স্বর্ণমৃগ ২

০৫.

বেলা নয়টার দিকে স্নান সেরে সবচেয়ে দামি ট্রপিকালের নীল সুটটা পরে নিল রানা। শেষবারের মত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নিল টাইয়ের নটটা বাকা হয়ে আছে কি না। এমনি সময় কমলা রঙের একটা চমৎকার দামি কাতান শাড়ি পরে ঢুকল জিনাত রানার কামরায়।

‘আমিও করব!’ আবদারের সুরে বলল জিনাত ঘরে ঢুকেই।

‘কী?

‘ওই যে সকালবেলা আব্বাজী যা করছিল।’ বলেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওর আব্বার নকল করে চুমো খেল জিনাত রানার দুই গালে। তারপর বলল, ‘ছিঃ! গিজগিজে দাড়ি!’

হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল দুজন রাস্তায়। লাউঞ্জে দেখা হয়ে গেল ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে। লিফটের দিকে যাচ্ছিল সে। থেমে দাঁড়িয়ে দেখল দুজনকে হাত ধরাধরি করে হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে। বিচিত্র একটুকরো হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে।

‘কোন্ দিকে যাবে, জিনাত?

তুমি যেদিকে নিয়ে যাবে, সেইদিকে।

‘গান্ধী গার্ডেন দেখেছ?

‘না। চলো না যাই? অনেক শুনেছি এই গার্ডেনের কথা।

‘বেশ। প্রথমে ওখানেই চলো।

হাতের ইশারায় ট্যাক্সি ডাকল রানা। চকচকে নতুন ট্রায়াম্প হেরাল্ডের ছাদ হলুদ করা। থামল এসে ওদের সামনে। মিটার ডাউন করে নিল ড্রাইভার। দরজা খুলে ধরল। পিছনের সিটে উঠে বসল ওরা দুজন।

ঠিকই বলেছিল খান মোহাম্মদ জান। ইতিমধ্যেই মস্ত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে জিনাতের ভেতর। জীবনের সবকিছুর প্রতি সেই কুটি কুটিল, দৃষ্টিভঙ্গিটা আর দেখতে পেল না রানা। সহজ স্বচ্ছন্দ একটা ভাব ফিরে এসেছে ওর মধ্যে। প্রথম লক্ষণ, কাটা কাটা বাঁকা কথার বদলে স্বাভাবিক নারীসুলভ কথার খৈ ফুটছে ওর মুখে। অনর্গল কথার ফুলঝুরি। আর অকারণ উচ্ছল হাসি।

সারাটা গান্ধী গার্ডেনে যেন খুশির বন্যা বইয়ে দিল ওরা। জেব্রাগুলোকে বুট খাওয়াল’ জিনাত, উটের পিঠে চড়ল, বানরগুলোকে দিল কলা-তার থেকে রানা একটা খেয়ে ফেলায় ওর মনুষ্যত্বে সন্দেহ প্রকাশ করল।

বেলা সাড়ে-দশটায় লোকজনের ভিড় নেই গার্ডেনে। এই অসময়ের নিরিবিলিতে ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে গোটা কমক কলেজ পালানো প্রেমিক জুটি দেখা গেল। জায়গায় জায়গায় শান বাঁধানো বসবার ব্যবস্থা আছে গাছের তলায়। তারই একটায় বসে রয়েছে পাঞ্জাবী-পাজামা পরা বাবরি-চুলো এক ভাবুক। ফিলসফার না আধুনিক গানের গীতিকার ঠিক বোঝা গেল না। গাছের ডালে চিল বসে ছিল একটা নিশ্চিন্ত মনে এক লাদা পায়খানা করল। আর, পড়বি তো পড় সোজা ভাবুকের চাদির উপর। চমকে উঠে মাথায় হাত দিয়েই কালো হয়ে গেল ভাবুকের মুখ। হেসে খুন হয়ে গেল জিনাত।

‘আজব জানোয়ার’ লেখা একটা তাঁবুতে ঢুকল ওরা দুই আনার টিকিট কেটে। মুখটা মানুষের আর দেহটা শেয়ালের। মুখে একগাদা স্নো-পাউডার-রুজ লিপস্টিক লাগানো। ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। রানার গা ঘেঁষে দাঁড়াল জিনাত। এক হাতে খামচে ধরল কোটের হাতা। ভয় পেয়েছে। খেলা যে দেখাচ্ছিল, সেই লোকটা এগিয়ে এসে জন্তুটিকে জিজ্ঞেস করল, ক্যয়া নাম তুমহারা?

‘মামতাজ বেগম,’ উত্তর এল নাকি গলায়।

‘ঘ্যর কাঁহাঁ?’ আবার জিজ্ঞেস করল লোকটি।

‘আফ্রিকা, উত্তর এল আবার।

‘খাতি হো ক্যয়া?

কামলা।

‘পিতি হো ক্যয়া?’

দুদ্‌।

রানা লক্ষ্য করল ফেঁশ ফোশ করে শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে ওঠা নামা করছে শেয়ালের পেটটা, কিন্তু কথা বলবার সময় থেমে যাচ্ছে কয়েক সেকেণ্ডের। জন্য। কৌশল করে বানিয়েছে এই ভোজবাজী।

‘পাঁও যারা হিলাও দেখেঁ?

পা নড়াচ্ছে জন্তুটা।

‘হাথ যারা হিলাও দেখেঁ?

আর দেখাতে হলো না। একটানে রানাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল জিনাত তাঁবু থেকে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখ। অন্তত বিশ কদম দূরে না সরে মুখ খুলল। না সে।

‘ওরেব্বাপরে বাপ! এখনও আমার বুকের ভেতর ধুক ধুক করছে। দেখবে? হাত দিয়ে দেখো!’ উত্তেজিত জিনাতের কণ্ঠস্বর। পিতার মতই সজীব প্রাণবন্ত ওর প্রতিটি কথাবার্তা, কার্যকলাপ।

প্রকাণ্ড চিড়িয়াখানাটা শেষই হতে চায় না। অনেক ঘুরল দুজন।

রানার হাজার পীড়াপীড়িতেও সিগারেট খেল না জিনাত। বলল, আমি ভাল হতে চাই, রানা। তুমি বলেছ, কিছুতেই মরতে দেবে না আমাকে। সারা সকাল ধরে খালি এই কথাটাই ভাবছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। মৃত্যুর গহ্বর থেকে উঠে এসেছি আমি তোমার হাত ধরে। তোমার জন্য বাঁচব আমি।’

একটু থেমে আবার বলল, ‘কিন্তু এত কালি, এত কলঙ্ক! তুমি আরও আগে এলে না কেন, রানা? ফুলের মত নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক হয়ে যদি আসতে পারতাম তোমার কাছে!

‘কলঙ্ক তো চাঁদের অলঙ্কার, জিনাত।’ বলল রানা, চাঁদের দেহটা কলঙ্কিত। কিন্তু আলোটা? এমন স্নিগ্ধ পবিত্র আছে কিছু আর? মানুষের দেহটা তো বাইরের জিনিস-মনের বিচারই আসল বিচার। তাই না?

‘তুমি তাই মনে করো? সত্যিই?’

‘হ্যাঁ। মানুষের মনটাই সব।

‘বোম, ভোলানাথ!’

চমকে উঠল রানা ও জিনাত একসঙ্গে। গুরু-গম্ভীর কণ্ঠস্বর। কাছেই। ঝোঁপের ওপাশে কম্বলের ওপর পদ্মাসনে বসে আছে সাধু বাবা। আশপাশে সাত আটজন চেলা জুটে গেছে। বসে আছে ওরা তীর্থের কাকের মত সাধুজীর মুখের দিকে চেয়ে।

সাধুবাবার চোখ বন্ধ। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। একটা নোংরা পুরু কম্বল গায়ে জড়ানো। পাশেই পিতলের চকচকে ললাটা আর সিঁদুর চর্চিত ত্রিশূল। সামনে ধুনো জ্বলছে। আশপাশে প্রচুর উপহার সামগ্রী, ফলমূল পড়ে আছে। অনাদর অবহেলায়। বোঝা গেল আসল সাধু-এসবের উপর কোনও লোভ নেই।

‘বোম, ভোলানাথ!’

ধীরে ধীরে চোখ মেলল সাধুজী। মৃদু গুঞ্জন উঠল মাড়োয়াড়ী ভক্তদের মধ্যে। কে কার আগে কৃপাদৃষ্টি লাভ করবে তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি লেগে গেল নিজেদের মধ্যে। সবাই এগিয়ে বসতে চায়। একটি বাণীও যেন ফসকে না যায়।

ওদের কারও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা চাইল সাধুজী রানার চোখের দিকে। প্রচুর গঞ্জিকা সেবনে লাল চোখ দুটো। যেন ভস্ম করে দেবে, এমনি চাহনি। মুচকি হাসল রানা। ব্যাটা সোহেল। এই গান্ধী গার্ডেনেই তা হলে আড্ডা গেড়েছে শালা।

চট করে সাধুজীর চোখ সরে গেল রানার চোখের উপর থেকে। বোধহয় হাসি সামলাবার জন্যে। জিনাতের প্রতি এবার স্নেহ বর্ষণ করল যেন সাধুবাবার চোখ।

‘জনম-দুখিনী তুমি, মা। এসো তো এগিয়ে, দেখি।

প্রথম দর্শনেই, ভক্তি এসে গেছে জিনাতের। পায়ে পায়ে এগোল সে সাধুর দিকে। ভক্তেরা সরে গিয়ে পথ করে দিল।

‘চলো, জিনাত, রানা ডাকল, এখান থেকে যাই আমরা।’

‘দুই মিনিট। প্লিজ! এসো না, তোমার হাতটাও দেখিয়ে নিই সাধুবাবাকে দিয়ে।

‘না।’ গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রানা। সোহেলেরই জয় হলো। এগিয়ে গেল জিনাত রানাকে পেছনে ফেলে। উচ্চ মার্গের একটা অনাবিল হাসি হাসল সোহেল।

‘বিশ্বাসে মিলয়ে হরি তর্কে বহুদূর!’

‘ঠিক, ঠিক।’ সায় দিল ভক্তেরা।

জিনাত এগিয়ে গিয়ে পদধূলি গ্রহণ করল।

‘পাহাড়ি দেশের মেয়ে তুমি, মা। সাগর থেকে উঠে এসেছ। সবই ভোলানাথের ইচ্ছে। বোম, ভোলানাথ! ভাগ্যের জুয়া খেলায় টাকা গেছে, কিন্তু মিলে গেছে মনের মানুষ, সোনার ময়না পাখি। কি? ঠিক বলিনি, মা?’

‘সব মিলে গেছে!’ ভয়-ভক্তিতে বুজে এল জিনাতের কণ্ঠস্বর। আবার একবার সাধুজীর পদধূলি গ্রহণ করল সে। একেবারে খাঁটি সাধু। ভক্তদের একজন বলল, ‘বাঙাল মুলুক থেকে এসেছেন বাবা, হিংলাজ যাবেন। আসল সাধু। সবাইকে সব কথা ঠিক ঠিক বলে দিয়েছেন।’

স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সাধুর মুখ। বলল, ‘কিন্তু পাখি। থাকবে না, মা। উড়ে যাবে। ইচ্ছে করলেই কি কাউকে ধরে রাখা যায়? এ সুযোগ পেলেই খাঁচা কেটে উড়ে যাবে।’

সভয়ে চাইল একবার জিনাত রানার দিকে। এখনই উড়ে গেছে কি না দেখবার জন্য বোধহয়। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, একে ধরে রাখার কোনও উপায় নেই, বাবা?’

‘আছে, বিচিত্র এক হাসি ফুটে উঠল সাধুজীর ঠোঁটে। ত্রিশূলটা ধরল সে জিনাতের বুকের উপর। তারপর বলল, ‘জুয়াড়ি থেকে সাবধান থাকতে বলো। তাকে। আর এই শিকড়টা সাথে রাখো। যখনই জল খাবে এটা একবার করে চুবিয়ে নিয়ে তারপর খাবে। বোম, ভোলানাথ।’

ভক্তিভরে কপালে ঠেকালো জিনাত যষ্টিমধুর শেকড়টা। তারপর ব্যাগে রেখে দিল সযত্নে। এক শ’ টাকার একটা নোট বের করে সাধু বাবাজির পায়ের উপর ছুঁইয়ে ঢুকিয়ে দিল কম্বলের তলায়।

আড়চোখে একবার নোটটার দিকে চেয়েই হুঙ্কার ছাড়ল বাবাজী, বোম, ভোলানাথ। তারপর তীব্র দৃষ্টিতে একবার রানার দিকে চেয়েই ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ল চোখ বুজে। মুখে প্রশান্ত হাসি।

.

দুপুরে হোটেল মেট্রোপোলে লাঞ্চ সেরে নিল ওরা। ওয়েট নিল দশ পয়সা দিয়ে। দুজনের জন্যে দুটো কার্ড বেরিয়ে এল। জিনাতের ওজন উঠল ১১৫ পাউণ্ড। ভবিষ্যদ্বাণী লেখা: ধৈর্য ধুরুন। আপনার সুখের দিন আসিতেছে।

ওজন দেখে মাথা নেড়ে বলল জিনাত, ‘অসম্ভব। যন্ত্রে ভুল আছে। এক শ’ দশের বেশি কিছুতেই হতে পারে না।’ কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী পড়ে অসম্ভব খুশি।

রানার ওজন ১৬০ পাউণ্ড। ভবিষদ্বাণী: সাবধান! আপনার সামনে-পিছনে শত্রু রহিয়াছে।

এটা পড়েই মুখটা কালো হয়ে গেল জিনাতের।

গাড়িতে উঠে হঠাৎ একসময়ে জিনাত বলল, ‘ওহ-হো। ভুলেই গিয়েছিলাম। আব্বাজী দশ হাজার টাকা দিয়েছে তোমাকে ফেরত দেবার জন্যে। এক্ষুণি দেব?’

‘ওঁর কাছ থেকে কেন নেব? ও-টাকা কিছুতেই নেব না আমি। ওটা তোমার জীবনে প্রবেশ করার এন্ট্রি-ফি। ওর বদলে তোমাকে পেয়েছি।’

‘টাকা দিয়ে কী কারও মন পাওয়া যায়? যা পেয়েছ, এমনি অকারণেই পেয়েছ। তুমি টাকাটা না নিলে আমি বকা খাব বাড়ি ফিরে।

‘তা হলে আর বাড়ি ফিরো না। থেকে যাও আমার সঙ্গে। চিরকাল।

রানার হাতটা তুলে নিয়ে চুম্বন করল জিনাত।

‘তোমাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে না হলে বেঁচে যেতাম আমি। কিন্তু আব্বাজী বলে দিয়েছে সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরতে হবে। তোমাদের নাকি কী

কাজ আছে? কিন্তু তুমি অন্য কথা বলে ভুলিয়ে দিচ্ছ আমাকে। টাকাটা…’

‘ও-টাকা আমি নেব না, জিনাত।

‘তোমার কসম লাগে, রানা। প্লিজ।

‘আচ্ছা। যদি নেহায়েত ফেরত দিতেই চাও, তা হলে একটা কায়দা শিখিয়ে দিতে পারি আমি।

কী রকম?

‘ওয়ালী আহমেদ এই ক’দিন ধরে জোচ্চুরি করছে তোমার সঙ্গে। আমি জানি ওর রহস্য। ওকে প্যাঁচে ফেলে সব টাকা বোধহয় আদায় করা যায়। একটু শাস্তিও হয় ওর। আজ বিকেলে আবার যদি খেলতে বসো ওর সঙ্গে, তা হলে বাকি ব্যবস্থা আমি করতে পারি। তখন আমার টাকা ফেরত দিয়ে দিয়ো।

‘কিন্তু ও চুরি করবে কী করে? আমারও যে সন্দেহ হয়নি তা নয়। কিন্তু সব রকম সম্ভবনাই ভেবে দেখেছি আমি। কার্ড বাটায় কোনও চালাকি নেই, কার্ডে কোনও চিহ্ন নেই। যতবার ইচ্ছে কার্ড বদলে নিয়েছি আমি, আমার নিজের কেনা নতুন প্যাকেটে খেলেছি। আশপাশে কোনও আয়না নেই। টেবিলের ওপর যে চকচকে সিগারেট কেস রেখে তাস বাটবার সময় তার সাহায্যে আমার কার্ডগুলো দেখে নেবে-তাও না। তবু কী করে যেন টের পায় সে আমার হাতে কী আছে। ব্লাফ খেলে দেখেছি, ব্লাইণ্ড খেলে দেখেছি, কিছুতেই কিছু হয় না। লোকটা বোধহয় জাদুকর।

‘লোকটা কচু! চোর একটা। আজকে খেলেই দেখো না কেমন বারোটা বাজিয়ে দিই শালার। একটু শিক্ষা না দিলে কত লোকের যে সর্বনাশ করবে তার। ঠিক নেই।’

‘যদি আজও হারি?’

তা হলে তোমার আব্বাজীকে বোলো আমাকে দিয়েছ টাকা।

‘কিন্তু আমি যে আর খেলব না ঠিক করেছি।’

‘তা হলে আর আমার টাকাটা শোধ করবার কোনও উপায়ই থাকল না, জিনাত। ঠিক আমার টাকাগুলোই ফেরত নিতে পারি আমি-তোমার বাবার টাকা নয়।’

‘আচ্ছা, বেশ। আজ না হয় খেলব কিছুক্ষণ। কিন্তু কতক্ষণ খেলতে হবে? তুমি থাকবে তো সাথে? আব্বাজীর কাছে শুনলাম তিনদিন পরই চলে যাচ্ছ, তুমি করাচি থেকে। তোমাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে পারব না আমি এই কদিন।

না, জিনাত। আমি থাকব না তোমার সাথে। অবশ্য আধঘণ্টার বেশি খেলতে হবে না তোমাকে। রাজি?’

‘নিম-রাজি। বিকেলটা নষ্ট করে দেবে আমার ওই শয়তানটা। এর চাইতে টাকাগুলো যাওয়াও ভাল ছিল। কাছে পেলেই এমন সব কথা আরম্ভ করবে…’

‘আরেকটা কথা, জিনাত। আমার মনে হচ্ছে ওয়ালী আহমেদের জোচ্চুরির রহস্য আমি ভেদ করতে পেরেছি। আমার অনুমান মিথ্যেও হতে পারে। কিন্তু খেলতে খেলতে যদি দেখো ওয়ালী আহমেদ একটু অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে, আশ্চর্য হয়ো না। চুপচাপ দেখে যেয়ো। বুঝলে?’

‘জো হুকুম, হুজুর।

কাছে সরে এসে রানার গা ঘেঁষে বসল জিনাত। কাঁধে একটা হাত রাখল রানা। পিচ্ছিল আঁচল খসে পড়ল কোলের ওপর।

‘বিকেলে কোথায় যাওয়া যায় বলো তো, জিনা?

‘ক্লিফটন বিচ।

‘বেশ। তাই হবে।’ এক টুকরো মুচকি হাসি ফুটে উঠল জিনাতের ঠোঁটে।

‘এই দুপুর রোদে আর টৈ-টৈ করে ঘুরতে ভাল্লাগছে না। বিকেলের তো অনেক দেরি আছে। আবার হাসল জিনাত। রাঙা হয়ে উঠল গাল দুটো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘চলো না, তোমার ঘরে যাই?

ট্যাক্সি এসে থামল বিচ লাগজারি হোটেলের সামনে।

.

০৬.

ছোটখাট একটা ঘুম দিয়ে উঠে অনেকখানি চাঙ্গা বোধ করল রানা।

সাড়ে চারটে বাজে। জিনাত আগেই উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছে। টা-টা করে চলে গেল সে সেইলরস ক্লাবের উদ্দেশে।

হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল রানা বাথরুম থেকে। কাপড়-চোপড় পরে নিল ধীরে-সুস্থে। ব্যালকনিতে এসে দেখল নীচে দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট আসনে বসে আছে ওয়ালী আহমেদ আর জিনাত সুলতানা। আজ কেন জানি কিছুতেই মানাচ্ছে না জিনাতকে ওই পরিবেশের সঙ্গে। কী অদ্ভুত পরিবর্তন। তাড়াতাড়ি মুক্তি দিতে হবে ওকে এই অবস্থা থেকে।

শখের নাইকন-এফ ক্যামেরায় লেন্স হুডটা লাগিয়ে ঝুলিয়ে নিল রানা গলায়। ব্রাউন হবি ই এল ৩০০ ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশ গানের ফ্ল্যাশ হেডটা লাগিয়ে দিল ক্যামেরার উপর। X-মার্কা কন্ট্যাক্ট পয়েন্টে ঢুকিয়ে দিল কেবলটা। এবার অ্যাপার্চার এফ-১১ দিয়ে ডিসট্যান্স সেট করল বারো ফুটে, এক্সপোজার ওয়ান হানড্রেড।

তারপর সুটকেসের মধ্য থেকে মোটা ‘সঞ্চয়িতা’ বই বের করল। তার ভেতর থেকে বেরোল একখানা নাইন মিলিমিটার ক্যালিবারের হ্যাঁমারলেস অটোমেটিক ডাবল অ্যাকশন লুগার পিস্তল। দ্রুত একবার পরীক্ষা করে কোটের পকেটে ফেলল সেটাকে রানা। একটা এক্সট্রা ম্যাগাজিনও নিল সাথে। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে।

ঘরে চাবি লাগাতে গিয়ে কী মনে করে থেমে একটা কাগজের টুকরোকে কয়েক ভাজ করল রানা। দরজার কজার কাছে টুকরোটা রেখে বন্ধ করল দরজা। বাইরে থেকে আর দেখা যাচ্ছে না কাগজের টুকরো। একবার পরীক্ষা করে দেখল সে, দরজা খুললেই টুপ করে পড়ে যাচ্ছে সেটা মাটিতে। ওর অনুপস্থিতিতে কেউ ঘরে ঢুকলে টের পাবে ও কাগজের টুকরোটা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে।

ঘরে, চাবি লাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল রানা দোতলায়। সোজা এসে দাঁড়াল একত্রিশ নম্বর কামরার সামনে। আগেই চাবি জোগাড় করেছে বেয়ারাকে ঘুষ দিয়ে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে খুলে ফেলল দরজা।

প্রথম ঘরটা বসবার ঘর। রানা যা ভেবেছিল তাই। খালি। পাশেই শোবার ঘর। তার ওপাশে ব্যালকনি। শোবার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে একটু হতাশ হলো। রানা। কিন্তু দেখল, ছিটকিনি লাগানো নেই তাতে। আস্তে চাপ দিতেই ফাঁক হয়ে গেল খানিকটা। প্রথমেই চাপা একটা কণ্ঠস্বর কানে এল, ‘থ্রি অভ ডায়মণ্ড, টু অভ ক্লাবস, ফোর অভ হার্টস।’ নারীকণ্ঠ।

মৃদু হাসল রানা। বেচারী জিনাত ব্লাইণ্ড খেলে না থাকলে খালি বোর্ড ফি-টা পাবে এবার। পা টিপে ঢুকে পড়ল রানা ঘরের ভেতর। একটা উঁচু চেয়ারে বসে আছে একটি অ্যাংলো মেয়ে। ঘরের ভেতর গরম, তা ছাড়া কে-ই বা আসছে দেখতে, সেজন্যে কাপড় চোপড়ের বালাই নেই মেয়েটির গায়ে। শুধু ছোট্ট একটা কালো জাঙ্গিয়া, আর বক্ষাবরণ।

টেবিলের উপর মেয়েটির চোখ থেকে ইঞ্চি তিনেক দূরেই উইভার কোম্পানির একটা শক্তিশালী দুরবিন। ট্রাইপডের উপর বসানো। দুরবিনের পাশেই রাখা একখানা ছোট মাইক্রোফোন থেকে তার গেছে টেবিলের একপাশে বসানো একটা বাক্সের মধ্যে। বাক্সের ভেতর থেকে আবার কয়েকটা তার বেরিয়ে ঘরের ভেতর টাঙানো একটা ইনডোর এরিয়েলে গিয়ে মিশেছে।

আবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে দুরবিনে চোখ রেখে মেয়েটি একঘেয়ে। কণ্ঠে গড়গড় করে বলে গেল, কুইন অভ ক্লাস, জ্যাক অভ স্পেডস, ফাইভ অভ ডায়মণ্ড। বলেই মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করে দিল। সামনের দিকে ঝোঁকায় ফর্সা পিঠের উপর ব্রেসিয়ারের ফিতেগুলো চেপে বসেছিল। সোজা হতেই স্বাভাবিক হয়ে গেল।

এইটুকু সময়ের মধ্যে পা-টিপে এগিয়ে এল রানা। ক্যামেরাটা তুলল দু’হাতে মাথার ওপর। আন্দাজে যখন বুঝল দুরবিন, মাইক্রোফোন, এরিয়েল, মেয়েটির চেহারার একাংশ আর দূরে জিনাত ও ওয়ালী আহমেদের টেবিল, সবই এক সাথে ধরা পড়েছে স্ক্রিনে-টিপে দিল শাটার।

ঝলসে উঠল ঘরটা তীব্র আলোয়। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল মেয়েটির মুখ থেকে ঘটনার আকস্মিকতায়। চট করে ঘুরল ও রানার দিকে। নেমে পড়ল উঁচু চেয়ার থেকে।

‘কে? কে তুমি?’

‘ভয় পেয়ো না, সুন্দরী, আমি ভূত নই। আমার যা প্রয়োজন ছিল পেয়ে গেছি। তোমার কোনওই ক্ষতি করব না আমি। আমার নাম মাসুদ রানা।

মেয়েটিকে মোটামুটি সুন্দরীই বলতে হবে। লম্বা একহারা চেহারা, চমৎকার। স্বাস্থ্য। বয়স আটাশ-ঊনত্রিশ। যৌবন উছলে পড়ছে সারা অঙ্গে। বব ছাঁটা চুল বিছিয়ে পড়েছে নগ্ন কাঁধের উপর। চোখে একরাশ কৌতূহল।

কী করবে তুমি ছবি নিয়ে?

‘বলছি তো তোমার কোনও ক্ষতি করব না। অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? ওয়ালী আহমেদকে গোটা দুই গাট্টা মেরেই কেটে পড়ব। এইখানটায় দাঁড়িয়ে। থাকো চুপচাপ-কোনও রকম চালাকির চেষ্টা করলে স্রেফ খুন করে ফেলব।

ক্যামেরাটা নামিয়ে রাখল রানা টেবিলের উপর। ডান হাতে পিস্তলটা ধরে উঠে বসল মেয়েটির চেয়ারে। চোখ রাখল দুরবিনে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জিনাতের হাতের কার্ড। দুইয়ের পেয়ার পেয়েছে এবার সে। ওয়ালী আহমেদকে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবার সুযোগ দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা।

‘এত টাকা ওয়ালী আহমেদের, তাও এইসব করে কেন?’ জিজ্ঞেস করল ও মেয়েটিকে।

‘ওই মেয়েটিকে ও চায়। একটু অনুগ্রহ করলেই টাকা ফিরিয়ে দেবে সব।’

‘এই কি ওর প্রথম শিকার?

না। এর আগে আরও অনেকে এসেছে। সবাই আত্মসমর্পণ করেছে।’

‘তোমার মত রূপসী পেয়েও তৃপ্তি হয় না ওর?’

হাসল মেয়েটি।

‘আমি বেতনভোগী চাকরাণী মাত্র! আজ তিনমাস আমাকে স্পর্শও করেনি ওয়ালী আহমেদ। নিত্য নতুন মেয়েমানুষ পছন্দ ওর। আমি প্রথম দিনেই পুরনো হয়ে গেছি।

‘তা, তুমি এগুলো করো কেন? ভাগ্যিস, আমি আইবি কিংবা পুলিশের লোক নই। মেয়েটির একজন শুভাকাক্ষী মাত্র। নইলে আজ এই ফটোর জোরে ওয়ালী আহমেদের সাথে সাথে তোমারও হাতে হাতকড়া পড়ত, তা জানো?

‘জানি। আমি এসব করি টাকার জন্যে। দু’হাজার টাকা পাই মাসে। কিন্তু তুমি পুলিশ হলে কী আর হোত? টাকার কুমীর ও। টাকা দিয়ে কিনে নিত তোমাকে। আমাকেও মোটা টাকার মাইনে দেয় বলেই আছি। নইলে কার ভাল লাগে সকাল বিকেল বসে বসে একঘেয়ে অ্যানাউন্সমেন্ট করতে? এখন ভাবছি, চাকরিটা বুঝি গেল আমার। আর রাখবে না আমাকে।

আর একবার চোখ রাখল রানা টেলিস্কোপে। আধ ইঞ্চি উঠিয়ে ওয়ালী আহমেদের বসন্তের দাগ ভর্তি মুখের উপর সেট করে নিল টেলিস্কোপ। দেখল প্রান্ত মুখটা এবার সত্যিই একটু উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। একটা পান মুখে ফেলে দরজার চতুষ্কোণ অন্ধকারের দিকে চাইল সে একবার।

‘তোমার অ্যানাউন্সমেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ওয়ালী আহমেদ। এখন কি খেলা ছেড়ে উঠে পড়বে নাকি?

না। মাঝে মাঝে এরকম হয় কোনও তারটার ছুটে গেলে। ও ভাবছে, আমি এখন সেই তার জোড়া লাগানোয় ব্যস্ত আছি!

তোমার নামটা কী বললে না?

‘অ্যানিটা গিলবার্ট।

‘অনীতা?’

‘তা বলতে পারো। চার পুরুষ ধরে খ্রিস্টান। তাই উচ্চারণটা বেঁকে গিয়ে অ্যানিটা হয়ে গেছে। তোমার নাম কি যেন বললে, মাসুদ রানা, না?’

‘হ্যাঁ।

‘আমি পাশের ঘর থেকে একটা জামা পরে আসতে পারি? আমাকে দেখতে…’

‘উঁহু!’ মাথা নাড়ল রানা। মেয়েটার আর কোনও মতলব আছে কি না কে জানে? বলল, ‘বেশ তো চমৎকার লাগছে তোমাকে দেখতে। আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এক পা-ও নড়তে পারবে না তুমি। ইচ্ছে করলে, সিগারেট খেতে পারো একটা।

কাঠগড়ার আসামীর মত দাঁড়িয়ে রইল। একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। ভয়ে ভয়ে চাইল পিস্তলটার দিকে। রানা আবার চোখ রাখল দুরবিনে। ভ্রুকুটি দেখা দিয়েছে ওয়ালী আহমেদের কপালে। হিয়ারিং এইডের অ্যাম্পলিফায়ারটা অ্যাডজাস্ট করে এয়ারফোনটা ভাল করে খুঁজে দিল কানের মধ্যে-তাও কোনও সিগনাল নেই। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে ভাবল রানা। ব্যাপারটা আরেকটু জমে উঠুক।

‘বেশ সুন্দর ছোট্ট যন্ত্র আবিষ্কার করেছ। কত ওয়েভলেংথে ট্রান্সমিট করছ?’

টু হানড্রেড টেন মেগাসাইকলস।

মাইক্রোফোনটা হাতে তুলল রানা এবার। অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠল। অনীতা, ভয়ে পাংশু হয়ে গেছে ওর মুখ।

‘ভয়ঙ্কর লোক ওয়ালী আহমেদ। ওকে না ঘটলে চলে না?

‘না!’ দৃঢ় রানার কণ্ঠস্বর।

হঠাৎ এগিয়ে এসে রানার হাত ধরল মেয়েটা। বিস্ফারিত নয়নে চাইল রানার চোখের দিকে। বলল, আমার ওপর একটু কৃপা করো, মিস্টার রানা। ওকে ছেড়ে দাও। দয়া করে ছেড়ে দাও ওকে। নইলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আমাকে ওয়ালী আহমেদ। তুমি জানো না। ও পারে না এমন কাজ নেই। আরেকটু কাছে সরে এল মেয়েটা। চোখে তার করুণ আকুতি। প্লিজ! রানা, সব কথা তোমাকে বলা যাবে না। ওকে যদি কিছু করো তা হলে ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে আমার। দোহাই তোমার, ছেড়ে দাও ওকে। বিনিময়ে যা চাইবে তাই দিতে রাজি আছি আমি।

মৃদু হেসে রানা বলল, তা হয় না, অনীতা। তুমি খামোকা অত ভয় পাচ্ছ ওয়ালী আহমেদকে। ওর কিছুটা শিক্ষা হওয়া দরকার। আজ ও বড়লোক একটা মেয়েকে ঠকাচ্ছে, কাল হয়তো এমন কাউকে ঠকাবে, যার পক্ষে সহ্য করা কঠিন। কাজেই ওর ইসক্রুপে সামান্য টাইট দিতেই হবে।’

মাইকের সুইচ টিপে দিল রানা। খুট করে একটা শব্দ হয়তো পৌঁছুল ওয়ালী আহমেদের কানে। কপালের ভ্রূকুটি সোজা হয়ে গেল। প্রসন্ন হয়ে উঠল ওর মুখ। লালচে গোফে একবার তা দিয়ে নিয়ে একটা পান ফেলল মুখে।

রানা বলল, এইস অভ ডায়মণ্ড, এইস অভ হার্টস, এইস অভ ক্লাবস। টপ ট্রায়ো!

ঠিক যেন পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ। একবিন্দু চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল না ওর চেহারায়। এমনকী সবুজ চোখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত এদিকে।

‘ওয়ালী আহমেদ, আমি আপনার মাশুক নানা বলছি। নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন? আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি, দুরবিন, মাইক্রোফোন, ইত্যাদি সবকিছুর ছবি তুলে নিয়েছি আমি। আমার কথামত কাজ করলে এ ছবি। পুলিশের হাতে যাবে না। বুঝতে পারছেন? পারলে বা হাতটা ওপরে তুলে লাল মাথাটা চুলকান একবার।

মুখের ভাব পরিবর্তন হলো না। কিন্তু বাঁ হাতটা তুলে মাথাটা চুলকাল ওয়ালী আহমেদ একবার।

‘চমৎকার! এবার হাতের তাস চিত করে ফেলে দিন টেবিলের ওপর। ভয় নেই, কেবল টাকার ওপর দিয়েই যাবে এবারের ঝাঁপটা। হাতকড়া পড়বে না হাতে।

নিতান্ত ভাল মানুষের মত হাতের তাস তিনটে ফেলে দিল ওয়ালী আহমেদ টেবিলের ওপর। ব্যালকনির খোলা দরজার দিকে চাইল একবার সে। মনে হলো। সবুজ দৃষ্টিটা যেন দুরবিনের মধ্য দিয়ে এসে চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে রানার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে গেল।

এবার পকেট থেকে চেক বইটা বের করুন দয়া করে। হ্যাঁ। একলক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকার চেক লিখুন, একটা। মেয়েটির কাছ থেকে চুরি করেছেন। মোট একলক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার। বাকি দশ হাজার ফাইন করলাম এই চুরির জন্যে। আজকের ডেট দিন-এক্ষুণি ক্যাশ করতে হবে এই হোটেলের ব্যাঙ্কে। ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের চেক বই-ই তো দেখা যাচ্ছে। বেশ, বেশ। চেকটা ধরুন,

অঙ্কটা দেখব। বাহ, সব ঠিক আছে। এখন সই করুন। সই করবার সময়। ফটোগ্রাফটার কথা একবার স্মরণ করুন। এবার উল্টো দিকে আরেকটা কাউন্টার সাইন, ব্যস।

চেকটা ছিঁড়ে উল্টো পিঠে কাউন্টার-সাইন করল ওয়ালী আহমেদ। চেক বইয়ের কাউন্টার-ফয়েলে টুকে রাখল অঙ্কটা।

এবার আরেকবার দেখি তো চেকের এপিঠ-ওপিঠ? এই তো, গুড! এখন একটা বেয়ারা ডেকে চেকটা ক্যাশ করে আনতে বলুন। আর দু বোতল ফাণ্টার অর্ডার দিন। বিলটা আমিই দেব।’

অবাক বিস্ময়ে ভয়-ভক্তি-শ্রদ্ধা মিশ্রিত দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে রয়েছে অনীতা। রানা ওর দিকে চাইতেই ঢোক গিলল। রানা সিগারেট ধরাল। ওকেও দিল একটা।

বেয়ারা এল, চেক নিয়ে চলে গেল। আরেকজন দু’বোতল স্ট্র লাগানো ফান্টা এনে রাখল টেবিলের উপর। কোল্ড ড্রিঙ্ক শেষ করে একটা পান মুখে ফেলল ওয়ালী আহমেদ। একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছে ওর চোখে-মুখে। যাক, শুধু ক’টা টাকার উপর দিয়েই কেটে গেল ফাড়াটা। স্বয়ং ব্যাঙ্কের ম্যানেজারই এল টাকা নিয়ে। সসম্ভ্রমে ওয়ালী আহমেদের হাতে দিয়ে চলে গেল।

‘একটা নোটও যেন ভুল করে আবার পকেটে চলে যায়!’ বলল রানা। ‘সব টাকা ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে জোচ্চুরি করার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। বাহ, এই তো লক্ষ্মী ছেলে! এবার আমি নেমে আসছি। কোনও রকম চালাকির চেষ্টা করলে বিপদে পড়বেন। ব্যস। আজকের প্রথম অধিবেশনের এইখানেই সমাপ্তি। খোদা হাফেজ। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।

.

০৭.

ওয়ালী আহমেদের মুখের উপর এক দোয়াত কালি ছিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা বাইরে হাসতে হাসতে। তখন বিকেল সাড়ে-পাঁচটা। লোকজন জমতে আরম্ভ করেছে ক্লাবে। অনেকেই আড়চোখে চাইল। সকালের সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ওদের দেখে ডাকার অপেক্ষা না করেই সা করে এসে দাঁড়াল। দরজা। খুলে দিয়ে সালাম ঠুকল। ভাল বখশিশের এমনি গুণ! তা ছাড়া ড্রাইভার রানা জিনাতের আনন্দোচ্ছল কথোপকথনে প্রচুর রসের সন্ধানও পেয়েছিল।

‘ওয়ালী আহমেদেকে আমি মস্ত বড় যাদুকর মনে করেছিলাম,’ বলল জিনাত। এখন দেখছি তুমি তার ওপর দিয়েও এক কাঠি। ব্যাপারটা কী বলো তো? হঠাৎ সব টাকা ফেরত দিয়ে মাফ চাইল কেন? কি জাদু করেছিলে তুমি?’

সবটা ব্যাপার ভেঙে বলতেই হেসে গড়িয়ে পড়ল জিনাত। ড্রাইভারও হাসতে আরম্ভ করল। ব্যাটা সব কথা শুনছে এবং তার মধ্য থেকে রস আহরণ করছে দেখে ওর দিকে চোখের ইশারা করে আরেক দফা হাসল জিনাত।

‘আর পারি না, বাপু। হাসতে হাসতে খিল ধরে গেছে পেটে।’

রানা এ হাসিতে যোগ দিতে পারল না। লক্ষ্য করল সে, সবুজ রঙের একটা ফোক্সভাগেন আসছে ওদের পিছু পিছু ভদ্র দূরত্ব বজায় রেখে। অনেকক্ষণ ধরেই পিছু নিয়েছে।

এ ক্লিফটন বিচে বিকেল বেলা অনেক লোকের ভিড়। বাগানের ভেতর। পিঁপড়ের মত পিল পিল করে বেড়াচ্ছে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। সাগরের ধারে বসে

কফি খেল ওরা, সূর্যাস্ত দেখল। ভবিষ্যতের গল্পে এমন মশগুল হয়ে গেল যে। খেয়ালই করল না বিকেল গড়িয়ে গেছে, গোধূলির শেষ রঙও কালচে হয়ে আসছে মেঘের গায়ে। আসন্ন রাত্রির কালো ছায়া পড়েছে জনশূন্য সাগরের তীরে। গা-টা ছম ছম করে উঠল জিনাতের।

‘চলো, উঠে পড়ি, রানা। সব লোক চলে গেছে। খেয়ালই করিনি এতক্ষণ।

ধাপে ধাপে উঠে এল, ওরা, উপরে। অবাক হয়ে দেখল খা খা করছে। জনশূন্য বাগানগুলো। ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে এত লোক সবাই। সবাই চলে গেছে অন্ধকার লাগার আগে আগেই। এতক্ষণে রানার মনে পড়ল ওর এক বন্ধু উপদেশ দিয়েছিল-ক্লিফটন বিচে যদি যাও, আর বিপদ কুড়োবার ইচ্ছে যদি না থাকে, তবে লক্ষ্মী ছেলের মত ফিরে এসো পাঁচটা বাজতেই।

রাস্তায় পৌঁছে দেখল রানা বেশ কিছুটা দূরে সেই সবুজ ফোক্সভাগেনটা দাঁড়িয়ে আছে। বাম দিকের মাডগার্ডের ওপর লম্বা এরিয়েল।

ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই রয়েছে। কিন্তু ড্রাইভারটা পিছনের সিটে পা ভাঁজ করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে অকাতরে। অনেক ডাকাডাকি করেও ওঠানো গেল না ওকে। হর্ন বাজতেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘আরে ও মুন্নির মা, বাচ্চা কাঁদছে শুনতে পাও না? উঠে মুতের কাঁথা বদলে দাও।’ বলেই আবার গুটিসুটি মেরে শুয়ে নাক ডাকাতে আরম্ভ করল। মৃদু হাসল রানা। এমন ঘুমও হয় মানুষের! চুলের মুঠি ধরে গোটা দুই শক্ত ঝাঁকি দিতেই উঠে বসল ড্রাইভার। একটু লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ঘুমাইনি, স্যর। এই একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলাম আর কি?

মাইল চারেক যাওয়ার পরই ঘটল ঘটনাটা।

হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল ওরা সামনে রাস্তার ওপর জ্বলে উঠল ছ’টা হেড লাইট। আলোগুলোর দূরত্ব দেখে আন্দাজ করল রানা, ট্রাক হবে। সমস্ত রাস্তা জুড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল তিনটে ট্রাক হেড-লাইট নিভিয়ে দিয়ে। ট্যাক্সিটা। কাছে আসতেই হেড-লাইট জ্বালিয়ে এগোতে আরম্ভ করল ওদের দিকে।

ব্যাপার কী! অ্যাক্সিডেন্ট করবে নাকি?

মুহূর্তে রানার দেহের পেশিগুলো সজাগ হয়ে উঠল। বিপদের গন্ধ পেয়েছে ও। জায়গা ছাড়বে না এই ট্রাক। ওদের পিষে মারবার জন্যে পাঠানো হয়েছে। এগুলোকে। মনে পড়ল রানার, এই একটু আগেই রাস্তার পাশে এদিকে মুখ করা। পরপর তিনটে ট্রাককে ছাড়িয়ে এসেছে ওরা। তখন কিছুই সন্দেহ করেনি। এখন বুঝল ওগুলো আসবে এবার পিছন থেকে রাস্তা জুড়ে। পালাবার পথ থাকবে না। রানার অনুমানের সত্যতা প্রমাণ করবার জন্যেই যেন পিছন থেকে

একসাথে জ্বলে উঠল ছ’টা হেড-লাইট। দুই হাতে তালি দিয়ে যেমন ভাবে মশা। মারা হয়, তেমনি ভাবে হত্যা করা হবে ওদের। ফুল-স্পীডে এগিয়ে আসছে। ট্রাকগুলো। আলোয় আলোময় হয়ে গেছে রাস্তা। পালাবার কোনও পথ নেই।

এখন উপায়? রাস্তার ডাইনে-বামে বিস্তীর্ণ অসমান অনুর্বর মাঠ। ট্রায়াম্প হেরাল্ডের পক্ষে ওই মাঠের ওপর দিয়ে ট্রাকের সাথে পাল্লা দেয়া সম্ভব নয়। সেখানেও ধাওয়া করে আসবে ওরা। আশপাশে লোকালয়ের চিহ্নও নেই যে কোনও রকম সাহায্য পাবে।

‘ব্রেক করো, ড্রাইভার। গাড়ি থামাও!’ চিৎকার করে উঠল রানা।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ড্রাইভার। এমন ব্যাপার জীবনে দেখেনি সে কখনও। রানার চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেল সে। বিপদ বুঝে প্রাণপণে ব্রেক। করল। ছয় সাত গজ স্কিড করে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি।

এইটুকু সময়ের মধ্যে দ্রুত চিন্তা করে নিল রানা অবস্থাটা। হয় স্বর্ণমৃগ, নয় ওয়ালী আহমেদ। সোহেল কৌশলে জুয়াড়ি থেকে সাবধান হতে বলেছিল ওকে। ওয়ালী আহমেদের প্রতিশোধ হওয়াই বেশি স্বাভাবিক। কারণ হোটেল থেকেই পিছু নিয়েছে ওয়্যারলেস ফিট করা সবুজ ফোক্সভাগেন। টাকার জন্য পাঠায়নি সে এদের-কারণ ওয়ালী আহমেদ নিজের চোখেই দেখেছে ওদের টাকাগুলো ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে জমা দিতে। পাঠিয়েছে প্রতিশোধ নিতে। শিউরে উঠল রানা। কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! আর মাত্র গজ বিশেক আছে। দৈত্যের মত গর্জন করে এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। কাছে পিঠে সাক্ষী নেই কেউ। আগামীকাল সড়ক দুর্ঘটনার খবর বেরোবে পত্রিকায় মোটা হেডিং-এ। কে বুঝবে যে এটা খুন? নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে চায় ওয়ালী আহমেদ রানার ওপর-মেয়েটির ওপর নিশ্চয়ই নয়। এবং ট্যাক্সি ড্রাইভারের তো প্রশ্নই ওঠে না।

‘লাফিয়ে পড়ো গাড়ি থেকে। দৌড় দাও ডান দিকে মাঠের মধ্য দিয়ে।

‘আর তুমি?’ রানাকে বেরোতে না দেখে জিজ্ঞেস করল জিনাত।

যা বলছি তাই করো। জলদি!’ ধমকে উঠল রানা।

জিনাত এবং ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়েই ছুটল ডান ধারে।

এক ঝটকায় দরজা খুলে রানাও বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। আর মাত্র দশ গজ আছে। ডান ধারে গেলে চলবে না-তা হলে সবাই মারা পড়বে একসঙ্গে। দুই লাফে রানা সরে গিয়ে দাঁড়াল বাম দিকের মাঠের ধারে।

প্রথমেই সামনে থেকে ধাক্কা মারল মাঝের ট্রাকটা ট্রায়াম্প হেরাল্ডের নাকের ওপর। পরমুহূর্তেই পিছন থেকে হুড়মুড় করে এসে পড়ল আরেকটা ট্রাক। প্রচণ্ড ধাতব শব্দ হলো। চুরমার হয়ে গেল ট্রায়াম্পের নরম দেহ। তেলে চ্যাপ্টা হয়ে গেল লেটেস্ট মডেল ট্রায়াম্প হেরাল্ডের ছিমছাম চেহারা। গাড়ি বলে চিনবার উপায় রইল না। লোহার দামে বিকবে এখন ওটা। অন্যান্য ট্রাকগুলেও থেমে দাঁড়িয়েছে।

উও দেখো, ময়দান পর খাড়া হুয়া হ্যায় শায়তান।’

কথাটা কানে যেতেই আন্দাজের উপর গুলি ছুঁড়ল রানা দুবার। একটা আর্তচিৎকার কানে এল। দ্বিতীয়টা বোধহয় লাগল না। কিন্তু গুলির ভয়ে দমে যাবার পাত্র ওরা নয়। একটা ট্রাক থেমে রইল রাস্তার ওপর। বাকিগুলো নেমে আসছে মাঠে।

আরও দুটো গুলি ছুঁড়ল রানা। অন্য গাড়ির হেড-লাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল ড্রাইভিং হুইল ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল আরেকজন সিটের ওপর। অ্যাক্সিলারেটরের ওপর থেকে পা-টা বোধহয় সরেনি-মাঠের ওপর দিয়ে কোণাকুণি চলে গেল ফাস্ট গিয়াছে এবারও দ্বিতীয় গুলিটা লাগল না।

দুটো গেল। কিন্তু বাকি চারটে এবার সোজা তেড়ে এল রানার দিকে। দৌড় দিল রানা মাঠের মধ্য দিয়ে, কিন্তু হেড-লাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওরা রানাকে। কয়েকজন লোক মিলে খোলা মাঠের ওপর একটা শেয়ালকে তাড়া করলে তার কেমন লাগে বুঝতে পারল রানা। ছুটোছুটি করাই সার, নিস্তার নেই কিছুতেই।

পাগলের মত গুলি করল রানা হেড-লাইট অফ করার জন্য। পাঁচটা গুলির পরই শেষ হয়ে গেল গুলি। দুটো ট্রাকের চোখ কানা করে দিয়েছে রানা। কিন্তু তাতে ফল হলো উল্টো। রানা আর দেখতে পাচ্ছে না ওদের। অথচ ওরা। দেখতে পাচ্ছে রানাকে বাকি দুটো গাড়ির হেড-লাইটের আলোয়। যে কোনও মুহূর্তে ঘাড়ে এসে পড়তে পারে। এঁকে বেঁকে ছুটতে থাকল রানা মাঠময়। দৌড়াতে দৌড়াতেই রিলিজ বাটন টিপে ফেলে দিল খালি ম্যাগাজিন। এক্সট্রা ম্যাগাজিনটা ভরে নিল পিস্তলে। আর মাত্র আটটা গুলি। কাজেই বাজে খরচ করা যাবে না। টায়ার পাংচার করবার চেষ্টা বৃথা-তাতে ঠেকানো যাবে না। স্লাইড টেনে চেম্বারে গুলি নিয়ে এল রানা।

আবার একটা ট্রাকের হেড-লাইটের আলোয় ধরা পড়ল রানা। আলো না নেভাতে পারলে কোনও আশাই নেই। অদৃশ্য এক ট্রাকের গর্জন শোনা গেল। পেছনে। দিশেহারার মত ছুটল ও। ছুটতে ছুটতে ট্রাকের শব্দ খুব কাছে এসে গেলে দিক পরিবর্তন করছে বিদ্যুৎগতিতে। আর গুলি ছুড়ছে সুযোগ পেলেই।

ছয়টা গুলির পর নিভে গেল সব হেড-লাইট। এবার শুধু দেখা যাচ্ছে চারটে উন্মত্ত দানবের ছায়া মূর্তি। ডান দিক থেকে একটা ট্রাক ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল প্রায়। লাফিয়ে সরে দাঁড়াতেই বাম দিক থেকে এল আরেকটা। মাডগার্ডের প্রচণ্ড এক ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রানা মাটিতে। প্যান্টের কাপড় ছিঁড়ে দাঁত বসাল শক্ত মাটি রানার হাঁটুর চামড়ায়। ছড়ে গেল শরীরের অনেক জায়গা-নোনতা ঘাম লেগে জ্বালা করে উঠল কাটা জায়গাগুলো। দুরদর করে ঘাম ঝরছে সর্বাঙ্গ থেকে। নিঃশ্বাস পড়ছে হাপরের মত। উঠে বসবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। সোজা এগিয়ে আসছে একটা বিকট ছায়ামূর্তি। উঠে পড়ো। উঠে পড়ো, গর্দভ! এত সহজেই হেরে যাবে? আপন মনে বলল রানা। তারপর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ও ফুটবোর্ডের ওপর। ড্রাইভারের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপল ও, তারপরই চমকে উঠে লাফিয়ে নেমে গেল ফুটবোর্ড থেকে সামনে আরেকটা ট্রাক দেখে। এদিকেই আসছিল ট্রাকটা দ্রুতগতিতে। প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা লাগল দুটোয়। ডিজনির কার্টুনে দুই খরগোস যেমন পিছনের পায়ে ভর করে সামনাসামনি দাঁড়ায়–তেমনি দেখতে লাগল ট্রাক দুটোকে। দুটোরই সামনেটা। উঠে গেল আসমানের দিকে-তারপর খেলনার মত পড়ে গেল কাত হয়ে। ছুটে সরে যেতে আর একটু দেরি হলে রানার ওপরই পড়ত।

পিস্তলে আর একটা গুলি আছে। শত্রু আছে দুটো। এদিকে দুই ট্রাকের প্রচণ্ড সংঘর্ষের শব্দ শুনে দুটোই আসছে এদিকে। একটা উল্টানো ট্রাকের আড়ালে সরে দাঁড়াল রানা। কাছে আসতেই গুলি করল। শেষ গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। হঠাৎ একটা ট্রাক বিগড়ে গিয়ে পাই পাই ঘুরতে থাকল মাঠের মধ্যে অল্প একটু জায়গায়। বাকি ট্রাকটা তিন সেকেণ্ড থেমে থেকে বোধহয় হৃদয়ঙ্গম করবার চেষ্টা করল ব্যাপারটা, তারপর হাঁ-হাঁ করে ছুটে গেল রাস্তার দিকে। রাস্তায় উঠেই সোজা পিঠটান দিল শহরের দিকে।

হাঁপাচ্ছে রানা। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে ওর মাটির ওপর। কপালের দুইপাশে দপ দপ করছে শিরাগুলো। কান দিয়ে গরম ভাপ ছুটছে। এতক্ষণের প্রাণান্তকর দৌড়ের ফলে মাথার চুল পর্যন্ত ভিজে গেছে ঘামে। উল্টানো ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিল ও কিছুক্ষণ। গুলিহীন পিস্তলটা রেখে দিল কোটের পকেটে।

হঠাৎ মনে পড়ল জিনাতের কথা। তাড়াতাড়ি শহরে ফিরে রিপোর্ট করবার তাগিদও অনুভব করল ও। তিন পা এগিয়েই পিছনে একটু খস খস আওয়াজ পেয়ে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। প্রথমেই চোখ পড়ল একটা উদ্যত ছুরির ওপর। ডান হাতে কব্জিটা ধরেই আছড়ে ফেলল ও লোকটাকে মাটির উপর। বুড়ি গঙ্গার শুশুক মাছের মত মাথাটা নীচের দিকে করে ডিগবাজি খেল লোকটা। ছিটকে পড়ে গেল ছুরি হাত থেকে। উঠে বসবার চেষ্টা করছিল, শিরদাঁড়ার ওপর রানার বুটের একটা কড়া লাথি খেয়ে বেঁকে গেল ওর শরীর। মুখে গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে। এ সেই মাঠের মাঝখানে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া ট্রাকের অপর ড্রাইভারটা।

রাস্তায় উঠে এল রানা।

‘জিনা…!’ চিৎকার করে ডাকল ও।

‘আয়ি। উত্তর এল দূর থেকে।

হেড-লাইট জ্বালা ও স্টার্ট দেয়া অবস্থায় রাস্তার ওপর দাঁড়ানো ট্রাকের মধ্য থেকে টেনে নামাল রানা দুর্ধর্ষ চেহারার এক পাঞ্জাবী ড্রাইভারের মৃতদেহ। ঠিক চোখের পাশে লেগেছিল গুলিটা। দরজায় এবং সামনের উইণ্ড-স্ক্রিনে রক্তের সঙ্গে লেগে আছে মগজের অংশ।

রাস্তায় উঠে এল জিনাত ও ট্যাক্সি ড্রাইভার। তোবড়ানো গাড়িটার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ নিষ্ফল ক্ষোভ প্রকাশ করল ড্রাইভার, তারপর চূর্ণ বিচূর্ণ গাড়ির ড্যাশ বোর্ড থেকে ব্লু-বুক আর রোড পারমিটের টোকেনটা বের করে নিয়ে বলল, ‘হামকো ক্যয়া হ্যায়। গাঁড় ফাটেগা ইনশিওর ওয়ালোকা।

উঠে বসল ড্রাইভার ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে।

তখনও বন বন ঘুরছে একটা ট্রাক অন্ধকার মাঠের মধ্যে।

মাইল, ছয়েক আসতেই পিছনে কর্কশ হন শোনা গেল, ‘বিপ…বিপ’। অভ্যাসবশে সাইড দিল ড্রাইভার। পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল সবুজ ফোক্সভাগেন। এরিয়েলের রড়টা দুলছে এদিক ওদিক। রানা বুঝল ওয়্যারলেস ফিট করা আছে ওই গাড়িতে। রানার গতিবিধি সম্পর্কে ট্রাক ড্রাইভারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওই গাড়ি থেকেই। ফোক্সভাগেনের ব্যাক লাইট যখন প্রায় অদৃশ্য হয়ে এল তখন হঠাৎ ট্রাকের মধ্যে কে যেন কথা বলে উঠল।

‘মাসুদ রানা। হুশিয়ার, মওত বহোত দূর ন্যহি!’

মাথার ওপর চেয়ে দেখল রানা। স্পীকার ঝুলছে একটা।

.

০৮.

খান মোহাম্মদ জানের ওখান থেকে কয়েক জায়গায় ফোন করল মাসুদ রানা। এক বিশেষ মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল একদল লোক এদিক ওদিক।

না খাইয়ে ছাড়ল না জিনাত। খাওয়ার টেবিলেই পরিচয় হলো একজন সুদর্শন যুবকের সঙ্গে। সাঈদ খান। মোহাম্মদ জানের ভাতিজা। রানার চেয়ে কিছু ছোট হবে বয়সে। মোহাম্মদ জানের পরে সে-ই হবে, এই প্রতাপশালী ট্রাইবের চিফ। সত্যি, সর্দারের মতই চেহারা। চমৎকার স্বাস্থ্য। লম্বা একহারা পেটা শরীর। রানা নিজে মিশুক প্রকৃতির মানুষ না হলেও প্রথম দর্শনেই পছন্দ করল ছেলেটিকে। গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নির্ভর করা যায় এ লোকের ওপর। কিন্তু রানা এটাও বুঝল যে প্রথম দর্শনেই তাকে অপছন্দ করেছে সাঈদ। কারণ কিছুটা আঁচ করল ও জিনাতের দিকে ওর চোরা চাহনি দেখে। বুঝল, মস্ত ক্ষত চেপে রেখেছে পরাজিত সাঈদ। ভেতর ভেতর গুমরে মরছে সে কতদিন ধরে কে জানে। বোধহয় কাউকে, এমনকী জিনাতকেও, মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে কিছু। চেষ্টা করেও ওর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারল না। রানা। শেষে হাল ছেড়ে দিল মৃদু হেসে।

ট্রাক-হামলার সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া মন দিয়ে শুনল মোহাম্মদ জান। কুঞ্চিত হয়ে উঠল ওর কপাল। বলল, বুঝতে পারছি, মস্ত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে লেগেছ তুমি, রানা। এটা আমার মালাকান্দ নয়। হলে পিষে ফেলতে পারতাম যে-কোনও শত্রুকে। তুমি বরং এখানেই থেকে যাও রাত দশটা পর্যন্ত। এখান থেকেই বেরোনো যাবে তোমার স্বর্ণমুগের সন্ধানে।

তা হয় না। আমার কিছু কাজ আছে হোটেলে। আপনি বরং ওখানেই আসুন।’

‘বেশ। সাঈদ, তুমি মেজর রানার সঙ্গে গিয়ে চিনে আসো হোটেলটা।

বেরোবার আগে রানাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল জিনাত। রানা কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে খাওয়া দাওয়ার শেষে পানি খাওয়ার আগে সোহেলের দেয়া যষ্টিমধু চুবিয়ে নিল জিনাত গ্লাসের মধ্যে। অত্যন্ত সিরিয়াস সে এ-সব ব্যাপারে।

‘আমার জন্যেই তোমার আজ এই বিপদ, রানা।

‘তোমার জন্যে মানে?

‘আমার জন্যেই তো। সাধুবাবা তোমাকে জুয়াড়ির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বলেছিল আমাকে। পোড়া মন! ভুলে গেলাম কী করে? আজ রাতে আমার ঘুম হবে না, রানা।

‘ছিঃ। এসব চিন্তা করে মাথা গরম কোরো না, জিনাত। কাল না তোমার জন্মদিন? বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব আসবে। খামোকা রাত জাগলে কাল দুপুর হলেই দাঁত কেলিয়ে পড়ে থাকবে-কেক কাটারও শক্তি থাকবে না আর বিকেল বেলা!

হাসল জিনাত। রানার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, কাল আসছ তো?

‘আসছ তো মানে? আজ রাতের কাজটা ভালোয় ভালোয় চুকে গেলে কাল তো আমাকে এখান থেকে নড়াতেই পারবে না।

কী উপহার দেবে, বলো না? আব্দার ধরে জিনাত।

‘যখন দেব, তখন দেখো! অবাক করে দেব একেবারে।

মিনিট দুয়েক আর একটি কথাও হলো না দুজনে-তারপর লিপস্টিক মাখা ঠোঁট নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল মাসুদ রানা।

.

সাঈদ জিজ্ঞেস করল, ‘ওয়ালী আহমেদের সাথে লাগতে গেলেন কেন? শত্রুতা হলো কীসে?

রানা ওর জোচ্চুরির কথা সাঈদকে খুলে বলল। কীভাবে শায়েস্তা করেছে আজ বিকেলে, বলল। ওয়ালী আহমেদের আসল মতলব শুনে কঠিন হয়ে গেল সাঈদের মুখ।

তা হলে জিনাতকে নিয়েই লেগেছে আপনাদের মধ্যে?

‘অনেকটা তাই বলতে পারেন।

‘যদি তাই হয়, অর্থাৎ যদি সে জিনাতকে কামনা করে থাকে, তা হলে জিনাতের কপালটা নেহায়েতই খারাপ বলতে হবে। ওয়ালী আহমেদ যা চায় তা

সে করে ছাড়ে। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি চিনি ওকে। আজ পর্যন্ত কেউ ঠেকাতে পারেনি ওকে-আপনিও পারবেন না, আমিও না, চাচাজিও না। করাচি শহরে ওর ক্ষমতার কাছে আমরা কিছু না।’

‘ওকে আপনি চিনলেন কীভাবে?

‘আমাদের একটা গোপন ব্যবসায়ে দুই দুইবার মার খেয়েছি আমরা ওর। হাতে। তাও আবার মালাকালে বসে। চাচাজী জানে না। আমার ওপর ছিল ওই ব্যবসার ভার। অদ্ভুত ওর ক্ষমতা! আর করাচিতে তো দিন দুপুরে যদি সে ভোলা রাস্তার ওপর আপনাকে গুলি করে মারে, কিচ্ছু হবে না ওর। কেউ কিছু করতে পারবে না। পাত্তাই পাবে না।’

‘আপনি দেখছি ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন আমার মনে।

‘আমি আপনাকে সত্য উপলব্ধি করাবার চেষ্টা করছি মাত্র।’

‘আমার মনে হয় না সাধারণ একজন লোককে এত ভয় পাওয়ার কিছু আছে। আলোচনাটা ভাল লাগছে না রানার। গলার স্বরে সেটা টের পেল সাঈদ।

‘সাধারণ লোক! একটু হাসল সাঈদ। তারপর চুপ হয়ে গেল।

.

ছোট্ট লনটা পার হয়ে লাউঞ্জে উঠবার কয়েক ধাপ সিঁড়ি। হোটেলের বাইরে গাড়ি রেখে এগিয়ে আসছে সাঈদ আর রানা পাশাপাশি। রানার আপত্তি সত্ত্বেও ঘর-পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলে, সাথে আসছে সাঈদ। হঠাৎ রানার প্রবল এক ধাক্কায় ছিটকে রাস্তা থেকে লনের ঘাসে চলে গেল সাঈদ। টাল সামলাতে না। পেরে গোটা কয়েক ডালিয়া ফুলের গাছসহ ভূমিসাৎ হলো সে। রানাও লাফিয়ে সরে গেছে পথ ছেড়ে অপর পাশের ঘাসে। এমনি সময়ে দড়াম করে পড়ল পাথরটা রাস্তার ওপর। প্রায় তিন মণ ওজনের প্রকাণ্ড একখানা পাথর পিচের রাস্তাটা আধহাত ডাবিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে লাগল লোহার গেটে। দুমড়ে বেঁকে গেল গেট। কয়েকটা শিক খুলে বেরিয়ে গেল নীচের খোপ থেকে। সাততলার ছাদ থেকে পড়েছে পাথর।

চোখের নিমেষে ঘটে গেল ব্যাপারটা। উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এল সাঈদ রানার দিকে।

‘চোট তো নহি লাগি, মেজর?

কোনও উত্তর না দিয়ে ওর হাত ধরে দ্রুত উঠে এল রানা লাউঞ্জে। এটা যে। সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, কেউ ওদের খুন করবার জন্যে কাজটা করেছে, বুঝতে পেরেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটল সাঈদ ছাদের দিকে। এক এক লাফে তিন সিঁড়ি টপকাচ্ছে ও। ঠাণ্ডা মাথায় লিফটে করে পাঁচতলায় উঠে এল রানা। অল্পক্ষণ অপেক্ষা করতেই দেখল সাঈদ আসছে সিঁড়ি বেয়ে। হাতে রিভলভার। দ্রুত চিন্তা করছে রানা।

‘ছাতে গিয়ে কোনও লাভ নেই, মি, সাঈদ। এই দেখুন।

দেখা গেল বাম পাশের লিফটটা নীচে নেমে আসছে। রানা বোতাম টিপল বার কয়েক। 6.5…4…নেমে যাচ্ছে লিফট-থামল না। হলুদ নম্বরগুলো কমে আসছে, 2…1…G, সোজা নেমে গেল লিফট গ্রাউণ্ড ফ্লোরে।

‘আপনি ওপরে না এসে নীচে থাকলেই ধরা যেত ওদের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সাঈদ।

‘আমার যতদূর বিশ্বাস, ওই লিফটে অপারেটার ছাড়া আর কেউ-ই নেই।’

কী করে বুঝলেন?’

‘এইটাই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।’

তা হলে ছাতের ওপর নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে দুশমনদের।’ আবার রওনা হচ্ছিল সাঈদ, এক থাবা বসাল রানা ওর কাঁধে।

‘ছাতেও কিছু পাবেন না, মিস্টার সাঈদ। দুশমন যে-ই হোক না কেন, আমার-আপনার চেয়ে অনেক হুঁশিয়ার। যদি দেখতে চান তা হলে আসুন আমার সঙ্গে।

সাঈদের উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। দেখল কাগজের টুকরোটা পড়ে আছে মাটিতে। অর্থাৎ, নিশ্চয়ই কেউ ঘরে ঢুকেছিল-কিংবা এখনও আছে।

‘রিলভারটা দিন তো। আমার পিস্তলের গুলি শেষ।

অবাক হয়ে রানার মুখের দিকে চেয়ে এগিয়ে দিল সাঈদ ওর রিভলভার। নিঃশব্দে তালা খুলে ডান হাতে রিভলভারটা নিল রানা। তারপর বাঁ হাতের এক ধাক্কায় কপাট খুলেই লাফিয়ে ঢুকল ঘরের মধ্যে। না, ঘরের মধ্যে কেউ নেই। শূন্য ঘরটা যেন উপহাস করল রানার অতি-সতর্কতাকে। তবু বাতি জ্বালিয়ে। দুটো ঘর আর বাথরুমটা দেখে নিয়ে নিঃসন্দেহ হলো রানা। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে সাঈদকে নিয়ে এসে দাঁড়াল ব্যালকনিতে।

‘ওই যে!’ সাঈদেরই চোখে পড়ল আগে। রানাও চাইল সেদিকে। দেখল রশি বেয়ে নেমে যাচ্ছে একজন লোক ছাত থেকে হোটেলের পিছনে। আবছা অন্ধকারে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। মাটিতে পা ঠেকতেই দৌড় দিল লোকটা সাগরের দিকে। সেইলরস ক্লাবের কাছে গিয়ে রাস্তায় উঠতেই ল্যাম্প পোস্টের আলোয় লোকটার চেহারা দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল রানা এবং সাঈদ। মানুষের চেহারা যে এত প্রকাণ্ড আর এত সৃষ্টিছাড়া কুৎসিত হতে পারে, ধারণা ছিল না রানার। মিশমিশে কালো প্রায় সাত ফুট লম্বা, আর যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। একবার পেছন ফিরে দেখল কেউ আসছে কি না। দেখা গেল ওপরের ঠোঁট নেই। বিকট কালো মুখে ঝকঝক করছে হিংস্র সাদা দাঁত। বুলেটের বেগে চলে গেল বীভৎস মূর্তিটা সমুদ্রের দিকে।

‘গুংগা!’ কেঁপে উঠল সাঈদের কণ্ঠস্বর।

‘চেনেন আপনি ওকে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ, চিনি। ওয়ালী আহমেদের দেহরক্ষী। লোকটা কালা ও বোবা। ভয়ঙ্কর শক্তি ওর গায়ে।

‘তা চেহারা দেখেই মনে হলো। ওই তিন-মণী পাথর তা হলে ওই ফেলেছিল।

‘ওই পাথর ওর কাছে দশ ইঞ্চি হঁটের মত। আপনি বড় ভয়ঙ্কর পাল্লায় পড়েছেন, মিস্টার মাসুদ রানা। আমি পরামর্শ দিচ্ছি, সম্ভব হলে আজই পালিয়ে যান আপনি করাচি ছেড়ে।

এসব কথা শুনছে না, রানা। ওর মনে পড়ল, ঢাকায় হেড-অফিসে চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল শেখের একটা কথা। পিসিআই-এর একজনকে দিন দুপুরে খুন করা হয়েছিল ম্যাকলিওড রোডের ওপর। ছাতের ওপর থেকে মস্ত একটা পাথর ফেলে কেউ থেঁতলে মেরেছিল ওকে ফুটপাথের ওপর। আজকের ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। পিসিআই এজেন্টকে মারা হয়েছিল স্বর্ণমুগের। পিছনে লাগার জন্য, আর রানাকে খুন করবার চেষ্টা করা হলো ওয়ালী আহমেদের পিছনে লাগার জন্যে। দুই জায়গাতেই একই অস্ত্র-পাথর।

তা হলে? ওয়ালী আহমেদুই কী স্বর্ণমুগ? না এটা একটা দৈব-সংযোগ? কোইনসিডেন্স? এমনও হতে পারে যে ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে ঝগড়াও হলো, আর স্বর্ণমুগের কাছে ধরাও পড়ল একই সঙ্গে। স্বর্ণমৃগই আসলে আক্রমণ চালাচ্ছে, আর রানা খামোকা ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে ঘটনাকে জড়িয়ে নিয়ে জগা-খিচুড়ি পাকাচ্ছে।

কিন্তু তা হলে গুংগা? সাঈদের কথা কতখানি নির্ভরযোগ্য?

‘আপনি ঠিক জানেন যে ওই বিকট চেহারার লোকটা গুংগা? ওয়ালী আহমেদের দেহরক্ষী? চোখের ভুল হতে পারে?

‘পাগল নাকি? যে একবার সামনে থেকে দেখেছে ওই চেহারা, জীবনে তার এ ব্যাপারে অন্তত চোখের ভুল হবে না। আপনিই বলুন, আপনি তো এক মুহূর্তের জন্যে দেখেছেন, ভুলতে পারবেন ওই চেহারা?

কথাটা মনে মনে স্বীকার করতেই হলো রানাকে। সে চেহারা ভুলবার নয়। কয়েক রাত্রির ঘুম নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তা হলে? অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠল যে ব্যাপারটা। ওয়ালী আহমেদই যদি স্বর্ণমৃগ হয়ে থাকে তা হলে সে কি জেনে ফেলেছে রানার পরিচয়? নাকি পৌরুষে আঘাত লাগায় কেবল প্রতিশোধ নিতে চাইছে? ওর অনুপস্থিতিতে ঘর অনুসন্ধান করে কোনও তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গেল শত্রুপক্ষ? সোহেলই বা ওয়ালী আহমেদ সম্পর্কে সাবধান করল কেন গান্ধী গার্ডেনে? সে কি জানতে পেরেছে কিছু?

এমন সময় একটা স্পীড-বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ এল কানে। চলে গেল গুংগা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সাঈদ চলে যেতেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজল রানা। ঘরের ভেতরটা টাইম বম্ব রেখে যেতে পারে হয়তো। সুটকেসের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে। এক আধটা কাগজ খোয়াও গিয়ে থাকতে পারে, ঠিক বোঝা গেল না, সারা ঘরে অস্বাভাবিক কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। এর, আলমারি, আলমারির ছাদ, ওয়াল ক্লকের ভেতর, বিছানার তলা, এমনকী ভেন্টিলেটার পর্যন্ত দেখল রানা। নাহ। কোথাও কিছু রেখে যায়নি ওরা। হয়তো রানার সত্যিকার পরিচয় জানবার জন্য লোক পাঠিয়েছিল ওয়ালী আহমেদ। আর কিছু নয়। অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে কোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে জুতো পরেই শুয়ে পড়ল রানা বিছানায়। থ্রি-ক্যাসলস ধরাল একটা।

পাতলা একফালি নীলচে ধোঁয়া উঠছে ওর হাতে ধরা সিগারেট থেকে। কিছুদূর সোজা উঠে এঁকে বেঁকে যাচ্ছে, তারপর ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে, শেষে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। অন্যমনস্কভাবে সেদিকে চেয়ে গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল মাসুদ রানা।

খট খট খট। তিনটে টোকা পড়ল দরজায়। রানা ঘড়ি দেখল, সাড়ে নয়টা বাজে। মোহাম্মদ জান কি আগেই এসে গেল? সাঈদের মুখে সব কথা শুনে বোধহয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।

আবার টোকা পড়ল দরজায়। এবার চারটে। অর্থাৎ অসহিষ্ণু। দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেল রানা। দাঁড়িয়ে আছে অনীতা গিলবার্ট।

‘ভেতরে আসতে পারি?’ জিজ্ঞেস করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই রানাকে ঠেলে ঢুকে এল অনীতা ঘরের ভিতর। দরজাটা বন্ধ করে দিন। জরুরি কথা আছে।’ মেঝেতে হাইহিলের খুট খুট আওয়াজ তুলে দরজা থেকে সবচাইতে দূরের সোফাটায় গিয়ে বসল অনীতা। চমৎকার একটা নীল-চকলেট-সাদা ছিটের স্কার্ট পরেছে সে। চিকন কটিতে কালো বেল্ট। মাথায় কালো নেটের স্কার্ফ-গলার কাছে গিট দেয়া। মুখে সযত্ন প্রসাধন, ঠোঁটে ঘন করে লিপস্টিক। বিকেলের সেই অর্ধ উলঙ্গ মেয়েটি বলে চেনাই যায় না আর। এই প্রথম রানা উপলব্ধি করল মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী।

দরজা বন্ধ করে বসল রানা মেয়েটির মুখোমুখি।

তারপর, হঠাৎ?’ জিজ্ঞেস করল রানা সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে।

‘হঠাৎ নয়। তোমার জন্যে সাড়ে ছ’টা থেকে অপেক্ষা করছি আমি। তোমার ওই কাউ-বয় বন্ধুটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আসতে পারছিলাম না। আমার অনেক কথা আছে-সব শুনবার সময় হবে তোমার? পরিষ্কার বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল অনীতা।

না। মেয়েদের কথা কোনওদিন শেষ হয় না। আর অনেক কথা থাকলে তো সর্বনাশ-রীতিমত বিপজ্জনক! হাসল রানা। তা ছাড়া আর আধঘণ্টার মধ্যেই বেরোতে হবে আমাকে। একজন ভদ্রলোক আসবেন।

‘তা হলে খুব সংক্ষেপে সারতে হবে আমার সব কথা।

রানা উঠে দুটো গ্লাসে উইস্কি ও সোডা ভর্তি করে একটা নিজে নিল আর একটা নামিয়ে রাখল অনীতা গিলবার্টের পাশে।

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু,’ এক চুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখল গ্লাসটা অনীতা।

‘তোমার প্রভু কোথায়? যীশুর কথা বলছি না, ওয়ালী আহমেদ। আমার ঘরে এসেছ জানতে পারলে…’

হ্যাঁ। খুন করে ফেলবে। কিন্তু আমি এখন আর তার চাকর নই। আজ সাড়ে ছয়টায় সে আমার পাওনা চুকিয়ে তার ওপর আরও পাঁচ হাজার টাকা। বখশিশ দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।

‘তাই নাকি? জোচ্চুরি ছেড়ে দিয়েছে তা হলে তোমার প্রভু? সুখবর!

‘তোমার জন্যে এটা সুখবর নয়, মি. রানা। সে নিজে ঢুকেছিল তোমার ঘরে, বিকেলে তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর। তারপরের ঘটনাটুকু আমি জানি। বলেই আমার জিনিসপত্র বোনের বাসায় রেখে ফিরে এসেছি আবার।

আচ্ছা! তা হলে ওয়ালী আহমেদ নিজে এসেছিল তার ঘরে? পরের ঘটনাটুকু শুনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল রানার মন। কিন্তু সে-ভাব প্রকাশ না করে সিগারেট ধরাল একটা। প্যাকেট এগিয়ে দিল অনীতার দিকে। সিগারেট না নিয়ে উইস্কিতে চুমুক দিল অনীতা।

‘তোমার এই ঘরে যে কী পেল ওয়ালী আহমেদ জানি না। কিন্তু অত্যন্ত উত্তেজিত দেখলাম ওকে। প্রথমেই ওয়্যারলেসে চারদিকে তোমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করল, গাড়ি নিয়ে তোমাকে ফলো করবার আদেশ দিল কাউকে। তারপর ওর অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্টের ম্যানেজারকে ডেকে তোমাকে আজকের মধ্যেই সুযোগ মত পিষে মারবার আদেশ দিল। পিআইএ বুকিং-এ ফোন করে আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে রাওয়ালপিণ্ডির একটা ফার্স্ট ক্লাস টিকেট রাখতে। বলল-নিজের নামে। তারপর আমার টাকা-পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিল। জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে শুনতে পেলাম হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন করে বলছে, আজ সন্ধ্যায় জরুরী কাজে পিণ্ডি যাচ্ছে সে-কাজেই সব বিল যেন তৈরি রাখে ছ’টার মধ্যে।’

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে চুপ করল অনীতা। একটা সিগারেট ধরাল রানার প্যাকেট থেকে নিয়ে। গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে হাতেই ধরে রাখল সেটা। সিগারেটের সাদা কাগজের ওপর লাল লিপস্টিকের দাগ পড়েছে।

দ্রুত চিন্তা করছে রানা। কোনও কথা বলল না। চেয়ে রইল মেয়েটির দিকে।

‘তোমার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে এসব কথা আমি তোমাকে বলছি কেন? সে। কথায় পরে আসছি। আগে এখন এইসব ঘটনা থেকে আমার ডিডাকশনটা শোনো। যদিও তুমি বলেছিলে আইবি বা পুলিশের লোক তুমি নও, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস তুমি এমন কোনও সরকারি বিভাগের লোক যাকে শেষ না করতে পারলে বিপদে পড়বে ওয়ালী আহমেদ। কারণ, তোমার ঘরে ঢুকবার আগে ওকে খুব খুশি দেখেছিলাম। আমাকে তোমার সম্পর্কে বলেছিল, ‘এতদিনে সত্যিকার একটা যোগ্য লোক পাওয়া গেল। মাসে বারো হাজার টাকা দিতে হলেও এই লোককে রাখব আমি সহকারী বানিয়ে। তোমার ঘর থেকে ঘুরে আসার পর ওর চেহারা দেখে চমকে উঠেছিলাম আমি। তারপরের ঘটনা তো। বললামই। ট্রাক দিয়ে পিষে মারার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হইনি। স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক ইনটুইশনের বলে আমি জানতাম অত সহজে তোমাকে ঘায়েল করতে পারবে না ওরা।

করে এনেছিল প্রায়,’ বলল রানা।

‘কিন্তু পারেনি।’ কথাটা ওখানেই থামিয়ে দিয়ে নিজের কথায় ফিরে গেল। অনীতা। আর ওয়ালী আহমেদ যাতে এসব ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়ে, সেজন্যে আমার যতদূর বিশ্বাস ওর নাম নিয়ে ওর মত দেখতে কোনও লোক চলে গেছে। রাওয়ালপিণ্ডি, আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে। কাগজে কলমে ওয়ালী আহমেদ এখন আর করাচিতে নেই।’

‘কিন্তু আসলে সে সশরীরে করাচিতেই আছে, এই তো বলতে চাও? এর। পেছনে তোমার কী যুক্তি?

তিন মাস ছিলাম আমি ওর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। হাড়ে হাড়ে চিনি আমি ওকে। ও যে কী পরিমাণ ভয়ঙ্কর লোক তা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। জিনাত সুলতানা ওর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছে-অবাধ্যতা করে অপমান করেছে ওকে। আজ পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোক ওর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। জিনাতও পাবে না। ছলে-বলে কৌশলে সে ধূলিসাৎ করবে জিনাতের অহঙ্কার। আত্মসমর্পণ করতেই হবে তাকে ‘ওয়ালী আহমেদের কুৎসিত ইচ্ছার কাছে। তার আগে সে এক পা-ও নড়বে না করাচি থেকে।’

এ ছাই ঝাড়ল অনীতা সিগারেটের। হালকা করে একটা টান দিল সেটাতে, তারপর ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে সোজা রানার চোখের দিকে চাইল এবার সে।

‘আমি তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি, রানা।

কারণ কী, সুন্দরী? আমাকে হত্যা করা হলে তোমার তো কোনও ক্ষতি দেখি না।

‘ক্ষতি আছে। তোমাকে আমি কিছুতেই মরতে দেব না।’ রানাকে অবাক হয়ে চাইতে দেখে আবার বলল, তুমিই আমার একমাত্র ভরসা, রানা।

‘প্রথম দর্শনেই প্রেম মনে হচ্ছে!’ কৌতুক বোধ করল রানা।

হেসে ফেলল অনীতা। সোনা বাঁধানো একটা দাঁত চক চক করে উঠল। এক ঢোক উইস্কি গিলে নিয়ে বলল, ‘শুনতে ওই রকমই লাগছে, তাই না? আমি দেখেছি, পুরুষ মানুষকে ঈশ্বর হ্যাণ্ডসাম করে বানালেও মাথায় পাঁঠার বুদ্ধি দিয়ে দেয়। সবক্ষেত্রেই তাই। তোমার বেলায় একটু অন্যরকম ভেবেছিলাম। আজ বিকেলে খানিকটা বুদ্ধির ঝিলিক দেখেছিলাম কিনা, তাই। শোনো হে, আকর্ষণীয় যুবক। তোমার প্রেমে আমি পড়িনি। নারীর প্রেম অত সহজ নয়। তোমাদের মত যেখানে সেখানে ধুপ-ধাপ প্রেমে আমরা পড়ি না। অবশ্য আজ বিকেলে আমার প্রস্তাবে তুমি রাজি হলে খুশি হতাম না তা বলছি না। রানার দিকে তেরছা করে চেয়ে মুচকি হাসল অনীতা! কিন্তু তা হলে আর তোমার কাছে সাহায্য চাইতে আসতাম না।

‘সাহায্য?

‘হ্যাঁ, সাহায্য। আমি জানি, কেউ যদি আমাকে সাহায্য করবার শক্তি, সাহস, আর বুদ্ধি রাখে, সে হচ্ছ তুমি। আমি যখন অপমানের জ্বালায় তিলে তিলে দগ্ধে মরছি, কালনাগিনীর মত বিষাক্ত ছোবল তুলে প্রতিশোধ নেবারজন্যে সুযোগের প্রতীক্ষা করছি, ঠিক সেই সময় তুমি এসেছ আমার জীবনে প্রেরিত-পুরুষের মত। সাহায্য করবে আমাকে, রানা?

কথাগুলো বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেল অনীতা গিলবার্ট। করুণ মিনতি ফুটে উঠল ওর চোখে। সমস্ত সত্তা একাগ্র হয়ে উঠেছে ওর রানার উত্তর শুনবার জন্যে।

‘কীসের প্রতিশোধ, অনীতা?

রানা বুঝল এই মেয়েটির জীবনের কোনও দুর্বিষহ সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে। নিতান্ত ঘটনাচক্রে হৃদয়ের মস্ত একটা সূত্র উন্মোচন করে। দেখাবে মেয়েটি আজ তাকে। খামোকা এক কাজে এসে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়বার আশঙ্কায় একটু উদ্বিগ্ন হলো ও মনে মনে। কিন্তু বড় আশা করে এসেছে, ওকে ফেরাবেই বা কী বলে?

‘অপমানের। স্ত্রীলোক প্রকৃতির মতই সর্বংসহা। পুরুষের অনেক অত্যাচার, অনাচার আর কঠিন আঘাত সহ্য করতে পারে সে হাসিমুখে। পুরুষের বুনো স্বভাবের জন্যে আরও বেশি করে ভালবাসে, সে তাকে। এটা নারীর ধর্ম। পুরুষরা যখন নাটক নভেলে সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকের ওপর হৃদয়হীন পুরুষের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি বর্ণনা করে হাহুতাশ করে তখন আমরা মনে মনে হাসি। আমরা যাকে মন দিই, তার কোনও অত্যাচারই আর অত্যাচার মনে হয় না আমাদের কাছে। কিন্তু একটা জিনিস নারী কোনওদিন সহ্য করতে পারে না, কোনওদিন ক্ষমা করে না-সে হচ্ছে অপমান। এসব কথা শুনতে রানার অস্বস্তি লাগছে বুঝতে পেরে আবার বলল, ‘ঘটনাটা খুলে বলছি।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল অনীতা। তারপর বলল, ‘তিন মাস আগে আমি এয়ার হোস্টেস ছিলাম। কায়রো থেকে করাচি ফিরছিলাম। সেই প্লেনেই পরিচয় হয় ওয়ালী আহমেদের সাথে। ও প্রস্তাব দিল ওর সাথে ডিনার খাওয়ার। আমার নৈতিক চরিত্রের বালাই কোনওদিনই ছিল না, এখনও নেই। তা ছাড়া নিয়মিত কন্ট্রাসেপটিভ পিল ব্যবহার করতাম তখন আমি। কাজেই নির্ভয়ে রাজি হয়ে গেলাম। ক্যাপ্টেনের কাছে অনুমতি চাইতেই আমার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে মৃদু হেসে অনুমতি দিয়ে দিল সে।’

‘সেই রাতেই প্রথম এলাম আমি এই হোটেলে ওয়ালী আহমেদের কামরায়। ডিনার শেষ হতেই একটিও কথা নেই বার্তা নেই আমার জামা কাপড় খুলতে আরম্ভ করল ওয়ালী আহমেদ। আমি আপত্তি করলাম। কিন্তু এইমাত্র ওর পয়সায় তৃপ্তির সঙ্গে জীবনের শ্রেষ্ঠ ডিনার খেয়ে উঠে তেমন জোর করে কিছু বলতেও পারলাম না। তা ছাড়া, একজন পুরুষের সঙ্গে মেয়েমানুষ গায়ের জোরে পারবে কেন?’ লাল হয়ে উঠল অনীতার মুখ। নীচের ঠোঁটটা কাঁপছে। কামড়ে ধরে সেটাকে সংযত করবার চেষ্টা করল সে। অপলক চোখে চেয়ে শুনছে রানা একটি নারীর চরম লজ্জার কথা।

‘ধস্তাধস্তি করলাম। কিন্তু পারলাম না। লণ্ডন থেকে কেনা আমার দামি স্কার্টটা একটানে চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেলল ওয়ালী আহমেদ। প্রায় নগ্ন অবস্থায় ছুটোছুটি করতে থাকলাম ঘরের মধ্যে ওর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। ধরে ফেলল ও। তারপর পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল বিছানায়। নীল বাতিটা ছাড়া সব বাতি নিভিয়ে দিল। বলল, ‘ওই কাপড়ের জন্যে দুঃখ কোরো না অ্যানিটা, ও রকম একশ’টা কাপড় কিনে দেব আমি কাল তোমাকে। শুধু আজকের রাতটা উপভোগ করতে দাও আমাকে। বাধা দিয়ো না। আমিও ভেবে দেখলাম, একটা কাপড় ছিঁড়ে ফেলা এমন কিছু দোষের নয়, কামুক লোক উন্মত্ত হয়ে উঠলে এর চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর কাজ করতে পারে। চুপচাপ পড়ে থাকলাম।

কথাগুলো বলতে গিয়ে অস্বাভাবিক উত্তেজিত হয়ে উঠল অনীতা। নিজেকে শান্ত করবার জন্য একটা সিগারেট ধরাল। রানা দেখল থর থর করে কাঁপছে ওর হাত।

তারপর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘তারপর আমার সর্বাঙ্গে আদর করতে আরম্ভ করল সে। হাজার হোক রক্ত মাংসে তৈরি আমি। ধীরে ধীরে ভাবান্তর এল। এখন ভাবতে ঘৃণা হয়, কামাতুরা আমি চুম্বন করলাম ওর ঠোঁটে। আধঘণ্টা ধরে ক্রমাগত আদর করেই চলেছে। সে। অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। আমার অস্থিরতা দেখে এক মিনিটেই আসছি বলে বাথরুমে ঢুকল ওয়ালী আহমেদ। অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। তিন মিনিট পর সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক।’

একজন লোক? ওয়ালী আহমেদ না?’

‘না!’ শিউরে উঠল অনীতা একবার। বিকট দর্শন ভয়ঙ্কর চেহারার একটা পিশাচ। নীল আলোয় দেখলাম মিশমিশে কালো প্রকাণ্ড এক দৈত্য এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটো। উপরের ঠোঁট কাটা। দাঁত আর মাড়ি বেরিয়ে আছে। আঁতকে উঠে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমেই ছুটলাম দরজার দিকে। বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এল পিশাচটা। চুলের মুঠি ধরে শূন্যে তুলে ফেলল। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। আবার বিছানায় এনে ফেলল সে। তারপর…’

দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল অনীতা। ফুলে ফুলে উঠতে থাকল ওর সর্বশরীর। একটু সামলে নিয়ে ভাঙা গলায় বলল, তারপরের কথা আর বলতে পারব না আমি। সে একটা দুঃস্বপ্ন। তীব্র বেদনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে পিশাচটা। বিছানার চাদর ভেসে গেছে তাজা রক্তে।

চেহারা বিকৃত হয়ে গেল অনীতার। মুখটা হাঁ করে চোখ বন্ধ করল ও-গাল দুটো কুঁচকে ওপরদিকে ওঠানো। রানা বুঝল, সেই ব্যথার স্মৃতিটা ভুলতে পারছে না অনীতা, স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে আবার এখন। আবার দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

উঠে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল রানা। রানার মনের সমস্ত দ্বিধা আর সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব, অনীতা। তোমার। এ অপমানের কথা আমি ভুলব না। আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এর প্রতিশোধ নেব আমি!

কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল অনীতার চোখ-মুখ। যেন এই একটি কথায় হালকা হয়ে গেল ওর মনের বোঝা। বলল, ‘সেই থেকে অপেক্ষা করছি আমি সুযোগের। সাগ্রহে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম ওর প্রাইভেট সেক্রেটারি হবার প্রস্তাবে। প্রতিশোধ আমি নিতাম। কিন্তু আজ আমাকে বিদায় করে দিয়ে পালিয়ে গেছে সে আমার নাগালের বাইরে। তাই এসেছি তোমার কাছে। ধন্যবাদ, রানা। কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম তোমার কাছে। ধন্যবাদ।’

চোখ মুছে ভ্যানিটিব্যাগ খুলে ছোট্ট একটা আয়না বের করে আবার মেক আপ নিল অনীতা। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে সন্ত্রস্ত পায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *