৯. লুই দ্য ফ্রাঞ্চির বাসায়

৯.

পরদিন।

অবশ্য পরদিন না বলে সেদিন বলা উচিত। সকাল দশটায় আমি লুই দ্য ফ্রাঞ্চির বাসায় গেলাম। সিঁড়িতেই দুজন লোকের সাথে দেখা হলো। আমি উঠছি, আর তারা নামছেন। একজন শহরের ধনী শ্রেণির লোক তা। দেখলেই বোঝা যায়। দ্বিতীয়জনের বেসরকারি পোশাক পরে থাকলেও সে যে পেশাদার সৈনিক সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। লোক দুজনকে মনে হলো লুই দ্য ফ্রাঞ্চির ঘর থেকেই আসছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওরা নেমে সিঁড়ির নিচে চলে যাওয়ার পর আমি ফ্রাঞ্চির ঘরে গিয়ে দরজায় ঘা দিলাম।

চাকর এসে জানাল, তার মালিক পড়ার ঘরে আছেন।

সে ভেতরে গিয়ে আমার আসার কথা জানাল। লুই একটা চিঠি লিখছিল, লিখতে লিখতেই ফিরে চাইল।

আমাকে দেখেই হাতের চিঠিটা দলামোচা করে সামনের ফায়ার প্লেসের ভেতর জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলল। আপনি আসায় ভালোই হয়েছে, আপনার কাছেই চিঠিটা লিখছিলাম। তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেবার জন্য। তারপর চাকরকে ডেকে আদেশ করল, যে কেউ আসুক না কেন তাকে জানাতে যে লুই বাড়িতে নেই।

জোসেফ চলে গেল।

আমাকে চেয়ারে বসতে বলে লুই জানতে চাইল–সিঁড়িতে আমার সাথে দুজন লোকের দেখা হয়েছে কিনা?

আমি জানালাম–হ্যাঁ–সরকারি লোক একজন, আপনার কাছ থেকেই যাচ্ছে–এটা আমি বুঝেছিলাম। ওরা কি শ্যাটো রেনোর বন্ধু?

‘ওরা সবাই তার সহকারী।’

‘তাহলে ব্যাপারটাকে ওরা ভুলে যেতে রাজি না।’

‘এটা আপনিও স্বীকার করবেন যে, ভুলে যাওয়ার উপায় নাই।’

‘তা ওরা কী বলতে এসেছিল?’

‘আমাকে জানিয়ে গেল–আমি যেন আমার দুজন বন্ধুকে ওদের কাছে পাঠাই।’ এর জন্যই আপনাকে চিঠি লিখছিলাম।’

‘এ আমার সম্মান, আমি তো একা যেতে পারি না।

‘আমার আরেক বন্ধু ব্যারন গিওর্ডানি মার্তেনি। তাকে আমি দুপুরের খাবারের জন্য দাওয়াত দিয়েছি। এগারোটায় তিনি আসবেন। আমরা সবাই একসাথে লাঞ্চ খাব। তারপর দুপুরে আপনারা দুজন ওই ভদ্রলোকদের কাছে যান। তারা তিনটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকবেন। এই ওদের ঠিকানা।

লুই আমার হাতে দুটি কার্ড দিল, একজনের নাম হলো, ভাইকাউন্ট রিনি দ্য শ্যাটো গ্রান্ড, বাসা ১২নং রু দ্য লা পেয়াম–দ্বিতীয়জন–মঁসিয়ে আদ্রিয়েন দ্য রয়জী। এ সৈন্য বাহিনীর লোক আফ্রিকান রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট-এর বাসা ২৯ নং রু দ্য লীসে।

কার্ড দুটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি।

লুই বলল, ‘অত কী ভাবছেন?

‘আমি জানতে চাই ব্যাপারটাকে আপনি কি লড়াইয়ের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান? সেটা জানা থাকলে আমাদের সামনে এগোতে সুবিধা হবে।’

‘আপনি তো নিজের কানেই শুনেছেন আমি শ্যাটো রেনোর কোনো ইচ্ছেতেই বাঁধা দেব না বলে কথা দিয়ে দিয়েছি। তারপর তিনি তার দুজন সহকারীকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। এখন আমার হাতে আর কিছুই নেই। এর মধ্যে হেলাফেলারও কিছুই নেই।

‘সে ঠিক আছে, তবু আমাদের জানা দরকার যে লড়াইটা হচ্ছে কীসের জন্য। দুজন পরস্পরের গলা কাটছে, আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে, ভেতরের ব্যাপার কিছু না জেনেই-এটা তো সম্ভব না, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাইতে সহকারীদের দায়িত্ব অনেক বেশি।

লুই বলল, তাহলে শুনুন আমি ঝগড়ার কথা যথা সম্ভব সংক্ষেপে আপনাকে বলছি।

আমি যখন প্রথম প্যারিসে আসি, তখন ছোট এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো। সেই আমাকে তার স্ত্রীর সাথে আলাপ করিয়ে দিল।

তার স্ত্রী আশ্চর্য রকম সুন্দরী। আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম। পরে এই আকর্ষণ আরও গম্ভীর হয়ে ওঠার ভয়ে আমি তাদের বাড়ি যাওয়া একদম কমিয়ে দিলাম। যদিও ক্যাপ্টেন আমাকে তার বাড়িতে যখন খুশি যাওয়ার স্থায়ী অনুমতি দিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু আমি তেমন ভাবে না যাওয়ায় বন্ধুটি রাগ করতে লাগলেন। বাধ্য হয়ে তাকে সত্য কথা বললাম। তার স্ত্রীর জন্য আমার তার বাড়িতে যাওয়া অশান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। শুনে ভদ্রলোক হেসে ফেললেন এবং আমার হাত ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে তার সাথেই নিয়ে গেলেন জোর করেই তার বাড়িতে ডিনার খাওয়াবার জন্য।

খাবারের পর তিনি বললেন, ‘বন্ধু আমি তিন সপ্তাহের মধ্যে মেক্সিকো রওনা হয়ে যাচ্ছি। সেখানে তিন মাস কি তার চেয়েও বেশি দেরি হতে পারে। আরও বেশি দেরি হতে পারে। কারণ নাবিকেরা শুধু মাত্র খাবার সময়টাই ঠিক করে বলতে পারে, ফেরার তারিখটা না। আমার এই না থাকার সময়টা এমিলিকে তোমার দায়িত্বে রেখে যেতে চাই। এমিলির দিকে ফিরে বলল, ‘এমিলি একান্ত অনুরোধ লুই দ্য ফ্রাঞ্চিকে তুমি ভাইয়ের মর্যাদা দেবে।

এমিলি আমার সাথে হাত মিলিয়ে স্বামীর কথায় সম্মতি দিলেন।

আমি এতই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে কী বলব, তা বুঝতে পারলাম না। আমাকে যে তখন খুবই বোকা বোকা দেখাচ্ছিল তাতে সন্দেহ নেই।

ঠিক তিন সপ্তাহ পরেই বন্ধু বিদেশ রওনা দিলেন।

তার আগে এই তিন সপ্তাহে অন্তত তিনদিন তার আগ্রহে তার বাড়িতে খেতে গিয়েছি।

এমিলি তার মার সাথেই থাকেন। লোকে যেন তাকে হিংসুক বা অসামাজিক আখ্যা দিতে না পারে সেজন্য এমিলিকে স্বাভাবিকভাবে তার বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশতে বলে গিয়েছেন। তাছাড়া ভদ্রলোকের এমিলির উপর আস্থা ছিল প্রচুর।

কাজেই এমিলি নিজের বাড়িতে বন্ধুদের সবাইকে দাওয়াত দিতে থাকল। অল্প কয়েকজন লোক নিয়েই তার পার্টি। সেখানে তার মা নিজে উপস্থিত থাকেন। কাজেই লোকে কোনো নিন্দার বা এমিলির চরিত্র নিয়ে কথা বলার কোনো অবকাশ পেল না।

শ্যাটো রেনোর সাথে আমার আগের তিন মাস এভাবে কেটেছিল।

কিছু লোক আছে যাদের প্রথম দেখাই অশুভ একটা আশংকা জাগে।

এই শ্যাটো রেনোকে প্রথম যেদিন দেখলাম। আমার মনটা অশান্তিতে ভরে গেল। উনি আমার সাথে একটা কথাও বলেননি। উনি ভদ্রলোকের যেমন ব্যবহার করা উচিত তেমনি ব্যবহারই করলেন। তবুও সে চলে যাওয়া মাত্র তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি। কিন্তু এ ঘৃণা কেন তা আমি বলতে পারি না।

আমি হয়তো বুঝতে পেরেছিলাম যে, এমিলি আমাকে যেভাবে আকর্ষণ করেছিল। একে ঠিক একই ভাবে আকর্ষণ করেছে।

এমিলির কথাবার্তা আচার-ব্যবহার-স্বভাবত সংযত। কিন্তু শ্যাটো রেনোর কাছে এলেই সে একটু বাঁচালতার পরিচয় দিতে শুরু করল। অন্তত আমার সেটাই মনে হত। এর ফলে আমার হিংসা হওয়া স্বাভাবিক। আমি যে তাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম এবং বাইরে প্রকাশ না করলেও, সে। ভালোবাসা কোনোদিনই কমেনি এক ঘণ্টার জন্যও।

পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় শ্যাটো রেনোর উপর আমি চোখ রাখলাম। সেও সেটা লক্ষ্য করে এমিলিকে চুপি চুপি কী যেন বলে খুব হাসতে লাগল। আমার স্থির বিশ্বাস হলো এ হাসি আমাকে উপহাস করার জন্য।

আমার ওই লোকটার সাথে ঝগড়া বাজানোর একটা প্রবল ইচ্ছা হলো। তাতে যদি একটা ডুয়েল লড়তেও হয় সেটাও ভালো। হয় এসপার নয় ওসপার এ পরিস্থিতির একটা শেষ মীমাংসা হয়ে যাক।

অনেক কষ্ট করে সে বাসনা চেপে রাখলাম, সে ব্যাপারটা যে হাস্যকর হবে। সেটা বুঝার মতো জ্ঞান তখনও আমার ছিল।

সেদিন এ রাগ দমন করলাম ঠিকই, কিন্তু তার পর থেকে প্রতি শুক্রবার আমার পক্ষে একটা অগ্নি পরীক্ষার মতো হয়ে দাঁড়াল।

শ্যাটো রেনো হচ্ছে পুরোপুরি শহরের ফুর্তিবাজ লোক, সমাজে সুপরিচিত বিলাসী যুবক। আমার চাইতে অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু এমিলি তাকে যে রকম উঁচু দরের লোক বলে মনে করছে, তা যে না বলেই আমার বিশ্বাস।

দিন দিন বুঝতে পারলাম শ্যাটো রেনোর প্রতি এমিলির এই ব্যবহার শুধু আমার না, আরও অনেকের চোখেই পড়েছে, ও বাসায় আমার মতো রোজ যেত এরকম আরও অতিথি ছিল। তাদের একজন হলো গিওর্ডানো। সে একদিন সরাসরি আমার কাছে অভিযোগ করল।

এরপর আমার আর চুপ করে থাকা উচিত মনে হলো না। ঠিক করলাম এমিলিকে এ কথা সোজাসুজি প্রশ্ন করব। আমার ধারণা ছিল অবিবেচনাই এ ব্যাপারে এমিলির একমাত্র দোষ। তার আচরণটা যে একটা দারুণ কদর্য হতে পারে। এটা তার মাথাতেই ঢোকেনি। এই বিষয়টা তার মাথায় ঢুকলে পরে সে যে তার দোষ সংশোধন করে নেবে। এতে আমার সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু এ নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আমি বিব্রত হয়ে পড়লাম। এমিলি এমন ভাব দেখাল, আমার প্রতিবাদকে সে কেবল ঠাট্টা হিসাবে ভাবছে। সে জবাব দিল, তোমার এসব কথা একেবারে আজগুবি। অন্য যারা তোমার মতো সন্দেহগ্রস্ত। তাদেরও মতামতকে আজগুবি ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না।

এরপরেও তাকে বোঝালাম।

এবারে এমিলি তার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে আমাকে একদম চুপ করে দিল। সে আমাকে বলল, তুমি তো নিজেই আমাকে ভালোবাস। হতাশ প্রনয়ী কখনও ন্যায়বিচার করতে পারে না।’

ওর কথা শুনে আমি একেবার স্তম্ভিত। আমার গোপন ভালোবাসার কথা ওর স্বামী ওকে জানিয়ে দিয়েছে।

এরপর আমি এমিলির বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলাম। কি হবে গিয়ে, যেখানে আমার কোনো মর্যাদা নেই। হতাশ প্রনয়ী উপহাসের পাত্র!

যাই না ঠিকই, কিন্তু সব খবরই কানে আসে। সেসব খবরে মনের দুঃখ আরও বেড়ে যায়। সমস্ত শহরে শ্যাটো রেনো আর এমিলিকে নিয়ে গুজবের ফানুস উড়তে শুরু করল।

ভাবলাম একটা চিঠি লিখি।

সবকিছু বুঝিয়ে এমিলিকে একটা চিঠি লিখলাম। অনুরোধ করলাম। তার স্বামীর কথা চিন্তা করতে, যে বিদেশ গিয়েছে তার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে। তার এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যাতে তার সে বিশ্বাস। কোনো ভাবে চোট খায়। চিঠিতে তাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।

এমিলি সে চিঠির জবাব দিল না।

হয়তো তার জবাব দেবার কিছুই নেই। সে শ্যাটো রেনোর ভালোবাসায় মুগ্ধ। প্রেম অন্ধ তাই সে বুঝতে পারছে না এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে।

কিন্তু শহরে ছড়িয়ে পড়ছে এমিলির অপবাদ। শ্যাটো রেনোকে জড়িয়ে নিয়ে।

আমার মনের অবস্থা তখন বুঝার মতো কেউ ছিল না। তখনই কর্সিকায় বসে লুসিয়েন আমার মনের অবস্থার জন্য মানসিক অশান্তি ভোগ করেছিল।

এর মধ্যে দুই সপ্তাহ কেটে গেছে, আপনি ফিরে এলেন কর্সিকা থেকে।

আমার বাসায় আপনি প্রথম এলেন, সেদিনই আমি একটা বেনামী চিঠি পেয়েছি। এক অপরিচিতা মহিলা আমাকে অপেরার নাচে যোগ দেবার জন্য চিঠি লিখেছেন।

নাচে এসে তার সাথে দেখা করার পর সে আমাকে জানাল, আমার এক বান্ধবীর সম্পর্কে কিছু খবর আমাকে দেবেন। বান্ধবীর পুরো নাম না বললেও তার ডাক নাম যে এলিমিট্টা সে গোপন করল না।

আমি এবার প্রশ্ন করলাম, সেই মহিলাই বুঝি ভায়োলেট ফুলের তোড়া পরে এসেছিলেন?

‘হ্যাঁ, আমি তখন আপনাকে বলেছিলাম–অপেরার নাচে এলেই আমি ভালো করতাম। কথাটা ভুল বলেছিলাম। ভাগ্য টেনে আনলে আমার সাধ্য কি না গিয়ে?

মহিলা আমার সেই শোনা খবরগুলোই আমাকে আবার বলল–কিন্তু যখন শ্যাটো রেনো এমিলির প্রেমিক বলে দাবি করলেন, তখন আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম–না, এটা মিথ্যা কথা এ সম্ভব না।

তখন ওই মহিলা জানালেন–অপেরার কথা যে কতখানি মিথ্যা তা প্রমাণ করার জন্যই আপনাকে জানাচ্ছি–শ্যাটো রেনো আজ বাজি ধরেছে যে এমিলিকে সে ‘ডি’ বাড়িতে ডিনারের দাওয়াতে নিয়ে আসবে।

আপনি ‘ডি’ কে চেনেন, ‘ডি’ আপনাকে বন্ধু সহ সেই ডিনারে দাওয়াত করেছে, এসবই এক ভাগ্যের সুতায় গাঁথা।

তারপর সব ঘটনাই তো আপনার জানা।

লুই এর কথা শেষ হওয়ার পর আমাকে প্রশ্ন করল। এই পরিস্থিতিতে শ্যাটো রেনোর ডুয়েল লড়বার প্রস্তাব আমি কীভাবে ফিরিয়ে দেই?

এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাধ্য আমার নেই। হঠাৎ ভয়ংকর একটা কথা মনে পড়ে যেতেই আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। সাথে সাথে লুইকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মনে হয় আপনার ভাই লুসিয়েন বলেছিলেন যে, আপনি জীবনে পিস্তল বা তরোয়াল স্পর্শ করেননি।

‘সে কথা সত্যি।

‘তাহলে আপনার জীবন মরণ নির্ভর করছে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর।

‘ভুল বললেন, আমার জীবন মরণ শুধু আমারই না, সব মানুষের জীবন মরণ কি একমাত্র সৃষ্টিকর্তার উপরই নির্ভর করে নাই।

.

১০.

জোসেফ ব্যারন গিওর্ডানো মার্তেনির আসার খবর দিল।

লুই দ্য ফ্রাঞ্চির মতো, এই ব্যারন গিওর্ডানোও কর্সিকার বাসী, মার্টিন অঞ্চলে এরও বাড়ি। সেনাবাহিনীতে আছেন। যুদ্ধে বীরত্বের ফলে অল্প বয়সে মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি ক্যাপ্টেন হয়েছেন। বর্তমানে তার পরনে বেসামরিক পোশাক। ঘরে ঢুকেই প্রথমে আমাকে সালাম দিল, তারপরে লুই-এর দিকে ফিরে বললেন, তাহলে ব্যাপারটার এভাবেই মীমাংসা হচ্ছে? তোমার চিঠি পড়ে মনে হলো, তাতে শ্যাটো রেনোর সহকারী তো আজকে দেখা করবে?

‘তারা এসেছিল।’

‘ও। নাম ঠিকানা রেখে গিয়েছে?’

‘এই তাদের কার্ড।

‘ঠিক আছে। তোমার চাকর বলছিল–লাঞ্চ তৈরি। তাহলে খেয়ে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি?

আমরা খাবার ঘরে গিয়ে বসলাম, ডুয়েনের কথা ইচ্ছা করেই ভুলে গেলাম।

খাবার টেবিলে বসেই লুই আমাকে কর্সিকা ভ্রমণ সম্পর্কে জানতে চাইল। এর আগে সে এ ব্যাপারে জানার সময় পায়নি। আমি সংক্ষেপে তাকে বললাম।

এই কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে এটা বোঝা গেল, এতদিন ধরে সে যে একটা মানসিক অশান্তির মধ্যে ছিল, আজ আর তা নেই। তার টেনশন শেষ হয়েছে। কারণ অনিশ্চয়তার অবসান হয়েছে। তার টেনশনের কারণ সেই শত্রুর সাথে কালকেই ডুয়েল হবে। সুতরাং আর দুশ্চিন্তা করার কিছু নাই। এ পরিস্থিতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। মন এখন শান্ত। শান্ত বলেই লুইয়ের চরিত্রের স্বাভাবিক মাধুর্য, তার দেশ প্রেম, আত্মীয়স্বজনের প্রতি তার অপরিসীম অনুরাগ তার কথার ভঙ্গির ভেতর দিয়ে ফুটে বেরুতে লাগল।

মা, ভাই, তাদের নিজেদের ব্যাপারে তারা কি বলেছে লুই-এর ব্যাপারে। তা খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নিল আমার কাছ থেকে।

তাকে মুগ্ধ করল, কলোনা আর অলাৰ্ত্তির ব্যাপারে লুসিয়েনের আচরণ। লুই জানে তার ভাই খাঁটি কর্সিকান। তার রক্ত মাংসে ঢুকানো ভেনডেটার সংস্কার। সেই লোক অলাৰ্ত্তি আর কলোনার ভেনডেটা শেষ করার জন্য এত কষ্ট করবে এতটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। যা কিছু করেছে তা শুধু লুই এর খাতিরে। কতখানি ভালোবাসলে ভাইয়ের খেয়ালের কাছে নিজের সংস্কারকে ত্যাগ করা যায়।

নিজের মনে মনেই বললাম, ‘অনেকখানি।

ঘড়িতে বারোটা বাজল।

এবার লুই জানাল, আর দেরি করা উচিত না, এখন ভদ্রলোকদের সাথে দেখা করে আসুন, না হলে তারা আমাদের অভদ্র ভাবতে পারে।

আমি বললাম, তা কি করে ভাববেন? তারা এখান থেকে গিয়েছেন মাত্র দুই ঘণ্টা হলো। আপনার বন্ধুদের খবর দেয়ার জন্য আপনার তো কিছু সময় দরকার।

ব্যারন গিওর্ডানো বলল, সে যাই হোক, আমাদের বেরিয়ে পড়াই ভালো।’

আমি বললাম, আপনি পিস্তল না তরোয়াল ব্যবহার করবেন, সেটা বলে দিন।

‘আরে একটা হলেই হলো। আমার কাছে তো দুটোই সমান। কারণ কোনোটার ব্যবহার সম্পর্কেই আমি কিছুই জানি না। এছাড়া শ্যাটো রেনোই হাতিয়ার বেছে নেবেন। কারণ তার বিশ্বাস তিনিই অপমানিত পক্ষ।

‘অপমানিত যে কে সে ব্যাপারে তো সন্দেহ থাকতে পারে। আপনি এমন কি করেছেন? মহিলাটির অনুরোধেই তাঁকে আপনি সাহায্য করেছেন।

লুই বলল, আলোচনার ঝামেলায় যেতে চাই না, ও প্রসঙ্গে গেলেই ওরা ভাববে, আমরা বিষয়টা মিটিয়ে ফেলতে চাইছি। আপনারা জানেন আমি শান্তি প্রিয় লোক। দ্বন্দ্ব যুদ্ধ এর আগে আমি কখনও করিনি, সেই জন্যই আমি চাই, আনাড়ি বনে কেউ যেন আমার কোনো ত্রুটি ধরতে না পারে।’

‘বন্ধু, আপনার পক্ষে ওভাবে কথা বলা সহজ। কিন্তু যদি সত্য কথা বলতে হয়, তবে বলব আপনি বিনা কারণে জীবনটাকে সাংঘাতিক বিপদের মুখে ফেলেছেন। ঈশ্বর না করুন, যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে আপনার পরিবারের লোকও আমাদের দায়ী করবেন।’

লুই হেসে বলল, ‘মোটেই না। আমার মাকেও আমি জানি, ভাইকেও জানি, তারা শুধু জিজ্ঞাসা করবেন–লুই ঠিক দ্রলাকের মতো আচরণ করেছিল তো?’ আপনি যদি বলতে পারেন যে হ্যাঁ, তা করেছিল, তাহলেই তারা বস্তুষ্ট হবে।

‘তা হলে যে কথা ছেড়ে দেয়া যাক। তবুও কোনো অস্ত্র আপনার পছন্দ তা তো জানতেই হবে।’

‘বেশ তো। ওরা যদি পিস্তল চায়, রাজি হয়ে যাবেন।

ব্যারন জানাল, ‘আমারও তাই মত।’

‘তাহলে পিস্তলই হোক। কিন্তু পিস্তল বড় বিপজ্জনক।’

‘লুই জানতে চাইল, একদিনের ভেতর তাকে তরোয়াল শিখানো সম্ভব কিনা?

‘হয়তো চেষ্টা করলে আত্মরক্ষার কৌশল কিছুটা শেখানো যেতে পারি।’

লুই হাসল, দেখুন! অকারণে হাঙ্গামা করতে চাই না। কাল যা হবে, তা আগে থেকেই ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে। আপনারা কোনো চেষ্টা করেই তার পরিবর্তন করতে পারবেন না।

হাত মিলিয়েই বিদায় নিলাম আমরা। কাছেই শ্যাটো রেনোর সহকারীদের বাসা। প্রথমে ভাইকাউন্ট শ্যাটো গ্রান্ডের কাছে গেলাম। লুই দ্য ফ্রাঞ্চির কথা বলতেই তিনি দেখা দিলেন।

দেখা গেল ভাইকাউন্টটি দক্ষ। দ্বিতীয় সহকারী মঁসিয়ে বয়জিকে তার বাসায় ডেকে পাঠালেন তিনি।

বয়জি আসার আগ পর্যন্ত, আসল কথার ব্যাপারে কোনো আলোচনা করলাম না আমরা। শুধুমাত্র ঘোড়দৌড় শিকার আর নাটকের গল্প। দশ মিনিটের মতো গল্প করার পর বয়জি এসে পৌঁছলেন।

এরা অস্ত্র বাছার ব্যাপারে কোনো কথা তুললেন না। কারণ তাদের বন্ধু শ্যাটো রেনো পিস্তল বা তরোয়ালে সমান পারদর্শী। তখন টস করার জন্য একটা মুদ্রা উপরে ছুঁড়ে দিলাম। রাজার মাথা উপরে পড়লে পিস্তল, নিচে পড়লে তরোয়াল।

পিস্তল উঠল।

ঠিক হলো যে পরদিন সকালে নয়টার সময় ভিনসেন্স এর বনে ডুয়েল অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের থেকে বিশ পা ঘুড়ে দাঁড়াবেন। তিনবার হাত তালি দেয়া হবে। তৃতীয় তালিতে ওরা গুলি ছুড়বেন।

ফিরে এসে ফ্রাঞ্চিকে সব সিদ্ধান্তের কথা বললাম।

.

সন্ধ্যা আটটা। আমি আবার ফ্রাঞ্চি ঘরে এসেছি। আমাকে কোনো উপদেশ বা নির্দেশ (দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ভেবে নিয়েই কাজ করতে হয়) সে দিয়ে রাখতে চায় কিনা। সেটা জানতে এবার আসা।

ফ্রাঞ্চি যেমন ওরকম অদ্ভুত স্বরে বলল–কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, রাতের মতো পরামর্শ দাতা আর নেই।

কাজেই তখনকার মতো ফিরে এলাম।

পরদিন সকাল বেলায় গেলাম। আসলে আটটার সময় গেলেই চলত। কিন্তু শুধু মাত্র যদি কোনো নির্দেশ দেয় তাই সাড়ে সাতটায় গিয়ে হাজির হলাম।

দেখলাম লুই বসে চিঠি লিখছে।

তার চেহারা খুবই বিমর্ষ। বলল, আপনি বসুন, মাকে চিঠি লিখছি। আপনি এতক্ষণ বসে ‘লা প্রেম’ খবরের কাগজটা দেখুন। ওটায় মঁসিয়ে মেরির একটা চমৎকার গল্প আছে, আপনার ভালো লাগবে।

খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বসে আছি, কিন্তু এক অক্ষরও পড়া হচ্ছে। না। পড়ব কি করে। মনে অন্য চিন্তা, সামনে বসা যুবক, যার মুখের রং ছাইয়ের মতো সাদা। কিন্তু ব্যবহারে এবং কথাবার্তা সে অত সংযত কি করে হয়?

মিনিট পাঁচ পরে, সে জানাল তার চিঠি লেখা শেষ হয়েছে।

ঘণ্টা বাজিয়ে তার চাকরকে ডাকল, সে এলে, তাকে জানিয়ে দিল জোসেফ, এখন আমি কারও সাথে দেখা করব না, গিওর্ডিনোর সাথেও না। সে এলে তাকে বাইরের ঘরে বসাবে। আমি এর সাথে নিরিবিলি দশ মিনিট কথা বলব, কেউ যেন বিরক্ত না করে।

জোসেফ দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।

তারপর লুই আমাকে বলতে শুরু করল–বন্ধু আলেকজান্ডার, গিওর্ডিনো নিজে কর্সিকার মানুষ, কর্সিকার সব সংস্কার তার সমস্ত মনে। শুধু। সেই কারণে তাকে কোনো গোপন কথা বলতে পারি না। অথচ তাকে বলতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হতো। তাকে শুধু এটাই বলব, এই ব্যাপার নিয়ে সে যেন চুপ থাকে। কিন্তু তোমার কাছে আমি প্রতিশ্রুতি চাই বন্ধু। এই জন্য আমি এখন যা বলব তা, তুমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। এই প্রতিশ্রুতি তুমি আমাকে দেবে।

‘তা তো করবই। সহকারীর কর্তব্যই সেটা।

কর্তব্য ছাড়াও আরও কিছু। তা যদি তুমি কর, সম্ভবত আমাদের পরিবার দ্বিতীয় একটা বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাবে।’

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তুমি কি বলছ? দ্বিতীয় বিপদ আবার কি?

‘মায়ের কাছে লেখা এ চিঠিটা পড়।’

আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। পড়ার সাথে সাথে আমার বিস্ময়ও বেড়ে উঠতে থাকে।

‘মা-।

আমি ভালোভাবেই জানি, তুমি মালটার মহিলাদের মতোই সাহসী, খ্রিস্টান মহিলাদের যেমন হওয়া উচিত, ঈশ্বরের করুণার উপর নির্ভরশীল। তা না জানলে, যা বলতে যাচ্ছি তা বলার অনেক আগে একটা ভূমিকা করে তোমার মাকে তৈরি করে নিতে হতো আমাকে।

তোমাকে জানি বলেই কোনো ভূমিকার প্রয়োজন দেখি না। যা বলার সরাসরি বলছি। এ চিঠি যখন তুমি পাবে, তখন মাত্র এক ছেলেই বেঁচে থাকবে।

(ভাই লুসিয়েন এখন থেকে মাকে তুমি আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসবে। দুই ছেলের ভালোবাসা তোমাকে একাই দিতে হবে)।

গত পরশু রাতে আমার জ্বর হয়। জ্বরের আক্রমণে আমার মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায়। অনেক আগে থাকতেই প্রাথমিক উপসর্গগুলো দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রাহ্য করিনি। ফলে যখন ডাক্তার এলো তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মা, জীবনের আশা আর নাই। যদি না ঈশ্বরের দয়ায় যাদুর মতো কিছু না ঘটে। তেমন করুণা আশা করার মতো পূণ্য কি আমার আছে?

মাথাটা এখন একটু পরিষ্কার আছে। তাই এ চিঠি লিখতে পারছি। যদি মারা যাই মৃত্যুর পনেরো মিনিটের ভেতরে ডাকে এই চিঠি দেয়া হবে। তুমি জেনো মৃত্যুতে আমার একমাত্র দুঃখ এই যে তোমার হে এবং আমার ভাইয়ের ভালোবাসা আমি আর ভোগ করতে পারব না।

বিদায় মা।

তুমি কেঁদো না মা! তুমি তো আমার মাটির এই দেহকে ভালোবাসনি, ভালোবেসেছ আমার আত্মাকে। আর আত্মা হলো সেই অবিনশ্বর সত্তা। সে যেখানেই থাকুক, তোমাকে সে ভালোবাসতেই থাকবে।

(লুসিয়েন! বিদায় ভাই। মাকে কখনও ছেড়ে যেও না। মনে রেখা এখন মায়ের তুমি ছাড়া আর কেউ রইল না।)

তোমার সন্তান

তোমার ভাই

লুই দ্য ফ্রাঞ্চি।

চিঠি শেষ করে লেখকের দিকে চাইলাম। এ চিঠির অর্থ কি?’

‘বুঝতে পারছ না?’

‘না।’

নয়টা দশ মিনিটে আমি নিহত হব।’

‘মারা যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এ ধারণা তোমার মনে হলো কেন?’

‘আমাকে বলে গিয়েছেন।’

‘বলে গিয়েছেন কে?

লুই হেসে জবাব দিল–‘তুমি কি আমার ভাইয়ের কাছে শোননি যে আমাদের বংশের পুরুষেরা একটা বিশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী?

আমি শিউরে উঠলাম। হা লুসিয়েন বলেছিল, আমি থেমে থেমে উত্তর দিলাম–‘হ্যাঁ বলেছিল–পূর্ব পুরুষের আত্মার।

ঠিক। আমার বাবা কাল রাতে আমাকে দেখা দিয়েছিলেন। সে জন্যই আমাকে এত বিবর্ণ দেখছ। মৃত লোকের দেখা পেলে কোনো জীবিত ব্যক্তি ভয় না পায়?

আমি অবাক হয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। কাল রাতে তোমার বাবা তোমাকে দেখা দিয়েছিলেন? কিছু বলেছেন?

‘বলেছেন যে এই ডুয়েলে আমি মারা যাব।’

‘ভয়ানক স্বপ্ন তো?

‘স্বপ্ন না, একান্তই বাস্তব। বাবা এসে ছেলেকে দেখা দেবেন, এর ভেতর আশ্চর্যের কি আছে?

না। কিছু নাই। মনে মনে আমিও বিশ্বাস করি যে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। উত্তর দিতে না পেরে আমি মাথা নিচু করলাম। শেষকালে ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছিল?

অস্বাভাবিক বা জটিল কিছু না। আমি তাঁকে মনে মনে চাইছিলাম। কারণ আমার জানা ছিল যে, আমার আয়ু যদি শেষ হয়ে থাকে, বাবা আসবেনই। তাঁর আশাতেই দুপুর রাত পর্যন্ত আমি জেগে ছিলাম। একটা বই পড়ছিলাম। ঠিক শেষ রাতের দিকে আলোটা কমে এলো, দরজা খুলে বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন।

‘কী রকম চেহারা?

ঠিক যে রকম দেখতে ছিল বেঁচে থাকার সময়। সাধারণ কাপড় চোপড় পড়ে তিনি এলেন এ যে মুখ অবশ্যই একেবারে সাদা। আর চোখ। ভারলেশহীন। তিনি আমার বিছানার কাছে এলেন, আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠলাম। বললাম, ‘স্বাগতম বাবা।’

আমার বাবা এসে একভাবে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। যে চোখ একটু আগেও দেখেছি ভাবলেশহীন, তাতে ফুটে উঠেছে বাবার হের কোমলতা।’

‘শুনতে ভয় করছে, তবু বলো।’

‘তারপর তার ঠোঁট নড়তে লাগল, যদিও তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তবুও আমি মনের গভীর থেকেই তার না উচ্চারিত কথা বুঝতে পারছিলাম। তিনি বললেন, ‘ঈশ্বরকে মনে কর পুত্র।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম-’ডুয়েলে কি আমি মারা যাব?

আত্মার চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার সেই বিবর্ণ মুখের উপর।

আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম–‘কয়টার সময়। তিনি আঙুল দিয়ে ঘড়ির দিকে দেখালেন। সেই রাত বারোটার সময় স্পষ্ট দেখলাম আমার ঘড়িতে ঠিক নয়টা দশ বাজে। বললাম, ঠিক আছে বাবা। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়ই পূর্ণ হোক। দুঃখ এই, মাকে ছেড়ে যেতে হবে, কিন্তু সে দুঃখে সান্ত্বনা এই মাকে ছেড়ে গিয়ে আপনাকে পাব।’

পবিত্র আত্মার মুখে ফুটে উঠল একটা ক্ষীণ হাসির রেখা। তিনি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। দরজা নিজে থেকে খুলে গিয়ে তাঁকে পথ করে দিল, আবার তিনি চলে যাওয়ার সাথে সাথে নিজ থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।

লুই এর মুখ থেকে এই শিহরণ জাগানো ঘটনাটা এমন সহজ, স্বাভাবিক স্বরে বের হলো যে তার ঘটনাটা সত্যি ঘটেছে এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। দেখাটা হয়তো তার চোখের ভুলও হতে পারে। কিন্তু সে নিজে মনে নিশ্চিত জানে যে তার এ অভিজ্ঞতা একান্ত ভাবেই বাস্তব, এর মধ্যে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।

‘আমার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছিল, মুছে ফেললাম।

লুই বলল, ‘যা বলছি তা শোনো। আমার ভাইকে তো তুমি চেনো।’

‘সে তো অবশ্যই চিনি।

‘তাহলে সে যদি শোনে যে একটা ডুয়েল লড়তে গিয়ে আমি মারা পড়েছি, তাহলে সে কি করবে বলে তোমার বিশ্বাস?

‘সে সাথে সাথে সুল্লাকারো থেকে এখানে চলে আসবে। তোমার হত্যাকারীকে ডাকবে আবার ডুয়েলে।

‘ঠিক বলেছ, তারপর যদি সেও মারা গেল ডুয়েলে, তা হলে আমার মায়ের অবস্থা একবার ভেবে দেখো তো! বিধবা হয়েও মা বেঁচে আছেন, কিন্তু সাথে দুটো ছেলের মৃত্যু শোক যদি তাকে সইতে হয়

‘বুঝেছি–সে অবস্থা হবে সাংঘাতিক।

‘কাজেই সে সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই শেষ করতে হবে। সেই জন্যই এভাবে আমি চিঠি লিখেছি। মস্তিষ্কের প্রদাহ থেকে আমি মারা গেছি জানলে, লুসিয়েনের মাথায় প্রতিহিংসার চিন্তা ঢুকবে না। মাও এই ভেবে সান্ত্বনা পাবে যে, ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই আমার মৃত্যু হয়েছে। আততায়ীর আঘাতে না। তবে যদি এমন হয়

‘কী রকম?’

‘না আশা করি সেটা হবে না।’

ও যখন মনের কথা বলতে রাজি না, তখন আবার জানার কৌতূহল দমন করাই উচিত।

এই সময় দরজা খুলে ব্যারন গিওর্ডিনো ঘরে ঢুকলেন–‘ভাই ফ্রাঞ্চি যতক্ষণ সম্ভব তোমাকে নিরিবিলি আলাপের সময় করে দিয়েছি। কিন্তু এখন আটটা বেজে গেছে, ওদের সাথে দেখা করার সময় নয়টায় ঠিক করা আছে, এখন রওনা না দিলে সাড়ে চারামাইল পথ এই সময়ের মধ্যে যাওয়া যাবে না।’

‘আরে ভাই–আমি তো রেডি–বলল লুই–আমার যা বলার একে বলে দিয়েছি। এই বলে ঠোঁটের উপর হাত রেখে আমাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করল।

গিওর্ডিনোর হাতেও ফ্রাঞ্চি একটা মুখ আটকানো খাম দিল। এটার ভার রইল তোমার উপর। আমার যদি কিছু হয়, তুমি, এই চিঠি পড়ে সেই অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করবে। এই আমার অনুরোধ।

উত্তর দিল গিওর্ডিনো–সব ব্যবস্থা ঠিক মতোই করব।’

‘এবার একটা অস্ত্র জোগাড় করে নিতে হবে তো?’

যাবার সময় ডে ভাইজিনের দোকান থেকে পিস্তল কিনে নেব। আমি জানালাম আমার পিস্তলটা একটু খারাপ হয়েছে দেখলাম।

লুই আমার হাতে একটু চাপ দিল–সে বুঝেছে, আমি কেন নিজের পিস্তল এ কাজে লাগাতে চাই না। আমাদের পিস্তল ব্যবহার করবে শত্রুপক্ষ। শত্রু পক্ষের পিস্তল ব্যবহার করব আমরা। এটাই হলো নিয়ম, আমার পিস্তলের গুলিতে ফ্রাঞ্চির মারা যাক এ কখনও আমার ইচ্ছা হতে পারে না।

লুই জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি আছে?

‘আছে, তিনজন উঠলে যদিও একটু চাপাচাপি হবে। কিন্তু ভাড়া গাড়ির উপর ভরসা করা উচিত হবে না, কারণ আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে।’

তিনজনে নেমে এলাম, দরজায় জোসেফ দাঁড়িয়ে আছে, সে জিজ্ঞাসা করল আমি কি মালিকের সাথে আসব?

‘না জোসেফ তার দরকার নেই। এই বলে একটু এগিয়ে গিয়ে আবার পিছনে ফিরে গেল লুই। কতগুলো মোহর ভর্তি একটা থলে জোসেফের হাতে দিয়ে বলল, ‘কখনও যদি খারাপ ব্যবহার করে থাকি ক্ষমা করো।’

জোসেফের চোখ জলে ভরে এল–এ সবের মানে কি মালিক?

লুই বলল, ‘চুপ।’

জোসেফের দিক পিছু ফিরে তাকাতেই তাকাতেই লুই আমাদের সাথে এগিয়ে চলল–ছেলেটা ভালো। তোমরা যদি ওর কোনো উপকার করতে পার–আমি খুব খুশি হব।

গিওর্ডিনো জিজ্ঞাসা করল–‘ওকে ছাড়িয়ে দিয়েছ নাকি?’

‘না, ছাড়াইনি, তবে ছেড়ে যাচ্ছি। লুই বলল।

.

পাঁচ মিনিট বাকি থাকতেই ভিনসেন্স পৌঁছলাম। আর একটা গাড়িও সেই সময় পৌঁছুল। এরা শত্রুপক্ষ। বিভিন্ন পথে আমরা বনের ভেতর ঢুকলাম। গাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো। ওরা–গ্রান্ড এ্যাভিন্যুতে অপেক্ষা করবে। আমরা নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগোলাম।

ভাইকাউন্ট শ্যাটো গ্রান্ড বললেন–‘আমার জানা, কাছেই একটা ছোট মাঠ আছে এই বনের ভেতরে। এখানে হঠাৎ কোনো বাইরের লোক এসে পড়তে পারে।

‘সেখানেই চলুন,–জবাব দিল ব্যারন গিওর্ডিনো।

দুই দল আলাদা হয়ে সেই মাঠের দিকে আমরা চললাম। একটা নিচু জায়গা আগে বোধহয় পুকুর ছিল। আস্তে আস্তে ভরে গেছে। ঠিক এরকম একটা গোপন ব্যাপার অনুষ্ঠান করার জন্যই কেউ যেন এ স্থানটি তৈরি করে রেখেছে।

গিওর্ডিনো আর ভাইকাউন্ট মিলে কুড়ি পা দূরত্ব মেপে দিল।

আমি ততক্ষণ ফ্রাঞ্চির কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সে বলল, আমার লেখার টেবিলে আমার উইল পাবে।

‘দেখব।’

শ্যাটো গ্রান্ড ডাক দিলেন, আপনারা যদি প্রস্তুত হয়ে থাকেন—

আমি প্রস্তুত, উত্তর দিল লুই।

তারপর আমাকে বলল অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমার জন্য আরও কষ্ট পেতে হবে। ধন্যবাদ।

আমি তার হাত ধরলাম। হাত ঠাণ্ডা। কিন্তু কাঁপছে না। গিওর্ডিনে এসে তার হাতে পিস্তল দিল। সে পিস্তলের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না। হাতে করে তার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়াল।

শ্যাটো রেনো আগেই নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা অনুক্ষণে নিস্তব্ধতার ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রথমে নিজের নিজের সহকারীদের তারপর প্রতিপক্ষের সহকারীদের অভিবাদন জানাল।

শ্যাটো রেনোর নির্বিকার ভাব দেখে সহজেই বোঝা যায়–এ জাতীয় ব্যাপারে সে রীতিমতো অভ্যস্ত। তার মুখে মৃদু হাসি যেন সেও বুঝতে পেরেছে যে ফ্রাঞ্চি তার জীবনে আজই প্রথম পিস্তল ধরেছে।

লুই আমার দিক একবার তাকাল, তারও মুখে মৃদু হাসি। তারপর সে আকাশের দিকে তাকাল।

শ্যাটো গ্রান্ড বলল–‘তাহলে প্রস্তুত হোন।

তারপর সে হাতে তালি দিতে লাগল।

এক! দুই! তিন!

দুটো গুলির শব্দ এক সঙ্গে মিশে গেল।

সাথে সাথে দেখলাম লুই দুইবার ঘুরপাক খেলো, তারপর এক হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। শ্যাটো রেনো ঠিক দাঁড়িয়ে আছে, শুধু তার কোটের হাতায় একটা ছিদ্র। গুলি সেটা তৈরি করে চলে গেছে।

আমি লুইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম–আহত হয়েছ?

সে উত্তর দিতে চেষ্টা করল, পারল না। কেবল তার ঠোঁটের উপর রক্ত। মাখা ফেনা ফুটে উঠল। তার হাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল, সে হাত দিয়ে বুকের ডান দিকটা চেপে ধরেছে।

কোটের উপর একটু খানি ছিদ্র। একটা আঙুলও তার ভেতর ঢুকবে না। আমি গিওর্ডিনোকে বললাম। ব্যারন। কাছেই সৈন্যদের ছাউনি। সেখান থেকে একজন সেনাবাহিনীর ডাক্তারকে এক্ষুণি নিয়ে আসুন।

ফ্রাঞ্চি মাথা নেড়ে বারণ করল। বুঝল তাতে কোনো ফল হবে না। সাথে সাথে অন্য হাঁটু ভেঙে সে মাটিতে পড়ে গেল।

এদিকে শ্যাটো রেনো চলে গিয়েছে। কিন্তু তার সহকারীরা এসে লুই এর পাশে দাঁড়াল। আমরা ততক্ষণে আহত লুইয়ের কোর্ট এবং শার্ট ছিঁড়ে ফেলেছি। গুলিটা ডান পাশের পাজরার ছয় নম্বর হাড়ের ঠিক নিচ দিয়ে ঢুকে বা দিকের নিতম্বের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। প্রত্যেক বার নিঃশ্বাস নেয়ার সাথে সাথে দুই ছিদ্র দিয়েই তীরের মতো রক্ত বের হচ্ছে। আঘাত যে খুবই মারাত্মক দেখেই বোঝা যায়।

শ্যাটো গ্রান্ড বললেন–‘মঁসিয়ে ফ্রাঞ্চি এ ঘটনার পরিণতি যে এই দুঃখের পরিণতি হবে এতে আমরা আন্তরিক দুঃখিত। আশা করি, সিয়ে শ্যাটো রেনোর উপর আপনার কোনো রাগ নেই।’

মৃত্যুপথযাত্রী ফ্রাঞ্চি অস্ফুট স্বরে বলল–‘না, আমার কোনো রাগ নেই। তবে তাকে চলে যেতে বলুন–চলে না গেলে

তারপর অতি কষ্টে পাশ ফিরে আমার দিকে তাকাল–‘প্রতিজ্ঞা মনে রেখ

আমি বললাম–‘শপথ করছি, তুমি যা বলেছিলে, অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করব।

একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে একটু হেসে সে বলল–‘আমার ঘড়িটা দেখ।’

আমি ওর ঘড়ি দেখলাম-নয়টা বেজে দশ মিনিট হয়েছে। তার বাবার আত্মার দেয়া নির্দিষ্ট সময়।

ফ্রাঞ্চি তখন ঢলে পড়েছে। শেষ নিঃশ্বাস আমাদের চোখের সামনে বেরিয়ে গেল।

.

১১.

ডুয়েলে অভিজাত বংশের কোনো সন্তান মারা গেলে, এ নিয়ে কাগজওয়ালা তুমুল হৈ চৈ শুরু করে দেয়। কিন্তু আশ্চর্য। ফ্রাঞ্চির মৃত্যুতে সে ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড দেখা গেল না।

আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে লুই ফ্রাঞ্চির দেহ নিয়ে গেলাম পেরে লেমাই-এর সমাধিক্ষেত্রে। লুই এর শেষ পরামর্শ অনুযায়ী শ্যাটো রেনোকে প্যারিস ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু সে এ ব্যাপারে কোনো মাথাই ঘামাল না। থেকে গেল প্যারিসেই।

এরপর পাঁচ দিন চলে গেছে।

রাত প্রায় এগারোটা, লেখার ঘরে বসে আমি লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু মনের জন্য তেমন আগাতে পারছি না। এই সময় আমার চাকরটি প্রায় দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল এবং ভয়ার্ত স্বরে আমাকে বলল, মঁসিয়ে দ্য ফ্রাঞ্চি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমি বো করে ঘুরে গেলাম। অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর ভয়ে মুখ একদম সাদা হয়ে গেছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম–‘কি বলছিলে, ভিক্টর?’

সে উত্তর দিল–‘মালিক! কী যে বললাম–তা নিজেই ভালো জানি না।’

‘স্থির হও। কোন মঁসিয়ে ফ্রাঞ্চির কথা বলছিলে?’

‘আপনার বন্ধু। যিনি কয়েকবার এখানে এসেছেন।

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তুমি কি জানো না, পাঁচ দিন আগে তাঁকে আমরা হারিয়েছি।’

‘তা তো জানি, মালিক! আর জানি বলেই আমাকে এতটা বিচলিত হতে দেখছেন। তিনি এসে বাইরে ঘণ্টা বাজালেন, আমি দরজা খুলে দিলাম, তিনি ভেতরে এলেন। তাকে দেখে ভয় পেয়ে আমি পিছিয়ে এলাম।

কিন্তু তিনি সাথে সাথে এগিয়ে এসে আপনি বাড়ি আছেন কিনা জানতে চাইলেন? আমি ‘হ্যাঁ বলতেই তিনি বললেন। গিয়ে বল মঁসিয়ে ফ্রাঞ্চি দেখা করতে চান। কাজেই ছুটে আপনাকে খবর দিতে এলাম।

‘তুমি সত্যি পাগল হয়েছ, হল ঘরে ভালো আলো নেই। তুমি ভালো করে দেখতে পাওনি। নতুবা ঘুমিয়ে পড়েছিলে, পরিষ্কার শুনতে পাওনি, ফিরে গিয়ে আবার নাম জেনে এস।

‘তার দরকার হবে না, আমি শপথ করে বলতে পারি–আমার ভুল হয়নি। আমি স্পষ্ট দেখেছি, স্পষ্ট শুনেছি।

‘তাহলে তাকে আসতে বল।’

ভিক্টর দরজা খুলতে গেল। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপছে। দরজা খুলেও সে বাইরে যেতে সাহস পেল না, দাঁড়িয়ে রইল ঘরের ভেতরে। কাঁপা গলায় এখান থেকে তাকে বলল, ‘ভেতরে আসুন।

পায়ের শব্দ পাচ্ছি। আত্মার পায়ে শব্দ হয় না। তবু শব্দ পাচ্ছি। হল ঘরে কার্পেট পাতা আছে, ছোট খাট শব্দ অন্য ঘর থেকে শুনতে পাওয়ার কথা না। তবুও শুনতে পাচ্ছি।

সে শব্দ হল ঘর পেরিয়ে আমার ঘরের দিকে এল। তারপর হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার ঘরের দরজায় ফ্রাঞ্চিই দাঁড়িয়ে।

প্রথমটা যে খুব ভয় পায়নি-একথা বললে সত্য বলা হবে না। উঠে এক পা পিছিয়ে গেলাম।

অসময়ে বিরক্ত করছি-ক্ষমা করবেন–বলছেন আঁসিয়ে ফ্রাঞ্চি–মাত্র দশ মিনিট হলো পৌঁছেছি। আপনার সঙ্গে দেখা করে সব শোনার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছি। রাত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলাম না।

ও! লুসিয়েন।

বুঝতে পেরেই ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখে জল এসে গিয়েছে। মুখে আর কিছু বলতে পারলাম না।

‘হ্যাঁ। আমিই।’

তাড়াতাড়ি মনে মনে সময়ের হিসাব করছি। মাদাম ফ্রাঞ্চির কাছে যে সময় লুইয়ের চিঠি পাঠিয়েছি। তা সুল্লাকারো দূরে থাকুক, এখন পর্যন্ত আজাইচোতে পৌঁছে নাই। বলে উঠলাম–তাহলে তুমি কোনো কথাই জানো না?

‘আমি সমস্ত কথাই জানি। বলল সে।’

‘বলো কি? সব।’

‘হ্যাঁ।

ভিক্টরের দিকে তাকালাম। সে তখনও ভয়ে কাঁপছে। তাকে বললাম তুমি এখন যেতে পার ভিক্টর। পনেরো মিনিট পরে আমাদের দুজনের খাবার নিয়ে আসবে। লুসিয়েনকে বললাম–তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে খাবে এবং আমার কাছেই থাকবে?

আনন্দের সঙ্গেই থাকব এবং খাব। আওয়ার পার হবার পর খাবার আর সময় পাইনি। এসে ভাইয়ের ঘরে গিয়েছিলাম। সেখানে কেউ আমাকে চিনল না। তারপর একটু করুণ হাসি দিয়ে বলল–‘অথবা সবাই চিনতে পেরেছে বলেই কেউ আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে সাহস পেল না। মহা গ্যাঞ্জাম বেঁধে গেল–আমি চলে আসতে বাধ্য হলাম।

‘বন্ধু লুসিয়েন, লুইয়ের সাথে তোমার চেহারার এত মিল যে, এই মাত্র আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম।’

ভিক্টর তখন যায়নি, হয়তো ভূতের বাড়িতে একা যেতে সাহস পাচ্ছিল । সে হাফ ছেড়ে বলল–ও তাই! ইনি তার ভাই?

‘হ্যাঁ, তুমি এখন গিয়ে খাবার তৈরি কর।’

ভিক্টর চলে যাবার পর লুসিয়েনকে হাত ধরে এনে বসিয়ে আমি তার পাশে বসলাম।

তাহলে এখানে আসার পথেই তুমি দুঃসংবাদটা পেলে?’

‘না, পেয়েছি সুল্লাকারোতে।

‘কী বলো? সে তো অসম্ভব! তোমার ভাইয়ের চিঠি সুল্লাকারোতে এখনও পৌঁছায়নি।’

‘ভাই আলেকজান্ডার। সেই একটা ছড়া আছে এদেশে–‘মৃতের গতি আকাশ পথে, পায় না বাঁধা কোনো মতেই। মনে নেই?

আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

বলছ কি? আমাকে বুঝিয়ে বল, বুঝতে পারছি না।’

তোমাকে সুল্লাকারোতে কি বলেছিলাম? আমাদের বংশের পুরুষেরা কোনো বিপদের আগে মৃত আত্মীয়দের আত্মাকে দেখতে পায় বলিনি?

আমার অজান্তেই মুখ দিয়ে প্রশ্ন বের হলো–‘তুমি তা হলে তোমার ভাইকে দেখেছ না কি?

‘দেখেছি।’

‘কবে?’

‘১৬ আর ১৭ এর মাঝের রাতে।’

‘সে তোমাকে সব বলেছে?’

‘স-ব।’

‘বলেছে যে সে মরে গিয়েছে?

‘বলেছে যে সে নিহত হয়েছে। মৃতেরা মিথ্যা বলে না।

কীভাবে নিহত হয়েছে তাও বলেছে?’

‘বলেছে, ডুয়েলে।’

‘কার হাতে মৃত্যু হয়েছে তার?’

‘মঁসিয়ে শ্যাটো রেনোর।’

‘না, এ হতেই পারে না। তুমি অন্য কোনো ভাবে শুনেছ।’

‘এ অবস্থায়ও আমি বাজে কথা বলতে পারি–এই কি তোমার বিশ্বাস?

‘না, তা নয়। কিন্তু তোমার সব কথা এত অবিশ্বাস্য। তোমাদের দুই ভাইয়েরই জীবনের সব ঘটনা–সাধারণ নিয়মের এত বাইরে যে

‘যে তা বিশ্বাস করাই যায় না–এই তো? কিন্তু এই দেখ–এই বলে সে তার গায়ের শার্ট খুলে ফেলল। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম তার ডান পাজরার উপরের হাড়ের নিচে একটা নীল দাগ।

সে জিজ্ঞাসা করল, এটা বিশ্বাস কর?

আমি বলতে বাধ্য হলাম-ঠিক ওই জায়গাতেই তোমার ভাইয়ের গুলি ঢুকেছিল।

লুসিয়েন আবার বাম নিতম্বে হাত দিয়ে বলল–‘গুলিটা এখান দিয়ে বেরিয়ে ছিল না?

‘এ জাদু ছাড়া কিছু না।’

‘কখন তার মৃত্যু হয়েছিল, তাও বলব? নয়টা দশ মিনিটে।

আমি ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলাম–থামো লুসিয়েন। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে তুমি এসব জানলে তোমার পাজরার নিচে ও দাগ কোথা থেকে এল–সব যদি খুলে বল তো ভালো হয়।

লুসিয়েন কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে বসল–আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–ব্যাপারটাতে জটিলতার কিছু নাই। যেদিন সে মারা গেল সেদিন সকাল বেলাই আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। যাচ্ছিলাম কার্বোনিতে। আমাদের ভেড়ার রাখালদের কাজ দেখতে।

তখন বাজে নয়টা দশ। ঘড়িতে সময় দেখে সেটাকে জামার ভেতর রাখতে যাচ্ছি। এমন সময় পাজরার নিচে এমন একটা আঘাত পেলাম। তার তীব্রতায় আমাকে জ্ঞান হারাতে হলো। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, দেখলাম আমি মাটিতে শুয়ে আছি, আর অলাৰ্ত্তি আমার পাশে বসে চোখে মুখে জল ছিটাচ্ছে। ঘোড়াটা চার গজ দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ বাড়াচ্ছে।

অলার্তি জিজ্ঞেস করল–‘তোমার কি হয়েছিল?’

‘ঈশ্বর জানেন, কিন্তু গুলির শব্দটা শুনেছিলে?’

‘না তো।

‘আমার মনে হলো–এখানে একটা গুলির আঘাত লেগেছে।’ ব্যথার জায়গাটা তাকে দেখালাম।

অলাৰ্ত্তি বলল, ‘প্রথম কথা–কেউ বন্দুক বা পিস্তল ছোড়েনি। দ্বিতীয় তোমার গায়ে কোনো গুলি ঢোকেনি। ঢুকলে কোট ফুটো হতো না?

তাহলে বোধহয় আমার ভাইই পেয়েছে আঘাতটা।

অলাৰ্ত্তি দ্বিধার সুরে বলল–তা, সেটা আলাদা কথা।

আমি জামা খুলে দেখলাম–এই জায়গায় এই চিহ্নটি। তবে প্রথম দিকে চিহ্নটা ছিল লাল, যেন ওখান থেকে রক্ত ঝরছে।

শরীরে ও মনের আঘাতে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তখন একবার ভেবেছিলাম সুল্লাকারোতে ফিরে যাব। তখন আবার এ চিন্তা এলো–হঠাৎ ফিরে গেলে মা ভাববে, আমার ফিরে যাওয়ার কথা সেই রাতে। মাকে কি উত্তর দেব?

কাজেই সে সময় আর বাড়ি ফেরা হলো না। কার্বোনি গিয়ে কাজ সেরে সন্ধ্যা ছয়টার সময় বাড়ি ফিরে গেলাম।

মাকে স্বাভাবিকই দেখলাম। সে কোনো আভাস পায়নি প্রেত লোক থেকে।

দুজনে বসে ডিনার শেষ করলাম। তারপর একটা মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে বারান্দায় দিয়ে দোতলার দিকে চললাম। আমাদের ঘর তো তুমি দেখেছ।

দোতলায় উঠতেই একটা দমকা বাতাস এসে মোমটা নিভিয়ে দিল।

নিচে ফিরে গিয়ে মোমটা আবার জ্বেলে আনব ভাবছি। এমন সময় দেখলাম। লুইয়ের ঘরের দরজার নিচ থেকে একটা আলোর রেখা বের হচ্ছে। ভাবলাম–গ্রিফো বুঝি ও ঘরে কোনো কাজ করছিল, বেরিয়ে যাবার সময় আলোটা নিভাতে ভুলে গিয়েছে।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। বিছানার পাশে একটা আলো জ্বলছে, আর বিছানাতে শুয়ে আছে আমার ভাই লুই। তার সমস্ত শরীর খোলা এবং রক্তাক্ত।

এখন স্বীকার করছি, এ দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু সে এক সেকেন্ডের জন্য। তারপর সাহসে ভর করে আমি এগিয়ে গেলাম।

ভাইয়ের শরীর ছুঁয়ে দেখলাম আমি–সে দেহ তখন ঠাণ্ডা।

তার দেহে ঠিক সেখানেই গুলির ক্ষত। যেখানে আমি নিজে ব্যথা পেয়েছিলাম।

এরপর কি কারো বুঝতে বাকি থাকে যে লুইকে হত্যা করা হয়েছে।

আমি বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা শুরু করলাম। এরপর যখন চোখ খুললাম দেখলাম–ঘর অন্ধকার। বিছানা খালি কেউ নেই।

কোনো রকমে নিচে নেমে এলাম। পা টলছে, শরীর থেকে ঘাম ঝরছে।

আর একটা মোম জ্বেলে নিয়ে উপরে উঠে এলাম–লুইয়ের ঘরে গিয়ে দেখলাম, লুইয়ের বিছানায় যে একটু আগে কেউ শুয়েছিল, এমন কোনো চিহ্নই নেই।

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর সম্পূর্ণ ডুয়েলের দৃশ্যটা ঘটতে দেখলাম চোখের সামনে আততায়ীর নামও শুনলাম–মঁসিয়ে শ্যাটো রেনো সবটাই ঘটেছে স্বপ্নের মধ্যে।

লুসিয়েনের কথা শেষ। আমার হতম্ভব ভাবটা কাটতে কিছু সময় লাগল। তারপর জানতে চাইলাম লুসিয়েন এখন প্যারিসে কেন এলো?

‘এসেছি ওকে শেষ করতে। ঐ হত্যাকারী শ্যাটো রেনোকে।’

‘ওকেও হত্যা করবে?

‘হ্যাঁ, তবে কর্সিকার ভেনডেটা না, আড়াল থেকে মারব না। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ডুয়েলে ওকে হত্যা করব।’

‘মাদাম ফ্রাঞ্চিকে বলেছ? তিনি তোমাকে আসতে দিয়েছে?

‘আমার মা কর্সিকার মা। তিনি আমাকে আর্শীবাদ করে বিদায় দিয়েছেন।

ভিক্টর খাবার নিয়ে এল। নিশ্চিন্ত ভাবে লুসিয়েন খেলো।

পরদিন সকালে আমরা দুজনেই গেলাম ভিনসেঙ্ক বলে, যেখানে ডুয়েল হয়েছিল, ডুয়েলের সময় কে কোথায় দাঁড়িয়েছিল–সব কিছুই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।

সন্ধ্যার পর তাকে নিয়ে গেলাম ক্যাফে দ্য প্যারিতে। সেখানে সে গিওর্ডিনাকে আসতে বলেছে।

গিওর্ডিনোর উপর ভর দিয়েছিল লুসিয়েন। ডুয়েলের ব্যবস্থা করার জন্য। গিওর্ডিনো খবর দিল। শ্যাটো রেননা এক শর্তে ডুয়েলে রাজি হয়েছে। এই লড়াইটা হয়ে যাবার পর যদি লুসিয়েন মারা না যায়–শ্যাটো রেনোকে শান্তিতে থাকতে দেবে। এক রকম অদ্ভুত হাসি হেসে লুসিয়েন বলল–দেব, নিশ্চয়ই শান্তিতে থাকতে দেব। অখণ্ড, চিরন্তন শান্তি।

সে হাসি দেখে যে কোনো লোকই শিউরে উঠবে।

রাতটা লুইয়ের ঘরেই থাকল লুসিয়েন। পরদিন সকাল আটটায় তার কাছে আমি গেলাম। নয়টায় ডুয়েল।

মায়ের কাছে চিঠি লিখছে লুসিয়েন।

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি লিখছ?

‘লিখছি যে লুইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছি। মা নিশ্চিত থাকতে পারে।

‘এত নিশ্চিত তুমি কি করে হলে? শ্যাটো রেনো রীতিমতো ওস্তাদ–এ রোয়ান বা পিস্তলে।

রাতে আমার সাথে লুই দেখা দিয়েছে। সে বলে গেছে ও ডুয়েলে শ্যাটো রেনো মরবেই। এই দেখ–নিজের কপালে একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে সে বলল, ‘শ্যাটো রেনোর ঠিক এখানে গুলি ঢুকবে।’

‘আর তোমার।’

‘আমাকে সে স্পর্শও করতে পারবে না।’

আশ্চার্য। তার ভবিষ্যত্বাণী কাটায় কাটায় মিলে গেল।

ডুয়েলের জায়গায় এসে শ্যাটো রেনো দেখতে পেল–এই কয়েকদিন আগে লুই যেখানে আহত হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। লুসিয়েন, লুসিয়েনকে সে এই প্রথম দেখল, তার মনে হলো যেন মৃত লুই এসে দাঁড়িয়েছে আবার। আধুনিক শ্যাটো রেনোর মনে কুসংস্কার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার মনে হতে লাগল লুইয়ের প্রেতাত্মা প্রতিহিংসা নিতে এসেছে।

এ অবস্থায় তো আর গুলি লক্ষ্য ভেদ করতে পারে না। তার গুলি লুই যা বলেছিল স্পর্শও করতে পারল না লুসিয়েনকে।

আর লুসিয়েনের গুলি–সেটাও লুই যা বলেছিল–শ্যাটো রেনোর কপালের পাশে গিয়েই ঢুকল। সাথে সাথে তার নিষ্পণ দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

আমি লুসিয়েনের কাছে গেলাম। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই হাতের পিস্তলটা মাটিতে ফেলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর সাথে সাথে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল–ভাই! আমার ভাই!’

পরে শুনেছিলাম–এই কান্নাই ছিল লুসিয়েনের জীবনের প্রথম কান্না।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *