৫. খড়ের বিছানা

৫.

দ্যার্তেগা সবেমাত্র নিজের জন্য তৈরি করা এক হাত পুরু খড়ের বিছানায় শুয়ে গায়ের উপর চাদর টেনে দিয়েছে এমনি সময় পোর্থস মুখ কাচু মাচু করে এসে হাজির। ‘ও ভাই দ্যার্তেগা আমি এখন কোথায় শুই?’

দ্যার্তেগা কানের উপর চাদর টেনে নিয়ে ঘুম ঘুম ভাব করে জবাব দিল–‘কেন? মস্কেটন তোমার জন্য খড় রাখেনি?’

পোর্থস গর্জে ওঠে–‘হতভাগা শয়তানটা পয়সার লোভে সব খড় বেচে দিয়েছে আমার জন্য এক আঁটিও রাখেনি। আমাকে তোমার অর্ধেক খড় দাও।’

‘বিছানা তৈরি করার আগে যদি বলতে, তাহলে নিশ্চয়ই দিতাম, এখন এই তৈরি বিছানা ভাঙব কি করে? অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি।’

দ্যার্তেগাও বিছানা ভেঙে তা থেকে খড় দিতে রাজী হয় না, আর পোর্থস এরকম অবস্থা মেনে নিতে রাজী নয় যে দ্যার্তেগা আরামে নাক ডেকে ঘুমাবে আর সে বসে বসে শীতে হি হি করে কাঁপবে। শেষে একটা মীমাংসা হলো। পোর্থস দুই লুই দেবে দ্যাৰ্তেৰ্গাকে বদলে পোর্থসকে নিজের বিছানায় শুতে দেবে দ্যার্তেগা।

পোর্থসকে নগদ দুই লুই গুনে দিতে হলো।

তারপর দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আবার চোখ বুজেছে, এমন সময় এক সৈনিক কর্মচারী এসে ডাকল—’লেফটেনান্ট দ্যার্তেগা এখানে আছেন?’

দ্যার্তেগা কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু পোর্থস লাফিয়ে উঠল, চটপট জবাব দিল—’এই যে এখানে শুয়ে আছে।’

‘ও এখানে শুয়ে আছে, লেফটেনান্ট আপনাকে এক্ষুণি ডাকছেন কার্ডিনাল ম্যাজারিন শিগগির আসুন।’

লাফিয়ে উঠল দ্যার্তেগা। নিশ্চয়ই এত রাত্রে ডেকে তাকে ক্যাপটেন পদ এবং পোর্থসকে ব্যারণ উপাধি দেবে না, ম্যাজারিনের কৃতজ্ঞতা নেই এমন কথা কে বলবে?

কোমরের বেল্টে তরোয়াল ঝোলাতে ঝোলাতে দ্রুতপায়ে হাঁটছে দ্যার্তেগা, এদিকে বিছানার মাঝখানে এসে আরাম করে হাত পা ছাড়িয়ে শুয়ে পড়ল পোর্থস।

দ্যার্তেগা গিয়ে সালাম দিতেই ম্যাজারিন একখানি খাম এগিয়ে দিলেন। তার দিকে-এই মুহূর্তে লন্ডন যাত্রা করতে হবে তোমাকে। বোলম বন্দরে মর্ডন্ট নামে এক যুবকের সঙ্গে দেখা করো। চিঠিটা তার হাতে দেবে এবং সে যেভাবে যা করতে বলে সেভাবেই সে কাজ করবে।

দ্যার্তেগা বেশ তিক্ততার সাথে প্রশ্ন করে, ‘আমাকে ক্যাপটেনের পদ আর আমার বন্ধুর ব্যারণ উপাধী’?

এসব হাঙ্গামা না হলে আজই ওটা হয়ে যেতে পাত, কিন্তু বুঝতে পারছ তো, রানীর মেজাজ এখন কীরকম? ধরে নাও ও তোমাদের হয়েই আছে, তোমরা ফিরে এলেই-হ্যাঁ তোমার বন্ধু ভ্যালনকে নিতে ভুলো না, তার উপর আমার অনেক ভরসা

দ্যার্তেগা এরপর প্রশ্ন করে, কিন্তু লন্ডনে যেতে হলে টাকার দরকার? খড় বিক্রির লাভের টাকা ম্যাজারিনের কাজে খরচ করতে দ্যার্তেগা রাজী নয়।

বাধ্য হয়ে ম্যাজারিনকে এক থলি স্বর্ণমুদ্রা বের করে দিতে হলো, তিনি মনে মনে মহা বিরক্ত। ওরা কাজ করছে বটে কিন্তু প্রতি কাজেই রক্ত শুষে নিচ্ছে, ম্যাজারিনের কাছে টাকাই হলো রক্ত।

থলেটা পকেটে নিয়ে দ্যার্তেগা বাইরে এল, বাইরে তখনও অপেক্ষা করছে সেই সৈনিক কর্মচারী, দ্যার্তেগা বলল–‘আমার বিছানায় মঁসিয়ে ভ্যালন শুয়ে আছেন, তাকে ডেকে দিন,’ দ্যার্তেগার সাথে আস্তাবলে দেখা করতে বলবেন।

বাতাসের বেগে দৌড়ে গেল সৈনিক। পোর্থসকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আস্তাবলে পাঠাতে বেশ পরিশ্রম করতে হলো তাকে কিন্তু কাজটা করার পর সৈনিক আর ম্যাজারিনের আদেশ শোনার জন্য তার কাছে ফিরে গেল না দ্যার্তেগা পোর্থসের ছেড়ে যাওয়া বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

সেন্ট জার্মেইনের রাজবাড়িতে সে রাত্রে একজন মাত্র লোক, যার কপালে বিনা পয়সায় বিছানা জুটেছে, না বললেও চলে, সে ঘুমালো খুব আরামে এবং আনন্দে।

দ্যার্তেগা পোর্থসের কথা বাদ দিয়ে এবার দেখা যাক কোথায় আছে অ্যাথোস আর অ্যারামিস।

পাহাড়ি এলাকা স্কটল্যান্ডের ছোট শহর সাজেল নিউক্যাসল। অবশ্য শহর ছোট হলেও এতে একটা দুর্গ আছে এবং দুদিন আগেও সেই দুর্গের মাথায় উড়ছিল ইংল্যান্ডের রাজার বিজয় পতাকা।

রাজার পতাকা কাল থেকে নেমে গেছে, সেখানে উড়ছে বিদ্রোহী ক্রমওয়েলের পতাকা, বাধ্য হয়ে রাজা দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে এসেছে খোলা জায়গায় কয়েকজন সেনৗ এখনও সঙ্গে আছে, তারা আশ্বাস দিয়েছে, পরের যুদ্ধেই তারা শেষ করে দিতে পারবে ক্রমওয়েলের শক্তি, কারণ পাহাড়ি এলাকা থেকে রাজার সামন্তেরা সদল বলে আসছে রাজার সেবা করার পবিত্র দায়িত্ব মাথায় তুলে নেয়ার জন্য।

শহরের নিচে সরু এক নদী, তার এপারে উঁচু নিচু একটি জায়গা, সেখানে অল্প কয়েকটি তাবু। সবচেয়ে বড় যে তাবুটা সেখানে এই শেষ রাত্রেও একটা প্রচণ্ড ঝগড়া ঝাটি বলছে, সেখানে উপস্থিত আছেন সীমান্ত অঞ্চলের সব সামন্ত সর্দার। সভাপতির আসনে আছেন লর্ড লেভেন, কারণ রাজার সৈন্যের তিনিই সেনাপতি।

তাবুটার আশেপাশে পাহারা রয়েছে, যাতে বাইরের কেউ এসে এই বাদানুবাদের একটি কথাও শুনতে না পায়, কিন্তু পাহারাদারদের চোখে ফাঁকি দিয়ে একটি লোক তাবুর বাইরে শুয়ে আছে, একেবারে তাবুর কাপড়ের সাথে শরীর মিশিয়ে। ভেতরে যেসব কথা হচ্ছে, তার কান এড়িয়ে যাচ্ছে না কোনো কিছুই।

লর্ড লেভেন বলে উঠলেন, ‘এই তাহলে ঠিক হল?’

‘নিশ্চয়ই’–সমস্বরে বলে উঠল সমবেত সামন্তেরা।

আর অপেক্ষা করল না, বাইরে আত্মগোপনকারী ব্যাক্তি, হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে গেল, এভাবে তাকে অনেক দূর আসতে হলো, অবশেষে একটা উঁচু ঢিবি পাওয়া গেল, একজন সৈনিক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে তার আড়ালে ঢিবির সাথে গা মিশিয়ে। এবার উঠে দাঁড়াল হামাগুড়ি দেয়া লোকটিও। তারপর আস্তে আস্তে কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে তারা এগিয়ে গেল অন্য দিকে। সেখানে রাজার শিবির ঘিরে রয়েছে অল্প কয়েকজন ইংরেজ সৈনিক।

গুপ্তচর দুজন ঢুকে পড়ল রাজার তাবুর পাশের তাবুতে। সেখানে তখনও পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে লর্ড উইন্টার, তার চোখে ঘুম নেই, এই গুপ্তচর দুজন যে অ্যাথোস ও অ্যারামিস তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পারছেন,–‘লর্ড উইন্টার, এই মুহূর্তে রাজার সাথে আমাদের দেখা হওয়া দরকার, অ্যাথোস জানাল।’

দুঃখের সাথে জানালেন উইন্টার রাজা বিশ্রাম নিচ্ছেন। ‘এখন তাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? এ মুহূর্তে রাজাকে না তুললে আর জীবিত অবস্থায় হয়তো তোলা যাবে না।’ বলল অ্যাথোস।

একথা শুনে তবে চুলুন–‘বলে দুজনকে তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন।’

রাজার তাবুতে যাওয়ার একটা পথ উইন্টারের তাবুর ভেতর দিয়েই, ঢাকা এবং সুরক্ষিত। তিনজনে আধা মিনিটের ভেতর রাজার শোবার ঘরে উপস্থিত হলেন। ঘরে কোনো আসবাব নেই। ইংল্যান্ডেরা রাজা চার্লস শুয়ে আছেন, একটা সরু খাঁটিয়ার উপরে। দুটি মাত্র মোমবাতির আলোতে তাবুর ভেতরের অন্ধকার দূর হয়েছে সামান্যই।

শোবার আগে রাজা পোষাক পর্যন্ত খোলেননি, যুদ্ধের পোষাক পরেই সারা দিনের পর শুয়েছেন। ঘুমে ঢলে পড়েছে শ্রান্ত শরীর। কিন্তু শান্তি পায়নি মন, মাথার বালিশে দুই ফোঁটা চোখের জলই যে তার সাক্ষি বন্ধ দু চোখের কোনো থেকে আস্তে আস্তে জেগে উঠলেন রাজা নিজেই।

রাজা আস্তে আস্তে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলেন। শান্ত স্বরে বললেন–‘প্রিয় উইন্টার আরো প্রিয় আমার নতুন বিদেশী বন্ধুদ্বয়। বিপদ নিশ্চয়ই আগের চাইতে গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে?–তা নইলে তোমরা এই শেষ রাতে আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত করতে ছুটে আসতে না।’

মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে অ্যাথোস বলল—’মহারাজ, বিপদ সত্যিই গুরুতর। এই মুহূর্তে না পালালে পালাবার পথও বন্ধ হয়ে যাবে।’

রাজা অবাক হয়ে বললেন–‘পালাব কেন? এখানে আমার সৈন্যবল অল্প হলেও আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সাহায্য আসবে, সেনাপতি লেভেন আমাকে কথা দিয়েছেন যে–’

‘আপনাকে লর্ড লেভেন যে কথা দিয়েছেন রাজা, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এইমাত্র তারই সভাপতিত্বে এক সভায় সৈনিক এবং সামন্তেরা স্থির করেছেন যে—’

‘কী, কী স্থির করেছে তারা?’–ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলেন রাজা, অ্যাথোসকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে।

অ্যাথোস সরাসরি উত্তর দিতে পারল না ঘুরিয়ে জানতে চাইল—’স্কচ সৈনিকদের বেতন কি কিছু বাকী আছে রাজা?’

‘তা আছে। গত দুই বছর আমার সাহসী সৈন্যরা রক্তের বিনিময়ে গৌরব ছাড়া আর কিছুই পায়নি।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাজা।

অ্যাথোস মাথা নেড়ে বলল–‘সেজন্যই, তাদের পাওনা আছে চার লক্ষ পাউন্ড। দুই লক্ষ পাউন্ড তারা আজই আদায় করবে-অর্থাৎ ক্রমওয়েলের কাছ থেকে পুরুস্কার পাবে।’

‘পুরস্কার পাবে? মানে?’ রাজা যেন বিভীষিকা দেখছেন?

‘পুরস্কার পাবে আপনাকে ক্রমওয়েলের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে। সোজা কথা দুই লক্ষ পাউন্ড মূল্যে ওরা রাজাকে বিক্রি করেছে শত্রুর কাছে।’

এক মুহূর্ত নীরব রাজা, চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছেন না, অবশেষে তিনি থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন–‘কাউন্ট। এ খবরে কোনো ভুল নেই তো?’

‘আমি নিজের কানে শুনেছি প্রত্যেকটি কথা, নিজের চোখে দেখেছি প্রতিটি রাজদ্রোহী সৈনিককে।’

‘উইন্টার। তোমার অল্প ইংরেজ সেন্য তারা—’

‘তাদের বিশ্বস্ততার জন্য আমি জামিন, রাজা।

‘তাহলে চলো, সেই কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে আমরা স্কটল্যান্ডের ভেতরে যাই। যেখানে রাজদ্রোহ এখনও ব্যাপকভাবে দেখা দেয়নি। সেখানে যদি নতুন সৈন্যদল গড়তে পারি তো ভালোই, যদি না পারি স্কটল্যান্ড পার হয়ে, সমুদ্র পার হয়ে নরওয়েতে চলে যাব–যেখানে বন্ধু মন্টরোজকে আগেই আশ্রয় নিতে হয়েছে।’

রাজা তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ পোশাক পড়ে নিলেন, তারপর উইন্টার, অ্যাথোস ও অ্যারামিসকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাবু থেকে।

উইন্টার চলে গেল তার ইংরেজ সেন্যদের দলটিকে নিয়ে আসার জন্য। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে, রাজা উত্তর পশ্চিম দিকে তাকালেন, ওই দিকেই হাইল্যান্ডে যাওয়ার রাস্তা। ওই রাস্তাই তাকে ধরতে হবে, একটা জমাট কালো বিস্তৃত পদার্থ। কী ওটা? সারা উত্তর পশ্চিম দিকটাকেই আটকে রেখেছে? কুয়াশা?

অ্যাথোস ও অ্যারামিস লক্ষ্য করল কালো রেখাটাকে। অ্যাথোন চারদিকে তাকাল না, কুয়াশা তো অন্য কোথাও নেই! সে কাঁপা গলায় বলল—’মজারাজা আমাদের আর পালানো হলো না।’

‘হলো না? কেন?–রাজার মনেও যে একই সন্দেহ জেগেছে তা তার কণ্ঠের সুরেই ধরা পড়ে গেল।

‘হলো না কারণ, ওই কালো রেখাঁটি হচ্ছে ক্রমওয়েলের সৈন্যের দল আমাদের একমাত্র পালাবার পথ ওরা আটকে রেখেছে।’

নিজের মনের সন্দেহ অ্যাথোসের মুখ থেকে এভাবে মিলে যেতে দেখে রাজা বোধহয় ক্ষোভে রোষে মরিয়া হয়েই স্কচ সৈন্য শিবিরের দিকে ছুটলেন, বাধ্য হয়েই অ্যাথোস ও অ্যারামিসকেও ছুটতে হল তার সঙ্গে।

পথে তারা বারবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছেন, মহারাজা?’

‘আমি শুধু একটা মুখোমুখি বোঝাপড়া করতে চাই লেভেনের সঙ্গে।’

রাজাকে আটকানো গেল না, তখনও সেই চক্রান্তকারী সৈন্য সামন্তরা জটলা করছে লেভেনের তাবুতে। রাজাকে হঠাৎ তাবুর মধ্যে উপস্থিত হতে দেখে কয়েকজন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাজা, রাজা’।

লর্ড লেভেন সচকিত হয়ে উঠলেন, ‘রাজা? এ সময়ে রাজা এখানে?’

রাজা ততক্ষণে একেবারে তাবুর মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, তিক্তস্বরে তিনি বললেন–‘হ্যাঁ, রাজা। যে রাজাকে তোমরা দুই লক্ষ পাউন্ডে ক্রমওয়েলের কাছে বিক্রি করেছ, সেই রাজাই বটে আমি।’

আকাশ থেকে পড়লেন লেভেন–এ খবর রাজার কানে এর মধ্যে পৌঁছে গেল কীভাবে ভেবে পেলেন না কিছুতেই, ঢোক গিলে আমতা আমতা করে কোনো মতে বললেন, কি যে বলেন, মহারাজা। আমরা যে প্রত্যেকে রাজার জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত, তার যে কোনো প্রমাণ আমরা দিতে পারি।

রাজা বললেন, আমি একটাই মাত্র প্রমাণ চাই লেভেন, এই মুহূর্তে ক্রমওয়েলের সৈন্যকে আক্রমণ কর। তাতেই তোমার কথার সত্যতা প্রমাণ হবে, লেভেন মাথা নিচু করে বলেন–‘রাজা জানেন যে সেটা অসম্ভব। কারণ ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ বিরতির চুক্তি রয়েছে।’

‘কিন্তু ওদের সৈন্য আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তাকে কি চুক্তির বরখেলাপ হয়নি?’

‘কে বলল যে ওরা ক্রমওয়েলের সৈন্য?’

‘কাউকে বলতে হয়নি, আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি, রাত্রি জেগে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ব্যস্ত না থাকলে তোমরাও দেখতে পেতে।’

আর কথা যোগাল না লেভেনের মুখে।

তখন সামনে এগিয়ে এল কয়েকজন দুঃসাহসী পাহাড়ি সামন্ত, নীচ লোকদের স্বভাবই এই যে তাদের নিচুতা যখন ধরা পড়ে যায়, তখন তারা লজ্জা ঢাকতে যায় ঔদ্ধাত্ব এবং স্পর্ধার দ্বারা। এরাও তাই করল—’হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র করেছি, করব না কেন? অত্যাচারী শোষণকারী চার্লস স্টুয়ার্টের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছি। আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে। আর তোমাকে তাবুর বাইরে যেতে হবে না। চার্লস স্টুয়ার্ট, তোমাকে আমরা বন্দি করলাম।’

এই বলে সত্যি সত্যি দুই দুবৃত্ত দুই দিক থেকে হাত বাড়াল রাজার দুই হাত ধরার জন্য। অমনি বিদ্যুতের ঝলকের মতো বেরিয়ে এল দুটি তরবারি, আর আমূল ঢুকে গেল তাদের বুকে। অ্যাথোস আর অ্যারামিস অকারণে আসেনি রাজার সঙ্গে।

অপ্রত্যাশিতভাবে দুজন অপরিচিত যোদ্ধাকে হঠাৎ রাজার সাহায্যে উপস্থিত হতে দেখে রাজদ্রোহীরা ভয় পেয়ে গেল। অপরিচিত যোদ্ধারা বেপরোয়া এবং মরিয়া। বিনা বাক্য ব্যয়ে দুই জনকে তারা পরলোকে পাঠিয়েছে চোখের পলকে। পরের বার যারা রাজাকে বন্দি করতে যাবে তারাও হয়তো একই পথের পথিক হবে। এ অবস্থায় হঠাৎ আর কেউ এগিয়ে এল না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আক্রমণের একটা ধারা আগে স্থির করে নিতে চায়। এদিকে অ্যাথোস আর অ্যারামিস দাঁড়িয়ে নেই। রাজাকে মাঝখানে নিয়ে তারা দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে, তাবু থেকে বেরিয়ে পড়তে আর কতক্ষণ লাগবে তাদের? অচিরেই খোলা মাঠে এসে পড়ল তারা রাজাকে নিয়ে।

রাজদ্রোহীরা পিছু ধাওয়া করেনি। লেখেন তাদের বুঝিয়েছে, যাক না রাজা কোথায় যাবে, চারিদিকের পথঘাট বন্ধ। তোমরা সজ্জিত হয়ে নাও। সুশৃঙ্খল ভাবে সামনে এগোও। ক্রমওয়েল যেন আমাদের এলোমেলো হাটুরও জনতা বলে ভুল না করে।

উইন্টার এখনও আসছে না, একজন তার খোঁজ করতে যাবে কিনা ভাবছে। এমন সময় অ্যাথোসের দৃষ্টি পড়ল–শীর্ণ নদীটির ওপারে পিলার উপর সৈন্য পরিবেষ্টিত একজন বেঁটে মোটা লোক চোখে দূরবীন তুলে তাদের তিন জনকে দেখছে, রাজাকে সে জিজ্ঞেস করল–‘রাজা কি ওই লোকটাকে চেনেন?’

‘চিনার কথা তো, ওই হলো ক্রমওয়েল’, একটু হেসে রাজা বললেন। পিছনে একটি ছোট সৈন্যদল নিয়ে উইন্টার এসে পড়লেন। ছোট হলেও এই চারশো অশ্বারোহী যদি তাদের কর্তব্য ঠিকমতো করে, তাহলে এখনও আশা আছে।

এতক্ষণে স্কট সৈন্যরাও জোট বেধে মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে, উইন্টার ইংরেজ সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে দেখে তাদের অনেকের লজ্জা হলো, তবে তারা কেউ নেতা নয়, ঘটনার গতি পালটে দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই তারা শুধু লাইন ছেড়ে বেড়িয়ে এল। আর হাঁটুতে চাপ দিয়ে যার যার তরোয়াল দু টুকরো করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এ দৃশ্য দেখে রাজার বিষন্দু মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। উইন্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘সবাই ওরা বিশ্বাসঘাতক নয়, দেখছ? সময়ের চাপে পড়ে ওদের রাজদ্রোহীদের দলে মিশতে হয়েছে, যাই হোক আর দেরি করার প্রয়োজন নেই। উইন্টার তোমার সৈনিকেরা সামনে এগোক। এবার আমাদের ওই ফরাসি বন্ধুদের সম্মানে ফরাসি জাতির জয়ধ্বনিই আমরা উচ্চারণ করি এসো-মন্টজয় এবং সেন্ট ডেনিস, ইংল্যান্ডের জাতীয় জয়ধ্বনি ‘সেন্ট জর্জ ফর ইংল্যান্ড’ তো এখন বিদ্রোহীদের গলায় উচ্চারিত হচ্ছে।’

উইন্টার আদেশ দিলেন–‘খোলা তরোয়াল, মন্টজয়ে এন্ড ডেনিস, মন্টজয় এন্ড সেন্ট ডেনিস।’ ধ্বনিত হল চারশো কণ্ঠে, চারশো তরবারি ঝিলিক দিয়ে উঠল ভোরের সূর্যের আলোয়।

‘সামনে এগোও’–দ্বিতীয় আদেশ এল।

কিন্তু কোথায়? অশ্বারোহী সৈন্য দল পাথরের মসর্তির মতো অচল।

অ্যারামিসের কানে কানে অ্যাথোস বলল–‘ওই দেখ বিশ্বাসঘাতকতা কাকে বলে,’ ততক্ষণে রাজা চমকে ফিরে দাঁড়িয়েছেন, উইন্টার ক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ স্বরে গর্জন করে উঠেছেন–‘যারা ভগবানকে ভালবাস দেশকে ভালোবাস, রাজাকে যারা ঈশ্বরের এবং পিতৃভূমির জীবন্ত প্রতিনিধি বলে মানো, এগিয়ে যাও তারা।’

এবারে তারা এগিয়ে গেল, কিন্তু সারি বেধে না, একদিকেও না, যে। যেভাবে খুশি ঘোড়া ছুটিয়ে এক একজন বিস্তীর্ণ মাঠের এক একদিকে হাওয়ার মতো উধাও হলো, সেনাপতির আদেশ যাতে আর কানে না যেতে পারে সেইজন্য।

উইন্টারের পায়ের নিচে থেকে মাটি যেন সরে গেল, ‘বেঈমান’ একটা চাপা গর্জন ছাড়া তার মুখ থেকে আর কোনো কথাই বেরুলো না। অ্যাথোস লক্ষ্য করল–মাত্র পনেরোজন অশ্বারোহী তখনও উইন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

রাজা তরোয়াল ঘুরিয়ে চিৎকার করে বললেন–‘কিছু যায় আসে না। সংখ্যা যত কম হবে, গৌরব তত বেশি হবে, ওই আসছে ক্রমওয়েলের সৈন্য, বন্ধুগণ ওই সৈন্যদের ভিতর দিয়ে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে।’

তখন অ্যাথোস, অ্যারামিস আর উইন্টারের অনুসারী ১৫ জন বিশ্বস্ত সৈনিক, মোট আঠারজন যোদ্ধা রাজা চার্লসকে চারদিক থেকে ঘিরে দাঁড়াল এবং উইন্টারের আদেশে আঠারজন অশ্বারোহীর সেই দল একটা সুচের মতো ছুটে গেল শত্রু সৈন্যের উদ্দেশ্যে। তীব্রগতি, প্রচণ্ড আঘাত, ঘোড়ার

ডাক, রক্তমাখা তরোয়ালের ঝলকানি, একটা গুলি এসে লাগল উইন্টারের বুকে, একটা হাসির শব্দ শোনা গেল শত্রুসৈন্যের পিছন থেকে।

উইন্টার ঘোড়া থেকে পড়তে পড়তেও লক্ষ্য করলেন তার আততায়ী সেই মর্ডন্ট, মিল্যাডির ছেলে।

একদিকে সতেরোজন যোদ্ধা অন্যদিকে সতেরো শত। একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ড চলছে রাজার চারপাশে, অ্যাথোস আর অ্যারামিসকে ধরাশায়ী করার জন্য তরবারি উঠছে অনেক, কিন্তু রাজার গায়ে কেউ আঘাতের চেষ্টা করছে না, রাজা বুঝলেন ওরা তাকে বন্দি করতে চায়, কিন্তু তা তিনি হতে দেবেন না, মৃত্যুকেই বরং বেছে নেবেন, যেমন করে বেছে নিয়েছেন তার শেষ ইংরেজ বন্ধু উইন্টার। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে একবার এ সৈনিকের কাছে আবার ঘোড়া ছুটিয়ে ও সৈনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লাগলেন হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে, কিন্তু না, কেউ তার সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, প্রত্যেকেই সরে যাচ্ছে তার সামনে থেকে।

কিন্তু অন্যরকম অবস্থা অ্যাথোস আর অ্যারামিসের। প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়েও এই দুই যোদ্ধা আর বুঝি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। মৃত্যু তাদের এগিয়ে আসছে। ওই শত্রুর তরবারি নামছে।

হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে দুটো প্রকাণ্ড ঘোড়া শত্রু সৈন্যের পিছন থেকে সামনে ছুটে এলো নিজের দলের সৈন্যদের চাপা দিয়ে। অ্যাথোস ও অ্যারামিসকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে হটিয়ে দিল, তারপর একজনে অ্যাথোসকে, হামলাকারীদের অ্যারামিসের ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল ‘আত্মসমর্পণ কর। আত্মসমর্পণ কর। নিচু গলায় বলল–‘আমায় চিনতে পারছ না?

হুশ ফিরে পেয়ে অ্যাথোস সবিস্ময়ে বলল–‘দ্যার্তেগা!’

অ্যারামিস বলল–‘পোর্থস!’

তারা দুজনেই শুধু বলল–‘চুপ আমরা তোমাদের অপরিচিত।’

.

৬.

দুই ঘণ্টা পরে।

নিউক্যাসল দুর্গের একটি রুমে ক্রমওয়েল বসে যুদ্ধের বিবরণ শুনছেন। বিবরণ দিচ্ছে সেই মর্ডন্ট।

আক্রমণের আদেশ দিয়ে ক্রমওয়েল অন্য কাজে চলে যেতে বাধ্য। হয়েছিলেন, যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। রাজা হয় বন্দি হবেন না হলে মারা যাবেন এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন তিনি। কাজেই নিজে যুদ্ধের শেষ দেখার জন্য উপস্থিত থাকার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি।

তাই মর্ডন্ট সব কথা তাকে শোনাচ্ছে।

‘রাজা আত্মসমর্পণ করেছেন।’

‘কার হাতে তরোয়াল তুলে দিলেন?’ প্রশ্ন ক্রমওয়েলের।

‘কারও হাতেই না, হাঁটুতে রেখে ভেঙে ফেলে দিলেন।’

‘তা খারাপ করেননি, তবে না ভেঙে ওটা নিজের উপকারে লাগাতে পারতেন। আর সেটি করলেই সকলের পক্ষে ভালো হত।’

মর্ডন্ট বলল—’আপনি বলতে চাইছেন–রাজা নিজের বুকে বসিয়ে দিতে পারতেন ওটা।’

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ক্রমওয়েল জিজ্ঞাসা করলেন–‘আর কোনো বিশেষ ব্যক্তি মারা গেছেন?’

‘লর্ড উইন্টার।’

‘লর্ড উইন্টার? তোমার কাকা?’ ও মর্ডন্টের এই বলে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন ক্রমওয়েল-দিকে।

‘আমার চাচা বলেও তাকে আমি রেহাই দিতে পারি না, সে যখন পার্লামেন্টের শত্রু।’

‘তা তো বটেই।’ মাথা নাড়েন ক্রমওয়েল।

মর্ডন্ট হঠাৎ বলে—’মালিকের কাছে একটা প্রার্থনা আছে আমার। চার্লস স্টুয়ার্টের দলে শেষ সময়ে দুজন ফরাসি নাইট এসে যোগ দিয়েছিল। আমার কাকা এনেছিল তাঁদের ফ্রান্স থেকে, তারা আজকের যুদ্ধে বন্দি হয়েছে। ওই বন্দি দুজনকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, এই প্রার্থনা—’

‘কে তাদের বন্দি করল?’ ক্রমওয়েল একটু আপত্তি তুললেন। যে বন্দি করবে তার অধিকার থাকবে বন্দির ওপর, এ পুরান নিয়ম আমি পালটাই কী করে?

‘আপনার কাছে বিশেষ অনুগ্রহ চাইছি আমার এতদিনের সেবার বিনিময়ে।’

‘ওরা খুব ধনী বুঝি? মোটা রকম মুক্তিপণ পাবার আশা করছ?’ ক্রমওয়েলের মুখে পরিহাসের হাসি।

‘ঠিক ধরেছেন–আমি যে গরীব তা তো জানেনই।’

‘বিশেষ অনুগ্রহ হিসাবে এইটিই যখন তুমি প্রার্থনা করছ এও সত্য যে তুমি কখনও কিছু চাওনি-বেশ, নিতে পার তুমি বন্দি দুজনকে যা ইচ্ছা করতে পার তাদের নিয়ে।’

‘যা ইচ্ছা করতে পার’–কথাটার ওপর একটি বেশি জোর দিয়ে রহস্যপূর্ণ চোখে ক্রমওয়েল একবার চাইলেন মর্ডন্টের দিকে, কি সে করতে চায় তা অনুমান করতে পেরেছেন তিনি। মর্ডন্ট ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।

আসল কথা হলো প্যারিসে যখন সে ছিল, উইন্টারের চলাফেরার ওপর তীক্ষ্ণ চোখ সে রেখেছিল। উইন্টারের সঙ্গে দেখেছে অ্যাথোসকে, খোঁজ নিয়ে নামও জেনেছে তার।

আবার তার আগে বেথুনের ঘাতকের স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে জেনেছে তার মায়ের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে উদ্যোক্তা ছিল অ্যাথোস, পোর্থস, অ্যারমিস ও দ্যার্তেগা নামের চার ফরাসি সৈনিক।

এখন সেই অ্যাথোসকে সে দেখেছে তারই অধীনে দ্যার্তেগার বন্দিরূপে। চিনেছে অ্যাথোসকে। মায়ের হত্যাকারী বলেই চিনেছে, প্রতিহিংসা নেবার এই সুযোগ, তারই জন্য বন্দিদের নিজের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসার এই প্রয়াস।

অ্যারামিস, পোর্থস বা দ্যার্তেগাকে প্যারিসে দেখেনি–তাদের নামও জানে না এখন পর্যন্ত, ম্যাজরিন যখন দ্যার্তেগা আর পোর্থকে ক্রমওয়েলের সেবা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন মর্ডন্টের কাছে, দ্যার্তেগাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে জটিলতা এড়িয়ে চলার পথ খোলা রাখার জন্য ছদ্ম নামে নিজের ও পোর্থসের পরিচয় দিয়েছে।

কাজেই মর্ডন্ট মায়ের হত্যাকারী বলে নিঃসন্দেহে চিনেছে এবং অ্যাথোসকেই তার সঙ্গী বন্দি হয়তো পোর্থর্স বা অ্যারামিস বা দ্যার্তেগা হতেও পারে। কাজেই সঠিক চিনতে না পেরেও তাকে অ্যাথোসের সঙ্গে যমালয়ে পাঠাতে সে রাজী, কিন্তু দ্যার্তেগা ভাবে পোর্থসকে সে সন্দেহ করে না, ওরা যে মিল্যাডির হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, এমন কথা তার মাথায় খেলেনি।

আটজন সৈন্য নিয়েই সে বেরুলো, দ্যার্তেগা পোর্থসের জন্য নিউক্যাসেল শহরে একটি বাসস্থান দিয়েছেন ক্রমওয়েল। এটা শুধু ম্যাজারিনের দূতকে সম্মান দেখানোর জন্য।

এই বাসস্থানেই তারা বন্দি অ্যাথোস আর অ্যারামিসকে এনে তুলেছে, ঘরের ভেতর বসে চার বন্ধুতে আলোচনা হচ্ছে। অ্যাথোস বলছে, রানী হেনরিয়াটার অনুরোধে কীভাবে তাকে ও অ্যারামিসকে চলে আসতে হয়েছিল লর্ড উইন্টারের সঙ্গে, রাজা চার্লসের বিপদের দিনে তার সাহায্যের জন্যে, এদিকে দ্যার্তেগা জানাচ্ছে ম্যাজারিন কীভাবে ক্রমওয়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ঘনিষ্ট করে তুলার জন্য তাকে ও পোর্থসকে পাঠিয়েছিলেন মর্ডন্টের কাছে, বিশেষ রাজদূতের মর্যাদা দিয়ে। অ্যাথোস জিজ্ঞাসা করে ‘তোমাদেরকে মর্ডন্ট চেনে?’

‘বোধহয় না, কিন্তু আমরা তাকে চিনি, মর্ডন্টের নাম আমাদেরকে গ্রিমড জানিয়েছে। উত্তর দিল দ্যার্তেগা।

পোর্থস ক্ষোভের সঙ্গে জানাল–‘লোকটাকে দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে, গলাটা চেপে ধরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে, অথচ ভাগ্যের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে এই মর্ডন্ট হয়েছে কর্নেল, আর আমরা যেহেতু অলস হয়ে বসে না থেকে যুদ্ধ করতে চেয়েছি, কাজেই আমরা কর্নেল মর্ডন্টের অধীনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। এ জানলে যুদ্ধ করার কথা মুখেও আনতাম না।’

ঠাট্টা করে অ্যারামিস বলল–‘আরে ভাই, যুদ্ধ করতে চেয়েছিলে বলে আমাদের প্রাণটা বাঁচাতে পারলে, বিশেষ রাজদূত সেজে চেয়ারে বসে থাকলে আমরা এতক্ষণে…’ খটাখট, খটাখট, অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দে কথা থেমে গেল তার।

লাফিয়ে উঠে দরজার বাইরে চলে দ্যার্তেগা।

ঘোড়া থেকে নামছে মর্ডন্ট, বেশ খুশী দ্যার্তেগা–‘আরে কর্নেল, ডিনারটা কি দয়া নামী দামি লোক,’ একটু হেসে গলা নামিয়ে দ্যার্তেগা আবার বলে, ‘মোটা দাও মিলে গেছে কর্নেল, এক একজন এক এক হাজার। পাউন্ড মুক্তিপণ তো দেবেই।‘

বিরক্ত ভরে মর্ডন্ট বলল–‘কিন্তু ক্রমওয়েল আমাকে ওই বন্দি দুজনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই পাঠালেন।’

এটা গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিল দ্যার্তেগা, তবে সে জানে, ক্রমওয়েলের কোনো আগ্রহ এই বন্দিদের সম্পর্কে থাকতে পারে না, আগ্রহ থাকতে পারে এবং প্রবলভাবে রয়েছে ওই মর্ডন্টেরই, এখন সে যেন আকাশ থেকে পড়ল মর্ডন্টের কথা শুনে বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য? সে কি? ওরা তো আমাদের বন্দি, সব সভ্যদেশে এই নিয়ম যে যাকে বন্দি করেছে সেই বন্দির মালিক হবে। মহান ক্রমওয়েল, যার মতো বিজ্ঞ শাসক বা দক্ষ যোদ্ধা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই, তিনি কখনও ফরাসি দেশের বিশেষ রাজদূতদের ওপর এরকম অন্যায় আদেশ দিতে পারেন না।

‘অন্যায় আদেশ কিসে হলো?’ রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলেই তিনি এদের নিজের হেফাজতের ভেতরে এনে নিরাপদে রাখতে চাইছেন।

‘তা অবশ্য খুব স্বাভাবিক। মিষ্টি স্বরে বলে দ্যার্তেগা। কিন্তু কর্নেল আপনি তো বিবেচক লোক, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের পাপ্য টাকাটা না পেলে আমরা কি করে বাঁচি? সৈনিক বৃত্তি গৌরব বৃত্তি হলেও সৈনিকদের আর্থিক দুরবস্থাও আপনার অজানা নেই, কারণ আপনি নিজে একজন বিখ্যাত সেনাপতি, আমাদের বন্দি দুজনকে আপনি নিয়ে যান তাতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু মুক্তিপণ দু’হাজার পাউন্ড আমরা পেতে চাই।’

‘বেশ পাবেন দু’হাজার পাউন্ড। আমি কথা দিচ্ছি, এখন লোক দুটোকে এনে দিন।’ মর্ডন্ট আর রাগ চেপে রাখতে পারে না।

‘আচ্ছা, কর্নেল এখনও তো মহান ক্রমওয়েলের লিখিত আদেশ পত্রটা দেখালেন না।’

‘লিখিত আদেশ?’–এবার সত্যি সংযম হারায় মর্ডন্ট—’আপনি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছেন?’

জিভ কামড়ে সবেগে বারবার মাথা নাড়াতে লাগল দ্যার্তেগা এমন পাপ আমি করতে পারি? সব কাজেরই একটা রীতি পদ্ধতি আছে, এই বন্দিদের নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে–আপনিই তো বলছেন–সেক্ষেত্রে এদের যে আমরা আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি, মহান ক্রমওয়েলের আদেশ মতো তারও একটা দলিল থাকা চাই, না থাকলে, ভবিষ্যতে আমরা বেচারীরা শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়ে যেতে পারি। না, না, লিখিত আদেশ পত্র না পেলে আমরা বন্দিদের ছাড়তে পারি না।’

ক্রোধে গর্জন করে মর্ডন্ট বলে–‘আমি কেড়ে নিয়ে যাব ওদের, দেখছেন আমার সঙ্গে আটজন সৈনিক?’

‘এ হে হে হে।’ দ্যার্তেগা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ে–‘আপনি কেন যে এমন অবুঝ হচ্ছেন, আদেশ পত্রটা নিয়ে আসেননি, নিয়ে আসুন গিয়ে, কতক্ষণের ব্যাপার আপনার জুলুমবাজি প্রতিরোধ করতে বাধ্য হব, লড়াই হবে, আপনারা নয়জন আছেন, আমরা মাত্র দুজন, সুতরাং আমরা মারা পড়ব সন্দেহ নেই। কিন্তু ফরাসি দেশ যে দেশের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করার জন্য আপনাকে যেতে হয়েছিল, প্যারিসে তার বন্ধুত্বের প্রতিদান আপনি যদি এভাবে দেন ফ্রান্সের রাজদূতের মস্থক কেটে ফেলে সেটা কি ম্যাজারিনই ভালো চোখে দেখবে–বোকা সে মোটেই নয়, দ্যার্তেগার কথায় সে মনে মনে স্বীকার করল, ঠাণ্ডা মেজাজে বলল–তাহলে এখানে আমার সৈনিকেরা রইল, আমি যাচ্ছি। আধঘন্টার ভেতরেই নিয়ে আসি আদেশ পত্র।’

যোগ করে দেয়, দ্যার্তেগা। আর তার সঙ্গে দু হাজার পাউন্ড।

সে কথার উত্তর দেয় না মর্ডন্ট, দুর্গের দিকে সে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় দ্যার্তেগা, সারাবাড়িটা ঘিরে বসে থাকে আট জন সৈনিক, সতর্ক প্রহরায়।

ভেতরে বসেই, অ্যাথোস কান পেতে শুনেছে।

অ্যারামিস বলে, ‘মর্ডন্টের মতলবটা পরিষ্কার, বেথুনের ঘাতকের কাছেই আমাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’

অ্যাথোস জিজ্ঞাসা করে দ্যার্তেগাকে–‘পালাবার উপায় কিছু আছে নাকি?’

‘আছে বইকি? বজ্জাতি বুদ্ধি মর্ডন্টের একচেটিয়া নয়। দ্যার্তেগাও শিশু নয়, আমি একবার আস্তাবল ঘুরেয়ে আসছি।’

আস্তাবলে গিয়ে চাকরদের ডাক দিল দ্যার্তেগা, মস্কটন আর তার পোর্থসের সঙ্গেই এসেছিল, মিড আর ব্রেইসিরস ছিল অ্যাথোসের সঙ্গে রাজ শিবিরে যুদ্ধের পরে তারা এখানে এসে অ্যাথোসের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

প্রহরী সৈনিকদের শুনিয়ে শুনিয়ে জোর গলায়, দ্যার্তেগা বলতে থাকে। মাস্কেটন। গ্রিমড। ব্রেইসিরস! খুব ভালোই হয়েছে। বন্দিদের বাড়ি থেকে কবে মুক্তিপন আসত, কিছু ঠিক ছিল না, এখন আর তার জন্য আমাদের হাঁ করে বসে থাকতে হবে না, কর্নেল মর্ডন্ট নিজে আমাদের দুই হাজার পাউন্ড দিয়ে দিচ্ছেন, তিনি এখনি টাকাটা এনে দিবেন, টাকাটা পাওয়া মাত্র আমরা নিজের দেশের পথ ধরব। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে এক্ষুণি সাজিয়ে নিয়ে এস বাইরে। বন্দিদের ঘোড়া দুটোও আনো। কারণ তারাও যাবেন কর্নেল মর্ডন্টের সঙ্গে, একসাথে বেরুবো সবাই।

তারপর দ্যার্তেগা আবার ঘরের ভেতর এল, চুপি চুপি বলল–‘এক্ষুণি ঘোড়া নিয়ে চাকরেরা বাইরের দরজায় আসবে, তোমরা তৈরি হয়ে থাক, অ্যাথোস আর অ্যারামিস আবার তরোয়াল বেঁধে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি, যখন শুনবে আমি ‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছি, তখন তোমরা একসাধে ছুটে বেরুবে।’

আবার আস্তাবলে ঢুকল দ্যার্তেগা, প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল, আর দেরি করা চলে না। কর্মচারীরা প্রস্তুত। দ্যার্তেগার ইশারায় তারা ছয়টা ঘোড়া সাজিয়ে নিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। তিনটিতে তারা চড়ে রয়েছে। অন্য তিনটির লাগাম হাতে ধরা। আস্তাবলে শুধু দ্যার্তেগা আর তার নিজের ঘোড়াটি, প্রহরী সৈনিকদের ঘোড়াগুলোকেও তারা এখানে অবশ্য বেঁধে রেখেছে।

এক কোণে কর্মচারীরা আগুন জ্বালিয়ে ছিল, সেখান থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা তুলে তারে জড়িয়ে নিল দ্যার্তেগা, তারপর তার সহ কয়লার টুকরা হাতে নিয়ে সে ঘোড়ার লাগাম ধরে বাইরে এলো, গেটের সামনে প্রহরীরা জমায়েত হয়ে আছে আটজন, আর একটু সামনে গ্রিমড, মাস্কেটন প্রস্তুত রয়েছে নিজেদের ঘোড়া নিয়ে।

দ্যার্তেগা প্রহরীদের সামনে আবার আগেই ঘোড়ায় উঠে পড়ল, তারপর সকলের অজান্তে হাতের সেই জ্বলন্ত কয়লা ঢুকিয়ে দিল নিজের ঘোড়ার কানের ভেতর, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ঘোড়াটা, আর পেছনের পায়ে খাড়া হলো। একবারে দ্যার্তেগার মতো দক্ষ আরোহী না হলে সে অবস্থায় কেউ ঘোড়ার পিঠে ঠিকমতো বসে থাকতে পারে না। দ্যার্তেগা পায়ের প্রবল চাপ এবং হাতের তেমনি শক্তিশালী চাপ দিয়ে তাকে আবার চার পা মাটিতে নামাতে বাধ্য করল বটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এমন কৌশলে জুতোর স্লাম দিয়ে তার পেটে গুতো দিল যে ঘোড়াটা পাগলের মতো ঘুরপাক খেতে খেতে প্রহরীদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। এই হঠাৎ উৎপাতে যেন আহত হতে না হয়, এজন্য প্রহরীরা তাড়াতাড়ি পিছু সরে গেল, এমন সময় দ্যার্তেগা যেন ঘোড়ার কাণ্ড কারখানায় ভয় পেয়েই আর্তনাদ করে উঠল–‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ বলে। ঘোড়ার কানের ভেতর তখনও আগুন জ্বলছে, ঘোড়াটা তখনও পিছনের পা তুলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সে যদি কারও গায়ের উপর দিয়ে পড়ে এই ভয়ে প্রহরীরা ক্রমশ আরও পিছনে সরে যাচ্ছে, এমন সময়ে ঘরের ভেতর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো—’পোর্থস, অ্যাথোস এবং অ্যারামিস।’

প্রহরীদের চোখ তখনও দ্যার্তেগার ঘোড়ার দিকে, বন্দিরা পালাচ্ছে এটা তারা লক্ষ্য করার আগেই পোর্থর্সরা প্রায় দ্যার্তেগার কাছে চলে এসেছে। তখন প্রহরীরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল, ‘বন্দিরা পালাচ্ছে, ধর ধর’ এবং এক সাথে ছুটে এসে পথ আটকে দাঁড়াবার চেষ্টা, কিন্তু সামনে বাধা হয়ে আছে দ্যার্তেগা, এখন তার ঘোড়া আর লাফাচ্ছে না, কারণ কাউকে না দেখিয়েই দ্যার্তেগা আগুনটা বের করে ফেলেছে তার সহ, ঘোড়া লাফাচ্ছে না এবং দ্যার্তেগার দুই হাতে দুই পিস্তল, প্রহরীরা পিস্তল নিয়ে আসেনি, সুতরাং যে এগুবে, তার নিশ্চিত মৃত্যু।

পোর্থস, অ্যাথোস, অ্যারামিস ছুটে এগিয়ে গিয়েছে, উঠেছে গিয়ে নিজের নিজের ঘোড়ায়। এবার দ্যার্তেগা নিজের ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল, তখন প্রহরীরাও ছুটে এল, কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চড়া ছুটন্ত পলাতকদের পিছু ধাওয়া পায়ে হেঁটে যায় না। তারা ছুটল আস্তাবলে, ঘোড়া নিয়ে আসার জন্য। ঘোড়া আনবে তাতে উঠবে, তারপর পিছু নেবে, সে এখন অনেক দূর। এদিকে দ্যার্তেগারা বাতাসের বেগে ছুটছে।

.

৭.

এই তো জীবন–এই তো আনন্দ। এই তো ফুর্তি।

নিজের স্বাধীনতা নিজের হাতে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি, পিছনে পড়ে আছে নিষ্ঠুর খুনী, সামনে খোলা পৃথিবী আর স্বাধীনতা।

সাতটা ঘোড়ার বেগে ছুটছে নিউক্যাসল থেকে এসে। এদের মাথায় এখনও আসছে না রাস্তায় কোনো লোকজন নেই, যদিও সর্বসাধারণ এ পথ ব্যবহার করে না, যুদ্ধের ভয়ে পালিয়েছে লোকজন? হয়তো তাই হবে।

অনুসরণ করেনি মর্ডন্ট। টিলার মাথায় উঠে মাঝে মাঝে ওরা পিছন ফিরে দেখেছে। নিউ ক্যাসল পর্যন্ত উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো পথের কোথাও শত্রুর কোনো চিহ্ন নেই। এরই বা মানে কি?

ঘোড়ার রশি আলগা দিল ওরা। শত্রুর দেশ এই স্কটল্যান্ড, তবু কি সুন্দর। যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন যদি ভুলে যাওয়া যেত। সত্যি কথা, চার বন্ধু পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে ঠিক বিশ বছর আগের মতো, কেমন যেন বিস্ময় লাগে, মাঝে এতগুলো দিন তাদের রোজকার সমস্যা নিয়ে এসেছে, গিয়েছে এ যেন বিশ্বাস করাই কঠিন মনে হয়।

বিকাল নাগাদ ওরা একটা বনভূমিতে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলো ঘাস খেতে লেগে গেল। তাই দেখে পোর্থস পোর্টের উপর হাত দিয়ে একটা চড় মেরে বলল, তাই তো, এখন আমরা খাই কি? ডিনারের বেলা যে যায়।

অ্যারামিস প্রতিবাদ করে ‘ডিনারের আবার বেলা অবেলা কী, যখন জুটবে তখনই বেলা। এখন যখন জোটেনি, তখন এটা অবেলা।’

মন্তব্য করে দ্যার্তেগা ‘এটা খুব জ্ঞানের কথা, সুতরাং ডিনারে যাওয়ার কথা নিয়ে বাজে আলোচনা না করে, এসো কাজের কথা বলি, সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর কত দূরে হতে পারে, সে ধারণা কারও আছে?’

না সে ধারণা কারও নেই।

অ্যাথোস শুধু বলে–‘সমুদ্র বন্দরের কথা তুলছ, তোমরা কি তাহলে ফ্রান্সে ফিরে যেতে চাইছ?’

আকাশ থেকে পড়ল দ্যার্তেগা–‘আমরা না তোমরা? ফ্রান্সে ফিরে যেতে চাইছ সেটা ঠিক। কারণ ফ্রান্স ছাড়া আর কোথায় যেতে চাইব? যেতে চাইছি ঠিকই, কিন্তু যাওয়াটাই তো শক্ত।’

তাহলে বিদায় বন্ধু দ্যার্তেগা, বন্ধু পোর্থস এবং ধন্যবাদ তোমরা যে উপকার করেছ, তা তোমরা ছাড়া আর কেউ করতে পারত না, যুদ্ধে আমার আর অ্যারামিসের প্রাণ যাওয়া অনিবার্যই ছিল, সে প্রাণ বাঁচিয়েছ তোমরা। এখন আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকা আমাদের কোনো লাভ তো নেই, তোমরাও পদে পদে অসুবিধায় পড়বে আমরা সঙ্গে থাকলে, সুতরাং যা বলেছি বিদায়।

‘দ্যার্তেগা আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। অ্যাথোস এসব কি পাগলামি করছ? তোমরা কি একেবারে দেশ ত্যাগ করে এসেছ নাকি?’

‘অ্যাথোসের ঠোঁটে একটু করুণ হাসি খেলে যায়–না দেশ ত্যাগ করে আসিনি এবং ত্যাগ করব না কোনো দিনও। কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করে দেশ থেকে বেরিয়েছি, সে প্রতিজ্ঞা পালন না করেও ফিরতে পারি না।’

‘প্রতিজ্ঞা? মানে রাজা চার্লস এর সাহায্য? অন্ধকার হয়ে আসে দ্যার্তেগার মুখ–সে প্রতিজ্ঞা রাখার জন্য তোমরা কি যথাসাধ্য চেষ্টা করনি? বারবার নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছ ওই রাজার সেবা করতে গিয়ে, তিনি এখন তোমাদের সেবার বাইরে চলে গিয়েছে, তোমরা আর কি করতে পার শুনি?’

আপন মনেই যেন স্বগতোক্তি করে অ্যাথোস–‘রাজাকে উদ্ধার করতে পারি।’ চমকে উঠে দ্যার্তেগা! পোর্থসও ওঠে। অ্যারামিসও। যুক্তি বুদ্ধির ধার না ধেরে সম্ভব অসম্ভব বিবেচনা না করে। নিছক ভাবাবেগের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়া যে কত বড় ঝকমারি, তা অ্যাথোসের সহকর্মী বন্ধুরা আগে বহুবারই অনুভব করেছে, কিন্তু পুরো বিশ বছর কেটে যাওয়ার পরও অ্যাথোসের মনোবৃত্তি সেই ডন কুইক্সেটের এক গুয়ে গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এমনটা দেখাবার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না।

কয়েক মিনিট নীরব থাকার পরে দ্যার্তেগা কষ্টের হাসি হাসে খানিকটা। রাজাকে একটা পুরো রেজিমেন্ট ঘিরে রেখেছে। সেই ঘেরাওর মধ্যে দিয়ে রাজাকে উদ্ধার করে আনা…

‘হয়তো সত্যিই অসম্ভব। দ্যার্তেগার কথা শেষ করে অ্যাথোস। বিশ বছর আগে হয়তো অসম্ভব ছিল না, কারণ তখন আমরা চারজন ছিলাম, এখন মাত্র দুইজন।’

দ্যার্তেগার মুখে চাবুকের মতো এসে লাগল ওই তিরস্কার। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না, কিন্তু পোর্থ সরল উদার পোর্থস হাত বাড়িয়ে অ্যাথোসের হাত চেপে ধরল—’কে বলে দুজন?’

‘আমরা চিরদিন চারজন ছিলাম, এখনও চারজন, মনে নেই আমাদের যৌবনের সেই মিলন মন্ত্র একে চার চারে একই’ ম্যাজারিন বা আমাদেরকে আর ক্রমওয়েলেই বা আমাদেরকে। তবে অ্যাথোস যদি আমাদের ডাকে তবে… পৃথিবীর হাতে এমন কোনো প্রলোভন নেই, যা দিয়ে সে আমাদের পিছু টেনে রাখতে পারে।

দ্যার্তেগা এগিয়ে এসে অন্য হাত ধরল অ্যাথোসের। পোর্থর্স ঠিকই বলেছে সারা পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যার আকর্ষণ আমাদের অ্যাথোসের থেকে দূরে টেনে রাখতে পারে। ওই মিলন মন্ত্র যেমন বিশ বছর আগে সত্য ছিল, আজও তেমনি আছে, একে চার চারে এক।

তখন সে কি কোলাকুলি গলাগলি, চার বন্ধুতে মিলে, অ্যাথোস আবেগ জড়িত স্বরে বলে ‘বন্ধুগণ! আমি জানি একাজ আমার পক্ষে অমার্জনীয় স্বার্থপরতা হচ্ছে নিজের নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার নিজস্ব ব্যাপারে তোমাদের সকলকে টেনে নিয়ে যাওয়া, তোমাদের উপর দাবি আছে বলেই তা করতে পারছি, কেন করছি তা বলা উচিত। আমি ভুলতে পারি না, রানী হেনরিয়েটার সেই কাতর অনুরোধ তার স্বামী এরকম মারাত্মক সংকটে উপস্থিত হতে পারে আশংকা করেই তিনি আমাদের সাহায্য ভিক্ষা চেয়েছিলেন। আমি আর অ্যারামিস মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলাম যে সাহায্য আমরা করব।’

‘স্বীকার করছিলাম বই কী?’ দৃঢ় স্বরে সায় দিল অ্যারমিস।

অ্যাথোস কৃতজ্ঞভাবে তার দিকে মাথা নেড়ে আবার বলতে থাকে, দ্যার্তেগা পোর্থস কে সম্বোধন করে। আজ সেই সময় এসেছে, রানী হেনরিয়েটার সবচেয়ে মর্মান্তিক আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। রাজা চার্লস বন্দি, তার জীবন শত্রুর হাতে বিপন্ন। একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর উইন্টার মৃত। এই সময়ে বন্ধুহীন বন্দি রাজাকে ত্যাগ করে দেশে চলে যাওয়া কি মানুষের কাজ? আমি যদি সে কাজ করি, হেনরিয়েটাকে গিয়ে কি বলব আমি? আমি আর অ্যারামিস? এই কথাই কি বলব যে রাজা বন্দি হওয়ার পর আমাদের আর করার কিছু ছিল না বলেই আমরা চলে এসেছি, এটা জানা কথা এখন তারা রাজাকে হত্যা করবে, আর তা দাঁড়িয়ে দেখার জন্য আমরা লন্ডনে বসে থেকে করব কি?

দ্যার্তেগা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—’না বন্ধু, ঠিকই বলেছ তুমি, পরে গিয়ে হেনরিয়েটাকে ‘পারলাম না কিছু করতে’ বলার সময় এখনও আসেনি, এখনও চেষ্টা করার অনেক কিছু আছে। কাজ কীভাবে শুরু করা যায়, সেটা সবাই মিলে ভেবে দেখি।’ পোর্থস তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কাজ আরম্ভ করা উচিত ডিনার দিয়ে। সকালের খাবারটা মারা গেল ওই মর্ডন্টের উৎপাতে, তৈরি খাবার খেয়ে আসা গেল না, লাঞ্চের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ লাঞ্চের সময়টা ঘোড়ার পিঠেই কেটেছে, কিন্তু ডিনার? এখন তো আর পালাচ্ছি না। সুতরাং খেয়ে নিতে অসুবিধা কি?

দ্যার্তেগা জবাব দেয় বিমর্ষভাবে, ‘অসুবিধা সামান্যই, কিন্তু মারাত্মক। সেটা এই যে ডিনারের কিছুই সঙ্গে নেই, পালাবার তাড়ায় আমরা খাবার আনতে পারিনি কিছুই।’

একথা হঠাৎ কেউ বিশ্বাস করতে রাজী হয় না, মাস্কেটন এবং গ্রিমডের মতো এক জোড়া পোড় খাওয়া পুরাতন চাকর সঙ্গে থাকতেও তারা পালাবার সময় কিছুমাত্র খাবার সঙ্গে আনেনি। এটা যেন বিশ্বাসের অযোগ্য মনে হয়। কিন্তু প্রত্যেকের কাছে যাচাই করে যখন জানা গেল যে দ্যার্তেগার সন্দেহ ষোলো আনা সৎ। তখন হতাশ ভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল ওরা যে খাবারের খোঁজে তাহলে বন ছেড়ে বের হওয়া দরকার।

বনের বাইরে একটা মাঠ, মাঠের ওপারে আবার বন। সেই বনের আড়ালে যে একটা সাদা বাড়ি আছে, এটা মস্কেটন আবিস্কার করল।

বাড়ি যখন আছে, সেখানে মানুষও আছে এবং খাবারও আছে, সুতরাং কষ্ট করে এই মাঠটুকু পেরুতেই যা দেরি। তারপরই তো ডিনারের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে।

চার বন্ধু তিন চাকর এবং সাতটা ঘোড়া-এই চৌদ্দটি ক্ষুধার্ত প্রাণী বাড়িটার দিকে ছুটে চলল—সেই সাদা ছোট বাড়িটার দিকে।

মাঠ পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে বাড়ি।

বাড়িটার এটা পিছন দিক। ওরা ঘুরে সামনের দিক দিয়েই ঢুকবে স্থির করল। কারণ পিছন দিক দিয়ে যারা ঢোকে, তাদের চট করে চোর ডাকাতের পর্যায়ে ফেলে দেবার একটা বদ অভ্যাস সাধারণত মানুষের থাকে।

কী কাণ্ড, বাড়ির সামনেই যে চওড়া রাস্তা, এ দেখে অ্যাথস মন্তব্য করে এই তাহলে লন্ডন-নিউক্যাসল রাজপথ। নিজেদেরকে যতটা নিরাপদ ভাবা যাচ্ছিল ততটা আমরা নই তাহলে।

দ্যার্তেগা রাস্তার ধুলোর দিকে তাকাচ্ছিল, দেখে বলল–আপাতত বোধহয় নিরাপদ আমরা। বিপদ যাদের দিক থেকে আসতে পারত তারা কিছুক্ষণ আগেই লন্ডনের দিকে যাত্রা করেছে। এই দেখ অসংখ্য ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন। সব লন্ডনের দিকে।

অ্যাথোসের মুখে নীরব জিজ্ঞাসা ‘তবে কি?’

তাই নিশ্চয়ই। এ হলো হ্যারিসনের সৈন্যদল। শুনেছিলাম যে, ‘হ্যারিসন রাজাকে লন্ডনে নিয়ে যাবে।’

‘রাজাও তাহলে?’ অ্যাথোসের প্রশ্ন একটা আর্তনাদের মতো শোনায়। ‘হ্যাঁ রাজাও আছেন এদের সাথে। আমরাও ভিড়ে যাই ওই সৈন্যদলে। রাজার কাছাকাছি থাকতে তো পরবই তাছাড়া আরও এক লাভ আছে। মর্ডন্ট আজ হোক কাল হোক আমাদের সন্ধান করবেই, কিন্তু সে যতই চালাক হোক, এটা তার মগজে কখনই ঢুকবে না যে পলাতকরা পালিয়ে যায়নি। হ্যারিসনেরই বাহিনীর সঙ্গে মিলে মিশে লন্ডনের দিকে ধীরে সুস্থে সামনে এগুচ্ছে।’

‘কিন্তু বাড়িটার ভেতরে একবার গিয়ে ডিনারের একটা চেষ্টা করার কথা ছিল না? পেটের মধ্যে যে আগুন জ্বলে।’ এ বক্তব্য পোর্থসের। অ্যারামিস টিটকারী দিল–‘চল ঘুরে আসি একবার বাড়িটার ভেতরে। কিন্তু যে পথ দিয়ে একটা সৈন্যদল গিয়েছে, সে পথের পাশে কোনো বাড়িতে এক বিন্দু খাবার পড়ে থাকে, এমনটা আমি আগে কখনও দেখিনি।’

তবু অ্যারামিসই আগে বাড়ির ভেতর ঢুকল। দরজা খোলা, এটা সন্দেহজনক বাড়িতে লোক থাকলে দরজা বন্ধ থাকত।

যা হোক, খোলা দরজা দিয়ে ওরা একটা ছোট হল ঘরে ঢুকল। লোকজন নেই, যদিও অনেক লোক এখানে একটু আগে বসে ছিল, খেয়েছিল, তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে, হল পেরিয়ে ওরা আরও ভেতরে ঢুকল। এবার একজন লোক দেখতে পাওয়া গেল। সে দাঁড়িয়েও নেই বসেও নেই রুমের মেঝেতে শুয়ে আছে।

আর মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তের ঢেউতে।

লোকটা বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ, বেঁচে থাকলেও জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছে, নিস্পন্দন তার দেহ।

গ্রিমড এসে তার বুকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল, আছে। বেঁচে আছে। এখনও, জল পাওয়া গেল একটু খুঁজতেই। চোখে মুখে দিতেই সে চোখ মেলল।

লোকটার মাথা দুফাঁক হয়ে গিয়েছে, কোনো একটা ভারী জিনিসের আঘাত লেগেছিল বলে মনে হয়।

এরা সবাই মোটামুটি প্রাথমিক চিকিৎসা জানে, আহত লোকটির মাথায় পট্টি বেঁধে রক্ত মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের কথা বলল–রাজার ব্যক্তিগত ভৃত্য প্যারী আমার ভাই। এ বাড়ি আমার। রাজাকে বন্দি করে নিয়ে সেনাপতি হ্যারিসন এই পথ দিয়েই লন্ডনের দিকে গেল। প্যারী আছে রাজার সঙ্গে।

চোর ডাকাতের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এ বাড়িতে একটা গুপ্ত কুঠরি আমি তৈরি করেছিলাম। ওর ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে দুরবর্তী বনভূমিতে গিয়ে পৌঁছান যায়। প্যারী তা জানত। ওরই সুযোগ নিয়ে রাজকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা সে করতে চেয়েছিল। এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাব যার সময় প্যারী সেনাপতিকে অনুনয় করে বলে, এখান থেকে রাজাকে এক পেয়ালা কফি খাইয়ে নিতে চাই।

হ্যারিসন আপত্তি করল না। কারণ তার নিজেরও খাওয়ার দরকার ছিল, ভেতরে ঢুকেই প্যারী আমায় ইশারা করল। আমি সে ইশারা বুঝলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য প্যারীর ইশারা যে হ্যারিসনের চোখ এড়ায়নি, তা আমি বুঝতে পারিনি। হাত মুখ ধোয়ার অজুহাতে আমি রাজাকে পিছনের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ইচ্ছা ছিল ওখান থেকে রাজাকে গুপ্ত কুঠুরিতে ঢোকাব, আর এক মিনিট সময় পেলে ঠিকই ঢোকাতে পারতাম। কিন্তু সে সময় আর পেলাম না।

একটা ভয়ানক শক্তিশালী লোক পিছন থেকে আমাকে এমন এক ঘুষি মারল যে আমার মাথার তালু দু’ফাঁক হয়ে রক্তের স্রোত বেরুল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম জবাই করা পশুর মতো। বাড়ির মধ্যে যেন প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়েছে, জ্ঞান হারাতে হারাতে আমি টের গেলাম।

বিফল হয়েছে রাজাকে উদ্ধার করার প্রথম চেষ্টা। এক গরীব প্রজা চেষ্টা করেছিল রাজাকে উদ্ধার করার, সে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছেন কোনো রকমে। অথবা শেষ পর্যন্ত বাঁচবে কিনা, বলাও যায় না। সেবা করার কেউ রইল না।

বাড়িতে খাবার বলে কোনো বস্তু নেই। যা কিছু ছিল হ্যারিসর নিয়ে গিয়েছে। পোর্থসের ডিনারের আশা মিলিয়ে গেল।

আহত লোকটাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিয়ে খালি পেটেই দ্যার্তেগারা বিদায় নিল। ঘোড়া ছুঁটিয়ে গেলে বোধহয় সন্ধ্যার পরেই হ্যারিসনের সঙ্গে মিলিত হওয়া যাবে। অন্য সব বড় কারণ বাদ দিলেও মিলিত হওয়ার আসল কারণ হলো এটা যে, হ্যারিসনের বাবুচি খানা ছাড়া খাবার পাওয়া যাবে না এ পথে কোথাও। সৈন্যদল যে পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, সে পথের দু’পাশের যা খাবার, তারা ঝেটিয়ে তুলে নিয়ে যায়, এতো সবাই জানে।

হ্যারিসনের সঙ্গে তারা সত্যই সন্ধ্যার পরে মিলিত হল। দ্যার্তেগা পোর্থসকে দেখেছেন হ্যারিসন ক্রমওয়েলের দরবারে এবং মর্ডন্টের আশেপাশে তারা যে এখন এই সৈন্যদলের সঙ্গে মিলে লন্ডনের দিকে যেতে চাইবে, এটাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মনে হলো হ্যারিসনের ‘পিছিয়ে পড়ছিলে কেন? শুধু একবার মাত্র জিজ্ঞাসা করলেন।

দ্যার্তেগা উত্তর দিল, আর বলেন কেন? আমাদের এই বন্দি দুজনের জন্য। ওরা একবার আশা দিয়েছিল নিউক্যাসল থেকেই মুক্তিপনের ব্যবস্থা করে নিজেরাও মুক্তি নেবে। আমাদেরও মুক্তি দেবে। শেষ পর্যন্ত সে ব্যবস্থা আকাশ কুসুমে পরিণত হলো। তাই ওদের লেজে বেঁধে রওনা হতে হলো। মাঝখান থেকে দামী সময়ের অপব্যয়। কিন্তু আসার সময় এক বাড়িতে আপনাদের হাতের কিছু কাজ দেখে এলাম, একটা লোক খেতে বসেছেন হ্যারিসনের চোট বড় কয়েকটা টেবিল জুড়ে, বন্দি সহ দ্যার্তেগারাও বসেছে একটা ছোট টেবিলে। সবার থেকে একটু দূরে আর একটা ছোট টেবিলে খেতে বসেছেন রাজা একা। তাকে পরিবেশন করছে তারই ব্যক্তিগত চাকর প্যারী। সেই প্যারীকে শোনাবার জন্যই গলাটা অস্বাভাবিক উঁচু করল দ্যার্তেগা ‘একটা লোক মাথা দু’ফাঁক হয়ে পড়ে আছে। আঘাতটা যার হাত থেকে এসেছে, সে লোক বাহাদুর সেনাপতি। মানুষটা আর একটু হলেই শেষ হয়ে যেত।’

হ্যারিসনের টেবিল থেকেই একটা ষণ্ডা লোক বলে উঠল, ‘শেষ হয়ে যেত? তাহলে শেষ হয়নি, অ্যাঁ? আমি তো ভেবেছিলাম’…

সান্ত্বনার সুরে দ্যার্তেগা বলল, তার জন্য আফসোস করবেন না ভাই, শেষ যে হয়ে যায়নি, সে শুধু তার বরাত জোরে। আপনার দিক থেকে ত্রুটি কিছু ছিল না, তা আমরা দেখেই বুঝতে পেরেছি। সত্যি অদ্ভুত কব্জির জোর দেখিয়েছেন আপনি। খালি হাতে ওরকম মাথা ফাটিয়ে দেয়া না, না অসাধারণ বাহাদুরি আপনার। একসঙ্গে যখন চলেছি, আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ করব আপনার সঙ্গে। শক্তিশালী লোক দেখলেই আনন্দ হয় একটা।

শক্তিশালী লোকটার নাম গ্ৰসলো। হ্যারিসনই আলাপ করিয়ে দিলেন। আলাপের সুত্রে প্রকাশ পেল প্যারিসে গ্রসলো বেশ কিছুদিন ছিল, অল্প স্বল্প ফরাসি ভাষাটা বলতে পারে।

দ্যার্তেগাকে আর পায়কে, সে গ্রসলোকে জানাল, লেফটেন্যান্ট গ্রসলো, কী চমৎকার জ্ঞান আপনার ফরাসি ভাষাতে। এমন সুন্দর ফরাসি অনেক সময় খাস ফরাসিরাও বলতে পারে না। তা আপনার সময়ে বেশ আনন্দে কাটছে তো? আমি আর আমার বন্ধু ভ্যালন, আমরা ভাই ভারী অসুবিধায় পড়েছি, আমরা ভাই আমুদে লোক সন্ধ্যাবেলা একহাত তাস খেলতে না পারলে আমাদের ডিনার হজম হয় না। এখানে তো… এই বলেই মুখ দিয়ে একটা আফসোসের আওয়াজ বার করল দ্যার্তেগা।

কথাটা লুফে নিল এসলো, আর বলবেন না ভাই। আমারও ওই একই সমস্যা। তাস আমার ধ্যান, তাস আমার জ্ঞান, যে দিন তাসে অন্তত পাঁচটা পাউন্ড জিততে না পারি, সেদিনটা আমার বৃথা গেল মনে হয়। যুদ্ধের সময়ও অবাধে খেলা চলেছে। কেল্লায় ক্যাম্পে খেলার সাথীর অভাব কোথাও হয় না, কিন্তু ইদানীং পড়েছি ঝকমারীতে। রাজার পাহারার ভার আমার উপরেই পড়ে প্রতি রাত্রে না পারি নিজে বাইরে যেতে, না পারি বাইরের লোক ভেতরে আনতে। খেলতে না পেরে আমার পেট ফুলে ওঠার অবস্থা। গ্রসলোর মনোভাব যখন এরকম, দ্যার্তেগার তখন তার সুযোগ নিতে দেরি হবে কেন?

সে দিন ডাবি শহরে রাতের বিশ্রাম ঠিক হয়েছে। আজ গ্রসলোকে পাহারা দিতে হবে না। গ্ৰসলোকে নিজের ঘরে ডেকে আনল দ্যার্তেগা। এক বন্ধুকে নিয়ে গ্রসলো এলো। একদিকে গ্রসলো আর তার বন্ধু অন্যদিকে দ্যার্তেগা আর পেপার্থস। কুড়ি পাউন্ড হেরে ঘসলোরা বিদায় নিল।

কাল রাত কাটার কথা রিষ্টন শহরে। শোধ নেব ওখানে, গ্রসলো বিদায় নেবার সময় বলে বসলো।

‘কালও বুঝি তোমার পাহারা নেই।’

‘আছে, আছে, পাহারা দিতে দিতেই খেলব। আজ আমরা এলাম তোমাদের ঘরে, কাল তোমরা যাবে আমাদের ঘরে। অর্থাৎ স্টুয়ার্টের ঘরে। রাজাকে এখন ওরা আর রাজা বলে না,’ চার্লস স্টুয়ার্ট বলে।

দ্যার্তেগা সব খুঁটিয়ে জেনে নিল। যেদিন যেখানে রাজার রাতের থাকার ব্যবস্থা হয়, জোড়া কামরাতে রাখা হয় তাকে। প্যারীকে নিয়ে রাজা ভেতরের কামরায় থাকেন আর আটজন প্রহরী নিয়ে গ্রসলো থাকে দ্বিতীয় কামরায়। দুই কামরার ভেতর খোলা দরজা, সেই দরজার উপর বসে থাকে প্রহরীরা, যাতে এক মুহূর্তের জন্যও রাজা চোখের বাইরে না থাকেন।

সব ব্যবস্থা বুঝিয়ে দিয়ে গ্রসলো বলে বাইরের ঘরে বসে আমরা খেলব, ভেতরে শুয়ে থাকবে স্টুয়ার্ট তাতে অসুবিধা কি?

চিন্তিতভাবে দ্যার্তেগা বলে–‘অসুবিধা আর কিছু নয়, অসুবিধা শুধু আমাদের বন্দি দুজনকে নিয়ে, ওদের রেখে এলে ওরা পালাতে পারে। আমাদের চাকরেরা বিশ্বাসী ঠিকই, কিন্তু তারাও অস্ত্র ধরতে জানে না, অথচ বন্দিরা ওস্তাদ তরোয়ালবাজ, না, ওদের রেখে এনে নগদ চার হাজার পাউন্ড মারা যাবার আশঙ্কা রয়েছে বন্ধু, এক একজনের মুক্তিপণ ঠিক হয়েছে দুই হাজার, ফ্রান্সে পৌঁছেই ওরা দেবে বলেছে—’

‘দূর এসব চিন্তা বাদ দাও’–রেগে গ্রসলো বলে, ‘বন্দি দুটোকে না হয় সঙ্গেই নিয়ে এসো। বাইরের ঘরে আটজন প্রহরীর মাঝে ওরা নিরাপদ থাকবে।’

‘দ্যার্তেগার এখন কাজ হলো সব কথা প্যারীকে জানানো। কাল রিষ্টন শহরে গভীর রাতে রাজাকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা করা হবে, রাজা যেন সতর্ক থাকেন। সংকেত শব্দ হলো ‘এবার তাহলে—’’

দ্যার্তেগার মুখে থেকে ওই সংকেত বেরুনো মাত্র বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বাইরের দিকে ছুটবেন, পোষাক পরেই তাকে কাল শুতে হবে। চাকরেরা নিজেদের সাতটা ঘোড়া ছাড়াও অতিরিক্ত আরও দুটো ঘোড়া সাজিয়ে নেবে হ্যারিসনের আস্তাবল থেকে, এ সব ঘোড়া নিয়ে তারা শিবিরের বাইরে অপেক্ষা করবে, কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না, কারণ অশ্বারোহীরা সারা রাত দলে দলে আসছে, দলে দলে বেরুচ্ছে, ঘোড়ার আনাগোনা, কার ঘোড়া কোথায়, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

অ্যাথোস আর অ্যারামিস বন্দি, কাজেই তরোয়াল থাকবে না ওদের, থাকবে জামার ভেতরে পিস্তল আর ভোজালি, তারই সাহায্যে পাহারাওয়ালা সৈনিকদের ঘায়েল করে তরোয়াল যোগাড় করে নেবে ওরা।

পরের দিন সন্ধ্যে বেলা, সবাইকে আর এক দফা তালিম দিয়ে নিল দ্যার্তেগা ডিনারের পর। চাকরেরা ঘোড়া নিয়ে ঠিক কোনখানে অপেক্ষা করবে, তা দিনের বেলাতেই তাদের দেখিয়ে এনেছে। এখন তাদের কাছে প্রশ্ন—’ঘোড়াগুলোকে নিয়ে ভালো করে খাওয়ান হয়েছে তো? ওদের জিন লাগাম রেকাব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে তো? ওদের জুতোর নাল সব ঠিক আছে তো? ঘোড়ার পায়ের নালের একটা পেরেক খুলে গেলে একটা লড়াই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বার বার সে কথা দ্যার্তেগা স্মরণ করিয়ে দেয়। পোৰ্থস মাঝে মাঝে মাথা নাড়ে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। দ্যার্তেগা তার কাঁধে হাত রেখে বলে কিছু টাকা গ্রসলোকে পেতে দিও, বন্ধু। জিতলে ও জেতার নেশাতেই মেতে থাকবে, অন্য কোনো দিকে তাকাবে না।’

অ্যাথোস আর অ্যারামিস অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে দ্যার্তেগাকে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে তারা, জামার ভেতরে গুলি ভরা। পিস্তল আর ভোজালি নিয়েছে, এক একজনকে দুটো শত্রু নিপাত করতে হবে। কারণ এরা চারজন আর গ্রসলোরা আটজন। তা হয়ে যাবে এখন। সবাই রাত নয়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ল, রাজার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে পাশাপাশি ঘর। একটি ঘর রাজার জন্য, আর একটি প্রহরীদের জন্য। দ্যার্তেগারা গিয়ে দেখে রাজা বিছানায় শুয়ে পড়েছেন, গায়ের চাদরের তলায় তার দিনের বেলার পোষাক দেখা যাচ্ছে, তার পায়ের কাছে বসে বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছেন তাকে। রাজা আধবোজা চোখে শুয়ে শুয়েও শুনছেন, আর মাঝে মাঝে বলছেন, তারপর?

দ্যার্তেগাকে সোল্লাসে অভ্যর্থনা করল গ্রসলো।

গ্ৰসলো প্রহরীদের আগে থাকতেই বলে রেখেছিলেন। তারা বেশ আগ্রহ দেখাতে লাগল খেলার ব্যাপারটাতে। জুয়া খেলার উপর আসক্তি সৈনিকদের যেন মজ্জাগত।

টেবিলের চারকোণে বসল দ্যার্তেগা আর পোর্থস, গ্রসলো আর তার সহকারী প্রহরীদের কাছেই বসল অ্যাথোস আর অ্যারামিস, সংকেত উচ্চারণের সাথে সাথেই যাতে চোখের পলকে চারজন শত্রু খতম করা যায়, এমনি ভাবে কায়দা করে বসেছে চারজন। তারপর? তারপর ওরাও চারজন, ওরাও চারজন, মুখোমুখি লড়াইয়ে দ্যার্তেগার সঙ্গে সমানে সমানে লড়বে, এমন যোদ্ধা ইংল্যান্ডে কে আছে?

খেলার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের ভেতরে যেখানে রাজা শুয়ে আছেন, সে দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে দ্যার্তেগা। প্রহরীদের চোখ আর রাজার উপর নেই, খেলার টেবিলের দিকেই তাকিয়ে আছে তারা।

খেলা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সেখানে, যার হাতে রাজা মার্কা তাস এসে পড়বে, জিতবে সেই। পোর্থস তাস তুলল না রাজা নয়, গ্রসলে তুলল না দ্যাগো তুলল–ঈশ্বর এই তো রাত গ্লাসে চেঁচি… উঠল–‘এবার তা হলে ঘরের ভেতর বিছানার উপর রাজা নড়ে উঠলেন। প্যারী বাইবেল রেখে উঠে দাঁড়াল। অ্যাথোস আর অ্যারামিস জামার ভেতরে হাত দিয়ে পিস্তল ধরেছে, দ্যার্তেগা আর পোর্থস লাফিয়ে উঠে হাত দিয়েছে কোমরের তরবারিতে–এমনি সময়ে বন্ধ দরজা হঠাৎ করে খুলে গেল, একটা ব্যস্ত মুখ দেখা গেল দরজায়, সে মুখ কর্নেল হ্যারিসনের।

বাজ পড়ল গ্রসলোর মাথায়, এ সময়ে এখানে কর্নেল আসবেন, মশগুল অবস্থায় জুয়া খেলা হাতেনাতে ধরে ফেলবেন তাকে, এ স্বপ্নেরও বাইরে, কিন্তু গ্রসলার দিকে কর্নেলের চোখ নয়, তিনি সোজা চলে গেলেন ভেতরের ঘরে, আর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘চার্লস স্টুয়ার্ট! তোমার ভাগ্যে আর রাতের বিশ্রাম নেই, এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে লন্ডনে রওনা হতে হবে, এই বার্তা নিয়ে এসেছেন, জেনারেলের বিশেষ দূত।’

সে দূত আর অন্য কেউ নয়, মর্ডন্ট।

দ্যার্তেগাদেরও মাথায় বাজ। ইংল্যান্ডের ইতিহাস অন্যরকম লিখতে পারত তারা–আর মাত্র দুমিনিট সময় পেলে। তা তারা পেল না। একা হ্যারিসন হলেও বা এ জুয়া খেলার একটা কৈফিয়ত দেয় সম্ভব ছিল, কিন্তু হ্যারিসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শনি মর্ডন্ট। এক পলকের মধ্যে জীবন মরণ কোনটা ঘটে যায়, কিছু বলা যায় না।

রাজার দিকেই প্রথমটায় তাকিয়ে ছিল মর্ডন্ট, কিন্তু পরক্ষণেই চোখ পড়ল দ্যার্তেগার উপর। সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত উল্লাসে ঝকমক করে উঠল তার চোখ আর মুখ। সে চেঁচিয়ে বলল–‘ওই সেই পলাতক ফরাসিরা! আটকাও মারো শেষ করে দাও।’

কিন্তু ততক্ষণে পলাতক ফরাসিরা আর ঘরের ভেতরে নেই, তরোয়াল খুলে দ্যার্তেগা পোর্থর্স ছুটে বেরিয়েছে, তাদের পায়ে পায়ে অ্যাথোস আর অ্যারামিস পিস্তল হাতে, রাজা উদ্ধার হলো না। এখন সবচেয়ে বড় দরকার আত্মরক্ষার। ছুট, ছুট ঘোড়া নিয়ে গ্রিমডেরা তৈরি আছে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে রিস্টন পেরিয়ে দূরে-বহুদুরে

একটা শুকনো নদী, তার উপরে পুল, দ্যার্তেগা ঘোড়া নিয়ে সেই নদীর খাদের ভেতর নামল, সঙ্গে অন্য সবাইও। পুলে থামের তলায় আত্মগোপন করল তারা, কয়েক মিনিটের ভেতরই একদল সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেল সেই পুলের উপর দিয়ে। ওরা পিছু নিয়েছে পলাতকদের। নদীর খাদ থেকে উঠে এসে আর রাজপথ ধরল না পলাতকেরা, মাঠ ভেঙে পাহাড় পেরিয়ে অনেক কষ্ট ভোগ করে তিন দিন পর এসে পৌঁছালো লন্ডনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *