১. রাজধানীর সেন্ট আনোর রাজপথ

টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার

০১.

রাজধানীর সেন্ট আনোর রাজপথ ধরে বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছুটে চলেছে, দুই অশ্বারোহী, দুই বীরযোদ্ধা। তাদের নাম, দ্যার্তেগা এবং পোর্থস, ভিনসেন দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছে রাজবন্দি ডিউক অফ বোফর্ট। তাকে ধরে আনার জন্যই ছুটছে এই দুই বীরযোদ্ধা। অবশ্য এদের পিছনে বড়সড় একদল অশ্বারোহী সৈন্য আছে, কিন্তু অনেক পিছিয়ে পড়েছে তারা। তাতেই বোঝা যায় সৈন্যদের উপর এরা মোটেই নির্ভরশীল নয়।

রাজপথের শেষ মাথায় পৌঁছাতেই সামনে এক গ্রাম। তার শেষ প্রান্তে এক বড় বনের শেষ প্রান্তে ছোট এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের চূড়ো থেকে দেখা যায় একটা পানিশূন্য লেকের ওপারে ভিনসেন দুর্গের মাথা আকাশ ছুঁয়েছে। লেকের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে ঘোড়া, পাশেই সেন্টমোর গ্রাম। ডিউক অফ বোফর্ট ঐ দুর্গের একটি মাথা থেকে দড়ি ঝুলিয়ে সেন্ট মোরের অন্য প্রান্তে নেমে পালিয়ে গেছেন। সেখানটায় এখনও জটলা করছে দুর্গের পাহারাদাররা। জটলার কাছে পৌঁছে প্রশ্ন করল দ্যার্তেগা ‘ডিউকের কোনো সাহায্যকারী ছিল?’

উত্তর দিল সৈন্যরা চারজন ছিল, আমরা দুর্গের দেয়ালের উপর দেখেছি তাদের। কিন্তু গুলি ছুঁড়েও কিছু করতে পারিনি বন্দুকের নাগালের বাইরে থাকায়। মাত্র চারজন। পোর্থাসের উদ্দেশ্যে বলল দ্যার্তেগা, ভাবখানা-চারজন কোনো ব্যাপার হল? অন্তত যোদ্ধা হলে না হয় দ্যার্তেগা আর পোর্থসের মতো দুই যোদ্ধাকে বাধা দিতে সক্ষম হত।

দ্যার্তেগা আবার জিজ্ঞাসা করল–‘কতক্ষণ আগে পালিয়েছে ওরা।‘

‘সোয়া দুই ঘণ্টা হবে।’ জবাব দিল পাহারারত সৈন্যরা।

‘মাত্র!’ পোর্থসের দিকে ফিরল দ্যার্তেগা। বোফর্ট কোথায় পাবে এত তেজি ঘোড়া আমাদের মতো। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে ওদের ঠিকই ধরে ফেলব আমরা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পোর্থস। বেয়ার্ড আর ভলকান নামের এই দুই ঘোড়ার মালিক সে। সবে ঝড়ের বেগে দুই ঘণ্টা ছুটে এসেছে। আবারও যদি পাঁচ ছয় ঘণ্টা এই বেগে ছুটতে হয় তাহলে ও দুটোর শেষ পরিণতি কী হবে ভেবে শঙ্কা জাগছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তা নিয়ে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। শুরু যখন হয়েছে কাজটা শেষ করতে হবে। পলাতকদের ধরতেই হবে, তবেই মিলবে দ্যার্তেগার জন্য ক্যাপ্টেন এবং নিজের জন্য ব্যারন পদবী। এই আশ্বাস এসেছে ফ্রান্সের মহামন্ত্রী স্বয়ং ম্যাজারিনের কাছ থেকে।

বিশ বছর, হ্যাঁ সুদীর্ঘ বিশ বছর ধরে দ্যতেঁগা মাস্কেটিয়ার বাহিনীর লেফটেন্যান্ট, কিন্তু ক্যাপ্টেনের পদে উন্নতির কোনো আশা নেই, কারণ ট্রিভাইন এখন জীবিত। কাজেই তিনি মারা না গেলে ক্যাপ্টেনের পদ খালি হবে না, আর দ্যার্তেগার তার মৃত্যু কামনাও করতে পারে না, তিনি দ্যার্তেগা বিশেষ উপকারী। রানী অ্যান এর জন্য অনেক কিছুই করেছে দ্যার্তেগা তাকে চরম অবমাননার হাত থেকে রক্ষা করেছে একদিন। এজন্যই রানীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সমস্ত জীবন। ফরাসি দেশের পরিচালিকা এখন সেই রানী। রাজা চতুর্দশ লুই নাবালক তাও অভিভাবক হিসেবে রানী অ্যান দেশ শাসন করছেন। তিনি ইচ্ছে করলে দ্যার্তেগাকে মার্শাল পদে বসাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। না করার কারণ তিনি নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছুই করেন না। মহামন্ত্রী কার্ডিনা ম্যাজিরিনের হাতের পুতুল রানী, বাজারে জনশ্রুতি আছে বিধবা হওয়ার পর অ্যান এই ইতালীয় ভাগ্যান্বেষীকে গোপনে বিবাহ করেছেন।

ম্যাজারিন নিজেও চরম লোভী ও স্বার্থপর। যেখানে নিজের কোনো লাভ নেই, এমন কোনো কাজ সে নিজেও করবে না। রানীকেও করতে দেবে না।

সুতরাং রানী দ্যার্তেগার জন্য কিছুই করতে পারেনি এবং যেখানে উপকারীর উপকার করার সম্ভাবনা নেই, সেখানে উপকারীর কথা মনে রাখলেই শুধু বেদনা থাকে বলেই রানী ইচ্ছে করেই ভুলেছেন দ্যার্তেগাকে। যদিও দুজনই একই প্রাসাদে থাকেন, রানী ভেতরে, দ্যার্তেগা প্রাসাদের পাহারায়।

হ্যাঁ বিশ বছর দ্যার্তেগা প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে কিন্তু রানী তাকে মনে রাখেননি। অবশেষে একদিন ম্যাজারিনই বাধ্য হলেন দ্যার্তেগাকে খুঁজে বের করতে। গরিব প্রজাদের উপর নতুন কর বসিয়েছেন ম্যাজারিন অথচ যে বিশাল পরিমাণ অর্থ এই সব কর থেকে আসে তা রাজকোষে জমা হয় না, হয় ম্যাজারিনের নিজের তহবিলে। সিন্দুক ভরা হীরে, মুক্তো ম্যাজারিনের অথচ রাজা চতুর্দশ লুইকে থাকতে হয় রীবি হালে।

স্বভাবতই প্রজারা এতে অসন্তুষ্ট যে কোনো অভিজাত, প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রজাদের পক্ষে কথা বলেছেন তক্ষুণি তাকে আটকে বন্দি করেছেন ব্যাস্তিল কারাগারে। ম্যাজারিনের নির্দেশে রানী অ্যান ব্যামাসপিয়ার ব্যাস্তিল কারাগারেই মারা গিয়েছেন, বোফর্ট ভিনসেন থেকে পালিয়েছেন পাঁচ বছর কারাবাসের পর। বোফর্টকে মুক্ত করার জন্য তার আত্মীয় বন্ধু জমিদারেরা গোপনে চেষ্টা করছেন, একথা গুপ্তচরেরা আগেই জানিয়েছেন ম্যাজারিনকে, এদিকে রাজধানী প্যারির জনগণ যে এসব নিয়ে প্রায় বিদ্রোহের পর্যায়ে। পৌঁছেছেন সেকথাও। ম্যাজারিন যেদিকে তাকান, সেখানেই শুধু শত্রু আর শত্রু। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ কেউ গোপনে। চিন্তিত হয়ে মহামন্ত্রী ভাবতে লাগলেন কমপক্ষে দুই চারজন ঘনিষ্ট বন্ধুও যদি তার থাকত।

এই সময়ে একজন তাঁকে চার বীরের কথা বলল, চারজনই সৈনিক তারা, কিছুদিন আগে দেশের তদানীন্তন পরাক্রমশালী কার্ডিনান রিশনকে পরাজিত করেছিল, তাদের একজনের নাম লেফটেনান্ট দ্যার্তেগা।

ম্যাজারিন উফুল্ল হয়ে উঠলেন। তখনই ডেকে পাঠালেন দ্যার্তেগাকে। একটা চুক্তি হলো তাদের মধ্যে। চুক্তিটা হলো এই যে, আসন্ন প্রজা বিদ্রোহে দ্যাগো তার আগের তিন বন্ধুকে নিয়ে সমর্থন ও সাহায্য করবে ম্যাজারিনকে বদলে ম্যাজারিন দ্যার্তেগাকে দেবেন ক্যাপ্টেন পদ এবং বন্ধুদের যে যা চাইবে তাকে তা দেবেন।

দ্যাগে বিশ বছর কোনো খবর রাখে না বন্ধুদের। ম্যাজারিনের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে, সে তাদের খুঁজতে বের হলো, কে কোথায় আছে। বেশি খুঁজতে হলো না সহজেই সন্ধান মিলল তাদের, কিন্তু কেউ রাজী হলো

ম্যাজারিনের প্রস্তাবে। অ্যারামিস আর অ্যাথোস সোজা বলে দিল রাজা ছাড়া আর কারও জন্যে তারা অস্ত্র ধরবে না। ম্যাজারিন যতই রাজার মন্ত্রী হোক, আসলে সে রাজার শত্রু, শত্রু এই জন্যে যে রাজার নাবালকত্বের সুযোগ নিয়ে দেশটাকে শোষণ করছে, প্রজাদের করে তুলেছে রাজার উপর অসন্তুষ্ট। সুতরাং অ্যারোমিস ও অ্যাথোসের মতে, ম্যাজারিনের সাহায্য করা মানেই হলো আসলে রাজার ক্ষতি করা।

একমাত্র পোর্থস রাজী হলো। সহজ সরল বুদ্ধির মানুষ পোর্থস। সে রাজনীতি বোঝে না, রাজার স্বার্থ আর মন্ত্রীর স্বার্থ যে ভিন্ন হতে পারে এমন চিন্তাই নেই তার। ম্যাজারিন যদি তাকে ব্যারন উপাধি দেয়, তা হলে সে ম্যাজারিনকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। কারণ, প্রচুর অর্থ এবং তিনটি জমিদারির মালিক হওয়ার পরেও শুধুমাত্র একটা উপাধির অভাবে সে অভিজাত সমাজে স্বীকৃতি পাচ্ছে না।

একমাত্র পোর্থসকে নিয়েই দ্যার্তেগা পারিতে ফিরছে। পোর্থসের লম্বা চওড়া গঠন দেখে খুশী হয়েছেন ম্যাজারিন। রাজী হয়েছেন তাকে ব্যারন উপাধি দিতে। কথাবার্তা পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খবর এসেছে, ভিনসেন দুর্গ থেকে বোফট পালিয়েছেন। কাজেই দ্যার্তেগা এবং পোর্থসের প্রথম কর্তব্য বোফর্টকে ধরে আনা, কারণ বোফর্ট যদি বিদ্রোহী প্রজাদের নেতা হওয়ার সুযোগ পায়, তবে সে বিদ্রোহ দমন করা অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে ম্যাজারিনের বিশ্বাস।

.

ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে বেয়ার্ড আর ভলকান। সারাদিন চলেছে দ্যার্তেগা আর পোর্থর্সকে নিয়ে, এক মুহূর্তের জন্যে বিশ্রাম পায়নি ঘোড়া দুটো। শেষ পর্যন্ত আর পারল না, একই সময়ে একযোগে আছড়ে পড়ল ওদুটো এবং পড়ার সাথে সাথে মারা গেল।

অশ্বারোহী দুজনই ঘোড়া পড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেড়ে সময়মতো নেমে পড়েছে।

এরপর?

সঙ্গের সৈনিকেরা পিছিয়ে পড়েছে সেই সকাল বেলাতেই পোর্থসের চাকর মাস্কেটনও আছে তাদের মধ্যে। পিছনে আছে, কিন্তু তার ঘোড়াও দুর্বল।

বোফর্টকে এখন ধরা যায়নি, বেয়ার্ড ভলকানের মতো তেজী ঘোড়া

ববস্থা করেছেন, নির্দিষ্ট আস্তানায় ঘোড়া রাখা আছে, বোফক্ট আসছেন, ক্লান্ত ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নতুন ঘোড়ায় উঠে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ভেন্ডেসের উদ্দেশে এই ভেন্ডেসে প্রদেশের ডিউক বোফট। দ্যার্তেগা পোর্থসের ঘোড়া খতম। তার মানে কি এই অভিযানের এখানেই সমাপ্তি কি হবে একজনের ক্যাপ্টেনের অন্যজনের ব্যারণ পদের! সবই কি স্বপ্নই থেকে যাবে?

কিন্তু ওই ঘোড়ার ডাক শোনা যায়। তাড়াতাড়ি দুই বন্ধু ঐ ডাক লক্ষ্য করে ছুটল, তখন সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। পথের দুই পাশে জঙ্গল সেই জঙ্গলের ভেতরে আলো দেখা যায়, আবার ঘোড়ার ডাকও শোনা গেল, সেই আলোর কাছ থেকেই। দ্রুত এবং সংগোপনে বড় বড় গাছের আড়ালে দুই বন্ধু আলো লক্ষ্য করে ছুটছে, আলোর কাছে দেখতে পেল, চারটি বড় ঘোড়া রয়েছে। সহিসেরা দলাইমলাই করে খেতে দিয়েছে তাদের।

দ্যার্তেগা ও পোৰ্থস সহিসদের সামনে গিয়ে বলল, ‘ঘোড়াগুলো আমরা কিনতে চাই। সহিস প্রথমে অবাক হলো তারপর রেগে গেল, কিনব! কিনব বললেই কেনা যায় নাকি? এ ঘোড়ার মালিক কে জান? মন্টবেজনের ডিউক। তিনি ঘোড়া বিক্রি করবেন ভেবেছ?

‘না বিক্রি করলে এমনি নিয়ে নেব। রাজার দরকার। মন্টবেজনই হোক বা অন্য যে হোক, রাজার প্রয়োজনের কাছ সবাইকে মাথা নোয়াতে হবে।‘

সহিসেরা শেষ চেষ্টা করল, ‘মাত্র আধঘণ্টা আগে ঘোড়াগুলো অনেকদূর থেকে ছুটে এসেছে, বিশ্রামের দরকার ওদের।‘

‘আধ ঘণ্টা বিশ্রাম যথেষ্ট।’ বলে ঘোড়াগুলোকে খুলে নিল দ্যার্তেগা। ‘রাজার কোষাগার থেকে মন্টবেজনকে ঘোড়ার দাম পাঠিয়ে দেয়া হবে। একটার পিঠে দ্যার্তেগা অন্য একটাতে পোৰ্থস চড়ে অন্য দুটোকে সামনে তাড়িয়ে নিয়ে চলল, একটা তো মস্কেটনের এখনই দরকার হবে। মরিয়া হয়ে সহিসেরা বন্দুক বার করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল দ্যার্তেগাকে লক্ষ করে। সহিসের গুলি সৈনিকের গায়ে লাগে না।’ হেসে উঠল পোর্থস। জোরে ঘোড়া চালিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেল তারা।

রাজপথে উঠতেই মাস্কটনের সঙ্গে দেখা হলো। তার ঘোড়াও পড়ে গিয়েছে। নতুন একটা ঘোড়া দেয়া হলো তাকে। দ্যার্তেগা বলল, ‘ঘোড়াগুলো আধঘণ্টা আগে বহুদূর থেকে ছুটে এসেছে। অর্থাৎ বোফর্টই এসেছেন এই ঘোড়ায়। মন্টবেজনের ডিউক বোফর্টের আত্মীয়। বোফর্টের ঘোড়াতেই বোফর্টকে ধরতে চলেছি আমরা, মজা মন্দ নয়।’ বলে হেসে উঠল পোর্থস। কিছুটা সামনে এগুতেই বহু ঘোড়ার খুঁড়ের শব্দ শোনা গেল।

‘আমরা শুনেছি বোফর্টের সঙ্গে মাত্র চার জন সঙ্গী আছে।’

‘কিন্তু এত অনেক ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’ বলে পোর্থ।

‘চার হোক আর চল্লিশ হোক–ধরব বলে বেরিয়েছি যখন, তখন ধরবই। বোফর্টকে দ্যার্তেগার ওয়াদা মিথ্যে হবে না। আরো জোরে ঘোড়া ছোটাল দ্যার্তেগা। রাজপথে ঘোর অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এল দুটো জমাট অন্ধকারের স্তূপ। সেই স্তূপ থেকে কর্কশ আওয়াজ এল-’ কে যায়, থামো।

‘যে যার সে রাজার নামে যায়। সরে যাও, নতুবা মরো।’ হুংকার দিয়ে উঠে দ্যার্তেগা।

পরমুহূর্তেই এদিকে দ্যার্তেগা আর পোর্থস, অন্যদিকে সেই দুই জমাট কালো মূর্তির মধ্যে শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ।

পোর্থসের তরোয়ালের আঘাতে তার প্রতিপক্ষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দ্যার্তেগার পিস্তলের গুলিতে ঢলে পড়ল দ্বিতীয় জন।

‘চলো চলো’ বলে ঘোড়া ছোটাল। বিজয়ী দুজন। কার্ডন্ট সামনেই কোথাও আছে বিশ গজ না যেতেই আবার দুটো অন্ধকারের স্তূপ আলাদা হয়ে এল রাজপথের অন্ধকার থেকে।

‘আর এক পা এগুলেই মরবে’ শাসিয়ে ওঠে সেই স্তূপকৃত অন্ধকার।

‘মরবে রাজদ্রোহীরা’ গুলি চালাল দ্যার্তেগা আর পোর্থস একসাথে। গুলি আসে ও পক্ষ থেকেও একদিকে মারা পড়ে দার্তেগার ঘোড়া, ওদিকে বিদ্রোহীরা। একটা বাড়তি ঘোড়া সঙ্গে আছে, চোখের পলকেই তার পিঠে উঠে বসে দ্যার্তেগা, চলো কোথায় যাবে বোফক্ট? ধরেছি তাকে, এবার নির্ভয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলে দ্যার্তেগা আর পোর্থস।

‘থামো’ আবারও আসে কঠোর নির্দেশ। সামনের পথ আটকে দিয়েছে তৃতীয় একজোড়া অন্ধকার মূর্তি।

দ্যার্তেগা, পোর্থস উত্তর দেয় পিস্তলের মুখে, ওদিকের যোদ্ধারা ঘোড়াকে দাঁড়া করায় পিছনের পায়ের উপর। ফলে গুলি দুটোই বেঁধে যায় ঘোড়ার গলায়। দুটো ঘোড়াই উল্টে পড়ে যায় মাটিতে।

চোখের পলকে আরোহীরা লাফিয়ে নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। একজন কৌতুক করে বলে উঠে ‘ঘোড়ার পর ঘোড়া খুন করে আর কত বীরত্ব দেখাবেন? হিম্মত থাকে তো তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসুন।’

পোর্থস জবাব দেয় ‘তরোয়াল? তা পেলে আর কিছুই চাই না।‘

পোর্থস আর দ্যার্তেগা ঘোড়া থেকে নেমে তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসে।

একদিকে দুইজনে, ওদিকেও দুইজন।

দ্যার্তেগার নিয়ম হলো বিদ্যুতের বেগে তরোয়াল খাপমুক্ত করেই ঝড়ের বেগে আক্রমণ। তার সে আক্রমণ সহ্য করতে পারে এমন যোদ্ধা ফ্রান্সে আছে বলে সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজ তার প্রচণ্ড আঘাতই ব্যর্থ হলো, প্রতিপক্ষ ব্যর্থ করে দিয়েছে তার আঘাত ‘জাহান্নাম’ গর্জে উঠে দ্যার্তেগা সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আঘাত হানে জাহান্নাম! দ্যার্তেগার এই বিশেষ শপথ বাক্যটি এবং সে উচ্চারণের বিশেষ ভঙ্গীটি যে প্রতিপক্ষ ওই যোদ্ধার একান্ত পরিচিত। আঘাতের উত্তরে প্রত্যাঘাতের চেষ্টা না করে সে যোদ্ধা এক লাফে তিন হাত পিছিয়ে গিয়েছে এবং সেই খান থেকে কুঁজো হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। অন্ধকারের জড়তা ভেদ করেও দ্যার্তেগার মুখ তার দেখা চাই।

ওদিকে পোর্থস আর তার প্রতিযোদ্ধা দুইজনের তরোয়াল ভেঙে গিয়েছে যুদ্ধ করতে গিয়ে। তারা এখন গুলি চালাচ্ছে। যে সামান্য ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে গুলি বেরোবার সময় তাতেই ক্ষনিকের জন্য দ্যার্তেগার মুখ আবছা ফুটে উঠল, অমনি দ্যার্তেগার প্রতিপক্ষের কণ্ঠ থেকে আর্তনাদ বের হলো ‘দ্যার্তেগা? অ্যারামিস। গুলি বন্ধ কর। গুলি বন্ধ কর’।

এ কণ্ঠস্বর ভুল হওয়ার নয়, দ্যার্তেগারও চিনতে কষ্ট হলো না, সেও প্রায় একই রকম তীক্ষ্ণস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ‘অ্যাথোস?

পোর্থস বলে উঠল, ‘অ্যারামিস’।

অ্যারামিস বলে উঠল, ‘পোর্থস।‘

কী করুণ পরিস্থিতি! একদিন যারা ছিল এক আত্মার বন্ধু তারা আজ প্রাণের শত্রু। কে ধারণা করতে পেরেছিল যে দ্যার্তেগার সঙ্গে অ্যাথোস একদিন যুদ্ধে লিপ্ত হবে, কোন পাগলের মাথায় এ কল্পনা এসেছিল যে পোর্থস আর অ্যারামিস পরস্পরের টুটি ছিঁড়ে নেবার জন্য ক্ষেপে উঠবে একদিন?

‘ভবিতব্য।’ বলে কপালে চাপড় দিল দ্যার্তেগা, ‘সারা ফ্রান্সে একটি মাত্র মানুষ ছিল যে আমার তরোয়ালের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। আজ কিনা সেই মানুষটিই আমার তরোয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল, আমার মর্যাদাকে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে?’

অ্যাথোসের প্রাণের বন্ধু দ্যার্তেগা। তার এই কাতর আর্তি অ্যাথোসের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে তুলল, সে এগিয়ে এসে দ্যার্তেগার সামনে দাঁড়াল তরোয়াল খাপে পুরে বলল ‘বন্ধু’ তোমার মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কাজ আমি করতে পারি না। তুমি তোমার তরোয়াল আমার বুকে গেঁথে দাও। কারণ জীবন থাকতে আমি বোফটকে ত্যাগ করতে পারব না।

‘তোমরা বোফক্টের পক্ষে সে কথা আগে বলনি কেন?’ দ্যার্তেগার গলায় তিক্ত অভিযোগ।

‘আমিও তোমার আর অ্যারামিসের কাছে গিয়েছিলাম? তখন কেন তোমাদের ইচ্ছা প্রকাশ করোনি।’

অ্যাথোস হঠাৎ এ অভিযোগের কোনো উত্তর দিতে পারল না। বলল, ‘এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আলোচনা করব। কাল পারি তো সাক্ষাত করব আমরা। তোমাদের সঙ্গে বড় ধরনের একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তা হোক, কিন্তু এতে আমাদের সারা জীবনের বন্ধুত্ব যাতে বিনষ্ট না হয়, তা আমাদের করতেই হবে।’

বেশি কথার সময় হলো না, প্রায় পঞ্চাশ জন ঘোড়া সওয়ারী নিয়ে বোফর্ট নিজে এসে পড়েছেন। তিনি অনেকটা এগিয়ে ছিলেন অ্যাথোস আর অ্যারামিসের দেরি দেখে তাদের খোঁজ নিতে ফিরে এসেছেন।

পঞ্চাশজন ঘোড়া সওয়ার এসে ঘিরে ফেলেছেন দ্যার্তেগা আর। পোর্থর্সকে ‘আপনারা আমার বন্দি, অস্ত্রসমর্পন করুন’ আদেশ দিলেন বোফক্ট।

‘জীবন থাকতে নয়।’ স্পষ্ট জবাব দ্যার্তেগার।

অ্যাথোস এগিয়ে গিয়ে বোফটকে কানে কানে কিছু বলল,

‘তখন আপনাকে আমার অদেয় কিছু নেই,’ এই বলে ডিউক সঙ্গীদের নিয়ে ভেন্ডোমের পথে অগ্রসর হলেন।

অ্যাথোস আর অ্যারামিসকেও তার সঙ্গী হতে হলো, কিন্তু যাওয়ার আগে অ্যাথোস বুকে জড়িয়ে ধরল দ্যার্তেগা ও পোর্থসকে বলল, ‘কাল নিশ্চয়ই দেখা করব। জীবন থাকতে আমাদের বন্ধুত্বকে ক্ষুণ্ণ হতে দেব না।’

সে আশ্বাসের মূল্য এখন কি মর্মান্তিক দ্যার্তেগার কাছে? জীবনে এতবড় পরাজয় তার ভাগ্যে আর কখনও ঘটেনি।

.

২.

যেমন সীমান্ত যুদ্ধ চলছে কিছুদিন থেকে। রবরয় বিজয়ী প্রিন্স কন্ডি সেখানে ফরাসি সৈন্য পরিচালনা করছে, গ্রামন্ট আর শ্যাট্রিলনের দুই ডিউক সহকারী হিসাবে রয়েছেন তার সঙ্গে। গ্রামান্টের একমাত্র পুত্র, কাউন্ট গিচে, তার বয়স ষোলো কি সতেরো। প্যারিস থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিয়েছে। পিতার সঙ্গে থেকে সে যুদ্ধবিদ্যা শিখবে। সঙ্গে আছেন তার পৌঢ় শিক্ষক এবং দুই সশস্ত্র চাকর। এদের সবাই ঘোড়ার পিঠেই ভ্রমণ করছেন।

পথে পড়ল খরস্রোতা অয়সি নদী, পারাপারের জন্য আছে নৌকা, এত চওড়া আর মজবুত নৌকা যে, ঘোড়া সহই তার উপরে উঠে যায় গিচেও সবাই মিলে উঠেছে। নৌকা প্রায় মাঝ নদীতে।

হঠাৎ কেন জানি গিচের ঘোড়াটা ভয় পেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল গিচকে পিঠে নিয়ে, হায় হায় করতে করতে লাফিয়ে পড়লের গিচের বৃদ্ধ শিক্ষকও কারণ তিনি জানেন গিচ সাঁতার জানে না।

গিচ ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছে, তলিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক উজান ঠেলে তার কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। নৌকায় অন্য যাত্রী যারা আছেন, তারা বোকার মতো তাকিয়ে আছে, নদীতে লাফ দিয়ে পড়ার মতো সাহস তাদের কারোরই হচ্ছে না।

গিচে তলিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক বেচারী সাঁতার দিতে দিতে করুণ আর্তনাদ করে চলেছেন বাঁচাও, বাঁচাও।

বাঁচাবার কি কেউ নেই?

আছে পনেরো বছরের একটা ছেলে লাফিয়ে পড়েছে জলে, নৌকা থেকে নয়, সে পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল পরবর্তী খেয়ার অপেক্ষায়। সেই নদীর পাড় থেকেই সে ঝাঁপ দিয়েছে।

সাঁতারে অসাধারণ পটু এই কিশোর আর তার সুবিধে এই, স্রোতের পক্ষেই সে আসছে। দেখতে দেখতে সে এসে পড়ল, গিচে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এমন সময় কিশোর এসে তার চুল ধরে টেনে তুলল, টেনে নিয়ে তাকে ধরিয়ে দিল তারই ঘোড়ার কেশর, তারপর গিচের দিকে লক্ষ্য রেখে ঘোড়াটাকেই চালিয়ে নিতে লাগল পাড়ের দিকে।

তীরে পৌঁছে গিচেকে সুস্থ করে তুলতে বেশি সময় লাগল না, গিচের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, শিক্ষক এই অপরিচিত কিশোরকে নিয়ে মেতে উঠলেন এক বারে। গিচে বলে উঠল, ‘আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে, সারা জীবনের মতো অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমি কাউন্ট গিচে, ডিউক গ্রামন্ট আমার বাবা। তার সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি যুদ্ধ ক্ষেত্রে।

পরিচয় পেলেই পাল্টা পরিচয় দিতে হয়, কিশোর বলল, আমি রাওল, ভাই কাউন্ট ব্রাগোলেন। কাউন্ট ড্যা-লা-ফেয়ারই প্যারিসের মাস্কেটিয়ারও রাজনৈতিকদের সমাজে অ্যাথোস নামে পরিচিত।

রাওলও যুদ্ধেই চলেছে, প্রিন্স কন্ডির কাছে যাচ্ছে, তারই বোনের সুপারিশ নিয়ে।

প্রথম বয়সের বন্ধুত্ব, দেখতে দেখতে তা গম্ভীর হয়ে উঠে। বিশেষত যেখানে শিক্ষা দীক্ষা মনের মিল থাকে, এখানেও তাই হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই গিচে আর রাওল সমপ্রাণ বন্ধুতে পরিণত হলো। এক সঙ্গে ভ্রমণ করবে, এক হোটেলে থাকবে, এক টেবিলে খাবে, একই রুমে ঘুমাবে।

প্রথম দিন নির্ঞ্ঝাটে কাটল, মনের আনন্দে পথ চলছে দুই বন্ধু। রাওলের মনে শুধু একটাই চিন্তা গ্রিমড এসে পৌঁছেছে কিনা।

গ্রিমড ছিল ডিউক বোফর্টের সঙ্গে। আসলে গ্রিমডের সাহায্যেই বোর্টের ভিনসেন দুর্গ থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিল।

রাওলকে বিদায় দেয়ার সময় অ্যাথোস বলে দিয়েছে–প্যারিস গিয়েই সেখান থেকে তিনি গ্রিমডকে পাঠাবেন রাওলের সঙ্গী হওয়ার জন্য, গ্রিমড সঙ্গে থাকলে রাওলের সম্পর্কে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। ও হবে সহকারী ও অভিভাবক। গ্রিমড যাতে রাওলকে খুঁজে পায়, তার জন্যই প্রতি হোটেলে রাওল হোটেলের মালিককে বলে যাচ্ছে গ্রিমডের নাম–এখানে এলেই তাকে ওখানে যেতে বলবেন দেরি না করেই।

দ্বিতীয় দিনে গিচে রাওলের দলটি বেথুন শহরের কাছে এসে পড়ল, প্রিন্স কন্ডিকে এখানেই পাবার আসা করেছিল তারা, কিন্তু এখানে খবর পেলে কন্ডি বেথুন ত্যাগ করে কাম্পিয়ার পিছু হঠেছেন।

তাহলে ওদের আর বেথুনের দিকে যাওয়ার কোনো কারণ থাকে না।

নদীর ধারে ছোট ছোট ঝোঁপ ঝাড়। এক একটা এমন ঘন যে বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না তার ভেতরের চেহারা। এর একটার পাশ দিয়ে ওরা যখন ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে, হঠাৎ শোনা গেল পরপর কয়েকটা বন্দুকের শব্দ।

সবাই ওরা কানখাড়া করে ফেলল ঘোড়া থামিয়ে। কাছেই শত্রু সৈন্য রয়েছে, তা হলে কন্ডি বেথুনে ত্যাগ করতেন না, সেই শত্রু সৈন্যের কোনো ছোট দল কাছে থাকা অসম্ভব নয়। সঠিক সন্ধান না নিয়ে আর অগ্রসর হওয়া উচিত নয়।

গুলির শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে এগিয়ে গেল ও। রাওলদের দলটা যা খুঁজছিল তা সহজেই পাওয়া গেল অন্য একটা ঝোঁপের আড়ালে এক ভয়াবহ কান্ড হচ্ছে।

দুটো লোক রক্তাক্ত মাটিতে পড়ে আছে, অন্য দুটো লোক তাদের জামা কাপড় হাতড়াচ্ছে। অনায়াসে বোঝা যায়, এরা সৈন্য দলের অংশ হলেও সময় বিশেষে ডাকাতিতে পিছপাও নয়। স্পেনীয় সৈন্যদের এরকম দুর্নাম চিরদিনই আছে।

রাওলদের দলটাকে দেখতে পেয়েই এই ডাকাত দুটো বুন্দুক তুলে গুলি করল, একজনের গুলিতে রাওলের ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে গেল রাওলকে নিয়ে। আততায়ী ছুটে এলো রাওলকে হত্যা করার জন্য।

কিন্তু অন্য আততায়ীর গুলি ব্যর্থ হয়েছে এবং গিচেকে নিজের দিকে এগোতে দেখে সে দ্রুত অদৃশ্য হয়েছে ঝোঁপের আড়ালে, গিচে গিয়ে উদ্ধার করল রাওলকে এবং বন্দি করল তার আততায়ীকে।

এবার আহত লোক দুটিকে পরীক্ষা করে তারা দেখতে পেল যে, একজন মারা গিয়েছে, অন্যজনও সাংঘাতিক আহত, গুলিতে তার উরুর হাড় ভেঙে গুড়ো হয়ে গিয়েছে। রাওলদের প্রাথমিক চিকিৎসায় একটুখানি প্রকৃতিস্থ হয়েই এই আহত লোকটি অতি কাতরভাবে ত দর বলল, ‘ভাই আপনারা আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য বৃথা চেষ্টা করবেন না, বাঁচাবার কোনো সম্ভাবনা আমার নেই, বরং যদি আমার আত্মাকে বাঁচাবার জন্য একটু কষ্ট স্বীকার করেন তাতেই আমার উপকার হবে অনেক বেশি।’

‘আত্মাকে বাঁচানো’? গিচে আর রাওল জিজ্ঞেস করে, ‘কী করতে পারি, বলুন। আপনারাতো খ্রিস্টান! জানেন না কি যে প্রত্যেক খ্রিস্টানেরই উচিত মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কোনো ধর্ম যাজকের কাছে সারা জীবনের পাপ স্বীকার করা? অকপটে পাপ স্বীকার করলে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে ধর্মযাজক তাকে পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন, অনুতপ্ত পাপী নরক থেকে রক্ষা পায়।’

‘আপনি কোনো ধর্মযাজকের কাছে পাপ স্বীকার করতে চান?’ জিজ্ঞেস করে দুই তরুণ।

‘একান্তভাবে চাই, না করলে অনন্ত নরকবাস অনিবার্য। আমরা একটা ঘোরতর পাপ করেছিলাম বহুদিন আগে। বিবেকের কাছে তার জন্য দায়ী হয়ে আছি। তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে যদি মরতে হয় তবে আমার আত্মা মুক্তি পাবে না। আপনারা যান, একজন যাজক এনে দিন আমার কাছে।’

‘কোথায় পাওয়া যাবে যাজক বলতে পারেন?

‘তা পারি। এই পথ ধরেই আধমাইল গেলে একটা সরাইখানা পাবেন। গ্রামটার নাম ঘোনি, ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে সন্ন্যাসিদের মঠে আছে একটা। মঠে খবর দিলে সন্নাসীরাই কেউ আসবেন।’

তখন রাওলেরা গাছের ডাল কেটে মাচা বেঁধে চাকরদের দ্বারা আহত লোকটিকে ওই সরাইখানায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করল। রাওল আর গিচে ততক্ষণে চলে যাবে ওই মঠে এবং সন্ন্যাসীদের কাউকে সরাইখানায় আসতে অনুরোধ করবে। মঠ থেকে তারা নিজেদের পথে এগিয়ে যাবে, সরাইখানায় আর ফিরবে না, কারণ সময় নেই তাদের। যে কোনো সময় যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যেতে পারে এবং যুদ্ধের আগেই তারা কন্ডির কাছে উপস্থিত হয়ে চায়। রাওল আর গিচে ঘোড়া ছুটিয়ে গ্ৰেনির দিকে চলে গেল। শিক্ষক চাকরের সাহায্যে আহত লোকটিকে নিয়ে আসছেন, তাকে আপাতত সরাইখানায় এনে তোলা হবে, সেখানেই ডাক্তার এবং যাজক ডেকে আনা হবে তার। জন্য।

সরাইখানার সামনে দিয়ে রাস্তা। সেখানে ঢুকে সরাইওয়ালাকে জানানো হলো একজন আহত লোককে তার হোটেলে নিয়ে আসা হচ্ছে। একে আশ্রয় দানের জন্য পাওনা যা হবে, তা সে শিক্ষকের কাছ থেকে পাবে, সে ততক্ষণে একখানা ঘর ঠিক করে রাখুক। তারপরই তারা ছুটল গ্রামের শেষে মঠের অভিমুখে, সেখান থেকে একজন যাজককে এক্ষুণি পাঠানো চাই।

ভাগ্য ভালো মঠ পর্যন্ত যেতে হলো না, নির্জন গ্রামের রাস্তা দিয়ে একটা গাধা আসছে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে। তার পিঠে এক আরোহী। পোষাক দেখে তাকে সন্ন্যাসী শ্রেণীর ধর্মযাজক বলেই মনে হবে। দুই বন্ধু উৎফুল্ল, তাদের কাজ সহজ হয়ে এল।

তাড়াতাড়ি গাধার মুখোমুখি দাঁড়াল তারা যাজকের দিকে এক পলক তাকিয়ে। কিন্তু কী রকম যেন লাগল তাদের। লোকটির বয়স কুড়ি বাইশের না, তবু বিভীষিকার একটা আবহাওয়া যেন ঘিরে রেখেছে ওকে। যাজক দেখলে যে সমবোধ মনে আসার কথা তা মোটেই আসছে না এদের মনে।

তা না আসুক, একে এখন প্রয়োজন, সুতরাং কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল একং নম্র করে রাওল বলল–‘গুরুদেব, একটি আহত লোককে শেষ সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আপনার কাছে কি আমরা অনুরোধ জানাতে পারি? সে কাছেই আছে।’

আশ্চর্য যাজকটি রাওলের কথা যে শুনতে পেয়েছে তাতে তিল মাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায় কেন?

পাশ কাটিয়ে সত্যিই চলে যাচ্ছে লোকটা।

গিচে এ ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারল না, ঘোড়ার মুখ ঘুড়িয়ে দিয়ে রাস্তা বন্ধ করল গাধার তারপর কঠিন স্বরে বলে উঠল, ‘এ আপনার কি রকম ব্যবহার যাজকভাই? প্রশ্ন শুনলে তার জবাব দিতে হয়, সেটা সাধারণ ভদ্রতা। আপনাকে যে অনুরোধ করা হয়েছে, সেটার সঙ্গে তো আপনার পোষাকের কোনো বিরোধ নেই।’

‘কথার উত্তর দেয়া না দেয়া আমার ইচ্ছে।’ নিচু গলায় অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল যাজক।

‘ইচ্ছে?’ গর্জে উঠল গিচে। আমরা সে শ্রেণির লোক নই, যাদের কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়া যায়।

রাওল দেখল যে কলহ বাধলে মৃত প্রায় লোকটির কাছে যাজককে নিয়ে যেতে ব্যাঘাতই সৃষ্টি হবে, সে শান্তভাবে কথা বলল রাগী যাজককে ঠাণ্ডা করার জন্য, তার প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলল এবং আবার অনুরোধ করল–যাজক যাতে অবিলম্বে সরাইখানায় গিয়ে ধর্মীয় সান্তনা দেন মুহুর্মুকে। গিচের কিন্তু রাগ কমে না। সে আবারও ধমকে উঠল, আপনি যদি না যান, আপনাকে বাধ্য করতে আমরা জানি।

এবার যাজক চোখ তুলে তাকাল। দুই চোখের দৃষ্টি যেন ছুরি হয়ে ঢুকে যায় একবারে মনের মধ্যে।

‘আমি যাচ্ছি’ আস্তে উত্তর দেয় সে।

রাওলই তাকে বুঝিয়ে বলে–‘সরাইখানায় গেলেই আহত লোকটিকে পাবেন। আঘাত খুবই সাংঘাতিক তার। ডাক্তার যদি পাওয়া যায়ও তাহলেও কোনো উপকার হবে না। উপকার যদি হয়, আপনার দ্বারাই হবে, আপনি এগিয়ে যান, আমরা আপনার সঙ্গে যেতে পারছি না। কারণ আমাদের তাড়া আছে। ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছি আমরা।’

গিচেও তার কথা বলে–‘আমরা অন্যদিকে যাচ্ছি সত্যি, কিন্তু এই পথেই ফিরব। তখন যদি শুনতে পাই যে আপনি যাননি বা কর্তব্যে অবহেলা করেছেন, তা হলে আপনি যেখানেই থাকুন, আপনাকে খুঁজে বার করে সে অবহেলার সাজা দেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। তা জেনে রাখুন।’

আবার সেই ছুরি ঝলসে উঠল যাজকের চোখে। কিন্তু চোখ নামিয়ে সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল–‘আমি তো যাচ্ছিই।’

তারপর যাজক তার খচ্চর চালাল গ্রামের দিকে, আর গিচে রাওলও ঘোড়া ছোটাল ক্যাম্বিন শিবিরের দিকে, কন্ডি সেখানে আছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যদি তার কাছে হাজির না হওয়া যায়, এত তাড়াতাড়ি করে ছুটে আসা একান্তই বৃথা যাবে।

যাজক এসে যখন সরাইখানায় পৌঁছাল, আহত লোকটি তখন ঘরের ভেতরে। একটু আগেই গিচের শিক্ষক তাকে এখানে এনে তুলেছেন।

মুমূর্ষকে যখন ঘরে ঢোকানো হচ্ছে, সরাইওয়ালা আর তার স্ত্রী তখন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুজনেই তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে এবং কি আশ্চর্য! দুজনে একই সঙ্গে চমকে, শিউরে উঠেছিল।

সরাইওয়ালা তার স্ত্রীকে বলল, ‘চিনতে পারলে?’

‘পারিনি আবার! আমাদের ভাগ্যে যে কি আছে, কে জানে।’ স্ত্রী কপালে আঘাত করে বলল–‘ভাগ্যে আছে ঘোরতর বিপদ, তা নইলে বেথুনের ঘাতক আমাদের ঘরে এসে উঠবে কেন?’ ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই যাজক ‘বেথুন ঘাতক’ কথাটি তার কানে প্রবেশ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে গেল।

.

প্রায় আধঘণ্টা পরে। গিচের শিক্ষক চাকরদের নিয়ে সরাই থেকে চলে গিয়েছে, গিচের সাথে যোগ দিতে হবে তাকে।

এদিকে যাজক ঢুকেছে মুমূর্ষের রুমে, সে রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কারণ মৃত্যুপথযাত্রী যখন যাজককের কাছে পাপ স্বীকার করে যাজক ভিন্ন অন্য কারো তা শোনা নিষেধ।

‘হ্যাঁ, আধঘণ্টা কেটে গিয়েছে, নতুন একজন পথচারী এসে সরাইতে ঢুকল, এ মিড, যার জন্য রাওল সারা পথে হোটেলে ঠিকানা রেখে যাচ্ছে।’

গ্রিমড এসেই জিজ্ঞেস করল—’এ পথে ষোলো বছর বয়স্ক কোনো তরুণ যোদ্ধা গিয়েছে কি?’

সরাইওয়ালা বলে উঠল–‘গিয়েছে বইকি? মাত্র আধঘণ্টা আগে তিনি এখানেই ছিলেন, ভাইকাউন্ট ব্যাগোলন? তিনি আজ রাতে ক্যাম্বিনে থাকবেন। সেখানে গিয়েই ধরতে পারবেন তাকে।’

যাক নিশ্চিন্তা গ্রিমড হাফ ছেড়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। কিছু খাবার আনার জন্য বলল সরাইওয়ালাকে।

খাবার আসতে দেরি হলো না, গ্রিমড খেতে শুরু করেছে–

এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।

সবাই চমকে উঠল! কার আর্তনাদ! কোথা থেকে?

ভেতরের ঘর থেকে, সেখানে আছে ওই আহত ব্যক্তি আর যাজক।

কে সেই আহত, গ্রিমড উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসার উত্তরে সবে বলতে শুরু করেছে সরাইওয়ালাও, এমন সময়ে আবার আবার একটা আর্তচিৎকার, এবার আর তত তীক্ষ্ণ চিৎকার নয়, অনেকটা যেন কাতরানির মতো।

গ্রিমড আর নির্লিপ্ত থাকতে পারল না, ছুটল আর্তনাদ লক্ষ্য করে, ছুটল সরাইওয়ালাও। আহতের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, এদিক থেকে সজোরে, ধাক্কা দিল গ্রিমড। কেউ দরজা খোলে না, কোনো সাড়াও দেয় না, কিন্তু কাতর আর্তনাদ সমানভাবে শোনা যাচ্ছে, না সমানভাবে নয়, স্বরটা যেন ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে।

‘দরজা ভাঙতে হবে,’ বলে গ্রিমড।

সরাইওয়ালা সায় দিলে, দরজা ভাঙতেই এক বীভৎস দৃশ্য দেখে দুজনেই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল। বিছানার উপর সেই আহত লোকটি পড়ে আছে, তার বুকে একটি লম্বা ছোরা, ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তের স্রোতে।

মুহূর্তে ভয় এবং আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রিমড এগিয়ে গেল ঘরের ভেতর, এ লোকটাকে ছোরা মারল কে? শুধুমাত্র যাজক ছিল এই ঘরে, সে কোথায় গেল? কোথাও নেই সে, জানালা অবশ্য ভোলা রয়েছে। ওই পথ দিয়ে পালিয়ে গেছে সে।

সরাইওয়ালা ছুটে বেরিয়ে গেল, যাজককে ধরার জন্য এবং ডাক্তারকে ডাকার জন্যও। গ্রিমড গিয়ে ঝুঁকে পড়ল বিছানার উপর। লোকটা এখানো মরেনি।

মরেনি এবং তাকে দেখেই গ্রিমড আবার এক পা পিছিয়ে এল ভয়ে, বিস্ময়ে তার মুখ থকে বেরিয়ে এল একটা অর্ধস্ফুট শব্দ–‘বেথুনের সেই ঘাতক!’

.

৩.

মনে ব্যথা নিয়ে ফিরে এসেছে দ্যার্তেগা আর পোর্থস, অ্যাথোস আর অ্যারামিস ছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তারা আজ শত্রুপক্ষে।

আজ যারা শত্রুপক্ষে, কাল তারা শত্রু হয়ে দাঁড়াতে কতক্ষণ? আজ বোফোর্টের জন্য যারা তরোয়াল তুলেছে দ্যার্তেগা-পোর্থসের মাথার উপর, কাল যে তারা নিজেদের স্বার্থের খাতিরে সেই তরোয়াল তুলবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?

কিন্তু বিদায়ের সময় অ্যাথোস বলে দিয়েছে–প্যারিসে এসে তারা এ সম্বন্ধে আলোচনা করবে। আজই রাত দশটার সময় তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা, হোটেল রোহানের পাশে একটা ছোট পার্ক আছে, অত রাত্রে সেখানে জনপ্রাণী থাকবে না, আলোচনা হবে সেখানে।

‘আলোচনা, না যুদ্ধ’ দ্যার্তেগা বাকা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে পোর্থর্সকে। বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছে, এখন বিশ্বাসঘাতকতা।

পোৰ্থস সাদাসিধে, সে বলে–‘যুদ্ধ হয়–হতে কতক্ষণ? হোক, আমরা তাতে পিছপা নই, কারণ ওরা পঞ্চাশ জন ছিল, আজ আমরাও দুজন, ওরাও দুজন। দেখে নেব।’

রাত নটাতেই ওরা প্রস্তুত হয়ে রওনা হল, লম্বা আলখেল্লার নিচে লুকিয়ে রাখল লম্বা তরোয়াল, প্রস্তুত থাকা ভালো, কি জানি যদি যুদ্ধই করতে হয়।

অ্যাথোস আর অ্যারামিসও দেরি করল না। অস্ত্র নিয়ে তারাও এসেছে। অ্যাথোস অবশ্য আসতে চায়নি, আসতে বাধ্য হয়েছে অ্যারামিসের জন্য। অ্যারামিস বিশ্বাস করে না এদেরকে, বিশেষ করে দ্যার্তেগাকে। পার্কের গেট তালা বন্ধ, চাবি থাকে রোহান হোটেলে, অ্যারামিস সবাইকে চেনে, সে গিয়ে চাবি নিয়ে এল সেখান থেকে, চারজন গিয়ে বসল এক গাছের নিচে, অন্ধকারে।

অভিযোগ, অনুযোগ, অসন্তোষ, আক্ষেপ, রাগারাগি থেকে ক্রমশ আক্রমণের পর্যায়ে। বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই, ক্রোধে, উত্তেজনায় আলখেল্লার নিচে তরোয়ালের বাট ধরেছে শক্ত করে।

একই নালিশ উভয় পক্ষের মুখে–সরলতার অভাব তোমাদের, আগে কেন বললে না যে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ। এ ঠিক যেন পিছন থেকে ছুরি মারা।

অবশেষে সমস্ত ঝগড়ার উপর শান্তিজল ছিটিয়ে দিল অ্যাথোস। নিজের তরোয়াল হাঁটুর চাপে দুই টুকরো করে ভেঙে ফেলে দিল বুক চিতিয়ে দাঁড়াল দ্যার্তেগার সামনে–‘ইচ্ছে হয় তোমার তরোয়াল বসিয়ে দাও আমার বুকে, আমি কখনও বন্ধুকে আঘাত করতে পারব না।’

এ মহৎ দৃষ্টান্ত কি অন্তর স্পর্শ না করে পারে? যারা অস্ত্র কোষ মুক্ত করেছিল, তারা কোষবদ্ধ করল আবার, আগের দিনের সাহচর্যের মধুর স্মৃতি তাদের হৃদয় করে তুলল সিক্ত, আপ্লুত পোৰ্থস আর অ্যারামিস পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল বুকে, দ্যার্তেগা অ্যাথোসের বুকের উপর পড়ে চোখের জল ফেলতে লাগল।

তারপর সবাই একটু শান্ত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হলো আবার, এবার আলোচনায় অতীত নেই, আছে ভবিষ্যৎ একটা নীতি স্থির করতে হবে, একটা কর্মসূচী চাই।

অ্যাথোস বলল–‘বোফোর্টও আমার কেউ নয়, দ্যার্তেগারও কেউ নয় ম্যাজারিন, সাময়িক প্রয়োজনে আমরা যে যার দলে যোগ দেই না কেন, আসলে আমরা চারজনে এক দল, যে দল চিরদিন এক থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। বিরোধী দলে আমরা কাজ করতে পারি, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ আমরা প্রাণ গেলেও করব না, যুদ্ধ ক্ষেত্রে, শত্রু শিবিরে যখন যেখানে আমাদের সাক্ষাৎ হবে, আমরা যেন সেখানেই পরস্পরের সংকটকে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারি। যে কোনো প্রয়োজনে চারবন্ধু যেন একান্ন হয়ে চেষ্টা করতে পারি। ঠিক সেই বিশ বছর আগের মতো।’

এই শপথকে হৃদয় দিয়ে মেনে নিল চারবন্ধু, তাদের নীতি হল, বীরে সমাজে বন্ধুত্বের আদর্শ স্থাপন। একের জন্য চার। চারের জন্য এক।

রাত্রি অনেক হয়েছে। আজকের মতো আলোচনা শেষ করতে হয়, কিন্তু কাল আবার মিলিত হবে। ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগার এ আনন্দকে এত সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না। ঠিক হলো একটা নির্দিষ্ট হোটেলে পরদিন সন্ধ্যা বেলা চার বন্ধু আবার এক হবে এবং রাতের খাবার খাবে।

অ্যাথোস জানে, খাবার টেবিলে মনের উদারতা বেড়ে যায়, হৃদয় হয় নরম। অতীতের অনেক ভুলই শ্যাম্পেনের গ্লাসে ডুবে যায়।

.

পরের দিন সন্ধ্যায় খাবারের টেবিলে বিশ বছর আগের সুবাতাস বইছে, পোর্থসের হাসিতে ভরে উঠছে সারা হোটেল। অ্যারামিস আর দ্যার্তেগা পরস্পরকে হানছে রসিকতার তীক্ষ্ণ ছুরি, সাথে অ্যাথোস বড় ভাই সুলভ হাসিতে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে তিনজনকে।

হঠাৎ অপ্রতাশিত ভাবেই সেখানে ঢুকল গ্রিমড। অ্যাথোস চমকে উঠল। তবে কি কোনো বিপদ ঘটল প্রিয় রাওলের? কী সর্বনাশ! রাওল যে একমাত্র অবলম্বন অ্যাথোসের জীবনে। ঈশ্বর কী কেড়ে নেবেন সেই সম্বলকে।

কিন্তু অ্যাথোসের সুস্পষ্ট আদেশ ছিল গ্রিমড রাওলের সঙ্গে থাকবে যুদ্ধক্ষেত্রে। গুরুতর কারণ না ঘটলে গ্রিমড অ্যাথোসের সামান্য আদেশ ফেলত না।

‘রাওল বেঁচে আছে তো’ সরাসরি প্রশ্ন করে অ্যাথোস।

‘না, না, ভাইকাউন্টের কিছু হয়নি মালিক, সামান্য বিপদও নয়, সে জন্য আপনি ভাববেন না।’

‘ওঃ বড় ভাবিয়ে তুলেছিল, যাক রাওল যখন বেঁচে আছে, তখন কোনো কিছুতেই আমি বিচলিত হব না।’

‘কিন্তু এমন খবর এনেছি, যাতে মলিক নিশ্চয়ই বিচলিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। বেথুনের সেই ঘাতক। তাকে মনে আছে? মালিক অথবা মালিকের মাননীয় বন্ধুগণের?’

বেথুনের ঘাতক! অ্যাথোসের ঠিকই মনে আছে, মনে আছে দ্যাগো, পোর্থস ও অ্যারামিসেরও। সে সেই নারীপিচাশী সিন্যাকির মাথা কেটে ছিল লয়ার নদীর পাড়ে বিশ বছর আগের এক অন্ধকার রাতে। হ্যাঁ মরে আছে বই কি। সে ঘটনা ভুলার নয়।

অ্যাথোস উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে–‘কী হয়েছে সেই বেথুনের ঘাতকের?’

‘সে মারা গেছে কাল রাত্রে।’

‘তাই? মরে থাকলে তো ভালই হয়েছে, বিবেকের দংশনের হাত থেকে বেচেছে লোকটা। তুমি জানলে কী করে? প্রশ্নটা অবান্তর বলে মনে হয়।’

‘বেথুনের কাছাকাছিই তো যুদ্ধ হচ্ছে।’

‘তা সত্য, কিন্তু কীভাবে মারা গেল বেথুনের ঘাতক?’

‘আততায়ীর ছোরার আঘাতে।

আবার একটা চমক খেল সবাই, ঘাতককে কে করবে ছোরার আঘাত? তার কে এমন শত্রু থাকতে পারে?

‘ছিল একজন।’ বলতে গিয়ে গ্রিমড যেন শিউরে ওঠে–‘একজন ছিল তার দারুণ শত্রু। মিল্যাডি।’

সে নাম শুনে শিউরে উঠলেও মুখে সবাই একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করল—’মিল্যাডি মারা গিয়েছে কবে।’

‘কিন্তু মিল্যাডির ছেলে বেঁচে আছে।’ নিয়তির মতো নির্মম শোনায় গ্রিমডের কথা।

‘ছেলে? মিল্যাডির ছেলে ছিল নাকি?’ ভূতে পাওয়া লোকের মতো দেখায় চার বন্ধুকে।

‘ছিল তো বটেই। সে এখন বাইশ বছরের যুবক, মায়ের হত্যার বদলা নিতে সে ফ্রান্সে এসে হানা দিয়েছে, তার প্রথম শিকার ওই বেথুনের ঘাতক।’

‘লোকটার–ছেলেটার নাম কী?’

‘বেথুনের ঘাতক বলেছিল মর্ডন্ট ওই ছেলেটার নাম।’

‘ওই মর্ডন্ট রাওলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি তো?’

‘হয়েছে বইকি, তা নইলে আর নিয়তির খেলা বলছিলেন ব্যাপারটাকে?’ ভাইকাউন্ট রাওলই যাজকবেশী মর্ডন্টকে পৌঁছে দেন আহত ঘাতকের শেষ শয্যার কাছে।

অ্যাথোস কপাল চাপড়ে বললেন ‘সত্যিই নিয়তি’।

এবার গ্রিমডও সমস্ত কাহিনী খুলে বলল। সেটা এরকম :

গ্ৰেনির সরাইখানায় খেতে খেতে পরপর দুটো আর্তনাদ শুনতে পায় গ্রিমড। খাওয়া ফেলে সে ছুটে যায় স্বর লক্ষ্য করে। কাতরানি শোনা যাচ্ছিল একটা ঘরের ভেতর থেকে। তার দরজা বন্ধ। দরজা ভেঙে সে দেখতে পেল একটা লোক বিছানায় পড়ে আছে। তার বুকে একটা ছোরা গাঁথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা।

আহত লোকটিকে দেখেই চিনল সে, লোকটি সেই বিশ বছর আগের দেখা বেথুনের ঘাতক।

একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় চার বন্ধুর মুখ থেকে। ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ সেই আওয়াজে।

গ্রিমড বলে চলে তার গল্প।

বেথুনের ঘাতক তখনো মারা যায়নি। অতি কষ্টে তার মুখ থেকে কাহিনীটি শুনেছে গ্রিমড। যাজককে আনা হয়েছিল শেষ স্বীকারোক্তি শোনাবার জন্য। সেই কারণে আত্মপরিচয় দিতে হয় তাকে। পরিচয় শুনেই হলদে মুখ লাল হয়ে যায় যাজকের।

প্রশ্ন করে বিশ বছর আগের সেই দুযযার্গের রাতেও বীভৎস কাহিনী সে। সবই শুনে নিল, মিল্যাডির বিচার ও মাথা কাটার কাহিনী। প্রশ্নের ভঙ্গী থেকে ঘাতকের মনে হয়েছিল এ কাহিনীর কিছু অংশ তার আগে থেকেই জানা।

মিল্যাডির কথা বলতে বলতে একসময় ঘাতক উল্লেখ করে মিল্যাডির আগের নাম ছিল অ্যান নই। ব্যস, এই নামটি শুনেই যাজকের চেহারা পাগলের মতো হয়ে গেল। ‘তুমি অ্যান ব্রুনইকে হত্যা করেছিলে?’ বলেই ছুটে এসে ছোরা বসিয়ে দিল ঘাতকের বুকে, তারপর ‘আমি অ্যান ব্রুইনের পুত্র’ এই কথাটি ঘাতকের নাকের কাছে মুখ এনে বলল। সে তো মানুষের কথা নয়, যেন সাপের হিসহিসানি। ওটাই ছিল যাজকের শেষ কথা। তারপর সে জানালা খুলে পিছন দিক দিয়ে লাফিয়ে পড়ল বাইরে।

শেষে গ্রিমড জানাল–সরাইওলা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যাজক বা তার গাধার সন্ধান পায়নি।

‘কিন্তু সে কোথায় গিয়েছে, তা আমি জানি?’–জোর দিয়ে বলে উঠে গ্রিমড–‘সে এসেছে এই প্যারিসে। শত্রু তার ছয়জন, ছয়জনের মধ্যে একজন গেল–বাকি আরও পাঁচ। পাঁচের চারজন আপনারা আর একজন বোধহয়—’

‘লর্ড উইন্টার’ কথা যুগিয়ে দেয় অ্যাথোস।

‘নিশ্চয়, গ্রিমড বলে জানি না তিনি এখনও বেঁচে আছেন কি না। কিন্তু আপনারা জীবিত। মিল্যাডির ছেলে এখন ছোরা শানাচ্ছে আপনাদের রক্তপাতের জন্য। আপনারা সতর্ক হোন, সে হয়তো খুঁজছে আপনাদের। হয়তো এই মুহূর্তে রাজপথ থেকে এই ঘরের জানালার দিকে লক্ষ্য রেখেছে সে।’

অ্যারামিস তাড়াতাড়ি জানালার পর্দা টেনে দিল, পোর্থস বুকের উপর আঁকল ক্রশের চিহ্ন।

কিন্তু দ্যার্তেগা হাসল–‘আমরা কি চারটা জোয়ান বীর পুরুষ, না দাঁত হীন বুড়ী? একটা মাত্র বালক তা সে যত শক্তিশালী দুবৃত্তই হোক, আমাদের পিছু নিয়েছে বলে আমরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকব?’

অ্যাথোস ধীরে ধীরে গম্ভীর স্বরে জবাব দিল–‘না আমরা থাকব না, যে অবস্থাতেই পড়ি, বীরের যোগ্য আচরণ আমরা করব বই কি! তবে এটা ঠিক যে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ওই একটিমাত্র বালকই আমাদের চারজন বীরপুরুষের সঙ্গে সমানে-সমানে মোকাবিলা করার শক্তি রাখে।’

‘বলো কি। এমন মানুষ দুনিয়ায় আছে বলে বিশ্বাস করি না, বলে ওঠে দ্যার্তেগা।

‘ও মানুষ নয় বন্ধু, ও মানুষ রুপের পিশাচ।

অ্যাথোসের ভাগ্য ভালো, তার সমস্ত দুঃখ ঘুচিয়ে দেয়ার জন্য রাওল হঠাৎ এসে পড়ল। সুসংবাদ নিয়ে এসেছে সে, রাজা ও রানীমার কাছে সুসংবাদের বাহক হয়ে এসেছে। প্রিন্স কন্ডির সুনজরে সে পড়ে গিয়েছে এর মধ্যে। তাই কন্ডি তাকেই বেছে নিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের খবর রাজধানীতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। লেনস এর যুদ্ধে স্পেনীয় বাহিনীকে শেষ করেছেন কন্ডি। ফরাসি সীমান্ত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন শত্রুকে।

রাওল রাজ সভা থেকে এসেই অ্যাথোসের সঙ্গে দেখা করল এবং রাত্রিটা তার কাছে কাটিয়ে সকাল বেলাতেই রওনা হয়ে গেল ব্রাগোলেন দুর্গের দিকে, ব্লয় নগরীর কাছেই ব্রাগোলন অ্যাথোসের বাড়ি। সেখানকার বন্ধু বান্ধবীদের জন্য রাওল খুব উৎকণ্ঠা বোধ করছে।

অ্যাথোস দুঃখ পেল একটু। সংসারে রাওল ছাড়া আর তার অন্য কোনো অবলম্বন নেই, সে এখনও সংসারে রয়েছে, সে শুধু এই রাওলের মুখ চেয়ে। সেই রাওল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসে এক রাতের বেশি অ্যাথোসের কাছে থাকতে পারছে না, সংসার এমনই বিচিত্র জায়গা।

কিন্তু অ্যাথোসের এ দুঃখ অল্প সময়ের জন্য। পরের দিনই সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিল যে রাওল সেই মুহূর্তে তার কাছে ছিল না, কিন্তু সে কথায় পরে আসছি।

.

রাজা, রানীমা ও মহামন্ত্রী ম্যাজারিন থাকেন প্যালেই–রয়েল নামক নামের প্রাসাদে, আগের দিনের স্যুভর প্রাসাদ এখন বাতিল বললেই হয়। সেখানের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা রানী হেলরিয়েটা।

এই রানী হেলরিয়েটা ইংল্যান্ডের রাজা চার্লসের স্ত্রী, ফ্রান্সের রাজকন্যা। বর্তমান রাজার দাদা (পিতামহ) যে চতুর্থ হেনরি, তারই কন্যা। ইংল্যান্ডে প্রজা বিদ্রোহ চলেছে ভয়ানক ভাবে। যুদ্ধে রাজা চার্লস পরাজিত হয়েছেন প্রজাদের হাতে নিরাপত্তার জন্য রানীকে এবং বেশির ভাগ ছেলে মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বিদেশে। প্রথম পুত্র গিয়েছে হল্যান্ডে। রানী একটি কন্যাকে নিয়ে এসেছেন বাপের বাড়ি ফ্রান্সে।

এখানে তিনি আশ্রয় পেয়েছেন, আর কিছু পাননি, কৃপন ম্যাজারিন রাজা লুইকে ঘেঁড়া বিছানায় শুতে বাধ্য করেন, আর তিনি অন্য দেশের রানী, নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত রানীর আরামের কী ব্যবস্থা করবেন? অতিকষ্টেই কাটে হেলরিয়েটার, শীতকালে ঘরে আগুন জ্বালাবার টাকা জোটে না তার। সারাদিন বিছানাতেই শুয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে আত্মরক্ষার কারণ। একটি চাকরও নেই। বাইরের লোক এলে রাজকুমারীকেই গিয়ে দরজা খুলে দিতে হয়।

এমনি সময় ইংল্যান্ড থেকে দূত এল তার কাছে দ্রুত। আর কেউ নয় লর্ড উইন্টার। রাজা চার্লসকে ইংল্যান্ডের সমস্ত লর্ডেরাই ত্যাগ করেছেন, ত্যাগ করেননি শুধু উইন্টার। আজ তিনি চালর্সের চিঠি নিয়ে এসেছেন হেনরিয়েটার কাছে, একটি অতি প্রয়োজনীয় চিঠি।

রাজা চালর্স এই চিঠিতে জানতে চেয়েছেন, শেষ যুদ্ধে যদি তিনি ক্রমওয়েলের (অতি সাধারণ ঘরে জন্ম, কিন্তু প্রজা বিদ্রোহের ইনিই ছিলেন নেতা, চার্লসকে পরাজিত ও নিহত করার পর ইনিই ইংল্যান্ডের শাসক হন) হাতে পরাজিত হন, ফ্রান্স কি তাকে আশ্রয় দেবে?

রানী হেনরিয়েটা এ প্রশ্নের জবাব দেবেন কেমন করে? তাকে তাহলে ম্যাজারিনের কাছে যেতে হবে।

ম্যাজারিনের কাছে? লর্ড উইন্টারের ভালো লাগে না এ কথা। যেতে যদি হয়ই রানী হেনরিয়েটার যাওয়া উচিত রানী অ্যানের কাছে, উনিও রানী, উনিও রানী, তার উপর দুই রানীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, অ্যানের কাছে গিয়ে যদি ব্যর্থ হয়ে ফিরতেও হয় তবু তাতে অপমান নেই। কিন্তু ম্যাজারিন? সেদিন পর্যন্ত যে এক ফরাসি যাজকের চাকর ছিল, তার কাছে ইংল্যান্ডের রানীর যাওয়া উচিত নয়। আর গেলেও আবেদন সফল হওয়ার নিশ্চয়তা কি? ইতালী কি বুঝবে? কিন্তু হেনরিয়েটা জেদ করে ম্যাজারিনের কাছেই গেলেন।

ক্রমওয়েলও চিঠি লিখেছেন ফ্রান্সে, তার দূত একটু আগেই চিঠি এনে দিয়েছে ম্যাজারিনের হাতে, সে দূত আর কেউ নয় হত্যাকারী মর্ডন্ট হেনরিয়েটা আসছেন সংবাদ পেয়েই ম্যাজারিন পিছনের সিঁড়ি দিয়ে মর্ডন্টকে প্রাসাদ থেকে বার করে দিয়েছেন। হেনরিয়েটা ঢুকেছেন সামনের দরজা দিয়ে, মর্ডন্ট বেরুচ্ছে গুপ্তদ্বার দিয়ে।

শেষ পর্যন্ত হেনরিয়েটাকে খালি হাতেই ফিরতে হলো, ম্যাজারিনকে তিনি কোনো মতেই রাজী করাতে পারলেন না, পরাজিত রাজা চার্লস যদি ইংল্যান্ড থেকে পালাতে পারেন, ফ্রান্সে তার ঠাই হবে না, তাকে আশ্রয় নিতে হবে স্পেন বা হল্যান্ডে। কারণ? আছে বই কি? অন্য দেশের যুদ্ধে নাক গলাতে ইচ্ছুক নন ম্যাজারিন। নিজের অশান্তিরই শেষ নেই তার, এখানেও প্রজারা বিদ্রোহী হয়েই আছে বলা যায়। ক্রমওয়েল যদি উসকানি দেন চ্যানেলের ওপার থেকে, এখানেও রক্তনদী বয়ে যাবে দেখতে দেখতে, না ক্রমওয়েলকে শত্রু করতে পারেন না ম্যাজারিন। মহান চতুর্থ হেনরি কন্যার জন্যও না।

হেনরিয়েটার মুখে খবর শুনে বড়ই মুষড়ে পড়লেন লর্ড উইন্টার। কোনো আশ্বাস না নিয়েই তিনি চার্লসের কাছে ফিরে যাবেন?

না, তা কিছুতেই হবে না, ফরাসি রাজশক্তির কাছে সাহায্য না পান, ফরাসি জনসাধারণের সাহায্য পাওয়ার একটা চেষ্টা তাকে করতেই হবে। কিন্তু জনগণ এখন নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। ম্যাজারিনের শোষণ ও কুশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছে যারা রাজপক্ষ তাদের ব্যঙ্গ করে ‘ফ্রন্ডি’ নাম দিয়েছে। ফ্রন্ডি বলতে সেই সব নিষ্কর্মা রাস্তার ছেলেদের বুঝায় যারা ঢিল মেরে ব্যাঙ মারে রাস্তার নর্দমায়, আর পুলিশ দেখলেই ছুটে পালায়, রাজার দল ব্যঙ্গ করে ফ্রন্ডি নাম দিয়েছে তাদের, তারা সে নাম গৌরবে মাথায় তুলে নিয়েছে। ফ্রন্ডির ভয়ে ম্যাজারিন এখন তটস্থ।

তাহলে রাজা প্রজা কোনো দিকই থেকেই কোনো সাহায্যের আশা নেই। না, আছে। হঠাৎ উইন্টারের মনে পড়ে গেল বিশ বছর আগের কথা দ্যার্তেগা, অ্যাথোস, পোর্থস আর অ্যারামিসের কথা সেই অদ্ভুত করিতকর্মা সৈনিক চারজন এখন কোথায়? তাদের যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, রাজা চার্লসের বন্ধুহীন অবস্থার কথা বুঝিয়ে হেনরিয়েটা যদি সেই উদারচেতা বীর পুরুষদের অনুকম্পা জাগিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে ওই চারটি তরবারি অন্তত ইংল্যান্ডের রাজার সেবায় আন্তরিকভাবেই নিয়োজিত হবে এবং পূর্ব অভিজ্ঞা থেকে উইন্টার ভালই জানেন যে পুরো একটি সৈন্যবাহিনীর চাইতে ওই চারজন সৈনিকের অনুগত্যের মূল্য অনেক বেশি।

চেষ্টা থাকলে উপায় হয়ই, অপ্রত্যাশিতভাবে কাউন্ট দ্য ল ফেয়ারের ঠিকানা পেয়ে গেলেন উইন্টার। রানী হেনরিয়েটার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল রাওল, তার মুখ থেকেই, সেদিনই উইন্টার সাক্ষাৎ করলেন কাউন্টের। অর্থাৎ অ্যাথোসের হোটেলে গিয়ে, তাকে এবং অ্যারামিসকে নিয়ে এলেন রানীর বাসস্থানে।

রানী বাসস্থানের গরীবি দশা দেখে ওরা দুজনই রেগে আগুন। ফরাসি সরকার এমনই নীচ যে মহান চতুর্থ হেনরীর কন্যাকে তারা উপযুক্ত আতিথেয়েতা দিতে নারাজ।

হেনরিয়েটার দুর্দশা দেখেই বিচলিত হয়েছে অ্যাথোস ও অ্যারামিস এখন হেনরিয়েটার মুখ থেকে কাতর আবেদন শুনেই দুজনে সমস্বরে প্রতিজ্ঞা করল যে ইংল্যান্ডে গিয়ে রাজা চার্লসের সেবায় তারা প্রাণ দেবে।

উইন্টার প্রশ্ন তুললেন দ্যার্তেগা আর পোর্থসের সম্পর্কে, তাদের কেন পাওয়া যাবে না?

অ্যাথোসই বুঝিয়ে দিল, ওরা ম্যাজারিনের পক্ষে এবং ম্যাজারিন ক্রমওয়েলের পক্ষে। কাজেই দ্যার্তেগা আর পোর্থসের সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

‘কী করে এটা সম্ভব হলো?’ জিজ্ঞাসা করেন উইন্টার। ওই নীচ ম্যাজারিনের আদেশ মানবে দ্যার্তেগা বা পোর্থসের মতো মহাপ্রাণ বীর প্ররুষ! এ যে কল্পনা করাও যায় না।

নিশ্বাস ফেলে অ্যাথোস বলল–‘ঘটনা চক্র ছাড়া আর কিছুই না, দ্যার্তেগা তো রাজকর্মচারী। যে যখন শাসনতন্ত্রের কাণ্ডারী, তারই আদেশ মানতে হবে সৈনিককে। আর পোর্থ? তার প্রয়োজন একটা উপাধি–ব্যারণ বা ডিউক। সে উপাধি ম্যাজারিন ছাড়া কেউ দিতে পারে না।’

রানী হেনরিয়েটা বিষণ্ণ ভাবে বললেন, ‘পারতাম আমি। একবার ইংল্যান্ডের প্রজা বিদ্রোহ দমন করে দিন আপনারা, সাহায্যকারী প্রত্যেককে আমি ডিউক উপাধি দেব, দেব ডিউকের মর্যাদা অনুযায়ী জমিদার। কিন্তু পোর্থস কথা দিয়েছে ম্যাজারিনের কথার খেলাপ করে না, এখন হেনরিয়টের প্রস্তাব নিয়ে পোর্থসের কাছে গেলে অপমানই করা হবে তার।’

ঠিক হলো দ্যার্তেগা আর পোর্থসের আশা ত্যাগ করে অ্যাথোস আর অ্যারামিস যাবেন উইন্টারের সঙ্গে, কোথায় তারা যাচ্ছেন, তা জানার দরকারও নেই বন্ধুদের বিদায় জানালেন, বন্ধুরা বিদেশে যাচ্ছে শুনে দ্যাগে তাদের পাঠিয়ে দিল সব পিস্তল, পোর্থসকে পাঠালে দুইশো লুই সমান ভাগ করে নেবে দুজনে।

দ্যার্তেগার কাছে আর একটি অনুরোধ ছিল অ্যাথোসের, রাওলের দেখাশুনা যেন করে সে, যখন সৈন্যবাহিনীতে সে ফিরে যাবে, তখন আর অভিভাবকত্বের প্রশ্ন উঠে না, যতক্ষণ রাজধানীর অশান্তির পরিবেশে সে থাকবে, ততক্ষণই তার অভিভাবকের প্রয়োজন, সে দায়িত্ব নেবার পক্ষে দ্যার্তেগার চেয়ে যোগ্যতর কে আছে? বীরত্বে, মর্যাদায়, দূরদর্শিতায়, দ্যার্তেগা অতুলনীয়। তার চেয়ে বড় কথা, সে রাওলকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে।

গেনম এর যুদ্ধে প্রিন্স কন্ডি জয় লাভ করেছেন, ফ্রান্সের গৌরব সূর্য আজ মধ্য আকাশে। শেষ হয়ে আসা রাজশক্তির মর্যাদা এতে অনেকখানি বেড়ে গেল। এই আনন্দের দিনে বড় একটা উৎসবের অনুষ্ঠান হলো সারাদেশে। রাজা ও রাজমাতা এলেন নোতরদাম গির্জায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেবার জন্য। জাঁকজমকের শেষ নেই, শহর ভেঙে পড়েছে নোতরদামের রাস্তায়।

প্রজারা এদিকে রাজার জয়ধ্বনি করে আকাশ ফাটিয়ে ফেলছে, রাজার পক্ষ থেকে রানী অ্যান ওদিকে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্রুসেলকে ধরে এসে ব্যাস্টিলে আটকে রাখার জন্য।

কে ব্রুসেল? জননায়ক। প্যারিসের জনগণের মুখপাত্র। কাজ শেষ হবে বলে আশা করলেও তা হলো না। জনগণ টের পেয়ে গেল, ব্রুসেলকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে রাজসৈন্যরা, কাতারে কাতারে মানুষ এসে পড়ল চারদিক থেকে। দাঙ্গা বেধে গেল। গাড়ি ঘিরে রেখেছে বিশজন সৈন্য। তাদের ঘিরে ধরেছে দুই হাজার দাঙ্গাবাজ।

অসম যুদ্ধে রাজসৈন্যরা কচুকাটা হয়ে যেতে বসেছে এমন সময়ে একটি তরুণ যোদ্ধা এসে সৈন্যদলের শক্তি বৃদ্ধি করল। বয়সে সে নবীন কিন্তু তরোয়াল চালাচ্ছে প্রবীণ সৈনিকের মতো। তার তরোয়ালের নাগালের ভেতরে যে আসছে, সে আর রক্ষা পাচ্ছে না।

এ হচ্ছে রাওল ব্রাগেলোন থেকে ফিরে এসে সবে প্যারিসে প্রবেশ করেছে।

কিন্তু জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রাওলের তরোয়াল তাদের বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারল না। তাদের সম্মিলিত আক্রোশ এসে পড়ল রাওলের উপর। জীবন সংশয় হয়ে দাঁড়াল রাওলের।

হঠাৎ লম্বা তরোয়ালের আঘাতে ঘন জনতার ভেতর দিয়ে রাস্তা করে নিতে নিতে রাওলের কাছে এসে পড়ল দুজন সৈনিক। তারা দ্যার্তেগা আর পোর্থস।

দ্যার্তেগারা এসে পড়ায় শুধু রাওলের যে জীবন রক্ষা হলো তা নয়, ব্রুসলকেও ব্যাস্টিলে পাঠানো সম্ভব হলো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দ্যার্তেগা বা পোর্থসের অস্ত্রের সামনে দাঁড়াবে জীবনের প্রতি এত বিতৃষ্ণা কারো নেই।

দ্যার্তেগা সেই দিনই রাওলকে সৈন্য শিবিরে পাঠিয়ে দিল, সেখানে সে, নিরাপদে থাকবে, প্যারিসে অনেক নাগরিক তাকে চিনে ফেলেছে, রাস্তায় বেরুনোই আর নিরাপদ নয় তার পক্ষে।

স্বয়ং অ্যাথোস দ্যার্তেগাকে অভিভাবক হিসেবে রেখে দিয়েছেন রাওলের। রাওল দ্যার্তেগার নির্দেশ অমান্য করতে পারল না।

রাওল প্যারিসে থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভালোই করল। আর একটা দিন দেরি হলে সে আর বেরুতে পারত না। কারণ এক রাতের মধ্যে রাজধানীতে বিরাট একটা পরিবর্তন এসে গেল। সকাল বেলায় লোকজন ঘরের বাইরে এসে দেখে রাস্তা আর রাস্তা নেই। ইট পাথর খুড়ে তুলে। কোথায় পুকুর তৈরি করা হয়েছে, কোথায় হয়তো পাহাড় বানিয়েছে। সৈন্যদের চলতে বাধা দেবার জন্য। শুধু কি ইট আর পাথর? উল্টানো গাড়ি, খালি পিপে, বিছানার খাট, বসার সোফা সব এনে এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে রাজপথে, অশ্বারোহী সৈন্যের এক পা চলার উপায় নেই।

প্যালেই রয়েলে বসে রাজমাতা অ্যান শুনলেন সব ঘটনা। তিনি কন্ডিকে ডেকে পরামর্শ করতে বসলেন কী ভাবে এই বিদ্রোহী প্রজাদের শায়েস্তা করা যায়। সব ঘটনা শুনলেন ম্যাজারিনও। তার গোপন স্বর্ণ ভাণ্ডার রাজপ্রসাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে যে কোথায় লুকিয়ে ফেললেন, তা কেউ জানল না, কর্তির পরামর্শ অনুসারে চলাই স্থির করলেন অ্যানি, পালিয়ে যাবেন তিনি বালক রাজাকে নিয়ে। যাবেন সেইন্ট জামেইন শহরে। রাজার। একটা ক্ষুদ্ৰবাড়ি আছে সেখানে, সেটিই আপাতত রাজ প্রাসাদের কাজ করবে। রানী রীতিমতো উত্তেজিত। প্রজাদের জব্দ করার সুন্দর একটা মতলব এঁটেছে কন্ডি, প্যারিসের বিদ্রোহী ফ্রন্ডিরা মজা বুঝবে এবার। রাজা যদি না থাকেন, না থাকে ম্যাজারিও, শহরে তারা শৃঙ্খলা রক্ষা করবে কেমন করে? শহর অরাজক হয়ে যাবে যে!

তাই যাক, কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক দুর্বিনীত প্যারিসবাসী। রানী যাবেন পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে। এমনভাবে শহর ত্যাগ করবেন, যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে যে ওরা যাচ্ছে না সন্দেহ হলে আর যাওয়া হবে না, কারণ পথে পথে হাজার জনতা দিনরাত হল্লা করছে, তাদের ভেতর দিয়ে রাজা ও রাজা মাতার যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।

অসম্ভব? নিশ্চয়ই তাই।

কিন্তু অসম্ভব সম্ভব করতে পারে, এমন লোক রানী দেখেছেন। সে, আজ বিশ বছর আগের কথা। প্যারিস থেকে লন্ডন পর্যন্ত রাজপথের দুই ধারে সৈন্যবাহিনী সাজিয়ে রেখেছিলেন। বিশাল সেই সৈন্য থেকে বের হয়ে যাওয়া যে কোনো যুগের যে কোনো বীরের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তবু সে অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো লোক পাওয়া গিয়েছেল তখন, এখন কি যাবে না? সেই দ্যার্তেগা তো রয়েছে। এই প্রাসাদের সীমানার মধ্যেই রয়েছে, আজ বিশ বছর ধরেই তো সে রানীকে পাহারা দিচ্ছে ও খানে বসে! আজ যদি তাকে ডাকা যায়–ডাকতেই হলো। ডাকলেন রানী, বিশ বছর পরে দ্বিতীয় বার ডেকে পাঠালেন দ্যাগোকে। দ্যার্তেগা প্রবেশ-করল দুরু দুরু বুকে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখে কেউ তার অন্তরের চাঞ্চল্য অনুমান করতে পারবে না কখনও। অভিবাদন করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল রানীর আদেশের প্রতিক্ষায়।

অনেক ভণিতা করে তারপর রানী প্রকাশ করলেন তার বক্তব্য, একদিন তার মস্ত উপকার করেছিল দ্যার্তেগা। তার দরুণ যতখানি কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করার অধিকার ছিল দ্যার্তেগার তা সে হয়তো পায়নি, কিন্তু সেই অভিযোগ অন্তরে পুষে রেখে আজ কি সে রানীর দ্বিতীয় অনুরোধ প্রত্যাখান করবে? যদি সত্যিই কোনো দ্বিতীয় অনুরোধ আজ আসে এই বিশ বছর পরে?

দ্যার্তেগা অবিচলিত স্বরে বলল–‘না কখনই প্রত্যাখান করব না। কৃতজ্ঞতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সৈনিকের তরবারি রাজা ও রাজমাতার যে কোনো প্রয়োজনে উন্মোচিত হওয়ার জন্যই তো রয়েছে। আদেশ করতে যেটুকু দেরি। উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা পালিত হবে।’

‘উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই?’ রানী অ্যান সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যদি কোনো অসম্ভব আদেশই করে বসি?’

‘অসম্ভব হলেও তা পালিত হবে। আর অসম্ভব যদি না হবে, তবে মহারানী দ্যার্তেগাকে কেন স্মরণ করবেন?’

রানী মনে মনে বলেন–লোকটার শক্তি আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে দম্ভও আছে প্রচুর।

কিন্তু মনের ভাবনা এখন মনেই থাকুক। বৃথা সময় নষ্ট করা চলে না বাজে কথা বলে। নিজের প্রয়োজনটা সংক্ষেপেই ব্যক্ত করলেন অ্যান ‘বিদ্রোহীদের ফাঁকি দিয়ে আমি যদি গোপনে রাজধানীর বাইরে যেতে চাই, সেটা কি সম্ভব?’

‘অবশ্যই সম্ভব।’

‘অবশ্য রাজাকে নিয়ে সেটা বুঝতে পারছ তো?’

‘রাজাকে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব।’

‘কী করে সম্ভব? রাজপথে গিজগিজ করছে বিদ্রোহীরা। পরীক্ষা না করে মাছিটাকেও তারা শহর থেকে বেরুতে দিচ্ছে না।’

‘তা না দিক, সেজন্য মহারানীর চিন্তা করতে হবে না, দুটি মাত্র শপথ করতে হবে রানীর, একটি হলো–এই পলায়নের কথা সবার কাছে গোপন রাখতে হবে। দুই এ ব্যাপারে সমস্ত ভার সম্পূর্ণভাবে আমার উপরে ছেড়ে দেবেন। একমাত্র তা হলেই আমি পারব একাজ সম্পূর্ণ করতে।’

রানী বললেন, ‘তাতে আমার আপত্তি নেই।’

‘রাত এারোটায় আমি মহারানীর সঙ্গে দেখা করব।’

রানীর রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই দ্যার্তেগার কোর্টের পিছনে টান পড়ল। ফিরে তাকাতেই দেখে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বেইন। বেইন প্রধানমন্ত্রী ম্যাজারিনের খাস চাকর।

‘মহামন্ত্রী ডেকেছেন আপনাকে’–বেইন জানাল।

‘জানতাম, ডাকতেই হবে।’

দ্যার্তেগা এসে সালাম জানাতেই ম্যাজারিন উচ্ছ্বসিত ভাবে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন–‘আরে এসো এসো। তোমাকেই আমার সবেচেয়ে বেশি দরকার। তোমাকে এবং তোমার সেই বন্ধু মঁসিয়ে ভ্যালোনকে তিনি এখনও ব্যারণ উপাধিটা পেতে চান তো?’

উত্তর দেয় দ্যার্তেগা—’চাইবেন না কেন? আপনি তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’

‘আর তুমি কি? তুমিও তো পেতে চাও ক্যাপটেন পদ?’

‘ক্যার্ডিনাল, উত্তর ওই একটাই।’

‘বেশ ও দুটো আনার জন্য তোমাদের দুজনকে একবার লন্ডন যেতে হবে।’ এমনভাবে ম্যাজারিন কথা বলছেন, যেন দুই বন্ধুকে তিনি খাবার ঘরটা একবার ঘুরে আসার জন্য অনুরোধ করছেন। দ্যার্তেগা মনে মনে যতই বিরক্ত হোক, মুখে বিন্দু মাত্র ভাব দেখাল না। শুধু বলল–আমরা প্রস্তুত কিন্তু যেতে হবে কখন?’

‘হায় ঈশ্বর এটা একটা প্রশ্ন হলো? যেতে হবে এখুনি।’

‘বেশ আমি এই মুহূর্তে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা যে যাচ্ছি এটা আপনি একবার মহারনীকে জানিয়ে এলে ভালো হয়।’

‘এসব সামান্য ব্যাপার মহারানীকে? সে কী? কেন?’

‘ব্যাপারটা মহারানীও সামান্য মনে করবেন, তার নিশ্চয়তা কী? আমাকে যদি যেতেই হয় মহারানীকে সেকথা আগে জানানো ছাড়া উপায় নেই, কার্ডিনাল।’

ম্যাজারিন ক্রুদ্ধ, বিরক্ত এবং ভীত হলেন, আড়ালে আড়ালে রানীর সঙ্গে একটা কিছু বন্দোবস্ত এদের হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই, কী সে বন্দোবস্ত? সেটা ম্যাজারিনের পক্ষে ক্ষতিকর নয়তো?

একবার মনে হয়েছিল, এরকম সাধারণ বিষয় নিয়ে রানীর কাছে যাওয়া তার পক্ষে মর্যাদা হানির ব্যাপার হবে, কিন্তু কৌতূহলের তাড়নায় তাকে যেতে হলো, রাণীর সঙ্গে এদের বোঝাপড়াটা কী রকম, একান্তভাবে জানা দরকার, সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন ম্যাজারিন, এসেই হেসে বললেন—’তুমি ঠিকই বলেছিলে লেফটেনান্ট, রানীকে না জানিয়ে যাওয়া তোমার উচিত হত না, তুমি একটা কাজের ভার পেয়েছ রানীর কাছ থেকে।’

‘যে কাজ আমি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না’ মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল দ্যার্তেগা।

মুহূর্তের জন্য লোকটার আত্ম অহংকার হতবাক করে দিল ম্যাজারিনকে, অনেক চেষ্টায় নিজেকে ঠিক করে বললেন—’রানী কি রাত এগারটায় বেরুচ্ছেন?’

‘আপনি রানীর মুখ থেকেই সে কথা শুনেছেন।’

‘তা শুনেছি, কিন্তু তুমি আমার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা করতে চাও, সে কথা শুনিনি। অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলা ম্যাজারিনের।

‘আপনার সম্পর্কে?’ আকাশ থেকে পড়ে দ্যার্তেগা।

‘বাঃ রানী চলে যাবেন, রাজা চলে যাবেন, আমি এখানে পড়ে থাকব কি বিদ্রোহীর হাতে চুচকাটা হওয়ার জন্য?’

‘কিন্তু যাবেন কি করে?’

‘রানীর গাড়িতে।’

‘অসম্ভব, জায়গা হবে না। বরং রানীকে পৌঁছে দিয়ে এসে তারপর আপনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি।’

‘রানীকে পৌঁছে দিয়ে এসে, তারপর? বলি তারপর যদি তোমার প্যারিসে আসার আর প্রয়োজন না থাকে? অর্থাৎ তোমার ক্যাপটেন পদ এবং তোমার বন্ধুর উপাধি যদি রানী ওখান থেকেই দিয়ে দেন? তারপরও এই গরীব বিদেশীর কথা তোমাদের মনে থাকার এতখানি আশা করতে পারি না মঁসিয়ে দ্যার্তেগা।’

দ্যার্তেগা বেশ গম্ভীর ভাবে চিন্তা করছে কথাটা, তারপর বলল ‘আপনার ইচ্ছে কি?’

‘ইচ্ছে এই যে, রানীর সঙ্গে যদি যাওয়া না হয় আমার তা হলে রানীর আগেই আমি যাব, উনি যাবেন রাত এগারটায়। আমায় তুমি রাত দশটায় সেন্ট জার্মেইন শহরে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

দ্যার্তেগা অতিকষ্টে হাসি থামায়। কী চালাক এই ইতালিয়ান যাজকটা!

‘সেটা অসম্ভব নাও হতে পারে, এখন তাহলে বলুন রাত দশটার সময় আপনাকে সেন্ট জার্মেইন নিয়ে যাওয়ার দরুণ আমাদের পাওনা কি হবে। বুঝতেই তো পারছেন অন্য লোকের পক্ষে যে কাজ অসম্ভব সেই কাজই যখন করতে হচ্ছে আমাকে, তখন মজুরিটাও লোভনীয় হওয়া দরকার।’

টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করতে ম্যাজারিনের চিরদিনই অনীহা, তাই মহা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কিন্তু রানীকে নিয়ে যাবার জন্য সেখানে টাকার কোনো কথা হয়নি বোধহয়।

আকাশ থেকে পড়ে দ্যার্তেগা রানী বা রাজা–এদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা, রাজার বা রানীর প্রজা বা সৈনিকদের জীবনের উপর দাবি রয়েছে একটা। ইচ্ছা করলেই তারা বলতে পারেন–তোমার জীবনটা আমাকে দিয়ে দাও, ওটা আমার দরকার হয়েছে, কিন্তু সে কথা অন্যদের ব্যাপারে খাটে না।

‘অন্যের বেলায় পারিশ্রমিকের দরকার হয়।’ বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ম্যাজারিন। ম্যাজারিনের হাতে একটা হীরের আংটির দিকে বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে দ্যার্তেগা। আংটি তার পরিচিত। বিশ বছর আগে এ আংটিটি তারই ছিল, তাকে ওটা রানী দিয়েছিলেন, তারপর ওটা দ্যাগো বেচে দিয়েছিল। রানীর প্রয়োজনে। টাকা দরকার হওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত কি জানি কেমন করে আংটিটি এই লোভী ম্যাজারিনের হাতে এসেছে।

তা যেভাবেই এসে থাকুক, দ্যার্তেগা ওই আংটি মজুরী হিসাবে না পেলে কিছুতেই শহরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে না ম্যাজারিনকে।

দ্যার্তেগার অর্থপূর্ণ চাহনির মানে বুঝতে না পারার মতো বোকা নন ম্যাজারিন।

এখন যেহেতু দর কষাকষির সময় নেই, সেটা বুঝেই ধীরে ধীরে, দ্যার্তেগার হাতে আংটিটি তুলে দিলেন এবং আংটি দেয়ার সাথে যেন আলোচনার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, এমনভাবে বললেন, আমি তাহলে রাত দশটার সময় তৈরি থাকব।

‘থাকবেন, আমি ঠিক সময়েই চলে আসব।’

‘কিন্তু গাড়ি? কোর গাড়িতে যাব আমি?’ জানতে চাইল ম্যাজারিন।

‘গাড়ি আমি নিয়ে আসব, আপনার মাথা ঘামাতে হবে না ও নিয়ে।’

.

পোর্থসের গাড়ি রাত ঠিক দশটার সময় প্রাসাদের পিছনে এসে দাঁড়াল, গাড়ির পিছনে পোর্থস।

মাস্কেটিয়ারের পোষাকেই একটা ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন ম্যাজারিন দরজার তলায় চাবি ঢোকাতে পারছেন না, হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। চাবি চেয়ে নিলেন দ্যার্তেগা ম্যাজারিনের কাছ থেকে। চাবি নিয়ে তালা বন্ধ করল দ্যার্তেগা। কিন্তু চাবি ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের পকেটে রাখল। আর একবার আসতে হবে এই দরজা দিয়ে তাকে এক ঘণ্টা পরে।

গাড়িতে উঠে বসলেন ম্যাজারিন, পোর্থস আর দ্যার্তেগা দুপাশে, আগেই কোচম্যানকে বলে দেয়া ছিল, মাঝারি কদমে গাড়ি এগিয়ে চলল সেন্ট আনোর গেটের দিকে, তখন রাজপথে জনতায় পূর্ণ। একটু পরপরই চেঁচিয়ে উঠছে তারা ‘ম্যাজারিন নিপাত যাক।’ মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মুখ বের করে দ্যার্তেগাও চিৎকার করছে, ‘নিপাত যাক ম্যাজারিন।’ ম্যাজারিন যতটা সম্ভব পিছনে সঙ্কুচিত হয়ে বসেছেন, এপাশে পোর্থস, ওদিকে দ্যার্তেগা মাঝখানে পুরোপুরি আড়ালে পড়ে গেছেন ম্যাজারিন, বিদ্রোহী জনতা মধ্যে মধ্যে উঁকি দিচ্ছে গাড়ির জানালা দিয়ে। দ্যার্তেগার ‘নিপাত যাক ম্যাজারিন’ চিৎকার শুনে খুশি হয়ে চলে যাচ্ছে।

একদল অস্ত্রধারী জনতা এসে গাড়ির পথ আটকাল, ‘কে যায় গাড়িতে?’

‘যায় ম্যাজারিন।’ হেসে জবাব দিল দ্যার্তেগা।

ভয়ে সজারুর কাঁটার মতো মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল ম্যাজারিনের। জনতা সত্য কথাটা তামাশা মনে করে রাস্তা ছেড়ে দিল।

গাড়ি প্রায় সেন্ট আনোর গেটের কাছে নিয়ে পৌঁছেছে, এই সময় আবার একদল জনতা এসে পথ আটকে দাঁড়াল, গাড়ি দেখব, দরজা খোল।

দ্যার্তেগা মুখ বের করে দেখল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার এক সময়ের চাকর প্ল্যাঞ্চেট, যে এখন শহরের একজন নামকরা মিষ্টির ব্যবসায়ী, একটা দোকান এবং একটা বাড়ির মালিক, দ্যার্তেগা তার সব খবর রাখে।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দ্যার্তেগা। আরে প্ল্যাঞ্চেট যে, আমাদের একটু তাড়াতাড়ি এগিয়ে দাও তো ভাই। পোর্থস ভীষণ আহত।

‘বলেন কি? মঁসিয়ে ড্যানস, আহত।’

‘ভাই প্ল্যাঞ্চেট এবার বোধহয় আর বাঁচব না, গুলিটা কাঁধের ভেতর দিয়ে পাজরায় ঢুকেছে,’ টেনে টেনে কাতরায় পোর্থস।

‘আহ্‌হা, এ অবস্থায় ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?’

তাড়াতাড়ি উত্তর দিল দ্যার্তেগা। নিয়ে যাচ্ছি পোর্থসের ব্রাশিওজের জমিদারীতে, নিজের বাড়িতে গিয়ে মরার জন্য জেদ করল, আর, লোকের শেষ ইচ্ছায় বাঁধা দেয়া উচিত নয়, আহা পোর্থসরে তুই না বাঁচলে আমি কি সেই শোক সইতে পারব।

প্ল্যাঞ্চেট হুকুম দিল—’এরা বন্ধু, গেট খুলে দাও।’

সেন্ট জার্মানের পথে গড় গড় করে চলে গেল সেন্ট আলোর গেট পেরিয়ে ম্যাজারিনের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল দ্যার্তেগা, এখানে আগে থেকে তোক দিয়ে নিজেরও পোর্থসের ঘোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিল, একটু পরেই সেই ঘোড়া খুঁজে পাওয়া গেল, দ্যার্তেগা উঠল নিজের ঘোড়ায়। এবার সে রানীকে আনতে যাবে।

দ্যার্তেগাকে বিদায় দিয়ে ম্যাজারিন নিজের মনেই বলল, মাত্র একটা হীরের আংটি দিয়েছি ওকে, কিন্তু এ উপকারের প্রতিদানে হীরে দিয়ে ওজন করে সব হীরে দিয়ে দিলেও শোধ হয় না।

.

ম্যাজারিনের গার্ড হিসেবে যেতে হয়েছে পোর্থসকে, দ্যার্তেগা একাই ফিরছে রাজধানীতে। সে সেন্ট আলো দিয়ে ফিরল না, সন্দেহ হতে পারে লোকের। অন্য দরজা দিয়ে ঢুকে নোতরদামের কাছাকাছি আসতেই দেখল রাস্তার উপর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

গাড়িটা তার চেনা, গাড়ির মালিক কেচ অ্যাডজুটর গন্ডি, এই গন্ডি হলো নোতরদামের ভারপ্রাপ্ত মহাযাজক, আর্কবিশপের ভাইয়ের ছেলে, নিজে কার্ডিনাল পদবির প্রত্যাশী, রাজনীতির ক্ষেত্রে ম্যাজারিনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

যেহেতু সে ম্যাজারিনের প্রতিদ্বন্দ্বী সেই কারণেই জনতার একান্ত আপনজন আসলে প্যারিসের এই প্রজাবিদ্রোহের মূলে যাদের ইন্ধন আছে। তাদের মধ্যে প্রধান হলো গন্ডি।

রাস্তার মাঝখানে গন্ডির গাড়ি দেখে একটা বুদ্ধি এল দ্যার্তেগার মাথায়। একটু আগেও জানত না দ্যাগো কীভাবে বালক রাজা আর রানীকে প্যারিসের বাইরে নিয়ে যাবে এত বিদ্রোহীদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। এখন সে খুশি হয়ে উঠল, উপায় একটা পেয়ে গেছে।

গাড়ির মাথায় কোচয়ান বসে বসে ঢুলছে, পিছন দিকে সহিসেরা নেই। হয়তো মালিকের অনুপস্থিতের সুযোগ নিয়ে কোনো হোটেলে খাবার খেতে গিয়েছে এই সুযোগে।

নিঃশব্দে গাড়ির ভেতর ঢুকল দ্যার্তেগা একটা দড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে কাঠের দেয়াল ফুটো করে। গাড়ি থেকে দড়ির একমাথা ঝুলছে। কোচয়ানের হাতের আঙুলে বাধা অন্য মাথা, এই দড়ি টান দিলেই ভেতর থেকে কোচয়ানের মনযোগ আকর্ষণ করা যাবে।

দড়ি টানল দ্যার্তেগা এবং হেঁকে বলল–‘প্যালেই রয়্যাল।

ধড়মড় করে উঠে বসল কোচয়ান দড়িবাধা আঙুল টান পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে তার কানে এল–‘প্যালেই রয়েল।’ হুকুম যে তার মনিবের মুখে থেকে আসেনি সেটা বেচারার মাথায় এক মুহূর্তের জন্যেও আসেনি, সদ্য ঘুম। ভেঙেছে তার। গলার আওয়াজের পার্থক্য তার বুঝার কথা নয়।

প্যালেই রয়্যাল অর্থাৎ রাজপ্রাসাদে যাবে তার মালিক–এটাই সম্ভব। তিনিই তো প্রজা বিদ্রোহের নেতা। কোচয়ান গাড়ি হাঁকিয়ে দিল।

প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে সে যখন সিঁড়ির নিচে থামল, তখনই লক্ষ্য করল গাড়ির পিছনে সহিসেরা নেই, তবে? তবে আর কি, মালিক তাদের কোনো কজে পাঠিয়ে দিয়ে থাকবেন। সুতরাং কোচওয়ান নিজেই লাফিয়ে নেমে এল গাড়ির দরজা খুলে দিতে।

আর দরজা খুলতেই গাড়ির ভেতর থেকে একটি লোক নেমে এসে দুই হাতে সজোরে গলা টিপে ধরল কোচওয়ানের। তারপর সে ডাকল দুইজন মস্কেটিয়ারকে, যারা তখন প্রাসাদে পাহারায় আছে।

তাদের হাতে কোচওয়ানকে ছেড়ে দিল দ্যার্তেগা–একে প্রাসাদের ভেতর কোনো নির্জন ঘরে নিয়ে আটকে রাখো। মুখ বেঁধে হাতে, পায়ে শিকল পরিয়ে, আর পোষাকটা খুলে আমাকে দাও। আমি যতক্ষণ একে ছেড়ে দিতে না বলছি, ছাড়বে না।

কোচওয়ানকে নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে চলেছেন মাস্কেটিয়াররা, দ্যাগো নিজে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গেল প্রাসাদের পিছন দিকের দরজায়। এ দরজার চাবি সে ম্যাজারিনের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিল, দরজা খুলে সে সোজা উঠে গেল রানীর মহলে। রাত তখন ঠিক এগারটা।

‘রানী তারই অপেক্ষায় আছেন।’

কোন বিদ্রোহী আটকাবে কো-অ্যাডজুন্ট গন্ডির গাড়ি? গাড়ি চালিয়ে প্যারিস থেকে নিরাপদে বেরিয়ে গেল একেবারে সেন্ট জার্মেইন, কোচওয়ানবেশে দ্যার্তেগা। সেখানে রাজার ছোট একটা বাড়ি আছে।

দ্যার্তেগার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য আজ আবার নতুন করে রানীর অন্তর শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে উঠল, রাজার কানে কানে বললেন–লেফটেন্যান্টকে একটা ধন্যবাদ দাও। ওই লোকটিই আজ আমাদের রক্ষা করেছে।

আস্তে আস্তে ফ্রান্সের রাজভক্ত অভিজাতেরা একে একে সেন্ট জার্মেইন এসে পৌঁছতে লাগলেন, প্রিন্স এবং ডিউকেরা বাদ রইলেন না কেউ, রানী তাদের আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।

এলেন তো সবাই। কিন্তু ঘুমাবেন কোথায়? শীতের রাত্রি, সেন্ট জার্মেইনের ছোট সরকারী বাড়িটিতে বিছানা মাত্র তিনটি, একটিতে রানী, একটাতে রাজা এবং অন্যটাতে রাজার চাচা প্রিন্স অব অর্ণিয়।

দ্যার্তেগা আগে থাকতেই অনুমান করেছিল যে বিছানার অভাবে আজ এই অভিজাত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের না ঘুমিয়ে বসে বসে রাত কাটাতে হবে, তাদের এই দুর্যোগ থেকে নিজের জন্য কিছু সুযোগ করে নেয়ার চেষ্ট সে করবে না কেন? পোর্থসকে নিয়ে সমস্ত শহর একবার টহল দিয়ে এসেছে এবং শহরের সমস্ত খড় কিনে এনেছে রেখেছে মস্কেটনের কাছে–এক আটির দাম এক স্বর্ণ মুদ্রা। যে কিনতে আসবে, ওই দামই দিতে হবে তাকে।

তারপর প্রিন্স আর ডিউকদের সামনে বসে নিজের জন্য একটি খড়ের বিছানা তৈরি করতে বসল, প্রিন্স ডিউক এবং তাদের স্ত্রীরা তখন বসে হি হি করে কাঁপছেন শীতে, কোথায় পেলেন খড়? কোথায় পেলেন? জিজ্ঞেস করল সবাই। সেই রাত্রে খড় বিক্রি করে চারশো লুই লাভ করল দ্যার্তেগা আর পোর্থস। মস্কেটন দশ বিশ লুই চুরি করেছিল, সেটা বাদ দিয়েই।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *