৪.০৩ আমেরিকা নিউ হ্যাম্পশায়ার

০৩.

আমেরিকা নিউ হ্যাম্পশায়ার। কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে লেখাপড়ার পাট অনেক আগেই চুকিয়ে ফেলেছে কে অ্যাডামস। একটা গ্রেভ স্কুলে শিক্ষিকার দায়িত্ব নিয়েছে সে।

মাইকেল অদৃশ্য হয়ে যাবার প্রথম ছমাস কর্লিয়নি পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এসেছে কে। প্রতি হপ্তায় মিসেস কর্লিয়নিকে ফোন করতে ভুল হত না তার। প্রতিবারই তিনি ওর সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছেন। সস্নেহে বলতেন, তোমার মত ভাল মেয়ে হয় না। কিন্তু মাইকের কথা ভুলে যেতে হবে তোমাকে। অন্য কোন ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেল।

কথাগুলো স্পষ্ট, কিন্তু রূঢ় নয়। কে বুঝতে পারত ওর শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই কথাগুলো বলছেন তিনি। সেজন্যে কিছু মনে করত না সে। তাকে তিনি ছেলেমানুষ বলে মনে করতেন, আর যা ঘটে গেছে তা কোন দিন ফেরানো সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস করতেন।

স্কুলে প্রথম টার্ম শেষ হলো কে সিদ্ধান্ত নিল নিউইয়র্কে যাবে। কিছু বন্ধু বান্ধবের সাথে দেখা করাও দরকার, ভদ্রগোছের কিছু পোশাক-আশাক কেলনারও সময় হয়েছে। সেই সাথে ভেবে রেখেছে মনের মত একটা চাকরি বা আর কিছু যদি জুটে যায়, ওখানেই থেকে যাবে সে। দুটো বছর তো কাটাল সন্ন্যাসিনীর মত। এই দুবছর কোন পুরুষ বন্ধুর সাথে দেখা পর্যন্ত করতে অস্বীকার করেছে সে। বই পড়ে আর অধ্যাপনা করে কাটিয়েছে সময়টা। লং বীচে টেলিফোন করার অভ্যাসটা শ্রাগ করেছে অনেক দিন আগেই, বাড়ি থেকে বলতে গেলে কাজ ছাড়া বড় একটা বের হয়নি, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে নিজেকে; তাতে ফল যে ভাল কিছু হয়েছে তা নয়, বরং মেজাজটা সব সময় খারাপ হয়ে থাকে ওর। ইদানীং বুঝতে পারে, এভাবে জীবন কাটানো সম্ভব নয়।

মাইকেল ওকে চিঠি লিখবেই, এই রকম একটা অন্ধ বিশ্বাস ছিল ওর। ওরা অন্তত একটা খবর তো পাঠাবেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খবর বা চিঠি কোনটাই যখন এল না, রীতিমত অপমান বোধ করেছে ও। এখন ওর মনের অবস্থা আরও খারাপ। বুঝতে পারে, মাইকেলের তরফ থেকে চিঠি পাবার কোন আশা নেই। ওর দুঃখ, মাইকেল ওকে বিশ্বাস করতে পারেনি।

খুব ভোরের ট্রেন ধরল কে। নিউইয়র্কে পৌঁছুতে দুপুর হয়ে গেল। মেয়ে বন্ধুরা সবাই চাকরি করে, তাদেরকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছা হলো না। রাতে ফোন করবে স্থির করে সোজা হোটেলে উঠল ট্রেন জার্নির ফলে খুব ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে, এখন আর ঘুরেফিরে কেনাকাটা করারও ইচ্ছে নেই।

হোটেল কামরায় একা বসে আবোলতাবোল ভাবছে। মাইকেলের কথা মনে পড়ে গেল। দুজনে এই হোটেল কামরাতেই প্রেম করত ওরা। হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল মনটা। সেজন্যেই বোধহয় লং বীচে ফোন করে মাইকেলের মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করল ওর।

ডায়াল করতেই কর্কশ পুরুষ কণ্ঠ কানে ঢুকল। মিসেস কর্লিয়নিকে চাই, বলল কে। কয়েক মুহূর্ত আর কোন সাড়া নেই, তারপর একটা মেয়েলি গলা ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে, আপনি কে?

আমি কে অ্যাডামস, অপ্রস্তুত হয়ে বলল কে! মিসেস কর্লিয়নি, আমাকে কি আপনার মনে আছে?।

নিশ্চয়! একশোবার মনে আছে, বললেন মিসেস কর্লিয়নি। ফোন করোনি যে অনেক দিন? বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?

না, না। এই কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম কিনা। ফোন করা ছেড়ে দেয়ায় মাইকেলের মা অসন্তুষ্ট হয়েছেন বুঝতে পেরে আশ্চর্যই হলো কে। জানতে চাইল, মাইকেলের কোন খবর জানেন? ও ভাল আছে তো?

কয়েক সেকেণ্ড অপরপ্রান্তে কোন সাড়া নেই। তারপর পরিষ্কার, স্পষ্ট কণ্ঠে মিসেস কর্লিয়নি বললেন, কেন, মাইকেল বাড়ি এসেছে তুমি জানো না? ফোন করেনি তোমাকে ও? দেখাও করেনি?

এমন চমকে উঠল কে যে মাথাটা ঘুরে উঠল হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছে ও। গলার কাছে আটকে থাকা অদম্য কান্নাটা বিস্ফোরণের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভাঙা গলায় জানতে চাইল, মাইকেল বাড়ি ফিরেছে? কত দিন হলো?

সেতো আজ ছমাসের ওপর।

ও, বুঝেছি, ফিসফিস করে বলল কে। এরপর আর বুঝতে বাকি থাকে কিছু? এখন শুধু দুঃখ এই যে মাইকেল ওকে এতটা তাচ্ছিল্য করে তা জেনে ফেললেন মিসেস কর্লিয়নি। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার পরমুহূর্তে প্রচণ্ড রাগ হলো।

শুধু মাইকেলের ওপর নয়, মনে মনে সব বিদেশীদের ওপর খেপে উঠল কে, মাইকেলের মায়ের ওপর, সব ইতালীয়দের ওপর, যাদের এইটুকু ভব্যতাজ্ঞান নেই যে প্রেমের সম্পর্ক চুকে গেলেও অন্তত একটা বন্ধুত্বের ভাব জিইয়ে রাখা যেতে পারে। মাইকেল তাকে এতটা তুচ্ছ ভাবতে সাহস পেল কিভাবে?

না হয় শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে ওকে সে চাইছে না, নাহয় ওকে বিয়ে করা সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু তার তো অন্তত এটুকু মনে করা উচিত ছিল যে কে বন্ধু হিসেবেও তার ভাল মন্দ ভেবে দুশ্চিন্তায় থাকবেনাকি ভেবে নিয়েছে তাকে। সতীত্ব দান করার পর বিয়ে হবে না বুঝতে পেরে আত্মহত্যা করেছে কে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইতালীয় মেয়েদের মত? নাকি ভেবেছে খবর দিলেই বিয়ে করার জন্যে ঘাড়ে চেপে বসবে, না করলে গোলমাল পাকাবে, লোক জড়ো করবে?

বুঝেছি, ঠিক আছে, অসংখ্য ধন্যবাদ, গলাটাকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলল। কে। মাইকেল বাড়ি ফিরেছে, ভাল আছে, এটুকু জেনেই আমি খুশি। এর বেশি জানার কিছু নেই আমার। আর কখনও ফোন করব না আপনাকে।

অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা গেল, কে-র ওপর খুব বিরক্ত হয়েছেন মিসেস কর্লিয়নি। এত দ্রুত কথা বলতে শুরু করলেন, মনে হলো কে-র কথা তিনি যেন শুনতেই পাননি। মাইকির সাথে দেখা করতে চাইলে এখুনি চলে এসো তুমি হঠাৎ তোমাকে দেখে সাঙ্ঘাতিক খুশি হবে ও। ট্যাক্সি নিয়ে এসো, আমাদের গেটের লোককে বলে রাখছি, সে-ই ভাড়াটা দিয়ে দেবে। ড্রাইভার হয়তো এতদূর আসতে আপত্তি করতে পারে, তুমি বলবে ডবল ভাড়া দেব। কিন্তু তুমি তাকে ভাড়া দেবে না। মাইকির বাপের লোক আছে গেটে, সে-ই দেবে।

তা হয় না, মিসেস কর্লিয়নি, ঠাণ্ডা গলায় বলল কে। বোঝাই যাচ্ছে আমার সাথে দেখা করার কোন ইচ্ছে মাইকেলের নেই। তা যদি থাকত, অনেক আগেই ফোন করত আমাকে ও। বাড়ির ফোন নাম্বার তো জানাই আছে ওর তার মানে, আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না ও। এই পরিস্থিতিতে আপনাদের বাড়িতে আমার যাওয়া চলে না।

তুমি খুব ভাল মেয়ে, চটপট উত্তর দিলেন মিসেস কর্লিয়নি। তোমার পায়ের গড়ন খুব সুন্দর। কিন্তু যাকে বলে বুদ্ধি, সে জিনিসটা খুব বেশি নেই তোমার মাইকির সাথে নয়, তুমি আমার সাথে কথা বলতে আসছ। তোমার সাথে গল্প করতে চাই আমি দেখো, দেরি কোরো না যেন আবার, এখুনি চলে এসো ট্যাক্সির ভাড়া তুমি দেবে না, মনে আছে তো? তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি কুট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবার শব্দ হলো।

আবার ফোন করতে পারে কে, বলতে পারে লং বীচে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কথাটা একবারও ভেবে দেখল না ও। নিজেকে বোঝাল অন্তত ভদ্রতার খাতিরে হলেও মাইকের মার সাথে দেখা করা দরকার একবার। মিসেস কর্লিয়নির। কথা শুনে মনে হলো, মাইকেলের নিউইয়র্কে ফিরে আসাটা কোন গোপনীয় ব্যাপার নয়। তার মানে তার আর কোন বিপদের ভয় নেই, এখন স্বাভাবিকভাবেই দিন কাটাচ্ছে। লাফ দিয়ে খাট থেকে নামল কে, খুব যত্ন করে পোশাক পরল, সাজল, মেক-আপ লাগাল। বেরুবার আগে আরেকবার দাঁড়াল আয়নার সামনে। মাইকেলের সাথে শেষ দেখা হবার পর চেহারাটা কি ভাল হয়েছে আরও? নাকি বিচ্ছিরি রকম বেশি মনে হচ্ছে বয়সটা? সন্দেহ নেই, কাঠামোয় নারীত্বের ভাব আরও প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। কোমরের কাছটা আরও সুগোল এখন, বুকটা আরও কত ভারি। সবাই বলাবলি করে ইতালীয়রা নাকি এই রকমই ভালবাসে। কিন্তু মাইকেল ওর সম্পর্কে সব সময় অন্য কথা বলত, ও এত রোগা বলেই নাকি ওকে অত ভাল লাগে। তবে, এ-সবে এখন আর কিছুই এসে যায় না। ওর কথা ভুলে গেছে মাইকেল। কোন সম্পর্কই রাখতে চায় না। তা না হলে ছমাস হলো বাড়ি ফিরেছে, একটা ফোন পর্যন্ত করল না!

ট্যাক্সি ডাকল কে। কিন্তু লং বীচের নাম শুনে বেঁকে বসল ড্রাইভার, ওদিকে যাবে না। মিষ্টি করে হাসল কে, তাতেই অর্ধেক ঘায়েল হয়ে গেল লোকটা, তারপর যখন শুনল কে তাকে দিগুণ ভাড়া দেবে, সাথে সাথে উঠে বসতে ইঙ্গিত করল সে।

লং বাঁচে পৌঁছুতে সময় লাগল এক ঘটা:। উঠানটাকে কেমন যেন একটু অচেনা লাগল ওর। অনেক দিন আসেনি ও, তার ওপর এখানে সেখানে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। চারদিকে এখন লোহার রেলিং, লোহার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। স্ন্যাকস, লাল শার্ট আর সাদা কোট পরে একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটে, গাড়ি থামতেই জানালা দিয়ে ভেতরে মাথা গলিয়ে মিটার দেখল। ড্রাইভারকে কয়েকটা নোট দিল সে টাকাটা গুণে খুব খুশিই বলে মনে হলো ড্রাইভারকে সুতরাং গাড়ি থেকে নেমে পড়ল কে।

.

উঠানের মাঝখানে বাড়িটায় মিসেস কর্নিয়নি থাকেন, সেদিকে এগোল কে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মিসেস কর্লিয়নি নিজে যা কোনদিন ঘটেনি, ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন তিনি। অবাক হয়ে গেল কে, একটু লজ্জাও পেল। নিজের বুকের ওপর থেকে কে-কে একটু সরালেন মিসেস কর্লিয়নি, কিন্তু ছেড়ে দিলেন না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন, কি যেন মেলাচ্ছেন, কি যেন যাচাই করছেন, তারপর বললেন, তোমার মত সুন্দর মেয়ে খুব কম হয়। দুঃখ কি জানো, আমার ছেলেগুলো একটাও চালাক নয়। কে-র হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলেন সোজা কিচেনে। খাবারদাবার সেখানে সব সাজানোই রয়েছে। স্টোভে টগবগ করে ফুটছে কফির পানি। মুচকি একটু হাসলেন তিনি। ওর আসার সময় হয়ে গেছে। খুব অবাক হয়ে যাবে তোমাকে দেখে।

কে যেন পালিয়ে যাবে, তাই তার কাঁধে হাত রেখে পাশেই বসে আছেন মিসেস কর্লিয়নি। জোর-জার করে এটা-সেটা খাওয়াচ্ছেন ওকে, সেই সাথে অত্যন্ত আগ্রহ আর কৌতূহলের সাথে খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছেন সমস্ত খবরাখবর। স্কুলে ছাত্রী ঠেঙাচ্ছে কে, নিউইয়র্কে এসেছে:মেয়ে-বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্যে, আর তার বয়স মাত্র চব্বিশ বছর–এসব শুনে সাঙ্ঘাতিক পুলকিত হয়ে উঠলেন ভদ্রমহিলা। তার মাথা দোলাবার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, মনে মনে যা তিনি ভেবে রেখেছিলেন তার সবগুলো ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে, কোথাও কোন ত্রুটি নেই। রীতিমত ঘাবড়ে গেল কে, তাই ঠিক যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তারই উত্তর দিচ্ছে, বেশি কথা বলছে ।

চোরা চোখে বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল কে, তাই সে-ই প্রথম দেখতে পেল ওকে।

একটা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। এক এক করে দুজন লোক নামল নিচে। তারপর নামল মাইকেল মাথা তুলে লোকগুলোর একজনের সাথে কথা বলছে ও। ওর মুখের বা দিকটা দেখতে পাচ্ছে কে। ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল বুকটা। এই মেয়ে, করো কি! নিজেকে শাসন করছে সে, কিন্তু চোখের পানি তাতে বাধা মানছে না। এমন সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়েছিল মাইকেল তা জানা ছিল না বলে নিজেকে তার অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। লাথি মেরে প্লাস্টিকের পুতুল তুবড়ে দিলে যেমন দেখায় ঠিক সেই রকম দেখাচ্ছে মাইকেলকে। কিন্তু তবু কিভাবে যেন কে-র চোখে ওর সৌন্দর্য একটুও কমল না, বরং আরও কঠোর, শক্ত দেখাচ্ছে ওকে–সেটা পছন্দও করছে সে। ধবধবে একটা সাদা রুমাল বের করে প্রথমে নাকে তারপর মুখে চেপে ধরল মাইকেল। ঘুরে দাঁড়াল। বাড়িতে ঢুকছে এবার

দরজা খোলার শব্দ। হলঘরে পায়ের আওয়াজ। কান পেতে শুনছে কে, হাঁটার অভ্যাসটা আগের মতই আছে মাইকেলের, এই পায়ের আওয়াজ তার হৃৎ স্পন্দনের সাথে তালে তালে মিলে আছে, এতই চেনা, এতই প্রিয়। এগিয়ে আসছে শব্দটা। কিচেনের খোলা দরজার সামনে দেখা গেল মাইকেলকে।

ওকে দেখে প্রথমে ভাবের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না মাইকেলের মধ্যে। তারপরই হাসল সে। মুখের ভাঙনটার কাছে এসে আটকে গেল হাসিটা। হ্যালো, কেমন আছ? আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে কে, এইরকম কিছু একটা বলবে। কিন্তু মাইকেলকে দেখামাত্র সব ওলটপালট হয়ে গেল কি করছে নিজেই বুঝতে পারল না, বুঝতে চাইলও না। কিভাবে উঠে দাঁড়াল জানে না ও। একছুটে স্যাং করে সেঁধিয়ে গেল মাইকেলের বাহ-বন্ধনে।-ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দিল।

কে-র ভিজে গালে চুমু খেলো মাইকেল। ফোপাচ্ছে কে। যতক্ষণ না শান্ত হলো সে, দুহাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল মাইকেল। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল গাড়ির দিকে।

বডিগার্ডদের বিদায় করে দিল মাইকেল। ওকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে উঠল ড্রাইভিং সীটে। স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল গাড়ি। বেরিয়ে এল ওরা বাড়ি ছেড়ে।

ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছে কে। নড়েচড়ে বসে মেক-আপ ঠিক করছে। স্বেচ্ছায়, মৃদু গলায় বলল সে; নিজের অজান্তেই ছেলেমানুষিটা করে বসলাম। কিন্তু তুমি যে এমন ভয়ঙ্করভারে জখম হয়েছ তা তো আমাকে কেউ বলেনি ওঁরা।

ও কিছু নয়, একটু হাসল মাইকেল। মুখের ভাঙা দিকটা ছুঁলো একবার বিপদ হলো, সারাক্ষণ শুধু সর্দি গড়ায়। ফিরে যখন এসেছি. ত্রুটিটা হয়তো এবার সারিয়ে নেব। একটু থেমে গলাটাকে আরও খাদে নামিয়ে আবার বলল, উপায় থাকলে তোমাকে চিঠি লিখতাম বা খবর পাঠাতাম, কিন্তু সে উপায় ছিল না–সবকিছুর আগে এটা তোমাকে বুঝতে হবে।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল কে, তারপর বলল, বেশ। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সে।

আমার একটা আস্তানা আছে শহরে। সেখানে যাব? জানতে চাইল মাইকেল। নাকি কোন রেস্তোরাঁয়?

ক্ষিধে পায়নি আমার, বলল কে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল দুজনেই। তারপর জিজ্ঞেস করল মাইকেল, ডিগ্রিটা নিয়েছ?

নিয়েছি। একটা স্কুলে পড়াচ্ছি, আমাদের শহরেই। পুলিশ ক্যাপটেনকে যে খুন করেছে সে কি ধরা পড়েছে? সেজন্যেই তুমি বাড়ি ফিরতে পেরেছ, তাই না?

উত্তর দেবার আগে কিছুক্ষণ চিন্তা করল মাইকেল। তাই। খবরের কাগজে তো সব কথা ছাপা হয়েছিল, পড়েছ নিশ্চয়ই?

নিজেকে খুনী বলে স্বীকার করছে না মাইকেল, সেজন্যে পরম একটা স্বস্তির পরশ অনুভব করল কে। মন খুলে এই প্রথম হাসল সে। বলল, ছোট শহর, ওখানে নিউইয়র্ক টাইমস ছাড়া আর কিছু পৌঁছায় না। খবরটা হয়তো ডননব্বই পৃষ্ঠায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। যদি জানতাম আরও অনেক আগে ফোন করতাম তোমার মাকে। খানিক ইতস্তত করে আবার বলল সে, তোমার মা কিন্তু অনেক আবোলতাবোল কথা বলতেন, তার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারতাম না আমি। খুব অদ্ভুত শোনাত তার কথাগুলো, মনে হত ওই জঘন্য কাণ্ডটার জন্যে তুমিই যেন দায়ী। কিন্তু আজ তিনি সম্পূর্ণ অন্য কথা শোনালেন আমাকে, কফি খেতে খেতে খুব হাসির সাথে জানালেন, কোন এক খ্যাপা লোক নাকি নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেছে।

মা হয়তো ভুল করে আমাকেই সন্দেহ করতেন, বলল মাইকেল; আসল। ঘটনা জানতে পেরে ভুল ভেঙেছে তার।

তোমাকে সন্দেহ করতেন? চোখ তুলে জানতে চাইল কে। তোমার নিজের মা?

ছেলেমানুষের মত একগাল হাসল মাইকেল। জানো না, পুলিশেরও বাড়া হয় মায়েরা? সবচেয়ে খারাপটাই আগে বিশ্বাস করে?

মালবেরি স্ট্রীটে পৌঁছে একটা গ্যারেজের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল মাইকেল। মালিক নোকটা ওর পরিচিত বলে মনে হলো কে-র। পায়ে হেঁটে বাক নিল ওরা, চারদিকে ধসে পড়া পোড়ো বাড়িঘর, সেগুলোর একটায় তাকে নিয়ে এল মাইকেল। গেটের চাবি রয়েছে ওর কাছে, ভেতরে ঢুকল ওরা। দেখতে ভাঙাচোরা হলে কি হবে, কে আবিষ্কার করল, বাড়িটার ভেতর সব রকম অত্যাধুনিক আরাম আয়েশের নিখুঁত আয়োজন রয়েছে, একজন শহুরে কোটিপতির বাড়িতে যেমন থাকে।

ওরতলার ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে এল মাইকেল। বসবার ঘরটা প্রকাণ্ড। কিচেনটা বিশাল। একটা দরজা দিয়ে ঢুকলে শোবার কামরা। বার রয়েছে বসবার ঘরে, মাইকেল দুটো গ্লাসে পানীয় ঢালল। কে-র হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে একটা সোফায় বসল ও, নিজেও বসল তার পাশে। তারপর মৃদু গলায় বলল, তুমি চাইলে শোবার ঘরে গিয়েও বসতে পারি আমরা।

গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিল কে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মাইকেলের দিকে। হেসে ফেলল দুজনেই। পারিই তো। চলো তাহলে, বলল সে।

আজকের প্রেমটা কে-র কাছে আগের মতই লাগল। তবে আগের চেয়ে একটু রূঢ় মনে হলো মাইকেলকে। কোমল ভাবটা নেই ত, যা হলো সোজাসুজি হলো। ওর মনে হলো, তার কাছেও মাইকেল যেন সতর্কতা বজায় রাখছে। ঠাট্টার সুরে অনুযোগ করতে পারে সে, কিন্তু ইচ্ছে হলো না। জানে এরকম আড়ষ্ট ভাব কেটে যাবে, অনেক দিন পর প্রথম বলেই হয়তো এমন হচ্ছে। তার ধারণা, এসব ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যেই আশ্চর্য একটা স্পর্শকাতরতা দেখা যায়। দীর্ঘ দুবছর পর দেখা এবং মিলন, কই, কিছুই তো অস্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার কাছে। সব যেন সেই আগের মতই আছে। মাইকেলকে এতদিন দেখেনি, ওর সাথে শোয়নি, এসব অনুভবই করছে না।

মাইকেলের গায়ে গা ঠেকিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল কে। বলল, আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি, না? তা নাহলে চিঠি লেখোনি কেন? একটা চিঠি লিখে না হয় দেখতেই, তোমার সাথে বেঈমানী করি কিনা। ভুয়া ঠিকানা দিয়েও তো লিখতে পারতে, আমার পরীক্ষাটা অন্তত হয়ে যেত। যদি লিখতে, বিশ্বাস করো, নিউ ইংল্যান্ডের ওমের্তা পালন করতাম আমি। তুমি বোধহয় জানো না, ইয়াংকিরাও যথেষ্ট মুখ বুজে থাকতে পারে।

আশ্চর্য একটা পুলক অনুভব করছে মাইকেল। অন্ধকারে নিঃশব্দে হাসছে ও ভুলেও কখনও ভাবিনি তুমি আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে। যা বিশ্রী একটা ব্যাপার ঘটল, তারপরও আমার জন্যে অপেক্ষা করবে, ভাবতেই পারিনি।

লোক দুটোকে তুমি মেরেছ, এ আমি কক্ষনও বিশ্বাস করিনি, দ্রুত বলল কে। কিন্তু তোমার মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। সে যাই হোক, মনে মনে আমি ঠিকই জানতাম এ ধরনের কাজ তোমার পক্ষে সম্ভবই নয়। অন্তত আমি তোমাকে চিনি তো!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাইকেল। আমি দায়ী কি দায়ী নই, কিছু এসে যায় না তাতে, মৃদু গলায় বলল ও। এটুকু তোমাকে মেনে নিতে হবে। আসলে কিছু এসে যায় না। আমার কথা বুঝতে পারলে?

মাইকেলের গলার সুরে, অদ্ভুত একটা ঠাণ্ডা ভাব, অনুভব করে শিউরে উঠল কে। এক সেকেণ্ড নিজের সাথে যুদ্ধ করে কঠিন সুরে বলল, তাহলে এখনই আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। ওই লোক দুজনকে তুমি খুন করেছ নাকি করোনি?

উঠে বসল মাইকেল, ঠেস দিল বালিশে। লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাল একটা। তারপর বলল, ধরো, তোমাকে আমি বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছি, এখন তোমার এই প্রশ্নের উত্তর না পেলে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না?

তোমাকে ভালবাসি। আমার কাছে তুমিই আসল ব্যাপার। আর কিছু আমি গ্রাহ্য করি না। আর কিছু কেয়ার করি না। আমি যেমন ভালবাসি তোমাকে, তেমনি তুমিও যদি ভালবাসতে আমাকে, তাহলে সত্যি কথাটা বলতে এত ভয় পেতে না। তোমার মনে এই সন্দেহ জাগত না যে আমি পুলিশের কাছে গিয়ে সব কথা লাগাব। ঠিক কিনা? গুণ্ডা গুণ্ডা, আসলে তুমি একটা গুণ্ডা-তাই না? তবু সত্যি বলছি, তাতেও কিছু এসে যায় না আমার। কিন্তু তুমি সত্যি আমাকে ভালবাস কি ভালবাস না তাতে আমার অনেক কিছু এসে যায়। বোঝাই যাচ্ছে, আমাকে ভালবাস না তুমি। যদি বাসতে, প্যাঁচ মেরে কথা বলতে না। বাড়ি ফিরে একটা ফোন পর্যন্ত করলে না। কেমন মানুষ তুমি সেতো বোঝাই যাচ্ছে। পাষণ্ড!

ঘন ঘন সিগারেটে টান মারছে মাইকেল। কে-র উদোম পিঠে খানিকটা ছাই পড়ল। শিউরে উঠে বলল কে, প্লীজ টরচার কোরো না। কাউকে কিছু বলব না আমি, যীশুর কিরে!

রসিকতাটায় কিন্তু হাসল না মাইকেল। কথা বলছে, কিন্তু স্বরটা কেমন যেন দূর থেকে ভেসে মাসা বলে মনে হলো কে-র।

একটা কথা কি জানো, বাড়িতে ফিরে ওদের সবাইকে দেখে ভাল লেগেছিল, কিন্তু সেটা তেমন কিছু নয়। আজ কিচেনে তোমাকে দেখেই আনন্দে ভরে উঠল বুকটা। এর তুলনা হয় না, এত আনন্দ! এরই নাম কি ভালবাসা?

ঠিক জানি না, বলল কে। কিন্তু ভালবাসার এত কাছাকাছি বলে মনে হচ্ছে যে ওতেই আমার চলে যাবে।

এরপর আবার পরস্পরের শরীর নিয়ে মেতে উঠল ওরা। গতবারের চেয়ে এবার মাইকেলের আচরণে অনেকটা কোমলতা প্রকাশ পেল। এক সময় বেরিয়ে গিয়ে দুজনের জন্য দুটো গ্রাসে মদ নিয়ে এল ও। ফিরে এসে বিছানায় উঠল না আর, বসল খাটের কাছে একটা আরাম কেদারায়।

এসে, এবার একটু সিরিয়াস হওয়া যাক, বলল ও। আমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কিছু ভেবেছ নাকি?

প্রশ্নটাকে পাত্তা দিল না কে, ঠোঁট বাঁকা করে হেসে ইঙ্গিতে বিছানাটা দেখাল।

মাইকেলও হাসল, তারপর বলল, না, আগে কাজের কথা শেষ হোক। একটা কথা মেনে নিতে হবে তোমাকে। যা ঘটে গেছে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না তোমাকে। বাবা কিছু কাজ দিয়েছেন, সেগুলো এখন করতে হচ্ছে আমাকে। শেষ পর্যন্ত আমাদের পারিবারিক জলপাই তেলের ব্যবসাটা আমার ঘাড়ে চাপবে, তার ভার নেবার জন্যে তৈরি করা হচ্ছে আমাকে। কিন্তু তুমি তো জানোই, এই পরিবারের শত্রুর কোন অভাব নেই। বাবার কিছু ব্যক্তিগত শত্রুও আছে। আমি বলতে চাইছি, আমাকে বিয়ে করলে, কাল বা পরশু কিংবা তার পরদিন তুমি বিধবা হয়ে যেতে পারো যাবেই, তা বলছি না-তবে সম্ভাবনা আছে, যদিও খুব বেশি নয়। আরেকটা কথা, অফিসে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে বিষয়ে রোজ তোমাকে আমি জবাবদিহি করতে পারব না। ব্যবসা, পেশা বা কাজ-কর্মের ব্যাপারে কিছুই তোমার জানা চলবে না। আমার ও-দিকটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে থাকতে হবে তোমাকে। তার মানে, আমার স্ত্রী হয়েও তুমি আমার কাজীবনের সহকারিণী হবে না। অন্তত সমান সমান অংশীদার হবে না। সেটা হবার একদম উপায় নেই।

বিছানায় উঠে বসল কে। টেবিলের আলোটা জ্বালল সে, সিগারেট ধরাল একটা। ধীরে ধীরে বালিশে ঠেস দিয়ে বলল, এত কথা বলে তুমি আসলে নিজের পরিচয়টা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছ আমার কাছে, তাই না? তুমি একজন গুণ্ডা, এই কথাটাই ঘুরিয়ে বলছ, তাই না? খুন, এবং ওই ধরনের কিছু অপরাধের জন্য তুমি দায়ী। আরও বলছ, ওসব বিষয়ে কখনও কোন কথা তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারব না, চিন্তা পর্যন্ত করতে পারব না। এই হলো তোমার শর্ত। এ যেন ঠিক হরর ফিন্মের কাহিনী-নরপিশাচ নায়িকাকে ধরেছে, বলছে তাকে ওর বিয়ে করতে হবে।

ভাঙা মুখটা কে-র দিকে ঘুরিয়ে দেখাল মাইকেল, তারপর হাসল একগাল।

মুখ শুকিয়ে চোখ বড় হয়ে গেল কে-র, অনুতপ্ত হয়ে দ্রুত বলল, যীশুর কিরে, মাইক, তা ভেবে ওকথা বলিনি আমি। সত্যি বলছি, এটা আমি ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না!

হাসছে মাইকেল। জানি! আমার নিজেরও আজকাল এটাকে আর খারাপ লাগে না। তবে সারাক্ষণ সর্দি গড়াচ্ছে, এটাই যা দুঃখের বিষয়।

তুমি আমাকে সিরিয়াস হতে বলেছ, বলল কে। বিবাহিত জীবনটা কেমন হবে আমার? তোমার মায়ের মত, আর সব ইতালীয় স্ত্রীদের মত? শুধু বাচ্চা বিয়ানোই আমার একমাত্র কাজ হবে? ছেলেপুলে, ঘর-সংসারই আমার জগৎ, তার বাইরে আমি অবাঞ্ছিত থেকে যাব? তারপর ধরো, যীশু না করুন, যদি কিছু হয়? একদিন হয়তো তোমাকে ধরে জেলেই পুরে দিল। তখন?

এদিক ওদিক মাথা দোলাল মাইকেল। না, তা কখনও হবে না। খুন? হ্যাঁ। জেল? না।

স্বীকারোক্তির বহর লক্ষ করে হেসে ফেলল কে, তার হাসিতে গর্বের সাথে অদ্ভুতভাবে মিশে রয়েছে একটু কৌতুক। আশ্চর্য মানুষ তো! এ ধরনের একটা কথা মুখে আনতে পারলে তুমি? কি ভেবে বললে কথাটা? বলো, বলতেই হবে তোমাকে।

 এই সব বিষয়েই তোকিছু জানাতে পারব না তোমাকে জানাতে চাইও না।

অনেকক্ষণ আর কোন কথা বলল না কে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেই নিস্তব্ধতা ভাঙতে হলো। এতদিন কেটে গেল, একটা খবরও তো নাওনি, আজ আমি হঠাৎ এসে পড়ায় দেখা হয়ে গেল–তাহলে আবার বিয়ে করতে চাইছ কেন? বিছানায় আমি কি এতই ভাল?

গম্ভীর হয়ে গেল মাইকেল। চেহারাটা থমথম করছে। মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই। আমার জন্যে বিছানায় তোমার চেয়ে ভাল আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু না চাইতেই, বিনা পয়সাতেই পাচ্ছি যখন, বিয়ে করে ঝামেলা ঘাড়ে নিতে যাব কেন? বসো, এখুনি উত্তর দিয়ো না। এখন থেকে আগের মত আবার মেলামেশা চনতে থাকুক। ইচ্ছে করলে তুমি তোমার মা-বাবার সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করতে পারো। আমি বরং সেটাই চাইব। শুনেছি, তোমার বাপটিও নিজের ক্ষেত্রে কারও চেয়ে কম যান না। তার উপদেশ অবহেলা কোরো না।

ক্ষীণ জেদের সুর ফুটে উঠল কে-র গলায়, কিন্তু কেন বিয়ে করতে চাও তা তো বললে না?

টেবিলের দেরাজ থেকে সাদা একটা রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরল মাইকেল। এই সর্দিটাই হয়তো আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে তোমাকে। সারাক্ষণ শুধু নাক ঝাড়ে, এমন লোককে কি কাছে রাখতে ভাল লাগবে তোমার?

ঠাট্টা করছ কেন? ধৈর্য হারিয়ে ফেলল কে। একটি বারের জন্যেও কি সিরিয়াস হতে পারো না তুমি? আজেবাজে কথা বলে ভোলাতে পারবে না আমাকে। প্রশ্নের উত্তর দাও।

বেশ, দিচ্ছি, বলল মাইকেল। আরেকবার নাক ঝেড়ে ভাল করে মুছে নিল। কিন্তু, মনে রেখো, এই প্রথম এবং এই শেষ–আর কখনও এসব ব্যাপারে কোন কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। আমি আশা করব, এখন যা বলছি তার প্রতিটি কথা তুমি বিশ্বাস করবে। একটু থামল মাইকেল, তারপর শুরু করল, তুমিই একমাত্র মানুষ যার ওপর গভীর টান আছে আমার। সে এত গভীর টান, তার পরিমাপ আমার জানা নেই। বাড়ি ফিরে এসে তোমাকে ফোন করিনি। কিন্তু সেজন্যে আমাকে দোষ দিতে পারো না তুমি। অমন জঘন্য একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবার পরও তুমি যে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে, মনে রাখবে তা আমি কি করে বুঝব বলে? হ্যাঁ, তোমার পিছু পিছু ঘুরতে পারতাম আমি পারতাম তোমাকে একগাদা মিথ্যে কথা বলে ধাপ্পা দিতে, কিন্তু সেরকম ইচ্ছাই হয়নি আমার। একটু থামল ও। তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, এখন যে কথাটা বলব, সেটা তুমি তোমার বাবাকেও বলতে পারবে না। তোমাকে বিশ্বাস করি, তাই বলছি কথাটা। সব কিন্তু যদি ঠিকঠাক মত চলে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কর্লিয়নি পরিবার আর কোন রকম অন্যায়, বেআইনী কাজের সাথে জড়িত থাকবে না। এটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে। এই ইচ্ছেটাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে অনেকগুলো বড় আর সূক্ষ্ণ চাল চালতে হবে আমাকে। কিন্তু তার আগেই তুমি বিধবা হয়ে যেতে পারো। যদিও, বিধবা হলে অবস্থাপন্ন বিধবাই হবে, ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে কখনও দুশ্চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। এবার বলি, তোমাকে কেন দরকার আমার। কেন যেন মনে হয় আমার, আমার সন্তানের মা হিসেবে একমাত্র তোমাকেই মানায়। ছেলেপুলে চাই আমি, নিজস্ব একটা পরিবার চাই–এসবের প্রয়োজন আছে তার সময়ও হয়েছে। তোমাকে চাওয়ার আরেকটা কারঙ, আমি চাই আমার প্রভাব যেন আমার ছেলেমেয়েদের ওপর না পড়ে। আমার ওপর বাবার প্রভাব পড়েছে, সেজন্যেই এব্যাপারে এতটা সতর্ক হতে চাইছি আমি। তার মানে বাবা আমার ওপর ইচ্ছা করে তার প্রভাব ফেলেছেন তা  আমি বলছি না।

না, তা তিনি ফেলেননি। বরং উল্টোটাই চেয়েছিলেন তিনি। আমাকে অধ্যাপক, ডাক্তার বা ওই ধরনের কিছু এটা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে সব ওলটপালট হয়ে গেল। পারিবারিক ব্যাপারে জরিয়ে পড়তে বাধ্য হলাম আমি, পরিবারটিকে রক্ষা করার জন্যে লড়তে হলো আমাকে। লড়তেই হলো, তার কারণ, বাবাকে আমি শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি। ভক্তি করি। আর সব আদর্শ ছেলের মতই, আমিও আমার বাবার অনুগত পুত্র, বাইরে থেকে যাই মনে হোক না কেন। আসলে, এতটা ভক্তি করার যোগ্য মানুষ আমার জীবনে আর দেখিনি আমি। তার মত ভাল স্বামী, ভাল বাপ, গরীব দুঃখী অসহায়ের এত বড় বন্ধু, এত বিচক্ষণ মানুষ কোথাও আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। তাঁর আরেকটা দিক আছে, কিন্তু আমি তার ছেলে বলে সেটার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

রুমাল দিয়ে আবার নাক মুছল মাইকেল। চেহারায় শান্ত অথচ দৃঢ় একটা ভাব ফুটে উঠেছে তার। কিন্তু আসল কথা আমি চাই ছেলেমেয়েরা যেন আমার প্রভাবে না পড়ে। এদেরকে আমি সত্যিকার আমেরিকান হিসেবে দেখতে চাই। যাকে বলে আগাগোড়া, আপাদমস্তক, পুরোপুরি আমেরিকান, ওরা হবে তাই। কে জানে, ওরা হয়তো আমেরিকার গর্বে পরিণত হবে। ওরা হয়তো রাজনীতি করবে। আপন মনে হাসল মাইকেল। কে জানে, ওদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হবে। হতে বাধাটা কোথায় বলো? কলেজে থাকার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত, পারিবারিক তথ্য বিষয়ে একটা বই পড়তে হয়েছে আমাকে। তাতে এমন সব তথ্য আছে, পড়লে তুমি হতভম্ব হয়ে যাবে। প্রেসিডেন্টদের বাপ দাদাদের কারও কারও ভাগ্য নেহাতই ভাল, তা না হলে ওঁদের অনেকেরই ফাঁসি হওয়া উচিৎ ছিল। এমন গুরুতর সব অপরাধ করেছেন তারা, গুরুত্বের আর নৃশংসতার বিচারে ইদানীংকার অপরাধের তুলনায় সেগুলো শতগুণ বেশি জঘন্য। তবু তো তাদের ছেলেদের প্রেসিডেন্ট হতে বাধা পেতে হয়নি। আর আমার কথা যদি বলো, আমি তো সজ্ঞানে কখনও কোন অন্যায় কাজ করব না। অন্তত বিবেকের কাছে সাধু সেজে থাকার সব রকম প্রয়াস থাকবে আমার মাঝে। তাই, যদি আশা করি আমার ছেলেদের মধ্যে কেউ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে, তাতে অন্যায় কোথায়? সেটাকে দুরাশা মনে করার কি আছে? এখন আর হাসছে না মাইকেল। প্রেসিডেন্ট হতেই হবে, তা আমি বলছি না। হবার পথে কোন বাধা থাকবে না, সেটা বোঝাতে চাইছি। প্রেসিডেন্ট না হলে, অধ্যাপক হবে ওরা, ডাক্তার হবে, কিংবা সঙ্গীতজ্ঞ হবে-তাতেই আমি খুশি। তার মানে, পারিবারিক ব্যবসাতে ওদেরকে আমি ঢুকতে দেব না। সেখানে ওদের কোন জায়গা নেই। তবে, কি জানো, অতটা বড় করতে করতে আমিও অবসর নেব তখন। তখন আমার সময় কাটবে তোমাকে নিয়ে। তুমি আর আমি ক্লাবে যাব। সচ্ছল আমেরিকানদের উপযুক্ত সাদামাঠা স্বাস্থ্যময় জীবন উপভোগ করব। এবার বলো, কেমন লাগছে। প্রস্তাবটা?

চমৎকার! অপূর্ব! বলল কে। কিন্তু ওই বিধৰা হবার বিষয়টা এড়িয়ে গেলে কেন?

এটার খুব যে একটা সম্ভাবনা আছে তা নয়, রুমাল দিয়ে নাক মুছে বলল মাইকেল, সত্যি কথা বলতে হয়, তাই বললাম আর কি।

প্রসঙ্গটা তুলে তুমি যাই বোঝাতে চাও না কেন, আমি কিন্তু ওসব একেবারেই বিশ্বাস করি না। তুমি অত খারাপ লোক হতে পারো না। উহ, তা কি করে হয়! এমন তো নয় যে তোমাকে আমি চিনি নবা চিনতে ভুল করেছি। অসম্ভব। কিন্তু চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বিভ্রান্তিতে ভুগছে কে! দূর ছাই, তোমার কথা ভাল বুঝতেই পারিনি আমি। আরেকটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। তোমার বিরুদ্ধে এত বড় আর এমন জঘন্য অভিযোগ আনা হলো কেন?

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাইকেলকে-র দিকে। নরম গলায় বলল, প্লীজ, জেদ ধরো না, কে। এর বেশি তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। এসব বিষয় আসলে কিছু চিন্তা করার দরকারই নেই তোমার, কেমন? যা ঘটে গেছে, গেছে-এর সাথে তোমার বা আমাদের বিবাহিত জীবনের কোন সম্পর্কই থাকবে না। এর আগেও তো বললাম, পারিবারিক ব্যবসার ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামানো চলবে না, তার কোন দরকার নেই। তুমি আমাকে পাবে, আমি তোমাকে পাব, ভাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে আমাদের। আমার ছেলেমেয়ের মা হিসেবে তোমাকে দেখতে চাই আমি।

হঠাৎ রেগে গেল কে। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কণ্ঠস্বর। তোমার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে বিয়ে করার কথা কিভাবে মুখে আনছ, কিভাবে যে আভাস দিচ্ছ আমাকে তুমি ভালবাস-কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে না আমার কাছে। ভালবাসি, এই শব্দটা কখনও তুমি আমার সামনে উচ্চারণ করোনি। একটু আগে। বললে, তোমার বাবাকে তুমি ভালবাস! কই আমাকে ভালবাস সে কথা তো একবারও বললে না! তা বলবেই বা কিভাবে! আমাকে যদি বিশ্বাস করতে, তাহলে হয়তো বলতে পারতে কিন্তু তা তো করো না। করলে, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো চেপে রাখতে চাইতে না। তাহলেই জিজ্ঞেস করতে হয়, বিশ্বাসই যখন করতে পারছ না, তাহলে আমাকে বিয়েই বা করতে চাইছ কেন? আমি জানি, তোমার বাবা তোমার মাকে বিশ্বাস করেন, অস্বীকার করতে পারবে?

অস্বীকার করব কেন? বলল মাইকেল। আমিও জানি বার মাকে বিশ্বাস করেন! করবেন না কেন? কিন্তু বিশ্বাস করেন মানে এই নয় যে বাবা তাকে সব কথা বলেন। তাছাড়া, আরও কথা আছে। বাবার বিশ্বাস অর্জনের জন্যে আমার মাকে অনেক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হতে হয়েছে। নিজের স্ত্রী বলেই নয়, মার। ওপর বিশ্বাস রাখার আরও অনেক কারণ আছে বাবার। এক সময় সন্তানের জন্ম দেয়া ভীষণ কঠিন একটা ঝুঁকির ব্যাপার ছিল, সে-সময় আমাদের চার ভাই-বোনের জন্ম দিয়েছিলেন মা। বিপদের সময় বাবাকে আগলে রাখতেন তিনি। বাবা গুলি খেলে কে তাঁর সেবা করত? মা। মা কখনও বাবার কথার ওপর কথা বলেননি। বাবাকে শুধু ভালই বাসেননি, বাবার বিচার বুদ্ধি আর বিচক্ষণতার ওপর সম্পূর্ণ আস্থাও রেখেছেন। একটানা চল্লিশটা বছর ধরে মার প্রথম কাজ ছিল বাবার সেবা করী। এত সব করে তুমিও যদি আমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারে, কেন তোমাকে দুচারটে কথা বলতে পারব না আমি? অবশ্য তখন তুমিই শুনতে চাইবে না।

শান্তভাবে জানতে চাইল কে, আমরা কি উঠানে থাকব?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মাইকেল। খারাপ লাগবে না তোমার, নিজেদের আলাদা বাড়ি থাকবে আমাদের। কেউ আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না, আমার মা বা বাবা সেরকম মানুষই নন। আমাদের রুচি আর পছন্দ মত যেভাবে খুশি থাকব আমরা। তবে, সব হাঙ্গামা মিটে না যাওয়া পর্যন্ত ওই উঠানেই থাকতে হবে আমাদের।

তার কারণ, বাইরে থাকা তোমার জন্যে নিরাপদ নয়।

পরিচয় হবার পর এই প্রথম মাইকেলের রাগ দেখল কে। হঠাৎ ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা হয়ে গেল ও। চেহারায় এমন সন্ম পরিবর্তন এল, প্রায় ধরাই যায় না। তার গলার স্বরও বদলাল না। বরফের ধোয়ার মত একটা ঠাণ্ডা ভাব উঠছে শরীর থেকে। নিজের অজান্তে শিউরে উঠল কে। ঢোক গিলল একটা। পরিষ্কার উপলব্ধি করছে, মাইকেলকে যদি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় সে, তার কারণ হবে মৃত্যুর মত ভয়াল ওর এই ঠাণ্ডা ভাবটুকু।

যত নষ্টের গোড়া ওই সিনেমা আর খবরের কাগজগুলো, বলল মাইকেল। আমার বাবা অথবা কর্লিয়নি পরিবার সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই নেই। সম্পূর্ণ ভুল বুঝে বসে আছ তুমি। শুধু তোমার খাতিরে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করছি, কিন্তু এই শেষ, আর কখনও এ-বিষয়ে কোন প্রশ্ন কোরো না। শোনো, বুঝিয়ে দিচ্ছি। একটু থামল মাইকেল, রুমাল দিয়ে নাক মুছল। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। তার একটা পরিবার আছে। আর আছে বেশ বড় একদল বন্ধু, যারা তার বিপদ আপদের সময় সাহায্য করবে। এদের সবার জীবিকার ব্যবস্থা করতে হয় তাকে। এঁরা যাতে ভাল খেয়ে পরে জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে সেদিকেও তার নজর রাখতে হয়। আমাদের চারদিকে যে সমাজটা দেখতে পাচ্ছি, আমার বাবা সে সমাজের নিয়ম বা আইন মানেন না। না মানার কারণও আছে। তিনি একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ, তার অসংখ্য দুর্লভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই সমস্ত যোগ্যতা আর উপযুক্ততা তার আছে বলেই তিনি নিজের মনের মত করে বেঁচে থাকতে চান, কিন্তু প্রচলিত সমাজের নিয়ম মেনে চললে তাকে সেভাবে বেঁচে থাকতে দেয়া হবে না। যতটুকু প্রাপ্য তার চেয়ে কম সুযোগ-সুবিধে নিয়ে বেঁচে থাকতে রাজী নন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, কথাটা তোমাকে বুঝতেও হবে, আমার বাবা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বা গভর্নরদের চেয়ে নিজেকে ছোট বলে মনে করেন না। একদল লোক নিজেদের সুবিধে করে নেবার মতলবে কিছু আইন তৈরি করে নিয়েছে, সেগুলো মেনে চললে বাবাকে নিকৃষ্ট জীবন গ্রহণ করতে হবে, তাই তা তিনি মানতে রাজী নন। অবশ্য, প্রচলিত সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়াই তার অন্তিম ইচ্ছ, কিন্তু তা হবার আগে প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হতে চান তিনি। ব্যক্তিগত ক্ষমতা না থাকলে এই সমাজ কাউকে সাহায্য করে না। সেই প্রচুর ক্ষমতা যতদিন না তাঁর হাতে আসছে, ততদিন তিনি নিজের তৈরি কিছু আইন মেনে চলবেন বলে ঠিক করেছেন। প্রচলিত সমাজের বিধি বিধান এবং আইনের চেয়ে তার নিজের তৈরি বিধিবিধান এবং আইনগুলো অনেক বেশি ন্যায্য এবং উন্নত বলে মনে করেন তিনি।

দু চোখে নগ্ন অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে কে। কিন্তু তা কি করে হয়? ধরো সমাজের সবাই আমরা যদি এই কথা বলি, ফল কি দাঁড়াবে? সমাজটা তাহলে টিকবে কিভাবে? উত্তর দাও। আমরা সবাই কি তাহলে গুহাবাসীদের যুগে ফিরে যাব না? উহু, এ অসম্ভব। কথার কথা, তাই না? আসলে যা বললে তা নিজেও তুমি বিশ্বাস করো না, তাই না, মাইক? বিশ্বাস করো?

হাসিতে ভরে উঠল মাইকেলের মুখ। আমার বাবা কি বিশ্বাস করেন তাই নিয়ে কথা বলছিলাম। তোমাকে আমি শুধু এইটুকু বোঝাতে চাই যে বাবাকে তুমি আর যাই মনে করে, দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মনে কোরো না–তা তিনি নন। অন্তত তার নিজের তৈরি সমাজে না। মোটেও তিনি একদল উন্মাদ মেশিনগানধারী খুনে গুণ্ডাদের পাণ্ডা নন। তাঁর সম্পর্কে এসব তোমার একেবারেই বাজে চিন্তা। আমার বাবার মত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ আমি আর দেখিনি।

বেশ বুঝলাম, শান্ত গলায় বলল কে। কিন্তু নিজের ব্যাপারটা তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? তোমাকে নিয়েই তো আমার মাথাব্যথা। তুমি কিসে বিশ্বাস করো সেটা আমাকে জানতে হবে।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, কল মাইকেল। তুমি আর আমি মিলে একটা পরিবার গড়ে তুলতে পারি, আমার বিশ্বাস ট্রোর ওপর। যদি বিশ্বাস করতাম এই সমাজ আমাদেরকে রক্ষা করবে তাহলে হয়তো ভাল হত। কিন্তু সমাজের ওপর আমার আস্থা নেই। ভাওতা আর ধোকা দিয়ে একদল লোকের ভোট যোগাড় করতে পারাটাই যাদের একমাত্র কৃতিত্ব তাদের ওপর আমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে আমি রাজী নই। আমাকে ভুল বুঝে না। যা বলছি তা শুধু এখনকার পরিস্থিতির কথা ভেবেই বলছি। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, আরও বদলাবে। আমার বাবার কাল এই তো শেষ হয়ে গেল। অনেক বিস্ময়কর কাজ শেষ করেছেন তিনি, কিন্তু ভয়ঙ্কর সব ঝুঁকি না নিয়ে সে-ধরনের কাজ এখন আর করা ব নয়। আমরা চাই বা না চাই, একদিন প্রচলিত সমাজেই ঢুকতে হবে কর্লিয়নি পরিবারকে। কিন্তু বাবার মত আমারও ইচ্ছ, যখন কবে অগাধ ক্ষমতার অধিকারী হয়েই ঢুকবে। তার মানে আগে আমাদেরকে কোটি কোটি টাকা আর সয়সম্পত্তি, শ্রদ্ধা আর সম্মান অর্জন করতে হবে। দশজনের দলে ভিড়ে সবার নিয়তির সাথে নিজেদেরকে এক সুতোয় গেঁথে নেবার আগে আমি চাই আমার সন্তানেরা যতটা পারা যায় সচ্ছল আর ক্ষমতাবান হয়ে উঠুক।

কিন্তু আমি অন্তত জানি প্রচলিত সমাজের বাইরে তুমি কোনদিন ছিলে না, বলল কে। যেহায় যুদ্ধে গেছ তুমি। দেশের জন্যে লড়াই করে বীর খেতাব পেয়েছ। হঠাৎ তুমি সমাজের হাত গলে পরিবারের মুঠোয় গিয়ে পড়লে কিভাবে? কি এমন ঘটল যে এতটা বদলে গেলে তুমি?

এসব আসলে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়, বলল মাইকেল। তোমাদের গাঁ গ্রামে গোড়া কিছু রক্ষণশীল মানুষ আছে, আমি হয়তো তাদেরই একজন। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ সবচেয়ে আগে দেখি। একটু ভাবনা, বুঝতে পারবে কোন সরকারই তার নাগরিকদের জন্যে তেমন কিছু করে না, কিন্তু তাও আসলে সত্যি নয়। তোমাকে শুধু একটা কথা জানাতে পারি-বাবা আমার সমর্থন পাবেন। তার পক্ষ নিতে হবে আমাকে। আর তোমাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে তুমি আমার পক্ষ নেবে কিনা। হাসছে মাইকেল। বিয়ে করার প্রস্তাবটা এখন আর তেমন সুবিধের মনে হচ্ছে না, তাই কি?

বিছানার ওপর হাত দিয়ে চাপড় মারুল কে। বিয়ের কথা জানি না। ধৈর্য হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। বিয়েটা বিয়ে নাকি মরণ তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আমি শুধু জানি দুদুটো বছর পুরুষমানুষ ছাড়া জীবন কাটিয়েছি-এখন যত পাঁয়তারাই কষো, সহজে তোমাকে আমি ছাড়ছি না। অ্যাই, স্বার্থপর, এদিকে এসো। কি হলো! এলে!

আলো নিভিয়ে বিছানায় গেল আবার ওরা। মাইকেলের কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলছে কে। তুমি চলে যাবার পর আমি আর কোন পুরুষের কাছে যাইনি। কথাটা বিশ্বাস করো?

করি।

আরও নরম গলায় জানতে চাইল কে। তুমি?

আমি গেছি, বলল মাইকেল। হঠাৎ শক্ত কাঠ হয়ে গেল কে-র শরীর, অনুভব করল ও। গত ছয়মাসের মধ্যে নয় অশ্য। সত্যি কথাই বলল। অ্যাপলোনিয়া মারা যাবার পর এই প্রথম কারও সাথে প্রে করছে মাইকেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *