ভারতনাট্যম ২

০৫.

২৯ আগস্ট, ১৯৬৫!.

সকালে প্রবল করাঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙল রানার। দরজা খুলে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে জয়দ্রথ মৈত্র। ভূত দেখার মত চমকে উঠল জয়দ্রথ ও রানা একইসঙ্গে। হলুদ দৃষ্টি রানার চোখের ওপর স্থির হয়ে গেল। ডান দিকের ঘা-টা চাটল জয়দ্ৰথ। মৈত্র।

‘আপনি এ ঘরে কেন? দৃষ্টিটা রানার চোখ থেকে সরে গিয়ে সারা ঘরে একবার ঘুরে জানালার ওপর থমকে দাঁড়াল, তারপর আবার স্থির হলো এসে রানার মুখে। ঠিক এমনি সময় মিত্রা এসে ঘরে ঢুকল বাথরুমের দরজা দিয়ে। জয়দ্রথের চোখে কুৎসিত একটা সন্দেহের ছায়া দেখতে পেল মিত্রা। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল ওর।

গম্ভীর মুখে সব শুনল জয়দ্রথ মৈত্র। কতটুকু বিশ্বাস করল আর কতটুকু ইচ্ছেমত যোগবিয়োগ করে নিল কে জানে। সবশেষে রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার কাছে আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞ, মি. তরিকুল ইসলাম। আপনার সাহায্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, রাতেই আমাকে জানানো উচিত ছিল তোমার। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটু থেমে পেছনে নাঃ ফিরেই বলল, ‘আমার ঘরে একটু শুনে যেয়ো, মিত্রা। তারপর বেরিয়ে। গেল ঘর থেকে।

.

‘তোমাদের সব ধরে ধরে ইয়ে করা দরকার। বুঝছ? এটা কি চা হয়েছে, না কানা চোখের পানি?’ সোহেলের হাতে ট্রের ওপর চায়ের কাপের দিকে চেয়েই গর্জে উঠল মাসুদ রানা।

নাস্তার এঁটো তস্তরি-বাসন তুলতে তুলতে নিচু গলায় সোহেল বলল, ‘নে, ইয়ার্কি রাখ। আজ দুপুরে ওরা সব চলল শিলাইদহ দেখতে। তুই যাবি নাকি?’

কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল রানা। তারপর বলল, আমাকে ওরা চিনে ফেলেছে বলছিলি না কাল তুই?

‘হ্যাঁ।

‘আর তোকে? তোর ওপর কোনও সহেন্দ হয়নি তো ওদের?

না। এখনও হয়নি!

তা হলে আমি যাব শিলাইদহে।’

সন্দেহের সঙ্গে শিলাইদহের কী সম্পর্ক? অবাক হলো সোহেল।

সম্পর্ক আছে। শোন বলছি। আমি ওদের সঙ্গে যদি শিলাইদহে যাই তবে ওরা এদিকটায় অত কড়া পাহারা দেবে না। পাঁচ নম্বর রুমে ওদের কী আছে। আমার জানা দরকার। কিন্তু সব সময় ওদের লোক ঘরটা এত কড়া পাহারায়। রাখে যে কোনরকমে ভিড়তেই পারছি না কাছে। তুই যখন বলছিস তোর ওপর ওদের কোনও সন্দেহ নেই, যত সন্দেহ এই আমার ওপর, তখন আমি ওদের সঙ্গে শিলাইদহ গেলে ওই ঘরটার ব্যাপারে ওরা নিশ্চিন্ত থাকবে। আর সেই সুযোগে তুই ঢুকবি ওই ঘরে, দেখে আসবি কী চলছে গোপনে ওই নিষিদ্ধ ঘরটার মধ্যে। কী বলিস, পারবি না?’

‘যো হুকুম, ওস্তাদ।

.

সেদিন, অর্থাৎ ২৯ আগস্ট দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই দল বেঁধে বেরোল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠি দেখতে। রানাও গেল। মিত্রাও। কিন্তু মিত্রা যেন সেই গতরাতের সহজ সাবলীল মিত্রাই নয়। সারা মুখে থমথমে গাম্ভীর্য। চোখ, দুটো কেমন উদ্ভ্রান্ত। রানার সঙ্গে একটি বাক্য বিনিময়ও যেন না হয় সেদিকে কেবল জয়দ্রথ কেন, দলের প্রত্যেকটি লোক এবং স্ত্রীলোক সতর্ক দৃষ্টি রাখল। মিত্রার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ হলো না। শুধু এটুকু লক্ষ করল রানা, গভীর চিন্তামগ্ন মিত্রা সেন থেকে থেকে ওর দিকে চাইছে দূর থেকে। ও চাইলেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অন্য দিকে। অনেক চিন্তা করেও যেন কোনও একটা কঠিন সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না মিত্রা।

লঞ্চঘাটে নেমে পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। হাতের বাঁয়ে পড়ল রবীন্দ্রনাথের পোস্টাপিস বা ডাকঘর। এখানে নিজস্ব ব্যাংকও নাকি স্থাপন করেছিলেন তিনি। আরও কিছুদূর এগিয়ে দূর থেকে দোতলা কাছারি বাড়ি দেখা গেল, কিন্তু সেদিকে না গিয়ে ডান দিকে মোড় ঘুরল ওরা। কুঠি বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেই ডান দিকে বিরাট আম বাগান, বায়ে কিছু খেত ও ঝাউয়ের বন। সোজা এগিয়ে দেখা গেল সুন্দর বাংলো টাইপ পাকা দোতলা বাড়ি, ওপরটা টালি দেয়া। ফুলের বাগান। ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই হলঘর। পাল্কিটা সত্যিই দেখবার মত। অল্পস্বল্প আসবাবপত্র আছে-কয়েকটা আলমারিতে রয়েছে কিছু বই। দোতলার ঘর আর ছাতের চিলেকোঠা দেখে দলবল এগিয়ে গেল আঙিনায় আম বাগানের সেই বিখ্যাত চাতাল দেখতে। হঠাৎ এদের সঙ্গ কেন জানি বড় তিক্ত লাগল রানার কাছে। পিছিয়ে পড়ল সে। বেরিয়ে এল বাইরে। ফুলের বাগান বায়ে রেখে এগিয়ে। গেল পুকুরের দিকে। ডানধারে চাকরদের একতলা লম্বা ঘর। ঘাটের দুই ধারে মস্ত দুটো বকুল গাছ। বিকেল বেলাতেই চারদিকটা নিঝুম হয়ে এসেছে। পুকুরে স্নানার্থী নেই আর।

শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে চুপচাপ বসল গিয়ে রানা। একা। ফ্লাস্ক থেকে চা। ঢেলে নিয়ে সিগারেট ধরাল একটা।

অদ্ভুত সুন্দর বিকেল। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশের সাদা মেঘগুলো ছায়া ফেলেছে কানায় কানায় ভরা পুকুরটার কালো জলে। মৃদু বাতাসে ঝির ঝির শব্দ করছে ঝাউয়ের পাতা। চারদিকে স্নিগ্ধ, শান্ত, সমাহিত একটা ভাব।

বি.এ. ক্লাসে পড়া রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কটা লাইন মনে পড়ল রানার:

কাছে এল পূজার ছুটি।
রোদ্দুরে লেগেছে চাপা ফুলের রঙ।
হাওয়া উঠছে শিশিরে শিরশিরিয়ে,
শিউলির গন্ধ এসে লাগে
যেন কার ঠাণ্ডা হাতের কোমল সেবা।
আকাশের কোণে কোণে সাদা মেঘের আলস্য–
দেখে, মন লাগে না কাজে।

সেই মুহূর্তে ভুলে গেল রানা তার কাজের কথা, জয়দ্রথ মৈত্রের কথা, মিত্রার কথা। শহরের কর্মমুখর জীবনের বিচিত্র ঘাত-প্রতিঘাত থেকে হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে এসে এক অদ্ভুত পরিপূর্ণতাকে উপলব্ধি করল ও সমস্ত হৃদয় দিয়ে। অদ্ভুত। অদ্ভুত এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছে এই জগৎ জুড়ে।

পৃথিবীটা সত্যিই মায়াবী এক স্বপ্নের দেশ!

.

দুপুর বেলা ডাকবাংলোটা নিঝুম হয়ে গেল। দু’জন ছাড়া সাংস্কৃতিক মিশনের বাকি সবাই চলে গেছে শিলাইদহ দেখতে, রানা গেছে সঙ্গে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল সোহেল একজন বিছানায় শুয়ে এবং অপর জন বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে ‘হানিমুন ব্রিজ খেলছে। চেয়ারে বসা লোকটার হাতে একটা অনার্স কার্ডও নেই-কিন্তু হাঁক ছাড়ল: ফোর নো ট্রাম্পস।

আস্তে ঘরের শিকলটা তুলে দিল সোহেল বাইরে থেকে। তারপর একগোছা চাবি হাতে নিয়ে দাঁড়াল সেই নিষিদ্ধ ঘরটার সামনে। কয়েকটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর একটা চাবি লেগে গেল তালায়।

বেশ বড় ঘর। একটা আলমারি আর ছোট একটা টেবিলের দু’ধারে দুটো চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। ঘরের মধ্যে এলোমেলো করে ছড়ানো স্টেজ ডেকোরেশনের সাজ সরঞ্জাম। কিন্তু বাক্সগুলো কীসের?’

প্রকাণ্ড সাইজের তিনটে বাক্স ক্যানভাসের তেরপল দিয়ে ঢাকা। তেরপল উঠিয়ে ডালা খুলল সোহেল। বড় সাইজের কাঁচা বেলের মত গোল সবুজ পেইন্ট করা অসংখ্য বল। বোম-টোম নাকি? তিনটে বাক্সেই একই জিনিস। হাতে তুলে নিল একটা। বেশ ভারী। টোকা দিয়ে দেখল ওপরটা প্লাস্টিকের।

সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও উল্লেখযোগ্য আর কিছুই পাওয়া গেল না। একটা বল হাতে বেরিয়ে এল সোহেল ঘর থেকে। বলটা দুই উরুতে চেপে ধরে তালা লাগিয়ে দিল আবার দরজায়।

জানতেও পারল না সে, আলমারির মাথায় নিখুঁত ভাবে লুকোনো একখানা সিক্সটিন মিলিমিটার মুভি ক্যামেরায় তার সমস্ত গোপন কার্যকলাপের ছবি উঠে গেল।

জয়দ্রথের মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলল সোহেলের মাথার ওপর।

.

রাত তখন সাড়ে-বারোটা হবে। রানা শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুম আসছে না, কিছুতেই। আজ কুষ্টিয়ায় শেষ হয়ে গেল অনুষ্ঠান। আবার পাততাড়ি গুটিয়ে ভোর রাতের ট্রেনে রওনা হতে হবে রাজশাহীর পথে। পাশের ঘরে মিত্রা নেই। ওকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্য ঘরে।

ইয়াং টাইগারস-এর দলটাকে সোহেল চিনিয়ে দিয়েছে দূর থেকে। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আজকের রিপোর্ট পেয়ে রাহাত খান কেমন চমকে উঠবে ভাবতে ভাল লাগল রানার। স্যাম্পলটা রানার কাছেই আছে, ঈশ্বরদি পৌঁছে প্লেনে করে পাঠিয়ে দেয়া হবে ঢাকায়, হেড-অফিসে। এতদিন পর একটা কৃতিত্বপূর্ণ কাজ করবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে সোহেল। আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু ওর জন্যে মনে মনে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছে না রানা। কথায় কথায় সোহেল বলেছে: আমিও ধরা পড়ে গেছি রানা। ওদের ব্যবহারেই টের পেয়েছি আমার পরিচয়। ওদের কাছে আর গোপন নেই। অবশ্য তাতে ক্ষতি নেই, আজই তো শালারা ভাগছে এখান থেকে আমার ডিউটিও এখানেই শেষ। কিন্তু রানা জানে সহজে ছাড়বার পাত্র জয়দ্রথ মৈত্র নয়।

ঠিক এমনি সময়ে গগনভেদী এক অপার্থিব চিৎকারে কেঁপে উঠল রাত্রির নিস্তব্ধতা। সোহেল না তো! একলাফে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল রানা। ঠিক দশগজ দূরে আধো-অন্ধকারে ঘাসের ওপর পড়ে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছে। একজন লোক। পিঠের ওপর আমূল বিধে আছে একখানা ছোরা। লোকটার হাতেও ছুরি ধরা। সোহেলের মতই লাগছে না অনেকটা? আরে, ওই তো! দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে একটা মূর্তি। মাথায় খুন চেপে গেল রানার। একটানে পিস্তল বের করল ও হোলস্টার থেকে। এখনও রেঞ্জের বাইরে যায়নি আততায়ী।

ট্রিগারে আঙুল চেপে গুলি করবার ঠিক আগের মুহূর্তে থেমে গেল রানা। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে দেখল দৌড়াবার সময় আততায়ীর একটা হাত দুলছে-আরেকটা হাত স্থির হয়ে ঝুলছে কাঁধ থেকে।

নিঃশব্দে জানালা থেকে সরে এল রানা।

বাইরে চিৎকার শুনে ছুটে আসা লোকজনের উচ্চকণ্ঠে আলাপ-আলোচনা নির্লিপ্ত ভাবে শুনতে শুনতে একসময় গভীর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল সে।

.

ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা পড়ল। গার্ডের বাঁশি। হুইসল দিয়ে ছেড়ে দিল লোকাল প্যাসেঞ্জার ট্রেন। পোড়াদা-ভেড়ামারা-ঈশ্বরদি, তারপর আবদুলপুর-সারদা এবং সবশেষে রাজশাহী। মোট পঁচাত্তর মাইল।

রানা, উঠে পড়ল সেকেণ্ড ক্লাস একটা কম্পার্টমেন্টে। সাংস্কৃতিক মিশনের রিজার্ভ করা সব শেষের দুই কামরার বগিতে কিছুতেই উঠতে দিল না ওকে। জয়দ্রথ মৈত্র। কাজেই যতটা সম্ভব কাছের একটা কামরায় উঠতে হলো রানাকে। রানা লক্ষ্য করল সবশেষের কামরায় উঠেছে বাক্স তিনটে।

ব্রডগেজ লাইনে হু হু করে স্পীড বেড়ে গেল ট্রেনের। চার সিটের কামরা। দু’জন প্যাসেঞ্জার নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাঙ্কের ওপর। আর যে লোকটা অনেক ধাক্কাধাক্কির পর দরজা খুলে দিয়েছিল বিরক্ত মুখে, সে এখন পাশের সিটের ওপর পা চড়িয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঢুলছে। জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে শেষের কামরার দিকে চাইল রানা।

পার্টিশন কীসের? রানা দেখল শেষ বগির দরজা দিয়ে স্টেজ ডেকোরেশনের একটা ক্যানভাস-পাটিশন বেরিয়ে আছে বাইরে। ব্যাপার কী? ওপাশের দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখল ওদিকেও ঠিক তাই। ফলে শেষের কামরাটা পুরো ট্রেন থেকে আড়াল হয়ে গেছে। কী হচ্ছে শেষ কামরায়? এখান থেকে বোঝার উপায় নেই।

আট মাইল পেরিয়ে এসে পোড়াদা স্টেশনে থামল ট্রেন। প্রায় লাফিয়ে নেমে এল রানা। দেখল পার্টিশনটা আর নেই। শেষ দুই কামরার পাশ দিয়ে এক চক্কর ঘুরে এল মাসুদ রানা। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না তার। এদিকে হুইসল দিয়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। প্রাণপণে দৌড়ে কোনরকমে বাদুড় ঝোলা হয়ে উঠল গিয়ে নিজের কামরায়।

ভোর হয়ে আসছে। পুবের আকাশটা বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। হাল্কা কুয়াশায়। আচ্ছন্ন ফসল ভরা আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আউশ ধান। মাঝে মাঝে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কুঁড়ে ঘর, উঠোনে খড়ের গাদা, আম কাঁঠাল আর কলা গাছ; মেঠেলের। ধারে বাঁশের ঝাড়।

আবার জানালা দিয়ে পার্টিশন দেখতে পেল রানা।

সুটকেস থেকে একটা নাইলন কর্ড বের করল সে। কামরার কেউ জাগেনি এখনও। আধ-শোয়া লোকটার মুখ থেকে লালা ঝরছে গেঞ্জির উপর।

কামরায় উঠবার সুবিধের জন্যে যে লোহার হাতলটা থাকে তার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল রানা দড়ির এক প্রান্ত। ভারী দরজাটা খুলে হাঁ করে দিল। এবার খোলা দরজার ধারে বাইরের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল। একবার ভাবল, তার দেহের ওজন সহ্য করতে পারবে তো কর্ডটা? পারবে। হাঁটু সোজা রেখে রশিটা একটু একটু করে ছেড়ে ধীরে ধীরে বাইরের দিকে শুয়ে পড়ল ও চিত হয়ে। মাটি থেকে সমান্তরাল ভাবে রয়েছে ওর দেহ। হু হু বাতাস আর সেই সঙ্গে প্রচুর ধুলিকণায় শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। ডান চোখের ভিতর বুলেটের বেগে একটা কাঁকর এসে পড়ল। বেশিক্ষণ এই ভাবে থাকা সম্ভব নয়। যে-কোনও মুহূর্তে গাছের গুঁড়িতে কিংবা কোনও খুঁটিতে লেগে ছাতু হয়ে যেতে পারে মাথাটা।

ডান চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাঁ চোখ মেলে রানা দেখল পার্টিশনের ওধারের কামরা থেকে ডাল তোলার চামচের মত দেখতে কিন্তু আয়তনে দশগুণ বড় একটা চামচ বের হলো। চামচের ওপর সোহেলের সেই প্লাস্টিকের বল একখানা। চামচের হাতলটা বড় হতে হতে বারো-চোদ্দ ফুট লম্বা হলো। একটা সবুজ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাবার সময় আলগোছে সেটা নামিয়ে দেয়া হলো চামচ থেকে। হাতল আবার ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল কামরার। ভিতর।

তা হলে এই শুভেচ্ছা নিয়েই এসেছে এবারের সাংস্কৃতিক মিশন? আর এই জন্যেই রেলপথে চলছে ওরা? গোটা পূর্ব-পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর এই বোমা ছড়িয়ে যাচ্ছে ওরা সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু কী ওদের উদ্দেশ্য? এই টাইম-বম্ব। ফাটলে পরে কী হবে? কোন সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে আমাদের দেশের ওপর কে জানে। ভেড়ামারাতে পৌঁছেই রিপোর্ট লিখতে হবে। ঈশ্বরদিতে নঈমকে দিয়ে দেবে রিপোর্ট এবং স্যাম্পল।

‘টাশশ!’ একটা তীক্ষ্ণ শব্দ কানে এল রানার ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে। চমকে উঠল ও। অনুভব করল, কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল বুলেট। পা দুটো ভাজ করে ফেলল রানা, তারপর দড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে আসতে থাকল। আবার সেই তীক্ষ্ণ শব্দটা এল কানে… ‘টাশশ’! এবারও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো গুলি। কামরার ভিতর চলে এল রানা।

বাথরুম থেকে চোখ-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে এল মাসুদ। রানা। জানালার ধারে বসে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। বাসি মুখে সিগারেট বিস্বাদ লাগছে। আকাশটা লাল করে দিয়ে তখন সূর্য উঠছে পুব দিগন্তে। আঁধার পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমে।

.

০৬.

৩০ আগস্ট, ১৯৬৫।

গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে সোজা ডাকবাংলোর পথে হাঁটা ধরল মাসুদ রানা।

রাত এগারোটা।

টেপ-রেকর্ডারের স্কুলগুলো না পেয়ে জয়দ্রথ মৈত্রের চেহারাটা কেমন হবে ভেবে খুশি হয়ে উঠল রানার মনটা। মোলায়েম, চাঁদের আলোয় রানার সুঠাম দীর্ঘ দেহের ছায়া পড়েছে রাস্তায়। লম্বা জনবিরল রাস্তাটায় থেকে থেকে শিউলির তীব্র সুবাস আসছে নাকে, পরিবেশে থমথমে একটা শূন্য মঞ্চের রোমাঞ্চ। কাছেই ডাকবাংলো, আর বেশি দূর নেই-এগিয়ে চলল রানা দৃঢ় পদক্ষেপে।

রানা ভাবছে, কথা তো দিয়ে এল, সাহায্য করবে মিত্রাকে… কিন্তু কীসের সাহায্য? কী বিপদ? কেমন সে চক্রান্ত? কতখানি ভয়ঙ্কর ওদের মরণ-ফাঁদ? * আজ রাত্রিটা রানার জীবনে এক চরম পরীক্ষার রাত। কিন্তু সিলেবাস বা প্রশ্নপত্র সম্পর্কে তার কোনও ধারণাই নেই! এমনকী কোন সাবজেক্টে পরীক্ষা সেটাও জানবার উপায় নেই। ও কী উত্তীর্ণ হতে পারবে?

থাক, অত ভেবে আর কী হবে-’কে সারা সারা, যা হবার তা হবে।

একটা গাড়ি চলে গেল ওর পাশ দিয়ে ডাকবাংলোর দিকে।

রানার রিপোর্ট এবং সোহেলের স্যাম্পল এতক্ষণে পৌঁছে গেছে হেড অফিসে। রাহাত খানের কঁচা-পাকা ভুরু জোড়া হঠাৎ মনে পড়ল রানার। অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব। কতদিন কত ভয়ঙ্কর কাজে রানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, পিঠে হাত রেখে শক্তি, সাহস জুগিয়েছেন পিতার মত। কিন্তু তবু যেন কত দূরে। এক আধটা কথায় স্নেহ ঝরে পড়েছে রানার প্রতি, আশীর্বাদের মত, সিক্ত হয়েছে ও কৃতজ্ঞতায়; তেমনি আবার ওর সামান্য ভুলে তার কঠোর শাসনের চাবুক। ক্ষতবিক্ষত করেছে রানার মন সত্যিই অদ্ভুত মানুষটা।

দোতলার ওপর নিজের ঘরে ঢুকেই রানা টের পেল, ওর অনুপস্থিতিতে এ ঘরে লোক ঢুকেছিল। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ও ঘরের। পাশের ঘরে মিত্রার চুড়ির রিনিঠিনি শোনা যাচ্ছে। কী করছে মিত্রা?

পাশাপাশি দুই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। ওদিক থেকে ছিটকিনি দেওয়া। দুপুরে রানা লক্ষ করেছিল দরজার ফুটোটা। ভাবল দেখি তো কী করছে। মেয়েটা। ফুটোয় চোখ রেখে অবাক হয়ে গেল রানা। এক ইঞ্চি দূরে আরেকটা চোখ! মৃদু হেসে সরে এল ও। একই ফুটোয় চোখ রেখে মিত্রাও দেখতে চেষ্টা করছে ওঁর কার্যকলাপ!

বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিল রানা… এই নিয়ে তিনবার হলো। তারপর একটা অ্যাশ কালারের ফুলহাতা প্লে-বয় শার্ট এবং নেভি ব্লু রঙের ফুল প্যান্ট পরে। নিল। টেবিলে ঢেকে রাখা পরোটা মাংস খেয়ে নিয়ে বাক্স থেকে উইস্কির বোতল এবং গ্লাস বের করে বিছানার পাশে টিপয়ের ওপর রাখল। এবার বিছানায় বসে হোলস্টার থেকে ওর জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী ডাবল অ্যাকশন সেমি অটোমেটিক পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটা বের করল। বেশি বড় ক্যালিবার পছন্দ করে না রানা। ও মনে করে বড় ক্যালিবারের ভারী বুলেটের চেয়ে প্রয়োজনের সময় হাতের টিপটাই বেশি কাজের। দ্রুত আটবার স্লাইড টেনে আটটা বুলেট বিছানায় ফেলল রানা। ইজেক্টার ক্লিপটা পরীক্ষা করল, কারণ ঠিকমত কাজ না করলে বিপদের সময়ে এ মারণাস্ত্র খেলনা হয়ে যাবে। ম্যাগাজিন রিলিজ বাটন টিপে খালি ম্যাগাজিন বের করে সাতটা গুলি ভরল ও তাতে। স্লাইড টেনে চেম্বারে বাকি গুলিটা ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে হ্যাঁমারটা নামিয়ে রাখল। এবার ম্যাগাজিনটা যথাস্থানে ঢুকিয়ে দিতেই ক্লিক করে ক্যাচের সঙ্গে আটকে গেল সেটা। গুলি ভরা দুটো এক্সট্রা ম্যাগাজিন পকেটে ফেলে পিস্তলটা আবার হোলস্টারে ভরে রাখল ও সন্তুষ্টচিত্তে। উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে বেড সুইচ টিপে তিন ওয়াটের নীল বাতি জ্বেলে দিল রানা। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানায় জুতো মোজা পরা অবস্থাতেই। এক ঘণ্টা পর নীল আলোটাও গেল নিভে।

চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এক ফুট দূর থেকেও নিজের হাত দেখা যায় না। এত অন্ধকার যে চোখ না বুজেও ঘুমানো যায়। চুপচাপ অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে আছে রানা। প্রতীক্ষা করছে। বাইরে ঝিঁঝি পোকার কোরাস ভরাট করে রেখেছে যেন অন্ধকারকে। কই, কিছু তো ঘটছে না।

এই বিদ্রি অপেক্ষার কি শেষ নেই? খুট করে একটা শব্দ হলো পাশের ঘরে। সজাগ হয়ে উঠল রানা। ঘটুক, যা হয় একটা কিছু ঘটুক। এভাবে অনির্দিষ্টকাল প্রতীক্ষা করা যায় না। কয়েকজন লোকের সাবধানী পায়ের শব্দ। চটাশ করে একটা চপেটাঘাতের আওয়াজ। মৃদুস্বরে দুই একটা কথাবার্তা। রানা বুঝল সময় উপস্থিত। ( হঠাৎ তীব্র ঝটকা খেয়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে এল রানা। কী হলো? এমন জোরে ইলেকট্রিক শক লাগল কেন? বুকের ভেতর জোরে হার্ট-বিট হচ্ছে। পেন্সিল টর্চটা জ্বেলে দেখল লোহার খাটের পায়ার সঙ্গে দুটো তার জড়ানো। তার দুটোর অন্য মাথা চলে গেছে পাশের ঘরে। রানা আগে টের পায়নি এ তারের অস্তিত্ব। আলতো করে খাটটা ছুঁয়ে দেখল কারেন্ট নেই এখন।

ব্যাপার কী? তাকে কি ইলেকট্রিক শক দিয়ে মারবার ফন্দি এঁটেছিল এরা? তা হলে এখন আর কারেন্ট নেই কেন? নাকি একটা বিশেষ মুহূর্তে যেন শক খেয়ে ওর ঘুম ভেঙে যায়, তারই জন্য এই ব্যবস্থা? রানা ঘুমিয়ে থাকলে এই শক লেগে তার ঘুম ভেঙে যেত, কিন্তু কিছুতেই ও বুঝতে পারত না হঠাৎ মাঝরাতে এমন ঘুম ভেঙে গেল কেন। কিন্তু তার ঘুম ভাঙাতেই বা চাইবে কেন জয়দ্রথ মৈত্র।

কাঠের সিঁড়িতে কয়েকটা পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। একটু পরেই একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ পাওয়া গেল।

মিত্রাকে নিয়ে যাচ্ছে না তো লোকগুলো? কথাটা মনে আসতেই এক লাফে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল রানা। দেখল মিত্রার ঘরের কপাট খোলা। একটা জীপ গাড়ি ডাকবাংলো থেকে বেরিয়েই ডান দিকে মোড় ঘুরল। পিছনে জ্বলছে দুটো লাল ব্যাক লাইট।

ছুটে মিত্রার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালল রানা। খাঁ খাঁ করছে খালি ঘর। তবে কি ও কথা রাখতে পারল না? কী মনে করবে মিত্রা? মনে করবে প্রাণভয়ে বিপদের সময় ঘর থেকে বেরোতে সাহস পায়নি ও।

তিনলাফে সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমে এল রানা। গাড়ি-বারান্দায় একটা লাল রঙের ওয়ান-ফিফটি হোণ্ডা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে স্টার্ট দেয়া অবস্থায়। ডাবল একজস্ট পাইপ দিয়ে অল্প অল্প ধোয়া বেরোচ্ছে। নাম্বার প্লেটে বিদেশি নম্বর দেখে রানা বুঝল কোনও টুরিস্ট হবে। হ্যাঁণ্ডেলের সঙ্গে একটা ক্যানভাসব্যাগ আর ওয়াটার-বটল ঝোলানো। পেছনের ক্যারিয়ারে কিছু মালপত্র চামড়ার বেল্ট দিয়ে বাঁধা।

ফ্রস্টেড কাঁচের জানালা দিয়ে আবছা দেখল রানা একজন ফর্সা মত লম্বা লোক ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। কাঁধে ঝোলানো, একটা ফ্লাস্ক। টুরিস্টই হবে।

একবার একটু দ্বিধা হলো রানার। কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী? লাফিয়ে উঠে বসল ও মোটরসাইকেলের ওপর। হেড-লাইট অফ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল ডাকবাংলো থেকে। রাস্তায় পড়েই ডানদিকে মোড় নিল মোটরসাইকেল।

জীপ গাড়িটার কোনও চিহ্ন নেই। পাকা মসৃণ নির্জন রাস্তা দিয়ে ফুল স্পীডে এগিয়ে চলল রানা। উইণ্ডস্ক্রিন নেই। হু হু করে বাতাস লাগছে চোখে মুখে। বাতাসের বেগে দুই চোখের কোনা দিয়ে পানি বেরিয়ে কানের নীচ দিয়ে গিয়ে শার্টের কলার ভিজাচ্ছে।

হঠাৎ খটকা লাগল রানার মনে। সবগুলো ঘটনা অস্বাভাবিক নয়? ঠিক সময়। মত ঘুম ভাঙাবার ব্যবস্থা, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, জীপ গাড়ি, চালু অবস্থায় রাখা হো মোটরসাইকেল। সব যেন সাজানো গোছানো ছিল রানার জন্যে! এমন তো হবার কথা নয়। ঠিক যেন মিল খাচ্ছে না। তা ছাড়া এত রাতে ম্যানেজারের তো কাউন্টারে থাকবারই কথা নয়! কার সঙ্গে কথা বলছিল টুরিস্ট? বুঝল রানা, ট্র্যাপে পা দিয়েছে সে। বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।

দূরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে জীপ গাড়ির লাল ব্যাকলাইট। স্পীড কমাল রানা।

রাজশাহী-নাটোর রোডে চলেছে ওরা।

.

এদিকে মিত্রার মনের মধ্যে চলছে তুমুল ঝড়।

জয়দ্রথ মৈত্রের ভয়ঙ্কর প্ল্যান শুনে চমকে উঠেছিল ও। বলেছিল, আমাকে এভাবে ব্যবহার করবার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আমার মামাকে যদি বলি তখন আপনার কী অবস্থা হবে?

হেসেছিল জয়দ্রথ। বলেছিল, ‘মামার ভয় আমাকে দেখিয়ো না, মিত্রা। তুমি ছেলেমানুষ, সব কথা বুঝবে না! আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই তোমার। আমার একটি মাত্র মুখের কথায় তোমার মামার মন্ত্রীত্বের পদ চিরতরে ঘুচে যেতে পারে। ও-ভয় আমাকে দেখিয়ো না। আমি যা বলছি তা-ই তোমাকে করতে হবে।

‘আমি কি বেশ্যা?’ চোখের জল আর সামলাতে পারেনি অসহায় মিত্রা। রাগে, দুঃখে, অপমানে গলা বুজে এসেছিল ওর।

‘দেখো মিত্রা, দেশের প্রয়োজনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে নিতে হয়। মাসুদ রানা শত্রু, ওকে ধ্বংস করতে হবে; তাতে তোমার আপত্তি নেই। কিন্তু, এটা বুঝছ না কেন, পাকিস্তানে এসে আমরা যথেষ্ট করেছি, এর পরেও আবার নিজেরা খুন-খারাবির মধ্যে জড়িয়ে পড়লে আমাদের এতদিনকার মাস্টার প্ল্যান একদম ফেঁসে যাবে। আমরা ওসব কাজে হাত দেব না। কাঁটা দিয়ে কাটা তুলব। ইয়াং টাইগারস-এর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, মিত্রা সেনকে আমরা তাদের হাতে তুলে দেব-বিনিময়ে তারা মাসুদ রানাকে সরিয়ে দেবে এ পৃথিবী থেকে। এ কাজে যদি কোনও হাঙ্গামা হয়, টাকার জোরে সব সামলে নেবে ওরা, আমাদের মাথা ঘামাতে হবে না।’

একদিকের ঘা ভিজিয়ে নিয়ে আবার আরম্ভ করেছিল জয়দ্রথ মৈত্র, অনেক ভেবে এই প্ল্যান এটেছি আমি। তোমাকে ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি ভারতে। তোমার প্রতি ইয়াং টাইগারদের আসক্তি অল্পদিনেই ফুরিয়ে যাবে। তারপর ওরা তোমাকে ব্যবহার করবে বড় বড় ব্যবসা ধরবার টোপ হিসেবে। অনেক বড় বড় অফিসার ওরা নিয়ে আসবে তোমার কাছে। তুমি তাদের আনন্দ দান করবে, বিনিময়ে তথ্য সগ্রহ করবে যা আমাদের প্রয়োজন। ঢাকায় আমাদের লোক তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবে।’

শিউরে উঠেছিল মিত্রা।

‘আর, একটা কথা ভালমত জেনে রাখো। যদি বিশ্বাসঘাতকতা করো, নির্মম মৃত্যু ঘটবে তোমার। এখন থেকে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কার্যকলাপ আমরা লক্ষ্য করব।’

আপনার পায়ে পড়ি, মৈত্র মশাই, আমাকে রেহাই দিন।’ সত্যিই পা ধরতে গিয়েছিল মিত্রা।

‘আমি দুঃখিত, সরে গিয়েছিল জয়দ্রথ। তুমি এখন যেতে পারো।

‘আর আপনার প্ল্যান অনুযায়ী মাসুদ রানা যদি আমাকে রক্ষার জন্যে এগিয়ে না আসে? তা হলে? আমাকে ভাসিয়ে দিলেন, ওকেও হত্যা করতে পারলেন না।

আসতেই হবে তাকে। ও যে ধাতুতে গড়া-কোনও নারীর অবমাননা সহ্য করবে না। সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেই। সে সব তোমার ভাবতে হবে না, নিখুঁত জাল পেতেছি আমি-শিকার তাতে পড়বেই।’ হেসে চলে গিয়েছিল জয়দ্রথ পাশের ঘরে।

এতখানি অসহায় অবস্থা মিত্রার জীবনে আর কখনও আসেনি। এ কী চক্রান্তে জড়িয়ে পড়ল সে? ভয়ানক রাগ হলো মাসুদ রানার ওপর। ওই… ওই শয়তানটার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা। ওকে যদি খুন করতে না চাইত জয়দ্ৰথ, তবে তো মিত্রাকে ইয়াং টাইগারস-এর হাতে তুলে দেবার প্রশ্নই উঠত না। আবার ভাবল,

বেচারা রানা জানবে কী করে যে ওকে হত্যা করার বিনিময়ে মিত্রাকে তুলে দিচ্ছে। জয়দ্রথ একদল বদমাইশের হাতে। জয়দ্ৰথই আসলে পাপিষ্ঠ, নীচ, নরাধম। তারপর আবার ভাবল, জয়দ্রথ তো নিজের স্বার্থে কিছু করছে না, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এঁটেছে এই ভয়ানক ষড়যন্ত্র। এ না করলে তো জয়দ্রথ কর্তব্যচ্যুত

তবে? তবে দোষ কার? মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যায় মিত্রার। দোষ মিত্রার ভাগ্যের। দোষ ওর রূপের, ওর যৌবনের। ও আত্মহত্যা করবে। আর তো কোনও পথ খোলা রইল না ওর জন্য!

হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসল মন। কেন? কেন সে ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর খেলাকে নীরবে সহ্য করবে? এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসবার কি কোনও পথই নেই? নিজেকে রক্ষা করবার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ও বাঁচতে চায়। বাঁচতে কে না চায়। দেশ, দলপতি, চক্রান্ত সব চুলোয় যাক। ও নিজেকে রক্ষা করবে। কিন্তু কী করে? এই বিদেশে কে আছে ওর আপনজন যে এগিয়ে এসে সাহায্য করবে? মাসুদ রানা?

অনেক ভেবে ও স্থির করেছিল সমস্ত চক্রান্তের কথা খুলে বলবে রানাকে। কিন্তু সুযোগ পেল কোথায়? চোখের ইঙ্গিতে ডেকে এনে গ্রিনরূমে যে দু’একটা কথা হলো, তাতে রানার কাছে কিছুই তো পরিষ্কার হলো না। কোনও কথা খুলে বলা হলো না, এসে পড়ল জয়দ্রথ মৈত্র। কী ধরনের বিপদ ওর জন্য অপেক্ষা করছে সে-সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই রানার। দলপতির বদ্ধমূল ধারণা, রানা যে চরিত্রের মানুষকেউ বিপদে পড়লে সে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। এবং তা হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। আজ সাবধান করে দেয়ার ফলে সে যদি মিত্রার সাহায্য প্রার্থনাকে ফাঁদে ফেলবার জন্য মিথ্যা অভিনয় মনে করে? যদি এগিয়ে না আসে, তা হলে? তা হলে মিত্রার নিশ্চিত মৃত্যু। ও যদি আত্মহত্যা না-ও করে, জয়দ্রথ হত্যা করবে। ওকে।

মাথাটা খারাপ হয়ে যাবি নাকি মিত্রার? রানা তো কথা দিয়েছেই। নিষ্ঠুর চেহারার লোক হলে কী হবে-নিশ্চয়ই সে তার কথা রাখবে। আশ্বাস খোঁজে মিত্রা এসব ভেবে।

উপায় নেই। তার খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে আছে একজন। টেপ রেকর্ডারের স্কুল পুকুরে ফেলে দেয়ায় মিত্রার ওপর সন্দেহ হয়েছে জয়দ্রথ মৈত্রের-সে আর কোনও সুযোগ দেবে না মিত্রাকে। অথচ ওই টেপ-রেকর্ডারের কথা মিত্রার জানাই ছিল না। ভাগ্যিস, রানা ওগুলো ফেলে দিয়েছিল-নইলে ওর বিশ্বাসঘাতকতার কথা আর গোপন থাকত না হিংস্র জয়দ্রথের কাছে। কিন্তু বুঝল কী করে মানুষটা!

এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল পাঁচজন ইয়াং টাইগার। একজন টর্চ ধরল মিত্রার দিকে, আর একজন তুলে নিল ওকে বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে। বাঁ হাতটা তার বেঁকে এসে মিত্রার স্তনের ওপর পড়ল। মুখে অশ্লীল হাসি। চুম্বন করবার জন্যে মুখ নামাচ্ছিল লোকটা-ঠাই করে এক চড় দিল মিত্রা তার গালে। বাঁ হাতটা যথাস্থানেই থাকল, কিন্তু পুনর্বার চুম্বনের চেষ্টা করল না লোকটা। দলের অন্যান্যদের কী একটা ইঙ্গিত করে বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে বাইরে। গাড়িতে এনে তোলা হলো মিত্রাকে। মিত্রা চেয়ে দেখল মোটরসাইকেলটা যথাস্থানেই আছে।

ছেড়ে দিল গাড়ি। মিত্রা এখন ওদের। যে যেখানে খুশি ওর দেহের ওপর হাত রাখছে অবাধে। অশ্লীল সব কথাবার্তা এবং রসিকতা চলেছে পরস্পরের মধ্যে।

চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল মিত্রার।

রানা কি কথা রাখবে? ও কি আসবে এই পিশাচদের হাত থেকে ওকে উদ্ধার করতে? কতদূর চলে এসেছে ওরা? রানা কি খোঁজ পাবে ওদের তাঁবুর? যদি দেরি হয়ে যায়? যদি সর্বনাশ ঘটে যায় রানা পৌঁছবার আগেই? শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল মিত্রা।

চোখ খুলেই দেখতে পেল মিত্রা বহুদূরে আবছা মত কী একটা আসছে গাড়ির পিছন পিছন। মাসুদ রানা! আসছে সে! হঠাৎ কেন জানি অদ্ভুত মায়া লাগল তার ওই দুঃসাহসী লোকটার জন্যে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মিত্রা শত্রুপক্ষের ওই দুর্দান্ত লোকটির জন্য। ইশ, কেন সে এই নিশ্চিত মৃত্যুর পথে টেনে আনল এমন একটা মানুষকে? যদি এখনও ওকে ফিরিয়ে দেয়ার উপায় থাকত কোনও। কিছু বুঝবার। আগেই শেষ করে দেয়া হবে যে ওকে।

ইয়াং টাইগাররাও দেখল রানাকে। কিছু কথা হলো ওদের নিজেদের মধ্যে

এক বিচিত্র ভাষায়। মিত্রা তার একবর্ণও বুঝল না।

বাম দিকের একটা সরু রাস্তায় ঢুকল এবার জীপ। কিছুদূর গিয়েই থামল জীপটা একবার। একটা বেরেটা অটোমেটিক সাব-মেশিনগান হাতে নেমে গেল। একজন। মাইল খানেক গিয়ে হাতের ডাইনে মাঠের মধ্যে আলো দেখা গেল। পাশাপাশি তিনটে তাঁবু খাটানো। জীপ এসে থামল একটা তাঁবুর সামনে।

সাঙ্কেতিক কিচির-মিচির ভাষায় একমিনিট কথাবার্তা বলল ওরা। তারপর লটারি করল নিজেদের মধ্যে। চারজন রিভলভার হাতে ছড়িয়ে পড়ল তাবুর। চারদিকের অন্ধকারে। আর লটারি বিজয়ী ধরল মিত্রা সেনের হাত।

‘হাত ছাড়ো! নখ-দাঁত ব্যবহার করে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল মিত্রা সেন।

‘ছোড় দেঙ্গে? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হা!’ আরও শক্ত হলো মুঠো।

এমনি সময় দূর থেকে দশ-বারো সেকেণ্ড মেশিনগানের একটানা বিশ্রী শব্দ ভেসে এল। এদিক-ওদিক প্রতিধ্বনি উঠল তার। কান পেতে শুনল সে শব্দ ওরা দুজন। দপ করে সব আশা ভরসা নিভে গেল মিত্রার। বুকের ভিতরটা দুর-দুর করে উঠল অজানা-এক আশঙ্কায়। হাত-পা অবশ হয়ে এল।

কুকুরের জিভ দিয়ে ঘাম ফেলার মত হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাসল বিজয়ী। তারপর প্রায় ছেচড়ে টান দিয়ে মিত্রাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভিতর।

পরিপাটি করে খাঁটিয়ার ওপর বিছানা পাতা। ছোট একটা টেবিলের ওপর হ্যাঁজাক জ্বলছে। আর কোনও আসবাব নেই তাবুর মধ্যে। সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে বিছানায় এনে ফেলল সে মিত্রাকে ধাক্কা দিয়েও সূরাতে পারল না ওকে মিত্রা। একটা ভেজা উত্তপ্ত ঠোঁট ঘৃণিত চুম্বন করল ওর ঠোঁটে। উত্তেজিত গরম নিঃশ্বাস পড়ছে ওর নাক-মুখে।

হঠাৎ লোকটা দাঁড়িয়ে উঠে কাপড় ছাড়তে আরম্ভ করল। এক হাতে ধরে থাকল মিত্রার হাত। উঠে আসতে চেষ্টা করলেই ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানার ওপর।

‘কিউ বেকার ল্যড়তি হো, পেয়ারী?

নগ্ন লালসা ওর দৃষ্টিতে। অন্ধ কামোত্তেজনায় ফ্যাকাসে মুখের চেহারা। নাকটা ফুলে গেছে একটু। কাপড় ছাড়া দেখে ভয়ে ঘৃণায় চোখ বন্ধ করল মিত্রা। বিছানায় উঠে এল লোকটা। ঘৃণিত চুম্বন করল দ্বিতীয়বার।

হাতটা একটু আলগা পেয়ে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল মিত্রা। কিন্তু চট করে আঁচল ধরে ফেলল লোকটা। এক পাক ঘুরে থমকে দাঁড়িয়েই চোখ পড়ল মিত্রার একটা দীর্ঘ মূর্তির ওপর। নিজের চোখকেও বিশ্বাস, করতে ভরসা হচ্ছে না ওর।

তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাসুদ রানা!

.

০৭.

৩১ আগস্ট, ১৯৬৫।

‘চোখ বন্ধ করো; মিত্রা।

গম্ভীর কণ্ঠ রানার। হাতে তার ওয়ালথার পিপিকে। নলটা আরও কয়েক ইঞ্চি বড় হয়ে গেছে সাইলেন্সর লাগানোতে। চোখ বন্ধ করল মিত্রা। ধড়মড় করে বিছানা থেকে লোকটার ওঠার শব্দ পাওয়া গেল। দুপ। একটা মৃদু গম্ভীর শব্দ। তারপরই একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল মাটিতে ভারী কিছু।

‘শিগগির বাইরে চলে এসো। মাটির দিকে চেয়ো না।’

তবু থেকে বেরিয়েই এক দৌড়ে একটা আমগাছ তলায় এসে দাঁড়াল, ওরা। রানা বলল, ‘চিৎকার শুনে এক্ষুণি আরও লোক এসে পড়বে। কোয়ার্টার মাইল দূরে মোটরসাইকেল। পালাতে হবে এখন জলদি।’

কথাটা শেষ হতে না হতেই তিন দিক থেকে টর্চ জ্বলে উঠল। গর্জে উঠল তিনটে রিভলভার। চট করে আমগাছের আড়ালে সরে গেল রানা মিত্রাকে নিয়ে, তারপর একটা টর্চ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল।

বাপস! মোটা কর্কশ গলার আওয়াজ এল। গুলি গিয়ে ঢুকল একটা টর্চের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গেই নিভে গেল সব টর্চ রানার অব্যর্থ গুলির ভয়ে। কিন্তু আরও একবার গর্জে উঠল তিন রিভলভার। মিত্রাকে নিয়ে মাটির ওপর দিয়ে বুকে হেঁটে সরে গেল রানা বেশ অনেকটা বাম দিকে। আগেই রাস্তার দিকে গেল না। বিশগজ ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে রাস্তা। তিনজনই আশা করবে রানা ওই পথে যাবে। গুলি। এড়িয়ে রাস্তায় ওঠা সহজ হবে না।

গাছের আড়ালে চলে গেছে চাঁদ। মিনিট দুয়েক চুপচাপ থেকে একটা টর্চ হঠাৎ রাস্তার দিকে একবার ফোকাস করেই নিভে গেল। সেই আলোয় রানা দেখল, গলির মুখের কাছাকাছি মেশিনগানধারী যে লোকটাকে কায়দা করে ও বন্দি করেছিল, সেই লোকটা কোনও রকমে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে তাঁবুতে ফিরে। আসছে।

তিনটে রিভলভার গর্জে উঠল একসঙ্গে। ঢিল খেলে কুকুর যেমন শব্দ করে ঠিক তেমনি একটা শব্দ করে বসে পড়ল লোকটা মাটিতে। রানা এবার দ্রুত বাম দিকের ঝোঁপঝাড়ের দিকে সরতে থাকল। দুটো টর্চ জ্বলে উঠল এবার অনেকটা নির্ভয়ে। ইচ্ছে করলে তিনজনকেই শেষ করে দিতে পারে রানা, কিন্তু তা না করে চুপচাপ মাটির সঙ্গে সেঁটে থাকল। রানার কয়েক ফুট পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল তিনজন আহত লোকটার দিকে। মাটিতে পড়ে ছটফট করছে বটে, কিন্তু গুলি করতে পারে ভেবে আরও কয়েক রাউণ্ড গুলি করল ওরা গজ দশেক দূরে দাঁড়িয়ে। একেবারে স্থির হয়ে যেতেই এগিয়ে গেল সামনে।

রানা ততক্ষণে মিত্রার হাত ধরে জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে রাস্তায় গিয়ে। পড়েছে। মিনিট পাঁচেক, একটানা ছুটে একটা ঝোঁপের ধারে দাঁড়াল রানা। মোটরসাইকেলটা নিয়ে এল ওধার থেকে।

একটু দ্বিধা করল মিত্রা মোটরসাইকেলের পেছনে উঠতে। টাইমবম্বটার কথা মনে হলো। কিন্তু আর তো উপায় নেই এখন। কাঁচা রাস্তা দিয়ে যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে চলল ওরা বড় রাস্তার দিকে।

বড় রাস্তায় বাস-টাস পাওয়া যাবে না?’ জিজ্ঞেস করল মিত্রা।

‘এত রাতে কোথায় কীভাবে বাস পাবে? আর বাসের দরকারই বা কী? এই ষাট মাইল যেতে বড় জোর সোয়া ঘণ্টা লাগবে হোণ্ডায়।’

না, মানে, আমরা কোনও ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে তো লুকিয়ে থাকতে পারি রাতটা। সকালে না হয় বাসে ফেরা যাবে রাজশাহী।

হঠাৎ বাসের প্রতি তোমার এত ভক্তি কেন, মিত্রা? হেসে জিজ্ঞেস করল রানা।

কোনও উত্তর দিল না মিত্রা। ওর অস্বস্তিটা মনে মনে উপভোগ করছে রানা। বড় রাস্তায় উঠল ওরা। হেড-লাইট জ্বেলে দিয়ে মাইল মিটারের দিকে চেয়ে বলল, ‘সিক্সটি ফাইভ।

পেছনে শক্ত করে রানার কাঁধ ধরে বসে আছে মিত্রা। বাতাসে ওর চুল উড়ে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে রানার গলায়।

‘মোটরসাইকেলটা আমাদের ত্যাগ করা উচিত, বেশ কিছুক্ষণ উসখুস করে বলল মিত্রা।

‘কেন, বলো তো!

তুমি জানো না, এতে টাইমবম্ব ফিট করা আছে। অল্পক্ষণেই ফাটবে।’

টাইমবম্ব? তা, এতক্ষণ বলোনি কেন? আশ্চর্য হয়ে গেল রানা। কিন্তু মোটরসাইকেলের স্পীড কমাল না একটুও।

‘সেই কখন থেকেই তো বলছি, শুনছ তো না। আর শুনেও তো থামাচ্ছ না! উদ্বেগ প্রকাশ পেল মিত্রার কণ্ঠে।

‘ওটা এখন আমার পকেটে। নির্বিকার চিত্তে জবাব দিল রানা।

হাঁ হয়ে গেল মিত্রা। ভাবল, সাঙ্ঘাতিক ধুরন্ধর লোক তো ব্যাটা! নইলে আর এত নাম! আমাদের সার্ভিসে এর মতন একটা লোকও যদি থাকত। এতবড় বুকের পাটা আর এমন প্রশস্ত মন!

তুমি ঠিক সময় মত গিয়ে না পৌঁছলে আমার কী যে অবস্থা হোত! মেশিনগানের আওয়াজ শুনে আমি তো সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

‘হ্যাঁ, আমিও তাই চেয়েছিলাম। পেছন থেকে গিয়ে ব্যাটাকে কাবু করে ফেলে ফাঁকা আওয়াজ করেছিলাম যাতে সবাই নিশ্চিন্ত থাকে আমার মৃত্যু সম্পর্কে।

‘উহ! তুমি মনে করে কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল ওরা ওই লোকটাকে!

মাইল মিটারের কাটা একেকবার সত্তরের ঘরে গিয়ে থর থর কাঁপছে–আবার খারাপ রাস্তায় চল্লিশ এমনকী তিরিশে আসছে নেমে। জোর বাতাসে আঁচল উড়ছে মিত্রার। সামনের রাস্তাটা আলোকিত করে এগিয়ে চলেছে ওরা। পেছনে বিশাল অন্ধকার যেন গ্রাস করতে চাইছে ওদের। তেড়ে আসছে হিংস্র নখদন্ত বের করে, কিন্তু ধরতে পারছে না ওদের, পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা সামনে। আকাশে। মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তারার চোখে নীল আলো। মুক্তির আনন্দে মিত্রা বলছে জয়দ্রথের চক্রান্তের কথা–কিন্তু বেশ কিছু রেখে ঢেকে।

তা হলে এই ছিল প্ল্যান? আমাকে হত্যার বিনিময়ে ওরা পাচ্ছিল তোমাকে?

হ্যাঁ।

‘আহ্‌-হা। আমি যদি পেতাম এমন সুযোগ। সব শালাকে সাফ করে দিতাম।’

বুঝলাম, মস্ত বীরপুরুষ তুমি। কিন্তু আমাকে নিয়ে কী করতে? বৌ ছেলেমেয়ে নেই?

নাহ্। প্রথমটাই হলো না-শেষেরগুলো আসবে কোত্থেকে?

‘বিয়ে করোনি কেন?

‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না। তা ছাড়া আমার এই বিপজ্জনক জীবনে কে আসবে? মেয়েরা বড় হিসেবী।

ভুল করে চেয়েছিলে কাউকে?

‘চেয়েছি।’

কাকে?

‘শুনে তোমার লাভ? ভাবছ গদগদ কণ্ঠে তোমার নাম বলব, না? আর কলকাতায় ফিরে পাকিস্তানী এক ছোঁড়াকে পাগল করে দিয়ে এসেছ ভেবে অনাবিল আনন্দ লাভ করবে। সেটি হচ্ছে না।’

তুমি একটা ছোটলোক।

কথাটা বলেই কাধ ছেড়ে দিয়ে আলতো করে রানার মাথার পেছনে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিল মিত্রা। কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে একমুঠি চুল আলগা করে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল রানার মাথাটা। আবার বলল, তুমি একটা ছোটলোক।

একটু পরেই চমকে উঠল মিত্রা। পিছন থেকে একটা গাড়ি আসছে না?

রানা! ভয়ে কেঁপে উঠল মিত্রার কণ্ঠস্বর। ওরা আসছে পিছন পিছন।

‘রিয়ারভিউ-মিররে অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি। বিপদেই পড়া গেল। এগিয়ে। আসছে ওরা ফুল স্পীডে। আমরা চল্লিশের বেশি স্পীড তুলতে পারছি না। আর দশ মিনিটেই ধরে ফেলবে ওরা আমাদের।’

তা হলে উপায়? উৎকণ্ঠিত মিত্রার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা। জবাব দিল না রানা, দ্রুত চিন্তা চলছে ওর উর্বর মস্তিষ্কের ভিতর।

ধীরে ধীরে পেছনের হেড-লাইটের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর কোনও উপায় নেই। একটা পিস্তল নিয়ে মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। এগিয়ে আসছে জীপ। এবার নিশ্চিত মৃত্যু।

হঠাৎ সামনের হ্যাঁণ্ডেল থেকে মিলিটারি মডেলের বড় ওয়াটার বটলটা নিয়ে। মিত্রাকে দিল রানা। বলল, এর মুখটা খুলে ভেতরের পানি সব ফেলে দাও তো, মিত্রা।

‘এটা দিয়ে কী হবে?’ জিজ্ঞেস করল মিত্রা।

‘প্রশ্ন নয়, যা বলছি তাই করো। জলদি! গম্ভীর রানার কণ্ঠ। পানি ফেলে দিল। মিত্রা কর্ক খুলে।

হঠাৎ ডাইনের মোড়টা ঘুরেই লাইট অফ করে দিয়ে কষে ব্রেক চাপল রানা। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে মিত্রা। কয়েক গজ গিয়েই থেমে গেল ভারী। মোটরসাইকেল। স্ট্যাণ্ডে তুলে দিয়ে মিত্রার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে টান দিয়ে ফুয়েল পাইপটা খুলে ফেলল সে। বোতলটা ধরল পাইপের মুখে। দ্রুত নেমে আসতে থাকল পেট্রোল।

পিছনের গাড়িটা একেবারে কাছে এসে পড়েছে এবার। ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হেড-লাইটের আলোয় রাস্তার সোজাসুজি মস্ত ছাতার মত ছাতিম গাছটা, আলোকিত। দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা। এক্ষুণি এসে পড়বে। আর অপেক্ষা করা যায় না। বোতলটার চারভাগের তিনভাগ ভরতেই পেট্রোল শেষ হয়ে গেল ট্যাঙ্কের। মিত্রার হাত ধরে এবার দৌড়ে রাস্তার ডানদিকের একটা শুকনো নালা পেরিয়ে ঝোঁপের ধারে সজনে গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল রানা। পকেট থেকে রুমাল বের করে ভিজিয়ে নিল পেট্রোলে। রুমালের অর্ধেকটা ঢুকিয়ে দিল পেট মোটা ওয়াটার-বটলের মধ্যে, বাকি অর্ধেক বাইরে বের করে রেখে ওটার মুখে কর্ক এঁটে দিল শক্ত করে। মুখে বলল, মলোটভ বম্ব।’

মোড় ঘুরেই ব্রেক করল জীপটা রাস্তার মাঝখানে মোটরসাইকেল দেখে। রাস্তার উপর দিয়ে হেঁচড়ে কিছুদূর গিয়ে পিছন দিকটা স্কিড করে একটু বাঁয়ে। হেলে থামল জীপ। তিন সেকেণ্ড থমকে থাকল। তারপর এক পশলা গুলি বর্ষণ করল মোটরসাইকেলটার ওপর।

একটা শেয়াল বোধহয় এতক্ষণ গোপনে লক্ষ্য করছিল রানা ও মিত্রার সন্দেহজনক কার্যকলাপ। গুলির শব্দে হাত পাঁচেক দূরের একটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল। পাতার ওপর মচমচ শব্দ হতেই আবার গর্জে উঠল। মেশিনগান। একটা চিৎকার করেই পড়ে গেল শেয়ালটা মাটিতে।

এবার একজনের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল:

উতারো স্যব গাড়িসে! ঢুণ্ডকে নিকালো উও কুত্তাকো।

খট করে শব্দ হলো রানার লাইটারের। রুমালের এক কোণে আগুনটা ছুঁইয়ে দিয়েই ছুঁড়ে মারল ও বোতলটা গাড়ির ওপর। আলো দেখেই আবার ক্রুদ্ধ গর্জন

করে উঠল বেরেটা মেশিনগান। নরম সজনে গাছের গায়ে ফুটো হয়ে গেল। অনেকগুলো।

ব্যাপারটা বোঝার আগেই রানার আগুনে বোমাটা গিয়ে পড়ল জীপের ভিতর। বিস্ফোরণের শব্দ হলো একটা। দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল গাড়িতে। সর্বাঙ্গে আগুন লেগে গেছে ভেতরের লোকগুলোর। হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে পাগলের মত চিৎকার করছে চারজন ইয়াং টাইগার। সারা শরীরে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। জীপের পেট্রোলট্যাঙ্ক বাস্ট করল। নরক কুণ্ড জ্বলে উঠল যেন। আগুনের লেলিহান শিখা উঠল পঁচিশ-তিরিশ হাত উঁচু পর্যন্ত। সেই উত্তাপের হল্কা এসে লাগল রানা ও মিত্রার মুখে। মাংস পোড়া গন্ধ ছুটল চারদিকে। এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চোখ ঢাকল মিত্রা।

বহু কষ্টে এক ছোকরা জীপ থেকে বেরোল। মশালের মত আগুন জ্বলছে ওর সারা দেহ ঘিরে। একটা চুলও নেই মাথায়। দু-তিন পা এগিয়েই আছাড় খেল রাস্তার উপর। বীভৎস দৃশ্য।

আগুন একটু কমলে পর মোটরসাইকেলটা স্ট্যাণ্ড থেকে নামাল রানা। ঠেলে আরও কয়েক গজ দূরে নিয়ে গেল আগুন থেকে।

‘ট্যাঙ্কে তো আর পেট্রোল নেই। এখন ফিরব কী করে?’ মিত্রা জিজ্ঞেস করল।

উত্তর না দিয়ে ফুয়েল পাইপটা যথাস্থানে লাগিয়ে নিয়ে রিজার্ভ ট্যাঙ্কের চাবি খুলে দিল রানা। স্টার্টার বাটুন টিপতেই মৃদু গর্জন করে চালু হয়ে গেল ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন।

আবার হু হু করে বাতাস কেটে অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলল ওরা রাজশাহীর দিকে। আরও বিশ মাইল আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেছে রানার। বিয়োগান্ত নাটক দেখে বেরিয়ে এসেছে যেন। জোর করে দূর করে দিল ও মন থেকে দুঃস্বপ্নের মত ঘটনাগুলোর স্মৃতি।

চাঁদ ডুবে গেছে। জ্বলজ্বল করছে শুভ্র তারাগুলো, যেন শিশির ভেজা। থেকে থেকে হাসনাহেনা, শিউলি আর ছাতিমের ভারী সুগন্ধ জমাট বেঁধে আছে রাস্তার উপর। একটা নক্ষত্র খসে পড়ল।

রানা।’

বলো।’

যখন তারা খসে পড়ে তখন নাকি মনে মনে যে যা চায় তাই পায়? তুমি বিশ্বাস করো একথা?’

‘তুমি নিশ্চয় করো? কী চাইলে শুনি?

‘তোমাকে। গালটা রাখল সে রানার পিঠের উপর।

তথাস্তু।’ খোদ ভগবানের মত বলল রানা। তারপর হাসল।

‘রানা। আবার ডাকল মিত্রা একটু পর।’

কী বলছ?’

‘তোমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলাম, তুমি দিয়েছ। আমার কাছে কি তোমার কিছুই চাওয়ার নেই?

‘আছে, যা চাইব দেবে?

‘তোমার জন্যে সব দিতে পারি আমি এখন।

‘সত্যিই?’

সত্যি। কী চাও তুমি বলো?

‘ইনফরমেশন।

কেউ যেন কালি মাখিয়ে দিল মিত্রার মুখে। এক মুহূর্তে বাস্তব জগতে ফিরে। এল সে। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাসুদ রানা ইনফরমেশন চাইছে। ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের মিত্রা সেনের কাছে। কথা দিয়েছে সে। এখন ফেরাবে কী করে? চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।

‘দ্বিধা হচ্ছে, মিত্রা? জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ। নিজের স্বার্থে জয়দ্রথের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার কাছে সাহায্য চেয়েছি আমি রানা। কেবল নিজেকে রক্ষা করবার জন্যে। তোমার বিরুদ্ধে জয়দ্রথের চক্রান্ত সফল হলো না আমি স্বার্থপরের মত বিশ্বাসঘাতকতা করলাম বলে। অদ্ভুত এক মানসিক পীড়ায় ভুগছি আমি, রানা। আমার বিবেক ছিন্নভিন্ন করছে আমাকে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমি অন্যায় করেছি। তবু সান্ত্বনা ছিল-নিজেকে রক্ষা করবার অধিকার সবার আছে। কিন্তু তোমাকে যদি আমি কোনও ইনফরমেশন দিই তবে কোনও সান্ত্বনাই আর থাকবে না আমার, রানা। তোমাকে কথা দিয়েছি, যদি বলো দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতিনী হতে…

‘থাক তা হলে।

‘আমাকে ক্ষমা করো, রানা। তা ছাড়া আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছু…’

‘বেশ, ক্ষমা করে দিলাম।

আর কিছু চাইবে না?’

না।

‘আমি যদি কিছু দিই গ্রহণ করবে?

‘দিয়েই দ্যাখো না!’

তীরের মত বাতাস ভেদ করে এগিয়ে চলল শক্তিশালী দ্বিচক্র যান। এসে পড়েছে রাজশাহী। সারি সারি বন্ধ দোকানপাট আর দালান-কোঠা ছাড়িয়ে চলল। ওরা ডাকবাংলোর দিকে। মোটরসাইকেলটা ডাকবাংলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দ পায়ে উঠে এল ওরা দোতলায়। সারা ডাকবাংলো ঘুমে। অচেতন। ঘড়িতে বাজে চারটে।

প্রথমেই পিস্তলটা পরিষ্কার করল রানা যত্নের সঙ্গে। আরও দুটো গুলি ভরে নিল ম্যাগাজিনের মধ্যে। শরীরে ক্লেদাক্ত ক্লান্তি। আবারও গোসল করল রানা। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। গোটা শহরটা নিঝুম ঘুমে আচ্ছন্ন। দূরে লাইট পোস্টের আলোর চারধারে কতগুলো পোকা ঘুরছে অনবরত। অনেক কথা ভাবছে সে। অনেক অনেক পুরনো কথা।

খুট করে একটা শব্দ হলো ঘরের ভিতর। মাঝের দরজাটা খুলে মিত্রা এসে দাঁড়াল রানার পাশে। মিষ্টি একটা সেন্টের সুবাস ওর দেহে। মুখে সযত্ন প্রসাধন।

কী মিত্রা, ভয় করছে?

না। চাপা গলায় ছোট্ট উত্তর।

তবে?

একা একা ভাল্লাগছে না। ঘুম আসছে না কিছুতেই।

রানার একটা হাত তুলে নিল মিত্রা ওর হাতে। গালের ওপর রাখল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ চেপে ধরল সেটা বুকের উপর।

‘চলো, ঘরে গিয়ে গল্প করি দুজন।’ মৃদু টান দিল সে রানার হাত ধরে।

এক মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে নিল রানা। তাকাল মিত্রার মুখের দিকে। মাথাটা নীচু করল মিত্রা। চিবুক ধরে মিত্রার লজ্জিত মুখটা উঁচু করল রানা। চোখে

চোখে চেয়ে থাকল দু’জন। রানা দেখল উদগ্র কামনায় জ্বলছে নারীর চোখ।

দূরের লাইট পোস্ট থেকে ম্লান আলো এসে পড়েছে। চিক চিক করছে মিত্রার আধবোজা ভীরু চোখ। শেষ রাতের শিশির ভেজা অন্ধকারকে শিউরে দিয়ে কাছেই কোনও বাড়িতে কেঁদে উঠল একটি শিশু।

ওরা দুজন হাসল। ঠাণ্ডা এক দমকা বাতাস এসে দুলিয়ে দিল মিত্রার শাড়ির আঁচল। ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে চলে এল ওরা।

আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এল মিত্রা। আলতো করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল রানা। ওর বিবশ দেহ।

তিন ওয়াটের নীল বাতিটা চেয়ে চেয়ে দেখল, এক সময় ফুঁপিয়ে উঠে দুই হাতে চোখ ঢাকল মিত্রা সেন।

.

সকাল আটটায় ঘুম ভাঙল রানার। পাশে কেউ নেই। পাশের ঘরেও কেউ নেই। সারা ডাকবাংলোতে মিশনের কেউ নেই। ভোজবাজির মত যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক মিশনের গোটা দলটা।

.

০৮.

২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।

মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও, মাসুদ রানা! ঠিক চার ফুট সামনে থেকে ভেসে এল জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

এয়ারকুলারের একটা মৃদু গুঞ্জন এল কানে। সাউণ্ড প্রুফ ঘরটায় একজনকে গুলি করে হত্যা করা হলে পাশের ঘরের কেউ টের পাবে না। কিন্তু চমকে উঠল না রানা। ডান হাতটা দ্রুত চলে এল না কোটের নীচে বগলের কাছে লুকানো। স্প্রিংলোডেড শোল্ডার হোলস্টারের কাছে। এক লাফে সরে গেল না, ও আততায়ীকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার জন্য। যেমন ছিল, তেমনি স্থির হয়ে বসে রইল। কোনও রকম চাঞ্চল্যই প্রকাশ পেল না রানার ব্যবহারে। কারণ, কথাটা উচ্চারিত হয়েছে পুরু কাঁচ ঢাকা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে পিঠ-উঁচু চেয়ারটায়। বসা মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খানের কণ্ঠ থেকে।

বড় বীভৎস মৃত্যু, স্যর! যাই হোক, আমি প্রস্তুত। কিন্তু ঘণ্টা তিনেক সময়। দিতে হবে। মৃত্যুর পর তো আর হবে না-কয়েকটা কাজ সেরে নিতে চাই।’

‘আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় আছে। হাভানা ধরিয়ে নেবার জন্য থামলেন রাহাত খান, তারপর টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন, আর এই চিঠিটা রেখে দাও। ইচ্ছে করলে আজই নাভানা ট্রের্ডাস থেকে ডেলিভারি নিতে পারো তোমার নতুন টয়োটা করোনা গাড়ি।

করোনা পেয়ে রানার ভিতরে কী প্রতিক্রিয়া হবে ভালভাবেই জানা আছে রাহাত খানের। তাই আর রানার মুখের দিকে না চেয়ে একটা ফাইল নিয়ে পাতা ওল্টাতে আরম্ভ করলেন।

রানা তুলে নিল চিঠিটা। শেষ কালে ফিফটিন হান্ড্রেড সিসি ফ্যামিলি কার! ছি, ছি। ক্ষোভে, দুঃখে নিজের আঙুল কামড়াতে ইচ্ছে করল রানার। মনটা বিষিয়ে গেল বসের উপর। অনেক চেষ্টায় মুখের চেহারাটা ভদ্রোচিত রেখে বলল, ‘কিন্তু। অন্য কোনও বাজে গাড়ি নিয়ে গেলে হয় না, স্যর? আমার জাগুয়ারটা এভাবে ভেঙেচুরে…মানে ওটা আমার…’

যত প্রিয় গাড়িই হোক না কেন ওটাতেই তোমার অ্যাকসিডেন্ট করতে হবে। গাড়ির চেয়ে তোমার প্রাণের মূল্য অনেক বেশি। আমি চাই না ভবিষ্যতে তুমি একটা অসাধারণ গাড়ি চালিয়ে ফিল্ম স্টারের মত সবার মুখ-চেনা হয়ে যাও। ওই গাড়ি চালানো আজই শেষ। আরেকটা জিনিস, শত্রুপক্ষের ফাইলে তোমার অভ্যাস সম্পর্কে একটা স্পেশাল নোট আছে। সেটা হচ্ছে তোমার সিগারেটের ব্র্যাণ্ড–সিনিয়র সার্ভিস। ওটা ত্যাগ করে আমাদের দেশি কোনও ব্র্যাণ্ড বেছে নিতে হবে তোমাকে। চোখে পড়ার মত কোনও শখ বা অভ্যাস তোমার জীবনে হারাম।’

বুঝলাম, স্যর। কিন্তু হঠাৎ আমার মৃত্যু-সংবাদ ছাপছেন কেন কাগজে? চেনাজানা লোক জিজ্ঞেস করলে কী বলব? কাজের কথায় আসতে চেষ্টা করল রানা।

‘আগামী কয়েকদিন চেনাজানা লোকের সঙ্গে তোমার দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। আগামীকাল ভোর চারটের ফ্লাইটে তুমি যাচ্ছ রেঙ্গুন হয়ে ব্যাঙ্কক। তারপর থাইল্যাণ্ডের ব্যবসায়ী হিসাবে আসছ কলকাতায়-ওখান থেকে যাচ্ছ টিটাগড়। আমি চাই আইএসএস যেন তোমার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে। সহজে যেন তোমার ছদ্মবেশ ধরতে না পারে। ওরা খবরের কাগজ এবং গোপন ওয়ায়ারলেসের মাধ্যমে তোমার মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ পাবে। কল্পনাও করতে পারবে না তোমার টিটাগড়ে উপস্থিতি। তারপর যখন কাজ উদ্ধার করে ফিরে আসবে এখানে… অবশ্য যদি ফেরা সম্ভব হয়, (মুচকে হাসলেন রাহাত খান) তখন ভুল সংশোধন করে ছোট্ট দু’তিন লাইন আবার ছাপা যাবে পত্রিকায়। সে সব তোমার ভাবতে হবে না।

‘টিটাগড় গিয়ে কী করতে হবে আমাকে?

‘সেটা বলবার জন্যেই ডেকেছি আজ তোমাকে। আধঘণ্টার মধ্যেই আসছেন জুয়োলজিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর ডক্টর আলী আকবর। অনেক কথা জানতে পারবে তার কাছে। তার আগে এই পৃষ্ঠা দুটোতে একবার চোখ বুলিয়ে নাও। ‘B’ লেখা কাগজটা ভাল করে পড়ো; ওইটাই আসল।

সাগ্রহে ফাইলটা নিল রানা। কিন্তু পরমুহূর্তেই চুপসে গেল ফাটা বেলুনের মত। হাফ-ফুলস্ক্যাপ কাগজের ওপর ইংরেজিতে টাইপ করা:

‘A’

LOCUST Species:

1. Locusta migratoria L.-widest range of distribution, universal between L. 20-N-60-S: five sub. species.

(a) L. migratoria migratoria-South East Russia.

(b) L. migratoria rossica-Central russia & Western Europe.

(c) L. migratoria migratorioides-Africa & Western Asia.

(d) L. migratoria capito-Madagascar.

(e) L. migratoria manilensis-Malayasia, East Indies, Phillipines & China.

2. Melanophis Spretus Walsch (M. mexicanus Sanss). Plains of America.

3. Chortoicetes terminfera (walker) –Australian Plague Locust.

4. Docistaurus maroccanus-Moroccan Locust-Countries of the Mediterranean, West & South Russia.

5. S. Peranensis-South American Locust.

6. Locustana pardalina-Brown Locust-South Africa.

7. Nomadacris septemfasciata-Red Locust-South Africa.

8.Schistocera gregaria-Desert Locust-Whole of Africa and wes tern Indo-Pakistan.

9. Patanga succincta-(Acridium succinctum)–Bombay Locust– Indo-Malayasia.

‘B’

Patanga succincta

(Bombay Locust)

1. Breeding habit-desert or semi-desert areas.

2. 150 to 200 eggs at a time in the sand by a single female.

3. Humidity and temperature have great effect at all phases.

4. Morphological diff.-Ph. gregaria-6 eyestrips
26antennal segments
ph. solitaria-6-7 eye strips
27-28 antennal segments.

5. Stages a) Egg) b) Pupa c) Larva (hopper) d) Adult.

6. Swarm Movements-Down-wind direction.

7. Wing Movement-17 cycles per second.

8. Speed-2.5 miles to 3 miles per hour.

9. Flight habit-Day time. Never fly at night or early morning.

10.Locusticides. r-BHC and DNC are effective. But no locusticide can repulse a swarm at flight.

.

কাগজ দুটো শেষ করেই চোখ তুলল রানা। দেখল তার দিকে চেয়ে আছেন রাহাত খান। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।

‘এ যে দেখছি পঙ্গপালের ইতিবৃত্ত! এর সঙ্গে টিটাগড়ের সম্পর্ক কী?

সত্যিই কোনও সম্পর্ক আছে কি না আমরা কেউ-ই জানি না। সবই অনুমান। নিশ্চিত হবার জন্যেই তোমাকে পাঠানো হচ্ছে সেখানে। এখন শোনো, সবটা ব্যাপার খুলে বলি। তুমি যে সবুজ গোলাকার জিনিসটা পাঠিয়েছিলে ঈশ্বরদি থেকে, সেটা একটা বিচিত্র টাইমবম্ব। এর মধ্যে ঘড়ির মত কোনও ব্যবস্থা নেই। ছোট্ট একটা ছিদ্রবিশিষ্ট অ্যাসিডের ক্যাপসুল আছে। একটা প্লাস্টিকের ফিউজকে নির্দিষ্ট গতিতে জ্বালাতে জ্বালাতে এগোচ্ছে সে অ্যাসিড। যখনই পুরো পাস্টিকের ফিউজটা ক্ষয় হয়ে যাবে, অমনি ফাটবে বম্ব।’

এইবার কিছুটা উৎসাহ বোধ করল রানা। সোজা হয়ে বসল সে। ছাই ঝেড়ে নিয়ে আবার আরম্ভ করলেন রাহাত খান।

কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো? ওর ভেতর লোহা লক্কড়ের বদলে আছে পাতলা কয়েকটা কাঁচের গোলক। তেল জাতীয় একটা জিনিস ভরা সবগুলোর মধ্যে। বোমাটা ফাটলে পরে এগুলো ছিটকে অনেক দূরে গিয়ে পড়বে।

কী জিনিস ভরা সেই কাঁচের বলে?

Molasses scent-চিটাগুড়ের গন্ধ। আর কিছু না। বল ভাঙলেই দশ মিনিটের মধ্যে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে ভেসে। ডক্টর আলী আকবর ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন একটা বল। ওঁর রিপোর্টে দেখছি প্রথম চিটাগুড়

থেকে তেল জাতীয় এই গন্ধ এক্সট্রাক্ট করে নিয়ে তার মধ্যে হাইপ্রেশার দিয়ে। হাইড্রোজেন মলিকিউল তুলে নিয়ে বয়লিং পয়েন্ট পনেরো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট করে দেয়া হয়েছে। একে ডিহাইড্রোজেনেশন বলে। বয়লিং পয়েন্ট যদি অতখানি নিচু করে দেয়া যায় তা হলে এ ধরনের যে কোনও জিনিস মিনিমাম অ্যাটমসফেরিক। টেম্পারেচারেও এভাপোরেট করবে। বাতাসে উড়ে যাবে স্পিরিটের মত।

কিন্তু তাতে লাভ কী হবে ভারতের?

‘সেটাই তো প্রশ্ন। হিসেব করে দেখা গেছে, যে হারে প্লাস্টিক ফিউজটা ক্ষয় হচ্ছে, তাতে আগামী ৬ই সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে তিনটায় ফাটবে টাইম বম্ব। প্রত্যেকটা বোমাই একসঙ্গে ফাটবে বলে ধারণা করে নেয়া অসঙ্গত হবে না। এখন ওই বিশেষ দিনে যদি সারা পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা বরাবর এই সেন্ট বম্ব ফাটে, তা হলে কী এমন সুবিধা হতে পারে ভারতের? ডক্টর আকবর সমাধান দিচ্ছেন-পঙ্গপাল!’

‘পঙ্গপাল!’ রানার বুকের মধ্যে কলজে বরাবর কেউ যেন হাতুড়ির ঘা দিল একটা। একসঙ্গে দ্রুত.অনেকগুলো চিন্তা খেলে গেল মাথার মধ্যে। একটা ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা উঁকি দিল মনের কোণে। ইতেও তো পারে, ওদের দ্বারা অসম্ভব কী?

ইন্টারকমে গোলাম সারওয়ারের গলা শোনা গেল।

ডক্টর আলী আকবর, স্যর।

‘ভেতরে পাঠিয়ে দাও। আর নাসরীনকে বলো, যেন নিজ হাতে তিন কাপ কফি বানিয়ে পাঠিয়ে দেয় আমার কামরায়।’

চট করে একবার রাহাত খানের দিকে চেয়ে নিয়ে মনে মনে হাসল রানা। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন ঘরে। উঠে দাঁড়িয়ে সাদরে ডেকে বসালেন তাকে রাহাত খান। ফর্সা গায়ের রঙ, খয়েরি চোখের মণি। ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিলেতি ছাঁটের নীল সুট। প্রশস্ত কপালে প্রতিভার ছাপ। রানার পাশের চেয়ারটা ছেড়ে বসলেন ডক্টর আলী আকবর। হাতের অ্যাটাচি কেসটা রাখলেন খালি চেয়ারের উপর। পরিচয় দিলেন রাহাত খান।

‘আমি রানাকে সমস্ত ব্যাপার মোটামুটি বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম। ও যাচ্ছে। আমাদের তরফ থেকে টিটাগড়ে। রানা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল ওই সেন্ট থেকে আপনি পঙ্গপালের কথা মনে করলেন কেন? আপনিই বরং বুঝিয়ে দিন।

‘এটা খুব সাধারণ কথা। এই গন্ধ লোকাস্ট-কে আকর্ষণ করে, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় রিসার্চ সেন্টারে পঙ্গপাল ধ্বংস করবার জন্যে লৌকাস্টিসাইড তৈরি হচ্ছে এবং এই সেন্ট-এর সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই গন্ধের সঙ্গে পঙ্গপাল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

কিন্তু, রাহাত খান সূত্রটা ধরলেন কথার, দেখা যাচ্ছে লোকাস্টিসাইডের কোনও চিহ্নও নেই, শুধু গন্ধটাই ছড়াতে চাইছে ওরা আমাদের আকাশে-বাতাসে। তার মানে কী হতে পারে? একটাই অর্থ আপাতত মনে হচ্ছে: ওরা সীমান্ত থেকে পঙ্গপাল ছাড়বে ওই দিন। বিনা যুদ্ধেই আমাদের এই কৃষিপ্রধান দেশ ধ্বংস করে। দেবে। তাই না?

সত্যিকার কোনও ক্ষতি করবার মত অত পঙ্গপাল পাবে কোথায় ওরা, স্যর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আমার কাছেও ব্যাপারটা খুবই অবাস্তব বলে মনে হয়েছে, মি. খান। বললেন ডক্টর আলী আকবর। যদিও আমি একে সম্ভব বলে বিশ্বাস করি না, তবু সারাদিন ছটফট করেছি দুশ্চিন্তায়, এবং শেষ পর্যন্ত কাল সারা রাত পরিশ্রম করে একটা সলিউশন তৈরি করেছি। স্প্রে-গানে ভরে এনেছি সেটা। যদি সত্যিই ওখানে গিয়ে দেখেন পঙ্গপালের কারবার, তা হলে এই সলিউশনটা স্প্রে করে আসবেন। অ্যাটাচি কেস থেকে একটা কৌটো বের করে সযত্নে টেবিলের ওপর। রাখলেন তিনি।

কী আছে এতে?

‘ম্যাটারিজিয়াম।

কফি এল। চুপচাপ কফি খেলেন, তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর আকবর।

‘এটা দিতেই এসেছিলাম। পরে আরও আলাপ হবে, এক্ষুণি আমার একটা ক্লাস আছে, আজ আসি।

আপনি কি ইউনিভারসিটিতে এখনও আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।

‘তা ঠিক নেই, পুরনো অভ্যেস, বুঝলেন না? সুপারনিউমারারি করে রেখেছে, এক-আধটা ক্লাস নিই। আচ্ছা আসি।’

ব্যস্ত-সমস্ত প্রফেসর বেরিয়ে গেলেন। ওঁর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন রাহাত খান। বললেন, ‘অদ্ভুত মানুষ! জীবনে ছুটি কাকে বলে জানেন না। এই রকম আরও কিছু লোক থাকা দরকার ছিল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেগুলোতে।

আবদুল কাপ নিতে এল। এক চুমুকে অবশিষ্ট কফি শেষ করে আবার কাজের কথায় ফিরে গেলেন রাহাত খান।

তা হলে দাঁড়াল এই, আমাদের দেশে ভারতীয় গুপ্তচরদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে; কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সঠিক জানা যাচ্ছে না। অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সবটুকু। কাজেই তোমাকে যেতে হচ্ছে টিটাগড়। দুই বর্গ মাইল জায়গা জোড়া ওদের সেই নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকতে হবে তোমার। প্রথম কাজ ওদের হাতে ধরা না পড়া। কারণ, তা হলে নিশ্চিত মৃত্যু। দ্বিতীয় কাজ, সত্যিসত্যিই ওরা কী করছে ওখানে, কী ওদের ভবিষ্যৎ প্ল্যান ইত্যাদি জেনে আসা। কিছুতেই একা কিছু করবার চেষ্টা কোরো না। একটা গোটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একা তোমার কিছুই করবার নেই। ক্ষতিকর কিছু দেখলে আমরা অন্য ব্যবস্থা। গ্রহণ করব।

আর যদি ধরা পড়ে যাই, তবে?

বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করো।’

‘কোনও রকম সাহায্যের ব্যবস্থা থাকবে না?’

না। আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।’

কিন্তু ওদের আড্ডার ভেতর আমি ঢুকব কেমন করে?

‘সেটা এখানে বসে আমি কী করে বলি, বলো? অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ। করবে তুমি নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা মত। ওই যে, ওদের একটা মেয়ে স্পাই…কী যেন নাম…ও, মিত্রা সেন। যার জন্য এতগুলো ক্ষমতাশালী লোককে পুত্রহারা করলে তুমি-তার সঙ্গে তো তোমার খুব, মানে (বাম হাতের মধ্যমা দিয়ে ডান চোখের নীচটা একটু চুলকে নিলেন রাহাত খান), বেশ খানিকটা অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। তার। কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্যের আশা আছে?

না, স্যর। ও একটু অন্য ধরনের মেয়ে। মানে…

‘আচ্ছা, আচ্ছা। ও কেমন মেয়ে আমার না জানলেও চলবে। এদিকে ইয়াং টাইগারসের পিতৃদেবরা আমার মাথা চিবিয়ে খাবার চেষ্টা করছে। উঁচু মহলটা তোলপাড় করে ফেলেছে একেবারে। মহা ঝামেলায় পড়েছি। যাক, সেইদিন যদি শুভেচ্ছা মিশরে দলটাকে ধরতে পারতে, তবে আর এত ঝামেলা পোহাতে হত না।’

‘ভোরে উঠে দেখছি ডাকবাংলো সাফ। নদীপথে পার হয়ে গেছে।’

‘তোমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’ অসমর্থন-সূচক মাথা নাড়লেন রাহাত খান।

এরপর অপারেশন গুডউইল সম্পর্কে আলোচনা হলো। কয়েকটা ম্যাপ এঁকে রাহাত খান কী কী সব বোঝালেন রানাকে। সবরকম সম্ভাবনাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো। তারপর একসময় আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে এল রানা সে ঘর থেকে।

রাহাত খানের ঘর থেকে বেরিয়েই একটা সিগারেট ধরাল রানা, তারপর প্যাকেট সুদ্ধ বাকি পনেরোটা সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। নিজের কামরায় গিয়ে বসল রানা চিন্তান্বিত মুখে। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ কাজগুলো।

কী ব্যাপার? বড় সাহেব মেরেছে নাকি? নাসরীন রেহানা সামনে এসে দাঁড়াল।

‘মেরেছে মানে? একেবারে খুন করে ফেলেছে। কাল খবরের কাগজে দেখবে।

বুঝলাম না।

‘এখন বুঝে কাজ নেই। কাল কাগজ হাতে নিয়েই বুঝতে পারবে। এখন এই চিঠিটা নিয়ে নাভানা ট্রেডার্সে চলে যাও তো সোজা। ওদের শো-রুম থেকে যে রঙটা তোমার পছন্দ হয় সে রঙের একটা করোনা নিয়ে চলে এসো। আর আবদুলকে বলে যেয়ো, এক প্যাকেট ক্যাপস্ট্যান সিগারেট নিয়ে আসবে আমার জন্যে। এই যে টাকা।

ক্যাপস্ট্যান?’ দুই চোখ কপালে তুলল রেহানা।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ক্যাপেস্ট্যান। কানে কম শোনো নাকি? যাও ভাগো। আমার মেজাজ এখন তিন-চাররকম হয়ে আছে। ঘাটিয়ো না আমাকে।

‘ওরেব্বাপস!’ কেটে পড়ল রেহানা।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল মাসুদ রানা।

.

গ্রিন রোডের একটা ছোট্ট মোটর ওয়ার্কশপের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে থামল লরেল গ্রিন মেটালিক কালারের একখানা আনকোরা টয়োটা করোনা। সামনে পিছনে ON TEST লাগানো।

‘আরে, আসুন, আসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম। বাঁচবেন অনেক দিন। রানাকে দেখেই হৈ হৈ করে এগিয়ে এল দেওয়ান মটর ওয়ার্কসের এনামুল হক; পাতলা-সাতলা ছিমছাম চেহারা। কপালটা ক্রমেই বড় হয়ে যাচ্ছে-মাঝখানে কিছু চুল রেখে মাথার দুই পাশ দিয়ে এগোচ্ছে টাক। ডান গালে চোয়ালের কাছে। কোনও হাতুড়ে ডাক্তারের অপারেশনের দাগ, গর্ত হয়ে আছে। বাড়ি মুর্শিদাবাদ। রানার গাড়ির একমাত্র অভিভাবক।

‘এ যে দেখছি নতুন গাড়ি। কোনও বন্ধুর বুঝি?’ করোনাটার দিকে একবার চেয়েই ঔৎসুক্য হারিয়ে ফেলল এনামুল হকের পাকা চোখ। অন্য কথায় চলে গেল।

‘আপনার জাগুয়ারের পিস্টন রিং চেঞ্জ করে দিয়েছি, আর ধোঁয়া নেই। ট্যাপেট আর ডিসট্রিবিউটার এবার ঠিকমত অ্যাডজাস্ট হয়েছে, খেয়াল করেছেন?

জাগুয়ারের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল রানার। ঘণ্টা দেড়েক পর নিজ হাতে ধ্বংস করতে হবে ওকে একান্ত প্রিয় গাড়িটা। খবরটা জানতে পারলে রানার মতই অন্তরে আঘাত পেত এনামুল হক।

‘গাড়িটা বন্ধুর নয়। আমার। এখন থেকে ওটাই চালাতে হবে আমাকে। জাগুয়ার বাদ।

‘জাগুয়ার বাদ? জাগুয়ার ছেড়ে এই গাড়ি চালাবেন আপনি?’ তাজ্জব হয়ে গেল হক সাহেব।

‘হ্যাঁ। ওপরওয়ালার হুকুম। তাই আপনার কাছে ওটা নিয়ে এলাম। একটু মানুষ করে দিতে হবে।

তা করা যাবে, কিন্তু জাগুয়ারটা-ছি ছি ছি। আচ্ছা যাই হোক, কী আর করা। গলাটা হঠাৎ উঁচু করে হাঁক ছাড়ল হক সাহেব, ওই পিচ্চি, দিলু মিঞাকে বল্ মাসুদ সাহেব এসেছেন, ফাস কেলাস করে ডালপুরি আর চা। তাড়াতাড়ি করতে বলিস, বাবা।’

একটা চেয়ার হক সাহেবের খুব কাছে টেনে নিয়ে বসল রানা। তারপর ঘাড়ের ওপর দিয়ে বুড়ো আঙুলে করোনাটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এগুলো বোধহয় ঘণ্টায় আশি-পঁচাশি করে। না?

‘হ্যাঁ, তা ওই রকমই। এর বেশি আর কি আশা করেন?

কমপক্ষে একশো তিরিশ। পারবেন?

‘পারব না কেন? একটু সময় লাগবে। নতুন গাড়ি, মাত্র শো-রুম থেকে বের করেছেন, ক’দিন চালান, তারপর এক সময়…’

নতুন গাড়ির মোহ আমার নেই, হক সাহেব, আপনি ভাল করেই জানেন। তা ছাড়া আগামী কয়েকদিন আমি ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। এটা আমি এখনই এখানে ছেড়ে ট্যাবিতে ফিরব বাসায়। ফিরে এসে কমপ্লিট চাই। কী কী বদলাতে হবে?

‘সে অনেক কিছু। প্রথমে তো চেসিস আর বডির ওজন কমাতে হবে; ইঞ্জিনের রোটেটিং আর রেসিপ্রোকেটিং পার্টসের ওজন কমাতে হবে। সিলিণ্ডার হেড মেশিনিং করে কম্প্রেশন রেশিও বাড়াতে হবে; ইনলেট পার্টসগুলোকে হাই। পলিশ লাগাতে হবে-যাতে ভাল ফ্লো পাওয়া যায়, কাস্ট আয়রন থাকলে ফ্লো অত সুবিধের হয় না; সাইলেন্সর বক্স উড়িয়ে দিয়ে ডাইরেক্ট একজস্ট পাইপ দিতে হবে; টুইন ডাউনড্রাফট কারবুরেটর লাগাতে হবে; (রানার বাড়ানো প্যাকেট থেকে ক্যাপস্ট্যান না নিয়ে নিজের কিংস্টর্ক বের করল এনামুল হক) তা ছাড়া কম্বাসচন। চেম্বারের ডিজাইন বদলে ফেলতে হবে; আরও শক্তিশালী ভ্যালভ স্প্রিং দিতে হবে; স্পেশাল ক্যামশ্যাফট ফিট করতে হবে; ট্যাপেট-ক্লিয়ারেন্স বাড়িয়ে দিতে হবে; ইনডাকশন র‍্যামিং এফেক্টের জন্যে সুপার চার্জার লাগাতে হবে। তার ওপর একখানা ওভার ড্রাইভ ইউনিট ফিট করে দেব ইঞ্জিন স্পিড হুইল স্পিডের সমান। হয়ে যাবে, পেট্রোলও খাবে অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণ গাড়িতে ইঞ্জিন স্পিড হুইল স্পিডের ডবল থাকে-সমান করে দিলে, বুঝতে পারছেন না, কত বেশি স্পিড পাচ্ছেন? এ ছাড়া আরও দু’একটা টুকিটাকি জিনিস আছে। যেমন, কুলিং সিস্টেমটা ইমপ্রুভ করতে হবে, কারণ বুঝতেই পারছেন…

‘কিছু বুঝতে পারছি না, হক সাহেব, আর সহ্য করতে পারল না রানা। ‘এবং বুঝবার কিছুমাত্র আগ্রহও নেই। এসব আপনি বুঝলেই চলবে। স্পিড কত পাচ্ছি শুধু সেটাই বলেন, সাহেব।

‘তা, কমপক্ষে হানড্রেড টোয়েনটি তো বটেই। ঠিক কত পাবেন বলা মুশকিল। বেশিও হতে পারে।’

ব্যস, তা হলেই খুশি। কিন্তু হবে তো?

হবে না কেন, বিদেশে হরদম হচ্ছে। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, যে রকম স্পিড আর পিক-আপ চাইছেন, তাতে পেট্রোল কনজাম্পশন বেড়ে যাবে অনেক।

তা হোক। এই পাঁচ হাজার টাকার চেক রেখে যাচ্ছি-আরও যা লাগে। লাগিয়ে দেবেন। এক হপ্তার মধ্যে আসছি আমি।’

‘আরে সে-সব আমাকে বলতে হবে না। চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, নিন আরম্ভ করুন।

রানার প্রিয় ডালপুরি-দিলুর নিজ হাতে তৈরি-আর চা শেষ করে সিগারেট ধরাল দুজন। ঠিক এমনি সময় ঢুকল এসে ইদু মিঞা।

‘ওস্তাদ, আমার গাড়িটা আবোর ফির টেরাবোল দিতাছে! ইকজিরিসা দেইখা দিবার লাগবো।’ হঠাৎ রানার দিকে চোখ পড়তেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ইদু মিঞা। আরে আপনে এইখানে, হুজুর! ওস্তাদের লগে জানপয়চান আছে বুজি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, জান পয়চান আছে। আয় দেখি তোর গাড়ির কী হয়েছে!’ ধমকের সুরে বলল হক। তারপর তিনজন এসে দাঁড়াল ট্যাক্সির সামনে। দে, স্টার্ট দে দেখি!’

ইদু মিঞা স্টার্ট দিল কিন্তু কোনও ট্রাবল পাওয়া গেল না। রানা একটু অবাক হলো।

ব্যাটা শয়তান, এই রাস্তা দিয়ে যখনই যাবে, নেমে এসে এরকম বিরক্ত করবে। কিছু না, ঠিক আছে গাড়ি। রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘এটা ওর একটা বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই পথে যেতে একবার থামা চাই।

‘আরে না না, ওস্তাদ। আপনেরে দেখলেই হালায় টেরাবল যায় গা।’

হাঁসে ইদু মিঞা। আহেন, হুজুর, কোন দিকে যাইবেন?’ রানাকে ডাকল এবার সে।

‘তোমার গাড়িতে উঠব না।’

‘কেলেগা, হুজুর, ব্যাবি অইছে কোনও?

না। ভাড়া না নিলে তোমার গাড়িতে আর ওঠা যাবে না।’

কী কন, হুজুর। বারার লগে কী? দিলে দিবেন, না দিলে না দিবেন। মাগার। বেইনসাফ দিবার পারবেন না। পুরানা পল্টন থেইকা এয়ারপোর্ট-ঘ্যাচ কইরা। বিশটা টাকা বাইর কইরা দিলেন। পাঁচ ট্যাকা বি কেরায়া অহে না। বেইমান পাইছেন আমারে?

‘আর এদিক-ওদিক যে ঘুরলে?’ গাড়িতে উঠে বসে বলল রানা।

‘গুরলাম তো বেহুদা, হুজুর। আপনে বি চুপ থাকলেন। আইবি লাগছে মনে কইরা খামাখা লৌর পারলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল ইদু মিঞা। রানা হাত নাড়ল এনামুল হকের দিকে।

মতিঝিল। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন।

কথার খেই ধরে আবার আরম্ভ করল ইদু মিঞা।

উই হালার পিছে লাগছিলাম আমি এয়ারপোর্ট থেইকা, দেখি হালায় যায় কই। আইবি না আইবি-র … উইটা। ভাগতে ভাগতে এক্কেরে রমনা পার্ক। গাড়ি ফালায়া গেল গা …মারানি। আমি…’

আজ রাত তিনটের সময় আমার বাসায় আসতে পারবে?

‘পারুম না কেলেগা, স্যর? মাহাজনের গাড়ি তো না, আপনা গাড়ি।

‘বেশ, এসো তা হলে।’

ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা সাততলা বাড়িটার মধ্যে। ভাবল তোর রাতে ইদু মিঞাকে বলে দেবে যেন আগামী কাল একবার এনামুল হকের সঙ্গে দেখা করে দুপুরের দিকে। নিশ্চয়ই এনামুল হক ওকে রানার মৃত্যু-সংবাদ। দেবে-তারপর অবাক হয়ে শুনবে ভোর রাতে রানার ঢাকা ত্যাগের কথা। ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়ে চেপে যাবে হক সাহেব। কাজ বন্ধ করবে না করোনার। কদিন পর ঢাকায় ফিরে তৈরি গাড়ি পাবে রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *