ভারতনাট্যম ৩

০৯.

৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫। রেঙ্গুনে দুই ঘণ্টা থামতে হবে। পিআইএ-র দৌড় ওই পর্যন্তই। এরপর বিওএসি তে যেতে হবে ব্যাঙ্কক। ব্যাঙ্কক-যাত্রীরা বেশির ভাগই বেরিয়ে পড়ল ভোরের রেঙ্গুন দেখতে। একা রানা বসে থাকল প্যাসেঞ্জারস লাউঞ্জে। ঢাকা এয়ারপোর্টে কেনা আজকের বাংলা কাগজটা খুলল ও। এতক্ষণ প্লেনে ওটা ভাজ করে নিয়ে বসেছিল, খুলতে সাহস হয়নি, পাছে কেউ চিনে ফেলে।

খবরের কাগজে পরিষ্কার উঠেছে ছবিটা প্রথম পৃষ্ঠায়। ভাঙাচোরা, জাগুয়ার গাড়িটার দুমড়ানো দরজা দিয়ে বেরিয়ে আছে রানার দেহের অর্ধাংশ। রক্তে (লাল কালিতে) ভেসে গেছে কপাল, গাল, জামার একাংশ। কিন্তু চেনা যাচ্ছে ওকে পরিষ্কার। হেডিং-সড়ক দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু। নীচে লেখা:

(নিজস্ব সংবাদদাতা)

গতকল্য বৃহস্পতিবার বৈকাল সাড়ে ছয়টায় চন্দ্রার নিকট, গাছের সহিত ধাক্কা খাইয়া একটি জাগুয়ার গাড়ি, ই বি এ. ৪৭৮৪, সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইয়া চালক ঘটনাস্থলেই নিহত হইয়াছেন। বেপরোয়া গতিতে গাড়িটি ঢাকা হইতে আসিতেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হইতে জানা যায়, পথের উপর খেলায় রত। দুইটি বালককে রক্ষা করতে গিয়া ডান দিকে কাটিয়া একটি গাছের সহিত ধাক্কা খাইয়া গাড়িটি চুরমার হইয়া যায়। নিহত চালক জনাব মাসুদ রানা ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ময়না তদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হইয়াছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানা ভাবল সত্যিই যদি ওর মৃত্যু ঘটত তা হলেও ঠিক এমনি নিরুত্তাপ ভাষায় লাইন কটি লেখা হত। তারপর ভুলে যেত সবাই ওর কথা। নতুন নতুন মানুষ আসত এই পৃথিবীতে-ঢেউয়ের পর ঢেউ আসত নতুন জেনারেশন-হাজার হাজার বছর পার হয়ে যেত। এখনকার মতই চাঁদ উঠত আকাশে পৃথিবীটাকে স্নিগ্ধ আলোয় মায়াময় করে দিয়ে, সাগর দুলত আবেগে, মাতাল হাওয়া এসে নিবিড় করে তুলত প্রেমিক-প্রেমিকার মধু-মিলন। তরুণ তার প্রথম প্রেমের রঙে রাঙিয়ে নিত এই ভুবন; যৌবনের গর্বে বুক ফুলিয়ে বলত, ‘আমি ভালবাসি, ভালবাসি এই সুন্দর পৃথিবীকে। তারপর একদিন সে-ও হারিয়ে যেত রানারই মত কালের অতলে। মানুষের জীবনটা কী! এর উদ্দেশ্য?

মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে এসব বাজে চিন্তা দূর করে দিল মাসুদ রানা। যতক্ষণ বেঁচে আছে অন্তত ততক্ষণ তো ও স্বেচ্ছাধীন। তার ইচ্ছের ঘোড়া যেদিক খুশি ছোটাতে পারে-কাল মহাকালের থোড়াই পরোয়া করে সে! তারপর যা হবার হোক না, কে মানা করতে গেছে।

লাগাও ব্রেকফাস্ট। তারপর আবার প্লেন। পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে ব্যাঙ্কক।

.

ব্যাঙ্ককে কাস্টমস চেকিং হয়ে যেতেই বেরিয়ে এল রানা। মৃদু হেসে ভাবল, ওর অ্যাটাচী কেসটা দেখলেই হয়েছিল কাজ। পঞ্চাশটা একশো ডলারের কড়কড়ে নোট ছিল একটা চোরা পকেটে। কাউকে না জানিয়ে এগুলো এনেছে ও হোম ডেলিভারী স্কিমে এক বন্ধুর জন্যে কিছু শখের জিনিস কিনে পাঠাবে বলে।

‘মিস্টার মাসুদ রানা? গগলস আঁটা এক ভদ্রমহিলা কাছে এসে দাঁড়াল। বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে। গায়ের রঙ রীতিমত ফর্সা। চমৎকার স্বাস্থ্য। বোধহয়। অ্যাংলো-থাই হবে। নাক-মুখের চেহারা অপূর্ব বলা যাবে না। মঙ্গোলিয়ান টাইপ। কিন্তু চমৎকার একপাটি ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল মেয়েটি।

‘ইয়েস।

‘দিস ইজ ক্যাথি ডেভন। গ্ল্যাড টু মিট ইয়।’

‘গ্ল্যাড টু মিট ইয়ু,’ উত্তর দিল রানা।

আপনার জন্যে গাড়ি তৈরি। আসুন আমার সঙ্গে। ব্রিস্টল হোটেলে আপনার জন্য রুম রিজার্ভ করা আছে। মি. ক্রিয়াং শ্রীসানান জরুরী কাজে সায়গন গেছেন। আমার ওপর অভ্যর্থনার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আশা করি প্লেনে সময়টা ভালই কেটেছে।’

নাহ। খুব খারাপ! পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে আসবার সময় এত বাম্প করেছে যে মাথাটা ঘুরছে এখনও। ভাবছি পায়ে হেঁটে দেশে ফিরব।

‘আপনার দুর্ভাগ্য। আজ বোধহয় আবহাওয়া কিছু গোলমাল করেছে। সাধারণত এমন অনুযোগ শোনা যায় না।’

স্যাণ্ড বিজ কালারের ছোট্ট একটা এইট-ফিফটি ফিয়াট দাঁড়িয়ে ছিল, ড্রাইভিং সিটে বসে ভেতর থেকে ওপাশের দরজাটা খুলে দিল ক্যাথি ডেভন। ছোটখাটো টু-ডোর গাড়িটা বেশ পছন্দ হলো রানার। উঠে বসল প্যাসেঞ্জার সিটে। গাড়ির ওই সিটটাকে ডেথ সিট বলে-কোন এক আমেরিকান ম্যাগাজিনে পড়েছিল। অ্যাক্সিডেন্টে ওই সিটের যাত্রীই বেশি আহত হয়। মুচকি একটু হাসল রানা।

পাকা হাত মেয়েটির। যখন ডান দিকে মোড় ঘুরবে তখন ঠিক ডানদিকেই সিগনাল দিচ্ছে; আমাদের দেশি মেয়ে ড্রাইভারের মত বাঁয়ে সিগনাল দিয়ে ডাইনে ঘুরছে না। কাজেই নিশ্চিন্ত মনে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে চলল রানা। পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েক মাইল গিয়ে শহরে ঢুকল গাড়ি। একেবারে বাংলাদেশের মত দেশটা। কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত এখানকার জীবন যাত্রা। শহরের মধ্য দিয়ে গেছে অসংখ্য খাল-তাই অসংখ্য কালভার্ট। প্রচুর আমেরিকান মুখ দেখা গেল। সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে এটা ওটা চেনাতে চেনাতে এগিয়ে চলল ক্যাথি ডেভন। চারতলা ব্রিস্টল হোটেল। তিনতলায় রানার ঘর।

‘বিকেলে আমাদের মেকাপম্যান এসে আপনার চেহারা পাল্টে দিয়ে ফটো তুলে নিয়ে যাবে। মি. ক্রিয়াং শ্রীসানান সব ব্যবস্থা করে গেছেন। কাল আপনার নতুন পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন দশটার ভেতর। আপনি আপনার ঘরে বিশ্রাম নিন। টেলিফোন আছে, যা লাগবে রুম-সার্ভিসে বলে দেবেন, সোজা আপনার ঘরে চলে আসবে।’

দুপুরের লাঞ্চটা কোথায় সারা যায় বলুন তো? আসুন না, এক সঙ্গেই লাঞ্চ করা যাক? রানা বলল।

‘ঠিক আছে। আমি ক’টা কাজ সেরেই চলে আসছি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।

ক্যাথি ডেভন বেরিয়ে যেতেই রানা স্নান সেরে নিল। ইজি চেয়ারে শুয়ে, সিগারেট ধরাল একটা। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আবার বাংলা কাগজটা খুলল। চুরি, নৃশংস ভাবে স্ত্রী-পুত্র হত্যা, মোহামেডান স্পোর্টিং এর ৩-০ গোলে জয়লাভ, ভিয়েৎকং সৈন্যদের গুলিতে তিনটি মার্কিন বিমান ভূপাতিত, প্রেসিডেন্টের পিণ্ডি প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি শেষ করে বিজ্ঞাপনগুলোর উপর কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে আর একবার নিজের মৃত্যুসংবাদটা পড়ল। হাসি পেল ওর।

এনামুল হক নিশ্চয়ই এতক্ষণে ইদু মিয়ার কাছ থেকে খবর পেয়ে টয়োটা করোনার কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাহাত খান মোটা হাভানা চুরুট ধরিয়ে কাজে মগ্ন। রেহানা রানার অবর্তমানে রানার সহকর্মী জাহেদ ইকবালের ডিকটেশন। লিখছে শর্ট হ্যাঁণ্ডে। জেল পলাতক কবীর চৌধুরীর মনটা খারাপ হয়ে যাবে নিজ হাতে রানাকে শেষ করতে পারল না বলে। চিটাগাং-এর আবদুল হাই, কুষ্টিয়ার সোহেল এরা চমকে উঠবে। ভাববে আহা–ব্যাটা নেহাত খারাপ লোক ছিল না। জয়দ্রথ মৈত্র ঠোঁটের কোণের ঘা চেটে নিয়ে হাসবে তার বীভৎস হাসি। আর মিত্রা? দুঃখ পাবে? খুশি হবে?

মিত্রার মনের অবস্থাটা ঠিক কল্পনা করতে পারল না রানা। ওর জটিল মনের মধ্যে রানার জন্যে কতখানি দুর্বলতা আছে তা জানা সম্ভব হয়নি রানার পক্ষে। দেশ-প্রেম ওর কাছে অনেক বড়। হিন্দুসমাজ সংস্কারের প্রতি আছে গভীর অনুরক্তি, অথচ ভালবেসেছে এক বিদেশী মুসলমানকে। রানার মৃত্যু সংবাদে হয়তো মিত্রা হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাবে। সেই রাত্রির ঘটনাটিকে সাময়িক দুর্বলতা বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে। নিজের দেশ, নিজ আত্মীয়স্বজন, সমাজ, এতদিনকার মজ্জাগত সংস্কার, সব ভাগ করে নতুন জীবনে ঝাঁপ দেয়ার দ্বন্দ্ব। থেকে তো সে অন্তত মুক্তি পেল।

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রানা ভাবল মানুষের কাজ না থাকলে বোধহয় এসব বেহুদা চিন্তা মাথার মধ্যে কিলবিল করে। ও এসব কী ভাবছে? জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল ও আনমনে।

.

ব্যাক গিয়ারটা কোন দিকে? ড্রাইভিং সিটের নীচে লিভারটা ডান দিকে চাপ দিয়ে সিটটা কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘অন্যান্য গিয়ার জানেন তো? ব্যাক হচ্ছে চেপে নিচু করে ফোর্থ গিয়ার।’

সাঁ করে বেরিয়ে গেল রানা হোটেল থেকে ক্যাথি ডেভনকে নিয়ে।

লাঞ্চের আগে আমি একটু বাসা হয়ে যেতে চাই। বাড়ির কাউকে বলা হয়নি, ওরা অপেক্ষা করবে। দুমিনিট লাগবে আমার। লজ্জা পেল ক্যাথি একটু।

তাতে কী-চলুন না। আপনি শুধু ডাইনে-বাঁয়ে বলে দেবেন। বাড়িতে টেলিফোন নেই বুঝি?

না, এখন আর নেই। এখন আমরা খুব গরিব হয়ে গেছি।’

‘গাড়িটা আপনার না?

‘আমার হবে কেন? অফিসের। আমার হলে তো এক্ষুণি বেচে দিতাম।’’

‘কেন?’

চট করে অন্য কথায় চলে গেল ক্যাথি। রানা বুঝল এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা। ঠিক হয়নি। পাঁচ মিনিট পর একটা সরু গলির ভিতর ঢুকল গাড়িটা। একটা পুরনো ইট বের করা, প্লাস্টার খসে পড়া বাড়ির সামনে থাল গাড়ি। রাস্তার পাশে। কলে জল নেবার জন্য লাইন লেগে গেছে। বালতি-হাতে একটা ছোট্ট অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল ক্যাথি, বাবা কী করছে রে? মেজাজ কী রকম?

‘এই রকম! চোখ-মুখ পাকিয়ে একটা ভঙ্গি করে খিলখিল করে হেসে উঠল। মেয়েটি। তারপর অবাক হয়ে রানাকে লক্ষ করতে আরম্ভ করল।

‘আমার বোন,’ বলল ক্যাথি রানাকে। আপনি গাড়িতেই বসুন এই ইলেকট্রোফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে, আমি এক্ষুণি আসছি।’

‘আপনার বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন না?

একটু ইতস্তত করল ক্যাথি, তারপর ডাকল রানাকে।

নোংরা ঘর। মেঝেটা খাওয়া খাওয়া। খুবই সস্তা দরের কয়েকটা কাঠের চেয়ার, তাও আবার কোনওটার হাতল ভাঙা, কোনওটার পা মচকানো। একটা ময়লা পর্দা ঝুলছে দরজায়।

হঠাৎ সেই দরজা দিয়ে একটা ইনভ্যালিড় চেয়ারে বসে এক হাতে চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে একজন বৃদ্ধ এসে ঢুকল ঘরে। ক্যাথি পরিচয় করিয়ে দিল বাবার সঙ্গে। এক ফোঁটা হাসি নেই বৃদ্ধের মুখে। গম্ভীর মুখে তীক্ষ্ণ দুটো সন্দেহপূর্ণ চোখ মেলে আপাদমস্তক লক্ষ করল বৃদ্ধ রানাকে। রানার পরিচয় যে সে একবিন্দু বিশ্বাস করল না তা স্পষ্ট বোঝা গেল। অস্বস্তি লাগছে রানার। ক্যাথি বলল, আমরা দুপুরে বাইরে খাচ্ছি আজ, তাই বলতে এলাম।

হঠাৎ বৃদ্ধ পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল ক্যাথিকে, এতক্ষণ এই লোকটার সঙ্গে ছিলে তুমি? একে চেনেনা তুমি, যে বিয়ে করতে যাচ্ছ?

চমকে উঠল রানা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল ক্যাথি ডেভনের মুখ। শুধু বলল, বাবা!’

ন্যাকামি কোরো না। ভেবেছ আমি কিচ্ছু টের পাই না? শয়তান মেয়ে! বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে! বাপ-মা-ভাই-বোন কিছু না? দূর হ তুই আমার বাড়ি থেকে। তোর টাকা না খেলেও চলবে আমার। এবার রানার দিকে অগ্নি-দৃষ্টি ফেলল বৃদ্ধ, আর তুমি, হারামজাদা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? জামাই হতে এসেছ? মনে করেছ কোলে বসিয়ে দুই গালে চুমু দেব সকাল-বিকেল? জানো, তোমাকে পুলিশে দেব আমি! বদমাইশ, সর্বনাশ করতে এসেছ আমাদের?

দুই হাতে চোখ ঢেকে কেঁদে ফেলল ক্যাথি। এমন সময় একজন প্রৌঢ়া থাই ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকল। রানা এবং ক্যাথির দিকে এক নজর চেয়েই ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়ে বলল, ‘অ্যাই, আবার তুমি বাইরের ঘরে এসেছ? ইনভ্যালিড চেয়ারটা ঠেলে পাশের ঘরে নিতে নিতে রানার দিকে চেয়ে বলল, আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না, মি. …’

রানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল বুড়ো চিৎকার করে বলছে, সবাই জোচ্চোর, সব শয়তান! আমি এদের চিনি না মনে করেছ? এখন আমাদের কী অবস্থা হবে? বিয়ে করলে আর টাকা দেবে ক্যাথি?’-গলাটা ভেঙে গেল। কাঁদতে আরম্ভ করল বৃদ্ধ।

‘এত বড় সংসার নিয়ে এবার পানিতে পড়লাম রে…’

মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, চুপ করো! আহ চুপ করো তো, লক্ষ্মী। ক্যাথি বিয়ে করছে কে বললে তোমাকে? ছি ছি, ওই ভদ্রলোকের সামনে তুমি মেয়েটাকে কতবড় অপমান করলে বলো তো।’

ভদ্দোরনোক! উহ! পরিষ্কার ডাকাতের চেহারা। উনি আবার ভদ্দেরনোক সাজতে এসেছেন…’

রুমালে চোখ মুছে নিয়ে ক্যাথি বলল, ‘মাফ করবেন, মি. রানা। আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি মাকে বলেই চলে আসছি।

হতবাক রানা গাড়িতে গিয়ে বসল। ঠিক দু’মিনিটেই চলে এল ক্যাথি। গাড়ি ছাড়ল রানা। লাবন্ লুয়াং রোডের রেইনবো হোটেলে ইংলিশ লাঞ্চ অর্ডার দিল ও।

সুপের মধ্যে গোল মরিচের গুঁড়ো ফেলতে ফেলতে রানা বলল, আপনার বাবার এই অবস্থা কতদিন ধরে।

‘কী অবস্থা?

‘এই, মানে একটু অপ্রকৃতিস্থতা…’

‘আমার বাবা পাগল নন। উনি ভুগছেন সন্দেহ রোগে। আর এই রোগও আরম্ভ হয়েছে অল্পদিন ধরে। পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়ায় ওঁর মস্ত ব্যবসা বন্ধু বান্ধব, পার্টনার আর কর্মচারীরা মিলে উচ্ছন্নে দিয়েছে। অনেক টাকা ধার হয়ে গেল বাজারে। সেই থেকে সবাইকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছেন উনি। আমি এবং আমার এক বোন উপার্জন করে সংসার না চালালে সবাই না খেয়ে মারা যাবে। তাই ওঁর সন্দেহ আমরা নিজের সুখের জন্যে স্বার্থপরের মত বিয়ে করে ফেলব। এবং সংসারে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যাবে। সব সময় এই অবস্থা থাকে না। প্রত্যেক মাসের প্রথমে যখন টাকা তুলে দিই বাবার হাতে, বাবা তখন ছেলে মানুষের মত হাউ মাউ করে কাঁদে। বলে-তোদের আমি নিংড়ে শুষে ছোবড়া। বানিয়ে ফেলছি রে, ক্যাথি। দোহাই তোদের, আমাকে একটু বিষ এনে দে। আমি মরলেই তোরা সুখে সংসার বাঁধতে পারবি। হঠাৎ সচকিত হয়ে ক্যাথি বলল, ‘ছি ছি, আপনাকে এসব কী বলছি!’

‘আমার কিন্তু শুনতে বেশ লাগছে। আপনার বাবা কি এদেশের…’

উনি আয়াল্যাণ্ডের। আমার মায়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে এখানেই সেটল করেছিলেন। তাই আমরা হয়েছি এক মিশ্র জাত। ধর্ম আমাদের ক্রিশ্চানিটি। সমাজে স্থান নেই। সবাই ‘অ্যাংলো বলে মুখ বাঁকায়।’

‘আপনার বোনও কি চাকরি করেন?

না, সে নৃত্য-শিল্পী। ঠিক শিল্পী বলা যায় না। নেচে টাকা উপার্জন করে আর কী। কলকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলে আছে ও এখন। নেচে যা পায় খরচটা রেখে দিয়ে সব পাঠিয়ে দেয় বাবার কাছে। আমাদের বোধহয় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা উচিত। এসব দুঃখের কথা, আপনি শুনে কী করবেন?

পুডিং শেষ হতেই কফি এল। একটা সিগারেট নিজে নিয়ে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল রানা ক্যাথির দিকে। দুটো সিগারেটে আগুন ধরিয়ে রানা বলল, আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের প্ল্যান কী?

‘ভবিষ্যতের চিন্তা একদম বন্ধ করে দিয়েছি।’

‘কেন?’

‘আমরা যে পাঁকে পড়েছি, এ থেকে বেরোতে আরও দশ বছর লাগবে। আমার বয়স কত জানেন? দেখলে অনেক কম মনে হয়, আসলে বত্রিশ। দশ বছর পর হবে বেয়াল্লিশ। তারপরেও কি আর কোনও ভবিষ্যৎ থাকতে পারে মেয়েমানুষের? প্ল্যান করে লাভ আছে কোনও? আমার জন্যে অনন্তকাল তো আর অপেক্ষা করতে পারবে না উইলিয়াম।

দশ বছর কেন?

আমরা দু’বোন সমস্ত সংসার খরচের পর গড়পড়তা এক শ’ ডলার (থাই বাহত-এর হিসাব দেশি পাঠকদের বুঝতে অসুবিধে হতে পারে বলে ডলারেই লেখা হচ্ছে টাকা-পয়সার কথা। Baht 25=Dollar 1=Rs.5.00; মোটামুটি এই হিসেব মনে রাখলেই চলবে।) করে জমাচ্ছি প্রতিমাসে। আড়াই বছরে তিন হাজার ডলার জমিয়েছি আমরা। যখন আরও বারো হাজার জমাতে পারব তখন আমাদের সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। এই রাস্তার ওপরেই আমাদের একটা ছয়তলা বাড়ি আছে। সেটা মর্টগেজ মুক্ত হয়ে যাবে। সে বাড়ির ভাড়াই মাসে এক হাজার ডলার-আবার বড়লোক হয়ে যাব আমরা। কিন্তু তখন আমাদের আর বয়স থাকবে না সেটা উপভোগ করবার। ম্লান হাসি ফুটে উঠল ক্যাথির পাতলা ঠোঁটে।

‘আচ্ছা, এতবড় দায়িত্বের বোঝা ইচ্ছে করলেই তো কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজে সুখী হতে পারেন আপনি। কেন আপনি নিজের জীবনটা…’

‘ওকথা বলবেন না। দুই হাতে কান ঢাকল ক্যাথি। ওকথা শোনাও পাপ। অনেকে বলেছে, এমনকী উইলিয়ামও। ভুলেও যদি করে বসি একাজ-তা হলে তার প্রায়শ্চিত্ত হবে আত্মহত্যা।

‘কোনও আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার পাওয়া সম্ভব নয়?

না। সে চেষ্টা করেছি।’

তবে তো দেখছি আপনার সুখের সব দরজা বন্ধ।

‘হোটেলের দরজা তো আর বন্ধ নয়। বেলা অনেক হয়েছে। চলুন, আপাতত ওই দরজা দিয়ে বেরোনো যাক। হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল ক্যাথি। রানার মনে পড়ল ঠিক এমনি করেই হাসে ক্যাথির দশ বছরের অর্ধ-উলঙ্গ দুষ্টু বোনটা। ‘এবং ধন্যবাদ। আপনাকে সব কথা বলে নিজেকে অনেক হাল্কা লাগছে এখন।

বিকেলে মেকাপম্যান এসে আধ ঘণ্টা পরিশ্রম করল রানার মুখের উপর। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য একটা লোককে দেখতে পেল রানা। মোটামুটি মঙ্গোলিয়ান চেহারা দাঁড়িয়েছে।

উঠিয়ে না ফেললে এই দাগ হপ্তাখানেক থাকবে। তারপর প্রয়োজন হলে আবার এক পোচ বুলিয়ে নেবেন। কেমিক্যালসের শিশি দুটো রেখে যাচ্ছি।’ উঠে। দাঁড়াল লোকটা। তারপর রানার একটা ছবি তুলে নিল। এটা পাসপোর্টে যাবে। আপনার নামঃ চরোসা থিরা। থাই আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল ইণ্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

লোকটা বেরিয়ে যেতেই এসে ঢুকল ক্যাথি ডেভন।

‘বাহু, চমৎকার হয়েছে। এখন তৈরি হয়ে নিয়ে চলুন দেখি, আপনার জন্যে সুটকেস, জামা-কাপড়, সবকিছু নতুন করে কিনতে হবে। আপনার এই থ্যাবড়া সুটকেস ফেরত যাবে পাকিস্তানে।

কাপড়-চোপড়, জুতা-মোজা, টাই-টাইপিন, ইত্যাদি যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে সন্ধ্যার সময় ফিরল ওরা হোটেলে। ক্যাথি চলে যাচ্ছিল কাল দেখা হবে বলে, কিন্তু রানা ওকে যেতে দিল না।

‘আজ সন্ধ্যেটা আমার সঙ্গে কাটাতে হবে, মিস ডেভন। কাল দশটার পর কোথায় আমি আর কোথায় আপনি। জীবনে আর দেখা হবে না। আমার অনুরোধটার অমর্যাদা করবেন না দয়া করে।

অবাক দৃষ্টিতে রানার দিকে চাইল একবার ক্যাথি। নাহ্। কোনও খারাপ মতলব আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। মুখে বলল, ‘কিন্তু আটটার বেশি থাকতে পারব না। বাড়ির অবস্থা তো দেখেই এসেছেন।’

গাড়িতে উঠে রানা বলল, এখানকার সবচেয়ে নাম করা, ক্যাসিনো কোনটা? সবচেয়ে উঁচু স্টেকে খেলা হয় যেখানে?’

ক্যাসিনো কথাটা বোধহয় বুঝল না ক্যাথি, কিন্তু উঁচু স্টেকে খেলার কথা শুনে বুঝল জুয়া খেলার কথা হচ্ছে। বলল, ‘ডায়মণ্ড হাউস।

‘কোথায় সেটা?

‘সুরায়য়াং রোডে। আমি ঢুকিনি কখনও ভেতরে। কেন?’

‘চলুন ডায়মণ্ড হাউসেই সন্ধ্যেটা কাটাই।

.

বিরাট ক্যাসিনোর চকচকে মোজাইক করা মেঝে। এন্ট্রি ফি দিয়ে দোতলায় উঠে এল ওরা। চারদিকে নানান রকম খেলার ব্যবস্থা। সুন্দরী থাই মেয়েদের সঙ্গে জোড়া বেঁধে প্রচুর আমেরিকান বসে আছে। Chemin de. fer এবং Caisse-র পাশ কাটিয়ে ওরা একটা কোণের খালি টেবিলে গিয়ে বসল। নিজের জন্যে একটা স্কচ এবং ক্যাথির জন্যে ভোদকা মাটিনি অর্ডার দিল রানা। একটা সিগারেট অর্ধেক বের করে ক্যাথির দিকে ধরল প্যাকেটটা, তারপর নিজে নিল একটা।

সিগারেট ধরিয়ে রানা বলল, আমি একজন পাক্কা জুয়াড়ি। খুব খারাপ লোক, সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ আমার খেলতে ভয় করছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি আজ আমার ভাগ্য সহায়তা করবে না। খেললে ঠিক হেরে যাব। আমাকে একটু সাহায্য করবেন আপনি?

‘আমি জীবনে এসব খেলিনি। তা ছাড়া এসব পছন্দও করি না। চাকরি খোয়াবার ভয় না থাকলে কিছুতেই আপনার সঙ্গে এখানে ঢুকতাম না। এখন বলুন, কী সাহায্য করতে হবে? একটু বিরক্তি ক্যাথির কণ্ঠে।

‘খুব সোজা খেলা। আমার হয়ে আপনাকে একটু খেলতে হবে।’

বললাম তো, আমি এসব খেলা জানি না।’

‘আপনার কোনও চিন্তা নেই। শিখিয়ে দেব। আমি যা বলব আপনি শুধু তাই করবেন। এই নিন চার হাজার ডলার। রুলেত খেলতে হবে আপনাকে।

বিস্মিত ক্যাথি বলল, বাব্বা, এত টাকা! যদি হেরে যাই?

ব্যাপারটা আগে আপনাকে বুঝিয়ে বলি।’ নোটগুলো ক্যাথি ডেভনের হাতে দিয়ে রানা বলল, এই টাকা আপনাকে ধার দিচ্ছি, কারণ ধার না দিলে আমার আজ রাত্রির মন্দ ভাগ্যের আওতা থেকে রেহাই পাবে না টাকাগুলো। আমরা, পাকা জুয়াড়িরা, সৌভাগ্য এবং মন্দভাগ্যের অদৃশ্য হাত উপলব্ধি করতে পারি এক আশ্চর্য শক্তির বলে। এবং সেটার নির্দেশ মেনে চলি। যেই ধার দিয়ে দিলাম, অমনি এই মুহূর্ত থেকে ওই টাকা আমার না। বুঝেছেন? কিন্তু যাতে হেরে গেলে ওই ধার আপনাকে আবার শোধ করতে না হয় সেজন্যে টাকাটা কোথায় কীভাবে খেলতে হবে সেটা আমি আপনাকে বলে দেব। হারলে আমার দোষে হারবেন, আপনি দায়মুক্ত।

কত প্যাঁচ! জুয়াড়িদের নানান কুসংস্কার থাকে জানতাম-কিন্তু আপনার মধ্যেও…’ হাসল ক্যাথি। বেশ, এখন বলুন কী করতে হবে।’

রুলেত টেবিলের সামনে অল্প লোকের ভিড় ছিল। রানা জিজ্ঞেস করল, ‘এখানকার সবচেয়ে উঁচু স্টেক কত?

‘আনলিমিটেড! যত খুশি খেলতে পারেন। নিরুৎসুক কণ্ঠে জবাব দিল কাঠিহাতে লোকটা।

‘মিস ডেভন, টাকাগুলো ক্রুপিয়া-র (Croupier) কাছে দিয়ে কালোয় খেলুন।

‘সব একসঙ্গে? অবাক হয়ে যায় ক্যাথি।

হ্যাঁ, সব।

চার হাজার ডলার দেখে শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল ক্রুপিয়া-র। চটপট গুণে নিয়ে আড়চোখে দেখে নিল একবার রানাকে। নোটগুলো টেবিলের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ফেলে দিয়ে চল্লিশটা লাল ‘প্লেক’ নিয়ে কালো ঘরে রাখল। আরও কয়েকজন অল্প-স্বল্প স্টেক ধরল। টেবিলের তলায় হাত ঢোকাল একবার ক্রুপিয়া, রানা বুঝল, কোথাও একটা বেল বেজে উঠল নিশ্চয়ই। যেন হাওয়ায় ভেসে দু’জন ষণ্ডা মত লোক এসে দাঁড়াল টেবিলের পাশে। ঘুরিয়ে দেয়া হলো থালাটা। হাতির দাঁতের ছোট্ট সাদা বলটা ছুটে বেড়াতে লাগল থালাময়।

রানা চেয়ে দেখল ক্যাথি একষ্টে চেয়ে আছে থেমে আসা থালাটার দিকে। কী করে জানি রানা জানত, জয় অনিবার্য। মৃদু হাসল ও।

‘থারটিন। ব্ল্যাক। লো অ্যাণ্ড অড। উঁচু গলায় বলল কাঠিধারী।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্যাথির চোখ। রানার দিকে চাইল সে। এক বস্তা লাল ‘প্লেক’ জমল ক্যাথির পাশে। মোট আশিটা হলো।

‘আবার চল্লিশটা দিন কালোয়।

কাঠি দিয়ে ‘প্লেক’-গুলো গুণে নিয়ে কালোয় রাখা হলো। আবার থেমে এল। থালাটা। আশপাশে লোক জড়ো হতে আরম্ভ করেছে। হাতির দাঁতের বলটা এঘর। ওঘর টপকে গিয়ে একটা ঘরে থামল।

‘টোয়েনটি। ব্ল্যাক। হাই অ্যাণ্ড ইভেন।

বাচ্চা মেয়ের মত আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল ক্যাথি ডেভন। অদ্ভুত এক অনাস্বাদিতপূর্ব উত্তেজনা অনুভব করছে সে। নেশায় পেয়ে বসেছে যেন ওকে। জিজ্ঞেস করল, এবার?

‘এই দানটা আমরা খেলব না,’ বলল রানা।

অবাক হয়ে ক্যাথি এবং ক্রুপিয়া চাইল রানার দিকে। মাথা নাড়ল রানা। রানার ভেতর থেকে কে যেন বলে দিল অপেক্ষা করো।

আশপাশে সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল রানা। এতক্ষণ যারা দশ বিশ ডলার খেলছিল, রানার জেতা দেখে তারাও স্টেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ ত্রিশ, কেউবা পঞ্চাশ। জমে উঠেছে খেলা। লোকে ভিড় করতে আরম্ভ করল এই টেবিলে। আবার ঘুরল থালা।

থালা থামতেই রানা দেখল ছোট্ট বলটা পড়ল গিয়ে সবুজ দুটো ঘরের একটায়। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল একবার। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি তো!

স্টিক-ধারী চিৎকার করে বলল, ‘ডাবল জিরো!’ তারপর কালো লাল সব। ঘরের প্লেকগুলোই তুলে নিল টেবিল থেকে।

এবার রেড, রানা হাসল ক্যাথির দিকে চেয়ে।

‘কত? ডাবল জিরো দেখে ভয় ধরে গেছে ক্যাথির। বুকের ভিতরটা ওর কেঁপে উঠল একবার রানা যখন বলল, ‘চল্লিশ।’

বেশ লোক জড়ো হয়ে গেছে এবার। কানাঘুষো হচ্ছে ওদেরকে নিয়ে। ক্যাথির হাত থেকে প্লেকগুলো নিয়ে লালে রাখল কাঠিধারী। আবার ঘুরল থালা। রানা টের পেল কিছু উৎসুক চোখ লক্ষ্য করছে ওর মুখ। নিরাসক্ত ভাবে সিগারেট ধরাল ও। একবিন্দু কাঁপল না হাত। কিন্তু ভিতর ভিতর একটু উত্তেজিত না হয়ে পারল না রানা। প্রতিবারই কি ভাগ্য তার সহায় হবে? এইবার খেলা কি উচিত হলো?

থালাটা যখন থেমে আসছে রানা দেখল কপালের ঘাম মুছছে ক্যাথি। হাত কাঁপছে তার। সেই মুহূর্তে আরেকবার রানা ঘৃণা করল জুয়া খেলাটাকে। এ এক কুৎসিত সংক্রামক ব্যাধি।

‘থারটি-ফোর। রেড। হাই অ্যাণ্ড ইভেন।

মৃদু গুঞ্জন উঠল আশপাশে। লোভী দৃষ্টিতে সবাই চেয়ে দেখল গুণে গুণে আশিটা লাল ‘প্লেক’ ক্যাথির পাশে সাজিয়ে দিল পিয়া। মোট হলো একশ ষাটটা।

ব্যস। চলুন, রানা ডাকল ক্যাথিকে।

‘আর খেলবেন না?

না।

ক্যাথিকে নিয়ে ক্যাশিয়ারের কাউন্টারের দিকে এগোল রানা। ষোলোটা হাজার ডলারের নোট গুণে নিল ক্যাথি দুই তিনবার করে। তারপর সেগুলো কালো ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে আবার এসে বসল রানার সঙ্গে কোণের সেই টেবিলটায়। হাতের ব্যাগটা সযত্নে রাখল সে টেবিলের মাঝখানে।

নিজের জন্য একটা স্কচ এবং ক্যাথির জন্যে আরেকটা মার্টিনি অর্ডার দিয়ে রানা বলল, আপনার কপালটা সত্যিই ভাল।’

‘আমার কপাল মানে? খেললেন তো আপনি-আমি তো কেবল আপনার কথা মত কাজ করলাম।’

যাই হোক, আপনার কপালেই তো হলো। এখন আমার চার হাজার ডলার শোধ করে দিন।’

‘সবই আছে ব্যাগে। বের করে দেব?’ ব্যাগে হাত দিল ক্যাথি।

না, না। সব কেন? আমার টাকা আমাকে দিয়ে দিন। আপনি খেলে যা জিতেছেন-ও টাকা আপনার। আমাকে দেবেন কেন?

অবাক হয়ে রানার চোখের দিকে চাইল ক্যাথি ডেভন। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেছে–চোখ দুটো বিস্ফারিত। কথাগুলো যেন ঠিক বুঝতে পারল না সে। বারো হাজার ডলার!

এ কী সম্ভব? বলল, ‘যাহ, ঠাট্টা করছেন!

ঠাট্টা নয়, সত্যি। বারো হাজার ডলার দরকার বলছিলেন না? সেই বারো হাজার আজ নিজেই উপার্জন করে নিলেন আপনি।

বিস্মিত, বিমূঢ় ক্যাথি ধীরে ধীরে বুঝল কেন ওকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে মাসুদ রানা। কেন জোর করে ওকে ধার দিয়েছে চার হাজার ডলার। তারপর যেন এটাকে ও অপরিচিত বিদেশীর অযাচিত দান বলে প্রত্যাখ্যান করতে না পারে সেজন্য তাকে দিয়েই খেলানো হয়েছে সবটা খেলা। কথাটা ঠাট্টা নয়। তাকে দশ বছরের দুর্বিষহ দায় থেকে মুক্ত করে দিয়েছে ওই নিষ্ঠুর, দুর্ধর্ষ চেহারার পাকিস্তানী স্পাই। হঠাৎ এক অদম্য আবেগে উথলে উঠল ক্যাথির বুকের ভিতরটা।

টেবিলের কিনারা ধরে না ফেললে হয়তো পড়েই যেত ক্যাথি। দুই কনুই টেবিলের ওপর রেখে দুই হাতে দুই গাল ধরে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করল সে। তারপর হঠাৎ দুই চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল প্লাস্টিক ঢাকা টেবিলের ওপর। হাতের তালু বেয়ে। একটা ওয়েটার তাই দেখে এগিয়ে আসছিল, হাতের ইশারায় তাকে সরে যেতে বলল রানা। এক মিনিটের মধ্যেই সামলে নিল ক্যাথি। চোখ। মুছে নিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন। নিজেকে সামলাতে না পেরে এক বিশ্রী সিন। ক্রিয়েট করলাম। কিন্তু কেন আপনি এটা করলেন? কেন আমার মত একটা নিঃস্ব মেয়েকে হঠাৎ এমন প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিলেন? অদ্ভুত লোক আপনি। আপনি বুঝতে পারবেন না, মি. মাসুদ রানা, আমার কেমন লাগছে। এত টাকা সব আমার! বাবার কেমন লাগবে? উহ্! আর উইলিয়াম! বলতে বলতে আবার দুই বিন্দু জল। নেমে এল গাল বেয়ে।

মৃদু হেসে উইস্কিতে চুমুক দিল রানা। চেয়ে চেয়ে দেখল ও প্রায় অচেনা একটা বিদেশি মেয়ের উদ্বেগ, বিস্ময়, উত্তেজনা ও আনন্দাশ্রু। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘পৌনে আট। ওঠার সময় হলো। ওটুকু শেষ করে চলুন উঠে

পড়ি।’ বিল চুকিয়ে দিল রানা।

গ্লাসের তলায় পড়ে থাকা জলপাইটা কাঠি দিয়ে তুলে মুখে পুরল ক্যাথি ডেভন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন।

হোটেলের সামনে রানাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ক্যাথি দুই ডানা মেলে ভবিষ্যৎ সুখ কল্পনায় ভাসতে ভাসতে। জীবনের সবকটা দিন যদি এমনি সুখের হত!

ঘরে ঢুকেই রানা বুঝল ওর অনুপস্থিতিতে কেউ ঢুকেছিল ঘরের ভিতর। জিনিসপত্র যেমন রেখেছিল ঠিক তেমনটি আর নেই। খোয়া যায়নি কিছুই-কিন্তু সমস্ত জিনিসপত্র ঘেঁটেছে কে যেন। চোর হলে তো চুরি করত। তা হলে? ব্যাপারটা আবছাই থেকে গেল রানার কাছে।

রাতে, বিছানায় শুয়ে, রানা ভাবল মিত্রার কথা। কেন যে ঘুরেফিরে বারবার এই মেয়েটির ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায় বুঝতে পারে না রানা। কেন অবসর পেলেই নিজের অজান্তে ওর কথা ভাবতে থাকে ও? দেখা হবে আর কোনও দিন? কেন যে এমন হয়-হঠাৎ কেন এমন ফাঁকা লাগে? রানার জীবনে কোথায় যেন একটা মস্ত গলদ রয়ে গেছে। বুঝতে পারে না ও অনেক ভেবেও, ত্রুটিটা ঠিক কোনখানটায়।

.

১০.

৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।

‘ইওর অ্যাটেনশন, প্লিজ!’ প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজ অ্যানাউন্সেস দ্য ডিপারচার অভ ইটস জেট ক্লিপার রাউণ্ড দ্য ওয়ার্লর্ড সার্ভিস ফ্লাইট পিএ জিরো জিরো ওয়ান, টু রেঙ্গুন-ক্যালকাটা-কারাচী-বায়রুত-ইস্তাম্বুল-মিউনিখ-ফ্রাঙ্কফুর্ট লণ্ডন-নিউ ইয়র্ক। প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়েস্টেড টু বোর্ড দ্য এয়ারক্রাফট। থ্যাঙ্ক ইয়ু।

চড়া পর্দার তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ বিশটা লাউড-স্পীকার থেকে ছড়িয়ে পড়ল সারাটা এয়ারপোর্টে।

বহু ছাপ-ছোপ দেয়া পাসপোর্টটা ফেরত পেয়ে প্যাসেঞ্জারস লাউঞ্জের দিকে এগোল রানা। প্রায় চল্লিশ-পয়তাল্লিশ জন, প্যাসেঞ্জার। রানা খেয়াল করল, একজন যাত্রী ওকে লক্ষ্য করছে সামনে ধরা খবরের কাগজের আড়াল থেকে, আড়চোখে। আনমনে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। লোকটার হাতে ধরা কাগজটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সে। তিন তারিখের একটা পূর্ব পাকিস্তানী কাগজ। রানার দুর্ঘটনার খবরটা পড়ছে লোকটা মনোযোগ দিয়ে। মাটিতে রাখা একটা অ্যাটাচি কেসের গায়ে লোকটার নাম পড়ল রানা-টি.আর. পট্টবর্ধন। নিশ্চয়ই ভারতীয়। টের পেয়ে গেল নাকি ওরা? ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দেবে? সপ্তাহে তিনটে মাত্র ফ্লাইট-মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি। আজ না গেলে ছ’তারিখের আগে পৌঁছতে পারবে না টিটাগড়। কিন্তু টের পাবে কী করে? অসম্ভব। এটা বোধহয় দৈব-সংযোগ। গত রাতে তার ঘরে লোক ঢোকার কথাও মনে পড়ল রানার। গোড়াতেই গলদ হয়ে গেল না তো? এই অবস্থায় কোলকাতা যাওয়া কি নিরাপদ? ঘুরে দাঁড়াল চিন্তিত রানা। তারপর স্থির করল, এখন আর পিছিয়ে যাওয়া যায় না।

প্লেনে উঠবার সিঁড়িতে পা দিয়েই নিজের নাম, অর্থাৎ মি. থিরা শুনে থমকে দাঁড়াল রানা। দেখল ক্যাথি ডেভন আসছে পিছন থেকে দৌড়ে।

‘ওই পট্টবর্ধন থেকে সাবধান। ও কিছু একটা সন্দেহ করেছে। খুব সাবধান! এখন সব কথা বলবার সময় নেই। কাছে এসে নিচু গলায় কথাটা বলেই লোকটার দিকে ইঙ্গিত করল ক্যাথি। একটা রক্ত গোলাপের কুড়ি রানার কোটে লাগিয়ে দিল সে। তারপর বলল, ‘আজকের ফ্লাইটটা ক্যান্সেল করতে পারেন না?’

না, দেরি হয়ে যাবে। নেক্সট ফ্লাইট সাত তারিখে। অনেক দেরি হয়ে যাবে।

রানা লক্ষ্য করল ভিতর ভিতর কেন জানি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছে ক্যাথি।

‘আপনি গ্র্যাণ্ড হোটেলেই উঠছেন, না?’

‘খুব সম্ভব।

‘ওই হোটেলেই আছে আমার বোন স্যালি ডেভন। আমার একটা চিঠি পৌঁছে দেবেন তাকে, দয়া করে?

‘নিশ্চয়ই। আর মি. শ্রীসনানকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন। আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। গুডবাই।

‘গুডবাই। ভায়া খণ্ডিওস।

চিঠি নিয়েই রানা উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। রুমাল নাড়ল ক্যাথি। রানাও একটু হাত নেড়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। রানার ঠিক পেছনের সিটে এসে বসল টি.আর. পট্টবর্ধন। মাথায় একবোঝা দুশ্চিন্তা নিয়ে সিট বেল্ট বাঁধল মাসুদ রানা।

সুনীল সাগর পেরিয়ে একসময় এল রুপালী নদী-নালার দেশ শ্যামলবাংলা। নীচে সবুজ কার্পেট বিছানো! তারপর মহানগরী কলকাতা-ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, খেলনার মত ট্রাম বাস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গড়ের মাঠ, মনুমেন্ট, হাওড়া ব্রিজের একাংশ।

ক্লিপার জেট নামল দমদম এয়ারপোর্টে। রানওয়ের ওপর দিয়ে ট্যাক্সিইং করে এসে একপাক ঘুরে দাঁড়াল প্রকাণ্ড প্লেনটা হ্যাঁঙার ও এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের। মাঝামাঝি জায়গায়। এয়ার কণ্ডিশন করা প্লেন থেকে বেরিয়েই অসম্ভব গরম লাগল রানার। রোদের মধ্যে এইটুকু পথ হেঁটে যেতেই ঘাম দেখা দিল কপালে। পিছন পিছন এল পট্টবর্ধন।

মস্ত লাউঞ্জে গিয়ে বসল সবাই। মাল নামবে, কাস্টমস চেকিং হবে-বেশ অনেকক্ষণের ব্যাপার। ফাইভ ফিফটি-ফাইভের টিন থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিল রানা। বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জারই একবার জেন্টস লেখা ঘর থেকে ঘুরে এল। রানা গেল না। এবং রানাকে চোখের আড়াল করবে না বলে পট্টবর্ধনও বসে রইল পায়ের ওপর পা তুলে। স্বাভাবিক থাকা- চেষ্টা করল রানা।

বেশ খানিকক্ষণ পর ডাক এল প্যাসেঞ্জারদের কাস্টমস চেকিং রুমে যাবার জন্য। সবাই যে যার ছাতা, লাঠি আর ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ল ছত্রভঙ্গ হয়ে। এবার রানা গিয়ে ঢুকল টয়লেটে। পরমুহূর্তেই এসে ঢুকল পট্টবর্ধন। বেচারা অনেকক্ষণ ধরে বোধহয় চেপে রেখেছিল। ভাবল, এই সুযোগে দুটো কাজই সেরে নিই। নজর রাখাও হবে, আর… ঢুকেই দেখল রানা দাঁড়িয়ে গেছে জায়গা মত। আর জায়গা নেই দাঁড়াবার। কিন্তু ল্যাট্রিনের দরজাটা খোলা। প্রস্রাব পায়খানার আলাদা বন্দোবস্ত। আর চাপতে না পেরে ঢুকে পড়ল সে একটা ল্যাট্রিনের মধ্যে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে বাইরে থেকে বন্টু লাগিয়ে দিল রানা ল্যাট্রিনের। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে। দেখল লাউঞ্জ খালি। বাইরের দরজাটাও বন্টু লাগিয়ে দিয়ে ভাবল জমাদার ব্যাটা তাড়াতাড়ি এসে না পড়লেই এ যাত্রা রক্ষা। পাওয়া যায়। দুম দুম করে ল্যাট্রিনের দরজায় বাড়ি মারার শব্দ শুনল রানা কান পেতে! নাহ্। কেউ খেয়াল করবে না। কাস্টমস’ লেখা দরজা দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঢুকল রানা এবার।

‘মি. চরোসা থিরা?’ কাস্টমস অফিসার চাইল রানার দিকে।

‘ইয়েস!

রানার সুটকেসের ওপর লাগানো একটা লেবেল, ওর নামের নীচে ম্যানেজিং ডিরেক্টর’ ও তার নীচে ‘আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল ইত্যাদি শব্দগুলো চোখে পড়ল অফিসারের। ব্যস, আর ঝামেলা হলো না। দুটো স্ট্যাম্প ছিঁড়ে সুটকেস এবং অ্যাটাচি কেসে লাগিয়ে দিল অফিসার। সাদা চক দিয়ে ক্রস এঁকে দিল। দুটো।

‘উইশ ইয়ু হ্যাপি স্টে, স্যর।

‘থ্যাঙ্ক ইয়।’

একটা পোর্টার তুলে নিল রানার সুটকেস মোটা বখশিশের লোভে। বিদেশি লোক, বেশি দেবে নিশ্চয়ই।

ট্যাক্সি, স্যর?

মাথায় পাগড়ি আর হাতে বালা পরা লম্বা চওড়া শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে দাঁড়াল যমদূতের মত। পোর্টারকে ড্রাইভারের সঙ্গে এগোবার জন্যে ইশারা করে রানা বলল, কিপ দ্যাট অন দ্য ব্যাক সিট।’

পকেট থেকে দুটো একশো ডলারের নোট বের করে ভাঙিয়ে ইণ্ডিয়ান কারেন্সি মিল রানা দমদম এয়ারপোর্টের ব্যাঙ্ক থেকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়েই ভূত দেখার মত চমকে উঠল।

মিত্রা! ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বিশেষ ড্রেস পরে একটা কাউন্টারের ওপাশে বসে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে মিত্রা সেন। মিত্রা কি ছেড়ে দিল। সিক্রেট সার্ভিস? হঠাৎ এই বেশ কেন? ওর ওপর নজর রাখবার জন্যে এই ভোল নেয়নি তো!

নিজের অজান্তেই মুখটা অল্প একটু হাঁ হয়ে গেছে মিত্রার। খুব চেনা চেনা লাগছে ওর এই লোকটাকে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না কোথায় দেখেছে এর আগে। এই ফিগার, ঠিক এমনি ব্যাক ব্রাশ করা চুল, প্রশস্ত কপাল, ওই দৃষ্টি যেন তার অনেক চেনা। মাসুদ রানা! এ নিশ্চয়ই মাসুদ রানা!

এক মুহূর্তেই সামলে নিয়েছে রানা। না চিনবার ভান করে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল সে, কাটা ঘুরিয়ে রিস্ট-ওয়াচটা ইণ্ডিয়ান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইমের সঙ্গে মিলিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে গেল গাড়ি-বারান্দার দিকে। হাঁটার ভঙ্গিটা একটু বদলে নিল সে। পেছনে ফিরে চাইল না আর একটিবারও।

কিন্তু চাইলে দেখতে পেত এক অবর্ণনীয় খুশিতে ঝলমল করে উঠল মিত্রা সেনের মুখ। চিনতে পেরেছে সে। ওই দৃষ্টি ভুলবার নয়। তা হলে বেঁচে আছে! চোখ বন্ধ করে দুই হাত তুলে কপালে ঠেকাল সে তার অদৃষ্ট দেবতার উদ্দেশে। দুই ফোঁটা জল ঝরে পড়ল তিন তারিখের একটা পূর্ব-পাকিস্তানী খবরের। কাগজের ওপর।

চিড়িয়ামোড়, গানফাউণ্ডি রোড, কাশীপুর রোড, ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড, শ্যামবাজার, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে এঁকে বেঁকে এসে শিখ ড্রাইভার থামল চৌরঙ্গীর এ্যাণ্ড হোটেলের সামনে। পিছনের সিটে বসে এতক্ষণে গোলাপের কুঁড়িটা পকেটে পুরেছে রানা, উল্টে পরেছে কোট, প্লেনের সব রকমের ট্যাগ ছিঁড়ে ফেলেছে সুটকেস আর অ্যাটাচি কেস থেকে, টান দিয়ে চরোসা থিরার লেবেল উঠিয়ে ফেলেছে বাক্সের ডালা থেকে। অন্য মানুষ হয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।

সুন্দরী রিসিপশনিস্টের প্রচুর প্লিজ এবং থ্যাঙ্কিউ-র পর লিফটে করে উঠে এল রানা তেতলার একটা চমৎকার ডাবল-বেড রুমে। খ্রিষ্টান নাম নিয়েছে ও এবার। মরিস রেমণ্ড। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। এয়ারকুলারটা অন করে দিয়ে ফাইভ-ফিফটি-ফাইভ টিনের ভিতর থেকে একটা ক্যাপস্টান বের করে ধরিয়ে নিল মাসুদ রানা। পোর্টারকে বখশিশ দিয়ে বিদায়। করে দরজা লাগিয়ে একটা চেয়ারে এসে বসল। অতি দ্রুত চিন্তা করছে সে।

পট্টবর্ধন এতক্ষণে নিশ্চয়ই ছাড়া পেয়েছে। ধরা পড়ে গেছে রানা। তার থাই পাসপোর্টের আর কানাকড়ি মূল্যও নেই এখন। ও এখন একটা পাকিস্তানী স্পাই ছাড়া কিছুই নয়। এখানে যদি ধরা পড়ে তা হলে কোনও সাহায্য পাবে না ও স্বদেশ থেকে। সোজা অস্বীকার করবে পাকিস্তান ওর পরিচয়। জামার একটা বোতামে হাত বুলাল মাসুদ রানা। এই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য পটাশিয়াম সায়ানাইড লুকোনো আছে বোতামটায়। সে তো অনেক পরের কথা। এখন কী করা যায়?

নিশ্চয়ই প্রত্যেকটি হোটেলে খোঁজ নেয়া হবে চরোসা থিরা বলে কেউ উঠেছে কি না। না পেলে সারা কলকাতার প্রত্যেকটি হোটেলে আজকে যত লোক উঠেছে তাদের সবাইকে পরীক্ষা করে দেখবে ওরা। রানার চেহারার বর্ণনা দেয়া হবে প্রত্যেকটি হোটেলে, থানায় এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ-এ। রানার ফটোগ্রাফ পাঠানো হবে সব জায়গায়। শহরটা তছনছ করে খুজবে ওরা মাসুদ রানাকে। অবশ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একটা মানুষকে খুঁজে বের করা অত সহজও নয়। কথাটা ভেবে একটু আশ্বস্ত বোধ করল ও।

কিন্তু ধরা পড়ল কী করে? কোনখানটায় ভুল করল সে? থাই ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ এখন ওর দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত দাগ মুছে ফেলল রানা কেমিক্যালস দিয়ে। চরোসা থিরার পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, প্লেনের টিকেট, ইত্যাদি সবরকম চিহ্ন এক সঙ্গে জমা করে বাথরুমে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলল। এখন আর কোনও আবরণ থাকল না, নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে টিকে থাকতে হবে। ধরা পড়লে হয় বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করবে, না হয় বোতাম তো আছেই। হঠাৎ মনে হলো, মিত্রা? এই অবস্থায় মিত্রা কোনও সাহায্য করবে?

‘ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনস? গুড আফটারনুন, ম্যাডাম। পুট মি টু এনকোয়ারি কাউন্টার, প্লিজ!’

‘জাস্ট হোল্ড আ মোমেন্ট, স্যর। এনকোয়ারি এনগেইজড।

দশ সেকেণ্ড অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকল রানা রিসিভার কানে ধরে। তারপর খটাং করে ও-ধারের রিসিভার তুলল মিত্রা সেন। গড়গড় করে আউড়ে গেল গৎ।

ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনস, এয়ারপোর্ট এনকোয়্যারী। গুড আফটারনুন।

‘চিনতে পারছ, মিত্রা?’

‘ধক করে উঠল মিত্রার বুকের ভিতরটা। সেই গলা! সত্যিই ও বেঁচে আছে! ভুল হয়নি তার।

‘হ্যাঁ, পারছি।

‘কেমন আছ?

‘ভাল।

‘আমার ঠিকানাটা বলব?

না। এটা ওপেন লাইন।

‘কোথায় দেখা হবে?

‘পাঁচটায়। চিড়িয়াখানার সামনে।

‘কেবল তুমি থাকবে, না আশপাশে তোমার বন্ধু-বান্ধবকেও আশা করব?

‘অবিশ্বাস কোরো না।

কারণ?

‘পরে বলব। অনেক কথা আছে, সব বলব। রাখলাম।’ ছেড়ে দিল মিত্রা।

নীরব রিসিভারটা কান থেকে সরিয়ে একবার দেখল রানা, তারপর নামিয়ে রেখে সোজা ঘরে ফিরে গিয়ে লাঞ্চ অর্ডার দিল। মাটনটা বাদ রাখল অর্ডার থেকে সযত্নে। মাটন বলতে এরা বোঝে পাঁঠার মাংস-আর ওই গন্ধটা একদম বরদাস্ত করতে পারে না ও।

আবার চিন্তার ঘোড়দৌড় চলল রানার মাথার মধ্যে! কতক্ষণ? আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে ও? চব্বিশ ঘণ্টা? এর মধ্যেই হোটেল পরিবর্তন করতে। হবে। প্ল্যান করে ফেলল ও কীভাবে এগোবে। কীভাবে ভুল নিশানা দিয়ে ওদের চোখে ধুলো দেবে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো রানা।

স্নান সেরে খেয়ে নিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল রানা দরজা বন্ধ করে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই পিস্তলটা পরীক্ষা করে নিল একবার। তারপর বালিশের পাশে পিস্তলটা রেখে ওটার বাটের ওপর ডান হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

রানা যখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে অনেকগুলো সরকারী ডিপার্টমেন্টে ইমার্জেন্সি অর্ডার এল। টেলিফোনের পর টেলিফোন চলতে থাকল সারা কলকাতা জুড়ে। মৌমাছির চাকে যেন ঢিল পড়েছে। অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠল এক শ্রেণীর কর্মচারী। ওয়ায়ারলেসে ইনফরমেশন গেল টিটাগড়। মাইক্রোবাস থেকে মোড়ে মোড়ে নামিয়ে দেয়া হলো এক এক জোড়া সন্ধানী চোখ-হাতে বি-টু সাইজের একটা করে ফটো।

ঠিক সাড়ে চারটায় পাক্কা বিলিতি পরিচ্ছদ পরে বেরিয়ে এল রানা ঘর থেকে। চেহারাটা সামান্য পরিবর্তন করে নিয়েছে সে। হাতে দামি সানগ্লাস।

লিফটের দিকে না গিয়ে করিডোর ধরে এগোল রানা সিঁড়ি ঘরের দিকে। বামপাশে মোড় ঘুরে দেখল একটা মেয়ে ঘরে তালা দিয়ে রওনা হলো সিঁড়ির দিকে। প্রথমেই রানার মনে হলো ক্যাথি এখানে কেন। পরমুহূর্তে বুঝতে পারল এ ক্যাথি নয়, তার বোন স্যালি ডেভন। ক্যাথির চাইতে দেখতে অবশ্য এ অনেক ভাল, তবে দু’বোনে মিল আছে চেহারায়। চিঠিটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। পকেট হাতড়ে পেয়ে গেল। ওটা বের করে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ও মেয়েটির দিকে।

‘আপনি বোধহয় মিস স্যালি ডেভন! তাই না?

রানার দিকে চেয়েই অসম্ভব চমকে উঠল মেয়েটি। বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি স্যালি। আর আপনি?

‘আমার নাম মরিস রেমণ্ড। সম্প্রতি ব্যাঙ্কক থেকে এসেছি। আপনার জন্যে চিঠি আছে।’ স্যালির চোখের দৃষ্টিটা একটু অদ্ভুত লাগল রানার।

‘কে দিয়েছে?’

‘আপনার বোন, ক্যাথি।

চিঠিটা প্রায় খাবলা দিয়ে কেড়ে নিল স্যালি রানার হাত থেকে। খাম ছিঁড়ে ওখানে দাঁড়িয়েই পড়তে আরম্ভ করল। থাই ভাষায় লেখা চিঠি। কিছুটা পড়ে রানার মুখের দিকে চাইল একবার। রানা চলে যাচ্ছিল পাশ কাটিয়ে। স্যালি ডাকল, ‘শুনুন।

‘কিছু বলছেন?

‘একটু অপেক্ষা করুন দয়া করে।

আধাআধি পড়েই চিঠিটা ভাঁজ করে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না, আমার ঘরে চলুন।

ঘরে এসে বসল ওরা দুজন। চিঠি শেষ করে গভীর চিন্তামগ্ন মুখে চুপচাপ বসে থাকল স্যালি ডেভন। কপালে ভ্রুকুটি। হঠাৎ আনমনে বলল, আমি একা এখন চেষ্টা করলে কী হবে? ভুল যা হবার তা তো হয়েই গেছে।

‘কোনও দুঃসংবাদ?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘না, দুঃসংবাদ আপনার জন্য। আপনার সামনে এখন ভয়ানক বিপদ, মি. মাসুদ রানা। হন্যে হয়ে খুঁজছে ওরা আপনাকে।

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘এই চিঠি পড়ে। আমার বোন আপনার সর্বনাশ করেছে, মি. রানা। টাকার বিনিময়ে ব্যাঙ্ককের ইণ্ডিয়ান সিক্রেট এজেন্টের কাছে আপনার আসল পরিচয় বিক্রি করেছে। কিন্তু সেই সন্ধাতেই আপনি আমাদের টাকার প্রয়োজন মিটিয়ে দিলেন চিরকালের মত। তার আগেই ও ভুল করে বসে আছে। আমাকে লিখছে আপনাকে সাহায্য করতে। কিন্তু আমি এখন একা কী করব..

রানার মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেল। ক্যাথি। ক্যাথি বিশ্বাসঘাতকতা করল? এই জন্যে ব্যাঙ্কক থেকে লোক লেগে গেছে ওর পিছনে। কেউ যেন রানার বুকে আমূল বসিয়ে দিয়েছে একটা ছুরি। ছাড়া যাবে না ওই পিশাচিনীকে। আরও কত লোকের সর্বনাশ করবে কে জানে! স্যালির শেষের কথাগুলো রানার কানের ভিতর ঢুকল না। উঠে দাঁড়াল সে। চট করে রানার হাত ধরল স্যালি।

‘আমার বোনকে ক্ষমা করতে হবে, মি. রানা। আপনার হাত ধরে ক্ষমা চাইছি আমি আমার বোনের হয়ে। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ও-আর কারও ক্ষতি করতে পারবে না কখনও। আত্মগ্লানিতে মরছে এখন। টাকার আমাদের কত প্রয়োজন ছিল আপনি বুঝতে পারবেন না, মি. রানা। কত যে কষ্ট করেছি আমরা…’ গলাটা ভেঙে এল। গাল বেয়ে জল নেমে এল দু’ফোঁটা। বিকৃত হয়ে গেল মুখটা কান্নায়।

টাকার প্রয়োজন, মনুষ্যত্ব, ন্যায়-নীতির মূল্যবোধ, আর মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার অধিকার, সব মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে গেল রানার মনের মধ্যে। ভদ্রভাবে হাতটা ছাড়িয়ে নিল স্যালির হাত থেকে। ভাবল কাউকে বিচার করবার অধিকার তার নেই। মানুষের হাজারো সমস্যার কতটুকুই বা ও জানে! বিচার করবে বিচারক। ও কেবল দেখে যাবে। চোখের জলে নিভে গেল ক্রোধের আগুন।

‘আপনি আমাকে দেখেই চমকে উঠেছিলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

আপনার ছবি দেখেছি আমি আমার এক বন্ধুর কাছে। এই মুহূর্তে সারা কলকাতাময় হাজারটা চোখ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হোটেলে আজ রাতটা আপনি নিরাপদ। ভোর ছটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত যে মেয়েটি কাউন্টারে থাকে সে ছাড়া আর কেউ আপনার খবর দিতে পারবে না ওদের। তার মধ্যেই আমি ভেবে দেখি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না।

‘ধন্যবাদ। তার দরকার হবে না।’

বেরিয়ে এল রানা ওর ঘর থেকে। স্যালিও বেরোল পিছু পিছু। আঙুল দিয়ে স্যালিকে লিফটের দিকে যাবার নির্দেশ দিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে চলে গেল রানা।

দেরি হয়ে গেছে। সানগ্লাসটা পরে নিয়ে হাতের ইশারায় একটা ট্যাক্সি ডাকল রানা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে।

‘আলীপুর। চিড়িয়াখানা।

পিছনের সিটে বসে রানা ভাবছে, এইবার বোঝা গেল কী করে ওরা টের পেল তার সত্যিকার পরিচয়! এতক্ষণ কিছুতেই জটিল গ্রন্থিটা খুলতে পারছিল না ও। চারদিক থেকে আটঘাট বেঁধে নেমেছিল ও। হঠাৎ সব যেন ওলটপালট হয়ে গেল। খেলা মাত্র শুরু হয়েছে পন কে ফোর, পন কে ফোর, কিংস নাইট বিশপ থ্রি, কুইন্স নাইট বিশপ থ্রি, বিশপ নাইট ফাইভ, পন কুইন্স থ্রি-ব্যস, আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়েটা এসে উল্টে দিল যেন দাবার বোর্ড।

ঠিক সোয়া পাঁচটায় পৌঁছল রানা চিড়িয়াখানার গেটের সামনে। মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। দুটো টিকেট কেটে রেখেছিল সে। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল রানা।

‘দেরি হয়ে গেল একটু, রানা লজ্জিত হলো।

‘দেরি কোথায়? পাকিস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম অনুসারে পনেরো মিনিট আগেই পৌচ্ছে বরং। আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতাম, লোকে যে যাই ভাবুক না কেন।’

অনেক হাঁটল দুজন। হরেক রকম রঙ-বেরঙের পাখি, বানর, বাঘ-ভালুক সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, হিপোপটেমাস, গণ্ডার সব দেখে বসল গিয়ে ওরা নির্জন লেকের পারে পাথরের আসনে। লেকের ভিতর দ্বীপের মত জায়গাটায় লাল এবং কালো ঠোঁটের রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে অল্প জলে, আর থেকে থেকে শামুক তুলছে ডুব দিয়ে দিয়ে। এতক্ষণ দরকারী একটা কথাও হয়নি ওদের মধ্যে।

রানার বাঁ হাতটা তুলে নিয়ে কোলের ওপর রাখল মিত্রা।

‘অনেক কথা বলবে বলেছিলে, কই, একটা কথাও তো বলছ না? রানা জিজ্ঞেস করল।

‘কথাগুলো গুছিয়ে নিতে পারছি না।’

‘তুমি এয়ারলাইন্সে ঢুকলে কবে? আর ঢুকলেই যদি, এয়ার হোস্টেস হলে কেন?’

এয়ার হোস্টেস? গ্ল্যামারের লোভে সবকিছু বিকোনো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মামাকে ধরে জয়দ্রথের মুঠি থেকে বেরিয়েছি। নাচের স্কুলে মাস্টারি করতে পারতাম-আগেও ভরতনাট্যম আর কথক শেখাতাম আমি-কিন্তু এখন আমার পক্ষে নাচা উচিত হবে না বলে এই চাকরিটাই নিলাম।

‘নাচা উচিত নয় কেন?

‘সেই কথা বলতেই তোমাকে ডেকেছি, রানা। আমি প্রেগনেন্ট। মাথা নিচু করল মিত্রা।

বলো কী? বিস্মিত রানা মিত্রার মুখের দিকে চাইল।

হ্যাঁ। তোমার সন্তান।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। অদ্ভুত এক উত্তেজনা বোধ করল সে। বিচিত্র এক শিহরন। মিত্রার দুই বাহু ধরল ও দুই হাতে।

সত্যি বলছ, মিত্রা! সত্যি বলছ?

মৃদু হাসল মিত্রা।

‘খুশি হয়েছ?

‘আমার কেমন লাগছে তা তোমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারব না, মিত্রা। আমার সন্তান! চলো আজই বিয়ে করি আমরা। কিন্তু না, বিয়ে করা বোধহয় ঠিক হবে না। এক ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছি আমি। যে-কোনও মুহূর্তে মৃত্যু ঘটতে পারে আমার। তোমার তখন কী হবে! তুমি মহাচিন্তায় ফেললে দেখছি আমাকে!’

‘অত বিচলিত হচ্ছ কেন? বিয়ে তো আমাদের হয়েই গেছে। আর তোমার কপালেও যা হবার তা হবেই। ভবিতব্য। অদৃষ্ট তো নির্ধারিতই থাকে।

‘এত কম সময়ের মধ্যে বুঝলে কী করে তুমি? মাত্র তো কদিন হলো!’

‘সব রকম লক্ষণ আরম্ভ হয়ে গেছে। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি আমি!

অনেক জল্পনা-কল্পনা করল দুজন ভবিষ্যৎ নিয়ে। দুজন দুই দেশের, দুই জাতের মানুষ এক হয়ে গেল অদৃশ্য এক বন্ধনে। অন্য সময়ে কি কেউ কাউকে এত আপন ভাবতে পারত? অবাক হয়ে যায় রানা, মিত্রা দুজনেই।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। নিজের বিপজ্জনক অবস্থার কথা মিত্রাকে বলল রানা সব খুলে। বলল, আগামীকাল ভোরের ট্রেনে টিটাগড় যাচ্ছে ও। সব শুনল মিত্রা। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যদি পারতাম, বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম তোমাকে। কিছুতেই যেতে দিতাম না টিটাগড়ে। ওই দেয়ালের ওপাশে আমি যাইনি কখনও, শুনেছি যে যায় সে আর ফেরে না কোনোদিন।

কী আছে ওখানে?’

‘জানি না! জয়দ্রথ মৈত্রের সবচাইতে বিশ্বস্ত এক-আধজন ছাড়া বাইরের আর কেউ জানে না। যারা জানে তাদের বাইরে আসতে দেয়া হয় না। আমরা। সবাই জানতাম পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর একটা চরম আঘাত হানবার জন্যে আমাদের ওই সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশন। কিন্তু কই, কিছুই তো হলো না, শেষ পর্যন্ত কোনওমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে বাঁচলাম আমরা। কী ছিল মৈত্র মশায়ের মনে, কতদূর সফল হলো সেই মিশন, তা তিনিই জানেন। আমি শুধু বলতে শুনেছি ওঁকে একবার-ওদিকের কাজ শেষ, এবার টিটাগড়ের প্রহরা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। অনেকগুলো অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটগানও ফিট করেছে ওরা এরিয়ার চারধারে।’ হঠাৎ থেমে বলল, তুমি আমার যত আপনই হও না কেন, এসব কথা একজন পাকিস্তানী স্পাইকে বলতে আমার কী যে খারাপ লাগছে তা বোঝাতে পারব না। দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছি। অথচ তোমাকে না। বললে বিপদে পড়বে তুমি।’

‘তোমাকে বাড়ি ফিরতে হবে ক’টার মধ্যে?’ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইল। রানা।

‘আজ ফিরব না বলে দিয়েছি মামাকে। বলেছি বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি।’

‘কিন্তু আমার সঙ্গে যদি ধরা পড়ো তবে তো কঠিন শাস্তি হয়ে যাবে তোমার।

‘হোক। শাস্তি হওয়াই তো দরকার আমার। মেরে তো আর ফেলতে পারবে না। সান্ত্বনা পাব-প্রায়শ্চিত্তও হলো, আর তোমাকে একা বিপদে ফেলে পালিয়েও গেলাম না!’

‘এসব কী আবোলতাবোল কথা বলছ তুমি?’

‘সে তুমি বুঝবে না। আমি যে একজন শত্রুপক্ষের স্পাইকে ভালবেসেছি! যে শপথ নিয়ে দেশের কাজে নেমেছিলাম, কোথায় গেল সে অগ্নি-শপথ? মাঝে মাঝেই ভাবছি, এ আমি অন্যায় করছি। নিজের স্বার্থে জয়দ্রথের বিরোধিতা করলাম, দেশের বিরোধিতা করলাম। এখন স্বামীর স্বার্থে, সন্তানের স্বার্থে আবার তাই করছি। সন্দেহ হচ্ছে, ভালবাসার মূল্যে কি জাতি-ধর্ম-দেশ-সমাজ সংসার সবকিছু বিকিয়ে দেয়া যায়, না উচিত? তা ছাড়া এটা ভালবাসা না একটা সাময়িক মোহ তা-ও তো বুলতে পারিনি আজও। প্রেম যদি হবে, তো এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেন? অন্তর্দাহে জ্বলছি কেন অহরহ?

‘এত ভাবলে তুমি ঠিক মরে যাবে, মিত্রা! তোমার দুর্বলতার কোনও সুযোগ নিতে আমি চাই না। তুমি বরং সরে যাও আমার পথ থেকে। যদি কখনও ইচ্ছে। করে, এসো, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব। তুমি স্বেচ্ছায় এসেছিলে এগিয়ে, এখন যদি পিছিয়ে যাও তোমার দোষ দেব না আমি।’

‘তা জানি। চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই যেতে পারছি না পিছিয়ে। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা।’

‘শোনো,মিত্রা। ব্যাপারটাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তো ইচ্ছে করলেই দেখতে পারো। তুমি তো আসলে তোমার দেশের কোনও ক্ষতি করছ না-প্রতিবেশী একটা দেশকে এক হীন চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করছ। আমরা তো তোমার দেশের কোনও ক্ষতি করতে যাচ্ছি না। তোমার দেশের কয়েকটা খারাপ লোক মিলে যদি শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীকে অন্যায় ভাবে পর্যুদস্ত করতে চায়, তা হলে পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে সেটা বন্ধ করা তোমার কর্তব্য নয়? অন্যায় যা, তা অন্যায়ই। নিজের দেশ অন্যায় করলেও সেটা ন্যায়। হয়ে যায় না। যাক, এসব কথা তোমার ভাল লাগবে না হয়তো। তবে ভেবে দেখতে চেষ্টা করো। হয়তো অন্তর্দাহ কমতে পারে।

ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। আটটা বাজে। আজকের মত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিড়িয়াখানা। বেরিয়ে এল ওরা।

ঠিক সোয়া আটটায় চিড়িয়াখানার গেটের পাশে একটা পাবলিক টেলিফোনে একটা বিশেষ নাম্বার ঘোরল রানা। খটাং করে তুলল কেউ রিসিভার, কিন্তু কথা বলল না। হিশুশ করে একটা একটানা শব্দ এল রানার কানে। আশপাশে কেউ নেই, তবু গলাটা যতদূর সম্ভব খাদে নামিয়ে রানা বলল, মাসুদ রানা ইন ডেঞ্জার। সিক্স প্রোটেকশন অ্যাণ্ড হেল্প। তাও কোনও উত্তর নেই। আবার বলল রানা, ‘আই রিপিট। মাসুদ রানা ইন ডেঞ্জার। সি প্রোটেকশন অ্যাণ্ড হেল্প।’

রেকর্ড হয়ে গেল রানার বক্তব্য। নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার। মিত্রাকে নিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এল রানা। দুজনের কেউ লক্ষ করল, ওরা লিফটে উঠতেই একজন লোক দ্রুতপায়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল।

ঘরে বসেই ওরা খেয়ে নিল সাত কোর্সের ইংলিশ ডিনার। স্যালির সঙ্গে কয়েকটা দরকারী কথা বলবার প্রয়োজন বোধ করল রানা। কিন্তু সে তো এখন নাচ-ঘরে চলে গেছে। ওখানেই দেখা করতে হবে ওর সঙ্গে। মিত্রা সেন ওসব, নাচ দেখবে না বলে দিল পরিষ্কার। ওকে ঘরেই বসিয়ে ডান্সিং ফ্লোরের দিকে এগোল রানা। নাচের প্রথম সেশন আরম্ভ হচ্ছে তখন। টিকেট করে ঢুকে পড়ল ও ভিতরে। অনেক লোক জড়ো হয়েছে। দরজার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল রানা। বয় এসে দাঁড়াল পাশে। উইস্কি এবং সোডার অর্ডার দিয়ে চারধারে একবার চোখ বুলাল সে।

বারোশ’ বর্গফুট মত হবে চারকোণা ঘরটা। গোটা তিরিশেক টেবিল এলোমেলো ভাবে সাজানো। অনেক স্ত্রী-পুরুষ এসেছে’ জোড়ায় জোড়ায়। ছেলে-বুড়ো সব রকম মুখই দেখা যাচ্ছে। বিকৃত রুচির সমাবেশ। সবার সামনেই গ্লাস। গরম হয়ে নিচ্ছে সবাই নাচ আরম্ভ হবার আগে। একটা মুখও চিনতে পারল না দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। ভাবল মহানগরী কলকাতায় একজন লোককে খুঁজে বের করা কী এতই সোজা। স্যালির সাথে আরেকবার দেখা না করে টিটাগড়ের পথে রওনা হতে পারছে না রানা। নাচের বিরতিতে নিশ্চয়ই দেখা হবে।

একজন উঠে বঁড়াল ডান্সিং ফ্লোরের ওপর। একটা স্পট লাইট পড়ল তার মুখের ওপর-বাকি ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল।

‘আজকের অনুষ্ঠানই কলকাতায় মিস স্যালির শেষ অনুষ্ঠান। আপনারা যারা আজ শেষবারের মত তার নাচ দেখতে পাচ্ছেন তাদের ভাগ্যবানই বলব। আজ আবহ-সঙ্গীতে আছেন জোসেফ ফার্নান্দেজু।

আরেকটা স্পট লাইট পড়ল ভায়োলিন, চেলো, ট্রাম্পেট, মারাক্কাস এবং ড্রাম বাদকের ছোট্ট একটি দলের ওপর। স্টেজের ডান পাশে গোল হয়ে বসেছে তারা বিচিত্র রঙচঙে কাপড় পরে। বৃদ্ধ গোয়ানিজ মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল। ডুম’ করে ড্রামের ওপর টোকা পড়ল একটা। মোলায়েম বাজনা এল কানে।

‘এবার শুরু হচ্ছে নাচ। মিস স্যালি ডেভন ফ্রম ব্যাঙ্কক।

ঘোষকের মুখের ওপর যে স্পট লাইটটা ছিল সেটা নিভে গেল। স্টেজের মাঝখানে এবার স্পট লাইট পড়ল। কিছুই নেই সেখানে। আলোটা ধীরে ধীরে বেগুনী হয়ে গেল। যেন মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এল স্যালি ডেভন স্টেজের ওপর। ট্র্যাপ ডোরটা বন্ধ হয়ে গেল।

কালো নায়লনের নেটে ঢাকা স্যালির দেহ। পরিষ্কার দেখা গেল ভেলভেটের একটা ছোট্ট জাঙ্গিয়া এবং ব্রেসিয়ার ছাড়া কিছুই নেই স্যালির ফর্সা শরীরে। বাজনার তালে তালে সাপের মত দুলছে ওর দেহের ওপরের অংশ। উসখুস। করে সোজা হয়ে বসল দর্শকবৃন্দ। রানা বড় একটা চুমুক দিল গ্লাসে।

নায়লনের নেটটা ছেড়ে দিল স্যালি গলার কাছে একটা বোতাম খুলে। এবার তালে তালে ফর্সা পেটটা ওঠা-নামা করতে থাকল, সেই সঙ্গে কোমর দুলছে অল্প অল্প। রানার মনে পড়ল টোকিয়োর হোটেলে স্ট্রিপটিজের কথা। একবার ভাবল এই নোংরামি দেখতে না ঢুকলেই পারত।

লয় বাড়ছে ধীরে ধীরে। ট্রাম্পেটের লম্বা টান রক্তের মধ্যে নেশা ধরিয়ে দিতে চায়। নাকটা একটু ফুলে গেছে স্যালির। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে। একটু। পাঁচ মিনিট পর হঠাৎ একটানে বক্ষবন্ধনী খুলে দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে দিল স্যালি। হৈ-হৈ করে উঠল দর্শকবৃন্দ। অশ্লীল একটা মন্তব্য করল কেউ অন্ধকার থেকে।

রানা বুঝল আর থাকা যাবে না। একটু পরেই খোলো খোলো, সব খুলে ফেলো। টেক ইট আউট, বেইবে-বলে চিৎকার আরম্ভ করবে উত্তেজিত দর্শকবৃন্দ। ধাপে ধাপে নামিয়ে নিয়ে যাবে স্যালি এদের নরকের দরজায়। ছিক ছিকছিক মারাক্কাসের শব্দে কান গরম হয়ে উঠেছে সবার। আশপাশের টেবিলে উত্তেজনায় হাপাচ্ছে সবাই। ক্লেদাক্ত নারকীয় পরিবেশ।

– দ্রুততর হচ্ছে ড্রামের ছন্দ। এক্ষুণি তাণ্ডব লীলা আরম্ভ হয়ে যাবে এই ঘরের মধ্যে। মেঝেতে একটা বোতল আছড়ে ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল। উঠি উঠি করেও উঠতে পারছিল না রানা। এবার এক ঢোকে গ্লাসটা খালি করে উঠে পড়বে ভাবল। ঠিক এমনি সময়ে একটা বজ্র কঠিন হাতের থাবা এসে পড়ল ওর কাঁধের উপর। চমকে উঠল রানা। এক মুহূর্তে বাস্তব জগতে ফিরে এল সে।

কানের কাছে মৃদুস্বরে বলল কেউ, দিস ইজ নো এনিমি, ব্রাদার। দিস ইজ আ ফ্রেণ্ড।’

.

১১.

৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।

..লেটস গেট আউট।

উঠে দাঁড়িয়েছিল রানা এক ঝটকায়। দেখল, কথাটা বলেই পেছন ফিরে দরজার দিকে এগোল ছায়ামূর্তিটা। রানাও বেরিয়ে এল লোকটার পিছু পিছু। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল লাউঞ্জের দিকে না গিয়ে বারের পাশ দিয়ে অন্ধকার করিডোর ধরে এগোল লোকটা। একবারও চাইল না রানার দিকে ফিরে।

‘কে আপনি?’ এগিয়ে গিয়ে এক থাবা বসাল রানা লোকটার কাঁধে।

‘কোনও কথা নয়, জলদি বেরিয়ে আসুন আগে।’

অল্প কিছুদূর গিয়েই ছোট একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওরা হোটেলের বামধারের সুইপার প্যাসেজে। রানা ভাবছে আর এগোনো ঠিক হবে কি না। খশ করে ম্যাচের কাঠি জ্বালল লোকটা। সেই আলোর সামনে একটা কাগজ ধরল। রানা পড়ল:

Lew Fu-Chung
01633
Chinese Secret Service

লাফিয়ে উঠল রানার হৃৎপিণ্ড। এরাও তা হলে চোখ-কান খোলা রেখেছে! ফুচুং-এর নাম ও শুনেছে বহুবার। কলকাতার চিফ এজেন্ট। কিন্তু তাকে বের। করে আনল কেন ফুচুং?

কাগজটা পুড়িয়ে ফেলল ফু-চুং। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে ছাইটা গুঁড়িয়ে দিয়ে ইশারায় এগোতে বলল রানাকে। কিচেনের পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে পার হয়ে এল ওরা। বিরিয়ানী, কালিয়া, কাবাব, চিকেন কারি, প্রন-কাটলেট, ফ্রায়েড এগ, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদি সবকিছুর গন্ধ মিলেমিশে একটা বোটকা গন্ধ এল নাকে। আরও কিছুদূর এগিয়ে মুখ খুলল লিউ ফু-চুং।

‘আপনার ঘর এখন সার্চ হচ্ছে।’

‘মিত্রা!’ দাঁড়িয়ে পড়ল রানা।

‘উনি এখন নিরাপদে আমাদের গাড়িতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি আর এগোচ্ছি না-এখান থেকেই আবার ব্যাক ডোর দিয়ে হোটেলে ফিরে। যাব। ওদের কার্যকলাপ লক্ষ করা দরকার। আপনি গলি দিয়ে বেরিয়ে বা দিকে। হাঁটতে থাকবেন। ঠিক পাঁচ শ গজ দূরে দেখবেন রাস্তার ওপাশে একটা কালো সুপার ভক্সহল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আপনি উঠে বসলেই আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবে ড্রাইভার। আমি বাসায় টেলিফোন করে সব ইন্ট্রাকশন দিয়ে দিয়েছি। কোনও অসুবিধা হবে না আপনাদের। গুড লাক।’

‘সময় মত সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

উত্তর এল না কোনও। ততক্ষণে পিছন ফিরে কয়েক পা এগিয়ে গেছে ফুঁ চুং। দ্রুত মিলিয়ে গেল সে অন্ধকারে।

গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল সুপার ভক্সহল। হোটেলের দিকে এক নজর চেয়েই চমকে উঠল রানা। ঠিক লাউঞ্জে ঢুকবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জয়দ্রথ মৈত্র। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল ও এযাত্রা। আরও অনেক সাবধান হওয়া উচিত ছিল ওর। মনে মনে নিজেকে কষে গোটা কয়েক চাবুক লাগাল রানা নির্মম ভাবে। শক্ৰব্যুহের মধ্যে বুদ্ধির ঘোড়া আরও দ্রুত ছোটাতে হবে। বারবার আর ভাগ্য ওকে সহায়তা করবে না।

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখল রানা আগাগোড়া সবটা ব্যাপার। খ্যাপা কুকুর হয়ে খুঁজছে ওকে এই দেশের এক মহা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। কী করবে এখন ও? ফিরে যাবে পাকিস্তানে? সবকথা শুনে রাহাত খান নিশ্চয়ই ওকে। দোষারোপ করতে পারবেন না। কিন্তু খুশিও হবেন না। পরাজয়কে রাহাত খান ঘৃণা করেন। যে কাজে এসেছিল সে কাজ শেষ না করে কোন্ মুখে গিয়ে দাঁড়াবে ও ওই অসমসাহসী তীক্ষ্ণধী বৃদ্ধের সামনে? আর একটু মাথা খাটালে নিশ্চয়ই কোনও পথ বেরোবে কার্যোদ্ধারের। যাই ঘটুক না কেন, পালিয়ে যেতে পারবে না ও-অসম্ভব। কিন্তু এগোবে কোন পথে? প্রতি পদেই ধরা পড়বার ভয়। প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ঢুকবে কী করে পাঁচিলের ভিতর? কোনও বুদ্ধিই যে। খেলছে না মাথায়। হেই, হ্যাট করে লেজে মোচড় দিয়েও নড়াতে পারছে না ও তার চিন্তার গরুর গাড়ি। ভাবনাটা দূর করে দিল রানা। মাঝে মাঝে এমন হয়–অনেক মাথা খাঁটিয়েও সমাধান পাওয়া যায় না। কিন্তু আপনিই একটা পথ বেরিয়ে যায় ঠিক প্রয়োজনের সময়ে।

মৃদু হেসে বাইরে চেয়ে রইল ও। দ্রুত অপসৃয়মাণ বাড়ি-ঘর দোকান-পাট আর লাল-নীল নিয়ন সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল ওরা পার্ক স্ট্রিট ধরে। আমীর আলী এভিনিউ ছাড়িয়ে গড়িয়াহাটায় পড়ল সুপার ভক্সহল।

‘অত ভেবো না। আমি তোমাকে সাহায্য করব, রানা।’

চমকে উঠল গভীর চিন্তামগ্ন রানা। মিত্রার উপস্থিতি ও প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। নিজের অজান্তেই ডুবে গিয়েছিল চিন্তায়।

না,’ মিত্রার কাঁধে হাত রাখল রানা। তোমার অন্তর্দাহ বাড়িয়ে লাভ কী?’

‘আর কোনও দ্বন্দ্ব নেই আমার। তোমার এই বিপদের সময় আমি কিছুতেই চুপচাপ বসে থাকতে পারব না। আমি বুদ্ধি বের করে ফেলেছি। আরও কাছে সরে এল মিত্রা।

‘কী বুদ্ধি, মিত্রা?’

‘কাল সকালে তোমার যাওয়া হবে না টিটাগড়। আমি নিয়ে যাব তোমাকে সন্ধ্যায়। কোনও কথাই যখন শুনবে না, ঢুকবেই যখন তুমি ওই প্রাচীরের ভেতর, তখন যাতে ঢোকার আগেই ধরা না পড়ো তার ব্যবস্থা আমি করব।’

‘তোমার সঙ্গে আমি গেলে তো!’

‘কেন? যাবে না কেন?

‘তোমার কোনও বিপদ হোক এটা আমি চাই না। তা ছাড়া তোমার শরীর, ভাল না-কোনও রকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না এই অবস্থায়।

কিচ্ছু ঝুঁকি নেই। আমার মামার গাড়িতে যাবে। গাড়ির সামনে ফ্লাগ দেখলে কেউ ঠেকাতে সাহস পাবে না।

তুমি চাইলেই ওঁর গাড়ি পাবে? ওঁর নিজের কোনও দরকার থাকতে পারে না?’

‘উনি সন্ধ্যের পরই জপে বসেন। অরবিন্দ ঘোষের চেলা। আজীবন। ব্রহ্মচারী। স্বদেশী আন্দোলনের একজন পাণ্ডা ছিলেন। আমি ওঁর একমাত্র আদরের ভাগ্নি। ওসব তুমি ভেবো না, গাড়ি পাব।’

বালিগঞ্জে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল ওরা। রানার ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা। একজন চীনা মহিলা দরজা খুলে দিয়ে। হেসে অভ্যর্থনা জানাল ওদের। সোনা বাঁধানো একটা দাঁত। মাথা ঝুঁকিয়ে হাতের ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল ভিতরে। মোজাইক করা সুন্দর ঝকঝকে তকতকে একটা বেড রুমে ওদের বসিয়ে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে। একটু পরেই রানার সুটকেস এবং অ্যাটাচি কেসটা এনে রাখল ড্রাইভার এক কোণে।

‘এ কোন মুলুকে এলাম রে, বাবা। সবই তো চীনা দেখছি!’ বাথরুমের দিকে এগোল মিত্রা।

রানা ভাবছে, পিসিআই-এর পাত্তা নেই কেন? কী হলো? আর চাইনীজ সিক্রেট সার্ভিসই বা এত খবর জানল কোত্থেকে? এখানে একই সঙ্গে কাজ করছে নাকি দুই দেশ?

মিনিট পনেরো পর ফুচুং এসে ঢুকল ঘরে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলিষ্ঠ দেহ। চেহারা অনেকটা বাঙালির মত। পরিষ্কার বাংলা বলে।

‘ভাগ্যিস সময়মত মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, মি. রানা। আর একটু দেরি হলেই কাজ হয়েছিল আর কী। কিন্তু আপনাকে স্পট করল কী করে ওরা? তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে দেখলাম? আর আপনিই বা টের পেলেন কী করে যে ধরা পড়ে যাচ্ছেন?

সমস্ত ঘটনা ভেঙে বলল রানা। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা খবর পেলেন কী করে?

‘ওহ-হো! আপনি বুঝি জানেন না? গতরাতে আপনাদের পিসিআই এজেন্ট মোহাম্মদ আলী ধরা পড়ে গেছে দলবল সহ। এখন সে আইএসএস-এর টরচার চেম্বারে। আমরা আপনাদের চিফের সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছিলাম আজ। তাঁর কাছেই আপনার আগমন সম্পর্কে জানতে পারি–টেলিফোন নাম্বারটাও ন’টার দিকে আপনার মেসেজ পেয়েই আমি ছুটেছিলাম, গ্র্যাণ্ড হোটেলে। পিসিআই-এর কাজ এখন আমরা টেক-আপ করেছি। যতদিন অন্য কেউ না আসবে ততদিন আমাকেই চালিয়ে নিতে হবে।’

‘হোটেলের অবস্থা কী রকম দেখলেন?

কী আবার? একটু অবাক হয়ে গেছে ওরা, কিন্তু মোটামুটি নিশ্চিন্ত আছে, ধরা আপনাকে যাবেই। ‘H’ তো এখন সেই ডান্সারের সঙ্গে খুব মৌজে আছে। জড়াজড়ি করে ঢুকল দুজন রুমের মধ্যে-দরজা লাগিয়ে দিল, আমি বেচারা আর কী করি, ফিরে এলাম।

রানা বুঝল এই বন্ধুটির কাছেই স্যালি ডেভন ওর ছবি দেখেছে। তাই এক নজরেই চিনতে পেরেছিল আজ বিকেলে। জয়দ্রথের সঙ্গে স্যালি! হাসি পেল। রানার।

যাক, এখন আপনার প্ল্যান কী?’ জিজ্ঞেস করল ফু-চুং।

‘কাল যাচ্ছি টিটাগড়।

‘এত ঘটনার পরেও। নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবেন। কোনও লাভ নেই গিয়ে। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি চারপাশ। অ্যাবসলিউটলি ইনভালনারেবল! না সূচক মাথা নাড়ল ফুচুং ঠোঁট উল্টে। অবশ্য আপনার কাজ, আপনি যা ভাল। বুঝবেন করবেন। তবে আমার মনে হয়…’ কথাটা আর শেষ করল না সে। মিত্রার দিকে চোখ পড়তেই লজ্জিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। আপনাদের বিশ্রাম দরকার। আর বিরক্ত করব না। কাল দেখা হবে। এখান থেকে ইচ্ছে করলেই কাল আপনি আপনার চিফের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমাকে বললেই ব্যবস্থা করে দেব। আচ্ছা, আসি। শুভরাত্রি।

রানা বসেছে বিছানার উপর। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মিত্রা এসে রানার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল।

‘আচ্ছা, এই চীনা ভদ্রলোক আমাকে কী মনে করলেন বল তো। এমন লজ্জা করছিল। ভাবছিলাম, অন্তত শালীনতার খাতিরে আমার আজ বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত ছিল এখানে না থেকে। কিন্তু কিছুতেই নড়তে পারলাম না।

‘কেন পারলে না?’ হেসে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘বোঝ না? রানার মাথাটা চেপে ধরল সে বুকের মধ্যে। কেউ কি বলতে পারে এ আমার শেষ রাত নয়? তুমি আমাকে বেহায়া বানিয়ে দিয়েছ, রানা।

একটা মস্ত ডাবল বেড স্প্রিং-এর খাট নীল বেড কাভারে ঢাকা। নীচে দামি নীল চাদর।

‘ওঠো দেখি, এটা তুলে ভাজ করে রাখি।

বাক্স থেকে স্লিপিং গাউনটা বের করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল রানা। বেড কাভার ভাজ করে আলনায় রাখল মিত্রা। শাড়িটার ভাজ নষ্ট করলে চলবে না, খুলে সেটাও রাখল আলনার উপর। ব্লাউজ না খুলেই ভিতর থেকে হুক খুলে টান। দিয়ে বের করে আনল ব্রেসিয়ার। তারপর ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে ইয়ার্ডলি ট্যালকম পাউডারের কৌটোটা তুলে নিয়ে অকৃপণভাবে ছড়াল সারা গায়ে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা কর্কশ পুরুষালী হাত গায়ে এসে পড়তেই চমকে উঠল। মিত্রা।

‘অ্যাই,পাজি। কখন পা টিপে এসে দাঁড়িয়েছ পেছনে, টেরই পাইনি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম একেবারে।

সারা অঙ্গে পাউডার মাখিয়ে দিল রানা। বোতাম খুলে গেল ব্লাউজের। চোখ বুজল মিত্রা। মুখে চাপা দুষ্টামির হাসি। আঙুল ধরে নিয়ে গেল সে রানাকে বিছানার ধারে। বলল, ‘বড় বেহায়া মনে হচ্ছে আমাকে, না?’ মুখটা রক্তিম হয়ে উঠল ওর।

কোনও উত্তর না দিয়ে টেনে নিল ওকে রানা। ব্যবধান রইল না আর। শক্তিশালী দুই বাহুর মধ্যে এলিয়ে পড়ল মিত্রা সেন।

‘কোনও দ্বিধা নেই তো, মিতা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

না।’

.

১২.

৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।

সিক্সটি ওয়ান মডেল হিন্দুস্থান অ্যামব্যাসাডার-মার্ক টু। ফোর ডোর। থারটিন হানড্রেড নাইনটি নাইন সিসি বা ফোরটিন হর্স পাওয়ার। স্টিয়ারিং গিয়ার। ওয়ান পিস, ফ্রণ্ট সিট। ওয়াটার কুলড ইঞ্জিন।

ভারতের তৈরি এই বেঢপ সাইজের কালো গাড়িটার চারধারে এক চক্কোর ঘুরে দেখল রানা। মন্ত্রিত্ব লাভ করে বোধহয় মিত্রার মামাবাবু পেয়েছেন গাড়িটা সরকার থেকে। ছোট্ট হিন্দুস্থানী পতাকা উড়ছে সামনে বনেটের ওপর। রানা বুঝল ডায়ালের ওপর ‘৯০’ লেখা থাকলেও ‘৭৫’-এর এক ইঞ্চি বেশি যাবে না ঘণ্টায়। গ্যালনে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল যেতে পারে বড় জোর, যদি টিউনিং ঠিক থাকে। কার্টসি লাইটের বালবগুলো খুলে ড্যাশ বোর্ডে রেখে দিল রানা।

তৈরিই আছে রানা। ছোট্ট একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। দুটো ডেক্সেড্রিন ট্যাবলেট গিলে নিয়েছে আগেই। গিয়ে বসল ও গাড়ির পিছন সিটে। ড্রাইভিং সিটে মিত্রা সেন। সাড়ে সাতটা বাজছে রানার রিস্টওয়াচে। উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠেছে দোকানে দোকানে।

গাড়িয়াহাটা, লোয়ার সার্কুলার রোড, শেয়ালদা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, শ্যামবাজার, বেলগাছিয়া, পাইকপাড়া হয়ে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে পড়ল ওরা। এরপর কামারহাটি, পানিহাটি, সোদপুর, খড়দহ হয়ে টিটাগড়। একটি কথাও হলো না ওদের মধ্যে সারাটা রাস্তায়।

টিটাগড় ছাড়িয়ে আরও আধমাইল গিয়ে স্পিড কমাল মিত্রা। বাঁয়ে মস্ত এরিয়া জুড়ে উঁচু পাঁচিল দেখা গেল আবছা মত। নাগরদোলায় নীচে নামবার সময়ে বা প্লেনে এয়ার-পকেটে পড়লে যেমন লাগে তেমনি হঠাৎ শূন্যতা অনুভব করল রানা পাকস্থলীর মধ্যে। এই সেই নিষিদ্ধ এলাকা। বায়ে মোড় নিল গাড়ি।

প্রাচীরের বাইরে দুশো গজ জায়গা ছেড়ে কাটাতার দিয়ে সমস্ত এলাকাটা ঘেরা। হাই ভোল্টের ইলেকট্রিক কারেন্ট দিয়ে সেই বেড়াকে দুর্ভেদ্য করা হয়েছে। এ ছাড়াও কাঁটাতারের বাইরে প্রতি বিশ গজ অন্তর অন্তর রাইফেল হাতে প্রহরী দাঁড়ানো। ভিতরে ঢোকার একটাই মাত্র পথ। একটা সাদা-কালো। রঙ করা কাঠের দণ্ড দিয়ে আটকানো রয়েছে পথ। এটা চেক পোস্ট। দুই পাশে সেন্ট্রির ঘর। দুইজন প্রহরী গেটের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্টেনগান হাতে। মোটা দণ্ডের মাঝ বরাবর ঝোলানো একটা বড় সাইনবোর্ডে লেখা:

PROHIBITED AREA
No Entry Without Pass

সাঁ করে এসে গেটের সামনে থামল গাড়ি। ফ্ল্যাগ এবং নাম্বার প্লেট দেখে স্যালিউট ঠুকল দুই প্রহরী। রেল গেটের মত উঠে গেল পোস্টের এক মাথা ওপর দিকে। ঢুকে পড়ল গাড়ি সীমানার মধ্যে। শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গিয়েছিল। রানার, আবার হেলান দিয়ে বসল।

খোয়া বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে গেল হিন্দুস্থান অ্যামব্যাসাডার। প্রায় দুশো গজ অন্ধকার পথ। তারপর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আসল এলাকা। স্টেইনলেস স্টিলের শিট লাগানো লোহার গেট ভিতর থেকে বন্ধ। কলিং বেল টিপলে ছোট একটা ফোকর সৃষ্টি হবে স্টিল শিটে, সেখানে উদয় হবে প্রহরীর মুখ। দুই ধারের প্রহরী কক্ষের ফুটো থেকে চারটে মেশিনগান তৈরি থাকবে, যাতে কোনও অবস্থাতেই কেউ বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। এই গেটে মন্ত্রী হোক বা লাট সাহেব হোক, ছাড়পত্র দেখাতে হবে। উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে হবে এবং উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে আগে থেকে কোনও সংবাদ না দিয়ে হঠাৎ আগমনের। টেলিফোনে জয়দ্রথের অনুমতি আসবে। তারপর খুললেও খুলতে পারে সুরক্ষিত প্রকাণ্ড গেট!

‘হেড-লাইট নিভিয়ে দাও, মিত্রা। গজ পঞ্চাশেক থাকতে বলল রানা। এবার ডান দিকে মাঠের মধ্য দিয়ে নিয়ে চলো গাড়ি।

লাইট নিভিয়ে দিতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পেছন ফিরে দেখল রানা কেউ লক্ষ্য করছে কি না। না। সেন্ট্রি দুজন পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। আছে ওদের দিকে পিছন ফিরে। ডান দিকের মাঠে নেমে গেল গাড়ি। ঠিকমত গ্রিজ দেওয়া নেই, তাই ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট সাসপেনশন থেকে স্বাধীনভাবে নানান স্কেলে ক্যাঁচকুঁচ শব্দ উঠল অসমান জায়গায় চাকা পড়ায়।

একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাশে দেয়াল ঘেঁষে থামল মিত্রা। ব্যাগটা আগেই ঝুলিয়ে নিয়েছিল কাঁধে, এবার একলাফে নেমে গেল রানা গাড়ি থেকে। মিত্রাও নামল। বিশফুট উঁচু দেয়াল। এ্যাপলিং-হুঁক লাগানো দড়িটা ছুঁড়ে দিল রানা দেয়ালের মাথায়। খটাং শব্দ করে আটকে গেল সেটা।

কাল ঠিক আটটার সময় আবার আসব আমি এখানে। দড়ি ফেলব। ওধারে। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করব। যদি বেঁচে থাকো তবে এই জায়গাটায় ফিরে এসো কাজ শেষ হয়ে গেলে।

‘সেটা ঠিক হবে না, মিত্রা। আমি অন্য কোনও পথ বের করে নেব। তুমি আর এসো না।’

‘আমি আসব। গরজ আমার নিজের-আমার ভাবী সন্তানের। তুমি বারণ কোরো না, রানা।’

‘বেশ, এসো। আর এখন ফেরার পথে ওই গেটটায় কলিং বেল টিপে তোমার মামা এখানে এসেছিলেন কি না জিজ্ঞেস করে যেয়ো। তা হলে হঠাৎ আর এখানে আসার ব্যাপারে সন্দেহ করবে না কেউ। কাল আবার আসার পথও পরিষ্কার থাকবে।

শেষ চুম্বন দিয়ে তরতর করে রশি বেয়ে উঠে গেল মাসুদ রানা। দেয়ালের ওপর উঠে মুক্ত বাতাস লাগল ওর চোখে মুখে। একটা আলো এগিয়ে আসছিল ডান ধার থেকে। সার্চ লাইট। দেয়ালের ওপর দেহটা সাটিয়ে পড়ে থাকল রানা। পার হয়ে চলে গেল তীব্র আলোটা। সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল রানা ভিতরের দিকে। এখানে-ওখানে বাতি দেখা যাচ্ছে, কাকর বিছানো রাস্তাটা গেট দিয়ে সোজা ঢুকে কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে ঘুরেছে। এদিকটা অন্ধকার। নীচে কী আছে বোঝা গেল না ঠিক। বেশ অনেকটা দূরে পাকা দালান দেখা যাচ্ছে। রশিটা ভিতর দিকে এনে হুকটা উল্টো করে বসাল রানা। তারপর নেমে গেল ভিতরে।

শক্ত মাটিতে পা ঠেকতেই রশিটা ছুঁড়ে ওপারে পাঠিয়ে দিল রানা। আধ। মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে শুনল সে। দূরে চলে গেল গাড়ির মৃদু গুঞ্জন।

আবার একবার পাকস্থলীর মধ্যে সেই বিচিত্র অনুভূতি হলো। তা হলে সত্যিই ঢুকল ও জয়দ্রথের নিষিদ্ধ এলাকায়! সামনে পুরো একটা রাত। এর মধ্যেই সব দেখে-শুনে নিতে হবে। উঁচু টাওয়ার থেকে সার্চ লাইটের আলোটা সমস্ত এলাকা পরিক্রমণ করে আবার আসছে ফিরে। দেয়াল থেকে হাত দশেকের মধ্যেই একটা গাছ। ছুটে সেই গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল রানা। পার হয়ে গেল তীব্র আলো।

ব্যাগ থেকে বিনকিউলারটা বের করল রানা। আমেরিকার উইভার কোম্পানির তৈরি। জার্মানীর আবিস্কৃত স্নাইপারস্কোপের মত ইনফ্রারেড লেন্স লাগানো আছে এতে। রাতের অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখা যায় এই দুরবিন দিয়ে। চোখে লাগাতেই ধীরে ধীরে কালো অন্ধকার ফিকে হয়ে গেল। ফোকাসিং নবটা ঘুরিয়ে আরও পরিষ্কার করে নিল রানা দূরের গাঢ় অন্ধকারকে। চারদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে।

বাম দিকে গেটের দুই ধারে সেন্ট্রিরুমে আলো জ্বলছে। কোনওরকম অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য দেখা গেল না সেখানে। বোধহয় বিনা বাধায় বেরিয়ে যেতে পেরেছে মিত্রা।

কোথাও লুকাবার জায়গা দেখতে পেল না রানা। ডানদিকে দুই দেয়ালের কোণে একটা সেণ্টিঘর-গজ পঞ্চাশেক দূরেই। গেটের কাছে থরে থরে সাজানো মস্ত আকারের অসংখ্য চারকোণা বাক্সমত কী যেন দেখল রানা। সোজাসুজি তাকালেও সেই রকম কী যেন দেখা যাচ্ছে বহুদূরে। আশপাশে কোনও লোকজন দেখতে পেল না ও। এখানে-ওখানে অনেকগুলো গাছ আছে এলাকার মধ্যে কিন্তু একটা গাছেও পাতা নেই। ন্যাড়া ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে ছোট বড় হরেক রকমের গাছ। কদাকার লাগছে ওগুলোকে দেখতে।

হাঁটতে আরম্ভ করল রানা সোজা। পুরো এলাকা সম্পর্কে একটা ধারণা দরকার প্রথমেই। সোজা আধমাইল মত পশ্চিমে হেঁটে আবার একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল রানা। বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে দেখল প্রকাণ্ড একটা পাকা একতলা দালান দেখা যাচ্ছে। প্রায় সিকি মাইল মত লম্বা হবে। চওড়া কতটা তা বোঝা গেল না যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকে। ওখানেই আসল। ব্যাপার চলছে বুঝতে পেরে সেদিকেই এগোল রানা। আলোকজ্জ্বল রাস্তাটা এক লাফে পার হয়ে এল। আশা করল কেউ দেখতে পায়নি। পুকুর ধার দিয়ে এসে দাঁড়াল সেই প্রকাণ্ড ঘরের পাশে। জায়গায় জায়গায় কাঁচ বসানো। শো-রুমের মত। ভিতরটা অন্ধকার। বিনকিউলার চোখে তুলে দেখল রানা গোটা ঘর ফাঁকা। মেঝেটা বালির। যতদূর দেখা যায় কেবল বালি আর বালি। আর কিছু নেই ঘরের ভিতর। প্রায় দেড় শ গজ চওড়া ঘরটা।

কিছুই বুঝতে না পেরে রানা ভাবল, দেখা যাক ওপাশে কী আছে। এমন সময় চোখে পড়ল দু’জন সেন্ট্রি এগোচ্ছে এদিকে। চট করে আড়ালে সরে গেল। রানা। ব্যাপার কী! দেখে ফেলেছে নাকি ওরা ওকে?

দেড় শ গজ পার হয়ে রানা দেখল হাত চারেক জায়গা ছেড়ে একই আকারের আরেকটা ঘর ওপাশে। এই ঘরটায় উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। কাঁচ দিয়ে দেখা গেল এ ঘরেও বালির মেঝে। কাঁচটা গরম। ভেতরটায় হিটার বসানো। নাকি? হঠাৎ রানার চোখে পড়ল, অসংখ্য ছোট ছোট পোকা তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে বালির ওপর। প্রকাণ্ড ঘরটায় একটি জন-প্রাণীর চিহ্ন নেই। ভূতুড়ে কারবার নাকি?

এই ঘরটাও পার হয়ে গেল রানা পেছন দিক থেকে। আরেকটা ঘর। এ ঘরটা প্রথম ঘরের মত অন্ধকার। কাঁচে হাত লাগতেই রানা বুঝল ঘরটা অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা। ভিতরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার বিনকিউলার তুলল রানা চোখে। ভিতরে চেয়েই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল ওর। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পঙ্গপালে ছেয়ে আছে সারাটা ঘর। নড়াচড়া করছে না কেউ-এখন। ওদের গভীর রাত। উত্তেজিত হয়ে উঠল রানা। সর্বনাশ! তা হলে তো ডক্টর। আলী আকবরের কথাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে! আর্টিফিশিয়াল উপায়ে ল্যাবরেটরিতে ব্রিড করছে এরা অসংখ্য পঙ্গপাল! ঘরের ভিতর মরুভূমির আবহাওয়া তৈরি করেছে এয়ারকুলার ও হিটার ব্যবহার করে।

চতুর্থ ঘরটায় দ্বিতীয় ঘরের মত উজ্জ্বল আলো। কাঁচে চোখ রেখেই শিউরে উঠল রানা। বালি দেখা যাচ্ছে না। মাটি থেকে চার ফুট উঁচু হয়ে সারা ঘরময় বিছিয়ে রয়েছে পঙ্গপাল। একটার ওপর আরেকটা, তার ওপর আরেকটা চড়ে। এগুলো আকারে বড়-পূর্ণ অ্যাডাল্ট। একটার গায়ে লেগে আছে আরেকটা। ডক্টর আকবরের ভাষায় ফেজ গ্রিগেরিয়া, লম্বা পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে একে অন্যকে। মারামারি চলছে নিজেদের মধ্যে। সবচাইতে নীচে যেগুলো আছে। তাদের কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এল রানার। গা-টা শিউরে উঠল তার আপনাআপনি কয়েকবার এত পোকা দেখে। সিকি মাইল লম্বা, দেড় শ গজ চওড়া, চারফুট উঁচু। শুধু পঙ্গপাল আর পঙ্গপাল!

আবার এগোল। আরও একটা ঘর দেখা গেল একই আকারের। কিন্তু এর মধ্যে হরেক রকম যন্ত্রপাতি আর মানুষ দেখা গেল। বাতি জ্বলছে এই ঘরটায়। দুই পা পিছিয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল রানা। বুঝল এটাই আসল ল্যাবরেটরি।

ঘরের মধ্যে পনেরো ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিশিষ্ট একটা তারের জাল ঘেরা খাঁচার ভিতর ঠাসাঠাসি করে ভরা পঙ্গপাল। মাটিতে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে একটা ন্যাড়া গাছের আড়ালে উঠে দাঁড়াল রানা। পঙ্গপাল ভর্তি খাঁচাটার পঁচিশ গজ দূরে আরেকটা সেই সমান খালি খাঁচার মুখ খোলা। একজন পুরু কালো। ফ্রেমের চশমা পরা লোক সেই খাঁচার পিছনে কী একটা জিনিস ডান হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ধুতিটা উড়ছে জোর বাতাসে। রানা বুঝল প্রবল বাতাস বইছে পঙ্গপাল ভরা খাঁচাটার দিকে। ধুতি পরা লোকটা বাম হাতে ইশারা করতেই পঙ্গপালের খাঁচার মুখ খুলে গেল। হুড়মুড় করে বেরুতে থাকল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল। বাতাসের প্রতিকূলে উড়ে তিন মিনিটের মধ্যে সব গিয়ে ঢুকল খালি খাঁচাটার মধ্যে। মুখ বন্ধ হয়ে গেল সে খাঁচার। রানা ভাবল, নিশ্চয়ই মোলাসেস সেন্ট।

বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে পোকাগুলোকে। এই সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে দিনরাত নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে শ’ পাঁচেক একনিষ্ঠ লোক পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বনাশ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। এদের দূরদর্শী পরিকল্পনার নিষ্ঠুর ভয়াবহতা চিন্তা করে রানার নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হলো এদের বুদ্ধি এবং শক্তির তুলনায়। ঠাণ্ডা মাথায় এরা কতখানি ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক বিদ্বেষপূর্ণ কাজে লিপ্ত হতে পারে, ভাবতে গিয়ে এদের প্রতি একটা প্রবল ঘৃণা অনুভব করল সে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে এরা নিজেদের হিংস্রতা চরিতার্থ করবার জন্যে।

বিভিন্ন রকম কাজ চলছে এই ল্যাবরেটরিতে। নানান রকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির একাংশ দেখতে পেল রানা। চট করে পঞ্চম ঘরটার দেয়ালের সাথে। সেটে গেল ও হঠাৎ। একটা পায়ের শব্দ শোনা গেল না? এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝল, মনের ভুল। আরও কী আছে সব দেখতে হবে। আঁধারের মধ্যে দিয়ে দ্রুত হেঁটে দেড়শ’ গজ প্রস্থ পার হয়ে এল রানা। নাহ। আর ঘর নেই। পঞ্চমটাই শেষ। একটা উঁচু বালির ঢিপি। দূরে কয়েকটা সুদৃশ্য বাংলো। শক্তিশালী জেনারেটর চলছে কাছেই-পাশে পানি-ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য ফোয়ারা। তারপরই চোখ পড়ল রানার খাঁচাগুলোর ওপর। শত শত ১৫x১৫X১৫ ফুট খাঁচা সাজিয়ে রাখা আছে পঞ্চম ঘরটার গা ঘেঁষে লম্বালম্বি ভাবে। প্রত্যেকটা খাঁচায় ঠাসাঠাসি করে ভরা একগাদা পঙ্গপাল।

রানা ভাবল, ডক্টর আলী আকবরের দেয়া ম্যাটারিজিয়াম সলিউশনটা এখনই ছড়াতে আরম্ভ করে দেবে, না আগে সবটা এলাকা দেখে নেবে? গোটা পশ্চিম দিকটা বাকি রয়ে গেছে। আগে সবটা দেখে নেয়াই ভাল। রাত আরেকটু হোক। হাতঘড়ির দিকে চাইল রানা। সাড়ে দশটা বাজে। দু’ঘণ্টা পার হয়ে। গেছে কখন টেরই পায়নি ও। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল ওর খুব। কিন্তু উপায় নেই এখন।

হঠাৎ মাথার ওপর ঘর ঘর শব্দ শুনে চমকে উঠল রানা। ওভারহেড ক্রেন। আড়ালে সরে দাঁড়াল সে। লোহার তারের মাথায় লাগানো হুক নেমে এসে একটা খাঁচা শূন্যে তুলে নিল। রানাকে দেখতে পায়নি ক্রেন চালক। আলো পড়তেই রানা দেখল খাঁচার ওপর একটা টিনের পাতে ইংরেজিতে লেখা যশোহর। তা হলে এই খাঁচা চলল যশোর বর্ডারে। ক্রেনটা চলে যেতেই বিনকিউলার চোখে তুলল রানা। দেখল যতগুলো দেখা যায় সবগুলোর উপরই লেখা আছে যশোহর। সবশেষের খাঁচাটা একটু বাঁকা হয়েছিল-সেটাতেও পড়ল। রানা, যশোহর।

তা হলে! প্রত্যেকটা জেলার জন্যে এতগুলো করে পঙ্গপাল যাচ্ছে। অন্যান্য জেলার খাঁচা কি গন্তব্যস্থলে রওনা হয়েছে? ওভার-হেড ক্রেনটাকে অনুসরণ করবে ভেবে এক পা এগিয়েছে, অমনি পিছন থেকে আওয়াজ এল, ‘খবরদার! মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।’

ঘুরে দাঁড়িয়েই গুলি করল রানা। সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল থেকে আওয়াজ হলো, দুপ! ছিটকে লোকটার হাতের সাব-মেশিনগানটা পড়ে গেল মাটিতে। তারই ওপর আছড়ে পড়ল লোকটা। রানা বুঝল, একটু আগে দেখা দুজন প্রহরীর একজন হবে। দেখে ফেলেছিল ওকে নিশ্চয়ই। সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দ্বিতীয়জন।

‘পাকাড় লিয়া? জিজ্ঞেস করল সে।

হাঁ, রানা উত্তর দিল।

কিন্তু গলার স্বরেই চিনে ফেলল সে, তা ছাড়া পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে রানার হাতে সাব-মেশিনগানটা নেই। মুহূর্ত মাত্র সময় না দিয়ে দ্বিতীয়বার গুলি করল রানা। এই লোকটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে, টু শব্দটি না করে। নিজের শার্ট প্যান্টের ওপর প্রথমে প্রহরীর কাপড়চোপড় পরে নিল রানা। তারপর দুটো মৃতদেহ আর একটা সাব-মেশিনগান বালি চাপা দিয়ে দিল। ততক্ষণে আরও একটা খাঁচা তুলে নিতে ফিরে এল ওভার-হেড ক্রেন। চুপচাপ মাটিতে পড়ে রইল ও।

ওটা চলে যেতেই দ্রুত কাজ সারার তাগিদ অনুভব করল রানা। এই দুজন প্রহরীর অনুপস্থিতি টের পেতে বেশি সময় লাগবে না এদের। তার মধ্যেই চেষ্টা করতে হবে এখান থেকে বেরোবার। ব্যাগ থেকে প্রেগান ফিট করা সলিউশনের কৌটো বের করে পকেটে রাখল রানা। তারপর সাব-মেশিনগানটা তুলে নিল হাতে। ইছাপুর গান অ্যাণ্ড শেল ফ্যাক্টরির তৈরি পয়েন্ট থ্রী-এইট ক্যালিবারের গান। বিশ রাউণ্ডের ম্যাগাজিন। চমৎকার হালকা যন্ত্রটা।

খাঁচাগুলোর পাশ দিয়ে খোয়া বিছানো রাস্তায় গিয়ে উঠল রানা। তারপর এগোল ক্রেনটা যেদিকে গেছে সেদিকে আলোকিত রাস্তার ওপর দিয়ে বুক ফুলিয়ে। কিছুদূর পেছনে একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ পেল সে। হেডলাইট জ্বলে উঠল। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করল রানার-কিন্তু পালাতে গেলেই সন্দেহ হবে। টিপ টিপ করে জোর হার্টবিট আরম্ভ হয়ে গেল রানার। পিছন ফিরে চাইল না ও। পাশ কাটিয়ে চলে গেল জিপ। কোনও রকম সন্দেহ করেনি ওকে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন।

রাস্তা দিয়ে চলতে বাম দিকে চেয়ে দেখল রানা হাজার হাজার খাঁচা ভর্তি পঙ্গপাল থরে থরে সাজানো। সিলেট-কুমিল্লা-চিটাগাং লেখা খাঁচাও দেখল রানা। কী বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র, ভাবতেই বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে ওর। দেখল, ওভার-হেড ক্রেনটা তখন ফিরছে গেটের কাছ থেকে। ওদিকেও আছে নাকি? ডান দিকে মোড় ঘুরল রানা। গেটের কাছেই রাস্তার দুইপাশে অসংখ্য খাঁচা জমা করা। প্রথমে এখানে ঢুকে রানা ওগুলোকে বাক্স মনে করেছিল!

পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রে-গানটা বের করে প্রত্যেকটা খাঁচায় একটু করে সলিউশন স্প্রে করল রানা। ওষুধের নামটা জানে সে, কিন্তু কেন পঙ্গপালের কারবার দেখলে এটা ছড়াতে বলেছেন ডক্টর আকবর তা জানে না রানা। ভদ্রলোকের ব্যস্ততার কারণে সেটা আর জানা হয়নি। রানা ভেবেছিল ছড়ালেই বুঝি মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে এই কোটি কোটি পঙ্গপাল। কিন্তু কই, কিছুই তো হলো না। দেখার মত কিছু ঘটল না। নিরাশ হলো ও। নষ্ট হয়ে যায়নি তো ওষুধ?

দৃঢ় পদক্ষেপে ফিরে এল ও রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকের খাঁচার সামনে। পথে মোড়ের ওপর সেন্ট্রি পোস্টটা খালি দেখে বুঝতে পারল এই চেক পোস্ট থেকে দুজন প্রহরী ওকে অনুসরণ করেছিল। আলোকিত রাস্তাটা পার হবার সময় হয়তো রানাকে দেখে ফেলেছিল ওরা।

বেশ অনেকক্ষণ সময় লাগল পশ্চিম দিকের খাঁচাগুলোয় স্প্রে করতে। তারপর এগিয়ে গিয়ে আবার সেই প্রথম ঘরটার সামনে দাঁড়াল রানা। দরজা তালা বন্ধ। এদিক দিয়ে চেষ্টা করে লাভ নেই। পাশাপাশি দুই ঘরের মাঝখান দিয়ে এগোল সে। পনেরো গজ গিয়েই কাঁচের জানালা পেল। মেশিনগানের মাথা দিয়ে এক ঘায়ে খানিকটা কাঁচ ভেঙে ফেলল সে। অল্প খানিকটা সলিউশন স্প্রে করে দ্বিতীয় ঘরটায়ও তাই করল। তারপর বেরিয়ে এল রাস্তায়; আবার ঢুকল তৃতীয় এবং চতুর্থ ঘরের মাঝের রাস্তা দিয়ে, সেখানে কাজ সারল; কিন্তু পঞ্চম ঘরটায় কিছুই করতে পারল না সে। পূর্ণোদ্যমে কাজ চলেছে সেখানে। যশোহর লেখা খাঁচার গোটা পনেরোতে দেয়ার পরই শেষ হয়ে গেল সলিউশন। রানার কাজও শেষ। আর কিছুই করার নেই ওর। ফেলে দিল স্প্রে-গানটা ড্রেনের মধ্যে।

করবার নেই কেন? ঊরুতে বাঁধা চামড়ার খাপের ভিতর থেকে ছুরি বের করে এক বর্গ ফুট আন্দাজ কাটতে আরম্ভ করল ও তারের জাল। রাতের বেলা ওরা কিছুই টের পাবে না। এরাও বেশ চুপচাপ বসে থাকবে খাঁচার মধ্যে। ডক্টর আলী আকবরের কথাটা মনে পড়ল। রাত হলো কি কাত হলো। রাতে নড়াচড়া করবে না ওরা, কিন্তু সকাল হলেই ফুরফুর করে সব বেরোবে খাঁচা থেকে। পশ্চিমবাংলার ওপর দিয়ে এগোবে ওরা সমস্ত সবুজ মুছে দিতে দিতে। একটা অদ্ভুত আনন্দ শিহরণ অনুভব করল রানা। শত্রুর অস্ত্র তাদেরই বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবার মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি আছে।

গোটা পাঁচেক খাঁচা আর কাটতে পারল না রানা। খটাং করে দরজা খুলে গেল ল্যাবরেটরির। এক ঝলক আলো এসে পড়ল খাঁচাগুলোর ওপর। একটা খাঁচার আড়ালে সরে গিয়ে রানা দেখল চারজন লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। চলে গেল তারা হিন্দীতে কথা বলতে বলতে মাঠের মধ্য দিয়ে বাংলোগুলোর দিকে। খোলাই থাকল দরজাটা। আলোর মধ্যে আর কাজ করা সম্ভব নয়, ছুরিটা যথাস্থানে খুঁজে রেখে সাব-মেশিনগানটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল ও রাস্তায়। পঞ্চম ঘরের বৈজ্ঞানিকরা শিশি-বোতল-টেস্ট-টিউব আর নানান রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্তই থাকল। হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের সেই খালি চেক পোস্টের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। ক্রিংক্রিং করে ফোন বাজছে। রিসিভার তুলে নিল। কানে। একদমে অনেকক্ষণ বকাবকি করল কোনও উপরওয়ালা।

যতসব গেঁয়ো চাষাভুষো নিয়ে পড়েছি আমি। এতক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে, কানের মধ্যে কি তুলো খুঁজে রেখেছ, না ডিউটি ফেলে ঘুমোচ্ছিলে?’ বকুনি থামল একটু।

‘কাছেই পেচ্ছাব করতে গিয়েছিলাম। রানা উত্তর দিল।

‘আর তোমার সঙ্গের ভূতটা?

‘ওকে দেব টেলিফোন?

না। আমি জিজ্ঞেস করছি দুজনে কি একসঙ্গে গেছিলে জল তৈরি করতে? তোমাদের নামে আমি রিপোর্ট করব, তা জানো? এক্ষুণি অ্যালার্ম সাইরেন। বাজাতে যাচ্ছিলাম।

‘সরি, স্যর। উত্তর দিল রানা।

‘স্যর? স্যর বলছ কেন!

লোকটার কণ্ঠে সন্দেহ ফুটে উঠল। রানা বুঝল স্যর বলা উচিত হয়নি।

‘ভুল হয়ে গেছে।’

‘তোমার নম্বর কত? পরিষ্কার সোজা প্রশ্ন।

‘সেভেন্টি-নাইন, সিপি। কাঁধের ওপর পিতলের নম্বর দেখে বলল রানা।

খসখস করে কাগজপত্র ঘাঁটার আওয়াজ এল মৃদু। চেক করল বোধহয় অফিসার ডিউটি-রুটিন। একটু থেমে আবার বলল, তৈরি থেকো, এরিয়ার মধ্যে লোক ঢুকেছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। সজাগ দৃষ্টি রাখবে চারদিকে।’ রিসিভার ছেড়ে দিল অফিসার।

রাত তখন দেড়টা।

ব্যাগ থেকে কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ বের করে খেয়ে নিল রানা উইস্কি দিয়ে গিলে। তারপর সিগারেট ধরাল একটা। তৃপ্তির সঙ্গে কয়েকটা টান দিয়ে ভাবল ব্যাটারা টের পেল কী করে? নাকি এই টেলিফোনের কথোপকথনেই বুঝে ফেলেছে?

এই চেক পোস্টটা ত্যাগ করা উচিত। এইভাবে বেশিক্ষণ আর আত্ম গোপন করে থাকতে পারবে না সে। মিত্রা যদি আসে তো সেই আগামীকাল রাত আটটায়। কিন্তু এখন যত শিগগির সম্ভব এই এলাকা ছেড়ে বেরোনো দরকার। অন্যভাবে বেরোবার চেষ্টা করে দেখতে হবে।

ঠিক এমনি সময়ে কাঠের চেক-পোস্টের বাইরে মৃদু একটা খস খস আওয়াজ পেল রানা। মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল ওর কান। এত আলো কেন? বুঝল, দেরি হয়ে গেছে অনেক। একটা সার্চ লাইট স্থির হয়ে আছে এই সেন্ট্রিপোস্টের ওপর। সাব-মেশিনগানের ওপর হাত পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বেজে উঠল আবার। রিসিভারটা কানে তুলে শুনল রানা, পরিষ্কার বাংলায় একজন বলছে, আমি জয়দ্রথ মৈত্র বলছি। বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই, মি, মাসুদ রানা। বিশটা মেশিনগান ধরা আছে আপনার দিকে। কথা না শুনলে এক সেকেণ্ডে শেষ হয়ে যাবেন।

কথাটা বিশ্বাস করল রানা। কণ্ঠস্বরটাও চিনতে পারল অক্লেশে।

‘মেশিনগান আর পিস্তলটা ডেস্কের ওপর রেখে দয়া করে খালিহাতে বেরিয়ে আসুন বাইরে ভদ্রলোকের মত।

চিন্তা করছে রানা। তা হলে ধরা পড়ল ও! ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে ভাল করেই জানা আছে রানার। এখনই বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করবে, না অপেক্ষা করবে সুযোগের? জামার বোতামটা ছিঁড়ে খেয়ে নেবে?

সার্চ লাইটটা সরে গিয়ে অন্ধকার মাঠের ওপর ঘুরে এল একবার। সেই। আলোয় রানা দেখল বিশজন সৈন্য মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে চেয়ে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে সাব-মেশিনগান। রানা স্থির করল, কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরবে না, অপেক্ষা করবে ও সুযোগের।

‘অলরাইট, বাস্টার্ড!’ বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা।

‘বেরিয়ে এসো, বাপ। সময় নষ্ট করে লাভ আচে কিচু?

খুব কাছেই পেছন থেকে মোলায়েম কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বেপরোয়া রানা বেরিয়ে এল বাইরে। খপ করে দুপাশ থেকে দুজন ধরল রানার হাত। তৃতীয়জন এবার পিছন থেকে এসে পিস্তলটা বের করে নিল রানার ওয়েস্ট-ব্যাণ্ড থেকে। অন্ধকার থেকে এগিয়ে এল মেশিনগান-ধারীর দল। ইতিমধ্যে রানার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাধা হয়ে গেছে। দড়াম করে এক লাথি মারল আর্মি লেফটেন্যান্ট রানার পেছন দিকে। দুই পা সামনে এগিয়ে গেল রানা সেই ধাক্কায়।

একটা সুদৃশ্য বাংলোর সামনে নিয়ে যাওয়া হলো রানাকে।

‘আসুন, আসুন! আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, মি. মাসুদ রানা! জানতাম আপনি বাঘের বাচ্চা-পালিয়ে যাবার লোক নন। কলকাতায় পেলাম না, কিন্তু জানতাম এখানে আপনার দেখা পাবই।’ হলুদ বীভৎস চোখ মেলে রানার দিকে চেয়ে রয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র। ওর মুখে এই প্রথম হাসি দেখল রানা। হাসতে গিয়ে টান লাগতেই জিভ দিয়ে মুখের দুই কোণের ঘা ভিজিয়ে নিল লোকটা। কেশ-বিহীন প্রকাণ্ড মাথাটার তিন ফুট উঁচুতে উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। আলোটা চকচকে মাথায় প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে রানার।

কিন্তু আশা করেছিলাম বাইরেই ধরা পড়বেন-ভেতরে ঢোকার আগেই।

পেছন ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করল জয়দ্রথ মৈত্র। পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই পিছনে রয়ে গেল। ওয়েটিংরুমের মধ্য দিয়ে একটা বিরাট কনফারেন্স হলে নিয়ে যাওয়া হলো রানাকে। প্রকাণ্ড একটা পাক-ভারতের ম্যাপ ঝুলছে একধারের পুরোটা দেয়াল জুড়ে। মোটা লোহার শিক দিয়ে ঘেরা ঘরের একটা অংশ। চাবি দিয়ে গেটটা খুলে দিল জয়দ্রথ মৈত্র। দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে ভাল করে সার্চ করা হলো রানার সারা দেহ। উরুতে বাধা খাপ থেকে ছোরাটা বের করে নেয়া হলো।

‘পিস্তলটা কোথায়?

‘এই যে, রানার ওয়ালথার এগিয়ে দিল লেফটেন্যান্ট।

সাইলেন্সর খুলে ফেলল জয়দ্রথ মৈত্র। স্লাইড টেনে ছটা গুলি বের করে ফেলল মাটিতে। ব্যারেলের গোড়ায় চেম্বারের কাছে বুড়ো আঙুলের নখ রেখে পরীক্ষা করে দেখল গুলি ছোঁড়া হয়েছে কি না। নলের ভিতরে পাউডারের দাগ দেখে মাথা নাড়ল সে।

‘লাশ দুটো কোথায়? দপ করে জ্বলে উঠল জয়দ্রথের চোখ।

লেফটেন্যান্ট তখন নিচু হয়ে মাটি থেকে গুলিগুলো তুলছিল। রানা দেখল এই সুযোগ। রেঞ্জের মধ্যে আসতেই হঠাৎ প্রাণপণে ঝেড়ে এক লাথি লাগাল ওর চিবুকের নীচের নরম মাংস লক্ষ্য করে। এমন ঘটনার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। স্টিলের ডোল বসানো জুতো সোজা গিয়ে লাগল লক্ষ্যস্থলে। একটা বিকট আওয়াজ করে দুই হাত শূন্যে তুলে চিত হয়ে পড়ল লোকটা মেঝেতে। খুঁটে তোলা গুলিগুলো ছিটকে গেল চারদিকে। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে। বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। শিরা ছিঁড়ে গেছে। আধ মিনিট ছটফট করে জয়দ্রথের চোখের সামনে স্থির হয়ে গেল দেহটা।

লাল হয়ে গেল জয়দ্রথের ফর্সা মুখ। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল। সে। এবার এক ঝটকায় হতভম্ব প্রহরীদের কাছ থেকে ছুটে এল রানা। হাত দুটো তেমনি পেছনে বাঁধা। এক লাফে জয়দ্রথের কাছে চলে এল সে। তলপেট লক্ষ্য করে প্রচণ্ড একটা লাথি চালাল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জয়দ্রথ। চট করে এক পা পিছিয়ে ধরে ফেলল রানার পা।

রানার কানে গেল, পিছনের কাউকে জয়দ্রথ বলল, ‘খবরদার, গুলি করো না!’ তারপরই ধাই করে একটা রাইফেলের বাট এসে পড়ল ওর মাথার উপর। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মাসুদ রানা।

ঠিক সেই সময় পাশের একটা দরজা দিয়ে স্লিপিং গাউন পরিহিতা স্যালি ডেভন ঢুকল এসে ঘরে। এক মুহূর্ত অবাক হয়ে রানাকে দেখল সে।

‘এখন যাও, স্যালি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি আমি।

বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল স্যালি পাশের ঘরে। শক্ত করে রানার পা বেঁধে ফেলা হলো। জয়দ্রথের ইঙ্গিতে লেফটেন্যান্টের মৃতদেহ উঠিয়ে নিয়ে গেল দুইজনে। বাকি দুজন রানার পা ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এল জ্ঞানহীন দেহটা লোহার গরাদ দেয়া হাজত ঘরটার মধ্যে। তালা লাগিয়ে দিল জয়দ্রথ লোহার। গেটে। হাতের ইঙ্গিতে ওদের চলে যেতে বলে টেবিলের ওপর কয়েকটা কাগজ ঘটল কিছুক্ষণ। একটা টেলিফোন করল কোথাও। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে।

ঘণ্টাখানেক পর জ্ঞান ফিরে পেল রানা। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। চোখ মেলে দেখল চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কোথায় আছে বুঝতে পারল না ও। পিঠের তলায় হাতটা বেকায়দায় পড়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেহ কাত করে চাপ মুক্ত করল রানা শক্ত করে বাঁধা হাত দুটো। আবার রক্ত চলাচল শুরু হওয়ায় ঝিঁঝি ধরে গেল ডান হাতে। বিকারগ্রস্তের মত অনেক আজেবাজে চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকল ওর মাথার মধ্যে। একই কথা বারবার ফিরে আসে-চেষ্টা করেও তাড়াতে পারে না রানা। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ও।

অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল রানার। চোখ বন্ধ করেই শুনল পাশের ঘরে খবর। হচ্ছে রেডিয়োতে। হঠাৎ ভয়ঙ্কর রকম চমকে উঠল রানা। মুহূর্তে ঘুমের রেশ কেটে গেল তার। যুদ্ধ! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে ভরসা হলো না।

‘এ খবর প্রচারিত হচ্ছে রেডিয়ো পাকিস্তান থেকে। আজ ভোর সাড়ে তিনটায় লাহোরের আটারি-ওয়াগা ও বার্কি সেক্টরে কোনও রকম যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকেই সাম্রাজ্যবাদী ভারতের হীন আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। অতর্কিত আক্রমণ করে ভারতীয় সৈন্য লাহোর সেক্টরে পাকিস্তানের মূল ভূ-খণ্ডের তিন মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান স্থল বাহিনীর বীর জোয়ানরা বিপুল বিক্রমে শত্রু সৈন্যকে প্রতিহত করছেন। এই মাত্র খবর পাওয়া গেছে–ভারতীয় বিমান বাহিনী ওয়াজিরাবাদে দণ্ডায়মান একটি যাত্রীবাহী রেলগাড়ির ওপর বোমা বর্ষণ করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত রাখা হয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে আজ প্রেসিডেন্ট যে জরুরী বেতার ভাষণ দান করেছেন তার বাংলা তর্জমা প্রচার করা হবে পূর্ব পাকিস্তান সময় বিকেল চারটায়।

ব্যাপার কী? যুদ্ধ লেগে গেল? লাহোর আক্রমণ করেছে হিন্দুস্থান!

খবরের বিশেষ বিশেষ অংশগুলো আবার পড়ে শোনানো হলো। মন দিয়ে শুনল রানা। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান বিমান বাহিনী আটটি ভারতীয় বিমান ধ্বংস। করে দিয়েছে; স্থল বাহিনীর গুলিতে ভূপাতিত হয়েছে আরও তিনটি! খবরের পরই ভেসে এল রানার প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর বলিষ্ঠ কণ্ঠ:

রক্তে লিখেছি জন্মভূমির নাম…

সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল রানার। স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনীর বন্ধু বান্ধবদের ছবি ফুটে উঠল ওর চোখের সামনে। সমগ্র পাকিস্তানে আজ যুদ্ধ চাঞ্চল্য আর ও কিনা পড়ে রয়েছে নিরুপায় বন্দি অবস্থায়।

এমনি সময় জয়দ্রথ এসে ঢুকল ঘরে। একটা সরু দড়ি ধরে টান দিতেই সারা ঘরে উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠল।

‘ঘুম ভেঙেছে তা হলে? খবরটা শুনলেন? অবাক লাগছে না?

পরম পরিতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল জয়দ্রথের মুখে। টেবিলের ওধারের চেয়ারটায় বসল সে। দুবার হাতে তালি দিতেই দু’জন সিপাই ঢুকল ঘরে। তালা খুলে রানাকে নিয়ে এসে বসানো হলো একটা বিশেষ ভাবে তৈরি লোহার চেয়ারে। মেঝেতে লেফটেন্যান্টের রক্তের দাগ কালচে হয়ে লেগে আছে। এখনও। চেয়ারের সঙ্গেই ফিট করা চামড়ার বেল্ট দিয়ে প্রথমে রানার বুক, পেট এবং আলাদা আলাদা করে দুই উরু বাঁধা হলো শক্ত করে; তারপর পায়ের বাঁধন খুলে পা দুটো চেয়ারের দুই পায়ার সাথে বাঁধা হলো। এবার হাতের বাঁধন খুলে কনুই আর কব্জি বেঁধে ফেলা হলো চেয়ারের হাতলের সঙ্গে। একবিন্দু। নড়াচড়ার ক্ষমতা রইল না ওর। জয়দ্রথের ইশারায় বেরিয়ে গেল সিপাই দু’জন ঘর থেকে।

‘আজ আমার বড় আনন্দের দিন, মি. মাসুদ রানা। আজ আমাদের ডি-ডে। দুই-দুইটা বছর কঠোর পরিশ্রম করবার পর আজ আমরা সাফল্য অর্জন করতে চলেছি। তাই অন্যান্য সবাই পৌঁছবার আগেই আপনার সঙ্গে দুটো রসালাপ করবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসল জয়দ্রথ।

‘ওই যে চেয়ারটায় বসে আছেন, ওটাকে আমরা বলি ‘প্যানিক চেয়ার। কারও কাছ থেকে তথ্য বের করতে হলে ওটা ব্যবহার করি আমি। আমার নিজের আবিষ্কার। অনেক রকম কাজ হয় ওতে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমাদের দেশের উচ্চ মার্গের কয়েকজন ভদ্রলোক এসে পৌঁছবেন এখানে। স্টেনোগ্রাফারও আসবে দুইজন। তাদের সামনে আপনার কাছ থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য বের করে নেয়া হবে নানান কৌশলে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন কয়েকটা ইলেকট্রিক তার গিয়ে ঢুকেছে চেয়ারটার ভিতর। বারোটা বোম আছে আমার হাতের কাছে-একেকটাতে একেক ফল, সময়মত টের পাবেন সব। এখন আমার অতিথিরা এসে পৌঁছবার আগেই আপনাকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করে নিতে চাই।’

এক টিপ নস্যি নিল জয়দ্রথ মৈত্র।

‘গত দুই বছর ধরে আমরা একটা মহা প্রস্তুতি নিয়েছি পাকিস্তানকে পঙ্গু, নির্জীব, মেরুদণ্ডহীন এক জাতিতে পরিণত করবার জন্য। তার প্রথম অংশ আপনি রেডিয়োতে শুনেছেন। এগারো ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য আজ পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে প্রস্তুত। আখনুর থেকে রাজস্থান পর্যন্ত ভারতীয় পদাতিক, পার্বত্য অশ্বারোহী, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনী আজ আক্রমণোদ্যত। কেবল লাহোরেই দুই ডিভিশন সৈন্য আজ ঢুকে পড়েছে পাকিস্তানের ভেতর। ফিফটিনথ আর সেভেনথ পদাতিক ডিভিশন। আর টোয়েনটি থার্ড পার্বত্য ডিভিশন রিজার্ভ রাখা হয়েছে, প্রয়োজন হলে লাগানো হবে। এ ছাড়া কাছেই অমৃতসরে আরও এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়েছে। দুই দিক আক্রমণ করা হয়েছে-আটারি-ওয়াগা এবং বার্কিলাহোর। এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ প্রতিহত করবার ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের নেই। এ ছাড়া এয়ারফোর্স তো রয়েছেই সাহায্যের জন্য। আমাদের Mig 21, Gnat, Hunter, Canberra, Vampire ছাতু করে দেবে পাকিস্তানের দুর্বল Sabre F-86, B-57 এবং F-104। সারা পৃথিবী জানে আজ সন্ধ্যায় আমাদের সেনাপতি লাহোর ‘ফোর্টে বসে চা খাবেন। আগামীকাল লাহোর দখলকারী বাহিনী গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে কাসুর থেকে অগ্রসরমান বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবে। লাহোরের পর শিয়ালকোট। চুরমার হয়ে যাবে পাকিস্তানীদের মনোবল। সর্বত্র দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। মাত্র দশদিন লাগবে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানকে পদানত করতে। এমনই আঘাত হানব-যেন আগামী দুশো বছরেও সে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। সে ভার গ্রহণ করেছেন আমাদের সেনাপতি। আর আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানের ভার পড়েছিল এই আমার ওপর।

বুকের ওপর বুড়ো আঙুল ঠেকাল জয়দ্রথ মৈত্র।

‘আমি ভেবে দেখলাম এই নদী নালার দেশে সৈন্য বাহিনী পাঠিয়ে খুব। সুবিধে হবে না। ট্যাঙ্ক যাবে নরম মাটিতে বসে। তা ছাড়া আমাদের সামরিক শক্তির পূর্ণ প্রয়োেগ হওয়া দরকার পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই এক নতুন উপায় উদ্ভাবন করলাম। পঙ্গপাল দিয়ে ধ্বংস করে দেব পূর্ব-পাকিস্তান। সীমান্ত বরাবর খুলনা-যশোহর-কুষ্টিয়া-রাজশাহী-দিনাজপুর-সিলেট-কুমিল্লা-চিটাগাং, চারদিক থেকে কোটি কোটি পঙ্গপাল ছাড়া হচ্ছে। মাঝরাত থেকেই স্পেশাল ট্রেনে করে। রওনা হয়ে গেছে সব পঙ্গপাল গন্তব্যস্থলে। দশ দিনের মধ্যে ধু-ধু করবে আপনাদের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা পূর্ব-পাকিস্তান-সবুজের লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না কোথাও! ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ লাগবে। না খেতে পেয়ে মারা যাবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাইরে থেকে সাহায্য পাবে না কোনও, বাধ্য হয়ে আমাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে তখন। হাহাকার পড়ে যাবে সারা দেশ জুড়ে। আমরা তখন দয়া পরবশ হয়ে অনায়াসে দখল করে নেব পূর্ব-পাকিস্তান। বাধা দেয়ার লোক থাকবে না আর।’

নির্বিকার ভাবে শুনছিল মাসুদ রানা। এবার বলল, ‘আর চুপচাপ তাই দেখবে পৃথিবী। গাঁজা মারার জায়গা পাওনি, শালা।’

জয়দ্রথ একটা বোতাম স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠল রানা তীব্র একটা বিদ্যুৎ ঝটকা খেয়ে।

‘কেউ অশোভন কথা বললে এই বোতামটা সাধারণত টিপি আমি। বারো রকম কৌশলের এটা একটা। আশা করি ভবিষ্যতে আর অভদ্র ভাষা ব্যবহার করবেন না। যাক, যা বলছিলাম… পৃথিবীতে দুর্বলের স্থান নেই। ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা দেশ যা করে সেটাই ন্যায়। তবে হ্যাঁ, প্রতিবাদ হবে, বড় বড় কনফারেন্স হবে, অনেক যুক্তিতর্কের ঢেউ উঠবে-পড়বে, বৃহৎ শক্তিবর্গ বৈঠকের পর বৈঠক বসাবে, আলোচনা চলবে দিনের পর দিন। শেষকালে ছাড়ব আমরা পাকিস্তান। গড়িমসি করে যাচ্ছি-যাব করতে করতে চার-পাঁচ বছর পার হয়ে। যাবে। শুষে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেব আমরা পাকিস্তানকে। প্রাণটা কেবল দুর্বলভাবে ধুকপুক করবে-আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। জন্মের পর থেকেই আপনারা যে অবিরাম উদ্বেগের মধ্যে রেখেছেন আমাদেরকে, তাতে সমূলে। বিনাশ করা ছাড়া আর কোনও পথই ছিল না আমাদের।

একটু থেমে একটিপ নস্যি নিল জয়দ্রথ মৈত্র। পাশেই রাখা একটা ছোট্ট দামি অলওয়েভ ট্রানজিস্টার রেডিয়ো খুলে দিল। প্রেসিডেন্টের ভাষণের অনুবাদ প্রচার করা হচ্ছে।

ভারতের কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত দশ কোটি পাকিস্তানী বিশ্রাম গ্রহণ করবে না। ভারত এখনও বুঝতে পারছে না কোন জাতির বিরুদ্ধে সে মাথা তুলেছে।

একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে বন্ধ করে দিল জয়দ্রথ রেডিয়োটা।

‘আমার দায়িত্ব ছিল মস্ত বড়, মি. মাসুদ রানা। বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমার পঙ্গপাল বাহিনী তৈরি করতে হয়েছে। কত শত কঠিন সমস্যা এসে উপস্থিত হয়েছে। ওই যে চারটে ব্রিডিং রুম দেখেছেন-সবগুলোয় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। মরুভূমির আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে সেখানে। লো হিউমিডিটি, হাই টেম্পারেচার-আর রাতে শীতল। বছরে ছয়বার ডিম পাড়িয়েছি ওদের দিয়ে। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চারবার দিনকে রাত করেছি, রাতকে দিন। এক মাসের জায়গায় এক সপ্তায় পূর্ণ বয়স্ক পঙ্গপাল তৈরি করেছি। স্ত্রী পঙ্গপাল বালুর নীচে দুশো করে ডিম পেড়েছে। ডিম থেকে পিউপা, তার থেকে লারভা এবং সবশেষে অ্যাডাল্ট। বিশেষ প্রক্রিয়ায় দশ দিনের মধ্যেই ডিম পাড়াবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে নতুন জেনারেশন। চিন্তা করে দেখুন, নইলে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তান ছেয়ে ফেলা সম্ভব হত না এত অল্প সময়ের মধ্যে। আমার বম্বে লোকাস্ট, অর্থাৎ Accridium Succinctum আবার চলে হাওয়ার অনুকূলে। যে সময়টাতে ছাড়তে চাই সে সময় হাওয়া বয় দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে। সিলেট-কুমিল্লা-চিটাগাং-এর জন্যে চিন্তা নেই, কিন্তু আপনাদের পশ্চিম সীমান্তে ছাড়লে সব চলে আসবে আমাদের নিজেদেরই দেশে। তাই এদের স্পেশাল ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। Molasses-’

‘ওসব আমাদের জানা আছে। আপনাদের কার্যকলাপ সবই আমাদের নখ দর্পণে। ওই গন্ধ ছড়িয়ে পঙ্গপালগুষ্টি হাওয়ার প্রতিকূলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। আপনারা।

‘হ্যাঁ। আজ সকালেই আমাদের সব কটা বর্ষ ফেটে সীমান্ত জুড়ে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে।

রানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে আবার আরম্ভ করল জয়দ্রথ মৈত্র।

‘আপনাদের পিসিআই-চিফ সেগুলো তুলে অকেজো করে ফেলবার জন্যে লোক লাগিয়েছে, এই তো বলতে চাচ্ছেন? সব আমরা জানি। তাই সকাল বেলা প্লেনে করে নতুন একদফা গন্ধ ছড়ানো হয়েছে। দুপুরে চারটে Mig-21যাবে আবার একদফা এক্সট্রাক্ট ছড়াতে। কয়দিক সামলাবে রাহাত খান? ও হচ্ছে গরু খেকো নেড়ে মুসলমান। বুদ্ধির খেলায় আমার কাছে ও তো একটি তৃতীয় শ্রেণীর গর্দভ।

আবার একবার খুলল জয়দ্রথ রেডিয়োটা। শেষ হয়ে এসেছে প্রেসিডেন্টের বাণী।

কঠোরতম আঘাত হানার জন্য আপনারা তৈরি হোন। এগিয়ে যান, এবং শত্রুর মোকাবেলা করুন। আল্লাহ আপনাদের সঙ্গে রয়েছেন। শয়তানের ধ্বংস অনিবার্য। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।

পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল। বন্ধ করে দিল জয়দ্রথ রেডিয়োটা বিতৃষ্ণার সঙ্গে।

‘পঙ্গপালের আপনারা কী দেখেছেন? ১৯৬২ সালে করাচির ওপর দিয়ে যে ছোট্ট দলটা উড়ে গিয়েছিল তার ফলেই সারাদিন সূর্যের মুখ দেখতে পায়নি করাচিবাসী। ওটা ছিল মাত্র ৯৫ মাইল লম্বা, ৮ মাইল চওড়া আর উচ্চতা ছিল আধ মাইল। আর এখানে আমি প্রত্যেক জেলার জন্যে ছাড়ছি এর পাঁচগুণ বড় এক একটা করে দল। দুঃখ, শুধু এই, আমার ইচ্ছেমত ছাড়তে পারলাম না। সেনাপতি তৈরি হতে সময় নিয়ে নিলেন একটু বেশি। আর মাস দুই ভাগে। ছাড়তে পারলে অতুলনীয় ক্ষতি করতে পারতাম।

একবার মুখের দুই কোণ ভিজিয়ে নিল সে। দেখল রানা ঝিমোচ্ছে-ওর কথা শুনছে না। একটা বোতাম টিপল সে। গরম হয়ে উঠেছে চেয়ারটা। অবাক হয়ে রানা দেখল জয়দ্রথ হাসছে। লাল হয়ে উঠেছে চেহারাটা। ধোয়া বেরোতে আরম্ভ করল রানার কাপড় থেকে আগুন ধরে যাচ্ছে। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল রানা। সুইচটা অফ করে দিল জয়দ্রথ।

‘ইচ্ছে করলে অসম্ভব ঠাণ্ডাও করা যায় অন্য এক বোতাম টিপে। যাক, যা বলছিলাম। অনেক বাধা বিপত্তি। একবার তো একটা ফাংগাস রোগ ধরে তিন দিনে শেষ হয়ে গেল সব পঙ্গপাল। অত্যন্ত সংক্রামক রোগ। ম্যাটারিজিয়াম থেকে, হয়…’

কী বললেন? চমকে তাকাল রানা জয়দ্রথের মুখের দিকে।

‘ম্যাটারিজিয়াম। কেন, নামটা শুনেছেন নাকি?

হঠাৎ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রানার মুখ। বত্রিশ পাটি দাঁত বের হয়ে গেল ওর। অবাক হয়ে বক্তৃতা বন্ধ করল জয়দ্রথ মৈত্র।

হাসছেন যে?

‘আনন্দ চেপে রাখতে পারছি না, তাই।

‘হঠাৎ এত আনন্দের কারণ?

আমার দেশকে আমি রক্ষা করেছি-তাই মরলেও আজ আমার দুঃখ নেই।

জয়দ্রথ ভাবল হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি ব্যাটার? অতিরিক্ত নার্ভাস হলে এমন হয় অনেক সময়। কিন্তু হাসিটা তো বিকারগ্রস্তের হাসি বলে মনে হচ্ছে না! ( ‘ফাংগাস রোগের কথা বললেন না? ম্যাটারিজিয়াম? আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ওই রোগটা বয়ে এনেছি আমি দেশ থেকে। প্রত্যেকটা খাঁচায় ওই সলিউশন স্প্রে করেছি আমি গত রাতে; কিন্তু জানতাম না কী ক্ষতি হবে আপনাদের। এখন বুঝলাম। কালকের মধ্যে সমস্ত পঙ্গপাল মরে ভূত হয়ে যাবে। আপনার। এত পরিশ্রম করেও শেষ কালে হেরে গেলেন, মৈত্র মশাই।’

মুখটা হাঁ হয়ে গেছিল জয়দ্রথের, নিজের অজান্তেই নস্যির কৌটাটা তুলে নিল টেবিল থেকে। ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে একটা ঢোক গিলল সে।

‘অসম্ভব!’

‘খুবই সম্ভব। আপনার পঞ্চম ল্যাবরেটরির পাশে যেখানে যশোহর লেখা খাঁচাগুলো ছিল কাল রাতে… ওইখানে ড্রেনের মধ্যে খোঁজ করলে পাবেন, খালি কৌটোটা পড়ে আছে। তুলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ওইখানে এসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সলিউশন। তাই বাকি খাঁচাগুলোর জাল আমি ছুরি দিয়ে কেটে ফাঁক করে দিয়েছি। জালগুলোও ওখানেই পাবেন। একটু বেলা উঠলেই খাঁচা থেকে বেরিয়ে গেছে ওরা সব-মিথ্যে কথা নয়, খোঁজ নিয়ে দেখুন, এতক্ষণে পশ্চিম বাংলার ক্ষেত খামার চষে বেড়াচ্ছে ওগুলো।

জয়দ্রথ বুঝল মিথ্যে কথা বলছে না রানা। সমস্ত মুখ কুঁচকে গেল ওর। ধক ধক জ্বলে উঠল হলুদ লম্বাটে চোখ জোড়া। শেষ কালে এই সামান্য লোকের কাছে পরাজয় হলো জয়দ্রথের? একটা সাধারণ পাকিস্তানী স্পাই এসে শেষ করে দিল তার এত দিনের সাধনা, এত পরিশ্রম! একজন লোক পাঠিয়ে দিল জয়দ্রথ কৌটোটা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে দেবার জন্য? ল্যাবরেটরিতেও ফোন করে কয়েকটা নির্দেশ দিল সে।

জয়ের উল্লাসে রানা বলে চলল, ‘আর, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের রাহাত খান সম্পর্কে সতর্ক হয়ে মন্তব্য করবেন। আমার। হাত খোলা থাকলে চড়িয়ে আপনার দাঁত কয়টা ফেলে দিতাম ওই অশোভন উক্তির জন্যে।

আবার বোতামে হাত দিতে যাচ্ছিল জয়দ্রথ মৈত্র, কিন্তু টেলিফোন বেজে উঠতেই সেদিকে হাত বাড়াল। রিসিভার কানে তুলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। জয়দ্রথ মৈত্রের।

কী বললে? খবর এসেছে খাঁচা খালি? (কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনল) না, এখন আর কোনও ইনসেক্টিসাইড দিয়েই ফেরানো যাবে না। যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে।… কোথায় বললে? বারাসত? (মাথা নাড়ল হতাশ ভাবে) এতগুলো লোক কেউ লক্ষ্য করল না এত খাঁচা সব কাটা?…না, ওখানে জানিয়ে কী হবে?…কী বললে? প্রধান মন্ত্রী? ওদিক আমি সামলাব। আমি আসছি এক্ষুণি।’

রানার প্রতি তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি হেনে উঠে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। তেমনি মুচকি মুচকি হাসছে রানা। বলল, হেরে গেলেন মৈত্র মশাই। এবং পশ্চিম পাকিস্তানেও লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসতে হবে আপনাদের সেনাপতিকে বেত খাওয়া কুকুরের মত। আমাদের সামরিক শক্তি আপনাদের ভুল ভাঙিয়ে দেবে অল্পদিনেই।

‘আমি আসছি! তারপর তোমার উপযুক্ত ব্যবস্থা করছি, বদমাশ।

একটা সুইচ টিপে দিয়ে নিশিতে পাওয়া লোকের মত দিশেহারা পা ফেলে বেরিয়ে গেল জয়দ্রথ মৈত্র।

খুব নিচু ভোল্টে অত্যন্ত হাই অ্যাম্পিয়ারের কারেন্ট চালু হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল রানা। দশ মিনিট পর পর ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে ওর। আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে ভাঙা ভাঙা ভাবে চিন্তা করছে ও অনেক কথা। মাঝে মাঝে চেষ্টা করছে বাধন খুলতে-শেষে হাল ছেড়ে দিল। এ বাঁধন খুলবার নয়। বাজে কয়টা এখন? জয়দ্রথ ফিরবে কখন? কখন, আরম্ভ হবে জয়দ্রথের আসল নির্যাতন? তাড়াতাড়ি করছে না কেন? যা ঘটার ঘটে যাক না। এমনি অশ্চিয়তার মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করা যায় না।

মাথার ওপর দিয়ে কত যে জেট গেল ঝাঁকে ঝাঁকে তার ইয়ত্তা নেই। রানা। ভাবল, এ এক অদ্ভুত নির্যাতন বের করেছে তো জয়দ্রথ। যখন ও ঘুমাতে চাইছে, তখন কে যেন জাগিয়ে দিচ্ছে ওকে…আবার জেগে থাকবার চেষ্টা সত্ত্বেও কে যেন ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে পাগল হয়ে যাবে ও। ঘুমটা যতবার ভাঙছে দুঃস্বপ্ন দেখে ভাঙছে। টপ টপ করে ঘাম ঝরছে সর্বাঙ্গ থেকে।

একটা ছায়া কেঁপে উঠল ঘরের ভেতর। চমকে ঘাড় ফেরাল রানা। স্যালি ডেভন। প্রথমেই পা টিপে টিপে বোতামগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। আবার। ঘুমিয়ে পড়েছিল রানা-সুইচ অফ করে দিতেই ঘুমের রেশটা গেল ছুটে। চটপট রানার বাধন খুলতে আরম্ভ করল এবার স্যালি। হাতের বাঁধন আগে খুলল, তারপর পায়ের। বিস্মিত রানা নিজেই তাড়াতাড়ি গলা, বুক এবং পেটের বেল্টগুলো খুলে ফেলল। আধ মিনিটের মধ্যেই বাঁধন মুক্ত রানা উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।

আপনি কোত্থেকে? রানা জিজ্ঞেস করল।

জয়দ্রথের সঙ্গে আছি ব্যাঙ্কক যাবার আগের কটা দিন। ক্যাথির পাপের। প্রায়শ্চিত্ত করছি। আপনার ঋণ আমরা কোনদিনই শোধ করতে পারব না। আমার বোন ভুল করেছিল–ওকে ক্ষমা করতে পারবেন না, মি. রানা?

‘ওসব পরে হবে, স্যালি। এখন বাজে কয়টা?

সাড়ে সাতটা।’

‘ক’জন সশস্ত্র লোক আছে এ বাড়িতে?

‘আট দশ জন। কিন্তু সম্পূর্ণ এরিয়ার অর্ধেক প্রহরীকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে আজ।

‘আমার পিস্তলটা কোথায় জানেন?

না।

‘প্রহরীদের চোখে না পড়ে এ বাড়ি থেকে বেরোবার কোনও পথ আছে?’

তা ঠিক বলতে পারব না। গতকালই প্রথম এসেছি আমি এখানে।

‘জয়দ্রথ কখন আসবে বলে গেছে কিছু?

স্যালিকে আর জবাব দিতে হলো না। একটা জিপ জোরে ব্রেক কষে স্কিড করে থামল গাড়ি-বারান্দায়। স্যালিকে, পাশের ঘরে যাবার জন্যে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ইঙ্গিত করল রানা। দ্রুত চোখ বুলাল ও ঘরের চারধারে। অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় এমন একটা জিনিসও চোখে পড়ল না ওর। টেবিলের ওপর থেকে দুটো কাঁচের পেপার-ওয়েট তুলে নিল হাতে। কয়জন লোক আসছে কে জানে! দেয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়াল রানা দরজা থেকে চার হাত দূরে। পায়ের শব্দ শুনে রানা আন্দাজ করল দুজন লোক এগিয়ে আসছে এই ঘরের। দিকে।

কথা বলতে বলতে ঢুকল জয়দ্রথ মৈত্র। পিছন পিছন এল কোমরে রিভলভার ঝোলানো একজন উচ্চ পদস্থ মিলিটারি অফিসার।

‘হোয়্যার ইজ দ্য সোয়াইন!’ জিজ্ঞেস করল অফিসার।

প্যানিক চেয়ারটা খালি দেখেই আঁতকে উঠল জয়দ্রথ। ধাই করে একটা ভারী পেপার-ওয়েট গিয়ে লাগল মিলিটারি অফিসারের নাক বরাবর। নাকে হাত দিয়ে বসে পড়ল প্রকাণ্ড চেহারার লোকটা, তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে। দ্বিতীয় ঢিল ছুঁড়ল রানা জয়দ্রথের মাথা লক্ষ্য করে। দ্রুত মাথা সরিয়ে নিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিল রানাকে জয়দ্রথ। সোজা ওপাশের দেয়ালে লেগে চৌচির হয়ে গেল কাঁচের পেপার-ওয়েট।

বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা জয়দ্রথের উপর। কিন্তু নাকে-মুখে দমাদম কয়েকটা ঘুসি খেয়ে থমকে দাঁড়াল ও। শক্তিতে কিছু কম হলেও অত্যন্ত দ্রুত হাত-পা চালাতে পারে জয়দ্রথ মৈত্র। সেই সঙ্গে বুদ্ধিও। পিছন ফিরেই দৌড় দিল জয়দ্রথ। রানাও ছুটল পিছনে। অফিসারের কোমর থেকে রিভলভার নিতে গেলে হারিয়ে ফেলবে জয়দ্রথকে, তাই খালি হাতেই। চিৎকার করে লোক ডাকছে জয়দ্রথ। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে পেছন দিকের বারান্দায় পড়ল-তারপর ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে ছুটল সে। যাবার সময় ড্রইংরুমের দরজায় লাগানো একটা কলিং বেল টিপে দিল একবার। পেছন থেকে ধাওয়া করে প্রায় ধরে ফেলবে রানা এমন সময় হঠাৎ রুখে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। হাতে উদ্যত ছুরি।

সময়মত সাবধান না হলে ঢুকে যেত ছুরিটা রানার বুকে। ওর হাত ধরে ফেলল রানা, তারপর যুযুৎসুর এক প্যাঁচে দড়াম করে আছড়ে ফেলল মাটিতে। জোরে মাথাটা ঠুকে গেল মেঝেতে। কিন্তু ছুরিটা ছাড়ল না সে হাত থেকে। প্রচণ্ড ওজনের গোটা দুই লাথি লাগাল রানা জয়দ্রথের পাঁজরের ওপর। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল ওর দেহটা। বিলিয়ার্ড বলের মত চকচকে গোল মাথায় একটা লাথি। মারতেই বড় সাইজের সুপারির মত ফুলে উঠল জায়গাটা। |||||||||| এমন সময় বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল। দৌড়ে এদিকে আসছে কয়েকজন লোক। চিৎকার করবার চেষ্টা করল জয়দ্ৰথ, কিন্তু ভাঙা একটা কর্কশ শব্দ বেরোল ওর মুখ থেকে। মৃত্যুর বিভীষিকা ওর চোখে-মুখে। আরেকটা লাথি মারল রানা ওর মাথায়। সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারাল জয়দ্রথ। এবার জয়দ্রথের একটা হাত ধরে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ল রানা। ডাইনিং রুম।

এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরল রানা। জয়দ্রথের। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেল জয়দ্রথ। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে হলুদ চোখ দুটো। তখনও ছুরিটা ধরা আছে ওর হাতে। চেষ্টা করল ও একবার। ডান হাতটা ওঠাল দুর্বল ভাবে। রানার পিঠে বসাবার চেষ্টা করল ছুরি। খোঁচা খেয়েই গলা থেকে একটা হাত সরিয়ে কেড়ে নিল রানা ছুরিটা এবার পা দুটো মাটিতে আছড়ে প্রহরীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করল জয়দ্রথ। রানা দেখল এভাবে এর পিছনে সময় নষ্ট করা যায় না, ধরা পড়ে যাবে। নিষ্ঠুর ভাবে ছোরা চালাল ও। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। ছিটকে এসে লাগল রানার চোখে মুখে। মাথাটা এক দিকে হেলে পড়ল জয়দ্রথের। ফাঁক হয়ে আছে গলা। কলকল করে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে মেঝেতে।

ছুরি হাতে প্রস্তুত থাকল রানা। কিন্তু না। ডাইনিংরুমটা ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল ওরা সামনে। পর্দার নীচ দিয়ে ওদের বুট দেখতে পেল রানা। জনা ছয়েক হবে।

এবার ধীর পায়ে পেছনের দিকে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরেটা। যদি এখান থেকে বেরোতে না পারে তবে যতগুলোকে সম্ভব শেষ করে তারপর মৃত্যুবরণ করবে ও। হঠাৎ পঞ্চাশ গজ দূরে বালির ঢিবিটার কথা মনে পড়ল ওর। মৃতদেহ দুটোর সঙ্গে সাব-মেশিনগানটার কথাও মনে এল। এতক্ষণ পর্যন্ত ওগুলো যথাস্থানে আছে কি না কে জানে? আবার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল করিডোরে। দরজা খুলে বাড়িটার পেছন দিকে বেরিয়ে এল রানা। সার্চ লাইটের আলোটা একবার ঘুরে যেতেই দৌড় দিল ও। পাওয়ার জেনারেটারের পাশ দিয়ে সামনের আলোকিত খোলা মাঠে পড়ল এবার। এক ছুটে চলে এল বালির ঢিবিটার কাছে।

আছে। টান দিয়ে সাব-মেশিনগানটা বের করে বালি ঝেড়ে নিল রানা। একজন মৃত প্রহরীর কব্জি পর্যন্ত হাত বেরিয়ে পড়ল বালির ভিতর থেকে। রওনা হতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল রানা, টেনে বের করল ও মৃতদেহটাকে। দুটো এক্সটা ম্যাগাজিন টান দিয়ে বের করে নিল মৃত প্রহরীর কোমরের বেল্ট থেকে।

ছয়জন প্রহরী রাইফেল হাতে জয়দ্রথের বাংলোর পেছন দিয়ে বেরিয়ে এল। জয়দ্রথের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই, তাই বেরিয়ে এসেছে পেছনের খোলা দরজা দিয়ে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ট্রিগার টিপল রানা। বিকট চিৎকার করে আছড়ে পড়ল মাটিতে সব ক’জন। এবার ছুটল রানা ল্যাবরেটরি ঘরগুলোর। পেছন দিয়ে সোজা উত্তর দিকে। কিন্তু এক নম্বর ঘরটার পেছনে পৌঁছতেই আকাশ কাঁপিয়ে বেজে উঠল সাইরেন। এলাকার সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে বিপদ-সঙ্কেত দিয়ে। চারদিকে খবর হয়ে গেছে। গেট থেকে আট দশজন। ছুটল সোজা রাস্তা ধরে জয়দ্রথের বাড়ির উদ্দেশে। সেন্ট্রি-ব্যারাক থেকে হুড়মুড় করে বেরোচ্ছে ইউনিফর্মবিহীন সশস্ত্র প্রহরী দলে দলে। পাগল হয়ে খুঁজছে রানাকে সার্চ লাইটের আলো। এক ছুটে পুকুর ধারে চলে এল রানা। তারপর আরেক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠল কয়েকটা মেশিনগান এবং রাইফেল। আশপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলিগুলো। সার্চ লাইটটা রানার ওপর এসে স্থির হয়ে গেছে। প্রথমেই গুলি করে সার্চ লাইটটা নিভিয়ে দিল রানা, তারপর শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে কোনাকুনি এগোল ইউক্যালিপ্টাস গাছের দিকে। হৈ-হৈ করে এগিয়ে আসছে একদল। আবার গুলি করল রানা। চিৎকার করে কয়েকজন পড়ে গেল মাটিতে, বাকি ক’জন শুয়ে পড়ল সটান। বিশগুলির ম্যাগাজিন শেষ হয়ে গেছে, ওটা ফেলে দিয়ে আরেকটা ম্যাগাজিন ভরল রানা। তারপর অন্ধকার মাঠের ওপর দিয়ে প্রাণপণে বুকে হেঁটে এগিয়ে চলল সামনে। ঘাসবিহীন শুকনো মাটিতে ঘষা লেগে ছড়ে গেল দুই কনুই ও হাঁটুর চামড়া। আরও লোক আসছে এগিয়ে। রানাকে দেখতে পাচ্ছে না। ওরা। ক্রমেই আরও অন্ধকারে সরে যাচ্ছে ও। কিন্তু পেছনে আলোকিত রাস্তা থাকায় রানা দেখতে পাচ্ছে প্রহরীদেরকে পরিষ্কার। আর একটু ডাইনে সরে গেল রানা। আরও বেশ খানিকটা দূরে আছে দেয়ালটা। গুলি এসে বিঁধছে। আশপাশে। খাবলা খাবলা মাটি লাফিয়ে উঠছে আধ হাত।

সাইরেন, গোলমাল ও গালিগালাচের শব্দে হতচকিত হয়ে উত্তর-পূর্ব কোণের গার্ড পোস্ট থেকে বেরিয়ে এল দুজন। কয়েক পা এগিয়ে ধরাশায়ী হলো দুজনেই নিজের পক্ষের সাব-মেশিনগানের গুলিতে। ব্যারাকের লোকগুলোও এতক্ষণে এসে যোগ দিয়েছে। ঠা-ঠা-ঠা-ঠা-ঠা’ মেশিনগান চলছে–দুই হাত থর থর করে কাঁপছে, সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে টাশ করে উঠেছে রাইফেলের গুলি। রীতিমত রণাঙ্গন হয়ে গেছে যেন।

হত্যা করতে হবে। যতগুলোকে পারা যায় হত্যা করতে হবে। খুন চেপে গেছে রানার মাথায়। আবার গর্জে উঠল রানার মেশিনগান। গরম হয়ে উঠল ব্যারেলটা। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ল কয়েকজন। এগিয়ে চলল। রানা বুকে হেঁটে। পিছন পিছন মিলিটারি সেন্ট্রিরাও এগোচ্ছে বুকে হেঁটে। খালি ম্যাগাজিন ফেলে দিয়ে শেষ ম্যাগাজিনটা ভরে নিল রানা দুই সেকেণ্ড থেমে। দেয়ালের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে এবার রানা। মোটা গাছটার আড়ালে উঠে দাঁড়াল।

এমনি সময় বুম’ করে একটা বোমা ফাটল আকাশে। আলোকিত হয়ে গেল চারদিক। জ্বলন্ত ম্যাগনেশিয়ামের তীব্র আলো ছোট্ট একখানা প্যারাশুটে ভর করে ধীরে নামছে নীচে। রাতকে দিন বানিয়ে দিল সেই আলো। পরিষ্কার দেখতে পেল রানা বেশ কাছেই দ্রুত বুকে হেঁটে জনাদশেক প্রহরী এগিয়ে আসছে রাইফেল হাতে। আর একটু হলে ধরে ফেলত ওকে। নির্বিচারে গুলি চালাল রানা উঁচু থেকে। বঁড়শি বাধিয়ে ডাঙায় ভোলা চিতল মাছের মত লাফাতে থাকল কয়েকজন। নরক হয়ে গেল জায়গাটা। রক্ত, ধোয়া, করডাইটের গন্ধ, আর সেই সঙ্গে যন্ত্রণাকাতর আহত প্রহরীর ভয়াবহ চিৎকার।

অপর পক্ষ থেকেও কয়েকটা মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। অনেকগুলো এসে লাগল গাছে, বাকিগুলো গিয়ে বিধল দেয়ালে। আবার গুলি চালাল রানা। কয়েকটা বেরিয়েই শেষ হয়ে গেল গুলি, ধক করে উঠল রানার বুকের ভেতরটা। আর রক্ষে নেই। টের পেলেই এগিয়ে আসবে ওরা নির্ভয়ে। কুকুরের মত গুলি করে মারবে ওকে। দেয়ালের দিকে চাইল রানা। কই, মিত্রা তো এল না? রশি ফেলবে বলেছিল, কোথায়? হয়তো আজ ঢুকতেই পারেনি। মিত্রা। কিংবা হয়তো এসে পৌঁছায়নি এখনও। আটটা কি বেজেছে?

আবার না-ও তো আসতে পারে মিত্রা! রানার বন্দি হবার খবর যদি ওর কানে গিয়ে থাকে তা হলে হয়তো আসার প্রয়োজনই বোধ করেনি সে। শির শির করে একটা ভয়ের ঠাণ্ডা শিহরন ওর মেরুদণ্ড বেয়ে উঠে এল উপরে। আর রক্ষে নেই।

মিত্রার ওপর নির্ভর না করে সোজা গেটের দিকে যাওয়াই বোধহয় উচিত ছিল। এক্ষুণি ওরা টের পেয়ে যাবে রানার হাতে আর গুলি নেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওরা আর অবিরাম গুলিবর্ষণ করছে। প্যারাসুটে চড়ে ম্যাগনেশিয়ামের আলো নেমে এসেছে অনেক নীচে। পুকুরের মধ্যে পড়েই দপ করে নিভে গেল আলো। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। গুলি বন্ধ করল সিপাইরা।

ঠিক এমনি সময়ে পেছনে সড়াৎ করে একটা শব্দে চমকে উঠল রানা। মিত্রা না তো? লাফিয়ে উঠল রানার হৃৎপিণ্ড। ছুটে গিয়ে দেয়াল হাতড়াতে আরম্ভ করল ও পাগলের মত। সত্যিই, রশি এসে পড়েছে দেয়াল ডিঙিয়ে। দ্রুত উঠতে আরম্ভ করল রানা রশি বেয়ে

মাঝ বরাবর উঠতেই ‘বুম’ করে আরেকটা শব্দ এল কানে। দিনের মত আলোকিত হয়ে গেল আবার চারদিক। দেখে ফেলেছে এবার ওরা রানাকে। হৈ হৈ করে এগিয়ে এল ওরা, কয়েকটা গুলি বিধল এসে আশপাশের দেয়ালে। ছিটকে হঁটের গুঁড়ো লাগল রানার চোখে-মুখে। আবার কয়েক রাউণ্ড গুলি এল

ইউক্যালিপ্টাসের মিষ্টি গন্ধ এল নাকে। লাফিয়ে এদিকে পড়ল রানা দেয়াল থেকে। নামল বটে, কিন্তু নেমে আর উঠতে পারল না। অসম্ভব চোট লেগেছে পায়ে। ছুটে এসে ধরল ওকে মিত্রা। বহু কষ্টে টেনে নিয়ে গেল গাড়ির কাছে। পেছনের দরজা খুলে সাহায্য করল ওকে ভেতরে ঢুকতে।

কোনও মতে আছড়ে পাছড়ে উঠল রানা সিটের ওপর।

‘খানিকটা উইস্কি দেব? সঙ্গে আছে।’

‘শিগগির গাড়ি ছাড়ো, মিতা। হাঁটুতে হাত বুলাচ্ছে রানা।

গাড়ি ছেড়ে দিল মিত্রা।

ই প্রহরী দুজন অবাক হয়ে চেয়ে আছে, এদিকে এত গোলাগুলি, চিৎকার এবং সাইরেনের আওয়াজ শুনে। ম্যাগনেশিয়াম ফ্লেয়ার দেখে টের পেয়েছে ওরা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে ভিতরে। দূর থেকেই হাত তুলল ওরা। এই অবস্থায় গাড়ি ছেড়ে দিতে পারে না ওরা।

ড্যাশবোর্ড থেকে একটা পিস্তল বের করে রানার হাতে গুঁজে দিল মিত্রা। পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের রণবীর’ পিস্তল। ভারতের তৈরি।

লুটিয়ে পড়ল দুই প্রহরী কাঁকর বিছানো রাস্তার ওপর পেট চেপে ধরে। মিত্রা নেমে গিয়ে সাদা-কালো পেইন্ট করা ভারী পোস্টটা তুলে দিল। তারপর

ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ছুটল হিন্দুস্থান অ্যামব্যাসাডার ফুল স্পিডে।

.

১৪.

৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫। রানার সুটকেস নিয়ে এসেছে মিত্রা গাড়িতে করে। কয়েক ঢোক উইস্কি গিলে নিল রানা। কিছুটা মালিশ করল দুই হাঁটুতে। খিদেতে জ্বলছে পেট। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। কিছুটা চাঙ্গা বোধ করল উইস্কির কল্যাণে। গাড়ি তখন বারাসতের পথে ছুটছে সত্তর মাইল স্পিডে। স্টিয়ারিং ধরে স্থির হয়ে বসে আছে মিত্রা সেন।

চলল ওরা বর্ডারের পথে। কিন্তু সেখানে পার হওয়া আরও কঠিন হবে। যুদ্ধ বেধে গেছে দুই দেশে, এখন দুই দিকের সীমান্ত প্রহরীরাই সদা সতর্ক। হিন্দুস্থান থেকে যদি বহু কষ্টে বেরোতে পারে তবে মারা পড়বে গিয়ে ইপিআরের গুলি খেয়ে। কী করা যায়? প্ল্যান চলছে রানার মাথায় আশি মাইল স্পিডে।

তা ছাড়া নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে সবাইকে ইনফরম করা হয়ে গেছে। টিটাগড় থেকে কলকাতার দিকে গেলে এতক্ষণে ধরা পড়ে যেত। ব্যারাকপুর সামরিক ঘাঁটি পার হয়ে আসতে পেরেছে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হলো রানা। বুদ্ধি বের করার সময় পাওয়া যাবে এখন। পথের মধ্যেই যে বাধা দেয়া হবে রানাকে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সহজে ছাড়া হবে না ওকে।

বারাসতে পৌঁছে বনগা-যশোহরের রাস্তায় না গিয়ে সোজা পুবে টাকির রাস্তায় চলল ওরা। যশোহরের পথে দুই দেশের সীমান্ত প্রহরী অনেক বেশি তৎপর থাকবে। ওদিকে সুবিধে হবে না। তবে টাকি থেকে পাকিস্তানে ঢোকার তেমন কোনও ভাল পথ জানা নেই রানার।

পঁচাত্তরের কোঠায় উঠল মাইল মিটারের কাঁটা। কিন্তু নিশ্চয়ই দ্রুততর কোনও গাড়িতে অনুসরণ করবে ওরা। এ ছাড়াও বর্ডারের সৈন্যরা প্রস্তুত থাকবে রানার জন্য। হঠাৎ মৃদু হাসল রানা। প্ল্যান এঁটে ফেলেছে ও।

এতক্ষণে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে চারদিকে ভাল করে চাইল রানা। আকাশে কৃষ্ণা পঞ্চমীর ম্লান চাঁদ, ঘণ্টাখানেক হলো উঠেছে, পাশে সাদা মেঘের ভেলা। চারদিকে প্রেম-প্রেম রহস্য। খুশি হয়ে উঠল ওর মন।

মিত্রার ঘড়িতে বাজে রাত নটা। আর দশ মাইল পরই বশিরহাট। এতক্ষণেও কোথাও বাধা পেল না দেখে একটু অবাকই হলো রানা। দুই হাঁটুতে অনেকক্ষণ মালিশের পর বেশ খানিকটা সুস্থ বোধ করছে ও। মিত্রার পাশে গিয়ে। বসল সিট ডিঙিয়ে। কাঁধের ওপর রাখল একটা হাত।

জোর বাতাসে উড়ছে মিত্রার খোলা চুল। মুখের এক পাশে পড়েছে চাঁদের আলো। মৃদু হাসল মিত্রা। কেঁপে উঠল যেন সারাটা আকাশ। রানা ভাবল ধন্য হলো ও। যে দেখেছে এমন হাসি তার জীবন সার্থক। দু’পাশের মাঠে পাকা আউস ধান দুলছে মৃদু বাতাসে। পৃথিবীটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রানার। ঠিক বোঝানো যায় না এই ভাল লাগাটাকে। বিচিত্র মানুষের জীবন। প্রতিপদে যার মৃত্যুর হাতছানি, সেই রানা জানে এই মায়াবী পৃথিবীর কী যাদু। বেঁচে থাকায়। কত সুখ। হৃদয়টা উথলে উঠতে চাইল রানার এক অসীম কৃতজ্ঞতায়। কিন্তু কার প্রতি কৃতজ্ঞতা? খোদা? প্রকৃতি? নারী? বুঝতে পারে না রানা। প্রকৃতির মায়া, নারীর প্রেম, বন্ধুর বন্ধন, সব মিলিয়ে তীব্র একটা ভাল লাগা-এজন্যে কার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে রানা?

আবোল তাবোল ভাবছে ও।

‘জয়দ্রথ আমাদের সহজে ছাড়বে না, রানা, মিত্রা বলল।

‘জয়দ্রথকে শেষ করে এসেছি। কিন্তু ঠিকই বলেছ, টিটাগড়ের ব্যাপারটা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। সরাসরি ডিফেন্স মিনিস্টারের আণ্ডারে। সহজে ছাড়বে না। ওরা।

‘ভেতরে কী দেখলে?

‘পঙ্গপাল।’

রাস্তাটা বাঁয়ে ঘুরেছে। চাঁদটা চলে গেছে পেছনে। হঠাৎ এক সঙ্গে চমকে উঠল মিত্রা ও রানা। সামনের রাস্তায় ছায়া পড়েছে একটা। এক মুহূর্তে বুঝল। রানা ব্যাপারটা। চাপা উত্তেজনায় টান হয়ে গেল ওর পেশিগুলো।

‘ব্রেক করো! ব্রেক করো, মিত্রা!’ চিৎকার করে উঠল রানা।

পনেরো-বিশ গজ স্কিড করে থামল গাড়ি। হেড-লাইট অফ করে দিল মিত্রা।

‘শিগগির বেরিয়ে পড়ো গাড়ি থেকে!’ পিস্তলটা নিল রানা সঙ্গে। এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা।

বেরোবার আগেই জ্বলে উঠল সার্চ লাইট। ওদের মাথার পঞ্চাশ গজ ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে একখানা হেলিকপ্টার। বিশ্রী আওয়াজ হচ্ছে প্রকাণ্ড রোটর ব্লেড থেকে।

একলাফে বেরিয়ে মিত্রার হাত ধরল রানা। এই সম্ভাবনার কথা একবারও মাথায় আসেনি ওর। ছুটল ওরা মস্ত বটগাছটার দিকে। গজ পনেরো-বিশেক। যেতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ হলো পেছনে। সাঁ করে একটা তপ্ত লোহার টুকরো এসে ঢুকল রানার বাম বাহুতে। দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। পড়ে যাচ্ছিল, মিত্রার কাধ ধরে সামলে নিল। অবশ হয়ে গেছে বাম হাত। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। গাড়িটায়। সার্চ লাইটটা আবার খুঁজে বের করল ওদের। এক চোখ মেলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে যেন অগ্নিবর্ষণ করছে ওদের ওপর। এগিয়ে আসছে এবার ওদের দিকে। আবার ছুটল ওরা। এক ঝাক গুলিবর্ষণ করল কো-পাইলট। কাঁধের কাছ থেকে এক খাবলা মাংস উড়ে গেল রানার। পড়ে গেল ও মাটিতে। আর অল্প বাকি আছে বটগাছ তলায় পৌঁছতে। বাঁচার তাগিদে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল রানা। এবার।

ঝিঁঝি ডাকছে চারপাশে। প্রকাণ্ড ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছটা। ওর তলায় কিছুটা নিরাপদ বোধ করল না। গাছের গায়ে বিধে যাচ্ছে কো-পাইলটের গুলিগুলো; কোনও কোনওটা আবার ডালে পিছলে ‘বি’ শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। টেনে তুলে রানাকে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসাল মিত্রা। গুলি খাওয়া হাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। কাঁধের জখম থেকে রক্ত ঝরে ভিজে গেছে রানার শার্ট। হাতটা বেঁধে দিল মিত্রা শাড়ি ছিঁড়ে। কিন্তু তিন সেকেণ্ডের মধ্যেই কয়েক পরতা কাপড় ভেদ করে টপ টপ করে রক্ত ঝরতে থাকল। হঠাৎ বড় অসহায় এবং দুর্বল মনে হলো রানার নিজেকে। ও কী করবে? একটা গোটা দেশের বিরুদ্ধে কী করবে ও একা?

গুলি চালানো বন্ধ হয়েছে। অনেক নীচে নেমে এসেছে পঙ্গপালের মত দেখতে কুৎসিত যন্ত্র দানবটা। হঠাৎ ছোট কী একটা জিনিস টুপ করে পড়ল কয়েক হাত দূরে।

‘হ্যাণ্ড গ্রেনেড! মিত্রা! আড়ালে চলে যাও। কানে আঙুল দাও জলদি!’

রানাও সরে এল বটগাছের প্রকাণ্ড গুঁড়ির আড়ালে। প্রচণ্ড শব্দে ফাটল হ্যাণ্ড গ্রেনেড। থেমে গেল ঝিঁঝি পোকার ডাক। পাতার খানিকটা ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখা গেল খোলা ককপিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কো-পাইলট। ধীরে ধীরে নামছে হেলিকপ্টার রাস্তার ওপর। গুলি করল রানা পর পর দুবার। আবার পাতার আড়ালে চলে গেল হেলিকপ্টার। তিন সেকেণ্ড পরই ধপাস করে রাস্তার ওপর পড়ল কো-পাইলটের লাশটা।

ধীরে ধীরে নেমে এল হেলিকপ্টার পীচ ঢালা রাস্তার উপর। ওদের দেখতে পেয়ে হুইল এবং রোটর ব্রেক করে ককপিটের সামনে এসে দাঁড়াল পাইলট, হাতে মৃত কো-পাইলটের ব্রেন গান।

দুর্বলতায় হাত কাঁপছে রানার। পরপর চারটে গুলি করল ও পাইলটকে লক্ষ্য করে। কোন গুলিটা লাগল বোঝা গেল না। বোধহয় শেষটা, কিংবা তার আগেরটা হবে। ধনুষ্টঙ্কারের রোগীর মত বেঁকে গেল পাইলটের দেহ। ট্রিগারে। হাত পড়ে গেল-লক্ষ্যহীন ভাবে আকাশের দিকে পনেরো-বিশবার অগ্নিবর্ষণ করে স্তব্ধ হয়ে গেল ব্রেন গান। লুটিয়ে পড়ল পাইলট হেলিকপ্টারের মেঝেতে। একটা পা বেরিয়ে থাকল ককপিট থেকে।

রক্ত! প্রচুর রক্তক্ষরণে অবশ হয়ে গেছে রানার দেহ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ও ধীরে ধীরে। শত্রু এলাকার মধ্যে জ্ঞান হারালে চলবে না। সমস্ত মনোবল। একত্র করবার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু বুঝল ক্রমেই ঝিমিয়ে আসছে ওর স্নায়ুগুলো।

আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজনের হৈ-হল্লা শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে ওরা মশাল এবং লণ্ঠন হাতে করে। উপায় নেই। ধরা পড়ে যাচ্ছে ওরা। ছুটে গিয়ে গাড়ির ধ্বংস-তূপের মধ্যে থেকে রানার সুটকেসটা টেনে বের করল মিত্রা। ডালাটায় আগুন জ্বলছে এখনও। উইস্কির বোতলটা বের করে নিয়ে। দিশেহারার মত ছুটে এল মিত্রা রানার কাছে। লোকজন তখন বেশ কাছে চলে এসেছে। সময় নেই। যে করেই হোক রানাকে সজ্ঞান রাখতে হবে।

কয়েক ঢোক উইস্কি খেয়ে উঠে বসল রানা। চারপাশের অবস্থাটা বুঝে নিয়ে। বলল, আমাকে একটু ধরো, মিতা। হেলিকপ্টারের কাছে নিয়ে চলো।’

ককপিটের দরজা খোলা। কিন্তু সিঁড়ি নেই। রানার পক্ষে ওখানে ওঠা সম্ভব নয়। মিত্রা ভাবল, হেলিকপ্টারের ভিতরে যখন উঠতে চাইছে, তখন নিশ্চয়ই কোনও গল্প বানিয়ে বলতে চায় রানা ওই গ্রামবাসীদের।

লাফিয়ে দু’হাতে ধরল মিত্রা ককপিটের নীচের অংশ। অনেক কসরত করে। আঁচড়ে খামচে উঠে পড়ল ভেতরে। ওপরে উঠে সিঁড়ি নামিয়ে দিল নীচে। ধীরে। ধীরে উঠে এল রানা সিঁড়ি বেয়ে হেলিকপ্টারের ভিতর। মিত্রা সাহায্য করল ওকে হাত ধরে। পাইলটের পা ভাঁজ করে ভিতরে নিয়ে এল রানা।

‘সিঁড়ি তুলে ফেল।

সিঁড়ি তুলে ফেলল মিত্রা। ককপিটের দরজাও বন্ধ করে দিল রানার হাতের ইশারায়। ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল রানা।

আমার সিট বেল্টটা বেঁধে দাও তো, মিত্রা। তুমিও বসে পড়ো ওই সিটে।’

কথামত কাজ করল মিত্রা। তারপর অবাক হয়ে দেখল যন্ত্রপাতি নিয়ে টানাটানি আরম্ভ করেছে রানা।

রাডার পেডালগুলো পা দিয়ে ছুঁয়ে দেখে নিল রানা, তারপর রোটর ব্রেক ছেড়ে দিয়ে পিচ কন্ট্রোলের থ্রটল একটু ঘোরাল। প্রকাণ্ড পাখাটা ঘুরতে আরম্ভ করল। প্রথম কয়েক পাক ভয়ানক লাগল প্রকাণ্ড রোটরের ছায়াটা দেখতে। ধীরে ধীরে রোটর স্পিড ইণ্ডিকেটারের কাঁটা উঠতে থাকল ওপরে। টেইল রোটরের দিকে পেছন ফিরে একবার চাইল রানা। ইণ্ডিকেটারে যখন দেখা গেল স্পিড মিনিটে দুশো পাক, তখন হুইল ব্রেক ছেড়ে দিয়ে আস্তে পিচ লিভারটা ওপরে টেনে থ্রটল ঘোরাল ও আরও খানিকটা। কেঁপে উঠল হেলিকপ্টার। উড়ি উড়ি করেও যেন প্রকাণ্ড পতঙ্গটা মায়া কাটাতে পারছে না মাটির।

লণ্ঠন এবং মশাল হাতে নিয়ে বহু লোক জড়ো হয়ে গেছে রাস্তার দুই ধারে। ধুলো উড়ছে বলে নাকে কাপড় দিয়েছে বেশির ভাগ, কিন্তু স্পষ্ট উদ্বেগ দেখল। রানা ওদের চোখে। রানা হাত নাড়ল ওদের দিকে। ওরাও ধন্য হয়ে গিয়ে হাত নাড়াতে থাকল।

আরও খানিকটা থ্রটল দিতেই প্রকাণ্ড পঙ্গপালটা শুন্যে উঠে গেল। তিনশ’ গজ ওপরে উঠে নীচে চেয়ে দেখল রানা একবার। তখনও হাত নাড়াচ্ছে সরল গ্রামবাসী। কয়েকজন ঘিরে দাঁড়িয়েছে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহটাকে, আর কিছু লোক চলে গেছে গাড়ির ধ্বংস স্তূপের কাছে।

দুই হাঁটুর মাঝখানে জয়-স্টিকটা ঠেলে দিল রানা সামনে, সেই সঙ্গে দিল। লেফট রাডার।

বর্ডার পেরোবে কী করে? অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। দুই দিকের সীমান্ত প্রহরী! মিত্রার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।)

‘হিন্দুস্থান গার্ড কিছুই বলবে না। এটা ভারতীয় এয়ারফোর্সের মার্কা মারা হেলিকপ্টার। আর পাকিস্তান গুলি ছোঁড়ার আগে নামবার আদেশ দেবে। ভদ্রলোকের মত নেমে পড়ব, ভয় কী?

আরও কয়েক ঢোক উইস্কি গিলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা। হেড ফোনটা লাগিয়ে নিল কানে।

আর রানাকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনে চলল মিত্রা সেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *