৮. মাঠ পাহাড় পেরিয়ে

৮.

দ্যার্তেগারা সোজা মাঠ পাহাড় পেরিয়ে আসার জন্য দূরত্ব কিছুটা কমেছে। সন্দেহ নাই, কিন্তু তেমনি আবার বলে জঙ্গলে লুকিয়েও থাকতে হয়েছে অনেক সময়, ফলে মর্ডন্ট আর তার শত্রুরা প্রায় একই সাথে রাজধানীতে ঢুকল।

যে সৈন্যদল রাজাকে লন্ডন নিয়ে এসেছে, মর্ডন্ট তার অধিনায়ক। রাজাকে সোজা তার প্রাসাদের নিয়ে যাওয়া হলো। টাওয়ার বা কোনো কারাগারে নয়, একেবারে হোয়াইট হলে। কড়া পাহারায় সেখানেই তাকে রাখা হবে, যতক্ষণ না বিচার হচ্ছে এবং বিচার অনুযায়ী দণ্ড।

দণ্ড যে হবেই, তা ওয়াকিবহাল সবাই জানে, কারণ বিচার করবে পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট রাজার অনুরক্ত সদস্য ছিল বেশি, তাদের সব বিদায় করা হয়েছে ক্রমওয়েলর হুকুমে। এখন যারা আছেন, তারা রাজদ্রোহীও বটেই, তারা জনে জনে রাজার ব্যক্তিগত শত্রু।

বিচার প্রহসনের আয়োজন করতে থাকুক ক্রমওয়েলের আজ্ঞাবাহীরা। আমরা ততক্ষণে চার নিঃস্বার্থ ফরাসি বীরের কাজ কারবার দেখি।

.

লন্ডনে এসেই অ্যাথোসের পূর্ব পরিচিত এক হোটেলে গিয়ে উঠল। অতি সাধারণ হোটেল, দামও সস্তা, তবে খাবার দেয় ভালোই, সবচেয়ে বড় কথা। এখানে খরিদ্দারের রুচি অনুযায়ী খাবার মেলে।

খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা যখন হয়ে গেল, পরবর্তী কাজ হলো প্রত্যেকের জন্য এক প্রস্থ করে পোষাক তৈরি করানো, আগেই বেশভূষা। পাল্টানো দরকার, নইলে মর্ডন্টের চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে না।

সাধারণ পোষাকই বেছে নিল ওরা, এক একজনে এক এক রকম। সবই অসামরিক পোষাক, কেউ সাজল ব্যবসায়ী, কেউ চাষী, কেউ দালাল, কেউ মহাজন।

বিভিন্ন রকমের পোষাক পরে চার বন্ধু রাজার বিচার দেখার জন্য অবশেষে বেরুল। হোয়াইট হলের অনেকটা দূরে সুরক্ষিত আদালত ঘরে বিচার সভা বসেছে। ।

পার্লামেন্টের সদস্যরা যেখানে আসন গ্রহণ করেছেন, তাদের সামনে রাজাকে হাজির করা হয়েছে।

ক্রমওয়েলের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি মর্ডন্ট হাজির আছে। রাজাকে বসতে দেয়া হয়েছে। তিনি তাতে বসে হাতের ছড়ি দিয়ে পায়ের জুতোর উপর আঘাত করছেন।

একটা অভিযোগের ফিরিস্তি বলে গেল, কাগজপত্র দেখে আদালতের একজন কর্মচারী শোষণ, কুশাসন, ধর্মদ্রোহ, প্রজাপীড়ন এসব অভিযোগসহ প্রধান বিচার সভার সভাপতি বললেন–‘চার্লস স্টুয়াট, তোমার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ সম্বন্ধে তোমার কিছু বলার আছে?’

রাজা উত্তর দিলেন–‘আগে তোমরা বলো যে আমার বিচার করার ক্ষমতা তোমরা পেলে কোথায়, তার পরে আমি যা বলার তা বলব।’

সভাপতি উত্তর দিলেন—’সব অধিকারেরই উৎস হলো জনসাধারণ। যেজন সাধারণ তোমার বিচার করতে চাইছে।’

অকস্মাৎ একটা বাজ পড়ল যেন সভাঘরে। দর্শকদের বেঞ্চের উপরে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল একটা মামুলি পোশাক পড়া আধবয়সী লোক, আর চেঁচিয়ে উঠল–‘মিথ্যা কথা! ঘোর মিথ্যা কথা, ইংরেজ অধিকাংশই রাজভক্ত। প্রমাণ দেখতে চাও? পার্লামেন্টের অর্ধেকর বেশি সদস্য পার্লামেন্ট ত্যাগ করে গিয়েছেন এই বিচার প্রহসনের প্রতিবাদে।’

‘বন্দি কর, বন্দি কর। এরা সেই পলাতক–ফরাসিরা।’ চিৎকার করে উঠল মর্ডন্ট, প্রহরীরা ছুটে এলো দর্শকের দিকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ভিড় ঠেলে আসা সহজ নয়। তারা এসে পৌঁছার আগেই অ্যাথোস (ওই প্রতিবাদকারী অ্যাথোস ছাড়া কেউ নয়) এবং তার বন্ধুরা ছুটে বেরিয়ে পড়েছে বিচার কক্ষ থেকে।

বাইরে জনারণ্যে মিশে গিয়ে তারা তখনকার মতো নিরাপদ হলো সন্দেহ নেই, কিন্তু এভাবে আত্মসংযম হারালে আবার বিপদে পড়তে কতক্ষণ? দ্যার্তেগা বোঝাতে লাগল–‘রাজার জন্য কীভাবে কখন কী করা যায়, তার সম্পূর্ণ ভার কি তোমরা আমার উপর দিতে পারছ না? এভাবে আবেগে পরিচালিত হলে কাজ উদ্ধার তো হবেই না, উল্টো আমরাই বন্দি হয়ে পড়ব।’

সভার অধিবেশন বেশিক্ষণ চলল না, কিছুক্ষণ পরেই প্রহরী ঘেরা রাজাকে দেখা গেল বিচারালয়ের বাইরে–সেখানে কি ভিড়! রাজার অনুরাগীরা আত্মপ্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে না, রাজদ্রোহীদেরই প্রচণ্ড দাপট সেই ভিড়ের ভেতর। চারদিক থেকে তারা রুখে পড়েছে, উঁচু গলায় বাজে কথা বলছে, প্রহরীরা অতিকষ্টে রাস্তা করে নিয়ে চলেছে রাজাকে। একটা লোক সামনে এগিয়ে এসে রাজার মুখে থুথু দিল।

অ্যাথোস গর্জে উঠল। যেন তার বুকের ভেতর তরোয়াল বিধিয়ে দিয়েছে, তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি দ্যার্তেগা, পোর্থস টেনে নিয়ে গেল অ্যাথোসকে।

চোখের বাইরে যেতে দিচ্ছে না ওই লোকটাকে দ্যার্তেগা, হালকা হচ্ছে। ভিড়। আরও দুই তিনজনের সঙ্গে মিলে ওই জানোয়ারটা হেলে দুলে দুজনে চলছে নদীর দিকে। মেজাজ তার খুব ভালো। নিজের বাহাদুরীর তারিফ নিচ্ছে অন্য সবার কাছে। তার পিছনেই যে চারজন অনুসরণ করছে সে তার কিছুই জানে না।

নির্বিকার, উদাসীন, টেমস নদী বয়ে চলেছে এক রাজার পতন হলো, তার কিছুই এসে যাচ্ছে না। আবার একদিন যদি এই ক্রমওয়েলের পতন হয়, সেদিনও তার কিছুই যাবে আসবে না। সময়ের উপর যদিও বা মানুষ দাগ রেখে যেতে পারে কিন্তু জল প্রবাহের উপর কোনোভাবেই পারে না।

সঙ্গে আরও তিনটে নোক নিয়ে আনন্দে পায়চারী করছে ওই জানোয়ারটা যে রাজার মুখে থুথু ছিটিয়ে ছিল।

দ্যার্তেগার চারজন কাছে এসে দাঁড়াল। গ্রিমডের তিনজন একটু দূরে। হঠাৎ চারজন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল।

অ্যারামিস ভোজালি বের করল।

‘না, ভদ্রলোকের জন্য ইস্পাতের আঘাত, এটা জানোয়ার, এর জন্য অন্য ব্যবস্থা।’ দ্যার্তেগা দুই হাত বাড়িয়ে ঘাড় ধরল লোকটার। সে আউ করে উঠল। প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল হাত ছাড়াবার। তার সঙ্গীরা দেখলেন এই আততায়ীরা সশস্ত্র হিংস্র, ভাবছে পালাবে কি না?

দ্যার্তেগা বলে উঠল, ‘পোর্থস, এক ঘুষিতে এই লোকটার মাথা নিশ্চয়ই গুড়ো করে দিতে পারো তুমি।’

পোর্থসের হাতটি উবু হয়ে উঠল, যম দণ্ডের মতো। একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়ল ওর ব্রহ্ম তালুর উপর। একখানা কাগজ যেন ছিঁড়ে গেলো ফাত করে। মাথাটা ছাতু হয়ে গিয়েছে একবারে, গলগল করে রক্ত বেরুলো। দ্যার্তেগা ছেড়ে দিতেই শরীরটা ধড়াস করে মাটিতে পড়ে গেল। ওর সঙ্গের লোক তিনটা ছুটে পালাল। তা যাক–যাকে শাস্তি দেয়ার দরকার ছিল। তাকে দেয়া হয়েছে।

অ্যাথোস এসে দ্যার্তেগা হাত ধরল। ‘তোমার কাছে রাজার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভার দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।’

.

রাজা একজন পাদ্রী চেয়েছেন। যিনি তাকে ধর্মোপদেশ দিতে পারবেন। আর্চ বিশপের উপর ভর দিয়েছেন পার্লামেন্ট। রাত দশটার সময় একজন ধর্ম যাজক রাজার কাছে যাবেন, বলে জানিয়েছেন আর্চ বিশপ।

প্রহরীদের দলপতির কাছে ঠিক রাত দশটার সময় হোয়াইট হলে এল একজন পাদ্রী, অভিজ্ঞান দেখাল আর্কবিশপের। দলপতি পাদ্রীকে সম্মান দেখিয়ে পৌঁছে দিল রাজার রুমে। বিশ্বস্ত সহকারী আর্চ বিশপের। পাদ্রী জ্যাকসন।

বিছানায় শুয়েছিলে রাজা, বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছিল তাকে প্যারী পাদ্রীর ঘরে ঢুকতেই প্যারী উঠে দাঁড়াল, রাজা উঠে বসলেন।

‘মহারাজ আমি গির্জার সান্ত্বনার বানী নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।’ রাজার কাছে কণ্ঠস্বরটি কি পরিচিত মনে হলো? তা না হলে তিনি চমকে উঠে পাদ্রীর মুখের দিকে চাইলেন কেন?

লম্বা কালো দাড়ি পাদ্রীর মুখে, এক মুহূর্তের জন্য সেই দাড়ি সরে গেল। রাজা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, ‘শিভালিয়ার দ্যা হারবেন?’

ঠিকমত দাড়ি লাগিয়ে অ্যারামিস বলল–‘না-পাদ্রী জ্যাকসন। আমরা এখনও আশা ত্যাগ করিনি মহারাজ, আপনার আশে পাশেই আমরা আছি। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব।’

করুন হাসলেন রাজা–‘আপনার এবং কাউনস্ট দ্য-লা ফেয়ার এর বন্ধুত্বের তুলনা হয় না। বন্ধুত্ব আর উদারতাই বলুন এ এক স্বর্গীয় বস্তু, আমি আপনাদের কেউ নই অথচ এই নিঃসম্পর্কীয় অপরিচিত, বিদেশী। ভাগ্যহীন রাজার জন্য বারবার আপনারা যেভাবে নিজেদের প্রাণকে বিপন্ন করছেন।’

‘আমরা আপনার স্ত্রী ও কন্যার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’ রাজা উত্তর দেয় অ্যারামিস ‘সে কথা যাক, কাল বিচারালয়ে ওরা কি আদেশ দেয়। তাই দেখে আমরা কাজ স্থির করব এবং কাল রাত্রে এভাবে এসে আপনাকে জানাব।’

‘প্রতিদিন একবার করে এভাবে জীবন বিপন্ন করা–একটা সত্যিকারের বিপদ ঘটে যেতে কতক্ষণ শিভালিয়ার?’ মৃদু কণ্ঠে রাজা প্রতিবাদ করেন।

কথা আজ আর বাড়াতে পারল না। প্রহরীর দলপতি এসে জানাল নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। রাজা নিচু হয়ে অ্যারামিসের হাতের ক্রুশ চুম্বন করলেন, অ্যারামিস মার্জিত ল্যাটিনে আশাবাণী উচ্চারণ করল। তারপর প্রহরীর সঙ্গে চলে গেল।

রাজা বিছানার পাশে নতজানু হয়ে বসলেন উপসনার জন্য। পার্লামেন্ট পরের দিন ঘোষণা করল–রাজা চালর্স এর প্রাণদণ্ড হবে প্রজাদ্রোহের অপরাধে এবং এই দণ্ড কার্যকর হবে ঠিক পরের দিন বেলা দশটাতে হোয়াইট হলে রাজার শয়ন কক্ষের বাইরে।

রাজা শোবার ঘরে ঠিক রাত দশটার সময় অ্যারামিস আবার দেখা করল। রাজার সঙ্গে। আজ শেষ রাত রাজার জীবনের, কাজেই বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি পেয়েছে সে। অ্যারমিস করল–‘এখনও হতাশ হবেন না মহারাজ।’

রাজা হেসে বললেন ‘আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এখনো আশা করার মতো অবশিষ্ট কিছু আছে কি? কাল বেলা দশটাতেই ঘাতকের কুঠার আমার শিরচ্ছেদ করবে।’

‘কিন্তু সে ঘাতক নিখোঁজ হয়েছে মহারাজ, কাল দশটার সময় তাকে কোথাও পাওয়া যাবে না,’ জানাল অ্যারামিস।

‘সেকি!’

‘বন্ধু দ্যার্তেগার অসাধ্য কিছু নেই, ঘাতককে ঘুষ দিয়ে সে বশ করেছে, আমরা তাকে পাঁচশো পাউন্ড দিয়েছি, তার নিজেরও রাজ হত্যায় বিতৃষ্ণা ছিল। তারপর এরকম একটা মওকা পেয়ে গেল, সে একভাবে মদ খাচ্ছে আমাদের হোটেলের রুমে বসে। এ ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আর বেরুবে না।’

রাজার প্রশ্ন ‘সে না বেরুক, ওরা কি আর ঘাতক পাবে না?’

‘ওই একমাত্র ঘাতক লন্ডন শহরে। আর এটা নিশ্চয়ই তো শখ করে কেউ আসবে না এই ঘৃণিত কাজ করার জন্যে, কাজেই অন্য শহর থেকে একজন ব্যবসাদার ঘাতক আনতে হবে ওদের। সেটা কালকে সম্ভব নয়।’

‘কালকে না হোক পরশু সম্ভব হতে পারে।’

‘তা পারে। তবে আমাদের কাজ একটা রাত্রি পেলেই হয়ে যাবে, আমরা আপনাকে কাল রাতে উদ্ধার করব।‘’

অবাক হয়ে যান রাজা, সমস্ত পরিকল্পনা তাকে খুলে বলে অ্যারামিস, ওরা বধ্যমঞ্চ বানিয়েছে ঠিক রাজার জানালার সামনে, যে ঠিকাদারের উপর এই মঞ্চ বানাবর ভার পড়েছে, সে লোকের অভাবে অসুবিধায় পড়েছিল, কাল কোনো মিস্ত্রি রাজী হয়নি রাজাকে হত্যা করার জন্য মঞ্চ বানাতে, শেষ মুহূর্তে খুব সস্তাতেই সে দুজন মিস্ত্রি পেয়েছে, সে দুজন মিস্ত্রি হলো অ্যাথোস আর পোর্থস।

রাজা চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, অ্যারামিস তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর বলে চলল তার পরিকল্পনা, ‘এক্ষুণি তারা মঞ্চ বানাতে শুরু করবে, কাঠের মাচাটা হয়ে গেলেই ওরা তার উপর থেকে একটা সুরঙ্গ খুড়বে আপনার প্রাসাদের দেয়ালে। ঠিক জানালার নিচে কাঠের আবরণের নিচে চাপা থাকবে সুরঙ্গের মুখ, আর সেই সুরঙ্গ দিয়ে অ্যাথোস এসে ঢুকবে আপনার এই রুমে। নিচের ঘরে। সে ঘর খালি আছে। অন্য কোনো লোক আপনার নাগালের মধ্যে থাকতে দেবে না বলে।’

‘এখন অ্যাথোস নিচে থেকে এই ঘরের মেঝে খুঁড়ে ফেলবে, তিন চার খানা টালি খুলতে পারলেই আপনি সেই গর্ত দিয়ে গলে নিচের ঘরে নামতে পারবেন, সেখান থেকে সুরঙ্গ পথে মঞ্চের ভেতর, সেখানে কোনো মিস্ত্রি বা মজুরের কাপড় পড়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন। একটি ছোট জাহাজ ভাড়া করা রয়েছে গ্রীণউইচে, সমুদ্রের ধারে, আপনি তাতে উঠলেই জাহাজ ফরাসি উপকূলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলবে।’

এই রোমাঞ্চকর পরিকল্পনা রাজা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন।

এরা মানুষ, না মহামানুষ এই ফরাসিরা।

.

পরের দিন, বেলা দশটার আগেই বধ্যমঞ্চ তৈরি করা হয়ে গিয়েছে, যাতে সমবেত জনগন সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে পায়, তাই মঞ্চটি দোতালা করে তৈরি করা হয়েছে, হত্যা কাণ্ডটি ঘটবে দোতালায়, রাজাকে কোনো কষ্ট করতে হবে না, জানালা পথ দিয়ে সোজা একবারে মঞ্চে উপস্থিত হতে পারবেন।

মঞ্চের নিচে মোটা কালো কাপড়ে ঢাকা। বাঁশ, খুটির কদর্য কাঠামোটা লোকের চোখে যাতে বিশ্রী না দেখায় সেজন্য এরই আড়ালে অ্যাথোস সুরঙ্গ খুঁড়ছে, রাজার ঘরের ঠিক নিচে যখন অ্যাথোস পৌঁছুল একটি খাটো মই নিয়ে, তখন বেলা আন্দাজ নয়টা। সব কাজ প্রায় শেষ, এখন রাজার ঘরের মেঝে থেকে কয়েকটা টালি খুলে নেয়া শুধু বাকি।

এখনও তার সময় হয়নি, আজ যে প্রাণদণ্ড হতে পারে না, যে সেটা আজ মুলতবি রইল-এই আদেশটি প্রচারিত হোক আগে। এখনও যে আদেশ জারি হয়নি, কারণ ঘাতক যে নিরুদ্দেশ, কর্মকর্তারা তা এখনও জানেন না, জানবেন, যখন বেলা দশটায় তার খোঁজ পড়বে তখন।

বাইরে লোকে লোকারণ্য। এখন অসংখ্য লোক রান্নার ঘরে। পাদ্রী এবং প্রহরী অ্যারামিস রাজাকে ফিস্ ফিস্ করে সাহস দিচ্ছে।

‘অ্যাথোস ঠিক আপনার পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, এখানকার ভিড় একটু হালকা হলে আমি এখান থেকে সংকেত দেব, আর যেই টালি ফাঁক করবে, তারপর আরকি! গ্রীন উইচের মুক্তি।’

.

অধীর আগ্রহে অ্যাথোস প্রতীক্ষা করছে, উপরের ঘর খালি হলেই সংকেত দেবে অ্যারামিস, রুমের মেঝেতে পর পর তিনবার পায়ের আওয়াজ করে, সেই সংকেত পাওয়া মাত্র টালি আলগা করতে শুরু করবে অ্যাথোস। কাজ আর কতক্ষণ? তারপর ধৈর্য্য ধরে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করা। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসলেই রাজা নেমে যাবেন সুরঙ্গ পথ দিয়ে মজুরের ছদ্মবেশে বধ্যমঞ্চ থেকে বেরিয়ে।

কিন্তু কই অ্যারামিস তো সংকেত দেয় না। অথচ মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না উপরের ঘরে, মানুষের পায়ের শব্দও পাওয়া যায় না, ঘরটা নিস্তব্দ, অথচ কেন নীরব অ্যারামিস?

ওদিক একটা গমগম আওয়াজ উঠছে প্রাসাদের বাইরে যেখানে একত্র হয়েছে লক্ষ লক্ষ লোক, তারা নিঃশব্দ নিস্পন্দ থাকলেও সেখানে ওই রকম একটা শব্দ উঠবেই, কিন্তু অ্যাথোস বুঝতে পারছে না–ওখানে এখনও লক্ষ লোক থাকবে কেন? অনেকক্ষণ হলো দশটা বেজে গিয়েছে, এতক্ষণে নিঃশব্দ ঘোষণা হয়ে গেছে যে, ঘাতকের অনুপস্থিতির জন্য রাজার দণ্ড আজকের মতো মুলতবি রইল। তবে লোকগুলো ওখানে কি করছে? বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছে অ্যাথোসের। সে কোনো মতেই আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না, সুরঙ্গ পথ বেয়ে বেরিয়ে এল বধ্য মঞ্চের নিচের তলায়, মোটা কাপড়ের পর্দা দিয়ে যে জায়গাটা ঘেরা আছে, সেই পর্দার এক কোনো ফাঁক করে সে যে দৃশ্য দেখতে পেল, তাতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, মানুষ, মানুষ, আরো মানুষ, কাতারে কাতারে আছে চোখ বিস্ফোরিত করে, স্থানটি হলো ঠিক মাথার উপরের স্থানটি, অর্থাৎ যেখানে রাজার শিরোচ্ছেদ হওয়ার কথা। সেখানটিতে।

তবে কি সেই বিভীষিকার দৃশ্য ঘটতে যাচ্ছে যা চাচ্ছে এই রাজদ্রোহী প্রজারা। অ্যাথোস কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তার চোখের আড়ালে রাজবলির শেষ দৃশ্য কি এক্ষুণি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? তবে কি ঘাতকটা গুপ্ত স্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে কোনো রকমে? অসম্ভব, তার পাহারায় রয়েছে গ্রিমড, তার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসবে ওই ঘাতক, এটা অসম্ভব, তবে কি অন্য ঘাতক পেয়েছে ওরা? নিশ্চয়ই তাই, কিন্তু লন্ডনে তো আর ঘাতক নেই।

হঠাৎ একটা অতি মৃদুস্বর উপরের কাঠের পাটাতন ভেদ করে এসে অ্যাথোসের কানে প্রবেশ করল, শিউরে উঠল অ্যাথোসের সমস্ত শরীর, এ স্বর চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। এ কণ্ঠস্বর রাজার। রাজা শুয়ে কথা বলছেন। নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে ঘাততের কুঠার তার মাথার উপরে উদ্যত রয়েছে, মুখোশ পড়ে এসেছে ঘাতক। শুধু একটা কালো দড়ির ডগা দেখা যাচ্ছে মুখোশের নীচ থেকে। রাজা শেষ শোয়ার আগে তাকে বলেছেন ‘হঠাৎ আমাকে আঘাত করো না, আমি যখন বলব ‘মনে রেখো তখনই আঘাত করবে। কুঠারের এক আঘাতেই শেষ করতে পারবে তো?’

ঘাতক শুকনো গলায় উত্তর দিল ‘চেষ্টা করব।’

এখন শুয়ে শুয়ে রাজা অতি মৃদুস্বরে বলছেন–‘কাউন্ট-দ্যা-লা ফেয়ার আপনি কি নিচে আছেন?’

অ্যাথোসের কানে এল একটা উত্তর ‘আছি।’ সে উত্তর যে অ্যাথোসের নিজেরই তা তার বিশ্বাস হতে চায় না যেন, এ স্বর তার স্বর নয়। এ উত্তর তার গলা থেকে বেরুল কখন? সে তো টের পায়নি।

উপর থেকে আবার শোনা গেল, ‘যা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি আপনি করেছেন, আপনি এবং আপনার তিন বন্ধু। ঈশ্বর আপানদের মঙ্গল করবেন। আমার স্ত্রী কন্যাকে খবর দেবেন, সাহসে বুক। বাধতে বলবেন। এ অন্যায়ের প্রতিকার একদিন হবেই, আমার বড় ছেলে হল্যান্ডে আছে, তার জন্য দশ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা লুকনো রইল। নিউক্যাসল দুর্গের মাটির নিচের যে ঘর আপনাকে আমি দেখিয়েছিলাম, সেই কক্ষে, ঈশান কোনো ভিত্তির নিচে রাখা আছে, আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না এই স্বর্ণ মুদ্রার কথা।’

দৃঢ়স্বরে বলে অ্যাথোস ‘এ অর্থ যুবরাজ পাবেন।’

এবার রাজার গলার স্বর সুস্পষ্ট হলো। উঁচু হলো। তিনি ভরাট গলায় বললেন, ‘মনে রেখো।’

রাজদ্রোহী লক্ষ্য দর্শকের মনে হলো এটা তাদের মাথার উপর মৃত্যুপথ যাত্রী রাজার শেষ অভিশাপ, তারা আঁতকে উঠল, একমাত্র জানল–এ সতর্কবানী তাকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত হয়েছে, যাতে প্রিন্স অব ওয়েলেস এর জন্য রাখা শেষ মিলিয়টির কথা সে ভুলে না যায়। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আঘাতে মাথার উপরের কাঠের পাটাতন দুলে উঠল, আর কী যেন এক ফোঁটা গরম জিনিস এসে পড়ল অ্যাথোসের কপালে, সে কেঁপে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

ফোঁটা পরে স্রোত হয়ে ঝরতে লাগল অ্যাথোসের পায়ের কাছটিতে। তাজা গরম টকটকে লাল রক্ত, অ্যাথোস পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ে সেই রক্ত ভালো করে মাখল রুমালে তার রাজার শেষ চিহ্ন।

কীভাবে সেই নরক থেকে বেরিয়ে কোন পথে অ্যাথোস হোটেলে এসে পৌঁছল তা তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে বলতে পারত না।

মাস্কেটনের সঙ্গে প্রথমেই দেখা, সে তখন পাহারা দিচ্ছে বন্দি ঘাতককে। না, লোকটি পালায়নি। আজকের কাজটি যার হাত দিয়েই হয়ে থাকুক, সে যেই হোক না কেন, লন্ডনের সরকারী ঘাতক যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘লোকটাকে ছেড়ে যাও মাস্কেটন,’ অ্যাথোস বলল।

অ্যারামিস এল, পোর্থস এল, অনেক পরে এল দ্যার্তেগা, এসেই বন্ধুদের বলল, ‘কে জানে এই হত্যাকারী? সেই মর্ডন্ট।’

‘মর্ডন্ট-আর একবার নতুন করে সকলের শিউরে উঠার পালা, এই নররাক্ষস, এই পিশাচ কি তাদের সকলকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এসেছে এই পৃথিবীতে? উইন্টার গেলেন, রাজা গেলেন, এবার কি এই চার বন্ধুর পালা?’

কিন্তু দ্যার্তেগা ভাবার সময় দিল না। সবাইকে তাড়া দিয়ে নিয়ে গেল শহরের বাইরে এক নির্জন স্থানে, সেখনে একটা ছোট বাড়িতে মর্ডন্ট ঢুকেছে, দ্যার্তেগা জানে, কারণ বধ্যভুমি থেকে মর্ডন্টকে অনুসরণ করে সে এই বাড়ি পর্যন্ত এসেছিল। মর্ডন্ট বাড়ির ভিতর ঢুকার পরে বাড়ির পিছনে গ্রিমডকে এবং বাড়ির বাইরে অন্য এক অনুগত ব্যক্তিকে পাহারায় রেখে সে গিয়েছিল বন্ধুদের ডাকতে। এই অনুগত লোকটি হলো প্যারীর ভাই, যাকে ওরা শুশ্রষা করে বাঁচিয়ে তুলেছিল সেদিন।

তখন দুজন অনেক কথা বলছে ঘরের ভেতর। একজন মর্ডন্ট অন্যজন স্বয়ং ক্রমওয়েল। ক্রমওয়েলেরই এই বাড়ি। এরকম বাড়ি অনেকগুলি আছে। তার লন্ডন শহরে, এক এক স্থানে এক একটি। পরপর দুইদিন এক বাড়িতে থাকেন না তিনি। অনেক সময় সকালে এক বাড়িতে বিকালে অন্য বাড়িতে।

ক্রমওয়েল বলছেন—’আমি জানি না কে এসে ঘাতকের কাজটি করে দিয়ে গেল, জানতেও চাই না, এক কাজের জন্য পুরস্কার হোক, সাজা হোক যা পাওয়ার সে তার ঈশ্বরের কাছ থেকে পাবে। আমার কিছু বলার নেই তাকে।’

‘কিন্তু রাজাকে হত্যা করার দরকার ছিল। আপনার কাজই তো সে করেছে। ঠিক সময়ে সে যদি হাজির না হত।’

আবেগের সঙ্গে বলে উঠে ক্রমওয়েল ‘বড়ই ভালোই হত, মর্ডন্ট।’

‘ভালো হত? ও যদি হাজির না হত, হত্যা কাণ্ডটা আজ হতে পারত না। এবং রাত্রে চার্লস স্টুয়াট পালাতে পারত।

‘পালাতে পারত! মর্ডন্ট যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।’

‘নিশ্চয়ই পারত পালাতে, হোয়াইট হলের ভেতর চারজন ফরাসি সুরঙ্গ কেটেছে মিস্ত্রির ছদ্মবেশে। আজ রাতে চার্লস স্টুয়াট ওই পথে পালাত। আজ তিন দিন থেকে গ্রীন উইচ সমুদ্র কুলে চালর্স এর জন্য ছোট একটা জাহাজ ভাড়া করে রাখা হয়েছে। সেই জাহাজে ওই ফরাসিরা আজ রাতেই চার্লসকে নিয়ে পালাত। আমি মুক্তি পেতাম রাজহত্যার অপবাদ থেকে।’

মর্ডন্ট তিক্তস্বরে বলে ওঠে–‘অপবাদ থেকে মুক্তি হয়তো পেতেন, কিন্তু অত বড় শত্রু জীবিত অবস্থায় যদি ফ্রান্স গিয়ে উঠতে পারত।’

‘তা পারত না।’ শান্তস্বরে বলেন ক্রমওয়েল–‘কারণ যে জাহাজে তারা যাবে, তার খোলের ভেতর পাঁচ পিপে বারুদ বোঝাই করা আছে। ক্যাপ্টেন আমার হাতের লোক। গভীর রাতে বারুদে জ্বলন্ত পলতে সংযোগ করে দিয়ে সে তার নাবিকদের নিয়ে নৌকায় চড়ে পালাত। রাজার মৃত্যুর জন্য পৃথিবীর লোক ক্রমওয়েলকে আর দায়ী করত না। দায়ী করত তার ভাগ্যকে।’

মর্ডন্ট, নিজেকে যে পৃথিবীর সেরা ধূর্ত বলে মেন করে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল তার মালিকের এই চরম ধূর্ততার পরিচয় পেয়ে, তাকে বিব্রত ভাব থেকে মুক্ত করলেন ক্রমওয়েলই–‘আমার কাছে কিছু তোমার বলার আছে?’

মর্ডন্ট তার কথা লুফে নিল—’হ্যাঁ মালিক, আমার একটা প্রার্থনা আছে, আমাদের হাতে একসময় দুজন ফরাসি বন্দি হয়েছিল। মালিক তখন সেই দুবন্দিকে আমাকে দিয়েছিলেন। আমি তখন তাদের ধরতে পারিনি, কারণ অন্য দুই ফরাসির সাহায্যে পালাতে পেরেছিল তারা। আজ আমার প্রার্থনা, মালিককে যদি আমার একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে খুশি করতে পারে তা হলে ওই চারজন ফরাসিকেই আমার হাতে দিন।’

‘নিতে পার এবং ওই যে জাহাজখানার কথা বলছিলাম, সেখানেও তুমি দুই একদিনের জন্য নিজের কাজে ব্যবহার করতে পার।’

এই বলে ক্রমওয়েল উঠলেন, ‘তোমার সঙ্গে বোধহয় দেহরক্ষী নেই?’ জিজ্ঞেস করলেন মর্ডন্টকে।

‘জ্বি না।’

‘তা হলে তুমি আমার সঙ্গেই চলল।’

‘না মালিক, এখানে আমি একটু সময় থাকব। একটু নিরিবিলি জায়গা দরকার আমার চিন্তা করার জন্য।’

ক্রমওয়েল রুমের দেয়ালের একটি বিশেষ স্থানে হাত দিয়ে চাপ দিলেন একটু। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ার সরে গিয়ে সেখানে বেরিয়ে এল একটি গুপ্ত দরজা। তারই ভেতর দিয়ে নিচে সুরঙ্গ পথে অদৃশ্য হলেন তিনি।

ঠিক তারপরেই রুমের জানালা দিয়ে উঁকি দিল দ্যার্তেগা। মর্ডন্ট গভীর চিন্তায় মগ্ন, কীভাবে নির্যাতর করে মার হত্যাকারী চারজন ফরাসিকে মৃত্যুকে মৃত্যুদ্বারে পাঠাবে তারই উপায় নিয়ে সে ভাবছে। সে ধ্যান তার যখন ভাঙল তখন একের পর একজন ফরাসি লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে।

মর্ডন্ট চমকে লাফিয়ে উঠল, তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে, যাদের বারুদে উড়িয়ে দেবার জন্য বুদ্ধি ঠিক করে এখুনি কাজে নামবে বলে ভাবছিল খারাপ ভাগ্যের একটি মাত্র আঙ্গুলের ইশারায় তাদের কবলে পড়ে গেল মর্ডন্ট। এরা যে কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে এভাবে ঘিরে ধরেনি, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে নেই।

কিন্তু মর্ডন্ট অস্থির হলো না। ঠাণ্ডা মাথায় তখনও চিন্তা করার শক্তি তার আছে। এই অপ্রত্যাশিত সংকট থেকে সে কিভবে মুক্তি পেতে পারে।

দ্যার্তেগাই প্রথম কথা বলল–‘তাহলে আবার দেখা হলো মিস্টার মর্ডন্ট।’

‘এই দেখাই হয়তো শেষ দেখা। ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে মর্ডন্ট বলে। কারণ এ সাক্ষাৎকার থেকে জীবিত বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ যে আমার হবে না তা আমি বুঝতে পারছি। আমার অভাগিনী মাকে যেভাবে সেভাবেই আমাকে আজ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার মতলব তোমাদের।’

উত্তর দিল দ্যার্তেগা—’রাজার হত্যাকারী নরাধমকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার অধিকার যে কোনো সৎ লোকেরই আছে। কিন্তু আমরা তোমাকে হত্যা করব না। তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি দ্বন্দ্ব যুদ্ধে বীরের মৃত্যুবরণ করার। আমাদের চার বন্ধুদের মধ্যে যার সঙ্গে ইচ্ছে তুমি যুদ্ধ করতে পার।’

আমার আবার ইচ্ছে—’অনিচ্ছা কী? যে কোনো একজন লড়তে পার আমার সঙ্গে, কিন্তু যুদ্ধে যদি আমি জিতি, তা হলে আমি মুক্তি পাব তো? না আবার দ্বিতীয় একজনের সঙ্গে লড়তে হবে নতুন করে?’

‘না, তা হবে না। একজনের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে পারলেই তুমি মুক্তি পাবে।’

এরপর দ্যার্তেগার সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হলো মর্ডন্টের। সে শুধু আত্মরক্ষা করে যাচ্ছে, আর ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে, সরতে সরতে সেই বিশেষ স্থানটিতে তার পৌঁছনোর মতলব যেখান থেকে গুপ্ত দরজা পথে একটু আগেই ক্রমওয়েল ভূগর্ভের সুরঙ্গে নেমে গিয়েছেন।

দ্যার্তেগা সে গুপ্ত দরজার কথা জানে না। কাজেই মর্ডন্টের ক্রমাগত স্থান পরিবর্তনের উপর কোনো গুরুত্ব সে দিচ্ছে না।

মর্ডন্টের উদ্দেশ্য কিন্তু হাসিল হতে বসেছে। দ্যাগের আক্রমণ সহ্য করবার শক্তি তার প্রায় শেষ। ঠিক এমন সময়ে সে গিয়ে সেই বিশেষ জায়গায় পৌঁছাল। দ্যার্তেগা তাকে দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে ফেলার জন্য তরোয়াল হাকিয়েছে। এমন সময়ে মর্ডন্টের দেহের চাপে গুপ্ত দরজা খুলে গেল এবং চোখের পলকে মর্ডন্ট অদৃশ্য হয়ে গেল।

দ্যার্তেগা ছুটে আসার আগেই গোপন দরজা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমনভাবে মিলিয়ে গেছে যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার অবস্থানটা এরা বের করতে পারল না। ওদিকে মর্ডন্ট হাসছে। দেয়ালের পিছনে হাসির উচ্চস্বর ক্রমশ কমতে কমতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল।

চার বন্ধু সব দেয়ালে আঘাত করতে লাগল, তবুও গুপ্ত দরজা খুঁজে পেল না, কিন্তু না, এখন সময় নষ্ট করা বোকার কাজ। তাদের জন্য গ্রীন উইচ বন্দরে জাহাজ অপেক্ষা করছে, এখনও হয়তো পালানো যেতে পারে। দেরি করলে আবার কতই না বিপদ এসে হাজির হতে পারে। এখানে মর্ডন্ট সর্বশক্তিমান।

ওরা ছুটল হোটেলে। এখনই গ্রীন উইচ রওনা হওয়া চাই ভাড়া টাড়া মিটিয়ে। গ্রীন উইচ পর্যন্ত ঘোড়াতেই যাবে, সঙ্গে প্যারীর ভাই যাচ্ছে। সে ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসবে। তারপর সে আর তার ভাই প্যারী ঘোড়াগুলো বেচে টাকাটা ভাগ করে নেবে।

.

লাইনিং বিদ্যুৎ জাহাজের নাম। ক্যাপ্টেন রিচার্ডস। অ্যাথোসের কথা হয়েছিল এই রিচার্ডস এর সঙ্গেই।

কিন্তু রিচার্ডস তখন জাহাজে নেই। অ্যাথোস যখন তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সমুদ্রকূলে পৌঁছল তখন। অসুস্থ হয়ে সে নিজের বাড়ি চলে গিয়েছে। তার বদলে যে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে, তাকে রাতের অন্ধকারে চিনতে পারল অ্যাথোসেরা, এই সেই গ্ৰসলো। তাকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে সৈন্যদের দায়িত্বশীল পদ থেকে, কর্তব্যে অবহেলার জন্য, সে ভার পেয়েছে আপাতত রিচার্ডস এর জায়গায় জাহাজ চালাবার জন্য। যদি এ কাজটি ভালয় ভালয় করে দিতে পারে, তাহলে আবার পুরনো পদে ফিরে যেতে পারবে, এমনি একটা ক্ষীণ আশ্বাস সে পেয়েছে।

অ্যাথোসদের প্রথমে রিচার্ডস নেই দেখে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু তখন তাদের সঙ্গীন অবস্থা, বেশি সতর্ক হওয়ার সুযোগ নাই, জাহাজ রয়েছে, জাহারে ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এখনই জাহাজ নিয়ে রওনা হতে প্রস্তুত। এটাই কি তাদের পক্ষে বেশি নয়?

তর্ক না করে চার বন্ধু আর তিন চাকর জাহাজে বসল। প্যারীর ভাই ঘোড়াগুলোকে লন্ডনের পথে ফিরিয়ে নিয়ে চলল। তখুনি জাহাজ ছেড়ে দিল।

রাত গভীর। অ্যাথোসদের উপরের ডেক সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে তারা গভীর ঘুমে অচেতন। নিচের তলায় গ্রিমড, ম্যাস্কেটন আর ব্লেইগিয়স ঘুমের তোড়জোড় করছে। কিন্তু অসুবিধা হয়েছে একটা। বিলাসী পোর্থসের মতোই বিলাসী চাকর মাস্কেটন। একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার দীর্ঘদিন ধরে, রাতে ঘুমের আগে এক গ্লাস সুস্বাদু মদ খেতে না পারলে ঘুম আসে না। তাড়াতাড়ি লন্ডন থেকে আসার সময় মদ সে সঙ্গে করে আনতে আছে। গ্রিমড বলল।

গ্রিমড সেরকমই শুনেছে, জাহাজে উঠেই দ্যার্তেগা একবার উপর নীচ সব পরীক্ষা করে দেখেছিল। খোলর ভেতর পাঁচটা পিপাও দেখেছিল। জিজ্ঞাসা করাতে পিপেগুলোতে পোর্ট মদ আছে বলে জানিয়েছিল ছদ্মবেশী গ্রসলো।

এই খবরটাই মাস্কেটনকে জানিয়ে দিল গ্রিমড, আহা এক গ্লাস মদের অভাবে ঘুম আসছে না বন্ধুর? যাক না, নিয়ে আসুক গিয়ে। সত্যিই মাস্কেটন পোর্ট আনতে গেল, এক গ্লাস নয়, এক মগ আনবে। একা সে পেটি খাবে না। সে স্বার্থপর নয়। সে এক গ্লাস গ্রিমডকে দেবে, ব্রেইসিয়মকেও দেবে এক গ্লাস।

মগ ভর্তি করে খানিক পরেই সে ছুটে এল। উত্তেজনায় তার চোখ দুটো বেরিয়ে যেতে চাইছে। এটা কি জাতীয় পোর্ট হে গ্রিমড? গ্রিমডের সামনে মগ রেখে সে জিজ্ঞেস করল।

গ্রিমড অবাক হয়ে দেখল, তরল সোনার রং এর বদলে কালো এক রকম গুড়ো পদার্থে মগ ভর্তি রয়েছে। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে সে লাফিয়ে উঠল-এতো বারুদ! সব কয়টা পিপেই এই দিয়ে ভর্তি নাকি?

‘সব কয়টাই।’

গ্রিমড মগ হাতে নিয়ে ছুটল কর্তাদের কাছে। জানাল দ্যার্তেগাকে। দ্যার্তেগা নিজের চোখে একবার পরীক্ষা করে এলো পিপেগুলো। তারপর বন্ধুদের জানিয়ে বলল—’এই মুহূর্তে জাহাজ ছাড়তে হবে। মর্ডন্ট বা ক্রমওয়েল যেই হোক আমাদেরকে জাহাজ সুদ্ধ উড়িয়ে দেবার মতলব করছে।’

তারা নৌকা নামাতে গেল চুপি চুপি। যাতে নাবিক বা ক্যাপ্টেন টের না পায়। এদিকে নিজেদের ব্যবহার করার জন্য গ্রসরো নৌকা জলে নামিয়ে রেখেছে। জানা নেই, কতক্ষণ বা কয়দিন নৌকায় থাকতে হবে। সেই জন্য। কিছু খাঁচার এবং কয়েক বোতল পানীয়ও সে সাবধানে নৌকায় গুছিয়ে রেখেছে।

মর্ডন্ট ঠিক রাত বারোটার সময় জাহাজে আগুন দেয়ার কথা। সে ক্যাপ্টেনের কেবিনে লুকিয়ে আছে। সে এবং এসলো নিজের বিছানায় নাবিকদের জানায়নি নৌকা নামাবার আসল উদ্দেশ্য। কড়া নিষেধ আছে মর্ডন্টের।

জলে নৌকা ভাসছে। জাহাজের সঙ্গে রশি দিয়ে বাধা, চাকরদের নিয়ে চার বন্ধু সাবধানে উঠে বসল নৌকায়। তারপর রশি কেটে দিয়ে জাহাজ থেকে অনেক দূরে চলে গেল, নৌকা বেয়ে বেয়ে। মর্ডন্ট ঠিক বারোটায় গ্রসলোকে বলল–‘আমি বারুদের পিপের গায়ে পলতে বেধে রেখে এসেছি, দ্বিতীয় মুখ এই সেই পলতের। এখানে আমি এখন আগুন লাগিয়ে দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পলতে জ্বলতে জ্বলতে পিপের গায়ে পৌঁছাবে। আমি আসছি। নাবিকদের এর মধ্যে তুমি নৌকায় তোলা। ফরাসিগুলোকে একঘরে তালা বন্ধ রেখে আসছি। যাতে কেউ জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে।’

‘চটপট নৌকায় উঠে পড়ো’–গ্ৰসলো নাবিকদের আদেশ দিলেন। আশ্চর্য। নাকিবেরা রশি ধরে টানতেই রশি সড়সড় করে উপরে উঠে এল।

‘নৌকা কোথায় রশির মাথায়?’

‘নৌকা তো নেই, ক্যাপ্টেন।’

নৌকা নেই? মাথার চুল সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল গ্রসলোর। পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল সে। নৌকা নেই, নিশ্চয়ই নৌকা চুরি করে পালিয়েছে ফরাসিরা। সে মর্ডন্টের কাছে পাগলের মতো ছুটল। সে যাতে পলতের মুখে আগুন না দেয়, বা দিয়ে থাকলেও এক্ষুণি নিভিয়ে ফেলে। মর্ডন্টের সাথে মাথা ঠোকাঠুকি লাগল দুপা না যেতেই। জ্বলন্ত একটা মশাল তার হাতে। এই মশাল দিয়ে সে পাঁচ মিনিট আগে পলতের মুখে আগুন জ্বালিয়েছে। তারপর ফরাসিদের ঘরের বাইরে একটা তালা ঝুলিয়ে–

ভূতে ধরা মূর্তি গ্রসলোর–‘নৌকা নেই, আগুন নেবাও।’

‘নৌকা নেই’–আর্তনাদ করে উঠল মর্ডন্ট।

পাল্টা আর্তনাদ গ্রসলোর–‘না, এক্ষুণি আগুন নেবাও।’

‘নেভানোর এখন আর সময় নেই, আগুন এতক্ষণে পিপে ছুঁয়েছে,’-এই বলে হাতের মশাল ফেলে দিয়ে, মর্ডন্ট সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিল। আর

অপার্থিব আওয়াজে, তারপরই আগুনের হলকা আকাশ ভেদ করে। গ্ৰসলো আর তার নাবিকেরা জলে ঝাঁপ দেবারও সময় পেল না।

সেই ভয়ানক দৃশ্যের দিকে তাকিযে সবই ভুলে গেল নৌকায় বসা পলাতকরা হত্যাকারীরা নিজেদের ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু এ যে বড় মর্মান্তিক মৃত্যু। ওরা ঈশ্বরকে স্মরণ করারও সময় পেল না।

কিন্তু বেশিক্ষণ ওদের চিন্তা করবে—দ্যার্তেগারাও তেমন নিরাপদ নয়। ওদের জীবন শেষ হয়েছে আগুনে। এদেরও যে কোনো মুহূর্তে জীবন্ত ডুবে মৃত্যু হতে পারে। দিকচিহ্নহীন অন্ধকার সমুদ্র। জাহাজ ডুবির ঢেউ-এর আঘাতে উথাল পাথাল ছোট নৌকা। তাতে আশ্রয় নিয়ে এই সাতটি মানুষ আর কতখানি নিশ্চিন্ত হতে পারে। নৌকা চলে যায়। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার সেই সমুদ্রের বুক চিরে ‘বাচাও বাঁচাও। কে ডাকে? এ নিশ্চয়ই সেই মর্ডন্ট। কণ্ঠস্বর ভুল হওয়ার কথা নয়।’

‘ও তাহলে মরেনি’–বলে দ্যার্তেগা। দ্বিগুণ জোরে দাঁড় টানে গ্রিমড।

‘কাউন্ট দ্যা লা ফেয়ার। উদার, মহানুভব কাউন্ট। আমায় বাঁচান।’ আকুল আহ্বান ভেসে আসে আবার। বিশেষ করে অ্যাথোসকে সম্বোধন করেই বার বার আবেদন জানায় ধূর্ত। অ্যাথোসের হৃদয় যে কতখানি কোমল তার জানতে বাকি নেই।

সত্যিই অ্যাথোসের মনে দাগ কাটে এই আর্ত আবেদন, স্পষ্টই দেখা যায় অ্যাথোস চঞ্চল হয়ে উঠছে।

মর্ডন্ট আবারও চিৎকার করে উঠে আমাকে কি সত্যি মারতে চাচ্ছেন কাউন্ট। ভেবে দেখুন, বয়সে কত তরুণ আমি। আপনার যদি পুত্র থাকে, তবে তার বয়স হয়ত আমার মতো হবে। মনে করুণ, আপনার সেই পুত্রই জীবন ভিক্ষা চাইছে আপনার কাছে।

আর সহ্য করতে পারে না দয়ালু অ্যাথোস। চিৎকার করে ডেকে বলে ‘তুমি একটু চেষ্টা করে এদিকে ভেসে আস, আমরা তোমায় নৌকায় তুলে নেব।’

‘অ্যাথোস বলে কী?’ এক সঙ্গে তিন বন্ধু চমকে উঠল।

অ্যাথোস অনুরোধ করে বলে, একটি বালক মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে তোমাদের কাছে আশ্রয় চাইছে, কি বলে তোমরা তাকে ফিরিয়ে দেবে?

তীক্ষ্ণ স্বরে দ্যার্তেগা বলে–‘বালক? এই বালক তোমার চোখের সামনে গুলি করে লর্ড উইন্টারকে মেরেছে। এই বালকই মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করে রাজহত্যা পর্যন্ত করেছে। এরই মধ্যে তা ভুলে গেছ তুমি?’

পোর্থস তরোয়াল খুলে উঁচু করে তুলে ধরে—’সে এসে যদি নৌকা স্পর্শ করে, তার হাত আমি কেটে ফেলব।’

কিন্তু মর্ডন্ট যখন সত্যসত্যই এসে নৌকা ধরল তখন তরোয়াল হাকাতে পারল না পোর্থস। তাকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল অ্যাথোস—’এই যে আমার হাত ধর তুমি। তারপর আমার কাঁধ ধরে নৌকায় উঠে পড়।’

একটু ঝুঁকে পড়ে নৌকা থেকে নিজের কাধ বড়িয়ে দিল অ্যাথোস। মর্ডন্ট এসে জাপটে ধরল সেই কাধ। কেমন করে অ্যাথোসকে বাধা দেবে তা পোর্থস বা অন্য কেউ ভেবে পেল না।

কিন্তু হঠাৎ একটা পিশাচের হাসিতে সমুদ্র আকাশ শিউরে উঠল। সে হাসি মর্ডন্টের–‘মাগো মা। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার চার শত্রুকেই শেষ করে শাস্তি দেব তোমার আত্মাকে। তা আর হলো না। তবু একজনকে শেষ করছি। নাও তাকে। চারজনের মধ্যে যে ছিল সেরা শত্রু তোমার। তাকেই উৎসর্গ করছি তোমার কাছে।’

নৌকার কিনারে ঝুঁকে পড়েছিল অ্যাথোস। প্রবল শক্তিতে তাকে জলে ফেলে দিল মর্ডন্ট। অ্যাথোস এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। ছিল না অন্য কেউ, চোখের সামনে সমুদ্রজলে অ্যাথোস মিলিয়ে গেল। তারা কেউ কিছুই করতে পারল না।

অ্যাথোস ডুবেছে, মর্ডন্ট ডুবেছে, জলে ঢেউ উঠেছিল, ঢেউ থেমে গিয়ে বুদ্বুদ উঠেছিল, এখন সব শান্ত। কালো জলের দিকে ছয়জোড়া চোখ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। তারা কেউ ভাবতে পারেনি, অ্যাথোসকে এভাবে ছেড়ে যেতে হবে।

প্রায় দুই মিনিট। তারপর হঠাৎ আবার জলে বুদ্বুদ দেখা গেল, ছোট একটা ঢেউ উঠল, তারপর জলের উপর ভেসে উঠল একটা মাথা। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল ছয়টা কণ্ঠ—’ছয়জোড়া হাত ধরাধরি করে নৌকায় তুলে ফেলল অ্যাথোসকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নৌকার পাশে ভেসে উঠল মর্ডন্টের দেহটা। অ্যাথোসের ছোরা তার বুকে গাঁধা। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, অ্যাথোস, ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করুন। আমার ছেলে আছে, তার কথা মনে করেই ওকে আমি হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি।’

.

৯.

অ্যাথোসের জ্ঞান নেই, এমন কোনো জিনিস পৃথিবীতে কমই আছে। নৌবিদ্যাও তার ভালোই জানা ছিল এক সময়ে, নাবিকের শিক্ষাই সে পেয়েছিল তরুণ বয়সে।

সে শিক্ষার সাহায্যে নৌকাটিকে সে নিরাপতে ভাসিয়ে রাখল এবং ক্রমশ ফরাসি উপকূলের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল, অন্য সবাই সারা দিনরাত্রি চরম উত্তেজনার পর নৌকার খোলের ভেতর শুয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেক বেলায় তারা উঠল অনেক ক্ষুধা নিয়ে। ওদের ভাগ্য ভালো কিছু খাবার এবং পানীয় গ্ৰসলো মজুদ রেখেছিল নৌকায়। সেগুলি ব্যবহার করে শরীরকে তাজা করে তুলল।

অবশেষে একটা জাহাজ পাওয়া গেল। সেটা বোলো বন্দরে যাচ্ছে। মাথাপিছু এক স্বর্ণমুদ্রা ভাড়া দিয়ে, ওরা সেই জাহাজে উঠে পড়ল। বিকেলবেলা বোলো বন্দরে নামল।

নেমেই পোর্থস কোনো ভালো হোটেলে যেতে চাইছিল। দ্যার্তেগা তাতে বাধা দিল। বন্দরের ডানদিকে সমুদ্র পারে ঝাপির সারিতে ভর্তি, ও সবাইকে সেদিকে টেনে নিয়ে চলল। বন্দর থেকে কিছু খাবার কিনেও নিল।

বেশ কিছুদূর দিয়ে একটা বালিয়ারির আড়ালে সবাই বসল, খাওয়া দাওয়া সেরে নিল চটপট, তারপর দ্যার্তেগা বলল-বন্ধুগণ শোন, এবার আমাদের আলাদা আলাদা পথে যেতে হবে। আমি আর পোর্থ একদিকে, অ্যাথোস আর অ্যারামিস অন্যদিকে।

সবাই বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? আলাদা পথে কেন?’

‘ভুলে গেলে? তোমরা কন্ডির দলে। এই দুই দলের ভেতর মেলা মেলা দেখলে দুই দলের নেতারাই সন্দেহ করবে।’

দ্যার্তেগাকে বিদায় দিতে ইচ্ছা নেই অ্যাথোসের, ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বিপদের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিমান সেনাপতির মতো সে অদ্ভুত কৌশলে সবাইকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে। তার স্মৃতি দ্যার্তেগার প্রতি আগের চাইতেও বেশি আকর্ষণ করেছে। সে শুধুই বলে–‘সবাই একসাথে থাকাই নিরাপদ। আর এ এলাকায় রানীর দলের শক্তি বেশি। রানী মানেই ম্যাজারিন। সুতরাং ম্যাজারিনের দলের দ্যার্তেগা অনায়াসে আমাদের রক্ষা করতে পারবে। আমরা একপাও সামনে যেতে পারব না ও সঙ্গে না থাকলে। রাজ সৈন্যের হাতে বন্দি হয়ে যাব।’

‘তোমরা ভেন্ডোমার ভেতর দিয়ে প্যারিসের দিকে চলে যাও। ওটা বোফোর্টের জমিদারী। তোমাদের ফ্রন্ডিদেরই অধিকার ওখানে। আমরা। নিবার্ডির পথে যাচ্ছি। প্যারিসে দেখা হবে।’

সবাইকে পরাজয় মেনে নিতে হলো দ্যার্তেগার জিদের কাছে। অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে অ্যাথোস আর অ্যারামিস বিদায় নিল দ্যার্তেগা আর পোর্থসের কাছে। গ্রিমড, ব্রেইয়িইস আর মাস্কেটন সবাইকে অ্যাথোসের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল দ্যার্তেগা। চাকর একটাও সঙ্গে থাকবে না। পোর্থস একবার বিদ্রোহ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু কনুই দিয়ে দ্যার্তেগা তাকে এমন গুতো দিল যে, সে। আর আপত্তি করতে সাহস পেল না।

বিদায় নেয়ার পর দুইদল দুই দিকে রওনা হলো। সবারই মন খারাপ। ইংল্যান্ডে চরম বিপদের দিনেও মন তাদের এমন মুষড়ে পড়েনি কোনো দিন, কারণ তখন এক সঙ্গে চার বন্ধু ছিল। আজ কেন এ ছাড়াছাড়ি, কে তা বলে দেবে? এ ছাড়াছাড়ি কি চিরদিনের?

কিছুদূর গিয়ে পোর্থস হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠল–তুমি কিন্তু এটা অন্যায় করছ দ্যার্তেগা। অ্যাথোসকে বিপদের মুখে ছেড়ে দিয়ে আমরা দুইজনে তোফা নিরাপদে পথ চলেছি। এরকম স্বার্থপরতা তোমার ভেতর দেখতে পাব এ আমি কোনোদিন ভাবিনি।

দ্যার্তেগা এক মুহূর্ত নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তার ঠোঁটের কোণে করুণ হাসি ফুটে উঠল। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল—’সরল, মহৎ পোর্থস। অ্যাথেসেরা বিপদে নয়। বিপদে আছি আমরাই। আমাদের সঙ্গে থাকলেই ওদের বিপদের সম্ভাবনা ছিল। ভেণ্ডোমের পথে ফ্ৰণ্ডিরা নিরাপদ। আমি বা তুমি কোথাও নিরাপদ নই।’

‘কেন? কেন? আমরাও ম্যাজারিনের দলে। এ অঞ্চল ম্যাজারিনের অধীনে।’

‘আমরা ম্যাজারিনের দলেই ছিলাম। কিন্তু দলদ্রোহী হয়ে পড়েছি। ম্যাজারিন আমাদের ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ক্রমওয়েলকে সাহায্য করার জন্য। মর্ডন্টের অধীন হয়ে থাকার জন্য। তা না করে আমরা রাজা চার্লসকে উদ্ধার করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করেছি। ভাগ্য খারাপ না হলে উদ্ধার করতেও পারতাম। আর মর্ডন্ট, তাকেও আমরা হত্যাই করেছি। ম্যাজারিন এর মধ্যেই সব খবর পেয়ে গেছে। এ আমি শপথ করে তোমায় বলতে পারি। কাজেই যারা তার হুকুমের বিরুদ্ধে উল্টো কাজ করেছে, যারা তাকে ক্রমওয়েলের বিরাগভাজন করেছে তাদের উপর ম্যাজারিনের দলের প্রতিক্রিয়া কি রূপ হবে, অনুমান করতে পারছ?’

‘ও ব্যাটার মনের ভাব সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না বন্ধু, তবে ওর আগের কার্ডিনাল যে রিশশু, তার মনের ভাব এরকম অবস্থায় কী রকম দাঁড়াত, তা বলতে পারি। রিশলু আমাদের খতম করার জন্য প্রতি রাস্তার মোড়ে গুণ্ডা রাখত।’

‘এ তার চেয়ে কম কিছু করবে না ঠিক জেনো।’

‘আমার ব্যারণ উপাধিটা তা হলে আকাশ কুসুমই থেকে গেল, আহা’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে পোর্থ বলল।

‘মোটেই না।’ দ্যার্তেগা মনে মনে যতই দমে যাক, বন্ধুকে দমতে দেবে না, ‘বলল, তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখো। ওই ম্যাজারিনের কাছ থেকে তোমার ব্যারণ উপাধি আমি আদায় করে দেবই।’

ভেন্ডমের ভেতর দিয়ে নিরাপদে প্যারিসে পৌঁছাল অ্যাথোস আর অ্যারামিস। সেখানে গিয়ে প্রধান কর্তব্য রানী হেনরিয়েটাকে দুঃসংবাদ দেয়া। কিন্তু কর্তব্য কর্তব্যই। অ্যাথোস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছে রাজার শেষ সংবাদ রানীকে দেবার জন্য। শোকবার্তা বলে সে কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়া চলে না।

ধূর্ত ম্যাজারিন–পাষণ্ড ম্যাজারিন।

লুভর প্রাসাদে গিয়ে অ্যাথোস আর অ্যারামিস দেখে, রানী হেনরিয়েটা খুশি মেনে প্রায় হাসি হাসি মুখে আলাপ করছেন দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। এরা ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণীর গণ্যমান্য লোক। অ্যাথোস অ্যারামিস দুজনেরই পরিচিত। এদের একজন শ্যাটিলনের ডিউক, বিখ্যাত সেনাপতি।

অ্যাথোসদের দেখে রানী খুশি হয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন ‘আসুন, আমার স্বামীর কুশল সংবাদ দিতে আপনারাও এসেছে দেখছি। কিন্তু দেখেছেন তো রানী অ্যান দেরি না করে নিজের দূত পাঠিয়েছেন আমাকে আনন্দ সংবাদ দিতে।’

আনন্দ সংবাদই? কি আনন্দ সংবাদ? আর্তনাদের মতো শোনায় অ্যাথোসের স্বর। রানী হেনরিয়েটা চমকে উঠেন তার কণ্ঠস্বরে। কে যেন প্রচণ্ড হাতুড়ির আঘাত হানে তার বুকের ভেতর। তিনি প্রায় ককিয়ে উঠেন—’কেন? রানী অ্যানের দূতেরা বলছেন আমার স্বামীকে তারা বধ্যমঞ্চে নিয়ে এসেছিল, সেই সময় তাকে উদ্ধার করেছে তার অনুরক্ত প্রজারা। তিনি আবার একটা সৈন্যদল পরিচালনা করছেন। সিংহাসন উদ্ধারের আশা খুবই বেশি। তার ওই মুহূর্তে আপনারাতো ইংল্যান্ডেই ছিলেন তার কাছে। আপনাদের এসব স্বচক্ষে দেখার কথা এসব। এরা যা বলছে তার কি সত্য নয়?’

শ্যাটল অ্যাথোসকে চুপি চুপি উত্তর দেয়—’মিথ্যা চিরদিনই ঘৃণার। তার প্রচারক যেই হোন না কেন। দুঃখিনী চার্লসের রানী। আমার দুর্ভাগ্য যে এই দুঃসংবাদ আমায় দিতে হল। আপনার মহলে স্বামীর শেষ আদেশ আপনাকে না জানিয়ে আমার উপায় নেই বলেই আমি এখানে এসেছি। মহারানী, মিথ্যাবাদীর ছলনায় ভুল আশা করবে না। আপনার স্বামী আর পৃথিবীতে নেই। তার স্বাক্ষী এই রুমাল।’ রাজার রক্তে ভেজা রুমালটি অ্যাথোস নিজের বুকের ভেতর থেকে বের করে রানীর সামনে রাখাল। অভাগিনী রানী। তিনি তখন অজ্ঞান।

সেদিন সন্ধ্যায় রানী অ্যানের দূত সেনাপতি শ্যাটিলনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে শেষ করল অ্যারামিস। দুর্ভাগিনী হেনরিয়েটার দুর্ভাগ্য নিয়ে পরিহাস করার জন্য এই সাজা।

কিছুদিন প্যারিসে ঘোরাফেরা করেই অ্যাথোস আর অ্যারামিস বুঝতে পারল যে ফন্ডির বিদ্রোহে জয়ী হওয়ার কোনো আশা নেই। কারণ বিদ্রোহের নায়কেরা সবাই গোপনে গোপনে ম্যাজারিনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে। কেউ পাবে জমিদারী, কেউ উচ্চপদ, কেউ অনেক নগদ টাকা। গরীব জনগণের দুঃদুর্দশার দিকে তাকিয়ে স্বার্থহানি করবে এমন মহান ব্যক্তি একজনও নেই বিদ্রোহী দলপতিদের ভেতর।

তারপর আছে দুঃশ্চিন্তা, এখনও এসে পৌঁছায়নি দ্যার্তেগারা। বারবার দ্যার্তেগার বাসায় গিয়েছে অ্যাথোস। দ্যার্তেগা আসেনি, আর কোনো খবরও পাওয়া যায়নি। দ্যার্তেগা আর পোর্থস–দুইজনেই নিরুদ্দেশ। বন্ধুদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা না জেনে নিশ্চিন্ত থাকা অ্যাথোস বা অ্যারামিসের পক্ষে সম্ভব নয়। বোর্নোতে ফিরে এসে সেখান থেকে পিকার্ডির পথে যাওয়ার কথা দ্যার্তেগাদের। ওরাও পিকার্ডির পথ ধরল। অনুসন্ধান শুরু করল। প্রতি শহরে যেখানে খাবারের বা রাতে থাকার জন্য দ্যার্তেগাদের অপেক্ষা করার সম্ভাবনা ছিল, সাবধানে জিজ্ঞাসা করে ওরা। না, কোথাও কোনো খবর পাওয়া গেল না।

অবশেষে মনট্রিল শহরের এক হোটেলে খেতে বসেছে অ্যাথোস আর অ্যারামিস। অন্যমনস্কভাবে টেবিলের পর্দার উপর হাত রেখেছে, অ্যাথোসের মনে হলো-চাদরের নিচে কাঠ ঠিক মসৃণ লাগছে না। কৌতূহলের বসে চাদর তুলে একটা নিশানা সে দেখতে পেল।

দেখল, টেবিলের কাঠের ছুরির ফলা দিয়ে লেখা আছে-পোর্থস-দাত রোফেব্রু চমৎকার এখানে তাহলে তারা এসেছিল। রাতটা এখানে কাটাব ভেবেছিলাম। তা আর হবে না, চল এখনই রওনা হই।

অ্যারামিস বলে–‘এখানে এত খোঁজাখুজি করার কোনো দরকার নেই। দ্যার্তেগা হোটেলে বসে আরাম করার পাত্র নয়। কোনো হোটেলে যা হোক কিছু খেয়ে নিয়ে সে রওনা হয়ে গিয়েছে সামনের দিকে। সুতরাং সামনে চল।

আবার তারা পথে নামল। শহরের দরজায় দরজায় একটু খবরের জন্য চেষ্টা, সে যে কী বিরক্তিকর ব্যাপার। কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধন আছে। আছে কৃতজ্ঞতা, আছে আত্ম মর্যাদার প্রশ্ন-কষ্ট বা বিরক্তি কাছে পরাজয় স্বীকার করার পাত্র নয় ওরা।

এবার ওরা কম্পিয়ে শহরের দিকে ছুটল। শহরের গেটের পাশেই একটা সাদা দেয়াল একটা। তার উপর কয়লা দিয়ে কালো ছবি আঁকা। অতি আনাড়ী হাতের আঁকা, তবু স্পষ্ট বোঝা যায়–দুজন ঘোড়ার পিঠে মানুষের ছবি। নিচে লেখা–‘ওরা পিছু নিয়েছে।’

উৎসাহে অ্যাথোস বলে উঠে, আর সন্দেহ নেই, এ দ্যার্তেগা আর পোর্থস, পিছু নিয়েছে, কে?-তা যেই হোক খুব কাছাকাছি পৌঁছুতে পারেনি। শত্রু কাছে থাকলে, দ্যার্তেগা পাঁচ মিনিট ধরে ছবি আঁকতে পারত না।

অ্যারামিস বলে—’কাছে যদি পৌঁছতে না পেরে থাকে, তাহলে হয়তো দ্যার্তেগাদের ধরতেও পারেনি। একটু একটু আশা হচ্ছে।’

‘আমার আশা হচ্ছে না। বন্দি না হলে তারা এরকম অদৃশ্য হবে কেন?’

কী চিন্তা! কি ভাবনা! বিপদের নিশ্চিন্ত খবর পেলেও এতখানি অস্বস্তি ভোগ করতে হত না। অ্যাথোসের হে প্রবণ মন বন্ধুদের অমঙ্গলের আশঙ্কায় অধীর। আবেগ সর্বস্ব অ্যারামিস রশিটানা ঘোড়ার মতো ছটফটিয়ে উঠছে একটু পরপর। তারা ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল ঘণ্টা দুই তিন। হঠাৎ রাস্তার এককোণে দেখতে পেল, কে যেন বড় একখণ্ড পাথর এনে রেখে দিয়েছে। যাতায়াত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই।

মাস্কেটনকে সঙ্গে আনা হয়নি–সে প্যারিসে রয়েছে যদি দ্যার্তেগা বা পোর্থর্স এসে পড়ে সেজন্য। সঙ্গে আছে গ্রিমড আর সেই পিয়ন। তাদের সাহায্যে পাথরখানা উলটে ফেলতেই তারা দেখতে পেল তার তলার দিকে লেখা রয়েছে পীকক হোটেলে আমরা উঠব। হোটেলওয়ালা আমাদের বন্ধু।

‘তবু একটা সঠিক খবর পেলাম, চল পিককে যাই।’

কিন্তু ঘোড়াদের না খাইয়ে আর একপাও চালানো যায় না। ঐখানে। তাদের তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে হল।

তারপর পিককে পৌঁছাতে আরও ছয়ঘণ্টা লাগল। হোটেলওয়ালাকে প্রশ্ন করতেই সে এক টুকরো ভাঙা তরোয়াল নিয়ে এল–এটা চিনতে পারছেন? এক নজর দেখেই অ্যাথোস বলল–দ্যার্তেগার তরোয়াল।

‘দু’জনের ভেতর যিনি বিশেষ লম্বা চওড়া তার এটা? না-যিনি ছোটখাট তার?’

‘ছোটখাট জনের।’

তাহলে বুঝতে পারছি, আপনারা সত্যিই ওদের বন্ধু—’শুনুন, এখানে এসে ওরাও ঢুকল। পিছনে ঢুকল আটজন সৈন্য। কিন্তু আটজনেও কিছু করতে পারত না। এই শহরে একদল রাজসৈন্য আছে, সংখ্যায় বিশজন, পেরে উঠলেন না।’

‘কিন্তু তাদের কি অপরাধে ধরা হয়েছে? কিছু শুনেছেন?’

‘না, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার সময় পাইনি, তারা চলে গেলে দেখি গোটা তিনেক লাশ পড়ে আছে। ঘোড়াসওয়ার সৈন্যের লাশ, আর ছয়জন আহত হয়ে পড়ে আছে। তাদের সরিয়ে ফেলতে গিয়ে এই তরোয়ালের টুকরো পেলাম।’

‘কোথায় নিয়ে গেল কিছু জানেন?’

‘ভরে শহরের দিকে–তাছাড়া আর কিছু জানি না।’

ছোট শহর ভরে। সেখানে একটি মাত্র হোটেল। এই হোটেলের মদ বিখ্যাত। ঘোড়াসওয়ারীরা কি এই বিখ্যাত মদ এক গ্লাস না খেয়েই চলে যাবে এখান থেকে? এত বড় লড়াইয়ের পর। এখানে যদি তারা থেমে থাকে নিশ্চয়ই কোনো চিহ্ন রেখে গিয়েছে দ্যার্তেগা।

হোটেলে ঢুকে দুই গ্লাস মদের অর্ডার দিল অ্যাথোস আর অ্যারামিস এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে লাগল। ঢাকনা হিসাবে একটা চওড়া রূপা এবং দস্তার তৈরি পাত রয়েছে কাউন্টারের উপর। তার উপরে কতগুলো আলপিনের আঁচড়। অক্ষর আকারে আঁচড়গুলো—’এলোমেলো নয়। স্পষ্ট লেখা আছে, রুইন-ডি’।

‘তাহলে ওরা রুইনে গিয়েছে?’

‘সেন্ট জার্মেইনের পাশ হল রুইন। রানী অ্যান আছেন সেন্ট জার্মেইনে, ম্যাজারিন আছে রুইনে।’

‘কার্ডিনাল রিম রুইনে একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সে বাড়ির নিচে একটা কবরস্থান আছে বলে শোনা যায়। কিছু কবরে মৃতদেহ আছে। কিছু এখনও খালি।’

‘ম্যাজারিন এবার হয়তো খালিগুলি ভর্তি করার মতলবে আছে। দ্যার্তেগার মতো দুর্ধর্ষ লোককে হাতে পেয়ে সে আর ছাড়বে না। সাপের লেজে পা দিয়ে কোনো বুদ্ধিমান লোক তাকে ছেড়ে দেয় না।’

ঘোড়া ছুটছে আর দুই বন্ধু এরকম বলছে, সেন্ট জার্মেইনে আসতে আসতে মন ঠিক করে ফেলেছে তারা। সোজা রানীর কাছে যাবে অ্যাথোস, স্মরণ করিয়ে দেবে পুরান দিনের কথা এবং রানীর কাছে দ্যার্তেগার মুক্তি চাইবে। দ্যার্তেগার এবং পোর্থসের। এমনও হতে পারে রানী হয়তো জানেনই না ম্যাজারিনের-এ কাজের কথা।

সন্দেহ নিয়ে মাথা নাড়ে অ্যারামিস। অ্যাথোসের মতো সরল নয় সে। রানীর সঙ্গে দেখা করে অ্যাথোস কোনো কাজই আদায় করতে পারবে না বলে অ্যারামিসের বিশ্বাস, উল্টো সে নিজেই বন্দি হয়ে পড়বে।

সুতরাং সাবধানী অ্যারামিস বলল—’তুমি রানীর কাছে যেত চাও যাও। আমি যাই মহা যাজক ফ্ৰণ্ডির কাছে। ফ্ৰণ্ডির দলের কিছু লোক চেয়ে নেই তার কাছে। কাজে লাগবে হয়ত।’

‘বোকার মতো কোনো কাজ করো না’–বলে বিদায় নিল অ্যায়োস।

রানীর দরবার। নানা লোক এসেছে দেখা করতে। কাউন্ট দ্য-লা ফেয়ারের নাম সাক্ষাৎ প্রার্থীর তালিকায় দেখেই রানীর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। দ্যা-লা-ফেয়ারের মানে সেই অ্যাথোস তো? বাকিংহামের ব্যাপারে যে চার সৈনিক রানীর মর্যাদা রক্ষা করেছিল, তাদেরই একজন। প্রত্যেকের জীবনে অনেক সময় আসে যখন আগের দিনের উপকারীর নাম শুনলে রাগ। হয়ে যায়।

কিন্তু কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ার ফরাসি দেশের অভিজাত শ্রেণীর অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি। তিনি দেখা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব। সেটা সমস্ত প্রিন্স এবং ডিউকদের আঘাত করার মতো হবে। বর্তমান সংকটের সময় সে কাজ করার সাহস রানীর নেই।

সুতরাং রানীকে অ্যাথোসের কথা শুনতে হলো। মন না চাইলেও, কথা ধৈৰ্য্য ধরে শুনতে হলো।

অ্যাথোস বলছে,–‘মহারানীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়, লেফটেন্যান্ট দ্যার্তেগা আর তার বন্ধু পোর্থস ওরফে মঁসিয়ে দ্য ভ্যালের নাম। এটাও রানী বিশ্বাস করতে পারেন যে, এই বিশ বছরে রানীর প্রতি তাদের ভক্তি এক তিলও কমে যায়নি।’ রানীর চোখে মুখে মৃদু ব্যাঙের হাসি ফুটে উঠল।–’যাক, ওদের ভক্তি অটুট আছে জেনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আজকাল তো বিশ্বস্ত প্রজা পাওয়াই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘দোষটা অবশ্য প্রজাদের, তাতে সন্দেহ নেই,’–সবিনয়ে উত্তর দেয় অ্যাথোস। ‘তবে রাজশক্তির কাছে সুবিচার যখন দুষ্প্রাপ্য হয়, তখন ভক্তি স্বভাবতই কমে আসে বইকি।’

তীক্ষ্ণস্বরে রানী মন্তব্য করেন, ‘সুবিচার দুষ্প্রাপ্য?’

‘বর্তমান ক্ষেত্রেই দেখুন।’ দৃঢ়কণ্ঠে নিবেদন করে অ্যাথোস।

‘মহামন্ত্রী ম্যাজারিনের আদেশে লন্ডনে যেতে হয়েছিল দ্যার্তেগা আর ভ্যালোকে। সেখানে যথা সম্ভব সাহায্য তারা ক্রমওয়েলকে করেছেন। আর তার প্রতিদানে ফ্রান্সে ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই তার বন্দি হয়েছেন রাজসৈন্যের হাতে।‘

রানীর যেন বিশ্বাস হয় না কথাটা—’আপনি কি এমন কোনো প্রমাণ পেয়েছেন যাতে নিঃসন্দেহে বলতে পারেন যে—’

‘মহারানী আমি তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি এবং এও বলতে পারি যে এই মুহূর্তে তারা মহামন্ত্রীর রুইন প্রাসাদে, সম্ভবত সে প্রাসাদের মাটির নিচে কবরখানায় আটক আছে দ্যার্তেগা এবং ভ্যালো।’

রানী এক মুহূর্ত নীরব রইলেন–তারপর বললেন–‘আপনি পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন। আমি মঁসিয়ে ম্যাজারিনকে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করে তারপর আপনাকে জানাচ্ছি যে, আপনার ধারণা কতদূর সত্যি এবং সত্যি হলে এ ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি।’ অ্যাথোসকে বাধ্য হয়েই পাশের ঘরে যেতে হলো। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। গার্ড সেনার লেফটেন্যান্ট কাসি বললেন–‘কাউন্ট আপনার তরবারি খানা আমায় দিন। রানী আপনাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছেন।’

অ্যাথোস জানালা খুলে ফেলল। নিচের চত্বরে ভিরের মধ্যে অ্যারামিস দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাথোস ডেকে বলল—’অ্যারামিস আমি বন্দি হয়েছি।’

‘তা আমি আগেই জানতাম’–অ্যারামিস বলল।

.

১০.

আজ তিনদিন দ্যার্তেগা আর পোৰ্থস রুইন প্রাসাদে বন্দি হয়ে আছে। মাটির নিচে কবরখানায় নয়। ম্যাজারিন এখনও অতটা সাহস করে উঠতে পারেনি। কারণ ফ্রন্ডির নায়ক অ্যাথোস ও অ্যারামিস এখনও বাইরে আছে। দ্যার্তেগা পোর্থসের অপঘাতে মৃত্যু হলে, তাই নিয়ে একটা চাল চালবে ফ্রন্ডির দল। ম্যাজারিন যে মিটমাটের চেষ্টায় আপ্রাণ পরিশ্রম করে যাচ্ছে সেটা একটা দারুণ হোঁচট খাবে।

কাজেই এখনও জীবিত দ্যার্তেগা এবং পোর্থস। তবে যতক্ষণ না ফ্রন্ডি সন্ধি করছে ততক্ষণই তাদের জীবনের মেয়াদ।

বন্দিশালার জানালায় সন্ধ্যার সময়ে এসে কমিঞ্জে দেখা দিল। নমস্কার লেফটেন্যান্ট। নমস্কার দ্যা ভ্যালো।

কমিঞ্জে রীতিমতো শ্রদ্ধা করে দ্যার্তেগাকে। বীরের মর্যাদা বীরই বোঝেন। তাছাড়া দ্যার্তেগার সাহায্যে কমিঞ্জের জীবন একদিন বেঁচে গিয়েছিল। এই ফ্রন্ডির যুদ্ধে বাধাবার পরেই ব্রুসেলকে বন্দি করার সময়। কমিঞ্জকে প্রতি নমস্কার জানিয়ে দ্যার্তেগা বলল–খবর কি লেফটেন্যান্ট?

‘খবর এই যে আপনাদের বন্ধু কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ারও বন্দি হয়ে এসেছেন। তার অনুরোধেই খবরটা আপনাকে দিতে এলাম।

‘অ্যাথোস বন্দি? এখানে?’–দ্যার্তেগা বিমর্ষ না হয়ে উফুল্ল হয়ে উঠল। তার ধারণা দুইজনকে যদিও বন্দি করে রাখতে পেরেছে ম্যাজারিন, তিনজনকে পারবে না। হ্যাঁ, এই প্রাসাদের অন্য অংশে।’ এই বলে কমিঞ্জ বিদায় নিল। ম্যাজারিনের অজান্তে বন্দিদের সঙ্গে বেশি কথা বলার সাহস তার নেই।

দুইদিন এই প্রাসাদে কাটিয়েছে দ্যার্তেগা। চক্ষু বুজে দিন কাটায়নি। লক্ষ করেছে প্রতি সন্ধ্যায় দুইজন প্রহরী এসে টহল দেয় এই বন্দিশালার সামনে। আর ম্যাজারিন বন্দিশালার সামনে দিয়ে রোজ একবার বাগানের দিকে বেড়াতে যায়। ফিরে আসে আধঘণ্টা পরে।

সেদিন সন্ধ্যায় দুই বন্ধু পরিপাটি করে ডিনার খেলো। তারপর দ্যাগো বলল, ‘পোর্থস, তোমার গায়ের জোর কমে যায়নি তো।

‘কমবে’–অবাক পোর্থস দুই হাতের মাংস পেশী দুলিয়ে দেখাল বন্ধুকে ‘কি মনে হয়?

‘মনে হয় যে এই জানালার মোটা মোটা লোহার শিকল তুমি বাঁকিয়ে ফেলতে পার ইচ্ছে করলে।

‘ফেলব নাকি?’–বলেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল পোর্থস। তারপর দ্যার্তেগা আপত্তি করছে না দেখে জানালার একটা শিক দুই হাতে ধরে এমন টান দিল যে মাঝখানে ধনুকের মতো বেঁকে গেল শিকলটা এবং দুই মাথা সিমেন্টের খাজ থেকে চড়চড় করে উঠে বেরিয়ে এল পোর্থসেনরের হাতে।’

‘ঠিক আছে। এখন দেখি ওই ফাঁক দিয়ে তুমি বেরুতে পার কিনা? চেষ্টা করে দেখে পোর্থস বলল–পারি তবে ছাল-চামড়া খানিক উঠে যাবে বোধ হয়।—প্রাণ বাঁচার জন্য ছাল চামড়া কিছু যদি দিতে হয় দিও। এখন শোনো দুজনে চুপে চুপে বেশ কিছুক্ষণ পরামর্শ হলো। অবশ্য এক তরফা পরামর্শ ‘দ্যার্তেগা বলে যায়। পোর্থর্স মাথা নাড়ে।

একটু পরেই বন্দিশালার সামনে দুইজন প্রহরী দেখা গেল। একজন ডানে দেখতে দেখতে চলে গেল। আর একজন বাঁ দিয়ে যায়, জানালার সামনে দিয়ে ‘নমস্কার সাথী, বড় শীত বটে, উত্তর দেয় প্রহরী। দ্যার্তেগার পরিচয় মেজাজে ভদ্রতা বজায় রেখে উত্তর দেয়াতে সে কোনো ক্ষতি দেখল না।

‘কার্ডিনাল একটা ভালো মদ পাঠিয়েছিলেন। দুজনে আর কত খাব? একটা আস্ত বোতলই রয়েছে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস খেয়ে যান না–শীতটা কমবে।

‘বলছেন যখন, তা দিন, ধন্যবাদ।’

দ্যার্তেগা মদ ঢালছে গ্লাসে, পোর্থস জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, জানালার কাছে প্রহরি আসতেই পোর্থস দুই হাত বাড়িয়ে তার গলা টিপে ধরল। সে শক্ত মুঠির চাপে দম বন্ধ বেচারীর। চোখের পলকে দুই হাতে তাকে উঁচু করেছে পোর্থস আর শিকের ফাঁক দিয়ে তাকে টেনে এনেছে ভেতরে।

একটা কাপড় মুখে গুঁজে দেয়া। পিছনে হাত বাঁধা এবং পোশাক খুলে বিছানায় কম্বল চাপা দিয়ে রাখা কয়েক সেকেণ্ডের কাজ। পোর্থসই পোষাকটা পরে নিল চটপট। হতে পায়ে ছোট হলো এবং সেলাইগুলো পটপট করে ছিঁড়ে গেল দু’এক জায়গায়। কিন্তু তাতে কি? দূর থেকে দেখে কে বুঝবে?

সুইস গার্ডের পোষাক পরে পোর্থস বাইরে এসে দাঁড়াল জানালা গলে। ডান দিক থেকে টহল দিয়ে অন্য প্রহরীও এসে পড়ল। জানালার কাছাকাছি এসে সে জিজ্ঞাসা করল–‘দাঁড়িয়ে করছ কি?

সে কথার উত্তর পেল না। পোর্থস শক্ত মুঠি তারও গলা টিপে ধরল। তারপর তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের ভেতর তুলে ফেলল দ্যাগো আর পার্থস মিলে। তারও পোষাক খুলে নিয়ে বেঁধে কম্বল চাপা দিতে আর ক’সেকেন্ডের কাজ। সে পোষাকটি পড়ল দ্যার্তেগা।

এবার দুইজনে জানালা দিয়ে বাইরে চলে এল। একজনে ডানে, অন্যজন বামে টহল দিতে লাগল মনোযোগের সঙ্গে।

কিছুক্ষণ পরে ম্যাজারিন মূল প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে তার খাস চাকর বেদুঈন। ম্যাজারিন আদেশ দিল–‘আমি একবার বাগানটা ঘুরে আসি। তুমি কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ারকে বলল আমি আধঘণ্টা পরে তার ঘরে গিয়ে তার কথা শুনব। তার ঘরের চাবিটা আমায় দাও।

বেদুঈন চাবি দিয়ে চলে গেল।

হাতে একটি লণ্ঠন নিয়ে ম্যাজারিন ধীরে ধীরে চলেছেন। সুই প্রহরীদের বলছেন সঙ্গে আসতে হবে না। এখানে অপেক্ষা কর। কাউন্ট দ্যা-লা ফেয়ারের ঘরে যাওয়ার সময় তোমাদের সঙ্গে নেব। কোনো বন্দির ঘরে একা একা ঢুকতে নেই। কারণ সাধারণত বন্দিরা মরিয়া হয়।

দ্যার্তেগা সংক্ষেপে উত্তর দিল–‘জা জা’–অর্থাৎ হা হা। ম্যাজারিন চলেছেন, রাস্তার মাথায় লতার ঝোঁপ–তার ভেতর কমলালেবুর বড় বড় টব। ম্যাজারিন সতর্কভাবে চারিদিকে তাকিয়ে একটি বিশেষ টবের পাশে লণ্ঠনটি রাখলেন। প্রহরীদেরও চোখে পড়ল না। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বিশেষ একটা টবের গায়ে একটা কল ঘুরিয়ে দিলেন। সাথে সাথে গাছসহ টবটা ঘুরতে ঘুরতে অনেকখানি সরে গেল। আর ম্যাজারিন মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। টব আবার আগের জায়গায় ফিরে এল।

প্রহরীদের ম্যাজারিন দেখতে পাননি। কিন্তু তারা কাছেই ছিল। ওই টবের আড়ালে তারা লুকিয়েছিল। ঘুরন্ত টবের নিচে সিঁড়ি এবং সিঁড়ি বেয়ে ম্যাজারিনের মাটির নিচে যাওয়া কিছুরই নজরে এড়ায়নি তাদের।

এখন এগিয়ে গেল তারা। আবার কল ঘুরিয়ে টব সরাল–তারপর সেই সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে একটা ছোট ঘরে এসে দাঁড়াল। ম্যাজারিন সেখানেই রয়েছে, কিন্তু এদের দিকে পিছন ফিরে দেখতে পেলো না অবাঞ্চিত অতিথিদের। আর অন্য দিকে চোখ ফেরায় কীভাবে? সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য। সারি সারি সিন্দুক সাজানো দেয়ালের পাশে। সবগুলোরই ঢাকনি খোলা, ওগুলো থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে উজ্জ্বল আলো। লণ্ঠনটা বাইরেই আছে। কিন্তু এখানে ঢুকে ম্যাজারিন জ্বেলে দিয়েছে কয়েকটি মোমবাতি। তার আলোতে প্রতিটি সিন্দুকের হীরে জহরতগুলো এমনি আলো ছড়াচ্ছে।

দ্যার্তেগা কানে কানে বলল পোর্থসকে ম্যাজারিন এখন কোষাগার তৈরি করেছেন রিশলুর কবরখানায়। সমস্ত ফরাসি দেশ লুট করে এনে দরিদ্রের মুখের খাবার জমা করা হচ্ছে এই ঘরে।

বলে উঠল পোর্থস–‘ওকে এখানেই গলা টিপে শেষ করে দেই।’

‘পাগল! তা যদি করি, অ্যাথোসকে মুক্ত করব কেমন করে?’

আর দেরি না করে দ্যার্তেগা আর পোর্থস পা টিপে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। এসে টব আবার আগের জায়গায় রেখে টহল দিতে লাগল বন্দিশালার সামনে। সেখানে ঘরের ভেতর মুখবাঁধা সুইস গার্ড দুইজন নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে।

ম্যাজারিন একটু পরেই উঠে এলেন। রোজ সন্ধ্যায় একবার ধনরত্নগুলো না দেখলে রাতে তার ঘুম হয় না।

প্রহরীদের কাছে এসে ম্যাজারিন তাদের ডাক দিলেন–এসো আমার সঙ্গে। দ্যার্তেগা উত্তর দিল–জা জা।

সামনে ম্যাজারিন, পিছনে দুই সুইস গার্ড। অনেকেই লক্ষ্য করল এদের যেতে, কেউ কোনো কথা বলার দরকার মনে করল না, ম্যাজারিন এর সাথে অযথা কি কথা বলবে।

অনেক আঁকাবাঁকা বারান্দা পার হয়ে, চাবি দিয়ে একটি ঘরের তালা খুলে ফেললেন ম্যাজারিন। তিনি ঢুকলেন, পিছন পিছন সুইস দুইজনও ঢুকল।

ম্যাজারিন বললেন–‘নমস্কার কাউন্ট। আপনার সঙ্গে নির্জনে আলাপের সুযোগ পেয়ে আমি অনেক খুশী। আমি ইংল্যান্ডের ঘটনা সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করব। আপনি মন খুলে সত্য উত্তর দেবেন–এই আমার অনুরোধ।

অ্যাথোস কোনো উত্তর দেয়ার আগেই পরিষ্কার বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় দ্যার্তেগা বলে উঠল–হ্যাঁ, আপনি স্বচ্ছন্দে মন খুলে কথা বলতে পরেন কাউন্ট। কারণ এই সুইস গার্ড দুটো ফরাসি ভাষা একদম বোঝে না।’ ঘরের মধ্যে যদি বাজও পড়ত তাতেও মনে হয় ম্যাজারিন এত বেশি চমকাতেন না। ঘরের দরজার ভেতর থেকে বন্ধ করে তাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে পোস।

অ্যাথোস এসে দ্যার্তেগার হাত ধরল–‘তুমি?

ম্যাজারিন বিচলিত ভাবটা গোপন রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘মঁসিয়ে। আপনারা দান উলটে দিয়েছেন বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু সে আপনাদের ভুল। আমার হাতের এই বাঁশিতে ফুঁ দিলেই কমিঞ্জে এসে পড়বে তার বিশজন সৈন্য নিয়ে।

দ্যার্তেগা বলল–ভুল আমাদের নয়। ভুল আপনার কার্ডিনাল, বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার তরবারি আপনার বুকে প্রবেশ করবে সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? আমরা মরিয়া লোক, বেপরোয়া, জীবন-মরণ আমাদের কাছে খেলার বস্তু, তা কি আপনি আজও বুঝতে পারেননি? ম্যাজারিন যেন বোবা, অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক করে শেষ পর্যন্ত বললেন ‘আপনারা কি চান, তাই বলুন না হয়।

‘চাই? আবার কি চাইব? মুক্তি চাই। অকারণে অন্যায়ভাবে আমাদের তিনজনকে বন্দি করেছেন আপনি, আমাদের প্রথম দাবি হলো মুক্তি। সেটা না পেলে পরে অন্য সব কথা হবে।’

‘মুক্তি?–বেশ যান, আপনারা মুক্ত, দরজা খুলে যেখানে খুশী চলে যান কেউ আপনাদের বাধা দেবে না।’

‘অনেক ধন্যবাদ কার্ডিনাল। এতই যদি দয়া করলেন। আর একটু দয়া করে আপনার বাগানের পিছন দিক দিয়ে বের হবার রাস্তাটা আমাদের দেখিয়ে দিন।

চোখে সন্দেহ নিয়ে বলে উঠল ম্যাজারিন, কে বলল যে বাগানের পিছন দিক দিয়ে বের হবার একটা রাস্তা আছে?

‘কে আর বলবে? আমরা নিজের চোখে দেখেছি, দেখেছি যে কমলালেবুর টবটা ঘুরিয়ে দিলেই তার নিচে বেরিয়ে পড়ে পাকা সিঁড়ি এবং সেই সিঁড়ি দিয়ে নামলেই চোখে পড়ে বিশাল ধনভাণ্ডার। আপনি কি দয়া করে আমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন। যদি না দেন, তবে অবশ্য আপনাকে রেখে আমরা যাব। জীবিত নয় মৃত। জীবিত শত্ৰু পিছনে রেখে যাওয়ার মতো বোকা আমরা নই। তা আপনার বোঝা উচিত।’

জীবনের ভয়ে মোটেই ভীত নয় ম্যাজারিন। যতটা ভয় তার ধনসম্পত্তির কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে। সুতরাং এদেরকে বর্তমানে তোয়াজ করতে তিনি বাধ্য।

ম্যাজারিন তাড়াতাড়ি বললেন–‘চল যাচ্ছি।’

ঘরের দরজা খুলে সবার আগে ম্যাজারিন বেরুলেন। তার সামান্য পিছনে ডাইনে বায়ে দ্যার্তেগা ও পোর্থস, দুইনেরই হাতে গুলি ভরা পিস্তল। দ্যার্তেগা ম্যাজারিনের কানে কানে বলছে–‘চালাকির বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে দুইদিক থেকে দুটো গুলি আপনার পিছনে ঢুকবে, সুতরাং সাবধানে।

ইঙ্গিত বোঝেন ম্যাজারিন–ধীরে ধীরে পায়চারি করতেই যেন বাগানের দিকে চলেছেন। সঙ্গে দুইজন সশস্ত্র সুইস গার্ড এবং আর একজন বেসামরিক নিরস্ত্র ভদ্রলোক। অনেকেই দেখল, কিন্তু কেউ কোনো কিছু সন্দেহ করতে পারল না।

বাগানে এসে পৌঁছালেন ম্যাজারিন। ওই যে দেয়াল দেখা যায়। লাফিয়ে চলে যান, এদিকে কোনো প্রহরী নেই।

‘কই-এ অন্ধকানে দেয়াল তো চোখে পড়ছে না। আপনি দয়া করে আর একটু কষ্ট করুন প্রভু। দেয়াল পর্যন্তই পৌঁছে দিন আমাদের।’

ম্যাজারিনের পাঁজরায় কি যেন ঠেকছে। তার মানে হলো একটা পিস্তলের নল। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে বাগান পেরিয়ে চললেন

দ্যার্তেগা বলল–‘পোর্থসের কাঁধে উঠে অ্যাথোস দেয়াল পার হও, লাফিয়ে ওপরে নাম।

অ্যাথোস ওপারে লাফিয়ে পড়ল।

তারপর দ্যার্তেগা উঠল পোর্থসের কাঁধে–‘কার্ডিনালের পাঁজর থেকে পিস্তল সরিও না পোর্থস।

দ্যার্তেগা দেয়ালের মাথায় শক্ত হয়ে বসে বলল–এবার কার্ডিনালকে তুলে ধরে আমার কাছে দাও পোর্থস। কার্ডিনাল আমি কিন্তু উপর থেকে পিস্তল ধরে আছি। আপনি টু শব্দটি করলেই গুলি করতে বাধ্য হব।

ম্যাজারিন টু শব্দটিও করলেন না। নিঃশব্দে উঠে গেলেন দেয়ালে, দ্যার্তেগা হাত বাড়িয়ে তুলল তাকে।

এবার দ্যার্তেগা কার্ডিনালকে ধরে,তাকে নামিয়ে দিল দেয়ালের ওপাশে অ্যাথোস রয়েছে ওখানে, সে ম্যাজারিনকে ধরে নামিয়ে নিল।

তারপর নিজের বেল্ট খুলে সেটা ঝুলিয়ে দিল দ্যার্তেগা। ওটা ধরে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল পোর্থস। দেয়াল কাঁপছে থর থর করে। বুঝি ভেঙে পড়ে। কিন্তু টিকে গেল কোনো রকমে। পোর্থর্স উঠে বসল দেয়ালের উপর। এবং ওপাশে লাফিয়ে পড়ল। তারপর লাফিয়ে পড়ল দ্যাগো।

ওদিকে ছুটে আসছে ওরা কারা? গ্রিমড, গ্রিমডের পর অ্যারামিস, অ্যারামিসের পিছনে রাওল। প্রত্যেকে প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরল। এদিকে ঘোড়া তৈরি। তৈরি ষাটজন দেহরক্ষী এবং ফ্রন্ডিওয়ালা। কন্ডি এদের ধার দিয়েছেন অ্যারামিসের সাহায্যের জন্যে।

ম্যাজারিন আশা করছিলেন, ওরা তাকে এবার ছেড়ে দেবে। কিন্তু সে বৃথা আশা। দ্যার্তেগা তাকে ঘোড়ায় চড়তে বাধা দিল। ঘোড়াগুলো পোর্থসের জমিদারি ব্রাসিওজ দুর্গের দিকে ছুটল।

রানীর কাছে, সেন্ট জার্মেইনে পরদিন দ্যার্তেগা ফিরে এল।

রানী অবাক। তিনি জানেন রুইল প্রাসাদে দ্যার্তেগা বন্দি হয়ে আছে।

‘আমি বন্দি নই, রানী-বন্দি এখন কার্ডিনাল ম্যাজারিন।

ম্যাজারিন বন্দি? এটা ঠিক বেরুলুইন গোপন সংবাদ দিয়ে গিয়েছে রানীকে যে কার্ডিনাল নিরুদ্দেশ হয়েছেন।

সে নিরুদ্দেশের অর্থ যে, কার্ডিনাল ব্রামিওজ দুর্গে বন্দি, একথা রানী স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

তিনি গর্জন করে বললেন–দুঃসাহসী সৈনিক। তুমি কার্ডিনাল ম্যাজারিনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার স্পর্ধা কর?

দ্যার্তেগা বিনীতভাবে বলে,–‘আমি চিরদিনই দুঃসাহসী, মহারানী। ম্যাজারিনের আগে রিশলুর সঙ্গেও পাঞ্জা লড়েছিলাম এক সময়। মহারানীর অবশ্য তা মনে থাকার কথা নয়।

রানী অ্যান মনে লজ্জা পেলেন একটু,–এই সেই দ্যার্তেগা যার দুঃসাহসের কারণে একসময় তিরি চরম অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

কিন্তু মনের লজ্জা মুখে প্রকাশ করার লোক রানী নয়। তিনি ভয় দেখিয়ে বললেন–‘সব সময় দুঃসাহস ভালো হয় না। আমি এখনই সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারা ব্রাসিওজ দুর্গ মাটির সাথে মিটিয়ে দিয়ে কার্ডিনালকে উদ্ধার করে আনবে।’

‘ব্রাসিওজ দুর্গ শেষ করা আপনার পক্ষে অবশ্য অতি সহজ কাজ রানী। কিন্তু কার্ডিনালকে জীবিত আনা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দূত গিরি যদি সফল না হয়, আমি যদি আজকের মধ্যে নিরাপদে ব্রাসিওজে না ফিরি বা আবার ফিরে যাওয়ার আগে যদি রাজসৈন্য ও পথে যাত্রা করে, তাহলে কার্ডিনাল ম্যাজারিনের জীবনের মূল্য এক ফ্রাঙ্কও নয়। আমরা সব মরিয়া এবং বেপরোয়া। জীবন মৃত্যু আমাদের কাছে খেলার বস্তু মহারানী–এটা স্মরণ রাখলে ভালো করবেন।’

রানী চিন্তা করে দেখলেন, বুঝতে পারলেন দ্যার্তেগার প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই তার। তিনি প্রশ্ন করলেন, কি তোমাদের দাবি?

দাবির একটা লিস্ট করেই এনেছে দ্যার্তেগা। ফণ্ডিওয়ালের সব দাবির পরও দ্যার্তেগাদের ব্যক্তিগত দাবিগুলোও এতে আছে। প্রথম দ্যার্তেগাকে ক্যাপ্টেনের পদ ও লক্ষ ফ্রাঙ্ক পুরষ্কার দিতে হবে। পোর্থসের জন্য মঞ্জুর করতে হবে ব্যারণ উপাধি। অ্যারামিস চায় তার বন্ধু লাংভিলের ডিউকের জন্য নামত্তির শাসন কতৃত্ত্ব এবং পাঁচ লক্ষ ডলার এবং অ্যাথোস–অ্যাথোস কিছুই চায়নি। দিলেও সে নেবে না।

রানী অবাক হয়ে বলেন, ‘যে কিছুই চায় না, এমন লোকও আছে?’

দ্যার্তেগা উত্তর দেয়-’ওই একজনই আছে–অ্যাথোস।’

রানী সন্ধিপত্রে সই করে তারপর বললেন—’রাজা যেদিন প্যারিসে পুনঃপ্রবেশ করছেন সেদিন তার দেহরক্ষা করবে কে?’

তরবারি খাপ থেকে খুলে দ্যার্তেগা বলল—’সেদিন এবং সারাজীবন রাজার দেহরক্ষার ভার রইল-এই অধম সৈনিকের উপর-ঈশ্বর সাক্ষী করে বলছি, দ্যার্তেগার দেহে প্রাণ থাকতে শত্ৰু কখনও রাজার ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে পারবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *