৪.১৩ কার্লোর বাড়ি

১৩.

লং বীচ উঠান। কার্লোর বাড়ি।

মাইকেলের সাথে দেখা করার জন্যে এখনও অপেক্ষা করছে কার্লো ফটক দিয়ে অসংখ্য লোক আসা-যাওয়া করছে, চারদিকে কেমন যেন একটা চাপা ব্যস্ততার ভাব, গা ছমছম করছে তার পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু একটা পাকাচ্ছে মাইকেল, কিন্তু তা থেকে সম্ভবত বাদ রাখা হয়েছে তাকে। একটু রাগ হলো তার। তারপর বিরক্তি বোধ করল অপেক্ষারও তো একটা সীমা আছে, আর কতক্ষণ ধৈর্য ধরবে সে? অবশেমে ফোন করল মাইকেলকে।

অপরপ্রান্তে রিসিভার তুলল একজন বডিগার্ড। কার্লোকে লাইনে থাকতে বলে মাইকেলকে ডাকতে গেল সে। একটু পরেই লাইনে ফিরে এসে জানাল বডিগার্ড, বস আপনাকে চুপচাপ বসে থাকতে বলেছেন। একটু পরই হাতের কাজ শেষ হবে তার।

রিসিভার রেখে দিল কার্লো। তারপর আবার সেটা তুলে নিল। ফোন করল তার রক্ষিত মেয়েটাকে লোভ দেখিয়ে বলল, রাত আজ যতই হোক, তার সাথে দেখা করবেই কার্লো, ভাল কোন রেস্তোরাঁয় সাপার খেতে নিয়ে যাবে তাকে। তারপর বাকি রাতটা একসাথেই কাটাবে দুজনে মনে মনে সময়ের একটা হিসাব কষে নিল কার্লো একটু আগে জানা গেছে, মাইকেলের ডাক আসতে দেরি নেই। বলার কথা যাই থাকুক, আর যে কাজই করতে দিক, দুঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। এরপর ওয়েবারি পৌঁছুতে খুব জোর চল্লিশ মিনিট। সুতরাং এই প্ল্যানটা টিকে যেতে পারে মেয়েটাকে আবার কথা দিল কার্লো, আজ রাতে যাবেই সে। মান ভাঙার জন্যে কিছুক্ষণ রসিকতাও করল এর সাথে রিসিভার রেখে দিয়ে ঠিক করল, কাপড়চোপড় পরে তৈরি হয়ে থাকাই ভাল, তাহলে আর সময়টা নষ্ট করতে হবে না পরে।

নতুন একটা শার্ট গায়ে চড়িয়েছে মাত্র, এই সময় টোকা পড়ল দরজায়। ভুরু কুঁচকে মুখ তুলে কাল কার্লো ভাবল, নিশ্চয়ই তাকে ফোন করেছিল মাইকেল, কিন্তু ইন এনগেজড় দেখে ডাকাতে নোক পাঠিয়েছে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল সে।

দরজা খুলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল কার্লো। এক নিমেষে রক্তশূন্য হয়ে গেল মুখটা! আতঙ্কে আওয়াজ বেরুচ্ছে না গলার ভেতর থেকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাইকেল কর্লিয়নি তার চেহারায় মৃত্যুর হিম ছায়া এই মৃত্যুর ছায়া অনেকদিন অনেকবার স্বপ্নের মধ্যে দেখেছে কার্লো।

মাইকেলের পিছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে টম হেগেন। তার পাশে অবিচল মূর্তির মত বকো ল্যাম্পনি। প্রত্যেকের চেহারায় বিষণ্ণতার মান ছাপ, যেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কোন দুঃসংবাদ দিতে এসেছে ওরা।

ঘুরে দাঁড়াল কার্লো। কাঁধ দুটো ঝুলে পড়েছে তার। ধীর পায়ে ফিরে এল সিটিংরুমে। তার পিছু পিছু এল ওরা তিন জন। এরই মধ্যে প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে কার্লো। তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেছে, তাই ভয় পেয়েছে সে, আসলে হয়তো কিছুই নয় ব্যাপারটা। নিজেকে আশ্বস্ত করার জন্যে এই সব ভাবছে সে।

কিন্তু মাইকেল তার সমস্ত ভুল ধারণা ভেঙে দিল।

সনির মৃত্যুর জন্যে জবাব দিতে হবে তোমাকে আজ, শান্ত, দৃঢ় কণ্ঠে বলল মাইকেল।

জবাব দিল না কার্লো, ভান করল মাইকেলের কথা যেন বুঝতেই পারেনি। সরে গিয়ে কামরার দুদিকের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে হেগেন আর রকো কামরার মাঝখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল আর কার্লো

সনিকে তুমি বার্জিনিদের হাতে তুলে দিয়েছিলে, মৃদু গলায় বলল মাইকেল। সে-রাতে আমার বোনের সাথে ছোট্ট একটা প্রহসন করেছিলে তুমি? বুদ্ধিটা তোমার নয়, বার্জিনির। কিন্তু বার্জিনির কথায় তুমি বিশ্বাস করলে কিভাবে যে একজন কর্লিয়নির চোখে ধুলো দিতে পারবে তুমি?

আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব সব হারিয়ে ফেলল কার্লো মৃত্যু ভয়ে কাঁপছে সে। পাগলের মত চেঁচিয়ে বলতে শুরু করল, কসম খেয়ে বলছি, বিশ্বাস করো, আমি নির্দোষ। মিথ্যে কথা বললে আমি আমার ছেলেদের মাথা খাব। আমি নির্দোষ, আমি নির্দোষ! মাইক, আমাকে বাঁচতে দাও। আমাকে মেরো না। দোহাই তোমার, আমাকে রেহাই দাও।

বার্জিনি মারা গেছে, শান্তভাবে বলল মাইকেল। টাটাগ্লিয়াও নেই আজ রাতেই পরিবারের সব দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে ফেলতে চাই আমি তাই, তুমি নির্দোষ এ-কথা শুনিয়ে না আমাকে। যা করেছ তা স্বীকার করাই তোমার জন্যে ভাল হবে।

অবাক হয়ে মাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছে টম হেগেন আর রকো ল্যাম্পনি। ওরা ভাবছে, এখনও বাপের মত হয়ে উঠতে পারল না মাইকেল এই বিশ্বাসঘাতকটাকে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করার দরকারটা কি? এ-ধরনের একটা ব্যাপার যতটুকু প্রমাণ করা যায় ততটুকু প্রমাণ তো পাওয়াই গেছে উরেটা দুয়ে দুয়ে চারের মত সহজ। কিন্তু নিজের অধিকার সম্পর্কে এখনও ততটা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না মাইকেল। এখনও তার মানে অন্যায় করে ফেলার ভয় ক্ষীণ একটু সন্দেহে এখনও ভুগছে সে কার্লোর স্বীকারোক্তিই শুধু তা দূর করতে পারে

কিন্তু কার্লো এখনও চুপ করে আছে।

তোমার এত ভয় পাবার কিছু নেই। প্রায় সদয় কণ্ঠে বলল মাইকেল তুমি আমার বোনের স্বামী, ওখানেই আমার হাত-পা বাধা তাকে তো আর বিধবা করতে পারি না আমি। তাছাড়া ভাগ্নেদের মুখও চাইতে হবে আমাকে ওদেরকে বাপ-হারা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভুলে যাচ্ছ কেন, তোমার একটা ছেলের গড় ফাদার আমি। না, তুমি যা ধরে নিয়েছ তা আমি করতে যাচ্ছি না। তোমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া মানে, যাদেরকে আমি আমার শরীরের অংশ বলে মনে করি, তাদের ক্ষতি করা–তা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার শাস্তি হবে, কর্লিয়নি পরিবার তোমাকে বিশ্বাস করে আর কোন কাজ করতে দেবে না কখনও। কর্নিয়নি পরিবারের কাজ করে খুব ভাল রোজগার করতে ভূমি, সেই সুযোগটা হারাতে যাচ্ছ! লাস ভেগাসে স্ত্রী আর ছেলেদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে তোমাকে, ওখানেই থাকবে তুমি। আমরা ধু একটা মাসোহারা দেব কনিকে। ওই পর্যন্তই, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু ওই কথাটা যেন তোমার মুখে আবার আমাকে শুনতে না হয়–আমি নির্দোষ। কথাটা বলে তুমি আমার বুদ্ধিকে অপমান করছ। আমাকে খেপিয়ে দিলে তার ফল ভাল হবে না। প্রস্তাবটা কে নিয়ে এসেছিল তোমার কাছে, বাৰ্জিনি? নাকি টাটাগ্লিয়া?

বাঁচার তীব্র আকুতি ফুটে উঠল কার্লোর চেহারায়। ওকে মেরে ফেলা হবে না শুনে মুক্তির ঝিরঝিরে একটা শান্তির পরশ অনুভব করছে সারা শরীরে। বার্জিনি, ফিসফিস করে বলল সে।

বেশ, বেশ, নরম গলায় বলল মাইকেল। ডান হাত তুলে দরজাটা দেখিয়ে দিল ও। বেরোও। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। সোজা এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।

চঞ্চল পায়ে সবার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল কার্লো। ওকে অনুসরণ করছে মাইকেল। পিছনে হেগেন আর রকো ল্যাম্পনি।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা উতরে গেছে। তবে রোজকার মত আজও ফ্লাড লাইটের আলোয় ঝলমল করছে প্রকাণ্ড উঠানটা। প্রায় নিঃশব্দে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল কার্লোর সামনে। আগেই দেখতে পেয়েছে ও গাড়িটাকে, কিন্তু চিনতে পারেনি। এখন দাঁড়িয়ে পড়ার পর দেখল ওটা তারই গাড়ি। ড্রাইভিং সীটে বসা লোকটাকে চিনতে পারছে না ও। পিছনের সীটে আরও একজন বসে রয়েছে, তাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির দরজা খুলে দিল রকো ল্যাম্পনি, ইশারায় উঠতে বলল কার্লোকে।

ঘাড় ফিরিয়ে মাইকেলের দিকে তাকাল কার্লো।

কনিকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি তুমি রওনা হয়ে গেছ, বলল মাইকেল। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠল কার্লো। সিল্কের শার্টটা ভিজে গেছে ঘামে।

কার্লোকে নিয়ে উঠান পেরোচ্ছে গাড়ি। স্পীড বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে সঁৎ করে বেরিয়ে গেল ফটক দিয়ে। পিছনের সীটে বসা লোকটা পরিচিত কেউ কিনা দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাতে যাচ্ছে কার্লো।

ছোট মেয়েরা যেভাবে অনায়াস দক্ষতার সাথে বিড়াল ছানার গলায় সিল্কের ফিতে পরিয়ে দেয়, পাট ক্লেমেঞ্জাও তেমনি চট করে ফাসটা পরিয়ে দিল কার্লোর গলায় রশির দুই প্রান্ত ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেটা কার্লোর গলার চারদিকে এঁটে গেল। বঁড়শিতে আটকানো মাছের মত শূন্যে লাফিয়ে উঠল কার্লোর শরীর। তৈরি ছিল ক্লেমেঞ্জা, রশিটা ছাড়ল না সে। গায়ের জোরে আরও টান করল সেটা, যধাব কষে দিল ফাসটাকে। কয়েক সেকেন্ডেই নেতিয়ে পড়ল কার্লো। শেষ হয়ে গেছে ক্লেমেঞ্জার কাজ, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে টান করে ধরে রাখল রশিটা আরও কিছুক্ষণ।

 তারপর ফাঁস খুলে রশিটা গুছিয়ে নিয়ে পকেটে ভরল সে কার্লোর নিষ্প্রাণ শরীর পড়ে গেল সীট থেকে দরজার গায়ে কাত হয়ে রয়েছে নাটের পিছনে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লেমেঞ্জা।

.

পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেল নিউ ইয়র্কে ছাব্বিশ ঘণ্টা পেরোবার আগেই সম্পূর্ণ হলো কর্লিয়নি পরিবারের বিজয় একের পর এক সুখবর আসছে চারদিক থেকে। কিন্তু কর্নিয়ানদের কেউ বিজয়ের উল্লাসে ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিল না প্রত্যেকের চেহারায় পরম তৃপ্তি এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বন ফুটে উঠল বটে, কিন্তু সবার চালচলনে আশ্চর্য একটা সমাহিত ভাব দৃষ্টি এড়াল না কারও। প্রতিটি সুসংবাদ প্রশান্ত গাভীর্যের সাথে গ্রহণ করছে মাইকেল কর্লিয়নি। তার সামনে একটা অতিরিক্ত শব্দ উচ্চারণ করার দুঃসাহস দেখাল না কেউ, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা তো দূরের কথা। অনেক চমকপ্রদ সুখবর,এল, অপ্রত্যাশিত অনেক সাফল্য ধরা দিন পরিবারের হাতে, কিন্তু খবরগুলো গ্রহণ করার সময় মাইকেল কর্লিয়নির চোখের পাতা নড়তে দেখল না কেউ, গর্বে তার বুক ফুলে উঠতে দেখল না কেউ, আনন্দে তার চোখ চিকচিক করে উঠতে দেখল না কেউ। বিস্ময়কর সংযম আর ইস্পাতের মত কঠিন ব্যক্তিত্বের চরম দৃষ্টান্ত দেখাল মাইকেল। শুধু অদ্ভুত একটা গভীরতা ফুটে উঠল তার দৃষ্টিতে।

তোযক নেবার দরকার পড়েনি। কেননা কর্লিয়নি পরিবারের প্রথম আক্রমণের ধাক্কাটাই শত্রুদের মেরুদণ্ড ভেঙে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে বিষম আতঙ্কে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল সবাই। ঠিক এই সময় দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণ শুরু করুল কর্লিয়নিরা। ক্লেমেঞ্জা আর রকো ল্যাম্পনি তাদের সৈনিকদেরকে ছেড়ে দিল শহরে।

কর্লিয়নি সামাজ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল যারা, তাদেরকে যেখানে পাওয়া গেল সেখানেই ধরে ধরে মেরে ফেলা হলো। ছোটখাটো প্রতিরোধের সম্মুখীন হলো বটে সৈনিকরা, কিন্তু সে-সব অগ্রাহ্য করে দুর্বার গতিতে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে গেল তারা।

টেসিওর দলের ভার নেবার জন্যে পাঠানো হলো নেরিকে। বার্জিনিদের গোটা বুকমেকিং ব্যবসাটাকে দখল করতে সময় লাগল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। চুনোপুটিগুলোকে পাইকারীভাবে মেরে ফেলা হলো। ভাগ্যগুণে যারা ওদের হামলা এড়িয়ে যেতে পারল, শহর ছেড়ে চিরকালের জন্যে পালিয়ে বাঁচল তারা। বার্ভিনিদের সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুজন উচ্চপদস্থ পারিবারিক নেতা মালবেরি স্ট্রাটের একটা ইতালীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার খেয়ে কাঠি দিয়ে দাঁত খুটতে খুটতে বেরিয়ে আসতেই কে বা কারা গুলি করে মেরে ফেলল তাদেরকে। ঘোড়দৌড়ের মাঠ থেকে বিস্তর টাকা জিতে বাড়ি ফিরছিল যারা, তাদের মধ্যে থেকে মার্জিনি আর টাটাগ্লিয়াদের লোকগুলোকে বেছে বেছে মেরে ফেলা হলো। তাছাড়া গায়েব হয়ে গেল অসংখ্য লোকজন। এদের সন্ধান কেউ কোনদিন পাবে না।

ওই একরাতের একটা হিংস্ব হামলা পরিচালনা করে শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিল মাইকেল কর্লিয়নি। কর্লিয়নি পরিবার আবার তার আগের মর্যাদা ফিরে পেয়েছে। নিউ ইয়র্কের পাঠ পরিবারের মধ্যে তারাই এখন শ্রেষ্ঠ, অপরাজেয়। এর সবটুকু কৃতিত্ব মাইকেল কর্লিয়নির। তবে শুধু তার অত্যাশ্চর্য কর্ম-কুশলতার জন্যে তাকে শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসনে বসানো হলো, ব্যাপাা জ নয়। বার্জিনি আর টাটাগ্লিয়া পরিবারের প্রথম সারির সেরা ক্যাপোরেজিনিদের সবাই কর্লিয়নি পরিবারে চলে এল, সেটাও একটা বড় কারণ। নিউ ইয়র্কের দুটো পরির সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করল কর্লিয়নিদের কাছে বার্জিনি আর টাটাগ্লিয়াদেব তো আত্মসমপণ করার প্রশ্নই উঠল না তাদের অস্তিত্বের আর অবশিষ্টই বা আছে কি?

কিন্তু এত বড় বিজয় সামান্য একটা কারণে বিষাদময় হয়ে উঠল মাইকেলের জন্যে। সাফল্য চুড়ান্ত এবং সার্বিক হয়েছে, কিন্তু তবু এক জায়গায় একটু খুঁত থেকে গেল।

ছেলেদেরকে ভেগাসে রেখে একাই ফিরে এল কনি কর্লিয়নি। এসেই আদিনার মত আচরণ শুরু করে দিল সে।

কনিকে নিয়ে উঠানে এসে থামল গাড়িটা। এখন পর্যন্ত বৈধব্যের শোক কোনরকমে দমন করে রেখেছে সে। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে মেয়েকে এগোর্ডে দেখে মা বুড়ি কর্লিয়নি ছুটে এলেন কিন্তু তিনি বাধা দেবার আগেই মাইকেলের বাড়িতে ঢুকে পড়া কনি। সিটিংরুমে ঢুকেই দেখল সোফায় বসে রয়েছে মাইকেল আর কে

কনিকে দেখেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মাইকেল, তার সাপে কে-ও। ননদকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেবে বলে তাড়াতাড়ি তার দিকে এগোল কে। কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। শোকে নয়, প্রচণ্ড ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠেছে কনির চেহারা।

ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে মাইকেলকে দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছে কনি। মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল সে, চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে গেল। উন্মাদিনীর মত হাত দুড়ে শুরু করে দিল চিৎকার বয়সে মাইকেলের চেয়ে ছোট, কিন্তু বড় ভাইকে সম্মান দেখাবার মত মানসিক অবস্থা এখন নেই তার।

বেজন্ম, শুয়োর। আমার স্বামীকে খুন করেছিস তুই। বাবা বেঁচে ছিল, তাই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলি। যেই বাবা মরেছে, অমনি তোর পাখা গজিয়েছে, ভেবেছিস আর তোকে পায় কে! খুনী, পাযৎ, বদমাশ। চিরকাল আমার স্বামীকে ঘৃণা করতিস তুই। দুচোখে দেখতে পারতিস নাই, তোরা সবাই সনির জন্যে দায়ী করতিস ওকে। সবই বুঝতে পারতাম আমি, কিন্তু তুই পাষণ্ড আমার.এতবড় সর্বনাশ করবি তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। তোর কথা ভাবতেও ঘৃণা হয় আমার, তুই আমার শত্রু। এই পরিবারে একমাত্র তুই কক্ষনও আমার ভাল চাসনি। কি করব এখন আমি, এই শুয়োর, কি হবে এখন আমার! এক মায়ের পেটের ভাই না তুই, আমার মুখ চেয়েও তোর মনে দয়া হলো না একটু? গুণ্ডা

কখন যেন নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকেছে মাইকেলের দুজন বডিগার্ড। কনির দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা, মাইকেলের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে।

কিন্তু ভাবলেশহীন মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল।

হতভম্ব হয়ে গেছে কে। কথা বলার সময় গলাটা কেঁপে গেল তার। শান্ত হও, কনি। মাথা ঠাণ্ডা করো! কি বলছ তা তুমি নিজেও জানে না।

হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল কনি, নিজেকে সামলে নিয়েছে এরই মধ্যে। ঝট করে ফিরল সে কে-র দিকে। বিষাক্ত তীরের মত বেরিয়ে আসছে প্রতিটি শব্দ। তোমার স্বামী তোমাকে বোকা বানাতে পেরেছে, কিন্তু আমাকে পারেনি ওর স্ত্রী হয়ে ওকে তুমি চিনতে পারোনি, সেটা তোমার জন্যে নচ্ছার কথা জানো, আমার সাথে কেন ও অমন নীরস ব্যবহার করত? কেন উঠানে নিয়ে এসে রেখেছিল কার্লোকে? তাকে খুন করবে বলে। ইচ্ছেটাকে এতদিন পুষে রেখেছিল মনে। বাবা জানতে পারলে বাধা দেবে, তাই অপেক্ষা করে ছিল। আমাদেরকে বোকা বানাবার জন্যে আমাদের ছেলের গড ফাদার হয়েছিল। জানো, পিশাচটা আরও কত লোককে খুন করেছে? যাও না, খবরের কাগজগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে এসো, নিজেই দেখতে পাবে। বার্জিনি, টাটাগ্লিয়া, এই রকম আরও কত নাম জানতে চাও? তোমার স্বামী খুন করেছে ওদের সবাইকে।

আবার হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছে কনি। মাইকেলের মুখে থুতু ছিটাবার চেষ্টা করুল সে, কিন্তু এত কথা বলে মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে, থুতু বের হলো না।

ওকে বাড়ি নিয়ে যাও, এতক্ষণে কথা বলল মাইকেল। সম্পূর্ণ শান্ত দেখাচ্ছে ওকে। একজন ডাক্তারকে ডেকে পাঠাও, পরীক্ষা করে যাক।

কনির হাত চেপে ধরল মাইকেলের বডিগার্ডরা, টানাটানি করে বাড়ির বাইরে নিয়ে চলে গেল তাকে।

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও কে। দুচোখ ভরা আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে স্বামীর মুখের দিকে। মাইক, এসব কথা কেন বলল কনি? এসব কথা বিশ্বাস করতে পারল কিভাবে ও?

শ্রাগ করল মাইকেল। ও অসুস্থ। হিস্টিরিয়া হয়েছে ওর।

স্বামীর চোখে চোখ রেখে কি যেন খুঁজছে কে। আতঙ্কে সবুজ হয়ে গেছে তার চেহারা, মাইক, বলো ওসব সত্যি নয়? দুই হাত দিয়ে মাইকেলের শার্টের কলার চেপে ধরুল সে। বলো, কনি যা বলে গেল সব মিথ্যে!

হঠাৎ ক্লান্ত দেখাল মাইকেলকে। ধীরে ধীরে উপর-নিচে মাথা নাড়ল ও। শান্তভাবে বলল, মিথ্যেই তো। ওর কথায় কান দেবার দরকার নেই তোমার, আমি যা বলছি সেটাই সত্যি। কিন্তু মনে রেখো, এই শেষবারের মত আমার কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে দিচ্ছি তোমাকে, তার উত্তরও দিচ্ছি। কনির মাথার ঠিক নেই, ও যা বলে গেল তা সত্যি নয়। বলার ভঙ্গি আর সুরে এর চেয়ে বেশি আশ্বাস প্রকাশ করা সম্ভব নয়। স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে কথাটা বলল মাইকেল। বিবাহিত জীবনে পরস্পরের মধ্যে যে গভীর আন্তরিকতাময় বিশ্বাসের শক্ত বাধন রচনা করেছে ওরা, তার সবটুকু প্রয়োগ করে কেকে কথাটা বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করল মাইকেল। সমস্ত সন্দেহ, সমস্ত ভয় এক নিমেষে দূর হয়ে গেল কে-র মন থেকে। পরম স্বস্তির হাসিতে মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার, দুহাতে জড়িয়ে ধরেআলিঙ্গন করল স্বামীকে।

গলা শুকিয়ে গেছে, আমাদের দুজনেরই খানিকটা করে মদ দরকার, স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বরফ আনার জন্যে কিচেনে গিয়ে ঢুকল কে। হঠাৎ সদর দরজা খোলার আওয়াজ গেল কানে। তাড়াতাড়ি কিচেন থেকে আবার বেরিয়ে এল সে।

ক্লেমেঞ্জা, নেরি আর রকো ল্যাম্পনি ঢুকল ঘরে। উল্টোদিকের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে কে, ওর দিকে পিছন ফিরে রয়েছে মাইকেল। মাইকেলকে পাশ থেকে দেখার জন্যে ঘরের ভেতর ঢুকে একটু সরে দাঁড়াল কে।

ঠিক এই সময় ওর স্বামীকে সম্বোধন করল ক্লেমেঞ্জা, আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানাল!

ডন মাইকেল, মুগ্ধ কণ্ঠে বলল ক্লেমেঞ্জা।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কে। দেখতে পাচ্ছে কিভাবে মাইকেল ওদের সবিনয় ভক্তি, শ্রদ্ধা আর স্বীকৃতি গ্রহণ করছে। রোমের প্রাচীন মূর্তির কথা মনে পড়ে গেল তার। তাদেরই মত মাইকেল যেন একজন রোমক সষাট, যারা দেবতাদের আনুকূল্য পেয়ে মানুনদের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা হতেন।

একটা হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল কর্লিয়নি। পাশ থেকে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছে কে। সেই মুখে ঠাণ্ডা, প্রশান্ত গর্বের উদ্ভাস। দাঁড়াবার ভাঙ্গটা সহজ, কিন্তু আশ্চর্য একটা দীপ্ত দাম্ভিক ভাব ফুটে রয়েছে তাতে। একটা পা অপরটার চেয়ে সামান্য একটু পিছিয়ে রয়েছে, শরীরের ভার চাপানো রয়েছে সেই পিছনের পায়ের ওপরই। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যাপোরেজমিরা। মুহূর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল কে-র কাছে। বুঝতে পারল, কনির সমস্ত অভিযোগ সত্যি! ঘুরে দাঁড়াল কে, দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিচেনে ঢুকে ভেঙে পড়ল কান্নায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *