১৩. নিজেকে জানুন

নিজেকে জানুন

একটা গল্প শুনুন।

দুটো প্রধান চরিত্র: একজন, তার অগাধ ধন-দৌলত আছে, কিন্তু স্বাস্থ্য তার খুবই খারাপ; অপরজন, তার টাকা-পয়সা নেই কিন্তু স্বাস্থ্যটা দেখবার মতো, যেন ব্যায়ামবীর। এরা একজন অপরজনকে ঈর্ষা করে।

ধনী লোকটা তার সর্বস্ব ধন-সম্পদ দিয়ে দিতে রাজি আছে যদি সে তার বিনিময়ে ভালো স্বাস্থ্য পায়, ওদিকে গরীব লোকটা এক কথায় রাজি হয়ে যাবে প্রচুর নগদ টাকা-পয়সা পেলে তার স্বাস্থ্যটা হারাতে।

পৃথিবী বিখ্যাত এক সার্জেন এমন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যার সাহায্যে এক দেহ থেকে আরেক দেহে ব্রেন বদলাবদলি করা সম্ভব।

ধনী লোকটা গরীব লোকটার সাথে একটা চুক্তি করলো। চুক্তি অনুযায়ী তারা পরস্পরের ব্রেন বদল করবে। ফল দাঁড়াবে, ধনী লোকটা হবে পথের ফকির কিন্তু অত্যন্ত ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারি, গরীব লোকটি হবে প্রচুর ধন-দৌলতের মালিক কিন্তু তার শরীর হবে দুর্বল, রোগ-জর্জরিত।

অপারেশন সফল হলো। গরীব লোকটা হলো ধনী, ধনী লোকটা পরিণত হলো ভিখিরিতে। কিন্তু দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি ঘটলো।

প্রাক্তন ধনী লোকটার মধ্যে সবসময় সাফল্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা বিদ্যমান ছিলো। গরীব হওয়ার পরও সেই সচেতনতা তার মধ্যে অটুট রইলো। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে কি করতে হয় তা সে জানে। সেই জানা কৌশলটা সে ব্যবহার করতে শুরু করলো এবং অচিরেই আবার অগাধ ধন সম্পদের মালিক হয়ে উঠলো। কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অতি-সচেতনতার ফলে, একটু সর্দি লাগলে বা বুক-মাথা একটু ব্যথা করলে ভীষণ রকম ঘাবড়ে যেতো সে, মুষড়ে পড়তো। হজম হবে না এই ভয়ে ভালো খাওয়া-দাওয়া করতো না সে। ফলে, উত্তম, নীরোগ স্বাস্থ্যটা ভেঙে পরিণত হলো দুর্বল রোগজর্জরিত স্বাস্থ্যে। অন্য কথায়, সে তার সাবেক অবস্থায় ফিরে এলো-ধনী একজন মানুষ কিন্তু দুর্বল। স্বাস্থ্যের অধিকারী।

এবার দেখা যাক, নব্য কোটিপতি লোকটার বেলায় কি ঘটনা ঘটছে।

সাফল্য সম্পর্কে এই লোকটার কোনো ধারণাই নেই। গরীব ছাড়া নিজেকে লোকটা আর কোনো কিছু ভাবতেই পারতো না। অকস্মাৎ হাতে অগাধ ধন-সম্পদ এসে পড়ায় দিশেহারা হয়ে পড়লো সে। সুবিন্যস্ত জীবনধারা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকায়, উন্নত মানের জীবন যাপন কাকে বলে তা জানা না থাকায় টাকা পয়সা না ব্যয় করলো নিজের উপভোগের জন্যে, না কোনো গঠনমূলক প্রকল্পে। তার টাকা পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খেলো, বাকি যা ছিলো ব্যবসা করতে গিয়ে অনভিজ্ঞতা ও অবহেলার দরুন সব হারালো। আবার সে পরিণত হলো একটা গরীব মানুষে। কিন্তু, তার স্বাস্থ্য? সে অন্য গল্প।

স্বাস্থের ব্যাপারে কক্ষনো সে দুশ্চিন্তায় ভুগতো না। নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভুলেও সে খারাপ কিছু ভাবতো না। স্বাস্থ্য ভালো আছে, বেশ আছে, এই ছিলো তার একমাত্র বিশ্বাস। বাছ বিচার করে খাওয়া কাকে বলে, জানতো না। খাবার যা পেতো, পেট ভরে খিদে মিটিয়ে খেতো। হজম হবে কি হবে না এ বিষয়ে মাথা ঘামাতো না। ফলে স্বাস্থ্যটা তার পূর্বের মতো হয়ে উঠলো। অর্থাৎ আবার সে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠলো।

গল্পটা থেকে শিক্ষণীয় কি পাচ্ছি আমরা?

‘আমরা নিজেকে যা মনে করি আমরা তাই!’ নিজেকে জানুন, আপনি নিজেকে শিল্পী বলে জানুন, শিল্পী হতে পারবেন অনায়াসে। নিজেকে আপনি বুদ্ধিমান বলে জানুন, দেখবেন, সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান। হয়ে উঠবেন আপনি।

নিজেকে জানাটাই বড় কথা। শিল্পী, লেখক, গায়ক, ব্যবসায়ী, নেতা, খেলোয়াড়-কি হতে চান জেনে নিন। হওয়াটা তখন অনায়াসসাধ্য হবে।

এবার আসুন, পিছনের ফেলে আসা পরিচ্ছেদগুলোর কিছু কিছু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক। রোমন্থন উপকারী অভ্যাস, যদি তা থেকে কিছু শিখে নিতে পারেন। আপনি, সংশোধন করে নিতে পারেন ত্রুটিগুলো।

প্রথম পরিচ্ছেদ: এই পরিচ্ছেদে আপনি শিখেছেন, সাফল্য গন্তব্য স্থান নয়, ভ্রমণ বা যাত্রা। সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে যেই মুহূর্তে পা রাখলেন পথে সেই মুহূর্তে সাফল্য লাভ করলেন আপনি। ব্যাঙ্কে টাকা জমা হোক, নতুন বাড়ি কেনা হোক, সব দেনা শোধ হোক–সফল হবার আগে এসবের জন্যে আপনার অপেক্ষা করবার দরকার নেই। এই মুহূর্তে, যখন আপনি সাফল্য লাভ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজেকে একজন সফল মানুষ হিসেবে মনে করতে হবে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: এই পরিচ্ছেদে আপনি শিখেছেন আপনার চাওয়া এবং হওয়ার তালিকা কিভাবে তৈরি করতে হবে। সুখী হওয়ার সহজ উপায় কি জানানো হয়েছে আপনাকে। প্রত্যক্ষদর্শন কততটা উপকারী ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: এই ফর্মুলার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো, মানুষের মন। থেকে নেতিবাচক মনোভাব সমূলে উৎপাটন করতে হবে। ইতিবাচক, হ্যাঁ-সূচক, আশাব্যঞ্জক এবং গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও মনোভাবের অধিকারী হতে হবে আপনাকে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ: সুখ। সুখ ভাড়ায় পাওয়া যায় না। সুখ রয়েছে আপনার মধ্যেই। সুখী বলে নিজেকে মনে করাই সুখী হবার সর্বোত্তম উপায়। সাফল্য চান? চাইলে, আগে সুখী হোন। যে সুখী নয়, তার দ্বারা সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ: গভীর আগ্রহ। গভীর আগ্রহ প্রচণ্ড একটা পরিচালিকা শক্তি। আপনি শিখেছেন গভীর আগ্রহবোধ কিভাবে নিজের মধ্যে আমদানী করা যায়। গভীর আগ্রহবোধ কাজকে ভালবাসতে শেখায়।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: অতৃপ্তি। মানুষের অতৃপ্তিই স্পৃহা যুগিয়েছে মানব সভ্যতাকে গড়ে তুলতে। যত বড় বড় আবিষ্কার, মহৎ শিল্পকর্ম, বিস্ময়কর সাফল্য-অতৃপ্তির বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে। আপনি শিখেছেন কিভাবে অতৃপ্তি দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়।

সপ্তম পরিচ্ছেদ: অ্যাকশন। চিন্তা বা আইডিয়ার কোনোই দাম নেই যদি সেটাকে কাজে, বাস্তবে রূপান্তরিত করা না যায়। আপনি শিখেছেন দু’ধরনের এনার্জির কথা। পোটেনশিয়াল এনার্জি এবং কাইনেটিক এনার্জি। আপনি আরো শিখেছেন নিষ্ক্রিয়তা কারণ নয়, ফলাফল। উপদেশ দেয়া হয়েছে, কাজে নামুন, কাজে হাত দিন, কাজের ভেতর দিয়ে এগোন-জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দুটোই অর্জন করা সম্ভব হবে।

অষ্টম পরিচ্ছেদ: ধারাবাহিকতা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই; আপনারও স্থির হয়ে থাকলে চলবে না। এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় কাজ করা। কাজের পর কাজ, একের পর এক কাজ করে যেতে হবে আপনাকে। একটা কাজ প্রথমে শেষ করুন, শেষ হবার পরই আপনি অপর কাজে হাত দেবেন। কাজের পর আবার কাজে হাত দিন। এগিয়ে যান অবিরত।

নবম পরিচ্ছেদ: উপাদান। আপনার কাম্যবস্তু একক কোনো জিনিস দিয়ে তৈরি নয়, ওটা কয়েক প্রকার উপাদানের সমষ্টি। আপনি শিখেছেন, কাম্যবস্তুকে ভালবাসতে হবে, তাকে কল্পনার চোখে দেখতে পেতে হবে। আপনার কাম্যবস্তু কেউ তৈরি করে রাখেনি, আপনিই তাকে বিভিন্ন উপাদান সহযোগে তৈরি করবেন।

দশম পরিচ্ছেদ: বিভক্তিকরণ এবং সংযুক্তকরণ। যে-কোনো কাম্য-বস্তুকে দু’ভাবে দেখতে শেখানো হয়েছে। প্রথমে কাম্যবস্তুর স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপটা দেখুন বা চিন্তা করুন, তারপর সেটাকে দেখুন কয়েকটা ভাগে ভাগ ভাগ করে, বিভক্ত করে। এই পদ্ধতিতে দেখায় বা চিন্তা করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে আপনাকে।

একাদশ পরিচ্ছেদ: বৃহত্তর-ক্ষুদ্রতর। আপনার স্বয়ংসম্পূর্ণ কাম্যবস্তুকে আপনি বৃহত্তর কাম্যবস্তু বলে মনে করুন। বৃহত্তর কাম্যবস্তুটিকে এবার ভাঙুন টুকরো টুকরো করে। এই টুকরোগুলো আপনার ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তু। এই ভাঙা টুকরোগুলোর একটা তালিকা তৈরি করুন। তালিকায় উপর দিকে থাকবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তুগুলো। তালিকার এক নম্বর ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তুটি অর্জন করতে হবে আপনার। তারপর দু’নম্বরটা, এরপর তিন নম্বরটা–এইভাবে এক এক করে সবগুলো অর্জন করার চেষ্টা করতে যাচ্ছেন আপনি।

তালিকার এক নম্বর ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তুটি অর্জন করতে যাওয়ার আগে ওটিকে ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তু না ভেবে, ভাবুন ওটিই আপনার বর্তানের বৃহত্তর কাম্যবস্তু। এই পদ্ধতিতে যখন যে ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তু অর্জন করার পালা আসবে তখন সেইটিকেই ভাবুন বৃহত্তর কাম্যবস্তু হিসেবে।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ: জীবনের নতুন মান। নিজেকে তৈরি করাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্য লাভের চাবিকাঠি রয়েছে আপনার হাতে। ফর্মুলাটা কাজে প্রয়োগ করলে সাফল্য লাভ অবধারিত, প্রয়োগ না করলে পিছিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ: আপনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই পৃথিবীতে, এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে আপনাকে।

আমরা নিজেদেরকে ধোকা দিচ্ছি, নিজেদের কাছে মিথ্যে কথা বলছি, কিন্তু তার জন্যে কোনো অপরাধবোধে ভুগছি না। এর প্রতিক্রিয়া খারাপ হতে বাধ্য।

আপনি নিজের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করবেন সেটা ভঙ্গ করে আপনার অবচেতন মনকে কুশিক্ষা দিচ্ছেন। আপনার অবচেতন মন আপনার উপরই প্রতিশোধ নেবে।

সম্পদের সদ্ব্যবহার করার নিয়ম জানানো হয়েছে আপনাকে। আপনার ধন সম্পদ যেন আপনার প্রভু না হয়ে ওঠে। আপনার জন্যে যে আন্তরিকভাবে কাজ করছে, তাকে সুখী মানুষ হতে সুযোগ করে দিন।

কেউ যদি প্রচুর পরিমাণে না পায় মনে করতে হবে প্রচুর পরিমাণে দিচ্ছে না সে, তাই পাচ্ছে না।

বয়স মাত্রই সম্পদ, আপনার বয়স পঞ্চাশ-ই হোক আর নব্বই-ই হোক। বুড়ো সে-ই যে নিজেকে বুড়ো বলে ভাবতে শুরু করেছে, আর কেউ নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *