৩.১১ নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছে মাইকেল কর্লিয়নি

১১.

সিসিলি। নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছে মাইকেল কর্লিয়নি। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোয় এখন মাইকেল তার বাবাকে চিনতে শিখেছে, বুঝতে পেরেছে তার চরিত্র আর নিয়তিকে। এখানে এসে জীবন সম্পর্কে তার ধারণা একটু। একটু করে বদলে গেছে। এখন তার মনে হয় জীবনের কঠোর বাস্তব দিকটা সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না-বলতে গেলে এক রকম অন্ধই ছিল সে। এখন সে শুধু বাবাকে নয়, লুকা ব্রাসিকেও বুঝতে পারে। বুঝতে পারে পাষাণ হৃদয় ক্যাপোরেজিমি ক্লেমেঞ্জাকে। বুঝতে পারে মায়ের আত্মসমর্পণের কারণ, আর তার। নির্ধারিত ভূমিকার তাৎপর্য এরা সবাই যোদ্ধা, ভাগা এদের শত্রু। ভাগ্যের সাথে। যুদ্ধ না করলে এরা সবাই অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত দুনিয়ার বুক থেকে। সিসিলিতে না এলে এই জ্ঞান হত না মাইকেলের। একটাই মাত্র নিয়তি থাকে মানুষের, ডনের এই কথাটার অর্থ এবং তাৎপর্য কি, এখন তা পরিষ্কার বুঝতে পারে সে। কর্তৃপক্ষ বা বৈধ, আইনসঙ্গত সরকারকে কেন অমান্য করা হয়, যারা ওমের্তা লঘন করে, নীরবতার শপথ ভঙ্গ করে, কেন তাদেরকে ঘৃণা করা হয়-সময়ের সাথে সাথে এসবেরই অর্থ বুঝতে পারছে মাইকেল।

আজ থেকে পাঁচ মাস আগে হৃদ্মবেশ পরিয়ে পালার্মে বন্দর থেকে সিসিলি দ্বীপের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা হয়েছে মাইকেলকে। ব্যবহার করা পুরানো পোশাক পরানো হয়েছিল ওকে, মাথায় বসিয়ে দেয়া হয়েছিল ঠোঁট লাগানো টুপি।

জায়গাটা একটা প্রদেশের মাঝখানে, প্রদেশটা পরিচালনা করে একটা মাফিয়া সংগঠন। মাফিয়া সংগঠনের নেতা ডন কর্লিয়নির কাছে ঋণী, ডন কর্লিয়নির কাছ থেকে তিনি বড় ধরনের একটা উপকার পেয়েছিলেন এক সময়। কর্লিয়নি গ্রামটা এই প্রদেশেরই একটা অংশ। অনেক বছর আগে মাইকেলের বাবা যখন দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন তখন তিনি তার জন্মস্থানের নামটা নিজের নামের সাথে গেঁথে নিয়েছিলেন।

তবে ডন কর্লিয়নির আত্মীয়-স্বজনরা এখন আর কেউ জীবিত নেই এখানে। মেয়েরা সবাই বুড়ো হয়ে মারা গেছে। আর পুরুষরা হয় নিহত হয়েছে গৃহযুদ্ধে, নয়তো আমেরিকা, ব্রাজিল অথবা ইটালিরই অন্য কোন প্রদেশে চলে গেছে।

আরও পরে মাইকেল জানতে পারল, এই দরিদ্র গ্রামটায় খুনোখুনির হার সারা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

মাফিয়া সংগঠনের নেতার এক চিরকুমার কাকা আছেন, তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে মাইকেল। সত্তর বছর বয়স কাকার, ভদ্রলোক এই এলাকার জনপ্রিয় ডাক্তারও বটে।

মাফিয়া সংগঠনের নেতা ডন টমাসিনোর বয়স প্রায় পঞ্চাশ, সিসিলির সবচেয়ে অভিজাত আর ধনী পরিবারের যাবতীয় সয়-সম্পত্তি দেখাশুনা করেন তিনি। এই পরিবারটির প্রধান তত্ত্বাবধায়ক তিনিই, পদমর্যাদার স্বীকৃতিস্বরূপ স্থানীয় ভাষায় তাঁকে গ্যাবেলোটো বলা হয়। গ্যাবেলোটোর কাজের মধ্যে একটা হলো, সর্বহারা বা সুযোগসন্ধানীরা যাতে পতিত জমি দখা করে না ফেলে, বা অবৈধভাবে মালিকের জমিতে শিকার না করে কিংবা ফসল কেটে নিয়ে না যায় সেদিকে নজর রাখা। সংক্ষেপে, মাফিয়াদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে গ্যাবেলোটোরা। গরীব আর সাধারণ লোকদের ন্যায্য অন্যান্য সব রকম দাবি আর অধিকার থেকে তাদেরকে। বঞ্চিত করে ধনী মনিবদের স্থাবর সম্পত্তি রক্ষা করাই এদের কাজ। বিমিয়ে এরা মনিবের মোটা টাকা খায়। কখনও যদি জমিহীন গরীব কৃষক আইনের সাহায্য নিয়ে। পতিত জমিতে ফসল বোনার চেষ্টা করে তাহলেই কাজ শুরু হয়ে যায় গ্যাবেলোটোদের। মারধর করে, খুন করার ভয় দেখিয়ে চাষীদেরকে ভাগিয়ে দেয়। তারা। পানির মত সহজ কাজ। তেমন ঝক্কি-ঝামেলা নেই।

ডন টমাসিনো এলাকার পানি ভাগ-বাটোয়ারার মালিকও বটে রোমক সয়াট যদি এখানে কোন নতুন বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেন, তিনি সেটা এক কথায় বাতিল করে দেন। বাঁধ তৈরি হলে তার মস্ত ক্ষতি হবে, সুতরাং আর সব কিছু তিনি মেনে নেবেন, কিন্তু বাধ তৈরি হতে দেবেন না। অসংখ্য আর্টেজায় কুয়ো আছে। তার হাতে। ওই সব কুয়োর পানি বেচে বস্তা বস্তা টাকা কামান তিনি। বাধ তৈরি হলে একেবারে সস্তায়, পানির দরে বিক্রি হবে পানি-তার এত লাভের ব্যবসাটা। ধ্বংস হয়ে যাবে। তা তিনি কিভাবে হতে দিতে পারেন? যুগ যুগ নয়, শত শত বছর ধরে পানি সরবরাহের একটা একচেটিয়া কারবার কত সহস্র লোকের পরিশ্রমের ফলে তিলে তিলে গড়ে তোলা হয়েছে। বৃদ্ধি এবং ভাগ্যের জোরে আজ তিনি এটির মালিক। এমন একটা ঐতিহ্যকে, প্রচণ্ড সাধনার ফলকে কিভাবে তিনি ধ্বংস হতে দিতে পারেন?

তবে যে যাই বলুক, ডন টমাসিনো ড্রাগস বা নারী ব্যবসা ছুঁয়েও দেখেন না। সবাই জানে, এসব ব্যাপারে তিনি অত্যধিক সেকেলে, রক্ষণশীল স্বভাবের মানুষ। ওদিকে পালার্মো আর অন্যান্য বড় শহরে নতুন নতুন যে-সব মাফিয়া নেতার উদয় হচ্ছে তাদের উপর ইটালিতে নির্বাসিত মার্কিন গুণ্ডাদের প্রভাব বড় বেশি-বেশ্যা বা ড্রাগস কেন, কোন ব্যবসাতেই তাদের অরুচি নেই।

সাঙ্ঘাতিক মোটা মানুষ ডন টমাসিনো। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে পেটওয়ালা মানুষ। আক্ষরিক অর্থে তো বটেই, আবার আলঙ্কারিক অর্থেও বলা হচ্ছে–যাকে সবাই সভম আর ভয় করে। এই রকম একজন নেতার আশ্রয়ে রয়েছে মাইকেল। ভয়ের কোন কারণ নেই, সবদিক থেকে নিছিদ্রই বলা যায় ওর নিরাপত্তা। কিন্তু তবু ওর পরিচয় গোপন রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ডনের কাকার নাম ডা. তাজা। তার পাচিল ঘেরা বাগান বাড়ির ভিতরই সময় কাটে মাইকেলের।

অস্বাভাবিক লম্বা আকৃতির মানুষ ডাক্তার তাজা। পুরো ছয় ফুট, সিসিলীয়দের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা। মুখটা টকটকে লাল, মাথায় ধবধবে সাদা চুল। বয়স সত্তরের উপর হলে হবে কি, হপ্তায় একবার অন্তত পালার্মোয় যানই তিনি-ওখানেই তত সেরা তরুণী বেশ্যা মেয়েদের আড্ডা। মেয়েগুলোর একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি। তাদের বয়স যত কম হবে, ততই আকৃষ্ট হবেন তিনি। সাঙ্ঘাতিক রসিক মানুষ। তার আরও একটা দুর্বলতা আছে। সেটি হলো বই পড়া। ব্যাপারটা নেশার মত, বা তার চেয়েও বাড়া। বইগুলো গ্রোসে গেলেন বললেও কম বলা হয়। যত পান। তত পড়েন। কোন বাছবিচার নেই। ছাপার অক্ষরে যেখানে যত কিছু আছে সবই তাঁর পাঠ্য বিষয়। শুধু যে পড়েই ক্ষান্ত হন, তা নয়। পড়া বিষয়গুলো মজার গল্পের আকারে গ্রামের লোকজন, নিজের নিরক্ষর চাষী, রোগী আর জমিদারের রাখালদেরকে শোনান তিনি। তার স্বভাবের জন্যে স্থানীয় লোকেরা তাকে পণ্ডিত, বুদ্ধ ইত্যাদি উপাধি দিয়েছে।

প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় প্রকাণ্ড বাগানে মাইকেলকে সঙ্গ দেন ডন টমাসিনো আর ডাক্তার তাজা। শ্বেত পাথরের অসংখ্য স্ট্যাচু রয়েছে বাগানে। দেখে মনে হয় এখানের মিঠেকড়া রসে ভরপুর কার্লো আঙ্গুরের গাছগুলোর মত মূর্তিগুলোও যেন। মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে মাটির নিচে থেকে। মাফিয়াদের সম্পর্কে, তাদের শত শত বছরের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে মজার মজার গল্প বলতে ভালবাসেন ডাক্তার তাজা। তার মৃগ্ধ শ্রোতা হলো মাইকেল কর্লিয়নি। এমন একজন আদর্শ শ্রোতা পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন ডাক্তার তাজা। এবং মাঝে-মধ্যে সবুজের গা জুড়ানো মিষ্টি মধুর শীতল বাতাস, ফুলের গন্ধে ভরাট কড়া মদ আর বাগানটির প্রশান্ত পরিবেশের প্রভাবে ডন টমাসিনো পর্যন্ত অভিভূত হয়ে পড়েন। তখন তিনিও নিজের দুএকটি অভিজ্ঞতার গল্প শোনান মাইকেলকে।

কত যুগ, কত শতাব্দী আগে তৈরি হয়েছে বাগানটা। এর সাথে কত শত আনন্দ আর করুণ ঘটনার স্মৃতি জড়িত। এখানে বসে মাইকেল কর্লিয়নি বুঝতে পেরেছে তার বাপের বংশের মূল শিকড়টা কোথায়।

মাফিয়া শব্দটার কথাই ধরা যাক। শব্দটার আদি অর্ধ ছিল আশ্রয় স্থল। পরে শব্দটার অর্ধ বদলে যায়। নতুন মানে দাঁড়ায় একটি সংগঠন। এই সংগঠন আপনা আপনি গড়ে উঠেছিল। যে সরকার দেশে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দেশের লোকদেরকে শত শত বছর ধরে শোষণ আর নিষ্পেষন করে এসেছে সেই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্যে এই সংগঠনের জন্ম। পৃথিবীর ইতিহাস আঁটলে দেখা যাবে সিসিলির মত আর কোন দেশকে এমন পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে নিভাবে ধর্ষণ করা হয়নি। ধনী-দরিদ্র সবাইকে রোমক ইনকুইজিশন অর্থাৎ ধর্মযাজকদের প্রশাসন অত্যাচার করেছে নির্বিচারে।

এখানকার রাখাল আর চাষী সমাজের উপর বড় বড় জমিদার আর ক্যাথলিক চার্চের রাজপুরুষদের একচেটিয়া প্রভাব প্রতিপত্তি। এই সব প্রভাবশালীদের হাতের পুতুল হলো পুলিশ বিভাগ। সে জন্যেই সিসিলিতে সবচেয়ে জঘন্য আর অশ্লীল গালি বলতে, পুলিশম্যান বোঝায়।

পুলিশের সাহায্যে পরিপুষ্ট এই প্রচণ্ড পাশবিক ক্ষমতার মুখোমুখি হয়ে নিষ্পেষিত দেশবাসীরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আতঙ্কে বাধ্য হয়ে নিজেদের রাগ, ঘৃণা আর বিদ্বেষ গোপন করে রাখতে শিখেছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এ শিক্ষাও হয়েছে তাদের যে শত্রু তাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, ওদেরকে শাসানো বা মুখ ফুটে ওদের বিরুদ্ধাচারণ করা নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু নয়–এতে কোন লাভও নেই, কারণ পাল্টা আক্রমণ সাথে সাথেই আসে। তারা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পায়, সমাজ ওদের পরম শত্রু। অন্যায়ের প্রতিকার যদি চাইতেই হয়, গোপনে বিদ্রোহীদের কাছে যেতে হয়। বিদ্রোহী মানে মাফিয়ারা ন্যায্য বিচার করে দেয়।

ওদিকে মাফিয়া সংগঠনের কাজও দিনে দিনে এগিয়ে চলেছে ওমের্তা অর্থাৎ নীরবতার কঠোর নিয়ম চালু করে নিজেদের নিরাপত্তা আর ক্ষমতার ভিত্তি আরও মজবুত, আরও নিচ্ছিদ্র করে এনেছে তারা সিসিলির যে কোন একটা পাড়াগাঁয়ের কথা ধরা যাক, অচেনা কোন লোক এসে যদি জিজ্ঞেস কার সবচেয়ে কাছের শহরে কোন পথ ধরে যেতে হবে, স্থানীয় লোকেরা সাথে সাথে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, উত্তর দেবার ভদ্রতাটুকুও দেখাবে না! মাফিয়া সংগঠনের দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুতর অন্যায় কি? পুলিশের কাছে সাহায্য চাওয়া। সংগঠনের কোন সদস্য যদি গুলি খায়; যদি তার উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়–তবু সে পুলিশের কাছে গিয়ে মুখ খুলতে পারবে না। পুলিশের সাহায্য না চাইলে লাভ হয়, সবাই টের পেল ব্যাপারটা। ফলে স্থানীয় লোকদের আদর্শ, ধর্ম হয়ে দাঁড়াল ওমের্তা। একটা মেয়ের স্বামী যদি খুন হয়ে যায়, মেয়েটি তার স্বামীর হত্যাকারীর পরিচয় পুলিশকে জানায় না। ছেলে খুন হলে মাও তার খুনীর পরিচয় প্রকাশ করে না। যুবতী, কুমারী মেয়ের সতিত্ব নষ্ট করেছে যে তার নামও পুলিশের সামনে উচ্চারণ করা হয় না।

সমাজে ন্যায় বিচার বলে কোন জিনিসের অস্তিত্ব কোন কালেই ছিল না, আজও নেই। এটাই হলো একমাত্র সত্য। কর্তৃপক্ষ বা বৈধ সরকার নিজেদের আর নির্দিষ্ট মহলের ভাগ্য-উন্নয়নে সাঙ্ঘাতিক ব্যস্ত। আরও একটা কাজে তারা ব্যস্ত বটে, সেটা হলো নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার। তাদের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাবার আশা করা বাতুলতা মাত্র। কেউ কোন দিন কখনও পায়নি। তাই রবিনহুডের মত দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করে যারা সেই মাফিয়াদের কাছেই গোপনে আসে দেশের লোকেরা। মাফিয়া সংগঠনও ন্যায় বিচার করে দিয়ে দেশবাসীর আস্থা অর্জন করে। কেউ কোন বিপদে পড়লেই মাফিয়া সংগঠনের নেতার কাছে ছুটে আসে। তিনিই দীন-দুঃখীদের আদর্শ সমাজপতি, তিনিই তাদের রক্ষাকর্তা। বস্তা। ভর্তি টাকা, ঝুড়ি ভর্তি খাবার আর গাদা গাদা চাকরি হাতে নিয়ে সারাক্ষণ তৈরি হয়ে থাকেন তিনি সবার জন্যে। কেউ এসে চাইলেই ন্যায় বিচার দেন। তিনিই তো সবার রক্ষাকর্তা।

কিন্তু মাফিয়া সংগঠনের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে একটা কথা উল্লেখ করেননি ডাক্তার তাজা। সংগঠন সম্পর্কে এই সত্যটা মাইকেল নিজে আবিষ্কার করেছে। তাতে অবশ্য বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছ তার! ওর আবিষ্কারটা হলো, সিসিলির মাফিয়া সংগঠনগুলো ইদানীং ধনী জমিদার আর বড় বড় ব্যবসায়ীদের বে-আইনী খাদেমে পরিণত হয়েছে। এমনকি এদেশের বৈধ সরকারি নিয়মের আওতায় যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার নিয়ম-কানুন মেনে নিয়ে এরাও এক একজন রাজনৈতিক পাণ্ডা হয়ে উঠেছে বললে ভুল বলা হবে না। সিসিলীয় মাফিয়া সংগঠন এখন একটা আদর্শচ্যুত ধনিক স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠনে। নেমে এসেছে। এরা এখন আর গণতন্ত্রের রক্ষক নয়, বরং গণতন্ত্র বিরোধী। এদের মধ্যে উদারতার অভাব দেখা যাচ্ছে। এমন লোভী হয়ে উঠেছে যে যে-কোন রকম ব্যবসার উপর ট্যাক্স ধরে বসে এরা, সে ব্যবসা যত ছোট আর নগণ্যই হোক না কেন। অর্থাৎ সিসিলীয় মাফিয়া সংগঠন বৈধ সরকার বা আইনসঙ্গত কর্তৃপক্ষের চেয়েও জঘন্যতর কাজ করতে শুরু করেছে।

বাবার মত একজন সর্বগুণে গুণান্বিত পুরুষও কেন বৈধ সরকারের আদর্শ নাগরিক না হয়ে ওণ্ডা হয়ে গেলেন, এ প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে পেয়েছে মাইকেল। যে কোন আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন তেজস্বী পুরুষের পক্ষে এই বিভীষিকাময় দারিদ্র, আতঙ্ক আর অবমাননা সহ্য করা বা মেনে নেয়া এক কথায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। যে সব সিসিলীয় আমেরিকায় গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল তারাও ধরে নিয়েছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষও সিসিলীয় কর্তৃপক্ষের মত অত্যাচারী।

পালার্মোর বেশ্যাপাড়ায় সাপ্তাহিক অভিযান চালান ডাক্তার তাজা, অভিযানের সঙ্গী হিসেবে মাইকেলকেও তিনি সাথে নিতে চান। কিন্তু রাজী হয়নি মাইকেল হঠাৎ করে সিসিলিতে পালিয়ে আসতে হয়েছে বলে ওর ভাঙা চোয়ালের উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কির প্রচণ্ড ঘূষির স্মৃতিচিহ্ন এখনও মুখের বা দিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও। হাড়গুলো জোড়া লেগেছে বাকা ভাবে, পাশ থেকে তাকালে ভাঙাচোরা দেখায় মূর্খটাকে। শুধু তাই নয়, মুখের এই ভাঙাচোরা, তোবড়ানো চেহারার জন্যে কেমন যেন দুশ্চরিত্র লম্পট বলে মনে হয়:ওকে। নিজের চেহারা নিয়ে মনে মনে সব সময়ই একটা গর্ব অনুভব করত ও, সেজন্যেই দুঃখটা আরও বেশি করে বাজে বুকে, চেহারা নষ্ট হওয়ায় যে এত দুঃখ পাবে তা নিজেও কখনও ভাবেনি।

শুধু যে চেহারাটা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে তাই নয়, মর্জি-মাফিক একটা ব্যথাও আসা-যাওয়া করে। অবশ্য ব্যথাটা তেমন ভোগাতে পারে না ওকে, ডাক্তার তাজা। ট্যাবলেট খাইয়ে সেটাকে সামলে দেন। তিনি ওর মুখের চিকিৎসা করে ত্রুটিটা সারিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু মাইকেল এড়িয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা মাস সিসিলিতে বসবাস করে এটুকু অন্তত বুঝেছে ও যে এখানকার সবচেয়ে অযোগ্য। আর বাজে ডাক্তার সম্ভবত এই তাজা বুড়ো। প্রচুর পড়াশুনা করেন ভদ্রলোক, কিন্তু তার মধ্যে ডাক্তারি বই-পত্র একটাও নেই। মুক্তকণ্ঠে নিজেই স্বীকার করেন, ডাক্তারি বিষয়ের কিছু তিনি বুঝতেই পারেন না। মাফিয়া সংগঠনের প্রধান নেতার তদবিরে পরীক্ষায় পাস করে ডাক্তারি করার ছাড়পত্র পেয়েছেন তিনি। তার পক্ষে সুপারিশ করার জন্যে নেতাটি পালার্মোয়ও গিয়েছিলেন। ডাক্তার তাজা তখন ছাত্র, পরীক্ষা দিয়েছেন মাত্র। তাকে কত নম্বর দেয়া যায় না যায় তা অধ্যাপকদের সাথে আলোচনা করে স্থির করে আসেন নেতাটি। এধরনের আরও ঘটনা থেকে মাইকেল। বুঝতে পারে, যে-সমাজকে মাফিয়া সংগঠন রক্ষা করে সেই সমাজকেই সংগঠনটি। ক্যাসার রোগের মত কুরে কুরে খাচ্ছে। কাজ, সাধনা, পরিশ্রম–এসবের কোন মূল্যই নেই। সিসিলির সব কটা গডফাদার যাকে তাকে দান করেন পেশা, পাবার: যোগ্য নয় যে সে-ও পেয়ে যায় উপকার আর সাহায্য–অনুগত হলেই হলো। এই রাতি যে কতটা বিপজ্জনক তা এরা কেউ বুঝতে চায় না। এতে যে সত্যিকার কাজের লোকেরা ঠকছে, বঞ্চিত হচ্ছে, তা একবার ভেবে দেখার মত লোক নেই সিসিলিতে।

 সমস্ত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার জন্যে হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে মাইকেলের। দিনের বেলাটা বাইরে বাইরে কাটায় ও, পল্লীগ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ডন টমাসিনোর জমিদারিতে কাজ করে দুজন রাখাল, মাইকেল বাইরে বেরুলেই লুপারা কন্দুক হাতে ওর সঙ্গী হয় তারা। অনেক সময় মাফিয়াদের হয়ে ভাড়াটে খুনী হিসেবে কাজ করতেও পিছ পা হয় না সিসিলি দ্বীপের রাখালরা, অবশ্য শুধু জীবিকা অর্জনের তাড়নায় এ-কাজ করতে বাধ্য হয় তারা।

আমেরিকাতে তার বাবার মাফিয়া সংগঠনের কথা চিন্তা করে মাইকেল। সংগঠনটার প্রভাব যদি আরও বাড়ে, যদি আরও সাফল্য অর্জিত হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত নির্ঘাৎ এই দ্বীপের সংগঠনের মত ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে সেটারও, তার বিষাক্ত প্রভাব আর প্রতিক্রিয়া গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্যানসার রোগের মত কুরে কু? খাবে, সম্পূর্ণ রসাতলে পাঠাবে দেশটাকে। যার চোখ আছে সেই দেখতে পাই এরই মধ্যে একটা ভূতের দেশ হয়ে গেছে সিসিলি। শুধু পেটের জন্যে খাবার যোগাড় করার আশায় কত লোক দেশ ছাড়া হয়ে অচেনা অজানা বিদেশে চলে। গেছে। যোতের মত এখনও বেরিয়ে যাচ্ছে। আরেক দল লোক, যারা নিজের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে অন্যান্যদের শত্রু অর্জন করেছে, তারাও খুন হয়ে যাবার ভয়ে দেশের মায়া শ্রাগ করে গোপনে গা ঢাকা দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন বেড়াতে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে বহু বহু দূর চলে যায় মাইকেল। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে ও দেশটার উদার সৌন্দর্য দেখে। এখানে সেখানে অগভীর, চওড়া খাদ, খাদের মধ্যে কমলালেবুর বাগান ছায়া তৈরি করে রেখেছে। বাগানে পানি সরবরাহ করা হয় বিশাল মুখওয়ালা নালার মধ্যে দিয়ে। প্রকাণ্ড দাঁতালো সাপের মুখের মত দেখতে সেগুলো খুব সম্ভব তৈরি করা হয়েছে যীশুর জন্মেরও আগে। দালান কোঠাগুলো প্রাচীন রোমক প্রাসাদ আর বাগান বাড়ির ধাচে তৈরি। বিশাল প্রবেশদ্বারগুলো শ্বেত পাথরের তৈরি, প্রকাণ্ড খিলান দিয়ে সাজানো প্রত্যেকটা কামরা। কিন্তু সব ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। বেওয়ারিশ ভেড়ার আস্তানা এখন সব!

দূর-দিগন্তের কাছে দেখা যায় উঁচু পাহাড় শ্রেণী। কঠিন পাথরের পাহাড় ওগুলো, মাংস ছাড়ানো ন্যাড়া হাড়ের সাদা টিবি বলে মনে হয়। চারদিকের এই সাদা মরুভূমির মাঝখানে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে যেন উজ্জ্বল সবুজ বাগান আর খেতগুলো প্রকৃতির গলায় যেন পরানো রয়েছে ঝকমকে সবুজ পান্নার হার। কখনও কখনও পায়ে হেঁটে কর্লিয়নি গ্রাম পর্যন্ত চলে যায় মাইকেল। গ্রামের সবচেয়ে কাছের পাহাড়টার গায়ে নতুন বসতির সূচনা হয়েছে। বাড়িঘর তৈরি করে আঠারো। হাজার লোক বাস করে ওখানে। দুর থেকে পাহাড়ের গায়ে লম্বা লম্বা দাগের মত। দেখতে লাগে বাড়িগুলোকে।

গরীব মানুষেরা আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে ওখানে। পাহাড়ের গা কেটে কার্লো পাথর বের করে নিয়ে তাই দিয়ে তৈরি করেছে বাড়ি ঘর! গোটা এলাকায় প্রায় সবারই অকস্থা করুণ। ছোট্ট এই গ্রামটায় গত বছর ষাটজন লোক খুন হয়েছে। মৃত্যু যেন তার হিম-শীতল ছায়া ফেলেছে এই গ্রামটার উপর।

পাহাড় ছাড়িয়ে আরও দরে চাষের জমি। খেতের চোখ টাটানো একঘেয়ে দৃশ্য। ভেঙে তারপর শুরু হয়েছে ফিকুৎসার বিস্তীর্ণ বনভূমি।

মাইকেলের সাথে যখনই বেরোয়, সাথে অবশ্যই লুপারা বন্দুক নেয় রাখাল বা দেহরক্ষীরা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী সিসিলীয় শটগানকে লুপারা বলা হয়। মাফিয়াদের অত্যন্ত প্রিয় অস্ত্র এটা। এই অস্ত্রকে কতটা ভয়ঙ্কর বলে মনে করা হয় তার একটা উদাহরণ দেয়া যায় মুসোলিনীর নিযুক্ত একজন পুলিশ অফিসারের নির্দেশ থেকে।

 সিসিলি থেকে মাফিয়া সংগঠনকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার জন্যে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে মুসোলিনী একবার একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে পাঠালেন। পুলিশ অফিসারের প্রথম কয়েকটা কাজের মধ্যে একটা হলো, যেখানে যত পাথরের তৈরি উঁচু দেয়াল আছে সব ভেঙে তিন ফুট উচ্চতায় নামিয়ে আনা, পারাধারী খুনীরা যাতে দেয়ালের পিছনে গা ঢাকা দিয়ে পুলিশ মারতে না পারে। তবে, এতে তেমন ফায়দা ঠয়নি অগত্যা, অন্য কোন উপায় নেই দেখে, মাফিয়ার সমর্থক বা সদস্য বলে যাকেই সন্দেহ হয় তাকেই গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্য কোন দ্বীপে। এই পদ্ধতিতে অবশ্য পুলিশ অফিসারের উদ্দেশ্য সফল হলো।

তারপর মিত্রপক্ষের সৈন্যরা যখন সিসিলিকে মুক্ত করুক, মার্কিন সামরিক সরকারের মনে হলো ফ্যাসিস্ট শাসনামলে যাকেই জেলে ভরা হয়েছে সে নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের খাঁটি সমর্থক। মার্কিনীরা মাফিয়া সদস্য আর তাদের সমর্থকদের অসংখ্য লোককে শহর-গ্রামের মেয়রের পদ আর সামরিক সরকারের দোভাষীর পদে নির্বাচিত করল! অপ্রত্যাশিত এই সৌভাগ্য লাভ করে আবার পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পেল মাফিয়া সংগঠন। আবার তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।

খানিকটা ঘুমের জন্যে প্রচুর পরিশ্রম আর সাধ্য-সাধনা করতে হয় মাইকেলকে। অনেক দূর পর্যন্ত হাটে ও, রাতে গুরুপাক এক প্লেট পাস্তা এক বোতল কড়া মদ আর প্রচুর মাংস খেতে হয় ওকে। ইতালীয় ভাষায় লেখা অসংখ্য বই আছে ডাক্তার তাজার লাইব্রেরিতে। কলেজে খানিকটা ইটালিয়ান পড়েছে মাইকেল, ইতালির আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কিছু কথাও বলতে পারে, তবু বইগুলো পড়তে যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে ওকে। তবে এই কষ্টটুকু স্বীকার করায় একটা লাভ হলো। উচ্চারণ আর টান প্রায় নিখুঁত হয়ে এল ওর। এখন আর ওর কথায় বিদেশী টান নেই। কিন্তু তাই বলে নিজেকে স্থানীয় লোক বলে চালানো সম্ভব নয়। সবাই ভাবে, এই অদ্ভুত মানুষটা সুইজারল্যাণ্ড আর জার্মানীর কাছাকাছি সীমানা থেকে এসেছে।

মুখের ভাঙা বাঁদিকটার জন্যে এদিকের লোক বলে মনে হয় ওকে। চেহারায় এ-ধরনের বিকৃতি সর্বত্র প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায় সিসিলিতে। তার কারণ, এখানে চিকিৎসার অভাব সবচেয়ে বড়। তাছাড়া, ছোটখাটো ক্ষত বা শারীরিক ত্রুটির চিকিৎসা হয় না টাকার অভাবেও। এখানে ছেলে থেকে বুড়ো পর্যন্ত সবার চেহারায় এমন সব বিকৃতি লক্ষ করা যায় যা সামান্য একটু অপারেশন বা ডাক্তারির সাহায্যে। শুধরে নেয়া যায় আমেরিকায়।

কে-এর কথা প্রায়ই মনে পড়ে মাইকেলের। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তার

মুখের হাসি। চোখ বুজলে তার শরীরটাও দেখতে পায় ও। যখনই মনে পড়ে তার কথা, প্রতিবার বিবেকের দংশন অনুভব করে ও। একটা অপরাধবোধে জর্জরিত হয়। চলে আসার সময় বিদায় জানানো হয়নি, ওদের সম্পর্কের যে এখানেই ইতি সে-কথা বলা হয়নি-সেটাই ওর অপরাধবোধের কারণ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দু-দুজন লোককে খুন করে আসায় ওর মনে কোন অপরাধবোধ নেই। ওদের ব্যাপারে বিবেকের দংশন অনুভব করে না ও। তার কারণ, ওরা দুজন ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল। সলোযো ওর বাবাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, আর ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কি তো ওর চেহারাই বিকৃত করে দিয়েছে চিরকালের জন্যে।

মাইকেল ব্যথা কমাবার ওষুধ চাইলেই ডা. তাজা ওর ভাঙা মুখের চিকিৎসা করার জন্যে চাপ দেন যত দিন যাচ্ছে আরও ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে ব্যথাটা, সেই সাথে তীব্রতাও বাড়ছে।

এ-ব্যাপারে একটা সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ডা. তাজা। চোখের নিচে একটা স্নায় আছে, সেটা থেকে আরও অনেক খুদে স্নায়ু বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে থাকে চারদিকে। মাফিয়া গুণ্ডারা সাঙ্ঘাতিক পছন্দ করে মুখের ওই জায়গাটা। বরফ ভাঙার গাইতির দুচের মত সরু ডগা দিয়ে ঠিক ওই জায়গাটা বেছে নিয়ে খোঁচা দেয় ওরা। ওই স্নায়ুটাই জখম হয়েছে মাইকেলের। এমনও হতে পারে, সরু এক চিলতে হাড় ফুটে আছে এখানে। পালামোর হাসপাতালে গেলেই ল্যাঠা চুকে যায়। ছোট্ট একটা অপারেশন। তাতে চিরদিনের মত দূর হয়ে যাবে ব্যথাটা।

কিন্তু মাইকেল তাতে রাজী নয়। ডাক্তার কারণ জানতে চাইলে শুধু একগাল হাসে। একদিন উত্তরে বলল, বাড়ি থেকে সাথে করে আনা জিনিস যে ওটা।

ব্যথাটাকে গ্রাহ্য করে না মাইকেল। খুলির ভিতর স্পন্দনের মত টনটনে একটা ভাব অনুভব করে ও জায়গাটাকে যেন যন্ত্রের সাহায্যে পরিষ্কার করার জন্যে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।

পল্লী-গ্রামে এক এক করে সাতটা মাস কেটে গেছে এবার সত্যি একঘেমে লাগছে মাইকেলের! এই সময়টায় নিজের কাজ-কারবারেও সাঙ্ঘাতিক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ডন টমাসিনো আজকাল তাকে বড় একটা দেখা যায় না বাগানবাড়িতে।

নতুন একদল মাফিয়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে পালার্মোতে, যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন আর গৃহনির্মাণ কারবারে ঢুকে পড়ে বস্তা বস্তা টাকা রোজগার করছে তারা। পূরানো মাফিয়া নেতাদের গ্রাম্য জমিদারিতে অনধিকার অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা ওই টাকার জোরে। পুরানো, বুড়ো নেতাদেরকে তারা শ্রদ্ধা করে না, গুঁফো সর্দার বলে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে। এদের হাত থেকে নিজের সম্পত্তি রক্ষার কাজেই খুব ব্যস্ত হয়ে আছেন ডন টমাসিনো। ফলে তার সঙ্গ থেকে আপাতত বঞ্চিত হচ্ছে মাইকেল। ওদিকে ডা. তাজা এখনও ওকে গল্প শোনান বটে, কিন্তু ভারও ভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে গেছে, ফলে প্রথম থেকে আবার তিনি পুনরাবৃত্তি শুরু করেছেন।

এর মধ্যে একদিন মনস্থির করল মাইকেল, কর্লিয়নি গ্রাম ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত বেড়াতে যাবে ও, সেই পাহাড় টপকে আরও ভিতর দিকের গ্রামগুলোয়।

বলাবাহুল্য, সেই রাখাল দেহরক্ষীদেরকেও সাথে লি মাইকেল। সিসিলিতে কর্লিয়নি পরিবারের শত্রু আছে, তাদের ভয়ে দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতে হয় মাইকেলকে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। আসল কথা, এলাকাটা সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক। স্থানীয় নয় এমন যে-কোন লোকের জন্যে একা বাইরে ঘুরে বেড়ানো আত্মহত্যা করার সামিল। অনেক সময় এমন কি স্থানীয় লোকেরাও নিরাপদ নয়, তাদেরও বিপদ ঘটতে পারে। চোর ডাকাত গিজগিজ করছে চারদিকে, তার উপর চলছে নিজেদের মধ্যে মাফিয়া দলগুলোর মারামারি কাটাকাটি। এই সব কারণে সাধারণ লোকেরাও টপাটপ খুন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, একা বেরুলে, পাগলিয়াও-চোর বলে মনে করা হতে পারে মাইকেলকে।

খেতের মাঝখানে খড় দিয়ে তৈরি চালের ঘরগুলোকে বলে পাগলিয়াও। এই ঘরগুলোয় চাষবাসের জন্যে যতরকম হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি লাগে তার সবই রাখা হয়। প্রয়োজনে ওখানে বিশ্রাম নিতে পারে শ্রমিকরাও। সিসিলিতে খেতগুলো গ্রাম থেকে অনেক দূরে, রোজ রোজ কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো বয়ে নিয়ে আসার ঝামেলা থেকে রেহাই পাবার জন্যে এই ব্যবস্থা। খেতের কাছেপিঠে বসবাস করার অনেক বিপদ। তাছাড়া, ঘর তুলে খেতের জমি নষ্ট করতে চায় না কেউ। চাষীরা সবাই যে-যার গ্রামে থাকে, সূর্য উঠতে যা দেরি, অমনি সবাই খেতের দিকে হাঁটা দেয়। পায়ে হাঁটা ডেলি প্যাসেঞ্জার বলা চলে এদেরকে। কিছুদিন আগে পাগলিয়াও থেকে যন্ত্রপাতি চুরির হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এতে চাষীর সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি হত, তার কারণ সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চুরি যাওয়া জিনিস কখনোই উদ্ধার করে দিতে পারত না। আইন যখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো, স্থানীয় মাফিয়া সংগঠন তখন গরীব চাষীদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এল। তারা নিজেদের আলাদা নিয়মে সমস্যার সমাধান করে ফেলল। অন্যান্য ক্ষেত্রের মত এখানেও তারা প্রায় সম্পর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। গর্তের ভিতর ধোয়া দিয়ে যেমন ইদর বের করা হয় তেমনি কৌশলে যেখানে যত পাগলিয়াও চোর ছিল তাদের সবাইকে তাড়া করে বের করে আনা হতে লাগল ঘরের বাইরে, তারপর গুলি করে মেরে ফেলা তো পানির মত সহজ কাজ। একথা সত্যি যে এই পাইকারী হত্যাযজ্ঞের দরুন বেশ কিছু নিরীহ ভাল মানুষও মারা পড়ল।

তবে, চাষীদের যন্ত্রপাতি এখনও কিছু কিছু চুরি যায়। তাই সদ্য লুঠ করা কোন পাগলিয়াও-এর আশে পাশে ঘুর ঘুর করতে দেখলে মাইকেলকেও ওরা চোর বলে মনে করতে পারে, কিন্তু ওর সাথে স্থানীয় কোন চেনা লোক জামিন হিসেবে থাকলে আলাদা কথা।

সকালটা মিষ্টি রোদে ভরা। খেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে মাইকেল। রাখাল দুজনও আসছে ওর পিছু পিছু।

রাখালদের একজন খুবই সাদাসিধে, যাকে বলে ভাল মানুষের গাছ। দেখেও মনে হয়, আর আসলেও কথাটা সত্যি-লোকটার মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি বলতে গেলে একেবারেই নেই। লোকটার নাম কার্লো। মরা মানুষের মুখে যেমন কথা থাকে না, কার্লোর মুখেও কথা নেই, তবে বাবা নয় সে, মুখটা রেডইণ্ডিয়ানদের মত ভাবলেশহীন। বোগা পাতলা লোক, শরীরের বাঁধুনির মধ্যে একটা ক্ষিপ্র ভাব আছে-মাঝ বয়সী সিসিলীয়দের গায়ে চর্বি জমতে শুরু করার আগে যেমন থাকে।

অপর রাখালটা ঠিক তার উল্টো। উদ্যমী, উৎসাহী, প্রাণচঞ্চল এক যুবক। সিসিলি ছাড়াও অন্যান্য দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে তার। অবশ্য বেশির ভাগ সমুদ্রই দেখেছে, স্থলভাগ দেখার বিশেষ কোন সৌভাগ্য হয়নি। যুদ্ধের সময় নাবিক হিসেবে ইটালিয়ান নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল সে। জাহাজ ডুবির আগে বেচারা উলকি পরার সময়টুকু পেয়েছিল মাত্র। বৃটিশরা তাকে বন্দী করে। কিন্তু ছাড়া পেয়ে যখন গ্রামে ফিরে এল, ওই উঁকিটার জন্যে মস্ত এক কেউকেটা বনে গিয়েছিল।

সিসিলির লোকদের উলকি পরতে দেখা যায় না বললেই চলে। আসলে, সুযোগ নেই, সেজন্যে ইচ্ছাও নেই। এই রাখালটার নাম ফ্যাৱিষযিয়ো। উলকি সে শখ করে পরেনি, তার পেটের উপর বেটপ আকৃতির লাল একটা জজুল আছে, সেটা ঢাকার জন্যে পরেছিল।

সিসিলীয়রা উলকি না পরলেও রঙচঙে ছবি তারা খুবই ভালবাসে। মাফিয়া, সংগঠনের যে সব সদস্য বা সমর্থক হাটে গিয়ে বেচাকেলনার ব্যবসা করে তাদের কাঠের তৈরি গাড়িতে আশ্চর্য সব আদি রসাত্মক ছবি আঁকা থাকে। প্রচুর শ্রম আর স্নেহ ঢেলে আঁকা হয় রঙচঙে দৃশ্যপটগুলো।

তবে, একথা সত্যি, গ্রামে ফিরে এসে ফ্যাব্রিযযিয়ে তার উঁকিটাকে নিয়ে খুব বেশি গর্ব করত না। কিন্তু উলকিতে আঁকা ছবিটার বিষয়বস্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সিসিলীয়দের আত্মসম্মান জ্ঞানের সাথে জড়িত একটা ব্যাপার। ফ্যাব্রিযযিয়োর পেটটা লোমশ। উঁকির ছবিতে দেখা যায়, একজোড়া নরনারী, দুজনেই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, জড়াজড়ি করে রয়েছে–ওদেরকে ছোরা মারছে একজন লোক, সে হলো মেয়েটার প্রতারিত স্বামী।

ছোকরা চটপটে, রসিকতা পছন্দ করে! সুযোগ পেলেই মাইকেলের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে সে, কৌভূহল মেটাবার জন্যে নানা প্রশ্ন করে আমেরিকা সম্পর্কে। মাইকেলের আসল ঠিকানা এই দুজন রাখালের কাছ থেকে গোপন করে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে মাইকেলেব প্রকৃত পরিচয় ওদেরকেও জানানো হয়নি। আমেরিকা থেকে এখানে এসেছে লুকিয়ে থাকার জন্যে, এর বেশি কিছু জানে না তারা। আর জানে, এই লোক সম্পর্কে কাউকে কিছু বলা চলবে না।

প্রায়ই পনির এনে দেয় ফ্যাব্রিযযিয়ো মাইকেলকে। জিনিসটা এত টাটকা যে ঘামের মত পনিরের গায়ে বিন্দু বিন্দু দুধ লেগে থাকে।

ধুলোয় মোড়া পাড়াগাঁর পথ ধরে হাঁটছে ওরা। ওদের পাশ ঘেঁষে এগোচ্ছে রঙচঙে ছবি আঁকা গাধায় টানা গাড়ি! যেদিকে তাকাচ্ছে ওরা সেইদিকেই দেখা যাচ্ছে গোলাপী ফুল, কমলা লেবুর বাগান, জলপাই আর কাগজি বাদামের কুঞ্জবন। যত দেখে ততই অবাক হয় মাইকেল যত বই পড়েছে ও, সব কটাতে ফলাও করে সিসিলীয়দের দারিদ্রের কথা সবিস্তারে লেখা আছে। তাই মনে করেছিল, যত সামনে এগোবে ততই বন্ধ্যা, অনুর্বর নিঃস্ব জমি দেখতে পাবে সে। কিন্তু বেড়াতে বেরিয়ে দেখছে দেশটার চারদিকে শুধু প্রাচুর্য উপচে পড়ছে। পায়ের তলায় এত ফুলের গালিচা। লেবু-ফুলের সুবাস ঢুকছে নাকে। কী সুন্দর এই দেশ! অথচ এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায় কিভাবে মানুষ? সে-দুঃখ সয় কিভাবে? ভেবে কোন কূল পাচ্ছে না মাইকেল। হঠাৎ উপলব্ধি করল ও, মানুষ যে মানুষের ওপর কতটা নির্মম অত্যাচার চালাতে পারে তার একটা পরিমাপ পাওয়া যায় এই নন্দনকানন ছেড়ে দল বেঁধে চিরকালের জন্যে অন্য কোথাও লোকজনের চলে যাওয়া থেকেই।

ইচ্ছা ছিল পায়ে হেঁটে মাজারা গ্রাম পর্যন্ত যাবে ও গ্রামটা সমুদ্রতীরে। তারপর বিকেলের দিকে কর্লিয়নিতে ফিরে আসবে বাসে চেপে। এতটা পরিশ্রমে শরীর নিশ্চয়ই ক্লান্ত হবে, তাতে নির্ঘাৎ চোখে ঘুম আসবে রাতে। চিন্তার কিছু নেই, প্রচুর রুটি আর পনির আছে রাখালদের পিঠে ঝোলানো থলিতে। পথে কোথাও থেমে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলেই হবে। লুপারা বন্দুক গোপন করে রাখার কোন চেষ্টা নেই খালদের মধ্যে, দেখে যাতে মনে হয় শিকারের তল্লাশে সারাটা দিন কাটাতে যাচ্ছে ওরা।

আশ্চর্য সুন্দর লাগছে আজকের সকালটা। ছোটবেলার কথা, একদিন খুব ভোরে উঠে মাঠে বল খেলতে গিয়েছিল মাইকেল, সেদিন অদ্ভুত এক পুলকে শরীর আর মন পুলকিত হয়ে উঠেছিল ওর–সেই রকম রোমাঞ্চকর পূলক আজও অনুভব করছে সে। সেই ছোটবেলার প্রতিটি সকাল দেখে মনে হত নতুন করে ধুয়ে সাফসুতরো করে কে যেন রঙ দিয়ে কি সুন্দর ভাবে এঁকে দিয়েছে। আজকের সকালটাকেও ঠিক সেই রকম লাগছে।

জমকালো ফুলের গালিচা পাতা সিসিলি। বাতাস ভারী হয়ে আছে কমলা আর লেবু ফুলের গন্ধে। সে-গন্ধ এত তীব্র যে দীর্ঘদিন বুজে থাকা গন্ধনালী ভেদ করে ভিতরে ঢোকার পথ করে নিতে পারল, সেই মন মাতানো গন্ধ বুকে টেনে নিয়ে পুলকিত হয়ে উঠল মাইকেল।

  ওর ভাঙা মুখের ক্ষতটা সম্পূর্ণ সেরে গেছে, তবে হাড়টা জায়গামত জোড়া গেনি। তাছাড়া, সাইনাসগুলোর উপর একনাগাড়ে চাপ লাগায় বা চোখে ব্যথা অনুভব করে। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে বিচ্ছিরি ব্যাপার হলো, অনবরত পানি ঝবে নাক দিয়ে, রুমালটা ভিজে জবজবে হয়ে যায় শ্লেষ্ময়-গেয়ো, অসভ্য চাষাদের মত, নাক ঝাড়তে হয় মাটির উপর। অথচ ছোটবেলার কথা মনে আছে মাইকেলের, রুমাল ব্যবহার করা নাকি ইংরেজি বাবুগিরি, তাই বুড়ো ইতালীয়রা ওটা ব্যবহার করত না, পিচঢালা রাস্তার ওপর দাড়িযে ড্রেনে নাক ঝাড়–সে দৃশ্য সাঙ্ঘাতিক ঘৃণার উদ্রেক করত ওর মনে।

আরেকটা ব্যাপার। মুখটা আগের চেয়ে অনেক ভারী হয়ে গেছে, অস্বস্তির সাথে অনুভব করে মাইকেল। অজায়গায় জোড়া লেগেছে হাড়, তাতে চাপ পড়ছে। সাইনাসে, সেটাই নাকি এর কারণ বলেছেন ডা. তাজা ডিমের খোলা ভাঙন, ডাক্তারি ভাষায়, তিনি জানিয়েছেন, জাইগোমার। তার বক্তব্য, হাড় জোড়া লাগার আগে ভাল একজন ডাক্তারকে দেখানো উচিত ছিল, চামচের মত একটা যন্ত্র দিয়ে সেই ডাক্তার যদি ঠেলে হাড়টাকে যথাস্থানে বসিয়ে দিত, তাহলে আর এই অবস্থার সৃষ্টি হত না। এখন এর একমাত্র উপায়, ডা. তাজা জানিয়েছেন, পালার্মোতে যেতে হবে, সেখানের একটা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে মাইকেলাকে। অপারেশন ছাড়া এর চিকিৎসা নেই। এই বিশেষ অপারেশনটার নামও বলে দিয়েছেন ডা. তাজা–ম্যাক্সিলো-ফেশ্যাল-সার্জারি। বড়সড় একটা সার্জারি, ঠিক জায়গায় জোড়া নাগাবার জন্যে আবার ভেঙে নিতে হবে হাড়টাকে। এই শেষ কথাটাই মাইকেলের জন্যে যথেষ্ট। প্রবল আপত্তি জানিয়ে অপারেশন করাবার ধারণাটাকেই বাতিল করে দিয়েছে ও। ওদিকে ব্যথা বা নাকে সর্দি আসার চেয়ে বেশি কষ্ট দেয় ওকে মুখের ওই ভারী ভাবটা।

আজ আর সমুদ্র তীর পর্যন্ত বেড়ানো হলো না ওদের মাইল পনেরো বাকি থাকতে একটা কমলা বনের সবুজ শীতল কোমল ছায়ায় বসে পড়ল মাইকেল, ওর দেখাদেখি অনুগত ভৃত্যের শত বসল রাখলি দুজনও। মদ আর খাবার দিয়ে পেট ভরাবে এখন। সেই কখন থেকে বক বক করে চলেছে ফ্যাব্রিযযিয়ো, এখনও সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। তার একটাই বক্তব্য, একদিন সে যেভাবে হোক যাবেই। আমেরিকায়।

পান এবং আহারের পর গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় শুয়ে পড়ল মাইকেল, দেখাদেখি রাখাল দুজনও। শার্টের বোতাম খুলে একটা খেলা দেখাচ্ছে ফ্যাব্রিযযিয়ো, পেটের পেশী সঙ্কুচিত করে জ্যান্ত করে তুলছে উল্কির ছবিটাকে। বিবস্ত্র প্রেমিক-প্রেমিকার শরীর রতিক্রিয়ার ভঙ্গিতে নড়েচড়ে উঠছে, যে ছোরাটা ওদের শরীরে গেথে দিয়েছে। প্রতারিত স্বামী সেটা কাঁপছে থরথর করে। আরেক রাখাল কার্লো আর মাইকেল তাই দেখে খুব মজা পাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেল মাইকেলের মগজে। সিসিলির লোকেরা যাকে মাথায় বাজ পড়া বলে ঠিক তাই হলো মাইকেল কর্লিয়নির। এক নিমেষে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ভেঙে পড়ল যেন ওর মাথায়।

সামনে কমলাকুঞ্জ, তার পিছনে জমিদারের খেত। খেতের চারধারে সবুজ লতাপাতা আর ঘাসের পাড়। কুঞ্জবন থেকে সামান্য একটু দূরে দেখা যাচ্ছে। একটা বাগানসহ বাড়ি বাগানবাড়িটার আকার-আকৃতি এত বেশি রোমক-ধাচের যে একবার তাকালেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে পম্পিয়াইয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে খুঁড়ে বের করে তারপর এখানে তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ছোটখাটো একটা প্রাসাদই বলা চলে। গাড়ি বারান্দাটা বিশাল, শ্বেতপাথরের তৈরি। প্রকাও থামগুলোর গায়ে গ্রীসীয় ধাচে খাজ কাটা। দুটো থামের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে এল গ্রামের একদল মেয়ে, সাথে মোটা নোটা দুজন বয়স্কা গিন্নি মহিলা, পরনে কার্লো পোশাক। অবশ্যপালনীয় একটা কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে গ্রাম থেকে এসেছে ওরা। বাগানবাড়িটা জমিদারের, সেটা সাফসুতরো করে রাখা ওদের দায়িত্ব, যাতে শীতকালটা কাটাতে এসে সব কিছু ঝকঝকে তকতকে দেখতে পান জমিদার।

এখন মাঠের দিকে যাচ্ছে মেয়ের দল, সেখান থেকে ফুল তুলে আনবে ওরা, বাগানবাড়ির ঘরে ঘরে সাজিয়ে রাখতে হবে। গোলাপী রঙের সুলা-র, বেগুনী রঙের উইস্টারিয়ার সাথে লেবু ফুল, কমলা ফুল। তিন তিন জন পুরুষ মানুষ কমলা-বনে বিশ্রাম করছে, মেয়েদের চোখে ব্যাপারটা ধরাই পড়েনি। দ্রুত আরও কাছে চলে আসছে ওরা।

মেয়েদের গায়ের সাথে আঁটসাট ভাবে লেপ্টে আছে সস্তা ছিট কাপড়ের পোশাক। সবার বয়স কুড়ির নিচে, কিন্তু এই কম বয়সেই মেয়েদের শরীরে পরিপূর্ণ যৌবন বিকশিত হয়ে উঠেছে, রোদের দেশের যা নিয়ম। দলের তিন চারটে মেয়ে অপর একটা মেয়েকে তাড়া করছে, তাড়া খেয়ে হরিণীর মত ছুটছে মেয়েটা, সোজা এই কমলা-বনের দিকেই এগিয়ে আসছে। বেগুনী আঙ্গুরের মস্ত,একটা গুচ্ছ দেখা যাচ্ছে তার হাতে, তা থেকে একটা করে আর ছিঁড়ছে সে, ছুঁড়ে মারছে পিছন দিকে, তাকে যারা ধাওয়া করছে তাদেরকে লক্ষ্য করে। তার হাতের ওই আঙ্গুরের মতই গাঢ় বেগুনী রঙের একরাশ চুল মুকুটের মত শোভা পাচ্ছে তার মাথায়। মেয়ে নয়, পরী! তার শরীরের বর্ণনা দিতে হলে মহাকাব্য রচয়িতার মুন্সিয়ানাতেও বুঝি কুলাবে না। তুকের মোড়ক ছিঁড়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যৌবন।

কমলা-বনে প্রায় পৌঁছে গেছে মেয়েটা। এই সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে। সবুজ বনে পুরুষদের শার্টের বেমানান রঙ চোখে পড়ে গেছে তার। অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটা, কিন্তু তার এই দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যেও কি এক অদ্ভুত শিল্প রয়েছে। পায়ের আঙুলগুলোর ডগা কে কষল যেন, ক্ষুরের মত ধারাল কিছুর উপর দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে যেন, এস্তা হরিণীর মত ছুটে পালাবে এখুনি। কিন্তু এরই মধ্যে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সে। মাইকেল কর্লিয়নি তার মুখে প্রতিটি খো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

শরীরের রেখা আর ভাজগুলো গোল, ডিম্বাকৃতি। চোখজোড়া টানা টানা। সৃষ্টিকর্তা যেন কত রাত জেগে কি ভীষণ পরিশ্রম করে এমন নিখুঁত, এমন অবিশ্বাস্য সুন্দর একটা মুখ গড়েছেন। ছোট সুডৌল কপালে যে সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছে, মাইকেল, লক্ষ-কোটি হীরে-জহরত মণি-মাণিক্য দিয়েও এর সমান সৌন্দর্য সৃষ্টি করা কখনও সম্ভব হবে না। গাঢ়, ঘন ঘি-এর মত আশ্চর্য গভীর তার গায়ের রঙ। গাঢ় বেগুনী, অথবা বলা যায় কালচে রঙের সুদীর্ঘ চোখের পাপড়ি, ভীষণ সুন্দর মুখের ওপর ছায়া ফেলেছে। আয়ত লোচন। পরিপুষ্ট এক জোড়া ঠোঁট, কিন্তু সুল নয়; মিষ্টি অথচ দুর্বল নয়। রসালো আঙ্গুরের মত টসটসে।

এ কেমন সৌন্দর্য! এ কেমন অবিশ্বাস্য রূপ! ফ্যারিযযিয়োর মনে হলো, দম ফেটে মারা যাচ্ছে সে। নিজের অজান্তেই চাপা স্বর বেরিয়ে এলো তার গলার ভেতর থেকে, মরে গেলাম, প্রভু যীও! তুমি আমাকে তুলে নাও। ফ্যাব্রিযযিয়ের কথা শুনতে পেয়েই বুঝি শরীরের ভার আঙুলের ডগা থেকে নামিয়ে, চরকির মত আধপাক ঘুরে এস্তা হরিণীর মত বান্ধবীদের কাছে ফিরে গেল মেয়েটা। ছাপা কাপড়ের আঁটো পোশাকের নিচে বুনো প্রাণীর সহজ সাবলীল হাঁটার ভঙ্গি, প্রকৃতির কন্যার মতই নিষ্পাপ কামনাময়, নির্মল আর আদিম।

বন্ধুদের মাঝখানে পৌঁছুল মেয়েটা। আঙ্গুরের গুচ্ছ ধরা হাতটা বাড়িয়ে কমলা-বনের দিকটা দেখিয়ে দিল তাদেরকে। সাথে সাথে পুরুষদেরকে দেখতে পেয়ে খিলখিল করে মিষ্টি সুরে হেসে উঠল সব কটা মেয়ে। কালবিলম্ব না করে ছুটে পালাচ্ছে ওরা। পিছন পিছন যাচ্ছে কার্লো পোশাক পরা মোটাসোটা বয়স্কা দুজন গিন্নী, ওদেরকে ধাওয়া করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, খই ফুটছে মুখে, বকা-ঝকা করছে দস্যি মেয়েগুলোকে।

আর মাইকেল কর্লিয়নির কি অবস্থা? তার কথা আর কিইবা বলা যায়। কখন, কিভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে, নিজেও সে তা জানে না। মাথাটা ঘুরে উঠল, তারপর এই এতক্ষণে আবিষ্কার করল, দাঁড়িয়ে আছে সে ধড়াস ধড়াস করে বাড়ি খাচ্ছে বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ড। মাথাটা এখনও ঘুরছে একটু একটু। রক্তে তার বান ডেকেছে, শিরায় শিরায় প্লাবন বয়ে যাচ্ছে-শরীরের সর্বশেষ সীমানায় পৌঁছে হাত আর পায়ের আঙুলের ডগায় আছাড় খেয়ে পড়ছে রক্ত মোত। দ্বীপের যত সুগন্ধ বাতাসে ভর করে সব তার নাকে উড়ে এলো-কমলা-ফুল, লেবু-ফুল, পাকা আঙ্গুর আর কুসুম সারের সমস্ত সুগন্ধ। তারপর রাখালদের হাসি ঢুকল ওর কানে।

মাথায় বাজ পড়ল, সত্যি কিনা? বলল ফ্যাবিযিয়ো। সস্নেহে মাইকেলের কাঁধে একটা হালকা চাপড় মারল সে।

বোকা হারা কার্লো পর্যন্ত বিমুঢ় হয়ে পড়েছে মাইকেলের করুণ অবস্থা দেখে। পরম বন্ধুর মত সেও মাইকেলের হাত ধরে একটু নাড়া দিল। আদরের সুরে বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ব্যাটা, শান্ত হও।

ঝড়ের বেগে ধাবমান একটা মোটর গাড়ি যেন দুম করে ধাক্কা মেরেছে। মাইকেলকে। পরিস্থিতি বুঝে, বুদ্ধি করে একটা মদের বোতল বাড়িয়ে ধরল ফ্যাব্রিযযিয়ো বোতলটা প্রায় ছো মেরে কেড়ে নিয়ে সেটা থেকে ঢক ঢক করে কয়েক ঢোক মদ খেলো মাইকেল। পরিষ্কার হয়ে গেল মাথাটা।

অ্যাই, হতভাগা! তোরা কি বলতে চাইছিস?

দুজন রাখালই হাসছে।

হঠাৎ ভালো মানুষ কার্লোর ভাবলেশহীন মুখটা আষাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল। ভারিক্কী ভঙ্গিতে বলল সে, দেখো হে, মাথায় যদি কারো বাজ পড়ে, তা আর লুকোবার জো নেই-তাকালেই দেখতে পায় সবাই। তায় যী, এতে আবার লজ্জা কিসের? মানুষ তো মাথায় বাজ পড়ার আশায় সাধনা-করে, গির্জায় প্রার্থনার আয়োজন করে। এ তো তোমার পরম সৌভাগ্য!

এতো সহজে ওর মনের অবস্থা রাখালরা বুঝে ফেলেছে লক্ষ করে মোটেই সন্তুষ্ট নয় মাইকেল। ভাবছে, এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটল ওর জীবনে। কিশোর বয়সে একে তাকে এক-আধটু ভাল লাগত বৈকি, কিন্তু এর সাথে সে-সবের কোন মিলই নেই। এতোদিন কে-কে ভালবেসে এসেছে ও, সেই ভালবাসার সাথেও এর কোন মিল নেই। কে-এর স্বাভাবিক মাধুর্য, তার সরলতা আর বুদ্ধি মত্তা, এই সবই। ছিল তাকে ভালবাসার আসল কারণ। একজনের কার্লো চুল, আরেকজনের সোনালী, সেটাও একটা আকর্ষণ ছিল!

কিন্তু এটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। দেখামাত্র দুর্দমনীয় বাসনা জেগে উঠেছে, যেভাবে হোক অধিকার করতে হবে অপরূপ সৌন্দর্য আর যৌবনের আধারটাকে। ওকে পাবার জন্যে দুনিয়াটাকে পায়ে দলতে হয়, যদি নিজের গায়ের মাংস কেটে বিক্রি করতে হয়–হাসি মুখে তা করতে পারবে মাইকেল। মেয়েটার মুখের ছবি গেথে গেছে ওর মগজে। ও বুঝতে পারছে, মেয়েটাকে না পেলে অসহায় একটা পর মত, মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে তাকে, নিজের কাছে এত হেয় হয়ে যাবে যে কোন দামই থাকবে না নিজের অস্তিত্বের। সারাটা জীবন, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে পর্যন্ত মেয়েটার স্মৃতি পীড়া দেবে ওকে।

সেই সাথে অনুভব করছে মাইকেল, আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে তার জীবনটা। তার সমস্ত অস্তিত্ব এখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে একটা মাত্র বিন্দুতে। ওই মেয়েটা, সেই ওর সম্পূর্ণ জীবন। বাকি আর যা কিছু রয়েছে সেগুলোর কোন মূল্য নেই, তাৎপর্য নেই-মনে হচ্ছে, দুনিয়ার আর সব ব্যাপার এতই তুচ্ছ যে সেগুলো সম্পর্কে এক সেকেণ্ড চিন্তা করারও কোন দরকার নেই। সমস্ত কিছুই চিন্তার অযোগ্য।

সিসিলিতে এই নির্বাসনের দিনগুলোয় প্রায়ই কে-র কথা ভাবে মাইকেল। ও বুঝতে পারে, সেই প্রেমের সম্পর্ক ওদের মধ্যে আর কখনও ফিরে আসবে না। কে-র সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কও আর সম্ভব নয়। যতভাবেই চাপা দেবার চেষ্টা করা হোক, সে একজন খুনী তো বটে। এখন সে একজন ম্যাফিয়োনো যার পৌরুষের পরীক্ষা হয়ে গেছে, পাস করেছে সে। এর ফলে কে-কে হারাতে হয়েছে তাকে, চিরকালের জন্যে। তবু কে-র স্মৃতি মন থেকে মুছে যায়নি এতোদিন। কিন্তু আজ এই একটু আগে যা ঘটে গেল, মাইকেলের চেতনা থেকে কে-এর সমস্ত স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এক নিমেষে।

চলো, গ্রামে যাই, মেয়েটার খবর আনি, ব্যাকুল ব্যস্ততার সাথে বলল ফ্যাৱিযযিয়ো। যা মনে হচ্ছে তা হয়তো নয়–ততটা হয়তো নাগালের বাইরে নয়। বাজ যখন পড়েছেই, তার চিকিৎসা তো করতে হবে, কি বলো, কার্লো? বাজ পড়ার ওই একটা চিকিৎসাই তো আছে। চলো, যাই। গিয়ে দেখাই যাক না কতটা ধরাছোঁয়ার বাইরে ওই মেয়ে।

এখন আরও গম্ভীর দেখাচ্ছে কার্লোকে। নিঃশব্দে মাথা দোলাল শুধু কথা বলে পরিবেশের গাম্ভীর্য নষ্ট করল না।

মাইকেল কিন্তু সায়ও দিল না, আপত্তিও জানাল না। দুই রাখাল যখন পাশের গ্রামে যাবার জন্যে হাঁটা ধরুল, সে-ও, নিঃশব্দে ভিজে বেড়ালের মত পিছু নিল ওদের।

এই পথ ধরেই অদৃশ্য হয়ে গেছে মেয়ের দল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *