০৮. ধারাবাহিকতা

ধারাবাহিকতা

প্রখ্যাত এক জার্মান কবি বলেছেন, ‘যে সামনের দিকে এগোচ্ছে না সে আসলে পিছনে সরে যাচ্ছে।’

কেউ কি পিছিয়ে থাকতে চায়? যদি কেউ চায়, তাকে আমি একটি পরামর্শ দিতে পারি-কাজ না করে হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন, তাহলেই নিশ্চিন্তে পিছিয়ে যেতে পারবেন।

মানুষ কাজ করে। কেন করে? আসলে দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে মানুষ। দুটোই ফলপ্রসূ, কিন্তু দুটো দু’রকম দু’জাতের ফল দেয়।

অধিকাংশ মানুষ কাজ করে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে। তাদের উদ্দেশ্য টিকে থাকা।

কাজ করার আর এক উদ্দেশ্য হলো, এগিয়ে যাওয়া অর্থাৎ সমৃদ্ধি অর্জন করা। খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ এগিয়ে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে।

কাজ না করলে মানুষ পিছিয়ে যায়, একথা আগেই বলেছি। এখন ওই কথার সাথে যোগ করে আর একটা কথা বলতে চাই, তা হলো, শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে যে মানুষ কাজ করে সে-ও আসলে পিছিয়ে থাকে।

কাজ কেন করবেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে খুব বেশি কাজ করার দরকার হয় না। ছোটো একটা সংসার আপনার, অল্প সময় কাজ করে যা রোজগার করেন, মোটা ভাত খেয়ে মোটা কাপড় পরে দিন কাটাচ্ছেন–আরো বেশি কাজ করবার দরকার কি আপনার?

যে-লোক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে কাজ করে সে মনে করে, স্থিতিশীল একটা পর্যায়ে অবস্থান করছে সে। আসলে তার এই মনে করাটা সম্পূর্ণ ভুল। সে নিজেকে স্থির হয়ে আছে ভাবলে ভুলই করবে।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। নদী, বাতাস, নক্ষত্র, এমন কি বৃক্ষ-কেউ স্থির নয়, সবাই, সবকিছু এগিয়ে চলেছে। যে এগিয়ে যায় না সে পিছিয়ে থাকে। কাজ না করে বসে থাকা মানে এই নয় যে আপনি নির্দিষ্ট এক জায়গায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছেন, আসলে আপনি পিছিয়ে যাচ্ছেন। আপনাকে। পিছনে রেখে এগিয়ে চলেছে মহাকাল। যারা কাজ করছে তারা আপনাকে পিছনে রেখে ছুটে চলেছে সামনের দিকে।

অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় কাজ করা। কিন্তু এগিয়ে যাবার উপায় কি?

এগিয়ে যাওয়ারও নির্দিষ্ট উপায় আছে।

এগিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট উপায় হলো একটির পর একটি কাজ করা। শুধু। একটি কাজ নয়, একটির পর একটি কাজ করলে এগিয়ে যেতে পারবেন আপনি।

একটি কাজ ধরলেন। শেষ হলো সেটা। কিন্তু তারপর? চুপচাপ বসে থাকতে চান নাকি?

চুপচাপ বসে থাকা মানে তো পিছিয়ে পড়া। পিছিয়ে তো আপনি পড়তে চান না। তা যদি না চান, এগিয়ে যাবার নিয়ম পালন করতে হবে আপনাকে। নিয়মটা হলো: কাজের পর কাজ, একের পর এক কাজ করে যাওয়া।

একটা কাজ শেষ করুন, তারপর আর একটা কাজ ধরুন। কাজের পর আবার কাজে হাত দিন। যদি এগিয়ে যেতে চান, ভুলেও কক্ষনো প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে কাজের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন না।

কাজকে গ্রহণ করবেন আনন্দের উৎস হিসেবে। কাজের প্রতি ভালবাসা থাকা। চাই, তবেই না গভীর মনোযোগ আনতে পারবেন। কাজকে কষ্টকর ব্যাপার বলে। মনে করবেন না। কাজ কষ্টকর, একথা সত্যি। কিন্তু কাজ তেমনি সুফলদায়কও বটে। কি না দেয় কাজ আপনাকে? গাড়ি, ড়ি, সয়-সম্পত্তি, মর্যাদা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব সামাজিক সম্মান, ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক মর্যাদা, প্রশংসা, খ্যাতি-এমন কিছু তো দেখি না যা মানুষকে দিতে পারে না কাজ। যে কাজ সম্ভাব্য সবকিছু দেয় তা করতে কষ্ট হয় নাকি আবার?

কষ্ট মনে করলে, কষ্ট তো রসগোল্লা খেতেও হয়। দোকান থেকে কিনে নিয়ে যাবেন বাড়িতে, বাক্স থেকে খুলবেন, প্লেটে সাজাবেন, হাত মুখ ধুয়ে এসে বসবেন, তারপর হাত দিয়ে তুলে মুখের ভিতর পুরবেন, চিবাবেন। কষ্টকর বৈকি। কিন্তু তবু রসগোল্লা খাওয়াটাকে কেউ কষ্টকর বলে মনে করে না।

রসগোল্লা খাওয়াটা যদি কষ্টকর কাজ না হয়, সমৃদ্ধি অর্জন করাটা কষ্টকর। কাজ হতে যাবে কেন? এটা তো আনন্দের কাজ।

কাজকে আপনার সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য বলে মনে করতে হবে। এমন একটা মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে যার ফলে নিজেকে কাজ করতে বাধ্য করার দরকার পড়বে না। কাজ করাটা আপনার জন্যে হবে একটা শখ, একটা মজার ব্যাপার। কাজ করে মজা পেতে হবে। তা পেতে হলে প্রয়োজন মনে করে নয়, ভালবাসি মনে করে কাজ করতে হবে।

একটু চিন্তা করলেই দেখতে পাবেন, আপনার করার মতো কাজ অনেকগুলো রয়েছে। সিদ্ধান্ত নিলেন, অমুক কাজটা ধরবো।

ধরলেনও।।

কিন্তু কাজটা ধরে খানিকদূর করে কিছু বাধাবি দেখতে পেলেন আপনি। ফলে সেটা বাদ দিয়ে অন্য একটি কাজ ধরলেন আবার। এই দ্বিতীয় কাজটির বেলাতেও কিছু বাধার সৃষ্টি হলো, আপনি সেই বাধাগুলোকে টপকাবার চেষ্টা না করে এরপর ধরলেন তৃতীয় কাজটিকে। ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে? ধরছেন বটে আপনি, কিন্তু একটা কাজও শেষ করতে পারছেন না।

এ থেকে প্রমাণ হয়ে গেল বাধাগুলোকে আপনি ভয় পাচ্ছেন। কেন, জানেন? কাজের প্রতি আপনার ভালবাসা নেই, তাই।

এ কাজের প্রতি ভালবাসা থাকলে বাধাগুলোকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করতেন, ওগুলোকে জয় করবার জন্যে উদ্যমী হয়ে উঠতেন, বাধাগুলোকে অপসারণ করার মধ্যে প্রচুর মজা পাবার কথা আপনার, নৈরাশ্য বা বিরক্তি বোধ করার কথা নয়।

কাজ ধরেও শেষ করতে না পারার আরো একটা কারণ হলো, পরিকল্পনার অভাব। শুধু তাই নয়, পরিকল্পনার অভাব কাজের প্রতি মানুষের অহেতুক আতঙ্কেরও সৃষ্টি করে।

পরিকল্পনার অর্থ অনেক। তার মধ্যে একটি হলো, প্রস্তুতি।

প্রস্তুতি না থাকলে কাজের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও, কাজটি শেষ করতে আপনি ব্যর্থ হবেন। সুতরাং প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে আপনাকে। অনেক সময় দেখা যায় কাজের প্রতি উৎসাহ এবং ভালবাসা আছে বটে কিন্তু প্রস্তুতির অভাব থাকায় কাজটি কোনদিনই শেষ করা সম্ভব হয় না। সুতরাং, প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে আপনাকে।

স্থির হলো, প্রস্তুতি নিতেই হবে। কিন্তু কিসের জন্যে আপনার এই প্রস্তুতি? কেউ যদি আপনাকে হুট করে প্রস্তুত হতে বলে আপনি কি প্রস্তুত হতে পারবেন? পারবেন না। কেন প্রস্তুত হতে হবে, প্রস্তুতি কিসের জন্যে তা আপনাকে জানতে হবে প্রথমে, তাই না?

প্রস্তুতি নেবার আগে আপনাকে জানতে হবে কি সেই জিনিস যা আপনি চান। অর্থাৎ কাম্যবস্তু বা অবজেকটিভ নির্দিষ্ট করতে হবে আপনাকে।

পাঠক, আপনি হয়তো ভাবছেন, উপরিউক্ত কথাটি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছি না, কারণ, কাম্যবস্তু তো আপনার নির্দিষ্ট করাই আছে। কিন্তু আসলে কি তাই? সত্যিই কি আপনি নিজের কাম্যবস্তু নির্দিষ্ট করে রেখেছেন? আপনি জানেন আপনি কি চান?

অধিকাংশ মানুষ মনে করে তারা জানে তারা কি চায়। আসলে তাদের এই জানাটা সঠিক জানা নয়। প্রশ্ন করে দেখা গেছে তাদের নিজেদের ধারণা পরিষ্কার নয় ঠিক কি চায় তারা।

ধরুন, আপনার কাম্যবস্তু বা অবজেকটিভ হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাভ করা।

একজন রাজনৈতিক নেতা কাকে বলে, বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে পার্থক্য কি, কোন্‌টা গ্রহণ করবেন আপনি, নেতার করণীয় কাজ কি, কর্তব্য কি, কি কি নিয়ম তাঁকে পালন করতে হয়, কি ধরনের দায়িত্ব তার কাঁধে থাকে, তার আচার ব্যবহার, পোশাক-আশাক, চলন-বলন কি রকম হওয়া উচিত এবং অন্যান্য গুণ কি থাকা বাঞ্ছনীয় ইত্যাদি যদি আপনার ভালোমত জানা না থাকে, তাহলে বলা যায় কাম্যবস্তু বা অবজেকটিভ সম্পর্কে আপনার পরিষ্কার ধারণা নেই।

যা হতে চান তা হবার পর কি করবেন, কি করার জন্যে হবেন, কিভাবে কি করার নিয়ম-এ আপনাকে জানতেই হবে। নেতা কাকে বলে তাই যদি পরিষ্কারভাবে না জানেন, কি দরকার আপনার তা হয়ে? দরকারও নেই, তা হবার অধিকার নেই আপনার। কাম্যবস্তু নির্ধারণ বা নির্দিষ্ট করার সময় একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে বলবো আমি আপনাকে, তা হলো, কাম্যবস্তু অর্জনের লাইসেন্স আপনি তখনই পেতে পারেন যখন কাম্যবস্তু সম্পর্কে পরিপূর্ণ, পরিষ্কার ধারণা আসবে আপনার মধ্যে।

ধরুন, আপনি নিজের একটা ব্যবসা চান। বেশ, ভালো কথা।

এখন বলুন, কি ধরনের ব্যবসা করতে চান আপনি? ব্যবসা তো অনেক রকমেরই আছে-ম্যানুফ্যাকচারিং, হোলসেল, রিটেইল, মেইল অর্ডার, না ইনডেন্টিং। কোন্ ধরনের ব্যবসা করতে চাইছেন আপনি? যে ব্যবসা করতে চান কল্পনায় নিজেকে সেই ব্যবসা করতে দেখতে পান কি?

বেন সুইটল্যাণ্ড একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন, এক ভদ্রমহিলা এই প্রসঙ্গে আলোচনার সময় আমাকে বলেন, ‘আমার অবজেকটিভ ঠিক আছে। লেখিকা হতে চাই আমি।’

‘কি ধরনের লেখিকা হতে চান?’

আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা বেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েন। তাকে আমি জানাই, লেখিকা অনেক রকম হয়, কেউ গল্প লেখে, কেউ প্রবন্ধ লেখে, কেউ ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে মালমশলা সংগ্রহ করে লেখে, কেউ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে পুঁজি করে লেখিকা হয়, কেউ অনুবাদক, সংবাদপত্রের মহিলা রিপোর্টারদেরকেও লেখিকা বলা হয়, কেউ ভ্রমণ কাহিনী লেখে। এরা সবাই। লেখিকা কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বিষয়ের লেখিকা। আমার কথা শুনে ভদ্রমহিলা বুঝতে পারেন, অবজেকটিভের অংশবিশেষ সম্পর্কে তাঁর ধারণা আছে, গোটাটা সম্পর্কে ধারণা নেই। এই ভদ্রমহিলার অবস্থা ছিলো সেই খেলোয়াড়ের মতো, যে জানতে সে মাঠে প্রবেশ করবে কিন্তু মাঠে সে কি খেলায় অংশগ্রহণ করবে তা জানতো না।

ভালো একটা চাকরি খুঁজছেন আপনি। ঠিক করুন কি ধরনের চাকরি চান। যে ধরনের কাজ আপনার কাছে প্রিয়, করতে ভালো লাগে সেই ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে যে চাকরিতে সে চাকরি খুঁজুন।

চাকরির জন্যে কোনো কোম্পানির কর্মকর্তার কাছে গেলেন। বললেন, “যে-কোনো একটা চাকরি দিন, আমি করবো।’ কর্মকর্তা আপনাকে চাকরি দেবেন বলে মনে হয় না। কারণ, বুদ্ধিমান কর্মকর্তারা চান সেই ধরনের লোক যারা জানে তারা কি ধরনের কাজে পটু বা কি ধরনের কাজ তাদের কাছে প্রিয় বা পছন্দ।

নিজের একটি বাড়ি, এই যদি হয় আপনার অবজেকটিভ তাহলে সর্বপ্রথম স্থির করুন কি ধরনের বাড়ি চান, কতোটা জায়গা জুড়ে হবে বাড়িটা, আশপাশে কি থাকবে, বাড়ির ভিতর বাগান থাকবে কিনা, রূমের সংখ্যা ক’টা হবে, একতলা না বহুতলা, কোন্ এলাকায় চান বাড়িটা?

.

বাধাবিঘ্ন

গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করতে চান আপনি? যদি চান, বাধা আপনি পাবেনই।

বাধাগুলোকে আমরা সাধারণত বিরূপ চোখে দেখে অভ্যস্ত। এটা একটা অবৈজ্ঞানিক বদভ্যাস। বাধা যেখানে নেই সেখানে উত্তরণ নেই, এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা। বাধাগুলোকে আমরা আসলে সঠিকভাবে চিনতে ভুল করি বলে ওগুলোকে খারাপ চোখে দেখি। আসলে, বাধাগুলোই কিন্তু আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

বাধা টপকানো মানে এগিয়ে যাওয়া, তাই নয় কি? বাধা আছে বলেই না। সেটাকে জয় করার, টপকাবার উদ্যোগ আয়োজনের প্রয়োজন পড়ছে। বাধা না থাকলে কি হতো, ভাবুন একবার! আপনি হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। উত্তরণ ঘটতো না আপনার, এগোতে পারতেন না।

বাধা আসলে প্রয়োজনীয়। এই বাধাগুলোকে এক এক করে জয় করেই আপনি আপনার কাম্যবস্তুর দিকে ধীরে ধীরে এগোবেন।

বাধাগুলোকে জয় করার আগে আপনার প্রথম কাজ হলো সেগুলোকে চেনা। প্রথমে একটি বাধাকে ধরুন। ওটার ভাবগতিক বুঝুন, আকার-আয়তন পরিমাপ করুন, ওর স্বভাব-প্রকৃতি অনুধাবন করুন। একটা বাধাকে একবার চেনা হয়ে গেলে সেটাকে অতিক্রম বা জয় করা তেমন কঠিন হবে না। অপর দিকে, বাধা। সম্পর্কে আপনার যদি কোনো ধারণা না থাকে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেগুলো আপনার সামনে আবির্ভূত হবে, ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করবে আপনাকে।

বাধাগুলোকে একে একে চিনে নিন। তারপর খাতা পেন্সিল সাথে নিয়ে বসুন। ক্রমিক নাম্বার দিয়ে এক এক করে লিখুন বাধাগুলোর নাম। তালিকা তৈরি করুন। তালিকা হবে দুটো। একটা সম্ভাব্য বাধার তালিকা, আর একটা প্রত্যক্ষ বাধা তালিকা।

তালিকা দুটো তৈরি হয়ে গেলে বসুন এবার বিশ্লেষণে। একটা একটা করে বাধাকে ধরুন, চিন্তা করে বের করুন কিভাবে ওই বিশেষ বাধাটিকে অতিক্রম করা যায়। এই ভাবে প্রত্যেকটি বাধাকে অতিক্রম করার উপায় বের করুন।

তারপর তৈরি করুন কাজের পরিকল্পনা।

আপনার পরিকল্পনা তৈরি করার মূলনীতি হবে-একটা কাজ ধরবেন, সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকবেন, সেটা শেষ না করে দ্বিতীয় কাজে হাত দেবেন না। এইভাবে কাজ করতে একবার অভ্যস্ত হয়ে উঠলে কাজের ধারাবাহিকতা অটুট রাখতে কোনো অসুবিধা হবে না আপনার। এবং কাজে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখলে কাম্যবস্তুর অধিকারী না হবার কোনোই কারণ নেই আপনার।

.

উপাদান

প্রশ্ন করি, কাম্যবস্তু কি?

সকল বস্তুর উপাদান অণু বা অ্যাটম, এ আমরা জানি। যদিও আমাদের বর্তমান আলোচনায় অণুর মতো ছোটো কোনো জিনিসের দিকে মনোযোগ দেবার দরকার নেই, তবু আপনাকে জানিয়ে দেয়া উচিত বলে মনে করছি যে আপনার কাম্যবস্তু নানাপ্রকার জিনিসের সমষ্টিমাত্র। আপনার কাম্যবস্তুতে বিভিন্ন উপাদান রয়েছে।

অনেকে অনেক বস্তু বা বিষয় কামনা করে, কিন্তু পায় মাত্র অল্প কয়েকজন। এর কারণ কি জানেন? কারণ হলো বেশিরভাগ লোক তাদের কাম্যবস্তুকে একটা ইউনিট হিসেবে গ্রহণ করে। তারা জানে না বা জানতে চায় না যে কাম্যবস্তুটি আসলে একক পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়, ওটা বহু উপাদানের সমষ্টি, একত্রিত রূপমাত্র।

আপনি ব্যবসা করতে চান। এটা আপনার একটা কাম্যবস্তু। ব্যবসা করতে অভিজ্ঞতা, টাকা, দোকান, কারখানা বা অফিস লাগে–এইরকম আরো অনেক কিছু লাগে। এগুলো হলো আপনার ব্যবসার অর্থাৎ আপনার কাম্যবস্তুর উপাদান।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক।

এনাম অর্থহীন জীবনযাপন করে। ছোটো একটা চাকরি করে যা রোজগার করে তাতে তার সংসার ভালো ভাবে চলে না। নোংরা এলাকায় ছোট্ট একটা ভাড়াটে বাড়িতে দীর্ঘকাল ধরে বাস করছে সে। দেনায় ডুবে আছে, সঞ্চয়ের কৌটা শূন্য।

এনামের বন্ধু মতিন। মতিনের অবস্থা এনামের ঠিক উল্টো। মতিনের প্রচুর টাকা সয়-সম্পত্তি আছে। সুন্দর বাগানসহ চমৎকার একটি বাড়ির মালিক সে। গাড়ি কিনেছে। বাড়িতে চাকর-চাকরানী রাখে। কোনো দেনা তো নেই-ই, সঞ্চয় রয়েছে প্রচুর। আরাম-আয়েসের সব রকম উপকরণ উপভোগ করে সে।

এনাম মতিনকে হিংসা করে এবং মনে মনে সে ভাবে মতিনের মতো অবস্থা যদি আমারও হতো!

মতিনের সুখ এবং প্রাচুর্য দেখতে পাচ্ছে এনাম, ঈর্ষান্বিত হচ্ছে সে এই কারণেই। মতিনের বর্তমান অবস্থাটাই শুধুমাত্র দেখতে পাচ্ছে সে। মতিনের মতো অবস্থায় সে উঠতে চাইলেও সে জানে না যে মতিনকে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছুতে কি কি নিয়ম কানুনের ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে।

নিয়ম কানুনগুলো জানা নেই এনামের। জানা থাকলে সে-ও ইচ্ছে করলে পারবে মতিনের অবস্থায় উঠে আসতে।

এনামের কাম্যবস্তু বা অবজেকটিভ রয়েছে। তার কাম্যবস্তু: সে মতিনের মতো অবস্থায় উঠতে চায়।

কিন্তু নিজের কাম্যবস্তুর উপাদান সম্পর্কে এনামের কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই।

মতিনের কাম্যবস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা যাক এবার। প্রথমেই আমরা খোঁজ নিয়ে জানছি যে মতিনের এখন যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, এই অবস্থা প্রথম দিকে তার ছিলো না। বর্তমানে এনাম যে দুরবস্থায় আছে, মতিনও এক সময় সেই দুরবস্থায় ছিলো। কিন্তু তার দুরবস্থাকে সে মেনে নেয়নি। মেনে তো নেয়ইনি, সে নিজের কাছে এই বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল কেউ যদি জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে, আমিও পারবো, আমাকেও পারতে হবে।

মতিন নিজের মধ্যে গড়ে তুলেছিল গঠনমূলক অতৃপ্তি বোধ।

কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে একত্রে একটা ব্যবসায়ে নামে মতিন। ব্যবসা করতে গিয়ে প্রথম প্রথম অনেক বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হয় সে, মার খায় বেশ ক’বার। কিন্তু মুষড়ে পড়েনি বা নৈরাশ্যে হাবুডুবু খায়নি সে কখনো, নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়নি, কাজের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হতে দেয়নি, নিজেকে ভুলেও অযোগ্য বলে চিহ্নিত করেনি।

মতিনের কারখানায় যা তৈরি হতো তা প্রথম প্রথম বিক্রি হতো স্থানীয়ভাবে। জিনিসের গুণ এবং মান ভালো হওয়ায় জেলাভিত্তিক বাজার পেলো মতিন। এখন গোটা দেশব্যাপী তার তৈরি জিনিস বিক্রি হচ্ছে।

সাফল্য অর্জনের জন্যে মতিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে কিন্তু শুধুই কি পরিশ্রম? না, শুধু পরিশ্রম করলে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গাধার মতো খাটলে সাফল্য আসে না। পরিশ্রমের পিছনে উদ্দেশ্য (অবজেকটিভ) থাকতে হয়। উদ্দেশ্যটাকে ভাগ করে নিয়ে (উপাদান বিভক্তিকরণ এবং সংযুক্তকরণ, পরবর্তী পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) একটা একটা করে অর্জন করতে হয়। মতিন এইসব নিয়ম পালন করেছিল, জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে, তাই সে জীবনে সাফল্য লাভ করেছে।

.

মনোভাব! মনোভাব!

মনোভাবটাই হলো আসল কথা। জীবন সম্পর্কে আপনার মনোভাব কি রকম? কখনো ভেবে দেখেছেন? জীবন, এই পৃথিবী, বর্তমান সভ্যতা, আপনার পারিপার্শ্বিকতা-এগুলোকে আপনি কি ভালোবাসেন?

পৃথিবী মোটেই খুব একটা সুবিধের জায়গা নয়, এখানে কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে না-একথা সত্যি। কিন্তু যেহেতু আপনি জন্মেছেন এই ভালোয় মন্দতে মেশানো পৃথিবীতে, এবং একবার জন্মালে মরতে ইচ্ছা করে না, সেই হেতু মৃত্যু অনিবার্য না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে তো এই পৃথিবীতেই বসবাস করতে হবে। পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করার জন্যে হাজার হাজার মানুষ অক্লান্ত খাটছে, এ-ও তো আপনি মানবেন, তাই না? এবং, দেখা যাচ্ছে, কেউ যদি সঠিক অর্থে সততা বজায় রেখে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে চায় তা সে ঘটাতে পারে, অর্থাৎ এই অসুবিধাবহুল পৃথিবীতে সে পারে নিজের আরাম-আয়েসের ব্যবস্থা করতে, জীবনটাকে আনন্দদায়ক এবং সুখের করে তুলতে; প্রাচুর্য, নেতৃত্ব, মর্যাদার অধিকারী হতে পারে সে নিজেকে সুখী করতে। সুতরাং, জীবনকে কেন ভালবাসবে না সে?

জীবনকে ভালবাসা উচিত। কথাটা আপনাকেই বলছি।

জীবনের প্রতি ভালবাসার মনোভাব সাফল্যের চাবিকাঠি। কাম্যবস্তুটাকে ভালবাসতে শিখুন। তাকে কল্পনার চোখে দেখুন। আপনাকে জানতে হবে আপনার কাম্যবস্তু কেউ তৈরি করে রাখেনি, আপনিই তাকে তৈরি করবেন। কি দিয়ে?

নানারকম উপাদান সংযোগে তৈরি করবেন আপনি আপনার কাম্যবস্তু। কাম্যবস্তুর প্রতি ভালবাসার মনোভাব উপাদান অর্জনে আপনাকে সাহায্য করবে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, কি কি উপাদান লাগছে?

কাম্যবস্তু সম্পর্কে আপনার পরিষ্কার ধারণা থাকলে কি কি উপাদান দরকার তা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।

এখন, এক এক করে লিখে ফেলুন খাতায় উপাদানগুলোর নাম। তালিকা বড় হয়ে যাবার ভয় যেন পেয়ে না বসে আপনাকে। উপাদানের সংখ্যা বেশি হওয়া শুভ লক্ষণ। এতে প্রমাণ হয়, তৈরি করার মাধ্যমে কাম্যবস্তু অর্জনের কাজে আপনি। নিবেদিতপ্রাণ, কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন না বা ভেজাল মিশাচ্ছেন না।

আপনি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে চান। এটা আপনার একটা কাম্যবস্তু হতে পারে। আপনার এই বিশেষ চাহিদার উপাদান কি কি?

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এমন কোনো জিনিস নয় যে একদল লোকের মধ্যে তা। থাকবে আর একদল লোকের মধ্যে তা থাকবে না। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে-কেউ হতে পারে।

চরিত্রের বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের সমষ্টির ফলাফল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সেগুলো কি কি?

সেগুলো: বন্ধু বাৎসল্য, উদারতা, মুক্তবুদ্ধি, সহানুভূতি, কর্তব্যবোধ, আনন্দমুখরতা ইত্যাদি। এগুলোই আপনার উপাদান, এক এক করে সংগ্রহ করে নিন। তৈরি হয়ে যাবে আপনার মধ্যে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *