলে। ওরা ঠিক করল : আমরা সরদারকে বের করে দেবো। জঙ্গি ছাত্রদের বলা হয়েছিল, তোরা কেউ সরদারের সাথে আগুমেন্ট করবি না। কেন থাকতে পারবেন না ইত্যাদি কোনো কথাই বলবি না। ওরে ধরবি আর টাইনা বার করে দিবি। তার সাথে আগুর্মেন্টে গেলে পারবি না। ওদেরও ধারণা, সরদার ফজলুল করিম কোনো খারাপ লোক না। মারামারির লোক না। এ্যান্টি-হক মুভমেন্টের সময় আমাকে হেল করা হয়েছিল। এ্যান্টি-হক মুভমেন্ট হয়েছিল আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়।

ওরা এসে আমাকে বলল, আপনি হলে থাকতে পারবেন না। তখন আমি, ইন মাই ওন ন্যাচারাল ওয়ে, বলেছি, না, আমি থাকবো না। হলের একটি ছেলেও যদি অবজেক্ট করে, যদি অবজেকশান দেয় যে আমি হলে থাকতে পারবো না, তবে আমি হলে থাকবো না। এ উত্তর শুনে তারা খুশি হল। আমার উপর কোনো হাতটাত না উঠিয়ে নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর শ্লোগান দিয়ে চল চল বলে চলে গেল।

এবার আমাকে পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হল। আগে যা-ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করতে পারতাম, খেতে পারতাম-এর ওর বাসায়, এখন তাও বন্ধ হল। আমাকে বলা হল, তুমি এভাবে ঘুরতে পারবে না। আজ তুমি গ্রেপ্তার হচ্ছে না বলে যে কালও হবে না এমন কোনো। নিশ্চয়তা নেই। আমি তখন পার্টিকে বললাম, আমাকে শেল্টার দাও। পার্টি তো একটা ছোট অরগানাইজেশন, মিলিট্যান্ট বটে কিন্তু প্রধানত একটা থিওরেটিক্যাল পার্টি। তার একটা থিওরি আছে, একটা প্রগ্রেসিভ আউটলুক আছে। এই প্রগ্রেসিভ আউটলুক দিয়েই তারা বিভিন্ন ছেলেদের যোগাড় করার চেষ্টা করে। তখন ডিস্ট্রিক্ট কমিটি বা সেক্রেটারিয়েটের সভা ডাকা হল। তাদের তো আরো নানান ইস্যু আছে। সেইসব ইস্যুর মধ্যে এটাও একটা ইস্যু যে সরদার তো রিজাইন দিয়েছে। এখন তাকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তার আত্মীয়ের বাসায় তো সে থাকতে পারে না। কোথায় তাকে রাখা যায়? কমিউনিস্ট পার্টির যে খুব একটা বড় বেইজ ছিল, খুব স্ট্রং, তাতো না। পারিবারিক কারণে অনেক হিন্দু কমরেড তখন ভারতে চলে যাচ্ছেন। পার্টিতে খুব সাংঘাতিক একটা কর্মী ও নেতা-সঙ্কট চলছে।

পার্টি আমাকে রাখতে পারছে না ঢাকায়। কোনো সেফ জায়গা নেই। কোথায় রাখবে? আমাকে তখন বলা হল, তুমি বরং কলকাতায় চলে যাও। সেখানে গিয়ে তুমি অমুক ঠিকানায় রিপোর্ট কর। সেখানে তোমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। তখনো পাসপোর্ট হয়নি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা সতর্কতা ততদিনে ডেভেলপ করেছে যে, কোনো ইউজুয়াল পথ আমার ব্যবহার করা চলবে না। তখন কলকাতা যাবার ইউজুয়াল পথটা ছিল এরকম : ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে। শিয়ালদা। আমি একটু ডাইভার্স রুট নিলাম। আমি ঢাকা থেকে ট্রেনে গেলাম পাবনা ঈশ্বরদী। ঈশ্বরদী থেকে পাবর্তীপুর। এভাবে নর্থ বেঙ্গল হয়ে আমি কলকাতায় রিচ করলাম। তাতে করে আমার মনে একটা সেন্স এসেছিল যে, আই অ্যাম সেফ, কেন না এত ঘুরেটুরে এসেছি। পথে তো কেউ বাধা দেয়নি, কেউ জিজ্ঞেসও করেনি।

ঢাকা থেকে কলকাতায় গিয়ে যারা রিফিউজি হয়েছিলেন, তারা আমাকে আশ্রয় দিলেন। আমি দেখলাম যে তাদের অবস্থাও বড় খারাপ। তখন হঠাৎ একদিন আহসান হাবীব সাহেবের সঙ্গে দেখা হল আমার দৈনিক ইত্তেহাদ অফিসে। কবি আহসান হাবীব। তিনি আমার পারিবারিক ভাই ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেছেন একেবারে কিড অবস্থায়, আমি যখন ক্লাস এইট নাইনে পড়তাম।

দৈনিক আজাদ হয়তো তখন ঢাকায় এসেছে, কিন্তু দৈনিক ইত্তেহাদ আসেনি তখনো। আহসান হাবীব ইত্তেহাদের সাহিত্য সম্পাদক। আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন ইত্তেহাদের এডিটর। রোকনুজ্জামান তখনো কলকাতায়। পার্ক সার্কাসে যে বাড়িটাতে আহসান হাবীব সাহেব থাকতেন সেই একই বাড়িতে রোকনুজ্জামানও থাকতেন।

আমি কলকাতায় গিয়ে নিজেকে খুব ফ্রি বোধ করলাম। চৌরঙ্গীর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি ট্রাফিক দেখছি, ট্রামে চড়ছি। আমি ভাবছি, এখানে আমাকে কে চেনে? চিনবে কে? হাবীব ভাইকে একদিন বললাম, আমার তো থাকার জায়গার খুব অসুবিধা। রিফিউজিরা খুবই কষ্টেসৃষ্টে আছেন, কেউ চৌকির উপরে, কেউ নিচে-এভাবে থাকছেন। আমি যে এই সমস্ত রাস্তায় গেছি তা হাবীব ভাই খুব একটা জানতেন না। তিনি বললেন, আমি তোমার বড় ভাই। তুমি কলকাতায় এসেছো, তুমি আমার বাসায় থাকো। এটা বলাতে আমি আমার সামান্য বিছানাপত্র যা ছিল তা নিয়ে পার্ক সার্কাসে আহসান হাবীব সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠলাম।

কদিন ওখানে ছিলাম বলতে পারবো না। একদিন শেষরাতের দিকে তিনি পত্রিকা অফিস থেকে ফিরেছেন কাজটাজ করে। তখন তিনি বিয়েও বোধ হয় করেছেন। আমাকে যে ঘরে তিনি শুতে দিয়েছিলেন তার পাশের ঘরে ছিলেন রোকনুজ্জামান, পরে সে আমাকে বলেছে। সেই ঘরে নকিং হচ্ছে। হাবীব ভাই যখন জিজ্ঞেস করলেন, কে? তখন উত্তর এল, আমরা পুলিশের লোক। দরজা খুলুন। তখন হাবীব ভাই আর কি করবেন, উনি জীবনে তো পুলিশ দেখেননি। দরজা খুলে দিলেন। তখন কয়েকটা লোক, সাদা কাপড়ে বোধ হয়, অর্থাৎ ইউনিফর্মে না, অর্থাৎ আই বি ডিপার্টমেন্টের লোক, তারা হাবীব ভাইকে বলল যে, স্যার আমাদের খবর আছে, আপনার এখানে একজন ইস্ট বেঙ্গলের পলিটিক্যাল এ্যাবসকন্ডার আছে। তখন এটা সাংঘাতিক টার্ম : পলিটিক্যাল এ্যাবসকন্ডার। এ ধরনের লোককে যে রাখে তার অবস্থা কিন্তু নিরাপদ না। হাবীব ভাই বললেন, আমার এখানে পলিটিক্যাল এ্যাবসকন্ডার কেন থাকবে? তখন পুলিশ বলল, আপনার এখানে কে কে আছে? তিনি প্রথমে নিজের ফ্যামিলি মেম্বারদের কথা বললেন। তারপর বললেন যে তাঁর বাড়িতে একজন রিলেটিভ আছেন। পুলিশ এবার বলল, কই আপনার সেই রিলেটিভ কোথায়? তাকে ডাকুন। আমরা তাকে একটু দেখবো।

হাবীব ভাই আমাকে ভিতরের ঘরে ডেকে নিলেন। আমাকে বললেন, করিম (করিম বলে ডাকতেন তিনি আমাকে কি করবো? ওরা তোমাকে দেখতে চায়। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি যাবো। খুব স্মার্টলি বললাম কথাটা। আমি তো অত চিন্তাভাবনা করে কথা বলতাম না, যখন যা দরকার হয় বলার তা বলতাম। যখন যা দরকার হয় করার তা করতাম। আমি যে মাস্টারি শুরু করেছিলাম, তাও অত চিন্তাভাবনা করে করিনি। টিচার ক্রাইসিস হয়েছিল বলেই মাস্টারি করতে রাজি হয়েছিলাম। স্যার বলেছেন, তুই কালকে থেকে ক্লাস নে, আমি নিতে শুরু করলাম। আমাকে পার্টি বলেছে, তুমি এ্যারেস্টেড হয়ে যাবে। তুমি চাকরি করতে পারবে না। তুমি রিজাইন দাও। আমি রিজাইন দিলাম। পার্টিকে বলেছি, আমাকে রাখার ব্যবস্থা করো। পার্টি বলেছে, তোমাকে কোথায় রাখবো? এর পর তারা আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি চলে গেছি কলকাতায়। তারাই বলেছে, এই পথ দিয়ে যাও, সোজা গোয়ালন্দের পথ দিয়ে যেও না। ন্যাচারালি, নিশ্চয়ই তারা আমাকে এ্যাডভাইস করেছে।

ঢাকাতে আমি কোনো সাংঘাতিক কমিউনিস্ট পলিটিক্যাল লিডার ছিলাম না। ঢাকায় যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে পুরোনো সব আই বি অফিসার তারা ইস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্টকে সাহায্য করেছে বাই গিভিং লিস্ট অব দি মুসলিম স্টুডেন্টস এন্ড আদার্স হু আর কমিউনিস্ট মাইন্ডেড। এই লিস্টিটা তারা দিয়ে গেছে। এই লিস্টি অনুযায়ী তারা সবাইকে ফলো করছে। কারণ এ্যারেস্ট তো এমনি করা যায় না। অ্যাকশনের উপর তো এ্যারেস্ট করবে। বিনা এ্যাকশনে তো এরেস্ট করা যায় না। তখনো তো কমিউনিস্ট পার্টি ইললিগাল না। একজন যদি কমিউনিস্ট থাকেও তবুও তাকে এ্যারেস্ট করার যে ফর্মালিটি সেটা তো আনা যায় না। ওয়াচ করার ব্যাপারটা আছে। ওয়াচিংটাও কিছুদিন পর্যন্ত এ্যাভয়েড করা গেছে। আমি তো গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতায় যাইনি, আমি গিয়েছি পার্বতীপুর হয়ে। কলকাতায় গিয়ে আমি খুব ফ্রি ফিল করছি। সেই ফ্রিনেসটা ধাক্কা খেলো একদিন শেষরাতে যে কথা আগেই বলেছি।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলাম, গোটা পাঁচ-ছয় লোক। ওরা আমাকে অবজার্ভ করল, আগা সে মাথা, মানে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এরপর তারা আমাকে প্রশ্ন করল, আপনার নাম কি? আমি উত্তর দিলাম, আমার নাম ফজলুল করিম। সরদার শব্দটা আমি বাদ দিলাম। তেমন কিছু ভেবে নয়, এমনিই স্পন্টেনাসলি। আপনি কি করেন? আমি বললাম যে আমি কলেজে পড়ি। কী পড়েন? কোথায় পড়েন? আমি বললাম যে আমি চাখার কলেজে পড়ি। কি কি বলেছিলাম, আমার সব মনে আছে। আমি এইভাবেই জবাব দিয়েছিলাম। কী পড়েন? আমি বললাম আমি বি এ পরীক্ষা দিয়েছিলাম গত বছর। আমি পাস করতে পারি নাই। এ বছর আবার দেবো। বাড়ি কোথায়? বলেছি : বরিশালে। কেন এসেছেন? আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। পুলিশের লোকজন তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল, নো, নো, নট দিজ ওয়ান। সাম বিগ গাই। সাম বিগ সরদার ফ্রম ইস্ট বেঙ্গল। এ কথাটাও আমার মনে আছে। ওরা আমাকে পছন্দ করছে না। যখন ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ আমাকে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশের কাছে হ্যান্ড ওভার করেছে তখন তারা আমার নাম বলেছে, সরদার ফজলুল করিম, কমিউনিস্ট লিডার ফ্রম ইস্ট বেঙ্গল।

সন্দেহ হলেই কাউকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গ্রেপ্তার করে না। পুলিশ সন্দেহভাজন ব্যক্তির পেছনে স্পাই লাগায়। সেই স্পাই কখনো সামনে থাকে না, সব সময় পিছনে থাকে। পিছন থেকে ওয়াচ করে, দেখিয়ে দেয়–ঐ যাচ্ছে। একসাথে যায় না, দশগজ পেছনে থেকে ফলো করে এবং তারপর রিপোর্ট করে। ওদের তো চাকরিই ওটা। আমাকে যে কলকাতাও ফলো করা হচ্ছে এটা আমার মাথার মধ্যে ছিল না। আমি যখন চৌরঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকছি, ট্রাম দেখছি, ট্রামে উঠছি কিংবা ইত্তেহাদ অফিসে যাচ্ছি, আহসান হাবীব সাহেবের সাথে কথা বলছি, তখন তো আমার মাথার মধ্যে নাই যে আমার পেছনে একটা শ্যাডো আছে। আমি হাঁটছি, সেও হাঁটছে। আমি থামলে সেও থামছে। আমি যদি এই ব্যাপারটা খেয়াল করতাম তা হলে আমার মনের মধ্যে একটা চিন্তা আসত যে, আই এ্যাম বিয়িং ফলোড। আই শুড বি মোর কশাস। এই কথাটা কিন্তু ঐ রাত্রের হামলার আগ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে আসে নাই। তখন আমার বন্ধু মোহাম্মদ আবুল কাসেম কলকাতায় আছে। অন্যান্য বন্ধুরা আছে, তাদের বাসায় যাচ্ছি।

পরদিনই আমি আহসান হাবীব সাহেবের বাসা ছেড়ে চলে আসি। দ্যাট ওয়াজ এ রোমান্টিক এসকেপ। সেখান থেকে আমি কোথায় গেলাম মনে নেই। কিছু দিন পরে আমি ইস্ট বেঙ্গলে ফিরে এলাম। কতদিন পরে ফিরে এলাম, কোন রুট দিয়ে এলাম তা এতদিন পরে আর খেয়াল নেই। এটা ৪৮ এর শেষ বা ৪৯-এর প্রথম দিকে হবে। ঢাকায় এসে আমি যেখানে রিপোর্ট করার দরকার সেখানে রিপোর্ট করলাম। কিন্তু কলকাতাতেও যে পুলিশী হামলা হয়েছিল সেটা অবশ্য তাদের জানালাম না।

আমি আর কি করবো? পার্টির কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে নিয়ে পার্টি করবে কি? আমাকে দিয়ে কি তারা ধান ভানাবে? আন্ডারগ্রাউন্ড থাকাটাই হচ্ছে এখন কাজ যতদিন পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে জীবন রক্ষা করা যায়। পার্টিকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখন কি করবো? পার্টির যারা অরগানাইজার অর্থাৎ সেক্রেটারিয়েটের সদস্য তারা আমাকে ছোট ছোট স্লিপ পাঠাত। এইসব স্লিপে লেখা থাকত আমাকে কী করতে হবে। এসব স্লিপ অবশ্য রোজ তারা পাঠাত না আমাকে। তখন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস বলে কিছু নেই। শাহ আজিজেরা আক্রমণ করার আগে একটা অফিস ছিল, সেখানে আলোচনা সভা বসত।

২২. ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ : মাটির তলে

পার্টি আমাকে একদিন একজন কুরিয়ার মারফত স্লিপ পাঠাল আমার কাছে। মেসেঞ্জারকে পার্টির ভাষায় বলা হত কুরিয়ার। স্লিপে বলা হল, কুরিয়ার যাচ্ছে তোমার কাছে। তুমি এর সাথে চলে যাও। কোথায় যাবো সেটা জানতাম না। গিয়ে দেখলাম জায়গাটা নরসিংদীতে, মনোহরদির চালাকচরে। সুন্দর সাজানো জায়গা। আমার খুব ভালো লাগল।

কমিউনিস্ট পার্টি ওয়াজ নট এ উইক পার্টি ইন ইস্ট বেঙ্গল। কমিউনিস্ট পার্টি ওয়াজ এ্যান অরগানাইজড পার্টি। আবুল হাশেম সাহেবের মুসলিম লীগের সঙ্গে তাদের একটা লিয়াজোঁ ছিল। আবুল হাশেম সাহেবের যে পার্সোনাল সেক্রেটারি, সে একজন কমিউনিস্ট ছিল। বিভিন্ন জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টির বেইজ ছিল। আমি ঢাকার কথা বলতে পারি। অন্যান্য জায়গার কথা তেমন বলতে পারি না। নলিনী দাশ, মুকুল সেন এঁরা ছিলেন বরিশালের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা।

চালাকচরে কমিউনিস্টদের একটা সিমপ্যাথেটিক বেইজ ছিল প্রধানত প্রাইমারি স্কুল টিচারদের মধ্যে* [*চালাকচরের প্রাথমিক শিক্ষক আখতারুজ্জামান খুবই গুরুত্বপূর্ণ কমরেড ছিলেন। তিনি আজ নাই।] এবং তার চাইতেও বেশি বারুইদের মধ্যে। বারুই হচ্ছে পানচাষী-অর্থাৎ যারা পানের বরজ করে। চালাকচরের কাছেই শরীফপুর নামে একটা এলাকা ছিল। সেখানেও বারুইদের একটা কমিউনিটি ছিল। এই চালাকচরে আবুল হাশেম সাহেব পাবলিক মিটিং করেছিলেন এবং নবাববাড়ির গ্রুপ এই মিটিংটা এ্যাটাক করেছিল।

আমার প্রকৃত পরিচয়টা পার্টি চালাকচরের লোকজনকে জানায়নি। পার্টি হয়তো বলে পাঠিয়েছে, মজিদ সাহেবকে পাঠালাম। যখন কোনো হিন্দু বাড়িতে থাকতে হয়েছে, তখন আমি নতুন একটা নাম নিয়েছি, যেমন ধরুন, অশোক। মুসলিম হিসেবে আমাকে তো হিন্দুরা তাদের খাবারঘরে নিয়ে যাবে না। হিন্দু বাড়িতে খাওয়ার কিছু কাস্টম আছে, যেমন খাবার সময় ডান হাত দিয়ে গ্লাস ধরতে হবে। কাসার থালা বাটিতে খেতে হবে। আমি এসবে বেশ রপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েরা আমাকে ছোটভাই বলে ডাকত। কেউ হয়তো আমার কমরেডের ওয়াইফ, তাকে বউদি বলে ডাকতাম। কোয়ায়েট হোমলি ওয়েতে ছিলাম।

এই এরিয়ার বড় নেতা যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল অন্নদা পাল। তিনি একজন বিখ্যাত আন্দামান ফেরত স্বাধীনতা সংগ্রামী। আন্দামান সেলুলার জেলে তিনি দীর্ঘদিন রাজবন্দি ছিলেন। অন্নদা পালকে পরবর্তীকালে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হয় পারিবারিক কারণে। তিনি মারা গেছেন ওয়েস্ট বেঙ্গলেই, এখানে না। এই আন্দামান সেলুলার জেল ইন্ডিয়ান সোসালিস্ট মুভমেন্টে বেশ বড় একটা অবদান রেখেছে।

আমার এক বন্ধু অনিল মুখার্জীও আন্দামানে রাজবন্দি ছিলেন। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতা। অনিল মুখার্জী একজন ভালো লেখক ছিলেন। তিনি একজন এমিয়েবল এবং সাউন্ড থিওরেটিশিয়ান ছিলেন। তার সাম্যবাদের ভূমিকা এবং শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি নামে দুটি বই আছে। তিনি কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের মধ্যে। কমিউনিস্ট পার্টি যখন ভালো ভালো মুসলিম ছাত্রদের সংগ্রহ করছে, তখনই তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি সে সময়েই আমাকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গেছেন, মিটিং-এ বক্তৃতা দিইয়েছেন আমাকে দিয়ে।

অনিলদার কাছ থেকে আমি আন্দামানের জেল সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়েছিলাম। কোনো কয়েদির যদি দশ বছরের বেশি কারাদণ্ড হয়ে যেত কোনো অপরাধে বা কোনো রাজনৈতিক কারণে তবে তাকে কলকাতা থেকে জাহাজে করে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত। আন্দামানের নাম ছিল কালাপানি। লোকে ভাবত, ওখানে যাকে পাঠানো হয় সে আর ফেরত আসে না, আসতে পারে না। সেলুলার জেলে যে শুধু আন্দোলনের বড় বড় নেতাদেরকেই পাঠানো হয়েছে তা না, সাধারণ কয়েদিদেরও সেখানে পাঠানো হয়েছে। আন্দামান মানুষের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে উঠেছে প্রধানত আন্দামান জেলের কয়েদিদের দ্বারা। ওখানে যাওয়ার পর সাধারণ বন্দিরা বাইরে ঘোরাফেরা করত, কাজকর্ম করত, জেলের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করত, চাষ করত।

আন্দামানের সাধারণ কয়েদিদের কয়েক বছর পর ছেড়ে দেওয়া হত। জেল থেকে বের হয়ে তারা ওখানকার মেয়েদের বিয়ে-সাদি করত। কিন্তু পলিটিক্যাল প্রিজনার যারা তাদের বের হতে দিত না সেলুলার জেল থেকে। অনিলদা বলেছিলেন, আন্দামান সেলুলার জেলে তারা কেমন করে কাজ করেছেন। কেমন করে আন্দামান সেলুলার জেলে অনশন ধর্মঘট করে তারা। সেখানকার নিয়মকানুনে পরিবর্তন আনেন এবং কেমন করে আন্দামান সেলুলার জেল ওয়াজ চ্যাইড ইন টু এ মার্কসিস্ট ইউনিভার্সিটি।

কংগ্রেস নেতা, কোয়াইট এ নাম্বার, ছিলেন সেলুলার জেলে। কংগ্রেসের মধ্যে যে সেকশানটা কমিউনিস্ট মাইন্ডেড হয়ে যায় এই আন্দামানেই তারা চেঞ্জ হয়ে যায় থু রিডিং কমিউনিস্ট লিটারেচার। এই লিটারেচার তারা নানাভাবে সংগ্রহ করত। আন্দামান সেলুলার জেলের যিনি সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন তিনি ছিলেন একজন আইরিশ। ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তার একটা সফট কর্নার ছিল। যত সব কমিউনিস্ট লিটারেচার তা সে রাজবন্দিদের এনে দিত পড়ার জন্যে। কমিউনিস্টেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে করে এই লিটারেচারগুলো পড়ত। এসব পড়েই অগ্নিযুগের বেশ কিছু বিপ্লবী, সবাই না অবশ্য, বেশ কিছু কমিউনিস্টে পরিণত হয়। তারা তো এক-দুই বছর না, বহু বছর সেখানে কাটিয়েছেন।

আমি যে সরদার ফজলুল করিম তা চালাকচরের সবাই জানত না। মনে করুন, আমাকে একটা মুসলিম বাড়িতে রেখেছে। সেখানে ছাত্র আছে। কোনো ছাত্রের সাথে আমি হয়তো গল্প করছি। পড়াচ্ছি তাকে, কিছু একটা করে দিন কাটানো আরকি। বাড়ির যে মুরুব্বী সে অবশ্য জানে আমি কে এবং আমার সমস্ত তদবীর তদারক তিনিই করছেন। রাত্রে সাধারণত আমি কোনো নোন প্লেসে থাকতাম না। এই যেমন ধরুন, কোনো একটা গরুর ঘর, তার মধ্যে বিছানাপত্র বিছিয়ে আমি থাকতাম। গরিব এলাকা ছিল। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো চাহিদা ছিল না আমার। হয়তো কোনোদিন একটি পুঁটিমাছ দিয়ে বা কোনোদিন পাটকাঠি দিয়ে শুঁটকি মাছ পুড়িয়ে তা দিয়ে কিছু ভাত খেলাম। সে এলাকায় সাধারণ মানুষ সব সময় ভাত খেতে পেত না। একটা সময়ে তাদের কম খেতে হত। ওটা আবার কাঁঠালের এরিয়া ছিল। কাঁঠালের সিজনে, সকাল বেলা কিছু কাঁঠাল দিত, সেই কাঁঠালের কোষ খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। দ্যাট ওয়াজ এ ভেরি রোমান্টিক লাইফ ফর মি।

’৪৯-এর প্রথম দিক থেকে শুরু হয় আমার এ জীবন। কেমন করে দিন কাটত আমার? একদিন এক কমরেড হয়তো বলল, চলেন মজিদ সাহেব আজ অমুক জায়গায় একটা আলোচনা আছে। সেখানে গেলাম তার সাথে। সেই আলোচনা সভায় আমার বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে এই সমাজ, তার মানুষ এবং তার ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে কিছু বললাম। দৈনন্দিন আন্দোলন সম্পর্কে তেমন। কিছু অবশ্য বলা হত না। এর মধ্যে যারা একেবারে কমিউনিস্ট নেতা যিনি, তিনি জানেন আমি সরদার ফজলুল করিম। অন্যরা জানে, মজিদ মিয়া হিসেবে কিংবা বারুই কমিউনিটির মধ্যে অশোক হিসেবে।

সে সময়ের দুএকটি গল্প করা যায়। একদিন ক্লাস এইট না নাইনে পড়ে এমন একটি কমিউনিস্ট ক্যাডার ছেলে আমাকে বলছে, মজিদ সাহেব, আপনি ঢাকা শহরটহর চেনেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, কিছু চিনি। তখন ছেলেটা বলল, সেখানে আমাদের একজন বড় নেতা আছে, আপনি জানেন? আমি বললাম, আমি তো জানি না। তখন ছেলেটি বলল, তার নাম হচ্ছে সরদার ফজলুল করিম। আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি নাম শুনেছি কিন্তু দেখি নাই। ছেলেটি তখন বলে, আমি তার কাছে যাবো, তার সঙ্গে দেখা করবো। আমি হয়তো তাকে তখন বলেছি, যাওয়ার আগে আমার একটা চিঠি নিয়ে যেও। এখনো ঐ এলাকার লোক আমাকে নিতে চায় এখানে। কিন্তু আমার তো খুব একটা মুভমেন্ট নাই ইদানীং। তাদের মনে সাংঘাতিক রোমান্টিক সব আইডিয়া ছিল এ্যাবাউট সরদার ফজলুল করিম। তারা এই ভেবে গর্ব বোধ করে যে, সরদার ফজলুল করিম আমাদের এখানে থাকতো। ছেলেটি বলেছিল যে সরদার ফজলুল করিম ওদের নেতা। মুসলমানদের মধ্যে কোনো কমিউনিস্ট নেতা আছে এটা সে যুগে তাদের জন্যে একটা গর্বের ব্যাপার ছিল।

তখন প্রাইভেট লাইফেও, কৃষকদের মধ্যে, গ্রামে, ঘড়িটা ছিল আনইউজুয়াল। কোনো মানুষ ঘড়ি পরতে পারে এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। আমার একটা রিস্টওয়াচ তখন ছিল, পুরোনো টাইপের, আমি কেয়ার নিতাম যে রাস্তাঘাটে যখন আমি হাঁটি তখন যেন হাতে ঘড়ি না পরি। গ্রামে, আপনি তো একা হাঁটবেন না। আপনার পাশে আরো লোক যাবে। গ্রামের লোক, দে উইল পিক আপ ডায়ালগ উইথ ইউ, আরে ভাই আপনি কই যাবেন? আমি অমুক জায়গায় যাবো। আপনি কী করেন? আমি মেট্রিক পড়ি, স্কুলে পড়ি। ডেইলি লাইফটা ছিল ওখানে এ রকম। গোপন লাইফটা ছিল সাধারণত একই জায়গাতে না থাকা। না থাকা মানে আমি যে থাকতাম না তা নয়, ওরাই আমাকে রাখত না। যারা রেখেছে তারা তো বোঝে, বিপদ কতটা! এর আগে অলরেডি কমিউনিস্টদের উপর হামলা আরম্ভ হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গাতে এ্যারেস্ট হয়ে যাচ্ছে তারা। সুতরাং এরা আমাকে বিভিন্ন পিকুইলিয়ার জায়গায় রাখত। পুলিশ যদি রাত্রে হামলা করে, তাদের ঘরের উপর হামলা করলেও গোশালায় তো আর হামলা করবে না! সে গরুর ঘর ইজ সেইফার। আমার তো কোনো অসুবিধা ছিল না।

কয়েক মাস আমি চালাকচরে ছিলাম। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে আমার কাছে একটা গোপন মেসেজ যায়। মেসেজটা হচ্ছে এই যে, ঢাকাতে অত তারিখে তুমি আসো। এখানে আমাদের ডিস্ট্রিক্ট কমিটির একটা মিটিং হবে। তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হল। নারায়ণগঞ্জ থেকে রায়পুরা যেতে যে লোহার ব্রিজটা আছে ঘোড়াশালের মহোহরদী এলাকায় সেটা পার হতে হয়েছিল এটা মনে আছে। মনোহরদী, হাতিরদিয়া–এসব জায়গা আমার পরিচিত। এই হাতিরদিয়া কিন্তু আমাদের আসাদের বাড়ি। আমি আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থাতেও ঢাকা থেকে ওখানে যাতায়াত করেছি। এস্কর্ট (মানে বাহক) হয়তো একজন ছিল। কিন্তু আমি মোটামুটি রাস্তাটা চিনে গিয়েছি : টঙ্গী থেকে ট্রেনে করে ঘোড়াশাল গিয়ে ওখানে স্টেশনে নেমে তারপর পায়ে হেঁটে গেছি অনেক বার।

গ্রাম থেকে নিয়ে এসে অর্গানাইজেশন আমাকে একটা বাসায় উঠাল। এই বাসাটা হচ্ছে সন্তোষ গুপ্তের বাসা। সন্তোষ গুপ্ত নিজেও তখন কমিউনিস্ট। ডিস্ট্রিক্ট কমিটির মিটিং চলছিল সেই বাসাতে। কারণ ইতোমধ্যে অনেক লোক গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। অনেক লিডার গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। এখন ডিস্ট্রিক্ট কমিটির অবস্থাই বড় কাহিল। এখন এমন একজন কাউকে দরকার যে কিছুটা গাইড করতে পারবে। কাকে দেওয়া হবে এই দায়িত্ব এই প্রশ্ন যখন করা হল তখন সরদার ফজলুল করিমের নাম এল। সরদার ফজলুল করিমকে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। হি উইল বি দি সেক্রেটারি অব দি ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট কমিটি।

১৯৪৯-এর ২৫ ডিসেম্বর সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে এই সমস্ত আলোচনা করে যখন আমরা দুপুরে খাওয়ার পরে বিশ্রাম নিচ্ছি তখনি দরজায় ঘা পড়ল। আমাদের সংগঠন এই গোপন আশ্রয়কে যতখানি গোপন ভেবেছিল আশ্রয়টা ততখানি গোপন ছিল না। এই বাসার আশপাশেই কমিউনিস্ট নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন সময়টা ছিল এমন যে, যদিও কমিউনিস্ট পার্টিকে ফর্মালি বেআইনি করা হয়নি তবুও এ্যাডমিনিস্ট্রেশান কমিউনিস্টদের টার্গেট করছে। একের পর এক কমিউনিস্ট কর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। সুকুমার চক্রবর্তী নামে একজন অঙ্কবিদ, মানে খুব ভালো শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে। ফনি গুহ নামে একজন বড় নেতা ছিলেন আমাদের, তিনিও এ্যারেস্টেড হয়ে গিয়েছিলেন। এ্যারেস্টেড না হয়ে তো উপায় ছিল না।

সন্তোষের এই বাড়িটা ওয়াজ আন্ডার ওয়াচ। এই কথাটা সন্তোষ গুপ্ত নিজেও জানত না, যদিও সন্তোষ ছিল আই জি অব প্রিজনসের কনফিডেন্সিয়াল ক্লার্ক। ওর একটা বিশ্বাস ছিল। কিন্তু হামলা করা হল। আমাদের মধ্যে দুজন মহিলা ছিলেন। একজন হচ্ছেন সন্তোষের বিধবা মা। আর একজন হচ্ছেন অজিত চ্যাটার্জী নামে একজন কৃষক নেতার ওয়াইফ। এরা সন্তোষের বাড়িটাকে বাসাবাড়ি বানিয়ে একটা ক্যামুফ্লেজের মতো ব্যবহার করত। আমরা গোপনে রাত্রে আসতাম সে বাসায়। কিন্তু এর মধ্যে অনেক কমিউনিস্ট নেতা কর্মী গ্রেপ্তার হয়ে গিয়েছিলেন। কোন্ রাস্তায় কোন পুলিশ কীভাবে পাহারা দেয় তা জানা যেত না তো কিছু। এই ক্যামুফ্লেজের ব্যাপারে যে পুলিশ জেনে গেছে, তা আমরা জানতাম না।

২৩. গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম

দুপুরের পরে যখন হামলা হল, দরজা ভাঙল, তখন পুলিশ বলছে, এই বাড়িটা, এই বাড়িটা। আমরা তখন এসকেপ করার চেষ্টা করছি, দেয়াল ক্রস করে এখন যেখানে কোতোয়ালী থানা ঐ এলাকায় যাবার চেষ্টা করছি আর আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন পুলিশকে দেখিয়ে দিচ্ছে : ঐ যায়, ঐ যায়! কেননা পাবলিকের ধারণা হচ্ছে আমরা ডাকাতের দল। আমরা দুই একটা বাড়ি ক্রস করেছি, হয়তো বাথরুম বা কোথাও আশ্রয় নিয়েছি, কিন্তু উই ওয়েয়ার কট। আমাকে তখন পুলিশ লাঠি দিয়ে বাড়িটাড়ি মেরেছে, সন্তে ষিকেও মেরেছে। এলাকার লোকজন আমাদের গায়ে হাত তুলেনি, তোলেছে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ এবং পুলিশ। পুরো ব্যাপারটার আসল অরগানাইজার হচ্ছে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ এবং পুলিশকে তারা নিয়ে যায়, এভাবেই ব্যাপারটা ঘটে।

সেদিন ঐ বাসায় যেসব কমিউনিস্ট ছিলেন তারা সবাই গ্রেপ্তার হন। মহিলা দুজনও গ্রেপ্তার হলেন। আরো কিছু লোক ছিলেন যাদের নাম বলাটা। ঠিক হবে না। জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন আমাদের সাথে। মনু মিয়া বলে একজন দিনমজুর কমরেডও ছিলেন। ১৯৪৯ সালের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ছিল এ রকম যে, পিপলের মধ্য থেকে ক্যাডার বার করতে হবে। শ্রমিকদের মধ্য থেকে ক্যাডার বার করতে হবে। দে উইল বি অরগানাইজার্স, নট দি মিডল ক্লাস। মিড়ল ক্লাসের দুর্বলতা আছে। ওয়ার্কার্স, কৃষক, দিনমজুর এদেরকে ট্রেইনড করতে হবে। এই মনু মিয়া ওয়াজ লাইক দ্যাট। এই রকমই আর এক জন লোক ছিলেন সিরাজুল হক সাহেব। তিনি তার এলাকার বড় নেতা হয়েছিলেন, ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।

এই হচ্ছে আমার প্রথম এ্যারেস্ট হওয়ার কাহিনী। এ্যারেস্ট করে প্রথমে আমাদের কোতোয়ালী থানায় নিয়ে গেল। থানায় প্রথমে কিছুটা ইন্টারভিউয়ের মতো হল। পিটানোও কিছু হল। সন্তোষকে পিটাল। আমাকেও থাপ্পড়টাপ্পড় মারল। পরে রাত্রিতে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিল। মহিলাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল মহিলা ওয়ার্ডে। আসামি জেলে পাঠানোতে সময় লাগে, ওয়ারেন্ট ইত্যাদি তৈরি করতে হয়। আমাদের জেলে পাঠাতে পাঠাতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে গিয়েছিল। সেখানে আগে থেকেই সরদার ফজলুল করিম একটি বড় নাম। যত আই বি শুনল, সরদার ফজলুল করিম ধরা পড়েছে, তারা সবাই দৌড়ে দেখতে এল। এসে তো দেখল ছোটখাটো একটা মানুষ আমি। সেদিন থেকেই শুরু হল আমার ডিটেনশান জীবন।

জেলে আসামি নেওয়ার পর প্রথমে তাকে সুপারিনটেনডেন্টের কাছে হাজির করা হত। তখন আইজি অব প্রিজন ছিলেন আমির হোসেন। তিনিও ইন্সপেকশনে এসেছেন। এই আইজি অব প্রিজন-এর পার্সোনাল কনফিডেন্সিয়েল ক্লার্ক হচ্ছেন সন্তোষ গুপ্ত। সন্তোষকে আমাদের মধ্যে দেখে আমির হোসেন সাহেবের চোখ ছানাবড়া। তিনি খুব অবাক হয়ে বললেন, সন্তোষ, তুমিও এর মধ্যে আছো? এ অনেকটা বাঘের ঘরে গোগের বাসার মতো আরকি!

২৪. জেলজীবন

পাকিস্তান আমলে আমরা যারা বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের গ্রেপ্তার করেছিল। বিভিন্ন জেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেক বার জেলখানার গেটে আমাদেরকে রিলিজ করার ভান করা হয়েছে, কিন্তু রিলিজ করার পরপরই আবার নিরাপত্তা আইনে জেলে ঢুকানো হয়েছে। একবার দেখানো হচ্ছে যে আমাকে জেলখানা থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে আবার পরপরই হচ্ছে যে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুনভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্যে জেলে রাখা যাবে।

আমরা যারা কমিউনিস্ট কর্মী, আমাদের যখন পুলিশ ধরত তখন তারা আমাদের ঠাট্টা করে বলত, যান, যান, আপনারা জেলখানায় গিয়ে পার্টি করেন। বাইরে কেন এত কষ্ট করেন? কিংবা নাজির জমাদার, যাকে আমরা সিকিউরিটি জমাদার বলতাম অর্থাৎ সিকিউরিটি প্রিজনারদের দায়িত্বে যারা থাকত তাদের বিভিন্ন র‍্যাঙ্ক ছিল। জমাদার একটা খুব বড় র‍্যাঙ্ক। আমি জানি না নাজির জমাদার এখনো বেঁচে আছেন কি না। আমাদের যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল এবং যখন আমাদের সিকিউরিটি জেলে ঢুকানো হল তখন সে তার বিহারিভঙ্গি মেশানো বাংলায় আমাদের বলল, যাইয়ে যাইয়ে, অন্দরমে যাইয়ে। এখান থেকে আর বেরুতে হবে না। কথাটা সত্যি। ১৯৪৮ সাল থেকে সব কমিউনিস্ট কর্মীদের মুসলিম লীগ সরকার গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে। মুসলিম লীগ প্রশাসন জানত এই কমিউনিস্টরাই হচ্ছে পাকিস্তানের প্রধান শত্রু। কারণ তখন পর্যন্ত পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তিটা মুসলিম কর্মীদের মধ্যে শুরু হয়নি। সেটা আওয়ামী লীগের কথাই বলি বা মুসলিম লীগের কথাই বলি।

২৫. কখন গেলেন, কখন এলেন? : এটাই কি সব?

লোকজন আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে, আপনি কখন জেলে গেলেন? আমি উত্তর দিই আমি প্রথম ১৯৪৯ সালে জেলে গেলাম। এরপর তারা জিজ্ঞেস করে আপনি কবে জেল থেকে বের হলেন? আমি বলি ১৯৫৫ সালে। মাঝখানে আমি আমার জেল জীবনের দীর্ঘ ৬/৭ টি বছর কেমন করে কাটালাম-এটা তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে না। বাইরে যারা থাকে তাদের মনে এই প্রশ্নটা আসে না। তারা মনে করে জেল ইজ জেল। সেখানে লোকে যায় আর বেরিয়ে আসে। কিন্তু একটা লোক যদি রাজনৈতিকভাবে জেলে যায় এবং যদি রাজনৈতিকভাবেই বের হয়ে আসতে পারে তবে সেটা সোজা কথা নয়। এটা একটা বড় কথা। তুমি কেমন করে তোমার রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ বা মরাল রক্ষা করে জেল থেকে জীবন্ত বের হয়ে আসতে পারলে! এই ইতিহাস বাংলাদেশে এখনো অজানা। জেলের ভেতরকার ইতিহাস যারা জানতে চায় তাদের এটা জানা উচিত।

গোয়েন্দা বিভাগ সিদ্ধান্ত নিত কোন্ সিকিউরিটি প্রিজনারকে কোন জেলে রাখা হবে। জেলখানার ভেতরেও ম্যাপ দেখে তারা বলতে পারত কে কোনখানে আছে বা কার কোত্থানে থাকা উচিত, তার সমস্ত চার্ট ওরা করত। তাদের নির্দেশেই জেল প্রশাসন পলিটিক্যাল প্রিয়জনারদের ডিল করত। ওদের নিয়ম ছিল এক জেলে কোনো প্রিয়জনারকে একসঙ্গে বেশিদিন রাখা যাবে না এবং প্রিয়জনারকে তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে যত দূরে রাখা যায় তত ভালো। জেলখানার মধ্যেও পলিটিক্যাল প্রিয়জনারদের সাধারণ কয়েদি থেকে আলাদা ভাবে রাখতে হবে।

জেলখানায় কিছু সেল থাকে। সেল হচ্ছে দশ হাত বাই পাঁচ হাতের খুপরির মতো এক একটা ঘর যাতে একটি দরজা থাকে। এই সেলের মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে একজন বন্দিকে সারা দিনরাত তলা দিয়ে রাখতে পারত। দিনের বেলায় যদি কখনো রাজবন্দিকে বার করত তৰুও ঐ সেলের সামনে যে উঁচু দেয়াল আছে তার সামনেই তারা কিছুক্ষণ পদচারণা করতে পারত। রাতে সেলের মধ্যে একটা টুকরি রাখা থাকত। সেই টুকরির মধ্যেই রাজবন্দিকে তার প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে হত। সকাল বেলা হয়তো সেল খুলে দিত। বন্দিকে কিছুক্ষণ পদচারণা করিয়ে আবার সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হত।

জেলে বইপত্র যা ছিল তা তারা পড়তে পারত। আত্মীয়স্বজনেরা যদি কোনো বইপত্র বন্দির নামে জমা দিত তবে জেল কর্তৃপক্ষ এইসব বইপত্র আইবি অফিসে পাঠিয়ে দিত। আইবি অফিস এইসব বইপত্র চেক করে যে বইয়ের উপর ওরা সেন্সরড এন্ড পাসড মেরে দিত সে বইগুলো আবার জেলখানায় আসত। তখন প্রিজনারেরা সেগুলো পড়তে পারত। জেলে অনেকেই লেখাপড়া বা গবেষণামূলক কাজ করতে পেরেছেন। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অনিল মুখার্জী এঁরা সবাই জেলে বসে ভালো কাজ করেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত যেসব রাজবন্দি তারা জেলখানায় গিয়ে চিন্তা করতেন, জেলখানার সময়টা তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন লেখাপড়ার কাজে। কিন্তু আমরা যারা মুসলমান রাজবন্দি আমাদের লেখাপড়ার কোনো ট্র্যাডিশন তেমন ছিল না। আমরা মুসলমানেরা জেলখানায় গিয়েই ভেঙে পড়তাম। আমাদের মধ্যে ভেঙে পড়ার যে প্রবণতা এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল।

জেলখানায় সেল কথাটির একটি প্রতিশব্দ আছে। প্রতিশব্দটি হচ্ছে ডিগ্রি। ইসকো ডিগ্রিমে লে যাও। আট ডিগ্রিমে।–অফিস থেকে এ রকম অর্ডার হল। আট ডিগ্রি বা আট নাম্বার সেলটি হচ্ছে ফাঁসির সেল। ফাঁসি দেবার আগে আসামিকে এইসব সেলে রাখা হয়। আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন। যদিও আমি তেমন কোনো নেতা নই। তবুও গোয়েন্দা বিভাগ থেকে হুকুম পাঠিয়েছে–সরদার ফজলুল করিমকে অন্য প্রিজনার থেকে আলাদা করা হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কতদিন সেলে রাখবে তার ঠিক নেই কিছু। আমাকে ওখানে খাওয়াদাওয়া দেওয়া হত। সেলে কারো সাথে কোনো আলাপ করতে পারি না। বই-পত্র দেওয়া হয় না। হাঁটাচলারও উপায় নেই।

পূর্ব পাকিস্তানের জেলখানায় কৃষক আসছে, শ্রমিক আসছে, ক্ষেতমজুর আসছে, শিক্ষক আসছে, তরুণ ছাত্র আসছে, কত বিচিত্র ধরনের লোকজন! এটা সাংঘাতিক একটা ব্যাপার। পূর্ববঙ্গে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত জেলখানায় যারা ছিল তাদের উপর বিস্তারিত গবেষণা হওয়ার দরকার। জেলখানার ফাইল দেথে তাদের জেল জীবনের ইতিহাস তৈরি করা একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজ। কোনো সিরিয়াস গবেষক সরকারের কাছে আবেদন করে পুরোনো ফাইলপত্র উদ্ধার করে তার মধ্য থেকে সেই সময়ের রাজবন্দিদের একটা পোর্ট্রেট দাঁড় করাতে পারে। কথাটা এ কারণে বলছি যে, আমাদের এখানে কিছুই আর থাকছে না। সব মুছে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে আমি মুছে যাবো। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের যেসব বন্ধুরা আজ আমাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছেন–এটা তাদের একটা আন্তরিক চেষ্টা। ওঁরা বলছেন, না, আমরা কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করবো, সব মুছে যেতে দেবো না।

২৬. অনশন ধর্মঘট

আমি যখন ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে ঢাকা জেলে ঢুকলাম তখন আমি জানতে পারলাম যে জেলখানায় একটা অনশন ধর্মঘট চলছে। এই অনশন ধর্মঘটের একটি ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ আমলে রাজবন্দিদেরকে সম্মানের সাথে রাখা। হত। কখনো কখনো তাদের জেলখানা থেকে বের করে থানা ডিটেনশানে রাখা হতে কোনো ওসির দায়িত্বে। তারা ঐ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারত না। সেখানে তাদের জন্য কিছু খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা হত। তারপর বছর দুই-তিনেক পরে তাদের পুরোপুরি রিলিজ দিয়ে দেওয়া হত। তাদের হাত খরচা ছিল ও পোশাকআশাক ছিল। হাতখরচা কত ছিল তা আমি জানি না। বিভিন্ন গ্রেড ছিল নিশ্চয়ই রাজবন্দির। হাতখরচার টাকাটা তাদের পরিবার যেতে পারত।

পাকিস্তান হওয়ার পর যখন মুসলিম লীগ সরকার যে আইনের বলে পলিটিক্যাল কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে আরম্ভ করল সেটার নাম দিল তারা। আন্ডার সিকিউরিটি এ্যাক্ট বা নিরাপত্তা আইন। এই আইনে বন্দিদের যতদিন খুশি জেলে রাখা যেতে পারে, কোনো বিচার-আচার ছাড়াই। এইসব বন্দিদের কোনো প্রকার ভাতা দেওয়া হত না। ব্রিটিশ আমলে যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত রাজবন্দিদের, সমস্ত সুযোগসুবিধা বাতিল করা হল। তাদের মোটামুটিভাবে জেলখানার মেঝেতে মানে ফ্লোরে নামিয়ে দেওয়া হল।

ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের মানবেতর পরিবেশের প্রতিবাদে সিকিউরিটি প্রিজনাররা অনশন করছেন। অনশন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রথম ছয়দিন কর্তৃপক্ষ অনশনকারীদের সামনে খাবার রাখত, অনশনকারীরা তা স্পর্শ করত না, কর্তৃপক্ষ খাবার তুলে নিত। এই প্রক্রিয়াটা ছয় দিন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ চলতে দিত। ছয় দিনের পর থেকে জেলের ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, তাদের সহকারীরা মানে সাধারণ কয়েদিরা দল বেঁধে এসে অনশনকারীদের বাধা দিত কিন্তু এমন কিছু সুইসাইডাল বাধা নয়; কারণ তারা তো জেলে মরতে আসেনি। তারা বেঁচে থাকতে এসেছিল যাতে তাদের আদর্শের বাস্ত বায়ন তারা করতে পারে ভবিষ্যতে–এই ছিল তাদের মনের ইচ্ছা ও চেষ্টা।

অনশনের সেদিন ছিল ২০তম দিন। ২০তম দিনে কুষ্টিয়ার এক শ্রমিক নেতা শিবেন রায় মারা যান। সেদিন কর্তৃপক্ষ একদল জঙ্গি কয়েদি নিয়ে এসেছিল তাকে ফোর্স ফিডিং করাতে। তাদের সাথে ছিল একটা রাবারের নল। এই নলটা নাকের মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। নলের একদিকে ঢোকানো হত পানি মিশ্রিত দুধ। জেলের ডাক্তার-কম্পাউন্ডারেরা মনে করত, এই তরলটা পেটে গেলে প্রিজনার অনশনজনিত কারণে মারা যাবে না। এটা অনেকটা জোর করে অনশন ভঙ্গ করানো। স্বাভাবিক কারণেই প্রিজনাররা এটা করতে দিতে চাইত না।

মানুষের শরীরের শ্বাসনালী আর খাদ্যনালী পাশাপাশি। আমাদের নাক থেকে দুটো পথের একটি খাদ্যনালী হয়ে গেছে পাকস্থলীতে আর অন্যটি শ্বাসনালী হয়ে গেছে ফুসফুসে। কয়েদিরা যখন জোর করে কমরেড শিবেন রায়ের নাক দিয়ে নলটা ঢুকিয়েছে সে নলটা খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল। শিবেন রায় তার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে চিৎকার করেছে, কিন্তু কয়েদিরা তার কথা শোনেনি। তারা ঐভাবেই দুধ ঢেলে শিবেন রায়কে সেলে তালা মেরে চলে গেছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। রাতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অনশনের ২০তম দিবসে শিবেন রায় মারা যান। এটা খুবই দুঃখজনক একটা ব্যাপার। সাধারণত পলিটিক্যাল প্রিজনারেরা এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে জেলের ভিতরে চিৎকার করত, স্লোগান দিত : রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, ইত্যাদি। সেদিনও তারা স্লোগান দিয়েছে। কিন্তু তাতে কারো কিছু এসে যায়নি। জেলখানার চার দেয়াল পার হয়ে বন্দিদের এসব প্রতিবাদ বা চিৎকার কখনোই বাইরে পৌঁছাত না। বাইরের কর্মীরা অবশ্য চেষ্টা করছিল পোস্টার লাগিয়ে জনগণকে এই অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে অবহিত করতে। সুতরাং বাইরের লোকেরা এ সম্পর্কে কিছুটা জানত, তবে সাধারণ মানুষ তেমন একটা জানত না।

শিবেন রায় যেদিন মারা যান সেদিনই রাতে আমাকে ঢাকা জেলে ঢোকানো হয়। জেলে ঢোকার পর আমরা ঠিক করলাম যে আমরাও এই অনশনে যোগ দেব। পরদিন সকালে যখন সিপাহীরা আমাদের সামনে খাবার রেখে গেল, খিচুড়ি বা ভাত, আমরা তাদের খাবারটা রাখতে দিলাম কিন্তু খাবারটা আমরা স্পর্শ করলাম না। দ্বিতীয় দিনও খাবার প্রত্যাখ্যান করলাম। আমার সেলে কলসিভরা পানি থাকত। পাশে থাকত লবণ। গ্লাসে কিংবা বাটিতে লবণ মিশিয়ে জল খেতে লাগলাম। তখন সিপাহী এবং হাবিলদারেরা প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট দিল যে নতুন যারা এসেছে তারাও অনশন ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে।

বাই দিস টাইম দি হোল জেল ওয়াজ ফুল অব কমিউনিস্ট। জেল প্রশাসনের নীতি ছিল এ রকম যে, সাধারণ কয়েদিকে পলিটিক্যাল প্রিজনার্সদের সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না। মিশতে দিলে তারা সাধারণ কয়েদিদেরকে পলিটিকাললাইজ করবে। সাধারণ কয়েদিদের বলা হল এদের সাথে তোমরা মিশবে না। এরা হচ্ছে পাকিস্তানের শত্রু! সাধারণ কয়েদিরা সবাই পাকিস্তানের বন্ধু হয়ে গেল এবং তাদের দিয়ে মাঝে মাঝেই রাজবন্দিদের পেটানোর ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হল। পুরোপুরি একটা অমানবিক ব্যাপার।

রাজবন্দিরা তো একে অপরের সঙ্গে মিশতে পারছে না। কিন্তু সিপাহীদের মধ্যে ভালো কিছু লোক ছিল। তাদেরকে দিয়ে এক রাজবন্দি অন্য রাজবন্দির কাছে খবর পাঠাত বা একটা চিঠি সিপাহীর হাতে দিয়ে হয়তো কেউ বলত, এই চিঠিটা আপনি তাঁতীবাজারে অমুক ঠিকানায় একটু পৌঁছে দেবেন। যোগাযোগের আর একটা উপায় বের করল মুসলমান প্রিজনারেরা। তারা দাবি। করল শুক্রবারে তাদের জুম্মার নামায পড়তে দিতে হবে। তারা যে বাইরে খুব একটা নামায রোযা ইত্যাদি পালন করত তা কিন্তু নয়। যেহেতু ধর্মীয়ভাবে দাবিটা করা হচ্ছে, সেহেতু জেল কর্তৃপক্ষের পক্ষে এ দাবি পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং সিপাহীদের তত্ত্বাবধানে তাদের শুক্রবারে একটা জায়গায় নিয়ে হাজির করা হত। রাজবন্দিরা যখন মোনাজাত করত তখন দুই হাত তুলে মোনাজাত করার সময় প্রথম কথাটা তারা জিজ্ঞেস করত, তোমরা কেমন আছো? অবস্থা কি? আমাদের তো জেলখানায় বেঁচে থাকতে হবে। জেলখানায় কিইবা আমরা করতে পারি। একমাত্র পথ যে খাবার দিচ্ছে জেলখানায় তা প্রত্যাখ্যান করা। খাবারও এমন কিছু ভালো ছিল না। যাচ্ছেতাই একেবারে।

জেলখানায় যদি কোনো প্রিজনার খাবার প্রত্যাখ্যান করে তবে তা হয় একটা এ্যাডিশনাল ক্রাইম। জেলখানায় ফাইল করা বলে একটা কথা আছে। সবাইকে লাইন ধরে বসতে হবে এবং আই জি পি অর্থাৎ ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন যখন সামনে দিয়ে যাবে তাকে হাত তুলে সালাম করতে হবে। এসব ব্যাপারে রাজবন্দিরা বিভিন্ন সময়ে আপত্তি জানিয়েছে। প্রতিটি প্রিজনারের টিকেট ছিল একটা। সেই টিকেটে তার নাম ধাম, ঠিকানা এবং অপরাধের বিবরণ লেখা থাকত। জেলের ভিতরে একটা জেল কোর্ট বসে। সেই কোর্টে জমাদার বা হাবিলদারেরা তাদের আসামিদের হাজির করত এবং প্রিজনারেরা জেলের অভ্যন্তরে তার অপরাধের জন্যে শাস্তি পেত। শাস্তি হতে পারে এ রকম : আসামিকে এক সপ্তাহ সেলে রাখা হোক। প্রিজনার যদি একটা বড় ওয়ার্ডে আর পাঁচজন বন্ধুদের সঙ্গে থেকে থাকে, তবে সেখান থেকে তাকে আলাদা করে একটা সেলে নিয়ে যাওয়া হোক। সাতদিন সেখানে সে একা থাকবে। সাতদিন পর তাকে আবার ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হোক। অথবা তাকে পেনাল ডায়েট দেওয়া হোক, তাকে সাতদিন ধরে শুধু ফেনভাত দেওয়া। হোক। এই রকম বিভিন্ন ধরনের শাস্তি জেলে দেওয়া হত।

অনশনের ফলে স্বাভাবিক ভাবেই শরীর দুর্বল হতে থাকে। আমি খেয়াল করে দেখেছি, এ রকম অবস্থায় শরীর কি করে। শরীর তখন স্বপ্ন দেখে। কিসের স্বপ্ন? খাবারদাবারের স্বপ্ন। শরীর তার চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে নিজের মতো করে। আমি হয়তো স্বপ্ন দেখলাম, আমি নবাবপুরের রাস্তা দিয়ে। হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকানে ঢুকে গেছি এবং মিষ্টি খাচ্ছি। এই যে ইচ্ছাপূরণ এই ইচ্ছাপূরণের ব্যাপার কিন্তু সবারই থাকত। যারা ধূমপানে আসক্ত ছিলেন তাদের খুব অসুবিধা হত। অনশন ধর্মঘট না থাকলে কনসোলিডেশন বিড়ির ব্যবস্থা করত। কিন্তু অনশন ধর্মঘট তো একটা। পীড়নমূলক ব্যাপার। সুতরাং তখন বিড়ির ব্যবস্থা করতে পারত না এবং ধূমপায়ী ব্যক্তিদের খুবই কষ্ট হত। তাদের মনে তখন একটা প্রশ্ন জাগত–আর কতদিন? প্রত্যেকটি ব্যক্তির মনেই কারাবাসের নির্দিষ্ট একটা সময়ে গিয়ে এই প্রশ্নটি জাগত। রাজবন্দিদের মধ্যে যারা একটু অগ্রসর তাদের কাউকে যখন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হত তখন তিনি পাশের বেড়ে শুয়ে থাকা প্রিজনারদের উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করতেন। তিনি বলতেন, আমাদের আন্দামানের কাহিনী আছে যেখানে তারা ৬০ দিন অনশন ধর্মঘট করেছে। তাদের অনেককে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কি করা? আমাদের তো একটা আদর্শ নিয়ে থাকতে হবে। এভাবে তারা অন্যদের রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করতেন যাতে তারা মানসিকভাবে ভেঙে না পড়েন।

যদিও আমি ২০তম দিবসে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছি তবুও আমার শরীর তো দুই-এক দিন পরেই অনশন ভাঙতে চায়। আমার মন তা চায় না কিন্তু শরীর তা চায়। আমি তখন নিজের মনকে বলতাম, আমার তো ভাঙার দিন এখনো আসেনি। আমার সাথীরা ইতোমধ্যে ২০ দিন অনশন করেছে। আমি যখন ২০ দিন পার করতে পারব এবং তারা ২১ দিন অনশন করবে তখন আমি নিজেকে বলতে পারব যে আমি এখন আর থাকতে পারছি না। এই যে একটা মনোবল যে, আমার সাথীরা অতদিন পার করেছে, আমিও ততদিন পার হয়ে নিই তারপর দেখা যাবে। এভাবে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে আমাকে চলতে হয়েছে।

আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আল-মুতী শরফুদ্দীন এই অনশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। আল-মুতী যখন তাঁর স্মৃতিচারণ করেন তখন তিনি এই অনশনের উল্লেখ করেন না। আমরা কিন্তু করি। আল-মুতী বড় লেখক ছিলেন। সহজ ভাষায় লিখতেন। আমার খুব বন্ধু মানুষ। তাকে বলা যেতে পারে পূর্ববঙ্গের রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। তিনি অনশন চালিয়ে গেছেন। অনেক ভুগেছেন তিনি। অনশন ধর্মঘটের পরে তার বাবা তাকে রিলিজ করে নিয়ে যান। রিলিজ করে নিয়ে যাওয়াতেই তিনি ফিজিক্সে তাঁর এমএসসিটা শেষ করতে পারেন।

জেলখানায় মানবেতর পরিবেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে পলিটিক্যাল প্রিজনারেরা অনশন ধর্মঘটকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন যথাসাধ্য। সব সময়, সব জায়গায় তারা তা করতে পারেননি। অত্যাচার হয়েছে তাদের উপর। যেমন সিলেট জেলে আমি শুনেছি, সেখানে বয়স্ক সব প্রিজনারদের লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে পিঠে দাগ করে দিয়েছে। আর একটা মেথড ছিল। প্রিজনারেরা বলেছে, আমরা আর কিছু খাব না, শুধু জল খাব। জলের সাথে লবণ মিশিয়ে তারা খেত। এতে করে শরীরে অনশনের প্রতিক্রিয়াটা যে পরিমাণ হওয়ার কথা সে পরিমাণ হত না, একটু কম হত। এটা রাজবন্দিরা শিখেছিল আন্দামান ফেরত বন্দিদের কাছ থেকে। কিন্তু সিলেট জেলে কর্তৃপক্ষ জলের কলসও সরিয়ে নিয়েছিল। জলও খেতে দেয়নি। সাথী প্রিজনারেরা আমাকে বলেছে, ছয়দিন পর আমার সারা শরীর গরম হয়ে গেছে, আমি আমার কাপড়-জামা খুলে ফেলেছি, যন্ত্রণায় আমি মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়েছি। আমার জিহ্বা শুকিয়ে গেছে। জিহ্বা থেকে আমার রক্ত বের হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রিজনারদের সারেন্ডার করতে হয়। বা জেলপ্রশাসনও এগিয়ে আসে অনশন ভাঙাতে। এভাবেই অনশন ধর্মঘটগুলো শেষ হয়। তবে ঢাকা জেলের অনশন ধর্মঘটটা অনশনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এ ধর্মঘটটা দীর্ঘ ৫৮ দিন চলেছিল। অনশন হচ্ছে জেলখানায় প্রিজনারদের প্রতিবাদ করার একমাত্র উপায়। উপায়টি সুইসাইডাল ছিল অবশ্যই, কিন্তু এ ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো উপায় ছিল না।

২৭. কনসোলিডেশন

 জেলখানায় আমাদের জীবনটা সহজ ছিল না। বেশ কঠিন এই জীবন। জেল প্রশাসন অবশেষে একদিন জানতে চাইল, আমাদের নেতা কে? আপনাদেরও। জানতে ইচ্ছে হতে পারে, প্রিজনারেরা তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করত কীভাবে? পলিটিক্যাল প্রিজনারেরা ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ধরা যাক, একটা ঘরের মধ্যে ত্রিশজন সিকিউরিটি প্রিজনার আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটা কমিটি তৈরি করত। এর নাম ছিল কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন। কনসোলিডেশনের একজন মুখপাত্র নির্বাচন করা হত। কনসোলিডেশনের কাজ ছিল অর্গানাইজ করা।

আমাদের দাবিগুলো কী কী? আমরা বলতাম, আমরা এই চাই। আমাদের বিছানা দিতে হবে। আমাদের অন্তত জামাকাপড় দিতে হবে। আমাদের খাবারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমাদের কমিটি দাবি করত, আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আমরাই করব। আমাদের একটি রান্নাঘর দেওয়া হোক এবং সাধারণ কয়েদিদের কয়েকজনকে আমাদের হেল্পার হিসেবে দেওয়া হোক। রেশন গুদাম থেকে আমাদের জন্যে বরাদ্দকৃত রেশন আমরাই নিয়ে আসবো। রেশন আমরা কীভাবে ব্যবহার করব তা আমাদের ব্যাপার। এ রকম একটি দাবিনামা প্রশাসন নিয়ে যেত প্রিজনারদের মুখপাত্রের কাছ থেকে। প্রশাসন বলত, আমরা তো এটা করতে পারি না। আমরা এটা হোম মিনিসট্রিতে পাঠিয়ে দেবো। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন এ ব্যাপারে। আমরা সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেব।

অবশেষে জেল প্রশাসন বলল, ঠিক আছে, এই বরং ভালো। প্রিজনাররা খাওয়াদাওয়া নিয়ে হাঙ্গামা করার চাইতে নিজেদের খাবার যদি নিজেরা তৈরি করে নেয়, মন্দ কি? কমিটি একজনকে মুখপাত্র নির্বাচন করত। মুখপাত্র যিনি হতেন প্রশাসন তাকে মেনে নিত। তার সঙ্গেই তারা কথাবার্তা চালাত। আমাদের পার্সোনাল ক্যাশ অফিসে জমা থাকত। তার থেকে আমরা অল্পস্বল্প খরচ করতে পারতাম। ধরা যাক, একটা খাতা কিনলাম। তার আবার হিসাব থাকত।

এভাবে জেলখানার মধ্যেই কমিউনিস্টদের একটা অর্গানাইজেশন বা জার্ম অব অর্গানাইজেশন দাঁড় করানোর চেষ্টা হত। মুখপাত্র খেয়াল রাখতেন যে, তার যে অন্য কমরেডরা আছেন, তাদের কারো মনোবল যেন ভেঙে না পড়ে। ধরুন, একজন ক্ষেতমজুর, একজন দিনাজপুরের এক সাঁওতাল, একজন মধ্যবিত্ত–এদের সবার মনোবল অটুট রাখা কনসোলিডেশনের দায়িত্ব। এমনও হয়েছে জেলের ভিতর থেকে একটা চিঠি লিখে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া। হয়েছে। সেই চিঠি বাইরে থেকে পোস্ট করা হয়েছে কমরেডের নামে। চিঠি পড়ে কমরেডের মনোবল ফিরে এসেছে।

যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিত, তবে সপ্তাহে একদিন এক জায়গায় বসে পত্রিকা পাঠ করা, পাঠ করে অন্যদের শোনানো ইত্যাদির আয়োজন করা হত। এক কমরেডকে দায়িত্ব দেওয়া হত যে, আপনি একদিন সন্ধ্যায় আমাদের লক আপে বন্ধ করার আগে গত পনেরো দিনে কী কী ঘটলো তা আমাদের জানাবেন এবং এরপর আমরা সবাই একসাথে আলোচনা করব। এসব করা হত যাতে পলিটিক্যাল প্রিজনারদের ইন্টেলেকচুয়াল ফুডটা দেওয়া যায়, যাতে মানসিকভাবে তারা ভেঙে না পড়ে। এ রকম এক একটা মেথড পলিটিক্যাল প্রিজনারেরা বের করত যাতে পলিটিক্যালি তারা বেঁচে থাকতে পারে।

আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরী ছিলেন তখন মন্ত্রী। তিনি মাঝে মাঝে জেল পরিদর্শন করতে যেতেন। এ ব্যাপারে তার কোনো ভূমিকা ছিল কিনা জানি না, কিন্তু এক সময় মুখপাত্র প্রশাসনের ইতিবাচক জবাব নিয়ে এল। সব দাবি তো আর প্রশাসন মানবে না। ধরুন, ডায়েটের বাজেটটা তারা দেড় টাকার। জায়গায় দু টাকা করবে। ছয় মাস অন্তর একটা হাফ শার্ট আর একটা লুঙ্গি দেবে। বিছানা হিসেবে একটা লোহার খাট আর তার উপরে একটা ছোবড়ার গদি ওরা দিতে রাজি আছে। একটা চাদরও পাওয়া যাবে। কলসোলিডেশনের মিটিং-এ অনশনকারীদের বলা হত–এই হচ্ছে বর্তমান অবস্থা। এর বাইরে আমরা কিছু পেতে পারব না। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে : আমরা অনশন ভাঙব, কি ভাঙব না। তখন নানান জনে নানান কথা বলল। কেউ হয়তো বলল, না এতে চলবে না। মরে গেলে মরে যাবো। জেলখানায় যখন এসেছি, আমরা কি আর জীবনের মায়া করি? কিন্তু অন্য কেউ হয়তো মন্তব্য করল, তাই বলে তো আমরা আত্মহত্যা করার জন্যে এখানে আসিনি।

এই দুইটা সাইডই আমাদের বিবেচনা করতে হবে। তখন একটা পর্যায়ে কনসোলিডেশন স্থির করে যে, আমাদের আপাতত এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই মেসেজটা যখন জেল-প্রশাসনকে দেওয়া হয় তখন তারা সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা মেনে নিলে ৫৮ দিনের অনশনের অবসান হয়। কিন্তু প্রিজনাররা বলে যে এভাবে তো হবে না। আমাদের একদিন একত্রিত হতে দিতে হবে। সেদিন মিলিতভাবে আমরা এই বিজয়টা সেলিব্রেট করব। সেদিন আমাদের একটু ভালো খাবারদাবার দিতে হবে।

প্রশাসন মেনে নিল এই দাবি। সবাইকে একদিন একত্রিত হতে দিল। ভালো খাবার মানে খিচুড়ির ব্যবস্থা হল। এই দীর্ঘ অনশনকালে অনেক সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল। অনশন করতে করতে অনেকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল। একটা সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। একজন প্রিজনার হয়তো অন্য পাঁচজনের সামনে বিবস্ত্র হয়ে যাচ্ছিল। সে যে বিবস্ত্র হয়ে যাচ্ছে–এটাও সে খেয়াল করতে পারছে না। চট্টগ্রামের কমরেড আব্দুস সাত্তারের কথা মনে পড়ছে আমাদের। কৃষক নেতা ছিলেন তিনি। তাকে আমি এ রকম অবস্থায় দেখেছি। কিংবা হয়তো কোনো কমরেড় বলছেন, আমি ওসব ব্রেক-ট্রেক বুঝি না। কিছু খাবো না আমি। আমরা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি এই বলে : এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। আমরা অনশন ভঙ্গ করবো। আপনি এই সরবতটা খান। তিনি তখন জবাব দিলেন, দালালদের কথা আমি শুনবো না। ফণি গুহ নামে ঢাকা জেলার একজন নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টকে অনশন ধর্মঘটের পরে ময়মনসিংহ জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান। অনশনের ধকল তিনি সহ্য করতে পারেননি। অনশনের ফলে শরীরে অনেক ধরনের বিকার শুরু হয়ে যায়। এসব বিকার সবাই সহ্য করতে পারেন না। ৫৮তম দিবসে আমিও অনশন ভঙ্গ করেছিলাম। আমার শরীরের ক্ষতি যা হবার তা তো ইতোমধ্যে হয়েই গিয়েছে।

২৮. জেল থেকে জেলান্তর

জেল জগতটা একটা ভিন্ন জগৎ। আমাদের পৃথিবীটা যেমন গোল, জেলটাও গোল। জেলের এক জায়গা থেকে যদি আপনি শুরু করেন তবে ঘুরতে ঘুরতে সেই জায়গাতেই আপনি শেষ করবেন। জেলের মধ্যেও জেল আছে, অসংখ্য জেল আছে। বিভিন্ন রকম সেগ্রিগেশন আছে জেলে। নানান রকমের টর্চার। আছে। হ্যান্ড ক্যাফ দেওয়া, সলিটারি সেলে রাখা, প্রত্যেকদিন কোর্ট বসানো। জেলের প্রত্যেক প্রিজনারের নামে একটা টিকেট আছে। এই টিকেটের মধ্যে প্রিজনারের ইতিহাস লেখা থাকে। শাস্তি শেষে প্রিজনারের টিকেট জেলারের সামনে হাজির করা হয়। পলিটিক্যাল প্রিজনারদের বদলি করা হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। পলিটিক্যাল প্রিজনারদের সব সময়ই একটা টেনশানে থাকতে হয়, কখন তার ডাক আসে, কখন জমাদার এসে বলে চলিয়ে! কতবার যে আমি শুনেছি এই ডাক, চলিয়ে সরদার সাহাব। শুনে চলে যেতে হয়েছে অন্য জায়গায়। কি আর করবো, যাওয়া ছাড়া!

অনশন ধর্মঘটের পরে জেল-প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিল ঢাকা জেলে যারা অনশন করেছে তাদের আর ঢাকা জেলে রাখা যাবে না। তাদের খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল পরিবার থেকে আমাদের যত দূরে রাখা যায়। গোয়েন্দা বিভাগ এ ব্যাপারে জেল প্রশাসনকে পরিচালনা করত। যে জমাদার সিকিউরিটি প্রিজনারদের ইনচার্জ ছিল সে একদিন হয়তো এসে বলল, কই, সরদার সাহাব কাহা? আমি যখন সামনে এগিয়ে গেলাম তখন আমাকে বলল, চলিয়ে। আপকা বিছানাপত্র গুটাইয়ে। আমি বিছানাপত্র গুটিয়ে নিলাম।

কয়েদি নেওয়ার দিন আগে থেকে পুলিশ বুক করা থাকে। সিলেট গেলে তো ট্রেনে যেতে হবে। ট্রেনে ওরা আগে থেকে বন্দোবস্ত করে। পুলিশ কর্ডন দিয়ে স্টেশনে নিয়ে যায়। ট্রেনে সেন্ট্রি বসে থাকে সাথে। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নেবার সময় প্রিজনারদের ওরা হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখে যাতে তারা পালাতে না পারে। যে জায়গায় যেতে হবে সেখানে নেমে নতুন জেলে নিয়ে গিয়ে প্রিজনারকে জেলারের হাতে সোপর্দ করে প্রিজনার বুঝে পেলাম।–এই মর্মে একটা রিলিজ অর্ডার নিয়ে নেয়। এর পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য পলিটিক্যাল প্রিজনারেরা যেখানে আছে সেখানে।

পরদিন আমাকে নিয়ে গেল অফিসে। আমাকে জানানো হল যে সিলেট জেলে বদলি করা হয়েছে আমাকে। আমার সঙ্গে আরো একজন পলিটিক্যাল প্রিজনার ছিল বোধ হয়। তার নাম সফি, সামসুদ্দীনের ভাই। এখন সে সাংবাদিক। আমাদের দুজনকে সিলেট জেলে পাঠিয়ে দিল। ঢাকা জেল থেকে সিলেট জেলে গিয়েছি ১৯৫১ সালে। সিলেটে বেশ কয়েক মাস ছিলাম। সেখানে বিখ্যাত নানকার নেতা অজয় ভট্টাচার্যের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। খুব দক্ষ লোক এবং সাহিত্যিক। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আমার খুব শ্রদ্ধেয় একজন লোক। এ রকম লোক আরো আছে। সত্যব্রত নামে একজন তরুণ ছাত্র এবং ওর বড় ভাই মঞ্জুব্রত দাশ তখন ছিল সিলেট জেলে। সত্যব্রত পরে মণি সিং-এর আত্মীয় হয়। সত্যব্রত দাশ, অজয় ভট্টাচার্যদের উপর কী রকম অত্যাচার করা হয়েছিল সে কাহিনীটা আমি সিলেট জেলে গিয়ে পাই।

সিলেটে আমাদের ওয়ার্ডে লোহার শিক ছিল না। তার বদলে দেশী বাশ ব্যবহার করা হত। অন্য জেলে বিছানা হত লোহার। সিলেট জেলে বিছানা ছিল শ্লোপিং সিমেন্টের। মাথাটা উপরের দিকে, পা-টা নিচের দিকে। এক একটা কায়দা, মন্দ না। খরচও বেশি নয়। আমরা মোটামুটি একটা বড় এলাকায় ছিলাম, মিশতে দিত, খেলতে দিত। বিভিন্ন দিবস আমরা পালন করতাম। জেল-প্রশাসন বাধা দিত না।

সিলেটে গিয়ে আমি শুনলাম যে ঢাকা জেলের কাহিনী শুনে সিলেট জেলের প্রিজনাররাও অনশন করেছিল। তখন তাদের উপর যে নির্মম অত্যাচার করা হয় সেটাকে সীমারের কাহিনীর পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে। কোনো প্রিজনার হয়তো শরীরের কাপড়চোপড় খুলে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে শরীর ঠাণ্ডা করার জন্যে। এদের কাছ থেকে জলের কলসিটাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে যাতে তারা জল পান করতে না পারে।

এরপর আমাকে কয়েক মাস পরে রাজশাহী জেলে নিয়ে আসা হয়। রাজশাহী খুব গরম জায়গা। সেখানে কিছুদিন আমি ওয়ার্ডে ছিলাম। কখনো শাস্তি হিসেবে আমাকে সেলেও রাখা হয়েছে। আমাকেই শুধু নয়, আরো অনেককেই আটকে রাখা হয়েছিল। রাজশাহীতে বসেই আমি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাটা শুনি। ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমি জেলে। ২১ তারিখে অবশ্য খবরটা আমরা জানতে পারিনি। সে সময় ঢাকার কাগজ এক দিনেই রাজশাহী পৌঁছাত না। ২৩ তারিখ যখন খবরের কাগজ গেল তখন আমরা তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কিন্তু খবর কাগজে দেখলাম প্রায় সবটাই কাটা। সব কেটে বিশাল জানালা বানানো হয়েছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খবর থাকলে প্রশাসন সেটা কেটে রেখে তারপর আমাদের পত্রিকাটা পড়তে দিত। এ থেকে আমরা বুঝতে পারতাম সাংঘাতিক কোনো খবর আছে। সে খবর আমাদের জানতে দেওয়া হবে না। আমরা চিৎকার করে উঠলাম, এই আসো, আসো, দ্যাখো, কী বিরাট জানালা বানিয়েছে। এর ভিতর দিয়ে আমরা নিজেরাই তো এপার থেকে ওপারে যেতে পারি। আমরা তাই করলাম, এপার থেকে ওপারে গেলাম, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলাম। আমরা যেন নূতন জীবন পেলাম।

রাজশাহী জেলে একদিন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা ডেপুটি কমিশনার হিসেবে জেল পরিদর্শনে এলেন শামসুর রহমান যাকে আমরা ড, জনসন বলতাম। আমাদের সম্পর্ক তো তুমির সম্পর্ক। আমি তাকে তখন কীভাবে এ্যাড্রেস করি–এ নিয়ে ভাবনায় পড়লাম। শামসুর রহমান হলো আতাউর রহমান খানের ছোট ভাই। ওদুদুর রহমান, শামসুর রহমান আর আতাউর রহমান তিন ভাই। আজকাল ওকে খুব একটা দেখা যায় না। খুব একটা সামাজিক জীবনযাপন করে না। ব্যবসাপাতি করে। খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। অধ্যাপক রাজ্জাকের স্মৃতিচারণে ওর কথা এসেছে।

রাজশাহীতে আমার স্ত্রী আমার সাথে দেখা করতে যেতেন। শামসুর রহমান থাকা অবস্থাতেই গিয়েছেন কয়েকবার। তাদের কাছ থেকে কিছুটা আপ্যায়িতও হয়েছেন। এরপর ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের পারমিশন নিয়ে অফিসারের সামনে বসে আমার সাথে কিছুটা কথাবার্তা তিনি বলে আসতে পেরেছেন।

জেল প্রশাসন সিকিউরিটি প্রিজনারদেরকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিল : এ ডিভিশন আর বি-ডিভিশন। যেমন ধরুন, অনিল মুখার্জী আর অরুণ মুখার্জী দুই ভাই। অনিল মুখার্জী ছিলেন বি-ডিভিশনে। বি-ডিভিশন মানে লোয়ার ডিভিশন। আমি ছিলাম বি-ডিভিশনে। সুতরাং অনিল মুখার্জীর সাহচর্য আমি পেয়েছি। সত্যেন সেনও ছিলেন বি-ডিভিশনে। কখনো হয়তো তাকে কুমিল্লা জেলে বদলি করা হয়েছে। আমাকেও পাঠানো হয়েছে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে পলিটিক্যাল প্রিজনার কম। সাত কি আটজন হবে। আমরা একসঙ্গে থাকছি। সত্যেন সেনের জীবনাচরণ দেখছি। সত্যেন সেন আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন। আমরা কেউ হয়তো রান্নাবাড়ার কাজ করছি, কেউ তরকারি কোটার কাজ করছি–এ রকম একটা এ্যাসোসিয়েশন মোটামুটিভাবে পাওয়া গিয়েছিল।

২৯. খাপড়ার সেই হত্যাকাণ্ড

রাজশাহী জেলে অন্যান্য বন্ধুদের কাছে আমি খাপড়া ওয়ার্ডের কাহিনী শুনেছি। রাজশাহী জেলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে যে হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত হয় তাকে আমরা বলি খাপড়া হত্যাকাণ্ড। রাজশাহী জেলের সাধারণ কয়েদিরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। পলিটিক্যাল প্রিজনারদের রাখা হয়েছিল খাপড়া ওয়ার্ডে। খাপড়া ওয়ার্ডটা ছিল একটা বাংলো বাড়ির মতো এবং এ বাড়িটার চারিদিকে অনেকগুলো জানালা ছিল। পলিটিক্যাল প্রিজনাররা এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নেয় যে সাধারণ কয়েদিদের সমর্থনে আমাদের কিছু করা উচিত। সাধারণ কয়েদিরা যদি অনশন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তবে আমরাও অনশন করব।

সে সময় রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন একজন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তার নাম ছিল মি. বিল। ও অর্ডার দেয় যে, কয়েদিদের মধ্যে যারা নেতা আছে তাদের আলাদা কর। আলাদা করার দিনটিতে মি. বিল যখন তার দলবল অর্থাৎ ডেপুটি জেলার ও অন্যদের নিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডের ভিতরে অর্থাৎ সেই বাংলো বাড়িতে ঢুকে তখন পলিটিক্যাল প্রিজনাররা বাংলোর দরজাটি বন্ধ করে দেয় যাতে জেলাররা সেখান থেকে বের হতে না পারে। আগে থেকে নিশ্চয়ই এ রকম একটা প্ল্যান করা ছিল। সুতরাং সেখানে একটা ক্ল্যাশ-ট্যাশ হয়। তখন যা সাধারণত হয়ে থাকে, আটকা পড়া জেলাররা বাঁশি বাজিয়ে দিল। বাঁশিতে ফুঁ দিলে সিগনাল হয়ে যায়। পাগলা ঘন্টি বাজতে আরম্ভ করে। আর্মড সিপাহীরা খাপড়া জেলের দিকে ছুটে আসে। জেলাররা তখনো ভিতরে আটকা পড়ে আছে। পলিটিক্যাল প্রিজনাররা খাটটাট এসব জানালার সামনে রেখে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিপাহীরা এসে জানালায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করতে শুরু করে। *সাতজন পলিটিক্যাল প্রিজনার নিহত হয়। [*বিভিন্ন সূত্র থেকে পড়ার ২৪ এপ্রিলের শহীদদের নাম সংগ্রহ করে উল্লেখ করা আবশ্যক। করাম সিং, আনোয়ার হোসেন, হানিফ সেখ, দেলোয়ার হোসেন, সুধীন ধর, বিজন সেন, সুখেন ভট্টাচার্য। বি.দ্র. খাপড়া হত্যাকাণ্ডের বিবরণ কিছুটা বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় বদরুদ্দীন উমরের : ভাষা আন্দোলন ১ম খণ্ডে : পৃ ৩০৯-৩১১। হামদি শেখ, আনোয়ার হোসেন, সুখেন ভট্টাচার্য, দেলওয়ার, সুধীন ধর, কম্পম সিং এবং বিজন সেন।]আহত হয় অনেকে। আবদুশ শহীদের বইয়ে নাম আছে, কারা কারা নিহত ও আহত হয়েছিল। জেল হত্যার ইতিহাসে এটা একটা বড় ঘটনা। জেল কিলিং অন্যত্র হয়েছে, প্রেসিডেন্সি জেলেও হয়েছে, এ রকম হয়।

খাপড়া ওয়ার্ডে যে ঘটনাটা ঘটেছিল তার নেতা ছিলেন যশোরের কমরেড আবদুল হক। উনি খুব জঙ্গি নেতা ছিলেন। উনি খুবই উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দিতে পারতেন। কলকাতার অনেক কমরেড তখনো ছিল। মনসুর হাবিবও একজন বড় এবং দক্ষ নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন বর্ধমানের আবুল হাশেম সাহেবের পরিবারের লোক। আবুল হাশেম সাহেবের পরিবার বর্ধমানের একটি জাতীয়তাবাদী মুসলিম পরিবার। অনেক শিক্ষিত ভালো ভালো ছেলে বের হয়ে এসেছে ঐ পরিবার থেকে। বইপত্রও লিখেছে অনেকে। সবার নাম বলতে পারছি না। বদরুদ্দীন উমর ভালো বলতে পারবেন।

খাপড়া হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের কমরেড আবদুশ শহীদের খাপড়া স্মৃতি বলে একটা বই রয়েছে। আবদুশ শহীদ নিজে খাপড়া জেলে ছিল এবং আহত হয়েছিল। আবদুশ শহীদ গ্রাজুয়েট ছিল। একটা স্কুলে শিক্ষকতা করত। একটা ধার্মিক পরিবারের ছেলে ছিল। সে কৃষক আন্দোলনে এসে গেল। কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজশাহী জেলে আমি তাকে পেয়েছিলাম। সে আমাকে খুব শ্রদ্ধা করত।

যারা সিকিউরিটি প্রিজনারদের ইনচার্জ থাকত তারা সবাই যে খারাপ লোক ছিল তা নয়। ডেপুটি জেলার কেউ খারাপ ছিল, কেউ আবার ভালোও ছিল। সবাই আমাদের দেশের লোক। জেলার এবং সাধারণ কয়েদি সবাই সিকিউরিটি প্রিজনার্সদের খুব শ্রদ্ধা করত। এক সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে সিকিউরিটি প্রিজনারদের চার্জে ছিলেন ডেপুটি জেলার কাজী আবদুল আউয়াল*। [*কাজী আবদুর আওয়াল যে একজন দেশপ্রেমিক মহৎ মানুষ ছিলেন তার এক পরিচয় এই যে, ১৯৭৫-এর ৩রা নভেম্বরে ঢাকা জেলে মোশতাকের নির্দেশে সামরিক সন্ত্রাসীরা ঢাকা জেলে ঢুকে পড়ায় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসাবে তিনি নিজ উদ্যোগে সাহসিকতার সাথে ঘটনার পরবর্তীতে থানায় এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন এবং তাঁর সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার ২৫ বছরের অধিককাল পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে উচ্চ আদালতে হত্যাকারীদের বিচার কার্য শুরু হলে অবসরপ্রাপ্ত ৮০ বছরের বৃদ্ধ কাজী আবদুল আওয়াল আদালতে হাজির হয়ে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষীর বিবরণ প্রদান করেন।] তিনি এম. এ. পাস ছিলেন। নাজমুল করিম, সাজেদুল করিম, বজলুল করিম–এই সমস্ত লোকদের পরিবারের তিনি পরিচিত লোক ছিলেন। অত্যন্ত মানবতাবাদী ও হৃদয়বান এই ভদ্রলোক পলিটিক্যাল প্রিজনারদের বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং সাহিত্যিকদের খুব প্রশংসা করতেন। বিশেষ করে সত্যেন সেন যে সমস্ত চিঠি লিখতেন সেসব চিঠি তিনি প্রথমে পাঠ করতেন। এরপর সেসব চিঠি তিনি পাঠিয়ে দিতেন আই বি ডিপার্টমেন্টে। এই চিঠিগুলোর যে সব অংশ আই বির পছন্দ হত না সেগুলো তারা মুছে দিত অমোচনীয় কালি দিয়ে। তারপর এসব চিঠি আবার তারা জেলে ফেরত পাঠাত। এই সুন্দর সুন্দর সব চিঠির ভিত্তিতে সত্যেন সেনের বইও তৈরি হয়েছে : রুদ্ধ দ্বার, মুক্ত প্রাণ।

কাজী আবদুল আউয়াল পরে ডিআইজিও হয়েছেন। জেলে যখন তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতাকে খুন করা হয় তখন বোধহয় কাজী আবদুল আউয়ালই ঢাকা জেলের ডিআইজি ছিলেন। তিনিই ব্যাপারটা ফেস করেছেন। যখন সশস্ত্র লোকজন গেটে দাঁড়িয়ে আছে এবং জেলের ভিতরে ঢুকতে চাইছে। তখন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করে জানালেন যে এ রকম কিছু লোক এসেছে। জেলে ঢুকতে চাইছে। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বা বঙ্গভবন থেকে বলা হচ্ছে : তারা যা করতে চায় করতে দাও।

৩০. যুক্তফ্রন্ট ও কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি

১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় এসে গেল। আমি মনে করি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের একটা ভূমিকা ছিল। ততদিনে বেশ কিছু মুসলমান যুবক কমিউনিস্ট আদর্শকে গ্রহণ করে কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। যেমন একজনের নাম আবদুস সামাদ, সাহিত্যিক লায়লা সামাদের স্বামী। এরা খুব বড় রকমের সংগঠক ছিলেন। ১৯৫৪ সালের কথা বলছি। তখনো মুসলিম লীগের শাসন চলছে। নুরুল আমীন ক্ষমতায়। মুসলিম লীগের ব্যাপারে ছাত্রসমাজের মোহমুক্তি অবশ্য শুরু হয়ে গেছে। মুসলিম লীগের একটা ক্রেডিট এই যে, তারা নানা রকম চাপের মুখে একটা সাধারণ নির্বাচন দিতে রাজি হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ, হক সাহেবের কৃষক পার্টি এবং নেজামে ইসলাম এর সাথে যুক্ত হল। এর মানে বিভিন্ন রাজনেতিক ব্যক্তিত্ব যেমন, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী এবং নেজামে ইসলামের আতাহার আলী একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট দাঁড় করালো সরকারের বিরুদ্ধে।

এটা সহজ কোনো কাজ ছিল না। আমি মনে করি, এর পেছনে সাংগঠনিক দায়িত্বটা পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা। এদের মধ্যে প্রফেসার মুজাফফর আহমেদ এখনো সক্রিয় আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ছে চট্টগ্রামের চৌধুরী হারুনুর রশীদ, সাহিত্যিক-সাংবাদিক সৈয়দ আলতাফ হোসেন যিনি এখন মারা গেছেন, সিলেটের পীর মুহম্মদ হাবিবুর রহমান এবং বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ-ইনিও কমিউনিস্ট সংগঠনের একজন অত্যন্ত কাছের লোক। আরো অনেকে ছিলেন যাদের নাম আমি তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে পারছি না। আমি মনে করি যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার দায়িত্বটা পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। সাধারণভাবে আমাদের দেশের নির্বাচনে যা হয়, নেতাদের পক্ষ থেকে আমি এটা চাই, আমি এই সিট ছাড়বো না, আচ্ছা এই সিটে কাকে দেওয়া যায় ইত্যাদি ধরনের দাবি ওঠে। সেখানে আমি শুনেছি কোনো কোনো। কমিউনিস্ট প্রার্থী তার নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে বলেছেন, অমুক আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সিটটা দেওয়া হোক। এই এ্যাকোমোডেশনের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা ছাড়া যুক্তফ্রন্ট দাঁড়াতে পারত না।

যুক্তফ্রন্টের সময় আমি জেলে। যুক্তফ্রন্ট হয়ে গেল। নির্বাচন হয়ে গেল। আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেবের মতো নেতারা আবার সামনে চলে এলেন। আবু হোসেন সরকার সাহেবের নেতৃত্বে হক সাহেবের সরকার পূর্ববঙ্গে তৈরি হল। পূর্ববঙ্গের সাধারণ দাবি ছিল রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। রাজবন্দিদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন কমিউনিস্ট কর্মীরা। দুটি সাধারণ শ্লোগান ছিল তখনকার দিনে : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এবং রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবু হোসেন সরকার সাহেব তার সুনাম রক্ষার জন্যে কিস্তিতে কিস্তিতে রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে শুরু করলেন : কোনো জেল থেকে দশ জনকে, কোনো জেল থেকে পাঁচ জনকে–এভাবে।

এই পর্যায়েই আমাকে ১৯৫৫ সালের মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের অফিসে ডেকে বলা হল-আজ কয়েকজন সিকিউরিটি প্রিজনার রিলিজড হবেন। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ফজলুল করিম। ঐ জেলে ফজলুল করিম নামে দ্বিতীয় কোনো লোক ছিল না। ফজলুল করিম সরদার অধ্যাপক হিসেবেও জেলের অফিসারদের কাছে পরিচিত। বিকেলে মুক্তি দেবার জন্যে ফজলুল করিমকে নিয়ে আসা হল। ফজলুল করিম তার দস্ত খত-টস্তখত দিয়ে জেল থেকে রিলিজড় হল।

রিলিজ করার ব্যাপারে একটা ঝামেলা ছিল। ফজলুল করিম সরদার নামে নাকি রাজশাহী জেলেও একজন সিকিউরিটি প্রিজনার ছিল। তবে এই সরদার ফজলুল করিমই ছিল বেশি পরিচিত। সরদার ফজলুল করিম যে শুধু পাকিস্তান ও করাচীতেই পরিচিত ছিল তা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরাও তার নাম জানত। ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরা যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কথা ইতোমধ্যে জেনেছে। পাকিস্তানে যে গভর্নমেন্ট ইন পাওয়ার হ্যাঁজ বিন ডিফিটেড লাইক এনিথিং-এটা ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা জানতেন। তাঁরা মনে করতেন, কমিউনিস্টদের সাংগঠনিক ক্ষতার কারণেই এটা ঘটেছে এবং ইস্ট বেঙ্গল হ্যাঁজ গন রেড।

কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির ফরমালিটিজগুলো হয়েছে আমি জেলে থাকার সময়েই। মোজাফফর জেলে গিয়ে আমার সম্মতিসূচক দস্তখত নিয়ে এসেছে। আমি তো অনুগত কর্মী ছিলাম। যা বলেছে তাই করেছি। সম্মতি জানিয়ে দস্ত খত দিয়ে দিয়েছিলাম। ১৯৫৫ এর মাঝামাঝি সময়ে আমি জেল থেকে বের হয়ে এলাম। আমি রিলিজ পেয়ে বাইরে আসার পর ইলেকশানটা হয়েছিল।

কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি গঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস এ্যাক্ট অনুসারে। গোলাম মহম্মদ সাহেব এই কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি ভেঙে দিলেন। তমিজউদ্দীন খান সাহেব এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেন। সেই মামলায় জাস্টিস মুনীর রায় দিলেন যে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস এ্যাক্টে কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি ভাঙার কোনো কথা নাই। তবু যখন ভেঙে দেওয়া হয়েছে তখন আর কি করা। এখন সেন্টারে নূতন একটা কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি গঠন করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে বিভিন্ন পার্টি থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমরি সদস্য নির্বাচিত করবেন।

প্রাদেশিক পরিষদে তখনো কংগ্রেসের একটা অংশ ছিল আর কমিউনিস্ট হিসেবেও কিছু সদস্য ছিলেন : প্রসূন কান্তি রায়, (বরুণ রায়), চট্টগ্রামের একজন সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সুধাংশু দস্তিদার। এরা ধর্ম বা সম্প্রদায়গতভাবে ছিলেন হিন্দু কিন্তু আদর্শগতভাবে ছিলেন কমিউনিস্ট। এঁদের একটা ক্ষমতা ছিল। কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী সদস্যের সংখ্যা ত্রিশের কম ছিল না।

কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়াটা ছিল এ রকম : ধরা যা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে সদস্য নির্বাচিত হবে পঞ্চাশজন। এই পঞ্চাশ দিয়ে আপনি তিনশকে ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যাবে অর্থাৎ ছয়জন সদস্যের সমর্থন যদি আপনি পান তবেই আপনি নির্বাচিত হয়ে গেলেন। কোনো সদস্য একবার ভোট দিয়ে ফেললে তার ব্যালটটা বাতিল হয়ে যাবে। এই নির্বাচন পদ্ধতির নাম ছিল প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশান উইথ সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট। যে দলের যে রকম শক্তি আছে সেই শক্তি অনুযায়ী সে সদস্য পাবে।

আওয়ামী লীগের প্যানেলটা হচ্ছে প্রধান প্যানেল। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে যে কমিউনিস্ট কর্মীরা ছিলেন তাঁরা শেখ মুজিব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে একটা কথা নাকি এভাবে বললেন যে, আওয়ামী লীগের মেইন প্যানেলকে আমরা ভোট দেব তবে আমাদের নিজেদের একটা দাবি আছে। আমাদের নিজেদের একজন লোককে কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লিতে পাঠাতে চাই। তারা। জানতে চাইলেন সে কে? কমিউনিস্ট নেতারা উত্তর দিলেন, সে যেই হোক। পরে আমার নামটাও আওয়ামী লীগের প্যানেলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের প্যানেলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।

এটা আমি তখনো জানতাম না। এ ব্যাপারটাকে আমি বলি, বাঙালের হাইকোর্ট দেখা। আমার কাছে করাচী ইত্যাদি দূর মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপার। আমি কোনোদিন চিন্তা করি নাই যে, আমি করাচী যাবো বা আমি আইন সভায় যাবো। আমি হচ্ছি একজন মোস্ট নন-এ্যামবিশাস পারসন। নন-এ্যামবিশাস অবজার্ভার অব লাইফ। আই টুক ইন্টারেস্ট ইন দি অবজার্ভেশন অব লাইফ। জেলখানায় ৫৮ দিনের হাঙ্গার স্ট্রাইকে আমি অংশগ্রহণ করেছি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নুরুল হক এবং প্রফেসার আনিসুজ্জামানের স্মৃতিচারণে আছে কনস্টিটিউশান এ্যাসেমব্লির ব্যালটিংটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এখন যেটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস সেখানে। ওটা আগে ছিল এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কমিশনার্স অফিস। ইলেকশানের শেষে তরুণ কর্মী যারা আছেন তাদের প্রধান প্রশ্ন দাঁড়াল যে সরদার ফজলুল করিম ইলেক্টেড হয়েছেন কিনা। তারা যখন শুনল যে তাঁদের প্রার্থী সরদার ফজলুল করিম নির্বাচিত হয়েছেন, তখন তারা খুবই উৎফুল্ল হলেন।

সে সময় আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। রোযার দিন ছিল তখন। পুলিশেরা তাদের কি একটা দাবি নিয়ে স্ট্রাইক করেছিল সে সময়। এ অপরাধে পুলিশদের এ্যারেস্ট করা হয়। ঘেরাও করা হয় তাদের। আইয়ুব খান তখন চার্জে ছিল। গভর্নমেন্ট কমিউনিস্টদের এই পুলিশ ধর্মঘটের সাথে ইনভলভ করে এবং তাদের এ্যারেস্ট করতে শুরু করে। আমাকেও এই সময়ে আবার এ্যারেস্ট করা হল।

আমি রিলিজ পেয়েছিলাম ঢাকা থেকে। ইলেক্টেডও হয়েছিলাম ঢাকা থেকে। ইলেক্টেড হয়ে আমি এ্যাসেমব্লিতে এ্যাটেন্ড করতে গেলাম। এ্যাসেমব্লির প্রথম অধিবেশন বসে মারী পাহাড়ে। মারী পাহাড় রাওয়ালপিন্ডির কাছে। এই মারী পাহাড়েই মোঘলরা তাদের রাজবন্দিদের রাখত। এটা একটা মজার ব্যাপার যে পাকিস্তান সরকার কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির প্রথম অধিবেশনটা করাচীতে করল না, করল পিন্ডির কাছে মারী পাহাড়ে গিয়ে।

আমি যখন পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলাম, তখন বিভিন্ন মহলে আমার বন্ধুবান্ধবেরা ছিল। হক সাহেবের দলের লোকদের সঙ্গেও আমার পরিচয় ছিল। সৈয়দ আজিজুল হক সাহেব আমাকে খুব এ্যাফেকশনেটলি দেখতেন। ওঁর একটা কমেন্ট আমার এখনো মনে আছে। করাচীতে পার্লামেন্টের মেম্বারদের থাকার জন্যে যে মেস ছিল (এখনকার এমপি হোস্টেলের মতো) সেখানে আমি দেখতাম পাকিস্তানের পলিটিক্স শুরু হয় আফটার মিড নাইট বা মধ্যরাতের পর। মধ্যরাতের আগ পর্যন্ত যে গভর্নমেন্ট আছে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, সেই গভর্নমেন্ট আর নাই। যত ষড়যন্ত্র, যত আলোচনা সব সেখানে হত মধ্যরাতের পরে। আমি ছিলাম একটা নরমাল মানুষ। আমি হয়তো সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ করে খুব বেশি হলে বারোটা পর্যন্ত জাগব, তারপর বারোটার সময় ঘুমাতে যাব। যদিও আই ওয়াজ এ্যালাইড টু আওয়ামী লীগ এবং আমি আওয়ামী লীগের যে কোনো মিটিং-এ যেতে পারতাম কিংবা আমি জিজ্ঞেসও করতে পারতাম কোনো ব্যাপারে, কিন্তু আমি দেখলাম যে আমি স্যুটেবল না। আমি অংশগ্রহণ করতাম না মধ্যরাতের পরে সংঘটিত হওয়া এই সব গোপন সভায়।

সুতরাং গভর্নমেন্টের উত্থান এবং পতনের সঙ্গে আমি খুব একটা জড়িত ছিলাম না। সে জন্যেই সৈয়দ আজিজুল হক যার পরিচিত নাম নান্না মিয়া এবং যিনি হচ্ছেন হক সাহেবের নিজের ভাগনা, তিনি আমাকে একদিন বললেন, সরদার (কিংবা ফজলুল করিম, এই দুই নামেই তিনি আমাকে ডাকতেন) একটা আশ্চর্য ব্যাপার শুনবেন? আমি বললাম কী? উনি বললেন, আপনি তো বড় সাংঘাতিক মানুষ। হোয়াইল উই রান আফটার পাওয়ার, পাওয়ার রানস আফটার ইউ। তারা একদিন মন্ত্রী হতে চাচ্ছেন, একদিন সরকার গঠন করতে চাচ্ছেন। আমার ভোট একটা হলেও অনেক সময় এক ভোটে ডিসিশন হয়ে যাচ্ছে। আমি যদি এই পক্ষে ভোট দিই তা হলে সে জিততে পারে–এরকম হতে পারে। সেই জন্যেই উনি বললেন যে পাওয়ার তোমাকে ধরতে পারছে না। এটা আমার জন্যে একটা বড় ট্রিবিউট বলে আমি মনে করি।

গীবন নামে একজন ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। স্পিকার ছিলেন আবদুল ওহাব খাঁ। গীবন আমার সম্পর্কে প্রশংসা করে লিখেছেন : হি ইজ এ সিরিয়াস ম্যান। পাঠানেরা যখন আমার সম্পর্কে একটু ঠাট্টা করে বলেছে, ইয়ে সরদার হ্যায়, ইস্ট পাকিস্তানকা, মাশরেকী সরদার। মানে এ একটা লিলিপুটের মতো মানুষ, তার নাম নাকি আবার সর্দার। এরকম বলেছিল হয়তো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আবদুর রশিদ যে আগে পুলিশের আই জি ছিল পরে চিফ মিনিস্টারও হয়েছিল। সে তখন পার্লামেন্টের মেম্বার এ ধরনের মন্তব্য শুনে গীবন বলতেন, ছোটা হ্যায়তো ক্যা হ্যায়, ইয়ে সরদার তো হ্যায়। সীমান্ত প্রদেশের কোনো কোনো পাঠান হয়তো আমাকে ডিফেন্ড করে বলত, নেহি নেহি, ইকো দিমাগ হ্যায়। এই কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির একটা বুকলেট পাকিস্তান সরকার বের করেছিল তাতে আমার ছবি ছিল। শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান এদের সবার ছবি ছিল। কিন্তু ৫৬-এর পাকিস্তান সংবিধানে আওয়ামী লীগ স্বাক্ষর করেনি। আমারও কোনো স্বাক্ষর ছিল না।

পাকিস্তান হওয়ার পর চারটি প্রভিন্সিয়াল ইউনিট ছিল : সিন্ধ, বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলা। এর পর ওয়ান ইউনিট করে সিন্ধ, বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অটোনোমি বাতিল করা হয়। তখনি সোহরাওয়ার্দী সাহেব এই ফর্মুলা নিয়ে আসেন যে ইস্ট পাকিস্তান আর ওয়েস্ট পাকিস্তান সমান। পার্লামেন্টের ওয়ান ইউনিটের ডিবেটে আওয়ামী লীগ সাপোর্টেড ওয়ান ইউনিট। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সাপোর্টেড ওয়ান ইউনিট। এক সময় আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পলিসির বিপক্ষে ভোট দিতে পারিনি কারণ আমার পাশে তখন কেউ ছিল না। এবং কমিউনিস্ট পার্টি চেয়েছিল যে আই ভোট এগেইনস্ট সোহরাওয়ার্দীর ফরেন পলিসি। কিন্তু ওয়ান ইউনিটের সময় আই ডিড নট হেজিটেট। আই সেইড মাই পয়েন্ট। ইংরেজিতে আমি বলেছি এই যে, এ্যাবোলিশান অব প্রভিন্সিয়াল অটোনোমি অব নর্থ-ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স, অব সিন্ধ, অব বালুচিস্তান–দিস ইজ নট গুড।

পাঞ্জাবিদের কারসাজিতে এসব হয়েছিল। জিয়ে সিন্ধ নামে একটা আন্দোলন পর্যন্ত হয়েছিল সিন্ধ প্রদেশে। সে সময় তাদের মধ্যে প্রচলিত একটি কৌতুক ছিল এ রকম : ধরা যাক, একজন সিন্ধ কোনো একটা ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। সেই ঘরে যদি একটি সাপ আর একটা পাঞ্জাবি ঢুকে পড়ে তবে সিন্ধটি তার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে কাকে আগে মারবে? সিন্ধটি অবশ্যই পাঞ্জাবিটিকে আগে মারবে, কারণ সে সাপের চেয়ে ভয়ঙ্কর। পাঞ্জাবিদের সম্পর্কে পাকিস্তানের বাকি প্রদেশবাসীদের মনোভাব এই গল্পে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সুতরাং আমার এই বক্তৃতা পাঠানেরা খুব এ্যাপ্রিসিয়েট করেছে। পাঠানেরা তো ওয়ান ইউনিট চায়নি। এবোলিশান অব পাখতুনিস্তান তারা চায়নি। আওয়ামী লীগ ওয়ান ইউনিট চেয়েছে কারণ পূর্ব পাকিস্তানে তারা ছাড়া তো আর কেউ ছিল না তখন। সুতরাং ওয়ান ইউনিট হলেই বা তাদের লোকসান কোথায়?

আমি ছিলাম ইনোসেন্ট একটা মেম্বার। আমি এসব কিছু দেখেছি। এমন হয়েছে, কোনো কোনো সময় যে, পত্রিকায় কোনো মেম্বারের নাম আসছে না। কিন্তু পত্রিকায় নাম কেমন করে আসবে যদি তিনি এ্যাসেমব্লিতে বক্তৃতা না। দেন? আমার এক বন্ধু (আমি নাম বলছি না) পিছন থেকে বারবার স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে বলছেন, স্যার! মানে উনি কিছু বলতে চান আরকি। স্পিকার বলছেন, ইউ সিট ডাউন। দুই মিনিট পরেই আমার ফ্রেন্ড আবার বলছে, স্যার আই ওয়ান্ট টু স্পিক। স্পিকার হয়তো আবার তাকে বলছেন বসে পড়তে। পরের দিন হি বিকেইম হেড লাইন অব পাকিস্তান টাইমস কিংবা ডন ইত্যাদি পত্রিকায়। প্রথমে তার নাম তারপর লেখা দি ইনডোমিটেবল। দি ইনডোমিটেবল মি. অমুক। স্পিকার তাকে সুযোগ দিচ্ছিলেন না, কারণ তার হয়তো সময় তখনো আসে নাই বা সময় দিলেও যে তিনি ইংরেজিতে একটা ডেলিবারেশন দিতে পারবেন এমন যোগ্যতা হয়তো তার নেই। যদিও বাংলা তখন গৃহীত হয়েছে তবুও বাংলায় বক্তৃতা দেওয়াটা। নৰ্ম নয়। বাঙালি কেউ পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তৃতা করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। তারা উর্দুতে বা ইংরেজিতে বলেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুও বেশিরভাগ সময় ইংরেজি ব্যবহার করেছেন, ইন হিজ ওন ওয়ে। শেখ সাহেব দেখতাম, বক্তৃতার ব্যাপারে খুব একটা পরোয়া করতেন না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা মাথায় আসত তাই ইংরেজিতে বলতেন। তিনি খুব একটা। মেপে কথা বলতেন না।

একমাত্র ঐ পাগলা, মানে ফরিদ আহমদ ইংরেজিতে প্রফিসিয়েন্ট ছিল। আমার ক্লাসফ্রেন্ডও ছিল সে এবং ইংরেজির ছাত্র ছিল। যেমন ইংরেজি, তেমন উর্দু এবং তেমন বাংলা-এই তিনটি ভাষাতেই সে বক্তৃতা করতে পারত। ওর মেম্বারশিপটাকে, হি মেড ইট এ প্রফেশান। কারণ তখন বিজনেসম্যানরা পার্লামেন্টের মেম্বারদের দিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রবলেম এ্যাসেমব্লিতে প্রজেক্ট করত : উইল দি অনারেবল মিনিস্টার রিপ্লাই হোয়াই দিস হ্যাঁজ হ্যাঁপেন্ড? কিংবা। লাইসেন্স-টাইসেন্স ইত্যাদি নানান ব্যাপারে সে প্রশ্ন করত। এই ফরিদ আহমদ। প্রত্যেকটা প্রশ্ন করার জন্যে ফি আদায় করত পাবলিকের কাছ থেকে। দ্যাট ওয়াজ কোয়াইট এ বিজনেস। হি ওয়াজ মোর এ ক্যারিকেচার দ্যান এ সিরিয়াস। স্পিকার। পরবর্তীকালে তার যে পরিবর্তন হয়েছে তাতে আপনারা দেখেছেন।

কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির মেম্বারদের মধ্যে একমাত্র আমিই বলতাম যে আমি কৃষকের ছেলে। আওয়ামী লীগের মেম্বারদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন এ্যাডভোকেট বা উকিল। এদের কেউ কেউ কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসতে পারেন। এ্যাসেমরি ওয়াজ কনস্টিটিউটেড বাই মুসলিম মিল ক্লাস, মুসলিম রাইজিং মিল ক্লাস। পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা সবাই ছিলেন বড় বড় সামন্ত প্রভু। পূর্ব পাকিস্তানের একজন সদস্যও তাদের কাছে গণনীয় ছিলেন না। পাকিস্তানেরও ইস্কান্দর মির্জার মতো বড় বড় নেতারা সব ছিলেন। মিয়া ইফতেখার উদ্দিন ছিলেন পাকিস্তান টাইমসের মালিক এবং জাতীয়তাবাদী। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একজন বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা। পরে পাকিস্তান সরকার তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।

মিয়া মমতাজ দৌলতানার বক্তৃতা আমি শুনেছি। পারফেক্ট বক্তৃতা দিতেন তিনি এবং সিরিয়াস ব্যাপারে আলোচনা করতেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টে সিরিয়াস কোশ্চেন উপস্থাপন করা হয়েছে এবং সিরিয়াসলি তার উত্তর দেওয়া। হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত প্রভুরা একে অপরের সাথে টেক্কা দেবার জন্যে একটি নির্বাচনী ট্যাকটিস ব্যবহার করত। সামন্ততন্ত্রের টপ সেকশানটা যদি মনে করত যে অমুককে আমরা নির্বাচনে কনটেস্ট করতে দেব না, তবে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে পঞ্চাশ বা একশত মাইল দূরে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিত। এর ফলে একদিকে সেই প্রার্থীর পক্ষে বাড়ি ফিরে এসে আবার নোমিনেশন পেপার সাবমিট করা সম্ভব হত না আর অন্যদিকে যে ব্যক্তি এটা করত তার বিরুদ্ধে কোনো মার্ডার কেস ফাইল করা যেত না।

কমিউনিস্ট কর্মী পশ্চিম পাকিস্তানেও ছিল, তবে ইস্ট বেঙ্গলের মতো অত বেশি ছিল না। এরিক রহিম নামে এক কমিউনিস্ট নেতার কথা মনে পড়ছে। ওখানকার কমিউনিস্ট কর্মীরা আমাকে যথা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। সব সময় আমার পেছনে স্পাই আছে এটা তো জানাই ছিল। প্লেনে করে। করাচী হয়ে যখন মারী গেলাম তখন আমার পাশের সিটেই বসে ছিল উচ্চপর্যায়ের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। আমার নির্বাচনটা পূর্ব ও পশ্চিম, এই উভয় পাকিস্তানে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওরা আমাকে কমিউনিস্ট বলে আখ্যায়িত করে, যদিও আমি নিজেকে কমিউনিস্ট দাবি করতাম না। আমি নিজেকে বললাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট। কিন্তু ওরা সে কথা স্বীকার করত না।

৩১. ওয়াশিংটনের উদ্বেগ ও দ্বিতীয়বার কারাবরণ

ওয়াশিংটনে আমার নির্বাচনের খবরটা আসে এভাবে : ওয়ান কমিউনিস্ট ফ্রম জেইল ইলেক্টেড টু কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লি। তাদের কাছে এটা একটা বড় ব্যাপার। ওয়াশিংটন এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দাবি করে করাচীতে আমেরিকান এ্যামবেসাডরের কাছে। আমেরিকান এ্যামবেসাডর ব্যাখ্যা দাবি করে করাচীতে পাকিস্তানের হোম ডিপার্টমেন্টের কাছে। করাচীর হোম ডিপার্টমেন্ট ব্যাখ্যা দাবি করে ঢাকার আবু হোসেন সরকারের কাছে যে, টেল আস, হাউ সরদার ফজলুল করিম হ্যাঁজ বিন রিলিজড়! তখন আবু হোসেন সরকার কোনো রকম করে একটা কৈফিয়ত তৈরি করে জানান যে, সরদার ফজলুল করিমকে রিলিজ করা হয়নি। সরদার ফজলুল করিম নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে জেল থেকে বের হয়ে এসেছে। আমরা শিগগিরই তার বিরুদ্ধে আবার মামলা করব এবং তাকে আবার এ্যারেস্ট করা হবে।

আমি পুলিশ ধর্মঘটের কথাটা জানতাম। এও জানতাম যে কমিউনিস্টদের আবার জেলে ঢোকানো হচ্ছে এবং তারা আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে। একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলি। সেদিন দ্বিতীয় বারের মতো পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এ্যাসেমব্লিতে যোগ দেবার জন্যে আমি তেজগাঁও এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেনে উঠেছি। শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান ইত্যাদি বড় বড় লিডাররাও প্লেনে উঠে পড়েছেন। বোর্ডিং শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে প্লেনটা ছাড়ছে না, দেরি করছে। এমন সময় এয়ারপোর্টের ওসি প্লেনে উঠে ডেকে বলছে, হু ইজ সরদার ফজলুল করিম? আমি নিজের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি আমাকে বললেন, ইউ প্লিজ কাম ডাউন। ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট। এই বলে আমাকে বিমান থেকে নামানোর সময় আমি মুজিব ভাই বলে ডাক দিলাম। বললাম, মুজিব ভাই, আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ আমাকে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করল, আমি কেমন করে রিলিজ পেয়েছি ইত্যাদি ব্যাপারে এবং তারপর সোজা আমাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিল।

৩২. জেল থেকে পালিয়েছে!

 সেন্ট্রাল জেলে আমাদের পুরোনো সাথীরা অল্পবিস্তর তখনো আছে। সিকিউরিটি এ্যাক্টের আন্ডারে তো আমি আছিই। ডেপুটি জেলারকে দিয়ে একটা মামলা ওরা দায়ের করল। মামলাটা হচ্ছে এ রকম : সরদার ফজলুল করিম ওয়াজ নট রিলিজড। দি রিলিজ অর্ডার ওয়াজ অন ফজলুল করিম সরদার অব রাজশাহী। যশোরের এক কর্মী অবশ্য ছিল যার নাম ফজলুল করিম সরদার। হোম ডিপার্টমেন্ট আবু হোসেন সরকারকে বলেছিল, এ ব্যাপারটাকে ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে কোনো কেস ফাইল করা যায়। কিনা। অভিযোগটা হবে এই যে, সরদার ফজলুল করিম নিজের নাম ভাড়িয়ে জেল থেকে রিলিজ নিয়েছেন, তাকে রিলিজ দেওয়া হয়নি।

কেস যেহেতু হয়েছে, আমাকে মাঝে মাঝে কোর্টে নিয়ে যেত জেল প্রশাসন। আতাউর রহমান খান সাহেব নিজে আমার পক্ষে মামলা লড়লেন। তিনি আবু হোসেন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এটা কি করেছো? সরদারের নামে এটা কি রকম কেস তুমি করলে? তখন আবু হোসেন সাহেব উত্তর দিলেন, এতে তো কিছু হবে না। কেস একটা করতে বলেছে তাই করেছি। কিছু হলো না অবশ্য শেষ পর্যন্ত। কোর্টে ডেপুটি জেলারকে জেরা করা হল এভাবে : সরদার ফজলুল করিমকে আপনি চেনেন? উনি উত্তর দিলেন : হ্যাঁ চিনি। সরদার ফজলুল করিমকে ওঁর সেল থেকে কে ডেকে নিয়ে এসেছিল আপনাদের অফিসে? উনি উত্তর দিলেন, আমরাই। তা হলে কেমন করে আপনি বললেন যে, উনি নিজের নাম ভঁড়িয়ে জেল থেকে পালিয়ে গেছেন? তখন জেলার মুখ ফসকে বলে ফেলল : স্যার আমাদের উপর হুকুম হয়েছে একটা কেস করার, তাই করেছি। এ কথা বলাতে ডেপুটি জেলার বেচারার চাকরিটা চলে যায়। তিনি নিজেকে ঠিকভাবে ডিফেন্ড করতে। পারেননি। আমি অবশ্য মানহানির মামলা করতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করিনি। জজ বললেন, মিসটেকেন রিলিজ হয়ে গেছে। এরপর সিকিউরিটি অধ্যাদেশের আন্ডারে আমাকে আবার সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হল।

৩৩. ৫৬-র সংবিধান : স্বাক্ষরবিহীন ছবি

১৯৫৬-এর কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেমব্লি একটা স্মরণিকা বের করেছিল। এই স্মরণিকাটি এখনো পাওয়া যায়। সেই স্মরণিকায় আমার ছবি আছে। একটা হ্যাংলা-পাতলা, মুখ ভাঙা লোকের ছবি যার নিচে ইংরেজিতে নাম লেখা আছে সরদার ফজলুল করিম। তাতে আওয়ামী লীগের সদস্যদেরও ছবি আছে কিন্তু ঐ ব্যাখ্যাটা নাই যে কেন তারা কনস্টিটিউশনে সই করেননি। হাসান হাফিজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের যে দলিলপত্রের একটা সঙ্কলন করেছেন তার মধ্যে এই ব্যাপারগুলো আছে কিনা, আমি জানি না। ওখানে প্রথম খণ্ডে ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাবলির একটা বিবরণ দেওয়া আছে। এই কনস্টিটিউশন মেকিং-এর ব্যাপারটা সেখানে কতখানি আছে তা আমি দেখতে পারিনি।

সেন্টারে যখন সরকার পরিবর্তন হল অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার আগে খুব ভাঙাগড়া হয়েছে সরকারে। কখনো চৌধুরী মুহম্মদ আলী, কখনো বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন আইনমন্ত্রী। তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হল। শেখ মুজিব একদিন ডেমোনেসট্রেটিভলী জেলখানায় গিয়ে সিকিউরিটি প্রিজনারদের বার করে নিয়ে আসলেন। এই ঘটনাটা ঘটে ১৯৫৬ সালে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন মতামত দেওয়া হচ্ছে তখন। জয়েন্ট ইলেকশানের পক্ষে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তৃতাটা এ সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতো লোকেরা খুব বড় রকমের এ্যাডভোকেট ছিলেন। তারা যখনই কিছু এ্যাডভোকেট করতে চাইতেন তখন। খুবই দক্ষতার সঙ্গেই তা করতে পারতেন। তখনই আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মুভমেন্টটা প্রথম দেখি। হি ওয়াজ এ সিরিয়াস ম্যান। যখন যে কাজ তিনি করতেন, তিনি তখন তা সিরিয়াসলিই করতেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন ঠিক করতেন যে তিনি একটা বক্তৃতা দেবেন তখন বক্তৃতার পয়েন্ট সব ঠিক করা, পয়েন্টগুলো উচ্চারণ করা, এ্যাসেমব্লির করিডোরে ঘুরে ঘুরে নিজের বক্তৃতা রপ্ত করা ইত্যাদি তিনি নিজেই করতেন।

তখন পূর্ববঙ্গ আইন সভার একদিকে হক সাহেবের দলের আবু হোসেন। সরকার আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগ। তারা পালটাপালটি করছে, এক দল আরেক দলকে কথা বলতে দিচ্ছে না, আজ আবু হোসেন সরকার সাহেবের গভর্নমেন্ট আছে কিন্তু পরদিন আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন না করার ফলে আবু হোসেন সাহেবের সরকার নো কনফিডেন্স ভোটে ডিফিটেড হয়ে যাচ্ছে, আবার আওয়ামী লীগ আসছে–এই যে ব্যাপারটা, এটা অত সহজে আমি। পিকচারাইজ করতে পারব না।

এই টাগ অফ ওয়ারের অবসান হল যখন ১৯৫৮ সালের অক্টোবরের গোড়ার দিকে (সম্ভবত ৭ অক্টোবর) পাকিস্তান সরকার মার্শাল ল জারি করল এবং এ্যাসেমব্লি ভেঙে দিল। ফলে ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানটাও বাতিল হয়ে গেল। যে অজুহাতটা দেখিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এল ১৯৫৮ সালে সেটা হচ্ছে প্রাদেশিক পরিষদের সভায় শাহেদ আলী সাহেবের মার্ডার হবার ঘটনাটা।

৩৪. ’৫৮-এর সামরিক শাসন

 জগন্নাথ হলের যে অংশটা এখন ভেঙে পড়েছে (অর্থাৎ যে জায়গায় এখন অক্টোবর বিল্ডিং) সেখানেই ছিল এই পার্লামেন্টের অবস্থিতি। এখানে পার্লামেন্টের সেশন হয়েছে। সেখানে দর্শকদের গ্যালারিতে বসে আমি পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পার্লামেন্টের সেশন অবজার্ভ করেছি। কিন্তু পাকিস্তান পার্লামেন্টের কোনো সেশন এই ভবনে হয়েছিল কিনা দ্যাট আই ক্যানট রিমেমবার।* [*অধ্যাপক আহমেদ কামালের বাবা আদেল উদ্দীন আহমদ কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির মেম্বার ছিলেন। আহমেদ কামাল সংশোধনী হিসাবে জানিয়েছেন তখনকার জগন্নাথ হল ভবনে পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেমব্লির অধিবেশন বসেছিল।] সেই প্রাদেশিক আইন সভায় শাহেদ আলী মার্ডার হন। ব্যাপারটা ঘটেছিল এ রকম : পার্লামেন্টে পেপার ওয়েট ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছিল, এবং একটা পেপার ওয়েট ইন্নোসেন্ট শাহেদ আলী সাহেবের কপালে গিয়ে লাগে এবং রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালাইজ করা হয়েছিল কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত কারণে শাহেদ আলী সাহেব মারা যান। দিজ। গেইভ এ ক্যজ টু আইয়ুব খান টু ডিক্লেয়ার মার্শাল ল এন্ড ডিজল অল এ্যাসেমব্লিজ। অল দিজ ওয়াজ ডান ইন অক্টোবর ১৯৫৮।

১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত আমি ন্যাশনাল এসেমব্লির মেম্বার হিসেবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। যেমন, বরিশাল গিয়েছি। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি। ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লির মেম্বার হিসেবে আমার কিন্তু প্রিভিলেজ ছিল যেমন, ট্রেনে প্রথম শ্রেণীর টিকেট পেতাম আমি। ১৯৫৮-এর শেষের দিকে একদিন বরিশাল গিয়েছি। তখন অক্টোবর মাসই ছিল সম্ভবত। এখনো মনে আছে, আমি জাহাজ থেকে ডিসএম্বার্ক করব তখন দেখি আমার বন্ধুবান্ধবরা, আমার কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বাররা সবাই স্টিমার ঘাটে এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা চিৎকার করে ঘোষণা দিচ্ছেন, মার্শাল ল জারি হয়ে গেছে। তখন আমি বুঝলাম যে মার্শাল ল জারি হয়ে গেছে। তখন আমি চিন্তা করলাম, আমার আর নরমাল জাহাজে করে (অর্থাৎ যে জাহাজে আমি সাধারণত চলাফেরা করতাম, R.S.N.I.G.N কোম্পানির বড় বড় সব জাহাজে) আমার ঢাকায় ফেরা উচিত হবে না। ঘটনা আরো ঘটবে। সুতরাং তার পরদিন বরিশালে আমি কোনো মিটিং করলাম না।

তখন বরিশাল-ঢাকা লঞ্চ সার্ভিস চালু হয়ে গেছে। আর এস এন আই জি এন কোম্পানির ভালো জাহাজও যেমন অস্ট্রিচ, লেপচা ইত্যাদি চলছে, আবার প্যারালাল ওয়েতে লঞ্চও চলছে। আমি এ রকম একটা লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরত আসলাম। আমার তখন বাসস্থান ছিল, এখন যেটা মতিঝিল এ জি বি কলোনি সেখানে। এই একাউন্টেন্ট জেনারেল, কলোনিতে আমার একটা কোয়ার্টার ছিল। কোয়ার্টারটা পেয়েছিলাম, কারণ আমার ওয়াইফ মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের টিচার ছিলেন। এ্যাডুকেশন সার্ভিসের লোক তিনি, সে যুগের এম এ বি টি ছিলেন। মাহফুজুল হক সাহেব নামে হক সাহেবের দলের একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি যখন তাকে বললাম যে, আমার তো বাসা নাই, আমার ওয়াইফ কেমন করে কাজ করবে? তখন মাহফুজুল হক বোধ হয় স্টেট মিনিস্টার ছিলেন। মাহফুজুল হক সাহেব ইন্টারভেন করে এ জি বি কলোনিতে আমার নামে একটা দুই কামরার বাসা এ্যালট করালেন। ঐ বাসাতেই আমার স্ত্রী আমাদের একটি বাচ্চা (তখনো সন্তান আমাদের একটি) নিয়ে থাকতেন।

আয়ুব খান মার্শাল ল জারি করার পর সব এ্যাসেমার ওয়াজ ডিজলভূক্ত। সো আমার মেম্বারশিপ ওয়াজ ডিজলড। আমি জানতাম, আমাকে আবার এ্যারেস্ট করা হবে। অন্য কাউকে এ্যারেস্ট করা হোক বা না হোক আমাকে এ্যারেস্ট করা হবে। তার জন্যে আমি মনে মনে তৈরি হলাম। আমার পরিবারকে এসব কথা জানালাম। আমার ফাদার ইন ল একজন অফিসার ছিলেন। তাকে বললাম যে আমি যদি এভেইলেবল না হই অর্থাৎ আমি যদি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই বা আমি যদি বাসায় না থাকি তা হলে এ্যাটাক উইল কাম অন মাই ফ্যামিলি। পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করবে : উনি কোথায় গেলেন? উনি তো ছিলেন। আমাদের কাছে খবর আছে যে সন্ধ্যার সময় উনি বাসায় ছিলেন। আমি দুই এক সময় যে রাত্রে আমার বাসা এ্যাভয়েড করে আমার বন্ধুদের বাসায় না গেছি তা না। কিন্তু আমি যে এভইলেবল অর্থাৎ আমাকে যে পাওয়া যায় এটাও আমি ওদের চোখের সামনে রেখেছি।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আমি যখন আমার বাসার কাছাকাছি একটা জায়গায় বেড়াচ্ছিলাম আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে তখন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কিছু লোক এসে আমাকে বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে আসেন। তারা আমাকে থানায় নিয়ে গেল। থানা থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল সেন্ট্রাল জেলে। আগের বার জেলে থাকা অবস্থায় আমি ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লির মেম্বার ছিলাম। কিন্তু এবার যেহেতু এ্যাসেমব্লি ডিজলভূ করে দেওয়া হয়েছে সেহেতু আমি এখন একজন সাধারণ সিকিউরিটি প্রিজনার মাত্র।

৩৫. আবার কারাবরণ

পাকিস্তান নামক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রটি ছিল আমার বৈরীশক্তি। এই শক্তি আমাকে জেলখানায় আটকে রেখেছে। কিন্তু তাই বলে পৃথিবীটাকে তো আটকে রাখতে পারেনি। এটা আমরা জেলখানায় বসেও বুঝতাম। পৃথিবী একটা গ্রহ, তার মধ্যে পাকিস্তান একটা উপগ্রহ, সেই উপগ্রহেরই আর একটা তস্য উপগ্রহ হচ্ছে জেলখানাটা। পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে জেলখানাটাও ঘুরছে। এভাবেই আমরা জিনিসটাকে দেখতাম। পৃথিবী ঘুরছে–এটা বিশ্বাস করতাম বলেই, ঐ যে কনসোলিডেশনের কথা বলছিলাম সেখানে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যাপার, এর অগ্রগতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতাম। আমাদের কল্পনার সাথে বাস্তবের মিল থাকুক বা না থাকুক, জেলখানার মধ্যে আমরা সবসময় একটা রাজনৈতিক জীবনযাপনের চেষ্টা করেছি।

মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করা হল এবং ইমিডিয়েটলি আমাকে ঢাকা থেকে রাজশাহী জেলে ট্রান্সফার করে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে ১৯৫৯ গেল। ১৯৬০ গেল। ১৯৬১ও কেটে গেল। রাজশাহী থেকে হয়তো আমাকে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমার তরফ থেকে সরকারের কাছে আবেদন ছিল, আমি তো কোনো পলিটিক্যালি ইনভলবৃড় লোক নই, আমাকে কেন এতবার এ্যারেস্ট করা হচ্ছে? জেলে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোক এসে মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। কাজী এমদাদুল হক সাহেবের ছেলে কাজী আনোয়ারুল হক একজন বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন। ওঁরা মনে করতেন যে আমি একজন বড় কমিউনিস্ট লীডার। এটা ভেবে একদিন ঢাকা জেলে তিনি আমার সাক্ষাৎকার নেন। উনি আমাকে কিছু পলিটিক্যাল প্রশ্ন করেন : এই যে কমিউনিস্ট থিসিস, এই থিসিস সম্পর্কে আমার কি বক্তব্য? আমি তাকে উত্তর দিলাম যে এই সব থিসিস আমি কিছুই জানি না। উনি বললেন, আপনার মতো লোক কিছু জানেন না এটা হয় কখনো? আমি রিয়েলি তেমন কিছুই জানতাম না।

১৯৬২-এর শেষের দিকে আমার ফাদার ইন ল যিনি একজন ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি গভর্নমেন্টের কাছে যান। উনি বললেন, ও তো ইন্নোসেন্ট লোক। ওকে আপনারা কেন আটকে রেখেছেন। ছেলেটা তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বললেন যে আমরা তো জানি ওনাকে। কিন্তু আপনারা। যদি ওনার পক্ষে সিকিউরিটি হিসেবে না দাঁড়ান তবে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। আমরা ওনাকে কিছু রেস্ট্রিকশান দেব। উনি যেন এসব রেস্ট্রিকশান ভালোলেট না করেন। এই সিকিউরিটিটা আপনারা যদি না দেন তবে আমাদের পক্ষে ডিসিশন নেওয়া মুস্কিল হবে। অন্য কোনো আত্মীয় হয়তো সাহস করতেন না, কিন্তু আমার ফাদার ইন ল অফারড হিমসেলফ এ্যাজ সিকিউরিটি ফর মাই রিলিজ।

এর ফলে ১৯৬২-এর ডিসেম্বর মাসে আই ওয়াজ রিলিজড আন্ডার। সারটেন কনডিশনস্। দুই বছর সেসব কনডিশন আমাকে মানতে হয়েছিল। দি ফলোয়িং কন্ডিশনস আর ইমপোজড আপন ইউ : ১. দ্যাট ইউ উইল নট ইনভলব ইয়োরসেল ইন এনি পলিটিক্যাল এ্যাকটিভিটিজ, ২. ইউ উইল নট মেক এনি পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট, ৩. দ্যাট ইউ উইল নট লীভ দি ঢাকা টাউন উইদাউট দি পারমিশন অব দি পুলিশ, ৪. ইফ ইউ গো সাম হোয়ার, ইউ উইল রিপোর্ট দি পুলিশ দেয়ার… এই কনডিশনগুলো আমি দুবছর ধরে স্কুপুলাসলি মেনটেন করেছিলাম।

আমার বাসাটা তখনো এ জি বি কলোনিতে ছিল। কমিউনিস্টেরা বুঝতে পেরেছিল যে আমি আর সক্রিয় নই। তবে ওদের বিরুদ্ধেও আমি নই। আগে তারা চাদাটাদা চাইত, এখন আর চায় না। কমিউনিস্টদের মধ্যে অনেকে আমাকে যত না পছন্দ করত তার চেয়ে বেশি পছন্দ করত আমার বাচ্চাদের। বাচ্চাদের কাছে এসে তারা গল্প করত। অনিল মুখার্জী সে সময়ের একজন বড় কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক। আমি তাকে অনিলদা বলতাম। তিনি আমার বাসায় একজন রেগুলার ভিজিটর ছিলেন। তিনি আমাদের বাসায় অনেক দিন খেয়েছেন। কিন্তু হি হ্যাড এ মেথড অফ হিজ ওন। তিনি কখনো কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। অনিলদা আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থাতেই রাশিয়া ভিজিট করেছিলেন।

৩৬. বাংলা একাডেমী

১৯৬৩-তে বাংলা একাডেমীতে যোগ দিলাম। সৈয়দ আলী আহসান সাহেব তখন বাংলা একাডেমীর পরিচালক। তিনি আমার অপরিচিত লোক নন। তার ভাই সৈয়দ আলী আশরাফ ইন্টারমিডিয়েটে আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। আলী আশরাফ খুব ভালো ছাত্র ছিল। আলী আশরাফ, অজিত দে এবং আমি একেবারে এক সেকশানে পড়েছি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। কার্জন হলের বিপরীত দিকের বিল্ডিংটা ছিল তখন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ১৯০৫ সালে এটি তৈরি করা হয়।

সৈয়দ আলী আহসানদের বাড়ি ছিল হোসেনী দালানে। তাদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ইন্টারমিডিয়েট থেকে। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন এবং আমার মেরিট তিনি জানতেন। আমাকে এবং আবু জাফর শামসুদ্দিন সাহেবকে বাংলা একাডেমীর অনুবাদ বিভাগে নিয়ে গেলেন সৈয়দ আলী আহসান। পরে। আমি জানতে পারি যে আমার ব্যাপারে সৈয়দ আলী আহসান হ্যাড টু টক। উইথ আবদুল মোনায়েম খান, হি দেন গভর্নর অব ইস্ট পাকিস্তান। সৈয়দ আলী আহসান মোনায়েম খানকে জিজ্ঞেস করেন যে, উনি আমাকে অর্থাৎ সরদার ফজলুল করিমকে বাংলা একাডেমীতে রাখতে পারেন কিনা। তখন মোনায়েম খান পরিষ্কারভাবে সৈয়দ আলী আহসানকে বলেন, আই উইল নট লেট সরদার ফজলুল করিম গো ব্যাক টু ঢাকা ইউনিভার্সিটি বাট ইউ ক্যান। কিপ হিম আন্ডার ইউ। পরবর্তীকালে মোনায়েম খান পাবলিক মিটিং-এও এ ব্যাপারটার উল্লেখ করেছেন।

সৈয়দ আলী আহসান সাহেব আমাকে যখন বাংলা একাডেমীর অনুবাদ সেকশানে নিলেন, তখন আবু জাফর শামসুদ্দীন আমার মতিঝিল বাসায় গিয়ে খবর দেন যে, আমার কেসটা হয়ে গেছে। আই রেসপেক্টেড হিম এন্ড হি লাভড মি লাইক এ্যানিথিং। তিনি ছিলেন ফ্রেন্ড অব দি কমিউনিস্ট। তাকে আমি জাফর ভাই বলতাম। সিকান্দার আবু জাফরকেও জাফর ভাই বলতাম। সিকান্দার আবু জাফর বড় কবি হিসেবে, নাট্যকার হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন।

আবু জাফর শামসুদ্দীন একজন সেলফ মেইড ম্যান। তিনি ঢাকার একটা অঞ্চল থেকে এসেছেন। তিনি প্রথমে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। তিনি কোনো ইংরেজি ডিগ্রি নিয়েছেন বলে আমি জানি না। কিন্তু তিনি ইংরেজিতে দক্ষ হন। ইংরেজিতে তিনি প্রবন্ধও লিখেছেন। গোড়াতে তিনি ছিলেন এ্যালাইড টু সৈয়দ আলী আহসান। আবু জাফর শামসুদ্দীন পিইএন নামে যে একটা ইন্টারন্যাশনাল আমেরিকান অর্গানাইজেশন ছিল তার সঙ্গে যুক্ত হন, যদিও এর সম্পর্কে খুব একটা এ্যাডভোকেসি তিনি করতেন না। পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। মাওলানা ভাসানীর কৃষক সমিতির সাথে তিনি এ্যালাইড হন। কাগমারী সম্মেলনে হি প্লেইড হিজ পার্ট বাই গিভিং এ্যাডভাইস এড এটসেটরা। তিনি ঔপন্যাসিক। তিনি গল্পকার। তার একটা গল্পের সঙ্কলন ছিল। ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান নামে একটি বেশ বড় রকমের বই লেখেন তিনি।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উলটো দিকে আবু জাফর শামসুদ্দীন সাহেবের বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি সেক্রেটারি ফরহাদের সময়ে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি সিমপ্যাথেটিক ইন্টেলেকচুয়ালদের নিয়ে একটা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। আবু জাফর শামসুদ্দীন ছিলেন এই উপদেষ্টাদের একজন। তাঁর বাড়িতে তিনি উপদেষ্টা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ডাকতেন এবং খই, মুড়ি, চানাচুর ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়িত করতেন। ৬০-এর দশকে কমিউনিস্টদের একজন বড় বন্ধু ছিলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন।

বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের পদটা হয়েছে স্বাধীনতার পরে। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত পরিচালক পদই ছিল। মুহম্মদ এনামুল হক সাহেবের পরে বাংলা একাডেমীর পরিচালক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। আলী আহসান সাহেব টুক হিজ প্রফেসরশিপ এবং তার পরে এলেন কাজী দীন মুহম্মদ। কাজী দীন মুহম্মদের একটা ধর্মীয় ভাব ছিল। ওয়েস্ট পাকিস্তানের লিডারেরা তখনো এখানে আসছে। কাজী দীন মুহম্মদ তাদের খুব করে আপ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন।

আমি তখন সংস্কৃতি বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তরুণ ছেলেরা একদিন এসে আমাকে বলল যে তারা একটা সভার স্থান চায়। বাংলা একাডেমীর বটতলা ব্যবহার করতে পারলে তাদের খুব লাভ হয়। আমি তাদের বললাম : বটতলার পারমিশন আমি তোমাদের দিতে পারি না। তোমাদের যেতে হবে কাজী দীন মুহম্মদের কাছে। আমি নিয়ে যাবো। ছেলেরা তখন আমাকে বলল, আপনি তো দীন মুহম্মদের দালাল হয়ে গেছেন। আমি তখন হেসে বললাম : দেখো, আমি যদি কাজী দীন মুহম্মদের দালাল না হবে তা হলে আমি আজ বাংলা একাডেমীতে কেন থাকবো? এটা তো তোমাদের বোঝা উচিত। এরপর সেদিন বিকাল বেলাতেই ছেলেরা এসে আমার কাছে মাফ চেয়ে গেছে এই বলে যে, আপনার সম্পর্কে এই কথা বলা আমাদের ঠিক হয় নাই।

আর একবার ছেলেরা এসে বলল যে, তারা সোমেন চন্দের উপর একটা অনুষ্ঠান করবে। আমি যেন একটা পারমিশান দিই। আমি বললাম, আমি পারমিশান দিলে তো হবে না। তোমরা দরখাস্ত করো পরিচালকের বরাবরে। সংস্কৃতি বিভাগের কর্মকর্তার মাধ্যমেই করো। আমি তোমাদের নিয়ে যাবো দীন মুহম্মদের কাছে। ছেলেদের নিয়ে গেলাম আমি কাজী দীন মুহম্মদের কাছে। বললাম যে, এরা সোমেন চন্দের উপর একটা অনুষ্ঠান করতে চায়। এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, কাজী দীন মুহম্মদ বললেন, সোমেন চন্দটা কে? আমি বললাম, সোমেন চন্দ ওয়াজ কিলড ইন ১৯৪২।

সোমেন চন্দ ওয়াজ এ ভেরি পোটেনশিয়াল রাইটার। দীন মুহম্মদ সাহেব বললেন, আমি তো জানি না! এ ব্যাপারে আমার একটা রাইট আপ আছে যে, সোমেন চন্দকে একটা জেনারেশন চেনে না কিন্তু একটা সময় আসছে যখন তরুণরা সোমেন চন্দকে মাটি খুঁড়ে বার করবে।

সংস্কৃতি বিভাগে যত অনুষ্ঠান হত আমিই সব কনডাক্ট করতাম। যারাই অনুষ্ঠান করতে আসতেন তাঁরা সবাই আমাকে খুবই এ্যাফেকশনেটলি গ্রহণ করতেন। যে অনুষ্ঠানই হত আমি তার বিবরণ একটা মাস্টার বুকে নোট করতাম। দৈনিক ইনকিলাব কদিন আগে লিখেছে যে সরদার ফজলুল করিমের সম্পাদনায় পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য নামে একটা সঙ্কলন বের হয়েছিল। এই সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা ছিল। এই লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন।

যখন উন্নয়নের দশক অর্থাৎ ছয়েক দশক সেলিব্রেট করা হচ্ছে তখন সৈয়দ আলী আহসান বাংলা একাডেমীতে এক সপ্তাহের একটি সেমিনার করেন। সেই সেমিনারটার নাম দেন তিনি আমাদের সাহিত্য। এতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পার্টিসিপেট করেছিলেন। মনসুর মুসা পার্টিসিপেট করেছিলেন কিনা আমি জানি না। আবুল কাসেম ফজলুল হক পার্টিসিপেট করেছেন। এক একটা শাখায় যেমন, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে আমার সম্পাদনায় আমাদের সাহিত্য নামে একটা সঙ্কলন বের হয়েছিল। এ এইচ এম আবদুল হাই যিনি এখন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের চীনা ভাষার অধ্যাপক তিনি এ কাজে আমার সহকারী ছিলেন। আমি ছিলাম বাংলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার। তিনি ছিলেন সহকারী কালচারাল অফিসার।

পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাদের সাহিত্য সঙ্কলনটিকে একটি রেফারেন্স বুক হিসেবে কনসিডার করেছেন। আমাদের দেশ বা এই আমার দেশ ধরনের একটা প্যাট্রিয়টিক শিরোনাম দিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্যেও আমি একটা সঙ্কলন করেছিলাম। এতে আমরা পুরস্কারও দিয়েছিলাম। বই পুস্কার দিয়েছিলাম। অনেকে এসে পুরস্কার নিয়েছেন। সংস্কৃতি ডিপার্টমেন্ট ওয়াজ কোয়াইট এ ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্ট এ্যাট দ্যাট টাইম।

বাংলা একাডেমীতে কাজ করাকালীন সময়ে আমার চেষ্টা ছিল, টু গো ব্যাক টু দি ইউনিভার্সিটি। মফিজ উদ্দিন সাহেব যিনি এক সময় ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্টের মিনিস্টার ছিলেন, তিনি আমার একটা রিলেশন হন, খালুশ্বশুর। আমি ওনাকে দুই-একবার এ্যাপ্রোচ করেছি। আমি অবশ্য তাঁকে বলিনি যে আপনি অমুককে একটু বলেন। আমি গোবিন্দ চন্দ্র দেবকেও বলেছিলাম, স্যার আমাকে ইউনিভার্সিটিতে আসতে দেন না? আপনি তো আমাকে জানেন। জি সি দেব বলেছেন, হ্যাঁ তোমাকে তো জানি, কিন্তু গভর্নমেন্ট না বললে আমি তো তোমাকে নিতে পারি না। মফিজ সাহেব নামে ঢাকা ইউনিভাসির্টির একজন বড় কর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন ইউনিভার্সিটির একজন বড় লিডার। তিনি মারা গেছেন কিনা আমি জানি না। তিনি সিন্ডিকেটের মেম্বার ছিলেন। আমি ওনাকেও ইমপ্রেস করার চেষ্টা করলাম এই বলে হোয়াই ডোন্ট ইউ গিভ মি এ চান্স টু গো ব্যাক টু দি ইউনিভার্সিটি? তখন উনি আমাকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কমিউনিস্ট নন? আমি উত্তর দিলাম, আমি তো কোনো অর্গানাইজেশন করি না। উনি বললেন, আই ডু নট বিলিভ দ্যাট। যে বীজ আপনার মধ্যে এসেছে তা কোনো দিনও আপনার মধ্য থেকে চলে যেতে পারে–এটা আমি বিশ্বাস করি না। তখনকার দিনে একজন সিরিয়াস কমিউনিস্ট ওয়ার্কারের প্রতি একজন সিরিয়াস নন কমিউনিস্টের যতটা না হোস্টিলিটি ছিল তার চেয়ে বেশি আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। যার জন্যে হি ডিড নট এ্যালাও মি টু গো ব্যাক টু দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি, বাট হি ডিড নট ডিজরেসপেক্ট মি। তিনি আমাকে এভাবে রেসপেক্ট দিলেন যে, আমি মনে করি না, আপনি কমিউনিজম ছাড়তে পারেন।

৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় মুনীর চৌধুরী একটু পার্টিজান হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান গভর্নমেন্ট যা চেয়েছে ও তাই করেছে। গভর্নমেন্ট তাকে খেতাব দিয়েছে। মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তান সরকার ফ্রন্টেও নিয়ে গিয়েছিল। আবু জাফর শামসুদ্দীন সাহেব ও পথে যায়নি। মুনীর এ সময়ে আমাকে একটু এড়িয়েই চলত। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে চাই–এটা সে জানত। কিন্তু আমার পক্ষে কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সেটা তার। নিজেরই ক্ষতি করতে পারত। সরদার ফজলুল করিমের পক্ষে যে বলে সেও যে কমিউনিস্ট–এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের আর কোনো সন্দেহই থাকত না।

প্রশাসন ভাবত, মুনীর বামপন্থী রাজনীতি থেকে দূরে সরে এসেছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে এ রকম ধারণা তাদের কখনোই জন্মায়নি। একবার পাকিস্তান গভর্নমেন্ট মুনীরের পাসপোর্ট আটকে দেয়। সে আমেরিকায় যেতে চাচ্ছিল উচ্চশিক্ষার জন্যে। তখন মুনীর তাদের ঠাট্টা করে বলেছিল, মিয়ারা আপনারা। কার পাসপোর্ট আটকাইতাছেন? আপনাগো পরে যারা ক্ষমতায় আইবো তারা তো প্রথমে আমার পাসপোর্টটাই সীজ করবো!

সে সময় কমিউনিস্টরা আমাকে তাদের একজন নিষ্ক্রিয় মিত্র হিসেবে বিবেচনা করত। মণিদা অবশ্য দুই-একবার বাংলা একাডেমীতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কমিউনিজমই যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি তুমি কি তা আর বিশ্বাস করো না? আমি তাঁকে উত্তর দিয়েছিলাম, মণিদা, বিশ্বাসের কথাটা যদি তোলেন তো সেটা অন্য ব্যাপার হয়ে যায়।

একবার আমেরিকান দূতাবাসের এক সেক্রেটারি আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসে বাংলা একাডেমীতে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ঐ সেক্রেটারি আমাকে বলে, হোয়াই ডোন্ট ইয়ু জয়েন আস ইন লাঞ্চ? আমি তখন তাকে জবাব দিই, ইয়োর টাইম ইজ ভ্যালুয়েবল এ্যান্ড মাই টাইম ইজ অলসো ভ্যালুয়েবল। লেট আস নট ওয়েইস্ট আওয়ার টাইম!

৩৭. ’৬৯-এর গণআন্দোলন

 ১৯৬৯ থেকে শুরু করে ১৯৭০ এবং ১৯৭১-এর ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি বাংলা একাডেমীর সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। আই ওয়াজ এ কনসাস অবজার্ভার অব দি টোটাল প্রসেস। আই ওয়াজ ভেরিটেবলি এ ক্যামেরাম্যান। আমি ফটোগ্রাফারও ছিলাম। ৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোর বিভিন্ন ঘটনা খুব সুন্দরভাবে আমি কালেক্ট করেছিলাম আমার ইয়াশিকা ক্যামেরায়। এগুলো। প্রিজার্ভেবল ছিল।

১৯৬৯-এর গণআন্দোলন আমি নিজের চোখে দেখেছি। আসাদের যে ঘটনা অর্থাৎ আসাদকে যখন মার্ডার করা হল, সে দিনের কথাও মনে আছে। সেদিন কাজী দীন মুহম্মদ মটর গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন কক্সবাজার। সেখানে একটি মিটিং-এ তিনি বক্তৃতা দেবেন। আমরা যখন মাঝপথে তখন এই নিউজটা এল যে, হাতিরদিয়াতে, আসাদ ওয়াজ কিলড। আমরা আর কক্সবাজার যেতে পারলাম না। আমরা ঢাকায় ব্যাক করলাম। আসাদকে আমি জানতাম না। কিন্তু তার মৃত্যুতে ঢাকায় সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া। হয়। এক মন্ত্রীর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মর্নিং নিউজ অফিস। আমার এসব ঘটনা মনে আছে। সত্যেন সেনের মতো লোকেরা তখন জেলখানা ভেঙে বেরিয়ে আসেন। সত্যেন সেনের মতো একটা নিরীহ লোক একটা লাঠি হাতে কয়েদিদের সাথে মিছিল করে যাচ্ছে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে, চিন্তা করুন একবার! এ ঘটনাটা আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। ইট ওয়াজ রিয়েলি এ গণঅভ্যুত্থান।

১৯৬৯-এ আগরতলা মামলা থেকে যে বঙ্গবন্ধু বের হয়ে এলেন–এটা একটা বিরাট ব্যাপার। তাকে দেখার জন্যে আমি গেলাম তার ধানমন্ডির বাড়িতে। আমি অবশ্য জানতাম যে জনতার ভিড়ে শেখ মুজিবের কাছে আমি যেতে পারব না। কিন্তু তবু আমি গেলাম, কারণ আমি মনে করতাম জনতাই হচ্ছে শেখ মুজিব এবং শেখ মুজিবই হচ্ছেন জনতা। এভাবে আমার একটা রাইট আপ আছে। রাইট আপটির শিরোনাম : তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।

৩৮. ১৯৭০-এর নির্বাচন ও অতঃপর

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করল। এই জয়ের পর বাংলা একাডেমী আয়োজিত ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়া হল*। [*বঙ্গবন্ধুর বাংলা একাডেমীতে আসার ঘটনাটা হয়তো ঘটেছিল ১লা মার্চ তারিখে : সেদিনই জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত সভা স্থগিত করার ঘোষণা প্রচারিত হয়।] এ ব্যাপারে কবীর চৌধুরী ওয়াজ দি টপমোস্ট পার্সন। তিনি তখন পরিচালক। আমি এবং কবীর চৌধুরী (এ এইচ এম আবদুল হাইও ছিলেন বোধ হয় আমাদের সঙ্গে) তাকে আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা গিয়ে পৌঁছার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমীতে এসে গিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমীতে একটি উদাত্ত বক্তৃতা দেন এই বক্তৃতায় তিনি সবার জবাবদিহিতার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন, আপনারা ভাষার জন্যে কি করেছেন? দেশের জন্য আপনারা কি করেছেন? তিনি আরো বলেছিলেন, আমরা যেদিন ক্ষমতায় যাবো সেদিন থেকে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে। পরবর্তীকালে ক্ষমতায় গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তার কথা রক্ষা করেছিলেন।

শেখ সাহেব যখন বাংলা একাডেমীতে বক্তৃতা দিচ্ছেন তখন খবর এল যে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছেন : সিডিউলড মিটিং অব দি ন্যাশনাল এ্যাসেমরি ওয়াজ পোস্টপনড। এই মেসেজ ওয়াজ গিভেন টু শেখ সাহেব এবং দি মোমেন্ট দি মেসেজ ওয়াজ গিভেন টু হিম, শেখ সাহেব বাংলা একাডেমীর মিটিং থেকে চলে যান। মিটিংটা ওভার হয়ে যায়। আমি যাই, পরে দেখা হবে–বলে আমাদের দিকে হাত নেড়ে শেখ মুজিব চলে গেলেন আওয়ামী লীগ অফিসে।

তখন ফান্ড-টান্ড রেইজ করার প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হচ্ছে এবং সেই কমিটির জন্যে চাঁদা তোলা হচ্ছে। আমরা চাদা তুলেছি, চাদা দিচ্ছি। আহমদ শরীফ স্যারসহ আমরা শহীদ মিনারে মার্চ করে যাচ্ছি। এই সমস্ত জঙ্গি ব্যাপার ৭১-এর প্রথম থেকেই শুরু হয়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের বিখ্যাত জনসভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। আমি বারবার বর্ধমান ভবনের ছাদে উঠে দেখছিলাম কী রকম গণজমায়েত হয়েছে। তখন রেসকোর্স ময়দানের উপর পাকিস্তানি বিমান চক্কর দিচ্ছিল বারবার।

’৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে বাংলা একাডেমী ওয়াজ এ্যাটাকড। তিন তলায় একটা আধফাটা শেল পাওয়া গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, শেলের খোলসটা মিউজিয়ামে রাখতে। ২৫ মার্চের শেলিং-এ তিনতলার তেমন ক্ষতি হয়নি। দোতলার ক্ষতি হয়েছিল বেশি। ২৭ মার্চ তারিখে অফিসে এসে দেখলাম, আমার ঘরের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। দেয়ালে অনেকগুলো বুলেট চার্জ করা হয়েছে। আমার টেবিলের পিছনে যে স্টিলের আলমারি, সেটার জিনিসপত্র সব তছনছ করে ফেলা হয়। সেই ঝাঁঝরা দেয়ালের সামনে, ভাঙা দরজাওয়ালা ঘরে বসেই পুরো ৭১ সালটা আমি অফিসের কাজ করেছি।

আই কনটিনিউজ ওয়ার্কিং ইন মাই অফিস। ইফ আই এ্যাম নট এ্যাভেইলেবল টু আর্মি, দেন আর্মি উইল জাম্প ওভার মাই ফ্যামিলি ইন মতিঝিল এ জি বি কলোনি। কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম না আমার ছেলেমেয়েদের সামনে আমাকে গ্রেপ্তার করা হোক। সে জন্যে আমি সকাল-সন্ধ্যা বাংলা একাডেমীতে অফিস করতাম। কবীর চৌধুরী সাহেব ওয়াজ কোয়াইট ওকে। তিনি তার লেখাপড়া করতেন। আমরা কথাবার্তা বলতাম। সাধারণ কিছু কাজকর্ম হত কিংবা হত না–সেটা বড় ব্যাপার ছিল না। এই যে এখলাস উদ্দিন এখন চোখে প্রায় দেখতেই পায় না, সে তো বড় এ্যাকটিভিস্ট ছিল। এই যে আমার গিয়াস, হিস্ট্রির, সে ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে আমার অন্ত রঙ্গ বন্ধু। সে সরদার ভাই বলতে অজ্ঞান ছিল। গিয়াসের বড় ভাই নাসিরুদ্দীন। আহমদ আমার ইন্টারমিডিয়েটের বন্ধু। গিয়াস, এখলাস এরা সবাই বাংলা একাডেমীতে আসত।

আমরা সময় কাটানোর জন্যে এক টেবিলে বসে গল্প করতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কী বলা হয়েছে, মুকুলের চরমপত্রে নতুন কী বলা হল ইত্যাদি আলোচনা করতাম। কতদিন লাগবে দেশ স্বাধীন হতে, কোন ফ্রন্টে কী হবে? এসব জানার জন্যে আমরা শেষ দিকে প্ল্যানচেট করা শুরু করলাম। প্ল্যানচেটের মধ্যে জিন্নাহ সাহেব আসলেন একবার। তাকে বিভিন্ন। প্রশ্ন করা হল। জিন্নাহ সাহেব কোনো কথাই বলতে চান না। তারপর হক সাহেব আসলেন। হক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বলেন, দেশ স্বাধীন হতে কতদিন লাগবে? আমাদের আঙুল নড়ে উঠল। কাগজে লেখা হল। : ইট উইল টেক টাইম। এটা বলেই হক সাহেব চলে গেলেন। এইসব করে আমরা বাংলা একাডেমীতে সময় কাটাতাম।

বাংলা একাডেমীর কর্মচারীদের মধ্যে মিলিটারিদের এজেন্ট ছিল। স্বাধীনতার পর তাদের হ্যাঁ করা হয়েছে। তাদের থাপ্পড়টাপ্পড় মেরেছে অনেকে। এক এজেন্টের নাম ছিল হেমায়েত। হেমায়েত রেডিও পাকিস্তানে কাজ করত। দি সিচুয়েশন ইজ নরমাল বলে একটা স্টেটমেন্ট তৈরি করে রেডিও পাকিস্তানের কিছু লোকজন সেই স্টেটমেন্টে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেন। তারা হেমায়েতকে সাথে নিয়ে বাংলা একাডেমীতেও যায়। হেমায়েত আমার কাছে গিয়ে বলল, সরদার ভাই, এটা দেখেন। সিগনেচার না দিলে যে কি হবে তা আমরা বলতে পারি না। আপনি নিজে তো বুঝতে পারেন। তখন আমি নিজে চিন্তা করলাম যে আমি যদি সাইন না দিই তবে আমাকে ইমিডিয়েটলি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হবে অর্থাৎ আমাকে বাসা। ছেড়ে চলে যেতে হবে অথবা আমি যদি বাসায় থাকি, তবে আই শেল বি এ্যারেস্টেড। এটা আমার পজিটিভ কনকুশান। আমি দস্তখত দিতে বাধ্য হলাম। এ্যাট দি গান পয়েন্ট। উপায় ছিল না।

আমি ঢাকা ছাড়তে পারিনি, কারণ পরিবার নিয়ে আমি কোথায় যাবো? গ্রামে চলে যেতে পারতাম আবু জাফর শামসুদ্দীন ভাইয়ের মতো। কিন্তু সেখানে গিয়ে পরিবার প্রতিপালন করব কীভাবে? ভারতে যাইনি, কারণ, ঢাকা শহর থেকে ভারতে যাবার ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। আমি কোনো দলের নই। সুতরাং কোনো দল আমাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাবে না। আমি তখন কোনো রাজনীতি করি না। কোনো পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িতও আমি ছিলাম না। আমি বড় কোনো নেতাও ছিলাম না যে পার্টি আমার ভারতে যাবার সব ব্যবস্থা করে দেবে। তা ছাড়া দল না হয় আমাকে রক্ষা করল কিন্তু আমার ফ্যামিলিকে রক্ষা করবে কে? আর আমি ভারতে গেলেই তো হবে না, আমার পুরো পরিবারটিকেও সেখানে নিতে হবে। আমার ফ্যামিলিকে আমি যদি রক্ষা করতে না পারি তবে হোয়াট উইল আই ডু উইথ মাই লাইফ? এই জন্য আই ডিড নট লিভ মাই কোয়ার্টার। সকালবেলা নিয়মিত অফিসে গেছি, বিকালবেলা বাসায় ফিরেছি। মাঝখানে অফিসে বসে গল্পটল্প করেছি। অনুবাদও করেছি কিছু।

আমি ইতোমধ্যে আমার বাসায় বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। আমি বিভিন্ন গণআন্দোলনের অনেকগুলো ছবি তুলেছিলাম। সেসব ফটোগ্রাফ ইত্যাদি আমি জ্বালিয়ে দিয়েছি। বিসমিল্লাহির রহমানুর রহিম লিখে টাঙিয়ে দিয়েছি আমার দরজায়। পাকিস্তানের পতাকাও একটা রাখা হয়েছে, দরকার মতো সেটাও দেখানো হবে। তখন আমার ছেলেমেয়েরা, দুটি বা তিনটি বোধ হয় ছিল তখন, তারা রাত্রে মিলিটারিদের গাড়ি যেমন, ট্রাক বা মাইক্রোবাস আসতে দেখে বা আসার শব্দ শুনে কেঁদে উঠত : আব্বা, ঐ আসছে। তারা বুঝে গেছে, আমাকে এখনো নেয় নাই কারণ, অন্যরা লিস্টের প্রথম দিকে আছে, আমার পালা আসবে একটু পরেই। আমি ঘুরে ঘুরে অন্যদের পিক আপ করে নিয়ে যাচ্ছে। এপ্রিল মাসের দিকে যখন পজিশনটা আরো এ্যাডভান্স করেছে অর্থাৎ মুজিবনগর গভর্নমেন্ট ফর্ম করেছে তখন আরো নানান ঘটনা ঘটছে। ঢাকায় প্রতি রাত্রেই বোমা ফাটছে এদিক ওদিক। যে রাত্রে বোমা ফাটছে না সে রাত্রে মনে হচ্ছে একটা বোমা ফাটলে হত। আমরা রেডিও কানের কাছে ধরে চরমপত্র শুনেছি।

৩৯. হু ইজ সরদার ফজলুল করিম

১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, বাংলা একাডেমী থেকে মিলিটারিরা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। এর আগে আবু জাফর শামসুদ্দীনকেও নিয়ে গিয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। আমি অপেক্ষা করছিলাম যে জাফর ভাই ফিরে এলে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব মিলিটারিরা তাকে কী কী ধরনের ইন্টারোগেশন করেছে। জাফর ভাইয়ের কাছ থেকে সব শুনে আমি ডিসিশন নেব আমি কী করবো। জাফর সাহেব ফিরে এসে আর জয়েন করেননি। ঐ যে তাকে ইন্টারোগেশনে নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি আর জয়েন করেন নাই। তিনি সেখানে থেকেই তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলে যান।

৭ সেপ্টেম্বর তারিখে আমি অফিসে যাই সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টার সময়। অফিসে গিয়ে বসার কিছুক্ষণ পর কয়েকটা লোক এসে আমার টেবিলের পাশে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে বাঙালি এবং নন বেঙ্গলি দুইই ছিল। তারা জিজ্ঞেস করল : হু ইজ সরদার ফজলুল করিম? আমি উত্তর দিলাম : আই এ্যাম সরদার ফজলুল করিম। তারা আমাকে বলল, ইউ কাম উইথ আস। ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট। আমি আশপাশের বন্ধুদের বললাম, দেখেন, আমি তো চলে গেলাম। আমার বাসায় একটু খবর দেবার চেষ্টা করবেন। মোতাহের বলে এক কর্মচারী ছিলেন। এখন তিনি মারা গেছেন। এই মোতাহারই বোধ হয় সেদিন বিকালে আমার মতিঝিলের বাসায় গিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলেন আমার ওয়াইফের কাছে। আমি পরে জেনেছি, ৬ সেপ্টেম্বরই আর্মি ইন্টেলিজেন্সের লোক বাংলা একাডেমীতে এসে জিজ্ঞেস করে গিয়েছিল, সরদার ফজলুল করিম কখন আসে। এই খবরটা কিন্তু আমাকে কেউ দেয় নাই। অবশ্য খবর দিলেও আমার কিছু আসত যেত না।

বাংলা একাডেমীর পাশে একটা আর্মি জিপ রাখা ছিল। জিপে আর্মড ম্যান। ছিল। আমাকে ওরা জিপে নিয়ে গিয়ে উঠাল। আমি ভাবলাম, বাংলা একাডেমীর গেট থেকে বের হয়েই ওরা ক্যান্টনমেন্টে যাবে। কিন্তু জিপটা ক্যান্টনমেন্টে গেল না। আমাকে নিয়ে শহরের মধ্যে মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়াতে ঢুকল। ঢুকে তারা এখানে-ওখানে ওয়ারলেসে নানা কথাবার্তা বলছে : হ্যালো, হ্যালো। টকিং ফ্রম মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়া। হোয়াই ডোন্ট ইউ ফাইভ হিম, হি সিট দেয়ার, হি হ্যাঁজ এ লিগাল ফার্ম, সার্চ আফটার হিম ইত্যাদি। তখনি আমি বুঝে নিই ব্যাপারটা : ওরা কামরুদ্দীন সাহেবকে খুঁজছে। কামরুদ্দীন সাহেব অনেক বই-পত্র লিখেছেন পাকিস্তান পিরিয়ডটার বিভিন্ন দিক নিয়ে। কামরুদ্দীন সাহেবের অপরাধ হচ্ছে এই যে, তাঁর ছেলে নিজাম ছাত্র ইউনিয়ন করত এবং সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। সম্ভাবনাময় এই ছেলেটি সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করত এবং বাপের সঙ্গে এ নিয়ে তার তর্কও হত। ফেনীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুখোমুখি সংগ্রামে নিজাম শহীদ হয়। এই ছেলেটিকে নিয়ে কামরুদ্দীন সাহেবের অনেক আশা ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উলটো দিকে কামরুদ্দীন সাহেব আর তার পার্টনারের লিগাল ফার্ম ছিল একটা। ওদের কাছে ক্রমাগত নির্দেশ আসছে ক্যাচ হিম, টেক হিম আপ*। [*সাইদুল হাসানকে এই ঘটনার পূর্বে জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে পাক আর্মি নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।] কিন্তু ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকেরা তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত যেতে যেতে কন্ট্রোল রুমের সাথে আলাপ করতে করতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে দিয়ে গাড়িটা রাখল এবং এক সময় দেখলাম, কামরুদ্দীন সাহেবকে ওরা নিয়ে আসছে। কামরুদ্দীন সাহেব গাড়িতে এসে আমার পাশে বসলেন। আমরা দুজনে এমন ভাব দেখালাম যেন উই ডু নট নো ইচ আদার। আমরা একে অপরকে চিনি না।

জিপটা এরপর আর কোথাও দাঁড়াল না। সোজা চলে গেল এম পি হোস্টেলে যেটা এখন প্রাইম মিনিস্টারের অফিস তার পিছনে একটা এম পি হোস্টেল ছিল। এম পি হোস্টেল ছিল একটা টরচার প্লেস অব দি আর্মি। ওখানে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে আমাদের দুজনকে বসাল। আমরা বসে আছি। একটা মেজর আসল কিছুক্ষণ পরে। মেজর এসে আমাকে একটা গাল দিল। ইউ পিপল, দি বাস্টার্ড সানস অব তাজউদ্দীন। উই শ্যাল টিচ ইউ এ গুড লেসন। তাজউদ্দীনের নামটা তারা নিল, অন্য কারো নাম না। অবশ্যই শেখ সাহেব তখন ওয়েস্ট পাকিস্তানে আটকা পড়ে আছেন। কিন্তু গভর্নমেন্ট তখন হয়ে গেছে এবং তাজউদ্দীন তখন সরকার প্রধান। তাজউদ্দীন ওয়াজ এ্যান ইম্পর্টেন্ট পার্সন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাইলেন্টলি কাজ করত। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে থাকত, সাইলেন্টলি বের হয়ে আসত। যা ফাইল ওয়ার্ক ছিল তা করত। তার কোনো বক্তৃতাবাজি ছিল না। আমাকে যেটা স্ট্রাইক। করল সেটা হচ্ছে, মেজর বেটা আমাকে গালি দিতে গিয়ে তাজউদ্দীনের নামটা উল্লেখ করল কেন!

আমরা বসেই আছি। বিকেলবেলায় আমাদের আর একটা অফিসারের সামনে হাজির করল। অফিসারের র‍্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক আমি জানি না। কামরুদ্দীন সাহেবের তো একটা পরিচয় ছিল। হি ওয়াজ এ্যান এক্স এ্যামব্যাসাডর। ওঁকে ছয় মাসের ডিটেনশন দিল। আমাকে দুই বছরের ডিটেনশন দিল। এরপর আমাদের দুজনকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আমি তো জেলবার্ড। আমার মনে একটু ভরসা এল যে, জেলে অন্তত সিপাহীটিপাহীদের মধ্যে কিছু পরিচিত লোক পাব।

আমাদের দুজনকে জেলে নেওয়ার পরে যে ট্রিটমেন্টটা আরম্ভ করল সেই ট্রিটমেন্টের মধ্যে কিছু ডিফারেন্স ছিল। দি ট্রিটমেন্ট হুইচ ওয়াজ গিভেন টু কামরুদ্দীন আহমদ এ্যান্ড দি ট্রিটমেন্ট গিভেন টু সরদার ফজলুল করিম ওয়াজ নট দি সেম। আমাকে তারা জেলের মধ্যে এমন খারাপ জায়গায় পাঠাল সেখানকার খাবার খেয়ে ব্লাড ডিসেন্ট্রি হতে বাধ্য। কাছাকাছি একটা আর্মির লোকও ছিল যে আমার কাছ থেকে সমস্ত কথা বার করার চেষ্টা করছিল। আমার বাইরের বন্ধুরা চেষ্টা করেছিল যাতে জেলের মধ্যে কোনো একটা ডিভিশন আমাকে দেওয়া হয়। এ জন্যে ওরা অনেক অফিসারের সঙ্গে মিট করেছে। এমনকি তারা মাহমুদ আলীর সঙ্গেও মিট করেছে। মাহমুদ আলী পাকিস্তানিদের সঙ্গে কাজ করছিল। কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা বিফলে গিয়েছিল। তারা কিছু করতে পারে নাই। ইন দি মিন টাইম সিচুয়েশনও ক্রমাগত চেঞ্জ করছে। পাকিস্তানিদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ইতোমধ্যে অক্টোবর গেল, নভেম্বর এসে পড়ল। এই দুই মাস আমি খুব সাফার করেছি।

পরাজয় নিশ্চিত-এটা বুঝে যাবার পর ডিসেম্বরের ১৩-১৪ তারিখে রাজাকার-আলবদররা বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করে। অনেকে। প্রশ্ন করে, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো লোক কেন সে সময় ঢাকা শহরে থেকে গেল? কিসের রসায়? মুনীর চৌধুরী কেন তার বাসায় অবস্থান করছিলেন? মুনীরের সাথে বহুদিন যাবৎ রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে ভাবত তাকে কেন পাকিস্তানিরা মারবে? কিন্তু রাজনীতির সাথে কোনো কালে কোনো প্রকার সম্পর্ক ছিল না এমন অনেক বুদ্ধিজীবী যেমন, মোফাজ্জল হায়দায় চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকেও* রাজাকাররা হত্যা করেছে। [*জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী গুলিবিদ্ধ করে। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পরবর্তীকালে হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন।] আসলে কোনো বুদ্ধিজীবীই ভাবতে পারেননি তাদের এভাবে ধরে এনে হত্যা করা হবে।

আমরা যারা জেলে ছিলাম তারা বেঁচে গেছি জেলে থাকার জন্যে নয় বরং আলবদর রাজাকাররা আমাদের হত্যা করার সময় পায়নি বলে। দেশটা এত তাড়াতাড়ি স্বাধীন হয়ে যাবে এটা তারা ভাবতে পারেনি। তারা ভেবেছিল, এগুলো তো জেলে আমাদের হাতের কাছেই আছে জিয়ল মাছের মতো; যে কোনো একদিন মেরে ফেললেই চলবে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দেয়ালের উপর মেশিনগান ফিট করাও ছিল। জেলে আমাদের হত্যা করলে এমন কিছু আসত যেত না ওদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ১৯৭১ সালে জেলের ভিতরেই রাজবন্দিদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার খবরটা আমরা জেলে বসেই পাই। সিপাহীরাই আমাদের খবরাখবর দিতে। ১৬ ডিসেম্বর তারিখে আমরা জেলেই ছিলাম। ১৭ ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা এসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দরজা খুলে দেয়। ঐ দিন অন্য সব কয়েদির সাথে আমি আর কামরুদ্দীন সাহেবও মুক্তি পাই এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বহু স্মৃতি-বিজড়িত গেটটি পার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখি।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম, ঢাকা তখনো একটি ভূতের নগরী। ট্রাফিক সিস্টেম তখনো কাজ করছিল না। আমি হেঁটে প্রথমে বাংলা একাডেমীতে গেলাম। সেখানে পুরোনো কর্মচারীরা সব ছিল। তারা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

৪০. রিটার্ন অব দি প্ৰডিগ্যাল সন : দুষ্ট গরুর গোয়ালে ফেরা

 পাকিস্তান হওয়ার কিছু দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আবার আমাকে নিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি পলিটিক্যাল সাইন্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলাম এ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর হিসেবে। এরপর প্রমোশন পেয়ে এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হয়েছিলাম। কিন্তু আমি প্রফেসর কোনো দিন হতে পারিনি। কেন পারিনি সেটার গল্প অন্য এক সময় করা যাবে।

অনেকে আমাকে বলতেন, রাজ্জাক সাহেব তো আপনার উপকার করতে গিয়ে আপনার ক্ষতি করলেন! আমি রাজ্জাক স্যারকে বলেছিলাম, স্যার আমি তো দর্শনের লোক। পলিটিক্যাল সাইন্সে তো আমার এম. এ. নেই। আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন? রাজ্জাক সাহেব আমাকে উত্তরে বলেছিলেন, আপনি ফিলসফির উপর কি সব লেখালেখি করছিলেন না? ঐগুলো আমার দরকার। উনি বিশ্বাস করতেন, দর্শন ছাড়া রাজনীতি সম্ভব নয়।

ওসমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাইব্রেরি এ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। এখনো লাইব্রেরিয়ানরা ওকে চিনতে পারে। আমি যখন প্রথম দিন লাইব্রেরিতে গেলাম তখন এই ওসমান আমাকে যেভাবে ওয়েলকাম করল সেটা খুব সিগনিফিকেন্ট : স্যার আপনি তো একটা ডেঞ্জারাস্ লোক। আপনি সেই যে পাকিস্তান ভাঙবেন বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন, পাকিস্তান না ভাইঙ্গা আপনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন না! আমার জীবনটাকে আমি এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিনি। কিন্তু ওর অবজার্ভেশনটায় কিছুটা সত্য যে আছে তা অস্বীকার করি কি করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *