৪.১১ আলবার্ট নেরির পরিচয়

১১.

 আলবার্ট নেরির পরিচয়।

স্কুলে পড়ে মেয়েটা, নাম রিটা। অসম্ভব লাজুক চেহারা, কুচকুচে কার্লো চুল, অত্যন্ত গোঁড়া ইতালীয় পরিবারের মেয়ে। রাত দশটার পর মেয়েকে আর বাইরে থাকতে দেয় না বাপ-মা। মেয়েটার সরুলতা, সততা, মিষ্টি চেহারার কোমলতা আর কার্লো চুল–এক সাথে সবগুলোর প্রেমে পড়ে গেল অ্যালবার্ট নেরি। সবেমাত্র পুলিশে ঢুকেছে সে। কিন্তু বিয়ে করতে দেরি করল না।

প্রথম দিকে স্বামীর প্রেমে রিটাও পড়ল। নেরির গায়ের জোর দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সে। লক্ষ করে, স্বামীর এই গায়ের জোর আর ন্যায়-অন্যায় বোধের জন্যে লোকে তাকে যমের মত ভয় করে। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে আরও আবিষ্কার করল রিটা, কারও মন জুগিয়ে চলার ধার দিয়েও যায় না নেরি। কারও সাথে যদি মতের মিল না হয়, হয় বোবার মত চুপ করে থাকে সে, নাহয় ভীষণ কর্কশ ভঙ্গিতে প্রতিবাদ জানায়। নরমভাবে সম্মতি জানাবার পাত্র সে নয়। আর সব লোকের মেজাজের সাথে ওর মেজাজের তুলনা হয় না। চণ্ডালের মত রাগ তার, খাঁটি সিসিলির জিনিস। তবে রিটার সাথে কখনও রাগারাগি করে না সে। স্ত্রীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, যথেষ্ট সমীহ করে চলে তাকে।

পাঁচ বছরের মধ্যে নিউ ইয়র্ক শহরের সবচেয়ে রগচটা পুলিশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করল নেরি। লোকে তাকে উকট বিপদ ধরে নিয়ে সাঙ্ঘাতিক ভয় করে। শুধু তাই নয়, নেরির মত সৎ, আদর্শ পুলিশ কর্মচারী নিউ ইয়র্কে আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ওকে নিয়ে অসুবিধেটা হলো, আইন প্রয়োগ করার নিজস্ব একটা নিয়ম মেনে চলে ও। গুণ্ডা ছোকরাগুলোকে দুচোখে দেখতে পারে না। রাতের বেলা রাস্তার মোড়ে পথচারীদের ওপর ছোকরাগুলো অত্যাচার করে, কিন্তু নেরির চোখে তা একবার পড়লে হয়, সাথে সাথে হিংস্র বাঘের মত তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। একবার যদি তার হাতে ধরা পড়ে যায় কেউ, বেচারার রেহাই নেই। তবে, প্রথমবার সবাইকেই সাবধান করে দেয় নেরি। সেই প্রথম এবং শেষ সতর্কবাণী কেউ যদি কানে না তোলে, তাহলেই বিপদ। গায়ে অসাধারণ শক্তি রাখে নেরি, তার এই আসুরিক শক্তি সম্পর্কে নিজেরও পরিষ্কার ধারণা নেই তার।

এক রাতের ঘটনা। সেন্ট্রাল পার্ক ওয়েস্ট। পেট্রল-কার থেকে লাফ দিয়ে নামল নেরি। কার্লো রেশমি কোট পরা ছয়জন গুণ্ডাকে এক লাইনে দাঁড় করাল সে। ওর সাথে একজন সহকারী রয়েছে, নেরিকে সে ভালকরেই চেনে, জানে তার রাগের সামনে দাঁড়াবার সাধ্য নেই কারও, তাই যা ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে নিজেকে জড়ারার কোন ইচ্ছে হলো না। গাড়ি থেকে নামলই না সে, বসে থাকল ড্রাইভিং সীটে।

ছোকরানোর কারও বয়সই কুড়ির বেশি হবে না। রাস্তার লোকজনদের পথরোধ করে তাদের কাছ থেকে সিগারেট চাইছিল ওরা। চাওয়ার মধ্যে হুমকি, শাসানি ইত্যাদি থাকলেও কারও গায়ে হাত তোলেনি ওরা। তবে, এরই সাথে আরেকটা অপরাধ করছিল। কোন মেয়েকে আসতে দেখলেই অশ্লীল যৌন ইঙ্গিত ইশারা করে বিরক্ত করছিল তাদেরকে। ফ্রান্সে এরকম দৃশ্য হরহামেশা দেখা গেলেও আমেরিকায় এ-ধরনের ঘটনা বিরল।

সেন্ট্রাল পার্ক আর এইটস্ এভেনিউয়ের মাঝখানে একটা পাথরের পাচিল আছে, সেটার সামনে দাঁড় করিয়েছে ওদেরকে নেরি। সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু লালচে আলো রয়েছে এখনও আকাশের গায়ে। কিন্তু এরই মধ্যে মস্ত একটা টর্চলাইট হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছে নেরি। কারণটা আর কিছুই নয়, এটা তার একটা অত্যন্ত প্রিয় অস্ত্রও বটে। রাগে অন্ধ হয়ে পকেট থেকে রিভলভার বের করেছে নেরি, এ কথা কেউ বলতে পারবে না তার সম্পর্কে। তার কোন প্রয়োজনই হয় না। রেগে গেলে হিংস্র পাষণ্ডে পরিণত হয় সে, চেহারায় ভীতিকর একটা পাশবিক ভাব ফুটে ওঠে, তার ওপর গায়ে চড়ানো থাকে পুলিশের ইউনিফর্ম, গুণ্ডাপাণ্ডারা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সাঙ্ঘাতিক ঘাবড়ে যায়। এই মুহূর্তে লাইন-বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যারা তারাও নেরির বীভৎস চেহারা দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে।

কালো রেশমি কাপড়ের কোট পরা প্রথম ছেলেটাকে প্রশ্ন করল নেরি, নাম কি?

নাম শুনে নেরির মনে হলো, ছেলেটা আইরিশ। আর কোন রাতে তোমাকে যদি রাস্তায় দেখি, সাবধান করে দেব না, ধরে সোজা ঝুলিয়ে দেব শে টর্চ নেড়ে নেরি ইঙ্গিত করতেই হনহন করে হেঁটে পালিয়ে বাঁচল ছেলেটা।

পরবর্তী দুটো ছেলের সাথে একই ধরনের আচরণ করল নেরি তারাও যথাসম্ভব দ্রুত কেটে পড়ল।

চতুর্থ ছেলেটা নেরির প্রশ্ন শুনে একটা ইতালীয় নাম বলল, আর মুচকি মুচকি হাসতে লাগল ওর দিকে তাকিয়ে, ভাবটা যেন আপনিও ইতালীয়, আমিও ইতালীয়, অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক আমাদের।

নেরি যে ইতালীয় তা তার চেহারার দিকে তাকালেই পরিষ্কার বোঝা যায়। ছেলেটার কথা শুনে একটু হাসল নেরি, জানতে চাইল, তাই নাকি? তুমি ইতালীয়?

ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল ছেলেটা, চেহারায় একটা নিশ্চিন্ত ভাব ফুটে উঠেছে তার। তারপর কিভাবে কেন ঠিক কি ঘটল, বলতে পারবে না সে। বিদ্যং খেলে গেল নেরির হাতে। ছেলেটার মাথায় প্রচণ্ড একটা ঘা বসিয়ে দিল সে হাতের টর্চটা দিয়ে। সাথে সাথে কপালের চামড়া কেটে গেল। ক্ষতটা গম্ভীর হয়েছে, হড়হড় করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ভাগ্য ভাল বলতে হবে ছেলেটার, আঘাতটা হাড় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়নি।-শালা বেজন্মা। ইতালীয়দের কলঙ্ক তুই। তোদের। জন্যেই তো এত বদনাম আমাদের। ওঠ, শালা, সিধে হ। ছেলেটার গায়ে একটা লাথি মারল নেরি। লাথিটা খুব জোরে মারল না, আবার খুব আস্তেও নয়! যা-শালা, এখান থেকে সোজা বাড়ি ফিরে যা। আবার যদি রাস্তায় ঘুর ঘুর করতে দেখি তোকে, মেরেই ফেলব। আর শোন, ফের যদি এই কার্লো কোটটা গায়ে দিল, আর আমার চোখে পড়ে যাস, যীশুর কিরে, তোর কপালে খারাবি আছে। তোর ভাগ্য ভাল যে আমি তোর বাবা নই।

বাকি ছেলে,দুটোর সাথে কোন কথাই বলল না নেরি। তাদের কোমরে লাথি মারতে মারতে অনেকটা পথ পার করে দিয়ে এল শুধু।

এ-ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, ঝামেলা মিটিয়েই সেখান থেকে সরে যায় নেরি। দেরি করলেই লোকজন জমবে, তার আচরণের প্রতিবাদ জানাবে। সহকারী তৈরি হয়েই থাকে, নেরি লাফ দিয়ে উঠে বসলেই গাড়ি ছেড়ে দেয় সে। তবে কখনও সখনও তাঁদোড় কিসিমের দুএকটা ছোকরার দেখা পাওয়া যায়, নিজেকে খুব দুঃসাহসী মনে করে লড়তে আসে, এমন কি ছোরা-ছুরি পর্যন্ত বের করে। এদের অবস্থা চোখের জলে নাকের জলে করে ছাড়ে নেরি! কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ পিশাচে পরিণত হয়ে যায় সে, অ্যায়সা মার মারে যে, ছেড়ে দে বাপ, ছেড়ে দে বাপ করে চেঁচাতে থাকে ছোকরালো। কিন্তু নেরির তখন একটাই উদ্দেশ্য, চেঁচানিটা থামানো। তাই যত বেশি চেঁচায় ওরা, ওর হাতও তত বেশি চলে। যতক্ষণ না রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তারা জ্ঞান হারায় ততক্ষণ নির্দয়ভাবে হাত চালিয়ে যায় সে। তারপর অজ্ঞান শরীরটা গাড়িতে তুলে নেয়। পুলিশের লোককে আক্রমণ করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া না পাওয়া পর্যন্ত বিচার স্থগিত রাখতে হয়।

থানার সার্জেন্টকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে না নেরি, তাই তাকে বদলি করে দেয়া হলো। ইউনাইটেড নেশন-এর বাড়িটা তার আওতাধীন নতুন এলাকার মধ্যে পড়ে। ইউনাইটেড নেশনস্-এর কর্মচারীদের রয়েছে রাষ্ট্রদূতদের সমান স্বাধীনতা। আইনের ধার ধারে না তারা, যেখানে ইচ্ছা গাড়ি পার্ক করে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কয়েকদিন ব্যাপারটা লক্ষ করল নেরি, তারপর থানায় রিপোর্ট করল। পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হলো তাকে, এ নিয়ে সে যেন পানি ঘোলা না করে, স্রেফ চোখ বুজে থাকতে হবে তাকে।

এক রাতের ঘটনা। রাস্তার প্রায় মাঝখানে গাড়ি রাখার ফলে ছোট একটা গোটা এলাকায় যানবাহন চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। রাত তখন বারোটা। টর্চ হাতে নিয়ে কর্তব্য পালনে নেমে পড়ল নেরি। রাস্তায় যে কটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সবগুলোর উইণ্ডস্ক্রীনের কাঁচ ভেঙে দিল সে। গাড়ির মালিকরা সবাই গণ্যমান্য ব্যক্তি হলেও কাঁচ পাল্টাতে সময় এবং কিছু টাকা ব্যয় করতে বাধ্য হলো তারা, তবে এ ধরনের বর্বরতার বিরুদ্ধে চুপ করে থাকল না কেউ, ফলে স্রোতের মত অভিযোগ আসতে শুরু করল থানায়।

কিন্তু এরপরও পুরো হপ্তা জুড়ে প্রতিদিন গাড়ির কাঁচ ভাঙার ঘটনা ঘটতে লাগল। অবশেষে আসল কারণ বুঝতে পেরে টনক নড়ল কর্তৃপক্ষের। সাথে সাথে হার্লেমে বদলি করে দেয়া হলো অ্যালবার্ট নেরিকে।

এর কিছুদিন পর এক রোববারে সস্ত্রীক বেড়াতে এল নেরি তার বোনের বাড়ি। আর সব সিসিলীয়দের মত বোনকে সাঙ্ঘাতিক ভালবাসে সে, সম্ভাব্য সব রকম বিপদ-আপদ আর আঘাত থেকে তাকে রক্ষা করতে চায়। দুমাস অন্তর একবার করে এসে দেখে যায় বোন কেমন আছে। বোনের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট সে, বছর কুড়ি বয়সের একটা বোন-পো আছে তার। নাম টমাস, মাথার ওপর বাপের শাসন না থাকায় ভালমানুষ মায়ের ওপর খুব অত্যাচার করে সে। এরই মধ্যে ছোটখাট দুএকটা অঘটন ঘটিয়েছে। আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিনে দিনে। একবার ছোট একটা চুরির কেসে ফেসেই গিয়েছিল টমাস, সহকারীদের ধরে তার রেহাই পাবার ব্যবস্থা করে দিল মেরি। সেবার প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল তার। কিন্তু স্বভাব অনুযায়ী প্রথমবার বলে গায়ে হাত তোলেনি, তবে শেষবারের মত সাবধান করে দিয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে আরও বলেছিল, দেখো, টমি, এখন তুমি বড় হয়েছ। মায়ের সাথে কি রকম আচরণ করা উচিত তা তোমার জানা আছে বলেই বিশ্বাস করি। ফের যদি শুনি তুমি আমার বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছ, নিজে এসে তোমাকে সিধে করব আমি। কথাটা ভয় দেখাবার জন্যে বলেনি নেরি, বলেছিল ভাগের প্রতি মামার শুভাকাক্ষী বন্ধুসুলভ পরামর্শের সুরে। ব্রুকলিনের এই গুণ্ডাপাড়ায় যত ছোকরা আছে তাদের মধ্যে টমাসই সবচেয়ে বেপরোয়া আর অকুতোভয়, কিন্তু মামাকে সে ভয় করে জুজুর মত!

রোববার সকালে বোনের বাড়ি এসে নেরি নল গতরাতে প্রায় ভোরের দিকে বাড়ি ফিরেছে টম, তাই এত বেলাতেও ঘুম ভাঙেনি তার। মা ছেলের কামরায় ঢুকে খানিকটা চেঁচামেচি করে এল। বলল, তোর মামীকে নিয়ে মামা বেড়াতে এসেছে, ওদের সাথে খাবি আয়।

কামরার মাঝখানের দরজা খোলা, তাই টমের উত্তরটা পরিষ্কার শুনতে পেল নেরি। টম কর্কশ সুরে বলল, এসেছে তো আমার কি! এখান থেকে যাও, আমি এখন ঘুমাব।

ছেলের ধমক খেয়ে মুখ কালো করে বেরিয়ে এল মা।

টমকে বাদ রেখেই খেতে বসল ওরা। বোনকে একটা প্রশ্ন করল নেরি, ইদানীং টম তার ওপর আগৈর মত অত্যাচার করছে কিনা। এদিক ওদিক মাথা নাড়ল টমের মা।

বিকেলের দিকে বিদায় নিচ্ছে নেরি, এই সময় বিছানা থেকে উঠল টম। দায়সারা গোছের একটা হ্যালো বলে কিচেনে গিয়ে ঢুকল সে। তারপর সেখান থেকে চিৎকার করে বলল, এই মা, আমার কথা কানে যাচ্ছে? খিদে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি কিছু একটা বেঁধে দাও। কথার সুরটা অনুরোধের মত নয়, আদুরে ছেলের আবদারের মত শোনাল।

গলায় ঝাঁঝ এনে জবাব দিল মা, লাটসাহেব ছেলে আমার, সারা রাত হারামীপনা করে এসে উনি ঘুম থেকে উঠলেন এই বিকেল বেলা! এখন ওঁকে আমার বেঁধে দিতে বয়ে গেছে। আরও ঘুমাও, একেবারে সেই রাতে খেয়ো।

অপ্রীতিকর একটা দৃশ্য, অনেক সংসারেই এই রকম ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে টমের মেজাজ ভাল নেই, মামার উপস্থিতি ভুলে গিয়ে একটা মারাত্মক অন্যায় করে বসল সে। তোমাকে আর তোমার খ্যাচখ্যাচানিকে ইয়ে করি আমি, চিৎকার করে অশ্রাব্য একটা গালি দিল সে। বাইরে গিয়েই খেতে পারি, বুঝেছ? কথাগুলো বলেই বুঝতে পারল টম, মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে সে।

শিকারী বিড়ালের মত ভাগ্নের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল নেরি। মাকে টম এমন জঘন্যভাবে অপমান করল বলে যতটা না, তার চেয়ে হলো নেরির বাড়িতে কেউ না থাকলে টম তার মায়ের সাথে আরও খারাপ আচরণ করে বুঝতে পেরে। এর আগে কখনও মামার সামনে এভাবে মায়ের সাথে কথা বলেনি ও। বাজে। কথাগুলো মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে আজ। কপালে খারাবি থাকলে যা হয়।

ঘরে দুজন মেয়েলোক উপস্থিত রয়েছে, কিন্তু তারা বাধা দেয়া তো দূরের কথা, আতঙ্কে পিছু হটতে হটতে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। একটা কথাও বেরুল না তাদের মুখ থেকে। বিস্ফারিত চোখে শুধু দেখছে মার কাকে বলে। ভাগ্নের পা থেকে মাথা পর্যন্ত অত্যন্ত যত্নের সাথে পেটাল নেরি। খুব বেশি ব্যস্ততা দেখাল না সে, যেন কাজটায় গভীর যত্ন না নিলে নিখুঁত হবে না। শুধু দুই হাতে পেটাচ্ছে, কিন্তু আঘাতগুলো যেখানে পড়েছে সেখানের মাংস সাথে সাথেই ফুলে উঠেছে। প্রথম দিকে আত্মরক্ষার একটু চেষ্টা করল টম, কিন্তু তা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে করুণা ভিক্ষা করতে শুরু করল। নেরি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিল টমের মুখের ওপর। একের পর এক চড় মেরে গেল যতক্ষণ না ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়াতে শুরু করল। তারপর টমের মাথার দিকে মনোযোগ দিল। মাথাটা ধরে ঠুকে দিতে লাগল শক্ত দেয়ালে। তারপর ভায়ের পেটে গোটাকতক ঘুসি মারল। পড়ে গেল টম। নেরি যেন এরই জন্যে অপেক্ষা করছিল, টম পড়ে যেতেই তার মুখটা ঘষে দিল গালিচার সাথে তোমরা এখানে অপেক্ষা করো, মহিলাদেরকে বলল নেরি। তারপর রক্তাক্ত ভাগ্নেকে ধাক্কা মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এসে সোজা তুলল নিজের গাড়িতে। স্টার্ট দিল না, ভামের পাশে বসে তার উদ্দেশে গালমন্দ শুরু করে একেবারে ভূত ভাগিয়ে দিল। ফের কখনও যদি জানতে পারি তোর মায়ের সাথে, ওভাবে কথা বলছিস, তখন কি করব তা আমার মনই জানে। শুধু এইটুকু বলে রাখিআজকের এই মারধরটাকে তখন মেয়েদের চুমো বলে মনে হবে তোর কাছে। যা এবার, সোজা বাড়িতে ঢুকে তোর মামীকে বল, তার জন্যে এখানে আমি অপেক্ষা করছি।

এই ঘটনার পর দুমাস কেটে গেছে। একদিন বাড়ি ফিরে অ্যালবার্ট নেরি দেখল তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ফোন করল সে। রিসিভার তুলল ওর শ্বশুর, বলল, নেরিকে সাঙ্ঘাতিক ভয় করে তার মেয়ে, তাই চলে এসেছে। রিটা জানিয়ে দিয়েছে, এমন চণ্ডালের মত রাগী লোকের সাথে ঘর-সংসার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

নেরি তো একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল, রিটা তাকে ভয় করে, একথা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। স্ত্রীর গায়ে কখনও হাত তোলেনি সে, এমনকি বকাঝকাও করেনি কখনও। স্ত্রীকে ভালবাসে সে, তাকে ভয় দেখাবার কথা ভাবতেই পারে না। স্তম্ভিত ভাবটা কেটে যেতে কয়েকটা দিন সময় লাগল। তারপর নেরি ঠিক করল, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রিটার সাথে কথা বলতে হবে তাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরদিন রাতেই ডিউটিতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেল সে। রিটার কাছে আর যাওয়া হলো না তার।

সাহায্যের ডাকটা এল হার্লেম থেকে। নিজের স্ট্রেল-কারের অয়্যারলেসের মাধ্যমে সাড়া দিল নেরি। তাকে জানানো হলো, ভয়ঙ্কর ধরনের খুনোখুনি ব্যাপার, অকুস্থলে দ্রুত পৌঁছুতে পারলে কিছুটা সামাল দেয়া যেতে পারে। তীর বেগে গাড়ি হাঁকিয়ে সেখানে পৌঁছে গেল নেরি, টর্চটা হাতে নিয়ে নেমে পড়ল লাফ দিয়ে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে, তবু জায়গাটা খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হলো না। বস্তী এলাকা, একটা বাড়ির সামনে ভিড় দেখে সেদিকে এগোল নেরি। একজন লোক বাচ্চা একটা মেয়েকে মেরে ফেলছে, নিগ্রো একটা মেয়েলোক বলল নেরিকে।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল নেরি। হলঘরের উল্টোদিকের দরজাটা খোলা, সেখান থেকে আলো আসছে। একটা গোঙানির আওয়াজও পাচ্ছে নেরি। খোলা দরজাটার দিকে এগোল সে। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। দুটোই নিগ্রো মেয়ে, একজনের বয়স পঁচিশের মত, আরেকজনের টেনেটুনে বারো হবে। মেয়ে দুটোর শরীরের নানা জায়গায়, বিশেষ করে মুখে ধারাল ক্ষুর দিয়ে পোচ মারা হয়েছে। সিটিংরুমে অপরাধীকেও দেখতে পাচ্ছে নেরি। খুব ভাল করে চেনে লোকটাকে সে। নাম ওয়াক্স বেনস, বেশ্যাদের একজন নীচ দালাল, তাছাড়া গুণ্ডামি আর বেআইনী ড্রাগসের ব্যবসাও করে থাকে। এই তো মাত্র এক হপ্তা আগের ঘটনা, রাস্তায় একটা বেশ্যা মেয়েকে মারধর করার অপরাধে নেরি তাকে অ্যারেস্ট করেছিল। অবশ্য তার পরদিনই জামিন পেয়ে গিয়েছিল বেনস।

নিগ্রোদেরকে মোটেই পছন্দ করে না নেরি। হার্লেম নিগ্রোদেরই এলাকা, এখানে কাজ করতে এসে নিগ্রোদের ওপর তার বিরক্তি আর ঘৃণা আরও বরং বেড়ে গেছে। নিগ্রোদের স্বভাব আর আচার আচরণই এর জন্যে দায়ী। নিগ্রো মেয়েরা প্রায় সবাই চাকরি করে, দেহ বিক্রি করে টাকা কামায়, কিন্তু পুরুষগুলো খাটা খাটনির ধার দিয়ে যায় না-ধু মদ খেয়ে নেশা করে। একে নিগ্রোদেরকে দুচোখে দেখতে পারে না, তার ওপর বেন এমন সীমা ছাড়িয়ে আইন অমান্য করেছে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল নেরির। ক্ষুর দিয়ে ফালা ফালা করা ছোট মেয়েটাকে দেখে বমি পাচ্ছে তার। অত্যন্ত শান্তভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় আশ্চর্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অ্যালবার্ট নেরিওয়াক্স বেনসকে গ্রেফতার করবে না সে.।

বাড়ির ভেতর ইতিমধ্যে সাক্ষীদের ভিড় জমে গেছে, বেশিরভাগই বস্তীর বাসিন্দা, তাদের সাথে পেট্রল-কার থেকে নেরির সহকারীও এসেছে। এই ব্যাটা, বেন, ছুরি ফেলে দে, গ্রেফতার করা হলো তোকে, বলল নেরি।

বিশ্রী শব্দ করে হেসে উঠল বেনস, বলল, এতই সহজ? আমাকে গ্রেফতার করতে হলে রিভলভার লাগবে, হাত তুলে ছুরিটা দেখাল সে! কিংবা হয়তো এটা দরকার তোমার?

বিদ্যুৎ খেলে গেল নেরির শরীরে, চোখের নিমেষে নিগ্রো লোকটার কাছে চলে এল সে। পকেট থেকে রিভলভার বের করার সুযোগই পেল না লোকটা, কিন্তু আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সাথে নেরিকে লক্ষ্য করে ছুরি চালাল। তৈরি ছিল নেরি, বাঁ হাত দিয়ে লোকটার কব্জি ধরে ফেলল সে। একই সাথে ডান হাতে ধরা টর্চটা দিয়ে ছোট একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে বেনসের মাথায় মোক্ষম একটা ঘা বসিয়ে দিল। নেশাগ্রস্ত বদ্ধ মাতালের মত হাসাকর ভঙ্গিতে বসে পড়ল বেনস: ছুরিটা পড়ে গেছে হাত থেকে। মাথায় টর্চের বাড়ি খেয়ে একেবারে অসহায় হয়ে গেছে লোকটা, সুতরাং এরপর আর তাকে মারধর করা চলে না নেরির। আইন সেটাকে সমর্থন করবে না। প্রথম আঘাতেই বারোটা বেজে গেছে বেনসের। টর্চের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, এনামেল করা ঢাকনি আর বাল ছিটকে চলে গেছে কামরার আরেক প্রান্তে। টর্চের ভারি শরীরটা পর্যন্ত তুবড়ে গেছে। ভেতরে ব্যাটারির সেলগুলো রয়েছে, তা না হলে দুমড়ে দুভাজ হয়ে যেত ওটা। মাথার খুলি ফেটে গেছে বেনসের। এই বাড়িরই একজন বাসিন্দা, নিগ্রো দর্শক, সবিস্ময়ে বলল, কি শক্ত মাথারে বাবা! চুরমার হয়ে যাবার কথা, তা না, শুধু ফেটে গেছে। তবু লোকটাকে দ্বিতীয়বার আঘাত করল নেরি। দুঘন্টা পর হার্লেমের হাসপাতালে মারা গেল বেনস।

বিভাগীয় অভিযোগের সম্মুখীন হতে হলো নেরিকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে শুনে নেরি ছাড়া আর কেউ এতটুকু আশ্চর্য হলো না। প্রয়োজনের বেশি শক্তি প্রয়োগ করার অপরাধে তাকে তো সাসপেন্ড করা হলোই, সেই সাথে কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে একটা ফৌজদারি মামলাও ঠুকে দিল। গোটা ব্যাপারটা নেরির কাছে। অবিশ্বাস্য, দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। বুঝতেই পারে না কি অপরাধ করেছে সে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা হলো তাকে, জেল হয়ে গেল দশ বছরের।

ইতিমধ্যে ব্যর্থ আক্রোশ আর গোটা সমাজের ওপর তীব্র একটা ঘৃণায় অন্তঃকরণ ভরে উঠেছে অ্যালবার্ট নেরির। কর্তব্যপালন করতে গিয়ে একটা বেশ্যার দালালকে, একটা নিগ্রো খুনীকে মেরে ফেলেছে বলে তাকে কিনা জেলে পুরে দিল। এত বড় স্পর্ধা! এর নাম বিচার। দু দুটো মেয়েমানুষকে ক্ষুর দিয়ে কেটে চিরকালের জন্যে পঙ্গু করে দিয়েছে বেনস, সেই বেনসকে খুন করায় তাকে সবাই ফুলের মালা পরাবে, তা না উল্টো কঠিন সাজা দিয়ে মজা দেখছে। তার মানে ভাল কাজের কোন দাম নেই সমাজে? জেল খাটাকে ভয় পায় না নেরি। তার ধারণা, হাজার হোক পুলিশে ছিলাম, ভাল ব্যবহারই করা হবে আমার সাথে। তাছাড়া, জেল কর্তৃপক্ষ আর কর্মচারীরা তার অপরাধের প্রকৃতিটাও তো দেখবে। কয়েকজন পুলিশ অফিসার ইতিমধ্যে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, তারা তাদের বন্ধুবান্ধবকে নেরির সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্যে অনুরোধ করবে। একমাত্র ওর শ্বশুর, একটা মাছের বাজারের মালিক তিনি, গম্ভীর মুখে বললেন, জেলে বোধহয় এক বছরও বাঁচবে না নেরি। হয় কোন কয়েদী ওকে মেরে ফেলবে, নয়তো, ওর হাতে মারা পড়বে তারা কেউ।

জামাইয়ের ওপর অদ্ভুত একটা টান ছিল ভদ্রলোকের। মেয়েটা এমন ভাল একটা স্বামীকে মেয়েলী ঢং দেখিয়ে ছেড়ে দেয়ায় নিজে তিনি অপরাধবোধে ভোগেন। কর্লিয়নি পরিবারের সাথে যোগাযোগ আছে তাঁর, বাজারটার নিরাপত্তার জন্যে পরিবারটিকে নিয়মিত টাকা দেন তিনি। তার ওপর বড় মাছগুলো উপহার হিসেবে প্রায় রোজই তো পাঠানো হচ্ছে। একজন ন্যায়পরায়ণ জামাইয়ের শ্বশুর হিসেবে নিজে কর্লিয়নিদের সাহায্য ভিক্ষা চাইলেন তিনি।

অ্যালবার্ট নেরির কথা এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে কর্লিয়নিদের। ন্যায়ের ধ্বজাধারী একজন ব্যতিক্রমী পুলিশ হিসেবে কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে গেছে সে। সবাই বলাবলি করে,নেরি এমন একটা মানুষ যাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা চলে না। পুলিশের ইউনিফর্ম আর সাথে আগ্নেয়াস্ত্র থাকত বলে লেকে ওকে ভয় করত তা নয়, এসব ছাড়া শুধু ওর ব্যক্তিই এমন যে ভয় না করে উপায় থাকে না কারও। ওর হিংস্রতার কথাটাই ধরা যাক। এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সারার ভঙ্গিতে, শুধু খালি দুটো হাত দিয়ে অনায়াসে মানুষ মারতে পারে সে। তার জন্যে। পরে কোন অনুতাপও বোধ করে না। এই জাতের লোক সম্পর্কে কর্লিয়নিরা সব সময়ই আগ্রহ প্রকাশ করে এসেছে। নেরি যে পুলিশের লোক; এটাকে তারা তেমন গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। তাদের জানা আছে নিয়তির নির্দিষ্ট করে রাখা লক্ষ্যে অনেক যুবক ভুল পথ ধরে পৌঁছে যায়। সময় এবং ভাগ্য তাদেরকে সাহায্য করে।

গন্ধ শুঁকে ভাল কর্মী খুঁজে বের করার একটা আশ্চর্য গুণ আছে পীট ক্লেমেঞ্জার। টম হেগেনের নজরে নেরিকে সেই আনল প্রথমে। পুলিশের তৈরি করা বিবৃতি পড়ে আরক্লেমেঞ্জার বর্ণনা শুনে হেগেন বলল, এখানে যেন আরেকটা লুকা ব্রাসির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে?

আমারও ঠিক তাই মনে হচ্ছে, উৎসাহের সাথে মাথা নেড়ে বলল ক্লেমেঞ্জা এদিকে একটু খেয়াল দেয়া উচিত মাইকেলের।

অস্থায়ীভাবে একটা কারাগারে রাখা হয়েছে নেরিকে, কিছুদিনের মধ্যে অন্য রাজ্যে বদলি করা হবে তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটল। তাকে জানানো হলো, উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের পেশ করা নতুন কিছু তথ্য আর হলফনামার ওপর নির্ভর করে বিচারক তার রায় রদবদল করেছেন। পুনর্বিচার করে আগের রায় বাতিল করে দিয়েছেন তিনি, নেরি খালাস পেয়েছে।

নেরি বোকা নয়, আর তার শশুর ভদ্রলোকটিও লাজুক বনফুলটি নন, সব কথা শুনল নেরি। বিটার ওপর তার দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে ঘরের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করল সে। তারপর রওনা হলো লংবীচের উদ্দেশে। যারা তার এত বড় উপকার করেছে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্যে। সব ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে। তার সাথে লাইব্রেরিতে দেখা করল মাইকেল কর্লিয়নি।

খুব একটা গদগদ ভাব না দেখিয়ে সাধারণভাবে ধন্যবাদ জানাল নেরি। কিন্তু তার এই সামান্য ধন্যবাদকে এমন আন্তরিক সহৃদয়তার সাথে গ্রহণ করল মাইকেল, নেরি যেমন আশ্চর্য হলো তেমনি কৃতার্থও হয়ে গেল।

আমি একজন সিসিলীয়, তাকে বলল মাইকেল, আরেকজন সিসিলীয়র সাথে ওই রকম অন্যায় ব্যবহার ওদেরকে আমি করতে দেই কিভাবে? সোনার একটা মেডেল দেয়া উচিত ছিল তোমাকে, তা না দিয়ে, ওরা তোমাকে জেলে ভরে দিল। এ কি সহ্য করার মত একটা ব্যাপার? আসলে কি জানো, শালার রাজনীতিকরা দলীয় চাপ ছাড়া আর কোন ব্যাপারেই মাথা ঘামায় না। সমস্ত খবর নিয়ে যখন বুঝলাম যে সত্যি সত্যি তোমার ওপর অন্যায় অবিচার করা হয়েছে, তখন আর নাক না গলিয়ে পারলাম না। তুমি যদি সত্যি অপরাধী হতে, কিছুই এসে যেত না আমার, তোমাকে নিয়ে এতটা মাথা ঘামাতাম না। তোমার বোনের সাথেও কথা বলেছে আমার লোক। শুনলাম বোনের জন্যে অনেক কিছু করেছ তুমি, তার ছেলেটাকেও জন্মের মত সিধে করে দিয়েছ। তোমার শ্বশুর তো নিজে আমাকে এসে বলে গেছেন, তোমার মত ভাল মানুষ তিনি নাকি আর দেখেননি। যাই বলো, একজন মানুষ সম্পর্কে সবাই শুধু ভাল ভাল কথা বলছে, এমন বড় একটা দেখা যায় না। নেরির স্ত্রী যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে, বুদ্ধি করে সেটা আর উল্লেখ করল না মাইকেল।

গল্পগুজব করে খানিকটা সময় কাটাল ওরা। খুব চাপা স্বভাবের লোক নেরি, ঘনিষ্ঠ লোকজনদের সাথেই বেশি কথা বলে না সে, কিন্তু সদ্য পরিচয় হলেও মাইকেলের সাথে মন খুলে কথা বলছে আজ। খুব বেশি হলে মাইকেলের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট হবে সে, কিন্তু এমন ভাবে কথা বলছে, মাইকেল যেন তার চেয়ে অনেক বড়, তার বাপের বয়েসী।

তারপর কাজের কথায় এল মাইকেল। প্রসঙ্গটা কৌশলে পড়ল ও, বলল, যাক, ভালয় ভালয় তোমাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা গেছে, সেটাই আসল কথা। তবে, তাতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, তা ভেব না। একটা বিপদ থেকে কাউকে উদ্ধার করে তাকে আবার সাগরে ভাসিয়ে দেয়া আমার নীতি নয়। তুমি চাইলে তোমার জন্যে কিছু কাজের ব্যবস্থা করতে পারি আমি। লাস ভেগাসে আমাদের বৈষয়িক স্বার্থ আছে, তোমার যা অভিজ্ঞতা, তাতে অনায়াসে ওখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারো তুমি। অথবা তুমি হয়তো ছোটখাট একটা ব্যবসার মালিক হতে চাও। তাতেও খুশি হব আমি পুঁজি যদি না থাকে, ব্যাংক থেকে লোন পাবার ব্যবস্থাও করে দিতে পারব।

কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে পড়ল নেরি। নিজেকে তার তুচ্ছ আর মাইকেলকে মহান বলে মনে হচ্ছে। অদ্ভুত একটা কুণ্ঠাবোধ করলেও গর্বের সাথে মাইকেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সে। তারপর বলল, শাস্তি থেকে রেহাই পেলে কি হবে, ওই আদালতের নাগালের বাইরে যেতে পারব না আমি।

ওসব কথার কথা, তাড়াতাড়ি বলল মাইকেল, আদালতের ওই নিষেধাজ্ঞা যাতে তুলে নেয়া হয় তার ব্যবস্থা আমি করতে পারব। আর ব্যাংক থেকে যাতে কোন আপত্তি না ওঠে তার ব্যবস্থাও করা সম্ভব, পুলিশের খাতা থেকে তোমার নামটা কেটে দেয়া এমন কোন কঠিন কাজ নয়।

এসব অত্যন্ত ঝামেলার কাজ, জানে নেরি। তার জন্যে মাইকেল এত ঝামেলা কাঁধে নিতে চাইছে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল সে। মৃদু গলায় বলল, ঠিক আছে। কখনও যদি সাহায্য দরকার হয়, আপনাকে জানাব।

খুব খুশি হলাম আমি, বলল মাইকেল। এখন চলো, আমার বাড়ির লোকেরা খাবার টেবিলে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। বাবা তোমার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছেন। এইটুকু পথ, চলো তার বাড়িতে আমরা হেঁটেই যাই। তোমাকে নিয়ে যেতে দেরি করলে মা আবার রাগ করবে আমার ওপর। হাল মাইকেল। লংকা ভাজা, ডিম, সসেজ, আরও অনেক কিছু–একেবারে খাঁটি সিসিলীয় নিয়মে তৈরি করা।

সেই কৈশোরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অ্যালবার্ট নেরির। তারপর থেকে আর কোন দুপুরবেলা এত আনন্দে কাটেনি তার। সেই পনেরো বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে, সেই থেকে আনন্দের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে সে। কিন্তু আজ সদ্য পরিচিত একটা পরিবারের সদস্যদের সাথে খেতে বসে এমন আপনজনের মত। ব্যবহার পাচ্ছে, রীতিমত অভিভূত হয়ে পড়ছে মনটা। আশ্চর্য প্রসন্ন মেজাজে তাকে অভ্যর্থনা করলেন ডন কর্লিয়নি। নেরিকে কথা বলিয়ে তিনিই আবিষ্কার করলেন, নেরির বাবা-মার আদি বাসস্থান থেকে তাদের গ্রামে যেতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। নেরি কর্লিয়নিদের এক রকম ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন ডন। গল্পগুজব করার জন্যে অনেকটা সময় দিলেন তিনি নেরিকে। ভোজের ব্যাপক আয়োজন রয়েছে, খাবারগুলো আশ্চর্য উপাদেয়, গাঢ় লাল রঙের মদ, বড়ই পুষ্টিকর। কর্লিয়নিদেরকে একান্ত আপনওন বলে মনে হলো নেরির। লক্ষ করল, এদের কোন গর্ব নেই, এরা দাম্ভিক নয়, উপকারের বিনিময়ে কিছু চায় না। উলে তার জন্যে আরও কিছু করতে পারে কিনা জানতে চাইছে বারবার। পরিষ্কার বুঝতে পারছে সে, আজ সে এই পরিবারে বহিরাগত মেহমান হলেও সে যদি চায়, এই পরিবারে একটা স্থায়ী আসন পেয়ে সুখী হতে পারে।

বিদায় দেবার সময় মাইকেল এবং ডন স্বয়ং যে সৌজন্য দেখালেন, জীবনে কখনও তা ভুলবে না নেরি। ওর গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এলেন তারা। সহাস্যে ওর হাত ধরে নেড়ে দিলেন ডন। বললেন, তুমি খুব ভাল ছেলে, নেরি। তোমার সাথে আলাপ করে খুব খুশি হয়েছি আমি। এই যে আমার ছেলে মাইকেলকে দেখছ, জলপাই তেলের ব্যবসা শেখাচ্ছি ওকে আমি। বয়স বাড়ছে তো, এবার অবসর নিতে হবে। কিছুদিন আগে হঠাৎ আমার কাছে এসে তোমার নাম করল, বলল এই ছেলেটা খুব ভাল, দুর্ভাগ্যক্রমে সাঙ্ঘাতিক একটা বিপদে পড়ে গেছে, সেই বিপদ থেকে একে উদ্ধার করতে হবে-বাবা, তুমি চেষ্টা করলে ছেলেটা বেঁচে যায়। আমাকে একটু স্বস্তি পেতে দেয় না, সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। অবশেষে বাধ্য হয়ে তোমার ব্যাপারে নাক গলাতে হলো আমাকে। তোমাকে এত কথা বলার কারণ, এখন বুঝতে পারছি তোমার ব্যাপারে আমার সাহায্য চেয়ে খুব ভাল করেছিল ও। তোমার মত ভাল ছেলে হয় না। কখনও যদি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি, মুখ ফুটে চেয়ে উপকারটা। আমার কথা বুঝতে পারছ তো? তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে আমরা খুশি হব।

মনস্থির করতে তিনদিনও সময় নিল না নেরি। ওকে তোয়াজ করা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার। কিন্তু সেই সাথে এও বুঝল, যে কাজের জন্যে প্রচলিত সমাজ তাকে দোষী মনে করে শান্তি দিয়েছিল, সেই কাজকে অনুমোদন করে কর্লিয়নি পরিবার। কর্লিয়নি পরিবার ওকে গুরুত্ব দেয়, ওর মূল্য বোঝে, কিন্তু সমাজ ওকে পাত্তাই দেয় না, মূল্য বোঝা তো পরের কথা। কর্নিয়নি পরিবার ওর প্রশংসা করে, সমাজ ওর নিন্দা করে। কর্লিয়নিরা নিজেদের চেষ্টায় আলাদা একটা জগৎ সৃষ্টি করেছে, সেখানে তার মত লোক সুখে থাকতে পারে আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারল নেরি, বৃহং সমাজের চেয়ে কর্লিয়নিদের সমাজ অনেক বেশি শক্তিশালী। এদের সমাজে থাকতে পারলে তার হাতেও অনেক ক্ষমতা আসবে। টাকা, আরাম-আয়েশ, সম্মান, দাপট এসব তো আসবেই।

আবার মাইকেল কর্লিয়নির সাথে দেখা করল নেরি। খোলাখুলি সে নিজের ইচ্ছের কথাটা বলল তাকে। ভেগাসে নয়, নিউ ইয়র্কে কর্লিয়নি পরিবারের কাজ করতে চায় সে। মাইকেলের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করল সে। বলল, উপকারীর ঋণ প্রাণ দিয়ে হলেও পরিশোধ করার চেষ্টা করবে সে। কথাটা বলে নিজের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত করতে চাইল মাইকেলকে। মাইকেল যে মুগ্ধ হয়েছে, তাও লক্ষ করল নেরি। সেদিনই সব কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। প্রথমেই শর্ত দিল মাইকেল, কর্লিয়নিদের খরচে মায়ামীতে গিয়ে লম্বা একটা ছুটি উপভোগ করে আসতে হবে নেরিকে। ওখানে কর্লিয়নিদের হোটেল আছে, সেখানে একবার গিয়ে উঠলেই হবে, নেরির আরাম-আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেবে তারা। সেই সাথে পুরো এক মাসের বেতন অ্যাডভান্স দিয়ে দেয়া হলো ওকে।

জীবনে এই প্রথম বিলাসিতার স্বাদ পেল অ্যালবার্ট নেরি। হোটেল কর্তৃপক্ষ সাঙ্ঘাতিক খাতির করল তাকে। আদর-যত্নের কোন ত্রুটি হলো না। ম্যানেজার, বলল, আপনার অযত্ন হলে রক্ষা থাকবে কারও? আপনি যে কর্লিয়নিদের বন্ধু মানুষ! হোটেলের সবচেয়ে সৌখিন আর দামী সুইটটা দেয়া হয়েছে তাকে। ঠেকায় পড়ে বা দয়া করে যেমন গরীব আত্মীয় স্বজনকে সস্তা একটা ঘর দেয়া হয়, ব্যাপারটা সেরকম নয়। নাইট ক্লাবের ম্যানেজার নিজে এসে নিয়ে গেল একদিন নেরিকে, কয়েকটা অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিল সে।

ছুটি কাটিয়ে আবার একদিন নিউ ইয়র্কে ফিরে এল নেরি। জীবন সম্পর্কে এই কদিনে ধারণাটা মোটামুটি বদলে গেছে তার। ক্লেমেঞ্জার দলে ভর্তি করে নেয়া হলো তাকে। কমী যাচাই করার ব্যাপারে ক্লেমেঞ্জার তুলনা মেলা ভার, এ কর সে যেমন দক্ষ, তেমনি মেজাজী। সম্ভাব্য সব উপায়ে নেরিকে পরীক্ষা করে নিল সে। হাজার হোক, পুলিশের লোক ছিল নেরি। তবে আসল কথা হলো, জন্ম সূত্রে পাওয়া একটা হিংস্রতা আছে ওর চরিত্রে। আইন মানে না এমন লোকদের হয়ে কাজ করার ব্যাপারে তার মনে একটু যদি দ্বিধা এসেও থাকে, ওর ভয়ঙ্কর হিংস্রতার জোয়ারে সব একেবারে বেমালুম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এক বছরও লাগল না, অপরাধ জগৎ সম্পর্কে একেবারে ঝানু হয়ে উঠল অ্যালবার্ট নেরি। ইতিমধ্যে পূর্ব জীবনে ফিরে যাবার পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।

নেরির কথা উঠলেই প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে ক্লেমেঞ্জা। ওর তুলনা হয় না, ঠিক যেন লুকা ব্রাসির আধুনিক সংস্করণ। গর্ব করে ক্লেমেঞ্জা এতদূর পর্যন্ত বলে, লুকাকেও ছাড়িয়ে যাবে নেরি। নেরিকে ক্লেমেঞ্জাই আবিষ্কার করেছে, গর্ব তো একটু হবেই তার।

শারীরিক দিক থেকে নেরিকে শুধু বিদ্যুতের সাথেই তুলনা করা চলে। তার ক্ষিপ্র গতি, আর সমন্বয়বোধ লক্ষ করে নির্দিধায় বলে দেয়া যায়, ইচ্ছে করলেই আরেকজন বেসবল প্রতিভা জো ডিম্যাজিও হতে পারত সে। ক্লেমেঞ্জা এও জানে যে নেরির মত একটা প্রাকৃতিক শক্তিকে সামলানো তার কাজ নয়। তাই ঠিক হলো, সরাসরি মাইকেল কর্লিয়নির কাছে জবাবদিহি করবে ননরি, প্রয়োজনে টম হেগেনের মধ্যস্থতায়। নেরির সাথে আর কারও তুলনা হয় না, তাই আর সবার চেয়ে বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে বেশি পায় সে। কিন্তু স্বতন্ত্র একটা জীবিকার ব্যবস্থা তাকে করে দেয়া হয়নি। সৈনিক পোষা বা বুকমেকিং-এর একটা ব্যবসা, এসব নয়।

কিছুদিন যেতেই সবাই লক্ষ করে খুশি হলো যে একমাত্র মাইকেল কর্লিয়নিকে অগাধ ভক্তি করে নেরি। মাইকেলের ব্যাপারে একেবারে অন্ধ সে। ঠাট্টা করে একদিন হেগেন বলল মাইকেলকে, দুঃখ করার আর কোন কারণ নেই তোমার, মাইকেল। তোমার লুকা ৰাসিকে পেয়ে গেছ তুমি।

সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল মাইকেল। সন্দেহ নেই, একটা কাজের মত কাজ করা গেছে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কর্লিয়নি পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে নেরি। তার বিশ্বাস যাতে অবিচল থাকে তার জন্যে কৌশল প্রয়োগ করছে ওরা। বলা বাহুল্য, কৌশলটা মাইকেল তার বাবার কাছ থেকেই শিখেছে। বাবার শিষ্যত্ব বরণ করার পর একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল মাইকেল, আমি তো ভেবে পাই না লুকা ৰাসির মত একজন লোককে তুমি কিভাবে কাজে লাগালে। একটা জানোয়ার ছাড়া কি বলা যায় ওকে?

ছেলের প্রশ্ন শুনে হাসলেন ডন কর্লিয়নি। বললেন, আয়, বোস। ছেলেকে কিছু জ্ঞান দান করতে বসলেন তিনি। বললেন, দুনিয়ায় এমন কিছু মানুষ আছে যারা নিজেরাই খুন হতে চায়। এ-ধরনের লোক তোমার চোখেও পড়েছে। জুয়া খেলতে বসে খামোকা ঝগড়া বাধিয়ে বসে তারা, না জেনে কেউ যদি এদের গাড়িতে একটু আঁচড় কাটে, অমনি লাফ দিয়ে নিচে নেমে মারপিট শুরু করে দেয়। নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী লোকের সাথে লড়তে যায়, তাদের আসল ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু না জেনেই। লোকটা কে তা না জেনেই যাকে তাকে অপমান করে, তার ওপর অত্যাচার চালায়। একজন লোকের কথা মনে পড়ছে আমার, একদল ভয়ঙ্কর লোককে অকারণে অপমান করছিল সে, অথচ নিজের না ছিল শক্তি, না ছিল পৃষ্ঠপোষকতা। এরা হচ্ছে সেই জাতের লোক যারা দিন রাত চেঁচাচ্ছে-আমাকে খুন করো! আমাকে খুন করো! মজার ব্যাপার হলো, একদল লোক ঠিকই জুটে যায় যারা এদের অনুরোধ রক্ষা করতে সাঙ্ঘাতিক উৎসাহী। খবরের কাগজে এ ধরনের ঘটনার কথা আমরা রোজই পড়ছি। নিজেদের তো বটেই, এরা অন্য লোকেরও প্রচুর ক্ষতি করে বেড়ায়।

লুকা ব্রাসি ছিল ওই জাতের একজন মানুষ। কিন্তু ওই জাতের মধ্যে সে ছিল অসাধারণ। তাই অনেকদিন পর্যন্ত কেউ তাকে মারতে পারেনি। এ-ধরনের লোকেদের সাথে আমাদের তেমন কোন সম্পর্ক থাকে না। তবে লুকার মত একজন। নোককে যদি ঠিকমত ব্যবহার করা যায়, তোমার হাতে সে একটা মারাত্মক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। রহস্যটা হলো, মৃত্যুকে যখন ভয় পায় না সে, বরং তাকে খুঁজে বেড়ায়, তার মানে নিজেকে তোমার এমন ভাবে গড়ে নিতে হবে যাতে শুধু তোমার হাতে মরতে চাইবে না সে। তার মনে এই একটাই ভয়, সে ভয় মৃত্যু নয়–তুমি যদি তাকে মারতে চাও, সেই ভয়। তা যদি করতে পারো, ওই লোক কেনা গোলাম হয়ে থাকবে তোমার।

মারা যাবার আগে মাইকেলকে যত জ্ঞান দিয়েছেন ডন সেগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে মূল্যবান। এবং সেই জ্ঞান ব্যবহার করেই নেরিকে লুকা ব্রাসিতে পরিণত করুল মাইকেল।

.

ব্রঙ্কস। অ্যালবার্ট নেরির ফ্ল্যাট।

নেরি ছাড়া আর কেউ নেই বাড়িতে। আজ আবার অনেকদিন পর পুলিশের পোশাকটা পরতে যাচ্ছে সে। অত্যন্ত যত্নের সাথে পুরানো নীল সার্জের ইউনিফর্মটায় বুরুশ চালাচ্ছে সে। এরপর পালিশ করতে হবে হোলস্টারটা। টুপিটাকেও বাদ দেবে না আর মজবুত কার্লো জুতোটাকেও চকচকে না করলে নয় মনটা আজ আশ্চর্য একটা আনন্দে ভরে আছে তার। ছোটখাট কাজগুলো করতে খুব উৎসাহ পাচ্ছে। আজ দুবছর হলো ওকে ছেড়ে চলে গেছে রিটা, তারপর থেকে এই প্রথম কোন কাজ করে মজা পাচ্ছে নেরি। প্রত্যেক মানুষের দুনিয়ায় একটা নিজের জায়গা থাকে, সেই জায়গা কেউ খুঁজে পায়, কেউ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শুধু খুঁজেই বেড়ায়। নেরি তার মনের মত জায়গাটা পেয়ে গেছে। মাইকেল কর্লিয়নি তাকে একাগ্রভাবে বিশ্বাস করে। তার সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না আজ নেরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *